ট্রেন টু ভিলেজ

ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রকি টনিকে বলল, এই টনি তুই এবার ভ্যাকেশনে কী কর্‌বি?

কী করব মানে?

রকি বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কী আইডিয়া?

এবার ভ্যাকেশনে আমি গ্রামে যাব।

টনি রকির কথা শুনে লাফিয়ে উঠল, ওয়াও গুড আইডিয়া। তোর মাথায় তো খুব ভালো একটা আইডিয়া এসেছে।

যাবি?

অফকোর্স কিন্তু কোন গ্রামে যাবি? গ্রামে তো আমাদের কোন রিলেটিভ নেই।

আমাদের আছে। তুই আমার সঙ্গে যাবি।

ওকে। তাহলে এক কাজ করি?

কী কাজ?

জেমসকে বলি?

বল।

জেমস একটু পিছিয়ে পড়েছিল। রকি আর টনি মাঠে দাঁড়াল। জেমস ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল। সে একটু সহজ-সরল প্রকৃতির। কোন কথা বুঝতে না পারলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে রকি আর টনিকে কথা বলতে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী করছিস তোরা?

কথাটা রকি জেমসকে বলল, এই জেমস শোন আমরা না গ্রামে যাব।

গ্রামে?

হ্যাঁ।

কেন?

গ্রাম দেখতে।

জেমস রকির মুখের দিকে এমনভাবে তাকালও যেন সে আকাশ থেকে পড়ল।

রকি কিছুটা ধমকের সুরে বলল, কী রে এমনভাবে তাকাচ্ছিস মনে হয় কথাটা বুঝতে পারিস নি?

তাইতো, আই ক্যান’ট আন্ডার স্ট্যান্ড গ্রামে দেখার কী আছে? বলে সে টনির দিকে তাকিয়ে বলল, এই টনি দেখতও রকি আমাকে কী বলছে। আই ক্যান’ট ইম্যাজিন গ্রামে দেখার কী আছে?

টনিও ধমক দিল, কী আছে মানে? গ্রাম দেখেছিস কোনোদিন?

না। তবে ছবিতে দেখেছি।

তো, না দেখেই বলছিস কেন যে গ্রামে কী দেখার আছে। তুই যাবি কী না বল?

যাব বাট ডেডিকে বলতে হবে। আচ্ছা কতক্ষণ সময় লাগবে যেতে আসতে। আই মিন আমি যদি স্কুলের কথা বলে যেতে পারতাম…

টনি এবার কিছুটা রেগে গেল, গ্রামে যাওয়া কী দু’য়েক ঘণ্টার ব্যাপার নাকি?

তো?

কয়েক দিনের জন্য।

ইম্পসিবল। ডেডি কোনোভাবেই এগ্রি করবে না।

রকি বলল, আগে বলে দেখ্‌, এগ্রি করতেও তো পারে। তাছাড়া ডেডই বলেছে একসময় সবার বাড়ি গ্রামেই ছিল। খুঁজে দেখলে দেখতে পাবি গ্রামে তোদেরও অনেক রিলেটিভ আছে।

জেমস আবারো রকির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করল, তা হতে পারে। মাম্মি একদিন বলছিল, গ্রামে নাকি আমাদের কে কে সব আছে।

টনি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুই যাবি?

ডেডই যদি পারমিশন দেয় তো অবশ্যই যাব।

ওকে।

জেমস আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?

টনি বলল, রকির সঙ্গে, ওর রিলেটিভের বাড়িতে।

তিনজনই হাঁটতে হাঁটতে মাঠের এক কোণের বেঞ্চে এসে বসল। তারপর জেমস জোরে চিৎকার করে বয়কে কোল্ড ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিল, এই পিচ্চি তিনটা ডিঙ্কস্‌ নিয়ে আয় তো।

বয় তিনটা এনার্জি ড্রিঙ্কস নিয়ে এল। তিনজনই পরস্পরের এনার্জি ড্রিঙ্কসের ক্যানের গায়ে গা ঠেকিয়ে বলল, চিয়ার্স।

তারপর টনি পাইপে একটা টান দিয়ে এক ঢোক ড্রিঙ্কস্‌ টেনে নিয়ে রকিকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ফ্রেন্ড এই থিমটা তোর মাথায় এল কীভাবে?

আগে থেকেই আমি যখন টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেটে গ্রামের ছবি দেখতাম তখন আমার গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা হতো। আমি মনে করতাম গ্রামে আমাদের কোন রিলেটিভ নেই। কিন্তু ক’দিন আগে আমাদের বাসায় আব্বুর এক তাহইতো ভাই এল।

টনি পাইপ থেকে মুখ তুলে বলল, তাহইতো ভাই কী রে?

রকি একটা মুচকি হাসি হাসল।

জেমস জিজ্ঞেস করল, তাইতো তাহইতো ভাই কী রে? তুই হাসছিস্‌ কেন?

আমি জানতাম তোরা এটা বুঝবি না।

টনি বলল, বল, প্লিজ!

রকি একটু ভাব নিল, সে তার কণ্ঠস্বর কৃত্রিম গম্ভীর করে বলল, বুঝবি না, তোরা বুঝবি নাতো, আমি আছি দেখে তোরা অনেককিছু জানতে পারিস, না হলে তোরা সব…মূর্খ হয়ে থাকতিস, তবে শোন।

টনি এবং জেমস দু’জনে রকির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

রকি বলতে শুরু করল, তাহইতো ভাই হল ডেডির যে সিস্টার আছে না, সেই সিস্টারের তো বিয়ে হয়েছে। সেই সিস্টারের ব্রাদার ইন ল।

দু’জনে মাথা নেড়ে জানাল তারা বুঝেছে।

জেসম বলল, গ্রামের মানুষ তোদের বাড়িতে এসেছিল! আর তোরা এ্যালাউ করলি! কেমন নোংরা, নোংরা না?

রকি কিছুটা ধমকের সুরে বলল, এই নোংরা কী রে?

টনি বলল, আমিও তো তাই জানি গ্রামের মানুষ সবসময় লুঙ্গি পরে থাকে, ময়লা কাপড়-চোপড় পরে থাকে। কথাবার্তায় কেমন ব্যাক ডেটেড, আনকালচারর্ড।

জেমসও টনির কথায় মাথা নেড়ে সায় জানাল।

রকি কিছুটা রেগে গেল, না, তোদের ধারণা ঠিক না। ডেডির সেই তাহইতো ভাই, মানে কাজিন তো এসেছিল ভালো কাপড়-চোপড় পরে, প্যান্ট-শার্ট পরে। তিনি নাকি স্কুলের ইংলিশ টিচার। আমার সঙ্গে তো ইংরেজি বাংলা মিশিয়েই কথা বলল।

জেমস বলল, তাই নাকি?

টনি বলল, ফুললি ইংলিশ বলতে পারবে না দেখে ইংলিশ বাংলা মিশিয়ে বলেছে।

রকি অস্বীকার করল, তোদের ধারণা ঠিক না। তিনি ভালো ইংলিশ জানেন।

জেমস বলল, তাই নাকি?

অফকোর্স। আর তার সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছিল ওর নাম তুলি। তুলিও খুব স্মার্ট মেয়ে।

টনি বলল, ও তাই বল। তুই তাহলে গ্রাম দেখতে যাবি না। আমরা যাব গ্রাম দেখতে আর তুই যাবি তুলিকে দেখতে। তারপর তুই তুলি দিয়ে ছবি আর্ট করে এক্সিবিশন কর্‌বি।

আরে না। তুলি তো এসেছিল একটা টি.ভি চ্যানেলে মিউজিক কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করতে।

টি.ভি চ্যানেলে? তাহলে তো তুলি সিঙ্গার।

ও খুব ভালো গান গায়। যেদিন কম্পিটিশন হয়েছিল সেদিন আমিও টি.ভি দেখেছি। তোরা তো দেশি চ্যানেল দেখিস না।

টনি আর জেমস পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে। টনি জেমসকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, আর তুই বুঝি দেখিস? সেদিন তুলির কম্পিটিশন ছিল তাই তুই দেশি টি.ভি’র চ্যানেল দেখেছিস।

জেমস তিরস্কারের সুরে বলল, তাই না রকি?

রকি আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, তা অবশ্য ঠিক। তবে সেদিনের পর থেকে আমি দেশি চ্যানেল দেখতে শুরু করেছি।

ড্রিঙ্কস শেষ হল। টনি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুই সিডিউল ঠিক কর, আমিও যাব।

জেমস বলল, ডেডই যদি আমাকে পারমিশন দেয় তো আমি যাব।

রকি বলল, ওকে তাহলে ডিসিশন ফাইনাল। আমরা যাচ্ছি।

 

দুই

 

জেমস বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। বাবা কামরান সাহেব বনেদি ব্যবসায়ী, পুরাণ ঢাকায় তাদের তিন পুরুষের বাস। এই তো ক’বছর আগেও তাদের সেই আমলের কারুকার্য খচিত পুরনো চুন-শুড়কির গাঁথুনি করা বাড়ি ছিল। তখন কামরান সাহেবের বাবা বেঁচে ছিলেন তিনি পূর্ব পুরুষের তৈরি বাড়ি ভেঙ্গে আধুনিক বাড়ি তৈরি করতে চান নি কিন্তু ক্রমেই সেই বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সম্প্রতি কামরান সাহেব নতুন বাড়ি করেছেন।

জেমসের মা জুলেখা তার বাবার মামাতো বোন। কামরান সাহেবের মা আর তার মামা তাদের ভাইবোনের সম্পর্ক আরও পাকাপোক্ত ও তাদের বিশাল বিষয়-সম্পত্তি মেয়ের মাধ্যমে অন্যের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে নিজেদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাই কারুকার্য খচিত বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি তৈরি করলেও এবং জেমস ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করার পরও বাড়ির সবার কথা বলার ভাষা পুরাণ ঢাকার স্থানীয় ভাষাই রয়ে গেছে।

জেমস আজ স্কুল থেকে এসে যখন তার মাকে বলল, মাম্মি আমি গ্রামে যাব।

জুলেখা প্রথমে এতোটাই অবাক হল যে সে বুঝতেই পারল না। সে কয়েক মুহূর্ত জেমসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, কী বললি? আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমি গ্রামে যাব।

তুই গ্রামে যাবি! গ্রামে আমাদের কে আছে, তুই কার কাছে যাবি? হঠাৎ গ্রামে কেন? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে করতে সে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

আমি, টনি আর রকি তিনজন যাব।

কেন?

বেড়াতে।

ঢাকা শহরে কি বেড়ানোর জায়গার অভাব হল? সদর ঘাট, আহসান মঞ্জিল, বলধা গার্ডেন আছে না?

না। আমি গ্রামে যাব।

আর একবারো বলবি না। তোর ডেডই শুনলে রাগ করবে।

করুক, আমি তবু ডেডিকে বলব।

কী, কী বললি? তবু তুই ডেডিকে বলবি? তবু তুই গ্রামে যাবি? বলতে বলতে জুলেখা জেমসকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

রাতে কামরান সাহেব বাসায় এলেন। জুলেখার দিকে তাকিয়েই যেন চমকে উঠলেন, জুলেখা কী হয়েছে তোমার?

জুলেখা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ওগো শুনছো তোমার ছেলে নাকি গ্রামে যাবে।

কামরান সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লেন, কী বললে?

আমাগো জেমস নাকি গ্রামে যাবে।

কেন? গ্রামে যাবে কেন?

বেড়াতে।

কই, ওরে ডাকোতো ভালো করে শুনি।

জেমস তার রুম থেকে বাবা-মা’র কথা শুনছিল। মা ডাকার আগেই সে তার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এল, ডেডই আমাকে ডেকেছ?

হ্যাঁ ডেকেছি। কী হয়েছে বলতো?

কিছু হয় নি তো। আমি গ্রামে বেড়াতে যাব, মাম্মিকে তাই বলেছি।

না, তোর গ্রামে যাওয়া হবে না।

কেন?

গ্রামের অবস্থা কী তুই জানিস। গ্রামে খুব ঠাণ্ডা, গাছ-গাছড়া, খাল-বিল, কাদার রাস্তা। এই যে আমরা ঢাকা শহরে থাকি কত আরাম। আমাদের যদি গরম লাগে তো এসি চালু করে দিই, যদি ঠাণ্ডা লাগে তো রুম হিটার চালু করি।

ওখানে নেই?

কামরান সাহেব কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বললেন, এসি! রুম হিটার!

হ্যাঁ।

ঐদিকে তো ইলেক্ট্রিসিটি-ই নেই। এসি, রুম হিটার তো পরের কথা।

তাহলে মানুষ গ্রামে থাকে কীভাবে?

কষ্ট করে, গরম লাগলে গাছের নিচে বসে থাকে, হাত পাখার বাতাস করে।

আর ঠাণ্ডা লাগলে?

খড়, গাছের পাতায় আগুন জ্বালিয়ে পাশে বসে থাকে।

জেমস কয়েক মুহূর্ত তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, খড় কী ডেডই?

খড় হল ধান গাছ থেকে ধান নেয়ার পর তার যে ডাল-পালা থাকে তাকে খড় বলে।

জুলেখা ডাইনিংয়ে খাবার দিতে দিতে ড্রয়িং রুমে এল, তুমি যাই বল আমি কিন্তু পোলাকে গেরামে যেতে দিব না।

কামরান সাহেব জেমসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জুলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, নাহ্‌, ও যাবে না।

জেমস জিদ ধরল, না আমি যাব।

জুলেখার চোখ দিয়ে পানি বের হল। সে জেমসের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, না, তুই যাবি না। আজ তোর সঙ্গে কথা বলার পর আমি সব হুনছি। গ্রামে সাপ আছে, পুকুর আছে। তুই আমাগো একমাত্র পোলা, তুই যদি গ্রামে যাস আর তোকে যদি সাপে কামড় দেয়, তুই যদি পুকুরে নামোস্‌ আর পুকুরে ডুবে যাস। তবে আমাদের কী হবে? তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না বাবা। তুই কোথাও যাবি না। শোনো জেমসের আব্বা তুমি কিন্তু ওকে যেতে দিও না।

কামরান সাহেব সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে জানালেন সে জেমসকে গ্রামে যেতে দিবে না।

আহো তোমরা ডাইনিংয়ে আহো। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব। বলেই জুলেখা দ্রুত বেগে ডাইনিংয়ে চলে গেল তারপর তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে তার বাবাকে ফোন করল, হ্যালো বাবা আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কী হয়েছে মা? তোর গলার স্বর এমন শুনাচ্ছে কেন?

বাবা তোমাকে এক বার আমাদের বাড়িতে আসতে হবে।

কবে?

কাল, সকালে।

কেন মা?

বাবা একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে।

এখনি বল মা।

না বাবা তুমি কাল আগে আহো।

জুলেখার বাবা কিছুটা অবাক হলেন, এখনি একটু বল মা। এমন কী হয়েছে যে তুই একেবারে…

জুলেখা আর কান্না ধরে রাখতে পারল না, বাবা তোমার নাতি বলছে ও নাকি গ্রামে যাবে।

ও, তাই তুমি কাঁদছ।

জুলেখা কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, বাবা, ও চলে গেলে আমি বাঁচব না বাবা। যদি ওর একটা কিছু হয়ে যায়…

আচ্ছা মা এখন তুই থাক কাল তো আমি আসছি। তারপর আমি না হয় জেমসকে বুঝিয়ে বলব।

তোমাকে ও খুব পছন্দ করে বাবা, তুমি বুঝিয়ে বললে ও যাবে না।

আচ্ছা।

 

তিন

 

প্রতিদিন সকালবেলা মনিরা টনিকে নিয়ে স্কুলে যায়, যতক্ষণ ক্লাস চলে ততক্ষণ সেও স্কুলের ক্যাফেটেরিয়া, ওয়েটিং রুমে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেয়।

কয়েক দিন আগে মনিরার পরিচয় হয়েছে আদিত্যর সঙ্গে। আদিত্যর মেয়ে তিথি আর আর টনি একসঙ্গে লেখাপড়া করে। তিথির মা’র সঙ্গেও মনিরার পরিচয় আছে। ভদ্রমহিলা সরকারি চাকরি করে। আগে প্রতিদিন তিথিকে তার মা-ই নামিয়ে দিতে আসতো কিন্তু কয়েক দিন থেকে তিথি একাই স্কুলে আসছে আবার মাঝে মাঝে আদিত্যও তিথিকে নামিয়ে দিতে আসে।

সেদিন মনিরা টনিকে ক্লাসে পাঠিয়ে দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় দিকে যাচ্ছিল। পথে আদিত্যর সঙ্গে দেখা। আদিত্যই প্রথম কথা বলল, হাই ম্যাডাম।

মনিরা বলল, হাই।

কেমন আছেন?

ভালো। আপনি?

ভালো। টনি কেমন লেখাপড়া করছে?

ভালো কিন্তু তিথির মতো না। আপনার মেয়ে তো জিনিয়াস।

এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? চলুন ক্যাফেটেরিয়ায়…

হ্যাঁ চলুন।

দু’জনে ক্যাফেটেরিয়ায় বসল।

আদিত্য জিজ্ঞেস করল, কী খাবেন, বলুন?

আপনার যা ইচ্ছা।

আপনি বলুন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি মেয়েদের ওপর নির্ভর করি।

তারমানে এটা মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার, আর অন্য সব ব্যাপারে মেয়েদের কোন গুরুত্ব নেই, না?

সরি। আসলে আমি এভাবে বলতে চাই নি। মানে আমি বলছিলাম কী খাব সেটা আপনি বলুন। আই ডিজলাইক টু বারগেইনিং।

মনিরা হেসে ফেলল।

হাসছেন কেন?

আপনি তো দেখছি খুব সহজে মেনে নেন। ভেরি গুড, এটা আমার খুব পছন্দ। এ্যানিওয়ে আমি কফি খাব। আপনি?

কফি।

ওকে। বলে আদিত্য কফির অর্ডার দিল।

মনিরা বলল, ক’দিন থেকে ভাবীকে দেখছি না।

ওর একটু সমস্যা হয়েছে।

মানে? কোন অসুখ?

ওতো গভ:মেন্ট জব করে। আগে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ওর অফিসের রাস্তায় পড়তো তাই ও দিয়ে যেতো, এখন বদলি হয়ে গেছে। তাই এখন আমি আসছি।

আর আপনি?

আমি একটা কোম্পানিতে জব করি। যেদিন আমার ইভিনিং ডিউটি পড়ে সেদিন আমি তিথিকে নিয়ে আসি আর কখনো কখনো তো ও একাই আসে।

কফি চলে এল।

আদিত্য হাত দিয়ে ইশারা করে বলল, নিন প্লিজ!

মনিরা কফি নিল।

আদিত্য কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার হ্যাজবেন্ড কী করেন?

মনিরার মুখের ওপর একটা কাল মেঘ ঢেকে গেল। সে প্রথমে কোন কথা বলল না।

আদিত্য তার কথা ফিরিয়ে নিল, সরি। আপনার আপত্তি থাকলে থাক বলতে হবে না।

না। আপত্তি নেই। ও দেশের বাইরে থাকে।

জব করে?

হ্যাঁ।

কোন দেশে?

দুবাই।

ভালোত্বও।

মনিরা মৃদু কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ ভালোই।

 

টনির বাবা দেশের বাইরে থাকে। বছরে একবার এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসে আর বছরে একবার বা দু’বার টনি তার মা-সহ বাবার কাছে বেড়াতে যায়। মা মনিরা বেগম গৃহিণী। মনিরা বেগম, টনি আর বাসায় কাজের মেয়ে পারুল এই তিনজনের সংসার তাদের।

টনির বাবা ফারুক সাহেবের ছুটি এক মাস পিছিয়েছে শুনে মনিরার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। সেদিন পরিচয় হওয়ার পর আদিত্যর সঙ্গে মনিরার আরও একদিন কথা হয়েছে। কিন্তু আজ দু’দিন থেকে মনির আদিত্যকে মনে মনে খুঁজল কিন্তু চোখে পড়ল না।

আদিত্য এল কয়েক দিন পর। মনিরা আদিত্যকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এল। আদিত্য মনিরাকে দেখেই বলল, হাই ম্যাডাম। কেমন আছেন?

মনিরা শুষ্ক কণ্ঠে বলল, আমার কথা থাক, আপনি ভালো আছেন তো?

থাকবে কেন? কী হয়েছে আপনার?

মনিরা কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, বললাম তো আমার কথা থাক। আপনি ভালো থাকলেই সব ভালো।

এ্যানিথিং রং।

না। কোন রং নয়। অল ওকে। কী হয়েছিল আপনার?

কিছু হয় নি তো।

স্কুলে এলেন না যে।

পর পর কয়েক দিন মর্নিং ডিউটি পড়েছিল তখন তিথি একা আসতে শুরু করল, তাই আমি আর এলাম না। আপনার মুড অফ কেন? কী হয়েছে?

না। এমনিতেই।

আদিত্য একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কেবল তো ক্লাস শুরু হল, চলুন না বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।

কোথায়?

বাইরে, কোন রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাব।

মনিরা মাথা দুলিয়ে সায় দিল। তারপর দু’জনে স্কুল থেকে বের হল।

দিনে দিনে মনিরার সঙ্গে আদিত্যর একটা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আজকাল একটু সময় পেলেই মনিরা আদিত্যকে ফোন করে। তাদের দু’জনের সম্পর্কের বিষয়টি এখন তিথি আর টনির মধ্যেও গোপন নেই। তারা দু’জনে শৈশব থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, বিদেশি সংস্কৃতিতে লেখাপড়া করছে। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ইংরেজিতে কথা বলে। অনেক গার্জিয়ানও ইংরেজিতে কথা বলে। তাদের চালচলনও বদলে গেছে। কোন কোন ছাত্র-ছাত্রীর মা প্যান্ট-শার্ট পরে স্কুলে আসে। তারপরও কেউ কিছু বলে না। এখানে পাছে লোকে কিছু বলে কোন কথা নেই। তাদের স্কুল ক্যাম্পাস যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছোট্ট একটি ইউরোপ। ক্যাম্পাসের ভিতরে তারা সবাই যেন ইউরোপিয়ান। তাই বাবা-মা’র বন্ধুত্বের বিষয়টিকে তারা বন্ধুত্ব হিসেবেই গ্রহণ করেছে। আদিত্য আর মনিরা অবশ্য সেরকম না। তাদের মধ্যে এখনো অনেকটা বাঙালি-পনা রয়েই গেছে।

আজ আদিত্য স্কুল আসে নি। আজকাল যেদিন আদিত্য আসে না সেদিন তার স্কুল সময়টা কষ্টেই কাটে। বেশিরভাগ গার্জিয়ান অনেক বেশি আধুনিক। মনিরা এখনো তাদের মতো আধুনিক হতে পারে নি। সে তখন একা একটা চেয়ারে বসেছিল। স্কুল ছুটির পর টনি আর তিথি বেরিয়ে এল। মনিরাকে একা চেয়ারে বসে থাকতে টনি জিজ্ঞেস করল, হাই মাম্মি! আজ তোমার ফ্রেন্ড আসে নি?

টনির প্রশ্নের উত্তর দিল তিথি, ডেডির তো আজ মর্নিং ডিউটি।

আজ স্কুল ছুটির পর টনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতেই যখন বলল, মাম্মি আমি গ্রামে যাব। তখন মনিরা যেন চমকে উঠল, তুই গ্রামে যাবি? কার সাথে?

আমার ফ্রেন্ডরা যাবে।

ফ্রেন্ডরা মানে? স্কুল থেকে?

না। আমি, রকি আর জেমস।

হঠাৎ করে গ্রামে যাবি কেন?

সবাই যাবে তাই আমিও যাব, বলে টনি কয়েক মুহূর্ত তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বায়নার সুরে বলল, কী যেতে দিবে না? ডেডির আসাতো পিছাল।

কিন্তু ডেডই কি তোকে যেতে দিবে?

ডেডিকে আমি ম্যানেজ করব।

আমার কোন আপত্তি নেই তোর ডেডিকে যদি ম্যানেজ করতে পারিস তো যাবি।

ওকে, ডেডই তো আমাকে পারমিশন দিবেই। সো থ্যাঙ্ক ইউ মাই মাম্মি।

 

চার

 

মনিরা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, একটা কথা শুনেছেন?

কী কথা?

টনিরা যে গ্রামে যাবে।

তাই নাকি? শুনি নি তো। কে কে যাবে?

জেমস, রকি আর টনি।

কবে?

এইতো পুজোর ছুটিতে যাবে মনে হয়।

টনির বাবা নাকি আসছে?

হ্যাঁ আসার কথা তো ছিল কিন্তু এক মাস পিছিয়েছে। সেজন্যই তো ছেলেটা যাওয়ার জন্য অসি’র হয়ে উঠেছে। আসলে কোথাও যাওয়া হয় না তো। স্কুল আর বাসা, বাসা আর স্কুল করে করে বাচ্চারা হাঁপিয়ে উঠেছে।

এক্সাক্টলি।

 

রকি, জেমস আর টনি টিফিন পিরিয়ডে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। টনি রকিকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গ্রামে যাওয়ার কী হল ফ্রেন্ড?

রকি জেমসকে জিজ্ঞেস করল, জেমস তুই যাবি? তুই তো আবার হাই ব্রিড।

জেমস রকির মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, এই রকি তুই আমাকে হাই ব্রিড বললি?

হ্যাঁ তোকেই বললাম। তোর তো আবার কথাও যেতে গেলে পারমিশন নিতে হবে। তুই কি পারমিশন পেয়েছিস?

জেমস আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, না রে, মাম্মি খুব কান্নাকাটি করছে। আমাকে যেতে দিবে না।

রকি জিজ্ঞেস করল, টনি?

আই হ্যাভ নো প্রব্লেম, তোর?

আমারো কোন প্রব্লেম নেই। বাবা পারমিশন দিয়েছে। বাবার তো গ্রামের প্রতি খুব টান এখনো। কিন্তু…

টনি রকির কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, তবে আর কিন্তু কেন?

আরে আমার সিস্টার আছে না, মানে আমার এক ঘণ্টার ছোটো বোন।

টনি আর জেমস দু’জনে আগ্রহ সহকারে রকির মুখের দিকে তাকালও। টনি জিজ্ঞেস করল, কী করেছে ও?

ও যাবে।

টনি বলল, যাবে। প্রব্লেম কী?

ডেডই-মাম্মি কেউ যেতে দিবে না।

জেমস খুব সহজ-সরল প্রকৃতির, বুদ্ধিমত্তাতে সে অনেকটা পিছিয়ে। কোন কথা বুঝতে তার একটু বেশি সময় লাগে। সে রকি আর টনির মুখের দিকে তাকিয়ে কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কেন? ও তোদের সঙ্গে গেলে তো ভালোই হবে।

রকি কিছুটা ধমকের সুরে বলল, বুঝিস না বেটা, আমরা দু’জন ছেলের সঙ্গে ও একা একটা মেয়ে কেন যাবে?

জেমস বলল, দু’জন বয় আর একজন গার্ল গেলে বুঝি গার্ল একা হয়। সি অলসো ম্যা বি ইওর ফ্রেন্ড।

টনি বলল, জেমস ঠিকই বলেছে, সেও আমাদের ফ্রেন্ড হতে পারে।

দূর থেকে তিথি আসছে। তার হাঁটার ধরণটা অনেকটা স্টাইলিস্ট। তাকে দেখে রকির মুখ অনেকটা উজ্জ্বল হল, তবে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কী আইডিয়া? তুই তো আবার আইডিয়ালিস্ট টনি বলল।

যদি আমাদের সঙ্গে তিথি যায়।

টনি জিজ্ঞেস করল, তাতে কি প্রব্লেম সলভ হল?

রকি বলল, মাম্মিকে তিথির কথা বললে রিতুকে যেতে দিতে পারে। তাছাড়া ডেডির খুব একটা আপত্তি নেই।

টনি রকিকে বলল, তিথিকে বলে দেখ্‌।

আমি?

হ্যাঁ।

টনি একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, কেন? বলতে পারবি না কেন? ওতো আবার তোর…

আমার কী রে। ও তোরও ফ্রেন্ড, আমারো ফ্রেন্ড।

টনি বলল, তারপরও তোর সঙ্গে একটা ব্যাপার আছে না, তোর তো আবার অন্যরকম ফ্রেন্ড।

দু’জনে কথা বলতে বলতে তিথি কাছাকাছি চলে এল।

ওকে আমি বলছি। উই আর অলসো ফ্রেন্ড। সো আমি বলছি আই হ্যাভ নো হ্যাজিটেশন।

তিথি জেমসের কথা শুনে ফেলেছে, কী রে, কীসের হ্যাজিটেশনের কথা হচ্ছে?

জেমস বলল, তিথি টনি আর রকি গ্রামে যাচ্ছে।

গ্রামে? গ্রামে কেন?

টনি বলল, বেড়াতে। আমরা কখনো গ্রাম দেখিনিতো তাই। অবশ্য আইডিয়াটা এসেছে আইডিয়ালিস্ট রকির কাছ থেকে। রকির আরও একটা আইডিয়া আছে। সেটাতে অবশ্য তোর হেল্প লাগবে।

জেমস তিথিকে জিজ্ঞেস করল, তুই যাবি?

তিথি নিজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, আমি! অফকোর্স। তোরা গেলে আমি যাব না! বলে তিথি টনিকে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হেল্প রে?

এটাই।

এটাই মানে কী?

মানে রকির ইওঙ্গার সিস্টার যেতে চায় কিন্তু…

টনি রকির কথার মাঝে বলতে শুরু করল, কিন্তু মেয়ে বলে ডেডই-মাম্মি ওকে যেতে দিবে না। তাই তুই সঙ্গে গেলে ও যেতে পারবে। অবশ্য তোরও যাওয়াটা সহজ হবে।

সহজ আর কঠিন বলে কোন কথা না দোস্ত, তোরা গেলে আমিও যাব এটা ফাইনাল। এই তোর ডেডই-মাম্মি কেমন রে মেয়ে বলে ওকে যেতে দিবে না। এগুলো ব্যাক ডেটেড কালচার।

রকি বলল, ওকে তুই তাহলে যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে।

ওকে। ফাইনাল।

টনি জিজ্ঞেস করল, তোকে আবার যেতে দিবে তো?

তিথি আবেগ প্রবণ মেয়ে। তাকে যেতে দিবে কী না এ প্রশ্ন করায় সে প্রচণ্ড রেগে গেল। তার ফর্সা মুখ যেন মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে গেল।

টনি একটা ঢোক গিলে বলল, না মানে তোকে আবার যেতে দিবে তো? আফটার অল তুমিও তো একটা মেয়ে।

রেগে তিথির পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল, স্টপ। আমাকে কখনো মেয়ে বলবি না, নট গার্ল, নট বয় আই এ্যাম ম্যান। আমার ডেডই-মাম্মি কখনো আমাকে সেভাবে মিন করে না। তুই আর কখনো আমাকে সেভাবে মিন কর্‌বি না।

রকি তিথিকে শান্ত করার চেষ্টা করল, তিথি প্লিজ ওকে মাফ করে দে। টনি কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেছে। বলে টনিকে বলল, এই টনি সরি বল, সরি বল।

টনি সরি বলল।

তিথি যেমন তাড়াতাড়ি রেগে যায় তেমনি তাড়াতাড়ি তার রাগ থেমেও যায়। বেশি রাগি মানুষ এমনই হয়। খুব তাড়াতাড়ি রেগে যায় আবার তাড়াতাড়ি থেমেও যায়। বেশি রাগি মানুষ রাগ ধরে রেখে মনে মনে গুমরে ওঠে না। আর কম রাগি মানুষ রাগ ধরে রেখে গুমরে গুমরে উঠে, বুদ্ধি পাকায় কীভাবে তার রাগের প্রতিশোধ নিবে।

তিথি বলল, ওকে। তাহলে আমরা কে কে যাচ্ছি?

রকি বলল, আমি, টনি, রিতু আর তুই।

তিথি জেমসকে জিজ্ঞেস করল, তুই যাবি না?

জেমস না সূচক মাথা নাড়ল।

তিথি তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাঁচের চূড়ি বের করে জেমসের হাত ধরে বলল, তোকে পরিয়ে দিই। রিতু, আমি মেয়ে না, তুই মেয়ে। মেয়ে আর ছেলে শুধু জেন্ডারের ব্যাপার না, সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। তুই সাইকোলজিক্যালি মেয়ে এগুলো তোর পরা দরকার।

জেমস অসহায়ের মতো বলল, মাম্মি খুব কান্নাকাটি করছে রে।

তিথি নিজের বুকের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, দেখিস আমি যেতে চেয়েছি না। ঠিকই যাব।

রকি বলল, ওকে, বাদ দে।

তিথি বলল, তাহলে আমরা যাচ্ছি কবে?

রকি বলল, সানডে থেকে ছুটি না, তাহলে আমরা ফ্রাইডেতে স্টার্ট করব।

ওকে।

 

পাঁচ

 

স্কুল থেকে ফেরার পথে তিথি তার বাবাকে প্রথম বলল। তার কথা বলার ধরনে কিছুটা আবদারের সুর, ডেডই!

হ্যাঁ মা, বল।

আমার ফ্রেন্ডরা সবাই গ্রামে যাচ্ছে তুমি কি জানো?

আমি কীভাবে জানব তোদের ফ্রেন্ডদের ব্যাপার? তবে শুনেছি।

তোমার ফ্রেন্ডের কাছে? বলে তিথি একটা মুচকি হাসি হাসল।

আমার ফ্রেন্ড! আদিত্য কিছুটা লজ্জায় পেল।

তিথি আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ডেডই লজ্জা পাচ্ছ কেন? তোমার তো কোন ফ্রেন্ড থাকতেই পারে, নাকি?

পারে তবে তোর মা জানলে…

মা জানবে কেন, সবার একটা প্রাইভেসি আছে না। তোমার একজন ফ্রেন্ড থাকবে আর সেটা যদি মাম্মি জেনে জেলাস ফিল করে তবে তুমি মাম্মিকে জানাবে না।

আদিত্য তিথির মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তারপর বলল, তুই বলবি নাতো?

ইমপেসিবল।

থ্যাঙ্ক ইউ মাই চাইল্ড।

কিছুক্ষণ বাবা মেয়ের মধ্যে কোন কথা নেই। সি.এন.জি বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। দু’জনে গাড়ি থেকে নেমে লিফটে উঠল। লিফটে বাবা আর মেয়ে তিথি লিফটেই আদিত্যকে বলল, ডেডই আমিও যাব।

কোথায়?

গ্রামে।

ওরা না শুধু দু’জন ছেলে যাবে।

যদি আমি যেতে চাই তবে রিতুও যাবে।

রিতু কে?

রকির সিস্টার।

তা হল কিন্তু ওরা তো ভাই-বোন। ওরা আর তুই তো এক হলি না। যাওয়া ঠিক হবে না।

কেন? ঠিক হবে না কেন?

রকি আর রিতু ভাইবোন, ওদের একসঙ্গে যাওয়া আর তুই ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়া এক হল না রে মা।

তিথি তার বাবার কথা শুনে অভিমানে লাল হয়ে গেল, ডেডই তুমিও!

আমি কী রে মা?

তুমি না সবসময় বল, ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে কোন তফাত নেই। ওরা আমার ফ্রেন্ড। আমরা তো কখনো নিজেদের ছেলে বা মেয়ে ভাবি না ডেডই।

আগে ভাবিস নি কিন্তু এখন ভাবতে হবে রে মা।

বাবা-মেয়ে লিফট থেকে নেমে বাসায় ঢুকল। তিথি আদিত্যর একটা হাত নিজের মধ্যে নিয়ে তার বাবার কাঁধের ওপর কিছুটা ঝুঁকে পড়ল, ডেডই আমি যাব। তুমি না করবে না।

আদিত্য তিথির মুখের দিকে তাকালও। তিথি চোখে-মুখে জিদ ফুটে উঠেছে। আদিত্য তিথির এই অভিমানের অর্থ বোঝে, তিথি একবার যেটা করতে চায় সেটা থেকে আর পিছু হটে না।

তিথি রুমানা-আদিত্যর একমাত্র সন্তান। জন্মের পর থেকে তারা তাকে অত্যন্ত আদর যত্নে লালন-পালন করেছে। আর সে কারণে মাত্রাতিরিক্ত আদর পেয়ে পেয়ে মেয়েটি আরও বেশি জেদি হয়েছে। আদিত্য জানে এখনো তিথি আবদারের সুরে বললেও তা মুহূর্তে জিদে পরিণত হবে। সে সোফায় বসতে বসতে বলল, তাহলে তোর মা আসুক তারপর কাউন্সিলিং হবে।

কিন্তু তুমি তো রাতে থাকবে না।

আগামীকাল তো আমার মর্নিং ডিউটি। বিকেলে একসঙ্গে নাস্তা করব। তখন কাউন্সিলিং হবে।

ডেডই আমি কিন্তু তোমাকে বলে রাখছি, আমি যাব দ্যট ইজ ফাইনাল।

তিথির চোখে-মুখ লাল হয়ে গেছে দেখে আদিত্য তাকে সহজ করার জন্য বলল, এখনি ফাইনাল করিস না, বরং এটাকে সেমি ফাইনাল বলতে পারিস। বলে আদিত্য হেসে উঠল।

 

পরদিন বিকেলে নাস্তার টেবিলেই কাউন্সিলিং শুরু হল। তিথি প্রথমে বায়নার সুরেই বলল, মাম্মি।

রুমানা তিথি মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে?

মাম্মি তোমাকে একটা কথা বলব?

সেতো তোর কথার সুর শুনেই বুঝতে পাচ্ছি। বলে ফেল?

মাম্মি আমি গ্রামে যাব।

রুমানা এমনভাবে তিথির মুখের দিকে তাকালও যেন সে এরকম কথা জীবনে কোনোদিন শুনে নি। সে কয়েক মুহূর্ত তিথির মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল।

তিথি আবার বলল, মাম্মি।

কী বললি যেন?

আমি গ্রামে যাব।

গ্রামে? কেন?

বেড়াতে, গ্রাম দেখতে।

আচ্ছা। আগামীকাল তো আমার অফিস বন্ধ আছে। চল তোকে নিয়ে আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ ঘুরে আসি।

মাম্মি তুমি বুঝতে পারো নি।

মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন? রুমানার গলার স্বর কিছুটা ঝাঁঝাল।

থাক। আর বলব না।

তাহলে থাক আর বলতে হবে না।

কিন্তু আমাকে যে বলতেই হবে।

তাহলে বলে ফেল।

মানে আমার ফ্রেন্ডরা গ্রামে বেড়াতে যাবে।

ফ্রেন্ডরা মানে, স্কুল থেকে?

না। আমার ফ্রেন্ড রকি আর টনি গ্রামে বেড়াতে যাবে।

যাবে। ওরা দু’জন ফ্রেন্ড গ্রামে যাবে তো যাবে।

তিথি আবদারের সুরে বলল, মাম্মি আমিও যাব।

রুমানা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রেগে গেল, ওরা দু’ফ্রেন্ড তো ছেলে, ওদের সঙ্গে তুই যাবি?

তিথি বলল, মাম্মি ওদের সাথে রকির বোন রিতু যাবে।

যাবে। রিতু রকির বোন, ও যেতে পারে। তুই তো আর তোর ভাই’র সঙ্গে যাচ্ছিস না।

মাম্মি প্লিজ! প্রব্লেম কী? ওরা তো আমার ফ্রেন্ড।

ফ্রেন্ড হোক, ছেলে তো।

মাম্মি বিলিভ দেম, ওরা সেরকম ছেলেই না। ওরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

তিথি অন্যায় আবদার কর্‌বি না, বলে সে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, এই জন্য তোর বাবাকে বলেছিলাম মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার দরকার নেই। এখন বোঝো।

তিথি রেগে গেল, আমার স্কুল কী দোষ করল মাম্মি?

তোর স্কুল কী দোষ করল মানে? তুই কি বুঝতে পারছিস, তুই কী কথা বলছিস, ছেলে আর মেয়ে কখনো কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া যায়? ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের স্টুডেন্ট না হয়ে আমাদের দেশের কোন গভ:মেন্ট বা নন-গভ:মেন্ট স্কুলের স্টুডেন্ট হলে সে এরকম চিন্তাই করতে পারতো না, বলে রুমানা আদিত্যকে বলল, তুমি কোন কথা বলছ না কেন? মেয়েকে বোঝাও। বাপ মেয়ে তো দেখি খুব মিল।

আদিত্য কিছু বলল না।

মাম্মি তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তো আর একাই যাচ্ছি না। রিতুও যাচ্ছে।

এবার রোমান রাগান্বিত স্বরে বলল, তিথি তোকে আমি একবারই বলেছি অন্যায় আবদার নিয়ে আস্‌বি না।

তিথিও রেগে গেল, আসলে তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে।

রুমানা অবাক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, না বলে তুই কী করতিস? আমাদের না জানিয়েই চলে যেতিস? এতো বড় সাহস তোর।

দেখো মাম্মি আমি কিন্তু অন্যায় আবদার করি নি। রিতু না গেলে আমিও যেতে চাইতাম না।

কিন্তু বিষয়টা যদি এমন হয় যে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ওরা রিতুকে সাজিয়েছে।

এখানে সাজানোর কী আছে? ওরা যাচ্ছে, ওদের সঙ্গে একজন ফ্রেন্ডের বোন যাচ্ছে। ও তো দু’জনেরই বোন হতে পারে।

দেখ্‌ তিথি আমি তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। আমি শুধু জানি তুই যাবি না। একটা কথা মনে রাখিস ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হয় না।

তুমি ঠিক বলছ না মাম্মি। ফ্রেন্ড ফ্রেন্ডই। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক।

সেজন্য তো দেখছি ছেলেমেয়ে বন্ধুত্বের নামে আজকাল কত কী ঘটছে। আমি চাই না আমার মেয়ে হয়ে তোর নামে কোন কেলেঙ্কারি হোক। সো তুই যাবি না এটাই ফাইনাল।

 

ছয়

 

তিথির মন ভালো নেই। সে রাতে ভাত খেল না, রুমানা ভাত খাওয়ার জন্য দু’য়েকবার বলল কিন্তু তিথি ভাত খেল না। রাতে সে আর পড়ার টেবিলেই বসল না, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। আদিত্য তিথির ঘরে গিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে দেখে বলল, না কিচ্ছু হয় নি। ডিনার কর্‌বি না?

তিথি রাগে ফোঁস করে উঠল, না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।

ডিনার কর্‌বি না?

বললাম তো, না, প্লিজ তুমি এখান থেকে যাও। ডন্ট ডিস্টার্ব মি প্লিজ।

আদিত্য তিথির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, মায়ের রাগ পেয়েছিস। একবার যা বলবি তাই কর্‌বি। এতো বড় রাত না খেয়ে থাকলে…বলতে বলতে আদিত্য তিথির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রুমানা আদিত্যর কথা শুনতে পেয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, আমার কথা কী বললে তুমি?

আদিত্য থমকে গেল, তোমার কথা! না, তোমার কথা কিছু বলি নি তো। আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তোমাকে নিয়ে আমি কোন কমেন্টস্‌ করব!

পারো না, না? সুযোগ পেলে তো সবকিছুই বল। আচ্ছা তোমাকে আমি একটা কথা বলব?

বল। একটা না, হাজারটা বল, তোমার কথা শুনতে আমার একবিন্দুও আপত্তি নেই।

আদিত্য ভেবেছিল তার কথা শুনে রুমানা হেসে ফেলবে কিন্তু রুমানা হাসল না। সে আবার রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, মেয়েটা কি আমার একার?

মোটেই না।

তবে মেয়ে তার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে এটা আমাকে একা নিষেধ করতে হবে কেন? তোমার কি কোন দায়িত্ব নেই? ওখানে মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়?

আমি কি তোমাকে একবারও বলেছি ওকে যেতে দাও।

বল নি কিন্তু আমি যেভাবে নিষেধ করেছি সেভাবে নিষেধও করো নি। শাসন না করে না করে মেয়েটা মাথায় উঠেছে। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি দু’জন ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যাবে একথা বলার সাহস সে পেল কীভাবে।

তোমার কি ধারণা আমি ওকে সাহস দিয়েছি?

বলছি তো তা দাও নি কিন্তু যেভাবে ওকে শাসন করার কথা ছিল সেভাবে শাসন করো নি। আমি তোমার চালাকি বুঝি, তুমি মেয়ের কাছে ফেরেশতা হয়ে থাকতে চাও। মেয়ের যত রাগ আমার ওপরই হোক।

কী করব বল। এই দু’বছর আগেও মেয়েটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। এখনো সকাল বিকাল ও সবকিছু আমার সঙ্গেই শেয়ার করে। ওকে যদি আমি না বলি আর ও যদি মন খারাপ করে তবে আমিও খুব কষ্ট পাব, বলতে বলতে আদিত্যর কণ্ঠস্বর বুজে এল।

 

পরদিন সকালবেলাও তিথি নাস্তা না খেয়েই স্কুল চলে গেল। রুমানা কয়েক বার বলল, আদিত্য হাত ধরে নাস্তার টেবিলে বসানোর চেষ্টা করল কিন্তু তিথি কারো কথাই শুনল না। পর পর কয়েকটা ক্লাসের পর বিরতি। বিরতির সময় আদিত্য স্কুলের ক্যান্টিনে তিথিকে নাস্তা খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তিথি আদিত্যর কথাও শুনল না।

টনি, রকি আর জেমস একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। তিথি কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে হেলে-দুলে এল, রকি জিজ্ঞেস করল, হাই ফ্রেন্ড। হোয়াট ইজ ইওর কন্ডিশন?

নাথিং। দ্যা কন্ডিশন ইজ ভেরি বেড।

তোকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। এ্যানি প্রব্লেম?

তিথি মাথা নেড়ে জানাল, প্রব্লেম।

জেমস কিছুটা অবাক হয়ে বলল, তোর প্রব্লেম?

টনি সামনে এগিয়ে এল, কী প্রব্লেম আমাদের বল? উই আর অলসো ইওর ফ্রেন্ড।

তিথি বলল, বাট প্রব্লেমটাও তোদের নিয়েই।

তিনজনই যেন আকাশ থেকে পড়ল, আমাদের নিয়ে।

ইয়েস। তোরা ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে আমার তোদের সঙ্গে গ্রামে যাওয়া হতো। কিন্তু মাম্মি ছেলেদের সঙ্গে আমাকে গ্রামে যেতে দিবে না।

রকি বলল, কেন তুই রিতুর কথা বলিস নি?

বলেছি। তোরা ভাই-বোন একসঙ্গে যাবি, আমি তো আর তোদের বোন না।

সবাই কিছুটা নিরাশ হল। রকি বলল, তাহলে-

তিথি বলল, আমি এখনো ট্রাই করছি। আই হোপ আই উইল সাকসেস।

কীভাবে? জেমস জিজ্ঞেস করল।

একরাত না খেয়েই তিথির মুখটা শুকিয়ে গেছে। কণ্ঠস্বর বদলে গেছে সে শুষ্ক কণ্ঠে বলল, হ্যাঙ্গার স্ট্রাইক।

রকি বলল, ও সেজন্য তোর এই অবস্থা।

জেমস বলল, নো নো ফ্রেন্ড, এটা তোর ঠিক হয় নি। তোর চেহারাটা একেবারে…

তিথি বলল, ওয়াও। জেমসের দেখি আমার জন্য খুব সেমপ্যাথি হচ্ছে।

হবে না। ফ্রেন্ডের জন্য ফ্রেন্ডের তো সেমপ্যাথি হবেই। বলে সে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে তিথিকে জিজ্ঞেস, তোর ডেডই স্কুলে এসেছে?

তিথি হাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

কোথায়?

ক্যান্টিনে।

তাহলে তো ক্যান্টিনে গিয়ে তোকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। তুই ক্লাসে যা আমি তোর জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে আসছি।

তিথির পেট তখন খিদে চোঁ চোঁ করছে। তার মনে হচ্ছে এখনই ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেয়ে অন্তত: পেটের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে।

তিথি টনি আর রকির দিকে তাকালও। রকি বলল, তুই ক্লাসে যা।

তিথি বলল, তুই না একটা মেকানিজম করতে চাইলি।

সেজন্যই তো রিতুকে নিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু তাতেও তো কোন কাজ হল না। তুই তোর চেষ্টা চালিয়ে যা। আমি দেখছি আবার কোন মেকানিজম করা যায় কী না।

প্লিজ ফ্রেন্ড, আই উড লাইক টু গো উইথ ইউ।

তিথি চলে গেল।

টনি বলল, তিথি কেন আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য এডামেন্ট হয়ে গেছে জানিস?

রকি বলল, গ্রাম দেখতে যাবে তাই।

সেটা তো ঠিক আছে। আরও একটা কারণ আছে।

কী বলতো?

ওর মাথায় ঢুকেছে। গ্রাম থেকে তোদের বাড়িতে তুলি নামে একটা মেয়ে এসেছিল আর আমরা সেই তুলিদের বাড়িতেই যাচ্ছি। মেয়েদের খুব জেলাসি।

রকি একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, জেলাসি শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও। তিথি যখন আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল তখন কি তুই কম করেছিস।

টনি কিছুটা লজ্জা পেল।

সাত

 

টনি তুলির কথা বলতেই রকির মনে পড়ল তুলির তাদের বাসায় আসার দিনের কথা। সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল। তুলি আর তার বাবা রইসের বাসায় গিয়ে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা। কলিং বেলে টিপ দিতেই রইস দরজা খুলে দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কী রে ভালো আছিস?

হ্যাঁ ভালো।

তোর আসতে কোন কষ্ট হয় নি তো?

না।

কথা বলতে বলতে রইস হারুন আর তুলিকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর লোপা তার রুম থেকে বেরিয়ে এল, বাড়িতে গেস্ট এসেছে দেখে রকি, রিতুও ড্রয়িং রুমে এল।

রইস হারুনের সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করে দিল, লোপা এ হচ্ছে হারুন, আমার তাহইতো ভাই, তোমাকে তো ওদের কথা আগেই বলেছি। আর বলে সে তুলির দিকে মুখ করে তাকাতেই হরুন বলল, আমার মেয়ে তুলি।

তুলি সবাইকে সালাম দিল।

রইস এবার লোপার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, হারুন, বুঝতেই পাচ্ছিস তোর ভাবী বলে রকির দিকে তাকাতেই সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হাই, আমি রকি।

তুলি হাত বাড়াল না, সে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বলল, আমি তুলি, ক্লাস নাইনে পড়ি।

রকি মুখ কাল করল।

রিতু তার পরিচয় দিল।

সেদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে তুলির সঙ্গে রকি আর রিতুর দু’য়েক কথা হল। পরদিনও স্কুল বন্ধ ছিল। সকালবেলা নাস্তার পর রইস আর হারুন চলে গেল বাজার করতে। রকি তার রুমে গিয়ে কম্পিউটারে বসল। কিছুক্ষণ পর রকি তার রুম থেকে জোরে ডাক দিল, এই রিতু।

বল।

কী করছিস?

তুলির সঙ্গে গল্প করছি।

রকি কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, গল্প করতে হবে না। এদিকে আয়।

কেন?

আয় বলছি।

রিতু রকির রুমে এল, বল?

কে রে মেয়েটা?

ডেডই গতকাল পরিচয় করে দিল না, ও হচ্ছে তুলি। ডেডির তাহইতো ভাইয়ের মেয়ে।

তাহইতো ভাই কাকে বলে রে?

রিতু না সূচক মাথা নেড়ে বলল, তুলি জানে, কথা বলবি ওর সঙ্গে?

রকি আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, কথা বলবে? মেয়েটাকে দেখে তো আনকালচার্ড মনে হচ্ছে।

রিতু তার নিজের মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল, আস্তে বল। তুলি শুনতে পাবে তো।

শুনতে পাওয়ার জন্যই তো বলছি।

আনকালচার্ড কী না আগে কথা বল, শুনলে তুইও অবাক হবি।

তাই নাকি?

হাঁ, আমার রুমে চল।

দু’জনে কথা বলতে বলতে রিতুর রুমে ঢুকল।

তুলির পরনে একটা প্রিন্টের থ্রি-পিস, মাথায় ওড়না। সে বিছানায় বসে ছিল। রকিকে রুমে ঢুকতে দেখে সে একটু নড়েচড়ে বসে মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে সালাম দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

রকি রিতুর পড়ার টেবিলে বসল আর রিতু তুলির পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, এই তুলি তাহইতো ভাই কাকে বলে রে?

তুলি ফিক করে একটা হাসি হাসল, তাহইতো ভাই হল…বলে তুলি কথা বলার ধরন পাল্টাল, আচ্ছা তোকে বুঝিয়ে বলি যেমন তাহইতো ভাই হল তোর বিয়ে হলে তোর হ্যাজবেন্ডের ভাই আর রকি ভাইয়া তাহইতো ভাই হবে।

এবার রকি বলল, ও বুঝেছি। দ্যাট মিনস্‌ ব্রাদার ইন ল।

তুলি বলল, এক্সাক্টলি।

তুলি জিজ্ঞেস করল, আপনারা তুলির এক্সাক্টলি বলার উচ্চারণ শুনে দেখে রকি তুলির মুখের দিকে তাকালও।

কী বলেন?

রকি বলল, আমাদের তো তেমন কোন রিলেটিভ নেই।

রিলেটিভ নেই মানে?

আছে, আমার ফ্রেন্ডরা আছে।

আর…, চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু…

রকি বলতে শুরু করল, না, ডেডির দিক থেকে তো কোন রিলেটিভ নেই, মাম্মিরও কোন ব্রাদার-সিস্টার নেই।

আপনার নানা বাড়ি কোথায়?

পাশেই।

আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়? তুলি জিজ্ঞেস করল।

রিতু বলল, গ্রামে তো আমাদের কোন বাড়িই নেই।

রকি বলল, আমরা তো কোনোদিন গ্রামেই যাই নি।

ও মাই গড। চলে আসুন। আমাদের গ্রামে আসুন। গ্রাম কত সুন্দর। আমাদের গ্রামে নদী আছে, পুকুর আছে, শালবন আছে।

রকি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করো?

জি। আমি ঢাকা এসেছি একটা টি.ভি চ্যানেলে মিউজিক কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করতে।

রকি আর রিতু দু’জনে কিছুটা অবাক হল, রকি জিজ্ঞেস করল, কবে?

আজ বিকেল চারটায়।

লাইভ দেখাবে?

হ্যাঁ।

রিতু বলল, তারমানে তোকে আমরা আজ বিকেল চারটায় টি.ভিতে দেখছি।

তুলি মাথা নেড়ে সায় দিল।

রকি আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল, ওয়াও। ইউ আর অলসো স্টার।

তুলি প্রতিবাদ করল, স্টার না, সিঙ্গার।

সেদিনের কম্পিটিশনের লাইভ অনুষ্ঠান রকি, রিতু, রইস আর লোপা একসঙ্গে বসে দেখেছে। অনুষ্ঠানে তুলি রানার্স আপ হয়েছে। কম্পিটিশন শেষে তুলি আর তার বাবা যখন বাসায় ফিরল তখন রকি আর রিতু ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাল। রকি সামনে এসে রিতুর হাতে ফুল দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন তুলি।

থ্যাঙ্ক ইউ।

 

হারুনের সেদিন রাতের বাসে দিনাজপুর ফেরার কথা কিন্তু সেদিন ফেরার কথা শুনেই শুধু রইস না, পুরো বাসার সবাই যেন প্রতিবাদ করল। লোপা বলল, না, না, ভাই আজ কোনোভাবেই আমি আপনাকে যেতে দিচ্ছি না। আবার কবে আসবেন তার ঠিক নেই।

রিতু বলল, না আঙ্কল তুলিকে আমরা আজ যেতে দিব না। এতো বড় শিল্পীকে আমরা এতো সহজে ছাড়ছি না।

হারুন তুলিকে জিজ্ঞেস করল, কী রে মা থাকবি?

তুলি এতক্ষণ মাথা নত করে চুপ করেছিল এবার সবার মুখের দিকে একবার তাকাতেই রকি তুলির কানে কানে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ বল।

তুলি হেসে ফেলল।

 

আট

রাতের খাবারের পর রিতু আর তুলি রিতুর রুমে চলে গেল। কয়েক মিনিট পর রকিও রিতুর রুমে এল, হাই সিঙ্গার, আমাদের গান শুনাবি না?

তুলি কিছুটা লজ্জা পেল।

রিতু বলল, নে, তুলি একটা গান শুরু কর, লজ্জা কীসের?

তুলি শুরু করল, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই,

আমি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো আল বিলিয়ে যাই…

তুলির গান গাওয়ার সময় রকি এবং রিতু মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

গান শুনে লোপা ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।

গান শেষ হতে না হতেই রকি আর তুলি দু’জনে ওয়াও বলে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করল। তারপর রকি বলল, ইউ আর সো গ্রেট সিঙ্গার।

লোপা ভিতরে ঢুকে তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবেগ আল্পুত হয়ে বলল, তুই সত্যি মেঘে ঢাকা চাঁদ মা। একদিন মেঘ সরে যাবে। তুই অনেক বড় হবি, অনেক বড় শিল্পী হবি, বলতে বলতে লোপার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল।

ড্রয়িং রুম থেকে রইস জোরে ডাক দিল, মা তুলি এদিকে আয় তো, রকি, রিতু তোরাও আয়। সবাই একসঙ্গে বসে তুলির গান শুনি।

তুলি ড্রয়িং রুমে কার্পেটের ওপর বসল। রইস আর হারুন সোফার ওপর থেকে কার্পেটের ওপর বসল।

তুলি গান গাইতে শুরু করল, শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব,

তোমাদেরই মন ভোলাব,

শিল্পী হয়ে তোমাদেরই মাঝে

শিল্পী হয়ে তোমাদেরই মাঝে

চিরদিন আমি রব

শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব

তোমাদেরই মন ভোলাব।

শিল্পী, আমি শিল্পী…

তুলি একে একে কয়েকটা গান গাইল। তুলি গান গাওয়ার সময় সবাই মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। গান শেষ হতেই রইস আবেগে আল্পুত হয়ে পড়ল, সত্যি সত্যি তুই একদিন খুব ভালো শিল্পী হবি মা।

গান শেষ হতে না হতেই লোপা তার রুমে গেল, রুম থেকে ফিরে এসে তুলি গলায় একটা সোনার চেইন পরিয়ে দিয়ে বলল, অনেক বড় হ মা।

রকি জিজ্ঞেস করল, এগুলো গান তুই কার কাছে শিখেছিস তুলি?

আমার এক ফুপুর কাছে।

রকি একবার এদিক-সেদিক তাকালও। লোপা বুঝতে পেরেছে রকি কী জানতে চেয়েছে। সে বলল, ফুপু হল বাবার বোন, গাধা কোথাকার! বলে লোপা বলল, অনেক ধন্যবাদ মা এবার তুই ঘুমাতে যা। রিতু তুলিকে তোর রুমে নিয়ে যা।

হারুন তুলিকে বলল, তাড়াতাড়ি ঘুমাবি মা, সকাল দশটায় বাস, আমরা ন’টায় এখান থেকে রওয়ানা দিব।

 

পরদিন সকালবেলা তুলি কাপড়-চোপড় পরে রেডি হয়ে রিতুর সঙ্গে কথা বলছে এমনসময় রকি জোরে ডাক দিল, রিতু।

বল।

কী করিস?

তুলির সঙ্গে গল্প করছি।

আমার রুমে আয়তো একটু।

কেন?

এমনি।

রিতু তুলিকে বলল, চল তুলি।

রিতু আর তুলি দু’জনে রকির রুমে ঢুকল।

ওয়াও, গুড মর্নিং।

তুলি বলল, গুড মর্নিং।

রওয়ানা দিচ্ছিস?

হ্যাঁ। আমাদের গ্রামে আসবেন।

অবশ্যই। আমি গ্রাম কোনোদিন দেখি নি, কোনোদিন আগ্রহ ছিল না। এখন মনে হচ্ছে সুযোগ পেলেই একবার গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসব।

অবশ্যই আসবেন।

লোপা জোরে ডাক দিল রিতু, তুলি আয় মা। নাস্তা রেডি।

ওকে। ভালো থেকো।

আপনিও ভাল থাকবেন।

রিতু প্রতিবাদ করল, এই আপনি কী রে? কাল থেকে তুই শুধু আপনি আপনি করছিস। আমরা একসঙ্গে পড়ি না?

তুলি মাথা উঁচু-নিচু করে জানাল তারা একসঙ্গে পড়ে।

তাহলে তুই ওকে আপনি আপনি করছিস কেন? আমরা সবাই সমান।

রকি বলল, অফকোর্স, উই আর অলসো ফ্রেন্ড।

না। সমান না, তোর চেয়ে আমি এক ঘণ্টার বড়। আমি কিছু মনে করি না তাই, তোর আমাকে আপনি বলা উচিত, ভাইয়া বলা উচিত। তুলি আর আমি সমান। বলে রকি তুলির সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

এই দেড় দিনের মধ্যে তুলি যেন সবার মন জয় করে ফেলেছে। হারুন আর তুলিকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে লোপা বার বার করে চোখ মুছল, রিতু, রকি, রইস সবার চোখ যেন পানিতে ছলছল করছে।

তুলি লোপা আর রইসের পা ছুঁয়ে সালাম করতেই লোপা তুলিকে বুকে টেনে নিল, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আবার আসিস মা, ভালোভাবে লেখাপড়া করিস, আমি তোর জন্য দোয়া করছি তুই একদিন অনেক বড় হবি।

তুলিও আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আপনিও আমাদের বাসায় আসবেন আন্টি।

যাব মা, অবশ্যই যাব।

হারুন বলল, রইস, ভাবী কিন্তু বলল আমাদের বাড়ি আসবে, এবার আর না করবি না। চলে আসবি, রকি, রিতু তোমরাও এসো মা।

জি আঙ্কল, রকি বলল।

সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত সবাই দাঁড়িয়ে হাত তুলল।

 

নয়

 

কয়েক মাস পরের কথা। আর কয়েক দিন পর রকির পরীক্ষা শেষ হবে, তারপর ছুটি। সেদিন রাতে রকিই প্রথম কথা তুলল, মাম্মি আমি গ্রামে যাব।

গ্রামে? কেন?

এমনি, বেড়াতে। তুমি না বললে তুলিদের বাড়িতে যাবা।

বলেছিলাম। শুধু তোর না আমারো যেতে ইচ্ছা করছে। বলে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেল তার আপনমনে বলল, তুলি…খুব সুন্দর মেয়ে যেমনি সুন্দর তেমনি গানের কণ্ঠ। তোর সাথে তো আমারো যেতে ইচ্ছে করছে। বলে লোপা চুপ করে রইল।

রকি জিজ্ঞেস করল, মাম্মি?

কার সাথে যাবি?

কার সাথে আবার আমি একা।

লোপা জোর প্রতিবাদ করল, না তুই একা যেতে পারবি না।

তো?

তো কী? যদি আরও কেউ যেতো তবে তুই তাদের সাথে যেতে পারতিস।

মা’র কাছ থেকে বাধা পেয়ে রকি বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ডেডই তুমি কিছু বলছ না যে? তোমার কি ধারণা আমি একা যেতে পারব না?

রইস রকির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বিশ্বাস তুই যেতে পারবি তারপর লোপার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে বলল, আবার নাও পারতে পারিস। আজকাল যা দিনকাল খারাপ পড়েছে।

 

রইসের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে গ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধে রইসের বাবা-মা দু’জনে শহীদ হয়েছেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় রইস। তখন সে সবেমাত্র ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রইসকে তার মামা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। মামার বাসায় থেকে রইস লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকুরীতে জয়েন করেছে।

ছাত্রজীবনে রইস কয়েক বার মামার সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি জীবনেও দু’য়েকবার গেছে তারপর চাকরি জীবনের ব্যস্ততায় গ্রামে যাওয়াটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য গ্রামে যাওয়ার সুতোটাও ছিঁড়ে গেছে। রইস বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। কাছের আত্মীয়-স্বজন বলতে গ্রামে তেমন কেউ নেই। তাই বিয়ের পর ঢাকায় জমি কেনার সময় গ্রামে যা জমি-জমা ছিল বিক্রি করে দেয়। ফলে দু’য়েক বছর পর পর জমি দেখার অজুহাতে গ্রামে যাওয়ার পথটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে তার বাল্য বন্ধু বলে যা বোঝায়, প্রাইমারি স্কুলে যাদের সঙ্গে লেখাপড়া করে বিভিন্ন অফিসে চাকরি করছে তাদের কেউ কেউ যোগাযোগটা ধরে রেখেছে আর মোবাইল ফোন আবিষ্কারের সুবাদে তাদের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার নিয়ে এখনো কেউ কেউ যোগাযোগ করে। কোনোদিন কোন বাল্য বন্ধু ফোন করলে রইসের বুকটা ভরে যায়। সে ফিরে যায় শৈশবে। ইট-কাঠ পাথরে গড়া ঢাকা শহর থেকে তার মন ছুটে যায় সবুজ মাঠে, আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে, শাপলা ফোটা পুকুরে। তাই রকি যখন তার গ্রামে যাওয়ার কথা বলল তখন রইস কিছুক্ষণ উদাস হয়ে রকির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

রকি বাবাকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ডেডই।

হ্যাঁ বল।

কিছু বলছ না কেন?

রিতুকে টেবিলে খাবার বাড়িয়ে অন্তত: পনের মিনিট থেকে ডাকতে হবে, রিতু খাবার রেডি চলে আয়, রিতু….

তারপর সে আসবে। আজ খাবার টেবিলে গ্রামের যাওয়ার কথাটা তার কানে যেতেই একবার ডাক পড়তেই সে চলে এল, কী হয়েছে বাবা?

লোপা জানে গ্রামের প্রতি রিতু একটা টান আছে। সে বিষয়টা চাপা দেয়ার জন্য বলল, কিছু হয় নি, খেতে বস্‌।

রকি বলল, আমি গ্রামে যাব।

কে কে যাবি?

আমি একা যেতে চাচ্ছি কিন্তু মাম্মি বলছে আমি নাকি একা যেতে পারব না। ভাবছি আমার ফ্রেন্ডরা যাব মানে আমি আর টনি  যাব।

রিতু বাবার কাঁধে একটা হাত রেখে বায়নার সুরে বলল, বাবা আমিও যাব?

লোপা রিতুর দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, রিতু, খেতে বস্‌।

বসছি তো, বলে রিতু বাবার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, বাবা প্লিজ!

লোপা ডাইনিং থেকে রান্নাঘরে গেল সে সুযোগে রকি বাবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, বাবা প্লিজ!

রইস মাথা উঁচু-নিচু করে সায় দিল।

রকি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ডেডই।

লোপা ফিরে এল। সে পরিসি’তি বুঝতে পেরে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, ও বলল আর তুমি পারমিশন দিয়ে দিলে।

রইস সাহেব একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, পারমিশন দিই নি তো।

রকি এবং রিতু বাবার দিকে তাকালও।

তো? রকি তোমাকে থ্যাংকস দিল কেন?

ঐ একটু মাথাটা উঁচু-নিচু করেছি আর কী।

লোপা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, মাথা উঁচু-নিচু করা আর পারমিশন দেয়ার মধ্যে তফাৎ কী?

ছেলেটা গ্রাম দেখতে যেতে চাচ্ছে, যাক না।

রিতু বলল, হ্যাঁ আমিও তাই বলছি, বাংলাদেশে প্রায় আটাশি হাজার গ্রাম আছে আর আমরা যদি একটা গ্রামও না দেখি তো আমাদের জীবনটাই বৃথা।

লোপা রিতুর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, এই আমরা কী রে? রকি যদি ওর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় তো যাবে। তোর যাওয়া হবে না। বলে লোপা আবার রান্না ঘরে চলে গেল।

রকি বলল, ডন্ট ওরি মাই সিস্টার, তুই যাবি তো, দেখিস আমি একটা মেকানিজম বের করে ফেলব।

তুই কি মেকানিজম বের কর্‌বি?

সেটা আমি বুঝব। তাছাড়া ডেডির তো সাইলেন্স পারমিশন আছে।

থ্যাঙ্ক ইউ।

লোপা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল, কী হল? আবার থ্যাংকস কেন? বলে সে রইসকে বলল, এই কী হল বলতো?

রইস কিছু না বোঝার ভান করে বলল, আমি তো খাচ্ছিলাম।

ও, তাইতো, তুমি তো চোখ-কান বন্ধ করে খাচ্ছিলে। সবাই মিলে দল পাকিয়েছো।

আমি আবার কী পাকালাম। আমি বলছি ছেলেটা যেতে চায় যাক।

লোপা আবার বলতে শুরু করল, সারাজীবন নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিলে, কোনোদিনও তুমি আমার কথার কোন গুরুত্ব দিলে না।

আমি তোমার কোন কথার গুরুত্ব দিই না। বরং সব সিদ্ধান্ত তো তুমি নাও।

থাক আর বলতে হবে না। তোমার ছেলেমেয়ে তুমি যা ভালো বোঝো করো, বলে লোপা আবার রান্নাঘরে চলে গেল।

 

দশ

হারুন ফোন রিসিভ করল, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কী রে হারুন কেমন আছিস?

ভালো, তুই?

ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। শোন একটা খবর আছে।

বল, কী খবর?

রকি তোদের বাড়িতে যাবে।

তাই নাকি? খুব খুশী হয়েছি। কবে?

আগামী শুক্রবার ঢাকা থেকে রওয়ানা দিবে।

হারুন জিজ্ঞেস করল, তুই, রিতু, ভাবীসহ আসছিস তো?

আমার আর সময় কই রে, তোর ভাবীরও সময় নেই।

তো?

রকি আর ওর সঙ্গে ওর দু’য়েকজন ফ্রেন্ড যেতে পারে। কোন সমস্যা নেইতো?

না। সমস্যা কীসের? কীভাবে আসবে?

সেসব তোকে আমি পরে জানাব। তাহই কেমন আছে রে?

ভালো।

কী করে এখন?

কী আবার তার সেই লাইব্রেরি, জ্ঞান চর্চা আর মোড়ের মানুষকে জ্ঞানের কথা শোনানো। আজকাল আবার শুরু করেছে অনলাইনে লেখাপড়া যেন তার লেখাপড়ার শেষ নেই।

শেষ পর্যন্ত গ্রামে থেকেই জীবনটা শেষ করে দিল।

হুঁম। তার যেমন ইচ্ছা।

তাহইর শরীর ভালো আছে তো?

হ্যাঁ, এখনো আমাদের মতোই এনার্জেটিক আছে।

তাহইকে আমার সালাম দিস।

আচ্ছা।

ওকে, ভালো থাকিস। এখন রাখি।

তুই ভালো থাকিস। তবে তুইসহ সবাইকে নিয়ে এলে আমরা খুশি হতাম।

ওরা যাক। পরে একসময় যাব।

আচ্ছা।

ফোন রেখে হারুন প্রথমে তুলিকে খবরটা দিল, মা তুলি।

জি বাবা।

এদিকে আয় তো। তোর মাকে ডাক দে। বাসায় মেহমান আসবে।

তুলি দৌড়ে এল, কী হয়েছে বাবা? কে আসবে?

ঢাকা থেকে…কে আসবে বলতো?

রকি, রিতু নিশ্চয়ই। সঙ্গে আক্কেল আন্টি।

না। শুধু রকি আসবে আর ওর সঙ্গে দু’য়েকজন ফ্রেন্ড। বাবা কোথায়? দেখত বাবাকে খবরটা জানাই।

দাদু লাইব্রেরিতে আছে বাবা, তাহলে আমি যাই দাদুকে খবরটা দিই।

 

বিরল কালিয়াগঞ্জ রোডের উভয় পাশের কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি গ্রাম, মির্জাপুর। দেশের প্রায় আটাশি হাজার গ্রামের মতোই একটি সাধারণ গ্রাম। আজকাল প্রায় সারাবছর ক্ষেতে সবুজের সমারোহ থাকে। ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, বিভিন্ন ধরণের শাকসবজির ক্ষেত তো আছেই। একটা বিল মাঝ দিয়ে বয়ে গিয়ে গ্রামকে দ্বিখণ্ডিত করেছে কিন্তু বিভাজন করতে পারে নি গ্রামের মানুষকে। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমান আছে একসাথে ভাই ভাই হয়ে। পুজোর সময় সমস্ত মুসলমান হিন্দুদের পুজোর উৎসব পালন করে, আবার হিন্দুরাও মুসলমানদের ঈদের সময় আনন্দ করে। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত মির্জাপুর গ্রাম।

রাস্তার পূর্ব পাশে বিশাল সীমানা প্রাচীর ঘেরা বাড়ি। এল প্যাটার্নের কয়েকটি সেমিপাকা ঘর, ওপরে সবুজ ঢেউ টিনের ছাউনি। খোলা বারান্দা। পাশাপাশি ঘরে থাকে তুলির চাচা। বাপ-চাচা আর দাদা-দাদি মিলে তুলিদের একান্নবর্তী পরিবার। প্রতিদিন বড় পাতিলে পুরো পরিবারের জন্য ভাত রান্না হয়। বড় খোলা বারান্দায় সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে একসঙ্গে খাবার খায়।

তুলির দাদার নাম লতিফ। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। এই বয়সেও ডাইনিং টেবিলে থেতে সবাইকে ডাক দিবে, কেউ না এলে তার আসার কারণ না জানা পর্যন্ত খাবার মুখে তুলবেন না। ডাইনিং টেবিলে গোল হয়ে বসবেন ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনিরা সব। খাওয়ার পর শুরু হবে সংসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা। সবাইকে সংসারের, নাতি-নাতনিদের লেখাপড়ার বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেন। আগে এই দিক নির্দেশনায় অংশ নিতেন তুলির দাদিও কিন্তু কয়েক বছর আগে তিনি এই সমাজ-সংসারের মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

স্ত্রী বেঁচে থাকতে লতিফ সাহেব সংসারের দেখভাল নিজেই করতেন। সকালবেলা কামলা-কিষাণদের কাজের নির্দেশনাও দিতেন। তারপর কয়েক ঘণ্টা কাটাতেন লাইব্রেরিতে, লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ক্ষেতখামার দেখতে যেতেন। স্ত্রী বিয়োগের পর সংসার থেকে তিনিও অনেকটা বিয়োগ হয়েছেন। এখন লাইব্রেরিই যেন তার ঘর-সংসার।

হারুন লাইব্রেরিতে গেল, বাবা।

বল।

বাবা বাসায় ঢাকা থেকে মেহমান আসবে।

লতিফ সাহেব র‌্যাকে একটা বই খুঁজছিলেন। এবার তিনি মাথা তুলে হারুনের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকা থেকে আবার কে আসবে?

রকি আসবে, রইসের ছেলে রকি।

রইস আসবে না।

না, ওরা খুব ব্যস্ত।

লতিফ সাহেব ভেবেছিলেন রইসও আসবে কিন্তু রইস না আসার কথা শুনে মুখ কাল করলেন, অ।

কবে আসবে?

শুক্রবার।

লতিফ সাহেব বইয়ের র‌্যাকের কাছ থেকে চেয়ারে এসে বসলেন, তাহলে তো আর সময় নেই। ওরা থাকবে কোন ঘরে?

কেবল খবরটা শুনলাম। এখনো কিছু চিন্তা করি নি।

এ্যাটাচড বাথ ওয়ালা রুম টাতে ওদের থাকার ব্যবস্থা কর, বিদ্যুতের যা অবস্থা, আই.পি.এস’টা ঠিক আছে কী না সেটা ভাল করে দেখ। ওরা তো মনে হয় ঢাকার বাইরে কোনোদিন বের হয় নি।

সেজন্যই আসছে গ্রাম দেখতে।

আচ্ছা।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়িতে ধুমধাম আয়োজন শুরু হল। হারুনের ছোট ভাই হাসিব গেল রং মিস্ত্রি আনতে, বাড়ির রং পুরানা হয়ে গেছে। পরদিন সকালবেলা রং মিস্ত্রি বাইরে ওয়েদার কোট আর ভিতরে ডিসটেম্পারের কাজে লেগে গেল। পড়শিদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হল।

কেউ কেউ বলল, হঠাৎ করে হারুনের বাড়িতে রং-চংয়ের কাজ শুরু হল কেন? হারুনের মেয়ের বিয়ে নাকি?

আবার কেউ কেউ বলল, লতিফ ভাইকে তোমরা চেনো না, সারাজীবন যিনি বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ আর কুসংস্কারের জন্য কথা বলেছেন তিনি কি তার স্কুল পড়-য়া নাতনিকে বিয়ে দিবেন নাকি?

হারুন বাড়ি থেকে বের হয়ে বোর্ডের হাটের দিকে যাচ্ছিল। মোড়ে হাসেমের সঙ্গে দেখা। হাসেম হারুনের দূর-সম্পর্কের চাচা। বয়সে কাছাকাছি হওয়ায় সে প্রায়ই হারুনের সঙ্গে ঠাট্টা করে। সে হারুনকে মোড়ে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, হারুন বাড়িতে এতো ধুমধাম কেন? তোমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ নাকি? বলে সে এক গাল হাসি হাসল।

হারুন ধমকের সুরে বলল, তোমার তো দেখি কাণ্ড জ্ঞান কমে গেছে হাসেম, আমার মেয়ের বিয়ে এখনই।

হাসেম একটা ঢোক গিলল, না, মানে বাড়িতে…

হ্যাঁ রং-চংয়ের কাজ চলছে, ঢাকা থেকে মেহমান আসবে, রইস আছে না, আমার তাহইতো ভাই। ওর ছেলে আসবে, গ্রাম দেখতে, ওরা নাকি কোনোদিন গ্রামে যায় নি তাই গ্রাম দেখতে আসবে।

অ, তাই বল।

 

এগার

 

অনশন করতে করতে তিথির চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। রাতের খাবারের সময় রুমানা কয়েক বার তিথি, তিথি বলে ডাক দিল কিন্তু তিথি কোন সাড়া দিল না। রুমানা তিথির রুমে গেল। তিথির মাথায় হাত দিয়েই চমকে উঠল, জ্বর এসেছে নাকি তোর?

তিথি রেগে ফোঁস করে উঠল, না। আমার কিচ্ছু হয় নি। তুমি যাও।

রুমানা লাইট জ্বালিয়ে দিল, ইস্‌স! চোখ-মুখ শুকিয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।

তাতে তোমার কী। আমি মরে গেলেই তো তোমার ভালো।

তিথির মুখে তার মরে যাওয়ার কথা শুনে তার চোখ দিয়ে ছিটকে পানি বের হলো, কেন? এভাবে বলছিস কেন? তুই আমার একমাত্র সন্তান, তুই মরে গেলে আমি খুশি হব মানে।

তাহলে তো আমার সঙ্গে তুমি এমন আচরণ করতে না।

তুই বল, কোন মা কি এই বয়সের একজন মেয়েকে ছেলেদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে দিতে পারে, ফ্রেন্ড হোক ছেলে তো।

কেন পৃথিবীর সব ছেলেরাই কি খারাপ? রকি, টনি ওরা আমার ফ্রেন্ড, যতই হোক ছেলে আমি ওদের চিনি ওরা আমার কোন ক্ষতি করবে না। তাছাড়া ওদের সাথে তো রিতুও যাচ্ছে।

রিতু যাচ্ছে?

হ্যাঁ। ক’দিন থেকে তো আমি তোমাকে সেটাই বলছি।

আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি, তুই ভাত খা, যদি ওদের সাথে রিতু যায় তবে তুইও যাবি।

তিথি বিছানা থেকে একরকম লাফিয়ে উঠল।

 

রুমানার কথা শুনে লোপা চমকে উঠল, আমি তো জানি শুধু রকি যাচ্ছে, রিতু তো যাচ্ছে না।

রুমানা বলল, আপা তিথি বলছিল রিতু যাচ্ছে, তাই আমি ভাবছিলাম রিতু যদি যায় তবে ওর সাথে তিথিও যেতো।

লোপা বলল, আমি তো শুনছি উল্টোটা, তিথি যাবে ওর সাথে রিতুও যাবে। বলে লোপা রকি রকি করে ডাকতে ডাকতে রকির রুমে গেল, এই রকি কার সাথে কে যাচ্ছে বলতো?

কার সাথে কে যাচ্ছে মানে?

মানে তিথি যাবে বলে রিতু যাবে, নাকি রিতু যাবে বলে তিথিও যাবে?

রকি একটা ঢোক গিলে আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, না মানে ওরা দু’জনে যাবে, মা তুমি না করো না প্লিজ!

লোপা যখন মোবাইল ফোন নিয়ে রকির রুমে যাচ্ছিল তখন রিতুও তার পিছনে পিছনে গেল। লোপা রকির কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকাতেই রিতু হাত জোড় করে বলল, মা প্লিজ!

লোপা মোবাইল ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি আপা। বলে লোপা ফোন রেখে দিল।

লোপা রকিকে জিজ্ঞেস করল, আমি তো তোকে প্রথমেই বলেছি তুই যাবি যা, তোর ফ্রেন্ডদের সঙ্গে নিয়ে যা, তুই আবার রিতুকে সাজাচ্ছিস কেন? আবার রিতু যাচ্ছে বলে তিথিকে ওর মাকে ওকে ম্যানেজ করতে লাগিয়ে দিয়েছিস, এসব কী হচ্ছে বলতো।

রকি মৃদু কণ্ঠে বলল, কিছু হচ্ছে না মা।

কিছু হচ্ছে না তো আমি এসব উল্টা-পাল্টা কী শুনছি।

রকি প্রচণ্ড রেগে গেল, বলছি তো কিছু না। ওকে, তুমি যখন বলছ তখন আর যাবই না। থাক সব সিডিউল প্যাক আপ। বলে সে বারান্দায় চলে গেল।

রইস এতক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে টি.ভি দেখছিল রকির জোরে চিৎকার শুনে সে বেরিয়ে এল, কী হয়েছে রকি? এত জোরে চিৎকার করছিস কেন?

রকি কোন কথা বলল না। লোপা রকির রুম থেকে বেরিয়ে এসে রইসকে এতক্ষণ ফোনে রুমানার ফোন, তিথি আর রিতুর যাওয়ার বিষয়ে সবকিছু বলল।

সবকিছু শুনে রইস বলল, আচ্ছা বুঝছি, বলে সে রকি বলে জোরে ডাক দিতেই সে রইসের সামনে এসে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, বল?

কী হয়েছে?

শুনলে তো সবকিছু।

কে কে যাচ্ছিস তোরা?

আমি, টনি, তিথি আর রিতু।

তিথিকে ওর মা যেতে দিবে?

রিতু গেলে তিথিও যাবে।

আচ্ছা তুই যা, আমি তোর মা’র সঙ্গে কথা বলছি বলে রইস লোপা লোপা বলে ডাক দিতেই সে গজগজ করে বলল, শুনছি, যা বলার বলতে থাকো।

তুমি ড্রয়িং রুমে এসো তো।

দু’জনে ড্রয়িং রুমে ঢুকল, বল?

ওরা এডামেন্ট যাবেই। আমাদের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, সুলতান আমাদের অনেক দিনের গাড়ির ড্রাইভার, ওকে বলে দিব, ও  লক্ষ্য রাখবে। আর ওখানে তো হারুন আছে, আজকালকার দিনে ছেলেমেয়েদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন।

লোপা প্রচণ্ড রেগে বলল, তোমার ছেলেমেয়ে তুমি যা ভালো বোঝো করো, এমন হবে জানলে আমি ছুটি নিয়ে রকি আর রিতুকে নিয়ে যেতাম এখন শেষ মুহূর্তে এসে তো আমিও আর ছুটি পাব না।

রইস বলল, থাক বাদ দাও এখন ওসব। তোমাকে কি তিথির মা ফোন করেছিল?

লোপা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, এতক্ষণ কী বললাম তোমাকে।

আচ্ছা তুমি বলে দাও রিতু যাচ্ছে।

আমি বলতে পারব না, তুমি বল, বলে লোপা মোবাইল ফোনটা রইসের হাতে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, এতটুকু ছেলেমেয়েরা এত চালাক হয়েছে বাপ-মা’র সঙ্গে চালাকি করে, আমরা গুরুজনদের কথার ওপর কোনোদিন কথা বলি নি।

রইস ফোন হাতে নিয়ে রুমানাকে ফোন করল।

বার

 

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন লতিফ সাহেব। তাঁর কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে তুলি তার চাচাতো ভাই তরু। তুলি বার বার করে ঘড়ি দেখছে। একটা মাইক্রো বাস আসতে দেখে তুলি তরুকে বলল, এই তরু দেখত একটা মাইক্রো বাস আসছে না?

হ্যাঁ আসছে তো, একটা মাইক্রো বাস আসছে।

মাইক্রো বাসটা আরও কাছে আসতেই তুলি হাত তালি দিয়ে উঠল, হ্যাঁ এটাই তো ঐ যে সামনে রকিকে দেখা যাচ্ছে। তরু দাদুকে ডাক দে তো।

তরু জোরে দাদু বলে ডাক দিতেই লতিফ সাহেব এগিয়ে এলেন।

একটা মাইক্রো বাস রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

মাইক্রো বাস থেকে সবাই নামল। তুলি লতিফ সাহেবের সঙ্গে সবার পরিচয় করে দিল, রকি ইনি হচ্ছেন আমার দাদু। আর…বলতেই রকি আর টনি হাই বলে শুভেচ্ছা জানাল।

লতিফ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, হাই।

আর দাদু ও হচ্ছে তিথি, ওদের ফ্রেন্ড।

তিথিও হাই বলল।

সবার শেষে তুলি রিতুকে পরিচয় করে দিল। রিতু সালাম দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম দাদু।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছো দাদু? বলে লতিফ সাহেব কাছে এসে রিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করলেন।

এবার তুলি তরুর দিকে তাকিয়ে বলল, ও তোকে আবার পরিচয় করে দিই নি, রিতু ও হচ্ছে তরু আমার চাচাতো ভাই।

এটা রিলেশনটা নিশ্চয়ই তোরা জানিস?

রকি বলল, কাজিন।

তুলি বলল, এক্টাক্টলি। বলে তুলি একটু থামল তারপর একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, যদিও তোরা সবাই চিনতে পেরেছিস তারপরও ফরমালি একটা পরিচয় হওয়া দরকার, ইনি হলেন এভার গ্রিন বয় আব্দুল লতিফ, আমার দাদু।

লতিফ সাহেব মৃদু হাসলেন।

সবাই তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তিথি জিজ্ঞেস করল, এভার গ্রিন বয় মানে?

তুলি একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, সেটা আরও পরে বুঝবি। ওয়েট মাই ফ্রেন্ড।

 

বাড়ির পাশে মরিচ-বেগুন ক্ষেত সেখানে একটা পাঁঠা দাঁড়িয়ে ছিল। তার শরীরের লোমগুলো ছিল অনেক লম্বা আর দাড়িও অনেক বড় বড়। একে একে সবাই বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে। পিছনে পড়েছে রকি আর টনি। টনি রকিকে পাঁঠা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই রকি দেখ্‌ দেখ্‌। সিংহের মতো ওটা কী রে?

হ্যাঁ, সিংহের মতোই তো। বাচ্চা সিংহ মনে হয়।

এতো মানুষের সমাগম আর মাইক্রো বাস দেখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁঠাটা দৌড়ে এগিয়ে এল। পাঁঠাকে এগিয়ে আসতে দেখে দু’জনে একবার এদিক-সেদিক তাকালও তারপর টনি বলল, রকি পালা, পালা…

টনি বলামাত্র দু’জন দু’দিকে দৌড় দিল। পাঁঠা রকির পিছু নিল। কিছুদূর যাওয়ার পর পাশে একটা গর্তের মধ্যে সে পড়ে গেল। মরিচ-বেগুনের ক্ষেতে একজন কাজ করছিল সে এই ঘটনা দেখে হাসতে হাসতে টলে পড়ল আরেকজন দৌড়ে এসে পাঁঠাকে তাড়িয়ে দিয়ে রকিকে উদ্ধার করল।

পাঁঠা চলে যাওয়ার পর টনি বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াল তার চোখে-মুখে তখনো আতঙ্ক, সে হাঁপাচ্ছে। রকিকে যে উদ্ধার করল সেও তাকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল। রকির এ অবস্থা দেখে রিতু আর তিথিও ভয় পেল, কী হয়েছে? তোর এ অবস্থা কেন?

টনি কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওকে একটা সিংহ এ্যাটক করেছিল।

লতিফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আবার সিংহ এল কীভাবে? কী হয়েছে রে হামিম? বলে তিনি রকিকে যে উদ্ধার করেছিল তার দিকে তাকালেন।

হামিম বলল, পাঁঠা দাবাড় দিয়েছিল।

ঢাকা থেকে আগত মেহমান, বাড়ির যৌথ পরিবারের অনেক লোক আর প্রতিবেশীদের কয়েক জন আসাতে আঙ্গিনায় একটা জটলা তৈরি হয়েছিল। হামামের কাছে ঘটনার বিবরণ আর টনির পাঁঠাকে সিংহ বলতে শুনে সবাই হেসে উঠল।

লতিফ সাহেব রকি আর টনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী বলবা দাদু ভাই তোরা পাঁঠাকে সিংহ বলছিস, মানে তোরা ক্লাস নাইনে পড়ে যেমন পাঁঠা চিনিস না, তেমনি ও তোদের চেনে না, হাই বুঝে না। সেজন্য একটা মিস্‌আন্ডাস্ট্যন্ডিং হয়ে গেছে।

রকি আর টনি বুঝতে পারল না কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারল যে তাদের একটা বোকামি হয়েছে। আসলে এই প্রাণিটি তাদের আরও আগে চেনা উচিত ছিল। দু’জনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

লতিফ সাহেব বললেন, গ্রামের মানুষ হাই বলে না। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেয়। কয়েক দিন গ্রামে থাক এখানে কত গাছ-পালা আছে, পশু-পাখি আছে সব দেখবি। চল এখন ড্রেস চেঞ্জ কর, লাঞ্চ কর। কিছুক্ষণ রেস্ট নে তারপর বিকেলে তোদের নিয়ে আমি বের হব।

 

বিকেলে লতিফ সাহেব রকি আর টনিকে নিয়ে বের হবেন এমনসময় রিতু রকিকে জিজ্ঞেস করল, এই তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

রকি হাত ঈশারা করে জানাল, জানে না।

রকির কাছ থেকে কিছু জানতে না পেরে তিথি লতিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন দাদু?

হাট।

আমিও যাব, বলে তিথি আনন্দে দু’হাত একরকম লাফাতে লাগল তার রিতুকে বলল, এই রিতু তুই যাবি?

রিতু জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই।

তুলি হাসতে হাসতে একরকম টলে পড়ল। তুলির মা, চাচী সবাই তখন আঙ্গিনায় দাঁড়িয়েছিল। তারা তিথি আর রিতুর কথা শুনে লজ্জায় মুখ ঢাকল।

লতিফ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তোদের যাওয়া যাবে না।

তিথি বলল, কেন? কেন যাওয়া যাবে না দাদু?

আমরা যাচ্ছি তুলি তুই বোঝাতো। বলে লতিফ সাহেব রকি, টনি আর তরুকে নিয়ে চলে গেলেন।

তুলি বলল, এই রিতু তোরা আজ যা কাণ্ডটা করলি…

রিতু বলল, কী করেছি?

তোরা হাট চিনিস না?

রিতু বলল, না।

তুলি কিছুটা অবাক হল, তোরা হাট চিনিস না?

রিতু বলল, চিনব কী করে আমরা কি কোনোদিন গ্রামে দেখছি।

তাহলে শোন হাট হল বাজারের মতো কিন্তু প্রতিদিন না। সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন হাট বসে। গ্রামে তো প্রতিদিন বাজার বসে না সেজন্য সবাই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য হাটে যায়।

তিথি বলল, আমরাও যেতাম। আমরা যেতে পারব না কেন? মার্কেটে কি আমরা যাই না?

তুলি বলল, না, হাট শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য, মেয়েরা হাটে যায় না।

তিথি বলল, তাহলে তো এখনি রকিকে বলতে হয়…বলে সে তখনি রকিকে ফোন করল, হ্যালো।

বল।

তুই হাটের ছবি ভিডিও করে আনিস তো।

ওকে।

ফিরবি কখন?

জানি না।

তাড়াতাড়ি ফিরিস।

কেন?

তিথি অভিমান করে বলল, থাক তাড়াতাড়ি আসতে হবে না, যখন ইচ্ছা হয় তখন আসিস, কিচ্ছু বুঝিস না। গাধা। আমরা একটা নতুন জায়গায় এসেছি সেজন্য আসতে বলছি আর ওর হাজারটা কেন। থাক তোকে আসতে হবে না। আজ হাটে থাকিস।

তিথি যখন রকির সঙ্গে কথা বলছিল তুলি তখন তিথির দিকে তাকিয়েছিল। তিথির কথা বলা শেষ হতে না হতেই সে বলল, চল আমরা মেহেদি পাতা তুলি।

তুলি বলল, কেন?

মেহেদি পরব।

তিথি খুব খুশি হল, ওয়াও, গুড আইডিয়া।

 

তের

 

আজগরের চা দোকান অনেক পুঁতান। একসময় সবাই আজগরের চা’র দোকান বলতো কিন্তু কালক্রমে তা সংক্ষিপ্ত হয়ে নাম ধারণ করেছে আজগর চা’র দোকান। এই চা বলতে কেউ কেউ চা’র দোকান মনে করে আবার কেউ কেউ মনে করে আজগর চাচার দোকান।

লতিফ সাহেব দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আজগর চা কেমন আছেন বারে?

ভালো। আপনি?

হুঁম, ভালো।

এই ছেলে দু’টা কে?

লতিফ সাহেব রকিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এর নাম রকি, আমার বিহাই বেটা রইসের ছেলে, আর বলে তিনি টনিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এর নাম টনি রকির ফ্রেন্ড।

টনি হাই বলতেই রকি টনির হাতে একটা চাপ দিতেই সে সালাম দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

টনির হাই বলতে শুনে আজগর হা করে তাকিয়ে রইল। দোকানের অন্যান্য কাস্টমাররাও হেসে উঠল। বলতে গেলে টনির এই অতি আধুনিকতা একটা হাস্য রসের সৃষ্টি করল।

লতিফ সাহেব সবাইকে ধমকের সুরে বললেন, এই হাসি কীসের? হাই মানে কি তোমরা বোঝো না? আগে তো হ্যালো মানেও বুঝতে না আর এখন সবাই হ্যালো বলছ। চুপ করো।

লতিফ সাহেব এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ, উচ্চ শিক্ষিত এবং মুরুব্বী মানুষ। গায়ের রং ফর্সা ধবধবে, চুল দাড়ি পেকে কাশফুলের মতো আকার ধারণ করেছে। এই এলাকায় সবাইকে ধমক দেয়ার মতো অধিকার শুধু তাঁরই আছে।

লতিফ সাহেবের ধমক শুনে সবাই চুপসে গেল।

কিছুক্ষণ পুরো হোটেল জুড়ে একটা নীরবতা বিরাজ করল। অবশ্য নীরবতা ভঙ্গ করলেন লতিফ সাহেবই। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, এই যে ছেলে দু’টা দেখেছো এরা দু’জনে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। এদের বই-পুস্তক সবকিছু ব্রিটিশ থাকে আসে। এদেশে বাস করে বটে কিন্তু এদের জীবন-যাপন বিদেশিদের মতোই, বলা যায় এদের স্কুলটা বাংলাদেশের মধ্যে একটা ইংল্যান্ড।

কেউ কেউ মাথা নেড়ে সায় দিল।

লতিফ সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, দু’জনে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। তাই গ্রাম দেখতে এসেছে।

আজগর হেসে বলল, ও তাই এ অবস্থা।

লতিফ সাহেব নাস্তার অর্ডার দিলেন, এই আজগর ঝুরি বুন্দিয়া দাও আমাদের।

নাস্তা খেতে খেতে টনি জিজ্ঞেস করল, দাদু এখানে ফাস্ট ফুডের দোকান নেই?

তা নেই কিন্তু বেকারি আছে, রুটি-বিস্কুট, চানাচুর পাওয়া যায়।

বার্গার পাওয়া যাবে না?

লতিফ সাহেব হেসে উঠলেন, না দাদু, এখানে বার্গার, ভেজিটেবল রোল, পিজা এসব পাওয়া যাবে না।

স্যান্ড উইচ।

লতিফ সাহেব না সূচক মাথা নাড়লেন।

নাস্তা শেষ করে সবাই চায়ের দোকান থেকে বের হল।

হাট ঘুরে ঘুরে দেখাল।

মাছ হাটিতে ঢুকে আবার রকি শুরু করল নানান প্রশ্ন। টনির বাবা দেশের বাইরে থাকে, বাড়ির সব বাজার তার মা করে তাই সেও মাঝে মাঝে মা’র সঙ্গে কাঁচাবাজারে গেছে কিন্তু রকি কোনোদিন কাঁচাবাজারে যায় নি। তার বাবা যখন কাঁচাবাজারে যেতো তখন সেও বাবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতো, রকির বাবাও তাকে নিয়ে যেতে চাইতো কিন্তু কাঁচাবাজার নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বলে লোপা তাকে কোনোদিন বাজার যেতে দেয় নি।

রকি একটা মাছ দেখিয়ে বলল, দাদু এটা কোন মাছ?

টনি ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, আরে গাধা এটা বুঝিস না, এটা বালেয়া মাছ।

রকি বলল, তুই তো দেখি সবজান্তা হয়ে গেছিস।

এবার আরেকটা মাছ দেখিয়ে রকি জিজ্ঞেস করল, বলতো এটা কোন মাছ?

টনি বলল, গোতা মাছ।

রকি লতিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, দাদু টনি কি ঠিক বলেছে?

লতিফ সাহেব না সূচক মাথা নাড়লেন।

টনি জিজ্ঞেস করল, দাদু আই এ্যাম নট রাইট?

না দাদু। এটা হল বায়েন মাছ।

রকি টনিকে বলল, কী হল সবজান্তা।

টনি কোন কথা বলল না।

পুরো হাট ঘুরে দেখে সবাই মাইক্রোবাসে এসে উঠল। কিছুদূর আসার পর লতিফ সাহেব বললেন, কেমন লাগছে তোদের?

দু’জনে একসঙ্গে বলল, ফ্যান্টাস্টিক।

শোনো মানুষ প্রকৃতি থেকে যে শিক্ষা পায় শুধু বই পড়ে সে শিক্ষা কোনোদিন অর্জন করা সম্ভব হয় না। এই যে তোরা আজ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি দেখলি এগুলো যদি বই পড়ে শিখতে হতো তবে কতদিন সময় লাগতো, কতগুলো বই পড়তে হতো, কয়টা বায়োলজি ল্যাব লাগতো একবার চিন্তা করে দেখ।

টনি আর রকেট দু’জনে মাথা নেড়ে সায় দিল।

লতিফ সাহেব বললেন, তোদের আরও আগে গ্রামে আসা উচিত ছিল।

টনি জোর দিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন দাদু।

রকি আড় চোখে লতিফ সাহেবের দিকে তাকালেন।

টনি আবার বলতে শুরু করল, কিন্তু আসব কার কাছে? আমাদের তো গ্রামে কেউ নেই।

খুঁজে দেখলে অবশ্যই খুঁজে পাবি। আসলে যারা একবার উপরে উঠে গেছে তারা আর কোনোদিন নিচের দিকে ফিরে তাকায় না। খুঁজে দেখলে দেখা যাবে সবারই গ্রামে শিকড় আছে। শিকড় ছাড়া যেমন গাছ হয় না, গ্রাম ছাড়া তেমনি শহরেরও জন্ম হয় না। সারাদেশ খুঁজে দেখ যত শিক্ষিত, বড় অফিসার, রাজনীতিবিদ সবারই কিন্তু গ্রাম আছে। সবার হৃদয়ে আছে গ্রাম। তোরা কোনোদিন খুঁজিস নি তাই পাস  নি।

মাম্মি তো বলেছে গ্রামে নাকি আমাদের কেউ নেই।

মাম্মি বলবে না দাদু। মা বলবে, মা কথায় যেমন একটা রক্তের টান, নাড়ির টান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে মাম্মি কথাটাতে তেমনটি আছে বলে মনে হয় না। একটু দূরত্ব বেশি বেশি বলে মনে হয়। অথচ মা ও সন্তানের সম্পর্কের মতো সম্পর্ক পৃথিবীতে আর নেই, কোনোদিন হবেও না।

লতিফ সাহেব যখন কথা বলছিলেন রকি আর টনি তখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

লতিফ সাহেব বললেন, এখন থেকে আমাদের বাড়িতে আস্‌বি যখন আসতে ইচ্ছা করবে তখনই চলে আস্‌বি।

টনি বলল, অফকোর্স।

 

চৌদ্দ

 

বাড়ির গেটের পাশেই কাগজি লেবুর গাছ দিয়ে দেয়া বেড়ার ভিতরে একটা ছোট্ট বাগান। বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছপালায় ভরা। তারই এক কোণে একটি মেহেদি গাছ। বাঁশের তৈরি ছোট পকেট গেট দিয়ে ঢুকতেই রিতু জিজ্ঞেস করল, কোনটা মেহেদি গাছ রে তুলি?

তুলি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

রিতু মেহেদি গাছের কাছে গিয়ে মেহেদি পাতা ছেঁড়ার জন্য হাত বাড়াতেই তিথি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল, এই রিতু হাত দিয়ে ছিঁড়িস না, কাঁটা বিঁধবে।

মেহেদি গাছে কাঁটা থাকে? বলে তুলি হাসতে হাসতে তিথির গায়ের ওপর একরকম টলে পড়ল।

তিথি কিছুটা লজ্জা পেল।

রিতু বলল, হাস্‌ছিস্‌ কেন রে, আমরা কি কখনো মেহেদি পাতা দেখেছি। আমরা তো টিউবের মেহেদি কিনে পরি। আর তিথি তো তাও পরে না। ওতো কোন ওর্নামেন্টসও পরে না বলে ওগুলো নাকি মেয়েরা পরে।

তুলি বলল, ও মেয়ে না?

এবার তিথি কথা বলতে শুরু করল, মেয়ে কিন্তু তাই বলে কি সবসময় নাকে, কানে, হাতে ওর্নামেন্টস পরে প্রমাণ করতে হবে বলে তিথি মুখ ভেংচি কেটে বলল, আমি মেয়ে, আমি মেয়ে…

সেজন্য কি তুই সবসময় ফতুয়া আর প্যান্ট পরিস?

অফকোর্স।

তিথি বলল, ওকে।

তুলি বলল, তবে তোকে কিন্তু শাড়ি-চূড়ি পরলেও ভালো মানাবে। ঐযে দেখ্‌ একটা কত ছোট্ট মেয়ে শাড়ি পরেছে, ভালো দেখাচ্ছে না?

তিথি তুলির আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়াও।

এই ধর শাড়ি পরবি, ম্যাচিং করে চূড়ি, ঠোঁটে লিপ স্টিক, কপালে টিপ। দেখিস তোকে খুব ভালো লাগবে। আর হাতে থাকবে মেহেদি। মেহেদি পরলে মেয়েদের হাত আরও সুন্দর লাগে। আঙ্গুল তো ছেলেমেয়ে সবারই আছে কিন্তু মেয়েদের আঙ্গুল সুন্দর বলে তো মেয়েদের আঙ্গুলের একটা স্প্যাশালিটি আছে। সেজন্যই তো বলে লেডিস ফিঙ্গার।

তিথি খুব খুশি হল, ওয়াও। তাহলে হয়ে যাক। তোর শাড়ি আছে?

আছে।

লাল শাড়ি?

তিথি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

তিথি আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, তাহলে আজই পরব।

তুলি বলল, তাহলে তাড়াতাড়ি মেহেদি পাতা নিয়ে বাড়ি চল।

রিতু তুলি আর তিথির কথা শুনছিল আর মেহেদি পাতা তুলচ্ছিল। বার বার করে সে মাথা নাড়ছিল।

তুলি জিজ্ঞেস করল, এই রিতু তুই কথা বলছিস না কেন? কী ভাবছিস? মুড অফ কেন?

একটা কথা মনে করতে পারছি না। এই মেহেদি পাতা নিয়ে। কী যেন একটা কবিতা নাকি গান।

তুলি বলল, মেহেদি পাতা নিয়ে একটা কবিতা আছে। অনেকেই ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ইউজ করে।

রিতু বলল, এক্সাক্টলি।

বাংলা কবিতা! তিথি কথাটা এমনভাবে বলল যেন বাংলায় কোন ভালো কবিতা থাকতে পারে না।

তুলি বলল, বাংলা কবিতা শোনার পর তুই এমন করলি কেন? যেন বাংলা কবিতা কোন কবিতাই না। তাহলে তো তোকে মেহেদি পাতা নিয়ে লেখা কবিতাটা শোনাতেই হয়।

রিতু বলল, খুব সুন্দর কবিতা।

তিথি এবার মনোযোগী হল, ওকে, তোরা যখন বলছিস।

রিতু বলল, তুলি শোনা তো।

তুলি শুরু করল,     অনন্ত মেহেদি পাতা দেখেছো নিশ্চয়ই

ওপরে সবুজ ভিতরে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত

নিজেকে আজকাল বড় বেশি মেহেদি পাতার মতো মনে হয় কেন?

ওপরে আমি অথচ ভিতরে কষ্টের যন্ত্রণা।

 

এমনিভাবে কবিতার কয়েকটা লাইন আবৃতি করতে না করতেই তিথিও আবেগে চিৎকার দিয়ে উঠল, ওয়াও। এত সুন্দর কবিতা!

রিতু বলল, আমি তোকে বলেছিলাম না? আসলে তুই বাংলা কবিতা পড়িস না সেজন্য।

তিথি স্বীকার করল, আসলে তুই ঠিকই বলেছিস। এখন থেকে আমিও বাংলা কবিতা পড়ব।

মেহেদি পাতা তুলে তুলি আগে তিথি আর রিতুকে আলপনা এঁকে হাতে মেহেদি পরিয়ে দিয়ে নিজেও মেহেদি পরে বলল, তোরা মেহেদি হাতে বসে থাক। আমি মাকে বলে ততক্ষণে আমার শাড়ি-কাপড়গুলো বের করি। বলে তুলি একটা মুচকি হাসি হেসে চলে গেল।

 

বাইরে একটা রিকশা ভ্যান এসে দাঁড়াল।

তরু বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ঢুকল।

রান্না ঘরে বাজার পৌঁছে দিয়ে সে একটা প্যাকেট হাতে আঙিনায় দাঁড়িয়ে বলল, তুলি এটা রাখতো।

তুলি বলল, আমার হাতে মেহেদি?

সে সবার দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই মেহেদি পরেছিস?

রিতু মাথা নেড়ে সায় দিল।

তুলি জিজ্ঞেস করল, কী এনেছিস?

চানাচুর।

কোন দোকান থেকে?

দিলদারের।

তুলি মুচকি হাসল।

তরু জিজ্ঞেস করল, হাসছিস্‌ কেন?

না এমনি।

এমনি কেউ হাসে না বুঝলি।

নিশ্চয়ই তোর মনের মধ্যে কোন শয়তানি জেগেছে।

এবার তুলি আরও হেসে উঠল। কোনোকিছু না বুঝে রিতু এবং তিথিও হেসে উঠল।

তরু উঠানে রাখা একটা চৌকিতে রেখে তুলির মাথায় একটা ঠোকা মেরে বাইরে চলে গেল।

রিতু জিজ্ঞেস করল, হাসলি কেন রে রিতু?

তোরা বুঝবি না।

তিথি বলল, বুঝিয়ে বল?

তুলি বলতে শুরু করল, দিলদারের চানাচুর নিয়ে চাচির জীবনে একটা ঘটনা আছে সেজন্য।

তিথি জিজ্ঞেস করল, কী?

তুলি বলল, না রে থাক।

তিথি জিদ ধরল, ভাব নিচ্ছিস কেন? বল না প্লিজ!

চাচির তো চাচার সঙ্গে লাভ ম্যারেজ। তো চাচার সঙ্গে যখন চাচির প্রথম দেখা হয়েছিল তখন চাচা চাচিকে দিলদারের চানাচুর কিনে দিয়েছিল।

রিতু বলল, তাতে কী?

চাচার ফ্রেন্ডরা ঘটনাটা জেনে ফেলেছিল তাই বিয়ের অনেক পরেও নাকি চাচির দেবররা চাচিকে দিলদারের চানাচুর বলে খেপাত।

তুলির কথা শুনে রিতু আর তিথি হেসে ফেলল। তারপর রিতু বলল, কারো সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ তো কোন না কোন ঘটনার মধ্য দিয়েই হতে পারে। তবে আর দিলদারের চানাচুরের দোষ কী।

তিথি মৃদু হেসে বলল, তবে দিলদারের চানাচুরের নামটা তোরা পাল্টে দিতে পারতিস তুলি।

মানে?

মানে এটা জানাজানির পর তোরা যদি দিলদারের চানাচুর নামটা পাল্টে দিতিস, এই যেমন হতে পারতো রোমান্টিক চানাচুর।

 

পনের

 

আদিত্য তখন ড্রয়িং রুমে বসে একের পর এক টি.ভি’র চ্যানেল পরিবর্তন করছে। তাকে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস’ দেখাচ্ছে আর রুমানা বারান্দায় পায়চারি করছে আর বার বার তিথিকে ফোন করছে কিন্তু সে ফোন রিসিভ করছে না। রুমানা বারান্দা থেকে রুমে এল। আদিত্যর হাত থেকে রিমোটটা এক রকম কেড়ে নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল এটা রাখো আগে তুমি আমার মেয়েকে এনে দাও। এজন্য আমি ওকে পাঠাতে চাই নি তুমি আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আর মেয়েকে সায় দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছ। আমার মেয়ের যদি কোনোকিছু হয় তবে তোমাকে আমি ছাড়ব না।

আদিত্য রুমানাকে সান্ত্বনা দিল, রুমানা একটু ধৈর্য ধরো। এমন কী হয়েছে যে তুমি একেবারে অসি’র হয়ে পড়েছ?

অসি’র হব না। আমার একটাই মাত্র সন্তান। ওর যদি কিছু একটা…

আদিত্য রেগে গেল, রুমানা কিছু হবে না। তুমি দেখো এভরিথিং ইজ ওকে।

ওকে। তুমি বলছ আর হচ্ছে? কীসের ভিত্তিতে বলছ তুমি? তুমি কি একবার ফোন করে রিতুর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলছ, নাকি ধারণার ওপর ডিপেন্ড করে বলছ? বসে না থেকে তো একবার রিতুর বাবাকে, টনির মাকে ফোন করে দেখতে পারো?

ও তুমি ঠিক বলেছো। বলে আদিত্য প্রথমে রকির বাবাকে ফোন করল, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। ভাই কেমন আছেন?

জি ভাই ভালো আছি। আপনি?

ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।

আচ্ছা ভাই আপনার কি রকি বা রিতুর সঙ্গে কথা হয়েছে?

হয়েছে তো, কেন বলুনতো?

তিথিকে ওর মা বার বার ফোন করছে কিন্তু ও ফোন রিসিভ করছে না।

ওরা তো ভালো আছে। টনি, রকি ওরা…

রইসের কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য ফোনটা রুমানাকে দিল, আচ্ছা আমি ওর মাকে দিচ্ছি বলে সে ফোনটা রুমানার হতে দিল।

রুমানা ফোন হাতে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বলুনতো ভাই ওদের কী খবর? তিথি ফোন ধরছে না কেন?

আপা ওরা তো খুব ভালো আছে। ওরা টাইমটাকে ভালোভাবে এনজয় করছে। টনি, রকি হাট গেছে আর রিতু, তিথি, তুলি ওরা বাসায় আছে।

তাহলে ফোন ধরছে না কেন?

হয়তো ফোন সাইলেন্ট করে বাইরে আছে। সবাই মিলে হৈ চৈ করছে। একটু আগে রকির সঙ্গে আমার কথা হল।

রুমানা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, তাহলে তিথি আমার ফোন ধরছে না কেন?

রইস বলল, আচ্ছা আপা আপনি বরং রকিকে কিংবা রিতুকে ফোন করুন। যদি তিথির ফোন সাইলেন্ট থাকে তবে ওরা এখন আপনাকে তিথির সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিবে।

দিন ভাই, প্লিজ!

রইস রিতুর নাম্বার দিল।

রুমানা রিতুকে ফোন করল।

রিতু ফোন রিসিভ করল, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কে বলছিলেন প্লিজ।

মামুনি আমি তিথির মাম্মি, তোমরা এখন কোথায় আছো মা?

রিতু বলল, বাসায় আন্টি।

তিথি কোথায়?

আমরা একসঙ্গে আছি আন্টি।

ওকে একবার দাও তো মা।

ওকে আন্টি কথা বলুন। বলে রিতু তার ফোনটা তিথির কানের কাছে ধরল।

তিথি বলল, হ্যালো মাম্মি। বল?

রুমানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ফোন ধরছিস না কেন মা?

মাম্মি আমার ফোন সাইলেন্ট করে চার্জে দিয়েছি।

কেন তুই জানিস না তোর সাথে কিছুক্ষণ পর পর কথা না বললে আমি থাকতে পারি না। কেন? এমন করলি কেন?

সরি মাম্মি।

ওকে। আর কখনো এমন কর্‌বি না।

ওকে মাম্মি। মাম্মি আমি হাতে মেহেদি পরেছি, একটু পর আমার হাতগুলো খুব সুন্দর হবে। তাই না মাম্মি?

হবে মা। তোর আঙ্গুলগুলোতো এমনিতেও অনেক সুন্দর।

আমি আমার হাতের ছবি তুলে তোমাকে পাঠিয়ে দিব। আমরা সবাই খুব ভালো আছি মাম্মি। তুমি কোন টেনশন করো না। মাম্মি একটু পর আমি শাড়ি পরব।

কেন?

এমনিতে। তুলির শাড়ি আছে। আমি ওর শাড়ি-চূড়ি, নাক ফুল আর বলে একটু লাইনে থাকো জেনে নিই, এই তিথি কানের ওর্নামেন্টসকে কী বলে রে?

তুলি বলল, দুল

তিথি তার মাকে বলল, দুল পরব। পরে তোমাকে ছবি পাঠাব।

তাহলে একবারে পাঠাবি।

ওকে। মাম্মি এখন রাখি পরে আমি তোমার সাথে কথা বলব।

রুমানা বলল, কেন রে আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তোর ডেডির সাথে কথা বলবি না?

বলব মাম্মি আমার দু’হাতে মেহেদি তো সেজন্য কথা বলতে প্রবলেম হচ্ছে। রিতু ওর ফোনটা আমার কানের কাছে ধরে আছে আর আমি কথা বলছি। রাতে আমি ফোন দিব মাম্মি।

ওকে মা। দেরি করিস না যেন। আর ফোন সবসময় হাতের কাছে রাখবি, আমি যখনই ফোন দিব তখনই যেন তোর সঙ্গে কথা বলতে পারি।

ওকে মাম্মি।

রুমানা কথা শেষ করে চোখ মুছল।

আদিত্য বলল, হল তো! তুমি একটুতেই খুব অসি’র হয়ে পড়ো। একটু ধৈর্য ধরবে তা না।

তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন বলতো? আমাদের একমাত্র সন্তানকে আমি খুঁজে পাব না আর আমি চুপ করে থাকব?

ধৈর্য ধরবে, খুঁজবে। নাকি কান্নাকাটি করবে আমাকে বকাবকি করবে।

করব, আমি বকাবকি করব, কান্নাকাটি করব, আমি তোমার মতো হার্টলেস হতে পারব না।

তবে আমার মেয়ে ওরকম করলে বল কেন বাবার মতো হয়েছে।

ওতো এক্সাক্টলি তোমার মতো হয়েছে। তোমার মতো আবেগ-অনুভূতি, রাগ-ক্ষোভ, জিদ-অভিমান সব তোমার মতো। তবে পাগলামিটা তোমার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। দেখতে হবে না মেয়েটা কার। আমার মেয়ে সেজন্য দোষগুলো তোমার মতো হয়েছে আর গুণগুলো আমার মতো।

রুমানা হেসে ফেলল।

আদিত্য জিজ্ঞেস করল, কী বলল?

রুমানা হঠাৎ করে হেসে উঠল, ও নাকি হাতে মেহেদি পরেছে। হাতে মেহেদি পরলে ওকে খুব সুন্দর দেখাবে। বলল রাতে শাড়ি পরবে, চূড়ি পরবে। বউ সাজবে বলে রুমানা জোরে হেসে উঠল।

আদিত্য জিজ্ঞেস করল, পাগল হলে নাকি?

হব না। মেয়েটা আমার বড় হচ্ছে। হঠাৎ করে ওর আবার শখ হয়েছে শাড়ি পরার।

ছবি পাঠাতে বলেছো না?

বলেছি, পাঠাবে।

রুমানা তিরস্কারের সুরে বলল, তবে আর কী মেইল খুলে বসে থাকো।

আদিত্য বলল, থাকবই তো।

হ্যাঁ আমি জানি তো।

 

ষোল

 

বাজার থেকে আসার পর রকি আর টনি ড্রয়িং রুমে বসল। টনি কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক তাকালও। রকি একবার উঠানে এসে আঙিনায় উঁকি দিল কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। শুধু রান্না ঘরে রান্নার কাজ চলছে। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? রকি আবার ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই টনি জিজ্ঞেস করল, পেয়েছিস?

রকি বলল, নাতো।

কোথায় গেল ওরা?

রকি তার মোবাইল ফোন বের করে বলল, আচ্ছা রিং দিচ্ছি।

পাশের রুম থেকে মোবাইলের রিং বেজে উঠল কিন্তু রিতু রিসিভ করল না। রকি পর পর কয়েক বার ফোন করল কিন্তু রিতু রিসিভ করল না।

টনি জিজ্ঞেস করল, ফোন ধরছে না?

না।

ঘটনা কী?

বাদ দে। একটু পর এমনি খুলে দিবে।

কিছুক্ষণ পর রিতু দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে এল। রকি কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, কী রে ফোন ধরলি না কেন?

রিতু মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আগে আয় দেখ, তারপর বলছি।

কোথায়?

পাশের রুমে।

রকি আর টনি পাশের রুমে গেল।

তিথি লাল রংয়ের শাড়ি পরেছে, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে চূড়ি, আলতা, লিপস্টিক পরেছে, কপালে দিয়েছে বড় একটা টিপ। রকি  রুমে ঢুকতেই চমকে উঠল, ওয়াও। ইউ আর লুকিং নাইস।

টনি বলল, অপূর্ব!

টনি বলল, তোকে তো শাড়ি পরে খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু তুই না এসব ড্রেস পছন্দ করতিস না। আজ আবার হঠাৎ করে…

হঠাৎ করে না, শখ করে। বলে তিথি আরও কী যেন কথা বলতে যাচ্ছিল। তুলি তিথির মুখে হাত দিয়ে বলল, এই চুপ, চুপ, নতুন বউকে কথা বলতে হয় না।

তিথি মৃদু হাসল।

রকি তার মোবাইল ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলল তারপর রিতু রকির কাছ থেকে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বলল, এই তিথি নামত। এই তোরা সবাই পাশাপাশি দাঁড়া কয়েকটা ছবি তুলি।

সবাই পাশাপাশি দাঁড়াল। কিন্তু তিথি বসা থেকে উঠতে গিয়েও পারল না। তুলি বুঝতে পারল, সে তিথির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, বুঝতে পাচ্ছি তুই নিজে উঠতে পারবি না, আমার হাত ধরে ওঠ।

তিথি তুলির হাত ধরে খাট থেকে উঠে সাবধানে নিচে নামল।

রিতু কয়েকটা ছবি তুলল তারপর তুলি মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বলল, এবার তুই বস্‌ আমি তোদের ছবি তুলি।

তরু উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে ডাক দিল, এই তুলি কী করছিস?

ও, তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আয়, আয় ভিতরে আয়।

তরু রুমে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল, তিথি শাড়ি পরেছিস, তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তো।

রিতু বলল, শুধু শাড়ি পরেছে, বউ সেজেছে।

তাইতো।

তুলি বলল, আচ্ছা এখন তুই ওদের পাশে দাঁড়া। আমরা সবাই ছবি তুলেছি এবার তুইও দাঁড়া কয়েকটা ছবি তুলি।

তুলি কয়েকটা ছবি তুলল।

তারপর তুলি বলল, চল সবাই বাইরে গিয়ে বসি।

তিথি বলল, নারে আমি শাড়ি পরে বাইরে যেতে পারব না।

কেন? লজ্জা পাচ্ছিস?

তিথি মাথা নেড়ে সায় দিল।

লজ্জা কীসের? শাড়ি পরা কি কোন লজ্জার বিষয়?

না, তা না। তবুও আমার কেমন যেন লাগছে।

রিতু বলল, ভাব নিচ্ছিস কেন? চল।

তিথি বলল তাহলে একটু ওয়েট কর, আগে ডেডিকে ছবিগুলো মেইল করি। এই রকি ছবিগুলো আমার ফোনে পাঠিয়ে দেতো।

রকি তার ছবিগুলো তিথির ফোনে পাঠিয়ে দিয়ে দিল।

তরু বলল, তোরা এখানে বস্‌ আমরা আঙ্গিনায় গিয়ে বসছি।

তিথি তার ছবিগুলো তার বাবাকে মেইল করার পর তার বাবার সঙ্গে কথা বলল তারপর তিথি, তুলি আর রিতু আঙ্গিনায় যাওয়ার জন্য উঠল।

তুলি আর রিতু একটু সামনে আর তিথি কয়েক পা পিছনে হাঁটতে হাঁটতে খুব সাবধানে রুম থেকে বারান্দায় গেল। বারান্দা থেকে আঙ্গিনায় নামতে গিয়ে তিথির পায়ের সাথে শাড়ি পেঁচিয়ে সে আঙ্গিনায় উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ল, ও মাই গড।

তুলি আর রিতু দৌড়ে এল। দু’জনে তিথিকে তুলল। তুলি জিজ্ঞেস করল, ব্যথা পেয়েছিস?

তিথি মাথা উঁচু-নিচু করে জানাল সে ব্যথা পেয়েছে।

তিথিকে পড়ে যেতে দেখে টনি আর রকি হাসিতে টলে পড়তে লাগল।

তরু বলল, শাড়ি পরে হাঁটতে পারিস না। জীবনে কী যে শিখলি।

তিথিকে পড়ে যেতে দেখে রান্না ঘর থেকে তুলির মা ছুটে এল। তুলির মা তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, তুই আবার ওকে শাড়ি পরাতে গেছিস্‌ কেন?

ও নিজেই পরেছে মা।

পরেছে ভাল কথা, ঘরে কাপড়-চোপড় বদলে আসলে হতো না। মেয়েটা কষ্ট পেল বলে সে তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কিছু মনে করিস না মা। তুলি ওকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যা, আগে ওর কাপড় বদলে তারপর বাইরে নিয়ে আয়।

ঠিক আছে মা। তিথি চল তোকে রুমে দিয়ে আসি।

লতিফ সাহেব তুলিকে জোরে ডাক দিল, তুলি।

জি দাদু।

এদিকে আয়তো।

আসছি।

তুলি রিতুকে বলল, রিতু তুই নিয়ে যাতো, পারবি?

রিতু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

যা, সাবধানে নিয়ে যাস। তিথি এক পা এক পা করে যাবি। শাড়ির ওপর যেন পায়ে না পড়ে, তাহলে কিন্তু আবার পড়ে যাবি।

তিথি কিছুটা লজ্জিত হল, ওকে।

তুলি চলে যাবার পর রিতু চাপা স্বরে তিথিকে বলল, তুই ডুবালি। শাড়ি পরে হাঁটতে পারলি না। এরা ভাববে শহরের মেয়েরা অকর্মণ্য। এত বড় মেয়ে শাড়ি পরে হাঁটতে পারে না।

তিথি বলল, তুই পরলে বুঝতিস শাড়ি পরে হাঁটা কঠিন কী না।

কিন্তু বিকেলে যে দেখলাম এতটুকু মেয়েরা শাড়ি পরেছে।

পরেছে, ওরা অভ্যস’ হয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে তিথি আর রিতু আবার রুমে ঢুকল।

 

সতের

 

তুলির এক ফুপু আর রইস একসঙ্গে লেখাপড়া করতো। সে যখন শুনল রইসের ছেলেমেয়েরা ঢাকা থেকে আসছে তখন তার বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করল। রাতে খাবার পর বাইরের আঙ্গিনায় জ্যোৎস্নার আলোতে সবাই যখন আড্ডা দিচ্ছিল তখন তুলি বলল, এই যে বন্ধুগণ সবাই মনোযোগী হও।

সবাই নড়েচড়ে বসল।

আগামীকাল জাহান ফুপু আমাদের দাওয়াত করেছে।

সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালও।

তুলি গলা ঝেড়ে বলতে স্বাভাবিকভাবে বলতে শুরু করল, আমার মনে হয় তোরা কেউ চিনতে পারছিস না। জাহান ফুপুর বাড়ি দ্বীপ নগর। ফুপু তো তোরা বুঝতেই পাচ্ছিস আমার ফুপু। ওখানে গেলে তোরা দেখতে পাবি ঘন শালবন, নানান প্রজাতির পাখি, কাশফুল, আরও, আরও অনেককিছু।

তিথি যেন শুনেই আবেগ আল্পুত হয়ে গেল, ওয়াও, ফরেস্ট দেখতে পাব, ফ্যান্টাস্টিক।

রকি বলল, ভেরি ভেরি ফ্যান্টাস্টিক। উই মাস্ট গো।

টনি তুলিকে বলল, অফকোর্স, তুই যাচ্ছিস তো আমার সঙ্গে?

অবশ্যই।

তিথি খোঁচা মেরে বলল, সে চিন্তা তোকে করতে হবে না। তুই যাবি আর তুলি যাবে না তা কী করে হয়।

টনি বলল, দিজ ইজ ভেরি বেড তিথি। তুই সবকিছুতেই টিজ করবি এটা ভালো দেখায় না। তুই তো কালকে ফোন করে রকিকে তাড়াতাড়ি হাট থেকে আসতে বলছিস, সেটা নিয়ে কি কেউ তোকে টিজ করেছে?

তিথি জোর গলায় বলল, বলেছি তো কী হয়েছে, আমরা একসঙ্গে এসেছি তোরা দু’জন হাট গেছিস্‌, আমরা তো তোদের তাড়াতাড়ি আসতে বলতেই পারি।

টনি বলল, তোদের বলছিস কেন? বল রকিকে।

তিথি বলল, ও তোকে ফোন করি নি সেজন্য তুই জেলাস ফিল করছিস? আমি সেভাবে চিন্তা করি নি। আমি ভাবছি আমরা সবাই ফ্রেন্ড। একজনের সঙ্গে আরেকজনের ভালো সম্পর্ক থাকতেই পারে। বলতে বলতে তিথির ফর্সা রং লাল হয়ে গেল।

টনি বলল, ও অন্য কেউ করলে দোষ আর তুই করলে কোন দোষ নেই।

রকি বলল, ওকে, এভরিথিং ইজ ওকে, উই আর অলসো ফ্রেন্ড, মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হতেই পারে।

তিথি রিতুর পাশে বসেছিল। রিতু অনেকক্ষণ থেকে কোন কথা বলছে না দেখে সে রিতুর কানে কানে বলল, এই তুই কথা বলছিস না কেন? যাবি না।

যাব।

চুপ করে আছিস কেন?

শুনছি তো।

কিছু বলছিস না যে? মুড অফ।

সবাই বললে শুনবে কে?

ও তাইতো।

তরু এ বাড়িরই ছেলে তাই তার দায়িত্ব পড়েছে ঢাকা থেকে আগত মেহমানদের আপ্যায়ন, তাদের সিডিউল ঠিক করা এসবের তাই সে কখনো সবার সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে আবার কখনো কখনো ছুটে যাচ্ছে তার দায়িত্বের টানে। সে রুম থেকে বেরিয়ে মোড়ে গিয়েছিল। তাই এতক্ষণ সে ছিল না।

বাইরের দরজা খোলা আছে। সে আসছে, শরতের হাল্কা কুয়াশা আর মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলার মতো কখনো শুভ্র জোৎস্নায় আলোকিত আবার কখনো মেঘে ঢাকা তারার মতো স্তিমিত আলোকিত হয়ে। তরুর আসা নিশ্চিত হয়ে তিথি রিতুর থুতনিতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তরু আসছে না?

তাইতো মনে হচ্ছে।

তরু কাছে আসতেই তিথি জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, হাই প্রিন্স ইউ আর সো লেট। প্লিজ বসুন। বলে সে রিতুর পাশের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল।

তরু রিতুর পাশের চেয়ারে বসল।

রিতু ফিসফিস করে বলল, দ্বীপ নগর চিনিস?

চিনব না, জাহান ফুপুর বাড়ি।

তুই যাবি না?

হ্যাঁ।

তিথি পাশেই ছিল সে রিতু আর তরুর কথা শুনে চাপা স্বরে বলল, বুকে একটা ফুঁ দে।

রিতু রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, তিথি টিজ করার জন্য এখনি সবাই তোকে…

তিথি তার ভুল বুঝতে পারল, সরি রিতু। বিশ্বাস কর এবার আমি আসলে টিজ করি নি আমি বলতে চেয়েছিলাম সবাই মিলে না গেলে, হৈ চৈ না হলে আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যেতো। আর তোরা সবাই শুধু আমার টিজ করাটাই দেখিস।

তুলি সবার উদ্দেশ্যে বলল, এটেনশন প্লিজ।

সবাই আবার মনোযোগী হল।

তুলি বলল, তোরা কেউ ইন্ডিয়া দেখেছিস?

সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালও।

তিথি বলল, তুই খুব নাটক করতে পারিস?

কেন? এটা আবার নাটকের কী হল?

তিথি বলল, তুই জানিস না আমরা গ্রাম দেখতে এসেছি। আমরা তো গ্রামই দেখি নি তাহলে ইন্ডিয়া দেখব কী করে, ঢাকা শহরের আশেপাশে তো আর বর্ডার নেই।

তুলি বলল, সরি।

তরু বলল, তোরা যে দুনিয়াতে কী দেখেছিস?

তিথি বলল, কী দেখেছি মানে? সংসদ ভবন দেখেছি, আহসানউল্লাহ মঞ্জিল দেখেছি, লালবাগের বাশের কেল্লা দেখেছি। ভাসানি নভো থিয়েটার দেখেছি। তোদের দেখাগুলো এক ধরনের আর আমাদেরগুলো আরেক ধরনের।

তরু রিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, তাই বলে এই বয়সেও গ্রাম দেখবি না, মেহেদি পাতায় কাঁটা থাকে কী না জানবি না, ধান গাছের তক্তা হবে কী না জানবি না, তোদের জীবন ষোল আনাই মিছে।

মানে? টনি জিজ্ঞেস করল।

মানে সুকুমার রায়ের একটা কবিতা আছে ষোল আনাই মিছে। মানে পুরো জীবনটাই নষ্ট। বলে তরু তুলিকে বলল, এই তুলি কবিতাটা তোর মুখস্থ আছে নাকি রে?

তুলি মাথা নেড়ে সায় দিল।

তরু বলল, থাকবে না, এভারগ্রিন বয়ের যোগ্য নাতনি না।

তিথি বলল, আচ্ছা তোরা বার বার এভারগ্রিন বয় কাকে বলছিস বলতো?

তরু বলল, এটা যার পরিচয় সেই দিবে।

তুলি বলল, তুইওতো যোগ্য নাতি হতে পারতিস।

আমার দরকার নেই ওসব আজাইড়া কাজ করার।

কী? দাদু আজাইড়া কাজ করে? এরকম একটা গ্রামে যেখানে দু’য়েকজন তরুণ-তরুণী ফেসবুক ব্যবহার করে, যে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ফেসবুক বলতে কিছু বোঝে না, অনলাইন সম্পর্কে যাদের তেমন কোন ধারণাই নেই সে গ্রামে পঁচাত্তর বছর বয়সের একজন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে, গ্রামের ঐতিহ্য বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয় তার কাজকে তুই আজাইড়া বলছিস। জানিস আমি যদি দাদুকে বলে দিই তোকে কী করবে?

সরি আপা দাদুকে বলিস না। বলে তরু তুলির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল।

ওকে। মাফ করে দিলাম। তবে আবার যদি কোনোদিন বলেছিস তো আমি কিন্তু আর তোকে মাফ করতে পারব না। তোকে শাস্তি পেতে হবে।

ওকে। এখন ওদের একটু কবিতাটা শোনা।

তুলির কবিতা আবৃত্তি শুরু করতে দেরি হচ্ছে দেখে তিথি অধৈর্য হয়ে উঠল, দেরি করছিস কেন? আবার নাটক করছিস কেন? তোর কবিতা আবৃত্তি তো খুব সুন্দর। সেই যে মেহেদি পাতা দেখেছো কখনো… কবিতাটা আবৃত্তি করলি মনে হয় এখনো মনের মধ্যে বাজছে কথাগুলো।

তুলি শুরু করল,

ষোল আনাই মিছে

-সুকুমার রায়

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,

মাঝিরে কন, “বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?

চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?’’

বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালল্যালিয়ে হাসে।

বাবু বলেন, “সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,

জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।’’

 

খানিক বাদে কহেন বাবু, “বলতো দেখি ভেবে

নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেমে?

বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?

মাঝি সে কয়, “আরে মশাই অত কি আর জানি?’’

বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি

জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!’’

তরু কবিতা আবৃত্তির মাঝে বলল, এই যে তোরা অষ্ট আনা মানে জানিস? আনা মানেই তো জানিস না।

তিথি তার মুখে আঙ্গুল কথা না বলার জন্য ইশারা করল আর তুলিকে ইশারা করল আবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

তুলি আবৃত্তি চালিয়ে গেল।

আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলতো ওরে বুড়ো,

কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?

বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?’’

বৃদ্ধ বলে, আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?’’

বাবু বলেন, “বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-

দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।’’

 

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,

বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!

মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,

ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?’’

মঝি শুধায়, “সাঁতার জানো?’’-মাথা নাড়েন বাবু,

মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই, এখন কেন কাবু?

বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,

তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!’’

কবিতা আবৃতি শেষ হতেই সবাই হাততালি দিল।

রকি আবেগ আল্পুত হয়ে বলল, ইউ আর সো গ্রেট তুলি।

এই প্রথম তিথি তুলিকে সমর্থন দিল, তুলির আবৃত্তির প্রশংসা করল, অসাধারণ। তুমি খুব সুন্দর আবৃত্তি করো তুলি। আই এ্যাম ভেরি গ্লাড।

তুলি বলল, তাহলে আমরা কাল সকালে রওয়ানা দিচ্ছি।

ওকে।

তুলির মোবাইল ফোন বেজে উঠল, একটু থাম প্লিজ! জাহান ফুপু ফোন করেছে।

তুলি ফোন রিসিভ করল, হ্যালো ফুপু আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

তুলি কয়েক মুহূর্ত কানের কাছে ফোন রেখে দিল তারপর কানের কাছ থেকে ফোন রাখতেই হারুন জোরে ডাক দিল, তুলি সবাইকে নিয়ে আয়। খাবার রেডি।

তুলি বলল, আসছি আব্বু।

 

আঠার

 

ঘন শালবন। এক দল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কিশোর-কিশোরী জঙ্গলের মেঠো পথ দিয়ে চলছে। কার কত প্রশ্ন, যেন প্রশ্নের শেষ নেই। একটা উইপোকার ঢিবি দেখে তিথি জিজ্ঞেস করল, এই রকি এটা কী বলতো?

রকি বলল, আমি জানি না।

তো? কে বলতে পারবে?

তরু বলল, এটা উইপোকার ঢিবি।

তিথি জিজ্ঞেস করল, উইপোকা মানে?

তরু বলল, মানে এক প্রজাতির পাখি।

টনি বলল, দাঁড়া তোরা তো সবাই মূর্খ, আমি দেখছি বলে সে তার সাথে থাকা ট্যাব চালু করে উইপোকা লিখে সার্চ দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল উইপোকার ছবিসহ জীবন বৃত্তান্ত। সে জোরে জোরে সবাইকে পড়ে শোনাল, উইপোকা একটি একটি ছোট পেকা। এর আয়তন এক ইঞ্চির দশ ভাগের এক ভাগ। উইপোকার শরীরে শক্ত খোলস পোশম নেই। উইপোকা দলবদ্ধভাবে গাছের বাকলে আড়ালে, ভিজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা কিংবা মাটির ঢিবি করে বসবাস করে।

সবাই হাততালি দিল।

তিথি আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল, ওয়াও।

সবাই আবার চলতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা একাধিক দিকে বিভক্ত হয়ে গেছে। রকি সবার সামনে দিয়ে হাঁটছিল। সে পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুলি এখন কোন দিকে যাব রে?

তিথি রকির পিছনেই ছিল। রকি তুলির নাম উচ্চারণ করায় সে মুখ বিকৃত করে বলল, সেটা তুলি কী করে বলবে?

ও তাইতো। এই তরু বলে রকি ডান দিকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই রাস্তাটা কোথায় গেছে রে?

তরু বলল, অনেকদূর। কিছুদূর যাওয়ার পর ধানক্ষেত। তারপর একটা আদিবাসী গ্রাম।

আদিবাসী?

তরু বলল, আদিবাসী চেনো না? সাঁওতাল।

তিথি কিছু না বুঝেই বলল, রকি চল আমরা ওদিকে যাই।

রকি জিজ্ঞেস করল, আগে সবগুলো রাস্তার কথা শুনি।

তিথি কিছুটা জিদের ভঙ্গীতে বলল, আর কিছু শুনতে হবে না, আমি বলছি যাব, তুই চল।

রকি এবার তরুকে বাঁ দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এটা কোন দিকে গেছে?

তরু বলল, এটা কতদূর গেছে আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় এটা গভীর বনে চলে গেছে, না যাওয়াই ভালো হবে।

রিতু তরুর কথাকে সমর্থন করল, ঠিক বলেছিস। আমরা এখানে থাকব।

তিথি বলল, তাই বলে জঙ্গল দেখতে এসে এখানে বসে থাকব। ইম্পসিবল।

টনি তরুকে জিজ্ঞেস করল, আর সোজা গেলে?

এটাও গভীর বনে গেছে। যাস না শেষে তোরা যদি পথ হারিয়ে ফেলিস তবে আর বের হতে পারবি না।

টনি তুলিকে জিজ্ঞেস করল, তুই কোনোদিন এসেছিস জঙ্গলে? অনেকদূর গেলে বের হতে পারবি?

কোনোদিন আসি নি তবে মনে হয় বের হয়ে আসতে পারব।

তিথি আবার টিজ করল, তুই তো শিল্পী, পথ হারিয়ে ফেললে গান গাইবি তখন আমরা তোকে নিয়ে আসব।

তুলি মুখ কাল করল পরক্ষণেই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, না, না তার প্রয়োজন হবে না, সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন আছে না?

ও তাইতো, বলে তিথি তার ছোট ব্যাগ হাতড়িয়ে দেখল, আমার মোবাইল?

না তার কোন ব্যাগ বা পকেটে মোবাইল ফোন নেই।

রকি তিথির ফোনে রিং দিয়ে বলল, রিং হচ্ছে তো। কয়েক বার রিং দেয়ার পর এক অপরিচিত নারী কণ্ঠ ফোন রিসিভ করল। রকি তার ফোনটা তুলিকে বলল, কথা বলতো, মনে হয় তোদের বাড়িতে কেউ রিসিভ করেছে।

তুলি ফোনটা কানের কাছে নিয়েই বলল, হ্যালো চাচি।

তুলির চাচি ফোন রিসিভ করেছে, সে বলল, চাচি এটা তিথির ফোন চার্জ দেয়া শেষ হলে তোমার কাছে রেখে দিও। আর ওর বাড়ি থেকে যদি ফোন করে তবে বল যে ওরা বেড়াতে গেছে।

আচ্ছা।

তিথি রকিকে বলল, চল, আমরা ঐদিকে যাই। বলে সে তরু যেদিকে গভীর জঙ্গল দেখিয়ে দিয়েছে সেদিকে যেতে বলল।

তুই না এদিকে যেতে চাইলি বলে রকি সাঁওতাল গ্রামের দিকে দেখিয়ে দিতেই তিথি বলল, না এখন আর ওদিকে যাব না। আমি গভীর জঙ্গলের দিকেই যাব।

তোরা আবার পথ হারাবি না তো? তোরা তো দু’জনে নতুন।

হারাব না। আমরা যেতে পারব। বরং তোরা এখানে থাক। আমরা জঙ্গল দেখতে এসেছি, জঙ্গলের গভীরে যাব।

টনি আমরা- বলে তুলির মুখের দিকে তাকালও।

তুলি বলল, আমরা এখানেই থাকব। আশে-পাশে, বেশিদূর গেলে আমার ভয় করবে। যদি পথ হারিয়ে ফেলি।

তরু বলল, আমি ভাবছিলাম সবাই একসঙ্গে বেড়াব। কারণ আমিও জঙ্গলে দু’য়েকবার এসেছি মাত্র।

তিথি রেগে গেল, তাহলে তোরা একসঙ্গে থাক, রকি চল আমরা যাই।

ওকে। বলে রকি আর তিথি চলে যাচ্ছিল।

তরু বলল, কেউ যদি পথ হারিয়ে ফেলিস তবে ফোন করবি। আর সবাই ঠিক এই মোড়ে চলে আসবি। আর না হয় গাড়ির কাছে।

ওকে। বলে রকি আর তিথি চলে গেল।

তরু বলল, রিতু, তুলি আয় এদিকে একটু বসি।

রিতু বলল, ওকে।

তরু আর রিতু হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেল। একটু পিছনে হাঁটছে টনি আর তুলি, কিছুদূর যাবার পর একটা ছোট্ট মাঠ। মাঠ বললে ভুল হবে একটু ফাাঁক জায়গা। তার পাশেই একটা গাছ প্রকৃতির নিয়মে বাঁকা হয়ে, আধ শোয়া হয়ে বেড়ে উঠেছে। তরু আধ শোয়া গাছের ওপর উঠতে যাচ্ছিল। রিতু একরকম আঁতকে উঠল, উঠবি না, পড়ে যাবি তো।

তরু একটু হাসল, এটুকু গাছের ওপর থেকে পড়ে যাব, এর চেয়ে কত বড় বড় গাছে উঠেছি বলে সে আধ শোয়া গাছের ওপর উঠে বসে টনির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

টনি না সূচক মাথা নেড়ে বলল, না আমার ভয় করে।

এটুকু গাছে উঠতে পারবি না। এই গাছে তো তুলিই উঠতে পারবে, তুলি? বলে তরু তুলির দিকে তাকাতেই তুলি এক লাফে গাছে উঠল।

টনির মুখ শুকিয়ে গেল। তার বুক ধুকধুক করে উঠল, তুলি তুই নেমে আয়। পড়ে যাবি, নেমে আয় প্লিজ!

তুলি বলল, কিচ্ছু হবে না। আমি এ গাছের ডালে ডালে যেতে পারব।

টনি জিদ ধরে বলল, না, না তোকে আর ডালে যেতে হবে না, নেমে আয়।

একটু থাম, তোর কয়েকটা ছবি তুলি বলেই রিতু তার মোবাইল ফোন দিয়ে তুলির ছবি তুলল।

রিতু তুই উঠবি? বলে তরু রিতুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

না, আমার ভয় করছে।

কীসের ভয়, আমি তোকে বলেছি না, আমি আছি ভয় নেই।

রিতু কিছুটা তিরস্কারের সুরে বলল, বাহ্‌, ভালো বলেছিস, আমি গাছ থেকে পড়ে গেলে তুই আমাকে কী করবি, শুনি? বলেই সে হেসে ফেলল।

তুই পড়ে যাবি কেন? আমি তোকে হাত ধরে টেনে তুলব। পাশে বসিয়ে রাখব। বলে সে আবার হাত বাড়িয়ে দিল।

তুলি বলল, ঠিকই বলেছে তরু খুব রিলায়েবল। একবার তোর হাত ধরলে আর কোনোদিন ছাড়বে না।

রিতু অদ্ভুত ভঙ্গীতে তরুর দিকে তাকিয়ে বলল, রিয়েলি?

একবার হাত বাড়িয়েই দেখো।

রিতু তার মোবাইল ফোনটা টনির হাতে দিয়ে বলল, তুই আমাদের কয়েকটা ছবি তুলবি তো। বলে সে তরুর বাড়ানো হাতের দিকে হাত বাড়াতেই তরু রিতুর হাত ধরে তাকে টেনে গাছে তুলল। তাকে পাশে বসিয়ে তার বাহুতে হাত রেখে বলল, এখনো ভয় করে?

রিতু না সূচক মাথা নাড়ল।

তরু বলল, সুকুমার রায় ঠিকই বলেছে তোদের জীবন আসলে ষোল আনাই মিছে।

হোক, মিছে হোক, তবু গাছে উঠে আমার কাজ নেই, বলে সে তুলির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, তুই গান গাইবি।

তুলি গাছ থেকে নেমে বলল, আচ্ছা।

তরু বলল, তুলি গান গাইতে গাইতে যেন দূরে যাস না। আমরাও যেন তোর গান শুনতে পাই।

ওকে ভাইয়া।

তরু আর তুলি সমবয়সী সাধারণত কেউ কাউকে ভাইয়া বা আপা বলে না। এখন আপা বলায় প্রথমে তরু হেসে উঠল তারপর সবাই তার সঙ্গে হাসিতে যোগ দিল।

 

উনিশ

 

রকি আর তিথি জঙ্গলের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে আর মাঝে মাঝে ছবি তুলছে কখনো অপরূপ প্রকৃতির, কখনো গাছপালা-লতাপাতার অবার কখনো সেলফি তুলছে নিজেদের এই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোর। এমনিভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে দু’জনের কেউ-ই বুঝতে পারে নি। অনেকক্ষণ এভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়াবার পর তিথি রকির কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলল, এই আমরা কোথায় যাচ্ছি?

রকি বলল, আমি তো সেকথা চিন্তা করি নি। আমাদের ফিরে যাওয়া দরকার। চল, যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে ফিরে যাই।

কিন্তু ফেরার রাস্তা কোন দিকে?

রকি সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, এদিকে।

তিথি রকির আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, গাধা ওদিকে তো আমরা যাচ্ছি। বলে সে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, আমি যেদিকে বলি সেদিকে চল। আমার মনে আছে। আমরা এদিক দিয়ে এসেছি।

রকি কিছুটা রেগে গেল, সেজন্য আমি আসতে চাই নি। তরু ঠিকই বলেছিল সবাই একসঙ্গে থাকতে।

তিথিও রেগে গেল, এখন সব দোষ আমার! তুই আসতিস না, আমি একাই আসতাম।

একাই আসতিস না? দু’জনে এসেও পথ হারিয়ে ফেলছি আর তুই একাই আসতিস না?

সঙ্গে এসেছিস সেজন্য তোকে ধন্যবাদ। এখন কথা বলিস না।

কয়েক মুহূর্ত কারো মুখে কোন কথা নেই। তিথি গাছের ডালে একটা সুন্দর পাখিকে গাছের ডালে ঠোকর মারতে দেখে বলল, ওয়াও, রকি দেখ্‌ দেখ্‌ একটা সুন্দর পাখি।

রকি মাথা উঁচু করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, কোথায়?

তিথি রকির মাথা ঘুরিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ঐযে গাছের ডালে, দেখতে পেয়েছিস? কী সুন্দর না?

ওয়াও। খুব সুন্দর তো। দাঁড়া একটা ছবি তুলি বলে রকি তার মোবাইল ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলল।

তিথি বলল, দেখছিস, আমি যদি তোকে না নিয়ে আসতাম তবে তুই এতো সুন্দর একটা পাখি দেখতে পেতিস না। থ্যাংকস বল।

রকি বলল, থ্যাংকস ফ্রেন্ড।

তিথি জিজ্ঞেস করল, কী নাম পাখিটার জানিস?

না।

তিথি দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, এটা পাখির নাম জানিস না তুই? এটা ময়ূর।

রকি বলল, তুই যেভাবে বললি তাতে মনে হল তুই জানিস আসলে এটা ময়ূর না।

কী তাহলে?

আমিও জানি না। তবে এটা ময়ূর না এটা আমি কনফার্ম।

তুই তো কিছুই জানিস না। তুই ময়ূরটাকেও চিনিস না। এটা ময়ূরের বাচ্চা।

আচ্ছা থাক। তুই যখন এটাকে ময়ূর বলছিস তখন আমার কিছু বলার নেই। আগে বাসায় যাই। তারপর বই দেখে তোকে আমি ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিব।

ওকে।

ওকে চল বলে দু’জনে হাঁটতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর তিথি জিজ্ঞেস করল, ক’টা বাজে রে দেখতও?

রকি সময় দেখার জন্য তার মোবাইল ফোন বের করল। ফোন হাতে নিয়েই সে মুখ কাল করল, ও মাই গড, মোবাইল অফ!

তিথির মুখ শুকিয়ে গেল, হোয়াট?

চার্জ নেই মনে হয় বলে রকি বার বার ফোন অন করার চেষ্টা করল কিন্তু ফোন আর চালু হল না। দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে গেল, এখন!

তিথি রকির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, চল একটু বসি, আমি আর হাঁটতে পারছি না।

রকি বলল, আমিও।

দু’জনে ঘাসের ওপর বসল।

কারো মুখে কোন কথা নেই। এই ক্ষণিক আগের হাসি-খুশি মুখে এখন দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা। তিথি কান্না কান্না গলায় বলল, ফোনে চার্জ আছে কী না তুই সকালবেলা দেখবি না?

মনে ছিল না।

তিথির গলায় উত্তেজনা, কেন মনে ছিল না? কেন?

রকি বলল, তোর যেমন মোবাইল ফোন নিয়ে আসার কথা মনে ছিল না তেমনি আমারো সকালবেলা ফোন চার্জ দেয়ার কথা মনে ছিল না।

কী হবে এখন? আমরা কীভাবে এখান থেকে বের হব।

তিথি প্লিজ একটু শান্ত হ, ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখি, কী করা যায়।

তিথি আবারো উত্তেজিত হল, কী কর্‌বি তুই? আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি আর হাঁটতে পারছি না। যদি এখান থেকে বের হতে না পারি…

তিথি প্লিজ তুই একটু চুপ করবি।

আমি তো চুপ করে থাকতেই চাই কিন্তু…

রকি বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

তিথি কৌতূহলী দৃষ্টিতে রকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বুদ্ধি?

জোরে জোরে টনির নাম ধরে ডাকব।

তিথির মুখ উজ্জ্বল হল, ওয়াও। গুড আইডিয়া। এমনি আমি তোকে আইডিয়ালিস্ট বলি। তোর মাথায় আসলে বুদ্ধি আছে বলে সে রকির মাথায় একটা ঠোকা মারল।

রকি টনি বলে পর পর কয়েক বার জোরে ডাক দিল। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। রকি আবারো টনি টনি বলে ডাকতে শুরু করল কিন্তু কারো সাড়া না পেয়ে তিথিকে বলল, চল, এখানে বসে থেকে ডাক দিলে হবে না। চল আমরা যেদিক থেকে এসেছি ডাকতে ডাকতে সেদিকে যাই।

ওকে।

দু’জনে উঠে দাঁড়াল।

রকি তিথির একটা হাত ধরে যেতে শুরু করল, তিথি বলল , এদিকে কেন?

আমরা এদিক দিয়ে এসেছি না?

না, বলে তিথি অন্যদিকে হাত দেখাল।

রকি সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ্‌ আমরা যখন এসেছিলাম তখন সূর্যটা আমাদের ডান দিকে হেলে ছিল আর এখন বাম দিকে।

এক্সাক্টলি। আমরা এসেছিলাম সকালে এখন কি সকাল?

রকি বলল, ওকে চল, তুই যেদিকে যেতে চাস সেদিকেই চল। বলে রকি আবার টনি… বলে ডাকতে শুরু করল।

 

সবার একত্রিত হওয়ার কথা ছিল দুপুর একটা মধ্যে কিন্তু এখন বেলা দু’টা বাজে কিন্তু রকি আর তিথি ফিরে এল না। প্রথমে সবাই স্বাভাবিক মনে করেছিল কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা থেকে বার বার ফোন করে যখন ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। তখন সবার মুখ শুকিয়ে গেল। তরু জোরে রকি রকি বলে ডাকতে শুরু করেছে কিন্তু তাদের কোন সাড়া মিলছে না।

রিতু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এখন কী হবে? ওদের যদি না পাওয়া যায়?

তরু কিছুটা ধমকের সুরে বলল, রিতু এমন কথা বলিস না তো। দেখ্‌ কোন একটা ব্যবস্থা হবেই। আমার মনে হয় ওরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, খুঁজে খুঁজে ঠিকই আসবে।

কীভাবে আসবে? ওরা তো কোনোদিন জঙ্গলে আসে নি।

আমরা যেমন খুঁজছি, ওরাও তেমনি আমাদের খুঁজছে। আমি একটা কথা বলি?

সবাই তরুর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালও।

তুলি আর রিতুকে মাইক্রো বাসের কাছে রেখে আসি আর আমরা দু’জন আবার জঙ্গলে ঢুকে জোরে জোরে নাম ধরে ডাকি। এখানে বসে থেকে তো অনেকবার ডাকলাম। মনে হয় ওরা অনেক দূরে আছে সেজন্য ওরা আমাদের ডাক শুনতে পাচ্ছে না।

তুলি বলল, তাহলে আমরাও সঙ্গে থাকলে অসুবিধা কী।

রিতু শুষ্ক মুখে বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি আর হাঁটতে পারব না।

তরু একটা শুষ্ক হাসি হাসল, ও তুই তো আবার হাই ব্রিড।

রিতু বলল, মানে?

মানে হাই ব্রিড পোল্ট্রি মুরগী যেমন কষ্ট সহ্য করতে পারে না, একটু বেশি গরম বা একটু বেশি ঠাণ্ডা হলেই ঝিমিয়ে পড়ে তেমনি।

ইয়ার্কি না?

ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? একটা ব্যবস্থা হবেই। চল আগে তোদের মাইক্রো বাসের কাছে রেখে আসি।

 

বিশ

 

রকি কখনো টনি আর কখনো তরু বলে ডাকছে কিন্তু কারো কোন সাড়া নেই এভাবে জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে আর জোরে ডাকতে ডাকতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার পা দু’টো যেন শিথিল হয়ে আসছে। তিথি রকির কাঁধে ভর করে হাঁটছে। দু’জনে একটা মোড়ে এসে পৌঁছাল।

তিথি রকির কাঁধ থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে নিচে বসে পড়ল, এটা সেই মোড় না? যেখান থেকে আমরা গেছিলাম?

রকি একবার এদিক-সেদিক তাকালও তারপর বলল, কীভাবে বলব আমার কাছে তো সব রাস্তা, সব মোড়, সব গাছ একই রকম মনে হচ্ছে।

তিথি বলল, আমি আর পারছি না রকি, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমার খুব পানি খেতে ইচ্ছা করছে। আই নিড সাম ওয়াটার, আই নিড লাঞ্চ।

রকি একটা কষ্টের হাসি হাসল, এখনো ইংরেজি। পশু-পাখিরা নিশ্চয়ই ইংরেজি বোঝে না। ওদের ভাষা আলাদা। আমি কনফার্ম, আমরা যদি ওদের ভাষা বুঝতাম তবে ওরা আমাদের সহযোগিতা করতো।

তিথি একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, এখনো ইয়ার্কি করছ? এখন আমাদের জীবন বাঁচানোই কঠিন আর তুমি আছো ইয়ার্কি নিয়ে।

রকি আবার জোরে ডাক দিল, তরু…

তিথি উঠে দাঁড়িয়ে রকির কাঁধের ওপর ভর করল। রকি সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

হঠাৎ রকি চমকে উঠল, তিথি!

বল।

দেখতও ওগুলো কী? ভল্লুকের মতো।

তিথির বুক কেঁপে উঠল, আতঙ্কে তার মুখ শুকিয়ে গেল। সে পেছন থেকে রকির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ও মাই গড। রকি আমার খুব ভয় করছে, প্লিজ এখান থেকে চল।

দু’জনে ভয়ে কাঁপছে। প্রাণীগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দু’জনের আতঙ্ক আরও বাড়ছে। তিথি বলল, চল আমরা কোথাও লুকাই।

দু’জনে রাস্তার পাশে একটু ঘন জঙ্গল দেখে লুকাল। প্রাণীগুলো সোজা রাস্তা দিয়ে তাদের অতিক্রম করল। কিন্তু তাদের পেছনে থাকা কাল মানুষটি তাদের দেখে ফেলল। তার হাতে একটা তীর ধনুক, মাথায় মাথাল দু’আঙ্গুলের ফাঁকে শালপাতার বিড়ি। সে সামনে এসে দাঁড়াতেই দু’জনের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল। অজানা আশঙ্কায় হৃদপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে কাঁপছে।

তাদের আতঙ্ক দেখে সে আশ্বস্থ করল, আলোবেন বতর:আ বাবু, আলোবেন বতর: আ, অকয় কানাবেন আবেন দো? চেকাতেবেন হেচ্‌ এনা ননডেদো? অকাতে বাংবেন চালা:কানা? (ভয় নেই বাবু, ভয় নেই। তোমরা কে? এখানে কীভাবে এলে? এখন কোথায় যাবে?)।

লোকটি যখন কথা বলছিল তখন তার নাম-মুখ দিয়ে বিড়ির ধোঁয়া বের হচ্ছিল। রকি তিথির দিকে তাকালও। তিথির চোখ-মুখ থেকে আতঙ্ক কমছে না। নাকের কাছ থেকে ধোঁয়া সরিয়ে সে রকির শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, না, তুমি কথা বলবে না। আমার খুব ভয় করছে, যদি কিছু হয়ে যায়।

রকি বলল, না তিথি, দেখে আমার তা মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে এই লোকটি আমাদের জন্য হেল্প ফুল হবে।

রকি আর তিথির ঠোঁটে কাঁপুনির তীব্রতা দেখে সে বলল, আলোবেন বতর:আ বাবু, ইঞা: ত্রু:তুম দ ফিলিপ মারন্ডী, জাত দ সাঁওতাল মেনখান মানওয়া গে। ইঞ দ বেন পাতিয়াউ দাড়েয়াঞা (ভয় নেই বাবু, আমার নাম ফিলিপ মারন্ডী, জাতে সাঁওতাল কিন্তু মানুষ। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করতে পারো)।

ফিলিপের কথা দু’জনের কেউ-ই বুঝল না। তবে অনুমান করতে পারল যে সে তাদের জন্য হেল্প ফুল হবে।

রকি উঠে দাঁড়াল। তিথি রকির কাঁধে ভর করে দাঁড়াল।

রকি বলল, আমার নাম রকি ওর নাম তিথি। আমরা জঙ্গল দেখতে এসেছি।

ফিলিপ মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে।

তারপর রকি তাদের আলাদা হওয়া এবং পথ ভুলে যাওয়ার ঘটনা শোনাল।

সবকিছু শুনে ফিলিপ বলল, আবেন দ আডি ভিতরী গাজাড়রেবেন বলোয়াকানা, আভি লাংগাবেন ঞেল: কানা। দেলা আলে ওড়া: সেচ সেনকাতে যা উভিচ। ওনা তায়নম গাড়িঠেন ইঞ্‌ সেটের কাবেনা নাহা: (তোমরা জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে এসেছো। তোমাদের তো খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তোমরা আমার বাড়িতে চল। তারপর আমি তোমাদের গাড়ির কাছে পৌঁছে দিব)।

তিথি আপত্তি করল, না, না আপনি আমাদের মাইক্রো বাসের কাছে যাবার পথ দেখিয়ে দিন, প্লিজ!

হর ইঞ্চ উদু: আবেন খান্‌ আর হ হরবেন আদা নাহা:। দেলা ইঞ্‌ গেঞ্‌ ইদি সেটের কাবেনা। (পথ দেখিয়ে দিলে তোমরা যেতে পারবে না বাবু। আবার পথ হারিয়ে ফেলবে। চল আমি তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি, তোমরা আমার সঙ্গে এসো), বলে সে সামনে চলতে থাকল আর বিড়বিড় করে রকি আর তিথিকে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করতে শুরু করল, আডি কাজাক বেন বতরলেনা বাং (তোমরা খুব ভয় পেয়েছিলে না)?

তিথির ভয় তখনো কাটে নি, সে একটা ঢোক গিলে রকির কানে ফিসফিস করে বলল, আমার কিন্তু এখনো ভয় করছে, লোকটা আমাদের অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে না তো।

রকি তিথির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে যেমন হাঁটছিল তেমনিভাবে হাঁটতে হাঁটতে আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, তা একটু পেয়েছিলাম।

আলোবেন বতর:আ বাবু, আলোবেন বতর:আ, নেতার দ গাজাড়রে জাহান বতর দ বানু: আ, যত বতর দ একেন শহর রে গে। (ভয় পাবে না বাবু, ভয় পাবে না, আজকাল জঙ্গলে কোন ভয় নেই যত ভয় শহরে)।

রকি আর তিথি কোন কথা বলছে না তার পিছু পিছু হাঁটছে কিন্তু সেদিকে ফিলিপের কোন লক্ষ্য নেই। সে আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলছে আর হাঁটছে, মিতধাও ইঞ ঢাকা তেঞ চালাওলেনা। মিত্‌দিন আয়ুপ বেলাঞ ঞেল কেদা যে, থোড়াগান ছিনতাইকারী, মিত হড় ছুরিতে কো সব: কেদেয়া আর টাকা কো ইদি কেত্‌ তায়া- শায় শায় হড়কো হিজু: চালা: কানা মেনখান অকয় ইঁ চেত হঁ বাকো রড় লেদা। নোয়া গাজাড় রে হোয়লেন খান নুই ফিলিপ মারন্ডী খান নোয়া আ: সারতে ওনকোয়া: কোড়াম ইঞ্চ্‌ তুঞ্চ পারম কেয়া। আড়ি আঁট রারা: সানা লেদিঞা বাবু, ঞিনদা ইঞ্‌রেন সুবোল এ মেতাদিঞা, আমদো তাড়া: তে চালাংমে। ঢাকারে দো বাম তাঁহে দাড়েয়া: আ আ্যাম দো। দোসার হিল: গেঞ হেচ্‌ এনা। আপেয়া: শহর মঁজ বাঞ আইকাউলেদা বাবু। আপেয়া: শহর বে যুদি দিন মাহারে শায় হড় সামাংরে হড়গে হড়কো গচদাড়ে লেখান। আর আলেয়া: নোয়া গাজাড়রে হেচকাতে বিঞ কিদিঞ আর জানোয়ার কো নাপায়তেকো বিদায়পে খান, অকাটা:দ বোগে হোয়া: আ বাবু? (আমি একবার ঢাকা গেছিলাম। সেদিন বিকেলে আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম একটা লোককে কয়েক জন ছিনতাইকারী ছুরি মেরে টাকা নিয়ে গেল। অথচ পাশ দিয়ে শত শত মানুষ যাচ্ছে আসছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না। এই জঙ্গলে হলে…বলে সে ঘুরে তীর ধনুক তাক করে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, এই ফিলিপ মারন্ডী হলে এই তীর দিয়ে ওদের বুক আমি ঝাঁঝরা করে দিতাম। আমার খুব কান্না পেয়েছিল বাবু, রাতে আমার সুবল বলল, তুমি বাড়ি যাও বাবা। তুমি ঢাকা থাকতে পারবে না। আমি পরদিন চলে এসেছি। তোমাদের শহর আমার ভালো লাগে নি বাবু। তোমাদের শহরে যদি দিনের আলোয়, শত শত মানুষের সামনে মানুষ মানুষকে মারতে পারে আর আমাদের এই জঙ্গলে এসে সাপ-পোকামাকড়, হিংস্র প্রাণই যদি তোমাদের নিরাপদে ফিরিয়ে দেয় তবে কোনটা ভালো বাবু?)

এতক্ষণে তিথির ভয় কেটেছে সে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন আঙ্কল।

হেচ সেটেরেনাবেন বাবু, হানে আবেনা: গাড়ি ঞেল:কানা (তোমরা এসে গেছো বাবু, ঐ দেখো তোমাদের গাড়ি দেখা যায়)।

তিথি আনন্দে লাফিয়ে উঠল, ওয়াও।

তুলি অভিমানের সুরে বলল, তোরা এসেছিস তাহলে!

ফিলিপ বলল, নিত: দঞ রুয়াড়া বাবু, জোহার মামুনি, জোহার, জোহার (আমি আসি বাবু, আসি মামুনি, নমস্কার)।

তিথি বলল, না আপনি যাবেন না, তারপর তুলিকে বলল, তুই আমাদের কয়েকটা ছবি তোলতো, রকি আয়।

ফিলিপের দু’পাশে রকি আর তিথি দাঁড়াল। তুলি ছবি তুলল।

রকি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কল।

ফিলিপ আবার জোহার বাবু, জোহার মামুনি (আসি বাবু, আসি মামুনি) বলে চলে গেল।

তিথি তুলির কাছে গেল, তার দু’কাঁধে হাত রেখে চোখের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল, তোর জেলাসি হচ্ছে? বলে সে আপনমনে হো হো করে হেসে উঠল।

রাগে তুলির চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে বলল, তা হবে কেন? তোদের দু’জনের জন্য আমাদের কতক্ষণ থেকে টেনশন করতে হল। আমরা তো ভেবেছিলাম তোরা হারিয়ে গেছিস্‌?

রিয়্যালি। আমরা তো হারিয়েই গেছিলাম। ভাগ্যিস এক ফিলিপ আঙ্কল আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।

রিতু মুচকি হাসি হেসে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়েছিল।

রকি রিতুকে ধমকের সুরে বলল, রিতু! তারপর বলল, বাদদে তো ওসব। টনি, তরু ওরা কোথায়?

তুলি বলল, ওরা তোদের খুঁজতে গেছে।

ওদের আসতে বল।

দাঁড়া আমি ফোন করছি বলে তুলি ফোন করল।

 

একুশ

 

কালিয়াগঞ্জ হাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ একপাশে ঘন বন আর অপর পাশে লোকালয় তারপর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম দ্বীপ নগর। শুধু সীমান্ত ঘেঁষা বললে ভুল হবে। সীমান্তের ওপর বলাই যুক্তিসঙ্গত। গ্রামের তিন দিকেই ভারতীয় ভূখণ্ড শুধু উত্তর দিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ড গ্রামটিকে ডিম্বাকৃতিতে ধারণ করেছে। এই গ্রামেরই শেষ বাড়িটি জাহানের। জানালা খুললেই ভারত।

মাইক্রো বাস যখন জাহানের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন বিকেল চারটা বাজে। তরু সবার সঙ্গে জাহান আর আতাউরের পরিচয় করে দিল।

জাহান রকির পাশে এসে দাঁড়াল, ও বাবা তুমি রইসের বেটা না?

ক্ষুধা তৃঞ্চায় তখন সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। রইস একটা শুষ্ক হাসি হেসে সায় দিল।

আর বেটি?

রিতু জাহানের পাশে গিয়ে ফিক করে একটা হাসি দিয়ে বলল, আমি।

জাহান আরও কথা বাড়াবে জেনে আতা তাড়া করল, তুমি আগে খেতে দাও। তারপর কথা বল।

 

খাওয়ার পর সবাই বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল। তিথি কাঁটাতারের বেড়া দেখিয়ে রকিকে জিজ্ঞেস করল, এই তরু কাঁটাতারের বেড়া কেন রে ঐদিকে?

জাহান বলল, ওটা ইন্ডিয়া মা।

তিথি আনন্দে চিৎকার করে বলল, ওয়াও। তারপর দৌড়ে সেদিকে যেতে উদ্যত হচ্ছিল।

তুলি হাত টেনে ধরল, যাবি না। আগে ভালো করে শোন একবার হারিয়ে গিয়ে তুই আমাদের অনেক টেনশনে ফেলেছিলি এবার ইন্ডিয়া গিয়ে যদি আবার ধরা পড়িস তখন আরেকটা ফ্যাসাদে পড়ব আমরা।

তিথি ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল, তাতে কী হয়েছে একটা নতুন এ্যাডভেঞ্চার হয়েছে।

জাহান নিষেধ করল, যেও না মা। কাঁটাতারের বেড়া দূরে হলেও বর্ডার আরও কাছে বলে জাহান সামনে কয়েক ফুট দূরে একটা সীমানা পিলার দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই যে পিলারটা দেখছ ওটার ভিতরে বাংলাদেশ আর বাইরে ইন্ডিয়া।

আন্টি পিলারের ওপাশে যাওয়া যাবে না?

না মা।

তিথি কারো কোন কথা শুনল না, সে দৌড়ে সীমানা পিলারের বাইরে ভারতীয় ভূখণ্ডের কয়েক ফুট ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দেখ তোরা কিন্তু যেতে পারলি না। আমি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে এলাম।

রকি তিথির একটা হাত চেপে ধরে বলল, ভেরি গুড, ইউ আর এ গুড গার্ল। কিন্তু এমন আর করিস না।

জাহান বলল, আর যেও না মা।

আতা মন্টু বলে জোরে ডাক দিতেই বাড়ির কাজের ছেলেটি চলে এল, চাচা।

এখানে কয়েকটা চেয়ার এনে দে তো।

আচ্ছা।

মন্টু কয়েকটি চেয়ার এনে দিল।

সবাই গোল হয়ে বল।

একেক জনের একেক রকম প্রশ্ন, ফুপু তুমি কখনো গেছো ইন্ডিয়ায়? রকি প্রশ্ন করল।

না।

তিথি অবাক হয়ে গেল, একবারো যান নি?

না।

যেতে ইচ্ছা করে নি আপনার?

করেছিল, এদিকের অনেকেই যায় কিন্তু বাবা আমাকে নিষেধ করেছে। বাবা বলেছে বেআইনিভাবে ইন্ডিয়া যেতে হয় না। তাই ইচ্ছা করলেও আমার যাওয়া হয় নি।

তিথি বলল, আমি হলে যেতাম। আমার এখনই খুব যেতে ইচ্ছা করছে আর আপনি…

জাহান বলল, আমরা বাবা-মা’র কথা মেনে চলি মা। বলেই জাহান উদাস হয়ে গেল, তোমার ফুপাকে দেখছ না, আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর হল কোন ছেলেমেয়ে হল না। অনেকেই কত বলেছে আরেকটা বিয়ে করতে কিন্তু তোদের ফুপা করল না তার মা নিষেধ করেছে বলে। বলতে বলতে জাহানের দু’চোখ পানিতে ভরে গেল।

আতা ধমকের সুরে বলল, এদের এসব কথা বলছ কেন? এরা ছোটো মানুষ।

জাহান আতার ধমককে পাত্তা দিল না। আবার বলতে শুরু করল, রইস আর আমি প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম।  এস.এস.সি পাসের পর বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিল বলতে বলতে জাহান রিতুকে বলল, তোমরা আজ থাকো মা।

রিতু অপ্রস’ত হয়ে গেল। সে একবার সবার দিকে তাকালও, তুলি ইশারায় না সূচক উত্তর জানাল।

তিথি বলল, ওয়াও গুড আইডিয়া।

রকি তিথির হাতে একটা চাপ দিয়ে বলল, না।

কেন?

রকি বলল, তোর ফোন ছেড়ে এসেছিস। এতক্ষণ কতবার তোর ফোন এসেছে জানিস?

তাতে কী। মাম্মিকে সরি বললে সব…

তরু বলল, না ফুপু দাদু রাগ করবে। বলে দিয়েছে রাতে সবাইকে নিয়ে বসবে।

আমি বাবাকে ফোন করে বলছি, জাহান বলল।

তুলি বলল, ফুপু ওরা কোনোদিন গ্রামে আসে নি। খুব কম সময়ের জন্য এসেছে। দাদু বলেছে ওরা যেন অল্প সময়ের মধ্যে অনেককিছু দেখতে পারে।

তাতো বলবেই, বাবার তো সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।

আতা বলল, তুমি বরং তাড়াতাড়ি চা করে নিয়ে আসো।

চা-চক্র শেষ হল। সবাই মাইক্রোবাসে উঠবে এমনসময় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বরাবর উজ্জ্বল আল জ্বলে উঠল। সবাই একরকম চমকে উঠল।

রিতু বলল, ফুপু কী হল?

জাহান বলল, বর্ডারের আলো জ্বলে উঠল।

তিথি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ফ্যান্টাস্টিক। মানুষ খুব কনজারভেটিভ, এই বর্ডারটা না থাকলে কী হতো, আমরা এখন যেতে পারতাম।

কথা বলতে বলতে সবাই জাহান আর আতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল। জাহান রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে লাগল।

তিথি আবার কথা বলতে শুরু করল, আমার মনে হয় পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া সবাই স্বাধীন।

রিতু বলল, মানে?

এই যেমন পশু-পাখিরা যদি এখনই মনে করে তারা ইন্ডিয়ায় যাবে চলে যেতে পারে তাদের কোন সীমানা নেই। কিন্তু মানুষের যত বাধা।

তুলি বলল, আমিও তাই মনে করি মানুষের যত বাধা। শুধু কি ইন্ডিয়ার কাঁটা তারের বেড়া? কথা বলতে বাধা, কথা শুনতে বাধা, যেন দুনিয়াতে নিজের মতো করে কিছু করতে গেলে বাধাই বেশি।

তরু গলা ঝেড়ে কিছুটা গম্ভীর হয়ে মুরুব্বি পনা কথা বলল, তোরা সব ঠিক বলছিস না, ভালো কাজে কোন বাধা নেই যত বাধা মন্দ কাজে আর মন্দ কাজে মানুষের আসক্তি বেশি।

তুলি ইয়ার্কি করে বলল, তুই ঠিক বলেছিস দাদু ভাই।

সবাই হেসে উঠল।

 

বাইশ

 

বাড়িতে এসেই তিথি আগে তার মাকে ফোন করল, হ্যালো মাম্মি।

হ্যালো। মা কেমন আছিস? রুমানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল।

ভালো আছি মাম্মি। তুমি কাঁদছ কেন?

রুমানা অভিামানের সুরে বলল, কেন কাঁদছি, না? সকালে কথা বলে গেলি একবার মনে করলাম তোর সঙ্গে একটু কথা বলি। তোকে কতবার যে ফোন দিলাম তুই ফোন রিসিভ করছিস না। পরে জানলাম তুই জঙ্গল দেখতে গেছিস্‌।

হ্যাঁ। মাম্মি সে এক ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার তোমাকে গিয়ে বলব।

এসে কেন এখনি বল।

জঙ্গলে গিয়ে আমরা হারিয়ে গেছিলাম।

মানে?

দ্যট মিনস আমরা জঙ্গল থেকে বের হবার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

তারপর-

তিথি রুমানাকে তাদের জঙ্গল থেকে বের হওয়ার কথা বলল। সবকিছু শুনে রুমানা বলল, একথা আর কাউকে বলবি না মা।

তিথি এতক্ষণ আনন্দের সঙ্গে মা’র সঙ্গে কথা বলছিল এবার সে একটু থমকে গেল, কেন মাম্মি?

এটা ভাল শুনায় না মা।

কেন? আমরা জঙ্গলে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম একথা কাউকে বলা যাবে না কেন?

বড় হলে বুঝবি মা। আর কোথাও যাস না মা, তাড়াতাড়ি চলে আয় সবাই মিলে।

ওকে মাম্মি তুমি কোন চিন্তা করো না।

চিন্তা তো করতে চাই না মা। কিন্তু চিন্তা না করে কী থাকতে পারছি? তোকে আর আমি কোথাও একা যেতে দিব না। বলতে বলতে রুমানার কণ্ঠস্বর আবার জড়িয়ে গেল।

তিথি বলল, মাম্মি তুমি কাঁদছ! ওকে মাম্মি আমি আসছি এজ আর্লিয়েস্ট পসিবল।

ততক্ষণে সবাই ড্রেস বদলে আঙ্গিনায় চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। তুলির মা বলল, তুলি তোর দাদু তোকে দু’বার খুঁজেছে।

ও তাইতো। রিতু যাবি? এই রকি, টনি তোরা যাবি?

কোথায়?

দাদু ডেকেছে।

রকি বলল, তিথি আসুক।

তুলি বাঁকা চোখে রকির দিকে তাকিয়ে বলল, ও তোরা তো আবার ট্যাগ হয়েছিস্‌।

সবাই হা হা হা করে হেসে উঠল।

তিথি এল, কী রে আমার নাম করে হা হা করে হাসছিস্‌ কেন? আমি কনফার্ম তোরা আমাকে নিয়ে কিছু বলছিলি।

রিতু বলল, আরে না। তোকে নিয়ে কেউ কিছু বলবে এতো সহজ, আমি আছি না। চল দাদু ডেকেছে।

কথা বলতে বলতে সবাই লতিফ সাহেবের ঘরে ঢুকল।

লতিফ সাহেব তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। সবাইকে ভিতরে আসতে দেখে তিনি যেভাবে কাজ করছিলেন সেভাবেই মৃদু  হেসে বললেন, ওয়েলকাম অল ইয়ংম্যান এন্ড ইয়ং লেডি।

তুলি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ইয়ং ম্যান।

তুলি লতিফ সাহেবকে ইয়ং ম্যান বলায় তিথি হেসে উঠল।

লতিফ সাহেব একবার তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করল, তোরা সবাই বস্‌। আমি স্ট্যাটাসটা দিই। বলতে বলতে লতিফ সাহেব টাইপ করতে শুরু করলেন।

রকি, টনি রিতু, তিথি সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালও।

রিতু তুলিকে জিজ্ঞেস করল, মানে?

তুলি মুখে একটা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল, চুপ!

তিথি বলেই ফেলল, স্ট্যাটাস মানে? আপনার কি ফেসবুকে এ্যাকাউন্ট আছে?

ততক্ষণে লতিফ সাহেবের স্ট্যাটাস দেয়া শেষ হয়েছে। তিনি ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বললেন, হ্যাঁ? সার্চ দাও দেখি বলে তিনি তার এ্যাকাউন্ট আই.ডি বললেন।

সবাই মোবাইল ফোনে লতিফ সাহেবের এ্যাকাউন্ট সার্চ দিল।

তিথি প্রথম খুঁজে পেল, ওয়াও। ইউ হ্যাভ এ লট অফ ফ্রেন্ড।

তরু রুমে ঢুকল, ও তোরা সবাই ইয়ং ম্যানের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিস।

তিথি বলল, হি ইজ অলসো এন ইয়ং ম্যান।

তুলি হাসতে হাসতে বলল, আমিতো বলি এভারগ্রিন বয়।

রিতু বলল, ঠিকই বলিস।

তিথি বলল, এক্সাক্টলি।

তোরা সবাই নাস্তা খেয়েছিস।

তুলি একটা নি:শ্বাস টেনে বলল, সে সময় আর পেলাম কই। এভারগ্রিন বয় তো…

আমি ডেকেছি এইতো। ওকে, তরু তুই আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আয় এখানে। আজ আমরা সবাই এখানে বসে নাস্তা করব।

তুলি বলল, ফেসবুকে দাদুর একটা গ্রুপ আছে।

রিতু বলল, তোমার গ্রুপের নাম কী দাদু?

লতিফ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ট্রেন টু ভিলেজ।

টনি সবার আগে গ্রুপে ঢুকে বলল, ওয়াও, খুব সুন্দর কভার তো। এতো সুন্দর ছবি আপনি কোথায় পেয়েছেন? জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ট্রেন…এটা কোথায় পেয়েছেন?

লতিফ সাহেব বললেন, আমার গ্রুপ মেম্বাররা পাঠিয়েছে।

রকি বলল, ইওর কালেকশন ইজ ভেরি গুড।

লতিফ সাহেবের এ্যাকাউন্ট আই.ডি আর গ্রুপের নাম শোনার পর সবাই এখন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। সবাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। গ্রুপে জয়েন করল। লতিফ সাহেব সবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল, সবাইকে গ্রুপে একসেপ্ট করল।

নাস্তা চলে এল।

লতিফ সাহেব সবাইকে নাস্তা নিতে বললেন। সবাই নাস্তা খেতে খেতে ফেসবুকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবার তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, প্লিজ এটেনশন মি।

সবাই মোবাইল ফোন থেকে মুখ তুলল কিন্তু তিথি যেমন মনোযোগ সহকারে ফেসবুকে চ্যাটিং করছিল সে মুখ না তুলে তেমনিভাবে বলল, প্লিজ বলুন, ইয়ং ম্যান।

লতিফ সাহেব মৃদু অভিমানের সুরে বললেন, তিথি-

তিথি মুখ তুলল, ও সরি।

লতিফ সাহেব বললেন, ওকে। একটা কথা সবাই মনে রাখবি। সবচেয়ে ভালো ফ্রেন্ড যারা তোদের কাছের মানুষ যেমন: বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদু-দাদি, কাজিন এরা। সামাজিক যোগাযোগ বলতে সেটা শুরু হবে ফ্যামিলি থেকে।

তিথি আবদারের সুরে বলল, দাদু প্লিজ।

রকি বলল, দাদু তিথি সরি বলেছে, ছেড়ে দাও।

তুলি মুখ বিকৃত করে বলল, তিথিকে বলছে দেখে তোকে লাগছে কেন? এখন যদি বলি…

তিথি বলল, কী বলবি? বল?

তুলি বলল, না থাক।

লতিফ সাহেব সবাইকে থামতে বললেন, ওকে। এভরিথিং ইজ ওকে। আমি এখন তোদের ট্রেন টু ভিলেজ নিয়ে কিছু বলব।

সবাই মনোযোগী হল।

তোরা ঢাকা থেকে সবাই গ্রাম দেখতে এসেছিস। ভালো লাগছে তো তোদের?

তিথি সবার আগে জবাব দিল, ভেরি ইন্টারেস্টিং।

সবাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

কিন্তু এটাও ইন্টারেস্টিং যে তোরা এই চৌদ্দ পনের বছর বয়সে এই প্রথম গ্রাম দেখলি।

অফ কোর্স, আরও আগে দেখা উচিত ছিল, রকি বলল।

টনি বলল, কিন্তু আমাদের তো গ্রামে কোন রিলেটিভ নেই। আমরা কার কাছে আসব?

লতিফ সাহেব বললেন, প্রবলেমটা এখানেই। খুঁজে দেখলে তোদেরও অনেক রিলেটিভ পাওয়া যাবে কিন্তু তোরা কেউ খুঁজতে চাস না। বরং ভুলতে চাস। আর সেটাই হয়েছে, তোরা ভুলতে চাইছিস, ভুলে গেছিস্‌। আজ থেকে দুই বা তিন জেনারেশন আগে সবারই গ্রামে কোন না কোন রিলেটিভ ছিল।

রকি বলল, তা হয়তো ছিল।

অবশ্যই ছিল। এই যে আমাদের রইস, রকির বাবার নাম বলায় রিতু আর রকি লতিফ সাহেবের মুখের দিকে তাকালও।

লতিফ সাহেব বলতে শুরু করলেন, রইস ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত গ্রামে থেকে লেখাপড়া করেছে। তারপর ঢাকা শহরে চলে গেছে, হায়ার এডুকেশন নিয়েছে, লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হয়েছে। তারপরও সে কয়েক বার গ্রামে এসেছে। কিন্তু সেটা রইস পর্যন্তই, তোরা বলে তিনি রকি আর রিতুর মুখের দিকে তাকালেন, তোরা এই প্রথম গ্রামে এলি। তোদের যখন ছেলেমেয়ে হবে তারা নিশ্চয়ই জানবে না গ্রামে তাদের কেউ আছে।

টনি মাথা নেড়ে সায় দিল।

লতিফ সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, এই যেমন টনি বলছে ওর গ্রামে কেউ নেই। এটাই বাস্তবতা যে রকি আর রিতুর ছেলেমেয়েরাও একদিন বলবে গ্রামে ওদের কেউ নেই। এমনিভাবে গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে একটা প্রাচীর তৈরি হয়েছে এবং এটা দিনে দিনে আরও উঁচু হচ্ছে। তোরা এখানে আসার আগে হয়তো ভাবতিস গ্রাম মানে নোংরা, কাদা, পুকুর, নদী, খাল জঙ্গল এসব, মানে ভয়ঙ্কর কিছু।

তিথি বলল, এক্সাক্টলি।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আলু মাটির নিচে নাকি ওপরে ফলে, ধান গাছের তক্তা হয় কীনা জানতে চাইবে। গাছ থেকে বেগুন তুলতে গিয়ে কাঁচি নিয়ে ছুটে যাবে। একজন পরিপূর্ণ মানুষ সাঁতার জানবে না, পুকুর দেখে ভয় পাবে এই শিক্ষা অপরিপূর্ণ।

লতিফ সাহেব যখন কথা বলছিলেন তখন সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।

লতিফ সাহেব একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস টেনে আবার বলতে শুরু করলেন, এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের কথাই বল। সামাজিক যোগাযোগের জন্য ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে গিয়ে মানুষ যদি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, দূরের মানুষ কাছে টানতে গিয়ে যদি কাছের মানুষ দূরে চলে যায় তবে তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কও ফেল করল।

তিথি বলল, এক্সাক্টলি।

আমার ট্রেন টু ভিলেজের উদ্দেশ্যে গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে যেন এই প্রাচীর তৈরি না হয়। মানুষে মানুষে কোন তফাৎ নেই, গ্রাম কিংবা শহর, ধনী কিংবা দরিদ্র, ধর্ম কিংবা বর্ণ। মানুষ মানুষে কোন তফাৎ নেই। কেউ এসি রুমে বসে সফটওয়ার আবিষ্কার করে আর কেউ রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কৃষিকাজ করে তাদের খাদ্যের জোগান দেয়। সমাজে অবদানের দিক থেকে কৃষকের অবদানই বেশি অথচ কৃষক মানে আজকাল দরিদ্র, গ্রাম মানে জরা-বার্ধক্য। মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের মানুষ যেন আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেজন্য গ্রামের অপার সৌন্দর্যকে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ছড়িয়ে দেয়া। কথা বলতে বলতে লতিফ সাহেব হাঁপিয়ে উঠেছেন, তাঁর দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল।

সবাই একবাক্যে বলল, আমরা আপনার ট্রেন টু ভিলেজকে ছড়িয়ে দিব দাদু।

থ্যাংকস এভরিবডি।

তুলি লতিফ সাহেবের কাছে গিয়ে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এবার ক্ষান্ত হও বালক। তুমি ক্লান্ত।

তিথি বলল, ইউ আর সো টায়ার্ড।

লতিফ সাহেব দৃঢ় চিত্তে, বলিষ্ঠ কণ্ঠে আঙ্গুল উঁচু করে নজরুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তি করল, বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, সেইদিন হব আমি শান্ত।

 

তেইশ

 

তিনজনে এক বিছানায় শুয়েছে। আজ সারাদিন, না শুধু আজ সারাদিন নয়, এ’দিন খুব পরিশ্রম গেছে ওদের ওপর দিয়ে। সবাই একরকম ক্লান্ত। রিতুর একটু একটু ঘুমের তন্দ্রা এসেছে, তুলিও ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তিথির চলছে একের পর এক প্রশ্ন।

ক’দিন থেকেই ঢাক-ঢোল বাজছে। আগেও তিথির কানে এসেছে কিন্তু সে ভালোভাবে লক্ষ্য করে নি। আজ সেই বাজনা আরও বেড়েছে। তার কৌতূহলী স্বভাব বশত: তুলিকে জিজ্ঞেস করল, এই তুলি মিউজিক হচ্ছে নাকি রে?

তুলি মৃদু হেসে বলল, মিউজিক না, পুজোর ঢোল বাজছে।

এদিকেও পুজো হয়!

হ্যাঁ, হবে না কেন, বিলের ওপারে যে পাড়াটা আছে, ওটা হিন্দু পাড়া, ঐ পাড়ায় আমাদের অনেক আত্মীয় আছে।

রিতু জিজ্ঞেস করল, আত্মীয়?

হ্যাঁ।

হিন্দু আর মুসলমানে আত্মীয় হয়?

কেন হবে না। আত্মার সম্পর্কই তো আত্মীয়। আমরা ওদের বাড়ির যেকোনো অনুষ্ঠানে যাই, ওরাও আসে, ওদের পুজোর সময় আমরা যাই আবার আমাদের ঈদের সময় ওরা আসে। তবে আর আত্মীয়তার বাকি থাকল কী।

তিথি সায় দিল, এক্সাক্টলি! এভরিবডি ইজ ইকুয়াল। তুই আগে বললে আজ পুজো দেখতেও যেতাম।

রিতু স্বীকার করল, তুই ঠিকই বলেছিস, এভাবে তো কোনোদিন চিন্তা করি নি।

শেষ হয় নি তো, কালকেও যেতে পারবি। আগামীকাল বিজয়া দশমী।

বিজয়া দশমী কী?

বিজয়া দশমীতে হিন্দুরা তাদের দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দেয়।

তিথি জিজ্ঞেস করল, তুই পুজো করতেও জানিস নাকি?

পুরোপুরি জানি না একটু একটু জানি।

তিথি তার মোবাইল ফোন বের করে আদিত্যকে ফোন করল।

রিতু জিজ্ঞেস করল, কাকে ফোন দিচ্ছিস?

ডেডিকে।

কেন?

কাল যে পুজো, মাকে জানাব না।

কালকে জানাতে পারতিস। তোর সবকিছু বেশি বেশি।

তিথি তার বাবার সঙ্গে কথা বলল, হ্যালো ডেডই।

বল মা? এতো রাতে কেন? এ্যানি প্রব্লেম?

না ডেডই। এদিকে দুর্গা পুজো স্টার্ট হয়েছে। কাল আমরা পুজো দেখতে যাব।

ভেরি গুড। সাবধানে থাকিস মা।

ওকে ডেডই। ডেডই আমার না একটা এভারগ্রিন বয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।

আদিত্য কপালে চোখ তুলে বলল, এভারগ্রিন বয়!

হ্যাঁ। সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স ইয়ং ম্যান, টুয়েলভ ইয়ার্স গ্রিন বয়। আমরা ওর নাম দিয়েছি এভারগ্রিন বয়।

আমি তোর কথা বুঝতে পারছি না মা। একটু ক্লিয়ারলি বলতো।

আমরা যাদের বাড়িয়ে এসেছি না, তুলি। ওর দাদু সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড, স্টিল হি ইজ এন ইয়ং ম্যান।

পাশে থেকে রুমানা জিজ্ঞেস করল, কী বলছে তিথি। কী সব বয়, ইয়ং ম্যান শুনছি। আমাকে দাও তো, বলে রুমানা একরকম জোর করে আদিত্যর হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, এই কী হয়েছে রে? কী সব বয়, ইয়ং ম্যান, গ্রিন বয় বলছিস?

মাম্মি তুলির দাদু। হি ইজ সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড বাট স্টিল নাউ হি ইজ এন ইয়ং ম্যান। তুমি তার এক্টিভিটিজ জানলে অবাক হয়ে যাবে। সবাই তার নাম দিয়েছে এভারগ্রিন বয়।

আচ্ছা। ঠিক আছে এখন অনেক রাত হয়েছে, ঘুমা।

ওকে মাম্মি।

তিথি ঘুমলও না। সে আবার ফোন টিপতে শুরু করল।

রিতু আবারো বিরক্তির সুরে বলল, আবার কাকে?

রকিকে বলব না, একটা মেন্টাল প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে না, শোন সবকিছুতে মেন্টাল প্রিপারেশনের প্রয়োজন আছে। আর কোনোকিছু এনজয় করার জন্য তো মেন্টাল প্রিপারেশন মাস্ট।

ওকে বল। তবে তাড়াতাড়ি শেষ কর।

ওকে। বলে সে রকিকে ফোন দিল।

রকি ঘুমের মধ্যে ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো কে বলছেন প্লিজ?

এই আমাকে চিনতে পাচ্ছিস না? ঘুমিয়েছিস নাকি?

রকি বিরক্তির সুরে বলল, হ্যাঁ ঘুমাচ্ছিলাম। দিলি তো ঘুমটা ভেঙ্গে। বল কী হয়েছে?

শোন কাল আমরা পুজো দেখতে যাব। মেন্টালি প্রিপারেশন নে।

কেন ওখানে গিয়ে আমাকে ফাইট করতে হবে?

রেগে যাচ্ছিস না। তোকে না বলাই ভালো ছিল। দিলি তো আমার মেজাজটা বিগড়ে। মেজাজ বিগড়ে গেলে আমি সারারাত ঘুমাতেই পারব না।

ওকে। ওকে সরি। এখন রাখি প্লিজ!

থ্যাঙ্ক ইউ।

 

চব্বিশ

 

পুজো মণ্ডপের সামনের পূজারি আর দর্শনার্থীদের ভিড় জমে উঠেছে। দূর থেকে এই নবাগতদের দেখে সবাই রাস্তা ফাঁকা করে দিল। একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হল, এই সরে দাঁড়া, সরে দাঁড়া।

কেউ কেউ বলল, কে এল? নতুন মনে হচ্ছে?

মণ্ডপের কাছে যেতেই তিথি আনন্দে একরকম লাফিয়ে উঠল, ওয়াও। ভেরি ইন্টারেস্টিং। এই রকি দেখ দেখ বলে তিথি পাশে তাকাতেই রিতু বলল, ওরা তো ছেলেদের লাইনে। এখানে ছেলেদের লাইন আর মেয়েদের লাইন আলাদা।

তিথি বলল, ও।

দূর থেকে টনি হাত নেড়ে জানাল, এই তুলি আমরা এখানে।

রকিও হাত তুলতেই তিথি বলল, হাই।

তিথি তুলিকে জিজ্ঞেস করল, এই তুলি দুর্গার এতোগুলো হাত কেন রে?

আমি জানি না রে।

তুলিকে দেখে একটা মেয়ে এগিয়ে এল, তুলি, কখন এলি?

এইমাত্র এলাম। বলে তুলি বলল, সাবিত্রী তোকে পরিচয় করে দিই। বলতেই তিথি হাই বলে তার নাম বলল।

রিতু মিষ্টি হাসি হেসে বলল, আমি রিতু।

সাবিত্রী বলল, নমস্কার।

তিথি তুলিকে কাছে টেনে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বলল, নমস্কারের কী জবাব দিতে হয় রে।

তুলি বলল, নমস্কার।

তিথি সাবিত্রীর নমস্কারের জবাবে মাথা নত করে বলল, নমস্কার।

তুলি জিজ্ঞেস করল, এই সাবিত্রী তুই কি জানিস দুর্গার এতোগুলো হাত কেন?

সাবিত্রী দেবী দুর্গাকে লক্ষ্য করে দু’হাত একসঙ্গে করে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল, দেবী দুর্গা দুর্গতি নাশিনী। মানে সমস্ত দুর্গতি থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য, সেজন্য দুর্গার অনেকগুলো হাত।

তিথি বলল, থ্যাংকস।

এখন কয়েকটা ছবি তুলে নিই বলে তিথি তার মোবাইল ফোন বের করে ছবি তুলতে তুলতে তারপর বলল, এখান থেকে গিয়ে ছবিগুলো ট্রেন টু ভিলেজে আপলোড দিতে হবে।

সবাই পুজো মণ্ডপ থেকে বের হল। মণ্ডপের সামনে মেলা বসেছে। হরেক রকম খেলনা, মুড়ি, মুড়কি, খুরমা, জিলাপি, পিঁয়াজিসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান বসেছে।

তুলি কিছু কিনতে যাচ্ছিল কিন্তু তিথি হাত টেনে ধরল, এগুলো কিনবি না, নোংরা-ময়লা এগুলো খেলে যেকোনো ডিজিস হতে পারে।

তুলি হাসল, কিচ্ছু হবে না। তোদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম সেজন্য এতো চিন্তা করিস, সবাই খাচ্ছে দেখিস কিচ্ছু হবে না। বলে তুলি মুচকি হাসি হেসে বলল, ধুলোবালি যাই থাকুক ফরমালিন তো আর নেই।

তিথি স্বীকার করল, তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।

সাবিত্রী তাড়া করল, তাড়াতাড়ি চল।

রিতু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব এখন তুলি?

সাবিত্রীদের বাড়িতে।

ওরা কোথায় বলে রিতু ডানে-বাঁয়ে একবার তাকালও তারপর হাত তুলে ডাক দিল, এই রকি। আমরা এদিকে।

রকি, টনি আর তরু এল।

রিতু রকিকে জিজ্ঞেস করল, যাবি?

কোথায়?

সাবিত্রীদের বাড়িতে।

রকি বলার আগে তিথি উৎসাহের সঙ্গে বলল, অফকোর্স।

সবাই মেলা থেকে বের হল।

 

মণ্ডপের অদূরে সাবিত্রীদের বাড়ি। মাটির দেয়ালের ওপর ছনের ছাউনি। সবাই বাড়িতে ঢুকতেই তিথি আনন্দে একরকম লাফিয়ে উঠল, ওয়াও, ভেরি গুড।

তুলি জিজ্ঞেস করল, কী?

তিথি ছনের ছাউনির দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, এগুলোকে কী বলে তুলি?

তুলি বলল, ছন। ছনের ছাউনি।

এই রিতু দেখ, দেখ কী সুন্দর না? কটেজের মতো।

রিতু মৃদু হেসে বলল, এক্সাক্টলি।

সাবিত্রীর মা রান্না ঘরে কাজ করছিল সবাইকে ঢুকতে দেখে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

তুলি বলল, আদাব পিসি।

সাবিত্রীর মা উঠানে একটা পাটি পেতে দিতে দিতে বলল, তোদের যে কী বসতে দিই মা। আমরা গরীব মানুষ।

তুলি বলল, এভাবে বলবেন না পিসি।

সবাই পাটিতে গোল হয়ে বসল। তিথি আবার তুলিকে কাছে টেনে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বলল, পিসি কী রে?

তুলি মৃদু হেসে বলল, পিসি হল ফুপু।

তিথি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সাবিত্রীর মা তোর পিসি হয়! তোরা মুসলমান আর…দাঁড়া একটু মিলিয়ে নেই।

রকি তিথির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল, তিথি! এতো কিউরিসিটি ভালো না।

সাবিত্রী প্লেটে করে নারিকেলের নাড়-, সন্দেশ, বাতাসি নিয়ে এল।

সাবিত্রী বিনয়ের সঙ্গে বলল, প্লিজ স্টার্ট কর।

তিথি বলল, ভেরি নাইস। এই রকি আজ পিকনিক, পিকনিক মনে হচ্ছে, না?

সবাই তিথির কথাকে সমর্থন করল।

 

সবাই বের হয়ে যখন মণ্ডপের কাছে এল তখন প্রতিমা বিসর্জনের প্রস’তি শুরু হয়ে গেছে। দুর্গাকে একটা গরুর গাড়িতে উঠানো হয়েছে, পিছনে নারী-পুরুষের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেছে। বিলের দু’পাশে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। হিন্দু-মুসলমান সবাই প্রতিমা বিসর্জন উপভোগ করছে।

সাবিত্রী বলল, এখানে দাঁড়া। এদিক দিয়ে নিয়ে যাবে আর বলে সাবিত্রী দূরে বিলের সামান্য স্রোতকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওখানে বিসর্জন দিবে, বলতে বলতে সাবিত্রীর দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল, কণ্ঠস্বর বুজে এল।

 

পঁচিশ

 

বিদায়ের ঘণ্টা বেজে উঠল। আগামীকাল সকালে সবাই ঢাকা ফিরবে। সন্ধ্যায় পুজো থেকে ফিরে সবাই লতিফ সাহেবের ঘরে গেল। তিনি তখন একটা বই পড়ছিলেন। রিতু সবার আগে ছিল সে সালাম দিল, দাদু আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। ও তোরা এসেছিস, বস্‌। তুলি কোথায়?

তরু তুলি বলে জোরে ডাক দিল।

তুলি এল, এভারগ্রিন বয়, বল?

তোর হারমোনিয়াম নিয়ে আয় আজ একটু গান শোনা। অনেকদিন থেকে তোর গান শোনা হয় না।

তুলি চলে গেল। তিথি তার মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। লতিফ সাহেব কিছুটা অভিমানের সুরে বললেন, হাই তিথি তারপর একটু হেসে বললেন, উই আর অলসো এ লট অফ ফ্রেন্ড ওয়েট ফর ইউ। প্লিজ এটেনশন।

তিথি মোবাইল ফোন থেকে মুখ তুলে বলল, রি এভারগ্রিন বয়। ট্রেন টু ভিলেজে পুজোর ছবি আপলোড দিচ্ছিলাম।

লতিফ সাহেব তার ল্যাপটপে দেখে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। খুব সুন্দর হয়েছে।

তুলি তার হারমোনিয়াম নিয়ে এল। তরু মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসল।

তুলি হারমোনিয়ামে সুর তোলার আগে লতিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, ইয়ং ম্যান কোন্‌ গান?

তরু আমার ক্যামেরাটা নে। ভিডিও করবি। বলে লতিফ সাহেব তরুর হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বললেন, ইয়েস র্স্টাট। আগে তোর পছন্দমতো দু’য়েকটা গান গা, তারপর আমার পছন্দে…

ওকে। বলে তুলি শুরু করল লতা মুঙ্গেস্করের গান

আমি যে কে তোমার তুমি তা বোঝো না

আমি চিরদিন তোমারই তো থাকব

তুমি আমার আমি তোমার

এ মনে কী আছে পারো যদি খুঁজে নাও

আমি তোমাকেই বুকে ধরে রাখব

তুমি আমার আমি তোমার তুমি তা বোঝো না…

তুলির গান শেষে সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল।

গানের সুর শুনে তিথির বাবা-মা, চাচা-চাচি সবাই লতিফ সাহেবের দরজার সামনে ভিড় জমাল। লতিফ সাহেব জোরে ডাক দিলেন, হারুন, হাসিব, বউমা সবাই ভিতরে এসো।

তুলি একে একে কয়েকটি গান গাইল আর সবাই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিল।

অনেকক্ষণ একটানা কয়েকটা গান গাওয়ার পর তুলি হারমোনিয়াম থেকে মুখ তুলে বলল, ইয়ং ম্যান তোমার পছন্দের…

লতিফ সাহেব বললেন, একটা আব্দুল আলীমের গান।

তুলি বলল, কোনটা বল?

লতিফ সাহেব বললেন, পরের জায়গা পরের জমি।

তুলি শুরু করল,

পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি লই

আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।

এই ঘরখানা তার জমিদারি, আমি পাই না তাহার হুকুমজারি

আমি পাই না জমিদারের দেখা মনের দু:খ কারে কই

আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।

গান শুনতে শুনতে লতিফ সাহেব উদাসীন হয়ে গেলেন, তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

গান শেষ করে তুলি বলল, হাই ইয়ং ম্যান তুমি কোথায় চলে গেছো?

লতিফ সাহেব যেন তন্দ্রার মধ্যে পড়েছিলেন। তুলি কাছে গিয়ে কানের কাছে বলল, হাই ইয়ং ম্যান।

লতিফ সাহেব চমকে উঠলেন, হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমি যেন হারিয়ে গেছিলাম। গান শুনতে শুনতে আমি যেন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছিলাম।

তুলি একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, নিশ্চয়ই দাদির কাছে।

তিথি কৃত্রিম আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, হোয়াট। ভেরি বেড ইয়ং ম্যান।

রিতু বলল, আমরা এখানে এতগুলো ফ্রেন্ড তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি কী না…

লতিফ সাহেব কান্না জড়িত একটা হাসি হেসে বললেন, সরি, সরি এভরিবডি।

ওকে। এবার তুমি একটা গান শোনাও তুলি বলল।

টনি রকির কানে ফিসফিস করে বলল, দাদু গান গাইতে পারে?

রকি ঠোঁট উল্টে বলল, কী জানি পারতেও পারে। এই বুড়ো তো দেখি সবই পারে।

লতিফ সাহেব একবার রকির দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালও।

তুলি লতিফ সাহেবের দিকে হারমোনিয়াম এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও এবার শুরু করো।

লতিফ সাহেব শুরু করলেন,

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।

 

কলের বোমা তৈরি করে

দাঁড়িয়েছিলাম রাস্তার ধারে মাগো

বড়লাটকে মারতে গিয়ে

মারলাম আরেক ইংল্যান্ড বাসী।

হাতে যদি থাকতো ছোরা

তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো

রক্ত-মাংসে এক করিতাম

দেখতও জগতবাসী।

 

শনিবার বেলা দশটার পরে

জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো

হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি

রইল মা তোর বেটা বেটি মাগো

তাদের নিয়ে ঘর করিস মা

ওদের করিস দাসী।

দশ মাস দশ দিন পরে

জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো

তখন যদি না চিনতে পারিস

দেখবি গলায় ফাঁসি।

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

 

গান গাইতে গাইতে লতিফ সাহেবের চোখের পানিতে সাদা দাড়ি ভিজে গেল। তিনি গান শেষ করে কাশতে শুরু করলেন। তারপর কাশ থামিয়ে চোখ মুছে বলতে শুরু করলেন, আমি জানি তোরা কেউ ক্ষুদিরামের ইতিহাস জানিস না। ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা সূর্য সেনসহ অসংখ্য মানুষ ভারত বর্ষের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের ইতিহাস আজ অনেকেই জানে না। অথচ মানুষের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য এসব ইতিহাস জানা অনেক ইমপোর্টেন্ট। ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। আমরা মনে করলাম আমরাও স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু না, আমরা স্বাধীন হতে পারলাম না। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের পরাধীনতায় বন্দি হলাম। শুরু হল মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য আন্দোলন। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য জীবন দিয়েছি পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই প্রথম, আমরাই সেই গর্বিত জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। স্যালুট রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা সেই বীরদের।

কী দেশপ্রেম! ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ হালের পেন্ডি নিয়ে কামানের গোলার সামনে বুক পেতে দিল। মা চোখের পানি মুছে সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিল। গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানের রক্ত একাকার হয়ে মিশে গেল। কই সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিল সেদিন তো রক্ত আলাদা হল না। কারণ সেদিন কোন হিন্দু মরে নি, কোন মুসলমান মরে নি, কোন খ্রিস্টান মরে নি। যারা সেদিন জীবন দিয়েছে তারা সবাই দেশপ্রেমিক। তোরাও সবাই দেশপ্রেমিক হবি। আজকাল দেশপ্রেমিক মানুষের খুব অভাব। কথা বলতে বলতে লতিফ সাহেবের দাড়ি গড়িয়ে  পানি পড়তে লাগল।

তুলি লতিফ সাহেবের কাছে গেল। তার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, এভারগ্রিন বয়, তুমি তো সহজে চোখের পানি ফেল না। তুমি তো নিজে বল চোখের জল ফেলতে নেই। মানুষকে চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়। তুমি এখন সোজা হয়ে দাঁড়াও, তোমার ট্রেন টু ভিলেজে গ্রামের দৃশ্য আপলোড দাও। গ্রাম বাংলার শোভা, গ্রাম-বাংলার মানুষের কৃষ্টি-কালচার, বিশ্বময় ছড়িয়ে দাও। এখন তো আমরাও আছি তোমার সঙ্গে।

তিথি বলল, অফকোর্স, এখন আমরাও তোমার সঙ্গে আছি। আফটার অল ইউ আর অলসো আওয়ার ফ্রেন্ড।

রকি বলল, অবশ্যই। তুমি দেখো এখন থেকে আমরাও প্রতি বছর একবার করে গ্রামে আসব।

টনি বলল, আমিও আসব।

রিতু বলল, তুমি দেখো, তুমি যে আশঙ্কা করছ গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। একটা প্রাচীর তৈরি হচ্ছে সেটা আমরা হতে দেব না। আমরা ঠিকই…

তরু তুইও দাদুর পাশে আয়, বাবা আমাদের কয়েকটা ছবি তোল তো, বলে তুলি তার বাবার হাতে মোবাইল ফোনটা দিয়ে বলল, নাও।

সবাই লতিফ সাহেবের চেয়ারের পিছনে দাঁড়াল।

সমাপ্ত।

আমাকে ফেসবুকে এড করতে ভিজিট করুন: https://web.facebook.com/profile.php?id=100000449437795

আমার লেখা গল্প এবং উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি শর্ট ফিল্ম দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন: https://www.youtube.com/watch?v=cMxZl1-ACMY&t=360s

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*