অবশেষে…

অবশেষে…

 

বিয়ের ধুমধাম আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণ আগে রুমীর বান্ধবী বরযাত্রীদের গাড়ি গেটের কাছে আসার খবর জানাল। বাইরের আনন্দ উল্লাস যেন রুমীর হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। তার অন্তরে তখন সোহেলের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে, সোহেল ব্যবসার কাজে ঢাকা গেছে, ফিরতে আরো অনেকদিন দেরি আছে, হয়তো ফিরে দেখবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ছুটতে ছুটতে তার হৃদয়ের সমস্ত সম্পদ চুরি হয়ে গেছে। এমনিভাবে ভাবতে ভাবতে হয়তো কাজি সাহেব বিয়েতে রুমীর মতামত নেয়ার জন্য চলে আসবে, তখন কীই বা করার আছে তার। সামাজিক কারণে হোক আর গুরুজনদের সম্মান রক্ষার্থেই হোক কাবিন নামায় দু’টি স্বাক্ষর সোহেলের কথা ভাবার অধিকারটি চিরতরে ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে। আজ জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনটি রুমীর কাছে জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মনে হচ্ছে, এমন দুঃখ তার জীবনে কোনোদিন সে পায় নি। অথচ আজ থেকে সারা জীবনের জন্য তাকে দুঃখের সাগরে ডুবে যেতে হচ্ছে।

রুমীর সঙ্গে যার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে সে তাকে কোনোদিন দেখেনি, রুমীর সঙ্গে তার পরিচয়ও নেই। শুধুমাত্র রুমীর ছবি দেখেই ছেলেটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। অথচ একজন অপরিচিত ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। বাইরে থেকে আনন্দ উল্লাসের ধ্বনি আসছে। কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেব কাবিন নামার বড় একটি রেজিস্টার নিয়ে রুমীর কাছে এসে যখন পাত্রের নাম ঠিকানা বলে জিজ্ঞেস করল, আপনি রাজি আছেন তো?

রুমী তখন কান্নায় ভেঙে পড়ল। অথচ এখন তার না বলার উপায় নেই। রুমী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, জি।

কাজি সাহেব কাবিন নামায় দু’টি স্বাক্ষর নিতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলতে বলতে চলে গেলেন। রুমী ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে জ্ঞান ফিরে দেখল সে স্বামীর পাশে একটি প্রাইভেট কারে বসে আছে। তাদের গাড়ির সামনে এবং পিছনে আরো কয়েকটি গাড়ি সজোরে চলছে। রুমীর হৃদয়ে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে। তার অতীত, সোহেলের সঙ্গে তার স্মৃতি যেন আজ থেকে হৃদয়ে আঁকড়ে রাখা অনৈতিক এবং অনধিকার হয়ে গেল। অথচ সোহেলকে ছাড়া সে অন্য কারো কথা ভাবতে পারে না, নিয়তির নির্মম পরিহাস হলেও সত্য যে পাশে উপবিষ্ট লোকটি তার স্বামী। রুমীর বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই এখন তার সঙ্গে গেঁথে দেয়া হয়েছে।

রুমীর সঙ্গে সোহেলের প্রথম পরিচয় হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। একদিন সোহেল মোটর সাইকেল নিয়ে শহরে যাচ্ছিল। জগতপুর গ্রামের মোড়ে একটি রিকশা ভ্যান ওভারটেক করতে না করতেই রুমী ভ্যান থেকে নেমে সোহেলকে লক্ষ্য করে বলল, প্লিজ একটু থামুন।

সোহেল মোটর সাইকেল থামাতেই রুমী মোটর সাইকেলে উঠে বসল।

তারপর বলল, এখন চলুন।

সোহেল মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি, জানা নেই, শোনা নেই, অপরিচিত একটা ছেলের মোটর সাইকেলে চড়ে বসলে।

ভ্যানটিতে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, তাছাড়া দিনের বেলা আপনি তো আর বাঘ-ভল্লুক নন যে খেয়ে ফেলবেন। বলে রুমী সোহেলের কাঁধে হাত রাখল।

সোহেল জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী? যাবে কোথায়?

আমার নাম রুমী যাব বাড়িতে।

তোমার বাড়ি কোথায়?

বানিয়াপাড়া।

কোথায় গেছিলে?

জগতপুর আমার ফুপার বাড়ি, ফুপাতো ভাইয়ের বউ ভাত অনুষ্ঠানে।

সোহেল ঠাট্টা করে বলল, আমি তো বিরল যাব, সেখান থেকে বানিয়াপাড়া আরো চার কিলোমিটার দূরে, তুমি যাবে কীভাবে?

রুমী নিঃসঙ্কোচে বলল, আপনি পৌঁছে দিবেন।

বাঃ! এমনভাবে বললে যেন আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে বাধ্য।

আপনার মোটর সাইকেলে আমাকে নিয়ে আপনি অনেকটা হিউম্যান রিলেশনে আটকে গেছেন, এখন আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া আপনার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

আমি যে নিরাপদ তা তুমি কীভাবে বুঝলে?

সে আমি অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি।

কীভাবে?

মুখ দেখে।

মুখ দেখে আর কী কী বুঝলে?

সে কথা পরে হবে এখন আপনার কথা বলুন।

আমার নাম সোহেল, বাড়ি ধর্মপুর।

কী করেন আপনি?

ব্যবসা।

কী ব্যবসা?

আমার ছোট্ট একটা কন্সট্রাকশন ফার্ম আছে, সেটাই দেখা-শোনা করি আর গ্রামে জমি আছে, কৃষিকাজ আছে, এই আর কী।

তাহলে তো বলা যায় অতি অল্প বয়সে আপনি একজন সচ্ছল মানুষ।

সোহেল মুচকি হেসে বলল, তুমিও তো অল্প বয়সে কম চালাক হওনি।

তারপর কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব। বিরল পৌঁছার পর সোহেল একটা বেকারির সামনে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল, নামো।

কেন?

তোমার দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে হবে। তা না হলে তো আবার দায়িত্বে অবহেলা করা হবে। বলে সোহেল দোকানের ভেতরে ঢুকে রুমীকে বলল, কী খাবে বলো?

শুধু ঠাণ্ডা।

দু’জনে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠল। সোহেল আর কোনো কথা না বলে একেবারে বানিয়াপাড়া এসে মোটর মাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল, নামো।

রুমী মোটর সাইকেল থেকে নেমে বলল, চলুন না আমাদের বাসায় চা খাবেন। আমার মা আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন।

না অন্যদিন।

আপনার মোবাইল নাম্বারটা প্লিজ!

সোহেল পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রুমীকে দিয়ে বলল, ফোন করবে, না কি এমনি কার্ড নিলে?

আপনি বিরক্ত না হলে অবশ্যই ফোন করবো। তাছাড়া এমন দিনের স্মৃতি কি আর ভুলা যায়?

দেখা যাক, ফোন করলে বুঝবো মনে রেখেছ, আর মনে রাখলে খুশি হবো, বলে সোহেল মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছিল।

এভাবে হারানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে সজোরে গাড়ি ব্রেক করার ধাক্কায় রুমী চমকে উঠল। গাড়ি থামল একটা চারতলা বাড়ির সামনে তারপর কয়েকজন মেয়ে এসে ধরাধরি করে রুমীকে দ্বিতীয় তলার একটা কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর রুমীকে রেখে সবাই চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর শিহাব ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে জামা কাপড় ছেড়ে রুমীর মাথার উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, রুমী।

রুমী চোখ তুলে তাকাল।

আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

রুমী মুখ বিকৃত করে বলল, কী জানি?

শিহাব কপালে চোখ তুলে বলল, কী জানি মানে?

আমি তো তোমাকে কোনোদিন দেখিনি। আপনি বলুন জানা নেই, শোনা নেই হঠাৎ করে কি কাউকে পছন্দ করা যায়? নাকি চেনা যায়?

বাঃ তুমি তো খুব সুন্দর করে বলতে পারো, তুমি সত্যিই খুব চালাক মেয়ে।

আমি মোটেই সুন্দর করে বলতে পারি না, আর আমি খুব বোকা মেয়ে।

আপনি বলবে না, আমি তোমার হ্যাজবেন্ড, আমাকে তুমি বলবে।

রুমী মাথা কাত করে সায় দিল, আচ্ছা।

তারপর দু’জনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, শিহাব মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, তুমি আমার বা আমাদের বাসার বিষয় কিছু জানো? এই যেমন আমরা ক’ভাই, ক’বোন? আমি কী করি ইত্যাদি ইত্যাদি।

না।

তবে শোন, আমার নাম শিহাব, ইংরেজিতে এম. এ. পাস করে বর্তমানে একটা এন.জি.ওতে জব করছি। আমার ছোট বোন মিনি সরকারি কলেজে ইকনোমিকসে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। বাবা অবসর প্রাপ্ত সরকারি অফিসার, আর মা গৃহিণী। বলে শিহাব একটু থামল তারপর বলল, আর কিছু ?

রুমী মাথা বাঁকিয়ে জানাল, না।

শিহাব জিজ্ঞেস করল, কথা বলছ না কেন ?

ইচ্ছে করছে না।

শিহাব বিস্ময়ের সুরে বলল, রুমী আজ আমাদের বাসর রাত। এমন রাতে প্রিয়জনকে মনের সব কথা উজাড় করে বলতে হয়, হৃদয়ের ভালোবাসা নিংড়ে দিতে হয়।

জানি।

তো?

আচ্ছা আপনি বলুন তো আপনি কি আমার প্রিয়জন?

হ্যাঁ, তোমার কোনো সন্দেহ আছে?

হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আজ আমার পরিচয় হলো আপনি আমার প্রিয়জন হবেন কী না এটা বুঝতে তো আরো অনেকদিন সময় লাগবে।

কিন’ আমি তো তোমার স্বামী।

হ্যাঁ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সব স্বামীরাই যে প্রিয়জন হবে এমন তো না।

শিহাব কিছুটা রেগে গেল, তুমি খুব পাকা মেয়ে, খুব কথা জানো।

তবে কি চুপ করে থাকবো?

না চুপ করে থাকবে কেন? কথা বলো?

কী বলব?

তোমার কি কিছু বলার নেই?

রুমী মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, না।

রুমীর আচরণ শিহাবের কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়ল, রাগে তার সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। শিহাব কৃত্রিম ক্রোধ প্রতিরোধ করে বলল, তুমি কি ঘুমাবে?

রুমী মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, সে ঘুমাবে।

তবে বেশ ঘুমাও, বলে শিহাব বিছানায় শুয়ে পড়ল।

বিয়ের ধুমধাম আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণ আগে রুমীর বান্ধবী বরযাত্রীদের গাড়ি গেটের কাছে আসার খবর জানাল। বাইরের আনন্দ উল্লাস যেন রুমীর হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। তার অন্তরে তখন সোহেলের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে, সোহেল ব্যবসার কাজে ঢাকা গেছে, ফিরতে আরো অনেকদিন দেরি আছে, হয়তো ফিরে দেখবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ছুটতে ছুটতে তার হৃদয়ের সমস্ত সম্পদ চুরি হয়ে গেছে। এমনিভাবে ভাবতে ভাবতে হয়তো কাজি সাহেব বিয়েতে রুমীর মতামত নেয়ার জন্য চলে আসবে, তখন কীই বা করার আছে তার। সামাজিক কারণে হোক আর গুরুজনদের সম্মান রক্ষার্থেই হোক কাবিন নামায় দু’টি স্বাক্ষর সোহেলের কথা ভাবার অধিকারটি চিরতরে ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে। আজ জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনটি রুমীর কাছে জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মনে হচ্ছে, এমন দুঃখ তার জীবনে কোনোদিন সে পায় নি। অথচ আজ থেকে সারা জীবনের জন্য তাকে দুঃখের সাগরে ডুবে যেতে হচ্ছে।

রুমীর সঙ্গে যার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে সে তাকে কোনোদিন দেখেনি, রুমীর সঙ্গে তার পরিচয়ও নেই। শুধুমাত্র রুমীর ছবি দেখেই ছেলেটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। অথচ একজন অপরিচিত ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। বাইরে থেকে আনন্দ উল্লাসের ধ্বনি আসছে। কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেব কাবিন নামার বড় একটি রেজিস্টার নিয়ে রুমীর কাছে এসে যখন পাত্রের নাম ঠিকানা বলে জিজ্ঞেস করল, আপনি রাজি আছেন তো?

রুমী তখন কান্নায় ভেঙে পড়ল। অথচ এখন তার না বলার উপায় নেই। রুমী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, জি।

কাজি সাহেব কাবিন নামায় দু’টি স্বাক্ষর নিতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলতে বলতে চলে গেলেন। রুমী ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে জ্ঞান ফিরে দেখল সে স্বামীর পাশে একটি প্রাইভেট কারে বসে আছে। তাদের গাড়ির সামনে এবং পিছনে আরো কয়েকটি গাড়ি সজোরে চলছে। রুমীর হৃদয়ে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে। তার অতীত, সোহেলের সঙ্গে তার স্মৃতি যেন আজ থেকে হৃদয়ে আঁকড়ে রাখা অনৈতিক এবং অনধিকার হয়ে গেল। অথচ সোহেলকে ছাড়া সে অন্য কারো কথা ভাবতে পারে না, নিয়তির নির্মম পরিহাস হলেও সত্য যে পাশে উপবিষ্ট লোকটি তার স্বামী। রুমীর বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই এখন তার সঙ্গে গেঁথে দেয়া হয়েছে।

রুমীর সঙ্গে সোহেলের প্রথম পরিচয় হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। একদিন সোহেল মোটর সাইকেল নিয়ে শহরে যাচ্ছিল। জগতপুর গ্রামের মোড়ে একটি রিকশা ভ্যান ওভারটেক করতে না করতেই রুমী ভ্যান থেকে নেমে সোহেলকে লক্ষ্য করে বলল, প্লিজ একটু থামুন।

সোহেল মোটর সাইকেল থামাতেই রুমী মোটর সাইকেলে উঠে বসল।

তারপর বলল, এখন চলুন।

সোহেল মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি, জানা নেই, শোনা নেই, অপরিচিত একটা ছেলের মোটর সাইকেলে চড়ে বসলে।

ভ্যানটিতে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, তাছাড়া দিনের বেলা আপনি তো আর বাঘ-ভল্লুক নন যে খেয়ে ফেলবেন। বলে রুমী সোহেলের কাঁধে হাত রাখল।

সোহেল জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী? যাবে কোথায়?

আমার নাম রুমী যাব বাড়িতে।

তোমার বাড়ি কোথায়?

বানিয়াপাড়া।

কোথায় গেছিলে?

জগতপুর আমার ফুপার বাড়ি, ফুপাতো ভাইয়ের বউ ভাত অনুষ্ঠানে।

সোহেল ঠাট্টা করে বলল, আমি তো বিরল যাব, সেখান থেকে বানিয়াপাড়া আরো চার কিলোমিটার দূরে, তুমি যাবে কীভাবে?

রুমী নিঃসঙ্কোচে বলল, আপনি পৌঁছে দিবেন।

বাঃ! এমনভাবে বললে যেন আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে বাধ্য।

আপনার মোটর সাইকেলে আমাকে নিয়ে আপনি অনেকটা হিউম্যান রিলেশনে আটকে গেছেন, এখন আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া আপনার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

আমি যে নিরাপদ তা তুমি কীভাবে বুঝলে?

সে আমি অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি।

কীভাবে?

মুখ দেখে।

মুখ দেখে আর কী কী বুঝলে?

সে কথা পরে হবে এখন আপনার কথা বলুন।

আমার নাম সোহেল, বাড়ি ধর্মপুর।

কী করেন আপনি?

ব্যবসা।

কী ব্যবসা?

আমার ছোট্ট একটা কন্সট্রাকশন ফার্ম আছে, সেটাই দেখা-শোনা করি আর গ্রামে জমি আছে, কৃষিকাজ আছে, এই আর কী।

তাহলে তো বলা যায় অতি অল্প বয়সে আপনি একজন সচ্ছল মানুষ।

সোহেল মুচকি হেসে বলল, তুমিও তো অল্প বয়সে কম চালাক হওনি।

তারপর কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব। বিরল পৌঁছার পর সোহেল একটা বেকারির সামনে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল, নামো।

কেন?

তোমার দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে হবে। তা না হলে তো আবার দায়িত্বে অবহেলা করা হবে। বলে সোহেল দোকানের ভেতরে ঢুকে রুমীকে বলল, কী খাবে বলো?

শুধু ঠাণ্ডা।

দু’জনে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠল। সোহেল আর কোনো কথা না বলে একেবারে বানিয়াপাড়া এসে মোটর মাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল, নামো।

রুমী মোটর সাইকেল থেকে নেমে বলল, চলুন না আমাদের বাসায় চা খাবেন। আমার মা আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন।

না অন্যদিন।

আপনার মোবাইল নাম্বারটা প্লিজ!

সোহেল পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রুমীকে দিয়ে বলল, ফোন করবে, না কি এমনি কার্ড নিলে?

আপনি বিরক্ত না হলে অবশ্যই ফোন করবো। তাছাড়া এমন দিনের স্মৃতি কি আর ভুলা যায়?

দেখা যাক, ফোন করলে বুঝবো মনে রেখেছ, আর মনে রাখলে খুশি হবো, বলে সোহেল মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছিল।

এভাবে হারানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে সজোরে গাড়ি ব্রেক করার ধাক্কায় রুমী চমকে উঠল। গাড়ি থামল একটা চারতলা বাড়ির সামনে তারপর কয়েকজন মেয়ে এসে ধরাধরি করে রুমীকে দ্বিতীয় তলার একটা কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর রুমীকে রেখে সবাই চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর শিহাব ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে জামা কাপড় ছেড়ে রুমীর মাথার উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, রুমী।

রুমী চোখ তুলে তাকাল।

আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

রুমী মুখ বিকৃত করে বলল, কী জানি?

শিহাব কপালে চোখ তুলে বলল, কী জানি মানে?

আমি তো তোমাকে কোনোদিন দেখিনি। আপনি বলুন জানা নেই, শোনা নেই হঠাৎ করে কি কাউকে পছন্দ করা যায়? নাকি চেনা যায়?

বাঃ তুমি তো খুব সুন্দর করে বলতে পারো, তুমি সত্যিই খুব চালাক মেয়ে।

আমি মোটেই সুন্দর করে বলতে পারি না, আর আমি খুব বোকা মেয়ে।

আপনি বলবে না, আমি তোমার হ্যাজবেন্ড, আমাকে তুমি বলবে।

রুমী মাথা কাত করে সায় দিল, আচ্ছা।

তারপর দু’জনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, শিহাব মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, তুমি আমার বা আমাদের বাসার বিষয় কিছু জানো? এই যেমন আমরা ক’ভাই, ক’বোন? আমি কী করি ইত্যাদি ইত্যাদি।

না।

তবে শোন, আমার নাম শিহাব, ইংরেজিতে এম. এ. পাস করে বর্তমানে একটা এন.জি.ওতে জব করছি। আমার ছোট বোন মিনি সরকারি কলেজে ইকনোমিকসে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। বাবা অবসর প্রাপ্ত সরকারি অফিসার, আর মা গৃহিণী। বলে শিহাব একটু থামল তারপর বলল, আর কিছু ?

রুমী মাথা বাঁকিয়ে জানাল, না।

শিহাব জিজ্ঞেস করল, কথা বলছ না কেন ?

ইচ্ছে করছে না।

শিহাব বিস্ময়ের সুরে বলল, রুমী আজ আমাদের বাসর রাত। এমন রাতে প্রিয়জনকে মনের সব কথা উজাড় করে বলতে হয়, হৃদয়ের ভালোবাসা নিংড়ে দিতে হয়।

জানি।

তো?

আচ্ছা আপনি বলুন তো আপনি কি আমার প্রিয়জন?

হ্যাঁ, তোমার কোনো সন্দেহ আছে?

হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আজ আমার পরিচয় হলো আপনি আমার প্রিয়জন হবেন কী না এটা বুঝতে তো আরো অনেকদিন সময় লাগবে।

কিন’ আমি তো তোমার স্বামী।

হ্যাঁ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সব স্বামীরাই যে প্রিয়জন হবে এমন তো না।

শিহাব কিছুটা রেগে গেল, তুমি খুব পাকা মেয়ে, খুব কথা জানো।

তবে কি চুপ করে থাকবো?

না চুপ করে থাকবে কেন? কথা বলো?

কী বলব?

তোমার কি কিছু বলার নেই?

রুমী মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, না।

রুমীর আচরণ শিহাবের কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়ল, রাগে তার সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। শিহাব কৃত্রিম ক্রোধ প্রতিরোধ করে বলল, তুমি কি ঘুমাবে?

রুমী মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, সে ঘুমাবে।

তবে বেশ ঘুমাও, বলে শিহাব বিছানায় শুয়ে পড়ল।

দুই

ঢাকায় পৌঁছেই সোহেল একবার ফোন করে রুমীর সঙ্গে কথা বলেছে, রুমীর পছন্দমতো অনেক কিছু গিফট কিনেছে তারপর বার বার ফোন করেও রুমীর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। যতবারই রিং করেছে ততবারই সেই বেরসিক মহিলার কণ্ঠস্বর এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্ক্ষিত মোবাইলে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।

যেদিন সোহেল রুমীকে প্রথম মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছে সেদিন থেকে প্রতিদিন দু’একবার কথা হয়েছে। কোনোদিন সোহেল যোগাযোগ করতে না পারলে রুমীই সোহেলের সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন’ কয়েক দিন থেকে রুমীও তার সঙ্গে যোগাযোগ না করায় সে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ল।

বাসায় পৌঁছেই সোহেলের মোবাইলের রিং বেজে উঠল। সোহেল চমকে উঠল, তার বুকটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো এই বুঝি রুমী ফোন করল। সে রিসিভ করল, হ্যালো।

রাশেদ জিজ্ঞেস করল, সোহেল কি বাসায় পৌঁছেছিস?

হ্যাঁ, কী খবর বলতো?

তোর জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।

দুঃসংবাদ! সোহেল শুষ্ক কণ্ঠে বলল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বল, দেরি করলে দুঃসংবাদের সঙ্গে আরো দুশ্চিন্তা যোগ হবে।

হঠাৎ করে রুমীর বিয়ে হয়ে গেছে।

সোহেলের হৃদয়টা যেন ভেঙে মুচড়ে গেল, তার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে কোনো রকমে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এতক্ষণে সোহেল রুমীর মোবাইল বন্ধ রাখার কারণ বুঝতে পারল। সোহেল চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে রুমীর স্মৃতি ভেসে উঠল, রুমীর অতি মধুর কথাগুলোও যেন আজ তার কানে অবিরত হাতুড়ির মতো আঘাত করতে লাগল। তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এই বাসায় এই বিছানায় রুমী বসেছে তার পাশে স্ট্যান্ড করা মোটর সাইকেলটার দিকে চোখ তুলে তাকাল এই মোটর সাইকেলে কতদিন রুমী তার গা ঘেঁষে বসেছে, তার কাঁধে হাত রেখে নিবিড়ভাবে বসে মাইলের পর মাইল মোটর সাইকেলে ঘুরে বেরিয়েছে এমনি অসংখ্য স্মৃতি তার হৃদয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।

একটানা কয়েক দিন বিছানায় কেটে গেল। এই ক’দিনের দুশ্চিন্তা, অনাহার আর অনিদ্রায় সোহেলের চোখের গোড়া কালো হয়ে গেছে। শরীর দুর্বল ও মেজাজ রুক্ষ্ম হয়ে গেছে। একদিন সোহেলের মা ফরিদা বেগম সোহেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, এভাবে আর কতদিন বাবা? একটা কষ্টই মনের মধ্যে পুষে রেখে কি সারা জীবন নষ্ট করবি?

প্রত্যুত্তরে সোহেল একটা শুষ্ক হাসি হেসে নীরব রইল। সে নিজেও জানে রুমীর কথা ভেবে আর লাভ নেই, সে তার ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করেছে। তার কথা হৃদয়ে লালন করা আর নিজেকে তিলে তিলে নষ্ট করা একই কথা। কিন্তু সোহেল যতই তাকে ভুলতে চায় রুমীর স্মৃতি যেন তার হৃদয়ে আরো বেশি করে দাগ কেটে বসে।

সোহেলের ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের অনেকে তাকে বিরল বাজারে না পেয়ে অনেকে বাসায় আসতে শুরু করল। একদিন রাজমিস্ত্রি বাসায় এসে নির্মাণ কাজ বন্ধের কথা জানাল। সোহেল তাকে দিয়ে রাশেদকে ডেকে পাঠাল। রাশেদ বাসায় এসে সোহেলের রুমে ঢুকেই বলল, কয়েকদিনে তো শরীরটা একেবারে শেষ করে ফেলেছিস।

সোহেল মলিন হেসে বলল, আর শরীর, তারপর একটু থেমে বলল, সকালে মিস্ত্রী এসেছিল কয়েকদিন থেকে আমি সাইটে যেতে পারিনি, কাজ বন্ধ করে, তুই কি একটু সাহায্য করতে পারবি?

অবশ্যই পারব।

একবার জগতপুর সাইটে যাবি, সাইটে কী কী মালামাল লাগবে জেনে আসবি, ফেরার পথে কাশেম মিস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসবি।

তুইও চল না, আমি মোটর সাইকেল চালাব, তুই পিছনে বসে থাকবি।

আজ নারে তুই খবর নিয়ে আয়, আমি না হয় কাল থেকে যাব।

সোহেল তুই কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।

বল।

তুই রুমীর বিয়েটাকে খুব সহজভাবে মেনে নেয়।

কী রকম?

এই মনে কর ঠিকাদারি কাজে অসংখ্য টেন্ডার দিয়ে যেমন কাজ পাওয়া যায় না, তেমনি রুমীকে পাওয়ার জন্য তুই একটা টেন্ডার দিয়েছিলি তাকে পাস নি, ঠিক এভাবে।

তুই সহজ করে বললি তত সহজ করে বলা যায়, মানা যায় না। কারণ টাকার ক্ষতি আর হৃদয়ের ক্ষতি এক জিনিস না। অর্থের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায় কিন্তু হৃদয়ের ক্ষতি কোনো দিন পুষিয়ে নেয়া যায় না।

কিন্তু এটাই বাস্তব যে তোকে খুব সহজভাবে মেনে নিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে।

রাশেদ তুই এখন যা আমি কাল থেকে বেরুবো।

আচ্ছা, বলে রাশেদ চলে গেল।

তিন

প্রায় দিনই অফিস থেকে ফিরে শিহাব রুমীকে নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা বললেও রুমী কোনোদিন শিহাবের কথায় কোন আগ্রহ দেখায় নি। এ নিয়ে শিহাব মন খারাপ করেছে অনেকদিন। সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই শিহাব বলল, রুমী তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও, চলো কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসি।

কোথায় যাবে?

যেখানে তোমার ইচ্ছা।

আমার তো কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই।

শিহাব রুমীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে রুমীর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, চলো না প্লিজ!

রুমী মলিন মুখে বলল, বললাম তো আমার ইচ্ছা নেই।

আজ না হয় আমার ইচ্ছাই একবার চলো।

রুমীকে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য নাছোড় বান্দা হওয়ায় একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুমী শিহাবের সঙ্গে বেড়াতে বের হলো। শিহাবের মোটর সাইকেলের পেছনে উঠতেই রুমী আবার সোহেলের চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। এমনিভাবে রুমী কতদিন সোহেলের মোটর সাইকেলে গা ঘেঁষে বসেছে। কতদিন এমনি বিকেল বেলা দু’জনে মোটর সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সব কিছু তার হৃদয়ের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শিহাব আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে রুমী?

বললাম তো আমার কোনো ইচ্ছা নেই, যেখানে তোমার ইচ্ছা, সেখানেই নিয়ে চলো।

শিহাব আর কোনো কথা বলল না, মোটর সাইকেল চালিয়ে সোজা সিংড়া ফরেস্টে এসে ঢুকল।

দিনাজপুর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কের পাশেই সিংড়া ফরেস্ট, গেট দিয়ে ঢুকতেই বাংলো, পরিকল্পিতভাবে লাগানো গাছপালা, মাঝে মাঝে নির্মিত কয়েকটি বেঞ্চ। তার কিছুদূর পরে ঘন বন যেখানে গোধূলি লগ্নে পাখিরা বাসায় ফিরে, তারপর ধীরে ধীরে বনের মাঝে সূর্য হারিয়ে যায়। রুমী মোটর সাইকেল থেকে নেমে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে একটি বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শিহাবও পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রুমীর হাতটা নিজের হাতে নেবার চেষ্টা করল।

রুমী ধমকের সুরে বলল, শিহাব কী হচ্ছে?

শিহাব নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, সরি।

একবার সরি বললে মেনে নেয়া যায়, কিন্তু বার বার যেন ভুল না হয়।

শিহাব হাঁটতে হাঁটতে একটি বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল।

রুমী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

এমনিভাবে রুমী বেড়াতে এসেছিল সোহেলের সঙ্গে। এই বেঞ্চটিতে সোহেলের সঙ্গে বসে দু’জনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল। সোহেল পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখে বলেছিল, রুমী সারাদিন চরে বেড়ানো শেষে পাখিরা বাসায় ফিরছে। এইতো তাদের শান্তি, এমনিভাবে তারা সারা জীবন কাটিয়ে দেবে। তাদের ঘর জুড়ে বাচ্চা আসবে, দু’জনে তাদের লালন পালন করবে তারপর তারা স্মৃতি হিসেবে বাচ্চাদের দুনিয়াতে রেখে চলে যাবে। ঠিক আমাদের বেলায়ও এমন। আমরাও একদিন ঘর বাঁধবো, আমাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে একটি বাচ্চা আসবে-

রুমী সোহেলের কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলেছিল, একটি নয় দু’টি।

তাই হবে, তবে দু’য়ের বেশি না, বলে রুমীর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, কবে?

এমনিভাবে ভাবতে ভাবতে রুমীর দু’চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এমন সময় শিহাব কাছে এসে বলল, রুমী।

রুমী নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো।

চলো ওই দিকে একটু ঘুরে আসি, শিহাব বলল।

আর ভালো লাগছে না, চলো যাই।

একটু দাঁড়াও, এখন সূর্যাস্তের সময় দেখ বনের মাঝে কীভাবে সূর্যাস্ত হয়।

সূর্যাস্ত দেখতে কেউ জঙ্গলে আসে, না কি সি-বিচে যায়? রুমী তিরস্কারের সুরে বলল।

তুমি যাবে রুমী, তবে চলো কয়েকদিনের জন্য কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি।

রুমী চুপ করে রইল।

শিহাব আবার জিজ্ঞেস করল, যাবে?

রুমী শিহাবের কথার উত্তর না দিয়ে বলল, চলো বাসায় যাই, আম্মা চিন্তা করবে।

রুমীর নির্লিপ্ততা আর প্রসঙ্গক্রমে তার কথার উত্তর এড়িয়ে যাওয়ায় শিহাবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে দ্রুতগতিতে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, ওঠো।

রুমী মোটর সাইকেলে ওঠা মাত্র শিহাব দ্রুতগতিতে মোটর সাইকেল চালাতে লাগল।

বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন শিহাব তার দাম্পত্য অশান্তির যন্ত্রণা কৃত্রিম হাসির মাধ্যমে আড়াল করতে পারলেও ধীরে ধীরে তার মুখের হাসি ম্লান হয়ে অন্তরে দগ্ধতার ক্ষত মুখের অবয়বে ফুটে উঠল। শিহাবের সদা হাস্য মুখ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকায় তার হিতাকাঙখী ও সহকর্মীরা হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারণ সমালোচনা করতে লাগল।

সেদিন কখন যে সবাই অফিস থেকে চলে গেছে শিহাব খেয়ালই করেনি। সে চেয়ারে চোখ বুজে ছিল। শিহাবের এক কলিগ মারিয়া কয়েকবার মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, শিহাব সাহেব, শিহাব সাহেব।

শিহাব চমকে উঠল, কে!

মারিয়া বলল, বাসায় যাবেন না?

শিহাব এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে বলল, সবাই চলে গেছে?

জি বাসায় যান, ভাবী অপেক্ষা করছে।

শিহাব ম্লান হেসে বলল, আর ভাবী!

বা রে এ ক’দিনেই মান-অভিমান শুরু হয়েছে। যান বাসায় যান বলে মারিয়া চলে যাচ্ছিল। শিহাব মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, মিস মারিয়া।

মারিয়া ফিরে তাকিয়ে বলল, জি বলুন।

আপনার কি সময় আছে?

কেন বলুন তো?

সময় থাকলে একটু বসুন।

মারিয়া চেয়ারে বসে বলল, কোনো সমস্যা?

হুম, আসলে সমস্যাটার কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না।

আমাকে বলা যাবে?

হ্যাঁ।

বেশ বলুন।

বলতে চাচ্ছিলাম আপনার ভাবির কথা।

ভাবির কী হয়েছে?

খুব একঘেয়ে, কোনো চাঞ্চল্য নেই। যেন এক নিষ্প্রাণ মেয়ে।

আপনি প্রাণবন্ত করে তুলুন।

চেষ্টা করছি কিন্তু সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

আপনার মতো স্মার্ট, মার্জিত, ভদ্র হ্যাজবেন্ড পেয়েও ভাবী নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকতে পারে?

আপনি আমার যে গুণের কথাগুলো বললেন আসলে কি আমি এতগুলো গুণের অধিকারী?

শুধু এতগুলো নয়, আপনি অসংখ্য গুণের অধিকারী, যতগুলো গুণের প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। আমার ধারণা আপনি চেষ্টা করলে ভাবিকে ম্যানেজ করতে পারবেন। যান ভাবির জন্য এক গোছা রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে বাসায় যান।

ফুল কী জন্য?

বলবেন ইনক্রিমেন্ট হয়েছে।

মিথ্যা কথা বলব?

হ্যাঁ বউয়ের জন্য একটু আধটু মিথ্যা কথা বললে পাপ হয় না। তাছাড়া আপনি তো মিথ্যা বলছেন স্ত্রীর মন জয় করার জন্য, মানুষ স্ত্রীর মন জয় করার জন্য কত কী করে। এই ধরুন শ্যামলদার কথা-

কী হয়েছে শ্যামলদার?

আমাদের প্রোগ্রাম অফিসার শ্যামল রড্রিগস।

হ্যাঁ, চিনি তো শ্যামলদাকে।

শ্যামলদা তিনদিনের জন্য অফিসিয়াল ট্যুরে যায় অথচ বউদিকে বলে যায় পাঁচদিনের কথা।

তারপর-

তারপর আর কী, তিনদিন পর বাসায় ফিরে বলে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না গো, তাই চলে এলাম। আর শ্যামলদা বছরে যে কয়টা ইনক্রিমেন্ট আর কয়বার বোনাস পায় তা বোধ হয় দাদা নিজেই খেয়াল রাখতে পারে না।

অনেক কষ্টের মাঝে শিহাব মৃদু হেসে বলল, মিস মারিয়া আপনি খুব বুদ্ধিমতী।

না জনাব, প্রশংসা করে মাথায় তুলবেন না। এখন উঠুন, বাসায় যান, সুখে থাকুন। আমি এবার উঠি বলে মারিয়া শিহাবকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেল।

শিহাব আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। অদ্ভুত সুন্দর এ মেয়েটির হালকা পাতলা গড়ন, শ্যামলা অথচ এট্রাক্টিভ। যখন কথা বলে তখন গালের মাঝখানে টোল পড়ে, যেন হৃদয়ে ঝড় তোলে। শিহাবসহ একদিনেই জয়েন করেছে। পাশাপাশি চেয়ারে বসে কাজ করে, সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। চোখের দৃষ্টি যেন শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। শিহাবের সঙ্গে আগেও কথা হয়েছে। মেয়েটি খুব রোমান্টিক। শিহাব একবার তাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিল। কিন্তু মারিয়া খ্রিস্টান, তাই শিহাব তার অন্তরের সুপ্ত ভালোবাসার কথা মারিয়াকে কোনোদিন বলেনি এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ কেটে গেছে। নাইট গার্ড লাইট ফ্যান চালু দেখে সব বন্ধ করতে এসে শিহাবকে বলল, স্যার বাসায় যাবেন না?

শিহাব চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, হ্যাঁ চলি।

চার

সেদিন বিকেলে চায়ের টেবিলে রুমীর শাশুড়ি শাহানা বেগম জিজ্ঞেস করল, বউমা তোমার মনটা কি খুব খারাপ?

না, মা।

বাপ মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে?

রুমী নীরবে বসে রইল।

শাহানা বেগম বললেন, আজ শিহাব আসুক আমি বলে দিচ্ছি তুমি বাপ-মা’র কাছ থেকে কয়েকদিন ঘুরে এসো মনটা ভালো হবে।

রুমী একটু শুষ্ক হাসি হেসে চুপ করে রইল। এমন সময় শিহাব ফুল নিয়ে বাসায় ঢুকল।

মিনি জিজ্ঞেস করল, কীসের ফুল ভাইয়া?

ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তাই? বলতে বলতে শিহাব তার রুমে যাচ্ছিল শাহানা ডেকে বললেন, শিহাব ফুল রেখে আয় বাবা চা খাবি।

শিহাব ফুল রেখে এসে চায়ের টেবিলে বসতেই তিনি বললেন, চা খেয়ে বউমাকে নিয়ে একটু তোর শ্বশুরবাড়ি যা, বউমার মনটা ভীষণ খারাপ, হয়তো বাপ-মা’র কথা মনে পড়েছে।

শিহাব রুমীর দিকে মুখ করে বলল, তাই নাকি?

রুমী চুপ করে রইল।

শিহাব বলল, আমাকে তো কিছু বলল না মা?

মিনি বলল, বুঝলে না ভাইয়া নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

তুমি যাও বউমা রেডি হও, শাহানা বললেন।

রুমী রুমে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাপড় চোপড় পরে তৈরি হলো।

তাপর দু’জনে মোটর সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়ল।

যখন তারা রুমীদের গ্রামের বাড়ি পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রুমীকে দেখামাত্র তার মা রুমীর গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, তোর একি চেহারা হয়েছে মা? এ’কদিনে চোখ দু’টো ঢুকে গেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে।

রুমী মায়ের বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শিহাব বলল, রুমী আমি তো অফিসে যাব তারপর পাঁচ দিনের অফিসিয়াল ট্যুর, তুমি কি এ’কদিন এখানেই থাকবে?

রুমী প্রথমে কিছু বলল না।

শিহাব আবার জিজ্ঞেস করল, নাকি আমাদের বাসায় থাকবে?

আমি এখানেই থাকব, রুমী বলল।

তবে থাকো আমি ট্যুর থেকে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

তারপর নাস্তা খেয়ে শিহাব চলে গেল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা রুমীর বাবা সামাদ সাহেব রুমীকে জিজ্ঞেস করল, কীরে মা তোর শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন?

ভালো বাবা।

ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করতেন। খুব বংশীয় লোক, এককালে জমিদারি ছিল, গ্রামে বিশাল সম্পত্তি। ওদের গ্রামে গিয়ে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় শুধু ওদেরই জমি। লিচু বাগান, আম বাগান, কাঁঠাল বাগান, গ্রামের বাড়িতে শতবর্ষের সাক্ষী চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি দালান বাড়ি। কেন শিহাব তোকে দেখাতে নিয়ে যায়নি?

রুমী মাথা বাঁকিয়ে জানাল, শিহাব তাকে নিয়ে যায়নি।

এবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে জামাইকে বলবি তোকে নিয়ে যাবে। দেখে তোর খুব ভালো লাগবে মা। বলে তিনি রুমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলেন।

রাহেলা জিজ্ঞেস করল, শুকিয়ে গেছিস কেন রে মা?

রুমী কোনো কথা না বলে মায়ের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর রুমী মা’র গলা ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সোফায় বসল।

রাহেলা জিজ্ঞেস করল, তোর কি কোনো অসুখ করেছে মা?

না, মা।

তোর শ্বশুর-শাশুড়ি তোকে আদর করে না?

করে।

তোর ননদ।

সেও ভালো মা।

তবে কি জামাই বাবু-

না মা, ও খুব ভালো।

তবে সমস্যা কোথায়?

কোনো সমস্যা নেই মা, তুমি কাজ করো আমি রুমে যাচ্ছি বলে রুমী নিজের রুমে গিয়ে দেখল ড্রেসিং টেবিলের উপর তার মোবাইল ফোন, সে তাড়াতাড়ি মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে জোরে রাহেলাকে ডাক দিল, মা।

রাহেলা তার রুমে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল, মা আমার মোবাইল ফোনটা কোথা থেকে এলো?

জানি না তো মা।

মা তুমি নিশ্চয় জানো।

আমি কিচ্ছু জানি না মা, বলে সে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে চলে গেল। এতক্ষণে রুমী বুঝতে পারল তার বিয়ের কথাবার্তা শুরুর পর একরকম ইচ্ছে করেই বাবা-মা তার মোবাইল ফোনটা লুকিয়ে রেখেছিল। তার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে অনেকদিন কাটিয়েছে তার আর অন্য কারো হাত ধরে চলে যাবার অবকাশ নেই। তাই কৌশলে তার মোবাইল ফোনটা তাকে ফেরত দিয়েছে। রুমী মোবাইল ফোনটা বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর এক সময় মনে হলো সোহেলকে একবার ফোন করবে। আবার মনে হলো সোহেল যদি তার সঙ্গে কথা না বলে বা তার মোবাইল নাম্বার দেখেই লাইন কেটে দেয়। তবুও ভালো কিন’ যদি মোবাইল রিসিভ করেই জানতে চায় “রুমী তুমি আমার সাথে প্রতারণা করলে কেন”?

তবে কী জবাব দেবে? এমনিভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজের অজান্তে মোবাইল চালু করে রেখে দিল।

গভীর রাত, শরতের আকাশে চাঁদের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। রুমী নিদ্রাহীন অবস্থায় বিছানায় ছটফট করছে কখনোবা জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের সাথে মেঘের খেলা উপভোগ করছে। হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠল।

রুমী রিসিভ করল, হ্যালো…..

অপর পাশ থেকে সোহেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, রুমী তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, আমি ঢাকা থেকে তোমার মোবাইলে অনেকবার রিং করেছি কিন্তু তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করার জন্য মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছ।

সোহেল আমি ফোন বন্ধ করিনি, আসলে ফোনটা আমার কাছে ছিল না। বাবা আমার ফোনটা লুকিয়ে রেখেছিল। আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি কিন্তু মোবাইলটা হাতে ছিল না, আর আমি একরকম নজর বন্দি ছিলাম। তাই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। আজ সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনটা হাতে পেলাম।

তবে আজ ফোন করলে না কেন? সোহেল জিজ্ঞেস করল।

কোন মুখে আমি তোমাকে মোবাইল করবো? কী করে তোমাকে বুঝাব যে, যা কিছু ঘটেছে তার সব কিছুই ঘটেছে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, জোরপূর্বক। একথা তোমাকে বুঝাবার মতো ভাষা আমার জানা নেই। আমি এই ক’দিন শুধু তোমার কথা ভেবেছি আর আপন মনে জ্বলে পুড়ে মরছি। প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা মনে পড়েছে, তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে তোমার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সোহেল আমি তোমার গিফটগুলো ফেরত দিতে চাই।

বেশ সব কিছু যদি ফিরিয়ে দিতে পারো তবে দিও।

কোথায় আসব বলো? রুমী জিজ্ঞেস করল।

আমি বললেই কি তুমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে? সোহেল বলল।

অবশ্যই যাব, তবে দিনাজপুর ছাড়া অন্য কোথাও?

রুমী তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার সেই পছন্দের জায়গায় চলো।

সিংড়া ফরেস্টে? রুমী জিজ্ঞেস করল।

যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।

না, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি বিকেল চারটায় তোমার অফিসে পৌঁছাব, এখন রাখি বাই। বলে মোবাইল রেখে রুমী তার স্টিল আলমারি খুলে সোহেলের দেওয়া চিঠি, অর্নামেন্টস, কসমেটিকস, থ্রি-পিস সবকিছু বের করে মেঝেতে রাখল। তারপর সোহেলের দেওয়া একটি থ্রি-পিস পরল, অর্নামেন্টসগুলো পরল, তার দেওয়া কসমেটিকসে সেজে-গুজে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তারপর সোহেলের চিঠিগুলো কয়েকবার পড়ল, পড়তে পড়তে তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। রুমীর ইচ্ছা করছে উচ্চ স্বরে শব্দ করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে কিন্তু তার মনের যন্ত্রণার কথা সবাই জেনে যাবে তাই রুমী অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের কান্নার রূপ দেখল। তারপর ড্রেস পরিবর্তন করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পরদিন ঠিক বিকেল চারটার সময় রুমী সোহেলের অফিসে এলো। সোহেলের চোখে চোখ পড়তেই চাপা কান্নায় রুমীর বুক ভেঙে গেল। সোহেলের চোখ দু’টো যেন গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে, চোয়ালগুলো বসে গেছে, চোখে-মুখে হতাশা ও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রুমীর চোখ দু’টো যেন ছলছল করে উঠল।

সোহেল জিজ্ঞেস করল, কী খাবে গরম না ঠাণ্ডা?

কিছু না।

তবে চলো, বলে সোহেল চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল এমন সময় রুমীর হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল, এসব কী?

রুমী মাথা নত করে চুপ করে রইল।

সোহেল ম্লান হাসি হেসে বলল, ব্যাগটা এখানেই থাক চলো আমরা যাই। বলে দু’জনে মোটর সাইকেলে চড়ে সিংড়া ফরেস্টের দিকে রওয়ানা হলো।

সারাটা রাস্তা দু’জনে নীরবে বসে রইল, সিংড়া ফরেস্টের গেট দিয়ে ঢুকে সোহেল মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করতে করতে রুমী একটি বেঞ্চে বসল।

সোহেল মুখোমুখি অন্য একটি বেঞ্চে বসতে বসতে বলল, রুমী আগে বলো তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে কেন?

রুমী সোহেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আগে সব কিছু শোন তারপর তুমি বলবে আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছি কি না?

বলো?

তুমি যেদিন ঢাকা গেলে তার দু’দিন পর হঠাৎ করে সকাল থেকে আমার মোবাইল ফোনটা পাচ্ছিলাম না, অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম, মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম কিন’ কোথাও পেলাম না। বিকেল বেলা ধুমধাম আয়োজন শুরু হলো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা এত কিছুর আয়োজন কেন?

মা বলল, আজ তোকে দেখতে আসবে।

আমার বুঝতে বাকি রইল না। আমি প্রচণ্ড রেগে বললাম, আমি কি গরু-ছাগল নাকি আমাকে দেখতে আসবে?

মা ধমক দিয়ে বলল, রুমী সব জেনে-শুনে না বোঝার ভান করিস না, তুই জানিস না বিয়ের উপযুক্ত মেয়েকে মানুষ কেন দেখতে আসে?

আমি মায়ের হাত ধরে জোর করে আমার রুমে নিয়ে অনেক বুঝালাম, তোমার কথা বললাম, মা সবকিছু শুনে বলল, আমি তোর বাবাকে বলেছি মা। ও কিছুতেই মানছে না, আমি তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তুই নিজে বল। বলে মা গিয়ে বাবাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিল। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করে বললাম, তুমি এসব বন্ধ কর বাবা, তুমি তো জানোই আমি সোহেলকে ভালোবাসি, যদি বিয়ে করতেই হয় তবে ওকেই বিয়ে করবো।

না, ওর সঙ্গে তোর বিয়ে হবে না, তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে তোর জন্য আমি ছেলে দেখেছি, ছেলেটা ভালো চাকরি করে, শহরে বাড়ি-গাড়ি আছে, সেখানে তোর অমঙ্গল হবে না।

আমার মঙ্গল-অমঙ্গলের ভাবনাটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও বাবা।

না, তোর এখন ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়নি।

বাবা আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, আর ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়নি?

মুখে মুখে তর্ক করিস না রুমী, বলে বাবা চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে বর পক্ষের লোকজন এলো, আমাকে কনে সাজিয়ে আমার হাত-পা, চোখ-মুখ, নাক-কান, চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তখন আমার বার বারই মনে হচ্ছিল কোরবানির গরু যেমন বিক্রির সময় নিখুঁতভাবে গরু যাচাই করা হয় তেমনি যেন তারা আমাকে আদর্শ বধূ হিসেবে নিরীক্ষা করল। কপাল খারাপ সেজন্যই বুঝি তারা আমাকে পছন্দ করল। আর আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা-মা আমাকে ওদের হাতে তুলে দিল। আমি ওদের হাতের পুতুল হয়ে গেলাম, ওদের ইচ্ছায় হাসলাম, ওদের ইচ্ছায় কাঁদলাম। বলতে বলতে রুমীর গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি পড়িয়ে পড়ল।

সোহেল রুমীর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম রুমী, তুমি কিছু মনে করো না।

সোহেল আমি তোমার দেয়া গিফটগুলো ফেরত নিয়ে এসেছি।

গিফটগুলো ফেরত দিয়ে গেলেই কি সব মিটে গেল?

তবু-

সোহেল রুমীর কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলতে শুরু করল, রুমী তুমি যদি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারো, তুমি যদি আমার হৃদয়ের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিতে পারো তবে আমার দেয়া সব গিফট ফেরত দাও। আর যদি তা না পারো তবে কিছুই ফেরত দেয়ার প্রয়োজন নেই, কি পারবে?

রুমী সোহেলের মুখের দিকে ফাল ফাল করে তাকিয়ে রইল।

সোহেল রুমীর মুখ উঁচু করে ধরে বলল, তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই রুমী, তুমি খুব ভালো মেয়ে।

তুমিও খুব ভালো ছেলে, তোমার সঙ্গে থাকতে না পেরে আমি জীবনের চরম সুখ থেকে বঞ্চিত হলাম। এখন বলো তুমি কী ভাবছ?

কী ভাবছি মানে?

এই তোমার বিয়ে-টিয়ে।

সোহেল প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, পরে ফোনে কথা হলে জানাবো, আজ চলো।

চলো, বলে রুমী মোটর সাইকেলে উঠল।

পাঁচ

অফিস থেকে দেরিতে বাসায় ফেরা শিহাবের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাসায় ফেরার সময় হলে শিহাবের মন খারাপ হয়ে যায়। তাই অফিস থেকে দেরিতে রওনা হয়। আবার কোনো দিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য রওনা হলেও রাস্তার মোড়ে বা দোকানে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাসায় ফিরে। অফিসেও আগের মতো সবার সাথে খোলামেলা কথা বলে না, কখনো কখনো শুধু পাশের চেয়ারে বসা মারিয়ার সঙ্গে দু’একটা কথা হয় মাত্র।

সেদিন অফিস শেষে মারিয়া শিহাবের সামনের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, কী শিহাব সাহেব এখন কেমন দিন যাচ্ছে?

শিহাব দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল, দিন যাচ্ছে না ম্যাডাম, ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পার করছি।

কেন আমার পরামর্শে কোনো উপকার হয়নি?

হ্যাঁ আপনার পরামর্শ মতো সেদিন ফুল নিয়ে গেলাম, মিথ্যা ইনক্রিমেন্টের কথা বললাম কিন্তু ও ফুল ছুঁয়েও দেখল না, ওর কোনো ফিলিংস নেই।

তারপর-

আপনার পরামর্শ মতো পাঁচ দিন অফিসিয়াল ট্যুরের কথা বলে ওকে বাপের বাড়িতে রেখে তিন দিন পর ট্যুর থেকে ফিরে যখন তাকে বাপের বাড়ি থেকে আনতে গেলাম, তখন ও আমার সঙ্গে এলো না, কিংবা আমাকে থাকতেও বলল না, আমার মনে হয় ওর মনে আমার বিন্দুমাত্র সন্তান নেই। বলতে বলতে শিহাবের দু’চোখ ছলছল করে উঠল।

সরি শিহাব সাহেব আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।

না, আপনি তো আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন না, বরং আমার কষ্ট আপনি অনুভব করতে পেরেছেন সে জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মিস মারিয়া আপনি কি আমাকে একটা হেল্প করতে পারেন?

বলুন কীভাবে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি?

আপনি বলতে পারেন কি রুমী আমার সঙ্গে কেন এমন আচরণ করছে?

শিহাব সাহেব কিছু মনে করবেন না, আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো।

করুন।

বিয়ের আগে কি ভাবির সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?

না।

আপনি কি ভাবিকে দেখেছিলেন?

শুধু ছবিতে দেখেছিলাম।

ভাবী কি আপনাকে দেখেছিল?

না।

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে ভাবির অন্য কোনো পছন্দের ছেলে থাকতে পারে?

আমার মনে হয় এরকম একটু গ্যাপ আছে।

মারিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, শিহাব সাহেব আমার একটু তাড়া আছে। আজ চলি বলে মারিয়া চলে গেলে শিহাব কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল তারপর অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল। কয়েকটি রিকশা পাশ দিয়ে ওভারটেক করে যাওয়ার সময় রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, ভাই যাবেন না কি?

শিহাব কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মডার্ন মোড়ে এসে পৌঁছাল।

মডার্ন মোড়ের অদূরে নিমতলা মোড়। মোড়ের সঙ্গে একটা চায়ের দোকান, এই দোকানের চা দিনাজপুর শহরের সেরা। এখানে এক কাপ চা পান করার জন্য অনেক লোক গাড়ি নিয়ে আসে। শিহাবও সময় পেলে এখানে এক কাপ চা পান করে। আজও শিহাব নিমতলা গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা পান করছিল।

সীমান্ত হঠাৎ শিহাবের কাঁধে গাত রেখে বলল, বন্ধু কী খবর?

শিহাব চমকে উঠল, সীমান্ত কেমন আছিস?

হ্যাঁ আমি ভালো আছি, তুই?

ভালো নেই রে।

তোকে অবশ্য দেখে মনে হচ্ছে ভালো নেই, মুখ শুকিয়ে গেছে, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ততক্ষণে শিহাবের চা শেষ হয়ে গেছে সে বলল, থাকিস যাই।

কোথায় যাবি এখন?

কোনো উদ্দেশ্য নেই এই এমনিই।

চল কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি, তোর ভালো লাগবে।

শিহাব সায় দিয়ে বলল, চল।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে নিমতলার অদূরে একটি বাসায় গেল। সীমান্ত বিশেষ কৌশলে কলিং বেল এ তিনটি টিপ দেওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যে একটি মেয়ে দরজা খুলে মুচকি হেসে বলল, সীমান্ত এতদিন পর।

শিহাব মেয়েটির আপাদমস্তক একবার তাকাল। ফর্সা ধবধবে, লম্বা, সুন্দরী, স্লিম ফিগারের মেয়েটির পরনে সঙ্কীর্ণ কামিজ, ওড়না বিহীন বক্ষ, সমস্ত শরীরে উগ্রতার চিহ্ন স্পষ্ট। মেয়েটির সঙ্গে দু’জনে ড্রয়িং রুমে ঢুকল। ড্রয়িং রুমে কার্পেট বিছানো, ঝলমলে আলো, বিশালাকার টি.ভি কক্ষে আভিজাত্যের কমতি নেই। শিহাব কক্ষের দেয়ালে এবং সিলিং-এ একবার তাকাল। সমস্ত বাসায় অদ্ভুত রকমের অত্যাধুনিক সাজসজ্জা।

সীমান্ত শিহাবকে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল শিহাব তুই গল্প কর, আমি খালার সঙ্গে দেখা করে আসি।

শিহাব সোফায় বসে পড়ল। মেয়েটি শিহাবের পাশে গা ঘেঁষে বসে বলল, তোমার নাম কী?

শিহাব।

আমার নাম লাকী, তোমার কি মন খারাপ?

শিহাব মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল, হুঁ।

ফুর্তি করতে এসেছ, তাই না? বলে লাকী শিহাবের কাঁধের ওপর হাত রাখল।

শিহাব লাকীর হাত নামিয়ে দিয়ে সরে বসল, তার সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল, হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করল, পা দু’টো শিথিল হয়ে এলো।

শিহাব ঘরের চতুর্দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। তার মনে হলো জোরে চেঁচিয়ে সীমান্তকে ডাক দেয়। আবার পরক্ষণেই নিবৃত হলো। ততক্ষণে লাকী শিহাবের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, এ রাস্তায় নতুন বুঝি?

শিহাব কাঁপা স্বরে বলল, হুম।

কোনো ভয় নেই, এখানে কেউ আসবে না, খালা আম্মার সব ম্যানেজ করা আছে। অনেক বড় বড় অফিসার এখানে আসে, শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সবাই ফুর্তি করতে আসে, তোমার কোনো ভয় নেই। ফুর্তি করো। কী লাগবে বিয়ার? হুইস্কি? অন্য কিছু? বলে লাকী শিহাবের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্লীল ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, আমাকে পছন্দ হচ্ছে না?

শিহাব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। লাকী শিহাবের হাত ধরে একরকম জোর করে ভিতরে অন্য একটি রুমে নিয়ে গেল। সীমিত আলোর মধ্যে ষোল কিংবা সতের বছর বয়সের একটি মেয়ে বসে আছে। শিহাব একবার তাকাতেই মনে হলো এমন সুন্দর মেয়ে সে জীবনে দেখেনি। টকটকে চেহারা যেন ফুলের আঁচড়ে রক্ত ঝরে পড়বে। লম্বা, ফর্সা, গোলগাল যেন চোখের দৃষ্টিও অপূর্ব। লাকী শিহাবকে একটি চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, লিপি নিউ কামার, তোর কাছে দিয়ে গেলাম, ভালোভাবে যত্ন করিস, বলে লাকী চলে গেল।

লিপি শিহাবকে বসতে বলে ভি.সি.ডিতে একটি নগ্ন ছবি চালু করে দিয়ে বলল, দেখ, ভালো লাগবে, তারপর শিহাবের গা ঘেঁষে বসল। শিহাবের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, মন ভালো নেই, ফুর্তি করতে এসেছ?

মন ভালো নেই, তবে আমি ফুর্তি করতে আসিনি, শিহাব রাগান্বিত স্বরে বলল।

তবে-

আমি সীমান্তের সঙ্গে এসেছি, তুমি কি একটু সীমান্তকে ডেকে দেবে?

একটু বসো, এসেছো যখন তখন না হয় এক প্যাক হয়ে যাক, বলে লিপি গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দিয়ে শিহাবের গায়ে এলিয়ে পড়ল। শিহাব সরে বসে বলল, লিপি কী হচ্ছে এসব? বলছি তো আমি এসবে অভ্যস্ত নই।

অভ্যস্ত না হলেও একটু-আধটুতে দোষ কী? লিপি বলল।

শিহাব দৃঢ় কণ্ঠে বলল, না আমি এসবে নেই, তুমি কি আমাকে সীমান্তকে ডেকে দিবে নাকি আমি চলে যাব?

লিপি ইন্টারকম তুলে বলল, খালা তোমার কাছে কি সীমান্ত আছে? যদি থাকে তো পাঠিয়ে দাও।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সীমান্ত চলে এলো সঙ্গে মধ্যবয়সী এক মহিলা। সীমান্ত পরিচয় করে দিল, খালা এ হচ্ছে আমার বন্ধু শিহাব মাঝে মাঝে আসবে, বলে সীমান্ত সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকল।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে খালা বলল, তোমার নামটা কী যেন বললে?

শিহাব, শিহাবের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

সীমান্ত তোমার বন্ধুটা বড় লাজুক প্রকৃতির আর ভীতু, বলে খালা একটা কার্ড শিহাবের হাতে দিয়ে বলল, আবার যেদিন আসবে কার্ডটা সঙ্গে আনবে আর না হয় গেটে সীমান্তের পরিচয় দিবে।

শিহাব কার্ডটি পকেটে রেখে সীমান্তের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।

ছয়

সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে শিহাবের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তারপরও শিহাব না আসায় শিহাবের মা বিরক্তির স্বরে বললেন, তোমরা শুরু করো, ও যে কখন আসবে বোঝা যাচ্ছে না।

কেন তোমাকে কিছু বলে যায় নি? শফিক সাহেব বললেন।

ও কি কোনোদিন আমাকে কিছু বলে যায়? আর আজ তো ও অফিসে থেকেই ফিরে আসেনি, শাহানা বললেন।

এখন রাত ন’টা বাজে এখনো অফিস থেকে ফিরেনি মানে? বলে শফিক সাহেব একটু থামলেন তারপর মিনির দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে তুই কিছু জানিস?

না বাবা, মিনি উত্তর দিল।

শাহানা বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, তুমি কি সংসারের কোনো খবর রাখো?

কেন কী হয়েছে? শফিক সাহেব মুখ তুলে বললেন।

বউমা বাপের বাড়ি গেল আজ প্রায় পনেরো দিন হলো তারপর তো শিহাব একবার আনতেও গেল, বউমা এলো না।

কেন?

আরো কয়েকদিন থাকবে বলে।

আরো কয়েকদিন তো হয়ে গেল, কালকে আবার যেতে বলো, গিয়ে বউমাকে নিয়ে আসবে।

সে কথা তুমি বলো, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারব না, বিয়ের পর থেকে দেখছি ছেলেটার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গেছে, ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে, মেজাজটাও যেন খিটখিটে হয়ে গেছে বলতে বলতে শাহানা চোখ মুছলেন।

শফিক সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করো চোখের জল দিয়ে সবকিছুর সমাধান করতে যেও না শিহাব আসুক আমি দেখছি।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল, মিনি দরজা খুলে দিতেই শিহাব ড্রয়িং রুমে ঢুকল।

শফিক সাহেব ততক্ষণে ডাইনিং রুম থেকে খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসেছে। শিহাবকে দেখে বললেন, কী রে এত রাত কেন? কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

অফিসে।

অফিস তো শেষ হয়েছে সেই বিকেল পাঁচটায় আর এখন তো রাত প্রায় দশটা বাজে।

শিহাব মাথা নত করে বলল, বাবা।

বউমা কোথায়? শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

বাবার বাড়ি।

সে তো আমিও জানি, নিয়ে আসিস না কেন?

শিহাব মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

কী কথা বলছিস না কেন? আগামীকাল গিয়ে বউমাকে নিয়ে আসবি, বলে শফিক সাহেব মিনিকে ডেকে বললেন, মিনি আমার মোবাইল ফোনটা নিয়ে আয় তো।

মিনি মোবাইল ফোনটা এনে হাতে দিতেই তিনি রিং করলেন। অপর পাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

শফিক সাহেব বললেন, হ্যালো বিয়াই সাহেব কী খবর আপনাদের?

আমরা ভালো আছি, আপনারা কেমন আছেন? সামাদ সাহেব বললেন।

জি আমরাও ভালো আছি, আচ্ছা আমাদের বউমা কি বাসায় আছে?

আছে, কথা বলবেন?

হ্যাঁ দিন, প্লিজ।

কয়েক সেকেন্ড পর শফিক সাহেব আবার বললেন, হ্যালো বউমা তোমার এই বুড়ো বাবাকে ভুলে গেলে নাকি?

না আব্বা।

তবে আমি কালকে শিহাবকে পাঠিয়ে দেব, তুমি চলে এসো।

জি আব্বা।

মোবাইল ফোন রেখে রুমী বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। এ’কদিন বাবার বাড়িতে বেশ আরামেই ছিল। প্রতিদিন রাতে সে একবার করে সোহেলের সঙ্গে কথা বলত। সারাদিন সে তার স্মৃতি হৃদয়ে লালন করে শিহাবের স্মৃতি থেকে একরকম দুশ্চিন্তা মুক্তই ছিল কিন্তু আজ শ্বশুরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার পর তার মন দুশ্চিন্তা ভরে গেল। একদিন রুমী তার দুশ্চিন্তা আর নির্ঘুম রাতের কথা বলতে বলতে সোহেল বলেছিল যদি কোনোদিন রাতে ঘুম না আসে তবে হাঁটবে তারপরও যদি ঘুম না আসে তবে উল্টা দিক থেকে এক’শ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই এভাবে এক’শ থেকে এক পর্যন্ত গুনবে। তবুও যদি ঘুম না আসে তখন ধীর গতিতে ফ্যান চালু করে দিয়ে তাকিয়ে থাকবে। রুমী বিছানায় শুয়ে আজ সোহেলের পরামর্শ মতো ঘুমাবার সব রকম চেষ্টা করল কিন্তু কোনো ভাবেই ঘুম এলো না। ঘড়িতে ঠং ঠং করে এগারোটা বাজার ঘণ্টা বেজে উঠল তার ঠিক কয়েক মিনিট পরেই মোবাইল ফোন বেজে উঠল। রুমীর বুঝতে বাকী রইল না যে, সোহেলই ফোন করেছে।

রুমী ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে সোহেলের কণ্ঠ ভেসে এলো, হ্যালো রুমী।

হুম বলো।

ঘুমাও নি।

না।

কেন?

ঘুম আসছে না।

হঠাৎ কী হলো আবার? সোহেল জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ এ’কদিন তো ভালোই ছিলাম, আজ হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল, রুমী বলল।

কেন?

দিনাজপুর থেকে শ্বশুর ফোন করেছিলেন, কালকেই শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, বলে রুমী সোহেলের উত্তরের অপেক্ষায় চুপ করে রইল।

কিন’ সোহেলের কোনো কথা শুনতে না পেয়ে আবার বলল, হ্যালো সোহেল।

হ্যাঁ বলো।

তুমি কিছু বলছ না যে?

তোমাকে আমার বলার কিছু নেই রুমী, তোমার সমস্যার সমাধানও আমার জানা নেই।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না সোহেল। আমার সবসময় মনে হচ্ছে আমি যেন সাঁতার না জানা একটি অসহায় মেয়ে সাগরের অথৈ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। যেন আমাকে হাত ধরে রক্ষা করার কেউ নেই। কখনো কখনো মনে হয় আত্মহত্যা করি।

ছি : রুমী এমন কথা বলবে না, নিজেকে নিঃশেষ করা কোনো সমাধান নয়। তুমি নিরাশ হয়ো না। সব সময় মনে করবে আমি তোমার সঙ্গে আছি, আমি তোমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবো। তোমার সুখে হাসবো, তোমার কষ্ট আমি সমানভাবে ভাগ করে নিব। তুমি নিজেকে কখনো অসহায় ভেবো না। সবসময় মনে করবে তুমি অসহায় নও। আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি।

রুমী অস্ফুট স্বরে বলল, সোহেল।

হ্যাঁ রুমী, তুমি শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর তোমার কাছে আমার ফোন করার পথ বন্ধ হয়ে গেল। যে কোনো দুঃসময় আমার কাছে এসো আমি তোমাকে ফিরাব না।

সোহেল তুমি খুব ভালো মানুষ, খুব উদার মনের মানুষ অথচ তোমার সাথে আমি-

সোহেল বাধা দিয়ে বলল, তোমার মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন রাখো রাত অনেক হয়েছে।

হোক অনেক রাত, আমার ইচ্ছে করছে আজ সারারাত তোমার সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দিই।

রুমী এখন শুয়ে পড়, ঘুমাও।

কিন্তু আমার যে ঘুম আসছে না।

আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করো, নিশ্চয় ঘুম আসবে, আমি রাখছি, গুড নাইট।

গুড নাইট, বলে রুমী মোবাইল বন্ধ করল।

সাত

কয়েকদিন পর রুমীকে কাছে পেয়ে শিহাবের হৃদয়ের সমস্ত কথা উজাড় করে বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু রুমীর অদ্ভুত রকমের নীরবতা আর গম্ভীর মুখের কাছে তার সমস্ত আশায় ভাটা পড়ল। শিহাব মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে ইচ্ছাকৃতভাবেই কয়েকবার সজোরে ব্রেক করল। শিহাবের ধারণা ছিল ব্রেক করার সঙ্গে সঙ্গে রুমী তার পিঠে ঝুঁকে পড়বে, রোমাঞ্চ অনুভব করবে কিংবা কিছু না হলেও অন্ততপক্ষে কোনো কথা বলবে। কিন্তু এর কোনোটাই হলো না, রুমী স্ট্যাচুর মতো মোটর সাইকেলে শক্তভাবে বসে রইল। শহরে ঢুকে শিহাব একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে মোটর সাইকেল থেকে নেমে রুমীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিতেই রুমী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, দাঁড়ালে কেন?

কিছু খেয়ে যাই, বলে শিহাব রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। রুমীর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিহাবের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। সীমিত আলো, সজ্জিত অত্যাধুনিক চেয়ার টেবিল, দেয়ালে টাঙ্গানো আকর্ষণীয় পোস্টার সবকিছু মিলে যেন অদ্ভুত সুন্দর রকমের পরিবেশ। শিহাব রুমীকে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে টেবিলের প্রাইজ লিস্টটা রুমীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বলো কী খাবে?

তোমার যা পছন্দ, রুমীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

শিহাব খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল, বলো?

কী বলব?

তোমার কিছু বলার নেই?

না।

এমন সময় টেবিলে খাবার দিয়ে গেলে শিহাব রুমীকে খেতে বলে নিজে খাওয়া শুরু করল। রুমী নীরবে শিহাবের সঙ্গে খাওয়া শুরু করল এবং কোনো কথা না বলেই খাওয়া শেষ করল।

শিহাব কয়েকবার রুমীর চোখে চোখ রেখে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু রুমী তাকে গুরুত্ব না দিয়েই খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়াল। বাসায় পৌঁছে রুমী শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম জানিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

শিহাব কাপড় পরিবর্তন করতে করতে বলল, রুমী শুয়ে পড়লে যে?

কেন?

এতদিন পর এলে মা-বাবার সঙ্গে, মিনির সঙ্গে একটু কথা বলো।

রুমী চুপ করে শুয়ে রইল।

শিহাব ড্রয়িং রুমে মা-বাবার সামনে বসল।

শফিক সাহেব প্রশ্ন করলেন, কী রে বউমা কী করছে?

শিহাব মাথা নত করে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, শুয়ে আছে।

কেন?

শরীর খারাপ করেছে? শাহানা জিজ্ঞেস করল।

না মা।

তবে-বলে সে শিহাবের বেড রুমে গিয়ে রুমীর কপালে হাত দিয়ে বলল, বউমা, শরীর খারাপ করছে?

রুমী বিছানায় উঠে বসে বলল, না মা।

তবে অসময়ে শুয়ে আছ যে, চলো ড্রয়িং রুমে তোমার শ্বশুর অপেক্ষা করছে।

আপনি যান মা।

শাহানা গম্ভীর মুখে রুমীর কাছ থেকে ফিরে একটি সোফায় বসতে বসতে বলল, আমার মনে আমাদের বুঝতে কিছু ভুল হচ্ছে।

শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, যেমন?

শাহানা বলল, আমার মনে হচ্ছে শিহাবের সঙ্গে বউমার এ্যাডজাস্টমেন্টে কোন সমস্যা হচ্ছে?

শফিক সাহেব চোখ তুলে বললেন, তুমি কীভাবে বুঝলে?

শাহানা একটা নিশ্বাস টেনে বলল, আমি প্রথম থেকেই দেখছি বউমা সবসময় মন খারাপ করে থাকে, আমাদের কারো সঙ্গে তেমন একটা ভালোভাবে কথাও বলে না, শিহাবকেও কৌশলে এড়িয়ে চলে, তাদের স্বামী-স্ত্রীর আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।

কীরে তুই কিছু বলছিস না কেন? শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

এতক্ষণ শিহাব মাথা নত করে বসেছিল এবার সোফা থেকে উঠে বেড রুমে চলে গেল।

শফিক সাহেব সোফা থেকে উঠে পায়চারি করতে করতে বললেন, শাহানা বউমাকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করেছ ওর শরীরটা খারাপ কিনা, নাকি একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?

তুমি যখন বলছ, তখন কাল না হয় একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব, কিন্তু আমার মনে হয় না তাতে কোনো লাভ হবে। বউমার অসুখটা দেহে নয়, মনে, বলে শাহানা ড্রয়িং রুম থেকে চলে গেল।

শিহাব ঝড়ের বেগে বেডরুমে ঢুকে রুমীকে জিজ্ঞেস করল, রুমী একটু উঠে বসো।

কেন?

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বলো।

তোমার আচরণ আর আমাদের দাম্পত্য নিয়ে বাবা-মা প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন আমাদের সম্পর্ক অস্বাভাবিক। তারা আমাদের অ্যাডজাস্টমেন্ট নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

রুমী কোনো কথা বলল না।

শিহাব কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, তুমি কিছু বলো?

রুমী বিছানায় উঠে বসে বলল, কী বলব?

তবে আমার কয়েকটা কথার ঠিক ঠিক উত্তর দাও।

রুমী নীরব বসে রইল।

শিহাব জিজ্ঞেস করল, আমাদের বিয়ের আগে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে?

হুম, রুমীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

তবে আমাকে বিয়ে করলে কেন?

আমি তো তোমাকে বিয়ে করিনি।

রুমী, শিহাব অস্ফুট স্বরে বলল।

হ্যাঁ আমি তোমাকে বিয়ে করিনি, তুমি শুধু আমার ছবি দেখে আমার মতামত না জেনে একরকম আভিজাত্য আর বিত্ত বৈভব দিয়ে আমাকে বিয়ে করে এনেছ।

কিন্তু তুমি এ কথা আমাকে আগে বলনি কেন?

বিয়ের আগে তো আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যেদিন আমার বিয়ে সেদিন সকাল বেলা আমি জানলাম, অচেনা, অজানা, বিত্তশালী, চাকরিজীবী, ভদ্র, স্মার্ট এক ছেলের কাছে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ন্যস্ত করা হচ্ছে। তারপর সবকিছু ঠিকঠাক করে ন্যূনতম সামাজিকতা রক্ষার জন্যই আমার মতামত চাওয়া হয়, যখন আমার আর না বলার উপায় ছিল না। তাই তোমার ইচ্ছার কাছে আমি আমার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছি। বলতে বলতে রুমীর কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

শিহাব জিজ্ঞেস করল, তুমি কি তাকে এখনো ভালোবাসো?

রুমী কোনো কথা বলল না। মাথা নত করে বসে রইল।

শিক্ষা-দীক্ষা, বিষয়-সম্পত্তি, বিত্ত-বৈভব কোন দিক থেকে সে আমার চেয়ে বেশি যে বিয়ের এতদিন পরও তুমি তাকে ভুলতে পারছ না?

বিষয় সম্পত্তি আর আভিজাত্য দেখে আমি ওকে ভালোবাসিনি শিহাব, ওর সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। তাই আমি ওকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না। এক মুহূর্তের জন্য আমার মন থেকে ওর ছবি মুছতে পারছি না, আমি আর পারছি না শিহাব।

ছি : রুমী, ছি :, তোমার হ্যাজবেন্ডের সামনে তুমি অন্য পুরুষের কথা বলতে পারছ?

আমি আর কিছু লুকাতে চাচ্ছি না শিহাব।

তবে কি তোমাকে বিয়ে করা আমার অপরাধ হয়েছে? যে কারণে তুমি আমাকে দাম্পত্য সুখ থেকে বঞ্চিত করছ?

অবশ্যই দোষ হয়েছে, ছবি দেখে আমাকে পছন্দ করে তুমি মূল্যবান সামগ্রীর মতো আমাকে ভোগ করতে চেয়েছ, তুমি তোমার ওয়াইফ সিলেকশনের আগে অসংখ্য ছবি থেকে আমাকে বেছে নিয়েছ, ছেলে হিসেবে তোমার যেমন মেয়ে পছন্দ করার অধিকার আছে তেমনি আমারও যে পছন্দ থাকতে পারে সেকথা তুমি কোনোদিন চিন্তা করনি। এটাই তোমার অপরাধ হয়েছে আর দাম্পত্য সুখের কথা বলছ। তুমি আরেক জনের বাগানের ফুল ছিনিয়ে এনে নিজের বাগান সাজাতে চেয়েছে, তুমি তো আমার জীবনের চরম পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছ। সব দোষ তোমার, আমার বাবা-মা আর এই মান্ধাতা আমলের সমাজ ব্যবস্থার। হ্যাঁ শিহাব, আমি একজনকে ভালোবাসি, আমি আরো জোরে চিৎকার করে বলতে চাই আমি একজনকে ভালোবাসি, অনেকদিন আগে তার সঙ্গে আমার হৃদয় এক হয়ে মিশে গেছে। স্বামী হিসাবে তাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে কল্পনা করিনি, একদিন সকালবেলা বাসায় ধুমধাম আয়োজন শুরু হলো, বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমার বিয়ে, আমি হতবাক হয়ে গেলাম, আমার বিয়ে আমি জানলাম না, যাকে আমি সমস্ত হৃদয় উজাড় করে দিয়েছি বিত্ত আর আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় সে হেরে গেল আর তুমি আমাকে তার হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলে। তাই তোমার কাছে থেকেও আমি এক মুহূর্ত তাকে মনের আড়াল করতে পারছি না। বলে রুমী বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

আট

নিত্য দিনের মতো শিহাব অফিসে কাজ করছিল। কয়েকদিনে তার চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে, চুল এলোমেলো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মারিয়া কাজের ফাঁকে শিহাবের সামনের চেয়ারে বসে বলল, কী ব্যাপার শিহাব সাহেব? আপনার এ অবস্থা?

শিহাব কাগজ কলম রেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, মিস মারিয়া আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে?

কেন বলুন তো?

আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

মারিয়া শিহাবের টেবিলের দিকে ঝুঁকে বসল, বলুন।

আমি বলছিলাম রুমীর কথা।

কী হয়েছে?

অনেক বড় ভুল হয়েছে।

কী ভুল হয়েছে?

রুমীকে বিয়ে করা।

কেন?

রুমী অন্য একজনকে ভালোবাসে।

বিয়ের আগে কোন মেয়ে কোন ছেলেকে ভালোবাসতেই পারে, মারিয়া বলল।

শুধু বিয়ের আগে নয়, এখনো রুমী তাকে ভালোবাসে।

কিন’ বিয়ের আগে আপনি খোলাখুলিভাবে জানলেন না কেন? মারিয়া জিজ্ঞেস করল।

বিয়ের আগে রুমীর সঙ্গে কথা বলাই হয় নি, শিহাব বলল।

মারিয়া কপালে চোখ তুলে বলল, বিয়ের আগে আপনাদের মধ্যে কোন দেখা সাক্ষাৎও হয়নি।

শিহাব একবার ডানে আরেক বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানালো, আগে কোনোদিন আলাপ হয় নি।

মারিয়া অবাক হলো, অপরিচিত দু’জন ছেলে-মেয়ের মধ্যে চিরদিনের সম্পর্ক হতে পারে, এটা কী করে সম্ভব?

জি ম্যাডাম, এটাই বাস্তবতা।

আপনাদের সোসাইটিতে বিয়ের আগে পরস্পরকে ভালোভাবে জানার অধিকার নেই?

আছে কিন্তু গোপনে।

আপনি কিছু মনে করবেন না শিহাব সাহেব বিয়ের ব্যাপারে এ ধরনের ব্যবস্থা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

শিহাব প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, সে যা হোক, মিস মারিয়া শুনলাম আপনার নাকি বিয়ে হচ্ছে?

হুম, ডিসেম্বরে, বড় দিনের ছুটিতে।

কেবল তো অক্টোবর মাস, ডিসেম্বর তো এখনো অনেক দেরি।

মারিয়া একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, হুম, আমাদের বিয়ের পদ্ধতিটা বেশ দীর্ঘ, কমপক্ষে তিন মাস।

এতদিন কেন?

মারিয়া একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, পাঁচটা বাজে, অফিস শেষ কাজেই এখন বলা যেতে পারে।

বলুন।

মারিয়া বলতে শুরু করল, এই ধরুন আপনি কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চান, প্রথমে আপনার পরিবারের পক্ষ থেকে আপনার গার্জিয়ান মেয়ের পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। তারপর মেয়ে পক্ষ যদি স্বেচ্ছায় বিয়ে দেয়ার কথা ভেবে থাকে তবে আপনার ও আপনার পরিবারের বিষয় খোঁজ খবর নিবে এবং তাদের পছন্দ হলে ও মেয়ে সম্মত থাকলে অফিসিয়ালি প্রস্তাব নিয়ে আপনার পরিবারকে জানাবে, আপনার ও মেয়ের মতামত জিজ্ঞেস করবে। আপনার ও মেয়ের উভয়ের গার্জিয়ানের মতামত নিবে। এভাবে দশ জনের সামনে সম্মতি প্রকাশ করার পর আপনি যে প্যারিস বা ধর্ম পল্লির বাসিন্দা সেই প্যারিসের ফাদারের নিকট থেকে অনুমতি পত্র নিয়ে মেয়ে যে প্যারিসের বাসিন্দা সেই প্যারিসের ফাদারের নিকট উভয়ের নাম নিবন্ধন করবে। বলে মারিয়া একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল, ফাদার আপনাদের উভয় পক্ষের সম্মতি জেনে দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে আপনাদের নাম নিবন্ধন করবেন। আপনাদের এ নাম নিবন্ধনের বিষয়টি ফাদার লিখিতভাবে আপনার প্যারিসের ফাদারকেও জানাবেন। তারপর উভয় প্যারিসেই পর পর তিন রবিবার প্রতিটি প্রার্থনা সভায় আপনাদের দু’জনের নাম ঘোষণা করা হবে যেন আপনাদের বিয়েতে আপনার, মেয়ের বা অন্য কারো কোনো আপত্তি থাকলে তা ফাদারকে জানানো হয়। যদি কোনো মেয়ে বা ছেলে ফাদারকে বলে যে, “ফাদার সে আমাকে ভালোবাসে এবং আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন আমাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করতে চায়।’’ তবে ফাদার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবেন যাতে কারো প্রতি অবিচার করা না হয়।

এতক্ষণ শিহাব গভীর মনোযোগ সহকারে মারিয়ার কথা শুনছিল।

মারিয়া মৃদু কণ্ঠে ডাক দিয়ে বলল, শিহাব সাহেব শুনছেন।

হুম বলুন খুব ভালো লাগছে, শিহাব বলল।

একবার হলো এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।

কী রকম?

পিটার গোমেজ নামে এক ছেলে রীনা গোমেজ নামে এক মেয়েকে ভালোবাসত। কিন্তু তাদের পারিবারিক প্রাচুর্যের ব্যবধান ছিল বিশাল। তাই পিটার গোমেজের বাবা মার্কস গোমেজ ছেলের বিয়ের জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখলেন তারপর ছেলে মেয়ে দু’জনের প্যারিসে জানানো হলো।

তারপর-

রীনা তখন ঢাকায় ছিল, সে পিটারের বিয়ের সম্পর্কে কিছুই জানতো না, বিয়ের ঠিক সপ্তাহ খানেক আগে রীনা গোমেজ তার সমস্ত চিঠি পত্র, ছবিসহ সবকিছু নিয়ে গির্জায় ফাদারের কাছে গিয়ে হাজির হলো। ফাদার পিটারের হাতের লেখা চিঠি পড়লেন, ছবি দেখলেন তারপর প্রথমে পিটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রীনাকে ভালোবাসতে?

জি।

তুমি কি এখনো রীনাকে ভালোবাসো?

জি।

তবে তুমি রীনাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করছ কেন?

পিটার মাথা ঝেঁকে সায় দিল।

তুমি রীনাকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে না করে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারো না। তাতে রীনার প্রতি তোমার অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। এমন অন্যায় তুমি করো না, ফাদার বললেন।

পিটারের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। পিটার ফাদারকে বলল, ফাদার আমি তো রীনাকে বিয়ে করতেই চাই, কিন’ বাবা-মা আমাকে রীনার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায় না।

তারপর ফাদার পিটারের বাবাকে ডেকে বললেন, শোন মার্কস, ঈশ্বর সব মানুষকেই খালি হাতে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আবার মৃত্যুর পর সমস্ত ধন-সম্পদ পৃথিবীতেই রেখে মানুষকে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে। কাজেই ধন সম্পদের কারণে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে না। আমি রীনা এবং পিটার দু’জনেরই কাছে জেনেছি তারা পরস্পরকে ভালোবাসে এবং তারা পরস্পরকে বিয়ে করতে চায়। তাদের পবিত্র সম্পর্কে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। তুমি তাদের সম্পর্কে বাধা দিয়ে পাপ করেছ, ঈশ্বর মহান তিনি তোমার মঙ্গল করবেন।

পিটারের বাবা ফাদারের প্রস্তাব মেনে নিয়ে রীনার সঙ্গে পিটারের বিয়ে দিলেন।

মারিয়ার কথা শুনতে শুনতে শিহাবের চোখ থেকে কয়েক ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। শিহাব কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, মিস মারিয়া আমারই ভুল হয়েছে। হয়ত এ ভুলের মাসুল আমাকে সারা জীবন দিতে হবে। বলতে বলতে শিহাব দু’চোখ মুছল।

মারিয়া ইতস্তত করে বলল, সরি শিহাব সাহেব, আমি আসলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।

না, ঠিক আছে।

আচ্ছা শিহাব সাহেব বলুন তো আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?

বিরল।

কোন গ্রামে?

বানিয়াপাড়া।

মারিয়া চমকে উঠে বলল, ভাবির নাম কী বলুন তো?

রুমী।

বানিয়াপাড়ার আমি এক রুমীকে চিনি, সে-ই কী না? আচ্ছা আমাকে একবার আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন?

অবশ্যই, আজই চলুন।

মারিয়া একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন।

নয়

রুমী বিকেল বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে আকাশের দিকে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। সে একরকম আনমনা হয়ে গিয়েছিল। কলিং বেলের শব্দে তার দৃষ্টি ভেঙে গেল। কয়েকবার কলিং বেল বেজে উঠার পর কেউ দরজা খুলে না দেয়ায় রুমী নিজেই দরজা খুলে দিতে গেল। দরজা খুলে দিতেই রুমী যেন চমকে উঠল, মারিয়া তুই?

মারিয়া রুমীকে জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যাঁ তুই তো বিয়ের কথা জানালি না শেষ পর্যন্ত নিজেই চলে এলাম।

রুমী খুশিতে গদগদ কণ্ঠে বলল, তুই বস, আমি তোর জন্য চায়ের কথা বলে আসি, বলে রুমী বাইরে চলে গেল। কয়েক মিনিট পর নিজ হাতে চা-নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে চায়ের ট্রে টি টেবিলে রেখে বলল, নে চা খেতে খেতে গল্প করি। আগে তোর কথা বল?

এস. এস. সি পাশ করে শহরে চলে এলাম তারপর এইচ.এস.সি এবং ডিগ্রি পাশ করে কারিতাসে চাকরি পেলাম। সেখানেই প্রথম শিহাব সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। শিহাব সাহেবের বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলাম কিন্তু বুঝতে পারিনি যে তার সাথেই তোর বিয়ে হচ্ছে। পারলে তোর বিয়েতে অবশ্যই যেতাম। আজ সবকিছু শুনে মনে হলো তোর কথা আর বাসায় এসে তো দেখলাম সত্যি সত্যিই তুই শিহাব সাহেবের বউ, বলে মারিয়া একটু থামল তারপর রুমীর দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তোর কথা বল।

তুই শহরে এলি আর আমি বিরল কলেজে ভর্তি হলাম। একবার অসুখের জন্য এইচ. এস. সি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আর একবার ফেল করলাম। তারপর এইচ. এস. সি এবং বি. এ পাশ করলাম। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কয়েকদিন পরেই বিয়ে হয়ে গেল। এখন তো দেখতেই পারছিস, বলে রুমী একটা শুষ্ক হাসি হাসল।

মারিয়া মৃদু হেসে বলল, তবে তো ভালোই আছিস। সুন্দর বর পেয়েছিস, ভালো ঘর পেয়েছিস, বেশ তো সুখেই আছিস।

হঠাৎ করে রুমীর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে ম্লান মুখে বলল, সুখ তো বটেই, সুখ যেন মাথা থেকে পায়ে তেলের মতো গড়িয়ে পড়ছে।

এভাবে বলছিস কেন?

শিহাব সাহেব নিঃসন্দেহে খুব ভালো মানুষ, তবে আমি তো শিহাবকে করিনি, বলতে হয় শিহাবই আমাকে বিয়ে করেছে।

মারিয়া চমকে উঠল, রুমী তুই কী বলছিস? বুঝতে পারছিস!

আমি জেনে শুনেই বলছি মারিয়া। এতদিন নিঃসঙ্গ থেকে আমার মন গুমরে উঠেছে। মনের কথা খুলে বলার মতো আমি কাউকে পাইনি। তুই আমার বান্ধবী, তোকে কাছে পেয়ে সবকিছু খুলে বলতে ইচ্ছে করছে, বলতে বলতে রুমীর চোখ থেকে কয়েক ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। রুমী চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করল, আমি তখন বি.এ পড়ি। একদিন এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো, ওর নাম সোহেল।

প্রথম প্রথম শুধু মোবাইল ফোনে কথা হতো কিন্তু ধীরে ধীরে আমি ওর খুব কাছাকাছি চলে গেলাম। আমার অবস্থা এমন হলো যে একদিন কথা না বললে বা কয়েকদিন দেখা না হলে আমার কোনো কিছু ভালো লাগতো না। ও আমাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। সোহেল আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য সোহেল আমাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল। তারপর প্রতিদিন গভীর রাতে আমাকে ফোন করতো। আমরা দু’জন যুগল পাখির মতো রামসাগর, সিংড়া ফরেস্ট, কড়াই বিল, স্বপ্নপুরীসহ সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি। সোহেল তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছে, তার সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে আমাকে খুশি করার চেষ্টা করেছে। আমিও ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি। কিন্তু তোর এই শিহাব সাহেব আমার ছবি দেখে, পাখির মতো ছোঁ মেরে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। বলতে বলতে রুমী আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ল, তার দু’চোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি পড়ছে। রুমী মারিয়ার হাত দু’টো ধরে বলল, তুই বল মারিয়া, তুই হলে কি এমন একজন সুন্দর মনের মানুষকে ত্যাগ করতে পারতিস?

রুমীর কথা শুনতে শুনতে মারিয়ার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। তারপর মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে, এখন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়, আর কী করবি?

আমি এখন কিছু বলতে পারছি না মারিয়া, আমার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার যাবার কোথাও জায়গা নেই, চারদিক থেকে আমার পৃথিবী সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। তুই দেখিস আমি সংসার করবো না। যারা আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছে, আমার উচ্ছল আনন্দময় জীবনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, জীবন দিয়ে তাদের আমি শিক্ষা দেব। রুমীর কথার প্রথম দিকে করুণ মনে হলেও শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা যেন প্রতিবাদের মতো শোনাল।

মারিয়া অস্ফুট স্বরে বলল, রুমী।

তারপর কয়েক মুহূর্তে চুপ করে থেকে আবার বলল, রুমী তোকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই তবু বলি আত্মহত্যায় কোন গর্ব নেই, আত্মহত্যা কোন প্রতিশোধ নয় বরং পরাজয় বলে মারিয়া তার একটা কার্ড রুমীর হাতে দিয়ে বলল, আমার কার্ডটা রাখ আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস, যতটুকু পারি সাধ্যমতো তোকে সহযোগিতা করবো।

রুমী কার্ডটি হাতে নিয়ে বলল, সে বিশ্বাস আমার আছে।

তবে আজ চলি।

আর একটু থাকতিস, তোর সঙ্গে কথা বলে আমার সময়টা কীভাবে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।

মারিয়া রুমীর থুতনি উঁচু করে ধরে বলল, তুই খুব সুন্দর হয়েছিস রে, আজ চলি আরেক দিন আসবো।

দশ

একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও রুমীর সাথে শিহাবের দূরত্ব অসীম। বেশির ভাগ দিনই পরস্পরের মধ্যে কোনো কথা হয় না। বেশির ভাগ দিনই শিহাব অধিক রাতে বাসায় ফিরে ডাইনিং-এ তার জন্য খাবার ঢেকে রেখে শাহানা ঘুমাতে যায়। এ নিয়ে শিহাবের সাথে তার বাবা মা’র দু’একদিন কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবুও তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। দাম্পত্য অশান্তির কারণে শিহাব একরকম প্রায় ঘর ছেড়েই দিয়েছে। আর রুমীও ক্রমাগত সোহেলের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন রুমী কমপক্ষে একবার সোহেলের সাথে মোবাইলে কথা বলে এবং কথা চলে অবিরাম।

সেদিন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে শিহাব আগেই ঘরে ফিরেছে। রুমী বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে গিয়ে সোহেলের মোবাইলে রিং করল।

সোহেল রিসিভ করেই বলল, কী খবর রুমী?

কোনো খবর নেই, এমনিই ফোন করলাম, রুমী উত্তর দিল।

কেমন যাচ্ছে দিনকাল?

রুমী একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, দিন যাচ্ছে না কোনোভাবে ধাক্কা দিয়ে পার করে দিচ্ছি, তোমার?

হুম, তোমার যেমন ঠিক আমারো তেমনি।

তোমার ব্যবসা?

আর ব্যবসা, মনে সুখ নেই বলে ব্যবসায় মন দিতে পারছিনা। তাই চলছে কোনোভাবে, ওসব এখন রাখো, ঘরে যাও আকাশে মেঘ জমেছে। এখনই বৃষ্টি নামবে।

আজ বৃষ্টিতে ভিজবো।

তবে যে সেদিন বললে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার কথা নিজের স্বামীকে বলে দিয়েছ, সে কিছু মনে করেনি?

করেছে।

তোমাকে কিছু বলেনি?

বলেছিল, আমি সোজা জবাব দিয়েছি। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি, বাবা জোর করে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। আর তুমি একরকম জোর করে আমাকে নিয়ে এসেছ।

তারপর-

তারপর আর কী এখন চলছি যে যার মতো, সে সারাদিন অফিস করে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে দেয়। ততক্ষণে কোনোদিন আমি জেগে থাকি আর কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়ি।

এভাবে কি সংসার চলে?

চলছে না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিন কেটে যাচ্ছে।

এমন সময় দু’এক ফোটা বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। বেরসিক মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরছে, আজকের মতো রাখি, বলে রুমী মোবাইল বন্ধ করে রুমে চলে গেল।

নিজের স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে গভীর রাতে কথা বলা, আর তার প্রতি অবহেলা শিহাব কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছিল না। এতক্ষণ অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিছানায় শুয়েছিল। রুমী ঘরে ঢুকতেই শিহাব দাঁত কড়মড় করে বলল, দাঁড়াও।

রুমী কোনো কথা বলল না, দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।

শিহাব ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

ছাদে, রুমীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

কেন?

মোবাইলে কথা বলছিলাম।

নিশ্চয়ই সোহেলের সঙ্গে।

জানোই তো।

শিহাব বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল, হুম, জেনে শুনে আমাকে আর কতদিন নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা দেখতে হবে?

রুমী চুপ করে রইল।

শিহাব আরও কর্কশ স্বরে বলল, আমি আর মানতে পারছি না।

রুমী তবুও কোনো কথা বলল না।

শিহাব রুমীর দুই কাঁধে হাত রেখে বলল, চুপ করে আছ কেন?

রুমী আবারো চুপ করে রইল। রুমীর নীরবতায় শিহাব সহস্র গুণ জ্বলে উঠল। রুমীর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, তুমি একটা অসতী, তুমি, তু…।

রুমীর দু’চোখ জলে ভরে গেল, সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে মারলে? আমি অসতী?

হ্যাঁ মারলাম, প্রয়োজনবোধে আরো মারবো, যতদিন তুমি পুরোপুরি আমার হবে না ততদিন মারবো, খুন করা যদি পাপ না হতো, অপরাধ না হতো তবে আমি তোমাকে খুন করতাম।

বেশ তো আমাকে মেরে ফেল, তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পারবে, কিন্তু যেভাবে জোর করে আমাকে তুলে এনেছ, সেভাবে জোর করে আমাকে ভোগ করতে পারবে না।

চুপ, আর একটি কথাও না, চুপ।

এমন সময় শিহাবের মা বাহির থেকে ডাক দিল, বউমা, দরজাটা খুলে দাও তো।

শিহাব দরজা খুলে দিতেই সে বলল, কী হয়েছে তোমাদের? এত রাতে হৈ চৈ কেন?

কিছু হয় নি, মা তুমি যাও তো, ঘুমাও, শিহাব বলল।

এমন সময় শিহাবের বাবা ঘরে ঢুকে বললেন, না, তোর মা যাবে না, কী হয়েছে তা আমাদের জানতে হবে, বউমা আমরা যা যা শুনছি, এই যেমন শিহাবের সঙ্গে বিয়েতে তোমার মত ছিল না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা তোমাকে জোর করে পুত্রবধূ বানিয়েছি।

রুমী চুপ করে রইল।

শিহাবের বাবা আবার বললেন, বুঝতে পারছি বিয়ের আগে তোমার মতামত না জেনে পুত্রবধূ করে আমরা ভুল করেছি কিন্তু এখন তুমি কী করতে চাও, বলো? বলে শফিক সাহেব কয়েক মুহূর্ত রুমীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, না এখনই বলার প্রয়োজন নেই। কয়েক দিন পরে জানালেও চলবে। আর শিহাব তোকেও বলছি এ বাড়িতে চিৎকার করা চলবে না। এটা ভদ্র লোকের বাড়ি এখানে থাকতে চাইলে ভদ্রভাবেই থাকতে হবে। বলে তিনি ও শাহানা চলে গেলেন।

এগারো

দাম্পত্য অশান্তির কারণে আজকাল শিহাব প্রায়ই অন্যমনস্ক থাকে। কোনো কাজ আগের মতো গুরুত্বের সাথে পালন করতে পারে না। মোটর সাইকেল চালাতে গিয়েও অন্যমনস্কের কারণে কয়েকবার দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে তাই মোটর সাইকেল চালানো ছেড়ে দিয়েছে। সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিমতলা মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পান করল তারপর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা সাতটা বাজে। শিহাব পকেট থেকে খালা আম্মার দেওয়া কার্ডটা বের করে দেখে সেই বাড়িতে গিয়ে খালা আম্মার শিখিয়ে দেয়া পরামর্শ মতো কলিং বেল এ টিপ দিল। একটি মেয়ে গেট খুলে দিয়ে শিহাবকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল। শিহাবের মধ্যে আজ তেমন জড়তা নেই, আজ সে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। মেয়েটি ওড়না সোফায় রেখে শিহাবের গা ঘেঁষে বসল তারপর শিহাবের দিকে অশ্লীল ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, এমন গম্ভীরভাবে বসে আছ কেন?

শিহাব চুপ করে রইল।

লাইলি শিহাবের হাত ধরে টান দিয়ে বলল, চলো ভিতরে যাবে?

শিহাব লাইলির সঙ্গে ভিতরে যেতে যেতে মালতী ডেকে বলল, কে রে লাইলি?

লাইলি শিহাবকে মালতীর কাছে নিয়ে যেতেই সে বলল, শিহাব না?

শিহাব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, জি খালা।

এই মেয়ে তুই যা, বলতেই লাইলি চলে গেল।

তারপর মালতী শিহাবকে বলল, আমার সঙ্গে এসো।

শিহাব মালতীর পিছু অনুসরণ করল। মালতী প্রথমে যে কক্ষে নিয়ে গেল সেই কক্ষে একটি মেয়ে বসে ছিল। মালতীকে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়াতেই মালতী বলল, এর নাম সুমী, আজকেই এসেছে, এ লাইনে একেবারে নতুন। আর বয়সটাও কেমন আকর্ষণীয় এক্কেবারে কচি বলে মালতী অশ্লীল ভঙ্গিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না? যাবে না কি? বলে মালতী শিহাবকে মৃদু ঠেলে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

শিহাব একবার ভালোভাবে রুমটা পরখ করে নিল। একটি বড় সিনেমা কোয়ালিটি টি.ভি., টি.ভি স্ট্যান্ড একটি ভি.সি.ডি সেট, দেয়ালে টাঙ্গানো অ্যাডাল্ট পোস্টার, রঙ্গিন বাতি, ড্রেসিং টেবিলে পারফিউম আর পার্শ্বে একটা টেবিলে একটি বিদেশি মদের বোতল। শিহাব একটি সোফায় বসে পড়ল। তাকে তখন অন্য রকম লাগছে। পা দু’টো যেন কাঁপছে। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শিহাব অস্ফুট স্বরে বলল, এক গ্লাস পানি।

সুমী শিহাবের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এক গ্লাস পানি এনে দিয়ে সোফায় জড়সড় হয়ে বসে রইল।

শিহাব মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করো?

কী করি তা তো বুঝতেই পাচ্ছ।

এ পথে আসলে কেন?

সে অনেক কথা।

বলো না প্লিজ, শিহাব মিনতির সুরে বলল।

তুমি এনজয় করতে এসেছ, এনজয় করবে। এতকিছু জানা তোমার কী দরকার? সাংবাদিক নাকি?

না, না আমি সাংবাদিক না, এমনি জানতে ইচ্ছা করছে তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।

সুমীর কণ্ঠস্বর কিছুটা রুদ্ধ হলো, আমি তখন সবেমাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি। নবীন বরণ অনুষ্ঠানের দিন এক ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ছেলেটি খুব ভালো ছিল। একেবারে সহজ-সরল। আমি প্রায় দিন তার সঙ্গে কথা বলতাম, আমার সবসময় তাকে দেখতে ইচ্ছা করতো। আমি তাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতাম। সেও একদিন আমার সঙ্গে কথা না বললে অসি’র হয়ে যেত। আর সেও আমাকে খুব ভালোবাসত, পাগলের মতো। এইচ.এস.সি পাশের পর হঠাৎ করে একদিন তার বাবা মারা গেল। সংসারের সমস্ত বোঝা তার কাঁধের উপর এসে পড়ল। সে লেখা পড়া বাদ দিয়ে চাকরির জন্য ঢাকায় চলে গেল। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ঠিকই সে চাকরি নিয়ে কুয়েত যাওয়ার পথ পেয়ে গেল। কুয়েত যেতে তখন অনেক টাকা লাগতো, সে বাড়ি ফিরে এলো টাকা সংগ্রহ করতে। কিন্তু সে ছিল একবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে বিদেশ যাবার মতো টাকা সংগ্রহ করা তার জন্য ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। সবকিছু শুনে আমি বাবাকে তার বিদেশ যাওয়ার টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। বাবা আমার উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন টাকাতো দিলই না বরং তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করার জন্য আমাকে ঘরে বন্দি করে রাখল কয়েক দিন। তারপর ছাড়া পেয়ে জানলাম সে যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বলতে বলতে সুমীর চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

শিহাব তার চোখের পানি মুছে মুছে দিতে দিতে বলল, যৌতুকের লোভে সে অন্য মেয়েকে বিয়ে করল। তোমার ভালোবাসার সে কোনো মূল্যই দিল না।

এভাবে বলছ কেন? বিয়ের উপযুক্ত বোন, ছোট ভাই আর অসহায় বিধবা মা যার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে তার বোনের বিয়ে, বেকার ছোট্ট ভাইটির ভবিষ্যৎ আর বিধবা মায়ের মুখে হাসির কাছে নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিবে এটাই তো ঠিক। সে ঠিকই করেছে আমি তাকে কোনো দোষ দেই না। মায়ের ভালোবাসার কাছে প্রিয়ার ভালোবাসা অর্থহীন সে এটাই প্রমাণ করেছে।

সুমী তুমি খুব বড় মাপের, উদার মনের মেয়ে।

সুমী তিরস্কারের সুরে বলল, এখনো তো এক ঢোক মদ খাওনি তাতেই কি তোমার নেশা ধরে গেল নাকি?

কেন আমি কি মাতাল হয়েছি?

মাতাল না হলে কি একজন কল গার্লকে কেউ বড় মাপের, উদার মনের মানুষ বলে?

আচ্ছা, যা হোক তারপর বলো।

তারপর যে বাবা তার মেয়ের কাঙ্ক্ষিত মানুষকে পাওয়ার জন্য এক লাখ টাকা দিতে পারেনি সেই বাবাই যে তার মিথ্যা অহংকার আর সামাজিক মর্যাদা রক্ষার নামে দুই লাখ টাকা যৌতুকের বিনিময়ে তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করল।

সুমীর কথা শুনতে শুনতে শিহাবের চোখ পানিতে ভরে গেল। সে রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তারপর-

সুমী চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলাম। আর বাবাও একরকম মরিয়া হয়ে তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল। তাই বিয়ের ঠিক আগের দিন আমি মায়ের দেয়া গয়না আর আমার কাছে জমানো কিছু টাকা নিয়ে রাতের অন্ধকারে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

রাতের আঁধারে একটা মেয়ে একা বেরিয়ে পড়লে, তুমি তো খুব সাহসী।

দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ সবকিছু করতে পারে।

তারপর কী করলে?

শহরে উঠলাম আমার দূর সম্পর্কের এক বোনের বাসায়। কিন্তু আমার সেই দুলাভাইটি ছিল দুশ্চরিত্রের, সে-ই আমাকে গতকাল খালার বাসায় নিয়ে এলো, বলে সুমী শুষ্ক হাসি হেসে বলল, সরি, তুমি এসেছ নিজের মনের বোঝা হাল্কা করতে আর আমি আমার কষ্টের কথা বলে তোমার মনের বোঝা বাড়িয়ে দিলাম।

না-না সুমী আজ তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ, তোমার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেলাম তা যদি আরো আগে পেতাম তবে আমাদের তিনটি জীবন আজ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তো না। আসলে বিয়ের আগে আমাদের উচিত ছেলে মেয়ে সকলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। প্রয়োজনে বংশ মর্যাদা, প্রতিপত্তি ও বিষয়-সম্পত্তির অহংকার ভুলে যাওয়া।

ও তুমিও তাহলে ছ্যাঁকা পেয়ে এখানে এসেছ?

না।

তবে কি বিয়ে করেছ?

কাগজে কলমে।

সেটা আবার কেমন?

কাগজে কলমে আমি বিবাহিত কিন’ আমি যাকে বিয়ে করেছি সে অন্য একজনকে ভালোবাসে। এক ঘরে বাস করেও আমরা কেউ কারো নই। একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও আমাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বিশাল। লোক চক্ষুর আড়ালে আমরা দু’জন যেন দু’গ্রহের বাসিন্দা বলতে বলতে শিহাবের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

শিহাব কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। তারপর সুমীর দুই হাতে হাত রাখতেই সুমী চমকে উঠল।

শিহাব সুমীর কাছ থেকে দূরে সরে বসে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, না, না, আমি তোমাকে অবৈধভাবে ভোগ করতে চাই না। আমি তোমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। আমি……….

সুমী শিহাবের মুখে হাত দিয়ে বলল, চুপ করো, খালা শুনতে পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না।

শিহাব সুমীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল, সুমী, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, বলো তুমি কি রাজি?

সুমী অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, কিন’ আমি এ অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তি পাবো কীভাবে?

সে ব্যবস্থা আমি করবো। তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না? বলো?

সুমীর সমস্ত হৃদয় কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে উঠল, তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে শিহাবের পা ছুঁয়ে সালাম করতে উদ্যত হলে শিহাব কাছে টেনে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিল।

বারো

সেদিন সন্ধ্যাবেলা রুমীর বাবা-মা এই প্রথম বারের মতো তার শ্বশুর বাড়িতে এসেছে তারা রুমীর শ্বশুর বাড়ির বিষয়-সম্পত্তি ও আভিজাত্যে খুশি হলেও রুমীর ভগ্ন স্বাস্থ্য, শুষ্ক মুখ দেখে চোখের জল ফেলেছে। রুমীও এতদিন এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। যেদিন সে তার হৃদয়ের সমস্ত ক্রোধ, ঘৃণা তার বাপ-মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি সকলের সামনে প্রকাশ করে অনিচ্ছার সংসার থেকে তার হৃদয়ের জ্বালা নিভিয়ে সমস্ত মায়া ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে। আজ তেমনই একটি সুযোগ তার সামনে সৃষ্টি হলো। রুমীর বাবা-মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি যখন গল্প করছিল তখন বধূ বেশে সুমীকে সঙ্গে নিয়ে শিহাব বাসায় ঢুকল।

শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, শিহাব কাকে নিয়ে এসেছিস?

আমার বউ।

শফিক সাহেব সোফা থেকে উঠে শিহাবের গালে সজোরে চড় মেরে বললেন, চুপ, আর একটা কথাও না।

কেন, চুপ করবো কেন? আমি আজ সব বলবো, বিয়ের রাত থেকে আজ পর্যন্ত যার সঙ্গে শুধু কাগজে-কলমে স্বামী হয়ে স্বামীর অভিনয় করে যাচ্ছি। জীবনে আমি কোনোদিন একটি মিথ্যা কথা বলিনি, বিয়ের আগে কোন মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাইনি অথচ সেই আমি কেন আজ মিথ্যা স্বামীর অভিনয় করে যাচ্ছি, কেন আমি অন্ধকার জগতে আলোর সন্ধান করছি? সব কিছুর জন্য দায়ী ঐ হারামজাদি, শয়তান, অসতী। ওর জন্য আমার সুন্দর সাজানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ঐ হারামজাদিকে তালাক দেব, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বায়েন তালাক, যাও আজ থেকে তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। তোমাকে আমি সমস্ত শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিলাম, মুক্তি!!

শফিক সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থমকে দাঁড়ালেন। রুমীর মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। রুমী ঠিক যেমন সোফায় বসে ছিল তেমনি বসে রইল। শিহাবের মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, এ তুই কী করলি বাবা? তুই বউমাকে তালাক দিস না বাবা, মুখে তালাক দিলে তালাক হয় না, বউমা তুমি শিহাবকে ঘরে নিয়ে যাও।

এবার রুমী সোফা থেকে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, না-মা তা হয় না, আমিও বিচ্ছেদ চাচ্ছিলাম। শিহাবের সঙ্গে বিয়েতে আমার মত ছিল না, শিহাবের সঙ্গে বিয়ের আগেই আমি অন্য একজনের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক জড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ বাবা আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিহাবের সঙ্গে এক রকম জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আর আপনারা অসংখ্য ছবি থেকে আমার ছবি বাছাই করে আমার মতামত না জেনে আপনাদের ছেলেকে সুন্দরী বউ উপহার দিয়েছেন, কী ভেবেছেন আপনারা? আপনারা আপনাদের ছেলের সুখের কথা ভেবেছেন, কিন্তু একটা মেয়েরও যে পছন্দ থাকতে পারে, একটা মেয়ে যে শুধু অর্নামেন্টসের মতো নিয়ে এলেই হয় না তার অন্য পছন্দ থাকতে পারে। সে কথা আপনারা কেউ-ই একবারও ভাবেননি।

এতক্ষণ রুমীর বাবা হতবিহব্বল হয়ে সোফায় বসে ছিলেন এবার রুমীকে ধমক দিয়ে বললেন, রুমী থাম, অনেক হয়েছে।

না বাবা তুমি আজ আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিও না, আজ এতকিছুর জন্য দায়ী শুধু তুমি, বিয়ের আগেই আমি তোমাকে বলেছিলাম এ বিয়েতে আমার মত নেই কিন্তু তুমি আমার মতামতকে গুরুত্ব দাওনি, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বিয়ে দিয়েছ, আজকের মতোই ধমক দিয়ে ঘরে বন্দী রেখে কোরবানির পশু বিক্রির মতো আমাকে তুলে দিয়েছ।

শফিক সাহেব ধপাস করে সোফায় বসে বললেন, এই বিয়েতে মেয়ের মত নেই, এ কথা তো আপনারা আমাকে আগে বলেন নি, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে আমার ছেলের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আপনারা তার অধিকার ক্ষুণ্ন করেছেন।

রুমীর বাবা রুমীর দু’হাত ধরে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে মা, তুই তোর এ বুড়ো বাপকে ক্ষমা কর মা।

ক্ষমা, সব ভুলের ক্ষমা হয় না বাবা। বলো তোমার ভুলের কারণে আমার জীবনের যে ক্ষতি হয়েছে তোমাকে ক্ষমা করলেই কি আমার সেই ক্ষতি পূরণ হবে? আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে এখন মুক্তি পেয়ে যেন মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরে হাল্কা মনে করছি। শিকল ছিন্ন হওয়ায় আজ নিজেকে মুক্ত মনে করছি বলে রুমী বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। শফিক সাহেব পথ রোধ করে বললেন, যেওনা বউমা, মুখে মুখে তালাক দিলেই তালাক হয় না।

মনের বিয়ে তো আমাদের কোনদিনই হয় নি বাবা, আইন আর সামাজিকতার যে শৃঙ্খলটুকু ছিল তাও আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমার এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পথটাও পরিষ্কার হলো। আমি আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে চাই না, বলে রুমী ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল।

তেরো

রুমী উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলছে। কোথায় যাবে সে? এই বিশাল পৃথিবী তার কাছে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। বাবা-মার কথা মনে হলে তার মন ঘৃণায় ভরে যায়, সংসার তার কাছে শৃঙ্খল মনে হয়। সর্বোপরি এই সংসার, সমাজ সবকিছু তার কাছে অসহনীয় মনে হয়। রুমীর মনে পড়ে একদিন পেপার পড়েছিল সমাজ সৃষ্টির উদ্দেশ্য “এক সময় মানুষ দুর্বল ছিল তাই বনে-জঙ্গলে মানুষ হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য একত্রিত হয়ে সমাজ গঠন করেছিল। সমাজ গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মঙ্গল ও দুর্বলকে সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করা। অথচ সমাজে আজ দুর্বল সবলের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, দুর্বলের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সমাজ মানুষের অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমাজই আজ মানুষের প্রভু সেজেছে। কল্যাণের নামে সমাজ তার কঠোর শৃঙ্খলে মানুষকে আবদ্ধ করেছে। মানুষের মঙ্গলের চেয়ে সমাজের নিয়ম-কানুনই আজ বড় হয়ে উঠেছে। আর সমাজও পরিচালিত হচ্ছে সবল, বিত্তবান আর ক্ষমতাবান মানুষের দ্বারা। তাই দুর্বল, নিম্নবিত্ত মানুষ বরাবরই সমাজের নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে। সমাজকে পাপ মুক্ত করার জন্য সীতাকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছে, সতীদাহ প্রথার মতো নিষ্ঠুর প্রথার নামে কত নারীকে জীবন দিতে হয়েছে, আজও সমাজকে কলুষমুক্ত রাখার জন্য অনেক নারীকে মাটিতে প্রোথিত করে পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছে, দোররা মারা হচ্ছে। জীবন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির পূর্বেই কত কিশোরীকে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে স্বামীর ঘরে যেতে হচ্ছে তার ঠিক নেই। এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে রুমী রেলক্রসিং এ এসে পৌঁছেছে। রুমী রেললাইন ধরে সোজা পশ্চিম দিকে চলতে থাকল কয়েক মিনিট পরেই দিনাজপুর রেল স্টেশন। স্টেশনের প্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুমীর চোখে পড়ল, আবছা আবছা আলোতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে দেখতে অপর দিক থেকে একজন মেয়েটির কাছে এসে ফিস ফিস করে কী যেন বলল, তারপর দু’জনে অন্ধকারে মিশে গেল। যে মেয়েটি জীবিকার প্রয়োজনে অন্ধকার জগতে পা দিয়েছে সমাজের কাছে সে নষ্ট মেয়ে বা পতিতা। যে সমাজের দায়িত্ব ছিল বিপথগামী মানুষকে পথ দেখানো সে সমাজ আজ শুধু বিপথগামী নিরুপায় মেয়েটিকে পতিতা বলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। ক্রমেই সমাজের প্রতি, সমাজে বসবাসরত উঁচু তলার মানুষগুলোর প্রতি রুমীর মন ঘৃণায় ভরে গেল।

রুমী আরও কয়েক মিনিট চলার পর স্টেশন অতিক্রম করে ষষ্টিতলা রেল ক্রসিংয়ের কাছে আসতেই একটা রিকশা থমকে দাঁড়াল তারপর বিশ্রী ভঙ্গিতে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে রিকশাওয়ালা বলল, আপা যাবেন নাকি?

রুমীর ইচ্ছা হলো রিকশাওয়ালার গালে দু’টো কষে চড় মারতে, কিন্তু কিছু বলল না। পূর্বের মতো হাঁটতে থাকল। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান আর জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় রুমীর আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। এমন সময় হঠাৎ একটি উল্কার পতনে রুমী চমকে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টের মাঝে রুমী একটা শুষ্ক হাসি হেসে মনে মনে বলল, “একটি উল্কার পতনে সৌরজগতের কোন পরিবর্তনই হয় না, তেমনি বিশ্বের কয়েকশ কোটি মানুষের মধ্যে আমার মতো একজন রুমী ঝরে গেলেও তেমন কিছুই হবে না”। তারপর আবার উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকল।

কিন’ কোথায় যাবে সে? হাঁটতে হাঁটতে তো শহর পার হয়ে এলো, পুনর্ভবা নদীর উপর কাঞ্চন ব্রিজ, তারপর গ্রাম। সামনেও তার পরিচিত আত্মীয় স্বজনের কোনো বাড়ি নেই, তার যাবার তেমন কোথাও জায়গা নেই। রুমী তার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়ে দেখল কোনো টাকা নেই। তার সম্বল শুধুমাত্র সোহেলের দেয়া মোবাইল ফোনটা। আজ সোহেলের কথা তার খুব মনে পড়ছে। এই বিশাল পৃথিবীতে এখন সোহেল ছাড়া তার আর কোন হিতাকাঙ্ক্ষী নেই। সোহেল সবসময়ই বলেছে, তোমার যে কোনো দুঃসময়ে আমার কাছে এসো, আমি তোমার সঙ্গে থাকবো।

মুহূর্তেই রুমী সিদ্ধান্ত নিল সে সোহেলের কাছে যাবে কিন্তু তার বাড়ি তো এখান থেকে অনেক দূরে তবু রুমী সিদ্ধান্ত নেয় সে সোহেলের কাছেই যাবে তারপর সে দ্রুত গতিতে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে। একসময় কাঞ্চন রেল ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে স্লিপার থেকে পিছলে নদীতে পড়ল। তারপর-

রুমী জ্ঞান ফিরে দেখল সে হাসপাতালের একটি খাটে শুয়ে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদা কাপড় পরিহিত একজন নার্স। রুমী জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?

নার্স জবাব দিল, দিনাজপুর সদর হাসপাতালে।

কেন সিস্টার? আমি ক্লিনিকে কেন?

পুনর্ভবা নদী দিয়ে যাবার সময় মানপুর গ্রামের লোকেরা আপনাকে উদ্ধার করে আজ সকাল বেলা হাসপাতালে দিয়ে গেছে।

রুমী কিছুক্ষণ চুপ করে মনে করার চেষ্টা করতেই গতকাল রেল লাইন দিয়ে চলতে চলতে পা পিছলে পড়ার কথা মনে পড়ল। তারপর রুমীর আর মনে নেই।

মনে করতে পারছেন? নাস। জিজ্ঞেস করল।

হুম মনে পড়েছে, আচ্ছা সিস্টার আমাকে যারা নিয়ে এসেছে তাদের কি কেউ এখানে আছে?

না, সাধারণত এ ধরনের কেইস এ কেউ থাকতে চায় না। পরে কোনো আইনি জটিলতায় পড়ে তাই সবাই কেটে পড়েছে।

কিন্তু যারা আমার জীবন রক্ষা করল আমি তাদের একবার দেখতে পাবো না, বলে রুমী একটু থামল তারপর বলল, তারা কি আর কিছু দিয়ে গেছে? যেমন ব্যাগ বা মোবাইল ফোন?

নাতো।

আচ্ছা আপনি কি আমাকে একটা মোবাইল ফোন ম্যানেজ করে দিতে পারেন?

হুম, বলে সে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর একটা মোবাইল সেট এনে রুমীর হাতে দিয়ে বলল, আপনি কথা বলুন আমি ভর্তি রেজিস্টার নিয়ে আসি, বলে সে চলে গেলে রুমী সোহেলের মোবাইল নাম্বারে ফোন করল।

অপর পাশ থেকে সোহেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

রুমী বলল, হ্যালো সোহেল, আমি রুমী।

তুমি এখন কোথায়?

আমি দিনাজপুর সদর হাসপাতালে, তুমি এখনই চলে এসো, খুব তাড়াতাড়ি, বলে রুমী মোবাইল বন্ধ করতেই নার্স বড় একটা রেজিস্টার খাতা নিয়ে রুমে ঢুকল।

নার্স খাতা খুলে রুমীকে জিজ্ঞেস করল, বলুন আপনার নাম কী?

রুমী।

আপনার পিতার বা স্বামীর নাম?

রুমীর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। রুমী নার্সের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

নার্স কয়েক মুহূর্ত রুমীর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, বলুন আপনার পিতার নাম কী?

পিতার নাম না লিখলে হয় না? রুমী শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

তবে স্বামীর নাম বলুন।

যে স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে তার নাম বলবো?

নার্স কী যেন বলতে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো, তবু একটা ঠিকানা তো থাকা চাই, বলে নার্স উত্তরের অপেক্ষায় রুমীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

রুমী নার্সের একটা হাত চেপে ধরে শুষ্ক কণ্ঠে বলল, সিস্টার আমার যে কোনো ঠিকানা নেই।

নার্স করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এত বড় পৃথিবীতে আপনার কি কোন হিতাকাঙ্ক্ষী নেই?

রুমী মুখে তৃপ্তির স্পষ্ট আভা ফুটে উঠল। সে একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, আছে একজন।

নাম বলুন?

ওর নাম সোহেল।

আপনার সাথে সম্পর্ক?

আইনের বা সমাজের দৃষ্টিতে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আত্মার।

নার্স মুচকি হাসি হেসে বলল, বুঝেছি, তারপর বলুন, ঠিকানা?

গ্রাম-ধর্মপুর, বিরল, দিনাজপুর।

নার্স খাতা লেখা শেষ করে রুম থেকে বের হচ্ছিল এমন সময় রুমীর বাবা-মা রুমে ঢুকতেই রুমী জোরে চিৎকার বলল, সিস্টার ওদের চলে যেতে বলুন, ওরাই আমার সর্বনাশ করেছে, ওদের চলে যেতে বলুন।

তবুও রুমীর মা রুমীর কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ছি : মা এভাবে বলতে হয় না, তোর বাবা তার ভুল বুঝতে পেরেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও মা।

সামাদ সাহেব কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, তোর উপর অনধিকার চর্চা করে আমি তোকে অনেক শাস্তি দিয়েছি মা, কাল তুমি চলে আসার পর আমি তোকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু-

রুমী হাত উঁচু করে তার বাবাকে থামতে ইশারা করল।

তুই আমাকে ক্ষমা করে দে মা। তোর পছন্দমতো ছেলের সঙ্গেই আমি আবার তোর বিয়ে দিব।

এমন সময় সোহেলকে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করতে দেখে রুমীর বাবা-মা কয়েক মুহূর্ত অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে বের হয়ে গেল। রুমী সোহেলকে দেখামাত্র আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি, তুমি এসেছ, তুমি আমার পাশে একটু বসো, আমার হাতে হাত রাখো, তোমার হাতে হাত রেখে আমার মরতেও কোনো কষ্ট হবে না।

সোহেল রুমীর মাথার কাছে বসে তার হাতে হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বলল, রুমী!

সমাপ্ত

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস
2 comments on “অবশেষে…
  1. Dia Brombho says:

    অনেক সুন্দর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*