শহরে মাইকিং হচ্ছে, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, সৌরভ নামে চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়সের একটি ছেলে হারিয়ে গেছে, ছেলেটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, লম্বা চার ফুট দশ ইঞ্চি, গালের ডান পাশে একটি কালো, বড় তিলক আছে। হারিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটির পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট, লাল-খয়েরি রংয়ের হাফ গেঞ্জি, পায়ে কেডস্। কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি ছেলেটির সন্ধান দিতে পারলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে, বলে মাইকে তৌহিদের নাম, বাসার ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার ঘোষিত হলো।
সৌরভ গতকাল সেই-ই যে বিকেলে বেরিয়ে গেছে আর বাসায় ফিরেনি। সাধারণত প্রতিদিন বিকেলে সে কোচিং-এ যায়, কোচিং থেকে ফিরে ব্যাগটা রেখেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায় শহরে। শহরে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তার একটা শখের বিষয়। প্রতিদিন বিকেলে শহরে কোথায় কী দেখল তা নিয়ে রাতে বাবাকে হাজারটা প্রশ্ন, তৌহিদ কখনো বিরক্ত হয় না বরং খুশিই হয়। সে বলে, বাচ্চাদের কৌতূহলী হওয়া ভালো।
কিন্তু বাধ সাধে সোমা, ধমক দিয়ে বলে, এভাবে বাচ্চাদের মাথায় তোল। সারাদিন ছেলেটা বই নিয়ে একবারো বসেনি, তুমি কী একটু বই নিয়ে পড়াতে বসাবে তা না করে তুমিও ওর সঙ্গে গল্প করে করে ওকে মাথায় তুলছ।
আমি কী মাথায় তুলছি, ছেলেটা সারাদিন তো স্কুল আর কোচিং নিয়েই ব্যস্ত থাকে, বাসায় একটু বাবার সঙ্গে শেয়ার করবে তাতে অসুবিধা কী? তারপর বই নিয়ে বসবে?
তাই বলে সারাদিন ছেলে শহরে ঘুর বেড়াবে আর সন্ধ্যায় বাপ বেটায় গল্প চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বেশ তোমার ছেলে তুমি যেভাবে মানুষ করবে করো।
হ্যাঁ আমার ছেলেকে আমি মানুষ করবো, দিনরাত পড়ার টেবিলে বসে থাকলেই হয় না। মনোযোগ দিয়ে এক ঘণ্টা পড়লেই যে কাজ হয় জোর করে তিন ঘণ্টা পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখলেও সে কাজ হয় না, জানো তো ভরা কলসে জল ঢাললে আর ভরে না।
সৌরভের দু’চোখ ততক্ষণে পানিতে ছলছল করে উঠে, আব্বু, আম্মু খালি আমাকে সবসময় বলে পড়, পড়। আমি বাসায় একটা কিছু নিয়ে খেলা করলে, কম্পিউটারে বসলেই আমাকে খালি মারে।
ছিঃ আব্বু, আম্মুর কথা এভাবে কথা বলতে হয় না, আম্মুরা কখনো মারে না, শাসন করে। তুমি এখনো ছাত্র, এখন তোমার লেখাপড়া করার কথা, এখন যদি তুমি লেখাপড়া না করে সবসময় শুধু কম্পিউটার নিয়ে খেলা করো, মোবাইলের ব্যাটারি নিয়ে খুটখাট করো তবে তো আম্মু একটু-আধটু শাসন করবেই।
আমি কি শুধু কম্পিউটারে খেলা করি, আসো তুমি আমার সঙ্গে আসো, আমি আজ কম্পিউটারে কী সুন্দর একটা কার্টুন তৈরি করেছি, বলে সৌরভ তার বাবাকে কম্পিউটারে তার তৈরি করা একটা কার্টুন দেখায়।
তৌহিদ অবাক হয়ে যায়, এতটুকু ছেলে কার্টুন তৈরি করল কীভাবে? সে মনে মনে খুশি হলো, থ্যাঙ্ক ইউ মাই চাইল্ড।
এমনসময় রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো সোমার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ এখন পড়ার সময় আর তুমি ছেলেকে নিয়ে কম্পিউটারে বসো।
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বেশিরভাগ দিনই মায়ের মুখে ছেলের বিরুদ্ধে কিংবা ছেলের মুখে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মায়ের বিরুদ্ধে ছেলের অভিযোগের সমাপ্তি যত সহজেই সমাধান হয়ে যায় ছেলের বিরুদ্ধে মায়ের অভিযোগ তত সহজে সমাপ্তি টানা যায় না। অনেক সময় ছেলের অভিযোগের দায়ভার শেষ পর্যন্ত বাপের এবং কোন কোন সময় বংশ পরম্পরায় তা পূর্বপুরুষ পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে। মা-বেটার এসব অভিযোগ তাই তৌহিদ অনেক সময় হেসে উড়িয়ে দেয়। সে সোমাকে সহজ করার জন্য সে জোরে ডাক দেয়, এই সোমা দেখে যাও, দেখে যাও সৌরভ একটা সুন্দর কার্টুন তৈরি করেছে।
রান্নাঘর থেকে সোমার কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, তোমার কাজ নেই তুমি দেখো, আমার কাজ আছে।
তৌহিদ এসব কর্কশ কণ্ঠের জবাব দিতে গেলে বড় ধরনের কোন বাক-বিতণ্ডা লেগে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত নিজের মনকেই সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, তুমি আর দেখবে কী? সবার সবকিছু দেখার মতো চোখ লাগে, সেই চোখ যখন আল্লাহ তোমাকে দেয়নি তখন তুমি আর দেখবে কী? তুমি বরং তোমার কাজ নিয়েই থাক।
এমনসময় হঠাৎ করেই শহরের সমস্ত আলো নিভে গেল, শুরু হলো লোড শেডিং, কমপক্ষে এক ঘণ্টা।
সৌরভ দৌড়ে পাশের রুমে গেল। মুহূর্তেই পাশের রুম আলোকিত হলো কিন্তু সে আলো একটা রুমকে আলোকিত করলেও রান্নাঘরে গ্যাসের চুলোর পাশে রাঁধুনির হৃদয় আলোকিত করল না। রান্নাঘর থেকে আবার কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কতদিন থেকে বলছি বাসায় একটা আই.পি.এস-এর ব্যবস্থা করো, না তার কোনদিন টাকাই হচ্ছে না। কোনদিনও হবে না।
রাঁধুনির হৃদয় আলোকিত হোক আর না হোক তৌহিদ অন্তত: হৃদয়ের অন্ধকার, হৃদয়ের প্রতিহিংসার আগুনে এক মুঠো বালু ছিটিয়ে আগুন নেভানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল, আই.পি.এস লাগবে না, দেখো তোমার ছেলে বাসায় চার্জার তৈরি করেছে।
সোমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার পরনের কামিজ ঘামে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, ওড়নাটা কোমরে পেঁচিয়ে ডান হাত দিয়ে অদূরের একটা বাড়ির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ছেলের তৈরি চার্জার আমাকে দেখাচ্ছ, না? বাইরে একবার তাকিয়ে দেখ আজকাল ফকির মিসকিনরা পর্যন্ত আই.পি.এস কিনছে। তুমি কিনবে কেন? তুমি টাকা রোজগার করবে আর খাওয়াবে তোমার বাবা-মাকে, তোমার ভাইবোনকে।
তৌহিদের সঙ্গে সোমা এমন আচরণ প্রায়ই করে। তার কাছে ছেলের ক্রিয়েটিভটির কোন মূল্য নেই। সে শুধু সৌরভের ক্রিয়েটিভটিকেই অবমূল্যায়ন করেনা, দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তাকেও কম অবহেলা করেনি। সোমার মেজাজটা অত্যন্ত রুক্ষ, খুব ছোটখাটো কারণেই সে তৌহিদকে খুব খারাপ ভাষায় বকাবকি করে, সোমা যখন বকাবকি করে তখন সে একরকম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, কী বলতে কী বলে তা সে নিজেই জানে না। তৌহিদের ধারণা সোমা সৌরভের সঙ্গে এমন কোন আচরণ করেছে যা তার প্রতিবাদী কিশোর মন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত সৌরভ বাসায় না ফিরলেও তেমন দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না কিন্তু ধীরে ধীরে রাত যতই বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তাও ততই বাড়তে থাকে, তৌহিদ নিকট আত্মীয়দের কাছে ফোনে সৌরভকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে কোন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যায়নি, কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায়ও যায়নি।
তৌহিদ ড্রয়িং রুমে বসে একে একে সব সম্ভাব্য স্থানে সৌরভকে খুঁজছিল। তার মনের মধ্যে হাজার রকম চিন্তা, সৌরভ কোন অপহরণকারীর হাতে পড়েনি তো? না, না সৌরভ বুদ্ধিমান ছেলে সে অপহরণকারীর পাল্লায় পড়বে কেন? তবু তৌহিদ সবসময় তার নিজের মোবাইল ফোন এবং সোমার মোবাইল ফোন নিয়ে টেলিফোন সেট এর কাছে বসে আছে। মাঝে মাঝে তার কানে যেন আজগুবি মোবাইল কিংবা টেলিফোনের রিং হওয়ার শব্দ বেজে উঠে সে রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরে রাখে কেউ টেলিফোন করল নাকি?
বিকেল তিনটার দিকে একবার সত্যি সত্যি টেলিফোনের রিং বেজে উঠল। টেলিফোনের রিং তৌহিদের যতটা না কানে পৌঁছলও তার চেয়ে বেশি আঘাত করল তার বুকে। তার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল, কানের কাছে অদ্ভুত কণ্ঠের ধ্বনি হৃদয় পর্যন্ত উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করল। সোমা পাশের রুমে বিছানায় শুয়ে দুশ্চিন্তার সাগরে হারিয়ে গিয়েছিল কিন্তু টেলিফোনের রিং এর শব্দ যেন তাকে মুহূর্তেই বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, সে দৌড়ে পাশের রুম থেকে ছুটে এলো। সে পাশের রুম থেকে টেলিফোন সেট-এর কাছে আসার আগেই তৌহিদ রিসিভার কানের তুলে নিয়েছে, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
অপর পাশ থেকে কিশোর বয়সের কণ্ঠস্বর, আঙ্কল আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম।
আঙ্কল আমি সৌরভের ফ্রেন্ড।
তুমি সৌরভের কোন খবর জানো নাকি বাবা?
না আঙ্কল, কাল ক্লাসে যখন স্যার ওকে খুব বকাবকি করেছে, স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিতে চেয়েছে তখন ও আমাকে বলল, ক্লাস টিচার এমন আচরণ করলে ও নিজেই এই স্কুল থেকে চলে যাবে।
টিচার বকাবকি করেছে? কেন?
আঙ্কল ও কিছু বলেনি?
না তো বাবা, কী হয়েছে স্কুলে?
গতকাল যখন ফার্স্ট ক্লাসটা শেষ করে স্যার বের হচ্ছিলেন তখন কে যেন শিষ দিয়েছে আর স্যার মনে করেছে সৌরভ শিষ দিয়েছে, তাই স্যার ওকে বকাবকি করেছে।
তারপর-
তারপর ও হেড স্যারের কাছে গিয়েছিল কিন্তু হেড স্যার ওর কথাই শোনেনি। হেড স্যারের কাছ থেকে ফিরে এসে আমাকে বলল, আমি আর কোনদিন এই স্কুলেই আসবো না। আব্বুকে বলে অন্য স্কুলে ভর্তি হবো।
তারপর-
তারপর আর স্কুলে কথা হয়নি, আমার বাড়ি তো মিশন রোডে আমি বিকেলে একবার স্টেশন রোডে গিয়েছিলাম দেখলাম ও স্টেশনে ঘোরাঘুরি করছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই সৌরভ কোথায় যাচ্ছিস?
আমাকে কিছু বলল না।
তৌহিদ নিরাশ হয়ে টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিল।
তৌহিদের সঙ্গে সোমার বিয়ের পর অনেকদিন কোন সন্তান হয়নি। অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক চিকিৎসা করে তবেই তাদের ঘরে প্রথম সন্তান আসে, সৌরভ। তারপর আরেকটি সন্তানের জন্য আবারো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় কিন্তু আর কোন সন্তান হয়নি। সেজন্য সৌরভকে দুজনে খুব ভালোবাসে, সৌরভই যেন তাদের সবকিছু, তাকে ছাড়া তৌহিদ এবং সোমা কিছু কল্পনাও করতে পারে না। তবে সৌরভকে নিয়ে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া হওয়ার কারণে সোমা সৌরভকে খুব ছোটখাটো কারণে শাসন করে। তাছাড়া তাদের দুজনের দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য প্রায় লেগেই থাকে, তাই দুজনের মধ্যে প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা কথা হয় না।
অনেকদিন পর আজ সোমা তৌহিদের কাছে এলো, কয়েক ঘণ্টার দুশ্চিন্তায় তার চোখে-মুখে উদ্বিগ্নের ছাপ পড়েছে, এমনিতেই সোমা সবসময় সেজে গুঁজে থাকে, আজ আর সেরকম নেই তার চুলগুলো এলোমেলো, গণ্ডদেশে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আভা এখনো মুছে যায়নি, দরজায় দাঁড়িয়েই সে তৌহিদের টেলিফোনে কথোপকথন শুনেই সবকিছু বুঝতে পারার কথা, হয়ত পেরেছেও তবুও মায়ের মন এখন যেন তার কানকেও খুব সহজে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কোন খবর পেলে?
না।
সোমা কাল বিকেলে কী হয়েছিল বলোতো?
সোমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শুরু করল, সৌরভ স্কুল থেকে এসেই ভাত খেয়ে বসল মোবাইলের কী যেন নিয়ে। আমি বললাম, স্কুল থেকে ক্লান্ত হয়ে এলে একটু রেস্ট নাও। না ও রেস্ট নিল না, মোবাইলের ব্যাটারি আর বাজার থেকে একটা প্লাস্টিকের ফ্যান কিনে এনেছে সেটা নিয়ে খুটখাট করে কী যেন করছিল।
তারপর-
তারপর আমি আবারো বললাম কিন্তু সে আমার কথা শুনল না।
তখন তুমি একটু শাসন করেছ?
হুঁম্।
মানে মেরেছ?
সোমা কোন কথা বলল না।
তৌহিদ সোমাকে ধিক্কার দিল, ছিঃ সোমা, ছিঃ।
ছেলেটা স্কুল থেকে টিচারের বকাবকি শুনে বাসায় এলো, তোমাকে কোনকিছু না বললেও হয়ত আমাকে বলতো কিন্তু তুমিও তার ওপর রাগারাগি করাতে সে আর কাউকে কিছু বলেনি, বলে তৌহিদ ক্ষোভের সঙ্গে বলল, ভালোই করেছে, স্কুলে টিচারের শাসন, বাসায় বাবা-মা’র শাসন, সব জায়গায় শুধু শাসন আর শাসন দুনিয়ার কোথাও যেন স্নেহ ভালোবাসা নেই, বলতে বলতে তৌহিদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল সে আপনমনে বলল, তুমি আমাকে কেন বললে না বাবা? আমি তোমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিতাম।
দুই
রেল স্টেশনে একটা ট্রেন এসে থামল। ট্রেন থেকে যাত্রীরা নেমে দ্রুত যার যার গন্তব্যে যাচ্ছে। ট্রেন থেকে একটি ছেলে নামল। ছেলেটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, লম্বা, সুঠাম দেহ। নাকের নীচে একটু একটু গোঁফ গজাতে শুরু করেছে। পরনে জিন্সের প্যান্ট, লাল-খয়েরি রংয়ের হাফ গেঞ্জি, পায়ে কেডস্। ছেলেটি ট্রেন থেকে নেমেই পকেটে হাত দিয়ে কী যেন দেখল। তারপর কৌতূহলী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক কী যেন খুঁজল, না কিছু খুঁজে পেল না, সোজা হেঁটে চলে গেল প্লাট ফরমের শেষ প্রান্তে, একবার নাক উঁচু করে দেখল। বড় বড় অক্ষরে লেখা কমলাপুর রেলস্টেশন। তার চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল। তার খুব ভালো লাগছে, এই কমলাপুর রেলস্টেশনটা সে টি.ভি’তে অনেকবার দেখেছে কিন্তু বাস্তবে আজই প্রথম। তার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সৌরভ কৌতূহলী মনে কিছুক্ষণ প্লাটফরমে ঘোরাঘুরি করল।
ছেলেটির নাম সৌরভ। নবম শ্রেণীর ছাত্র। গতকাল দিনাজপুরে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসেছে, যাত্রা উদ্দেশ্যবিহীন। যেখানে দু’চোখ যায়, সবসময় লেখাপড়া, মা’র অতিরিক্ত শাসন, বাবা-মা’র দাম্পত্য কলহ, তার রোমাঞ্চকর এবং সৃষ্টিশীল কাজের বাধা থেকে একরকম শৃঙ্খল ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছে, আর সর্বশেষ ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল। একটা ক্লাস শেষে শিক্ষক ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কে যেন পিছন থেকে শীষ দেয় আর সে দোষ এসে পড়ে তার ঘাড়ে। অন্যায় দোষে শিক্ষক সবার সামনে তাকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে। তারপর যখন বাড়িতে ফিরে মাকে একথা বলার জন্য ভাবছিল তখন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুক আরো শুকিয়ে যায়। মাকে কোনকিছু না বলে সৌরভ তখন মোবাইলের একটা পুরানা ব্যাটারি, পুরানা মোটর আর প্লাস্টিকের ফ্যান নিয়ে ফ্যান তৈরির চেষ্টা করছিল কিন্তু তাতেও মায়ের বাধা। প্রথমে বকাবকি তারপর চুল ধরে মাথা ঝাঁকুনি। তারপর কাউকে কোনকিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে।
সৌরভ আর কোনদিন স্কুলে যাবে না, বাড়িতেও যাবে না, এমন শৃঙ্খলিত জীবনে আর কোনদিন ফিরে যাবে না। সে কম্পিউটার চালাতে পারে, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, মোবাইলের ব্যাটারি দিয়ে ফ্যান তৈরি করতে পারে, আরো অনেক কাজ জানে, সে শুনেছে ঢাকা শহরে এসে অনেকের ভাগ্য বদলে গেছে, অনেক মানুষ ফুটপাথ থেকে রাজা বাদশা পর্যন্ত হয়েছে। কমলাপুর রেলস্টেশন দেখে সৌরভ আপনমনে একবার হাসল, তারপর এদিক-সেদিক তাকাল, তার চোখে পড়ল একটা উঁচু বিল্ডিং, এত বড় বড় বিল্ডিং সে আগে কখনো দেখেনি। তার খুব ইচ্ছা একদিন এত বড় বিল্ডিংয়ের ওপর উঠবে, সে একবার আকাশ ছুঁয়ে দেখবে।
ততক্ষণে সৌরভের পেট খিদে চিন চিন করতে শুরু করেছে। সে গেট থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে ঢুকে ভাত খেল। প্যান্টের সাইডের পকেটে হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা মোবাইলের পুরানা ব্যাটারি, একটা ছোট্ট মোটর, একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ফ্যান বের করে দেখল তারপর পিছনের পকেটে হাত দিয়ে টাকা দেওয়ার সময় মানিব্যাগের টাকা গুণে দেখল, মানিব্যাগে তিন’শ টাকা আছে। সে হোটেল থেকে বের হলো, এখন কোথায় যাবে? হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়াল, না আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিংটা আর চোখে পড়ছে না কিন্তু সে ঐ উঁচু বিল্ডিংটায় একবার উঠবেই। যেখানে দাঁড়িয়ে বিল্ডিংটা তার চোখে পড়েছিল আবার সেখানে গিয়ে দাঁড়াল বিল্ডিংটা চোখে পড়ল কিন্তু সোজা ঐ উঁচু বিল্ডিংটায় যাওয়া যায় এমন রাস্তা তো দেখতে পাচ্ছে না, স্টেশন থেকে বেরিয়ে দু’টো রাস্তা দু’দিকে চলে গেছে। সৌরভ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তার মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন, কাউকে জিজ্ঞেস করবে নাকি?
না সে কাউকে জিজ্ঞেস করবে না, সৌরভ শুনেছে ঢাকা শহরে ছেলেধরা আছে, তারা সুযোগ পেলেই ধরে নিয়ে যায়। একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাতেই তার চোখে পড়ল একটা লোক অনেকক্ষণ থেকে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে, লোকটা বেশ লম্বা চওড়া, জোট পাকানো লম্বা চুল, দাড়ি, বড় বড় গোঁফ, পান খেয়ে মুখটা লাল করেছে, একবার হাই তুলতেই লোকটার দাঁতগুলো তার চোখে পড়ল। পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলল, সৌরভের মনে হলো যেন লোকটা কোনকিছু পাওয়ার ইঙ্গিত দিল, হ্যাঁ সত্যিই তো, লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার বুক কেঁপে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল, তার চোখে পড়ল একটা বড় বাস, গায়ে গোলাকার বৃত্তের মধ্যে লিখা আছে-৬ নাম্বার| তার সমবয়সী একটা ছেলে বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে জোরে জোরে চিৎকার করছে, মতিঝিল, গুলিস্তান, গুলশান, বনানী…..।
সৌরভ কাছে যেতেই ছেলেটি বলল, কই যাবা, মতিঝিল, গুলিস্তান, গুলশান, বনানী।
সৌরভ মনে কিছুটা সাহস পেল, হ্যাঁ এই ছেলেটাকেই জিজ্ঞেস করবে, এই যে ভাইয়া এই বাসে চড়ে কি ঐ যে উঁচু বিল্ডিংটা দেখা যায় ওখানে যাওয়া যাবে?
যাও বাসে ওঠো, মতিঝিল গিয়ে নেমে পড়বা, মতিঝিল থেকে কাছেই, ওঠো, ওঠো, ছেলেটা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সৌরভকে একরকম জোর করে বাসে উঠিয়ে দিল।
সৌরভ বাসে উঠে সিটের রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল আর বার বার করে বাইরে তাকাল, হ্যাঁ ঐ লোকটাও তো এদিকেই আসছে, লোকটা বাসে উঠবে না তো?
তার আশংকাই সত্যি হলো, লোকটি বাসে উঠল, সৌরভ ভিড় ঠেলে একটু একটু করে পিছনের দিকে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মিনিট পরেই বাসের হেলপার জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, মতিঝিল, মতিঝিল।
সৌরভ তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। তার চোখে পড়ল, শাপলা ফুল, যে ফুলটা সে টি.ভি’তে অনেকবার দেখেছে। তার খুব ইচ্ছা হচ্ছে শাপলা ফুলটার কাছে দাঁড়িয়ে দেখবে কিন্তু একটু দাঁড়াতেই তার চোখে পড়ল সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার বুক আবার কেঁপে উঠল। সে একবার উপরের দিকে তাকাল। অদূরেই সেই বিল্ডিংটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সৌরভ দ্রুত বেগে এগিয়ে গেল, হ্যাঁ ঐতো আরেকটু গেলেই বিল্ডিংটা। সে একবার পিছন ফিরে তাকাল, লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার কানের কাছে মোবাইলটা লাগান আছে, কথার মাঝে মাঝে লোকটা মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে।
সৌরভ বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি একটা লিফটে ঢুকে পড়ল, তার জীবনে এই প্রথম লিফটে ওঠা, কতদিন টি.ভি’তে এই উঁচু বিল্ডিংটা দেখে ওপরে ওঠার স্বপ্ন দেখেছে। লিফটে আরো অনেক লোক ছিল, সেও তাদের সঙ্গে মিশে গেল। প্রতি ফ্লোরে কেউ উঠল আবার কেউ নেমে গেল। সে বুঝতে পারার আগেই লিফটটা আবার নিচে নামতে শুরু করেছে। লিফট নিচে নামার আগে সেটা আবার ভরে গেল। একইভাবে লিফট নিচ থেকে উপরে উঠতে শুরু করল। এবার সে লিফটের সুইচের দিকে লক্ষ্য রাখল। সবার উপর তলায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে সেও নেমে পড়ল, এটাই বিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চ্য তলা কিন্তু বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠার কোন উপায় খুঁজে পেল না।
সে উপর থেকে একবার নিচের দিকে তাকাল, নিচ থেকে যে বিল্ডিংগুলোকে উঁচু মনে হতো সেগুলোও উপর থেকে অনেক ছোট ছোট দেখাচ্ছে। সে বিল্ডিংয়ের প্রতিটি ফ্লোরের লবিতে ঘুরে ঘুরে ডিসপ্লেগুলো পড়ে দেখল, দেশের বড় বড় সব কোম্পানিগুলোর অফিস। সে অনেকটা খুশিই হলো। কয়েকটা ফ্লোর ঘুরে দেখার পর সে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, এই বিল্ডিংয়ে ওঠার প্রায় তিন ঘণ্টা হলো, এতক্ষণে কি সেই ছেলেধরা টাইপের লোকটা আছে নাকি চলে গেছে?
সৌরভ প্রতিটি ফ্লোর ঘুরে দেখতে দেখতে অনেক নিচে নেমেছে, সে একবার বিল্ডিংয়ের নিচের দিকে তাকাল, না ঐ লোকটা নেই কিন্তু আশে-পাশে কোথাও থাকার আশঙ্কাটা তার মন থেকে দূর হলো না। সে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে আবার সেই শাপলাটার দিকে গেল। কিন্তু না এখন আর শাপলা দেখতে ভালো লাগছে না। পেটে খিদে থাকায় সবকিছু যেন বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে। সে রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গেল, একটা হোটেলে ঢুকে ভাত খেল। তারপর এলো মতিঝিল শাপলা চত্বরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল, রাস্তা দিয়ে অসংখ্য বাস বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে এবং আসছে। সে কোনকিছু না বুঝেই আবার একটা বাসে উঠে পড়ল। কিছুদূর যাওয়ার পর হেল্পার যখন গুলিস্তান, গুলিস্তান বলে চিৎকার করে উঠল তখন তার মনে হলো সে হয়ত আগের বাসেই উঠেছে। সে কাউকে কিছু না বলে বাসে দাঁড়িয়ে রইল। আরো কিছুক্ষণ পর হেল্পার বাস যখন ফার্মগেট, ফার্মগেট বলে চিৎকার করে উঠল তখন সৌরভ বাস থেকে নেমে পড়ল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রাস্তায় জ্বলে উঠল রং বেরংয়ের বাতি। শপিং কমপ্লেক্সগুলোয় হাজার রকম চোখ ঝলসানো বাতি। সৌরভ ফার্মগেট ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাল একটা বড় টি.ভি’র পর্দায় বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হচ্ছে, সে আপনমনে হেসে উঠল, নিজের অজান্তেই একবার হাত তালি দিল, তারপর কিছুটা লজ্জা পেল, কেউ দেখে ফেলেনি তো?
সে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাল, না কেউ দেখেনি।
ততক্ষণে রাত অনেক হয়েছে, সারাদিনের রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সে রাতে থাকার কথা একেবারে ভুলেই গেছে কিন্তু এখন আর কিছুই বুঝতে পারছে না, এই রাতে সে কোথায় যাবে?
সৌরভ একবার পকেটে হাত দিল, পকেটে প্লাস্টিকের ফ্যান, মোবাইলের পুরানো ব্যাটারি আর ছোট্ট মোটরটা আছে কিন্তু মানিব্যাগটা নেই। তার বুক কেঁপে উঠল, এই মানিব্যাগে তার আরো দু’শো টাকা ছিল। এখন রাতে খাবে কী? প্যান্টের ডান পকেটে হাত দিয়ে দেখল, দশ টাকা আছে। কিন্তু দশ টাকায় তো ভাত খাওয়া হবে না, তারপর, তারপর কী হবে? সৌরভের দু’চোখ ছলছল করে উঠল। চোখে পানি এলে তার হাত দু’টো এমনিতেই চোখে চলে যায় সে চোখ কচলাতে থাকে।
ধীরে ধীর ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের ওপর পথচারীদের আনাগোনা কমতে থাকে, একসময় ওভার ব্রিজের ওপর থেকে ভিক্ষুক, দোকানদাররাও যেতে থাকে সৌরভ তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তারপর ব্রিজের ওপর থেকে নেমে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। ব্রিজ থেকে অল্প কয়েক মিনিটের পথ। দক্ষিণ দিকে যেতেই দেখতে পায় অনেকগুলো লোক খোলা আকাশের নিচে ফুটপাথের ওপর কেউ বসে গল্প করছে কেউ ফুটপাথে চাদর বিছিয়ে কিংবা ডালির ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
সৌরভ বুঝতে পারল এরা ছিন্নমূল মানুষ, যাদের ঘরবাড়ি নেই। এরকম ছিন্নমূল মানুষকে নিয়ে সে টিভি’তে অনেক অনুষ্ঠান দেখেছে আজ সত্যি, সত্যি চোখের সামনে দেখছে। সৌরভ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
মধ্যবয়সী একজন মহিলা ফুটপাথে শুয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কে দাঁড়িয়ে আছে? ময়না মিয়া নাকি?
সৌরভ কোন কথা বলল না।
মহিলা আবার বলল, ময়না মিয়া না?
মহিলা ফুটপাথে আধশোয়া হয়ে বসে সৌরভের আপাদমস্তক দেখে বলল, কে বাবা? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
সৌরভ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আমি ময়না মিয়া না, আমার নাম সৌরভ।
এখানে কেন? দেখে তো ধনী লোকের ছেলে বলে মনে হচ্ছে।
সৌরভ কিছু বলল না।
এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাড়ি যাবা না?
সৌরভ কী বলবে বুঝতে পারছে না, তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, আপনারা বাড়ি যাবেন না?
মহিলা কিছুটা অবাক হলো, সে এবার নিশ্চিত হলো সৌরভ আসলে কোন ধনী লোকের ছেলে, তাদের যে বাড়ি ঘর নেই সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। সে বলল, ওমা আমাদের আবার বাড়ি ঘর কোথায়? আমরা তো এখানেই থাকি। তুমি মনে হয় নতুন?
সৌরভ কিছু বলল না।
সে জিজ্ঞেস করল, ঘুমাবে?
সৌরভ তবুও কিছু বলল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
মহিলা মেঝেতে বিছানো তার ছেঁড়া চাদর একটু ঝেড়ে দিয়ে বলল, এখানে ঘুমাও।
সৌরভ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তারপর চাদরের ওপর শুয়ে পড়ল।
তিন
জয়া সেদিন স্কুল গিয়ে আর ফিরে আসেনি। প্রথম প্রথম খবরটা পারিবারিকভাবে গোপন রাখা হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ক্ষেত্রে তার জীবনের চেয়ে সতীত্ব হারানোর বিষয়টিই বড় করে দেখা হয়, হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে বিয়ে দেওয়া বেশিরভাগ সময় খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর সেজন্য কোন ছেলে হারিয়ে গেলে যেমন ঢাকঢোল পিটিয়ে খোঁজা শুরু হয় তেমনি কোন মেয়ে হারিয়ে গেলে খুব সহজে বিষয়টি প্রকাশ করা হয় না, এমনকি খুব সহজে আইন-কানুনের আশ্রয়ও নেয়া না।
জয়ার স্কুল থেকে আসার সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তার বাবা তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে, খুব সাবধানে, গোপনীয়ভাবে। জয়ার মা ফরিদা বেগম প্রথমে ফোন করল তার মা’র কাছে।
ফরিদার মা তার কণ্ঠ শুনেই যেন আঁতকে উঠল, কী হয়েছে মা? তোর গলার ¯^i এমন কেন?
মা জয়া কি তোমাদের বাড়িতে গেছে?
না তো।
ফরিদা রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, মা জয়া এখনো স্কুল থেকে আসেনি।
ফরিদার কথা শুনে তার মা একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, তুই কী বলছিস মা? এত বড় মেয়ে স্কুল গিয়ে আর ফিরে আসেনি, এখন তো রাত প্রায় বারোটা বাজে।
না মা, প্রতিদিনের মতো সকালে স্কুল গেছে এখনো আসেনি।
আর কাউকে বলেছিস?
না মা।
ওর বান্ধবীদের কারো কাছে খোঁজখবর নিয়েছিস?
না।
বলিস না, এখনই কাউকে বলিস না, আগে দেখা যাক।
তাহলে কী করবো মা?
আগে নিজেদের মধ্যে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে দেখ মা, ছেলে হলে কোন কথাই ছিল না। জামাই কী করছে?
ওর মনটা খুব খারাপ, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
কোন বান্ধবীর বাড়িতে যেতে পারে? আগে কাল স্কুল টাইম পর্যন্ত দেখ। আর আমি তোর বাবাকে বলছি, দেখি ও কী করতে বলে।
জি মা, ঠিক আছে।
ফরিদা মোবাইল রেখে দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমিনুলকে বলল, জয়া তো ওর নানার বাড়ি যায়নি।
হুম্ তা তো শুনলাম।
এখন কী হবে? এরকম চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়সের একটা মেয়ে, কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাওয়াও তো মান-সম্মানের ব্যাপার, ভবিষ্যতে বিয়ে-শাদির ব্যাপার আছে।
আমিনুল অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল এখন এত রাতে আর কোথায় খুঁজবো, আগে কাল সকাল হোক তারপর আবার খোঁজাখুঁজি করতে হবে।
তুমি কিন্তু আমাকে না বলে হঠাৎ করে কাউকে কিছু বলবে না, একটা কথা মনে রাখবে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।
আচ্ছা।
সারারাত কারো চোখে ঘুম নেই। এই বয়সের একটা মেয়েকে তারা কোথায় খুঁজবে? কারো কাছে খুঁজতে গেলেই সবাই মনে করবে মেয়ে কারো হাত ধরে পালিয়েছে, আত্মীয়-স্বজনের মুখে সান্ত্বনার কথা শোনালেও পিছনে নানান মুখরোচক কথা বলবে। থানা পুলিশ পর্যন্ত গোড়ালে রাষ্ট্রময় হয়ে যাবে, পত্র-পত্রিকায় পর্যন্ত হৈ চৈ হবে। একদিকে মেয়ে হারানোর কষ্ট আরেকদিকে মান-সম্মানের কথা ভাবতে ভাবতে দুজনের কোন রকমে রাত কেটে গেল।
আমিনুলের ছোট ভাই মমিনুল, সে হাইস্কুলের শিক্ষক। জয়া তারই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমিনুল প্রথমে তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল। মমিনুল সবকিছু শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
জয়া কাল স্কুল থেকে ফিরেনি? আমাকে কাল রাতেই বলোনি কেন? আমি ওর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজখবর নিতাম।
ফরিদা কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বলল, মাথা গরম করবি না, ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাবি, না? তাতে মান-সম্মান কিছু থাকবে?
মেয়ে হারিয়ে গেছে, সে কোথায় গেছে? নিজে চলে গেছে নাকি কেউ তাকে অপহরণ করেছে? সবার আগে সবকিছু জেনে তাকে উদ্ধার করার চেয়ে তার হারিয়ে যাওয়ার খবরটা বেরিয়ে পড়লে মান-সম্মানের ক্ষতি হবে সেটাই বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সে ফরিদার ওপর কিছুটা রাগ করল। অন্যসময় হলে সে অনেক কথা বলতো কিন্তু ফরিদার মুখের দিকে চেয়ে সে কিছু বলল না আবার জয়াকে উদ্ধার করার জন্য করণীয় এ প্রশ্নটাও তাকে বার বার করে বিদ্ধ করল, হয়ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু-
শোন তুই ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাউকে কিছু বলবি না, একটু চালাকি করে জেনে নিবি ও ওর কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে নাকি?
সে মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো সে বিরক্তিতে তার চোখে-মুখে একটা সেরকম ভাবও ফুটে উঠল। সে প্রশ্ন করল, কিন্তু তাতে তো দেরি হবে? স্কুল খুলবে তো আগামীকাল সকালে, ততক্ষণ-
ফরিদাও মমিনুলের আচরণে কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বলল, তুই সবসময় বেশি বুঝিস, আমি যা বলছি তাই কর, সারাদেশ হৈ চৈ করে মেয়ে খুঁজতে হবে না।
মমিনুল আর কথা বাড়ালো না মনের মধ্যে হাজার চিন্তা রেখে সে শুধু নীরবে মাথা নত বলল, আচ্ছা।
মমিনুলের মাথায়ও অনেক চিন্তা ভিড় করছে। সে নবম শ্রেণীর ক্লাস টিচার, জয়াকে সে একজন ভালো ছাত্রী হিসেবে জানে, ক্লাসে সে বরাবরই দশম স্থানের মধ্যেই থাকে কিন্তু কিছুদিন থেকে সে তাকে পড়াশোনায় বেশ অমনোযোগী দেখছে। প্রতিদিন সময়মতো স্কুলে আসে, প্রথম ক্লাস ঠিক মতোই করে কিন্তু তারপর প্রায় সময়ই মমিনুল তাকে দেখেছে কমনরুমে বসে অথবা কোন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলতে।
মমিনুল ক্লাসে ঢুকে একবার গোটা ক্লাসরুমে চোখ বুলালো, না জয়া আসেনি।
সে রোল কল করার সময় জয়ার রোল কল করে একরকম ইচ্ছা করেই থামল, তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, জয়া আসেনি?
কেউ কোন কথা বলল না। জয়ার না আসার বিষয়টাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দিল না। এমনিতেই তো অনেকেই মাঝে মাঝে ক্লাসে আসে না। শ্রেণী শিক্ষক অনেকের নাম একাধিক বার জানতে চায় আবার কাউকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু তাতে কেউ কিছু মনে করে না। মমিনুল কয়েক মুহূর্ত জয়ার নামের জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করেই এভাবে স্কুলে অনুপস্থিত থাকো কেন? তোমরা কেউ জানে নাকি জয়া স্কুলে আসেনি কেন?
কারো কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। সে রীতিমতো ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে এলো।
সারাদিন কেটে গেল জয়ার কোন খবর পাওয়া গেল না।
ফরিদার বাবা-মা দুজনে তাদের বাড়িতে এলো। ফরিদার বাবা আমিনুলকে বিষয়টি থানায় জানাতে বলল কিন্তু বাধ সাধলো ফরিদার মা তার একই কথা এখনই থানায় জানানোর প্রয়োজন নেই। তার কথার সঙ্গে সুর মিলালো ফরিদা। কথায় কথায় ফরিদার মা বলল, তাদের গ্রামে এক গণক আছে ধরণী কান্ত বাবু, ঝাড় ফুঁকের কাজ জানে, অতীত-ভবিষ্যৎ সবকিছু বলে দিতে পারে, ওর কাছে একবার গেলে হয়ত কোন একটা খবর বলতে পারবে।
আমিনুল এসব বিশ্বাস করে না কিন্তু মায়ের মন যেন কোনকিছুই মানতে চায় না। ফরিদাকে যে যা বলছে সে তা-ই করছে। মা’র মুখে এমন কথা শুনে সে উতলা হয়ে উঠল, যাব মা, আমার জয়ার জন্য আমি যাব, সবকিছু করবো, আমার কলিজার টুকরা মেয়েকে যেমন করেই হোক আমি উদ্ধার করবো।
তাহলে কাল সকালেই যেতে হবে মা, শনিবার আর মঙ্গলবার দিন খালি মুখে তার কাছে গেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ঠিক আছে মা।
ফরিদার মুখে ধরণী কান্ত বাবুর কথা শুনে আমিনুল বলল, এটা কি করে সম্ভব?
মা বলছে আমি একবার যাই, ধরণী কান্ত বাবুর নাম আমি আগেও শুনেছি, উনি হারানো জিনিস উদ্ধার করে দিতে পারে।
কীভাবে?
উনার ওপর নাকি কালী ভর করে আর কালী ভর করলে উনি আর মানুষ থাকেন না, কালী হয়ে যান, তখন বিড়বিড় করে সব বলতে থাকেন।
আমিনুল অন্য সময় হলে ফরিদাকে ধমক দিত কিন্তু আজ ধমক দিল না, একবার রাগান্বিত চোখে ফরিদার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি উনার কাছে যেতে চাচ্ছ?
হুঁম্, তুমিও চলো।
না আমি যাব না, তুমি যাও।
ফরিদার বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ধরণী কান্ত বাবুর বাড়ি, বাড়ির বাইরে উঠোনে কয়েকটা বেঞ্চ বিছানো আছে, কেউ কেউ বেঞ্চে বসেছে আবার কেউ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। একটা চটের ওপর একজন লোক বসে আছে, তার গায়ের রং কালো, চুলে জট বাঁধা, লম্বা দাড়ি, লম্বা গোঁফ দিয়ে মুখ ঢেকে গেছে। সম্ভবত সে-ই ধরণী কান্ত বাবু।
ফরিদা একটা বেঞ্চে বসল।
ফরিদা আসার আগেই একজন মহিলার বিষয় তিনি কথা বলছেন চোখ বন্ধ করে, সে তো তোমাকে একেবারেই পছন্দ করে না মা।
কেন বাবা?
ধরণী কান্ত বাবু আবার বলতে শুরু করল, তোমার স্বামী পরলোভী, তার এখন আরেকজন মহিলার সঙ্গে মন দেয়ানেয়া চলছে।
মহিলার বুক শুকিয়ে গেল, যদিও স্বামীর এসব বিষয় দিনের পর দিন সে অনেকটা নিজেই অনুভব করেছে। তাই ধরণী কান্ত বাবুর যেন তার মনের সমস্ত ধারণার সঙ্গে সমস্ত অনুভূতির সঙ্গে মিলে গেল। তার একটা কথা বার বারই মনে হলো, ধরণী কান্ত বাবু এতকিছু ঠিক ঠিক বলতে পারল কীভাবে?
নারীই হোক আর পুরুষই হোক কেউ তার ভালোবাসার মানুষের অধিকার ভাগাভাগি করতে পারে না, যত রক্ষণশীল হোক আর যত উদারপন্থীই হোক অন্তত এই একটা বিষয়ে পৃথিবীর সব মানুষেরই উদারতা যেন একটা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে থেমে যায়। মহিলাটির বেশ ভূষায় অশিক্ষা ও দারিদ্রের ছাপ আছে, তার মনের অবস্থাটাও এমন যেন চরিত্রবানই হোক আর চরিত্রহীনই হোক স্বামী নামের এই মানুষটি ছাড়া পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। তাই সর্বস্ব হারানোর আতঙ্কে তার বুক হাহাকার করে উঠল, তার গণ্ডদেশ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল, কণ্ঠস্বর বুজে এলো, তার কম্পিত দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো, তাহলে আমি এখন কী করবো বাবা?
আগে তাকে সেই মহিলার কাছ থেকে বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে মা, তারপর তোমার সঙ্গে মিল দিতে হবে।
আমি কীভাবে করবো বাবা, যা করার আপনি করে দেন।
ধরণী কান্ত বাবু এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে সবকিছু বলে যাচ্ছিল, এবার সে চোখ খুলল, তুমি সঙ্গে করে পানির বোতল এনেছ?
জি।
কোনটা?
ধরণী কান্ত বাবুর বাঁয়ে একটা পঞ্জিকা, কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ আর একটা কলম। ডানপাশে ছোট বড় কয়েকটা বিভিন্ন মাপের পানির বোতল। মহিলাটি একটা পানির বোতলের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ঐটা।
ধরণী কান্ত বাবু পানির বোতলটা হাতে নিয়ে কয়েকটা ফুঁ দিয়ে বলল, এটা তোমার স্বামীকে প্রতিদিন খালি পেটে একবার করে খাওয়াবে, আর কিছু কাজ করতে হবে।
করে দিন বাবা।
ধরণী কান্ত বাবু অনেকগুলো অপরিচিত গাছপালার নাম বলল যার একটাও সেই মহিলা বুঝতে পারল না। সে বলল, আমি এসব কোথায় পাব বাবা, আপনি সব ব্যবস্থা করে দিন।
ধরণী কান্ত বাবু কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল তারপর বলল, আপনি টাকা নিয়ে এসেছেন?
ক’টাকা বাবা?
দু’শো এক টাকা।
মহিলা শাড়ির আঁচলে গুঁজে আনা টাকা থেকে দু’শো এক টাকার ধরণী কান্ত বাবুর হাতে দিল।
ধরণী কান্ত বাবু একবার বেঞ্চে বসা সবার দিকে তাকাল। একে একে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলল, তারপর এলো ফরিদার সিরিয়াল। ধরণী কান্ত বাবু ফরিদাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী মা?
ফরিদা।
স্বামীর নাম?
আমিনুল।
ঠিকানা?
কাঁঠাল বাড়ি।
ধরণী কান্ত বাবু চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে অস্পষ্ট ভাষায় যে মন্ত্র পাঠ করল তার প্রথম অংশের কোন কিছু বোঝা গেল না কিন্তু শেষের অংশটুকু বোঝা গেল, যাও তো কালিমা, আমার এক মা এসেছে ফরিদা, স্বামী আমিনুল, কাঁঠাল বাড়ি, কুড়িগ্রাম তার খতিয়ানটা একটু দেখে এসো তো।
ধরণী কান্ত বাবু কয়েক মুহূর্ত মাথা নত করে বসেই রইল, তারপর বলতে শুরু করল, অবস্থাদৃষ্টে যা দেখা যাচ্ছে তোমার বাড়ি থেকে একটা জিনিস চুরি হয়ে গেছে মা যে তোমার কলিজার টুকরা, তুমি মনে করছ সে হারিয়ে গেছে কিন্তু না সে হারিয়ে যায়নি সে চুরি হয়েছে। তোমার এই বস্তুটা তো মানুষ তাই তাকে কেউ জোর করে নিয়ে যায়নি প্রথমে সে নিজেই তার কাছে চলে গেছে এখন সে আর তার নিজের ইচ্ছায় নেই, সে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, একটা বড় প্রতারকের খপ্পরে আটকা পড়ে গেছে। সে খুব সরল মনের, তার সরলতার সুযোগে আরেকজন তাকে নিয়ে গেছে। তো মা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
ফরিদা একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে সায় দিল।
তার সঙ্গে কি কারো প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল?
ফরিদা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, জানি না বাবা।
জানা উচিত ছিল মা, আমার খতিয়ানে আমি পাচ্ছি তার সঙ্গে একজনের মন দেয়ানেয়া চলছিল অনেকদিন থেকে, সেই সূত্রে তার হাত ধরে চলে গেছে এটাই ছিল তার ভুল আর যার হাত ধরে সে চলে গেছে সে তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করেছে আর এখন সে বুঝতে পেরে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
এখন কেমন আছে বাবা?
ধরণী কান্ত বাবু ফরিদার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম কী যেন মা?
জয়া।
ধরণী কান্ত বাবু চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করল, উত্তরে দেখো, দক্ষিণে দেখো, জলে দেখো, স্থলে দেখো, দেখে আমাকে জানাও তো কালিমা।
ধরণী কান্ত বাবু গম্ভীর কালো মুখ উঁচু করলেন, ও তো অনেক দূর চলে গেছে মা।
কোথায় বাবা?
নির্দিষ্ট করে শহরের নাম তো আমি বলতে পারি না, তবে এটুকু বলতে পারি সে এখন অনেক দূর চলে গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে।
ফরিদা রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আপনি আমার মেয়েকে এনে দিন বাবা, যত টাকা লাগে আমি দিব।
আমি তো টাকা নিয়ে কাজ করি না মা, আমি মানুষের সেবা করি, যদি তোমার মেয়েকে আমি এনে দিতে পারতাম তবে এনে দিতাম। সে যদি মুক্ত থাকতো তবে আমি তাকে এনে দিতে পারতাম। আমি মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারি কিন্তু বন্দি মানুষকে মুক্ত করতে পারি না মা।
তাহলে আমি কী করবো বাবা?
তুমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো মা, পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নাও, তোমার মেয়ে একদিন তোমার কাছে ফিরে আসবেই।
ফরিদা রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তাই যেন হয় বাবা।
ফরিদা তার ব্যাগ থেকে একটা এক’শ টাকার নোট বের করে দিল। ধরণী কান্ত বাবু অবশিষ্ট টাকা ফেরত দিচ্ছিল কিন্তু ফরিদা বলল, আপনি রেখে দিন বাবা।
ধরণী কান্ত বাবু প্রতিবাদ করল, না মা, কোন তাবিজ করে না দিলে আমি দশ টাকার বেশি নিই না।
ফরিদা অনুরোধ করল, আমি খুশি করে দিচ্ছি বাবা।
না মা।
চার
জয়া এখন একটা গুদাম প্রকৃতির ঘরের মধ্যে বন্দি। তার ঘরের বাইরের দিকে কোন দরজা, জানালা এমনকি একটা ভেন্টিলেটর পর্যন্ত নেই। তার ঘর থেকে পাশের ঘরে যাওয়ার একটা দরজা আছে মাত্র। ঘরের সঙ্গে একটা বাথরুম আছে কিন্তু সেই বাথরুমে একটা ভেন্টিলেটরও নেই। বাথরুমে লাইট জ্বালিয়ে ঢুকতে হয়। ঘরে বাইরের শব্দ তো দূরের কথা একটু আলো পর্যন্ত ভিতরে ঢুকতে পারে না।
জয়ার খুব তার বাবা-মা’র কথা মনে পড়ছে। জয়ার এখন মনে হচ্ছে মা তাকে মারতো না, শাসন করতো, যে শাসনের মধ্যে স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ছিল। মায়ের শাসনে জয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল ভাত না খাওয়া, কোনদিন মা কোন কাজে জয়াকে বকাবকি করলেই জয়া সবার আগে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিত, জয়া কোনদিন ভাত না খেলে তাকে ছেড়ে মাও কোনদিন ভাত খেত না। তারপর শুরু হতো বাবার দেন দরবার, বাবা জয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে মা’র ওপর রাগারাগি করতো, তুমি সবসময় মেয়েটাকে শুধু বকাবকি করো, কী হয়েছে আমাকে বলবে তো?
ফরিদা কোন অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো চুপ করে থাকতো, বাবা জয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, চল মা, তুই না খেলে তো তোর মাও খাবে না।
আমি না খেলে মা খাবে না কেন? আমার ইচ্ছা করছে না তাই আমি খাচ্ছি না।
শুধু তোর মা কেন, আমিও তো খাবো না, তুই কি চাস তোর জন্য আমি রাতে ভাত না খেয়ে ঘুমাই?
তোমার আবার কী হলো?
কী হলো মানে আমার মা খাবে না, আর আমি খাবো? ঠিক আছে তাহলে তুই শুয়ে থাক, আমিও শুতে গেলাম।
জয়া সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে তার বাবার সঙ্গে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতো।
জয়ার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তার বাবা-মা’র কানে গিয়েছিল। বাবা আবেগপ্রবণ মানুষ না, খুব শক্ত প্রকৃতির মানুষ, মনের সব কষ্ট চেপে রাখতে পারে। বাবা দিনের পর দিন জয়ার মোবাইলে কথা বলার অভিযোগ শোনার পরও তাকে কোনদিন বকাবকি করেনি, ধমক দেয়নি। একদিন তার পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গম্ভীর অথচ শান্ত কণ্ঠে বলল, জয়া তোকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা মা, তুই একদিন অনেক বড় হবি, আমরা সবার কাছে মাথা উুঁচ করে দাঁড়াতে পারব।
জয়া মাথা ঘুরিয়ে বলেছিল, কী হয়েছে বাবা? তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছ কেন?
দেখ আমাদের দেশে এখনো বেশির ভাগ মেয়েদেরই আসলে লেখাপড়া করতে করতে বিয়ে হয়ে যায়, খুব অল্প বয়সে। তারপর জীবনের ভার বইতে বইতে একসময় শেষ হয়ে যায়। আমি কিন্তু তোকে নিয়ে অনেককিছু ভাবি, তুই একদিন বড় অফিসার হবি, ভালো ঘরে আমরা তোর বিয়ে দিব।
জয়া তার বাবার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছিল, সেদিনের পর থেকে জয়া মোবাইলে খুব সাবধানে, খুব আসেন্ত আসেন্ত পিয়ালের সঙ্গে কথা বলতো। শৈশবে জয়া কোনদিন তার বাবার কথার অবাধ্য হয়নি, কোনদিন বাবার সঙ্গে কোন চালাকিও করেনি। কিন্তু পিয়ালের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে তার বাবার কথাগুলো যেন জয়ার কানে অসহ্য লেগেছিল। জয়ার সবসময় মনে হতো পিয়াল যেন তার সব, পিয়ালকে ছাড়া সে আর কাউকে চিন্তা করতে পারে না। কী হবে লেখাপড়া শিখে? শেষ পর্যন্ত তো কারো না কারো ঘরে যেতেই হবে তবে পিয়ালই বা খারাপ কীসে?
জয়ার মোবাইল ফোন কেনার কয়েকদিন হয়েছে মাত্র, তার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেরই মোবাইল ফোন নেই তাই তার ফোনে তেমন কারো কল আসে না, কোন বন্ধু মোবাইল করলে দু’য়েক কথা বলে রেখে দেয়। তার এক ফুপু মাঝে মাঝে জয়ার মোবাইলে ফোন দিয়ে তার ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর নেয়। কয়েকদিন আগে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, লেখাপড়ার তেমন চাপও নেই। তার খুব একঘেয়েমি লাগছিল, সে বার বার করে মোবাইল ফোনটার দিকে তাকাচ্ছিল আর ভাবছিল, পৃথিবীতে কি আমার কেউ নেই যে মোবাইল করে আমার একটু খোঁজ-খবর নিবে, শিল্পীর মোবাইল ফোন আছে একবার যে ফোন দিয়ে আমার খবর নিবে তাও না। সবসময় অপেক্ষা করবে আমি কখন ফোন দিই। ও ফোন দিলে তাড়াতাড়ি বলে এখন রাখি রে, ফোনে টাকা নেই আর আমি ফোন দিলে তখন ইনিয়ে বিনিয়ে স্কুলের খবর, বন্ধুদের খবর সব জানতে চাইবে। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয়া আপন মনে একবার হাসল। তারপর মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই বেজে উঠল।
সে খুব আগ্রহভরে ফোনটা হাতে নিল, একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। সে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে রিসিভ করল, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
অপরিচিত কণ্ঠস্বর, ওয়ালেকুম আসসালাম।
হ্যালো কে বলছেন প্লিজ?
আমি পিয়াল।
জয়া পিয়াল নামে কাউকে চিনে না, সে কয়েক মুহূর্ত মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু না এই নামে তো তার কেউ নেই। সে বলল, আপনি কাকে চাচ্ছেন প্লিজ?
আপনাকে।
আমাকে! জয়া কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
প্লিজ যদি কিছু মনে না করেন, আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
বললাম তো আমি পিয়াল।
কী করেন আপনি?
আমি বি.বি.এ পড়ি, আপনি?
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।
আপনি তো আমার চেয়ে অনেক ছোট, আমি যদি আপনাকে তুমি করে বলি আপনার কোন আপত্তি আছে?
না, বলার পর জয়া পিয়াল নামের কাউকে চিনে কি না খুঁজে বের করার চেষ্টা করল, আপনি থাকেন কোথায়?
ঢাকা?
জয়ার কিছুতেই মনে পড়ছে না। সে কথার ফাঁকে ফাঁকে পিয়াল নামের তার পরিচিত কাউকে খুঁজছে। পিয়াল যখন তার ঢাকা থাকার কথা বলল তখন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঢাকায় তাদের সব আত্মীয়-স্বজনদের ছবি তার মনের মধ্যে ভেসে উঠল। কিন্তু না, এই নামে তো তাদের কেউ নেই। জয়া অনেকটা নিশ্চিত হলো পিয়াল নামে তার পরিচিত কেউ নেই। সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকাতেই পিয়াল বলল, হ্যালো।
জয়া আরো কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল তারপর মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, দেখুন আমি তো আপনাকে চিনতে পাচ্ছি না, আপনি মনে হয় রং bv¤^v‡i ফোন করেছেন?
পিয়াল ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বাড়াতে লাগল, দেখো প্রথমে রং নাম্বার ফোন করেছিলাম এখন সেটাই আসল নাম্বার হয়ে গেছে।
মানে?
মানে এই যে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো।
ভাইয়া আমি এখন রাখি।
তুমি কি খুব ব্যস্ত?
না, কেন?
ও, এই যে রাখি রাখি করছ তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আপনি মাইন্ড করেছেন?
পিয়াল কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, না মাইন্ড করবো কেন? তুমি তো আমার তেমন কেউ না যে তোমার কথায় মাইন্ড করবো?
সরি ভাইয়া।
আচ্ছা ঠিক আছে, আর সরি বলতে হবে না, তোমার নামটা কী যেন?
আমার নাম জয়া।
তোমাদের বাড়ি কোথায়?
কুড়িগ্রাম, আপনার?
আমার বাড়ি তো তোমাদের বাড়ির পাশেই।
কোথায়?
রংপুর, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
আমিও।
ভাইয়া আপনি তো ভার্সিটিতে পড়েন তাই না?
হুঁম।
আচ্ছা ভাইয়া বি.বি.এ পড়লে আগে কি পাস করতে হয়?
কেন? তুমি বি.বি.এ পড়তে চাও?
হুঁম।
না তুমি বি.বি.এ পড়বে কেন? আগে ভালোভাবে এইচ.এস.সি পাস করো, আমার মনে হয় তুমি ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে।
আপনি দোয়া করবেন।
অফকোর্স।
থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া।
পাঁচ
সেদিনের পর থেকে পিয়াল প্রতিদিন জয়াকে মোবাইল করতো, জয়াও যেন পিয়ালের মোবাইলের অপেক্ষায় থাকতো। কোনদিন পিয়াল কথা না বললে জয়াও কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করতো, জয়ার জীবনে এ এক নতুন অনুভূতি। প্রেম বলে বিষয়টা জয়ার কাছে একেবারে অপরিচিত, কোন ছেলের সঙ্গে এমন দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে কথা বলাও তার জীবনে প্রথম। সে নিজের কাছে প্রশ্ন করে, সে কি পিয়ালের প্রেমে পড়েছে? তারপর আপনমনে হেসে উঠে।
গতকাল পিয়াল জয়াকে তার ভালোবাসার কথা বলতেই জয়া লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠেছিল, সে মোবাইলে লাইন কেটে দিয়েছিল, জয়া ভেবেছিল পিয়াল যতই মোবাইল করুক না কেন সে আর কোনদিন তার সাথে কথা বলবে না কিন্তু পরদিন তার মোবাইলর ফোন বেজে ওঠার সাথে সাথে তার মন বলেছিল, নিশ্চয়ই পিয়াল মোবাইল করেছে।
সে প্রথমে মোবাইল ফোনটা হাতে নিতে চায়নি, মোবাইলের মনিটরের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও চায়নি কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা অন্যরকম অদৃশ্য টান যেন আকুতি করেছিল, একবার হাতে নিয়ে দেখি তো যদি পিয়াল হয় তবে রিসিভ করবো না।
কিন্তু মোবাইলের মনিটরে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে তার হৃদয়ে ঝড় উঠল, নিজের অজান্তে তার হাত চলে গেল মোবাইল ফোনে, আঙ্গুল ঠিক মোবাইল ফোনের ইয়েস বাটনে।
তার মুখ থেকে অষ্ফুটস্বরে বের হলো, হ্যালো।
হ্যালো, জয়া কেমন আছ?
ভালো, আপনি?
হুঁম ভালো আছি, তোমার মন ভালো হয়েছে?
আমার মন খারাপ হয়েছিল নাকি?
হুঁম সেজন্যই তো কাল রাগ করে মোবাইল রেখে দিলে।
জয়া কোন কথা বলল না।
পিয়াল জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কাল আমার কথায় মাইন্ড করেছ?
না।
তবে রেখে দিলে কেন?
এমনি।
আর কখনো এমন করবে না, এটা আমি পছন্দ করি না। কথা বলা শেষ হবে মোবাইল রেখে দিবে কিন্তু কথা বলতে বলতে হঠাৎ মোবাইল রেখে দিবে এটা-
সরি আমার ভুল হয়ে গেছে।
সেদিনের পর থেকে জয়ার সঙ্গে পিয়ালের অনেকক্ষণ যাবত কথা হতো গভীর রাতে। পড়ার টেবিলে বসে জয়া বার বার করে পিয়ালকে মিস কল দিত, দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর নিয়ম হয়ে গিয়েছিল, মিস কল এর অর্থ হলো মিস করা, মানে মনে করা। তারপর জয়া খেয়াল রাখতো বাবা-মা তাদের রুমে যাওয়ার পর সে পিয়ালকে রিং দিত তারপর কথা শুরু হতো ন্যূনতম ঘণ্টা খানেক, কথার যেন কোন শেষ নেই।
একদিন রাতে জয়া পিয়ালের সঙ্গে কথা বলছিল। কতক্ষণ আগে কথা বলা শুরু করেছিল মনে নেই। কথা বলার এক পর্যায়ে পিয়াল বলল, জয়া অনেকদিন তো হলো আমরা মোবাইলে কথা বলছি, আমার তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
আমারো তো, আমার সবসময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ছে, চোখের সামনে শুধু অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠছে, একবার যদি তোমার সঙ্গে দেখা হতো-
দেখা হলে কী করবে?
তোমার সঙ্গে ঢাকা যাব।
তুমি আগে কোনদিন ঢাকায় এসেছ?
একবার গিয়েছিলাম, আমার আঙ্কলের বিদেশ যাওয়ার সময় তাকে বিমানে তুলে দিতে।
ঢাকা শহর বুঝি তোমার খুব পছন্দ?
হ্যাঁ, আমার তো ঢাকা থেকে আসতেই ইচ্ছা করছিল না।
তাহলে একেবারে চলে এসো।
হুঁম্, তুমি যদি বলো তবে আসবো।
একেবারে?
হ্যাঁ, জয়া জানে না নিজের অজান্তে সে পিয়ালকে কত বড় কথা বলে ফেলেছ। পিয়ালকে সে কোনদিন দেখেনি শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে মাত্র। পিয়াল তাদের বাড়ি রংপুরের কথা বলেছে, আদৌ সে সত্য কথা বলেছে কী না তা একবারো ভাবেনি। তার চোখের সামনে এখন শুধু পিয়াল।
হঠাৎ দরজা নক করার শব্দে জয়া চমকে উঠল, সে মোবাইলটা তার বালিশের নিচে রেখে দরজা খুলে দিতে দিতে একটা হাই তুলল, মা তুমি?
ফরিদা দরজায় দাঁড়িয়ে, রাগে যেন তার চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। ফরিদার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর, কী করছিলি জয়া?
ঘুমাচ্ছিলাম।
ঘুমাচ্ছিলি, না? মনে করেছিস আমি কিছু জানি না।
মা।
মোবাইলে কথা বলছিলি?
জয়া কোন কথা বলল না, সে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
আমার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে।
একজন স্টুডেন্ট রাত জেগে পড়ালেখা করে নাকি ফ্রেন্ডের সঙ্গে মোবাইলে আড্ডা দেয়?
জয়া মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
জয়া আর তার মায়ের কথা শুনে আমিনুল বেরিয়ে এলো, কী হয়েছে?
কী হয়েছে সে কথা তোমার মেয়েকে বলো?
আয় তো মা তুই আমার ঘরে আয় তো।
জয়া তার বাবার সঙ্গে বাবার রুমে গেল।
আমিনুল ফরিদাকে জিজ্ঞেস করল, হুঁম বলো তো কী হয়েছে?
ফরিদা জয়ার সঙ্গে পিয়ালের কথা বলার ধরণটা আমিনুলকে বলল।
সবকিছু শুনে আমিনুল প্রচ- রেগে গেল কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, জয়া আমি এটা তোর কাছে আশা করিনি।
ফরিদা মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, আরো আদর করো, আদর করতে করতে মাথায় তোল। আমি এত করে বললাম ওকে মোবাইল কিনে দেয়ার দরকার নেই, না তুমি আমার কথা শুনলে না, আজকাল মোবাইল নাকি খুব প্রয়োজনীয় জিনিস, তোমার মেয়ে কখন কোথায় থাকে তোমার জানা দরকার, বেশ ভালো এখন জানো।
ঠিক আছে আমি যখন মোবাইল কিনে দিয়ে ভুল করেছি তখন এই ভুলটা আমাকেই সংশোধন করতে দাও, বলে আমিনুল মোবাইলটা তার নিজের কাছে রেখে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, জয়া তুই ঘুমাতে যা।
জয়ার একবার মনে হলো বাবার কাছে মোবাইল ফোনটা চাইবে কিন্তু বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে আর কিছু বলতে পারল না।
কিন্তু ততদিনে পিয়ালেরর মোবাইল নাম্বার জয়ার মুখস্থ হয়ে গেছে। পরদিন স্কুল যাওয়ার পথে জয়া পিয়ালকে গতরাত থেকে তার হাতে মোবাইল না থাকার কথা জানালো। পিয়াল প্রথমে একটু মন খারাপ করল তারপর বলল, ঠিক আছে, তুমি যে কোন মোবাইল ফোন থেকে আমাকে মিস কল দিও তারপর আমি কল ব্যাক করে কথা বলব। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে নতুন নিয়মে কথা চলতো।
পিয়ালের সঙ্গে জয়ার দেখা হবে আগামী পরশুদিন, জয়ার চোখে ঘুম নেই। এতদিন যার সঙ্গে শুধু মোবাইল ফোনে কথা বলেছে, যার কণ্ঠস্বর কানে এলেই তার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে তার সেই কণ্ঠস্বরের মানুষটির সঙ্গে তার দেখা হবে। জয়ার চোখে ঘুম আসছিল না, সবসময় শুধু পিয়ালের কথা মনে পড়তো আর সময়টাকে অনেক ছবিটা মনে হতো, মাঝে মাঝে পিয়ালের ওপর রাগও হতো দেখা করতে এতদিন দেরি হবে কেন?
অবশেষে অপেক্ষার সময় শেষ হলো। একদিন জয়া স্কুলের কথা বলে তার স্কুল ব্যাগের ভিতর কয়েকটা কাপড়-চোপড় নিয়ে বের হলো। জয়া স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বের হয়েছে। সে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিল তখন তার মা একবার তার দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
তখনো স্কুলে তেমন কেউ আসেনি, জয়া কমনরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম পরিবর্তন করে তার স্কুল ব্যাগ এ নিল। তারপর স্কুল থেকে বের হলো কাঁঠাল বাড়ি বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। তার স্কুল থেকে কাঁঠাল বাড়ি বাস স্ট্যান্ডের দূরত্ব কয়েক’শ ফুট। জয়া মাঝে মাঝে এই বাস স্ট্যান্ড অতিক্রম করে বাজারে আসে কিন্তু কোনদিন তার মনের মধ্যে লজ্জা কিংবা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে এই কয়েক’শ ফুট রাস্তা তার কাছে অনেক লম্বা মনে হলো। তার পা দুটো যেন এগুচ্ছে না। সবসময় মনের মধ্যে কেউ দেখে ফেলার ভয়, জয়া মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। ভাগ্যিস বাস স্ট্যান্ডে এসে তাকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। সেও বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো আর একটা বাসও এসে দাঁড়ালো। জয়া তাড়াতাড়ি বাসে উঠে বসল।
জয়া বাসে বসে সামনের সিটের সঙ্গে মাথা রেখে নিজের মুখ লুকিয়েছে। তার মনে অনেক স্বপ্ন, প্রথম প্রেম, নতুন অনুভূতি, ভয় ও ভালোবাসার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। জীবনে এই প্রথম জয়া কোন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, দেখা করতে না একবারেই চলে যাচ্ছে সারাজীবনের জন্য। আর কিছুক্ষণ পরই পিয়ালের সঙ্গে তার দেখা হবে, পিয়াল বলেছে তার গায়ের রং ফর্সা, লম্বা, চুলগুলো কোঁকড়ানো। জয়ার চোখের সামনে যেন পিয়াল ছবিটা ভেসে উঠল। জয়া আপন মনে হেসে উঠল।
জয়া বাস থেকে নামল পার্কের মোড়ে, পিয়ালকে তার খুঁজে নিতে হলো না। সে আগে থেকেই মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। জয়া বাস থেকে নামতেই সে জয়ার মোবাইলে রিং দিল। জয়ার মোবাইল বেজে উঠতেই সে নিজের পরিচয় দিল, আমি পিয়াল।
জয়া মুচকি হাসি হেসে বলল, আমি জয়া।
পিয়াল তার নিজের ব্যাপারে ঠিকই বলেছে। পিয়াল দেখতে সুন্দর, সাজিয়ে গুছিয়ে কাথা বলতে পারে, চোখের দৃষ্টিটাও সুন্দর কিন্তু একটা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যে জিনিসটা বেশি সুন্দর প্রয়োজন তা হলো তার মন, তার বিবেক আর পিয়ালের মধ্যে এই সুন্দর জিনিসটারই অভাব, কত বড় জঘন্য হলে কেউ তার প্রেমিকাকে পাচারকারীর হাতে তুলে দিতে পারে, ছিঃ পিয়াল, ছিঃ।
এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয়ার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
ছয়
গতকাল সারারাত একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে সৌরভ দিনাজপুর থেকে ঢাকা এসেছে। সারাদিন কখনো বাসে কখনো হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সারাদিন এই সব অনিয়মে তার শরীর একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাই ক্ষুধার্ত অবস্থায়, ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে, মশার উপদ্রবেও সে আজ সহজে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা সেই লোকটির ছবি, লোকটি যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে তার হাতে একটা বড় চটের বস্তা, পাশে একটা মাইক্রো বাস, মাইক্রো বাসের মধ্যে কয়েকটা বস্তার মধ্যে যেন মাছ ধরার পর বস্তায় পুরলে যেমন মাছ বস্তার ভিতর ধড়ফড় করে তেমনি বস্তার ভিতর কী যেন ধড়ফড় করছে। লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে তার পান খেকো লাল দাঁতগুলো বের করে।
আর সৌরভ যেন তার কাছ থেকে বাঁচার জন্য সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে, রাস্তায় অনেক মানুষ সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যাচ্ছে সে বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করছে কিন্তু কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ঘেমে গেছে, তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে, তার এক গ্লাস পানি খাওয়ার খুব ইচ্ছা হলো কিন্তু কাকে ডাকবে সে?
সৌরভ একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হতে পারে কিন্তু কারো কোন চিন্তা নেই যে যার মতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সৌরভ আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল, ঘুমানোর চেষ্টার করল কিন্তু তার ঘুম আসছে না। চোখের সামনে বার বার করে সেই ভয়ঙ্কর লোকটার ছবি ভেসে উঠছে। ইতোমধ্যে দু’য়েক ফোটা করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। সবাই যে যার মতো ছুটে চলছে, সৌরভও উঠে দাঁড়াল, তার পাশে শুয়ে থাকা মহিলাটি তখনো শুয়েই আছে। সৌরভ কী বলে ডাকবে বুঝতে পারল না সেও সবার মতো করে একদিকে দৌড়াচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সে জানে না, তবে তার মনে হচ্ছে সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় খুঁজছে।
সৌরভ হাঁটতে পারছে না, সারাদিনের ক্ষুধা, তৃঞ্চা আর ক্লানিন্ততে তার পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে আসছে। হ্যাঁ সবার পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে তারও একটা আশ্রয় হলো, বেশ ভালো আশ্রয়। এটাকে কী বলে সে জানে না, তবে যেন মাটির নিচে একটা সুড়ঙ্গের মতো। সৌরভ সুড়ঙ্গের ভিতরে চাপাচাপি করে দেয়ালে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল, না, আর না, এভাবে জীবন চলে না, এরপর কী করবে? কাল সকাল হলে যেকোনভাবেই হোক বাসায় মোবাইল করবে, আবার ফিরে যাবে বাবা-মা’র কাছে, এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলা তৌহিদ আগে আগে সৌরভের স্কুলে গেল। সালাম দিয়ে প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকতেই তিনি তৌহিদকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন, ওয়ালেকুম আসসালাম, তৌহিদ ভাই বসুন।
তৌহিদ বসল, গতকাল কী হয়েছিল হেড মাস্টার সাহেব?
তেমন কিছু না তো ভাই, ক্লাস শেষে টিচার যখন বের হচ্ছিলেন তখন সৌরভ নাকি পিছন থেকে শীষ দিয়েছে, তাই ক্লাস টিচার ওকে বকাবকি করেছে।
কিন্তু সৌরভ তো তেমন ছেলে না, আমার ছেলে আমি তো জানি ওতো শীষ দিতেই পারে না।
নিজের ছেলে সম্পর্কে সবারই ভালো ধারণা থাকে কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে কী পরিমাণ দুষ্ট তা কল্পনাই করাই যায় না।
প্রধান শিক্ষকের কাছে নিজের ছেলে সম্পর্কে এমন কথা শুনে তৌহিদের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল, আপনি কি নিজে ক্লাসের ছেলেদের কাছে শুনেছেন নাকি ক্লাস টিচারের কাছে শুনেই বলছেন?
তৌহিদের একথার জবাবে প্রধান শিক্ষক কিছু বললেন না, তিনি এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন।
তৌহিদ বলল, আমি ওর ক্লাসের অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে শুনেছি, আসলে ক্লাসে সৌরভ শীষ দেয়নি অথচ আপনারা ওকে বিনাদোষে শাসিন্ত দিয়েছেন।
প্রধান শিক্ষকের মুখ শুকিয়ে গেল, তিনি কিছু বললেন না।
ক্লাসে যে এমন একটা ঘটনা ঘটল তারপর কি আপনি বিষয়টা নিজে তদন্ত করে দেখেছেন?
আমি কাল খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই কাল আর এবিষয়ে কোন কথা হয়নি।
আপনি ক্লাস টিচারের কাছে শুনেই থেমে গেছেন, অথচ আমার ছেলেটা বিনাদোষে এমন একটা অপমানের গ্লানি নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল।
সৌরভ বাড়ি থেকে চলে গেছে।
তৌহিদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, হুঁম্।
প্রধান শিক্ষক ক্লাস টিচারকে ডেকে পাঠালেন, তাকে গতকাল সৌরভকে বকাবকির ফলে যে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে একথাও বললেন, শুনে ক্লাস টিচার বিষয়টাকে একরকম পাত্তাই দিলেন না, এটুকু কারণে একটা ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে? আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খোঁজখবর নিন, দেখবেন কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গেছে দুয়েকদিন পর ঠিকই চলে আসবে।
তৌহিদের রাগ যেন আরো চরমে উঠে গেল, হ্যাঁ চলে আসলে তো ভালোই তা না হলে তো আবার থানা পুলিশ করতে হবে।
এবার ক্লাস টিচার কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন, তিনি তৌহিদের হাত চেপে ধরলেন, তৌহিদ ভাই আমি এতটা ভাবিনি, ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত এতদূর পর্যন্ত গড়াবে এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি, প্লিজ তৌহিদ ভাই আমাকে মাফ করবেন, এমন ভুল আর হবে না।
তৌহিদ আর কথা বাড়াল না।
সাত
তৌহিদ স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ড্রয়িং রুমে সোফার ওপর ধপাস করে বসে পড়ল। তার বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সবাই এলো। তার দিকে সবার কৌতূহলী দৃষ্টি যেন তৌহিদ কোন সুখবর নিয়ে এসেছে। কিন্তু তৌহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই অনেকটা অনুমান করল।
সোমা জিজ্ঞেস করল, কোন খবর পেলে?
না।
তৌহিদের শ্বশুরও তার বাসায় ঢোকার পরপরই ড্রয়িং রুমে ঢুকেছেন। তিনিও সোমার মতোই জিজ্ঞেস করলেন, কোন খবর পেলে বাবা?
না আব্বা।
সোমা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল স্কুলে?
টিচার বকাবকি করেছে।
সোমা রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, সেজন্যই তো ও বাসা থেকে পালিয়েছে, তুমি টিচারকে কিছু বললে না?
হ্যাঁ বলেছি।
কী বললে?
কী আর বলব? কিছু বলতে গিয়েই তো টিচার মাফ চাইল।
টিচার মাফ চাইল আর তুমি মাফ করে দিলে?
টিচার তো তাও মাফ চেয়েছে, আর যারা সারাদিন বকাবকি করে তারা তো মাফও চাচ্ছে না।
তুমি কী বলছ?
তৌহিদ সোমার কথার কী জবাব দিবে? তার মনের মধ্যে অনেক কথার ঝড় বইছে। তৌহিদের বিয়ের জন্য তখন মেয়ে দেখা হচ্ছে। একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছে, অনেকের ধারণা বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে কোন কনের জন্য ভালো ঘর-বর পাওয়া যত কঠিন কোন বরের জন্য আদর্শ কনে পাওয়া তত কঠিন নয়। কিন্তু তৌহিদের বিয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত এই ধারণাটির ব্যতিক্রম ঘটল। একটা ভালো কনে খুঁজতে খুঁজতে অনেকদিন কেটে গেল। ভালো বংশের শিক্ষিত, সুন্দরী আদর্শ কনে পাওয়া সত্যিই কঠিন হলো।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ভালো কনের সন্ধান গেল চিরিরবন্দর। কনের নাম সুমাইয়া আক্তার সোমা, কনের গায়ের রং ফর্সা, লম্বা, এককথায় কনে দেখতে সুশ্রী এবিষয়ে কনে দেখতে আসা সবাই একবাক্যে স্বীকার করল। কনের বিশেষ যোগ্যতা হলো যে সে পর্দানশীন, নম্্র, তাকে বোরকা ছাড়া দেখেছে কিংবা উচ্চ কণ্ঠে তাকে কথা বলতে শুনেছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রতিবেশীদের মধ্যেও কম। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর বি.এ পাস করেছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, প্রতি বছর রমযান মানে এক খতম কোরআন তেলাওয়াত করে। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এমন মেয়ে আজকাল পাওয়া কঠিন। কনে দেখার পর পাত্র-পাত্রীর সম্মতিতে উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার পর বিয়ের দিন ধার্য হলো।
বিয়ের অনুষ্ঠানে যে মেয়েটি একহাত ঘোমটা বাড়িয়ে নিজেকে পর্দানশীন, অবরোধবাসিনীরুপে নিজেকে জাহির করল, বিয়ের অনুষ্ঠানে মৃদু কণ্ঠে কথা বলে মৃদুভাষিণী, স্বল্পভাসিনী বলে প্রশংসা অর্জন করল বিয়ের কয়েকদিন যেতে না যেতেই তার সেই সব গুণাবলীর অবসান ঘটল। মাথার ঘোমটা ঝুলে পড়ল কাঁধে, কথার খৈ ফুটল মুখে, কণ্ঠস্বর শুধু চার দেয়ালই ভেদ করল না, কখনো কখনো তৌহিদের হৃদয়েও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করল।
তৌহিদ সোমার আচরণে ব্যথিত হলো তাকে বোঝানো চেষ্টা করল বটে কিন্তু সেই সঙ্গে তার হৃদয়ে একটা ধারণা ধীরে ধীরে বিশ্বাসে রূপ নিল যে সোমার মুখে যে কথার খৈ ফুটেছে, নিজের অধিকার আদায়ের নামে সে যে তৌহিদের অধিকার প্রতিনিয়ত খর্ব করেছে তা থেকে সে কোনদিন ফিরে আসবে না। একবার তৌহিদ সিদ্ধান্ত নিল নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার, সংসার জীবনের ইতি টানবার কিন্তু পরক্ষণেই তার অন্তর্দৃষ্টিতে ভেসে উঠল সামাজিক মর্যাদা। তার বিচ্ছেদের সে চিন্তা আর কোনদিন মাথাচাড়া দেয়নি। নিজের কাছে সে সান্ত্বনা হিসেবে একটা যু্ক্তি দাঁড় করালো যে, তাদের ঘরে একটা সন্তান এলে তার এই রুক্ষ মেজাজ, আন্ত অহমিকার অবাসন ঘটবে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে তৌহিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।
কিন্তু অবস্থার এতটাই অবনতি হলো যে তৌহিদ একবার তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর উদ্যোগ নিল, তাতে সোমা আরো ক্ষুব্ধ হলো। সে হাজার গুণ জ্বলে উঠল, আমি কি পাগল যে আমাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে?
তৌহিদ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল, সোমা তুমি বিষয়টাকে এভাবে নিচ্ছ কেন? এই যে তোমার ঘাড় ব্যথা করছে, তুমি ছোটখাটো কথায় রেগে যাচ্ছ এটা তো অসুখ হতে পারে একবার ডাক্তার দেখালে সমস্যা কি?
না আমার কিচ্ছু হয়নি, আমাকে আর কোনদিন এসব কথা বলবে না।
না সোমাকে তৌহিদ কোনভাবেই ডাক্তার দেখাতে রাজি করতে পারল না।
তাদের ঘরে নতুন অতিথি এসেছে। তৌহিদের শেষ ভরসা গিয়ে দাঁড়াল এই নতুন অতিথি সৌরভের কাছে। এই নতুন অতিথির মুখের দিকে তাকিয়ে সোমা যদি নিজেকে সংবরণ করে?
সৌরভ তখন সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে। সে সারাটা বাসায় সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে বেড়ায়, কখনো খাটের ফাঁকে লুকোচুরি খেলে, বাসার সাজানো-গুছানো জিনিসপত্র এলোমেলো করে। একদিন তৌহিদ অফিস থেকে ফিরে ঢুকতেই সৌরভ ভ্যা, ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে তার সামনে এলো। তৌহিদ তাকে কাছে নিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আব্বু?
সৌরভ কাঁদতে কাঁদতে বলল, আব্বু আম্মু খালি আমাকে মেরেছে।
কেন?
সৌরভ আর কোন কথা বলল না।
এসময় পাশের রুম থেকে সোমা বেরিয়ে এলো, কী হয়েছে বলো? বলো?
আমি একটা গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছি।
কীভাবে?
সৌরভের একথার জবাব দিল সোমা, কীভাবে আবার ডাইনিং টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে নিজে পানি খেতে চেয়েছিল। কেন ও আমাকে বলতে পারল না?
সেজন্য তুমি ওকে মেরেছ?
মারবো না তো কী? কত সুন্দর গ্লাসটা এই ক’দিন আগেই কিনলাম। আর ও-
তৌহিদ ivMvwš^Z চোখে সোমার দিকে তাকাল।
বলো? কিছু বলছ না কেন?
তোমাকে কী বলব, তোমার কাছে তো ছেলেটার মন ভেঙ্গে যাওয়ার চেয়ে গ্লাস ভেঙ্গে যাওয়াই বড়।
সেদিনের সোমার রাগ সে পর্যন্তই থেমে থাকলে ভালো হতো কিন্তু সে রাগ শেষ পর্যন্ত থামল গভীর রাত বকাবকি করার পর, তৌহিদের মনের মধ্যে এতদিন যে সান্ত্বনা লালন করেছে তার অবসান ঘটল। সেদিনই তৌহিদ বুঝতে পারল, সোমা কোনদিন ভালো হবে না, তার রুক্ষ মেজাজ, বংশ মর্যাদার অহমিকা এবং সংসারের সবাইকে শাসন করার মনোবৃত্তি থেকে সে কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারবে না।
তৌহিদকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে সোমা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, চুপ করে আছ কেন বলো?
এবার তৌহিদ মুখ তুলে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ও কি শুধু টিচারের বকাবকির জন্যই পালিয়েছে?
তো-
ও তো তোমার কারণেও পালিয়েছে।
আমার কারণে কীভাবে?
কেন, ও যখন স্কুল থেকে এসে খেলছিল তখন তুমি ওকে বকাবকি করলে কেন?
কিন্তু ও তো স্কুলের কথাটা আমাকে বলতে পারতো?
তুমি কি কোনদিন ওর কথা শুনতে চেয়েছ?
সোমা কোন কথা বলল না।
শুধু কি আজ? তুমি কোনদিন ওর কথা শোনতে চাওনি, ও কোনদিন স্কুল থেকে এসে কম্পিউটারে বসতে চেয়েছে তুমি বকাবকি করেছ, কোনকিছু নিয়ে খেলতে চেয়েছে তুমি দাওনি। ওর বয়স অনুযায়ী এখন ওর কী করতে ইচ্ছা করছে কী করতে ইচ্ছা করছে না তার প্রতি তুমি কোনদিন একটু সমর্থন দাওনি, সবসময় তুমি তোমার ইচ্ছাটাই ওর ওপর চাপিয়ে দিয়েছ।
তাহলে কি মা হিসেবে ওকে পড়তে বলা আমার দোষ হয়েছে? আমি তো যা করেছি সব ওর ভালোর জন্যই।
তুমি আসলে ভালো মন্দই বোঝ না, সবসময় নিজেকে দিয়ে ওকে বিচার করেছ, ও যে এখনো কিশোর, তোমার ইচ্ছা, তোমার চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে যে ওর চাওয়া-পাওয়ার তফাৎ আছে সেটা তুমি কোনদিন বুঝতেই চাওনি। আর এখন বলছ ও টিচারের বকাবকির জন্য পালিয়েছে, কেন? বাসায় এসে ও যখন তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল তখন তুমি ওর কথা শুনলে না কেন?
তৌহিদের শ্বশুর বলল, এখন ওসব রাখ বাবা।
না আব্বা আমাকে বলতে দিন, ও শুধু সৌরভের সঙ্গেই দুর্ব্যবহারই করেনি, আমার সঙ্গেও সে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে, আমাকেও ও কোনদিন বুঝতে চায়নি। আমাদের দু’জনকে ও সবসময় শাসনের মধ্যে রাখতে চেয়েছে, ও যখন যা বলবে আমাদের দু’জনকে তাই করতে হবে, না করলে চিৎকার, বকাবকি। আমিও মান-সম্মানের ভয়ে দিনের পর দিন মুখ বুজে ওর সব অত্যাচার সহ্য করেছি কিন্তু সৌরভ, সৌরভ ছোট ছেলে, ও একটু অভিমানী, এতটুকু বয়সে ওর মধ্যে কেমন যেন ব্যক্তিত্ব বোধ জন্মেছে, তা না হলে দেখুন এই বয়সের অনেক ছেলেই তো স্কুল টিচারের মার খেয়ে মুখ বুজে থাকছে আর ও প্রতিবাদ করেছে।
তৌহিদের শ্বশুরের সোমার ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো তিনি তৌহিদকে বললেন, তুমি কেন সহ্য করলে বাবা? আরো আগে বললে না কেন? সৌরভ পালিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করেছে তুমি আমাদের কাছে বিচার দিতে আমরা ওর বিচার করতাম।
কয়েক বছর আগে আমি তো আপনাদের কাছে একবার বিচার দিয়েছিলাম আব্বা কিন্তু আপনারাও ওকে একটু বকাবকি করে ওর সব অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন। তবুও কিছুদিন ও ঠিক ছিল তারপর আবার যেমন ছিল তেমনই।
আবার আমাদের বলতে।
এভাবে আর কতবার বিচার দিতে ইচ্ছা করে, অনেক সময় নিজেকেই খারাপ লাগে।
তৌহিদের শ্বশুর গম্ভীর কণ্ঠে সোমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সোমা, আমি এসব কী শুনছি?
সোমার দু’চোখ ছলছল করে উঠল। দিনের পর দিন তৌহিদ আর সৌরভের ওপর সে যে তার ইচ্ছা অনিচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছে এটা সে বুঝতে পারল, সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমার ভুল হয়েছে বাবা, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তারপর তৌহিদের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, শোন সৌরভের আব্বা আমার ভুল হয়েছে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও, এমন ভুল আর আমার কোনদিন হবে না।
আট
আজ প্রায় পাঁচদিন হলো কিন্তু জয়াকে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন, তার বন্ধু-বান্ধবী সব জায়গায় খোঁজার পরও পাওয়া গেল না। ইতোমধ্যে জয়া নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা এলাকায় গুঞ্জনের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ মুখরোচক কথাও বলছে, চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়সের মেয়ে যাবে কোথায়? দেখো কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে, ক’দিন পর জামাই সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
আবার কেউ কেউ বলছে, আমিনুল হয়ত জানে তাই থানা পুলিশ না করে জেনে-শুনে চুপ করে আছে। একটা মেয়ে বিয়ে দিতে ডিমান্ড লাগত, চলে গেছে তো ভালোই হয়েছে।
অনেকেই এসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলছে, না, না আমিনুলের মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো, তার এমন করার কথা না।
রাস্তায় চলার পথে আমিনুলের কানে অনেক কথা আসছে কিন্তু সে শুনেও না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আজ সকালবেলা মান-সম্মানের কথা বাদ দিয়ে আমিনুল থানায় গেল সঙ্গে মমিনুলও।
কুড়িগ্রাম সদর থানায় যোগদানের পর থেকে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ওসি সাহেবের বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। আমিনুল সালাম দিয়ে ওসি সাহেবের চেম্বারে ঢুকল।
ওসি সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী আপনাদের?
স্যার একটা জি.ডি করবো।
বসুন, কী হয়েছে বলুন?
দু’জনে বসল, আমিনুল একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে জয়া হারানোর বিষয়টি বলল।
সবকিছু শুনে ওসি সাহেব রেগে গেলেন, আজ পাঁচদিন পর আপনার থানায় আসার সময় হলো? আরো আগে এলেন না কেন?
আমিনুল বলল, স্যার মেয়ে মানুষ তো আগে কাউকে জানাতে চাইনি। আগে নিজেরা খুঁজেছি, কোথাও না পেয়ে থানায় এলাম।
আপনাদের সঙ্গে আমরাও খুঁজতাম, এখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমিনুল ওসি সাহেবকে বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার আপনি একবার দেখুন, বুঝতেই তো পাচ্ছেন।
হ্যাঁ বুঝতে পাচ্ছি বলেই তো আপনার ওপর আমার রাগ হচ্ছে, আপনি আরো আগে এলেন না কেন?
আমিনুল একথার কোন উত্তর দিল না।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে?
জি স্যার বলুন।
আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? এই যেমন স্কুলে যাওয়া-আসার পথে কোন বখাটে টিজ করতো কিংবা প্রেমের প্রস্তাব দিত এরকম?
এ কথার উত্তর দিল মমিনুল, না স্যার।
ওসি সাহেব কৌতূহলী দৃষ্টিতে মমিনুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? আপনি কীভাবে জানলেন?
আমি জয়ার চাচা এবং আমি ওর ক্লাস টিচার।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার চোখে তেমন কিছু পড়েনি?
না।
আচ্ছা আমিনুল সাহেব আপনি বলুন তো জয়া কি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো?
জি।
মোবাইল নাম্বার দিন, বলে ওসি সাহেব একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন।
আমিনুল মোবাইল নাম্বার লিখে দিল।
সে কি মোবাইল ফোনে খুব কথা বলতো?
আমিনুল মাথা নত করে কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল, জি স্যার।
দেখুন একটা কাজ আপনি ঠিক করেননি?
আমিনুল মাথা তুলে তাকাল।
আজকাল চৌদ্দ/পনেরো বছরের মেয়ে একেবারে ছোট না, এরকম টিন এজার মেয়েকে মোবাইল ফোন কিনে দেয়া আপনার ঠিক হয়নি। বাড়ি থেকে স্কুল এক কিলোমিটার পথ, কাজ শুধু স্কুল যাওয়া আর আসা, তাতে মোবাইল ফোন লাগবে কেন? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?
জি স্যার, বলুন।
সে কার কার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতো এমন কোন ইনফরমেশন আপনার জানা আছে?
আমিনুল না সূচক মাথা নাড়ল।
স্ট্রেঞ্জ! মেয়ে কার সাথে মোবাইলে কথা বলে এটা আপনি জানেন না, মেয়ের কোন খোঁজখবরও রাখেননি।
আমিনুল কিছু বলল না।
ওসি সাহেব বললেন, আজকাল ছেলেমেয়েদের প্রতি এত উদাসীন থাকলে হয় না। ছেলেমেয়েদের প্রতি চোখ কান খোলা রাখতে হয়।
আমিনুল অপরাধীর মতো মাথা নত করে বসে রইল।
ওসি সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, দেখুন কাজটা খুব জটিল একেবারে ক্লু বলে কিছু নেই, আমাদের ইনকোয়ারী করতে হবে একেবারে ডার্কে থেকে। তবু আমি চেষ্টা করবো। আপনি একটা ডাইরি করুন, বলে ওসি সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিলেন।
স্যন্ট্রি এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল, স্যার।
ইলিয়াস সাহেবকে আমার সালাম দাও তো।
কয়েক মিনিট পর ইলিয়াস সাহেব স্যালুট দিয়ে ভিতরে ঢুকল, স্যার।
ওসি সাহেব আমিনুলকে ইশারা করে বললেন, উনার সঙ্গে যান, ইলিয়াস সাহেব উনার কাছ থেকে শুনে একটা ডায়েরি এন্ট্রি করে নিন।
আমিনুল এবং মমিনুল চেয়ার থেকে উঠল, আমিনুল ছলছল চোখে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, স্যার, আপনি একটু দেখুন আমার মেয়েটা-
ওসি সাহেব বললেন, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আপনি কেস এন্ট্রি করুন।
জি স্যার, বলে আমিনুল আর মমিনুল ওসি সাহেবের চেম্বার থেকে বের হলো।
চলবে…
এই উপন্যাসটি পেতে আসুন, নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টল নাম্বার-১৭২-১৭৩, অমর একুশে বইমেলা, ঢাকা।
Leave a Reply