বন্ধন

বিমান থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইকবাল দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, সুখ, বুক ভরা সুখ। তারপর দূরে দিগন্ত বরাবর অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আজ অনেক বছর পর নিজের জন্মভূমিকে সে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করল। বারো বছর আগে উচ্চ শিক্ষার্থে সে যেদিন আমেরিকা চলে যায় সেদিনের স্মৃতিগুলো ইকবালের মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল। ইকবাল বিমান বন্দর থেকে বের হওয়ার সময় অনেকবার এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া নিয়ে শান্তিবাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। শুধু বিমান বন্দর নয়, ঢাকার রাস্তাগুলোও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে, বিমান বন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাছ যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছ। ইকবাল মনে মনে স্বদেশের গুণ কীর্তন করতে করতে শান্তিবাগে তার দুলাভাই’র বাসার গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। ইকবাল কলিং বেলে টিপ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ১৩/১৪ বছর বয়সের একটি মেয়ে গেট খুলে দিয়ে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইকবাল মেয়েটির মুখ উঁচু করে বলল, কেমন আছ সোনামণি?

আমার নাম সোনামণি না, খুকুমণি। বলে খুকুমণি ভিতরে দৌড়ে গিয়ে জোরে চিৎকার করে বলল, খালা আম্মা।

ইকবাল খুকুমণির পিছনে পিছনে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই সালাম সাহেব সহাস্যে চিৎকার করে বললেন, কীরে বিমান থেকে নেমে একটা ফোন তো করতে পারতিস, আমরা তোকে রিসিভ করতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, যাক তুই চলে এসেছিস ভালোই হলো।

দুলাভাই বিমান এক ঘণ্টা আগেই এসে পৌঁছাল, ভাবলাম আপনাদের ফোন করে এক ঘণ্টা বিমান বন্দরে বসে থাকার চেয়ে বরং চলে যাই, আপা কোথায়?

কই গো, তোমার ভাই এসেছে আগে এদিকে এসো।

আয়েশা ড্রয়িং রুমে চলে এলেন। ইকবাল আয়েশার পা ছুঁয়ে সালাম করল, আয়েশা ইকবালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, বেঁচে থাক ভাই।

ইকবাল আয়েশাকে সালাম করা শেষ হলে শ্রেয়া ইকবালের পা ছুঁয়ে সালাম করতেই ইকবাল শ্রেয়ার দু’হাত ধরে বলল, বেঁচে থাক মা, তারপর ব্যাগটা খুলে আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা গিফটগুলো বের করছিল। এমনসময় সালাম সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, ওসব এখন রাখ, আগে হাত মুখ ধুয়ে আয়, নাস্তা খাই তারপর সব জিনিসপত্র বের করিস।

ইকবাল গলা পরিষ্কার করে মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলল, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, এখন আপনাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে প্যাকেট দেয়া হবে তারপর আপনারা সবাই নিজ নিজ রুমে গিয়ে প্যাকেট খুলে দেখবেন, দেখার পর আবার এখানে চলে আসবেন, কার প্যাকেটে কী আছে তা বলা যাবে না। সমালোচনা করা যাবে না, আজকেও না, কোনদিনও না। সবাই বলুন, প্রোমিজ।

খুকুমণি ও শ্রেয়া প্রোমিজ বলে হাত তুলল। তারপর দু’জনে তাদের প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেল।

তোর পাগলামিটা এখনো আগের মতোই আছে, বলে আয়েশা তার প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেলেন।

পাগলের পাগলামি থাকবে না তো কী থাকবে? বলে সালাম সাহেবও তার রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সবাই হাসিমুখে ড্রয়িং রুমে ফিরে এলেন। তারপর ইকবাল হাতমুখ ধুয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে অবাক বিস্ময়ে কপালে চোখ তুলে বলল, আপা সব মনে রেখেছিস, ঠিক আগের মতোই!

কী মনে রেখেছি?

আমার যা যা পছন্দ, ঠিক সে সবই রান্না করেছিস। পাট শাক, কচু পাতা ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা, বলে ইকবাল টাকি মাছ ভর্তা নাক দিয়ে শুকে বলল, আহ! টাকি মাছের ভর্তা কত দিন পর আবার তোর সাথে দেখা।

আয়েশা ধমকের সুরে বললেন, তোর আর বক বক করতে হবে না, শুরু কর।

দুলাভাই প্লিজ, বলে ইকবাল শুরু করল। খেতে খেতে ইকবাল এক মুহূর্ত চুপ করে রইল না। সবসময় কথা বলেই চলল। সালাম সাহেব ইকবালের কথায় ঈষৎ রাগান্বিত হলেন মুখে কিছু বললেন না, নীরবে খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলেন।

একে একে আয়েশা ও শ্রেয়া ড্রয়িং রুমে বসলে ইকবাল প্রথমে বলতে শুরু করল, দুলাভাই আমরা কয়েকজন ডাক্তার এক সঙ্গে ছিলাম, সবাই বিভিন্ন দেশের, সেখানে একজন বাঙ্গালীও ছিল না যে প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলব। আমিও তাদের সঙ্গে সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতাম। কিন্তু কথা বলে তৃপ্তি পেতাম না, মন খুলে কথা বলার জন্য আমার সাথে যদি একজন বাঙালি থাকত তবে খুব মজা হতো। ভাবলাম যা সম্ভব নয়, তা ভেবে লাভ নেই, তার চেয়ে একজনকে বাংলা শেখানোই ভালো। তারপর ইংল্যান্ডের একজন ডাক্তারকে বাংলা শেখাতে চাইলাম, কিন্তু প্রথমে রাজি হলো না। তারপর আমি যখন তাকে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেয়ার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানালাম তখন সে বাংলা শেখার জন্য খুব আগ্রহ প্রকাশ করল। ধীরে ধীরে আমি তাকে বাংলা শেখালাম। তখন তার সঙ্গেই বাংলায় কথা বলতাম। আজ কতদিন পর আপনাদের সাথে বাংলায় কথা বলতে পারছি-

আয়েশা ইকবালের কথার মাজে বাধা দিয়ে বললেন, বাংলায় কথা বলতে যখন এতই ইচ্ছা তখন এবার একটা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যা।

আমি বিয়ে করব? বিয়ে করে আমেরিকা নিয়ে যাব? ইকবাল বলল।

সালাম সাহেব ঈষৎ রাগান্বিত স্বরে বললেন, কেন? তোর বিয়ের বয়স হয়নি? নাকি তোর বিয়ের বয়স চলে গেছে? বয়স প্রায় চল্লিশ হলো এখনও বলে বিয়ে করবে না। আর ক’দিন পরে তো তোর জন্য মেয়েই পাওয়া যাবে না।

দুলাভাই আমার যখন বিয়ে করার সময় হবে তখন আমি নিজেই বলব। আর আমি তো আমেরিকা থেকে একেবারে চলে এসেছি।

কেন? আমেরিকায় কি আর পাগল নেই? যে একেবারেই চলে এসেছিস। এবার বাংলাদেশের পাগল ভালো করবি নাকি?

দুলাভাই আপনি বার বার পাগল বলছেন কেন? মানুষকে পাগল বলতে হয় না, বলতে হয় মানসিক রোগী। আর আমি পাগলের ডাক্তার নই, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মামা তুমি আর আমেরিকা যাবে না? সবাই আমেরিকা যাবার জন্য পাগল আর তুমি আমেরিকা থেকে চলে এসেছ?

ইকবাল নিজের সোফা থেকে উঠে শ্রেয়ার পাশে বসে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, না রে মা, আমি আর কোনো দিন আমেরিকা যাব না। আমাদের দেশে ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। রোগীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের অর্থ এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমি বাংলাদেশের আলো বাতাসে মানুষ হয়েছি, দরিদ্র মানুষের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া করেছি। দেশের মানুষের কাছে আমার ঋণ অনেক, তাই মানুষের সেবা করে ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করতে করব। বলতে বলতে ইকবালের দু’চোখের কোণা জলে ভরে গেল।

সালাম সাহেব আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ইকবাল তোর মতো যদি সবাই দেশের কথা ভাবত তবে এ দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি একটা চেম্বার ভাড়া করব। দুলাভাই, আমি কয়েকদিনের জন্য পঞ্চগড় যাব সেখান থেকে ফিরে এসে চেম্বারে বসব। আপনি আমাকে একটা চেম্বার ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন।

অবশ্যই! কবে থেকে চালু করবি?

আজতো মাসের বারো তারিখ, আগামী মাসের মধ্যে।

বেশ আমি তার আগেই তোর সব ব্যবস্থা করব।

 

দুই

 

ইকবালের বন্ধু হাসিবুল, খুব কাছের বন্ধু। ছাত্র জীবনে হোস্টেলের একই রুমে থেকেছে দীর্ঘ দিন। হাসিবুল শান্তশিষ্ট, ভদ্র, খোলামেলা এবং উদার মনের মানুষ। কথাবার্তা একটু বেশি বলে তাই ইকবালের সঙ্গে খুব ভালো মিল ছিল। দু’জনেই বেশী কথা বলার লোক, তাই দু’জনে পাল্লা দিয়ে কথা বলতে কে বেশী কথা বলতে পারে? তবে হাসিবুল যত বেশি কথাই বলুক না কেন পারভিনকে ভালোবাসার কথাটা সে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল হৃদয়ের মাঝে। পারভিন হাসিবুল আর ইকবাল মেডিক্যাল কলেজে এক সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। পারভিন ইকবাল আর হাসিবুল দু’জনের সঙ্গেই সমানভাবে মিশেছিল। এমনভাবে মিশতে মিশতে পারভিন হাসিবুলের প্রতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ল নিজের অজান্তেই হাসিবুলও পারভিনের দিকে এগিয়েছিল সমানভাবে আর দু’জনের ভালোবাসার কথা তারা খুব যত্ন করে লালন করেছিল। ইকবাল হাসিবুলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রুমমেট হলেও ঘুণাক্ষরেও হাসিবুল নিজে কোনোদিন তাদের ভালোবাসার কথা বলেনি আর ইকবালও টের পায়নি। শুধু তাই নয় তারা পরস্পরকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। হয়তবা কোনো গোপনীয়তা আর অপেক্ষা ছাড়া প্রেম সফল হয় খুব কমই।

ইকবাল যখন আমেরিকা চলে যায় তখনো হাসিবুল আর পারভিন বিয়ে করেনি। ইকবালই প্রথম আমেরিকা থেকে হাসিবুল আর পারভিনকে চিঠি লিখে ঠিকানা জানিয়েছিল। তারপর তারাই ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। অনেকদিন পর ইকবাল হঠাৎ বিয়ের কার্ড পেয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন আর দীর্ঘায়ু কামনা করে। তারপর থেকে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কয়েকমাস আগে চিঠিতে হাসিবুল লিখেছিল তাদের বাসার পরিবর্তিত ঠিকানা।

সেই ঠিকানা ধরে ইকবাল বাস থেকে নেমে বি.পি স্কুলের বিপরীতে একটি তিনতলা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকানাটা একবার মিলিয়ে দেখল তারপর কলিং বেল এ টিপ দিল। ভিতর থেকে নারী কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, কে? বাবা সৌরভ দরজাটা খুলে দে তো।

৮/১০ বছর বয়সের একটি ছেলে দরজা খুলে দিল। ইকবাল ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে সস্নেহে বলল, বাবা আলেকজান্ডার।

ছেলেটি মিষ্টি হেসে বলল, আমার নাম আলেকজান্ডার নয়, সৌরভ।

ইকবাল কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি তোমার নাম সৌরভ কিন্তু তুমি একদিন গ্রেট হবে। তাই তোমাকে আলেকজান্ডার দি গ্রেট এর নাম অনুযায়ী আলেকজান্ডার বলে ডাকলাম। তোমার বাবার নাম নিশ্চয়ই হাসিবুল আর মায়ের নাম পারভিন।

সৌরভ ও ঠিক ইকবালের ভঙ্গিতে বলল, আপনি নিশ্চয়ই ইকবাল মামা, প্লিজ ভিতরে আসুন, বলে সৌরভ ইকবালের হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল।

ইকবাল জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে?

সৌরভ উত্তর দিল, আপনার ছবি আমি অ্যালবামে দেখেছি, আর মা প্রায়ই আপনার কথা বলে তাই অনুমান করলাম আর কী! তারপর ইকবালকে সোফায় বসতে বলে সৌরভ ভিতরে চলে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে পারভিন ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে কপালে হাত দিয়ে বলল, ইকবাল তুই? কোনো চিঠিপত্র না দিয়ে সশরীরে?

জি ম্যাডাম, ভাবলাম সারপ্রাইজ দেব।

এমনসময় হাসিবুল ড্রয়িং রুমে ঢুকল, ইকবাল কোথা থেকে? কীভাবে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে, মার-টার খেয়েছিস নাকি?

পারভিন বলল, কতদূর থেকে এসেছে, ভালোভাবে কথাবার্তা বলবে তা না করে আসা মাত্র তুমি ঝগড়া শুরু করলে।

ঝগড়া ও করবে কী? ঝগড়া তো করব আমি। তার আগে তোরা দু’জন বস, সম্পর্কটা ঠিক করে নেই, ইকবাল বলল।

ইকবালের কথা মতো পারভিন আর হাসিবুল সোফায় পাশাপাশি বসল। তারপর ইকবাল জিজ্ঞেস করল তোরা দু’জনে আমার বন্ধু ছিলি, এখন আবার নতুন সম্পর্ক পেতেছিস, তাই আমি ও তোদেরকে নতুন সম্পর্ক ধরে ডাকব। আমি যদি হাসিবুলকে ভাই বলি তবে তোকে ভাবী বলব, আর যদি তোকে আপা বলি তবে হাসিবুলকে দুলাভাই বলব। এখন তোরা দু’জনে বল আমি কাকে কী বলে ডাকব?

পারভিন আর হাসিবুল দু’জনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিবুল সহাস্যে বলল, তোর পাগলামি টা দেখি এখনো গেল না, তোর যাকে যা ইচ্ছা তাই বলে ডাকিস।

তবে তাই হোক, আপা-দুলাভাই বলেই ডাকব। আপা ডাকলে একটা বাড়তি সুবিধা আছে, না?

বাড়তি সুবিধাটা কীরে? পারভিন জিজ্ঞেস করল।

আপা যদি রাগ না করিস তবে বলব।

কিছু বলব না, নিঃসঙ্কোচে বল।

আমাদের দেশের মেয়েরা দেবরের চেয়ে ভাইকে বেশি আদর করে তাই-

পারভিন মুখ বিকৃত করে চলে গেল।

হাসিবুল নিঃশ্বাস টেনে বলল, এখন তোর কথা বল, বিদেশের কথা বল।

বড্ড খারাপ দিন গেছে দুলাভাই, সাফল্যের পিছনে ছুটে চলা স্নেহ, মায়া মমতাহীন এক যান্ত্রিক জীবন।

বলিস কী তুই? সবাই তো বিদেশে গিয়ে আনন্দে থাকে তারপর আমেরিকা তো স্বপ্নের দেশ। সেখানেও তোর ভালো লাগল না। তবে কি আর আমেরিকা যাবি না?

ইকবাল দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, অবশ্যই না।

ঢাকায় প্র্যাকটিস করবি?

হ্যাঁ, দুলাভাইকে চেম্বার ভাড়া করতে বলেছি, এখান থেকে ফিরে গিয়ে চেম্বারে বসব।

এমন সময় পারভিন ট্রেতে করে চা নাস্তা এনে টি টেবিলে রেখে বলল, আগে চা নে, খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

ইকবাল পারভিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা এখন তোদের কথা বল।

আমাদের কী শুনবি? তুই তো বিদেশ চলে গেলি, আমরা দু’জনে বি.সি.এস পরীক্ষা দিলাম, সরকারি চাকুরিতে জয়েন করলাম, এখন আমার পোস্টিং সদর হাসপাতালে আর ওর পোস্টিং আটোয়ারী হাসপাতালে। দিন চলে যাচ্ছে কোনোভাবে। আমাদের একমাত্র ছেলে সৌরভ।

হাসিবুল ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক তো হলো, এবার বিয়ে করে সংসারী হ।

কেবল তো দেশে এলাম, আগে নিজের দেশটা ভালোভাবে দেখব।

আগে বিয়ে কর তারপর বউ নিয়ে ঘুরিস, দেখিস, পারভিন বলল।

আপা এখনকার মতো বিষয়টা থাক, পরে আলাপ হবে। বলে হাসিবুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোদের কি আগামীকাল ডিউটি আছে?

দু’জনে সমস্বরে বলল, না।

তবে চল আগামীকাল তেঁতুলিয়া থেকে ঘুরে আসি।

পরদিন সকাল বেলা সবাই তেতুঁলিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। হাসিবুল স্ট্যান্ড থেকে একটা মাইক্রো-বাস ভাড়া করে নিয়ে এলো এমনসময় হাসিবুলের মোবাইলে রিং বেজে উঠল।

হাসিবুল মোবাইলে কথা বলা শেষ করে গম্ভীর মুখে বলল, আমার আর যাওয়া হলো না, ইমারজেন্সি কেইস এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে। তোরা গিয়ে ঘুরে আয়।

 

তিন

 

মাইক্রো-বাস দ্রুত গতিতে ছুটে চলল। অনেক দিন পর এক সঙ্গে কথা বলতে পেরে ইকবাল আর পারভিন দু’জনে আনন্দে মেতে উঠল। কখন যে গাড়ি তেঁতুলিয়া ঢুকে পড়েছে দু’জনে খেয়াল করতে পারেনি। ড্রাইভার তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা মোড়ে মাইক্রো-বাসটি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, কই যাবেন স্যার?

বাহ্‌! তেঁতুলিয়া এসে পড়েছি? ডাকবাংলোর দিকে যাও, ইকবাল বলল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি ডাক বাংলোর সামনের মাঠে এসে দাঁড়াল সবাই গাড়ি থেকে নেমে একটি কংক্রিটের ছাতার নিচে বসল। কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে কাছে এসে বলল, স্যার কিছু লাগবে?

ইকবাল বলল, তোর কাছে তো কিছু দেখছি না, অথচ জিজ্ঞেস করলি কী লাগবে?

সব আছে স্যার, চিনাবাদাম, বুট, ঝালমুড়ি সব আছে, ঐ যে আমাদের দোকান বলে ছেলেটি অদূরে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, স্যার কী আনব?

ইকবাল একবার সৌরভ ও পারভিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চিনাবাদাম নিয়ে আয়। তুমি কি বল বাবা? আপা ঠিক আছে?

না মামা ঠিক নেই, আমি চলকেট খাব বলে সৌরভ তার মাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বলো মা?

কয়েকটা চকলেট আর এক’শ গ্রাম চিনা বাদাম নিয়ে আয়, বলে ইকবাল অর্ডার দিতেই ছেলেটি চলে গেল। কয়েক মিনিট পর ছেলেটি চিনাবাদাম আর চকলেট নিয়ে এলো। ইকবাল পকেট থেকে টাকা বের করে দিতে দিতে বলল, ডাকবাংলোর কেয়ার টেকার কোথায় থাকে জানিস?

জি, এখন আমাদের দোকানে বসে আছে।

ডাক দে তো।

জি আচ্ছা, বলে ছেলেটি চলে গেল।

মামা আমি ঐ দোলনায় উঠব, সৌরভ বলল।

বেশ তো যাও।

সৌরভ দোলনায় দোল খাওয়ার জন্য চলে গেল। কিছুক্ষণ পর চল্লিশ/পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দাড়িওয়ালা একটি লোক বসে বলল, আমাকে ডেকেছেন স্যার?

ইকবাল জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কুদরত না?

কুদরত কপালে হাত দিয়ে নিরিখ করে বলল, আপনি কি ইকবাল ভাই?

তুমি তো দেখছি বুড়া হয়ে গেছ।

ভাইজান অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা, তাও আবার ভাবী-ভাতিজাসহ, চলেন আমার বাসায়, আমার পরিবার ভাবিকে দেখে খুব খুশি হবে।

পারভিন লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইল।

ইকবাল বলল, কুদরত ও তোমার ভাবী না, আমার আপা।

তওবা, তওবা বলে কুদরত নিজের দু’গালে নিজেই চড় মারল, তারপর বলল, তাহলে ডাকবাংলো খুলে দিই, এই বলে কুদরত ডাকবাংলোর দিকে যাচ্ছিল। এমনসময় ইকবাল বলল, এই কুদরত লাগবে না। আমরা এখানেই কিছুক্ষণ বসব।

ঠিক আছে ভাইজান, বলে কুদরত চলে গেল।

পারভিন ইকবালকে জিজ্ঞেস করল, কিরে কুদরতকে কীভাবে চিনিস?

কুদরতের বাবা আমার বাবার অফিসে পিয়নের চাকুরি করত, তখন কুদরত প্রায়ই আমাদের বাসায় যেত। সে সময় ডাকবাংলোতে চাকুরি করার লোক পাওয়া যেত না, এক রকম বাবার পরামর্শে কুদরত ডাকবাংলোর কেয়ারকেটার পদে চাকুরিতে যোগ দেয়।

থাম থাম হিসাবটা মিলিয়ে নেই, তোদের বাসায় যেত মানে?

ও তুই তো জানিস না, আমরা অনেকদিন পঞ্চগড় ছিলাম। বাবা পঞ্চগড়ে চাকুরি করতো।

তাই বল, আমি তো জানতাম তোদের বাড়ি ঢাকায়।

ঢাকায় আমি দুলাভাইয়ের বাসায় থাকতাম, ইকবাল বলল।

এমন সময় কুদরত প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর নিয়ে এলো।

ইকবাল বলল, কুদরত এসবের কি প্রয়োজন ছিল?

আপনারা খান আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে কুদরত চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর চা এলো। দু’জনে চা শেষ করতে করতে অনেক গল্প করল, তারপর ইকবাল একটা গাছের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, আপা চল না ঐ গাছটার নিচে গিয়ে একটু বসি।

দু’জনে গাছের দিকে যাচ্ছিল এমন সময় সৌরভ মা বলে ডাক দিতেই পারভিন বলল, ইকবাল তুই গিয়ে বস আমি আসছি।

ইকবাল গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ঘাসের উপর বসল। মৃদু বাতাসে অল্পক্ষণের মধ্যেই যেন ইকবালের দু’চোখে ঘুম নেমে এলো।

পারভিনও কিছুক্ষণের মধ্যে গাছের নিচে এসে ইকবালকে ঘুমাতে দেখে কয়েকবার মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, ইকবাল, ইকবাল…………।

ইকবালের কোনো সাড়া নেই। পারভিন ইকবালের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতেই ইকবাল চমকে উঠল, কে?

কিরে একটুতেই ঘুম? গাছের নিচে কোনো পরী আছে নাকি?

আগে ছিল, এখন নেই।

পারভিন ইকবালের পাশে বসে বলল, বল না একটু পরীর গল্প শুনি।

শুনবি? তাহলে শোন। আমার বাবা পঞ্চগড় চাকুরি করত, দীর্ঘদিন আমরা পঞ্চগড় ছিলাম। আমরা ধাক্কামারার শীলা ভিলা নামে একটি সেমিপাকা বাসায় ভাড়া থাকতাম। বাড়িওয়ালা তার একমাত্র আদরের মেয়ে নামে বাসাটির নাম রেখেছিলেন শীলা ভিলা। পাশেই বাড়িওয়ালা থাকত। কিন্তু দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাসায় থাকলেও শীলার সঙ্গে আমার কোনোদিন কথা হয়নি। শীলা পঞ্চগড় গভ. গার্লস স্কুলে আর আমি পঞ্চগড় বি. পি. স্কুলে পড়তাম। এস.এস.সি পাশের পর দু’জনের এম. আর কলেজে ভর্তি হলাম। একদিন আমি আর আমার এক বন্ধু কলেজের মাঠে বসেছিলাম। পাশ দিয়ে শীলা আর তার এক বান্ধবী হেঁটে যাচ্ছিল। অবশেষে সাহস করে বললাম, শীলা এসো।

শীলা আর ওর বান্ধবী আমাদের দু’বন্ধুর মুখোমুখি বসেছিল। আমি আমার পরিচয় দিতেই শীলা বাধা দিয়ে বলল, তুমি ইকবাল, বি. পি. স্কুল থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।

তারপর অনেকক্ষণ সবাই চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিলাম সেদিন থেকে শীলার সঙ্গে কথা বলা শুরু হলো। আমরা দু’জন ধীরে ধীরে পরস্পরের খুব কাছাকাছি হলাম। একজনের নোট বই, খাতার প্রয়োজনে অন্যজন খুব সহজে চেয়ে নিতাম। যদিও সে সময় দু’জন ছেলে মেয়ে একই রিকশায় উঠার প্রচলন ছিল না। তবুও আমরা দু’জনে অনায়াসে একই রিকশায় উঠতাম। সে বছর কলেজের পিকনিকে এসেছিলাম, এখানে। তেঁতুলিয়া ডাক বাংলোয়। এখানে তখন এত কিছু তখন ছিল না, বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ ছিল। আমরা এখন যে গাছটার নিচে বসে আছি এই গাছটার চারপাশে তখন ফুলের গাছ থাকায় এখানে বসে থাকলে ডাক বাংলো থেকে দেখা যেত না। আমরা দু’জন অনেকক্ষণ এখানে বসে গল্প করছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘর বাঁধার, জীবন গড়ার। ঐ দিকে সবাই আমাদেরকে না পেয়ে তামাশা করে মাইকে বার বার নিখোঁজ সংবাদ ঘোষণা করেছিল। তারপর ডাক বাংলোয় গিয়ে সব বন্ধুরা মিলে মহানন্দা নদীতে নেমেছিলাম। শুরু হয়েছিল নদী থেকে পাথর তোলার প্রতিযোগিতা। বন্ধুরা কেউ কেউ পাথর তোলার জন্য নদীতে নেমেছিল। আর প্রত্যেকের পাথর গুনার জন্য একজন করে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার পাথর গুনার জন্য শীলা পাড়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ আমার মনে দুষ্টুমি ভর করল।

আমি শীলাকে বললাম, শীলা জোরে একটা পাথর ছুঁড়ে মারি?

শীলা মিষ্টি হেসে বলল, তোমার হাতের যা অ্যাটেমপ্‌ট আমার কপালে মারতে চাইলে আরও দু’হাত দূরে গিয়ে পড়বে।

ঠিক আছে, বলে আমি ওর দিকে ছোট্ট একটা নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে শীলার কপালের ডান পাশে লেগে ফিনকির মতো রক্ত ঝরে পড়ল। আমি নদী থেকে দৌড়ে উপরে উঠলাম। আরও দু’একজন উপরে উঠে এলো, সঙ্গে সঙ্গে খেলা শেষ, বলে ইকবাল একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, হয়তো এতদিন কপালের দাগটা মিশে গেছে?

এতক্ষণ পারভিন ইকবালের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিল। এবার বলল, কপালের দাগ মিশলেও মনের দাগটা হয়তো মিশেনি, বলে একটু থামল তারপর বলল, তারপর বল।

দু’জনে এইচ.এস.সি পাস করলাম। আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলাম আর শীলা ইডেন কলেজে। একদিন বিকেল বেলা ইডেন কলেজের গেট থেকে শীলার সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ পাঠিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে বলল, আপা রুমে নেই। আমি মনে করেছিলাম বাইরে থেকে ফিরবার সময় দেখা করব। কিন্তু বেশিক্ষণ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। শীলা গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। শীলাকে দেখে আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম। শীলার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলাম, শীলা।

শীলা আমার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, কে আপনার শীলা?

তারপর শীলা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা প্রাইভেট কার-এ উঠল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শীলাকে চিনতে ভুল করেছিলাম কি না সে কথা ভাবতে ভাবতে কয়েক মিনিট কেটে গিয়েছিল। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে বললে শীলা নেই?

দারোয়ান বলল, আপাই তো আমাকে শিখিয়ে দিল।

আমার আর বুঝতে বাকী রইল না, আমি ফিরে এলাম। তখন থেকে শীলার সঙ্গে আর কোনোদিন যোগাযোগ করিনি।

কীরে আমি তো জানতাম তুই কোন কিছু লুকাতে পারিস না। কিন্তু অনেকদিন একসঙ্গে লেখাপড়া করলাম, কোনদিনও তো বললি না। তুইও তো কষ্ট কম চেপে রাখতে পারিস না, পারভিন বলল।

এমন সময় সৌরভ মা মা বলে ডাক দিতেই পারভিন বলল, চল উঠা যাক।

তারপর দু’জনে উঠে পড়ল।

 

চার

 

পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে পারভিন ও হাসিবুল দু’জনে ডিউটিতে চলে গেল। ইকবালও দু’জনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। শহরে তার পরিচিত দু’একজনের সঙ্গে দেখা হলো, এক রকম বাজারে আড্ডা দিয়েই ইকবাল অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিল। তারপর বাসায় ফেরার সময় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে একটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠল। ইকবাল মনে মনে ভাবল, আবার ভুল হচ্ছে না তো? চোখে চোখ পড়তেই শীলাই প্রথম কথা বলল, ইকবাল না?

ইকবাল থতমত খেয়ে বলল, শীলা।

ইকবাল ভিতরে এসো।

ইকবাল শীলার পিছনে পিছনে দ্বিতীয় তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকল।

ইকবালকে সোফায় বসতে বলে শীলা নিজে পাশাপাশি সোফায় বসে বলল, কেমন আছ?

ভালো, ইকবালের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

পোস্টিং কোথায়? কোথা থেকে এলে?

ইকবাল বলল, আমি আসলে দেশে ছিলাম না, এম. বি. বি. এস পাশ করে হায়ার এডুকেশনের জন্য আমেরিকায় গেছিলাম, লেখাপড়া শেষ করেও আমেরিকা অনেকদিন ছিলাম। কয়েকদিন হলো দেশে ফিরেছি। এই বিল্ডিং এর তৃতীয় তলায় ডাক্তার হাসিবুল আর ডাক্তার পারভিন আমার বন্ধু। গতকাল তাদের বাসায় এসেছি।

ভাবী-বাচ্চা?

এখনও হয়নি।

কেন?

বিয়ে করার সময় পেলাম কই?

বলো কী? তুমি এখনও বিয়েই করোনি?

যাক, তোমার কথা বলো, ইকবাল জানতে চাইল।

ইডেন কলেজে পড়ার সময় আমি তো হোস্টেলে ছিলাম। সেখানে আমার এক রুম মেট ছিল। ওদের বাসা গুলশানে কিন্তু সে একরকম শখ করেই হোস্টেলে থাকত। একদিন আমি ওর সঙ্গে ওদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে ওর ভাই রনির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর থেকে রনি প্রায় হোস্টেলে আসত। আমিও প্রায় ওদের বাসায় যেতাম। এমনভাবে আমি রনির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে বাবা-মা সবার সম্মতিতে আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের প্রথম এক বছর ভালোই কাটল। আমাদের বিয়ের আগে থেকেই পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ওদের ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের কাজ চলছিল। আর সে জন্য রনিকে মাসের বেশির ভাগ সময় পঞ্চগড়েই থাকতে হতো। পঞ্চগড়ে আমার বাবার বাড়ি হওয়ায় ওর নারী ঘটিত অনেক কেলেঙ্কারি আমার কানে যেত। সেজন্য একদিন আমি ওকে পঞ্চগড়ে বাসা ভাড়া নিতে বলেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রনি আমার কথায় রাজি হলো। তখন এই বাসায় উঠলাম, কিন্তু, এ বাসায় উঠার পর দেখলাম রনি আর পঞ্চগড়ে থাকতে আগ্রহী নয়। সে আসলে ইন্ডাস্ট্রির কাজে নয়, আমাকে এ্যাভোয়েড করার জন্য পঞ্চগড়ে থাকত। একদিন রনি বলল, শীলা আমাদের ইন্ডাস্ট্রি চালু হয়েছে, আর এত ছোট ইন্ডাস্ট্রির জন্য আমার ঢাকা ছেড়ে এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না। বলে সেদিনই সে ঢাকা চলে গেল। ততদিনে আমি মা হতে চলেছি। একথা আমি টেলিফোনে বলার পর সে মোটেই খুশি হলো না, একবার পঞ্চগড়েও এলো না, আমাকেও ঢাকা যেত বলল না। একদিন আমি নিজেই চেক আপের জন্য ঢাকা গেলাম। ঢাকা গিয়ে দেখলাম সে আরো একটা বিয়ে করেছে। আমি শ্বশুরের কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, সেজন্য আমার আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে তেঁতুলিয়ার ইন্ডাস্ট্রি ও পোলট্টি ফার্মটি আমার নামে উইল করে দিলেন। তারপরও আমি একদিন ঢাকায় ছিলাম, কিন্তু নিজের স্বামীকে অন্য স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখে আমি মোটেই সহ্য করতে পারছিলাম না। অবশেষে পঞ্চগড়ে ফিরে এলাম। আমি ইন্ডাস্ট্রি ও পোলট্টি ফার্ম দেখাশুনার কাজে লেগে গেলাম। আমাদের প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করল, তখন ও এলো তারপর থেকে বছরে দু’একবার আসে, মাঝে মাঝে আমিও ঢাকায় যাই, টেলিফোনে যোগাযোগ করি। এতক্ষণ বিড়বিড় করে সব কথা বলে শীলা একটা শুষ্ক হাসি হেসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, আসলে রনির প্রাচুর্যের মোহে পড়ে আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি।

ইকবাল মনে মনে বলল, এতদিন পর ন্যায় অন্যায়ের কথা ভেবে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েছেই, তুমি সুখ চাওনি, ভালোবাসা চাওনি, প্রতিপত্তি চেয়েছিলে তাই আল্লাহ্‌ তোমার মনস্কামনা পূরণ করেছেন।

ইকবালকে চুপ করে থাকতে দেখে শীলা জিজ্ঞেস করল, কিছু ভাবছ?

ইকবালকে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, এতদিন পর এসব কথা কেন বলছ শীলা? থাক না ওসব।

এমন সময় কলিং-বেল বেজে উঠতেই শীলা নিজেকে সংবরণ করে দরজা খুলে দিল। বার/তের বছরের ইউনিফর্ম পরা একটি মেয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে ইকবালকে সালাম দিল। ইকবাল সালামের জবাব দিয়ে শীলাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, শীলা উত্তর দিল।

কী নাম রেখেছ?

মেয়েটি হেসে বলল, আমার নাম সুকন্যা।

মুহূর্তেই ইকবাল বুকের মধ্যে ধাক্কা পেল। তার মনে পড়ল একদিন কথা প্রসঙ্গে শীলা ইকবালকে বলেছিল, আমাদের ছেলে হলে নাম রাখব সাকিব।

ইকবাল বলেছিল, মেয়ে হলে সুকন্যা।

শীলা ইকবালের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ঠিকই কিন্তু প্রতারণা করার পর পরই সে তার ভুল বুঝতে পেরে ইকবালের স্মৃতিকে হৃদয়ে লালন করার জন্য ইকবালের পছন্দের নামে মেয়ের নাম রেখেছে।

শীলা, ইকবাল ও সুকন্যাকে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুকন্যাকে বলল, তুই যা মা, ড্রেস চেঞ্জ করে আয়। আমি তোর আর তোর মামার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি।

সুকন্যা ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ড্রেস পরিবর্তন করে ড্রয়িং রুমে এসে ইকবালের পাশে বসল। ইকবাল সুকন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সুকন্যা এবার কোন ক্লাসে পড়ছ?

ক্লাস সিক্সে, মামা আপনি কি ঢাকায় থাকেন?

হ্যাঁ মা।

আপনি কী করেন?

আমি ডাক্তার।

এমন সময় শীলা নাস্তার ট্রে সোফার সামনের টেবিলে রেখে বলল, আমার মেয়ে তোমার ইন্টার্ভিউ নেওয়া শুরু করেছে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, বাচ্চাদের কৌতূহলী হওয়া ভালো, বলে ইকবাল নাস্তা খেতে খেতে শীলা ও সুকন্যার সাথে অনেক গল্প করল। তারপর সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতেই শীলা বলল, তোমার একটা কার্ড দিবে না?

আমি তো এখনো কার্ড তৈরি করিনি, বলে ইকবাল একটা কাগজে মোবাইল নাম্বারটা লিখে দিয়ে বলল, আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখ।

ইকবাল, শীলা ও সুকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠছিল তখন শীলার গণ্ডদেশ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল।

 

পাঁচ

 

কয়েকদিনের মধ্যে গ্রিন রোডে মেইন রাস্তা সংলগ্ন একটি ভবনে চেম্বার ভাড়া পাওয়া গেল। আর চেম্বারের ঠিকানা নির্ধারিত হওয়ার পরদিন থেকেই ইকবাল কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় এক সপ্তাহ বিজ্ঞাপন দিল। চেম্বার চালু হওয়ার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত সালাম সাহেবের বাসার টেলিফোন এবং ইকবালের মোবাইল নাম্বারে অবিরত রোগী ও রোগীর আত্মীয় স্বজনদের টেলিফোন আসতে লাগল। আর রোগীদের আগ্রহ ইকবালের আগ্রহকে সহস্রগুণ বাড়িয়ে তুলল। ইকবাল নির্ধারিত তারিখে চেম্বার চালু করল। চেম্বারের সামনে ঝুলান সাইন বোর্ডে বড় বড় করে লিখা ডাক্তার মো. ইকবাল হোসেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, রোগী দেখার সময় শনিবার থেকে বুধবার সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা, বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা এবং দরিদ্র ও ছিন্নমূল রোগীদের জন্য বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত।

ইকবালের চেম্বারে ঢুকবার আগেই ওয়েটিং রুমে সারি সারি করে সাজানো বেতের সোফা, দেয়ালে টাঙ্গান কয়েকটি বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং ফুলের পোস্টার। ওয়েটিং রুম থেকে ইকবালের রুমের প্রবেশ পথে টুল নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সিরিয়াল মেইনটেইনের জন্য একজন কর্মচারী রাখা হয়েছে। সেদিন বিকেল বেলা ইকবাল চেম্বারে রোগী দেখছিল। এমনসময় একজন ছেলে প্রবেশ ঢুকল। তার চোখে মুখে ক্লান্তি, বেদনা ও হতাশার চিহ্ন, এলোমেলো চুল, কোটরাগত চোখ। ছেলেটি চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। ছেলেটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এক ভদ্রমহিলা তিনি পাশের চেয়ারে বসলেন। ইকবাল ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

ছেলেটি রাগান্বিত স্বরে বলল, বাপ্পী।

বাঃ সুন্দর নাম তো, তুমি কী করো, একটু সুন্দর করে হাসি মুখে বলো।

বাপ্পী মিষ্টি হেসে বলল, এইচ.এস.সি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।

বাপ্পী তোমার লেখা পড়া নিশ্চয় ভালো চলছে।

বাপ্পী মাথা নত করে চুপ করে রইল। পাশে বসা ভদ্র মহিলা উত্তর দিল, আগে থেকে তো ভালোই চলছিল গত কিছুদিন থেকে ছেলেটা ঠিকমতো খাচেছ না, ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে না, সবসময় শুধু ঝিম মেরে বসে থাকছে, যেন ছেলেটার প্রাণ শক্তি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, প্লিজ ডাক্তার সাহেব আপনি একটু ভালোভাবে দেখুন!

ইকবাল ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম? আপনি বাপ্পীর কে হয়?

আমার নাম ফারহানা আমি বাপ্পীর ফুপু।

ইকবাল ফারহানাকে ইশারা করে বলল, আপনি বাইরে বসুন আমি একটু বাপ্পীর সঙ্গে কথা বলব।

ফারহানা বাইরে চলে গেলে ইকবাল বাপ্পীকে জিজ্ঞেস করল, বাপ্পী ডাক্তারে কাছে সব কিছু খুলে বলতে হয়, তা না হলে ভালো চিকিৎসা করা যায় না। এখন আমি তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করব তার ঠিক উত্তর দিবে।

বাপ্পী নীরবে বসে রইল।

তুমি নেশার জগতে পা বাড়ালে কেন?

ইকবালের কথায় বাপ্পী চমকে উঠলাম আঙ্কেল।

হ্যাঁ, আমি অনেকটা কনফার্ম হয়েছি, তাই তোমার কাছে সব কিছু জানতে চাচ্ছি।

বাপ্পী বলতে শুরু করল, আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট ছিলাম এবং আমার টিচাররা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠার সময় লেখাপড়ায় পিছিয়ে গেলাম। তখন থেকেই টিচাররা, আমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা স্বাভাবিক ব্যবহারও করতেন না, সবসময় আমাকে অবজ্ঞা করতেন। ফলে লেখাপড়ায় আমি আরও পিছিয়ে গেলাম। এস.এস.সি পরীক্ষায় আমি ফেল করলাম। পরীক্ষায় ফেল করায় বাবা আমাকে মারল, মাকে আমার খাবার বন্ধ করে দিতে বলল। মা আমার খাবার বন্ধ করল না ঠিকই কিন্তু আগের মতো আদর করল না। অবশ্য এর একটা কারণও আছে বাবা খুব বদরাগী টাইপের লোক। কাজেই মাও সবসময় বাবার ভয়ে ভীত থাকত। যে বাবা অফিস থেকে ফিরেই আমার খবর নিত, বিকেলে চায়ের টেবিলে আমাকে ডেকে নিত, সেই বাবা-ই রাতের খাবার সময় আমার খবর নিল না।

তারপর-

একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার এক বন্ধু রকি হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল, এই বাপ্পী কেমন আছিস?

আমি বললাম, ভালো।

রকি আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোর মুখ শুকনো কেন? কোনো সমস্যা?

রকির আগ্রহ দেখে আমি সব খুলে বললাম। রকি আমাকে ছোট্ট একটি দোকানের কাছে নিয়ে গেল এবং আমার হাতে একটা বোতল নিয়ে বলল, খেয়ে দেখ, ভালো লাগবে।

হাফ বোতল খেতেই সত্যিই সত্যিই আমি সব ভুলে গেলাম। কোনো রকম বাসায় এসে শুয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর যেন আমার গভীর ঘুম হলো। তখন থেকে জানলাম বোতলের ভেতরের পদার্থটির নাম ফেনসিডিল। সেদিন থেকে প্রতিদিন এক বোতল করে ফেনসিডিল না খেলে আমি অস্থির হয়ে পড়ি।

এতক্ষণ ইকবাল গভীর মনোযোগ সহকারে বাপ্পীর কথা শুনছিল। এবার বলল, বাপ্পী তোমার বাবা-মা কি জানেন যে তুমি নেশায় এ্যাডিকটেড?

না, তারা কিছু জানে না।

তোমার বাবা কী করেন?

আমার বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, কোটিপতি বলতে পারেন বিজনেন্স ম্যাগনেট, বাপ্পী অনেকটা ক্রোধের সুরে বলল।

এখন আসল কথায় আসা যাক বলে ইকবাল একটু থেমে বলল, বাপ্পী তোমাকে যে ফেনসিডিল ছাড়তে হবে।

বাপ্পী কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।

ইকবাল বাপ্পীর দিকে তাকিয়ে ইগ্‌জ্যমিনেশন টেবিলে উঠে শোয়ার ইঙ্গিত করে বলল, দেখি আঙ্কেল তুমি একটু বিছানায় শুয়ে পড় তো।

বাপ্পী বিছানায় শুয়ে পড়তেই ইকবাল বাপ্পীর পেটে এপাশ-ওপাশ দু’এক বার চাপ দিয়ে বলল, ঘন ঘন শ্বাস নাও। তারপর পেটের তলা থেকে বুক পর্যন্ত কয়েকবার চাপ দিয়ে বলল, ব্যথা পাও?

এক সময় বাপ্পী বলল, জি।

ইকবাল বলল, এবার ওঠো।

বাপ্পী বিছানা ছেড়ে চেয়ারে এসে বলল। ইকবাল প্যাড এর উপর প্রেসক্রিপশন লিখার জন্য হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি খিদে পেলে পেট ব্যথা করে?

জি।

রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায়?

জি।

ইকবাল প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল, বাপ্পী নিয়ম মাফিক ঔষধ খাবে, বেশী করে পানি খাবে, সময় মতো খাবার খাবে, অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ এবং অ্যালকোহল জাতীয় খাবার তোমার জন্য একেবারে নিষেধ। তারপর প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ করে বলল, বন্ধুদের সাথে আড্ডা কমাবে। প্রেসক্রিপশন লিখে তারিখে আবার এসো। বাপ্পী চেয়ার ছেড়ে উঠলে ইকবাল বলল, বাপ্পী তুমি ওয়েটিং রুমে বস আর তোমার ফুপুকে পাঠিয়ে দাও।

বাপ্পী বাইরে চলে যাওয়ার পর ফারহানা চেম্বারে আবার ঢুকল। মিসেস ফারহানা বলে ইকবাল কিছু বলার আগেই ফারহানা প্রতিবাদ করে বলল, মিসেস না।

মিস ফারহানা আপনি আগামী দিন বাপ্পীর বাবা মাকে আসতে বলবেন, তাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

ফারহানা বলল, ভাই-ভাবি তো খুব ব্যস্ত, আপনি যা বলার আমাকেই বলুন।

বাপ্পীর স্বাস্থ্যের যে অবস্থা তাতে ওকে বাঁচানোর চেয়ে তাদের অন্য কোনো ব্যস্ততা থাকতে পারে না।

ফারহানা ইকবালকে বলল, ডাক্তার সাহেব জটিল কিছু?

ইকবাল সান্ত্বনার সুরে বলল, না জটিল কিছু নয়, তবে ওর যত্ন নেয়া জরুরি।

ফারহানা জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার সাহেব বাপ্পীর অসুখটা কী?

বাপ্পী অ্যাসিডিটিতে ভুগছে এবং সেটা এখন পেপটিক আলসারের পর্যায়ে। পেপটিক আলসার দীর্ঘায়িত হলে অপারেশন করতে হতে পারে আর ঠিকমতো ঔষধ খেলে নিয়ম কানুন মেনে চললে ঔষধেই সারানো সম্ভব। কিন্তু পেপটিক আলসারটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়।

ফারহানা উৎকণ্ঠার সাথে বলল, তো?

ইকবাল মৃদু কণ্ঠে বলল, বাপ্পী মাদকাসক্ত।

ফারহানা অস্ফুট স্বরে বলল, বলেন কী ডাক্তার সাহেব?

মিস ফারহানা, বাপ্পীর যত্ন নেয়া এখন খুব জরুরি, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে মাদক মুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। আপনারা সবসময় ওকে চোখে চোখে রাখবেন ও যেন খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে না পারে। মনে রাখবেন ওকে যদি মাদক মুক্ত করা না যায় তবে সুস্থ করা যাবে না।

ডাক্তার সাহেব আমি বাপ্পীকে সবসময় চোখে চোখে রাখব। ওর খাওয়া-দাওয়া ঔষধ পথ্য সব কিছু খেয়াল রাখব। কিন্তু ওকে ভালো করার জন্য আপনার সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

আপনি সাহস হারাবেন না, ধৈর্য ধরুন সব ঠিক হয়ে যাবে, সম্ভব হলে আগামী দিন ওর মা-বাবাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।

 

ছয়

 

ইকবাল যখন মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন একদিন তার বাবা মা দু’জনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন থেকে ইকবালের অসমাপ্ত লেখাপড়া ও উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমনের যাবতীয় ব্যয় ভার সালাম সাহেবই বহন করেছেন। আর ইকবালেরও তার এক মাত্র বোন আয়েশা ও দুলাভাই সালাম ছাড়া কেউ নেই। ইকবালের বিদেশ যাবার দিনক্ষণ যখন ঠিক হয় তখন একবার তার বোন আয়েশা তাকে বিয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আয়েশার ইচ্ছা ছিল ইকবাল বিয়ে করে বউকে তার কাছে রেখে বিদেশ যাবে। কিন্তু ইকবালের প্রচণ্ড বাধার কারণে তা হয়ে উঠেনি। পরবর্তীতে আয়েশা ও সালাম সাহেবের ইচ্ছা ছিল ইকবাল বিদেশ থেকে ফিরে এলে যত শীঘ্রই সম্ভব তার বিয়ে দেবেন। সে উদ্দেশ্যে তারা দু’একজন মেয়েও দেখেছেন। তাতে কী? ইকবালের বিয়ের প্রতি মনোযোগ নেই, দিন রাত শুধু তার চেম্বার আর রোগী এই নিয়েই মহা ব্যস্ত। বিয়ের কথা শুনলেই যেন কানে শুনতে পায় না। তাই আয়েশা ও সালাম সাহেব দু’জনে আর ইকবালের বিয়ের কথা নিয়ে ভাবেন না। সালাম সাহেব একদিন সাফ কথা বলে দিয়েছেন, তোর যখন সময় হবে, যাকে পছন্দ হবে, তাকেই বিয়ে করবি আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

সালাম সাহেবের এক দুর সম্পর্কীয় মামাতো বোন দীর্ঘদিন যাবত মানসিক সমস্যায় ভুগছিল। ইতঃপূর্বে সালাম সাহেব কথা প্রসঙ্গে তার মামাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ইকবাল তার শ্যালক একথা বলে ফেলেছেন। তাই ভদ্রলোক বার বার অনুরোধ করেছেন ইকবালকে তার বাসায় নিয়ে যাবার জন্য। সেদিন ছিল শুক্রবার ইকবালের চেম্বারে বন্ধের দিন। তাই সুযোগ বুঝে সালাম সাহেব ও আয়েশা বিকেল বেলা ইকবালকে নিয়ে মামার বাসায় যাওয়ার জন্য ঠিক করেছেন। ইকবাল সকাল বেলা শ্রেয়াসহ বের হয়েছে শপিং এর উদ্দেশ্য। সাধারণত ইকবাল বাইরে কোথাও গেলে ফিরতে দেরি হলে মোবাইলে বাসায় জানিয়ে দেয় কিন্তু আজ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও বাসায় না ফিরাতে সালাম সাহেব মোবাইল করলেন, হ্যালো ইকবাল তুই কোথায়?

অপর পাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, দুলাভাই আমি এখন নীলক্ষেত?

শ্রেয়া তোর সাথে আছে?

হ্যাঁ।

দুপুরের খাবার খেয়েছিস?

হ্যাঁ, শ্রেয়াসহ আজ বাইরে খাওয়া করলাম।

মামা ভাগ্নি মিলে বাইরে লাঞ্চ করেছিস। এখন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়।

দুলাভাই আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি।

আধ ঘণ্টা দেরি করা যাবে না তুই এখনি রওয়ানা দে, বলে সালাম সাহেব মোবাইল বন্ধ করলেন।

সালাম সাহেব মোবাইল বন্ধ করার পর আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল? ও আসছে?

আসবে না যেভাবেই বলেছি, সালাম সাহেব মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন।

তবে আর দাঁড়িয়ে আছ কেন? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সালাম সাহেব ও আয়েশা তৈরি হয়ে ইকবালের জন্য অপেক্ষা করলেন। ইকবাল ঠিক আধ ঘণ্টার মধ্যে বাসায় ফিরল সঙ্গে বিশালাকার আকার এক বান্ডিল।

সালাম সাহেব কপালে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে এতকিছু কী নিয়ে এলি?

ইকবাল উত্তর দিল, এগুলো মহামূল্যবান বই।

আয়েশা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, মহামূল্যবান তো বটেই, কিন্তু এতগুলো? আপা এতগুলো দেখলে কোথায়? আমি ভাবছি বাসায় ছোট একটা লাইব্রেরি বানাব।

বাসায় লাইব্রেরি বানাবি?

অবশ্যই, আমার মতে প্রত্যেক বাসায় একটি করে পারিবারিক লাইব্রেরির প্রয়োজন। টি. ভি. ফ্রিজ, লক্ষ লক্ষ টাকার টাকার গহনা যদি বাসায় থাকতে পারে তবে সামান্য ক’ টাকা দামের বই থাকবে না কেন? সব ভোগ্য পণ্যই এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে, কিন্তু বই থাকবে যুগের পর যুগ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

আয়েশা ধমকের সুরে বললেন, হয়েছে এখন ওসব রাখ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।

ইকবাল জিজ্ঞেস করল, কেন আপা এত তাড়া কীসের?

তোকে নিয়ে বাইরে বেরুব তাই-

আমাকে নিয়ে কেন? দুলাভাইসহ যাও।

তোর উদ্দেশ্যই তো যাওয়া, তোকে বাদ দিলে কি হয়?

ইকবাল রাগান্বিত স্বরে বলল, আমার আর বুঝতে বাকি নেই, নিশ্চয়ই আমাকে বউ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ?

এতক্ষণ সালাম সাহেব আয়েশা আর ইকবালের কথা শুনেছিলেন, এবার তিনি মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন, না, তোর ধারণা ঠিক নয়। আমি তোকে একদিন বলেছি তোর বিয়ে নিয়ে আর কোনোদিন কথা বলব না। আজ অন্য কাজ আছে, এখন তাড়াতাড়ি চল।

ইকবাল জিজ্ঞেস করল, দুলাভাই কাজটা কী? জানতে পারি কি?

সেটা না হয় রাস্তায় যেতে যেতে বলব।

 

সাত

 

ট্যাক্সি ক্যাব এর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সবাই হাঁটতে হাঁটতে অদূরে একটি কয়েক তলা ভবনের গেটের ভিতরে ঢুকতেই ইকবাল জিজ্ঞেস করল, দুলাভাই, ভুল হচ্ছে না তো?

আয়েশা ধমকের সুরে বলল, তুই চুপ কর যা বলার তোর দুলাভাই বলবে।

সালাম সাহেব দ্বিতীয় তলায় উঠে কলিং-বেল এ টিপ দিতেই দশ/বার বছর বয়সের একটি মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কাকে চান?

সালাম সাহেব বললেন, মামা বাসায় আছেন?

সালাম সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মতিন সাহেব বেরিয়ে এসে সহাস্যে বললেন, সালাম, বউমা ভিতরে এস।

সবাই মতিন সাহেবের সঙ্গে ড্রয়িং রুমে ঢুকলে সালাম সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, মামা, আমার মেয়ে শ্রেয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকস-এ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।

বউমা তোমার বউমা একটু বস আমি ভিতর থেকে আসি, বলে মতিন সাহেব ভিতরে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সোফায় বসলেন।

কয়েক মিনিট সবাই নীরবে বসে রইলেন। তারপর মতিন সাহেব প্রথম মৌনতা ভঙ্গ করে ইকবালকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় প্র্যাকটিস করছ?

গ্রিন রোডে চেম্বারে ভাড়া করেছি।

মতিন সাহেব বিভিন্ন বিষয়ে কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে গল্প করলেন তারপর সোফা ছেড়ে উঠলেন, সালাম তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো। বউমা তোমরা বস, বলে তিনি সালাম সাহেবসহ ভিতরে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর ফর্সা ধবধবে দুধে আলতা বর্ণের দীর্ঘাঙ্গী, আকর্ষণীয় স্বাস্থ্যের অধিকারী একটি মেয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে সোফায় বসল। ইকবাল মেয়েটির আপাদমস্তক একবার তাকিয়ে দেখল। মেয়েটির চোখ দু’টো টানা টানা, মেহেদী মাখানো চুলগুলো গলা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে আর ফ্যানের বাতাসে চৈতালি হাওয়ার মত দোল খাচ্ছে, ফর্সা ধবধবে শরীরে কাল রঙের থ্রি-পিস যেন তার রূপ হাজার গুণ বাড়িয়ে তুলছে। তাছাড়া সালাম দেওয়ার সময় মেয়েটির গালের টোল যেন ইকবালের হৃদয়ে ঝড় তুলেছে।

আয়েশা ইকবালকে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, একা, আমার ননদ, বলে ইকবালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, একা তোকে বলেছিলাম না, আমার ভাই ডা. ইকবাল বিদেশে থাকে। ওর নাম ইকবাল ক’দিন আগে দেশে ফিরেছে।

একা ইকবালকে আবার সালাম দিল।

ইকবাল সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কি করছ?

আগে বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করতাম, এখন কিছু করছি না।

লেখাপড়া?

ইতিহাসে মাস্টার্স করেছি।

বাঃ খুব সুন্দর সাবজেক্ট তো।

আমাকে তিরস্কার করছেন?

তিরস্কার করব কেন? যা সত্য তাই বলছি, ইকবাল বলল।

দেখুন মেধাবী স্টুডেন্টসরা ইতিহাস পড়ে না। প্রথমে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কোন সাবজেক্ট আর অগত্যা যারা কোথাও পড়ার চান্স পায় না, তারাই বাংলা, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, সাধারণ ইতিহাস এ সব সাবজেক্ট পড়ে আর আপনি বলছেন ইতিহাস ভালো সাবজেক্ট, একা বলল।

ইকবাল বলল, দেখ ভালোর সংজ্ঞা আসলে একেক জনের কাছে একেক রকম। ইতিহাস কোন দেশ বা জাতির ঐতিহ্য, অহংকার। কেউ যদি ইতিহাস না জানে তবে দেশের ভবিষ্যৎ গড়বে কীভাবে? সবাই যদি তিতুমীর, ঈশা খাঁ, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ অসংখ্য দেশ প্রেমিক আর শহিদের ইতিহাস জানত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করত, তবে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। আমাদের অতীত অত্যন্ত গৌরব উজ্জ্বল, এই চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই সবাইকে ইতিহাস জানানো প্রয়োজন।

এভাবেই তো কোনোদিন ভাবিনি, একা বলল।

সমস্যাটা এখানেই, তুমি ইতিহাসের গুরুত্ব না বুঝেই শুধুমাত্র একটা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য ইতিহাস পড়েছ। শুধু তুমি কেন, অধিকাংশ স্টুডেন্ট জীবিকা উপার্জনের জন্য লেখাপড়া করে, জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়।

আপনি তো অনেক কিছু নিয়ে ভাবেন, আর আপনি কথাও বলতে পারেন খুব সাজিয়ে গুছিয়ে, তো এত সচেতন একজন মানুষ হয়ে আপনি আমেরিকা থেকে ফিরে এলেন কেন?

ইকবাল আবার বলতে শুরু করল, দেখ মিস একা, এ প্রশ্নটা আমাকে আরো কয়েকজন করেছে, এ বিষয়ে আমার যুক্তি উল্টা।

কী রকম?

এই ধর আমি আমাদের দেশ থেকে আমেরিকা গেলাম উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে অনেকে উচ্চাভিলাষী জীবন যাপনের জন্য বিদেশে থেকে যায়। আর আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমার যুক্তিটা হলো শৈশব থেকে এদেশে মানুষ হয়েছি, এদেশের দরিদ্র, মানুষের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হয়েছি। কাজেই এদেশের মানুষের কাছে আমার ঋণ অনেক। তাই আমি আমার দেশের মানুষের সেবা করে ঋণ কিছুটা হলেও হালকা করতে চাই।

একা অস্ফুট স্বরে বলল, ইকবাল সাহেব।

ইকবাল আবার বলতে শুরু করল, অনেকেই ছেলেদের বিদেশে চাকুরীতে পাঠিয়েই গর্ববোধ করেন কিন্তু আমাদের দেশের বি.এ/এম.এ পাশ ছেলেরা বিদেশের মাটিতে গিয়ে খুব নিম্নমানের পেশায় কাজ করছে, অথচ দেশের মাটিতে অনেক কিছুই করার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়। আবার আমাদের দেশ থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সহ উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী ছেলে মেয়েরা বিলাস বহুল জীবন যাপনের জন্য চলে যাচ্ছে, ফলে দেশ হয়ে যাচ্ছে মেধা শূন্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মেধা দিয়ে দেশের মানুষের সেবা করব।

ইকবাল সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে এবং আমার অনেক বদ্ধমূল ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। আসলে আপনি একজন অসাধারণ মানুষ, একা বলল।

আচ্ছা মিস একা তুমি হঠাৎ করে ব্যবসা দেখাশুনা বাদ দিয়ে ঘরমুখো হয়ে বসে রইলে কেন?

মুহূর্তেই একার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। একা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, সেটা না হয় আরেক দিন শুনবেন।

ঠিক আছে আরেকদিন বলবে, কিন্তু মনে রাখবে আমি ডাক্তার এবং তোমাকে সুস্থ করে তোলবার জন্যই এসেছি।

একা কয়েক মুহূর্ত নীরবে বসে রইল। তারপর বিনীত স্বরে বলল, আপনার একটা কার্ড দিবেন প্লিজ!

অবশ্যই, বলে ইকবাল একবার হাতে একটা কার্ড দিল।

এমন সময় চায়ের ট্রে নিয়ে বুয়া ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল এবং তারপরই সালাম সাহেব, আয়েশা, শ্রেয়া ও একার বাবা-মা প্রবেশ করলেন। ইকবাল দাঁড়িয়ে একার মাকে সালাম দিতেই তিনি বললেন, বস বাবা বস।

কিছুক্ষণ সবাই ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইকবাল চুপ করে রইল। সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কথা বলছিস না কেন?

বল বাবা, মতিন সাহেব বিনয়ের সুরে বললেন।

দুলাভাই আপনি একার মানসিক অবস্থার যে বিবরণ দিয়েছিলেন আমি তো তার কিছুই বুঝলাম না। আমার ধারণা মানসিক আঘাতের ফলে একা মুড ডিজঅর্ডারে ভুগছিল। এখন ক্রমাগত উন্নতির দিকে, আশা করি শীঘ্রই সেরে উঠবে, বলে ইকবাল প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে একাকে বলল, একা নিয়মিত ঔষধগুলো খাবে, দুশ্চিন্তা করবে না, পনেরো দিন পর আমাকে জানাবে।

একা প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করল। তারপর ইকবাল, সালাম সাহেব, আয়েশা ও শ্রেয়া বেরিয়ে পড়ল।

 

আট

 

লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে সাজু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, শ্রেয়া তোমার আর ক্লাস আছে?

না।

চলো কোথাও গিয়ে বসি, বলে সাজু আর শ্রেয়া হাঁটতে হাঁটতে টি. এস. স্থির সামনে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিতরে ঢুকল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে গাছের নিচে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ দু’জনেই নীরব। শ্রেয়াই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, তোমাকে তো মামার কথা বলাই হয়নি।

কবে এসেছেন তোমার মামা?

বেশ কয়েকদিন আগে।

আর কখনো যাবে না? একেবারে চলে এসেছে?

কেন?

আমার মামা এক ব্যতিক্রমী মানুষ, বলে দেশে টাকায় লেখাপড়া করে বিদেশের মানুষের সেবা করব কেন?

বাঃ সুন্দর যুক্তি তো তোমার মামার, দেশ প্রেমও আছে।

শুধু কী তাই? আমেরিকা থেকে এসেই বলে আগে নিজের দেশটা ঘুরে দেখবে, যেমন কথা তেমন কাজ বেরিয়ে পড়ল। ঘুরে এলো সাতদিন পর। জিজ্ঞেস করলাম, মামা কোথায় কোথায় ঘুরলে?

মামা বলল, বেশী দেখতে পারলাম নারে মা, এ যাত্রায় শুধু পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, বাংলা বান্ধা, দিনাজপুরের কান্ত জিউ মন্দির, রাজবাড়ি, রামসাগর, আরও লালমনিরহাটের কোন কোন জায়গায় যেন গিয়েছে? এই আর কী।

আমি একটু দুষ্টুমি করে বললাম, মামা তুমি কি রামসাগরের ইতিহাস জানো?

তারপর! সাজু বলল।

তারপর মামা বিড়বিড় করে রাম সাগরের ইতিহাস বলে ফেলল।

মামা বললেন আর তুমি শিখলে না?

কেন তুমি জানতে চাও?

অবশ্যই।

বেশ বলছি তবে শোন বলে শ্রেয়া বলতে শুরু করল, প্রাণনাথ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ধন দৌলতের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর মন সব সময় দুশ্চিন্তায় ভরে থাকত। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে রাজার ঘরে এক ছেলে জন্ম গ্রহণ করল। রাজা তার নাম রাখলেন রাম নাথ। রাজা তার রাজ্যের জ্যোতিষীদের দ্বারা রামনাথের হস্তরেখা পরীক্ষা করলেন। জ্যোতিষীগণ জানালেন রাজপুত্র বীর ও বিদ্বান হবেন, কিন্তু তিনি স্বল্পায়ু হবেন, একথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে রাজা আঁতকে উঠলেন। রাজপুত্র যখন যৌবনে পা দিলেন তখন রাজা অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। দেশ বিদেশ থেকে বহু রাজা মহারাজা আসলেন। উৎসব কোলাহলে রাজবাড়ি মুখরিত হলো। এমন সময় সংবাদ এলো শত্রুসৈন্য রাজধানী আক্রমণ করার জন্য কাছাকাছি পৌঁছেছে। সংবাদ শুনে সব কিছু থমকে গেল। রাজপুত্র অভিষেক অনুষ্ঠান ছেড়ে উল্কার মতো দ্রুত গতিতে রণক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। যুদ্ধে রাজপুত্র জয়ী হলেন, শত্রু সৈন্য পরাজিত হয়ে ফিরে গেল। তারপর শুরু হলো অনাবৃষ্টি। সর্বত্র পানির জন্য ক্রন্দন ধ্বনি ধ্বনিত হলো। রাজ্যে নামল দুর্ভিক্ষ। রাজা প্রাণনাথ ছিলেন যেমন ধনবান, সুশাসক তেমনি দয়ালু। তিনি ভাণ্ডার খুলে দিলেন। পানীয় জলের কষ্ট নিবারণের জন্য রাজা একটি পুকুর খননের সিদ্ধান্ত নিলেন। এলাকার দরিদ্র, দুর্ভিক্ষ পীড়িত এবং বেকার জনগোষ্ঠীকে পুকুর খননের কাজে লাগিয়ে দিলেন। বিশাল আকারের অনেক গভীর এক পুকুর খনন করা হলো। কিন্তু পানি পাওয়া গেল না। রাজা ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। একদিন রাজা স্বপ্নে দেখলেন, রাম নাথকে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে বলি দিলে পুকুরে পানি উঠবে। রাজার দুঃস্বপ্নের সংবাদে রাজবাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। কিন্তু রাজপুত্র প্রজাদের জীবন রক্ষার্থে নিজের জীবন বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হলেন। রাজপুত্রের নির্দেশে পুকুরের মধ্যস্থানে ছোট একটি মন্দির তৈরি করা হলো। নির্ধারিত দিনে মৌন মিছিল সহকারে রাজা-রাণী রাজপুত্র পুকুরের পশ্চিম ঘাটে হাজির হলেন। রাজপুত্র ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন মন্দিরের দিকে। রাজপুত্র যতই এগিয়ে চললেন ততই তিনি পানিতে তলিয়ে গেলেন। সেদিন থেকে রামসাগরের পানি আর কোনোদিন শুকায় নি।

এতক্ষণ সাজু শ্রেয়ার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। শ্রেয়ার বলা শেষ হতেই সাজু বলল, বাঃ যোগ্য মামার যোগ্য ভাগ্নি।

শুধু তাই নয় মামার কাছে আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিষয়ক অনেক বই পাবে। মামার সঙ্গে না কথা বললে তুমি বুঝতেই পারবে না মামা সদ্য আমেরিকা ফেরত মানুষ। তোমার খুব ভালো লাগবে।

তবে চলো একদিন মামার সঙ্গে দেখা করে আসি।

আচ্ছা তোমাকে একদিন নিয়ে যাব।

 

নয়

 

ইকবাল চেম্বারে একরে পর এক রোগী দেখছিল। ফারহানা ও বাপ্পী সালাম দিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করল। তারপর প্রেসক্রিপশনটা ইকবালের হাতে দিয়ে দু’জনে চুপ করে বসে রইল। ইকবাল ফারহানাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখে বাপ্পীকে জিজ্ঞেস করল, বাপ্পী বল এখন কেমন লাগছে?

এখন একটু ভালো।

তুমি একটু শুয়ে পড় আমি একবার তোমাকে পরীক্ষা করে দেখি। বাপ্পী শোবার পর ইকবাল তার পাল্‌স, জিহ্বা দেখল এবং পেটে চাপ দিয়ে দেখল। তারপর চেয়ারে বসে প্রেসক্রিপশন লিখে বাপ্পীকে জিজ্ঞেস করল, বাপ্পী তুমি অবসরে কী কর?

শুয়ে থাকি, ঘুমাই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেই।

তোমার কি বই পড়ার অভ্যাস আছে?

জি আগে পড়তাম।

এখন পড় না কেন?

বাপ্পী চুপ করে বসে রইল।

ইকবাল বাপ্পীর হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে আবার লিখতে শুরু করল। তারপর বলল, বাপ্পী প্রেসক্রিপশনে যে সব ঔষধ লিখে দিয়েছি তা ঠিক ঠিকমতো খাবে, বিশ্রাম নিবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কমাবে, ফেনসিডিল খাবে না, আমি যে তিনটি বইয়ের নাম লিখে দিয়েছি। অবসরে বই পড়বে। দেখবে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। আগামীতে যেদিন আসবে সেদিন আমি জিজ্ঞেস করব তুমি বইগুলো পড়েছ কি না? মনে রাখবে বই পড়াও তোমার চিকিৎসার একটি অংশ।

বাপ্পী মৃদু কণ্ঠে বলল, জি আঙ্কেল।

বাপ্পী বাইরে যাওয়ার পর ফারহানা চেম্বারে প্রবেশ করলে ইকবাল ফারহানাকে জিজ্ঞেস করল, মিস ফারহানা আমি তো বাপ্পীর মা-বাবাকে আনতে বলেছিলাম। আপনি কি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন?

জি, ভাই খুব ব্যস্ত তাই আসতে পারেন নি কিন্তু কথা দিয়েছেন আগামী দিনে অবশ্যই আসবেন।

ইকবাল বলল, দেখুন মিস ফারহানা আমি বাপ্পীর শারীরিক সুস্থতার ঔষধ লিখে দিলাম কিন্তু ওর মানসিক সুস্থতা বা মাদক মুক্ত করার জন্য চাই বাপ্পীর বাবা-মা এবং আপনার সহযোগিতা। একটা কথা মনে রাখবেন মাদকাসক্তির কোনো চিকিৎসা নেই। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায় হলো মোটিভেশন বা মাদকাসক্তকে স্বেচ্ছায় মাদক ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করা এবং মাদক পরিহার বা বর্জন মনোচিকিৎসা (কাউন্সিল)। আর এ দু’টিতেই অভিভাবকের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আশা করি আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন।

আপনি কিছু মনে করবেন না আগামী দিনে ভাই অবশ্যই আসবেন।

আর হ্যাঁ ততদিন বাপ্পীকে সব সময় চোখে চোখে রাখবেন, নিঃসঙ্গতা, দুশ্চিন্তা, অসৎ সঙ্গ বাপ্পীকে আরো মাদকাসক্তিতে আকৃষ্ট করতে পারে। আপনি এখন আসুন প্লিজ!

মিস ফারহানা চলে যাবার পর শ্রেয়াকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে ইকবাল এক রকম চমকে উঠল, শ্রেয়া তুই।

শ্রেয়া সাজুর সঙ্গে ইকবালের পরিচয় করে দিল, মামা ও আমার বন্ধু সাজু। আর সাজু আমার মামা।

সাজু ইকবালকে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসল। ইকবাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই ওয়েটার হারেস ভিতরে এসে দাঁড়াল।

ইকবাল বলল, দুই গ্লাস বেলের শরবত, তারপর শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল, বলো মা কী মনে করে?

কিছু মনে করে না, ভাবলাম যাই মামার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি তাই চলে এলাম। আর সাজুর খুব ইচ্ছা তোমার সঙ্গে দেখা করবে তাই।

ইকবাল জিজ্ঞেস করল, সাজু তোমার বাড়ি কোথায়?

লালমনিরহাট।

সাজু বলল, পাটগ্রাম

মামা তুমি কখনো পাটগ্রাম গিয়েছ? শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল।

হুম। এই তো ক’দিন আগে একবার তিন বিঘা করিডোর আর কবি বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম।

সাজু জিজ্ঞেস করল, কোন কবি বাড়ি মামা?

কবি শেখ ফজলল করিমের বাড়ি তুমি দেখনি?

না তো।

কালীগঞ্জ থেকে পাটগ্রাম যেতে রাস্তার পাশেই তাঁর বাড়ি, তাঁর বিখ্যাত কবিতা কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।

এমন সময় হারেস ট্রেতে শরবত নিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করে সাজু ও শ্রেয়া হাতে এক গ্লাস করে শরবত দিয়ে চলে গেল।

ইকবাল বলল, খাও বেলের শরবত।

সাজু শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপ করে রইল।

সাজু হাসতে হাসতে বলল, মামা শ্রেয়া আপনার বিষয় যা যা বলেছিল সব মিলে যাচ্ছে তাই।

ইকবাল শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, শ্রেয়া কী কী বলেছিস?

সাজু বলল, না মামা, খারাপ কিছু বলেনি, ও বলেছে আপনার দেশীয় পণ্য ও দেশী সংস্কৃতির প্রতি ভীষণ রকমের টান আছে।

শ্রেয়া বলল, মামা আমরা কি তোমার সময় নষ্ট করছি?

না, না।

সাজু ও শ্রেয়া চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, মামা আমরা আজকের মতো আসি।

এসো।

 

দশ

 

সালাম সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে টি. ভি দেখছিলেন। পাশাপাশি সোফায় আয়েশা এবং শ্রেয়াও বসে ছিল। এমন সময় ঝড়ের বেগে ইকবাল ড্রয়িং রুমে ঢুকল। তার এলোমেলো চুল ও চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখে সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কীরে তোকে এমন দেখাচ্ছ কেন? কী হয়েছে?

ইকবাল ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল। কপালে হাত দিয়ে মাথা নত করে অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর নিজেকে সংবরণ করে মাথা নত করে বলল, দুলাভাই আপনাদের সবাইকে সারপ্রাইজ দিব বলে কাউকে না জানিয়ে আমি একটা কাজে হাত দিয়েছিলাম, একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু আজ আমার স্বপ্ন-

কীরে পাগলা? কী হয়েছে? সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

দুলাভাই আমি একটা ক্লিনিক করার জন্য অনেকদূর এগিয়েছি। সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের অনুমতির জন্য অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছি। আজ এ কাগজ, কাল ও কাগজ করে শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে কাগজ দিতে দিতে আমি হয়রাণ, একেবারের হয়রাণ হয়ে গেছি। যা হোক অনেক কষ্টে আমার এক বন্ধুর সহযোগিতায় ফাইলটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তারপরও অনুমতি পাচ্ছি না। আজ সকাল বেলা সেই অফিসে গিয়েছিলাম।

সালাম সাহেব বললেন, তারপর-

আমার ক্লিনিক করার অনুমতির ফাইলটা যে লোকের কাছে আছে সে লোকের সঙ্গে দেখা করলাম। আমার ফাইলটার কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি এক গাল হেসে বললেন, আপনার ফাইলটার কাজ অনেকদূর এগিয়েছে আর সামান্য বাকি। এখন আপনি ইচ্ছা করলেই বাকী কাজটুকু শেষ হয়।

আমি বললাম, তো আমাকে কী করতে হবে?

না মানে এতদিন অনেক পরিশ্রম করে ফাইলের কাজটা শেষ করলাম, একেবারে খালি হাত বলে তিনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ততক্ষণে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে লোকটাকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, তারমানে আপনি আমার কাছে ঘুষ চাচ্ছেন?

তিনি বললেন, আপনি রেগে যাচেছন কেন? টাকা না দিলে অনুমতি পাবেন না এ কথা তো আমি বলিনি। পাবেন, পাবেন, এতদিন যখন ধৈর্য ধরলেন আর সামান্য ক’দিন অপেক্ষা করুন পেয়ে যাবেন।

দেখুন আমি বেশিদিন ঘুরতে পারব না আর একদিন আসব, এখন বলুন কবে আসব? যেদিন আসতে বলবেন সেদিনই আসব কিন্তু খালি হাতে ফিরব না। বলে আমি চলে এলাম।

এই অবস্থা, বলে সালাম সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, তোর কি মনে হয় আগামী দিন গেলেই তোর কাজ করে দিবে?

দিতেও পারে আবার নাও দিতে পারে বলে ইকবাল একটু থামল। তারপর বলল, আগে জানতাম না আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হয় না কেন? কোন বিদেশি বিনিয়োগকারী যখন কোন শিল্প কারখানা স্থাপন করার জন্য আমাদের দেশে আসেন তখন তাঁরা এমনি অসংখ্য জটিলতা আর হয়রানির শিকার হন। ফলে তাঁরা নিরাশ হয়ে ফিরে যান।

আর দেশী বিনিয়োগকারীরা?

তারা হয়ত এমন অত্যাচার নীরবে হজম করেন।

সালাম সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তাহলে অর্থটা দাঁড়াল কী?

তাই বলে একটা ভালো কাজ করার জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হবে অবৈধভাবে টাকা দিয়ে।

এমন সময় ইকবালের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। ইকবাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

অপর প্রান্ত থেকে একা বলল, কয়েকদিন থেকে আপনার খবর পাচ্ছি না কেন?

ম্যাডাম খুব দুশ্চিন্তায় আছি।

কীসের দুশ্চিন্তা?

সেদিন যে তোমার সঙ্গে আলাপ করলাম ক্লিনিক করার জন্য সেই ফাইলটা এখনো আটকে আছে। অনুমতি পেলেই ক্লিনিকটা চালু করতে পারি।

ফাইলটা কোন পর্যায়ে আছে?

চূড়ান্ত পর্যায়ে।

একবার অফিসের নাম ঠিকানাটা বলুন তো, যদি আপনার জন্য কিছু করতে পারি।

ইকবালের অফিসের নাম ঠিকানা বলা ষে হতে না হতেই একা বলল, আমি বাবাকে বলে দেখি আপনি একটু ও টেনশন করবেন না, ফাইলটা তো চিরদিন আটকে থাকবে না। দেখবেন দু’একদিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যাবেন।

আপনার কথাই যেন হয়, বলে ইকবাল মোবাইল বন্ধ করল।

সালাম সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ডাক্তার সাহেব সম্পর্কটা যেন রোগী-ডাক্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

ইকবাল কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কী দুলাভাই?

না তোর উপর অবশ্য আমাদের ভরসা আছে, আর এতদিন যখন করিস নি তখন পাত্রী সিলেকশনটা আমাদের ছাড়া করবেন না, যা হোক কোনটা আগে ক্লিনিক, নাকি বিয়ে?

ইকবাল জোর গলায় বলল, আর বিয়ে করবি না?

না আপা?

আয়েশা রাগান্বিত স্বরে বললেন, আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, তোকে আজ নির্দিষ্ট করে বলতে হবে কতদিনের মধ্যে তুই বিয়ে করবি?

শ্রেয়া আনন্দে হাত তালি দিয়ে বলল, বলো না মামা, বলো সাত দিনের মধ্যে বিয়ে করবে।

সালাম সাহেব মুচকি হেসে বললেন, কীরে বল না, তোর আপা যখন বলছে, বল।

ইকবাল একবার আয়েশা, শ্রেয়া ও সালাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই।

বল।

ইকবাল হঠাৎ করেই বলে ফেলল, ক্লিনিক চালু হওয়ার এক মাসের মধ্যে।

 

এগার

 

ক্লিনিক চালু করার অনুমতির জন্য আর ইকবালকে যেতে হয় নি। একদিন ইকবাল ফাইলের খবর নেওয়ার জন্য হারেসকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু হারেস একেবারে অনুমতি পত্রটা নিয়ে আসায় ইকবাল অনেকটা অবাক হয়েছে। অনুমতি পত্রটা হাতে পেয়ে ইকবাল প্রথমেই একাকে মোবাইল করল।

একা মোবাইল রিসিভ করে বলল, হঠাৎ করে জনাবের এই অধমের কথা মনে পড়ল? আজ সকালবেলা মনে হয় সূর্যটা পশ্চিম দিকে উদয় হয়েছে?

ইকবাল হেসে বলল, না না সূর্যটা পূর্ব দিকে উদয় হয়েছে? তবে একটা সুখবর নিয়ে উদয় হয়েছে।

বলুন, বলুন তাড়াতাড়ি বলুন।

তুমি বলেছিলে না ক্লিনিক করার অনুমতি পেয়ে যাব দু’একদিনের মধ্যে। সত্যি সত্যি অনুমতিটা পেয়ে গেলাম। আমার যে কি খুশি লাগছে না!

একার ইচ্ছা হলো ইকবালকে বলবে, অনুমতিটা কি এমনি পাওয়া গেল, ভাগ্যিস ঐ অফিসে বাবার বন্ধু ছিল, পরক্ষণেই মনে হলো না তাতে ইকবালের সমস্ত আনন্দ থেমে যাবে তাই একা ইকবালের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য বলল, আচ্ছা আপনি বলুন তো এমন একটা সুখবর আপনি আমাকে মোবাইলে জানালেন, আপনি তো খুব বেরসিক মানুষ, যেন ইট, কাঠ, পাথরের-

ইকবাল একার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, একা থাম আর বলতে হবে না। তুমি চলে এসো আমার চেম্বারে তারপর একসঙ্গে বের হব।

আমি মিষ্টি খেতে আপনার চেম্বারে যাব?

তবে?

আপনি মিষ্টি নিয়ে বাসায় আসবেন।

ঠিক আছে আগামী কাল শুক্রবার তোমাদের বাসায় আসব বলে ইকবাল মোবাইল বন্ধ করল। ইকবাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই বাপ্পী তার বাবা-মা ও ফারহানা চেম্বারে প্রবেশ করলেন। বাপ্পীর বাবা সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি সাইদুর রহমান, চেয়ারম্যান, অনন্যা গ্রুপ অব কোম্পানি, বাপ্পীর বাবা। আর বলে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন।

ইকবাল মৃদু হেসে বলল, প্লিজ আপনারা ওয়েটিং রুমে একটু বসুন আমি বাপ্পীর সঙ্গে কথা বলার পর-

আচ্ছা ঠিক আছে বলে সাইদুর সাহেব সহ সবাই বের হয়ে গেলেন।

ইকবাল বাপ্পীকে জিজ্ঞেস করল, বাপ্পী এখন কেমন আছ?

জি ভালো।

খুব ভালো কথা, তুমি খুব শীঘ্রই সেরে উঠবে। আমি তোমাকে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলাম নিয়ম মতো ঔষধ খাবে, বিশ্রাম নিবে, বই পড়বে, মাইকেল এইচ হার্ট এর শত মনীষীর জীবনী এবং ডেলকার্ণেগীর রচনা সমগ্র বই কিনে পড়বে। আর হ্যাঁ অখাদ্য-কুখাদ্য সব ছেড়ে দিয়েছ?

বাপ্পী মৃদু হেসে চুপ করে রইল।

আগামী দিন আমি তোমার কাছে স্পষ্ট করে জানতে চাই যে, তুমি ফেনসিডিল ছেড়ে দিয়েছ।

বাপ্পী সালাম দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সাইদুর সাহেব, তাঁর স্ত্রী এবং ফারহানা প্রবেশ করলেন। সাইদুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার সাহেব বাপ্পী সুস্থ হতে আর কতদিন লাগবে?

দেখুন আমি আপনাকে দেখা করতে বলেছিলাম কারণ বাপ্পীকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলার জন্য আপনাদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন, ইকবাল বলল।

আপনি কি বলছেন ডাক্তার সাহেব? আমার ছেলে, আমি সহযোগিতা করব না মানে? অবশ্যই করব। আপনি আমার ছেলেকে সুস্থ করার জন্য যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন সে জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

ইকবাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, সাইদুর সাহেব আপনি জানেন কি বাপ্পী মাদকাসক্ত?

সাইদুর সাহেব ও তাঁর স্ত্রী যেন আকাশ থেকে পড়লেন, আপনি বলেন কি? বাপ্পী মাদকাসক্ত?

আপনি বাবা হয়ে ছেলের খবর জানেন না?

সাইদুর সাহেব লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইলেন।

ইকবাল বলতে শুরু করল, বাপ্পী ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে তার রেজাল্ট খারাপ খারাপ হয়, তখন থেকে শিক্ষকরা তার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ে, ফলে বাপ্পী আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে। তখনও আপনারা কেউ তার লেখাপড়ার দিকে খেয়াল করেন নি। তারপর সে যখন এস.এস.সি পরীক্ষায় ফেল করল তখন আপনি আপনার অতি আদরের ছেলেকে মেরেছেন। তখন থেকে আপনারা বাপ্পীর দিকে কোনো খেয়াল রাখেন নি, এটা আপনারা ঠিক করেন নি। প্রথমত: অবিচার করেছেন তার শিক্ষকরা। একজন ছাত্র খারাপ রেজাল্ট করলেই তার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে হবে এটা ঠিক নয়। তখন থেকে আপনারা তার দিকে খেয়াল রাখেন নি। ফেল করার পর তাকে মার দেওয়া বা তার প্রতি এমন আচরণ করা একেবারেই ঠিক হয়নি।

সাইদুর সাহেব মাথা উঁচু করে বললেন, ইকবাল সাহেব আমি বুঝতে পেরেছি।

ইকবাল বাধা দিয়ে বলল, না, আপনি বুঝতে পারেননি। সাইদুর সাহেব সবাইকে ভালো ফল করতে হবে এমন নয়, অনেক মানুষই আছেন যাদের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, আমাদের চোখের সামনে এমন অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ আছেন যারা শ্রেণীকক্ষের পিছনের সারির ছাত্র ছিলেন। আবার এমনও অনেক মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী আছে যারা জীবনে কোনোদিন দ্বিতীয় হননি। কাজেই পুঁথিগত বিদ্যায় কেউ খারাপ করলেই তাকে তিরস্কার করতে হবে এটা কোনোভাবেই যুক্তি সঙ্গত নয়। যে বাপ্পী এস.এস.স্থিতে ফেল করল তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করলে সে যেমন হতে পারে একজন সফল মানুষ তেমনি তাকে তিরস্কার করে দূরে সরিয়ে দিলে সে হয় যেতে পারে সমাজের কীট। এখন আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এমন ঝরে পড়া তরুণদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, নাকি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই?

বাপ্পীর মা অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে বললেন, আমি অনেক বার বলেছি একবার ছেলেটার দিকে নজর দাও কিন্তু তুমি আছ তোমার ব্যবসা নিয়ে।

ইকবাল আবার বলতে শুরু করল, সাইদুর সাহেব অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই বরং বাপ্পীর জীবনে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়, এখনো সময় আছে আমরা সবাই মিলে ওকে বাঁচিয়ে তুলি। বলে ইকবাল একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল, এখন বাপ্পীর জন্য প্রয়োজন সহানুভূতি, কর্ম ব্যস্ততা আর ভালো সঙ্গ। সে যখন একা থাকে তখন তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তারপর সে মাদকের নেশায় অস্থির হয়ে উঠে। এখন তাকে সব সময় কাজে ব্যস্ত রাখতে পারলে ক্রমে ক্রমে মাদকের নেশামুক্ত হবে।

সাইদুর সাহেব এতক্ষণ নীরবে বসে ছিলেন। এবার মাথা তুলে বললেন, ডাক্তার সাহেব আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আমি ওর স্বাস্থ্যের দিকে এবং লেখা পড়ার দিকে গভীরভাবে খেয়াল করব।

সাইদুর সাহেব আপনার বিশাল প্রতিপত্তি, ব্যাংকে গচ্ছিত অঢেল টাকা, আপনার গ্রুপ অব কোম্পানি এর স্বত্বাধিকারী সবকিছুরই ভবিষ্যৎ বাপ্পী তাই না?

হ্যাঁ।

মনে রাখবেন বাপ্পী আপনার পরবর্তী প্রজন্ম, সে-ই আপনার বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে, আপনার বিষয় সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি ধরে রাখবে। তাই তাকে যদি সেভাবে আপনি যোগ্য করে তুলতে না পারেন তবে আপনার সকল সফলতা ব্যর্থ হবে। মানুষের সফলতা বলতে শুধু আর্থিক সফলতাকে বুঝায় না। নিজেদের ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত ও বিদ্বান করে তোলাও সফলতা। আমি মনে করি, বাপ্পী আপনার শিল্প গোষ্ঠীর একাংশের চেয়ে অনেক বেশি।

সাইদুর সাহেব একমত পোষণ করে বললেন, ইকবাল সাহেব আপনি অতিবাস্তব কথা বলেছেন। আপনি বাপ্পীকে সুস্থ করে তোলার জন্য যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনার মতো সব ডাক্তারই যদি রোগীর প্রতি আন্তরিক হতো-

ইকবাল কথার মাঝে দিয়ে বলল, সাইদুর সাহেব, ভাবী, মিস ফারাহানা আপনারা এখন আসুন, প্লিজ!

সাইদুর সাহেব, তাঁর স্ত্রী ও ফারহানা সালাম দিয়ে বের হয়ে গেলেন।

 

বার

 

ইকবালের আসার অপেক্ষায় একা বেলকনিতে বসে ছিল। আর বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল এমন সময় গেটে একটা ট্যাক্সি ক্যাব এসে দাঁড়াল। একা বেলকনি থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখল। ততক্ষণে কলিং বেল বেজে উঠেছে। একা নিজেই দরজা খুলে দিল। দরজা খোলা মাত্রই পরস্পরের চোখে চোখ পড়ল। কয়েক মুহূর্ত দু’জনে দাঁড়িয়ে রইল। ইকবাল মৃদু হেসে বলল, কি দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবে? নাকি ভিতরে আসতে বলবে?

ওহ আসুন, ভিতরে আসুন। বলে একা ভিতরে ঢুকে পড়ল। ইকবাল একার পিছনে পিছনে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল।

প্লিজ আসুন! বলে একা ইকবালসহ ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসল। কয়েক মিনিট পর বুয়া নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকল।

কিছুক্ষণ দু’জনে নীরবে বসে রইল। ইকবাল নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, একা কিছু বলো?

কী বলব?

বাহ্‌ মোবাইল করে আসতে বললে এখন বুঝি বলার কিছু পাচ্ছে না।

আগে আপনার কথা বলুন। ক্লিনিকের কাজ কতদূর এগিয়েছেন?

অনুমতি পেয়েছি সে তো তুমি জানো, ক্লিনিকের জন্য বাসা ভাড়া আগেই করেছি, এখন ডেকোরেশন, ডাক্তার, ম্যানেজার, নার্স নিয়োগ এসব হলেই চালু করব। তবু মনে হয় আরো একমাস লাগবে। এমন সময় মতিন সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কে রে মা?

মতিন সাহেব ড্রয়িং ঢুকতেই ইকবাল দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

তিনি বললেন, বসো বাবা, বসো। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম তুমি নাকি ক্লিনিক করছ?

হ্যাঁ।

এখনই তো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বয়স। তোমার যেমন উঁচু মাপের ডিগ্রি আছে তাতে বড় ধরনের একটা ক্লিনিক করতে পারলে দু’হাতে টাকা রোজগার করবে।

ইকবাল প্রতিবাদ করে বলল, মামা আমার আসলে খুব বড় ধরনের ক্লিনিক করার সামর্থ্য নেই। আমি আমেরিকায় থাকার সময় অনেক কষ্টে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিলাম, যে টাকা দিয়ে নিজস্ব ভবনে বড় ধরনের ক্লিনিক করা সম্ভব নয়। তাই ছোট আকারে ক্লিনিকের নাম দিয়ে একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করতে চাই।

তবুও বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন তো আছেই।

জি মামা বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন আছে কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা মানুষের জীবনের সুখ কেড়ে নেয়। মানুষের বিবেক অন্ধ করে দেয়, মানুষকে অহংকারী করে তোলে।

মতিন সাহেব আর কোনো কথা না বলে একার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা বস মা, গল্প কর, আমার একটু কাজ আছে। তারপর তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মতিন সাহেব চলে যাবার পর একা বিনয়ের সঙ্গে বলল, বাবা কী বলতে কী বলেছেন আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ!

না মনে করব কেন? তুমি বাদ দাও ওসব। এখন তোমার কথা বলো।

আমার আর কী কথা? আমি ডাক্তার নই, তাই ক্লিনিক করার স্বপ্ন নেই। বলতে পারেন বিয়ের অপেক্ষায় আমি এক’শ পার্সেন্ট বেকার।

বিয়ে করলেই তো পারো।

বিয়ে করতে চাইলেই তো হয় না, ঘর বর এসব মিলানো কি সহজ কথা? ঘর মিলে তো বর মিলে না, বর মিলে তো ঘর মিলে না। তারপর আমার বয়স বত্রিশ, মেয়ে হিসেবে আমার বিয়ের বয়স চেলে গেছে অনেক আগেই।

বলছ কি তুমি? তুমি ট্যালেন্ট, বিউটিফুল অ্যান্ড হাই কোয়ালিফাইড একটা মেয়ে-

আপনার কি পছন্দ হয়েছে?

ইকবাল মৃদু হেসে বলল, বড় কঠিন প্রশ্ন করেছ।

প্রশ্ন কঠিন সহজ বলে কি আছে? উত্তর হ্যাঁ অথবা না।

একা তোমার প্রশ্নটার উত্তরের সঙ্গে কি জীবনের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে? যদি বলো হ্যাঁ তবে আমাকে ভেবে উত্তর দিতে হবে আর যদি বলো না তবে এখনি উত্তর দিব।

একা মৃদু হেসে বলল, তবে ভেবেই উত্তর দিন।

ইকবাল আরও অনেকক্ষণ একার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিল।

 

তের

 

বলধা গার্ডেনের গেট দিয়ে ঢুকতেই পকেট গেটের উপরের ফ্রেমের সাথে সজোরে আঘাত পেল। মুহূর্তেই একা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। একার দু’চোখ থেকে পানি ছিটকে পড়ল। ইকবাল একার মাথায় হাত দিয়ে কয়েকবার ম্যাসেজ করে দিল, চোখেরে পানি মুছে দিল। একা মাথা তুলে তাকাতেই ইকবালের চোখে চোখে পড়ল। দু’জনের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। দু’জনে উঠে দাঁড়াল তারপর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছোট একটি গাছের নিচে বসল। ইকবাল জিজ্ঞেস করল, একা কেন ডেকেছিলে? এখন বলো।

ভাবলাম আজ একবার বেরুব, আপনার প্র্যাকটিসও আজ বন্ধ তাই আপনাকে মোবাইল করলাম, শুধু একসঙ্গে বেড়াবার জন্য। আপনার সঙ্গে সেই অল্পক্ষণের কথা বলাতেই আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি আসলে খুব বড় মাপের মানুষ।

একা ভাবে মুখের উপর প্রশংসা করতে হয় না তাতে মানুষ অহংকারী হয়, ইকবাল বলল।

কিন্তু আমি তো মিথ্যা বলছি না, যা সত্য তাই বলেছি। আপনি বলুন, আমেরিকার বিলাস বহুল জীবন ছেড়ে মানুষের সেবা করার জন্য কেউ কি দেশে ফিরে আসে? এদেশে কি এমন ডাক্তার আছে যে নিম্নবিত্ত মানুষের সেবার জন্য সপ্তাহের একদিন বিনা টাকায় সেবা দেয়? আপনার মধ্যে যে দেশাত্মবোধ, মানবতাবোধ আছে তা এ যুগে বিরল। আমার মনে হয়েছে এতদিন পর আমি একজন খাঁটি মানুষের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেলাম। আমি যেন আপনাকে নিয়ে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি।

ইকবাল গম্ভীর স্বরে বলল, একা আমি কিন্তু এখনও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছি না। আগে ক্লিনিক চালু করব।

বেশ তো আমিও আপনার পাশে থাকব। দু’জনে বলধা গার্ডেন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে তোপখানা রোডের একটি হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। ইকবাল ট্যাক্সি ক্যাব এর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হোটেলের গেটের কাছে আসতেই হোটেলের একজন সিকিউরিটি গার্ড এক নিঃশ্বাসে বলল, টেংরা মাছ, টাকি মাছের ভর্তা, করলা ভাজা, পাট শাক, পুঁই শাক, লাল শাক, খাসী, মুরগী।

ইকবাল তার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে ভিতের ঢুকল। হোটেলের ভিতের ছোট কেবিনে দু’জনে মুখোমুখি বসতেই একা জিজ্ঞেস করল, আপনি এই হোটেলে আসলেন কেন? এই হোটেলে তো চাইনিজ খাবার নেই, ভাবছিলাম আজ এক সঙ্গে চাইনিজ খাবার খাব।

চাইনিজ তো আমি পছন্দ করিনা তাই বাংলা খাবার খাব বলে এসেছি আর এ হোটেলে কেন? আমি অনেক হোটেলে খেয়ে দেখেছি এ হোটেলে খাবারের মান ভালো, সবরকম খাবার পাওয়া যায়। হোটেলের সব কর্মচারীরা খুব কর্তব্যপরায়ণ।

তাই?

তুমি গেটে দাঁড়িয়ে যে সিকিউরিটি গার্ডকে এক নিঃশ্বাসে সমস্ত তরকারির নাম বলতে শুনলে সে সারাদিন এভাবেই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমনভাবে দেশের প্রতিটি মানুষ যদি কর্তব্য পরায়ণ হতো তবে এদেশের অনেক উন্নতি হতো।

এমনসময় একজন বয় কেবিনে ঢুকে বলল, স্যার কি ভাত খাবেন?

হ্যাঁ দু’জায়গায় ভাত দাও। আমার জন্য টাকি মাছের ভর্তা, পাট শাক, করলা ভাজি আর পাবদা মাছ বলে ইকবাল একাকে জিজ্ঞেস করল, একা বলো তুমি কী খাবে?

আপনি যা খাবেন তাই বলতেই বয় চলে গেল। দু’জনে খেতে খেতে অনেক গল্প করল পরস্পর কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। দু’জনে ভাত খাওয়া শেষে ইকবাল বয়কে জিজ্ঞেস করল, শরবত কী কী আছে?

লেবুর শরবত, ইসবগুলের শরবত বলে বয় জিজ্ঞেস করল, কী দিব স্যার?

ইকবাল বলল, দু’গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসো।

একা মৃদু হেসে বলল, আপনি আসলে একজন ব্যতিক্রমী মানুষ এমন মানুষ দেশে আর একজন আছে বলে মনে হয় না।

ইকবাল কোনো কিছু না বলে নীরবে খাওয়া শেষ করল। তারপর দু’জনে হোটেল থেকে বের হলো।

 

চৌদ্দ

 

রাত এগারটা বাজে তখনও শ্রেয়া বাসায় ফিরে না আসায় সালাম সাহেব দুশ্চিন্তায় বার বার মাথার চুল টানছিলেন, আয়েশা মাথা নত করে সোফায় বসেছিলেন। ইকবাল অভ্যাসবশত: দুশ্চিন্তায় তার বেডরুম ও ড্রয়িং রুমের মাঝে পায়চারি করছিল। সালাম সাহেব আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি শ্রেয়ার কোনো বন্ধু-বান্ধবীর মোবাইল নাম্বার আছে?

আয়েশা কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, ভার্সিটিতে যায় আসে, কোনোদিন তো কোন সমস্যা হয়নি, আমি কি এতকিছুর খবর রাখি?

সালাম সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, খবর রাখনা কেন? আজকাল ছেলে-মেয়েদের সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়, বুঝলে?

এমন সময় কলিং বেলের শব্দ শুনে ইকবাল গিয়ে দরজা খুলে দিল।

মাজা সাজু মারা গেছে, বলে শ্রেয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে মা?

ইকবাল শ্রেয়ার বাহুতে হাত রেখে তার বেড রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল, দুলাভাই শ্রেয়ার খুব কাছের এক বন্ধু মারা গেছে।

কীভাবে?

দুলাভাই আপনি আপনার রুমে যান আমি দেখছি, বলে ইকবাল শ্রেয়াকে তার রুমে নিয়ে গেল।

শ্রেয়া রুমে ঢুকে বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল। ইকবাল শ্রেয়ার মাথায় অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, শ্রেয়া।

শ্রেয়া বিছানায় উঠে বসল। ইকবাল শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল, শ্রেয়া সাজুর কী হয়েছিল?

মামা, সাজু ভার্সিটিতে ভর্তির পর যখন হলে সিট পাচ্ছিল না, তখন ক্ষমতাসীন দলের এক ছাত্র নেতার সহযোগিতায় হলে সিট পায়।

কেন হলে সিট বরাদ্দ কর্তৃপক্ষ দেয় না?

মামা সেটাতো হলো নিয়মের কথা, কিন্তু কোনো ছাত্র নেতার সহযোগিতা ছাড়া হল-এ অনেকেই সিট পায় না।

যা হোক তারপর বলো?

তারপর থেকে সে ছাত্র নেতা সাজুকে তার দলের ক্যাডার হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল।

ক্যাডার কীরে মা?

শ্রেয়া বিরক্তির সুরে বলল, মামা তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না, ক্যাডার হলো অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী।

অনেক বছর দেশের বাইরে ছিলাম তো, তাই অনেক কিছু জানি না, তারপর বল-

সাজু তার কথায় কোন দিন সাড়া দেয়নি, কিন্তু হরতালে মিছিল বা ভার্সিটিতে যে কোন মিছিলে মাঝে মাঝে যেতে হত। গতকাল বিকালে তেমনি একটি মিছিলে সাজু গিয়েছিল। তখন মিছিলকারী দু’টি দলের ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়, এক পর্যায়ে শুরু হয় গোলাগুলি। একটি গুলি সাজুর বুকে এসে আঘাত করে, সাজুকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার সময় সে মারা যায়।

ইকবাল শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাঁদিস না মা, সাজুর মৃত্যুতে তুই তোর বন্ধুকেই হারাসনি, তার বাবা-মা হারাল তিলে তিলে লালন করা তাদের আদরের সন্তানকে। তাদের কথা ভেবে দেখ তুই যদি ভেঙ্গে পড়িস তবে তার বাবা মা কী করবে? আসলে সন্ত্রাস আমাদের সমাজে একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এমনি আর কত সাজুকে সন্ত্রাসের জন্য জীবন দিতে হবে কে জানে? সবাই মিলে আমাদের একত্রিত হয় সন্ত্রাস মোকাবেলা করতে হবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগিতা করতে হবে। সন্ত্রাসীদের সাথে সব রকমের সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, চল মা ভাত খেতে চল।

শ্রেয়া বলল, তুমি যাও মামা আমার খিধে নেই।

না মা, চল, রাতে না খেয়ে ঘুমাতে নেই, যা ঘটে গেছে তার জন্য আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি। চল মা এবার চল বলে ইকবাল শ্রেয়াকে একরকম জোর করে টেনে নিয়ে গেল।

 

পনেরো

 

ইতোমধ্যে কয়েকদিন অতিবাহিত হয়েছে। ইকবাল মিরপুরে নিরিবিলি পরিবেশে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে ক্লিনিক চালু করেছে। ইকবালের পূর্বের সব রোগীরা নতুন ক্লিনিকে আসতে শুরু করেছে আর নতুন রোগীও আসতে শুরু করেছে। একদিন বিকেল বেলা ইকবাল ক্লিনিকে রোগী দেখছিল। এমন সময় একজন যুবক হারেসকে ধমক দিয়ে বলল, শালা, খানকির পো দরজা খোল, তারপর একসঙ্গে চারজন যুবক দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। ইকবাল হতভম্ব হয়ে গেল তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে অস্ফূষ্টস্বরে বলল, আপনারা?

একজন টেবিলের উপর পা তুলে মুখ বিকৃতি করে বলল, মিয়া ভাই আমাগো এলাকায় যে ক্লিনিক করলেন টাইগার ভাইর অনুমতি নিয়েছেন।

টাইগার ভাই মানে-

কীরে ফারুক্যা, মিয়া ভাই কয় কী টাইগার ভাইরে চিনে না? দিমু নাকি চিনাইয়া?

না থাক টাইগার ভাইকে না বলে সাইজ করা যাবে না, তুই মোবাইল লাগা বলে একজন মোবাইল ফোনে কথা বলল। তারপর বলল, এই যে, মিয়া ভাই এটা টাইগার ভাইর এলাকা, এই এলাকায় টাইগার ভাইকে ট্যাক্স না দিয়ে কেউ কিছু করে না।

এই ফারুক্যা বেশি কথা বলিস কেন? অ্যামাউন্টটা বল না।

এই যে মিয়া ভাই আগামী কাল সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা রাখবেন তারপর যেখানে পৌঁছে দিতে বলব সেখানে পাঠিয়ে দিবেন আর না দিলে বা কোন রকম চালাকি করলে বলে একজন পিস্তল বের করে ইকবালের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, ফুটা কইরা ফালাইমু, বলে সবাই চেম্বার থেকে বের হতে না হতেই একা চেম্বারে প্রবেশ করে বলল, কারা এসেছিল? আপনার এ অবস্থা কেন?

একা চাঁদাবাজ এসেছিল, পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা না দিলে ক্লিনিক চালু করা যাবে না।

একা ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে নীরবে বসে রইল।

একা প্রথম স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলল, আপনি কি ভাবছেন?

কী ভাবছি মানে? আমি সন্ত্রাসীকে চাঁদা দিয়ে ক্লিনিক করব? আমি থানায় মামলা করব, ওদের জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব, বলতে বলতে ইকবাল উত্তেজিত হয়ে উঠল।

একা ইকবালকে শান্ত করার জন্য বলল, আচ্ছা সে না হয় পরে হবে, আমাকে কি একটু সময় দিতে পারবেন?

ইকবাল সংযত হয়ে বলল, বলো কি মনে করে এসেছ?

কিছু মনে করে না, আমার এক বান্ধবী কাছাকাছি ভাড়া থাকে ওর কাছে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

ইকবাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই হারেস ভিতরে ঢুকল।

ইকবাল বলল, আর কেউ আছে?

না।

ইকবাল একাকে বলল, চলো বের হই।

দু’জনে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে উঠে বসল। কিন্তু দূর যাওয়ার পর ইকবাল একাকে জিজ্ঞেস করল, একা কোথায় যাবে?

আপনার মন ভালো নেই, চলুন কোথাও ঘুরে আসি।

বেশ তা বলো কোথায়?

চলুন ন্যাশনাল পার্ক থেকে ঘুরে আসি।

চলো।

গাড়ি ছুটে চলল, ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। প্রায় এক ঘণ্টা পর গাড়ি ন্যাশনাল পার্কের গেটে এসে দাঁড়াল। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ঘাসের উপর মুখোমুখি বসল। কিছুক্ষণ দু’জনে নীরবে বসে রইল। এক সময় একা নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আমরা যখন বাড়ির কাজ শুরু করি তখন ঐ এলাকার সন্ত্রাসী বাইট্টা কবির বাবার কাছে থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। প্রথমে সে মোবাইলে বাবার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে এবং বাবা ঠিকানা মতো টাকা না পাঠানোয় বাবাকে লাঞ্ছিত করে। আমার বাবা ছিলেন বরাবরই এক রোগা মানুষ, তিনি চাঁদা না দিয়ে বিল্ডিং এর কাজ চালিয়ে গেলেন। ফলে সন্ত্রাসীরা আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে বাবাকে প্রাণ নাশের হুমকিসহ আমাকে এসিড নিক্ষেপের হুমকি দিল। বাবা তবু মচকালেন না। নিজের সিদ্ধান্তে স্থির রইলেন। একদিন বিকেল বেলা আমি বেবি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমাদের বাসার কাছের মোড়ে একটা মাইক্রো-বাস আমার ট্যাক্সির গতিরোধ করে আমাকে জোরপূর্বক তাদের মাইক্রো বাসে তোলে। আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে জোরে চিৎকার করি। কিন্তু রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য লোক চলাফেরা করলেও কেউ আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেনি।

ইকবাল কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, তারপর-

তারপর তারা আমাকে একটি বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখে। আমার উপস্থিতিতে তারা মোবাইলে বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ লক্ষ টাকা চাঁদা না দিলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। উঃ কী বিশ্রী একেক জনের কথাবার্তা, মুখের ভাষা। একজনকে বলেছিলাম আপনাদের কি মা বোন নেই? আপনাদের মা কি জন্মের সময় মুখে-মধু দেয়নি?

সে যখন বিশ্রী ভঙ্গিতে ধমক দিয়ে আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছিল, এই খানকি চুপ নইলে ফুটা কইরা ফালামু।

এমন সময় আর একজন রুমে প্রবেশ করে বললেন, ঠিক আছে তুই এবার যা।

ছেলেটি চলে যেতেই আমার গা শিহরে উঠেছিল। তিনি আমার মুখ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, আমার নাম মো. হুমায়ুন কবির ওরফে বাইট্টা কবির।

আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।

কি চমকে উঠলেন মনে হচ্ছে?

না মানে-

যদিও আমার নাম শুনলে সবাই ভয় পায় তবুও আপনি ভয় পাবেন না। কারণ মেয়েদের আমি শ্রদ্ধা করি।

এতই যদি শ্রদ্ধা করেন তবে আমাকে তুলে এনেছেন কেন?

টাকার জন্য।

তাই বলে এভাবে মানুষকে জিম্মি করে টাকা রোজগার?

টাকার প্রয়োজন তাই এ লাইনটাই বেছে নিলাম। আমার অনেক টাকার প্রয়োজন, বলতে বলতে কবিরের গলার স্বর নরম হয়ে গেল।

কেন?

জানতে চান?

বলুন?

তবে শুনুন বলে কবির বলতে শুরু করেছিলেন, মার কাছে শুনেছি আমার বাবা ঠেলাগাড়ি চালাত। বাবা মায়ের সংসার খুব সুখের ছিল, ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নিয়ে বাবা-মা আগারগাঁও বস্তিতে থাকত। আমার জন্মের প্রায় মাস খানেক আগে বাবা হঠাৎ করে ইন্তেকাল করে। মা হয়ে পড়ে একেবারে দিশেহারা, ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে মা পাশে এক বিধবা মহিলার কাঁচা বাসায় থাকা শুরু করে। সেই ঘরে আমি জন্ম গ্রহণ করি। মা আমাকে ঘরে রেখেই ঐ মহিলার সঙ্গে সারাদিন ছাই বেচে বেড়াত। তার সেই সামান্য রোজগার দিয়ে মা আমাকে লালন পালন করে। আমার বয়স তখন সাত বছর। মা আমাকে এনজিও পরিচালিত একটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সেখান থেকে আমি ফাইভ পাশ করি। কিন্তু মায়ের রোজগারে আমাদের সংসার না চলায় আমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে বস্তির পাশে একটি হোটেলে বয় এর কাজ নেই। হোটেলের মালিক সব বিবরণ শুনে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন এবং স্কুলের সময় আমার ডিউটি মাফ করে দেন। তাঁর সহযোগিতা আর আমার কঠোর অধ্যবসায়ে আমি এস.এস.সি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করি। তারপর একটি নাইট কলেজ থেকে এইচ. এস. সি এবং বি.এ পাশ করি। কিন্তু এত কষ্ট করে বি. এ পাশ করার পর ঢাকার রাস্তায় চাকরির জন্য অনেক ঘুরলাম। কিন্তু চাকরি হলো না। একদিন আমার স্নেহময়ী মা অসুস্থ হয়ে পড়ল, একটা ভ্যানে কর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বস্তির মানুষ কাজেই হাসপাতালে সিট পাওয়া গেল না, মা কয়েকদিন হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় মরে গেল। মায়ের লাশ দাফন করে মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম, “মা টাকার জন্য তুমি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে একদিন আমি প্রচুর টাকার মালিক হবো।” তারপর যে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের আমি ঘৃণা করতাম সেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলালাম। ধনী আর গরীব মানুষের মধ্যে যদি সামাজিক বন্ধন থাকত, আপনাদের মতো উঁচু তলার মানুষেরা যে পরিমাণ অর্থ অপচয় করে তার সামান্য অংশ যদি বস্তিবাসী, বিত্তহীন, ছিন্নমূল মানুষের কল্যাণে ব্যয় করত তবে দেশে কোনো বস্তি থাকত না, কেউ না খেয়ে মরত না, কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যেত না। আমার মতো বেকার যুবকরা সামান্য বেতনের একটি চাকুরি পেলে কলম ছেড়ে দিয়ে হাতে তুলে নিত না অবৈধ অস্ত্র, হতো না মানুষ থেকে সন্ত্রাসী। যা হোক ওস্তাদ আমাকে খুব পছন্দ করতেন বড় বড় সব অপারেশনে তিনি আমাকে সঙ্গে রাখতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি একদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে নেয়ার সময় পথে ওস্তাদ ইন্তেকাল করলেন। শুনেছি ওস্তাদকে নাকি পুলিশ খুব মেরেছিল, একরকম পুলিশের মার খেয়ে ওস্তাদ মারা গেলেন। ওস্তাদের লাশের ময়না তদন্ত হলো না, হবে কী করে? ওস্তাদ তো সন্ত্রাসী, মানুষ না, সন্ত্রাসী মেরে ফেললে বিচার কীসের? পরে জানলাম আসল বিষয়। ওস্তাদ পুলিশের মারের চোটে গডফাদারের নাম বলে ফেলেছিলেন, তাই তিনি সেই গডফাদারের জন্য নিরাপদ ছিলেন না। পরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি গডফাদারের অদৃশ্য ইশারায় ওস্তাদকে জীবন দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয় কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকজন সন্ত্রাসী রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সহযোগী সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করতে গিয়ে ক্রস ফায়ারে মৃত্যু বরণ করলো। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এলো গডফাদারের নাম এবং কীর্তি বলে দেয়ার জন্য কৌশলে তাদেরকে মেরে ফেলা হলো। সন্ত্রাসীদের সব কথা জনসম্মুখে বেরিয়ে পড়লে গডফাদারের মুখোশ উন্মোচন হতো। সে জন্য অসীম ক্ষমতাধর গডফাদাররা তাদের পরিচয় বেরিয়ে পড়ার ন্যূনতম আশঙ্কা থাকলে যে কোন মূল্যে পৃথিবী থেকে তাকে ট্রান্সফার করে দেয়। আবার নতুন সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়, নতুন নতুন সন্ত্রাসীর জন্ম দেয়। একের পর এক সন্ত্রাসী ধরা পড়ছে, মৃত্যু বরণ করছে কিন্তু গডফাদাররা থেকেই যাচ্ছে আড়ালে, নিরাপদে। ফলে তারা আবার নতুন সন্ত্রাসীদেরকে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া যাবে না। ততদিন শুধু সন্ত্রাসী ধরে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না। সন্ত্রাসীর মুখ পাল্টাবে কিন্তু সন্ত্রাস দমন হবে না। এই যেমন ওস্তাদের অনুপস্থিতিতে দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে আমি দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। বস্তির হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজার ব্যবসা, বস্তি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা সবকিছু চলে এলো আমার হাতে। আমার ক্যাডার বাহিনী আর এলাকায় আমার আধিপত্য দেখে ওস্তাদের গডফাদার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তাকে বড় ভাই বলে ডাকতে শুরু করলাম। তারপর থেকে এই বড় ভাই আমাকে যে কোনো বিপদ-আপদে আশ্রয় দিতেন। থানায় আমার নামে মামলার পর মামলা দায়ের হতে থাকল। আমার নামে মামলার সংখ্যা যতই বাড়ল, ততই মানুষ আমার নাম শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ফলে মানুষকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করাটা আরো সহজ হলো। খুব দ্রুত গতিতে আমি টোকাই থেকে কোটিপতি হয়ে গেলাম। সেই সাথে আমি হলাম দেশের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী। বলতে বলতে কবিরের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণে আমি কবিরের গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। তার চোখের পানি দেখে তিরস্কারের স্বরে বলেছিলাম, এত বড় সন্ত্রাসীর চোখে পানি?

কেন সন্ত্রাসীরা কি মানুষ নয়? তাদের কি কষ্ট থাকতে পারে না?

এমন সময় কবিরের মোবাইলে রিং বেজে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে কবির অমানুষ হয়ে গিয়েছিল। আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছিল, এই কুত্তার বাচ্চা তোর বাপ আমার নামে মামলা করেছে, তোরে আর সময় দেওয়া যায় না। এই হারামজাদী তোর বাপকে বল আট ঘণ্টার মধ্যে তোর যদি থানা থেকে মামলা তুলে নিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে না যায় তবে তোর এই সুন্দর দেহটা আমার মানুষরূপী ঐ পোষা কুত্তা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াব। তোর লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে ঝিলের কচুরিপানায় পচাব, এই খানকি বল তোর বাপকে মামলা তুলে নিতে, পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে, বলে সে আমার হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে বলল, বল হারামজাদী।

আমার হাত-পা তখন থর থর করে কাঁপছিল। আমার মনে হচ্ছিল মৃত্যুকে আমি খুব কাছ থেকে দেখছি। আমি বাবাকে মোবাইল করতেই বাবা আমার কান্না শুনে আর দেরি করেনি। শেষ পর্যন্ত কবিরের কথামতো মামলা তুলে নিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে আমাকে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করে।

মান সম্মানের ভয়ে বাবা পুরো ঘটনাটা কাউকে জানাল না ঠিকই, কিন্তু তার পরও কেমন করে যেন আমাদের প্রতিবেশী, আত্ময়ই-স্বজনরা জেনে ফেলল। বাড়ির কাজ শেষ হলো বাবা আমার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু করল। কিন্তু ঐ একটা কারণেই বার বার বিয়ে ভেঙে গেল।

ইকবাল উত্তেজিত হয়ে বলল, কী আশ্চর্য? তোমার তো কোনো দোষ নেই, তুমি তো শুধু ঘটনার শিকার, তারপরও তোমাকে শাস্তিভোগ করতে হবে কেন?

একা ক্রোধের সুরে বলল, এটাই নিয়ম।

ইকবাল তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, না এটা অনিয়ম, উদর পিণ্ডি বুদর ঘাড়ে। যারা অপরাধ করল, যারা একটা নির্দোষ মেয়েকে অপহরণ করল তাদের কোনো দোষ নেই?

তারা তো পুরুষ তাদের বেলায় সতীত্বের প্রশ্ন নেই, কিন্তু মেয়েদের বিয়ের বেলায় সতীত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেনে শুনে কেউ কি একজন অপহৃত মেয়েকে বিয়ে করবে? বলে একা একটু থামল তারপর বলল, যাক সে কথা আপনাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?

বলো?

আপনি টাইগার ভাইয়ের সঙ্গে একটা আপোষ করে ফেলুন।

ইকবাল আশ্চর্য হয়ে বলল, একজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে আপোষ করতে হবে।

আপনি সেবা করার মতো একটা মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন, এ কাজে আপনাকে সফল হতে হবে। কিন্তু চাঁদা না দিলে সন্ত্রাসীরা আপনাকে কোনোদিন ক্লিনিক চালু করতে দিবে না, আপনি অল্প দিন হলো দেশে ফিরেছেন তাই সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। ওরা অনেক বেশি ক্ষমতাবান, ওদের হাত অনেক লম্বা।

ইকবাল উত্তেজিত হয়ে বলল, একা আমি সন্ত্রাসীদের কাছে মাথা নত করব না, প্রয়োজনবোধে আমি অন্য কোথাও ক্লিনিক করব।

আপনি যেখানেই ক্লিনিক করুণা না কেন, দেখবেন সেখানেও কোনো সন্ত্রাসীকে চাঁদা দিতে হবে সমস্ত শহর, না সমস্ত দেশ যেন সন্ত্রাসীরা লিজ নিয়েছে। আপনি চাঁদা না দিলে ক্লিনিক করতে পারবেন না। ক্লিনিক করতে না পারার মানে আপনার একটা মহৎ প্লান ভেস্তে যাওয়া।

একা চুপ করো, আমি এখন এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।

একা ইকবালকে সান্ত্বনার জন্য মৃদু হেসে বলল, হয়েছে জনাব হয়েছে একবার ঘড়ির দিকে তাকান সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

ইকবাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ওহো আচ্ছা, চলো যাওয়া যাক।

তারপর দু’জনে উঠে পড়ল।

 

ষোল

 

সালাম সাহেব তামাশার স্বরে বললেন, চুপ করে থাকলে তো চলবে না, তোর ঐ লায়ন ভাইর-

ইকবাল সালাম সাহেবের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, লায়ন না, টাইগার ভাই।

আচ্ছা হলো, ঐ টাইগার ভাইর সঙ্গে তো একটা আপোষ করতেই হয়।

দুলাভাই আপনিও টাইগারের সঙ্গে আপোষ করতে বলেছেন?

সালাম সাহেব ইকবালের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য বললেন, তুই কি লায়ন না কি ঐ যে টাইগারের সঙ্গে আপোষ করবি না?

দুলাভাই আপনি বিষয়টা খুব হাল্কা মনে করেছেন?

সালাম সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, হাল্কা মনে করছি না সমস্যাটা এত জটিল আর ভয়ঙ্কর যে সহজভাবে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। কেউ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে চায় না, সবাই কোন না কোনোভাবে তাদের সঙ্গে মিলে মিশে চলে যাকে বলে বাঘে মেষে এক ঘাটে জল খাওয়া। আর যারা প্রতিবাদ করে বা চাঁদা দিতে অস্বীকার করে তাদেরকে শুধু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, প্রকাশ্যে দিনের বেলায় গুলি করে হত্যা করে। তাই আমি বলছি তুই ওদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাস না। একটা রফা করে ফেল। একটা অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করব? দুলাভাই আমি আপনার কথা মানতে পারছি না, বলে ইকবাল সোফা থেকে উঠে তার রুমের দিকে যাচ্ছিল এমন সময় সালাম সাহেব আবার ডাক দিলেন, পাগলামি করসি না, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ।

আর মাথা ঠাণ্ডা থাকছেনা দুলাভাই, ক্লিনিক করার অনুমতির জন্য ঘুরতে ঘুরতে অনেকদিন কেটে গেল। ভাবলাম আর বুঝি কোনো বাধা নেই। এখন দেখি নতুন সমস্যা উদয় হলো।

সালাম সাহেব বললেন, সমস্যা তো থাকবেই, আমি বলি কি ওরা যখন তোর কাছে চাঁদা চাইছে তখন ওরা আবার আসবে। আসলে তুই একটা বোঝাপড়া করে ফেলবি।

ইকবাল মুহূর্তেই জ্বলে উঠল, না দুলাভাই আমি আপনার কথামতো ওদের সাথে বোঝাপড়া করব না। আমি এ ক’দিনে দেখলাম যে, সন্ত্রাসীরা প্রাণ নাশের দিয়ে টাকা দাবি করে আর অনেকেই ঝামেলা এড়ানোর জন্য টাকা দিয়ে আপোষ করে।

তাইতো সন্ত্রাসীদের দৌড়ত দিন দিন বেড়েই চলছে। সবাই পাশ কাটিয়ে গেলেই তো চলবে না। কাউকে না কাউকে সাহসী হতে হবে, ওদের প্রতিরোধ করতে হবে। যদি কেউই প্রতিরোধের দায়িত্ব না নেয় তবে এক এক করে সবাইকে মূল্য দিতে হবে।

আয়েশা ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, না ভাই তোর ওদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করার দরকার নেই, তুই ওদের সঙ্গে পারবি না, আমি তোকে কিছুতেই যেতে দিব না, বলতে বলতে আয়েশার দু’চোখ ছল ছল করে উঠল।

তুই আমাকে বাধা দিস না আপা, আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে এক ইঞ্চিও পিছ পা হব না, বলে ইকবাল তার রুমে চলে গেল।

 

সতের

 

দরজা খুলে দিয়ে একাকে দেখামাত্র প্রিয়া জড়িয়ে ধরে বলল, একা তুই? এতদিন পর আমাকে মনে পড়েছে? আজ কি সূর্যটা সত্যি সত্যিই পূর্ব দিকে উঠেছে?

চন্দ্র, সূর্য সবই ঠিক আছে, কিন্তু তুই কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে গেট থেকে বিদায় করবি?

প্রিয়া একার হাত ধরে টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল। তারপর দু’জনে মুখোমুখি বসে একা জিজ্ঞেস করল, প্রিয়া বল কেমন আছিস?

আমার কিরে সংসার করছি এক রকম ছকে বাঁধা জীবন, বৈচিত্র্য নেই রে।

কেন তোর সাহেব তো বেশ রোমান্টিক।

হ্যাঁ সে তো খুব রোমান্টিক, সব সময় হাসি খুশি থাকে, কিন্তু বেচারা ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত। এখন তোর কথা বল, প্রিয়া বলল।

আমি তোর সাহেবের কাছে একটা কাজে এসেছি।

অতো দোকানে আছে।

একটু খবর দে না প্লিজ।

তুই একটু বস আমি মোবাইলে মিস কল দিলে এখনি চলে আসবে, বলে প্রিয়া ভিতরে চলে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে পূর্বের মতো বসতে বসতে বলল, ইমারজেন্সি মিস কল দিয়েছি।

মিস কলের আবার অর্ডিনারি আর ইমারজেন্সি কী? একা জিজ্ঞেস করল।

বুঝিসনি তাহলে শোন বিনা কারণে আমরা কেউ মিস কল দেই না, আমাদের মিস করল এর অর্থ আছে, এক মিস কল এর অর্থ হলো হাতের কাজ সেরে এসো, পর পর দুই মিস কলের অর্থ হলো তাড়াতাড়ি এসো আর পর পর তিন মিস কলের মানে হলো যত কাজই থাকুক না কেন তুমি এখনই চলে এসো।

প্রিয়া তুই এখনো আগের মতোই আছিস, ঠিক আগের মতোই যেন এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সব সময় হাসি খুশী।

কি করব বল আমি ছোটবেলা থেকেই এ রকম, মনের মধ্যে কখনো দুশ্চিন্তা লালন করি না। কপালে যা আছে তাই হবে, প্রিয়া বলল।

প্রিয়া তোর মতো যদি আমি মনের সব বোঝা ঝেড়ে ফেলতে পারতাম বলে একা আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠায় প্রিয়া সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এই বুঝি এলো। তারপর দরজা খুলে দিতেই তানজিল বলল, কী ব্যাপার? ইমার্জেন্সি কল?

আগে ভিতরে এসে দেখ কে এসেছে?

তানজিল ড্রয়িং রুমের ভেতরে ঢুকেই যেন চমকে উঠল, তুমি একা না?

চিনতে পেরেছেন তাহলে?

তোমার মতো বুদ্ধিমতী, সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েকে কেউ কি চিনতে ভুল করে? বলতে বলতে তানজিল সোফায় বসল।

কীরে প্রিয়া তোর সাহেবের তো দেখি চোখের চিকিৎসা করা দরকার।

দায়িত্বটা তোকেই দিলাম, তুই বস গল্প কর, আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করি, বলে প্রিয়া চলে গেল।

একা মৃদু কণ্ঠে বলল, দুলাভাই আমি আপনার কাছে একটা বিপদে পড়ে এসেছি।

কী বিপদ বলো?

দুলাভাই আপনার দোকানের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা উত্তরে দিকে চলে গেছে সে রাস্তার শেষের বাসায় আমার এক আত্মীয় ইকবাল সাহেব একটা ক্লিনিক করেছেন। ক্লিনিক চালু করার অল্প কয়েকদিন হলো। কিন্তু গতকাল বিকেল বেলা কয়েকজন সন্ত্রাসী ক্লিনিকে গিয়ে বলেছে, আজ দিনের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে ক্লিনিক বন্ধ করে দেবে।

প্রিয়া চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে বলল, কী রকম আত্মীয়?

আত্মীয় আবার কী রকম? যার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক থাকে।

বাহ্‌ তলে তলে এতদূর অগ্রগতি-

তানজিল ধমকের সুরে বলল, প্রিয়া।

প্রিয়া সোফায় বসে বলল, ঠিক আছে ভাই চা খাও আর গল্প কর আমি মুখে তালা দিলাম।

একা বলতে শুরু করল, ইকবাল সাহেব খুব নীতিমান মানুষ, তিনি কোনোক্রমেই চাঁদা দিবেন না, তাঁর যুক্তি হলো এমনভাবে সব মানুষ সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে দিয়ে একটা সিস্টেম চালু করেছে। কাজেই কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতে হবে। আর সেটা করতে চান তিনি নিজেই।

তুমি বুঝাও নি? তানজিল জিজ্ঞেস করল।

তিনি কয়েক মাস হলো আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছেন এদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা নেই।

আমি তোমাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি?

আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন তারা যেন আর কোনোদিন ক্লিনিকে না যায়।

তোমার কাছে কি কোন ঠিকানা বা মোবাইল নাম্বার আছে?

না, তবে শুনেছি লোকটার নাম টাইগার।

তানজিল বলল, আমার সঙ্গে ওর সরাসরি পরিচয় নেই, ওর এক চামচা ফারুক্যার সঙ্গে পরিচয় আছে। ফারুক্যাই তো টাইগার ভাইয়ের হয়ে এই এলাকার চাঁদা তোলে।

আপনাকেও চাঁদা দিতে হয়? একা জিজ্ঞেস করল।

শুধু আমাকে কেন? মুদির দোকান থেকে শুরু করে বড় দোকান পর্যন্ত এই এলাকার সবাইকে টাইগার ভাইকে চাঁদা দিতে হয়। আর টাইগারকে চাঁদা না দিয়ে কেউ এ এলাকায় ব্যবসা করতে পারবে না।

দুলাভাই প্লিজ আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন। একা বিনয়ের সুরে বলল।

ক্লিনিকের নাম যেন কী?

আশ্রয় মনো ক্লিনিক।

তানজিল ফারুক্যার মোবাইলে কয়েকবার রিং করার পর মোবাইল বন্ধ করে বলল, না, পাওয়া গেল না, মোবাইল বন্ধ আছে।

একা তানজিলের মুখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই এখন কী হবে?

তানজিল বলল, এত টেনশনের কিছু নেই, এটা কোনো সমস্যা নয়, তারা যখন সময় বেঁধে দিয়েছে তখন তারা আবার আসবে, তখন টাকা দিলেই সমস্যা শেষ।

সমস্যাটা তো ওখানেই।

কেন? তানজিল জিজ্ঞেস করল।

কারণ ইকবাল সাহেব চাঁদা তো দিবেনই না এবং আমি যে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি এ কথা শুনলে তিনি হয়ত আমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই রাখবেন না।

আপনি ডাক্তার সাহেবকে বোঝাবেন, সন্ত্রাসীদের রূপ সম্পর্কে ধারণা দিবেন, দেখবেন তিনি রাজি হয়ে গেছেন, বলে তানজিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, একা তুমি গল্প করো, আমার একটু তাড়া আছে, বলে তানজিল বের হয়ে গেল।

প্রিয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে একার পাশে বসে বলল কীরে লোকটা তোর এমন কে? যার জন্য তুই টাকা দিয়ে টাইগারকে ম্যানেজ করতে চাচিছস আবার বিষয়টি গোপন রাখতে চাচ্ছিস, একেবারে নীরব ভালোবাসা!

মুহূর্তেই একা উদাস হয়ে বলল, প্রিয়া তুইতো আমার জীবনের দুর্ঘটনার কথা জানিস তারপর থেকে জীবনের প্রতি আমি বিতৃষ্ণ হয়ে যাই। সমস্ত পুরুষ মানুষকেই আমার হিংস্র দানব বলে মনে হতো, আমার মনে পুরুষ সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীর আলো যেন আমার চোখে তীরের মতো আঘাত হানত। সব সময় আমি নিঃসঙ্গ ঘরের মধ্যে বসে থাকতাম। ইকবাল সাহেব তখন বিদেশে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে এলে আমার দূর সম্পর্কের এক ফুপাতো ভাই তাঁকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। ইকবাল সাহেবের সঙ্গে প্রথম কথা বলেই আমি তার প্রতি যেন দুর্বল হয়ে পড়লাম। তিনি তাঁর যুক্তি, মনোবল ও বাঁচার প্রেরণা দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুললেন। আমাকে সুস্থ করতে তিনি যে শ্রম দিয়েছেন, যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন টাকা দিয়ে কোনো দিন তা কেনা যায় না।

প্রিয়া মৃদু হেসে বলল, বাহ্‌! তুই তো একেবারে ………….

একা প্রিয়ার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, প্রিয়া ইয়ার্কি করিস না, তুই যদি একদিন তাঁর সাথে কথা বলিস তোরও ভালো লাগবে।

বেশতো একদিন পরিচয় করিয়ে দিস।

তুই থাক রে আমি আসি, বলে একা বেরিয়ে পড়ল।

 

আঠার

 

কিছুক্ষণ দু’জনে বসে রইল। তারপর একরকম হঠাৎ ইকবাল বলল, একা।

জি বলুন।

আসলে তোমাকে কথাটা যে কী করে বলি?

এতদিন থেকে আমরা এভাবে মেলামেশা করা ঠিক হচ্ছে না।

মুহূর্তে একা রেগে লাল হয়ে বলল, আপনি যদি তাই মনে করেন তবে আর মেলামেশা করবেন না, এজন্যই কি আমাকে ডেকেছেন?

ইকবাল হতভম্ব হয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ করে বলে ফেলল, একা তার চেয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলি।

একা হো হো করে হেসে উঠল।

ইকবাল রেগে বলল, একা আমি হাসির কথা বলছি না, সিরিয়াসলি বলছি, তুমি একদিন জানতে চেয়েছিলে না।

একা হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, হাসব না, জেনে শুনে আপনি অপহরণ করা একজন মেয়েকে বিয়ে করবেন? আমার প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন?

দয়া দেখাব কেন?

তবে?

তোমার বাবা-মা তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য ছেলে দেখছেন, আমি বিদেশে থাকতেই আপা দুলাভাইও আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেছেন। তুমি যদি রাজি থাক তবে আমি বাকী সব ব্যবস্থা করি।

আপনি ভেবে বলেছেন তো-

অবশ্যই।

একা বলল, না আপনি আবেগের বশে বলছেন।

একা আমি প্রথম দিন তোমাকে দেখতেই ভালোবেসে ফেলেছি এবং মনে মনে তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চিকিৎসার প্রয়োজনেই হোক কিংবা মনের টানেই হোক আমি বার বার তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তোমার জীবনে পুরুষ সম্পর্কে যে ভীতি জন্মেছিল আমার সঙ্গে মেলামেশা করে তোমারও সেই ভীতি দূর হয়েছে। আমরা দু’জনে প্রায় সব বিষয়ে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের মতো আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করার বয়স নেই। আমি দেশে পা দিয়েই অনেক ভেবে চিন্তে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপর তোমাকে প্রথম দেখেই আমার মনে হলো তোমাকে পাওয়ার প্রতীক্ষায় বুঝি আমার এত বছর কেটে গেল।

এটা আপনি এখন বলছেন, কিন্তু বিয়ের পর যদি আপনার আত্মীয়-স্বজন আমার অতীত নিয়ে প্রশ্ন তোলে?

ইকবাল গম্ভীর স্বরে বলল, একা তুমি আমাকে এখনও চিনতে পারনি?

একা নীরবে বসে রইল। ইকবাল একার মুখ উঁচু করে ধরে বলল, একা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

একা ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে দিল।

তবে আমার হাতে হাত রাখ আজ থেকে আমাদের দু’জনের অন্তর এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যাক। আমরা দু’জন একই বন্ধনে আবদ্ধ হই।

একা ইকবালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ইকবাল একার হাত চেপে ধরল।

 

উনিশ

 

ইকবাল থানায় ঢুকে একজন কনস্টেবলকে ওসি সাহেবের চেম্বারের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ইকবাল ওসি সাহেবের রুমে ঢুকে সালাম দিতেই ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি?

আমি ডা. ইকবাল, মনোরোগ চিকিৎসক বলে ইকবাল হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

ওসি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে হ্যান্ড শ্যাক করে বললেন, বসুন, আপনার জন্য কী করতে পারি বলুন?

আমি কয়েকমাস হলো আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছি এবং কয়েকদিন আগে একটা ক্লিনিক চালু করেছি।

ক্লিনিকের নাম কী? ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

আশ্রয় মনো ক্লিনিক।

আশ্রয়, আশ্রয় বলে ওসি সাহেব চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিলেন তারপর বললেন, দেখেছি আপনার ক্লিনিক, বলুন কী সমস্যা?

গতকাল টাইগারের নামে এক সন্ত্রাসীর রেফারেন্স কয়েকজন সন্ত্রাসী আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা করছে।

টাইগারের তেইশটি মামলা আছে, আমরাও হন্যে হয়ে ওকে খুঁজছি।

ইকবাল উৎসাহী হয়ে বলল, আমি আপনাদের সহযোগিতা করতে চাই।

ওসি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন, দেখুন আমরা যখন কোনো সন্ত্রাসী গ্রেফতার করি তখন ভয় কেউ সাক্ষী দেয় না, তাই সন্ত্রাসীরা বেরিয়ে যায়। আর আপনি এসেছেন সন্ত্রাসী ধরতে সহযোগিতা করতে?

ইকবাল রেগে ফেটে পড়ল। সে ক্রোধের সুরে বলল, দেখুন আপনাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। আপনাদের অপারেশন মিশন রওয়ানা হওয়ার খবর নাকি আগেই সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে যায় ফলে সন্ত্রাসীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় আর আপনাদের মিশন ব্যর্থ হয়।

ওসি সাহেব বললেন, দেখুন কোন কোন সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং আমাদের অপারেশন ব্যর্থ হয়। তারমানে এই নয় যে, আমরাই তাদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করি। আপনি আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা কঠোর গোপনীয়তা সহকারে অপারেশন পরিচালনা করব এবং অবশ্যই পুরো দলসহ টাইগারকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।

এখন বলুন আপনি কীভাবে অপারেশনে যেতে চান এবং আমি আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি? ইকবাল জিজ্ঞেস করল।

আপনার ক্লিনিকে ক’জন রোগী আছে?

ক্লিনিক তো সবেমাত্র চালু করেছি, বেশির ভাগই রোগী আউটডোরে, ইনডোরে সাতজন রোগী আছে।

বেশ শুনে খুব খুশী হলাম আপনার ক্লিনিকে সিভিল ড্রেসও দশজন পুলিশ সদস্য রোগী হিসাবে ভর্তি থাকবে, তাদের বালিশের নিচে প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে। আর অপারেশন সফল না হওয়া পর্যন্ত আপনার সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকবে একজন মহিলা পুলিশ সদস্য, ওসি সাহেব বললেন। তারপর কলিং বেল-এ টিপ দিয়ে বললেন, সেন্ট্রি চা নিয়ে এসো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে চা চলে এলো, ওসি সাহেব চা খেতে খেতে বললেন, ইকবাল সাহেব কোনো কিছুতেই ভয় পাবেন না। পুলিশ আপনাকে প্রটেকশন দিবে।

ইকবাল মৃদু হেসে বলল, মৃত্যুর ভয় আমি করি না, এমন একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। তারপর চা শেষ করে ইকবাল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। ওসি সাহেব নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, আপনি ক্লিনিকে যান, কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার লোকজন আপনার ক্লিনিকে পৌঁছে যাবে। বলে ওসি সাহেব হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ইকবাল সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করে বিদায় নিল।

 

কুড়ি

 

ইকবাল ক্লিনিকে পৌঁছার কয়েক মিনিট পর সিভিল ড্রেস এ একজন মহিলা পুলিশ ইকবালের কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে ওসি সাহেবের পরামর্শ মত সেক্রেটারির আসন গ্রহণ করল। তারপর একে একে রোগীর ছদ্ম বেশে দশজন পুলিশ সদস্য ক্লিনিকের বেডএ অবস্থান গ্রহণ করল। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর পাঁচ-ছয়জনের একদল যুবক ইকবালের চেম্বারে ঢুকল। তাদের চেহারা দেখে ইকবালের বুঝতে বাকি রইল না যে তারা টাইগারের লোক। তাদের একজন টেবিলে পা রেখে বলল, এই খানকির পো, মাল দে শালা হারামজাদা।

ইকবাল থমমত খেয়ে বলল, দেখুন ভাই আমি সবে মাত্র ক্লিনিক চালু করেছি, এত টাকা চাঁদা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

এই কথা কম কাজ বেশী, একেবারে ফুডা কইরা ফালামু।

এমন সময় সেক্রেটারি বাইরে থেকে বলল, স্যার একটু ৭নং বেড এর রোগীর কাছে আসুন।

ইকবাল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই একজন মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, এই চালাকি করবি না, মাল ছাড় বেটা খানকির পো।

ইকবাল বিনীতভাবে বলল, দেখুন ভাই আমাকে রোগীটা দেখে আসতে দিন, তারপর আপনাদের সঙ্গে আবার কথা বলব।

সন্ত্রাসীদের একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পিস্তল নামিয়ে বলল, চল বেটা তোর উপর বিশ্বাস নেই, পরে পালিয়ে গেলে আবার একদিন আসতে হবে।

ইকবালের পিছনে পিছনে সবাই রোগীদের ওয়ার্ডে প্রবেশ করল। ৭নং বেড রুমের এক কোনায়। ইকবাল ৭নং বেডের কাছে যেতেই মুহূর্তের মধ্যেই সমস্ত পুলিশ সদস্য বেড় ছেড়ে উঠে বিদ্যুৎ গতিতে সন্ত্রাসীদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একজন পুলিশ বলল, হ্যান্ডস আপ, অস্ত্র ফেলে দাও, নইলে কেউ বাঁচবি না।

সন্ত্রাসীরা সকলেই অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত উঁচু করল। ওয়ার্ডে প্রবেশ করলেন ওসি সাহেব তারপর ব্রজকণ্ঠে বললেন, হ্যান্ড কাপ লাগিয়ে থানায় নিয়ে যাও।

সন্ত্রাসীদের হ্যান্ড কাপ পরিয়ে পুলিশ সদস্যরা নিয়ে গেল। ওসি সাহেব ইকবালের সঙ্গে হ্যান্ড ক্যাশ করে বললেন, মি. ইকবাল আপনার সহযোগিতার জন্য আমি কৃতজ্ঞ, আমাদের অপারেশন এখনো শেষ হয়নি, আপনি মোটেই ভয় পাবেন না, প্রটেকশনের জন্য সিভিল ড্রে এ পুলিশ আপনার আশে-পাশে থাকবে। সুসংবাদের জন্য অপেক্ষা করুন, টাইগারকে গ্রেফতার করতে পারলেই আপনাকে জানাব।

ইকবালের দু’চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরছে, গর্বে বুক ভরে গেছে। ইকবালের মনে হচ্ছে সে যেন অপ্রত্যাশিতভাবে আরো একটি সফলতা অর্জন করল।

ইকবাল বলল, আমি আপনার সাফল্য কামনা করছি।

ওসি সাহেব থানায় পৌঁছেই টাইগারের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে টাইগারের ঠিকানা নিয়ে সিভিল ড্রেস একদল পুলিশ নিয়ে ছুটে চললেন। প্রথমে সমস্ত বাসা ঘিরে ফেললেন, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসার ভিতর থেকে গুলি শুরু হলো। ওসি সাহেব আরো পুলিশ চেয়ে কন্ট্রোল রুমে ম্যাসেজ পাঠালেন। ফোর্সদের গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন। প্রায় আধাঘণ্টা গোলাগুলি চলল, কন্ট্রোল রুম থেকে আরো পুলিশ সদস্য এসে যোগ দিল। ওসি সাহেব নিজে গুলি করতে করতে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলেন। আরো দু’জন সন্ত্রাসী সহ টাইগারকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এলেন তারপর টাইগারকে গ্রেফতারের খবর ইকবালের মোবাইল করে জানালেন।

 

একুশ

 

এতদিন বিয়ের কথা বলতেই ইকবাল কৌশলে এড়িয়ে যেত অথচ নিজ মুখে বিয়ের আয়োজন করতে বলায় সালাম সাহেব আয়েশা দু’জনেই অবাক না হয়ে পারলেন না। সালাম সাহেব কিছুক্ষণ ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশা আমার সামনের সোফায় বসা আমি কি আমার একমাত্র শ্যালক ইকবালকে দেখছি, না কি অন্য কাউকে?

দুলাভাই আমি আপনার একমাত্র শ্যালক ইকবাল, আপনার বিশ্বাস না হয় চশমাটা চোখে লাগান।

সালাম সাহেব দু’চোখ মুছে সোফায় বসতে বসতে বললেন, না না চশমা পরতে হবে না, আমি চিনতে পেরেছি আমার শ্যালকের সুমতি হয়েছে।

আয়েশা বলল, তুই কি বউ দেখেছিস? নাকি আমাদের দেখতে হবে?

তুই দেখেছিস, আমিও দেখেছি, সবার পরিচিত।

তুই কার কথা বলছিস? আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন।

বলল ইকবাল, বুঝতে পারছিস না?

সালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুই একার কথা বলছিস?

ইকবাল মাথা নেড়ে সায় দিল।

আয়েশা তৎক্ষণাৎ রেগে বললেন, তুই একাকে বিয়ে করবি?

কেন আপা? তুই অবাক হচ্ছিস কেন?

তুই একটা শিয়াল ধরা মেয়েকে বিয়ে করবি আর আমি অবাক হব না?

আপা তুই কাকে শিয়াল ধরা বলছিস?

সালাম সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, তোর আপা ঠিকই বলেছে, অপহৃত, ধর্ষিতা মেয়েকে সবাই শিয়াল ধরাই বলে। একজন শিয়াল ধরা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না।

দুলাভাই একা অপহৃত হয়েছিল, ধর্ষিত হয়েছিল, কয়েকজন মানুষ নামের হিংস্র দানব তার চরিত্র কলঙ্কিত করেছে কিন্তু তাতে একার দোষ কী?

একার কোনো দোষ নেই, কিন্তু সে কলঙ্কিনী।

আপা তুই বিষয়টাকে এভাবে দেখছিস কেন? মনে কর পথিক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটা কুকুর পথিককে কামড় দিল, দোষ করল কে? পথিক নাকি ঐ কুকুরটা? এক্ষেত্রে যদি পথিক নির্দোষ হয় তবে একার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা দোষী না হয়ে একা দোষী হবে কেন? তাহলে কি বুঝব সমাজ অপরাধীর শাস্তি না দিয়ে ভুক্ত ভোগীকেই শাস্তি দিবে?

সালাম সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, ইকবাল আজ সমাজে আমাদের একটা মান-সম্মান আছে, তুই যদি একাকে বিয়ে করসি তবে আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।

দুলাভাই এমনভাবে সমাজের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে আপনারা একার মতো একটা নিষ্পাপ মেয়েকে শাস্তি দিতে পারেন, কিন্তু আমি পারব না, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনারা আমার বিয়েতে মত দেন বা না দেন আমি একাকেই বিয়ে করব এবং অতিসত্বর। দ্যাটস্‌ ফাইনাল, বলে ইকবাল কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুতবেগে নিজের রুমে চলে গেল।

সালাম সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন, তারপর হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে বললেন, পাগল বিয়ে পাগল।

আয়েশা অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে বললেন, থামো, তুমিও পাগল হয়ে গেলে?

আয়েশা তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? ইকবাল ইমমেচূর্ড ছেলে নয়, সে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভেবে চিন্তেই নিয়েছে। সে যাকে নিয়ে সারা জীবন কাটাবে তা তার পছন্দমতো হওয়া উচিত আর আমাদের উচিত তার সিদ্ধান্তকে রেসপেক্ট করা।

 

বাইশ

 

বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। কিন্তু কথায় কথায় বাধ সাধল ইকবাল। বিয়ের কার্ড কিনতে গিয়ে ইকবাল শ্রেয়ার মতবিরোধ হলো। শ্রেয়া যে কার্ড পছন্দ করল, ইকবাল সে কার্ড মোটেই পছন্দ করল না। ইকবাল শ্রেয়ার মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে কার্ডের উপর একটি মেঠো পথ দিয়ে বর কনে নিয়ে ছয় বেহারার পালকির ছবি সম্বলিত একটি কার্ড কিনল। কার্ড ছাপানোর অর্ডার দেওয়ার সময় আবারও নতুন শর্ত সংযোজন করল। ইকবাল যুক্তি দেখাল, যেহেতু আমাদের দেশে বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে উপহার সামগ্রী প্রদানের প্রচলন আছে, তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার সামগ্রী না আনার জন্য ধন্যবাদ” কথাটি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। তা না হলে সবাই উপহার নিয়ে আসবে।

আয়েশা রাগান্বিত স্বরে বললেন, কেউ যদি খুশি হয়ে কোনো উপহার দিয়েই থাকে তবে তোর অসুবিধাটা কী শুনি?

ইকবাল আয়েশার কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, না আপা, উপহার দেয়ার প্রচলন যখন চালু হয়েছিল তখন হয়ত সবাই খুশি হয়ে দিত কিন্তু এটা রেওয়াজে পরিণত হওয়ার পর এখন মানুষ সামাজিকতা রক্ষার জন্য উপহার দেয়।

তাতে অসুবিধা কি?

অসুবিধা তো অবশ্যই আছে। আমি বিয়ে অনুষ্ঠানে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি আমাদের শুভ দিনে আশীর্বাদ করার জন্য, দামি দামি উপহার পাওয়ার জন্য নয়।

আয়েশা আর কিছু বললেন না, মুখ বিকৃত করে ভিতরে চলে গেলেন।

ইকবালের সিদ্ধান্তই বহাল রইল। তারপর সালাম সাহেব বললেন, এখন খাবারের আয়োজন কর, কোথায় করবি?

আমি ‘বন্ধন’ কমিউনিটি সেন্টারে কন্ট্রাক্ট করেছি এবং বিয়ের কার্ডে লিখে দিয়েছি।

‘বন্ধন’ কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হলো। বাবুর্চি ডাকা হলো, কিছুক্ষণ সালাম সাহেব ও ইকবাল খাবারের মেনু নিয়ে আলোচনা হলো।

সালাম সাহেব ঈষৎ রাগান্বিত হয়ে বললেন, আমার মেনু তোর পছন্দ হলো না? পোলাও মুরগি রোষ্ট, মাংস, খাওয়া শেষে বুরহানি, এসব কি খারাপ খাবার?

দুলাভাই খাবার ভালো মন্দের কথা বলছি না। আমার পছন্দ কাটারী ভোগ চাউলের সাদা ভাত, ভুনা মাংস, দই এসবে তো কোনো অসুবিধা নেই। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সালাম সাহেব ইকবালের কথায় সায় দিলেন।

বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষ হলো, অতিথিগণ অনেকদিন পর বিয়ের অনুষ্ঠানে অতি সাধারণ খাবার তৃপ্তি সহকারে খেয়ে খুশি হলেন। দু’একজন সালাম সাহেবের কাছে তার আয়োজনের জন্য উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করলেন।

সালাম সাহেব নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়ে মনে মনে বললেন, এসবই ইকবালের আয়োজন, আসলে বুদ্ধি আছে ছেলেটার।

কনের মুখ দর্শনের সময় অনেকে প্রশংসা করলেন। কেউ কেউ অপহৃত মেয়ে জেনে তীর্যকভাবে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ছি : ছি : এত বড় ডাক্তার শেষ পর্যন্ত একজন অবহৃত মেয়েকে বিয়ে করল?

ইকবাল সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে এগিয়ে গেল। কিন্তু একজন নিরপরাধ মেয়েকে নিয়ে অতিথিদের অযাচিত কৌতূহল এবং অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনায় মনে মনে ক্ষুব্ধ হলো। মঞ্চের উপর বসে ঘোমটার আড়াল থেকে বিষয়টি একার চোখেও পড়ল। একার মন যেন কান্নায় ভেঙ্গে গেল। কিন্তু অনেক কষ্টে একা নিজেকে স্বাভাবিক রাখল। তার কষ্টের বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটল না।

বাসর ঘরে বসে একা ইকবালের জন্য অপেক্ষা করছিল। ইকবাল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর কাপড় পরিবর্তন করে একার কাছে গিয়ে বসে মাথার ঘোমটা সরিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, একা।

একা কোনো সাড়া না দিয়ে চুপ করে রইল। ইকবালের একার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, একা আজ থেকে আমাদের দু’জনের পথ এক হয়ে গেল। এখন থেকে সব কিছু আমাকে খুলে বলবে।

একা মৃদু কণ্ঠে বলল, আচ্ছা।

আচ্ছা বলতো, আমার মধ্যে কি তুমি এমন কোনো আচরণ দেখেছ যা তোমার পছন্দ নয়?

তোমার অসীম সাহস আর সরলতা, একা বলল।

কেন?

অতিরিক্ত সাহসের কারণে তুমি বিপদে পড়তে পার, তোমার শিশু সুলভ সরলতার জন্য তুমি প্রতারিত হতে পারো।

তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে, তুমি শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী মেয়ে, আমার সব দায়িত্ব আজ থেকে তোমার উপরই ছেড়ে দিলাম। তুমি আমাকে গাইড করবে।

তাহলে তুমি আমাকে একটা কথা বলো?

বলো?

আমাকে বিয়ে করে তুমি কি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছ?

মিথ্যা কথা বলব না, তোমাকে বিয়ে করে আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু আমিতো প্রকৃত ঘটনা জানি তাই কিছু মনে করিনি।

তোমার মনটা আকাশের মতো বিশাল, সাগরের মতো গভীর কিন্তু আকাশের কোণায় কোনোদিন মেঘ জমবে না তো?

ইকবাল একার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে জিজ্ঞেস করল, না কোনোদিন মেঘ জমবে না, আমাদের বন্ধন কখনও দুর্বল হবে না। এখন বলো, আমি পুরুষ, কিন্তু আমাকে কি তুমি ভয় পাচ্ছ?

একা মুচকি হেসে ইকবালের গায়ে এলিয়ে পড়ল।

সমাপ্ত

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*