এটা কি পৃথিবী নাকি অন্য কোন গ্রহ? এখানকার মাটি এমন কেন? এখানকার আলো-বাতাস, এখানকার বাতাসে একটা গন্ধ, কেমন যেন একটা গন্ধ? এ গন্ধ তো আমার একেবারে অপরিচিত এ কোথায় এলাম আমি? আমি কোথায়? সূর্য নেই, চাঁদ নেই অথচ আলোকিত, যেন জোছনার মত আলোকিত সবকিছু বলতে বলতে ভয়ে মিনুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল।
মিনু কাত ফেরার চেষ্টা করল কিন্তু সে শুধু মাথা সামান্য ঘুরাতে পারছে পুরো শরীর কাত ফেরাতে পারছে না। কাত ফেরার ব্যর্থ চেষ্টায় সামান্য মাথা ঘুরিয়ে যা দেখতে পেল তাতে উপরে আকাশ, আকাশে বিচিত্র রঙের মেঘ, বিভিন্ন রঙের তারকা কিন্তু চাঁদ কিংবা সূর্য কিছু নেই। গাছের গোড়া দেখা যাচ্ছে না, শুধু ডালপালা, মিনু মনে করল পুরো কাত ফিরতে পারছে না বলে সে হয়ত গাছের গোড়া দেখতে পারছে না শুধু ডালপালা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু বাড়ি-ঘর? কোন বাড়ি-ঘর তো চোখে পড়বে! মিনু মাথা ঘুরিয়ে বাড়ি-ঘর খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু দিগন্ত পর্যন্ত কোন বাড়ি-ঘর নেই, আর দিগন্ত? দিগন্তের শেষ কোথায়? না এ দিগন্তের যেন শেষ নেই, এ যেন অসীম দিগন্তের কোন এক ভিন্ন পৃথিবী, অন্য কোন গ্রহ।
অন্য গ্রহ, অন্য পৃথিবী! মিনু কি মৃত নাকি জীবিত? জীবিত হলে এটা কোন পৃথিবীতে সে, যে পৃথিবীর আলো বাতাস সম্পূর্ণ আলাদা, যে পৃথিবীর বাতাসের গন্ধ আলাদা, যে পৃথিবী চন্দ্র সূর্য ছাড়াই আলোকিত! মিনু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান নেই বললেই চলে সে তো আধুনিক প্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত, সে বিজ্ঞান বিশ্বাস করে যে সামান্য ধর্মীয় জ্ঞান আছে তা বিভিন্ন সময় শুনেছে, মৃত্যুর পর ভালো-মন্দের, পাপ-পূণ্যের বিচার হবে, সেখানে অপরাধী হলে তার জন্য আছে ভয়ানক শাস্তি কিন্তু এখানে তো শাস্তির কিছু দেখি না, বলে মিনু আবার কাত ফেরার চেষ্টা করল কিন্তু না সে কাত ফিরতে পারল না। আর পূণ্যবানদের জন্য আছে পুরস্কার, বেহেশত। যেখানে থাকবে, অত্যন্ত সুস্বাদু পানীয়ের নদী, যাকে ধর্মীয় ভাষায় বলা হয়েছে নহর। যেখানে থাকবে ফুলে-ফলে ভরা আলাদা জগৎ, থাকবে অনন্ত যৌবনা নারী। নারী কথাটা মনে পড়তেই মিনুর অজান্তেই একটা কষ্টের হাসি বেরিয়ে এলো।
মিনুর সঙ্গে পড়ত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছাত্র-ছাত্রী। তাদের মধ্যে ছিল জয়ন্ত বড়ুয়া, সন্তোষ কুমার রায়, স্টিফেন রোজারিও। তাদের একেকজনের ধর্ম বিশ্বাস একেকরকম। কারও ধর্মে পুন:জন্ম বলে একটা কথা আছে যেখানে কেউ যদি ভালো কাজ করে তবে তার পরজন্ম ভালোই হবে আর কেউ যদি খারাপ কাজ করে, পাপ করে তবে পৃথিবীতে তার আগমন ঘটবে ভয়ঙ্কর এবং ঘৃণ্য প্রাণী হিসেবে কিন্তু আমি তো মানুষই আছি। আমি জীবিত নাকি মৃত? আমি পৃথিবীতে নাকি অন্য কোন জগতে। কাকে জিজ্ঞেস করব, কাকে? ঘোরের মধ্যে কথাগুলো আপনমনে বলতে বলতে আতঙ্কে মিনুর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। সে জোরে চিৎকার করে উঠল, কে আছেন আমাকে বাঁচান, কে আছেন, প্লিজ আমাকে বাঁচান।
মিনু লক্ষ্য করল সে চিৎকার করছে কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।
একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, নারী কণ্ঠস্বর, এখানে মৃত্যু নেই বন্ধু। ভয় নেই তুমি আর মরবে না।
তুমি? কে তুমি?
চিনতে পারছ না, আমাকে চিনতে পারছ না। একবার মনে করে দেখ চেন কী না?
মিনু মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু সে মনে করতে পারছে না। মেয়েটির কণ্ঠস্বরও তো অন্যরকম। মানুষের কণ্ঠস্বরের মত না কিন্তু কথাগুলো বাংলায়, হ্যাঁ, হ্যাঁ মেয়েটি বাংলায় কথা বলছে। তবুও ভালো মেয়েটি বাংলায় কথা বলছে বলে বুঝতে পারব কিন্তু কণ্ঠস্বরটা এমন কেন? ভাঙ্গা ভাঙ্গা, শীতে কম্পমান মনে হচ্ছে, কণ্ঠস্বরটাও স্বাভাবিক না।
মেয়েটি আবার তাড়া করল, চিনতে পারছ না।
ভয়ে মিনুর কণ্ঠস্বর শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে তোতলাতে তোতলাতে, না, না মানে আমি আসলে…
মিনুর কথা শেষ হওয়ার আগে মেয়েটি বলল, চিনতে পারছ না এই তো?
মিনু আমতা আমতা করে বলল, তুমি ঠিক বলেছ?
একবার মনে করে দেখ একটা মেয়ে তোমাকে ভালোবাসতো…
একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসতো? একটা মেয়ে, একটা মেয়ে…
মেয়েটি ধমকের সুরে বলল, একটা মেয়ে, একটা মেয়ে করছ কেন? বল তোমাকে তো অনেক মেয়ে ভালোবেসেছে।
না, না আসলে আমি মনে করতে পারছি না।
মনে থাকবে না তো, অনেক মেয়েই তো তোমাকে ভালোবাসতো, তোমার চেহারাটা ছিল খুব সুন্দর, ফর্সা, লম্বা, স্মার্ট আর তুমি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে মেয়েদের মনজয় করতে পারতে, না, না মনজয় করতে না, ইমোশনালি ব্লাকমেইল করতে পারতে। তাই অনেক মেয়েই তোমাকে ভালোবাসত। পোকামাকড় যেমন আলো দেখে দূর থেকে ছুটে আসে তেমনি মেয়েরাও একবার তোমার সঙ্গে পরিচিত হলে তোমার কথার বুননি আর সুদর্শন চেহারা দেখে দূর থেকে ছুটে আসত আর পোকামাকড় যেমন আগুনে পুড়ে মরত তেমনি মেয়েরাও তোমার ভালোবাসা আগুনে পুড়ে মরত।
মিনু কিছুটা রেগে গেল, এই মেয়ে, এই, কী বলছ তুমি?
এটা তোমাদের তথাকথিত পৃথিবী না যে মিথ্যা কথা বলবে। এটা তোমাদের তথাকথিত পৃথিবী না যে অর্থ-বিত্ত, প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে ধমক দিয়ে কারও মুখ বন্ধ করবে। এখানে সবাই সত্য কথা বলে।
তুমি, তুমি কে বলত?
আমি কে এটা জানা তোমার জন্য খুব জরুরি না। মনে কর তোমার মিথ্যা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে মরা মেয়েদের আমিও একজন। তুমি তো অসংখ্য মেয়ের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছ, কতজনকে আর মনে রাখবে, বল?
তোমার কথাগুলো আমার পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বরটা…
হবেই তো, আমার কথা, আমার মুখ, আমার ঠোঁট, আমার সমস্ত শরীর তোমার খুব পরিচিত, এখনও কি আমাকে চিনতে পাচ্ছ না? পাবে কীভাবে তুমি তো অসংখ্য জনের শরীরে স্বাদ পেয়েছ, যদি শুধু একজনের স্বাদ নিয়েই ক্ষান্ত থাকতে তবে আমার পরিচয় দিতে এতগুলো হিনটস দিতে হত না। কণ্ঠস্বর যতই পরিবর্তন হোক কথাগুলো তো বুঝতে পাচ্ছ।
মিনু মনে করার চেষ্টা করল, তুমি, তুমি, উফ্, তোমার নামটা মুখে আসতে আসতে আসছে না। তুমি কি ইচ্ছা করে আমাকে বোকা বানানোর জন্য কণ্ঠস্বর বিকৃত করে কথা বলছ।
মেয়েটি প্রচণ্ড রেগে গেল, সে ধমকের সুরে বলল, চুপ, একটা কথাও না। আমি তোমাকে বলেছি না এখানে কেউ মিথ্যা কথা বলে না। কেউ কারও সাথে প্রতারণা করে না, চালাকিও করে না। এখানে সবার কণ্ঠস্বরই বিকৃত। এখানে যে যেভাবে এসেছে তার কণ্ঠস্বরটাও সেভাবেই হয়ে গেছে। একবার মনে করে দেখতো একটা মেয়ে প্রচণ্ড শীতের রাতে গাজিপুর ফরেস্টে…
গাজিপুর, গাজিপুর, কী হয়েছিল গাজিপুর ফরেস্টে?
এখনও মনে করতে পারছ না কী হয়েছিল। আর কোন মেয়ের সাথে হয়েছিল।
তুমি, তুমি কি মু, মু, মুক্তা? মিনু তোতলাতে তোতলাতে শেষ পর্যন্ত বলতে পারল।
হ্যাঁ মুক্তা, আমি মুক্তা, এখন মনে করার চেষ্টা কর কী হয়েছিল গাজিপুর ফরেস্টে।
তুমি, তুমি না মরে গেছ? তুমি না মৃত?
আমি মরে গেছি? হা হা হা। এটা তথাকথিত পৃথিবী না যে মিথ্যা কথা বলে তুমি বেঁচে যাবে। এখানে তোমার সব কৃতকর্মের প্রমাণ আছে। তুমি চাইলেও কিচ্ছু গোপন করতে পারবে না। এটা অন্যরকম পৃথিবী, এই পৃথিবীতে মিথ্যা নেই, ভালোবাসার নামে প্রতারণা নেই, সততার নামে শঠতা নেই, তবে জবাবদিহিতা আছে তোমাদের পৃথিবীর প্রত্যেকটি কর্মের জন্য জবাবদিহিতা আছে। ভালো কাজের পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে, কঠোর শাস্তি।
মিনুর কণ্ঠস্বর শুকিয়ে গেল, মুক্তা তুমি কি শেষ বিচারের কথা বলছ?
তুমি তো স্রষ্টায় বিশ্বাস করতে না, পৃথিবীর সব কাজকর্মের বিচার হবে এটাও বিশ্বাস করতে না। তুমি মনে করতে পৃথিবীতে মানুষ আসবে, তুমি বৈধ কিংবা অবৈধ বিত্তবৈভবের মালিক হবে, আনন্দ-ফুর্তি করবে তারপর একদিন পৃথিবী থেকে চলে যাবে। তবে আজ কেন বিচারের কথা শুনে তোমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে?
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, মুক্তা প্লিজ!
আমিও তোমাকে প্লিজ বলেছিলাম, তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে? তোমার লেলিয়ে দেয়া হায়েনারা আমাকে…বলতে বলতে মুক্তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
মুক্তা প্লিজ হেল্প মি। মুক্তা আমাকে বল আসলে আমি কোথায় আছি, আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি?
তোমাদের পৃথিবীর নিয়মে বেঁচে থাকা মরে যাওয়া আছে কিন্তু প্রাণের আসলে মৃত্যু নেই, আছে স্থানান্তর। তোমরা আসলে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে থাক, তোমাদের কাছে আত্মার স্থানান্তর মানে মৃত্যু বলে মুক্তা একটা বিকট হাসি হেসে বলল, তোমরা কত বোকা!!!
কিন্তু আমার যে ওখানে অনেক কাজ ছিল, আমার অনেক অতৃপ্তি ছিল, অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল।
পৃথিবীতে সবারই অতৃপ্তি থাকে, অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে, অনেক কষ্ট থাকে। পৃথিবী আসলে তৃপ্তির জায়গা না, পৃথিবীতে যারা সুখ আশা করে, স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষা করে তারা সারাজীবন শুধু হৃদয়ে দুঃখই লালন করে, সুখের জন্য ছুটে বেড়ায়। আর একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় হয় অতৃপ্তি নিয়ে।
তুমি ঠিকই বলেছ মুক্তা।
আমি তো বলেছি এখানে কেউ কারও মন জয় করার জন্য গল্প বানায় না।
একটা লাল তপ্ত ছুরির মত অতি উচ্চ মাত্রার আলো আকাশের মাঝখান থেকে যেন ঈশান কোণে গিয়ে ভূমিতে পতিত হলো, তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরই একটা বিকট শব্দ হলো যেন মিনুর কানের পর্দা ফেটে গেল। সে যেন ভূুমি থেকে কয়েক ফুট লাফিয়ে উঠে আবার নিচে পড়ে গেল।
মুক্তা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, এবার আমাকে যেতে হবে, চললাম, বলে মুক্তা মিনুকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
মিনু কান্নার স্বরে বলল, মুক্তা একটু দাঁড়াও, মুক্তা একবার দেখা দাও, মুক্তা হাজার হলেও একসময় তুমি আমার বন্ধু ছিলে, তুমি আমার হৃদয়ের মানুষ ছিলে, মুক্তা, মুক্তা।
আমি তোমার হৃদয়ের মানুষ ছিলাম, বলে হা হা হা করে একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে আবার হাসিটা প্রতিধ্বনিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেল।
আবার প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাত হলো। এবার আরও বেশি আলোকিত এবং আরও হাজারগুণ বেশি শব্দ হলো। মিনুর কানের পর্দা ফেটে গেল। সে অনেক উপরে লাফিয়ে উঠে আবার মাটিতে পড়ে গেল। তারপর আর মিনুর কোন কথা মনে নেই। সে মনে করার চেষ্টা করছে, তার চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল মুক্তার ছবি।
মিনুর বয়স তখন বাইশ তেইশ বছর হবে। সে তখন ফেসবুকের নেশায় আসক্ত ছিল। তার অনেকগুলো ফেসবুক আইডি ছিল। একটা আইডি ছিল হীরা নামে। মিনু যখনই সেই আইডি’তে বসত তখনই তার চোখের সামনে একটা আইডি ভেসে উঠত, “বনফুল’’। মিনু বনফুল আইডি’তে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেই বনফুল বন্ধুত্বের আহবান গ্রহণ করল। তারপর মিনু প্রথম লিখল, হাই।
হাই।
হাউ আর ইউ ফ্রেন্ড?
বনফুল লিখল, নাইস, ইউ?
আই অ্যাম অলসো নাইস। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?
নাথিং।
মিনু লিখল, আই অলসো আস্কড ইউ অ্যাবাউট ইওর প্রফেশন।
আই অ্যাম অলসো স্টুডেন্ট, অনার্স ফাইনাল ইয়ার, ইউ?
এম.বি.এ করছি, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে।
বনফুল লিখল, ওয়াও। নাইস টু মিট ইউ।
আই অ্যাম অলসো নাইস টু মিট ইউ। আপনি কোন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছেন?
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে, আপনি?
দিনাজপুর সরকারি কলেজে। এখন কিন্তু আমাদের কোন ডাউট নেই যে আমি আপনার চেয়ে জুনিয়র। সো আপনি আমাকে তুমি করে ডাকবেন।
নো, নো ডিয়ার আমাদের ফ্রেন্ডশিপে কোন সিনিয়র জুনিয়র নেই। অল আর ইকুয়্যাল। তুমিও আমাকে তুমি বলে ডেকো, ওকে?
বনফুল লিখল, না, না, তা হবে না। আমি আপনাকে তুমি বলে ডাকতে পারব না।
কেন?
না। আমার লজ্জা করে।
মিনু আর জোর করল না। সে লিখল, ওকে, তুমি যখন চাচ্ছ না তবে আপনিই বল। যখন মনে হবে তখন তুমি বল।
বনফুল লিখল, থ্যাংক ইউ ডিয়ার।
মিনু লিখল, আমি কিন্তু এখনও তোমার নাম জানলাম না। বলবে প্লিজ!
নো, নো প্লিজ! আমার আরও আগে বলা উচিত ছিল। আমার নাম ময়মুনা বেগম মুক্তা। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
মিনু লিখল, অফকোর্স। একটা কেন তোমার যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পার।
আপনার নাম তো হীরা?
ইয়েস। হ্যাভ ইউ এ্যানি ডাউট?
আসলে আমি পরিচিত জন ছাড়া কার রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করি না, আপনার নাম হীরা দেখে এক্সেপ্ট করলাম, ভাবলাম হীরা-মুক্তা মানাবে ভালো।
থ্যাংকস। নামের জোরে আমি তোমার মত একটা বিউটিফুল এন্ড সুইট ফ্রেন্ড পেলাম।
হা হা হা। আমি বিউটিফুল!
অফকোর্স।
মুক্তা লিখল, থ্যাংকস, ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস।
অনেকক্ষণ থেকে মিনুর কলিং বেল বেজেই চলছে কিন্তু তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে মুক্তার সঙ্গে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। অবশেষে বর্ষা ফোন করল।
মিনু বর্ষার ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
হ্যালো, কী হয়েছে তোমার?
কেন?
আমি অনেকক্ষণ থেকে কলিং বেল দিচ্ছি আর তুমি দরজা খুলছ না।
ওকে আমি আসছি। জাস্ট এ মিনিট।
মিনু অনেকক্ষণ থেকে মুক্তার লেখার রিপ্লাই না দেয়ায় সে লিখল, আপনি কি ব্যস্ত?
একটু…
ডিনার করেছেন?
না, করব।
মুক্তা লিখল, ম্যাডাম ডাকছে বুঝি?
ম্যাডাম…
ম্যাডাম নেই?
আমি তো বলেছি আমি এম.বি.এ করছি, স্টুডেন্ট।
স্টুডেন্টদের বুঝি ম্যাডাম থাকে না।
তুমি হবে…
দুই
মিনু কৈশোর থেকে বেড়ে ওঠাটাই ছিল অন্যরকমভাবে। মিনুর মা-বাবার দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের না হওয়ার কোনও কারণও ছিল না। উভয় পরিবারের আয়োজনে এবং মতলুব ও ডলির সম্মতিতে বিয়ে, আগে যে জানাশোনা ছিল না এমনও নয়। দু’জনের পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া এবং জন্ম থেকে দুজনের বড় হয়ে ওঠা সবকিছুতেই দুজনের অনেক মিল কিন্তু দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কোন ঘটনা আছে যা তাদের দুজনের মধ্যে সুখের ঘরে একটা বাধা তৈরি করে।
মিনুর বাবা আব্দুস সোহবহান চৌধুরী অনেক বড় ব্যবসায়ী, অঢেল সম্পদের মালিক। চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট, স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্য আলাদা আলাদা গাড়ি। চৌধুরী সাহেবের একাধিক ব্যবসা, দুহাতে টাকা রোজগার করে আর ব্যয়ও করে উদার হস্তে। অঢেল অর্থ, ঘরে সুন্দরী স্ত্রী, স্ত্রীর মন রাখার জন্য চৌধুরী সাহেব সবসময় সচেষ্ট থাকত কিন্তু স্ত্রীর মন জয় করা একটি দুর্বোধ্য কাজও বটে, কত রথী মহারথীগণ স্ত্রীর মন জয় করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তবুও সবাই চেষ্টা করে গৃহসুখ আর একটা সুন্দর মুখের হাসির জন্য। চৌধুরী সাহেব তাদেরই একজন যারা স্ত্রীর মন জয় করা কঠিন কাজ জেনেও শত ব্যস্ততার মাঝে স্ত্রীর সুখের কথা ভেবে, স্ত্রীকে সময় দেয়, স্ত্রীর মন বোঝার চেষ্টা করে। চৌধুরী সাহেবও ডলির সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখ তো। ডলি চাওয়া মাত্র টাকা-পয়সা, গয়না যখন যা চায় তাই দিয়ে দেয়।
মিনুর মা ডলি চৌধুরী গৃহিণী, রূপে-গুণে অনন্য এক নারী। ডলিও ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে, ধনাঢ্য পরিবার হিসেবে ডলির পরিবারের একটা নাম আছে। তাই ডলি জন্ম থেকে ভোগ বিলাসের সঙ্গে বড় হয়েছে। আসলে মতলুব চৌধুরীর সঙ্গে ডলির বিয়েটা ডলির বাবা-মা মেনে নিত না বিত্তবৈষম্যের কারণে, ডলি যখন মতলুব চৌধুরীকে বিয়ে করার কথা বলে তখন তার মা প্রতিবাদ করল। বলল, ওরা নতুন ধনী হয়েছে আর আমরা বনেদি। আমাদের সাথে ওদের সম্পর্ক ভালো হবে না, ওখানে তোর বাবা তোকে বিয়ে দিতে রাজি হবে না আর যেখানে মা-বাবার দোয়া থাকবে না সেখানে তুই সুখীও হতে পারবি না।
মায়ের কথা শুনেই ডলি বুঝল মা-বাবাকে বললে ওরা কোনদিন তাকে মতলুবকে বিয়ে করতে দিবে না। তাই সে আর মা-বাবাকে কিছু বলেনি, মতলুবকে বলল আর মতলুব সব আয়োজন করল। তাদের দুজনের জীবনেই কোন অপ্রাপ্তি ছিল না, কোন অতৃপ্তিও ছিল না কিন্তু তারপরও দুজনের মধ্যে এমন কোন ঘটনা আছে যা মতলুব কোনদিন মেনে নিতে পারেনি তাই তাদের সবকিছু থেকেও যেন সুখের অভাবটা প্রকট।
অথচ ডলি-মতলুব দম্পতি বিয়ের আগে কতই না সুখের স্বপ্ন দেখ তো। বাধাহীন সব জয় করে তারা যেন সুখের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই গিয়েছিল কিন্তু এমন কী ঘটল যে সুখের ঘরেও ফাটল দেখা দিল। যা কেউ কোনদিন কাউকে বলতেও পারে না।
জীবনে এমন অনেক অপ্রকাশিত ঘটনা থাকে যা কেউ কোনদিন প্রকাশ করতে পারে না বরং সতর্কভাবে গোপন রাখে। এই গোপন রাখায় যে যতটুকু সতর্ক সে সংসার জীবনে ততটুকু সফল ও সুখী। অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রকাশিত কোন ঘটনাই কি অসতর্কভাবে বেরিয়ে পড়েছিল চৌধুরী সাহেব কিংবা ডলির জীবনে যে কারণে তাদের সুন্দর, পরিপাটি, সাজান সংসারে বিষ ছড়িয়েছে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস বিষাক্ত সাপের ছোঁবলের মত শরীরের রক্ত পানি করে দেয় অথচ বাইরে থেকে মনে হয় তরতাজা একটি মানুষ, একটি সম্পর্কও তেমনি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের সৃষ্টি হলে বাইরে থেকে দুজনকেই খুব সুখিই মনে হয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে থাকে বিশাল দূরত্ব।
চৌধুরী সাহেব আর ডলির জীবনেও কি তেমনি কোন ঘটনা আছে যা তারা দুজন ছাড়া কেউ-ই জানে না। হয়ত ডলির জীবনে আছে, এতদিন গোপন ছিল হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছে আর তা জেনেই মতলুব আর ডলির দাম্পত্য জীবনে সন্দেহ আর অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। ঠিক একই ঘটনা উল্টোও হতে পারে। যাই হোক কিছু না কিছু তো একটা আছে।
দাম্পত্যজীবনের শুরুটা এরকমই ছিল। চৌধুরী সাহেব ব্যবসার কাজে সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যেত, সারাদিন টাকার পেছনে, সফলতার পেছনে ছুটোছুটি করত। রাতে বাসায় ফিরত ক্লান্ত দেহ নিয়ে। ড্রয়িং রুমে ঢুকে কোনোরকমে কাপড় ছেড়ে সোফায় গা এলিয়ে বসত। ডলি ততক্ষণে সরবত তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকত।
চৌধুরী সাহেব সরবত খেয়ে বলত, থ্যাংক ইউ ডলি।
সত্যি সত্যি ডলি যেমন স্বপ্ন দেখেছিল তেমনই একটা সংসার পেয়েছিল সে কিন্তু ছোট্ট একটা ঘটনা, না ছোট্ট না, একটি ঘটনাই তার জীবনের সব সুখ, সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। ডলি তার ভুলের জন্য বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করল কিন্তু চৌধুরী সাহেবের একই কথা, এটা ক্ষমার যোগ্য অপরাধ না ডলি, পৃথিবীর কোন মানুষ এটা মেনে নিবে না। আমি, আমি তোমাকে…
না, কথাটা শেষ করতে দেয়নি ডলি, চৌধুরী সাহেবের মুখে হাত দিয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, ঘটনার এখানেই যবনিকাপাত হলে সবকিছু ঠিকঠাকই থাকত কিন্তু এখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত হলো। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্মানের সম্পর্ক নষ্ট হলো, স্বামী স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস হারাল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়ল, একটা মধুর সম্পর্ক যন্ত্রণাময় হলো।
চৌধুরী সাহেব একবার ডলিকে ডিভোর্স দেয়ার কথা চিন্তা করেছিল কিন্তু মিনুর বয়স তখন সবেমাত্র তিন বছর আর সামাজিক মর্যাদা তো আছেই। ডলি চৌধুরী সাহেবের সামাজিক মর্যাদা আর আবেগকে আশ্রয় করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি একবার আমাদের মিনুর মুখের দিকে তাকাও, মাসুম বাচ্চাটা কী দোষ করেছে, দেখ, দেখ তুমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ, কত সুন্দর একটা ইনোসেন্ট বয়। আমি দোষ করতে পারি কিন্তু মিনু কী দোষ করেছে যে আমার দোষের শাস্তি তাকেও ভোগ করতে হবে।
ঠিক এমন সময় মিনু আব্বু, আব্বু করে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে এসে তার বাবার কোলে উঠল। চৌধুরী সাহেব খুব শক্ত মানুষ তবুও নিজের সন্তান যখন আব্বু আব্বু বলে তার কোলে এলো তখন সে আর ডলিকে ডিভোর্স করার কথা বলতে পারল না ঠিকই কিন্তু একসময়ের মধুর, ছন্দময়, বর্ণালী সম্পর্কটা যেন হয়ে গেল একটা ছন্দহীন, বিবর্ণ সম্পর্ক।
সেই থেকে চৌধুরী সাহেব বিপথে পা বাড়াল। ঘরের সুখ বাইরে খুঁজতে শুরু করল। বিত্তবান মানুষ, হাতের কাছে সব সুযোগ তো আছেই, চৌধুরী সাহেব শুধু একটু ইশারা করলেই হাতের কাছে সব এসে ধরা দেয়। আগে চৌধুরী সাহেব এসব কৃত্রিম সুখ থেকে মুখ ফিরিয়েছিল এবার একটু ইশারা করতেই সব কৃত্রিম সুখ যেন তার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়ল।
চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ডলির মানসিক দূরত্ব তৈরি হলো, শুধু দূরত্বই না বলতে গেলে তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা হলো শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে কথা বলত না, কেউ কারও বেডরুমে পর্যন্ত যেত না। একই ছাদের নিচে স্বামী স্ত্রী দুজনের দুটো আলাদা আলাদা জগৎ, যা বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না।
শৈশবে মিনু দেখ তো স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে, পরীক্ষা কিংবা রেজাল্টের দিন বেশিরভাগ ছাত্রের বাবা-মা দুজনে যেত কিন্তু মিনুর বাবা কখনও যেত না। কোন পিকনিক বা তার কোন বন্ধুর জন্মদিনে তার বন্ধুদের বাবা-মা দুজনে যেত তার বাবা যেত না। তবে দুজনে একসঙ্গে না গেলেও কখনও কখনও বাবা তাকে একাই বেড়াতে নিয়ে যেত, বংশের একমাত্র কর্ণধার হিসেবে সবার সাথে পরিচয় করে দিত। সবই ঠিক ছিল শুধু কোথায় যেন বাবা মার মধ্যে প্রচ্ছন্ন দূরত্ব মিনু অনুভব করত যে কথা মিনু না পারতো কাউকে জিজ্ঞেস করতে, না পারতো কাউকে বলতে। তবুও সম্পর্কটা সহনীয় ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার বাবা যেন বদলে গেল।
সেদিন ছিল শুক্রবার, চৌধুরী সাহেব শুক্রবার সারাদিন বাড়িতেই থাকে। বিশাল সীমানা প্রাচীর ঘেরা বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে ডান পাশে গাড়ি রাখার গ্যারেজ, গ্যারেজ থেকে সরু রাস্তা চলে গেছে বাসায়। একটা ডুপ্লেঙ বাসা, এই ডুপ্লেঙ বাসার দোতলায় থাকে চৌধুরী সাহেব। গ্যারেজ থেকে যে রাস্তাটা বাসায় ঢুকেছে সেই রাস্তার দুপাশে সারি সারি সাজান বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ। অফিস ছুটির এই দিনে চৌধুরী সাহেব বেশিরভাগ সময় কাটায় এই ফুল গাছ পরিচর্যা করে।
বিকেলে ফুল গাছের পরিচর্যা করে চৌধুরী সাহেব বাসায় ওঠে, হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং ঢুকে। ততক্ষণে তার টেবিলে বিস্কুট আর চা পৌঁছে গেছে। কে পৌঁছে দিয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, দুজনের প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা হয় না কিন্তু কারও প্রতি কারও দায়িত্ব পালনে ত্রুটিও হয় না। ডলি টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিয়ে তার আর মিনুর জন্য নাস্তা তৈরি করে আর লক্ষ্য রাখে মতলুব কিছু চায় কী না।
কোনদিন কিছু চায় না কিন্তু তবুও ডলি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। হঠাৎ আজ মতলুব ডাকলো, ডলি।
ডলি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এলো।
মতলুব মাথা নিচু করে একটা বিস্কুট নিচ্ছিল। সেভাবেই বলল, মিনু তো ফাইভ পাস করল, এখন ওকে ঢাকায় কোন ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলে কেমন হয়?
প্রশ্নটা খুব সহজ মনে হলেও ডলির জন্য অনেক কঠিন। সে কয়েক মুহূর্ত মতলুবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা তার বড় অচেনা, কোনটা তার আসল কথা আর কোনটা তার মনের কথা এটা বোঝা বড় কঠিন। ডলির মনে অনেকগুলো প্রশ্ন দেখা দিল, মতলুব কি আমার পরীক্ষা নিচ্ছে? সে তো কোনদিন কোন বিষয়ে আলোচনা করে না, কারও মতামত নেয় না। যা করার নিজেই করে, আজ আবার মিনুকে ঢাকায় পড়াবে কী না জানতে চাচ্ছে কেন? মিনুকে ঢাকায় পড়ানর নাম করে আমাকেও দূরে সরাতে চাচ্ছে না তো? নাকি সে ইচ্ছা করেই ডলিকে ঢাকায় শিফট করে তার কাছে যেতে উদ্বুদ্ধ করছে। তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়ালো, মানে মতলুব সব জানে এবং তাকে সরিয়ে দিতে এই কথা বলছে।
ডলির কোন উত্তর না পেয়ে মতলুব জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছ না যে?
না আমি ভাবছি তুমি তো আমাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস কর না, যা করার একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কর। আজ আবার মিনুর বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছ তো তাই অবাক হচ্ছি।
কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করি না মানে এই নয় যে কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করব না।
অনেকদিন ভালোবাসাহীন দাম্পত্যে ডলিও হাঁপিয়ে উঠেছে। মতলুবের সাথে সে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে সেটা নিয়ে অনেকটা দুশ্চিন্তায় ছিল। মতলুবের এ কথায় সে খুব একটা অখুশি হলো না। সে বলল, দেখ, এটা তোমার ইচ্ছা। আমার কোনোকিছুতে না নেই। তুমি যদি মনে কর তাতে মিনুর লেখাপড়া ভালো হবে তবে পাঠাবে।
আর তুমি?
আমার বিষয়টাও তুমি জান, তুমি যদি মিনুকে হোস্টেলে রাখতে চাও তবে হোস্টেলে রাখ আর যদি মনে কর আমাদের বাসায় রাখবে তবে বাসায় থাকুক।
তুমি কি বাসায় থাকতে চাও?
মিনুকে বাসায় রাখলে তো আমারও থাকা উচিত, ওর দেখাশুনা কে করবে।
চৌধুরী সাহেব আর কিছু বলল না। কয়েকদিন পর ডলি আর মিনুকে ঢাকার বাসায় পাঠিয়ে দিল।
যাওয়ার দিন মিনু একবার বাবার কাছ থেকে চলে না যেতে মার কাছে আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু মা তাকে মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিল, ঢাকায় তোর অনেক ভালো লাগবে বাবা, তাছাড়া আমি তো আছি, তোর বাবাও তো মাঝে মাঝে ঢাকা আসবে।
মিনু বাবার কাছেও বায়না ধরলো সে ঢাকা যাবে না কিন্তু বাবাও তাকে মায়ের মতই সান্ত্বনা দিয়ে বলল মা ঠিকই বলেছে বাবা, ঢাকায় তোর মাসহ থাকবি।
মিনু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা তুমি আসবে তো?
চৌধুরী সাহেব অনেক শক্ত আর সবসময় হাসিমুখে থাকে, তার বুকে যে কষ্টের পাথর চাপা দেয়া আছে তা কেউ কোনদিন জানাত না। মিনু বাবার মুখ কোনদিন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বা গম্ভীর দেখেনি কিন্তু আজ মিনু যখন গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা তুমি আসবে তো? তখন চৌধুরী সাহেবের চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল।
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বাবা তুমি কাঁদছ?
মিনু ভেবেছিল তা মা বুঝি বাবার চোখে পানি দেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলবে, হয়ত বাবাকে ছেড়ে যেতে তার মায়ের চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে কিন্তু না, তার মায়ের মধ্যে তেমন কোন অনুভূতি নেই।
চৌধুরী সাহেব রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ বাবা। অবশ্যই আসব।
সেদিনই মিনু আর তার মা ঢাকা চলে এলো।
মা-ছেলের নতুন জীবন শুরু হলো। ঢাকায় নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকা, মিনুর স্কুল যাওয়া-আসার জন্য গাড়ি এবং চৌধুরী সাহেবের মাসে মাসে প্রচুর টাকা। মিনুর কোনোকিছুর অভাব ছিল না কিন্তু তার সবসময় বাবাকে মনে পড়ত। একজন সন্তান চায় বাবা-মা দুজনের সাথেই থাকতে কিন্তু মিনুর আর সে ভাগ্য হলো না। বাবা মিনুকে বলেছিল ঢাকা আসবে, প্রথম প্রথম দুয়েকবার এলো তারপর আর আসত না। মিনুর সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলত, মিনুর লেখাপড়ার খোঁজখবর নিত। বাবার দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করত কিন্তু পিতৃস্নেহ বঞ্চিত মিনু শুধু বাবার দায়িত্ব পালনই সন্ত্বোষ্ট ছিল না।
স্কুলের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারতরা সবাই বিত্তবান পরিবার থেকে আসা। এই ওয়েটিং রুমই এখন ডলির সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, সে মিনুকে ক্লাসে দিয়ে সবার সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠে। প্রায় দিনই আড্ডায় ডলি সবার টিফিনের স্পন্সর হয়, সবাই ডলিকে বাহাবা দেয়। আসলে ডলি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়, এই কোটি মানুষের ঢাকা শহর, এই স্কুল আর হাতে গোনা কয়েকজন পরিচিত মানুষের মাঝে সে ব্যস্ত থাকতে চায়, যেন কোন নিঃসঙ্গতা তাকে স্পর্শ করতে না পারে। ডলি লক্ষ্য করল আসলে সে ভিড়ের মধ্যে, হৈ, চৈ এর মধ্যে থাকে বটে কিন্তু তাতে করে নিঃসঙ্গতা দূর হয় না। লক্ষ মানুষের ভিড়ও হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব ও শূন্যতাকে দূর করতে পারে না। ডলি ধীরে ধীরে জানতে পারল আসলে এখানে আসার বেশিরভাগ মানুষ বিত্তবান পরিবারের হলেও, অনেক বড় পারিবারিক পরিধির মধ্যে বসবাস করলেও আপন হৃদয়ে অনেকেই একা।
তিন
ঢাকা আসার পর প্রথম কয়েকদিন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ডলির ঘন ঘন ফোনে কথা হত, যদিও সেকথাগুলো একান্তই আনুষ্ঠানিক, যেমন : মিনুর লেখাপড়া কেমন চলছে, বাসায় কোন অসুবিধা আছে কী না এসব।
ডলি বুঝে চৌধুরী সাহেবের এসব জানার উদ্দেশ্য মিনুর ভালোমন্দ জানা। ডলিকে ঘৃণা করলেও চৌধুরী সাহেব মিনুকে খুব ভালোবাসে। বলতে গেলে মিনুর কথা ভেবে চৌধুরী সাহেব ডলিকে ডিভোর্স করেনি। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর চৌধুরী সাহেবের ফোনে যোগাযোগও কমে গেল। সে শুধু মিনুকে ফোন করে, তার খোঁজখবর নেয়। কোনদিন ডলির কথা জিজ্ঞেস করে আবার কোনদিন ডলির কথা জিজ্ঞেসও করে না। ডলির তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, অবহেলিত মনে হয়, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হয়। ডলি নিজেকে প্রশ্ন করে, চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আসলে কী।
ডলি অনুভব করে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে তার শুধু একটা কাগুজে সম্পর্ক আছে, একটা দৃশ্যমান সামাজিক সম্পর্ক আছে। মনের সম্পর্ক নেই, শারীরিক সম্পর্ক নেই। চৌধুরী সাহেবের সংসারে ডলির কোন ভবিষ্যতও নেই অথচ সামনে পড়ে আছে তার দীর্ঘ জীবন এবং দীর্ঘ জীবনে তার মাথার ওপর একটা ছায়া প্রয়োজন, পায়ের নিচে মাটি দরকার। তার বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন দরকার কিন্তু চৌধুরী সাহেবের ওপর ডলির সে ভরসা নেই।
ডলির এক বান্ধবী মিনতি। মিনতি রায়। মিনতি ডলির স্কুল এবং কলেজ জীবনের বন্ধু। হাতে গোনা যে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গে ডলির যোগাযোগ ছিল মিনতি তাদের মধ্যে একজন। আরও দু’চারজন বন্ধুর সঙ্গে ডলির যোগাযোগ আছে কিন্তু বিয়ের পর ডলি নিজেই একরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ডলি আসলে কোনোভাবে চাইত না যে তার স্কুল এবং কলেজ জীবনের কোন স্মৃতি, কোন বন্ধুত্ব কিংবা অল্প বয়সের হৃদয়ঘটিত কোন ঘটনা তার দাম্পত্য জীবনে কোন প্রভাব ফেলুক। অথচ সে না চাইলেও আজকের মতলুবের সঙ্গে তার দূরত্বও সেই স্মৃতিময় জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
কয়েকমাস আগে মিনতি একবার ঢাকায় এলো। আসার আগে ফোন দিল, তার বাসায় উঠবে বলে। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডলি যেন তার কৈশোর এবং তারুণ্যের মাঝে হারিয়ে গেল। কত আনন্দ, কত হৈ চৈ করে সবাই একসঙ্গে বড় হয়েছে, শুধু কি হৈ চৈ আর হাসি ঠাট্টা ! আজকাল ছেলেমেয়েরা ক্লাস এইট পেরিয়ে কেউ কেউ তারও আগে প্রেমে পড়ে, জীবনের প্রথম শুভ দৃষ্টি বিনিময়। সেদিন রাত জেগে কথা বলতে বলতে মিনতি বলল, শুভ দৃষ্টি বিনিময় আসলে সেই চোখে চোখ রাখা, যাকে কেউ প্রথম ভালোবাসার চোখে দেখে।
ডলির বুকে একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল। ক্ষণিকের জন্য সে অন্য জগতে হারিয়ে গেল। মিনতি আর ডলি একই খাটে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। মিনতি কথার মাঝে ডলির দিকে লক্ষ্য করছিল। ডলিকে অন্যমনস্ক দেখে মিনতি জিজ্ঞেস করল, কী রে হারিয়ে গেলি মনে হয়?
ডলি নিজেকে সামলে নিল, একটা কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, তোর বুঝি কিছু হয়নি, এই যে তুই বললি শুভ দৃষ্টি বিনিময় হয় প্রথম দেখাই, তাহলে তোর তো শুভ দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে মনসুরের সঙ্গে।
মিনতি খুব সহজভাবে বলল, হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছি। জীবনের প্রথম কাউকে ভালোবাসার চোখে কাউকে হৃদয় দিয়ে দেখার নামই শুভ দৃষ্টি বিনিময়টা, হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে থাকে সারাজীবন।
আর বিয়ের সময় যে শুভ দৃষ্টি বিনিময় হয়? ডলি জিজ্ঞেস করল।
সেটা তো আনুষ্ঠানিকতা। আন্তরিকতা আর আনুষ্ঠানিকতা দুটো আলাদা জিনিস। তাইত আজকাল বেশির ভাগ দম্পতির অন্তর পড়ে থাকে এক জায়গায় আর আন্তরিকতাহীন আনুষ্ঠানিকতায় পড়ে থাকে আরেকজনের কাছে।
তুই ঠিক বলেছিস রে।
মিনতি উদাস হয়ে গেল, বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল, আমাদের চাওয়া-পাওয়াটা দূষণীয় হলো, আমরা দু’জনই অপরাধী হয়ে গেলাম, সমাজের কাছে, দেশের কাছে, আমাদের ধর্ম ভিন্ন বলে। অথচ দেখ জন্মের আগে কিন্তু সবাই মানুষ। পৃথিবীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে কারও কানের কাছে আযান, কারও কানের কাছে উলুধ্বনি দিয়ে তাকে ভাগ করা হয় আলাদা ধর্মে। স্রষ্টার তৈরি মানুষ ভাগ হয়ে গেল মানুষের তৈরি ধর্ম আর সামাজিকতায়। আমরা যে সমাজে বসবাস করি সে সমাজে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, মানুষের অধিকারের চেয়ে ধর্ম রক্ষা করাই বড়, কথাগুলো বলতে বলতে আবেগে মিনতির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কণ্ঠস্বর বুজে এলো। সে চোখ মুছে একটা হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, তবে আমি এখন সুখে আছি। প্রফুল্ল আমাকে খুব ভালোবাসে, বেচারার কী দোষ বল। বিয়ের বয়স হয়েছে, বাবা মা ওর জন্য কনে দেখেছে। আমাকে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে। বাবা-মা বিয়ের আয়োজন করেছে। আমার তো তার আগেই মনসুরের সঙ্গে ব্রেক আপ হয়েছে।
জামাই বাবু কি জানে তোর সঙ্গে মনসুরের সম্পর্কের কথা।
আমি বলিনি, ও বলে বিয়ের আগে কে কি করেছে সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই। ও শুধু বর্তমানটাই দেখে। আমিও তাই
মনে করে, আমি তাই মনে করি। হৃদয়ে যা আছে থাক না, হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানেই তো সেই দগদগে আগুনে ঘি ঢালা। আগুনে ঘি ঢাললে তো আগুন আরও জ্বলে উঠবেই। সেই আগুনে তো আমরা দু’জনেই পুড়ে মরব।
তুই ঠিক বলেছিস।
আমিও একটু একটু শুনেছি ওর এক কাজিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এখন আছে কী না জানি না। আমি জানার চেষ্টাও করি না। প্রফুল্ল আমাকে খুব ভালোবাসে, আমাদের ঘরে একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে এসেছে, আমি তো স্বামী-সংসার সব পেয়েছি। এখন আর এসব জেনে শুধু তিক্ততা বাড়িয়ে কী লাভ। দেখ আমি এসে পৌঁছার ঠিক পর পরই ফোন দিয়েছে ঠিকমতো পৌঁছালাম কী না, আবার মাঝখানে একবার ফোন দিয়েছে, দেখিস রাতে আরেকবার ফোন করবে। আমি কোথাও গেলে যেন ও একাই বাসায় শুধু অসি’রতায় ভুগে। কিছুক্ষণ পর পর ফোন দেয়। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে, বলে মিনতি একটা মিষ্টি হাসি হেসে বলল, মধুর বিরক্ত।
মিনতির কথা শুনতে শুনতে ডলির গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, সে আপনমনে বলল, কত ভাঙ্গা-গড়ার পরও মিনতি কত সুখী। তার হ্যাজবেন্ড তাকে বোঝে, বেচারা মিনতিকে কত সহজভাবে নিয়েছে, কত সরল বিশ্বাসে স্ত্রীর অতীত জীবনকে মেনে নিয়েছে।
অনেকক্ষণ ডলির কোন সাড়া না পেয়ে মিনতি ডলির বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, কী রে ঘুমিয়েছিস?
ডলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, না, তোর শুনতে শুনতে…
মিনতি ডলির কথাটা শেষ করতে দিল না। সেও ডলির কণ্ঠস্বর শুনে অবশিষ্ট কথাটুকু বলল, চোখে জল এসে গেছে, এই তো!
ডলি মৃদু কণ্ঠে বলল, হুঁ।
এতবড় একটা জীবন, কষ্ট থাকবে, আনন্দ থাকবে, প্রেম থাকবে বিরহ থাকবে। সবকিছু মেনে নিয়েই তো খুব সহজভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে। যারা খুব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস হয় তাদের জীবন শেষ পর্যন্ত ভালো হয় না। আমি বুঝি না তোর চৌধুরী সাহেব কেন এতটুকু একটা বিষয় কেন সিরিয়াসলি নিয়েছে।
বিষয়টা এতটুকু না রে, ওর কাছে এটা অনেক বড়। আমিও মনে করি এটা অনেক বড় একটা বিষয়। এটাকে আমাদের সমাজব্যবস্থায় কেউ মেনে নিবে না। কিন্তু তুই বিশ্বাস কর আমি অনেকবার সরি বলেছি, ওর হাত-পা ধরে মাফ চেয়েছি কিন্তু ওকে সহজ করতে পারিনি। আসলে দূরত্বটা এত বেশি বেড়ে গেছে যে আর বুঝি কোনদিন এটা মিটবে না।
তুই কী বলছিস?
হ্যাঁ রে।
এভাবে জীবন চলে?
ঐ যে তুই বললি, সিরিয়াস বিষয়কেও সহজভাবে মেনে নিয়ে চলতে হবে।
মিনতির মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে বিছানা থেকে উঠে টেবিলের ওপর চার্জে দেয়া ফোন নিতে গিয়ে ফোনের কাছে না গিয়েই বলল, তোকে বলছিলাম না, রাতে একবার কথা বলবে।
হ্যাঁ। তুই অনেক লাকি রে।
মিনতি ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
প্রফুল্ল বলল, হ্যালো।
হ্যাঁ বল।
কী করছ?
বলত কী করছিলাম, দেখি তুমি বলতে পার কী না।
বলব?
হ্যাঁ বলছি তো বল।
তোমরা দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিলে।
মিনতি লাউড স্পিকার দিয়ে বলল, আবার বলত ভালোভাবে শুনতে পাইনি।
প্রফুল্ল আবার বলল, তোমরা দু’বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিলে।
ঠিক বলেছ, এক’শতে একশ।
আমি বুঝি তোমার ডিসটার্ব করলাম।
হ্যাঁ। তাতো করেছই।
আচ্ছা তাহলে একবার আমাদের পিংকি লক্ষ্ণীসোনাকে দাও। একটু কথা বলে রেখে দিই।
পিংকি ঘুমিয়েছে।
আমার সাথে কথা না বলে তুমি ঘুমাতে দিলে। আমাকে ফোন করতে, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতাম। নাকি দুই বান্ধবী কথা বলতে বলতে আমার কথা ভুলেই গেছিলে যে একবার পিংকির সঙ্গে কথা বলতেও দিলে না।
সরি, সরি ডিয়ার, কালকে আর এই ভুল হবে না।
ওকে। রাখি বাই।
ডলির চোখ দিয়ে সেই যে গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তার যেন শেষ নেই। মিনতি তার চেয়ে কত সুখী।
মিনতি ফোন রেখে বিছানায় এসে ডলির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, তোকে না বললাম, জীবন যখন যেভাবে চলে সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। তুইও কত সুখী, তোর মিনুর মত একটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলে আছে, চট্টগ্রাম শহরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর স্ত্রী তুই, যাকে সবাই এক নামে চিনে, তোর হ্যাজবেন্ড তোকে কত বিলাসিতা আর আভিজাত্যের মধ্যে রেখেছে। আমাদের যেমন কিছু নেই পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসাটাই সুখ তোর কাছে তেমন ভোগ বিলাসিতাটাই সুখ। তোর সুখটাকে কী বলে জানিস?
ডলি বুজে আসা কণ্ঠে বলল, না।
ফাইন্যান্সিয়াল হ্যাপিনেস।
ডলি একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, সুখের একটা আশ্চর্য সংজ্ঞা দিয়েছিস তো।
এটা আমার কথা না। প্রফুল্ল বলেছে। তুই তো জানিস প্রফুল্ল সামান্য একটা চাকরি করে, আমাদের কোনোভাবে দিন চলে যায়। ঠিক হ্যান্ড টু মাউথ না, বলতে পারিস প্লেট টু মাউথ।
এটা আবার কোন ভাষা। প্লেট টু মাউথ?
এটাও প্রফুল্ল বলেছে, ও তো ইংরেজি নিয়ে লেখাপড়া করেছে। তাই যখন আমি কোনদিন কিছু বলি, মানে ভালো কোন শাড়ি বা অন্য কিছু নিতে চাই আর ওর কাছে টাকা থাকে না তখন আমি বলি আমি যে কেন তোমার মত একটা হ্যান্ড টু মাউথকে বিয়ে করলাম। তখন ও কারেকশন করে দিয়ে বলে এই আমি কিন্তু হ্যান্ড টু মাউথ না, প্লেট টু মাউথ।
আচ্ছা বল এবার তো ফাইন্যান্সিয়াল হ্যাপিনেস কী?
অর্থ বিত্তের মাঝে, ভোগ বিলাসের মধ্যে নিজের সুখ খুঁজে পাওয়াকেই বলে ফাইন্যান্সিয়াল হ্যাপিনেস। আজকাল মানুষ ভোগ বিলাসের মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে। কারও অর্থ বিত্ত নেই কিন্তু ঘরে ভালোবাসা আছে তারা এক ধরনের সুখী আবার কারও দাম্পত্য জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি আছে, শূন্যতা আছে কিন্তু অর্থবিত্তও আছে তারা আরেক ধরনের সুখী। যার যা আছে তাই নিয়ে সুখী থাকতে হয়।
এবার ডলি সত্যি সত্যি হেসে ফেলল। সে মিনতিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, এই, এই তুই কী বললি আরেকবার বলত।
মিনতি আবার বলল, শুনে ডলি বলল, তুই তো প্রফুল্লের সঙ্গে থেকে একেবারে দার্শনিক হয়ে গেছিস।
ঐ যে যার যা আছে তাই নিয়ে সুখী থাকা।
ডলি স্বীকার করল, তুই ঠিকই বলেছিস রে।
পরদিন মিনতি চলে গেল। ডলিকে শিখিয়ে দিয়ে গেল যার যা আছে তাই নিয়ে নিজেকে সুখী ভাবতে, ডলিও যেন বদলে গেল, সে ফাইন্যান্সিয়াল হ্যাপিনেস মানে ভোগ বিলাসিতার মাঝেই নিজেকে সুখী ভাবতে শুরু করল।
প্রায় মাস খানেক পর মিনতি ফোন করল। অনেকক্ষণ ফোনে দুজনের আড্ডা চলল, তারপর মিনতি বলল, ও তোকে তো একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
বল।
মিনতি আমতা আমতা করে বলল, না, তোকে বলা ঠিক হবে কী না।
বল, তুই তো আমাকে জীবন যখন যেভাবে চলে সেভাবেই মানিয়ে নিতে শিখিয়েছিস। বল নতুন আর কী বলবি?
গতকাল আফসারের সঙ্গে কথা।
কথাটা ডলির কানে না যেন বুকে ধাক্কা দিল। সে অস্ফুটস্বরে বলল, আফসার!
হ্যাঁ। চমকে গেলি কেন?
ডলি নিজেকে সামলে নিল, না বল, তোর নাম্বার কীভাবে পেল?
ফোনে না, আমার কাছে তো সবার গ্রুপ ছবি আছে, আমি সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। ফেসবুকে তো আমাদের অনেক বন্ধু আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছে। তারা সবাই আবার সেটাতে কমেন্টস করেছে, কেউ কেউ শেয়ার দিয়েছে। তারপর দেখি আফসার আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। আমিও এক্সেপ্ট করলাম তখন কথা হলো।
ডলি কোন কথা বলল না। সে যেন বোবা হয়ে গেছে। আফসারের কথা শোনার পর সে বোবা হয়ে গেছে।
মিনতি জিজ্ঞেস করল, কথা বলছিস না কেন?
ডলি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, বল, কী কথা হলো?
তোর কথা জানতে চাইল।
ডলি কৌতুলহবশতঃ বলল, ও এখন কোথায়?
ঢাকা এসেছে।
ঢাকা, আফসার এখন ঢাকায়! কথাগুলো নিজের অজান্তে ডলির শিথিল ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে বেরিয়ে গেল।
হ্যাঁ। তোর ফেসবুক আইডি চাচ্ছিল। আমি বললাম ও ফেসবুক ব্যবহার করে না। বলল, তাইতে ওকে ফেসবুকে অনেক সার্চ দিয়েছি কিন্তু পায়নি।
আর কী বলল?
তোর ফোন নাম্বার চাইল।
দিয়েছিস?
না, বলেছি তোর কাছে শুনে তারপর দিব।
এই কয়েকদিনে ডলি মিনতির কথামতো জীবনটাকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিল এমন সময় আফসার আবার ফিরে এলো। মিনতিকে কী বলবে ডলি। আফসার তার ফোন নাম্বার পাওয়ামাত্র ফোন করবে, সত্যি সত্যি ঢাকায় থাকলে দেখা করতে চাইবে, তারপর, তারপর যদি বিষয়টা জানাজানি হয় তবে মতলুব তাকে…না, না আর ভাবতে পারছে না ডলি।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে মিনতি জিজ্ঞেস করল, কী রে দিব?
ডলি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি কিচ্ছু বলতে পারছি না মিনতি, আমি কিচ্ছু বুঝছি না। তুই যা ভালো বুঝিস কর বলে ডলি ফোন রেখে দিল।
চার
ডলির মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল, মতলুব সব জানে না তো যে আফসার এখন ঢাকায় আছে? আর সেজন্যই তাকে আর মিনুকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিল, পাঠিয়ে দিল নাকি সরিয়ে দিল? মতলুবের মন ডলি কোনদিন বুঝতে পারেনি। মতলুব সহজভাবে কোন কথা বললেও ডলির কাছে দুর্বোধ্য মনে হয় না। মতলুব খুব জটিল এবং ভয়ঙ্কর কথাও খুব সহজভাবে বলে। ডলি একটা ক্যালকুলেশন খুঁজে পেল। আফসার ঢাকায় আছে বলেই মতলুব তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিল যাতে করে ডলি আর আফসার সাহেব আবার একে অন্যকে কাছে পায় আর… না, না আর ভাবতে পারছে না। একথা সত্যি ভাবতেই ডলির মনটা ঘৃণায় ভরে গেল। ছিঃ, ছিঃ মতলুব তুমি এত নিচু। নিজের স্ত্রীকে…
ডলি যখন এমনই একটা আস্থাহীন সম্পর্কের অনিশ্চয়তায় ভুগছিল তখনই মিনতি ফোন করে জানাল আফসারের কথা। মিনতি কি আফসারকে সবকিছু বলেছে? বলেছে যে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই ডলি তার হ্যাজবেন্ডের কাছে বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। আর সেদিন থেকেই তার হ্যাজবেন্ডের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে, যোজন যোজন দূরত্ব।
মিনতিকে তো বলেছি সে যা ভালো বুঝে, মিনতি যদি আমার ফোন নাম্বার না দেয় তবে ভালোই। উঃ কেন যে দিতে নিষেধ করলাম না। তখন আফসারের নাম শুনতেই কেমন যেন আমি হারিয়ে গেলাম ওর মাঝে। আমার মনে হলো আমি আর এই জগতে নেই। চলে গেছি আফসারের কাছে, আমার সুখ, আমার স্বপ্নের কাছে।
আফসারের সঙ্গে ডলির প্রথম পরিচয় হলো ডলি যখন এস.এস.সি পাস করে এইচ.এস.সি ভর্তি হলো তখন। আফসার ডলির চেয়ে অনেক ভালো ছাত্র ছিল। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র বলা যায়। দেখতে, শুনতে ভালো, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, কথাবার্তায় মার্জিত। তার ব্যক্তিত্ব খুব সহজে কোন মেয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার মত। অল্প কয়েকদিনে দু’জনের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল।
ক্লাসের অনেক মেয়েই তাকে পছন্দ করত কিন্তু আফসার পছন্দ করত ডলিকে। ডলি ক্লাসে কোন পড়া বুঝতে না পারলে ক্লাসের পরে আফসারের কাছে বুঝিয়ে নিত। ধীরে ধীরে ডলি ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে থাকত। ক্লাস টিচারের লেকচারে মনোযোগ থাকত না। সে ক্লাসে আফসারের দিকে তাকিয়ে থাকত আর ক্লাসের পর আফসারকে বলত, কিচ্ছু বুঝছি না।
আফসার বলত, তোর মাথাটা গেছে।
হ্যাঁ গেছে তো বটেই। তুই আমার মাথাটা নষ্ট করেছিস। এখন ক্লাসের পর তুই আমাকে পড়াবি।
ক্লাসের পর ক্যাম্পাসের কোন গাছের নিচে দু’জনে বসত, আফসার যখন বুঝাত তখন ডলি মুগ্ধ হয়ে আফসারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।
দু’জনের চোখে চোখ পড়ত। এক জোড়া তরুণ-তরুণীর রক্তে যেন ঢেউ উথাল-পাথাল করত। সময় পেলে, ক্লাসের ফাঁকে কিংবা টিউশনির কথা বলে দু’জনে বাইরে ঘুরে বেড়াত। আফসার পড়ালেখার হাল ঠিকই ধরে রাখল কিন্তু ডলি সব তালগোল পাকিয়ে ফেলল। এইচ.এস.সি পরীক্ষায় আফসার ঠিকই জি.পি.এস ফাইভ পেয়ে পাস করল কিন্তু ডলি পেল জি.পি.এ ফোর পয়েন্ট ফাইভ।
আফসার চুয়েট এ ভর্তি হলো আর ডলি ভর্তি হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু’জনের পথ আলাদা হয়ে গেল। আগে যেখানে প্রতিদিন দেখা হত, সবসময় কথা হত সেখানে দু’জনের দেখা হয় সপ্তাহে কিংবা পনেরো দিনে। তারপরও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। সুযোগ পেলেই দু’জনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াত, কোন কফি হাউজে বসে আড্ডা দিত।
আফসারের লেখাপড়ার চাপ বেশি তাই সে তেমন সময় দিতে পারতো না, এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য হত, ডলি আফসারকে ভুল বুঝত, মোবাইল ফোনে জোরে চিৎকার করে আফসারের সাথে ঝগড়া করত, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দরজা বন্ধ করে ঘরে শুয়ে থাকত। ডলির এসব আচরণ মা-বাবার চোখ এড়ায় নি। ডলির বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিল তাকে বিয়ে দিবে।
বিয়ে দেখার জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। একের পর এক পাত্র দেখ তো আর অপছন্দ করত। ডলির বাবা-মা বুঝতে পারতো এসব ডলির আফসারকে বিয়ে করার জন্যই। মতলুবের সঙ্গে ডলির আগে থেকে পরিচয় ছিল। ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে এই দুই পরিবারের মধ্যে আগে থেকেই জানাশোনাও ছিল। মতলুব তখন বাবার ব্যবসার হাল ধরতে শুরু করেছে, কাজের ফাঁকে সে ডলিকে মাঝে মাঝে ফোন দিত, ফোনে অনেকক্ষণ চুটিয়ে আড্ডা দিত। ডলির সঙ্গে আফসারের দ্বন্দ্ব চরমে তখন মতলুবের মোবাইল ফোনে সদয় দেয়াটাই ডলির কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা আরও বাড়তে থাকলো। ডলির বিয়ে দেয়ার কথাটা সে একদিন মতলুবকে বলে ফেলল, শুনে মতলুব বলল, ডলি তুমি যদি কিছু মনে না কর তবে একটা কথা বলি?
বল।
তোমার কি কারও সঙ্গে রিলেশন আছে?
ডলি খুব সহজভাবে বলে দিল, আরে না, আমি ওসব রিলেশন টিলেশনে বিশ্বাস করি না।
তাহলে তোমার লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে বিয়ে দিতে চাচ্ছে কেন?
মা-বাবার ইচ্ছা। আমি ফোনে একটু বেশি আড্ডা দিই, ফেসবুকে বেশি ছবি আপলোড দিই, সবসময় হৈ চৈ করে বেড়াই সেজন্য বাবা-মা আশঙ্কা করছে। আচ্ছা তুমি বল এখন আমি ভার্সিটিতে পড়ি এখন যদি একটু হৈ চৈ না করি, আড্ডা না দিই, ঘুরে না বেড়াই তবে কখন করব, বুড়ি হলে। বাবা-মা এটাই সন্দেহ করে। তাছাড়া এটা তো খুব স্বাভাবিক এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কারও না কারও সঙ্গে রিলেশন থাকবে তাই বলে বিয়ে দিতে হবে।
তোমার কাউকে পছন্দ নেই?
আছে একটু একটু বলে ডলি একটা হাসি হাসল।
কিন্তু তোমার জন্য একের পর এক যেভাবে বিয়ের ঘর আসছে তাতে করে তোমার বিয়েতে তো আর বেশি দেরি নেই।
ডলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
তুমি আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পার।
জান আমার কোন বন্ধু নেই যার সঙ্গে আমি এই ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারি।
তুমি আমাকে বলতে পার, দেখি আমি যদি তোমাকে কোন পরামর্শ দিতে পারি।
তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারবে?
মতলুব যেন এমন একটা কথাই আশা করছিল ডলির কাছে, ডলি বলামাত্র সে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, অবশ্যই পারব না কেন?
পরদিন মতলুব ডলির সঙ্গে দেখা করল….পার্কে। মতলুবের সঙ্গে ডলির আগেও দু’য়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু মতলুবকে ডলির আগে তেমন ভালো লাগত না। মতলুব আগে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকত, কম কথা বলত কিন্তু আজ দেখামাত্র ডলির বুকের মধ্যে যেন একটা ঝড় উঠল। সে কি সেই মতলুবকে দেখছে।
ডলিকে দেখে মতলুব একটা সুন্দর হাসি হেসে বলল, কেমন আছ ডলি?
জানই তো কেমন আছি।
হ্যাঁ, তা অবশ্য জানি।
কথা বলতে বলতে দু’জনে একটা গাছের নিচে পাশাপাশি বসল। মতলুব প্রথমে জিজ্ঞেস করল, বল, ওদিকের কী অবস্থা?
ওদিকের অবস্থা খুব খারাপ।
কী রকম?
প্রতিদিন কোন না কোন পাত্রের খবর আসছে। যেকোনোদিন বিয়ে দিতে পারে।
তুমি তোমার পছন্দের কথা বলনি?
আমি বলেছি আমি এখন বিয়ে করব না কিন্তু তারা ছাড়বে না।
তো?
ডলি মতলুবের মুখের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখে চোখ পড়ল। ডলি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, মতলুব আমাকে হেল্প কর প্লিজ!
অবশ্যই, তুমি আমার ভালো বন্ধু। আমি তোমাকে অবশ্যই হেল্প করব। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো।
মতলুব ডলির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ডলি তোমাকে একটা কথা বলব?
বল?
কিছু মনে করবে না তো?
ততক্ষণে ডলি মতলুবের কাঁধে মাথা রেখেছে, বল না, প্লিজ! আমাকে এত সংকোচ করছ কেন?
মতলুব বলল, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ডলি।
ডলি মুখ তুলে মতলুবের মুখের দিকে তাকালো, ডলির দু’চোখ পানিতে ভরে গেল, আমি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি মতলুব, আই লাভ ইউ।
মতলুব ডলিকে বুকে টেনে নিল, তবে আমার একটা কথা আছে।
কী কথা?
আমি এভাবে আজ এখানে কাল সেখানে প্রেম করে বেড়াতে পারব না। আমি তোমাকে বিয়ে করব, বিয়ের পর আমরা ঘুরে বেড়াব, ভালোবাসব, প্রেম করব।
ডলি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আমিও এমন একটা কথাই আশা করছিলাম মতলুব।
কিন্তু আমাদের বিয়ে তোমার বাবা-মা মেনে নিবে তো?
ডলি না সূচক মাথা নেড়ে জানাল মেনে নিবে না।
তো?
ডলি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি, আমি চিরদিনের জন্য তোমার কাছে চলে যাব মতলুব, চিরদিনের জন্য আর কোনদিন বাবার বাড়ি ফিরে আসব না। তারা নিজেরা যদি কোনাদিন সম্মানের সাথে নিয়ে আসে তবে আসব নয়তো কোনদিন আসব না। তুমি আমাকে সারাজীবন বুকে জড়িয়ে রাখতে তো মতলুব।
অবশ্যই।
ডলির চোখের সামনে আফসারের ছবি ভেসে উঠল, তার মনের মধ্যে তখন অনেক কথার ঝড় বইছে, দিনের পর দিন আমি তোর জন্য অপেক্ষা করেছি আফসার, তুই পড়ার চাপ, পড়ার চাপ বলে আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছিস, থাক, তুই তোর লেখাপড়া নিয়ে থাক। আজ ব্যস্ততার অজুহাতে তুই আমাকে হারালি একদিন বুঝবি, একদিন আমাকে খুঁজে বেড়াবি কিন্তু পাবি না। বিয়ের পর যখন দেখবি আমি ফেসবুকে ছবি আপলোড দিয়েছি তখন বুঝবি, আমাকে অবহেলা করার শিক্ষা পাবি।
মতলুব জিজ্ঞেস করল, কিছু ভাবছ ডলি?
হ্যাঁ। ভাবছি তো অনেক কিছু বলে ডলি একটা কৃত্রিম হাসি হাসল।
বিয়ের পর যখন ডলি এবং তার বন্ধু বা বান্ধবরা ডলির বিয়ের ছবি ফেসবুকে আপলোড দিল সেই ছবি দেখে আফসার প্রচণ্ড আঘাত পেল। সে বার বার ডলির ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে নক করল, ডলির মোবাইল ফোনে বার বার ফোন করল কিন্তু ডলি ফোন তো ধরলই না, আফসারের মোবাইল নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে রাখল। আফসারের ম্যাসেঞ্জার ব্লক করে দিল, তাকে আনফ্রেন্ড করে দিল। আফসার কোনভাবেই ডলির বিয়ে মেনে নিতে পারল না।
একদিন সন্ধ্যায় মতলুব তখন বাসায় ছিল। ডলির মোবাইল ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো। ডলি রিসিভ করল। আফসার ফোন কান্নাভাঙ্গা গলায় ডলির কাছ থেকে তার সাথে প্রতারণা করার জবাব চাইল। ডলি কী জবাব দিবে আফসারের প্রশ্নের, সে ফোন আবার রেখে দিল কিন্তু মতলুব ডলির পাশে থাকায় সে আফসারের সব কথা শুনতে পেল। সে ডলির হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে দিল এবং পরদিনই একটা নতুন সিমকার্ড কিনে দিল। আর ডলিকে শাসনের সুরে বলল, ডলি আমি তোমার মোবাইল ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে দিলাম, তুমি ওকে ফেসবুকের তোমার ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছ। আবার যদি আমি কোনদিন তোমার সাথে স্কুল কিংবা কলেজ জীবনের সম্পর্ককে টেনে এনে আনো তবে আমি কিন্তু তোমাকে আর ক্ষমা করব না।
মতলুব তো ঠিকই বলেছিল। স্ত্রীর সাবেক প্রেমিকার কথা জেনেও তাকে ক্ষমা করেছিল। সেদিনের পর থেকে ডলির সবসময় আফসারকে মনে পড়ত। ডলির বার বার মনে হত সে একটা ভুল করল, আফসারের প্রতি সে অবিচার করল। ডলিকে সবসময় একটা অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। যে কথা সে পারতো না কাউকে বলতে আবার পারতো না আফসারকে ভুলে যেতে।
ডলির প্রায়ই ইচ্ছা হত আফসারকে একবার ফোন করবে, কথা বলবে, তাকে বুঝিয়ে বলবে, তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইবে কিংবা ফোন করে আফসার যেখানেই থাকুক দেখা করবে কিন্তু ডলির ফোন করে কথা বলার কোন উপায় ছিল না। তার সবসময় ভয় হত মতলুব যদি জেনে ফেলে আবার বাইরে গিয়ে দেখা করারও উপায় ছিল না কারণ এ বাড়ির বউ বেটিরা সবাই গাড়ি নিয়ে বাইরে যায়। বাসার ড্রাইভার সঙ্গে থাকে ফিরে এসে বলে দিতে পারে। ডলি সুযোগ খুঁজতে থাকলো কীভাবে সে অন্তত একবার আফসারের সঙ্গে দেখা করবে।
মতলুব ব্যবসার কাজে প্রায়ই ঢাকা যায়, দেশের বাইরে যায়। ঢাকা গেলে দুয়েকদিনে ফিরে আসে কখনও কখনও দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসে কিন্তু দেশের বাইরে গেলে সে অনেকদিন থাকে, কখনও তিন দিন, কখনও সাত দিন কখনও আরও বেশি। সেদিন ছিল রবিবার, মতলুব চীনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করল সাত দিনের ব্যবসায়িক কাজে। সেদিন রাতেই ডলি তার পুরাতন সিমকার্ড বের করে আফসারকে ফোন করল।
একবার ফোনের রিং হতেই আফসার ফোন রিসিভ করল। আফসারের কণ্ঠস্বর আবেগপ্রবণ, যেন হৃদয় ভেঙ্গে কান্না আসছে, হ্যালো!
হ্যালো আফসার!
ডলি, ডলি তুই, ডলি কোথায় আছিস? কেমন আছিস?
আমি চিটাগাংয়ে আছি আফসার, আমি ভালো নেই আফসার।
কেন ভালো নেই কেন? তুই তো ভালো থাকার জন্য চলে গেছিস ডলি। আমি ফোন করলে তোর ডিসটার্ব হয় দেখে আমিও আর তোকে ফোন দিই না কথাগুলো বলতে বলতে আফসারের কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে গেল।
আমার সবসময় তোর কথা মনে পড়ে আফসার, আমার বার বার মনে হয় আমি রাগে অন্ধ হয়ে ভুল করেছি, তোর ওপর আমি অন্যায় করেছি। আফসার আমাকে ক্ষমা করিস আফসার। আমি তোকে শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেই শিক্ষা পেয়েছি।
কেন, তোর কী হয়েছে? কোন অসুখ?
না। আমার শরীরে কোন অসুখ নেই, মনের অসুখ। কথায় আছে বনের বাঘে খেলে সবাই দেখে কিন্তু মনের বাঘে খেলে কেউ দেখতে পায় না। তুই কোথায় আফসার?
আমি ঢাকা। আর এক সপ্তাহ দেশে আছি।
তারপর-
আমি কানাডার একটা ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়েছি, আগামী সপ্তাহে ফ্লাইট।
ডলি আফসারের কানাডায় চলে যাওয়ার কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, তুই কানাডা যাবি, আমাকে রেখে তুই কানাডা যাবি, আমি এখানে একা কী করে থাকবো আফসার?
একা কেন ডলি তুই বিয়ে করেছিস, তোর হ্যাজবেন্ড আছে। স্বামী-সংসার নিয়ে তুই তো ভালোই আছিস, আমি একা ছিলাম, এখানে থাকলে সবসময় তোর স্মৃতি আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাই আমি চলে যাচ্ছি ডলি। দোয়া করি তুই ভালো থাকিস। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে থাকিস।
এভাবে বলিস না আফসার, আমার কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দিস না। তুই দেশের বাইরে যাবি আমার সঙ্গে একবার দেখা না করে চলে যাবি। এটা তুই কীভাবে ভাবলি।
আমার কোন উপায় নেই ডলি, তোকে আমি হাজার বার ফোন দিয়েছি কিন্তু তোর ফোন বন্ধ। আমি বুঝতে পেরেছি তোর সাহেব তোর সিমকার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছে।
আফসার তুই কি আগামীকাল একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবি?
অবশ্যই পারব। তুই ডাকলে আমি দেখা না করতে পারি এটা ভাবলি কী করে বল।
তুই কালকে চিটাগাং চলে আয়।
কখন, কোথায় আসব?
তুই যেকোনোভাবে সকালবেলা চিটাগাং চলে আয় আমি বিকেলে তোর সঙ্গে দেখা করব। আর হ্যাঁ আমার এই সিমকার্ডটা বন্ধ থাকবে, আমি সকাল থেকে তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। ওকে?
ওকে।
পরদিন বিকেলে ডলি আফসারের সঙ্গে দেখা করল…..পার্কে। এই পার্কটা দু’জনের অতি পরিচিত, স্মৃতি বিজড়িত। এই পার্কে বসে কতদিন দু’জনে একসাথে উন্মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ানর স্বপ্ন দেখেছে, ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে, সারাজীবন একসঙ্গে কাটাবে বলে কত প্রতিশ্রুতি করেছে অথচ আজ দু’জনের কত দূরে। আজ ডলির আফসারের কথা ভাবতেও মানা।
একটা গাছের নিচে দু’জনে বসলো। আফসার একবার ডলির হাতটা ধরতে গিয়ে সংকোচে আবার ফিরিয়ে নিল। ডলি আফসারের সংকোচের কারণটা বুঝতে পেরেছে। সে ডলির হাতটা টেনে নিয়ে বলল, সংকোচ করছ কেন আফসার? আমাকে বুঝি খুব পর পর মনে হচ্ছে?
না, ঠিক তা না। হাজার হলেও এখন তুই আরেকজনের, যখন আমার ছিলি তখন কিন্তু আমার কোন সংকোচ হত না। তাছাড়া তুই যদি কিছু মনে করিস। তোর প্রতি আমার সেরকম কোন লোভ নেই ডলি। তোকে একসময় ভালোবাসাতাম, এখনও বাসি কিন্তু এখন একটা বাধার প্রাচীর তৈরি হয়েছে। যে প্রাচীরের এক পাশে আমি আর ওপর পাশে তুই। এই প্রাচীর অতিক্রম করা যে অনেক কঠিন কাজ।
ডলি আফসারের কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আমি ভুল করেছি আফসার, আমি ভুল করেছি। আমি রাগের মাথায় এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু একবার ভেবে দেখ আমি নিজেও কি কম কষ্ট পাচ্ছি। আমার সবসময় তোর কথা মনে পড়ে, আমি ওর কাছে স্বাভাবিক হতে পারছি না। আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অভিনয় করে যাচ্ছি। আমি আর পারছি না আফসার, জানি না এর শেষ কোথায়।
আফসার ডলির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, এখন আর কেঁদে কী হবে বল। সেজন্য বলে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এই হার, এই পরাজয় মেনে নিয়েই আমাদের সারাজীবন কাটাতে হবে ডলি।
এভাবে চোখের জলে গড়াগড়ি দিয়ে দু’জনে কাটিয়ে দিল ঠিক তার ঠিক নেই, ছবি তুললা, সেলফি তুললো, ছবি তোলার সময় আফসার তাকে বলল, ডলি স্মাইল, স্মাইল।
ডলিও মুখে বলল, আফসার স্মাইল, স্মাইল প্লিজ। তুমি বোঝো না আজকের ছবিগুলো অনেক ইম্পোর্টেন্ট। তুমি যখন থাকবে না তখন আমি তোমার ছবিগুলো দেখব, তোমার সুন্দর হাসি দেখব। স্মাইল প্লিজ!
ডলির মুখে কি আর হাসি আসে, হাসি তো আসতে হয় অন্তর থেকে, মুখে তো শুধু হাসির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ঘড়ির কাঁটার দিকে কার কোন খেয়াল নেই। প্রকৃতির দিকে কার খেয়াল নেই। পার্ক পুরোটা খালি হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। গোধূলী লগ্নে পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে, পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাই যাই করতে শুরু করেছে কিন্তু দু’জনের কারও যাওয়ার নাম নেই। পার্কের সিকিউরিটি এসে দু’জনে চলে যেতে বলল।
দু’জনে উঠে দাঁড়ালো। মৃদু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে এগিয়ে গেল কিন্তু তারপর, তারপর কে কোথায় যাবে? দু’জনের দু’টি হাত যেন এক হয়ে আছে, কেউ কাউকে ছাড়তে চাচ্ছে না। ডলি আফসারের কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে। একবার ডলি থমকে দাঁড়ালো, আফসারের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আর কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে আফসার, কতদিন পর? আদৌ কি তোমার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হবে। এমনি করে দু’জনে একসাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাব, ঘুরে বেড়াব, ঠিক আগে যেমন আমরা ঘুরে বেড়াতাম।
আফসার ডলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তেমন দিন আর আমাদের কখনও আসবে না ডলি। আমরা নিজেরাই আমাদের সুখ, আমাদের স্বপ্নকে কবর দিয়েছি ডলি।
ডলি একটা হাত দিয়ে আফসারের মুখে হাত দিল, না, না, তুমি এমন কথা কখনও বলবে না। তুমি কানাডা থেকে আবার ফিরে আসবে, তুমি বাংলাদেশে থাকবে। আমি সারাজীবন তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
অনেক কষ্টের মাঝে আফসার একটা করুণ হাসি হেসে বলল, পাগলি, তুমি এখন আরেকজনের বউ, তোদের একটা বেবি আছে। এখন আমরা চাইলেই কি এভাবে দেখা করতে পারব?
পারব, তুমি ডেকো, তুমি ডাকলেই আমি চলে আসব।
আফসার ডলির মুখটা উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রাখল, আসবে তো?
অবশ্যই।
পাঁচ
কয়েকদিন পর মতলুব ফিরে এলো। এই কয়েকদিনে তার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। দেশের বাইরে মতলুবের খাওয়া-দাওয়া একদম ভালো হয় না। দেশের বাইরে থেকে আসার পর আগের চেহারা ফিরে পেতে কয়েকদিন লেগে যায়। আসার দিন কথাবার্তায় সে স্বাভাবিকই ছিল। দেশের বাইরে থেকে এলে প্রথমেই সে ডলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে, প্রাণ ভরে আদর করে। সে একরকম ডলিকে বুঝিয়ে এই কয়েকদিন তাকে সে খুব মিস করেছে। এবারও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটল না। ডলি অনেকটা আশ্বস্ হলো যে মতলুব তার আফসারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার বিষয়ে কিছু বুঝতে পারেনি।
আরও একদিন কেটে গেল তবুও কিছু হলো না। তারপর দিন মতলুব অফিস থেকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরল। সেদিন আফসারের কানাডার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার কথা। ডলি একথা ভাবছিল আর সেদিনের তোলা ছবিগুলো দেখছিল, দেখতে দেখতে ডলির হৃদয় ভেঙ্গে কান্না আসছিল। ডলির ইচ্ছা হচ্ছিল সে যদি জোরে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো তবে হৃদয়ের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হত। ডলি এতটাই আবেগপ্রবণ ছিল যে বাইরের গেট দিয়ে কখন গাড়ি ঢুকেছে, কখন মতলুব দরজার কাছে এসেছে ডলি কিছুই বুঝতে পারেনি। মতলুব কোন কথা না বলে হঠাৎ করে রুমে ঢুকলো ডলির হাতে তখনো মোবাইল ফোনের গ্যালরিতে রাখা ছবি, চোখের পানি আর নাকের পানিতে একাকার মুখমণ্ডল। কোন কথা না বলেই মতলুব ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনটা তার হাতে নিল।
ডলি আঁতকে উঠল, তুমি?
হ্যাঁ, আমি তুমি তন্ময় হয়ে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়েছিলে আর তোমার গণ্ডদেশ বেয়ে পড়া চোখের পানিতে ছবিগুলো ভিজে যাচ্ছে। তাই মনে করলাম আমিও দেখি কার ছবি দেখে তুমি কাঁদছ।
ঘটনার আকস্মিকতায় ডলি বোবা হয়ে গেল। মতলুবের কথার কী জবাব দিবে সে, সে ভাবতেই পারেনি মতলুব এসময় বাসায় আসবে। দরজার সামনে যখন একটা প্রতিবিম্ম এসে পড়েছিল তখন সে ভেবেছিল কাজের মেয়ে হয়ত কোন কাজে আসছে।
আফসার গ্যালিরর ছবিগুলো একটা একটা করে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, কবেকার ছবি এগুলো?
ডলি তোতলাতে তোতলাতে বলল, আগের, অনেক আগের। আমাদের বিয়ের আগের।
ডলি ভেবেছিল মতলুব প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তার গালে থাপ্পড় মেরে বসবে কিংবা জোরে চিৎকার করে গালিগালাজ করবে কিন্তু মতলুব সেরকম কিছু করল না। বিছানারা ওপর ধপাস করে বসে পড়ল তারপর অস্বাভাবিক গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে বলল, বিয়ের পর যখন তোমার মোবাইল ফোনে বার বার ফোন আসছিল তখন আমি মেনে নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আজকাল বিয়ের আগে সবারই এরকম সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু বিয়ের পর কেটে যায়, ছেলেমেয়েরা ভুলে যায়। তবুও আমি তোমার মোবাইল ফোনের সিমকার্ড চেঞ্জ করে দিলাম, ফেসবুকের আইডি ডিএক্টিভ করে দিলাম যাতে তোমার ফেলে আসা কোন স্মৃতি আমাদের দাম্পত্য জীবনে কোন জটিলতা তৈরি করতে না পারে কিন্তু নিজেই আসলে চাও না তোমার পিছনের স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে যে দাগ হৃদয়ে গেঁথে আছে আমি সিমকার্ড বদলে ফেলে বা মোবাইল আইডি ডিএক্টিভ করে সেই দাগ মুছব কী করে।
ডলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমাকে এবারের মত ক্ষমা কর প্লিজ!
করতাম কিন্তু তুমি আরও একটা মিথ্যা কথা বলেছ।
কী? আমি কী মিথ্যা কথা বলেছি?
তুমি যে থ্রি-পিস পরে দেখা করতে গিয়েছিলে সেটা আমার দেয়া থ্রি-পিস। তাহলে বিয়ের আগের ছবি কীভাবে হয় বল?
আমি তোমাকে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই কী বলতে কী বলে ফেলেছি।
তোমাকে আমি বলেছিলাম আমি দ্বিতীয়বার কাউকে ক্ষমা করি না।
আমাকে কর, প্লিজ আমাকে ক্ষমা কর।
না, আমি আর তোমাকে রাখব না, আমি তোমাকে আজই ডিভোর্স করব, বলে মতলুব বের হওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠতে যাচ্ছিল।
ডলি মতলুবের পা জড়িয়ে ধরে বলল, এবার আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ! প্লিজ আমাদের একমাত্র সন্তান মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে ক্ষমা কর, প্লিজ!
মতলুব একবার মিনুর মুখের দিকে তাকালো, এক বছরের এক নিষ্পাপ শিশু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে মতলুব আবার বিছানায় বসল।
সেদিনের পর থেকে একটা সংসার টিকে থাকলো বটে কিন্তু সে সংসারে রইল না ভালোবাসার বন্ধন, রইলো না মধুর দাম্পত্য। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ঘুনপোকা, একবার সম্পর্কের মধ্যে ঘুনপোকা ধরলে সেই সম্পর্ক আর কোনদিন আগের মত মধুর হয় না।
সেদিন মিনতির কাছে আফসারের দেশে আসার কথা শোনার পর থেকে ডলি কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে। কতদিন পর সে আফসারের কণ্ঠস্বরটা শুনবে, কত কাঙ্ক্ষিত তার কাছে আফসারের প্রতিটি কথা। আফসারের সাথে সত্যি তার আবার দেখা হবে, দেখতে কেমন হয়েছে আফসার, অনেক বছর আগের কথা এতদিনে নিশ্চয়ই মোটা হয়েছে, গলার স্বরটাও মোটা হয়েছে, একটু গম্ভীর, ভারত্ব এসেছে কি চেহারায়? নাকি সেই ছেলেমানুষটিই রয়ে গেছে?
ডলি নিশ্চিত তার মোবাইল নাম্বার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আফসার সে তাকে ফোন করবে। আফসারের সাথে কীভাবে কথা বলবে ডলি, ডলি কিছুটা অপ্রস্তুতও আফসার ফোন করল রাত সাড়ে দশটায়। ডলি তখন আফসারকে নিয়ে হাজার কথা ভাবছিল। মোবাইল ফোনটা চার্জে দেয়া ছিল একটু দূরে কিন্তু ফোনের রিংটোন শুনেই কেন জানি ডলির মনে হলো এটা নিশ্চয়ই আফসারেরই ফোন। নাম্বারটা দেখেই চমকে উঠল ডলি। আফসার তার ফোন নাম্বারটা চেঞ্জ করেনি। এই নাম্বার তো ডলির মুখস্। ডলি যদি আরও আগে এই নাম্বারে চেষ্টা করত তবে আফসারের সঙ্গে কথা বলতে পারতো। আফসার মিনতিকে বলেছে সে বার বার তাকে ফেসবুকে সার্চ দিয়েছে কিন্তু পায়নি আর ফোন নাম্বার তো মতলুব সেদিনই বদলে দিয়েছে, আহা, বেচারা বুঝি তার আগের নাম্বারে ফোনও দিয়েছে কিন্তু পায়নি।
ডলির বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে, কতদিন, কতদিন পর আজ আবার আফসারের সঙ্গে কথা বলবে। ডলি মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। ফোন রিসিভ করবে কী করবে না। বুকটা কাঁপছে, হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলছে। ঠোঁট দুটো শিথিল হয়ে আসছে, কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর আবেগে জড়িয়ে যাচ্ছে। ডলি ফোন রিসিভ করে চুপ করে রইলো, কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না।
আফসারের কণ্ঠস্বর ঠিক আগের মতই একটু ভারী হয়েছে কিন্তু কথাগুলো ঠিকই একই রকম, হ্যালো ডলি, কী রে কথা বলছিস না কেন? কেমন আছিস?
ডলির বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বল, আমি আর কেমন আছি, তুই যেমন রেখে গেছিস তেমনি আছি।
আরে বাবা আমি আবার কেমন রাখছি, আমি তো জানি তুই ভালো আছিস, সুখে আছিস।
হ্যাঁ ঠিকই জানিস, আমি খুব ভালো আছি, সুখে আছি। তুই কেমন আছিস?
আছি, আমিও কোনোমতে আছি।
কোনোমতে কেন? বিয়ে করেছিস, বউ-বাচ্চা নিয়ে তো ভালোই আছিস, ডলির কথায় অভিমান ফুটে উঠল।
আফসার একটা কষ্টের হাসি হাসলো, হা হা হা, তুই তাই জানিস।
জানবো না কেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
দুনিয়াতে কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটে না? বাদ দে, তুই তো ঢাকায় আছিস?
হ্যাঁ। তুই?
আমিও।
আফসার কিছুটা আবদারের সুরে বলল, ডলি একবার দেখা করতে পারবি?
এবার ডলি একরকম হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল, একবার, একবার তোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে… না আর কথা বলতে পারছে না ডলি তার কণ্ঠস্বর বুজে আসছে।
আফসার ডলির কান্না শুনে জিজ্ঞেস করল, ডলি, কী হয়েছে ডলি? ওকে তোর যদি খুব প্রবলেম হয় তরে দেখা করিস না।
ডলি কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, আমার তোর সঙ্গে খুব দেখা করতে ইচ্ছা করছে আফসার, খুব কিন্তু আমার খুব ভয় হচ্ছে। তুমি কানাডা যাওয়ার আগে যখন তোর সঙ্গে দেখা করলাম তারপর থেকেই প্রবলেমের শুরু। একটা প্রবলেম আমি আজ এগারো বারো বছর থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি। তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে আফসার, অনেক। তোর সঙ্গে দেখা করা আমারও যে খুব প্রয়োজন।
তাহলে কাঁদছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস কেন?
যদি কোনোভাবে ও জেনে ফেলে তবে…
জেনে ফেললে কী করবে? তোকে বের করে দিবে?
দিতেও পারে ওকে তুই চিনিস না।
গুড, তাহলে একবারে আমার কাছে চলে আসবি।
ডলি চোখ মুছল, আফসারের কথায় সে কিছুটা মনে বল পেল, সে কান্না হাসি মিশ্রিত একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, ঠিক বলছিস তো? ভেবে বল কিন্তু।
আমি আবার কী ভেবে দেখব, আমার তো চাল চুলো নেই, এবার হবে।
আফসারের কথায় ডলির মনে হাজারও প্রশ্নের উদয় হলো, চাল চুলো নেই মানে, আফসার কি এখনও বিয়েই করেনি? মিনতির কাছ থেকে সে কথা শোনা হয়নি। হয়ত মিনতিও একথা শোনেনি। ডলি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তো ভালোই হলো এবার আমি তোর চাল-চুলোর ব্যবস্থা করে দিব।
আফসার একটা প্রাণখোলা হাসি হেসে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়, তোর একটা পুণ্যের কাজ হয়।
হ্যাঁ। তোরও শূন্য স্থান পূর্ণ হয়।
তাহলে কবে দেখা করবি? আগামীকাল?
ডলি মনে মনে কী যেন ভেবে নিল তারপর বলল, আগামীকাল তো, ওকে। আমি মিনুকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে তোকে ফোন দিব। তখন তুই স্কুলের কাছাকাছি আসবি।
ওকে।
ডলির ফোনে একটা কল ঢুকলো। সে ফোনটা চোখের সামনে ধরে দেখলো মতলুব ফোন করেছে। তার বুকটা কেঁপে উঠল। সে যেন অসি’র হয়ে উঠল, এখন তাহলে রাখি আফসার বলে সে ফোনের লাইন কেটে দিল।
ফোন রেখে দিতেই আবার মতলুবের ফোন ঢুকলো। ডলি কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, সবকিছু তার মাথায় গুলিয়ে যাচ্ছে। মতলুব আবার কী মনে করে ফোন করল। আজকাল সে তো অনেক দিন পর পর ফোন করে, এই তো সেদিন ফোন করেছিল আবার এমন কী প্রয়োজন হলো যে ফোন করল। মতলুবের কথার কী জবাব দিবে ভাবতে ভাবতে ডলি ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
অপর পাশ থেকে মতলুবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।
বল।
কেমন আছ?
ভালো, তুমি?
আছি, আমিও ভালো আছি। এত রাতে কার সাথে কথা বলছিলে?
মিনুর স্কুলের এক বন্ধুর মায়ের সঙ্গে।
মতলুব বিশ্বাস করল কী না বোঝা গেল না। কিন্তু মতলুব আর এ নিয়ে কথা বাড়াল না। সে জিজ্ঞেস করল, মিনু কোথায়?
ও ঘুমিয়েছে।
আচ্ছা, বলে মতলুব ফোন রেখে দিল।
ডলির মনে হলো মতলুব তার কথায় বিশ্বাস করেনি তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল।
ছয়
বাসার ড্রাইভার কুদ্দুস অনেক পুরান এবং বিশ্বস্থ বলেই মতলুব যখন ডলি আর মিনুকে ঢাকার বাসায় পাঠিয়ে দেয় তখন তাদের ব্যবহৃত গাড়িটি পাঠিয়ে দেয় সেই সঙ্গে পুরান ড্রাইভার কুদ্দুসকে। কুদ্দুসকে পাঠানোর উদ্দেশ্যটা আপাত দৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এর পেছনে মতলুবের অসৎ মতলবও আছে। কুদ্দুস শুধু গাড়ি চালায় না বাসার বাজার-সওদা করে, বাসার ছোটো-খাটো কাজও করে আর তার অতিরিক্ত যে দায়িত্বটা পালন করে তা একজন গৃহিণীর জন্য লজ্জাকরও বটে। প্রতিদিন রাতে কুদ্দুস ডলি আর মিনুর সারাদিনের গতিবিধি মতলুবের কাছে পৌঁছে দেয়। কুদ্দুস অনেকটা প্রভুভক্ত কুকুরের মত। তবে প্রভু বলতে সে শুধু মতলুবকেই চিনে। অপরদিকে গাড়ির ড্রাইভারকে স্ত্রীর গোয়েন্দাগিরি করার কাজে ব্যবহার করাটাও শুধু ডলির জন্য লজ্জাজনক নয় মতলুবের জন্যও হীনম্যনতার পরিচায়ক।
ডলি প্রতিদিন সকালবেলা মিনুকে নিয়ে স্কুল যায়, স্কুল থেকে নিয়ে আসে। যদি কোনদিন শপিং করতে যায় তবে মিনুকে নিয়ে এবং বাসার গাড়িতেই যায়, যে গাড়ির ড্রাইভার কুদ্দুস। আগে বাইরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি কিন্তু এবার আফসারের সঙ্গে দেখা করার বেলায় ডলি কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, সে সামান্য দোষে অনেক বেশি শাস্তি পেয়েছে। যাকে বলে লঘু পাপে গুরু দণ্ড। এবার না হয় গুরু পাপে গুরু দণ্ড হবে।
পরদিন সকালবেলা ডলি স্কুলে গিয়ে আফসারকে ফোন করল। আফসার হয়ত স্কুলের কাছাকাছিই ছিল সে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুলের গেটে চলে এলো। আফসার গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিতেই ডলি গাড়িতে উঠল। আফসার নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। ডলি আফসারের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। আফসার গাড়ি চালাতে চালাতে একবার ডলির দিকে তাকিয়ে বলল, তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে।
ডলি একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, ইয়ার্কি করছিস। আমি কত মুটিয়ে গেছি আর তুই বলছিস সুন্দর হয়েছি। সুন্দর তো হয়েছিস তুই।
তাই নাকি?
আফসার গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝে ডলির দিকে তাকাচ্ছে। ডলি বলল, রাস্তায় দেখেশুনে চালা।
আফসার বলল, ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো অনেক উন্নত হয়েছে। আমি যখন কানাডা যাই তখন এই ফ্লাইওভারগুলো কেবল তৈরি হচ্ছিলো, তখন কত যানজট ছিল, এখন ফ্লাইওভারগুলো তৈরি হওয়ার পর যানজট অনেকটা কমে গেছে, রিলাঙলি গাড়ি চালান যায়।
এমনিভাবে কথা বলতে বলতে গাড়ি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এলো। আফসার আবার বলতে শুরু করল, যেদিন আমি কানাডার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলাম সেদিন এয়ারপোর্টে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম, আমি তোর একটা ফোন খুব আশা করেছিলাম। বার বার তোর ফোনে রিং দিয়েছি কিন্তু তোর ফোন বন্ধ।
সেদিনের কথা উঠতেই ডলি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। সে কিছু বলতে গিয়ে যেন কণ্ঠস্বর বুজে এলো, সেদিনের কথা আর বল না। সেদিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। আমি সেদিন বিছানায় শুয়ে সারাদিন কেঁদেছি। যখন আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসি তখন তো তোর ওপর আমার অনেক রাগ ছিল, অভিমান ছিল। সেদিন বুঝিনি যে আমি চিরতরে তোকে হারাতে বসেছি কিন্তু যেদিন তুই কানাডায় যাস সেদিন আমার মনে হলো আমি চিরদিনের জন্য তোকে হারিয়ে ফেললাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে না। অথচ আবার দেখা হলো, আল্লাহ’র কাছে হাজার শুকরিয়া, বলতে বলতে ডলির গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।
আফসার একবার হাত বাড়াল ডলির চোখের পানি মুছে দিল। ডলি আবার বলতে শুরু করল, এভাবে সারাজীবন চোখের পানি মুছে দিতে পারবে তো।
আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম, তুমি রাগের বশে এমন একটা কাজ করে ফেললে…
ডলি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ? অনেকদূর তো চলে এলাম।
হ্যাঁ সামনে গাজিপুর চৌরাস্তা। তারপর কোথাও বসব।
গাজিপুর চৌরাস্তা পার হয়ে কিছুদূর যেতে মেইন রাস্তা থেকে হাতের ডানে একটা রাস্তা চলে গেছে ন্যাশনাল পার্কে, দু’জনে পার্কে ঢুকলো।
পার্কে ঢুকে আফসার একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ডলি হাত বাড়াতেই আফসার ডলির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিল। ডলি হাঁটছে আর ভাবছে আজকের দিনটির মত এমন মধুর তার সারাজীবন হতে পারতো, সে নিজেই, নিজেই অভিমান করে সেই সুন্দর, মধুর সম্পর্কটা নষ্ট করেছে। আজ আবার সেই আফসারের হাত ধরে হাঁটতে তার কী যে আনন্দ লাগছে ডলি বলে বোঝাতে পারবে না। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নিচে একটু নিরিবিলি জায়গায় গা ঘেঁষে বসল।
আফসার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস বল?
ডলি আফসারের কথার জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করল, আগে তুই বল কেমন আছিস? বউ কোথায়, বেবি ক’জন?
তোকে বললাম না, চাল-চুলো নেই।
ডলি কিছু আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, এখনও বিয়েই করিসনি?
আফসার না সূচক মাথা নেড়ে জানাল সে বিয়ে করেনি।
কেন?
কানাডায় গিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম। এম.এস, পি.এইচ.ডি করতে অনেকদিন লেগে গেল।
তারপর?
তারপর থেকে বউ খুঁজছি। তেমন পছন্দের কাউকে পাইনি।
এটা কী বলিস, তুই এতবড় ইঞ্জিনিয়ার তোর আবার মেয়ের অভাব পড়ল।
হ্যাঁ। ক্যাটাগরি ফিঙড করে দিয়ে খুঁজলে কি পাওয়া যায়?
কী রকম? বুঝিনি তোর কথা।
বুঝিসনি, আমি আসলে তোর মত একটা মেয়ে খুঁজছিলাম। সবাইকে তুলনা করতাম তোর সঙ্গে, নাক, মুখ, চোখ, গায়ের রং, আবেগ-অনুভূতি, মান-অভিমান সবদিক থেকে যেন তোর মত হয় কিন্তু পাওয়া গেল না। মানুষের মত কী আর মানুষ পাওয়া যায়। তাই বিয়ে করা হয়নি।
আফসারের কথা শুনে ডলির বুক ভরে গেল। আফসার এতদিন তার মতই একজনকে খুঁজছে, তার স্মৃতিই বুকে লালন করছে। আর সে এমন একটা ভালো মনের মানুষকে সামান্য অজুহাত দেখিয়ে ছেড়ে চলে এসেছে। ডলির নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো, আমার চেয়ে ভালোও তো পেতে পারতিস।
আমার তো তোকে দরকার ডলি, তোর চেয়ে ভালো না। হয়ত তোর চেয়ে বেশি সুন্দর হত, তোর চেয়ে সুন্দর করে কথা বলত, তোর চেয়ে বেশি ইমোশনাল হত কিন্তু সেটা তো তুই না। আসলে একজনের বিকল্প অন্যজন হয় না ডলি।
আমি রাগের বশে খুব ভুল করে ফেলেছি আফসার। আমি তোকে খুব কাছে পেতে চাইতাম আর তোর ছিল লেখাপড়ার চাপ, ব্যস্ততার জন্য তুই আমাকে সময় দিতে পারতিস না আর আমি মনে করতাম তুই বুঝি অন্য কারও সাথে রিলেশন করছিস। তাই আমি তোর সঙ্গে চিৎকার করে ঝগড়া করতাম, কান্নাকাটি করতাম। এগুলো বাবা-মা বুঝতে পেরে আমার বিয়ের আয়োজন করল, আমি তোকে শিক্ষা দিতে গিয়েই মতলুবকে বিয়ে করলাম। মতলুবকে বিয়ে না করলে বাবা-মা হয়ত অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে দিত সেটা আরও বেশি খারাপ হতে পারতো।
কেন, ভালো তো। শুনেছি তোর হ্যাজবেন্ড নাকি অনেক ধনী মানুষ।
ডলি প্রচণ্ড রেগে গেল, টিজ করছিস? আমি কোনদিন টাকা-পয়সার কাঙ্গাল ছিলাম?
আফসার মৃদু হেসে উড়িয়ে দিল, সরি, আবার রেগে গিয়ে কী যে কষ্ট দিবি।
না। আর রেগে গিয়ে কিছু করব না। যদি কিছু করি তবে ঠাণ্ডা মাথায় করব।
আফসার ডলির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, তেমন কিছু করবি নাকি?
মানুষের মন বলে একটা জিনিস আছে, কোনোকিছুর ওপর থেকে যখন মানুষের মন উঠে যায় তখন মানুষ যাচ্ছেতাই করতে পারে।
কেন হঠাৎ এই অবস্থা?
হঠাৎ না বলে ডলি আফসারের সঙ্গে তার কানাডা যাওয়ার আগে শেষ দেখা করার দিন থেকে সব ঘটনা খুলে বলল, বলতে বলতে ডলি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। সেই তোর যাওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি আফসার।
ডলির কথা শুনে আফসারও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, আমার জন্য, আমার জন্য তোর এত বড় শাস্তি হয়েছে ডলি। অথচ আমাকে একবার বললিও না।
তোকে বলে আর কী লাভ, আমি ভাবছিলাম আমার পাপের শাস্তি আমিই পাব, তুই কেন পাবি। তোর তো কোন দোষ নেই।
আমার দোষ নেই কিন্তু আমার জন্যই তো তুই শাস্তি পাচ্ছিস।
জানি না আজকে দেখা করার কথা জানতে পারলে আমার কপালে কী আছে।
আমি আছি, আমি তোর পাশে আছি ডলি, আমাকে জানাবি। পাপ যদি হয়ে থাকে তবে তা তো আমাদের দু’জনের, দু’জনের পাপের শাস্তি তুই একাই পাবি কেন?
ডলি মাথা উঁচু করে আফসারের চোখে চোখ রাখল। আফসারের চোখে কোন চতুরতা নেই, সহজ-সরল, স্বচ্ছ দু’টি চোখ। ডলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, সত্যি বলছিস তো, তুই আমার পাশে থাকবি?
অবশ্যই থাকবো।
দু’জনে আরও কিছুক্ষণ একান্তে কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছিল এমন সময় ডলি আফসারের হাত টেনে বসাল, উঠছিস যে, একটা কবিতা শুনাবি না?
ডলি আফসার দু’জনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। দু’জনের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, আফসার ডলির গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিতে দিতে কান্না-হাসি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, কবিতা? তুই তো আমার কবিতা, আমি তো সারাজীবন তোকেই আবৃতি করছি। নতুন আর কী কবিতা আবৃতি করব, বল?
হ্যাঁ, যতবার তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবার একটা কবিতা না শুনে তো কথা শেষ হয়নি।
পড়ব?
অবশ্যই।
আফসার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হঠাৎ দেখা কবিতাটা আবৃতি শুরু করল
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি লাল রঙের শাড়িতে-
দালিম ফুলের মত রাঙা, আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায় দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হলো, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব, ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব, সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায় শালবনের নিলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা, চেনা লোককে দেখলাম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে, আলাপ করলেন শুরু-’কেমন আছ’, কেমন চলছে সংসার’ ইত্যাদি।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে ছোটো দুটো-একটা জবাব, কোনটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অসি’রতায়-কেন এ-সব কথা, আর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময় আঙুল নেড়ে জানাল কাছে আসতে।
মন এ হলো সাহস কম নয়-বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে বললে মৃদুস্বরে, কিছু মনে কোরও না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের ষ্টেশনেই দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেকে আছে, শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো? আমি বললেম, ’বলব’
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধোল,
আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে-কিছুই কি নেই বাকি?
একটুকু রইলেম চুপ করে, তারপর বললেম, ’রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেন নাকি।
ও বললে, ’থাক্, এখন যাও ও দিকে।’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে। আমি চললেম একা।
আফসারের কবিতা আবৃতি শুনে ডলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, আফসারের দু’চোখ আবার পানিতে ভরে গেল। ডলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আফসার আমাদের যে দিন গেছে-কিছুই কি নেই বাকি?
আফসার কোন কথা বলল না। ডলি আফসারের বুকে মাথা রেখে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল, কথা বল আফসার, প্লিজ কথা বল।
আফসার ডলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি যা চাইবে তাই হবে ডলি।
সাত
আফসারের গাড়ি থেকে ডলি যখন তার বাসার সামনে নামল তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে। ডলি গাড়ি থেকে নেমে আফসারকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। আফসার গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে কয়েকবার তার গাড়ির লুকিং গ্লাসে ডলিকে দেখলো। ডলিও আফসার গাড়ির ভিড়ে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইল। ডলির দু’চোখ বেয়ে তখন অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে, আফসারের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বার বার হৃদয় আকুতি করছে, আমাকে কেন রেখে যাচ্ছিস আফসার, কেন? আমি তো তোর কাছে যেতে চাই একেবারে, চিরদিনের জন্য।
একসময় আফসার গাড়ির ভিড়ে মিশে গেল। ডলি চোখ মুছে বাসায় ঢুকলো। লিফট থেকে নেমে বাসার কলিং বেল টিপতেই মিনু দরজা খুলে দিল, আম্মু কোথায় গেছিলে তুমি?
ডলি মিনুকে কোলে তুলে নিল। একটা কাজ ছিল বাবা, তোর কোন অসুবিধা হয়নি তো।
না, কুদ্দুস আঙ্কেল আমাকে বাসায় এনে ভাত খাইয়ে তারপর গেছে। তোমাকে আঙ্কেল বার বার ফোন করেছিল, বাবাও নাকি ফোন করেছিল।
ডলি তার মোবাইল ফোন বের করে দেখলো কুদ্দুস পাঁচ বার ফোন করেছে, মতলুব তিন বার।
ডলির বুক কেঁপে উঠল, নিশ্চয়ই মতলুব এটা ভালোভাবে নেয়নি। এভাবে ফোন সাইলন্ট করে রাখা তার ঠিক হয়নি। কুদ্দুস যখন প্রথম ফোন করেছিল তখন যদি ফোন করে কিছু একটা বলে রেখে দিত তাহলে হয়ত কুদ্দুস মতলুবকে ফোন করত না। উঃ ডলি একটা নতুন দুশ্চিন্তায় পড়ল। ডলি আফসারকে পেয়ে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল যে সে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। মাত্রাতিরিক্ত আবেগ মানুষের বিবেক বুদ্ধি ধ্বংস করে।
মতলুব ফোন করল রাত সাড়ে দশটার সময়, এমন একটা ভাব দেখালো যে সে ফোন করেনি এবং দিনে এমন কিছু ঘটেনি। মতলুব এমনই, সে যখন কোনোকিছু খুব সহজভাবে, গম্ভীরভাবে চেপে যায় তখন বুঝতে হবে সে ভয়ঙ্কর কিছু করবে। এটা ডলি তার দাম্পত্য জীবনে দেখেনি তবে মতলুবের ব্যবসায়িক জীবনে দেখেছে। মতলুবের ব্যবসার প্রতিপক্ষ আছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তার আছে বিভিন্ন রকমের কৌশল। আছে টাকা, ক্যাডার এবং লিডার, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তার যখন যেটা প্রয়োজন হয় তখন সেটাই করে। ডলিদের পরিবারও একসময় মতলুবের প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু ডলির বিয়ের পর সে কিছুটা নরম হয়েছে। ডলি দেখেছে যখন সে কাউকে ঘায়েল করার জন্য পরিকল্পনা করে তখন খুব শান্ত ব্যবহার করে, তখন বাসায় তার চলাফেরাও গম্ভীর হয়। তখন তার কথাবার্তাও হয় সংক্ষিপ্ত, কাউকে নির্দেশনা দেয় খুব সংক্ষেপে, হ্যাঁ কর, এগিয়ে যাও, বি কেয়ারফুল এরকমের।
ডলি ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
মতলুবের গম্ভীর, শান্ত কণ্ঠস্বর, হ্যালো, কেমন আছ?
ভালো, তুমি?
হ্যাঁ। ভালো আছি। মিনু কোথায়?
ও পাশের রুমে পড়ছে। ডাকবো?
না থাক, বলে বলে মতলুব ফোন রেখে দিল।
খুব অল্প কথায় শেষ হলেও ডলির বুক কেঁপে উঠল। কী হয়েছে মতলুব কি ভয়ঙ্কর কোন কাণ্ড ঘটাবে নাকি? হতে পারে তার সাথে অথবা অন্য কারও সাথে।
মতলুব এত ফোন করে অথচ কোনদিন ডলির সঙ্গে তেমন কথা বলে না, দু’য়েকটা কথা বলেই রেখে দেয়। ডলির ভালো-মন্দের বিষয়ে কেমন আছ এতটুকুই। আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা।
ডলি রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে আফসারকে ফোন করল।
আফসার ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো।
বল, কী করিস?
এই তো শুয়ে শুয়ে তোর কথা ভাবছি।
আমার কথা না ভেবে এবার নিজের কথা কহ কবি, বলে ডলি হাসল।
হ্যাঁ। নিজের কথা তো ভাবতে গেলেই তো তোর মুখটা ভেসে উঠে।
সত্যিই?
হ্যাঁ। দেখা হওয়ার আগেও ভাসত তবে আজ দেখা হওয়ার পর, তোর সঙ্গে কথা হওয়ার পর বেশি বেশি মনে হচ্ছে। আমাদের খুব সুন্দর একটা জীবন হতে পারতো, তুই রাগের বশে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি যে সব নষ্ট হয়ে গেল। তবুও যদি তুই সুখে থাকতে পারতিস তাহলে মনে করতাম আমার যত কষ্টই হোক তুই সুখে আছিস, আমি তাতেই সুখী আফসার বলল।
আমিও যদি দেখতাম তুই বিয়ে করেছিস, বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে আছিস তাহলে আমিও তোর জন্য কিছু ভাবতাম না। আমি কি তোর জন্য একটা কনে দেখব?
আফসার পাগলের মত হো হো করে হেসে উঠল, তুই আমার জন্য কনে দেখবি?
হ্যাঁ। আমি তোর বন্ধু, সেই কলেজ জীবনের বন্ধু, আমি তোর পাশে দাঁড়াব না?
অবশ্যই দাঁড়াবি।
তাহলে তোকে কিছু অপশন দিই, উত্তর দিবি।
ওকে।
ডলি জিজ্ঞেস করল, কম বয়সী, টিন এজ পাত্রী চলবে?
আমার বয়স তো প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। টিন এজ পাত্রী কি আমার সঙ্গে বিয়েতে বসবে আর বসলেই কি সারাজীবন থাকবে নাকি কয়েকদিন পর ফুড়-ৎ।
বেশি বয়সের আনমেরিড পাত্রী পাওয়া তো দুষ্কর, ডিভোর্সি হলে চলবে?
হ্যাঁ, চলবে কিন্তু দেখতে শুনতে তোর মত হতে হবে, আফসার বলল।
যদি আগের পক্ষের বেবি থাকে।
আফসার বলল, আন্ডার কন্সিডারেশন।
ওকে। জানা থাকলো। আমি দেখি যদি কাউকে পাওয়া যায়। তোর অপশন কিন্তু আমি জেনে নিলাম পরে যেন না করিস না।
ওকে, আগামীকাল তোর কি শিডিউল?
আমার আর শিডিউল কী, সকালে মিনুকে নিয়ে স্কুল আর স্কুল শেষে বাসা।
কাল কি একবার দেখা হবে?
না রে। কালকের দিনটা থাক, পরশুদিন আবার দেখা হবে। তবে আর লং ড্রাইভে না। আশেপাশের কোন রেস্টুরেন্টে।
ওকে।
পরদিন রাতে আবার আফসারের সঙ্গে ডলির কথা হলো। অনেকক্ষণ, যেন কথার শেষ নেই, সেই কলেজ জীবনের কথা, নিঃসঙ্গ জীবনের কথা, একাকী জীবনের কথা। কথায় কথায় ডলি তার ইচ্ছার কথা জানাল, আফসারও জানাল তার ইচ্ছার কথা। পাওয়ার আনন্দ মানুষ অনেক সময় অবহেলা করে, হারানোর পর পাওয়ার আনন্দময় মুহূর্তগুলো তিলে তিলে অনুভব করে। পুরন প্রেম আবার ফিরে এলে বেশি মধুর হয়।
রাত ভোর হতে চলল কিন্তু কেউ যেন ফোন রাখতেই চাচ্ছে না, ডলি একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, আফসার কত বাজে একবার ঘড়ি দেখেছ?
বাজুক, একটা রাত কথা চলুক, আমাদের জীবনে আজকের রাতটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ডলি আবেগজড়িত কণ্ঠে আমি আর আমাদের প্রেমকে ইতিহাস করতে চাই না আফসার আমি চাই আমরা বর্তমানকে উপভোগ করতে।
মানে?
মানে আগে দেখা হোক দেখা তো হচ্ছেই আবার।
হ্যাঁ।
আফসার রেস্টুরেন্টে পৌঁছেছিল ডলির চেয়ে কিছুক্ষণ আগে। সে রেস্টুরেন্টে ঢোকার দরজার দিতে মুখ করে বসেছিল। ডলি রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। সীমিত আলোয় ডলি দেখতে পাবে না ভেবে আফসার একটা হাত তুললো। ডলি কাছে এসে একটা সুন্দর হাসি হেসে বলল, সরি ডিয়ার দেরি হয়ে গেল। কখন এসেছিস তুই?
ডলি খুব সেজেগুঁজে এসেছে, অপরূপ দেখাচ্ছে তাকে। আফসার ডলির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়াও, ইউ আর লুকিং নাইস ডিয়ার।
ডলি আফসারের মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?
না, তা কেন?
তাহলে…
আফসার ডলির এই তাহলে কথার অর্থ বুঝতে পারল। ডলি ইনিয়ে বিনিয়ে সব অপশন তার সঙ্গে মিলিয়ে বলেছে। ডলিকে আফসারের পছন্দ, ডলির বয়স যতই হোক না কেন। আফসারের কাছে ডলি এখনও সেই কলেজ জীবনের বন্ধু, সেই চঞ্চল, স্লিম ফিগারের তরুণী। ডলির বয়স যদি আরও বেড়ে যায় তবুও ডলিকে তার সেরকমই মনে হবে। আফসারের চোখে ডলি চির সবুজ, চির তরুণী।
আফসার ডলির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী ডলি?
ডলি কনুই টেবিলে ভর করে থুতনিতে হাত দিয়ে আফসারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোকেও কিন্তু আজ খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে আফসার।
মজা করছিস?
মোটেই না।
তবুও তো এতদিনেও একটা পাত্রী পাচ্ছি না।
পাচ্ছিস না, নাকি পেয়ে বসে আছিস, আমার সাথে ভণিতা করছিস, না?
আফসার ডলির থুতনি থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে তার নাক টেনে বলল, কনগ্রাচুলেশন?
ডলি একটা লাজুক হাসি হাসল।
আফসার জিজ্ঞেস করল, কী খাবি?
তুই বল।
না, আজ থেকে খাওয়ার মেনু বলবি তুই। আর বিল দিব আমি।
তুই বল কী খাবি আমি নিয়ে আসছি।
ডলি বলল, আমার জন্য শুধু চিকেন ফ্রাই আর ক্লোড ড্রিঙ্কস। তুই যা খাবি তাই।
তাহলে আমিও তাই খাব, বলে আফসার কাউন্টারে গিয়ে নিজ হাতে খাবার নিয়ে এলো।
খেতে খেতে দু’জনে অনেক কথা হলো। সিদ্ধান্ত হলো বিয়ের পর আফসার ডলিকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে, চিরদিনের জন্য আর কোনদিন দেশে আসবে না। আর পরে যদি আসার সিদ্ধান্ত হয় তবুও অনেকদিন পর। কারণটা ডলি বলল, বাংলাদেশে থাকলে মতলুব তাদের প্রতি হিংস্র হয়ে যেতে পারে।
আফসার ডলির কথায় একমত হলো। যত দ্রুত সম্ভব আফসার ভিসার ব্যবস্থা করবে তারপর একটা শুভদিন দেখে দু’জনে বিয়ে করে সাত সমুদ্র তেরো নাদির পারে কানাডায় পাড়ি জমাবে।
আট
প্রায় এক যুগের সংসার কিন্তু মধুর দাম্পত্য জীবন ডলির ক’দিনই বা ছিল। প্রথম বছর দু’য়েক তারপর থেকেই তো শুরু হলো সন্দেহ আর অবিশ্বাস। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ঘুণপোকা সংসারটা নষ্ট করে দিল। ডলি তার প্রাক্তনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই ছবি পড়ল মহলুবের হাতে, মতলুব ক্ষমা করতে পারতো, ক্ষমা মহৎ গুণ কিন্তু মহলুব সেই মহৎ গুণে গুণান্বিত না। মতলুব ডলিকে শাস্তি দিল, শুধু কি শাস্তি দিল সেও কি কম শাস্তি পেল।
ডলির পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই। সে বলে যাবে, মতলুবকে ডিভোর্স করে যাবে। প্রতিশোধ, সেও তাকে অবহেলার প্রতিশোধ নিবে। তার লঘু পাপে গুরু দণ্ডের মত সেও মতলুবকে গুরু দণ্ডই দিবে কিন্তু তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে সে যে তার একমাত্র সন্তান, যাকে সে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছে। বছরের পর বছর স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে লালন পালন করেছে তাকেও যে সে চিরদিনের মত মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করবে।
ডলির আর পিছু ফেরার পথ নেই মতলুব তাকে আর কোনদিন ভালোভাবে গ্রহণ করবে না, জীবনের এখনও কত দীর্ঘ পথ বাকি, এই দীর্ঘ পথ সে মতলুবের সঙ্গে কীভাবে পাড়ি দিবে। শুধু বিষয়-সম্পত্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে কী জীবন চলে। সুখী ও সুন্দর দাম্পত্য জীবনের জন্য চাই একটা ভালোবাসার ঘর, আর সেই ঘরকে বর্ণিল করে সাজানর জন্য প্রয়োজন বিত্ত, চিত্তে সুখ না থাকলে বিত্ত কখনও মানুষকে সুখ দিতে পারে না। ডলির মিনতির কথা মনে পড়ল। মিনতির সেই ফাইন্যান্সিয়াল হ্যাপিনেসে ডলি সুখী হতে পারবে না। তাছাড়া সে আফসারকে কথা দিয়েছে।
ডলি একবার মিনুর মুখের দিকে তাকালো। একটা নিষ্পাপ মুখ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মিনুর কোন চিন্তা নেই, সে মা-বাবার এসব নিয়ে কিছু ভাবেও না। ছেলেটার কোন দোষ নেই কিন্তু সেও শাস্তি পাবে, মা-বাবার বিচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় সন্তান। একটা বিব্রতকর, অসম্মানজনক সম্পর্ক নিয়ে বেড়ে ওঠে, মা-বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় সন্তানকে।
ডলি একবার ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। হ্যাঁ চৌধুরী সাহেবকে ফোন করার সময় হলো ডলির। সে একবার ফোন করল, ফোন রিসিভ হলো না।
ডলি আবার ফোন করল। চৌধুরী সাহেব ফোন রিসিভ করেছে, তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।
কথাটা কীভাবে উপস্থাপন করবে একথা ডলি অনেকবার মনে মনে সাজিয়ে নিয়েছে কিন্তু তবুও বলতে গিয়ে বুকটা একটু কেঁপে উঠল। সে একটা ঢোক গিলে বলল, তুমি কি একটু ফ্রি আছ?
হ্যাঁ ফ্রি আছি বল?
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বল?
আমি আর এভাবে থাকতে চাচ্ছি না।
কীভাবে?
এই যে তোমার সঙ্গে আমার যেভাবে দিন যাচ্ছে। যেভাবে আমরা সংসার করছি।
তাহলে কী করতে চাচ্ছ?
আমি, আমি…কথাটা বলতে গিয়ে ডলি আবার একটা ঢোক গিলল, তার বুকে যেন একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল। ডলি এমন ভাবেনি, সে ভেবেছিল সে খুব সহজভাবে কথাটা বলতে পারবে। যে সংসারে তার এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছা নেই সে সংসার ছেড়ে যেতে তার মধ্যে মায়াটা যেন প্রকট হয়ে উঠল।
সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি, আমি তোমার সংসার থেকে মুক্তি চাচ্ছি।
চৌধুরী সাহেবের কথা শুনে ডলির মনে হলো যেন সে আগে থেকেই সব জানে, সে অবাক হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, মুক্তি? কী রকম মুক্তি?
ডলি উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ মুক্তি। এ কথার অর্থ তুমি ভালো করেই বোঝ, আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছি। আমি এভাবে আর বাঁচতে চাচ্ছি না।
মানে?
মানে এখনও বোঝোনি, মানে তোমার ছেলেকে তুমি নাও। আমি চলে যাচ্ছি।
কোথায়?
যেখানে আমার ইচ্ছা। যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাব।
যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাবে নাকি কারও হাত ধরে চলে যাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ, কারও হাত ধরে চলে যাব। যে আমার হাত শক্ত করে, হৃদয় দিয়ে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখবে আমি তার সাথে চলে যাব।
এবার বুঝতে পেরেছি। মানে তুমি কারও সাথে চলে যাবে। এই তো।
যেখানে যাই বা যার কাছেই যাই আমি আর তোমার সাথে থাকছি না। আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। আমি মুক্ত হয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছা, যার সাথে ইচ্ছা চলে যাব। আশা করি তুমি আমার পিছু নিবে না।
মতলুব একটা রহস্যময় বিকট হাসি হেসে বলল, আমি তোমাকে খুঁজব! আমি জানতাম এরকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
না জেনে কথা বলবে না, তুমি কীভাবে জানতে?
যখন কোন স্ত্রীর মোবাইল ফোনের পুরানা সিমকার্ড ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে, যখন কোন স্ত্রী তার সন্তানকে ক্লাস রুমে রেখে লং ড্রাইভে যায় তখন একজন স্বামীকে বুঝতে হয় কী ঘটতে চলেছে। ওকে, তুমি যাবে। তুমি না বলেও যেতে পারতে, বলে যাচ্ছ দেখে আমি তোমার ওপর খুশী হয়েছি।
হ্যাঁ পারতাম কিন্তু আমি চোরের মত পালিয়ে যাব না। তোমাকে বলে যাব তাই তোমাকে ফোন করলাম।
মতলুব অস্বাভাবিক শীতল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ওকে, বেস্ট অফ লাক।
একটা সংসার ভাঙ্গা, একটা দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান কত ঠুনকো। দীর্ঘ দিনের একটা সম্পর্ক। দুজনের সম্পর্কটাও ছিল এমনই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা। ডলি জানত পালিয়ে বিয়ে করলে তার বাবা-মা তাকে কোনদিন মেনে নিবে না। বাবার বাড়ির পথটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তবু ডলি সেদিন মতলুবের হাত ধরে এক কাপড়ে বাবার বাড়ি থেকে চলে এসেছে। সেদিনের পর থেকে ডলি আর কোনদিন বাবার বাড়ি দিকে মুখ তুলেও তাকায়নি। বাবা-মা আর তাকে কোন দিন ডাকেনি, কোনদিন তাদের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। বাবা-মা’র স্নেহ মমতা ছেড়ে একদিন ডলি এই মতলুবের জন্য চলে এসেছিল আর আজ সেই মতলুবকে ছেড়ে আফসারের হাত ধরে চলে যাচ্ছে, সবকিছু এতই সহজ!
সেক্রিফাইজ বা ত্যাগ স্বীকার নামে পৃথিবীতে যে একটা শব্দ আছে সেটা পৃথিবী থেকে উঠে যাচ্ছে। কেউ কার জন্য বিন্দুমাত্র ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি না, বাবা-মা সন্তানের জন্য সেক্রিফাইজ করে না, সন্তান বাবা-মা’র মুখের দিকে তাকায় না, স্বামী স্ত্রীর বিন্দুমাত্র অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকায় না। স্ত্রী স্বামীর জন্য বিন্দুমাত্র সেক্রিফাইজ করে না, যে যার আপন গতিতে চলছে, শিক্ষার নামে, আধুনিকতার নামে গড়ে উঠল এক নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা।
ডলি যে রাগ, যে ক্ষোভ নিয়ে ফোন করেছিল এবং যেভাবে বলবে ভেবে ফোন করেছিল সেভাবে বলতে পারল না। কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল। এখন যত দূরত্বই বাড়-ক না কেন একদিন তো তাদের মধ্যে অনেক রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল। বিয়েটা রাগের বশে হলেও বিয়ের পর দু’জনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। যাকে বলে বিয়ের পরে প্রেম এটা হয়ত তাদের বেলায় সঠিক ছিল।
চৌধুরী সাহেব বিয়ের আগেই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, শুধু সে নয়, তাদের পরিবারের সবাই ব্যবসায়ী। লেখাপড়ায় সার্টিফিকেট অর্জনটা তাদের ছিল মর্যাদার বিষয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই ব্যবসায়িই হয়। মতলুবও মাস্টার্স করার পর ব্যবসায় যোগ দেয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিয়ে হলো কিন্তু তখনও তার বাবাই ব্যবসা দেখাশুনা করত। বিয়ের পর মতলুব কিছুদিনের জন্য ব্যবসা থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হানিমুন করতে। প্রথমে দেশের বাইরে তারপর কয়েক দিনের বিরতির পর সারাদেশ ঘুরে বেড়ায়। তারপর আবার ব্যবসায় মনোযোগী হয়। ব্যবসায় ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে মতলুব আর ডলি বেরিয়ে পড়ত লং ড্রাইভে। একটা মধুর, ভালোবাসার অকৃত্রিম সম্পর্ক ছিল ডলির সাথে মতলুবের। সেসব দিনের কথা মাঝে মাঝে ডলিকে দোলা দেয়। আর সেসব মধুর স্মৃতি হৃদয়ে ভেসে ওঠায় ডলি অনেক কঠোরভাবে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তার হৃদয়ে ভেসে উঠল মতলুবের সেই মায়াভরা মুখটা।
মতলুব বিয়ের আগে সম্পর্কের ব্যাপারে খুব নিষ্ঠাবানই ছিল। ব্যবসায়ী হলেও তার চলাফেরা ছিল রুটিন মাফিক। সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যেত, সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফিরত যা সাধারণত ব্যবসায়িদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তার আশা ছিল তার স্ত্রীও হবে সেরকমই একেবারে শতভাগ ঘোরণী, ছিলও তাই কিন্তু বিয়ের আগে ডলির তার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ বললে ভুল হবে অনেকটা হৃদয়ঘটিতও।
বিয়ের আগে সাধারণত মেয়েদের অনেকেই এসব সম্পর্ক এড়িয়ে যায়। ডলিও এড়িয়ে গিয়েছিল, বিয়ের পর মতলুবের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তার বিগত জীবনের হৃদয়ঘটিত সম্পর্কও একরকম ভুলিয়েই দিয়েছিল কিন্তু ডলির সঙ্গে মতলুবের সম্পর্কের অবনতির পর সে বদলে গেল। ভালো একজন নিষ্ঠাবান মানুষ, একজন হৃদয়বান মানুষ পরিণত হলো একজন মাতাল, নারীলোভী মানুষে আর এটাও হলো তার নারীর প্রতি ঘৃণা থেকে। থাক সে নারীর প্রতি ঘৃণা নিয়েই থাক কিন্তু ডলি তার জন্য বাকি জীবনটা নষ্ট করবে না ডলি। ডলি আর পিছু ফিরতে চায় না। সে মতলুবের সঙ্গে হৃদয়ের সব লেনদেন শেষ করে নতুনভাবে বাঁচতে চায় আফসারের সাথে।
ডলি ফোন রেখে দিল। এমন সময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
হ্যালো, ডলি এ্যানি প্রবলেম? আফসারের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
ডলি চোখ মুছে বলল, না, কোন প্রবলেম না। বল?
আফসারের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল, ডলি তুমি ঠিক আছ তো! মানে কোন প্রবলেম হয়নি তো!
না, না কোন প্রবলেম হয়নি তুমি টেনশন করছ কেন? আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি ঠিকঠাক আছি এবং তোমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। তোমার কোন প্রবলেম নেই তো?
না। আমার আবার কী প্রবলেম হবে। তাহলে আমরা ভেরি সুন যাচ্ছি।
ডলি জোর দিয়ে বলল, ওকে। আমিও রেডি।
থ্যাংক ইউ ডিয়ার।
ডলি মোবাইল ফোন রেখে মিনুর রুমে ঢুকলো। মিনু তখনও পড়ার টেবিলে বসা। মাকে তার রুমে ঢুকতে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।
ডলি মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ঘুমাসনি? আমি তো ভেবেছিলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস? প্রতিদিন তো আরও আগে ঘুমাস।
আজ ঘুম আসছে না।
ডলি মিনুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মিনু আমি যদি না থাকি তবে তুই একা থাকতে পারবি না?
মিনু এ কথার অর্থ বুঝল না, সে হেসে উঠল।
ডলি বলল, হাসির কথা না মিনু, আমি ভাবছি আমি আর তোর আব্বুর সঙ্গে থাকবো না।
মিনু না বুঝে বলল, তুমি তো আব্বুর সঙ্গে থাকছ না আম্মু, আমার সঙ্গে আছ।
তুই বুঝিসনি মিনু, মানে আমি কীভাবে বোঝাব যে আমি আর তোদের সঙ্গে নেই।
এটা কেমন কথা বলছ আম্মু। তুমি আমার আম্মু, তুমি আমাদের সঙ্গে নেই মানে?
আচ্ছা আমি সহজ করে বলি, আমি যদি না থাকি তবে তুই একা থাকতে পারবি না?
তখন আমাকে কে খাওয়াবে? কে স্কুল নিয়ে যাবে?
ডলির দু’চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি ছিটকে পড়ল, সে মিনুকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে বাবা।
কয়েক দিন ডলির কাটল দ্বিধাদ্বন্দ্বে কীভাবে বাসা থেকে যাবে, মিনুকে বলে যাবে নাকি না বলে। বলে যাওয়ার সময় যদি মিনু কান্নাকাটি করে, শুধু মিনু নয় ডলিও তো যেতে পারবে না। হাজার হলেও মা তো, দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে যে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছে, যার কান্না শুনে পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে গেছে, যার হাসি মাখা মুখ দেখ দেখে পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে গেছে তাকে ছেড়ে কীভাবে চলে যাবে। ডলির বার বার চৌধুরী সাহেবের ওপর রাগ হচ্ছে, কেন, কেন তুমি আমাকে আর মেনে নিতে পারলে না, কেন আগের মত ভালোবাসতে পারলে না। আমি তো যেতে চাইনি, আমি সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম অন্য সব মেয়েদের মত।
না ডলি মিনুকে আর কিছু বলবে না। ভিসা পাবার পর বিমানের টিকেট কেনার পর এখান থেকেই সোজা গিয়ে বিমানে উঠবে। সত্যি সত্যি একদিন ডলি ড্রাইভারের কাছে বাসার চাবি দিয়ে মিনুকে আল্লাহ’র হাতে সঁপে দিয়ে বাড়ি ছাড়লো। সেদিন মিনু স্কুল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল। মাকে না দেখে সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল আম্মু আসেনি?
মিনুর প্রশ্নের উত্তরে সে কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। সে মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, বাসায় চল দাদু, বাসায় চল।
বাসায় ফিরে মিনু বার বার তার মা’র মোবাইলে ফোন করল কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ। তারপর তার বাবাকে ফোন করল। চৌধুরী সাহেব কুদ্দুসের কাছ থেকে বাসার খবর রাখত এবং ডলি যে এরকম একটা করবে এটা তো ডলিও তাকে আগেই বলেছিল কাজেই আজ ডলি চলে যাবার পর কুদ্দুস যখন তাকে ফোন করল তখন সে খুব একটা অবাক হয়নি। চৌধুরী সাহেব ফোন রিসিভ করল, হ্যালো বাবা।
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আব্বু, আম্মু নেই!
চৌধুরী সাহেব বলল, আমি জানি বাবা। তুই তোর ড্রাইভার আঙ্কলের সঙ্গে চট্টগ্রাম চলে আয় বাবা।
আমার স্কুল?
আমি দু’য়েকদিন পর গিয়ে তোকে রেখে আসব বাবা। তুই চট্টগ্রাম চলে আয়।
ওকে।
সেদিন কুদ্দুসসহ মিনু চট্টগ্রামে গেল। দু’য়েকদিন বাবার কাছে থাকার পর ঢাকায় ফিরল। তারপর চৌধুরী সাহেব মিনুকে স্কুলের হোস্টেলে রেখে চট্টগ্রাম ফিরল।
মিনুর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অনেক ছাত্র-ছাত্রীই ইউরোপিয়ানদের ছেলেমেয়ে, শিক্ষকদের মধ্যেও কয়েকজন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তাই স্কুলের পরিবেশটাও গড়ে উঠেছে ইউরোপিয়ানদের মত। যেন বাংলাদেশের মধ্যে সীমানা প্রাচীর ঘেরা একটি ছোট্ট ইউরোপ।
ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা মিনু এক দুরন্ত কিশোর। প্রথম প্রথম তার বাবা মাঝে মাঝে ঢাকা আসত, তারপর মতলুব আবার বিয়ে করল। আর বিয়ে করার পর থেকে মিনুর প্রতি তার দায়িত্ববোধও কমে গেল। মাসের প্রথম সপ্তাহে মিনুর নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মতলুব তার খরচের জন্য টাকা পাঠিয়ে দিত। সপ্তাহে, পনেরো দিনে একবার ফোন করে মিনুর ভালোমন্দ খবর নিত।
মিনুর কৈশোর এবং তারুণ্য, যখন বাবা-মা’র স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-শাসন প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তখন সে বেড়ে উঠল ইউরোপিয়ান স্টাইলে, খোলামেলাভাবে, লাগামহীন স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। তার ওপর বাবার বেহিসেবি টাকা তো আছেই। তার চলাফেরা যেন অন্যরকম, সবসময় ফ্রেন্ড, গার্ল্ড ফ্রেন্ডদের নিয়ে হৈ চৈ করে সময় কাটিয়ে দেয়া।
এ লেভেল পাস করে মিনু ভর্তি হলো একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। এ লেভেল পরীক্ষা পর্যন্ত মিনু হোস্টেলেই ছিল। পরীক্ষার পর চলে এলো তাদের আগের বাসায়। যে বাসায় প্রথম ঢাকায় এসে তার মা আর সে একসঙ্গে থাকত। কুদ্দুস ড্রাইভার আবার চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এলো সেই বাসায়। প্রথম প্রথম মিনুর ভালো লাগত না, তার মা যখন বাসা থেকে চলে যায়, মিনু যখন হোস্টেলে গিয়ে উঠল তখন মিনুর খুব খারাপ লাগত, সবসময় মাকে মনে পড়ত, মাঝে মাঝে কান্নাকাটি করত। তারপর একসময় মিনু কিছুটা স্বাভাবিক হলো। মিনু যখন আরেকটু বড় হলো তখন তো বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে শুরু করল, ব্যস্ততা মানুষকে অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। মিনুকেও দিয়েছিল কিন্তু মিনু যখন আবার আগের বাসায় ফিরে এলো তখন আবার মায়ের সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো তার হৃদয়ে ভেসে উঠল। সেই অল্প বয়সে মিনু মায়ের জন্য কাঁদত বাসায় আসার পর আবারও মায়ের জন্য মাঝে মাঝে কাঁদত।
বাসায় এখন মিনু আর কুদ্দুস ড্রাইভার থাকে। কুদ্দুস ড্রাইভার গাড়ি চালায়, মিনু যেখানে যেতে চায় সেখানে নিয়ে যায়, বাড়ির বাজার করে আর একজন বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। মিনুর হোস্টেলের জীবন আর এই বাসার জীবনের মধ্যে কোন তফাৎ রইল না। বাসায় মাঝে মাঝে মিনুর বাবা আসে, মিনুকে ধীরে ধীরে ব্যবসার দায়িত্ব দিতে থাকে যাতে করে মিনু সবসময় ব্যস্ত থাকে আর অল্প বয়স থেকে ব্যবসা বুঝতে পারে, একদিন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে।
মিনুও কিছুদিন পর ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করে আর অবসর সময় ব্যবসা দেখাশুনা করে, বনানীতে তাদের একটা অফিস আছে, ঢাকার কর্পোরেট অফিস বলা যায়। আগে চৌধুরী সাহেব মাঝে মাঝে ঢাকার অফিসে এসে দেখভাল করত কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে মিনু যখন ব্যবসা বুঝতে শিখল তখন বলতে গেলে চৌধুরী সাহেব ঢাকা আসা কমিয়ে দিল। চৌধুরী সাহেব মাঝে মাঝে মিনুর কাছ থেকে ব্যবসার খোঁজখবর নেয়।
নয়
বর্ষা’র গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। বাবা হারুন দেশের বাইরে চাকরি করে, মা রুনা গৃহিণী, ছোট ভাই মুকুল আর মা গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির সঙ্গে একই পরিবারে থাকে। দাদা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ….গ্রামের নিম্নবিত্ত কৃষক। বর্ষা’র বাবা তার একমাত্র সন্তান। বর্ষা’র বাবাও তেমন লেখাপড়া করেনি। গ্রামের স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করে জীবিকার সন্ধানে দেশের বাইরে গেছে। কয়েক বছর পর দেশে এসে রুনাকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর এক মাস দেশে ছিল। তারপর আবার চলে গেল দেশের বাইরে। বর্ষা’র জন্মের পর বাবা তাকে দেখেনি। তখন সোশ্যাল মিডিয়াও ছিল না তাই ভিডিওতেও দেখেনি।
বর্ষা যখন সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছে তখন থেকেই বাবার সঙ্গে কথা বলে, হ্যালো বাবা, ও বাবা।
হ্যালো মা।
রুনা বর্ষাকে শিখিয়ে দেয়, বল মা, বাবা তুমি কেমন আছ?
বর্ষা মা’র শিখিয়ে দেয়া কথা বলে, বাবা তুমি কেমন আছ?
ভালো মা। তুমি ভালো আছ?
রুনা শিখিয়ে দেয়, আমি ভালো নেই বাবা, সবসময় শুধু তোমাকে দেখতে মন চায়।
বর্ষা মা’র শিখিয়ে দেয়া কথা তোতা পাখির মত বলে, আমি ভালো নেই বাবা, সবসময় শুধু তোমাকে দেখতে মন চায়।
আসব মা, আসব।
বর্ষা মা’র শিখিয়ে দেয়া কথা বলে, কবে?
এই তো মা আর কয়েকদিন পরেই আসব।
বাবা সম্পর্কটা তখন বর্ষা’র কাছে একটা কণ্ঠস্বর মাত্র। বাবা নামের সেই কণ্ঠস্বরের মানুষটির সঙ্গে বর্ষার প্রথম দেখা হলো তার বয়স যখন পাঁচ বছর। প্রথম প্রথম বর্ষা কাছে যেতেই ভয় পেত। ক’দিন যেতে না যেতেই বাপ-বেটির খুব মিল হলো। বর্ষা সবসময় বাবার সাথে ঘুরত, হারুন আঙিনায় গেলে সেও আঙিনায় গিয়ে দাঁড়াত, বাজারে গেলে সেও বাবার সঙ্গে বাজার যেত। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকাতে বর্ষা’র মনে একটা ভয় হয়েছিল বাড়ি থেকে বের হলেই বাবা বুঝি চলে যাবে।
অবশেষে সেই ভয়ই একদিন সত্যি হলো। প্রায় তিন মাস থাকার পর তার বাবা একদিন আবার চলে গেল। বাপ-বেটির প্রথম দেখা হলো তিন মাসের জন্য। তারপর মাসে অন্তে রুনা যখন হারুনের সঙ্গে কথা বলত তখন মাঝে মাঝে বর্ষাকে দিত। ধীরে ধীরে বাপ-বেটির সম্পর্কটা হয়ে গেল হাই-হ্যালো’র মতই।
বর্ষা গ্রামের স্কুল থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে এস.এস.সি পাস করে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ভর্তি হলো। এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর অ্যাডমিশন কোচিংয়ের জন্য এলো ঢাকায়। বাড়ি থেকে বর্ষার স্কুল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, স্কুলে পড়ার সময় পথেঘাটে দাদা, চাচা, চাচাতো ভাই এবং প্রতিবেশীরা খোঁজখবর রাখত, প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করত রাস্তায় কোন সমস্যা হয়েছে কী না, গাইবান্ধায় এইচ.এস.সি পড়ার সময় ছাত্রী মেসে থাকত, বর্ষা’র এক মামা বর্ষাকে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মেসে রেখে গিয়েছিল। তারা সবসময় বর্ষার খোঁজখবর রাখত, মেস থেকে বের হলে তাদের বলে যেতে হত। রুনা মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে সেই মেসের মালিকের কাছ থেকে বর্ষার খোঁজখবর নিত। কিছুটা হলেও বর্ষা একটা মৌন শাসনের মধ্যেই ছিল কিন্তু এইচ.এস.সি পাস করে বর্ষা যখন কোচিং করার জন্য ঢাকায় এলো তখন আর তার ওপর কোন শাসন রইল না।
কোচিং শেষে শুরু হলো ভর্তিযুদ্ধ। ঢাকায় আসার পরই বর্ষা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে ঢাকার বাইরে ভর্তি হবে না। ঢাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ না পেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কোন কলেজে ভর্তি হবে, হলোও তাই। বর্ষা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল না। অবশেষে বর্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত তিতুমীর কলেজে ভর্তি হলো। বর্ষা প্রথম যখন অ্যাডমিশন কোচিংয়ের জন্য ঢাকায় এলো তখন মনিপুরী পাড়ায় একটা ছাত্রী মেসে সিট নিয়েছিল কিন্তু যখন তিতুমীর কলেজে ভর্তি হলো, যাওয়া আসার অসুবিধার কথা ভেবে মহাখালীতে একটা ছাত্রী মেসে উঠল। নতুন মেসের বর্ষার রুমমেট মমতা।
মমতা বর্ষার চেয়ে কয়েক বছরের বড়, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার উচ্ছলএক তরুণী। সবসময় মুখে হাসিটা লেগেই থাকে, মমতা বর্ষাকে কখনও ছোটবোন মনে করে না, বন্ধুই ভাবে এবং বন্ধুর মত স্বাচ্ছেন্দ্যে কথাবার্তা বলে। অল্প দিনের মধ্যে দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলো। সকালবেলা দুজনে বেরিয়ে যায় যার যার ক্লাসে, রুমে ফেরার আগে দুয়েকবার ফোনে কথা হয়। বিকেলে দুজনে বেরিয়ে পড়ে, ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায়। খুব কম সময় আলাদা থাকে তারপরও সারাদিন শেষে মেসে ফিরে কত গল্প, যেন গল্পের শেষ নেই।
প্রতিদিন রাতে দুজনের শেষ কথা হয় পরদিনের শিডিউল নিয়ে। কোন কোনদিন গল্পের মাধ্যমে জানা হয়ে যায় নইলে মমতা জিজ্ঞেস করে বর্ষার পরদিন কোন শিডিউল আছে কী না?
বরাবরের মতই মমতা ঘুমাবার আগে জিজ্ঞেস করল, বর্ষা কাল তোর ক্লাস আছে?
না আপু।
বাইরে কোন শিডিউল?
না।
তাহলে কাল তোকে আমি আমাদের ভার্সিটিতে নিয়ে যাব।
বর্ষা খুব খুশি হলো, ওয়াও, কাল কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি আপু?
অনুষ্ঠান ঠিক না, জব ফেয়ার আছে।
জব ফেয়ার? জব ফেয়ার কী আপু?
জব ফেয়ার হলো দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানে জবের জন্য ফেয়ার করে, মানে মেলা বসায় সেখানে যারা জব খুঁজে তারা একই প্লাটফরমে সব কোম্পানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চান্স পায় আর কোম্পানিগুলো ভালো কর্মী পাওয়ার চান্স পায়।
মমতা যখন কথা বলছিল বর্ষা তখন মমতার মুখের দিকে হা করে তাকিয়েছিল। মমতা জিজ্ঞেস করল, হা করে আছিস কেন? বুঝিসনি?
বর্ষা না সূচক মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেনি।
জব ফেয়ার হলো চাকরি প্রত্যাশী এবং চাকরি দাতাদের মিলনমেলা।
ওখানে গেলে কি চাকরি পাওয়া যায়?
হুম, যেতেও পারে। আবার চাকরি পাওয়া না গেলেও চাকরি সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যা পরবর্তীতে চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক হেল্পফুল হয়।
তাহলে তো আমাকে যেতেই হবে।
কেন চাকরি করবি?
হ্যাঁ পার্ট টাইম কোন চাকরি যদি পাই, তুমিও চাকরি খুঁজছ নাকি আপু?
হ্যাঁ। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা জব পেলে মন্দ কী।
তুমি ঠিকই বলেছ আপু। আগে তোমার হোক তারপর আমার জন্যও একটা ব্যবস্থা কর।
ওকে। আমি চেষ্টা করব। তাহলে কাল সকাল দশটায় রেডি হবি।
ওকে আপু।
ইউনিভার্সিটির একটা ফ্লোর জুড়ে সাজান বিভিন্ন কোম্পানির স্টল। দেশের শীর্ষস্থানীয় থেকে মাঝারি রকমের গ্রুপ অব কোম্পানিজ, টেলিকম কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, মেডিসিন কোম্পানি, কসমেটিকস কোম্পানিসহ অনেক কোম্পানি অংশগ্রহণ করেছে মেলায়। অপূর্ব সুন্দর, আলো ঝলমলে, সুসজ্জিত একটা মেলা। বর্ষার কাছে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। বর্ষার ধারণা মেলা মানে সেখানে থাকবে বিভিন্ন রকমের পণ্য, সে হাতে নিয়ে দেখবে, দরদাম করবে, পছন্দ হলে কিনবে। শৈশব থেকে বর্ষা এমন মেলা দেখে এসেছে, তাদের গ্রামে প্রতি বছর শীতকালে মেলা বসে, খাট, বিছানা-বালিস, বিভিন্ন রকমের গৃহস্থালি সামগ্রী, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদি পণ্যের মেলা, সেখানে সার্কাস, পুতুলনাচ, যাত্রাও বসে।
না, এই মেলায় তেমন কোন পণ্য নেই। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি পণ্য সামগ্রীর ডিজিটাল ব্যানার, লিফলেটসহ বিভিন্ন রকমের প্রচারপত্র নিয়ে স্মার্ট তরুণ-তরুণীরা দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে হাতল চেয়ারে বসে আছে খুব সম্ভবত তাদেরই সিনিয়র দুয়েকজন কর্মকর্তা। দুজনে গেট দিয়ে ঢুকে ডান দিকের প্রথম স্টলের সামনে দাঁড়ালো। স্টলে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণী অভ্যর্থনা জানাল, হাই, গুড মর্নিং।
মমতা তরুণীর অভ্যর্থনার জবাব দিল, গুড মর্নিং বলে মমতা উপরে কোম্পানির ব্যানারের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলল, আইটি স্পেস লিমিটেড। তারপর তরুণীকে জিজ্ঞেস করল, এক্সকিউজ মি, আপনাদের এক্টিভিটিজ সম্পর্কে কিছু বলবেন প্লিজ।
তরুণী বলতে শুরু করল, আইটি স্পেস নাম দেখেই আপনারা বুঝতে পাচ্ছেন দিস ইজ এ আইটি রিলেটেড কোম্পানি, স্প্যাশালি আউট সোর্সিং কোম্পানি। আমরা গ্লোবালি কাজ করি। দেশের বাইরে থেকে আমরা প্রচুর অর্ডার পাই, ওয়েব ডিজাইন, সফট ওয়্যার ডেভলাপমেন্টসহ আইটি রিলেটেড দেশে এবং দেশের বাইরের কাজ করি। ফর দিস ইউ মাস্ট বি এ কম্পিউটার এন্ড আইটি এঙপার্ট।
বর্ষা মমতার কানে কানে বলল, আপু জিজ্ঞেস করতো ট্রেনিং করা যায় কোথায়?
মমতাকে বলতে গিয়ে তরুণীও কথা শুনে ফেলল। সে জিজ্ঞেস করল, এক্সকিউজ মি। আপু কী বলছিলেন, কোথায় ট্রেনিং করা যায়। আমাদের কোম্পানি আগে ট্রেনিং করায় তারপর ট্রেনিং শেষে আপনি এই কোম্পানিতে জব করতে পারেন আর না হয় আপনি অন্য কোথায় জবের সুযোগ পেতে পারেন।
বর্ষার মুখ উজ্জ্বল হলো।
তরুণী মমতা এবং বর্ষার হাতে কোম্পানির একটি করে ব্রুসিয়ারদিয়ে বলল, আসবেন আপু প্লিজ!
দুজনে সামনে এগিয়ে গিয়ে আরেকটা স্টলের সামনে দাঁড়ালো। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। মমতা আর বর্ষা স্টলের সামনে দাঁড়াতেই স্মার্ট এক তরুণী প্রমোটার দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল, গুড মর্নিং মেম।
মমতা বলল, গুড মর্নিং তারপর মেয়েটি ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে তাদের কোম্পানি ডিটেইলস এবং এক্টিভিটিজ বলতে শুরু করল। মমতা প্রমোটরের কথা বুঝল কিন্তু বর্ষা বুঝে কিংবা না বুঝে হা অথবা না সূচক মাথা নাড়লো।
মমতা জিজ্ঞেস করল, জাস্ট নাউ আপনাদের কোম্পানিতে কোন জব ভেকেন্সি আছে কি?
ইয়েস মেম, বাট রিমেম্বার ইট আমাদের কোম্পানিতে ইংরেজি জানা কম্পালসরি।
ইয়েস আই অ্যাম অলসো এ স্টুডেন্ট অফ ইংলিশ লিটারেচার।
ভেরি গুড মেম বলে প্রমোটার একটা ফর্ম বের করে দিল, দিস ইজ আওয়ার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। ইউ মে রাইট নাউ অর ইউ মে সেন্ড ইট থ্রো ইমেইল।
মমতা ফর্মটা হাতে নিয়ে প্রমোটরকে বিদায় জানিয়ে আরেকটা স্টলের দিকে পা বাড়াল।
একে একে কয়েকটি স্টল ভিজিটের পর একটা স্টলের সামনে এসে মমতা দাঁড়ালো। স্টলের সামনে দাঁড়াতেই মমতার চোখ একটি ছেলের ওপর সি’র হয়ে গেল। ছেলেটিকে তার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। ছেলেটি একটি চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মাথা নিচু করে থাকায় মমতা তাকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার মনে হচ্ছে ছেলেটি তার খুব পরিচিত। ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো কিন্তু মাথা নিচু করেই রইল, এবার মমতা আরও নিশ্চিত হলো যে ছেলেটি তার পরিচিত। সে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, হাই মিনু।
মিনু মাথা উঁচু করে তাকাতেই একটা সুন্দর হাসি হেসে বলল, হাই মমতা, তুই?
হ্যাঁ। আমি তো অনেকক্ষণ থেকে তোর দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি এমন সুন্দর, স্মার্ট ছেলেটি মিনু ছাড়া আর কেউ না।
মিনু আবার হাসল। আর এবার সেই হাসি যেন হৃদয়ে ঝড় তুললো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বর্ষার বুকে। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! ফর্সা, লম্বা, স্লিম ফিগারের ছেলে মিনু, চেহারায় আভিজাত্য আছে।
জাস্ট এ মিনিট, আসছি, বলে মিনু স্টল থেকে বেরিয়ে এসে মমতা আর মিনুর পাশে এসে দাঁড়ালো, হাউ আর ইউ?
ভালো, তুই? ও তোকে তো এখানে তুই বলা যাবে না। কী বলতে হবে যেন, হিউম্যান রিসোর্স ডিরেক্টর।
ইয়েস অল রাইট। আমার ডেজিগনেশনটা ঠিক বলেছিস কিন্তু তোর কাছে আমি ভার্সিটির তোর ক্লাস ফ্রেন্ড মিনু।
ঠিক বলেছিস।
অফকোর্স। আয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করি আর কফি খাই, বলে মিনু এগিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বর্ষা মৃদু আপত্তি জানাল, আপা…
মমতা মিনুকে ডাক দিল, এই মিনু। আজ থাক অন্য একদিন কফি খাব।
মিনু ফিরে দাঁড়ালো, এ্যানি প্রব্লেম।
মমতা বলল, না কোন প্রব্লেম নেই, ও আচ্ছা তোকে পরিচয় করে দিই। এ হচ্ছে আমার রুমমেট বর্ষা।
বর্ষা সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি মিনু, মম’র আই মিন মমতার ক্লাসফ্রেন্ড। তুমিও আমার ফ্রেন্ড হতে পার, নো প্রব্লেম। নাইস টু মিট ইউ।
অদূরেই একটা কফি শপ। সবাই হাঁটতে হাঁটতে কফি শপের সামনে গিয়ে তিনটা কফি নিয়ে দাঁড়ালো। মমতা জিজ্ঞেস করল, এটা তোদের স্টল বুঝি?
মিনু কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আমাদেরই কিন্তু আমি এখনও বিজনেস পুরোপুরি দেখাশুনা করি না। প্রবেশনাল বলতে পার। ডেডি ঐ একটা ডেজিগনেশন ধরিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। সব স্টাফরাই দেখাশুনা করে।
ইউ আর সো লাকি।
হোয়াই?
জন্ম থেকেই কোম্পানির মালিক।
নো, নো ম্যাডাম। আমি কোম্পানির মালিক না। ডেডি মালিক, আমি এখনও স্টুডেন্ট।
মমতা আর মিনুর কথা বর্ষা বুঝতে পাচ্ছিল না। সে কিছু না বুঝেই একবার মমতার মুখের দিকে আরেকবার মিনুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
মমতা বর্ষার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, বর্ষা তুই হয়ত বুঝতে পাচ্ছিস না। আচ্ছা এবার তোকে বলি মিনুর বাবা একটা গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক এবং মিনুই তার একমাত্র সন্তান তাহলে মিনুই আগামী দিনের মালিক না?
বর্ষা সায় দিল, হ্যাঁ তাইতো। তাহলে তো আমাদের চাকরি নিয়ে কোন চিন্তা নেই।
অফকোর্স। আফটার অল তুমি মম’র ফ্রেন্ড মানে তো আমারও ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ড তো ফ্রেন্ডের পাশে দাঁড়াবেই। তুমি বললাম ডন্ট মাইন্ড প্লিজ!
না, না, আমি কিছু মনে করব না। তবে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমারও নিজেকে লাকি বলে মনে হচ্ছে।
কফি খেতে খেতে আরও অনেক কথা হলো। বিদায়ের ঠিক আগে মিনু নিজেই বর্ষাকে তার মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল, প্রয়োজনে ফোন করবে।
বর্ষা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, অবশ্যই।
দশ
সেদিন জব ফেয়ার থেকে ফেরার পর থেকে বর্ষার বার বার করে মিনুর কথা মনে পড়ত। মিনুর গায়ের রং ফর্সা ধবধবে, ঠোঁট দুটো লাল, দেখলে মনে হয় যেন মেয়েদের মত ঠোঁটে লিপস্টিক পরেছে, লম্বা-চওড়া, মাথার চুলগুলো ঢেউ খেলান, সে যখন কথা বলে তখন কথা বলার ভঙ্গীটা অসাধারণ, যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। জব ফেয়ারে কফি খেতে খেতে দুয়েকবার বর্ষার মিনুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে তাতেই বর্ষার মনে হয়েছে মিনু বুঝি তার অনেক পরিচিত, অনেক আপন।
মিনু প্রায়ই মমতার সঙ্গে চ্যাট করে, মাঝে মাঝে ফোনও করে, বর্ষা বুঝতে পারে কিন্তু মমতাকে সে জানতে দিতে চায় না যে এক মিনিটের একটু দেখাই তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে, সে তার হৃদয়ের অনেকখানি জায়গা দখল করেছে তাছাড়া মমতার সঙ্গে মিনুর সম্পর্ক কী তা মিনু জানে না। কাজেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে মমতাকে মিনুর কথা বলতে গিয়ে মমতা যদি কিছু মনে করে সেজন্য বর্ষা মমতাকেও কিছু জিজ্ঞেস করল না। অবশ্য তার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটাল মিনু। সেদিন রাতে মমতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মিনু জিজ্ঞেস করল, তোর সেই রুমমেট কী যেন নাম?
মমতা বলল, বর্ষা।
বর্ষা আছে না?
হ্যাঁ আছে। কথা বলবি?
দে।
আমি আগেই বুঝেছিলাম তুই ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইবি।
কীভাবে বুঝলি?
বুঝলাম কারণ তুই সবসময় সুন্দর মেয়েদের পছন্দ করিস। আমি তো আর বর্ষার মত সুন্দর না যে আমার সঙ্গে কথা বলবি, মমতার কথার শেষ দিকে তার কণ্ঠে অভিমান ফুটে উঠল।
এই, এই মমতা এভাবে কথা বলবি না। আমি তোর সাথে কথা বলি না, তুই তো আমার ফ্রেন্ড। সরি মমতা, থাক বর্ষাকে দিতে হবে না।
মমতা হেসে ফেলল, আরে না তোর সঙ্গে ইয়ার্কি করছিলাম। বর্ষা শুধু আমার রুমমেটই না, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর প্রতি আমার কোন জেলাসি নেই। নে কথা বল, বলে মমতা মিনুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মোবাইল ফোনটা বর্ষার হাতে দিল।
কিছুক্ষণ আগেও বর্ষা মনে করত একবার মিনুর সঙ্গে কথা বলতে পারলে সে মন খুলে কথা বলবে, একবার মিনুর সঙ্গে কথা বলতে পারলে বুঝি তার জীবন ধন্য হবে কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল।
মিনু বলল, হ্যালো।
বর্ষা কথা বলছে না দেখে মমতা বর্ষাকে বলল, বল, কথা বল।
মিনু থতমত খেয়ে বলল, হ্যালো, আসসালামুয়লাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছ?
জি ভালো, আপনি?
তোরা কথা বল আমি আসছি, বলে মমতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ভালো। সেই যে গেলে আর তো কোন খবর নেই, ইউ হ্যাভ নো নিউজ।
আপনারও তো কোন খবর নেই।
আমি তোমার মোবাইল নাম্বার জানতাম না কিন্তু আমি তো তোমাকে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়েছিলাম। তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতে।
যোগাযোগটা আগে ছেলেদের পক্ষ থেকে হতে হয় স্যার, বলে বর্ষা হি হি করে হেসে উঠল।
ইউ আর অলসো রাইট। ভাব বলে মেয়েদের একটা বস’ আছে যেটা ছেলেদের নেই। তাই মেয়েরা ভাব নেয় আর ছেলেরা সেই ভাব ভাঙায়। ওকে। এখন থেকে আমিই যোগাযোগ রাখব, তোমার মোবাইল নাম্বার দাও।
বর্ষা তার মোবাইল নাম্বার বলল।
মিনু বর্ষার মোবাইল নাম্বার সেভ করে নিয়ে বর্ষার মোবাইল ফোনে ফোন করল।
সেদিনের পর থেকে প্রায়ই মিনু বর্ষাকে ফোন করত। কথা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রথম প্রথম বর্ষা বাইরে গেলে মমতার সঙ্গে যেত কিন্তু মিনুর সঙ্গে পরিচয় এবং ঘণিষ্ঠতার পর থেকে সুযোগ পেলেই বর্ষা মিনুর সঙ্গে দেখা করতে যেত।
মমতা বর্ষার সঙ্গে মিনুর ঘণিষ্ঠতাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। মিনু সম্পর্কে তার অতীত ধারণা ভালো ছিল না। ভার্সিটিতে ভর্তির পর মিনুর সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয় তখন মিনু একটা মেয়েকে পছন্দ করত, শুধু পছন্দ করত বললে ভুল হবে, ভালোবাসত। মিনুর ভালোবাসা শুধু হৃদয়ঘটিত হলে ভালোই হত কিন্তু সে আসলে ভালোবাসার নামে মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মিনুর সঙ্গে সেই মেয়েটির সম্পর্কও সেভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল। কথাটা তাদের ক্লাসফেন্ডদের মধ্যে অনেকটা ওপেন সিক্রেটই ছিল।
হৃদয়ের সম্পর্কহীন সম্পর্ক যেনামেই অভিহিত হোক না কেন বেশিদিন স্থায়ী হয় না, সেই মেয়েটির সঙ্গে মিনুর সম্পর্কটা বেশিদিন টিকসই হলো না। মিনু আরেকটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গেও মিনুর সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হলো না। মিনুর কথাবার্তা, চালচলন প্রথম থেকেই অন্যরকম ছিল বলে অনেক মেয়েই তার সঙ্গ এড়িয়ে চলত। মমতাও তাদের মধ্যে অন্যতম তাই প্রথমত মমতার কাছ থেকে বর্ষার মোবাইল নাম্বার চাওয়ার পরও মমতা মিনুকে বর্ষার মোবাইল নাম্বার দেয়নি কিন্তু সেদিন বর্ষার নাম্বার পাবার পর বর্ষা যে এভাবে অতিদ্রুত মিনুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে এটা মমতার ধারণা ছিল না। মমতা যখন জানতে পারল তখন বর্ষাকে ফেরান আর সম্ভব হলো না।
সেদিন রাতে মমতা বর্ষাকে জিজ্ঞেস করল, কী রে আজকাল তো একা একা খুব ঘুরে বেড়াচ্ছিস, মিনুর সঙ্গে রিলেশনটা ভালোই জমে উঠেছে বুঝি?
কথাটা মমতা সহজভাবেই বলেছে কিন্তু বর্ষা সহজভাবে গ্রহণ করেনি। সে তীর্যক দৃষ্টিতে মমতার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, হিংসে হচ্ছে বুঝি।
আরে না। আমার হিংসে হবে কেন তুই আমার রুমমেট এবং ক্লোজ ফ্রেন্ড বলে বলছি।
বল আপু।
মিনু সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ভালো না। আই মিন মিনু এর আগে আরও দুজন মেয়ের সঙ্গে রিলেশন ব্রেক আপ করেছে। রিলেশন গড়া আর ব্রেক আপ করা তার কাছে কোন বিষয় না। দেখিস শেষে যেন কোন ভুল না করিস।
সেরকম কোন আশঙ্কা নেই আপু। তুমি টেনশন কর না আমি কোন ভুল করব না।
না করলেই ভালো।
বর্ষার সঙ্গে মমতার একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কিন্তু মিনুর সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এই সম্পর্কের মাঝে একটু চিড় দেখা দিল। বর্ষা মনে মনে ভাবত মমতা বুঝি তারই প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বুঝি মিনুকে ভালোবেসেছিল আর মিনু তাকে পাত্তা দেয়নি বলে মিনু সম্পর্কে উল্টাপাল্টা ভাবতে শুরু করেছে। বর্ষা ভাবত কোন সুযোগে সে মমতার কাছ থেকে দূরে যেতে পারলে মিনুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা আরও ভালো হবে, আরও প্রাণবন্ত এবং রোমান্টিক হবে।
অনার্স শেষ করার পর মমতা বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি দপ্তরে চাকরির জন্য অনেক দরখাস্ত করেছিল। প্রায়ই কোন না কোন দপ্তরের চাকরির ইন্টারভিউ দিত। একদিন একটা চাকরিও জুটে গেল, একটা কল সেন্টারে। ছয় ঘণ্টা ডিউটি তারপর আর কোন কাজ নেই। চাকরিটা স্থায়ী না, আপাতত নিজের খাওয়া-থাকার খরচটা চালিয়ে নেয়ার মত, একদিক থেকে মমতার জন্য ভালোই হলো ফুলটাইম চাকরি হলে কিংবা স্থায়ী চাকরি এবং ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলে তার লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া কঠিন হত সমস্যা হলো চাকরিটা উত্তরায়। ছয় ঘণ্টা ডিউটি সার্কেলওয়াইজ দিনে এবং রাতেও পড়বে, অবশ্য কোম্পানি নাইট ডিউটিতে গাড়িতে নিয়ে যাবে এবং পৌঁছে দিয়ে যাবে কিন্তু মহাখালী তাদের গাড়ি আসে না। কাজেই মমতাকে মেস পরিবর্তন করতে হচ্ছে উত্তরায়, তার অফিসের আশেপাশে। এখবর শুনে বর্ষা কিছুটা খুশিই হলো। মমতা জানাল আগামী মাসে সে নতুন মেসে উঠবে।
যাওয়ার দিন মমতা বড় বোনের মত বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, সাবধানে থাকিস। মেয়েদের সিঙথ সেন্স বলে একটা জিনিস থাকে।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, এই কথাটা আমি আগেও শুনেছি কিন্তু বুঝিনি আপু তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে?
সিঙথ সেন্স হলো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ছেলেদের পাঁচটা ইন্দ্রিয় থাকে, মেয়েদের একটা বেশি থাকে এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থেকে মেয়েরা বুঝতে পারে তার জন্য কে নিরাপদ আর কে নিরাপদ না। সেভাবে দেখেশুনে চলতে পারে। আবার কেউ কেউ এটাকে থার্ড আই বলে।
বর্ষা বলল, থার্ড আই মানে, তৃতীয় চক্ষু মানে অন্তরাত্মা। আপু তুমি সিঙথ সেন্স বল আর থার্ড আই বল এটা আমার মোটামুটি ভালো আছে। আমি আগে থেকেই সব বুঝতে পারি।
বর্ষাকে ছেড়ে যেতে মমতা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। মমতা বুঝতে পারল বর্ষা মুখে যাই বলুক না কেন তার সিঙথ সেন্স খুব দুর্বল, নইলে মিনুর মত একটা ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পরও সে বুঝতে পারবে না কেন যে সে তার জন্য কতটুকু নিরাপদ। সে দুচোখ মুছে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, দোয়া করি বোন আল্লাহ যেন তোর সিঙথ সেন্স আরও বাড়িয়ে দেয়।
সেই থেকে বর্ষা রুমে একাই রয়ে গেল। বর্ষার সঙ্গে মিনুর প্রতিদিন কয়েকবার করে কথা হত, মমতার চাকরি হওয়া এবং তার চলে যাওয়ার বিষয়টিও বর্ষা মিনুকে জানাল। মিনু সব শুনে বলল, এখন থেকে তাহলে তুমি একাই থাকবে?
হুম।
ভেরি গুড।
কেন? গুড কেন? বর্ষা জিজ্ঞেস করল।
আগে তোমাকে ভিডিও কল দিতে গেলেই তুমি মমতা আছে অজুহাত দেখিয়ে শুধু না, না করতে এখন আর তা করতে পারবে না।
হুম, আপনি বলবেন আর আমি দিনরাত শুধু আপনার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলব। আপু না থাকলেও অন্য কেউ তো আসবে।
আবার আপনি?
সরি। আপনি করে বলতে বলতে তুমিটা সহজে মুখে আসছে না।
ওকে। তুমি আর কাউকে নিবে না। প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে।
আহা রে আমার প্রাইভেসি ওয়ালা রে। আমার লাগবে মাসে মাসে দুটা সিটের টাকা আর আমি থাকবো আমার প্রাইভেসি ওয়ালার সাথে ভিডিও কল করার জন্য একা রুমে। এখন রাখছি আমার আগামীকাল ক্লাস আছে।
ওকে বাই।
এগারো
মমতার কাছে বর্ষার জবাবদিহিতা না থাকলেও দুজনে কোথাও গেলে সারাদিনে কয়েকবার কথা হত। কে কোথায় আছে, কখন ফিরবে ইত্যাদি, ইত্যাদি কিন্তু মমতা চলে যাওয়ার পর বর্ষা সারাদিন কোথাও ঘুরে বেড়ালেও কেউ ফোন করে কোন খবর নেয় না বা তাড়াতাড়ি রুমে ফেরার জন্যও তাড়া দেয় না। মমতা থাকতে মিনুর সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে বর্ষা একটা বাধা বলে মনে করত কিন্তু মমতা চলে যাওয়ায় সে বাঁধাও দূর হয়েছে।
সেদিন রাতে মিনু ফোন করল, হ্যালো।
বল।
আগামীকাল তোমার কোন কাজ আছে? মিনু জিজ্ঞেস করল।
বর্ষা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ, অনেক কাজ।
মিনু বলল, আগামীকাল তো অফ ডে, অফ ডে’তে কীসের এত কাজ।
মেয়েদের কাজের তুমি কী বুঝবে, অফ ডে’তে মেয়েদের বেশি কাজ।
মিনু কৃত্রিম রাগান্বিত সুরে বলল, ওকে তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাক।
রেগে যাচ্ছ কেন? কিছু বলবে?
হ্যাঁ বলব বলেই তো তোমাকে ফোন করেছি।
ওকে বল।
কাল আমরা দূরে কোথাও যাব।
দূরে মানে কী চাঁদে নাকি মঙ্গল গ্রহে?
তুমি সকালবেলা রেডি থেকে। আমি ফোন দিলে তুমি বেরিয়ে এস। তারপর দেখা যাবে চাঁদে নাকি মঙ্গলগ্রহে নাকি এখনও আবিষ্কার হয়নি এমন কোন গ্রহে, ওকে?
ইয়েস স্যার।
মিনু ফোন করল সকাল দশটার সময়। বর্ষা ফোন রিসিভ করতেই মিনু জিজ্ঞেস করল, রেডি।
জি।
কাম অন।
বর্ষা আজ শাড়ি পরেছে। আগে কোন ঈদ-পরবে, পহেলা বৈশাখে, ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে বর্ষা শাড়ি পরত, কোনদিন বেড়াতে যাওয়ার জন্য শাড়ি পরলো আজই প্রথম, রঙিন শাড়ি, ম্যাচ করে ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ। সাজতে সাজতে বর্ষা কয়েকবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিল। তারপর আপন মনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
মিনু রাস্তার মোড়ে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বর্ষা প্রথমে বুঝতে পারেনি। সে আগে কখনও মিনুকে গাড়ি চালাতে দেখেনি। আগে যতবার দুজনে বেড়াতে বেরিয়েছে তাতে রেন্ট এ কারে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজই প্রথম মিনুকে গাড়ি চালাতে দেখলো। বর্ষা গাড়ির কাছে যেতেই মিনু সামনের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ওঠো।
বর্ষা গাড়িতে উঠল।
মিনু কয়েক মুহূর্ত বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইল।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, তাকিয়ে আছ কেন, গাড়ি চালাবে না?
ও হ্যাঁ। তোমাকে দেখে গাড়ি চালাতে ভুলে গেছি। বিউটিফুল, তোমাকে আজ এঙিলেন্ট লাগছে।
মিনু গাড়ি চালাতে শুরু করল।
বর্ষা বলল, তোমাকেও আজ খুব সুন্দর লাগছে।
থ্যাংক ইউ।
রাস্তা ফাঁকাই ছিল। মিনু জোরে গাড়ি চালিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে টঙ্গী ব্রিজ পার হলো। মিনু গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে বর্ষার দিকে তাকাচ্ছে দেখে বর্ষা জিজ্ঞেস করল, রাস্তার দিকে তাকাও, কোথায় এসেছি দেখেছ?
ইয়েস। টঙ্গী ব্রিজ।
যাচ্ছ কোথায়?
তুমি না বলেছ চাঁদে নাকি মঙ্গলগ্রহে।
বর্ষা কয়েক মুহূর্ত মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ সেও মিনুর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। গাড়ি আরও কিছুক্ষণ চলল বর্ষা আবার জিজ্ঞেস করল, কিছু বললে না তো?
কী বলব?
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
গন্তব্যহীন যাত্রা। দুজন একসাথে আছি, সারাদিনের জন্য বেরিয়েছি। সারাদিন ঘুরে বেড়াব, যেখানে সময় হবে লাঞ্চ করে নেব। বিকেলে ঢাকায় ফিরব। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে মিনু বর্ষার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, হ্যাভ ইউ অ্যানি প্রব্লেম মেম?
না, না আমার কোন প্রব্লেম নেই। তবে সন্ধ্যার আগে রুমে ফিরতে পারলেই হলো।
আর যদি আজ ফিরতে না পার।
বর্ষার বুক কেঁপে উঠল। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, না, না প্লিজ এমন কর না। বেশি দূরে যাওয়া যাবে না, সন্ধ্যার আগেই রুমে ফিরতে হবে।
ওকে মেম। আমার মনে থাকবে তুমি যেন সন্ধ্যার আগেই রুমে ফিরতে পার।
দুজনে সারাদিন ঘুরে বেড়াল উন্মুক্ত আকাশে মুক্ত পাখির মত, ন্যাশনাল পার্কসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান এবং রিসোর্ট। সবশেষ এসে ঢুকেছে নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টে। জায়গাটা বেশ মনোরম, গাছ-গাছালিতে ভরা একটা শীতল পরিবেশ। ঢুকতেই হাতের ডানে কাউন্টার, কাউন্টারের সমানে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার বাম পাশে একটা পুকুর। আকারে বেশি বড় না কিন্তু পুকুরের সবচেয়ে সৌন্দর্য হলো পুকুরের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে সাজান কয়েকটি কুটির। কুটিরগুলো পুকুরের ওপর খুঁটির ওপর ভর করে পুকুরের পানি ছুঁই ছুঁই অবস্থায় আছে। পুকুরের প্রায় মাঝখান দিয়ে একটা সরু ফুটপাথ প্রকৃতির ব্রিজ, ব্রিজের রেলিংগুলো সুন্দরভাবে সাজান গোছান। ব্রিজের ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে হেঁটে গেলে বাঁয়ে পড়বে পুকুরের অংশবিশেষ আর ওপরদিকে অর্থাৎ ডান দিকে আলাদা আলাদা সরু রাস্তা চলে গেছে কুটিরগুলোতে। কুটিরের ছাদগুলো সবুজ রঙের ঢেউটিন দিয়ে তৈরি। প্রকৃতির এক অপূর্ব সমাহার ঘটেছে নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টের এই ছোট্ট পরিসরে।
পুকুরের উত্তর পাড়ে একটা কয়েকতলা বিল্ডিং, একেকটি ফ্লোরের বৈশিষ্ট্য একেকরকম। নিচতলায় বিশালাকার ডাইনিং, ডাইনিং এর পাশে কেবিনে নিরিবিলি বসে দেশি এবং বিদেশি ভোজনের ব্যবস্থা। বিল্ডিংয়ের উত্তর পাশে একটি সুইমিং পুল। বর্ষা আগে কখনও সুইমিং পুল দেখেনি, নামও কখনও শুনেছে কী না মনে পড়ছে না। মিনু গেট দিয়ে ঢুকতেই সেই যে বর্ষার হাত ধরেছে তো পুরোটা সময় বর্ষার একটা হাত ধরেই রইল। কোন পুরুষ মানুষের হাতে হাত রেখে চলা বর্ষার এটাই প্রথম। বর্ষা কখনও কখনও মিনুর কাঁধে হাত রাখল, গা ঘেঁষে হাঁটল। এই রিসোর্টের সবকিছুই বর্ষার অজানা। মিনু ঠিকই বলেছে এটা বর্ষার কাছে এখনও আবিষ্কার হয়নি এমনি একটা গ্রহ। রিসোর্টের পুরো এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখে দুজনে বিল্ডিংয়ের নিচতলায় ডাইনিংয়ে এসে বসল।
ডাইনিং এ বসে সুইমিং পুল খুব কাছ থেকে দেখা যায়। কয়েকজন তরুণ-তরুণী খুব সংকীর্ণ পোশাকে সুইমিং পুলে সাঁতাড় কাটছে, গোসল করছে দেখে বর্ষা একবার মুখ ফিরিয়ে নিল।
মিনু জিজ্ঞেস করল, তুমিও সুইমিং পুলে যাবে?
বর্ষা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল।
মিনু বলল, লজ্জা কীসের? এখানে যারা আসে তারা এনজয় করতেই আসে।
আসুক, ছিঃ আমি পারব না। কত মানুষ দেখছে।
তার মানে কি যদি কেউ না দেখে, একাকী, নির্জনে…
এমন করে বললে আমি কিন্তু চলে যাব, বলে বর্ষা উঠে দাঁড়ালো।
মিনু বর্ষা’র হাত টেনে ধরে বলল, সরি বর্ষা আর বলব না।
দুজনে লাঞ্চ করল। লাঞ্চের পর বর্ষা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বর্ষা যখন ঢাকা থেকে বের হয় তখন ভেবেছিল লং ড্রাইভ আর কি সকালে ঢাকা থেকে বেরি হবে দুপুরে আবার ঢাকায় ফিরে লাঞ্চ করবে কিন্তু আসতেই কয়েক ঘণ্টা লেগে গেল, তারপর এই রিসোর্টে হাঁটাহাঁটি করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
সে মিনুকে জিজ্ঞেস করল, ফিরতে কতক্ষণ লাগবে?
এই ধর তিন ঘণ্টা।
অনেক দূরে চলে এসেছি তো।
হ্যাঁ। অবশ্য তুমি না ফিরতে চাইলে থাকতেও পার।
মানে?
হ্যাঁ। ঐ যে লজগুলো দেখছ ওগুলোতে থাকতেও পার আবার তুমি চাইলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতেও পার, এ্যাজ ইউ লাইক।
আর তুমি?
আমিও তোমার সঙ্গে থাকবো।
আবার, আবার বলে বর্ষা উঠল এবার মিনুও উঠল, মিনু বর্ষার একটা হাত ধরে ডাইনিং থেকে বেরিয়ে পুকুরের উত্তর পাড় দিয়ে হেঁটে পূর্ব দিকে চলে গেল। জায়গাটা একটু নিরিবিলি গাছগাছালিতে ভরা, নরম ঘাস কিছুটা শীতল পরিবেশ। বর্ষা পা সোজা করে বসেছে আর মিনু বর্ষার কোলে মাথা রেখেছে। বর্ষা মিনুর কপালের চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছে। কতক্ষণ এভাবে কাটিয়ে দিয়েছে কারও খেয়াল নেই। একবার বর্ষা খেয়াল করল সূর্যের তাপ কমে গেছে, সূর্যটা ডুবে গেছে গভীর বনের মধ্যে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামান্য সূর্য রশ্নি পড়ছে মিনুর মুখের ওপর। বর্ষা চমকে উঠল, এখন ক’টা বাজে?
মিনু কৃত্রিম বিরক্ত হয়ে বলল, উফ্, এমন একটা রোমান্টিক মুহূর্তে তুমি সময় দেখতে না চাইলে হত না।
তা হত কিন্তু ফিরতে তো হবেই।
হবেই কেন? না ফিরলে?
না ফিরলে মানে, এখন হোক, একটু পরে হোক।
আজ থাকি না প্লিজ!
কোথায় থাকবে?
কেন এই রিসোর্টে।
বর্ষা অনুরোধ করল, প্লিজ মিনু আজ না। আরেকদিন আসব।
ওকে। ঠিক আছে তাহলে আর কিছুক্ষণ থাকি বলে মিনু বর্ষা’র থুতনি উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলল, তোমাকে যেতে দিতে কী আমার মন চাচ্ছে, বল!
বর্ষা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। সে মিনুর চোখে চোখ রাখলে আর নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে না, সে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আমারও কি মন চাচ্ছে, তুমি বল।
কালকেও তো তোমার ক্লাস নেই।
বর্ষা বলল, না, নেই।
কাল একবার তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব।
তোমার বাসায়?
হ্যাঁ। কেন আমার বাসায় যেতেও তোমার প্রব্লেম?
না, কোন প্রব্লেম নেই। তোমার বাসায় আর কে কে আছে?
সেটা তো গেলেই দেখবে বর্ষা। এটুকু ডিপেন্ড তো কর আমার ওপর। একটা কথা মনে রেখ বর্ষা আমি তোমার ওপর কোনদিন ফর্স ক্রিয়েট করব না, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।
বর্ষা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, তোমার এই অভ্যাসটা আমার খুব ভালো লাগে মিনু। সাধারণত ছেলেরা কিছু মানতে চায় না, জোর করে আর সেজন্যই বেশিরভাগ রিলেশন টিকে না।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার বর্ষা, আমার দ্বারা সেরকম কিছু হবে না, বলে মিনু বর্ষার চোখে চোখ রাখল, তোমাকে কিন্তু রঙিন শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে বর্ষা। ভেরি বিউটিফুল।
সেদিন রুমে ফিরে বর্ষার মনে হাজার রকমের কথা তোলপাড় করছে। বিশেষ করে মমতার কথাগুলো তার কানে বাজছে। মমতা মিনুর বিষয়ে অহেতুক কতকগুলো অভিযোগ করেছিল। মিনুর সাথে বর্ষার পরিচয় হওয়ার প্রায় কয়েক মাস হয়ে গেল। এই কয়েক মাসে বর্ষা মিনুর সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। মিনুর হাত ধরে, মিনুর কাঁধে হাত রেখে অনেকদূর পথ হেঁটেছে কিন্তু মিনুকে তার কখনও মনে হয়নি যে মিনু কখনও তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। অথচ তার সম্পর্কে মমতার ধারণাগুলো কত মিথ্যা। আসলে মিনু খুব সুন্দর, স্মার্ট, আকর্ষণীয় ফিগারের, বিত্তবান পরিবারের ছেলে, ঠিক কোন সুন্দরী মেয়ের পিছনে যেমন অনেক ছেলে ঘুরঘুর করে, টিজ করে মিনুর মত সুন্দর ছেলেদের প্রতিও অনেক মেয়ের দূর্বলতা থাকে, রিলেশন গড়ে তোলার চেষ্টা করে আর পাত্তা না দিলেই তখন এমন অহেতুক অভিযোগ। যাকে বলে আঙ্গুর ফল টক।
পরদিন বিকেল চারটায় ঠিক আগের দিনের মতই মিনু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোন করল। বর্ষাকে আগে থেকেই সময় জানিয়ে দেয়ায় সে তৈরিই ছিল। মিনুর ফোন পেয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।
বর্ষা গাড়িতে উঠতেই মিনু গাড়ি চালাতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি একটা বহুতল বিল্ডিংয়ের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে দুজনে লিফটে উঠল। মিনু লিফটের সাত টিপ দিল।
লিফটের সাতে দুজনে নামল। মিনু ডর লকে ফিঙ্গার টাচ করতেই দরজা খুলে গেল। বড়, বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট। ফ্লোরে মিরর পলিশ টাইলস বিছান, দেয়ালের রং অত্যন্ত আকর্ষণীয়, দরজাগুলো সেগুন কাঠের তৈরি, জানালাগুলো অত্যাধুনিক কালার থাই গ্লাসের তৈরি। ড্রয়িং রুমে কাঠের তৈরি বঙ সিলিং, সিলিংয়ের ফাঁক দিয়ে পর্যাপ্ত আলো ছড়িয়ে পড়ছে। দেয়ালে টাঙ্গান কয়েকটি শিল্পকর্ম। ইলেকট্রিক এবং স্যানিটারি ফিটিংসগুলো অত্যাধুনিক, বর্ষা এত আধুনিক বাসা আগে কখনও দেখেনি।
বর্ষা কিছু বুঝতেই পারল না কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখলো বাসায় আর কেউ নেই।
বর্ষার বুক কেঁপে উঠল, সে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, বাসায় আর কেউ নেই?
আগে বাসাটা ঘুরে দেখ, তারপর বলছি বলে মিনু বর্ষাকে একে একে বারান্দা, বেলকনি, রান্নাঘর, বাথরুম, ড্রাইভার কুদ্দুসের থাকার রুম, তার বাবার রুমে তালা দেখে বর্ষা জিজ্ঞেস করল, এই রুমে তালা কেন?
এটাতে আমার বাবা যখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসে তখন থাকে।
আর তোমার রুম।
ওয়েট, ওয়েট মাই ফ্রেন্ড, বলে মিনু বর্ষার একটা হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গেল, দিস ইজ মাই রুম।
মিনু খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে তার রুমটা। একটা খুব গর্জিয়াস খাট, পড়ার টেবিলে তার সাজান বই-খাতা, কাগজ-পত্র, একটা সুন্দর পেন স্ট্যান্ড, দেয়ালে তার পছন্দের দেশি-বিদেশি নায়ক-নায়িকার ছবি।
মিনু আমতা আমতা করে বলল, বর্ষা আসলে তোমাকে বলা হয়নি, আমার জীবনটা বেশ জটিল। বস গল্প করি, তুমি টেনশন কর না আমি বলেছি না তোমার কোন অমর্যাদা হবে না, তোমার ইচ্ছার বাইরে কিছু হবে না।
রুমে দুটো সোফাও আছে। বর্ষা সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, এখানে তুমি একা থাক?
মিনু বর্ষার পাশের সোফায় বসে বলল, আমি তো একাই।
মানে?
আমি শুধু একাই থাকি না, আমি পৃথিবীতে একা।
বুঝলাম না, ক্লিয়ার করে বল।
মানে বাবা বড় ব্যবসায়ী, চিটাগাং থাকে, বলে মিনু তার বাবা-মা’র সম্পর্ক এবং তাদের পারিবারিক অবস্থা বলতেই বর্ষার দুচোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। সে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, সরি মিনু আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আসলে আমি সবসময় তোমাকে হাসিখুশি দেখে ভাবতাম তুমি খুব সুখে আছ কিন্তু আজ বুঝলাম তোমারও মনে মধ্যে অনেক কষ্ট আছে।
আমি এভাবেই বড় হয়েছি বর্ষা, এখন আর কোনোকিছুতেই আমি কষ্ট পাই না, সব কষ্ট সহজভাবে মেনে নিয়েছি, বলতে বলতে মিনুর চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
বর্ষা চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, তুমি না ছেলেমানুষ, ছেলেমানুষ কখনও কাঁদে নাকি?
মিনু বর্ষার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, তুমি কেন কাঁদছ বর্ষা। আমার কষ্ট আমারই থাক। তুমি আমার ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডই থাক।
ফ্রেন্ড বলেই তো তোমার সুখে-দুঃখে তোমার পাশে থাকবো। বল তুমি আমাকে তোমার পাশে রাখবে তো?
অবশ্যই। আমি তোমার মতই একজন বেস্ট ফ্রেন্ড খুঁজছিলাম বর্ষা। তুমি পাশে থাকলে আমার আর কোন কষ্টই থাকবে না, বলতে বলতে মিনু বর্ষাকে তার দুবাহুতে হাত রাখল, চোখে চোখ রাখল।
বর্ষা জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষ মানুষের এত কাছাকাছি এলো। বর্ষা কোনদিন ভাবতে পারেনি তার জীবনেও এমন কোন অধ্যায় আসবে। আজ যখন সেরকম পরিসি’তির মুখোমুখি হলো তখন আর নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারল না। সে মিনুর বুকে মাথা রাখল।
মিনু বর্ষাকে দাঁড় করাল, বর্ষার কপালে একটা চুমু দিয়ে এক পা দু পা করে তার বিছানায় শুয়ে দিল। বর্ষা তখন আবেগে বোবা হয়ে গেছে, সে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে, তার আপন সত্তা বলে আর কিছু নেই। দু’জন তরুণ-তরুণীর এভাবে একা বাসায় নিরিবিলি পরিবেশে, একান্তে আপন করে পেয়ে একাকার হয়ে গেল, দুজনের দুটি মন এক হয়ে গেল, দুটি সত্তা এক হয়ে গেল। বর্ষাও অনুভব করল এক অভিনব অভিজ্ঞতা, এক অনাবিল সুখের স্পর্শে নিজের অজান্তে মুখ থেকে শীৎকার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো, মিনু তুমি খুব ভালো মিনু, তুমি আমাকে এতটা সুখী করতে পারবে আমি কখনও ভাবিনি।
মিনু আরও জোর নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো বর্ষাকে, উত্তাল ঢেউয়ে যেন দুজন মিশে গেল। উত্তেজনায় মিনুর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, আই লাভ ইউ বর্ষা, আই লাভ ইউ।
সুখের যন্ত্রণায় কাতর বর্ষার মুখ থেকে বেরিযে এলো, আই লাভ ইউ টু মিনু।
ড্রাইভার কুদ্দুস আগে যখন ডলি ছিল তখন সহজে ছুটিতে যেতে চাইত না কিন্তু এই যাত্রায় মিনু একা থাকে, মিনু নিজে গাড়ি চালাতেও পারে তাই সে বিভিন্ন অজুহাতে ছুটিতে প্রায় চট্টগ্রাম চলে যায়। তাই সে যখন ছুটিতে যায় তখন মিনু বুয়াকেও ছুটি দিয়ে দেয় তারপর বর্ষাকে ফোন করে ডেকে আনে। প্রায় এক বছর হলো বর্ষার সঙ্গে মিনুর সম্পর্কটা এভাবেই চলল যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল ভাইবোনের সম্পর্ক হিসেবে তারপর বন্ধুত্ব, তারপর…
আসলেই কি বন্ধুত্ব? আজকাল এই বয়সের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগ সম্পর্কই গড়ে ওঠে প্রথমত ভাইবোন হিসেবে, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। আজকাল প্রেম ভালোবাসার সংজ্ঞাও অন্যরকম। আগে প্রেম ভালোবাসা ছিল হৃদয়ঘটিত, ভালোবাসার মানুষের জন্য, একজন অন্যজনের জন্য অপেক্ষা করত জনম জনম। ভালোবাসার মানুষ ছাড়া অন্য কারও কথা কেউ কল্পনাই করতে পারতো না। এখন সেরকম প্রেম দেখা যায় না, দেখা যায় না ভালোবাসার জন্য আত্মাহুতি দিতে, একই রশিতে ফাঁসিতে ঝুলতে। যদিও সেটা কারও কাম্য নয়, সেটা একটা সমাজের জন্য লজ্জার এবং অপমানের। তারপর প্রেম।
তবে কি মিনু আর বর্ষার সম্পর্ককে প্রেম বলে? না দেয়া নেয়ার সম্পর্ক। প্রায় দিনই দুজনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, যে ঘুরে বেড়ানর মধ্যে না আছে শালীনতা, না আছে সততা।এই বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রেম করে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে, কফি হাউজে আড্ডা দেয়, পার্কে হাত ধরাধরি করে হাঁটে এটা স্বাভাবিক কিন্তু মিনু আর বর্ষা অফ ডে গুলোতে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার বাইরে। এই অবাধ মেলামেশায় মিনু অনেক দিন থেকে অভ্যস’ হলেও প্রথম প্রথম বর্ষা’র মধ্যে কিছুটা জড়তা ছিল, পিছুটান ছিল, মনের মধ্যে পাপবোধ জেগে উঠত কিন্তু মিনুর পৌরষদীপ্ত চেহারা, সুন্দর বচন ভঙ্গী, চোখের দৃষ্টির কাছে বর্ষা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।
বারো
পরদিন মিনুর ক্লাস ছিল না তাই ইচ্ছা করেই সে ঘুম থেকে দেরিতে উঠল। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মুক্তা ইনবঙে অনেকগুলো ম্যাসেজ দিয়েছে, অভিমানী ম্যাসেজ:
গুড মর্নিং
গুড মর্নিং ডিয়ার
এখনও ঘুম…
আপনার ক্লাস নেই?
ঢাকার লোকেরা কি রাত জেগে ফেসবুকে চ্যাট করে আর দিনের বেলা ঘুমায় নাকি?
নাকি কালকের কথা ভুলে গেছেন?
ফেসবুকিয় রিলেশন এমনই, বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগে না ভাঙ্গতেও সময় লাগে না। তার ওপর আপনি তো আবার স্মার্ট ইয়ংম্যান। হাজার হাজার বন্ধুর ভিড়ে এই গ্রাম্য কিশোরী….হা, হা, হা।
মিনু ম্যাসেজগুলো পড়তে পড়তে হেসে উঠল, উত্তর লিখল, হা, হা, হা।
বর্ষা মিনুকে আপনমনে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হলো? ঘুম থেকে উঠেই যে হাসতে শুরু করলে?
বর্ষা কখন এসে মিনুর পাশে দাঁড়িয়েছে মিনু খেয়ালই করেনি তাই মিনু যখন ফিসফিস করে বলল, পাগল তখন বর্ষা বলল, পাগল না পাগলী?
মিনু কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বলল, বর্ষা তোমাকে না বলেছি মানুষকে নারী পুরুষে ভাগ করবে না।
ও সরি, কী লিখেছে দেখি?
মিনু বলল, তোমাকে দেখান যাবে না।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, তুমি আবার নতুন আইডি খুলেছ?
মিনু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
কী নাম নতুন আইডির?
মিনু বলল, নো নো ফ্রেন্ড, প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে তো। তোমাকে বলা যাবে না।
বর্ষা অভিমান করে বলল, তা ঠিক তোমার তো আবার অনেকগুলো আইডি আর আইডি অনুযায়ী গার্ল ফ্রেন্ড।
মিনু একটা মুচকি হাসি হাসল।
ওকে, বলে বর্ষা রুম থেকে বাইরে যেতে যেতে বলল, আমি আজকের মত আসি।
মিনু কিছুটা অবাক হয়ে বলল, আজ না তোমার কাজ নেই, বললে আজ সারাদিন তুমি ফ্রি।
বর্ষা ঘুরে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলল, এটা তুমি জিজ্ঞাসা করতে পার না মিনু, প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে তো। তাছাড়া…
কী? কী তাছাড়া বল, মিনু হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল।
তাছাড়া তুমি তো আমার হ্যাজবেন্ড না, বলে দু’জনে হো হো করে হেসে উঠল।
মুক্তা সকালবেলা মিনুকে ম্যাসেজ লিখে দিয়ে অফলাইনে চলে গিয়েছিল। আবার অনলাইনে এলো তখন সকাল এগারোটা বাজে। মিনুর হা হা হা হাসির প্রত্যুত্তরে মুক্তা লিখল, আপনি হাসছেন?
তো?
আমি আপনার জন্য কষ্ট পাচ্ছি, আর আপনি হাসছেন?
মাই গড, তো কী করব?
কাল এত কথা হলো আর আজকেই ভুলে গেলেন?
না তো ভুলিনি।
তাহলে আপনার মধ্যে কোন ফিলিংস নেই কেন?
অবশ্যই আছে এতক্ষণ আমি তোমার সঙ্গে ফান করছিলাম। হাউ আর ইউ ফ্রেন্ড?
ভালো নেই?
হোয়াই?
আজ আমি আপনার প্রোফাইল স্ট্যাডি করেছি।
গুড, কী পেলে?
আপনার ফ্রেন্ড লিস্ট মেয়ে বন্ধু দিয়ে ভরা। আপনার অসংখ্য মেয়ে বন্ধু আছে।
ছেলে হোক আর মেয়েই হোক ফেসবুক ফ্রেন্ড তো ফেসবুক ফ্রেন্ডই।
ইয়েস। আমিও তো আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড। অসংখ্য মেয়ে বন্ধুর মতই বরং ওদের চেয়ে কম ঘনিষ্ঠ কারণ ওদের অনেক যোগ্যতা আছে।
কী রকম যোগ্যতা? মিনু জিজ্ঞেস করল।
যেমন আপনার বন্ধুরা সবাই খুব সুন্দর, স্মার্ট। বেশিরভাগই আপনার সঙ্গে পড়ে, ঢাকায় থাকে। যখন তখন ওদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়, কথা হয় আর আমি এক গেঁয়ো মেয়ে, আমার না আছে রূপ, না আছে গুণ। একটা কথা মনে রাখবেন আমি এবং আমরা গ্রামের মেয়েরা, আমাদের রূপ-গুণ না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের ভালোবাসার মত মন আছে। আমরা ভালোবাসতে পারি।
মিনু বুঝতে পারল মুক্তার গ্রামের প্রতি বেশ দূর্বলতা আছে। সে মনে করে গ্রামের মানুষ মানে ভালো মানুষ। গ্রামের মানুষের ভালোবাসা খাঁটি, অকৃত্রিম। তাই সে মুক্তার সরলতার কিছুটা সুযোগ নিল, ও সেকথা বলছ তুমি কি জান আমিও গ্রামের ছেলে?
আপনিও গ্রামের ছেলে? ঠিক বলছেন?
ইয়েস। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম। আমাদের গ্রামে বাড়ি আছে, জমি আছে। আমার তো গ্রামের বাড়ি গেলে আর আসতেই মন চায় না। সবসময় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে, বলে মিনু বর্ষাসহ গাজিপুর বেড়াতে গিয়ে তার একার তোলা কয়েকটা ছবি মুক্তার ম্যাসেঞ্জারে দিল।
কয়েকমিনিট মুক্তার কোন রিপ্লাই নেই দেখে মিনু লিখল, হাই। কী করছ?
কিছু না।
আমি বলব তুমি কী করছ? মিনু জিজ্ঞেস করল।
বলুন।
মিনু জানে না আসলে মুক্তা তার ছবিকে কী করেছে বা এতক্ষণ কী করছিল তবুও সে মুক্তাকে খুশি করার জন্য বলল, বলব?
বলুন।
রাগ করবে না তো?
না, বলুন প্লিজ।
মিনু লিখল, তুমি আমার ছবির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলে। আর…
…কী?
তুমি আমার ছবিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলে।
কিছুক্ষণ মুক্তা কিছু লিখল না।
মিনু আবার লিখল, এ্যাম আই রাইট?
মুক্তা তবুও কিছুক্ষণ কিছু লিখল না।
এবার মিনু ভিডিও কল দিল।
মুক্তা তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অফ করে মিনুর ভিডিও কল রিসিভ করল। মিনু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। সে বুঝতে পেরেছে মুক্তা নিজেকে লুকালেও সে ঠিকই তাকে দেখছে। তাই সে তার সুদর্শন, স্মার্ট পৌরষদীপ্ত চেহারা ক্যামেরার সামনে তুলে ধরে বলল, হাই মুক্তা। এস প্লিজ!
মুক্তা কল কেটে দিয়ে লিখল, ওয়াও। আপনি, আপনি এত সুন্দর, এত্তো স্মার্ট।
মিনু লিখল, তুমি ক্যামেরার সামনে এলে না কেন?
আমার লজ্জা করে। আপনার সামনে দাঁড়ানোর কোন যোগ্যতা আমার নেই। বলেছি তো আমার না আছে রুপ, না আছে গুণ বলে মুক্তা মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিল।
মেয়েদের কথার জালে ফেলে, ভালোবাসার অভিনয় করে তাদের সাথে সখ্য গড়ে তুলে তাদের সবকিছু লুটে নিতে মিনু সিদ্ধহস্ত। সে বুঝতে পেরেছে মুক্তা তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর তাকে এভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই সে খুব পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
মিনু লিখল, তুমি তো একটা কথা বলেছ মুক্তা, গ্রামের মেয়েরা ভালোবাসতে জানে আর আমি সেই গ্রামের মেয়ের হৃদয়ের পিওর ভালোবাসা চাই। রূপ-গুণ আমার কাছে কোন প্রবলেম না। কাউকে ভালোবাসতে পারার চেয়ে বড় গুণ আর নেই।
থ্যাংকস হীরা আমি এমন একটা কথাই তোমার কাছে আশা করেছিলাম। আমি, আমি তোমাকে ভালোবাসি হীরা, আই লাভ ইউ।
মিনু মুক্তাকে পরীক্ষা করার জন্য লিখল, এত তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেলবে না ইনোসেন্ট গার্ল, আগে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নাও।
মুক্তা লিখল, হি, হি, হি।
হাসছ কেন?
আমি গার্ল?
অফকোর্স, তুমি আমার বালিকা বধূ।
ওয়াও, আমি তোমার বালিকা বধূ। এই ভাষা তুমি কোথায় পড়লে তুমি না ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছ, বাংলা উপন্যাসও পড়েছ নাকি? আমি যদি তোমার বউ হতে পারি তবে আমার চেয়ে সুখী আর কে হতে পারে বল।
মিনুর মোবাইল ফোন বেজে উঠল, বর্ষা ফোন করেছে। সে রিসিভ করল, হ্যালো।
এই তুমি কোথায়?
বাসায়।
সত্যি সত্যি কোথাও বের হওনি?
না।
নতুন গার্লফ্রেন্ড পেয়ে রুম থেকে বেরই হচ্ছ না। তুমি যে কখন আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে বলতে বলতে বর্ষার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল।
মিনু জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায়?
রুমে চলে এসেছি। তুমি বিকেলে বের হবে নাকি?
তুমি চাইলে বের হতেও পারি।
এভাবে বলছ কেন, তুমি কি শুধু আমার চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর কর, তোমার আছে আমার মত অনেক গার্লফ্রেন্ড। প্লিজ মিনু একটু থাম। অনেক তো হয়েছে। আমি তোমার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আমি বিশ্বাস করতে চাই না প্লিজ তুমি…
মিনু বর্ষার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, বর্ষা এমন তো কথা ছিল না। এমন কথা ছিল না যে তুমি আমাকে শাসন করবে। তুমি তো জানই আমি সারাজীবন ইচ্ছামতো চলাফেরা করেছি, কেউ আমাকে শাসন করুক আমি এটা পছন্দও করি না।
ওকে, ওকে মিনু। ভালো থেকো বলে মিনু কোন কথা জিজ্ঞেস না করে ফোন রেখে দিল।
মিনুর কোন সাড়া না পেয়ে মুক্তা লিখল, হ্যালো, চলে গেলে?
না, তোমাকে ছেড়ে যাব কোথায়?
মুক্তা লিখল, হি হি হি।
এই নটী হাসবে না, এমনিতেই তুমি আমাকে আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করেছ আমি রাগ করলেও কিছু বলিনি আবার এখন হি হি করে হাসছ।
সরি, তুমি না চাইলে আপনি করেই বলব।
মিনু লিখল, নো নো, ইটস ওকে।
এতক্ষণ কী করছিলে? নিশ্চয়ই একসঙ্গে অনেক মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করছ?
নো নো ফ্রেন্ড, এটা আমি একদম পছন্দ করি না। তোমার মত বালিকা বধূ রেখে আর কারও সাথে চ্যাট করব এতবড় চিট আমি না।
থ্যাংক ইউ ডিয়ার। এখন একটু রাখতে হবে।
কেন?
মা ডাকছে।
ওকে। আপাতত রাখি। ইনোসেন্ট গার্ল।
মুক্তা লিখল, কখনও নটী গার্ল, কখনও ইনোসেন্ট গার্ল আবার কখনও বালিকা বধূ, হি হি হি, বাই।
তেরো
মিনুর সঙ্গে বর্ষার প্রথমদিকে সম্পর্কটা বেশ মধুর ছিল। মাঝে মাঝে মধুর মনোমালিন্য হত সম্পর্কটা অসংজ্ঞায়িত হলেও তাদের বাইরে থেকে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক বোঝার উপায় ছিল না। সেই অসংজ্ঞায়িত মধুর সম্পর্ক ধীরে ধীরে কেমন যেন বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলল। ইদানীং মিনু বর্ষার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করে না। বর্ষা অবশ্য কারণটা বুঝতে পেরেছে, ইদানীং মিনু নতুন কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছে, যদিও বর্ষা মেয়েটির নাম-ধাম জানে না তবুও একথা সত্যি। কারণ বর্ষা মমতার কাছ থেকে মিনু সম্পর্কে যা শুনেছে তার প্রতিটিই সত্য। মিনুর একজনের সঙ্গে বেশি দিন সম্পর্ক টিকে না। অনেক দেরিতে হলেও বর্ষা বুঝতে পেরেছে কিন্তু বুঝতে বর্ষার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হয়ত এমনই হয় মিনুর আসল চরিত্রটা চিনতে মেয়েরা দেরি করে ফেলে।
কয়েকদিন আগের কথা সেদিন মিনুর অফিস কিংবা ক্লাস ছিল না। বর্ষা ফোন দিল কিন্তু মিনু তবুও ব্যস্ততা দেখালো। বর্ষা জিজ্ঞেস করল, আজ তো অফ ডে আজ কীসের ব্যস্ততা মিনু, তুমি বাসায় থাক আমি বিকেলে আসছি। কয়েক দিন থেকে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। রিলেশনটা কেমন আর্টিফিসিয়াল হয়ে যাচ্ছে।
মিনু হ্যাঁ বা না কিছু বলল না।
বর্ষা আর কোন ফোন না করেই বিকেলে মিনুর বাসায় গেল। এই সম্পর্কের মধ্যে মিনুর যেন কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই, কোন আগ্রহ নেই, কোন বৈচিত্র্য নেই।
বর্ষা মিনুকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে একটা কথা বলব?
মিনু কিছুটা অবাক হলো কারণ তারা দু’জনে কখনও এভাবে অনুমতি নিয়ে কেউ কারও সাথে কথা বলে না। মিনু বুঝতে পারল বর্ষা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলবে। সে জিজ্ঞেস করল, এত ফরমালিটিজ করছ কেন, বল?
তুমি কি কারও সঙ্গে রিলেশন করছ?
হঠাৎ একথা কেন বর্ষা?
আমার জানা দরকার।
মিনু বর্ষার কথার প্রতুৎত্তর না করে পাল্টা প্রশ্ন করল, আমাদের এমন কোন কন্ডিশন ছিল কি যে কারও সাথে রিলেশন করা যাবে না?
তার মানে তুমি, তুমি…বলে আবেগে বর্ষার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে গেল।
মিনু বর্ষাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, তার চোখের পানি মুছে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল, বর্ষা প্লিজ ডন্ট মিসআন্ডাস্ট্যান্ডিং মি। আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি তোমাকে কী বলতে কী বলে ফেলেছি।
বর্ষা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি তোমার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করেছি, আমি তোমার মধ্যে দ্বৈত সত্তাপেয়েছি। আমি থাকতে তুমি আরও কাউকে খুঁজছ, রিলেশন করছ।
মিনুর কথায় কোন দৃঢ়তা নেই। সে বর্ষার কথার তেমন জোরাল প্রতিবাদও করল না।
বর্ষা সোফায় বসে পড়ল, মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আপনমনে বলল, নীতি-নৈতিকতাহীন, হৃদয়ের বন্ধনহীন কোন সম্পর্ক হতে পারে না। আনকন্ডিশনাল রিলেশন বলে কোন সম্পর্ক নেই।
বর্ষা ভেবেছিল মিনু তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করবে। তাকে বলবে, বর্ষা তুমি যা অনুমান করছ তা সত্যি না। আসলে তুমি শুধু আমার কিন্তু মিনু বলল না।
বর্ষার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তার মা ফোন করেছে, বর্ষা ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো মা আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছিস মা?
ভালো মা, তুমি?
আমিও ভালো আছি মা।
মা আমি একটু বাইরে আছি রুমে গিয়ে তোমাকে ফোন করব।
আচ্ছা মা। বলে তার মা ফোন রেখে দিল।
কিছুক্ষণ পর বর্ষা সোফা থেকে উঠে মিনুর কাছে গেল। মিনুকে জড়িয়ে ধরে বলল, চল আমরা বিয়ে করে ফেলি।
মিনু যেন আকাশ থেকে পড়ল, বিয়ে!
হ্যাঁ বিয়ে।
বিয়ে এখনই?
বর্ষা বলল, কেন আমাদের দুজনেরই তো বিয়ের বয়স হয়েছে, দুজনে চুটিয়ে প্রেম করছি। বিয়ে করতে প্রবলেম কী?
বর্ষা আমরা এখনও স্টুডেন্ট। তুমি অনার্স পড়ছ আর আমি এম.বি.এ। পড়ালেখা শেষ করার আগে বিয়ে কোনভাবেই সম্ভব না। এটা আমাদের ফ্যামিলি মেনে নিবে না।
ফ্যামিলিকে পরে জানাবে, এম.বি.এ কমপ্লিট হওয়ার পর।
না, বর্ষা তা হয় না। এসব কথা গোপন থাকে না।
কেন, হয় না কেন?
আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না। আমার বাবা হার্টের পেশেন্ট, এমন কথা শুনলে হয়ত হার্ট অ্যাটাক করবে।
বর্ষার প্রচণ্ড রাগ হলো। সে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল, মিনু প্রেম করার আগে তো ফ্যামিলির কথা বলনি, তবে এখন বলছ কেন?
বর্ষা প্রেম করার আগে কি কেউ ফ্যামিলিকে বলে কিন্তু বিয়ে জীবনে একটা ইম্পোর্টেন্ট সাবজেক্ট, ভেবেচিন্তে করতে হয়, ফ্যামিলির পারমিশন নিতে হয়।
আর প্রেমটা বুঝি কোনোকিছু না ভেবেই করতে হয়। মানুষের মন নিয়ে খেলা খেলতে বুঝি কোন চিন্তাভাবনা করতে হয় না।
মিনুও কিছুটা ধমকের সুরে বলল, বর্ষা আননেসেসারি তর্ক বাড়াবে না। আমি বাবার একমাত্র সন্তান, আমি বাবাকে একথা বলতে পারব না। বাবা এটা কোনভাবেই মেনে নিবে না। হঠাৎ করে তুমি বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছ কেন?
মিনু আমি গ্রামের মেয়ে। আমাদের গ্রামে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আমার সমবয়সী মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ফ্যামিলি থেকে আমাকেও বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি লেখাপড়া করার কথা বলে এতদিন থামিয়ে রেখেছি। আমার তো অনার্স শেষ হচ্ছে আর কয়েক মাস পর। মা বার বার করে ফোন করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য, জানি না বাড়ি গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে কী না। তাই আমি মনে করেছিলাম বিয়ে করে গ্রামের বাড়ি যাব।
তুমি আগে বাড়ি থেকে ঘুরে এস বর্ষা।
বাড়ি গিয়ে যদি দেখি বিয়ের আয়োজন চলছে।
মিনু একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, করে ফেলবে।
বর্ষা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি একথা বলতে পারছ, তুমি একটা স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। ওকে আমি যাচ্ছি, যদি বিয়ের প্রসঙ্গ আসে তবে আমি কিন্তু ফিরে আসব এবং ফিরে এসে তোমাকেই বিয়ে করব, বলে বর্ষা আর কোন কথা না বলে মিনুর বুকে মাথা রাখল।
আজ বাইরে থেকে বাসায় ফিরতে বর্ষার রাত হয়েছে। ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে রাত এগারোটা বেজে গেল। বর্ষা যেদিন তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে সেদিন রাতের লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার মাকে ফোন দেয়। কিন্তু আজ খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে দেরি হওয়ায় বর্ষার মা আগে ফোন করল।
বর্ষা কিছুটা অবাক হলো। সাধারণত গ্রামের বাড়িতে তারা রাত দশটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ হঠাৎ এত রাতে ফোন করায় বর্ষার বুকটা কেঁপে উঠল, বাড়িতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো, মা এত কী জরুরি যে দিনের বেলা একবার আবার রাতে, আমি তো ফোন দিবই।
বর্ষা কাঁপা কাঁপা গলায় তার মাকে সালাম দিল, মা আসসালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস মা?
ভালো মা। তুমি? মা তোমরা সবাই ভালো আছ? কোন দুঃসংবাদ নেই তো?
না মা, কিছু হয়নি। আমি একটা খবর দেয়ার জন্য তোকে ফোন করলাম।
বল মা।
তোর বাবা ফোন করেছিল, আগামীকাল আসবে।
বর্ষার বাবা এবার প্রায় বছর খানেক আগে দেশের বাইরে গেছে। সাধারণত তাদের এলাকায় আরও যারা দেশের বাইরে গেছে তারাও কখনও এক বছরের মধ্যে দেশে আসে না। তাতে করে যাওয়া আসার যে ব্যয় হয় তাতে দেশের বাইরে ছোট চাকরি করে কুলাতে পারে না। বর্ষার বাবাও একবার গেলে বেশ কয়েক বছর পর দেশে আসে কিন্তু এবার এক বছরের মধ্যে দেশে আসবে আবার হঠাৎ করে। আগে দেশে এলে কয়েক মাস আগে থেকে ছুটি হলে আসবে, ছুটি হলে আসবে শোনা যেত। এবার কোনোকিছু না বলে হঠাৎ দেশে…
বর্ষার মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিল। গত কয়েক মাস থেকে বর্ষার মা ফোন করলেই ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলে, গ্রামের তোর বয়সের সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেল। আমার সব বান্ধবীরা নাতি-নাতনির মুখ দেখছে। আর তোর এখনও লেখাপড়াই শেষ হলো না। কবে যে তোর লেখাপড়া শেষ হবে, কবে যে বিয়ে হবে, আর কবে যে আমি নাতি-নাতনির মুখ দেখব।
মায়ের কথা বর্ষা হেসে উড়িয়ে দিত, মা, আমার এমন কি বয়স হয়েছে। আমি আগে লেখাপড়া শেষ করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব তারপর বিয়ের কথা ভাবব।
কয়েকদিন আগের কথা। একদিন রুনা ফোন করল। ফোন করেই তার জন্য এক পাত্রের গুণগান গাইতে শুরু করল, ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর, তোর সঙ্গে খুব ভালো মানাবে। বাড়ির অবস্থাও ভালো, সুন্দরগঞ্জে একটা বড় দোকান আছে, আই.এ পাস দিয়েছে।
বর্ষা কিছুটা রেগে গেল, এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছ কেন মা?
বর্ষার কথা শুনে রুনাও রেগে গেল, কেন শুনাচ্ছি তুই বুঝিস না, বাড়িতে বিয়ের বয়সের মেয়ে থাকলে বাবা-মা’র কি আর চিন্তার শেষ আছে। তুই রাজি হয়ে যা মা, এত ভালো ভালো ছেলেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেলে আর ভালো ছেলে পাওয়াই কঠিন হবে।
প্রতিদিন এসব কথা শুনে শুনে আর হঠাৎ করে তার বাবার দেশে আসার কথা শুনে বর্ষার সেই আশঙ্কাটা আরও বেশি দেখা দিল। তাই বাবার দেশে আসার কথায় খুশির পরিবর্তে কিছুটা মন খারাপ করল।
সে জিজ্ঞেস করল, বাবা হঠাৎ দেশে আসছে?
হ্যাঁ। তুই খুশি হইসনি?
অবশ্যই খুশি হয়েছি মা, একটু অবাকও হয়েছি। বাবা তো এই সেদিন দেশের বাইরে গেল। আর বাবা তো একবার গেলে বেশ কয়েক বছর পরে দেশে আসে, এবার আবার খুব তাড়াতাড়ি এলো…
তুইও আগামীকাল বাড়ি চলে আয় মা, তোর বাবা বুঝি বেশিদিন থাকবে না।
কিন্তু আমার যে কলেজে ক্লাস আছে মা।
বাবা বিদেশ থেকে আসছে আর মেয়ে ঢাকা থেকে আসবে না, এটা কি হয় পাগলি।
আচ্ছা মা, আমিও আসছি তাহলে।
চৌদ্দ
মিনু প্রত্যেকটা কাজ করেছিল অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে, পরিকল্পিতভাবে। মুক্তার সঙ্গে তার ভালোবাসায় কোন আবেগ ছিল না, তার প্রতিটি কাজ ছিল মুক্তাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, তার প্রতিটি কথা ছিল শুধু মুক্তাকে মুগ্ধ করার জন্য, মুক্তাকে পাগল করার জন্য, মুক্তার সুন্দর আকর্ষণীয় দেহটা ভোগ করার জন্য আর হীরা নামধারী মিনুর প্রতি মুক্তার ভালোবাসা ছিল খাঁটি, অকৃত্রিম, সুন্দর, পবিত্রতম।
তুমি তো বেশ সুখেই ছিলে হীরা। ফেসবুকের শত শত বান্ধবী তোমার জন্য পাগল ছিল, তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ভার্সিটিতে তোমার অনেক গার্ল ফ্রেন্ড ছিল। সুন্দর নারীদেহ ভোগের জন্য বর্ষাকে তুমি যখন যেভাবে চেয়েছ সেভাবে পেয়েছ। আর কত দরকার ছিল তোমার। দাম্পত্যজীবন শুরুর আগেই তুমি কত যে নারীসঙ্গ ভোগ করেছিলে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আর আমি, আমি তো আমার লেখাপড়া, আমার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কীভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব, কীভাবে একজন ভালোমানুষকে হ্যাজবেন্ড হিসেবে পাব সেটাই আমি সবসময় ভাবতাম। আমাদের দুজনের দুটি পথ ভিন্নই ছিল, আমি তোমাকে আমার পথ সম্পর্কে খোলামেলাভাবেই বলেছিলাম কিন্তু তুমি মুখে এক আর হৃদয়ে আরেক স্বপ্ন লালন করতে। তোমার সুন্দর অভিনয়ের কারণে আমি বিন্দুমাত্র তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি কেন আমাকে তোমার জীবনের সঙ্গে জোড়ালে?
মিনু কাত ফিরতে চাইল কিন্তু পারল না। সেই যে বজ্রপাতের গর্জনে তার কান ফেটে রক্ত বেরিয়েছে তারপর থেকে তার প্রাণশক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। তার ভিতরেও অনেক কথা তোলপাড় করছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না।
মুক্তা আবার বলতে শুরু করল, তুমি পরিকল্পনা করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমার সহজ-সরল মনটাকে মাতাল করে তুলেছিলে। আগে শুধু চ্যাটিং করতে তারপর শুরু করলে ভিডিও কল। প্রথমদিন আমি ক্যামেরার সামনে এলাম না, তুমি এলে, তুমি নিজেকে এমনভাবে ক্যামেরার সামনে উপস্থাপন করলে যে আমি আর থাকতে পারলাম না।
মিনু গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, তারপর তুমিও তো এলে।
হ্যাঁ এলাম। তুমি আমাকে ইমোশানালি ব্ল্যাক মেইল করেছিলে তাই এলাম।
তুমি প্রথম নক করলে, হাই মুক্তা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হাই হীরা কেমন আছ?
তুমি লিখলে, ভালো রেখেছ?
কেন আমি আবার কী করলাম?
তুমি লিখলে, কী করনি, তুমি আমার মনটাই নিয়ে নিয়েছ, না সরি, মনটা নাওনি চুরি করেছ। না, চুরিও না ডাকাতি করেছ। হা হা হা।
হাসছ, তুমি মানুষের কষ্ট দেখে হাসতে পার। তুমি একটা পাষাণ, নিষ্ঠুর।
কী করছ মুক্তা?
শুয়ে আছি। তুমি?
আমিও শুয়ে আছি, বলেই তুমি ভিডিও কল দিলে।
আমি প্রথমে লাইন কেটে দিয়ে লিখলাম, সরি হীরা।
তুমি লিখলে, সরি কেন? আমি আশা করছি প্লিজ এস। তুমিও তো একা আছ।
আমাকে দেখলে তোমার পছন্দ হবে না হীরা, সেজন্য তোমার সামনে আসতে আমি লজ্জা পাচ্ছি। প্লিজ রাগ কর না।
তুমি অভিমান করে লিখলে, থাক তাহলে, আর কোনদিন তোমাকে নক করব না। বলে তুমি ডাঁটা অফ করে দিলে। তুমি রাগ করেছ দেখে আমার বুকটা যেন খালি হয়ে গেল। তোমাকে ছাড়া আমি যেন তখন বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন মনে করছিলাম। আমি তোমাকে ফোন করে সরি বললাম। তারপর তুমি আবার নেটে এলে। আবার ভিডিও কল দিলে।
আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম, ক্যামেরা অফ করে তোমার সাথে কথা বলছিলাম। তুমি রাগান্বিত কণ্ঠে বললে, মুক্তা, আসবে নাকি আমি…
আমি আবারও তোমাকে হারানোর ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ক্যামেরা অন করলাম। আমি তখন লজ্জায় সংকুচিত, আমি এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে তোমাকে দেখতে শুরু করলাম। কী এক অপূর্ব সৌন্দর্য, মাতাল করার মত চোখের দৃষ্টি। আমি যেন তোমার মাঝে হারিয়ে গেলাম।
তুমি কিছুটা ধমকের সুরে বললে, মুক্তা, মুক্তা হাত সরাও বলছি। না সরালে কিন্তু আমি আবার অফলাইনে চলে যাব।
তোমার অফলাইনে যাওয়ার কথাটা শুনলেই আমার মনে হত আমি বুঝি তোমাকে পেয়ে হারিয়ে ফেললাম। আসলে আমি যে তোমাকে পাইনি এটা আমি কখনও মনেই করতাম না। আমি তোমার প্রতি এতটাই ইমোশনাল ছিলাম যে তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য না পেলে আমি মনে করতাম তুমি বুঝি হারিয়ে গেলে। আমি হাত সরালাম কারণ আমি কোনভাবেই তোমাকে হারাতে চাচ্ছিলাম না। তুমি আমাকে দেখে বললে, ওয়াও। ইউ আর মোস্ট বিউটিফুল ইনোসেন্ট গার্ল।
আমি কী বলব বুঝতে পাচ্ছিলাম না। আমি শুধু তোমার দিকে তাকিয়েই ছিলাম আর একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম, তোমার মত সর্বগুণে গুণান্বিত একটা ছেলে কেন আমাকে ভালোবাসবে?
তুমি চোখের ইশারায় আমাকে জিজ্ঞেস করলে, কী দেখছ?
আমি বললাম, তোমাকে?
তুমি হা হা করে হেসে বললে, আমাকে দেখার কী আছে? বরং আমি তোমাকে দেখছি আর ভাবছি আই এ্যাম সো লাকি দ্যাট তোমার মত ফ্রেন্ড পেয়েছি।
আমি স্বাভাবিকভাবে জানতাম মেয়েরা ভাব নেয় আর ছেলেরা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, ছেলেরা মেয়েদের মুখের দিকে, বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মেয়েরা লজ্জা পায় কিন্তু আমাদের বেলায় যেন উল্টোটা হচ্ছিল। তুমি যেন ভাব নিতে আর আমি নিজেকে উজাড় করে তোামকে ভালোবাসতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, শুধুই ফ্রেন্ড?
তুমি বললে, না। শুধু বন্ধু না, তুমি আমার পুরোটা হৃদয়ে জুড়ে থাকা এক তরুণী। যাকে নিয়ে আমি অনেক কিছু ভাবছি।
তোমার কথা শুনে আমার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে আসছিল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাবছ?
তুমি আমাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখালে, তুমি বললে, মুক্তা ঢাকা এস। তোমার তো অনার্স শেষ হচ্ছে, তারপর ঢাকা এস, বিয়ের পর ঢাকায় থেকে মাস্টার্স করবে, আমরা একসাথে থাকবো।
একাসথে থাকার কথা শুনে আমি প্রথমে কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলাম, তারপর মনে হলো তুমি তো ঠিকই বলেছ বিয়ে করলে তো আমরা একসাথেই থাকবো। তোমার কথা শুনে আমি যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা সংসার। তুমি আমি আর আমাদের একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। আমি যেন তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেলাম কিন্তু তোমার কথার মধ্যে গ্যাপ ছিল। তুমি আসলে বিয়ের কথা বলনি, বলেছিলে একসাথে থাকার কথা যেটা আমি চিন্তাই করতে পারতাম না। পারব কীভাবে, আমি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, আমি জানি নারী-পুরুষের সম্পর্ক শুধু বিয়ের মাধ্যমে একসাথে থাকা যায় এর বাইরে না। তাই তোমাকে বিয়ে করে সংসার করার স্বপ্ন দেখছিলাম কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ভুল ছিল। তুমি শুধু আমাকে খুশি করার জন্য, আমাকে পাগল করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করছিলে। তুমি শুধু আমাকে ভোগ করার জন্য সমস্ত আয়োজন করছিলে।
সেদিনের পর থেকে তুমি আমাকে ইনবঙে অ্যাডাল্ট ভিডিও পাঠাতে শুরু করলে, আমি সবসময় তোমার পাঠান অ্যাডাল্ট ভিডিও দেখতাম আর তোমাকে কল্পনা করতাম। প্রতিদিন রাতে তুমি আমাকে ভিডিও কল করতে। তুমি আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতে, আমাকে অ্যাডাল্ট ভিডিওর কথা বলে তোমার সাথে সেরকম করতে প্রলোভন দেখাতে। তুমি বল হীরা একজন বিশ বাইশ বছর বয়সের তরুণী এরকম পরিবেশে কতক্ষণ ঠিক থাকতে পারে। আমারও তো রক্ত মাংসের শরীর।
মিনু গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, সরি মুক্তা, সরি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও, সরি ফর এভরিথিং।
আমিও অনেকবার অনুরোধ করেছিলাম প্লিজ, প্লিজ বলেছিলাম কিন্তু ওরা কি আমাকে মাফ করেছিলে।
আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম পুরো হৃদয় দিয়ে। তোমার কাছে ছুটে গেছিলাম কয়েক শ কিলোমিটার দূর থেকে, আশা ছিল তুমি আমাকে ভালোবাসবে, আদর করবে, আমাকে বিয়ে করবে, সারাজীবন তোমার বুকে আগলে রাখবে। বল আমার কি দোষ ছিল হীরা? তুমি বলতে পারতে তুমি বর্ষাকে ভালোবাসো, বর্ষা ছাড়াও তোমার অসংখ্য গার্ল ফ্রেন্ড আছে তাদের ছেড়ে তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না কিংবা তুমি কেন বললে না যে বিয়ে, দাম্পত্য, সংসার এসব তুমি পছন্দ কর না। ট্রেডিশনাল লাইফ তুমি পছন্দ কর না, তুমি কোনদিন বিয়ে করবে না, বিয়ে তোমার কাছে শৃংঙ্ক্ষলমনে হয়। তুমি কেন আমাকে মিথ্যা ভালোবাসায় জড়ালে? তুমি কেন আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখালে? তুমি কেন আমাকে….
মিনু মুক্ত মুক্তা করে গোঙ্গাতে লাগল।
মুক্তা নেই। মিনু আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কতক্ষণ কে জানে আবার ঘুম ভাঙল কানের ব্যথা আর আলোর ঝলকানিতে। সব অন্ধকার যেন আলোকিত হলো, আবার সেই অপরিচিত পৃথিবী, অন্যরকম গাছপালা, মিনু মাটিতে শুয়ে আছে কিন্তু মাটিও যেন তেলতেলে একটা অন্য ধরনের গন্ধ। বজ্রপাতের ঝলকানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। কাছে, খুব কাছে, মিনুর কানের কাছেই শব্দ। মিনুর কান থেকে আরও কয়েক ফোটা রক্ত ছিটকে পড়ল। ব্যথা, প্রচণ্ড ব্যথা যেন প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইছে। মিনু গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, আমি কি মৃত্যু যন্ত্রণায় ভুগছি, নাকি মরে গেছি?
মুক্তার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, তুমি কোনটা চাও? পৃথিবীতে থাকতে চাও নাকি মরে যেতে?
তুমি, তুমি এসেছ? বল না প্লিজ, তুমি না বলেছ এখানকার কেউ মিথ্যা কথা বলে না, ছলনা করে না, প্রতারণা করে না তবে তুমি কেন আমাকে বলছ না। আমি এখন কোথায়?
ঠিকই বলেছি তো, এটা তোমাদের তথাকথিত পৃথিবী না, অপেক্ষা কর, একটু অপেক্ষা কর সব জানতে পারবে। আচ্ছা মনে কর তুমি মরে গেছ। তাহলে তুমি কী করবে? তুমি অসহায়, এখন তোমাকে তোমার কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তোমার ভালো এবং মন্দ কাজের বিচার হবে। তোমার একটা কথা মনে রাখা উচিত ছিল পৃথিবীতে কিন্তু মানুষকে পরীক্ষা দিতে হয় ফাঁস হওয়া কোয়েশ্চিন দিয়ে।
মানে?
মানে পৃথিবীর সব মানুষই জানে ভালো কাজ করলে তারা মৃত্যুর পর পুরস্কার পাবে এবং খারাপ কাজ করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারপরও মানুষ খারাপ কাজ করে, নিজের সুখের জন্য, প্রতিষ্ঠা, যশ, খ্যাতি’র জন্য মানুষের ওপর অন্যায় করে। এই যেমন তুমি কত কত অন্যায় করেছ। আমার মত কত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছ, কত নিরীহ মানুষের জমি দখল করে ডেভলপার কোম্পানি বানিয়েছ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করেছ, গ্রুপ অব কোম্পানিজ বানিয়েছ, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ফেরত দাওনি, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছ। এখন সারাদেশের মানুষ তোমার কাছে সেই টাকা চাইবে। এটা তাদের টাকা, তাদের তো ফেরত দিতেই হবে।
এখন, এখন আমি কীভাবে দিব, আমি তো কিছুই নিয়ে আসিনি। আমার দেবার মত তো কিচ্ছু নেই।
দিতে হবে হীরা, দিতে হবে। তুমি কি ভেবেছ আমি তোমাকে ছেড়ে দিব। আমি তোমার জন্য পাগল ছিলাম হীরা, তুমি আমাকে পাগল করে তুলেছিলে, আমি আবেগে অন্ধ হয়ে তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। আর তুমি, তুমি আমাকে…আবেগে মুক্তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
কয়েক মুহূর্ত কারও মুখে কোন কথা নেই। তারপর মুক্তা আবার বলতে শুরু করল, সেদিন সকালে আমি কলেজ যাওয়ার কথা বলে বের হলাম। তুমি আমার সবকিছু লুটে নেয়ার জন্য সবরকম আয়োজন করেছিলে। অনলাইনে বাসের টিকেট কিনে দিয়েছিলে, একটা নুতন সিমকার্ড, নতুন সেট কেনা এবং রাস্তায় হাতে কিছু টাকা রাখার জন্য, আসার জন্য আগেই টাকা পাঠিয়েছিলে। তুমি পদে পদে আমাকে তোমার ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিলে। আমিও মনে করতাম তুমি, তুমিই আমার সব, তাইত আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছিলাম। আমি পুরো রাস্তায় শুধু ভাবছিলাম কখন তোমার কাছে পৌঁছাব। তুমি বলেছিলে আমাকে বিয়ে করবে, বিয়ের পর আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে। তোমার কথায় আমি তো পুরো সংসার সাজাতে শুরু করেছিলাম এমনকি আমাদের ছেলে হলে কী নাম রাখব আর মেয়ে হলে কী নাম রাখব। তোমার কাছে আবেগের কোন মূল্য নেই কিন্তু আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, আমাদের কাছে আবেগের মূল্য অনেক।
আমি ঢাকা পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত আটটা, বাস থেকে নামতেই তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। আসলে কত কিছুই তো হতে পারতো। তুমি যদি আমাকে রিসিভ করতে না আসতে তাহলেও আমার কিছু করার ছিল না। আমি পরম নির্ভরতায় তোমার হাত ধরে ছিলাম। তোমার হাত ধরে অন্ধের মত তোমার সঙ্গে গেলাম। তুমি বলেছিলে তুমি মেসে থাক। আমি ঢাকা গেলে তুমি আগে তোমার কাজিনের বাসায় আমাকে রাখবে। তারপর বিয়ে করে নতুন বাসা ভাড়া নিবে। আমি তোমার কাজিনের বাসা ভেবে তোমার সঙ্গে গেলাম কিন্তু তুমি তোমার বাসায় নিয়ে গেলে। বিশাল একটা বিলাসবহুল বাসা। তোমার বিছানা-বালিস, খাট, পড়ার টেবিল, দেয়ালে ঝুলান টেলিভিশন, ফ্রিজসহ পুরো একটা ফ্যামিলি বাসার মত আসবাবপত্র, তবে সবকিছুতেই ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া।
বাসায় ঢুকেই তুমি দরজার ছিটকানি বন্ধ করে দিলে। তখন আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি কথায় এলাম, আমি একটা মেয়ে, একা একটা অচেনা পুরুষ মানুষের বাসায় এলাম।
তুমি আমার মুখ দেখে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলে, তুমি জিজ্ঞেস করলে, ভয় পেয়েছ?
আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, না, মানে…
মানে মানে করছ কেন? কোন ভয় নেই, আমি আছি না, আমি থাকতে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
না মানে আমি ক্ষতির কথা বলছি না। তুমি তো বলেছিলে আমরা তোমার কাজিনের বাসায় থাকবো, তারপর বিয়ের পর বাসা ভাড়া নিব।
কাজিনের বাসায় একটা প্রবলেম হয়েছে। হঠাৎ করে চিটাগাং থেকে অনেক গেস্ট এসেছে। দুপুরে আমি যখন রিপাকে মোবাইল করলাম তখন ও বলল ওর বাসায় অনেক গেস্ট এসেছে কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাসে উঠেছ এবং অনেকদূর চলে এসেছ। তাই তোমাকে আর না করতে পারিনি।
খুব তাড়াতাড়ি একজন কাজিনের নামও বানিয়ে ফেললে। আমি তখন বুঝতে পারিনি, আসলে রিপা নামে তোমার কোন কাজিনই ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, বিয়ে ছাড়া একটা বাসায় শুধু তুমি আর আমি থাকবো এটা আমি কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে আজ কোথায় থাকবো হীরা?
তুমি বললে, এখানে।
আমি যেন আঁতকে উঠলাম, এখানে?
ইয়েস, এ্যানি প্রবলেম?
হীরা তাহলে চল কাজি অফিসে, আমরা আজই বিয়ে করে ফেলি।
তুমি আমার কথাটা যেন হেসে উড়িয়ে দিলে, মুক্তা, আসলে তুমি ভয় পাচ্ছ, না?
আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছিলাম, সেটা তুমিও বুঝতে পারছিলে, আসলে বানিয়ে বানিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কীভাবে মেয়েদের পটাতে হয় তা তুমি ভালো করেই জানতে। তুমি আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালে, তোমার বাম হাতটা আমার ডান বাহুতে, ডান হাত দিয়ে আমার থুতনি উঁচু করে চোখে চোখ রাখলে। তুমি আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বললে, মুক্তা চোখ খোল, দেখ আমি তোমার স্বপ্ন, আমার জন্য তুমি কয়েক শ কিলো দুর থেকে ছুটে এসছ। একবার চোখ খোল, দেখ সত্যি কী না।
তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম তোমার চোখে চোখ রাখলে আমি তোমাকে কোনোকিছু না করতে পারব না। আর তুমি সেই সুযোগটাই নিলে। অনেকক্ষণ আমার চোখে চোখ রাখলে। আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বললে, মুক্তা একসাথে থাকলেও আমার একার ইচ্ছা বলে কিছু নেই, তুমি যা চাইবে, যতটুকু চাইবে ঠিক ততটুকুই হবে এর বেশি কিছু হবে না।
তখন আমার একার আসলে কিছু করারও ছিল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছি ঢাকায় তোমার কাছে, তুমিই তো আমার সব, তাছাড়া তোমার কাছ থেকে পালিয়ে ঢাকায় অন্য কারও কাছে গিয়ে আমার থাকার কোন উপায় নেই আর তোমার কথা, তোমার বুকে মাথা রাখার পর আমার নিজস্বতা বলে আর কিছু ছিল না। আমি তোমার মাঝে হারিয়ে গেলাম।
জীবনের প্রথম যে রাতটার কথা আমি সবসময় কল্পনা করতাম। ঢাকা যাওয়ার পথে যে তোমাকে আমি কল্পনা করতে করতে ঘুমের মাঝে হেসে উঠতাম সেই তুমি জীবনের প্রথম রাতেই আমাকে ধর্ষণ করলে, আমার জীবনের সব হাসি কেড়ে নিলে।
মিনু গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, না, না আমি তোমাকে ধর্ষণ করিনি। আমি তোমাকে জোর করিনি। শুধু তোমাকে না, আমি সারাজীবন কাউকেই জোর করিনি। জয় করার চেষ্টা করেছি মাত্র এবং করেছিও। ঠিক তেমনি আমি তোমাকে জয় করেছিলাম আর তুমি নিজের ইচ্ছায়…
মুক্তা বাধা দিয়ে বলল, নিজের ইচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে। তুমি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলে যে আমার না করার মত শক্তি, ক্ষমতা বা স্বকীয়তা কিছুই ছিল না। তুমি ঠিকই বলেছ তুমি কাউকে জোর করনি। তুমি সবাইকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেছ যাতে করে তারাই তোমার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়।
আমিও তোমাকে ধর্ষক বলতাম না যদি রাতের কথামতো পরদিন তুমি আমাকে বিয়ে করতে। পরদিন আমি তোমাকে বিয়ের কথা বললাম। তুমি আবারও হেসে উড়িয়ে দিলে, আফটার অল আমি তো আগে কখনও বিয়ে করিনি যে এখনই বিয়ে করে ফেলব। দু’জন সাক্ষী ম্যানেজ করতে হবে, কাজি অফিসে যেতে হবে।
এটা হেসে উড়িয়ে দেয়ার মত বিষয় না হীরা।
তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করব করছি বলে আরও কয়েকদিন কাটিয়ে দিলে। দিনে দিনে তোমার আচার-ব্যবহারও বদলে গেল।
আমি তোমাকে আবারও বিয়ের জন্য চাপ দিলাম, তুমি বিয়ের কী করলে হীরা?
এবার আর তুমি হেসে উড়িয়ে দিলে না। প্রচণ্ড রেগে গেলে, করব তো, আমাকে একটু সময় দাও, এত অসি’র হচ্ছ কেন?
আমারও প্রচণ্ড রাগ হলো, আমি বললাম, শোন হীরা আমি কিন্তু সেরকম মেয়ে না যে বিয়ে না করে তোমার কাছে থাকবো।
তুমিও রেগে গেলে, কী করবে? চলে যাবে?
আমি বুঝতে পারলাম আমাকে তুমি ভালোবাসোনি, শুধু ভোগ করার জন্য ভালোবাসার অভিনয় করেছ। আমাকে তোমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এখন তুমি আমাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচ কিন্তু আমারও পিছু ফেরার পথ ছিল না। আমি ফিরে গিয়ে কী বলব? এরকম কেস এ সাধারাণত মেয়েরা বিয়ে করে হ্যাজবেন্ডকে নিয়ে বাবার বাড়ি যায়। আমি তোমার কাছে পালিয়ে এলাম, সম্মান হারালাম, সংসার করলাম কিন্তু স্বামী পেলাম না।
আমি বললাম, না, চলে যাব না। আমি চলে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে আসিনি। যদি যেতেই হয় তবে চিরতরে, পৃথিবী থেকে এবং সেটা তোমার ঘরে।
তুমি সুইসাইড করবে?
তাছাড়া আর উপায় কী বল? এবং তোমার ঘরে। জানই তো সুইসাইড করার জন্য মেয়েদের গলায় ওড়ানটা ঝুলানই থাকে, মাথার ওপর সিলিং ফ্যানও থাকে।
তুমি প্রচণ্ড রেগে গেলে, হোয়াট! তুমি আমার ঘরে ফাঁসি লাগিয়ে সুইসাইড করবে?
তোমার জন্য সুইসাউড করছি তো তোমার ঘরে করব না? দু’জনে পাপ করেছি আর শাস্তি ভোগ করব আমি একা? কথাগুলো আমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিলাম। এমন সময় তোমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
পনেরো
তোমাকে খুব বিমর্ষ দেখাতে শুরু করল, তুমি ঘামতে শুরু করলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী, খারাপ কিছু?
তুমি আমতা আমতা করে বললে, না, নট অ্যাট অল।
আমি বললাম, ফোন রিসিভ কর।
হ্যাঁ করছি, বলে তুমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে।
ততক্ষণে কল কেটে গেছে তুমি কল ব্যাক করলে।
আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি কথা বলতে শুরু করলে, হ্যালো।
অপর পাশ থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো। কেমন আছ?
ভালো, তুমি?
ভালো আছি। আমি গাইবান্ধা আসার পর থেকে তুমি তো একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেছ। শোন তোমার সঙ্গে আমার একবার কথা বলা খুব প্রয়োজন।
তুমি ডানে-বাঁয়ে একবার তাকিয়ে বললে, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে তোমার সাথে কথা বলছি।
মেয়েটি তাড়া করল, না, না। আমার এখনই কথা বলা প্রয়োজন। তুমি কোথায় আছ, কথা বলতে প্রবলেম কী বলত।
না, কোন প্রবলেম নেই বলে তুমি আবার ডানে-বাঁয়ে এবং কিছুটা উঁকি মেরে ঘরের ভিতরে চোখ রেখে আবার কথা বলতে শুরু করলে, বল।
আমি যা ভেবেছিলাম তাই।
কী হয়েছে?
সবাই বিয়ের আয়োজন করছে।
করে ফেল।
না।
তো কী করবে? তুমি জিজ্ঞেস করলে।
আমি ঢাকা আসছি।
কিন্তু আমি তো আজ রাতে ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছি।
তুমি ঢাকার বাইরে যাচ্ছ! কেন? কোথায় যাচ্ছ?
তুমি আবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বললে, আমি এখন তোমাকে কিচ্ছু বলতে পারছি না। পরে বলব।
তুমি ফিরবে কবে?
এখনও ঠিক নেই, বলে তুমি ফোন রেখে দিয়ে রুমে ঢুকলে।
ততক্ষণে আমার বুক কাঁপতে শুরু করেছে, সমস্ত শরীর ঘামতে শুরু করেছে। তোমাকে কী বলব আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি যা শুনলাম তা যদি সত্যি হয় তবে কার জন্য আমি বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে শুধু মাত্র ফেসবুকে পরিচিত একজনের ওপর নির্ভর করে চলে এলাম, শুধু এলাম, ছিঃ, আমার নিজের ওপর ঘৃণা হলো।
তুমি রুমে ঢুকলে অপরাধীর মত কিন্তু মুখে একটা কৃত্রিম হাসি, তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য টেনে নিতে চাইলে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে ফোন করেছিল?
আমার ফ্রেন্ড।
ফ্রেন্ড নাকি গার্ল ফ্রেন্ড?
মুক্তা প্লিজ বাদ দাও তো ওসব কথা।
আমি প্রতিবাদ করলাম, না, বাদ দিব কেন? তোমার গার্ল ফ্রেন্ড? নাকি একসাথে থাকতে?
তুমি আমার কথার কোন সদুত্তর দিতে পারলে না।
আমি আর নিজেকে সামলে নিতে পারছিলাম না। জোরে চিৎকার করে বললাম, তাহলে আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে কেন?
তুমি খুব শান্তভাবে বললে, আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করিনি মুক্তা। আমি তোমাকে বিয়ে করব বলেই তোমাকে ভালোবেসেছি এখন তুমি যদি অতীতের কথা তুলে ঝগড়া কর তবে কীভাবে হবে বল।
অতীত হলে তো কোন কথাই ছিল না, সে তো আসলে বর্তমান, সে যদি ফিরে এসে ঝামেলা করে।
কেন করবে আমি তো ওকে বিয়ে করতে চাইনি। আমি শুধু ওর ফ্রেন্ড ছিলাম।
আমি অবাক হলাম যে মেয়েটা তোমার জন্য বিয়ের পিঁড়ি থেকে পালিয়ে আসতে চাইছে তাকে তুমি শুধু ফ্রেন্ড বলে কাটিয়ে দিলে তাহলে আমাকে তুমি কী বলে পরিচয় করে দিবে।
তুমি বললে, তুমি তো আমার বউ হবে মুক্তা, বউকে আবার মানুষ কী বলে পরিচয় করে দেয়, তুমি আমাকে আজকের দিনটা সময় দাও, আমি দিনের মধ্যে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলব।
তুমি কী ম্যানেজ করে ফেলবে?
বিয়ের সব আয়োজন।
আমি প্রচণ্ড রেগে জোরে চিৎকার করে বললাম, আমি কিন্তু বার বার ঠকবো না মিনু, একবার বিয়ের কথা বলে আমাকে নিয়ে এসছ কিন্তু এখনও বিয়ে করনি আবার যদি তুমি আমাকে বিয়ে না কর, আমাকে স্ত্রীর সম্মান না দাও, আমার সঙ্গে কোন চালাকি কর তবে আমি, তোমার ওপর রেপ কেস করব আর না হয় তোমার বাসায় সুইসাইড করব।
তুমি সবকিছু খুব ঠান্ডাভাবে ম্যানেজ করলে, আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললে, ছিঃ মুক্তা এভাবে বলতে নেই। হ্যাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে এসব কথা আসবে কেন?
আমি তোমার চোখে চোখ রাখলাম, তোমার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারলাম না, আমি বুঝতে পারলাম না তুমি আমাকে বিয়ে করবে কী না, তখন আমি ভাবতাম তোমাকে ছাড়া বুঝি আমার আর কোন বিকল্প নেই। অথচ তখন চাইলে আমি কোন সিন ক্রিয়েট করে লোক জড় করতে পারতাম, তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম কিন্তু আমি কিছুই করলাম না, একজন সহজ-সরল গ্রাম্য বালিকার মতই তোমাকে স্বামী ভেবে বুকে মাথা রাখলাম।
অনেকগুলো মানুষের হৈ চৈ এর শব্দ শোনা গেল, অনেকগুলো মানুষ না, অসংখ্য মানুষ। হৈ চৈ না, মিছিলের শব্দ। দূর থেকে ভেসে আসা একটা মিছিলের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছে, একটা শব্দ বার বার প্রতিধ্বনত হচ্ছে। মিনু কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করল। স্লোগান শুনে সে চমকে উঠল। তার হৃদ্পিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল। মিছিলের লোকেরা যেন তার বিরুদ্ধেই স্লোগান দিচ্ছে। কেন? আমার বিরুদ্ধে কেন? মিনু আবার শোনার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, হ্যাঁ তার বিরুদ্ধেই তো, মিছিলটা আরও কাছাকাছি আসতেই দৃশ্যমান হলো। অসংখ্য মানুষের হাতে ব্যানার, ফেস্টুন, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, আমাদের বসতবাড়ি আমরা ফিরিয়ে চাই, কেরামত হত্যার বিচার চাই।
আমাদের বসতবাড়ি মানে? কেরামত হত্যা? মিনু চমকে উঠল কিছুটা আশ্বস্থও হলো, এসব কী হচ্ছে, মুক্তা, মুক্তা কোথায় গেলে? কথা বলতে বলতে হঠাৎ কোথায় চলে গেলে?
না মুক্তা নেই। মিছিলের সামনে থেকে একজন লোক এগিয়ে এলো, আমাকে চিনতে পারছেন স্যার?
মিনু না সূচক মাথা নাড়লো।
আমি কেরামত।
মিনু অনেকক্ষণ লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। না সে চিনতে পারল না। কেরামত নামে কোন লোকের সে কোনদিন নামও শুনেনি। সে আবার না সূচক মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
চিনবেন না তো। কারণ আপনারা তো থাকেন উপর তলায়। উপর তলা থেকে শুধু আদেশ করেন আর আপনাদের আদেশ তামিল হয়। মানুষের জমিজমা দখল করেন, সেই জমি দখল করতে গিয়ে মানুষের প্রাণ যায় তখন আপনারা বলেন আমি জানি না তো। আপনারা কিচ্ছু জানেন না।
আমি আপনাদের জমি দখল করেছি? আমি আপনাকে মেরেছি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি আমাকে মেরেছেন।
না, না, আমি আপনাকে মারিনি।
এটা মিথ্যা বলার জায়গা না স্যার, এখানে কেউ মিথ্যা কথা বলে না। কারণ এখানে প্রত্যেকের কাজের উপযুক্ত সাক্ষী আছে। আপনি মিথ্যা বললে সেই সাক্ষী প্রমাণ করবে যে আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। একবার মনে করে দেখুন, আপনাদের রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা আছে।
হ্যাঁ আছে। লেখাপড়া শেষ করার পর বাবার ঢাকার ব্যবসা আমি দেখতাম। তার মধ্যে রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও ছিল।
কেরামত হেসে উঠল, একটা বিকৃত, বিভৎস, ভয়ঙ্কর হাসি, সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে বার বার মিনুর কানে আসতে লাগল। কেরামতের হাসি দেখে মিনুর বুক কেঁপে উঠল।
কেরামত বিকৃত হাসি থামিয়ে তিরস্কারের সুরে বলল, আপনাদের পৃথিবীর মানুষগুলো কত ভণ্ড, একজনের জমি দখল করে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে আর নাম দিয়েছেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা।
মিনু প্রতিবাদ করল, সবাই জমি দখল করে না।
কেরামত ধমকের সুরে বলল, এই কথা বলবেন না। সবাই করে না কিন্তু যারা করে তাদের মধ্যে আপনিও একজন।
আমি না, আমি না, বলে মিনু কাঁপতে কাঁপতে বলল।
কেরামত জোরে ধমক দিল, চুপ। মিথ্যা কথা বলবেন না। একবার মনে করে দেখুন গোড়ানে আপনাদের কোম্পানির একটা প্রজেক্ট ছিল।
মিনু মনে করার চেষ্টা করল, মনে পড়েছে। মিনু তখন এম.বি.এ পড়ত। একদিন তার বাবা ফোন করল। সাধারণত চৌধুরী সাহেব ফোন করে রাত সাড়ে দশটার পর কিন্তু সেদিন বিকেলেই ফোন করল। মিনু বাবার ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। ফোন রিসিভ করতেই চৌধুরী সাহেব বলল, মিনু কেমন আছিস বাবা?
চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠে ক্লান্তি। মিনুর কিছুটা সন্দেহ হলো, বাবা অসুস্থা না তো?
মিনু উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, বাবা তোমার শরীর ভালো তো? কোন অসুবিধা নেই তো?
চৌধুরী সাহেব টেনে টেনে কথা বলল, না, কোন অসুবিধা নেই, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় বাবা।
বাবা তোমার কি ঘাড় ব্যথা? প্রেশারটা বেড়েছে? মেপেছ?
এত ভাবছিস কেন? ওই যা বলছিস তাই, প্রেশারটা একটু বেড়েছে, মেপেছি সেরে উঠব ইনশাআল্লাহ।
আমি আসছি বাবা। আমি এখনই রওয়ানা দিচ্ছি।
মিনু সঙ্গে সঙ্গে বিমানের টিকেট করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হলো।
মিনু চট্টগ্রাম পৌঁছে দেখে বাবা সত্যিই অসুস্। ডায়বেটিস, উচ্চ মাত্রার ব্লাড প্রেসার এবং হার্টের অসুখ চৌধুরী পরিবারের বংশানুক্রমে পাওনা। চৌধুরী সাহেবের বাবারও ব্লাড প্রেসার হাই ছিল, অবশেষে হার্টের অসুখে একদিন না ফেরার দেশে চলে গেল। এত টাকা-পয়সা, বিষয়-সম্পত্তি কোনোকিছুই কাজে দিল না এমনকি চিকিৎসা করার সুযোগ পর্যন্ত পেল না। বাবার মৃত্যু চৌধুরী সাহেব নিজের চোখে দেখেছে। আজকাল মানুষ অনেকদিন বাঁচে, মানুষের গড় আয়ু বাহাত্তর বছর অতিক্রম করেছে অনেক আগে অথচ চৌধুরী সাহেবের বাবা মারা গেল পঞ্চান্ন বছর বয়সে। চৌধুরী সাহেবের বয়স এখন পঞ্চান্ন, অর্থাৎ এই বয়সে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে আরও কয়েক বছর আগে। ডাক্তার বলেছে, রক্তে কোলেস্টরেল বেশি যা হার্টের অসুখের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আর ব্লাড প্রেসার হাই, ডায়বেটিস তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম-কানুন খুব কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে, কোন রকম দুশ্চিন্তা করা যাবে না।
ডাক্তার চৌধুরী সাহেবের বন্ধু মানুষ, তার কথা শুনে চৌধুরী সাহেব বলল, ডাক্তার খাওয়ার নিয়ম-কানুন মেনে চলব সেটা ঠিক আছে কিন্তু চিন্তা না করে কি কেউ বাঁচতে পারে? তুই পারবি?
চৌধুরী সাহেবের কথার জবাবে ডাক্তার সাহেব মৃদু হেসে বলল, অসুখটা তো আমার হয়নি চৌধুরী কাজেই সে চিন্তা আমার নেই, তোর অসুখ তোকে সব মেনে চলতে হবে আমাকে নয়, হা হা হা।
চৌধুরী সাহেব সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ মতই চলছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না একদিন সত্যি সত্যি চেয়ারে বসে কাজ করতে করতে সে ঘামতে লাগল, চোখের সামনে লেখাগুলো ঝাপসা দেখতে পেল।
মারুফ দীর্ঘ দিনের কর্মচারী। চৌধুরী সাহেবের দেখভাল সে-ই করে। চৌধুরী সাহেব কখন কোন ফাইল সই করবে সেসব টেবিলে মারুফই সাজিয়ে রাখে, চৌধুরী সাহেব ঘেমে যাচ্ছে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনার কি খারাপ লাগছে? আপনি ঘেমে যাচ্ছেন কেন?
চৌধুরী সাহেব চেয়ারে এলিয়ে পড়ল। মারুফ জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো, সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরী সাহেবকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর জানাল, প্রেশারটা অনেক বেড়েছে, কোন টেনশন নেই তবে দেরি হলে বিপদ হতেও পারতো।
শৈশবে মিনু বাবাকে দেখেছে একরকম, তখন চৌধুরী সাহেব খুব কড়া আর রাগি মানুষ ছিল। তার সামনে কথা বলতে মিনু ভয় পেত, খুব সহজে বাবার সামনে যেত না। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত না। ডলি চলে যাওয়ার পর চৌধুরী সাহেব বদলে গেল। যে বাবা মিনুকে সবসময় শাসন করত, পান থেকে চুন খসলেই ধমক দিত সেই বাবা তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে শুরু করল। আজকের অসুস’তার পর চৌধুরী সাহেবের আবার পরিবর্তন হলো। চৌধুরী সাহেব আগে কখনও মৃত্যু, পরকাল, ভাগ্য নিয়ে কথাবার্তা বলত না। এবার কথায় কথায় বলল, দুনিয়াটা ক’দিনের, এই এলাম, এই চলে যাব।
মিনু ক্লিনিকের কেবিনে ঢুকে ডাক দিল, বাবা।
চৌধুরী সাহেব চোখ মেলে তাকালো, এসেছিস।
জি বাবা। বাবা, তোমার কী হয়েছে বাবা? বলতে বলতে মিনুর কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল।
চৌধুরী সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কিচ্ছু হয়নি। এই একটু প্রেশারটা বেড়েছিল। সবাই ক্লিনিকে নিয়ে এলো, ডাক্তার প্রেশারটা মাপল, ঘুমের ঔষধ দিল। আমি ঘুমালাম, ব্যাস। সুস্। ডাক্তার বলল কয়েকদিন রেস্ট নিতে। ব্যাস খাব আর ঘুমাব। বলে একটু থামলো তারপর আবার বলতে শুরু করল, তারপর ভাবলাম বসে বসেই যখন থাকবো, খাব আর ঘুমাব তাহলে তুই এলে মন্দ হয় না। বাপ-বেটা একসঙ্গে খাব আর ঘুমাব, বলে চৌধুরী সাহেব উদাস হয়ে গেল, তার চোখের কোনা পানিতে ভরে গেল, রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আসলে পৃথিবীতে তো তুই ছাড়া আমার কেউ নেই।
বাবার কণ্ঠে এরকম আবেগজড়িত কথা মিনু কোনদিন শোনেনি। আজ হঠাৎ এরকম কথা শুনে মিনুও কিছুটা ভেঙ্গে পড়ল। তার দুচোখ পানিতে ভরে গেল। সে বাবার আরও কাছে গিয়ে বসল, আমি আছি বাবা, দেখলে তো ফোন করেছ আর আমি সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হলাম। আমারও তো তুমি ছাড়া কেউ নেই বাবা।
অনেক দিন পর এলে, কয়েকদিন থাক বাবা। তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। তোকে এখন থেকে সবকিছু ধীরে ধীরে বুঝে নিতে হবে, আমি কখন আছি, কখন নেই।
বাবা, বাবা তুমি এভাবে বলছ কেন?
এমনি বলছি না বাবা। আমার বয়স হয়েছে, তার ওপর এমন কোন অসুখ নেই যা আমার নেই। সব বডলকী অসুখ। হবেই তো আমি তো ধনী মানুষের মত সবসময় আমিষ জাতীয় খাবার খাব, শরীর থেকে ঘাম ঝরাব না, ঘরে বসে এ.সি’র হিমেল বাতাস খাব, আয়েশি জীবন-যাপন করব, ধনী লোকের সব সুবিধা নিব আর অসুখগুলো নিব না তা তো হয় না বাবা, বলে চৌধুরী সাহেব একটা কষ্টের হাসি হাসল।
বাবা, অসুখ আছে , চিকিৎসাও আছে, তাছাড়া তুমি তো সবসময় নিয়ম-কানুন মেনেই চল, দেখ তোমার কিচ্ছু হবে না।
তারপরও সবকিছু বুঝে নিতে সমস্যা কী। কয়েকদিন এখানে থাকলে আমি সবকিছু তোকে বুঝিয়ে দিব, আপাতত তুই ঢাকার অফিসে বসবি, তারপর ধীরে ধীরে পুরো ব্যবসা দেখাশুনা করবি। তোর মত বয়সে আমি সিম্পল বি.এ পাস একটা মানুষ ব্যবসার হাল ধরেছিলাম আর তুই তো এম.বি.এ করছিস, শরীরে ব্যবসায়ী পরিবারের রক্ত। তুই অবশ্যই পারবি।
তুমি দোয়া করলে অবশ্যই পারব বাবা।
দুদিন মিনু বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামে থাকলো। ডলি চলে যাওয়ার পর মিনুর বাবা আবার বিয়ে করেছে। দরিদ্র পরিবারের শান্ত শিষ্ট এক মহিলাকে। মিনুর সঙ্গে আগে তার কোনোদিন দেখা হয়নি। সৎ মা বলতে সমাজে ঈর্ষপরায়ণ, আত্মকেদিন্দ্রক, নিষ্ঠুর মায়ের যে গল্প শোনা যায় মিনুর সৎ মা সেরকম হয়। একেবারে ব্যতিক্রম, মিনুকে খুব সুন্দরভাবে নিজের সন্তানের মতো আপ্যায়ন করল।
ষোলো
ঢাকায় তখন তাদের কোম্পানির রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, কন্সট্রাকশন ফার্ম আর একটা ফার্নিচারের শো রুম। ঢাকার অফিসে আগে একজন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার বসত। জরুরি প্রয়োজনে চৌধুরী সাহেব নিজে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসত। দেখভালের অভাবে চৌধুরী সাহেব আর ঢাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করেনি বরং মিনুর লেখাপড়া শেষ এবং মিনুর ব্যবসায় হাল ধরার অপেক্ষায় ছিল। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে মিনু ঢাকার অফিসে বসতে শুরু করল।
একটা মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়, একটা বড় ফ্লোর জুড়ে স্টার গ্রুপ অব কোম্পানির কর্পোরেট অফিস। স্টার রিয়েল এস্টেট, স্টার কন্সট্রাকশন, স্টার ফার্নিশার্স এর জন্য আলাদা আলাদা এ.জি.এম বা অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার আছে। তারা আলাদা আলাদা চেম্বারে বসে, একটা চেম্বারে বসত ডি.জি.এম বা ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। ডি.জি.এমের চেম্বারের পাশের চেম্বারে বসে চৌধুরী সাহেব। তারই নির্দেশে মিনুর জন্য তার চেম্বারটি ঠিক করা হয়েছে।
মিনু যেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছে। দেশে হাজার হাজার বেকার তরুণ চাকরির জন্য রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে জুতোর তলা ক্ষয় করে ফেলছে আর মিনু লেখাপড়া শেষ করার আগেই একটা গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। প্রথম প্রথম একজন এম.বি.এ পড়-য়া ছাত্রের কাছে এসব পদ পদবী যেমন : ডি.জি.এম, এ.জি.এম, প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার, সাইট ইঞ্জিনিয়ার, সুপারভাইজার এসব বুঝতে বেশ কষ্ট হলো কিন্তু মিনুর চেষ্টার কমতি নেই। তাকে ব্যবসায়ীই হতে হবে, একজন সফল ব্যবসায়ী।
একেকটা ব্যবসার ধরণ একেক রকম। একেকটা ব্যবসার জন্য একেক রকম মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। ফার্নিশার্সের জন্য একজন এ.জি.এম কে কাজ করতে হয়, কাঠের ব্যাপারী, কাঠ মিস্ত্রিদের সঙ্গে, কন্সট্রাকশন ফার্মের জন্য একজন এ.জি.এমকে কাজ করতে হয় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে, বড় বড় প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের সাথে, কাজ পেতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের দ্বারস্ হতে হয় তদবিরের জন্য। চৌধুরী সাহেব রাজনীতিতে সক্রিয় না, তবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার সখ্য আছে। পার্টিতে বড় বড় ডোনেশন দিয়ে তাদের দিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম তদবিরের দিকটা চৌধুরী সাহেব নিজেই তদারকি করত। অন্যান্য দিকগুলোতে ধীরে ধীরে মিনু সক্রিয় হলো।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সমস্যাগুলো অন্য রকমের। জমি কিনতে গিয়ে দেখা যায় কাগজপত্রের ত্রুটি, জমি কেনার পর জমিতে অংশীদার আসে, জমির ভাগ দাবি করে। কাজগজপত্র খুঁজে দেখা যায় তাদের দাবিই সঠিক। তাদের জমি বিক্রি করতে বললে অস্বীকার করে, জোরপূর্বক দখল নিতে চায়, আবার দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত জমির মধ্যে ছোট্ট এক টুকর জমির মালিক জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না কিন্তু প্লট সম্পন্ন করতে চাইলে সেই জমিটুকুও প্রয়োজন। তখনই প্রয়োজন হয় গায়ের জোরের, আর সেজন্য কোম্পানির আছে কিছু লালিত বাহিনী, যারা এসব কাজ করে।
এসব সমস্যার সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত এ.জি.এম, ডি.জি.এম হয়ে আসে মিনুর কাছে। সমাধানের পথ বের করতে হয় মিনুকেই। মিনু যখন ব্যবসায় যোগ দিল তখন গোড়ানে আবাসন প্রজেক্ট সম্প্রসারণের কাজ চলছে। তাদের প্রজেক্টের উত্তর দিকে তখন দিগন্ত বিস্তৃত নিচু জমি, মাঝে মাঝে ভিটে উঁচু করে দু’য়েকটা নিম্নবিত্ত মানুষের বাড়ি আছে। আসলে জমিগুলো সেই নিম্নবিত্ত মানুষগুলোরই। তারা মাটি আঁকড়ে নিজ ভূমিতে ছিল। প্রথম প্রথম মিনু শুনত তাদের গোড়ান প্রজেক্টের এক্সটেনশনে সমস্যা হচ্ছে। সে বুঝত না, মনে করত স্টাফরা সমাধান করে ফেলবে কিন্তু সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করল। বনানীর অফিসে বসে মিনু অনেকবার কাগজে কলমে দেখেছে প্রজেক্টের অবস্থা কিন্তু কোনদিন সরেজমিনে দেখা হয়নি। একদিন বিকেলে মিনু গেল প্রজেক্টের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে, সত্যি, সত্যি অনেক ফাঁকা জমি। মিনুরও একরকম লোভ হলো। এই দিগন্ত বিস্তৃত জমি প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে তো মন্দ হয় না। মিনু দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে ডি.জি.এম, এ.জি.এম এবং প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারকে বলল, এ্যানি হাউ ঐ জমিগুলোও কেনার ব্যবস্থা করুন।
রাজা-বাদশাদের আমলে যেমন রাজার ইচ্ছা পূরণের জন্য নির্দেশ পাওয়ামাত্র উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদারা মাঠে নেমে পড়ত তেমনি প্রজেক্টের কর্মকর্তারাও মাঠে নেমে পড়ল। কিন্তু কাজটা সহজ হলো না। কোন কোন জমির মালিক জমি বিক্রি করতে রাজি হলো না। ফলে পুরো জমি কেনা কঠিন হয়ে পড়ল তবে বিচ্ছিন্নভাবে ছিটমহলের মত কিছু জমির মালিক বিক্রি করতে রাজি হলো।
আবাসন প্রকল্পের কেনা জমিতে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হলো। বাধা হলো জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়া মালিকদের জমিগুলো। তাদের ওপর শুরু হলো প্রথমে মানসিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সবশেষে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির পালিত বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া। বিভিন্ন রকমের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিরীহ জমির মালিকরা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হলো কিন্তু কয়েকজন মালিক ছিল একরখা। নিজেদের জমি রক্ষায় তারা ছিল মরিয়া। তারা সংঘবদ্ধ হলো, কোম্পানির অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন শুরু করল।
আন্দোলনরত মানুষ আর কোম্পানির বাহিনীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হলো, মারামারি হলো। মারামারিতে একজন লোক মারা গেল। ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেল প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়াও। পত্রিকা মাধ্যমে মিনু জানতে পারল সেই নিহত ব্যক্তির নাম কেরামত।
মিনু মুখ তুলে তাকালো, আপনি সেই কেরামত?
বলুন তো কোন কেরামত?
আমাদের আবাসন প্রকল্পে যে মারা গিয়েছিল সেই কেরামত।
এতক্ষণে চিনতে পেরেছেন।
মিনু শুষ্ক মুখে বলল, কিন্তু আমি তো আপনাকে মারিনি ভাই।
কেরামত কিছুটা রাগের সুরে বলল, আবার মিথ্যা কথা, তারপর মিনুর চোখের সামনে ভেসে উঠল ঠিক সেই ছবিটি ডি.জি.এম আর প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মিনুর দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে দূর দিগন্তে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে, এ্যানি হাউ ঐ জমিগুলোও আমার চাই।
মিনু আর অস্বীকার করতে পারল না। সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল, কেরামত ভাই আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ! আমি ভুল করেছি।
আমিও এমন কান্নাকাটি করছিলাম স্যার। আমিও আপনার লোকজনদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার লোকজন তো আমাকে মাফ করেনি স্যার।
কিন্তু আমি তো মারিনি। আমি কাউকে মেরে জমি দখল করতেও বলিনি।
নিজেই তো শুনলেন সেকথা। এখানে কারও মিথ্যা কথা বলার সুযোগ নেই। সবার সব কাজের ভিডিও করা আছে, এমনকি কেউ মনে মনে খারাপ কাজের কথা চিন্তা করলেও তা রেকর্ড করা আছে, যে অস্বীকার করবে তাকেই তার অপকর্মের ভিডিও দেখান হবে। আর তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুবিধাভোগী তো বটেই, এমনকি যে পরোক্ষভাবে জড়িত, যে অপকর্মের সহযোগী তাদের প্রত্যেকের দায় ঠিক করে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
মিনু মিনমিন করে বলল, কিন্তু আমি তো জানতাম যার হোক নষ্ট করা হয়েছে সে যদি ক্ষমা করে দেয় তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবে।
আপনি কি মনে করেছেন আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিব? আমার সঙ্গে যারা এসেছে তাদের সবার জমি আপনি দখল করেছেন। সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে তারা রাস্তায় দিন কাটিয়েছে। তাদের সন্তানরা লেখাপড়া করতে পারেনি, তাদের অনেকেই এখন ভিক্ষা করে খাচ্ছে, কারও কারও সন্তান নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবন নষ্ট করেছে। আপনার কি ধারণা তারা আপনাকে ক্ষমা করবে?
মিনু হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনারা আমার সব নিয়ে নিন, আমার যত জমিজমা আছে, আমার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে, আমার গার্মেন্টস আছে, সব, সব নিয়ে নিন।
কেরামত এবার একটা তিরস্কারের হাসি হাসল, সবাই তার হাসিতে যোগ দিল। সেই হাসি বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে মিনুর কানে বেজে উঠল, কোথায় আছে আপনার ধন-সম্পদ?
মিনু একবার ডানে একবার বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলো, সে একটা সাদা কাপড় পরে মাটিতে শুয়ে আছে। মাটিটাও অন্যরকম। পৃথিবীর মাটির সঙ্গে এ মাটির যেন কোন মিল নেই। সে কেঁদে উঠল, আমার সব টাকা-পয়সা গেল কোথায়?
কেরামত বলল, এখানে সবাই খালি হাতে আসে স্যার। এখানে টাকা-পয়সা কোন কাজে লাগে না। এখানে কাজে লাগে ভালো কাজ, পৃথিবীর প্রত্যেকটা ভালো কাজ এখানে আপনার কাজে লাগবে এবং সেই ভালো কাজ যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আপনার মঙ্গল কামনা করবে, এখানে কাজে লাগবে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর যত মন্দ কাজ সব আপনার শাস্তির পাল্লা ভারী করবে। এখানে আপনার দেয়ার মত কিচ্ছু নেই। আপনার সব ওপারে আটকা পড়েছে, আপনি আমাদের দিবেন কী বলুন?
মিনু তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।
কেউ আপনাকে ক্ষমা করবে না।
তো?
আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। যদি আপনি কিছু না দিতে পারেন তবে আমাদের পাপের শাস্তিও আপনাকে পেতে হবে।
আপনাদের পাপের শাস্তি বলে মিনু একটা শুষ্ক হাসি হেসে আবার বলল, আপনাদের পাপের শাস্তি, আমারই যত পাপ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার পাপের তো বটেই আমাদের পাপেরও শাস্তি আপনাকে ভোগ করতে হবে।
এমন সময় মিনুর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা অগ্নিকুণ্ড, বিশাল কালচে অগ্নিকুণ্ড এবং তার লেলিহান শিখা। কিন্তু আগুনের শিখাটা কালো কেন? এই অগ্নিশিখা কি কোটি কোটি বছর পুড়ে কালো হয়েছে। পরক্ষণেই দেখা গেল একটা অগ্নিদগ্ধ গলিত, বিকৃত মানুষের শরীর আর করুণ কান্না। সে কান্নার ভাষা বোঝা যাচ্ছে না। মিনু বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু বুঝতে পারল না, অনুমান করল অগ্নিদগ্ধ মানুষটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে।
কেরামত কর্কশ স্বরে বলল, এই লোকটিকে চিনেছেন স্যার?
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, না।
এটা আপনার বাবা।
আমার বাবা, না, না এটা আমার বাবার কণ্ঠস্বর না। আমার বাবার কণ্ঠস্বর আমি চিনব না?
না, চিনবেন না। এখানে সবার কণ্ঠস্বর বিকৃত। তাছাড়া বছরের পর বছর শাস্তি ভোগ করতে করতে কারও কণ্ঠস্বর ঠিক থাকে না।
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, না, না এটা আমার বাবা না।
এবার সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আমি তোর বাবা মিনু, আমি তোর বাবা। আমি তোর বাবা মতলুব চৌধুরী।
মিনু কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, বাবা, বাবা তোমার এ অবস্থা।
প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে বাবা। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তুই পৃথিবীতে ভালোভাবে চলবি। কোন পাপ করবি না, কারও প্রতি অন্যায় করবি না। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করবি না। কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করবি না। এখানে প্রতিটি কাজের জন্য মানুষকে শাস্তি পেতে হয় তাই পৃথিবীতে এমন কোন কাজ করিস না যাতে তোকেও শাস্তি ভোগ করতে হয়।
বাবা, বাবা আমি কি এখনও পৃথিবীতে? আমার কি এখনও ভালো হয়ে চলার সুযোগ আছে?
না। মিনু আর তার বাবার কথা শুনতে পেল না। সেই অগ্নিকুণ্ডটা দূরে সরে গেল।
মিনু শিশুর মত বাবা বাবা বলে কাঁদতে লাগল।
সতেরো
মুক্তা প্রতিদিন সকালবেলা কলেজ যায় আর বিকেলে ফিরে আসে এর মাঝখানে শহরে কোন কাজ থাকলে বলে যায় আর বলে যেতে না পারলে পরে ফোনে জানিয়ে দেয়। মুক্তা আড্ডাবাজ মেয়ে না, নিরীহ, শান্ত, ভদ্র প্রকৃতির মেয়ে। কলেজে তার দু’য়েকজন বান্ধবী ছাড়া তেমন কারও সঙ্গে সে উঠবসও করে না। আগে ফোন ব্যবহার করত না, কয়েকমাস আগে বাবার কাছে বায়না ধরে একটা স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনেছে আর ফোন কেনার পর থেকে সে অনেকটা বদলে গেছে।
আগে সকালবেলা উঠে পড়তে বসত, মায়ের রান্নার কাজে সহযোগিতা করত, বিকেলবেলা পুকুরপাড়ে গাছগাছালিতে পানি দিত। বিকেলে পাশের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দিত কিন্তু মোবাইল ফোন কেনার পর সব চলে গেল। সকালবেলা উঠেই মোবাইল ফোনের চ্যাটিংয়ের শব্দ।
মুক্তার বাবা মাজেদুর স্বল্প শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কৃষক, মা আকলিমা গৃহিণী। এক ভাই এক বোনের মধ্যে মুক্তা বড়। মুক্তার বাবা-মা কম শিক্ষিত হলেও মেয়েকে নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখ তো। মাজেদুর প্রায়ই মুক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, মা রে তোকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তুই একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসার হবি।
মুক্তা বাবার সঙ্গে ইয়ার্কি করে বলত, কত বড় বাবা, তালগাছের মত?
তালগাছের মতই হতে হবে মা, অনেক বড় হতে হবে যেন কেউ তোকে ছুঁতে না পারে। টিভি’তে দেখিস না তোর মত মেয়েরা কেমন ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে, জজ-ব্যারিস্টার হচ্ছে।
আমি ম্যাজিস্ট্রেট হব, জজ-ব্যারিস্টার হব?
হ্যাঁ মা। পারবি না?
পারব বাবা, তুমি দোয়া করলে আমি অবশ্যই অনেক বড় হতে পারব, তোমার মনের আশা পূরণ করতে পারব।
মুক্তার মা আকলিমা গল্পে যোগ দেয়, আর আমার দোয়া বুঝি লাগবে না।
এ তুমি কী বলছ মা। মায়ের দোয়া ছাড়া কি কেউ বড় হতে পারে?
আকলিমা মুক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, অবশ্যই দোয়া করব মা। আল্লাহ যেন তোর বাবার মনের আশা পূরণ করে মা।
মুক্তা কলেজ থেকে ফেরার সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু সে ফিরে এলো না। আকলিমা মাজেদুরকে ফোন করল, হ্যালো।
হ্যাঁ বল।
মুক্তা তো এখনও কলেজ থেকে ফিরল না।
মাজেদুর চমকে উঠল, এখনও ফিরল না মানে? তারপর বলল, প্রতিদিন তো এতক্ষণ চলে আসে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি ফোন করেছিলে?
করেছিলাম, ফোন বন্ধ।
আচ্ছা আমি দেখছি, বলে মাজেদুর মুক্তার মোবাইল ফোনে ফোন করল।
মুক্তার ফোন বন্ধ, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।
মাজেদুর পর পর কয়েকবার ফোন করল কিন্তু মুক্তার মোবাইল ফোনের একই রিপ্লাই, দুঃখিত…
মাজেদুর বাজার থেকে দ্রুত বাসায় ফিরল। আকলিমার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেছে, সে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথায় অনেক চিন্তা। এরকম বয়সের একটা মেয়ে কলেজ থেকে ফেরার সময় পেরিয়ে গেলেও না ফিরলে বাবা-মা’র চিন্তার অন্ত থাকে না, মেয়েটি কোথায় গেল? কোন ছেলের সঙ্গে কি তার কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল? নাকি কেউ তাকে জোর করে…না, না আকলিমার আর ভাবতে পারছে না।
মাজেদুর ঘরের ভিতরে ঢুকতেই আকিলমা বিছানায় উঠে বসল। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাজেদুরকে জিজ্ঞেস করল, কোন খবর পেলে?
মাজেদুর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, না, আমি আর কোথায় খুঁজব। আমি তোমার কাছ থেকে শুনে ওর মোবাইল ফোনে কয়েকবার ফোন করলাম কিন্তু ওর মোবাইল ফোন বন্ধ। তোমার কাছে ওর কোন ফ্রেন্ডের মোবাইল নাম্বার আছে? বা ওর সঙ্গে কলেজে একসঙ্গে যাওয়া-আসা করে এমন কারও?
কারও মোবাইল নাম্বার নেই তবে বিঞ্চুপুরের একটা মেয়েসহ যাতায়াত করত।
মাজেদুর উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, কী নাম মেয়েটার? কার মেয়ে?
মেয়েটার নাম সুমি, বাবার নামত জানি না।
আচ্ছা, ঠিক আছে, মোড়ে গেলে এখন জানা যাবে কার মেয়ে। আমি এখনই যাই দেখি সুমি ওর কোন খবর দিতে পারে কী না?
সুমির বাসায় যেতে যেতে মাজেদুর আরও কয়েকবার মুক্তার মোবাইল ফোনে রিং করল কিন্তু মোবাইল বন্ধ। বিঞ্চুপুর ঢুকতেই একটা মোড়, মোড়ে কয়েকটা দোকান আছে, একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই মাজেদুর সুমি বাবার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা পেয়ে গেল।
সুমির বাবা মাজেদুরের পূর্ব পরিচিত এবং বন্ধু মানুষ কিন্তু সুমি যে তারই মেয়ে এটা জানা ছিল না। মাজেদুরকে দেখে সুমির বাবা প্রথমত খুব খুশি হলো, তুই এতদিন পর? কী মনে করে দোস্ত?
এলাম একটু কাজে।
হ্যাঁ বুঝেছি তো কাজে এসেছিস, কাজ ছাড়া তো তুই আসিসনি। আগে বস, অনেকদিন পর এসেছিস, বলে মাজেদুরকে বারান্দায় চেয়ারে বসেত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তো কী কাজ?
সুমি তো তোর মেয়ে না? মাজেদুর জিজ্ঞেস করল।
সুমির বাবা থতমত খেল, হ্যাঁ, কোন সমস্যা?
সুমি তখন তার পড়ার ঘরে ছিল। তার বাবা জোরে ডাক দিল, মা সুমি, একটু বাইরে আয়ত।
আসছি বাবা, বলে সুমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছ মা?
ভালো আঙ্কেল। আপনি?
সুমির বাবা জিজ্ঞেস করল, তুই চিনিস তোর আঙ্কেলকে?
জি বাবা। আমার বান্ধবী মুক্তার বাবা।
মাজেদুর শুষ্ক মুখে বলল, আমরা ভালো নেই মা। তোমার কাছে একটা কাজে এলাম।
কী কাজ আঙ্কেল?
মাজেদুর জিজ্ঞেস করল, তুমি আর মুক্তা তো কলেজে একসঙ্গে যাতায়াত কর।
জি আঙ্কেল, প্রায়ই একসঙ্গে যাই।
আজকেও একসঙ্গে গেছিলে মা?
জি আঙ্কেল।
আসার সময় কি একসঙ্গে এসেছিলে?
না আঙ্কেল। আসার সময় আসলে কোন কোনদিন সময় মিলে না। কোনদিন ওর আগে ক্লাস শেষ হলে ও চলে আসে আবার আমার আগে শেষ হলে আমি চলে আসি।
আজ?
আজ আমার ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমি ওকে ফোন দিলাম কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। আমি ভাবলাম ওর ফোনের বুঝি চার্জ শেষ হয়ে গেছে তাই ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর আমি চলে এসেছি। ও বাসায় আসেনি আঙ্কেল?
না, মা। সেজন্য আমি তোমার কাছে এলাম।
আমি তো কিছু জানি না আঙ্কেল।
তোমার কাছে মুক্তার কোন বন্ধু বা বান্ধবীর মোবাইল নাম্বার আছে নাকি মা?
না আঙ্কেল, আসলে আমরা একসাথে পড়লেও আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা আলাদা।
আচ্ছা মা, তুমি একটু ওর কাছের বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর নিও তো যদি পাও তবে আমাকে জানাইও বলে মাজেদুর উঠছিল সুমির বাবা বলল, বস, চা খেয়ে যাবি।
না দোস্ত, মনটা ভালো নেই।
বাসায় ফিরে মাজেদুর ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। আকলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাজেদুরের পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, কিছু জানতে পারলে?
মাজেদুর না সূচক মাথা নেড়ে জানাল সে কিছু জানতে পারেনি তারপর বলল, এক গ্লাস পানি দাও।
আকলিমা পানি এনে দিল। মাজেদুর এক ঢোকে পানি পান করে বলল, সুমি তো কিছু বলতে পারছে না। প্রতিদিন একসঙ্গে যায় কিন্তু আসার সময় প্রতিদিন একসঙ্গে হয় না। কেউ আগে আসে কেউ পরে আসে কথাগুলো মাজেদ ইনিয়ে বিনিয়ে কিছুটা কান্নার সুরে বলল।
আকলিমা সান্ত্বনার সুরে বলল, তুমি ভেঙ্গে পড় না। আচ্ছা একটা কাজ কর।
কয়েক ঘণ্টার দুশ্চিন্তায় মাজেদের মুখ শুকিয়ে গেছে। সে শুষ্ক মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী কাজ?
বড় আপাকে ফোন কর, কোন ওদের বাসায় গেছে নাকি?
মাজেদুরের বড় বোন মাকসুদা, ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার হলেও সম্প্রতি বাবার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। দোষটা অবশ্য মাজেদুরেরই, না, শুধু মাজেদুরের না, এই দোষটা পুরো সমাজব্যবস্থারই। এক ভাই এক বোনের মধ্যে মাকসুদা সবার বড়, মাজেদুরের বাবার আর্থিক অবস্থা বেশি ভালো ছিল না। হাটে একটা ছোট্ট মুদির দোকান আর বিঘা দুই জমির আবাদ দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালিয়ে অনেক কষ্ট করে সন্তানদের লালনপালন করেছেন। অভাব অনটনের কারণে সন্তানদের তেমন লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। তাই মাকসুদাকে বিয়ে দিয়েছেন ছাপোষা সংসারে। বিয়ে নয়, যেন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা দায় সেরেছেন মাত্র।
মাকসুদা বড়, মাজেদ ছোট। মাকসুদার বিয়ের পর সংসার খরচ কিছুটা কমে গেল এবং দোকানের আয় উন্নতিও বাড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে মাজেদও সংসার দেখাশুনা এবং দোকানদারিতে মনোযোগী হলো। ব্যবসার প্রসার ঘটল, একসময়ের টানাটানির সংসার থেকে তাদের সংসারে সচ্ছলতা এলো। বাড়ি পাকা হলো, গ্রামে কয়েক বিঘা জমিও কেনা হলো।
কথায় বলে সুখ বেশিদিন টিকে না। মাজেদুরের বাবা সারাজীবন কষ্ট করেছেন আর যেই তিনি কয়েকবিঘা জমি কিনেছেন, দুটো টাকা-পয়সার মুখ দেখেছেন আর রক্ষা নেই। মৃত্যুদূত এসে নিয়ে গেল। কোন অসুখ-বিসুখ নেই একদিন গভীর রাতে বুকের ব্যথা শুরু হলো, প্রচণ্ড ব্যথা! সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো, এ্যাম্বুলেন্সে করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তার জীবনাবসান হলো। সুখের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
মাজেদুরের মা-বাবার মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠা তার জন্য খুব কঠিনই হলো। মৃত্যু সংবাদ শুনে সেই যে সে বোবা হয়ে বসে আছে আর কোন নড়াচড়া নেই। হতবিহব্বল দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কয়েকদিন বিনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে কেঁদে কাটাল তারপর সেও একদিন পরপারে পাড়ি জমাল।
বাবা-মা’র মৃত্যুর কিছুদিন পর মাকসুদা এলো বাবার সম্পত্তির ভাগের জন্য। বোনেরা ভালো যতক্ষণ না তারা পৈত্রিক সম্পত্তির দাবি না করে। ভাইয়েরা মনে করে বাবার সম্পত্তি শুধু তাদেরই পাওনা কিন্তু তাদেরও মনে করা উচিত যে পুত্র-কন্যা দুজনেই বাবার সন্তান কাজেই বাবার সম্পত্তিতে উভয়েরই অধিকার আছে।
মাজেদ যুক্তি দেখালো, বাবার তো আগে থেকে মাত্র বিঘা দুই জমি ছিল সব তো কেনা হয়েছে আমি যখন বাবার সাথে রোজগার করতে শিখেছি তখন। এগুলো আমার পরিশ্রমের জমি, তুমি বড় বোন হয়ে আমার পরিশ্রমের টাকার ভাগ নিবে?
সালিশে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিল, কেউ কেউ মাজেদুরের পক্ষ নিল আবার কেউ কেউ বলল, কার পরিশ্রমের টাকায় কেনা হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। কথা হলো বাবার নামে যে সম্পত্তি আছে তার ভাগ ভাইবোন উভয়ই পাবে।
সম্পত্তি ভাগাভাগির নিষ্পত্তি হলো না। যাওয়ার সময় মাকসুদা বলে গেল, আর কোনদিন ভাইয়ের বাড়িতে আসবে না, ভাইয়ের মুখ দেখবে না।
সেই থেকে ভাইবোনে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথা বলা বন্ধ। তা প্রায় ছয় মাস আগের কথা। ভাইবোনে কথা না বললেও মুক্তা তার ফুপুর সঙ্গে কথা বলে একথা মাজেদুর জানে, ম্ক্তুা মাঝে মাঝে এসে তার ফুপুর বাড়ির গল্প করে। তার ফুপাত ভাইবোনদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো।
আজ মুক্তা বাসায় না ফেরায় আকলিমা যখন তার বড় আপাকে ফোন করতে বলল তখন মাজেদুরের বুকটা কেমন করে উঠল, নিজের বোন অথচ যোগাযোগ না থাকলে তাকে ফোন করতেও সংকোচ হয়। মাজেদ আকলিমাকে জিজ্ঞেস করল, করব?
হ্যাঁ। নিজের বোন তাছাড়া মুক্তা ওর ফুপুর বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে যেত। বড় আপা জানতেও তো পারে।
মাজেদ মাকসুদাকে ফোন করল, হ্যালো, আপা আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কেমন আছ আপা?
মাজেদের কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে আসছিল। তার মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। কণ্ঠস্বর শুনেই মাকসুদা হয়ত কোন একটা দুঃসংবাদ অনুমান করতে পেরেছিল। তাই বলল, আমি তো ভালো আছি তোর কী হয়েছে ভাই? তোর গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে? অপর পাশ থেকে মাকসুদার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
মাজেদ মৃদু কণ্ঠে বলতে শুরু করল, মাকসুদা মনোযোগ দিয়ে মাজেদের কথা শুনে আবেগজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আগে থেকে খেয়াল করিসনি?
মাজেদ কিছুটা লজ্জা পেল, আপা তুমি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছ?
তা নয়ত কী, ওর বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে ভালো করে খবর নে, কেউ না কেউ অবশ্যই জানে।
আপা ওর তেমন বন্ধু-বান্ধবী নেই।
যে দু’চারজন পরিচিত আছে ওদের মধ্যে খুঁজে দেখ, ঢাক-ঢোল যেন পিটাস না, মেয়েমানুষ বলে কথা। আমিও তলে তলে খোঁজখবর নিচ্ছি।
জি আপা বলে মাজেদ ফোন রাখল।
মাজেদ যখন ফোনে মাকসুদার সঙ্গে কথা বলছিল আকলিমা তখন মাজেদের কানের কাছে ধরে রাখা মোবাইল ফোনের কাছে কান রেখে দু’জনের কথা শুনছিল। মাজেদ ফোন রাখতেই আকলিমা বলল, আপা এগুলো কী কথা বলছে?
হতে তো পারে আকলিমা।
মায়েদের মন কখনও সন্তানের দোষ দেখে না। সন্তান মায়ের কাছে সবসময় নির্দোষ, ধোয়া তুলসীপাতা। আকলিমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে জোর দিয়ে বলল, আমার মেয়ে এমন কাজ করতেই পারে না। আমার মনে হয় ও কোন বান্ধবীর বাড়িতে গেছে, তারপর ফোনে চার্জ নেই বন্ধ হয়ে গেছে।
তাই যেন হয়, বলে মাজেদ চোখ মুছল।
মাজেদ মুক্তার মামার বাড়িতে ফোন করল কিন্তু সেখানেও যায়নি। একে একে সব আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ফোন করল কিন্তু মুক্তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু কেউ যদি স্বেচ্ছায় চলে যায় তবে তাকে খুঁজে পাওয়ার সাধ্য কার।
দু’জনের চোখে ঘুম নেই। প্রথম সন্তান ছেলে হোক মেয়ে হোক একটু বেশি আদরেরই হয়। প্রথম সন্তানকে নিয়ে মানুষ স্বপ্নও দেখে বেশি কিন্তু সেই সন্তানের জীবনে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন বাবা-মা’র স্বপ্নগুলোও যেন দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
রাত অনেক গভীর হলো, আকলিমার মাথায় অনেক দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আকলিমা ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না, একটু ঘুমের ভাব আসছে আর মুক্তার মুখচ্ছবিটা ভেসে উঠছে। মুক্তা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে যে চিৎকার করে কান্না করল সেই কণ্ঠস্বরটা যেন আজ প্রায় একুশ বছর পর আবার কানের কাছে ভেসে এলো, চোখের সামনে সেই নিষ্পাপ, সেই নবাগত শিশুটির ছবি ভেসে উঠল। সেদিনই প্রথম আকলিমার মনে হয়েছিল তার পৃথিবীতে আসা সার্থক হয়েছে, তার নারীজীবন পরিপূর্ণ হয়েছে।
সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুটিকে মাতৃত্ব দিয়ে, স্নেহ, আদর-ভালোবাসা দিয়ে আকলিমা বড় করেছে। একটা মেয়েকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে রাখা কি কম কষ্টের, একটা মেয়েকে একুশ বছর লালনপালন করা কি কম ধৈর্যেযর। এত কষ্ট, এত ধৈর্যয ধরে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে লালনপালন করা একটা মেয়ে কীভাবে মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে? এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে আকলিমা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার চোখের সামনে, দূর দিগন্তে একটা অস্পষ্ট মানুষের ছবি ভেসে উঠল। সময়টা ঠিক গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, দাঁড়ান মানুষটিকে চেনা যাচ্ছে না কিন্তু একটা মানুষ হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর একটা মেয়ে সেদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। মেয়েটির দৌড়টা মুক্তার দৌড়ানর মতই, মুক্তা, হ্যাঁ মুক্তাই তো।
আকলিমা ডাক দিল, মুক্তা, মা মুক্তা, যাস না মা।
কিন্তু মুক্তা কথা শুনছে না, সে আরও দ্রুতবেগে দৌড়ে সেই লোকটির দিকে যাচ্ছে কিন্তু লোকটি আরও দুরে সরে যাচ্ছে। মুক্তা, মুক্তা তুই কার সঙ্গে যাচ্ছিস মা, তুই ভুল করছিস, তুই আমাদের ছেড়ে যার সঙ্গে যাচ্ছিস সে তো তোকে ছেড়ে চলে যাবে মা। যাসনা মা, ফিরে আয়, মুক্তা, মুক্তা।
না, মুক্তা আকলিমার কোন কথা শুনছে না সে আরও জোরে দৌড়ে সেই লোকটি দিকে যাচ্ছে। আকলিমা উপায়ন্তর না দেখে পাশে শুয়ে থাকা মাজেদকে বলল, এই মুক্তার বাবা, এই তুমি ওঠো, দেখ মুক্তা চলে যাচ্ছে ওকে আটক কর, এই।
মাজেদ বিছানায় উঠে বসে হাঁপাতে লাগল, আকলিমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মুক্তার মা?
আকলিমাও বিছানায় উঠে বসল, সেও হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বলত?
তুমি তো আমাকে ডাকলে আর মুক্তাকে আটকাতে বললে।
আমি দেখলাম একটা লোক মুক্তাকে ডাকছে আর মুক্তা সেই লোকের ডাকে চলে যাচ্ছে। আমি এত করে ডাকছি কিন্তু মুক্তা আমার কোন কথা শুনল না। তাই আমি ঘুমের মাঝে তোমাকে ডেকেছি বুঝি।
হ্যাঁ। তাই হবে বুঝি। এখন ঘুমাও।
আঠারো
আরও একদিন কেটে গেল আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খুঁজতে খুঁজতে কিন্তু মুক্তাকে পাওয়া গেল না। ততক্ষণে পাড়া-পড়শীদের মাঝেও একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকসমাজে জানাজানি হলে দুর্নাম হবে বলে এতদিন মাজেদ পুলিশের কাছে যায়নি কিন্তু এখন আর এলাকার বা আত্মীয়-স্বজনদের কারও অজানা নেই। তবুও থানা-পুলিশের বিষয়টি মাজেদ গোপনই রাখতে চায়।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সাধারণত থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি এড়িয়ে চলে। মাজেদও জীবনে কোনদিন থানায় যায় নি, তাই থানার নাম শুনলে তার বুক কেঁপে ওঠে অথচ এখন হারানো মেয়েকে উদ্ধারের জন্য তাকে যেতে হবে থানায়, পুলিশের কাছে।
মাজেদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আকলিমা বলল, এমন করছ কেন? আজ প্রায় দুদিন হলো মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, থানায় যাওয়া ছাড়া আর উপায় কী, দেখো পুলিশ যদি কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
মাজেদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কী যেন ভেবে নিল তারপর বলল, মেয়েটা এমন একটা কাজ করল…
মেয়েটার দোষ দিচ্ছ কেন? ওরত কোন বিপদও হতে পারে। আমি বলি কি তোমার একা থানায় যেতে ভয় করলে তুমি চেয়ারম্যানকে বল। চেয়ারম্যান তো তোমাদের কাছের মানুষ।
এবার মাজেদ কিছুটা আশ্বস্ হলো, হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। দেখি চেয়ারম্যানকে বলে। চেয়ারম্যান যদি সময় দিতে পারে।
পারবে, অবশ্যই পারবে, তুমি এখনই ফোন কর।
আকলিমার কথামতো মাজেদ তখনই চেয়ারম্যানকে ফোন করল এবং চেয়ারম্যানসহ থানায় গেল।
সন্ধ্যায় থানায় প্রচণ্ড ভিড় থাকে। ডিউটি অফিসারের রুমে কয়েকজন ভুক্তভোগী কথা বলছিল দেখে চেয়ারম্যান সাহেব ওসি সাহেবের রুমে গেল। ওসি সাহেব টেলিফোনে কথা বলছেন। চেয়ারম্যান সাহেবকে ঢুকতে দেখে ওসি সাহেব চেয়ারম্যান আর মাজেদকে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসার জন্য ইশারা করলেন।
ওসি সাহেব টেলিফোনে কথা বলা শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন চেয়ারম্যান সাহেব কী মনে করে?
মাজেদ সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
এবার চেয়ারম্যান সাহেব কথা বললেন, স্যার ইনি আমার চাচা। একটা সমস্যায় পড়ে উনাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বলুন কী সমস্যা?
চেয়ারম্যান সাহেব মাজেদকে ইশারা করে বললেন, চাচা বলেন।
মাজেদ কিছুটা লজ্জা পেল, তুমি তো সব জান বাবা তুমি বল।
ওসি সাহেব বললেন, আপনি বলুন চেয়ারম্যান সাহেব?
চেয়ারম্যান সাহেব বলতে শুরু করলেন, আসলে কথাটা একটু লজ্জারই। চাচার মেয়ে মানে আমার চাচাতো বোন পরশুদিন কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত বাড়ি ফিরেনি।
ওসি সাহেব এক পলক চেয়ারম্যান সাহেব আর মাজেদের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কলেজে পড়ত?
মাজেদ মাথা নেড়ে সায় দিল।
কোন ক্লাসে?
অনার্সে, মাজেদ বলল।
ফোন ব্যবহার করত?
মাজেদ মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্মার্ট ফোন?
মাজেদ বুঝতে পারল না। সে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকালো।
চেয়ারম্যান সাহেব জিজ্ঞেস করল, চাচা মুক্তা কি টাচ ফোন ব্যবহার করত?
মাজেদ বলল, হ্যাঁ, টাচ ফোন।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ফেসবুক ব্যবহার করত নিশ্চয়ই?
মাজেদ বুঝতে পারল না। সে আবারও চেয়ারম্যান সাহেবের মুখের দিকে তাকালো।
চেয়ারম্যান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, চাচা মুক্তা কি ফেসবুক ব্যবহার করত?
মাজেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শুরু করল, টাচ ফোন কিনে দেয়ার পর থেকে মেয়েটা আমার সবসময় শুধু মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকত। ফেসবুক চালাত কী না তাত জানি না বাবা।
স্মার্ট ফোন ব্যবহার করত, অনার্স পড়-য়া মেয়ে কারও সঙ্গে হয়ত অ্যাফেয়ার ছিল…
চেয়ার ম্যান সাহেব বললেন, যদি তেমন কারও সঙ্গে রিলেশন থাকে আর তার সাথে চলে যায় তবুও তো আমাদের জানা থাকা উচিত। আবার কোন দুর্ঘটনাও তো ঘটতে পারে।
আচ্ছা দেখছি বলে ওসি সাহেব মাজেদকে বললেন, ফোন নাম্বারটা দিন।
মাজেদ ফোন নাম্বারটা বলল। ওসি সাহেব মুক্তার মোবাইল ফোনে রিং করলেন কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ। ওসি সাহেব মুক্তার মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়ে ফেসবুকে সার্চ দিলেন কিন্তু পেলেন না তারপর মুক্তার নাম দিয়ে সার্চ দিলেন কিন্তু মুক্তার তার সঙ্গে ম্যাচ করে তেমন কোন আইডি পেলেন না।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, মোবাইল সেদিন থেকেই বন্ধ।
হুম, এই মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে ফেসবুকের আইডিও খোলা হয়নি, নিজের নামেও আইডি খোলেনি, হয়ত ফেক নামে আইডি খুলে ফেসবুক চালাত বলে ওসি সাহেব মাজেদকে জিজ্ঞেস করলেন, কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
কাউকে সন্দেহ মানে? কথাটা ফিসফিস করে বলে মাজেদ বলল, না স্যার।
ওসি সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, ওর এমন কোন বন্ধু ছিল নাকি যার সাথে যেতে পারে বা এমন হতে পারে ও যেদিন বাসা থেকে ফিরেনি সেদিন থেকে ওর কোন বন্ধুকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
না স্যার তেমন কাউকে তো আমরা চিনি না। মেয়েটা সকালবেলা কলেজ যেত আর বিকেলে কলেজ থেকে বাসায় ফিরত। আমরা তো থাকি গ্রামে, আমরা কীভাবে জানবো ওর বন্ধুবান্ধবীর খবর।
জানতে হয়, আজকাল ছেলেমেয়েদের বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজখবরও রাখতে হয়। আচ্ছা এবার বলুন ও কলেজে কি একা যেত?
না স্যার, এলাকার আরও কয়েকজন মেয়েসহ যেত।
ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন? ওরা কিছু জানে কী না?
যোগাযোগ করেছি কিন্তু ওরা কিছু বলতে পারছে না। মাজেদ বলল।
ওসি সাহেব কলিং বেল টিপতেই স্যান্ট্রি এসে স্যালুট দিল, স্যার।
এস.আই রাশেদকে আসতে বল আর আমাদের চা দাও।
জি স্যার, বলে আরেকবার স্যালুট দিয়ে স্যান্ট্রি চলে গেল।
কয়েক মিনিট পর এস.আই রাশেদ এসে স্যালুট দিল, স্যার।
ওসি সাহেব বললেন, পরশু দিনের আগের দিন উনার মেয়ে কলেজে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছে কিন্তু বাসায় ফিরেনি। তুমি একটা মিসিং কেস এন্ট্রি কর।
জি স্যার।
মেয়েটি যার সঙ্গে কলেজ যাওয়া আসা করত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কর কেউ কিছু বলতে পারে কী না। তাদের ফেসবুক আইডি নিয়ে দেখ ওদের মিউচুয়াল ফ্রেন্ড কারও সাথে মেয়েটির রিলেশন ছিল কী না।
জি স্যার।
মেয়েটির মোবাইল নাম্বার নাও। মোবাইল ট্র্যাক কর, ফোন বন্ধ করার আগে কাদের সাথে বেশি বেশি কথা বলত, সেরকম সন্দেহজনক নাম্বারগুলোকে মার্ক কর এবং ট্র্যাক কর।
জি স্যার।
চা চলে এলো। চা খেতে খেতে ওসি সাহেব রাশেদকে আরও কিছু নির্দেশনা দিলেন তারপর বললেন, কেসটা সিরিয়াসলি ডিল কর যেন খুব তাড়াতাড়ি, মেয়েটার কোন ক্ষতি হওয়ার আগে উদ্ধার করা যায়।
জি স্যার।
ওসি সাহেব মাজেদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার আরও আগে আসা উচিত ছিল।
মাজেদ মিনমিন করে বলল, স্যার ভেবেছিলাম মেয়েটা চলে আসবে আর কেউ জানাজানি হবে না। জানেনই তো স্যার গ্রামে থাকি, লোকজন জানলে মান-সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে তাই আসিনি স্যার।
আগে জীবন তারপর তো মান-সম্মান। লোকজন খারাপ বলবে সেজন্য মেয়েকে উদ্ধারের পুলিশের কাছে আসতে হবে না। এটা ঠিক না। যাক তবুও এসেছেন ভালো করেছেন। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করব আপনার মেয়েকে উদ্ধার করতে।
চেয়ারম্যান সাহেব ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ জানালেন, ধন্যবাদ স্যার আপনার সহযোগিতা পেলে মেয়েটাকে উদ্ধার করা যাবে।
অবশ্যই যাবে। বলে ওসি সাহেব রাশেদকে বললেন, রাশেদ তুমি উনাদের নিয়ে যাও, মিসিং কেস এন্ট্রি কর।
জি স্যার।
সবাই চলে গেল।
উনিশ
হারুন ঢাকায় বিমান থেকে নেমে আবার সৈয়দপুরের বিমানে উঠেছে তারপর সেখান থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে গ্রামের বাড়ি। বর্ষা রাতের বাসে উঠেছে কিন্তু রাস্তায় যানজট থাকায় গাইবান্ধা পৌঁছাতে দেরি হয়েছে, সেখান থেকে আবার বাসে সুন্দরগঞ্জ তারপর অটোরিকসায় গ্রামের বাড়ি।
বর্ষা রাতের বাসে উঠেছে, পরদিন ভোরবেলা বাস পৌঁছে যাওয়ার কথা কিন্তু যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন দুপুর গড়িয়েছে, দীর্ঘ ভোগান্তির যাত্রায় বর্ষার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়েছে। অটোরিকশা বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই বর্ষার ছোট ভাই মুকুল দৌড়ে এলো, মুকুলের পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা, মাথায় গোল টুপি, পায়ে স্যান্ডেল। মুকুল একটা হাফেজি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। সে সালাম দিল, আপা আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কী রে কেমন আছিস?
ভালো আপা। তোমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?
অসুবিধা তো হয়েছেই। দেখছিস না আসতে কত দেরি হলো। তোর লেখাপড়া কেমন চলছে?
জি আপা ভালো। দশ প্যারা মুখস্ হয়েছে।
গুড।
মুকুল বর্ষার গুড কথার অর্থ বুঝল কী না বোঝা গেল না। সে বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে অটোরিকশা থেকে বর্ষার ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো।
বর্ষা মুকুলের পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, তুই কবে এসেছিস?
কালকে।
বর্ষা আঙিনা থেকে দেখতে পেল রান্না ঘরে তার খালা রান্না করছে।
বর্ষার মনে কৌতূহল দেখা দিল, খালা কবে এসেছে রে মুকুল?
আজ সকালে।
বাবা এসেছে?
হ্যাঁ।
বর্ষা সোজা তার ঘরে চলে গেল। টিউবওয়েলের পাড় থেকে তার মা রুনা তার ঘরে এলো, আসতে অনেক দেরি হলো মা, অনেক কষ্ট হয়েছে মা, তাই না? মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।
রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল মা।
রুনা বর্ষার কাছে গেল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নে মা, নাকি গোসল করবি?
গোসল করব মা।
আচ্ছা তুই তাড়াতাড়ি গোসল করে আয় আমি তোর খাবারের ব্যবস্থা করছি, বলে রুনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বর্ষা পিছন থেকে ডাক দিল, মা।
রুনা ঘুরে দাঁড়ালো, বল মা।
বাবা কোথায় মা?
তোর বাবা এসে আবার গাইবান্ধা গেছে, বলতে বলতে রুনা চলে গেল।
বর্ষা বুঝতে পারল তার মা কিছু লুকাচ্ছে কী না। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে গেল।
বিকেল হতে হতেই বর্ষার ফুপু এলো, মামা এলো। বাড়িতে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল কিন্তু কেউ বর্ষাকে কিছু বলছে না। এই বাড়িটাকে এবারের মত পর বর্ষার আর কখনও মনে হয়নি। বর্ষা এ বাড়িরই মেয়ে এতদিন তো বাড়ির সবাই তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলত এবারই কেন জানি একটা চাপা গোপনীয়তা তার চোখে পড়ছে।
রাতে বর্ষার সঙ্গে তার বাবার দেখা হলো। বাবাকে সালাম দিতেই বাবা সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস মা?
ভালো বাবা। তুমি?
ভালো।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি হঠাৎ করে এলে যে?
হঠাৎ করেই আসতে হলো মা, শুধু তোর জন্য।
বর্ষা কিছুটা অবাক হলো, আমার জন্য মানে?
তুই অনেকদূর থেকে এসেছিস, এখন আর কথা না মা, আজ রেস্ট নে, কাল কথা হবে।
বর্ষার আশঙ্কা আরও বেড়ে গেল, বাবা শুধু আমার জন্য এসেছে। আমাকে নিয়ে এত কি টেনশন যে বাবা শুধু আমার জন্য সৌদি আরব থেকে দেশে ছুটে এসেছে। বাবা মিনুর বিষয়টা জানতে পারেনি তো? না, তা জানবে কী করে। এমনি হাজার চিন্তায় বর্ষার মানসিকভাবে অসি’র হয়ে পড়ল।
সেদিন রাতে আর বাবার সঙ্গে কথা হলো না। আগে বর্ষা বাড়িতে এলে বাবা-মা’সহ অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করত, বাড়ির বিভিন্ন টুকটাক বিষয়ে বর্ষাও কথা বলত, এবার আগের চেয়ে আরও বেশি মিটিং-সিটিং হচ্ছে। বর্ষার মামা এসেছে, ফুপু-ফুপা এসেছে, খালা এসেছে। সবাই মিলে বর্ষার দাদার ঘরে মিটিং করছে, বাড়িতে সবার যেন ব্যস্ততা বেড়েছে।
পরদিন সকাল থেকে তার বাবা ব্যস্ত, সকালবেলা নাস্তা খাওয়ার সময় বর্ষা তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা বাবাকে দেখছি না।
তোর বাবা সকালবেলা শহরে গেছে।
কাল রাতেও একবার দেখলাম না।
রাতেও ব্যস্ত ছিল। খুব কম সময় ছুটি নিয়ে এসেছে তো সেজন্য ছুটোছুটিটা একটু বেশি। ব্যস্ততা কমলে তোর সঙ্গে কথা বলবে। এত তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই মা।
বর্ষা বুঝতে পারছে বাবার খুব কম সময় ছুটি নিয়ে দেশে আসা, আসার পর থেকে ছুটোছুটি করা সবকিছু তাকে নিয়েই। হয়ত বাবা প্রথমে তাকে বলতে চায়নি কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বর্ষা তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
বল।
বাবা এত ব্যস্ত কেন মা? আবার বলল, আমাকে নিয়ে…
ততক্ষণে রুনার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। দুশ্চিন্তায় বর্ষার পেটে তেমন খাবার যাচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। রুনা নাস্তা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো, তুই খা মা, আমার কাজ আছে পরে বলব তোকে।
রুনাও এড়িয়ে গেল। বর্ষার আর বুঝতে বাকি রইল না কিন্তু একটা কথা তার মাথায় আসে না। তারা কিছু না বুঝেই সবকিছু গোপন করছে কেন? নাকি তারা ধরেই নিয়েছে লেখাপড়া জানা মেয়ে, তার নিজস্ব পছন্দ আছে কাজেই সে হয়ত তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি নাও হতে পারে তাই সবকিছু গোপন করছে। হয়ত এমন সময় বলবে যখন বর্ষার আর কিছু বলার থাকবে না। অনেকটা কৌশলে তাকে তাদের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে।
অবশেষে বিকেলবেলা রুনা প্রথম তাকে বলল তার বিয়ের কথা। বর্ষা আগে থেকেই এমন একটা আশঙ্কা করছিল বলে খুব একটা অবাক হলো না। সে অস্বাভাবিক গম্ভীর, শান্ত কণ্ঠে বলল, হঠাৎ তোমরা আমাকে না বলে আমার বিয়ের আয়োজন করছ কেন মা?
রুনা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে বাবা-মা বিয়ের আয়োজন করবে এটাই তো স্বাভাবিক মা, অনেকদিন থেকে আত্মীয়-স্বজনরা বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে। ঘর-বর ঠিকমতো মিলছে না বলে দেরি হলো।
তোমরা আমাকে বলে পাত্র খুঁজছিলে?
তোমাকে বলতে হবে কেন, এটা তো বাবা-মা’র দায়িত্ব।
আমার বিয়ে আমাকে বলতে হবে না!
রুনা বর্ষার কাছে এলো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, রাগ করিস না মা। ভালো ঘর-বর পাওয়া খুব কঠিন, একটা মিলে তো আরেকটা মিলে না।
বর্ষা রেগে গেল, আমার ঘর-বর তোমাদের মেলাতে হবে না মা। আমার ঘর-বর আমি মেলাবো।
রুনা প্রচণ্ড রেগে গেল, এসব তুই কি বলছিস বর্ষা। সবকিছু রেডি, আজ সন্ধ্যায় তোকে দেখতে আসবে, দেখে পছন্দ করলে বিয়ে আর তুই এখন এসব উল্টা-পাল্টা কী বলছিস।
উল্টা-পাল্টা আমি বলিনি মা, উল্টা-পাল্টা তোমরা শুরু করেছ। আমি কাল এলাম কতদিন হলো, তোমরা কি একবারও আমাকে বলেছ বিয়ের কথা। তোমরা তলে তলে সব ঠিক করে আমাকে বলবে একটা অজানা-অচেনা ছেলেকে বিয়ে করতে আর আমি বিয়ে করব।
তো কী করবি?
আমি এখনই বিয়ে করব না। আমি আগে লেখাপড়া শেষ করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব তারপর আমার পছন্দমতো ছেলেকে বিয়ে করব।
তুই যা বলবি তাই হবে, তুই যা করতে চাইবি আমরা তাই হতে দেব। বাবা-মা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মেয়েকে ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া। তোর বাবা, ফুপা-ফুপু, মামা-মামি মিলে অনেকদিন থেকে পাত্র খুঁজছে, ভালো পাত্র পেয়েছে বিয়ে দিবে।
তুমি এভাবে কথা বলছ কেন মা, আমার বিয়ে, যার সঙ্গে আমি সারাজীবন কাটাব সে আমার পছন্দমতো হবে না।
মা-মেয়ের কথা কাটাকাটি এমন পর্যায়ে গেছে যে বাড়ির সবাই তো বটে, প্রতিবেশিদেরও অনেকেই ব্যাপারটা বুঝে গেছে। বর্ষা আর রুনা যে রুমে কথা বলছে সে রুমের দরজার সামনে এসে অনেকেই জড়ো হয়েছে।
বর্ষা প্রচণ্ড রেগে জোরে চিৎকার করে বলল, আপনারা যান, এটা আমাদের বাড়ির ব্যাপার, ভালো-মন্দ আমরা বুঝব।
দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ মহিলা গজগজ করে বলল, মেয়েটাকে লেখাপড়া শেখাতে ঢাকা পাঠিয়েই সব নষ্ট হয়েছে, কোন মেয়ে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে। আমাদের বাবা-মা আমাদের বিয়ে দেয়নি, আমরা সংসার করছি না।
বর্ষা উঁকি মেরে দেখলো যে মহিলাটি গজগজ করে কথা বলছে পাড়ার সম্পর্কে সে বর্ষার দাদি। বর্ষা তার সেই দাদির কথার প্রতিবাদ করল, আহারে যা সংসারটা করেছ তুমি। বিয়ে করেছ আর স্বামী সন্তানকে ভাত রান্না করে খাইয়েছ, আর কী করেছ। দু’টা মেয়েকেই হাইস্কুল শেষ না করতেই বিয়ে দিয়ে ওদের জীবনটা নষ্ট করেছ।
বৃদ্ধা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, শুনলে বউমা, শুনলে তোমার মেয়ের কথা।
রুনা সেই বৃদ্ধাকে বলল, আপনি আবার আমাদের মা-মেয়ের কথা মধ্যে কথা বলছেন কেন চাচি।
তোমাদের মা-মেয়ের ঝগড়া শুনেই তো মানুষ জড়ো হয়েছে। তোমরা যে কেমন মা আর কেমন মেয়ে। শুনেছি লেখাপড়া শিখে মেয়েটা শিক্ষিত হয়েছে। এই শিক্ষিত! মায়ের মুখে মুখে কথা। এর চেয়ে আমাদের অশিক্ষিত মেয়েরাই ভালো, ঘর-বর আমাদের পছন্দ হয়েছে, বিয়ের আয়োজন করেছি মেয়ে বিয়ে করেছে। মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি বলতে বলতে বৃদ্ধা গজগজ করতে করতে চলে গেল।
বৃদ্ধার কথায় শতভাগ সত্য। দেশের বেশিরভাগ গ্রামের বিয়ের চিত্র এরকমই। আগে হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে বিয়ের কথাবার্তা, তারপর কনে দেখার নাম করে পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষের বাড়িতে কনে দেখা, উভয় পক্ষের অভিভাবক আর বরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা মিলে গেলে কনের বাবা-মা ঠিক এভাবেই বোঝাবে, আমরা অনেক কষ্ট করে তোমাকে মানুষ করেছি মা, আমরা নিশ্চয়ই তোমার অমঙ্গল চাই না।
মেয়েটির হয়ত তখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। বিয়ে, স্বামী-সংসার সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণাই নেই। আর থাকবেই বা কী করে, গ্রাম-গঞ্জে অনেক মেয়েরই তো বিয়ে হয় বিয়ের অর্থ বোঝার আগে। তারই সমবয়সী অনেক মেয়ের বিয়ে দেখতে দেখতে বরং সেও বিয়ের জন্য মনে মনে বউ সেজে বসে থাকে। ততক্ষণে গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত, চতুর মাতব্বর প্রকৃতির মানুষ, কাজি সাহেব বয়স বাড়ানরও একটা কায়দা তৈরি করে ফেলে।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটির আত্মীয়-স্বজন এলো, বন্ধুবান্ধবীরা এলো। মেয়েটিকে বউ সাজান হলো, বন্ধুবান্ধবীরা তাকে ঘিরে গল্প-গুজব করতে থাকলো। কাজি সাহেব একটা সবুজ রেজিস্টার নিয়ে এলো, বিড়বিড় করে বর কনের নাম ঠিকানা বলেই চলল তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন মেয়েটির চাচা বা মামা বা অন্য কোন পড়শি কাজি সাহেবের শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো তোতা পাখির মত বলে জিজ্ঞেস করল, আপনি রাজি আছেন তো?
মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে কী বলল বোঝা গেল না। তবে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকুরগোজারি করতে লাগল।
আবার কোন কোন মেয়ে হয়ত স্কুল পড়ুয়া, বিয়ের কথা হয়ত তখনো সে ভাবেইনি, তার চোখে লেখাপড়া শিখে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন কিন্তু পরিবেশ পরিসি’তির কারণে সে তার হৃদয়ে লালন করা স্বপ্নগুলো অব্যক্তই রয়ে গেল। নিজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল তারপর অজানা-অচেনা একজন পুরুষের কাঁধে মাথা রাখল।
বর্ষার মত শিক্ষিত, সচেতন মেয়েদের বেলায় বিষয়টা একটু অন্যরকম কিন্তু বর্ষা যে এলাকায় বড় হয়েছে, সে এলাকাটি একেবারে অজো পাড়াগাঁ বললেও ভুল হবে না। এই অঞ্চলের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো নেই। অশিক্ষা আর কুসংস্কারে আচ্ছাদিত গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার। কোন মেয়ে কোনদিন প্রতিবাদও করে না কিন্তু বর্ষা শিক্ষিত, সচেতন একটা মেয়ে সে কেন অশিক্ষিত বালিকার মত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেকে সঁপে দিবে না।
বর্ষার পাড়ার কয়েকজন সমবয়সী মেয়ে, দূর সম্পর্কের মামাত বোন, ফুপাত বোন এসে তার পাশে বসল। বর্ষা বুঝতে পারল তার মা-ই তাদের আসতে বলেছে, আবার নাও হতে পারে বিয়ের কথা শুনলে সহপাঠী বোন, বন্ধু, সমবয়সী খালা-ফুপুরা কনের পাশে বসে, তবে কি বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেল?
বর্ষা তার বাবাকে ফোন করল।
কয়েকবার রিং হতেই তার বাবা ফোন রিসিভ করল, হ্যালো মা।
বাবা তুমি কোথায়?
একটু বাইরে মা।
তুমি এক্ষুনি আমার কাছে চলে এস।
কেন মা, হঠাৎ করে কী হলো?
আমি বলছি তুমি এক্ষুনি চলে এস।
আচ্ছা মা আসছি, বলে হারুন কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরে এলো, কী হয়েছে মা?
বর্ষা রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি এসব কী শুরু করেছ?
কী শুরু করেছি মানে?
তুমি আমার বিয়ের আয়োজন করছ?
হ্যাঁ মা।
বর্ষা জোরে চিৎকার করে উঠল, আমি এখনই বিয়ে করব কী না তুমি আমাকে বলেছ?
আমি তো তোর মাকে তোকে বলতে বলেছিলাম মা, বলেনি?
আমি তো বললাম বর্ষাকে, কথাটা রুনা কাঁপা কণ্ঠে বলল।
বিয়ের সব আয়োজন পাকাপোক্ত করে আমাকে বলেছ? তোমরা কি আমার বিয়ের আয়োজন করার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছ আমি বিয়ে করব কী না?
হারুন কিছুটা বিনয়ের সঙ্গে বলল, মাথা গরম করিস না মা, আজ তোকে দেখতে আসবে, দেখে যদি পছন্দ হয় তবে কাবিন হবে।
কাবিন হবে মানে, কাবিন মানেই তো রেজিস্ট্রি আর রেজিস্ট্রি মানে বিয়ে। রেজিস্ট্রি হলে আর বিয়ে হতে কী বাকি থাকলো। এসব বন্ধ কর বাবা, আমি এখনই বিয়ে করব না।
আস্তে কথা বল মা, হৈ চৈ করিস না।
আমি কোন হৈ চৈ করব না, কোন সিন ক্রিয়েট করব না বাবা যদি তুমি বিয়ে বন্ধ কর আর যদি তোমরা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা কর তবে আমি কী করব তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। এই আমার শেষ কথা।
বিশ
বর্ষার কথা কেউ তেমন আমলে নিল না। কনে দেখার অনুষ্ঠানে সাধারণত দু’চারজন বা পাঁচ-ছয়জনের দল আসে কিন্তু বর্ষাকে দেখার জন্য যে দল এলো তা বেশ লম্বা, সঙ্গে দু’জন নারী সদস্যও আছে। আঙিনায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালান হয়েছে, চেয়ার টেবিল সাজান হয়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে যেন বিয়েরই ধুমধাম আয়োজন। দুশ্চিন্তায় বর্ষার বুক কাঁপছে, শেষ পর্যন্ত গ্রামের অবলা কিশোরীদের মত তাকেও কি তার বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিবে?
বাবা বলেছে কাবিন হবে, কাবিন মানে তো বিয়েই হওয়া, একজন অজানা, অচেনার পুরুষের সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া। বর্ষা’র মনোবল দৃঢ়, সে কোনোভাবে অভিভাবকদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না, বর্ষা মনে আরও শক্তি অর্জন করছে। যেকরেই হোক তাকে এই বিয়ে প্রতিরোধ করতেই হবে।
বর্ষা’র দূর সম্পর্কের একজন ভাবী আর চাচাতো বোন বর্ষা’র ঘরে ঢুকলো। ভাবির হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগে নতুন কাপড়-চোপড়। ভাবী বর্ষা’র পাশে বসে ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড়গুলো বের করতে করতে বলল, বাহ শাড়িটাত খুব সুন্দর। অনেক দামি বুঝি বলতে বলতে সে শাড়িটা বর্ষা’র গায়ে এলিয়ে ধরলো।
বর্ষা’র চোখের সামনে মিনুর স্মৃতি ভেসে উঠল। মিনুর সঙ্গে তার কতদিনের সম্পর্ক, কীসের সম্পর্ক, বন্ধুত্বের, প্রেমের নাকি দাম্পত্যর? অসংজ্ঞায়িত এক হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক। বিয়ের কথায় মিনু হেসে উড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু বর্ষা উড়িয়ে দেয়নি। বর্ষা’র জীবনে মিনুই একমাত্র পুরুষ। মিনুর সঙ্গে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মিনুসহ বসুন্ধরা সিটিতে শপিং করতে যেত, মিনু একটা একটা করে থ্রি-পিস বর্ষা’র গায়ের ওপর এলিয়ে ধরে বলত, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বর্ষা, দেখ দেখ বলে বর্ষাকে আয়নার কাছে নিয়ে যেত।
পহেলা বৈশাখ এবং বসন্ত উৎসবে মিনু বর্ষাকে শাড়ি কিনে দিত, দু’জনে ঘুরে বেড়াত আজ বিয়ে হয়ে গেলে মিনুর পরিবর্তে অন্য একজন অচেনা, অজানা পুরুষের পাশে বসে তাকে ঘুরে বেড়াতে হবে কিন্তু মিনুও তো তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি, বরং কথা প্রসঙ্গে যতবারই বর্ষা তাকে বিয়ে করতে বলেছে ততবারই মিনু হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, শুধু হেসে উড়িয়েই দেয়নি বিয়ে করতে অস্বীকার করেছে বললেও বাহুল্য হবে না।
তবুও বর্ষা বিয়ে করবে না। মিনু বিয়ে না করুক, তাকে অস্বীকার করুক তবুও বর্ষা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অচেনা-অজানা কাউকে বিয়ে করবে না। বর্ষা বিয়ে প্রতিহত করবে নিজের জন্য, নিজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য।
বর্ষার শরীরে তার ভাবী শাড়িটা এলিয়ে দেয়া দেখে বর্ষার চোখ দিয়ে যে ক’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল বর্ষা সে পানি মুছে মনকে শক্ত করল। যে করেই হোক বর্ষাকে এই প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
ভাবী বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কাঁদিস না বোন, মেয়ে হয়ে জন্মালে তো শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে, সবাইকে মানিয়ে নিতে হবে। দেখছিস না আমিও তোমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে মানিয়ে নিয়েছি।
বর্ষা ভাবির হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল, তুমি মানিয়ে নাও, আমাকে এসব বুঝ দিতে এস না।
ভাবী কিছুটা শাসনের সুরে বলল, ছিঃ বর্ষা বিয়ের শাড়ি এভাবে ফেলে দিতে হয় না।
বর্ষার চাচাতো বোন বলল, ভাবীত ঠিকই বলেছে বর্ষা।
বর্ষা প্রচণ্ড রেগে বলল, তুই চুপ কর। পরতে ইচ্ছা করলে তুই পর।
মেয়েটি হেসে বলল, আমাকে দেখতে এলে তো আমি এতক্ষণ পরতাম, কী সুন্দর ছেলে…
বর্ষা বাধা দিয়ে বলল, বেশত তুই কর, তুই বিয়ে কর। এদিকে তো একজনকে বিয়ে করতে এসে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে শেষে যাকে পাওয়া যায় তাকেই বিয়ে করে নিয়ে যায়, বিয়ে তো এদিকে টিউবওয়েলের পানি, কোনোভাবে গিলে ফেলতে পারলেই হয়।
ভাবী বাইরে চলে গেল কিছুক্ষণ পর রুনা এলো, মিনির নানিও এলো। রুনা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কী হয়েছে বর্ষা?
তুমি তো ভালো করেই জান মা কী হয়েছে।
না। আমি জানি না। আমি জানি পাত্রপক্ষ কনে দেখতে এসেছে, কনে দেখে পছন্দ হলে কাবিন হবে।
না, কাবিন হবে না।
আচ্ছা। আগে তো দেখুক। ওদের তো পছন্দ নাও হতে পারে।
বর্ষা তীর্যক দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর যদি পছন্দ হয়?
পছন্দ হলে কাবিন হবে।
বর্ষা কিছুটা উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল, না। পছন্দ হলেও কাবিন হবে না।
বর্ষার নানি বলল, জোরে কথা বলিস না, ওরা শুনলে কী মনে করবে।
বর্ষা গজগজ করে বলল, যা মনে করে করবে। ওরা কী মনে করবে আর সেজন্য আমি চুপ করে থাকবো নাকি।
রুনা বর্ষার কাছে এলো। বর্ষার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলল, আস্তে, আস্তে কথা বল মা। বাইরে মেহমানরা আছে। তুই তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় পরে নে মা।
বর্ষা চিৎকার করে বলল, না। আমি ওদের কাপড়-চোপড় পরব না।
বর্ষার উচ্চ স্বরে কথা শুনে বর্ষার মামা ফরিদ ঘরে এলো, কী হয়েছে বর্ষা?
রুনার মায়েরা এক ভাই দুই বোন। ভাই ফরিদ সবার বড়, তারপর বর্ষার খালা, সবার ছোট রুনা। বর্ষার মামার গলার স্বর বেশ গম্ভীর। ভাইবোনদের মধ্যে সবাই তাকে ভয় করে, এমন কি তার নানা বেঁচে থাকতে বড় ছেলে হিসেবে তার নানাও তার ফরিদ মামার ওপর কোন কথা বলত না। ।
বর্ষা চিৎকার করে বলল, কী হয়েছে তুমি জান না?
বর্ষার কাছে সদুত্তর না পেয়ে ফরিদ রুনাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রুনা?
রুনা চাপাস্বরে বলল, কিছু হয়নি ভাইজান।
ফরিদ বলল, বর্ষা তাড়াতাড়ি কাপড় পর।
বর্ষার নানি এসময় কথা বলল, মেয়েটার কথা শুনেছ, ও নাকি শাড়ি পরবে না।
ফরিদ যেন আকাশ থেকে পড়ল, মানে?
রুনা তার ভাইয়ের রাগ জানে। সে রেগে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে। রুনা ফিসফিস করে বলল, তুমি যাও ভাইজান, আমি ওকে কাপড় পরিয়ে তোমাকে ডাক দিব। তখন তুমি এসে নিয়ে যেও।
ফরিদ কোন কথা না বলে গনগন করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, এলাকায় আমাদেরও একটা মান-সম্মান আছে সেটা যেন নষ্ট কর না রুনা।
রুনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, পর মা, তাড়াতাড়ি পর।
বর্ষা তার ওয়ারড্রপ থেকে একটা থ্রি-পিস বের করতে করতে বলল, আমি কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি মা, তোমাদের সম্মান বাঁচানোর জন্য আমি পাত্র পক্ষের সামনে যাচ্ছি কিন্তু আমি বিয়ে করব না।
রুনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তাড়াতাড়ি পর মা আমি আসছি।
রুনা চলে গেল বর্ষা একটা নতুন থ্রি-পিস পরে তৈরি হলো, রুনা ফিরে এলো, সঙ্গে ফরিদও।
ফরিদ বর্ষাকে জিজ্ঞেস করল, শাড়ি পরলি না।
রুনা ইশারা করে বলল, ও যখন চাচ্ছে না তখন থাক ভাইজান। থ্রি-পিস পরেই দেখুক।
ফরিদ গজগজ করে বলল, পরে আবার শাড়ি পরবে।
রুনা মুখ কাল করল, আগে দেখুক ভাইজান।
আচ্ছা আয়, বলে ফরিদ বর্ষাকে হাত ধরে আঙিনায় নিয়ে গেল।
এই প্রথম বর্ষা কনে হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করল। বর্ষা সারাজীবন বিয়ের নামে মেয়েদের কনে দেখার অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে এসেছে। বর্ষার কাছে মনে হয় কনে দেখা আর কোরবানির পশু দেখার মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই। কোরবকানীর পশু দেখার সময় গ্রাহক যেমন পশুর পিঠে হাত দিয়ে মাংস, শিং, লেজ দেখে তেমনি কনে দেখার অনুষ্ঠানে মেয়েদের হাত, নখ, চোখ-মুখ দেখে কোরবানির পশুর শরীরে কোন খুঁত আছে কী না তেমনি কনে দেখার সময় পাত্রপক্ষ মেয়ের শরীরে কোন খুঁত আছে কী না তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
বর্ষা ভাগ্য বিশ্বাস খুব সামান্য কিন্তু সারাজীবন কনে দেখার অনুষ্ঠানকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করলেও নিজেকে কনে দেখার অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করার সময় অদৃষ্ট হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই করার রইল না।
বর্ষা অনেক সাহসী হলেও সে ভয় পাচ্ছিল, তার ঠোঁট দুটো সামান্য কাঁপছিল। সে কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সালাম দিল, আসসালামুয়ালায়কুম।
সবাই ওয়ালাইকুম আসসালাম বলার পর একজন মুরুব্বী কিসিমের লোক বলল, বসো মা।
জানা গেল মুরুব্বী কিছিমের লোকটি পাত্রের ফুপা, সেই পাত্রপক্ষের গার্ডিয়ানের ভূমিকা পালন করছে। যে ফাঁকা চেয়ারটা বর্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল সেই চেয়ারের পাশের চেয়ারে বসা পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়সের মহিলা নিজের পরিচয়ে জানাল সে মাকসুদের ভাবী। এতক্ষণে বর্ষা জানতে পারল তার সম্ভাব্য বরের নাম মাকসুদ।
বর্ষার মুখোমুখি চেয়ারে বসা একজন ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের লক, সে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলল সে পাত্রের দুলাভাই। তারপর জোর দিয়ে গর্বভরে আবার বলল, আমি হলাম মাকসুদের দুলাভাই। বাড়ির বড় জামাই। দুলাভাইর পাশেই বসেছিল আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, মাকসুদ।
বর্ষা চেয়ারে বসল। মুরুব্বী লোকটি জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী মা?
বর্ষা মৃদু কণ্ঠে বলল, বর্ষা।
পুরো নাম বল মা, আকিকা করা পুরো নাম বলতে হয়।
বর্ষা বলল, মমতাজ বেগম বর্ষা।
কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ মা?
অনার্স পড়ছি। আমি এখনও লেখাপড়া করছি।
ঐ হলো। অনেকদূর পর্যন্ত পড়েছ মা। সংসার চালানোর জন্য এর চেয়ে বেশি পড়া না হলেও চলবে।
বর্ষা বলল, এটা ঠিক না। লেখাপড়া শুধু সংসার চালানোর জন্য নয়, নিজের পায়ে দাঁড়ান, সমাজে মাথা উঁচু করে থাকা, দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য লেখাপড়া জানা অনেক জরুরি।
আমি বলছিলাম আমাদের কথা। আমাদের বউমার আর লেখাপড়া না হলেও চলবে।
বর্ষা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, কিন্তু আমার চলবে না। আমি আরও লেখাপড়া করব। অনার্সের পর মাস্টার্স করব, তারপর চাকরি করব, সুযোগ পেলে পি.এইচ.ডিও করব।।
মুরুব্বী লোকটি বর্ষার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো। সে ফরিদকে জিজ্ঞেস করল, ফরিদ বউ মা কী বলছে?
ফরিদ ইশারা করল, আপনি কিছু মনে করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।
বর্ষা আবার কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ফরিদ কিছুটা ধমকের সুরে বলল, বর্ষা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলিস না।
মুরুব্বী লোকটি যেন আর কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। গর্বভরে জামাই পরিচয় দেয়া লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, জামাই তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে?
সে আমতা আমতা করে বলল, আমরা গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষ, আমরা আর কী জিজ্ঞেস করব। মেয়ের লেখাপড়া জানলাম বাকি সব তো জানাশোনার মধ্যেই বলে সে মাকসুদের কানে কানে জিজ্ঞেস করল, কী রে তোর পছন্দ হয়েছে?
মাকসুদ মাথা নেড়ে সায় দিল।
তুমি যাও মা, ভিতরে বসো বলে মুরুব্বী লোকটি বলল, ফরিদ মামুনিকে নিয়ে যাও।
বর্ষা চেয়ার থেকে উঠে সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।
একুশ
বর্ষা লক্ষ্য করল সে চেয়ার থেকে উঠে আসার পথে পাত্রপক্ষের কে যেন বলল, মেয়ে তো সুন্দরই আছে।
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কি রে বউ পছন্দ হয়েছে?
বরের কনে পছন্দ হয়েছে কী না একথা শোনা গেল না বর্ষা ধীর পদে তার ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির পরিবেশ আনন্দমুখর হলো। আঙিনায় আরও চেয়ার সাজান হলো, আরও কয়েকটা বাতি জ্বালান হলো। বর্ষার বুঝতে বাকি রইল না যে পাত্রপক্ষ তাকে পছন্দ করেছে আর বিয়ের আয়োজনও শুরু হয়ে গেছে। বর্ষা একবার ডানে-বাঁয়ে তাকালো পড়শি চাচাতো বোনেরা, তার সমবয়সী দূর সম্পর্কের ফুপুরা সবাই তাকে একরকম ঘিরে রয়েছে। কেউ চৌকিতে তার পাশে বসে আছে, কেউ চেয়ারে বসে আছে, ইতোমধ্যে আঙিনায় জনসমাগমও বেড়েছে।
পালাবার সব পথ বন্ধ। হয়ত তার আত্মীয়-স্বজনরাই কৌশলে তাকে বন্দি করেছে। গ্রামে বর্ষা’র তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই যারা তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, তারপরও সে একবার তার মোবাইল ফোনটা খুঁজল, তার এক বান্ধবী আছে তাকে ফোন করলে সে যদি তাকে সহযোগিতা করতে পারে কিংবা পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা চাইতে পারে। ততক্ষণে বর্ষার মোবাইল ফোনটাও তারা সরিয়ে ফেলেছে। সে তার মোবাইল ফোনটাও খুঁজে পেল না। সে জোরে চিৎকার করে তার মাকে ডাক দিল, মা।
তার পাশে বসা একজন তার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
বর্ষা তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আমার মুখ চেপে ধরছেন কেন?
বিয়ের দিন জোরে চিৎকার করতে হয় না।
চিৎকার করলে কী হয়?
অমঙ্গল হয়। আর পাত্রপক্ষ যদি তোর জোরে চিৎকার দেয়া কণ্ঠস্বর শুনতে পায় তবে খারাপ ভাববে।
ভাবুক আমাকে নিয়ে কে কী ভাবে সেটা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। বলে বর্ষা আবার জোরে চিৎকার করে তার মাকে ডাক দিল, মা।
রুনা এরকম দৌড়ে এলো, কী হয়েছে মা?
আমার মোবাইল ফোনটা কোথায়?
তোর মোবাইল ফোন, তোর মোবাইল…
বর্ষা চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, আমার মোবাইল ফোনটা।
রুনা চাপাস্বরে বলল, আস্তে, আস্তে কথা বল মা।
আস্তে কেন, আমি জোরে কথা বলব, জোরে চিৎকার করে কথা বলব। চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিব।
রুনা তোতলাতে তোতলাতে বলল, কী, কী জানাবি তুই?
কী জানাব বুঝতে পারছ না। বুঝবে, তোমরা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলেই বুঝবে আমি কী করতে পারি। এখন আমার ফোনটা দাও।
তোর ফোনটা আমার কাছে নেই।
কার কাছে আছে?
আমি জানি না।
জান না? বলে বর্ষা আরও জোরে চিৎকার করে বলল।
বর্ষার জোরে চিৎকার শুনে ফরিদ আবারও ভিতরে এলো, কী হয়েছে রুনা? বর্ষা জোরে চিৎকার করছে কেন? আঙিনা থেকে সব শোনা যাচ্ছে।
বর্ষা ফরিদের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার মোবাইল ফোনটা কোথায়?
তোর মোবাইল ফোন, তোমার মোবাইল ফোন আমরা কী করে জানবো।
তুমিও মিথ্যা কথা বলছ? ভাই-বোন দু’জনে মিথ্যুক।
ফরিদ রেগে গেল, সে চাপাস্বরে বলল, মুখ সামলে কথা বল বর্ষা।
আমার তোমাদের সঙ্গে কথা বলার কোন দরকার নেই। তোমরা ভালো চাও তো আমার মোবাইল ফোন আমাকে দিয়ে দাও।
এখন মোবাইল ফোন দিয়ে তুই কী করবি?
আমি কী করব আমি বুঝব। তোমরা আমার মোবাইল ফোন আমাকে দাও।
আচ্ছা আমি দেখছি কার কাছে আছে। তুই যেন চিৎকার করিস না, বলে ফরিদ আর রুনা চলে গেল।
অনেকক্ষণ কেটে গেল কিন্তু ফরিদ এলো না। কিছুক্ষণ পর রুনা ফিরে এসে বলল, তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নে মা।
কেন? শাড়ি পরব কেন? তোমরা না আমার মোবাইল ফোন এনে দেয়ার জন্য দু’ভাইবোন বেরিয়ে গেলে। আমার মোবাইল ফোন কোথায়?
তোর মামা খুঁজছে।
নিজে লুকিয়ে রেখে খুঁজলে পাবে কী করে। তুমি যাও আগে আমার মোবাইল ফোন নিয়ে এস।
তোর মামা বলল এখন তোর মোবাইল ফোনটা কী দরকার, কার সাথে কথা বলবি?
আমি কার সাথে কথা বলব সেটা তোমাদের বলতে হবে?
আমি তোর এত কথার জবাব দিতে পারব না বাবা। আমি গিয়ে বলি ভালো-মন্দ যা বুঝার তোর মামাই বুঝবে, বলে রুনা চলে গেল।
বর্ষা শৈশব থেকে দেখছে এসব। কত মেয়ের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়, মেয়েরা প্রতিবাদও করে না। তার সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত এমন মেয়েদের কারও বিয়ে বাকি নেই। গতকাল বিকেলে তার এক স্কুল জীবনের বান্ধবী এলো তার সঙ্গে দেখা করতে, সঙ্গে তার একটা আট বছর বয়সের মেয়ে এবং ছয় বছর বয়সের একটা ছেলে। বর্ষা প্রথমে চিনতেই পারেনি। মেয়েটি যখন পরিচয় দিল তখন বর্ষা চিনতে পারল। বর্ষা তাকে দেখে অবাক হলো, মেয়েটি তার সমবয়সী হলেও চেহারায় যেন বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে।
বর্ষা কেমন আছিস জিজ্ঞেস করতেই তার চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে উঠল, কণ্ঠস্বর বুজে গেল। সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আছি কোনোমতে।
বর্ষা আবার জিজ্ঞেস করল, কেন, কিছু হয়েছে?
বর্ষা আর রুনা একসঙ্গে উঠানে বসে গল্প করছিল সেসময় মেয়েটি এসেছিল। মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর রুনা দিল, ওর অনেক কষ্ট।
বর্ষা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?
বিয়ের পর থেকে স্বামী ডিমান্ডের জন্য অত্যাচার করছিল।
তাহলে এতদিন দেরি করলি কেন, বাচ্চা নিলি কেন?
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভেবেছিলাম বাচ্চা নিলে যদি ঠিক হয়ে যায়।
তবুও ঠিক হলো না?
মেয়েটি না সূচক মাথা নাড়লো। তার দু’চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, তুমি পুলিশের কাছে যাওনি? মামলা করনি?
রুনা বর্ষাকে ইশারা করল এসব কথা জিজ্ঞেস না করতে কিন্তু বর্ষা নাছোড়বান্দা, সে আবারও জিজ্ঞেস করল, এখন কী বলছে?
রুনা বলল, কী আর বলবে শুনছি ওকে নাকি তালাক দিয়েছে।
বর্ষা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?
মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
সেজন্য মেয়েদের শিক্ষিত হতে হয়, শিক্ষিত মেয়েদের এসব সমস্যা কম।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তো আরও লেখাপড়া করতেই চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা বিয়ে দিয়ে দিল। আপনি বলুন আপা বাবা-মা বিয়ে দিলে কি না করা যায়।
না, বাবা-মা বিয়ে দিলে না করা যায় না কিন্তু মা-বাবাকে বোঝান যায়। বর্ষা ভাবত মা-বাবাকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করা যায় কিন্তু আজ এই পরিসি’তিতে তার মনে হলো পরিসি’তি নিজের প্রতিকূলে চলে গেলে আর আসলে কিছু করা যায় না। বর্ষা সেদিন বলেছিল শিক্ষিত মেয়ে হলে সমস্যা কম হত, হয়ত হত কিন্তু তার অভিজ্ঞতা তা বলে না।
বর্ষা তখন মনিপুরীপাড়া একটা মেসে ছিল। তার রুমমেট একবার ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেল, ক’দিন পরই ফেরার কথা ছিল কিন্তু ফিরল না। বেশ কয়েকদিন পর ফিরল, মেসে ফিরে বলল, তার আর লেখাপড়া হলো না।
কেন?
তার বিয়ে হয়ে গেছে।
লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে তোকে বিয়ে দিয়ে দিল?
হ্যাঁ, বাবা-মা ভালো মনে করেছে তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
সেদিন বর্ষার মনে হলো তার বান্ধবীটি বুঝি খুব সহজভাবেই বলেছিল, খুব সাধারণভাবে বিয়ে মেনে নিয়েছিল কিন্তু আজ বর্ষার উপলব্ধি অন্যরকম। সেদিন তার বান্ধবীটির কথায় যে রাগ, ক্ষোভ আর অভিমান ছিল আজ বর্ষা তা বুঝতে পারল।
কত মেয়ের জীবন বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে। বর্ষাও তাদের মত একজন হতে চলেছে কিন্তু বর্ষা প্রতিবাদ করবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে তার বিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে।
না বর্ষার মোবাইল ফোন এলো না। অনেকক্ষণ পর টুপি পাঞ্জাবি-পরা একজন মৌলভি সাহেব এলো, তার হাতে একটা সবুজ রেজিস্টার, তার সঙ্গে কয়েকজন লোক এসে ঢুকলো।
মৌলভি সাহেব ঘরে ঢুকে একবার পুরো ঘর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, পাত্রী কোথায়?
বর্ষার পাশে বসে থাকা দূর সম্পর্কের তার এক ফুপু বলল, এই যে পাত্রী।
বিয়ের দিন, শাড়ি পরবে না?
ফরিদ আড়ালে ছিল, সে পিছন থেকে বলল, কাজি সাহেব তোমার এত জিজ্ঞাসার কী আছে, শাড়ি না পরলে কি বিয়ে হয় না?
বর্ষা বুঝতে পারল বিয়ের সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত এখন তিন বার রাজি আর একটা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার বিয়ে সম্পন্ন হবে। কাজেই প্রতিবাদ করতে হবে এখনই।
কাজি সাহেব আর কোন কথা না বলে বিড়বিড় করে বিয়ের সব বিবরণ বলে চলল আর তার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বর্ষার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, বলুন আপনি রাজি আছেন তো?
বর্ষা উঠে দাঁড়ালো, কোমরে তার ওড়না পেঁচিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, না।
কাজি সাহের হতভম্ব হয়ে পড়ল। সাধারাণত এরকম ঘটনা ঘটে না। কোন মেয়ে এভাবে তার বিয়ের প্রতিবাদ করেছে এটা কাজি সাহেবের দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম।
বর্ষার আচরণে ফরিদ আড়াল থেকে দাঁত কড়মড় করে হুঙ্কার দিয়ে বলল, বর্ষা, ভদ্রতার একটা সীমা আছে।
বর্ষা জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, সেটা তো আমারও কথা, ভদ্রতার একটা সীমা থাকা উচিত। আমার বিয়ে আমি রাজি নই আর আপনারা বিয়ের আয়োজন করছেন। বলে বর্ষা কথা বলতে বলতে এরকম হাঁপিয়ে উঠল, সে শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, কাজি সাহেব আপনি শুনলেন তো পাত্রী রাজি নয়, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পুলিশ না আসা পর্যন্ত কি আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
কাজি সাহেব ভয় পেয়ে গেল। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তার রেজিস্টার নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল, যাওয়ার সময় গজগজ করে বলল, আপনাদের মেয়ে রাজি না তো বিয়ের আয়োজন করেছেন কেন? আজকালকার শিক্ষিত মেয়েরা একটু অন্যরকম, বিয়ের আগে নিজের স্বামী নিজে বাছাই করে রাখে।
শিক্ষা মানুষের চোখ খুলে দেয়, শিক্ষা মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী করে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়। কাজেই একজন শিক্ষিত সচেতন মেয়ে তো তার ভালোমন্দ নিজেই ঠিক করবে। বিয়ে! যার সাথে একটা মেয়েকে সারাজীবন কাটাতে হবে সে তাকে বিয়ের আগে দেখারও সুযোগ পাবে না, তার পছন্দ-অপছন্দ সে বলতেও পারবে না?
বাইশ
মুক্তা এসেছে বর্ষা যেদিন গ্রামের বাড়ি যায় সেদিন সন্ধ্যায়। আগের দিন ড্রাইভার পাঁচ দিনের ছুটিতে চট্টগ্রাম গিয়েছিল। সাধারাণত ড্রাইভার ছুটিতে গেলে চট্টগ্রাম গিয়ে ফোনে আবার দুয়েকদিন ছুটি বাড়িয়ে নেয় এবং আসার আগে ফোন করে, মিনু ভেবেছিল এবারও আসার আগে ফোন করবে।
সেদিন বিকেলে বাসার কলিং বেল বেজে উঠল। মিনু তো অবাক, এখন আবার কে এলো। সাধারণত বর্ষা বাসায় আসার কথা থাকলে মিনু কাজের বুয়াকে ছুটি দিয়ে দেয়, ড্রাইভারকে কোন না কোনোভাবে বাসার বাইরে রাখে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে ছুটি দিয়ে দেয় আর সে ছিল ছুটি পাগল। ছুটি দিলে আর কোন কথা নেই, সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ গুছিয়ে চট্টগ্রাম। তাই কোনদিন কলিং বেল বেজে ওঠে না।
মিনু দরজার লুকিং মিররে দেখলো, ড্রাইভার এসেছে। তার বুক কেঁপে উঠল, উফ্, এই বেটা আবার এত তাড়াতাড়ি ঢাকায় এলো কেন, একটা ফোন দিয়ে আসবে তো। ড্রাইভার দেখলে তো বাবার কানে খবরটা পৌঁছাতে এক মিনিটও সময় লাগবে না। সে মুক্তাকে লুকিয়ে রাখার জন্য এক রুম থেকে আরেক রুম খুঁজল কিন্তু তাকে লুকিয়ে রাখার মত কোন জায়গা খুঁজে পেল না।
মুক্তা জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে? এমন করছ কেন?
মিনু বলল, ড্রাইভার আঙ্কেল!
মুক্তা মনে মনে খুশিই হলো সে চাচ্ছিল এমন কেউ দেখুক যাতে করে মিনু চাইলেও বিষয়টা লুকাতে না পারে। সে যেমনভাবে দাঁড়িয়েছিল তেমনভাবে বলল, ড্রাইভার তো তোমাদের গাড়ি চালায়, তাকে এত ভয় পাবার কী আছে?
আছে, আছে, ড্রাইভার জানামাত্র বাবাকে ফোন করে বলবে।
এতক্ষণে মুক্তা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, সে মুচকি হাসি হসে বলল, তাহলে তো ভালোই হলো। ছেলের বাবা মানে আমার শ্বশুরকে পাওয়া গেল আর একজন সাক্ষীও পাওয়া গেল।
মিনু প্রচণ্ড রেগে গেল, সে চাপাস্বরে বলল, মুক্তা চুপ! তুমি কিচেনে থাক দেখি আমি কোনোকিছু বলে বোঝাতে পারি কী না।
মিনু দরজা খুলে দিয়ে একটা ঢোক গিলে বলল, আঙ্কেল আপনি?
হ্যাঁ, চলে এলাম।
ঠিক আছে কিন্তু আপনি তো কখনও ফোন না করে আসেন না বলতে বলতে সে বাসার ভিতরে ঢুকলো।
মুক্তা মনে মনে চাচ্ছিল যে ড্রাইভার তাকে দেখুক এবং খবরটা তার বাবা পর্যন্ত যাক যাতে করে মিনু কোনোভাবে তাকে অস্বীকার করতে না পারে। কুদ্দুস কিচেনের দিকে যেতে উদ্যাত হলে মিনু জিজ্ঞেস করল, বুয়া আসেনি আঙ্কেল, আমি বাজারও করিনি। আপনি এসেছেন এখন সবকিছু দেখে বাজার করুন। আপনি বরং আরও দুয়েকদিন থাকতে পারতেন।
কুদ্দুস কিচেনের দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো। হয়ত মুক্তাকে দেখে ফেলেছে কিন্তু সেটা মিনুকে জানাতে চায়নি তাই পিছু ফিরে তার রুমে চলে গেল।
মিনু আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না কিন্তু সে জানে তাকে নিষেধ করে কোন লাভ নেই সে বাবার খাস লোক। সে যদি দেখে ফেলেছে তবে বাবাকে না জানান পর্যন্ত তার পেটের ভাত হজম হবে না। অবশ্য তার প্রতিক্রিয়া কিছু বোঝা না গেলেও সে যে দেখেছে তা মিনু নিশ্চিত হলো কয়েক মিনিট পরেই।
চৌধুরী সাহেব মিনুকে মোবাইল করল, ততক্ষণে কুদ্দুস বেরিয়ে গেছে হয়ত বাইরে গিয়েই বাবাকে ফোন করেছে।
মিনু ফোন রিসিভ করল, হ্যালো বাবা, আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস বাবা?
ভালো বাবা, তুমি?
এই তো আছি আর কী?
কুদ্দুস পৌঁছেছে?
জি বাবা।
আচ্ছা।
কোন সমস্যা নেই তো?
না বাবা। কী সমস্যা থাকবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, রাখছি।
ওকে বাবা।
মিনু ফোন রেখে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, উফ্।
মুক্তা কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো, কী হলো? কোন প্রবলেম?
হ্যাঁ প্রবলেম তো বটেই। এখন কী করা যায়?
কী করা যায় মানে? আজ তো আমাদের বিয়ে করার কথা, তুমি তোমার বাবাকে বল, মুক্তা খুব সহজভাবে বলল।
মিনু আকাশ থেকে পড়ল, তোমার মাথা খারাপ! বাবা আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিবে।
তো?
এখানে থাকলেও তো ড্রাইভার আঙ্কেল তোমাকে দেখে ফেলবে। এই বেটা আবার কোনোকিছু না বলে হঠাৎ করে চলে এলো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। নিশ্চয়ই কুদ্দুস আঙ্কেল তোমাকে দেখেছে, আর তোমাকে দেখেই বাবাকে ফোন করেছে। বাবা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ তাই জেনেশুনেও এড়িয়ে গেল কিন্তু এবার কুদ্দুস আঙ্কেল এসে তো তোমাকে সামনাসামনি দেখবে।
তুমি কুদ্দুস আঙ্কলকে ম্যানেজ করতে পারবে না?
অসম্ভব। সে বাবার খাস লোক। তাকে ম্যানেজ করতে চাওয়া মানে বাবার কানে সব খবর চলে যাওয়া। আমার তো মনে হয়েছে কুদ্দুস আঙ্কেল দেখেছে এবং বাবাকে বলেছে নইলে বাবা হঠাৎ করে ফোন করবে কেন।
মুক্তা বুঝতে পারছিল মিনু তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না, একসময় ভালোবাসার অভিনয় করে তাকে নিয়ে এসেছে, এখন স্বার্থ হাসিল করে তাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে কিন্তু মুক্তার কী হবে? মুক্তার তো পিছু ফেরার পথ নেই। মুক্তা কয়েক মুহূর্ত মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, নাকি তুমি ম্যানেজ করতে চাচ্ছ না?
মিনু রেগে গেলা, মুক্তা!
মুক্তা বুঝতে পারল মিনু রেগে গেছে কিন্তু সে মিনুকে এই মুহূর্তে রাগাতে চায় না। সে মিনুর কাছে গেল তার বুকে মাথা রেখে বলল, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি হীরা। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি, আমার পিছু ফেরার পথ নেই। প্লিজ তুমি সবকিছু ব্যবস্থা কর। কুদ্দুস আঙ্কলকে বোঝাও, আঙ্কলকে দিয়ে তোমার বাবাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা কর।
মিনু কিছুটা উদাস হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আসলে নিজেকে লুকানর চেষ্টা করছে, সে মুক্তার চোখে চোখ রাখছে না।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। মিনু বলল, দাঁড়াও আমি দেখি বলে মিনু লুকিং মিররে গিয়ে দেখে আবার মুক্তার কাছে ফিরে এসে ফিসফিস করে বলল, কুদ্দুস আঙ্কেল, এখন!
এখন কী, কথা বল।
হ্যাঁ, তাই বলছি, তুমি কিন্তু কোন কথা বল না।
কুদ্দুস বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাসায় ঢুকলো। সে কিচেনের দিকে যেতেই মিনু ব্যাগ হাতে নিল, আঙ্কেল, আমাকে দিন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
কুদ্দুস নিষেধ করল, না, না তোকে নিতে হবে না।
মিনু একরকম পথ আগলে রাখল। কুদ্দুস বলতে শুরু করল, মিনু তুই যখন ছোট ছিলি তখন থেকে কোনদিন তোকে আমি কোন কষ্ট পেতে দিইনি, একটা ফুলের আঘাতও লাগতে দিইনি, এটা তো বাজারের ব্যাগ, আমি তোকে এত ভারি ব্যাগ নিতে দিব ভেবেছ?
মুক্তার মাথায় একটা কথা যেন চক্কর লাগল। কুদ্দুস হীরাকে মিনু বলল, এখন মুক্তার মনে পড়ছে, সেদিন হীরা যখন ফোনে কথা বলছিল তখন তাকে মেয়েটি বার বার মিনু মিনু বলছিল কিন্তু মুক্তা তখন বুঝতে পারেনি। তবে কি হীরার নাম হীরা নয়, মিনু। মুক্তার নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো। একটা প্রতারক, ভণ্ড যে কিনা ফেক আইডি খুলে তার সঙ্গে প্রেম করেছে আর সে কী না তার কথায় বাড়িঘর ছেড়ে, বাপ-মা ছেড়ে চলে এসেছে। উফ্ মুক্তার মনে হলো বিল্ডিংয়ে ছাদ ফেটে, মাটি গভীর হয়ে যাচ্ছে আর সে মাটির নিচে ঢুকে যাক। তার চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করল কিন্তু মিনু তাকে কিচেনে থাকতে বলেছে, চিৎকার করলে, সিন ক্রিয়েট করলে সে রেগে যাবে। তাই সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল।
মিনু একরকম জোর করে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বলল, আঙ্কেল আজকের দিনটা অন্তত আমি দরজা থেকে কিচেনে নিয়ে যাই। তুমি তোমার রুমে যাও আমি আসছি।
অগত্যা কুদ্দুস একবার মিনুর আপাদমস্তক তাকিয়ে বলল, সব বড় লোকদের খামখেয়ালি। তারপর তার রুমে চলে গেল।
মিনু ব্যাগ নিয়ে কিচেনে এসে মুক্তাকে ফিসফিস করে বলল, তুমি থাক আমি দেখি কথা বলে, তাছাড়া তো আর উপায় দেখছি না।
মিনুর কথায় মুক্তার মনটা যেন আনন্দে নেচে উঠল, সে মিনুর একটা হাত ধরে চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, পারবে, তুমি পারবে মিনু। আমি পৃথিবীর সব ছেড়ে এসেছি শুধু তোমার জন্য, আমি তোমাকে হারাতে পারব না। প্লিজ তুমি তোমার বাবাকে বোঝাও, আমার মনে হয় তুমি বোঝালে তিনি বুঝবেন।
মুক্তা মিনুকে হীরা নামেই জানত। এবারই প্রথম সে মিনু নামে ডাকলো। তার মুখে প্রথম মিনু ডাক শুনে মিনু মৃদু হেসে বলল, শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমাকে পাবার জন্য হীরা নাম রেখেছি মুক্তা। তাহলে হীরা আর মুক্তা মিলবে।
অনেক রাগ, ক্ষোভ আর কষ্টের মাঝে একটা শুষ্ক হাসি হেসে মুক্তা মাথা উঁচু-নিচু করে বলল, এখন মিলানর চেষ্টা করুন স্যার।
মিনু কুদ্দুসের রুমে গেল। মুক্তা পা টিপে টিপে মিনুকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। ভেজান দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে কুদ্দুস দেখে ফেলতে পারে ভেবে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে একটু দূর থেকে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করল। দুজনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ফিসফিস করে অনেকক্ষণ কথা বলল তারপর কুদ্দুস মোবাইল ফোনে অনেকক্ষণ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলল তারপর আবার কুদ্দুস আর মিনু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলল। মিনু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে তেমন দক্ষ না, তার দুয়েকটা কথা মুক্তা বুঝতে পারল কিন্তু মিনু তেমন কথা বলল না, সে বার বার দরজার দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে ইশারা ইঙ্গিতে কুদ্দুসকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কুদ্দুসের আঞ্চলিক ভাষায় কথার একবিন্দুও মুক্তা বুঝতে পারল না।
মিনু বেরিয়ে এলো কিন্তু তার মুখ দেখে মুক্তা কিছু অনুমান করতে পারল না। মিনুকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আঙ্কেল বাবার সঙ্গে কথা বলে জানাবে।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর কুদ্দুস আবার মিনুকে তার রুমে ডাকলো। আবার দরজা ভিজিয়ে দিয়ে দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর মিনু বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে মুক্তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করেছে, সে অপেক্ষা করছিল একটা সুসংবাদের আশায়, মিনুর একটা হাসি মুখের, ভিডিও কলে যে প্রাণ খোলা হাসি দেখে মুক্তা ঘর ছেড়েছে, সেই হাসি দেখার অপেক্ষায়।
মিনুর হাসির ভাষা মুক্তা বুঝল না। তার হাসিতে কেমন যেন একটা জড়তা আছে, সে হাসছে কিন্তু তার মুখ হাস্যোজ্জ্বল না, তবুও মুক্তার তার কথায় বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
তেইশ
আমরা কাজি অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি শহরে প্রথম এসেছি তার ওপর যেদিন এসেছি সেদিন থেকে ঘরে বন্দি, একবারও তুমি আমাকে ঘর থেকে বের হতে দাওনি, আমারও ঢাকা শহরে এত মানুষজনের সামনে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে না কিন্তু তাই বলে আমি তোমার স্ত্রী হব, আমি তোমার কাছে ছুটে এলাম আর তুমি আমাকে ঢাকা শহরটা একটু ঘুরে দেখাবে না তা কী করে হয়। আসলে তুমি আমাকে আপন করতে পারিনি, তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারনি, তুমি আমাকে স্ত্রী ভাবতে পারনি, আমাকে রক্ষিতার মত রেখে ভোগ করেছ।
তখন সন্ধ্যা, আলো ঝলমলে ঢাকা শহর। সেদিন ছিল শুক্রবার। রাস্তায় তেমন একটা ভিড় ছিল না। আমি রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ঢাকা শহরের অপরূপ সৌন্দ্যের্যে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি তখন তোমার কাঁধে মাথা রেখে কল্পনার রাজ্যে ভাসছিলাম, আমার মনে তখন আনন্দের উছলে পড়া ঢেউ। আর কিছুক্ষণ পর আমরা কাজি অফিসে পৌঁছাব, তুমি আমাকে বিয়ে করবে, আমরা ঢাকা শহর থাকবো। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে, আমাদের ছেলেমেয়ে হবে কিন্তু কাজি অফিস আর কতদূর!
আমার মাথায় একটা কথা ঘুরপাক করছিল, তুমি কেন তোমাদের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ না। কিন্তু তোমাদের গাড়ি আমি চিনতাম না, ড্রাইভারকে তো চিনতাম। তোমাদের গাড়ি হলে তো কুদ্দুস আঙ্কেল গাড়ি চালাত। আমি একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলাম কিন্তু তোমার গম্ভীর কালো মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারলাম না।
একটা স্পিড ব্রেকারে গাড়ি ব্রেক কষল। আমি রাস্তার দিকে তাকালাম, রাস্তার সাইনবোর্ডে লেখা টঙ্গী, গাজিপুর। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাজিপুর কেন? আমরা কোথায় যাচ্ছি মিনু?
তুমি আমার বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে বললে, কাজি অফিস।
কিন্তু আমরা তো ঢাকা ছেড়ে অন্য একটা জেলায় এলাম, এতদূর কেন, ঢাকায় কি কাজি অফিস নেই?
তুমি আমাকে কাছে টেনে নিলে, আমার কানে ফিসফিস করে বললে, আস্তে বল তারপর ড্রাইভারের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললে, শুনতে পাবে তো।
আমি তোমার মুখের দিকে তাকালাম, রাস্তার ঝিলমিল আলোর টুকরো, আলো আঁধারি তোমার মুখের ওপর খেলা করছে, আমি তোমার চোখ চোখ রাখতে চাইলাম, তুমি নিজেকে লুকালে। আমি তোমাকে চিনতে পারলাম না।
তুমি বললে, গাজীপুরে তোমাদের কোম্পানির এক ম্যানেজারের বাড়ি, ওদের বাড়িতে কাজি এনে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। কুদ্দুস আঙ্কেল তো সেই ম্যানেজারের বাসা চিনে না, সেজন্য এই ড্রাইভারকে নিয়ে এসেছি।
তোমার কথায় আমি সন’ষ্ট হতে পালাম না, তোমার কথা আমার সুবিধার মনে হয় নি, আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আমার কাছে তোমার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট এবং ষড়যন্ত্রমূলক মনে হচ্ছিল। আমি আমতার আমতা করে তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকা শহরে এত কাজি অফিস থাকতে…
তুমি আমার কথায় বাধা দিয়ে বললে, শুধু কাজি অফিস থাকলে তো হবে না। দু’জন সাক্ষী, একজন মৌলভি লাগবে। একটা বিয়ে বিয়ে ভাবও তো লাগবে, বলে তুমি একটা রহস্যময় হাসি হাসলে।
আমি বুঝতে পারলাম না, তোমার কাছে তো হাসিই সব। এই হাসি দিয়েই তো তুমি সুন্দর সুন্দর মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছ, এই হাসি দিয়েই তাদের ধরে রেখেছ, এই হাসি দিয়েই তুমি সবার সাথে প্রতারণা করেছ।
গাড়ি গাজিপুর চৌরাস্তা পার পার হয়ে কিছুক্ষণ চলার পর সোজা যেতে যেতে একটা সাইড রাস্তায় ঢুকলো। আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠল, আমি মনে মনে ভাবলাম, আমি আবার কোন ভুল করছি না তো।
আরও কয়েকমিনিট চলার পর হঠাৎ জোরে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। আমি আরও ভয় পেলাম।
তুমি জিজ্ঞেস করলে, কী হলো আঙ্কেল?
সাইড রাস্তাটা ছিল সিঙ্গেল। একটা গাড়ি আমাদের গাড়ির গতিরোধ করে দাঁড়ালো। আমাদের গাড়ি দাঁড়ান মাত্রই সামনের গাড়ি থেকে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে আমাদের গাড়ির দরজা খুলল। তোমাকে একদিকে আর আমাকে আরেক দিকে টেনে হিঁচড়ে বের করল। তোমার মাথায় কয়েকটা কিল-ঘুঁষি মারতে শুরু করল, আমি চিৎকার করতে চাইলাম কিন্তু ততক্ষণের ওরা আমার মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে, আমি হাত-পা ছুঁড়োছুঁড়ি করছিলাম কিন্তু ওরা আমার হাত-পা চেপে ধরেছে। অনেকক্ষণ গাড়ি চলল, আমি বুঝতে পারছিলাম গাড়ি ধীরে ধীরে গভীর জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে। আমার মাথায় তখন একসাথে দুটো চিন্তা, নিজেকে কীভাবে রক্ষা করব আর তোমাকে ওরা মেরেই ফেলল কী না।
ওরা আমাকে গাড়ি থেকে নামালো। আমার ওপর চলল পাশবিক নির্যাতন, কয়েকজন পুরুষ একে একে বলতে বলতে মুক্তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো, তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
এবার মুক্তা প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল, তুমি বল সেদিনের গাজিপুর জঙ্গলে আমার ওপর যে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে তা কি আমি ভুলে গেছি? আমি তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করব না। শুধু আমি না, এখানে কেউ কাউকে ক্ষমা করে না। একটা কথা মনে রেখ ক্ষমা অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়। পৃথিবীতে যদি প্রতিটি অপরাধের শাস্তি হতো তবে অপরাধ কমে যেত, মানুষ মানুষকে ক্ষমা করে, কেউ কেউ বিড়ম্বনার ভয়ে বিচার চায় না, আবার কেউ বিচার চেয়ে পায় না, তাইত মানুষ দুনিয়াতে দিব্যি সব অপরাধ করে এবং পারও পায়।
তুমি আমার কথাই বল, বাবা থানায় মিসিং কেস করল। পুলিশ কি আমাকে খুঁজে বের করল? অথচ পুলিশ যদি দ্রুত অ্যাকশনে যেত তবে আমাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারতো। ওরা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলল। অবশ্য বাবাও সময় নষ্ট করেছে।
মিনু অভিমানের সুরে বলল, সে অপরাধও কি আমার? পুরো পৃথিবীর অপরাধের শাস্তি কি আমাকে পেতে হবে?
না, তা পেতে হবে কেন? যে যতটুকু অপরাধ করেছে তাকে ততটুকু শাস্তি পেতে হবে। তোমার বাবার শাস্তি নিশ্চয়ই দেখেছ?
মিনুর চোখের সামনে তার বাবার সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ছবি ভেসে উঠল। মিনু বাবা, বাবা, বাবা…বলে জোরে চিৎকার করে উঠল কিন্তু কণ্ঠস্বর দিয়ে কোন কথা বের হলো না। সে কাত ফিরতে চাইল কিন্তু ফিরতে পারল না। সে মুক্তাকে কাছে ডাকতে চাইল কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। সে মুক্তাকে কাছে আসার ইশারা করল, তার প্রচণ্ড ইচ্ছা হলো মুক্তার চোখের পানি মুছে দেয়, তাকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু সে তো আসলে মুক্তার ছবি নভো থিয়েটারের পর্দায় দেখছে, মুক্তার সঙ্গে যা করা হয়েছে তারই চলচ্চিত্র দেখছে।
প্রচণ্ড ব্যথায় আমি কাতরাচ্ছিলাম তবুও ওরা আমাকে ছাড়েনি, শেষ পর্যন্ত আমি ওদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলাম, শুধু আমার জীবনটা চেয়েছিলাম। বলেছিলাম তোমরা আমাকে বাঁচতে দাও, আমি তোমাদের কিচ্ছু করব না। কোনদিন কাউকে বলব না। আর বলব কী আমি তো তোমাদের কাউকে চিনিই না।
ওদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে বলছিল, মেয়েটা এত করে বলছে, ছেড়ে দিই। আরেকজন ধমকের সুরে বলল, বসের নির্দেশ নেই।
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, মুক্তা, মুক্তা তুমি কোথায়? ওরা কি তোমাকে মেরে ফেলেছে নাকি তুমি বেঁচে আছ মুক্তা?
মুক্তার অভিমানী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কেন, বেঁচে থাকলে মেরে ফেলবে আর মরে গেলে ভাববে আপদ দূর হয়েছে? ওরা তোমাকে তো বাঁচিয়ে দিল, তোমার হব স্ত্রীকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে গেল তুমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে না কেন? তোমার কিছুই হলো না কেন? লোক দেখান ওরা তোমাকে দু’য়েকটা কিল-ঘুষি মারল তারপর জামাই-আদর করে তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দিল কেন?
মিনু কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, মুক্তা, সরি মুক্তা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি এসব কিছু জানতাম না। সব কুদ্দুস আঙ্কেল আর বাবা জানে।
একটা মেয়ে তোমার ভালোবাসার টানে নিজের লেখাপড়া, বড় হওয়ার স্বপ্ন, বাবা-মা’র স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে তোমার কাছে ছুটে এলো আর তুমি তাকে পণ্যের মত ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিলে? একদল সন্ত্রাসী তোমার ভালোবাসার মানুষকে কুকুর-শেয়ালের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তোমার ভালোবাসার মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলবে এটা তুমি করতে পারলে? তোমার মত প্রতারক, ভণ্ড, অমানুষের কোন ক্ষমা নেই, আছে শুধু অনন্তকাল ভয়ানক শাস্তি।
ও তুমি তো বলছ তুমি কিছু জান না, কুদ্দুস আঙ্কেল আর বাবা জানে তাহলে দেখ বলতেই মিনুর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের দৃশ্য কুদ্দুস আর চৌধুরী সাহেব ফোনে কথা বলছে।
কুদ্দুস বলছে, ভাইজান একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
কী সমস্যা?
আমার ভাতিজা তো বউমা নিয়ে এসেছে।
বউমা নিয়ে এসেছে মানে? মিনু বিয়ে করেছে?
জানি না, আমি তো এই মাত্র বাসায় এলাম, এসে দেখি বাসায় একটা মেয়ে, ও লুকাতে চেয়েছিল কিন্তু আমি দেখে ফেলেছি।
তারপর?
তারপর আমি বাইরে এলাম এসে তো আপনাকে ফোন করছি।
চৌধুরী সাহেব ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। সবকিছু শুনে উত্তেজিত হলো না, গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি জানতে পারনি বিয়ে করেছে কী না?
মনে হয় করেনি। করলে লুকাতে চাইবে কেন?
তুমি আগে শোন, বিয়ে করেছে কী না, তারপর আমাকে জানাও।
জি আচ্ছা, জি আচ্ছা বলে কুদ্দুস বাসায় ফিরে মিনুকে তার রুমে ডেকে নিয়ে কথা জিজ্ঞেস করল, মিনু তুই কি ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করেছিস?
মিনু না সূচক মাথা নাড়লো।
বিয়ে করবি?
মিনু আবারও না সূচক মাথা নাড়লো তার ফিসফিস করে আঞ্চলিক ও চলিত ভাষা মিলিয়ে বলল, আমি তো করতে চাচ্ছি না কিন্তু ও এখন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। বলছে বিয়ে না করলে নাকি সুইসাইড করবে।
তার মানে তোর বিয়ে করার ইচ্ছা নেই?
মিনু না সূচক মাথা নাড়লো।
আচ্ছা। তাহলে আমি দেখি ভাইজানের সঙ্গে আলাপ করে।
কুদ্দুস চৌধুরী সাহেবকে ফোন করল, ভাইজান ওত বিয়ে করতে চায় না কিন্তু মেয়েটা ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
ওকে, তুমি একটা কাজ কর, ওকে বল সন্ধ্যা সাতটায় রেডি থাকতে, ও মেয়েটাকে বলবে ওরা কাজি অফিসে যাচ্ছে। আমি একটা গাড়ি পাঠাবো, ঐ গাড়িতে দু’জনে কাজি অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। তোমার যাওয়ার দরকার নেই আর মিনুকেও বল ও যেন মোবাইল ফোন নিয়ে না যায়।
আচ্ছা।
মিনু হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মুক্তা আমি তো জানতাম কারও কাছে অপরাধ করলে সে যদি মাফ করে দেয় তবে সে মাফ পাবে। তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি মাফ করে দিলেই তো…
মুক্তা মিনুর কথার মাঝে প্রতিবাদ করে বলল, আমি, আমি কেন তোমাকে মাফ করব? আমি কি সেই শীতের রাতে আমার ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা ভুলে গেছি? আমি কাউকে ক্ষমা করব না। বাবা থানায় জি.ডি করল, পুলিশের কাজ ছিল আমাকে খুঁজে বের করা। অথচ আমি একটা মানুষ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলাম তারা দায়সারা গোছের খোঁজাখুঁজি করে ফিরে গেল। তারা যদি চেষ্টা করত তবে আমাকে খুঁজে বের করতে পারতো। তোমাদের তথাকথিত পৃথিবীতে কারও জবাবদিহিতা না থাকতে পারে কিন্তু এখানে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। তাদেরকেও শাস্তি পেতে হবে, ভয়ানক শাস্তি, বলে মুক্তা চলে গেল।
মিনু আবেগজড়িত কণ্ঠে ডাক দিল, মুক্তা, মুক্তা, কোথায় যাচ্ছ, আমাকেও নিয়ে যাও। মুক্তা…
মুক্তা হারিয়ে গেল। মিনু চিৎকার করে উঠল, মুক্তা তুমি অন্তত এটুকু বল তুমি মরে গেছ নাকি বেঁচে আছ? আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি।
চব্বিশ
ওসি সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভাবছেন এমন সময় রাশেদ সাহেব ওসি সাহেবের চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইল, স্যার আসব?
ওসি সাহেব চোখ মেলে তাকালেন, তাড়াতাড়ি চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, এস, এস।
রাশেদ ওসি সাহেবের চেম্বারে ঢুকে চেয়ারে বসল।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বল, কী নিয়ে এসেছ?
রাশেদ তার হাতে থাকা ফাইল থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে বলল, স্যার মুক্তা মিসিং কেসের বিষয় কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
হ্যাঁ কতদূর এসলে?
স্যার যেদিন মুক্তা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সেদিন থেকেই তার মোবাইল ফোন অফ আর সে যে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করত সেটাও ডিএক্টিভ করা হয়েছে।
ওর মোবাইল ফোন অফ করা আর ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভ করার আগে যাদের সঙ্গে কথা বলেছে তাদের ফোন নাম্বারগুলোর কলরেকর্ড কালেক্ট করেছ?
জি স্যার।
সুমী নামে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছে।
সুমীর সঙ্গে কথা বলেছ?
জি স্যার।
কোন ইনফরমেশন পেয়েছ?
না স্যার, মুক্তা আর সুমী একসঙ্গে কলেজ যেত। সেদিনও একসঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু ফেরার সময় মুক্তার সঙ্গে সুমীর দেখা হয়নি। আর একটা নম্বরের সঙ্গে এক মিনিটের মত কথা বলেছে। তবে সেই নাম্বারটার সঙ্গে আগেও কয়েকবার কথা বলেছে।
তুমি সেই সাসপেক্ট নাম্বারটার সঙ্গে কথা বলেছ?
না স্যার, সেদিন থেকে ঐ নাম্বারটাও অফ।
সিমকার্ড ডিটেইলস বল।
মঞ্জুর হোসেন চৌধুরী মিনু, পিতা : আব্দুস সোহবহান চৌধুরী, হালিশহর, চট্টগ্রাম।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, পেশা?
ছাত্র।
নাম্বারটার সর্বশেষ লোকেশন কোথায়?
বনানী, ঢাকা।
ওসি সাহেব ভ্রু’কুঁচকে বললেন, এটাই ক্লু হতে পারে। সেই নাম্বারটা যাদের সঙ্গে কথা বলেছে তাদের সঙ্গে কথা বল কোন ইনফরমেশন দিতে পারে কী না।
জি স্যার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি কিন্তু সেরকম কিছু পাইনি। মিনু ভার্সিটি পড়-য়া এক ছাত্র।
কিন্তু ফোন বন্ধ করবে কেন? একই দিন থেকে মুক্তার ফোন বন্ধ আর মিনুরও, না, না এটা কাকতালীয় হতে পারে না, পরিকল্পিত। রাশেদ তুমি মিসিং কমপ্লেইনটা সব থানায় জানিয়ে দাও। ওর বন্ধু-বান্ধবদের লিস্ট কালেকশন করে দেখ, আরও কেউ নেই নাকি, আই মিন কোন ছেলে কলেজে আসছে না বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারও না কারও সঙ্গে তো পালিয়েছে আমার ধারণা, এ বয়সের মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার কেসটা এরকম হওয়াই স্বাভাবিক।
জি স্যার। আবার অপহরণও হতে পারে আই মিন হয়ত কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তারপর তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে।
তাও হতে পারে।
জি স্যার।
তাহলে আপাতত সাসপেক্ট ঐ একটা মোবাইল নাম্বার। তুমি প্রস’তি নিয়ে রেখ, ভেরি সুন আমরা মিনুকে আ্যরেস্ট করব।
রাশেদ মিনমিন করে বলল, মিনুকে আ্যরেস্ট করা যায় কিন্তু সেটা হবে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ার মত স্যার।
কেন, তোমার এমন মনে হচ্ছে কেন?
মিনু বলবে, আমার সিমকার্ড নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ফোন বন্ধ।
আচ্ছা তাকে আ্যরেস্ট না করা হোক তার কাছে তো কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে যা হয়ত মুক্তাকে খুঁজে পেতে কাজে লাগবে।
জি স্যার।
মিনুর ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে আর কোন সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন আছে?
জি স্যার। মোট তিনটা সিমকার্ড কেনা আছে।
তারমধ্যে কোন সিমকার্ড চালু আছে।
জি স্যার একটা সিমকার্ড চালু আছে।
তুমি ফোন করেছিলে?
জি স্যার তবে কোন কথা বলিনি।
কেন?
কথা বললে মিনু সাবধান হয়ে যেতে পারে।
গুড।
আর কোন কল কর না।
জি স্যার।
মিনুর মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই। সে গাজিপুর থেকে বাসায় ফেরার পথে টঙ্গী ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তা তার কাছে আসার আগে যে সিমকার্ডটা ব্যবহার করত সেটা সেট আলাদা করে নদীতে ফেলে দিল। হীরা নাম দিয়ে খোলা ফেসবুক আইডিটা মুক্তা যেদিন এসেছে সেদিনই সে ডিএক্টিভ করেছে। মুক্তা, যে মেয়েটি তার ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছিল, যে মেয়েটি তার প্রতিটি কথা সরলভাবে বিশ্বাস করেছিল সে মেয়েটিকে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দিয়েও তার মধ্যে কোন অনুতাপ নেই, কোন পাপবোধ নেই।
সে বাসায় ঢুকে কাপড়-চোপড় ছেড়ে পুরো রুমটা একটা ভালো করে চোখ বুরিয়ে নিল মুক্তা কোন জিনিসপত্র ছেড়ে গেছে কী না। না মুক্তা কোনোকিছু ছেড়ে যায়নি। সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুক্তাকে উদ্দেশ্য করে আপনমানে ফিসফিস করে বলল, বিয়ে না করলে আমার বিরুদ্ধে ধর্ষণ কেস করবে, না? আমাকে হুমকি দেখাও?
যাও, যাও, ধর্ষণ কেস যখন করবে তবে আগে ধর্ষণ হও নইলে তো আবার কেসটা মিথ্যা হবে। তুমি তো আসলে ইনোসেন্ট গার্ল, তুমি মিথ্যা কেস করবে কেন, তাই তুমি যে কেসটা করবে সেটা সত্যি করে দিলাম কিন্তু তারচেয়ে বেশি সত্যি কি জান?
তারচেয়ে বড় সত্যি হলো তুমি আর কোনদিন কেস করতে পারবে না। তুমি কেসটা ওপারে গিয়েই দাও। আমি আমার রুম থেকে, আমার মন থেকে তোমার সব স্মৃতি, তোমার সব আলামত মুছে ফেলতে চাই এমনি নানান কথা বিড়বিড় করে বলতে বলতে কখন মিনু ঘুমিয়ে পড়েছে তার মনে নেই।
মিনুর ঘুম ভাঙল তার মোবাইল ফোনের রিংয়ের শব্দে। সে ঘুমে জড়ান গলায় ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
দরজা খোল।
কে? এত সকালে…
দরজা খোল, আমরা পুলিশ।
পুলিশ, হোয়াট।
মিনু আপনমনে ফিসফিস করে বলল, দেশটা কি ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে গেল নাকি? পুলিশের হাতে কি রাডার আছে নাকি? হতে পারে পুলিশ মুক্তাকে খুঁজতে গিয়ে আমার নাম্বার বা ফেসবুক আইডি বা কোন কানেকশন পেয়েছে? কিন্তু তারপরের ঘটনা তো পুলিশের জানার কথা নয়… বলে মিনু গলা ঝেড়ে নিল, না, না আমার নরম হলে চলবে না। আমার এখন মনের জোর ঠিক রাখার সময়।
মিনু কুদ্দুসকে ডাকলো, আঙ্কেল, আঙ্কেল।
মিনু ঘুমে জড়ান গলায় বলল, কী হয়েছে মিনু?
আঙ্কেল দরজায় পুলিশ।
পুলিশ!
হ্যাঁ।
কুদ্দুস আপনমনে বলল, পুলিশ টের পায়নি তো, না, না টের পাওয়ার তো কথা না।
মিনু জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল পুলিশ কোনোভাবে টের পায়নি তো।
কুদ্দুস মিনুকে অভয় দিল, তুই মোটেই ভয় পাবি না, একেবারে স্বাভাবিক।
জি আঙ্কেল।
দুজনে দরজার কাছে এসে লুকিং মিরর দিয়ে দেখলো। কয়েক জন পুলিশের একটি দল। কুদ্দুস দরজা খুলে দিল, তার পাশে মিনু দাঁড়িয়ে আছে।
রাশেদ কোন কথা না বলে মুক্তার ছবি দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটিকে চেন?
মিনু চোখ হাত দিয়ে মুছে বলল, এই মেয়েটি, এই মেয়েটি….না তো।
এই মেয়েটির সঙ্গে তুমি অনেকবার কথা বলেছ? অন্য একটা সিমকার্ড দিয়ে।
বলেছি হয়ত। মোবাইল ফোনে তো কতজনের সঙ্গেই কথা বলি।
তোমার একটা ফেসবুক আইডি ছিল হীরা নামে?
হীরা নামে ফেসবুক আইডি! এরা সব জেনে ফেলেনি তো। ও মাই গড। সব জেনে ফেললে তো আমি শেষ কথাগুলো আপনমনে বলে মিনু পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি চিটাগাং থেকে এসেছেন?
পুলিশের কোন এলাকা নেই। সারাদেশই পুলিশের এলাকা। কেন চিটাগাং থেকে এলে কী হত? তাহলে আমার বাবাকে আপনারা চিনতেন। আমি মতলুব চৌধুরীর ছেলে। মা নেই, বাবা চিটাগাং থাকেন আমি ঢাকায় লেখাপড়া করি, স্টুডেন্ট মানুষ, একা থাকি ফেসবুক চালাই, বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে আড্ডা দিই, হৈ চৈ করে দিন কাটাই। কখন কার সঙ্গে কথা বলি ঠিক নেই। বলে মিনু একটা কৃত্রিম ঢোক গিলে বলল, আচ্ছা বলুন তো মনি না মুক্তা মেয়েটার বাড়ি কি ঢাকা বা চিটাগাং?
না, ঢাকা চিটাগাং না।
তাহলে আমি চিনব না। আমি ঢাকা বা চিটাগাংয়ের বাইরে কোনদিন যাইনি, উফ্ আপনারা শুধু শুধু সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙ্গালেন।
রাশেদ ওসি সাহেবকে ফোন করল, স্যার।
হ্যাঁ রাশেদ বল, মিনুকে পেয়েছ?
জি স্যার।
কোন ইনফরমেশন পেয়েছ?
না স্যার। ঠিক আমি যা যা বলেছিলাম তাই বলছে।
ওকে। তুমি ব্যাক কর।
জি স্যার।
সরি মিনু।
ওকে অফিসার।
রাশেদ তার টিম নিয়ে ফিরে এলো। মুক্তার বাবা যদি আরও আগে পুলিশের শরণাপন্ন হত আর পুলিশ যদি তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যেত তবে মুক্তাকে রক্ষা করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হত। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, পুলিশের সহযোগিতার প্রতি জনগণের আস্থার অভাবের কারণেই মুক্তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলো না।
মিনু আবারও প্রমাণ করল সে একজন দক্ষ অভিনেতা এবং সুন্দর মুখ, সহজ-সরল চোখের চাহনির আড়ালে একজন ক্রিমিনাল। একটা মেয়ের সঙ্গে প্রতারণা এমনকি হত্যা পর্যন্ত করার পরও সে অত্যন্ত স্বাভাবিক।
পঁচিশ
ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিনু মুক্তার সব ঝামেলা কাটিয়ে উঠেছে। মিনুর আচরণটাও যেন পেশাদার অপরাধীদের মত, একটা মেয়েকে খুন করার পরও তার মধ্যে কোন অনুশোচনা নেই, এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে যেন মুক্তার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলেছে।
ভার্সিটিতে কয়েক দিন থেকে কোন ক্লাস হচ্ছে না, মিনু প্রতিদিন অফিসে বসছে। ভার্সিটির বাইরে সে এখন একজন পুরোপুরি ব্যবসায়ী। দিনে দিনে সে বেশ দক্ষতাও অর্জন করেছে। পুরো অফিস সামলে নিয়েছে। হবে না বা কেন? শরীরে ব্যবসায়ীর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, লেখাপড়ায় এম.বি.এ, কোনোকিছুর কমতি তো নেই।
সেদিন বর্ষা ফোন করল, মিনু তখন অফিসের একটা মিটিংয়ে ছিল। মিনু প্রথমবার বর্ষার ফোন কেটে দিল, বর্ষা আবার ফোন করলে মিনু কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, আমি একটা মিটিংয়ে আছি, দেখছ না ফোন কেটে দিচ্ছি, পরে ফোন দাও বলে মিনু ফোন কেটে দিল।
পরে বর্ষা আরও কয়েকবার ফোন দিয়েছে, কখনও অফিস টাইমে, কখনও রাতে কিন্তু মিনু বর্ষার ফোন রিসিভ করেনি। বর্ষাও নাছোড়বান্দা। সেদিন রাত্রে সে বার বার ফোন করল কিন্তু মিনু রিসিভ করল না। একদিন সকালবেলা বর্ষা কোনোকিছু না বলে হঠাৎ করে মিনুর বাসায় চলে এলো।
বর্ষার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে সহজে অনুমান করা যায় যে তার ওপর কত প্রচণ্ড বেগে ঝড় বয়ে গেছে। বর্ষার চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো যেন কোটরে বসে গেছে। লাবন্যময় মুখ রক্ষ্ণয়ে গেছে। মিনু দরজা খুলে দিয়েই চমকে উঠেছে এ কোন বর্ষাকে সে দেখছে। সে কয়েক মুহূর্ত বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বর্ষা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, এভাবে তাকাচ্ছ কেন? চিনতে পারছ না নাকি?
মিনু আমতা আমতা করে বলল, না মানে হঠাৎ চলে এলে তো তাই।
ফোন দিলে তো তুমি বাসায় নাও থাকতে পারতে। তাই ফোন না করে চলে এলাম। ফোন রিসিভ করছ না কেন?
মিনু আমতা আমতা করে বলল, না মানে, আজকাল সবসময় অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি তো।
হুম রাতেও অফিসের কাজ, না?
না, প্রব্লেমও আছে।
কী প্রবলেম? জানতে পারি?
কুদ্দুস আঙ্কেল আছে তো।
বর্ষা অবাক হলো, আগে যতবার সে বাসায় এসেছে কখনও মিনু দরজায় দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলেনি, আসামাত্র দরজা খুলে আগে ভিতরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। অবশ্য আগে যতবার বর্ষা বাসায় এসেছে তখনই মিনু বলেছে কুদ্দুস আঙ্কেল চট্টগ্রাম গেছে। বর্ষা কি ফোন না করে এসে ভুল করেছে।
বর্ষা কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, তাই বলে কি দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবে?
মিনু অপ্রস’ত হয়ে বলল, না, এস।
বর্ষা ভিতরে এলো। মিনুর মনের মধ্যে অনেক কথা ভিড় করছে, একবার একজনকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ে সে বাবা এবং কুদ্দুস আঙ্কলের সহযোগিতায় রক্ষা পেয়েছে আবার যদি কুদ্দুস আঙ্কেল এসে দেখে আবার একজন মেয়ে এসে ঝামেলা তৈরি করছে তবে তার আর শুধু মান-সম্মান তো দূরের কথা এবার বাবাও তার ওপর খুব মন খারাপ করবে, রাগও করবে। একবার সরাসরি কিছু বলেনি যা বলার কুদ্দুস আঙ্কলকে বলেছে এবার তাকেও বলবে।
মিনু আবার বলল, বর্ষা তুমি প্লিজ এখন যাও। আমি কাল বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা করব, তুমি এখন যাও প্লিজ কুদ্দুস আঙ্কেল দেখলে বাবাকে বলবে, বাবা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে।
বর্ষা মিনুর কথা খুব সরলভাবে বিশ্বাস করল, আচ্ছা।
মিনু দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল।
বর্ষা অনেক আশা নিয়ে মিনুর কাছে এসেছিল। সে ভেবেছিল মিনুকে সবকিছু বলবে তারপর বিয়ে করতে বলবে কিন্তু সে আর কথা বাড়াতে পারল না, একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, ওকে। কালকে সময় কর কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
ওকে। ঠিক আছে। আমি তোমার সব কথা শুনব। আমাকে একটা দিন সময় দাও প্লিজ!
মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বর্ষার মনে হলো মিনু হয়ত সত্যি তার সব কথা শুনবে। মিনুর বিনয়, মিনুর আশঙ্কা এবং মিনুর সব কথা শোনার প্রতিশ্রুতি শুনে বর্ষা অনেকটা আশ্বস্ হলো।
ওকে মিনু, আমি আসছি। আসলে আমারই ফোন করে আসা উচিত ছিল। ওকে বাই।
ওকে।
পরদিন বর্ষা বার বার ফোন দিল কিন্তু সেদিন মিনু ফোন রিসিভই করল না। রাতে মিনু একটা অন্য সিমকার্ড দিয়ে ফোন করল। একবার ফোন দিতেই মিনু ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
বর্ষা কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, গুড, ভেরি গুড ডিয়ার।
ও তুমি?
বাহ, খুব ভালো মিনু, আমি বার বার ফোন দিচ্ছি তুমি ফোন রিসিভ করলে না আর অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিতেই ফোন রিসিভ করলে। কী হয়েছে বল তো? তোমার কি কোন প্রবলেম? প্রবলেম থাকলে বলবা তো?
মিনু আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ প্রবলেমই তো। না, না থাক তোমার শুনে কাজ নেই।
কেন? বল?
না, থাক। তোমার কথা বল।
তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে মিনু, অনেক কথা। আজ আমাদের দেখা করার কথা ছিল।
হ্যাঁ ছিল কিন্তু বললাম না প্রবলেম আছে।
তাহলে আগামীকাল দেখা কর।
মিনু প্রথমে পরদিনও দেখা করতে রাজি হলো না। অবশেষে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর পরদিন দেখা করতে রাজি হলো। বর্ষার ইচ্ছা ছিল দূরে কোথাও যাবে, সারাদিন ঘুরে বেড়াবে, মিনুকে বিয়ে করতে রাজি করানোর চেষ্টা করবে কিন্তু মিনু দূরে যেতে রাজি হলো না। দেখা করতে রাজি হলো কেএফসি’তে।
মুখোমুখি দুটো চেয়ারে দুজন বসেছে। বর্ষা লক্ষ্য করেছে মিনু তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না, কয়েক দিন আগের খুব আপনজনকে আজ খুব দূরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, কী প্রবেলম হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?
না। তেমন কিছু না। বল তোমার খবর কী?
আমার খবর আর কী, বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এলাম, বলে বর্ষা বর্ষা গত কয়েক দিনে তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়, সমস্ত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে তার কাছে ফিরে আসার গল্প শোনাল। এমনিভাবে বিয়ের পিঁড়ি থেকে ফিরে আসার গল্পটা খুব সাধারণ না। সাধারাণত এরকম পরিসি’তিতে মেয়েরা ফিরে আসতে পারে না, অভিভাবকদের অনুরোধ, শাসন কিংবা সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মেনে নেয়, তারপর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সারাজীবন কাটিয়ে দেয় অনিচ্ছার মানুষটির সঙ্গে।
আর যারা ফিরে আসে তাদের কাছের মানুষটি ফিরে আসার পুরস্কার হিসেবে সারাজীবন বুকে আগলে রাখে হারানো অধিকার ফিরে পেয়ে। বর্ষার ধারণা ছিল সব শুনে মিনু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে, তার ভালোবাসার মানুষ তার কাছে ফিরে এসে তাতে সে অনেক খুশি হবে কিন্তু মিনুর মধ্যে তেমন কোন আবেগ নেই, বর্ষাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাল না, বলল না বর্ষা তুমি খুব ভালো মেয়ে, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো বলে আমার কাছে ফিরে এসেছ। আমি অনেক ভাগ্যবান বলে তোমাকে ফিরে পেয়েছি কিন্তু সেদিন যখন বাসায় গেল তখন একরকম জোর করে তাড়িয়ে দিল আর আজ মিনু সি’র। তার চোখে-মুখে কোন আনন্দ নেই, কোন উচ্ছ্বাস নেই, কোন আবেগ-অনুভূতি নেই। মিনু অবাক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মিনু তুমি খুশি হওনি?
মিনু সি’র শান্ত কণ্ঠে বলল, আমার খুশি-অখুশিতে কী যায় আসে বর্ষা। বিষয়টা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত।
মানে? মানে বিষয়টা শুধু আমার, আমাদের না?
বর্ষা যখন মোবাইল ফোনে মিনুকে তার বিয়ের কথা বলছিল তখন মিনুর কথাগুলো বর্ষার বিশ্বাস হয়নি। বর্ষা ভেবেছিল মিনু হয়ত তাকে রাগানোর জন্য বলছে কিন্তু আজ তার কথা শোনার পর বর্ষা বুঝতে পারল না মিনু সত্যি সত্যি তাকে নির্মম সত্য কথাগুলো বলেছিল।
মিনুকে চুপ করে থাকতে দেখে বর্ষা কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মিনু, কোন কথা বলছ না কেন? বিষয়টা আমাদের না? আমার একার?
এবার মিনু যে কথাটা বলল তাতে বর্ষার হৃদয় ভেঙে গেল। মানুষ এত স্বার্থপর, এতটা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে। মিনু বলল, বর্ষা তোমার বাবা-মা তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিল, আয়োজন করেছিল, একটা ভালো ছেলেও পেয়েছিলে, তুমি আসলে বিয়েটা করে ফেললে ভালো করতে।
বর্ষার কানে কথাগুলো পৌঁছাল বটে কিন্তু সে বিশ্বাস করতে পারল না এগুলো মিনু ভেবে বলছে নাকি, ইয়ার্কি করে বলছে, নাকি বর্ষাকে রাগানর জন্য বলছে।
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, মিনু তুমি কি সত্যি বলছ? ভেবেচিন্তে বলছ?
মিনু খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ইয়েস, বি প্র্যাকটিক্যাল বর্ষা।
বর্ষা আরও উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, মিনু তুমি কী বলতে চাও আমাকে বলত, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না?
মিনু চাপাস্বরে বলল, বর্ষা এটা হোটেল, পাবলিক প্যালেস, এখানে কোন সিন ক্রিয়েট করবে না।
বর্ষা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। সে একবার আড়চোখে কাউন্টারের দিকে লক্ষ্য করল, কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজার তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ কারও মুখে কোন কথা নেই। বর্ষা প্রথম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি তোমার জন্য চলে এসেছি মিনু। আমার পিছু ফেরার পথ নেই।
মিনু আবারও চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিল, আমার তো তোমাকে বিয়ে করার কথা ছিল না বর্ষা।
কী কথা ছিল না?
আমাদের তো কোনদিন বিয়ে করার কথা ছিল না।
ছিল না কিন্তু করলে কোন প্রবলেম?
এসব কথা তো অনেক আগেই হয়েছে বর্ষা।
কী কথা হয়েছে?
মিনু মিন মিন করে বলল, আমরা তো শুধু একসাথে, একই ছাদের নিচে থাকতে চেয়েছিলাম। আমাদের জীবনের সব ডিসিশন হবে যার যার মত। তোমার জীবনের ডিসিশন তুমি নিবে, আমার ডিসিশন আমি নিব। বল এরকম কথা ছিল না?
হ্যাঁ ছিল। সেগুলো ছিল ইমোশনাল কথা। তুমি আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেছিলে। ইমোশন আর বাস্তবতা এক না। বাস্তবতা হলো একটা মেয়ের একজন হ্যাজবেন্ড থাকবে, একটা সংসার থাকবে, দুয়েকটা বাচ্চা থাকবে।
মিনু একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, তোমাদের মেয়েদের না একটাই প্রবলেম। সব ছেলেরাই শুধু তোমাদের ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে, তোমরা কাউকে ভালোবেসে শুধু বিয়ে আর বাচ্চার স্বপ্ন দেখ, লাইফকে এনজয় করতে চাও না।
তুমি, তুমি কতজন মেয়েকে চেন। এরমধ্যে আরও কারও সাথে…
ইয়েস হতেই পারে, তোমারও হতেই পারে। তোমার সঙ্গে তো আমার এমন কোন কন্ডিশন ছিল না যে তোমার সাথে প্রেম করলে আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না।
তুমি ছেলেমানুষ, তুমি ইউরোপিয়ান স্টাইলে বড় হয়েছ, তুমি চাইলে শত শত মেয়েকে তোমার ভালোবাসা বিলাতে পার কিন্তু আমি মেয়ে, হ্যাঁ আমি বাঙালি মেয়ে, এটাই আমার অহংকার। বাঙালি মেয়েরা একাধিক ছেলের সঙ্গে রিলেশন করে না। তারা যাকে ভালোবাসে তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে, তাকেই বিয়ে করে, সংসার করে, বাচ্চা লালন পালন করে। আমি তোমার কাছে তাই চাই। আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই মিনু, বলতে বলতে বর্ষার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
মিনু মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। তার মনের মধ্যে অনেক কথার ঝড় বইছে, এ আবার নতুন কোন প্রবলেম হলো, একজনকে তো… কাটিয়ে না উঠতেই আরেকজনের মুখে সেই একই কথা, উফ্…
বর্ষা জিজ্ঞেস করল, কী চুপ করে আছ কেন?
তুমি খুব ভুল করেছ বর্ষা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি ভুল করেছি, আমি কি ভুল করেছি জান, তোমাকে ভালোবেসে আর তারচেয়ে বেশি মারাত্মক ভুল করেছি বাঙালি মেয়ে হয়ে ইউরোপিয়ান স্টাইলের একজন ছেলের সঙ্গে, ছিঃ, আমার নিজের ওপরই খুব ঘৃণা হচ্ছে।
এটাকে আমি ভুল মনে করি না। আমরা দুজনই ম্যাচুর্ড, আমরা জেনেশুনে ডিসিশন নিয়েই এটা করেছি। তুমি ভুল করেছ বিয়েটা না করে।
তার মানে তুমি ক্লিয়ার যে আমাকে তুমি বিয়ে করছ না।
উফ্, একই কথা বার বার বলা আমি পছন্দ করি না বর্ষা, প্লিজ চ্যাপ্টার চেঞ্জ কর।
বর্ষা মিনুর আচরণে হতাশ হলো, সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, আমি চাইলে তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে পারি।
বাট সেটা কি ওয়াইজ হবে?
ওয়াইজ হবে না। আমি করবও না কারণ তোমার মত একটা হৃদয়হীন, অমানুষের সঙ্গে সারাজীবন কাটান যায় না। আসলে তোমার সঙ্গে আমার রিলেশনটা ছিল অনৈতিক আর অনৈতিক সম্পর্ক দিয়ে নৈতিক অধিকার আদায় করা যায় না, বলে মিনু রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ওকে, তুমি থাক। আমি আসছি।
মিনু বলল, বর্ষা এভাবে রেগে যাবে না, সিনক্রিয়েট করে যাবে না।
ভালো মানুষেরা রেগে যায়, রাগের মাধ্যমে তাদের রিঅ্যাকশন দেখায় আর তোমার মত ভদ্রতার মুখোশ পরা অমানুষ, ভণ্ড, প্রতারকরা মিটমিট করে হেসে মরণ কামড় দেয়। আসি বাই, বাই ফরএভার।
মিনু মৃদু কণ্ঠে বলল, বর্ষা বসো।
সরি, বলে বর্ষা মিনুকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল।
মিনু বর্ষার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, যা হওয়ার ভালোই হলো।
ছাব্বিশ
অনেকক্ষণ মিনু চোখ বুজে শুয়ে রইল। এটা কি ঘুম নাকি তন্দ্রা? মিনু কিছু মনে করতে পারছে না। সে চোখ খুলল, না সে আর আগের জায়গায় নেই হয়ত। আকাশটা গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেছে, ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে একটা ভয়ঙ্কর আলো-আঁধারির খেলা শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে যেন করুণ শব্দ করে উল্কার পতনের মত আলোক রশ্মির খণ্ড পৃথিবীতে খসে পড়ছে, না খসে পড়ছে কী না বোঝা যাচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শব্দটা ভয়ঙ্কর! করুণ আর্তনাদের! মিনু ছুটোছুটি করতে চাচ্ছে কোথায় গেলে একটু আশ্রয় পাবে, নিরাপদ থাকতে পারবে সেই আশ্রয় খুঁজছে কিন্তু সে নড়াচড়া করতে পারছে না।
মুক্তা আবার এলো। মিনু কিছুটা আশ্বস্ হলো। একসময়ের বন্ধু এবং এখনকার শত্রুও বটে তবুও মিনুর কেন জানি মুক্তাকে আপন মনে হয়, মনে হয় এই বিপদসংকুল পথে বন্ধু হোক আর শত্রুই হোক মুক্তাই তার একমাত্র ভরসা। মুক্তা জিজ্ঞেস করল, বর্ষার কোন খবর জান?
হঠাৎ করে এমন প্রশ্নের জন্য মিনু প্রস’ত ছিল না। সে থতমত খেয়ে গেল, বর্ষা, কোন বর্ষা?
মুক্তা একটা তিরস্কারের হাসি হাসল, বর্ষা তোমার বন্ধু তালিকায় সবচেয়ে বেশিদিন যে ছিল, সে বর্ষা।
ও হ্যাঁ। বর্ষা তো আমার কাছ থেকে চলে গেল।
চলে গেল নাকি তুমি বিদায় করে দিলে। বর্ষা চলে যাওয়ায় তো তুমি খুশিই হলে। বর্ষাও বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসেছিল শুধু তোমার ভরসায়। ও ভেবেছিল তুমি ওকে বিয়ে করবে কিন্তু তুমি তার সাথেও প্রতারণা করলে। একটা মেয়ে বাবা-মা’র অবাধ্য হয়ে তোমার ভালোবাসার টানে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এলো আর তুমিও তাকে প্রত্যাখ্যান করলে। ঢাকা শহরে কোন চাকরি নেই, বাবা-মা’র টাকাও নেই একটা মেয়ে চলবে কীভাবে বল।
বর্ষা আমার কাছে ফিরে আসতে পারতো।
বর্ষা তোমার কাছে ফিরে আসতে পারতো, কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে মুক্তা বলল, কথাটা বলতে লজ্জা করল না তোমার। তুমি যেভাবে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছ তাতে তার কি আর তোমার কাছে তার ফিরে আসার রুচি থাকতে পারে। একটা কথা মনে রেখ গরীব, মধ্যবিত্ত মানুষের টাকা-পায়সা না থাকতে পারে কিন্তু তাদের আবেগ-অনুভূতি আছে, তাদের অপমানবোধ আছে। তুমি বোধ হয় জান না গরীব মানুষের আবেগ বেশি। দেখ না গরীব মানুষের আত্মীয়-স্বজন কেউ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় মাটিতে গড়াগাড়ি যায়, বাড়িতে তিন দিন চুলো জ্বলে না। আর তোমাদের মত ধনীদের বাবা-মা মারা গেলেও বিদেশ থেকে একটা শোকবার্তা পাঠিয়ে দাও। বর্ষার খবর তাহলে তুমি জান না?
মিনু না সূচক মাথা নাড়লো।
তারপর তুমি আবার ব্যবসায়ী হয়ে গেলে, আবার কত যে বর্ষা, মুক্তার মতো মেয়েকে ঠকালে। অবশেষে তোমার বাবা বিত্তবান পরিবারের এক সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার জন্য চাপ দিল, তুমি বিয়ে করার জন্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে আর বর্ষা বেচারা।
কী হয়েছে বর্ষার? মিনুর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
মুক্তা আবার বলতে শুরু করল, বর্ষা ফিরে এসে তার মেসে উঠল। বর্ষার হাতে কিছু জমান টাকা ছিল যা দিয়ে হয়ত তার মাস দুয়েক চলত কিন্তু এর মধ্যে তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ি থেকে আসার সময় বাবা-মা তাকে খুব বকাবকি করেছে বলতে গেলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পরিসি’তিটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে না করে সে একটা বড় রকমের অন্যায় করে ফেলেছে। কাজেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথটা বর্ষার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, মা-বাবার প্রতি তার অভিমানটাও এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে বর্ষারও আর তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
বর্ষা মমতার সঙ্গে দেখা করল। বর্ষা তার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে আসার গল্প শোনাল। শুনে মমতা বলল, ঠিকই করেছিস। আমি হলেও এমন করতাম, তোর কাছে আমার একটা কথা জানার খুব ইচ্ছা।
কী আপা?
তুই কি মিনুর জন্য বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসেছিস?
এ কথার কী জবাব দিবে বর্ষা। মমতা তো তাকে আগেই মিনুর কাছ থেকে সাবধান থাকতে বলেছিল। বর্ষাকে বলেছিল মিনু আগেও এরকম ভালোবাসার অভিনয় করে মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে…
না, না আর ভাবতে পারছে না বর্ষা। বর্ষা একটা শিক্ষিত মেয়ে, প্রেমের ফাঁদে তো পড়বে কম শিক্ষিত, অল্প বয়সের আবেগপ্রবণ মেয়ে। না, বর্ষা প্রেমের ফাঁদে না, সে আসলে মিনুর কাছে ইমশোনালি ব্লাকমেইল হয়েছে, মিনু আগে তার আবেগকে জিম্মি করেছে তারপর বর্ষা নিজেই মিনুর কাছে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। বর্ষা মমতার কথার কোন জবাব দিতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
মমতা বর্ষার কাছে গিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রেখে আরেকটা হাত দিয়ে বর্ষার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল, আমি বুঝতে পেরেছি বর্ষা। আমি আগে থেকে জানতাম এরকম একটা হবে, সেজন্য…
বর্ষা মমতার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
মমতা বর্ষার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুই কিচ্ছু ভাবিস না, আমি আছি না। আমি তোর পাশে আছি বোন, তোর যেকোন বিপদে আমি পাশে আছি।
বর্ষা মিনতির স্বরে বলল, আমাকে একটা জবের ব্যবস্থা করে দিবি আপু? তোর ওখানে?
মমতা বর্ষার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিয়ে বলল, এভাবে বলিস না বর্ষা। আমি তোকে বোন ডেকেছি না। বোন কি বোনের বিপদে পাশে না দাঁড়িয়ে পারে।
অনেক কষ্টের মাঝে বর্ষা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, থ্যাংক ইউ আপু।
মমতা সান্ত্বনার স্বরে বলল, শোন বিপদে ভেঙে পড়তে হয় না, বিপদ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। ভুল বা বিপদ থেকে শিক্ষা নিতে হয় তাতে মানুষ আবার ভুল করে না আর বিপদেও পড়ে না। আমি আশা করি তুই যে ভুলে তুই বিপদ ডেকে এনেছিস সেই ভুল আর করবি না।
কখনোই করব না আপু।
মিনু মুক্তাকে জিজ্ঞেস করল, বর্ষা, বর্ষা এখন কোথায়?
মুক্তা একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল, কেন? তুমি বেঁচে থাকলে কি বর্ষাকে খুঁজে বের করবে? বর্ষাকে খুঁজে বের করে তার যোগ্য সম্মান দিবে।
অবশ্যই।
কিন্তু তুমি তো বিয়ে করে ফেলেছ।
তবু, তবুও আমি চেষ্টা করব, আমি বর্ষাকে খুঁজে বের করব, একজন ভালো বন্ধু হিসেবে কীভাবে তার পাশে থাকা যায়।
এবার মুক্তা একটা বিকট অট্টহাসি হাসল, তার হাসিটা প্রতিধ্বনিত হয়ে বার বার তার কানে এসে বেজে উঠল। ভয়ে মিনুর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। মিনুর কণ্ঠস্বর এত ভয়ঙ্কর হলো কী করে? সে মুক্তাকে ভয় পাচ্ছে? এতক্ষণ মুক্তা নামের যে নারী কণ্ঠের সঙ্গে সে কথা বলছে সেটা কি আসলে মুক্তা না? মুক্তা নামের কোন প্রেতাত্মার সঙ্গে সে কথা বলছে।
মিনু আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, মুক্তা, মুক্তা তুমি কোথায় চলে গেলে? তুমি কি আসলেই মুক্তা? তুমি না বলেছ এখানে কেউ কারও সঙ্গে প্রতারণা করে না, মিথ্যা কথা বলে না তবে তুমি আমার সঙ্গে রহস্যময় আচরণ করছ কেন?
মিনু চোখ মেলে তাকালো। সাদা পোশাক পরা, ফর্সা, সুন্দর, এক স্মার্ট তরুণী চোখে পড়ল কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আমার হাত-পা খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে বাঁধা কেন? সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ান কেন? এটা, এটা হাসপাতাল? মানে আমি হাসপাতালে? কোথায় কীভাবে আমি হাসপাতালে এলাম? মুক্তা, মুক্তা কোথায়? কেরামত ভাই কোথায়? উফ্, এসব কী হচ্ছে আমার সঙ্গে? কখনও আমি অন্যজগতে, মুক্তা, কেরামতের সামনে, কখনও হাসপাতালে কথাগুলো মিনু আপনমনে মৃদু কণ্ঠে বলল তারপর জোরে চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, সমস্ত শরীরে অসহ্য ব্যথায় যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
মেয়েটি এগিয়ে আসছে মিনু কথা বলতে চাইল, মেয়েটি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, গুড মর্নি স্যার।
মিনু কথা বলতে গিয়েও পারল না। তার শরীর আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ল। দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। মিনুর চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো মুক্তা।
মিনু কিছুটা অবাক হলো, মুক্তা, মুক্তা তুমি? তুমি কি এতক্ষণ হাসপাতালে ছিলে না? তুমি সেই মেয়েটা না?
কী সব আজেবাজে বলছ তুমি? আমি হাসপাতালে যাব কেন? এখানে অসুখ-বিসুখ নেই, হাসপাতালও নেই যে রোগী থাকবে, ডাক্তার থাকবে, সিস্টার থাকবে, হাসপাতালের মালিকও থাকবে। আর সবাই মিলে চেষ্টা করবে কীভাবে রোগীর কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা রোজগার করবে। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা, মানুষের লাশ নিয়েও ব্যবসা। এখানে আসার পথে রহমত ভাইকে হাসপাতালের ডাক্তার, সিস্টার আর মালিকরা চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল।
বুঝলাম না।
মুক্তা একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল, ও তুমি তো বুঝবে না। তোমাদের ওখানে তো টাকা রোজগারই সব, কে কীভাবে মানুষের পকেট কেটে, কিডনি কেটে, রক্ত শুষে টাকা নিবে সেটাই সব, ব্যবসার নাম করে তোমরা সবই কর। নীতি-নৈতিকতা তোমাদের কাছে অর্থহীন।
তবুও বল।
রহমত ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার অনেক টাকাপয়সা ছিল। অনেকদিন থেকে বেচারা অসুখে ভুগছিলেন। ছেলেমেয়েরা তার সেবাযত্ন করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল তার ওপর তার অবস্থাও ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছিল। জীবনের শুরুতে রহমত ভাইর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। নিজে খেয়ে না খেয়ে, অনেক কষ্ট করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, সন্তানদের জন্য ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন। অথচ সেই বাবা যখন অসুস্ হয়ে পড়ে রইল তখন সন্তানরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে, তার সেবাযত্ন না করে তাকে নার্সিং হোমে রেখে এলো।
তারপর-
রহমত ভাইর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলো। তাকে শিফট করা হলো নার্সিং হোম থেকে হাসপাতালে। সেখানে তার চিকিৎসা চলল কিন্তু শারীরিক অবস্থার আর উন্নতি হলো না। তাকে তোমাদের তথাকথিত পৃথিবী থেকে এখানে চলে আসতে হলো। এটাই তো সবার শেষ ঠিকানা। সবাইকে একদিন এখানে আসতেই হবে, যত বড় প্রভাবশালী, বিত্তবান, ক্ষমতাবান যেই হোক না। যে সন্তানরা বাবাকে অবহেলা করল সে সন্তানরাও একদিন বাবা হবে, তাদের সন্তানরাও তাদের ঠিক সেই পরিমাণ অবহেলা করবে যতটুকু তারা করেছে। প্রকৃতি কখনও কাউকে ক্ষমা করবে না।
ঠিক বলেছ।
আর হাসপাতাল কী করেছে জান?
কী?
রহমত ভাইকে আটকে রেখেছিল চব্বিশ ঘণ্টা।
কেন?
টাকা নেয়ার জন্য। ওখানে নাকি আইসিইউ নামে কী একটা আছে, মানুষকে আটকে রেখে ফেরানর চেষ্টা করা। চেষ্টা তো খুব কমই করে, অনেক সময় ফেলে রেখে বড় একটা বিল ধরিয়ে দেয়। ওখানে নাকি এক ঘণ্টার বিল অনেক টাকা, সেজন্য চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রেখে অনেক টাকা নিয়েছে।
হতে পারে।
মুক্তা আবার বলতে শুরু করল, টাকা নামক বস’টা তোমাদের কত প্রয়োজন। অথচ দেখ যে ডাক্তার বা হাসপাতালের মালিক টাকার জন্য এই কাজটা করল তাকেও কিন্তু একদিন সেই টাকাগুলো রেখে আসতে হবে খালি হাতে। তোমাকে একটা কথা বলব?
মুক্তার সঙ্গে প্রতারণা করলেও এই অচেনা পৃথিবীতে মুক্তাই মিনুর পরম বন্ধু। মিনু মুখ তুলে বলল, বল?
টাকা দিয়ে কী হয় বলত?
পৃথিবীতে টাকাই সব। টাকা ছাড়া জীবন-জীবিকা অচল। টাকা ছাড়া লেখাপড়া, চিকিৎসা, যশ, খ্যাতি, রাজনীতি কিছুই হয় না।
তাই নীতি-নৈতিকতা-জবাবদিহিতার পরোয়া না করে সবাই শুধু টাকার পেছনে ছুটে।
এঙাক্টলি।
মুক্তা একটা বিকট হাসি হেসে বলল, ও আমি আবার তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। টাকা দিয়েই তো তুমি আমাকে…
মিনু কিছুটা রেগে গেল, কী কী তোমাকে?
তুমিও তো টাকা দিয়েই বর্ষার সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছ, টাকার লোভ দেখিয়ে আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছ, যখন আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে তখন আবার টাকা দিয়ে খুনি ভাড়া করে আমাকে ট্রান্সফার…
মিনু প্রতিবাদ করল, এটা তুমি ঠিক বলনি, আমি তোমাকে টাকা দিয়ে কিলার হায়ার করে ট্রান্সফার করে দিব কেন?
তুমি দাওনি, তোমার বাবা দিয়েছে। তুমি তো শুধু কুদ্দুস আর তোমার বাবাকে জানিয়েছ যে তুমি বিয়ে করবে না। তারপর তোমার বাবা ধরে নিয়েছে বিয়ে না করলে ঝামেলা বাড়তে পারে তাই আমাকে ট্রান্সফার করে দিয়েছে, ভাড়া করা খুনি দিয়ে, কী নিখুঁত প্লান। একটা মানুষ পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গেল অথচ একটা কাক-পক্ষীও টের পেল না। এখন বল, কথাটা সত্যি কী না?
না।
মুহূর্তে মুক্তাও গর্জে উঠল, একদম না, একদম মিথ্যা কথা বলবে না। দেখতে চাও তুমি কী করেছ, দেখতে চাও?
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি দেখতে চাই।
তবে দেখ বলে মুক্তা যেন হারিয়ে গেল, প্রচণ্ড একটা বজ্রপাতের গর্জন হলো, সমস্ত কিছু আলোকিত হয়ে, সবকিছু যেন পাল্টে গেল। এটা আবার কোন জায়গা? না কোন জায়গা না, চোখের সামনে নভোথিয়েটারের পর্দা ভেসে উঠল, চৌধুরী সাহেব কানে ফোন ধরে আছে। অপর পাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জি স্যার বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
চৌধুরী সাহেব বলল, একটা ট্রান্সফার কেস আছে, পারবে?
জি স্যার। আপনার আদেশ পেলে তো আমি ধন্য হই।
কিন্তু কাজটা করতে হবে নিখুঁতভাবে।
অবশ্যই স্যার আপনার কোন কাজে কোন ত্রুটি হয়েছে নাকি?
না হয়নি, আশা করি এবারও হবে না।
হবে না স্যার। দেখবেন একটা কাক-পক্ষীও টের পাবে না।
ওকে, সময়মতো আমার লোক তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
মুক্তা তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞেস করল, আর কিছু?
কিন্তু আমি এত কিছু জানতাম না।
কিন্তু তুমি জানতে তুমি বিয়ে করতে নয়, কোন একটা সিস্টেমে আমাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছ।
মিনু আর মুক্তার কথার কোন জবাব দিতে পারল না। এত জ্বলন্ত প্রমাণ মিনু অস্বীকার করবে কীভাবে?
সাতাশ
আবার একটা প্রচণ্ড হৈ চৈ এর শব্দ, অসংখ্য মানুষের শ্লোগান শোনা গেল, ক্রমে ক্রমে শ্লোগানের শব্দ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ এদিকেই তো, এদিকেই আসছে। মিনু কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, কী বলছে লোকগুলো? না শুধু পুরুষ না, নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এমনকি ছোট্ট শিশুর পর্যন্ত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। হ্যাঁ, আমার নামই তো বলছে। আমি আবার কী করলাম। মুক্তা আবার হারিয়ে গেল। এই মেয়েটা কেন যে এভাবে আমাকে ছেড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই কোটি কোটি মানুষ দৃশ্যমান হলো। শুধু শ্লোগান নয়, তারা তো মিনুকে ধাওয়া করতে আসছে, তাদের সবার মুখে একই কথা, চোর, চোর এসেছে, এই চোরই তো একদিন আমাদের টাকা চুরি করেছে।
মিনু ভয় পেয়ে গেল তার গলার স্বর শুকিয়ে গেল। সে পালাবার চেষ্টা করছে কিন্তু না, সে তো এখন কাত ফিরতেই পারছে না, পালাবে কী করে? আর পালাবেই বা কোথায়? সে তো এখনও স্পষ্ট না যে সে আসালে মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে? না সে পালাতে পারল না। সে একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কারা? আপনারা আমাকে চোর বলছেন কেন?
তুমি তো চোর, তুমি আমাদের টাকা চুরি করেছ, চুরি করে তুমি দিনে দিনে অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছ, দিগন্তের পর দিগন্ত জমি কিনেছ, বিলাসবহুল মার্কেট করেছ, রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি করেছ, তুমি দুনিয়াতে বেহেশতের সুখ উপভোগ করেছ আর আমরা দিনে দিনে নিঃস্ব হয়েছি, আমরা জমিজমা হারিয়েছি, আমরা বাড়িঘর হারিয়ে গাছতলায়, ফুটপাথে জীবন কাটিয়েছি।
কিন্তু আমি কী করেছি, আমি তো ব্যবসা করেছি, ব্যবসা করে টাকা রোজগার করেছি। ব্যবসাকে তো আল্লাহ হালাল করেছে। আমি হালাল পথে টাকা রোজগার করে ধন-সম্পদের মালিক হয়েছি। এটা তো আমার কোন অন্যায় না।
ব্যবসা করে টাকা রোজগার করেছ, না? তুমি শোষণ করেছ, জনগণের টাকা নিজের পকেটে তুলেছ, সম্পদের লাগামহীন নেশা তোমার বিবেক ধ্বংস করে দিয়েছে তাই তুমি বুঝতে পারছ না তুমি চুরি করেছ কী না?
মিনু জোরে চিৎকার করে বলল, না, না আমি চুরি করিনি।
তুমি চুরি করেছ, তোমার এঙপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা ছিল সেখানে তুমি ট্যাঙ ফাঁকি দিয়েছ, তুমি ইনকাম করেছ কিন্তু ট্যাঙ ফাঁকি দিয়েছ, জমি জমি কিনেছ কিন্তু রেজিস্ট্রি কম দেখিয়ে জনগণের টাকা ফাঁকি দিয়েছ, তুমি সরকারি জমি দখল করেছ, দেশে যখন খাদ্যের অভাব তখন তুমি খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছ। এগুলো যে অপরাধ, চুরি, সেটা তুমি কোনদিন মনেই করনি, এমনি অসংখ্য উপায়ে টাকা চুরি করে তুমি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছ। এই সব ছিল আমাদের টাকা, আমাদের টাকা চুরি করে তুমি বিত্তবান হয়েছ আর আমরা নিঃস্ব হয়েছি।
কিন্তু এটা তো পৃথিবীর সিস্টেম। আমি শুধু সিস্টেমের শিকার হয়েছি। সবাই বড় হতে চায়, আমিও চেয়েছি। আমি চাইলেও তো আর এই সিস্টেম পাল্টাতে পারতাম না।
ঠিক বলেছ, যাদের সিস্টেম পাল্টান দায়িত্ব তাদেরও বিচার হবে, কঠোর বিচার। তারাও তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি পাবে, তুমি তোমার শাস্তি পাবে। এখানকার নিয়মই তাই, যে যতটুকু অপরাধ করবে সে ততটুকুই শাস্তি পাবে। এখন তুমি আমাদের টাকা ফিরিয়ে দাও।
টাকা, আমি এখানে কোথায় টাকা পাব। আমি তো এখানে কিছুই নিয়ে আসিনি।
সেটা তো বললে হবে না। আমাদের টাকা যদি তুমি না দাও, বলে সেই বিশাল আকৃতির একটা লোক কর্কশ স্বরে বলল, তবে আমরা তোমাকে টুকর টুকর করে হাড় মাংস আলাদা করে সবাই ভাগ করে নিব, সমানভাবে। তোমার প্রতিটি রক্ত বিন্দু ভাগ করে নিব সমানভাবে। না, না তোমাদের মত এখানে সম্পদের অসম বণ্টন নেই। এখানে সবাই সমান, এখানে কেউ উঁচু-নিচু নয়।
কিন্তু এখানে আমি আপনাদের কীভাবে টাকা দিব?
প্রথমে সেই লোকটি বলল, না, না আমরা মানব না। আমাদের টাকা দিতে হবে।
মিনু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি এখন কোথায় টাকা পাব? আমি তো এখনও জানিই না যে আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি। আমি যদি বেঁচে থাকতাম, আমার টাকাগুলো যদি থাকত তবে আমি ঠিক ঠিক হিসেব করে আপনাদের সব টাকা দিয়ে দিতাম কিন্তু আমার তো এখন কিছু করার নেই।
তুমি বেঁচে থাকলে সবার টাকা ফিরিয়ে দিবে তো? আর কারও টাকা চুরি করবে না তো?
না, না আমি বেঁচে থাকলে আর কোন অপরাধ করব না। আমার সমস্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করব।
এবার এখানকার কেউ কোন কথা বলল না, অদৃশ্য একটা কণ্ঠস্বর মিনুর কানে ভেসে এলো, তোমরা পৃথিবীর মানুষরা একথা বল, তোমরা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্, ভঙ্গ করতেও অভ্যস্। তোমরা পৃথিবীতে গেলে একটা ঘোরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাও, কেউ টাকার জন্য, কেউ খ্যাতির জন্য, কেউ নারীর জন্য, সেই ঘোর থেকে কেউ বের হতে পার না। সরিষা থেকে তেল বের করার গরু যেমন সারাজীবন বৃত্তের মধ্যে ঘুরতে থাকে তোমরাও তেমন যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্তের পিছনে ঘুরতেই থাক, কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক তোমরা আমলে নাও না। সেই গরুর মত ঘোরের মধ্যেই সারাজীবন কাটিয়ে দাও।
আমার ভুল হয়েছে, সত্যিই আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি যদি আবার কোনদিন সুযোগ পাই, তবে আর কোন অপরাধ করব না, কারও সম্পদ কিংবা দেশের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করার চেষ্টা করব না। কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করব না। উফ্, পৃথিবীতে থাকতে কী যে ভুল করেছি। আর একবার যদি ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ পেতাম তবে, তবে আমি…বলতে বলতে মিনুর চোখের সামনে আবার সেই সাদা পোশাকের স্মার্ট তরুণী কাছে এগিয়ে এলো।
মিনু কয়েকমুহূর্ত তাকিয়েই রইল। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, তার পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ, মুখে মাস্ক পরান, এটা কি, তার নাকে অঙিজেন লাগান, স্ট্যান্ডে একটা স্যালাইন ঝুলছে সেটা এসে ঢুকেছে তার বাঁ হাতের শিরার মধ্যে, তার একটা পা ব্যান্ডেজ অবস্থায় বেড এর স্ট্যান্ডের সঙ্গে ঝুলান আছে। বুকের ডান পাঁজরে ব্যান্ডেজ করা আছে, ব্যথা নেই কিন্তু কিছু একটা হয়েছে বলে মিনুর মনে হচ্ছে, শরীরটা সাংঘাতিক দুর্বল। তরুণী কাছে এগিয়ে এলো, একটা সুন্দর হাসি হেসে, গুড মর্নিং স্যার।
মিনু গুড মর্নিং বলার চেষ্টা করল। সে তার ঠোঁট সামান্য নড়াতে পারল।
এবার তরুণী জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন স্যার?
মিনু মাথা উঁচু-নিচু করে জানাল সে ভালো আছে।
তরুণী একরকম দৌড়ে বাইরে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে একদল মানুষ তার রুমে ঢুকলো। কয়েকজনের গায়ে অ্যাপ্রোন পরা, সেই তরুণী এবং তার বাবাও আছে। মিনুর বাবা আবেগপ্রবণভাবে জিজ্ঞেস করল, বাবা, বাবা তুই বেঁচে আছিস?
মিনু মাথা উঁচু-নিচু করে জানাল সে বেঁচে আছে, সেও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চাইল তার বাবা বেঁচে আছে কী না কিন্তু সে শুধু হ্যাঁ, না করতে পারছে, এতগুলো কথা বলতে পারছে না।
ডাক্তার চৌধুরী সাহেবকে কথা না বলার জন্য ইশারা করল।
মিনু তখনো পুরোপুরি ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু সে এখন বুঝতে পেরেছে যে সে বেঁচে আছে।
মিনু বুঝতে পারল সবাই ডাক্তার আর অ্যাপ্রোন পরা সেই তরুণী সিস্টার। একজন ডাক্তার মিনুকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিস্টারকে মিনুর মুখ থেকে মাস্ক খুলে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল।
সিস্টার মিনুর মুখ থেকে মাস্ক খুলে দিল, বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বাবাকে তার অনেক জিজ্ঞাসা, তাহলে বাবাও বেঁচে আছে কিন্তু সে যে দেখলো তার বাবা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে শাস্তি ভোগ করছে।
যে ডাক্তার মাস্ক খুলে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল, সে বলল, মিস্টার চৌধুরী ইওর সন ইজ নাউ আউট অফ ডেঞ্জার।
মিনু বুঝতে পারল সে এখন আউট অফ ডেঞ্জার। সে একটা মুচকি হাসি হাসার চেষ্টা করল। পুরোপুরি হাসতে পারল না।
ডাক্তার মিনুর আংশিক হাসি দেখে হাতের ইশারা করে জানাল, নাউ ইউ আর অলসো আউট অফ ডেঞ্জার ইয়ং ম্যান, আমরা তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করব।
ডাক্তার হাত তুলে বিদায় জানাল। চৌধুরী সাহেবের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সে হাত তুলে বিদায় জানিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি সেরে উঠবে বাবা, তুমি সেরে উঠবে।
সবাই চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সিস্টার আবার এসে স্যালাইনের মধ্যে একটা ইনজেকশন পুশ করে চলে যাচ্ছিল। মিনু মৃদু কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু সিস্টার না সূচক ইশারা করে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিনুর দুচোখ জুড়ে ঘুম এলো।
যখন ঘুম ভাঙল তখন মিনু চোখ মেলে তাকালো, একটা নতুন জায়গা। খুব সম্ভবত সে হাসপাতালের একটা কেবিনে শুয়ে আছে। সে এখন অনেকটা সুস্, সে অপেক্ষা করছে কেউ এলে তাকে জিজ্ঞেস করবে যে সে এখন কোথায়?
অনেকক্ষণ পর একজন সিস্টার এলো, গুড মর্নিং স্যার।
মিনু মৃদু কণ্ঠে বলল, গুড মর্নিং।
এখন কেমন আছেন স্যার?
ভালো। আমি এখন কোথায় সিস্টার?
আপনি এখন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে।
আমি এখানে কীভাবে এলাম?
আপনি রোড এঙিডেন্টে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে অ্যাডমিশন নিয়েছিলেন স্যার।
মিনু আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সিস্টার মিনুর আরও কাছে এসে মৃদু কণ্ঠে বলল, নো মোর স্যার। এখনও বেশি কথা বলার মত আপনি সুস্ হননি স্যার।
মিনু মৃদু হাসল।
সিস্টার চলে গেল।
মিনু ঘটনাটা মেলানোর চেষ্টা করল কোথা থেকে কী হলো। ধীরে ধীরে তার মনে পড়ল, অনেকদিন থেকে তার বাবা তাকে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য ফোন করছে। চট্টগ্রাম যাওয়ার কারণটা মিনু জানে সেজন্যই সে একরকম বিভিন্ন কাজের অজুহাতে শুধু সময় ক্ষেপণ করছিল। সেদিন রাতে চৌধুরী সাহেব ফোন করল, তার কথার মাঝে অনেক ক্ষোভ, অনেক অভিমান, আমরা তো দু’টা মানুষই বাবা, আমার বয়স হয়েছে, আজ আছি কাল নেই, তোরও বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তোর বিয়েটা দেখে মরতে চাই বাবা।
বাবা তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি এখনই মরবে কেন? আল্লাহর রহমতে তুমি অনেক দিন বাঁচবে।
আমি তোর কোন কথা শুনতে চাই না। যদি তোর কোন মেয়ে পছন্দ থাকে তো বল আমি তার সঙ্গেই তোকে বিয়ে দিব আর যদি না থাকে তো তুই চট্টগ্রাম চলে আয়, আমি মেয়ে দেখে রেখেছি আশা করি তোর পছন্দ হবে।
চৌধুরী সাহেব একদিন ম্যাসেঞ্জারে একটা মেয়ের ছবিও পাঠালো। অসাধারণ সুন্দর একটা মেয়ে লম্বা, ফর্সা। মেয়েটির চেহারায় আভিজাত্য আছে। ছবি পাঠানোর পরদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটাকে দেখেছিস?
কোন মেয়ে?
আমি যে তোর ম্যাসেঞ্জারে একটা ছবি পাঠিয়েছি। খুব সুন্দর একটা মেয়ে, ছবিতে তেমন ফুটে উঠেনি। আমার বন্ধুর মেয়ে, ওর বাবা বড় ব্যবসায়ী।
মিনু কোন কথা বলেনি। মিনুকে চুপ করে থাকতে দেখে চৌধুরী সাহেব আবার বলল, আমি তোকে জোর করছি না, যদি তোর অন্য কোন পছন্দ থাকে তবে বল, আমি কিছু মনে করব না, একটু কষ্টও পাব না।
সত্যিই তো চৌধুরী সাহেব এর মধ্যে বুক ব্যথা নিয়ে দু’বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাছাড়া মিনু জীবনে অনেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে, অনেকের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে তাদের ভোগ করেছে কিন্তু হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেনি। সে কাউকে বিয়ে করবে এমন কথা কখনও ভাবেনি। বিয়ে বলতে যে আবেগ, যে কৌতূহল থাকে সে বয়স মিনুর অনেক আগেই শেষ হয়েছে,্ এখন শুধু দায়িত্ববোধের বিয়ে।
সেদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার বাসে মিনু রওয়ানা হলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাস, বাস ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠল। বাসে বিন্দুমাত্র ঝাঁকুনি নেই, মিনু স্লিপিং চেয়ারে পিছনে গা এলিয়ে দিয়ে দু’চোখ বুজে শুয়ে রইল। প্রায় এক ঘণ্টা বাস চলল, মিনু একবার বাইরে তাকালো কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। বাস খুব দ্রুত গতিতে চলছে। হঠাৎ বাস এক পাশে প্রথমে কাত হয়ে গেল, বাসের যাত্রীদের মধ্যে সে একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল, সে নিজেও জোরে চিৎকার করে উঠল তারপর আর মিনুর মনে নেই। মিনু এবার বুঝতে পারল, ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, তার বাস এঙিডেন্ট করেছে আর সেই এঙিডেন্টে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কিন্তু বর্ষার সঙ্গে তার দেখা, কেরামত, তার বাবার জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড, এসব কী।
দরজা খুলে চৌধুরী সাহেব ভিতরে ঢুকলো, সঙ্গে একজন ডাক্তার এবং একজন নার্স। চৌধুরী সাহেব আবেগপ্রবণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, বাবা, বাবা এখন ভালো আছিস তো?
জি বাবা, এখন ভালো আছি কিন্তু তুমি?
চৌধুরী সাহেব বলল, আমি তোর বাবা, চিনতে পাচ্ছিস না।
জি বাবা চিনেছি কিন্তু তুমি না মরে গেছ।
চৌধুরী সাহেব মিনুর কাছে এলো, মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুই এসব কী বলছিস, আমি তো বেঁচে আছি, এই যে, এই যে আমি তোর পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
মিনু তার বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল যেন তার বাবাকে সে নতুন দেখছে। সিস্টার মিনুর চোখের সামনে হাত নাড়লো, মিনু চোখ সরালো এবং সবার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল, তার কাছে সবাই যেন নতুন, সে যেন নতুন একটা জগৎ দেখছে।
বাবা, বাবা তুমি বেঁচে আছ, তবে আমি যে দেখলাম তুমি মরে গেছ, মুক্তা, কেরামত, লক্ষ লক্ষ মানুষ। আমি কী দেখলাম এসব।
চৌধুরী সাহেব চিৎকার করে উঠল, ডাক্তার, ডাক্তার আমার ছেলের মাথায় আঘাত পেয়ে স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়নি তো।
ডাক্তার চৌধুরী সাহেবের বন্ধু মানুষ, সে চৌধুরী সাহেবের পিঠ চাপড়ে বলল, তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমি দেখি কী করা যায়। সেজন্য আমাকে কিছু টেস্ট করাতে হবে।
ওকে, তুমি টেস্ট করাও, যা কিছু করাতে চাও কর কিন্তু আমার ছেলেকে তুমি সুস্ করে দাও ডাক্তার। তুমি তো জান দু’বাপ বেটা ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের আর কেউ নেই।
তুমি একটু ধৈর্য ধর চৌধুরী আমি দেখছি, বলে ডাক্তার মিনুকে জিজ্ঞেস করল, মিনু এখন সুস্ আছ তো, শরীরে কোন ব্যথা।
মিনু মাথা ডানে-বাঁয়ে নেড়ে জানাল, কোথাও ব্যথা নেই।
ডাক্তার চৌধুরী সাহেবের একটা হাত ধরে মিনুকে জিজ্ঞেস করল, এটা কে?
মিনু হেসে বলল, বাবা।
ডাক্তার একটা কাগজ বের করে দিয়ে বলল, এটা পড় তো।
মিনু ঠিকমতো পড়ল।
ডাক্তার চৌধুরী সাহেবকে বলল, ওকে, নো প্রবলেম, আমি দেখছি। তোমরা বাপ-বেটা গল্প কর। আমি আরও কিছু টেস্ট করে দেখছি কোন প্রবলেম আছে নাকি?
চৌধুরী সাহেব মিনুর মাথার কাছে চেয়ার নিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা? তোর কি কোন প্রবলেম হয়েছে?
মিনু তার মুক্তা, কেরামতের সঙ্গে কথা, লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল এবং তার বাবার জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কথা বলল, সবকিছু শুনে চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষণ মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আচ্ছা দেখা যাক বাবা ডাক্তার কী বলে, আমার মনে হচ্ছে আইসিইউ’তে থাকা অবস্থায় মানুষের এ ধরনের প্রবলেম হতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে মিনুকে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবার শুরু হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা তারপর ডাক্তার জানাল, আইসিইউ’তে থাকা অবস্থায় তার হ্যালোসিনেশন হয়েছিল শীঘ্রই কেটে যাবে।
সমাপ্ত
Leave a Reply