দুর্নীতিবাজের ডায়েরি

নীলার বান্ধবী বৃষ্টি। শুধু বান্ধবী বললে ভুল হবে একেবারে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, দু’জনের মধ্যে যেন আত্মার সম্পর্ক। ক্লাস ফাইভ পাস করার পর নীলা যখন চক ময়রাম হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তখন দু’জনের মধ্যে প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে এক সঙ্গে এইচ.এস.সি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কিন্তু এইচ.এস.সি পাসের পর দু’জনে যেন আলাদা হয়ে গেল। নিজের ইচ্ছায় নয় যেন অনেকটা পারিপার্শ্বিকতার কারণে। দু’জনে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিল। নীলা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিল আর বৃষ্টি চান্স পায়নি। অগত্যা বৃষ্টি ভর্তি হয়েছিল একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। দু’জনের ইচ্ছা ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলে এক সঙ্গে হল-এ থাকবে। কিন্তু বৃষ্টি চান্স না পাওয়ায় সে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে তার মামার বাসায় উঠেছিল।

ইচ্ছা থাকলে দূরত্ব কোনো বিষয় নয় তার ওপর তা যদি হয় ঢাকা শহরে তবে তো দূরত্ব আরো কমে যায়। তাই সুযোগ পেলেই বৃষ্টি ছুটে আসতো নীলার কাছে। দু’জনে চুটিয়ে আড্ডা দিত, কোন কোন দিন বৃষ্টি তার মামিকে মোবাইলে জানিয়ে দিয়ে থেকে যেত নীলার রুমে, তবে বেশির ভাগ দিনই বৃষ্টি চলে যেত তার মামার বাসায় আর নীলা তার হল-এ ঢুকে পড়ত।

বৃষ্টির মাধ্যমে নীলার পরিচয় হয় তারই মামাতো ভাই আকাশের সঙ্গে। বৃষ্টি আকাশের সঙ্গে নীলার পরিচয়টা করে দিল ঠিক এভাবে:

বৃষ্টি আর আকাশ ওয়েটিং রুমে নীলার জন্য অপেক্ষা করছিল।

নীলা হল থেকে বেরিয়ে আসতেই বৃষ্টি বলল, কিরে এত দেরি করলি?

সরি বৃষ্টি একটু দেরি হয়ে গেল।

ঠিক আছে আর সরি বলতে হবে না। চল, বলে সবাই টি.এস.সি’র দিকে পা বাড়াল।

টি.এস.সি’র সামনে এসে বৃষ্টি আবার থমকে দাঁড়ালো, ও নীলা তোর সঙ্গে তো আকাশের পরিচয় করে দেয়াই হয়নি। আমার সঙ্গে যে সুদর্শন, স্মার্ট তরুণটা এসেছে সে আমার মামাতো ভাই, নাম আকাশ স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বি.বি.এ পড়ছে। আর আকাশ ও হচ্ছে নীলা, আমার বান্ধবী, শুধু বান্ধবী না আরো বেশি কিছু। তোকে কীভাবে বলি মানে নীলা যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তবে আমি ওকে বিয়ে করে ফেলতাম, বলে বৃষ্টি হেসে ফেলল।

আকাশ লজ্জায় মাথা নত করল।

সবাই মুখোমুখি হয়ে বসল।

বৃষ্টি আবার বলতে শুরু করল, আকাশ আমার বান্ধবী কিন্তু খুব ভালো ছবি আঁকে।

আকাশ বলল, কথাটা তুই আগেও অনেকবার বলেছিস।

বৃষ্টি রেগে গিয়ে বলল, আর কি কি বলেছি?

বলেছিস তোর বান্ধবীটা খুব সুন্দর, স্মার্ট, ভদ্র, মার্জিত আরো অনেককিছু, মানে একটা মেয়ের যতগুলো গুণ থাকে তার সবগুলোই বলেছিস।

কোন্‌টা মিথ্যা বলেছি?

সবকিছু সত্যি বলেছিস, তুই কি আমার কাছে মিথ্যা বলিস? আমি তোর বড় ভাই না?

জি তুই আমার বড় ভাই, বেশি বড় না, উনত্রিশ দিনের বড়।

নীলা হেসে ফেলল, বৃষ্টি তুই ঝগড়া থামাবি?

বৃষ্টি বলল, ঝগড়া থামাবো কি রে ও তো সারাদিন আমার সঙ্গে ঝগড়া করে, এখানে তোর সামনে আবার নতুন কি?

আকাশ একটু স্মার্ট হয়ে বলল, তো ম্যাডাম নীলা আপনি কেমন আছেন?

বৃষ্টি ধমকের সুরে বলল, আপনি কি রে ওকে তুমি বলবিব, আবার ম্যাডাম কীসের? মেয়ে পটানোর জন্য একেবারে ম্যাডাম বলছিস, কই আমাকে তো কোনোদিন ম্যাডাম বললি না?

কোনো অপরিচিত ভদ্র মহিলাকে হঠাৎ করে তুমি বলতে হয় না। আর ম্যাডাম বলে ডাকবো না তো কী বলব? তুই তো আমার কাজিন, তারও পর তোর চেহারাটা কেমন না একেবারে একটা ভুতুম পেঁচার মতো। তাই তোকে কীভাবে ম্যাডাম বলব? তুই-ই বল?

ও কাকে ম্যাডাম বলতে হবে, কাকে তুমি বলতে হবে আর কাকে তুই বলতে হবে এটা তাহলে চেহারার ওপর নির্ভর করে? আচ্ছা আমি ভুতুম পেঁচার মতো হলে অসুবিধা নাই আমার বান্ধবীটা সুন্দর তো? যা বলেছিলাম ঠিক সে রকম?

না।

কী আমার বান্ধবীটাও খারাপ, তাই না? আর নিজে খুব রাজপুত্রের মতো, তাহলে তো তোর নামটা আকাশ না রেখে প্রিন্স রাখাই ভালো ছিল।

আমি তো খারাপ বলিনি। আমি বলতে চাচ্ছি তুই নীলার সৌন্দর্যটা আমাকে গুছিয়ে বলতে পারিস নি। আসলে তোর তো ভাষা জ্ঞান কম তাই সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারিস নি, আমি বলি তুই শোন, তুই বলেছিস নীলা সুন্দর, স্মার্ট, ভদ্র এবং মার্জিত। কিন্তু এভাবে বললে নীলার সৌন্দর্যযকে লুকিয়ে রাখা হয়। নীলা হচ্ছে অপূর্ব সুন্দর, অসাধারণ স্মার্ট, অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিত।

তবে আর কী বিশেষণ বাকী থাকলো?

আমিও বাংলায় দক্ষ না, তাই আর যা কিছু বাকী থাকলো তা আমি জানি না।

বৃষ্টি কী যেন বলতে যাচ্ছিল।

নীলা বলল, বৃষ্টি তুই একটু থামবি?

আচ্ছা আমি মুখে তালা লাগালাম। তোরা কথা বল। তবে কথা বলতে গিয়ে কেউ কোনো ভুল করলে কিন্তু আমি চুপ করে থাকব না। এই মনে কর তোরা কথা বলবি আর আমি রেফারির কাজ করব।

তো মিঃ আকাশ বলুন আপনি কেমন আছেন?

বৃষ্টি বলল, এইতো তোরা আবার ভুল করলি তাই আমি আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। আকাশ আমার চেয়ে ঊনত্রিশ দিনে বড় আমি ওকে তুই বলে ডাকি, নীলা তুই ওকে বড় জোর তুমি বলতে পারিস।

আকাশ বলল, নীলা তুমি আমাকে তুমিই বল। আমার কোনো আপত্তি নাই।

আমি ভালো আছি, তুমি?

ভালো।

তোমার গ্রামের বাড়ি?

ধামইরহাট, তোমার?

আমাদের গ্রামের বাড়ি পত্নীতলা উপজেলায়, তবে এখন ঢাকায় সেটেল।

তোমরা ক’ ভাই বোন?

আমার কোনো ভাই-বোন নাই, আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান, তোমরা?

আমরা এক ভাই এক বোন। আমি বড়, ভাইটা আমার ছোট, ও এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে।

তুমি তো জার্নালিজম নিয়ে পড়ছ তাই না?

হ্যাঁ।

তারমানে লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিকতা করবে?

হ্যাঁ সেরকম ইচ্ছাই আছে।

মেয়ে মানুষ হয়ে হঠাৎ করে সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা হলো যে?

এতক্ষণ বৃষ্টি চুপ করে ছিল এবার বলল, কেন সাংবাদিকতায় কি মেয়েদের জন্য কোনো বাধা আছে নাকি? আজকাল তো অনেক মেয়ে সাংবাদিকতা করছে, নীলা করলে অসুবিধা কী?

না অসুবিধা নাই।

নাই তবে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করছিস কেন?

সরি বৃষ্টি আর উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে তোর বান্ধবীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলব না।

আমরা এখানে বসে আছি তুই যা আমাদের জন্য চট্‌পটি নিয়ে আয়।

যাচ্ছি, বলে আকাশ চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর চট্‌পটি নিয়ে ফিরে এলো।

সবাই খেতে শুরু করল।

খাওয়া শেষ করে আকাশ বলল, ও নীলা তুমি নাকি খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পার?

সুন্দর না তবে ছবি আঁকতে পারি।

আমার একটা ছবি এঁকে দিবে, প্লিজ?

নীলা মৃদু হেসে সায় দিল।

আকাশ বলল, তবে ঠিক আছে আমরা আসামিতে যেদিন আসব সেদিন তোমার কাছ থেকে তোমার আঁকা ছবি নিব।

নীলা মুচকি হেসে বলল, আচ্ছা।

তারপর সবাই নীরব।

কিছুক্ষণ পর নীলা মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, বৃষ্টি আজ উঠি, জানিস তো হল-এ আবার সান্ধ্য আইন আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে হবে।

সবাই উঠে পড়ল।

আকাশ হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য নীলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সি ইউ।

নীলা চলে গেল আকাশ তার পথের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

বৃষ্টি আকাশকে জিজ্ঞেস করল, কিরে কেমন লাগল আমার বান্ধবীকে?

এঙিলেন্ট।

 

দুই

 

আকাশ আগে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠত, কোনোদিন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়নি। কিন্তু কয়েকদিন থেকে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হচ্ছে। তাছাড়া ইদানীং সে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করেছে। এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে তার বাবা সিরাজ সাহেব একদিন তার মা সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার সুলতানা? আকাশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে? হঠাৎ করে আবার বাথরুম সিঙ্গার হয়ে গেল? ব্যাপার কী?

সুলতানা বললেন, কী জানি? বয়স হয়েছে তাই হয়তো এমন বদলে গেল আমার ছেলেটা। যাকগে আমি দেখি ও ঘুম থেকে উঠল নাকি? বলে সুলতানা আকাশের রুমে ঢুকলেন।

আকাশ তখনো ঘুম থেকে উঠেনি, সুলতানা তার বিছানার কোণায় বসে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আকাশ ঘুমের মধ্যে আপন মনে হেসে উঠল।

সুলতানা আকাশের বাহুতে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলেন, আকাশ, আকাশ।

আকাশ চমকে উঠল, কে, মা?

কী রে হাসছিস কেন?

আকাশ বিছানায় উঠে বসল, দিলে তো সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙ্গে?

এমন কী হলো যে হঠাৎ করে সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলি?

এমন সময় সিরাজ সাহেব ডাক দিলেন, সুলতানা আমি গেলাম।

সুলতানা বাইরে গেলেন। সিরাজ সাহেবকে বিদায় দিয়ে সুলতানা আকাশ আর বৃষ্টির জন্য নান্তা টেবিলে সাজিয়ে ডাক দিলেন, আকাশ, বৃষ্টি নান্তা রেডি খেতে আয়।

বৃষ্টি নান্তা খেতে এলো, আকাশ টয়লেটে ঢুকলো। যতক্ষণ টয়লেটে থাকলো ততক্ষণ তার গানের সুর ভেসে এলো। কয়েকমিনিট পর টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে নান্তার টেবিলে বসল।

সুলতানা স্নেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে হঠাৎ করে আবার বাথরুম সিঙ্গার হয়ে গেলি যে, ব্যাপারটা কি?

আকাশ বলল, মা আমি এখন বড় হয়েছি, আমি এখন দেরি করে ঘুম থেকে উঠব, বাথরুমে গান গাইব, কি কি করব সব কি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?

বড় হয়েছিস না? বলে সুলতানা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা তো আগে খুব ঝগড়া করতিস, একেবারে সরকারি দল আর বিরোধী দলের মতো, হঠাৎ করে আবার মিলে গেলি যে, দু’দল এক হয়ে গেলি নাকি? সরকারি দল আর বিরোধী দল এক হয়ে গেলে তো দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সেজন্য যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন, তুই বল তো মা কি হয়েছে?

বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে দুষ্টামির ভঙ্গিতে বলল, আকাশ ভাইয়া বলব?

সুলতানা শাসনের সুরে বললেন, এই বৃষ্টি তুই তো ওকে তুই বলে ডাকতিস্‌, এখন আবার ভাইয়া বলিস নাকি?

জি মামি, হাজার হলেও আকাশ ভাইয়া আমার চেয়ে ঊনত্রিশ দিনে বড় না? তাই আমি ওকে এখন ভাইয়া বলে ডাকি।

কবে থেকে?

তা প্রায় সাতদিন থেকে।

কেন সাতদিন আগে কি হয়েছে যে তুই ওকে খুব শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিস?

বৃষ্টি কিছুটা ভাব নিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কিছু মনে করো না, আমি কিন্তু আর মামির কথার উত্তর না দিয়ে পারছি না। আর তুমি তো জানো আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না, আবার কোনো কথা মনের মধ্যে চেপেও রাখতে পারি না। পেট ব্যথা করে।

সুলতানা অভয় দিয়ে বললেন, আমি বলছি তুই বল মা।

ভাইয়া বলব?

আকাশ কোন কথা না বলে নীরবে মাথা নত করে নান্তা খেতে লাগল।

বল মা।

মামি আকাশ না একটা মেয়েকে পছন্দ করে।

একটা মেয়েকে পছন্দ করে সেজন্য এত পরিবর্তন? মেয়েটা কি খুব সুন্দরী? শিক্ষিত? ভদ্র? ভালো ফ্যামিলির মেয়ে?

জি ভালো।

কী ভালো? শুধু দেখতে সুন্দরী হলেই তো আর ভালো বলা যায় না।

মামি সব ভালো।

সুলতানা রেগে গেলেন, এভাবে কেটে কেটে কথা বলছিস কেন? বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে হয় না। সবকিছু স্পষ্ট করে বল?

সরি মামি এবার সোজা করে বলছি। মেয়েটার নাম নীলা, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এবার জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি ধামইরহাট।

মেয়ের বংশ বুনিয়াদ ভালো?

জি মামি। উঁচু বংশের মেয়ে, বনেদি পরিবার। মেয়েটা খুব ব্রিলিয়ান্ট, আমরা একসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম, আমি আর এই গাধাটা চান্স পাইনি আর ও চান্স পেয়েছে।

আকাশ বলল, আমি গাধা তাই আমি চান্স পাইনি। আমি যদি চান্স না পেলে গাধা হই তাহলে তুই কী?

বৃষ্টি নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেল।

সুলতানা আদরের সুরে বললেন, তোরা আমাকে সবকিছু বলবি তো। মেয়েটাকে তো একদিন বাসায় নিয়ে এলে পারতিস।

আকাশ এবার মুখ তুলে বলল, মা তাহলে আজই বাসায় নিয়ে আসি?

সুলতানা ধমকের সুরে বললেন, তুই চুপ কর। মাকে এখন পর্যন্ত চিনলি না। খবরটা আমাকে বৃষ্টির কাছ থেকে জানতে হলো। তুই একদিন গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসিস মা।

বৃষ্টি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, ভাইয়া আমাদের জন্য কোনো স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান বোধ হয় আর পাওনা নাই।

আকাশ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, চল।

বৃষ্টি তার রুমে যাচ্ছিল আকাশ ডাক দিল, বৃষ্টি আমার রুমে আয় তোর সাথে আমার কথা আছে।

বৃষ্টি আকাশের সঙ্গে তার রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, কী বল?

সিগনাল তো গ্রিন, চল না আজ একবার নীলার সঙ্গে দেখা করে আসি?

আজই কথা হলো, আজ না, কাল যাব, ক্লাস শেষ করে চলে যাব।

আকাশ একটা নিঃশ্বাস মোচন করল।

বৃষ্টি বলল, কেন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে?

আকাশ খুব সাদাসিধে এবং সরল হাসি হেসে মাথা বাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।

আহ্‌ চুক, চুক।

পরদিন আকাশ আর বৃষ্টি ক্লাস শেষ করে টি.এস.সি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছিল। এমনসময় পল্লব সামনে এসে দাঁড়ালো, বৃষ্টি কোথাও যাচ্ছিস?

হ্যাঁ।

পল্লব ফ্যালফ্যালাল করে তাকিয়ে রইল।

বৃষ্টি একরকম ধমকের সুরে বলল, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে না কতদিন বলেছি আমার দিকে এভাবে তাকাবি না। কেন কিছু বলবি?

পল্লব কিছু বলল না, তবে তার চাহনি বলছে সে কিছু বলতে চায়।

বৃষ্টি তার মুখের ভাব দেখে বুঝল। সে বলল, আমরা টি.এস.সি’তে যাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি?

পল্লব মাথা নেড়ে সায় দিল।

বৃষ্টি বলল, তাহলে চল।

তিনজন একটা সি.এন.জি’তে চেপে টি.এস.সি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

টি.এস.সি’তে পৌঁছে সি.এন.জি থেকে নেমে বৃষ্টি আকাশকে বলল, আকাশ তুই যা। আমরা সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে আছি। তোর কথা বলা শেষ হলে একটা মিস কল দিস আমি চলে আসব, বলে বৃষ্টি আর পল্লব সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানের দিকে রওয়ানা হচ্ছিল।

আকাশ ডাক দিল, বৃষ্টি এভাবে স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?

স্বার্থপরের মতো কেন? তুই স্লিপ দিয়ে ওয়েটিং রুমে ওয়েট করবি, নীলা চলে আসবে।

বৃষ্টি তুই তো জানিস, কারো জন্য একা ওয়েট করতে আমার খুব খারাপ লাগে। তাছাড়া মেয়েদের হল। আমি ছেলেমানুষ, তুই না থাকলে আমি খুব আন ইজি ফিল করব।

হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। চল, বলে সবাই হল-এর দিকে পা বাড়াল।

হল-এর গেটে স্লিপ দিয়ে ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ সবাই বসল। তারপর নীলা বেরিয়ে এসে এক টুকরা মিষ্টি হাসি হেসে বলল, সরি, বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত।

আর দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই। তোরা থাক গল্প র্ক্‌ আমরা আসছি।

নীলা কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল, আমরা মানে? আর আবার কে? তোর সঙ্গে আর কেউ আছে নাকি?

পল্লব নিজের পরিচয় দিল, আমি পল্লব, বৃষ্টিসহ এক সঙ্গে পড়ি।

নীলা বলল, নাইস টু মিট ইউ।

নীলা তোরা গল্প কর আমরা আসছি, বলে বৃষ্টি আর পল্লব হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানের দিকে গেল।

আকাশ নীলার আঁকা ছবিটা দেখে তো একেবারে অবাক, তুমি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পার? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। আচ্ছা আমি জানতাম কোন আর্টিস্ট কারো ছবি আঁকলে তাকে সামনে বসিয়ে রাখে কিন্তু তুমি তো আমাকে শুধু একবার দেখেছ তাতেই আমার ছবি এঁকে ফেললে, স্ট্রেঞ্জ।

ছবিটা কি প্রফেশনাল আর্টিস্টদের আঁকা ছবির মতো হয়েছে? নীলা জিজ্ঞেস করল।

না, তা হবে কেন? তারচেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। আসলে প্রফেশনাল আর্টিস্টরা তো ছবি আঁকে জীবিকার প্রয়োজনে, সেখানে হাতের সঙ্গে, দেহের সঙ্গে, মনের সম্পর্ক থাকে খুব সামান্য। আর তোমার আঁকা ছবি দেখে মনে হচ্ছে ছবি আঁকার সময় তোমার দেহের সঙ্গে মনের সমন্বয় ঘটেছিল। তা না হলে ছবিটা এত জীবন্ত হতো না।

আমাকে খুশি করার জন্য বলছ?

মোটেই না, আমি তোমাকে খুশি করার জন্য বলব কেন? ও নীলা তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।

কী সুখবর?

মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

কেন? আমাকে দেখতে চাইলেন কেন? তিনি তো আমাকে চিনেন না।

চিনে না কথায় কথায় জেনে ফেলেছে এবং তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। তুমি না হয় আজ আমাদের সঙ্গে চল।

আজ না আরেকদিন যাব।

সরু ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পল্লব এদিক সেদিক তাকালো। কিন্তু খুব একটা ফাঁকা জায়গা পেল না। নিরিবিলি একান্ত আপনজনকে মনের কথা বলার জন্য কপোত-কপোতীরা আজকাল এই উদ্যানকে বেছে নেয়। তাই সব সময় কপোত-কপোতীদের দখলে থাকে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান। পল্লব একটা গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলো মোটামুটি ফাঁকা। কাছাকাছি আর কেউ নাই। সে বৃষ্টিকে হাত দেখিয়ে ইশারা করল। তারপর দু’জনে গাছের নিচে গিয়ে বসল।

বৃষ্টি জিজ্ঞেস করল, কী বলবি? বল।

পল্লব আম্‌তা আম্‌তা করে বলল, না মানে আমি বলছিলাম কি, মানে।

মানে মানে করছিস কেন? বলে ফেল।

না মানে আজ তোকে খুব ফিল করছিলাম।

কেন হঠাৎ আমাকে ফিল করার কী হলো?

তুই হয়তো জানিস না আমি মনে মনে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।

শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারলি?

পল্লব বোকার মতো হেসে বলল, বৃষ্টি তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

এটা সবাই জানে, আকাশ যদি জানে তুই আমাকে ভালোবাসিস তবে কি করবে একবার ভেবেছিস?

বৃষ্টির কথা শুনে পল্লবের মুখ শুকিয়ে গেল, কেন আমি তোকে ভালোবাসি একথা আকাশ জানলে রেগে যাবে কেন? আকাশ কি তোর সঙ্গে প্রেম করে নাকি?

বৃষ্টি একটা হাসি হেসে বলল, ছি : আমি আকাশের সঙ্গে প্রেম করব কেন? আকাশ আমার কাজিন না?

এমনসময় বৃষ্টির মোবাইলে রিং বেজে উঠল।

বৃষ্টি মোবাইল বের করে দেখলো, আকাশ মিস্‌ কল দিয়েছে।

বৃষ্টি বলল, পল্লব চল উঠি। আকাশ মিস্‌ কল দিয়েছে।

দু’জনে উঠে পড়ল।

 

তিন

 

নীলার রুম মেট মোহনা, সব সময় মোবাইলে কথা বলতে থাকে। দিন নাই, রাত নাই প্রায় সময়ই মোবাইলে কথা বলে, যেন ক্লান্তি নাই। কখনো জিজ্ঞেস করলে বলে মামাতো ভাই, ফুপাতো ভাই, ক্লাস ফ্রেন্ড তার সম্পর্কের অভাব নাই। নীলার মোবাইল নাই, সে তার বাবা আর বৃষ্টিকে মোহনার মোবাইল নাম্বার দিয়েছে তার বাবা মাঝে মাঝে মোহনার মোবাইলের মাধ্যমে তার খোঁজখবর নিয়ে থাকে আর প্রায় দিনই বৃষ্টি রাতে একবার করে মোবাইল করে।

তখন রাত দশটা বাজে।

নীলা পড়ছিল মোহনা নীলাকে বলল, নীলা তোর ফোন।

নীলা মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

মা আমি, তুই কেমন আছিস?

জি বাবা আমি ভালো আছি, তুমি? মা?

আমরাও ভালো আছি, তোর লেখাপড়া ঠিক মতো চলছে তো?

জি বাবা, লেখাপড়া ঠিক মতো চলছে, তুমি আমাকে নিয়ে কিচ্ছু ভেবো না।

ভাবি কি আর সাধে রে মা। তুই ভালোভাবে লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় অফিসার হবি, ভালো একটা ছেলের হাতে তোকে আমি তুলে দিব সেদিন আমার সব ভাবনা শেষ হবে।

বাবা তুমি আমাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন বল তো? আমি কি এখনো ছোট আছি যে হারিয়ে যাব?

সেটা তুই বুঝবি না মা, তুই যেদিন মা হবি সেদিন মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝবি। আর হ্যাঁ তোর টাকা লাগবে নাকি রে মা?

বাবা আজ কত তারিখ বল তো?

আজ পনেরো তারিখ।

পনেরো তারিখে আমার টাকা লাগবে কেন? তুমি তো আমাকে এক তারিখে টাকা পাঠিয়েছ আর টাকা লাগলে তো আমি বলি।

ও তাই তো, আজ তো সবেমাত্র পনেরো তারিখ তোকে তো টাকা পাঠাতে হবে আবার এক তারিখে। তবু কখনো টাকা লাগলে তুই আমাকে বলবি।

বাবা তুমি তো কোনোদিন রাতে মোবাইল কর না, আজ আবার রাতে হঠাৎ মোবাইল করলে কেন?

না মা আজ তোর কথা খুব মনে হচ্ছিল।

নীলা তার বাবার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে মোবাইলটা মোহনার হাতে দিয়ে পড়তে বসল।

কিছুক্ষণ পর আবার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

মোহনা মোবাইল রিসিভ করে আবার নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নীলা তোর ফোন।

নীলা মোবাইল রিসিভ করতেই আকাশের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো নীলা।

আকাশ তুমি মোহনার মোবাইলে রিং করেছ কেন?

সরি নীলা, এবারের মতো-

এটা খুব অন্যায় আকাশ।

নীলা তোমাকে খুব ফিল করছিলাম, তাই বৃষ্টির কাছ থেকে তোমার রুম ম্যাটের মোবাইল নাম্বার নিয়ে তোমাকে মোবাইল করলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

ঠিক আছে আর কোনোদিন এই নাম্বারে মোবাইল করবে না।

নীলা কাল তো ভার্সিটি বন্ধ, এসো না আমাদের বাসায়। আমি আর বৃষ্টি না হয় কাল গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।

ঠিক আছে গেটে এসে স্লিপ দিও, আমি চলে আসব, ঠিক আছে এখন রাখ আমার পড়া আছে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

নীলা মোবাইলটা মোহনার হাতে দিল।

মোহনা মোবাইলটা নিয়ে একটা দুষ্টামির হাসি হেসে বলল, কে রে?

আকাশ, আমার যে বান্ধবীটা আসে বৃষ্টি, ওর মামাতো ভাই?

ও এতদিন তো জানতাম শুধু আমারই মামাতো ভাই, ফুপাতো ভাই, পাড়াতো ভাই আছে এখন তো দেখি তোরও সব আছে।

নীলা কোনো কথা বলল না।

মোহনা বলল, আমি তোর রুম মেট আমার কাছে কিছু লুকাবি না। এখানে আমাদের কেউ নাই রুমে তুই আর আমি পরস্পরের সুখ-দুঃখ নিজেদের মধ্যে শেয়ার করতে হবে। আর আমার কাছে লুকিয়েই বা তোর লাভ কি? আমি তো তোর ফ্রেন্ডকে কেড়ে নিচ্ছি না।

মোহনার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

মোহনা মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো আস্‌সালমুয়ালায়কুম।

কেমন আছ বন্যা?

জি ভালো, আপনি?

ভালো আছি তবে আজ তোমাকে খুব মনে পড়ছিল।

মোহনা হেসে উঠল, তাই নাকি?

বন্যা একটা ব্যাপার কি জানো?

কি?

আমি যেন না দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছি।

এটা কিন্তু ঠিক না, এই মনে করুন আমি খুব বিশ্রী একটা মেয়ে। মনে করুন গায়ের রং কালো, খাট, নাকটা বোঁচা। মানে যাকে বলে অখাদ্য। তাহলে কী করবেন? আমাকে দেখে দৌড়ে পালাবেন?

তাহলে তো একবার দেখা হওয়া দরকার।

মোহনা কিছু বলল না।

বন্যা তুমি কি কাল একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?

কেন বলুন তো?

এই এমনি এতদিন থেকে আমরা মোবাইলে কথা বলছি, অথচ কেউ কাউকে দেখিনি।

কাল আপনার অফিস নাই।

না কাল তো অফিস বন্ধ, এসো না প্লিজ।

ঠিক আছে কোথায় দেখা করবেন বলুন?

আগামীকাল সকাল দশটায় তুমি আড়ংয়ের নিচে চলে এসো।

আমি আপনাকে কীভাবে চিনবো?

তুমি আড়ংয়ের মেইন গেটে এসে আমার মোবাইলে কল করবে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

মোহনা মোবাইল রেখে দিতেই নীলা জিজ্ঞেস করল, কিরে নতুন নাকি?

নতুন ঠিক না কয়েকদিন আগে পরিচয় হয়েছে।

নাম কী?

হৃদয়।

নামটা তো বেশ সুন্দর, কোথায় লেখাপড়া করে?

বলেছে সে নাকি এক শিল্পপতির ছেলে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে এম.বি.এ করে এখন নিজেদের কোম্পানিতে একজন ডাইরেক্টর পদে জয়েন করেছে।

এত বড় মানুষের সঙ্গে তোর পরিচয় হলো কীভাবে?

মোবাইলে।

মোবাইলে পরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে তুই দেখা করতে যাবি?

হ্যাঁ, অসুবিধা কী?

অসুবিধা কী মানে? কত কী হতে পারে?

আরে না, কি হওয়ার আছে? তাছাড়া হৃদয় আমার ঠিকানা জানে না। আমার ঠিক নামও জানে না। হৃদয় আমাকে বন্যা নামে জানে।

এমনও তো হতে পারে লোকটা খারাপ, কোনো সন্ত্রাসী? নারী পাচারকারী? প্রতারক? আর তুই যেমন তোর আসল নাম বলিসনি সেও হয়ত তার আসল নাম তোকে বলেনি।

নীলা তুই আসলে বেশি চিন্তা করিস, আমার খুব ভালো লাগছে যেন একটা নতুন অনুভূতি, তাই না?

নীলা মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, তোর ভালো লাগলেই ভালো।

মোহনার চোখের সামনে তার বাবার অসহায় মুখটা ভেসে উঠল। মোহনা তার বাবাকে কথা দিয়েছে সে পার্ট টাইম জব করে নিজেই নিজের লেখাপড়ার খরচ বহন করবে। গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসে মোহনা বিভিন্ন অফিসে চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু অনেকদিন হলেও একটা চাকরি পায়নি। তার বাবা কয়েকদিন আগে মোবাইল করে তার চাকরির খোঁজখবর নিয়েছেন। মোহনার চাকরি হয়নি শুনে তিনি খুব নিরাশ হয়েছেন।

অবশ্য মোহনা তার বাবাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে, বাবা কয়েকটা অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছি। এক মাসের মধ্যে ইনশাআল্লাহ একটা ব্যবস্থা হবে, তুমি আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও বাবা।

তাই যেন হয় মা।

তার পরদিন তিনি মোহনার নামে টাকা পাঠিয়েছিলেন।

আবার বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে মোহনা যেন সংকোচ বোধ করছে।

মোহনাকে চুপ করে থাকতে দেখে নীলা বলল, কী রে হঠাৎ চুপ করে গেলি কেন?

মোহনা হাসবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, আমার কথা থাক, এখন তোর কথা বল?

আমার আবার কী কথা?

কাল তো ভার্সিটি বন্ধ তুইও তো বাইরে যাচ্ছিস?

আমি কাল বৃষ্টির মামার বাসায় যাব, ফিরে এসে আমি তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব, ও কাল তো আবার তোর ফিরতে দেরি হবে।

আমি জানি না, হৃদয় যে কি কি প্রোগ্রাম করেছে, আসলে না হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝেছি ওর মনটা খুব বিশাল হয়ত এমন এমন প্রোগ্রাম করে বসেছে যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

নীলা কোনো কথা না বলে পড়ায় মনোযোগ দিল।

 

চার

 

আকাশ আর বৃষ্টি নীলাকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডের একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। নীলা মাথা উঁচু করে তাকালো বেশ উঁচু একটা এ্যাপার্টমেন্ট।

লিফ্‌ট উঠে গেল পঞ্চম তলায় সবাই নেমে আকাশ কলিং বেল-এ টিপ দিল।

বুয়া দরজা খুলে দিল।

বৃষ্টি নীলাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো আর আকাশ ভিতরে চলে গেল। নীলা একবার ড্রয়িং রুমটা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো। অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত, একটা বেশ বড় আকারের এ্যাকুরিয়ামে অনেকগুলো বিভিন্ন রঙের মাছ খেলা করছে, দেয়ালে টাঙ্গানো পোস্টার, কোণায় একটা সুন্দর আকৃতির কর্নার বিভিন্ন রকমের শোপিসে ভর্তি, সিলিং থেকে ঝুলানো একটা ঝাড়বাতিতে যেন আলো খেলা করছে। নীলা এর আগে কখনো এমন অত্যাধুনিক ড্রয়িং রুম দেখেনি। সে মনে মনে কী যেন ভাবছিল। এমন সময় সুলতানা ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন।

নীলা সালাম দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম মামি।

সুলতানা সালামের জবাব দিয়ে বললেন, কেমন আছ মা?

জি মামি ভালো, আপনি?

ভালো, আচ্ছা মা তুমি বল তো তোমার বাবার নাম কি?

নীলা তার বাবার নাম বলল।

তুমি কি জানো তোমার বাবা রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছে কি না?

জি মামি বাবা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছে।

আমি তোমার বাবাকে চিনেছি, আমরা একসঙ্গে পড়তাম। কেন জানি তোমাকে দেখে আমার পরিচিত মনে হয়েছে, তুমি ঠিক তোমার বাবার মতো হয়েছ।

নীলা কোনো কথা বলল না।

তোমার বাবা এখন কী করে?

ব্যাংকে চাকরি করে।

কথা হয়েছে দু’য়েকদিনে?

জি মামি কাল রাতেই কথা হয়েছে।

তুমি একটু বস মা, আমি তোমার মামাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলি, বলে সুলতানা মোবাইল করলেন, এই তোমার কি আসতে দেরি হবে?

হ্যাঁ।

কতক্ষণ?

আধ ঘণ্টা।

সুলতানা মোবাইল রেখে দিলেন।

বৃষ্টি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার বলল, মামি নীলা কিন্তু খুব ভালো ছবি আঁকে।

কই আগে বলিসনি তো।

মামি নীলা তো আকাশের একটা ছবি এঁকে দিয়েছে, আকাশ বলেনি?

না তো, তুইও তো বলিসনি।

তুমি বস, আমি নিয়ে আসছি, বলে বৃষ্টি চলে গেল এবং পাশের রুম থেকে আকাশের ছবিটা নিয়ে এসে সুলতানার হাতে দিল।

সুলতানা ছবিটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বাঃ একেবারে জীবন্ত ছবি, তুমি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পার মা।

নীলা কিছুটা লজ্জা পেল। সে মাথা নত করে বসে রইল।

সুলতানা আবার বলতে শুরু করলেন, পারবে না ট্যালেন্ট মেয়ে। আমি দেখেই বুঝেছি, কথায় বলে না যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।

আকাশ বলল, মা তুমি নীলাকে দেখে আর কি কি বুঝলে?

দেখ আকাশ খোঁটা দিয়ে কথা বলবি না। সবাই তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিলি তোরা দু’জনে চান্স পাসনি আর নীলা চান্স পেয়েছে। আবার ভালো ছবিও আঁকে। তোরা দু’জনে কি পারিস?

আকাশ এবং বৃষ্টি দু’জনে মাথা নত করে বসে রইল।

সুলতানা আবার বলতে শুরু করলেন, যেমন বাপ তেমন মেয়ে। তোমার বাবা খুব ট্যালেন্ট স্টুডেন্ট ছিল। আমরা একসঙ্গে পড়তাম, কিন্তু ও যেন ছিল আমাদের শিক্ষকের মতো। আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি তোমার বাবার যোগ্য মেয়ে হয়েছ।

নীলা কিছু বলল না, মাথা নত করে বসে রইল।

তোমরা বস মা আমি তোমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি, বলে সুলতানা চলে যাচ্ছিলেন।

নীলা বাধা দিয়ে বলল, এখন কিছু খাব না মামি, একেবারে ভাত খাব।

তাহলে দেখি তোমার মামা আসছে কি না? বলে সুলতানা আবার মোবাইল করলেন, এই তুমি আসছ?

হ্যাঁ আমি লিফ্‌টের কাছে।

তোমরা বস মা আমি খাবার রেডি করি।

সুলতানা চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশের বাবা বাসায় ঢুকলেন। সুলতানা ডাইনিং রুম থেকে ডাক দিলেন, মা বৃষ্টি তোরা সবাই খেতে আয়।

নীলা ডাইনিং এ ঢুকেই এক পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেল। নীলা তাঁর বুকে লাগানো নেম প্লেটে দেখলো নাম লিখা আছে সিরাজ।

সুলতানা পরিচয় করে দিলেন, ও হলো নীলা যার কথা তোমাকে বলেছিলাম, নীলা তোমার মামা।

নীলা সালাম দিল।

সিরাজ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, কেমন আছ তুমি?

জি মামা ভালো, আপনি?

ভালো, সুলতানা খেতে দাও খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

সিরাজ সাহেব হাত ধুয়ে খেতে বসেছেন।

এমন সময় ওয়্যারলেস্‌ সেট বেজে উঠল।

জি স্যার আমি এক্ষুনি আসছি, কই সুলতানা তুমি মেহমানকে আপ্যায়ন কর আমি আসছি, বলে সিরাজ সাহেব চলে গেলেন।

নীলা অবাক হয়ে বলল, মামি, মামা চলে গেল!

সুলতানা খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, এটা নতুন কিছু না, আমার বিয়ের পর থেকেই দেখছি। তোমার মামা পুলিশের চাকরি করে সব সময় ব্যস্ততা, কাজ আর কাজ, দিন নাই রাত নাই শুধু ডিউটি আর ডিউটি। তোমরা খাও মা, তোমার মামা কখন ফিরে আসবে ঠিক নাই।

তাই বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে যেতে হবে!

তোমার মামা বলে এটাই তো পুলিশের চাকরি। তারপরও পুলিশের দুর্নামের শেষ নাই। আমার আজও মনে আছে আকাশের প্রথম জন্মদিনটা পালনের জন্য অনেক অতিথিকে দাওয়াত করেছিলাম, অনেক আয়োজন করেছিলাম। তোমার মামা সেদিন ছুটির জন্য অ্যাপ্লিকেশন করেছিল কিন্তু ছুটি পায়নি। তারপরও অনেক ব্যস্ততার মাঝে সবকিছু আয়োজন করেছিল। দুপুরে ভাত খেয়ে যাবার সময় বলে গেল সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চলে আসবে। মেহমানরা এলো কিন্তু তোমার মামা এলো না। আমি একাই আকাশের জন্মদিন পালন করলাম। সেদিন রাতে আমি খুব কেঁদেছিলাম আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। রাত বারোটার সময় খবর এসেছিল তোমার মামা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

হাসপাতালে মানে? নীলা অবাক বিস্ময়ের সাথে বলল।

হাসপাতালে মানে কোথায় যেন আসামি ধরতে গেছিল, আসামিরা ছিল খুবই দুর্ধর্ষ। তারা পুলিশের উপসি’তি টের পেয়ে পুলিশ ভ্যান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, আসামিরা পালিয়ে যেতে পারেনি ঠিকই কিন্তু তোমার মামার বাম হাতে একটা গুলি লেগেছিল। তারপর থেকে তোমার মামার বাসায় যাওয়া আসা আর জীবনের ঝুঁকিটাকে আমি খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। ধরেই নিয়েছি পুলিশের বউ হলে এটা মেনে নিতেই হবে।

মামি, মামা বোধ হয় খুব সিনসিয়ার পুলিশ অফিসার?

সে তো বটেই। ও চাকরিতে খুব সিনসিয়ার। একজন ভালো পুলিশ অফিসার হিসেবে ডিপার্টমেন্টে ওর সুনাম আছে। তাই আমিও চাই আমি একটু সেক্রিফাইজ করলে যদি ও আরো বেশি সার্ভিস দিতে পারে তবে অসুবিধা কি? আমার না হয় একটু কষ্ট হবে। এই আর কী, যাক তোমার মামার কথা বলে আর কাজ নাই। বৃষ্টি এই ক’দিনে দেখেছে আর আকাশ তো পুলিশের চাকরির কথা শুনতেই পারে না।

আকাশ বলল, আমার কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরিও পছন্দ না মা। জীবন তো যন্ত্র না যে দিন রাত শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে কাটাতে হবে।

বৃষ্টি বলল, তোর পছন্দ কি না তার ওপর তো কারো প্রফেশন নির্ভর করে না।

হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। মা তুমি কিন্তু ভুক্তভোগী, তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার ছেলে, ভাইঝি কিংবা তোমার ছেলের বউ তেমন ব্যস্ত আর ঝুঁকিপূর্ণ প্রফেশনে কাজ করুক?

সুলতানা নীলার প্লেটে মাংস বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, কেন মা তুমি কি সাংবাদিক হতে চাও না কি?

নীলা মৃদু হেসে বলল, জি মামি।

এখনকার মেয়েরাও তো সব প্রফেশনে কাজ করছে, অসুবিধা কী?

আকাশ বলল, মা তুমি কিন্তু যুক্তি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছ।

সুলতানা কিছু বললেন না।

মোহনা হল-এ ফিরল হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। নীলা তো একেবারে অবাক, কিরে ক’দিন থেকেই না শুনছি টাকা নাই। বাড়িতে টাকার জন্য মোবাইল করলি, বাড়ি থেকে টাকা এসেছে নাকি?

না রে বাড়ি থেকে টাকা আসেনি, হৃদয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম না, ও একরকম জোর করে শপিং করতে নিয়ে গেল। তারপর মার্কেটে গিয়ে এটা-সেটা করে কিনতে কিনতে অনেক কেনাকাটা হয়ে গেল। আমি এত করে নিষেধ করলাম ও আমার কোনো নিষেধ মানতেই নারাজ। একটা একটা করে থ্রিপিস আমার গায়ে এলিয়ে ধরে বলল, এটা তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে, সেটা তোমাকে সুন্দর মানাবে। তারপর শেষে একটা জামদানি শাড়ি আরো কত কসমেটিকস্‌ কিনে দিল।

টাকা দেয়নি?

হ্যাঁ টাকাও দিয়েছে। তবে কৌশলে।

কী রকম?

আমাকে বলল, বন্যা তোমার ব্যাগটা দাও তো একটু দেখি।

আমি ব্যাগটা দিলাম।

তারপর ব্যাগের মধ্যে একটা খাম ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, তোমার মোবাইলে আমি একটা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি, তুমি চলে যাবার পর ম্যাসেজের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করবে।

আমি বললাম, করব।

বলল না এভাবে বললে হবে না, তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, প্রোমিজ!

আমি প্রোমিজ করলাম।

নীলা কৌতূহলী হয়ে বলল, তারপর-

তারপর আমার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়ে বলল, চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।

আমাকে টি.এস.সি’তে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

তুই ম্যাসেজটা ওপেন করিসনি?

হ্যাঁ করেছি এবং সেভাবে কাজ করেছি।

কী করলি?

আমি হল-এর গেট-এ ঢুকলোাম তারপর ম্যাসেজটা ওপেন করলাম, প্রথমে লিখা ছিল, উড়হ্‌থঃঙঢ়বহ ওঃ, ডযবহ অহুু ইড়ফু ঋড়ষষড়ি ণড়ঁ পড়ার পর আমি চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ আমাকে ফলো করছে নাকি। দেখলাম কেউ নাই তারপর অনেকটা স্পেস দেওয়া আছে এটা করেছে মনে হয় কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যেন পড়ার আগে একটু অন্যরকম লাগে। তারপর উড়হ্‌থঃঙঢ়বহ ওঃ, ডযবহ অহুু ইড়ফু খড়ড়শরহম ণড়ঁ আমি আবার চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে নাকি? দেখলাম কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না আরো কিছুটা এগিয়ে পড়লাম তারপর লিখা আছে উড়হ্‌থঃঙঢ়বহ ওঃ, ডযবহ অহুু ইড়ফু উড়ঁঃ ণড়ঁ. আমি একবার মনে মনে ভেবে নিলাম কেউ আমার গতিবিধি সন্দেহ করছে নাকি? না আমাকে কেউ সন্দেহ করেছে বলে আমার মনে হয়নি।

তারপর-

তারপর লিখেছে উড়হ্‌থঃঙঢ়বহ ওঃ, ডযবহ ণড়ঁ অৎব উড়রহম.

আমি তখন দাঁড়িয়ে গেলাম, ভাবছিলাম ম্যাসেজটা এ পর্যন্তই শেষ হবে।

আরো আছে নাকি?

হ্যাঁ অনেকটা স্পেস দিয়ে লিখেছে উড়হ্‌থঃঙঢ়বহ ওঃ, ডযবহ ণড়ঁ অৎব ইড়ৎরহম.

আমি মোটেই বোর ফিল করছিলাম না। আমি আরো কিছুটা ওপেন করলাম।

তারপর লিখেছে ঙঢ়বহ ওঃ ঘড় িঙৎ ণড়ঁ ডরষষ খড়ংং ঝড়সবঃযরহম.

তারপর খুললি?

হ্যাঁ দেখলাম খামের ভিতর পাঁচ হাজার টাকা।

খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ তো।

ইন্টারেস্টিং তো বটেই তবে-

তবে কী?

বয়সটা একটু বেশি।

বেশি কত?

মনে হয় ত্রিশ এঙিড করেছে, তবে বয়স বোঝা যায় না।

তোর পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ-অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? একদিনের দেখাতেই পছন্দ-অপছন্দের কথা বলা যায়?

বাঃ রে একজনের সঙ্গে মেলামেশা করবি, প্রেম করবি আর আমি তোকে পছন্দ-অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না?

আমি তো তোকে বলিনি আমি হৃদয়ের সঙ্গে প্রেম করছি বা আমি হৃদয়কে ভালোবাসি।

তো।

হৃদয় আমার ফ্রেন্ড। একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি, এনজয় করছি ব্যাস, এর বেশি কিছু না। আমি হৃদয়ের সঙ্গে প্রেমও করছি না, বিয়েও করছি না। তবে এভাবে যদি দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায় তবে বাকী সব পরের বিষয়। আমি আপাতত ডিপলি কিছু ভাবছি না।

নীলা একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, তাই নাকি?

 

পাঁচ

 

সিরাজ সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতের কাছে টেবিলের ওপর রাখা ওয়্যারলেস সেটটা অনবরত বিড়বিড় করে যেন কথা বলেই চলেছে। মাঝে মাঝে সিরাজ সাহেব মাঠ পর্যায়ে ডিউটিরত পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। থানার ভিতর থেকে একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এলো।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি বলে?

স্যার ওতো বলছে ও চাঁদা চায়নি, ওর কাছে কোনও পিন্তল নাই।

ও বলল আর হয়ে গেল, ঠিকমতো পেদানি দিলে ঠিকই স্বীকার করবে। যাও মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা কর। পুলিশ অফিসার হয়েছ আর আসামির মুখ থেকে কথা বের করতে শেখনি।

জি স্যার, বলে পুলিশ অফিসার চলে গেল।

সিরাজ সাহেব আবার কাজ শুরু করলেন।

এমনসময় এক ভদ্রলোক সিরাজ সাহেবের চেম্বারে ঢুকে সালাম দিলেন। সিরাজ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি?

আমার নাম সোলায়মান আলী চৌধুরী, আমি শিবলি’র বাবা।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি করেন আপনি?

আমি একজন ব্যবসায়ী।

আপনি নিজে ব্যবসা করেন, নিজে একজন স্বচ্ছল মানুষ অথচ আপনার ছেলে একজন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিঃ।

সোলায়মান সাহেব বললেন, না ওসি সাহেব আমার ছেলে চাঁদাবাজ না, সন্ত্রাসী না। ও কোন ষড়যন্ত্রের শিকার।

হ্যাঁ সব গার্জিয়ানরাই তাই বলে। আসলে আপনারা ছেলেদের কোন খবর রাখেন না, তাই ছেলে কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তাকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।

বিশ্বাস করুন ওসি সাহেব আমি আমার ছেলের খবর রাখি, ও ভালো ছাত্র, সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওর কোন বন্ধুবান্ধবও নাই। আপনি ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ।

আপনি বললেই তো আর ছেড়ে দেয়া যায় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেলে আগামীকাল কোর্টে চালান দেয়া হবে। আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে কোর্ট থেকে রিমান্ডে নিয়ে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সোলায়মান সাহেবের কানে শিবলির চিৎকার ভেসে এলো, না না আমি চাঁদা চাইনি, আমার কাছে কোন পিন্তলও নাই। এর চেয়ে আমি বেশি কিছু জানি না।

সোলায়মান সাহেবের বুক কেঁপে উঠল। তাঁর দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি বিনীত কণ্ঠে বললেন, ওসি সাহেব আমি কি একবার শিবলির সঙ্গে দেখা করতে পারি?

অবশ্যই, আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থা করছি, বলে তিনি স্যান্ট্রিকে ডাক দিলেন।

স্যান্ট্রি এসে সামনে দাঁড়ালো।

সিরাজ সাহেব বললেন, ইলিয়াসকে ডাক দাও তো, বল শিবলির বাবা এসেছে। শিবলির সঙ্গে দেখা করতে চায়।

জি স্যার, বলে স্যান্ট্রি চলে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ অফিসার ইলিয়াস সাহেব সিরাজ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো।

সোলায়মান সাহেব ভিতরে চলে গেলেন।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর?

দেখি স্যার আমি চেষ্টা করছি।

শিবলির বাবা ব্যবসায়ী, ধনী মানুষ। ছেলেকে দেখে তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করতে পারে। দেখ চেষ্টা কর, কি করতে পার?

জি স্যার আমি দেখছি।

যদি তোমার সঙ্গে আন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়ে যায় তবে ফিফটি ফোর-এ চালান দিবে আর যদি আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হয় তবে চাঁদাবাজি মামলা’য় কোর্টে চালান দিয়ে আবার রিমান্ড চাইবে।

জি স্যার।

বাবাকে দেখে শিবলি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল, বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও, ওরা আমাকে অনেক মেরেছে, রাতে এখানে থাকলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে বাবা।

শিবলি সোলায়মান সাহেবের একমাত্র সন্তান। শৈশব থেকে তিনি তাঁকে অত্যন্ত আদর যত্ন করে লালনপালন করেছেন। কোনদিন ছেলেকে ছেড়ে একটা রাতও বাইরে কাটান নি। শিবলিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে শিবলির মা প্রায় উদ্মাদ হয়ে গেছেন।

শিবলির কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর শুনে সোলায়মান সাহেব আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না, আমি আলাপ করছি বাবা, আমি তোকে নিয়ে যাব, তোকে না নিয়ে গেলে তোর মা যে মারা যাবে, বলে সোলায়মান সাহেব শিবলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।

সোলায়মান সাহেব আবার সিরাজ সাহেবের সামনে বসলেন, ওসি সাহেব আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

বলুন।

শিবলি আমার একমাত্র সন্তান, ওকে নিয়ে আসার পর থেকে ওর মা পাগলের মতো হাউ মাউ করে কাঁদছে, আজেবাজে কথা বলছে।

দেখুন শিবলির মা হাউমাউ করে কাঁদছে সেজন্য তো আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি না, আপনি শিক্ষিত মানুষ জানেনই তো আইনের কাছে আবেগের কোন স্থান নাই।

ওসি সাহেব কোনোভাবে শিবলিকে আমার জামিনে দেওয়া যায় না? আপনারা তদন্ত করে দেখুন ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমি ওকে আবার থানায় পৌঁছে দিব।

সিরাজ সাহেব বললেন, জিজ্ঞাসাবাদে ও কি বলেছে তা তদন্তকারী কর্মকর্তাই জানেন, আপনি বরং ইলিয়াস সাহেবের সঙ্গে আলাপ করুন।

সোলায়মান সাহেব উঠে আবার ইলিয়াস সাহেবের কাছে গেলেন। তিনি গিয়ে দেখলেন, ইলিয়াস সাহেব একটা লাঠি হাতে শিবলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

সোলায়মান সাহেব রুদ্ধ কণ্ঠে ডাক দিলেন, ইলিয়াস সাহেব একবার আমার কথা শুনুন।

ইলিয়াস সাহেব বেরিয়ে এলো।

দু’জনে ফিসফিস করে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তারপর ইলিয়াস সাহেব বলল, আপনি শিবলির সঙ্গে কথা বলুন আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলছি।

সুলতানা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, দু’হাত উজাড় করে দান খয়রাত করেন, গ্রাম থেকে কোন আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় এলে তাঁর বাসায় উঠেন, তিনি একজন পরোপকারী মহিলা। তিনি যে মাসে কত টাকা খরচ করেন তা তিনি নিজেই জানেন না। কিন্তু তিনি কোনদিন স্বামীর কাছ থেকে জানতে চাননি, তুমি কত বেতন পাও? কিংবা আজ তো মাসের পঁচিশ তারিখ তুমি এত টাকা পেলে কোথায়? বরং সিরাজ সাহেব তাঁকে যখন টাকা দেন তখন তিনি খুশিতে স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান।

ঢাকা মেট্রোপলিটনের একটি থানায় সিরাজ সাহেবের পোস্টিং হওয়ার পর তাঁরা প্রথমে স্টাফ কোয়ার্টারে উঠেছিলেন। কিন্তু স্টাফ কোয়ার্টারগুলোর ডিজাইন এবং চাকচিক্য পছন্দ না হওয়ায় সুলতানা সিরাজ সাহেবের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ঢাকায় একটা এ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য। সিরাজ সাহেব এক রকম জিদ করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধেশ্বরী রোডে একটা এ্যাপার্টমেন্ট কিনে সেখানে বাসা স্থানান্তর করেন।

সিদ্ধেশ্বরী রোডের বাসায় কয়েক বছর কেটে গেল। ইদানীং সুলতানা ইনিয়ে বিনিয়ে সিরাজ সাহেবকে ধরেছেন একটা প্রাইভেট কার কেনার জন্য কিন্তু সিরাজ সাহেবের একই কথা তিনি প্রাইভেট কার কিনবেন না। তাতে একদিকে যেমন খরচ বেড়ে যাবে অন্যদিকে তাঁর আয় ব্যয়ের সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিবে।

সুলতানা এসব কিছু মানতে নারাজ তাঁর কথা কত গভর্নমেন্ট অফিসারই তো ঢাকায় স্বনামে বেনামে গাড়ি-বাড়ি করছে, ব্যাংক ব্যালেন্স করছে কারো কিছু হচ্ছে না আর তুমি শুধু একটা প্রাইভেট কার কিনবে তাতেই নানান প্রশ্ন। তার চেয়ে সোজা কথা বল তুমি আমাকে গাড়ি কিনে দিবে না।

সুলতানার এ’কথার উত্তরে সিরাজ সাহেব আর কোন কিছু বলেন না। সিরাজ সাহেবের নীরবতায় সুলতানা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, ঠিক আছে তুমি গাড়ি কিনলে যখন সরকার তোমার কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইবে, তোমার জেল হবে বলে ভয় পাচ্ছ তবে আমার নামে কিনে দাও তখন জেল জরিমানা যা-ই হোক না কেন আমার হবে আমি বলব আমার বাবার বাড়ি থেকে আমার জমি বিক্রি করে গাড়ি কিনেছি।

পুলিশের চাকরি। সীমাহনি ডিউটি, দিন নাই, রাত নাই শুধু অপরাধীর পিছনে পিছনে ছুটে চলা। তারওপর আছে ভি.আই.পি ডিউটি, বিশেষ অভিযান, আরো কত ডিউটি। অনেক সময় সিরাজ সাহেবের মনে হয় এটা একটা জীবন না, যেন যন্ত্র। শুধু ছুটে চলা তারওপর কত জবাবদিহিতা। ব্যস্ততার কারণে চাকরি জীবনে সিরাজ সাহেব বেশিরভাগ দিনই বাসার বাইরে ভাত খান। আবার কখনো সুযোগ পেলেই বাসায় ছুটে আসেন।

দুপুরে সিরাজ সাহেব বাসায় এলেন। সুলতানা তখন নামাজ পড়ছিলেন। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বুয়া দরজা খুলে দিল।

সিরাজ সাহেব সোজা বেড রুমে চলে গেলেন, বুয়া তোমার খালা কি করছে?

নামাজ পড়ছে খালুজান।

কয়েকমিনিট পর সুলতানা নামাজ শেষ করে তাসবিহ জপ করতে করতে বেড রুমে ঢুকলেন।

সিরাজ সাহেব সুলতানার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বললেন, সুলতানা এই ব্যাগটা রাখ।

সুলতানা ব্যাগটা খুলে টাকার বান্ডিল দেখে বললেন, কত আছে?

তিন লাখ।

সুলতানা তাঁর হাত থেকে তাসবিহটা টেবিলের ওপর রেখে টাকার ব্যাগটা স্টিল আলমারিতে রেখে বললেন, তুমি কিন্তু আর আমাকে না কর না।

কি না করব না।

আমার গাড়ি কেনাটা, তুমি আজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসো একসঙ্গে গাড়ি কিনতে যাব।

সিরাজ সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, আমি তোমার গাড়ি কেনার সঙ্গে একমত না, তুমি যদি একান্তই গাড়ি কিনতে চাও তবে তুমি একাই যেও এবং তোমার নামে কিনো, আমি তোমার সাথে-পিছে নাই।

সুলতানার চোখে-মুখে যেন আলোর আভা ফুটে উঠল, তুমি যখন বলছ তবে তাই হবে, এখন আসো ভাত খাবে।

 

ছয়

 

রুখাসানা বেগম তখন সবেমাত্র ধামইরহাট উপজেলার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল আগ্রাদ্বিগুন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করেছেন। তখনো এরকম একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে তেমন জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তাই রুখসানাকে এস.এস.সি পাস করার পর কলেজে ভর্তি করে দেয়ার পাশাপাশি তার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। অভিভাবকদের ইচ্ছা এইচ.এস.সি পাস করার আগে যদি ভালো পাত্র পাওয়া না যায় তবে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে আর যদি ভালো পাত্র পাওয়া যায় তবে বিয়ে দেয়া হবে।

রুখসানার গায়ের রং ফর্সা যেন দুধে আলতা, লম্বা কালো কেশ, মুখের গড়ন গোলগাল, নাকটা বাঁশির মতো, চোখ দু’টো মায়াবী, কথাবার্তা এবং চালচলনে একটা বিশেষ ধরনের আর্ট আছে যা সহজে যে কারো দৃষ্টি কাড়ে।

রুখসানার বিয়ের জন্য পাত্র পেতে বেশি দেরি হয়নি, পাত্রের বাড়ি ধামইরহাট। পাত্র পক্ষের অভিভাবকরা মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিলেন। পাত্র নিজেও গোপনে তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিল। মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে পাত্রের সামান্য কিছু আপত্তি থাকলেও মেয়ের সৌন্দর্যেযর কাছে তার লেখাপড়ার ব্যাপারটা গৌণ হয়ে গিয়েছিল। পাত্র মহাশয় রুখসানার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তিনিও শিক্ষার বিষয়টিকে মেনে নিয়েছিলেন।

পাত্রে নাম আতিয়ার রহমান, মধ্যবিত্ত পরিবারের, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তখন তিনি ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরিতে জয়েন করেছিলেন। ব্যাংকের চাকরি, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। অফিস থেকে ফিরে আর কোন কাজে আতিয়ার সাহেব মনোযোগ দিতে পারতেন না। স্বল্প শিক্ষিত হলেও সংসারের সমন্ত দায়িত্ব রুখসানা সুচারুরূপে পালন করতেন। নীলা ভালো রেজাল্ট করে এ বছর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ছোট ছেলে প্রান্ত এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। সেও লেখাপড়ায় ভালো তাকে নিয়ে স্কুলের শিক্ষকরা গর্ববোধ করেন।

আতিয়ার সাহেবের সঙ্গে রুখসানার সম্পর্কটা বেশ মধুর। আর সে কারণেই বোধ হয় প্রায় দিনই একজন আরেকজনকে খোঁটা মেরে কথা বলে দীর্ঘ দিনের ভালোবাসার ভিত্তিটাকে মজবুত করেন।

আতিয়ার সাহেবের পোস্টিং এখন জয়পুরহাটে। ধামইরহাট থেকে জয়পুরহাটের দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। তিনি প্রতিদিন মোটর সাইকেল নিয়েই জয়পুরহাটে যাতায়াত করেন। বেশিরভাগ দিনেই তিনি সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাসায় ফেরেন। আজ রাত প্রায় আটটা অতিক্রম করেছে তবুও তিনি বাসায় না ফেরায় রুখসানা কিছুটা চিন্তিত হলেন। ভালোবাসার চমৎকার সম্পর্কের কারণেই বুঝি এমন হয় একজনের সামান্যক্ষণের অনুপসি’তিও যেন অন্যজনকে চিন্তিত করে তোলে।

আতিয়ার সাহেব বাসায় ফিরলেন তখন রাত সাড়ে ন’টা বাজে। তিনি মোটর সাইকেল রেখে হাত মুখ ধুয়ে তাঁর রুমে গেলেন। রুখসানা তাঁর পিছনে পিছনে রুমে ঢুকলেন, আজ এত দেরি হলো যে?

আচ্ছা রুখসানা প্রান্ত রুমে আছে?

আছে।

আতিয়ার সাহেব আর কিছু বললেন না। আতিয়ার সাহেব জানেন কোন প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া বা নীরব থাকাটা রুখসানা একেবারে পছন্দ করেন না। তাই তিনি রুখসানাকে ক্ষেপানোর জন্য তাঁর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলেন।

রুখসানা রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমাকে কি জিজ্ঞেস করলাম?

আতিয়ার সাহেব বললেন, কি? কি যেন জিজ্ঞেস করলে?

আজ এত দেরি হলো কেন?

ব্যাংকে কাজ ছিল তাই দেরি হলো।

এত রাত পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ থাকে না? তুমি আমাকে বুঝালে আর আমি মেনে নিলাম।

তা তুমি মেনে নিবে কেন? তোমার যা বিদ্যার দৌড় তাতে চাকরিতে ব্যন্ততা সম্পর্কে তোমার ধারণা থাকার কথা না।

রুখসানা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, আমার বিদ্যার দৌড় কম, না? কিন্তু আমি কার জন্য লেখাপড়া শেষ করার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি? তোমার মতো একটা ব্যাংকের কেরানির সাথে বিয়ে না হলে আমিও ঠিকই লেখাপড়া শিখে বড় হতে পারতাম। তখন আমি এই ধামইরহাটে পড়ে থাকতাম না, হয়ত ঢাকা শহরে থাকতাম, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম।

তা যখন পারনি, পরের পায়ে ভর করে যখন দাঁড়িয়ে আছ তখন এত কথা জিজ্ঞেস কর কেন?

কি আমি পরের পায়ে ভর করে আছি?

একথা তো আমি বলিনি তুমি নিজেই বলছ।

এমনসময় দরজা নক করার শব্দ পেয়ে প্রান্ত দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল, আপা তুই?

হ্যাঁ চলে এলাম।

রুখসানা আঁচলে চোখ-মুখ মুছে বেরিয়ে এলো, মা তুই, আয় মা বস।

নীলা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে মা?

কিছু না।

কিছু তো নিশ্চয়ই হয়েছে, মা এখন আমি বড় হয়েছি, আমি সব বুঝতে পারি। তোমরা ঝগড়া করেছ।

তোর বাবা আজ দেরিতে ব্যাংক থেকে এসেছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি হলো কেন? তাতে তোর বাবা একেবারে আমাকে যাচ্ছেতাই বলল।

মা বাবা তোমাকে আজকেও তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছে?

আতিয়ার সাহেব বেরিয়ে এলেন, তুই হঠাৎ করে আসলি কেন মা? কোন সমস্যা? আসতে এত রাত হলো কেন? রান্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো? কার সঙ্গে আসলি?

কোন সমস্যা না বাবা, আমি আর বৃষ্টি একসঙ্গে আসলাম। আমার কথা আমি না হয় পরে বলছি তার আগে তো দেখি তোমাদের বিচার করতে হচ্ছে।

আমাদের বিচার করতে হচ্ছে মানে? আমরা আবার কি করলাম?

বাবা তোমরা আজকেও ঝগড়া করেছ?

ঝগড়া না রে মা আসলে তোর মা কখনো কখনো এমন সব কথা বলে যে আর মাথা ঠিক থাকে না। সামনে আমার জুন ক্লোজিং, আমার ওপর দিয়ে কাজের খুব চাপ যাচ্ছে। তাই আজকে আসতে দেরি হয়েছে। বাসায় আসতেই তোর মা জেরা করতে শুরু করেছে। আসতে দেরি হলো কেন?

তোমার হঠাৎ করে অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মা তো সেকথা জিজ্ঞেস করতেই পারে, তাই বলে তুমি মাকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে খোঁটা দিবে?

রুখসানা বললেন, সেকথা তো তোর বাবা আমাকে বললেই পারতো যে আমার কাজ ছিল তাই আসতে দেরি হলো। তা না বলে আমাকে আজে বাজে সব কি কথা বলল।

বাবা তোমাকে না আমি কতদিন বলেছি মা’র শিক্ষা নিয়ে তুমি কোন কথা বলবে না।

আতিয়ার সাহেব হেসে ফেললেন, তুই যা মা হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুখসানা আমাদের খাবার ব্যবস্থা কর।

রুখসানা খাবার রেডি করতে চলে গেলেন।

নীলা বলল, বাবা তোমার মোবাইলটা একটু আমাকে দাও তো।

আতিয়ার সাহেব তাঁর মোবাইলটা নীলার হাতে দিলেন।

নীলা জিজ্ঞেস করল, বাবা ব্যালেন্স আছে তো?

আছে, আজকেই রিচার্জ করেছি।

 

সাত

 

পরদিন বৃষ্টি এলো নীলাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। রুখসানা আম্‌তা আম্‌তা করে বললেন, ও তো কালকেই এলো মা, দু’য়েকদিন পরে না হয় তোমাদের বাড়িতে যেত।

বৃষ্টি বলল, খালা আম্মা আপনি কি যে বলেন, আমাদের ভার্সিটি কি অনেকদিনের জন্য ছুটি হয়েছে যে পরে যাবে। ওর ভার্সিটিতে মারামারি হয়েছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ হয়েছে, কর্তৃপক্ষ আবার যে কোনদিন ভার্সিটি খোলার নোটিশ দিতে পারে।

কিন্তু তোমার খালুকে যে একবার বলতে হবে মা।

খালা আম্মা আপনি না হয় মোবাইলে খালুর কাছ থেকে জেনে নিন, বলে বৃষ্টি নীলাকে বলল, খালুর মোবাইল নাম্বারটা বল তো আমি রিং করি।

বৃষ্টি নীলার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার নিয়ে রিং করে মোবাইলটা রুখসানার কাছে দিল।

রুখসানা বললেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে আতিয়ার সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো, আমি রুখসানা।

কি খবর? কোন সমস্যা?

কোন সমস্যা না, নীলার কাছে ওর বান্ধবী বৃষ্টি এসেছে, ও নীলাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

তুমি কি বললে?

আমি আবার কি বলব? সেজন্যই তো তোমাকে মোবাইল করলাম।

নীলা যেতে চাইলে যাক, কবে আসবে জেনে নিও।

আচ্ছা।

বৃষ্টি হাত তালি দিল, আমি জানতাম, আমার কথা শুনলে খালু নীলাকে যেতে দিবে।

বৃষ্টি ধামইরহাট উপজেলার অদূরের একটি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা বিত্তশালী কৃষক। তাছাড়া ধামইরহাট উপজেলায় ধান-চাউলের ব্যবসা আছে। গ্রামে বিশাল বাউন্ডারী ওয়াল বেষ্টিত বাড়ি। বাউন্ডারী ওয়ালের ভিতরে ঘাটবাঁধা পুকুর, বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। দু’বোন এক ভাইর মধ্যে বৃষ্টি সবার বড়।

অনেকদিন পর বৃষ্টি আর নীলা নিরিবিলি গল্প করার সুযোগ পেয়েছে। একের পর এক গল্প চলছে রাত কত হয়েছে কারো কোন খেয়াল নাই। বৃষ্টি তার মোবাইলের ঘড়িতে দেখলো রাত বারোটা বাজে।

বৃষ্টির মোবাইলের বিং বেজে উঠল।

পল্লব মোবাইল করেছে।

বৃষ্টি রিসিভ করল, কি রে? এত রাতে মোবাইল করেছিস কেন?

বৃষ্টি তুই কোথায়?

কেন এত রাতে আমাকে খুঁজছিস কেন?

বল না তুই কোথায়?

বৃষ্টি কিছু বলল না। অপর পাশ থেকে পল্লবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ঠিক আছে কোথায় আছিস বলার দরকার নাই। কাল একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবি?

না।

বৃষ্টি প্লিজ।

পারব না তো বলছি, বিরক্ত করিস না তো, আমি ঘুমাবো, বলে বৃষ্টি মোবাইল রেখে দিল।

নীলা কয়েকমুহূর্ত বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বৃষ্টি জিজ্ঞেস করল, কিরে এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?

আচ্ছা বৃষ্টি তুই কি পল্লবকে ভালোবাসিস?

বৃষ্টি মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, ফিফটি, ফিফটি।

ফিফটি, ফিফটি মানে? নীলার চোখে বিস্ময়!

ফিফটি ফিফটি মানে অর্ধেক অর্ধেক।

ভালোবাসা আবার অর্ধেক হয় নাকি?

অফ কোর্স, তোর মাথা খারাপ, একজনকে পুরো হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবো, তারপর সে যখন চিট করে অন্য কারো কাছে চলে যাবে তখন সুইসাইড করব?

এরকম হবে কেন? যাকে ভালোবাসবি তাকে পুরো হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবি। আর যদি কাউকে তোর সন্দেহ হয় তবে তাকে ভালোবাসবি না। তার কাছ থেকে দূরে থাকবি। পল্লবকে দেখে আমার যতটুকু মনে হয়েছে তাতে ওকে আমার বিশ্বাস হয়েছে, ওকে এক পলক দেখেই আমার মনে হয়েছে ছেলেটা সহজ-সরল। ও তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, আমার মনে হয় ও তোর সঙ্গে প্রতারণা করবে না।

বৃষ্টি বলল, আমারও তাই মনে হয়।

তবে আবার ফিফটি ফিফটি কেন?

বলা তো যায় না, ছেলে মানুষ পাল্টে যেতে কতক্ষণ।

নীলা রাগান্বিত স্বরে বলল, বৃষ্টি আমি যতটুকু জানি তাতে তোর সঙ্গে কেউ প্রতারণা করেনি, আর তুই নিজেও বুঝতে পাচ্ছিস্‌ পল্লব তোর সঙ্গে প্রতারণা করবে না। ব্যাপারটা স্পষ্ট করা দরকার, তুই যদি ওকে ভালোবাসিস্‌ তবে ভালো ব্যবহার করবি আর যদি না ভালোবাসিস্‌ তবে বলে দিবি, অযথা একজনকে আশ্বাস দিয়ে রাখিস কেন?

আমি তো ওকে কোনদিন আশ্বাস দিইনি।

তুই তো ওকে তোর পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতে নিষেধও করিস নি।

বৃষ্টি কিছু বলল না।

নীলা আবার বলতে শুরু করল, এভাবে থাকতে থাকতে ও একদিন তোকে ছেড়ে চলে যাবে সেদিন তুই খুব কষ্ট পাবি, আজ যেমন ফিফটি ফিফটি ভালোবাসছিস সেদিন তোর ফিফটি পার্সেন্ট হৃদয় ভেঙ্গে যাবে। তুই খুব কষ্ট পাবি। আমি বলি কি তুই এসব বাদ দে।

বৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, বাদ দে ওসব কোথাকার কোন পল্লব তার জন্য আবার তোর এত মায়া, এখন তোর কথা বল?

আমার কোন কথাই তো তোর অজানা নাই।

বৃষ্টির মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

বৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে আকাশের নাম দেখে বলল, তোর আকাশ মোবাইল করেছে, আগে একটু ইয়ার্কি করে নিই।

বৃষ্টি মোবাইল রিসিভ করে বলল, কি রে এত রাতে কি মনে করে?

তুই কেমন আছিস?

ভালো, আমার খুব ঘুম পেয়েছে রে, আমি ঘুমাবো, রাখ কালকে কথা বলব, বলে বৃষ্টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে কানের কাছে মোবাইল ধরে রাখল।

অপর পাশ থেকে আকাশের কোন কথা শোনা গেল না।

বৃষ্টি বলল, কি রে মোবাইল রাখছিস না কেন?

বৃষ্টি তোর সঙ্গে কি নীলা আছে?

আমার এখানে নীলা থাকবে কেন? নীলা তোকে বলেনি যে ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি দুরে।

হ্যাঁ কিন্তু তুই যে বলেছিলি আজ আমাকে নীলার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিবি?

হ্যাঁ বলেছিলাম, তাই বলে আমি তো তোর বেতনভুক্ত কর্মচারী না যে বলেছি দেখে আমার নিজের কাজ ছেড়ে তোর কাজ করব।

নীলা তুই আমার ছোট বোন, লক্ষ্‌ণীবান আমার, তুই আমার জন্য এটুকু কর প্লিজ।

আমার সঙ্গে যখন ঝগড়া করিস তখন মনে থাকে না যে আমি তোর ছোট বোন।

এরপর খেয়াল থাকবে?

অবশ্যই থাকবে।

এই কথা বল, বলে বৃষ্টি মোবাইলটা নীলাকে দিল।

হ্যালো আকাশ।

নীলা তুমি ভালো আছ?

আমি ভালো আছি, তুমি?

ভালো।

নীলা দেখ তো বৃষ্টিটা কত ফাজিল, তুমি পাশেই আছ তারপরও আমার সঙ্গে কতক্ষণ ফাজলামি করল।

হ্যাঁ ও রকমই, সবার সঙ্গেই ফাজলামি করে তবে তোমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটা খুব চমৎকার তো তাই তোমার সঙ্গে একটু বেশি ফাজলামি করে।

নীলা আর ক’দিন থাকবে?

ভার্সিটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ, ভার্সিটি বন্ধ থাকলে আমি ঢাকা গিয়ে কি করব?

আমার মনে হয় বেশিদিন বন্ধ থাকবে না।

ভার্সিটি চালু হলেই আমি চলে আসব।

নীলা বৃষ্টিদের বাসায় ক’দিন থাকবে?

কালই চলে যাব।

তাহলে তারপর আর তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব না?

নীলা কিছু বলল না।

অপর পাশ থেকে আকাশের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, নীলা তোমাদের বাড়িতে মোবাইল নাই?

আছে কিন্তু সেটা তো বাবার কাছে থাকে। কেন কথা বলবে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে কাল থেকে আমি বাবার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রাখব। তবে আমি মিস্‌ কল না দিলে কখনো রিং দিবে না।

থ্যাংক ইউ নীলা।

 

আট

 

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে ধামইরহাটের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল গরু গাড়ি। রান্তা-ঘাটের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গরু গাড়ির স্থান দখল করেছে বাস আর স্থানীয়ভাবে যোগাযোগের স্থান দখল করেছে রিঙা ভ্যান। গতকাল আকাশ ঢাকা থেকে বাসে ধামইরহাট আসার পর বাস স্ট্যান্ডে নেমে রিঙার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু কোন রিঙা না পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছিল। আকাশের সামনে কিছুক্ষণ পর পর রিঙাভ্যান এসে বলছিল, ভাইজান কোথায় যাবেন?

আকাশ বারবার করে বলছিল, যাব না।

অবশেষে আকাশ একজন ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে রিঙা পাওয়া যাবে না?

ভ্যানওয়ালা বলেছিল, ভাইজান এখানে রিঙা পাবেন কই? গোটা উপজেলায় রিঙা আছে একটা। সে যে এখন কোথায় গেছে কে জানে? আপনি আমার ভ্যানে উঠেন, কোথায় যাবেন আমি আপনাকে নিয়ে যাব?

আকাশ ভ্যানে উঠে বৃষ্টিদের বাসায় গিয়েছিল।

আজ সকালবেলা বৃষ্টি আর আকাশ প্রথমে রওয়ানা হয়েছে নীলাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে তারপর সেখান থেকে আলতাদিঘী। ধামইরহাট থেকে আলতাদিঘীর দূরত্ব প্রায় বারো কিলোমিটার। প্রায় তিন কিলোমিটার পর থেকেই রান্তার দু’পাশে শুরু হয়েছে ঘন শালবন। তারপরও সকাল থেকে প্রচণ্ড রৌদ্র আর গরমে মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করছিল, যেন আগুন ঝরছিল। একটা ভ্যানে মুখোমুখি দু’টা বেঞ্চ। আকাশ আর বৃষ্টি পাশাপাশি বসেছে। তাদের মুখোমুখি বসেছে নীলা। আকাশ আগে একবার গাজীপুর জাতীয় উদ্যানে গিয়েছিল, নওগাঁয় তাদের গ্রামের বাড়ি বা তার ফুপুর বাড়ির কাছেই এমন সুন্দর পরিবেশ আছে। এটা তার ধারণাই ছিল না।

একটা শিয়াল দৌড়ে রান্তা অতিক্রম করল।

আকাশ জোরে চিৎকার করে হাত তালি দিল, নীলা দেখ, দেখ একটা শিয়াল রান্তা ক্রস করল। এমন খাঁটি গ্রাম এখনো আমাদের দেশে আছে?

বৃষ্টি মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, আছে, এখন তুই সেই গ্রামে।

ভেরি বিউটিফুল, আমার খুব সুন্দর লাগছে, বৃষ্টি তুই একটু নাম, নীলা তুমিও নাম, আকাশ বলল।

সবাই নামল।

বৃষ্টি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল, সুন্দর তো লাগবে, এমন ছায়াঘেরা শীতল ফরেস্টের মধ্যে আমাদের দু’জনের মতো সুন্দর মেয়ে সঙ্গে থাকলে সবারই সুন্দর লাগবে।

দু’জন সুন্দর মেয়ে না, একজন সুন্দর মেয়ে।

ও নীলা সুন্দর মেয়ে আর আমি বুঝি অসুন্দর মেয়ে? ঠিক আছে তোরা যা, আমি যাব না, বলে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে রইল।

আকাশ বৃষ্টির দু’হাত জড়িয়ে ধরলো, বৃষ্টি, লক্ষ্মী বোন আমার, চল। আমি আসলে তোকে ক্ষেপানোর জন্য অসুন্দর বলেছি। এটা আমার ঠিক হয়নি। প্লিজ, ডন্ট মাইন্ড, এবার চল।

সবাই ফরেস্টের অনেকদূর ভিতরে চলে গেল। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে সরু রান্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াল। তারপর আবার ভ্যানে চড়ে আলতাদিঘীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

আলতাদিঘীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশ ক্লান্ত হয়ে গেল। সে গাছের নীচে কয়েকটা পাতা বিছিয়ে বসতে বসতে বলল, বৃষ্টি আমি আর পারছি না, প্লিজ একটু বস?

নীলা তোরা দু’জনে বসে গল্প কর, আমি ঐদিকে আছি।

আকাশ মুচকি হেসে সায় দিল।

নীলা কয়েকটা গাছের পাতা বিছিয়ে আকাশের মুখোমুখি বসল।

আকাশ বলল, নীলা দেখ শহর থেকে কত দূরে একটা নিভৃত পল্লিতে এরকম একটা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, খুব সুন্দর তাই না?

হ্যাঁ খুব সুন্দর।

তুমি আগে এখানে এসেছ?

না।

তোমার বাড়ির পাশে অথচ তুমি আসনি? ঢাকা শহরে যদি এরকম পুকুর থাকত তবে আমি সুযোগ পেলেই চলে যেতাম।

যেহেতু ঢাকায় এরকম পুকুর নাই তখন আর কি করা এখন থেকে সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসিও।

তোমাদের বাড়িতে?

আমাদের বাড়িতে কেন? তোমার ফুপুর বাড়িতে।

তোমাদের বাড়িতে আসলে ক্ষতি কি?

এটা ঢাকা শহর না মিস্টার যে কেউ কারো খবর রাখে না। এটা ধামইরহাট, দু’য়েকবার আসলেই পাড়ার লোকজন কানাঘুষা শুরু করবে।

আমি তোমাদের বাড়িতে আসলে প্রতিবেশীরা কানাঘুষা শুরু করবে কেন?

ঢাকা শহরে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন নাই বললেই চলে। একজন মানুষকে হাজার হাজার মানুষের সামনে ছিনতাইকারী ধরলেও কেউ কিছু বলে না, কোন ফ্ল্যাটে কোন মানুষ মারা গেলে পাশের ফ্ল্যাটের মানুষ তার কোন খবর রাখে না। ঢাকা শহরের মানুষ মানুষের বিপদেও হাত বাড়ায় না, কারো আনন্দও শেয়ার করে না। কিন্তু এখানে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়, যেমন একজনের বিপদ-আপদে অন্য মানুষ ছুটে আসে তেমনি অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়েও হস্তক্ষেপ করে।

এটা হলো সমাজের কুফল।

কুফল কেন? বলতে পার সমাজের রীতি। সমাজে বসবাস করতে চাইলে তোমাকে সমাজের কিছু রীতিনীতি তো মানতেই হবে।

কেউ যদি না মানে?

সমাজ তাকে শান্তি দিবে, ধিক্কার দিবে, ঘৃণা করবে।

থাক, থাক বাবা আমি তোমাদের বাড়িতে আসব না, সমাজের রীতিনীতিও ভঙ্গ করব না।

কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব। তারপর আকাশ প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, নীলা আর ক’দিন থাকবে ধামইরহাটে?

ক’দিন আবার, ভার্সিটি খুললেই চলে যাব।

আমি আসামি পরশুদিন ঢাকা যাব, বৃষ্টিকে আমি যেতে বলি তুমিও চল।

ভার্সিটি না খুললে আমি গিয়ে কি করব? কেউ যদি না আসে তবে আমি বা একাই থাকবো কীভাবে?

বৃষ্টি দূর থেকে বলল, কি রে তোরা আসবি?

নীলা উঠে দাঁড়ালো, চল আকাশ, না গেলে ও আবার তোমাকে ক্ষেপাবে।

হ্যাঁ চল।

তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর পাড়ে স্কুলের কাছে এসে দাঁড়ালো। স্কুলের অদূরে ভ্যানটি দাঁড়ানো আছে, ভ্যানওয়ালা ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে।

নীলা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি চল। আজ ব্যাংক বন্ধ, বাবা বাড়িতে আছে। বাবা আমাকে ছাড়া দুপুরে ভাত খাবে না।

আতিয়ার সাহেব নীলা, আকাশ আর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিল।

সবাই বাড়িতে ঢুকলো।

আতিয়ার সাহেব তাঁর রুম থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, মা এসেছিস, বৃষ্টি এসো মা, বস।

বারান্দায় ডাইনিং টেবিল বসানো আছে, আতিয়ার সাহেব সেখানে চেয়ারে বসলেন। নীলা আকাশকে তার বাবার সঙ্গে পরিচয় করে দিল, বাবা ও হচ্ছে আকাশ, তোমাকে যার কথা বলছিলাম, তোমার বান্ধবী সুলতানা মামির ছেলে।

নীলা লক্ষ্য করেছে তার সুলতানা মামির নাম শুনেই তার বাবা যেন মুখ কি রকম করেন? যেন কিছু একটা লুকাতে চান। নীলা আর কিছু বলল না।

আকাশ সালাম দিল।

আতিয়ার সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মা কেমন আছেন বাবা?

জি ভালো।

তোমার বাবার বোধ হয় একটা প্রমোশন হয়েছে?

জি, বাবা এখন ইন্সপেক্টর।

তোমার মা কি চাকরি করছে?

না খালু।

তুমি তোমার দাদার বাড়ি যাও?

জি।

নীলা তার বাবা এবং আকাশের দিকে তাকালো। তার বাবা আকাশকে তার দাদার বাড়ি যাবার কথা জিজ্ঞেস করল কেন? বিষয়টা নীলার কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না।

আতিয়ার সাহেব বললেন, নীলা আজ তো বোধহয় পেপার পড়িস্নিন, তোদের ইউনিভার্সিটি আসামি পরশুদিন খুলবে।

বাবা তাহলে তো আমাকে কালকেই ঢাকা যেতে হবে।

যেও।

 

নয়

 

নীলা সহজে সবকিছু সহজভাবে নিতে পারে না। কোন সুখের কথা মনে পড়লে আপন মনে হেসে উঠে, কোন কষ্টের কথা মনে পড়লে বার বার তার মনে খচখচ করে দাগ কাটে তখন সে মুখ ভার করে বসে থাকে। আবার কোন কথা তার কাছে অস্পষ্ট মনে হলে তার কৌতূহলী মন বার বার করে তা জানার জন্য বিচলিত হয়। সুলতানা নীলার মুখে তার বাবার নাম শুনে কেমন যেন থমকে গিয়েছিল, স্বাভাবিক হতে তাঁর কয়েকমুহূর্ত সময় লেগেছিল। আবার নীলার মুখে তার বাবা সুলতানার নাম শুনে কেমন যেন মুখ বিকৃত করেছিল সবকিছু যেন রহস্যময়, একটা অস্পষ্টতা। নীলা বিভিন্নভাবে এসব রহস্যের সূত্র উদ্ঘাটনেরর জন্য উৎসুক হয়েছিল এবং এসব রহস্যের জোট খোলার জন্য চেষ্টা করছিল।

আকাশ নীলাকে নিয়ে ইস্টার্ন প্লাজায় একটা মোবাইলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো।

নীলা জিজ্ঞেস করল, আকাশ তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসলে কেন?

একটা মোবাইল সেট কিনব, তুমি পছন্দ করে দিবে।

আমি মোবাইল সেটের কি বুঝব?

তবু তোমার পছন্দের গুরুত্ব অনেক।

দোকানদার অনেকগুলো মোবাইল সেট দেখালো, নীলা একটা মোবাইল সেট হাতে নিল।

আকাশ জিজ্ঞেস করল, এটার দাম কত?

দোকানদার বলল, পনেরো হাজার টাকা।

আকাশ মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে নীলাকে জিজ্ঞেস করল, সেটটাতে ভিডিও আছে, এম.পি. থ্রি, ইন্টারনেট আছে আরো অনেক ফাংশন আছে, সেটটা খুব সুন্দর না?

হ্যাঁ সেটটা সুন্দর কিন্তু দামও তো পনেরো হাজার টাকা, কি করবে এত দামি সেট দিয়ে।

একজনকে গিফট করব, যাকে গিফট করব তার জন্য আমার কাছে টাকা কোন বিষয় না। তার জন্য আমার সামর্থ্য আনলিমিটেড।

বাঃ যার জন্য তোমার সামর্থেযর অভাব নাই সে নিশ্চয়ই খুব ভাগ্যবান।

ভাগ্যবান না ভাগ্যবতী।

নীলার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল।

আকাশ নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নীলা রাগ কর না প্লিজ, একটা মোবাইলে তো, না হয় বাবার টাকা থেকে কিছু দিয়ে দিলাম।

না তোমার টাকা তুমি যাকেই দাও না কেন তাতে তো আমার কিছু বলার নাই। আমি তোমার এমন কেউ না যে আমি বললেই তুমি শুনবে। তবে আমি মনে করি মোবাইল কথা বলার জন্য, ভিডিও দেখার জন্য না, কাজেই মোবাইল সেট দিয়ে কথা বলা গেলেই হয়।

নীলা তুমি বুঝতে পাচ্ছ না সে আমার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিক আছে বুঝলাম, তুমি যা খুশি কর আমি আর দেরি করতে পারছি না।

প্লিজ নীলা একটু সময় দাও। এই যে দোকানদার ভাই একটু কম রাখা যায় না?

আপনি চৌদ্দ হাজার পাঁচশ টাকা দেন।

আকাশ টাকা বের করে দিয়ে বলল, একটা সিমকার্ড দেন।

দোকানদার অনেকগুলো সিমকার্ড বের করে দিয়ে বলল, একটা নাম্বার চয়েজ করে দেন।

আকাশ একটা নাম্বার চয়েজ করে দিয়ে বলল, এটা দিন।

দোকানদার সিমকার্ডের ফরম পূরণ করে সিমকার্ডটা অ্যাকটিভ করে দিল।

আকাশ আর নীলা ইস্টার্ন প্লাজা থেকে বের হয়ে একটা রিঙায় চেপে বসল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, আকাশ আমাকে হল-এ যেতে হবে।

নীলা আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করব।

নীলা রাগান্বিত স্বরে বলল, যার জন্য মোবাইল কিনেছ তাকে নিয়েই লাঞ্চ কর। আমাকে আমার হল-এ যেতে দাও।

নীলা প্লিজ রাগ কর না। একসঙ্গে লাঞ্চ করার পর তুমি চলে যাবে, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব।

আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব।

এমনিভাবে কথা বলতে বলতে রিঙা পি.জি’র মোড়ে এসে দাঁড়ালো। আকাশ রিঙা থেকে নেমে একটা ফুলের দোকানে গিয়ে একটা ফুলের তোড়া কিনে এনে আবার রিঙায় উঠল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, আবার ফুল কেন?

আকাশ কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে রিঙা রমনা রেস্টুরেন্টের গেটে এসে দাঁড়ালো। দু’জনে রিঙা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।

রেস্টুরেন্টের শেষ প্রান্তের এক কোণায় আকাশ নিজে একটা চেয়ারে বসে নীলাকে তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসতে বলল।

নীলা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আকাশ আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে কিছু খাব না এবং এই দেখাই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, তুমি যার জন্য মোবাইল সেট কিনেছ, ফুলের তোড়া কিনেছ আবার কোনদিন এখানে আসলে তাকে নিয়ে আসিও।

আকাশ ফুলের তোড়াটা নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নীলা আজ থেকে এক বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল তাই আজকের দিনটাকে উপভোগ করার জন্য আমি এতকিছু আয়োজন করেছি, মোবাইল, ফুলের তোড়া সবকিছু তোমার জন্য।

আকাশ।

প্লিজ নীলা, তুমি না কর না।

নীলা হেসে উঠল, থ্যাংক ইউ আকাশ, তুমি আসলে পার সবকিছু।

অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব কিন্তু কোন ইস্যু খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই আমি আজকের এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আকাশ প্রাইজ লিস্টটা নীলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নীলা কি খাবে?

তোমার যা ইচ্ছা।

আকাশ অর্ডার দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, নীলা আসলে তোমার সঙ্গে আমার সব সময় কথা বলতে ইচ্ছা করে, বিশেষ করে তুমি যখন গ্রামের বাড়ি গেলে তখন তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ইচ্ছা করছিল কিন্তু কি করব তোমার কাছে মোবাইল ছিল না তাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।

তুমি কি এই মোবাইল সেট আমার জন্য কিনলে?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমি যে এটা নিতে পারব না আকাশ।

কেন?

বাবাকে কি জবাব দিব?

এখানে জবাব দেওয়ার কি হলো? তুমি এখন ভার্সিটিতে পড়ছ তোমার কোন ফ্রেন্ড তোমাকে কিছু গিফট করতেই পারে।

আকাশ তুমি জানো না বাবা কি রকম প্রিন্সিপালের মানুষ?

প্লিজ নীলা তুমি না কর না, পরে কি হবে দেখা যাবে।

তুমি আমাকে আগে বললে না কেন আকাশ?

তোমাকে সাপ্রাইজ দেয়ার জন্য।

নীলা কয়েকমুহূর্ত আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আকাশ তুমি আমাকে এত ভালোবাস? কোনোদিন যদি আমি তোমার কাছে না আসতে পারি তখন কি করবে?

আকাশ জিজ্ঞেস করল, নীলা কি ভাবছ?

আচ্ছা আকাশ তোমার নানার বাড়ি কোথায়?

নজিপুর।

আর তোমার দাদার বাড়ি?

একই উপজেলায় তবে দাদার বাড়ি নজিপুর থেকে পূর্বদিকে আর নানার বাড়ি পশ্চিম দিকে।

ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে। আকাশ নীলাকে একটা প্লেট এগিয়ে দিতে দিয়ে বলল, নীলা শুরু কর।

নীলা তার প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে বলল, আকাশ তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব, তুমি কিছু মনে করবে না তো?

নীলা তুমি এতদিনেও আমাকে চিনলে না। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় এত ফরমালিটিস করার কোন দরকার নাই। যা বলার কোন হেজিটেশন ছাড়াই বলে ফেল।

না থাক আর একদিন বলব।

নীলাকে ব্যাগ হাতে রুমে ফিরতে দেখে মোহনা বলল, কি রে এত ব্যাগ-ট্যাগ কেন? খুব শপিং করলি বুঝি?

না শুধু একটা মোবাইল সেট।

দেখি দেখি কেমন মোবাইল সেট? বলে মোহনা তার চেয়ার থেকে উঠে নীলার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে মোবাইল সেটটা বের করল, ওয়াহ, খুব সুন্দর সেট তো? কত দাম হলো রে?

চৌদ্দ হাজার পাঁচশ টাকা।

এত টাকা দামের সেট, আকাশ দিয়েছে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

তবে শুধু আমাকে বলিস কেন?

কি বলি তোকে?

নীলা হৃদয়ের সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে তুই আমাকে অনেক ক্রিটিসাইজ করেছিস, এখন তো দেখি তুই-

নীলা রাগান্বিত স্বরে মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল, মোহনা হৃদয়ের সঙ্গে তোর ফ্রেন্ডশিপ আর আকাশের সঙ্গে আমার ভালোবাসা এক বিষয় না।

এক বিষয় না কেন?

কারণ আকাশ আমার বান্ধবীর রিলেটিভ, স্টুডেন্ট, আমাদের বয়স, পেশার মধ্যে সিমিলারিটি আছে, আর হৃদয়ের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছে মোবাইলে, তুই হৃদয়ের কোন ঠিকানা পর্যন্ত জানিস না। তাছাড়া তোদের বয়সের ডিফারেন্স অনেক। দেখ ঘরে বউ রেখে তোকে অ্যানম্যারিড বলছে নাকি।

নীলা সেকেলে কথা বলবি না। টেকনোলোজি ডেভলাপ করেছে এখনো কারো সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করার জন্য কাউকে না কাউকে মিডিয়া বানিয়ে তার মাধ্যমে পরিচিত হতে হবে এমন কথা না। তোর সঙ্গে আকাশের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বৃষ্টি, আমি হৃদয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি মোবাইল ফোনে। এখানে তো কোন তফাৎ নাই, আর হৃদয়ের বউ আছে কি না বলছিস আমি তো তোকে আগেই বলেছি আমি শুধু হৃদয়ের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করছি, প্রেম বা বিয়ে কোনটাই না।

নীলা কোন কথা বলল না।

মোহনা মুচকি হেসে বলল, তোর সেটটা খুব ভালো রে, আকাশের পছন্দ আছে, তুই যেমন আকাশের ওপর নির্ভর করতে পারছিস আমি যদি সেরকম দায়িত্ববান কাউকে পেতাম-

কেন তোর তো অনেক বন্ধু আছে।

বললাম তো, দায়িত্ববান যদি কাউকে পেতাম, আসলে সবাই শুধু আমার সৌন্দর্যেযর দিকে তাকায়, মনের দিকে তাকায় না। নীলা আকাশের সঙ্গে তোর বিয়ে হলে তুই খুব সুখী হবি।

মোহনা কথায় বলে জন্ম -মৃতু-বিয়ে সব আল্লাহর হাতে, দোয়া করিস, আল্লাহ যেন তোর দোয়া কবুল করেন।

 

দশ

 

নীলার পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি প্রতিদিনই মোবাইলে খবর নিয়েছেন পরীক্ষা ভালো হচ্ছে কি না? কোন অসুবিধা আছে কি না? টাকা পয়সার অসুবিধা আছে কি না? তাঁর জিজ্ঞাসার যেন অন্ত নেই।

একদিন নীলা হাসতে হাসতে তার বাবাকে বলেছিল, বাবা তোমার কথা শুনে মনে হয় শুধু তোমার মেয়েই ভার্সিটিতে পড়ে আর কেউ পড়ে না।

আতিয়ার সাহেব আর কোন কথা বলেননি।

আজকেই নীলার পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সন্ধ্যায় আতিয়ার সাহেব মোহনার মোবাইলে রিং করেছেন। মোহনা মোবাইল রিসিভ না করে নীলাকে মোবাইলটা দিয়ে বলল, নীলা তোর ফোন, খালু করেছে।

নীলা মোবাইল রিসিভ করে বলল, বাবা।

মা তুই ভালো আছিস?

জি বাবা, তোমরা ভালো আছ সবাই?

হ্যাঁ মা আমরাও সবাই ভালো আছি। মা তোর তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে বাড়ি আসবি না?

বাবা বৃষ্টির পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। আরো কয়েকদিন পর ওর পরীক্ষা শেষ হবে তখন না হয় এক সঙ্গে যাব।

না মা তুই কালই রওয়ানা দে, একাই আসতে পারবি না? নাকি আমি ঢাকা গিয়ে তোকে নিয়ে আসব?

না বাবা তোমাকে আসতে হবে না, আমি একাই আসতে পারব।

তবে কালই চলে আয় মা।

ঠিক আছে বাবা।

নীলা মোহনাকে মোবাইলটা দিতেই মোহনা জিজ্ঞেস করল, খালু আমার মোবাইলে রিং করেছে কেন রে? এতদিনেও তোর মোবাইল নাম্বার দিস নি?

না রে এখনো দিইনি, এখন মোবাইল নাম্বার দিলে হাজারটা প্রশ্ন করবে, মোবাইল তোর কি প্রয়োজন? টাকা কোথায় পেলি? তাই ভাবছি বাড়ি গেলে তখন বাবাকে বুঝিয়ে বলব।

আমার বাবা নিজেই একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়ে বলল, আজকালকার দিনে মোবাইল ছাড়া কি চলে? প্রতিদিন আমি আমার মা’র সঙ্গে কথা বলব না? আমি সেদিন ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেটটা সেকেলে হয়ে গেছে। তবু বাবার দেওয়া বলে কথা, ইচ্ছা করলেই তো আর বদল করা যায় না, বলে মোহনার মনটা যেন হাহাকার করে উঠল, যে বাবা আমাকে এত স্নেহ করে, যে বাবা সব সময় বলতো মেয়েদের আসলে সবার আগে উচিত শিক্ষিত হওয়া, স্বাবলম্বী হওয়া তারপর বিয়ে করা, শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হওয়া ছাড়া অধিকারের আন্দোলন অর্থহীন, সে বাবাই মিলন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আমার লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে–

নীলা তার মোবাইল থেকে আকাশকে মিস্‌ কল দিয়ে অপেক্ষা করছিল। কয়েকমিনিট পর আকাশ মোবাইল করল, হ্যালো নীলা, কি খবর?

শোন কাল আমি বাড়ি যাচ্ছি।

হঠাৎ করে? একাই যেতে পারবে?

হ্যাঁ বাবা মোবাইল করেছিল। আমি একাই যেতে পারব।

তোমার গাড়ি ক’টায়?

সকাল ন’টায়।

আমি সকালবেলা আসি, তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে আসব।

এসো, তুমি একবার বৃষ্টিকে মোবাইলটা দাও তো, ওর সঙ্গে কথা বলি।

আমার পাশেই আছে কথা বল।

হ্যালো বৃষ্টি বাবা মোবাইল করেছিল আমাকে কালই বাড়ি যেতে হচ্ছে।

ডিসিশন ফাইনাল?

হ্যাঁ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

নীলা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো। রাত দশটা বাজে। সে মোবাইল করে কাউন্টারে টিকেট বুকিং দিয়ে রাখল। তারপর তার ব্যাগ গুছাতে লাগল।

মোহনা সব সময় খোঁচা মেরে কথা বলে। নীলাকে ক্ষেপানোর জন্য তার সব কথা বা কাজকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। সে নীলাকে জিজ্ঞেস করল, কি রে ব্যাগ গুছাতে শুরু করলি?

হ্যাঁ।

বাড়ি যাবি এ কথাটা সিদ্ধেশ্বরী না কোথায় থাকে তোর ফ্রেন্ড তাদের জানালি আর আমি তোর রুমমেট আমাকে জানালি না?

আমি তো তোর সামনেই কথা বললাম, তোকে আবার নতুন করে কি বলতে হবে?

আমি তোর রুমমেট, শুধু রুমমেটই না সিনিয়রও, বলতে গেলে আমি তোর ভার্সিটি গার্জিয়ান একই রুমে থাকি বলে তোর সাথে আমি কখনো সিনিয়রের মতো আচরণ করি না। সিনিয়রই হই আর রুমমেটই হই তুই তো বাড়ি যাবার কথা সবার আগে আমাকে জানাবি নাকি?

সরি আপা।

আর আপা বলবি না, আগে যা বলতিস্‌ তাই বলবি, তুই সবাইকে জানালি আর আমাকে জানতে হলো তোকে জিজ্ঞেস করে।

বললাম তো সরি, সরি মোহনা তোকে আমার আগে বলা উচিত ছিল। ভুল হয়ে গেছে প্লিজ তুই কিছু মনে করিস না। এখন বলছি, বলে নীলা মোহনার কানের কাছে গিয়ে জোরে বলল, মোহনা আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কাল আমি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।

মোহনা মৃদু হেসে বলল, এবার ঠিক হয়েছে।

ঠিক আছে এখন থেকে আমি সবকিছু তোকে একেবারে তোর কানের কাছে গিয়ে বলব। তুই কবে যাবি?

আমার আসামি পরশু একটা পরীক্ষা আছে তার পরদিন।

পল্লব পরীক্ষা দিয়ে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিল। পল্লব অনেকদিন বৃষ্টির কাছ থেকে স্পষ্ট করে তার মনোভাব শোনার জন্য অপেক্ষা করছে আজ সে বৃষ্টির কাছ থেকে চূড়ান্ত জবাব নেবে। সে বৃষ্টিকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করবে সে তাকে ভালোবাসে কি না? বৃষ্টির জবাব যদি পজেটিভ হয় তবে তো পল্লবের মনের আশা পূরণ হয় তার প্রায় এক বছর বৃষ্টির পথ চেয়ে থাকার অবসান হয় আর বৃষ্টির জবাব যদি নেগেটিভ হয় তবে—,

না না নেগেটিভ হবে কেন? তাহলে বৃষ্টি তাকে এতদিন আশ্বাস দিয়ে রাখল কেন? কিন্তু বৃষ্টি তো তাকে আশ্বাস দেয়নি। বরং বার বার হালকাভাবে, ইয়ার্কি করে অনেককিছু্‌ বলেছে। বৃষ্টি যদি প্রথমে তার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করত তবে তো তার পিছনে দিনের পর দিন তাকে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।

বৃষ্টি পরীক্ষা দিয়ে বের হলো। সে একরকম পল্লবকে না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল।

পল্লব ডাক দিল, বৃষ্টি।

কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাসায় যাবি না।

বৃষ্টি আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।

কেন?

আজ পরীক্ষা শেষ না, চল না কোথাও একটু গিয়ে বসি?

কেন কি বলবি? এখানে বল।

বৃষ্টি আজকের দিনে আমাকে একটু সময় দে, আমি আর কোনদিন তোর কাছ থেকে সময় চাইব না। তোর সঙ্গে আমার আর কোনদিন কথা নাও হতে পারে।

বৃষ্টি পল্লবের মুখের দিকে তাকালো, সিরিয়াসলি?

অফ কোর্স।

বেশ চল তোর শেষ কথা শুনি।

দু’জনে একটা ট্যাঙি ক্যাব নিয়ে রওয়ানা হলো। বৃষ্টি তার মোবাইলটা দু’জনের সিটের মাঝখানে রেখেছিল পল্লব বৃষ্টির মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ টিপে টিপে কি যেন দেখলো।

তার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল।

বৃষ্টি তা খেয়াল করল না।

মগবাজার মোড় অতিক্রম করার পর ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ভাইজান কোথায় যাব?

পল্লব মুখ গম্ভীরস্বরে বলল, চন্দ্রিমা উদ্যানে চল।

কিছুক্ষণ পর ট্যাঙি ক্যাব চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়ালো। দু’জনে ট্যাঙি ক্যাব থেকে নেমে ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে চন্দ্রিমা উদ্যানে ঢুকলো। কিছুদূর সোজা যাবার পর হাতের ডানে গিয়ে দু’জনে একটা গাছের নীচে মুখোমুখি বসল।

বৃষ্টি একটা দুষ্টামির হাসি হেসে বলল, পল্লব বল তোর শেষ কথাগুলো?

পল্লব বলল, বৃষ্টি তুই আমাকে তিরস্কার করছিস? আসলে সত্যি সত্যি যখন আমাকে জানবি আমি আর নাই সেদিন বুঝবি কিন্তু সেদিন তোর কিছু করার থাকবে না।

বল, বল, বল তোর কথাগুলো বল?

তুই যা-ই বল না কেন আমি সবকিছু না বলে তোর কাছ থেকে বিদায় নিব না।

বল?

বৃষ্টি আজ আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। তোর সঙ্গে আমার পরিচয়েরও প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হলো। আমার যতটুকু মনে পড়ে প্রথম ক্লাসের দিনেই তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সেদিন থেকে আমি মনে মনে তোকে ভালোবেসেছি, আমি অনেকদিন তোকে ইন্ডাইরেক্টলি বলেছি। যখন দেখেছি ত্‌ইু বুঝেও না বোঝার ভান করছিস, আমাকে অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করছিস তখন আমি তোকে সরাসরি ভালোবাসার প্রন্তাব দিয়েছি। আমি তোর কাছ থেকে যেমন নেগেটিভ এ্যানসার পাইনি তেমনি পজেটিভ এ্যানসারও পাইনি। আসলে আমি একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আমি এই অবস্থার অবসান চাই এবং সেটা আজই।

তো আমাকে কি করতে হবে?

তুই আজ আমাকে বলবি, তুই আমাকে ভালোবাসিস্‌ কি না?

বৃষ্টি একটা মুচকি হেসে বলল, পল্লব তুই কি আমাকে খুব ভালোবাসিস্‌?

ভালোবাসি বলেই তো তোর অনেক অবহেলা সহ্য করেছি, প্লিজ তুই আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা কর।

পল্লব আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে, বলে বৃষ্টি মনে মনে বলল, দিলাম তো একটা প্যাচকি লাগাইয়া।

বৃষ্টি আমরা এক বছর থেকে একসঙ্গে লেখাপড়া করছি, মেলামেশা করছি তোকে আমার ভালোবাসার কথা বলেছি এরপরও কি আমি তোর মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারিনি যে সিদ্ধান্ত নিতে তোর সময় লাগছে?

বৃষ্টি মনে মনে বলল, তবুও একটু বাজিয়ে নিতে অসুবিধা কি?

পল্লব জিজ্ঞেস করল, বৃষ্টি কি ভাবছিস?

পল্লব তুই যা-ই মনে কর না কেন আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে। বুঝতেই পাচ্ছিস্‌ এটা সারাজীবনের ব্যাপার একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ক’দিন সময় দিতে হবে?

সাতদিন।

ঠিক আছে তবে সাতদিনের মধ্যে তুই আমাকে জানাবি। আমি আর তোকে রিং করব না।

বৃষ্টি মনে মনে বলল, সাতদিন তুই আমাকে মোবাইল না করে থাকতে পারবি?

পল্লব কিছু বলল না।

 

এগারো

 

নীলা সারাদিন মোবাইল বন্ধ রাখে। গভীর রাতে তার মা-বাবার ঘুমানো নিশ্চিত হয়ে মোবাইল চালু করে আকাশের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। কোনদিন বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলে। সে সব সময় চেষ্টা করেছে তার মোবাইলের বিষয়টা মা-বাবার কাছে গোপন রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হলো না। একদিন নীলা মোবাইল বন্ধ রাখতে ভুলে গিয়েছিল। মোবাইলটা তার রুমে বালিশের নীচে ছিল। নীলা তখন তার বাবার সঙ্গে কথা বলছিল, হঠাৎ করে তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল। নীলা দৌড়ে গিয়ে মোবাইল বন্ধ করল। সে মোবাইল বন্ধ করে তার বাবার কাছে এসে বসতেই আতিয়ার সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মা তুই তো আমার কাছে কোনদিন কিছু লুকাসনি, মোবাইলের কথাটা লুকালি কেন?

নীলা তার বাবার কথার কি জবাব দিবে খুঁজে পেল না। সে মাথা নত করে বসে রইল।

আতিয়ার সাহেব বললেন, নিয়ে আয় তো তোর মোবাইলটা একবার দেখি।

নীলা তার রুমে গিয়ে মোবাইলটা এনে তার বাবার হাতে দিল।

আতিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো অনেক দামি মোবাইল, তুই এত দামি মোবাইল কোথায় পেলি?

বাবা আকাশ আমাকে এই মোবাইলটা গিফট করেছে।

আতিয়ার সাহেব গম্ভীরস্বরে বললেন, তা দাম কত?

নীলা বুঝতে পারল তার বাবা তার ওপর খুব রাগ করেছে। সে মোবাইলটার প্রকৃত দাম না বলে একটু চালাকির আশ্রয় নিল, বাবা আমি তো দাম জানি না।

তবুও আমার মনে হয় দশ হাজার টাকার কম না।

নীলা কিছু বলল না।

আতিয়ার সাহেবের গায়ের রং ফর্সা ধবধবে, তিনি যখন রেগে যান তখন তাঁর চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। তাঁর রাগের সময় কোন কথার প্রতিবাদ করলে তখন তিনি প্রচণ্ড রেগে যান।

নীলা কোনো কথা না বলে মাথা নত করে বসে রইল।

নীলা তোকে কি আমি ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা দিয়েছি? কারো টাকার প্রতি, কারো জিনিসের প্রতি লোভ করার শিক্ষা দিয়েছি?

নীলা তবুও কোন কথা বলল না। সে মাথা নত করে বসে রইল।

নীলা একটা কথা মনে রাখবি পৃথিবীতে কেউ কাউকে কিছু এমনিতে দেয় না। কোন লোক যখন ভিক্ষুককে দান করে তখনো সে সওয়াবের আশায় দান করে। পৃথিবীতে স্বত্ব ত্যাগ করে কেউ কাউকে কিছু দেয় না। দান, উপহার, উৎকোচ যা-ই বলিস না কেন সমস্ত কিছুর পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে, কখনো তা থাকে প্রচ্ছন্নভাবে আবার কখনো থাকে প্রকাশ্যে। কখনো মহৎ উদ্দেশ্যে কখনোবা কোন স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে।

লজ্জা, ক্ষোভ আর ঘৃণায় নীলার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। বাবা এতকিছু বলে আমাকে কি বোঝাতে চায়? বাবা কি আমার অনেস্টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? হ্যাঁ তাই তো আমাকে দামি মোবাইল সেট গিফট করার পিছনে বাবা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই বোঝাতে চেয়েছে। ছিঃ বাবা, ছিঃ একটা সামান্য ঘটনাই তুমি আমাকে এভাবে সন্দেহ করলে? এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে নীলার মুখ থেকে অষ্ফুটস্বরে বের হয়ে এলো, সরি বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আকাশকে মোবাইলটা ফেরত দিব।

থ্যাংক ইউ মা। এখন তোর বয়স কম, ভুল হতেই পারে কিন্তু ভুল সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত।

নীলা আজ তার বাবাকে সুলতানা মামির সঙ্গে তার অতীত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে তার বাবাকে এ যাত্রায় সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে।

নীলা উঠে দাঁড়ালো।

আতিয়ার সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস মা?

নীলা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

আতিয়ার সাহেব একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন তারপর সস্নেহে বললেন, আমার মোবাইলটা নিয়ে আয় তো মা।

নীলা তার বাবাকে মোবাইলটা এনে দিল।

আতিয়ার সাহেব পটুকে মোবাইল করলেন, হ্যালো পটু।

জি দুলাভাই।

তুই কি দোকানে আছিস?

আছি।

তোর দোকানে ভালো মোবাইল সেট আছে?

আপনার সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি দামের মোবাইল সেট আমার দোকানে আছে।

এত কথা বলতে হবে না। মোবাইল সেটটা আসলে আমার সাধ্যের উপর নির্ভর করছে না। আমার মেয়ের পছন্দের উপর নির্ভর করছে।

আছে দুলাভাই।

আমি আসছি, একটা সেট নিতে হবে, বলে আতিয়ার সাহেব মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে বললেন, চল মা, তোকে এখনই একটা মোবাইল সেট কিনে দিব।

নীলা মুখ ভার করে বলল, আমি মোবাইল নিব না বাবা।

আতিয়ার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, নীলা তুই কিন্তু আমার কথা কোনদিন না করিসনি, আজও করবি না, চল, আর হ্যাঁ তোর মোবাইল সেটটার মডেল নাম্বারটা দেখে নিস।

নীলা তার বাবার কথার কোন প্রতিবাদ করল না।

সে তার বাবার সঙ্গে বের হলো।

নীলাদের বাড়ির অদূরে পটুর মোবাইল ফোনের দোকান। আতিয়ার সাহেব এবং নীলা কয়েক মিনিটের মধ্যে পটুর দোকানে এলো। পটুর পুরো নাম মোঃ জাহেদুল ইসলাম, ছোটবেলা থেকে সবাই তাকে পটু বলে ডাকে, পট,ু পটু বলে ডাকতে ডাকতে অনেকেই তার প্রকৃত নামটা ভুলে গেছে। পটু লম্বা, ফর্সা, বয়স চল্লিশ কিংবা পঁয়তাল্লিশ হতে পারে। সুঠাম দেহের অধিকারী, সদা হাস্য মুখ। শত চিন্তাতেও কেউ কোনদিন তাকে গম্ভীরমুখে থাকতে দেখেনি। পটু আতিয়ার সাহেবের দূর সম্পর্কের শ্যালক কিন্তু তার হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণে সে যেন তাদের সম্পর্কটা কাছের করে নিয়েছে।

পটু তার স্বভাবসুলব ভঙ্গিতে বলল, কি সেট নিবেন দুলাভাই?

আমি না তোর ভাগিনী নিবে, ভালো একটা সেট দেখাবি।

দুলাভাই বাজেট কত?

কেন? আবার বাজেটের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?

দুলাভাই আপনি সবকিছু কেনার আগে বাজেটের কথা চিন্তা করেন তো।

আমি চিন্তা করি আমার বেলায় কিন্তু সেট তো আমি নিচ্ছি না, নীলা নিচ্ছে, আমার মায়ের বেলায় বাজেট আনলিমিটেড আর তুই আজকাল খুব বেশি কথা বলছিস।

পটু আর কথা বাড়াল না, র‌্যাক থেকে কয়েকটা মোবাইল সেট বের করে টেবিলের ওপর রাখল।

নীলা একটা সেট হাতে নিয়ে বলল, বাবা আমি এই সেটটা নিব।

পটু ইয়ার্কি করে বলল, যেমন বাবা তেমন মেয়ে, এতগুলো ভালো সেট রেখে মা আমার পছন্দ করেছে একটা কম দামি সেট। এটাতে তো অডিও, ভিডিও, এম.পি থ্রি, ইন্টারনেট কিছুই নাই।

আতিয়ার সাহেবও কিছুটা অবাক হলেন, সে কি মা? এত কম দামি সেট নিবি কেন? আচ্ছা মা বলতো ঐ সেটটার মডেল কত যেন? কি কোম্পানির?

বাবা মোবাইল কথা বলার জন্য, কথা বলতে পারলেই হলো, আমি এই সেটটাই নিব।

আতিয়ার সাহেব বললেন, আমার ওপর রাগ করেছিস?

না বাবা আমি তোমার ওপর রাগ করিনি। আমি এই সেটটাই নিব, তুমি যদি দাও তবে দিবে এর চেয়ে বেশি দামি সেট আমি নিব না।

পটু বলল, এই না হলো বাবার যোগ্য মেয়ে, দুলাভাই ভাগিনীকে কি শিখিয়ে দিয়েছিলেন না কি?

নীলা রাগান্বিতস্বরে বলল, মামা, আমি যা বলছি তাই করুন প্লিজ, আমি এই সেটটা নিব আপনি প্যাকেট করে দিন।

পটু আতিয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, দুলাভাই, কি করব?

নীলা আবার বলল, মামা প্যাকেট করে দিন।

আতিয়ার সাহেব বললেন, দে।

পটু মোবাইল সেটটা প্যাকেট করে দিল।

আতিয়ার সাহেব বললেন, পটু নীলার নম্বরটা সেভ করে রাখ, ও কখনো মিস্‌ কল দিলে পঞ্চাশ টাকা ব্যালেন্স ট্রান্সফার করে দিবি।

জি দুলাভাই।

আতিয়ার সাহেব এবং নীলা দু’জনে দোকান থেকে বের হলো।

আতিয়ার সাহেব নীলাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এত কম দামি সেট নিলি কেন মা? তোর খারাপ লাগবে না?

খারাপ লাগবে কেন বাবা? আসলে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি একজন অনেস্ট ব্যাংক কর্মকর্তার মেয়ে, অনেক সময় বিলাসিতা, উচ্চাভিলাষ আমাকে বিচ্যুত করে। তাই কখনো কখনো আমি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ভুলে যাই।

সব সময় খেয়াল রাখবি মা, আমাদের পরিবারের একটা ঐতিহ্য আছে যেমন কেউ অমিতব্যয়ী না, কেউ অসৎ পথে টাকা রোজগার করে রাতারাতি বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, কেউ অন্যের সম্পদের ওপর লোভ করে না, আমাদের পরিবারে সমন্ত কিছুর জন্য পারিবারিকভাবে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আছে, ইচ্ছা করলেই কেউ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে পারবে না, যদি কেউ হঠাৎ করে ধনী হয়ে যায় তবে তার উৎস পরিবারের সবাইকে জানাতে হবে। আমি মনে করি এমনিভাবে প্রতিটি পরিবারে যদি জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে তবে দেশ থেকে দুর্নীতি অনেকটা কমে যাবে।

নীলা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য জানে তারপরও তার বাবা আজ তাকে আবার স্মরণ করে দিলেন। তার বুক যেন কেঁপে উঠল, আকাশের বাবা একজন পুলিশ অফিসার, ঢাকা শহরে তাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, তাদের জীবন যাত্রার মান অত্যন্ত উঁচু। একজন সরকারি চাকুরে হয়ে মামা এত বিলাসী জীবন-যাপন করেন কীভাবে? মামা কি একজন সৎ পুলিশ অফিসার? যদি তিনি সৎ অফিসার না হন তবে বাবা কি আকাশের সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিতে রাজি হবেন? শেষ পর্যন্ত মামার ডিজঅনেস্টির জন্য আকাশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে না তো?

 

বারো

 

প্রায় একমাস কেটে গেল পল্লব বৃষ্টিকে মোবাইল করেনি। পল্লবের নাম্বারে রিং দিয়েও বৃষ্টি যোগাযোগ করতে পারেনি। বৃষ্টি পল্লবকে ইউনিভার্সিটিতে অনেক খুঁজেছে এবং পল্লবের ঘনিষ্ঠ দু’য়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু কেউ পল্লবের কোন খবর বলতে পারেনি। কোনদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে মোবাইলে বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলতো, ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে গেটে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতো, তখন বৃষ্টি তাকে মূল্যায়ন করেনি তার ভালোবাসাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছে আজ পল্লবকে না পেয়ে বৃষ্টি পুরাতন স্মৃতি হাতড়ে যেন তাকে খুঁজছে। বৃষ্টি ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেটে এসে দাঁড়ালো, তার চোখের সামনে যেন পল্লবের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। বৃষ্টির চোখ পানিতে ভরে গেল।

পিছনে আকাশ এসে দাঁড়ালো, কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

তোর জন্য, চল।

আমার জন্য নাকি পল্লবের জন্য?

তুই ঠিকই বলেছিস, আমি আসলে পল্লবের কথাই ভাবছিলাম।

কেন? পল্লবের সঙ্গে দেখা হয়নি?

না।

ক’দিন থেকে?

প্রায় একমাস থেকে।

আকাশ বৃষ্টির দিকে তাকালো, কি রে তুই কাঁদছিস?

বৃষ্টি কোন কথা বলল না।

আকাশ বলল, যখন তোর পিছনে ঘুর ঘুর করতো তখন তো পাত্তাই দিস নি। এখন আবার কাঁদছিস কেন?

আকাশ তুই আমার কাজিন আমার কষ্টের সময় আর কষ্ট বাড়াস না। আমার খুব খারাপ লাগছে, পল্লবের কিছু হয়নি তো?

আরে না কি হবে? আর হলেই বা তোর কি? পৃথিবীতে তো কতজনের কতকিছু হয়ে যাচ্ছে তাতে কার কি যায়-আসে?

প্লিজ আকাশ।

আচ্ছা ঠিক আছে, চল।

বাসায় ফিরে বৃষ্টি সোজা তার রুমে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একা চুপ করে শুয়ে রইল। কিন্তু তার চোখের সামনে শুধু পল্লবের ছবি ভেসে উঠল।

বৃষ্টি নীলাকে মোবাইল করল, হ্যালো নীলা।

কি রে এই অসময়ে?

নীলা আসলে অসময় না আমার এখন দুঃসময়।

কেন? কি হয়েছে?

নীলা পল্লবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পল্লবকে তুই খুঁজছিস কেন?

নীলা আমার খুব খারাপ লাগছে, তুই একটু আয় না মামার বাসায়।

এখন তো বেলা দু’টা বাজে, আমি তিনটার সময় আসছি।

আচ্ছা ঠিক আছে।

কিছুক্ষণ পর খাবার টেবিলে বৃষ্টির ডাক পড়ল। বার বার ডাকার পরও খেতে না যাওয়ায় সুলতানা বৃষ্টির বেড রুমে ঢুকলেন, কি হয়েছে মা?

কিছু না মামি।

খেতে আয়।

মামি আমি খাব না।

সুলতানা আর কিছু বললেন না, তিনি চলে গেলেন।

বৃষ্টি বিছানায় শুয়ে বার বার করে পল্লবের মোবাইলে রিং করল। অপর পাশ থেকে বার বার ভেসে এলো, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। কিন্তু বৃষ্টি তবুও আপন মনে মোবাইলের বাটন টিপতে থাকলো।

অনেকক্ষণ এভাবে মোবাইলের বাটন টিপার পর বৃষ্টি মোবাইলটা তার বালিশের পাশে রেখে শুষ্ক কণ্ঠে বলল, একটু পরে মানে কতক্ষণ?

কলিং বেল বেজে উঠল। বৃষ্টি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।

নীলার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম মামি।

ওয়ালেকুম সালাম, মা তুমি হঠাৎ করে? কি মনে করে? মুখ শুকনো কেন? ভাত খেয়েছ?

ভাত খেয়েছি মামি, মামি বৃষ্টি কোথায়?

ওর রুমে আছে।

নীলা বৃষ্টির বেড রুমে ঢুকলো।

বৃষ্টির দু’চোখ থেকে তখন পানি গড়িয়ে পড়ার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে, চোখ দু’টো যেন জবা ফুলের মতো লাল হয়ে আছে।

নীলা বৃষ্টির বিছানার কোণায় বসে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, কি রে কি হয়েছে? এভাবে শুয়ে আছিস কেন?

নীলা তোকে তো বললাম পল্লবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমিও তো তোকে বললাম পল্লবকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তোর ক্ষতি কি?

নীলা এভাবে বলিস না, আমাকে হেল্প কর, প্লিজ!

কি হেল্প করব বল?

নীলা আমি পল্লবকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।

তুই খুব ভালোবাসিস্‌ না, ফিফটি ফিফটি ভালোবাসিস্‌, আমি তো জানতাম পল্লব তোকে খুব ভালোবাসতো, তোর সঙ্গে একটু গল্প করার জন্য, আড্ডা দেওয়ার জন্য সব সময় ঘুর ঘুর করত। হঠাৎ করে আবার লা-পাত্তা হয়ে গেল কেন?

বৃষ্টি বিছানা থেকে উঠে বসল, নীলা এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আগে তু্‌ই বল আমার ওপর রাগ করবি না।

বল আমি রাগ করব না।

নীলা তুই তো জানিস পল্লব একটু বেশি আবেগপ্রবণ। সেদিন আমাকে খুব করে ধরলো আমি ওকে ভালোবাসি কি না? আমার মনের মধ্যে একটা দুষ্টামি ভর করল। আমি বললাম আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে। ও আমাকে বলল আমি যেন সাত দিনের মধ্যে ওকে আমার মতামত জানাই, যদি না জানাই তবে আর ও আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবে না। আমি ভাবলাম ওতো এভাবেই কথা বলে, হয়ত এমনি বলছে। আমি সাত দিন ওকে মোবাইল করিনি, ও আমাকে মোবাইল করেনি। সাধারণত আমার সঙ্গে সাত দিন কথা না বলে কাটায়নি। সাত দিন পর থেকে আমি ওকে মোবাইল করছি কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ। পরীক্ষার পর ভার্সিটি খোলার প্রায় একমাস হলো এর মধ্যে ও কোনদিন ক্লাসেও আসেনি। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ ওর কোন খবর দিতে পারছে না।

বৃষ্টি তোকে আমি একদিন বলছিলাম বিষয়টা পরিষ্কার করতে কিন্তু তুই আমার কথা শুনিসনি। আসলে ভালোবাসা দু’টা মনের পবিত্র কামনার নাম, একটি পবিত্র সম্পর্কের নাম। সেই পবিত্র সম্পর্ক যখন চাতুরতায় আবদ্ধ হয় তখন ভালোবাসার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন আর রিলেশন টিকে না।

তুই ঠিকই বলেছিস নীলা আসলে তুই আর আমি একসঙ্গে লেখাপড়া করলেও তুই আমার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচুর্ড।

যাক ওসব কথা, আমার মনে হয় ও কোথাও গেছে আবার কয়েকদিন পর দেখবি ঠিকই চলে আসবে।

বৃষ্টি নীলার কথা মেনে নিতে পারল না।

সে মাথা নত করে বসে রইল।

সুলতানা ভিতরে ঢুকলেন, বৃষ্টি আয় মা, নীলা আসো।

কোথায় মামি? নীলা জিজ্ঞেস করল।

ভাত খেতে।

মামি আমি তো ভাত খেয়ে এসেছি।

এটা কি কথা, তুমি আমাদের বাসায় আসবে আর আমি তোমাকে ভাত না খেয়ে যেতে দিব। বৃষ্টি ওঠ নীলাকে নিয়ে খেতে আয়, বলে সুলতানা বের হয়ে গেলেন।

বৃষ্টি আর নীলা মামির পিছনে পিছনে গিয়ে খেতে বসল।

আকাশ কখনো বৃষ্টির বেড রুমে ঢুকে না। নীলা তাদের বাসায় ঢুকবার সময় নীলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সে নীলার সঙ্গে দেখা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। তারা ডাইনিংয়ে খেতে বসার সময় আকাশও ডাইনিংয়ে ঢুকলো।

সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, কি রে তুই তো ভাত খেয়েছিস, আবার খাবি নাকি?

না মা ভাত খাব না।

তবে উঠে আসলি যে।

আকাশ আবদারের সুরে বলল, মা।

ঠিক আছে বস, দই মিষ্টি খাবি?

দাও।

সুলতানা আকাশকে ফ্রিজ থেকে দই আর মিষ্টি বের করে দিলেন।

সবাই খেতে শুরু করল। সুলতানা খাবার বাড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে বসলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর সুলতানা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বৃষ্টি কি হয়েছে?

কিছু হয়নি তো মামি?

আমার কাছে লুকাস না। আমি বুঝতে পাচ্ছি তোদের তিনজনের নিশ্চয়ই কারো কোন সমস্যা হয়েছে? কি সেটা আমাকে বল? আমি তোদের গার্জিয়ান, শুধু গার্জিয়ান না তোদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বসুলভ, কি হয়েছে আমাকে বল?

আকাশ বলল, বৃষ্টি মা তো আমাদের বন্ধুর মতোই, মাকে মনে হয় বলা যায়? নীলা তুমি কি বল?

নীলা মৃদু হাসল।

বৃষ্টি কিছু বলল না।

আকাশ বলতে শুরু করল, মা পল্লব নামে বৃষ্টির এক ফ্রেন্ডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সুলতানা বললেন, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ভার্সিটিতে পড়ে একটা জলজ্যান্ত ছেলে যাবে কোথায়?

আকাশ মুচকি হাসল, মা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে হারিয়ে যায়নি, বৃষ্টির সঙ্গে যোগাযোগ করছে না, ভার্সিাটিতেও আসছে না।

মা তুই কি ছেলেটাকে ভালোবাসতিস?

আকাশ বলল, মা তুমি ঠিকই ধরেছ।

নীলা কিছু বলল না।

সুলতানা বললেন, ব্যাপারটা আসলে এরকম না হলে তোর মামাকে বললে খুঁজে বের করা যেত?

বৃষ্টি প্রতিবাদ করে বলল, না মামি, প্লিজ মামাকে কিছু বলবেন না।

ছেলেটা কি তোকে ভালোবাসতো?

বৃষ্টি মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

সুলতানা বললেন, আসলে ছেলেরা অলওয়েজ সেলফিস হয়। খুব সহজে সবকিছু ভুলে যেতে পারে।

মা তুমি কিন্তু ঢালাওভাবে সব ছেলেকে দোষারোপ করছ। বাবা তো সেরকম না, আমিও সেরকম না। ছেলেরা যেমন প্রতারণা করতে পারে, খুব সহজে সবকিছু ভুলে যেতে পারে। মেয়েরাও তেমনি প্রতারণা করতে পারে, সহজে সবকিছু ভুলে যেতে পারে, মা তুমি কি জানো পল্লব দিনের পর দিন এই বৃষ্টির পিছনে ঘুর ঘুর করেছে আর বৃষ্টি পল্লবকে স্পষ্ট করে কিছু না বলে ওকে অবহেলা করেছে, পল্লবের পবিত্র ভালোবাসাকে অপমান করেছে। আসলে বৃষ্টি নিজেকে খুব ইমপোর্টেন্ট মনে করত ওর এমন একটা শিক্ষা পাওয়া উচিত ছিল।

সুলতানার কথাটা নীলার মনে খোঁচা মারলো। তার মামি আসলে পরোক্ষভাবে তার বাবাকেই ইঙ্গিত করছে না তো?

আকাশ তুইও আমাকে এভাবে বলছিস? আসলে আমি পল্লবের কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিইনি তাই আজ মূল্য দিতে হচ্ছে।

নীলা আরো অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিল।

বৃষ্টির মনটা অনেকটা হালকা হলো।

নীলা তার রুমে ফিরবার জন্য সুলতানাকে সালাম দিতেই তিনি বললেন, তুমি একটু দাঁড়াও মা, এই আকাশ তুই গাড়ি নিয়ে যা তো নীলাকে নামিয়ে দিয়ে আয়।

গাড়ি কয়েক মিনিটের মধ্যে পি.জি’র মোড়ে এসে বাঁয়ে ঘুরতেই নীলা বলল, আকাশ আমাকে নামিয়ে দাও।

কেন? তোমাকে হল-এর সামনে নামিয়ে দিই।

না এটুকু আমি হেঁটে যাব।

নীলা গাড়ি থেকে নেমে আকাশকেও গাড়ি থেকে নামার জন্য রিকোয়েস্ট করতেই আকাশ গাড়ি থেকে নামল।

নীলা আকাশকে জিজ্ঞেস করল, আকাশ তোমরা গাড়ি কিনেছ?

হ্যাঁ।

আকাশ আমার খুব ভয় হয়।

কিসের ভয়?

বাবা খুব নিয়মতান্ত্রিক মানুষ। কখনো অনিয়ম পছন্দ করে না, বিলাসিতা পছন্দ করে না। কেন জানি বিত্তবান মানুষের ওপর বাবার এক ধরনের ক্ষোভ আছে। শেষ পর্যন্ত নীতি এবং নৈতিকতার বৈষম্যের কারণে আমাদের সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে না যায়?

নীলা তুমি অযথা চিন্তা করছ, আমাদের বিয়ে করতে আরো অনেকদিন বাকী আছে। তখন তোমার বাবা আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দিবে কি না আজকেই সে চিন্তা করে মনঃকষ্টে ভুগার কোন যুক্তি নাই। তখন যা হবার হবে, এখন মন খারাপ করার প্রয়োজন নাই। তাছাড়া এর মধ্যে কত কি হবে? হয়ত তোমার বাবার মানসিকতার পরিবর্তন হতে পারে।

তা হবে না আকাশ।

আকাশ বলল, যাক সে কথা যখনকার কথা তখন যা হবার হবে।

তুমি একটা কথা মনে রাখ আকাশ আমি আমার বাবাকে কষ্ট দিতে পারব না।

 

তেরো

 

আলোচনার বিষয় ছিল, ’’শুধু আইন প্রণয়ন ও দুর্নীতি দমন নয় সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা এবং দুর্নীতি দমনের চেয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া।’’ একজন বক্তা তার বক্তৃতায় বলল, দুর্নীতি আমাদের পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে জিম্মি করেছে, আমাদের উন্নয়নকে ব্যাহত করছে, মানুষের অধিকারকে খর্ব করছে। তাই সবার আগে আমাদের উচিত দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা। তার আগে আমাদের জানতে হবে আসলে দুর্নীতি করছে কারা? সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে যারা যে দায়িত্ব পালন করার কথা তারা সে দায়িত্ব পালন না করে যেন রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। জনগণের টাকা লুটপাট করে কত কোটিপতি যে আমাদের দেশে আছে সে সংখ্যা খুঁজে বের করা কঠিন। তবে শুধু যে রাঘব-বোয়ালরাই দুর্নীতি করছে এমন না, যাদের ট্যাঙের টাকায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে, যাদের সেবার জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে তারা যে কোন প্রয়োজনে যখন কোন অফিসে যায় তখন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রাণীর শিকার হতে হয়, সেবা পাওয়া তো দূরের কথা ফাইল আটকিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আই মিন ঘুষ আদায় করা হয়। পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, কাস্টম অফিসার, ইনকাম ট্যাঙ অফিসার, অন্যান্য পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সকল পেশার মানুষ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে এবং তা লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। এর কারণ সমাজ দুর্নীতিবাজ মানুষকে উৎসাহিত করছে। আজকাল কোন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগে পাত্র খুঁজতে গিয়ে আগেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায়োরিটি দেয়া হয়। জিজ্ঞাসা করা হয় ছেলের উপরি আয় আছে কি না? এই উপরি আয় থাকার পাত্ররা মেয়ের গার্ডিয়ান পছন্দের সারিতে প্রথম। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কোন ব্যবসায়ী কত তাড়াতাড়ি ব্যবসায় উন্নতি করল সেটাই বিবেচনা করা হয়। রাজনীতি কোন পেশা না, একটা মহৎ এবং সেবামূলক কাজ। কিন্তু রাজনীতি যেন আজকাল বড় হওয়ার একটা সিঁড়িতে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনীতি করে অল্পদিনে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এমন কোটিপতির সংখ্যাও কম না। তারা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিও এখন এক আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হয়েছে। মানুষের বিত্তবাসনা বেড়ে গেছে, মানুষের প্রাপ্তির তুলনায় প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে সৎ কিংবা অসৎ যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে আইন আছে, আইনে অনেকে শান্তি ভোগ করছে তারপরও দুর্নীতি কমছে না এর কারণ দুর্নীতি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। কারো সঙ্গে কোন সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে তার আয়ের উৎস বৈধ নাকি অবৈধ তা জানতে হবে, অবৈধভাবে উপার্জিত বিত্তবানদের সঙ্গে কোন সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ছাত্র-ছাত্রী, গৃহিণী, পিতামাতা সবাইকে দুর্নীতি করা থেকে বিরত রাখতে হবে। তাদের আয়ের উৎস জানতে হবে এবং তা অবৈধ হলে তাকে তিরস্কার করতে হবে। কোনো স্বামী যখন মাসের মাঝামাঝি সময়ে অথবা হঠাৎ করে তার স্ত্রীর হাতে প্রচুর টাকা এনে দেয় তখন প্রত্যেক স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে টাকা প্রাপ্তির উৎস জানতে চায়, কোন সচেতন ছাত্র-ছাত্রী যদি তাদের মা-বাবার আয়ের উৎস জানতে চায়, কোন পিতামাতা যদি তাদের সন্তানদের আয়ের উৎস জানতে চায় তবে দুর্নীতি মুক্ত একটা সমাজ ব্যবস্থা চালু হবে। আর দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা চালু হলে মানুষ এমনিতেই আর দুর্নীতি করবে না তখন আইনের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা হ্রাস পাবে।

বৃষ্টি তার সিট থেকে উঠে চলে গেল, আকাশ খেয়াল করল না।

বৃষ্টি বারান্দায় আসতেই ইভা ডাক দিল, এই বৃষ্টি এদিকে আয়।

বৃষ্টি ইভার কাছে গেল। তারপর দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে কেন্টিনে গেল।

দু’জনে মুখোমুখি বসেছে।

ইভা বলল, বৃষ্টি আসলে তোকে কথাটা কি করে যে বলি?

বলে ফেল। এত হেজিটেশন করছিস কেন?

শুনে তুই খুব কষ্ট পাবি।

তবুও বল।

পল্লব বলেছিল ও ফ্লাই করার আগে যেন কথাটা আমি তোকে না বলি।

পল্লব ফ্লাই করার আগে মানে?

মানে পল্লব অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

বৃষ্টি যেন আঁতকে উঠল, কবে?

গতকাল ফ্লাই করেছে।

তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?

বললাম না পল্লবের নিষেধ ছিল কথাটা ও ফ্লাই করার আগে আমি যেন কাউকে না বলি।

তাই বলে আমাকেও!

ইভা তিরস্কারের সুরে বলল, তোর জন্যই তো পল্লব অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

তাই বলে আমাকে বলে যাবে না, চোরের মতো পালিয়ে যাবে?

ওর সমালোচনা করিস না বৃষ্টি, নিজেকে একবার আয়নায় দেখ।

বৃষ্টির মনে অনেক বড় ঝড় বয়ে গেল, আসলে পল্লব আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি তাকে এভোয়েড করছি দেখে ও দেশ থেকে চলে গেল। ভালোবাসার এই বাণিজ্যিকিকরণের সময়ে কেউ কারো জন্য দেশ থেকে চলে যায়?

বৃষ্টি ওড়না দিয়ে চোখ মুছল।

দ্বিতীয় বক্তা বলতে শুরু করল, আমাদের দেশে দুর্নীতির একটা বড় অংশই সরকারি চাকরিজীবী এবং ন্যূনতম প্রয়োজনের তাগিদে দুর্নীতি করে যাদেরকে আমরা বলতে পারি চুনোপুঁটি দুর্নীতিবাজ। যারা প্রত্যেক্ষভাবে খেটে খাওয়া মানুষকে প্রভাবিত করে। এমনি সামাজিক বান্তবতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে এ অবস্থায় বর্তমান বেতনে দুর্নীতিমুক্ত থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা অসম্ভব। এ পরিসি’তিতে দুর্নীতিমুক্ত থাকার আহবান কোন অবস্থায় কার্যকর হবে না। তাছাড়া বর্তমান বেতন কাঠামোতে শুধুমাত্রত্র অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে এখন আর কোন মেধাবী ছাত্র এক সময়ের আকর্ষণীয় ক্যাডার সার্ভিসগুলোতে আসবে না। তারা বরং স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনের জন্য বেসরকারি এবং বিদেশের লোভনীয় চাকরিই বেছে নেবে, আমাদের দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাবে। এতে দেশ মেধাবী সন্তানদের সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

কাজেই রাষ্ট্রকে মেধাবী ছাত্রদের সেবা পেতে হলে এবং দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে সেবা প্রদানকারী বড় একটি অংশ সরকারি-কর্মকর্তা কর্মচারীদের ন্যূনতম দু’জন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করাসহ সামাজিকভাবে বসবাস করার মতো প্রয়োজনীয় টাকার সমপরিমাণ ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বান্তবসম্মত বেতন কাঠামো, দুর্নীতি দমনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা। কিন্তু বান্তবতা হলো বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন কাঠামো তো তৈরি হয় না বরং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বেতন বৃদ্ধির কয়েকমাস আগে ঘোষণা দেওয়া হয় বেতন বৃদ্ধির কমিটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে ফলে তখন একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়: আরেকবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় বেতন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে। তখনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির সুফল পাওয়া শুরু করে না কিন্তু দ্বিতীয় ধাপ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার বেতন কাঠামো ঘোষণা করার পর তা বাস্তবায়ন হয় কয়েক ধাপে ফলে আরো কয়েকবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। তারচেয়ে বার বার ঘোষণা দিয়ে বৃদ্ধি না করে প্রতি বছর মূল্য ষ্ফীতি হিসাব করে প্রতি বৎসর ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে বৃদ্ধি করা হয় তবে তার প্রভাব বাজারে পড়বে না, ফলে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া অনেকটা কমে যাবে। ধন্যবাদ সবাইকে।

তৃতীয় বক্তা বলতে শুরু করল, আমার পূর্ববর্তী দু’জন বক্তা ইতোমধ্যে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। তবে শুধু যে অসচ্ছলতার কারণে সরকারি চাকরিজীবীরা দুর্নীতি করছে তা কিন্তু নয়। শুধু পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, কাস্টম অফিসার, ইনকাম ট্যাঙ অফিসার, অন্যান্য পেশাজীবী, রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করছে তাও কিন্তু নয়, দুর্নীতি করার সুযোগ থেকেও দুর্নীতি করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের সর্ব্বোচ্য বিদ্যাপীঠ থেকে পাস করা একজন পেশাজীবী যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তখন খুঁজে বের করার সময় এসেছে আসল গলদটা কোথায়? আগে স্কুল কলেজে পাকা ক্লাস রুম ছিল না। কাঁচা ঘরে, ভাঙ্গা ক্লাস রুমে হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসে উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন টিচাররা শিক্ষা দিতেন। তাঁরা শিক্ষকতাকে সেবা হিসাবে গ্রহণ করতেন, কোন কারণেই শিক্ষকরা নীতি বিসর্জন দিতেন না। তাঁদের সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলার মতো কেউ ছিল না, তাঁরা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। আজকাল শিক্ষকতা অনেকেই সেবা হিসাবে গ্রহণ না করে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন, অন্যান্য পেশার মতো কিংবা বাণিজ্যিকভাবে টাকা রোজগারের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেন। শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন কোন রাজনৈতিক তদবির বা উৎকচ প্রদানের মাধ্যমে, ফলে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতা প্রবেশ করতে পারছে না। তুলনামূলকভাবে কম মেধা সম্পন্ন ছাত্র কিংবা রাজনৈতিক দলের কর্মীরা শিক্ষকতায় প্রবেশ করে ব্যবসা, রাজনীতি কিংবা কোচিং এর মাধ্যমে টাকা রোজগারের জন্য মরিয়া হয়ে পড়ছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে। ফলে কিছু সংখ্যক শিক্ষকের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে সমন্ত শিক্ষক সমাজ শ্রদ্ধার আসন হারাতে বসেছে। তাছাড়া আজকাল পাঠ্য পুন্তকে তুলনামূলকভাবে নৈতিকতার শিক্ষা কম দেয়া হয়। বাবার মুখে শুনেছি আগের দিনে পাঠ্য পুন্তকের কোন শিক্ষামূলক গল্প, কবিতা তাঁদের হৃদয়ে গেঁথে যেত। কোন কাজ করতে গেলেই পাঠ্য পুন্তকে লিপিবদ্ধ কথাগুলো মনে পড়ত, বিবেক নাড়া দিত। পাঠ্য বইয়ে আজকাল সে রকম গল্প, প্রবন্ধ খুব কমই অন্তর্ভুক্ত আছে, ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা নৈতিকতার শিক্ষা থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। আর শিক্ষা যেন পরিপূর্ণ মানুষ না বানিয়ে শুধু সার্টিফিকেট অর্জন এবং রুজি রোজগারের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফলে উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবীরা পর্যন্ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের সবার পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যে শুধু টাকা রোজগার করা, বিত্তশালী হওয়া। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য আইন প্রণয়ন, আইনের সঠিক প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, চাকরিজীবীদের ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন কাঠামো প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং পাঠ্য পুন্তকে দুর্নীতি বিরোধী গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব তৈরি করা। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

পর পর আরো কয়েকজন বক্তৃতা দিল। তারপর সভাপতি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, আমাদের আজকের এই আলোচনায় কোন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। এটা ছিল দুর্নীতি সম্পর্কে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চিন্তা-ভাবনা কিন্তু তোমাদের আলোচনা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে আমার মনে হয়েছে তোমরা সবাই একেকজন বিশেষজ্ঞ। তোমরা অনেক পরিশ্রম করে তথ্যবহুল বক্তৃতা উপস্থাপন করে আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছ। আমি আশা করি আজকের এই আলোচনা থেকে তোমরা সবাই শিক্ষা গ্রহণ করবে।

আকাশ ডানে-বামে একবার তাকালো। বৃষ্টি নাই।

সে বৃষ্টির মোবাইলে রিং দিল, হ্যালো বৃষ্টি।

আকাশ আমি গেটে দাঁড়িয়ে আছি তুই গেটে আয়।

আকাশ বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, কি রে কি হয়েছে?

বৃষ্টি কেঁদে ফেলল, আকাশ পল্লব অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

কে বলল?

ইভা।

চলে গেছে না, যাবে?

চলে গেছে।

তাহলে আর কি করার আছে? আসলে ছেলেটার সঙ্গে তুই যা আচরণ করেছিস?

বৃষ্টি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আকাশ কোনদিন তার বাবার চাকরি সম্পর্কে জানতে চায়নি। বলতে গেলে চাকরি সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। তার বাবা ক’টাকা বেতন পায়, তাদের সংসার খরচ কত? তাও তার জানা নাই এবং জানার আগ্রহ ছিল না। আজ প্রথম বক্তার বক্তৃতা শোনার পর থেকে একটা কথা বার বার করে আকাশের মনে পড়ল, প্রত্যেক সন্তান যদি তার মা-বাবার আয়ের উৎস জানতে চায় তবে একদিন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আকাশ তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা বাবা যেন পুলিশের কোন পদে চাকরি করে?

এটা কি তোর জানা নাই?

তবুও বল না।

ইন্সপেক্টর পদে।

আচ্ছা মা তুমি কি জানো বাবা ক’টাকা বেতন পায়?

এতক্ষণ সুলতানা আপন মনে একটা পেপারে চোখ রেখে কথা বলছিলেন। এবার চোখ তুলে বললেন, কেন হঠাৎ করে তোর বাবা ক’টাকা বেতন পায় সেটা তোর কি কাজে লাগল?

মা সেটা অন্য কথা আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি তুমি জানো কি না?

না।

কোনোদিন জিজ্ঞেস করনি?

না।

কেন?

প্রয়োজন মনে করিনি।

আকাশ কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে রইল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, মা বলতো তুমি মাসে ক’টাকা সংসার খরচ কর।

কোনোদিন তো হিসাব করিনি।

মা তুমি ক’টাকা মাসে খরচ কর তা কোনদিন হিসাব করনি?

কেন তুই মাসে ক’টাকা খরচ করিস তার কি কোন হিসাব রাখিস? যখনই টাকা চাস্‌ তখনই তো দেই।

মা আমার যতটুকু মনে হয় তাতে আমি মাসে কমপক্ষে দশ হাজার টাকা খরচ করি। তুমি সংসারে খরচ কর মাসে কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা।

সুলতানা বললেন, জিনিসপত্রের যা দাম বিশ হাজার টাকায় সংসার চলে? না?

তবে ধর ত্রিশ হাজার টাকা।

হ্যাঁ তা হবেই।

আচ্ছা মা তুমি কাল আমাকে বলবে বাবা ক’টাকা বেতন পায়?

আচ্ছা তোর হয়েছে কি? বলতো।

কিছু হয়নি মা, তবে আমার সবকিছু জানা দরকার।

 

চৌদ্দ

 

অনেকদিন থেকে সুলতানাই সংসার দেখাশুনা করেন। সিরাজ সাহেবের পুলিশের চাকরি দিন রাত শুধু ডিউটি আর ডিউটি, কাজের নেশায় ছুটে চলা। কাজ আর টাকা, যেন কাজ করলেই টাকা। আবার কাজ না করলেও উপায় নাই ঢাকায় মেট্রোপলিটন থানার মতো একটা এট্রাক্টিভ পোস্টিং পেতে হলে এবং টিকে থাকতে হলে যথেষ্ট দায়িত্ববান হতে হবে, উপরওয়ালাদের হুকুম যথাযথভাবে তামিল করতে হবে না হলে এমন একটা এট্রাক্টিভ পোস্টিং থেকে সরে যেতে হবে। তাই সিরাজ সাহেবের কাজ যেন শুধু চাকরি করা আর টাকা রোজগার করে সুলতানার হাতে এনে দেওয়া। তারপরের কাজ অর্থাৎ সংসার সামলানো, আকাশের লেখাপড়া দেখাশুনা করা এমনকি সিরাজ সাহেব নিজের শার্টটা পর্যন্ত সুলতানাই কিনেন। সুলতানাই বাজার থেকে শার্ট কিনে এনে বলেন, গায়ে দাও তো দেখি তোমাকে কেমন মানায়?

সিরাজ সাহেব গায়ে দিয়েই বলেন, বাঃ খুব সুন্দর হয়েছে তো, দেখতে হবে না কার পছন্দ।

সিরাজ সাহেব কোনদিন সংসারের কিছু জানতেও চান না। আজ সুলতানা দিনের বেলা আকাশের কথাগুলো যখন সিরাজ সাহেবকে বললেন তখন সিরাজ সাহেব যেন চমকে উঠলেন, আকাশ আমার বেতন জিজ্ঞেস করেছে?

হ্যাঁ।

তুমি কি বললে?

বললাম আমি কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি।

তারপর কি বলেছে?

তোমার কাছ থেকে আমি যেন জেনে রাখি কাল ও আমাকে আবার জিজ্ঞেস করবে।

তুমি বলবে আমার খেয়াল ছিল না।

এমন মিথ্যা কথা আমি বলতে পারব না। তোমার বলতে অসুবিধা কি?

সুলতানা অসুবিধা আছে, তুমি বুঝতে পাচ্ছ না ও আসলে কি জন্য আমার বেতনের কথা জানতে চাচ্ছে?

কিন্তু তুমি তো ওকে চেনো, ওর মনে যখন যা চেপে বসে তখন সেটার শেষ না করে ছাড়ে না।

সিরাজ সাহেব বেতনের কথা বললেন না। সুলতানা সিরাজ সাহেবের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালেন না। তাঁর মনের মধ্যে অসংখ্য চিন্তা ভিড় করছে, শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলে তার দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? সিরাজ সাহেবের মনের মধ্যে তাঁর অতীত স্মৃতিগুলি ভেসে উঠল। সিরাজ সাহেব নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন প্রান্তিক চাষি, মা গৃহিণী একমাত্র বোন বয়সে বড়, আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। সিরাজ সাহেব খুব ছোটবেলায় তার বাবাকে বলতে শুনেছেন, সিরাজের মা কষ্ট কর, কষ্টের ফল তুমি একদিন পাবে আমাদের সিরাজ একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে, চাকরি করবে, তখন তোমার আর কোনো অভাব থাকবে না। সিরাজ সাহেবের মা ছেলের বড় হওয়ার আশায়, একটা সরকারি চাকরি পাবার জন্য অনেক কষ্টে তাঁকে বি.এ পাস করিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সেই দুঃখিনী মা তাঁর চাকরি পাবার আগেই মারা যান। দিনের পর দিন বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে একদিন ভাগ্যক্রমে সোনার হরিণ একটা সরকারি চাকরি হয়, শুধু সরকারি চাকরি নয়, পুলিশের চাকরি। সিরাজ সাহেবের সরকারি চাকরি হওয়ার পর অনেকেই তাঁকে ইয়ার্কি করে বলেছিল, কিরে ভালোই চাকরি পেয়েছিস তো কথায় বলে, মাছের রাজা ইলিশ চাকরির রাজা পুলিশ। সিরাজ সাহেবও পুলিশে চাকরি হওয়াতে গর্ববোধ করতেন।

পুলিশের চাকরিতে যেন অন্তহীন কাজ। বেতন সামান্য, পর্যাপ্ত টি.এ, ডি.এ নাই অথচ পরিশ্রমেরও শেষ নাই। মাস শেষে যা বেতন পেতেন তা দিয়ে নিজের খাওয়া-থাকার পর বাবাকে এক হাজারের বেশি টাকা পাঠাতে পারতেন না। সিরাজ সাহেবের পোস্টিং তখন কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী থানায়, একবার বাবার অসুখের চিঠি পেয়ে সিরাজ সাহেব গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাবার অসুখ নওগাঁ গিয়ে বাবাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন।

ডাক্তার কিছু বলেননি। কিন্তু সিরাজ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর বাবার বার্ধক্যজনিত অসুখ যা একেবারে সেরে ওঠার মতো নয়।

সিরাজ সাহেবের ধারণাই ঠিক হয়েছিল। অবশেষে তাঁর বাবা মারা গেলেন। সিরাজ সাহেব একেবারে একা হয়ে পড়লেন। গ্রামের বাড়িতে আসার পথটা বন্ধ হয়ে গেল।

সিরাজ সাহেবের প্রথম পোস্টিং ছিল রাজশাহী ভার্সিটিতে। তখন পরিচয় হয় সুলতানার সঙ্গে। সেদিন বিকেলবেলা সিরাজ সাহেবের ডিউটি ছিল না। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ইবলিশ চত্বরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেখানে তাঁর পরিচিত কেউ নাই। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়তে পারেননি বলে একটা কষ্ট সব সময় তাঁকে ব্যথিত করত তাই তিনি সাদা পোশাকে নিজেকে ভার্সিটির স্টুডেন্ট ভাবতে আনন্দ বোধ করতেন। পথে হঠাৎ করেই সুলতানা জিজ্ঞেস করেছিল, এই যে পুলিশ বন্ধু কেমন আছেন?

আরে আশ্চর্য তো, আমি তো সিভিল ড্রেসে আছি তবুও মেয়েটা আমাকে চিনতে পারল কীভাবে? আর কাউকে বলেনি তো? সিরাজ সাহেব এদিক-সেদিক তাকিয়েছিলেন।

সুলতানা বলেছিলেন, অন্য কাউকে না, আপনাকে বলছি, আপনার নাম সিরাজ সাহেব না?

হ্যাঁ আমি সিরাজ এবং পুলিশ কিন্তু আমি তো এখন ইউনিফর্ম পরে নাই আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?

এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? একবার মনে করুন তো কোথায় আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?

সিরাজ সাহেব সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন কিন্তু মনে করতে পারছিলেন না, সরি আসলে মনে করতে পারছি না।

আরো একটু ভেবে দেখুন, পুলিশের চাকরিতে এত কম মেমোরি নিয়ে চললে হয় না। আমি কোন ভার্সিটি পড়-য়া মেয়ে না হয়ে অপরাধীও তো হতে পারতাম তখন মনে রাখতেন কীভাবে?

প্লিজ আর হেঁয়ালি করবেন না, বলে ফেলুন।

আমার দুলাভাই বোয়ালিয় থানার ওসি, দুলাভাইর বাসায় আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি কিন্তু নামটা মনে করতে পারছি না। বলুন তো আপনার নামটা কি যেন?

আমার নাম সুলতানা, অনার্স ফাইনাল ইয়ার, বাংলা আর ও হলো আমার বান্ধবী রুনা আমরা একসঙ্গে পড়ি।

সবাই হাঁটতে হাঁটতে ইবলিশ চত্বরে গিয়ে ঘাসের ওপর বসেছিল।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা আপনার বাড়ি তো নওগাঁয়?

বাড়ির কথা জানতে চাচ্ছেন কেন? বলুন তো।

কারণ আছে।

আমার বাড়ি নওগাঁ, আপনার?

একদিন দেখেই যখন চিনে ফেলেছেন তখন আমার বাড়ি কোথায় সেটাও আপনার মনে আছে?

দেখুন না আপনি আমার বাড়ির কথা জানতে চাইলেন আর আমি বলে ফেললাম, আমি যখন আপনার বাড়ির কথা জানতে চাইলাম তখন আপনি একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দিলেন। আসলে আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে সব পুলিশই জটিল, প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে কথা বলে। আচ্ছা বলুন তো এটাও কি আপনাদের ট্রেনিংয়ের সময় শেখানো হয়?

তা হবে কেন?

দুলাভাইকেও দেখেছি সব সময় কেমন জটিল করে কথা বলে। আপনাকেও দেখছি আপনিও বেশ জটিল।

দেখুন আপনি মোটেই ঠিক বলছেন না। আমাকে আপনি জটিল বলতে পারেন তাতে আমি কষ্ট পাব না কিন্তু আপনার দুলাভাই মানে আমার মাহমুদ ভাইকে আমি খুব রেসপেক্ট করি তিনি মোটেই জটিল মানুষ না।

ধন্যবাদ তাও নিজের পেশার প্রতি আপনার যথেষ্ট টান আছে।

সিরাজ সাহেব মনে মনে বলেছিলেন, মেয়েটা আসলে বেশি কথা বলে।

সুলতানা বলেছিলেন, এই যে মিস্টার, কি ভাবছেন?

না কিছু না।

এই বাদাম এদিকে আয় তো, বলে সুলতানা ডাক দিলেন।

একশ গ্রাম বাদাম দে।

সুলতানা বাদাম নিয়ে বলেছিলেন, তোর স্যারের কাছে টাকা নে।

সিরাজ সাহেব পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মনে মনে বলেছিলেন, কি আশ্চর্য মেয়ে রে বাবা? এমনভাবে কথা বলছে যেন আমি তার কতদিনের চেনা।

সিরাজ সাহেব কি ভাবছেন? ভাবছেন এত সহজে আমি কীভাবে আপনাকে বিল দেওয়ার কথা বলতে পারলাম? এটা কিছু না আমি কারো সঙ্গে একবার পরিচয় হলে সহজেই তাকে আপন করে ফেলি এটা আমার একটা অভ্যাসও বলতে পারেন আবার বদ অভ্যাসও বলতে পারেন।

না না বদ অভ্যাস হবে কেন? বলতে পারেন ভালো অভ্যাস।

বাদাম খাওয়া শেষ হলে সিরাজ সাহেব একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, সুলতানা আমার একটু তাড়া আছে, আমাকে উঠতে হবে।

ও আপনি তো আবার পুলিশে চাকরি করেন ডিউটি কড়াকড়ি।

হ্যাঁ আপনি তো দেখছি সবই বোঝেন।

আমি বেগম রোকেয়া হল-এ থাকি, রুম নং-২০৭। নীচে এসে স্লিপ দিবেন, আমি চলে আসব।

 

পনেরো

 

সিরাজ সাহেব যেন জন্মের পর পরই বই হাতে নিয়েছেন। দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র স্বপ্ন সিরাজ সাহেবকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সিরাজ সাহেবও যেন সেই শৈশব থেকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেজন্য তাঁকে অনেক সেক্রিফাইজ করতে হয়েছে। শৈশবে তাঁর বন্ধুরা যখন খেলাধুলা করেছে সিরাজ সাহেব তখন বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করেছেন। কৈশোরে তাঁর সমবয়সী ছেলেরা যখন মাঠে ফুটবল খেলতো তিনি তখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাটে যেতেন। কলেজ জীবনে বন্ধুবান্ধবীরা যখন ক্লাসের ফাঁকে কলেজের মাঠে একসঙ্গে গোল হয়ে বসে চিনাবাদাম খেতো তিনি তখন লাইব্রেরিতে বসে ক্লাসের বইগুলো নোট করতেন। এমনিভাবে তাঁর শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম প্রহরগুলো কেটে গেছে। আসলে এক জীবনে সব হয় না। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য সিরাজ সাহেবের অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো, রোমান্টিক দিনগুলো যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে।

সুলতানার গায়ের রং ফর্সা যেন দুধে আলতা, লম্বা আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারিণী। কথা বলার একটা আর্ট আছে যা সহজে মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। চোখের দৃষ্টি গভীর যেন সাগরের মতো। সুলতানার চোখে প্রথম চোখ পড়তেই সিরাজ সাহেব যেন সুলতানার গভীর চোখে হারিয়ে গিয়েছিলেন। সব সময় সুলতানার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠছিল। সিরাজ সাহেবের ইচ্ছা করছিল পরদিনই বেগম রোকেয়া হল-এর গেটে গিয়ে স্লিপ দিয়ে সুলতানার সঙ্গে দেখা করবে কিন্তু যেতে পারেননি যেন পা থমকে গিয়েছিল।

কয়েকদিন পর সিরাজ সাহেব বেগম রোকেয়া হল-এর নিচে গেটে গিয়ে গার্ডকে স্লিপ দিয়েছিলেন, গার্ড সিরাজ সাহেবের কাছ থেকে স্লিপটা নিয়ে একটা দুষ্টামির হাসি হেসে চলে গিয়েছিল।

সিরাজ সাহেবের কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল, গার্ড আমাকে চেনে না তো?

কিছুক্ষণ পর সুলতানা বেরিয়ে এসেছিলেন, এতদিন পর, আমাকে মনে করে, নাকি পথ ভুলে?

সিরাজ সাহেব সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পথ ভুলে না, সভয়ে।

সুলতানা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, আপনার কি আজ সময় আছে?

কেন বলুন তো?

ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে একবার পদ্মার পাড় বেড়াতে যাব।

কিন্তু আমার তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে হবে।

ফিরবেন, আমারও তো আবার সান্ধ্য আইন আছে।

বেশ চলুন, তবে একটা শর্ত আছে?

আবার শর্ত কিসের?

দেখুন গেট পর্যন্ত আপনাকে একা বের হতে হবে, আমি গেটের বাইরে গিয়ে আপনার সঙ্গে রিঙায় উঠব।

ওকে আপনি হাঁটতে থাকুন, আমি আপনাকে রিঙায় তুলে নিব।

সিরাজ সাহেব গেট দিয়ে বের হয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলছিলেন। কিছুদূর যাবার পর পিছন থেকে সুলতানার রিঙা এসে দাঁড়িয়েছিল।

দু’জনে রিঙায় উঠে পদ্মার পাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন।

বিকেলবেলা পদ্মার পাড়ে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। পদ্মায় যেন ভরা যৌবন। ঢেউয়ের পর ঢেউ গ্রোয়েনের উপর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছিল। গ্রোয়েনের ওপর এলোমেলোভাবে ছড়ানো বেঞ্চে বসে তরুণ-তরুণীরা যেন ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। কেউ বা দূর-দিগন্তে তাকিয়েছিল।

সিরাজ সাহেব আর সুলতানা একটা বেঞ্চে বসেছিলেন।

সুলতানা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আসতে এত দেরি করলেন কেন?

আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতে খুব ইচ্ছা করছিল কিন্তু আসিনি।

কেন? আসতে ইচ্ছা করলে আসলেন না কেন? আমি প্রায় দিনই বিকেলবেলা আপনার জন্য অপেক্ষা করতাম।

একদিনের পরিচয়ে এতদূর অগ্রগতি, এটা কিন্তু ঠিক না ম্যাডাম। মানুষকে এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করলে তো সহজে প্রতারিত হতে পারেন।

কাউকে বিশ্বাস করলে একদিনের পরিচয়েই বিশ্বাস করা যায় আর কাউকে হাজার বছরেও চেনা যায় না।

হাজার বছর কেউ বাঁচে না।

উঃ কথায় কথায় শুধু প্যাঁচ আর জটিলতা। দুলাভাইকে দেখেছি ঠিক আপনার মতোই-

প্লিজ আমাকে বলুন, আমার প্রফেশনের অন্য কাউকে বলবেন না।

কয়েকমাস পরের কথা ততদিনে সুলতানার পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। ইতোমধ্যেই দু’জনে যেন সবকিছুতেই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। সুলতানা বিকেলবেলা হল থেকে বের হবে কি না? বের হলে দু’জনে কোথায় গিয়ে বেড়িয়ে আসবে। আবার পরীক্ষার পর সুলতানা গ্রামের বাড়ি যাবে কি না? সেটাও নির্ভর করছিল সিরাজ সাহেবের উপর। সিরাজ সাহেব আর সুলতানার বিষয়টা ততদিনে সবাই জেনে ফেলেছিল। সিরাজ সাহেবের সঙ্গে সুলতানার বিয়েতে সুলতানার পক্ষ থেকে সকলের সম্মতি ছিল।

সুলতানা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আসার কথা বলে গতকাল এলেন না কেন?

ভাবলাম আপনার হল-এ অনুষ্ঠান আছে তাই এলাম না।

আমার হল-এ তো কোন অনুষ্ঠান ছিল না।

আপনি বেগম রোকেয়া হল-এ থাকেন আর গতকাল ছিল বেগম রোকেয়া দিবস তাই ভাবলাম আপনার হল-এ কোন অনুষ্ঠান আছে কি না?

কোনো অনুষ্ঠান ছিল না তো।

গতকাল বেগম রোকেয়া দিবস ছিল আর আপনি জানেন না?

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কই জানি না তো।

সুলতানা আপনি একজন মেয়ে হয়ে বেগম রোকেয়া দিবস সম্পর্কে জানেন না এটা কিন্তু আপনার মতো একজন প্রগ্রেসিভ মেয়ের জন্য বেমানান। বেগম রোকেয়া না জন্মালে আপনি হয়ত আজ ভার্সিটিতে পড়তে পারতেন না, অবরোধবাসিনী হয়ে থাকতেন, এতদিন আপনার বাবা-মা আপনার বিয়ে দিয়ে দিতেন আর আপনি সংসারী হয়ে যেতেন।

বেগম রোকেয়া সম্পর্কে যে একেবারে জানি না তা নয়। তবে বেগম রোকেয়া দিবস সম্পর্কে কিছু জানি না। এটা হয়ত সরকারিভাবে পালিত হয় কিন্তু ভার্সিটিতে কিংবা হল-এ তো কোন অনুষ্ঠান পালিত হয় না।

সুলতানা আপনি ভার্সিটিতে পড়েন। ভার্সিটি একটা সর্বচ্চ্য বিদ্যাপীঠ এখান থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বের হবেন অথচ দেখুন আপনি যে হল-এ থাকেন আই মিন যে মহিয়সী নারীর নামে হল তৈরি হয়েছে, তাঁর জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনে তাঁকে একবার স্মরণ করাও হয় না।

সুলতানা কোন কথা বলেনি। মাথা নত করে বসেছিলেন।

সিরাজ সাহেব বলেছিলেন অবশ্য এতে আপনার কিছু করার নাই। এটা কর্তৃপক্ষের করা উচিত ছিল। যাক এখন আপনার কথা বলুন।

বলতে তো অনেককিছু চেয়েছিলাম দিলে তো মুডটা অফ করে।

সিরাজ সাহেব মুচকি হেসেছিলেন।

সুলতানা রেগে গিয়েছিলেন, আপনি হাসছেন?

হাসবো না! জানি না আপনি ইচ্ছা করে নাকি আপন মনে একটা ভুল করে ফেলেছেন।

ভুল করেছি, আমি?

হ্যাঁ।

কি ভুল?

আপনি কিন্তু আমাকে তুমি বলে অ্যাড্রেস করেছেন।

বেশ করেছি তুমিও এখন থেকে আমাকে তুমি বলবে। এত সব ফরমালিটিজ ভালো লাগে না। আমরা এক সঙ্গে এতদিন থেকে কথা বলছি, খাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি বলতে গেলে আমাদের দু’জনের আত্মা যেন এক হয়ে গেছে তারপরও আবার এত ফরমালিটিজ কেন?

বলব।

হ্যাঁ।

সিরাজ সাহেব হেসে ফেলেছিলেন, এখন মুড অন হয়েছে।

সুলতানা হেসে ফেলেছিলেন, এই যে স্যার এভাবে আর কতদিন?

কতদিন মানে? সারাজীবন, তুমি কি অন্য কাউকে পেয়েছ নাকি? এখন আমাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে যেতে চাও?

দু’জনে হেসে ফেললেন।

সিরাজ সাহেব বলেছিলেন, এভরি থিং ওকে। সুলতানা আমি যে ভাবিনি তা নয়, তোমাকে তো বলেছি আমার মা নাই, বাবা আর বড় আপা আছে বড় আপার সঙ্গে আলাপ করেছি।

দুলাভাইর সঙ্গে তো তোমার পরিচয় আছে, আপা-দুলাভাই তোমাকে খুব পছন্দ করে, আমরা আমার দুলাভাইর হেল্প নিতে পারি।

তোমার দুলাভাই যা ব্যস্ত। তাঁর পক্ষে কি সময় দেয়া সম্ভব?

কেন সম্ভব না। আমি বললে ছুটি নিয়ে হলেও দুলাভাই আমাদের হেল্প করবে। বুঝ না আমি তো দুলাভাইর একমাত্র শ্যালিকা।

সুলতানার বাবার নাম শুনে সিরাজ সাহেবের বাবা তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন, অসম্ভব ঐ পরিবারের কোন মেয়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের মেয়ের বিয়ে হতে পারে না।

কেন বাবা?

ঐ পরিবারের মেয়েরা খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়, নিজেকে ছাড়া কাউকে চিনে না।

বাবা সুলতানা সেরকম মেয়েই না।

সেরকম না সেটা বিয়ের আগ পর্যন্ত বিয়ের পর চোখ উল্টাতে এক মাস সময়ও লাগবে না।

বাবা ঐ পরিবারের কোন মেয়ে এই পাড়ায় বিয়ে হয়েছে আর সেই মেয়ে আত্মকেন্দ্রিক কি না সে কারণে তার দায়ভার সুলতানা আর আমি বহন করব এটা তো হয় না। তুমি আসলে সুলতানাকে দেখনি তাই তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারছ ওকে দেখলে তোমার ভালো লাগবে।

আমার ভালো লাগা না লাগা নিয়ে তোর কিছু যায় আসে না। তুই বিয়ে করবি কি না সেটা তোর ব্যাপার তোর এই বিয়েতে আমার মত নাই। আর তুই যদি ঐ মেয়েকে বিয়ে করিস তবে যখন বাড়িতে আসবি একাই আসবি বউকে সঙ্গে আনবি না।

শেষ পর্যন্ত সিরাজ সাহেব বাবার অমতে বিয়ে করেন।

বিয়ে পর প্রথম কিছুদিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু বেশিদিন ভালোভাবে কাটেনি। বিয়ের প্রায় মাস খানেকের মধ্যে সিরাজ সাহেবের বদলি আদেশ এসেছিল, কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলায়।

বদলির অর্ডার নিয়ে সিরাজ সাহেব সুলতানাকে জানাতে সুলতানার তো প্রায় কান্না কান্না অবস্থা, না তোমাকে যেতে হবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।

সুলতানা আমি কি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছি, পুলিশের চাকরি আদেশ তামিল করাই নিয়ম।

তুমি তো তোমার অফিস আদেশ তামিল করতে যাবে। আমি এখানে একা কীভাবে থাকবো? আমিও যাব তোমার সঙ্গে। তুমি জানো কুড়িগ্রাম কতদূর? কীভাবে যেতে হয়?

সিরাজ সাহেব সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য খুব সহজভাবে বললেন, কেন, রাজশাহী থেকে রংপুরের সরাসরি বাস আছে, সেখান থেকে বাসে কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম থেকে বাসে চিলমারী তারপর ইঞ্জিন নৌকায় রৌমারী, ব্যাস্‌।

তুমি জানলে কীভাবে?

আমার একজন কলিকের বাড়ি কুড়িগ্রাম ওর কাছে শুনেছি।

তুমি খুব সহজভাবে বললে আর হয়ে গেল।

সুলতানা চাকরিতে ট্রান্সফার থাকবে এটা মেনে নিয়েই চাকরি করতে হবে।

তাহলে তুমি ওখানে গিয়ে বাসা ভাড়া করে আসবে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আর তুমি না আসা পর্যন্ত বাবার বাড়ি থাকবো।

তখনো রৌমারীতে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। অধিকাংশ রান্তা কাঁচা, সন্ধ্যা হতেই যেন গাঢ় অন্ধকার নাম তো, ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতো। জয়েন করেই সিরাজ সাহেবের ওপর চাপলো কাজের বোঝা। ইতোমধ্যে ছুটিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সবকিছু জানিয়ে সুলতানার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলেন।

সিরাজ সাহেবের ধারণা ছিল। চিঠি পেয়ে হয়ত রৌমারীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসতে চাইবেন না। কিন্তু চিঠির উত্তর পড়ে সিরাজ সাহেব অবাক হয়েছিলেন। সুলতানা পনেরো দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন পনেরো দিনের মধ্যে বাসা ঠিক করতে পনেরো দিন পর সে তার এক মামাতো ভাইকে নিয়ে রৌমারী আসবে।

অগত্যা সিরাজ সাহেব একটা বাসা ঠিক করেছিলেন। টিনের বেড়া বিশিষ্ট উত্তর-দক্ষিণে লম্বা দুই রুমের একটা বাসা, দুই রুমের সঙ্গে খুব ছোট আকৃতির দু’টা জানালা। জানালা না বলে বরং গোবাক্ষ বলাই সঙ্গত। কাঁচা ল্যাট্রিন। সবকিছু দেখে সুলতানা বলেছিলেন, সেই কখন রওয়ানা দিয়েছি, আসতে আসতে পথের যেন শেষ নাই। তারপর আবার নৌকায় তিন ঘণ্টার পথ। তুমি একটা ভালো বাসা পেলে না?

সুলতানা তুমি সবকিছু গুছিয়ে নাও, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হব। তুমি নিজেই দেখবে এর চেয়ে ভালো বাসা আছে কি না? যদি থাকে তবে আমরা ভাড়া নিব।

 

ষোল

 

শত বছরের পুরানো চুন সুরকি দিয়ে গাঁথুনি করা একটা জরাজীর্ণ ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থানার কাজকর্ম চলছিল। অনেক আগে সরকারি বিভাগ থেকে ভবনটি বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু থানার কাজকর্ম করার মতো বিকল্প ভবন না পাওয়ায় জনগণের নিরাপত্তা প্রদানকারী এ সংস্থার লোকজন নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কাজ করছিল। হারিকেনের মৃদু আলোতে সিরাজ সাহেব লিখছিলেন হঠাৎ করে ভবনের ছাদ থেকে এক খণ্ড প্লাস্টার খসে পড়েছিল। সিরাজ সাহেব চমকে উঠেছিলেন। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়েছিলেন। একটা টিকটিকি টিক টিক করে উঠেছিল। সিরাজ সাহেব চেয়ার থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু পরেই সাব-ইন্সপেক্টর কিবরিয়া সাহেব এসেছিলন। সিরাজ সাহেবের পর কিবরিয়া সাহেবের ডিউটি। কিবরিয়া সাহেব রসিক মানুষ তিনি সব সময় রসিকতা করেই কথা বলতেন। তিনি বলেছিলেন, কি সিরাজ সাহেব বাসায় যাবেন? যান, যান ঘরে নতুন বউ অপেক্ষা করছে।

সিরাজ সাহেব হেসে বলেছিলেন, কিবরিয়া ভাই আমি আসি।

হ্যাঁ আসুন। কাল আবার আপনাকে আসামি নিয়ে কুড়িগ্রাম যেতে হবে, মনে আছে তো?

জি ভাই আমি সকালে চলে আসব।

সুলতানা ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সিরাজ সাহেব দরজায় কড়া নাড়তেই কাজের ছোট মেয়েটা দরজা খুলে দিয়েছিল।

সুলতানা মলিনমুখে বলেছিলেন, এত দেরি করলে!

কি করব? কাল আবার কুড়িগ্রাম যেতে হবে।

সুলতানা ভাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, নদী ভরে গেছে, প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে কুড়িগ্রাম যেতে হবে?

সিরাজ সাহেব সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মৃদু হেসে বলেছিলেন, সুলতানা বৃষ্টিতে নৌকায় ভয় নাই, বর্ষাকালেও ভয় নাই। আসলে নৌকায় ভয় বৈশাখ মাসে তখন নদীতে কাল বৈশাখী ঝড়ে নৌকা ডুবে যায়। আর এখন তো নৌকা জার্নি খুব আরামদায়ক।

সুলতানা আর কিছু বলেননি। নীরবে খাওয়া শেষ করেছিলেন।

পরদিন সকালবেলা সিরাজ সাহেব যখন থানা থেকে আসামি নিয়ে বের হয়েছিলেন। তখন আকাশে প্রচণ্ড মেঘ জমেছিল যেন যে কোন মুহূর্তে প্রচণ্ড বৃষ্টির লক্ষণ। সিরাজ সাহেবের সঙ্গে তিনজন কন্সটেবল আর দু’জন আসামি ছিল। সত্যি সত্যি নৌকা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল, সেই সঙ্গে বাতাস। বৃষ্টির ঝাপটায় সবাই ভিজে গিয়েছিল। এভাবে প্রায় দু’ঘণ্টা চলার পর বৃষ্টি থামলো আরো আধঘণ্টা নৌকা চলার পর নৌকা চিলমারী ঘাটে থেমেছিল।

কুড়িগ্রাম পৌঁছার পর কোর্টে আসামি দিয়ে আবার যখন রৌমারী পৌঁচেছিলেন তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। থানায় ঢুকতেই ওসি সাহেব ডেকেছিলেন, সিরাজ সাহেব একবার এদিকে আসুন।

সিরাজ সাহেব স্যালুট দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, স্যার।

ওসি সাহেব একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলেেিেছলন, এই আসামিগুলো আ্যরেস্ট করার ব্যবস্থা করুন।

সিরাজ সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

ওসি সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটা নারী নির্যাতন মামলার তদন্ত করার জন্য আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম অগ্রগতি কতদূর?

জি স্যার আমি তদন্ত করে দেখছি।

এখনো আসামি আ্যরেস্ট করতে পারেননি?

না স্যার।

দেখুন আপনি আসামি ধরতে পারছেন না আর জবাব দিতে দিতে আমি হয়রান হচ্ছি। বার বার করে সার্কেল এস.পি টেলিফোন করছেন। বুঝছেন না এটা নারী নির্যাতন কেইস, আপনি চাকরিতে নতুন তো তাই নারীদের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারণা নাই, নারী নির্যাতন কেইসের আসামি ধরতে দেরি হলে সব এন.জি.ও’রা মিটিং করবে, মিছিল করবে, সাংবাদিক সম্মেলন করবে আর প্রশাসন আমাদের ওপর চাপ দিবে।

স্যার আমি তো আসামি ধরার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।

কীভাবে চেষ্টা করছেন? বলুন তো।

স্যার গতকালকেও আসামি ধরতে গেছিলাম কিন্তু আমরা পৌঁছার আগেই আসামি পালিয়ে গেছে।

এটা কোন পুলিশ অফিসারের কথা হলো না।

স্যার।

আসামি তো পালাবেই, আপনি যাবেন রিঙা ভ্যানে চড়ে বা সাইকেল নিয়ে আর আসামি পালাবে মোটর সাইকেল নিয়ে। আপনি কীভাবে আসামি ধরবেন বলুন?

কিন্তু আমার তো মোটর সাইকেল নাই স্যার।

মোটর সাইকেল নাই তো কিনে ফেলুন।

মোটর সাইকেল কীভাবে কিনব স্যার বলুন? সরকারিভাবে মোটর সাইকেল পেলে আমার কাজ করতে সুবিধা হতো।

দেখুন আমরা যারা মোটর সাইকেল নিয়ে ডিউটি করছি তাদের সবারই মোটর সাইকেলগুলো নিজেদের টাকা দিয়ে কেনা। আপনিও কিনে ফেলুন।

সিরাজ সাহেব শুষ্ক হাসি হেসে বলেছিলেন, একটা মোটর সাইকেলের তো দাম অনেক স্যার, আমার মতো একজন সাব-ইন্সপেক্টরের পক্ষে তো সেটা কেনা আদৌ সম্ভব না।

দেখুন এসব যুক্তি দেখাবেন না। আমি আপনাকে তদন্ত করার দায়িত্ব দিয়েছি, আসামি ধরার দায়িত্ব দিয়েছি আপনি আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। কীভাবে করবেন সেটা আপনার বিষয়।

জি স্যার।

সিরাজ সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে তাঁর চেয়ারে গিয়ে ধপাস্‌ করে বসে পড়েছিলেন। পাশে কিবরিয়া সাহেব বসে কাজ করছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি হলো ইয়াং ম্যান?

কিবরিয়া ভাই কেবল কুড়িগ্রাম থেকে এলাম, স্যার আবার একটা কেইস ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব দিলেন। আবার আগের মামলার তদন্ত এবং আসামি গ্রেফতারের জন্য বললেন।

বেশ তো এখন আপনার বয়স কম, এখনই তো কাজ করার সময়। নজরুল বলেছেন না এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার।

কিবরিয়া ভাই যুদ্ধে শুধু যৌবন থাকলেই চলবে না, ঢাল চাই, তলোয়ার চাই।

হ্যাঁ তা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন।

আচ্ছা কিবরিয়া ভাই, আমি তো এর আগে কখনো কোন থানায় চাকরি করিনি আপনি আমাকে বলুন তো এই যে আমি আসামি নিয়ে কুড়িগ্রাম গেলাম আমি যাতায়াতের জন্য টি.এ বিল পাব না?

হ্যাঁ তা পাবেন তবে পেতে অনেক দেরি হবে আর যত টাকা খরচ করবেন হয়ত তত টাকা পাবেন না।

তাহলে কি নিজের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে এসব কাজ করতে হবে?

এই তো কেবল শুরু।

আর আপনারা যে নিজের মোটর সাইকেল নিয়ে কাজ করছেন তার পেট্রোল এবং মবিলের বিল?

কিবরিয়া সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, সব নিজের টাকা দিয়ে।

তাহলে তো বেতনের সব টাকা ফুরিয়ে যাবে, খাব কি? সংসার চালাবো কি?

সিরাজ সাহেব মাথা ঠান্ডা রাখুন, আগে একটা মোটর সাইকেল কেনার ব্যবস্থা করুন, পেন্ডিং কাজগুলো করুন, কোনোভাবে আপনি যদি পেন্ডিং কাজগুলো করতে না পারেন এবং সেনসিটিভ কেইসগুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারেন তাহলে চাকরিতে আপনি ভালো করতে পারবেন না।

তারপর।

তারপর সবাই যেভাবে ম্যানেজ করছে আপনিও সেভাবে ম্যানেজ করবেন।

সিরাজ সাহেব সবকিছুই বুঝেছিলেন। সবাই তাকে পরোক্ষভাবে কি বলতে চাচ্ছিলেন? কিন্তু তাই বলে ঘুষ খাব? না না তা হতে পারে না।

সিরাজ সাহেব কয়েকজন ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। যখন বাসায় ফিরেছিলেন তখন রাত প্রায় এগারোটা বাজে। সিরাজ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সুলতানা যেন চমকে উঠেছিলেন, তোমার এ অবস্থা হয়েছে কেন? ভাত খেয়েছ?

না।

দুপুরে?

না।

তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও আমি খাবার দিচ্ছি।

দুশ্চিন্তা আর ক্রমাগত কাজের চাপে যেন সিরাজ সাহেবের আহার, নিদ্রা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। তিনি কোন রকমে সামান্য ভাত খেয়ে উঠে পড়েছিলেন।

সুলতানা খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি হলো তোমার?

কিছু না।

ভাত খেলে না যে?

খিধে নাই।

নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে। আমি তোমার স্ত্রী, আমাকে বল?

সিরাজ সাহেব বিছানায় শুয়ে ছিলেন এবার সুলতানার পাশে ফিরে বলেছিলেন, সুলতানা আমার বোধ হয় চাকরিটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

কেন?

অনেক সমস্যা।

যেমন?

যেমন নিজস্ব মোটর সাইকেল লাগবে, মোটর সাইকেল চালানোর জন্য তেল খরচ নিজেকে ম্যানেজ করতে হবে। সরকারিভাবে টি.এ, ডি.এ খুব সামান্য তাও পাওয়া যাবে অনেক দেরিতে আগে নিজেকে খরচ করতে হবে।

সুলতানা মুচ্‌িক হেসে বলেছিলেন, এটা কোন ব্যাপার হলো? তোমাকে তো দুলাভাই কত করে একটা মোটর সাইকেল কিনে দিতে চাইলেন, তুমি তো নিলে না। দুলাভাই তোমার সিনিয়র তিনি জানেন তোমার চাকরির জন্য মোটর সাইকেল খুব জরুরী। আর টি.এ, ডি.এর কথা বলছ, সবাই যেভাবে ম্যানেজ করছে তুমিও সেভাবে ম্যানেজ করবে।

সুলতানা ম্যানেজ করার কাজটা আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়। সরকারি চাকরি করি, জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমার কাজ, সে কাজ করতে গিয়ে যদি আমি ঘুষ খাই, নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেই তবে তো সবকিছু ম্যানেজ হয়েই যাচ্ছে।

সেভাবেই কর। আসলে সততার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। তুমি তোমার কথা চিন্তা কর, এখন তোমার যা অবস্থা তাতে কি তোমার পক্ষে সৎ থাকা সম্ভব? তুমি সৎ থাকতে চাইলেই তো হবে না, পরিবেশ অনুকূল হতে হবে। এখনকার দিনে সততা মানে হচ্ছে সব অবস্থাতেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া।

সুলতানা তুমি তো দেখি দুর্নীতির পক্ষে, অনৈতিক কাজের পক্ষে সুন্দর যুক্তি দাঁড় করেছ।

শোন তাহলে চল একবার নওগাঁ যাই।

কেন?

আপাতত তোমার মোটর সাইকেলটার ব্যবস্থা করি।

সিরাজ সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলেছিলেন, যৌতুক দিতে চাও।

তুমি এটাকে এভাবে দেখছ কেন? আমি তোমার স্ত্রী, তোমার বিপদে-আপদে তোমার পাশে দাঁড়াব না। তাছাড়া বাবার অবস্থা তো এত খারাপ না যে তোমাকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দিতে হিমশিম খেতে হবে।

সিরাজ সাহেব অনেক কষ্টের মাঝে হেসে উঠেছিলেন, ম্যাডাম, মোটর সাইকেল না হয় তুমি কিনে দিলে আমার টি.এ, ডি.এ কে দিবে?

 

সতেরো

 

কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন সিরাজ সাহেবের নাইট ডিউটি ছিল। সারারাত ডিউটি শেষ করে সকালবেলা বাসায় ফিরেছিলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরই ওয়্যারলেসে বিড় বিড় করে কি যেন বলেই চলেছিল। সিরাজ সাহেবও কি যেন বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। সুলতানা পিছন থেকে ডাকতে ডাকতেই সিরাজ সাহেব অনেকদূর চলে গিয়েছিলেন। সুলতানা মুখ গম্ভীর করে আবার বাসায় ফিরেছিলেন।

সিরাজ সাহেব থানায় ঢুকে ওসি সাহেবকে স্যালুট দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, স্যার।

সিরাজ সাহেব এস. পি স্যার টেলিফোন করেছিলেন।

সিরাজ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, স্যার হঠাৎ করে এস.পি স্যার আমাকে-

আপনার কাছে যে নারী নির্যাতন কেইসটার তদন্ত দিয়েছি সেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং আসামি অ্যারেস্টের জন্য তিন দিন সময় দিয়েছেন। তিন দিনের মধ্যে আসামি আ্যরেস্ট করতে না পারলে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিবেন। আপনি ছিলেন না প্রথম ঝড়টা আমার ওপর দিয়েই গেল। এখন আপনি ব্যবস্থা নিন। আপনি একাই না পারলে কিবরিয়া সাহেবের হেল্প নিন।

জি স্যার।

সিরাজ সাহেব ওসি সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

কিবরিয়া সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেইসটার এখন কি অবস্থা বলুন তো?

সিরাজ সাহেব কিবরিয়া সাহেবকে কেইসটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সবকিছু বলেছিলেন। কিবরিয়া সাহেব সবকিছু শুনে বলেছিলেন, তাহলে তো ব্যাপারটা সিরিয়াস, চর শৌলমারী তো পিক-আপ ভ্যান যাবার রান্তা নাই। আপনি আমার মোটর সাইকেল নিয়ে যান, উইথ আউট ফেইল আসামি এ্যারেস্টের ব্যবস্থা করুন। এটা সরকারি চাকরি তারওপর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, এখানে আপনার সমস্যার কথা কেউ শুনবে না কিন্তু কোন কাজে ফেইল করলে পানিশমেন্ট হবে।

থ্যাংক ইউ কিবরিয়া ভাই, বলে কিবরিয়া সাহেবের কাছ থেকে মোটর সাইকেলের চাবি নিয়ে একজন ফোর্সসহ থানা থেকে বের হয়েছিলেন।

সিরাজ সাহেব আসামি নিয়ে আবার থানায় ফিরেছিলেন বিকেলবেলা। ওসি সাহেব তখন থানায় ছিলেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে এস. পি সাহেবকে আসামি এ্যারেস্টের খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন।

কিবরিয়া সাহেব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, সিরাজ সাহেব আজকেও যদি আপনি ভ্যানে চড়ে বা সাইকেল নিয়ে যেতেন তবে আপনি যেতে যেতে আসামি পালিয়ে যেত। তাই তো বলি একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলুন।

সিরাজ সাহেব কিছু বলেননি।

কিছুক্ষণ পর একটা লোক এসেছিল। সে প্রথমে কিবরিয়া সাহেবকে সিরাজ সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিবরিয়া সাহেব তাকে সিরাজ সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

লোকটা সালাম দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, স্যার আমি এসেছি নুরপুর থেকে।

কি ব্যাপার বলুন? আপনার জন্য কি করতে পারি?

লোকটা একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিস্‌ফিস করে কি যেন বলেছিল। প্রথমে সিরাজ সাহেব রেগে গিয়েছিলেন তারপর নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল এখন তার প্রচুর টাকা দরকার, কমপক্ষে একটা মোটর সাইকেল। তারপর সবকিছু ম্যানেজ করে চাকরি করা। সৎ থাকতে গিয়ে যদি চাকরিটাই না থাকে তবে আর সৎ থেকে কি হবে? সিরাজ সাহেবের সুলতানার কথাগুলো মনে পড়েছিল, আসলে সততার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। তুমি তোমার কথা চিন্তা কর, এখন তোমার যা অবস্থা তাতে কি তোমার পক্ষে সৎ থাকা সম্ভব? তুমি সৎ থাকতে চাইলেই তো হবে না, পরিবেশ অনুকূল হতে হবে। এখনকার দিনে সততা মানে হচ্ছে সব অবস্থাতেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়া।

লোকটা বলেছিল, স্যার ছেলেটা আসলে নিরপরাধ, বড় লোকের ছেলে আপনি যত টাকা চাইবেন ততই পাবেন।

সিরাজ সাহেব কি যেন বলেছিলেন।

লোকটা মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠেছিল, স্যার আমি কিছুক্ষণ পর আবার আসছি।

সেদিন রাতে সিরাজ সাহেব ঘুমাতে পারেননি। সারারাত একটা কথাই তাঁর মনে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত আমি ঘুষ নিলাম, আমি একজন ঘুষখোর!

সুলতানা সিরাজ সাহেবকে বিছানায় ছট্‌ফট্‌ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি হয়েছে তোমার? ঘুমাচ্ছ না কেন? তুমি আমাকে বল?

সিরাজ সাহেব সেদিনের সমন্ত ঘটনা খুলে বলেছিলেন।

সুলতানা যেন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটা আর এমন কি তুমি এ লাইনে প্রথম তাই হয়ত হেজিটেশন করছ। টেক ইট ইজি। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর থেকে সিরাজ সাহেব যেন অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন।

কয়েকমাস পর সিরাজ সাহেব বদলী হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সদর থানায়।

কুড়িগ্রাম শহরে বদলী হওয়ার পর সিরাজ সাহেব একটা দ্বিতল বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু বাসায় আসবাবপত্র যেন কিছুই নাই।

একদিন সিরাজ সাহেবের এক কলিকের বউ বাসায় এসেছিলেন, তিনি মুখের ওপরই বলেছিলেন, আচ্ছা ভাবী আপনাদের বাসায় তো দেখছি কিছুই নাই।

কথাটা বারান্দা থেকে শুনতে পেয়ে সিরাজ সাহেব বলেছিলেন, নতুন চাকরি তো ভাবী ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভদ্র মহিলা চলে যাবার পর সুলতানা বলেছিলেন, দেখলে তো, ভাবী তোমার মুখের ওপরই বললেন আমাদের কিছু নাই। প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি আগে বাসাটা সাজাবার ব্যবস্থা কর। এই যেমন একটা ফ্রিজ, একটা কালার টি.ভি. সোফা সেট এসব।

সিরাজ সাহেব কিছু বলেননি। তাঁর মনের মধ্যে অঢেল সম্পদের একটা আকাঙ্‌ক্ষা জন্ম নিয়েছিল। তিনিও যেন লাগামহীন দুর্নীতি করে অসীম সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

আজ নিজের ছেলে তাঁর বেতন জিজ্ঞেস করায় সিরাজ সাহেবের মধ্যে অপরাধবোধ জেগে উঠল। একটা পাপবোধ তাঁর মনকে পীড়িত করে তুললো। তাঁর মনের মধ্যে একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছিল, আকাশ যখন জানতে পারবে তার বাবা পনেরো হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে। তার বাবার আয়ের উৎস কি? সে কি আঙ্গুল উঁচিয়ে বলবে, ছিঃ বাবা তুমি একজন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমার পরিচয় দিতে ঘৃণা হচ্ছে বাবা যে আমি একজন ঘুষখোরের ছেলে।

তখন হয়ত সুলতানা বলবে, ছিঃ বাবা এভাবে বলতে হয় না। তোর বাবা যা কিছু করেছে সব তোর জন্য করেছে।

ছিঃ মা তুমিও, তুমি কি করে ভাবলে আমি বাবার এই অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ, জনগণের সম্পদ নিব। আমি আজ থেকে তোমাদের সঙ্গে সমন্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলাম, একজন দুর্নীতিবাজের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই।

না, না বাবা তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি না, তাহলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচবো, বলে সিরাজ সাহেব চিৎকার করে উঠলেন।

সুলতানা বিছানা ছেড়ে উঠলেন, কি হয়েছে তোমার? শরীরটা খারাপ করছে?

সিরাজ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠলেন, সুলাতানা এক গ্লাস পানি দাও।

কি হয়েছে আমাকে বলতো?

রাত দু’টা বাজে, সিরাজ সাহেব আবার ঘুমাবার চেষ্টা করলেন।

পরদিন সকালবেলা সিরাজ সাহেব নিত্য দিনের মতো চলে গেলেন। সিরাজ সাহেব চলে যাবার পর সুলতানা বৃষ্টি আর আকাশের জন্য নান্তা তৈরি করে ডাক দিলেন, আকাশ, বৃষ্টি খেতে আয়।

দু’জনে নান্তা খেতে বসল।

আকাশ নান্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মা তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

সুলতানা না জানার ভান করে বললেন, কি?

কেন আমি তোমাকে বলছিলাম না বাবাকে তার বেতনের কথা জিজ্ঞেস করতে?

আমি তো ভুলে গেছিলাম, আচ্ছা বলতো হঠাৎ করে তোরা বাবার বেতনটা তোর কি কাজে লাগছে? এমনি তো তোর খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা নাই, যখন যত টাকা চাচ্ছিস্‌ ততই পাচ্ছিস্‌। তোর আবার বাবার বেতন জানার দরকারটা পড়ল কেন?

মা আমার কোন অসুবিধা নাই, তোমারও কোন অসুবিধা নাই, বাবা অগাধ টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে সেজন্যই তো আমার বাবার বেতনের কথা জানা দরকার।

কি জানি বাবা? হঠাৎ করে তোর মাথায় আবার কিসের ভুত চাপলো। আমি তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারব না, করতে হয় তুই জিজ্ঞেস করবি।

মা আমি নিজে বাবাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে চাইনি, তুমি যখন পারলে না তখন আমাকে তো জিজ্ঞেস করতেই হবে।

 

আঠারো

 

কয়েকদিন থেকে মোহনার মনটা খুব খারাপ, সে কারো সঙ্গে কোন কথা বলছে না। ঠিক মতো ক্লাস করছে না, মোবাইলটা সারাদিন বাজতে থাকলেও সহজে রিসিভ করছে না। নীলা বার বার পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু মোহনা কিছু না বলে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু নীলা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে মোহনার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

সেদিন বিকেলবেলা মোহনা মোবাইলে কথা বলছিল, প্লিজ হৃদয়, আমার সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা কর। আমি পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এখন তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তবে আমি কার কাছে যাব বল, আমি কাল থেকে তোমার মোবাইলে অসংখ্যবার রিং দিয়েছি কিন্তু তুমি রিসিভ করনি, আবার কখনো কখনো রিং দিয়ে দেখেছি তোমার মোবাইল ব্যন্ত, এখন মোবাইলের অন্য সিম কার্ড সেট করে তোমাকে রিং দিলাম তুমি রিসিভ করলে এটা কি মিন করে না যে তুমি শুধু আমার মোবাইল রিসিভ করছ না।

হৃদয়ের কোন কথা শোন গেল না।

মোহনা বলতে শুরু করল, তুমি ছাড়া আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে। আমার গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প থাকবে না, প্লিজ হৃদয় তুমি আমাকে হেল্প কর হৃদয়।

বন্যা আমি তোমার জন্য অনেক সময়, মেধা এবং অর্থ ব্যয় করেছি কিন্তু তোমাকে যেভাবে পেতে চেয়েছিলাম সেভাবে পাইনি। নিজেকে কি ভাবো তুমি? তোমার জন্য আমি যে টাকা ব্যয় করেছি সে পরিমাণ টাকা খরচ করলে-

মোহনা বলল, হৃদয় আমাদের ফ্রেন্ডশিপকে তুমি কমার্শিয়ালি দেখছ?

না কমার্শিয়ালি দেখছি না, আমি অনেকদিন থেকে তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি বলেছি কিন্তু তুমি বুঝেও আমার ইচ্ছাকে অ্যাভয়েড করেছ। যখনই আমি তোমার দিকে একটু এগিয়ে গেছি তখনই তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ। তুমি একবার চিন্তা কর তোমার সমস্যাগুলোকে আমি সব সময় নিজের সমস্যা মনে করেছি কি না? তোমার সব ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি কি না?

হৃদয় আমি তোমার কন্ট্রিবিউশনের কথা অস্বীকার করছি না। আসলে চরম দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছ, একথা আমি সব সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।

কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে মনে জপ করতে থাক, প্লিজ আমাকে এবার মুক্তি দাও। আমি আসলে আর তোমার জন্য আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না।

হৃদয় তুমি চলে যাবে এটা আসলে আমি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না।

বন্যা আমিও তো তোমার কাছ থেকে চলে যেতে চাচ্ছি না, তুমি আমাকে ধরে রাখতে না পারলে একদিন না একদিন তো আমি চলে যাবই।

হৃদয় আমাকে আজকের রাতটা সময় দাও, আমি কাল তোমাকে জানিয়ে দিব।

জানানোর তো কিছু নাই বন্যা, তুমি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে আর তোমার রেজাল্ট পজেটিভ হলে মোবাইল করে চলে আসবে।

ঠিক আছে হৃদয়।

এবার ঠিকানাটা লিখে নাও।

মোহনা একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে নিল।

বন্যা তোমার ইচ্ছার ওপর আমার কোন চাপ নাই, তোমাকে যা দিয়েছি তার জন্য কোন দাবিও নাই তবে তোমার রেজাল্ট পজেটিভ হলে খুশি হব।

ওকে হৃদয়, বলে মোহনা মোবাইলটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

মোহনার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য চিন্তা ভিড় করছে। বার বার করে হৃদয়ের কথাই মনে পড়ছে, তুমি কথাটা আমাকে এমন ওপেনলি বলতে পারলে হৃদয়? তুমি ওভাবে না বললে তো আমি সেদিন তোমার কাছ থেকে চলে আসতাম না। একটু অন্যভাবে বললেও পারতে। আসলে আমার টাকার প্রয়োজন এটা তোমাকে বুঝতে দেয়াটাই আমার ঠিক হয়নি। তোমার কাছ থেকে টাকা না নিলে এমন একটা অনৈতিক প্রন্তাব তুমি আমাকে দিতে পারতে না। অবশ্য তুমি বিষয়টাকে সিরিয়াসলি না নিয়ে খুব সহজভাবে নিতে বলেছ, বলবেই তো আজকাল তো এটা একরকম সহজ হয়ে গেছে। আমি যা অনৈতিক এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মনে করছি অনেকে কিছুই মনে করছে না বরং এটাকে এক ধরনের বিনোদন বলে ধরে নিয়েছে।

হৃদয় আসলে তুমি বুঝে ফেলেছ আমার টাকার প্রয়োজন আর তোমাকে ছাড়া আর কারো কাছ থেকে আমার টাকা পাবার সম্ভাবনা নাই তাই তুমি সুযোগ নিতে চাচ্ছ। আর তোমারই বা দোষ কিসের? তুমিও তো আমাকে পাবার আশায় দিনের পর দিন মেধা, সময় এবং টাকা অপচয় করেছ। আমি তোমার কাছ থেকে শুধু নিয়েছি তোমাকে কিছু দিতে পারিনি, তোমার আমাকে পাবার আশাটাও তো অমূলক না, তুমি সঙ্গত কারণেই আমাকে এমন প্রন্তাব দিয়েছ। সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে আজ রাতের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাল সকালে তোমাকে জানাতে হবে তারপর–

নীলা দরজা নক করল।

মোহনা দরজা খুলে দিল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, মোহনা কি হয়েছে?

মোহনা বলল, কিছু হয়নি রে।

নীলা মোহনার মুখোমুখি বসে মোহনার দুবাহুতে হাত দিয়ে বলল, মোহনা প্লিজ তুই আমাকে বল, আমি তোর রুমমেট, তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তুই বল আমি যেভাবে পারি তোকে হেল্প করব।

মোহনা কিছু বলল না।

নীলা আবার জিজ্ঞেস করল, কি রে কিছু বলছিস না কেন? কোন সমস্যা?

না রে কোন সমস্যা হলে তোকে বলব।

মোহনা তবুও কিছু বলল না।

নীলা বলল, হৃদয়ের সঙ্গে তোর কিছু হয়েছে?

মোহনা মাথা নেড়ে সায় দিল।

নীলা বলল, এটা তোর কাছে কোন বিষয় হলো। জীবনে এরকম কত হৃদয় আসবে যাবে, সেজন্য আর ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। তাছাড়া হৃদয় তো তোকে বন্যা নামে চিনে কাজেই তুই তো তোর মোবাইলের সিম কার্ডটা চেঞ্জ করলেই পারিস ও আর তোকে কোনদিন খুঁজেই পাবে না।

মোহনা আপন মনে বলল, খুঁজে পাবার দরকার নাই নিজেকেই ধরা দিতে হচ্ছে।

নীলা জিজ্ঞেস করল, কি রে কি ভাবছিস?

না, না নীলা আমি সবকিছু তোকে বোঝাতে পারছি না।

বল, আমাকে বোঝাতে পারবি না কেন?

আমি তোকে বলতে পারব না নীলা।

নীলা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব।

মোহনা নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, নীলা তোর মোবাইলে ব্যালেন্স আছে?

নীলা তার মোবাইলে ব্যালেন্স দেখে বলল, একটু ওয়েট কর, পটু মামাকে মিস্‌ কল দিচ্ছি এখনি ব্যালেন্স চলে আসবে।

তার মানে?

মানে আমার মামার মোবাইল ফোনের দোকান আছে বাবা সেখানে বলে দিয়েছে আমি মিস্‌ কল দিলেই পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়ে দিবে, বলে নীলা পটুর মোবাইলে মিস্‌ কল দিল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে নীলার মোবাইলে পঞ্চাশ টাকা ব্যালেন্স পৌঁছে গেল।

নীলা মোবাইলটা মোহনার হাতে দিয়ে বলল, নে কথা বল, নাকি আমি বারান্দায় যাব?

আরে না বাবার সঙ্গে কথা বলব।

মোহনা তার বাবার মোবাইলে রিং করল, হ্যালো বাবা, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

এটা কার মোবাইল রে মা?

বাবা এটা আমার রুম মেট নীলার মোবাইল নাম্বার সেভ করে রাখ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বাবা তুমি ভালো আছ?

ভালো তবে বুকের ব্যথাটা একটু বেড়েছে।

ডাক্তার দেখাওনি?

ডাক্তার দেখিয়েছিলাম বলেছে বরিশালে গিয়ে হার্টের স্প্যাশালিস্ট দেখাতে হবে।

যাও বরিশাল, অবহেলা করছ কেন?

আজ মাসের পঁচিশ তারিখ রে মা, মিলনকে এ মাসে বেশি টাকা দিতে হলো তো তাই মনে করছি বেতন পেয়ে বরিশাল যাব।

মোহনা আপন মনে বলল, বাবা আমি তোমাকে মোবাইল করলাম টাকার জন্য আর তুমি কি না টাকার অভাবে নিজেকে হার্টের ডাক্তার দেখাতে পারছ না। আমি আর কি টাকা চাইব বাবা? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে কিছু টাকা পাঠাতে পারলে মনে মনে শান্তি পেতাম।

হ্যালো মোহনা, কথা বলছিস না কেন রে মা?

মোহনার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল, না বাবা তুমি ভালোভাবে চিকিৎসা কর একটুও অবহেলা করবে না কিন্তু-

তুই কিছু ভাবিস না মা, আমি দুই কিংবা তিন তারিখে বরিশাল যাব।

বাবা আজ তাহলে রাখি, নীলার মোবাইল তো আমি অন্য সময় আমার মোবাইল থেকে তোমাকে রিং দিব।

মোহনার মোবাইল বেশিরভাগ ব্যন্ত থাকত গভীর রাতে। একের পর এক রিং আসতেই থাকত আর কথা চলতে থাকত বিরামহীনভাবে। এখন আর মোহনার মোবাইলের সে ব্যন্ততা নাই। মোহনা সবার মোবাইল রিসিভ করে না। নীলা তখন পড়ছিল আর মোহনা বিছানায় শুয়েছিল তার মোবাইল অবিরাম বেজেই চলছিল।

নীলা বলল, মোহনা রিসিভ র্ক্‌।

হোক যে কল করে করুক, আমি রিসিভ করব না।

আমি রিসিভ করব?

দেখ তো কে রিং করেছে?

নীলা মোবাইলের মনিটরে দেখে বলল, মোহনা তুষার মোবাইল করেছে।

দে তো, তুই পড়তে যা।

নীলা তার পড়ার চেয়ারে বসল।

মোহনা মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো তুষার।

কি ব্যাপার মোহনা মোবাইল ধরিস না কেন?

এমনিতেই মনটা ভালো নাই তো।

কেন কি হয়েছে?

তুষার তোকে তো বলাই হয়নি, বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য আদানুন খেয়ে লেগেছে। আমারও ইচ্ছাও সেরকমই কয়েকদিন পরে তো আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হবে তখন তো হল ছেড়ে দিতে হবে তখন তো আর ঢাকা শহরে থাকার জায়গা থাকবে না।

ঢাকায় থাকার জায়গা নাই তোকে কে বলল? ঢাকা শহরে যারা হল-এ থাকে না তারা কি বন্তিতে থাকে? নাকি কমলাপুর রেলস্টশনে থাকে? ঢাকায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা পড়ালেখা করছে না? ঢাকায় কর্মজীবী মেয়েদের থাকার জন্য অনেক কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল আছে না? তুইও সেখানে থাকবি।

আসল বিষয় সেটা না তুষার বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে আর আমিও বিয়ে করতে চাচ্ছি।

মোহনা সেকেলে কথা বলবি না, তুই একটা প্রগ্রেসিভ মেয়ে তোর মুখে এসব কথা মানায় না। তুই লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি তারপর বিয়ে করবি।

না তুষার আমি এখনই বিয়ে করব এবং মা-বাবার পছন্দ করা ছেলেকে।

খুব ভালো কথা, বড়ই আনন্দের কথা।

তুই খুশি হয়েছিস।

তোর বিয়ে আমি খুশি হব না।

রিয়েলি।

অফকোর্স।

তুই আমাকে ভালোবাসতিস না?

হ্যাঁ।

হঠাৎ করেই মোহনা গম্ভীর হয়ে গেল, তুষার আমি তোকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব, ঠিক ঠিক উত্তর দিবি?

বল।

তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?

তোর কি সন্দেহ আছে?

তুষার চালাকি করবি না, সোজা উত্তর দিবি।

হ্যাঁ আমি তোকে ভালোবাসি।

আমাকে বিয়ে করবি?

হ্যাঁ।

চল কালকেই।

এত তাড়াহুড়া করার কি আছে?

তোর তাড়াহুড়া না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে।

মোহনা আমাকে একটু ভাববার সময় দে।

এতদিন থেকে আমার সঙ্গে প্রেম করছিস তখন তো ভাবতে হয়নি বিয়ে করার বেলায় ভাবতে হচ্ছে কেন?

মোহনা বিয়ে আর প্রেম এক না। তোকে বিয়ে করতে গেলে আমাকে আমার গার্ডিয়ানকে জানাতে হবে তোদের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রন্তাব পাঠাতে হবে আরো কত আনুষ্ঠানিকতা আছে।

সেসব পরে হবে, চল কালকেই আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করি তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা পরে হবে, পরে তুই সবাইকে জানাবি।

সরি মোহনা আমি পারব না।

পারবি না, না? বছরের পর বছর প্রেম করতে পারবি আর বিয়ে করতে পারবি না, না? ভণ্ড, প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক, কথাগুলো জোরে চিৎকার করে বলে মোহনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

নীলা মোহনার বিছানার এক কোণে বসে মোহনার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, মোহনা ভেঙ্গে পড়িস্‌ না, দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

ঠিক হবে না নীলা তুই বুঝতে পাচ্ছিস্‌ না, আমার পৃথিবী দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না।

ছিঃ মোহনা এমন কথা বলতে হয় না।

পরদিন নীলার ক্লাস ছিল না তবুও সে রেডি হচ্ছিল।

মোহনা বিছানায় শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল, কি রে আজ নাকি তোর ক্লাস নাই তবে রেডি হচ্ছিস কেন?

বাইরে যাব।

আকাশের সঙ্গে নিশ্চয়ই।

নীলা মুচকি হাসল।

মোহনা বলল, নীলা তোর কাছে দু’শ টাকা হবে।

অবশ্যই, বলে নীলা তার ব্যাগ থেকে দু’শ টাকা দিল।

মোহনা বলল, আরো একটা উপকার করতে হবে।

বল।

বাইরে গিয়ে আমার মোবাইলে পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়ে দিবি।

আচ্ছা পাঠিয়ে দিব।

নীলা বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর মোহনার মোবাইলে ব্যালেন্স যোগ হলো।

সে হৃদয়কে মোবাইল করল, হ্যালো হৃদয়।

বন্যা বল।

আমি আসছি হৃদয়, বলে মোহনা মোবাইল রেখে দিল।

নীলা রুমে ফিরেছে একেবারে গেট বন্ধ হওয়ার কয়েকমিনিট আগে। কিন্তু হল-এ ঢুকার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও মোহনা ফিরে এলো না। নীলা বার বার করে মোহনার মোবাইলে রিং দিল, মোহনার মোবাইল বন্ধ। নীলা কিছুটা বিরক্ত হলো, কোন অসুবিধা হতেই পারে তাই বলে মোবাইল বন্ধ করে রাখবে। মোবাইল করে তো একবার জানাতে পারতো।

তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। নীলার মোবাইলের রিং বেজে উঠল। নীলা মোবাইল রিসিভ করল। অপরিচিত কণ্ঠের নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো, আপনি কি নীলা বলছেন?

জি, আপনি কে বলছেন প্লিজ?

আপনি কি মোহনার রুমমেট?

জি।

কথা বলুন।

অপর পাশ থেকে মোহনার কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, নীলা।

কি খবর মোহনা? কোন সমস্যা?

নীলা আমি এখন থানায়।

কেন?

নীলা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে, প্লিজ তুই আমাকে হেল্প কর, বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

নীলা সুলতানাকে মোবাইল করল, মামি আমি নীলা।

বল মা কি হয়েছে? তোমার গলা এমন কাঁপা কাঁপা মনে হচ্ছে কেন? কোন সমস্যা?

মামি ভীষণ সমস্যা।

বল মা কি সমস্যা?

মামি আমার রুমমেট মোহনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

কেন?

মামি আমি কিছু জানি না। একটা আননোন নাম্বার থেকে মোবাইল করে মোহনা আমাকে বলল।

যে নাম্বার থেকে মোবাইল করে তোমাকে বলল সেই নাম্বারটা আমাকে দাও তো। তুমি কিছু ভেবো না মা, আমি এখনই তোমার মামাকে বলছি।

নীলা মোবাইল নাম্বারটা তার মামিকে দিল।

 

উনিশ

 

মোহনা হাজতের সংকীর্ণ রুমে মুখ ঢেকে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে ছিল। আজ তার জীবনের বয়ে যাওয়া সব কথাগুলো বার বার করে মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। দু’ভাইবোনের মধ্যে মোহনা বড়, ছোট ভাই মিলন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ে। মোহনার বাবা মোখলেস সাহেব একজন সরকারি চাকুরে। তাঁর বেতনের সামান্য টাকায় দু’জনের লেখাপড়ার খরচ বহন করা কঠিন। মোহনাদের গ্রামের বাড়ি ভোলোা জেলার মনপুরা উপজেলায় কিন্তু মনপুরায় তাদের যাতায়াত খুব একটা ছিল না। চাকরির সুবাদে মোখলেস সাহেব সব সময় তাঁর কর্মস’লে সপরিবারে বসবাস করতেন। মোখলেস সাহেবের পোস্টিং তখন পটুয়াখালী জেলার খেপুপাড়া উপজেলায়। মিলন যেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে খেপুপাড়ায় ফিরেছিল সেদিন মোহনা খেপুপাড়ায় ছিল। তাদের বাসায় সেদিন যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। মোখলেস সাহেবের এক মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে আরেক ছেলে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ায় এ খবরটা যেন উপজেলা ক্যাম্পাসেও একটা আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছিল। মোখলেস সাহেব নিজেও খুব আনন্দ পেয়েছিলেন, তিনিও তাঁর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

কয়েকমাস পরের কথা একবার মোহনার জন্য টাকা পাঠাতে দেরি হলো।

মোহনা তার বাবাকে মোবাইল করেছিল, বাবা তুমি টাকা পাঠিয়েছ?

না মা।

বাবা আজ মাসের দশ তারিখ।

হ্যাঁ তা তো ঠিকই আচ্ছা, মা তুই একবার খেপুপাড়া আসতে পারবি?

বাবা এসময়-

আয় না মা, আগামী সপ্তাহে তো মিলন আসছে, তুইও আয়।

আচ্ছা বাবা ঠিক আছে মিলন আর আমি একসঙ্গে আসছি।

মোহনা আর মিলন কয়েকদিন খেপুপাড়ায় থাকার পরও মোখলেস সাহেব কিছু বলেননি। মোহনা আর মিলনের ঢাকায় ফিরবার সময় ঘনিয়ে এসেছিল।

যেদিন মোহনা আর মিলন ঢাকা রওয়ানা দিবে তার আর আগেরদিন মোখলেস সাহেব আর তাঁর স্ত্রী মোহনাকে নিয়ে বসেছিলেন।

মোহনা কিছু বুঝতে পারেনি হঠাৎ করে তার বাবা কেন তাদের নিয়ে বসছে। তবে অনুমান করেছিল তার বাবা হয়ত গুরুত্বপূর্ণই কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবে।

হ্যাঁ বিষয়টা আসলে গুরুত্বপূর্ণই ছিল।

মোখলেস সাহেব একটা নিঃশ্বাস মোচন করে বলেছিলেন, মোহনা আমি আর তোর মা আসলে তোর বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি তাই বিষয়টা তোর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।

কি বিষয় বাবা?

তোর বিয়ের বিষয়।

এখন আমার বিয়ে নিয়ে কথা কেন বাবা?

মোহনার মা বলেছিলেন, বিয়ের বয়স হয়েছে, বাবা-মা হিসাবে আমাদের দায়িত্ব তোকে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া। আমরা আমাদের যারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের অনেককে তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে বলেছিলাম। একজন ভালো ছেলে পাওয়া গেছে।

মোহনা কোন কথা বলেনি।

মোখলেস সাহেব বলেছিলেন, তোর যদি কোন ছেলেকে পছন্দ থাকে তবে বল? আমরা তোর পছন্দমতো ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দিব।

আমার কোন পছন্দ নাই বাবা, তবে আমি এখন বিয়ে করব না।

কেন?

আমার বিয়ে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না বাবা, আমি আগে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াব, তারপর বিয়ে করব।

মোহনার মা বলেছিলেন, মোহনা তোর বাবার দিকটা একবার ভেবে দেখ, সামান্য একটা সরকারি চাকরি করে কি দু’জন ছেলেমেয়েকে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করানো সম্ভব?

মা, বাবা সামান্য চাকরি করে না। বাবা একজন গভর্নমেন্ট অফিসার। একজন গভর্নমেন্ট অফিসারের বেতন দিয়ে কি তার দু’ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ হয় না?

তোদের লেখাপড়ার খরচ কেন? তোর বাবা যা বেতন পায় তাতে আমাদের চারজন মানুষের সংসার চালানোই কঠিন। লেখাপড়া করানো তো পরের কথা।

তাহলে এখন যারা সরকারি চাকরি করছে তাদের ছেলে-মেয়েরা কি সবাই অশিক্ষিত থেকে যাবে?

মোখলেস সাহেব বললেন, না অশিক্ষিত থেকে যাবে না। তবে কোন সরকারি চাকরিজীবী তাদের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবে না।

মোহনার দু’চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল।

সে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেছিল, মা আমি মেয়ে বলে তোমরা আমাকে বোঝা মনে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে চাচ্ছ?

মোখলেস সাহেব বলেছিলেন, না মা আসলে তা না। তুই তো জানিস আমার কাছে মেয়ে কিংবা ছেলে কোন তফাৎ নাই। মিলন যদি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারতো তবে টিউশনি করে তার নিজের খরচ কিছুটা জোগাড় করতে পারতো কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো একেবারে ঢাকার বাইরে-

মোহনা তার বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বাবা মিলনের যে সুযোগ নাই আমার তো সে সুযোগ আছে?

কি সুযোগ?

বাবা আমি তো ঢাকায় থাকি, আমি না হয় একটা পার্ট টাইম জব বা দু’য়েকটা টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করি।

মিলনের ক্ষেত্রে যেটা হয় তোর ক্ষেত্রে সেটা হয় না মা। মিলন ছেলে মানুষ আর তুই মেয়ে। নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে যদি তুই কোন খারাপ মানুষের-

আমার নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে বাবা, তুমি আমার ওপর সে ভরসা রাখ।

মোখলেস সাহেব আর কিছু বলেননি।

একবার অসহায় মুখ তুলে একবার মোহনার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করেছিলেন।

ঢাকায় ফিরে মোহনা একটা পার্ট টাইম চাকরির জন্য ঢাকা শহরে হন্য হয়ে ঘুরেছিল কিন্তু কোথাও একটা চাকরি পায়নি। এমনসময় মোহনার সঙ্গে হৃদয়ের পরিচয় হয়। হৃদয় বলেছিল সে ব্যবসা করে কিন্তু সে মোহনাকে কোনদিন তার অফিসে নিয়ে যায়নি। মোহনার চাকরির প্রয়োজন জেনে সে মোহনার দারিদ্রের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে বিভিন্ন অজুহাতে মোহনাকে হরেক রকমের জিনিস উপহার দেওয়ার পাশাপাশি কৌশলে প্রায়ই টাকা দিত। যা দিয়ে মোহনার মাসের খরচ করেও বেশি হতো। হৃদয়ের কাছ থেকে টাকা নিতে প্রথম প্রথম মোহনার বিবেক তাকে বাধা দিত কিন্তু তাছাড়া উপায় কি? এমন দুঃসময়ে মোহনার পাশে হৃদয়ের মতো মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তাতে বা মন্দ কি?

ধীরে ধীরে হৃদয় মোহনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। প্রেমে পড়েছিল বললে ভুল হবে একরকম অনৈতিক কাজের প্রন্তাব দিয়েছিল। মোহনা হৃদয়কে পছন্দ করতো, একজন ভালো বন্ধু হিসেবে খোলামেলাভাবে মেলামেশা করতো। হৃদয়ের সঙ্গে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সময় মোহনা লক্ষ্য করেছে সে অদ্ভুদ ভঙ্গিতে মোহনার চোখে চোখ রাখত, মোহনার সৌন্দের্য্যের প্রশংসা করত, মাঝে মধ্যে এক রকম ইচ্ছা করেই মোহনার হাত ধরতো, পাশাপাশি হাঁটার সময় গা ঘেঁষে চলার চেষ্টা করত। হৃদয়ের এসব আচরণে মোহনা মনে মনে বিরক্ত বোধ করতো কিন্তু যখন মোহনার মনে পড়তো হৃদয়ের সহযোগিতা ছাড়া তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে তখন সে হাসি মুখে কৌশলে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিত। মোহনা অনেক সময় কল্পনার দৃষ্টিতে নিজেকে হৃদয়ের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছে তাতে মোহনাকে শুধু হৃদয়ের বয়সটাই একটু বেশি মনে হয়েছে। এটা সে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি আবার তার দীনতার কারণে হৃদয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি।

হৃদয়ও তাকে পাবার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছিল, হৃদয় হয়ত আশা করেছিল মোহনা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজেই কিন্তু দিনের পর দিন অপেক্ষা করার পর শেষ পর্যন্ত তার আকাঙ্‌ক্ষার কথা বলে ফেলেছিল। হৃদয়ের দিক থেকে চিন্তা করলে তার আশাটা একেবারে অমূলক ছিল না। কিন্তু মোহনার একটা কথা বার বারই আহত করেছিল হৃদয় আমাকে সহযোগিতা করেছে, আমি তাকে সঙ্গ দিয়েছি তাই বলে আমার কাছ থেকে বিনিময় চাইবে?

একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে, আর দু’মাস লেখাপড়ার খরচ মিটানোর জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মোহনা হৃদয়ের ঠিকানা অনুযায়ী সেখানে গিয়েছিল।

তারপর, তারপরের কথা আর ভাবতে চাচ্ছে না মোহনা কিন্তু ভাবতে না চাইলেই কি হয়? মানুষের মন কখনো তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না যেন আপন গতিতে চলতে থাকে।

ফ্রেন্ড শিপ ক্লাবের ভিতরে আবছা আবছা আলোতে অসংখ্য তরুণ-তরুণী এমনকি মধ্য বয়সী মানুষও রয়েছিল। অশ্লীল, প্রায় নগ্ন পোশাক পরে কেউ বা নাচছিল কেউ বা নাচের তালে তালে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিল, ছোট ছোট টেবিলে বসে অনেকেই গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল।

ভিতরে ঢুকেই মোহনার শরীর শিউরে উঠছিল সে প্রতি মুহূর্তে বেরিয়ে আসার কথা ভাবছিল।

হৃদয় নিজে একটা চেয়ারে বসে মোহনাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলেছিল।

মোহনা চেয়ারে বসতেই হৃদয়ের একটা হাত চলে এসেছিল মোহনার কাঁধের ওপর। মোহনা কিছু বলতে গিয়েও যেন থমকে গিয়েছিল।

হৃদয় মোহনা ছোট ব্যাগটা হাতে নিয়ে চেইন খুলে একটা প্যাকেট ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

মোহনা বুঝতে পেরেছিল, হৃদয় তাকে টাকা দিয়েছে।

মোহনাকে টাকা দেওয়ার হৃদয়ের এটাই নিয়ম। সে আর কিছু বলেনি।

মোহনা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল।

হৃদয় বলেছিল, বন্যা তাকানোর কিছু নাই এখানে যারা এসেছে সবাই ম্যাচুর্ড, কেউ একা আসেনি যে যার মতো এনজয় করছে।

মোহনা কিছু বলেনি।

হৃদয় আরো কাছে এসেছিল, একটু নিবিড় হয়ে বসার চেষ্টা করছিল।

সে একবার পাশের টেবিলে তাকালো। আসলেই সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যন্ত।

একজন বয়কে ডেকে কি যেন বলল, মোহনা শুনতে পেল না।

কিছুক্ষণের মধ্যে বয় একটা ট্রেতে দু’টা গ্লাসে করে ড্রিংকস নিয়ে এলো।

মোহনা মৃদু আপত্তি করে বলেছিল, প্লিজ হৃদয় আমি না খেলে হয় না।

হৃদয় বলেছিল, বন্যা প্লিজ।

মোহনা এক প্যাক এক প্যাক করে কয়েক প্যাক ড্রিংকস খেয়ে ফেলেছিল।

ততক্ষণে মোহনাও যেন একটু নতুন ইমেজ অনুভব করতে শুরু করছে। তার কথাবার্তা জড়িয়ে এসেছিল। সে একবার হৃদয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হৃদয়কে যেন আজ তার অপূর্ব লাগছে, হৃদয় একবার তার দিকে তাকাতেই সে যেন তার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি।

হৃদয় বলেছিল, বন্যা চল।

কোথায়?

ক্লাবটা ঘুরে দেখবে না?

মোহনা উঠতেই হৃদয় একরকম জড়িয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

মোহনা কিছু বলেনি আজকের দিনটা যেন ধীরে ধীরে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল।

ক্লাবের ভিতর ঢুকতে হয় একটা করিডোর দিয়ে করিডরের দু’পাশে ছোট ছোট রুম, স্লাইডিং জানালাগুলো রঙিন গ্লাস দিয়ে তৈরি, বাইরে থেকে ভিতরে দেখা যাওয়ার কোন সুযোগ নাই।

একটা দরজার সামনে গিয়ে হৃদয় পকেট থেকে একটা চাবি বের করে রুমটা খুলে ভিতরে ঢুকেছিল।

হাজতের দরজা খুলে একজন মহিলা পুলিশের অফিসার এবং দু’জন মহিলা পুলিশ কন্সটেবল ভিতরে ঢুকলো।

অফিসার জিজ্ঞেস করল, মোহনা কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে তুমি কীভাবে চেনো?

আমি তো এ নামে কাউকে চিনি না।

পুলিশ অফিসার তার মোবাইলের মনিটরে হৃদয়ের মোবাইল নাম্বার দেখিয়ে বলল, দেখ তো এই মোবাইল নাম্বারটা তুমি চেনো কি না?

হ্যাঁ এটা তো হৃদয়ের মোবাইল নাম্বার।

পুলিশ অফিসার কোথায় যেন মোবাইল করল, হ্যালো, স্যার কামরুল ইসলাম চৌধুরীর ডাক নাম কি হৃদয়?

অপর পাশ থেকে কি বলল তা শোনা গেল না।

পুলিশ অফিসার একটা ছবি দেখিয়ে বলল, দেখ তো এই ছবিটা তুমি চেনো নাকি?

মোহনা বলল, না এই ছবিটা তো আমি চিনি না।

তবে তুমি কার সঙ্গে হার্ট টু হার্ট ফ্রেন্ড শিপ ক্লাবে গিয়েছিলে?

হৃদয়ের সঙ্গে।

মোবাইলের সিম কার্ডের ঠিকানা, ছবি কিংবা অ্যাড্রেস কোথাও তো হৃদয় নামে কেউ নাই।

মোহনা কিছু বলল না।

পুলিশ অফিসার বলল, তুমি হৃদয়ের কোন ঠিকানা জানো?

না।

তোমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল কীভাবে?

মোহনা তার সঙ্গে হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয়সহ সমন্ত ঘটনা খুলে বলল।

সবকিছু শুনে পুলিশ অফিসার বলল, তোমরা আসলে কি যে কর? জানা নাই, শোনা নাই হঠাৎ করে যার তার সঙ্গে চলে যাও।

মোহনা কিছু বলল না।

পুলিশ অফিসার বলল, হতে পারে সে কোন প্রফেশনাল ক্রিমিনাল?

মোহনা প্রতিবাদ করে বলল, না, না হৃদয় কোন ক্রিমিনাল না।

তবে কি কোন বিত্তবানের বখে যাওয়া ছেলে।

মোহনা কোন কথা বলল না।

পুলিশ হৃদয়ের মোবাইল সেটটা মোহনার হাতে দিয়ে বলল, এটা কি হৃদয়ের সেট।

মোহনা বলল, জি।

পুলিশ অফিসার বলল, তবে কি পুলিশ হার্ট টু হার্ট ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব রেইড দেওয়ার সময় হৃদয় তার মোবাইল সেট ছেড়ে পালিয়েছে?

পুলিশ অফিসার মোহনাকে আবার হাজতে ঢুকিয়ে দিল।

এমনসময় একজন পুলিশের একজন কন্সটেবল বলল, ম্যাডাম ওসি স্যার আপনাকে ডাকছে।

সবাই বেরিয়ে গিয়ে আবার হাজতের দরজা বন্ধ করে দিল।

 

বিশ

 

মোহনার বাবারা দু’ভাই। বড় ভাই মোরশেদ ভালো ছাত্র ছিলেন না, তাই তাঁর লেখাপড়া বেশি দূর পর্যন্ত এগোয়নি। তিনি গ্রামে থেকে কৃষিকাজ করার পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমি আর কিছু টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে কয়েকবছরে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। গ্রামে দিগন্ত বিসতৃত জমি, চরফ্যাশন-মনপুরা রুটে তিনটা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার (ইঞ্জিন চালিত নৌকা), ভোলোা-চরফ্যাশন রুটে পাঁচটা বাস চলাচল করে এবং ভোলোা শহরে একটা বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। মোরশেদ সাহেব এর এক মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন একজন স্প্যাশালিস্ট ডাক্তারের সঙ্গে, ছেলেটি ঢাকার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে লেখাপড়া করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করছে। কোনোদিক দিয়েই তাঁর যেন কমতি নাই। বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’হাত উজাড় করে দান করেন, মনপুরা থেকে কোন লোক মামলা মোকদ্দমা কিংবা অন্য কোন কাজে ভোলোা শহরে এলে অনেকেই নিজের মনে করে তার বাসায় রাত্রিযাপন করেন, যে কোন আর্থিক অনটনে তাঁর কাছে হাত বাড়ায়।

গ্রামে মোরশেদ সাহেব এর প্রচুর সুনাম, ভোলোা শহরে বিলাসী জীবন-যাপন করেন, শহরে তাঁর একটা অফিস আছে এই অফিসে বসেই তিনি তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করেন। কখনো মনপুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে আগে একবার আবহাওয়া বার্তা শুনে তারপর প্রাইভেট ট্রলার নিয়ে মনপুরায় যান। মোরশেদ সাহেব মনপুরায় আসার কথা শুনলে এলাকার সব গরীব দুঃখী মানুষ তাঁদের গ্রামের বাড়িতে কিছু পাবার আশায় ভিড় জমান। মোরশেদ সাহেব কাউকে বিমুখ করেন না। তাই মোরশেদ সাহেব এর প্রশংসা যেন সবার মুখে মুখে।

মোরশেদ সাহেব এর চেয়ে মোখলেস সাহেব বছর পাঁচ বছরে ছোট। ছাত্র হিসাবে মোখলেস সাহেব ছিলেন অসাধারণ। ক্লাস ফাইভ এবং ক্লাস এইটে তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। তাঁদের গ্রামের বাড়িটা ছিল উপজেলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে, দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রামে। সেখান থেকে উপজেলা সদর অনেকদূর, তাই ছোটবেলা থেকেই ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য উপজেলা সদরে একটা ম্যাসে থেকে মোখলেস সাহেব লেখাপড়া করেন।

কয়েক বছর থেকে স্কুলের রেজাল্ট বরাবরই খারাপ হচ্ছিল। তাই শিক্ষকদের সে বছরের ভরসা ছিল মোখলেস সাহেবের ওপর। মোখলেস সাহেব স্যারদের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন। তিনি স্টার মার্ক পেয়ে এস.এস.সি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন।

যেদিন এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয় সেদিন শুধু উপজেলা সদর হাজিরহাট নয়, দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাংলাবাজার পর্যন্ত যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।

সবাই গর্ব করে বলতো, আমাদের মোখলেস একদিন আমাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে।

সত্যি সত্যি মোখলেস সাহেব গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন।

এস.এস.সি পাসের পর নটরডেম কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পরপরই তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।

সরকারি চাকরিতে যোগদান করে মোখলেস সাহেব যেদিন প্রথম গ্রামে ফিরেছিলেন সেদিন এলাকার সবাই খুব খুশি হয়েছিলেন, মোখলেস সাহেবের সফলতায় সবাই গর্ববোধ করতেন।

মোখলেস সাহেবের পোস্টিং যখন বরিশালে তখন মোহসিনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রণয়, তারপর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। মোখলেস সাহেবের বাবা ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করায় তিনি মোরশেদ সাহেবকে বিয়ের তাঁর বিয়ের প্রন্তাব নিয়ে তাঁর হবু শ্বশুরবাড়ি যাবার অনুরোধ করেন। কিন্তু মোরশেদ সাহেব তাঁর শ্যালিকাকে বিয়ে করার জন্য প্রন্তাব দেন। মোখলেস সাহেব তাঁর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়।

মোহনা তখন খুব ছোট ছিল, তখন প্রতি বছর রমজান মাসে তাদের গ্রামের বাড়িতে তার দাদা-দাদির রুহের মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ হতো।

মোরশেদ সাহেব আর মোখলেস সাহেব আলোচনায় বসেছিলেন। মোরশেদ সাহেব আগত সম্ভাব্য অতিথি, প্রতিবেশী এবং গরীব দুঃখী মানুষের একটা তালিকা করেছিলেন।

তালিকা বড় দেখে মোখলেস সাহেব বলেছিলেন, ভাইজান লিস্টটা একটু ছোট করলে হতো না?

মোরশেদ সাহেব গম্ভীর মুখ তুলে বলেছিলেন, মোখলেস তোর সমস্যা থাকলে তোকে কিছু দিতে হবে না। আমিই সব টাকা দিব, তুই শুধু আপ্যায়নের সঙ্গে থাকবি।

মোরশেদ সাহেবের স্ত্রী বলেছিলেন, তা হবে কেন? তুমি যত টাকা দিবে মোখলেসকেও তত টাকা দিতে হবে।

লজ্জায় আর ক্ষোভে মোখলেস সাহেবের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল।

মোরশেদ সাহেব তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নত করেছিলেন।

সেদিনের বাবার অসহায় মুখচ্ছবিটা প্রায়ই মোহনার চোখের সামনে ভেসে উঠত।

তারপর থেকে মোখলেস সাহেব আর কোনদিন তাঁদের গ্রামের বাড়ি যাননি।

মোখলেস সাহেব স্বপ্নবিলাসী মানুষ। মোহনা তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তার বাবাকে বলতে শুনেছে, আমাদের মোহনা একদিন বড় হবে, অনেক বড় অফিসার হবে।

শুধু মোহনাকে নিয়ে নয়, মোখলেস সাহেব মিলনকে নিয়েও বড় বড় স্বপ্ন দেখতেন।

মিলনকেও তিনি প্রায়ই বলতেন, ভালোভাবে লেখাপড়া কর বাবা একদিন বড় অফিসার হবে।

মোহসিনা বলতেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে দু’জনেই তোমার মতো হয়েছে। দু’জনে খুব ব্রিলিয়ান্ট হবে।

তারপর মোহনা যখন গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে এস.এস.সি পাস করল তখন মোখলেস সাহেব বললেন, দেখতে হবে না মেয়েটা কার? আমার ছিল এস.এস.সি’তে স্টার, এইচ.এস.সি’তে স্টার, অনার্স মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস।

আজ অনেকদিন পর মোহনার মনের মধ্যে তার বাবার মুখে শোনা এবং শৈশব থেকে দেখা কথাগুলো যেন ভেসে উঠল।

তার বাবার প্রতি মোহনার মনটা ঘৃণায় ভরে গেল সে আপন মনে বলল, বাবা তুমি কি এতদিন আমাদের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছ? তোমার সব কথা সত্য হলে এস.এস.সি’তে স্টার, এইচ.এস.সি’তে স্টার, অনার্স মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করা একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, সৎ কর্মকর্তার মেয়েকে লেখাপড়ার খরচ মিটানোর জন্য অনৈতিক উপায়ে টাকা রোজগার করতে হবে কেন?

হাজতের গেট খুলে একজন মহিলা কন্সটেবল ডাক দিল, আসুন, স্যার আপনাকে ডাকছেন।

মোহনা শুধুমাত্র চোখ দু’টা বাদে ভালোভাবে মাথা এবং মুখ ঢেকে বের হলো।

মোহনা নেম প্লেটে দেখলো সিরাজ নাম লিখা।

মোহনা সালাম দিল।

সিরাজ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বলল, বস।

মোহনা চেয়ারে বসল।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি মোহনা?

জি স্যার।

তোমার বাবার নাম?

মোহনা তার বাবার নাম বলল।

কি করেন তিনি?

মোহনা কিছুটা ঘৃণার স্বরে বলল, আমার বাবা একজন গভর্নমেন্ট অফিসার।

তোমার বাবা একজন গভর্নমেন্ট অফিসার আর তুমি এমন ঘৃণ্য কাজে জড়িয়ে পড়লে?

এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না স্যার।

উপায় ছিল না মানে?

আমি কোনো মিথ্যা কথা বলিনি স্যার।

কাল যখন পেপারে উঠবে হার্ট টু হার্ট ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবে পুলিশের অভিযানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মোহনা গ্রেফতার।

মোহনা ঘৃণার সুরে বলল, শুধু আমার পরিচয় উঠবে? আমি যে একজন গভর্নমেন্ট অফিসারের মেয়ে সেটা উঠবে না?

গভর্নমেন্ট অফিসারদের প্রতি তোমার এত ঘৃণা কেন?

মোহনা তার জীবনের সমন্ত ঘটনা খুলে বলল, হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয় এবং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার কথা বলল। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ঘৃণাটা শুধু আমার বাবার ওপর নয় স্যার। আমার ঘৃণা সমন্ত সিস্টেমের ওপর। যে সিস্টেম একজন মেধাবী ছাত্র, একজন অনেস্ট গভর্নমেন্ট অফিসারকে তাঁর দু’টি সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সামর্থ্য দেয় না। যে সিস্টেমের কারণে একজন গভর্নমেন্ট অফিসারের মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করার জন্য মিথ্যা চাকরির অজুহাতে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য হতে হয়।

মোহনা কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে রইল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, আপনি বলুন স্যার আমার বাবা একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। ন্যূনতম ভরণ-পোষণ এবং স্ত্রী সন্তান নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবন-যাপনের জন্য সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছিল। আমার বাবাকে আমি কোনদিন মিথ্যা কথা বলতে শুনিনি, কোনদিন অবৈধ উপায়ে টাকা রোজগার করতে দেখিনি, আমার বাবাকে কোনদিন টাকার পাহাড় গড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখিনি। আমার বাবার স্বপ্ন আমাদের দু’ভাই-বোনকে লেখাপড়া করা কিন্তু তার চাকরির টাকা দিয়ে আমাদের দু’ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ মেটানোই সম্ভব হয় না। একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, একজন অনেস্ট অফিসারকে সোসাইটি কি দিল স্যার?

সিরাজ সাহেব মাথা নত করে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, তোমার কাছে হৃদয়ের কোন মোবাইল নাম্বার আছে?

হৃদয়ের কোন দোষ নাই স্যার, হৃদয় বখে যাওয়া ধনীর দুলালী। আমি ওকে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছি। আপনার ওর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিবেন না প্লিজ।

হৃদয় তোমাকে নিয়ে যায়নি?

না আমি স্বেচ্ছায় হৃদয়ের সঙ্গে গেছি, যদি কোন অপরাধ হয়ে থাকে তবে আমাকে শান্তি দিন স্যার, হৃদয়কে আপনারা কিছু বলবেন না।

সিরাজ সাহেব একটা কাগজে মোহনার নাম, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার লিখে নিলেন।

মোহনা আর্তনাদের কণ্ঠে বলল, আমি বাঁচতে চাই স্যার, আমার নাম যদি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায় তবে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না স্যার।

সিরাজ সাহেব আবার চোখ মুছলেন।

আর দু’মাস পর আমার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা স্যার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আমি এতদূর এসেছি স্যার। প্লিজ আমাকে বাঁচতে দিন স্যার।

তুমি সবকিছু পাবে, তবে শর্ত আছে।

আমি আপনার যে কোন শর্ত মানতে রাজি আছি স্যার, আপনি বলুন।

তুমি আর কোনদিন হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না, সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিষেধ করবে তারপরও তোমাকে বিরক্ত করলে আমাকে জানাবে। এই নাও আমার কার্ড, বলে সিরাজ সাহেব তাঁর একটা কার্ড মোহনাকে দিলেন।

মোহনা মাথা নত করে বসে রইল।

সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি রাজি?

রাজি স্যার।

সিরাজ সাহেব বললেন, তুমি আমার অনুমতি ছাড়া ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না।

মোহনা একবার মাথা উঁচু করে আবার মাথা নত করে বলল, যাব না স্যার।

সিরাজ সাহেব কলিং বেল টিপতেই একজন স্যান্ট্রি সামনে এসে দাঁড়ালো, স্যার।

তুমি এখন যাও, মহিলা হাজতে আরো মহিলা আছে তুমি কাউকে কিছু বলবে না।

 

একুশ

 

সিরাজ সাহেব বাসায় ফিরেছেন তখন রাত তিনটা বাজে।

সুলতানা তখনই সিরাজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মেয়েটার কি অবস্থা?

সিরাজ সাহেব বলেছিলেন, আপাতত কোন সমস্যা নাই।

সকালবেলা নাস্তার টেবিলে সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, আসলে কি হয়েছিল বলতো?

সিরাজ সাহেব সবকিছু খুলে বললেন।

শুনে সুলতানা মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন, আসলে আজকালকার মেয়েরা কি যে করে? জানা নাই শোনা নাই যার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, ঘুরে বেড়ায়।

সিরাজ সাহেব কিছু বললেন না।

সুলতানা আবার বলতে শুরু করলেন, আর মেয়ের গার্ডিয়ানই বা কেমন? এক ছেলে এক মেয়ে তাতেই ঠিক মতো খরচ দিতে পারে না।

সিরাজ সাহেব মুখ তুলে বললেন, সুলতানা আসলে এটাই বান্তবতা, জীবিকার জন্য যাদের মাসের ত্রিশ তারিখে বেতনের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাদের পক্ষে দু’জন ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ার টাকা জোগান দেওয়া অসম্ভব।

মেয়ের বাপের কথাও তো বললে ভালো চাকরি করে, আমার তো মনে হয় উপরতি কিছু ইনকামের সুযোগও আছে।

সুযোগ আছে, সুযোগ থাকলেই যে সবাই ব্যবহার করবে এমন তো না।

সুযোগ থেকেও ব্যবহার করবে না সততা দেখাবে আর মেয়ে টাকার জন্য অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়বে।

সুলতানা মেয়ের বাবা তো জানে না যে তার মেয়ে টাকার জন্য অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি তো জানেন তাঁর মেয়ে একটা পার্ট টাইম জব করছে।

আর মেয়েটা মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে?

সুলতানা আসলে মোহনার কাছে সবকিছু শুনে অনেকদিন পর আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়েছিল। যখন মোহনা কাকুতি করে বলেছিল, আর দু’মাস পর আমার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা স্যার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আমি এতদূর এসেছি। প্লিজ আমাকে বাঁচতে দিন স্যার।

তখন আমার মনে হয়েছিল ও যেন আমার মেয়ে, আমার মনে হয়েছিল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, তোমাকে আর কোনদিন কারো কাছে বিলিয়ে দিতে হবে না। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে তোমার লেখাপড়ার সব খরচ আমি দিব।

তবে বললে না কেন?

আমি বলিনি, আইনের পোশাক পরে আসলে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না। তাই আমি ওকে এমনভাবে ব্রিফ করেছি যেন সে লজ্জা কিংবা ক্ষোভে কোন অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে কিংবা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়িতে চলে না যায়।

তুমি যখন চাচ্ছ তখন বাকী কাজটুকু না হয় আমি করব।

তুমি কি করবে?

আমি নীলাকে বলে সবকিছু ম্যানেজ করব।

সিরাজ সাহেব নান্তা শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন, তুমি তাহলে নীলার সঙ্গে কথা বলে মেয়েটার লেখাপড়া শেষ করতে যা টাকা-পয়সা লাগে দিও।

আচ্ছা ঠিক আছে।

হল-এ ঢুকে মোহনা নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, নীলা মোহনার মুখের দিকে তাকালো।

একদিনেই তার অবস্থা এমন হয়েছে যেন চেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার চুল এলোমেলো, মুখ শুকনা যেন এক ঝড় পেরিয়ে আসা পাখির মতো। নীলা কোনোভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিল।

নীলা মোহনার পাশে বসল।

মোহনা কান্নাভাঙ্গা গলায় বলতে শুরু করছিল।

নীলা থামিয়ে দিয়ে বলল, মোহনা আমি জানি।

কি জানিস?

সব জানি।

সব জানি মানে? গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা জানিস?

হ্যাঁ।

মোহনা চোখের পানি মুছে বলল, কীভাবে?

মামির কাছে শুনেছি।

মোহনার মুখ শুকিয়ে গেল, নীলা ব্যাপারটা তাহলে সবাই জেনে গেছে?

আরে না সবাই জানবে কেন? আমার মামা আছে না, মানে বৃষ্টি মামা, আকাশের বাবা তো পুলিশের ওসি সিরাজ সাহেব। তুই যখন আমাকে মোবাইল করলি তখন আমি মামিকে মোবাইল করে বললাম। মামি তো মামাকে বলে তোকে ছাড়িয়ে দিল।

নীলা মোহনার চোখ মুছে দিয়ে বলল, তোর ওপর আমার অনেক রাগ আছে মোহনা।

মোহনা মাথা নত করে বসে রইল।

নীলা বলল, মোহনা মনের মধ্যে এত কষ্ট পুষে রেখে তুই হাসিমুখে দিনের পর দিন কাটিয়েছিস, কোনদিন আমাকে তোর কষ্টের কথা জানতেও দিসনি। এতদিন জানতাম তুই সব সময় হাসি খুশি থাকিস, তোর মনের মধ্যে কোন কষ্টই নাই, তুই আসলে চরম দুঃখী এক মেয়ে। এক বুক কষ্ট নিয়ে বন্ধুত্ব করার কথা বলে, নিজেকে তিলে তিলে বিলিয়ে দিয়ে হাসি মুখে কষ্ট ভুলে থাকার অভিনয় করেছিস, আমাকে কিছু বলিসনি। অথচ তুই সব সময় বলতিস্‌ আমি তোর রুমমেট। তুই নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছিস।

মোহনা কোন কথা বলল না।

নীলা আবার বলতে শুরু করল, ভাগ্য ভালো যে আমাকে মোবাইল করার সুযোগ পেয়েছিলি না হলে হয়ত ব্যাপারটা লুকানো যেত না।

মোহনা বলল, নীলা আমি বাড়ি যাব।

নীলা মুচকি হেসে বলল, তোর কি ঢাকার বাইরে যাবার অনুমতি আছে?

মোহনা মাথা বাঁকিয়ে জানাল তার ঢাকার বাইরে যাবার অনুমতি নাই।

আচ্ছা তুই কিচ্ছু ভাবিস না, তুই তো এখন পুলিশ অফিসার সিরাজ সাহেবের মেয়ে।

মোহনার মেঘাচ্ছন্ন মুখে এক খণ্ড আলোর আভা ফুটে উঠল, তুই কি বললি?

হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি।

কিন্তু পরক্ষণেই মুখ কালো হয়ে গেল, শেষ পর্যন্ত একজনের আশ্রিতা হওয়া!

নীলা বলল, আর কিচ্ছু ভাবিস না তো, চল আমার খুব খিধে পেয়েছে।

মোহনা মনে মনে বলল, তবুও একজনের পণ্য হওয়ার চেয়ে তো ভালো।

নীলা মোহনাকে ধাক্কা দিল, এই মোহনা?

মোহনা চমকে উঠল, কি রে?

চল ক্যান্টিন থেকে নান্তা খেয়ে আসি।

মোহনার মনে হলো সমন্ত পৃথিবীর মানুষ যেন তাকে চিনে ফেলছে, তাকে ব্যঙ্গ করছে, আঙ্গুল তুলে বলছে তুমি একটা নষ্ট মেয়ে। অনৈতিক কাজে জড়িত অবস্থায় হার্ট টুৃ হার্ট ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব থেকে পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করেছে।

কি রে আনমনা কেন?

মোহনা হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, না রে আমি নীচে যাব না।

নীলার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

সে রিসিভ করে বলল, হ্যালো মামি।

নীলা মোহনা ফিরেছে মা।

জি মামি।

আমাকে একটু দিবে কথা বলতাম, আগে শোন যদি কথা বলতে না চায় তবে থাক।

মামি আমি জিজ্ঞেস করি।

মোহনা মামি তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন, কথা বলবি।

মোহনা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, মামি।

 

বাইশ

 

আকাশের বি.বি.এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। কিন্তু তার মা-বাবাকে এম.বি.এ ভর্তির ব্যাপারে কিছু বলছে না। বরং সুলতানা বুঝতে পেরেছে আকাশ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা করছে।

একদিন সুলতানা আকাশকে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে তোর লক্ষণ দেখে তো মনে হচ্ছে চাকরির ধান্দা করছিস?

মা তুমি ঠিকই ধরেছ।

এম.বি.এ পড়বি না?

না।

কেন?

মা তোমরা না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি বাবা যে টাকা সংসার খরচ করেন তা বাবার বেতনের চেয়ে অনেক বেশি। আগে জানতাম না সেদিন আমাদের ভার্সিটিতে একটা অনুষ্ঠানে অ্যাটেন্ড করে আমার চোখ খুলে গেছে। একজন বক্তা তার বক্তৃতায় যে কথাগুলো বলেছেন আমি সেগুলো হুবহু ডায়েরিতে লিখে নিয়েছি এখন তোমাকে শোনাচ্ছি, শোন, তিনি তার আগের বক্তার বক্ততার রেফারেন্স টেনে বলছিলেন, আমার আগের বক্তা খুব সুন্দর করে দুর্নীতি দমনে সমাজিক সচেতনতার কথা উল্লেখ করেছেন। তার বক্তৃতার সঙ্গে আমি একমত হয়ে বলতে চাই, দুর্নীতি দমনের জন্য যেমন আইন প্রণয়ন, আইনের কঠোর প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন যারা দুর্নীতি করছে তাদের দুর্নীতি করার কারণ খুঁজে দেখা। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ উচ্চাভিলাষী, যারা দুর্নীতি করে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হতে চান, প্রথমতঃ তাদের সামাজিকভাবে ঘৃণা করা উচিত, তাদেরকে সমাজ থেকে বয়কট করা উচিত। তাদের জন্য আইনের প্রয়োগ কঠোর করা উচিত। আরেক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আছে যাদের বলা যায় চুনোপুঁটি দুর্নীতিবাজ। তারা এরকম বাধ্য হয়ে দুর্নীতি করছে। আপনারা অনেকেই হয়ত আমার সঙ্গে একমত হবেন না কিন্তু এটাই বান্তবতা। আমাদের দেশে একজন সরকারি চাকরিজীবীকে যা বেতন দেয়া হয় তা তাদের জীবন যাত্রার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। তাই সংসার চালানোর প্রয়োজনে, সামাজিকভাবে বসবাস করার জন্য তারা দুর্নীতি করতে বাধ্য হয়। আমরা যদি ধরি একজন সরকারি চাকরিজীবীর কথা শুধুমাত্র বেতনের টাকা দিয়ে তাদের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব কি না? গত কয়েকদিন আগে একটা পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর এর জীবন যাত্রার সঙ্গে তার বেতনের অসামঞ্জস্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমি এখন সেই নিউজটা পড়ছি। পুলিশ ইন্সপেক্টরের ছদ্মনাম দেয়া হয়েছে এন. হক। স্ত্রী, দুই কন্যা ও কাজের বুয়া নিয়ে ৫ জনের সংসার। বাসা ঢাকার খিলগাঁয়ে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ বাসাভাড়া আট হাজার টাকা। দু’কন্যার স্কুল ও কলেজে যাতায়াতসহ যাবতীয় খরচ ৬ হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াতসহ নিজের হাত খরচ মাসে প্রায় ১৫’শ টাকা। তিনি তার বাসার অন্য যে মাসিক খরচ তুলে ধরেন সেটি হচ্ছে চাল ৪৫ কেজি দাম ৯শ টাকা, আটা বা ময়দা ১১কেজি ৪শ টাকা। শাকসবজি, পিঁয়াজ, মরিচ, ডাল, আলু ও চিনি জাতীয় ভোগ্যপণ্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১শ করে মাসে লাগে ৩হাজার টাকা। মাছ, মাংস, ডিম ও শুঁটকিতে প্রতিদিন গড়ে খরচ ৫০ এবং মাসে ১৫শ টাকা। তেল, সাবান, কাপড় ধোলাই জাতীয় খরচ প্রতিদিন ৩০ টাকা হিসেবে মাসে ৯শ টাকা। ওষুধ, চিকিৎসা ও ডিশ সংযোগ, সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন নিমন্ত্রণ ও আত্মীয়স্বজনের যাতায়াতে প্রতি মাসে গড়ে খরচ হয় আরো ২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসের সর্বনিম্ন খরচের গড় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। অধিকাংশ মাসেই এর চেয়ে বেশি খরচ হয়। দুই ঈদ, কুরবানি ও পহেলা বৈশাখ, সন্তানদের জন্মদিন জাতীয় ঘরোয়া অনুষ্ঠানাদির খরচ এ হিসাবে নাই। এগুলো হিসেবে ধরা হলে বছরে আরো ৫০হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এতে প্রতি মাসের বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ৩০হাজারে। গত ৩২ বছরেরও বেশি সময় পুলিশে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৬ বছরই কেটেছে ইন্সটেক্টর পদে। দ্বিতীয় শ্রেণীর স্কেলে দীর্ঘমেয়াদের কল্যাণে সকল সুবিধাদিসহ বর্তমানে তিনি পান ১৪হাজার টাকার মতো। সংসার চালানোর বাকী টাকার জন্য অবৈধ পন’ার মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া তার আর কোন পথ নাই। রাজারবাগ রায়ট পুলিশের কন্সটেবল আতিক (ছদ্ম নাম)। ২ হাজার ৮৫০ টাকা স্কেলে বেতন ৪ হাজার ১১২ টাকা। চুলকাটা, ধোপা, ডি.এম.পি কাটিং ও মেসে দুই বেলা খাওয়ায় রেশনের অতিরিক্ত খরচ কেটে নেয়ার পর হাতে পৌঁছে ৩ হাজার ৪শ টাকা। মেসে সকালে একটা রুটি ও একটু ভাজি খেতে দেয়। এতে পেটের ক্ষুধা মিটে না। এজন্য বাইরেই নান্তা করতে হয়। রায়ট পুলিশ হিসেবে সারাদিন রান্তায় ডিউটি থাকে। সকালের নান্তা-চা-বিস্কুট ইত্যাদি বাবদ প্রতিদিন খরচ হয় ৬০/৭০ টাকা। বাকী যা থাকে এতে পরিবারকে কাছে রাখার চিন্তা করার সুযোগ নাই। বাড়ি সিরাজগঞ্জ, মা-বাবা ও দুই বোনের সংসার। বোনেরা এখনো পড়াশুনা করে, পিতা কৃষক। বোনদের পড়াশুনা ও পরিবারের অন্যান্য খরচ চালাতে টাকা পাঠানোর ক্ষমতা নাই তার। সংসার, বেতন, চাকরি, অভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা তার নিত্যসঙ্গী। বয়স হলেও বিয়ে করবেন এ চিন্তা এখনো মাথায়ই আসে না। এ চাকরির কারণে বিয়ের আগেই পরিবারের সঙ্গে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। রায়ট পুলিশে পোস্টিং হওয়ায় অন্য পথে দু’চার পয়সা রোজগার হবে সে সুযোগও নাই। এজন্য ভবিষ্যৎ চিন্তায় সবসময়ই মন খারাপ থাকে। শুধু যে পুলিশের এ দুরবস্থা এমন নয়। সাধারণ সরকারি চাকরির প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার স্কেল ৬হাজার ৮শ টাকা। বাসাভাড়া ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে পান ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে সচিব হলে সর্বোচ্চ বেতন পান সর্বসাকুল্যে ২৩ হাজার টাকা। বাংলাদেশে এখন একজনও জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি সেক্রেটারি নাই যিনি ২০ হাজার টাকা বেতন পান। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর বেতন সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকা এবং একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ২ হাজার ৪শ টাকার স্কেলে পেয়ে থাকেন সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এই চার শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে বর্তমান বেতনে সংসার পরিচালনা করা অসম্ভব। এ অবস্থায় দুর্নীতি বিরোধী কঠোর অভিযানও দুর্নীতি ঠেকাতে পারবে এমনটা কেউ মনে করেন না। বেতন কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে কর্মচারীদের প্রতি দুর্নীতিমুক্ত থাকার আহবান অনেকেই হাস্যকর মনে করেন। এছাড়া সিভিল সার্ভিসের ক্ষেত্রে রেশনিংয়ের কোন সিস্টেমও নাই। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে রেশনিং সিস্টেম রয়েছে। তবে পুলিশে রয়েছে শুধুমাত্র ইন্সপেক্টরের ওপরের পদের ক্ষেত্রে। সরকারি চাকরিজীবীরা জানান, জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান বেড়েছে বহুগুণ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের রেমিটেন্সের কারণে মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে অনেক বেশি। এ কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অনেক সময় পণ্যের জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলেও মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। দৈনন্দিন ব্যয়, বাস-ট্যাঙি ও রিকশা ভাড়া বৃদ্ধি, সন্তানদের স্কুল খরচসহ পড়াশুনা ব্যয়, পোশাক আশাক, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সকল ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিনই পরিসি’তি পাল্টে যায়। এসব হিসেব করলে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার যে কোন একটি ছোট পরিবারের পক্ষে এখন ৩০ হাজার টাকার কমে সংসার চালানোর সুযোগ নেই। অথচ প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার বেতন তার এক তৃতীয়াংশ মাত্র।

হয়েছে তোকে আর বলতে হবে না। এতই যদি বুঝিস তবে জিজ্ঞেস করছিস কেন?

কিন্তু তাই বলে বাবা ঘুষ খাবে!

তাতে তোর কি যায় আসে? যার পাপ সে বুঝবে।

আমার অনেক কিছু যায় আসে মা।

যেমন।

যেমন বাবা অবৈধভাবে ইনকাম করে আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে আর আমি বাবার অবৈধ টাকায় লেখাপড়া করব তা হয় না মা।

তাই বলে বি.বি.এ করেই লেখাপড়া শেষ করবি?

হ্যাঁ।

তোর বাবা কি তোর প্লানের কথা জানে?

না, তোমাকে বললাম, তুমি বাবাকে বলিও।

সুলতানা কিছু বললেন না।

আকাশ বলল, মা আরো কথা আছে।

কি কথা?

আমার কোথাও চাকরি হয়ে গেলে আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকবো না।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

না মা আমার মাথা খারাপ হয়নি। আমি খুব ভেবে চিন্তে, ঠান্ডা মাথায়, কারো বিনা প্ররোচনায়, সুস্‌ মন্তিস্কে বলছি।

সুলতানা আর কথা বাড়ালেন না।

তিনি রাতে সিরাজ সাহেবকে সবকিছু বললেন।

সবকিছু শুনে সিরাজ সাহেব কিছু বললেন না।

সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু বলছ না যে?

কি বলব?

ও বলল আর হয়ে গেল। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন দাম নাই। চাকরি করবে ভালো কথা তাই বলে আমাদের ছেড়ে যাবে? তুমি এক কাজ কর ওর সঙ্গে কথা বলে ওর বিয়ের ব্যবস্থা কর।

আচ্ছা।

কি আচ্ছা? তুমি তো সব কিছু পাশ কাটিয়ে যাও। এটা কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাবার মতো বিষয় না।

সুলতানা আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি না, বলে সিরাজ সাহেব একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একবার দেখ তো যদি ও জেগে আছে তবে ডাক দাও আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।

সুলতানা বেরিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর আকাশকে সঙ্গে নিয়ে রুমে ঢুকলেন।

আকাশ একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আমাকে ডেকেছ বাবা?

হ্যাঁ বস।

তুই নাকি এম.বি.এ ভর্তি না হয়ে চাকরি খুঁজছিস?

জি বাবা।

কেন?

সেকথা আমি মাকে বলেছি।

সেটাই কি তোর ফাইনাল ডিসিশন?

জি বাবা।

চাকরি করবি ভালো কথা কিন্তু বাসা ছেড়ে চলে যাবি কেন?

সেটাও আমি মাকে বলছি।

তবে এখন আমাদের কথা শোন।

আকাশ কোন কথা বলল না। মাথা নত করে বসে রইল।

সিরাজ সাহেব বললেন, আমাদের ইচ্ছা ছিল তোর লেখাপড়া শেষ হলে আমরা তোর বিয়ে দিব। তুই তো লেখাপড়া শেষ না করেই চাকরি খুঁজছিস, কাজেই এখন আমাদের দায়িত্ব তোর বিয়ে দেওয়া।

আকাশ কোন কথা বলল না।

সে তার রুমে গিয়ে নীলাকে মোবাইল করল, হ্যালো নীলা।

হ্যাঁ বল।

একটা খুশির খবর আছে।

কি খবর?

না মোবাইলে বলব না, তোমার সঙ্গে দেখা করে বলব, তোমার পরীক্ষা আজ শেষ তো, তাই না?

হ্যাঁ।

আগামীকাল আমি আসছি।

এসো।

বিয়ের খবরে আকাশ খুব খুশি হলো। আজকের রাতটা যেন তার কাছে অনেক দীর্ঘ বলে মনে হলো। কথাই বলে বিরহের রাত সব সময়ই দীর্ঘ হয়। সে আপন মনে নীলাকে নিয়ে ঘর সাজালো। গত কয়েক বছরের প্রেম, ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ হতে আর বেশি দেরি নাই। আকাশের ধারণা ছিল নীলাকে বিয়ে করতে তার অনেক লুকোচুরি করতে হবে। হয়ত তার বাবা-মা কিংবা নীলার বাবা-মা সহজে রাজি হবে না। আকাশ অনেক গল্প শুনেছে অনেক বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের পছন্দকে কখনো মূল্যায়ন করতে চায় না এদিক দিয়ে সে ভাগ্যবান তার বাবার মুখ দিয়েই প্রথম কথাটা বেরিয়েছে।

এখন আর আগে স্লিপ দিতে হয় না। আকাশ আগেই নীলাকে মোবাইল করে জানিয়ে দেয় তারপর টি.এস.সি’র কাছাকাছি গিয়ে একটা মিস্‌ কল দেয়।

আকাশের মোবাইল থেকে মিস্‌ কল পেয়ে নীলা বেরিয়ে আসে।

নীলা আকাশকে দেখে বলল, কি হয়েছে তোমার? চোখ-মুখ লাল কেন? মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাওনি?

আসলে তাই, এমন একটা আনন্দের খবরে কার ঘুম আসে বল? চল আমরা সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে গিয়ে বসি।

দু’জনে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে গিয়ে বসল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, কি সুখবর বল?

বাবাকে তো জানো সংসারের কোন খবরই যেন রাখতে চায় না। শুধু আমার ব্যাপারে বাবা খুব সিরিয়াস। বাবা-মা দু’জনে কি মনে করেছে জানো?

তুমি না বললে জানবো কীভাবে?

আমাকে বিয়ে দিবে।

করে ফেল।

নীলা তুমি খুশি হওনি।

না।

কেন?

আমি ভাবছিলাম তুমি এম.বি.এ করবে, আমিও মাস্টার্স করব। তারপর বিয়ে করব।

হ্যাঁ আমি চাকরি আর এম.বি.এ একসঙ্গে করব।

কিন্তু হঠাৎ করে মামা-মামি তোমার বিয়ের চিন্তা করলেন কেন? তোমার আচরণে কি তারা কোন–

আরে না, আমার আচরণে তারা কি মনে করবে?

তবে?

আকাশ মনে মনে বলল, নীলাকে আসল কথা বলা যাবে না, নীলার বাবা খুব নীতিবান মানুষ, কোনোভাবে যদি নীলাও তার বাবার মতো নীতিবান হয়, সে যদি জানে যে আমার বাবা একজন ডিজঅনেস্ট পুলিশ অফিসার তবে নীলা আমাকে বিয়ে নাও করতে পারে।

কি ভাবছ আকাশ?

দেখ নীলা বাবা আমাকে খুব স্নেহ করে, তোমাকে বলছিলাম না আমি যদি আকাশের চাঁদ চাই আর তা যদি পাওয়া যেত তবে বাবা আমাকে আকাশের চাঁদ এনে দিত।

কিন্তু আমার বাবা তেমন মানুষ না। আমি কোন কিছু চাইলে তা যদি বাবা ভালো মনে না করে তবে আমার জন্য তা করবে না।

আকাশ কোন কথা বলল না।

নীলা বলল, শেষ পর্যন্ত খুশির খবরটা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ হবে না তো?

নীলা তুমি সব সময় শুধু নেগেটিভ চিন্তা কর। বাদ দাও তো দুশ্চিন্তা। চল আমরা আজকের এই আনন্দের দিনটা এনজয় করি।

নীলার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

নীলা মোবাইল রিসিভ করল, আসস্‌ালামুায়ালায়কুম মামি।

অপর পাশ থেকে সুলতানার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো, নীলা।

মামি আপনি ভালো আছেন?

হ্যাঁ মা আমি ভালো আছি, তুমি?

জি মামি ভালো।

মা তুমি কোথায়?

মামি আমি তো ঢাকায়।

তোমার পরীক্ষা শেষ হয়নি?

মামি গতকালকেই পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কাল বাড়ি যাব।

মা তোমার বাবার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবে।

জি মামি, লিখে নিন আমি বলছি।

হ্যাঁ মা বল।

নীলা তার বাবার মোবাইল নাম্বারটা বলল।

 

তেইশ

 

নীলা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসেছে আতিয়ার সাহেবের আনন্দের সীমা নাই। তিনি অফিস থেকে ফিরে নীলা, নীলা বলে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে আসেন। অবসর সময় কাটান মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে। নীলা কি খাবে? সে কি বেশি পছন্দ করে আর কি পছন্দ করে না। নীলার পছন্দ মতো বাজার করে নিয়ে আসেন। সংসারের সবকিছু বিষয় নিয়ে নীলার সঙ্গে শেয়ার করেন।

গতকাল সুলতানা তাঁর ননদের বাড়িতে এসেছেন, আজ শনিবার নীলাদের বাড়িতে আসবেন। সুলতানা আগে কোনদিন নীলাদের বাড়িতে আসেননি আজ কেন তাদের বাড়িতে সুলতানা আসছেন নীলা বুঝতে পেরেছে। তার মনটা আজ খুব ভালো কিন্তু তার বাবার মধ্যে কোন পরিবর্তন নাই, ঠিক বরাবরের মতোই।

সুলতানা এলেন তখন সকাল এগারোটা বাজে, সঙ্গে বৃষ্টিও এসেছে। আজ নীলাদের বাড়িতে সুলাতানা আর বৃষ্টির জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সুলতানা আর আতিয়ার সাহেব অনেকক্ষণ গল্প করলেন। আতিয়ার সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিরাজ সাহেবের চাকরি, ঢাকায় তাদের বিষয়-সম্পত্তি সবকিছু জেনে নিলেন।

দুপুরের খাবারের পর সুলতানা কথা তুললেন, আতিয়ার আমার ছেলে আকাশ স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এবার বি.বি.এ করেছে, আমরা ওর বিয়ে দিব।

বেশ তো আমাকে দাওয়াত দিতে এসেছ বুঝি?

না দাওয়াত দিতে আসিনি আমি মা নীলার সঙ্গে ওর বিয়ের প্রন্তাব নিয়ে এসেছি। ওরা দু’জনে পরস্পরকে খুব ভালোবাসে।

আতিয়ার সাহেব মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন।

সুলতানা আবারও বলতে শুরু করলেন, তুমি তো আকাশকে দেখেছ, ওদের বিয়ে হলে মানাবে ভালো।

হ্যাঁ তোমার ছেলে তো লাখে একটা, বিত্তবান বাবার একমাত্র সন্তান। তোমার ছেলের জন্য তুমি আরো বড় ঘরের শিক্ষিত, নীলার চেয়ে অনেক সুন্দর মেয়ে পাবে। তুমি যে আমার মেয়েকে ঘরের বউ করার জন্য বিয়ের প্রন্তাব নিয়ে এসেছ এটাও আমার মেয়ের ভাগ্য।

সুলতানার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, না, না তা হবে কেন? নীলাও তো খুব সুন্দর, শিক্ষিত মেয়ে আর তুমি বা কম কিসে?

কিন্তু সুলতানা আকাশের জন্য তোমরা নীলার চেয়ে ভালো মেয়ে পাবে।

সে কথা কেন আতিয়ার? নীলা আর আকাশ ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। ওদের দু’জনের বিয়ে হলে মানাবে ভালো, আজকাল তো আর ছেলেমেয়েদের মতামতকে উপেক্ষা করে বিয়ে দেওয়ার দিন নাই।

তা নাই, আমিও ওদের মতামতকে রেসপেক্ট করি তবে আকাশের সঙ্গে নীলার বিয়েতে আমার সম্মতি নাই।

সুলতানা আঁতকে উঠলেন, মানে?

মানে এ বিয়ে সম্ভব না।

কেন?

সুলতানা তুমি আগে থেকেই জানো আমি একটু ভিন্ন টাইপের মানুষ, তুমি হয়ত আমাকে আনসোশ্যাল বলবে কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই। দোষটা আসলে আকাশের না, তার মা-বাবার।

কি দোষ আমাদের?

সুলতানা সিরাজ সাহেব একজন পুলিশের ইন্সপেক্টর, দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী তাঁর বেতন সর্বচ্চ্যে পনেরো হাজার টাকা। পনেরো হাজার টাকা বেতনের চাকরিজীবী হয়ে তোমরা ঢাকা শহরে প্লট, গাড়ি-বাড়ি এবং প্রচুর ব্যাংক ব্যালেন্স করেছ। সিরাজ সাহেবের বেতনের সঙ্গে তাঁর প্রোপ্রাটির হিসাব করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে তিনি কতবড় দুর্নীতিবাজ?

হ্যাঁ তা তো তুমি বলবে, সবার মতো তুমিও বলবে সিরাজ দুর্নীতিবাজ কিন্তু সিরাজ কেন দুর্নীতি করেছিল তা কি একবার ভেবেছ? সিরাজ একজন সৎ পুলিশ অফিসার হিসাবে পুলিশে জয়েন করেছিল। সৎ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি।

আমিও তো চাকরি করি, আমি তো সৎ থাকার চেষ্টা করে ফেইল করলাম না।

তোমার ব্যাপারটা আসলে আলাদা তোমার অবস্থা দিয়ে সব চাকরিজীবীদের কনসিডার করলে হবে না।

কেন? আমি আবার আলাদা কেন?

কারণ প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি কর, বেতন অনেক। অফিসের কাজে কোথাও গেলে পর্যাপ্ত টি.এ, ডি.এ পাবার ব্যবস্থা আছে। তোমার বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালানো, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বহন এবং সামাজিকভাবে বসবাস করা সম্ভব। তাছাড়া তুমি নিজের গ্রামের বাড়িতে থাক, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, চাল-ডাল অনেক কিছুই কিনতে হয় না। কিন্তু যাদের শুধু মাত্র বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয় বেতনের ফোরটি পার্সেন্ট হাউজ রেন্ট দিতে হয়, সরকারিভাবে যা চিকিৎসা ভাতা তা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একবারের ভিজিট দিতে হয়, সর্দি, জ্বর, মাথা ব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসা করতে চিকিৎসা ভাতার টাকা শেষ হয়ে যায়। যাদের দু’জন ছেলে-মেয়েকে কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে পড়াতে হয়, তাদের কথা একবার ভেবে দেখ। তুমি ব্যাংকে চাকরি কর এ হিসাবটা তুমি খুব ভালো করতে পারবে হয়ত তুমি বুঝতে পারবে কিন্তু মানবে না কারণ আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই চিনি তুমি মুখ থেকে যেটা একবার বলে ফেল সেখান থেকে আর ফিরে আস না।

এসব তোমার দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাওয়া। সুলতানা তুমি যা-ই মনে কর না কেন, একজন অপরাধীর ছেলের সঙ্গে আমি নীলার বিয়ে দিব না।

সুলতানা বললেন, আতিয়ার আমরা অপরাধী, কিন্তু আমাদের আকাশ বা নীলা কেন আমাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করবে?

সুলতানা ওদের বিয়ে না হলে আকাশ যেমন কষ্ট পাবে আমার মেয়ে নীলাও তেমনি কষ্ট পাবে, এটা সাময়িক কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে বংশ বুনিয়াদ না দেখে তো বিয়ে দেয়া যায় না।

আমাদের কি বংশ বুনিয়াদ খারাপ?

অবশ্যই খারাপ, মানুষকে সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যারা মানুষকে শোষণ করে, থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে রিমান্ডের নামে চোখ বেঁধে বর্বর নির্যাতন করে, মানুষকে বিপদে ফেলে যারা যারা টাকা আদায় করে, ফাইল আটকিয়ে যারা টাকা আদায় করে তারা তো খারাপই, তারা প্রতারক, সমাজবিরোধী, তারা সকলের কাছ থেকে শুধু ঘৃণা পাবার যোগ্য, তাদের সঙ্গে শুধু আমার না কারোই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত না। প্লিজ সুলতানা তুমি এ ব্যাপারে আমাকে আর রিকোয়েস্ট কর না।

সুলতানা আর কিছু বললেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

নীলা আর বৃষ্টি এতক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। নীলার বুক ফেটে গেল তার দু’চোখ দিয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

নীলা রুদ্ধকণ্ঠে ডাক দিল, মামি।

সুলতানা নীলার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, থাক মা, আসি।

সুলতানা আর বৃষ্টি বেরিয়ে গেল। নীলা তার বাবার কাছে গিয়ে তার পাশে বসে রুদ্ধ কণ্ঠে ডাক দিল, বাবা।

বস মা, তোকে একটা গল্প শুনাই।

নীলা কিছু বলল না।

তার বাবার বাহুতে মাথা রেখে বসে রইল।

আতিয়ার সাহেব নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোকে একটা গল্প বলি শোন, কোঠা ঘরে উইপোকা তো তুই চিনিস, আগের দিনে উইপোকা মারার ঔষধ পাওয়া যেত না, তাই কারো কোঠা ঘরে উইপোকা ধরলে তিন পুরের তিনজন সুদখোরের নাম লিখে কোঠার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখত, তাদের ধারণা ছিল সুদ দেওয়া খুব ঘৃণার কাজ, শুধু মানুষ কেন পোকামাকড় পর্যন্ত তাদের ঘৃণা করে তাই সুদখোরকে ঘৃণা করে উইপোকা চলে যাবে, বলে আতিয়ার সাহেব নীলার দিকে তাকালেন, কি রে মা কথা বলছিস না কেন?

শুনছি বাবা।

আতিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তিনপুর কি বুঝতে পাচ্ছিস্‌?

নীলা মাথা বাঁকিয়ে জানালো সে বুঝতে পারেনি।

আতিয়ার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, তিনপুর মানে হলো তিন গ্রাম, যে সমন্ত গ্রামের নামের শেষে পুর আছে যেমন : তিলকপুর, চন্ডিপুর, মির্জাপুর ইত্যাদি। এখন বুঝতে পাচ্ছিস্‌ সুদ নেওয়া কত খারাপ কাজ? ঘুষ তো আরো বেশি খারাপ। আমাদের দেশে যে সুদের প্রচলন আছে তা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক তাই সুদ শুধুমাত্র ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস’ করে আর ঘুষ গোটা জাতিকে ক্ষতিগ্রস্‌ করে।

নীলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আতিয়ার সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি রে? কথা বলছিস না কেন?

বাবা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

বল।

বাবা স্টুডেন্ট লাইফে সুলতানা মামির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি রকম ছিল?

কি রকম ছিল মানে?

বাবা আমার মনে হয় আমি কি বলতে চাচ্ছি তুমি তা বুঝতে পেরেছ?

তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস্‌ সুলতানার সঙ্গে আমার কোন প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক ছিল কি না?

নীলা কিছু না বলে মাথা নত করে বসে রইল।

আতিয়ার সাহেব বলতে শুরু করলেন, সুলতানার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় রাজশাহী ভার্সিটিতে লেখাপড়া করার সময়। ওর গ্রামের বাড়ি নজিপুরে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল আর মোবাইলও তো ছিল না। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আমরা একসঙ্গে আসতাম আবার আমরা কোনদিন যাব তাও আসার দিনই প্রোগ্রাম হতো। ঠিক যে বাসে আমার যাবার কথা সেই বাসের অপেক্ষায় সুলতানা বাস স্ট্যান্ডে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করত। ভার্সিটিতেও প্রায় দু’জনে দেখা হতো এমনিভাবে সে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সুলতানা ছিল অনেকটা বিলাসপ্রিয় এবং উচ্চাকাঙ্‌ক্ষী আর আমাকে তো বুঝতেই পাচ্ছিস্‌ আজকেও যেমন কাঠ-খোট্টা আগেও তেমনি। সুলতানার সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না বুঝতে পেরে আমি ওর ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। ব্যস এই তো শেষ।

সরি বাবা, আসলে আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।

 

চব্বিশ

 

সিরাজ সাহেব তো অবাক এখনো মানুষ মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় পিতৃপরিচয় দেখে? আমাদের আকাশের মতো সোনার টুকরো ছেলেকেও তার পিতৃপরিচয়ের কারণে আতিয়ার সাহেব মেয়ের বিয়ে দিবে না?

পিতৃপরিচয় বলতে আতিয়ার বংশ পরিচয় বলতে চায়নি, একজন দুর্নীতিবাজকে বলতে চেয়েছে।

সবাই শুধু উপরেরটাই দেখছে, আমি কি দুর্নীতিবাজ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি? আগে চাকরিতে জয়েন করে করেছি, তারপর সামগ্রিক পরিবেশের কারণে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। চাকরির পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ আমাকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করেছে, সুলতানা তুমি সবই জানো, তুমিও তো তখন আমাকে ইন্ধন যুগিয়েছ আর এখন সব দোষ আমার। এই যে বাড়ি-গাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি আমি করেছি এসব তো আকাশের জন্য, নাকি? অথচ আজ আকাশও আমার বেতন নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি বলবে আকাশকে?

যা সত্যি তাই বলব।

তুমি বলবে আর সে তাই মেনে নিবে? যেভাবে ছেলেকে মানুষ করেছ যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছ, কোনোকিছুই না করনি, তার কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখনি। আজ যখন সে তোমার কাছে সবকিছু জানবে তখন সে প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠবে, না জানি কি কাণ্ড করে বসে?

নিজের ওপর ঘৃণায় সিরাজ সাহেবের মনেটা ভরে গেল। তাঁর বার বারই মনে হলো যে টাকা দিয়ে কোন ভালো কাজ করা যাবে না, যে টাকা মানুষকে সমাজের কাছে হেয় করে তোলে, সে টাকার প্রয়োজন কি? না না আমি আর কোনদিন সে টাকার প্রতি হাত বাড়াবো না। কিন্তু আকাশ যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে, বাবা তোমার এই বাড়ি, গাড়ি, অবৈধ টাকার জন্য নীলার বাবা তার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেছে, মাকে অপমান করেছে। ছিঃ বাবা তুমি একজন দুর্নীতিবাজ? আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আমি একজন দুর্নীতিবাজের ছেলে।

সিরাজ সাহেব থানায় ঢুকলেন। টেবিলের ওপর ওয়্যারলেস সেটটা রেখে চেয়ারে বসলেন। ওয়্যারলেস সেট সব সময় বিড়বিড় করে কি যেন বলেই চলেছে, সিরাজ সাহেব মাঝে মাঝে কথা বলছেন। তাঁর চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। সাব-ইন্সপেক্টর মামুন সাহেব তাঁর চেম্বারে ঢুকে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালো, স্যার।

হ্যাঁ কি খবর? বলুন।

মামুন সাহেব সিরাজ সাহেবের ফিস্‌ফিস করে কি যেন বলল।

সিরাজ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, না, এসব বিষয় আমার সঙ্গে আর কোনদিন আলাপ করবেন না। আইন অনুযায়ী যা হয় তাই করবেন।

মামুন সাহেব মৃদু কণ্ঠে বলল, স্যার এতবড় একটা-

সিরাজ সাহেব ধমকের সুরে বললেন, স্টপ ফার্দার এরকম কথা বললেন না।

জি স্যার, বলে মামুন সাহেব মুখ কালো করে চলে গেল।

সিরাজ সাহেব বসে ভাবছিলেন এমন সময় তার টেলিফোনের রিং বেজে উঠল। সিরাজ সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার।

অপর পাশ থেকে কি যেন বলল তা জানা গেল না।

সিরাজ সাহেব বললেন, স্যার তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ অনেক অভিযোগ আছে, আমরা সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলাম, আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আজ শেষ দিন। রিমান্ডে সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা জবানবন্দী রেকর্ড করে আসামিকাল আদালতে পাঠিয়ে দিব।

অপর পাশ থেকে কি যেন বলল তা জানা গেল না।

সরি স্যার, বলে সিরাজ সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন।

আজকাল কোথাও গেলে আকাশ বলে যায় না। প্রায় দিনই সকালবেলা একটা ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুপুরবেলা এসে ভাত খায় কোনদিন আবার দুপুরবেলা বাসায় আসে না বাইরেই খেয়ে আসে কিছু জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়, মা আমি এখন বড় হয়েছি এখনো কি কোথাও গেলে তোমাকে বলে যেতে হবে?

কিন্তু সুলতানা বুঝতে পারেন, আকাশ তার বাবার ওপর রাগ করে হন্য হয়ে একটা চাকরি খুঁজছে। আজ আকাশ ফিরল বিকেল চারটায়। এ ক’দিনে তার চোখ কোটরে বসে গেছে, মাথার চুল এলোমেলো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে সুলতানার মুখ শুকিয়ে যায়।

সুলতানা আকাশকে ভাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন রে? শরীরের যত্ন নিচ্ছিস না কেন?

আকাশ কোন উত্তর দিল না।

সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে এখন কোথায় যাবি?

কেন মা?

তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।

এক জায়গায় মানে?

তোর বাবার এক কলিকের মেয়ে এ বছর জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স পাস-

আকাশ তার মা’র কথার মাঝে বলল, মা আমি নীলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম অন্য কাউকে না।

এ রকম তো হতেই পারে, বিয়ে হলো ভাগ্যের ব্যাপার, কার সাথে কার বিয়ে হবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। তুই তো নীলাকে ভালোবাসতিস বিয়ের কাবিনে সই করার আগেও বিয়ে ভেঙ্গে যায়। এসব মনে রাখতে হয় না, আবার নতুন করে ভাবতে হয়।

আকাশ রাগান্বিত চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো।

সুলতানা কোন কথা বললেন না।

আকাশ বলল, আচ্ছা মা তুমি আমাকে একটা কথা বলতে পার?

কি কথা?

তোমাদের অপরাধের দায়ভার আমরা বহন করব কেন?

আমাদের অপরাধের দায়ভার মানে? আমরা কি অপরাধ করলাম?

তোমরা অপরাধ করনি মানে? বাবা যদি দুর্নীতি না করতো, তুমি যদি বাবাকে দুর্নীতি করতে উৎসাহিত না করতে, তবে কি নীলার বাবা আমার সঙ্গে নীলার বিয়েতে অসম্মতি জানাতো? আমি একবার নীলার বাবাকে দেখেছি তখন বুঝতে পারিনি এখন বুঝতে পাচ্ছি তিনি একজন সৎ এবং নীতিবান মানুষ। আর বাবা দেশের জনগণের ট্যাঙের টাকায় বেতন নিয়ে সেবা করার নামে জনগণকে শোষণ করে অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছে সেটা তোমার কাছে কোন অপরাধ বলে মনেই হচ্ছে না। আসলে তোমাদের বিবেক অন্ধ হয়ে গেছে মা। তোমরা ভালো মন্দের তফাৎ ভুলে গেছ, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে গেছ। আসলে এটা শুধু তোমাদের দোষ না, যারা সব সময় দুষ্ট চিন্তা করে, অনৈতিক কাজ করে বিত্ত-বৈভবের নেশায় মত্ত থাকে তাদের বিবেক থেকে, তাদের মন ও মগজ থেকে তখন সুন্দর চিন্তাগুলো হারিয়ে যায়।

সুযোগ থাকলে সবাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে, শুধু নিজের জন্য তো কেউ করে না, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও করে। তোর বাবা যে এতসব ধন-সম্পদ করেছে তা কি শুধু আমাদের নিজের জন্য নাকি তোর জন্যও?

মা তুমি কি করে ভাবলে বাবার অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ আমি নিব?

তবে কি করবি?

তোমাদের সম্পদ তোমরা কি করবে সেটা তোমরা জানো।

তুই কি এসব কথা সিরিয়াসলি বলছিস?

জি, আমি সিরিয়াসলি বলছি।

সুলতানা কোন কথা বললেন না। তাঁর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল।

আকাশ বলল, মা খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের একটা সুখবর দিব।

কি সুখবর?

মা আগে বললে সেটার কোন ইমেজ থাকে না। বলছি তো আমি তোমাদের একটা সাপ্রাইজ দিব।

 

পঁচিশ

 

আকাশ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাসায় চলে আসে। আকাশের বাসায় ফিরতে কোনদিন রাত দশটা অতিক্রান্ত হয়নি। আজ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা অতিক্রান্ত হলেও আকাশ বাসায় না ফেরায় সুলতানা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন।

তিনি বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করলেন, মা তুই কিছু জানিস আকাশ কোথাও গেছে নাকি?

মামি আকাশ তো সকালবেলা অফিসে গেছে তারপর তো আর কিছু জানি না।

কয়েকদিন আগে বলল, আমাদের নাকি একটা সাপ্রাইজ দিবে? গতকাল মিষ্টি নিয়ে এলো চাকরি হয়েছে বলে। আজ ওর প্রথম অফিস, কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ফিরবে না? প্রথম দিনেই চাকরি শুরু করল বাপের মতো। বাপের যেমন দিন নাই, রাত নাই, ছেলেরও যেন প্রথম দিন থেকে শুরু হলো ম্যারাথন চাকরি। আকাশের মোবাইলে একবার রিং কর তো।

বৃষ্টি তার মোবাইল থেকে আকাশের মোবাইলে রিং করে বলল, মামি আকাশের মোবাইল বন্ধ।

আমিও কিছুক্ষণ আগে রিং দিয়েছিলাম তখনো মোবাইল বন্ধ ছিল। বল তো মা কি করি? বলে সুলতানা তাঁর রুমে গেলেন। কিছুতেই তাঁর মন বসছে না, রুমের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।

দেওয়াল ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার ঘোষণা প্রতিধ্বনিত হলো।

সুলতানা আবার বৃষ্টির রুমে গেলেন, বৃষ্টি এখনো আসল না, তুই একবার নীলাকে মোবাইল করবি নাকি?

মামি আপনি নওগাঁ থেকে ফিরে আসার পর থেকে নীলা আকাশের সঙ্গে কথা বলেনি। আকাশ প্রথমে কয়েকদিন নীলার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু নীলা কথা বলেনি।

তুই একটু দেখ না মা? বিপদের সময় এসব ভুলে যেতে হয়।

জি মামি করছি, বলে বৃষ্টি নীলাকে মোবাইল করল, হ্যালো নীলা।

কি রে এত রাতে?

নীলা তুই কি আকাশের কোন খবর জানিস?

না তো, নীলার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

নীলা আজ আকাশ চাকরিতে প্রথম জয়েন করেছে।

আমি জানি না তো।

নীলা আকাশ সকালবেলা অফিসে গেছে এখনো ফিরেনি, আমরা সবাই খুব চিন্তায় আছি। মোবাইল করছি, মোবাইলও বন্ধ।

আমি জানি না, আমি তো আকাশের সঙ্গে কথা বলি না, তবু আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। তুই কোন খবর পেলে অবশ্যই আমাকে জানাবি।

আচ্ছা।

বৃষ্টি মোবাইল রেখে বলল, মামি নীলা তো কোনো খবর জানে না।

মোবাইলটা আমাকে দে, আমি তোর মামার সঙ্গে কথা বলি।

সুলতানা সিরাজ সাহেবকে মোবাইল করলেন, হ্যালো।

কি খবর সুলতানা?

তোমার কি বাসায় ফিরতে দেরি হবে?

হ্যাঁ কেন? বল তো?

আকাশ এখনো বাসায় ফিরেনি।

এখন তো রাত বারোটা বাজে এখনো বাসায় ফিরেনি মানে, মোবাইল করেছিল?

না।

তুমি মোবাইল করেছিলে?

করেছিলাম, মোবাইল বন্ধ।

আচ্ছা আমি বাসায় আসছি।

সমন্ত কাজ ছেড়ে সিরাজ সাহেব বাসায় ছুটে এলেন।

দরজা খুলে দিয়ে সুলতানা রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ওতো কখনো দেরি করে বাসায় ফিরে না। নিশ্চয়ই ওর কোন অসুবিধা হয়েছে।

ওর অফিসের ঠিকানা জানো?

আমি কীভাবে ঠিকানা জানবো?

ওর ইন্টারভিউ কার্ডের বা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটারের কপি তোমার কাছে আছে নাকি?

না।

সিরাজ সাহেব আকাশের রুমে ঢুকলেন। পিছনে পিছনে সুলতানা এবং বৃষ্টিও ঢুকলো। আকাশের পড়ার টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট দিয়ে চেপে রাখা একটা চিঠি।

মা,

অনেকদিন থেকে একটা চাকরির চেষ্টা করছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। যেদিন জানতে পেরেছি বাবা একজন দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসার সেদিন থেকে আমার বিবেক আমাকে সবসময় দংশন করছে, আমার বার বার করে মনে হয়েছে সবাই যেন আমার দিকে আঙ্গুল উঁচু করে বলছে, তুমি একজন দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসারের ছেলে, তোমার শরীরের রক্ত মাংস এদেশের দরিদ্র মানুষের ট্যাঙের টাকায় পালিত একজন বিশ্বাসঘাতকের অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় লালিত। কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে গিয়ে যেন আমার বিবেক আমার মাথা হেঁট করে দিয়েছে। এতদিন আমার মনের মধ্যে একটা ঘৃণা চাপিয়ে রেখে আমি হন্য হয়ে একটা চাকরি খুঁজছিলাম। কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবার পর থেকে আমার মনে হয়েছে তোমাদের অবৈধ প্রতিপত্তির অভিশাপ থেকে আমি মুক্ত হয়েছি।

মা ছেলেমেয়েরা মা-বাবার আদর্শকে অনুসরণ করে, মা-বাবার নীতিকে আদর্শ নীতি হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তোমাদের নীতি এবং আদর্শ এত জঘন্য যা অনুসরণ করা তো দূরের কথা ভাবেতেও আমার ঘৃণা হয়। বাবার দুর্নীতির জন্য আমি শুধু বাবাকে দায়ী করি না, বাবা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হলেও তাঁর দুর্নীতির জন্য তুমিও দায়ী, আমি তোমাদের দু’জনকে সমানভাবে ঘৃণা করি।

আমি তোমাদের কাছ থেকে চলে গেলাম মা। আমার বন্ধুর ম্যাসে একটা সিট নিয়েছি। যা বেতন পাব তা দিয়ে আমার খুব ভালোভাবে চলে যাবে। আমাকে নিয়ে ভাববে না, সব সময় মনে করবে আমি বেঁচে আছি এবং তোমাদের কাছাকাছি আছি। শুধু তোমাদের অবৈধ সম্পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। কয়েকমাসের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার পর আজ মনে হচ্ছে আমি তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি।

ইতি-

তোমাদের ্‌েলহের

আকাশ

সিরাজ সাহেব চিঠিটা পড়া শেষ করে সুলতানার হাতে দিলেন। সুলতানা চিঠিটা পড়তে পড়তে তাঁর দু’চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি চিঠি পড়া শেষ করে কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না, তুমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি কর। মানুষের হারিয়ে যাওয়া, অপহরণ হওয়া ছেলেমেয়েকে তুমি উদ্ধার কর এবার নিজের ছেলেকে যেমন করে হোক তুমি আমার কাছে এনে দাও।

সিরাজ সাহেব কোনোকিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

 

ছাব্বিশ

 

সিরাজ সাহেব চাকরি জীবনে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়েছেন। পুলিশের চাকরি কখনো কোনো কাজের ব্যর্থতা, কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের খেয়ালখুশি মতো কাজ না করার জন্য তাঁকে অনেকবার শান্তিমূলক বদলী করা হয়েছে, কয়েকবার স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে, একবার সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনদিন ভেঙ্গে পড়েননি, ধৈর্যয সহকারে সমন্ত বাধা অতিক্রম করে একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসেবে ডিপার্টমেন্টে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি সুনামের সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটনের বিভিন্ন থানায় চাকরি করছেন। সবাই তাঁকে একজন সফল পুলিশ অফিসার হিসেবে জানে কিন্তু আজ তাঁর মনে হচ্ছে তিনি একজন সফল পুলিশ অফিসার হলেও মানুষ হিসেবে মোটেই সফল না।

কয়েকমাস আগে দুর্নীতি দমন কমিশন সিরাজ সাহেবের সম্পত্তির হিসাব চেয়েছিল, তিনি সম্পত্তির যে হিসাব দিয়েছেন তা তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা চালুর কার্যক্রম শুরু করেছিল। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন চার্জশিট অনুমোদন করেছে। সেই সূত্রে আজ প্রায় সবকটি পত্রিকায় সিরাজ সাহেবের ছবিসহ নাম ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। সারাদিন বিভিন্ন স্থান থেকে তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, মিডিয়া কর্মীরা তাকে মোবাইল করছে। এসব যন্ত্রণায় তিনি অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারওপর আকাশের চলে যাওয়া যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা।

আকাশ তাঁর একমাত্র সন্তান যার ভবিষ্যতের জন্য তিনি বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। সেই একমাত্র ছেলে তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত বিষয়-সম্পত্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাঁকে একজন দুর্নীতিবাজ পিতা হিসেবে তাকে ঘৃণা করে বাসা থেকে চলে গেছে। আজ এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই সে পেপার পড়েছে তাঁর কুকীর্তির কথা জেনে ফেলেছে, ছিঃ আমি সারাজীবন আমি কি করলাম? আমি সবাইকে কি জবাব দিব? এত বিষয় সম্পত্তি, ঢাকা শহরে বাড়ি গাড়ি এতকিছুর কি প্রয়োজন ছিল?

সিরাজ সাহেব ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে যে হাজত খানায় তিনি দিনের পর দিন মানুষকে আটকে রেখেছেন সে হাজতখানায় তাকে থাকতে হবে।

সিরাজ সাহেব একবার চেয়ার থেকে উঠে হাজতখানার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তার হৃদয়টা কান্নায় ভেঙ্গে গেল। সিরাজ সাহেব আবার চেয়ারে বসলেন। দুদকের ফাইলটা বের করে দেখলেন। তিনি আপন মনে বললেন, আমার বিচার হবে, দুর্নীতি করার অপরাধে আমার জেল হবে।

সিরাজ সাহেব আর ভাবতে পারছেন না। অনেক সময় ওয়্যারলেস সেট-এ বিড়বিড় করে ম্যাসেজ আসছে কিন্তু তিনি কোন কথা বলছেন না, কখনো কখনো মোবাইল বেজেই চলছে কিন্তু তিনি মোবাইলও রিসিভ করছেন না।

সিরাজ সাহেব বাসায় গেলেন। গভীর রাত পর্যন্ত তার মোবাইলে কল আসছে, ওয়্যারলেস ম্যাসেজ আসছে কিন্তু তিনি রিসপন্স করছেন না। তিনি সারারাত কি যেন লিখতে থাকেন।

আজ বিকেলবেলা সিরাজ সাহেব সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে গেছেন মাঝে মাঝে তিনি সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে যান কিন্তু কোনদিন ওয়্যারলেস সেট ছেড়ে যান না।

আজ আবার সে এত আত্মভোলো হলো কি করে? সুলতানা নিজেকে প্রশ্ন করলেন।

তিনি কয়েকবার সিরাজ সাহেবের মোবাইলে রিং করলেন কিন্তু মোবাইল বন্ধ, তারপর তিনি থানায় টেলিফোন করলেন। না থানায় যায়নি তো, তবে গেল কোথায়?

ডাইনিং টেবিলের ওপর ওয়্যারলেস সেট বিড়বিড় করে বেজেই চলছে। সুলতানা কি করবেন ভেবে পেলেন না। সিরাজ সাহেব ওয়্যারলেস সেট নিয়ে গেলে কোন কথাই ছিল না। সিরাজ সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার জীবনে সুলতানা দেখেছেন, এমনি সিভিল ড্রেসে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনদিন পর বাসায় ফিরেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।

কি করবেন সিরাজ সাহেব? তিনি যেন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আকাশ বাসা থেকে চলে যাবার কথা তিনি কাউকে বলতেও পারছেন না। কোনো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেও পারছেন না। কারণ আকাশ তো বাসা থেকে না বলে পালিয়ে যায়নি সবকিছু জানিয়ে তাকে ঘৃণা করে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। সিরাজ সাহেবের নিজেকে খুব অপরাধী এবং সমাজের কাছে একজন ঘৃণিত, অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।

তিনি ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলেছেন, হাতে একটা ডায়েরি। তাঁর নিজেকে খুব অসহায় বলে মনে হচ্ছে। এই রান্তায় তিনি অনেকদিন ডিউটি করেছেন, তাঁর ধারণা ছিল কেউ তাঁকে চিনে ফেলবে? কিন্তু অনেকক্ষণ হাঁটার পরও কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। আসলে ঢাকা শহরটা তাঁর কাছে খুব আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়, এখানে কেউ কাউকে চিনে না, যেন কেউ কারো নয়। অসংখ্য মানুষের সামনে কেউ কোন বিপদে পড়লেও সবাই যেন না দেখার ভান করে চলে যায়। ঢাকা শহরে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধনটা খুব শিথিল।

সিরাজ সাহেব একটা ঔষধের দোকান থেকে ঔষধ কিনলেন। তারপর আবার হেঁটে চললেন। অনেকদূর যাবার পর একটা আবাসিক হোটেলে ঢুকলেন, একটা সিঙ্গেল সিট হবে? এটাচ্‌ড বাথসহ?

জি হবে, ভাড়া দু’শ টাকা।

সিরাজ সাহেব ভাড়া দিয়ে রেজিস্টারে নাম, ঠিকানা লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম এবং গ্রামের ঠিকানা লিখলেন। তারপর রুমে গেলেন।

রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখতে গিয়ে সিরাজ সাহেবের তাঁর মায়ের মুখ খানা ভেসে উঠল। তাঁর মা আদর করে তাঁকে মানিক নামে ডাকতেন। মানিক নামের সঙ্গে তাঁর গ্রামের মাটির গন্ধ আছে, তাঁর শৈশবের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যতদিন তিনি মানিক ছিলেন ততদিন তিনি যেন একজন খাঁটি মানুষই ছিলেন। সিরাজ তাঁর সার্টিফিকেট নাম, এই নামের সঙ্গে কয়েকটা সার্টিফিকেট আর একটা চাকরির সম্পর্ক আছে যে চাকরির কারণে তিনি অসৎ হতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি যদি সরকারি চাকরিতে জয়েন না করে গ্রামে থেকে কৃষিকাজ করতেন তবে তাঁকে জীবিকা নির্বাহের জন্য অসৎ হতে হতো না। সিরাজ সাহেব ঔষধ খেয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে আবার লিখতে শুরু করলেন।

সারারাত সুলতানার চোখে ঘুম নাই। সিরাজ সাহেব মাঝে মাঝেই রাতে বাসায় ফেরেন না এটা নতুন কোন ঘটনা না। কিন্তু বাসায় না ফিরলেও তাঁর সঙ্গে সব সময় বাসার কিংবা থানার একটা যোগাযোগ থাকে, থানায় টেলিফোন করলে তাঁর ঠিকানা পাওয়া যায়। সারারাত বিছানায় দুশ্চিন্তায় ছট্‌ফট করতে করতে সুলতানার রাত কেটে গেল। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে থানায় টেলিফোন করলেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে ডিউটি অফিসারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো …..থানা থেকে বলছি।

সুলতানা আগে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি সুলতানা, সিরাজ সাহেবের মিসেস্‌।

জি ভাবী বলুন, আমি সাব-ইন্সপেক্টর ইলিয়াস বলছি।

আপনার স্যার তো রাতেও বাসায় ফিরেনি আপনারা কোন খবর পেলেন?

জি না ভাবী।

ইলিয়াস সাহেব আমি আগে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম আমি ভেবেছিলাম দিনে যেখানেই যাক রাতে বাসায় ফিরবে কিন্তু রাতেও বাসায় ফিরেনি। আমার খুব ভয় হচ্ছে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? আপনারা একবার সিরিয়াসলি দেখুন ইলিয়াস সাহেব, প্লিজ।

আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না ভাবী, আপনি কিছু ভাববেন না।

আচ্ছা ইলিয়াস সাহেব আপনার স্যারের কিছু হয়নি তো। এই যেমন ধরুন কোন আসামি যদি কিছু—

না, না ভাবী কোন অপরাধীই খুব সহজে পুলিশের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পাবে না।

না মানে আমি বলছিলাম আজকাল কত রকম ঘটনাই তো ঘটছে, বিচিত্র কি?

ভাবী ব্যাপারটা আমরা দেখছি, বাই দি বাই আপনি কিছু মনে করবেন না ভাবী আপনাকে আমার কিছু কথা জিজ্ঞেস করার আছে?

বলুন।

স্যারের সঙ্গে কি আপনার কিছু হয়েছে? আই মিন কোন মিস্‌ আন্ডারস্ট্যান্ডিং?

না সেরকম তো কিছু হয়নি।

আচ্ছা ভাবী আমরা দেখছি। আপনি একদম কিচ্ছু ভাববেন না।

সুলতানা টেলিফোন রেখে দিলেন।

বৃষ্টি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো, মামি মামা বাসায় ফিরেনি না?

না মা।

মামি আমি কি একবার আকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করব?

কীভাবে যোগাযোগ করবি মা? ওর মোবাইল তো বন্ধ।

মামি আমি নীলার সঙ্গে কথা বলি, ও যদি আকাশের কোন নতুন মোবাইল নাম্বার দিতে পারে।

কর।

বৃষ্টি নীলার মোবাইলে রিং করল, হ্যালো নীলা।

কি রে এত সকালে? কি মনে করে? নীলার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

নীলা গতরাতে মামা বাসায় ফিরেনি।

মামা পুলিশের চাকরি করে, হয়ত কোনো আসামিকে ধরার জন্য রাতে বাসায় ফিরতে পারেনি।

নীলা আসলে তা না, মামা অফিসের কাজে যায়নি। অফিসের কাজে গেলে তো মামার ওয়্যারলেস সেট নিয়ে যেত, তাছাড়া মামি থানায় টেলিফোন করেছিল, মামা থানায় যায়নি।

তো আমাকে কি করতে বলছিস?

তোকে কিছু করতে বলছি না। তোর কাছে যদি আকাশের কোন মোবাইল নাম্বার থাকে তো দে না প্লিজ?

বৃষ্টি এভাবে বলছিস কেন? আকাশের কোন মোবাইল নাম্বার থাকলে আমি তোকে দিব না কেন? ও তো অনেকদিন থেকে আমার সঙ্গেও কোন যোগাযোগ করছে না।

তুই একবার আয় না আমাদের বাসায়। মামি খুব দুশ্চিন্তায় আছে তুই এ সময় আমাদের পাশে থাকলে আমরা একটু হলেও সাহস পাব।

বৃষ্টি আমি সকালবেলা তোকে মোবাইল করতাম, তুই তো জানিস আমি একটা টি.ভি চ্যানেলে জয়েন করেছি। পনেরো দিন ট্রেনিং হলো গতকাল ট্রেনিং শেষ হয়েছে আজকেই প্রথম আমার টি.ভি’তে নিউজ করার কথা। আজ খবর দেখিস আমাকে দেখতে পাবি। আসলে আমার এমন একটা আনন্দের দিন মামা না থাকায় সব আনন্দ যেন ঢাকা পড়ে গেল রে।

থাক থাক আর বলতে হবে না এখন রাখি, তুই যা আজ তোকে টি.ভি’তে দেখাবে তুই আর আমাদের সঙ্গে থাকবি কেন? বলে বৃষ্টি মোবাইলের লাইন কেটে দিল।

সুলতানা অসহায়ের মতো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, মোবাইল নাম্বার পেলি না, না?

না মামি।

মোহনা এতক্ষণ বাথরুমে ছিল এবার রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কি রে নীলা? কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

নীলা বৃষ্টির সঙ্গে তার কথা বলা এবং সিরাজ সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার কথা বলল।

মোহনা যেন চমকে উঠল, নীলা তুই কি বলছিস?

নীলা কোন কথা বলল না।

নীলা মামা খুব সচেতন এবং দায়িত্ববান মানুষ। মামা নিখোঁজ হওয়া খুব চিন্তার বিষয়, আসলে মামা আমার লেখাপড়ার টাকা দিলেন নিজের ভাগিনী পরিচয় দিয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন আজ প্রথম চাকরিতে জয়েন করব, প্রতি মুহূর্তে আমার মামার কথা মনে পড়ছে, এমন একজন ভালো মানুষ, বলতে বলতে মোহনা চোখ মুছলো।

 

সাতাইশ

 

সুলতানা বার বার করে থানায় টেলিফোন করছেন কিন্তু থানা থেকে বার বারই বলা হচ্ছে, ভাবী আমরা চেষ্টা করছি, স্যার কোন সন্ত্রাসী দ্বারা অপহরণ হয়েছেন কি না তাও খতিয়ে দেখছি। আপনি প্লিজ একটু ধৈর্যয ধরুন।

সারারাত তো ধৈর্যয ধরলাম। আমাকে আর কত ধৈর্যয ধরতে হবে?

অপর পাশ থেকে কোন সাড়া মিলল না।

সুলতানা সকালবেলা নান্তা খাননি।

তিনি একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন, দুপুর বারোটা বাজে। বৃষ্টি এর মধ্যে কয়েকবার নান্তা খাওয়ার জন্য বলেছে কিন্তু সুলতানা মুখে রুচি নাই বলে খেতে পারেননি।

সুলতানা সেই অনেকক্ষণ আগে জোহরের নামাজ পড়তে বসেছেন। দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। তারপর নামাজ শেষ করতেই টেলিফোনের রিং বেজে উঠল।

সুলতানা টেলিফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে ইলিয়াস সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভাবী থানা থেকে সাব-ইন্সপেক্টর ইলিয়াস বলছি।

ইলিয়াস সাহেব বলুন, আপনার স্যারের কোন খবর পেলেন?

জি ভাবী পেয়েছি কিন্তু-

কিন্তু কি ইলিয়াস সাহেব?

ভাবী একটা রেসিডেন্সিয়াল হোটেল থেকে স্যারের ডেড বডি পাওয়া গেছে।

সুলতানা যেন আঁতকে উঠলেন, ইলিয়াস সাহেব!

ভাবী স্যারের ডেড বডি থানায় আনা হয়েছে, আপনি একবার আসুন প্লিজ।

সুলতানা কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, আমি আসছি ইলিয়াস সাহেব।

কান্নার শব্দ পেয়ে বৃষ্টি তার মামির রুমে ঢুকলো, কি হয়েছে মামি?

তোর মামা আর নাই মা।

নাই মানে?

তোর মামা মারা গেছে, ডেড বডি এখন থানায়, চল মা।

জি মামি।

থানায় যেন শোকের ছায়া নেমেছে। এতদিন যে মানুষটা এই থানায় দাপটের সঙ্গে চাকরি করেছেন, কত চোর ছেঁচড়, কত বড় সন্ত্রাসী শাসিয়েছেন, কত লাশ পোস্ট মোর্টেমে পাঠিয়েছেন তার ইয়ত্তা নাই। অথচ আজ নিজের লাশ পোস্ট মোর্টেমের জন্য তার অধীনস’রা পাঠিয়ে দিচ্ছে।

খবর পেয়ে থানায় পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির হয়েছেন। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সুলতানাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ভাবী ভেঙ্গে পড়বেন না, আমরা তো আছি যে করেই হোক আমরা সিরাজ সাহেব হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করবোই। তবে আমাদের যেটুকু ধারণা সিরাজ সাহেবকে কেউ হত্যা করেনি, খুব সম্ভব তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

ও আত্মহত্যা করবে কেন?

আমাদের তাই ধারণা, আচ্ছা সেসব পরে হবে লাশ পোস্ট মোর্টেমে পাঠানো হচ্ছে, রিপোর্ট পাওয়া গেলে সব বেরিয়ে আসবে।

সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আপনারা ভালোভাবে তদন্ত করুন স্যার, আসামির যেন দৃষ্টান্তমূলক শান্তি হয়।

বাই দি বাই, আপনাদের কোন ছেলে-মেয়ে নাই?

জি আছে, ও তো চাকরি করে, অফিসে গেছে এখন বার বার চেষ্টা করেও মোবাইলে পাচ্ছি না।

অফিসের ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার আছে না?

নতুন চাকরি তো, আমরা ঠিক ঠিকানা জানি না, তুই চেষ্টা কর তো মা।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পড়েছে ইলিয়াস সাহেবের ওপর। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালেন, স্যার।

হ্যাঁ তদন্ত কতদূর এগিয়েছ?

জি স্যার, অনেকদূর এগিয়েছি। লাশ পোস্ট মোর্টেমের জন্য পাঠানো হচ্ছে, হোটেলের যে রুম থেকে লাশ পাওয়া গেছে সেখানে স্যারের হাতের লেখা একটা ডায়েরি আর কয়েকটা স্লিপিং পিলের কভার পাওয়া গেছে। আমি স্লিপিং পিল আর ডায়েরির সূত্র ধরে তদন্ত করছি-

হ্যাঁ শুধু ডায়েরি আর স্লিপিং পিলের সূত্র ধরে তদন্ত করলেই হবে না। কোন সন্ত্রাসী অপহরণ করে তাকে হত্যা করেছে কি না এবং তাকে হত্যার পূর্বে জোর করে ডায়েরিতে কিছু লিখিয়ে নিয়েছে কি না? সবকিছু ভালোভাবে তদন্ত করে দেখ। পুলিশের চাকরি কর সবকিছু এত সহজভাবে চিন্তা করলে চলবে না।

জি স্যার।

ইলিয়াস সাহেব সিরাজ সাহেবের ডায়রিটা পড়তে শুরু করল, সিরাজ সাহেব লিখেছেন, আমি মানিক পত্নীতলা উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মায়ের আদরের সন্তান মানিক। শৈশবে অনেক কষ্ট করে কোন রকমে লেখাপড়া শেষ করে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরিতে জয়েন করেছি। যখন আমি একটা চাকরির জন্য হন্য হয়ে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি দপ্তরে চাকরি খুঁজছিলাম তখন একরকম কাকতালীয়ভাবে আমার চাকরি হয় পুলিশ বিভাগে। আমার বন্ধুরা অনেকেই আমাকে ইয়ার্কি করে বলতো মাছের রাজা ইলিশ আর চাকরির রাজা পুলিশ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি বুঝতে পারলাম পুলিশের চাকরিকে বাইরে থেকে যত আকর্ষণীয় মনে হয় বাস্তবে তারচেয়ে অনেক কঠিন। কাজ প্রচুর, বেতন সামান্য। বেতনের সামান্য টাকা থেকে প্রতিমাসে অনেক টাকা অফিসের জন্য খরচ হতো। বেতনের সামান্য টাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সংসার চালানো এবং চাকরিতে টিকে থাকার জন্য আমি দুর্নীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। বেতনের চেয়ে উপরি আয় অনেক বেশি হলো। আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর মনজয় আর সহকর্মীদের বিলাসবহুল জীবন-যাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি লাগামহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লাম। সম্পদের নেশায় আমি যেন উদ্মাদ হয়ে গেলাম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন রক্ষা আর চাকরিতে নিজের অবস্থান ভালো করা এবং টাকার পাহাড় গড়তে গিয়ে আমি অনেকের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছি। আমার বিবেক যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আমার ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ল, ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাড়ি হলো, গাড়ি হলো। একমাত্র ছেলেকে ব্যয়বহুল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করালাম। আমার একমাত্র ছেলে বি.বি.এ-পাস করে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিতে জয়েন করল। দীর্ঘ চাকরি জীবনে আমি যা বেতন পাই আমার ছেলে তার চেয়ে বেশি বেতনের চাকরিতে জয়েন করল।

কয়েকমাস আগে একদিন থানায় বসেছিলাম আমার এক সাব-ইন্সপেক্টর কয়েকজন ফোর্সসহ এক অভিযানে গিয়েছিল। তারা ফিরে এলো একজন ঘুষ গ্রহণের আসামিকে নিয়ে। আসামি আর কেউ না আমারই পরিচিত এক সিনিয়র ভাই। তাঁর নাম কুদ্দুস ভাই। আমাকে দেখে কুদ্দুস ভাই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেছিল, সিরাজ তুমি আমাকে ভুল বুঝ না, আসলে এ ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কুদ্দুস ভাই আপনি শেষ পর্যন্ত-

কি করব সিরাজ? আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে-মেয়ে দুজনে লেখাপড়া করছে। যা বেতন পাই তাতে সংসার চালানোই কঠিন তারওপর দু’জন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো একেবারে অসম্ভব। তাই একটু বাড়তি রোজগারের ধান্দা করেছিলাম। তুমি বিশ্বাস কর, আমার চাকরি জীবনে ব্যাংকে সঞ্চয় দশ হাজার টাকাও নাই। টাকার পাহাড় গড়ে তোলার জন্য নয় শুধুমাত্র ছেলেমেয়ে দু’টার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দুর্নীতি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভালোই হলো আজ থেকে আর পাপ করতে হবে না। এখন শুধু আমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমার নিষ্পাপ ছেলে-মেয়ে দু’টার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাবে। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারাও করবে। ভালোই হলো বাপের পাপের টাকার সুবিধা ভোগ করবে আর বাপের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে না? সিরাজ তুমি বিশ্বাস কর আমার বেতনের টাকা দিয়ে তাদের লেখাপড়া করা সম্ভব না। আমি অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখে একটু বড় হয়েছি, খুব আশা ছিল ছেলে-মেয়ে দু’টাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করব। আমি একজন প্রান্তিক চাষির সন্তান ছিলাম, লেখাপড়া শিখে কেরানী হয়েছিলাম। আশা ছিল আমার ছেলে-মেয়েরা কেরানীর ছেলে-মেয়ে থেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার আর কিছু প্রয়োজন ছিল না, শুধু ইচ্ছা ছিল আমার পরবর্তী জেনারেশনকে এক ধাপ এগিয়ে দেওয়া আর এটা আমার বেতনের টাকায় সম্ভব ছিল না। মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ জন্মে ছিল তবে কি চাষার ছেলে কেরানী আর কেরানীর ছেলে ভিক্ষুক হবে?

কুদ্দুস ভাইর কথা শুনে আমার দু’চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়েছিল। বিচারে কুদ্দুস ভাইর জেল হয়েছে তাঁর ছেলেমেয়ে দু’টা লেখাপড়া হয়ত আর শেষ করতে পারেনি। একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ওদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কুদ্দুস ভাইর ঐকান্তিক ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেছে, তাঁর পরবর্তী জেনারেশন এক ধাপ এগোতে পারেনি সত্যি সত্যি কেরানীর ছেলে হয়ত ভিক্ষুক কিংবা সন্ত্রাসী হয়েছে। কৃষকের ছেলে কুদ্দুস ভাই ঘুষ খোর হয়েছে, ঘুষ খোর কুদ্দুস ভাইর ছেলে হয়ত সত্যি সত্যি সন্ত্রাসী হয়েছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষাবাদ করা সৎ এবং আদর্শ কৃষকের ছেলে কুদ্দুস ভাইর ঘুষ খোর হওয়া এবং কুদ্দুস ভাইর ছেলে সন্ত্রাসী হওয়ার দায়ভার কে বহন করবে তা আমি জানি না। আমি সমাজ বিজ্ঞানী না, আমি আইন প্রণেতা না। আমি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য। আমার কাজ আইন প্রয়োগ করা। তাই কঠোর হন্তে আমাকে আইনের নিষ্ঠুর প্রয়োগ করতে হয়।

অপরাধ দমনের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে কোন অপরাধ দমন করা সম্ভব হয়েছে এমন নজির আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আইন প্রণয়ন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীকে শান্তি প্রদানের চেয়ে মানুষের অপরাধ প্রবণ হওয়ার কারণগুলো অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল করা বেশি সহজ।

কৃষকের ছেলে কুদ্দুস সাহেব কেন ঘুষ খোর হয়েছে? নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মানিক কেন দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসার হয়েছে? সৎ সরকারি কর্মকর্তা মোখলেস সাহেবের মেয়ে লেখাপড়ার খরচ মিটানোর জন্য কেন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে এসব বিবেচনা না করে শুধুমাত্র আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শান্তি দিলেই সমাজ থেকে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে না।

আতিয়ার সাহেব আমার মতো একজন দুর্নীতিবাজের ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। আকাশ আমার ওপর রাগ করে অবৈধভাবে অর্জিত আমার টাকাকে ঘৃণা করে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক দেরিতে হলেও মানুষ দিন দিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হচ্ছে এটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আইন কুদ্দুস ভাইকে শান্তি দিয়েছে, সমাজ আমাকে ধিক্কার দিয়েছে, আমি আমার প্রায়শ্চিত্ত নিজেই বেছে নিলাম। আমার এই আত্মত্যাগ সার্থক হবে যদি কোনদিন লাগামহীন দুর্নীতিবাজদের কঠোর শান্তি হয়, কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সামাজিকভাবে বসবাসের জন্য অবৈধ উপায়ে টাকা অর্জনের কথা চিন্তাও করতে না হয়। আমার এই আত্মত্যাগ সার্থক হবে যদি এদেশে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা চালু হয়।

ইলিয়াস সাহেব ডায়রি থেকে মুখ তুলে যেন চমকে উঠল, আপনারা।

আমরা ……..টি.ভি চ্যানেল থেকে এসেছি।

জি বলুন আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি?

টি.ভির পর্দায় নীলার ছবি দেখে আকাশ চমকে উঠল, নীলা।

নীলা ইলিয়াস সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, সিরাজ সাহেবের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কতদূর এগিয়েছেন?

তদন্ত চলছে, তবে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আলামত এবং সঙ্গে পাওয়া ডায়েরি থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটা হত্যা না আসলে সিরাজ সাহেব বিবেকের তাড়নায় মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। লাশ পোস্ট মোর্টেমে পাঠানো হয়েছে। পোস্ট মোর্টেমের রিপোর্ট পাওয়া গেলে কনফার্ম হওয়া যাবে।

বিবেকের তাড়নাটা কি তাঁর কোন অপরাধ প্রবণতা থেকে এসেছে বলে আপনি মনে করেন?

আমার ধারণা সিরাজ সাহেব দুর্নীতিগ্রস’ পুলিশ অফিসার ছিলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে আকাশ একটা মেয়েকে ভালোবাসতো কিন্তু মেয়ের বাবা দুর্নীতিগ্রস্‌ পুলিশ অফিসারের ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানায় এবং আকাশ বাসা ছেড়ে চলে যায়। ফলে সিরাজ সাহেব তাঁর কৃত কর্মের জন্য সুস্থ মন্তিস্কে আত্মহত্যা করেছে।

আকাশ টি.ভি অফ করে তাঁর মাকে মোবাইল করল, হ্যালো মা।

সমাপ্ত

 

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*