ক্যাপ্টেন

ক্লাস চলছে। কেমিস্ট্রি ক্লাস। রনি আর টিটু পাশাপাশি বসেছে, মাঝে মাঝেই টিটু রনিকে টিজ করছে, রনির কানে কানে ফিসফিস করে বলছে, আরে রাখ তোর পড়া। এতো পড়ে কী করবি?

রনি কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, চুপ কর রনি। আমি কেমিস্ট্রি কম বুঝি, একটু বুঝতে দে প্লিজ!

ওকে, ওকে পড়, দেখি ক্লাসে স্টাচুর মতো হয়ে বসে থেকে আর দিনরাত লেখাপড়া করে তুই কী হতে পারিস? আরে শোন তোকে আমি একটা গল্প শোনাই।

রনি চাপাস্বরে বলল, ক্লাসের পর বলিস।

টিটু বায়নার সুরে বলল, তখন মনে থাকবে না ফ্রেন্ড।

রনি বিরক্তির সুরে বলল, বলতে থাক। তারপর আবার ক্লাসে মনোযোগী হলো।

মেলায় যাবি?

কোন মেলা?

বাণিজ্য মেলায়।

না। সামনে পরীক্ষা এখন আমি কোথাও যাবো না। আর কথা বলিস না টিটু। আমি কেমিস্ট্রি এমনিতেই কম বুঝি।

আচ্ছা তুই মনোযোগ দিয়ে পড়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে তোর সাথে কথা বলবো।

রনি আর টিটুর কথা বলা শিক্ষক হামিদুল সাহেবের চোখে পড়েছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই টিটু-রনি কী হয়েছে তোদের? দাঁড়া, দু’জনে উঠে দাঁড়া।

রনি আর টিটু উঠে দাঁড়ালো।

হামিদুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এই টিটু বলতো কী হয়েছে?

হামিদুল সাহেব কোনোদিন ছাত্রদের গায়ে হাত তোলেন না কিন্তু তবুও ছাত্ররা তাকে ভয় পায়। তার চোখের দৃষ্টিতে একরকম শাসন আছে যে চোখের দিকে তাকালে খুব দুষ্টু ছাত্রদেরও বুক শুকিয়ে যায়।

টিটু একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, স্যার কিছু হয়নি তো।

তোরা কথা বলছিলি কেনো?

কথা বলছিলাম, না তো, না মানে…

হামিদুল সাহেব এবার রনিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রনি তুই বলতো কী হয়েছে? ঠিকঠাক বলবি কিন্তু…

টিটু রানির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ইশারায় কিছু না বলতে অনুরোধ করল।

রনিও টিটুর মতো একটা ঢোক গিলে বলল, না স্যার, কিছু হয়নি তো।

হামিদুল সাহেব রেগে গেলেন, কিছু হয়নি মানে, আমি কথা বলতে দেখলাম আর তোরা বলছিস কিছু হয়নি, একেই বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।

জুয়েল উঠে দাঁড়ালো, না স্যার, আপনি ঠিক বলেননি।

হামিদুল সাহেব থমকে গেলেন, ও তুই আছিস। আমি জানি না তুই আছিস, জানলে আমি কথাই বলতাম না।

কেন স্যার? কথা বলতেন না কেনো?

কারণ আমি কথা বললে তুই ভুল ধরবি। এতো ভুল ধরা ছাত্রের সামনে কথা বলাই বিপজ্জনক।

জুয়েল বলল, স্যার এখন আর চোরে চোরে মাসতুতো ভাই নেই। এখন চোর পুলিশে মাসতুতো ভাই।

হামিদুল সাহেব জুয়েলের কোনো কোনো আচরণে বিরক্ত বোধ করলেও তাকে ভালোবাসেন। তিনি কয়েকসেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি আছে রে, তুই ঠিক বলেছিস। আজকাল তো সবকিছু সিন্ডিকেট করেই হয়। আচ্ছা তুই বস। এই কী আর ওদের শাসন করব, তোর জন্য তো আমার শাসন করার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল।

জুয়েল বসে আবার উঠল।

হামিদুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, উফফ আবার কী বলবি তুই?

স্যার কোনো শিক্ষক আর কোনো ছাত্রকে শাসন করতে পারবে না, আপনি এটা জানেন না?

বস, বস, তোকে আর কথা বলতে হবে না। আমি দেখেছি, ভালো করে দেখেছি, এই তোরাও বস আর ক্লাসে কথা বলবি না, বলে হামিদুল সাহেব বই বন্ধ করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাহলে তোদের একটা গল্প বলি।

ছাত্রছাত্রীরা হামিদুল সাহেবের কথায় মনোযোগী হলো।

হামিদুল সাহেব বলতে শুরু করলেন, কয়েকদিন আগের কথা, আমি বাহাদুর বাজার যাচ্ছিলাম বাজার করতে, হঠাৎ করে পুলিশের একটা পিক আপ এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, আমি তো অবাক, পুলিশ!

পিক আপ থেকে নেমে পুলিশের একজন অফিসার সালাম দিয়ে বলল, স্যার আমি কাইয়ুম। আমাকে চিনতে পারছেন?

কাইয়ুম, কাইয়ুম….বলে আমি মনে করার চেষ্টা করলাম।

কাইয়ুম আবার বলল, স্যার আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না। আপনি আমাকে কামু বলে ডাকতেন, স্টুডেন্ট লাইফে আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। একদিন ক্লাসে পড়া হয়নি বলে আপনি আমাকে অনেকক্ষণ রোদে দাঁড় করিয়ে রাখছিলেন আর বলছিলেন আজ রাগ করতে পারিস কিন্তু যেদিন অনেক বড় হবি, ভালো চাকরি করবি সেদিন আমার কথা মনে পড়বে। সেদিন আপনার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল তারপর যেদিন আমার পুলিশে চাকরি হলো সেদিন আপনার কথা আমার খুব মনে পড়ল স্যার, খুব!

আমার শাসনটা তোদের আজ খারাপ লাগতে পারে কিন্তু যেদিন বড় অফিসার হবি সেদিন তোদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। একটা কথা মনে রাখবি, শিক্ষার শিকড় তেতো হলেও এর ফল কিন্তু মিষ্টি।

তুই আবার আমাকে স্মরণ করে দিলি শাসন করাও যাবে না। আগের দিনে আমরা যখন লেখাপড়া করতাম তখন আমরা ছিলাম অনেকটা শান্ত-শিষ্ট, শিক্ষকদের সম্মান করতাম, ভয়ও পেতাম, তখন ছাত্রছাত্রীরা কোনো দুষ্টুমি করলে শিক্ষক শাসন করতো আর এখন ছাত্ররা হয়েছে দুষ্টু আর শিকক্ষদের হয়েছে শাসনে বাধা। যা, যা পারিস কর, আমার পড়ানোর কাজ আমি পড়াব। শোনা উল্লাহ শুনিস আর না শুনিস, আমি বকাউল্লাহ বকেই যাবো, বলে হামিদুল সাহেব আবার বই খুললেন।

এবার সুবর্ণা উঠে দাঁড়ালো।

হামিদুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুই আবার কী বলবি? বললে আরেকদিন বলিস, আজ আর সময় নেই। পড়া বাকি আছে। আগে পড়া তারপর গল্প। আরেকদিন ক্লাস শেষে যদি সময় পাই তবে আবার গল্প শোনাব, এখন বস।

স্যার আমি বলতে চাচ্ছিলাম কেমিস্ট্রি ক্লাসটা একটু কঠিন। সহজে বুঝতে পারি না। তাই সবারই মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত আর ক্লাসে যদি এরকম হৈ চৈ হয় তবে তো আরো কিছুই বুঝবো না।

আমি জানি তুই ঠিকই বুঝতে পারছিস, বস।

টিটু তীর্যক দৃষ্টিতে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, উঁহ পণ্ডিত হয়েছে, সবার মনোযোগী হওয়া উচিত, যে বুঝবে সে এমনি বুঝবে আর যে বুঝবে না সে যতই মনোযোগী হোক বুঝতে পারবে না, মাথায় তো আছে গোবর, বুঝবি কী করে।

ততক্ষণে হামিদুল সাহেব ক্লাস থেকে চলে গেছেন। সুবর্ণা টিটুকে জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে করিস না টিটু, আসলে আমি কেমিস্ট্রি একেবারে বুঝি না। তাই চেষ্টা করছিলাম ক্লাসে যদি কিছু বুঝতে পারতাম।

টিটু কিছুটা অভিমানের সঙ্গে বলল, থাক, থাক আর বলতে হবে না। একটা কথা বলি, শোন।

বল।

আসলে তোরা তো অনেক লেখাপড়া করিস কিন্তু আমি লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী না। তবুও একটা বিষয় দেখিস জীবনের লক্ষ্যে কিন্তু আমিও ঠিকই পৌঁছাবো। যেমন আমার ইচ্ছা আমি ডাক্তার হবো। তোরা দেখিস আমি ঠিকই মেডিক্যালে ভর্তি হবো। এই ধর আমার রিনি আপুর কথা, কী লেখাপড়া করেছে অথচ ঠিকই মেডিক্যালে ভর্তি হলো আর আপুর চেয়ে কত ভালো, ভালো, ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্ররা চান্স পেল না।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে পেল?

টিটু বুক ফুলিয়ে, শার্টের কলার নেড়ে বলল, সময় আসুক, তখন দেখবি। আজকাল টাকা হলে সব হয়, মেডিক্যালে ভর্তিও হওয়া যায়।

পরবর্তী ক্লাস টিচার মাহবুব সাহেব এলেন। মাহবুব সাহেব কেমিস্ট্রি পড়ান, ফিজিক্সের একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে শহরে তার সুনাম আছে। দেয়ালে দেয়ালে, মোড়ের দর্শনীয় স্থানে তার প্রাইভেট পড়ানোর বিজ্ঞাপন আছে। তার নামের সঙ্গে কে বা কারা কিংবা নিজেই স্যার বিশেষণটি সংযুক্ত করেছেন। স্যার একটা উপাধি যা শুধু মাত্র যুক্তরাজ্যের রাণীর দেয়া সর্ব্বচ্য ’’নাইট’’ প্রাপ্তরাই ব্যবহার করতে পারেন যেমন : স্যার জদগীশ চন্দ্র বসু, স্যার ফজলে হাসান আবেদ। কিন্তু শুধু মফঃস্বল শহরেই নয় ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে এমনি হাজার হাজার স্যার আছেন। মাহবুব সাহেবও দিনাজপুর শহরে মাহবুব স্যার নামেই পরিচিত।

মাহবুব সাহেব ক্লাসের শুরুতেই কিছুক্ষণ পড়ানোর পর বলতে শুরু করলেন ফিজিক্স খুব জটিল সাবজেক্ট, এতো জটিল একটা সাবজেক্ট পড়ানোর জন্য এই ত্রিশ বা চল্লিশ মিনিট সময়ই যথেষ্ট না। তার ওপর ছাত্র-ছাত্রী যদি হতো পনেরো বিশ জন তাহলে হয়তো তোরা সবাই বুঝতে পারতিস, আমিও ভালোভাবে বুঝাতে পারতাম। এটুকু সময়ের মধ্যে কী পড়াবো আর কী পড়া ধরবো।

মাহবুব সাহেবের এই ডায়ালগ নতুন না, প্রায়ই বলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের বড় একটা অঙ্ক ক্লাসের বাইরে তার কাছেই প্রাইভেট পড়ে। তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য স্কুলের অনেক ছাত্র-ছাত্রী তার কাছে প্রাইভেট পড়ে। সকালবেলা স্কুল আসার আগে তিনটা ব্যাচ প্রাইভেট পড়ানোর ফলে ক্লাসে পাঠদানে তার অবস্থা গলদঘর্ম। তাই ত্রিশ বা চল্লিশ মিনিটের ক্লাসেও যদি পুরো সময় মনোযোগ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করতেন তবে ফিজিক্স যত জটিল সাবজেক্টই হোক না কেনো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বোধগম্য হতো কিন্তু প্রাইভেট কোচিং পড়ানোর ফলে তার দৃষ্টি থাকে সবসময় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। তাই জটিলকে সহজ না করে ক্লাসে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝতে আরো কঠিন হয়ে যায়।

মাহবুব সাহেব পিছনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, এই রাশেদ নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা বলতো।

রাশেদ উঠে দাঁড়ালো, স্যার প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

গুড বলে মাহবুব সাহেব অভিনন্দন জানালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন মাসুমকে, এই মাসুম তুই বলতো কাজ কাকে বলে?

মাসুম বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে বলল, আমি জানি না স্যার।

আর জানবি কী করে, বললাম না ফিজিক্স খুব জটিল সাবজেক্ট, ক্লাসের এই ক’মিনিটে পারবি না। দেখলি রাশেদ বলে ফেলল। ও প্রাইভেট পড়ে বলে শিখতে পারছে আর তাই বলতে পারলো, তোরা তো আমার কথা শুনবি না, ক্লাসে বুঝলে বুঝবি, না বুঝলে না বুঝবি, ফেল করলে তো দোষ হবে মাহবুব স্যারের, বস।

এবার মাহবুব সাহেব পড়া ধরলেন রনিকে, তুই বলতো কাজ কাকে বলে?

রনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার বল প্রয়োগে কোনো স্থিতিশীল বস্তু গতিশীল হয়ে যদি কিছুদূর সরে যায় তাহলে বুঝতে হবে কাজ হয়েছে।

গুড। তুই তো দেখি ভালোই পারিস, কোথায় প্রাইভেট পড়িস?

প্রাইভেট পড়ি না স্যার?

তোর বাবা কী করে যেন?

স্যার আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার।

তোদের তো তাহলে অনেক টাকা, প্রাইভেট পড়ালে তুই আরো ভালো পারবি।

আমাদের টাকা নেই স্যার। বাবা নিজেই আমাকে পড়ায়।

মাহবুব সাহেব মুখ কালো করলেন।

আচ্ছা তুই বস। আসলে নাইন, টেনে প্রাইভেট পড়তে হয়, প্রাকটিক্যালের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকে তো।

এতক্ষণ জুয়েল মনোযোগ দিয়ে মাহবুব সাহেবের কথা শুনছিল। সেও মাহবুব সাহেবের কাছে প্রাইভেট পড়ে না। সে এবার উঠে দাঁড়ালো, প্রাইভেট না পড়লে কি প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিবেন স্যার?

আরে কম দিবো কেনো? তোরা কম পেলে স্যার কি মার্ক বানিয়ে দিবে, তোরা যা পাবি তাই দিবে।

আর যারা প্রাইভেট পড়বে তাদের মার্ক বাড়িয়ে দিবেন স্যার?

মাহবুব সাহেব রেগে গেলেন, তুই খুব বেশি কথা বলিস, বস, বলে মাহবুব সাহেব আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, আগে প্রাইভেট না পড়ে দেখ, প্রাকটিক্যালে আমি তোকে কত মার্ক দিই।

আমি তো আপনার কাছে প্রাইভেট পড়ি না, আপনার কাছে প্রাইভেট পড়লে আপনি ভালো না পড়ালেও মার্ক বাড়িয়ে দিবেন, তখন ইন্টারে গিয়ে বা অ্যাডমিশন টেস্টে গিয়ে আমি কী করবো, কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে জুয়েল বসে পড়ল।

জুয়েল যে গজগজ করছে এটা মাহবুব সাহেব বুঝতে পেরেছেন। তিনি জুয়েলকে জিজ্ঞেস করলেন, বিড়বিড় করে কী বলছিস?

না স্যার, কিছু না।

মাহবুব সাহেব রেগে গেলেন, জুয়েল তোর এটা খুব বড় দোষ, সব বিষয়ে কথা বলিস, ছাত্র ছাত্রের মতো থাকবি। অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে নেয়ার কী দরকার, তুই ক্লাসের ক্যাপ্টেন মানে লিডার, লিডারের কথাবার্তা একটু সংযত হওয়া দরকার।

আমি অন্যের দোষ আমার ঘাড়ে নিইনি সার। রনিও আপনার কাছে প্রাইভেট পড়ে না, আমিও পড়ি না। তাহলে প্রাইভেট না পড়লে আপনি যদি রনিকে কম মার্ক দেন তাহলে তো আমাকেও কম মার্ক দিবেন।

রনিও জুয়েলের দলে যোগ দিল, জুয়েল ঠিকই বলেছে স্যার আপনি যদি প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেন তাহলে কিন্তু আমরাও ছাড়বো না।

মাহবুব সাহেব রেগে গেলেন, কী এতবড় কথা, কী করবি তোরা?

রনি, জুয়েল দু’জনে বলল, আমরা এগুলো ভয় পাই না স্যার। আপনি আমাদের ওপর এমন অন্যায় করলে আমরাও আপনাকে দেখে ছাড়বো।

মাহবুব সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, জুয়েল তুই কিন্তু ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন মানে দলনেতা। ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা তোকে ফলো করবে আর তুই যদি এমন কথা বলিস তবে সবাই তো আরো মাথায় উঠবে।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা খারাপ কিছু না স্যার। আমার মতে এটা সবার করা উচিত, আমিও করবো এবং সব ছাত্রছাত্রীরা আমাকে সাপোর্ট করবে।

আজ তোরা আমার পড়ার মুডটাই নষ্ট করে দিলি। শিক্ষককে সম্মান দিতে শেখ, শিক্ষকের দোয়া ছাড়া কোনো ছাত্র-ছাত্রী বড় হতে পারে না, বলে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে মাহবুব সাহেব ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

 

দুই

 

কফিলউদ্দীনের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে ডলার খুব একটা ভালো ছাত্র ছিল না। কৈশোরে এক দুরন্ত বালক ছিল ডলার। এস.এস.সি পাস করে যখন সে কলেজে ভর্তি হলো তখন পড়াশোনাটা ছিল যেন নামমাত্র। মিছিল-মিটিং, আলোচনা সভা, সংবর্ধনা এ সবই ছিল যেন তার ক্লাসের পাঠ্য বিষয়। পুথিগত বিদ্যায় ভালো না হলেও রাজনীতিটা সে ভালোভাবে রপ্ত করেছে। ছাত্রজীবনেই যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিত তখন ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে তার বক্তৃতা শুনতো। রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে কিংবা কোনো রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে যখন সে বক্তৃতা দিতো তখন ফাঁকা রাস্তাতেও মানুষের জট বেঁধে যেত।

ডলার কলেজ থেকে কোনো রকমে বি.এ পাস করল। লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটল সে পর্যন্তই কিন্তু লেখাপড়ার জন্য কলেজে গিয়ে বাই প্রডাক্ট হিসেবে রাজনীতির যে বিদ্যাটা অর্জন করল সেটাই হলো তার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। একসময় জনগণের কল্যাণে মানুষ রাজনীতি করতো, রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের সহায়-সম্পত্তি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছে এমন নজিরও আছে অহরহ কিন্তু রাজনীতি এখন পেশা। সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারা আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে পারার এই যোগ্যতার জোরে ডলার অতিদ্রুত রাজনীতিতে নিজের স্থান করে নিল। শুধু রাজনীতি নয়, ডলার অর্থনীতিতেও বেশ পাকা। ছোটবেলা মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসতো, রাজনীতিতে ঢুকে ব্যবসার অভিজ্ঞতাটুকু কাজে লাগিয়ে ডলার এখন অনেক টাকা-পয়সার মালিক। পুত্রের পরিচয়ে কফিলউদ্দীনও এখন পরিচিত নাম। গত বছর সে হজ করে এসেছে। মাথায় টুপি, সাদা ধবধবে দাড়ি, হাতে সবসময় একটা তাসবিহ থাকে। বিকেলবেলা এবং মাগরিবের পরে দোকানে একটু বসে, সুযোগ পেলে ব্যবসা দেখাশুনার পাশাপাশি মানুষকে ধর্মের পথে আসার আহ্বান জানায়।

কফিলউদ্দীনের একমাত্র মেয়ে রিনি। রিনি লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছাত্রী ছিল না। এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পাস করে কোনোভাবে মেডিক্যালে অ্যাডমিশন টেস্ট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। রিনি এডমিশনের আগে তেমন কোচিংও করেনি কিন্তু সে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেল।

কয়েক বছর আগেও মেডিক্যালে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট ছিল। রিনির মেডিক্যালে ভর্তির বিষয়টিও মানুষের মনে নানান প্রশ্ন দেখা দিল। কফিলউদ্দীনকে অনেকেই এরকম প্রশ্ন করেছে কিন্তু কফিলউদ্দীন ধমক দিয়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছে। অনেকের ধারণা সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে রিনি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ করে নিয়েছে।

মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে রিনি পড়ালেখার পাশাপাশি বড় ভাই ডলারের মতো রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। সে ছাত্রাবস্থায় সারাদিন ক্ষমতাসীন দলের মেডিক্যাল কলেজ শাখার মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেছে। দিন-রাত ছুটে বেড়িয়েছে রাজনীতি নিয়ে, এমনিতে ছাত্রী হিসেবে তেমন মেধাবী ছিল না তার ওপর রাজনীতি নিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে পরীক্ষায় বার বার ফেল করছে। তার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলাটি এখনো সি.আই.ডি’তে তদন্তাধীন আছে। সেই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে রিনির ছাত্রত্ব বাতিল এবং প্রশ্নপত্র কেনার অর্থের যোগানদাতা হিসেবে ডলারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় শাস্তিও হতে পারে।

সবার ছোট টিটু। ছোটবেলা থেকে টিটু অতি আদুরে এবং অর্থবিত্তের মাঝে বড় হয়েছে। টিটুর জন্ম হয়েছে কফিলউদ্দীনের সুদিনে, যখন তার ব্যবসায় উন্নতি শুরু হয়েছে আর যখন তার ছেলে ডলার হাতে আলাদীনের চেরাগ পেয়েছে সেসময়। টিটু ক্লাসে তেমন মনোযোগী না, তার পুরো লেখাপড়া-ই প্রাইভেট কোচিং নির্ভর। টিটুকে বাসায় প্রতিদিন প্রাইভেট পড়াতে আসে অনেকগুলো শিক্ষক, বলা যায় তাদের বাসায় বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক পড়াতে আসে। যদিও আজকাল বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর পড়ালেখা কোচিং নির্ভর এবং টিটু বাসায় প্রাইভেট পড়ার পাশাপাশি কোচিং সেন্টারে যায়।

মহাজ্ঞানী মাহজন যে পথে করে গমন হয়েছেন চিরস্মরণীয়, কবিতার এই পংক্তির মতো টিটু মহাজ্ঞানী ডলার আর রিনি’র পথ অনুসরণ করেছে। লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ না হলেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা ডলার এবং রিনি’র মতোই। পথটাও তাদের মতো কীভাবে খুব সহজে, বিনা পরিশ্রমে ডাক্তার হওয়া যায়। তাই সেও বসে আছে রিনি’র মতো কোনোরকমে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পাস করে মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার আশায়।

বিকেলবেলা মাহবুব সাহেবের বাসায় কোচিং ক্লাস চলছে। মাঝারি সাইজের একটা রুমে কয়েকটা বেঞ্চে ঠাসাঠাসি করে অনেকগুলো ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস করছে। এটাকে কোচিং সেন্টার বললে ভুল হবে, স্কুলের ক্লাসে পড়ানোর সময় একটা বেঞ্চে তিনজন বসে, সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে পড়ালেখা করতে পারে কিন্তু এখানে সেটাও খুব কষ্ট করে সম্ভব। রুম ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী, পিছনে আর বেঞ্চ বসানোর জায়গাও নেই, তবুও নতুন কোনো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে চাইলে মাহবুব সাহেবের না নেই। তাকেও ভর্তি করে নিয়ে এই চাপাচাপির মাঝে বসিয়ে দিবেন।

কোচিং ক্লাসের শুরুতে মাহবুব সাহেব সবার কাছে একটা করে নোট সিট দিলেন তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, কেউ নোট সিট না পেলে হাত তোল।

কেউ হাত তুললো না। মাহবুব সাহেব বললেন, তাহলে সবাই পাইছিস। এখন সবাই ক্লাসে মনোযোগ দে। ক্লাস শেষে সিটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য তোদের সময় দেয়া হবে। তারপর যদি না বুঝিস তবে আবারো বুঝিয়ে দিব কিন্তু আমার পড়ানোর সময় কেউ কথা বলবি না।

মাহবুব সাহেব পড়াতে শুরু করলেন, কিছুক্ষণ পর দরজায় একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো।

মাহবুব সাহেব পড়া বন্ধ করে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ছেলেটি সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, তুই? কী যেন নাম?

স্যার আমার নাম রাতুল, ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার বাবা, বলে রাতুল তার বাবার সঙ্গে পরিচয় করে দিল।

রাতুলের বাবা সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, বলেন? বলে মাহবুব সাহেব রাতুলের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন।

রাতুলকে আপনার এখানে দিব, কথা বলতে বলতে রাতুলের বাবা ক্লাসের দিকে একবার উঁকি মেরে দেখলো।

মাহবুব সাহেব বললেন, দিন, কোনো সমস্যা নেই।

এই ব্যাচে তো মনে হয় ফাঁকা নেই?

আছে, আছে। অন্য ব্যাচগুলোতে আরো বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়ে, এই ব্যাচে কম।

কিন্তু আমি তো দেখলাম এখানে ছাত্রছাত্রীরা চাপাচাপি করে পড়ছে। রাতুল ভর্তি হলে কোথায় বসবে?

মাহবুব সাহেব কিছুটা রেগে গেলেন, আমার এখানে পড়লে এরকম চাপাচাপি করেই পড়তে হবে। এই শহরে আমার একটা সুনাম আছে। তাই সবাই এখানে চাপচাপি করে পড়তে আসে এবং সবাই ভালো রেজাল্ট করে। আপনি আসলে আসবেন, না আসলে না আসবেন। সিদ্ধান্ত আপনার, বলে মাহবুব সাহেব কয়েকমুহূর্ত রাতুলের বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি না হয় সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে আসুন। আমার পড়ানোর সময় নষ্ট হচ্ছে।

রাতুল তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা আমি এই স্যারের কাছে পড়বো না।

ঠিক বলছিস, এখানে পড়ার দরকার নেই। চল তোকে আমি অন্য স্যারের কাছে দিব।

কোচিং ক্লাস শেষ হতে হতে শহরে সন্ধ্যা নেমেছে। ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে ক্লাস থেকে বের হলো। টিটু সবার আগে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো। পিছনে মৃদুল আর মুকুল। তাদের পিছনে মেয়েদের দলে তিশা, মনি, সুবর্ণা। টিটু মৃদুলকে জিজ্ঞেস করল, মেলায় যাবি?

মৃদুল টিটুর কথা বুঝতে পারেনি, সে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

মেলায়।

না রে, সামনে পরীক্ষা। পড়ালেখা করতে হবে।

লেখাপড়া করবি। মেলায় তো আর সারারাত থাকবি না।

না রে আমি যাবো না।

টিটু কিছুটা নিরাশ হয়ে বলল, মুকুল তুই যাবি?

মুকুল আমতা আমতা করছিল এমন সময় পিছন থেকে মেয়েদের দল এগিয়ে এলো। তিশা টিটুকে জিজ্ঞেস করল, কী রে টিটু মেলায় যাচ্ছিস?

টিটু অসহায়ের মতো মুকুলকে অনুরোধ করল, এই মুকুল চল না রে। একা যেতে ভালো লাগছে না তাই তোদের বলছি।

তিশা টিপ্পনী কেটে বলল, সবাইকে বললি আমাদের তো একবার বললি না, মনি, আমি, সুবর্ণা আমরা সবাই তো শুধু দেখছি তুই একবার বললেই চলে যাই।

টিটু উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল, যাবি, চল। খুব মজা হবে।

এখন কী আর কেউ যায়, তুই তো আমাদের আগে বলিসনি। বললে আমরা যেতাম তাই না রে বলে মনি, তিশার শেষের কথাগুলো বায়নার মত শোনাল।

মনি একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, তা তো যেতামই।

সুবর্ণাও মনির সঙ্গে সুর মিলাল।

ইয়ার্কি করলি। ঠিক আছে। এই মুকুল চল। তাড়াতাড়ি ফিরব।

তিশা বলল, তোরা যা না রে, আমাদের না হয় বলেনি তোদের তো অনেকবার করে বলেছে। আহা রে বেচারা!

যাবো, বলে মুকুল সবার দিকে তাকালো।

আরে যা একটা দিনই তো সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবি। আমাকে বললে তো আমিও যেতাম। যাক এই যাত্রায় তো আর যাওয়া হলো না। আবার সুযোগ হলে আমরাও যাবো, তাই না রে, বলে তিশা মনি আর সুবর্ণার দিকে তাকালো।

মনি, সুবর্ণা তিশার সঙ্গে সুর মিলাল।

টিটু বলল, চল।

সবাই গেট দিয়ে বের হয়ে যার যার মতো চলে গেল। রনি আর মুকুল টিটুর সঙ্গে মেলায় চলে গেল।

 

তিন

 

বাণিজ্য মেলার গেটে ভিড় জমেছে, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের লম্বা লাইন, টিকেট কাউন্টারের সামনেও দীর্ঘ লাইন। নারী পুরুষের আলাদা আলাদা লাইন, তুলনামূলকভাবে নারীদের লাইন কম লম্বা। টিটু লাইনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলল, এজন্য বলছিলাম মনি, সুবর্ণা, তিশা কেউ এলে কত সহজে আমরা টিকেট কাটতে পারতাম।

তাই বলে কি ওদের বাবা-মা আসতে দিবে? আমার আসার কথা জানলে তো বাবা আসতেই দিত না, মুকুল বলল।

আসতে দিবে না কেনো? মেয়ে বলে?

হ্যাঁ।

শোন, তুই তো ভালো ছাত্র। একটা কথা বল দেখি স্টুডেন্ট মানে কী?

মুকুল বলল, ছাত্র।

তাহলে দেখ ইংরেজিতে কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীর আলাদা কোনো মানে নেই। আসলে কী হতো, হাজার হলেও আমরা তো ফ্রেন্ড। আচ্ছা তোর বাবা-মা তোকে আসতে দিত না কেনো? তুই তো মেয়ে না, ছেলে।

লাইনের কয়েকজন লোক এগিয়ে গেল। মুকুল বলল, একটু আগা।

হঠাৎ করে টিটুর চোখে পড়ল অন্য। অন্য একা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য টিটুর ক্লাস ফ্রেন্ড না, এলাকার ফ্রেন্ড, সে অন্য স্কুলে পড়ে। টিটু জোরে চিৎকার করে ডাক দিলো, এই অন্য।

অন্য লাইনের কাছে এলো, মেলায় ঢুকবি?

হ্যাঁ। তুই এখানে? গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কী করছিস?

আমার এক ফ্রেন্ড আসার কথা, ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছি অন্য বলল।

আরে আমার সঙ্গে আয়, একসঙ্গে ঢুকি।

অন্য পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করছিল, টিটু নিষেধ করল, আরে বেটা আমার সঙ্গে মেলায় ঢুকবি, তোকে কি টাকা দিয়ে ঢুকতে হবে? আমাকে চিনিস না? আমি তোর জন্য টিকেট কাটছি।

অন্য মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।

টিটু অন্যর সঙ্গে মুকুলের পরিচয় করে দিলো।

প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল টিকেট কাটতে তারপর টিকেট নিয়ে তিনজনে ভিতরে ঢুকলো। অন্য আর মুকুল ডান দিকে একের পর এক স্টল দেখতে দেখতে একটা শার্ট-প্যান্টের স্টলে ঢুকলো। হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকা শার্ট দেখতে দেখতে মুকুল একটা শার্ট পছন্দ করল।

টিটু জিজ্ঞেস করল, কী রে নিবি?

মুকুল অসহায়ের মতো মুখ তুলে বলল, নিব কিন্তু টাকা নিয়ে আসিনি রে। আগে থেকে জানলে টাকা নিয়ে আসতাম।

টিটু শার্টের গায়ে লিখে রাখা মূল্য দেখে বলল, চারশ টাকা মাত্র।

মুকুল জিজ্ঞেস করল, টিটু তোর কাছে টাকা আছে?

টিটু মুখ কিছুটা মলিন করে বলল, টাকা আছে কিন্তু…

অন্য আগ বাড়িয়ে বলল, কিন্তু কী, দিয়ে দে, তোদের কি টাকার অভাব বেটা।

আচ্ছা। আগে গোটা মেলাটা ঘুরে দেখি। যাওয়ার সময় কিনে নিয়ে যাবো।

মুকুল কিছুটা করুণ সুরে বলল, ততক্ষণ থাকবে? কেউ যদি নিয়ে যায়?

টিটু স্টলের একজন সেলসম্যানকে বলল, আঙ্কেল, এই শার্টটা রেখে দিন তো যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো।

সেলসম্যান বলল, এভাবে তো রাখা যাবে না আঙ্কেল। তাহলে কিছু টাকা এডভান্স দেন।

টিটু পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল, এটা রাখেন, যাওয়ার সময় বাকি টাকা দিয়ে নিয়ে যাবো।

সেলসম্যান টাকাটা রেখে বলল, ওকে আঙ্কেল।

শার্টের স্টল থেকে বেরিয়ে সবাই একে একে মেলার আরো কয়েকটা স্টলে ঢুকলো টিটু অন্য আর মুকুলকে বার বার তাড়া করল। অন্য আর মুকুল বুঝতে পারল না কেন টিটু তাড়া করছে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মেলার স্টলগুলোতে, মাঠে এবং উঁচু টাওয়ারের সুন্দর, সুসজ্জিত আলোগুলো এক অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে।

মুকুল টিটুকে বলল, এই টিটু চল, দেখা তো হলো এবার বের হই সবাই।

এখনো তো আসল জায়গায় গেলাম না দোস্ত, তোদের জন্য সারপ্রাইজ আছে, টিটু বলল।

মুকুল বোকা বোকা দৃষ্টিতে টিটুর মুখের দিকে তাকালো, সারপ্রাইজ!

অন্য টিটুর কানে কানে কী যেন বলল মুকুল শুনতে পেলো না, টিটু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই অন্যর মুখ উজ্জ্বল হলো।

হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি চল, বলে টিটু আর মুকুলকে একরকম টেনে নিয়ে গেল।

ততক্ষণে খেলা শুরু হয়ে গেছে। গোল হয়ে বিভিন্ন বয়সের লোকেরা ঘিরে ধরেছে একটা ঘড়ির ডায়ালের মতো দাগ দেয়া বোর্ডকে কেন্দ্র করে। ওপরে একটা কাঁটা, ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতোই। একজন লোক জোরে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে প্রলুদ্ধ করছে আর চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজনদের মধ্যে কেউ বলছে, দু’শ, কেউ বলছে তিনশ আবার কেউ বলছে, পাঁচশ।

এবার লোকটি কাঁটাটা হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিল। প্রায় মিনিট দু’য়েক কাঁটাটা ঘুরে এক জায়গায় স্থির হলো। টিটুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, মধ্যবয়সী একজন লোক পাঁচশ টাকা একটা কাঁটার কাছে রেখেছিল, সে জয়ী হলো বোর্ডের সব টাকা পেলো। টিটু সেই লোকটির দিকে তাকালো, লোকটি একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, পাঁচশ টাকায় পাঁচ হাজার টাকা, অনেক লাভ। তুমি খেলবা?

হ্যাঁ খেলব তো। কত ধরব, বলে টিটু অন্য আর মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এই অন্য, মুকুল কত ধরব?

মুকুল বলল, এসব খেলিস না টিটু, টাকা চলে যাবে।

অন্য বলল, এটা ভাগ্য আসলে আসতে পারে, গেলে যেতে পারে। প্রথম বার একটু কম করে ধর।

টিটু কারো কথা গায়ে মাখল না, আরে না, তোরা তো সবসময় ভয় পাস, ভীরু কোথাকার। আমি এক হাজার ধরব। গেলে যাবে বলে টিটু চিৎকার করে বলল, এক হাজার।

মুকুল অবাক ভঙ্গিতে বলল, এক হাজার ধরলি। এক হাজার তো অনেক টাকা। যদি চলে যায়?

গেলে যাবে। এক হাজার টাকাই তো। এক হাজার কোনো টাকা হলো।

মুকুল কিছু বলল না।

একে একে অনেকেই টাকা দিল, কয়েক মিনিটের মধ্যে টাকায় বোর্ড ভরে গেল। টিটু অন্য আর মুকুলকে বলল, তোরা দোয়া করিস দোস্ত, জিতে গেলে তোদের বিরিয়ানি খাওয়াব।

কাঁটা ঘুরানো হলো। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে।

কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে অন্য জায়গায় থামলো। টিটুর টাকা চলে গেল।

মুকুল বলল, দেখলি, আমি বলেছিলাম না টাকা চলে যাবে। এবার হলো তো।

টিটু বলল, তুই থাম। আমি আগেও খেলেছি এরকম হয়। এবার বেশি করে ধরলে লাভসহ আগেরটাও উঠে আসবে দেখিস।

মুকুল বলল, আর যদি সবগুলো চলে যায়?

যাবে না। এটা খেলার ধর্ম, একবার গেলে একবার আসবে, বলে টিটু এবার দু’হাজার টাকা ধরলো।

এবার কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে টিটুর টাকার কাছে এসে দাঁড়ালো।

এবার টিটু অনেক টাকা বেশি পেল। মুকুল টিটুকে বলল, টিটু জিতেছিস তো এবার চল। আর ধরিস না, ধরলে সব চলে যাবে।

টিটু কিছুটা রাগের সুরে বলল, তোরা এমন করিস না তো। দেখিস এবার আরো বেশি লাভ হবে।

মুকুল বলল, কথায় আছে অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। আর দরকার নেই চল। অনেক রাত হয়েও যাচ্ছে, বাবা রাগ করবে।

তাহলে এবার বেশি করে ধরি। এবার যদি অনেক টাকা আসে তবে চলে যাবো।

টিটুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী লম্বা লোকটি টিটুকে উৎসাহ দিল, আঙ্কেল তোমার কিন্তু রাশি ফিরেছে এখন খেলো, দেখবে তোমার এখন টাকা শুধু আসতেই থাকবে। রাশি ফিরলে যদি খেলা ছেড়ে দাও তাহলে রাশি কেটে যায় আর কোনোদিন জিততে পারবে না। তারচেয়ে খেলে যাও।

টিটু তার হাতে থাকা সব টাকা ধরলো।

টিটু হেরে গেল। পুরো টাকা-ই চলে গেল।

মুকুল কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল, তোকে বলেছিলাম না, ধরিস না চল। এবার গেল তো।

পাশের সেই লোকটি আবার বলল, জুয়া এরকমই। আবার ধরো দেখবে চলে আসবে।

মুকুল নিষেধ করল কিন্তু টিটু শুনলো না। সে খেলার নেশায় পড়েছে। সে পকেট থেকে আরো পাঁচ হাজার টাকা বের করে ধরলো।

এবারও টিটুর সব টাকা চলে গেল। টিটুর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে অসহায়ের মতো মুকুল আর অন্যর দিকে তাকালো। মুকুল বলল, তোকে এতো করে বললাম চল, তুই গেলি না। এখন চল।

অন্য বলল, একটু কম করে ধরলেও অনেকক্ষণ খেলতে পারতিস। বাদ দে চল যাই।

সেই মধ্যবয়সী লোকটি বলল, আঙ্কেল আবার আসো, দেখবা হারতে হারতে জিতবা।

টিটু সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, আচ্ছা।

মুকুল বলল, কান ধরে তওবা কর আর কখনো এগুলো খেলবি না।

টিটু কোনো কথা বলল না। মুকুল জিজ্ঞেস করল, টিটু তোর কাছে আর টাকা আছে?

টিটু রাগান্বিত স্বরে বলল, আমার কাছে আর টাকা কই থাকলো, তোরা দেখলি না সব টাকা চলে গেল। আচ্ছা এক কাজ করি, আপুকে ফোন করি, বিকাশে টাকা পাঠালে আমি তোর শার্ট কিনে দিব আর আবার…

মুকুল আঁতকে উঠল, আবার খেলবি…

এমন সময় মুকুলের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মুকুল মোবাইল ফোন বের করে স্ক্রিনে তার বাবা ফোন করেছে দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। সে আপনমনে বলল, বাবা ফোন করেছে। এই শেষ, এখন কী বলবো।

মুকুল ফোন রিসিভ করল না, সে ভেবেছিল বাবা আর ফোন করবে না কিন্তু তার বাবা আবার ফোন করল। মুকুল ভয়ে ভয়ে বাবার ফোন রিসিভ করল, হ্যালো বাবা।

মুকুলের বাবার গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, কোথায় তুই?

মুকুল বাবার কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, বাবা।

মুকুল তুই কোথায়?

বাবা আমি, বাবা।

কী হলো বাবা করছিস কেনো? আমাকে না বলে কোথায় গেছিস?

বাবা।

তাড়াতাড়ি বাসায় আয়, আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন বলে মুকুলকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল।

ততক্ষণে টিটু অন্যর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে তার আপুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। মুকুল টিটুর কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে। টিটু বলল, আপু আমার একটা প্রবলেম হয়েছে?

অপর পাশ থেকে রিনির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কী প্রবলেম হলো ভাই?

আপু আমার কিছু টাকা লাগবে।

আগে বলবি তো কী প্রবলেম?

আমি পরে বলবো আপু, আগে তুমি আমাকে বিকাশে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও।

আচ্ছা। তোর বিকাশ নাম্বার দে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এটাই আমার বিকাশ নাম্বার আপু।

আচ্ছা।

টিটু বায়নার সুরে বলল, আপু।

কী হলো আবার?

আপু বাবাকে যেন বলো না।

আচ্ছা। বলবো না কিন্তু পরে আমাকে বলিস হঠাৎ তোর কী প্রবলেম হলো।

ওকে আপু।

মুকুল টিটুর কাছে এলো, চল।

টিটু বলল, কোথায় যাবি?

বাসায়।

টিটু কিছুটা ধমকের সুরে বলল, আরে থাম, যাবিই তো।

সরি দোস্ত, তোরা থাকতে পারিস আমি আর থাকবো না।

টিটু বলল, আরেকটু থাক। আমরা শার্ট নিয়েই যাবো।

মুকুল কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, আমার শার্ট লাগবে না, তোরা থাক আমি গেলাম বলে মুকুল হন হন করে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

অন্য টিটুকে বলল, দোস্ত বাদ দে। আবার অন্যদিন আসিস।

টিটুর মোবাইল ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। সে একটা মুচকি হাসি হেসে মুকুলকে বলল, টাকা এসেছে চল আবার।

অন্যর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করল, হ্যালো। এতক্ষণে তোর সময় হলো।

না, এখনো সময় হয়নি আমি যেতে পারছি না তাই তোকে ফোন দিলাম।

অন্য কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, সেটা তুই এতক্ষণ পর বলবি।

টিটু জিজ্ঞেস করল, কে?

আমার সেই ফ্রেন্ড, মনির। বেটা এতক্ষণ পর বলছে আসতে পারবে না। আচ্ছা টিটু আমি আর থাকতে পারছি না দোস্ত, চল বের হই।

টিটু অন্যর হাত চেপে ধরে বলল, দোস্ত একটু সময় দে। আচ্ছা তুই যখন বলছিস তো বড় চাইল দিবো, আসলে আসবে না, আসলে না আসবে। একটা চাইল দোস্ত।

অন্য আর কিছু বলল না।

টিটু বলল, হার জিৎ যা-ই হোক, একটা চাইল দিয়ে মামা হোটেলে বিরিয়ানি খেয়ে চলে যাবো।

টিটু এবার সত্যি সত্যি পুরো পাঁচ হাজার টাকা ধরলো আর সব টাকা চলে গেল।

আজকে ভাগ্যটাই খারাপ, বাদ দে, এটা ভাগ্যের ব্যাপার। একদিন গেছে আরেকদিন আসবে বলে দু’জনে গেটের দিকে পা বাড়ালো।

মেলার গেট থেকে বের হয়ে টিটু অন্যকে জিজ্ঞেস করল, তোর কাছে টাকা আছে?

কত?

এই রিকশা ভাড়া।

আমার কাছে তো টাকা আছে কিন্তু তুই যে আমাকে বিরিয়ানি খাওয়াতে চাইলি।

টিটু অনুনয়ের সঙ্গে বলল, আজকে না দোস্ত, আরেকদিন।

আছে।

চার

 

মুকুল মা-বাবা’র একমাত্র সন্তান, বাবা আমিনুল অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। একসময় তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। এখন কিছু নেই বললেই চলে, পৈত্রিক সুত্রে পাহাড়পুরে পাওয়া তিন শতক জমির ওপর একটা সেমিপাকা বাসায় বসবাস করে। প্রতিদিন সকালবেলা অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে যায়, সময়-সুযোগ পেলে দুপুরে বাসায় আসে আর নয়তো একেবারে রাতে চলে আসে। সারাদিনে কয়েকবার ফোন করে স্ত্রী মোসলিমার কাছে মুকুলের খোঁজখবর নেয়। আজ বিকেলবেলা আমিনুল ফোন করেনি, সন্ধ্যায় যখন শুনেছে মুকুল কোচিং থেকে বাসায় ফিরেনি তখন থেকে কয়েকবার ফোন করেছে, মুকুলকেও ফোন করেছে। মুকুলের কাছে বাইরে থাকার কথা শুনে তখনই ভাড়া ছেড়ে বাসায় ফিরেছে।

বাসায় ফেরার পর থেকে আমিনুল বারান্দায় পায়চারি করছে আর স্ত্রী মোসলিমার সাথে বিড়বিড় করে বকাবকি করছে, তোমাকে এত করে বলি ছেলের দিকে একটু লক্ষ্য রাখো, আমাদের একমাত্র সন্তান, আমাদের সারাজীবনের সম্পদ তো ঐ একজনই। যেমন করেই হোকে ওকে আমাদের মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। না, আমার কোনো কথা তোমরা কেউ-ই শুনবে না, না ছেলে, না মা। সারাদিন তোমার কাজটা কী শুনি।

প্রতিদিন এসব কথা শুনতে শুনতে মোসলিমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এখন সে যথাসাধ্য ছেলের দেখাশুনা করে আর আমিনুল এসব কথায় কোনো গুরুত্ব দেয় না। আমিনুল বলতে থাকে আর মোসলিমা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। কখনো কখনো মৃদু প্রতিবাদ করে, তুমি অযথা আমাকে দোষ দিও না তো। আমি কি ওর সঙ্গে স্কুলে কিংবা কোচিংয়ে যাই নাকি, ছেলেটা এখন বুঝতে শিখেছে, হারিয়ে যাওয়ার তো আর বয়স নেই। তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছে তবুও এত টেনশন কীসের। তুমি খুব অস্থির প্রকৃতির মানুষ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি অস্থির প্রকৃতির আর তুমি খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ। সেজন্য তো ছেলেটা ঠিক সময়ে কোচিং থেকে বাসায় ফিরল না তবুও তুমি একবার ফোন করে খবর নিলে না।

তোমাকেও নিতে হবে না। কথা হয়েছে এখন চুপ করে গিয়ে বসে থাক, দেখ ছেলে ঠিকই চলে আসবে।

আমিনুল পায়চারি করতে করতে আবার ফোন করল, হ্যালো।

বাবা।

কোথায়?

বাবা ষষ্টিতলা পার হলাম।

তাড়াতাড়ি আয়, আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন।

মোসলিমা জানে আমিনুল সহজে রেগে যায় না কিন্তু একবার রেগে গেলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলে তখন সে তার শ্বশুরকে ডাক দেয়। আমিনুল কম শিক্ষিত মানুষ হলেও বাবাকে এখনো খুব সম্মান করে। বাবার ওপর কোনো কথা বলে না। তাই মোসলিমা আমিনুলের এই রাগ থেকে মুকুলকে বাঁচানোর জন্য বাথরুমে গিয়ে মোবাইল ফোনে ফিসফিস করে তার শ্বশুরকে ডাক দিল।

পাশাপাশি বাসা। মুকুল এখনো বাসা থেকে ফিরেনি আর আমিনুল তাকে শাসন করার জন্য অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে শুনে মোসলিমার শ্বশুর আজাহার এলো। আজাহার নীতিবান মানুষ। সরকারি চাকরি করতো, কয়েক বছর আগে রিটায়ার্ড করেছে। রিটায়ার্ডের পর প্রতি মাসে পেনশনের যে সামান্য টাকা পায় তা দিয়ে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। আজাহারের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে অনেকদিন আগে, একমাত্র ছেলে আমিনুল লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি। প্রথমে বাহাদুর বাজারে একটা মুদির দোকান করেছিল কিন্তু সেটা চালাতে পারেনি তারপর একটা অটোরিকশা কিনে নিজেই চালিয়ে এক সন্তান মুকুল আর স্বামী-স্ত্রী নিয়ে কোনোরকমে দিন যাপন করে।

মুকুলই এখন এই পরিবারের স্বপ্ন। তাই সবাই মুকুলের লেখাপড়ার প্রতি বেশ যত্নবান। মুকুল বাসায় ফিরেনি শুনে আজাহারেরও রাগ হয়েছে কিন্তু এই মুহূর্তে সে মুকুলকে শাসন করতে চায় না, সে চায় মুকুলকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে লেখাপড়ায় মনোযোগী করতে। আজাহার কলিং বেলে টিপ দিতেই মোসলিমা দরজা খুলে দিয়ে সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম আব্বা।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ বউমা তোমরা?

জি আব্বা ভালো।

আমিনুল মনে করেছিল হয়তো মুকুল এসেছে কিন্তু বাবাকে দেখে সে কিছুটা অবাক হলো, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস আমিন?

ভালো বাবা, বলে আমিনুল পায়চারি বন্ধ করল।

মোসলিমা বারান্দায় রাখা চেয়ার ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিয়ে বলল, বসেন আব্বা।

আজাহার কিছু না জানার ভান করে একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মুকুল কোথায় বউমা?

মোসলিমা মৃদু কণ্ঠে বলল, আসছে আব্বা।

আমিনুল একটা চেয়ারে বসে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কথায় বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।

আজাহার ভ্রুকুঞ্চিত করে বলল, কেনো আবার কী হলো?

ও খুব খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করছে বাবা।

মানে?

কয়েকদিন আগে আমি একদিন দেখলাম কফিলের বেটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মোসলিমা ছেলের পক্ষ নিয়ে বলল, ওরা একসঙ্গে পড়ে তাই হয়তো কোথাও দেখেছ।

আমিনুল প্রচণ্ড রেগে দাঁত কড়মড় করে বলল, তুমি কথা বলবা না, কফিলের বেটাকে তুমি চেনো? খুব খারাপ ছেলে, অল্প বয়সে খুব ইঁচড়ে পাকা হয়েছে।

আজাহার আমিনুলের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, আচ্ছা থাম, তুই বেশি রাগারাগি করিস না, আমি বুঝিয়ে বলবো এখন।

বাবা।

হ্যাঁ। আমি বলছি শাসন করার দরকার নেই। আমি এখন ওকে বুঝিয়ে বলবো। আজকালকার ছেলেরা অল্প শাসনে বিগড়ে যায়। তখন আবার রাগ করে ভালোর জায়গায় মন্দ না হয়।

কলিং বেল বেজে উঠল। মোসলিমা দরজা খুলে দিল। বাসায় ঢুকতেই তার বাবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করা চেহারা দেখে মুকুলের মুখ শুকিয়ে গেল।

আমিনুল জোরে চিৎকার করে বলল, দাঁড়া।

মুকুল কোনো কথা না বলে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

আমিনুল জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

মেলায় গেছিলাম।

কার সাথে?

বন্ধুরা মিলে।

বন্ধু মানে? আমি জানতে চাইছি এত রাত পর্যন্ত যাদের সঙ্গে তুই ঘুরে বেড়াস তারা তোর কোন বন্ধু?

টিটু আর অন্য।

আমিনুল তার বাবার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, টিটু মানে কফিলের বেটা?

মুকুল হাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

আমিনুলের রাগ আরো বেড়ে গেল, শুনছ বাবা, শুনছ।

আজাহার কয়েকমুহূর্ত মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আমিনুলকে বলল, আচ্ছা আমি দেখছি তুই একটু শান্ত হ।

আমিনুল রাগ করে বাসার বাইরে চলে গেল, যাওয়ার সময় বলে গেল তুমি আর তোমার বউমা যা ভালো বোঝ করো, আমি যদি আর কোনোদিন খারাপ কিছু দেখি তবে ওকে আমি বলে মুকুলের দিকে তাকিয়ে দাঁত কড়মড় করে বাইরে চলে গেল।

আজাহার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, যা দাদু বইয়ের ব্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে আয় বলে আজাহার বউমা বলে জোরে ডাক দিয়ে বলল, বউমা আমাদের চা খাওয়াবে, আমরা দাদুভাইসহ একসঙ্গে চা খাবো।

চা কেনো আব্বা, এখন তো ভাত খাওয়ার সময় হয়েছে, আপনারা দাদু নাতি গল্প করেন আমি টেবিলে ভাত দিচ্ছি। ততক্ষণে আপনার ছেলের রাগ কমুক, বাইরে থেকে ফিরে আসুক।

আচ্ছা বউমা।

মুকুল রুমে গেল, বইয়ের ব্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে এলো। আজাহার স্নেহের সুরে বলল, দাদু বস।

মুকুল তার দাদুর পাশে বসল।

আজাহার কথা বলতে শুরু করল, কফিলের বেটা তোর বন্ধু?

মুকুল হাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

দাদু তুই আগামী বছর মেট্রিক পাস করবি, আই.এ পাস করে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবি এটা আমাদের স্বপ্ন। আমাদের আগের পুরুষরা অনেক ধনী ছিল, শহরে তাদের অনেক নাম-ডাক ছিল। আমাদের সময় আমরা সেটা রাখতে পারিনি। এতে মন খারাপের কিছু নেই একটা বংশের তিন পুরুষ কখনো একই রকম থাকে না, উত্থান-পতন হয়। তেমনি আমাদেরও পতন হয়েছে কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম যেমন তোর সময় এসে আমরা আবার উত্থান আশা করছি।

মুকুল এতক্ষণ মাথা নিচু করে দাদুর কথা শুনছিল, এবার মাথা উঁচু করে দাদুর মুখের দিকে তাকালো। আজাহার আবার বলতে শুরু করল, আমি সেই আমলের মেট্রিক পাস ছিলাম। তাই ছোটখাটো একটা সরকারি চাকুরি বলে কিছুটা নিজেকে অবজ্ঞার সুরে বলল, পিয়নের চাকরি করতাম, বাবার টাকা-পয়সা ছিল, বাবা মনে করতো আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমার তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে কিন্তু আমার আরেক ভাই ছিল ডানপিটে প্রকৃতির বাবা বেঁচে থাকতেই সে মামলা-মোকদ্দমায় পড়ল আর বাবা সব জমিজমা বিক্রি করে তার মামলা চালালো, ফলে আমাদের সব চলে গেল বাবা বেঁচে থাকতে অথচ আমাদের চেয়ে যারা তখন গরীব ছিল তারাও লেখাপড়া শিখে, চাকরি কিংবা ব্যবসা করে অনেক বড় হয়েছে। শিক্ষার মূল্য অনেক দাদু ভাই, তাই না?

মুকুল মাথা উঁচু-নিচু করে সায় দিল।

আজাহার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস মোচন করে বলল, বাবা যদি আমাকে লেখাপড়া শেখাতো তবে আমিও বড় চাকরি করতে পারতাম কিন্তু চাকরি করলাম পিয়নের চাকরি, সরকারের ছাপোষা কর্মচারী। জীবনে কিছু করতে পারলাম না। তোর বাবাকে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু হলো না। আজ অটোরিকশা চালিয়ে খেতে হচ্ছে। তবে আমিনুলের ওপর আমার রাগ একসময় ছিল কিন্তু আমি এটা ওর ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি, ওর ওপর আমি অনেকটা খুশি শুধু তোর জন্য।

আমার জন্য?

হ্যাঁ তোর জন্য। তোকে ও খুব ভালোবাসে যেকোনো মূল্যে ও তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে চায়। তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে, শুধু ও না আমিও।

দাদুর কাছে আবেগপ্রবণ কথা শুনতে শুনতে মুকুলও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল কিছু বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো, আমি তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করব দাদু।

আমি আশা করি তুই পারবি, একদিন তুই ভালো কোনো ভার্সিটিতে চান্স পাবি, বড় সরকারি চাকরি পাবি সেদিন পত্রিকায় তোর নামে হেড লাইন হবে অটোরিকশা চালক আমিনুলের ছেলে বড় ডাক্তার হয়েছে কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।

দাদু!

হ্যাঁ। কফিলকে সবাই একজন খারাপ মানুষ হিসেবে চিনে, তার ছেলেমেয়েদের সম্পর্কেও অনেক কথা শোনা যায়। শোনা যায় তার মেয়ে নাকি টাকা দিয়ে কোয়েশ্চিন কিনে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে কিন্তু আমাদের তো টাকা নেই আর আমাদের সেরকম খায়েশও নেই। মেধা ও যোগ্যতা বলে যারা বড় হয় তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে আর যারা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করে তারা আসলে কোনোদিন বড় হতে পারে না। সমাজে মাথা নিচু করে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না বলে আজাহার মুকুলের মুখের দিকে তাকালো, তোর বাবাকে না বলে কোথায় গেছিলি দাদু?

মুকুল কোনো কথা বলল না।

আজাহার কয়েকমুহূর্ত মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।

মোসলিমা দরজা খুলে দিতেই আমিনুল এলো। সে সম্ভবত দরজায় দাঁড়িয়ে দাদু-নাতির কথার কিছু অংশ শুনতে পেয়েছিল। সে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, কোথায় আবার, মেলায়।

আজাহার আবার জিজ্ঞেস করল, মেলায় গেছিলি?

মুকুল মাথা নেড়ে সায় দিল।

আমিনুল বলল, মেলায় যাবি, কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবি তা ভালো কথা তাই বলে কফিলের বেটার সঙ্গে। কফিলের ছেলেমেয়েগুলো ভালো না, এটা কে না জানে।

মুকুল মিনমিন করে বলল, টিটু আমার ফ্রেন্ড, ও খুব ধরলো তাই গেলাম। এতে যদি আমার কোনো দোষ হয় তো আর যাবো না।

আজাহার মৃদু হেসে বলল, এই তো আমার দাদু ঠিকই বলেছে আর যাবে না।

মোসালিমা ভাতের গামলা, টেবিলে রেখে বলল, আচ্ছা হয়েছে এখন বিচার সালিস সব থাক, আগে খেয়ে নিন আব্বা।

আমিনুল রাগান্বিত স্বরে বলল, আমি যেন আর কোনোদিন কফিলের বেটার সঙ্গে তোকে মেলামেশা করতে না দেখি। আমরা গরীব মানুষ আমাদের ধান্দাবাজি করে বড় হওয়ার সুযোগ নেই, আমাদের লেখাপড়াই সব।

 

পাঁচ

 

পড়া চলছে। বাবা শিক্ষক ছেলে শিক্ষার্থী। মা-বাবা’র চেয়ে ভালো শিক্ষক আর কে হতে পারে। সন্তানের প্রথম শিক্ষক মা, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে সারাজীবন মা সন্তানকে শেখায়। হয়তো কোনো কোনো মা কম শিক্ষিত কিন্তু শিক্ষা মানে তো শুধু একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না, শিক্ষা মানে প্রাণীকে মানুষ বানানোর শিক্ষা, সারা পৃথিবীর মায়েরা এই কাজটি করে থাকেন। নেপোলিয়ান বলেছেন, ’’তোমরা আমাকে একজন মা দাও, আমি তোমাদের একটা জাতি দেবো’’।

মায়ের পরেই আসে বাবার স্থান। সেই বাবা ছেলেকে টেবিলে নিয়ে বসেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হাসান সাহেব রনিকে পড়াতে বসান। অবশ্য ছেলেকে পড়ানোর আগে নিজেকে সেসব পড়া রপ্ত করতে হয়, তাতে হাসান সাহেব অধৈর্য হন না। পুরোদস্তুর একজন ছাত্রের মতো ছেলের পড়াগুলো নিজে রপ্ত করে তারপর একে একে সব সাবজেক্ট পড়ান। প্রাইভেট টিউশনি কিংবা কোচিংয়ে তো শিক্ষকদের সময় দেয়া থাকে কিন্তু ছেলেকে পড়ানোর বেলায় তো বাবার সময়ের কোনো কমতি থাকে না।

কয়েক বছর আগের কথা তখন হাসান সাহেবের বেশ কাজের চাপ যাচ্ছিলো একবার রনিকে বাসায় এক প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে ইংরেজি পড়তে দিলেন, শিক্ষকের নাম মাহিদুল, ইংরেজির প্রাইভেট শিক্ষক হিসেবে সে দিনাজপুর শহরে বেশ পরিচিত। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের যেমন সিরিয়াল পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় তেমনি মাহিদুলের একঘণ্টা সময়ের জন্য মাসের পর মাস সময় অপেক্ষা করতে হয় কখন একটা টিউশনি শেষ হবে আর একঘণ্টা সময় ফাঁকা হবে। অবশেষে শর্তসাপেক্ষে সেই সময় পাওয়া গেল। মাহিদুল একদিন পর একদিন পড়াবে, শুক্রবার বন্ধ অর্থাৎ সপ্তাহে তিন দিন। বেতনের আলাপ-আলোচনায় হাসান সাহেব রাজি হয়ে গেলেন। রনির জন্য নির্ধারিত সময় হলো সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা।

হাসান সাহেবের ধারণা ছিল প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে দিয়ে তাকে অন্তত ইংরেজি সাবজেক্ট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না কিন্তু মাহিদুলের পড়াতে আসা-যাওয়ার সময় দেখে তিনি তার পড়ানোর ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না। প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে মাহিদুল হন্তদন্ত হয়ে, ঘেমে কাদা কাদা হয়ে দশ বারো মিনিট দেরিতে আসে আবার যাওয়ার সময় সাত থেকে দশ মিনিট আগেই বেরিয়ে যায়। হাসান সাহেব হিসেব করে দেখেছেন মাহিদুল মোটামুটি চল্লিশ মিনিটের মতো পড়ায়।

হাসান সাহেব ধৈর্য ধরে কয়েকদিন দেখলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। একদিন পড়ানো শেষ হবে এমন সময় হাসান সাহেব পড়ার টেবিলে গেলেন। মাহিদুল বিনয়ী, হাসান সাহেবকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছেন মাস্টার সাহেব? বলতে বলতে হাসান সাহেবও একটা সোফায় বসলেন।

জি ভালো আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

ভালো আছি। কেমন পড়ছে রনি?

ভালো। ও তো খুব ভালো ছাত্র। একদিন অনেক বড় হবে ইনশাআল্লাহ।

হ্যাঁ, সেজন্যই তো আপনার মতো একজন স্বনামধন্য শিক্ষককে ইংরেজি পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছি।

কথা বলতে বলতে মাহিদুল কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকালো। হাসান সাহেব কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন, বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন কেনো? আটটা পার হয়েছে?

মাহিদুল আমতা আমতা করে বলল, আরেকটা প্রাইভেট আছে তো। সকালবেলা দু’টা আর বিকেলে পাঁচটা।

সবাইকে কি একদিন বাদে বাদে পড়ান?

জি।

তার মানে মোট দশটা প্রাইভেট পড়ান?

জি।

বেশ ভালো কথা, আপনি যদি পারেন তো পড়াবেন একজন শিক্ষক যদি ভালোভাবে ছাত্রদের পড়ায়, তাহলে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত পাঁচটা প্রাইভেট পড়াতে পারা খুব সহজ কাজ না। মাথায় সমস্যা হওয়ার কথা।

আলহামদুলিল্লাহ, এখনো সমস্যা হয়নি।

মাস্টার সাহেব আপনি তো শিক্ষক মানুষ, তাই আসলে কথাটা আপনাকে বলা কেমন দেখায়।

না, না আপনি কিছু বলতে চাইলে বলেন। আমার পড়ায় যদি কোনো প্রবলেম থাকে তো আপনি অবশ্যই বলবেন।

আসলে আমি সময় দিতে পারছি না বলে অনেক আশা করি আপনার কাছে রনিকে ইংরেজি পড়াতে দিয়েছিলাম কিন্তু কয়েকদিন দেখার পর আমার মনে হলো, আপনারও সময়ের অভাব।

মাহিদুল বুঝতে পারলো, সে কিছু বলল না, মাথা নত করে বসে রইলো।

একদিন পর একদিন একঘণ্টা সময় ইংরেজি পড়ানোর জন্য যথেষ্ট না। তার ওপর আপনি আসতে দেরি আবার যেতে আগে, আধঘণ্টা পড়তে না পড়তেই যাওয়ার জন্য তাড়া পড়ে যায়।

জি আমি তো বললাম, অনেকগুলো টিউশনি তো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সময় লাগে।

মাহিদুলের ঘড়ি দেখার কারণ হাসান সাহেব আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু এতক্ষণে আরো বুঝতে পারলেন সময়ের ব্যাপারে মাহিদুল কত হিসেবি। পথে যাওয়া-আসার সময়টাও তিনি ছাত্রদের ঘাড়ে চাপান। সারাদেশের শিক্ষকরা যদি মাহিদুলের মতো সময়ের মূল্য বুঝতো আর সে অনুযায়ী ঠিকমতো স্কুলে যেতো, ক্লাস নিতো তবে দেশে প্রাইভেট টিউশনি বলে কোনো কথা থাকতো না। সন্তানের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েই নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন।

হাসান সাহেব পুরো মাসটাই ধৈর্য ধরলেন কিন্তু মাহিদুলের ওপর ভরসা রাখতে পারলেন না। মাহিদুলকে প্রাইভেট পড়াতে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেলেন না ঠিকই কিন্তু কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। আসলে কোথায় যাবে সন্তানের অভিভাবকরা? কীভাবে গড়ে তুলবে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ? অভিভাবকদের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল সন্তানদের স্কুলে পাঠানো পর্যন্তই, স্কুল পাঠানোর পর শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষক তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিন্তু শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, নৈতিক, মানবিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা তো দূরের কথা শিক্ষকদের মাঝেই মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিক্ষাদান এখন আর সেবার কাজ না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান না। শিক্ষা পণ্যের মতো বাণিজিকিকরণ হয়েছে। এমনি একটি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কীভাবে সোনার বাংলা গড়া সম্ভব?

মাস পূর্তির পর হাসান সাহেব মাহিদুলকে অব্যাহতি দিলেন। আগে থেকেই হাসান সাহেব রনিকে নিজে পড়াতেন কিন্তু মাহিদুলকে দিয়ে ভালো ফলাফল পেলে নিজেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেসুযোগ আর হলো না বরং হাসান সাহেব নিজেই প্রাইভেট কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনিকে সারাজীবনের জন্য বিদায় করলেন। সেই থেকে হাসান সাহেব নিজেই রনিকে পড়ান।

একে একে দু’টা সাবজেক্ট পড়ানো হলো তারপর হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কী সাবজেক্ট?

রনি বলল, ফিজিঙ।

বই বের কর।

রনি ডাক দিলো, বাবা।

হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বল।

রনি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আগে পড়া শেষ হোক তারপর।

প্রায় আধঘণ্টা পড়ানোর পর, আজকের মতো আর পড়া নেই বলে একটা মুচকি হাসি হেসে রনি বলল, আজকের মতো তোমার ছুটি।

হাসান সাহেব বললেন, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে, না?

রনি বই গুছাতে গুছাতে থেমে গেল, বাবা তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

বল।

আমাদের যে ফিজিক্স স্যার আছে, মাহবুব স্যার।

হ্যাঁ, কী হয়েছে মাহবুব স্যারের?

আমার মনে হয় প্রাইভেট না পড়লে মাহবুব স্যার প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দিবে।

কথাটা হাসান সাহেবের বুকে আঘাত করল, ছেলে বলে কী, প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিবে?

এতক্ষণ বাপ-বেটার মধ্যে যে ইয়ার্কি-ঠাট্টা চলছিল তা হঠাৎ করে মিইয়ে গেল। হাসান সাহেব মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলেন, হঠাৎ করে তোর একথা মনে হলো কেনো?

আজকে ক্লাসে বলেছে, আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি প্রাইভেট পড়ি কী না? আমি বললাম আমি প্রাইভেট পড়ি না, বাবার কাছে পড়ি। তখন বলল, একটা প্রাকটিক্যালের ব্যাপার-স্যাপার থাকে তো।

হাসান সাহেব রনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এটা হয়তো বলেছে কিন্তু করবে না। ক্লাসে বলা আর বাস্তবে করা এক কথা না।

রনি বলল, আমি তো কেবল নাইনে উঠলাম, ভালোভাবে খবর নিয়ে দেখি, আগে যদি কেউ প্রাইভেট না পড়লে তাকে কম মার্ক দিয়েছে তাহলে মাহবুব স্যারকে ধরতে হবে।

আচ্ছা, আগে আরো দেখ, যদি সেরকম কিছু হয় তবে গার্ডিয়ানরা সবাই মাহবুব স্যারকে বলবো।

আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে আছে জুয়েল নাম, ও আবার ক্লাস ক্যাপ্টেন ও জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার কেউ প্রাইভেট না পড়লে তাকে কি কম মার্ক দিবেন?

তারপর কী বলল জানো?

কী বলল? হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

বলল, আগে না পড়ে দেখ।

হাসান সাহেব বিশ্বাস করতে পারছেন না, না রনিকে, না নিজের কানকে, তিনি কয়েকমুহূর্ত রনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, রনি সত্যি কথা বলছে তো? নাকি আমি ভুল শুনছি? হাসান সাহেব মৃদুকণ্ঠে বললেন, আচ্ছা তুই যা, বিষয়টা আমি দেখছি।

হাসান সাহেব স্বাভাবিক হতে পারছেন না। শিক্ষক কখনো ছাত্রের অমঙ্গল চাইতে পারে? যে শিক্ষক ছাত্রদের প্রাকটিক্যাল ক্লাসে কম মার্ক দেয়ার কথা বলে ভয় দেখিয়ে প্রাইভেটে যেতে বাধ্য করে সে শিক্ষক ভালো মানুষ তৈরি করবে কীভাবে?

 

ছয়

 

জুয়েলের বাবা কৃষক, উচ্চবিত্ত কৃষক। জুয়েলকে শহরের ভালো স্কুলে লেখাপড়া করানোর জন্য শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। গ্রামে প্রচুর জমিজমা আছে, জুয়েলের বাবা জহির সাহেব মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে সেসব জমিজমার আয়-ব্যয় তদারকি করেন। উচ্চবিত্ত কৃষক হিসেবে এলাকায় তার নাম ডাক আছে। জহির সাহেবের বাবা দীর্ঘদিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, একজন ভালো রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে এলাকায় তার সুনাম ছিল কিন্তু তিনি কিছুটা একরোখা ছিলেন, কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। জুয়েল কিছুটা তার দাদার মতোই হয়েছে।

ক্লাস সিঙে জুয়েলের রোল নাম্বার ছিল ভর্তির রোল নাম্বার। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস সেভেনে প্রমোশনের সময় জুয়েলের রোল নাম্বার ছিলো চার। জুয়েলের ধারণা ছিলো রনি ফার্স্ট, মুকুল সেকেন্ড আর সে থার্ড হবে কিন্তু সে থার্ড হতে পারলো না, হলো ফোর্থ। তার আগে ঢুকে পড়ল মতি। প্রথমে জুয়েল বুঝতে পারেনি কিন্তু মতি ফোর্থ হওয়ার পর থেকে জুয়েলের মাথায় একটা বিষয় চিন্তা ঢুকলো, মতি তো আমার চেয়ে ভালো ছাত্র না, ক্লাসে স্যাররা পড়া ধরলে হয়নি স্যার, হয়নি স্যার বলে, মতি আমার আগে এলো কীভাবে?

জুয়েল কিছুটা খুঁতখুঁতে প্রকৃতির, তার মাথায় কিছু একটা ঢুকলে সেটার শেষ না দেখে সে ছাড়ে না। এই জট খুলতে তার বেশিদিন সময় লাগলো না। মতির চাচা স্কুলের কেরানি, সে আবার দুটো ক্লাস নেয়, বাংলা আর সমাজ বিজ্ঞান। এই দু’টা সাবজেক্টে মতি অনেক বেশি মার্ক পেয়েছে। যেটা রনি, মুকুলের চেয়েও অনেক বেশি।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে জুয়েল তার বাবাকে বলল, বাবা আমাদের ক্লাসে যার তিন রোল, মতি, ও কীভাবে থার্ড হয়েছে জানো?

না তো।

ওর চাচা আমাদের স্কুলের কেরানি স্যার। কেরানি স্যার আমাদের বাংলা আর সমাজবিজ্ঞান ক্লাস নেয়।

তাতে কী?

মতি বাংলা আর সমাজবিজ্ঞানে অস্বাভাবিক মার্ক পেয়েছে, ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয়ের চেয়ে বেশি।

ভালো লিখেছে তাই মার্ক বেশি পেয়েছে।

জুয়েল রেগে গেল, তুমি তো বলবাই, তাহলে অন্য সাবজেক্টগুলোতে বেশি মার্ক পেলো না কেনো?

তাহলে কি ওর চাচা ওকে নাম্বার বাড়িয়ে দিয়েছে?

অবশ্যই দিয়েছে। যে ছেলে সব সাবজেক্টে কম মার্ক পায় সে আবার বাংলা আর সমাজবিজ্ঞানে বেশি পায় কীভাবে?

তুই আরো বেশি লেখাপড়া কর, তাহলে ঐ দুই সাবজেক্টের বেশি মার্ক দিয়েও তোর চেয়ে আগাতে পারবে না।

দেখি চেষ্টা করবো তবে একটা ভালো খবর আছে।

কী খবর?

কেরানি স্যার শুধু ক্লাস সিক্স আর ক্লাস সেভেনে ক্লাস নেয়।

তাহলে তো নাইনে ওঠার সময় তুই এগিয়ে যাবি।

দেখা যাক।

সত্যি সত্যি তাই হলো। জুয়েল ক্লাস এইট থেকে নাইনে প্রমোশনের সময় মতির চেয়ে এগিয়ে এলো। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে জুয়েলের আনন্দের সীমা নেই। বাবাকে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না, মতিকে ওর চাচা মার্ক বাড়িয়ে দেয়। এবার দেখো ঠিকই পিছিয়ে পড়েছে।

ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত প্রাইভেট টিচারদের অবস্থা কিছুটা জেনারেল ফিজিশিয়ানদের মতো। জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাক্তাররা যেমন শরীরে সব অঙ্গ সম্পর্কে একটা সাধারণ জ্ঞান রাখে কিন্তু কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না তেমনি সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত প্রাইভেট পড়ানোর টিচাররা যেমন : সায়েন্সের টিচাররা অঙ্কসহ বিজ্ঞানের সব সাবজেক্ট পড়ায় আর ইংরেজি টিচার শুধু ইংরেজি পড়ায়। ক্লাস এইট পর্যন্ত ছাত্রদের পড়ানোর জন্য জেনারেল ফিজিশিয়ানদের মতো সাধারণ বিজ্ঞানের প্রাইভেট টিচার হলেই বিজ্ঞানের সব বিষয় পড়াতে পারে কিন্তু ক্লাস নাইন থেকে উপরের ক্লাসগুলোতে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ টিচার। তাই জুয়েলের আগের জেনারেল টিচারদের পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ টিচারের প্রয়োজন হলো।

জুয়েল আগে থেকেই বাসায় প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়ে, সে যখন ক্লাস নাইনে উঠল, নতুন টিচারের কাছে প্রাইভেট দেয়ার সময় হলো তখন জুয়েল তার বাবাকে বলল, বাবা এখন তো আমার নতুন প্রাইভেট টিচার লাগবে।

হ্যাঁ তাইতো। আচ্ছা তোর স্কুলের টিচারদের দিলেই তো বোধ হয় ভালো হয়, তুই কি বলিস?

না বাবা।

কেন?

স্কুলের স্যারদের কাছে পড়লে ভালো পড়াবে না, শুধু শুধু পরীক্ষার খাতা দেখার সময় মার্ক বাড়িয়ে দিবে কিন্তু আমার এস.এস.সি পরীক্ষার খাতা তো আর আমার স্কুলের স্যাররা দেখবে না, তখন তো আমার রেজাল্ট ভালো হবে না। এস.এস.স্থির রেজাল্ট ভালো না হলে অনলাইন অ্যাডমিশনে আমি ভালো কলেজে চান্স পাবো না, তখন ইন্টারেও ভালো করতে পারবো না। আমার আমও যাবে ছালাও যাবে।

জুয়েল যখন কথা বলছিল জহির সাহেব তখন জুয়েলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তার স্মৃতিতে তখন বাবার মুখটা ভেসে উঠল। তার বাবা শেষবার যখন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন তখন তার কর্মীরা কিছুটা কৌশলে তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি কারো প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। জহির সাহেবের বাবা বললেন, আমি জনপ্রতিনিধি, জনগণ আমার নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করবে। আমি তিন তিন বার চেয়ারম্যানি করেছি এখন জনগণ যদি আমাকে না চায় তবে আমি চলে যাবো। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কৌশল করে আমি চেয়ারম্যান হবো না।

পর পর তিনবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠেনি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা অন্য কোনো। এরকম নীতিবান রাজনীতিবিদ যারা সবসময় জনগণের কথা ভাবতেন, জনগণের সুখ-দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশের কথা না ভেবে দিনরাত জনগণের মঙ্গলের জন্য নিজেদের আরাম-বিরাম পর্যন্ত উৎসর্গ করতেন। এমন জনদরদি রাজনীতিবিদ এখন ডাইনোসরের মতো বিলীন প্রজাতির মানুষ।

জহির সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তাহলে আম ছালা দুটোই রক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় দেখ।

আমি মনে করছি কলেজের স্টুডেন্টদের কাছে পড়বো।

ওরা পড়াতে পারবে?

পারবে, ধরো দিনাজপুর সরকারি কলেজে যে ম্যাথে মাস্টার্স করছে তার কাছে ম্যাথ পড়বো, যে ফিজিক্স পড়ছে তার কাছে ফিজিক্স পড়বো এরকম।

এতগুলো টিচার কীভাবে জোগাড় করবি।

তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, একটা টিচার জোগাড় করতে পারলে সে তখন আরেকজনকে নিয়ে আসবে। আমি একটা একটা করে টিচার পাবো আর তোমার কাছে নিয়ে আসবো, তুমি ইন্টারভিউ নিয়ে ঠিক করবা।

জহির সাহেবের স্ত্রী মাসুমা রাতের খাবারের জন্য বাপ-বেটাকে ডাকতে এসে দু’জনের কথা শুনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল, জুয়েলের কথা শুনে শেষ পর্যন্ত হেসে ফেললো। ড্রয়িং রুমের ভিতরে এসে জুয়েলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, বুদ্ধিজীবী অনেক হইছে, আইসো বাপ-বেটা দু’জনে ভাত খাও। খাবার রেডি।

জহির সাহেব উঠলেন, তাহলে টিচার ডাকার ব্যবস্থা কর, আমি ইন্টারভিউ নিয়ে ফাইনাল করবো।

আচ্ছা।

অল্পদিনের মধ্যে ইংরেজি, ম্যাথমেটিকস, ফিজিঙ, কেমিস্ট্রি প্রাইভেট টিচার জোগাড় হলো, অবশ্য প্রাইভেট টিচার জোগাড় করল জুয়েল নিজে। সেদিন থেকে তার স্কুল আর প্রাইভেট পড়া চলছে ঠিকমতোই। কয়েকদিন আগে প্রাইভেট পড়া শেষে রাতের খাবার টেবিলে জুয়েল বলল, বাবা আমাদের স্কুলে তো অনেক বিশৃঙ্খলা।

কী রকম বিশৃঙ্খলা?

সব টিচাররা প্রাইভেট পড়ায়।

এটা আর নতুন কী, আগে থেকেও পড়ায়, সব স্কুলের টিচাররাই তো প্রাইভেট পড়ায়।

এটা ঠিক না।

কেন?

বাজারের যা অবস্থা শুধু বেতন দিয়ে সবারই চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা-পয়সা পেলে শিক্ষকদেরও দিনকাল একটু ভালো চলবে।

সরকার বেতন দেয়, যার যেমন বেতন সে সেভাবেই চলবে।

প্রাইভেট পড়ালে অনেক সমস্যা। একবার তো তুমি দেখলে মতির চাচা যতদিন ক্লাস নিতো ততদিন মতি আমার আগে ছিল যেই ওর চাচা ক্লাস নেয়া বাদ দিলো তখনই আমার রোল নাম্বার এগিয়ে এলো।

এখন আবার কোন টিচারের ভাতিজা পড়ে তোর সঙ্গে? জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

এখন তো আরো বেশি সমস্যা। যারা স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ে তারা সবাই তো এখন স্যারদের ভাতিজা, কথাটা বলতে বলতে জুয়েল রেগে লাল হয়ে গেল।

জহির সাহেব জুয়েলকে আশ্বস্‌ করার জন্য একটা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, তাতে কী তুই ভালোভাবে লেখাপড়া করলে এস.এস.স্থিতে ঠিকই ভালো করবি।

সেটাই, তাহলে ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার সময় বলিও না তোর রোল নাম্বার কোনো পিছালো।

তা হবে কেনো, তুই ভালোভাবে লেখাপড়া কর, যেন স্যাররা ওদের বেশি মার্ক দিয়েও তোকে পিছনে ফেলতে না পারে।

এই তো তোমাকে নিয়ে সমস্যা। তুমি কোনোটাই মানতে চাও না। আমার নাইন থেকে টেনে ওঠার সময় রোল নাম্বার এগিয়ে কী লাভ। তারচেয়ে আমি যদি এস.এস.স্থিতে ভালো করতে পারি সেটাই আমার লাভ। তবে তুমি একটা কথা মনে রাখো কেরানি স্যারের মতো যদি টিচাররা কাউকে আন্দাজি মার্ক বাড়িয়ে দেয় তবে আমি কিন্তু ছাড়বো না।

কী করবি?

সেটা তখন দেখা যাবে। আগে দিয়ে দেখুক।

সাত

 

গতকাল বাসায় ফিরে বাবার কাছে অপমান হয়ে মুকুল টিটুর ওপর ক্ষেপে আছে। একবার টিটুর সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু কিছু বলেনি। পর পর দু’টা ক্লাস, তৃতীয় ক্লাসের টিচার না থাকায় টিটু মুকুলের সামনে এলো, কী রে কেমন আছিস?

মুকুল রেগে গেল, কেমন আর থাকবো তোর জন্য কালকে বাবা আমাকে খুব বকাবকি করেছে।

কেন তুই তো আগেই চলে গেলি।

মুকুল ভালো ছাত্র কিন্তু খুব সহজ-সরল সে যা ভাবে তাই বলে ফেলে, তারপরও তো অনেক রাত হয়েছে। আমি আর তোর সঙ্গে কোথাও যাবো না। তুই গেলে যাবি।

আরে রাখ, বাবা-মা তো একটু বলবেই তাই বলে কি ঘরে বসে থাকবো আর দিনরাত শুধু বই আর বই নিয়ে পড়ে থাকবো।

তুই না থাকিস, আমার থাকতে হবে ভাই। তোর বাপের টাকা আছে, তুই টাকার জোরে সবকিছু পার হয়ে যাবি কিন্তু আমার তো উপায় নেই।

টিটু আর মুকুলের কথাগুলো একটু জোরে হওয়ায় সবার কানে পৌঁছালো।

সুবর্ণা বলল, এই টিটু তোরা কালকে মেলায় গেছিলি না?

টিটু কিছুটা আনন্দের সুরে বলল, হ্যাঁ গেছিলাম তো।

সুবর্ণা দূর থেকে বুঝতে পেরেছে যে টিটু আর মুকুলের মাঝে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। সে আরো ঝামেলাটাকে উস্কে দেয়ার জন্য বলল, মুকুল তুই সঙ্গে গেছিলি না?

মুকুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, তো এভাবে মুখ গোমড়া করে আছিস কেনো? মেলা থেকে এসেছিস, আনন্দ-ফূর্তিতে থাকবি, মেলা থেকে কী এনেছিস আমাদের খাওয়াবি।

মুকুল বলল, কালকে মেলায় গিয়ে অনেক রাত হয়েছে তাই বাবা আমাকে বকা দিয়েছে। আমি আর কোনোদিন টিটুর সঙ্গে কোথাও যাবো না।

সুবর্ণা মুকুলের জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘি ছিটালো, আহা রে চুক চুক চুক।

টিটু বলল, বাবা-মা বকা দিবেই, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না কিছুক্ষণ পর আবার আদর করবে, তাই না রে তিশা, তোরা কী বলিস?

তিশা বলল, টিটু একেবারে ঠিক বলেছে। তুই যতই ভালো থাকবি বাবা-মা ততই টাইড দিবে।

আরে প্রবলেমটা অন্য জায়গায়, বলে সুবর্ণা টিটুকে জিজ্ঞেস করল, এই টিটু কালকে মেলায় কী কী খেলি? আমাদের জন্য আনছিস?

মুকুল ফোঁস করে রেগে উঠল, আরে কীসের খাওয়া, তোরা কি ভাবছিস আমি পেটুক, খাওয়া পেলেই খুশি, কিছু খেলাম না শুধু বাবার বকাবকি খেলাম, এই কান ধরছি আর কোনোদিন টিটুর সঙ্গে কোথাও যাবো না বলে মুকুল সত্যি সত্যি কান ধরলো।

আচ্ছা থাক। তুই সবার সামনে আমাকে এতো কথা না শোনালেও পারতিস, তুই না গেলেও কতজন যাওয়ার জন্য রেডি আছে। খই ছিটালে কাকের অভাব।

জুয়েল টিটুর কথা প্রতিবাদ করল, এই টিটু এটা তুই কী বললি, আমরা তোর বন্ধুরা কি কাক আর তুই কি টাকা ছিটালেই আমরা সবাই খুব হুমড়ি খেয়ে পড়বো।

রনিসহ আরো কয়েকজন ছাত্র এবং ছাত্রী জুয়েলকে সমর্থন করল, না, না এটা তুই ঠিক বললি না টিটু। আমরা তোর ফ্রেন্ড, আমরা কি টাকার জন্য তোর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই?

সুবর্ণা তিরস্কারের সুরে বলল, এতো অহংকার ভালো না টিটু, আল্লাহ টাকার গরম বেশিদিন সহ্য করবে না।

জুয়েল বলল, তোকে সবার সামনে সরি বলতে হবে।

সরি বলবো আমি।

জুয়েল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুই বলবি।

জুয়েলের সঙ্গে সবাই সুর মিলিয়ে একসঙ্গে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুই সবার কাছে সরি বলবি।

এটা আর বন্ধুদের মধ্যে তেমন কী। দু’হাত জোড় করে বলবি বলে মনি নিজের দু’হাত জোড় করে বলল, এভাবে বলবি সরি বন্ধু, আমার ভুল হয়ে গেছে।

টিটুর প্রচণ্ড রেগে গেল, কী বলিস তোরা, আমাকে সরি বলতে হবে? না বললে?

জুয়েল বলল, না বললে আমরা কেউ আর তোর সঙ্গে কথা বলবো না।

টিটু প্রচণ্ড রেগে গেল, সে দাঁত কড়মড় করে বলল, এই জুয়েলের বাচ্চা জুয়েল। তুই বেশি বাড়ছিস, তোকে আমি…

রনি বলল, টিটু তুই এভাবে কথা বলতে পারিস না। তুই কেনো বলবি খই ছিটালে কাকের অভাব, আমরা কি তোর কাছ থেকে কিছু খাওয়ার জন্য বন্ধুত্ব করি নাকি। জুয়েল তো ঠিকই বলেছে আমরা সবাই জুয়েলের সঙ্গে আছি। তোকে সরি বলতে হবে।

রনির সঙ্গে সবাই বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ তোকে সরি বলতে হবে।

সুবর্ণা দেখলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে তাই সে কিছুটা হালকা করার জন্য বলল, প্রবলেম কী, বন্ধুদের সামনে সরি বললে কী হবে, তুই তো ঠিকই ভুল করেছিস।

অসম্ভব।

সুবর্ণা বলল, বল না রে, এই এভাবে বলে সুবর্ণা দু’হাত জোড় করে বলল, এভাবে, এটাকে বলে করজোড়ে।

তিশা বলল, টিটু অন্তত সরি বল।

প্রচণ্ড রেগে টিটু বলল, হোয়াট, তিশা তুইও ওদের দলে, তুই না আমার কাজিন।

তাতে কী, ভুল করলে ক্ষমা চাইতে হবে না। সবাই তো হাতজোড় করে সরি বলতে বলছে, আমি বলছি অন্তত সরি বল।

না, আমি কোনো ভুল করিনি। আমি ক্ষমা চাইবো না।

মনি তার মোবাইল ফোন তাক করে হাত দেখিয়ে বলল, এই বল, বল।

এমন সময় হঠাৎ করে হামিদুল সাহেব ঢুকলেন, এই কী হচ্ছে তোদের? গোলমাল করছিস কেনো? বস, সবাই বস।

সবাই বসে পড়ল।

হামিদুল সাহেব বললেন, আজ আমার ক্লাস ছিলো টিফিনের পরে কিন্তু আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে তাই ভাবলাম এই ফাঁকে তোদের ক্লাসটা নিয়ে নিই। তবে আজ তেমন ক্লাস নিতে পারবো না কারণ আর মাত্র কয়েক মিনিট আছে। শুধু তোদের কাছে হাজিরা দিলাম আর কী।

হামিদুল সাহেব কয়েক মিনিট ছাত্রদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে ক্লাস থেকে চলে গেলেন।

টিফিনের পরের ক্লাসগুলোতে আর টিটুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে এমনিতেই কোনো কোনোদিন টিফিনের পর ক্লাস ফাঁকি দেয়। কোনোদিন ইচ্ছে হলে স্কুলে আসে আবার কোনোদিন আসে না। কথায় বলে মাথায় পচন ধরলে শরীরের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। তেমনি পারিবারিকভাবে তাদের পচন ধরেছে। টিটুর বাবার অঢেল টাকা, ভাই রাজনীতি করে, সেও ধনবান এবং ক্ষমতাবান, তারা সবাই মনে করে টাকা হলে দুনিয়াতে সবকিছুই সম্ভব। বাবা-বড়ভাই, বড়বোন সবার ধারণা টিটুর মনেও বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছে।

স্কুলে টিটুকে না পেয়ে সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা দেখা দিলো, ক্লাসের ফাঁকে সবাই ফিসফিস করে বলতে শুরু করল, টিটু কোথায়?

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো রাতে তারা বিষয়টা নিয়ে গ্রুপে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে।

শৈশব থেকেই টিটুর মধ্যে একটা নেতাগিরি ভাব আছে। ক্লাস সিঙে ভর্তির পর নেতাগিরির ভাবটা আরো বেড়ে গেল। ক্লাসে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো যে টিটু নিজেই অঘোষিত ক্যাপ্টেন হয়ে গেল আর তাই শিক্ষকরা তাকেই ক্লাস ক্যাপ্টেন করে দিলো। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত টিটুই ক্লাস ক্যাপ্টেন রয়ে গেল। টিটুর কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারের কারণে বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সাথে তার মনোমালিন্য হতো, কেউ কেউ ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে মানতে চাইতো না। তাদের মধ্যে রনি, জুয়েল, মুকুল অন্যতম। মেয়েদের দিক থেকেও আপত্তি ছিলো কিন্তু তারা মুখ ফুটে কিছু বলতো না।

ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার পর আবার যখন ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনের সময় হলো তখন জুয়েল আর রনি বিরোধীতা করল এবং ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী জুয়েল আর রনিকে সমর্থন করল। ক্যাপ্টেন নির্বাচন থেমে গেল, খবর পেয়ে হেড মাস্টার সাহেব তার চেম্বার থেকে ক্লাস নাইনের ক্লাসে এলেন।

ক্যাপ্টেন নির্বাচনের দায়িত্ব ছিলো হামিদুল সাহেবের ওপর, তিনি হেড মাস্টার সাহেবকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিলেন। সব শুনে হেড মাস্টার সাহেব বললেন, তাহলে এবারের মতো টিটু অফ যাক, অন্যদের মধ্য থেকে কেউ হোক।

টিটু প্রতিবাদ করল, না স্যার আমি ক্যাপ্টেন হবো।

হেড মাস্টার সাহেব বললেন, তুই হতে চাইলেই তো হবে না। সবাইকে তো তোকে চাইতে হবে।

টিটু কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বলল, সবাই চায় আমি ক্যাপ্টেন হই।

এভাবে দুই পক্ষই যদি ক্যাপ্টেন হতে চায় তাহলে তো ভোট হতে হবে। কে কে ক্যান্ডিডেট হতে চায়?

জুয়েল রনি পরস্পরের মুুখের দিকে তাকালো, পিছন থেকে বন্ধুদের মধ্য থেকে সবাই জুয়েলের নাম বলল। জুয়েল ছাত্র হিসেবে মেধাবী কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে সবার ওপর মাতব্বরি করে নষ্ট করতে সে আগ্রহী না। জুয়েল কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ল। সে ক্যাপ্টেন হিসেবে টিটুকে পছন্দ করে না তার মানে এই না যে সে নিজেই ক্যাপ্টেন হতে চায় কিন্তু সবার দৃষ্টি এখন জুয়েলের দিকে। পিছন থেকে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী হৈ হৈ করে বলল, জুয়েল ক্যাপ্টেন হোক। আমরা সবাই চাই জুয়েল ক্যাপ্টেন হোক।

হেডমাস্টার সাহেব সবাইকে থামতে বললেন, তোরা সবাই থাম, চেঁচামেচি করিস না। টিটু তোর জন্য তো কেউ সুপারিশ করছে না।

টিটুর চোখ-মুখ রেগে লাল হয়ে গেছে। সে অসহায়ের মতো একবার সবার দিকে তাকালো কিন্তু কেউ তাকে সমর্থন করল না। টিটু আর কোনো কথা বলল না, মাথা নত করে বসে রইলো।

সেদিন থেকে টিটু আর জুয়েলের মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত দলাদলি তৈরি হলো, যা জুয়েল কোনোদিন আশা করেনি। জুয়েল নিজেও চাচ্ছিলো এই দলাদলির একটা অবসান হোক কিন্তু অবসান তো নয়ই বরং আরো বেশি দূরত্ব তৈরি হলো।

ক্লাস এইট থেকে নাইনে প্রমোশনের পর সবাই মিলে ফেসবুকে একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছে। ক্লাসের যেকোনো সমস্যায় বা কেউ কিছু বুঝতে না পারলে রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে গ্রুপে সবাই মিলে আলোচনা করে। এতদিন সেটা ক্লাসের পড়ালেখা নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু আজ রাতের মিটিংটা হলো টিটুর আচরণ আর মাহবুব সাহেবের প্রাইভেট পড়ানোর বিষয় নিয়ে।

কেউ কেউ বলল, টিটু এটা ঠিক করেনি ওর পানিশমেন্ট হওয়া উচিত।

আবার কেউ কেউ বলল, থাক বাদ দে, আমাদেরই ফ্রেন্ড, সবাই তো জানিস ও একটু অন্যরকম।

মনি বলল, আমার তো ইচ্ছে করে ও কান ধরবে আর আমি ওর ছবি ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিব। আমি ক্যামেরাও তাক করেছিলাম। হামিদুল স্যার না এলে তো কাজ হয়ে যেতো।

মুকুল বলল, না না এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেত। ওরা অনেক টাকাওয়ালা আর ক্ষমতাবান। শেষে ওর সঙ্গে লাগতে গিয়ে ঝামেলা বাড়বে।

রনি মুকুলকে উদ্দেশ্যে করে বলল, সবই তো বুঝলাম কিন্তু ও যেটা বলেছে এটা মেনে নেয়া যায় না। আমি চাই ওর বিরুদ্ধে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই করতে, কালকে থেকে আমরা কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবো না তাতে যদি ও আমাকে কিছু করে তো আমি বুঝবো।

সুবর্ণা বলল, আমি মনে করি ওকে একবার সতর্ক করে দেয়ার দরকার। নাহলে তো সারাজীবন এভাবেই থাকবে। রনি তুই একটু মাথাটা ঠাণ্ডা কর, আমি দেখি কী করা যায়। আমি ওকে সরি বলাবো, ছবিও তুলবো, তোরা দেখবি আমি পারি কী না। তারপর যা হয় কাল রাতে আবার আলোচনা করা যাবে।

ওকে শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছি নাকি। আচ্ছা তুই দেখ, যদি না পারিস তখন দেখা যাবে। এখন মাহবুব স্যারের বিষয়টা কী করবি সবাই ভেবে দেখ, রনি বলল।

সুবর্ণা বলল, মাহবুব স্যার আবার কী করল?

জুয়েল বলল, কী করল মানে? তুই প্রাইভেট পড়িস সেজন্য মনে নেই, তাই না?

রনি বলল, আমি খবর নিয়েছি গত বছর যারা যারা প্রাইভেট পড়েনি তাদেরকে ফাইনাল পরীক্ষায় মাহবুব স্যার কম মার্ক দিয়েছে।

তিশা যেন আকাশ থেকে পড়লো, তাই নাকি?

জুয়েল বলল, হ্যাঁ।

তাহলে তো ভালোভাবে খবর নিতে হয়। যার ইচ্ছা প্রাইভেট পড়বে যার ইচ্ছা পড়বে না, প্রাইভেট না পড়লে কম মার্ক দিবে কেনো? তাছাড়া অনেকেই আছে যাদের প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই, তাদেরকে তাহলে স্যার মার্ক কম দিবে, তিশা বলল।

জুয়েল বলল, আরো একটা ব্যাপার তোরা বুঝি খেয়াল করিসনি?

সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, কী ব্যাপার?

মাহবুব স্যার তো প্রতিদিন কঞ্চি নিয়ে ক্লাসে আসে কিন্তু কাকে কেনো মারে লক্ষ্য করছিস? জুয়েল সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল।

কেউ কোনো কথা বলল না।

জুয়েল বলল, যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না তাদের মারে আর যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের পড়া না হলেও মারে না। দেখিস হয় কী না।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, তোর কথা কি সত্যি?

সেটা তো দেখলেই বুঝবি জুয়েল বলল।

তিশা বলল, আমি প্রাইভেট পড়ি একথা সত্যি কিন্তু তাই বলে যে প্রাইভেট পড়বে না তাকে মারবে, প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিবে এটা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না।

সুবর্ণা তুই কি বলিস? জুয়েল জিজ্ঞেস করল।

সুবর্ণা বলল, আমিও এটা মানতে পারছি না।

জুয়েল বলল, তাহলে এবার যদি মাহবুব স্যার কাউকে মারে আর যদি দেখা যায় স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়া ছাত্র তাহলে বুঝতে হবে পড়া না হওয়ার জন্য না, স্যারের কাজে প্রাইভেট না পড়ার জন্য মেরেছে।

রনি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুই তো সেদিন বললি আইন হয়েছে কোনো স্যার কোনো ছাত্রকেই মারতে পারবে না।

সেটাও ঠিক।

আট

 

টিটুর মন ভালো নেই। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। অসময়ে বাসায় ফিরতে দেখে টিটুর মা মমতাজ বেগম টিটুর রুমে ঢুকলো, টিটু, টিটু কী হয়েছে বাবা? এই অসময়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরলি যে, শরীর খারাপ?

কথা বলতে বলতে মমতাজ টিটুর রুমে ঢুকে কপালে হাত দিয়ে দেখলো, না, জ্বর নেই তো।

টিটু মৃদু কণ্ঠে বলল, কিছু হয়নি মা।

কিছু হয়নি তো শুয়ে পড়লি কেনো বাবা? চল ভাত খাবি, বলে মমতাজ টিটুকে টেনে তুলতে চাইলো।

টিটু কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, মা তুমি যাও তো, এখন আমার খিদে নেই। পরে যখন খিদে লাগবে তখন খাবো।

মমতাজ চলে গেল। টিটুর বার বার স্কুলে বন্ধুদের অপমানের কথা মনে পড়লো আর সে বিছানা থেকে ছিটকে ছিটকে উঠলো। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, জুয়েল তোকে আমি ছাড়বো না।

টিটু কী করবে আর কী করবে না ভেবে পাচ্ছে না। সে রিনিকে ফোন করল। রিনি ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল, কী রে জরুরি কিছু?

টিটু বলল, জরুরি না আপা কথা বলতে চাইছিলাম।

আচ্ছা বল।

আপা তোমাকে কী করে যে বলি।

বল, বল তাড়াতাড়ি বল।

আপা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে।

কিন্তু আমি তো এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলি তোর সঙ্গে এখন তো একটু ব্যস্ত।

আচ্ছা আপা।

টিটু বিছানা থেকে উঠে ডাইনিংয়ে গেল। টিটুকে ডাইনিংয়ে ঢুকতে দেখে মমতাজ একরকম দৌড়ে এলো, উঠছিস, ভাত খা বাবা।

টিটুর খিদে আছে কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। টিটু ছোটবেলা থেকেই জেদি, আগে আরো বেশি ছিল, ইদানীং একটু কমেছে। আজ থেকে পাঁচ ছয় বছর আগে কেউ টিটুকে এমন কথা বললে টিটু হয়তো নাকে ঘুষি মেরে দিতো। টেবিলে খাবার সাজানোই ছিলো। মমতাজ প্লেটে ভাত তুলে দিলো, তরকারি তুলে দিলো। টিটু কয়েকগ্রাস ভাত খেয়ে বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।

মমতাজ বলল, কেনো ইচ্ছা করছে না বাবা? অসুখ করেছে নাকি? তোর বাবাকে বলবো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, নাকি রিনিকে ফোন করবো, তোর কাছে শুনে ঔষধ দিবে।

কিচ্ছু লাগবে না মা। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। মা ভাইয়া কখন গেছে?

গেছে তো দশটা এগারোটার সময়।

কখন আসবে বলে গেছে?

ও কি কোনোদিন বলে যায় আর ঠিকমতো আসে। যখন ইচ্ছে আসবে। কেন তোর আবার ওকে কী প্রয়োজন হলো?

না এমনিতে।

টিটু ডলারকে ফোন করল।

ডলার ফোন রিসিভ করল, টিটু বল।

ভাইয়া তুমি কখন আসবা?

আমি তো একটু বাইরে এসেছি ফিরতে দেরি হবে, কেনো জরুরি কিছু?

না, তেমন কিছু না।

জরুরি হলে বল?

না, তুমি বাসায় আসো তখন বলবো।

ডলার সকালবেলা দেরিতে ঘুম থেকে উঠে, নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ফিরে আসে অনেক রাতে। কফিলউদ্দীনের বাহাদুর বাজারে কাপড়ের দোকান আছে। টিটু ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। যদিও এসময় সে কোনোদিন ঘুমায় না কিন্তু আজ স্কুলের সেই ঘটনার পর থেকে মাথাটা কেমন গোলমেলে করছে। কী করবে আর কী করবে না? সে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকার পর রুমের মধ্যে পায়চারি করল, না সে বন্ধুদের এই আচরণ কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না। বিশেষ করে জুয়েলের রাগান্বিত চোখ-মুখ ভুলতে পারছে না, না, না কাউকে না হলে অন্তত জুয়েলকে একটা কিছু করতেই হবে।

টিটু বাসা থেকে বের হলো সন্ধ্যার সময়। বাসা থেকে বের হয়ে একটা মোড়, মোড় থেকে কয়েকশ ফুট দূরে একটা পরিত্যক্ত ভবন, জায়গাটা একটু অন্ধকার, আশেপাশের লাইট পোস্টের বাতিটা নষ্ট হয়ে গেছে তাই হয়তো অন্ধকার আরো গাঢ় দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর কয়েকটা ছেলে এখানে আড্ডা দেয়, সিগারেট ফুকায়, বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে নেশাও করে সম্ভবত, টিটুও দু’য়েকবার ওদের আড্ডায় এসেছে।

আজ লাইটপোস্টের আলো নেই দেখে টিটুর মনে হলো আজ হয়তো আড্ডায় কেউ নেই। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো মোবাইলের আলোতে কয়েকজন ছেলে চাপাস্বরে গল্প করছে। কাছে যেতেই একজন টিটুর দিকে মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলে ধরে জিজ্ঞেস করল, কে? টিটু?

টিটু মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ আমি টিটু।

অন্য বলল, কী মনে করে?

না এমনিতে আসলাম।

মোবাইলের আলোতে সবার মুখ স্পষ্ট না। এখানকার সবার সঙ্গে টিটুর পরিচয় আছে কিন্তু সখ্য নেই। অন্যর সঙ্গেও সখ্য ছিল না সেদিন ঘটনাক্রমে দেখা হওয়ায় কিছুটা সখ্য হয়েছে। অন্যর পাশ থেকে একজন টিটুর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলো, এই নে।

টিটু বলল, আমি সিগারেট খাই না।

মানে?

খাই না মানে খাই না।

আরেকজন বলল, অন্যকিছু খাবি?

টিটু এবারো না সূচক মাথা নাড়লো।

অন্য বুঝতে পারলো টিটু কোনো কাজে এসেছে। সে টিটুকে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবি?

হ্যাঁ, অন্য আমি একটা কাজে এসেছি।

কী কাজ?

টিটু অন্যর হাত ধরে টেনে সবার কাছ থেকে আলাদা করে নিয়ে বলল, একটু এদিকে আয়।

টিটু অন্যকে স্কুলের ঘটনা, বন্ধুদের অপমান খুলে বলল।

সব শুনে অন্য জিজ্ঞেস করল, এখন কী করতে চাচ্ছিস?

এমন সময় টিটুর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তার ভাই ফোন করেছে। সে রিসিভ করল, হ্যালো ভাইয়া।

কী রে তুই কোথায়?

ভাইয়া আসছি।

আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়। আমি বাসায় আসছি।

অন্য এখন আসি। কালকে তোকে জানাবো, বলে আড্ডার ছেলেদের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, তুই বিষয়টা একটু ওদের সঙ্গে আলাপ কর।

আচ্ছা।

ডলার তখন তার রুমেই ছিল। টিটু বাসায় ঢুকে ডলারের সঙ্গে দেখা করতে তার রুমে গেলো। ডলার জিজ্ঞেস করল, কী রে? খুঁজছিলি কেনো?

টিটু সুবোধ বালকের মতো খুব সরলভাাবে বলল, ভাইয়া আজ স্কুলে একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

জুয়েল নামে আমার এক ফ্রেন্ড আছে, বলে টিটু কৃত্রিম কান্না কান্না কণ্ঠে বলল, ও আমাকে খুব অপমান করেছে।

তোকে অপমান করেছে, এতবড় সাহস? কেনো অপমান করল?

টিটু মাথা-উচু করে জানালো তাকে অপমান করেছে তারপর বলল, কোনো কারণ না, বন্ধুদের মাঝে একটু আধটু দুষ্টুমি, তাই বলে আমাকে বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

কাঁদছিস কেনো তোকে মেরেছে?

এরচেয়ে আড়ালে মারলেও ভালো হতো।

তো?

আমাকে সব ক্লাসফ্রেন্ডদের সামনে কান ধরে উঠবস করতে বলেছে।

ছিঃ ছিঃ, এটা তুই কী বললি?

সেজন্য আমি স্কুল থেকে পালিয়ে এসেছি। টিফিনের পরে থাকলে আমাকে কান ধরে উঠবস করাতো, জুয়েলের একটা কোনো ব্যবস্থা না হলে আমি আর স্কুল যাবো না।

এটা তুই কী বললি, তুই স্কুলে যাবি। তোকে কেউ একটা কথা বললে আমি দেখবো, তোকে কেউ জানে না যে তুই ডলারের ভাই।

কী জানি? আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছিস, আমার ভাই জানলে তোকেই কান ধরে উঠবস করাবে।

আচ্ছা তুই যা, পড়তে বস। আমি দেখি কী করা যায়।

টিটু স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে মমতাজের এরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছিল। সেজন্য টিটু আজ প্রাইভেট পড়তেও যায়নি। জানার কৌতূহল থেকে এতক্ষণ মমতাজ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দু’ভাইয়ের কথা শুনছিল। টিটু ডলারের রুম থেকে বের হবে দেখে সে আবার রান্নাঘরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সে ডলারের রুমে গেল। ডলারকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে টিটুর বলতো।

জুয়েল নামে এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে টিটুর গণ্ডগোল হয়েছে।

মমতাজ শিক্ষিত, শান্তশিষ্ট। সে ডলারকে বলল, তোকে কী করতে বলছে?

ডলার আমতা আমতা করে বলল, না কিছু না।

মমতাজ ডলারকে কিছুটা শাসনের সুরে বলল, শোন, আমি তো তোদের মা, তোদের সবাইকে আমি খুব ভালো চিনি। আমার মনে হচ্ছে টিটুই কারো সাথে সমস্যা তৈরি করেছে। বন্ধুদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে সেটা স্কুলেই শেষ হবে। সেটা গার্ডিয়ান পর্যন্ত টেনে আনার কোনো দরকার নেই।

আচ্ছা।

আমি কালকে খোঁজ-খবর নিই। তারপর না হয় জুয়েলের গার্ডিয়ানদের বলা যাবে।

তুমি ঠিকই বলেছো মা।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ডলারের মোবাইলে একটা ফোন এলো।

ডলার ফোন রিসিভ করে কয়েক মুহূর্ত কানের কাছে ধরে রাখল তারপর মোবাইল ফোন বিছানায় ছুঁড়ে আপনমনে বলল, উফফফ, এত্তোদূর। বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারেই তাই বলে বখাটে ছেলেদের দিয়ে শায়েস্তা।

ডলারের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ডলার ফোন রিসিভ করল, হ্যালো রিনি বল।

ভাইয়া তুমি কি একটু ফ্রি আছো?

হ্যাঁ বল।

রিনি জিজ্ঞেস করল, বাসায় আছো নাকি বাইরে?

ডলার কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বলল, বল, বল বাসায় আছি, এতো কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?

ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এখন তো দেখছি তোমার মুড ভালো নেই।

আচ্ছা বল। মুডের কিছু নেই।

ভাইয়া গতকাল টিটু ফোন করেছিল।

তারপর?

তারপর আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিল। আমি ভাবলাম জরুরি কোনো কাজে হয়তো লাগবে তাই দিয়ে দিলাম। আসলে এমনভাবে বলল, না দিয়ে আর পারলাম না। হাজার হলেও নিজের ভাই তো, কথার শেষ দিকে রিনির কণ্ঠে যেন দরদ উতলে পড়ল।

ডলার রাগান্বিতস্বরে বলল, ভালো করছিস, তোর টাকা বেশি হইছে দিছিস। টাকাটা কী করবে বলছিল?

বলল জরুরি কাজে লাগবে।

একজন স্টুডেন্ট এর জরুরি কী কাজ থাকতে পারে। তুই ওর পড়ালেখাটা নষ্ট করবি।

সেজন্যই তো আজ তোমাকে ফোন করলাম।

আজ আবার কী করেছে?

একটু আগে আমাকে ফোন করছিল। বলল ওর নাকি পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।

ডলার প্রচণ্ড রেগে গেল, নট অ্যা সিঙ্গেল মানি। ওকে একটা পয়সাও দিবি না।

আচ্ছা ভাইয়া।

রিনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ডলার প্রচণ্ড রেগে গেছে। তার চোখ-মুখ রেগে লাল হয়ে গেছে। ডলার কথা বলা শেষ করে জোরে টিটুকে ডাক দিলো, টিটু।

আসছি ভাইয়া বলে টিটু তার রুম থেকে ডলারের রুমে এলো। কিছুক্ষণ আগেও টিটুর চোখে-মুখে একটা অহংকার ছিলো, তার ধারণা ছিলো ডলার শোনার পর জুয়েলের ওপর প্রচণ্ড রেগে যাবে কিন্তু এখন ডলারের মুখের দিকে তাকাতেই টিটুর বুক কেঁপে উঠল।

টিটু মাথা নিচু করে ডলারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডলার রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, তুই জুয়েলকে মারার জন্য মাস্তান জোগাড় করছিস?

টিটু একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, না, মানে?

মানে মানে করছিস কেনো?

জুয়েল আমাকে সবার সামনে…

ডলার টিটুর কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, থাক, থাক আর বলতে হবে না। ওদের টাকা দেয়ার জন্য তুই রিনির কাছে টাকা চাইছিস?

টিটু কোনো কথা বলল না। সুবোধ বালকের মতো ডলারের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

ডলার আবার বলতে শুরু করল, তুই গতকালকেও রিনির কাছে পাঁচ হাজার টাকা নিছিস। সেই টাকা কী করলি?

টিটু তবুও কোনো কথা বলল না।

ডলার প্রচণ্ড রেগে গেল, বল, চুপ করে আছিস কেনো?

টিটু মিনমিন করে বলল, মেলায় গেছিলাম।

মেলায় যেতে পাঁচ হাজার টাকা লাগে? কী করছিস এতোগুলো টাকা?

টিটু কোনো কথা বলল না।

তুই কি জুয়া খেলছিস? তাছাড়া তো এতোগুলো টাকা মেলায় গিয়ে শেষ হতো না, বলে ডলার টিটুর দিকে এগিয়ে গেল।

মমতাজ রান্নার পাশাপাশি টিটু আর ডলারের দিকে লক্ষ্য রাখছিল। ডলার যখন টিটুকে জোরে ডাক দিলো তখনই তার মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। টিটু ডলারের রুমে ঢুকলে সে দরজার চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়ালো।

ডলার যখন টিটুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন তার ভঙ্গিমাটা ছিলো অত্যন্ত আক্রমণাত্মক, যেন টিটুকে সে খেয়ে ফেলবে। মমতাজ ডলারের এই আক্রমণাত্মক অবস্থা দেখে আর ঠিক থাকতে পারলো না। সে দু’ভাইয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, থাম।

ডলার গর্জন করে উঠলো, মা তুমি থামো। তুমি কিচ্ছু জানো না ও কতবড় কাণ্ড করেছে। যদি ঠিক সময়ে আমি না জানতাম তবে কী যে হতো। নিজেই দোষ করে আবার নিজেই এসেছে অভিযোগ করতে।

সেজন্যই তো আমি তোকে বললাম আগে ভালোভাবে খবর নে। দেখছিস এর কথা বিশ্বাস করলে কতবড় ভুল হতো, মমতাজ বলল।

ডলার কয়েকবার না সূচক মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, কিচ্ছু হবে না মা, একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যে ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জুয়া খেলে, নিজের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, বন্ধুকে শায়েস্তা করার জন্য মাস্তান ভাড়া করে তাকে দিয়ে আর কী হবে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারিনি বলে আমি পদে পদে আটকে যাচ্ছি। যখনই শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উঠে তখনই সবাই বলে ও তো গ্র্যাজুয়েট না। কী যে ভুল করেছি তখন বুঝিনি এখন পদে পদে বুঝছি কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। অনেক আশা ছিলো আমি যা পারিনি তোকে দিয়ে সেটাই করাবো কিন্তু সে আশা আর পূরণ হবার নয়।

একে নিয়ে আর কোনো ভরসা নেই। এখন যেভাবে লেখাপড়া করছে এভাবে লেখাপড়া করলে, ও তোর মতোও হতে পারবে না। তুই তো এখন অনেক বড় মাপের নেতা, এ তোর পা ধোয়া পানি খাওয়ার যোগ্যও হতে পারবে না।

আমার ভুল হইছে ভাইয়া, তুমি আমাকে মাফ করে দাও, কথাগুলো টিটু এমনভাবে বলল যে বলা দরকার তাই বলল। তার চোখে-মুখে অনুতপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

ডলার রাগান্বিতম্বরে বলল, থাক আর মাফ চেয়ে কী হবে, ভালোভাবে লেখাপড়া কর, এখনো সময় আছে যদি কিছু করতে পারিস।

মমতাজ টিটুকে একরকম টেনে হিঁচড়ে ডলারের রুম থেকে তার রুমে নিয়ে গেলো।

মমতাজ কিছুক্ষণ টিটুকে বোঝানোর চেষ্টা করল তারপর সে রান্নাঘরে চলে গেল।

মা চলে যাওয়ার পর টিটু অন্যকে ফোন করল, হ্যালো।

অন্য বলল, হ্যালো টিটু বল।

টিটু রাগান্বিতস্বরে বলল, অন্য আমি তোকে বললাম কিন্তু কথাটা ফাঁস হয়ে গেল কীভাবে?

ফাঁস হলো মানে?

হ্যাঁ, কথাটা ভাইয়ার কানে আসলো কীভাবে?

অন্য বলল, বুঝিস তো এগুলো কাজ একা করা যায় না তাই আমি তোর বিষয়টা নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করেছি।

কে কে ছিল ওখানে? কে বলতে পারে নাম আর মোবাইল নাম্বার আমাকে ইনবঙ কর।

সেটা তো আমি বলতে পারবো না টিটু। কে বলেছে আর আমি কার মোবাইল নাম্বার দিবো তোকে।

আচ্ছা তোকে কিছু করতে হবে না। কাল আমি নিজেই খুঁজে বের করবো কে ঘটনাটা ফাঁস করল বলে টিটু অন্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলো।

নয়

 

পরদিন আর টিটুকে স্কুলে দেখা গেল না কিন্তু টিটু যে ভয় পাবার পাত্র না এটাও সবার জানা, হয়তো পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে তাছাড়া তাকে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যে আলোচনা হয়েছে সে খবরও তার কানে গেছে নিশ্চয়ই। না, শুধু পরদিন না পর পর দুদিন সে স্কুলে এলো না। ক্রমে ক্রমে টিটুর প্রতি বন্ধুদের ক্ষোভ প্রশমিত হলো। বন্ধুদের মধ্যে একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হলো, টিটু কি শেষ পর্যন্ত স্কুল আসাই বন্ধ করে দিলো।

টিটুর স্কুলে না আসার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করল। কেউ কেউ জুয়েলের দিকেও অভিযোগের আঙ্গুল তুললো। সেদিন ক্লাসের ফাঁকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে টিটুকে নিয়ে কথা উঠল। সবার মধ্যে মুকুলের সঙ্গে টিটুর সম্পর্ক বেশি ভালো তাছাড়া অন্যান্যদের সঙ্গেও টিটুর সম্পর্ক খারাপ ছিলো না।

সুবর্ণাই প্রথম কথা তুললো, সে মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, এই মুুকুল টিটুর খবর কী রে?

মুকুল বলল, আমার সঙ্গে কথা হয়নি, কালকে ফোন দিছিলাম, বলল এমনিতেই আসছে না।

উঁহু, আমার মনে হচ্ছে সেদিনের ঘটনার জন্যই আসছে না।

রুবেল বলল, আমি সব বিষয়ে কথা বলি না কিন্তু সেদিন আসলে টিটুর ওপর এভাবে সবাই রেগে যাওয়া ঠিক হয়নি। ও তো ধনী মানুষের ছেলে, এমনিতেই কিছুটা অহংকারী, না হয় উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে তাই বলে ওকে হাতজোড়ো করে মাফ চাইতে হবে। এটা বাড়াবাড়ি, কথা বলেছে, কারো গালে তো আর চড়-থাপ্পড় দেয়নি।

সুবর্ণা মনিকে বলল, তুই তো মোবাইলের ক্যামেরা তাক করে ছিলি, খুব ছবি তোলার সখ তাই না? তোদের অপমানের জন্য ছেলেটা স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিলো।

মনি বলল, আহা রে তোর তো দেখি দরদ উতলে পড়ছে, যা না বাছা বাসায় গিয়ে স্কুলে নিয়ে আয়।

সুবর্ণা রেগে গেল, টিজ করবি না। একবার চিন্তা করে দেখ, তোদের ওপর জিদ করে ও যদি আর লেখাপড়াই না করে তাহলে সারাজীবন তোদের বিবেক তোদের ক্ষমা করবে না। আর জুয়েলের একেবারে শক্ত করে ধরলো, সহজভাবে নিলেই হতো।

জুয়েল মিনমিন করে বলল, আমি তো সরি বলতে বলেছি। ভুল করেছে সরি বলতো।

রনি বলল, জুয়েল তে ঠিকই বলেছে, মুখের কথাটা বলে দিলেই তো হতো। একটু শাস্তি না পেলে তো ধীরে ধীরে আরো খারাপ হয়ে যাবে।

এখন কী হলো, ও যদি আর লেখাপড়াই না করে তখন কী হবে, সুবর্ণা বলল।

মনি বলল, আচ্ছা আমি দেখছি বিষয়টা, কী করা যায়।

হ্যাঁ তোকেই তো দেখতে হবে, তুই তো হাতজোড় করে দেখিয়েছিলি, এই এমন করে বলে তিশা মনি যেভাবে টিটুকে হাত জোড় করতে বলেছিল সেভাবে হাতজোড় করে বলল, এমনকরে হাত জোড় করতে বলেছিলি এখন তুই সেভাবে হাতজোড় করে টিটুকে স্কুলে নিয়ে আসবি, সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

এমন সময় ক্লাসে টিচার ঢুকতেই সবাই চুপ করল।

মনি একটা মুচকি হাসি হেসে তিশার গালে হাত দিয়ে মুখ তার দিক থেকে টিচারের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ক্লাসে মনোযোগ দে।

সেদিনের পর থেকে টিটু হন্য হয়ে খুঁজছে সেই বিশ্বাসঘাতককে যে জুয়েলকে শিক্ষা দেয়ার কথাটা ডলারের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে। আর তাই সে প্রতিদিন এই আড্ডায় আসে, অন্যকে জিজ্ঞেস করলে বলে একই কথা, আমি অপারেশনের জন্য সবার সঙ্গে আলাপ করছিলাম কিন্তু কে যে সেটা ফাঁস করল তা আসলে আমি জানি না।

টিটু অন্যদের জিজ্ঞেস করলে বলে, ও তো আর আসে না। বাদ দে না বস। যা হবার হয়েছে, একটা বিষয় এতদিন মাথায় রাখতে নেই।

টিটুর ধারণা এদের মধ্যেই কেউ তথ্যটা তার ভাইকে দিয়েছে কিন্তু সবাই স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছে। টিটু খুব রাগি এবং জেদি, জানার পর হয়তো কোনো কাণ্ড করে বসবে আর টিটু যদি কাউকে কিছু করে বসে তবে তাকে কে শাস্তি দিবে। এই শহরে টিটুর পরিচিতি সে কফিলউদ্দীনের ছেলে তারচেয়ে বড় পরিচয় সে যুব নেতা ডলারের ভাই। শেষ পর্যন্ত টিটু সেই বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে পেলো না ঠিকই কিন্তু আড্ডায় যাওয়ার একটা বদ অভ্যাস গড়ে উঠলো। ইদানীং টিটু স্কুলে যায় না, কোচিং যায় না, সারাদিন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যায় আড্ডায় যায়।

তিশা টিটুদের বাসায় গেল। কলিং বেল টিপ দিতেই মমতাজ দরজা খুলে দিলো। তিশা সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম চাচি।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছিস মা?

ভালো আছি চাচি। আপনি?

ভালো আছি মা। পাশের বাড়ি তবুও তুই তো আসিস না মা।

পাশের বাড়ি বলে হয়তো আসা হয় না চাচি, দূরে হলে হয়তো ঠিকই আসতাম। কথায় বলে না মক্কার হাজি হজ পায় না।

ঠিক বলছিস মা, কথা বলতে বলতে চাচি ড্রয়িং রুমের দিকে গেল, পিছু পিছু তিশা ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। তিশা সোফায় বসতে বসতে বলল, চাচি টিটু নাই?

ও তো বাইরে গেছে মা।

বলে যায়নি।

না মা, ও তো কখনো বলে যায় না। স্কুল আর কোচিং ছাড়া তো ও কোথাও যায় না।

কিন্তু ও তো কয়েকদিন থেকে স্কুল কোচিং কোথাও যাচ্ছে না চাচি।

মমতাজ অবাক হয়ে গেল, হ্যাঁ কিন্তু ও তো বলে স্কুল নাকি বন্ধ।

স্কুল, কোচিং কোনোকিছুই তো বন্ধ নেই চাচি। তাহলে ও প্রতিদিন কী করে?

সারাদিন বাসায় বসে থাকে, খায়, ঘুমায়, যখন পড়তে ইচ্ছে করে, পড়ে, যখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করে তখন বাইরে যায়। এই যে এখন বাইরে গেছে, আর কিছুক্ষণ পরে আসবে, এসে ভাত খেয়ে পড়তে বসবে।

আচ্ছা আমি দেখছি, বলে তিশা টিটুকে ফোন করল।

তুই কথা বল মা আমি তোদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসি, বলে মমতাজ চলে গেল।

কয়েকবার রিং হলো কিন্তু টিটু রিসিভ করল না। তিশাও ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না, সে বার বার ফোন করতেই থাকলো অবশেষে টিটু ফোন রিসিভ করল, হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম।

তিশা কিছুটা ধমকের সুরে বলল, ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই টিটু আমি তিশা, আমার নাম্বারটাও সেভ করা নেই।

ও তিশা, কী খবর বল?

আমি তোদের বাসায়, কোথায় তুই বলতো?

আশেপাশেই আছি। কেনো? কী হয়েছে?

তাড়াতাড়ি বাসায় আয়, আমি তোর জন্য ওয়েট করছি।

আমাদের বাসায় কেনো?

কেন তোদের বাসায় আমি আসতে পারি না, আর তোদের বাসায় এলে তুই আমার সঙ্গে দেখা করবি না।

এবার টিটুর অভিমান কমলো, সে হেসে ফেলল, বস, আমি আসছি।

হ্যাঁ তাড়াতাড়ি আয়।

কয়েক মিনিটের মধ্যে টিটু বাসায় এলো, যেন একরকম দৌড়ে এসেছে। ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বলল, কী রে, কী খবর?

এই তো এলাম তোর সঙ্গে দেখা করতে।

আমার সঙ্গে দেখা করতে, কেনো? হাতজোড় করে সরি বলাবি নাকি?

আরে না, মনি তোর সঙ্গে ইয়ার্কি করছিল। আমি আছি না, আমি তোর কাজিন না, আমি কি তোর খারাপ চাই?

মনি যে ইয়ার্কি করে হাতজোড় করেনি সেকথা টিটু ভালো করেই জানে কিন্তু সে আর তর্কে জড়ালো না কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, তো এখন কি ভালো করতে আসলি?

শোন টিটু এভাবে কথা বলবি না। আগে বলতো তুই কোথায় ছিলি?

আরে আমি কি তোর মতো মেয়ে মানুষ যে বেলা ডুবতেই ঘরে ঢুকবো? বাইরে গেছিলাম।

এই টিটু এভাবে বলবি না, তুই জানিস না, আমি ছেলেমেয়ে তফাৎ করা পছন্দ করি না। আমি মেয়ে কিন্তু তোর চেয়ে আমার রোল নাম্বার আগে। ছেলে হয়ে তুই তো কোনোদিন আমাকে ক্রস করতে পারিসনি।

মমতাজ নাস্তা নিয়ে এলো, নাস্তার ট্রে টেবিলে রেখে বলল, কী হলো? ঝগড়া?

তিশা হেসে উঠলো।

মমতাজ বলল, সেই যে ছোটবেলা শুরু করছিস এখনো চলছে…

তিশা হাসতে হাসতে বলল, চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। বড় হয়েছি বলে এখনো কান ধরিনি, ছোট থাকলে এতক্ষণ আমি ওর কান ধরতাম।

টিটু প্রতিবাদ করল, দেখছ মা দেখছ?

মমতাজ একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, ঠিকই বলেছে, আমি এরকম একটা বউমা আনবো যেন কান ধরে তোকে শাসন করতে পারে।

কেন আমি কী করছি?

কী করছি, তোর স্কুল, কোচিং কোনোকিছুই তো বন্ধ না, তো এই ক’দিন স্কুলে, কোচিংয়ে গেলি না কেনো?

টিটু তিশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে বলল, নিশ্চয়ই তুই বলছিস।

মমতাজ কিছুটা ধমকের সুরে বলল, বলেছে তাতে কী হয়েছে? আরো আগে বলা উচিত ছিল। তুই স্কুল যাচ্ছিস না কেনো? বন্ধুদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে তাই বলে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হবে। আচ্ছা তোরা গল্প কর আমি চা নিয়ে আসছি, ঝগড়া করলে মুখোমুখি করবি কেউ যেন কারো গায়ে হাত না তুলিস বলে মমতাজ একটা মুচকি হাসি হেসে বেরিয়ে গেল।

মমতাজ বেরিয়ে গেলে টিটু বলল, সব বলে দিছিস, বিবিসির মতো।

কী হয়েছে বলতো, স্কুল যাচ্ছিস না কেন?

এমনিতেই। কেউ কিছু বলছে নাকি?

তিশা টিটুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবকিছু ধামাচাপা দিলো, না, কে কী বলবে, কবেই সব মিটে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। সেজন্যই তো আমি আসলাম। কাল স্কুল আসবি।

না।

না কেনো? এবার কিন্তু আমি সত্যি সত্যি কান ধরবো, বলে তিশা সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিলো, উঠতে হবে না, বস।

মমতাজ চা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো, তিশা বলল, চাচি আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ওকে কান ধরে স্কুলে নিয়ে যাবো।

তোকে আর কিছু বলতে হবে না মা, কাল থেকে ও স্কুল যাবে।

মমতাজ একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, তোর চাচা এসেছে বুঝি। এখন তোরা এসব চুপ কর, তোর চাচা যদি জানে টিটু স্কুল যায়নি তাহলে বাড়িতে একটা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবে।

তিশা উঠে দাঁড়ালো, আমিও আসি চাচি? বলে টিটুর দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, তুই কিন্তু কাল আসছিস।

মমতাজ দরজা খুলে দিতে গেল, চলে যাওয়ার জন্য তিশাও পিছনে পিছনে বের হলো।

 

দশ

 

পরদিন থেকে টিটু আবার স্কুলে যাতায়াত শুরু করল কিন্তু কেউ কিছু বলল না শুধু জুয়েলের সঙ্গে টিটুর একটা মন কষাকষি রয়েই গেল। অবশ্য সেদিন ক্লাসের ফাঁকে জুয়েলের টিটুর সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করল, হাই ফ্রেন্ড।

টিটু হ্যান্ডশ্যাক করল, কেমন আছিস?

ভালো, তুই?

ভালো।

ক্লাস টিচার ক্লাসে ঢুকলো।

বন্ধুদের মাঝে এই ভুল বোঝাবুঝির অবসানের মুখ্য ভূমিকা পালন করল তিশা। ক্লাসে তার নাম পড়ে গেলো লিডার। প্রথম প্রথম কেউ লিডার বলে ডাকলে তিশা অপ্রস্তুত হতো কিন্তু ধীরে ধীরে সয়ে গেল।

কয়েকমাস পরের কথা। এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। সার্বিকভাবে স্কুলের রেজাল্ট ভালো হয়েছে কিন্তু কয়েকজন প্রথম সারির ছাত্র-ছাত্রী ফিজিক্সে খারাপ রেজাল্ট করেছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ করে দশম শ্রেনির ছাত্র-ছাত্রীদের যারা ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলো। কেউ কেউ বলল, মাহবুব স্যার প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে যারা মাহবুব সাহেবের কাছে প্রাইভেট পড়েনি তাদেরই রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

সেদিন মাহবুব সাহেব ক্লাসে আসার পর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ দেখা দিলো। মাহবুব সাহেব কিছুটা অনুমান করতে পারলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সবাই ফিসফিস করছিস কেনো?

ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো, মাহবুব সাহেব মুকুলকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মুকুল তুই বলতো কী হয়েছে?

মুকুল আমতা আমতা করে বলল, না স্যার কিছু না, আমি জানি না।

কে জানে?

মাহবুব সাহেব জানে জুয়েল সবকিছু জানে কিন্তু তিনি জুয়েলকে এড়িয়ে গেলেন। রনিকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রনি তুই বলতো।

রনি উঠে দাঁড়ালো, স্যার এবার এস.এস.সি পরীক্ষায় যাদের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তাদের বেশিরভাগই খারাপ করেছে ফিজিক্সে।

মাহবুব সাহেব বুঝতে পারলেন আসলে রেজাল্ট খারাপ হওয়ার জন্য শুধু ছাত্ররাই নয়, হেডমাস্টার, কমিটির সদস্যরা, অন্যান্য শিক্ষকরা এবং গার্ডিয়ানরা পর্যন্ত তাকে দুষছে।

মাহবুব সাহেব একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সেজন্যই তো তোদের বলি ভালোভাবে লেখাপড়া কর। প্রয়োজনে প্রাইভেট পড়।

জুয়েল আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সে উঠে দাঁড়ালো, এতক্ষণে আপনি একটা ঠিক কথা বললেন স্যার। আসলে যারাই আপনার কাছে প্রাইভেট পড়েনি তাদেরই রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

মাহবুব সাহেব ধমকের সুরে বললেন, এই তুই দাঁড়ালি কেনো? তোকে আমি কিছু বলেছি?

আপনি মুখ বন্ধ করতে চাইলে হবে না স্যার। সবাই বলছে যারা আপনার কাছে প্রাইভেট পড়েনি তাদের আপনি প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিয়েছেন তাই রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

কে বলছে, কে বলছে একথা?

সবাই বলছে, মার্কসিট আসলে দেখা যাবে।

মাহবুব সাহেব জুয়েলের ওপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন, কী দেখবি, কী দেখবি তুই?

শুধু আমি একাই না, আমরা সবাই দেখবো।

ও তুই তো আবার ক্যাপ্টেন। এতো বছর চাকরি করলাম তোর মতো ক্যাপ্টেন দেখলাম না। একটু কিছু হলেই বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে উঠিস, সব বিষয়ে প্রতিবাদ করিস।

জুয়েলের সঙ্গে সঙ্গে তিশা, রনিসহ অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও বলে উঠলো, আমরা সবাই দেখবো।

মাহবুব সাহেব জোরে চিৎকার করে বললেন, চুপ, চুপ কর সবাই।

সেদিনের মতো সবাই চুপ করল কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ রইলো এবং শুধু সন্দেহ না তারা সবাই মোটামুটি নিশ্চিত প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়ার জন্য ফিজিক্সে সবাই খারাপ করেছে।

ক্লাসে হৈ চৈ এর বিষয়টি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সবার কাছে ছড়িয়ে পড়লো। স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি আছে এবং হেডমাস্টার সাহেব নিজেও একটা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। হেডমাস্টার সাহেবের দলের সদস্য মাহবুব সাহেব, প্রতিপক্ষ গ্রুপটি তুলনামুলকভাবে ছোট এবং দুর্বল। তারা সবসময় হেডমাস্টার কিংবা তার গ্রুপের সদস্য শিক্ষকদের ভুল ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। ক্লাসে হৈ চৈ এর বিষয়টি যে মাহবুব সাহেবের প্রাইভেট পড়ানোর বিরুদ্ধে এবং যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়ে না তাদের প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয়ার জন্য এ কথাও গোপন রইলো না। এটাই মাহবুব সাহেবের বিরুদ্ধে তার প্রতিপক্ষ শিক্ষকদের কাছে একটা মোক্ষম সুযোগ হিসেবে দেখা দিলো। তারা বিভিন্নভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্ধন দিতে শুরু করলে।

কয়েকদিন পর মার্কসিট এলো। মাহবুব সাহেবের ফিজিক্স প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়ার বিষয়টি আর গোপন রইলো না। ক্লাস টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। মার্কসিট আসার আগে মাহবুব সাহেব ছাত্রদের শান্ত করতে পারলেও আজ পারলেন না। মাহবুব সাহেব ক্লাসে ঢুকতেই ছাত্রছাত্রীরা উঠে দাঁড়ালো।

ছাত্র-ছাত্রীদের সেদিনের ক্ষোভ আজ উত্তেজনায় রূপ নিলো, জুয়েল দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে।

মাহবুব সাহেব মুখ কালো করলেন, তিনি সারাজীবন প্রাইভেট পড়িয়েছেন, যারা প্রাইভেট পড়েনি তাদের বাধ্য করার জন্য ভয় দেখিয়েছেন তবুও যারা প্রাইভেট পড়েনি তাদের সত্যি সত্যি মার্ক কম দিয়েছেন, যেন পরের বছরের ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে আসে। কেউ কোনোদিন প্রশ্নও তুলেনি, নিজের ভাগ্য মনে করে চলে গেছে। আগের দিনে ছাত্ররা শিক্ষকদের ভয় পেতো, শিক্ষকরা ছাত্রদের শাসন করতো এখন সেদিন নেই, ছাত্রদের শাসন করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই ছাত্ররাও বেপরোয়া হয়ে গেছে। মাহবুব সাহেব জুয়েলের আচরণ আর হৈ চৈ এর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের দোষারোপ করলেন, আইন প্রণয়নকে দোষারোপ করলেন কিন্তু একবারও নিজের দোষ খুঁজে পেলেন না।

মাহবুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোদের আবার কী কথা?

আছে। যে ভাইয়া আর আপুরা ফিজিক্সে খারাপ করেছে আমরা তাদের মার্কসিট দেখেছি, সবাই প্রাকটিক্যালে কম মার্ক পেয়েছে, ওদের কেউ আপনার কাছে প্রাইভেট পড়েনি। আর যারা প্রাইভেট পড়েছে তারা থিওরিতে কম মার্ক পেলেও প্রাকটিক্যালে কম বেশি মার্ক পেয়েছে।

মাহবুব সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, এটা তোদের ভুল ধারণা, আসলে আমি একা চাইলেই তো প্রাকটিক্যালে মার্ক কম বা বেশি করতে পারি না। তোরা যদি ভালোভাবে পড়িস, থিওরির মতো প্রাকটিক্যালে মনোযোগ দিস তাহলে তো বেশি মার্ক পাবি। ছাত্রছাত্রীরা প্রাকটিক্যালে মনোযোগ দেয় না, ভাইবার সময় এঙটার্নালদের সামনে গিয়ে হাবুডুবু খায় তাই এক্সটার্নালরা কম মার্ক দেয়, এখানে আমার কী করার আছে বল।

আমরা সব বুঝি, আপনি আমাদের সঙ্গে চালাকি করছেন, আমরা আর আপনার কাছে ক্লাস করবো না।

তিশাও জুয়েলের সঙ্গে সুর মিলালো, আমরা আর আপনার ক্লাস করবো না।

সব ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে বলল, আমরা আর আপনার ক্লাস করবো না।

মাহবুব সাহেব থ হয়ে গেলেন, তিনি থামানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু হৈ চৈ আরো বেড়ে গেল। পাশের ক্লাস রুম থেকে বাংলা স্যার বেরিয়ে এলেন, ও ফিজিক্স স্যার, কী হয়েছে? ক্লাসে এতো হৈ চৈ কেন?

মাহবুব সাহেব অবস্থা বেগতিক দেখে বাংলা শিক্ষককে দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলেন, দেখুন তো স্যার। এবার এস.এস.স্থিতে ছাত্রছাত্রীরা ফিজিক্সে খারাপ করেছে। করতে পারে, পরীক্ষার কোয়েশ্চিন কঠিন হতে পারে, সেজন্য খারাপ হতে পারে, এঙটার্নাল প্রাকটিক্যালে বেশি মার্ক না দিতে পারে। এখানে আমার কি করার আছে বলুন তো।

মাহবুব সাহেবের বিষয়টি সবাই জানে, বাংলা শিক্ষকও তার প্রতি ক্ষুব্ধ কিন্তু একজন শিক্ষকের অপমান তিনি মেনে নিলেন না। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের আশ্বস্‌ করলেন, তোরা মাহবুব স্যারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না, তোদের অভিযোগ তোরা হেড স্যারের কাছে দিবি, বলে তিনি তার ক্লাসে চলে গেলেন।

মাহবুব সাহেব বাংলা শিক্ষকের আচরণে খুশি হলেন, তার ধারণা ছিল ছাত্রছাত্রীরা বুঝি বাংলা শিক্ষকের কথায় আশ্বস্‌ হবে কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দল বেঁধে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণে ক্লাস টেনের মাহবুব সাহেবের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের হৈ চৈয়ের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। হেডমাস্টার সাহেব চেম্বারেই ছিলেন, ভাবগম্ভীর মানুষ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলেন না। তিনি কোনো ক্লাস নেন না কিন্তু যখন কোনো শিক্ষক ছুটিতে থাকেন তখন তার ক্লাস নেন। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের কোনোদিন শাসন করেন না কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাকে ভয় পায়।

দরজায় দাঁড়িয়ে জুয়েল সালাম দিলো, স্যার আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোরা সব ক্লাস ছেড়ে আমার কাছে কেনো?

জুয়েল ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করল, স্যার আমরা একটু আপনার কাছে আসলাম।

হেডমাস্টার গম্ভীর স্বরে বললেন, আয় কিন্তু দু’জন আয়, একজন ছেলে একজন মেয়ে। তোদের ক্যাপ্টেন কে?

জুয়েল বলল, স্যার আমি।

আচ্ছা তুই আয় আর মেয়েদের মধ্য থেকে একজন আয়।

ছাত্রছাত্রীরা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। টিটু নিজে থেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কিন্তু হেডমাস্টার সাহেব ক্যাপ্টেনের কথা উচ্চারণ করায় টিটুর যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল, রনি বলল, জুয়েল আর তিশা যাক।

পিছন থেকে সবাই হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে সমর্থন করল।

তিশা আমতা আমতা করল, আমি যাবো?

হ্যাঁ। কেনো না। তুই স্যারকে ভালোভাবে বলতে পারবি, সবার পক্ষ থেকে প্রস্তাব এলো।

জুয়েল আর তিশা হেডমাস্টারের রুমে ঢুকলো। হেডমাস্টার গম্ভীরস্বরে বললেন, বল কী সমস্যা?

জুয়েল তিশাকে ইশারা করল, তিশা তুই বল।

তিশা বলতে শুরু করল, স্যার, মাহবুব স্যার অনেকদিন থেকে আমাদের তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। যারা প্রাইভেট পড়ে না তারা পড়া না পারলে মার দেন আর যারা প্রাইভেট পড়ে তারা না পারলেও কিছু বলেন না। আর বলছেন প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিবেন।

তোরা তো কেবল নাইন থেকে টেনে উঠলি। তোরা কীভাবে বুঝলি প্রাইভেট না পড়লে মার্ক কম দিবে।

তিশা বলতে শুরু করল, স্যার উনি আগে থেকে বলেন প্রাইভেট না পড়লে মার্ক কম দিবো আর এবার এস.এস.সি পরীক্ষায় তো সত্যি সত্যি যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েনি তারা প্রাকটিক্যালে কম মার্ক পেয়েছে।

ভালোভাবে লেখাপড়া করেনি, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা খারাপ দিয়েছে তাই রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

জুয়েল প্রতিবাদ করল, না স্যার। মাহবুব স্যারের কথা সবাই জানে। তাছাড়া যারা মাহবুব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছে তারা থিওরিতে কম পেয়েও প্রাকটিক্যালে বেশি পেয়েছে আবার যারা প্রাইভেট পড়েনি তারা থিওরিতে বেশি পেয়েও প্রাকটিক্যালে কম পেয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব, কথা বলতে বলতে জুয়েলের গায়ের ফর্সা রং লাল হয়ে গেল।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আচ্ছা তোরা যা আমি দেখছি বিষয়টা।

জুয়েল রাগান্বিতস্বরে বলল, আপনি যা হয় তাড়াতাড়ি করেন স্যার, আমরা কিন্তু আর মাহবুব স্যারের ক্লাস করবো না।

বাইরে থেকে ছাত্রছাত্রীরা জোরে স্লোগান দিলো, আমরা মাহবুব স্যারের ক্লাস করবো না।

হেডমাস্টার সাহেব কিছুটা ধমকের সুরে বলল, চুপ কর। আমি স্কুলের হেডমাস্টার, আমার কাছে অভিযোগ করছিস আমি এখন দেখবো বিষয়টা।

জি স্যার, যত তাড়াতাড়ি দেখবেন তত তাড়াতাড়ি আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো, জুয়েল এবং তিশা হেডমাস্টার সাহেব কে একথা শুনিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।

হেডমাস্টার সাহেব গজগজ করতে লাগলেন, এতটুকু ছেলেমেয়েরা কেমন শাসিয়ে গেলো আর এই মাহবুবকে এতো করে বলা যে প্রাইভেট পড়াটা তুমি ছেড়ে দাও। তারপরও টাকার লোভ ছাড়তে পারলো না, এখন সত্যি সত্যি যদি ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে, আজকাল এই বয়সের ছেলেরা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে,প্রায়দিন পত্রিকায় দেখি কিশোররা এই করেছে, সেই করেছে, যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু করে বসে, তবে মহাকেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, বলে হেডমাস্টার সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিলেন।

পিয়ন এলো, স্যার।

মাহবুব স্যারকে ডাক দাও।

জি স্যার, বলে পিয়ন চলে গেল।

এগারো

 

মাহবুব সাহেবের প্রাইভেট পড়ানো আর তার কাছে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার বিষয়টি এখন আর শুধু ছাত্র-ছাত্রী এবং মাহবুব সাহেবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেদিন বাসায় গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা তাদের মা-বাবাকে জানিয়েছে। রনিও তার বাবাকে বলেছে, সবকিছু শুনে হাসান সাহেব বললেন, এ ঘটনা যদি সত্যি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। তোদের হেড স্যার কী বললেন?

হেড স্যার বললেন, ব্যবস্থা নিবে।

আচ্ছা তাহলে আগে দেখা যাক তিনি কী ব্যবস্থা নেন।

রনি বলল, কিন্তু মাহবুব স্যার যদি থাকে তাহলে আমরা যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যাই না তার ওপর আজকে আমরা হেড স্যারের কাছে কমপ্লেইন করলাম তাদেরকে প্রাকটিক্যালে বারোটা বাজাই দিবে।

আচ্ছা দেখা যাক হেড স্যার তো মাহবুব সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থাও নিতে পারে।

আমার মনে হচ্ছে স্যাররা সবাই এক, হেড স্যার মাহবুব স্যারকে ডেকে কিছু বলবে তারপর যা হওয়ার তাই হবে।

কী হবে? হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

আমাদেরকেও প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিবে। তখন আমাদের রেজাল্ট খারাপ হবে, আমরা ভালো কোনো কলেজে চান্স পাবো না। আমাদের জীবন শেষ করে দিবে, কথার শেষ দিকে রনির কণ্ঠে হতাশা ফুটে উঠলো।

হাসান সাহেব আশ্বস্‌ করলেন, তোর এতো কিছু ভাবার দরকার নেই। আমি তো আছি।

আচ্ছা, বলে রনি তার পড়ার রুমে চলে গেল।

হাসান সাহেব রনিকে আশ্বস্‌ করলেন বটে কিন্তু তিনি নিজেও দুশ্চিন্তায় পড়লেন। দেখতে দেখতে দুনিয়াটা যেন কেমন হয়ে গেল। শিক্ষকের কাছে সব ছাত্রই সমান, একজন শিক্ষক ছাত্রকে দেখবেন নিজের সন্তানের মতো, একজন বাবা যেমন শুধু তার সন্তানের কল্যাণ কামনা করে একজন শিক্ষকও তাই করবেন। সারাজীবন হাসান সাহেব তাই দেখে এসেছেন, হয়তো এখনো তেমন কিন্তু মাহবুব সাহেবের মতো কিছু শিক্ষক শিক্ষকতার মহান পেশাকে অপমান করছে। বিদ্যাদানকে সেবার নামে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। রনি ঠিকই আশঙ্কা করছে, মাহবুব মাস্টার যদি এবারের মতো আগামী বছরেও তার কাছে প্রাইভেট পড়তে না যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয় তাহলে তো সত্যি সত্যি বাচ্চাদের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, উফফ, মানুষ এতো খারাপ হতে পারে, ধুর এসব ঝুট-ঝামেলা বাদ দিয়ে রনিকে প্রাইভেট পড়তেই পাঠাই।

হাসান সাহেব রনি বলে জোরে ডাক দিতেই সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো, বাবা।

শোন আমি বলি তুইও মাহবুব মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়।

রনি কিছুটা অবাক হলো, বাবা তুমি একথা বলছ। মাহবুব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া মানে টাকা দিয়ে মার্ক কেনা। উনি তো প্রাইভেটেও ভালো পড়ায় না। তখন আমার ইন্টারে কী হবে।

সবাই তো পড়ছে।

সবাই পড়-ক, আমি পড়বো না।

আচ্ছা তুই পড়তে বস। দেখি কী করা যায়।

শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো নতুন না, আগেও শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতেন, হাসান সাহেব নিজেও প্রাইভেট পড়েছেন। তবে আগে প্রাইভেট পড়া ছিলো ক্ষেত্র বিশেষে। ক্লাসে শিক্ষকরা যথাসাধ্য পাঠদান করতেন, দু’চারজন ছাত্র ক্লাসে পড়া রপ্ত করতে না পারলে তারাই শুধু প্রাইভেট পড়তো কিন্তু শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়া আর না পড়া ছাত্রদের মধ্যে বৈষম্য করতেন না। আর্থিক লাভের কারণে প্রাইভেট পড়াতেন না, ছাত্রদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রাইভেট পড়াতেন। দিন পাল্টে গেছে এখন শিক্ষকরা শুধু প্রাইভেটই পড়ান না, রীতিমতো প্রাইভেট বাণিজ্য করেন আর এই বাণিজ্যিক কারণেই বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। ক্লাসে বৈষম্যমূলক আচরণ করা, প্রমোশন পরীক্ষায় মার্ক বাড়িয়ে দেয়া, এস.এস.সি পরীক্ষায় প্রাকটিক্যালে মার্ক বাড়িয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখানো ইত্যাদি, ইত্যাদি।

হাসান সাহেব আবার রনিকে ডাক দিলেন। রনি হাসান সাহেবের সামনে এলো, বাবা।

তোর কাছে হেড স্যারের নাম্বার আছে?

আছে, বলে রনি তার ডায়েরি এনে হেডমাস্টার সাহেবের নাম্বার বলল।

হাসান সাহেব মোবাইল নাম্বার সেভ করে নিয়ে বললেন, আচ্ছা আমি দেখি, তুই যা এ নিয়ে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

রনি আবার তার রুমে গেল।

জুয়েল স্কুলের পুরো ঘটনা তার বাবাকে বলল। জহির সাহেব শুনে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবো এটাই হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু উচিত কাজ আর কোথায় হয়। জহির সাহেবও বুঝলেন, বিষয়টা এখন আর ছোটখাটো নেই, সেই সঙ্গে জুয়েলের ওপর কিছুটা মন খারাপ করলেন, জুয়েল সব কাজে মাথা ঢুকায়, আরে বাবা মাস্টাররা প্রাইভেট পড়ায় এটা কেউ বন্ধ করতে পারছে না, তোর মতো এক জুয়েল কি বন্ধ করতে পারবে? তুইও প্রাইভেট পড়, টাকা তো আমি দিবো, তোর এতো মাথাব্যথা কীসের?

বাবাকে কিছু বলতে না দেখে জুয়েল জিজ্ঞেস করল, বাবা।

হ্যাঁ বল।

কিছু বলছো না যে?

জহির সাহেব জুয়েলকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললেন, কী আর করবি, আমি তো ভাবছিলাম তুইও ভর্তি হয়ে যাবি মাহবুব স্যারের কাছে কিন্তু তা তো আর হওয়ার না। তুই তো পুরো স্কুলের নেতা সেজেছিস, মাস্টারদের ভাত মারার দায়িত্ব নিছিস।

বাবার কথায় জুয়েল প্রচণ্ড রেগে গেল, বাবা।

হ্যাঁ, তুই আবার কেনো হেড স্যারের কাছে কমপ্লেইন করতে গেলি।

বাবা, তোমাকে আমি খালি খালি বললাম। আমি জানতাম তুমি এরকমই বলবে।

কী করবি বল, এখন মাহবুব স্যার যদি তোকে প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয়?

সেজন্যই তো আমাদের দাবি আমরা মাহবুব স্যারের কোনো ক্লাস করবো না, আর ক্লাস না করলে তো উনি এস.এস.সি পরীক্ষার দায়িত্ব থেকেও বাদ পড়ে যাবেন।

জহির সাহেব বললেন, কাজটা মনে হয় এতো সহজ না।

জুয়েল দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, এটা আলাপ-আলোচনা করে সহজ না কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা উনার ক্লাস না করলে সম্ভব। তুমি দেখিও মাহবুব স্যার এবার একটা ধরা খাইছে।

আচ্ছা। আমি কালকে আগে আরো কিছু গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলি। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তোমরা গার্ডিয়ান, শিক্ষকরা মিলে কী করবা করো কিন্তু ছাত্ররা আর মাহবুব স্যারের ক্লাস করবে না।

জহির সাহেব সবই বুঝলেন কিন্তু জুয়েলকে এই ঝামেলা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করলেন, আচ্ছা তুই লেখাপড়া কর, এসব ঝামেলায় পড়ে তোর লেখাপড়ার না ক্ষতি হয়।

আমার কোনো ক্ষতি হবে না। তুমি দেখিও। আর আমি যেমন তোমাকে ক্লাস ফাইভ আর ক্লাস এইটে জিপিএ ফাইভ রেজাল্ট এনে দিয়েছি এবারো এনে দিবো তবুও তুমি রেজাল্ট খারাপের ভয় পেয়ো না।

জহির সাহেব কয়েক মুহূর্ত জুয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জুয়েলের বুদ্ধিমত্তা সেই শৈশব থেকেই তীক্ষ্ণ। যেকোনো পড়া অল্প সময়ের মধ্যে সে রপ্ত করতে পারে। সে তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র সামনে পি.এস.সি পরীক্ষা কিন্তু জহির সাহেবের মনে হতো জুয়েল প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম সময় পড়ালেখা করছে তাই তিনি সবসময় পড়ার জন্য চাপ দিতেন।

একদিন জহির সাহেব জুয়েলকে পড়ালেখায় অমনোযোগী দেখে বললেন, ভালো করে পড়ালেখা কর বাবা, না হলে যে রেজাল্ট খারাপ হবে।

একথা শুধু একবার না জহির সাহেব প্রতিদিন সুযোগ পেলেই বলতেন তখন একদিন জুয়েল তার রুম থেকে দৌড়ে জহির সাহেবের সামনে এলো, বাবা তুমি খালি আমাকে সবসময় পড় পড় বলো কেনো বলতো?

বলবো না। পড়ালেখা না করলে রেজাল্ট ভালো হবে কীভাবে, আর রেজাল্ট ভালো না হলে বড় অফিসার হবি কীভাবে?

তুমি কী রেজাল্ট চাও বলতো, জি.পি.এ ফাইভ, গোল্ডেন।

হ্যাঁ।

তাহলে তুমি চুপ করে থাকো। তুমি যেরকম রেজাল্ট চাও সেরকমই হবে।

জুয়েলের পি.এস.সি পরীক্ষা হলো, সে সত্যি সত্যি গোল্ডেন ফাইভ পেলো।

একই ঘটনা ঘটলো জুয়েল যখন ক্লাস এইটে জে.এস.সি পরীক্ষা দিলো। পরীক্ষার আগে পড়ার চাপ দেয়াতে এবারেও জুয়েল জহির সাহেবের সামনে এসে মৃদু হেসে বলল, বাবা তুমি কিন্তু আগের মতোই বলতে শুরু করছ। আমি কিন্তু এবারো তোমাকে গোল্ডেন ফাইভ রেজাল্ট এনে দিবো।

জহির সাহেব মুচকি হাসি হেসে বললেন, ক্লাস ফাইভ আর ক্লাস এইট কিন্তু এক না কাজেই ফাইভের মতো করে এইটে পড়লে হবে না, আরো বেশি পড়তে হবে।

আচ্ছা। আমি তো তোমাকে বলছি। তুমি দেখো আমি গোল্ডেন ফাইভ পাই কী না।

জহির সাহেব জুয়েলকে বললেন, কিন্তু এবার আমি ভাবছি প্রাকটিক্যালের কথা। মাহবুব স্যার যদি প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দিয়ে তোর রেজাল্ট খারাপ করে দেয়।

আমরা সেসুযোগ মাহবুব স্যারকে দিবো না।

জহির সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস টেনে বলল, আচ্ছা।

বারো

 

মাহবুব সাহেব স্কুল থেকে ফিরলেন কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মন নিয়ে। আজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে প্রাইভেটগুলো ছিলো অসুস্‌ বলে সবগুলো প্রাইভেট বাতিল করে দিলেন। তার মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সামলানো যায়, যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই তার বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবে কীভাবে।

তার চোখের সামনে হেডমাস্টার সাহেবের শক্ত চোয়ালের ক্রুদ্ধ মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো, তোমাকে এতো করে বলি ক্লাসে ভালো করে পড়াও তারপর যদি প্রাইভেট পড়ানো প্রয়োজন হয় তবে দু’য়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়াবা আর অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াও তাতে আমার কোনো বাধা নেই। আচ্ছা এখন যা হবার হয়েছে কীভাবে সামাল দেয়া যায় দেখো।

মাহবুব সাহেব মিনমিন করে বললেন, ছাত্রছাত্রীরা যে অভিযোগ করেছে তাও তো সত্যি না।

তদন্ত করে দেখলে সব বেরিয়ে আসবে। তখন যদি সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় তবে তো চাকরিটাও হারাবে।

মাহবুব সাহেব আর কথা বাড়াননি, হেডমাস্টার সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে অনেকক্ষণ বকাবাকি করলেন, মাহবুব সাহেব সব শুনে নীরবে উঠে এসেছেন।

সন্ধ্যায় হামিদুল সাহেব ফোন করলেন।

মাহবুব সাহেব ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী হয়েছে স্যার স্কুলে? হামিদুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

মাহবুব সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বললেন। সবকিছু শুনে তিনি খুব সহজে উড়িয়ে দিলেন, ও সেই কথা, আপনার বিরুদ্ধে তো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

তা নেই কিন্তু স্টুডেন্টদের দাবি তারা আমার ক্লাস করবে না, শুধু তারাই না আমাকে আর কোনোদিন ক্লাস টেনের ক্লাস নিতে দিবে না।

কিন্তু ব্যাপারটা কেমন অপমানজনক হয়ে গেল না।

সেটাই আর কী, এটাতে ছাত্ররা সফল হলে এরপর একে একে সবাইকে এভাবে বিদায় করার চেষ্টা করবে। আপনারা সবাই একটু হেডস্যারকে বোঝান স্যার প্লিজ!

আচ্ছা দেখি কথা বলে। কালকে আমরা সবাই মিলে হেডস্যারকে বলবো।

হেডস্যার আগামীকাল বিকেল তিনটায় কমিটির মিটিং ডেকেছেন, আপনারা কিছু বলতে চাইলে মিটিংয়ের আগেই বলতে হবে স্যার।

আচ্ছা মিটিংয়ের আগেই বলবো। তবে আপনিও বসে থাকবেন না, সবাইকে বলুন, ছাত্রদেরকেও বোঝান।

আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, স্টুডেন্টদেরকেও বলতে হবে।

আচ্ছা, ভালো থাকবেন স্যার।

আপনিও ভালো থাকবেন স্যার বলে মাহবুব সাহেব মোবাইল ফোন রেখে দিলেন।

মাহবুব সাহেব মোবাইল ফোন রাখতেই তার স্ত্রী রুমা চা আর বিস্কুট নিয়ে রুমে ঢুকলো। মাহবুব সাহেবের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার? স্কুলে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

তেমন কিছু না, তুমি কিছু ভেবো না, ঠিক হয়ে যাবে।

বেশি সমস্যা হলে আমাকে বলো, আমি ভাইজানকে বলি।

মাহবুব সাহেব তখন লেখাপড়া শেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের বাসায় বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়ায় আর সোনার হরিণ সরকারি চাকরির জন্য এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তর ছুটোছুটি করে কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সরকারি চাকরির বয়স শেষ হলো কিন্তু সোনার হরিণ ধরা দিলো না। তারপর শুরু হলো একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার, কোনো এন.জি.ও অথবা কোনো স্কুল-কলেজে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই মাহবুব সাহেব তখন অনেক খুশি কিন্তু সেখানেও আছে হাজার রকমের প্রতিবন্ধকতা, আছে উন্নয়ন ফান্ডে বড় অঙ্কের টাকা দেয়ার সক্ষমতা এবং তদ্বির।

এই তদ্বির আর বিপুল অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে মাহবুব সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয় হেডমাস্টার সাহেবের। প্রস্তাবটাও একটু অন্যরকম, প্রস্তাবটা প্রথমে মাহবুব সাহেবের পছন্দ হয়নি কিন্তু চাকরিটা হাতছাড়া হয় ভেবে সে প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছে। রুমা তখন এইচ.এস.সি পাস করে বি.এ ভর্তি হয়েছে, সে লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছাত্রী ছিল না। তার বি.এ পড়াটা ছিলো নামকাওয়াস্তে, মূলত সে তখন বিয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

মাহবুব সাহেবের চাকরির ব্যাপারে যখন কথা চলছিল তখন পাশাপাশি রুমার বিয়ের বিষয়টিও সামনে এলো। রুমা হেডমাস্টার সাহেবের বোন, রুমার সঙ্গে মাহবুব সাহেবের বিয়েটা ঠিক শর্তসাপেক্ষে ছিল না কিন্তু আলাপ আলোচনায় মিলে গেল। মাহবুব সাহেব খুব সহজে রুমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। মাহবুব সাহেবের গার্ডিয়ানদের দিক থেকেও কোনো নেতিবাচক মন্তব্য এলো না।

কোনোদিন মাহবুব সাহেবের চাকরিতে কোনো সমস্যা হয়নি আর হেডমাস্টার সাহেবকে তার কিছু বলতে হয়নি কিন্তু এবার বুঝি বলতে হয়। তারপরও মাহবুব সাহেব বললেন, আগে দেখি কোনদিকের পানি কোনদিকে গড়ায়।

রুমা বলল, কিন্তু তোমাকে দেখে আমারই খুব ভয় হচ্ছে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সামনে তোমার ভয়ংকর বিপদ।

মাহবুব সাহেব শুষ্কমুখে বললেন, দেখি না আগে।

আচ্ছা বলে রুমা বেরিয়ে গেল।

মাহবুব সাহেব হামিদুল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় বুঝতে পারলেন বসে থাকলে হবে না, ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে হবে, কমিটির সদস্যদেরও বোঝাতে হবে, হেডমাস্টার সাহেব তার আত্মীয় মানুষ, মুখে কিছু না বললেও মনে মনে তার পক্ষেই থাকবেন।

মাহবুব সাহেব প্রথমে টিটুকে ফোন করলেন কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে জুয়েল আর টিটুর সম্পর্ক ভালো না, তাই কোনোভাবে যদি টিটু আর জুয়েল মধ্যে দূরত্বটা আরো বাড়ানো যায়, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা বিভাজন সৃষ্টি করা যায় তবে এ যাত্রায় রক্ষা।

টিটু ফোন রিসিভ করল, হ্যালো, স্যার আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, টিটু।

জি স্যার।

কেমন আছিস?

ভালো স্যার। আপনি?

কী আর ভালো থাকি। তোরা তো ভালো থাকতে দিচ্ছিস না।

কেন স্যার?

কেন আবার সবই তো জানিস। তোরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে হেডস্যারের কাছে কমপ্লেইন করলি এখন তো সমস্যা।

আসলে সবাই মিলে না স্যার। আমি কমপ্লেইন করার পক্ষে ছিলাম না, জুয়েল খুব সামান্য বিষয়টাকে অনেক বড় করছে। ওই তো সবাইকে নিয়ে গেল। আমি ভিতরে যেতে চাইলাম কিন্তু হেডস্যার দু’জনের বেশি অ্যালাউ করল না, দু’জনের মধ্যে আবার একজন ক্যাপ্টেন। আপনারাই তো জুয়েলকে ক্যাপ্টেন করে দিছেন স্যার, এখন বুঝছেন।

আচ্ছা আগে যা হয়েছে সেটা ভেবে আর লাভ নেই। আচ্ছা কে কে গেছিলো আমাকে বলতো?

স্যার জুয়েল আর তিশা।

তিশা আবার গেল কেনো? ও তো আমার কাছে প্রাইভেট পড়ে, ভালো মেয়ে, ওর মাথায় আবার কী ভূত চাপলো। হাজার হলেও আমি তোদের স্যার। আমার বিরুদ্ধে ছাত্ররা কমপ্লেইন করতে হেড স্যারের কাছে যেতে পারে এটা আমার ধারণা ছিলো না। তুই একটা কাজ করতে পারবি?

কী কাজ স্যার?

তুই একটু আমার জন্য সবার সঙ্গে কথা বল না। তিশা তো তোর কাজিন, তিশাকে বল, ও যেন থেমে যায়। আর জুয়েল যদি যায় আর আমি যদি পরীক্ষার সময় দায়িত্বে থাকি তবে ওরই একদিন কী আমারই একদিন।

আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। আমি তিশাকে বলছি, ও যেন আর জুয়েলের সঙ্গে দলে যোগ না দেয়। আর জুয়েলকে আপনি পারলে ফেল করে দিয়েন। যেন ও জি.পি.এ ফাইভ না পায়।

তুই একটু আমাকে হেল্প কর। তুই দল ভারি কর। জুয়েলের পক্ষে যেন কেউ না যায়। একটা কথা মনে রাখিস আমি ক্লাস নিতে না পারলে তো তোরও কোনো উপকার করতে পারবো না।

আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, আমি দেখছি।

আচ্ছা দেখ। কী হয় রাতেই আবার আমাকে জানাস।

জি স্যার।

গভর্নিং বডিতে দু’জন শিক্ষক প্রতিনিধি আছে, তাদের মধ্যে একজন বাংলা শিক্ষক আরেকজন বায়োলজি শিক্ষক। বায়োলজি শিক্ষক তেমন সক্রিয় না কিন্তু বাংলা শিক্ষক সবসময় যেকোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাহবুব সাহেব বাংলা শিক্ষককে ফোন করলেন, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, স্যার কেমন আছেন?

মাহবুব সাহেব বললেন, ভালো নেই স্যার, আপনি শুনেছেন বোধ হয়।

কী বিষয়?

ওই যে ছাত্ররা হেড স্যারের কাছে আমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে।

হ্যাঁ শুনলাম।

এটা একটা কথা হলো স্যার, আপনিই বলুন। ছাত্ররা শিক্ষকের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করবে? আমরাও তো একসময় ছাত্র ছিলাম, শিক্ষকদের সামনে কোনোদিন মাথা উঁচু করে কথা বলিনি আর আজকালকার ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেন কী অবস্থা।

বাংলা শিক্ষক একটু টেনে টেনে বলেন, কথাটা তো আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার কিন্তু আগের শিক্ষক আর এখনকার শিক্ষকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আপনার কাছে প্রাইভেট পড়া আর না পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ আর প্রাকটিক্যালে মার্ক বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগটা সবাই জানে স্যার।

প্রাইভেট তো সারাদেশের সব শিক্ষকই পড়ায় স্যার। শুধু শুধু আমি পড়ালে দোষ।

প্রাইভেট পড়ানো অবশ্যই দূষণীয় স্যার। সব ছাত্রকে প্রাইভেট পড়তে হয় তাহলে আপনি ক্লাসে কী পড়ান স্যার?

বাংলা শিক্ষকের কথা শুনে মাহবুব সাহেবের মাথাটা গরম হয়ে গেল কিন্তু তিনি তবুও শান্ত কণ্ঠে মিনমিন করে বললেন, আসলে ফিজিক্স অনেক কঠিন সাবজেক্ট স্যার।

সব সাবজেক্টই কঠিন স্যার আর আপনি যদি মনে করেন ফিজিক্স কঠিন সাবজেক্ট তবে ক্লাসে আরো ভালো করে পড়ান।

এবার মাহবুব সাহেব আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলেন না। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তাহলে আপনি একজন শিক্ষকের মান-সম্মানের দিকটা দেখবেন না স্যার।

অবশ্যই দেখবো স্যার। আপনি একটা কথা বলছিলেন না আপনিও একসময় ছাত্র ছিলেন, হ্যাঁ আপনিও ছাত্র ছিলেন আমিও ছিলাম কিন্তু একটা কথা কী স্যার আপনার মতো কিছু শিক্ষকের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত অপমান হচ্ছি। আমি আপনার বিষয়টা দেখবো মাহবুব স্যার কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখবেন আজকালকার ছাত্ররা শুধু শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে এমনটা আশা করা যায় না।

আপনি কী বলছেন স্যার।

হ্যাঁ। আজকাল দেখছেন না ছাত্ররা কেমন, কাউকেই মানতে চাচ্ছে না।

বাংলা স্যারের সঙ্গে কথা হলো এ পর্যন্তই তিনি দেখবেন বললেন কিন্তু তার কথায় মাহবুব সাহেব আশ্বস্‌ হতে পারলেন না। তার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল।

তেরো

 

জুয়েল সবাইকে ফোন করে বলেছে। তিশা স্কুলের ছোটখাটো বিষয়ে বাড়িতে কিছু বলে না, সে নিত্যদিনের মতো পড়ছিল এমন সময় টিটু ফোন করল, হ্যালো তিশা।

হ্যালো, হ্যাঁ বল। কী খবর?

তোকে একটা কথা বলবো বলে ফোন করছি।

কী কথা বল?

শোন তুই তো মাহবুব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়িস, তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে তোর কী সমস্যা, স্যার তো তোর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে না। তোকে প্রাকটিক্যালেও কম মার্ক দিবে না। তুই…

টিটুর কথা শুনে তিশার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সে টিটুর কথার মাঝে বাধা দিয়ে রাগান্বিতস্বরে বলল, তুই কী বলতে চাচ্ছিস?

টিটু আমতা আমতা করে বলল, না মানে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। শোন তুই তো আমার কাজিন, তোকে বলতে আমার প্রবলেম নেই।

বল।

মাহবুব স্যার আমাকে ফোন করছিল।

তিশা গম্ভীর স্বরে বলল, তারপর…

বলল আমি এমন কী দোষ করেছি যে তোরা আমার বিরুদ্ধে হেড স্যারের কাছে কমপ্লেইন করছিস।

কী দোষ করেনি তুই বল। শোন টিটু সব ছাত্রছাত্রীরা মাহবুব স্যারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। আমি প্রাইভেট পড়ি এটা ঠিক, স্যার আমাকে প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দিবে না এটাও ঠিক কিন্তু আমি তো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বেইমানি করতে পারি না।

বেইমানির কী আছে, তুই তো একজন শিক্ষককেও অপমান করতে পারিস না।

মাহবুব স্যারকে শিক্ষক বললে ভুল হবে। তুই যেন আর কাউকে ফোন করিস না, সবাই কিন্তু মাহবুব স্যারের ওপর খুব ক্ষেপে আছে এসময় মাহবুব স্যারের পক্ষ নেয়াকে কেউ-ই ভালো চোখে দেখবে না।

তুই তাহলে মাহবুব স্যারের বিরুদ্ধে লড়াই করবি?

শুধু আমি কেনো, ক্লাসের সব ছাত্র-ছাত্রী মাহবুব স্যারের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, যদি হেডস্যার বিচার করতে না পারে তবে পুরো স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা লড়াইয়ে নামবে। শোন তোকে একটা বুদ্ধি দিই?

কী বুদ্ধি?

সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত কিন্তু তুই ক্যাপ্টেন ছিলি তোর এসব আচরণের কারণে কিন্তু তোকে আর কেউ ক্যাপ্টেন হতে দেয়নি। তুই আসলে সবসময় স্রোতের বিপরীতে চলিস, তোর সঙ্গে কয়েকদিন আগেই ফ্রেন্ডদের একটা ঝামেলা হয়ে গেল, এখনো সবকিছু নরমাল হয়নি, অনেকেই এখনো রেগে আছে। এসময় সবার মতামতের বিরুদ্ধে তুই আবার মাহবুব স্যারের পক্ষ নিচ্ছিস। এসব বাদ দে, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিস না।

তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস?

না জ্ঞান দিচ্ছি না। তোকে জ্ঞান দেয়ার মতো আমার জ্ঞানবুদ্ধি থাকলে তো।

আচ্ছা ঠিক আছে রাখ। তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বেকার হলো, বলে টিটু ফোনের লাইন কেটে দিলো।

মিটিং শুরু হলো। ছাত্রছাত্রীরা একের পর এক কথা বলতে শুরু করল, কারো কারো মধ্যে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রীদের উত্তেজনাপূর্ণ কথা শুনে তারা ঝিমিয়ে গেল। টিটু মিটিংয়ে জয়েন করেনি, অবশ্য তার কথা কেউ জিজ্ঞেসও করল না।

তিশা সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করল, আজ সবার কথা শুনে মনে হলো এখনো কারো কারো মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, কেউ কেউ এখনো ভাবছে আমার কী প্রয়োজন, আমি তো প্রাইভেট পড়ছি। চাইলে আমিও একথা বলতে পারতাম। কারণ আমিও কিন্তু মাহবুব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি, স্যার আমাকে প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দিবে না এটাও আমি কনফার্ম, তাহলে আমি কেনো স্যারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সবার দায়িত্ব, তাছাড়া আমাদের সব বন্ধুদের কি সাবজেক্ট ওয়াইজ টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়া সম্ভব, সবার সেই সামর্থ্য আছে? নেই, তাহলে প্রাইভেট পড়ানোর কারণে স্যার আমাদের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি করছে সে বৈষম্য দূর করতে চাইলে আমাদের একত্রিত হতে হবে, একটা কথা মনে রাখতে হবে, দশের লাঠি একের বোঝা। আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করবো, কোনো ঝামেলা হলে সবাই মিলে প্রতিরোধ করবো। আমরা আমাদের যেসব বন্ধুর প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই তাদের পাশে দাঁড়াবো। আপনারা কি সবাই আমাদের সঙ্গে একমত? যারা একমত আছো তারা সবাই কমেন্টসে জানিয়ে দাও।

সবাই কমেন্টসে তাদের সম্মতি জানালো।

আমি এখন জুয়েলকে আমাদের আগামীদিনের করণীয় জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।

তিশার পরে সবার শেষ বক্তা জুয়েল তার বক্তৃতা দেয়া শুরু করল, সবাইকে আমার শুভেচ্ছা। আমার মনে আছে আমরা যখন এই গ্রুপটা ক্রিয়েট করছিলাম তখন আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো আমরা প্রতি সপ্তাহে একদিন করে আধ ঘণ্টার জন্য গ্রুপে বসবো এবং আমরা সবাই আড্ডা দিবো কিন্তু আজ আমরা সবাই গ্রুপে আলোচনা করছি একজন শিক্ষকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যাহোক আমাদের এখন একটাই দাবি আমরা মাহবুব স্যারের ক্লাস করবো না। সেজন্য আমরা হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, হেডস্যার মিটিং ডেকেছেন, আগামীকাল বিকেলে মিটিং, দেখি মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়। তবে মিটিংয়ে যদি আমাদের দাবি না মানা হয় তবে আমরা গার্ডিয়ানদের সম্পৃক্ত করবো, শুধু ক্লাস টেনের না, পুরো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করবো এবং মিছিল মিটিং করবো। আমাদের আর পিছানোর পথ নেই। কী বলিস তোরা সবাই?

অনেকেই তাদের মতামত জানালো। সবাই জুয়েলের প্রস্তাবে সম্মতি জানালো।

জুয়েল আবার বলতে শুরু করলো, এখন পিছপা হলে মাহবুব স্যারের অন্যায় আরো বেড়ে যাবে, যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়বে না, তাদের কম মার্ক দিবেন, তখন আমাদের রেজাল্ট খারাপ হবে। আমরা ভবিষ্যতে ভালো কলেজে চান্স পাবো না, আমাদের পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

অনেকেই তাদের মতামত জানালো, তুই ঠিক বলেছিস। আমাদের আর পিছু ফেরার পথ নেই।

তাহলে আজকের মতো মিটিং শেষ হলো। সবাইকে ধন্যবাদ।

মিটিং শেষ করে জুয়েল তার ল্যাপটপ বন্ধ করতেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। টিটু ফোন করেছে, জুয়েল ফোন রিসিভ করল, হ্যালো, কী খবর দোস্ত? কেমন আছিস?

টিটু গম্ভীর স্বরে বলল, ভালো। তোদের মিটিং শেষ হলো।

জুয়েল প্রতিবাদ করল, শুধু আমাদের মিটিং না রে, তোরও মিটিং ছিলো। তুই জয়েন করিসনি, করলে ভালো হতো।

আমি তোদের মিটিং-সিটিংয়ে নেই। সব স্যাররা প্রাইভেট পড়ায় মাহবুব স্যারও পড়ায়। এটা নিয়ে তোর পানি ঘোলা করার দরকার কী বল।

কী বললি?

না তোর ভালোর জন্য বললাম, কেটে পড়।

এসব কী বলছিস তুই? কেটে পড়বো মানে?

আরে আমি বলছি তোর বাপেরও তো টাকার অভাব নেই। তুইও প্রাইভেট পড়, ভালো রেজাল্ট কর।

জুয়েল রেগে গেল, তোর আমাকে পরামর্শ দিতে হবে না টিটু, তুই তোর কাজ কর। সবাই জানলো তুই ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদের সময় বেইমানি করলি।

এতবড় কথা।

বড় কথা না, কথার কথা তাই বলে ফেললাম। তবে সবাই এখনো জানে না যে, তুই তলে তলে মাহবুব স্যারের দালালি করছিস। জানলে এবারও তোকে ধরবে।

ধরবে মানে? কী করবি আমাকে?

কী করবে, তোর ভালোর জন্য বলছি। আর কাউকে কিছু বলিস না, সবাই তোকে পিটাবে।

কী, কী বললি তুই, আমাকে পিটাবে। কার এতবড় সাহস।

স্কুলের সবাই এখন একত্রিত হয়েছে। তুই উল্টাপাল্টা কিছু করলে কার সাহস কত দেখবি। আচ্ছা তোর সঙ্গে তর্ক করে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না, বলে জুয়েল টিটুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।

 

চৌদ্দ

 

আজ বিকেল তিনটায় মিটিং। ফার্স্ট হাফ এ মাহবুব সাহেবের ক্লাস ছিলো, তিনি ক্লাসে গেছিলেন কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা মাহবুব সাহেবের ক্লাস করবে না। এখন টিফিন পিরিয়ড, শিক্ষকদের কেউ কেউ দোকানে নাস্তা করতে গেছেন, কেউ কেউ বাড়ি থেকে দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসেন তারা শিক্ষক কমনরুমে বসে গল্প করছেন।

ইসলাম ধর্ম শিক্ষক মুসা সাহেব প্রথম কথা তুললেন, মাহবুব স্যারের বিষয়টা কী হলো স্যার?

মুসা সাহেব কাউকে উদ্দেশ্য করে বলেননি কিন্তু উত্তর দিলেন গণিত শিক্ষক কামরুল সাহেব, আজকালকার ছাত্রদের হেটাম আছে। আজ তো মাহবুব স্যারের ক্লাস করল না। আজ মিটিং, আগে মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হোক দেখবে তারপর ক্লাস করবে। মিটিংয়ে যে কী সিদ্ধান্ত হয় সেটা বাংলা স্যার আর বায়োলজি স্যার আছে আমাদের শিক্ষক প্রতিনিধি তারা ভালো বলতে পারবেন। কী যে অবস্থা বায়োলজি স্যার।

বায়োলজি শিক্ষক লতিফ সাহেব গভর্নিং বডির সদস্য, শিক্ষক প্রতিনিধি, তারপরও তিনি কোনোকিছুর আগে পিছে নেই। মিটিং হয়, উপস্থিত থাকেন, সবার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, সই করেন, এ পর্যন্তই, তিনি বললেন, মিটিং তো আজ তিনটায়, কী যে হবে এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

মিটিং তো আজ তিনটায়, নোটিশ পেয়েছি তবে অবস্থা বুঝি খুব একটা ভালো না। মাহবুব স্যার তো খুব আতঙ্কে আছে, বাংলা শিক্ষক ফারুক সাহেব বললেন।

কামরুল সাহেব বললেন, তাই নাকি?

হ্যাঁ গতকাল রাতে মাহবুব স্যার ফোন করছিল, আমি কমিটির সদস্য তাই তদ্বির করছে, তদ্বির কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তদ্বির করে লাভ হবে না ফারুক সাহেব বললেন।

কী হবে স্যার? মুসা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

আর কিছু না হোক, মাহবুব স্যারের প্রাইভেট পড়ানোটা বন্ধ হবে।

মুসা সাহেব খুব খুশি হলেন, এটা তো হওয়াই উচিত। ছাত্ররা যদি প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করতে পারে তাহলে এটা হবে তাদের একটা বড় বিজয়। সারাদেশে এটা একটা নজির হয়ে থাকবে।

ফারুক সাহেব বললেন, আপনি খুশি হচ্ছেন স্যার কেউ ইসলাম ধর্ম প্রাইভেট পড়ে না বলে কিন্তু আমাদের গণিত, কেমিস্ট্রি স্যার তো এটা চাইবেন না, এমনকি বেশিরভাগ শিক্ষকই প্রাইভেট পড়ান। আপনার ইসলাম ধর্ম, আমার বাংলা আর আর্টসের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ান না, সুযোগ পেলে তারাও পড়াতেন বলে তিনি মুচকি হাসি হেসে বললেন, হয়তো আমি পড়াতাম।

কামরুল সাহেব বললেন, এতক্ষণে আপনি একটা কাজের কথা বলেছেন স্যার, সুযোগ থাকলে আপনিও পড়াতেন, ধর্ম শিক্ষকও পড়াতো। প্রাইভেট পড়ানোতে আমি দোষের কিছু দেখি না। তবে প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়া খুব অন্যায়।

মুসা সাহেব প্রতিবাদ করলেন, না স্যার, প্রাইভেট পড়ানো অবশ্যই দোষের। আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য বেতন পান, তারা যদি আপনার পড়ানো বুঝতে না পারে বা রপ্ত করতে না পারে তবে সেটা আপনার ব্যর্থতা। আপনি সেটা কভার করার ব্যবস্থা করবেন। আপনি প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ক্লাসে ভালোমতো পড়াবেন না আর বলবেন প্রাইভেট পড়, বাসায় আয় এটা হয় না। ক্লাসে ফাঁকি দেয়ার জন্য তার রুজিটাই হারাম হয়ে যাবে। আর রুজি হালাল না হলে কোনো এবাদত কবুল হবে না।

লতিফ সাহেব এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিলেন, এবার কথা বললেন, আমি তো স্যার ক্লাসে ফাঁকি দিই না, সাধ্যমতো পড়াই, কাউকে প্রাইভেট পড়তে আসতেও বলি না কিন্তু তবু ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে আসে। তাহলে আমি কী করবো স্যার?

আপনি প্রাইভেট পড়াবেন না স্যার, ক্লাসে আরো ভালোভাবে পড়াবেন। দেখুন আমি, বাংলা স্যার, আর্টসের স্যাররা তো প্রাইভেট পড়াই না, ছাত্রছাত্রীরা তো আমাদের সাবজেক্টে খারাপ রেজাল্ট করে না স্যার। তাহলে ভালো রেজাল্ট করার জন্য কেনো ফিজিঙ, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স, বায়োলজি প্রাইভেট পড়তে হবে কেনো?

ফারুক সাহেব বললেন, আমি এতো যুক্তি তর্ক বুঝি না তবে ছাত্ররা যেভাবে ক্ষেপেছে তাতে করে আমার মনে হয় ওরা এবার মাহবুব স্যারের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করবে।

হামিদুল সাহেব এতক্ষণ ছিলেন না। তিনি রুমে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, এটা যদি তারা করতে পারে তাহলে শিক্ষকদের আর মান-সম্মান থাকলো না। তখন যেকোনো বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা হস্তক্ষেপ করবে।

মুসা সাহেব আবারো বললেন, ছাত্রছাত্রীরা অন্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে কেনো আর করলেই বা স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটা মানবে কেনো? তবে এটা হতে পারে যে এরপর অন্য স্যার যারা প্রাইভেট পড়ায় তাদেরও প্রাইভেট বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করতে পারে।

হামিদুল সাহেব মুসা সাহেবের ওপর কিছুটা ক্ষিপ্ত হলেন, আপনার সুযোগ থাকলে আপনিও প্রাইভেট পড়াতেন স্যার। প্রাইভেট অনেক আগে থেকে চলে আসছে, কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকার প্রাইভেট বন্ধ করতে পারেনি আর সামান্য ক’টা ছাত্র প্রাইভেট বন্ধ করবে, এটা সম্ভব না। এটা হতে দেয়া যায় না। আর ঐ যে ছেলেটা আছে না, জুয়েল ও একটু বেশি পাকামো করে। এতটুকু একটা ছেলে মুখে মুখে কথা বলে।

আমি তো ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়িয়েছি স্যার। ও খুব নায্যবাদী ছেলে, একটু উনিশ-বিশ হলেই প্রতিবাদ করে। সব ছাত্রছাত্রীরা ওর দলে যোগ দিয়েছে, আমার বিশ্বাস ও প্রাইভেট বন্ধ করেই ছাড়বে আর একবার যদি মাহবুব স্যারের প্রাইভেট বন্ধ করতে পারে তবে সব স্যারেরই প্রাইভেট বন্ধ করতে পারবে, মুসা সাহেব বললেন।

আপনি তাই দোয়া করুন, ক্ষোভের সঙ্গে হামিদুল সাহেব বললেন।

অবশ্যই করবো। প্রতিষ্ঠান বা সরকার যেসব কাজ পারে না ছাত্ররা সেসব কাজ পারে, পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। ছাত্ররা প্রাইভেট বন্ধ করতে পারলে এটা একটা নজীর তৈরি হবে এবং একে একে সব স্কুলে প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে, বাংলা স্যার, বায়োলজি স্যার আপনারা তো শিক্ষক প্রতিনিধি, আপনারা যেন ন্যায়ের পথে থাকেন মুসা সাহেব বললেন।

আমি জোরালো ভূমিকা রাখবো হুজুর আপনি চিন্তা করবেন না এখন বায়োলজি স্যার যদি মিনমিন করে তাহলে তো সমস্যা, বায়োলজি স্যার তো আবার নিজেই প্রাইভেট পড়ান বলে তিনি লতিফ সাহেবের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

লতিফ সাহেব বললেন, আমি আপনার সঙ্গে আছি স্যার কিন্তু আমি কিছু বলতে পারবো না, আপনি যা বলবেন আমি তাতেই রাজি। আর প্রাইভেট পড়ানোর কথা বললেন না, আমি নিজেও প্রাইভেট পড়াতে চাই না কাজেই যদি বাদ দিতে হয় তো হবে। বাদ দিবো এটা নিয়ে আমি ভাবি না।

মাহবুব সাহেব ভিতরে ঢুকতে গিয়ে হয়তো শেষের দিকের কিছু কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি রুমে ঢুকে দেখলেন সবাই কেমন চুপ, সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে তিনি লতিফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, থামলেন কেনো স্যার বলুন। সবাই তো আমার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছেন।

লতিফ সাহেব প্রতিবাদ করলেন, আমরা উঠে-পড়ে লাগিনি স্যার, আপনি টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আপনি যদি আপনার কাছে প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়ার কথা না বলতেন তবে কিছুই হতো না। আপনার জন্য আমরা সবাই আজ একটা বিতর্কের মধ্যে পড়ে গেছি।

আমার জন্য বিতর্কে পড়েছেন, না? মান হানি হয়েছে আপনাদের। নিজেরা ছোট সমস্যাকে বড় করতে না চাইলে তো মিটে যেতো, সবাই চুলকে ঘা করতে চাইলে তো হবে মাহবুব সাহেব কথাগুলো রাগান্বিত স্বরে বললেন।

ফারুক সাহেব পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য মৃদুকণ্ঠে বললেন, মাহবুব স্যার মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, আস্তে কথা বলুন।

মাহবুব সাহেব আরো জোরে কথা বললেন, আমি আপনাকে ফোন করলাম আমাকে হেল্প করার জন্য আর আপনি আমার বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন।

আমি কোথায় উসকানি দিচ্ছি স্যার। আপনার প্রাকটিক্যালে মার্ক কমিয়ে দেয়ার কথাটা কেউ মানতে পারছে না। আপনি পুরো শিক্ষক সমাজের মাথা হেঁট করেছেন। আর কথা বলবেন না, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন আর এ যাত্রায় বেঁচে গেলে নিজেকে সংশোধন করুন।

মুসা সাহেব বললেন, মানুষ ভুল করতেই পারে, কেউ যদি খাস দিলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন।

আপনি কথা বলবেন না স্যার। আপনারা এমনভাবে বলছেন মনে হয় আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি। সারাদেশের সব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ায়, আমিও পড়াই।

সবার বিরুদ্ধে তো কমপ্লেইন হয় না স্যার, মুসা সাহেব বললেন।

ফারুক সাহেব বললেন, আর প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়ার কথা?

মাহবুব সাহেব আর কথা বললেন না। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যার যার ক্লাসে চলে গেলেন।

 

পনেরো

 

মিটিং শুরু হয়েছে। সভাপতি, হেডমাস্টার, কমিটির সব সদস্যগণসহ প্রায় পনেরো ষোলো জন মানুষ প্রধান শিক্ষকের রুমে বসেছে কিন্তু রুমে এতোগুলো মানুষ থাকা সত্ত্বেও তেমন সাড়া-শব্দ নেই, রুমে একটা থমথমে ভাব। হেডমাস্টার সাহেব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মাহবুব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুব বলতো গতকালকে ক্লাস টেনে তোমার ক্লাসে কী হয়েছিল?

মাহবুব সাহেব একবার সবার মুখের দিকে তাকালেন, তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, কয়েকদিন আগে ক্লাস টেনের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে আমাকে বলল এবার যেসব ছাত্র-ছাত্রীর এস.এস.স্থিতে রেজাল্ট খারাপ করেছে তাদের সবারই নাকি ফিজিক্সে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। আমি বললাম হতে পারে, লেখাপড়া না করলে তো রেজাল্ট খারাপ হবেই।

কিন্তু তারা বলল প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয়ার জন্য নাকি রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। আমি বললাম, তাহলে মার্কসিট আসুক তারপর কথা বলো। সেদিন থেকে তারা মার্কসিট আসার অপেক্ষায় ছিল। এখন মার্কসিট আসার পর তারা নাকি দেখেছে যাদের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তাদের ফিজিক্স প্রাকটিক্যালে মার্ক কম দেয়ার জন্য খারাপ হয়েছে।

সভাপতি সাহেব মাহবুব সাহেবকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, হেড স্যার যারা ফিজিক্সে খারাপ করেছে তাদের মার্কসিটগুলো বের করেন তো দেখি।

হেডমাস্টার সাহেব আগেই কাগজপত্রগুলো কমিটির সামনে উপস্থাপনের জন্য একটা ফাইলে রেখেছিলেন। তিনি ফাইলটা সভাপতি সাহেবের হাতে দিতেই বললেন, আপনারা দেখুন, আরো দু’জন শিক্ষক প্রতিনিধি আছে তারাও দেখুক। অন্যান্য সদস্যরাও দেখেন তারপর মতামত দিন।

কয়েক মিনিট সবাই মিলে মার্কসিটগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘটনার সত্যতা জানালেন। এবার সভাপতি সাহেব নিজে দেখার জন্য মার্কসিটগুলো চাইলেন, এবার আমাকে দিন তো দেখি।

সভাপতি সাহেব শিক্ষিত মানুষ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন, চাকরির চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু কথায় বলে না সোনার হরিণ, সেই সোনার হরিণ তার কপালে জুটেনি তাই ব্যবসা করেন। অবশ্য ব্যবসায় তিনি সফলও হয়েছেন। শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ সভাপতি হওয়ায় স্কুল পরিচালনায়ও তিনি দক্ষ।

সভাপতি সাহেব একে একে কয়েকটা মার্কসিট দেখতে দেখতে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, চোয়াল দুটো শক্ত হলো। তিনি রাগান্বিতস্বরে মাহবুব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাহবুব সাহেব ঘটনা তো দেখছি সত্যি, কয়েকজন ছাত্র যারা থিওরিতে নাইনটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে তারা প্রাকটিক্যালে সিক্সটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে আবার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী থিওরিতে সিক্সটি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে তারা প্রাকটিক্যালে হান্ড্রেট পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছে, এটা কীভাবে সম্ভব?

মাহবুব সাহেব ডানে-বাঁয়ে তাকালেন, সবার মুখ অন্ধকার, যেন আষাঢ়ের মেঘ জমেছে, তার চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছবি ভেসে উঠলো। তিনি মিনমিন করে বললেন, প্রাকটিক্যালের মার্ক তো আমি দিই না, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়, ভাইভা হয়, এঙটার্নাল সেগুলো দেখে। এসব মিলিয়েই তো প্রাকটিক্যালের মার্ক, এখানে শুধু আমার দোষ কীভাবে?

সভাপতি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন, কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন মাহবুব সাহেব কিন্তু অভিযোগটা উঠেছে যারা আপনার কাছে প্রাইভেট পড়েনি তারাই শুধু কম পেয়েছে, মানে আপনার কাছে প্রাইভেট পড়া আর প্রাকটিক্যালে কম মার্ক এর মধ্যে একটা লিংক আছে। কথাটা কি সাত্যি?

আমি এভাবে দেখিনি ভাই, সব ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়েছে, যে ভালোভাবে লেখাপড়া করেছে সে ভালো রেজাল্ট করেছে, যে ভালোভাবে লেখাপড়া করেনি সে খারাপ করেছে।

এটা তো আপনি গতানুগতিক কথা বললেন, দেখেন মাহবুব সাহেব তদন্তে যদি আপনি দোষী প্রমাণিত হোন তবে কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, বলে সভাপতি ফারুক সাহেবকে বললেন, ফারুক সাহেব যারা প্রাকটিক্যালে বেশি মার্ক পেয়েছে তাদের নাম বলুন আর তারা প্রাইভেট পড়েছে কী না নিশ্চিত করুন। আবার যারা কম মার্ক পেয়েছে তাদের নাম বলুন আর নিশ্চিত করুন তারা প্রাইভেট পড়েছে কী না। মাহবুব সাহেব আগে আপনি বলুন কারা পড়েছে আর কারা পড়েনি। তারপর সেটা আবার যাচাই হবে।

ফারুক সাহেব একজনের নাম লিখে মাহবুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এ পড়েছে?

মাহবুব সাহেব হ্যাঁ বা না বললেন। এভাবে একে একে সবার তথ্য নেয়া শেষে সভাপতি সাহেব ফারুক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, এবার মার্ক কম-বেশি আর প্রাইভেট পড়া কিংবা না পড়া যাচাই করে দেখেন, পাশে পাশে লিখবেন যেন সহজে বোঝা যায়।

সব যাচাই করে ফারুক সাহেব সভাপতি সাহেবকে কাগজগুলো দিলেন, দেখে সভাপতি সাহেব বললেন, দেখেন হেডস্যার, দেখেন, মাহবুব সাহেবের দেয়া তথ্যে কী বেরিয়ে এলো।

মাহবুব সাহেব কোনো কথা বললেন না। সভাপতি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি প্রাকটিক্যালও প্রাইভেট পড়ান নাকি?

মাহবুব সাহেব মাথা নত করেই না সূচক মাথা নাড়লেন।

সভাপতি সাহেব বললেন, আপনি যাদের প্রাইভেট পড়ালেন থিওরি তারা থিওরিতে মার্ক বেশি পেলো না, বেশি পেলো প্রাকটিক্যালে। আবার যারা প্রাইভেট পড়েনি তারা থিওরিতে মার্ক পেলো বেশি আর প্রাকটিক্যালে মার্ক পেলো কম।

মাহবুব সাহেব এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারলেন না, মাথা নত করে বসে রইলেন।

মিটিংয়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। সভাপতি সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমার আর মাহবুব সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আপনাদের জানার কিছু থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

কেউ কিছু বলল না।

সভাপতি সাহেব বললেন, মাহবুব সাহেব আপনি এখন আসুন।

মাহবুব সাহেব যেভাবে মাথা নত করে বসেছিলেন, সেভাবেই চলে গেলেন। তারপর রুদ্ধ দ্বার বৈঠক শুরু হলো।

ততক্ষণে ক্লাসের বাইরে বিশেষ করে ক্লাস টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মাহবুব সাহেবকে নিয়ে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলল, এবার মাহবুব স্যারের একটা ব্যবস্থা হবে আবার কেউ কেউ বলল, মাহবুব স্যার হেডস্যারের কেমন যেন আত্মীয় হয়, দেখিস কিচ্ছু হবে না।

জুয়েল বলল, কিচ্ছু না হলে আমরাও উনার ক্লাস করবো না। দরকার হলে সব ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের এক করতে হবে।

টিটু পাশ থেকে মিনমিন করে বলল, কারো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোর কথা শুনবে।

রনি টিটুর পাশেই ছিলো, সে প্রতিবাদ করল, টিটু তুই এটা ঠিক বলছিস না। সবাই একদিকে আর তুই আরেক দিকে যাচ্ছিস।

রনির কথা শুনে জুয়েল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রনি?

মুকুল বলল, টিটু বলল কারো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোর কথা শুনবে।

জুয়েল রেগে লাল হয়ে গেল, টিটু অনেক সহ্য করেছি আর কিন্তু করবো না। সব ছাত্র-ছাত্রী যখন এক দাবিতে অনড় তখন তুই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভাঙ্গন তৈরি করার চেষ্টা করছিস।

আমার ইচ্ছা, আমি কি তোদের কেনা নাকি যে তোদের সাথে আমাকেও একমত হতে হবে।

ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলো।

অবস্থা বেগতিক দেখে তিশা সবাইকে থামানোর চেষ্ট করল, এই কী হচ্ছে এসব, কী হচ্ছে?

টিটু সবাইকে একদিকে দেখে ভড়কে গেল।

তিশাও টিটুর ওপর রেগে গেছে, টিটু তুই ভালো হয়ে যা। সব ছাত্র-ছাত্রী যখন একটা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে তখন তুই সবার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছিস।

টিটু আমতা আমতা করে বলল, না, মানে আমি…

তিশা বলল, সবসময় তুই স্রোতের বিপরীতে চলিস। এই অভ্যাটা ত্যাগ কর।

গণিত শিক্ষক কামরুল সাহেব এলেন। ছাত্রছাত্রীরা উঠে দাঁড়ালো।

এই গ্যাঞ্জাম করছিস কেনো? কী হয়েছে? বস সবাই।

সবাই বসল। কামরুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোদের বলতো?

কেউ কিছু বলছে না, একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

কামরুল সাহেব বললেন, আচ্ছা কিছু বলতে হবে না। তোদের কথা তোদের মধ্যেই থাক। এখন পড়া শুরু হোক।

গণিত ক্লাস শুরু হলো কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন আজ ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে মনোযোগ নেই। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা বিরাজ করছে। তিনি আবার সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আজ তোদের ক্লাসে মনোযোগী দেখছি না কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, ক্লাসে কিন্তু মনোযোগী না হলে চলে না। খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতে হয়। কী হয়েছে তোদের বলতো?

জুয়েল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা আর মাহবুব স্যারের ক্লাস করবো না।

মাহবুব স্যারের ক্লাস করবি না সেটা অন্য বিষয়, আমার ক্লাস তো করবি?

করবো কিন্তু আজ সবাই খুব আপসেট স্যার।

আচ্ছা, মনোযোগ না থাকলে ক্লাস করে লাভ নেই। গ্যাঞ্জাম করিস না, কী হয় দেখ। তবে আমি তোদের একটা কথা বলি।

জুয়েল বসে পড়ল। কামরুল সাহেব বলতে শুরু করলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে নেই। শিক্ষকদের মধ্যে ভালো-মন্দ, উনিশ-বিশ থাকবেই, সব মানুষ তো আর একরকম না, তাই বলে স্টুডেন্টরা টিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে এটা হয় না। আচ্ছা আমি কিছু বললে তোরা আবার মন খারাপ করবি। তোদের মনোযোগ নেই আজ আমি আসি, বলে কামরুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরেই ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলো।

ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। সবার কৌতূহলী চোখ জুয়েল আর তিশার দিকে। জুয়েল আর তিশা বিব্‌্রতকর অবস্থায় পড়লো। তিশা বলল, জুয়েল চল হেডস্যারের কাছে।

চল, তবে শুধু তুই আর আমি না আজ সবাইকে হেডস্যারের রুমে ঢুকতে হবে।

কথামতো সবাই বেরিয়ে পড়লো।

হেডমাস্টার সাহেব তখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সব ছাত্র-ছাত্রীদের তার রুমে ঢুকতে দেখে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন, কী হয়েছে তোদের? আবার কী?

তিশা শান্ত কণ্ঠে বলল, স্যার মাহবুব স্যারের কী করলেন?

হেডমাস্টার সাহেব টেনে টেনে কথা বলতে শুরু করলেন, কমিটির মিটিং হয়েছে, তদন্ত হয়েছে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জুয়েল বলল, স্যার আমাদের তো আবার ক্লাস আছে এরমধ্যে সিদ্ধান্ত না হলে তো আমাদের পড়ালেখার ক্ষতি হবে।

আমরা দেখছি বিষয়টা কাল পরশু তো স্কুল বন্ধ, এরমধ্যে একটা সিদ্ধান্ত হবে। তোরা ভালোভাবে লেখাপড়া কর।

জুয়েল পিছনে ঘুরে তাকালো। ছাত্রছাত্রীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। জুয়েল বলল, তোরা কী বলিস?

সবাই বলল, আর দু’টা দিনই তো।

ষোল

 

স্কুলের বিষয়টা শেষ পর্যন্ত রাজনীতির ময়দান পর্যন্ত গড়িয়েছে, অবশ্য আজকাল সবকিছু শেষটা হয় রাজনীতির ময়দানে। মাহবুব সাহেব কমিটির ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। পার্টি অফিসের স্মরণাপন্ন হয়েছেন, পার্টির নেতারা ফোন করেছেন হেডমাস্টারকে, হেডমাস্টার অবশ্য হ্যাঁ না কিছু বলেননি, তিনি কমিটির কথা বলে সরে পড়েছেন। বাসায় এসে কথাগুলো ডলার বলল টিটুকে তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর তো একটু কিছু হলেই আমাকে বলিস কিন্তু এতবড় একটা ঘটনা আমাকে জানালি না।

টিটু আমতা আমতা করে বলল, ভাইয়া আসলে আমি তো প্রাইভেট পড়ি, আমার জন্য কোনো সমস্যা না। অনেকেই প্রাইভেট পড়ে না, তারা মাহবুব স্যারের নামে উল্টোপাল্টা একটা কমপ্লেইন করেছে।

কী কমপ্লেইন করেছে?

মাহবুব স্যার নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের সমান চোখে দেখে না, প্রাইভেট না পড়লে প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয়।

কমপ্লেইনগুলো কি সত্যি?

টিটু মিনমিন করে বলল, কিছুটা সত্যি।

তাহলে তো ছাত্রছাত্রীরা ঠিকই করছে। এবার মাহবুব স্যারের সমস্যাই হবে। আমার তা মনে হয় শুধু যারা প্রাইভেট পড়ে না তারা না, সব ছাত্রছাত্রীরা নাকি এক হয়েছে।

কিছুটা সেরকমই বলে টিটু একবার ডলারের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুরোধের সুরে বলল, ভাইয়া, মাহবুব স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন, আমি চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু জুয়েল বিষয়টা এতো জটিল করেছে যে সবাই এখন মাহবুব স্যারের বিপক্ষে চলে গেছে। হাজার হলেও মাহবুব স্যার আমাদের স্যার তার বিরুদ্ধে এভাবে ষড়যন্ত্র করা ঠিক হচ্ছে না। তুমি একটু দেখো না মাহবুব স্যারের বিষয়টা।

আমি কী দেখবো?

মাহবুব স্যার থাকলে আমার অনেক উপকার হবে।

কী উপকার?

পরীক্ষার সময় স্যার আমাকে হেল্প করবে, তাছাড়া…

ডলার টিটুর কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, তাছাড়া কী?

মাহবুব স্যার আমাকে পরীক্ষার হলে শিখিয়ে দিবে, প্রাকটিক্যালে মার্ক বেশি দিবে, তাছাড়া তুমি তো জানোই প্রতিবছরের মতো মাহবুব স্যার যদি আগে কোয়েশ্চিন পায় তবে আমাকে হেল্প করবেই।

মাহবুব সাহেব অবশ্য এই পরিবারের একজন হিতাকাঙ্ক্ষী। তিনি ডলারকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন, রিনিকে পড়িয়েছেন। টিটু সত্যিই বলেছে, মাহবুব সাহেব থাকলে টিটুর কাজে লাগবে কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন। ছাত্রছাত্রীরা, কমিটির সদস্যরা এমনকি শিক্ষকদের একাংশ পর্যন্ত তার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ডলার টিটুকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আচ্ছা আমি দেখছি কিছু করতে পারি নাকি?

টিটু একরকম বায়নার সুরে বলল, দেখা যাক না, আমি জানি তুমি চাইলে পারবে। তুমি কোনো বড় নেতাকে দিয়ে হেডস্যারকে ফোন করালেই হবে।

ডলার কয়েকমুহূর্ত কী যেন ভেবে নিলো তারপর বলল, আচ্ছা দেখি তুই ভালোভাবে পড়াশোনা কর।

মিটিংয়ের সিদ্ধান্তহীনতায় মাহবুব সাহেব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন, যদি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হতো এবং তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতো তাহলে তিনি নিশ্চিন্ত হতেন উল্টো তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় তিনি সাধ্যমতো তদ্বির করে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে কমিটির তদন্ত যে তাকে দোষী সাব্যস্‌ করার দিকেই এগুচ্ছে এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। মাহবুব সাহেব পার্টি অফিস, বন্ধু-বান্ধব, ছাত্রদের গার্ডিয়ান সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটু রাত করেই বাসায় ফিরলেন।

রুমা দরজা খুলে দিয়েই যেন চমকে উঠলো। কিছু জিজ্ঞেস করল না, মাহবুব সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকে একটা সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো। রুমা একবারে লেবুর রস দিয়ে এক গ্লাস সরবত তৈরি করে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো, আগে খেয়ে নাও।

এই একটা দিকে মাহবুব সাহেব নিশ্চিন্ত আছেন, জীবনে যত ঝড়-ঝাপ্টাই আসুক না কেনো রুমা তার পাশে আছে সর্বদা, হাসিমুখে।

মাহবুব সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রুমা একটা সুন্দর হাসি হেসে সরবতের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল, আগে সরবত খাও।

মাহবুব সাহেব একটা মুচকি হাসি হেসে সরবত খাওয়া শেষ করতেই রুমা গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে মাহবুব সাহেবের পাশে বসল, এখন বলো, প্রবলেমটা কি বেশি জটিল হচ্ছে?

আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

কীরকম? মিটিং হয়েছে?

হ্যাঁ কিন্তু লক্ষণ ভালো না।

তাহলে আমি এক কাজ করি।

বলো।

কাল-পরশু তো স্কুল বন্ধ আছে, আমি বরং একবার ভাইজানের সঙ্গে দেখা করে আসি।

আগে আরো দু’য়েকদিন দেখা যাক।

মাহবুব সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। টিটু ফোন করেছে। মাহবুব সাহেব ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো।

আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, কী খবর টিটু?

অপর পাশ থেকে টিটু কথা বলছে মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলেন, তার মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হতে লাগলো। শেষে মাহবুব সাহেব টিটুকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলেন।

মাহবুব সাহেব যখন টিটুর সঙ্গে কথা বলছিলেন রুমা তখন মাহবুব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মাহবুব সাহেব মোবাইল ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করল, ভালো কিছু।

আচ্ছা দেখি বলে তিনি ডলারকে ফোন করলেন, হ্যালো ডলার।

জি স্যার বলেন।

মাহবুব সাহেব নিজেকে ডলারের স্যার বলে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন, আমি তোর স্যার, মাহবুব স্যার।

আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসলাম। স্যার কেমন আছেন?

আমি তো একটা ঝামেলায় পড়ে তোকে ফোন করলাম। তুই জানিস বুঝি বিষয়টা।

জি স্যার, শুনেছি।

তুই একটু দেখ না বিষয়টা, এই দু’য়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বিষয়টা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করছে, সঙ্গে কয়েকজন টিচারও আছে মনে হয়, সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করছে। দুনিয়াতে তো কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। তুই একটু দেখ তো বাবা, আমাকে একটু হেল্প কর, বলে মাহবুব সাহেব অনেকক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলেন। তিনি যতটা আশা নিয়ে ডলারকে ফোন করেছিলেন ততটা উজ্জ্বলতায় যেন কিছুটা ভাটা পড়লো। তিনি মোবাইল ফোন কান থেকে নামাতেই রুমা জিজ্ঞেস করল, কী বলল?

আসলে ও ঠিকই বলেছে। ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়েছে। রুমা তুমি এক কাজ করো।

বলো কী কাজ।

তুমি বরং হেড স্যারের বাসায় কাল সন্ধ্যায় একবার যাও।

আচ্ছা।

শুধু রুমার ওপর মাহবুব সাহেব আস্থা রাখতে পারলেন না। শুক্রবার দিন সন্ধ্যায় রুমা আর তিনি হেডমাস্টার সাহেবের বাসায় গেলেন। আগে যতবার মাহবুব সাহেব হেডমাস্টার সাহেবের বাসায় গেছেন ততবারই গেছেন শুধু আত্মীয় হিসেবে কিন্তু আজকের যাওয়াটা যেন একটু অন্যরকম। মাহবুব সাহেবের নিজেকে আসামি আসামি মনে হচ্ছে।

হেডমাস্টার সাহেব কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন তারপর রুমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর একটা মেয়ে না?

হ্যাঁ।

কোন ক্লাসে পড়ে যেন?

ক্লাস নাইনে।

কোন স্কুলে?

ওকে তো ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে, রংপুর দিয়েছি।

হেডমাস্টার সাহেব যখন কথাগুলো জিজ্ঞেস করছিলেন মাহবুব সাহেবের তখন মনে হলো হয়তো এমনি জানার জন্য জিজ্ঞেস করছেন কিন্তু যখন হেডমাস্টার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন তখন মাহবুব সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। হেডমাস্টার সাহেব এবার বললেন, একটা মেয়ে, স্কুলের একটা চাকরি আছে, গ্রামে কিছু জমিজমা আছে এতেই তো সংসার ভালোভাবে চলতে পারে, একটা জীবনে আর কত টাকা লাগে?

হেডমাস্টার সাহেব কথাটা রুমাকে বললেও উদ্দেশ্যটা যে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা একথা বুঝতে মাহবুব সাহেবের বাকি রইল না।

রুমা যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করল, ভাইজান আসলে এরকম তো কখনো হয়নি, আর প্রাইভেট তো শুধু ও পড়ায় না সারাদেশের মানুষ পড়ায়। আমরা আমাদের মেয়েটাকে ক্যান্ট পাবলিকের মতো ভালো একটা স্কুলে দিয়েছি তারপরও তো প্রাইভেট পড়াতে হয়।

প্রাইভেট পড়ায়, প্রাকটিক্যালের মার্ক তো আর বিক্রি করে না, ছিঃ এমন একটা অভিযোগ যা শুধু মাত্র মাহবুবকে না পুরো শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। এতক্ষণ কথাগুলো হেডমাস্টার সাহেব রুমার সঙ্গে বলছিলেন এবার মাহবুব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন ছাত্ররা আর তোমার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, ওদের ধারণা তুমি ক্লাস নিলে এবং পরীক্ষার ডিউটি করলে ওদের প্রতি বৈষম্য করা হবে, যারা প্রাইভেট পড়ে না ওদের তুমি কম মার্ক দিবা। গত এস.এস.সি পরীক্ষার মার্কসিটেও এটাই প্রতিফলিত হয়েছে। এই আস্থার সংকটটা আমি দূর করি কীভাবে।

মাহবুব সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, স্যার এবারের মতো মাফ করে দিন আর ভুল হবে না।

আমি মাফ করলেই কী আর হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তুমি তো জানোই আমাদের সভাপতি সাহেব ভালোমানুষ তিনিও অভিযোগের সত্যতা পেয়ে খুব মন খারাপ করেছেন। এখনো আমাকে তেমন কিছু বলেননি আবার শিক্ষকদের মধ্যেও দলাদলি আছে, কয়েকজন শিক্ষক চায় তোমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আচ্ছা দেখা যাক।

হেডমাস্টার সাহেবের কথা শুনে মাহবুব সাহেবের গলা শুকিয়ে গেল, স্যার আপনি একটু চেষ্টা করুন, আপনি চাইলে…

হেডমাস্টার সাহেব মাহবুব সাহেবের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললেন, থাক আর বলতে হবে না। আচ্ছা একটা কথা বলতো তুমি যখন ছাত্র ছিলে তখন কি তোমাকে সব সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়তে হয়েছিল।

মাহবুব সাহেব কথা বললেন না হেডমাস্টার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আগে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী প্রাইভেট পড়তো না, দুয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী পড়তো তবুও সব সাবজেক্ট না, দুয়েকটা সাবজেক্ট আর এখন সব ছাত্র-ছাত্রীকে সব সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়তে হয় তাহলে ক্লাসে কী পড়াও? আমি ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করি তারা ঠিকই বলেছে, অনেক গার্ডিয়ান আছে যাদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর সামর্থ্য নেই তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে? ছাত্রছাত্রীরা আমার চোখ খুলে দিয়েছে, এবার আমি স্কুলে প্রাইভেট বন্ধ করবো। তুমিও প্রস্তুতি নাও, কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবে না।

মাহবুব সাহেব কোনো কথা বলার সুযোগই পেলেন না, হেডমাস্টার সাহেব একা একা অনেকক্ষণ নীতিবাক্য শুনিয়ে চা-নাস্তা খাইয়ে আলোচনা শেষ করলেন। শেষে বললেন, দেখি আমি কীভাবে একটা সহজ সমাধানে যাওয়া যায়। টেনশন করো না।

 

সতের

 

সি.আই.ডি’তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলার তদন্ত চলছে কয়েক বছর ধরে, কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বার বার ফেল করায় তারা সি.আই.ডি’র সন্দেহভাজনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে রিনি অন্যতম, সি.আই.ডি সন্দেহভাজন শিক্ষার্থীদের তালিকা অনুযায়ী তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তাদের অভিভাবকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও কোচিং সেন্টারের মালিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে এবং সন্দেহভাজন শিক্ষার্থী ছাড়া সবাইকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সি.আই.ডি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।

রিনি এসবের কিছুই জানে না। তার বাবা কিংবা ভাই কেউ কিছু জানে না, জানার কথাও না, তারা জানে রিনির মেডিক্যালে ভর্তির সময় তারা কোয়েশ্চিন কিনেছিল এবং ভর্তির পর সব নিভে গেছে। রিনি এখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে একদিন না একদিন তো পাস করবেই।

সেদিন ডলারের মোবাইল ফোনে একটা ফোন এলো, ডলার ফোন রিসিভ করল, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

ডলার বলছেন? ভারী কণ্ঠস্বর যেন গমগম করছে।

জি।

রিনি আপনার কে হয়?

বোন, আপনি কে বলছেন প্লিজ?

আমি সি.আই.ডি ইন্সপেক্টোর হাবিব বলছি।

সি.আই.ডি’র কথা শুনে হাবিবের গলা শুকিয়ে গেল, স্যার ওর কোনো সমস্যা হয়েছে?

না, এখনো হয়নি। ওরতো সমস্যা হবেই আপনিও সমস্যামুক্ত নন।

কেন স্যার, কী হয়েছে?

কী হয়েছে সেটা এসে শুনবেন, আপনি বাসা থেকে বেরিয়ে আসুন, আপনার বাসার গেটে আমাদের টিম দাঁড়িয়ে আছে। কোনোরকম পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। কোনো সিন ক্রিয়েট করবেন না। ডলার জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। সে কী করবে ভেবে পেলো না। সে কয়েকজনকে মোবাইল করল কিন্তু কেউ তার মোবাইল ফোন রিসিভ করল না। তাদের দলের কাছের লোকজনও কি ব্যস্ত নাকি সবাই জানে যে সি.আই.ডি তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। দুঃসময় এমনই হয়, কাউকে কাছে পাওয়া যায় না, যেন প্রকৃতিও বিদ্রুপ করে।

টিটু বাইরে ছিলো সে বাসায় ঢোকার সময় বাসার সামনে মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে এসে ডলারকে বলল, ভাইয়া মাইক্রোবাসের ওরা কি তোমার কাছে এসেছে?

কী দেখলি?

বাইরে একটা মাইক্রোবাস আর কয়েকজন লোক।

ডলার চাপাস্বরে বলল, শোন কাউকে এখনই কাউকে কিছু বলবি না, ওরা সি.আই.ডি থেকে এসেছে, কেনো জানি আমাকে ডাকছে।

সি.আই.ডি শোনার পর থেকে ডলারের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে, তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সি.আই.ডি শোনার সঙ্গে সঙ্গে টিটুও খুব ভয় পেয়েছে, ভাইয়া ওরা কি তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে?

জানি না, যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় আর যদি রাতেই ফিরে আসি তো কাউকে কিছু বলবি না আর যদি রাতে ফিরে না আসি তবে বাবাকে বলিস, কথাগুলো বলতে বলতে ডলারের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ডলারের মোবাইল ফোন বেজে উঠল, সে দেখলো ইন্সপেক্টোর হাবিব আবার মোবাইল করেছে।

ডলার বাসা থেকে বের হতেই ইন্সপেক্টোর হাবিব আবার জিজ্ঞেস করলেন, ডলার?

জি।

গাড়িতে উঠুন।

আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

মেডিক্যালের কোয়েশ্চিন ফাঁসের মামলায় আপনার নাম এসেছে, আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার সসম্মানে ফেরত দিয়ে যাওয়া হবে আর বলে ইন্সপেক্টোর হাবিব মৃদু হেসে বললেন, বুঝতেই পাচ্ছেন।

ডলার মাইক্রোবাসে উঠলো।

সকালবেলা ডলারকে যাদের মুখোমুখি করা হলো তাদের একজন ডাক্তার মাহাতাব, ডলারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রিনির মেডিক্যালে ভর্তির আগে। ডলারকে দেখে ডাক্তার মাহাতাব বলল, ও আপনি?

ডাক্তারের চোখে-মুখে হতাশা, গালে-মুখে আঘাতের চিহ্নও স্পষ্ট। ডলারের আর বুঝতে বাকি রইলো না তাকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য।

অন্য একজন অফিসার এলেন, ডাক্তার মাহাতাব আর ডলারকে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে তিনি ডলারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম তো ডলার?

জি স্যার।

আপনি বলে ডাক্তার মাহাতাবের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একে চিনেন?

ডলার ভয়ে ভয়ে বলল, না স্যার।

অফিসার ডলারের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন, ঠিক বলছেন কী না ভেবে বলুন।

অফিসার ছাড়াও সম্ভবত কয়েকজন পুলিশই ছিলো, লম্বা-চওড়া এবং ভয়ঙ্কর ধরনের, রুমে কয়েকটা রশি এবং ইলেকট্রিক ক্যাবল ছড়ানো ছিলো। প্রতিটি উপকরণ দেখে ডলারের মনে হলো এটাই বুঝি রিমান্ড রুম, সিনেমা নাটকে সে দেখেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে অনেক ভয়ঙ্কর কথাও শুনেছে।

ডলার কী বলবে ভেবে পেলো না।

অফিসার তাড়া করলেন, সত্য কথা বলুন, নইলে বলে সেই লম্বা-চওড়া ভয়ঙ্কর প্রকৃতির চেহারার লোকগুলোর দিকে ইশারা করে বললেন, এরা আপনার মুখ থেকে সত্যি কথা বের করবে।

অফিসার আবার বলতে শুরু করলেন, একে আপনি চিনেন, এর সঙ্গে আপনার একাধিকবার দেখা হয়েছে, অনেকবার ফোনে কথা হয়েছে, পাঁচ লক্ষ টাকার একটা চেকও দিয়েছেন। এখন বলুন এতোগুলো হিনটস দেয়ার পরও কি আপনার মনে পড়ছে না যে এই ক্রিমিনালটা আসলে কে? নাকি আমার লোকজন আপনাকে আরো কিছু হিনটস দিবে?

দেয়ালের কোনে কয়েকটা লাঠি ছিল। একজন একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতেই অফিসার নিষেধ করলেন, থাক।

মি. ডলার বলুন ডাক্তার মাহাতাবকে আপনি পাঁচ লাখ টাকার চেক কী জন্য দিয়েছিলেন?

ডলার মাহাতাবের দিকে তাকাতেই অফিসার বললেন, নো, এদিক-সেদিক তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজ থেকে সব সত্যি কথা বলুন।

আমার বোন রিনি সেবার মেডিক্যালে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিল। অ্যাডমিশন টেস্টের কয়েকদিন আগে আমার ডাক্তার মাহাতাবের সঙ্গে পরিচয় হয়।

অফিসার গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে?

উনি আমাকে ফোন করেছিলেন।

তারপর-

আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। উনার সঙ্গে দেখা হলে উনি বললেন, বলে ডলার একবার মাহাতাব সাহেবের দিকে তাকালেন।

কী বললেন? অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন যে আপনার বোন তো মেডিক্যালে অ্যাডমিশন টেস্ট দিচ্ছে।

আমি বললাম, হ্যাঁ।

উনি বললেন, আপনি চাইলে আমি আপনার বোনকে মেডিক্যালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

আমি বললাম, কীভাবে?

উনি তখন আমাকে বললেন, আমি আপনাকে কোয়েশ্চিন সাপ্লাই দিবো এবং অ্যাডমিশনের পুরো দায়িত্ব নিবো।

আমি বললাম তো আমাকে কী করতে হবে?

তখন তিনি বললেন, পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।

আমি ভাবলাম, রিনি তেমন ভালো ছাত্রী না, তাই টাকা-পয়সা খরচ করে যদি মেডিক্যালে অ্যাডমিশন করাতে পারি তাহলে ওর জীবনটার একটা দাম হয়ে যায়। তাই রাজি হয়ে গেলাম।

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, এটা সেই চেক?

জি স্যার।

বোনের জীবনের দাম করার জন্য কোয়েশ্চিন কিনে বোনকে মেডিক্যালে ভর্তি করালেন কিন্তু এখন ভাইবোন দু’জনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।

 

আঠারো

 

রবিবার দিন যথারীতি চালু হলো, সবার মধ্যে একটা ধারণা ছিলো আজ আবার মিটিং বসবে এবং মাহবুব সাহেবের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিমতো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে আর কিছু না হোক মাববুব সাহেবের এবার প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ হবে। মাহবুব সাহেবের প্রাইভেট পড়ানো এবং প্রাকটিক্যালের মার্ক বিক্রি করার বিষয়টি এখন আর শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয় না। এ বিষয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও একটা দ্বিধাবিভক্তি তৈরি হয়েছে।

টিফিনের সময় হলো শিক্ষকদের আলাপ-আলোচনার সবচেয়ে ভালো সময়। তখন অবশ্য শুধু আলাপ-আলোচনায় হয় না, কুৎসা রটনা, পরচর্চা সবকিছুই হয়। সবাই পরস্পরের মধ্যে কথা বলছিলেন আর বায়োলজি শিক্ষক লতিফ সাহেব ফেসবুক চালাচ্ছিলেন, হঠাৎ করে তার চোখ যেন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে থেমে গেল। চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি নিউজটা আরেকবার পড়লেন তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, স্যার একটা খবর দেখেছেন?

সবাই মনোযোগী হলো। কামরুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?

শুনুন তো খবরটা ঠিক কি না?

মুসা সাহেব বললেন, খবরটা পড়বেন তো, কিছু না পড়েই বলছেন খবরটা ঠিক কি না।

লতিফ সাহেব জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন, মেডিক্যালে অ্যাডমিশন টেস্টের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ভাইবোনসহ আরো তিনজন গ্রেফতার, বলে তিনি পাশে বসে থাকা কামরুল সাহেবকে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখেন তো স্যার আমি ভুল পড়ছি নাকি?

কামরুল সাহেব পড়ে যা বললেন তার বিবরণ হলো, মেডিক্যালে অ্যাডমিশন টেস্টের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে সি.আই.ডি’র দীর্ঘ তদন্ত শেষে কফিলউদ্দীনের মেয়ে রিনি এবং ছেলে ডলারসহ মাহাতাব নামে এক ডাক্তারকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের আদালতে হাজির করা হলে বিজ্ঞ বিচারক তাদের জেল হাজতে প্রেরণের আদেশ প্রদান করেন।

লতিফ সাহেব খবরটা শুনে বললেন, এরকম একটা সন্দেহ কিন্তু আমার আরো আগে হয়েছিল, রিনি তো আসলে এতো ভালো ছাত্রী না কিন্তু মেডিক্যালে চান্স পেলো কীভাবে?

সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ধনী মানুষের ছেলেমেয়েরা এভাবে কোয়েশ্চিন কিনে মেডিক্যালে চান্স পায় তাইতো গরীব মানুষের মেধাবী ছেলেমেয়েরা মেডিক্যালে চান্স পায় না। আল্লাহ চাইলে কী না করতে পারে। আমরা হয়তো আল্লাহর মহিমা বুঝতে পারি না, বলে মুসা সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন।

মাহবুব সাহেব চুপচাপ বসেছিলেন। তিনি খবরটা শুনে কিছুটা হতাশ হলেন। ডলার তাকে সহযোগিতা করার কথা বলেছিল কিন্তু এখন সেই ডলারই তো হাজতে।

মুসা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, এখন থেকেই আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত পাপ করলে শাস্তি পেতে হয়।

রবিবার ফিজিক্স ক্লাস ছিল না, সোমবার ক্লাস ছিলো কিন্তু হলো না। একটু একটু করে ঘটনাটা কেমন যেন ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলো। অবশেষে সবাই সোমবার রাতে আবার ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসলো। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকালও যদি হেডস্যার মাহবুব সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়, মাহবুব সাহেবের পরিবর্তে অন্য কোনো শিক্ষককে দিয়ে ফিজিক্স ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা না করে তবে কালকে ক্লাস টেনের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করবে এবং মিছিল করবে।

মঙ্গলবার যথারীতি স্কুল চালু হলো। একের পর এক ক্লাস চলছে, আজকের ফিজিক্স ক্লাস নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা কৌতূহল ও উত্তেজনা ছিলো। ফিজিক্স ক্লাসের সময় হলো, কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলো কিন্তু কোনো শিক্ষক এলো না, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হলো, একে অপরকে জিজ্ঞেস করল, কী হবে? আজকেও বুঝি ক্লাস হবে না।

সবাই যেন জুয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জুয়েল সবার উদ্দেশ্যে বলল, এখন তো সবাই আছিস। সবাই বল কী করা যায়?

ক্লাসে আবার একটা গুঞ্জন শুরু হলো, চল সবাই হেডস্যারের কাছে যাই।

পিছন থেকে কে যেন একজন বলল আমার মিছিল করতে করতে যাই।

জুয়েল কিছু বলার আগে অতি উৎসাহী একজন স্লোগান দিতে শুরু করল, মাববুব স্যারের বিচার চাই।

সেই স্লোগানওয়ালার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী সমবেত কণ্ঠে বলল, মাহবুব স্যারের বিচার চাই।

জুয়েল তিশার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কী করা যায়?

কী আর করা যায়, সবাই যা চাচ্ছে তার সঙ্গে আমরাও আছি।

চল।

সবাই মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, পিছন থেকে জুয়েল ডাক দিলো, এই থাম সবাই।

কিন্তু ততক্ষণে মিছিল হেডমাস্টার সাহেবের অফিসের কাছে চলে গেছে।

সবাই হেডমাস্টার সাহেবের অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো, জুয়েল আর তিশা পিছন থেকে গিয়ে সবার সামনে দাঁড়ালো। জুয়েল আর তিশা দু’জনে হেডমাস্টার সাহেবের অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকলো।

হেডমাস্টার গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো তোমাদের?

জুয়েল বলল, স্যার আমাদের ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে না।

কেন হচ্ছে না।

স্যার আপনি তো জানেন, মাহবুব স্যারের ক্লাস করতে ছাত্রছাত্রীরা ভয় পায়। প্রাইভেট না পড়লে উনি আমাদের নির্যাতন করেন আর প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেন, ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন নিয়ে খেলা করেন।

হেডমাস্টার সাহেব জুয়েল আর তিশার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে দাঁত গজগজ করে বললেন, তোরা এই বয়সে খুব বেশি পেকেছিস।

জুয়েল জিজ্ঞেস করল, স্যার কিছু বললেন?

তোদের কমপ্লেইনের পর আমরা মিটিং করেছি, একটা সমাধানের চেষ্টা করছি কিন্তু সমাধানটা এতো সহজ না, সেজন্য তোদের ধৈর্য ধরতে হবে।

এবার তিশা বলল, স্যার আজ তিনদিন ফিজিক্স ক্লাস হয় না, আমরা তো ধৈর্য ধরেছি স্যার কিন্তু সমাধানটাও তো তাড়াতাড়ি করতে হবে।

তোরা বল বিকল্প কী সমাধান চাচ্ছিস, মাহবুব স্যারের ক্লাস কেউ তার মতো ভালো পড়াতে পারবে না। টিচার হিসেবে তো মাহবুব স্যার ভালো নাকি তোরাই বল?

কয়েকজন বাইর থেকে মিনমিন করে বলল, এটা অবশ্য হেড স্যার ঠিক বলেছেন।

তাহলে মাহবুব স্যারকে কি বাদ দেয়া ঠিক হবে? হ্যাঁ, আমরা বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।

চেষ্টাটা একটু তাড়াতাড়ি করেন স্যার, আমাদের তো ক্ষতি হচ্ছে।

হেডমাস্টার সাহেব জুয়েলের কথায় রেগে গেলেন। তোদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা তো আমিও স্বীকার করছি এবং বলছি, বলছি তো বিকল্প খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমি চাইলেই হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। মাহবুব স্যার ফিজিক্স পড়ায়, সে হিসেবে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় তারই ডিউটি পড়বে আবার কোচিং একটা ন্যাশনাল ট্রেডিশন, যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। আমিও প্রাইভেট পড়েছি, তোদের মা-বাবা’রাও প্রাইভেট পড়েছে। কেউ প্রাইভেট বন্ধ করতে পারছে না আর আমি তো একটা স্কুলের হেডমাস্টার মাত্র।

হেডমাস্টার সাহেব যখন কথা বলছিলেন সবাই তখন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তিশা বলল, স্যার কালকেও আমাদের ফিজিক্স ক্লাস আছে।

আচ্ছা তোরা যা বাবারা আমি দেখছি। কালকে ক্লাস থেকে যেন ক্লাস চালু করা যায় সেটা দেখছি।

পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এই জুয়েল চল। আর একটা দিনই তো।

আমরা তাহলে আসি স্যার।

হেডমাস্টার সাহেব অভিজ্ঞ মানুষ, তিনি দীর্ঘদিন এই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক ছিলেন প্রায় দশ বছর আগে হেডমাস্টারের দায়িত্ব পেয়েছেন। সবমিলিয়ে তার প্রায় পঁচিশ বছরের চাকরি। তার কত ছাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশাসনের বড় বড় অফিসার হয়েছেন। আগে ছাত্ররা শিক্ষকদের কথার প্রতিবাদ করতো না, আগের দিনেও শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতো কিন্তু এখনকার মতো ঢালাওভাবে নয়। কিছু ছাত্র-ছাত্রী যারা ক্লাসের পড়া রপ্ত করতে পারতো না, তারা পড়তো আর কোনো কোনো গার্ডিয়ান যাদের টাকা-পয়াসার কোনো অভাব নেই তারা বিলাসিতা করার মতো তাদের সন্তানদের প্রাইভেট পড়াতো। কিন্তু শিক্ষকরা পরিশ্রম করে, ছাত্রদের পড়িয়ে টাকা নিতো, কোনো রকমের পক্ষপাতিত্ব বা প্রমোশন পরীক্ষায় বেশি মার্ক দেয়ার প্রতিশ্রুতি বা তখনকার দিনের মেট্রিক পরীক্ষায় প্রাকটিক্যালে মার্ক বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিতো না।

এখনকার দিনে শিক্ষকরা ক্লাসে ভালো পড়ায় না, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়। যারা প্রাইভেট পড়ে না তাদের প্রতি শিক্ষকরা বৈষম্যমূলক আচরণ করে, আর তাই ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে অপমান করে, অসম্মান করে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। বলতে গেলে শিক্ষকরা নিজেদের শ্রদ্ধা ও সম্মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা চলে যাওয়ার পর হেডমাস্টার সাহেব কয়েকমুহূর্ত ঝিম মেরে বসে রইলেন তারপর মাহবুব সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। মাহবুব সাহেব শিক্ষক কমনরুমেই ছিলেন। পিয়ন এসে হেডমাস্টার সাহেবের কথা বলতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেলেন।

মাহবুব সাহেবের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে, দেখলে বোঝা যায় তার ওপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার?

বসো।

হেডমাস্টার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, দুদিন ধরে ক্লাস টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে না।

মাহবুব সাহেব মাথা নত করে বসে রইলেন।

তদন্ত তো সেদিন বুঝলা, তোমার প্রতিকূলে যাচ্ছে।

মাহবুব সাহেবের গলা শুকিয়ে গেল, কী রকম স্যার?

নিয়ম অনুযায়ী এম.পি.ও ভুক্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে পারে না।

মাহবুব সাহেব মিনমিন করে বললেন, কিন্তু সারাদেশের সব শিক্ষকই তো প্রাইভেট পড়ায় স্যার।

হেডমাস্টার সাহেব রেগে গেলেন, কারো বিরুদ্ধে তো কমপ্লেইন নেই আর তোমার বিরুদ্ধে, শুধু প্রাইভেট পড়ানো না, প্রাইভেট না পড়া ভালো ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও প্রাকটিক্যালে কম মার্ক দেয়ার অভিযোগ আছে এবং কমিটি তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সত্যতাও পেয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে তোমার চাকরিটাই থাকবে না। তখন বলিও সবাই প্রাইভেট পড়ায়, শুধু আমাকে শাস্তি দেয়া হলো কেনো?

মাহবুব সাহেব বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা জটিল হচ্ছে। তিনি একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বললেন, আপনি একটু ম্যানেজ করার চেষ্টা করুন স্যার।

সে চেষ্টাই তো করছি। তুমি আপাতত প্রাইভেট পড়ানোটা বাদ দাও।

মাহবুব সাহেব যেন আঁতকে উঠলেন, স্যার।

হ্যাঁ। প্রাইভেট না পড়ালে আর স্বজনপ্রীতির কমপ্লেইনটা আসবে না।

প্রাইভেট না পড়লে কি সব ছাত্রছাত্রীরা ভালো করতে পারবে?

তুমি ভালোভাবে পড়াবে আর যদি কোনো ছাত্র-ছাত্রী না বোঝে তো ক্লাসের পরে তুমি স্কুলেই পড়াবে, তোমার দায়িত্ব ফিজিক্স পড়ানো, প্রাইভেট পড়ানো ছাড়াই কীভাবে ছাত্রছাত্রীরা রেজাল্ট ভালো করবে সেটা তুমি বুঝবে আর যদি ছাত্রছাত্রীরা খারাপ করে তবে তোমার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

মাহবুব সাহেব আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, হেডমাস্টার সাহেব হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বললেন, আগে চাকরিটা রক্ষা করো মাহবুব, বাকিসব আপাতত ভেবো না, তোমার জন্য আজকে ছাত্রদের কাছে শিক্ষকদের ছোট হতে হলো।

স্যার এই নিয়ম কি শুধু আমার জন্য?

হেডমাস্টার সাহেব থমকে গেলেন তারপর কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা আমি কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দেখি, তাহলে সবার জন্যও একই নিয়ম করা যেতে পারে।

 

উনিশ

 

হেডমাস্টার সাহেব পরদিন সকাল এগারোটায় আবার কমিটির মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে মাহবুব সাহেবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির কারণে ক্লাস টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসের ক্ষতি এবং মিছিল করে তার কাছে আসার কথা কমিটিকে জানালেন। কমিটির সদস্যরা অনেকেই মাহবুব সাহেবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এমনকি সভাপতি নিজেও মাহবুব সাহেবকে শাস্তি দেয়ার পক্ষে তাদের মতামত প্রদান করলেন।

হেডমাস্টার সাহেবের চোখের সামনে মাহবুব সাহেবের অসহায় মুখটা ভেসে উঠল। হাজার হলেও মাহবুব সাহেব তার আত্মীয়, তার কোনো ক্ষতি হলে দায় কিছুটা হলেও তার ওপরও পড়বে। তাই হেডমাস্টার সাহেব মাহবুব সাহেবকে গুরুতর কোনো শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন, আমার একটা প্রস্তাব আছে।

সবাই হেডমাস্টার সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন।

আমরা চাইলে তো মাহবুবকে শাস্তি দিতেই পারি সেটা বড় কথা না কিন্তু একটা কথা কি সবাই ভেবেছেন ফিজিক্সের টিচার হিসেবে মাহবুব এই শহরের নামকরা টিচার।

সবাই স্বীকার করলেন।

তাই আমি ভাবছিলাম মাহবুবকে যদি শুধু প্রাইভেট পড়ানোটা বাদ দেয়া যায় তবে মাহবুব একজন ভালো টিচার আর প্রাইভেট বাদ দিলে ও আর স্বজনপ্রীতি করবে না। প্রয়োজনবোধে ওকে আমরা পরীক্ষার ডিউটিও করতে দিবো না।

হেডমাস্টার সাহেব যখন বলছিলেন সভাপতি সাহেব তখন মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, হেডমাস্টার সাহেব একটা সুন্দর সমাধান বের করেছেন। আমার পছন্দ হয়েছে আপনারা সবাই যদি সম্মত হোন তাহলে মাহবুব সাহেবকে সতর্ক করে দিয়ে আবার ক্লাসে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে তাতে করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা মাহবুব সাহেবের মতো একজন ভালো শিক্ষকের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হবে না। তাছাড়া চাইলেও মাহবুব সাহেবের মতো ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে না আবার স্কুলের একজন শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে নতুন একজন শিক্ষক পাওয়াও খুব কঠিন কাজ।

সবাই সভাপতি সাহেবের কথায় সম্মতি দিলেন।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, তখন একটা প্রশ্ন উঠবে।

কী প্রশ্ন? সভাপতি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

স্কুলের আরো কয়েকজন টিচার তো প্রাইভেট পড়ায়, তারা যদি সবাই প্রাইভেট পড়ায় আর আজকের সভা থেকে যদি শুধু মাহবুবের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত হয় তবে তার ওপর অন্যায় করা হবে।

কমিটিতে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আছেন। তিনি খুব কম কথা বলেন, বেশিরভাগ সময় তিনি চুপচাপ শুনে থাকেন এবং সবার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। আজও তিনি এতক্ষণ চুপচাপ শুনেছিলেন, এবার কথা বললেন, ও সভাপতি সাহেব আমি একটা কথা বলি।

সভাপতি সাহেব বললেন, বলেন চাচা, বলেন।

প্রাইভেট পড়ানোটা বন্ধ করে দেয়া যায় না। আমাদের স্কুলের কোনো মাস্টার, আমাদের স্কুলের কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবে না। তাদের যদি ইচ্ছা হয় তাহলে তারা অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াবে।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, তখন তো ছাত্রছাত্রীরা রেজাল্ট খারাপ করতে পারে চাচা।

তা কেনো করবে, মাস্টারদের কাজই তো ভালোভাবে ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো, তারা যদি ক্লাসের মধ্যে ভালোভাবে না পড়ায় আর ছাত্রছাত্রীরা রপ্ত করতে না পারে তাহলে যারা পারলো না, মাস্টাররা বিকেলে সেই পড়া পড়াবে, প্রয়োজনবোধে স্কুল মাস্টারদের অতিরিক্ত সম্মানি দিবে। ঠিক করা যায় কী না সবাই একবার ভেবে দেখেন। জিনিসপত্রের যে দাম তার ওপর মাসে মাসে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

সভাপতি সাহেব সম্মত হলেন, চাচা ঠিকই বলেছেন। আপনারা সবাই কী বলেন?

সবাই সম্মতি প্রদান করলেন।

সভাপতি সাহেব বললেন, তাহলে সিদ্ধান্ত হলো এই স্কুলের কোনো শিক্ষক আর এই স্কুলের কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। কোনো কোনো ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসে পড়া রপ্ত করতে না পারলে টিচাররা বিকেলবেলা আলাদাভাবে শুধু সেসব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবেন। সেজন্য শিক্ষকদের আলাদা করে সম্মানি দেয়া হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সভায় সম্মানি দেয়া হবে।

হেডমাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোনো শিক্ষক যদি বিকেলে আলাদা ক্লাস নিতে না চান?

সভাপতি সাহেব রেগে গেলেন, স্কুলে চাকরি করতে হলে কমিটির সিদ্ধান্ত মানতে হবে।

আজকে ফিজিক্স আছে, মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের পর ক্লাস শুরু হবে মাহবুব সাহেব ক্লাস নিবেন নাকি অন্যকোনো শিক্ষক ক্লাস নিবেন। আরেকটা ক্লাস পর ফিজিঙ, সেই ক্লাসটাও শেষ হলো। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে এমন সময় হেডমাস্টার সাহেব ক্লাসে ঢুকলেন, এই কী হলো তোদের? গ্যাঞ্জাম করছিস কেনো?

সবাই উঠে দাঁড়ালো।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বস।

সবাই বসলো।

হেডমাস্টার সাহেব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন, এই তো আমার অবিডিয়েন্ট স্টুডেন্টরা, শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলে উঠে দাঁড়াবে, শিক্ষক বসতে বলার পর বসবে। আমি তোদের ক্লাস নিতে আসিনি, তোদের ফিজিক্স ক্লাস তোদের ফিজিক্স স্যারই নিবে। ছাত্রছাত্রীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।

হেডমাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো আমি এভাবে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিস কেনো? বলে হেডমাস্টার সাহেব আদেশের সুরে বললেন, আমি স্কুলের হেডমাস্টার আমি যেভাবে বলবো তোরা সবাই সেভাবেই চলবি। প্রাইভেট পড়ানোর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ক্লাসে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয় একথা চিন্তা করে শুধু মাহবুব স্যারই নয়, স্কুলের সকল শিক্ষক আর কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না।

ছাত্রছাত্রীরা খুব খুশি হলো। সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

হেডমাস্টার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, এতে করে তোদের দায়িত্ব বেড়ে গেল। বলতো কী?

সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, তোদের ক্লাসে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে কারণ তোরা চাইলেও আর কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এরপরও যারা ক্লাসে পড়া বুঝতে পারবি না তাদের জন্য বিকেলে, স্কুল ছুটির সেই শিক্ষক অতিরিক্ত ক্লাস নিবেন। শিক্ষকের সম্মানি প্রতিষ্ঠান বহন করবে। বুঝছিস তো।

সবাই সমস্বরে বলল, জি স্যার।

জুয়েল উঠে দাঁড়ালো, স্যার ক্লাস টেনের সকল ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

বস, বস, তোর জন্যও কথা আছে। তুইও খুব বেড়েছিস, তুই নেতা হইছিস।

জুয়েল বসে পড়ল।

আমাকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই, এটা আমার দায়িত্ব ছিল। তোরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে শিখিয়ে দিলি, তোদের একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে। তোদের মধ্যে একতা আছে। তোদের মধ্যে অনেকেই মাহবুব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তো, তারা যদি দাবি আদায়ের সঙ্গে একমত না হতো তবে আজকের এই সফলতা অর্জন সম্ভব হতো না। এটা শুধু তোদের সফলতা না, এটা পুরো স্কুলের সফলতা, তোরা একটা নজির স্থাপন করলি। তোরা আবার প্রমাণ করলি, একতাই শক্তি, একতাই বল, বলে হেডমাস্টার সাহেব গলা ঝেড়ে হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, তোদের ক্লাস এখন থেকে মাহবুব স্যারই নিবেন। তোরা ঠিক অনুগত ছাত্রের মতো ক্লাস করবি, শিক্ষককে তার সম্মান ও শ্রদ্ধা করবি।

জি স্যার, ছাত্রছাত্রীরা সমস্বরে বলল।

হেডমাস্টার সাহেব কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে ডাক দিলেন, জুয়েল।

জুয়েল উঠে দাঁড়ালো।

এদিকে আয়।

জুয়েল স্যারের কাছে গেল, হেডমাস্টার সাহেব জুয়েলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে তুই সফল হয়েছিস। দোয়া করি একদিন যেন তুই বড় নেতা হতে পারিস, পুরো জাতিকে পথ দেখাতে পারিস।

সমাপ্ত

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in কিশোর উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*