বিয়ে বিয়ে খেলা

মেয়েটির বয়স আর কতোই বা হবে বড় জোর এগারো বা বারো। অথচ বিয়ের জন্য পাত্র সন্ধানের কাজ শুরু হয়েছে আরো বছর খানেক আগে। গায়ে গহনা, পায়ে আলতা, নাকে নোলক, মাথায় ঘোমটা লাগিয়ে নারীত্ব শেখানোর কাজ শুরু হয়েছে সেই সাত/আট বছর বয়স থেকেই। ইতোমধ্যেই পড়শীদের মধ্যে কানাঘুষাও কম শুরু হয়নি। তাই মেয়েটির বাপ-মা’র দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই, যেমন করেই হোক যত তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করা যায় ততই মঙ্গল।
মেয়েটির নাম বাতাসী। পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ডুডুমারী গ্রামে তার জম্ম। বাতাসী পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড়। বাতাসীর বাবার নাম ফরিদুল, মায়ের নাম আমিনা। পুত্র সন্তানের আশায় একে একে পাঁচটি মেয়ে এসেছে তাদের সংসারে, তাই বড় টান পোড়েনের সংসার, মানবেতর জীবন-যাপন, না মরে বেঁচে থাকা। ফরিদুল দিনমজুর, নিজের সুস্থ সবল দেহ আর হাত দু’খানাই তার জীবিকার একমাত্র সম্পদ| কোন কারণে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা কোনদিন কাজ না পেলে অনাহারে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই, তারপর পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দুঃশ্চিন্তায় ফরিদুল যেন দিশেহারা।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুজির পর হাড়িভাসায় এক পাত্রের সন্ধান মিললো। পাত্রের নাম বাবলু, বয়স ত্রিশ বছর, প্রথম স্ত্রীর কোন সন্তান-সন্ততি নেই বলে পাত্র মহাশয় দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে যে যৌতুকের কিছু টাকা পাওয়া যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহ প্রথা যে রাষ্ট্রীয় আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ এ নীতিবাক্য বেতার, টেলিভিশন থেকে এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব মানুষের কানে পৌঁছায়নি, তাই এ এলাকায় একাধিক বিয়ের ঘটনাও অনেক। তবে বাতাসীর ভাবী স্বামীরই বা দোষ কীসের?

বিবাহ স্থির হলো, যৌতুক বাবদ নগদ পাঁচ হাজার টাকা, একটা ভ্যান আর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। সেদিন সন্ধ্যায় বাবলু হাট থেকে ফিরে করিছন, কছিরন বলে ঘরে ঢুকে বলল, কাথা ঠিক করি আসিনু (কথা ঠিক করে এলাম)।
কছিরন সহসা বাবলুর কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কীসের কাথা (কীসের কথা)?
বাবলু সহাস্যে বলে উঠল, মোর বিহার কাথা (আমার বিয়ের কথা)।
কছিরনের মাথায় যেন বজ্রপাত পড়ল, প্রচণ্ড বিষ্ফোরণে হৃদয়ের ভিতরটা চুরমার হয়ে গেল। কছিরন অষ্ফুটস্বরে বলল, তোমহরা আরো বিহা করিবেন (তুমি আবার বিয়ে করবে)?
বাবলু মুখ বিকৃত করে বলল, বিহা করিবানাহু তে কি করিম? ভেলদিন তো দেখিনু, তোক বিহা করিবার ভেলদিন হইল আর কতদিন দেখিম? এলহাও তুই মোক একটা ছোয়া দিবা পারিলু নি, মোর কি বাপ হবা মনায় না? মোর কি বংশের বাতি ধরাবার কেহর দরকার নাই? (বিয়ে করবো না তো কী করবো? অনেকদিন তো দেখলাম, তোমাকে বিয়ে করার অনেকদিন হলো আর কতদিন দেখবো? এখনো তুমি আমাকে একটা সন্তান দিতে পারলে না, আমার কি বাবা হওয়ার সাধ নেই? আমার বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার দারকার নেই)?
তামান দোষ মোর কপালের নাহইলে বিহার ভেলদিন হইল, কত মাজারত গেনু, কত হুজুরের পানি পরহা খানু তাহ আল্লাহ মোক এক খানা ছোয়া দিল নাই। মুই আল্লাহরঠে কী দোষ করিনু যে আল্লাহ মোক একখান ছোয়া দিল নাই, (সব দোষ আমার ভাগ্যের, নাহলে বিয়ের অনেক দিন হলো, কত মাজারে তো গেলাম, কত মাওলানার পানি পড়া খেলাম তবু আল্লাহ আমাকে একটা সন্তান দিলো না। আমি আল্লাহর কাছে কী দোষ করেছি যে আলস্নাহ আমাকে একটা সনত্মান দিলো না।) বলে কছিরন কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

বাতাসী তার বিয়ের কথা জানতে পারলো বিয়ের আগের দিন। দুপুরে হাতে কাপড় ঝুলিয়ে বাতাসী যখন পুকুরে গোসল করার জন্য যাচ্ছিল তখন তার এক দুরসম্পর্কীয় ভাবী বাতাসীকে অদূরের একটা গাছের নিচে বসিয়ে বলল, বাতাসী শুনিনু তোর নাকি বিহা? (বাতাসী শুনলাম তোর নাকি বিয়ে)?
বাতাসী বিয়ের কথা কিছুই জানে না তাই ভাবীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
তোর বিহা তুই হে কহিবা পারিন না? এলাও শুনিননাই? আইসেক এইঠে বইসেক। তোর নগদ কুনিক কাথা কহু? (তোর বিয়ে তুই বলতে পারিস না? এখনো শুনিসনি? আয় এখানে বস। তোর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি)? বলে বাতাসীকে কাছে বসিয়ে মাথার উকুন মারার অজুহাত করে কথা বলতে শুরু করল, কাইল তোর বিহা, তুই স্বামীর বাড়ি যাবু, তোর বোধে ভাল লাগে না? (কাল তোর বিয়ে, তুই স্বামীর বাড়ি যাবি, তোর মনে হয় ভালো লাগে না?)
বিয়ে, স্বামী, সংসার সম্পর্কে এগারো/বারো বছর বয়সের বালিকা বাতাসীর ধারণা নেই তাই সে কোন উত্তর দিতে পারলো না, আর অবোধ বালিকাকে কাছে পেয়ে জ্ঞান বিতরণের সুযোগে ভাবীটিও স্বামী দেবতাকে সস্ত্বোষ্ট করার বিভিন্ন কৌশল অনবরত বিড় বিড় করে বলতে থাকলো, স্বামীর সেবা করে স্বর্গ চাবি হাতে নেওয়ার সহজ উপায় ও সংসারের সবার মন জয় করে নিজের সুখ বিসর্জণ দেওয়ার তৃপ্তিটিও বালিকার কানে ঢুকানো হলো। আর বাতাসী বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক হ্যাঁ কিংবা না, বলে সাড়া দিলো।
বর এলো, বরযাত্রী এলো, ২/১ টি পটকা ফুটিয়ে বিয়ের আনন্দধ্বনিও ঘোষিত হলো। দু’পক্ষের বেহাই-বেহাইনদের মধ্যে রং তামাশারও অন্ত রইল না, শুধু যার জন্য এতকিছুর আয়োজন তার মুখে কোন কথা ফুটলো না। তার চোখে-মুখে একটা গাঢ় কালিমা মাখা শঙ্কার ছাপ ফুটে উঠল, তা কারো চোখে ধরা পড়ল, কারো চোখে ধরাই পড়ল না। কিন্তু তাতে আর কী, বিয়ের দিনে মেয়েদের চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বিগ্নের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক| বর পক্ষের একজন দাড়িওয়ালা, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত মুরম্নব্বী কিছিমের লোক দেখা গেল। শোনা গেল তিনিই বিবাহ পড়াবেন। ভুঁড়ি ভোজ শেষে তিনি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সাদা কাগজ, কলম নিয়ে লেখালেখির কাজ শুরম্ন করলেন। লেখা শেষে কয়েকজন সাক্ষীসহ পাত্রের সম্মতি জানা গেল। কিন্তু পাত্রীর সম্মতি নিতে গিয়ে দেখা গেল বিপত্তি। সাক্ষীগণ মৌলভী সাহেবসহ পাত্রীর কাছে গিয়ে দেখেন বেচারী সংজ্ঞাহীন।
আবার কেউ কেউ রাত্রি গভীর হওয়ার অজুহাতে তখনই পাত্রীর সম্মতি জানার জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। অবশেষে মৌলভী সাহেব তার লেখা কয়েকটি লাইন পড়ে পাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন কবুল।
কিন্তু বালিকার বয়স এগারো/বারো বছর হলেও অন্য কারো কণ্ঠেই হোক, ভাবীর কণ্ঠেই হোক আর সংজ্ঞাহীন পাত্রীর কণ্ঠেই হোক তা জানার কারো অবকাশ রইল না। সকলে ঢেকুর ছেড়ে পান চিবাতে চিবাতে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলে সুংসবাদের আনন্দধ্বনি ছড়াতে লাগল। শুধু যার বিয়ে তার সম্মতির কথা জানা গেল না। জীবনের এমন আনন্দের দিনকে উপভোগ করা তো দূরের কথা, জীবনের একান্ত আপন পুরুষটিকেও একবার চোখে দেখার সুযোগ হলো না।
একটা অবোধ বালিকা নিজের ইচ্ছা, অধিকার, স্বামী-সংসার বুঝবার আগেই সমস্ত আশা আকাঙ্খা বিসর্জণ দিয়ে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে দায়মুক্ত করে ত্রিশোর্ধ একজন পুরুষের কাছে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সঁপে দিয়ে সতীনের সঙ্গে সংসার করতে চলল।
সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*