গডফাদার-০৩

জামাল সাধারণত সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়, সারাদিন বাসার বাইরে কেটে যায়। আজ জামাল হঠাৎ করে বাসায় দুপুরে ভাত খেতে বাসায় ঢুকল।

অনন্যা জামালকে দেখে কিছুটা অবাক হলো, তুমি দুপুরে বাসায়?

অনন্যা ভাত দাও, বলে জামাল ডাইনিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে পড়ল।

অনন্যা ভাত বাড়িয়ে দিল। জামাল ভাত খাওয়া শেষ করে বলল, অনন্যা তোমার দু’কপি ছবি আর এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেটের একটা ফটোকপি দাও তো।

আমার ছবি আর এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেট আবার কী কাজে লাগবে?

আমাদের ভবিষ্যৎ সাজাতে হবে না?

হঠাৎ করে তোমার আবার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা হলো কেন?

অনন্যা ভাবছি তোমার নামে একটা আর আমার নামে একটা ইনস্যুরেন্স করবো। সেজন্য তোমার ছবি আর এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেটটা কাজে লাগছে।

অনন্যা আর কোন কথা না বাড়িয়ে বেড রুমে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তার পাসপোর্ট সাইজের ছবি আর এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেট এনে জামালের হাতে দিল।

জামাল বাসা থেকে বের হলো। তারপর পৌরসভায় কিছুক্ষণ কাজ করে পাঁচটা বাজার আগেই মধুকুঞ্জে গেল।

জামালকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।

বিপ্লবী মধুকুঞ্জের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল।

জামাল বিপ্লবীর দিকে তাকিয়ে রইল।

বিপ্লবী সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই জামাল ওপর থেকে বলল, বিপ্লবী উপরে এসো।

বিপ্লবী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে তার শরীর যেন শিউরে উঠল।

বিপ্লবী দোতলায় উঠতেই জামাল উঠে দাঁড়িয়ে তার রুমের দরজা খুলে দিয়ে ইশারা করে বলল, ভিতরে এসো।

বিপ্লবী থমকে দাঁড়াল, ভাইয়া বাইরে বসি।

বোকা মেয়ে সঙ্কোচ করছ কেন? এখানে তোমার কোন অসুবিধা নেই। আমার এই মধুকুঞ্জের ভিতরে কেউ আসবে না, কেউ কিছু বলবে না, বলতে বলতে জামাল ভিতরে ঢুকল।

বিপ্লবী জামালের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে সোফায় বসল। বিপ্লবী লক্ষ্য করল রুমটা অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত। বিপ্লবী রুমে ঢোকার পর জামাল এয়ারকুলারটা বাড়িয়ে দিল।

জামাল রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

বিপ্লবীর বুকটা যেন ধক করে উঠল। সে আপত্তির সুরে বলল, ভাইয়া প্লিজ দরজাটা–।

কিচ্ছু হবে না, তুমি নিশ্চিন্তে কাজ করো।

জামাল ফ্রিজ খুলে দু’টা কোল্ড ড্রিঙ্কস এর বোতল বের করে নিজে মুখ খুলল। বিপ্লবী তখন মাথা নিচু করে ফরম পূরণ করছিল। জামাল একটা বোতলে কী যেন মিশালো তারপর বোতলটা বিপ্লবীর সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বিপ্লবী নাও, কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে কাজ করো।

বিপ্লবী আবার আপত্তি করল। ক্রমেই তার বুকের মধ্যে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করেছে। এটা একটা খামার বাড়ি বলা যায়। এখানে একজন মেয়ের একাই আসা উচিৎ হয়েছে কি না বিষয়টা বিপ্লবীর মনে ভাবিয়ে তুলেছিল কিন্তু জামালের মুখের ওপর বিপ্লবীর কিছু বলতেও যেন ঠোঁট দু’টো শিথিল হয়ে যাচ্ছিল।

জামাল বলল, কিছু খেতেও আপত্তি? কিন্তু মিস বিপ্লবী মধুকুঞ্জ থেকে তো কেউ কিছু না খেয়ে যায় না। তাতে মধুকুঞ্জের অপমান হয়।

জামালের চাপে একরকম ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিপ্লবী খেতে শুরু করল।

বিপ্লবী জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কত টাকার ইনস্যুরেন্স হবে?

তোমার ভাবীর নামে একটা পঞ্চাশ লাখ টাকার আর আমার নামে একটা পঞ্চাশ লাখ টাকার, বলে জামাল বিপ্লবীর পাশের সোফায় বসল।

বিপ্লবী দু’জনের বর্তমান ঠিকানা এবং স্থায়ী ঠিকানাসহ আনুষঙ্গিক লিখাগুলো লিখল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া আপনার ইনস্যুরেন্সের নোমিনি কে হবে?

এটা আবার বিবাহিত মানুষকে আবার এটা জিজ্ঞেস করতে হয়, আমার ইনস্যুরেন্সের নোমিনি হবে তোমার ভাবী আর তোমার ভাবীর ইনস্যুরেন্সের নোমিনি হবো আমি।

বিপ্লবী আবার লিখতে শুরু করল।

জামাল বিপ্লবীর বুকের দিকে তাকিয়ে রইল। বিপ্লবী  পরে এসেছে, ব্লাউজের গলা ইউ আকৃতির যা দিয়ে বুকের অনেকাংশ দৃশ্যমান হচ্ছে। সে যখন হেলে লিখছিল জামালের লোলুপ দৃষ্টি তখন ছিল বিপ্লবীর পরে থাকা ইউ আকৃতির ব্লাউজের ফাঁকের দিকে।

বিপ্লবী বুঝতে পেরে টা ঠিক করে নিল। বিপ্লবী আরো কিছুক্ষণ লিখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া চেক দিবেন নাকি ক্যাশ?

জামাল বিপ্লবীর ডান হাতটা ধরে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, বিপ্লবী তুমি খুব সুন্দর।

বিপ্লবী হাত ছাড়িয়ে নিল। সে নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে কেঁপে উঠল। এতক্ষণ পর বিপ্লবীর আশঙ্কাই সত্যি হলো সে মনে মনে বলল, এভাবে আর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চেকটা হাতে নিতে পারলেই হয়। কিন্তু বিপ্লবীর এমন লাগছে কেন? জামাল তার কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে খাওয়ায় নি তো? বিপ্লবীর চোখ দু’টা যেন বন্ধ হয়ে আসছে, কথাবার্তা জড় হয়ে আসছে, সমস্ত শরীর যেন শিথিল হয়ে আসছে।

জামাল একটা চেক বই বের করে সোফার টেবিলের ওপর রেখে বিপ্লবীর গা ঘেঁষে বসল।

চেক কী নামে হবে বিপ্লবী?

ম্যানেজার, ফিউচার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লি: নামে।

জামাল চেক বইয়ের পাতায় প্রাপকের নাম লিখে কলমটা টেবিলের ওপর রেখে বিপ্লবীকে জড়িয়ে ধরল। বিপ্লবী নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে জামালের হাত দু’টা বিপ্লবীর স্পর্শকাতর অংগসমূহ দলিত মোথিত করতে শুরু করেছে এবং ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় বিপ্লবীর প্রাণশক্তি যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

বিপ্লবী জামালের বুকের ওপর ঢলে পড়ল।

বিপ্লবীর যখন জ্ঞান ফিরল তখন প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারল না। একবার এদিক-সেদিক তাকানোর পর জামালকে জিজ্ঞেস করল, আমি এখন কোথায়?

মধুকুঞ্জে, একটু মনে করার চেষ্টা করো সব বুঝতে পারবে।

বিপ্লবী মনে করার চেষ্টা করল। তার মনে পড়ল আজ তার সব লুণ্ঠন হয়ে গেছে। একথা জানাজানি হলে সমাজে তার মুখ দেখানো কঠিন হবে। বিপ্লবী একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে, তার কোন দোষ নেই সে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কিন্তু সমাজ তা বুঝেও সমস্ত দায় তার ওপরই ফেলবে। এই নির্মম সত্যটাই যেন সমাজের নিয়মে  হয়েছে। বিপ্লবী সবকিছু কল্পনা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। জামাল বিপ্লবীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, বিপ্লবী চুপ করো প্লিজ।

বিপ্লবী কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, এখন আমার কী হবে?

জামাল বিপ্লবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কিচ্ছু হবে না, তুমি কাউকে কিছু না বললে কেউ কোনদিন জানবেও না। এটাকে তুমি এত সিরিয়াস মনে করছ কেন? এটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিবে। আমরা জাস্ট এনজয় করলাম। এটাকে তুমি যদি জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা মনে করো তবে শুধু কষ্টই বাড়বে।

বিপ্লবী সমস্ত কিছু হারিয়েও যেন সান্ত্বনা খুঁজল। দু’চোখ মুছে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল। রাত দশটা বাজে। সে উঠে দাঁড়াল।

জামাল একটা চেক বিপ্লবীর হাতে দিয়ে বলল, বিপ্লবী সবকিছু মন থেকে মুছে ফেল। আর হ্যাঁ ইনস্যুরেন্সের কাজে আমার আর কী করণীয় আছে?

বিপ্লবী বলল, না, ইনস্যুরেন্স নিয়ে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। সবকিছু কনফার্ম হয়ে গেলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

জামাল কিছুটা অবাক হলো। সে মনে মনে বলল, এরপরও তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে?

বিপ্লবী জিজ্ঞেস করল, কিছু ভাবছেন?

না।

তবে আমি আসি।

জামাল হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাইস টু মিট ইউ।

বিপ্লবী হাত বাড়াল না, আপন মনে বলল, আই হ্যাট ইউ।

আশি

পৌরসভার চেয়ারম্যানের পদটা জামালের  জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল। এই চেয়ারে বসায় যেন তার জীবনের একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু জামাল পৌরসভায় বসার পর থেকে রায়হান চেয়ারম্যানের তিলে তিলে গড়ে তোলা পৌরসভাটা একটা দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে হয়েছে। জামাল কোন কাজ করতে গেলেই সে কাজের ভালো-মন্দ দিক বিবেচনা না করে সে কাজে তার আর্থিক বা রাজনৈতিক কোন লাভ আছে কি না তা খুঁজতে থাকে। পৌরবাসীর ভালো-মন্দের চেয়ে তার কাছে যেন  নিজের লাভটাই বড়।

জামাল পৌরসভায় তার চেম্বারে ঢুকল। তার পিছনে পিছনে ঢুকল বেলাল কমিশনার।

জামাল তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বলো বেলাল।

ভাইজান চৌরাস্তা থেকে কালাম কমিশনারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা যেন কোনভাবে এবছর পাকা করা না হয়।

কেন?

ভাইজান আপনি তো জানেন কালাম কমিশনার জন দরদী পার্টি করে সে আবার বলে বেড়াচ্ছে সে নাকি বিরোধী দল করে বলে আপনি তার এলাকায় কোন উন্নয়নমূলক কাজ করছেন না? দেখছেন কত বড় নেমকহারাম? আমি যতটুকু দেখেছি আপনি তো কোনদিন দলীয় লোক দেখে উন্নয়নমুলক কাজ করেন নি, আপনি যা করেছেন সবই করেছেন জনস্বার্থে অথচ সে বলে বেড়াচ্ছে আপনি নাকি বিরোধী দল দেখে তার ওয়ার্ডে কাজ করছেন না। কোন দোষ না করতেই যখন আপনার দুর্নাম হয়েছে তখন আর তাকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লাভ কী? তখন তো সে সবাইকে বলে বেড়াবে এটা তারই ক্রেডিট।

তুমি ঠিকই বলেছ বেলাল বেটাকে অনেক টাইড দিয়েছি কিন্তু লাইনে আসছে না, আচ্ছা দেখি কিছু করা যায় নাকি?

জামাল চেয়ারে বসে একটা ফাইল উল্টাতে উল্টাতে কলিং বেল এ টিপ দিল।

পিয়ন এসে দাঁড়াল, স্যার।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আমার সালাম দাও।

কিছুক্ষণ পর পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার মিজান সাহেব রুমে ঢুকলেন, স্যার।

আচ্ছা আমরা এবছর পৌরসভার রাস্তা মেরামত করার জন্য যে কাজগুলো হাতে নিয়েছি সেই ফাইলটা একবার নিয়ে আসুন তো।

মিজান সাহেব চলে গেলেন আবার কয়েক মিনিট পর একটা ফাইল নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

জামাল ফাইলটা হাতে নিয়ে বললেন, মিজান সাহেব এখন আমি দেখি, পরে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব।

মিজান সাহেব চলে গেলেন।

জামাল ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, তাই তো, আমি পৌরসভায় নতুন তো তাই সব পৌরসভার কমিশনারদের মধ্যে সমানভাবে কাজ ডিস্ট্রিবিউশন করতাম এখন দেখছি অনেকে আমার কাছ থেকে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চায়।

এটা করা যাবে না ভাইজান, আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবে অন্যজন তা হবে না। আপনি একটু ভেবেচিন্তে কাজ করবেন, দলের কর্মীরা আছে, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা আছে তাদের সুযোগ-সুবিধা দেখতে হবে তাহলে ভোটের সময় তারা ভোটারদেরকে আপনাকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোট চাইতে পারবে। আর বিরোধী দলের কমিশনারদের এলাকায় কাজ করলে এলাকায় তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে আগামী নির্বাচনে আপনার ভরাডুবি হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ বেলাল, আমি দেখি আগে আমাদের দলের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করি তারপর সিদ্ধান্ত নিব।

জি ভাইজান, ফাইলটা সহজে সই করবেন না যেন।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বেলাল কমিশনার চলে গেল। জামাল একে একে অফিসের অন্যান্য কাজ করতে থাকল। তারপর পিয়নকে বলল, যাও তো ডাক ফাইলটা নিয়ে এসো।

পিয়ন ডাক ফাইল নিয়ে এলো, জামাল একটা একটা করে চিঠি দেখে সংশ্লিষ্ট শাখায় পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিল। তারপর পিয়নকে ডাক ফাইল নিয়ে যেতে বলল। পিয়ন ডাকফাইল দিয়ে আবার তার চেম্বারে একটা দরখাস্ত নিয়ে ভিতরে ঢুকল।

জামাল দরখাস্তটা পড়ে বলল, এই দরখাস্ত নিয়ে কে এলো?

পিয়ন বলল, স্যার একটা মহিলা এসেছে, অনেকক্ষণ থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

জামাল মনে মনে বলল, এ আবার কোন সুযোগ হাতে এলো, আমার কপালটাই ভালো, না হলে এমনভাবে একের পর এক সুযোগ আমার কাছে আসবে কেন?

পিয়ন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, জামাল একবার পিয়নের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, যাও আসতে বলো।

জামালের আশা ছিল হয়ত কোন সুন্দরী, স্মার্ট, ভদ্রমহিলা হবে। তার স্বামীর বিচার করাও হবে আবার তাকে একবার এনজয় করা যাবে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর যা দেখল তাতে জামালের বিরক্তি বাড়ল। সে একরকম আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, কী নাম তোমার?

রহিমা।

এমন সময় শাখাওয়াত কমিশনার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার ওয়ার্ডের ভাইজান।

আচ্ছা শাখাওয়াত বলো তো এত ছোট খাট ব্যাপারেও কি আমাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? তবে তোমরা আছ কী জন্য? তোমরা এতটুকু দায়িত্বও পালন করতে পারো না?

শাখাওয়াত কমিশনার কিছু বলল না। জামাল কলিং বেল-এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল।

জামাল বলল,  সেক্রেটারি সাহেবকে একবার আসতে বলো।

পিয়ন চলে গেলে শাখাওয়াত কমিশনার রহিমাকে বলল, এই রহিমা তুমি বাইরে বসো, আমি সবকিছু ব্যবস্থা করছি।

রহিমা চলে গেল, শাখাওয়াত কমিশনার বলল, ভাইজান ঐ ছেলেটা তো আমাদের দলের আমার ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।

তাই নাকি?

জি ভাইজান, এমন কিছু করা যাবে না যেন ছেলেটার কোন শাস্তি হয়।

কিন্তু আমরা কোন ব্যবস্থা না নিলে তো মেয়েটা কোর্টে যাবে তখন ছেলেটাকে রক্ষা করবে কী করে?

তাহলে ভাইজান।

আসলে ব্যাপারটা কী বলো তো?

ভাইজান মেয়েটার আসলে চরিত্র ভালো না। তারা মা আর মেয়ে একসঙ্গে থাকতো, তাদের আয় রোজগার বলতে ছিল দেহ ব্যবসা। মহল্লার অনেকে ছেলেদের সে বাড়িতে যাতায়াত ছিল। একদিন মেয়েটা ছেলেটাকে বাড়িতে আটকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে। ঘটনাটা ছিল পরিকল্পিত। তার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছেলে তাকে আটক করে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়। তাকে বিয়ে না করলে রেপ কেস করার হুমকি দেয়। ছেলেটা আইনি ঝামেলা এড়ানোর জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হয়। এখন মেয়েটা ওর গলার ফাঁস হয়ে গেছে।

ছেলেটা বোধ হয় ডিভোর্স করতে চায় নাকি?

জি ভাইজান।

তাহলে আমি দু’জনকে নিয়ে একদিন বসার ব্যবস্থা করি তুমি তার আগে ছেলেটাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।

জি ভাইজান।

এমন সময়  সেক্রেটারি চলে এলো, স্যার।

এই দরখাস্তটা নিন, আগামী মাসের তিন তারিখে বিকেলে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করুন।

জি স্যার।

জামাল আবার কলিং বেল টিপ দিল।

পিয়ন এলো।

জামাল বলল, রহিমাকে আসতে বলো।

রহিমা ভিতরে ঢুকল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, তুমি একবার মুখে বলতো আসল ব্যাপারটা কী?

ভাইজান আমাদের কয়েকমাস আগে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকেই ও আমাকে যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমরা গরীব মানুষ, বাবা বেঁচে নেই। মা আর আমি, সংসারে আয় রোজগারের কোন ছেলেমানুষ নেই। আমরা কীভাবে টাকা দিব?

জামাল ধমকের সুরে বলল, চুপ করো, একটা মিথ্যা কথাও বলবে না।

রহিমা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

আয় রোজগারের কেউ নেই তাই তো নিজেই আয় রোজগার করে খাও, তো অসুবিধা হলো কোথায়?

এখন ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুক চায়।

আবার মিথ্যা কথা বলছ, আমি না বলেছি একটাও মিথ্যা কথা বলবে না। এখন আর একজনকে দিয়ে পোষাচ্ছে না, তাই মনে করছ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে কেটে পড়বে। আসলে তো ও তোমার কাছে যৌতুক চায়নি।

রহিমা আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।

বিয়ের দেন মোহর কত?

পঞ্চাশ হাজার টাকা।

আচ্ছা তুমি এখন এসো, নোটিশ পেলে চলে এসো।

একাশি

মোজাহার সাহেব তাঁর নতুন কর্মস্থলে যোগদান করে জেলার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডসমূহ পর্যালোচনা করে দেখেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন জেলা শহরে অন্যান্য শহরের তুলনায় মাদক দ্রব্য এবং চোরাচালান অত্যন্ত বেশি এবং মাদক দ্রব্য বিক্রি করার জন্য এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘাতের হারও বেশি। তিনি জেলার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেছেন। মিটিংয়ে কঠোর ভাষায় তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক। একথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আমরা অনেক সময় জনগণের সেবক না হয়ে জনগণের সঙ্গে প্রভুর মতো আচরণ করি যা অত্যন্ত খারাপ। সেবার মনোভাব নিয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের একমাত্র কাজ। যে কোন অজুহাতে জনগণের জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি কোনভাবে সহ্য করা হবে না। যে কোন অঘটনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপনারা সবাই মনে রাখবেন অপরাধীদের সঙ্গে কোন আপোষ নয়, জানগণের জানমাল রক্ষার জন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। একটা বিষয় আমি জানতে পেরেছি যে, এই জেলায় মাদকদ্রব্য এবং চোরাচালানের হার অনেক বেশি এবং এ সংক্রান্ত অপরাধের হারও বেশি। এ জেলায় শুধু মাদক দ্রব্য বিক্রিই হয় না চোরাচালানের রুট হিসেবেও এই জেলা ব্যবহৃত হয়। ইতোপূর্বে মাদকদ্রব্য বিক্রির আধিপত্য বিস্তারের জন্য এ জেলায় কয়েকটা খুন হয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ পর্যন্ত প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত এবং গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আমি ডিপার্টমেন্টের সমস্ত সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলছি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। আমি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ডি.বি ইন্সপেক্টরকে নির্দেশ দিচ্ছি, এ ব্যাপারে সবাইকে ডি.বি ইন্সপেক্টরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করছি।

পুলিশ সুপারের নির্দেশের পর গোটা পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়েছে। মোজাহার সাহেব যে একজন নীতিমান এবং নির্ভীক পুলিশ সুপার এ বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের অনেকেই ইতোপূর্বেই জেনেছেন। তাই দুর্নীতিগ্রস্থ পুলিশ অফিসারদের অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়লেন।

জামাল তখন তার চেম্বারে বসে ছিল। তার টেলিফোনের রিং বেজে উঠল।

সে টেলিফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে পুলিশ অফিসার মনির সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো জামাল ভাই আমি মনির বলছি, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

বলুন।

নতুন এস.পি স্যার এসেছেন, জানেন তো।

শুধু জানি কেন উনাকে তো আমরাই নিয়ে এলাম।

হ্যাঁ এনেছেন তো ভালো কথা। এখন বোঝেন যেমন খাল কেটেছেন তেমনি এক জাঁদরেল কুমির চলে এসেছে। এখন কীভাবে সামাল দিবেন আপনি বুঝেন।

আপনি কী বলছেন এসব?

হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি, স্যার খুব কড়া এবং নীতিমান মানুষ, তিনি আজ সমস্ত পুলিশ অফিসারদেরকে কড়া ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছেন। কেউ দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করলে তিনি তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবেন।

রাখেন আপনার এস.পি সাহেবের কথা। উনি বললেন আর জেলার সব অপরাধ বন্ধ হয়ে গেল।

জামাল ভাই আমি বলছিলাম কয়েকদিন আপনার ফেন্সি আর হেরোইনের ব্যবসাটা বন্ধ রাখলে হয় না?

হ্যাঁ আপনি বললেন আর আমি ব্যবসা বন্ধ রাখলাম। আমি আমার ব্যবসা চালিয়ে যাবো, আপনি ঠিক আগের মতোই আমাকে ইনফরমেশন দিবেন, আপনার চাকরির কোন ক্ষতি হলে আমি দেখব, বলে জামাল মনির সাহেবকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রিসিভার রেখে দিল।

জামাল মনির সাহেবকে তার সাহস দেখালেও মনে মনে ঠিকই কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ল। আগামীকাল ঢাকা থেকে তার হেরোইন আসার কথা এমনসময় এস.পি সাহেবের হুশিয়ারি তাকে চিন্তিত করে তুলল।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো বস।

আপনার পাসওয়ার্ড নাম্বার বলুন।

জামাল তার পাসওয়ার্ড নাম্বার বলল, হ্যাঁ মিঃ জামাল আগামীকাল মাল যাচ্ছে, আপনার র নাম্বার দিন। আর হ্যাঁ আপনার  রওয়ানা দিবে ঠিক রাত দশটায়।

বস আমি কীভাবে আপনার  চিনবো?

আপনাকে আমার  চিনতে হবে না, আপনার তে যে মোবাইল থাকবে তার নাম্বারটা দিন আমার লোক আপনার  খুঁজে নিবে।

আজ জামালের মিঃ টি.আর খানের গলার স্বর অপরিচিত বলে মনে হলো। তাছাড়া মিঃ টি.আর খান জামালকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন। আজ আপনি বলে সম্বোধন করলেন, বিষয়টা জামালের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হলো। মিঃ টি.আর খানের কণ্ঠস্বর ছিল ভয়ঙ্কর, আজ যে লোকটা কথা বলল তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তার কণ্ঠস্বরও বেশ ভয়ঙ্কর। জামাল একবার মনে মনে ভাবল ভদ্রলোককে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করবে কি না? আবার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন কি না?

জামাল সভয়ে জিজ্ঞেস করল, বস একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

জি বলুন।

আপনি কি মিঃ টি.আর খান?

অপর পাশ থেকে ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আপনার সঙ্গে কোম্পানির ব্যবসায়ীক সম্পর্ক কোন ব্যক্তির সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। আপনি মাল পাবেন টাকা দিবেন, পুলিশ, প্রশাসন এবং অন্যান্য সুবিধা-অসুবিধা কোম্পানি দেখবে। এমন প্রশ্ন আর কখনো করবেন না।

জামাল সভয়ে বলল, জি বস।

তাহলে ঠিক আছে ডন্ট মিস মিঃ জামাল, এখন তে যে মোবাইলটা থাকবে সেটার নাম্বারটা দিন।

জামাল মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল, বস যদি অনুমতি দেন তবে একটা কথা বলি।

বলুন।

নতুন এস.পি সাহেব এসে তো এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। বস আমি খুব ভয় পাচ্ছি।

আপনাকে তো আমি বললাম, সবকিছু কোম্পানি দেখবে, আপনি কাজ করুন। আর ভবিষ্যতে কোনদিন কারো নাম জিজ্ঞেস করবেন না, সবসময় মনে রাখবেন এলাইনে কথা কম কাজ বেশি। ইচ্ছা করলেই সবকিছু বলা যাবে না, ওকে।

জামাল সভয়ে বলল, জি বস।

জামাল একবার উপরের দিকে তাকাল, সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পিডে ঘুরছে তবুও তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে, জামাল নিজে গিয়ে এয়ারকুলারটা দেখল, না এয়ারকুলারটাও ঠিক আছে।

জামাল মাথার ঘাম মুছে চেয়ারে ইজি হয়ে বসার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ জামাল চেয়ারে চুপ করে বসে রইল। এখনি তার ওপর দিয়ে যেন অজস্র মাইল স্পিডে ঝড় বয়ে গেল। জামাল কাউকে কিছু বলল না।

কয়েক মিনিট পর জামাল কলিং বেল-এ টিপ দিতেই জাকির দরজায় এসে দাঁড়াল, ভাইজান।

আমীরকে ডাক দাও তো।

আমীর ভিতরে এলো, ভাইজান।

তোমার আজকের কালেকশন নিয়ে এসেছ?

জি ভাইজান।

দাও।

আমীর কয়েকটা টাকার বাণ্ডিল জামালের হাতে দিল।

জামাল টাকা রেখে দিয়ে বলল, দু’য়েকদিনের মধ্যে তোমাকে মাল আনতে যেতে হবে। রেডি থেকো।

জি ভাইজান।

বিরাশি

আজ সকাল থেকেই জামাল বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। এ দুশ্চিন্তা কাটবে আমীর মাল নিয়ে তা ফেন্সি কুইনদের হাতে হাতে পৌঁছে যাবার পর। সে ব্যাংক থেকে হিসেব মতো টাকা উত্তোলন করার পর যেন একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তখন রাত নয়টা বাজে জামাল টাকাগুলো তার ড্রয়ার থেকে বের করে একটা ব্রিফ কেস এ ঢোকাল তারপর কলিং বেল-এ টিপ দিতেই জাকির তার চেম্বারে ঢুকল।

জামাল বলল, আমীরকে ডাক দাও তো।

আমীর তার চেম্বারে ঢুকল, ভাইজান।

আমীর গালপোড়া সেলিমের মোবাইলে রিং কর তো, রিসিভ করলে আমাকে দিও।

আমীর গালপোড়া সেলিমের মোবাইলে রিং করল।

অপর পাশ থেকে সেলিমের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আমীর ভাই বলুন।

সেলিম আমি আমীর না, জামাল।

জি বস বলুন।

তুমি এখনি আমার চেম্বারে চলে এসো, একটা অপারেশন আছে সঙ্গে তোমার বিশ্বস্ত কয়েকজন ক্যাডার নিয়ে এসো।

জি বস।

আমীর তুমি বাইরে বস, গালপোড়া সেলিম এলে আমার কাছে নিয়ে এসো, মাইক্রো বাস নিয়ে দুলালকে রেডি থাকতে বল।

জি ভাইজান।

জামাল অভ্যাসবশত: দু’চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে রইল। গালপোড়া সেলিম আর আমীর তার চেম্বারে ঢুকল তখন রাত দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকী।

রুমে ঢুকে গালপোড়া সেলিম বলল, বস হঠাৎ কী মনে করে?

হ্যাঁ বলছি, আমীর এই ব্রিফকেসে টাকা আছে, মাইক্রো বাসে এই ব্রিফকেস নিয়ে যাও। সেলিমের মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে কোথায় কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে সেটা ওরাই তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলবে, তুমি ব্রিফকেস দিয়ে মাল নিয়ে আসবে, একবার ঘড়ির দিকে তাকাও।

ভাইজান এখন দশটা বাজে।

তোমরা রওয়ানা দাও। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি মোবাইলে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব, বলে জামাল সেলিমের মোবাইলে মিস কল দিল।

সেলিম কলটা রিসিভ করার জন্য মোবাইল বের করতেই জামাল বলল, আমি মিস কল দিয়েছি এই নাম্বারটা সেভ করে রাখো, তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এই নাম্বারে আছি।

জি বস, বলে সেলিম এবং আমীর বেরিয়ে গেল।

দ্রুত গতিতে  ছুটে চলছে।

আমীর এবং সেলিম কেউ-ই জানেনা এই হাইওয়ে দিয়ে তাদের কোথায় যেতে হবে?  চলল প্রায় আধ ঘণ্টা সেলিম আমীরকে বলল, আমীর ভাই দেখুন তো এটা কোন ধরণের কাজ? কোথায় যাবো বস বলবে না। শুধু বলে দিল তোমরা যাও, এখন আমরা কোথায় যাই?

আমীর একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে বলল, সেলিম ভাই দেখুন তো আমার মনে হচ্ছে পিছনের টা শুরু থেকে আমাদের ফলো করছে।

সেলিম কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, আমরাই জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি আর কোন আবার আমাদের ফলো করবে? দুলাল টা একটু স্লো কর তো।

দুলাল টা স্লো করল। একটা মাইক্রো বাস তাদের ওভার টেক করে চলে গেল। সেলিম টার দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করল, তার মনে হলো বর-কনে পাশাপাশি বসে যাচ্ছে, তে আরো দু’জন মেয়ে এবং কয়েকজন পুরুষ।

সেলিম বলল, আমীর ভাই ভয় নেই, বিয়ের ।

আবার  আগের মতো গতিতে চলতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার মাইক্রো বাসটাকে ওভার টেক করল। আমীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

সেলিমের মোবাইলর রিং বেজে উঠল। সে রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আপনারা কি ঠিক দশটায় রওয়ানা দিয়েছেন?

জি।

 কত কিলোমিটার স্পীডে চলছে?

সেলিম র মিটারের দিকে তাকিয়ে বলল, ষাট কিলোমিটার।

আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনাদের সঙ্গে মিট করব, আপনি ড্রাইভারকে ডান পাশের ইনডিকেটর অন রাখতে বলুন, আমাদের র ডান পাশের ইনডিকেটর অন থাকবে আমাদের  দেখলেই আপনারা  দাঁড় করাবেন।

জি বুঝতে পারছি।

সেলিম মোবাইল রেখে দুলালকে বলল, দুলাল  ধীরে চালাও, ডান দিকের ইনডিকেটর জ্বালিয়ে দিয়ে  চালাতে থাক, আর খেয়াল রাখ ডানদিকের ইনডিকেটর জ্বালানো দেখলেই  দাঁড় করাবে।

দুলাল ধীর গতিতে  চালাতে থাকল।

কয়েক মিনিট চলার পর ডানদিকের ইনডিকেটর চালু অবস্থায় একটা  দেখতে পেয়ে দুলাল বলল, ভাইজান এই… ?

সেলিমের মোবাইলের রিং আবার বেজে উঠল, সেলিম মোবাইল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যাঁ আমি আপনাদের  দেখতে পাচ্ছি,  ডানে সাইট করে দাঁড়ান।

সেলিম বলল, দুলাল সাইট করে  থামাও।

দুলাল  থামানোর সঙ্গে সঙ্গে অপর পাশ থেকে একটা  এসে দাঁড়াল।  থেকে একটা লোক ব্রিফকেস নিয়ে নামল। আমীর  থেকে ব্রিফকেস নিয়ে নেমে দু’জনে পরস্পরের ব্রিফকেস বদল করল, এমন সময় পিছন থেকে মাইক্রো বাসটা এসে দাঁড়াল।

সেলিম তাড়াতাড়ি তে উঠে বলল, দুলাল  চালাও।

দুলাল বলল, আমীর ভাই?

সময় নেই, দেরি করলে আমরাও ধরা পড়ব।

সেলিম মুহূর্তের মধ্যে জামালকে মোবাইল করে ঘটনা জানিয়ে বলল, বস আমীর ভাই তে উঠতে পারেনি, আমি এখন কী করব?

অপর পাশ থেকে জামালের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আমীরকে ট্রান্সফার করে দাও আর পুলিশের র চাকায় গুলি করে তুমি গ্রামের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাও।

জামালের নির্দেশ মতো সেলিম আমীরকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড এবং পুলিশের মাইক্রো বাসের চাকায় কয়েক রাউন্ড গুলি করে সেলিম আর দুলাল পালিয়ে গেল।

জামাল ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল। আমীর মরেছে তো? আমীর বেঁচে থাকলে তো আমার ব্যবসার সমস্ত কিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে, আবার আমীর যদি মরেই যায় তবে আমি কী করব? উঃ আমি এখন কী করব? মিঃ টি.আর খানের মোবাইলে একবার রিং দিল। না মোবাইল বন্ধ। উঃ শালা আমাকে যে একটা মোবাইল নাম্বার দিবে তাও করবে না, প্রয়োজন হলে তারাই যোগাযোগ করবে, আমার যোগাযোগ করার প্রয়োজন হলে আমি কীভাবে যোগাযোগ করব?

জামাল তার চেম্বারের মধ্যে দুশ্চিন্তায় ছটফট করছিল। এমনসময় জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল, জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো বস।

জামাল আমার  নিরাপদে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তোমার একজন লোক গুলিতে মারা গেছে। তবে হেরোইনের ব্রিফকেসটা পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে।

বস এখন কী হবে?

ডন্ট ওরি ইয়াং ম্যান, ব্যবসায় রিস্ক থাকবেই, বিষয়টা আমরা দেখছি, তুমি কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায় এসো।

বস আপনার টাকা আপনি পেয়েছেন, আমার এক কোটি টাকার হেরোইন যে খোয়া গেল তার কী হবে?

কে বলে শুধু তোমার হেরোইন খোয়া গেছে?

তারমানে?

তোমাকে আমি বলছি না, আমরা দেখছি। আর তোমার কিছু ভাববার নেই। সব ঝামেলা কাটিয়ে উঠলে তুমি ঢাকায় এসো এর মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর বেশি ভয় পেলে ঢাকায় চলে আসুন।

জি বস, আমি ভেবে দেখি কী করা যায়?

তিরাশি

মিঃ টি. আর. খানের আশ্বাস সত্ত্বেও জামালের দুশ্চিন্তা কাটল না। সব সময় তার মনে হলো কখন জানি পুলিশ তাকে আমীরের বিষয় জিজ্ঞেস করবে। যদি পুলিশ বলে, আমীর আপনার স্টাফ আর সে এক কোটি টাকার হেরোইনসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে, এক কোটি টাকার হেরোইন নিশ্চয়ই আমীরের না, আমীর আপনার চাকরি করে তার এত টাকার হেরোইনের মালিক আপনিই।

জামাল একবার মনে করল, নাকি আমীরের নামে থানায় একটা মামলা করব যে আমীর আমার টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। না তাতে পুলিশের সন্দেহ আরো বেড়ে যেতে পারে। তারচেয়ে এমন একটা ভাব দেখানোই ভালো যে আমীরের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

কিন্তু এ সান্ত্বনাও জামালকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে পারল না। সব সময় তার মনের মধ্যে অবিশ্বাস্য, কাল্পনিক এবং অদ্ভুত চিন্তা তার মাথা থেকে দুর হচ্ছিল না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে সে বাসায় ঢুকল।

জামালের এলোমেলো চুল, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন আর রুক্ষ্ণ চেহারা দেখে অনন্যা অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার এ অবস্থা কেন? কী হয়েছে?

জামাল মৃদু কণ্ঠে জবাব দিল, কিছু হয়নি।

তবে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মনে হয় তোমার ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, কী হয়েছে আমাকে বলতো?

জামাল বিরক্তির সুরে বলল, অনন্যা আমি খুব ক্লান্ত আমাকে বিরক্ত করো না।

ভাত দিব, খাবে?

না আমার খিদে নেই, বলে জামাল রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

জামালের চোখে ঘুম নেই। সে সারারাত বিছানায় ছটফট করতে করতে কাটিয়ে দিল। সকালবেলা বিছানা ছেড়ে উঠবার আগেই পুলিশ তার বাসা ঘিরে ফেলেছে।

জামাল একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা আমার বাসায় কেন?

পুলিশ অফিসার বলল, আপনার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন আছে, আপনাকে একবার আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

আমাকে থানায় যেতে হবে কেন? আমার নামে কি ওয়ারেন্ট আছে?

আপনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনি আপোষে না গেলে আমি আপনাকে এরেস্ট করতে বাধ্য হবো।

জামাল আর কোন কথা বলল না। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে চলে গেল।

ওসি সাহেব আগে পুলিশ লাইনে ক্লোজড ছিলেন। জামাল মাননীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে সুপারিশ করে তাকে পুলিশ লাইন থেকে সদর থানায় পোস্টিং দিয়েছেন। তাই ওসি সাহেব জামালকে খুব সমীহ করে কথা বলতেন। কিন্তু আজ সেই ওসি সাহেব এমন একটা ভাব দেখালেন যে তিনি জামালকে চিনেন না।

জামাল মনে মনে বলল, শালা নেমকহারাম, অনেকদিন তো পুলিশ লাইনে ক্লোজ ছিলি আমি তদবির না করলে আজ পর্যন্ত তোকে পুলিশ লাইনেই থাকতে হতো, আর আজ আমাকে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিস যে আমাকেই চিনিস না। ওসি সাহেব এই দিন দিন না আরো দিন আছে, দেশে এমন কোন শক্তি নেই যে আমাকে বন্দি করে রাখে। সেদিন দেখব তোর ওসি গিরি কোথায় থাকে? তোকে আমি আবার পুলিশ লাইনে ক্লোজড করাবো দেখি তোকে আবার কে উদ্ধার করে?

জামালের ধারণা ছিল, ওসি সাহেব জামালকে ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করবে। কিন্তু ওসি সাহেব একবারও জামালের মুখের দিকেও তাকাল না। যেভাবে বসে ছিল তেমনিভাবে বলল, জামাল সাহেব বসুন।

জামাল লক্ষ্য করল ওসি সাহেব এতদিন জামালকে জামাল ভাই বলে সম্বোধন করতো আজ জামাল সাহেব বলে সম্বোধন করল।

জামাল চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ওসি সাহেব আমাকে কী মনে করে থানায় এনেছেন?

আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, ডি.বি পুলিশ আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

জামালকে থানায় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ জামালকে ঘিরে রেখেছে তাদের একজন বলল, জামাল সাহেব চলুন আমাদের সঙ্গে।

জামাল চেয়ার থেকে উঠতেই শাকিলকে দেখে বলল, শাকিল তুমি বিষয়টা একটু মোস্তফা ভাইকে এখুনি জানাও তো।

জি জামাল ভাই, বলে শাকিল চলে গেল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, আবার কোথায়?

সেটা গেলেই বুঝবেন।

পুলিশ অফিসারের শেষের কথাটা জামালকে বিদ্ধ করল কিন্তু সে কিছুই বলল না। ডি.বি পুলিশ জামালকে একটা রুমে নিয়ে গেল। তারপর কয়েকজন তাকে ঘিরে নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, জামাল সাহেব বলুন তো আমীর এখন কোথায়?

জামাল উত্তর দিল, আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই তো আপনারা আমাকে নিয়ে এসেছেন, আমীরের খবর আমি জানবো কীভাবে? ও তো সকালবেলা অফিসে আসে।

দেখুন জামাল সাহেব চালাকি করবেন না, আমীর গতকাল রাতে এক কেজি হেরোইনসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা গেছে।

জামাল কৃত্রিম আশ্চর্যান্বিত ভঙ্গীতে বলল, আমীর মারা গেছে! পুলিশের কাছে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গুলিতে? নাকি পুলিশের গুলিতে?

দেখুন ফাজলামি করবেন না। আমীর মারা গেছে কিন্তু আমীরের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক কেজি হেরোইন।

ফাজলামি তো আপনারা করছেন, আমীরকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে পালিয়েছে তো আপনারা কী করেছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না।

বুঝতে পাচ্ছেন না, এখনো ভদ্রভাবে কথা বলছি তো সে কারণে বুঝতে পাচ্ছেন না যখন পেঁদানি পড়বে, তখন ঠিকই বুঝতে পারবেন।

দেখুন ইন্সপেক্টর সাহেব, কথা বলার আগে ভেবে বলছেন তো, আমি পাওয়ার পার্টির জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি। আমাকে ধরে নিয়ে আসা এবং আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করার পরিণতি কী হতে পারে একবার ভেবেছেন?

আপনি আগে নিজের পরিণতি ভাবুন, আমার পরিণতি আপনাকে ভাবতে হবে না, যাক সে কথা পরিণতি যা হবার তাই হবে। আচ্ছা বলুন তো, গতকাল রাতে শেষ কখন আপনার সঙ্গে আমীরের দেখা হয়েছে?

সন্ধ্যায়।

কী কথা হয়েছে?

কোন কথা হয়নি তো, ও বাসায় যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে। তারপর তো আমি জানি না এখন আপনাদের কাছ থেকে শুনছি ও মারা গেছে, উঃ আমার খুব বিশ্বস্ত স্টাফ ছিল। এমনভাবে মারা যাবে আমি ভাবতেও পারিনি।

তাহলে আপনি বলছেন আপনি কিছুই জানেন না, এখন আমাদের কাছ থেকে শুনছেন।

হ্যাঁ।

আপনার মাইক্রো বাসটা কোথায়?

মাইক্রো বাসটা তো ভাড়া যায়, এখন সেটা কোথায় ভাড়া গেছে আমি জানি না।

প্রতিদিন মাইক্রো বাসের হিসাব আপনাকে দেয় না।

না, শুধু প্রতি বৃহস্পতিবার মাইক্রো বাসের ভাড়ার হিসাব হয়।

বাঃ খুব সহজ উত্তর তো আপনার, স্যান্ট্রি একটা লাঠি নিয়ে এসো বেটা পেঁদানি ছাড়া মুখ খুলবে না।

দেখুন ইন্সপেক্টর সাহেব ভদ্রভাবে কথা বলুন, পুলিশে চাকরি করেন দেখে জনগণকে পেটানোর অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। আপনার দায়িত্ব আইন রক্ষা করা, আইন রক্ষার নামে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে জনগণকে পেটানো না। কেন পুলিশে ট্রেনিংয়ের সময় কি হিউম্যান রাইটস্‌ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয় না? বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না এটা শেখানো হয় না? একজন ট্যাক্স হোল্ডার জনগণের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখানো হয় না?

সবকিছুই শেখানো হয় তবে কী করে একজন ক্রিমিনালের মুখ থেকে কথা বের করা হয় তাও শেখানো হয়।

আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে আমি একজন ক্রিমিনাল?

আমার কাছে সে রকম তথ্য আছে।

তথ্য আছে কিন্তু প্রমাণ নেই।

স্যান্ট্রি একটা লাঠি নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ভয়ে জামালের মুখ শুকিয়ে গেল। তার মনে হলো এখনি বুঝি তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হবে যা সে এতদিন পেপার পত্রিকায় পড়েছে। স্যান্ট্রি ভিতরে আসার পর জামাল আরো বেশি ভয় পেল।

পুলিশ অফিসার লাঠিটা হাতে নিয়ে বলল, জামাল সাহেব যদি আপনি সহজে সবকিছু বলেন তবে খুব ভালো কথা তা না হলে তো বুঝতেই পাচ্ছেন।

একজন কনন্সেটেবল বলল, স্যার আপনার ফোন।

চুরাশি

জামাল তার চেম্বারে বসেছিল। শাকিল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলল, বড়ভাই আসবো?

হ্যাঁ চলে এসো।

শাকিল ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বড়ভাই একটা কেস নিয়ে এসেছি।

কী কেস?

শাকিল ফিসফিস করে জামালের কানে কী যেন বলল।

জামাল মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল। শাকিল বাইরে গিয়ে আবার এক বৃদ্ধসহ চেম্বারে ঢুকল।

জামাল সালাম দিয়ে হ্যান্ডশ্যাক করে বলল, চাচা বসুন।

বাবা আমার নাম, করিমুল ইসলাম।

জি আপনাকে আমি চিনি। বলুন চাচা কী মনে করে এসেছেন?

আমার ছেলেটা একটা চাকরিতে দরখাস্ত করেছে-

কী চাকরিতে দরখাস্ত করেছে? ইন্টার্ভিউ কার্ডটা দেখি, বলে জামাল হাত বাড়িয়ে দিল।

করিমুল সাহেব জামালের হাতে ইন্টার্ভিউ কার্ডের একটা ফটোকপি দিল।

জামাল পড়ে দেখে বলল, চাচা আপনাকে কী করে যে বলি কথাটা, আবার না বললেও হচ্ছে না।

তুমি বলো বাবা, আমি কিছু মনে করব না।

আপনি তো জানেন আজকাল তদবির ছাড়া কোন চাকরি হয় না। আর আমি এগুলো কাজ একেবারে পছন্দ করি না। শুনলাম আপনার ছেলের চাকরির বয়স প্রায় শেষ, এ চাকরিটা না হলে তার আর সরকারি চাকরির বয়স থাকবে না। এখন কী করা যায় বলুন তো?

তুমি সব খুলে বলো বাবা, আমি কিছু মনে করব না। টাকা যদি লাগে তবে তুমি তাও বলো। তবু এ চাকরিটা যেন আমার ছেলেটার হাতছাড়া হয়ে না যায়।

আমি আমার কথা ভাবছি না। আজকাল এ চাকরিগুলো খুব এট্রাকটিভ হয়েছে, তাই যেন তদবিরও বেড়ে গেছে।

তুমি বলো বাবা কোন সঙ্কোচ করো না। টাকা যা লাগে আমি দিব।

চাচা আপনি এক কাজ করুন। আপাতত: লাখ দু’য়েক টাকা দিয়ে যান। যদি আরো বেশি খরচ হয় তবে পরে দেখা যাবে।

বাবা এতগুলো টাকা তো এত তাড়াতাড়ি দিতে পারব না, তোমাকে আমি এক লাখ টাকা দিই আর এক লাখ টাকা এপোয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার পর দিব।

তার মানে আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন? দেখুন চাচা আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন তবে পুরো টাকাই দিয়ে যাবেন আর আমাকে বিশ্বাস না করলে খালি খালি আপনি আর আসবেন না।

ঠিক আছে বাবা তোমাকে আমি আগামী সপ্তাহে দু’লাখ টাকাই দিব, তবু তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও।

ঠিক আছে আপনি টাকার ব্যবস্থা করুন, আমি দেখছি কী করা যায়?

তো বাবা টাকা কী চেক দিব নাকি ক্যাশ?

না না এসব টাকা কখনো চেক হয় না ক্যাশ দিবেন।

ঠিক আছে আমি টাকা ম্যানেজ করে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব, বলে করিমুল চলে গেল।

জামাল শাকিলকে বলল, শাকিল দেখ না এরকম কয়েকটা কেস পাও নাকি?

বড়ভাই আপনি পারমিশন দিলে তো আমি অবশ্যই চেষ্টা করি।

জামাল ঢাকা রওয়ানা দেওয়ার আগে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মন্ত্রী জামালকে রাত আটটায় এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। সাধারণত তিনি কখনো সময়ের হেরফের করেন না তাই জামাল হোটেলে সিট নিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর বাসার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল এমন সময় জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো বড়ভাই।

অপর পাশ থেকে মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল আমার তো বাসায় ফিরতে অনেক রাত হবে তুমি না হয় কাল সকালে এসো।

জি বড়ভাই কাল সকালেই আসবো।

জামাল আবার রুমে ঢুকল।

সে আপন মনে বলল, সময়ের অভাবে বেলিকেও কালকে আসতে বললাম এখন দেখি আমার হাতে অঢেল সময়। আজ ঢাকায় আসাটাই অযথা হলো। জামাল কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না, রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বেলিকে মোবাইল করল, হ্যালো বেলি।

অপর পাশ থেকে বেলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কী খবর?

খবর ভালো না, সময় নেই বলে তোমাকে কাল আসতে বললাম এখন কোন কাজও নেই, তুমিও নেই। দেখো না ডার্লিং এখন আমার হোটেলে আসতে পারো নাকি? প্লিজ।

সরি, এখন সাতটা বাজে, আজ যে আর বের হতে পারছি না। কাল দেখা হবে একটু কষ্ট করো।

তার মানে তুমি আসছ না।

এভাবে আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ।

জামাল বেলির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বয়কে ডেকে কফির অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিল। বয় কফি দিয়ে যেতেই মিঃ.টি.আর খান রুমে ঢুকলেন।

জামাল বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল, বস আপনি?

হ্যাঁ তোমার জন্য কয়েকটা সুখবর আছে।

কয়েকটা সুখবর আছে মানে? বলুন, তাড়াতাড়ি বলুন!

বলি, কফি খেতে খেতে বলি।

জামাল বলল, কফির অর্ডার দিই?

আমি অর্ডার দিয়ে এসেছি।

কফি চলে এলো। মিঃ টি.আর.খান কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, প্রথম সুখবর হলো কেমিক্যাল টেস্টে আমাদের এক কোটি টাকার হেরোইন পাউডারে পরিণত হয়েছে।

তারমানে?

তারমানে তোমার জানার দরকার নেই, শুধু একটা কথা মনে রাখো তুমি তোমার হেরোইন পেয়ে যাবে।

জামাল আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ বস।

আরো একটা সুখবর আছে, শুনলে তো তুমি অবাক হয়ে যাবে।

প্লিজ বস, তাড়াতাড়ি বলুন।

এস.পি সাহেবকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।

বস এতকিছু কীভাবে সম্ভব হলো?

মিঃ টি.আর. খান কফির কাপ রাখতে রাখতে জামালের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন।

জামাল বিনীত কণ্ঠে বলল, সরি বস, আর ভুল হবে না।

মিঃ টি.আর. খানের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

তিনি মোবাইল রিসিভ করে বললেন, জি বস, আসছি।

জামাল মিঃ টি. আর. খানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিঃ টি. আর. খান বললেন, জামাল এই হোটেলে তোমার আপ্যায়নের সব ব্যবস্থা করা আছে, তুমি যখন যা চাইবে তা-ই পাবে, কোন রকম ভয় পাবে না।

জি বস।

জামাল আমার একটু তাড়া আছে, আমি আসি, বাই, বলে মিঃ টি. আর. খান চলে গেলেন।

মিঃ টি. আর. খান চলে যাবার পর জামাল ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল, আমি তো ঢাকা আসার কথা কাউকে বলিনি, আমার ঢাকা আসার কথা জানতো বেলি, ও কি এই চক্রের কোন সদস্য হবে, যে আমার গতিবিধি সব সময় লক্ষ্য করছে। হয়ত মিঃ টি. আর. খানই আমার খোঁজখবর জানার জন্য কৌশলে বেলিকে ভিড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাই যদি হবে, আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখাই যদি তার ডিউটি হবে তবে বেলি রাতে বাসা ছেড়ে আসতে চাইবে না কেন? মিঃ টি. আর. খান মোবাইলে কথা বললেন তাঁর বস এর সঙ্গে তারমানে দাঁড়ায় মিঃ টি. আর. খান মালিক নয় একজন কর্মচারী মাত্র তবে এই ব্যবসার মালিক কে? যিনি হেরোইনকে পাউডার বানাতে পারেন? মোজাহার সাহেবের মতো অনেস্ট পুলিশ অফিসারকে স্ট্যান্ড রিলিজ করতে পারেন? আমার গতিবিধির ওপর সব সময় নজরদারি করতে পারেন?

হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে জামাল চমকে উঠল, কে?

বয় জোরে বলল, স্যার একটু দরজাটা খোলেন।

জামাল দরজাটা খুলতেই বয় বলল, স্যার বলছিলেন, বার খোলার সময় আপনাকে স্মরণ করে দেওয়ার জন্য।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও, বলে জামাল বয়কে বিদায় করে দেওয়ার পর বার-এ গেল।

পঁচাশি

মাননীয় মন্ত্রী জামালকে দেখে সহাস্যে বললেন, এই যে জামাল কী খবর? ভালো আছ?

জি বড়ভাই।

এলাকার রাজনীতি?

জি ভাইজান সবই ভালো তবে আপনি তো এলাকায় থাকেন না। রাজনীতির পুরো চাপটাই আমাকে সামলাতে হয়, এই ধরুন কারো রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, কারো স্কুলের উন্নয়ন, কারো ছেলে-মেয়ের চাকরি, এইসব নিয়ে আমি খুব ঝামেলায় আছি।

বেশ তো কাজ করো, তোমার মতো লিডার এলাকায় আছে দেখেই তো আমি ভরসা পাই। কাজ করো এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করো। আমার পরে তো তোমাকেই এলাকার হাল ধরতে হবে না কি বলো?

জামাল মাথা চুলকিয়ে সায় দিল।

মাননীয় মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, তো কী কাজ নিয়ে এসেছ?

বড়ভাই আসলে আমি না পারি কাউকে না বলতে, আবার না পারি আপনাকেও বলতে, আমার হয়েছে জ্বালা।

বিরক্ত হচ্ছ কেন? জনপ্রতিনিধিদের কখনো বিরক্ত হতে হয় না। হাসিমুখে সব কাজ করে দিতে হয়, বল কী কাজ নিয়ে এসেছ?

বড়ভাই, আমাদের দলের কয়েকজন কর্মী আপনার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে, আরে বাবা দরখাস্ত করেছিস তো ভালো কথা, ইন্টার্ভিউ দিবি, যোগ্যতা থাকলে চাকরি হবে এখানে আমার কী করার আছে? না সবারই এক যুক্তি আমরা ভোট দিয়ে মন্ত্রী বানিয়েছি আমাদের চাকরি দিতে হবে। আমি বলি, চাকরি দিতে হবে তো যাও না মন্ত্রীর কাছে যাও। না কেউ আবার আপনার কাছেও আসবে না। উল্টা কথা বলে মন্ত্রী এলাকায় থাকেন না, উনার পরেই আপনি, কাজেই মন্ত্রীকে বলে চাকরি করে দিবেন। এই নিন ইন্টার্ভিউ কার্ড, আপনার এলাকার মানুষ, আপনার দলের কর্মী কী করবেন এখন আপনি ভালো বুঝেন, বলে জামাল কয়েকটা ইন্টার্ভিউ কার্ড মাননীয় মন্ত্রীকে দিল।

মাননীয় মন্ত্রী ইন্টার্ভিউ কার্ডগুলো দেখে বললেন, চারটা ইন্টার্ভিউ কার্ড নিয়ে এসেছ? এতগুলো জেলা কোটা আছে তো?

বড়ভাই এতকিছু তো আর গ্রামের সাদাসিধে মানুষ জানে না, তারা জানে মন্ত্রীর কাছে গেলেই চাকরি হবে। বড়ভাই আমি কিন্তু এক রকম কথা দিয়ে এসেছি। চাকরি না হলে এলাকায় আমার মান-সম্মান বলে কিছু থাকবে না। আপনার ক্ষমতা নিয়েও মানুষ নানান কথা বলবে।

মাননীয় মন্ত্রী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললেন, চারজন ক্যান্ডিডেটের ইন্টার্ভিউ কার্ড নিয়ে এসেছ, আচ্ছা দেখি কী করা যায়?

জামাল আবদারের সুরে বলল, বড়ভাই আমি কিন্তু আপনার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, আপনি হলেন মন্ত্রী, আপনার মন্ত্রণালয়েরই চাকরি, আমাদের এলাকার ছেলেদের চাকরি হবে না তো কোথাকার ছেলেদের চাকরি হবে? তাছাড়া সবাই একসময় আমাদের দলেরই কর্মী ছিল। দলে তাদের অবদান আছে, তাদের চাকরি হলে তারা সব সময় দলের প্রতি অনুগত থাকবে। এটা তো আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ইনভেস্ট, এটাও যদি আপনাকে আমার বলে দিতে হয়, সরি বড়ভাই আমি আসলে আপনার কাছ থেকে এমন আশা করিনি।

জামাল রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কী তোমাকে না বলছি। দেখা যাক ইন্টার্ভিউ কার্ডগুলো আমার কাছেই রাখলাম, তুমি যোগাযোগ রেখো।

জি বড়ভাই।

তোমার পৌরসভা ভালোভাবে চলছে তো?

জি বড়ভাই।

ভোটের তো এক বছর কেটে গেল। এলাকায় ভালোভাবে কাজ করো, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড কমিটিগুলোকে সংগঠিত করো। সামনে কোন ভোট না থাকলেও দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড যেন থেমে না যায়।

জি বড়ভাই, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এবং আমি থাকতে আপনি বিন্দুমাত্র চিন্তা করবেন না। আপনাকেই যদি সবকিছু চিন্তা করতে হবে তবে আমি আছি কী জন্য?

মিঃ টি. আর. খান জামালের সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক করছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় কার টেলিফোনে সে ছাড়া পেল? কে এস. পি. সাহেবকে স্ট্যান্ড রিলিজ করালো, আর তার ঢাকা আসার খবরটাই বা টি. আর খান জানতে পারলেন কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে কৌশলে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে।

জামাল মাননীয় মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, বড়ভাই কয়েকদিনের মধ্যে কি শাকিল আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?

না তো।

নতুন এস. পি সাহেব তো স্ট্যান্ড রিলিজ হয়েছেন।

পরে শুনেছি।

জামাল বুঝতে পারল, মাননীয় মন্ত্রী এসবের কিছু জানেন না। সে আর কথা বাড়ালো না।

জামাল বলল, বড়ভাই এলাকায় আপনার একবার যাওয়া দরকার।

হ্যাঁ অবশ্যই যাবো, আগামী মাসে একবার এলাকায় যাবো আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করেই প্রোগ্রাম ফাইনাল করব।

জি বড়ভাই, আমি সবকিছু এ্যারেঞ্জ করব, বলে জামাল মাননীয় মন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বিদায় নিল।

জামাল মাননীয় মন্ত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে বেলিকে মোবাইল করল, বেলি তুমি কোথায়?

বাসায়।

তুমি আমার হোটেলে আসছ না?

হ্যাঁ এই আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।

তাড়াতাড়ি এসো আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। জামাল কয়েক মিনিটের মধ্যে তার হোটেলে পৌঁছাল। জামালের মাথার মধ্যে তখনো একটাই চিন্তাই বিড়বিড় করছে, আমার ঢাকা আসার খবরটা মিঃ টি. আর. খান জানলো কীভাবে? আর বেলির কাছ থেকে নিশ্চিত হতে পারলেই জামালের মাথা থেকে একটা দুশ্চিন্তা দূর হয়।

জামাল তার রুমের মধ্যে পায়চারি করছিল। আরো কয়েক মিনিট পর বেলি এলো। জামাল দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেলিকে বলল, বেলি বস।

আপনি কেমন আছেন?

আর ভালো থাকা। একটা ব্যাপার নিয়ে আমি বেশ দুশ্চিন্তায় আছি।

বেলি শুষ্ক মুখে বলল, কী ব্যাপারে?

আচ্ছা বেলি তুমি আমার ঢাকায় আসার কথা কাউকে বলেছ?

কাউকে বলেছি মানে?

না আমি বলছিলাম, আমি ঢাকা আসার খবরটা কেমন করে জানি ফাঁস হয়ে গেছে।

আপনি ঢাকা আসার খবর ফাঁস হয়ে গেলে কী? আপনি কী এমন কোন কাজ করেছেন যে ঢাকা আসা আপনার জন্য বিপজ্জনক হয়ে গেছে?

জামাল বেলির মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না।

বেলি কিছুটা বিরক্ত বোধ করল, আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?

না ঠিক সন্দেহ না, বলে জামাল বেলির কাছে গিয়ে তার দু’বাহুতে হাত রেখে বলল, সরি ডার্লিং ভুল হয়ে গেছে।

আমি আপনার আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছি, আমি আসি আপনি থাকুন আপনার সন্দেহ নিয়ে, বলে বেলি চলে যাচ্ছিল। জামাল বেলির হাত টেনে ধরল।

বেলি জামালের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ছাড়ুন নইলে আমি চিৎকার করব।

জামাল বেলির হাত ছেড়ে দিল। বেলি আর পিছনের দিকে ফিরে তাকাল না সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। জামাল কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তবে কী বেলির কোন দোষ নেই? না জামাল আর বেলিকে নিয়ে ভাবতে চায় না। কার মাধ্যমে টি. আর. খান জানতে পারল তা নিয়েও আর মাথা ঘামাতে চাইল না। বেলিকে সন্দেহ করায় আজ থেকে বোধ হয় বেলিকে সে চিরদিনে জন্য হারালো।

ছিয়াশি

জামাল অনেকদিন পর আজ পার্টি অফিসে এলো। পার্টি অফিসের সামনে নেতা-কর্মীদের পাদচারণায় মুখর। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে জামালকে অনেক ভিড় ঠেলতে হলো। অফিসের করিডোরেও লোক সমাগম অনেক বেশি। জামাল খুঁজতে খুঁজতে মোজাফফর সাহেবের কাছে গেল। তিনি তখন একজন কর্মীর সঙ্গে আলাপ করছিলেন।

জামাল সালাম দিয়ে দাঁড়াল।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি।

আমার নাম জামাল।

ও আপনি তো কাল আমাকে মোবাইল করেছিলেন, তাই না?

জি।

আপনি সেই ইয়ং লিডার, খুব অল্প বয়সে জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি।

জামাল মৃদু হাসল।

বসুন, প্লিজ। আমি আগে সুমনকে বিদায় করি। সুমন বলো তোমার কাজটা তো মোস্তফার কাছে, না?

জি ভাই।

এখন তো মোস্তফাকে টেলিফোনে পাওয়া যাবে না, তোমার কাছে মোস্তফার মোবাইল নাম্বার আছে?

ভাইজান আমার কাছে তো উনার মোবাইল নাম্বার নেই।

ও আচ্ছা আসল লোককেই তো পেয়ে গেছি, জামাল সাহেব আপনার কাছে মোস্তফার মোবাইল নাম্বার আছে না?

জি বড়ভাই।

আপনি কি মোস্তফার সঙ্গে দেখা করেছেন?

জি বড়ভাই, আমি সকালবেলা দেখা করে এসেছি।

                মোজাফফর সাহেব সুমন সাহেবের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, ও হচ্ছে সুমন, আমাদের দলের একনিষ্ঠ কর্মী এবং আমার খুব কাছের লোক, আপনি মোস্তফাকে বলে একটু ওর কাজটা করে দিন তো, আর না হয় আপনি মোস্তফাকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলুন।

সুমন সাহেব জামালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমি সুমন।

জামাল হ্যান্ড শ্যাক করে নিজের পরিচয় দিল। তারপর বলল, সুমন সাহেব বলুন তো আপনার কী কাজ?

সুমন সাহেব একটা কাগজ জামালের হাতে দিলেন। জামাল কাগজটা পড়ে দেখে বলল, এটা তো মোস্তফা ভাই’র মন্ত্রণালয়ের কাজ। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না বড়ভাই আমি মোস্তফা ভাইকে বলে কাজটা করে দিব।

মোজাফফর সাহেব বললেন, দেখুন তো পরিচয় না থাকলে কী হয়? আপনি একটু দেখুন তো বিষয়টা, কাজটা হয়ে গেলে আমাকে ইনফর্ম করবেন, আর মোস্তফাকে আমার সালাম দিবেন।

জামাল বলল, জি বড়ভাই, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, সুমন সাহেব আমি আপনাকে মোস্তফা ভাই’র কাছে নিয়ে যাবো, আপনার কাজ হয়ে যাবে।

জি ভাই।

মোজাফফর সাহেব বললেন, জামাল সাহেব বলুন কী মনে করে?

না, আমার কোন তদ্বির নেই, এমনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

দলীয় কর্মকাণ্ড ঠিক মতো চলছে?

জি ভাই। আমি তো লোকাল রাজনীতি মেইনটেইন করি।

হ্যাঁ আমরা সব খবরই রাখি। আপনি আপনার এলাকায় দলের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা এনেছেন। কাজ করুন এভাবে কাজ করলে আপনি একদিন অনেক বড় নেতা হতে পারবেন, আমাদের আর ক’দিন সামনে আপনারাই তো দলের হাল ধরবেন।

বড়ভাই আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং প্রবীণ নেতা, আমাকে তুমি করে বলবেন।

মোজাফফর সাহেব খুশি হলেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তো জামাল তোমার কী আর হেড অফিসে আর কারো কাছে কাজ আছে?

বড়ভাই কাজ নেই, তবে একবার ইমরান ভাই’র সঙ্গে দেখা করতাম।

ইমরান ঢাকার বাইরে আছে, আজ রাতে ঢাকায় ফিরবে, তুমি মোবাইলে কথা বলে দেখা করিও।

তোমার আর কারো সঙ্গে পরিচয় আছে।

জি না।

সুমন তুমি জামালকে নিয়ে যাও, দেখ কে কে আছে? আমার রেফারেন্সে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিও।

জি ভাই।

সুমন সাহেব জামালকে গোটা অফিস ঘুরে দেখাতে দেখাতে মিজান সাহেবের চেম্বারে নিয়ে গেল।

মিজান সাহেব তখন কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি মুখ তুলে তাকালেন।

সুমন সাহেব সালাম দিয়েই জামালকে মিজান সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

মিজান সাহেব সালামের জবাব দিয়ে কিছুটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ডিসট্রিক্ট জেনারেল  সেক্রেটারি।

জামাল মৃদু হাসল।

বসো, বসো বলে মিজান সাহেব খুব সম্ভব চেয়ারের জন্য এদিক-সেদিক তাকালেন।

তাঁর সামনের চেয়ারে বসা নেতা-কর্মীরা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে চলে গেল, মিজান ভাই আমরা না হয় পরে আসবো।

আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা পরে এসো, বলে তিনি জামাল এবং সুমনকে বসতে বললেন, ইয়াং লিডার বসো, এই দেখ আপনার অনুমতি না নিয়ে তুমি এড্রেস করলাম, আপনি কিছু মনে করবেন না, আসলে বয়স হয়েছে তো তাই নিজেকে সবার বড় মনে হয়।

না ঠিক আছে, আপনি আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন। আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট। আর আপনি তো আসলে রাজনীতিতে অনেক প্রবীণ।

কী নাম বললে যেন তোমার?

জি, আমার নাম জামাল।

তো জামাল বল কী মনে করে এসেছ?

না বড়ভাই, কিছু মনে করে না, ঢাকায় এসেছিলাম মনে করলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

তোমার এলাকার এম.পি যেন কে?

মোস্তফা ভাই।

এই দেখো তো সবকিছু সহজে ভুলে যাই।

বড়ভাই আপনি কিন্তু আমাকে ভুলে যেতে পারবেন না, আমি মাঝে মাঝে আপনাকে মোবাইল করব।

অবশ্যই।

প্লিজ আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড দিবেন?

অফ কোর্স, বলে তিনি একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন।

জামাল মিজান সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করে বের হলো।

জামাল পার্টির গেটে দাঁড়িয়েই মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল। বেশ কয়েকবার মোবাইল রিং হওয়ার পর মাননীয় মন্ত্রী মোবাইল রিসিভ করলেন, হ্যালো জামাল।

বড়ভাই আপনি কোথায়?

আমি তো হঠাৎ করে ঢাকার বাইরে চলে এসেছি, তুমি কোথায়?

আমি তো সকালবেলা আপনার সঙ্গে দেখা করলাম ভাবছিলাম আজই চলে যাবো কিন্তু হঠাৎ করে একটা কাজে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে, আপনার সঙ্গে দেখা করা আমার দরকার।

আমি তো ঢাকায় ফিরতে অনেক রাত হবে, তুমি কাল বারোটার দিকে একবার অফিসে এসো।

জি ভাই।

সরি সুমন সাহেব, মোস্তফা ভাই তো ঢাকার বাইরে, আপনার কাজের বিষয়ে আগামীকাল বারোটার আগে আলাপ করা যাচ্ছে না।

ঠিক আছে, প্লিজ আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড দিন, আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

জামাল সুমন সাহেবকে তার একটা ভিজিটিং কার্ড দিল। সুমন সাহেব তার একটা ভিজিটিং কার্ড জামালের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল ভাই উঠেছেন কোথায়?

জামাল তার হোটেলের নাম বলল।

সুমন সাহেব তার র দরজা খুলে দিয়ে বললেন, উঠুন আপনাকে লিভ দিয়ে যাই।

জামাল তে উঠল।

সুমনের ভিজিটিং কার্ডটা পড়ে জামাল জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সুমন সাহেব আপনার কার্ডে তো দেখছি আপনার এ্যাড ফার্মও আছে?

হ্যাঁ আসুন না সকালে একবার আমার এ্যাড ফার্মটা দেখে যাবেন।

দেখি সময় করতে পারলে আসবো।

সুমন সাহেব বললেন, কাল তো আপনার কোন কাজ নেই আসুন না একবার, নাকি আমি আপনার হোটেলে  পাঠিয়ে দিব।

জামাল কিছু বলল না।

সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই কাল সকালে আপনাকে একবার রিং করে  পাঠিয়ে দিব, আপনি চলে আসবেন, আপনার সময়টা ভাল কাটবে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

সাতাশি

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, মোস্তফা ভাই।

জামাল তোমার মোবাইল বন্ধ কেন?

মোবাইলে চার্জ ছিল না।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে খুঁজছিলাম কারণ আমি আজকেও ঢাকার বাইরে যাবো, তুমি কিন্তু দেরি করো না, বারোটার মধ্যে আমার অফিসে চলে এসো।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি বারোটার আগেই আপনার বাসায় আসছি।

জামাল সুমন সাহেবের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে মোবাইল করল, হ্যালো সুমন সাহেব মোস্তফা ভাই তো আজকেও ঢাকার বাইরে যাবেন, আমাকে বারোটার মধ্যে যেতে বলেছেন, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।

জি ভাইজান আমি আসছি, আপনি রেডি থাকুন আমি আপনাকে হোটেল থেকে নিয়ে যাবো।

মাননীয় মন্ত্রী জামালকে দেখে বলল, সরি জামাল আমি আসলে তোমাকে বেশি সময় দিতে পারছি না, বলো আগে তোমার কাজের কথা বলো?

বড়ভাই আমি তো গতকালই চলে যেতাম, হাতে একটু সময় পেলাম মনে করলাম একবার পার্টি অফিসটা দেখে যাই।

খুব ভালো করেছ।

সেখানে মোজাফফর ভাই’র সঙ্গে পরিচয় হলো তিনি আবার আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম আপনাকে টেলিফোন করার জন্য তিনি বললেন, না তুমি তাঁর খুব কাছের লোক তোমাকে হাতের কাছে পেয়েছি তো আর তাকে টেলিফোন করার কী দরকার? তুমি আমার কথা বলো সে নিশ্চয়ই করে দিবে।

দেখি কী কাজ?

জামাল কাগজটা বের করে দিতেই মাননীয় মন্ত্রী সুপারিশ করে দিয়ে আশরাফ সাহেবকে দিয়ে বললেন, আশরাফ জামালের এই কাজটা করে দিও।

বড়ভাই এই সকালবেলা আপনার সময় নষ্ট করলাম।

আরে না এভাবে বলছ কেন? কাজ হয়ে গেলে আশরাফ তোমাকে ফোন করবে।

জি বড়ভাই ঠিক আছে।

জামাল মাননীয় মন্ত্রীর রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সুমন সাহেব ততক্ষণ  নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

জামালকে দেখে সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই কী খবর?

খবর ভালো তবে আমার মনে হয় আমি না হয়ে অন্য কেউ হলে আপনার কাজ এত সহজে হতো না।

সে তো বটেই।

আপনি আসলে জানেন না মোস্তফা ভাই কী রকম মানুষ? আমি হাতের কাছে থাকি তবুও মাঝে মাঝে চিনতে আমার ভুল হয়। আমার মনে হয় মোজাফফর ভাই টেলিফোন করলেও কাজ হতো না।

সে জন্যই বুঝি ভাগ্যক্রমে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল, তাও আবার মোজাফফর ভাই’র সামনে।

মোজাফফর ভাইকে আমার কথা বলবেন।

অবশ্যই, এখন কাজের কী খবর বলুন?

এ.পি.এস কে মার্ক করে দিয়েছে, কাজ হয়ে গেলে আমাকে টেলিফোন করবে।

আজকেই হবে তো।

সুমন সাহেব আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। আমি যে কাজ হাতে নিয়েছি সে কাজ কী আজকে না হয়ে পারে? আমি কাজ করে আপনার হাতে দিয়ে মোজাফফর ভাই’র সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে যাবো।

থ্যাঙ্ক ইউ জামাল ভাই।

আচ্ছা তাহলে আমরা এখন যাবো কোথায়?

আমার অফিসে, কেন আপনার অন্য কোথাও কাজ আছে নাকি?

না তা নেই।

চলুন আমার অফিসে দুপুরে এক সঙ্গে লাঞ্চ করব তারপর আপনি চলে যাবেন।

তে সুমন সাহেবের ব্যবসা নিয়ে জামালের অনেক কথাবার্তা হলো। কথায় কথায় সুমন সাহেব জানালেন তার ঠিকাদারি ব্যবসাও ছিল কিন্তু ঠিকাদারি ব্যবসায় তিনি তেমন সফল হতে পারেননি। তাঁর এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর ব্যবসা আছে সেটাই তাঁর লাভজনক ব্যবসা আর এ্যাড ফার্মটাতে তাঁর খুব একটা লাভ নেই তবে অনেক ম্যান পাওয়ার আছে তারাই দেখাশুনা করে।

জামাল জিজ্ঞেস করল, সুমন সাহেব কিছু মনে করবেন না। আসলে এ্যাড ফার্ম সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণাই নেই। বিষয়টা একটু বলুন তো এ্যাড ফার্মের ব্যবসাটা আসলে কী রকম?

ভাইজান আমরা অফিসে এসে পড়েছি। চলুন কফি খেতে খেতে কথা বলা যাবে।

সুমন সাহেবের অফিসটা বেশ লাক্সারিয়াস। অফিসের দরজায় ঢুকতেই একটা বড় রুমে সোফায় বসে আছে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী। রিসিপশনিস্ট সুমন সাহেব এবং জামালকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। রিশিপসনের পর বাঁয়ের একটা রুমে কয়েকজন কম্পিউটার অপারেটর কাজ করছে। রুমের এক কোণায় কয়েকটা ক্যামেরা এবং স্ট্যান্ড, ডানের একটা রুমে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের কর্মচারী কাজ করছে। সোজা শেষের রুমের দরজায় একজন পিয়ন টুলে বসেছিল সুমন সাহেবকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষের দেয়ালে টাঙ্গানো কয়েকজন মডেল তারকার ছবি।

সুমন সাহেব তার চেয়ারে বসে বললেন, ভাইজান বসুন।

জামাল বসল।

কয়েক মিনিট পর ইন্টারকম বেজে উঠল।

সুমন সাহেব রিসিভ করে বললেন, হ্যালো লিজা।

স্যার পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে কয়েকজন মডেল এসেছে।

এক এক করে পাঠিয়ে দাও, তার আগে আমাদের দু’কাপ কফি পাঠিয়ে দাও।

কয়েক মিনিটের মধ্যে কফি চলে এলো। তারপর অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে চেম্বারে ঢুকে সালাম দিল।

সুমন সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, কী নাম তোমার?

চৈতী।

এখন কী করছ?

লেখাপড়া।

কোন ক্লাসে?

স্যার এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।

আগে কখনো মডেলিং অভিনয় করেছ?

জি না স্যার।

নাচ জানো?

জি না।

সুমন সাহেব মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন, তারমানে একেবারে নতুন।

চৈতী বিনয়ের সুরে বলল, আপনি আমাকে একবার চান্স দিয়ে দেখুন স্যার, আমি অবশ্যই পারবো।

তুমি বায়োডাটা নিয়ে এসেছ?

জি স্যার।

চৈতী সুমন সাহেবের হাতে তার বায়োডাটা দিল।

সুমন সাহেব বললেন, বায়োডাটায় তোমার মোবাইল নাম্বার আছে?

জি স্যার।

ঠিক আছে তুমি আগামী মাসে একবার আমার সঙ্গে দেখা করো।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, বলে চৈতী চলে গেল।

চৈতী চলে যাবার পর আরেকটা মেয়ে ঢুকল।

সুমন সাহেব তার ইন্টার্ভিউ গ্রহণের পর সে চলে গেল।

তারপর একটা ছেলে ঢুকল।

এমনভাবে বেশ কয়েকজনের ইন্টার্ভিউ হয়ে যাবার পর জামাল সুমন সাহেবকে বলল, সুমন সাহেব আমি বুঝতে পেরেছি, মানে টি.ভি’তে যে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে তাদের নিয়ে বিজ্ঞাপন তেরি করার কাজ আপনার।

জি ভাইজান এবার তাহলে বুঝতে পেরেছেন?

একেকটা বিজ্ঞাপনে মডেল তারকাদের ক’টাকা করে দিতে হয়?

ঠিক নেই, প্রতিষ্ঠিত তারকাদের অনেক টাকা দিতে হয়, আর নতুন মুখদের কিছু দিতে হয় না, বরং তারাই-

সুমন সাহেব আপনার ব্যবসাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে আমি মোবাইলে এবিষয়ে যোগাযোগ করব।

জি ভাইজান।

আটাশি

জামালের এক কোটি টাকার হেরোইনের চালান পুলিশের কাছে আটক, আমীরের মৃত্যুসহ তার অন্ধকার জগতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে তার ওপর দিয়ে একটা বড় রকমের ধকল গেল। সবকিছু কাটিয়ে জামাল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে এখন আগের মতোই তার রুটিন ওয়ার্ক করে যাচ্ছে, সকালবেলা অফিসে বসা, তারপর পৌরসভা, সারাদিন ছুটে চলা তারপর আবার রাতে অফিসে বসা। জামাল আবার সমস্ত দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠেছে।

সেদিন জামাল পৌরসভায় তার চেম্বারে বসেছিল। দরজা নক করে তার চেম্বারে ঢুকল শাখাওয়াত কমিশনার সঙ্গে একটা ছেলে।

শাখাওয়াত কমিশনার জামালের সঙ্গে ছেলেটার পরিচয় করে দিল, ভাইজান এ হলো খাইরুল, আমার ওয়ার্ডের যে মেয়েটা আপনার কাছে দরখাস্ত করেছে তার স্বামী। আমাদের দলের কর্মী, খুব ভালো ছেলে, খুব সাদাসিধে।

হ্যাঁ তা তো বুঝলাম তবে তোমার বিরুদ্ধে রহিমা একটা দরখাস্ত করেছে, তুমি নাকি তাকে যৌতুকের জন্য অত্যাচার করছ?

না ভাইজান, আমি যৌতুক চাইনি।

তবে সে দরখাস্ত করলো কেন?

ভাইজান আসলে ওকে আমার পছন্দ না, ওর সঙ্গে আমার মনের মিল হচ্ছে না। আমি ওকে তালাক দিব।

তালাক দিবে তো বিয়ে করলে কেন?

আমি বিয়ে করতে চাইনি, আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।

জামাল বলল, আইন জানো তুমি তালাক দিতে চাইলেই তো হবে না, যদিও আইনে পুরুষকে দেন মোহর পরিশোধ সাপেক্ষে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজকাল যে কেউ স্ত্রীকে তালাক দিলেই মেয়ে পক্ষ সোজা কোর্টে গিয়ে যৌতুকের মামলা করছে। তোমার বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করলে নিশ্চিত হাজতবাস করতে হবে। হয়ত যৌতুকের মামলার রায় তোমার পক্ষেই হবে কিন্তু ততদিনে হাজতে ঘানি টানতে টানতে তোমার জীবনের বারোটা বেজে যাবে।

ভাইজান আপনি থাকতে আমার যেন কোন ক্ষতি না হয় সেদিকটা একটু খেয়াল রাখবেন।

তোমার বিয়েতে দেনমোহর কত টাকা?

পঞ্চাশ হাজার।

আলাপ আলোচনায় যদি দেনমোহরের টাকা নগদ পরিশোধ করতে হয় তবে তুমি টাকা দিতে পারবে?

জি ভাইজান পারবো।

আগামীকাল হাজিরা আছে না?

জি ভাইজান।

ঠিক আছে কাল ঠিক সময়ে এসো।

খাইরুল চলে গেল। শাখাওয়াত কমিশনার আর জামাল খাইরুলের বিষয়ে আলোচনা করছিল এমন সময় কালাম কমিশনার ভিতরে ঢুকল।

জামাল হাসতে হাসতে বলল, কী ব্যাপার কমিশনার সাহেব? ভালো আছেন?

কালাম কমিশনার জামালের চেম্বারে ঢুকার সময় যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ঢুকেছিল। সে জামালের হাসি দেখে যেন বিদ্যুৎ ষ্ফুর্লিংয়ের মতো জ্বলে উঠল, ভালো তো সব সময় থাকতেই চাই কিন্তু আপনার জন্য ভালো থাকতে পারছি না।

জামাল না বোঝার ভান করে বলল, কেন আমি আবার কী করলাম?

আপনি চৌরাস্তা থেকে আমার বাসা পর্যন্ত রাস্তা পাকা করন কাজটা এবছরের উন্নয়নমূলক কাজের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন?

তাই নাকি? এবছরের উন্নয়নমূলক কাজের তালিকাটা একটু কাটছাঁট করা হয়েছে, তাতে চৌরাস্তা থেকে আপনার বাসা পর্যন্ত রাস্তাটা বাদ দেয়া হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।

আমি সংশোধিত তালিকা দেখেছি, তাতে শুধু আমার বাসা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তাটাই বাদ দেয়া হয়েছে। অন্য রাস্তাগুলো ঠিক আছে।

দেখুন কমিশনার সাহেব আপনি একজন জনপ্রতিনিধি, আপনার উচিৎ সব সময় জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা করা। আমি যদি আপনার বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা ঠিক রেখে আপনার ওয়ার্ডের অন্য রাস্তার কাজ বাদ দিতাম তাতে কি ভালো হতো?

তা হবে কেন? অন্য কোন ওয়ার্ডের কাজ বাদ না দিয়ে শুধু আমার ওয়ার্ডের কাজ বাদ দেয়া হলো কেন?

আপনারা যে কয়েকজন ওয়ার্ড কমিশনার আছেন তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজ নিজ ওয়ার্ডের জনসাধারণের সুবিধা দেখা কিন্তু আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান, আমাকে গোটা পৌরসভার ভালো-মন্দ দেখতে হয়। সেক্ষেত্রে কোন এলাকার কাজ বাড়াতে হবে আর কোন এলাকার কাজ বাদ দেয়া হবে তা আমাকে বুঝতে হবে।

দেখুন চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি যেভাবেই বুঝান না কেন আপনি এলাকায় আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্যই আমার বাসায় সংযোগকারী রাস্তাটার কাজ বাদ দিয়েছেন। এটা আপনি ভালো কাজ করেননি, আপনি বলছেন পৌরসভার সব মানুষের সুবিধা দেখছেন। আসলে কী তাই? আসলে আপনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সব উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করছেন। এই কয়েকমাসে দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পৌরসভাকে আপনি একটা দলীয় অফিসে পরিণত করেছেন। আপনি ভাবছেন আমরা কিছু বুঝতে পারি না? জনগণ কিছু বুঝতে পারছে না? সবাই ঘুমাচ্ছে? তাই যদি আপনার ধারণা হয়ে থাকে তবে আমি বলব আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমরা সবকিছু দেখছি, জনগণও দেখছে ঠিক সময়ে জনগণ আপনার কাজের জবাব দিবে।

দেখুন কমিশনার সাহেব এটা আমার চেম্বার, কোন রাজনৈতিক মঞ্চ না। আপনার যদি কিছু বলার থাকে তবে মনের মধ্যে পুষে রাখুন রাজনৈতিক মঞ্চে এর জবাব দিবেন। দয়া এখন আপনি আসুন।

যাচ্ছি তবে আপনাকে বলে যাচ্ছি এখনো ভালো হয়ে যান। যাদেরকে নিয়ে আপনি আমাকে এবং আমাদের দলের কমিশনারদের কোণঠাসা করছেন তারাই আপনাকে ডুবাবে, বলে কালাম কমিশনার চলে গেল।

জামাল হেসে উঠল। দেখছ শাখাওয়াত আমাকে একরকম হুমকি দিয়ে গেল। সামান্য একটা রাস্তার কাজ তা নিয়েই এত হৈ চৈ। বেটা দেখ বিরোধী দলে থাকার কী মজা?

এমন সময় বেলাল কমিশনার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল, ভাইজান কালাম কমিশনারকে দেখলাম লাফাতে লাফাতে বের হয়ে গেল, ব্যাপার কী?

আর বলো না বেলাল, কালাম কমিশনারের বাসা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তাটা বাদ দেয়া হয়েছে তাই সে একেবারে রেগে আগুন। আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে গেল। জানি না আমাকে কী করবে? আচ্ছা তুমি বসো তো একটা হিসাব করো।

বেলাল কমিশনার চেয়ারে বসল।

জামাল দু’জনের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা দু’জনে দেখ সে যে বলে গেল সেটা কি শুধু তার মুখের কথা নাকি তার কথার কোন ভিত্তি আছে?

বেলাল কমিশনার হাসতে হাসতে বলল, ভাইজান কী ভয় পেয়েছেন? আপনার কোন ভয় নেই, আমরা আছি না? আমরা পৌরসভায় দুই তৃতীয়াংশ কমিশনার আমাদের দলের আর এক তৃতীয়াংশ কমিশনার বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির। কাজেই আপনার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার তাদের কোন সুযোগ নেই। তারওপর আপনি সরকারি দলের নেতা। আপনার বিরুদ্ধে কোন রকম ষড়যন্ত্র করা মানে তার গর্তে পা দেয়া। কালাম কমিশনার বুদ্ধিমান এবং কয়েকবার নির্বাচিত কমিশনার জেনে শুনে সে এমন কোন কাজ করবে না যাতে তার নিজেরই ক্ষতি হয়। আপনি এবিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে সে তার ওয়ার্ডে ভোটারদের সংগঠিত করার চেষ্টা করবে। সেজন্য আপনাকে আমাদের দলের কর্মীদের সংগঠিত করে জবাব দিতে হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ কালাম কমিশনারকে একটা শক্ত জবাব দিতে হবে।

ঊননব্বই

জামাল প্রতিদিন সকালবেলা প্রথমে অফিসে বসে, সেখানে তার সহকর্মীদের প্রয়োজনীয় কাজকর্মের নির্দেশনা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন সকালবেলা জামাল তার চেম্বারে রশিদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বের হচ্ছিল। জাকির দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলল, ভাইজান একটা মহিলা এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।

জাকির বের হয়ে গেল।

বিপ্লবী ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।

জামাল সালামের জবাব দিয়ে বলল, বিপ্লবী তুমি?

আপনার ইন্স্যুরেন্সটার এগ্রিমেন্টটা হয়েছে তো তাই এগ্রিমেন্টের কাগজ-পত্রগুলো দিতে এলাম।

জামাল হাসতে হাসতে বলল, তুমি আমার সঙ্গে চালাকি করলে।

কী চালাকি করলাম?

তুমি আমাকে মোবাইল করে আসতে পারতে?

মোবাইল করলে কি আপনি এখানে আসতে বলতেন না?

না, কারণ তুমি জানো এসব আলাপ আমি অফিসে করি না।

কোথায় করেন? মধুকুঞ্জে?

জামাল মুচকি হেসে বলল, বুঝতেই তো পাচ্ছ।

বুঝতে পাচ্ছি বলেই তো কোনকিছু না জানিয়ে আপনার অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে শুনলাম, আপনি আছেন কি না? যখন জানলাম আপনি আছেন তখন ভাবলাম আপনার কাগজ-পত্রগুলো দিয়ে যাওয়াই ভালো। মোবাইল করলে তো আপনি মধুকুঞ্জে দাওয়াত করবেন। মধুকুঞ্জের দাওয়াত মানে তো বুঝতে আমার আর বাকী নেই। তাই একটু চালাকি করলাম। প্লিজ আপনার কাগজ-পত্রগুলো নিন।

জামাল কাগজ-পত্রগুলো নিয়ে বলল, তাহলে এখন এগ্রিমেন্ট কমপ্লিট মানে আমি মরে গেলে তোমার ভাবী আর তোমার ভাবী মারা গেলে আমি টাকা পাবো।

জি।

কফি খাবে?

কিছু মিশাবেন না তো?

জামাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই জাকির ভিতরে ঢুকল, ভাইজান।

দু’কাপ কফি।

কিছুক্ষণের মধ্যে কফি চলে এলো। জামাল কফি খেতে খেতে বিপ্লবীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। বিপ্লবী লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বসল।

জামাল বলল, তুমি এখনো আমাকে লজ্জা পাচ্ছ?

বিপ্লবী কিছু বলল না। তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল। বিপ্লবী লাইন কেটে দিল।

জামাল বলল, তুমি মোবাইল নিয়েছ কই আমাকে তো মোবাইল নাম্বার দাওনি?

বিপ্লবী জামালের মোবাইলে রিং দিয়ে বলল, আপনার মোবাইলে রিং দিয়েছি, নাম্বারটা সেভ করে নিন।

জামাল বিপ্লবীর মোবাইল নাম্বারটা সেভ করে নিয়ে বলল, তুমি আমার একটা বড় উপকার করলে, আবার কোন হেল্প প্রয়োজন মনে করলে তোমাকে রিং দিব।

জি না আমাকে আপনার কোন কাজে লাগবে না, আপনি বড় নেতা, পৌরসভার চেয়ারম্যান আরো আপনার কত গুণ, আপনার হাত অনেক লম্বা, আপনাকে আমার প্রয়োজন হলে আমি রিং দিব।

অবশ্যই, বলে জামাল হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

বিপ্লবী হাত বাড়াল না। সে বলল, নো থ্যাঙ্কস্‌।

মুচকি হেসে বিপ্লবী চলে গেল।

জামাল তার অফিস থেকে বেরিয়ে পৌরসভায় গেল। ততক্ষণে পৌরসভার বারান্দায় রহিমা ও তার মা এসে চেয়ারম্যানের জন্য অপেক্ষা করছে। বারান্দার অপর প্রান্তে খাইরুল তার এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য লোকজনসহ অপেক্ষা করছে।

জামাল সোজা তার চেম্বারে ঢুকল। সম্ভবত শাখাওয়াত কমিশনার আশে-পাশেই ছিল। জামাল তার চেম্বারে ঢোকার পরপরই সে জামালের চেম্বারে ঢুকল।

জামাল বলল, সাখাওয়াত সবাই এসেছে তো?

জি ভাইজান।

আসতে বলো।

শাখাওয়াত কমিশনার বের হয়ে গেল এবং কয়েক মিনিট পর সবাইকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল।

রহিমা কথা বলতে শুরু করেছিল কিন্তু তার মা রহিমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল।

চেয়ারম্যান সাহেব গত দু’বছর আগে খায়রুল আমার মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকেই ও আমার মেয়েকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো, ছোটখাটো কারণে গায়ে হাত তুলতো। আমি বিধবা মানুষ, আমাদের সংসারে আয় রোজগার করার মতো কেউ নেই। তাই মেয়ের শত কষ্টের কথা জেনেশুনেও আমি মেয়েকেই শাসন করতাম। কিন্তু কয়েকমাস আগে থেকে শুরু হয়েছে যৌতুকের জন্য চাপ।

জামাল গম্ভীর স্বরে রহিমাকে জিজ্ঞেস করল, রহিমা সেদিন তুমি আমাকে কী বললে আর আজ তোমার মা এখন কী বলছে?

রহিমা একটা ঢোক গিলল।

জামাল বলল, কী রহিমা বিবি কথা বলছ না কেন? তুমি বলছ এক কথা আর তোমার মা বলছে এক কথা। কোনটা ঠিক?

রহিমা এবং তার মা দু’জনে কোন কথা না বলে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

জামাল বলল, শোন রহিমার মা, রহিমার মুখে আমি সব কথা শুনেছি। আসলে তুমি তোমার এই অসতী মেয়েকে জোর করে খায়রুলের ঘাড়ে চাপিয়েছো আর এখন বলছ খায়রুল যৌতুকের জন্য তোমার মেয়েকে নির্যাতন করেছে, আসলে তোমরা মা-মেয়ে কি চাও তা ঠিক করে বলো?

শাখাওয়াত কমিশনার বলল, ভাইজান শুধু এক পক্ষে শুনলে তো হবে না আপনি খায়রুলের কাছ থেকে শুনুন সে কী করতে চায়?

জামাল খায়রুলকে জিজ্ঞেস করল, খায়রুল তুমি বল কী করতে চাও?

ভাইজান আমি আর রহিমার সঙ্গে সংসার করব না।

রহিমার মা তোমরা মা-মেয়ে কী ভাবছো?

শাখাওয়াত কমিশনার বলল, ওরা কী বলবে ভাইজান? আপনি একটা সমাধান করে দিন।

জামাল বলতে শুরু করল, রহিমা বিবি সবকিছু শুনে আমার মনে হলো তোমরা মা-মেয়ে যা বলছ তা আসলে সত্য না। প্রকৃত ঘটনা হলো খায়রুল তোমাকে বিয়ে করতে চায়নি তোমরা একরকম ফাঁদে ফেলে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছো। আসলে ও তোমাকে পছন্দ করে না তাই তোমাকে বিদায় করার জন্য বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে, তোমার যৌতুকের অভিযোগটা একটা ছুতা মাত্র। রহিমা বিবি কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসলে সংসার যায় না এখন আমরা যদি আবার খায়রুলকে তোমার সঙ্গে সংসার করতে বাধ্য করি তবে সে সুযোগ পেলেই তোমাকে আবার নির্যাতন করবে।

খায়রুলের চোখে মুখে একটা আলোর আভা ফুটে উঠল। রহিমার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তার দু’চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা রহিমার মা খায়রুল যদি আর রহিমার সঙ্গে সংসার করতে না চায় তবে আমার মনে হয় তালাক হয়ে যাওয়াই ভালো।

শাখাওয়াত কমিশনার এবং বেলাল কমিশনার দু’জনে জামালের কথায় সম্মতি দিল।

রহিমার মা তুমি কী বলো?

সবাই যখন বলছে তখন আমি আর কী বলব চেয়ারম্যান সাহেব?

জামাল রহিমাকে জিজ্ঞেস করল, রহিমা তোমার বিয়েতে দেনমোহর যেন কত ছিল?

পঞ্চাশ হাজার টাকা মনে হয়।

মনে হয় বললে হবে না, ঠিক করে বলতে হবে। খায়রুল তুমি বলতো?

খায়রুল বলল, পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাইজান।

রহিমা তুমি দেনমোহরের টাকার পেলে খুশি তো?

রহিমা কোন কথা বলল না, সে মাথা নত করে বসে রইল।

খায়রুল তুমি কি নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারবে?

ভাইজান আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে।

জামাল উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলল, আগামী মাসের তিন তারিখে আবার এ বিষয়ে বসতে হবে সেদিন খায়রুল দেনমোহরের সমস্ত টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে রহিমাকে তালাক দিবে। সময়মতো উভয় পক্ষ এবং কাজী সাহেবকে নোটিশের মাধ্যমে জানানো হবে।

নব্বই

আমীর মারা যাওয়ার পর জামালের মাদক ব্যবসা যেন কয়েকদিন থমকে গিয়েছিল। জামাল মাদক ব্যবসা পরিচালনার জন্য একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী খুঁজতে গিয়ে আরো কয়েকদিন কেটে গেল। তারপর আমীরের একজন সহযোগী সেন্টুকে জামাল মাদক ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব দিল। সেন্টুকে তার ব্যবসার জন্য যোগ্য বলে মনে হয়নি তারপরও তাকে দায়িত্ব না দিয়ে জামালের উপায় ছিল না কারণ এ লাইনে অনুগত, বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ লোক পাওয়া দুষ্কর। কয়েকদিন কেটে গেল কিন্তু সেন্টু সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারেনি। তাই নির্ধারিত তারিখে প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা কালেকশন করাও সম্ভব হয়নি।

জামাল তার চেম্বারে সেন্টুকে ডেকে পাঠালো।

সেন্টু তার চেম্বারে ঢুকে সালাম দিল, আস্‌সালামুয়ালায়কুম ভাইজান।

সেন্টু তোমার কালেকশনের কী খবর?

সেন্টু জামালকে একটা টাকার ব্যাগ দিল।

জামাল সেন্টুকে দরজাটা বন্ধ করতে বলে একটা একটা করে টাকার বাণ্ডিল গুনতে শুরু করল।

কয়েক মিনিট পর জামাল টাকা গুনা শেষ করে বলল, এত কম কেন?

ভাইজান, যা কালেকশন হয়েছিল তাই তো দিলাম।

ঠিক আছে প্রথম বার তাই আর বেশি কিছু বললাম না পরবর্তীতে যেন কোনদিন কালেকশন কম না হয়।

ভাইজান প্রথম মাস তো আমার সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগল। আগামী মাস থেকে আর কোন ত্রুটি হবে না।

জামাল মনে মনে হিসেব করে দেখল আরো অনেক টাকা ঘাটতি। জামালের হিসাব আছে সে কখনো এক কাজের টাকা অন্য কাজে লাগায় না। এবারই প্রথম তার মাদক ব্যবসার জন্য অন্য ব্যবসার টাকায় হাত দিতে হবে। সে চিন্তা করল একবার মিঃ টি. আর. খানকে অনুরোধ করে টাকা পাঠানোর জন্য কয়েকদিন সময় পাওয়া যায় নাকি। জামাল সেন্টুকে বিদায় দিয়ে উপরে উঠে গেল।

জামালের মোবাইল বিশেষ ধরণের শব্দে বেজে উঠল।

সে রিসিভ করে বলল, বস।

অপর প্রান্ত থেকে মিঃ টি. আর. খান এর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল আগামীকাল তোমার টাকা পাঠানোর কথা মনে আছে তো?

জি বস মনে আছে, কিন্তু-

জামাল তুমি তো জানো এ লাইনে কিন্তু বলে কথা নেই। ঠিক আছে কী বলতে চাইছ বলো?

জামাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, বস আপনি তো সবই জানেন আমার এই ব্যবসার ওপর দিয়ে এ মাসেই একটা ঝড় বয়ে গেল। আমার সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম আমাকে যদি সাতদিন সময় দিতেন?

মিঃ টি. আর. খান এর ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ ভেসে এলো, জামাল এটা কোনভাবেই সম্ভব না, কোম্পানিতে এমন দৃষ্টান্ত নেই, তুমি বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করছ তারপরও কেন যে এমন রিকোয়েস্ট করো?

জামাল বুঝতে পারল আর অনুরোধ করে কোন লাভ নেই সে প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, জি বস ঠিক আছে, টাকা পাঠিয়ে দিব।

তুমি রেডি থাকো আগামীকাল সময়মতো তোমাকে জানানো হবে, বলে অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।

জামালে মুখ মেঘে ঢেকে গেল।

সে শাকিলকে মোবাইল করল, হ্যালো শাকিল।

জি বড়ভাই।

আমার কিছু টাকা দরকার, দিতে পারবে?

কত টাকা?

বিশ লাখ।

না বড়ভাই এত টাকা তো আমার কাছে হবে না।

তুমি কত দিতে পারবে?

দশ লাখ।

তবে কাল সকালে আমাকে দশ লাখ টাকা দিও আর দশ লাখ টাকা না হয় কোথাও ম্যানেজ করতে হবে।

জামাল যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো আর দশ লাখ টাকা তার সি.সি একাউন্ট থেকে ওভার ড্রন করতে পারবে তবুও তার মন যেন আজ কিছুতেই ভালো হলো না।

অনন্যা শান্ত, ভদ্র এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল, খুব সহজে রেগে যায় না। রেগে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলে না, তবে তার মুখের ওপর কালো, শান্ত এবং নির্লিপ্ত গুমোট বাধা মেঘ দেখে জামাল তার মনের মধ্যেও যেন একটা অজানা ঝড়ের আভাস অনুমান করতে পারে। আজ রাতে জামাল তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল। সাধারণত জামাল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে নির্ধারিত সময়ে খাবার খেলে অনন্যা খুব খুশি হয়। জামালের ধারণা ছিল আজও অনন্যা খুশি হবে কিন্তু অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখ-মুখে গাঢ় কালো মেঘের গভীরতা দেখে চোখ নামাল। জামাল বুঝতে পারল অনন্যা নিশ্চয়ই তার ওপর কোন বিষয়ে রাগ করেছে, সে মনে মনে অনন্যার তার ওপর রেগে যাবার কারণ খুঁজতে লাগল, না তেমন কিছু তো হয়নি।

জামাল কোন কথা বলল না, খাবার শেষ করে নীরবে বেড রুমে ঢুকল।

কয়েক মিনিট পর অনন্যাও বেড রুমে ঢুকে জামালকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?

কেন হঠাৎ করে তুমি আমার সমস্যার কথা ভাবতে শুরু করলে?

আমি তোমার স্ত্রী, আমি তোমার ভালো-মন্দের কথা ভাববো না?

সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে।

তোমাকে কোন একটা কথা বললেই তুমি উল্টা-পাল্টা কথা বলে আমার মনটা খারাপ করে দাও। যাক তোমার ব্যবসার কথা না ভাবলেও আমার চলবে, তবে আমি একটা কথা জানতে চাই।

সেটা অন্যদিন, আজ বলার প্রয়োজন নেই।

কেন?

আজ আমার মন ভালো নেই।

কেন আজ তো তোমার অফিসেও একজন সুন্দরী মেয়ে এসেছিল তারপরও তোমার মন ভালো নেই কেন?

জামাল রাগান্বিত সুরে বলল, আমার অফিসে তো অনেকেই আসে।

অনেকেই আসে তা নিয়ে তো আমি কোনদিন কোন প্রশ্ন করি না। আজ যখন জানলাম তোমার মধুকুঞ্জের প্রমোদ বালারা অফিসে আসতে শুরু করেছে। তখন একজন স্ত্রী হিসাবে আর ঠিক থাকতে পারলাম না।

জামাল বিষয়টাকে সহজ করার জন্য হেসে বলল, ও তুমি বিপ্লবীর কথা বলছ, তোমার আর আমার লাইফ ইনস্যুরেন্স করলাম তো, সেই ইনস্যুরেন্সের এগ্রিমেন্টের কপি দিতে এসেছিল। কেন তোমার ছবি আর এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেট নিলাম না, সেদিনই তো তোমাকে ইনস্যুরেন্সের কথা বললাম।

আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা, এমনভাবে বাগানবাড়ির নাম করে তুমি মধুকুঞ্জকে বিনোদন কেন্দ্র বানিয়েছো, মধুকুঞ্জকে তোমার সমস্ত অপকর্মের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছ। আমি তো সেখানে তোমাকে বাধা দিতে যাইনি, সবকিছু জেনেশুনেও আমি তোমাকে কিছু বলিনা। কিন্তু আজ দেখছি তোমাকে প্রথমেই বাধা দেওয়া আমার উচিৎ ছিল। তাহলে তুমি এত বেপরোয়া হতে পারতে না।

তুমি কি এখন আমার কাজে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে চাচ্ছ?

হ্যাঁ আমি তোমার যে কোন অনৈতিক কাজে বাধা দিব, হেরোইন-ফেন্সিডিলের ব্যবসা করে শহরের তরুণ সমাজকে তুমি ধ্বংস করে দিচ্ছ আর মাদক ব্যবসার কারণে একে একে তোমার হাতে নিহত হয়েছে জাহিদ, হিটলার, কালা মাহবুব, আমীর। রায়হান চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে পারবে না দেখে তুমি তাঁকে হত্যা করেছ। অর্থ, প্রতিপত্তির কারণে তুমি দিনে দিনে অপরাধ জগতের অন্ধকারে ডুবে গেছ। আমি স্ত্রী হয়ে এভাবে তোমাকে দিনের পর দিন চলতে দিতে পারি না।

কী করবে তুমি?

তোমার কুকীর্তির সমস্ত কথা আমি জনগণকে জানিয়ে দিব, সমাজে তোমার মুখোশ খুলে দিব। সবাই তোমাকে ঘৃণা করবে, জনগণই তোমার রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করে দিবে।

জামাল মনে মনে বলল, ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমার সমস্ত কুকর্মের সাক্ষী তুমি, তোমাকে তো আর দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আগেই একবার তোমাকে ট্রান্সফার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তখনো ইনস্যুরেন্সের এগ্রিমেন্টটা হয়নি তাই তোমাকে মেরে আমি খালি খালি পঞ্চাশ লাখ টাকা হাতছাড়া করতে চাইনি। এখন সবকিছু ক্লিয়ার হয়েছে এখন শুধু তোমাকে নিরাপদে বিদায় করার পালা।

কী ভাবছ?

জামাল বিষয়টাকে অনন্যার কাছে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য বলল, তুমি ঠিকই বলেছ অনন্যা, এই না হলো গুণবতী স্ত্রী। তোমার মতো যদি সবার স্ত্রীরা হতো তবে দেশে কোন অপরাধী জন্মাতো না। থ্যাঙ্ক ইউ মাই সুইট হার্ট।

অনন্যা জামালের চালাকি বুঝতে পারল না। সে হেসে ফেলল।

একানব্বই

 জামালের কানের মধ্যে বার বার করে অনন্যার গত রাতের কথাগুলো বাজতে লাগল। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ঘরের শত্রুকে সে আর কোন সুযোগ দিবে না। কারণ বাইরের শত্রুকে প্রতিহত করা যত সহজ ঘরের শত্রুকে প্রতিহত করা তত সহজ না। আবার অনন্যার যে কোন দুর্ঘটনার জন্য সে-ই দায়ী। অনন্যার নামে একটা ইনস্যুরেন্স আছে এবং সেই ইনস্যুরেন্সে নোমিনি জামাল নিজেই। কাজেই অনন্যার যে কোন অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য পুলিশ প্রথমে তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। হাজার হলেও অনন্যার মৃত্যুর প্রথম বেনিফিসিয়ারিস তো সে-ই। তাই অপারেশনটা করতে হবে একেবারে নির্ভুলভাবে।

জামাল সকালবেলা তার চেম্বারে বসে দু’চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। এটা তার অভ্যাস, এভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে পৌরসভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

জামাল  সেক্রেটারিকে ডেকে পাঠালো।

 সেক্রেটারি তার চেম্বারে ঢুকে সালাম দিল, সেক্রেটারি সাহেব আমি কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে যাবো যদি প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকে তবে এ সপ্তাহের মধ্যে সেরে নিবেন। তারপর আমি পনেরো দিন ছুটি নিব।

 সেক্রেটারি সাহেব জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন স্যার?

ইন্ডিয়ায়, একবার আজমির শরীফ জিয়ারত করতে।

ঠিক আছে স্যার আমি দেখছি আমার হাতের কাজগুলো সারিয়ে নিবো, বলে  সেক্রেটারি সাহেব চলে যাচ্ছিল জামাল বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে একবার আমার সালাম দিবেন।

 সেক্রেটারি সাহেব চলে যাবার কয়েক মিনিট পর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন, জামাল মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কেমন আছেন?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কিছুটা বিস্মিত হলেন। কারণ জামাল কখনো এমন সুন্দর আচরণ করে না তাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

জামাল আবার বলল, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? বসুন।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বললেন, স্যার কিছু বলবেন?

বসুন, বলব বলেই তো ডেকেছি।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চেয়ারে বসলেন।

জামাল বলতে শুরু করল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমি হঠাৎ করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।

কী সিদ্ধান্ত স্যার?

আমি একবার ইন্ডিয়ার আজমির শরীফ জিয়ারত করতে যাবো।

বেশ ভালো তো স্যার, কবে যাবেন?

আগামী সপ্তাহে। আপনি তার আগে আমার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সারিয়ে নিন। আমি না থাকাতে কাজের যেন কোন অসুবিধা না হয়।

জি স্যার, বলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চেয়ার থেকে উঠছিলেন। জামাল বলল, বসুন আরো কথা আছে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আবার চেয়ারে বসলেন।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব রিফাত কন্সট্রাকশনের নামে একটা রাস্তার মেইনটেইনেন্স ওয়ার্ক আছে না?

জি স্যার।

কত টাকার কাজ যেন?

বিশ লাখ টাকার।

আপনি ঐ কাজটার দশ লাখ টাকার একটা বিল করে দিন তো।

কিন্তু স্যার কাজ তো সবেমাত্র শুরু হয়েছে দশ লাখ টাকার বিল দিলে তো অনেক টাকা এডভান্স হয়ে যাবে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বুঝতে পারলেন জামাল কেন তার সাথে আজ এত ভালো ব্যবহার করল।

জামাল মুহূর্তের মধ্যে রেগে গেল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আপনি ভালো করে জানেন রিফাত কন্সট্রাকশনের নামে কাজটা মূলত আমি করি। আর পে-মাস্টারও আমি, কাজেই আমি কি কাজ না করে চলে যাবো নাকি? কিছু হলে তো আমারই হবে আপনার তো এত টেনশন করার কিছু নেই।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মাথা নত করে বসে রইলেন। জামাল আবার বলতে শুরু করল, আপনাকে আমি বললাম আমি একটা শুভ কাজে যাচ্ছি, আপনার উচিৎ ছিল কোন বারগেইনিং না করে বিলটা দেওয়া তা না করে আপনি একটা ব্যারিকেড তেরি করলেন। আসলে আমি দেখেছি আপনি সব কাজে শুধু ঝামেলা তেরি করেন, সহজে কোন কাজ করতে চান না।

স্যার আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি।

ঠিক আছে যান, বিলটা তেরি করে আমার টেবিলে প্লেস করুন আমি যেন আগামীকাল ফার্স্ট হাফে বিলটা আমার টেবিলে পাই। আমার আবার অনেক কাজ আছে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আর কিছু বললেন না তিনি নীরবে চেম্বার থেকে বের হয়ে গেলেন।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় জামাল তার পারসোনাল চেম্বারে বসে ব্যবসায়ীক কাজ পরিচালনা করে। তারপর কোনদিন গিয়ে বসে পার্টি অফিসে আবার কোনদিন মধুকুঞ্জে চলে যায়। আজ জামাল তার হাতের কাজগুলো শেষ করে গালপোড়া সেলিমকে মোবাইল করল, সেলিম তুমি কোথায়?

বস আমি শহরে।

তুমি একবার মধুকুঞ্জে চলে এসো তো।

জি বস আসছি।

জামাল মধুকুঞ্জে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যে গালপোড়া সেলিম মধুকুঞ্জে ঢুকল। জামাল তখন দোতলার বারান্দায় বসে ছিল। সেলিম সোজা দোতলায় উঠে জামালকে জিজ্ঞেস করল, বস হঠাৎ জরুরী তলব?

ভিতরে এসো বলে জামাল আগে তার বেডরুমে ঢুকল।

সেলিম তার পিছনে পিছনে বেডরুমে ঢুকল।

জামাল আর গালপোড়া সেলিম মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

জামাল বলল, একটা ট্রান্সফার কেস আছে।

জি বস বলুন।

কাজটা করতে হবে নিখুঁতভাবে। বিনিময়ে তুমি এক লাখ টাকা পাবে।

জি বস আপনি একটুও ভাববেন না, এই গালপোড়া সেলিম কোন খুঁত রেখে অপারেশন করে না। কোন কাজে ফেল করে না। এখন নাম, ঠিকানা আর ছবি দিন।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, নাম অনন্যা, স্বামীর নাম জামাল।

গালপোড়া সেলিম যেন চমকে উঠল, তারমানে ভাবী!

চমকে উঠলে কেন?

বস আপনি ভালো করে ভেবে দেখেছেন?

হ্যাঁ ভেবে দেখেছি, ওকে ট্রান্সফার করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। তুমি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি তোমাকে কাজ দিয়েছি তুমি করবে, বলে জামাল তার চেয়ার থেকে উঠে স্টিল আলমিরা থেকে একটা পাঁচ’শ টাকার নোটের বাণ্ডিল বের করে গালপোড়া সেলিমের হাতে দিয়ে বলল, এই নাও পঞ্চাশ হাজার টাকা এডভান্স, অপারেশন সাকসেসফুল হবার পর বাকী টাকা পাবে।

গালপোড়া সেলিম টাকা নিল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, কবে অপারেশন সাকসেসফুল করতে হবে জানতে চাইলে না।

বস আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই।

আমি কয়েকদিনের জন্য ইন্ডিয়া যাবো, আমি যেদিন ইন্ডিয়া যাবো তার এক সপ্তাহ পর।

জি বস, ঠিক আছে।

জামাল মধুকুঞ্জ থেকে সেলিমকে বিদায় দিয়ে প্রথমে মোস্তফা সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো বড়ভাই।

কী খবর জামাল?

বড়ভাই আসলে আমি কয়েকদিনে জন্য ছুটি চাচ্ছিলাম।

হঠাৎ করে আবার ছুটি চাচ্ছ কেন? তুমি পৌরসভার চেয়ারম্যান, তোমার প্রতিষ্ঠানের তুমিই বস।

হ্যাঁ কিন্তু রাজনীতিতে তো আমার বস আপনি। এতদিন আমি কোনদিন দেশের বাইরে যাইনি তাই কোনদিন ছুটির প্রয়োজনও হয়নি।

তুমি দেশের বাইরে যাবে?

জি।

কোথায়?

আজমির শরীফ, আমি কয়েকদিনের জন্য আজমির শরীফ যেতে চাচ্ছি। তাই মনে করলাম আপনাকে বলে যাই, হঠাৎ করে আপনি খুঁজলে যেন কিছু মনে না করেন।

বেশ ভালো তো, আমাদের জন্য দোয়া করবে।

জি বড়ভাই।

তারপর ইমরান সাহেবকে মোবাইল করল।

ইমরান সাহেব মোবাইল রিসিভ করে বললেন, হ্যালো।

ভাইজান আমার নাম জামাল, মানে জামাল হোসেন।

সরি আমি তো আপনাকে চিনলাম না।

জামাল তার নাম এবং পরিচয় দিল।

অপর পাশ থেকে ইমরান সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এবার বুঝেছি তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তুমি সেই ইয়াং লিডার?

জি ভাইজান।

তো ইয়াং লিডার কী মনে করে?

কিছু মনে করে না। ভাবলাম অনেকদিন থেকে আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে না। তাছাড়া আমি আবার কয়েকদিনের জন্য আজমির শরীফ যাচ্ছি তো।

বেশ তো আমাদের জন্য দোয়া করবে, জনগণের জন্য দোয়া করবে, দেশের জন্য দোয়া করবে।

ভাইজান আমি ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

ওকে ইয়াং ম্যান।

তারপর জামাল মোবাইল করল মোজাফফর সাহেবকে। মোজাফফর সাহেবও প্রথমে জামালকে চিনতে পারেনি। জামাল পরিচয় দেওয়ার পর তিনিও হেসে উঠলেন, হ্যাঁ জামাল বল কী খবর?

বড়ভাই অনেকদিন থেকে কথা হচ্ছে না। আমি আবার সব সময় আপনার সঙ্গে কথা বলতে সাহস করতে পারি না।

না না এমন করে কথা বলছ কেন? আমরা জনপ্রতিনিধি আমাদের কখনো বিরক্ত হলে চলে না। যখন মনে করবে ফোন দিবে। কোন সমস্যায় পড়লে জানাবে।

জি বড়ভাই ঠিক আছে।

রাখি তাহলে।

বড়ভাই আরো কথা আছে।

কী কথা? বলো?

বড়ভাই আমি কয়েকদিনের জন্য আজমির শরীফ যাচ্ছি তো আমার জন্য দোয়া করবেন।

তাই নাকি বেশ তো।

জামাল কিছু বলল না।

মোজাফফর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কবে ফিরবে?

পনেরো দিন পর। ফিরে এসে আমি আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

জামাল মোবাইল বন্ধ করে দাঁত কড়মড় করে বলল, অনন্যা তুমি মনে করেছ আমি তোমাকে ছেড়ে দিব। আমি জীবনে কোনদিন কাউকে ছাড়িনি। আমার ঘরে থেকে, আমার খেয়ে তুমি আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে আর আমি জামাল তা মেনে নিয়ে তোমার সঙ্গে সংসার করব। মাননীয় মন্ত্রী, পার্টির সেন্ট্রাল লিডাররা, পুলিশ সবাই জানবে আমি ইন্ডিয়ায়। আমার পাসপোর্টে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার রেকর্ড থাকবে। আর তুমিও দুনিয়া থেকে চলে যাবে চিরতরে। যাও ওপারে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো।

বিরানব্বই

জামালের ইন্ডিয়া যাবার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। একরকম সবাইকে জানান হয়েছে। যাবার আগের দিন জামাল এস.পি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

এস.পি সাহেব জামালকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল সাহেব আপনি?

হ্যাঁ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

হঠাৎ করে?

কেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসা যাবে না নাকি? আমি ব্যস্ত থাকি কাজ করতে করতে একেবারে যান্ত্রিক হয়ে গেছি। আজকাল আপনার সঙ্গে কোন মিটিং-সিটিং ছাড়া তো আর দেখাই হয় না। আর কথা হয় শুধু মোবাইল ফোনে।

হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন, আমরা সবাই যান্ত্রিক হয়ে গেছি বলে এস. পি সাহেব কলিং বেল টিপে চায়ের অর্ডার দিলেন।

জামাল বলল, বাই দি বাই আসলে আমি কয়েকদিনের জন্য আজমির শরীফ যাচ্ছি তো তাই আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে এলাম।

তাই নাকি? বেশ ভালো কথা। তা ক’দিনের জন্য?

পনেরো দিনের ভিসা।

যাবেন কবে?

আগামীকাল।

জামাল চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

এস.পি সাহেব দাঁড়িয়ে জামালের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করে বললেন, সেফ জার্নি।

জামাল এস. পি সাহেবের সঙ্গে দেখা করে ওসি সাহেবকে মোবাইল করল, ওসি সাহেব।

জি ভাই বলুন।

আপনি একবার আমার অফিসে আসুন তো।

জামাল ভাই কোন সমস্যা?

আরে না কোন সমস্যা না। একসঙ্গে দু’ভাই চা খাবো আর কি?

ওকে ভাই আমি এখনই আসছি।

জামাল তার অফিসে ঢোকার পর পরই ওসি সাহেব জামালের অফিসে ঢুকলেন।

আসুন ওসি সাহেব আসুন।

ওসি সাহেব কৌতূহলী দৃষ্টিতে জামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার জামাল ভাই বলুন তো?

না কোন ব্যাপার না, আপনি আবার ভয় পেলেন নাকি?

না ভয় পাবো কেন? পুলিশে চাকরি করি ছোট-খাট কারণে ভয় পেলে কি চলে?

ওসি সাহেব আমি কয়েকদিনের জন্য আজমির শরীফ যাবো, যাবার আগে এক সঙ্গে বসে দু’কাপ চা খাবো বলে জামাল জিজ্ঞেস করল, কী খাবেন বলুন? চা না কফি?

কফি।

জামাল কলিং বেল টিপে জাকিরকে কফি আনার অর্ডার দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে কফি চলে এলো।

কফি খেতে খেতে জামালের ওসি সাহেবের অনেক কথা হলো।

কথায় কথায় জামাল বলল, ওসি সাহেব আপনি একটু খেয়াল রাখবেন। আপনি তো জানেনই এই শহরের সবাই আমার ওপর নির্ভর করে। আমার অনুপস্থিতিতে কারো কোন বিপদ হলে আপনি যেন একটু খেয়াল রাখবেন। আসলে আপনার বিপদে আমি থাকবো আর আমার বিপদে আপনি থাকবেন এটাই তো নিয়ম।

ওসি সাহেব বললেন, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছু সামলে নিব।

জামাল বলল, যে কোন প্রয়োজনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

ওসি সাহেবের ওয়্যারলেস সেট বেজে উঠল।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন, জামাল ভাই আমার একটু তাড়া আছে।

হ্যাঁ আপনি তো আবার ব্যস্ত মানুষ। ঠিক আছে আসুন।

আজমির শরীফ যাবার আগে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেল অনন্যার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করল, অনন্যাকে কয়েকদিন খুব আদর করল, অয়নকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে অঝোর ধারায় চোখের পানি ঝরালো। জামালের আচরণে অনন্যার মনে হলো জামাল হয়ত সুপথে ফিরে এসেছে। আজমির শরীফ থেকে ফিরে এসে সে হয়ত আর কোনদিন অপরাধ জগতে পা বাড়াবে না।

জামাল যাবার প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। এ’কদিন জামাল মাঝে মাঝে মোবাইল করে তার এবং অয়নের খবর নিয়েছে। জামাল থাকলে অনন্যার জামালের জন্য ঘুমাতে দেরি হতো কিন্তু জামাল ইন্ডিয়া যাবার পর থেকে অনন্যা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ রাতে খাবার খেয়ে অনন্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতে অনন্যা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। অনন্যা পাশের রুমে গিয়ে দেখল বুয়া নেই অনন্যার মনে পড়ল আজ তো বুয়া রাতের কাজ করে দিয়েই চলে গেছে। তাই সে নিজেই দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?

ভাবী একটু দরজাটা খুলে দিন।

আপনি কে?

ভাবী দরজাটা খুলে দিন, জামাল ভাই আমাকে পাঠিয়েছে।

অনন্যা দরজাটা খুলে দিতেই মুখোশ পরা একজন লোক তার মুখ কাপড় দিয়ে চেপে ধরল। অনন্যা চিৎকার করার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে একজন রুমাল দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছে তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন বলল, এই তোরা ভিতরে যা।

কয়েকজন ভিতরে গিয়ে বাসার জিনিস-পত্র তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজতে লাগল। কয়েক মিনিট পর তারা বেরিয়ে এসে বলল, বস চলুন, অপারেশন সাকসেসফুল।

মুখোশ পরা লোকটা অনন্যার নিষ্প্রাণ দেহটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।

তারপর সবাই বেরিয়ে গেল।

পরদিন সকালবেলা অয়ন তার মায়ের লাশ দেখতে পেয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের প্রতিবেশীরা বাসায় ভিড় জমালো। কিছুক্ষণের মধ্যে জহির সাহেব এলেন। তিনি থানায় মোবাইল করে পুলিশকে আসতে বললেন। সবাই অনেক চেষ্টা করেও জামালের কোন মোবাইল নাম্বার খুঁজে পেল না। অবশেষে পুলিশ অনন্যার মোবাইলটা পেয়ে মোবাইলের কল রেকর্ড দেখে খুঁজে পেল একটা ইন্ডিয়ান মোবাইল নাম্বার, পুলিশ অফিসার সেই মোবাইল নাম্বারে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে জামালের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো অনন্যা, কেমন আছ? অয়ন কেমন আছে?

পুলিশ অফিসার বললেন, জামাল ভাই আপনি কোথায়?

আমি তো ইন্ডিয়ায়।

বাসার খবর কিছু জানেন?

কেন কী হয়েছে বাসায়?

আপনার বাসায় ডাকাতি হয়েছে, ডাকাতরা অনেক মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। আপনার ওয়াইফ ডাকাতের হাতে নিহত হয়েছেন।

অপর পাশ থেকে জামালের ক্ষীণ কণ্ঠের স্বর ভেসে এলো, আপনি কী বলছেন? রাতেই তো আমি অনন্যার সঙ্গে কথা বললাম, অয়নের সঙ্গে কথা বললাম।

হ্যাঁ সবই ঠিক আছে আর এটাও ঠিক যে আপনার ওয়াইফ এখন মৃত। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন।

হ্যাঁ আমি আসছি, কিন্তু আপনি কে বলছেন প্লিজ?

আমি সাব-ইন্সপেক্টর মাসুদ বলছি।

মাসুদ সাহেব আমি আসছি আপনি যত দ্রুত সম্ভব আসামি এরেস্ট করার ব্যবস্থা করুন। আর আপনার প্রতি আমার একটা রিকোয়েস্ট আমি দেশে না আসা পর্যন্ত আপনারা আমার ওয়াইফের লাশ ময়না তদন্ত করবেন না এবং লাশ দাফন করবেন না।

আমি আমার হায়ার অথোরিটির সঙ্গে আলাপ করে আপনার রিকোয়েস্ট রাখার চেষ্টা করব।

অপর পাশ থেকে জামালের কান্না ভাঙ্গা গলার স্বর ভেসে এলো, মাসুদ সাহেব আমি একবার আমার অয়নের সঙ্গে কথা বলব, আপনি একটু মোবাইলটা অয়নকে দিন প্লিজ।

মাসুদ সাহেব মোবাইলটা অয়নকে দিলেন। অয়ন তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

জামাল ইন্ডিয়া থেকে ফিরল। কিন্তু পুলিশ ততক্ষণে অনন্যার লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। জামাল একথা শুনে তদন্তকারী কর্মকর্তার ওপর খুব রাগান্বিত হলো। সে কৃত্রিম কান্নার ভান করে বলল, আপনি কী বুঝবেন মাসুদ সাহেব আমার স্ত্রী মারা গেছে আমার যে কী যন্ত্রণা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। তারওপর ময়না তদন্তের জন্য আমার ওয়াইফের লাশ ছিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে। উঃ আমি আর পারছি না, অনন্যা তুমি এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। আমি তোমার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করব। তাকে আমি আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো।

মাসুদ সাহেব জামালকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনি শান্ত হোন জামাল ভাই, আমরা আসামি ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

জামাল কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বলল, আপনি কীভাবে আসামি ধরবেন? আপনি কি এখনো হত্যার মোটিভ বুঝতে পেরেছেন?

জামাল ভাই আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, এটা একটা স্রেফ ডাকাতির ঘটনা, আসামি প্রফেশনাল কিলার নইলে শ্বাসরোধ করে হত্যার সময় হাতে রুমাল পেঁচিয়ে গলা টিপে ধরবে কেন? গলায় আঙ্গুলের ছাপ পেলেও তালিকাভুক্ত আসামিদের ধরে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট পরীক্ষা করে ধরা সহজ হতো। তারপরও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি।

জামাল চোখ মুছে বলল, মাসুদ সাহেব প্লিজ হেল্প মি, অনন্যার হত্যাকারী শাস্তি না পেলে ওর আত্মা যে আমাকে অভিশাপ দিবে। আমি কিছুতেই শান্তি পাবো না।

আপনি আমাদের ওপর ভরসা রাখুন জামাল ভাই।

জামাল থানা থেকে বেরিয়ে মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল, মাননীয় মন্ত্রী মোবাইল রিসিভ করে বলল, কী খবর জামাল এখন কেমন আছ?

বড়ভাই আপনি হয়ত শুনেছেন আমার বাসায় ডাকাতি হয়েছে, ডাকাতরা আমার ওয়াইফকে হত্যা করেছে।

শুনেছি আসলে তোমাকে কী বলে যে সান্ত্বনা দিব। তুমি ভেঙ্গে পড়ো না জন্ম-মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে এখন কী করবা? যে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কোন আসামি ধরা পড়েছে?

না বড়ভাই।

আমি কি এস.পি সাহেবকে টেলিফোন করব?

না বড়ভাই আসলে এস. পি সাহেব, ওসি সাহেব সবার সঙ্গে আমার পার্সোনাল রিলেশন খুব ভালো তাই পুলিশ বেশ তৎপর আছে। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আমাকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দেন।

অবশ্যই দোয়া করব।

তিরানব্বই

কয়েকদিন কেটে গেল। জামাল ধীরে ধীরে আবার তার কাজকর্ম শুরু করেছে। তাকে দেখে কারো বুঝবার সাধ্য নেই যে মাত্র কয়েকদিন আগে তার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। সে আবার খুব স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করেছে। পৌরসভা, পার্টি অফিস, ব্যবসা সবকিছুই যেন আবার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে শুরু করেছে। অনন্যা মারা যাওয়ার পর থেকে জামালের বার বার করে বিপ্লবীর কথা মনে পড়েছে। ফিউচার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অনন্যার নামে একটা ইনস্যুরেন্স আছে। প্রথমে জামাল বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি কারণ তাতে করে অনন্যার নামে ইনস্যুরেন্স থাকার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে পুলিশ তাকে সন্দেহ করতে পারে। তাই সে অনন্যা মারা যাওয়ার প্রায় মাস খানেক পর বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ করল।

সেদিন সকালবেলা বিপ্লবী জামালের চেম্বারে এলো।

জামাল বিপ্লবীকে বলল, বিপ্লবী আমি তো সকালবেলা অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি তারপর বেরিয়ে যাই পৌরসভায় আবার কোনদিন পার্টি অফিস কিংবা মধুকুঞ্জে যাই। ফ্রি বলতে আমি ঐ মধুকুঞ্জে যেটুকু সময় পাই সেটুকুই।

বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকাতেই জামালের চোখে চোখ পড়ল। বিপ্লবী মুচকি হেসে বলল, আবার মধুকুঞ্জে, আবার সেই মধুকুঞ্জের বিশেষ আপ্যায়ন!

কেন অসুবিধা কি?

অসুবিধা কি সেটা কি আপনাকে ভেঙ্গে বলতে হবে?

জামাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, বিপ্লবী তোমার ভাবী মারা যাওয়ার পর থেকে আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছি, তোমার সঙ্গে তর্ক করার মতো ইচ্ছা আমার একেবারে নেই। তুমি তো দেখতে পাচ্ছ এখানে আমার অফিসের সব লোকজনকে সকালবেলা কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় আবার দিন শেষে কাজের খোঁজখবর নিতে হয়। এই কাজ ছাড়া আমার আরো কিছু ব্যবসা আছে, রাজনীতি আছে। দিনে দিনে আমি যেন খুব যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। তুমি যদি আজ একবার মধুকুঞ্জে এসো তবে আমি সময় করে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারবো, ইনস্যুরেন্স ছাড়াও তোমার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।

বিপ্লবী জামালের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। সে মনে মনে বলল, ব্যক্তিগত কথা মানে নতুন কোন মতলব নেই তো।

বিপ্লবীকে চুপ করে থাকতে দেখে বিপ্লবী বলল, বিপ্লবী প্লিজ আমার অনুরোধটুকু তুমি রাখো, আমি কথা দিচ্ছি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করব না। আর কোনদিন আমি তোমাকে কোন অনুরোধও করব না।

বিপ্লবী চেয়ার থেকে উঠে বলল, ঠিক আছে আমি আসবো।

আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব বিপ্লবী।

আজ সারাদিন জামাল বিপ্লবীকে নিয়ে ভেবেছে। সেই কতদিন থেকে জামাল যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো বুভুক্ষ হয়ে আছে, তপ্ত মরুভূমির মতো তার বুকে যেন মরীচিকা খেলা করছে, যা সিক্ত করতে পারে শুধুমাত্র একজন নারী।  আর সে নারী আজ আবার তার হাতে আসবে সে আবার তাকে ভোগ করবে তার ইচ্ছামতো, তার খেয়াল খুশি মতো। বিপ্লবীর প্রতিচ্ছবিখানা যেন জামালের চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই সুউচ্চ বক্ষ যেন জামালকে সহস্র মাইল দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। না জামালের আজ কিছুতেই কাজে মন বসছে না। সে বিকেল হতে না হতেই মধুকুঞ্জে চলে গেল। জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল। সবেমাত্র বিকেল পাঁচটা বাজে, সে বিপ্লবীকে মোবাইল করল, হ্যালো বিপ্লবী তুমি কোথায়?

একটু কাজে ব্যস্ত আছি।

দেরি করছ কেন? আবার তো এসেই বলবে সন্ধ্যা হয়ে গেল বাসায় যাবো, চলে এসো প্লিজ।

বিপ্লবী এলো। আজ সে একটা মেরুন রংয়ের জর্জেট  পরেছে, সংকীর্ণ পাতলা ভয়েল কাপড়ের ব্লাউজ যার ওপর দিয়ে যেন বিপ্লবীর যৌবন ফেটে বের হচ্ছে। জামাল একবার বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকাল, র রংয়ের সঙ্গে ম্যাচ করে বিপ্লবী ঠোঁটে লিপ স্টিক পরেছে।

জামাল বিপ্লবীর সমস্ত শরীরে চোখ বুলিয়ে অষ্ফুটস্বরে বলল, বিপ্লবী-

বিপ্লবীকে দেখে জামাল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, বিপ্লবী রুমে এসো।

বিপ্লবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না আমি বাইরে বসব, যা বলার আপনি এখানে বলুন।

আমি বলব কি? বলবে তো তুমি।

জি আমি বলব কিন্তু রুমে না বারান্দায়।

বিপ্লবী তোমাকে কেউ দেখে ফেলবে, সবাই তোমার চরিত্রকে কলুষিত করার চেষ্টা করবে। প্লিজ ভিতরে এসো। আমি তো তোমাকে বলেছি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করব না।

অগত্যা বিপ্লবী জামালের সঙ্গে তার বেড রুমে ঢুকল।

জামাল বিপ্লবীর গা ঘেঁষে বসল।

বিপ্লবী বলল, একটু সরে বসুন। আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন আজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না।

হ্যাঁ তাই হবে।

তবে এত কাছে আসছেন কেন?

জামাল একটু সরে বসল। বিপ্লবী তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা ফরম বের করে দিয়ে বলল, ভাবীর নামে যে ইনস্যুরেন্সটা ছিল সেটার নোমিনি তো আপনি?

হ্যাঁ।

আমি সব কাগজ-পত্র নিয়ে এসেছি, আপনি এই ক’টা ফরমে সই করে দিন। ভাবীর ডেথ সার্টিফিকেট আর এগ্রিমেন্টের কাগজপত্রগুলো আপনি আমাকে দিবেন তাহলে আমি সেগুলো আমাদের হেড অফিসে পাঠিয়ে দিব।

জামাল ফরমগুলোতে সই করে দিল।

বিপ্লবী সই করা কাগজগুলো তার ব্যাগের মধ্যে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠছিল।

জামাল বলল, বিপ্লবী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে না?

কী জিজ্ঞেস করব?

কেন আমাকে কি তোমার কিছুই জিজ্ঞেস করার নেই, আমি কি শুধুই তোমার ক্লাইন্ট এর বেশি কিছু নই।

তাই তো আপনি তো শুধু আমার ক্লাইন্ট এর চেয়ে বেশি কিছু না।

বিপ্লবী তুমি খুব আর্টিফিশিয়াল। আমার খুব খারাপ দিন যাচ্ছে আমাকে একটু হেল্প কর। আমি তোমাকে বলেছিলাম না যে তোমার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত আলাপ আছে।

আপনার খারাপ দিন যাচ্ছে? আপনি তো ছেলে-মানুষ কথায় বলে না ভাগ্যবানের বউ মরে। ভাবী মারা গেছে আপনি আবার বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনবেন। আপনার মতো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ধনাঢ্য ব্যক্তির আবার বউয়ের অভাব?

এখন বলুন আপনার কী ব্যক্তিগত আলাপ আছে?

এভাবে বললে, এভাবে তাড়াহুড়া করলে কি হয়? একটু বসো, আমাকে একটু সময় দাও।

জি বলুন।

আমি খুব একা, যেন আমার কেউ নেই।

কি বলেন কেউ নেই মানে?

কেউ থাকা বলতে যা বুঝায় সে রকম কেউ নেই।

কেন বিয়ে করে ফেলুন, আপনি তো আগের বউয়ের স্মৃতি আঁকড়ে সারাজীবন থাকার মানুষ নন।

হ্যাঁ বিয়ে তো করবই কিন্তু বউয়েরও তো অভাব।

এটা আপনার মুখের কথা, আপনি বিয়ে করার আগে থেকে কতজনকে সিরিয়ালে রেখেছেন তার কি ঠিক আছে? বলে বিপ্লবী চেয়ার ছেড়ে উঠছিল।

জামাল বিপ্লবীর একটা হাত চেপে ধরে বলল, বিপ্লবী প্লিজ একটু বসো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

বিপ্লবী আবার বসল, জি তাড়াতাড়ি বলুন।

আমার খুব খারাপ দিন যাচ্ছে, তুমি এই দুঃসময়ে আমার পাশে থাকো।

আপনার উপরে যে আমার কোন বিশ্বাস নেই।

বিপ্লবী আমি তোমাকে বিয়ে করব।

বেশ তো চলুন কাজী অফিসে।

বিপ্লবী তোমার ভাবী মারা যাবার মাত্র কয়েকদিন হলো এত তাড়াতাড়ি তোমাকে বিয়ে করলে লোকে কী বলবে? বলো।

তবে আমাকে কী করতে বলছেন? বলুন।

                জামাল বিপ্লবীর দু’বাহুতে হাত রেখে জামালের চোখে চোখ রাখল। বিপ্লবীর শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কী করবে সে? জামাল ঠিক বলছে তো?

বিপ্লবীর পা দু’টা যেন শিথিল হয়ে গেল।

জামাল বিপ্লবীর মাথায় হাত দিয়ে কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, বিপ্লবী এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করব না। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো।

বিপ্লবী স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। জামাল একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা খোলা আছে, সে এক পা, দু’পা করে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

বিপ্লবী যেন বাধা দিতে গিয়েও বোবার মতো তাকিয়ে রইল।

জামাল বিপ্লবীকে জড়িয়ে ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে গেল। বিপ্লবী যেন কিছুই বাধা দিতে পারল না। তার সমস্ত কিছু যেন আজ অচল হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না। পা দু’টা যেন অবশ হয়ে গেছে। জামালকে বাধা দেয়ার মতো শক্তি সে হারিয়ে ফেলল।

মধুকুঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট নদীতে যেন আজ যৌবন ফিরে এসেছে। নদীতে বয়ে চলছে নৌকা তারি ঢেউ নৌকার তলায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দে শীৎকার করে মধুর ছন্দ তুলল অনেকক্ষণ তারপর একসময় ক্লান্ত অবসন্ন দেহ দু’টি নেতিয়ে পড়ল।

এলোমেলো চুল, ঠোঁটের এবড়ো থেবড়ো লিপস্টিক নিয়ে বিপ্লবী বিছানা ছেড়ে উঠে বাথ রুমে ঢুকল। কয়েক মিনিট পর বিপ্লবী বাথরুম থেকে বের হয়ে চেয়ারে বসল। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

জামাল পাশে বসল।

বিপ্লবী অষ্ফুটস্বরে বলল, আপনি আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবেন না তো?

বিপ্লবী আমি তোমার সঙ্গে প্রোমিজ করেছি না। তুমি আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো। আর হ্যাঁ আজ থেকে আমাকে একেবারে সঙ্কোচ করবে না। আমি কখনো তোমাকে ডাকলে সোজা চলে আসবে। আজকের দিনটা স্মরণ রেখো আজ থেকে তুমি আমার বউ।

বিপ্লবী জামালের বুকে মাথা রেখে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

চুরানব্বই

জামালের সমস্ত অপকর্মের সাক্ষী অনন্যা শেষ। অনন্যার নামে করা ইনস্যুরেন্সের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এক ঢিলে দু’পাখি। না দু’পাখি না, তিন পাখি। অপকর্মের সাক্ষী নিশ্চিহ্ন, ইনস্যুরেন্সের টাকা এবং অনন্যার মতো সুন্দরী তরুণীকে দিনের পর দিন ভোগ করার অপূর্ব সুযোগ। জামাল সমস্ত কিছু করে ফেলল যেন নিখুঁতভাবে। এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্ত। এমনভাবে বিভিন্ন চিন্তা করতে করতে জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল।

বিপ্লবী জামালের সব কথা বিশ্বাস করেছে। আজকাল জামাল বিপ্লবীকে মধুকুঞ্জে ডাকলেই সে সব কাজ ছেড়ে জামালের কাছে ছুটে আসে। অনেক সময় বিপ্লবী নিজেও জামালের সঙ্গে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে ওঠে তখন জামালকে মধুকুঞ্জে দেখা করার জন্য অনুরোধ করে। জামাল বিপ্লবীর ডাক পেয়ে ছুটে আসে। বিপ্লবী জামালের সান্নিধ্য পেয়ে যেন নিজেকে ধন্য মনে করে। জামালকে বিয়ে করার জন্য বিপ্লবী স্বপ্নের ভুবন সাজাতে শুরু করেছে। একদিন বিপ্লবী জামালকে তুমি বলে সম্বোধন করার জন্য অনুমতি নিয়ে সেদিন থেকে জামালকে তুমি বলে সম্বোধন করে। জামালও মাঝে মাঝে বিপ্লবীকে গিন্নী বলে ডাকে। দু’জনের নিষিদ্ধ সম্পর্কটাকে তার যেন একরকম অধিকার বলে গ্রহণ করেছে।

জামাল কলিং বেল টিপতেই জাকির ভিতরে ঢুকে বলল, ভাইজান।

আগে রশিদ সাহেবকে আসতে বলো। তারপর সেন্টুকে।

জাকির চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে রশিদ সাহেব চলে ঢুকলেন।

জামাল জিজ্ঞেস করল, রশিদ সাহেব আমি একবার পার্টি অফিসে যাবো, আর কোন কাজ আছে?

না ভাইজান।

ঠিক আছে আপনি আসুন।

রশিদ সাহেব চলে যাবার পর সেন্টু তার চেম্বারে ঢুকল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, সেন্টু কী খবর তোমার?

জি ভাইজান ভালো।

ঠিক মতো টাকা কালেকশন হচ্ছে তো?

জি ভাইজান।

দেখো এবার যেন তোমাকে আমার টাকা ধার দিতে না হয়।

ঠিক আছে ভাইজান।

কবে যেন তোমাকে রেডি থাকতে বলেছি।

সতেরো তারিখে।

তাহলে তো আর বেশিদিন সময় নেই। ঠিক আছে তুমি যাও। ষোল তারিখে টাকা রেডি করো।

জি ভাইজান, বলে সেন্টু চলে গেল।

এমন সময় জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো শাকিল, বলো।

বড়ভাই আজ তো পার্টি অফিসে মিটিং আছে, আসবেন না?

জামাল যেন চমকে উঠল, ও তাই তো, আমি এখনি আসছি।

                জামাল বের হলো পার্টি অফিসের উদ্দেশ্যে।

ততক্ষণে পার্টি অফিসে জেলা কমিটির সব সদস্য এসে উপস্থিত হয়েছে। সবাই জামালের জন্য অপেক্ষা করছিল। জামাল অফিসে ঢুকেই বিনীতভাবে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, সরি আমার আসলে আসতে দেরি হলো, আপনারা কিছু মনে করবেন না।

উপস্থিত দু’য়েক জন বললেন, না ঠিক আছে, আপনি ব্যস্ত মানুষ।

জামাল একবার তাকিয়ে দেখল। বেলায়েত সাহেব আসেনি। জামাল মনে মনে কিছুটা খুশি হলো, যাক ভালোই হলো।

তবু জামাল উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলল, বেলায়েত ভাই আসেন নি?

শাকিল বলল, না বড়ভাই আসেননি, আপনি মিটিংয়ের কাজ শুরু করেন।

জামাল সবার উদ্দেশ্যে বলল, মিটিংয়ের কাজ আর কি আসলে এটা কোন আনুষ্ঠানিক মিটিং না। প্রায় মাস দু’য়েক আগে মাননীয় মন্ত্রী আমাকে একটা কর্মী সম্মেলন করতে বলছিলেন। আমি কর্মী সম্মেলন করার জন্য মনে মনে একটা প্লান করেছি। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন যে আমি অনেকদিন বেশ ঝামেলায় ছিলাম। সেজন্য কর্মী সম্মেলন করার আয়োজন করতে পারিনি। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন আমি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি। এখন আমরা কাজ শুরু করতে পারি।

শাকিল বলল, জি বড়ভাই।

কর্মী সমাবেশ করার আগে ইউনিয়ন কমিটিগুলোর সঙ্গে আমি একবার মিটিং করতে চাই। তুমি কাগজ-কলম নিয়ে এসো।

শাকিল স্টিল আলমিরা থেকে কাগজ এবং কলম বের করে জামালের সামনে বসল।

জামাল পকেট থেকে একটা এক’শ টাকার নোট বের করে পিয়নের হাতে দিয়ে বলল, যাও তো তুমি চা’র ব্যবস্থা করো।

জামাল আর শাকিল দু’জনে সমস্ত ইউনিয়নের মিটিং করার জন্য একটা রুটিন তৈরি করল। তারপর উপস্থিত নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে শাকিল পড়ে শোনাল।

জামাল বলল, শাকিল তুমি তাহলে চিঠি তেরি করে কালকেই আমাকে দিয়ে সই করে নিও। দু’য়েকদিনের মধ্যে যেন চিঠিগুলো ডেলিভারি হয়ে যায়।

জি বড়ভাই।

তাহলে আমাদের কত তারিখে ইউনিয়ন কমিটিগুলোর সঙ্গে মিটিং শেষ হচ্ছে?

আগামী মাসের সাত তারিখে।

তারমানে অক্টোবরের সাত তারিখে, তাহলে আগামী মাসের পনেরো তারিখের পরে কর্মী সম্মেলন করার জন্য মোস্তফা ভাইকে বলি।

শাকিল বলল, জি ভাই বলতে পারেন।

জামাল উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা কী বলেন?

উপস্থিত সবাই বলল, ঠিক আছে আপনি মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুন।

জামাল তখনই মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল, হ্যালো বড়ভাই।

হ্যাঁ জামাল বলো।

জামাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, বড়ভাই আপনি তো সবকিছু জানেন আমার ওপর দিয়ে অনেক একটা ঝড় বয়ে গেল। সেজন্য পার্টির কাজে একটু-

ঠিক আছে আর বলতে হবে না। এখন বল তুমি ভালো আছ তো?

জি ভাই।

কী মনে করে বল?

বড়ভাই আজ আমরা সবাই পার্টি অফিসে বসেছি, আমি সবাইকে চিঠি দিয়েছিলাম তারপর আমি নিজে বেলায়েত ভাইকে মোবাইল করেছিলাম কিন্তু তিনি আসেননি। তাই আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।

কী সিদ্ধান্ত?

আগামী মাসে একটা কর্মী সম্মেলন করার জন্য, এখন আপনি যদি আগামী মাসের পনেরো তারিখ কিংবা তারপর যেদিন সময় দিতে পারেন তবে সেদিনই আমরা কর্মী সম্মেলন করব।

আমি ডায়েরি দেখি তারপর তোমাকে বলব।

জি ভাই।

তুমি তাহলে আগামীকাল একবার মোবাইল করো।

জি ভাই।

সবাই জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জামাল সকলের উদ্দেশ্যে বলল, মোস্তফা ভাই আগামীকাল মোবাইল করতে বললেন। তারপর তারিখ ঠিক করে বলবেন।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো বাবা।

অপর পাশ থেকে জহির সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল আমি তোর বাসায় আসছি তুই এখনি একবার বাসায় আয় তো।

জামাল কিছুটা অবাক হলো, বাবা তুমি আমার বাসায় মানে?

হ্যাঁ অবাক হচ্ছিস কেন? তোর সঙ্গে আমার জরুরী কাজ আছে।

জামাল মোবাইল রেখে দিয়ে বলল, সরি, বাবা আমার বাসায় এসেছে, আমাকে একটু উঠতে হচ্ছে।

শাকিল বলল, বড়ভাই চা খাবেন না?

জামাল উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলল, আপনারার চা খেয়ে যাবেন, প্লিজ।

পঁচানব্বই

জহির সাহেব এবং ফাহমিদা যখন জামালের বাসায় ঢুকলেন। বাসার বারান্দায় যেন ধুলো বালির স্তর জমেছে, ছোট্ট একটা টুল, কয়েকটা চেয়ার বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বারান্দার এক কোণে একটা বেসিনে পানি জমাট হয়ে যেন উপচে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ফাহমিদা বেসিনটা ঠিক করার জন্য বুয়াকে বলে ভিতরে ঢুকলেন।

ড্রয়িং রুমে সোফার ওপর অয়নের কিছু বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বারান্দার ওপর মেঝের মতোই ধুলো বালি স্তর জমেছে। সোফাগুলোর রং নষ্ট হয়ে গেছে যেন অনেকদিন কেউ বসেনি। সমস্ত বাসায় যেন একটা অবহেলা আর অযত্নের ছবি ফুটে উঠেছে। ফাহমিদা কয়েকবার অয়ন, অয়ন বলে ডাক দিল কিন্তু অয়ন কোন সাড়া দিল না।

বুয়া বলল, খালা আম্মা ভিতরে আছে, ওর পড়ার রুমে।

ফাহমিদা এবং জহির সাহেব খুঁজতে খুঁজতে অয়নের রুমে গেল। অয়ন তখন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিল। ফাহমিদা অয়নের কপালে হাত দিয়ে সস্নেহে বললেন, অয়ন, কী হয়েছে দাদু?

কিন্তু অয়ন কোন কথা বলল না।

জহির সাহেব একবার অয়ন বলে ডাক দিতেই সে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে হাসিতে ফেটে পড়ল।

জহির সাহেব অয়নকে কোলে তুলে নিলেন, খুব দুষ্ট হয়েছ না? দাদির সঙ্গে চালাকি করলে?

ফাহমিদা অয়নের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, কেমন আছ দাদু ভাই?

আমি ভালো নেই, আমি একেবারে ভালো নেই, আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।

কেন কী হয়েছে? ফাহমিদা জিজ্ঞেস করলেন।

আমার কেউ নেই, আমার মা নেই, বাবা সব সময় বাইরে থাকে, আমার কোন বন্ধু নেই, তোমরাও আসো না। আমার মা আমাকে কত আদর করতো, এখন আমাকে কেউ আদর করে না। আমি সারাদিন একা একা থাকি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না, বলতে বলতে অয়নের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

ফাহমিদা অয়নকে কোলে তুলে নিলেন। অয়নকে আদর করতে করতে বললেন, তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে?

অয়ন মাথা নেড়ে সায় দিল।

কলিং বেল বেজে উঠল।

বুয়া দরজা খুলে দিল।

জামাল ড্রয়িং রুমে ঢুকে বলল, বাবা, মা তোমরা ভালো আছ?

জহির সাহেব বললেন, আমাদের ভালো-মন্দ জেনে আর তোর কাজ নেই।

তোমরা একটু বসো মা আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।

জামাল হাত-মুখ ধুয়ে এসে একটা সোফায় বসতে বসতে বলল, মা হঠাৎ করে কোন কিছু না বলে?

তোর বাবা বলল, চলো একবার অয়নকে দেখে আসি, তাই চলে এলাম।

জহির সাহেব বললেন, এসে যা দেখলাম।

কী দেখলে বাবা?

দেখলাম অয়ন মন খারাপ করে ওর রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে।

হ্যাঁ বাসায় কেউ নেই তো, সারাদিন একা একা থাকতে থাকতে-

জহির সাহেব বললেন, সেজন্য তোর মা আর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কী সিদ্ধান্ত বাবা?

অয়নকে আমরা নিয়ে যাবো। বাসায় তোর মা সব সময় থাকে আমিও প্রায় সময় থাকি, প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশবে, তাছাড়া ওর তো বয়সও হলো। স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে।

জামাল অষ্ফুটস্বরে বলল, বাবা।

হ্যাঁ তোকে তো আমরা মানুষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি, আমাদের একমাত্র বংশধর অয়নকে আমি মানুষ করতে চাই আর তোর কাছে থাকলে ও কোনদিন মানুষ হবে না।

জামাল মলিন মুখ তুলে বলল, কিন্তু আমি যে একেবারে একা হয়ে যাবো বাবা।

তোর আবার একা কী, তুই তো সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকিস, অয়নের দিকে খেয়াল করার তোর সময় কোথায়?

ফাহমিদা সোফা থেকে উঠলেন, অয়ন এসো দাদু ভাই, তোমার কাপড়-চোপড়গুলো দেখিয়ে দাও আমি গুছিয়ে নিই।

ফাহমিদা অয়নকে নিয়ে তার রুমে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর ফাহমিদা একটা ব্যাগ নিয়ে বের হলেন, তাঁর পিছু পিছু অয়ন বের হলো। অয়নের গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির দাগ তখনো মিশেনি। জামাল অয়নকে কোলে নিয়ে গণ্ডদেশ মুছে দিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, তুই আমাকে ছেড়ে যাবি বাবা?

অয়ন বলল, আমি দাদু বাড়ি যাচ্ছি বাবা, তুমি আমাকে দেখতে এসো কিন্তু।

যাবো বাবা।

জহির সাহেব এবং ফাহমিদা বের হলেন। অয়ন যাবার সময় পিছনের দিকে তাকাতে লাগল। জামাল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনার জন্য জামাল প্রস্তুত ছিল না। এতদিন অয়ন বাসায় ছিল যত রাতই হোক না কেন অয়ন জেগে থাকলে দৌড়ে কাছে আসতো আর সে ঘুমিয়ে গেলে জামাল তার রুমে ঢুকে অয়নের মাথায় হাত দিয়ে দেখত। আজ সেও চলে গেল। অয়নকে তার বাবা নিয়ে যাওয়ার পর জামাল আজ অয়নের প্রতি তার ব্যবহারের কথা মূল্যায়ন করছে। দিনের পর দিন একটা অবুঝ বাচ্চা তার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করেছে, সারাদিন বাসায় একা একা কাটিয়েছে অথচ এত অল্প বয়সের একটা বাচ্চার জন্য প্রয়োজন ছিল বাবা-মা’র স্নেহ ভালোবাসা। উঃ আজ জামাল নিজেও অয়নের অভাব অনুভব করছে। রাত অনেক গভীর হয়েছে কিন্তু জামালের চোখে ঘুম নেই। বিভিন্ন এলোমেলো চিন্তা তার মাথায় ভিড় করছে।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল। বিপ্লবী মোবাইল করেছে সে রিসিভ করল, হ্যালো বিপ্লবী।

কেমন আছ তুমি?

হ্যাঁ ভালো, তুমি।

আমি ভালো নেই।

কেন কী হয়েছে? বিপ্লবীর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

কিছু হয়নি তবে মনটা ভালো নেই।

মনের আবার কী হলো?

সব সময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ছে।

আমারও।

কই তুমি তো আমাকে মোবাইল করলে না?

বিপ্লবী তুমি তো জানো আমি সব সময় কত ব্যস্ত থাকি।

হ্যাঁ আমি বুঝতে পাচ্ছি তুমি আসলে ব্যস্ততার কথা বলে আমাকে এভয়েড করছ।

জামাল কিছু বলল না।

অপর পাশ থেকে বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

বলো শুনছি।

তুমি কি শুধু শুনবে? তোমার কি কিছু বলার নেই?

বিপ্লবী আমার মনটাও ভালো নেই।

কেন? তোমার আবার কি হলো? বউয়ের কথা মনে পড়ল নাকি?

না বউয়ের কথা তো তুমি মন থেকে মুছে দিয়েছ।

সত্যি।

হ্যাঁ।

তবে মন খারাপ কেন?

বিপ্লবী আজ বাবা-মা এসে অয়নকে নিয়ে গেছে।

কেন?

আমার কাছে থাকলে নাকি মানুষ হবে না। তাই তারা নিয়ে গেছেন, মানুষ করার জন্য।

একদিক থেকে ভালোই করেছে। তুমি তো সব সময় থাক ব্যবসা আর রাজনীতি নিয়ে। সারাদিন একটা মাসুম বাচ্চা একা একা থাকে। কিছুদিন থাক আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে আবার আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো। আমি অয়নকে মানুষ করে তুলব। মানুষের মতো মানুষ।

জামাল কিছু বলল না।

কি ঠিক বলেছি না?

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।

আমাদের বিয়েতে আর কতদিন দেরি করতে হবে।

বিপ্লবী একটু দেরি করো। আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে তোমাকে জানাবো।

তাড়াতাড়ি করো তোমার খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে না, অয়ন ওর দাদার বাড়ি আছে, আমিও কষ্ট পাচ্ছি। আমাদের বিয়েটা যত দেরি হবে ততই আমরা সবাই কষ্ট পাবো।

জামাল বলল, বিপ্লবী আমি এখন ঘুমাবো।

সরি তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।

ছিয়ানব্বই

চৈতীর কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটা নতুন স্বপ্ন, একটা নতুন অনুভূতি তাকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখছে, টি.ভি’র পর্দায় তার ছবি ভেসে উঠবে, সারাদেশের মানুষ তার অভিনীত বিজ্ঞাপন, টি.ভি’তে তার অভিনীত নাটক বিজ্ঞাপন চিত্র প্রদর্শিত হবে, দেখে সবাই তার প্রশংসা করবে। ছেলে-মেয়েরা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবে, অটোগ্রাফ প্লিজ।

এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে চৈতী আপন মনে হেসে উঠল। চৈতীর বান্ধবী শারমিন তখনো পড়ছিল। সে ঘুমের মধ্যে চৈতীকে হাসতে দেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, কী রে হাসছিস কেন?

চৈতী বিছানায় উঠে বসল, শারমিন বস, তোর সঙ্গে গল্প করি।

শারমিন চৈতীর বিছানায় বসল।

শারমিন তোকে আসলে আগে বলতে চাইনি, ভাবছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দিবো।

তাহলে বলিস না।

তোকে না বললে এমন একটা আনন্দের খবর আমি আর লুকাতেও পারছি না।

তো বল?

কয়েকদিন আগে একটা এ্যাড ফার্মে গেছিলাম।

চান্স হয়েছে?

তা হয়নি তবে একরকম কথা হয়েছে?

কী কথা হলো? আমাকে বলা যাবে?

ইন্টার্ভিউ হলো। তারপর আমার বায়োডাটা জমা দিলাম। বায়োডাটায় মোবাইল নাম্বার দিয়েছি। ওরা আমাকে একমাস পরে খবর নিতে বলেছে।

কতদিন হলো?

চৈতী মনে মনে হিসেব করে বলল, তা প্রায় বিশ দিন হলো, আজ সেই এ্যাড ফার্ম থেকে মোবাইল করেছিল, আগামীকাল যেতে বলেছে।

শারমিন কিছু বলল না।

চৈতী বলল, কীরে কিছু বলছিস না কেন?

শারমিন মুখ ভার করে বলল, আমি আর কী বলব? আমার আসলে মডেলিং করার ইচ্ছা নেই, তাই আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।

উঃ আমার কী যে আনন্দ লাগছে?

কাল ক্লাস করবি না?

আরে রাখ তো ক্লাস! একবার মডেলিংয়ে হিট করতে পারলে, প্যাকেজ নাটক কিংবা ধারাবাহিক নাটকে চান্স পাওয়া ইজি হবে। তারপর তুই মাস্টার্স পাস করে, বড় চাকরি করে যা করতে পারবি না তারচেয়ে আমি অনেক বেশি উন্নতি করতে পারব। তাছাড়া এসব লাইনে একটা আলাদা চার্ম আছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শুটিং স্পটে শুটিং হবে, আজ কক্সবাজার, কাল পুর, পরশু কুয়াকাটা তারপর থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আরো যেখানে যেখানে শুটিং হবে সেখানেই ছুটে বেড়াবো। সারাদেশের মানুষ আমাকে টি.ভি’র পর্দায় দেখবে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমার ভক্ত হবে। উঃ আমার কী যে আনন্দ লাগছে! শারমিন এখন দেখতো রাত ক’টা বাজে?

একটা।

কাল এগারোটায় যাবো এখনো অনেক দেরি। এত সময় কাটাবো কী করে?

শারমিন মুখ আংশিক বিকৃত করে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চৈতী নাস্তা সেরে এ্যাড ফার্মে মোবাইল করল, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠে ধ্বনি ভেসে এলো, হ্যালো।

ম্যাডাম আমি চৈতী বলছি।

বলুন।

আমি মডেল হওয়ার জন্য আপনার ফার্মে ইন্টার্ভিউ দিয়েছিলাম। আজ আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।

হ্যাঁ আপনি আসুন।

থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।

চৈতী রিশিপশনে গিয়ে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল সাড়ে দশটা বাজে। অন্যান্য দিনের মতো তরুণ-তরুণীদের ভিড় নেই। চৈতী রিসিপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম স্যার নেই।

আপনি একটু বসুন, বলে রিসিপশনিস্ট ইন্টারকমে সুমন সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর চৈতীকে বলল, আপনি ভিতরে যান।

থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, বলে চৈতী সুমন সাহেবের চেম্বারে ঢুকল।

চৈতী সালাম দিল।

সুমন সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, বসো, তুমি চৈতী?

জি স্যার।

সুমন সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, নাচ শিখেছ কিনা?, গান জানো কি না? অভিনয় জানো কি না? আগে কখনো মডেলিং-এ জড়িত ছিলে কি না?

চৈতী না সূচক উত্তর দিল।

সুমন সাহেব মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন, একেবারে ফ্রেশ?

চৈতী কিছু বলল না।

তুমি তো এ লাইনে একেবারে নতুন।

জি স্যার।

দেখ চৈতী, মডেলিং-এ অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী আছে, নতুনদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এ লাইনে নতুন হলেও নাচ জানে, গান জানে, অভিনয় জানে তুমি তো একেবারে নতুন।

আপনি হেল্প করলে আমি অবশ্যই পারবো স্যার।

কিছু মনে করো না চৈতী, আসলে এ লাইনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুব কঠিন কাজ। আমাদের ব্যবসাটাও খুব কঠিন। কোন কোম্পানির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করার পর নিয়মানুযায়ী একটা এ্যাট্রাক্টিভ বিজ্ঞাপন তেরি করা আমাদের কাজ, এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের মান আমরা নিজেদের স্বার্থেই রক্ষা করে থাকি। আমরা কোন মডেল তারকাকে দিয়ে, নাকি কোন সিনেমার নায়িকাকে দিয়ে, নাকি কোন নতুন মডেলকে দিয়ে বিজ্ঞাপন তেরি করব সেটা আমাদের কোম্পানির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আজকাল এই চিরাচরিত নিয়মটা অচল হয়ে গেছে।

চৈতী কিছু বুঝল না, সে মাথা নত করে বসে রইল।

সুমন সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আজকাল আমরা কোন মডেলকে দিয়ে বিজ্ঞাপন তেরি করব সেটাও স্পন্সাররা বেঁধে দেন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদেরই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

স্যার তাহলে আমি নতুন বলে কি মডেলিং-এ চান্স পাবো না? আর কোনদিন যদি কাজই না করি তবে প্রতিষ্ঠিত মডেল হব কীভাবে?

চৈতী আমি আসলে তোমাকে মডেলিং এবং প্যাকেজ নাটকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য একটা লিফট দিতে পারি।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছে, তিনি প্যাকেজ নাটক প্রডিউস করতে চান এবং তিনি তাঁর আগে কিছু নতুন মুখ খুঁজছেন, তুমি এই চান্সটা নিতে পারো।

প্লিজ স্যার আপনি আমাকে হেল্প করুন এ চান্সটা যেন আমার হাতছাড়া হয়ে না যায়।

আমি তোমাকে হেল্প করব তবে মেইন রোল করতে হবে তোমাকে।

আপনি বলুন স্যার আমাকে কী করতে হবে?

প্রডিউসারকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।

চৈতী অষ্ফুটস্বরে বলল, আমি কীভাবে ম্যানেজ করব স্যার?

তুমি শিক্ষিত, সুন্দরী, প্রতিভাময়ী তরুণী একটু টেকনিক এপ্লাই করতে পারলেই তুমি সবকিছু ম্যানেজ করতে পারবে, অবশ্য আমার কোম্পানির স্টাফরা যেন তোমাকে হেল্প করে সেটা আমি বলে দিবো।

চৈতী মনে মনে বলল, লোকটার অন্য কোন মতলব নেই তো? কিন্তু আমার স্বপ্ন, সবার কাছে তো আমি আগেই বলেছি যে আমি অবশ্যই একদিন সফল হবো। চৈতীর চোখের সামনে তখন তার নিজের ছবিটা যেন টি.ভি’র পর্দায় ভেসে উঠল।

চৈতীকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমন সাহেব বললেন, তোমাকে আজকেই উত্তর দিতে হবে এমন নয়, তুমি ভেবে উত্তর দিতে পারো। তবে সেক্ষেত্রে আমরা যদি কাউকে সিলেক্ট করে ফেলি তবে আর তোমার চান্স থাকবে না। জানোই তো আজকাল মডেলিং এবং প্যাকেজ নাটকে অভিনয় একটা আকর্ষণীয় পেশা।

চৈতী আবেগ প্রবণ হয়ে বলল, আমি পারবো, আপনি আমাকে একবার চান্স দিন স্যার, প্লিজ!

সুমন সাহেব বললেন, তুমি সময় নাও, ভেবে বলো, পরে শুটিঙয়ের ডেট হয়ে যাবার পর আর কিন্তু না করতে পারবে না।

শুটিঙয়ের কথা শুনে চৈতী আরো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, আমি ভেবেই বলছি স্যার। আপনি শুটিঙয়ের ডেট করুন, আমাকে মোবাইল করলেই আমি ঠিক সময়ে উপস্থিত হবো।

থ্যাঙ্ক ইউ চৈতী। তুমি খুব ট্যালেন্ট মেয়ে। এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।

জি স্যার বলুন?

তুমি ঢাকায় থাকো কোথায়?

হোস্টেলে।

তোমার বাবা-মা?

গ্রামে থাকেন।

শোন তাহলে, আমাদের বেশিরভাগ শুটিং তো হয় ঢাকার বাইরে, এই যেমন কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পুর অনেক সময় শুটিং করতে গিয়ে রাত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের পুরো টিম নিয়েই বাইরে থাকতে হয়। অনেক সময় কক্সবাজার গেলে তো কয়েকদিন থাকতে হয়। আর বিদেশে শুটিং হলে তো কথাই নেই, তুমি গার্জিয়ানের সম্মতি নিতে পারবে তো?

আবেগে চৈতীর দু’চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছে বলল, আমি পারবো স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আসলে আমার ভাগ্য ভালো যে আমি আপনার মতো একজন ভালো মানুষের কাছে এসে পৌঁছেছি। তা না হলে হয়ত আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত। এখন আমি চোখের সামনে আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি স্যার।

চৈতী তুমি যোগাযোগ রেখো, শুটিঙয়ে যাবার আগের দিন তোমাকে খবর দেয়া হবে, তুমি চলে এসো।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

চৈতী বেরিয়ে যাবার পর পরই সুমন সাহেব জামালের মোবাইলে রিং করলেন।

হ্যালো, জামাল ভাই, কেমন আছেন?

অপর পাশ থেকে জামালের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভালো, আপনি?

জি ভালো।

ব্যবসা কেমন চলছে?

ভালো।

আচ্ছা সুমন সাহেব আপনাকে আমি একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম, মনে আছে?

জি জামাল ভাই মনে আছে আমি সেজন্যই তো আমি আপনাকে রিং দিলাম।

বলুন কী খবর?

জামাল ভাই আপনি কবে ঢাকা আসতে পারবেন?

আগামী সপ্তাহে।

সুমন সাহেব বলল, এভরিথিং ওকে।

ভাইজান চৈতীকে আপনার পছন্দ তো?

কোন চৈতী?

সেদিন আপনার সামনে যে মেয়েটার ইন্টার্ভিউ হলো।

ও মনে পড়েছে, হ্যাঁ ঠিক আছে।

তবে ভাইজান আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে।

আমি তো আবার অভিনয় করতে পারি না।

আসলে ঠিক নাটকের অভিনয় না, আপনি ঢাকা এলে আপনাকে আমি শিখিয়ে দিব।

ও কে সুমন সাহেব, থ্যাঙ্ক ইউ।

সাতানব্বই

জামাল অনেক হিসাব করে দেখেছে রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য শুধু স্থানীয় রাজনীতি করলেই হবে না, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে থাকতে হবে সখ্যতা। এম. পি পদে নোমিনেশন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে তার যোগ্যতা দেখাতে হবে। জামাল আপন মনে বলল, সামনে কর্মী সম্মেলন আমার যোগ্যতা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে দেখানোর এটাই মোক্ষম সময়।

আজ মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করে কর্মী সম্মেলনের তারিখ জেনে নেওয়ার কথা।

জামাল মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল, বড়ভাই।

হ্যাঁ জামাল বলো।

বড়ভাই কর্মী সম্মেলনের ডেট জানানোর কথা ছিল। আপনি যদি আপনার ডায়েরি দেখে বলতেন?

হ্যাঁ তুমি কবে বলছিলে যেন।

আগামী মাসের পনেরো তারিখের পর।

আগামী মাসের একুশ তারিখ করো।

আচ্ছা ভাই ঠিক আছে।

তাহলে একথাই থাকলো। তুমি সবকিছু এ্যারেঞ্জ করো। অবশ্য তোমার ওপর আমার সেই ভরসা আছে।

বড়ভাই আমার একটা প্রস্তাব ছিল।

বলো।

আমরা এত বড় একটা অনুষ্ঠান করছি, কোন সেন্ট্রাল লিডারকে দাওয়াত দিলে ভালো হতো না?

তা অবশ্য বলা যায়।

বড়ভাই আপনি যদি পারমিশন দেন তবে আমি ইমরান ভাই কিংবা মোজাফফর ভাই’র সঙ্গে আলাপ করি তারপর না হয় আপনি আনুষ্ঠানিকভাবে দাওয়াত দিবেন।

তুমি বললে গুরুত্ব দিবে, নাকি আমি বলব?

বড়ভাই আমি প্রাথমিকভাবে আলাপ করি তারপর আপনি বলবেন। আমি ছোট মানুষ আমার কথায় সম্মতি না দিলে কিছু যায় আসে না কিন্তু আপনি রিকোয়েস্ট করার পর যদি তাঁরা সম্মতি না দেন তবে আপনার জন্য বিষয়টা কেমন হয়ে যায় না?

হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি আগে কথা বলো। তারপর না হয় আমি বলব।

থ্যাঙ্ক ইউ বড়ভাই।

রশিদ সাহেব জামালের চেম্বারে ঢুকলেন।

জামাল মৃদু হেসে বলল, বসুন রশিদ সাহেব।

রশিদ সাহেব চেয়ারে বসলেন, ভাইজান আপনি তো সব সময় খুব ব্যস্ত থাকেন, আপনার সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারি না। এদিকে বিভিন্ন কাজ নিয়ে আমি নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

হ্যাঁ বলুন।

রশিদ সাহেব একে একে চলমান কাজগুলির বিবরণ দিলেন। তারপর বললেন, ভাইজান আগামীকাল ব্রিজের কাজটার জন্য রড কিনতে হবে।

ক’টন?

বারো টন।

আমি এখনি মোবাইল করছি, বলে জামাল দোকানে মোবাইল করে সাইটে রড পাঠানোর জন্য অর্ডার দিল।

ভাইজান ব্রিজের কাজটার সাটারিং চলছে তো কয়েকদিন পর সিমেন্ট লাগবে আর এখন তো লেবার পেমেন্টের জন্য প্রতিদিন অনেক টাকা করে লাগছে।

সিমেন্টের জন্য ঢালাই’র আগে আমাকে স্মরণ করে দিবেন আমি দোকানে মোবাইল করে দিব। আর ডেইলি লেবার পেমেন্টের জন্য আজ থেকে একেবারে ঢালাইয়ের আগের দিন পর্যন্ত ক’টাকা লাগবে বলুন আমি আপনাকে চেক দিয়ে দিচ্ছি।

ভাইজান তিন লাখ টাকা হলে একেবারে ঢালাইয়ের আগের দিন পর্যন্ত চলবে।

জামাল তার ড্রয়ার থেকে চেক বই বের করে, চেক লিখে দিল।

জামাল হাসতে হাসতে বলল, রশিদ সাহেব আপনার তো সবকিছু হলো, এখন বিলের কথা বলুন।

ভাইজান ফাণ্ড আছে, টপ স্লাবটা ঢালাই হয়ে গেলে বিল পাওয়া যাবে।

আপনি কি এস্টিমেট করে দেখেছেন? বিল ক’টাকা হতে পারে?

আমরা তো আগে একটা বিল নিয়েছি, টপ স্লাবটা ঢালাই হলে ত্রিশ লাখ টাকার মতো বিল হবে।

থ্যাঙ্ক ইউ রশিদ সাহেব।

জামাল একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, রশিদ সাহেব, আমি কিছুদিন থেকে দেখছি চাউলের ব্যবসাটায় আমার বেশ মন্দা যাচ্ছে। আসলে চাউলের ব্যবসায় যে মন্দা যাচ্ছে তা না। আমি ঠিক মতো মনিটরিং করতে পারছি না তাই এমন হচ্ছে। আপনি যদি আমাকে হেল্প করেন তবে আমি এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি।

জি ভাইজান, আপনি বলুন আমি কীভাবে হেল্প করতে পারি?

আসলে আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ আপনাকে কথাটা কী করে যে বলি। একটা কথা কি জানেন মানুষের যোগ্যতা থাকলে সবকিছু করতে পারে কাজে কোন ছোট বড় নেই। তাই আপনি যদি কন্সট্রাকশন কাজের পাশাপাশি ধান-চাউলের ব্যবসাটা দেখাশোনা করেন। অবশ্য আমি আপনার বেতন বাড়িয়ে দিবো।

ভাইজান আমি কি পারবো?

কেন পারবেন না? আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য তো ম্যানেজার আছে আপনি শুধু মোবাইলে সবার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। শিক্ষিত মানুষ পারবেন না কেন? প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

রশিদ সাহেব আর কিছু বললেন না। তাহলে এভাবে কথা থাকল। আমি ম্যানেজারকে এখনি বলছি কাল আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিবে। আর হ্যাঁ আমি আগামী সপ্তাহে ঢাকা যাচ্ছি, ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে। আপনি সবকিছু দেখে রাখবেন।

রশিদ সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, ভাইজান আমি আসি।

রশিদ সাহেব চলে যাবার পর সেন্টু জামালের চেম্বারে ঢুকল। জামাল সেন্টুর কাছ থেকে সবকিছু শুনে বলল, তো সেন্টু তুমি যাও। কোন সমস্যা না থাকলে আমাকে সবকিছু জানানোর দরকার নেই।

জি ভাইজান।

সবার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে জামাল অভ্যাসবশত: চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। এমন সময় শাকিল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।

জামাল চমকে উঠল, আরে শাকিল, বসো বসো।

শাকিল চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ভাইজান কেমন আছেন?

ভালো, তুমি?

জি ভালো আছি।

কী মনে করে?

কিছু মনে করে না, অনেকদিন থেকে ভালোভাবে কথা হচ্ছে না, তাই এলাম।

জামাল কলিং বেল টিপ দিতেই জাকির ভিতরে ঢুকল।

জামাল বলল, আমাদের জন্য দু’টা ঠাণ্ডা।

জাকির চলে গেল।

শাকিল বলল, বড়ভাই একটা দিক আপনি খেয়াল করেছেন?

কী?

সবার মুখে কিন্তু আপনার নাম আসছে। দিনে দিনে কর্মীদের কাছে মোস্তফা ভাইর চেয়ে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন।

তাই নাকি?

একটা কথা অবশ্য ঠিক। গত ক’বছরে মোস্তফা ভাই’র চেয়ে দলের জন্য আপনি বেশি কাজ করেছেন।

জামাল মুচকি হাসল।

বড়ভাই এভাবে আর কতদিন?

কীভাবে?

এই যে মোস্তফা ভাই ঢাকায় থেকে নোমিনেশন নিয়ে শুধু ভোটের আগে এলাকায় আসবেন আর আপনি সারা বছর দলের জন্য কাজ করে যাবেন।

জামাল শাকিলের কথা বুঝতে পারল। কিন্তু তবুও না বোঝার ভান করে বলল, তো কী করব?

কোল্ড ড্রিঙ্কস চলে এলো। জাকির চলে যাবার পর শাকিল এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, মানে আমি বলছিলাম সব সময় কি শুধু আপনি কাজ করে যাবেন আর মোস্তফা ভাই ফল ভোগ করবেন? আপনি নিজের জন্য কিছু করবেন না?

কী করব?

মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম আপনি না হয় এবার নমিনেশনের জন্য চেষ্টা করুন। এবার তো আর জনগণ মোস্তফা ভাইকে দেখে ভোট দিবে না, এবার সবাই ভোট দিবে আপনাকে দেখে।

জামাল মনে মনে বলল, শাকিল তো ঠিকই বলেছে কিন্তু নোমিনেশন পেতে হলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা প্রয়োজন আমি তো কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মাত্র দু’চার জনের সঙ্গে পরিচিত এবার ঢাকা গিয়ে মোজাফফর ভাই আর ইমরান ভাই’র মাধ্যমে আরো আমার সার্কেল বড় করতে হবে।

শাকিল বলল, বড়ভাই।

শাকিল আসলে শুধু লোকাল রাজনীতিতে জনপ্রিয় হলেই নোমিনেশন পাওয়া যায় না, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা রাখতে হয়। আর সবচেয়ে বড় বাধা কি জানো?

কী?

আমার বয়সটা। যে কাউকে পরিচয় দিলেই বলেন, এত অল্প বয়সে জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি? ও হ্যাঁ তোমার নাম তো আগেও শুনেছি।

শাকিল কিছু বলল না।

জামাল বলল, শাকিল তবুও আমি চেষ্টা করছি তবে তুমি কিন্তু আমাকে হেল্প করবে। আমি নোমিনেশন পাবার চেষ্টা করছি তুমি ফিল্ডের কাজ শুরু করে দাও।

আমাকে আপনার কিছু বলতে হবে না বড়ভাই, আপনি মনে করুন আমি কাল থেকেই কাজ শুরু করে দিচ্ছি।

শাকিল বেরিয়ে গেল।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো।

হ্যালো, বিপ্লবী বলছি।

বিপ্লবী তুমি? আননোন নাম্বার থেকে কেন? তোমার মোবাইল কী হলো?

আমি অনেকবার মোবাইল করেছি তুমি রিসিভই করছ না, অনেক সময় লাইন কেটে দিচ্ছ। তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ কেন? আমি কি তোমার কাছে এত তাড়াতাড়ি অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলাম?

ছিঃ ছিঃ বিপ্লবী তুমি এমন কথা বলছ কেন?

তুমি এখন কোথায়?

কেন। বলো তো।

আমি একবার তোমার সঙ্গে দেখা করব।

কিন্তু আমি যে এখন একটু ব্যস্ত আছি।

তুমি বারবারই ব্যস্ততার কথা বলে আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ।

বিষয়টা কি খুব জরুরী?

হ্যাঁ জরুরী।

কিন্তু আমি যে এখন তোমাকে সময় দিতে পারছি না।

দেখো আমাকে সময় দিতে না পারলে আমি এখনই তোমার অফিসে চলে আসবো, হৈ চৈ হবে, তখন আমাকে বলতে পারবে না। আমি এখনো চাই না তোমার মান-সম্মানের কোন ক্ষতি হোক।

তুমি আমাকে ব্ল্যাক মেইল করছ?

না, আমি তোমাকে ব্ল্যাক মেইল করিনি কিন্তু আমার অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে সবকিছু করবো।

মানে?

তুমি আজ দিনের মধ্যেই আমাকে সময় দিবে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। সাক্ষাতে সবকিছু বলব।

ঠিক আছে তাহলে আজ সন্ধ্যায় তুমি আমার অফিসে এসো।

না আমি মধুকুঞ্জে আসবো, তুমি মধুকুঞ্জে এসো।

জামাল মৃদু হেসে বলল, কী ব্যাপার? হঠাৎ করে মধুকুঞ্জে নিজেই আসতে চাচ্ছ?

হ্যাঁ অনেকদিন থেকে তোমার সঙ্গে সেভাবে দেখা হচ্ছে না তো, তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।

ঠিক আছে এসো, বলে জামাল মোবাইল রেখে দিয়েই যেন কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ল। বিপ্লবী তার অধিকার আদায়ের কথা বলছে, যে মেয়ে মধুকুঞ্জে সহজে আসতে চাইতো না সে নিজেই মধুকুঞ্জে আসতে চাচ্ছে। কোন খারাপ মতলব নেই তো?

মধুকুঞ্জে ঢুকে জামাল বিপ্লবীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আগে কোনদিন বিপ্লবীকে মধুকুঞ্জে আসতে বললে তার কাছে অপেক্ষার সময়গুলো অনেক লম্বা বলে মনে হতো আজো তার ব্যতিক্রম নেই তবে আগে অপেক্ষার সময় মনের মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করতো আর আজ একটা আতংক কাজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিপ্লবী চলে এলো। আজ বিপ্লবী বেশ সেজে গুজে এসেছে, খুব আকর্ষণীয় রঙের একটা পাতলা জর্জেট  পরেছে। মৃদু বাতাস বইছে, বাতাসে তার  বুক এবং পেটের সঙ্গে মিশে গিয়ে যেন টিলা এবং সমতল ভূমির মতো বন্ধুর ভৌগলিক অবস্থা তেরি করেছে। বাতাসে বিপ্লবীর র আঁচল উড়ছে, কোমর পর্যন্ত এলিয়ে পড়া চুলগুলো তার পিঠের মধ্যে দোল খাচ্ছে।

জামাল বিপ্লবীকে দেখে তার বেড রুমে ঢুকল। তার পিছনে পিছনে বিপ্লবীও বেড রুমে ঢুকল। আজ বিপ্লবী জামালের বেড রুমে ঢোকার আগে কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না।

জামাল কিছুটা অবাক হলো। সে বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বিপ্লবী জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ?

তোমাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

শুনে খুশি হলাম, বিপ্লবীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

জামাল বিপ্লবীর কাঁধে হাত রাখল। বিপ্লবী হাত সরিয়ে নিল না, জামালের চোখে চোখ রেখে বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সবকিছু তো আগেই নিয়েছ, আমিও তোমাকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। আজ আর তোমার কাছে আমার লুকানোর কিছু নেই।

বিপ্লবী সোফায় বসল। জামাল বিপ্লবীর গা ঘেঁষে বসল।

বিপ্লবী নিজেই জামালের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, আমি এসেছি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।

বিয়ের ব্যাপারে মানে? জামাল যেন চমকে উঠল।

কেন? চমকে উঠলে মনে কেন? তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?

না ঠিক তা না, কিন্তু এত তাড়াহুড়া কেন?

অনেকদিন তো হলো, আর দেরি কেন? বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

বেশ তো ভালো ঘর-বর পেলে বিয়ে করে ফেল।

তুমি কী বলছ? তুমি আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবে? তারমানে তুমি আমাকে ভালোবাসনি, শুধু আমার সুন্দর দেহটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য অভিনয় করেছ?

জামাল বিপ্লবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বিপ্লবীর আরো সান্নিধ্যে গিয়ে বলল, বিপ্লবী, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আমার চেয়ে ভালো কাউকে পেলেও তুমি বিয়ে করবে না কেন?

না, আমি তোমাকে বিয়ে করব। যাকে একবার সবকিছু দিয়েছি শুধু তার সঙ্গেই বিয়েতে বসব। আমার দেহটা পণ্যে না যে সবাইকে বিলিয়ে দিবো।

জামাল অবস্থা বেগতিক দেখে বলল, বিপ্লবী আমাকে আর ক’টা দিন সময় দাও, প্লিজ।

ঠিক আছে কিন্তু একটা কথা মনে রেখো কয়েকদিন মানে যেন কয়েক মাস না হয়।

জামাল বুঝতে পারল বিপ্লবী তাকে সহজে ছাড়বে না। আর তাকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তাতে সে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারে এবং কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত যেতে পারে। জামাল আপন মনে বলল, বিপ্লবী আমি পাওয়ার পার্টির জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি কাজেই তুমি আমাকে খুব সহজে বিপদে ফেলতে পারবে না। কিন্তু দলে এবং দলের বাইরে তো আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারো। কাজেই যা করতে হবে অত্যন্ত কৌশলে, যেন সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে।

বিপ্লবী বলল, কী ভাবছো?

জামাল কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, না কিছু না, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, আমার উপর ভরসা রাখো।

বিপ্লবী জামালের গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ল।

আটানব্বই

মাইক্রো বাস ছাড়লো সকাল এগারোটায়। তে মোট সাত জন। তিনজন মেয়ে চারজন ছেলে। পরিচয় পর্ব শেষ হয়েছে অফিসে বসে। এই চার জন মেয়ের মধ্যে একজন আগেও মডেলিংয়ে অভিনয় করেছে, নাম মুক্তা বলে জানিয়েছে, হ্যাঁ চৈতীরও মনে পড়েছে কোন বিজ্ঞাপনে যেন দেখেছে। আরেকজন চৈতীর মতোই এবারই প্রথম, নাম মেঘনা, একটু বেশি বয়সের আরেক মেয়ে বয়স পঁচিশ কিংবা ত্রিশ বছর হবে, নাম মমতাজ এর চেয়ে বেশি তার পরিচয় পাওয়া গেল না। চার জন ছেলের মধ্যে একজন নাকি আগে একটা প্যাকেজ নাটকে অভিনয় করেছে, একজন নতুন আর দু’জনের মধ্যে একজন স্ক্রিপ রাইটার আরেকজন ডিরেক্টর, ডিরেক্টরের নাম ফারুক। আরেকটা মাইক্রো বাসে আছে ক্যামেরাম্যানসহ সহযোগী অন্যান্যরা। পুরো টিমের লিডার ডিরেক্টর।

 শুটিং স্পটে পৌঁছাল বিকেলবেলা। অনেকটা পার্কের মতো, শুধু পার্কের মতো বললে ভুল হবে। একই ক্যাম্পাসের মধ্যে যেন ছোট আকারের একটা শিশু পার্ক, বিভিন্ন ধরণের কৃত্রিম প্রাণীজগৎ, বাঁয়ে একটা পুকুর, পুকুরে ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য কয়েকটা ছৈওয়ালা নৌকা এবং একটা ডিঙি নৌকা, পুকুরের চারপাশে সুসজ্জিত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ডানে প্রাকৃতিক আদলে তেরি কৃত্রিম বনাঞ্চল। আরো সামনে গিয়ে হাতের ডানে একটা সুরক্ষিত ক্যাম্পাসে কারুকার্যখচিত কয়েকটা কটেজ।

মাইক্রো বাস একটা কটেজের সামনে এসে দাঁড়াল। সবাই  থেকে নামল। কয়েকজন বয় এসে ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। প্রত্যেক রুমে একটা করে সিট, এট্যাচ্‌ড বাথ, পিছনে একটা বেলকনি যেখান থেকে অদূরের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে সূর্যাস্ত দেখা যায়। চৈতীর রুমটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। সে তার রুমে ঢুকে পোশাক পরিবর্তন করতেই দরজা নক করার শব্দে দরজা খুলে দিল।

মুক্তা আর মেঘনা।

মুক্তা বলল, চৈতী চলো, এম.ডি স্যার নাস্তা খেতে ডাকছেন। আমি আবার তোমাকে তুমি বলে ডাকলাম, তুমি কিছু মনে করো না। এ লাইনে আমি তোমাদের চেয়ে সিনিয়র তো।

চৈতী বলল, ঠিক আছে আপা। আমি কিছু মনে করব না।

মেঘনা মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

ক্যান্টিনে সুমন সাহেব আর জামাল বসে ছিল। মুক্তা, চৈতী এবং মেঘনা ক্যান্টিনে ঢুকল। সবাই একটা বড় গোল টেবিল ঘিরে থাকা চেয়ারে বসেছে।

সুমন সাহেব বললেন, তোমরা তো আমাকে চেনো, তাই না?

সবাই সমস্বরে বলল, জি স্যার।

জামাল সুমন সাহেবের ডান পাশে বসে ছিল।

সুমন সাহেব জামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ জামাল হোসেন, প্রডিউসার। তোমরা সবাই তোমাদের পরিচয় দাও।

চৈতী তার পরিচয় দেওয়ার জন্য দাঁড়াচ্ছিল।

সুমন সাহেব বললেন, বসেই পরিচয় দাও।

চৈতী তার পরিচয় দিল, আমি চৈতী।

আমি মেঘনা।

আমি মুক্তা।

বয় একটা প্রাইজ লিস্ট নিয়ে এলো।

সুমন সাহেব প্রাইজ লিস্ট দেখে নাস্তার অর্ডার দিয়ে বললেন, জামাল ভাই, মুক্তা আগেও আমাদের কয়েকটা বিজ্ঞাপনে কাজ করেছে, অন্য প্রডিউসারের একটা প্যাকেজ নাটকে কাজ করছে। আর মেঘনা এবং চৈতী নতুন কিন্তু আমার বিশ্বাস ওরা ভালো করবে।

সুমন সাহেব জামালকে প্রডিউসার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর থেকে মুক্তা বার বার করে জামালের দিকে তাকিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। হয়ত কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল। এবার সুযোগ বুঝে বলল, কবে থেকে কাজ শুরু করবেন স্যার?

সুমন সাহেব বললেন, স্ক্রিপ লিখার কাজ শেষের দিকে, এখন নায়ক-নায়িকা সিলেকশনের কাজ চলছে। তারপরই অন্যান্য কাজ শুরু হবে।

মুক্তা একটা ঢোক গিলল।

চৈতী এবং মেঘনা জামালের দিকে তাকাল। জামালের সঙ্গে চৈতীর দৃষ্টি বিনিময় হলো। চৈতীর সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। তবে কি সুমন সাহেব এই জামাল সাহেবের কথাই বলছিলেন? এই জামাল সাহেবকেই কি তাকে ম্যানেজ করতে হবে?

নাস্তা এবং কফি চলে এলো। নাস্তা খেতে খেতে আরো অনেক কথা হলো। বলতে গেলে একটা সুন্দর আড্ডা হয়ে গেল। কথা প্রসঙ্গে মুক্তা জামালের কাছ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড চাইল।

জামাল মুক্তা, চৈতী এবং মেঘনাকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, আমি এক’শ পাঁচ নাম্বার রুমে আছি।

মুক্তা, চৈতী এবং মেঘনা জামালের মোবাইল নাম্বার মোবাইলে সেভ করে নিল।

সুমন সাহেব বললেন, আমাদের কাজটা একটা টিম ওয়ার্ক, এখানে সবাই মিলে মিশে কাজ করতে হয়। পরস্পরের মধ্যে কোন লজ্জা বা সঙ্কোচ থাকলে এ লাইনে সাকসেস হওয়া যায় না।

মুক্তা বলল, জি স্যার।

তাহলে তোমরা জামাল ভাই’র সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। আর জামাল ভাই আমি তিনজন নায়িকার সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করে দিলাম, এদের মধ্যে থেকে আগে নায়িকা সিলেকশনের চেষ্টা করুন তারপর না হয় বিকল্প ভাবা যাবে।

থ্যাঙ্ক ইউ সুমন সাহেব।

কফি খাওয়া শেষ করে সুমন সাহেব বললেন, তোমাদের আগামীকালের শুটিঙয়ের স্ক্রিপ দিয়েছে তো, না?

মুক্তা বলল, জি স্যার।

তাহলে তোমরা ভালোভাবে স্ক্রিপ মুখস্থ কর। নিজে নিজে প্র্যাকটিস করো। যে কোন মূল্যে বিজ্ঞাপন-এর মান ভালো করতে হবে। আর জামাল ভাই’র ব্যাপারটা তোমাদের নিজেদের ওপর নির্ভর করবে, তোমাদের বচন ভঙ্গী, বুদ্ধিমত্তা এবং যোগ্যতায় যাকে তিনি লাইক করবেন সেই আগামী প্যাকেজের নায়িকা হবে।

মুক্তা একটা মুচকি হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ওকে তোমরা তাহলে এসো।

কটেজের সামনে একটা গোলাকার আকৃতির ছনের ছাতা। তার চারপাশে কয়েকটা চেয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে তিনজনে সেই ছাতার নীচে বসল। কথায় কথায় মুক্তা বলল তার এ লাইনে আসার কথা, আসলে কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়, বুঝলে? তবে প্রতিষ্ঠিত স্টার হতে চাইলে সেক্রিফাইজ করতে হয় একটু বেশি। ডিরেক্টর আর প্রডিউসারদের সঙ্গে স্প্যাশাল রিলেশন না থাকলে কাজ পাওয়া কঠিন। আর কাজ না পেলে নিজের ক্যারিয়ার গড়বে কী করে? তোমরা নতুন তাই হয়ত আমার কথাগুলো তোমাদের ভালো নাও লাগতে পারে।

চৈতী বলল, না আপা আসলে আপনি তো আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন। আমাদের ভালো লাগা না লাগার কথা না।

মেঘনা কিছু বলল না।

কথা বলতে বলতে মুক্তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

মুক্তা মোবাইল রিসিভ করে বলল, ভাইয়া, আমি আসছি।

চৈতী এবং মেঘনা মুক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

চৈতী, মেঘনা তোমরা গল্প করো, ফারুক ভাই আমাকে ডাকছেন, বলে মুক্তা চলে গেল।

মেঘনা আর চৈতী মুক্তার দিকে তাকিয়ে রইল।

চৈতী আর মেঘনা বসে গল্প করছিল। তাদের সঙ্গে যে দু’জন মডেল তারকা এসেছে তারা গেট দিয়ে বের হলো। তারা বের হওয়ার সময় বার বার করে পিছনের দিকে তাকাচ্ছিল।

মেঘনা চৈতীকে জিজ্ঞেস করল, আপা যাবেন?

চৈতী চিন্তা করে দেখল। জামাল সাহেব এবং সুমন সাহেব এখনো তাঁদের রুমে আছে তাঁরা বের হয়ে যাবার সময় সে একবার সুমন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে, এই সুমন সাহেবই এখন তার স্বপ্ন পূরণের একমাত্র চাবিকাঠি। কাজেই এ্যানি হাউ সুমন সাহেবকে তার ম্যানেজ করতে হবে।

চৈতী বলল, তুমি যেতে চাইলে যাও, আমি যাবো না।

মেঘনা বলল, থাক তাহলে আমিও যাবো না।

মুক্তা ফারুক সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মেঘনাকে বলল, মেঘনা ফারুক ভাই তোমাকে ডাকছে।

মেঘনা চলে গেল।

ফারুক সাহেব একাই রুমে বসে ছিলেন।

মেঘনা রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেল। একাই কোন পুরুষ মানুষের রুমে ঢুকতে গিয়ে মুক্তার পা দু’টা যেন শিথিল হয়ে গেল। বুক কেঁপে উঠল। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ফারুক সাহেব বলল, কেউ বন্ধ করে দেয়নি, এখানকার দরজাগুলোতে ডোর ক্লোজার লাগানো আছে, এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়।

মেঘনা একটা ঢোক গিলে বলল, ও তাই!

মুক্তা আর চৈতী দু’জনে বসে গল্প করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পাশাপাশি দু’টো রুম থেকে সুমন সাহেব এবং জামাল  বের হলো।

মেঘনা চেয়ার ছেড়ে উঠল।

চৈতী জিজ্ঞেস করল, উঠলেন কেন আপা?

স্যাররা গেটের দিকে যাচ্ছেন, একবার গেটের দিকে যাই, যদি কিছু বলেন?

চৈতীও মুক্তার সঙ্গে গেটের কাছে গেল। সুমন সাহেব তাদের দু’জনকে দেখে বললেন, তোমরা বের হওনি?

কেউ কিছু বলল না।

চৈতী জামালের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। চৈতী কিছু বলতে গিয়েও যেন থমকে গেল। চৈতীর দৃষ্টি যেন বলছে, একবার বললেই তো আমি আপনার সঙ্গে বের হই।

জামাল কিছু বলল না।

সুমন সাহেব বললেন, তোমরা বাইরে যাবে?

মুক্তা বলল, জি স্যার।

ততক্ষণে সূর্য বৃক্ষের আড়ালে যেতে চলেছে। বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে আলোক রশ্মি ছিটকে পড়ছে। দূর থেকে বিভিন্ন রকমের পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে। সবাই পুকুরের দিকে যাচ্ছিল চৈতী ইচ্ছা করেই একা হয়ে যাচ্ছিল, সে জামালকে আলাদা করার জন্য কৌশল খুঁজছিল। সে কিছুদূর বনের দিকে যাবার পর সুমন সাহেব আর মুক্তা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দিকে যাচ্ছে জামাল কিছুটা পিছিয়েছে।

জামাল চৈতীকে জিজ্ঞেস করল, চৈতী তুমি কি ঐ বনের দিকে যেতে চাচ্ছ?

জি স্যার, আসুন না প্লিজ।

জামাল এগিয়ে গেল। দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছে, বনের কাছাকাছি গিয়ে জামাল চৈতীর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল। চৈতী বাধা দিল না।

খানিকটা যাবার পর চৈতী আরো জামালের গা ঘেঁষে চলতে শুরু করল।

বনের কাছে সামনে একটা খোলা মাঠ। সেখানে তরুণ-তরুণীদের ভিড়, সবাই মুখোমুখি বসে আড্ডা দিচ্ছিল। জামাল আর চৈতী পাশাপাশি বসল। সবাই তরুণ-তরুণী জামালের নিজেকে বেমানান মনে হলো, তার নিজেকে এই পরিবেশের জন্য অনুপযোগী বলে মনে হলো। কিন্তু চৈতী যেন তার বয়সটাকে হঠাৎ কমিয়ে দিল। সে জামালের গা ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনি কি আন ইজি ফিল করছেন?

জামাল বলল, না তো?

তবে এমন করছেন কেন?

জামাল চৈতীর কাঁধে একটা হাত দিয়ে বলল, আচ্ছা চৈতী তুমি আর আমাকে স্যার বলে ডাকবে না।

তবে কী বলে ডাকবো?

ভাই বলে ডাকবে, জামাল ভাই বলে।

এমন সময় চৈতীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

চৈতী মোবাইল নিয়ে একটু দূরে গিয়ে মোবাইল রিসিভ করে আবার ফিরে এলো।

জামাল জিজ্ঞেস করল, কার ফোন? বয় ফ্রেন্ডের?

না ভাই, আমার কোন বয় ফ্রেন্ড নেই, আমার এখন একটাই স্বপ্ন মডেল তারকা হওয়া, প্যাকেজ নাটকে অভিনয় করা, একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হওয়া। এছাড়া আমার আর কোন বন্ধু নেই বলতে বলতে চৈতী কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল।

জামাল চৈতীর থুতনিতে হাত দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তার চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসলো।

চৈতী জিজ্ঞেস করল, কী দেখলেন?

দেখলাম তুমি পারবে কি না?

আমি কি পারবো?

তোমার মনে বল আছে, চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে।

ততক্ষণে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই চলে গেছে, চারিদিকে আবছা আবছা অন্ধকার নেমেছে, জামাল উঠার চেষ্টা করল।

চৈতী বলল, বসুন না আর কিছুক্ষণ, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

জামাল মনে মনে বলল, এত সহজে সব কথা শুনলে তো হবে না। সেজন্য তোমাকে অনেক সময় দিতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

চৈতী কিছু বলল না।

জামাল বলল, চৈতী সন্ধ্যা নেমেছে, আশে-পাশে তাকিয়ে দেখ অনেকেই চলে গেছে, যারা আছে তারাও চলে যাচ্ছে। চলো আমরাও যাই।

কিন্তু আপনার সঙ্গে তো আমার কোন কথাই হলো না।

কথা হওয়ার সময় তো আর চলে গেল না।

কখন? কোথায়?

রুমে এসো।

নিরানব্বই

সন্ধ্যায় ফারুক সাহেব সবাইকে তার রুমে ডাকলেন। তার রুমটা বেশ বড়, রুমে কয়েকটা সোফা আছে, সেখানে পাশাপাশি সবাই বসেছে। ফারুক সাহেব সবার হাতে একটা একটা করে স্ক্রিপ দিয়ে বললেন, পড়ে দেখো।

সবাই ফিসফিস করে পড়তে লাগল।

কয়েক মিনিট পর ফারুক সাহেব নাম ধরে ডাকলেন, মুক্তা আর শুভ দাঁড়াও।

মুক্তা আর শুভ দাঁড়ালো।

ফারুক সাহেব বললেন, মুক্তা আর শুভ তোমরা একসঙ্গে কাজ করবে। আজ স্ক্রিপটা মুখস্থ করবে নিজে নিজে প্র্যাকটিস করবে কাল বিকেলে শুটিং হবে।

আকাশ, চৈতী আর মেঘনা তোমাদের একই স্ক্রিপ দেওয়া হয়েছে, তোমরা তো নতুন তোমরা আরো ভালোভাবে স্ক্রিপ মুখস্থ করবে নিজে নিজে বার বার প্র্যাকটিস করবে।

চৈতী লক্ষ্য করেছে ফারুক সাহেব বার বার করে মুক্তার দিকে মুখ করে কথা বলছে, তার চোখে চোখ রাখছে। মুক্তা ফারুক সাহেবের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে তুলেছে। তার বিশেষ সম্পর্ক তাহলে ফারুক সাহেবের সঙ্গে। মুক্তা বিকেলবেলা কথা প্রসঙ্গে একবার বলেছে এই কোম্পানিতে ফারুক সাহেবই সবকিছু করে থাকেন এম.ডি স্যারের আরো অনেক ব্যবসা আছে। তিনি এ্যাডফার্মের সবকিছুতেই ফারুক সাহেবের ওপরই নির্ভর করেন। আজ প্রডিউসার জামাল সাহেব এসেছেন বলে তিনিও এসেছেন। তাই সে এই সুযোগটাই নিয়েছে, তবে আমিই বা কম কীসে? আমিও প্রডিউসারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলবো। তবে আমার পলিসিতে ভুল হচ্ছে না তো? না না শুধু প্রডিউসারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুললে হবে না। ডিরেক্টরের সঙ্গে স্প্যাশাল রিলেশন থাকা প্রয়োজন।

সবাই ফারুক সাহেবের রুম থেকে বের হলো। চৈতী তার রুমে কয়েক মিনিট থাকার পর ফারুক সাহেবকে মোবাইল করল, ভাইয়া আপনি কি ফ্রি আছেন?

কেন?

আমি একবার আপনার সঙ্গে দেখা করব।

বেশ তো চলে এসো।

ফারুক সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই চৈতী যেন কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল। কী বলবে ফারুক সাহেবকে? যদি তার রুমে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে। আবার মনে হলো ফারুক সাহেব ডিরেক্টর তার কাছে একজন মডেল তারকা শুটিং বিষয়ে কথা বলতে যাওয়াটা তো দোষের কিছু না।

চৈতীকে দেখে ফারুক সাহেব মুচকি হেসে বললেন, বসো।

চৈতী সোফায় বসল।

ফারুক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এ লাইনে কেমন লাগছে তোমার?

ভাইয়া এ লাইনে আর ঢুকতে পারলাম কই?

ঢুকতে পারোনি মানে? শুটিং করতে এসেছ তারপরও বলছ এ লাইনে ঢুকতে পারোনি?

থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি এ লাইনে ঢুকে পড়েছি, আমার নিজেকে একজন স্টার মনে হচ্ছে।

অফ কোর্স, তুমি তো স্টার, নিজেকে ছোট ভাবার কোন কারণ নেই। তুমি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করছ, আমাদের কোম্পানি কিন্তু ছোট না, আমার বস, মানে সুমন স্যার একজন সফল মানুষ। তুমি তাঁর কোম্পানিতে কাজ করছ। আমাদের কোম্পানিতে কাজ করে অনেক শিল্পী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তুমি ট্যালেন্ট মেয়ে তুমিও একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।

ফারুক সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে চৈতী একবার মুক্তার রুমে উঁকি মেরে দেখল। দরজা লক করা নেই অথচ মুক্তা রুমে নেই, চৈতী মুক্তার রুমে ঢুকে কয়েকবার মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, আপা।

কোন সাড়া নেই। চৈতী টয়লেটের দরজায় দেখল। টয়লেটে নেই। চৈতীর সন্দেহ হলো, মুক্তা জামাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি তো। সে জামাল সাহেবের রুমের দরজার দিকে কান রেখে সতর্কতার সঙ্গে বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেল। জামাল সাহেবের রুম থেকে ফিসফিস কথা বলার শব্দ ভেসে এলো।

চৈতীর ধারণাই ঠিক। তার বুকটা ধক করে উঠল। কিন্তু তার মনটা এমন করে উঠল কেন? সুমন সাহেব তো চৈতীর এমন কেউ নয় যে তার সঙ্গে মুক্তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠলে তাকে খারাপ লাগবে। চৈতী বারান্দায় পায়চারী করতে লাগল।

অনেকক্ষণ পর মুক্তা তার এলোমেলো চুলগুলো গুছাতে গুছাতে জামালের রুম থেকে হাসতে হাসতে বের হলো। চৈতী মুক্তার সঙ্গে সঙ্গে তার রুমে ঢুকল।

চৈতীকে তার রুমে ঢুকতে দেখে মুক্তা জিজ্ঞেস করল, চৈতী কী খবর?

আপা আপনাকে খুঁজছিলাম।

কেন?

কথা বলার কেউ নেই তো তাই খুব বোর ফিল করছিলাম।

আমি একবার তোমাকে ডাকতে চাইলাম। ভাবলাম তুমি আবার কী মনে করো? তাই জামাল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, খুব রোমান্টিক মানুষ।

চৈতীর সমস্ত শরীর যেন জ্বালা করে উঠল। সে মনে মনে বলল, ও আপনি তাহলে স্প্যাশাল রিলেশন গড়তে, সেক্রিফাইজ করতে গেছিলেন?

চৈতী কিছু বলবে? আমি আবার ফারুক ভাই’র সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

না কিছু বলব না আপা, আমি আসি, বলে চৈতী তার রুমে ঢুকল।

মুক্তা জামালের রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই মমতাজ জামালের রুমে ঢুকল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, তুমি?

স্যার আমার নাম মমতাজ।

কী মনে করে আমার রুমে?

স্যার আমি অনেকদিন থেকে এ লাইনে কাজ করি।

এখন?

এখন সরাসরি কাজ করি না তবে এখন এনার্জির যোগান দিই।

তারমানে!

মানে এনার্জি টেবলেট বিক্রি করি।

কী টেবলেট? দেখি?

মমতাজ একটা টেবলেট বের করে দেখালো, স্যার আপনি একটা খান, সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে, এনার্জি পাবেন, ভালভাবে এনজয় করতে পারবেন, বলে মমতাজ চোখ টিপল।

কী নাম এই টেবলেটের?

আমরা স্যার এ লাইনে এটাকে এনার্জি টেবলেট বলি, আসল নাম ইয়াবা।

জামাল একটা টেবলেট হাতে নিয়ে বলল, দাম কত?

বেশি না স্যার, এক হাজার টাকা।

খেয়ে মরে যাবো না তো?

আমি আপনাদের সঙ্গেই এসেছি স্যার, এই কোম্পানির সঙ্গে অনেকদিন থেকে কাজ করছি, আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।

জামাল একটা টেবলেট হাতে নিয়ে বলল, খেয়ে ফেলব?

কোন সমস্যা নেই স্যার।

জামাল টেবলেটটা খেয়ে ফেলল আর একটা টেবলেট নিয়ে তার টেবিলের ওপর রাখল। তারপর দু’হাজার টাকা দিয়ে মমতাজকে দিয়ে বলল, আবার প্রয়োজন হলে তোমাকে পাবো কীভাবে?

মমতাজ জামালের হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল, এটা আমার কার্ড স্যার, কখনো দরকার হলে ডাকবেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে যেন জামালের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হলো। তার সমস্ত শরীর শিহরিত হলো। জামাল কার কাছে বলবে এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা তা ভাবছিল।

কী করবে চৈতী? সেক্রিফাইজ শব্দের অর্থ বুঝতে আর তার বাকী নেই। এভাবেই ডিরেক্টর আর প্রডিউসারের সঙ্গে স্প্যাশাল রিলেশন গড়ে তুলে মুক্তা একটা বিজ্ঞাপন আর একটা প্যাকেজ নাটকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।

চৈতী জামালের রুমের দরজা নক করল।

জামাল দরজা খুলে দিল, চৈতী এসো।

চৈতী সোফায় বসতে বসতে বলল, রুমে থেকে খুব বোর ফিল করছিলাম তাই মনে করলাম আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।

হ্যাঁ আমিও তোমাকে খুব ফিল করছিলাম।

চৈতী মনে মনে বলল, আমাকে ফিল করছিলেন নাকি মুক্তার সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটাচ্ছিলেন? ছেলেমানুষের জাতটাই এমন কারো জন্য এতটুকু অপেক্ষা করবে না আরেকজনকে ম্যানেজ করে নিবে। বিকেলেই কত অন্তরঙ্গ কথা অথচ সন্ধ্যায় তার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে আরেকজনের সঙ্গে আড্ডা।

জামাল চৈতীর গা ঘেঁষে বসল, চৈতী কী ভাবছ?

ভাবছি এ লাইনে আমি পারবো তো?

পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। ও হ্যাঁ তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে এই টেবলেটটা খেয়ে নাও তো।

চৈতী একটা ঢোক গিলে বলল, কীসের টেবলেট ভাইয়া?

এনার্জি টেবলেট, এটা খেলে তুমি এনার্জি পাবে, তোমার ক্লান্তি দূর হবে।

না ভাইয়া, থাক। আসলে আমি ক্লান্ত না।

জামাল বলল, কিন্তু তোমার মুখ দেখে তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি একটা খেয়েছি একবার আমার দিকে তাকাও, আমাকে বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে, না?

চৈতী অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

নাও, খাও, বলে জামাল টেবলেটটা চৈতীর দিকে বাড়িয়ে দিল।

চৈতী টেবলেটটা খেয়ে নিল। তারপর বলল, ভাইয়া আমি বলছিলাম আমি তো এ লাইনে নতুন, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমি টিকতে পারবো তো?

চৈতী আসলে চলার পথে কারো লিফট না পেলে একাই কিছু করা যায় না।

কিন্তু আমার তো তেমন কেউ নেই যে আমাকে লিফট দিবে?

চৈতী তুমি ট্যালেন্ট, স্মার্ট, সুন্দরী তরুণী। কারো কাছ থেকে লিফট ম্যানেজ করা তোমার জন্য কঠিন হবে না।

আপনি আমাকে লিফট দিবেন?

অবশ্যই, আমি তোমাকে লিফট দিবো, বলে জামাল চৈতীর কাঁধে হাত রাখল।

চৈতীর সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। সে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল। রাত দশটা বাজে, এত রাতে কোন রেস্ট হাউজে কোন এক অপরিচিত পুরুষের রুমে প্রবেশ করা কি তার ঠিক হয়েছে? তার বিবেক তাকে ধিক্কার দিল। সে একবার সিদ্ধান্ত নিল তার রুমে যাবে, এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোন মানে হয় না। আবার মনে হলো টি.ভি’র পর্দায় তার ছবি ভেসে উঠবে, দেশ-বিদেশে শুটিং করতে যাবে, ঢাকা শহরে তার বাড়ি হবে,  হবে। আজকের এই সামান্য ত্যাগ স্বীকার করে সে যদি একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হতে পারে তবে এই বন্ধ ঘরের ভিতর নিজেকে উজাড় করে দেওয়া আর বেশি কী?

চৈতী জামালের হাত সরিয়ে দিল না। জামাল আরো নিবিড়ভাবে চৈতীর গা ঘেঁষে বসল। তার থুতনি উঁচু করে ধরে চৈতীর চোখে চোখ রাখল, চৈতী তুমি খুব সুন্দর।

চৈতী কিছু বলল না।

জামাল বুঝতে পারল তার সমস্ত শরীরে ঔষধের একশন শুরু হয়েছে।

চৈতী জিজ্ঞেস করল, দরজা বন্ধ কেন ভাইয়া?

জামাল চৈতীর মুখে হাত দিল। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে না? নতুন এনার্জি পেয়েছ না? মনে হচ্ছে না কেমন রোমাঞ্চকর একটা নতুন অনুভূতি?

চৈতী অষ্ফুটস্বরে বলল, আমার খুব ভয় করছে, কেউ দেখে ফেলবে না তো?

কেউ দেখলেও কিছু বলবে না, কিছুক্ষণ আগে মুক্তা আমার রুমে এসেছিল এতক্ষণে সেও হয়ত তোমার ডিরেক্টরের রুমে চলে গেছে। মুক্তা খুব চালাক মেয়ে কীভাবে সবাইকে ম্যানেজ করতে হয় তা সে খুব ভালোভাবে জানে। এ লাইনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে তোমাকে প্রতিদিন অসংখ্য মুক্তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজের জায়গা করে নিতে হবে। প্রয়োজনে অনেক সেক্রিফাইজ করতে হবে।

চৈতী কিছু বলল না।

এক’শ

নাস্তার টেবিলে আবার সবাই একত্রিত হলো। ফারুক সাহেব নাস্তার পর সবাইকে তার রুমে ডাক দিয়ে তাদেরকে দেয়া স্ক্রিপ মুখস্থ হয়েছে কি না এবং তাদের প্র্যাকটিসের খোঁজখবর নিলেন। তারপর তিনি আবার বিকেলে শুটিঙয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।

ফারুক সাহেব মেঘনাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর মেঘনা? তোমার মুড অফ কেন?

মেঘনা গতকাল ফারুক সাহেবের লোলুপ দৃষ্টি দেখেছে, চৈতী আর মুক্তার আচরণ আড়াল থেকে দেখেছে, তাতে অভিনয়ের প্রতি তার ঘৃণা জন্মেছে। ফলে এ লাইনে ঢুকার দীর্ঘদিনের স্বপ্নটা মন থেকে একেবারে মুছে গেছে। সে আপন মনে বলল, এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া?

ফারুক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ?

মেঘনা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না ভাইয়া, কিছু ভাবছি না, আমার মনে হচ্ছে আমি এ লাইনে কাজ করতে পারবো না।

ফারুক সাহেব আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

শুটিং শুরু হলো পড়ন্ত বিকেলে। তার আগে মেক আপ ম্যান মেক আপ করিয়ে দিল। চৈতী লক্ষ্য করল মেক আপ ম্যান মেক আপ করার সময় এক রকম ইচ্ছা করেই অপ্রয়োজন তার শরীর স্পর্শ করছে। চৈতী মুক্তাকে মেক আপ করার সময় দেখেছে তার প্রতিও মেক আপ ম্যান একই রকম আচরণ করেছে, মুক্তা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সে এসবে অভ্যস্ত তাই কিছু বলেনি, যেন এই অত্যাচারটুকু সে মেনেই নিয়েছে।

চৈতীকে অভিনয় করতে হবে একটা ঢেউ টিনের বিজ্ঞাপনে। কয়েক মিনিট আগে মুক্তা আর শুভ’র অভিনয় ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। তখন ফারুক সাহেব একবার কাজ শুরু করার নিয়ম বলে দিয়েছেন। চৈতীকে তেরি হওয়ার কথা বলে আবারো বললেন, আমি একশন বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা শুরু করবে।

রেডি থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো, একশন।

চৈতী একটা প্রিন্টের  পরেছে, নাকে নোলক, পায়ে নূপুর। তাকে মানিয়েছে ভালো একেবারে যেন একেবারে গ্রাম্য গৃহবধূ। আর সোহাগ পরেছে লুঙ্গি, কোমরে গামছা পেঁচিয়েছে, মাথায় একটা মাথাল। সেও যেন সেজেছে একেবারে গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষক।

সোহাগ চৈতীর একটা হাত টেনে ধরে বলল, রাগ করো না সোনার চাঁদ, তোমায় ভালোবাসি,

                                                                                 তোমার জন্য হাসতে হাসতে গলায় দিবো ফাঁসি।

চৈতী তার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,

 আমার জন্য তোমায় কেন দিতে হবে ফাঁসি?

 লাঙ্গল মার্কা ঢেউটিন আনো দেখবে যদি হাসি।

সোহাগ চৈতীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও তাই-

চৈতী সোহাগের বুকে মাথা রেখে বলল, হ্যাঁ গো, হ্যাঁ।

সবাই হাত তালি দিল।

শুটিং শেষ হলো। সবাই রেস্ট হাউজে ফিরল। চৈতী জামালের রুমে ঢুকল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে এখন?

জি ভালো। আমার খুব ভালো লাগছে, আমার ছবি টি.ভি’র পর্দায় ভাসবে, দিন রাত আমার কাছে অভিনয় করার জন্য অফার আসবে। দেশ-বিদেশে শুটিং করতে যাবো, ঢাকা শহরে আমার  হবে, বাড়ি হবে, আমি একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হবো। সারা দেশের মানুষ জানবে চৈতী নামে একজন স্টার আছে। আর বাকী থাকল প্যাকেজ নাটক। জামাল চৈতীর কাঁধে হাত দিয়ে তার চোখে চোখ রাখল।

চৈতী জিজ্ঞেস করল, আমি আপনার প্যাকেজ নাটকে নায়িকা হিসেবে সিলেক্ট হচ্ছি তো?

জামাল বলল, আজ তো তোমাদের শুধু শুটিং হলো, এরপর ক্যামেরায় এডিটিং হবে, তারপর টি.ভি চ্যানেলে যাবে। তবে তুমি নতুন হিসেবে খুব ভালো করেছ?

আমি নতুন হিসেবে ভালো করেছি, তারমানে আসলে ভালো করিনি।

জামাল মুচকি হেসে বলল, তুমি ভালো করেছ এটা তো ঠিক কিন্তু সবার ক্যামেরা ফেস তো এক না, সেটা বোঝা যাবে চ্যানেলে দেখার পর।

তারমানে আমি আপনার প্যাকেজ নাটকের জন্য এখনো সিলেক্ট হইনি? ছাড়ুন আমাকে, বলে চৈতী নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।

জামাল চৈতীর হাত টেনে ধরে বলল, চৈতী রাগ করো না প্লিজ, তোমার মতো মেয়ের রাগ করা মানায় না, একটু বসো।

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে চৈতী তার হোস্টেলে ফিরে সে শারমিনকে বুকে জড়িয়ে ধরল, শারমিন আই এ্যাম সাকসেস, শুটিং শেষ হয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে আমার অভিনীত বিজ্ঞাপন টি.ভি’র পর্দায় ভেসে উঠবে।

তাহলে তো তুই স্টার হয়ে গেলি?

আর শোন আমার এক প্রডিউসারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।

তাই নাকি?

তিনি কয়েকদিন পরেই একটা প্যাকেজ নাটকের কাজ শুরু করবেন। আমাকে খুব পছন্দ করেছেন, বলেই চৈতী থমকে গেল। না মানে তিনি আমাকে নাটকের নায়িকা বানাবেন বলে এক রকম কথা দিয়েছেন।

শারমিন চৈতীকে ছেড়ে দিয়ে তার চেয়ারে বসে বলল, তুই তো তাহলে স্টার হয়ে গেলি?

আমি তোকে জামাল ভাইয়া, সুমন ভাইয়া, ফারুক ভাইয়া সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিতে পারি, জামাল ভাইয়া চাইলে তুইও প্যাকেজ নাটকে অভিনয় করতে পারবি।

শারমিন বলল, ও এত তাড়াতাড়ি এতগুলো ভাইয়া জোগাড় করে ফেলেছিস?

চৈতী কিছু বলল না।

কী রে কথা বলছিস না কেন?

আমি অভিনয় করতে পারবো না রে, ফ্যামিলি পারমিট করবে না।

পার্টি অফিস এখন জমজমাট। আর প্রায় দু’বছরেরও কম সময় পর নির্বাচন। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। জামাল পার্টি অফিসে ঢুকে প্রথমে মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে দেখা করল, এসো ইয়ং লিডার। সুমন আমাকে সব বলেছে ওর কাজটা তুমি করে দিয়েছ, থ্যাঙ্কস এ লট।

জামাল মনে মনে চিন্তা করল। মোজাফফর ভাই তো সুমন সাহেবের খুব কাছের মানুষ, প্রায় সব কথাই বলে। জামাল জিজ্ঞেস করল, বড়ভাই আর কী কী বলেছে?

না আর কিছু বলেনি, তোমার খুব প্রশংসা করেছে। যাক কী মনে করে এসেছ? বল তোমার জন্য কী করতে পারি?

বড়ভাই আগামী মাসের একুশ তারিখে আমাদের কর্মী সম্মেলন। আপনি যদি সময় করে আসতেন, বিশেষ অতিথি হিসাবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব আশা করছি। আপনি আমার পপুলারটিও দেখে আসতেন।

তাই নাকি?

জি বড়ভাই, আসলে লোকাল পলিটিক্স তো আমিই করি, আমি সেটাই একবার আপনাকে দেখাতে চাচ্ছিলাম।

আগামী মাসের একুশ তারিখ, না?

জি ভাই।

মোজাফফর সাহেব ডায়েরির পাতা উল্টালেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে আমি আসবো।

থ্যাঙ্ক ইউ বড়ভাই।

মোজাফফর সাহেব কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন।

জামাল জিজ্ঞেস করল, বড়ভাইকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, কোন সমস্যা?

না আমার হয়েছে এক জ্বালা, এখনো নির্বাচনের অনেকদিন বাকী আছে অথচ এখন থেকেই নির্বাচনে নমিনেশনের জন্য তদবির শুরু হয়ে গেছে। একই আসনে দু’জন তিনজন করে ক্যান্ডিডেট। আমরা কাকে নোমিনেশন দিই বলো? যাকে দিবো না সেই অসন্তুষ্ট, তখন দলে দেখা দিবে কোন্দল।

জামাল সুযোগটা হাতছাড়া করল না। সে বলল, বড়ভাই আপনি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

বলো।

দলের কিছু কিছু আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য কেন্দ্র দায়ী।

কীভাবে?

                বড়ভাই সাধারণত বেশিরভাগ কোন্দল দেখা যায় নমিনেশনের সময়। সেজন্য নির্বাচনের সময় যখন দলের একাত্মতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন দলে আভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়। স্থানীয় রাজনীতিতে যারা বেশি দায়িত্ব পালন করে, রুট লেভেলে দলকে নেতৃত্ব দেয় তাদেরকে নোমিনেশন দিতে হবে, নমিনেশনে জেলা কমিটির মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা কাউকে নোমিনেশন দেয়া যাবে না। অনেক এম. পি. কে দেখা যায় সারাবছর সংসদীয় এলাকায় যান না তাদেরকে নোমিনেশন দেয়া হয় আবার সারাজীবনে কোনদিন রাজনীতি করেনি এমন কোন আমলা, ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবীকে কেন্দ্র থেকে নোমিনেশন দেয়া হয়, যার ফলে দলের রুট লেভেলের নেতা কর্মীরা এমনকি সাধারণ ভোটাররাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।

এতক্ষণ মোজাফফর সাহেব জামালের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার বললেন, জামাল একজন তরুণ নেতা হিসেবে আমি তোমার নাম শুনেছিলাম আজ তোমার কথা শুনলাম তুমি অনেককিছু নিয়ে চিন্তা করো। তোমার যুক্তি ছোট করে দেখার উপায় নেই। লিডার বলো, তোমার আরো কোন সুপারিশ থাকলে বলো? আগামী ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আলোচ্য সূচীতে রাখবো।

বড়ভাই আমি তো বললাম আমার মনে হয় এবার নির্বাচনে নোমিনেশন দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উচিৎ জেলা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করা, কাউকে নোমিনেশন দিয়ে তার জন্য কাজ করতে রুট লেভেলের কর্মীদের বাধ্য করা ঠিক হবে না। বার বার একই ব্যক্তিকে নোমিনেশন দিলে দলে নতুন নেতৃত্ব তেরি হবে না। তাই দলের ভবিষ্যৎ ভিত্তি মজবুত করার জন্য নতুন নেতৃত্বকে উৎসাহিত করতে হবে।

জামাল তুমি একজন জেলা কমিটির জেনারেল  সেক্রেটারি, তোমার মতামতের মূল্য অনেক। তোমার মতো যদি বেশিরভাগ জেলা থেকে এমন প্রস্তাব আসতো তবে তা কেন্দ্রীয় কমিটির আলোচনায় আরো বেশি গুরুত্ব পেত। আর আমি তো একাই সবকিছু না তবুও তুমি যোগাযোগ রাখলে তোমার জেলার আসনগুলোতে নোমিনেশন দেওয়ার আগে আমি তোমার সঙ্গে শেয়ার করব।

থ্যাঙ্ক ইউ বড়ভাই। আমি কিন্তু নমিনেশনের আগে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

ইয়েস ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম ইয়ং লিডার।

এক’শ এক

ইউনিয়ন এবং থানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে টাউন হল-এ কর্মী সম্মেলন চলছে। সভায় ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে থেকে একে একে অনেকেই বক্তৃতা দিচ্ছেন। ইউনিয়ন কমিটির একজন সভাপতির বক্তৃতা চলছে। তিনি একে একে তাঁর ইউনিয়নের নেতাদের ব্যক্তিগত সমস্যাদি তুলে ধরছেন এবং মাননীয় মন্ত্রী প্রতিশ্রুত এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এবং বাস্তবায়িত কাজের জন্য মাননীয় মন্ত্রীর প্রশংসা করছেন, মাননীয় মন্ত্রী আমাদের ইউনিয়নে অবস্থিত একমাত্র কলেজটা আপনি এম. পি. ও ভুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন, সেজন্য আমাদের সকলের পক্ষ থেকে আপনাকে আমাদের সাধুবাদ জানাই। আর আমাদের কলেজ এম. পি. ও ভুক্তির জন্য জামাল ভাই’র সহযোগিতার জন্য তাঁকে আমাদের পক্ষ থেকে জানাই ধন্যবাদ। শুধু তাই নয়, আমাদের যে কোন কাজে জামাল ভাইকে আমরা আমাদের কাছে পাই, তিনি আমাদের যে কোন বিপদকে নিজের বিপদ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। মাননীয় মন্ত্রী আপনি নির্বাচনের আগে আমাদের এলাকায় ক্যানভাস করতে গিয়ে বলেছিলেন হাট থেকে স্কুল পর্যন্ত রাস্তাটা পাকা করার ব্যবস্থা করবেন, আমাদের স্কুলটা আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে স্থাপিত হয়েছে কিন্তু অদ্যাবধি কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের স্কুলের অনেক পরে স্থাপিত এবং আমাদের স্কুলের চেয়ে রেজাল্ট অনেক খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাদের স্কুলে আপনি একাডেমিক ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু আপনি আমাদের স্কুলের একটা একাডেমিক ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করেননি। মাননীয় মন্ত্রী আপনি জানেন আমাদের ইউনিয়ন বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে প্রভাব বিস্তার করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন, আমাদের ইউনিয়নে আরো উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করে আমাদের দল সম্পর্কে জনগণের ভ্রান্ত ধারণার অবসান করা দরকার। মাননীয় মন্ত্রী আমরা আমাদের এলাকার সমস্যাদি উল্লেখ করে তা জামাল ভাইকে এবং আপনার এ.পি.এস এর কাছে দিয়েছি আশা করি আপনি আমাদের এলাকার সমস্যাগুলো সমাধানের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমার বক্তৃতা শেষ করছি।

বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাততালি দিল।

ইউনিয়ন কমিটির নেতা-কর্মীদের বক্তৃতা শেষে জামাল বক্তৃতা দিতে শুরু করল, আজকের অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি  বেলায়েত ভাই, প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী এবং কেন্দ্র থেকে আগত সম্মানিত বিশেষ অতিথি মোজাফফর ভাই, উপস্থিত ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের নেতা-কর্মী ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুয়ালায়কুম। মাননীয় মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের সহ-সভাপতি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মোজাফফর ভাই তাঁদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাদের আজকের সভায় যোগদান করেছেন বলে আমি প্রথমেই মাননীয় মন্ত্রী এবং মোজাফফর ভাইকে দলের সমস্ত নেতা-কর্মীর পক্ষ থেকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের দল ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় তিন বৎসর পেরিয়ে গেল। এই তিন বৎসরে মাননীয় মন্ত্রী আমাদের এলাকার উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, নিজের কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে এলাকার জনগণের মুখের দিকে তাকিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। তাই এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের দলের পক্ষ থেকে মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। মাননীয় মন্ত্রী এই কঞ্চবছরে এলাকার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করেছেন, নির্বাচনে মাননীয় মন্ত্রী যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার বেশির ভাগই ইতোমধ্যে পূরণ করেছেন। জনগণ এলাকার উন্নয়নের সুফল পেতে শুরু করেছে। এলাকার বিপুল সংখ্যক বেকার ছেলেমেয়েকে চাকরি দিয়েছেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মসজিদ, মন্দির, গির্জার উন্নয়ন করেছেন। গত তিন বছরে আমাদের দলের অর্জন অনেক, আমাদের এলাকার উন্নয়নও হয়েছে অনেক কিন্তু তারপরও আমাদের অনেক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি ফলে এলাকায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় আমাদের অনেক সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রী ঢাকায় থাকেন তাঁর পক্ষ হয়ে আমি স্থানীয় রাজনীতি দেখাশুনা করি, নেতা-কর্মীরা সবাই প্রথমেই যে কোন কাজে আমার কাছে আসে আর সে কারণেই দলের ব্যর্থতা বা দলের অপারগতার জন্য প্রথমে আমাকেই কথা শুনতে হয়। আমাদের সংগঠনকে আরো অধিকতর জোরদার করার জন্য আমি কয়েকমাস আগে মাননীয় মন্ত্রীর কাছ থেকে এমন একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করার অনুমতি চেয়েছিলাম, মাননীয় মন্ত্রী আমাকে অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু তারপর আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে আমি অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, অনেকের কাছে দলের কাজের জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী সম্প্রতি আমি জেলার সমস্ত ইউনিয়ন ঘুরে আমাদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন এলাকার সমস্যাগুলো এবং আমাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো সংগ্রহ করেছি যা আমি এখন পড়ে শোনাচ্ছি বলে জামাল তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়তে লাগল, পড়া শেষ করে তারপর আবার বলতে শুরু করল। মাননীয় মন্ত্রী ছাড়াও আজকে আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের সহ-সভাপতি মোজাফফর ভাই। আমি পরম শ্রদ্ধেয় মোজাফফর ভাই’র দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন ফলে তাঁর মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো আমরা সহজে পেয়ে থাকি কিন্তু অনেক কাজ আছে যেগুলো অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেসব ক্ষেত্রে মাননীয় মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রীরা মোস্তফা ভাই’র অনুরোধ রাখেন না। কিন্তু আপনি কেন্দ্রীয় নেতা, অনেক মন্ত্রী আপনার চেয়ে জুনিয়র বলতে গেলে আপনার উপর নির্ভরশীল তাই আপনার কোন অনুরোধ না করতে পারবেন না। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমার এলাকার সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে যাবো। তাতে একদিকে যেমন মোস্তফা ভাইঞ্চর ওপর চাপ কমবে তেমনি এলাকার জনগণ আরো বেশি সুবিধা পাবে। আমি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকি তাই জনগণের প্রত্যেক বিষয়ে আমাকে খুব সুক্ষ্ণভাবে খেয়াল রাখতে হয়। আমি আশা করি জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এবং সরকারের সুবিধা জনগণের হাতের কাছে পৌঁছে দিতে মোজাফফর ভাই আমাকে এতটুকু সহযোগিতা করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।

জামালের বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্লোগান এবং হাততালি শুরু হলো, জামাল ভাই দীর্ঘজীবী হোক, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক পার্টির জয় হোক ।

জামাল পড়া শেষ করে তার হাতের কাগজটা মাননীয় মন্ত্রীকে দিল। মাননীয় মন্ত্রী কাগজটা নিয়ে পিছনের চেয়ারে বসে থাকা আশরাফ সাহেবকে দিলেন।

জামাল বক্তৃতা শেষ করে চেয়ারে বসল। তারপর মোজাফফর সাহেব বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় মন্ত্রী, জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি, তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল নেতা জামাল, সভায় উপস্থিত নেতা-কর্মীগণ আস্‌সালামুয়ালাকুম। আজ আপনাদের মাঝে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আমি বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় বিভিন্ন সভা সমাবেশে যোগদান করেছি কিন্তু আজকের এমন সুশৃঙ্খল এবং শতভাগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি আমাকে অবাক করেছে। এমন অনুষ্ঠান দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরো জোরদার করবে। আমি ঢাকা গিয়ে অন্যান্য জেলাতেও এমন অনুষ্ঠান করে সংগঠনকে মজবুত করার আহবান জানাবো। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছ থেকে জামালের কথা শুনেছি, এখানে আসার আগে জামালের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে এবং কথা হয়েছে। তার কাছ থেকে আমি সব সময় এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনেছি। সে অতি অল্প বয়সে রাজনীতিতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। তার দক্ষতাকে আমি সম্মান করি। জামাল তার বক্তৃতায় এলাকার এবং জনগণের উন্নয়নের জন্য আমার কাছে আসার অনুমতি চেয়েছে। আমি জনপ্রতিনিধি আমার কাছে আপনাদের সবার জন্য দরজা খোলা আছে। যে কোন প্রয়োজনে আমার কাছে আসবেন অথবা জামালের মাধ্যমে আমার কাছে আসবেন আমি অবশ্যই আপনাদের সহযোগিতা করবো। আমি এখন থেকে মনে করবো আমার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে আমি এই জেলার জনগণের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমিও জড়িত হয়ে গেলাম।

এসময় সবাই হাততালি দিয়ে মোজাফফর সাহেবের বক্তৃতাকে স্বাগত জানালো।

মোজাফফর সাহেব আবার বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, আমি যতটুকু জানি আমরা ক্ষমতা গ্রহণের পর এই এলাকায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবুও অনেক প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে প্রতিশ্রুত কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য অনুরোধ করছি । এবিষয়ে আমার কিংবা দলের যে কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। পরিশেষে আপনাদের সবাইকে দলের প্রতি অনুগত থেকে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।

সবাই হাততালি দিল।

মোজাফফর সাহেবের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর মাননীয় মন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলেন, আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটির এবং থানা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সুধীবৃন্দ আস্‌সালামুয়ালায়কুম। আপনারা কষ্ট করে অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দলের কাজে, দলকে সংগঠিত করার জন্য এসেছেন সেজন্য প্রথমে আপনাদেরকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন কেন্দ্রীয় নেতা এবং আমাদের দলের সহ-সভাপতি মোজাফফর ভাই। তিনি আমাদের জেলার যে কোন কাজের বিষয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। সুধীবৃন্দ আপনারা সবাই জানেন আমাদের দল ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় তিন বৎসর অতিক্রান্ত হলো, এখন আমাদের গত তিন বৎসরের কাজকর্ম মূল্যায়নের সময় এসেছে যেন আমরা আমাদের ভুলগুলো চিহ্নিত করে আগামী দু’বৎসরের মধ্যে সংশোধন করতে পারি। সম্মানিত সুধীবৃন্দ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, আমাদের সম্পদের তুলনায় চাহিদা অনেক তাই অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হলেও অনেক প্রতিশ্রুতি আমরা এখনো পূরণ করতে পারিনি। আপনারা সবাই জানেন কাজ করতে গেলে সফলতা ব্যর্থতা দু’টাই থাকবে। তবে আমি একথা জোর গলায় বলতে পারি আমাদের ব্যর্থতার চেয়ে সফলতাই বেশি। তবে ব্যর্থতাও কম নয়। সম্মানিত সুধীবৃন্দ আপনারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এবং দলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে দেশ সেবার যে মহান সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাদের দেয়া মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকে বেশির ভাগ সময় আমাকে ঢাকায় থাকতে হয় এবং আমাদের তরুণ নেতা জামাল আপনাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করে থাকে। আপনারা জামালের মাধ্যমে যে সমস্ত কাজের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন আমি সেসব কাজ আমি তাৎক্ষণিকভাবে করে দিয়েছি এবং আপনারাও নিজেরা যে সমস্ত কাজ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন আমি সমস্ত কাজ করে দেয়ার সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি। আমার জানামতে আমি কাউকে বিমুখ করিনি। তারপরও এখনো যে সমস্ত কাজ করা সম্ভব হয়নি আপনারা সে সমস্ত কাজ জামালের মাধ্যমে কিংবা নিজেরা আমার কাছে নিয়ে আসবেন। আমি সুখ-দুঃখ সব সময় আপনাদের পাশে থাকবো।

এমন সময় নেতা-কর্মীরা হাত তালি দিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানালো।

মাননীয় মন্ত্রী আবার বলতে শুরু করলেন, শ্রদ্ধেয় নেতা-কর্মীবৃন্দ দেখতে দেখতে তিন বৎসর অতিক্রান্ত হলো, আর দু’বৎসর পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাই দলকে সংগঠিত করার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। আর এ কাজের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে আপনাদের পাশে থাকবে এ প্রজন্মের তরুণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল নেতা জামাল।

বেলায়েত সাহেব মুখ কালো করলেন, তিনি জামালের চালাকি এবং মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে জামালের সখ্যতা দেখে জামালের দুরভিসন্ধি তাঁর মনে সন্দেহ দেখা দিল, তিনি মনে মনে মাননীয় মন্ত্রীর ওপর কিছুটা বিরক্ত হলেন, মোস্তফা ভাই আপনি আসলে জামালকে বুঝতে ভুল করছেন। আজকের আপনার এই কথায় একদিন আপনার জন্য কাল হবে।

তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য আপনারা বিভিন্ন সভা সমিতিতে আমাদের বাস্তবায়িত উন্নয়নমূলক কাজসমূহের বিবরণ তুলে ধরবেন। জনগণের পাশে থেকে তাদেরকে সব রকম সহযোগিতা করবেন। যেন আগামী নির্বাচনে গিয়ে আমাদের যে কোন ধরণের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে না হয়। আপনাদের সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করছি।

মাননীয় মন্ত্রী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। জামাল একে একে সবাইকে বিদায় দিয়ে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকেল পাঁচটা বাজে। জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

এক’শ দুই

ঢাকা রওয়ানা দেওয়ার কয়েকদিন আগে জামাল তুলনামূলকভাবে তার প্রতি বেশি অনুগত দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে তার অফিসে বসল। উদ্দেশ্য দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে তার প্রতি অনুগত কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং কৌশলে মোস্তফা সাহেবের দোষগুলোকে তুলে ধরা। পাশাপাশি কয়েকটা চেয়ারে বসেছে শাকিল, ফরহাদ, করিম, কিবরিয়াসহ আরো অনেকে।

জামাল বলল, আজ আমরা অনেকে এখানে বসেছি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে, যদি তোমরা আমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দাও যে এখানকার কোন কথা এই রুমের চার দেওয়ালের বাইরে যাবে না, তবে আমি বলি?

সকলে সমস্বরে বলল, জি ভাইজান আপনি বলুন, আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি এক’শ পার্সেন্ট গোপন থাকবে।

তোমরা সবাই জানো তোমাদের সহযোগিতায় আমাদের পার্টির জেলা শাখার যাবতীয় কাজ-কর্ম একাই দেখা শুনা করি।

জি ভাইজান, শাকিল বলল।

আর এই ঘটনাটা এখন আর শুধুমাত্র আমাদের জেলার নেতা-কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, এখন কেন্দ্রের অনেক নেতাই জানেন এই জেলার সমস্ত কাজ-কর্ম আমিই পরিচালনা করি। মোস্তফা ভাইকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি কিন্তু দলের সব নেতা-কর্মীরা তা করে না। তাদের অভিযোগ মোস্তফা ভাই’র কাছে কোন কাজ নিয়ে গেলে তিনি বেশি করে আইন দেখান। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, অনিয়ম হবে, অডিট আপত্তি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই অনেক নেতা-কর্মীই এখন মোস্তফা ভাই’র বিকল্প চায়। তারা চায় এম. পি বা মন্ত্রীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা আরো কাছাকাছি হোক যেন আইন বা অনিয়মের দূরত্বটা একেবারে কমে যায়। এই যেমন আমরা ছোট ভাইদের জন্য যখন কোন কাজ করি তখন কি আমরা ভাবি কোনটা করা ঠিক হবে আর কোনটা করা বেআইনি হবে? এটা তো আত্মার সম্পর্ক এখানে আইন বাধা হবে কেন? ছোট ভাইদের জন্য এলাকার সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য যদি আইনটাকে একটু শিথিল করা যায় তবে ক্ষতি কি? তোমরা বলো?

ফরহাদ বলল, না ভাইজান, আপনি ঠিকই বলেছেন।

আর মোস্তফা ভাই’র সব কাজে বেলায়েত ভাই একটা বাধা, তিনি সব সময় মোস্তফা ভাইকে বিভ্রান্ত করেন। তিনি বয়সে সিনিয়র বলে সবসময় আমাদের উঠতি নেতা, উড়ে এসে জুড়ে বসা বলে খোঁটা দেন। বয়সটাই কি সব? তবে তো পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক লোকগুলোকে বড় বড় পদে বসানো হতো। তাই তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন আমাকে মোস্তফা ভাই’র বিকল্প হিসাবে দেখতে চায়।

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

জামাল বলতে শুরু করল, এটা শুধু এখানকার অবস্থা না, কেন্দ্রের অনেক বড় বড় নেতাও তাই চান। বুঝতে পাচ্ছ না। বড় নেতারাও তো মোস্তফা ভাই’র কাছ থেকে কোন সুবিধা পাচ্ছে না। তাই সবার উৎসাহ পেয়ে আমি আগামী নির্বাচনে নোমিনেশন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে চাচ্ছি।

সবাই সমস্বরে বলল, জি ভাইজান ঠিক আছে।

তাহলে তোমাদের কিছু দায়িত্ব নিতে হবে।

শাকিল বলল, আপনি বলুন ভাইজান আমরা যে কোন দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি।

এখন থেকে তোমরা কাজ শুরু করে দাও, এখনি সরাসরি আমাকে মোস্তফা ভাই’র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাঁড় করাবে না, এখন তোমরা যেটা করবে সেটা হলো কর্মীদের মাঝে তোমাদের গ্রহণযোগ্যতা তেরি করবে যেন নির্বাচনের সময় তারা তোমাদের অনুগত থাকে।

জি ভাইজান, শাকিল বলল।

এসব কাজে তোমাদের খুব কৌশলী হতে হবে, একাজে তোমরা আগে খুঁজে বের করো মোস্তফা ভাই’র কাছে কোন কাজে গিয়েছিল কিন্তু কোন সুফল পায়নি তাদের। তাহলে তারা তোমাদের জন্য হেল্পফুল হবে। আর কেউ কোন কাজের কথা বললে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তারপর আমি দেখব।

সবাই নীরবে জামালের কথা শুনছিল।

জামাল আবার বলতে শুরু করল, তাহলে এখন থেকে তোমরা কাজে লেগে যাও। একটা কথা মনে রেখো শুধু মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাই আমাকে নমিনেশনের জন্য উৎসাহিত করছে না, কেন্দ্রের কয়েকজন নেতাও তাই চাচ্ছে দেখলেই তো মোজাফফর ভাই’র মতো সিনিয়র নেতা শুধু আমার অনুরোধ রাখর জন্য এতদূর এসেছেন। তাহলে অনুমান করো, কেন্দ্রে আমার অবস্থানের কথা। ইমরান ভাইকেও আনতে চাইছিলাম কিন্তু মোজাফফর ভাই না এলে ইমরান ভাইকে নিয়ে আসতাম। আবার কোন অনুষ্ঠান হলে ইমরান ভাইকে নিয়ে আসবো।

ততক্ষণে চা-নাস্তা চলে এসেছে।

জামাল চা খেতে খেতে বলল, এখন থেকে তোমাদের কাজ হলো মাঠ পর্যায়ের কাজ দেখাশুনা করা আর আমাকে নমিনেশনের চেষ্টা করার জন্য বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতে হবে। আমি আজকেই ঢাকা যাচ্ছি, এদিকটা একটু তোমরা ম্যানেজ করো।

শাকিল বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাইজান।

সবাই শাকিলের কথায় সায় দিল।

পরদিন সন্ধ্যায় জামাল কী নিয়ে যেন গভীরভাবে চিন্তা করছিল। তার মোবাইলের রিং বাজছিল। জামাল মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল। বিপ্লবী মোবাইল করেছে। সে একরকম ইচ্ছা করেই মোবাইল রিসিভ করল না। কিন্তু বিপ্লবী বার বার করে রিং করতে থাকল।

অবশেষে জামাল মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো।

শোন তোমার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।

বিপ্লবী আমি খুব ক্লান্ত, কাল দিনের বেলা রিং করো।

কিন্তু বিষয়টা অনেক জরুরী, একটা দুঃসংবাদ আছে।

আচ্ছা বলো।

আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

কেন কী হয়েছে?

আমার কয়েকদিন থেকে বমি বমি ভাব হচ্ছে, কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছি।

ডাক্তার দেখাও।

তুমি বিষয়টাকে এত হালকা করে দেখলেও আমি বিষয়টা সিরিয়াসলি দেখেছি। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আমার শরীরে তোমার অস্তিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তারপর।

তারপর আমি ইউরিন টেস্ট করলাম।

রেজাল্ট?

পজিটিভ।

জামাল যেন চমকে উঠল, বিপ্লবী তুমি কী বলছ? বুঝতে পাচ্ছ?

দেখ এমন একটা বিষয় নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি না। প্লিজ তুমি আমাকে একটু সময় দাও, কাল আমি একবার মধুকুঞ্জে আসবো তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা করো।

কিন্তু আমি তো এখন ঢাকায়।

তুমি ফিরে এসো প্লিজ।

আচ্ছা ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যায় আমি মধুকুঞ্জে আসবো, তুমি এসো।

সারারাত জামালের চোখে ঘুম নেই। তার অভ্যন্তরে যত দোষই থাকুক না কেন, তার অপকর্মের কোন সাক্ষী নেই। দীর্ঘ দিন রাজনীতি করতে করতে এলাকায় তার একটা গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকা রাখার সময় এসেছে। নির্বাচনে তার নোমিনেশন পাবার একটা সুযোগ তেরি হয়েছে। তার সে পরিশ্রমের ফসল আজ ঘরে তোলার সময় এসেছে। এমন সময় বিপ্লবী যদি তার অবাঞ্ছিত সন্তানের জনক হিসেবে তাকে দায়ী করে তবে লোকসমাজে তার  মানসম্মান থাকবে না। যারা এতদিন তার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিত তারা তাকে দেখে ঘৃণা করবে।

আচ্ছা বিপ্লবী কী বলবে? বলবে তুমি আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিনের পর দিন স্ত্রীর মতো ভোগ করেছ, আমিও তোমাকে পাবার আশায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। এখন তোমাকে বিয়ে করা ছাড়া আমার কোন পথ নেই।

বিপ্লবী তুমি বুঝতে চেষ্টা করো।

আমি কী বুঝতে চেষ্টা করবো?

আমি একজন বিবাহিত পুরুষ, আমার আগের বউয়ের একজন ছেলে আছে।

থাক আমি তো জেনে শুনেই তোমাকে সবকিছু দিয়েছি, তোমার মধ্যে যত দোষই থাকুক না কেন আমি তোমাকে বিয়ে করবো।

আচ্ছা বিপ্লবী সবই ঠিক আছে, তুমি আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও।

আর কিছুদিন সময় দিবো মানে? আমি সময় দিলেও আমার ভিতরে তোমার অস্তিত্ব তো তোমাকে সময় দিবে না, তুমি তার কাছ থেকে সময় নিতে পারবে?

বিপ্লবী তোমাকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন আমাদের কলংকমুক্ত হওয়া। চলো আমি তোমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাই। আগে আমরা কলংকমুক্ত হই তারপর সব হবে।

না, না আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, কলংকমুক্ত হওয়ার নামে তুমি আসলে পালাবার চেষ্টা করছ। আমি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তোমাকে কোনভাবে হত্যা করবো না। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, তবে আমি সবার সামনে তোমার মুখোশ খুলে দিবো, তোমার রাজনীতি চিরদিনে জন্য বন্ধ করে দিবো। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিনে পর দিন ধর্ষণ করার অভিযোগে আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবো।

না, না আমি আর ভাবতে পারছি না, আমার অস্তিত্ব আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অত্যন্ত সুকৌশলে সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় ম্যানেজ করতে হবে, ভাবতে ভাবতে জামাল এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

জামাল হোটেলের চাবি নিয়ে এসেছে একরকম ইচ্ছা করেই। সে মধুকুঞ্জে পৌঁছেই বিপ্লবীকে মোবাইল করে তার আসার  কথা বলে তাকে আসতে বলেছে। জামাল বারান্দায় বসে বিপ্লবীর জন্য অপেক্ষা করছে। সে গালপোড়া সেলিমকে মোবাইল করল, সেলিম তুমি কোথায়?

বস, শহরেই আছি।

আমি মিস কল দিলে তুমি মধুকুঞ্জে চলে এসো, সঙ্গে তোমার কোন এ্যাসিস্টেন্টকে রেখো।

জি বস।

তারপর মধুকুঞ্জে এসে টর্চার সেল-এর ভিতরে ঢুকে আমার মোবাইলে একটা মিস কল দিবে।

জি বস।

বিপ্লবী এলো তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। প্রতিদিনের মতো বিপ্লবীকে দেখে জামালের মুখে আজ হাসি ফুটে উঠল না। একটা দুশ্চিন্তা তার মুখের ওপর কালো মেঘে ঢাকিয়ে রাখল। বিপ্লবীর মুখেও আজ হাসি নেই, সে আজ সেজে গুজেও আসেনি একেবারে সাধারণ একটা  পরে এসেছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, মুখ শুকনো। জামাল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, বিপ্লবী এসো।

জামাল তার বেডরুমে ঢুকল, তার পিছনে পিছনে বিপ্লবীও ঢুকল। বিপ্লবী সোফায় বসতে বসতে বলল, কী করলে জামাল?

কী করতে বলছ?

তোমাকে তো সবই বলেছি।

হ্যাঁ তা বলেছ, এখন কী করতে বলছ তাই বলো?

বিয়ের ব্যবস্থা করো।

জামাল চালাকির আশ্রয় নিলো, বিপ্লবী আমার মনে হয় আগে আমাদের কলংকমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তার আগে বিয়ে করলে তো অনাগত সন্তানের জন্ম তারিখ আর আমাদের বিয়ের তারিখের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করবে। তাই আমি বলছিলাম।

না তা হয় না জামাল, তুমি আমার সঙ্গে চালাকি করছ কিন্তু আমিও বোকা নই।

না তুমি বোকা না, বোকা হলে তো আমাকে এভাবে জিম্মি করতে পারতে না।

আমি তোমাকে জিম্মি করছি।

হ্যাঁ, তাই তো।

জামাল তুমি আমার অসুবিধাটা বুঝতে চাচ্ছ না। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো আমি কোন বিপদে পড়লে তোমাকে আমি ছাড়বো না। তোমার পাপের ভার আমি একাই বহন করবো না। আমি তোমার সমস্ত কুকর্মের কথা সবাইকে জানিয়ে দিব। লোকসমাজে আমি একাই কলঙ্কিনী হবো না, আমি তোমাকেও পচাবো।

বাঃ লোকজন তো বেশ ভালোই গুছিয়েছো? আমাকে ডুবানোর জন্য সমস্ত প্রস্তুতি একেবারে সম্পন্ন করে রেখেছ।

লোকজন গুছিয়ে রাখিনি, আমি নারী তোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার এই যোগ্যতাই যথেষ্ট। জামাল তুমি যত ক্ষমতাবানই হও না কেন, একজন নারীর চেয়ে তুমি বেশি ক্ষমতাবান না। নারীকে অবলা ভাবো, না?

জামাল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, না আমি তোমাকে অবলা ভাবছি না, আর এখনো যারা নারীকে অবলা ভাবে তারাই বোকা, তারা উন্মাদ, বাস্তবতা বিবর্জিত। আমি যদি তোমাকে অবলা ভেবে তাড়িয়ে দেই আর তুমি যদি তোমার অবাঞ্ছিত সন্তানকে আমার সন্তান বলে আমার ওপর কলঙ্ক চাপিয়ে দাও। তবুও তোমার পক্ষ নিয়ে আমাকে ঘায়েল করার লোকের অভাব নেই। দেশের সমস্ত মানুষ মনে করে মেয়েরা যা বলে তার পুরোটাই সত্য, সমস্ত দোষ পুরুষের, পুরুষ মিথ্যাবাদী, প্রতারক আর মেয়েরা সত্যবাদী, ধোয়া তুলসী পাতা। তাদের কোন দোষ নেই। কিন্তু মেয়েরা যে সামান্য টাকার লোভে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, নিজেকে পণ্যের মতো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে তা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ মেয়েরা কোন দোষ করতে পারে না। আজ তোমাকে অস্বীকার করলে তুমি আমাকে ফাঁসিয়ে দিবে দেশের সমস্ত নারীবাদী সংগঠন আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে, দেশের সমস্ত পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে লেখা নিউজ পাতায় পাতায় শোভা পাবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দলের জেলা শাখার জেনারেল  সেক্রেটারি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জামালের কুকীর্তির ফসল বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে অসহায় বিপ্লবী, পিতৃ পরিচয় হীন সন্তান নিয়ে এখন তার কী হবে? কেউ একবারও ভাববে না যে বিপ্লবী টাকার লোভে, প্রতিপত্তির লোভে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে সে যে টাকার লোভে অন্যের প্ররোচনায় আমার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য আমাকে জিম্মি করেছে একথা কেউ ভাববে না। তোমার পেটের সন্তান যে আমার নাকি অন্য কারো একথা কারো বিবেচনার প্রয়োজন নেই।

জামালের কথা শুনে বিপ্লবী যেন আকাশ থেকে পড়ল, জামাল তুমি কী বলছ?

যা সত্যি তাই বলছি, তুমি একটা অসতী, অসংখ্য পুরুষের কাছে তুমি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছ, তুমি নিজেই জানো না তোমার গর্ভের সন্তানের জন্মদাতা কে? আমি সমাজের একজন সম্মানী মানুষ, সমাজে আমার একটা পজিশন আছে, আমি মান-সম্মানের ভয়ে তোমাকে ম্যানেজ করবো, তাই তুমি টাকার লোভে আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছ। তোমার গর্ভে কার সন্তান ধারণ করেছ তা একমাত্র আল্লাহই জানে এখন সব দায়ভার চাপাচ্ছ আমার ওপর।

কি আমি আমার পাপের দায়ভার তোমার ওপর চাপাচ্ছি? ভাবছিলাম সোজা কথায় কাজ হবে, তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি মতো আমাকে বিয়ে করবে। আমি সরলভাবে তোমার কাছে সবকিছু সমর্পণ করেছি আর তুমি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছ। আমিও তোমাকে ছাড়বো না। আর এক মুহূর্ত এখানে না, আমি তো নষ্টা মেয়ে, এখন তোমাকে নষ্ট করবো, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে আমি তোমার মুখোশ খুলে দিবো, বলে বিপ্লবী দরজা খুলতে যাচ্ছিল।

মুহূর্তেই জামাল নিজেকে সামলে নিলো, আমি ভুল করছি না তো? বিপ্লবী যদি সত্যি সত্যি তাই করে তবে তো—না আর ভাবতে পারছে না। সে তার মোবাইল থেকে গালপোড়া সেলিমের মোবাইলে একটা মিস কল দিয়ে বিপ্লবীর একটা হাত টেনে ধরে কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, বিপ্লবী এত সামান্যতে রেগে গেলে হবে? তুমি একজন রাজনীতিবিদদের বউ হবে, রাজনীতিবিদদের বউদের শরীরের চামড়া হতে হয় গণ্ডারের চামড়ার মতো। সহজে রাগ করতে হয় না, সহজে বিরক্ত হতে হয় না। সবকিছুকে সহজভাবে নিতে হয়।

বিপ্লবী ক্ষণিকেই সবকিছু ভুলে গেল, তুমি সত্যি বলছ?

অবশ্যই এতক্ষণ তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম, তুমি পাস করতে পারোনি, বলে জামাল বিপ্লবীকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

বেশ কিছুক্ষণ জামাল বিপ্লবীকে আদর করল। কিছুক্ষণ আগে জামাল বিপ্লবী সম্পর্কে যে সব নোংরা, আপত্তিজনক কথা বলল তা বিপ্লবী খুব সহজে ভুলে গেল।

জামাল বিপ্লবীকে আদর করতে করতে মনে মনে বলল, বিপ্লবী তুমি আমাকে চেনো না, আজকের এ আদরই তোমার জীবনের শেষ আদর, তোমার জীবনের শেষ মুক্ত বাতাস।

গালপোড়া সেলিমের মোবাইল থেকে জামালের মোবাইলে একটা মিস কল এলো।

জামাল বিপ্লবীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, বিপ্লবী বিয়ের পর আমরা মাঝে মাঝে মধুকুঞ্জে এসে রাত থাকবো, চলো তোমাকে সমস্ত মধুকুঞ্জ একবার ঘুরে দেখাই।

বিপ্লবী মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

জামাল দরজা খুলে বিপ্লবীকে নিয়ে টর্চার সেলের দিকে পা বাড়াল।

এক’শ তিন

বিপ্লবী জ্ঞান ফিরে দেখল সে একটা পাকা মেঝের ওপর শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সে একবার সবকিছু মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ মনে পড়েছে গতকালের সব কথাই তার মনে পড়েছে। বিপ্লবী পরনের কাপড়ে রক্ত লেগে আছে তার পাশে মধ্যবয়সী এক মহিলা বসে আছে। বিপ্লবী জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?

মহিলা বলল, আমি তো জানি না।

ধীরে ধীরে বিপ্লবীর সবকিছু মনে পড়ছে। সে বুঝতে পারল সে এখন জামালের মধুকুঞ্জের টর্চার সেল-এ এবং জামাল তার ভিতরে বৃদ্ধি পাওয়া তার অস্তিত্বকে সরিয়ে ফেলেছে। তার প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।

বিপ্লবী মৃদু কণ্ঠে বলল, আপনি না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি আমি এখন কোথায়?

মহিলা কিছু বলল না।

বিপ্লবী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন ওরা আবার কখন আসবে?

না।

বিপ্লবী আর কিছু বলল না। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।

অনেকক্ষণ পর বিপ্লবীর কানে এলো কে একজন গম্ভীর স্বরে বলল, খালা ঘুম ভেঙ্গেছে?

হ্যাঁ ভেঙ্গেছে।

কিছুক্ষণ আর কোন শব্দ নেই। প্রায় আধ ঘণ্টা পর জামাল প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিলা চলে গেল।

জামাল বলল, সরি বিপ্লবী এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।

বিপ্লবীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

সে বলল, আমি এখন যাবো।

হ্যাঁ তুমি তো যাবেই, তবে বিপ্লবী বেগম একটা কথা মনে রেখো বলে জামাল হোটেলের চাবিটা বের করে দেখাল, আমি ঢাকায় যে হোটেলে উঠেছি এটা সেই হোটেলের চাবি। রেজিস্টারের বিবরণ অনুযায়ী আমি এখন ঢাকায় এবং গতকাল রাতেও ঢাকায় ছিলাম। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে প্রাণে মেরে ফেলবো কিন্তু কেন মারিনি জানো?

বিপ্লবী কিছু বলল না।

মারিনি কারণ হোটেলের রেজিস্টারে আমি এখন ঢাকায় কাজেই তুমি কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না যে আমি তোমার কোন ক্ষতি করেছি। তারপরও তুমি যদি আমার কোনরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করো তবে জানে বাঁচবে না।

বিপ্লবী শুষ্ক মুখে বলল, আমি কি এখনো বেঁচে আছি?

জামাল কোন কথা বলল না।

বিপ্লবী বলল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?

জামাল মাথা বাকিয়ে জানালো সে বিয়ে করবে না।

তোমাকে বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি। তোমার কাছ থেকে আমি কিছু পেলাম না কিন্তু সব হারালাম।

জামাল কোন কথা বলল না।

আমি জানি আমি এখানকার কথা কাউকে জানালে তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। তুমি আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করেছ আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি আমাকে মেরে ফেলতে তোমার বুক একবারও কাঁপবে না। আমার ওপর তুমি যে অবিচার করলে আল্লাহ যেন তোমাকে শাস্তি দেন। এখন আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

বলো।

আমাকে এখন যেতে দাও।

অবশ্যই।

আরেকটা অনুরোধ রাখবে।

বলো।

তোমরা পুরুষরা মেয়েদেরকে ভোগ করে খুব গর্ব করে তা বলে বেড়াও। বন্ধুদের মাঝে হাসি-ঠাট্টা করো। তুমি আমাকে কথা দাও, আমার সর্বস্ব লুটে নেওয়ার কথাটা তুমি গোপন রাখবে?

রাখবো।

কয়েক ঘণ্টা তার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড রকমের একটা ঝড় বয়ে গেল। এখন সে নিরাপদ, জামাল একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হোটেলে ঢুকেই জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকাল বিকেল পাঁচটা বাজে। সে মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল, হ্যালো বড়ভাই।

জামাল বলো।

বড়ভাই আপনি কোথায়?

জামাল আমি তো ঢাকার বাইরে, কেন বলতো?

না এমনিতেই খোঁজ নিলাম।

কোন সমস্যা?

বড়ভাই কী যে বলেন? আমি কি শুধু সমস্যা নিয়েই আসি নাকি? আসলে আমি ঢাকা এসেছিলাম তো তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতাম।

আমার তো ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে।

জি ভাই ঠিক আছে।

তুমি যোগাযোগ রেখো, আমি ঢাকা ফিরলে দেখা করে যেও।

জি ভাই।

জামাল মোবাইল বন্ধ করে একটু হেসে মনে মনে বলল, বড়ভাই আসলে আমিও তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই না, দেখলাম ঢাকায় নাকি বাইরে, আমি ঢাকা এসেছিলাম একথা পরে কারো কাছ থেকে জানলে তো আবার মাইন্ড করবেন।

জামাল কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল। জামালের চোখের সামনে বিপ্লবীর মুখচ্ছবিখানা ভেসে উঠছে, সে বার বার করে বিপ্লবীকে মন থেকে মুছে ফেলতে চায় কিন্তু কিছুতেই পারছে না। সে কলিং বেল-এ টিপ দিলো।

একজন বয় দরজা নক করে বলল, স্যার ডেকেছেন?

আচ্ছা আজ তো বার খোলা থাকবে, না?

জি স্যার।

জামালের যেন নিজেকে অসহায় মনে হলো। এই বিকেলে সে কোথায় যাবে? অথচ এই অসময়ে তার মন থেকে মুছে ফেলার জন্য কারো সঙ্গ প্রয়োজন। তার আনন্দ প্রয়োজন, হৈ চৈ প্রয়োজন, নিজেকে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন। সে তার মোবাইলের ফোন বুক দেখে চৈতীকে মোবাইল করল, হ্যালো, চৈতী।

ভাইয়া আপনি আমাকে মোবাইল করেছেন? আমার কী যে ভালো লাগছে।

কেন আমি তোমার খোঁজ-খবর রাখতে পারবো না?

অবশ্যই।

তুমি কেমন আছ?

ভালো, আপনি?

আমি ভালো নেই।

কেন? কী হয়েছে?

বললাম ভালো নেই, সর্বকালের সবচেয়ে বেশি খারাপ আছি।

ভাইয়া আপনার কথা শুনে আমারও খুব খারাপ লাগছে, আমি কি আপনাকে কোন হেল্প করতে পারি?

সেজন্যই তোমাকে মোবাইল করেছি, তুমি কি ফ্রি আছ?

আপনি ভালো নেই আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমি ফ্রি আছি কি না? আমার যত কাজই থাকুক না কেন আপনার জন্য আমি ফ্রি আছি।

তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?

অফ কোর্স, আপনি কোথায়?

জামাল তার হোটেলের নাম এবং রুম নাম্বার বলল।

আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি।

জামালের কাছে আধ ঘণ্টা সময়ও যেন অনেক লম্বা মনে হলো। কয়েক মিনিট পর থেকেই সে বার বার করে ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল। চৈতী এলো ঠিক আধ ঘণ্টার মধ্যে।

জামাল দরজা খুলে দিয়ে চৈতীর চোখে চোখ রাখল,বাহ্‌ তুমি তো সময় সম্পর্কে খুব সচেতন। সাধারণত শিল্পীরা এত সচেতন হয় না। বেশিরভাগ শিল্পী শিডিউল টাইমে শুটিং স্পটে যায় না, এটা যে তাদের ব্যস্ততা শুধু তাই না, কারো কারো উদাসীনতা।

অভিনয় ভালো করি বা মন্দ করি, প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হই আর নিউ কামার হই একটা গুণ তো তাহলে আমার আছে?

অবশ্যই।

চৈতী বলল, বসতে দিবেন না?

হ্যাঁ এসো, বসো।

চৈতী বসল।

জামাল একরকম চৈতীর গা ঘেঁষে বসল।

চৈতী বলল, এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল।

এতদিন পর কেন? তোমাকে তো আমার সব সময় মনে পড়ে।

চৈতী অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া এটা কিন্তু একেবারে মিথ্যা কথা।

চৈতী এভাবে বলতে হয় না, হঠাৎ করে কাউকে মিথ্যাবাদী বলা যায় না।

সরি ভাইয়া।

কিছু খাবারের অর্ডার দিই।

চৈতী মাথা বাকিয়ে সায় দিল।

ভাইয়া মুক্তা কি আপনার সঙ্গে কন্টাক্ট করেছে?

কোন মুক্তা?

ভাবটা এমন দেখাচ্ছেন যেন মুক্তাকেই চেনেন না। ঐ যে মেয়েটা আমাদের সঙ্গে শুটিঙয়ে গেছিল।

ও এবার চিনেছি, না মোবাইল করেনি তো।

সত্যি বলছেন?

জামাল ধমকের সুরে বলল, এই মেয়ে আমাকে বার বার করে মিথ্যাবাদী মনে করছ কেন?

সরি ভাইয়া আপনাকে একটু পরীক্ষা করলাম।

আর কখনো পরীক্ষা করবে না, বড়দেরকে কখনো পরীক্ষা করতে হয় না।

ভাইয়া বললাম তো সরি, সরি বললে আর কারো ওপর রাগ রাখতে হয় না।

ঠিক আছে মাফ করে দিলাম।

ভাইয়া আপনার প্যাকেজ নাটকে চান্স পাচ্ছি তো?

দেখ চৈতী তুমি প্রডিউসারের সবচেয়ে কাছের মডেল, তুমি চান্স পাবে না তো কে চান্স পাবে?

নাস্তা চলে এলো। নাস্তা খেতে খেতে জামাল আর চৈতী অনেক গল্প করল। তারপর দু’জনে বের হলো।

সীমিত আলোতে ততক্ষণে বার-এ নৃত্য চালু হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক টেবিলকে ঘিরে বেষ্টিত চেয়ারে বসে কেউ বা বিয়ার, মদ এর নেশায় মাতাল হয়ে পড়েছে। জামাল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফাঁকা সিটের জন্য এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল। তারপর একেবারে কোণার দিকে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে দু’জনে বসল।

বয় চলে এলো, স্যার কিছু দিবো?

জামাল বয় এর কানে কানে ফিসফিস করে কি যেন বলল, সে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে ড্রিঙ্কস নিয়ে এলো।

জামাল চৈতীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চৈতী প্লিজ।

চৈতী হাতে নিয়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, জামাল বলল, খাবে না।

কেন?

জামাল তার গ্লাসটা চৈতীর গ্লাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকে অনুসরণ করার জন্য ইশারা করে বলল, চিয়ার্স।

চৈতীও তার গ্লাসের সঙ্গে স্পর্শ করে বলল, চিয়ার্স। তারপর মুচকি হেসে গ্লাসে চুমুক দিতেই মুখ বিকৃত করল।

জামাল বলল, প্রথম দু’য়েক চুমুক একটু খারাপ লাগতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

দু’জনে নৃত্য উপভোগ করতে করতে আর এক প্যাক এক প্যাক করে ড্রিঙ্ক করতে করতে চৈতীর গলার স্বর জড়ো হয়ে এলো, তবু জামাল গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আর এক প্যাক প্লিজ।

চৈতী জিজ্ঞেস করল, এখন ক’টা বাজে?

রাত দশটা।

আমি হোস্টেলে যাবো না?

এভাবে হোস্টেলে যাওয়া তোমার ঠিক হবে না, তারচেয়ে তুমি আমার এখানেই থেকে যাও।

আপনি আমাকে কী খাইয়েছেন? আমার এমন লাগছে কেন?

জামাল বলল, খারাপ কিছু না, তুমি হালকা ড্রিঙ্ক করেছ। তোমার কি খুব ঘুম পাচ্ছে?

চৈতী জড়ানো গলায় বলল, জি।

ঘুমাবে।

চৈতী কিছু বলল না।

জামাল মনে মনে বলল, এই তো আমি চেয়েছিলাম।

সে চৈতীকে বলল, চলো।

চৈতী জামালের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

জামাল চৈতীকে তার রুমে নিয়ে গেল।

এক’শ চার

সকালবেলা এক সঙ্গে নাস্তা করে চৈতী চলে গেছে। আজ জামালের নিজেকে খুব সতেজ মনে হচ্ছে। তার সমস্ত অতীত যেন মুছে গেছে, মনে হচ্ছে তার যেন কিছুই মনে নেই, সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জামাল প্রথমে সুমন সাহেবকে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে সুমন সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল ভাই কেমন আছেন?

ভালো।

ঢাকায় এসেছেন?

হ্যাঁ, আপনি কোথায়?

আমি তো এখন বাসায়।

অফিসে যাবেন না?

হ্যাঁ অবশ্যই, আমি দশটার মধ্যে অফিসে যাবো, আপনি একবার অফিসে আসুন।

আচ্ছা ঠিক আছে।

জামাল সুমন সাহেবের অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

সুমন সাহেব চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন।

জামাল সালামের জবাব দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, সুমন সাহেব ব্যবসা কেমন চলছে?

জি ভাই ভালো, আপনি কবে এসেছেন?

কয়েকদিন হলো।

আগে দেখা করলেন না যে?

একটু ব্যস্ত ছিলাম।

হ্যাঁ নেতা মানুষ, ব্যস্ততা তো থাকবেই।

পার্টি অফিসে গেছিলেন?

না, আজ যাবো।

মোজাফফর ভাই, ইমরান ভাই সবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

না, দেখি একবার মোবাইল করি, বলে জামাল মোজাফফর সাহেবকে মোবাইল করল।

হ্যালো ইয়াং লিডার কী খবর?

জি ভাই ভালো আছি, আপনি?

জামাল আমার শরীরটা ভালো নেই।

ভাইজান কি আজ পার্টি অফিসে আসবেন না।

না।

ভাইজান আমি একবার আপনার সঙ্গে দেখা করবো, যদি অনুমতি দেন তবে আপনার বাসায় আসবো।

অফকোর্স চলে এসো।

আপনার বাসার ঠিকানাটা প্লিজ?

জামাল মোবাইলে শুনে মোজাফফর সাহেবের বাসার ঠিকানা লিখে নিল।

তারপর জামাল ইমরান সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো ইমরান ভাই।

হ্যালো, কে?

ভাইজান আমার নাম জামাল বলে জামাল তার পরিচয় দিল।

অপর পাশ থেকে ইমরান সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওহো এবার চিনতে পেরেছি, তুমি সেই ইয়াং লিডার।

জি ভাইজান।

কী খবর তোমার?

ভাইজান ঢাকায় এসেছি তো, তাই আপনার সঙ্গে একবার দেখা করবো।

সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে এসো।

জি ভাইজান, আসবো।

জামাল মোবাইল রাখতেই সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই আপনার সঙ্গে কি আমজাদ ভাই’র পরিচয় হয়েছে?

না তো।

যে কোন কাজে, কেন্দ্রের যে কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমজাদ ভাইকে আপনার প্রয়োজন।

আজ পার্টি অফিসে না হয় একবার দেখা করবো।

সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই আপনি যত সহজে মোজাফফর ভাই আর ইমরান ভাই’র কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন তত সহজে আমজাদ ভাই’র কাছে পৌঁছাতে পারবেন না।

তবে।

এ ব্যাপারে আপনি মোজাফফর ভাই’র সহযোগিতা নিয়ে এগোতে পারেন। মোজাফফর ভাই আপনাকে পরিচয় করে দিলে আপনার জন্য আমজাদ ভাই’র কাছাকাছি হওয়া সহজ হবে।

সুমন সাহেব আপনি রাজনীতি করলে ভালো করতেন।

না, করতাম না।

কেন?

আমি খুব সেনসিটিভ, আমার রাগ বেশি, খুব সহজে মানুষের ওপর রেগে যাই কিন্তু এগুলো থাকলে রাজনীতিতে ভালো করা যায় না।

বুঝেন তো, তবে এগুলো ত্যাগ করতে পারেন।

আমি ছোটবেলা থেকে যেসব অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সেসব অভ্যাস কি আর এত সহজে ত্যাগ করতে পারবো? তাছাড়া আপনার মতো রাজনীতিবিদ ভাই থাকতে আমাকে রাজনীতি করতে হবে কেন?

তা ঠিক বলেছেন।

আপনি রাজনীতিবিদ, আপনি বুঝবেন রাজনীতি। আমি ব্যবসায়ী মানুষ আমি বুঝবো অর্থনীতি। আজকাল অর্থনীতি অনেকটা রাজনীতি নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমরা এক সঙ্গে থাকলে আমরা রাজনীতি আর অর্থনীতি দু’টোতেই সফল হবো।

জামাল মুচকি হাসল, আপনার তো দেখি রাজনীতি আর অর্থনীতি দু’টোতেই ভালো জ্ঞান আছে।

সুমন সাহেব হাসলেন।

জামাল বলল, আচ্ছা সুমন সাহেব আপনার পার্টি অফিসে বেশ যাতায়াত আছে, না?

তা আছে।

মোটামুটি অনেকের সঙ্গে পরিচয়ও আছে?

জি আছে।

তাহলে তো আপনার কাছে আমার অনেক শেখার আছে।

সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই কি আগামী ইলেকশনে নোমিনেশন আশা করছেন।

আপনি ঠিকই ধরেছেন।

বলুন তো এখন আমাকে কী করতে হবে?

জামাল ভাই আমি যতটুকু জানি আপনার জেলায় লোকাল পলিটিক্সটা আপনি মেইনটেইন করেন।

হ্যাঁ।

কিন্তু নোমিনেশন পাওয়ার জন্য শুধু মাত্র লোকাল পলিটিক্সে ভালো করাই যথেষ্ট না। দরকার ঢাকায় অবস্থান করা, ঢাকায় একটা ঠিকানা থাকা, সেন্ট্রাল পলিটিক্সে অংশগ্রহণ করা, সেন্ট্রাল লিডারদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা, বলে সুমন সাহেব একটু হাসলেন তারপর বললেন, আমি সক্রিয় রাজনীতিবিদ না হলেও আপনাকে হেল্প করতে পারবো।

সেটা আমি বুঝতে পেরেছি, প্লিজ আমাকে হেল্প করুন সুমন সাহেব।

জামাল ভাই হোটেলে অবস্থান করা কোন পার্মানেন্ট এড্রেস না।

তাহলে ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া নিই। তখন বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকবো আর মাঝে মাঝে আমার এলাকায় গিয়ে কাজ করবো।

এক্সাক্টলি।

আচ্ছা সুমন সাহেব আপনার তো ম্যান পাওয়ার অনেক আপাতত আমার কাছে একজন ম্যানেজারকে আমাকে দিন। তার বেতনাদি আমি দিবো। তারপর আমার সবকিছু গুছানো হলে আবার ফিরিয়ে নিবেন।

সেকথা আপনাকে বলতে হবে না জামাল ভাই, আমার লোকজন আপনার সব কাজ করবে, তার আগে বলুন আপনি আর ক’দিন ঢাকায় আছেন?

সুমন সাহেব এখন তো এটাই আমার মেইন কাজ। দেরি হলে কোন অসুবিধা নেই। আপনি সব ব্যবস্থা করুন।

আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না জামাল ভাই, দু’য়েক দিনের মধ্যে আপনার সবকিছু এ্যারেঞ্জ হয়ে যাবে।

আপনি কিছু টাকা রাখুন।

জামাল ভাই আমি সবকিছু এ্যারেঞ্জ করি টাকার প্রয়োজন হলে আমি চেয়ে নিবো।

জামাল মনে মনে বলল, সুমন সাহেব সবকিছু নিজে থেকেই করে দিতে চাচ্ছে কেন? কোন মতলব নেই তো।

সুমন সাহেব মনে মনে বললেন, জামাল ভাই আমি ব্যবসায়ী মানুষ, আপনাকে আমি প্রথম দিন দেখেই বুঝেছি, আপনি রাজনীতিতে ভালো করবেন তাই এখন থেকেই ইনভেস্ট করছি। একদিন আপনি এম. পি কিংবা মন্ত্রী হবেন সেদিন আমি রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিবো।

সুমন সাহেব আজ সন্ধ্যায় আমি একবার পার্টি অফিসে যাবো, আপনি কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।

আচ্ছা ঠিক আছে সন্ধ্যায় আমরা একসঙ্গে পার্টি অফিসে যাবো।

সুমন সাহেবের মোবাইল বেজে উঠল। তিনি মোবাইল রিসিভ করে বললেন, হ্যাঁ আমি আসছি, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।

সুমন সাহেব কলিং বেল-এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল, স্যার।

সুমন সাহেব বললেন, ফারুক সাহেবকে আমার সালাম দাও।

কিছুক্ষণের মধ্যে ফারুক সাহেব চেম্বারে ঢুকেই সালাম দিলেন। তারপর জামালকে দেখে যেন চমকে উঠল, ভাইজান আপনি?

ফারুক সাহেব অবাক হচ্ছেন মনে হয়।

সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই আমাকে একটু বের হতে হচ্ছে আপনি ফারুক সাহেবের চেম্বারে বসুন।

ফারুক সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আসুন ভাইজান প্লিজ।

জামাল ফারুক সাহেবের সঙ্গে তার চেম্বারে গেল।

ফারুক সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ভাইজান কেমন আছেন বলুন?

হ্যাঁ ভালো, আপনার কাজ কেমন চলছে?

জি ভালো।

আপনাদের প্রোডাকশনের কোন কাজ চলছে?

জি ভাইজান আমাদের প্রোডাকশনের কাজ চলছে, তাছাড়া নতুন এক প্রডিউসারের কাজ পেয়েছি। সেটাও আগামী সপ্তাহে শেষ হবে।

আচ্ছা ফারুক সাহেব সুমন সাহেব আপনাকে কিছু বলেছেন?

জি ভাইজান আমাকে সবকিছু বলেছেন।

তাহলে আমাদের এখন কী কী করতে হবে?

এই ধরুন স্ক্রিপ সিলেকশন, নায়ক-নায়িকা সিলেকশন, শুটিং, ইডিটিং করা তারপর স্পন্সর ম্যানেজ করা।

আচ্ছা ফারুক সাহেব নাটক তেরি করার পর যদি স্পন্সর না পাওয়া যায় তবে-

মিডিয়াতে আমার একটা গুড উইল আছে, আমার ডিরেকশনে যে কোন নাটক স্পন্সর পাইনি এখনো এমন ঘটনা ঘটেনি, এদিক দিয়ে আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন ভাইজান।

তাহলে আপনি স্ক্রিপ তেরির কাজ শুরু করে দিন। তবে নায়ক-নায়িকা সিলেকশনের সময় আমি থাকতে চাই।

শুধু নায়ক-নায়িকা সিলেকশন কেন? আপনি প্রডিউসার, আপনি ইচ্ছা করলে সব কাজে থাকবেন।

ওকে ফারুক সাহেব তাহলে স্ক্রিপ লেখা শেষ হলে আমাকে জানাবেন। আমার বাইরে কিছু কাজ আছে, আজকের মতো উঠি, আপনি টাইম-টু-টাইম আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

অবশ্যই ভাইজান।

এক’শ পাঁচ

কয়েকদিন থেকে রিপন চৈতীকে মোবাইল করছে কিন্তু চৈতী মোবাইল রিসিভ করছে না, আবার কখনো কখনো মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দিচ্ছে। রাতে রিপন শারমিনের মোবাইলে রিং করল। তখন চৈতী রুমে ছিল না। রিপন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বাজে, এত রাত পর্যন্ত চৈতী হোস্টেলের বাইরে? কী এত কাজ?

হ্যালো শারমিন।

হ্যাঁ রিপন বলো।

চৈতী কি প্রতিদিন অনেক রাতে হোস্টেলে ফিরে।

হ্যাঁ ক’দিন থেকে তো তাই দেখছি।

ক্লাস করে না।

ক্লাস করে কী হবে? মডেলিং-এ চৈতী অনেকদূর এগিয়েছে আর ক’দিন পরেই তো ও স্টার হয়ে যাবে।

বুঝেছি, আচ্ছা শারমিন কীভাবে ওর সঙ্গে একবার দেখা করব বলো তো?

আজ আমি ওর আগামীকালের প্রোগ্রাম জেনে নিয়ে তোমাকে মোবাইল করবো। তখন তুমি চলে আসবে।

থ্যাঙ্ক ইউ শারমিন।

সারারাত রিপনের চোখে ঘুম নেই সব সময় শুধু চৈতীর কথা মনে পড়ছে। চৈতীর সঙ্গে রিপনের পরিচয় হয় শারমিনের মাধ্যমে। শারমিন আর রিপন একই কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করেছে। তারপর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শারমিন একটা ছাত্রী হোস্টেলে সিট নেয়। শারমিনের রুমমেট চৈতী। তাই ঘটনাক্রমে চৈতীর সঙ্গে রিপনের পরিচয় হয়। তারপর প্রেম, প্রথম প্রথম দিন ভালোই যাচ্ছিল। রিপন আর চৈতীর সুযোগ হলেই আড্ডা দিত, ডানা মেলে যেন উড়ে যেত ঢাকার অদূরের কোন দর্শনীয় স্থানে।

চৈতী আর রিপন আগেও কয়েকবার গিয়েছে ফ্যান্টাসি কিংডমে। ফ্যান্টাসি কিংডমের মিনি সৈকতটা দু’জনের অতি পরিচিত এবং পছন্দনীয়। অনেকক্ষণ দু’জনে সৈকতে হাঁটার পর চৈতী রিপনের হাত টেনে ধরে বলেছিল, তুমি চলো তো।

চৈতী ঠাণ্ডা লাগবে তো।

কিচ্ছু হবে না তুমি চলো তো।

অবশেষে অনুরোধে ঢেঁকি গেলা।

রিপন আর চৈতী পানিতে নেমে পড়ল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছিল, তারই এক খণ্ড রক্তিম আভা ছিটকে পড়েছিল চৈতীর গালে, এ যেন চৈতীর গাল না এক গুচ্ছ রক্তিম জবা। তখন মৃদু বাতাস বইছে, সৈকতে পানির মৃদু ঢেউ পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ করে মধুর ছন্দ তুলছে, রিপন চৈতীকে ধীরে ধীরে কাছে টেনে নিয়ে তার গালে চুমু দিতেই চৈতী বলেছিল, এই কী হচ্ছে?

না কিছু না, যেটুকু না হলে এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তটা নিরামিষ হয়ে যায় সেটুকু।

তাই বুঝি মুহূর্তটাকে রোমান্টিক করে তুললে?

রিপন মৃদু হাসল।

আরেকদিন রিপন চৈতীকে নিয়ে ঢাকার বাইরে যাবার কথা কিন্তু কী কারণে যেন সেদিনের প্রোগ্রাম ভেস্তে যায়। শেষে আর কী, চন্দ্রিমা উদ্যান। দু’জনে পাশাপাশি বসল। একটা ছোট মেয়ে ফুলের মালা নিয়ে সামনে এসে হাজির, স্যার একটা মালা নিবেন?

রিপন একটা মালা হাতে নিয়ে বলেছিল, বাহ্‌ সুন্দর তো।

চৈতী বাধা দিয়ে বলেছিল, নিতে হবে না, এই তুই যা।

আপা রাগ করেন কেন? নেন না একটা মালা।

রিপন ধমক দিয়ে বলেছিল, আপা কী রে ভাবী বল।

তারপর মেয়েটা বলেছিল, ভাবী নেন না একটা মালা স্যার যখন—

ঠিক আছে তোকে আর বলতে হবে না, বলে চৈতী একটা মালা নিয়েছিল।

মেয়েটা চলে যাবার পর চৈতী রিপনের কান টেনে ধরে বলেছিল, বউ বানাতে খুব ইচ্ছা করে, না?

রিপন মাথা বাঁকিয়ে জানিয়েছিল, ইচ্ছা করে।

আর কখনো বলবে না।

বলব।

তুমি জানো আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে কী কী করতে হবে?

না জানি না।

ঢাকা শহরে  থাকতে হবে, বাড়ি থাকতে হবে, কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স থাকতে হবে।

রিপনের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল।

চৈতী বলেছিল, কি মন খারাপ করলে?

রিপন কিছু বলেনি।

আরে না এটা বললাম তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য।

রিপন গম্ভীর স্বরে বলেছিল, আচ্ছা চৈতী আমি যদি কোনদিন -বাড়ি’র মালিক না হতে পারি তবে কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

চৈতী কিছু বলেনি, রহস্যময় নীরবতা পালন করেছিল।

তারপর থেকে চৈতী যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল।

একদিন হঠাৎ করে চৈতী রিপনকে মোবাইল করেছিল, রিপন তুমি কি বাইরে?

কেন বলো তো?

না হঠাৎ করে আমার মোবাইলে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেল তো।

আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

রিপন কিছু মনে করেনি। কিন্তু না, তারপর থেকে শুধু মোবাইলে ব্যালেন্স রিচার্জ না। একের পর এক আবদার করতো। প্রায় প্রায় চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাওয়া, বিলাসবহুল মার্কেটে শপিং করা, বাড়ি থেকে টাকা না আসার অজুহাতে টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়া।

রিপন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা’র একমাত্র আদুরে সন্তান। কোনদিন বাড়িতে টাকার জন্য মোবাইল করলেই সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা টাকা পাঠিয়ে দিত। সেদিক থেকে রিপনের টাকা-পয়সার কোন অভাব ছিল না। তাই রিপন তার সাধ্য মতো চৈতীর চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করতো।

তাতেও চৈতী যেন সন্তুষ্ট না। তার আরো চাই। রিপন লক্ষ্য করেছে চৈতী কিছুদিন থেকে অনেক বদলে গেছে। আগে দু’জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার একসঙ্গে কাটালেও চৈতীর মোবাইলে কোন কল আসতো না। চৈতীর মোবাইলে রিং করলে দু’য়েকবার রিং হওয়ামাত্র চৈতী রিসিভ করতো। তখন রিপন বলতো, তুমি কি আমার মোবাইল রিসিভ করার জন্য সব সময় বসে থাকো নাকি?

তুমি ছাড়া আমাকে আর কে মোবাইল করবে রিপন? তুমি ছাড়া যে আমার কেউ নেই।

গত কিছুদিন থেকে রিপন আর চৈতী কিছুক্ষণ একসঙ্গে থাকলে চৈতীর মোবাইলে কল আসতে থাকে। কখনো চৈতী মোবাইল বন্ধ করে দেয়। একদিন রিপনের খুব রাগ হলো, কী হলো চৈতী মোবাইল অফ করলে কেন?

এমনি।

এমনি না, এমন কার কল এসেছিল যে আমার সামনে রিসিভ করা গেল না?

চৈতী বলেছিল, বাঃ রে মোবাইল থাকলে কল আসবে না?

কল আসতে তো বাধা নেই। তবে রিসিভ করলে না কেন?

তুমি খুব কনজারভেটিভ মনের মানুষ। তোমার এই আচরণটা আমার একেবারে পছন্দ না।

রাতে কল করলে চৈতীর মোবাইল ব্যস্ত থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায়।

রিপন একবার ঘড়ির দিকে তাকাল রাত এগারোটা বাজে। সে চৈতীর মোবাইলে রিং করল। মোবাইল ব্যস্ত, রিপন যেন বুকে প্রচণ্ড আঘাত পেল। সে রাগ করে মোবাইলটা বন্ধ করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

পরদিন সকাল থেকেই রিপন শারমিনের মোবাইলের জন্য অপেক্ষা করল।

শারমিন মোবাইল করল বেলা এগারোটায়, হ্যালো রিপন।

শারমিন বলো।

চলে এসো।

রিপন তখনই রওয়ানা দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রিপন হোস্টেলের ওয়েটিং রুমে পৌঁছাল।

চৈতী রিপনকে দেখে অবাক হলো, তুমি!

হ্যাঁ।

তুমি কেন এলে?

তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

কেন হঠাৎ আমাকে কী প্রয়োজন পড়ল?

চৈতী তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বলো।

এখানে না, বাইরে কোথাও।

বাইরে কোথাও মানে?

বাইরে কোথাও মানে, বাইরে।

তুমি পাগল হয়েছ, আমি বাইরে যাবো তোমার সঙ্গে?

কেন?

দেখ রিপন পাগলামি করোনা, তুমি হয়ত জানো না। আমি মডেলিং-এ অনেকদূর এগিয়েছি, তোমার সঙ্গে বাইরে গিয়ে আমি যদি মিডিয়ার চোখে পড়ে যাই তখন?

চৈতী মিডিয়ার চোখে পড়ার ভয়ে তুমি আমার সঙ্গে বের হতে চাচ্ছ না। আমি তাহলে কী মনে করবো?

তুমি যা ইচ্ছা কর রিপন, তুমি আর এখানে এসো না প্লিজ, আমার কোন প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে মোবাইল করবো।

চৈতী তোমার এত উন্নতি হয়েছে?

চৈতীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল। সে রিসিভ করে বলল, ভাই আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো।

চৈতী মোবাইলে কথা বলা শেষ করে বলল, সরি রিপন আমি আর তোমাকে সময় দিতে পারছি না, বলে চৈতী রিপনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।

এক’শ ছয়

মোজাফফর সাহেব প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করেন। তাঁর গলার স্বর ছিল বলিষ্ঠ, হাত উঁচু করে তিনি যখন শ্লোগান দিতেন তখন পিছনের অজস্র হাত তার হাতের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতো। বড় বড় অনেক আন্দোলনের তাঁর নাম ইতিহাসে সাক্ষ্য বহন করে। রাজনীতিতে সফলতার পিছনে তাঁর একটা বড় গুণ হলো তিনি সহজে কারো ওপর রেগে যান না, সব সমস্যা ঠাণ্ডা মাথায় সমাধান করেন। সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেতে পারেন। পার্টির সর্বকনিষ্ঠ থেকে শুরু করে সভাপতি পর্যন্ত তাঁকে খুব সম্মান করেন।

জামাল মোজাফফর সাহেবের বাসার গেটে গিয়ে তাঁকে মোবাইল করল, ভাইজান আমি আপনার বাসার গেটে।

তুমি দাঁড়াও আমি কেয়ারটেকারকে বলে দিচ্ছি।

ইন্টারকম বেজে উঠল। কেয়ারটেকার রিসিভ করে বলল, জি স্যার।

তারপর জামালকে বলল, স্যার আপনি ভিতরে যান।

জামালকে দেখে মোজাফফর সাহেব সহাস্যে বললেন, ইয়াং লিডার, কেমন আছ?

জি বড়ভাই আমি ভালো আছি, আপনার শরীরটা কি আগের চেয়ে একটু ভালো?

হ্যাঁ একটু ভালো, আসলে ডায়াবেটিসটা একটু বেড়েছিল, এখন কমেছে। কাল থেকে অফিস যাবো।

চা-নাস্তা চলে এলো।

মোজাফফর সাহেব বললেন, নাও শুরু করো।

জামাল বলল, বড়ভাই আপনি?

না, আমার রিজার্ভেশন আছে, তুমি খাও।

জামাল খেতে খেতে বলল, বড়ভাই আপনি তো দেখলেন লোকাল পলিটিক্সে আমার ভূমিকা।

হ্যাঁ তুমি একজন অর্গানাইজার হিসাবে বেশ দক্ষ, একদিন বড় রাজনীতিবিদ হবে।

বড়ভাই সেজন্য আপনার দোয়া দরকার।

অবশ্যই দোয়া করবো।

বড়ভাই অনেকদিন থেকে তো লোকাল পলিটিক্স করছি এখন আমাকে একটু আপনাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিন।

বেশ তো ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

থ্যাঙ্ক ইউ বড়ভাই।

জামাল নাস্তা খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, বড়ভাই আমি একবার আমজাদ ভাই’র সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।

তোমার সঙ্গে আমজাদের পরিচয় নেই?

জি না।

তুমি কবে দেখা করতে চাও?

আজকেই।

আচ্ছা তবে আমি আজকেই আমজাদকে বলে দিবো।

জামাল তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল, বড়ভাই যদি নাম্বারটা বলতেন?

মোজাফফর সাহেব তাঁর মোবাইলের ফোন বুক থেকে আমজাদ সাহেবের মোবাইল নাম্বারটা বললেন।

জামাল নাম্বারটা সেভ করে নিল।

বড়ভাই যদি অনুমতি দেন তবে একটা কথা বলি?

বলো।

আপনারা সব ক্ষেত্রে বয়সকে প্রাধান্য দিবেন না, অন্তত: নমিনেশনের ক্ষেত্রে দক্ষতা, জনসমর্থন এবং আর্থিক সামর্থ্যকে প্রাধান্য দিবেন।

মোজাফফর সাহেব মৃদু হাসলেন।

জামাল সুমন সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো সুমন সাহেব, আপনি কোথায়?

জামাল ভাই আমি তো আমার অফিসে।

পার্টি অফিসে যাবার কথা ছিল না?

জি, আমি তো আপনার জন্য অফিসে অপেক্ষা করছি।

আমি এখন পার্টি অফিসে আপনি চলে আসুন।

কিছুক্ষণের মধ্যে সুমন সাহেব এলেন। জামাল ততক্ষণে ইমরান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে।

ইমরান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ইয়াং লিডার দিনকাল কেমন চলছে?

জি ভাই ভালো।

কী মনে করে?

না কোন কিছু মনে করে না, ঢাকায় এসেছিলাম মনে করলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। এই সৌজন্য সাক্ষাত আর কী।

বেশ ভালো করেছ।

তাছাড়া আপনাদের কাছাকাছি থাকতে পারলে, আপনাদের কোন কাজে এলে আমিও কিছু শিখতে পারি। শেখার তো আর শেষ নেই।

বেশ শেখার আগ্রহ থাকা ভালো, মোস্তফার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?

না ভাইজান, ঢাকায় এসে শুনলাম মোস্তফা ভাই এখন ঢাকার বাইরে। আসলে মোস্তফা ভাই ইদানীং নিজের কাজে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

আসলে প্রায় সব মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে একই রকম হচ্ছে, কেউ একজন মন্ত্রিত্ব পেলে আর এলাকায় যাচ্ছেন না। যেন সবাই ঢাকা শহরটাকে নিজের নির্বাচনী এলাকা মনে করছেন।

কিন্তু বড়ভাই পার্টির ভালো-মন্দ সবকিছু যারা দেখছে পার্টিতে তাদের কোন মূল্যায়ন নেই।

মূল্যায়ন নেই কে বলেছে? কাজ করো একদিন অবশ্যই মূল্যায়ন পাবে।

হ্যাঁ কবে মোস্তফা ভাই রাজনীতি থেকে অবসর নিবে আর আমার মূল্যায়ন হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে।

নিরাশ হবে না, বুঝলে? আমরা আছি না, আমরা অবশ্যই যোগ্যতার মূল্যায়ন করবো।

বড়ভাই আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। আমি কিন্তু একদিন আপনার কথাটা আপনাকে স্মরণ করে দিব সেদিন  আপনাকে আমার যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে হবে।

সুমন সাহেব ভিতরে ঢুকে সালাম দিলেন।

ও সুমন কী খবর তোমার?

না ভাইজান, এমনি এলাম।

জামাল ভাই কথা হয়েছে।

জামাল বলল, হ্যাঁ চলুন।

দু’জনে ইমরান সাহেবের চেম্বার থেকে বের হলো।

আমজাদ সাহেবের চেম্বারের সামনে গিয়ে সুমন সাহেব বললেন, জামাল ভাই, আপনি যান। আমি বাইরে আছি।

কেন?

জামাল ভাই আমজাদ ভাই খুব কড়া মানুষ, সব সময় কেমন যেন গম্ভীর হয়ে বসে থাকে, মনে হয় রেগে আছে, আমার দেখলেই আমার ভয় লাগে। তবে পার্টির কর্মীদের বিষয়ে তিনি খুব আন্তরিক। আপনি পরিচয় দিলে তিনি নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিবেন। তাছাড়া মোজাফফর ভাই তো আপনার কথা বলেছেন।

হ্যাঁ তা বলেছেন। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি কথা বলে আসছি।

জামাল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।

আমজাদ সাহেব একবার মুখ তুলে তাকালেন। তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আপনি?

জি, আমার নাম জামাল, বলে জামাল তার পরিচয় দিল।

ও মোজাফফর ভাই তোমার কথা বলেছিলেন, বসো, বসো।

জামাল চেয়ারে বসল।

তো কী মনে করে?

না এমনি এলাম।

তুমি তো জেনারেল  সেক্রেটারি, তাই না? মোস্তফা সাহেব সভাপতি?

জি, মোস্তফা ভাই তো সব সময় ঢাকায় থাকেন, লোকাল পলিটিক্সটা আমি দেখাশুনা করি।

আমজাদ সাহেব কিছু বললেন না। তিনি আপন কাজে মনোযোগ দিলেন।

জামাল কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর সালাম দিয়ে বের হলো।

সুমন সাহেব অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো জামাল ভাই?

পরিচয় হলো, আপনি ঠিকই বলেছেন, খুব গম্ভীর মানুষ। এই লোককে দিয়ে আমার কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না।

আমি শুনেছি তিনি গম্ভীর হলেও মানুষ ভালো এবং ক্ষমতাবান।

সুমন সাহেব এমন একজন ক্ষমতাবান মানুষকে তো আমার খুব প্রয়োজন কিন্তু কীভাবে?

জামাল ভাই ব্যস্ত হলে হবেন না। আপনি ইমরান ভাই আর মোজাফফর ভাই’র মাধ্যমে আমজাদ ভাইকে ম্যানেজ করতে পারবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ সুমন সাহেব।

পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে জামাল মোস্তফা সাহেবকে মোবাইল করল, বড়ভাই আপনি কি ঢাকায় ফিরেছেন?

না আমি তো আগামীকাল বিকেলে ঢাকায় ফিরবো।

বড়ভাই আমি তো আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেদিন থেকে ঢাকাতেই আছি।

তাই নাকি?

বড়ভাই আমি তাহলে কাল কখন আসবো?

তুমি কাল সন্ধ্যায় এসো।

জামালকে দেখে মাননীয় মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর জামাল? তুমি এতদিন ঢাকায়?

জি বড়ভাই, ঢাকা একটা কাজে এসেছিলাম, কাজ হয়ে গেল, মনে করলাম দু’য়েকদিন থেকে আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। কিন্তু এসে যা দেখলাম-

কি দেখলে?

আপনার এখানেও তো লোকজনের ভিড় কম না।

হ্যাঁ কী করব? জনপ্রতিনিধি, কাউকে তো না করতে পারি না।

তা ঠিক আছে কিন্তু বড়ভাই আমাদের দলের নেতা কর্মীরা তো আমার সঙ্গে কথা না বলে সরাসরি আপনার কাছে আসে না, এখানে যারা এসেছে তাদের সবাই তো আমাদের দলের না। কাজেই আপনি এভাবে ঢালাও কাজ করাতে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হবে। আমার মনে হয় যে কারো কোন কাজের জন্য সুপারিশ করার আগে সে আমাদের দলের কি না তা দেখে করা উচিৎ।

জামাল তুমি দলের নেতা আর আমি এলাকার মন্ত্রী। তুমি শুধুমাত্র দলের ভালো-মন্দ দেখো, দলের নেতাকর্মীর সুযোগ সুবিধা দেখ আর আমাকে পুরো এলাকার ভালো-মন্দ দেখতে হয়। আর একজন লোক যখন কোন কাজের জন্য আমার কাছে আসে তখন তাকে জিজ্ঞেস করা যায় না যে আপনি কোন দল করেন?

জামাল মনে মনে বলল, বড়ভাই আপনি বেশ ঝানু মাল, ভোটের রাজনীতি আপনি বেশ ভালোই বুঝেন। ভাবছিলাম উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে আপনাকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবো। তা আর হচ্ছে না। খুব সহজে আপনাকে সরিয়ে দিয়ে আমার নোমিনেশন পাওয়া হবে না। তবুও আমি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কিভাবে নোমিনেশন পাওয়া যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

মাননীয় মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, জামাল, কি কোন সমস্যা?

না বড়ভাই, কোন সমস্যা নেই। আসলে আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে, আপনার অভিজ্ঞতা অনেক, তাই আপনি ঠিকই বুঝেছেন।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, একেই বলে বাস্তব অভিজ্ঞতা, আরো অনেকদিন রাজনীতি করো ধীরে ধীরে সব বুঝবে।

জামাল মনে মনে বলল, হ্যাঁ আমি ধীরে ধীরে সব বুঝব আর আপনি সারাজীবন মন্ত্রী গিরি করবেন?

জামাল তোমাকে খুব এ্যাবসেন্ট মাইন্ড দেখাচ্ছে, কোন সমস্যা থাকলে বলো।

না বড়ভাই কোন সমস্যা হলে আপনাকে বলব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

জামাল মাননীয় মন্ত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটা বেজে গেছে। সে সোজা হোটেলে চলে গেল।

জামালের কিছুতেই ঘুম আসছে না। অনেকগুলো চিন্তা ভিড় করছে আগামী নির্বাচনে বোধ হয় নোমিনেশন পাওয়া যাবে না। জামাল একবার নিজের বয়স হিসেব করল, আমার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ বছর, রাজনীতিতে এ বয়সটা বোধ হয় বিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে না। বয়সে ছোট বলে সবাই আমাকে স্নেহ করেন কিন্তু নোমিনেশন পাওয়ার জন্য আমাকে এখনো যোগ্য মনে করেন না। বয়সের অজুহাতে বসে থাকলে তো আর চলবে না। সমস্ত কিছু করতে হবে মোস্তফা ভাইকে কোনকিছু বুঝতে না দিয়েই। যেমন করেই হোক নোমিনেশন আমার চাই-ই, আমার সামনে এখন অনেক স্বপ্ন, আমাকে আগামী নির্বাচনে নোমিনেশন নিতে হবে, এম.পি নির্বাচিত হতে হবে, মন্ত্রী হতে হবে, আমার তে পতপত করে জাতীয় পতাকা উড়বে এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল।

 চলবে…..

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস