দামি শাড়ি

মমতাজের চাহিদা বেশি না। ঈদে একটা দামি শাড়ি তার সঙ্গে ম্যাচিং করে ব্লাউজ, পেটিকোট, হাতে ইমিটেশনের চুড়ি আর সামান্য কিছু কসমেটিকস। ছেলেমেয়েদের বায়না নিয়ে তার কোন দুশ্চিন্তা নেই। তারা ঠিক তার মতোই হয়েছে। ঈদের ক’দিন আগে মোখালেস মিয়া সবাইকে নিয়ে শপিং করতে যায় নিজেরা পছন্দ করে ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিলেই তারা মহা খুশি কিন’ সমস্যা হয় মমতাজের শাড়ি নিয়ে। দামি শাড়ি!
ইদানীং ঈদের বাজার শুরু হয় রোজার চাঁদ দেখার পর থেকেই। মার্কেটগুলোও সেভাবেই জমে উঠে। মোখলেস মিয়ার স্ত্রী মমতাজও রোজার চাঁদ দেখার পর থেকেই তাকে স্মরণ করে দিতে থাকে এবারের ঈদে তার সামান্য বায়না। একটা দামি শাড়ি! আর এই দামি শাড়ির জন্য প্রায় বছরই খুশির ঈদ, আনন্দের ঈদ মোখলেস মিয়ার কাছে ফিকে হয়ে যায়। মোখলেস মিয়ার মন তখন ফিরে যায় শৈশবে, মনে পড়ে পুরাণ দিনের কথা।
বাবা হাট থেকে নতুন জামা এনে দিত। একগাদা ভাইবোন একসঙ্গে বড় হতো আর বাবার সামর্থ্য ছিল খুব সামান্য। সেই সামান্য সামর্থ্য দিয়েই বাবা সবাইকে ঈদে নতুন জামা কাপড় দিয়ে খুশী করার চেষ্টা করতো। সবাই খুশীও হতো। কোন কোন বছর মোখলেস মিয়ার বাবার নতুন পাঞ্জাবি হতো না, মা’র নতুন শাড়ি হতো না। তারপরও স্বামী-সন্তানদের নিয়ে স্বামীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে তার মা সবকিছু ভুলে যেত। ঈদের দিন সবার মাঝে সে কী আনন্দ!
সেই দিন আর নেই। এখন মোখলেস মিয়া নিজেই বাবা হয়েছে। এক গাদা সন্তান নয়। মোখলেস মিয়ার এক ছেলে এক মেয়ে আর প্রিয়তমা স্ত্রী। ঈদে কোনকিছু না পেয়েও তার মা’র মুখ ঈদের দিন একটা পাওয়ার তৃপ্তি ফুটে উঠতো। আর তার প্রিয়তমা স্ত্রী!
মোখলেস মিয়ার দাম্পত্য জীবন ছাব্বিশ বছরের। এই দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তার কোন একটা ঈদ আনন্দে কেটেছে বলে মনে পড়ে না। প্রতি বছর কোন না কোন অজুহাতে ঈদের ঠিক দু’য়েক দিন আগে স্ত্রীর সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হবেই। আর তার শেষ হবে দামি শাড়িতে গিয়ে।
লেখাপড়া শেষ করে মোখলেস মিয়ার সরকারি চাকুরী হলো। অফিস সহকারী পদে। চাকুরীর পরপরই বিয়ে। বেতনের সামান্য টাকা দিয়ে দু’জনের সংসার হয়তো কোনভাবে চলে যেত। কিন্তু বাবার অকালমৃত্যুতে সংসারের সামান্য হাল চলে এলো মোখলেস মিয়ার কাঁধে। মোখলেস মিয়া ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। ভাগ্যিস পুরো সংসারের হাল তাকে ধরতে হয় নি। যদি পুরো সংসার তার কাঁধে চাপতো তবে হয়তো মা, ভাইবোনদের কিছুটা সহযোগিতা করতে গিয়ে তার সংসারটাই ভেঙ্গে যেত। সংসার ভেঙ্গে গেলে ভালো হতো নাকি মন্দ হতো সে বিষয়ে মোখলেস মিয়া কোনদিন ভেবে দেখে নি কিন্তু তাকে ভাবনায় তোলে প্রতি বছর ঈদের আনন্দ।
মমতাজের এই দামি শাড়ির বায়নাটা মোখলেস মিয়া জীবনে মেটাতে পারল না। প্রতিবছর একটা শাড়ি কেনার পর মমতাজ সেই শাড়ির দাম তুলনা করতে থাকে প্রতিবেশী, কলিগের বউ, তার ভাবী আর ননদের শাড়ির সঙ্গে। তারপর কারো না কারো শাড়ি তো মমতাজের শাড়ির দামের চেয়ে বেশি হবেই আর তখনই মমতাজ জ্বলে উঠবে তেলে বেগুনে। ঈদের আগে হঠাৎ করে মোখলেস মিয়া বাসায় ফিরে দেখবে স্ত্রীর ফর্সা মুখে গাঢ় কালো মেঘ।
একবার ঈদে মোখলেস মিয়ার ইচ্ছা হলো স্ত্রীকে তার ই”ছামতো একটা দামি শাড়ি কিনে দেয়ার। তার পুরো বোনাস পকেটে তুলে স্ত্রীকে নিয়ে রওয়ানা হলো মার্কেটে। মেয়েটির বয়স তখন দু’বছর আর ছেলেটির পাঁচ। মোখলেস মিয়া মেয়েটিকে কোলে নিয়েছে আর ছেলেটির হাত ধরে স্ত্রীর পিছু পিছু হাঁটছে। পকেটে বোনাসের পুরো টাকা।
মোখলেস মিয়ার বোনাস তখন দশ হাজার টাকা। সরকারি চাকুরীতে তখন দশ হাজার টাকা বোনাস পাওয়াই অনেক বেশি। মমতাজ একের পর এক দোকান চষে বেড়া”েছ, একের পর এক শাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, দাম জিজ্ঞেস করে দামি কী না বার বার অনুমান করছে। অবশেষে কয়েক ঘণ্টা পুরো মার্কেট চষে বেড়ানোর পর মমতাজের একটা শাড়ি পছন্দ হলো। মোখলেস মিয়া দূর থেকে বাঁকা চোখে একবার গায়ে লাগানো দাম লেখা স্টিকারটি দেখে কপালে চোখ তুলল, সাত হাজার টাকা! ঈদের বাকি খরচ হবে কী দিয়ে!
মোখলেস মিয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে মমতাজের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মমতাজ তার পাশের চেয়ারে বসিয়ে নরম সুরে বলল, দামটা হয়তো তোমার কাছে একটু বেশি কিন্তু দেখ শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি বল তবে সংসারের অন্য বাজারগুলো আমি একটু হিসেব করে চলবো।
মোখলেস মিয়া সান্ত্বনা দিল, আরে তুমি এভাবে বলছ কেন? আমি তো তোমাকে বলেছি এবার তোমাকে আমি একটা দামি শাড়ি কিনে দিব।
না, আমি ভেবেছিলাম আরো একটু কম দামের মধ্যে নিব কিন’ এই শাড়িটা এতো সুন্দর লাগছে যে আর কোন শাড়ি হয়ত আমার পছন্দই হবে না।
আ”ছা ঠিক আছে। তুমি দামটা নিয়ে এতো বেশি ভাবছ কেন?
তুমি দামটা দেখেছ?
মোখলেস মিয়া লুকিয়ে তার শাড়ি দাম দেখার বিষয়টা গোপন করল, কত?
মমতাজ মোখলেস মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলল, সাত হাজার!
ও তাই বল, ঠিক আছে তুমি যখন চা”ছ…
মোখলেস মিয়া একবার এদিক-সেদিক তাকাল। বিভিন্ন স্থানে লেখা ’’একদর’’। তারপরও আমতা আমতা করে বলল, ভাই একটু কম হবে না?
সেলস ম্যান বিনয়ের সঙ্গে বলল, সরি ভাই আমাদের ফিক্সড প্রাইজের দোকান।
মোখলেস মিয়ার কাঁধের ওপর একটা হাত একটু জোরে ভর করল, মোখলেস ভাই।
মোখলেস মিয়া চমকে উঠল, ও, মিন্টু ভাই। কেমন আছেন?
জি ভালো, আপনি?
ভালো। ভাবীর জন্য শাড়ি কিনছেন?
মোখলেস মিয়া আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ।
দেখি, বলে মিন্টু শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখে বলল, ভাবী পছন্দ করেছে?
মমতাজ মাথা উঁচু করে একবার মিন্টুর মুখের দিকে তাকাল।
আ”ছা আমি দেখছি, বলে মিন্টু শাড়িটা হাতে নিয়ে ভেতরে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এসে মোখলেস মিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল, পাঁচ হাজার টাকা দিন।
মোখলেস মিয়া পকেট থেকে পাঁচ হাজার বের করে দিতেই মিন্টু শাড়িটা একজন সেলস ম্যানের হাতে দিয়ে বলল, এই শাড়িটা প্যাকেট করে দাও তো।
মমতাজ টাকা গুণে দেয়ার সময় আড়চোখে একবার দেখে নিল। সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ কালো করল। সে আর কোন কথা বলল না। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে ব্লাউজ, পেটিকোট, কসমেটিকস নিয়ে দু’জনে রিক্সায় চড়ে বাসায় এলো।
বাসায় ঢুকেই মমতাজ এক চোট নিল, তোমাকে আমি বললাম আমাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিতে আর তুমি…
আমি কী করেছি। তুমিই তো পছন্দ করেছ।
আমি পছন্দ করলাম আর তুমি পাঁচ হাজার টাকা দামের একটা শাড়ি কিনে দিলে? বলতে বলতে মমতাজ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
মোখলেস মিয়া সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল, মমতাজ শোন, এটা তো সাত হাজার টাকা দামের শাড়ি, মিন্টু ঠিক সময় না এলে এটা আমাদের সাত হাজার টাকা দিয়েই কিনতে হতো। ভাগ্যিস মিন্টু এলো তাই দু’হাজার টাকা ছাড় পেলাম।
এই পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়িটা তোমার কাছে দামি শাড়ি হলো?
তবে কি এই শাড়িটাই যদি সাত হাজার টাকা দিয়ে কিনতাম তবে তোমার কাছে দামি শাড়ি হতো?
সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*