ক্রিকেটার তূর্য (কিশোর উপন্যাস)

জীবনে প্রথম সেঞ্চুরি। এত অল্প বয়সে দিনাজপুরে আগে কেউ সেঞ্চুরি করেনি, এমনকি প্রফেশনাল ক্রিকেটাররাও না। অথচ স্কুলের মাঠে, অনিয়মিত একজন ক্রিকেটার ভালো খেলতে পারে এটা যেন কারো ধারণাই ছিল না। দিনাজপুর শহরের ক্রিকেট ক্লাবগুলোতে যারা নিয়মিত প্র্যাকটিস করে তূর্যর খেলা দেখে তারাও অবাক হয়েছে। কোন ক্লাবের যেন কোচ হবে তূর্যকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, তুমি তো ভালো খেলো, আমাদের ক্লাবে এসো, একদিন তুমি ভালো ক্রিকেটার হবে।
তূর্য মৃদু হাসল।
তুমি কাল একবার ক্লাবে এসো, আমি তোমাকে আমাদের ক্লাবে ভর্তি করে নিব।
তূর্য কিছু বলল না। ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কি আসবে না?
তূর্য হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেল, বাবাকে জিজ্ঞেস করবো।
তুমি এতো ভালো খেলো আর তোমার বাবা তোমাকে খেলতে দিবে না?
কী জানি?
আচ্ছা তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো, কেমন?
তূর্য কাঁধ বাঁকা করে সায় দিল।

দুই

স্টেডিয়াম থেকে ফেরার সময় পুরোটা পথ তূর্যর আনন্দেই কাটল, আজকের খেলায় জিতে তার বুক যেন গর্বে ভরে গেল। কিন’ বাসার গেটে গিয়ে কলিং বেলে টিপ দিতেই তার বুক কেঁপে উঠল। সে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত আটটা বাজে। তার চোখের সামনে বাবার গম্ভীর মুখ আর মা’র ভয়ঙ্কর মুখের ছবিটা ভেসে উঠল। সে একবার তার ব্যক্তিগত অর্জন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের মেডেলের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পেল। তার মনে হলো এই মেডেল দেখে বাবা-মা হয়ত আজ তাকে খুব স্নেহ করবে, তাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।
দ্বিতীয় তলা থেকে তূর্যর মা জোরে চেঁচিয়ে বলল, নীচে দাঁড়া আমি চাবি ফেলে দিচ্ছি।
তূর্যর এতক্ষণের সান্ত্বনা যেন নিমিষেই হারিয়ে গেল। সে ক্যাচ করার ভঙিতে চাবির গোছাটা ধরে নীচতলার চাবি খুলে দ্বিতীয় তলায় উঠল।
ততক্ষণে শিরিন দ্বিতীয় তলার গেট খুলে ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে আছে, এত দেরি হলো কেন?
তূর্য মনে মনে রেগে গেল তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আজ আমাদের আন্ত:স্কুল খেলা ছিল আম্মু। আমি ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছি। আমি সেঞ্চুরি করেছি।
ভেতর থেকে তার বাবার কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছিস ভালোই করেছিস! আমার মুখ উজ্জ্বল করেছিস! এখন হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস, আমাকে উদ্ধার কর।
শিরিন বলল, যা তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস, এভাবে প্রতিদিন খেলতে গিয়ে শরীর ক্লান্ত করে নিয়ে এলে তো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবে।
ভেতর থেকে আনোয়ার সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হুঁম এতক্ষণ ছেলে খেলাধুলা করে এলো আর এখন মা বকবক করে আরো দু’ঘণ্টা সময় নষ্ট করো, পড়ালেখা সব জাহান্নামে যাক।
তূর্য তার ঘরে গিয়ে মাকে আন্তে আস্তে ডাক দিল, আম্মু একবার আমার রুমে আসবে!
কেন? তুই কাপড়-চোপড় ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নে।
এসো না, তূর্য জিদ করে বলল।
শিরিন তূর্যর ঘরে গেল, কী হয়েছে?
আম্মু তোমাকে তো বললাম আজ আমি ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছি, সেঞ্চুরি করেছি।
হুঁম শুনলাম তো। আবার কী?
আম্মু, আজ একজন কোচের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে।
কোচ কী রে?
ও তুমি তো আবার বুঝবে না। কোচ হলো ক্রিকেটের শিক্ষক।
তাতে কী? বলেই শিরিন তূর্যর ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
তূর্য কিছুটা জিদের স্বরে বলল, একটু শোনই না।
আবার কী হলো?
কোচ আমাকে বলল, তুমি আমাদের ক্লাবে এসো, ভর্তি হও, তুমি একদিন অনেক বড় ক্রিকেটার হবে।
শিরিন নাক ছিটকিয়ে বলল, হুঁ, সবাই স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার আর তুই স্বপ্ন দেখ ক্রিকেটার হওয়ার, আমাকে যা বলেছিস তো বলেছিস, তোর আব্বু শুনলে…
শুনলে কী বলবে? আমিই আব্বুকে বলব।
তূর্যর জোরে কথা বলার শব্দ শুনে আনোয়ার সাহেব ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন, কী হয়েছে? কী বলছে ও?
থাক তোমার শুনতে হবে না। তুমি যাও।
আনোয়ার সাহেব ব্যঙাত্মক সুরে বললেন, ক্রিকেটার হবে, না? আমাদের দেশে ক্রিকেটারের কোন দাম আছে?
তূর্য সাহস করে মৃদু কণ্ঠে বলল, আছে আব্বু, ক্রিকেটারের দাম গোটা দুনিয়াতে আছে। সাকিব আল হাসানকে দেখ, তার কি কোন অভাব আছে?
তুইও সাকিব আল হাসান হবি, না?
তূর্য তার বাবাকে খুব ভয় পায়, সবসময় মাথা নত করে কথা বলে, সে তেমনভাবে বলল, আমি আজ ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছি, সেঞ্চুরি করেছি, একজন কোচ বলল আমি ক্লাবে ভর্তি হলে, ভালোভাবে প্র্যাকটিস করলে একদিন ভালো ক্রিকেটার হতে পারব।
আনোয়ার সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, থাক, থাক তোর সাকিব আল হাসানের মতো বড় ক্রিকেটার হতে হবে না, তোকে অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে।
তূর্য বিনয়ের সুরে বলল, আব্বু।
আর কথা বাড়াস না, ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি পড়তে বস। ক্রিকেটার হওয়ার আজে-বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
তূর্য মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

তিন

কালকের সেই ফুলটা তিশা রাগ করে ফেলে দিয়েছে, রাতে ভাত খায়নি, বিছানায় শুয়ে তূর্যর কথা মনে করে বার বার ফুঁপিয়ে উঠেছে। এরকম অবস’ায় তার চোখ দু’টো লাল হয়ে যায় জবা ফুলের মতো, নাকের মাংসগুলো বার বার ফুলে উঠে, নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় চোখ কচলাতে। ঘরে এসে তার মা জিজ্ঞেস করল, কীরে ভাত খাবি না?
না।
কেন?
এমনিতেই।
এমনিতেই কেন?
ক্ষিদে নেই, মা তুমি এখন যাও তো।
তিশার মা চলে গেলে তার মাথায় আবার খেলার মাঠে তূর্যর আচরণের কথা মাথায় ভিড় করল। তানিয়া ঠিকই বলেছে, তূর্য কোনদিন বড় খেলোয়াড় হলে, তোকে মনেই রাখবে না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ তানিয়া ঠিকই বলেছে, তানিয়া এসব বিষয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি জানে, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ও ওর এক কাজিনের প্রেমে পড়েছিল, তারপর ওর কাজিন বিদেশে চলে গেছে। যাওয়ার সময় নাকি ওর সঙ্গে একবার দেখা করেও যায়নি। অল্প বয়সে তাই ছেলে সম্পর্কে তানিয়ার একটা খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে।
কিন’ তূর্যও কি এমন করবে? না, না তূর্য এমন করবে না। তাছাড়া তানিয়া তার কাজিনকে ভালোবাসতো আর তূর্য তো তার ফ্রেন্ড, শুধুই ফ্রেন্ড।
শুধু ফ্রেন্ড কথাটা ভাবতেই তিশার মনে একটু মোচড় দিল। শুধু তূর্য তার ফ্রেন্ড না, তার তো আরো অনেক ফ্রেন্ড আছে কিন’ তাদের জন্য তো মন এমন করে না। তূর্যর ওপর রাগটা আরো বেড়ে গেল, একটা মোবাইল ফোনও নেই হাড়কিপটে কোথাকার!

তিশা আজ স্কুলে আসার সময় সুন্দরভাবে সেজেগুঁজে এসেছে, আয়নার সামনে দাাঁড়িয়ে বার বার নিজের প্রতিবিম্ব দেখেছে। মাধবীলতা থেকে একটা গোলাপ ফুল কিনে একবার নাকে দিয়ে শুঁকে দেখল তারপর আপন মনে একবার হেসে ফুলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। ফুলের দোকান থেকে স্কুলে আসার পথে সে বার বার করে চোখের সামনে এলিয়ে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। রিক্সা থেকে নামার আগে রিক্সার হুডের ভিতরে বসে সাবধানে তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে আয়না বের করে নিজের প্রতিবিম্ব দেখেছে।
ততক্ষণে স্কুলের মাঠে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। মঞ্চের পিছনে বড় একটা ব্যানারে লেখা ’’আন্তঃস্কুল ক্রিকেট লিগে বিজয়ী কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধণা’’ তার নিচে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথিদের নামের তালিকা। টেবিলের ওপর একটা ফুলের ডালা, মঞ্চের ওপর পিছনের দিকে এক কোণে অনেকগুলো রজনীগন্ধ্যা ফুলের স্টিক। মঞ্চের নিচে সামনের অনেকটা অংশ জুড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কৃতি ক্রিকেটার ছাত্রদের আসন। অন্যান্য চেয়ারগুলোতে অনেকেই বসতে শুরু করেছে। মমতাজ স্যার মাইকে বার বার ঘোষণা দিচ্ছেন, সম্মানিত সুধী আপনারা এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি না করে মঞ্চের সামনের চেয়ারে বসুন, স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীরা তোমরা তোমাদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে পড়ো, এখনি আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
তিশা রিক্সা থেকে নেমে একবার এদিক-সেদিক তাকাল, তার পরিচিত অনেক ছাত্র-ছাত্রীও চেয়ারে বসেছে, অনেক ক্রিকেটারও তাদের নির্ধারিত চেয়ারে বসেছে কিন’ কোথাও তূর্য নেই। তিশা মঞ্চের পিছনের দিকে গেল, হ্যাঁ ঐ তো তূর্য তার কয়েকজন বন্ধুসহ নরম রোদে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে, হাসি মাখা মুখটাকে সুর্যের এক খণ্ড আলো আরো উজ্জ্বল করেছে। তার একজন ফ্রেন্ড ইশারা করে তিশার কথা বলতেই তূর্য তিশার দিকে এগিয়ে এলো, হাই তিশা।
তিশা তার ব্যাগ থেকে গোলাপ ফুলটা বের করে তূর্যকে দিয়ে বলল, কনগ্রাচ্যুলেশন তূর্য।
থ্যাঙ্ক ইউ।
কাল তোর জন্য আমি অনেকক্ষণ ওয়েট করেছি কিন’ তুই আমার সাথে দেখা না করেই-বলতে বলতে তিশার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল।
আসলে কালকের ব্যাপারটা অন্যরকম।
হুঁম, তা তো হবেই বড় ক্রিকেটার হলে তো আরো অন্যরকম হবে।
না, না, সেরকম সুযোগ নেই।
কেন?
কারণ আমি কোনদিন বড় ক্রিকেটার হবো না।
কে বলেছে?
আমি বলছি, কারণ আব্বু আমাকে ক্রিকেট খেলতেই দিবে না। বলে আমাকে নাকি ডি.সি হতে হবে, জজ-ব্যারিস্টার হতে হবে, বড় ডাক্তার হতে হবে।
হুঁম, তুই ভালো ছাত্র, তোকে নিয়ে তো বাবা-মা এরকম স্বপ্ন দেখবেই।
মমতাজ স্যার মাইকে ঘোষণা করলেন, সম্মানিত সুধী, আমাদের প্রধান অতিথি এসে পৌঁছেছেন কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে, স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীরা, তোমরা হৈ চৈ না করে চেয়ারে বসে পড়ো, এখনি আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমি আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার ক্রিকেটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তোমরা তোমাদের আসনে বসো, এখনি আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
তূর্য বলল, তিশা চল।
তিশা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ওকে, অনুষ্ঠান শেষে তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে। ও সরি, বলে তিশা চোখ মুছে একটু হেসে বলল, অনুষ্ঠান শেষে আমাকে একটু সময় দেয়া যাবে স্যার! না, না এভাবে না বলে তিশা তার ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে তূর্যের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, অটোগ্রাফ প্লিজ!
তূর্য মিষ্টি হাসি হেসে বলল, এই ফাজলামি হচ্ছে, না?

অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি আসন গ্রহণ করলেন। স্বাগত বক্তব্য, ফুল দিয়ে ক্রিকেটারদের সংবর্ধণা জানানো হলো। ক্রিকেটাররা একে একে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করল। মাঝে মাঝেই সবাই হাততালি দিয়ে তাদের প্রেরণা দিল। তূর্য তার বক্তৃতা দিল একেবারে সাদামাঠা, প্রাণহীন এক বক্তৃতা, যে কথা না বললেই নয়। তিশা একবার চেষ্টা করছে তূর্য মঞ্চে কথা বলার সময় তূর্যর দৃষ্টি আকৃষ্ট করার, কিন’ তূর্য খুবই স্বাভাবিকভাবে কোনদিকে না তাকিয়েই তার বক্তৃতা শেষ করল। তিশা আবার নিরাশ হলো।
সবশেষে পুরস্কার বিতরণ। একে একে সবাইকে পুরস্কৃত করার পর শুরু হলো খেলার সবচেয়ে মধ্যমনি আন্তঃস্কুল ক্রিকেট লিগে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ক্রিকেটার তূর্যকে মেডেল দেবার পালা। উপস’াপক অনেকগুলো বিশেষণ যোগ করে তূর্যকে আহবান করল, এখন আমি আন্তঃস্কুল লিগ ক্রিকেটে আমাদের স্কুলের বিজয়ের মহানায়ক, আমাদের স্কুলের গৌরব এমনকি পুরো দিনাজপুর জেলার অহঙ্কার, গতকালের খেলার পর দিনাজপুরের অনেক ক্রিকেট ক্লাব যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, আমাদের সেই কীর্তিমান সোনার ছেলে তূর্যকে প্রধান অতিথির কাছ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করার জন্য আহবান করছি।
সবাই হাততালি দিয়ে অভিন্দন জানাল।
তূর্য ক্রেস্ট গ্রহণের সময় তিশা আরো একবার হাত উঁচু করে তূর্যর দৃষ্টি আকৃর্ষণ করার চেষ্টা করল কিন’ তিশার ওপর তূর্যর চোখ পড়ল না। তিশা আবার মুখ ভেঙচি কেটে আপন মনে বলল, তানিয়া ঠিকই বলেছে, একটু আগেই কথা হলো অথচ এখনই-

চার

সেদিনের স্কুল লিগের খেলার খবরটি স’ানীয় পত্রিকাগুলোতে শিরোনাম হয়েছে, কোন কোন জাতীয় পত্রিকায়ও নিউজ হয়েছে আবার কোন কোন পত্রিকায় স্কুলের বিজয়ী হওয়ার চেয়ে তূর্যর একক কৃতিত্বকে বড় করে নিউজ করেছে। খেলার পরদিনই তূর্যর অনেক বন্ধু তাকে দেখিয়েছে, সে নিজেও পড়েছে। তূর্যর নাম পেপারে নিউজ হওয়ায় তিশার বুক গর্বে ভরে গেছে, স্কুলের শিক্ষকরা তূর্যকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করছে। তূর্য কয়েকটা পেপার কিনে তার বাবাকে দেখিয়েছে, তূর্যর আশা ছিল তার কৃতিত্ব দেখার পর বাবা তাকে ক্লাবে খেলার অনুমতি দিবে, তার ক্রিকেটার হওয়ার পথের সব বাধা দূর হবে কিন’ তার বাবার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সেদিনই।
সেদিন রাতে রবি এলো। সে একটা ক্রিকেট ক্লাবের ম্যানেজার, সম্পর্কে তূর্যর মামা। শিরিন তো একবার আপাদমস্তক দেখে নিল, কীরে তুই আমার বাসায়? অন্য কোথাও যাচ্ছিলি মনে হয় পথ ভুল হয়ে গেছে, যা যা যেখানে যাচ্ছিলি সেখানে যা।
রবি তো হেসে ফেলল, আপা। আমি পথ ভুলিনি, ঠিক পথে এসেছি, বসতে বলবে নাকি সত্যি সত্যি চলে যাব?
আয় বস।
রবি সোফায় বসল, কেমন আছ আপা?
ভালো, তোরা কেমন আছিস? তোর ছেলে-মেয়ে?
হুঁম, ভালো।
তুই আমার ছোট খালার ছেলে তোকে আমি কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি, আগে প্রায় তুই আমাদের বাসায় আসতিস, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে না, একেবারে শুধু আমাদের কথা মনে করে আসতিস, তোর দুলাভাই’র সঙ্গেও তোর ভালো সম্পর্ক ছিল।
রবি ডলির অভিমান হাল্কা করার জন্য বলল, ছিল মানে? এখনো আছে, আমার সঙ্গে কি মারামারি হয়েছে নাকি?
এতদিন হয়নি তবে আজ হওয়ার আশঙ্কা আছে। বস তোর দুলাভাইকে ডাকি বলে শিরিন ড্রয়িং রুম থেকেই ডাক দিল, এই এসো তো, এদিকে দেখো কে এসেছে? চশমাটা নিয়ে এসো।
চশমা কেন? দুলাভাই কি ইদানিং চোখে কম দেখে নাকি?
না সবকিছু ঠিকই দেখে তবে তোকে মনে হয় চিনতে পারবে না।
রবি হেসে উঠল, আপা তুমি আসলে আগের মতোই আছ।
ঝগড়াটে?
না, ঠিক ঝগড়াটে না। অভিমানী।
আনোয়ার সাহেব এলেন, সেও ঠিক একইভাবে জেরা শুরু করল, কীরে রবি নাকি?
জি দুলাভাই।
খুব খুশি হয়েছি, তোকে দেখে ঈদ, ঈদ মনে হচ্ছে।
রবি হেসে উঠল, দুলাভাই আর বলতে হবে না এখন থেকে মাঝে মাঝে আসবো।
তোমরা কথা বলো, আমি দেখি রবিকে কিছু খাওয়াতে পারি নাকি, বলে ডলি ভেতরে চলে গেল।
অনেকক্ষণ শালা-দুলাভাই মিলে চলল হাসি-ঠাট্টা। ততক্ষণে শিরিন নাস্তা নিয়ে এসেছে। সে নাস্তার ট্রে টেবিলে রেখে আনোয়ার সাহেবের পাশের সোফায় বসল, রবি কি দাওয়াত দিতে এসেছিস নাকি?
না আপা দাওয়াত দিতে আসিনি, তোমাকে আবার দাওয়াত দিতে আসবো কেন? তোমার যখন ইচ্ছা চলে আসবে। তবে আজ একটা কাজে এসেছি।
শিরিন, আনোয়ার সাহেব দু’জনে মনোযোগী হলেন, শিরিন জিজ্ঞেস করল, বল?
দুলাভাই আপনি বোধ হয় পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন?
কী?
তূর্যর সাফল্যের কথা, অনেক পেপারে তো বেরিয়েছে, সাধারণত অপেশাদার কোন ক্রিকেটার এত ভালো পারফর্ম করতে পারে না। সেদিন ওর খেলা দেখে আমার মনে হয়েছে ওর খেলা গড গিফটেড।
ওই হঠাৎ করে সেদিন খেলতে পেরেছে আর প্রতিপক্ষ মনে হয় খুব দূর্বল ছিল, আচ্ছা যা হোক তাতে কী হয়েছে বল?
আপনি তো জানেন আমি আগে থেকে খেলাধুলা পছন্দ করি।
আনোয়ার সাহেবের মুখ কিছুটা গম্ভীর হলো, তো?
আমি বলছিলাম তূর্যকে আপনি আমাদের ক্লাবে দিয়ে দিন, ক্রিকেট খেলবে।
আনোয়ার সাহেব রেগে গেলেন, ক্রিকেট খেলে কী হবে?
কী হবে মানে?
কী হবে বলতে আমি যা বলছি, ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, জজ-ব্যারিস্টার হবে।
ক্রিকেট খেলে ক্রিকেটার হবে। আজকাল ভালো ক্রিকেটারের কত সম্মান, দেশ-বিদেশে কত সুনাম, দেশের সুনাম। একজন ভালো ক্রিকেটার দেশের অনেক বড় সম্পদ।
আনোয়ার সাহেব কিছু বললেন না। তার চোয়াল দুটো শক্ত হলো, সে যেন ফুলতে লাগল।
রবি আবার বলতে শুরু করল, আচ্ছা দুলাভাই আপনি একবার ভেবে দেখুন, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তূজার চেয়ে কি একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের অবদান বেশি? ইন্ডিয়ার কথা ভাবুন, সৌরভ গাঙুলী, শচীন টেন্ডুলকার এরা অনেক বড় ক্রিকেটার। একজন ক্রিকেটার একটা দেশের ব্রান্ড।
আনোয়ার সাহেব ফুঁসে উঠলেন, বিরলের বাকি, মিলন, মোজাহারুল এদের কথা একবার ভেবে দেখ। এক সময়ের ভালো ফুটবলার, শেষে কী হলো? কিছুই হতে পারে নি। এখন ভাত পাওয়াই দায়।
দুলাভাই এখন সে দিন নেই। এখন বিত্তবানরা ক্রিকেটের জন্য ডোনেশন দিয়ে ক্লাব করছে, সরকার পৃষ্ঠপোশকতা করছে।
শিরিন থামতে ইশারা করল। কিন’ রবি থামল না, তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো একটা তিরস্কারের হাসির মধ্য দিয়ে, না আজ অনেকদিন পর এসেছি, দুলাভাই’র সঙ্গে একটু অন্যরকম কিছু….
হ্যাঁ তুই তো আবার দেখা হলেই তোর দুলাভাই’র সাথে ঝগড়া করতিস। আজকেও-
আজ ঝগড়া না আমি দুলাভাই’র চোখ খুলে দিতে এসেছি, যাতে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। দুলাভাই চিন্তা করুন, ওয়ার্ল্ড কাপে খেলার পর বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে কী না, আজ বাংলাদেশকে সারা বিশ্ব চেনে, সাকিব আল হাসান কে সারা পৃথিবীর মানুষ চেনে। একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখুন।
তোর বুঝানো শেষ হয়েছে? আনোয়ার সাহেব রেগে জিজ্ঞেস করলেন।
রবি কিছু বলল না।
আমার ছেলেটার তো দেখি অনেক বুদ্ধি হয়েছে, বাবাকে ম্যানেজ করার জন্য শেষ পর্যন্ত মামাকে ধরেছে।
না, না ও আমার কাছে যায়নি, আসলে ও আমাকে চেনেই কী না।
আমি বুঝতে পারছি তুইও ওর ভালোই চাচ্ছিস কিন’ আমি আসলে ছেলেটাকে নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখছি। আমার স্বপ্নটা একটু ভিন্ন রকম। আমি চাই আমার ছেলে বড় হয়ে একদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা জজ-ব্যারিস্টার হবে। প্লিজ তুই আর ওকে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখাবি না।
ততক্ষণে চা খাওয়া হয়ে গেছে। রবি উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছে দুলাভাই ভালো থাকবেন, আপা তুমিও কিন’ আমাদের বাসার পথ ভুলে গেছ কিন’।
রবি চলে যাওয়ার পর আনোয়ার সাহেব শিরিনকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তূর্যর সারাদিন কী কী আমাকে একবার বলোতো?
সকালে টিচারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যায়। প্রাইভেট থেকে এসে স্কুল, দু’টার সময় কোচিং, এই কোচিংয়ের পর থেকে ছয়টা পর্যন্ত ফ্রি থাকে তারপর রাতে তো আবার বাসার টিচার।
হুঁম সব ঠিক আছে তুমি বিকেলে আরেকজন টিচারের ব্যবস’া করো, নাহলে ও একটু সময় পেলেই ক্রিকেটের মাঠে চলে যাবে।
কিন’ ছেলেটার একটু রেস্ট থাকতে হবে না।
সেটা তো আমিও বুঝি কিন’ ফ্রি রাখাও তো সমস্যা।
জানি না, ও কী বলবে।
আনোয়ার সাহেব রেগে গেলেন, ও আবার কী বলবে।

পাঁচ

তুর্য্যকে তার বাবা ক্রিকেটের ব্যাট কিনে দিয়েছিল তার মা’র অনুরোধে। শৈশবে টি.ভি’তে ক্রিকেট খেলা তূর্য জোরে হাত তালি দিত, মা’র কাছ থেকে রান্নাঘরের তৈজষপত্র ব্যাট বানিয়ে খেলতো দেখে একদিন শিরিনই আনোয়ার সাহেবকে বললেন, তূর্যকে একটা ব্যাট কিনে দাও তো, সবসময় শুধু রান্নাঘরের জিনিষপত্র নিয়ে একাই ক্রিকেট খেলে।
শিরিনরে কথামতো আনোয়ার সাহেব একদিন বাজার থেকে তূর্যকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাট আর একটা বল কিনে দিলেন। তারপর থেকে তূর্য নিজের সামান্য বুদ্ধিতে বলটা একটা রশি দিয়ে গ্রীলের সঙ্গে বেঁধে ব্যাট করতো, দেখে আনোয়ার সাহেব এবং শিরিন দু’জনে খুব মজা পেত।
আনোয়ার সাহেবের ব্যাংকের চাকরি। সকাল ন’টার মধ্যে ব্যাংকে গিয়ে হাজির হতে হয়, ফিরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, কোন কোনদিন রাতও হয়। বাসায় একটা কাজের বুয়া আছে, দিনে দু’বার কাজ করে দিয়ে চলে যায় সঙ্গে আসে তার ছেলেটিও, নাম মনু, তূর্যর চেয়ে বয়সে কয়েক মাসে ছোট। মনু এলেই তূর্য আর মনু ক্রিকেট খেলে, খুব মজা করে দু’জনে হাততালি দেয়।
একটু বয়স বাড়তেই তূর্য খেলতে শুরু করল বাসার সামনে সামান্য খোলা আঙিনায়, সঙ্গে জুটে গেল আরো দু’জন সহপাঠী। আরেকটু বয়স বাড়তেই তূর্যকে ভর্তি করে দিল প্রথমে একটা কিন্ডার গার্টেনে তারপর সেখান থেকে প্রাইমারি স্কুলে।
স্কুল থেকে আসার পর আর কোন কাজ নেই, দূপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই তূর্যর মন ছুটাছুটি করে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে দূরের কোন মাঠে বন্ধুদের বা তার সহপাঠীদের খেলা। মন ছুটে যায় খেলার মাঠে। বেশিরভাগ দিনই শিরিন তাকে নিয়ে বাইরের খোলা মাঠে ঘুরে আসে কিন’ তার ইচ্ছা যেন শেকল ছেঁড়ার, মায়ের কোল থেকে, মায়ের আঁচল থেকে ক্রিকেটের মাঠে যাওয়ার। বিকেল হলেই খেলার মাঠে, ক্রিকেট খেলে, আগে থেকে সবাই বলে সে ভালো খেলে কিন’ কোনদিন স্কুল লিগের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিযোগিতায় খেলা হয়নি।
বাবা-মা হাতে প্রথম ক্রিকেটের ব্যাট তুলে দিলেও, সেটা ছিল শখের বশে, আবেগে কিন’ তূর্য ক্রিকেটকে এভাবে প্রশেনালি নিতে চাইবে সেটা আনোয়ার সাহেব এবং শিরিন কেউ-ই মেনে নিতে পারেন নি। প্রথম প্রথম তাকে শাসন করেছে কিন’ তূর্য লুকিয়ে লুকিয়ে খেলেছে আর এখন তো প্রকাশ্যে। তাই শুরু হয়েছে তূর্যকে ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নেওয়ার সবরকম চেষ্টা।
সেদিন রাতে শিরিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, একেবারে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলার দরকার নেই বাবা। তোর বাবা চায় তুই লেখাপড়া শিখে একদিন অনেক বড় অফিসার হবি। পাড়ার মাঠে একটু ক্রিকেট খেলিস এটা ঠিক আছে কিন’ একেবারে ক্লাবে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি ক্রিকেটার হবি এটা তোর বাবা মানবে না বাবা, তোর ওপর রাগ করবে, আমার ওপর রাগ করবে।
আমি তো আগে পাশের মাঠেই খেলতাম কিন’ এখন তো আর মাঠটা নেই, তূর্য কিছুটা রাগের সুরে বলল।
কেন কী হয়েছে?
মাঠে একটা মার্কেট হচ্ছে।
পাড়ার মধ্যে মার্কেট হচ্ছে?
হ্যাঁ।
তোর অন্য ক্রিকেটার বন্ধুরা কী করছে?
কেউ বড় মাঠে কোন ক্লাবে ভর্তি হয়েছে আর কেউ খেলা বাদ দিয়েছে।
তুইও বাদ দে, তোর বাবা বলল বিকেলে একটা প্রাইভেট টিচার দিতে।
আরো প্রাইভেট টিচারের কথা শুনে তূর্য একরকম চিৎকার করে উঠল, আমি কখন পড়ব?
আনোয়ার সাহেব তখন ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন, তিনি জোরে ধমকের সুরে বললেন, এত জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? বিকেলে কী করবি?
বিকেলে আমার সময় কোথায়, স্কুল থেকে এসে একটু রেস্ট নিই তারপর কোচিং, সন্ধ্যায় তো আবার বাসার স্যার।
বিকেলে। বিকেলে কোচিংয়ের পর একজন টিচার আসবে, ও সব সাবজেক্ট পড়াবে।
আমি পড়ব না।
পড়ব না বললেই হলো, সামনে এস.এস.সি পরীক্ষা। এখন থেকে প্রস’তি না নিলে পিছিয়ে পড়বি, রেজাল্ট খারাপ হবে।
রেজাল্ট খারাপ হবে না, আমি ক্রিকেটও খেলবো, আমার রেজাল্টও ভালো হবে তুমি দেখো।
আমি অতশত বুঝি না, খেলা বন্ধ না করলে রেজাল্ট ভালো হবে না। কাল থেকে চারটার সময় একজন টিচার আসবে, তুই পড়বি। আর একটা কথাও বলবি না। আমরা মানুষ হয়েছি, বাবা-মা যা বলেছে তাই শুনেছি, আর এতটুকু ছেলে হয়ে এখনই মুখে মুখে কথা বলছিস, না? বলে আনোয়ার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, শিরিন তুমিও লক্ষ্য করো।
শিরিন কম শিক্ষিত, তেমন আধুনিকও না, তার চলাফেরা একেবারে সাদাসিদে, সংসারের কোন ব্যাপারে সে তার মত প্রকাশ করে না। আনোয়ার সাহেব যা বলেন শিরিন তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়।

পরদিন থেকে বাসায় আরো একজন টিচার আসতে শুরু করল। তূর্য টিচারের কাছে পড়তে বসল কিছুটা দায়সারা গোছের। বাসার টিচারের কাছে পড়ায় তার মনোযোগ নেই। টিচার যতক্ষণ পড়াতে থাকে ততক্ষণ বুঝে কিংবা না বুঝে হ্যাঁ অথবা না বলে কাটিয়ে দেয়। আনোয়ার সাহেব তখন ব্যাংকে থাকেন, শিরিন কিছু বুঝতে পারে না, তূর্য টিচারের কাছে পড়তে বসেছে তাতেই সে মহাখুশী।
এর মধ্যে তুর্য্যর মাথায় নতুন চিন্তা ঢুকেছে, মোবাইল ফোন কিনবে। তূর্যর সাথে তার বাবার সম্পর্কটা যেন একটু অন্যরকম। বাবার কথা মনে পড়লেই তূর্যর বুকের ভেতর একটা গম্ভীর মুখের মানুষের ছবি ভেসে উঠে, আনোয়ার সাহেব তাকে কোনদিন কাছে নিয়ে খুব আদর করেছেন বা একটু বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেছেন এমন না, আবার তাকে কোনদিন খুব শাসন করেছেন বা কোনদিন মেরেছেন এমনও না। তবুও বাবা নামে তুর্য্যর মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক আছে। তাই তার কোন চাওয়া-পাওয়া বাবাকে বলতে সাহস পায় না। এমনকি খুব প্রয়োজনীয় কিছু হলেও মাকে বলে আর একটু সাহস হলে বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলে আর আনোয়ার সাহেব আড়াল থেকেই জবাব দেন। বাবা কোন প্রশ্নের কোন উত্তর হতে পারে সেবিষয়ে তূর্যর অনেকটা ধারণা আছে তবু কিছু করার নেই তার সব চাওয়া-পাওয়ার জায়গা তো একটাই, তার বাবা।
তূর্য যখন তার মাকে মোবাইল ফোনের কথা বলছিল আনোয়ার সাহেব তখন টি.ভি দেখছিলেন। তূর্যর কথাটা কানে যেতেই তার পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠেছে, মোবাইল! মোবাইল কী করবি তুই!
আমি মোবাইল নিব।
কেন? মোবাইল তোর কী কাজে লাগবে?
আমি স্কুল যাচ্ছি, কোচিং যাচ্ছি, আমার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য, কোনদিন কোচিং বন্ধ, কোনদিন খোলা জানার জন্য মোবাইল ফোন দরকার।
যেদিন কোচিং যাবি সেদিনই শুনে আসবি। আগে যে মোবাইল ফোন ছিল না আমরা লেখাপড়া করিনি?
সবাই তো আগের দিন শুনে আসতে পারে তবুও তো সবাই মোবাইল ফোন কিনেছে, আমার ফ্রেন্ডদের মধ্যে আমাদের তিনজনের ছাড়া সবার মোবাইল ফোন আছে, রিক্‌্রাওয়ালাদের ছেলেদের তো মোবাইল ফোন আছে আর আমার মোবাইল ফোন থাকবে না।
না থাকবে না, মোবাইল ফোন নিলে বন্ধু বেড়ে যাবে, বন্ধু যত বেশি হবে লেখাপড়া তত খারাপ হবে।
হুঁম তাহলে তো আমার সব ফ্রেন্ডদের লেখাপড়া খারাপ হবে আর আমি শুধু বোর্ডের সেরা ছাত্র হবো।
হ্যাঁ ভালোভাবে লেখাপড়া শিখলে তুই ফার্স্ট হবি।
আমি পারব না, দিন রাত শুধু লেখাপড়া করলে আমার মাথা ব্যথা করবে, আমি সব পড়া ভুলে যাব।
শিরিন তূর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, থাক বাবা, চুপ কর, বাবা-মা’র মুখের ওপর কথা বলতে হয় না।
ততক্ষণে তূর্যর চোখের পানি আর নাকের পানিতে একাকার হয়ে গেছে। তার চোখ দু’টো লাল হয়ে গেছে। শিরিন চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, বাবা-মা কোন সন্তানের খারাপ চায় না বাবা। তোর বাবা যখন বলেছে এখন কিনে দিবে না তো দিবেই না, আমি বুঝিয়ে বলব এস.এস.সি পরীক্ষার পর তোকে মোবাইল ফোন কিনে দিবে।
তূর্য প্রচণ্ড রেগে নিজেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল, আমি কি এখনো ছোট আছি?
শিরিন স্নেহমাখা স্বরে বলল, বড় হয়েছিস, না? খুব বড় হয়েছিস।
তূর্য কোন কথা বলল না।
শিরিন হাত ধরে তাকে চেয়ারে বসাতে চাইল কিন’ সে জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, না আমি বসব না, আমি কিচ্ছু খাবো না।
বস বাবা, খা।
তাহলে আগে বলো আমাকে মোবাইল কিনে দিবে?
আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলব।
ঠিক বলছ?
হ্যাঁ ঠিক বলছি, আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলব। তারপর দেখি কিনে দেয় কী না-

ছয়

সিওর সাকসেস কোচিং সেন্টার থেকে এক ঝাঁক ছাত্র-ছাত্রী বের হলো। কোচিং সেন্টারের সামনের সামান্য খোলা জায়গা যেন ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে মুখরিত হলো। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে দু’দিকে ভাগ হলো, একটি রাস্তা চলে গেছে শহরের দিকে আরেকটি রাস্তা বালুয়াডাঙা হয়ে পূণর্ভবা ব্রিজের দিকে। আগে তূর্য প্রতিদিন কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে ক্রিকেটের ব্যাগ নিয়ে ছুটে যেত ক্রিকেটের মাঠে, জীবন থেকে ক্রিকেট নামটা মুছে যাওয়ার পর যেমন একজন প্রাইভেট টিচার যোগ হয়েছে তেমনি মাঠে যাওয়ার তাড়া না থাকায় অনেকটা সময়ও বেঁচে গেছে। অন্যান্য দিনের মতো তূর্য আজ সাইকেলে না চেপে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরের দিকে আসছিল। তিশা প্রথমে ভেবেছিল তূর্য অন্যান্য দিনের মতো সাইকেল চালিয়ে যাবে কিন’ অনেকটা পথ তূর্যর সঙ্গে আসার পরও তূর্য সাইকেল নিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে থাকায় তিশা কিছুটা অবাক হলো, এই তূর্য, আজ তাড়া নেই রে?
তূর্য গম্ভীর কণ্ঠে বলল, না।
কেন? মাঠে যাবি না?
না।
কেন? ছক্কা মারলি, সেঞ্চুরি করলি-
তূর্য বাধা দিল, আর বলিস না।
বলব না কেন? সেঞ্চুরি করার দিন থেকে তো মনে হচ্ছিল-
তূর্য কিছুটা রেগে গেল, তুই থামবি নাকি আমি- বলে তূর্য সাইকেলে উঠছিল।
তিশা তূর্যর হাত টেনে ধরল, সরি তূর্য।
তূর্যর দু’চোখ ছলছল করে উঠল।
তূর্যর চোখ ছলছল দেখে তিশার কণ্ঠস্বরও বুজে এলো, কী হয়েছে? আমাকে বল?
না, তোকে কিচ্ছু জানতে হবে না।
ততক্ষণে দু’জনে কথা বলতে বলতে ইকবাল স্কুলের মোড়ে চলে এসেছে। মোড় থেকে যে রাস্তাটা ডানে চলে গেছে সেই রাস্তার কোণে তূর্যদের বাড়ি আর তিশাদের বাড়ি ঠিক উল্টো দিকে। মোড়ে এসে তূর্য আবার সাইকেলে উঠছিল। তিশা সাইকেলের ক্যারিয়ার টেনে ধরল, এই, এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন?
কীভাবে চলে যাব?
আমাকে বল কী হয়েছে?
তোকে বলে আর কী হবে। আর কোনদিন ক্রিকেট খেলা হবে না।
কে বলেছে?
বাবা।
ম্যানেজ কর।
আমার বাবা ম্যানেজ হওয়ার মতো মানুষ না। যা বলে তাই করে।
তাইবলে-
না কিছু করার নেই, যেমন করেই হোক লেখাপড়া শিখে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, জজ-ব্যারিস্টার হতে হবে।
হবি, তাইবলে খেলা যাবে না?
আমি যাই, আমার দেরি হলে বাসায় আবার টিচার অপেক্ষা করবে, বাবা মা’র কাছে মোবাইল করে আমার খোঁজখবর নিবে।
তারপর-
তারপর রাতে বকাবকি করবে।
এই তুই তো ছেলেমানুষ, না? এটুকু রাস্তা আসতে আসতে কি তুই হারিয়ে যাবি? আর এত পড়া তুই পড়িস কীভাবে? বিরক্ত লাগে না?
লাগে।
তো?
পড়ি না, স্যারের সামনে বসে থাকি। বলে তূর্য একটা শুষ্ক হাসি হাসল। তারপর একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, আর সবমসয় নেই রে আরেকদিন কথা বলব।
তোর তো আবার মোবাইল ফোন নেই যে কথা বলব।
বাবা আমাকেও মোবাইল ফোন কিনে দিবে।
কবে?
এস.এস.সি পাসের পর।
তিশা হেসে উঠল। তার আগে মোবাইল ফোন কিনে দিলে কী হবে?

চলবে…

এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা-২০১৩

প্রকাশ করেছেন:

নওরোজ কিতাবিস্তান

০৫, বাংলাবাজার, ঢাকা

প্রচ্ছদ এঁকেছেন: চারু পিন্টু।

বইটির জন্য যোগাযোগ করুন:

মনজুর খান চৌধুরী-০১৭১১৩২১০৮৫

জিল্লুর রহমান-০১৭১৮১৫৭০৭৬

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*