নারী: তো সেই বাড়ির মালিক নয়

এই বাড়িটাকে রিনি নিজের বাড়ি ভেবেছিলো। বাড়ির প্রতিটি ইটের সঙ্গে, প্রতিটি বালুকণার সঙ্গে পাঁজরের হাড়ের মতো প্রতিটি রডের সঙ্গে মিশে আছে তার অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা ও সৃজণশীলতা। রিনির স্বপ্ন ছিলো একদিন তার একটা বাড়ি হবে। বিশাল অট্টালিকা নয়, এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী এই চারজন মানুষের থাকার মতো একটা বাড়ি। দক্ষিণে থাকবে একটা বেলকনি। সেই বেলকনিতে বসে সে আর আসাদ জ্যোৎস্না দেখবে। মেঘের সাথে চাদের লুকোচুরি খেলা দেখবে। রিনির চোখের সামনে তখন ভাসছে সিনেমার দৃশ্যের মতো একটা সুন্দর সংসার। কিন্তু সিনেমায় যে সুখের সংসারও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় রিনি তখনো সেকথা বেমালুম ভুলে গেছে।
তাদের ঘরে দু’টি সন্তান এলো। অন্তিক বড় সে তখন সবেমাত্র স্কুল যেতে শুরু করেছে আর জেবিন ছোট। বিয়ের আগে আসাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতা আর ব্যাংকের ঋৃণের টাকা দিয়ে সে প্রথমে শুরু করলো ঠিকাদারি ব্যবসা। এই ঠিকাদারি ব্যবসায় তার কপাল খুলে গেলো। লটারিতে একের পর এক কাজ তার নামে উঠতে লাগলো। কয়েক বছরের মধ্যে আসাদ প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেলো।
রিনির স্বপ্ন যেন দিনে দিনে বাস্তব হতে শুরু করলো। তখন আসাদ বাড়ির কাজ শুরু করলো। রিনির জীবনটা বদলে গেলো। সত্যি, সত্যি তার স্বপ্নের মতোই জীবনটা শুরু হলো। বাড়ি করার আগে শহরের বিখ্যাত আর্কিটেক্ট দিয়ে আসাদ বাড়ির প্লান তৈরি করে নিলো। বাড়ির প্লান চূড়ান্ত করার আগে বার বার রিনির সঙ্গে আসাদ আলোচনা করলো। তারপর শুরু হলো বাড়ির কন্সট্রাকশন কাজ।
রিনিরা যে বাসায় ভাড়া থাকতো তাদের নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ তার পাশেই। প্রথম দিকে আসাদ একাই বাড়ির কাজ দেখাশোনা করতো, তখন আসাদের সঙ্গে সেও মাঝে মাঝে কাজ দেখতো কিন্তু আসাদের ব্যবসার কাজে ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিনির ওপরও অনেক দায়িত্ব পড়লো।
রিনি প্রতিদিন সকালবেলা জেবিনকে কোলে নিয়ে অন্তিককে স্কুলে দিয়ে আসতো। তারপর বাড়ির কাজ দেখতো, কোনো মালামালের প্রয়োজন হলে আসাদকে ফোন করতো কিংবা নিজেই বাজার থেকে কিনে এনে দিতো। একটু সুযোগ পেলেই জেবিনকে ঘুমিয়ে রেখে আবার কাজ দেখতো, রিনির পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই কিন’ আসাদের কাছে শুনে আর পাশের বিল্ডিংয়ের কাজ দেখে সে মোটামুটি কাজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে। তার সেই সীমিত জ্ঞান দিয়েই সে কন্সট্রাকশন কাজ ভালো করার চেষ্টা করতো দিনরাত, রোদ-বাতাসে নিজের পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে এই বিল্ডিংয়ের কাজ মজবুত করে তুলেছে, নান্দনিক করে তুলেছে।
রিনির ইচ্ছা ছিলো এক তলার কাজ শেষ করে আগে নিজের বাড়িতে উঠবে তারপর ধীরে ধীরে দ্বিতীয় তলার কাজ করবে কিন’ আসাদ বললো, না একেবারে নতুন বাড়িতে উঠবে দ্বিতীয় তলার কাজ শেষ করে, ধুম ধাম করে অনুষ্ঠান করে বাড়িতে উঠবে। তাড়াতাড়ি নিজের বাড়িতে স্থানান্তরের জন্য আসাদ দ্রুতগতিতে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো। আর রিনি সাজাচ্ছিলো তার ড্রয়িং রুমের ওয়ালের রং, মেঝের টাইলস, বাথ রুমে ফিটিংস্‌।
বিয়ের প্রথম দিকে সংসারে যখন অভাব অনটন ছিলো তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার টান ছিলো, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা-মা’র একটা সুন্দর ভালোবাসার বন্ধন ছিলো, সংসারটা ছিলো সুখ-শান্তিতে ভরপুর। আসাদ প্রায় বলতো, রিনি তোমার মনে আছে যেদিন অন্তিক হলো সেদিন লটারিতে আমি একটা বড় বিল্ডিংয়ের কাজ পেয়েছি।
রিনি বলতো, আর যেদিন জেবিন?
সেদিন দু’কোটি টাকার রাস্তার কাজ পেয়েছি।
ঘরে স্বচ্ছলতা এলো। সংসারের শুরুতে অনেক কষ্টে কেনা ছোট রঙিন টেলিভিশনের স্থান দখল করলো বিশাল আকারের সিনেমা কোয়ালিটি টেলিভিশন, কাঁচাবাজরের ঝুড়ির স্থান দখল করলো ফ্রিজ, পুরাতন কাঠের সোফার সন্তান দখল করলো বিদেশি কোম্পানির দামি সোফাসেট। বাসার ফ্রিজ টি.ভি আর আসবাবপত্র পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সব পরিবর্তন শেষ হলে ভালোই হতো কিন্তু পরিবর্তন আর সীমিত থাকলো না। আসাদের রুচিরও পরিবর্তন হতে শুরু করলো।
আগে যেমন আসাদ ব্যবসার কাজ শেষে বাসায় আসতো, ছেলেমেয়েদের সময় দিতো তা ধীরে ধীরে কমে গেলো। টাকা তখন তার কাছে নেশা, না শুধু নেশা না। সে তখন টাকার নেশায় নেশাগ্রস্থ এক মানুষ। ব্যবসার কাজে সে ছুটে চললো ঢাকা, চিটাগাংসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, ঘরের মানুষ বের হলো। শুধু তাই নয়, রিনির অতি পরিচিত মানুষটি দিনে দিনে তার কাছে কেমন যেন অচেনা মনে হলো। সন্তানদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো তাদের বাবা।
রিনি লক্ষ্য করলো আসাদের মন আর ঘরের ভেতর নেই, সে শুধু ছুটে পালাতে চায়। আসাদ মডার্ন মোড়ে অফিস ভাড়া নিয়েছে। প্রতিদিন সকালবেলা অফিসের কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে গভীর রাতে। শুধু তাই নয় রিনি লক্ষ্য করেছে তার প্রতি আসাদের যেনো আগের মতো টান নেই। সম্পর্কটা কেমন যেনো আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ হয়ে গেছে। আসাদ সংসারের দায় সারে বটে কিন্তু সেটা যেনো আকর্ষণহীন, দায়সারা গোছেরই। রিনির ছোটোখাটো কথাতেই রেগে যায়।
একদিন রিনি আসাদকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি যে প্রতিদিন সকালে বের হয়ে যাও আর ফিরে আসো গভীর রাতে এতোক্ষণ কী করো অফিসে?
কী করি মানে? এতো বড় একটা ব্যবসা দেখাশোনা করা কি কম কথা।
হ্যাঁ তা তো জানি কিন্তু তাই বলে ঘর-সংসার বাদ দিয়ে!
বাদ দিয়ে কেনো বলছো? আমি ঘর-সংসারের কোন দায়িত্বটা পালন করছি না?
করছো কিন’ সেই করাটা যেনো কেমন হয়ে গেছে।
কেমন হয়ে গেছে বলো?
রিনি তার কথা একরকম ফিরিয়ে নিলো, না থাক্‌।
আসাদ অযথাই উত্তেজিত হলো, না থাকবে কেনো? আমি অনেক দিন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি আমার সঙ্গে সবসময় বাঁকা দৃষ্টিতে কথা বলছো। তুমি কি মনে করো আমি ঠিক আগের মতোই সংসার আঁকড়ে ধরে বসে থাকবো?
তো?
তুমি চাও আমি আগের মতো সকালবেলা উঠে বাহাদুর বাজার থেকে বাজার করে আনি, তুমি রান্না করবে আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, বাচ্চাকে স্কুল নিয়ে যাই। তাই না?
রিনি পরিসি’তি শান্ত রাখার জন্য চুপ করে রইলো। কিন্তু আসাদের রাগ তখন চরমে। সে আবার বলতে শুরু করলো, আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকি আর টাকার তো হাত-পা আছে যে এমনিতে আমার বাড়িতে হেঁটে আসবে?
আসাদের কথা সত্যি। সে ছুটোছুটি না করলে এতো দ্রুত আকাশ ছোঁয়া উন্নতি হলো কী করে। রিনিও প্রতিদিন নামাজ পড়তো আর আসাদের সুস্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতো। আসাদের উন্নতি মানে তো তারই উন্নতি, তার ছেলেমেয়েদেরই উন্নতি এটাই তো স্বাভাবিক কথা। সারাদেশের মেয়েরা তো এটাই ভাবে কিন্তু রিনি এখন বুঝতে পারেনি একটা ভুল ধারণা নিয়েই মেয়েরা স্বামীর সংসার করছে।
স্বামীর উন্নতিতে যে মেয়েরা গর্ববোধ করে তাদের প্রতি আজ তার ঘৃণা অনেক। স্বামীর লক্ষ লক্ষ টাকায় স্ত্রীর খুশি হওয়ার চেয়ে, স্বামীর দেয়া হাজার টাকা দামের শাড়ি আর লক্ষ টাকা দামের সোনার গয়নার চেয়ে নিজের একটা টাকাও অনেক, তিন’শ টাকা দামের শাড়িও অনেক বেশি গর্বের। এখনো মেয়েরা স্বামীর দেয়া সোনার গয়না পরে গর্ববোধ করে। রিনি এতদিনে বুঝেছে, স্বামীর দেয়া গয়না উপহার নয়, শৃঙ্খল। পরাধীনতার শৃঙ্খল। এই বোধটা রিনির যখন এসেছে তখন তার আর কিছু নেই। দিনের পর দিন যে সংসারটা তিল তিল করে যত্ন করে আগলে রেখেছে সেই সংসারটা আর তার নয়।

একদিন রিনির এক বান্ধবী লাবনী এলো। সেই প্রথম রিনিকে বললো আসাদের সঙ্গে একটা মেয়ের সম্পর্কের কথা। লাবনীর প্রতিবেশী, মেয়েটির নাম মৌ। মেয়েটির আগে একবার বিয়েও হয়েছিলো কিন্তু সংসার টিকেনি। এখন বাবার বাড়িতে থাকে আর আজ একজন তো কাল আরেকজনের সাথে এরকম সম্পর্ক গড়ে তোলে।
কথাটা প্রথমে রিনি বিশ্বাস করেনি কারণ নারীর প্রতি আসাদের কোনোদিনও আসক্তি ছিলো না। সে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভবের প্রতি নেশাগ্রস্থ ছিলো। কিন্তু লাবনী তার সেই ছোটোবেলার বন্ধু। সেই বা তাকে মিথ্যা কথা বলবে কেনো।
সবকিছু বলে লাবনী রিনির হাত চেপে ধরে, কাকুতি মতো করে বললো, আমি প্রথম যখন দু’য়েক দিন দেখেছি তখনও তোকে বলিনি কিন’ এখন তো প্রায়ই দেখি। তাই তোকে বললাম, শেষে তোর না অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়।
লাবনীর কথা শুনতে শুনতে রিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো। আসাদের সঙ্গে তার পাঁচ বছরের প্রেম, জীবনে কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। আসাদ তাকে কতো ভালোবাসে, কতো ভালোবাসে অন্তিক আর জেবিনকে। এতোকিছু ছেড়ে আসাদ যাবে একটা ডিভোর্স মেয়ের কাছে।
সে সোফায় হেলান দিয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে লাবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দু’চোখ দিয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে।
লাবনী রিনির হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, মাথা ঠাণ্ডা রাখ্‌। টাকা-পয়সা হলে ছেলে মানুষের এরকম দুয়েকটা নেশা হয়। ওকে বোঝানোর চেষ্টা কর্‌।
সেদিন রাতে আসাদ বাসায় এলো আরো গভীর রাতে।
দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রিনি জিজ্ঞেস করলো, ভাত খাবে না?
না।
কেনো?
খিদে নেই।
খিদে নেই কেনো?
এবার আসাদ গর্জে উঠলো, রিনি বিরক্ত করো না তো। বলেছি তো আমার খিদে নেই।
অন্তিক আর জেবিন ততক্ষণে ঘুমিয়েছে। রিনিও রাতে খেলো না। সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার কোণায় বসে আসাদকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, এই ওঠো তো।
তোমাকে না বললাম আমাকে বিরক্ত করো না।
আমি তোমাকে বিরক্ত করছি না। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
অন্যদিন বলো।
দরজা খুলে আসাদের দিকে তাকাতেই রিনির মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিলো। তবু সে কোনো রকমে সামলে নিয়েছে কিন্তু যখন সে ভাত না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে তখন তার মাথার আগুন আরও হাজারগুণ জ্বলে উঠেছে। সে মনে মনে গুমরে উঠছিলো। এবার যখন আসাদ বললো অন্যদিন বলো তখন সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সে জোরে চিৎকার করে বললো, না। আমি এখনই বলবো। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
আসাদ বিছানা থেকে উঠে বসলো। সেও রাগান্বিত স্বরে বললো, কী বলো?
তুমি এতো রাত পর্যন্ত কোথায় থাকো?
অফিসে থাকি, ব্যবসার কাজে ছুটোছুটি করি।
ব্যবসার কাজে ছুটোছুটি করো নাকি কালিতলায় গিয়ে মৌ’র কাছে মধু অন্বেষণ করো?
আসাদ গর্জে উঠলো, রিনি।
রেগে যাচ্ছো কেনো?
মৌ’র কাছে যাই না। মৌ’র ভাই আর আমি এক সঙ্গে ব্যবসা করি। তাই কাজের প্রয়োজনে ওদের বাসায় যাই।
কাজের প্রয়োজনে ওদের বাসায় যাও, ভাই’র সঙ্গে কাজ করো আর বোনের সঙ্গে…
আসাদ প্রচণ্ড রেগে গেলো, রিনি মৌ সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলবে না।
তুমি যেতে পারবে, মৌ’র সঙ্গে প্রেম করতে পারবে আর আমি শুধু একটা কথা-ই বলতে পারবো না।
না, পারবে না। কারণ সমাজে মৌ’দের একটা অবস্থান আছে। তুমি কার না কার কাছে শুনে একটা মেয়ের সঙ্গে আজেবাজে কথা বলবে এটা হতে পারে না।
আর তুমি ঘরে বিবাহিতা বউ রেখে অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াবে এটা হতে পারে?
না। আমি মৌ’র সঙ্গে প্রেম করছি না।
তো কেনো যাও ওদের বাসায়?
ব্যবসার কাজে।
ব্যবসার কাজে তো অফিস আছে, বাসায় কী?
কাজ থাকতে পারে না।
না। তুমি আর কোনোদিন ওদের বাসায় যাবে না। যদি যাও…
যদি যাই তো কী করবে?
আমি গিয়ে হাজির হবো। ঐ মাগীকে…
এতোক্ষণ জোরে কথা বলছিলো এবার তার কথার সুর গম্ভীর এবং ভয়ঙ্কর হলো, যাওয়া তো দূরের কথা তুমি যদি মৌ’র বিষয় কোনোদিন আজেবাজে কথা বলো…
রিনি উত্তেজিত হলো, তো কী করবে, ডিভোর্স করবে?
হ্যাঁ, ডিভোর্স করবো।
এতো সোজা, আমাকে ডিভোর্স করা এতো সোজা।
রিনি আমি এতো রাতে তোমার সঙ্গে সিন ক্রিয়েট করতে চাই না আমি আবারো বলছি তুমি যদি মৌ’র সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে বেড়াও তবে আমি তোমাকে ডিভোর্স করবো, সেটা সোজা হোক আর কঠিনই হোক।
তুমি, তুমি আমাকে…

সেদিনের পর থেকে কয়েক দিন আসাদের আচরণ একটু সংযতই ছিলো কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবার শুরু হলো গভীর রাতে বাসায় ফেরা। আবার মৌ’র বাসায় যাওয়া-আসা। সন্ধ্যার পর বাসায় কোনো জরুরি প্রয়োজনে ফোন দিলেও আসাদ রিসিভ করে না। একেবারে বাসায় এসে রিনির ওপর রাগারাগি করে, এতো ফোনের কী আছে, আসছি তো। কাজ করতে দিবে না? নাকি তোমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবো?
আমি কি তোমাকে কোলে করে নিয়ে বসে থাকতে বলেছি। আর দু’য়েক দিন পরই নতুন বাড়িতে উঠবো, আমার ওপর দিয়ে কতো কাজ যাচ্ছে। তুমি বাসায় থাকলে তো বাচ্চাদের একটু সময় দিতে পারো।
হ্যাঁ। আমি এখন আমার ব্যবসার কাজ ছেড়ে তোমার সঙ্গে এসে বাসার জিনিসপত্র গোছাবো না? আমি বাইরে থাকলে আমাকে আর কখনো একবারের বেশি ফোন দিবে না। মোবাইল ফোন বাজতে থাকলে খুব বিরক্ত লাগে।
আর একদিন পরই নতুন বাড়িতে উঠবে। ক’দিন থেকে টানা কাজ করতে করতে রিনি হাঁপিয়ে উঠেছে। কাজ শেষ করে রিনি টি.ভি চালু করে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে এমন সময় জেবিন মাম, মাম বলতে বলতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে তুলতেই মেঝেতে পড়ে গ্লাসটা ভেঙ্গে গেলো।
রিনির প্রচণ্ড রাগ হলো। সে সোফা থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে জেবিনের গালে ঠাস্‌ করে একটা চড় দিয়ে বললো, এতো ভালো গ্লাসটা ভেঙ্গে ফেললে?
জেবিন জোরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো।
রিনি জেবিনের হাত ধরে একরকম জোর করে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আসাদকে মোবাইল করলো।
রিনি পর পর কয়েক বার ফোন করলো কিন্তু আসাদ ফোন রিসিভ করলো না।
কয়েক দিন আগে আসাদের মোবাইল ফোনে একটা ফোন এলো। আসাদ বারান্দায় গিয়ে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে ফিস্‌ফিস করে কথা বলে ফোন রেখে দিলো। সেদিন আসাদের কথা বলার ধরণ দেখে রিনির সন্দেহ হয়েছিলো। আসাদ যখন বাথ রুমে ঢুকেছিলো তখন সে মোবাইল নাম্বারটা তার মোবাইলে সেভ করে নিয়েছিলো। পরদিন রিনি সেই নাম্বারে ফোন করলো।
হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।
অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠস্বর শুনেই রিনির মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই ওয়ালেকুম আস্‌সালাম বলার পর বললো, আপনি কি মৌ বলছেন?
জি বলছি।
রিনির ইচ্ছা হচ্ছিলো দু’য়েক কথা শুনিয়ে দিবে কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেক সামলে নিলো।
আজ বার বার ফোন করার পর যখন আসাদ ফোন রিসিভ করছে না তখন রিনি মৌ’র মোবাইলে ফোন করলো।
মৌ ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।
কে বলছেন প্লিজ?
আমি রিনি বলছি। আপনার ওখানে কি আসাদ আছে?
ও আসাদ ভাইয়া তারপর একটু থেমে বললো, নাতো।
রিনির কানে স্পষ্ট আসাদের কথা বলার শব্দ ভেসে এলো। সে কিছুটা জোর দিয়ে বললো, মিথ্যা কথা বলছেন কেনো? আমি তো ওর গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
মৌ কোনো কথা বললো না।
স্বামীকে অন্য নারীর পাশে থাকা নিশ্চিত জেনে রিনি রাগে ফেটে পড়লো। সে একরকম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, এই মাগী আমার হ্যাজবেন্ডকে নিয়ে ফুর্তি করতে তোর লজ্জা হচ্ছে না, এতোই যদি ফুর্তি করতে ইচ্ছা করে তো বিয়ে করলেই তো পারিস্‌ তখন নিজের হ্যাজবেন্ডকে নিয়ে ফুর্তি কর্‌বি। আমার হ্যাজবেন্ডকে নিয়ে…
রিনির কথা বলার শেষ হওয়ার আগেই মৌ লাইন কেটে দিলো।
রাতে রিনি আরো অনেকবার ফোন দিলো কিন্তু আসাদ এলো না। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে রিনির মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিলো। এইতো ক’দিন আগে আসাদ বলেছিলো, কোনোদিন মৌকে নিয়ে কোনো কথা বললে…
নাহ্‌, মৌকে বিশ্রী ভাষায় কথা বলার পর থেকে রিনির নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মৌ’কে সে কেনো খারাপ ভাষায় কথা বলবে, মৌ তো তার কেউ না।
উল্টো মৌ যদি বলতো, আপনি আমাকে বলছেন? আপনার হ্যাজবেন্ডকে বলুন।
তখন রিনি কী জবাব দিতো।
আবার আসাদ এসে যদি বলে তুমি মৌকে ফোন করেছো কেনো? যা বলার আমাকে বলবে, ওর ভাই আর আমি একসঙ্গে ব্যবসা করি আর তুমি…
না রিনি আর ভাবতে পারছে না। তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রিনি সারারাত আসাদকে অনেকবার ফোন দিলো কিন’ আসাদ ফোন রিসিভ করলো না।
আসাদ এলো পরদিন সকালবেলা। তার চোখ দু’টো লাল যেনো ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, চুলগুলো উস্‌কোখুস্‌কো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
্‌আসাদের চোখে চোখ পড়তেই রিনির বুক কেঁপে উঠলো। কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে। আসাদের চোখে চোখ রাখতে তো রিনির কোনোদিন ভয় হয়নি, তবে আজ কেনো?
রিনি দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে যাচ্ছিলো আসাদ গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিলো, দাঁড়াও।
রিনি ঘুরে দাঁড়ালো।
আসাদ রিনি হাতে একটা হলুদ খাম ধরিয়ে দিলো, নাও এটা তোমার খাম।
রিনি যেনো আকাশ থেকে পড়লো, আমার খাম!
আসাদ কোনো কথা বললো না। কোনো রকমে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো।
রিনি খামটা খুলে দেখেই পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো, তুমি, তুমি আমাকে…
আসাদের শান্ত, নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছি। তুমি আমার বাড়ি থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যাও।
রিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
অল্পক্ষণের মধ্যে ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামের বাড়ি থেকে রিনির আত্মীয়-স্বজনরা এলো। তারা প্রথমে আসাদকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন’ আসাদ তার সিদ্ধান্তে অনঢ়। অগত্যা রিনি অন্তিক আর জেবিনকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। বাসা থেকে বের হতেই রিনি তার নিজের মেধা, শ্রম দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা বাড়িটির দিকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তার বার বার মনে হলো এই বাড়িটি আর তার নয়, এই বাড়ির সে আর কেউ নয়।
সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*