আজ আলতা ঢাকা যাবে। মিয়া বাড়ির ছোট মেয়ে রুমা ঢাকায় থাকে, তার একমাত্র মেয়ে সবেমাত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখেছে, তার সাথে খেলা করার জন্য, তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আর রুমার সাংসারিক কাজে একটু-আধটু হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আলতার ডাক পড়েছে।
মিয়া সাহেব অনেক বড় মনের মানুষ, এই চরের মানুষের যেকোন বিপদে-আপদে সবার আগে মিয়া সাহেব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কারো মেয়ের বিয়েতে ডিমাণ্ড, কারো বুভুক্ষ মুখে ভাত তুলে দেয়া, এমনকি কারো অসুখ-বিসুখে নিজস্ব নৌকায় বিনা পয়সায় হাসপাতালে আনা-নেওয়ার কাজ। মিয়া সাহেবের দয়ার শেষ নেই। তাই মিয়া সাহেবের কথায় সাধারনত কেউ-ই না করে না। বরং মিয়া বাড়িতে কিংবা মিয়া সাহেবের কোন আজ্ঞা পাওয়া অনেকের কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার তো বটেই।
সেই মিয়া সাহেব ক’দিন আগে বাইরে দাঁড়িয়ে আয়নাল বাড়িতে আছ নাকি? বলে ডাকতে ডাকতে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। আয়নাল তখন বাড়িতে ছিল না, বড় মেয়ে আলতা রান্নাঘরে বসে মায়ের সাথে শাক কুটছিল আর ছোট মেয়ে আদূরি এইমাত্র স্কুল থেকে এসে বই-খাতা ঘরে রেখে সেও মায়ের সাথে কাজে যোগ দিল।
তছিরন শাড়ির ছেঁড়া আঁচল তাড়াতাড়ি মাথায় টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, জি না, ওতো বাড়িতে নেই, মিয়া সাহেব বাড়িতে আসেন।
মিয়া সাহেব এলেন না, বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গেছে?
ক্ষেতে।
কখন আসবে?
আপনি বাড়িতে আসেন, আমি এখন আসতে বলে পাঠাচ্ছি।
মিয়া সাহেব বাড়িতে ঢুকলেন। তছিরন উঠানে একটা পাটি বিছিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি বড় মানুষ আপনাকে কোথায় যে বসতে দিই? আমাদের ঘরে তো এই একটা ছেঁড়া পাটি ছাড়া আর কিছু নেই।
না, না এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই আমি তোমাদেরই মানুষ, এই পাটি কেন মোড়াতেও বসতে পারবো, বলে মিয়া সাহেব চটের উপর বসলেন।
তছিরন আদূরিকে ঘরে ডেকে নিয়ে হাতে টাকা গুঁজে দিতে দিতে ফিস্ফিস্ করে বলল, যাতো মা, এই টাকাটা নিয়ে যা, বিস্কুট-চানাচুর আর চা-পাতা নিয়ে আয়, এতবড় মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছে, আমি এখন কী দিয়ে যে আপ্যায়ন করি।
আর চিনি? আদূরি জিজ্ঞেস করল।
চিনি আছে মা, তুই তাড়াতাড়ি যা, যাওয়ার সময় তোর বাবাকে বলে যাবি, আমাদের বাড়িতে মিয়া সাহেব এসেছে।
আচ্ছা, বলে আদূরি চলে গেল।
তছিরন ঘরের বাইরে এলো।
মিয়া সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ছেলেমেয়ে ক’জন যেন?
ছেলে নেই, শুধু দু’টা মেয়ে, তছিরন মলিন মুখে বলল।
এই মেয়েটাই বড় ?
জি, এটা বড় আর যেটা বাইরে গেল ও ছোট।
ছেলের আশায় যেন সংসারটাকে আর বড় করো না।
তছিরনের গলার স্বর কিছুটা করুণ হয়ে এলো, একটা ছেলে না হলে কী হয় মিয়া সাহেব?
এমনসময় আয়নাল বাড়িতে ঢুকে মিয়া সাহেবকে সালাম দিল, আসসালামুয়ালায়কুম মিয়া সাহেব।
ওয়ালেকুম আসসালাম, কী খবর আয়নাল? কেমন আছ?
জি ভালো, আপনি ভালো আছেন মিয়া সাহেব?
হুঁম ভালো।
আয়নালের বাড়িতে মিয়া সাহেবের আগমনে সে যারপর নেই খুশি হয়েছে, সে খুশিতে কণ্ঠে বলল, মিয়া আপনি আমাদের বাড়িতে? কী মনে করে?
আসলাম এমনিতেই তো মনে মনে একটা চিন্তা নিয়ে ঘুরছি।
চিন্তা আপনার? আপনার আবার কীসের চিন্তা?
আছে? সব মানুষেরই চিন্তা আছে, তো একেকজনের চিন্তা একেকরকম, একেকজনের সমস্যাও একেকরকম।
জি আপনি ঠিকই বলেছেন।
আদূরি বাজার থেকে এসেছে, তছিরন একটা প্লেট-এ বিস্কুট, চানাচুর দিতে দিতে বলল, মিয়া সাহেবের আবার কীসের সমস্যা ?
মিয়া সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললেন, সমস্যাটা আমার না, আমার ছোট মেয়ে রুমার।
রুমা আপার? তছিরন জিজ্ঞেস করল।
মিয়া সাহেব কৃত্রিম রাগের সুরে বললেন, রুমা আপা না, রুমা তোমার চেয়ে অনেক ছোট।
ঐ হলো, আমরা গরীব মানুষ, গরীব মানুষ কখনো বড় হয় মিয়া সাহেব?
মিয়া সাহেব একবার রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, মেয়েটা আমার একেবারে একা, ছোটবেলা থেকে তো কোন কাজ করেনি, এখন সংসারের কাজ আর মেয়ের দেখাশুনা করতে গিয়ে একেবারে হিমশিম খাচ্ছে।
আয়নাল এবং তছিরন মিয়া সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মিয়া সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, ওর বাসার জন্য একটা মেয়ে দরকার, এই ওর ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে একটু খেলাধুলা করবে আর রুমাকে রান্নার কাজে একটু সাহায্যে করবে আর কি।
তছিরনের বুকটা কেঁপে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে যেন একটা আশংকা দেখা দিল, এই বুঝি মিয়া সাহেব এখনি বলবে তার একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা।
মিয়া সাহেব একবার আয়নাল এবং একবার তছিরনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের অবস্থা বুঝে কিছুটা সান্ত্বনার সুরে বললেন, না কোন অসুবিধা নেই, জামাই নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে, থাকার কোন অসুবিধা নেই। বাসায় টি.ভি আছে সবাই সবসময় আনন্দ ফুর্তিতেই থাকে। রুমাকে তো চেনোই, খুব ভালো মেয়ে তার কাছে থাকলে মেয়েটা ভালোই থাকবে, সে নিজের মেয়ের মতোই দেখবে।
তছিরনের আর বুঝতে বাকি নেই তবু মনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য একটা যুক্তি দাঁড় করালো, মিয়া সাহেব তো অন্য কারো মেয়ের কথা বলতে পারে।
তছিরন শুষ্কমুখে বলল, আপনি কার কথা বলছেন মিয়া সাহেব?
একথার উত্তরে মিয়া সাহেব আলতাকে কাছে ডেকে নিলেন, এসো তো মা, তোমার নাম কী যেন?
আলতা।
বাহ্ সুন্দর নাম তো, বলে আলতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আমি বলছিলাম আলাতাকে তোমরা যদি দিতে তো রুমা খুব খুশি হতো।
তছিরনের দু’চোখ ছল ছল করে উঠল, তার বুক চিরে একটা কথা বের হলো, এটা আপনি কী….
না তার কথা শেষ হতে দিল না আয়নাল, সে কিছুটা ধমকের সুরে বলল, তছিরন থামো তো, যাও চা নিয়ে আসো।
তছিরন চা তৈরি করতে গেল।
মিয়া সাহেব কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, আয়নাল তোমাদের যদি কোন আপত্তি থাকে তো লাগবে না, আমি বরং অন্য কোথাও…
আয়নাল মিয়া সাহেবের কথায় বাধা দিয়ে বলল, না মিয়া সাহেব, না। আপনি এনিয়ে চিন্তা করবেন না, আমি এখন ওকে বুঝিয়ে বলব।
সেদিনের পর থেকে তছিরনের চোখে ঘুম নেই। ঠিক আলতার মতো বয়সে তার জীবনে এক অভিশাপ এলো, তো ঠিক আলতার মতো না, তার ওপর ঝড়টা ছিল একটু ভিন্ন। কাজের প্রস্তাব না, তার এলো বিয়ের প্রস্তাব, আয়নালের সঙ্গে। আয়নাল তখন টগবগে যুবক, লম্বা, ফর্সা, রোদে পুড়ে গায়ের ফর্সা রংটা একটু তামাটে হয়ে গেছে, সুঠাম দেহ। তাহোক সারাদিন মাঠে কাজ করে এই চরের জমিতে সে যেন সত্যিকারের সোনা ফলায়, প্রতি বছর কিছু না কিছু জমি কেনে। বাপের একমাত্র ছেলে, কয়েক বিঘা জমি আছে, সারা বছরের খাবার নিজের জমির আবাদ করা ধান থেকেই আসে। কোদালকাটির চরে সে তখন বিয়ের পাত্র হিসেবে আকর্ষণীয়। তখন আয়ানালেরও প্রতিদিন কোন না কোন বিয়ের প্রস্তাব আসছিল।
চার বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে তছিরন প্রথম। সামান্য জমি নিয়ে তছিরনের বাবার এতবড় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তছিরন প্রতিদিন স্কুলে যায় কিন্তু তার পড়ালেখার প্রতি কারো তেমন গুরুত্ব নেই। কোনদিন গেল কী না তারই কোন খেয়াল নেই, এমনদিনে তছিরনের এক দূরসম্পর্কের এক দুলাভাই আয়নালের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। এমন সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে যৌতুকের পরিমান একটু বেশি হলেও তার বাবা স্বীকার করল, পরে অবশ্য সেই যৌতুকের দায় মেটাতে তার বাবার আরো এক বিঘা জমি হাতছাড়া হলো। কিন্তু মেয়ের সুখের কথা ভেবে সবাই যেন হাসিমুখে মেনে নিল।
শুরু হলো তছিরনের দাম্পত্য জীবন। জীবনের শুরুটা ভালোই ছিল, দিনে দিনে সংসারের উন্নতি হতে লাগল। কিন্তু এই সুখ, এই স্বাচ্ছন্দ্য বেশিদিন টিকল না। ব্রম্মপুত্রের করাল গ্রাস তাদের প্রায় জমিজমা সব রাতারাতি কেড়ে নিয়ে গেল। চরের জমি এমনই, আজ যে জমিদার কাল সে পথের ভিখারী। শুধু তাদের জমি না, আরো অনেকের জমি নদীগর্ভে বিলীন হলো। কেউ কেউ এই চর ছেড়ে রৌমারী-রাজিবপুর রাস্তার ওপর আশ্রয় নিল, কেউবা মিয়া সাহেবের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করে ঘর করে থাকার, এমনকি দু’য়েক বিঘা আবাদী জমিও বর্গা নিল।
আয়ানালের বাবার সঙ্গে মিয়া সাহেবের বেশ শখ্যতা ছিল সেই সুবাদে মিয়া বাড়িতে আয়নালের যাতায়াত দীর্ঘদিনের। আয়নালের বাবার মৃত্যুর পরও তার যাতায়াতে তেমন বাধা পড়েনি। আয়নালের এই দুর্দিনে মিয়া সাহেব এগিয়ে এলেন, বাড়ি করার জায়গা দিলেন, বর্গা চাষের জন্য তিন বিঘা জমি দিলেন। এসব তছিরনের নিজের চোখে দেখা। এতকিছুর বিনিময়ে মিয়া সাহেব কোনদিন কিছু চাননি, আজ তিনি অনেক আশা নিয়ে এসেছেন, তাকেই বা তছিরন আর আয়নাল নিরাশ করবে কীভাবে?
কিন্তু আলতাকে নিয়ে তছিরনের অনেক স্বপ্ন। তছিরন নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল কিন্তু তা সে স্বপ্ন সফল হয়নি তাই এখন সে আলতার মাঝে তার স্বপ্ন দেখছে অথচ আজ মিয়া সাহেব যে প্রস্তাব দিলেন তাতে তার স্বপ্ন যেন ভেঙ্গে মুচড়ে যেতে বসেছে। তছিরন আয়নালকে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, এই শুনছ?
পর পর দু’বার ডাক দেয়ার পর আয়নাল সাড়া দিল, উঁ।
তুমি কি আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে?
বলো?
তুমি যে মিয়া সাহেবের কথায় রাজি হয়ে গেলে, এখন কী হবে?
কী হবে মানে?
আমি আলতাকে লেখাপড়া শেখাবো, ওকে আমি অনেক বড় করবো। তুমি দেখোনা ও কোনদিন ক্লাসে সেকেণ্ড হয়নি, আমার এমন মেয়েটার লেখাপড়া বাদ দিয়ে আমি ঢাকা পাঠাবো কাজের মেয়ের কাজ করতে?
কিন্তু মিয়া সাহেব? আমি যে মিয়া সাহেবকে কথা দিয়েছি, এখন যদি কথার বরখেলাপ করি..
কী করবে মিয়া সাহেব?
মিয়া সাহেব যদি তার সব জমিজমা নিয়ে নেয়, যদি তার ভিটেমাটি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেয়?
করবে তো করবে, তছিরন জোর গলায় বলল।
তুমি যত সহজে বলছ, কাজটা তত সহজ না, মিয়া সাহেব যদি তার জমিজমা নিয়ে নেয়, ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেয় তবে তখন আমরা খাবো কী? সংসার চালাবো কী করে?
তছিরন বিছানায় উঠে বসে আয়নালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা আমি তোমাকে একটা কথা বলি? রাখবে?
বলো?
তুমি মিয়া সাহেবকে একবার বুঝিয়ে দেখো, যদি ..
আয়নাল কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, তছিরন তুমি মিয়া সাহেবকে জানো না, মিয়া সাহেব একবার যেটা বলে সেটা আর উল্টায় না।
তবু একবার চেষ্টা করতে অসুবিধা কি? যদি…….
আচ্ছা তুমি যখন বলছ তো চেষ্টা করবো কিন্তু আমার মনে হয় কোন লাভ হবে না। এখন ঘুমাও চিন্তা করে লাভ নেই কপালে যা আছে তাই হবে।
পরদিন সকালবেলা আয়নাল মিয়া বাড়ি গেল অনেক আশা নিয়ে, এ যেন এক অন্য রকমের আশা, নিজের মেয়েকে অন্যের কাছ থেকে ফিরে পাওয়ার আশা। আয়নাল অল্প শিক্ষিত মানুষ, মিয়া সাহেবের প্রতি তার শ্রদ্ধা অগাধ, সেই সঙ্গে মনের মধ্যে আতংকও কম নয়। আয়নালের বাড়ি থেকে মিয়া বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার পথ, মাঝখানে অনেকটা অংশ জুড়ে পাট ক্ষেত, পাটক্ষেতের মাঝে একসময়ের মেঠোপথ একটু প্রশস্থ হয়েছে। কিন্তু এ রাস্তায় তেমন চলাচল নেই। আয়নাল পথে যেতে যেতে কীভাবে মিয়া সাহেবকে তার মনের কথা বলবে, তার নিজের কথা বলবে নাকি তছিরনের কথা বলবে, নাকি আলতার কথাই বলবে সেকথা ভাবছিল আর আপনমনে বিড়বিড় করছিল।
মিয়া সাহেব বাড়িতেই ছিলেন, আয়নালকে দেখে সহাস্যে বললেন, এই যে আয়নাল, আসো আসো।
আয়নাল বরাবরের মতো মাথা নত করে বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিল, আসসালামুয়ালায়কুম মিয়া সাহেব।
মিয়া সাহেব সালামের জবাব দিয়ে কয়েকমুহূর্ত আয়নালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আয়নাল মিয়া সাহেব বলে কথা বলতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু মিয়া সাহেব থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, আয়নাল কাল আবার রুমার সঙ্গে কথা বললাম, ও তোমার খুব প্রশংসা করল, তোমাকে তো ও বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করে, তোমার নাম শুনেই বলল ও আয়নাল ভাই’র মেয়ে তো, আয়নাল ভাইকে আমার কথা বলবেন, দেখবেন না করবে না।
আয়নাল মাথা নত করে শুনছিল। মিয়া সাহেবের কথা বলা শেষ হতেই আবার বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মিয়া সাহেব আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো জানো, আমি আমার বিষয়-সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের নামে ভাগ করে দিয়েছি, তুমি যে জমিটা বর্গা চাষ করো সেই জমিটা দিয়েছি রুমার নামে, ওর নামে আরো জমি আছে, ও আগামীকাল ঢাকা থেকে আসবে, ও আসলে আমি ওর ভাগের আরো এক বিঘা জমি তোমাকে দিতে বলব, তুমি দেখো ও না করবে না।
আয়নালের রাস্তায় আসতে আসতে সব সাজানো কথা যেন এলোমেলো হয়ে গেল। সে বলল, কিন্তু আলতার মায়ে বলছিল..
আয়নালের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিয়া সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন, কী বলছিল? বাড়ির মেয়েছেলে মানুষ এত কথা বলে কেন?
আয়নাল আর কথা বলতে পারল না, মিয়া সাহেবের মুখের দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল।
মিয়া সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি কী বলতে এসেছ আমি বুঝতে পেরেছি আয়নাল, আগামীকাল রুমা আসবে দু’দিন বাদেই আবার ঢাকা চলে যাবে, যাওয়ার সময় আলতাকে নিয়ে যাবে আর যদি-
আয়নাল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ঠিক আছে মিয়া সাহেব, সব ঠিক আছে, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না।
আয়নাল বাড়িতে ফিরল তার মুখের দিকে তাকিয়ে তছিরনের মুখ শুকিয়ে গেল। সে কোনকিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আয়নাল উঠানে একটা মোড়ার ওপর ধপাস করে বসে মিয়া সাহেবের সঙ্গে তার কথাবার্তার সারমর্মটুকু বলল। সবকিছু শুনে তছিরনের কণ্ঠস্বর বুজে এলো, ঠোঁট দু’টো সামান্য ফাঁকা হয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে একটা কষ্ট বেরিয়ে এলো, শেষ পর্যন্ত.., বলেই অসমাপ্ত কথার সমাপ্তি টানল।
কয়েকদিন হলো রুমা কোদালকাটি এসেছে। গতকাল মিয়া সাহেব লোক পাঠিয়ে রুমার আজ ঢাকা যাওয়ার কথা বলে আলতাকে তৈরি থাকতে বলেছে। কিন্তু তছিরনের মন কিছুতেই মানছে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে একবার তার আকাংখার কথা রুমাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সে উদ্দেশ্যে রুমাকে এবাড়িতে একবার আসারও অনুরোধ করে এসেছে আয়নাল। আজ সকালে রুমা এসে আলতাকে মিয়া বাড়িতে নিয়ে যাবে তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে আজ রাতের কোচ-এ।
রুমা এলো সঙ্গে তার হাঁটি হাঁটি পা পা করে বেড়ানো মেয়েটি। মেয়ে তো নয় যেন পুতুল, গায়ের রংটাও যেন টুকটুকে লাল, যেন একটু টোকা দিলেই রক্ত বেরিয়ে পড়বে। রুমা বাড়িতে এসেই জিজ্ঞেস করল, তছিরন আপা কেমন আছেন?
তছিরনের দু’চোখ ছলছল করে উঠল। তার বুক ভেঙ্গে একটা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল, এই বুঝি তার আলতা, তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন, যা কয়েকমুহূর্ত পরই ভেঙ্গে যেতে বসেছে। সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, জি আপা ভালো, আপনি?
হুম ভালো। কই আপনার বাড়ির আর ছেলেমেয়েরা কে কোথায়? রুমা জিজ্ঞেস করল।
ছোট মেয়েটা স্কুলে গেছে আপা, আর আলতা বাড়িতে আছে, বলে তছিরন আলতা বলে একটা ডাক দিতেই ঘর থেকে আলতা বেরিয়ে এলো। আলতার পরনে একটা মলিন জীর্ণ কামিজ, চুলগুলো উসকো-খুসকো, গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া কান্নার ছাপ এখনো লেগেই আছে।
রুমা স্নেহের সুরে আলতাকে ডাক দিল, এদিকে আসো তো মা।
আলতা রুমার কাছে গেল। ওমা তুমি তো খুব সুন্দর হয়েছ, বলে রুমা একটা জামা বের করে আলতার হাতে দিয়ে বলল, যাও তো মা এই জামাটা পরে আসো তো।
আলতা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল, সে একবার রুমার দিকে আর একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। রুমা একরকম জোর করে তার হাতে জামাটা গুঁজে দিল।
রুমা তার ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে তছিরনের হাতে দিয়ে বলল, এটা আপনার জন্য আর বলে একটা লুঙ্গি বের করে দিয়ে বলল, আয়নাল ভাই এটা আপনার জন্য।
তছিরন চোখ মুছতে মুছতে বলল, এগুলো থাক আপা, আমাদের গরীবের বাড়িতে আগে নাস্তা খান, গল্প-সল্প করি, তারপর হবে এখন।
আচ্ছা রাখো তো, বলে রুমা উঠানে বিছানো পাটিতে রেখে দিল।
তছিরন নাস্তা এনে দিল। রুমা উঠানে পাটিতে বসেছে আর আয়নাল বসেছে আঙ্গিনায় একটা মোড়ায়। চা-নাস্তা খেতে খেতে রুমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করল। ততক্ষণে আলতা নতুন জামা-কাপড় পরে এসেছে, আলতাকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে রুমা বলল, বাহ্ তোমাকে তো সুন্দর মানিয়েছে।
আলতা একটা শুষ্ক হাসি হাসল।
তছিরন কয়েকমুহূর্ত রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল তারপর কিছুটা সংকোচের সুরে বলল, আপা আপনি যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলি?
বলেন আপা, এত সংকোচ করছেন কেন? আমি আপনার চেয়ে ছোট না?
হঠাৎ করেই তছিরন যেন উদাস হয়ে গেল, আপা আমি যখন শংকর মাধবপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করলাম তখন আমার বিয়ে হলো, আর লেখাপড়া করা হলো না, আমার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবো। কিন্তু হতে পারিনি, আলতা আমাদের প্রথম মেয়ে, আলতার জন্মের পর থেকে ওর মাঝে আমি আমার স্বপ্ন দেখতাম, অনেক আশা ছিল আলতা একদিন অনেক বড় হবে, আমি যা হতে পারিনি আলতা তা-ই হবে। এই চরে জন্ম গ্রহণ করে সে একদিন বড় ডাক্তার হবে, জজ হবে, ডি.সি হবে, সবাই তাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে। আল্লাহ ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি দিয়েছে, ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সে সবসময় ফার্স্ট হয়েছে, ও যদি লেখাপড়া করতো তবে একদিন সত্যি সত্যি সে অনেক বড় কিছু হতে পারতো, বলতে বলতে তছিরনের দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
রুমা কিছু বুঝতে পারল না। সে তছিরনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তছিরন আবার বলতে শুরু করল, সেদিন মিয়া সাহেব আমাদের বাড়িতে আসলেন, আলতাকে আপনার নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। আমরা মিয়া সাহেবের জমিতে ঘর করে থাকি, মিয়া সাহেবের জমি আবাদ করে খাই, মিয়া সাহেবের কথা না করি কীভাবে? এটা যে নেমকহারামি করা হবে আপা, আর আলতাকে না দিলে মিয়া সাহেব যদি আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়, তবে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? যদি বর্গার সব জমি নিয়ে নেয় তো আমরা কী আবাদ করে খাবো? তখন যে আমাদের শুধু আলতাই নয় সব যাবে আপা, বলে তছিরন আলতাকে কাছে টেনে নিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরে বলল, একবার আমার লক্ষ্মী সোনার মুখটার দিকে তাকান আপা, দেখেন চোখ দু’টা কী জ্বলজ্বল করছে, আমার মেয়েটা যদি লেখাপড়া করে তো সত্যি সত্যি ও একদিন অনেক বড় হবে, আর যদি কাজের মেয়ে হয়.., বলে কথাটা শেষ করতে পারল না তছিরন, তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, গলার স্বর বুজে এলো।
ততক্ষণে আয়নালের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। রুমার দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে, তার গলার স্বর বুজে এলো, সে আলতাকে আবার কাছে টেনে নিল, তার মুখটা উঁচু করে ধরে বলল, তোমাকে আমি নিয়ে যাবো না মা, আমি বাবাকে বলবো, বাবা যেন তোমাদের জমি ছাড়িয়ে না নেয়, তুমি লেখাপড়া করো, অনেক বড় হও, লেখাপড়া শিখে এই চরের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করো, আমার বাসার কাজের মেয়ে নয়, আমার বাসার পরিচারিকা নয়, শুধু আমার আর আমার এই ছোট্ট মেয়েটির সেবা নয় বড় হয়ে তুমি একদিন সারা দেশের মানুষের সেবা করো, তুমি একদিন সত্যিকারের ’’কাজের মেয়ে হও’’।
সমাপ্ত
Leave a Reply