একজন কবিকে ঘিরে ভক্তদের একটা জটলা তৈরি হয়েছে। কবির কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, পরণে পাঞ্জাবি আর পাজামা। কবি ভক্তদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আর টি.ভি ক্যামেরাগুলোতে চলছে বিরামহীন ভিডিও। বইমেলায় ঢুকতেই এ দৃশ্য দেখে কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সির মনটা খুশিতে ভরে গেলো, ইস্ এখানে এতগুলো ক্যামেরা একসাথে কবির ছবি তুলছে। আমার যদি একটা ছবি তুলতো, আমিও তো কবি। বলে তিনি তাঁর পাঞ্জাবির কুঁকুড়ে যাওয়া অংশগুলো সোজা করলো, দাড়িতে চিরুনি বুলালো।
এবার একুশে বইমেলায় আসার সময় কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি বউকে বলে এসেছেন, প্রতিদিন বিকেলবেলা মোবাইলটা তোমার কাছে রেখো গো, যখন টি.ভি’র ক্যামেরা আমার দিকে তাক করবে তখনই আমি তোমাকে ফোন করে বলবো, তুমি যেনো সেসময় মোবাইলটা দূরে রেখো না।
কয়েকমিনিট পর অটোগ্রাফ দেয়া কবি সাহেব একবার তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া করলেন, তাঁর পিছু পিছু ছুটে চললো অটোগ্রাফ শিকারী ভক্তরা, পিছনে পিছনে ছুটে চললো ক্যামেরাম্যানসহ টি.ভি সাংবাদিকরা। না কবি সাহেব আর দাঁড়ালেন না।
একজন ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা, স্ট্যান্ড গুছিয়ে চলে যাওয়ার প্রস’তি নিচ্ছিলো। কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি ছেলেটির কাছে গেলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন, বাবা আমার একটা ছবি তোলা যাবে?
ছবি তোলা মানে এটা তো স্টুডিও না, টি.ভি ক্যামেরা। এখানকার ছবি শুধু টি.ভি’তে দেখানো হয়।
রাজ্জাক মুন্সি একটু থতমত খেলেন, হ্যাঁ বাবা, বুঝেছি আমি কী বলতে কী বলে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। মানে আমাকে একবার টি.ভি’তে দেখানো যাবে?
ছেলেটি যেভাবে তার কাজ করছিলো সেভাবে বললো, কী করেন আপনি?
আমি, আমি কবি, কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি, কবি সাহেব গর্ব ভরে বললেন।
ছেলেটি কিছুটা অবজ্ঞার সুরে বললো, এই নাম জীবনে প্রথম শুনলাম।
কবি রাজ্জাক মুন্সি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন’ তাদের দলনেতা দূর থেকে জোরে ডাক দিলো, এই মন্টু তাড়াতাড়ি এসো, স্যার আসছেন। একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে।
কবি রাজ্জাক মুন্সিও দেখলেন একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক আসছেন। সবদিক থেকে ক্যামেরাম্যান আর ভক্তরা পিঁপড়ের মতো ছুটতে শুরু করেছে। মুন্সি সাহেব তো এই সাহিত্যিকের একটা বই গত বছর কিনেছিলেন। কী এমন আহামরি লিখেন তা তাঁর জানা আছে। অথচ টি.ভি ক্যামেরাগুলো কেমন ছুটছে।
এমনিভাবে সারা মাস বইমেলায় ঘুরে ঘুরে গত বছর বইমেলায় কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি টি.ভি’র পর্দায় নিজের ছবি দেখাতে পারেননি। বইমেলা থেকে ফিরে স্ত্রীর মুখে অনেক কথা শুনেছেন। ছেলেমেয়ে প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। কিন’ তিনি ছেড়ে দেয়ার মানুষ নন। ছোটো হোক বড় হোক তিনি কবি। কবিরা সমাজকে পথ দেখায়, কবিরা কখনো পিছু হটে না। তিনিই বা ছেড়ে দিবেন কেন?
তবে গত বছর বইমেলায় তার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। নজরুল মঞ্চে কবি-সাহিত্যিকদের বই সংগ্রহ করে সেখান থেকে একে একে সবাইকে টি.ভিতে দেখায়। কবি রাজ্জাক মুন্সিও তার একটা বই জমা দিয়েছিলেন কিন’ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে উপস’াপক বইটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, এটা কি একুশে বইমেলা থেকে পাবলিশ হয়েছে? বলে সে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো, এটা তো একুশে বইমেলা থেকে প্রকাশিত হয়নি।
তারপর কবি রাজ্জাক মুন্সির হাতে ফেরৎ দিয়েছিলো। তখন থেকে কবি রাজ্জাক মুন্সির স্বপ্ন ঢাকার কোনো বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে তার একটা বই বের করা, তারপর দিবেন আগামী বছর বইমেলার এরকম কোনো টি.ভি অনুষ্ঠানের উপস’াপকের হাতে। কবি রাজ্জার মুন্সির স্বপ্ন একবার কবি হিসেবে নিজেকে টি.ভি’র পর্দায় দেখাবেন, আজ যারা তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করছে তাদের সেই তিরস্কারের জবাব সে দিয়েই ছাড়বেন।
কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি কৈশোর থেকে কবিতা লিখেন। ছন্দময় কবিতা, একসময় সবাই তাকে ছড়াকার বলতো এখন কবি বলে। সবই মুখে মুখে ডাকে, তাকে নিয়ে কোনোদিন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি, তাকে গ্রামের মানুষ কোনো অনুষ্ঠানে কোনোদিন প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি এমনকি মঞ্চে বসারও আহবান জানায়নি। কবি নামে সবাই তাকে ডাকে কিন’ তার কবিগিরি কোনো সার্টিফিকেট নেই।
কবির পুরস্কার পাঠক-ভক্ত। কবির মনে কোনো ক্ষোভ নেই। তার গর্ব এলাকার মানুষ তাকে মূল্যায়ন না করুক, দেশ একদিন তাকে মূল্যায়ন করবে, একদিন তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হবে, টেলিভিশনের টকশোতে মিষ্টি হাওয়া বইবে আর তা দেখে গ্রামের মানুষ যখন এই মোড়ের মধ্যে আড্ডা দিবে তখন তাদেরও চায়ের কাপে ঝড় বইবে। হয়তো সবকিছুই হবে তার মৃত্যুর পর। ক’জন গুণী মানুষ বেঁচে থাকতে তার কৃতকর্মের পুরস্কার পায়?
বইমেলা থেকে ফিরে কবি সাহেব নেমে গেলেন আগামী বইমেলায় বই প্রকাশনার প্রস’তি নিয়ে। তার লেখার বিশাল পান্ডুলিপি থেকে বাছাই করলেন প্রায় এক’শ কবিতা। রাস্তার মোড়ে, চায়ের টেবিলে, গাছের ছায়ায়, কাউকে দেখেই কবি সাহেব তাঁর কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে সেই কবিতাগুলো বের করে দেখাতে শুরু করলেন।
সেদিন বিকেলে রাস্তায় তার এক বাল্য বন্ধু আমজাদের সাথে দেখা। সেই বন্ধু তো মহাখুশি, এই কবি কেমন আছিস্?
ভালো। তুই?
এইতো ভালো আছি, বলে কবি আমজাদকে একরকম হাত ধরে হোটেলে নিয়ে গেলেন। চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপর তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা কবিতা বের করে দিয়ে বললেন, এবার একটা কবিতার বই বের করতে চাচ্ছি আমজাদ।
তুই কবিতার বই বের কর্বি?
হ্যাঁ। আগেও তো একটা বই বের করেছি। ও তোকে দেওয়া হয়নি, না। বলে কবি আমজাদের হাতে একটা বই দিয়ে বললেন, এটা দিনাজপুর থেকে ছাপিয়েছিলাম। এবার ঢাকা থেকে বের করবো। এখান থেকে কবিতার বই বের করলে ঢাকায় গিয়ে তেমন গুরুত্ব পাওয়া যায় না। তাই ভাবছি এবার ঢাকা থেকে বই বের করবো। কী বলিস্?
অবশ্যই কর্বি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই টাকা-পয়সায় অনেক এগিয়েছে, কিন’ যশ-খ্যাতিতে তোর মতো কেউ আগাতে পারেনি। তোকে সবাই কবি বলে জানে। একজন কবি হওয়া কি কম কথা, কবিরা তো সমাজের বিবেক জাগ্রত করে, মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
কবির বুক গর্বে ভরে গেল।
আমজাদ চা খেতে খেতে কবিতাটা পড়ে বললো, বাহ্, খুব সুন্দর হয়েছে। তোর কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগলো। তোর কবিতায় বিপ্লব আছে, জাগরণ আছে, তোর কবিতা সমাজকে জাগিয়ে তোলার মতো কবিতা। দেখি আর একটা কবিতা দে দোস্ত, এবার একটা প্রেমের কবিতা দে। বলে আমজাদ চোখ টিপে হাসলো।
পান্ডুলিপি চূড়ান্ত। আগের বছরগুলোতে কেনা বইগুলো থেকে পাবলিশার্সদের ঠিকানা নিয়ে কবি আব্দুর রাজ্জাক রওয়ানা হলেন ঢাকা উদ্দেশ্যে।
দুই
বাংলাবাজারে শত শত পাবলিশার্স। তাঁর হাতের লেখা কয়েকটা ঠিকানা ধরে তিনি অনেক খুঁজলেন। না, তাঁর সেই ঠিকানা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন কাজ। হঠাৎ করে তার মাথায় নতুন চিন্তা এলো, এতো খোঁজাখুঁজির কী আছে। বইয়ে যেসব প্রকাশকের নাম আছে তাদের কেউ তো আমার পরিচিত না। কাজেই যেকোনো একটা পাবলিশার্সের সঙ্গে কথা বললেই হয়।
কবি আব্দুর রাজ্জাক একটা পাবলিশার্সের দোকানে ঢুকতে গিয়ে একটু ইতস্তত: করলেন। দোকানে বসা ভদ্রলোক অভয় দিলো, কবির চেহারা দেখে শ্রদ্ধাভরে ডাক দিলো, আসুন।
রাজ্জাক সাহেব ভিতরে ঢুকে সালাম দিলেন।
ওয়ালেকুম আস্সালাম।
রাজ্জাক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কি বই ছাপানো হয়?
ভদ্রলোকের বয়স রাজ্জাক সাহেবের কাছাকাছিই হবে। হাস্যজ্জ্ব্যেল মুখ। কথা বলার সময় মুখে একটা হাসি লেগেই থাকে। কথার সুর বেশ রসালো, হ্যাঁ। আপনি এক্কেবারে সঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
কবি সাহেব বসলেন, আমি একটা কবিতার বই ছাপাবো।
ভদ্রলোক বললো, বই আপনি ছাপাবেন কেন? আপনি তো কবি, আপনি কবিতা লিখবেন, বই ছাপাবে পাবলিশার্স।
কবি সাহেব নিজেকে সংশোধন করে বললেন, জি আপনি ঠিকই বলেছেন।
ভদ্রলোক এবার নিজের পরিচয় দিলো, আমি ইমরুল, আর আমার প্রতিষ্ঠানের নাম তো দেখছেনই, তরুলতা প্রকাশনা।
কবি সাহেব একবার দোকানটার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলেন। র্যাকে অনেক বই সাজানো আছে।
কবি সাহেব নিজের পরিচয় দিলেন, আমি আব্দুর রাজ্জাক।
কবি সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ইমরুল থামিয়ে দিলো, বুঝেছি আপনি একজন কবি। তো কবি ভাই’র বাড়ি কোথায়?
দিনাজপুর।
ও, খুব সুন্দর। দিনাজপুরের মানুষ তো খুব ভালো হয়। রাজ্জাক সাহেব একটু হাসলেন, তারপর ব্যাগ থেকে পান্ডুলপি বের করে ইমরুলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এগুলো আমার লেখা কবিতা। আমি আগামী বইমেলায় একটা বই বের করবো।
ইমরুল চেয়ার থেকে উঠে বললো, আপনি একটু বসুন আমি দু’টা চায়ের অর্ডার দিয়ে আসি।
ইমরুল সাহেব অর্ডার দিয়ে আবার ভিতরে ঢুকলো, জি এখন বলুন বলে সে কবিতাগুলো নিয়ে দু’য়েকটা কবিতা পড়ে দেখলো, বাহ্ আপনার লেখা তো খুব সুন্দর।
রাজ্জাক সাহেবর মুখ উজ্জ্বল হলো।
ততক্ষণে চা চলে এসেছে। ইমরুল চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, কিন’ একটা কথা কি রাজ্জাক ভাই জানেন?
রাজ্জাক সাহেব ইমরুলের মুখের দিকে তাকালেন, আজকাল টি.ভি, মোবাইল, ইন্টারনেট নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তাই কবিতা আজকাল আর কেউ পড়ে না। তো কত পৃষ্ঠার বই হবে আপনার?
এই একশটা কবিতা।
তাহলে তো বই ছয় ফর্মার চেয়ে বেশি হবে। অনেক খরচ পড়বে।
কতো?
ইমরুল একবার রাজ্জাক সাহেবের আপাদমস্তক তাকালো। তারপর বললো, এই ধরুন ছত্রিশ হাজার টাকা।
রাজ্জাক সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, এতো টাকা!
আরে ভাই কাগজ-কলমের যা দাম। আমি আবার খারাপ কাজ করি না। আপনার বই হবে ঝকঝকা। মানুষ দেখলেই নিতে চাইবে। বইয়ের গেট আপ ভালো না হলে আজকাল চলে না। আগে কথা ছিল চকচক করিলে সোনা হয় না আর এখন উল্টো, চকচক না করিলে সোনা হয় না।
টাকা কিছু কম করা যায় না?
রাজ্জাক ভাই আপনাকে আমি একটা পরামর্শ দিই?
বলুন?
আপনি বরং বইটা একটু ছোটো করুন।
মানে?
মানে এই ধরুন তিন বার চার ফর্মার একটা বই ছাপাবেন।
তাহলে ক’টা কবিতা ছাপানো যাবে?
এই ধরুন তিন ফর্মার হলে আটচল্লিশটা আর চার ফর্মার হলে চূষট্টিটা কবিতা।
চার ফর্মার একটা বই দেন তো একটু দেখি।
ইমরুল রাজ্জাক সাহেবের হাতে একটা বই দিলেন।
রাজ্জাক সাহেব বইটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কিছুটা উদাস হয়ে গেলেন, আমার এরকম একটা বই প্রকাশিত হবে। অমর একুশে বইমেলায় টি.ভি ক্যামেরার সামনে আমি ইন্টারভিউ দিবো। সারাদেশের মানুষ দেখবে, আমার বইটাও থাকবে এবার একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া কয়েক হাজার বইয়ের একটা। উ: আমি তো পৃথিবীতে অমর হয়ে…
ইমরুল ডাক দিলো, কবি ভাই কী ভাবছেন?
রাজ্জাক সাহেব চমকে উঠলেন, না, কিছু না।
ইমরুল রাজ্জাক সাহেবের মনের অবস’া বুঝতে পেরেছে। সে বললো, কবি ভাই একবার ভাবুন এরকম একটা বই একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হবে। এটা কিন’ কম ভাগ্যের কথা নয়। এটার সঙ্গে কি কখনো টাকার তুলনা হয়।
কীরকম টাকা খরচ হবে ভাই? রাজ্জাক সাহেব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন।
ইমরুল তার ড্রয়ার থেকে ক্যালকুটের বের করে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে টিপতে থাকলো তারপর বললো, পঁচিশ হাজার টাকা।
রাজ্জাক সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ভাই একটু সেক্রিফাইজ করুন। টাকার পরিমাণটা একটু কমান। বই তো ছোটো হলো সে অনুযায়ী টাকার পরিমাণটা একটু যদি কমাতেন।
দেখুন কবি ভাই। বইয়ের সাইজ কমালেও বইয়ের কভার, বাইন্ডিং এসব তো আর কমে না।
রাজ্জাক সাহেব কিছুটা মিনতির সুরে বললেন, ভাই একটা কথা বলবো। আপনাকে কিন’ রাখতে হবে। আমি কিন’ ধনী মানুষ নই। অনেক কষ্ট করে আমাকে বই ছাপানোর খরচের টাকাটা জোগাড় করতে হবে। আমি আপনাকে বিশ হাজার টাকা দিবো।
অবশেষে বিশ হাজার টাকা ঠিক হলো। রাজ্জাক সাহেব ইমরুলের মোবাইল নাম্বার নিলেন। তারপর বললেন, ভাই পান্ডুলিপিটা কবে পাঠাবো?
আপনি যতো তাড়াতাড়ি দিবেন, আমি ততো তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করবো। তবে বলে… ইমরুল একটা টান দিতেই রাজ্জাক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী ভাই?
তবে পান্ডুলিপি আর টাকা একসঙ্গে দিবেন।
রাজ্জাক সাহেব ভেবেছিলেন টাকাটা কিস্তিতে দিবেন কিন’ ইমরুল যেভাবে বললো তাতে তিনি কিছুটা অপ্রস’ত হয়ে পড়লেন। তার মুখের ওপর একটা হালকা কালো মেঘ খেলে গেলো। তিনি বললেন, আচ্ছা ভাই।
তিন
কবি ঢাকা থেকে ফেরার পর তার বই প্রকাশের কথা সবাইকে বলেছেন। যে-ই শুনেছে সেই কবির প্রশংসা করেছে, কবিকে উৎসাহিত করেছে। কবির স্ত্রীর নাম নুরজাহান বেগম। কবি বউয়ের নাম সংক্ষিপ্ত করে বেগম বলে ডাকেন। বেগম সবকিছু শুনে বললো, এতোদিনে বুঝি তুমি কবির মূল্যায়ন পেলে। তোমার কবিতা সারা দেশের মানুষ পড়বে।
কবি নুরজাহানকে এটুকুই বলেছিলেন। বই প্রকাশের সঙ্গে যে টাকার একটা বিরাট অংক জড়িয়ে আছে সেকথা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন কিন’ ক’দিন পর যখন বই প্রকাশের আনন্দ আর টাকা জোগাড় করার দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করলো তখন তার কলম একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো।
আজকাল কবি সবসময় দুশ্চিন্তায় ছট্ফট্ করছেন। কেমন একটা অসি’রতায় সবসময় তার কেন্দ্রীভূত চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে আসছে। কবির এই অসি’রতা বেগমের চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি।
আগে কবি অনেক রাত পর্যন্ত লেখালেখি করতেন। রাত যতো গভীর হতো কবির কলমের গতিও ততো বেড়ে যেতো। কবি যখন লেখালেখি শেষ করে বিছানায় যেতেন তখন বেশিরভাগ দিনে বেগম ঘুমিয়ে পড়তো। কবি বিছানায় যাওয়ার আগে বেগম ঘুমিয়েছে জেনেও ডাক দিতেন, বেগম ঘুমিয়েছো?
বেগম কোনো সাড়া দিতো না।
আজ ক’দিন থেকে কবি লেখালেখি না করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে আসছেন দেখে বেগম জিজ্ঞেস করলো, তুমি এতো তাড়াতাড়ি বিছানায়?
কবি কোনো কথা বললেন না।
আজ ক’দিন থেকে দেখছি তুমি লিখতে বসছো না। কী হয়েছে তোমার?
কবি তবুও কোনো কথা বললেন না।
বেগম বিছানায় উঠে বসলো, আমাদের সংসার করার কত বছর হলো বলোতো?
ত্রিশ বছর।
আমার আজো মনে আছে। প্রথম রাতে তুমি আমাকে বেগম বলে ডেকেছিলে। তারপর আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে হলো। ওদের সামনেও তুমি আমাকে বেগম বলে ডাকতে। ওদের বিয়ে হলো। আমরা বুড়োবুড়ি হলাম তারপরও তুমি আমাকে বেগম বলে ডেকেছো।
কবি মাথা নত করে বিছানার কোণায় বসে রইলেন।
আজ ক’দিন থেকে দেখছি তুমি লিখতে বসছো না। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ লেখার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে কিছু এলোমেলো লিখে শুয়ে পড়ছো। আমি ঘুমাবার ভান করে শুয়ে থেকেছি তুমি আমাকে বেগম বলে ডাকবে এই আশায় কিন’ তুমি সেই প্রিয় নামে আমাকে ডাকছো না। তুমি কেমন জানি অসি’র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো। কী হয়েছে তোমার?
কবি বেগমের বাহুতে একটা হাত রাখলেন। তারপর একটা কষ্টের হাসি হেসে বললেন, বেগম কাকে বলে জানো?
বেগম না সূচক মাথা নাড়লো।
বাদশাহ্র বউকে বেগম বলে। তুমি চেহারায় বেগম বটে কিন’ দূর্ভাগ্যক্রমে বাদশাহ্র বউ না। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছে আমার মতো একজন হাভাতে কবির ঘরে।
বেগম কিছুটা রেগে গেলো, তোমার এসব কথা আমি শুনতে চাইনি। কী হয়েছে তাই বলো?
কবি একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন, বেগম আমার বই ঢাকা থেকে ছাপা হবে এটা ঠিক কিন’ এর সঙ্গে একটা বড় টাকার অংক আছে।
মানে?
মানে টাকা দিতে হবে।
কতো?
সে অনেক টাকা।
বলবে তো কত টাকা?
বিশ হাজার।
অ। সেজন্য কবি নিরব?
কবি মাথা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
সেজন্য তোমার লেখালেখি বন্ধ। কবিরা এতো তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে পড়লে হয়, তুমিই বলো? তুমি যে কেমন কবি। তুমি মানুষকে আশার আলো দেখাবে, বিপদে পথ দেখাবে আর তুমি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো তবে তোমার ভক্তরা তোমার কাছে কী শিখবে, বলো?
কবি শুষ্ক হেসে বললেন, এতো টাকা আমি কোথায় পাবো?
সেজন্য ভেঙ্গে পড়ো না। তোমার জমির ধান আছে না।
তা আছে কিন’ ধান বেচা টাকা দিয়ে বই ছাপালে সারা বছর খাবো কী?
তখন দেখা যাবে। আল্লাহ কোনো না কোনোভাবে চালিয়ে নিবেন।
প্রতি বছর অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে মেয়ে জামাই আসে শীতের পিঠা খেতে। তাদের কী হবে?
হবে। আল্লাহ সব চালিয়ে নিবেন। তাছাড়া আমার কাছে কিছু টাকা আছে।
কবির মুখ উজ্জ্বল হলো, তাই নাকি? তুমি কোথায় টাকা পেলে?
হ্যাঁ। আমি কোথায় টাকা পেলাম সেটা কোনো বিষয় না। তুমি তো মুখে মুখে বলো অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। আমার ওপর একটুও সাহস করতে পারলে না?
বেগম আসলে আমি কখনো চিন্তা করিনি তোমার কাছে কোনো টাকা থাকতে পারে।
তা করবে না তো। এখন তোমাকে একটা কথা বলি?
বলো?
তোমার বই ছাপানোর পুরো টাকাটা যদি আমি দিই?
তুমি?
হ্যাঁ আমি। অবাক হচ্ছো কেনো? আমার কাছে টাকা থাকতে পারে না?
হ্যাঁ তা পারে।
একটা টাকা দুটাকা করে জমাতে জমাতে আমার কিছু টাকা জমেছিল। তারপর সেই টাকা থেকে ছাগল, তারপর গরু কিনে ডাঙ্গাপাড়া একজনকে পালতে দিয়েছি। তোমার কবিতার বই ছাপানোর জন্য যদি টাকার প্রয়োজন হয় তবে আমি না হয় আমার সেই গরুটা বেচে দিবো।
কবি বেগমের মুখ উঁচু করে ধরলেন। বেগমের চোখ পানিতে চিক্চিক্ করছে। কবির চোখ থেকেও কয়েক ফোটা পানিয়ে গড়িয়ে পড়লো। কবি বেগমকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বেগম, আমার বেগম।
কবির চোখে ঘুম নেই। সারারাত শুধু ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। সারারাত তার কাব্যিক জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন।
কৈশোরে কবি এক কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলেন। কবি তাকে খুব ভালো বাসতেন। সেই কবির প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেম হারানোর পর কবি কবিতা লেখা শুরু করেন। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। সেই চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি নিয়ে কবি তার জন্য কবিতা লিখে যাচ্ছেন। সেই কিশোরী নারী হয়েছে, নানি হয়েছে। এতদিনে বুড়ি হয়েছে নাকি মারা গেছে সে খবর কবির জানা নেই তবু তার সব কবিতা যেনো সেই নারীর উদ্দেশ্যে।
কবির আজ চোখ খুলেছে। যে নারীর জন্য কবি সারাজীবন বেগমের পাশে শুয়ে সেই নারীর স্মৃতি বুকে লালন করেছেন, বেগমকে বঞ্চিত করেছেন সেই নারীর কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ বেগম! বেগম তার পাশে শুয়ে আছে, জলজ্যান্ত এক নারী। তার কোনো দোষ নেই। এতদিন কবি শুধু একটা স্মৃতির পেছনে, মরীচিকার পেছনে ঘুরেছেন।
বেগম এতোকিছু জানে না। সে জানে কবি তার স্বামী, তার সঙ্গেই তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে। কবির সঙ্গেই তার সুখ-দু:খ ভাগাভাগি করে চলতে হবে।
না কবি আর সেই কৈশোরের নারীর কথা ভাববেন না। তিনি একবার ভেবেছিলেন তাঁর এই কবিতার বইটি সেই অনামিকার নামে উৎসর্গ করবেন। কিন’ এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই কবিতার বই কবি বেগমের নামে উৎসর্গ করবেন। উৎসর্গে লিখবেন: আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, সেই মহীয়সী নারী যে সুখে-দু:খে কবির পাশে দাঁড়িয়েছে তার উদ্দেশ্যে আমার এই ক্ষুদ্র কর্ম উৎসর্গ করলাম।
চার
পান্ডুলিপি পাঠানোর এক মাস হলো। ইমরুলের কথামতো কবি সঙ্গে টাকাও পাঠিয়েছেন। ইমরুল বলেছিলো ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখে মেলায় বই উঠবে। সে অনুযায়ী কবি ফ্রেবরুয়ারি মাসের এক তারিখে ঢাকায় এলেন। কবিকে দেখে ইমরুল একটু থতমত খেলো, অ আপনি এসেছেন?
কবি মৃদু হেসে বললেন, জি ভাই।
ইমরুল মুখ কালো করে বললো, আপনাকে এতো করে বললাম পান্ডুলিপি আগে পাঠান। এখন কম্পিউটার, কম্পোজ আর বাইন্ডিংখানায় যা ভীড়।
কবি কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন, বিনয়ের সঙ্গে বললেন, টাকা জোগাড় করতে করতে দেরি হয়ে গেলো। বুঝেনই তো একজন গরীব কবির পক্ষে বিশ হাজার টাকা জোগাড় করা কতো কঠিন।
হুম। আপনি কবে এসেছেন কবি ভাই?
এই তো আজই। বাস থেকে নেমে সোজা আপনার এখানে এলাম।
আসার আগে আপনি যদি একবার ফোন করে আসতেন। আসলে বইমেলা এক তারিখ থেকে হলেও মেলা জমতে জমতে প্রথম সপ্তাহ পার হয়ে যায়। আপনি আরো পরে এলেও পারতেন।
কবি ভয়ে ভয়ে বললেন, ইমরুল ভাই আমার বইয়ের খবর কী?
ইমরুল মাথা নিচু করে কথা বলছিলো সেভাবেই বললো, ক’দিন দেরি হবে ভাই।
কবি আমতা আমতা করে বললেন, ইমরুল ভাই এক তারিখে না হোক, সাত তারিখে তো হবে?
ইমরুল মিনমিন করে বললো, এই মনে করুন বই বের হতে হতে দশ তারিখ।
দশ তারিখ!
সেজন্যই তো বললাম আপনি আরো পরে এলে পারতেন।
আচ্ছা যাহোক, আপনি তাড়াতাড়ি করুন। আমি ঢাকায় থাকবো। একটু তাড়াতাড়ি করুন ভাই। সবাইকে বলে এসেছি তো।
দিনাজপুর থেকে এসে এতো দিন থাকবেন?
হ্যাঁ প্রতি বছরই তো থাকি। আজ প্রায় বিশ বছর হলো, আমি প্রতি বছর বইমেলায় আসি। প্রায় পনেরো দিন থাকি, এবার আমার বই আসবে এবার না হয় পুরো মাস থাকবো।
আচ্ছা থাকুন।
কবি কিছুক্ষণ ইমরুলের সামনে বসে রইলেন তারপর চেয়ার থেকে উঠলেন।
কবির মেয়ে-জামাই আশুলিয়ায় একটা গার্মেন্টসে চাকরি করে। সেখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। কবিও তাদের বাসায় উঠেছেন। প্রতিদিন সকালবেলা মেয়ে-জামাই গার্মেন্টসে চলে যায়, কবি তার একমাত্র নাতনিকে নিয়ে আশুলিয়া ঘুরে দেখেন তারপর নাতনিকে রেখে বিকেলে চলে আসেন বইমেলায়। বইমেলা ঘুরে দেখেন, লেখক কুঞ্জে বসেন, নজরুল মঞ্চের আশে-পাশে ঘুরে বেড়ান।
নজরুল মঞ্চে প্রতিদিন টেলিভিশন ক্যামেরায় লেখক-কবিদের প্রকাশিত বই, তাদের ইন্টারভিউ দেখানো হয়। কবি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন আর ভাবেন একদিন তাকেও এভাবে দেখানো হবে। তিনি ফোন করে বেগমকে জানাবেন, তাঁর বন্ধু-বান্ধব যাদের বই ছাপানোর কথা বলেছেন তাদের বলবেন, তার মেয়েকে বলবেন, মেয়ে-জামাই হয়তো দেখতে পারবে না কিন’ তারা জানবে, তাদের সঙ্গে আর যারা ভাড়া থাকে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখবে। তার নাতনি টি.ভি’তে নানাকে দেখবে। সবাই খুব খুশি হবে।
এবার বুঝি কবির স্বপ্ন পূরণ হবে। দেশ-বিদেশে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। কবিরা তো টাকা-পয়সা চায় না, ভোগ-বিলাসিতা চায় না নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়, গোটা দুনিয়ার মানুষকে পৃথিবীতে তার আগমনের কথা জানাতে চায়, পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকতে চায়।
আজকাল করতে করতে মেলা প্রায় শেষ হতে চললো কিন’ কবির বই প্রকাশিত হলো না। ইমরুল আজকাল আজকাল করে দিন পার করে। ইমরুল একদিন বলে আপনার বই ছাপাখানায় তো আরেকদিন বলেন বাইন্ডিং খানায়। কবি বিরক্ত হোন, কবির দু’চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ে কিন’ ধৈর্য ধরেন।
অবশেষে কবির বই মেলায় এলো সাতশ তারিখ বিকেলে। বইমেলায়। কবি তখন বইমেলায় ইমরুলের পাশে বসেছিলো।
ইমরুল কবির হাতে একটা বই তুলে দিয়ে মৃদু হেসে বললো, এই নিন বই হে কবি। আপনার অমর সৃষ্টি।
কবি বইটা হাতে নিলেন। কাঁচা বই, এখনো বাইন্ডিংয়ের আঠা শুকায়নি।
তারপরও নিজের লেখা বই হাতে পেয়ে কবির বুক ভরে গেলো। কবি বই হাতে পেয়েই বেগমকে ফোন করলেন, হ্যালো।
হ্যাঁ কী খবর বলো? কেমন আছো তুমি?
ভালো। বলে কবি আনন্দে গদগদ কণ্ঠে বললো, বই হাতে পেয়েছি। তুমি টি.ভি’র সামনে বসো আমি নজরুল মঞ্চের দিকে যাচ্ছি। বলে কবি একটা বই নিয়ে নজরুল মঞ্চের দিকে গেলেন কিন’ ততক্ষণে নজরুল মঞ্চে বই জমা নেয়া শেষ হয়ে গেছে। কবি নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন।
পরদিন মেলার শেষ দিন। তিনটা বাজতে না বাজতেই কবি কয়েকটা বই নিয়ে নজরুল মঞ্চে হাজির হলেন। হ্যাঁ, আজ বই নেয়া শুরু হয়েছে। কবিও তাঁর বইটা জমা দিলেন। কবি বেগমকে ফোন করে টি.ভি’র নাম বললেন, বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে জানালেন। টি.ভি’র ক্যামেরা ম্যান তার ক্যামেরা স্ট্যান্ড করলো, উপস’াপক ট্রায়াল দিলো, হ্যালো, মাইক্রোফোন টেস্টিং হ্যালো।
কবির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃতি করার অভ্যাস আছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে তাঁর কোনো জড়তা নেই। তিনি কী বলবেন মনে মনে সাজিয়ে নিলেন, কীভাবে নিজেকে উপস’াপন করবেন আপনমনে রিহার্সেল দিলেন।
অনুষ্ঠান শুরু হলো। কিন’ কবি লক্ষ্য করলেন তার বই সিরিয়ালের শেষে দিকে। তিনি কিছুটা অবাক হলেন। তিনি তো সবার আগে বই জমা দিয়েছেন। তিনি উপস’াপকের পাশে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে একে একে উপস’াপকের হাতে তুলে দিচ্ছে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন।
বার বার কবির এমন আচরণ দেখে ছেলেটি কিছুটা বিরক্ত বোধ করলো। একটা স্যাগমেন্ট শেষ হওয়ার পর ছেলেটি বললো, আপনি বয়স্ক মানুষ এতো অধৈর্য হলে চলে। আমরা তো সবাইকে দেখাবো।
কবি বইয়ের দিকে তাকালেন, হ্যাঁ তার বই আছে আর দু’টা বইয়ের পরে। কবি মনে মনে প্রস’তি নিলেন। আর একজন, কবির বুক একটু হলেও কাঁপছে, ভয়ে নয়, আবেগে, আনন্দে।
এখন একজনের ইন্টারভিউ হচ্ছে তারপরই কবির ইন্টারভিউ। ঠিক কবির ইন্টারভিউ’র আগ মুহূর্তে ভিড় ঠেলে একজন স্বনাম ধন্য সাহিত্যিক এগিয়ে আসতেই টেলিভিশনের উপস’াপক স্যার স্যার বলে সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার এবার আপনার কী বই এসেছে?
সাহিত্যিক সাহেব লম্বা এক বিবরণ শুরু করলেন। তার ইন্টারভিউ নেয়ার পরপরই উপস’াপক সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
পাঁচ
কবির মোবাইল ফোনে একের পর এর ফোন আসতে লাগলো কিন’ তিনি কারো ফোন রিসিভ করলেন না। কাকে কী জবাব দিবেন কবি। বিরক্ত হয়ে কবি মোবাইল ফোন বন্ধ করে বইমেলা থেকে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় যাবেন কবি?
কোনো তাড়া নেই অথচ জোরে জোরে পা ফেলছেন। আজ বইমেলা শেষ, কবির বাড়ি যাওয়ার কথা। কবির এই বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল হাসি-মুখে, স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা বীর দর্পে, সিংহাসন জয় করে। বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডার সময় কথা বলার কথা ছিল বিজয়ের হাসি মুখে নিয়ে। তা আর হলো না। কবি পরাজিত, কবির চোখে-মুখে ক্লান্তি, শরীর অবসন্ন, হৃদয়ে পরাজয়ের গ্লানি।
হাঁটতে হাঁটতে বাংলামোটর এসে পৌঁছেছেন। এখন কোনদিকে যাবেন? একটা বাস ফার্মগেট, ফার্মগেট বলে ডাকছে। ফার্মগেট গিয়ে কবি কী করবেন? বাস ধরে মেয়ের বাড়িতে যাবেন? ছোট্ট নাতনি বলেছিলো নানু তোমাকে যখন টি.ভিতে দেখাবে তখন আমি দেখবো। আমাকে বলো কিন’।
মেয়ে-জামাইয়ের বাসায় একটা পুরাতন মোবাইল ফোন আছে। বাসায় যে কাজের মেয়েটা আছে ওটা ওর কাছে থাকে। কবি সেই নাম্বারে ফোন করে ছোট্ট নাতনিকেও জানিয়েছেন, হয়তো ছোট্ট শিশু টি.ভি চালু করে বসেছিলো। কবি তাকে কী জবাব দিবেন?
কবি ফার্মগেটের বাসে উঠলেন না। সোজা ডান দিকে রওয়ানা হলেন। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে চলা। কবির পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, পাকা দাড়ি বাতাসে উড়ছে। জোরে হাঁটতে হাঁটতে একবার থমকে দাঁড়ালেন, আমি এতো জোরে হাঁটছি কেনো? কোথায় যাচ্ছি আমি? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যেখানেই যাবো সেখানেই একটা অপমান আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
হাঁটতে হাঁটতে কবি কখন কমলাপুর এসে পৌঁছেছেন নিজেই জানেন না। হঠাৎ করে কমলাপুর স্টেশন চোখে পড়লো। কবি প্লাট ফরমের ভিতরে ঢুকলেন। তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টালেন, নাহ্, আর পা চলছে না। এভাবে খেয়ে না খেয়ে আর কতোক্ষণ হাঁটা যায়। বলতে বলতে কবির চোখ গেলো ট্রেনের সময়সূচী লেখা সাইন বোর্ডের দিকে। দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে সন্ধ্যা সাতটা চল্লিশ মিনিটে। কবি স্টেশনের ঘড়িতে সময় দেখলেন। এখন সাতটা বাজে।
কবি কাউন্টারের দিকে পা বাড়ালেন। ট্রেনে ভিড় খুব, সিট নেই, কবি স্ট্যান্ডিং টিকেটই কিনেলন। ট্রেনে উঠে একটা সিটের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
দ্রুতযান দ্রুত গতিতে চলছে। কবি কখনো সিটে হেলান দিয়ে আবার কখনো কোনো সিট ফাঁকা পেলে বসছেন। আর মাঝে মাঝে ডুবে যাচ্ছেন কবিতার রাজ্যে। তার মাথায় আজ অসংখ্য কবিতার ছন্দ খেলা করছে। কবির চোখে বার বার ভেসে উঠছে বছরের পর বছর বইমেলায় এসে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য।
বই প্রকাশের দিক থেকে কবি নতুন হলেও কবি হিসেবে তিনি অনেক পুরাতন। ধান ক্ষেতের মেঠোপথ, ফুটপাথ, রাজপথ সবমিলিয়ে কবির কাব্য চর্চার বয়স অনেক। এই কবিতা লিখতে গিয়ে কবি জীবনে অনেক হারিয়েছেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন বন্ধুরা বার বার বলেছে কবি এবার সব ছাড়ো, সংসারে মনোযোগী হও, জমিজমাগুলো দেখাশোনা করো।
কিন’ কবির কোনোকিছুতেই মন নেই। কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি মনে প্রাণে কবি, তার অস্তিত্বে কবিত্ব। আর যারা অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে সেখান থেকে কিছু টাকা খরচ করে বইমেলায় বই ছাপিয়ে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, মিডিয়া কর্মীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে উপরে উঠেছেন তারা তো কবি না, তারা কবি সেজেছে। কবি হওয়া আর কবি সাজা তো এক কথা নয়। কবি উপরে ওঠার সিঁড়ি নয়, কবি কোনো পেশা নয়, মানুষের সুখ-দু:খ, প্রেম-ভালোবাসা, জাতির চরম দুর্দিনে জাতিকে পথ দেখানোর পথ প্রদর্শক কবি।
কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি তো কবি সাজেননি, তিনি কবি। নি:স্বার্থক একজন কবিতা প্রেমি। অথচ এই কবি বছরের পর বছর বইমেলায় পায়ের জুতা ক্ষয় করলো, এতো শত শত ক্যামেরা একবারো তার দিকে চোখ তুলে তাকালো না। না, কবি কোনোভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারলেন না।
ট্রেন সান্তাহার আসার পর কবি একটা সিট পেয়েছেন। সীমিত আলোতে কবি তার পান্ডুলিপি বের করে লিখতে শুরু করেছেন। তার মনের মধ্যে বিড়বিড় করা কবিতা। অনেক দিন থেকে কবি শরীরের প্রতি খুব অবিচার করছেন, ঠিকমতো খাওয়া নেই, ঘুম নেই। কবিতার বই, কবিতার বই করতে করতে তার শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কবির শরীর শুধু ঘামছে। বুকটা খুব জোরে শব্দ করে দ্রুত গতিতে চলছে। না কবি আর সিটে বসে থাকতে পারছেন না। তিনি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর হাত থেকে কবিতার পান্ডুলিপিটা পড়ে গেলো।
দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুর রেল স্টেশনে এসে থামতেই স্টেশন প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পেলো। যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে ট্রেন থেকে নামতে শুরু করলো। একসময় পুরো ট্রেন যাত্রী শূন্য হলো, টোকাইরা ট্রেনের ভিতরে পড়ে থাকা উচ্ছ্বিষ্ট পানির বোতল, কারো ফেলে যাওয়া কাপড়ের ব্যাগ কুড়ানোর জন্য এসে একজন যাত্রীকে সিটে পড়ে থাকতে দেখে এক টোকাই মৃদু ধাক্কা দিতেই কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি সিট থেকে নিচে পড়ে গেলেন।
সেই টোকাই আরো দুয়েকজনকে ডাক দিলো, এই তোরা একটু এগিকে আয়তো লোকটা বুঝি মরে গেছে।
আরো কয়েক জন টোকাই এলো। তাদের একজন পুলিশকে খবর দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জন পুলিশ এলো তাদের মধ্যে একজন পালস দেখে জানালো, নাই।
স্টেশনে হৈ চৈ পড়ে গেলো। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে গেলো পুরো শহর। পত্রিকার সাংবাদিক এলো, টি.ভি ক্যামেরা এলো। শুরু হলো কবির ছবি তোলা। কবির পড়ে থাকা পান্ডুলিপিতে তাঁর ঠিকানা লিখা ছিলো সেখান থেকে জানা গেলো কবির পরিচয়।
কিছুক্ষণ পরেই খবর ছড়িয়ে গেলো সমস্ত মিডিয়ায়, টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো কবির ছবি। কবির প্রিয়তমা স্ত্রী, কবির নাতনি, কবির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব টি.ভি’র পর্দায় দেখলো কবি আব্দুর রাজ্জাক মুন্সির ছবি।
সমাপ্ত।
Leave a Reply