শেষ গোধূলি

ষাট/পঁয়ষট্টি বছর বয়সের এক মহিলা, সমস্ত চুল পাকা সাদা ধবধবে, পাটের মতো সাদা। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, চিবুক, গালের চামড়ায়ও অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে। সেই বুড়ি বারো শিবালয় মন্দিরের গা ঘেঁষে প্রাচীন বটগাছটার আশেপাশে, ছোট যমুনা নদীর তীরে সেই বিকেল থেকে কী যেনো খুঁজছে, কোনো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন হন্য হয়ে খুঁজে তেমনি হন্য হয়ে খুঁজছে আর বিড় বিড় করে বুলি আওড়াচ্ছে, আরে বাবা যাবে তো যাবে, নিজের ছায়াটা তো রেখে যাবে আমার জন্য। তোমাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটা দিয়েছিলাম না, পড়েছো? পড়লে তো ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। এরকম তুমি বরাবরই করতে, আমি তোমাকে ইমদাদুল হক মিলনের বিখ্যাত উপন্যাস নূরজাহান দিয়েছিলাম, পড়োনি। সেই উপন্যাসটা আমি কিনেছিলাম কত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমদাদুল হক মিলনের অটোগ্রাফসহ। ইমদাদুল হক মিলন লিখেছিলেন, ’’ভালোবাসা থাকলে সব হয়’’। আর সেই অটোগ্রাফ পড়েই তো আমি তোমার কাছে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে। অথচ তুমি সেই উপন্যাসটা পড়লেই না।

ঠিক একই কাজ করেছো হয়তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটাও। যদি পড়তে তবে ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। আজ এসে তোমার ছায়াটা দেখতাম। তুমি জানো তোমার ছায়াটা দেখার জন্য আমি সেই কতদূর থেকে এসেছি, লুকিয়ে, সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে। ওরা আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দিবে না বলে আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিলো, আমাকে পাহারা দিয়ে স্কুলে পাঠাতো, স্কুলের সব কলিগদের বলে দিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে কথা বলতে না পারি। আমাকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে না বলি। তবুও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছি কিন্তু সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার করে বলেছে, দু:খিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি সেই মহিলাটাকে কাছে পেতাম তবে আমি ওকে জুতোপেটা করতাম।

একদিন তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি ফোন করছিলাম আর সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার দু:খিত বলছিলো। সেটা দেখে ওরা আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো, আমাকে প্রচণ্ড মার দিলো, দেখো আমার সামনের দাঁতটা ভাঙ্গা কী না। বলে বুড়ি বট গাছের সেই যুগলবন্দি লতার কাছে দাঁড়ালো। তারপর আবার বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো, যেদিন আমরা প্রথম এখানে এলাম সেদিনই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। তারপর তোমার জন্মদিন পালন করলাম এখানে। তোমার জন্মদিনের ক’দিন আগে থেকেই সে কী প্রস্তুতি আমার, তোমার জন্মদিনে কী দেবো আমি এই নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত ছিলো না। সেদিন সকাল থেকে উত্তেজনায় আমি যেনো কাঁপছিলাম। কখন মোশা স্কুল যাবে, কখন আমি স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তোমার কাছে আসবো। তুমি বার বার ফোন করছিলে, ইরা দেরি করছো কেনো? তোমার কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো?
আমি বললাম, না।
তাহলে দেরি করছো কেনো?
আমি তখন বেকারিতে তোমার জন্মদিনের কেক-এ নাম লিখতে দিয়ে ক্যাটস পো’তে তোমার জন্য শার্ট কিনছি, আমি তখন কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বললাম, এতো ব্যস্ত হয়োনা তো। একটু ধৈর্য ধরো। আমি আসছি।
আমি যতই রেগে যাই তুমি আমার ওপর কোনোদিন রাগ করতে না, এটা তোমার একটা বড় গুণ। তুমি হেসে বললে, একটু তাড়াতাড়ি এসো সোনা।
আমার সব কেনাকাটা ব্যাগে নিয়ে একটা অটো রিক্সায় উঠলাম। তুমি ততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলে। আমি দেরিতে এলাম অথচ তুমি একটুও রাগ করলে না। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললে, অনেক দেরি করে ফেললে, কখন যাবে আর কখন আসবে একবার ভেবে দেখেছো। তারপর রিক্সায় উঠলে।
বটগাছের নিচে এসে আমি তোমার হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে বললাম, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
তুমি বললে, থ্যাঙ্কস।
তারপর আমি ব্যাগ থেকে জন্মদিনের কেক বের করে কেক, মোমবাতি সাজালাম। তোমার জন্য আনা শার্ট-প্যান্ট, পারফিউম আরো যত গিফট এনেছিলাম তোমার হাতে দিলাম। তোমার চোখে-মুখে সে কি আনন্দ দেখেছি আমি। তোমার চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করছিলো। তুমি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলে, ইরা কেনো এতোকিছু করতে গেলে, কতকগুলো টাকা খরচ করে ফেললে আননেসেসারি।
তোমার চোখের পানি দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেলো, আনন্দে, গর্বে। গর্ব এজন্য যে, যে লেখকের শত শত ভক্ত যখন ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাসসহ বিভিন্ন ব্লগ এবং মোবাইল ফোনে জন্মদিন উইশ করছে সে লেখকের জন্মদিন পালন করছি শুধু আমরা দু’জন। আমার সেদিন নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো। তোমার সেই জন্মদিনটা আমার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির একটি।

এই বটগাছের নিচে সেদিন তুমিই আবিস্কার করেছিলে এই যুগলবন্দি লতাগুল্ম, কেমন বুকের মধ্যে জড়িয়ে আছে একটা লতা আরেকটা লতাকে। এমনি তুমিও আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে। তোমার বুকের সাদা লোমগুলো আমি কাশফুল বলতাম, আমি কাশফুলে মাথা রাখতাম আর তুমি বুকে জড়িয়ে রাখতে আমাকে, আহ কী সুখ! কী অনাবিল শান্তি তোমার কাশফুলে মাথা রেখে। অথচ দেখো তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম বলে মোশা আমাকে মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিলো। ও তুমি ভেবেছো বয়সের কারণে আমার দাঁত উঠে গেছে। বলে সে আবার হি হি করে হেসে উঠলো, পাগল, আমার আর কত বয়সই হয়েছে। এই তো, এই তো সেদিনই তুমি আমার সাথে ছিলে তখন আমার বয়স ছিলো সাইত্রিশ বছর। এখন কত আর হবে আটত্রিশ উনচল্লিশ। তুমি না বলতে, ইরা তুমি কোনোদিন বুড়ি হবে না, তুমি চিরসবুজ, চিরতরুণীই থাকবে, আমি তাই আছি। তুমি একবার এসো এই বারো শিবালয়ে, এই ছোটযমুনার তীরে।

বারো শিবালয় আমাদের ভালোবাসার, আমাদের পছন্দের জায়গা, তোমার ব্যস্ততম চাকরি, আমার শিক্ষকতার ফাঁকে, আমরা ছুটে আসতাম বারো শিবালয়। এই বটগাছের নিচে, গোল করে বাঁধানো গোড়ায় আমরা বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তুমি আমার চোখের ভাষা, মনের ভাষা সব বুঝতে। আমি যখন বাসায় মন খারাপ করে বসে থাকতাম, মনে মনে তোমাকে খুব মিস করতাম ঠিক তখনই তোমার ফোন যেতো। উ: কী যে ভালো লাগতো আমার। তুমি বিশ্বাস করো তোমার মতো করে আমাকে কেউ কোনোদিন ভালোবাসেনি আর বাসবেও না। তুমি এসো সোনা আমার, এসো। বলে ইরা যুগলবন্দি লতার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।

আসবে না, তুমি না বলতে ইরা যখন আমাকে খুব মনে পড়বে তখনই এখানে এসো, আমাকে পাবে, কই তুমি তো তোমার কথা রাখোনি। আমাকে দেখো, আমি ঠিকই তোমার কথা রেখেছি। ও, তুমিও এসেছো, বলে ইরা ছোট যমুনার তীর দিয়ে ভাটির দিকে যেতে লাগলো বিড়বিড় করে স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে, এইতো, এইতো আমরা এ-ইখানে দাঁড়িয়ে অনেক সেলফি তুলেছিলাম। আমি তোমার বুকে মাথা রেখেছিলাম, তুমি আমার থুতনি উঁচু করে ধরে আমার চোখে চোখ রেখেছিলে, কী আছে তোমার চোখে বলোতো, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কোনোদিন রেগে থাকতে পারতাম না, আর তোমার হাসি, বলে ইরা পাগলের মতো হো হো করে হেসে উঠলো, তোমার হাসি নিয়ে তুমি একটা গল্প করেছিলে, তোমার বাবা, মানে আমার শ্বশুর মশাই’র হাসিও নাকি খুব সুন্দর ছিলো, আমার শাশুড়ি নাকি সেই হাসির নাম দিয়েছিলো ভূবন মোহিনী হাসি। তুমিও উত্তরাধিকার সুত্রে বাবা’র সেই হাসিই পেয়েছিলে। তোমার হাসি দেখে প্রেমে পড়বে না এমন বেরসিক মেয়ে দুনিয়াতে আর একটাও নেই। তাই তোমার হাসিটাকে আমি খুব ভয় পেতাম, তোমাকে হারানোর ভয়, তোমাকে আমি বলতাম, এই তুমি কিন্তু কোনো মেয়ের সামনে হাসবে না।
তুমি জিজ্ঞেস করতে, কেনো?
তুমি হাসলে আমার ভয় লাগে, তোমার হাসি দেখে কেউ বুঝি তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলো।
তুমি বলতে, ছি: তুমি এমন কথা ভাবছো কী করে বলোতো, আমি তো তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে কখনো কল্পনাই করতে পারি না।

এবার হঠাৎ করেই ইরা গম্ভীর হয়ে গেলো, তারপর একটা লাজুক হাসি হেসে বললো, এই তুমি আবার কারো প্রেমে পড়োনি তো? ছি: এসব আমি কী ভাবছি, তুমি না আমাকে কথা দিয়েছো আর কারো সাথে তুমি জড়াবে না, এটাই তোমার শেষ প্রেম। তুমি খুব প্রতিশ্রুতিবান, তুমি যেদিন আমাকে যেটা বলেছো ঠিক সেটাই করেছো, তুমি আমাকে কথা দিয়েছো আমি মন থেকে ডাকলে তুমি আসবে, তুমি দেখো, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো। কথা ছিলো আমরা বছরের শেষ দিনটা, শেষ গোধূলীটা এখানে কাটাবো।
হাঁটতে হাঁটতে ইরা ঠিক সেই জায়গায় গেলো আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে যেখানে সে আর জয় বছরের শেষ বিকেলটা কাটিয়েছিলো। তারপর ইরাকে মোশা নিয়ে গেলো তার বাসায়, তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে প্রথম কয়েকদিন ঘরে বন্দি করে রাখলো, তারপর স্কুল যাওয়ার সময় কাউকে না কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতো, স্কুলের সবাই জানতো তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার চাকরিকে জিম্মি করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা। তাই সবাই একরকম পাহারা দিয়ে রাখতো ইরাকে, সে যেনো কারো সাথে কথা বলতে না পারে। তার সবসময় নিজেকে কয়েদি মনে হতো, কয়েদি বললে ভুল হবে, চিড়িয়াখানার প্রাণি মনে হতো নিজেকে। হ্যাঁ চিড়িয়াখানার প্রাণিই তো সে, তা না হলে সবাই তাকে দেখতে আসবে কেনো, সবাই তাকে দেখতে আসতো, আর ঘৃণা করতো, আড়ালে ফিসফিস করে বলতো, ছি: এই বয়সে স্বামী-সংসার ছেড়ে মহিলাটা পালিয়ে গিয়েছিলো অন্য পুরুষের সঙ্গে।

পাশে থাকা আরেকজন বললো, শুধু পালিয়ে গিয়েছিলো, বিয়েও করেছিলো কিছুদিন সংসারও করেছে তারপর আবার ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলতো, যখন পালিয়ে গিয়েছিলো তখনো একটা দিক ছিলো তার। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে বিচ্ছেদ হয়, সেই বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তো চলে গিয়েছিলো তো আবার ফিরে এলো কেনো?

একদিন তার এক কলিগ বললো, চলে এলেন কেনো আপা? গেছেন যখন তখন আবার ফিরে এলেন কেনো? সবাই খুব ছি: ছি: করছে। ইরা কারো কথার কোনো জবাব দেয় না। চিড়িয়াখানার প্রাণিগুলোকে কেউ কিছু ছুঁড়লে যেমন তারা আশ্রয় খুঁজে এক কোণ থেকে আরেক কোণে যায়, খাঁচার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজে, ইরাও তেমনি মুখ বুজে চুপ করে নিজের কাছেই নিজের আশ্রয় খুঁজে। কিন্তু এতো বড় পৃথিবীতে তার আশ্রয় কোথায়! গোটা পৃথিবী যেনো আঙ্গুল তুলে তাকে ঘৃণা করছে, তিরস্কার করছে। পৃথিবীতে একটি মানুষও কি নেই তার মনের ভাষা বোঝার। আছে একমাত্র জয়ই ছিলো যে তার মনের ভাষা বুঝতো, সেই মানিক-রতন সে নিজেই ছেড়ে এসেছে। তার সেই স্মৃতি, মানুষের অপমান সইতে না পেরে সে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

মোশা তাকে ঢাকায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো। ডাক্তার ঔষধের সঙ্গে কিছু পরামর্শও দিলো। তাকে একা থাকতে নিষেধ করলো, তার স্মৃতিময় জায়গাগুলো থেকে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসার পরামর্শ দিলো। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে ইরা হিহি করে হেসে উঠলো, ডাক্তার সাহেব আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমার বায়ুবদল দরকার, আগের দিনের উপন্যাসগুলোতে পড়তাম, ডাক্তাররা এমন পরামর্শই দিতেন। এখনকার দিনে এমন হয় না কিন্তু আপনি সেই সেকেলেই রয়ে গেছেন।

মোশা ইরার দিকে একবার রাগান্বিত চোখে তাকাতেই ইরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, তাকাবে না, আমার দিকে এভাবে তাকাবে না। তুমি, তুমি তো আমার সর্বনাশ করেছো, তুমি যদি আমাকে জোর করে নিয়ে না আসতে, জোর করে আবার বিয়ে না করতে তবে আমার কিচ্ছু হতো না। আমার এ অবস্থার জন্য তুমি দায়ি, তুমিই।
যে চাকরিকে জিম্মি করে মোশা জোর করে, কৌশলে, কুটচাল দিয়ে ইরাকে তার কাছে ফিরিয়ে এনেছিলো ইরার মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য সেই চাকরিটা আর থাকলো না।

ততদিনে শুভ’র লেখাপড়া শেষ করে চাকরিও হয়েছে। শুভ’র পোস্টিং হলো পাবনায়। শুভ ইরাকে পাবনায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো কিন্তু পরামর্শ সেই একই। স্মৃতিময় জায়গাগুলো আর মোশা কাছ থেকে দূরে রাখা। ডাক্তারের পরামর্শে শুভ ইরাকে নিয়ে গেলো তার বাসায় আর মোশা পড়ে রইলো তার গ্রামের বাড়িতে। ইরার ইচ্ছাও তা-ই ছিলো। জয়ের কাছ থেকে তোমরা যদি আমাকে নিয়েই যাও তবে আমি আমার ছেলের কাছেই যাবো। ইরা, তার বউমা ইভা আর শুভ এই তিনজনের সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। প্রায় বছর দু’য়েক পর ইভার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে, ইরার মতোই হয়েছে। ইরা তার নাতনির নাম রাখলো জুঁই।

সেই জুঁই’র বয়স এখন বিশ বছর। এই বিশ বছরে ঈদে কোরবানীতে ইরা গ্রামের বাড়ি এসেছে কিন্তু বাড়ি এলেই ইরার মাথাটা গোলমেলে হয়ে যায়। ইরা উত্তরের জানালায় বসে স্কুলের সেই বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, এই বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে জয় আসতো আর তখনই ইরার সঙ্গে জয়ের পরিচয় হয়েছিলো। ইরা সুযোগ পেলেই বিল্ডিংয়ে চলে যায়, দেয়ালে মাথা ঠুকে বলে, কেনো? কেনো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে আবার বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে আসবে। কেনো? আসো না কেনো?

রাতের আঁধারে বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানের ক্রিস্টমাস ট্রিতে ওড়না পেঁচিয়ে ইরা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ইরার সঙ্গে জয়ের কথা ছিলো প্রতি বছর বড়দিনে ইরা এই ক্রিস্টমাস ট্রিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করবে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে। জয়ের সাথে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে, স্মৃতিময় দিনগুলোতে ইরার মাথাটা গরম হয়ে উঠে।

জয়পুরহাট এলে ইরা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যায়। জোরে চিৎকার করে বলে, ঐ যে ক্যাটস পো, আমি আমার জয়কে এই ক্যাটস পো’তে শার্ট কিনে দিতাম, জয় নতুন শার্ট পরে ট্রায়াল রুম থেকে বের হতো, কী স্মার্ট আমার জয়।
জুঁই এসব কথা শুনছে ছোটবেলা থেকে, এখন সে বড় হয়েছে, দাদির কষ্ট সে এখন বোঝে। একদিন জুঁই ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদি তুমি যে সবসময় জয়, জয় করো, কই তোমার জয় তো একবারো তোমার কাছে এলো না। আজকাল তো মোবাইল ফোন আছে, ইন্টারনেট আছে, তোমার জয় তো একবারো তোমার খোঁজ নিলো না।

ইরার মুখ কালো হয়ে গেলো। সে যেনো বুকে একটা ধাক্কা খেলো, আসতো, আসতো কিন্তু আমার মনে হয় তোর দাদু ওকে নিষেধ করে দিয়েছে, হয়তো অনেক বকা দিয়েছে। তোর দাদু যে জটিল, যে পেঁচুক মানুষ, ওর সঙ্গে আমার জয় পারবে না। তুই দেখিস্‌ এবার বাড়ি গেলে আমি ঠিকই জয়কে ডেকে নিয়ে আসবো তোর কাছে, দেখিস্‌ আমার জয় কত সুন্দর আর স্মার্ট।
জুঁই মুখ বিকৃত করে বললো, আছে তোমার জয় এখনো স্মার্ট আছে, সুন্দর আছে, সত্তর বছরের বুড়োর আবার স্মার্টনেস।
ওর শরীরের গড়নটা খুব ভালো। বয়স বোঝা যায় না। দেখিস্‌, ওকে দেখলে তুই আবার বলে ইরা হি হি করে হেসে উঠলো।
জুঁই মুচকি হাসি হেসে বললো, কি ভাবছো আমি তোমার জয়ের প্রেমে পড়ে যাবো?
হ্যাঁ যাবিই তো। তুই দেখিস্‌ কালই আমি ওকে নিয়ে আসবো। কাল একত্রিশ ডিসেম্বর না?
হ্যাঁ, তাতে কী?
একত্রিশ ডিসেম্বর জয় আসবে, আমার সাথে দেখা হবে। আমাকে ও কথা দিয়েছে প্রতিবছর আমরা একত্রিশ ডিসেম্বর একসাথে সূর্যাস্ত দেখবো। কাল আমরা যখন সূর্যাস্ত দেখবো তখন ওকে আমি তোর কাছে নিয়ে আসবো।
জুঁই হি হি করে হেসে উঠলো, দাদু তোমাকে কিছু বলবে না?
ইরা চটে গেলো, কেনো বলবে? কেনো? আমি তো ওরই বউ, মোশা তো আমাকে জোর করে, আমার চাকরিকে জিম্মি করে নিয়ে এসেছে। আমার মনের স্বামী তো জয়-ই।
জুঁই বুঝতে পেরেছে ইরার মাথাটা আবার ডিসটার্ব শুরু করেছে। সে আর কথা বাড়ালো না।

ইরা গতকাল গ্রামের বাড়ি এসেছে। আসার পর থেকে সুযোগ খুঁজেছে বাসা থেকে বেরিয়ে জয়পুরহাট আসার। তারপর স্মৃতিময় বারো শিবালয় মন্দির, ছোট যমুনা নদী। জয় ইরাকে কথা দিয়েছিলো প্রতি বছর বছরের শেষ গোধূলীটা দু’জনে একসঙ্গে দেখবে। আজ সেই সুযোগ পেয়েছে ইরা, এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো ইরা দুই যুগ থেকে। ইরা বাসা থেকে বেরিয়ে একটা অটোতে উঠে সোজা কালাই এসেছে, ভাগ্যক্রমে পাঁচশিরা এসে একটা সি.এন.জি পেলো। ইরা কোনোকিছু না বলেই সি.এন.জি’তে উঠলো।
সি.এন.জি’র ড্রাইভার তো অবাক, কোথায় যাবেন আপনি? না বলে উঠলেন কেনো?
ইরা বললো, জয়পুরহাট যাবো, তুমি যাবে না?
না।
যাবে না কেনো? চলো তোমাকে আমি অনেক টাকা দিবো।
অনেক টাকা মানে? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো।
ইরা চোখ বড় বড় করে বললো, তোমাকে আমি পাঁচশো টাকা দিবো, যাবে না?
টাকার লোভে ড্রাইভার যেতে রাজি হলো। সেই সি.এন.জি নিয়ে ইরা সোজা চলে এলো বারো শিবালয়। তখন বিকেল চারটা বাজে। তখন থেকে ইরা জয়কে খুঁজছে কখনো বটগাছের চারপাশে লুকোচুরি করার মতো, কখনো নদীর ধার বরাবর একবার উজানে, একবার ভাটিতে।

বিকেল থেকে ইরাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোশা প্রথমে পাশের বাড়ি, স্কুলের আশ-পাশ, দেবর-ননদের বাড়ি এবং জয়পুরহাট ইরার বাবার বাড়িসহ অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। ইভা জুঁইকে বকাবকি করলো, একসাথে তো ছিলি তুই আবার কোথায় গিয়েছিলি যে তোর দাদিকে দেখে রাখতে পারলি না। খবর শুনে আত্মীয়-স্বজনরা বাড়িতে এলো, একেকজন একেকরকম পরামর্শ দিতে লাগলো।
অবশেষে মাইকিং শুরু হলো, কিছুক্ষণের মধ্যে খবরটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ বললো, বয়স্ক মহিলা কোথায় আর যাবে, মাথায় একটু গণ্ডগোল ছিলো, পথ ভুলে কোথাও গেছে। পথ খুঁজে পেলে ঠিকই চলে আসবে।
কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত মাইকিং, বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও ইরাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বাড়িতে একটা শোকের ছায়া নামলো।

ততক্ষণে রাত গভীর হয়েছে, ইরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই, তার কাছে এখনো সূর্য অস্ত যায়নি। সে বিড়বিড় করে কথা বলেই চলেছে, তুমি ভেবেছো আমি রাগ করে চলে যাবো? আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো, তুমি কথা দিয়েছো আসবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকবো। বলে কথা বলতে বলতে ইরা নদীতে নামলো, তারপর আবার বলতে শুরু করলো, একবার আমরা এখানে এসেছিলাম বর্ষায়, এখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিলো। আমরা নৌকায় উঠলাম। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, বলছিলাম আমি সাঁতাড় কাটতে জানি না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে, বলেছিলে তোমার সাঁতাড় কাটতে হবে না। আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো, ডুবে যেতে দিবো না।
আমি বলেছিলাম, তোমাকে তুলতে হবে না, জানো না প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
কথা বলতে বলতে ইরা নদীতে নামলো, স্রোতস্বীনির কাছে দাঁড়ালো, পানিতে ইরার অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। ইরা পানিতে তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো, পেয়েছি, এই তো তুমি তোমার ছায়া রেখে গেছো। আমি জানতাম তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে যাবে না, তুমি ফাঁকি দিতেই জানো না। আমি তোমাকে না পাই তোমার ছায়া তো পেয়েছি। আমি তোমার ছায়াকেই বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো সারাজীবন। তোমার ছায়া বুকে জড়িয়ে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিবো। বলে ইরা জয়ের ছবি মনে করে তার নিজের প্রতিচ্ছবিকে জড়িয়ে ধরার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নদীতে তেমন পানি ছিলো না। সোজা হয়ে দাঁড়ালে ইরা হয়তো দাঁড়িায়ে থাকতে পারতো কিন্তু ঝাঁপ দেয়াতে তার মুখ ডুবে গেলো পানিতে। সে বাঁচার চেষ্টা করলো হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো।

বারো শিবালয় মন্দিরের সামনে গতন শহর-খঞ্জণপুর রাস্তার ওপর মানুষের ভিড় জমেছে। কৌতূহলী মানুষের প্রশ্ন কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই?
একজন বললো, নদীতে একটা লাশ পাওয়া গেছে।
লাশ, কার লাশ?
একজন বিরক্ত হয়ে বললো, আরে ভাই কার লাশ কে জানে? হয়তো ভেসে এসেছে দূর থেকে।
আরেকজন বললো, না, দূর থেকে না। কাল বিকেলে আখ কাটার সময় কামলারা দেখেছে এই বুড়িকে বটগাছের নিচে বিড় বিড় করতে, সেই মহিলারই লাশ।
একটা পুলিশের ভ্যান এলো। কয়েকজন পুলিশ সদস্য বাঁশি বাজিয়ে ভিড় ফাঁকা করে বটগাছের শেকড়ের সঙ্গে আটকে থাকা লাশ টেনে উপরে তুললো।
পুলিশের একজন অফিসার ওয়্যারলেসে বিড়বিড় করে ম্যাসেজ পাঠালো। মিডিয়া কর্মীরা ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে খবরটা জয়পুরহাট শহর, পুরা জেলাসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়লো।
জুঁই প্রথম ছবিটা দেখলো, তার এক ফ্রেন্ড ছবিটা ফেসবুকে শেয়ার করেছে। দেখে সে চিৎকার করে উঠলো, দাদি।
পাশের রুম থেকে ইভা দৌড়ে এলো। মোশা বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সে ফিরে এলো। ইভা জিজ্ঞেস করলো, কী হলো মা?
জুঁই তার ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখিয়ে বললো, মা দাদি নেই, বলে সে বিলোপ করে বলতে শুরু করলো, দাদি কাল আমাকে বললো গোধূলী দেখতে যাবে। জয় না কার সাথে নাকি দাদির এক সাথে গোধূলী দেখার কথা আছে। আমি যদি জানতাম সুযোগ পেলে সত্যি সত্যি দাদি একাই গোধূলী দেখতে যাবে আর সেটাই হবে দাদির জীবনের শেষ গোধূলী তবে… বলে জুঁই আবার বিলোপ করে কাঁদতে শুরু করলো।
সমপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*