তবুও আমি তোমার

সবকিছু থেকেও রেজা সাহেবের যেন কিছু নেই, ঘরে সুন্দরী স্ত্রী আছে, গাড়ি আছে, আলীশান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসায় বসবাস করেন, বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন। সবকিছু থাকার মধ্যেও যেন তাঁর মনে সুখ নেই। এত অর্থ বিত্তের মধ্যে তাঁর মন সব সময় একটা অভাব অনুভব করে। মনের মধ্যে সব সময় একটা কথাই খচ্‌খচ্‌ করে দাগ কাটে, এতকিছু ভোগ করবে কে? এতবড় বাসা দিন-রাত নিঃসঙ্গতায় খাঁ খাঁ করে। বাসাটা যেন মরুভূমি, মনের মধ্যে উত্তাপ, যেন মরীচিকা খেলে যায়। সারাদিন কাজ শেষে রেজা সাহেব যখন বাসায় ফিরেন তখন কাকলীর চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে তাঁর মন বেদনায় ভরে যায়। তাঁদের অভাব শুধু একটাই, ঘরে কোন সন্তান-সন্ততি নেই। রেজা সাহেবের বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঢাকা শহরে তাঁর জমি-জমা টাকা-পয়সার অভাব নেই। কিন্তু একটা সন্তানের অভাবে তাঁর জীবনের সমস্ত উন্নতি, সমস্ত আভিজাত্য যেন ম্লান হয়ে গেছে। রেজা সাহেবের স্ত্রী কাকলী ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট, সদালাপী এবং উদার মনের মহিলা, তাঁর মনের মধ্যে কোন অহমিকা নেই কিন্তু তাঁর মনের মধ্যেও সবসময় মাতৃত্ব শূন্যতা কাজ করে।

বিয়ের প্রায় পনের বছর অতিক্রান্ত হলো অথচ তাঁরা বিয়ের পাঁচ বছর পর থেকে একটা সন্তানের জন্য কত যে ডাক্তার, কবিরাজ এবং ফকিরের কাছে গিয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। অবশেষে দু’জন সিঙ্গাপুর গিয়ে উভয়ই চিকিৎসা করানোর পর নিরাশ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তারপর সন্তানের জন্য আর কোথাও যাননি। তাঁরা তাঁদের এই ইচ্ছা পূরণের জন্য কাকলী তাঁর খালাত বোনের একটা বাচ্চা পোষ্য হিসেবে গ্রহণের জন্য তাঁর খালাত বোনের কাছে কত অনুনয় বিনয় করেছিলেন কিন্তু সন্তানের মায়া কার না আছে? তিনি পাঁচটি কন্যা সন্তানের জননী হলেও নিজের খালাত বোনকে কোন মেয়েকেই দিতে রাজি হননি, কাকলী সেখান থেকে ফিরে আসার পর রেজা সাহেবকে নিয়ে এক এতিম খানায় গিয়েছিলেন কিন্তু সেখান থেকে সন্তান নিতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তাতে সন্তানের পূর্ব পরিচয় থেকেই যায়, কাকলী চায় তাঁর খালাত বোনের একটা মেয়ে অথবা এমন একটা বাচ্চা যার কোন পূর্ব পরিচয় থাকবে না। কাকপক্ষীর মতো আহার মুখে তুলে দেবার পর কেউ ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে পারবে না।

একদিন সকালবেলা রেজা সাহেব দাঁত ব্রাশ করছিলেন আর কাকলী নাস্তা তৈরি করছিলেন এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। কাজের মেয়ে মর্জিনা দরজা খুলে দিতেই জোরে বলল, কে আপনি? এত সকালে? যান ভিক্ষা হবে না। উঃ গন্ধ সরে যান খালা আম্মা দেখলে রাগ করবে।

ঝুমলাল বলল, হাম ভিক্ষা না লেম, হাম একবার রেজা ভাইয়াকে সাত বাত বলেম (আমি ভিক্ষুক নই মা, আমি একবার রেজা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই)।

একটু দাঁড়ান খালা আম্মাকে জিজ্ঞেস করে আসি, বলে মর্জিনা ভিতরে গিয়ে কাকলীকে বলল, খালা আম্মা একটা লোক খালুর সঙ্গে দেখা করতে চায়, মনে হয় গেরাম থেকে আইছে।

ড্রয়িং রুমে বসতে দে, আমি আসছি।

ঝুমলাল তার চার বছরের ছেলে হরলালকে সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে মেঝেতে বসল।

মর্জিনা কাকলীকে বলল, খালা আম্মা মেহমান সোফায় না বসে মেঝেতে বইছে।

মেঝেতে বসেছে মানে? দেখি তো কে এলো? বলে তিনি ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন।

ঝুমলাল কাকলীকে সালাম দিয়ে বলল, হামার নাম ঝুমলাল, হাম লালমনিরহাটসে আইলবানি, রেজা ভাইয়াসে দেখা করে খাতিম (আমার নাম ঝুমলাল, আমি লালমনিরহাট থেকে এসেছি, রেজা ভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করব)।

তোমার কথা তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তুমি নীচে বসেছ কেন?

হরলাল এতক্ষণ সোফায় বসেছিল, ঝুমলাল বলল, নীচে বইঠ, ভাইয়া দেখিয়ন তো খিসি আইয়ান (নীচে বস, ভাই দেখলে রাগ করবে), বলে ঝুমলাল একরকম জোর করে হরলালকে নীচে নামিয়ে কোলে নিল।

রেজা সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, কে তুমি? নীচে বসেছ কেন?

তু হামরাকে চিনে নইখে সক্‌ল, হাম তোহাকে ঠিকই চিনলেবানি, হামার নাম ঝুমলাল, ঘর আদিতমারী, তু আদিতমারী স্কুলকে ছাত্র না, রহ্‌লা (আপনি আমাকে চিনতে পারেননি ভাইজান আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছি, আমার নাম ঝুমলাল, বাড়ি আদিতমারী, আপনি আদিতমারী হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন না)?

তোমার কথা তো আমি ভালভাবে বুঝতি পারছি না আস্তে বল। তুমি কে? কি মনে করে এসেছ?

হাম আদিতমারীহাট আউর আদিতমারী স্কুল ঝাড়্‌ত রহনি, তু রোজ আগে স্কুল জাত রহলা ঝাড়- দেতকে সময় তোহার সাথে আগে দেখা হত রহ্‌লা, বলত অ চিনে সক্‌লে বারো কি না (আমি আদিতমারীহাট এবং আপনার স্কুল ঝাড়- দিতাম, আপনি প্রতিদিন আগে ক্লাসে যেতেন আর ঝাড়- দিতে গিয়ে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হতো, কথা হতো, বলুন তো এবার চিনতে পেরেছেন কি না)?

ওহ এবার চিনতে পেরেছি, তুমি ঝুমলাল আদিতমারী থেকে এসেছ, তো ঝুমলাল কি মনে করে? বল তো?

ঝুমলাল রেজা সাহেবের পাঁ জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইয়া হাম তোহার লগে আইলবানি, তু হামরাকে ঘুরা নত দিহ (আমি আপনার কাছে এসেছি ভাইজান, বলুন আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না)।

কিছু না বুঝলে কি করে বলব যে তুমি কি জন্য এসেছ? আর আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব কি না?

ঝুমলাল হরলালকে রেজা সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখ্‌ তো ভাইয়া ই লাইকোয়া হামার হ না তোহার মনে হোতা (দেখুন তো ভাইজান এই ছেলেটা কি আমার মনে হয়, নাকি আপনার মনে হয়)?

হরলালের গায়ের রং ফর্সা ধব্‌ধবে, মুখের গড়ন গোলগাল, ঠোঁট দু’টো রাঙা যেন লিপষ্টিক পরানো। চোখ দু’টো আকর্ষনীয় যেন জ্বলজ্বল করছে। রেজা সাহেব একবার তাকিয়ে বললেন, বাঃ ছেলেটার চোখ দু’টো তো বেশ জ্বলজ্বল করছে, খুব বুদ্ধিমান হবে ছেলেটা।

হঁ ভাইয়া (জি ভাইজান)।

এত ছোট বাচ্চাকে ঢাকা নিয়ে এসেছ কেন?

কাকলী কোন কথা বললেন না, তিনি কৌতূহলী হয়ে সোফায় বসলেন।

ঝুমলালের দু’চোখ বেয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে বলল, ভাইয়া ই লাইকোয়া তোহার খাতিন লে আইলবানি (ভাইজান এই ছেলেটাকে আমি আপনার জন্য নিয়ে এসেছি)।

তুমি বল কি ঝুমলাল? আমি তো তোমাকে তোমার ছেলেকে নিয়ে আসতে বলিনি।

ঝুমলাল আপন মনে বলতে শুরু করল, হামনিকুল মেথর জাত, হামার বাপ মেথর রহলন, হামনিকুল ভাই বহিন মেথর হনি যা। হামার লাইকা-লাইকি মিলকে পাঁচ আদমি। সব্‌বে ক্যা মেথর হই। হামনিকুল হোটেল মে বইঠকে খায় না সখিত না যা হোটেল বাহার খায়নি যা, আদমি হামনিকুলকে দেখতে ঘৃণা লসন, তুহি বল ভাইয়া হামনি কুল ক্যা আদমি না হনিয়া (আমরা সুইপার জাত, আমার বাবা সুইপার ছিল, আমরা কয়েকজন ভাইবোন সবাই সুইপার। আমার ছেলে-মেয়ে মিলে পাঁচজন। সবাই কি সুইপার হবে? আমরা হোটেলে গিয়ে চেয়ারে বসে খেতে পারিনা, হোটেলের সামনে মাঠে বসে আমাদের খেতে হয়, লোকে আমাদের দেখলে নাক ছিটকায়, আপনি বলুন ভাইজান আমরা কি মানুষ না)?

হ্যাঁ কে বলেছে তোমরা মানুষ না, তোমরা তো সমাজের অনেক উপকারে আসছ।

হামনিকুল ক্যা আদমি কে নিহন বাঁচত নিযা (কিন্তু আমরা কি মানুষের মতো সমাজে বাঁচতে পারছি)?

রেজা সাহেব কোন কথা বললেন না, একটা চরম সত্যকে অস্বীকার করার তাঁর সাহস হলো না। তিনি মাথা নত করে বসে রইলেন। সমাজের তৈরি এই প্রচলন যেখানে তাঁর কোন হাত নেই এটা তিনি ঝুমলালকে কি করে বুঝাবেন?

ঝুমলাল আবার বলতে শুরু করল, বল্‌ তো ভাইয়া হামার লাইকা হরলালয়া যদি তোহার ঘর মে জনম লেত তোবকা মেথর হকিত (আচ্ছা ভাইজান আপনি বলুন আমার হরলাল যদি আপনার ঘরে  হতো তবে কি সে সুইপার হতো)?

না তা হতো না।

হামার ঘর মে জনম লেলে বা বলকে এত্‌না সুন্দর লাইকা মেথর কাহে হোকি? হাম ওখরাকে মেথর ক্যা কাম না করে দেম (তবে আমার ঘরে জন্মেছে বলে এমন সুন্দর ছেলেটা সুইপার হবে কেন? আমি ওকে সুইপার বানাতে চাই না ভাইজান), বলতে বলতে ঝুমলালের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো।

রেজা সাহেব ঝুমলালের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন কোন উত্তর দিলেন না, তিনি কয়েকমুহূর্ত নীরবে বসে রইলেন।

ঝুমলাল আপন মনে বলতে শুরু করল, ভাইয়া হামার রুপিয়া বা ইচ্ছা করলেসে হাম পড়ালিখা শিখা সখেম কিন্তু তন না হকি ভাইয়া, সমাজ মে আগে আদমি হিসাবে হয় লাগি তব যাকে পড়ালিখা শিখায় সখেম। মেথর যদি পড়ালিখা শেখকে যব আদমি হোকি তব মেথরকে কাম কে করি? ওহি খাতিন হামার হরলালয়াকে মেথরকে পরিচয় পাল্টায়ে পড়ি তব যাকে পড়ালিখা শিখে পড়ি। তওনা হামনিকুল আদিতমারীহাটকে এক কোণা মে মাটিকে ঘর মে রহিনি যা। ঐজন রহ্‌কে পড়ালিখা শিখাওল না বনি ভাইয়া ঐ খাাতিন বহুত আশা লেকে আমিনুলয়্যাসে ঠিকানা লেকে তোহার লগে আইলবানি (ভাইজান আমার টাকা আছে আমার ছেলেটাকে ইচ্ছা করলে আমি নিজের টাকায় লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারি কিন্তু তা তো হবে না, সমাজে আগে মানুষ হিসাবে পরিচিত হতে হবে তারপর লেখাপড়া শিখতে হবে। সুইপাররা যদি লেখাপড়া শিখে মানুষ হয় তবে সমাজে সুইপারের কাজগুলো করবে কে? তাই আমার হরলালকে মানুষের মতো মানুষ করতে চাইলে আগে তার পরিচয় পাল্টাতে হবে তারপর লেখাপড়া শিখাতে হবে। তাছাড়া আমরা আদিতমারীহাটের এক কোণায় কাঁচা ঘরে থাকি। সেখানে থেকে ওকে লেখাপড়া শেখানো সম্ভব নয় ভাইজান, তাই আমি অনেক আশা নিয়ে আমিনুলের কাছ থেকে আপনার বাসার ঠিকানা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি)।

রেজা সাহেব একবার কাকলীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা নামিয়ে আবার ঝুমলালের কথা শুনতে লাগলেন। ঝুমলাল আবার বলতে শুরু করল, হাম ওখর মাইকে হেসে একেবারে বলে আইলবানি ভাইয়া, বিশ্বাস কর ওখর মাইকে তোহার ঠিকানা কববো না দেন, হামুও কববো লাইকা কে দাবি করে তোহার লগে না আয়েম, হাম চাহাতানি হামার হরলালয়া মেথর না হোকে আদমি হোকো। তু ওখর নাম বদলা দেবো তু ওখরাকে তোহার নিহন আদমি বানাইবো, হাম কোওনোদিন লাইকা কে দাবি লেকে তোহার লগে না আয়েম ভাইয়া (আমি ওর মা’র কাছ থেকে ওকে একেবারে নিয়ে এসেছি ভাইজান, আপনি বিশ্বাস করুন ওর মাকে আমি কোনদিন আপনার ঠিকানা দিব না, আমিও কোনদিন আপনার কাছে ছেলের দাবি নিয়ে আসব না, আমি চাই আমার হরলাল সুইপার না, মানুষ হোক। আপনি ওর নামটা পাল্টিয়ে দিবেন, ওকে আপনার ইচ্ছা মতো করে মানুষ করবেন। আমি কোনদিন ওর দাবি নিয়ে আসব না ভাইজান)।

রেজা সাহেব কাকলীর মুখের দিকে তাকালেন, কাকলী রেজা সাহেবকে বেড রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন, শোন লোকটা কি বলছে আমি তো কিছু বুঝতে পারলাম না, তুমি আমাকে বল তো কি হয়েছে?

রেজা সাহেব বললেন, ওর মনে অনেক কষ্ট ওর ছেলে সুইপার ও তো ভবিষ্যতে সুইপারই হবে, তাই ও এই বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে আমরা যেন ওর বাচ্চাটাকে আমাদের পরিচয়ে মানুষ করি, ও কোনদিন বাচ্চার দাবি নিয়ে আসবে না এবং কাউকে আমাদের ঠিকানাও জানাবে না।

কাকলী বললেন, বাচ্চাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, এমন ফুটফুটে একটা বাচ্চা যদি আমার কোল জুড়ে আসত তবে আমার জীবনে নিঃসঙ্গতা বলে আর কিছু থাকত না। আমার জীবনটা পরিপূর্ণ হয়ে যেত, আমার জীবনে আর কোন চাওয়া-পাওয়ার কিছু থাকত না। বাচ্চাটা খুবই বুদ্ধিমান হবে, এত করে যখন বলছে তখন আমরা না হয় বাচ্চাটাকে রেখে দিই, তুমি কি বল?

রেজা সাহেব বললেন, আমি বরং তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি যখন চাইছ তখন আর অসুবিধা কি? কিন্তু কাকলী বাচ্চাটা যে সুইপারের তাতে কোন অসুবিধা নেই তো?

না তাতে কোন অসুবিধা নেই, আমরা আমাদের পরিচয়ে ওকে মানুষ করে তুলব, এটা ঢাকা শহর, এখন আমরা ভাড়া বাসায় থাকি, আমরা যখন নিজেদের বাসায় উঠবো তখন প্রতিবেশীরা তো আর জানবে না যে হরলাল আমাদের ছেলে নয়, আমরা শুধু ওর নামটা পাল্টিয়ে দিব। তুমি একটা সুন্দর দেখে নাম রাখবে।

রেজা সাহেব ড্রয়িং রুম থেকে বের হতেই কাকলী পিছন থেকে ডাক দিলেন, শোন।

বল।

আমার মনে হয় ঝুমলালকে কিছু শর্ত দেয়া উচিত।

যেমন?

যেমন সে গ্রামে গিয়ে কাউকে বলতে পারবে না, কোনদিন ছেলেকে দেখতে আসতে পারবে না, কোনদিন ছেলের দাবি নিয়ে আসতে পারবে না।

তা তো অবশ্যই।

দু’জনে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। রেজা সাহেব বললেন, ঝুমলাল আমরা হরলালকে রাখতে পারি।

রেজা সাহেবের কথা বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুমলাল রেজা সাহেবের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। সে কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, হাম জানতানি ভাইয়া তু হামকে ঘুরা দেয়না সখ্‌ব। তু যব পড়ালিখা কর্‌ত রহল তবেব সে হাম জানাত রাহ্‌নি। তু নিমন আদমি হর বহুত কষ্টসে তোহার লগগে আইলবানি (আমি জানতাম ভাইজান, আপনি আমাকে ফেরাতে পারবেন না। আপনি যখন লেখাপড়া করতেন তখন থেকে আমি জানি আপনি খুব ভাল মানুষ, তাই তো কাউকে কিছু না বলে অনেক কষ্টে আপনার কাছে চলে এসেছি)।

কিন্তু ঝুমলাল তোমার ভাবীর কিছু শর্ত আছে?

বল ভাইয়া হাম তোহার যে কোন শর্ত মানেকে রাজি বানি (বলুন ভাইজান আমি আপনার যে কোন শর্ত মানতে রাজি আছি)।

তুমি তোমার ছেলের দাবি নিয়ে কোনদিন আসতে পারবে না। তোমার ছেলে কেমন আছে তা জানতে পারবে না। কোনদিন তুমি আর আমার বাসায় আসতে পারবে না। তোমার ছেলেকে কার কাছে রেখেছ তাও গ্রামে গিয়ে কাউকে বলতে পারবে না।

বল ভাইয়া হাম তোহার যে কোন শর্ত মানেকে রাজি বানি, তব ভাইয়া হামারও একটা শর্ত– (জি ভাইজান ঠিক আছে। আমি আপনার শর্তে রাজি আছি, তবে ভাইজান আমারও একটা শর্ত–)।

বল কি তোমার শর্ত?

ওখরাকে তু কোওনোদিন হামার পরিচয় দিহ মত, তোহার পরিচয়ে সে আদমি বানায়ো (আপনি কোনদিন ওকে আমার পরিচয় দিবেন না, আপনার পরিচয়ে মানুষ করে তুলবেন)।

অবশ্যই।

ঝুমলাল রেজা সাহেবকে সালাম দিয়ে চলে যাচ্ছিল, তার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে, হরলাল ঝুমলালকে জিজ্ঞেস করল, বাবা তু কাঁদছ?

ঝুমলাল হরলালের গালে চুমু দিয়ে বলল, হাম তোহার বাপ না হনি হরলালয়া, ই সাবই তোহার বাবা। তব তু যব ছোট লাইকা রহলে তু হেরা গইল রহলে তব হাম তোহাকে কুড়াকে আদমি করত রহনি, অব তোর বাপকে খবর পাকে তোহার মাই-বাপকিহে দে জাতানি (আমি তোমার বাবা নই হরলাল, এই সাহেব তোমার বাবা। তুমি যখন খুব ছোট ছিলে তখন তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে, তখন আমি কুড়িয়ে নিয়ে তোমাকে মানুষ করেছিলাম, এখন তোমার বাবার খবর পেয়েছি তাই তোমাকে তোমার বাবা-মা’র কাছে দিয়ে গেলাম)।

হরলাল কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুহে হামার বাপ, হাম তোহার সঙ্গে যায়েম (না তুমি আমার বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব)।

ঝুমলাল আরেকবার হরলালের গালে চুমু দিয়ে বের হয়ে গেল।

কাকলী হরলালকে কোলে নিয়ে বেড রুমে গেলেন।

 

দুই

ঝুমলাল ঠিকই বলেছিল হরলালকে দেখে তার ছেলে মনে হয় না, তাকে যেন রেজা সাহেব এবং কাকলীর সঙ্গেই মানায়। আসলে স্রষ্টা যে কাকে কি দিয়ে সন্তোষ্ট করতে চান তা তিনিই জানেন, নাকি তিনি সবার জীবনে কিছু না কিছু অপ্রাপ্তি রেখে দিতে চান সে রহস্য বোঝা বড় কঠিন। ঝুমলাল সুইপার তার ঘরে পাঁচজন ছেলেমেয়ে দিয়েছেন তাও আবার হরলালের মতো সুন্দর, বুদ্ধিমান ছেলে আবার রেজা সাহেবকে অর্থ, বিত্ত, যশ, খ্যাতি সবকিছু দিয়েছেন কিন্তু কোন সন্তান দেননি। হরলালের চেহারায় কোন পিতৃ পরিচয়ের লেশমাত্র নেই। ঝুমলাল চলে যাবার পর হরলাল কাঁদছিল কাকলী ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে হরলালকে মিষ্টি মুখ করলেন, কোলে বসিয়ে টি.ভি’তে কার্টুন ছবি দেখালেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করলেন। হরলাল অনেকক্ষণ পর কান্না থামালো।

ঝুমলালকে বিদায় দিয়েই রেজা সাহেব হরলালের জামা কাপড় কেনার জন্য শপিং করতে গিয়েছিলেন। মার্কেট থেকে ফিরে হরলালের জন্য আনা কাপড় পরিয়ে দিয়ে একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে রেজা সাহেবকে বললেন, তুমি একবার হরলালের দিকে তাকিয়ে দেখ, কে বলবে সে আমাদের ছেলে না? বলে কাকলী হরলালের গালে চুমু দিলেন। তারপর আবার বললেন, ও মা আমরা এখনো হরলাল, হরলাল বলছি কেন ওর একটা সুন্দর নাম দিতে হবে না?

রেজা সাহেব বললেন, বল তো কি নাম রাখলে ভাল হয়?

আমাদের নামের সঙ্গে মিল করে নাম রাখলে ওর নামা রাখা উচিত কামাল রেজা।

রেজা সাহেব ইয়ার্কি করে বললেন, ছেলের নামের প্রথম অক্ষরটা তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখলে?

তুমি মাইন্ড করলে? জানোই তো ছেলের নাম রাখতে হয় মায়ের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে আর মেয়ের নাম রাখতে হয় বাপের নামের সঙ্গে মিল করে।

এত তাড়াতাড়ি যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেললে?

না এটা আমার যুক্তি না, আগের দিনে মানুষ এভাবে নাম রাখতো। তাই আমিও এই যুক্তিটা অনেক দিন ধরে মনে মনে লালন করেছি কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তেমন দিন আসেনি তাই কোনদিন বলা হয়নি।

এখন ডাক নামটা আমি রাখি কেমন?

বেশ তো তুমি যখন চাচ্ছ তবে ডাক নামটা তুমি রাখ।

আমি ওর নাম দিলাম কনক।

কাকলী হরলালকে কোলে নিয়ে আদর করে বললেন, হরলাল তোর জন্য আমি একটা সুন্দর নাম রেখেছি তোর নাম হলো, কামাল রেজা কনক, আমরা তোকে কনক বলে ডাকব, নামটা তোর পছন্দ হয়েছে?

কনক বলল, হামার বাবা অব না আইয়ন (আমার আব্বু আর আসবে না)?

কাকলী বললেন, ওভাবে না কনক আমার মতো করে বল্‌, আমার আব্বু আসবে না?

কনক বলল, আমার আব্বু আসবে না?

ঠিক আছে এভাবে বল্‌বি সুন্দর করে এখন থেকে আমি যেভাবে কথা বলতে বলব সেভাবে বল্‌বি।

কনক মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

কাকলী বললেন, তোর আব্বু তো সামনেই আছে বাবা। আমরা একদিন মেলা দেখতে গিয়েছিলাম সেখানে ভীড়ের মধ্যে তুই হারিয়ে গিয়েছিলি। অনেকদিন পর ঐ লোকটা আমাদের খুঁজে বের করে তোকে আমাদের কাছে দিয়ে গেল। তোর বাবা তোর জন্য কত সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় কিনে এনেছে, দেখ্‌ এই কাপড়গুলো পরলে তোকে খুব ভাল মানাবে। তারপর আমরা গাড়িতে চড়ে বেড়াতে যাব, তখন খুব মজা হবে।

কনক আর কোন কথা বলল না।

রেজা সাহেবস্নেহ মাখা কন্ঠে ডাক দিলেন, কনক এদিকে আয় তো বাবা।

কনক রেজা সাহেবের কাছে গেল। রেজা সাহেব বললেন, বাবা কোথাও বেড়াতে যাবি?

কনক মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল সে বেড়াতে যাবে।

কাকলী বললেন, তোমার তো আজ অফিস বন্ধ, চল না, আমরা কনককে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসি?

বেশ তুমি যখন চাচ্ছ তো চল।

যেই কথা সেই কাজ সবাই বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে ঢুকলেন শাহবাগ শিশু পার্কে। একে একে শিশু পার্কের সমস্ত রাইডে কনককে উঠালেন, দু’জনের যেন আজ আনন্দের সীমা নেই। রেজা সাহেব এবং কাকলী নিজেও যেন তাদের সমস্ত অতীত ভুলে গেলেন। কনক খুব সহজে দু’জনকে আপন করে নিল। তার কন্ঠে বার বার করে মা ডাক শুনে কাকলী আর চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি কনককে কোলে নিয়ে তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন। দু’জনে সমস্ত মার্কেট কনককে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন, কনককে তার পছন্দ মতো আরো অনেক জামা-কাপড় কিনে দিলেন। জামা-কাপড় কেনার সময় কনকের রুচিবোধ দেখে দু’জনে অবাক হলেন। তারপর সবাই বাসায় ফিরে কাকলী রান্নার কাজে মনোযোগ দিলেন কিন্তু আজ তাঁর রান্নায় মন বসল না বার বার করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলেন এবং রেজা সাহেবও কনককে সঙ্গ দিলেন।

রাতের খাবার শেষ করে কনক বলল, আমি আম্মুর কাছে যাব।

কাকলী মনে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। রেজা সাহেব কাকলীর মনের অবস’া বুঝতে পেরে বললেন, কাকলী একটু ধৈর্য্য ধর, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কাকলী বললেন, আমি তো তোর আম্মু বাবা, তোকে বলছি না তুই আমাদের ছেলে।

কনক বলল, আম্মু আমি ঘুমাবো।

কনকের মুখে মা ডাক শুনে কাকলীর বুক ভরে গেল। তিনি কনককে বিছানায় শুইয়ে দিতেই কয়েকমিনিটের মধ্যে কনক ঘুমিয়ে গেল। কাকলী তার নিষ্পাপ মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কাকলী রেজা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি হলো তোমার? হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?

রেজা সাহেব খাটের এক কোণায় বসলেন তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন, কাকলী কনককে পেয়ে যেমন আজ আনন্দ পেয়েছি এমন আনন্দ আমি আর কোনদিন পাইনি, অলৌকিকভাবে আল্লাহ যেন আমাদের ঘরে ফুট্‌ফুটে চাঁদের মতো একটা সন্তান দিয়েছেন।

কাকলীর মুখ হঠাৎ করে কালো মেঘে ঢেকে গেল। তিনি বললেন, কেন হঠাৎ করে তোমার কি হলো?

কনক আমাদের ছেলে না এ কথাটা যখন প্রতিবেশীরা জেনে ফেলবে তখন সে-ই বা কি মনে করবে? আর আমাদের মান-সম্মানই বা কোথায় থাকবে?

সে চিন্তা আমি আগেই করে রেখেছি।

কি চিন্তা?

কনকের একমাত্র সাক্ষী আমাদের কাজের মেয়ে মর্জিনা, ওকে আমি বিদায় করে দিব। আর প্রতিবেশীদের কথা বলছ, এটা ঢাকা শহর বাসা চেঞ্জ করলেই আর কেউ চিনবে না।

তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমার অফিসের লোকজন?

তোমার প্রাইভেট অফিস, চাকরি হারানোর ভয়ে প্রাইভেট অফিসে কেউ বস এর সমালোচনা করে না, আর যখন সমস্যা হবে তখন দেখা যাবে। তুমি এ নিয়ে কোনকিছু ভেবো না তো। তুমি আমার কথা শোন, বলত আমাদের ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্টের কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?

সে তো আরো কমপক্ষে ছ’মাস লাগবে।

তাহলে আগামী মাসে তুমি ধানমন্ডিতে একটা বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা কর, আগামী মাসেই আমরা যেন বাসা চেঞ্জ করতে পারি। নতুন বাসায় যাওয়ার আগেই মর্জিনাকে বিদায় করে দিতে হবে। বাসার ঠিকানা আর কাউকে দিবে না। তখন ঝুমলালও তার ছেলের ঠিকানা জানবে না। তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার কিছু জানার আছে?

বল।

ঝুমলালের সঙ্গে তোমার পরিচয় কিভাবে?

ঝুমলাল তো বললই আর তুমিও তো জানো আমি সব সময় আগে অফিসে যাই এমন কি যে কোন কাজে আমি কখনো স্লো নই। ছাত্রজীবনে আমি ঠিক এমনই ছিলাম। সবার আগে ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমি যখন হাই স্কুলে পড়তাম তখন ঝুমলাল আমাদের ক্লাস রুম ঝাড়- দিত, স্বাভাবিক কারণে আমি আগে ক্লাসে যাওয়ায় প্রতিদিন ঝুমলালের সঙ্গে আমার দেখা হতো, তার সঙ্গে দু’একটা কথাও হতো। এভাবেই পরিচয় তারপর অনেকদিন থেকে আর দেখা নেই হঠাৎ আবার আজ দেখা হলো।

তুমি যখন হাইস্কুলে পড়তে তখনকার পরিচয়ে এতদিন পর ও তোমাকে খুঁজে বের করেছে?

গ্রামের মানুষ এখনো অনেক সহজ-সরল, আমরা ওদের কথা মনে রাখি না কিন্তু ওরা ঠিকই আমাদের খবর রাখে। আমাদের নিয়ে গ্রামে ওরা অনেক গর্বও করে।

কিন্তু ও যদি আমাদের কনকের কথা সবাইকে বলে বেড়ায়?

ঝুমলাল কনককে মানুষ করার জন্য আমাদের কাছে দিয়ে গেছে  ও বলে বেড়াবে কোন্‌ দুঃখে?

কিন্তু তোমার গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এসে যদি কনককে দেখে ফেলে এবং গ্রামে গিয়ে বলে বেড়ায়।

গ্রামে আমার কে বা আছে যে আমাদের বাসায় আসবে?

তবুও কেউ যেন আসার সুযোগ না পায় সে ব্যবস্থাই কর।

আমিও তাই ভাবছি কাকলী, আমি একদিন গ্রামের বাড়ি গিয়ে গ্রামের সব জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে আসব। আর মোবাইলের সিম কার্ডটা চেঞ্জ করব। তাহলে তো গ্রামের মানুষ আর আমাকে খুঁজেই পাবে না।

কাকলী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

 

তিন

হরলালকে রেজা সাহেবের বাসায় দিয়ে ঝুমলাল লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। হরলালকে রেজা সাহেবকে দিয়ে ঝুমলালের হৃদয় ভেঙ্গে গেছে সারাটা রাস্তায় তার শুধু ছেলের কথাই মনে পড়েছে। ঝুমলালের দুই ছেলে তিন মেয়ে তম্মধ্যে হরলাল সবার ছোট। নিজের ছেলেকে কোল থেকে চিরদিনের মতো অন্যের কোলে তুলে দেওয়ার কষ্ট  আজ ঝুমলাল অনুভব করছে, এর আগে ঝুমলাল কখনো কোন সন্তান ছেড়ে থাকেনি। ঝুমলাল আদিতমারী হাট ঝাড়- দেওয়ার কাজ করে যা রোজগার করে তা দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে এক সঙ্গে বসবাস করে। আজ বিশ বছরের সংসার জীবনে তার পরিবার ছেড়ে সে কখনো রাত কাটায়নি আজ তারই সংসারের একটি সন্তানকে সে চিরদিনের জন্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে চলে এলো। এই বেদনা যেমন ঝুমলালের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে তেমনি ঝুমলালের মনে পড়ে প্রতিদিন সকালবেলা নাস্তার জন্য হোটেলের বাইরে কাপ নিয়ে বসে থাকার কথা। মানুষ সবাই সমান এবং প্রত্যেকটি মানুষের মানুষ হিসেবে সমাজে বসবাস করার অধিকার আছে একথা ঝুমলাল একদিন শিক্ষককে ক্লাসে পড়াতে শুনেছে, একদিন জনসভায় এক নেতার বক্তৃতায় শুনেছে কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখেনি। যে শিক্ষক ক্লাসে ছাত্রদের এবিষয়ে পড়িয়েছে সে শিক্ষকই ঝুমলালকে দেখে গা ঘেঁষা লাগার ভয়ে দূর দিয়ে চলেন, হোটেলের বাইরে ঝুমলালকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেন। সমাজের এ অবিচারই ঝুমলালকে নিজের ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ বানাবার জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে মনকে পাষাণ বানিয়েছে। ঝুমলালের মনে হলো প্রতিবেশীদের কাছে কি জবাব দিবে? হরলালকে সে বিক্রি করেছে? অন্যের কাছে পোষ্য দিয়েছে? তখন হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে কার কাছে বিক্রি করেছে বা কার কাছে পোষ্য দিয়েছে? তবে কি বলবে সে? এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঝুমলালের মাথায় একটা চিন্তা এসেছে সে হাউ মাউ করে কেঁদে বলবে হরলালকে সে কমলাপুর স্টেশনে হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করবে সে। কিন্তু বিবেকের কাছে কি জবাব দিবে সে? না আর ভাবতে পারে না সে। এমনিভাবে এক বুক বেদনা, হৃদয় ভরা আশা আর হরলালকে মানুষ বানানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক সময় ট্রেন জোরে ব্রেক করার শব্দে ঝুমলাল সচকিত হলো। ট্রেন স্টেশনে এসে থামলো। কয়েকজন টোকাই কাউনিয়া কাউনিয়া বলে চেঁচিয়ে বাদাম, চানাচুর বিক্রি করতে লাগল। ঝুমলাল ট্রেন থেকে নামল।

কানেকটিং ট্রেন এসে পৌঁছালে ঝুমলাল তার নির্ধারিত সিটে বসল। কিছুক্ষণ পরে এক ভদ্রলোক ট্রেনে উঠে ঝুমলালের মুখের দিকে তাকাল, লোকটিকে ঝুমলালের পরিচিত মনে হলো কিন্তু চিনতে পারল না। লোকটি ঝুমলালকে দেখে আঙ্গুল দিয়ে নাক চেপে ধরে বলল, এই বেটা সুইপার তুই সিটে কেন? নীচে বস্‌।

ঝুমলালের একবার মনে হলো টিকেট বের করে দেখাবে যে সে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের টিকেট করে উঠেছে এবং তার টিকেটে সিট নাম্বার দেওয়া আছে। কিন্তু সে তা করল না। সে তার ঘাড়ে ঝুলানো গামছা দিয়ে মেঝে পরিস্কার করে মেঝেতে বসল আর মনে মনে বলল, ই আদমি ওখর জনমকে খাতিন আজ খারাপ আচরণ করিয়েকে ভদ্রলোক সাজলেবা, ঝুমলাল আজ ওখর জনম খাতিন মেথর সাজলেবা কিন্তু হরলাল ওখর জনমকে পাপ মোচন করোতা উ অব রেজা সাবকে লাইকা হ কে জানতা রেজা সাব ওখর নাম বদলাকে কোন নাম রাখলেবা (এই ভদ্রলোক তার জন্মের কারণে আজ অভদ্র আচরণ করেও সকলের কাছে ভদ্রলোক সেজেছে, ঝুমলাল তার জন্মের কারণে আজ সুইপারের সারিতে বসতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু হরলাল তার জন্মের পাপ মোচন করেছে সে এখন রেজা সাহেবের ছেলে, কে জানে এতক্ষণে রেজা সাহেব তার নাম পরিবর্তন করে কি নাম রেখেছে)?

ঝুমলাল ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আউর কেতনা দিন? হয়ত আউর বিশ বছর অপেক্ষা করে পড়ি তব যাকে হামার লাইকা একদিন ঠিকে তোহার নিহন ভদ্রলোক হকি, রেজা সাব ওখরাকে বহুত বড় অফিসার বানাইয়ন। উ ওখর জনম স্মৃতি মুছা দিহন, মেথর না হকি, উ আদমি হকি (আর কতদিন? হয়ত আর বিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে তারপর আমার ছেলে একদিন সত্যি সত্যিই আপনার মতো ভদ্রলোক হবে, রেজা সাহেব ওকে আরো অনেক বড় অফিসার বানাবে। সে তার জন্মের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলবে, সে সুইপার হবে না, সে হবে মানুষ)।

ট্রেন লালমনিরহাট এসে থেমেছে, ঝুমলাল ট্রেন থেকে নেমে আদিতমারীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। লালমনিরহাট থেকে আদিতমারী কয়েকমিনিটের পথ তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আদিতমারী এসে পৌঁছাল। আদিতমারী বাজারের একাংশে হাটের জায়গায় কাঁচা ঘরে ঝুমলাল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল তার স্ত্রী ঝরনা। ঝুমলালকে একা দেখে ঝরনা কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, তু এতনা পাষাণ, হামার হরলালয়াকে ঠিকে ফেককে আয়সাকলো? তু বাপ, ওহি খাতিন পাষাণ হইলবারো, হাম মাই হনি হামার লাইকাকে হাম ফেককে না আয় সাকতি। হাম রহলে সে হামার লাইকাকে ঢাকা সে ঘুরা আনতি (তুমি এত নিষ্ঠুর, আমার হরলালকে তুমি সত্যি সত্যি ফেলে আসতে পারলে? তুমি বাপ, তাই পাষন্ড হয়েছ, আমি মা, আমি হলে আমার ছেলেকে ফেলে আসতে পারতাম না। আমি হলে আমার ছেলেকে ঢাকা থেকে ফেরত নিয়ে আসতাম)।

ঝুমলাল চাপা স্বরে বলল, ঝরনা এই সে নত বল আদমি জান জাই, তু ক্যা না চাহেলে হামার লাইকা আদমি হোকো? হামকা হামার লাইকাকে দেকে খুশি ভইলবানি রখত হেলহো, হাম ওখর আঁখ মুছাকে মনে মনে বলাত রহনি তু রহ বাবা আদমি কে নিহন আদিম হো। উঁ হরলালকে মুহয়া হামার অববো মনে পড়তা হামার বুকয়া ফাট যাতা কিন্তু ক্যা করেম? হামার হাত-পা আছে, হামনিকুল আদমি ক্যা নিহন দেখতে ওহি খাতিন সবকই আদমি বলে না যা, লেকিন হামনিকুলকে কেহু আদমি মনে না করেলা। হামনিকুল হোটেল মে বইঠে না সখি না যা, হামনি কুল বইঠকে সিনেমা দেখে না সখিত না যা, হামনিকুলকে দেখখে ঘৃণালসন, মুহ ঘুরাকে দুসর দিক তাকে লসন হরলালয়াকে হামনি কিহে রহলে সে উহোন একদিন হাট ঝাড়ত, পায়খানা সাফ করত, আদমি ওকে দেখে ঘৃণা করত। হাম হরলালয়াকে যব সাবকিহে দে আইলবানি ওখর কোওনো লাইকা নাইকে, সাব বহুত বড়লোক হনো হামকে বাত দেলেবা হামনিকে হরলালয়াকে বহুত বড় সাব বানাইয়েম। হামনিকে হরলালয়াকে বহুত আচ্ছা লাগি সাব হকিতো (ঝরনা এভাবে বল না মানুষ জেনে ফেলবে, তুমি কি চাও না আমাদের একটা ছেলে মানুষ হোক? আমি কি আমার হরলালকে মানুষকে দিয়ে এসে খুশি হয়েছি, হরলালকে যখন আমি ভাইজানের হাতে তুলে দিলাম তখন হরলাল একবার আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠল, আমি হরলালের চোখের পানি মুছে দিয়ে মনে মনে বললাম, থাক বাবা মানুষের মতো মানুষ হও। উঃ হরলালের মুখখানা আমার এখনো মনে পড়ছে, আমার বুকও যে ভেঙ্গে যাচ্ছে ঝরনা কিন্তু কি করব বল?  আমাদের হাত-পা আছে, আমরা দেখতে মানুষের মতো তাই সবাই আমাদের মানুষ বলে। আসলে আমাদেরকে কেউ মানুষ মনে করে না। আমরা হোটেলে বসতে পারি না, আমরা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে পারি না, আমাদের দেখলে মানুষ নাক ছিটকায়, মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আরেক দিক তাকায় আমরা যদি হরলালকে নিজেদের কাছে রেখে দিতাম তবে সেও একদিন হাট ঝাড়- দিত, ল্যাট্রিন পরিস্কার করত, মানুষ ওকে দেখে নাকে ঢাকা দিত। আমি হরলালকে যে সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছি সে সাহেবের কোন ছেলে-মেয়ে নেই, সাহেব অনেক বড়লোক, আমাকে কথা দিয়েছে আমার হরলালকে সাহেব অনেক বড় সাহেব বানাবে। আমার হরলালকে সাহেব মানাবে ভাল)। এমনিভাবে ঝুমলাল আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলছিল আর ঝরনা পাশে বসে শুনছিল এমন সময় ঝুমলালের বন্ধু কালচাঁন এসে জোরে ডাক দিল, ঝুমলালয়া ঘরক্যা আছিস্‌ (ঝুমলাল বাসায় আছিস্‌)?

ঝুমলাল বাসার ভিতর থেকেই বলল, আও ঘরকে ভিতর আও (আয় বাসার ভিতরে আয়)।

কালচাঁন বাসার ভিতর ঢুকতেই ঝুমলাল কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, এগো খারাপ খবর বা (একটা খারাপ খবর আছে বন্ধু)।

কালচাঁন আর ঝুমলাল একই সঙ্গে বড় হয়েছে, সেদিক থেকে কালচাঁন তাকে যতটুকু জানে তাতে ঝুমলাল মুক্ত মনের মানুষ, সবকিছু খুব সহজে খোলা মনে বলে ফেলে কোনকিছু গোপন করতে পারে না, সে সবসময় হাসি-খুশি থাকে কখনো তার মুখে কেউ মেঘের ছায়া দেখেনি, শত কষ্ট সে হাসিমুখে মেনে নিতে পারে কিন্তু আজ তার মুখে কালো মেঘের ছায়া দেখে অজানা আশংকায় কালচাঁনের মুখ শুকিয়ে গেল, ক্যা ভইলবা? খুলকে বলো (কি হয়েছে বন্ধু? আমাকে খুলে বল্‌)?

হাম হরলালয়াকে লেকে ঢাকা গইল রহানি ট্রেনসে উতরকে মনে ভইল স্টেশনকা নাম কমলাপুর হকি ওইজন বহুত ভীড় রহল হাম হরলালয়াকে হাত ধইলে রহনি কবজে হামার হাতওয়াছে ফসককে গহিল রহল হো হাম বুঝে নাইখে সখনি, ওখর পরে বহুত খোঁজাখুঁজি করনিহ হো, ল্যাকিন হরলালয়াকে না পাইনি (আমি আমার হরলালকে নিয়ে ঢাকা গেছিলাম ট্রেন থেকে নামলাম মনে হয় স্টেশনটার নাম কমলাপুর হবে, সেখানে খুব ভীড় ছিল আমি হরলালের হাত ধরেছিলাম কখন যে হরলাল আমার হাত থেকে ফসকে গেছে আমি বুঝতে পারিনি, তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম কিন্তু হরলালকে আর পেলাম না বন্ধু)।

ক্যা বলতারে ঝুমলালয়া? ঐজন হামনিকুলকে জাত ভাই বারসন না? তু ওখনি কুল কিহে কাহেনা গইলেহ। (বলিস্‌ কি ঝুমলাল? সেখানে আমাদের জাতি আছে না? তুই তাদের কাছে গেলি না)?

যায়েম কইসে? হামকা সব জায়গা চিনি না? জঁহে জাতানি সব রাস্তা একেনিহন লাগাত রহল হ হাম চিনে নাইখে সখনি ওহি খাতিন হাম ঢাকা সে ঘর আইলনি ল্যাকিন লাইকাকে না পাইনিহ (যাব কি করে? আমি কি সব জায়গা চিনি? যেদিক যাই সব রাস্তাগুলো একই রকম মনে হয়, আমি কিছু চিনতে পারলাম না তারপর আমি ঢাকা থেকে ফিরে এলাম আমার ছেলেটাকে আর ফিরে পেলাম না বন্ধু)।

চল তোকে লেকে হাম কাল ঢাকা যায়েম ঐজন হামার আত্মীয় বা ওখনিকুলকে বললে সে খোঁজকে ইকাল দেয় সকেলসন (চল্‌ আমিসহ কাল ঢাকা যাই সেখানে আমার আত্মীয় আছে তাদের বললে তারা খুঁজে বের করে দিতে পারে)।

না ভাইয়া ঢাকা শহর বহুত বড় শহর হ ঐজন আদমি বহুত কঠিন ব্যাপার হামার হরলালয়া চালাক লাইকা হ উ ঠিকে হামার নাম ঠিকানা বলে সকি নিমন আদমি পাইলেসে হামনিকুলকিহে দে যাই যদি খারাপ আদমি পাইজে ওখর কপালম্যা যন যা তনে হকি (না বন্ধু ঢাকা শহর অনেক বড় সেখানে মানুষ, খুঁজে পাওয়া সহজ ব্যাপার না, আমার হরলাল চালাক আছে সে আমার নাম ঠিকানা সব সে বলতে পারে যদি কোন ভাল মানুষ পায় তবে দিয়ে দিবে আর না হয় ওর কপালে যা আছে তাই হবে), বলে ঝুমলাল কালচাঁনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ঝরনা এক বোতল দারু লে আও, দু’বন্ধু বহুত দিনসে একসাথে দারু নে পিলেসে (ঝরনা এক বোতল মদ নিয়ে এসো, দু’বন্ধুর অনেকদিন থেকে মদ খাওয়া হয় না)।

কালচাঁন বলল, বন্ধু তু বহুত কষ্টমে বারে আজ দারু না পিলেসে না হকি (বন্ধু তুই খুব কষ্টে আছিস্‌ আজ মদ না খেলে হয় না)?

দুঃখমে বানি বলিয়ে কে তো দারু খায়েম, তু তো জনবে করেলে হাম রোজ দারু না পিয়েনি, যব দুঃখ মে রহিনা তববে দারু পিয়েনে, কববো আনন্দ মে রহেলে দারু না পিয়েনি, আজ এক বোতল দারু না পিয়েলে সে হামার লাইকা হরলালয়াকে ভুলাকে কইসে রহেম, তুহি বল্‌ ঝরনা দারু ঢাল (কষ্টে আছি বলেই তো মদ খাব বন্ধু, তুই তো জানিস্‌ আমি প্রতিদিন মদ খাই না, কখনো কষ্ট পেলে মদ খাই, কখনো আনন্দ পেলে মদ খাই, আজ একবার মদ না খেলে আমি আমার হরলালকে ভুলব কেমন করে? তুই বল্‌? বলে ঝরনাকে বলল, ঝরনা মদ ঢেলে দাও)।

ঝরনা পাশে বসে ঝুমলাল আর কালচাঁনকে মদ ঢেলে দিতে লাগল কখনো কখনো নিজেও মদ খেতে লাগল। কয়েক প্যাক মদ খাবার পর ঝুমলাল মাতাল হয়ে গেল সে মদের নেশায় মাতাল হয়ে আপন মনে বলতে থাকল, কববো মনে হকেলা ঠিকে ভইলবা মেথরকা লাইকা মেথরসে নীচু জাত নাইখে। কেহু যদি হরলালয়াকে পাইয়ে যায় তো ওখর কপাল উ মেথরসে আদমি হো যাই। কালচাঁন জানতবে হাম যব কাউনিয়া ট্রেন পর হামার সিট মে বইঠেনি হো তব এক ভদ্রলোক হামকে চিনলেলোস। বললস এই বেটা মেথর নীচ্চে বইঠ। একবার ইচ্ছা হতরহল হ টিকেটউয়া ওখর মুহে ফেক দেঁই তব বুঝাত সব আদমি হামরাকে ট্রেনসে নীচে নামা দিত। ওহি খাতিন কিছু না বলনিহ, নীচে গামছা বিছাকে বইঠ গাইনি। হামার হরলালয়াকে তো কেহু মেথর না বলি, উ ওর সাহেবকে লাইকা (কখনো মনে হয় ভালই হয়েছে সুইপারের ছেলে, সুইপারের চেয়ে তো আর নীচু জাত নেই। কেউ যদি হরলালকে পেয়েই থাকে তো হরলালের সেটা কপাল সে সুইপার থেকে মানুষ হয়ে যাবে। কালচাঁন জানিস্‌ আমি কাউনিয়া এসে ট্রেনে আমার সিটে বসলাম তখন এক লোক আমাকে চিনে ফেলল। বলল, এই বেটা সুইপার নিচে বস্‌। একবার ইচ্ছা করছিল টিকেটটা ছুঁড়ে দিতে সেই লোকটার মুখের ওপর কিন্তু তখন বুঝি সব লোক আমাকেই ট্রেন থেকে নামিয়ে দিত। তাই আর কিছু বললাম না, নিচে গামছা বিছিয়ে দিয়ে বসলাম। আমার হরলালকে তো আর কেউ সুইপার বলবে না, সে এখন সাহেবের ছেলে, বড় লোকের ছেলে), বলে ঝুমলাল হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল।

কালচাঁন রেগে গিয়ে বলল, তু বুঝাতা ঠিক নাইখে বলতারে ঝুমলাল, মেথরকা আদমি না হ (তুই কথাটা ঠিক বললি না ঝুমলাল, সুইপাররা কি মানুষ না)?

না মেথরকুল আদমি না হ, আদমি হলে সে হামনি কুল দুসার আদমিকে সাথে বইঠকে চা পিয়া, হামনিকুলকে লাইকা-লাইকি পড়ালেখা শিখখে আদমি হয়ে সাকিত, হামনিকুলকে দেখকে আদমিকুল নাক না ধর্‌ত, বুঝলে হ (না সুইপাররা মানুষ না, মানুষ হলে আমরা মানুষের সঙ্গে বসে চা খেতে পারতাম, আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে পারত, আমাদের দেখে মানুষ নাক চেপে ধরত না, বুঝলি)?

তু তো ঠিককে বলতারে ঝুমলাল। হামনিকুলকে কেহু আদমি মনে না করে লা (তুই তো ঠিকই বলেছিস্‌ ঝুমলাল। আমাদের তো কেউ মানুষ মনে করে না)।

 

চার

রেজা সাহেব ধানমন্ডিতে তাদের নির্মাণাধীন এ্যাপার্টমেন্টের অদূরে তিন রুম বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়েছেন। বাসাটি বেশ সুন্দর, ছয় তলা বিশিষ্ট এই বাসাটিতে দক্ষিণে একটি বারান্দা আছে। অবসর সময়ে কাকলী কনককে নিয়ে এই বারান্দায় খেলা করে কাটিয়ে দেয়। আজকাল কাকলীর আর নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় না। কাকলী কনককে নার্সারী ক্লাসের বই কিনে দিয়েছে, সকাল-সন্ধ্যা কনককে পড়াতে বসেন। বলতে গেলে কনক তাঁর নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে দিয়েছে, মাতৃত্বের অহংকার দিয়েছে, কনকই যেন তাঁর সব। কাজের মেয়ে মর্জিনাকেও ধানমন্ডির বাসায় আসার আগেই বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে কনকের আর কোন সাক্ষী রইল না। নতুন বাসার আশে-পাশে যাদের সঙ্গে রেজা সাহেব এবং কাকলীর পরিচয় হয়েছে তারা সবাই জানে কনক তাদের নিজেরই সন্তান। রেজা সাহেবের গ্রামের লোকজন এখনো জানে তিনি একজন নিঃসন্তান শুধু গ্রামের লোকদের কোনকিছু না জানালেই হয় এবং কনককে নিয়ে কখনো গ্রামে না গেলেই হয়। তাহলে গ্রামের লোকজনের যেমন রেজা সাহেবের সম্পর্কে সবকিছু অজানা থাকবে তেমনি ঝুমলালও কোনদিন রেজা সাহেবের কাছে কনকের দাবি নিয়ে আসতে পারবে না।

পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটির আজ জন্মদিন। ছেলেটির নাম পলাশ, ওর সঙ্গে কনকের খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সেই সকালবেলা থেকে কনক পলাশের জন্মদিন উৎসবে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। এ নিয়ে তার নানা প্রশ্ন, আম্মু  জন্মদিন কাকে বলে? তোমার জন্মদিন কবে? আমার জন্মদিন কবে?

কাকলী কনকের সব কথার উত্তর দিতে গিয়ে যেন থমকে যায়। কিন্তু কনক একবার প্রশ্ন করলে সেটার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত প্রশ্ন করতেই থাকে।

কাকলী উত্তর দিল, যেদিন মানুষ প্রথম পৃথিবীতে আসে সেই দিনটাকে জন্মদিন বলে। আমার জন্মদিন সেপ্টেম্বর মাসের এক তারিখে আর তোর জন্মদিন এখনো অনেকদিন দেরি আছে।

কবে আম্মু? আমার জন্মদিন কবে?

কনকের কথার উত্তর দিতে গিয়ে কাকলী থতমত খেয়ে যায়, কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থাকে কিন্তু কনকের পীড়াপীড়িতে কাকলী বলতে বাধ্য হলেন, তোর জন্মদিন ২৬ শে মার্চ।

আম্মু ২৬ শে মার্চ তো আমাদের স্বাধীনতা দিবস, না?

হ্যাঁ বাবা।

আম্মু সেদিন কি হয়েছিল?

সে তো অনেক বড় ইতিহাস শুনতে অনেকক্ষণ সময় লাগবে, আরেকদিন বলব।

না তুমি এখনি বল, আমি শুনব।

তাহলে শোন, আমাদের দেশের নাম আগে ছিল পূর্ব পাকিস্তান আমাদের দেশের আরেকটা অংশের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান এ দুই পাকিস্তান মিলে আমাদের দেশের নাম ছিল পাকিস্তান। তখন আমাদের দেশের সব বড় বড় অফিসার হতো পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা, তারা সব সময় আমাদের নীচু জাত বলে মনে করত, আমাদের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করত।

আম্মু বঞ্চিত মানে কি?

বঞ্চিত মানে আমাদের কোন সুযোগ-সুবিধা দিত না, সব সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করত। তখন আমাদের দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। তারাও পাল্টা আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করে ফলে আমাদের দেশের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করে। সেজন্য ২৬ শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস বলে। এবার বুঝলি স্বাধীনতা দিবস কাকে বলে?

আম্মু স্বাধীনতা মানে কি?

স্বাধীনতা মানে হলো মুক্তি। পাখিরা যেমন মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে এটাকে তাদের স্বাধীনতা বলে, কোন পাখিকে যখন খাঁচায়  বন্দি করা হয় তখন তাকে পরাধীন বলে আমরাও তেমন তাদের কাছে বন্দি ছিলাম এখন পাখির মতো মুক্ত হয়েছি।

আম্মু তোমার জন্মদিনে অনুষ্ঠান হবে না?

হবে বাবা। আমার জন্মদিনের চেয়ে বেশি আনন্দ হবে তোর জন্মদিনে, খুব মজা হবে।

কনক হাত তালি দিতে দিতে বলল, আমার জন্মদিন কি মজা? কি মজা?

পলাশের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কনক খুব মজা করল। পলাশের কেক কাটার সময় কনক তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পলাশ কনকের মুখে কেক পুরে দিল। কনক অন্য সবার মতো হাত তালি দিতে দিতে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।

কনকের জ্বল্‌জ্বল চোখ, আকর্ষনীয় মিষ্টি চেহারা অনেকের দৃষ্টি কাড়ল। পলাশের বাবা হারুন সাহেব কনকের হাত ধরে কাছে ডেকে নিলেন, এই যে পন্ডিত, তোমার জন্মদিন কবে?

কনক পাকামো ভঙ্গিতে বলল, ২৬ শে মার্চ, যেদিন আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবস সেদিন। আম্মু বলেছে আমার জন্মদিনে খুব মজা হবে। আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু।

হারুন সাহেব বললেন, এই যে পন্ডিত এটা তো কেবল জুলাই মাস, তোমার জন্মদিন ২৬ শে মার্চ এত আগে দাওয়াত দিলে কেমন করে হবে আমরা ভুলে যাব তো।

ভুলে যাবেন না আর ভুলে গেলে আমি আমার জন্মদিনের আগের দিন আবার স্মরণ করে দিব।

আচ্ছা পন্ডিত মশাই ঠিক আছে আমাদের স্মরণ থাকবে।

হারুন সাহেব কনকের সঙ্গে কথা শেষ করে রেজা সাহেবকে বললেন, রেজা সাহেব আল্লাহ আপনার ঘরে একটা নক্ষত্র দিয়েছেন।

থ্যাংক ইউ হারুন সাহেব।

দেখবেন আপনার কনক যেদিন অনেক বড় হবে সেদিন আমার কথাটা আপনার মনে পড়বে।

দোয়া করবেন হারুন সাহেব আল্লাহ যেন আপনার মুখে ফুল চন্দন ফোটান।

পলাশের জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলো। রেজা সাহেব আর কাকলী কনকসহ বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফিরে কনক ড্রয়িং রুমে তার বই নিয়ে বসল। রেজা সাহেব এবং কাকলী বেড রুমে ঢুকলেন। ড্রয়িং রুম থেকে কনকের পড়ার শব্দ ভেসে এলো,

Two little black birds

Sitting on a wall.

One called peter,

One called paul.

Fly away, peter,

Fly away, paul.

Good bye, peter,

Good bye, paul.

রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কাকলী কনক কয়টা ছড়া মুখস্ত করেছে?

কয়টা মানে? নার্সারী ক্লাসের যে বইগুলো কিনে দিয়েছিলাম সবগুলো বই মুখস্ত করে ফেলেছে। এখন ধরেছে কবে স্কুলে ভর্তি করে দিব?

তাই নাকি?

বিশ্বাস না হয় ড্রয়িং রুমে গিয়ে ওর বইটা হাতে নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস কর দেখবে সব মুখস্ত বলে দেবে, একটা পড়া ওকে দু’বার পড়াতে হয় না, একবার পড়লেই মুখস্ত হয়ে যায়। আর হ্যাঁ একটা কথা শোন কনক ওর জন্মদিন কবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি ২৬ শে মার্চ বলেছি তুমি যেন আবার অন্যটা বল না।

রেজা সাহেব ড্রয়িং রুমে গিয়ে কনকের একটা বই হাতে নিয়ে বললেন, কনক আজ আমি তোর পরীক্ষা নিব।

কি মজা আমার পরীক্ষা হবে?

রেজা সাহেব বললেন, পাঁচটা ফুলের নাম আর পাঁচটা ফলের নাম লিখ।

কনক কয়েকমিনিটের মধ্যে লিখে ফেলল।

রেজা সাহেব কনকের হাতের লেখা দেখে অবাক হলেন। তারপর তিনি একটা একটা করে সমস্ত বই মুখস্ত পড়া নিলেন। কনক কোন পড়াতেই আটকালো না।

পড়া শেষ করে কনক জিজ্ঞেস করল, আব্বু আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিবে না?

দিব বাবা এখন তো সবেমাত্র জুলাই মাস ভর্তির সময় তো জানুয়ারী মাস, এবার জানুয়ারী মাসে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিব।

কনক হাতের আঙ্গুলে এক এক করে মাসের নাম গুণে বলল, আরো পাঁচ মাস বাকী।

এমন সময় কাকলী রুমে ঢুকলো। রেজা সাহেব বললেন, কনককে স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে আমি বললাম জানুয়ারী মাসে ভর্তি করে দিব, আমার বলাও শেষ কনকের হাতের গুণাও শেষ আর পাঁচ মাস বাকী। তারমানে যোগ-বিয়োগ শিখে ফেলেছে?

তোমাকে বললাম কি? তুমি দু’য়েকটা যোগ-বিয়োগ করাতে পারতে? এবার হারুন সাহেবের কথা তোমার বিশ্বাস হলো। তুমি তো থাক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আমি ওকে পড়াই আমি ওকে চিনতে পারি কনক আসলেই একটা নক্ষত্র।

 

পাঁচ

না না আমি কনককে দিব না, কনক আমার ছেলে, বলে কাকলী ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলেন। রেজা সাহেবও জেগে উঠলেন, কাকলী কি হলো?

কাকলী তখনো বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছিলেন, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কাকলীর সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে, তাঁর হৃৎপিন্ড দ্রুতগতিতে চলছে, কাকলী রেজা সাহেবকে বললেন, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো, প্লিজ।

রেজা সাহেব কাকলীকে এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। কাকলী এক ঢোকে পানি শেষ করে বললেন, তুমি একটু আমার পাশে বস।

রেজা সাহেব কাকলীর পাশে বসলেন, কাকলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কাকলী কি হয়েছে? কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছ?

আমার কনক কোথায়?

কেন? মাঝখানেই তো শুয়ে আছে।

কাকলী একবার কনকের মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম কনককে ঝুমলাল নিতে এসেছে, আমি বললাম, কনক আমার ছেলে আমি ওকে দিব না।

কিন্তু ঝুমলাল বলল, কনক আমার ছেলে ওকে আমি নিতে এসেছি আপনি ওকে আমার কাছে দিয়ে দিন, বলে ঝুমলাল কনককে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল এমন সময় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

রেজা সাহেব কাকলীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কাকলী ঝুমলাল গ্রামের মানুষ, গরীব, নিঃস্ব, বলা যায় হ্যান্ড টু মাউথ। এরা কখনো সাত-পাঁচ বুঝে না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না, প্রতারণা করে না। সাধারনত সমাজে এ পর্যায়ের মানুষ সত্যবাদী হয়, প্রতিশ্রুতিশীল হয়। সমাজের উঁচু স্তরে বসে যারা এসব নিঃস্ব মানুষগুলোকে শোষণ করে তারা চাতুরতা করে, সুযোগ পেলে প্রতারণা করে, চোখ উল্টাতে সময় লাগে না। আর এখানকার সবাই জানে কনক আমাদের সন্তান। ওর সঙ্গে আমাদের চেহারার মিল আছে, কনকের কথাবার্তা, চালচলনে কি কোন চিহ্ন আছে যে সে ঝুমলালের ছেলে? তুমি অযথা দুশ্চিন্তা করছ।

কিন্তু তোমার গ্রামের বাড়ি থেকে যদি ঝুমলাল আমাদের ঠিকানা নিয়ে আমাদের কাছে চলে আসে?

আমি তো আমাদের বাসার ঠিকানা গ্রামের কাউকে দিই নি।

তাহলে একটা কাজ কর, এখনো যখন কেউ আমাদের ঠিকানা জানে না, তখন নতুন করে আর কাউকে আমাদের ঠিকানা দিও না, বলে কাকলী যেন থমকে দাঁড়ালেন।

কি বল?

গ্রামে তো আমাদের কেউ নেই, যা আছে সামান্য কিছু জমি-জমা যা না হলেও আমাদের চলবে, তুমি ঐ জমিগুলো বিক্রি করে দাও যেন জমির অজুহাতে কাউকে আমাদের ঠিকানা দিতে না হয়। কনকের কথা কেউ জানুক এমন কোন স্মৃতি বা চিহ্ন আমি রাখতে চাই না। প্লিজ তুমি আমাকে এমন ব্যবস্থা করে দাও যাতে কনককে নিয়ে আমাকে কোনদিন ভাবতে না হয়।

কনক শুধু তোমার একার নয় কাকলী, কনক আমারও তুমি যেমন ওকে নিয়ে ভাবছ আমিও তেমনি ভাবছি। আমিও ওর অতীতটা একেবারে মুছে ফেলতে চাই।

তবে তুমি তোমার গ্রামের বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন কর।

গ্রামে আর আছেই বা কে, বাবা-মা মারা গেছে তা আজ প্রায় পনের বছর হলো, আমি বাবার একমাত্র সন্তান, নিজের কোন ভাই-বোনও নেই। সামান্য জমিটুকুর মায়া ছাড়তে পারব না?

তবে তাই কর যত তাড়াতাড়ি পার কর।

তুমি এখন ঘুমাও কাকলী, কাল আমি আমিনুলকে বলে দিব আমার জমিগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করার জন্য, তারপর সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে একদিন গিয়ে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসব।

পরদিন সকালবেলা রেজা সাহেবের ঘুম ভাঙ্গল কনকের পড়ার শব্দে। রেজা সাহেব বিছানা ছেড়ে কনকের রুমে গিয়ে তার পড়ার টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসলেন। কনক তখন অবিরত পড়েই চলেছে, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।

রেজা সাহেব কনকের পড়া শুনছিলেন আর মনে মনে মুগ্ধ হচ্ছিলেন। শুধু তাই নয় কনকের পড়া শুনতে শুনতে রেজা সাহেবের স্রষ্টার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। স্রষ্টা কি কনকের উপর সঠিক বিচার করেছে? তিনি যা কিছু করেন তা নাকি মানুষের মঙ্গলের জন্য করেন কিন্তু কনকের মতো বুদ্ধিমান রত্নকে ঝুমলালের মতো একজন সুইপারের ঘরে জন্ম দেওয়ার পিছনে স্রষ্টার কি মঙ্গল নিহিত আছে তা তিনিই জানেন। এমনও তো হতে পারে কনকের কপাল ভাল বলেই আমার হাতে এসেছে, আবার কখনো মনে হয় আমার কাছে না এলে কনকের মতো রত্ন ডাস্টবিনে পঁচে যেত।

ছড়াটি পড়া শেষ করে কনক মা মা বলে ডাক দিতেই রেজা সাহেব বললেন, মাকে ডাকছ কেন?

মা আমার পড়া ধরবে।

আজ না হয় আমি পড়া ধরি?

তুমি আমার পড়া ধরবে?

হ্যাঁ কেন?

বেশ তো ধর।

রেজা সাহেব কনকের বইটা নিয়ে একটা একটা করে ছড়ার নাম বললেন আর কনক প্রত্যেকটা ছড়া মুখস্ত বলতে লাগল। রেজা সাহেব আরেক দফা কনকের প্রতি মুগ্ধ হয়ে স্রষ্টার প্রতি ক্ষুদ্ধ হলেন।

কনক তার ছড়া বইটা বন্ধ করে অংক বইটা বের করে বলল, আব্বু আমাকে অংক ধর তো।

রেজা সাহেব প্রশ্ন করলেন, কনক বল্‌ তো একটা গাছে মোট দশটা পাখি ছিল, এক শিকারী একটা পাখিকে গুলি করে মারল, গাছে আর কয়টা পাখি থাকল?

আব্বু আমি এ অংকের উত্তর দিব না।

কেন?

পাখি আমি খুব ভালবাসি আর শিকারী গুলি করে একটা পাখি মারল, শিকারী খুব খারাপ কাজ করেছে। পাখিরা আমার বন্ধু। যে আমার বন্ধুকে মেরেছে আমি তার অংক করব না, কাছে পেলে আমিও ঐ শিকারীকে গুলি করে মারব। তাছাড়া সেদিন টি.ভি’তে দেখলাম পাখি শিকার করা আইনত দন্ডনীয় কাজ। এটা শিকারী কেন করবে? আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিব না।

রেজা সাহেব হেসে উঠলেন, আমার মনে হয় তুই এ অংকটা পারবি না সেজন্য উত্তর না দেওয়ার জন্যই এমন যুক্তি দাঁড় করেছিস্‌, তাই না?

তাহলে শোন একটা পাখি গুলি করে মারলে গুলির শব্দে সব পাখিগুলো উড়ে পালাবে।

আচ্ছা এখন আর একটা অংক জিজ্ঞেস করি, একটা ডিম সিদ্ধ করতে যদি দশ মিনিট সময় লাগে তবে তিনটা ডিম সিদ্ধ করতে কত মিনিট সময় লাগবে?

দশ মিনিট।

কেন বেশি সময় লাগবে না?

কারণ সবগুলো ডিম এক সঙ্গে পাতিলে দিতে হবে।

কনক তুই তাহলে পড়, বলে রেজা সাহেব কাকলী কাকলী বলে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে গেলেন, কাকলী সত্যি কনকের বুদ্ধিমত্তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি, তুমি ওকে এত অল্প বয়সে অনেক কিছু শিখিয়েছ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তবে ওর ব্রেইনের ওপর আর বেশি চাপ দিও না।

ওকে শেখাতে গিয়ে অনেক সময় আমি অমনোযোগী হয়ে যাই কিন্তু ও ধৈর্য্য হারায় না, ও বলতেই থাকে আর এটা সেটা প্রশ্ন করতে থাকে, ছেলেটা কৌতুহলী।

বিরক্ত হবে না, বাচ্চারা কৌতুহলী হওয়া ভাল।

তাই তো সারাদিন ওর সঙ্গে লেগে থাকি ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিই। কখনো বিরক্ত মনে করি না।

ভালভাবে ওর যত্ন নিও, ওর ফেইস বলে ও একদিন অনেক বড় হবে এখন আমাদের উচিত চারাগাছের মতো ওকে আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বড় করে তোলা।

সে আর তোমাকে বলতে হবে না।

তুমি নাস্তা দাও, আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নিই।

আজ তোমাকে কি করতে হবে মনে আছে?

কি করতে হবে?

কি করতে হবে মানে?

মনে নেই?

কি?

আদিতমারীর জমি বিক্রির জন্য আমিনুলকে খবর দিতে হবে।

একথা তো আমার মনেই আছে আমি ভাবছিলাম আর কিছু বলার আছে বুঝি।

আমার আর কিচ্ছু চাই না। চাই কনকের মা হতে।

 

ছয়

রেজা সাহেবের বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন, মা ছিলেন গৃহিণী। রেজা সাহেব বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রেজা সাহেব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অপরাধে পাকিস্তানী বাহিনী তাঁর বাবা-মা দু’জনকে হত্যা করে। রেজা সাহেব মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে একেবারে একা হয়ে যান কিন্তু তিনি জমি-জমার লোভে গ্রামে পড়ে থাকেন নি। গ্রামের জমি-জমা দেখার দায়িত্ব তাঁর চাচাত ভাই আমিনুলের হাতে দিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকায় আসেন। প্রথমে কাকলী কন্সট্রাকশন ফার্মে চাকরি পান, রেজা সাহেব তাঁর মেধা আর দক্ষতা দিয়ে কাজ করেন ফলে অল্প দিনের মধ্যে ফার্মের কল্পনাতীত উন্নতি হয়। সেখানে পরিচয় হয় কাকলীর সঙ্গে। কাকলী ফার্মের প্রোপ্রাইটার কায়সার সাহেবের একমাত্র মেয়ে। রেজা সাহেবের সততা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তা দেখে কায়সার সাহেব তাঁর মেয়ে কাকলীর সঙ্গে রেজা সাহেবের বিয়ে দেন এবং কাকলী কন্সট্রাকশন ফার্মকে সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এ রুপান্তর করেন। কায়সার সাহেবের নিউ ইস্কাটনে একটা তিনতলা বাসা আছে, বিয়ের পর তাঁর শ্বশুর মহাশয় তাঁর বাড়ির একটা ফ্লোরে থাকার জন্য বললেও রেজা সাহেব আত্মসম্মানের কথা ভেবে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করেন। তারপর রেজা সাহেব ধানমন্ডিতে নির্মাণাধীন একটা এ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করার উদ্দেশ্যে নির্মাণাধীন এ্যাপার্টমেন্টের অদূরে বাসা ভাড়া নিলেন।

রেজা সাহেবের কথামতো আমিনুল সমস্ত জমি-জমা বিক্রি করার জন্য কাস্টমার ঠিক করে ফেলল। রেজা সাহেব আদিতমারী পৌঁছে আমিনুলকে জিজ্ঞেস করে তাঁর জমি বিক্রির বিষয়ে খবর নিলেন।

আমিনুল বলল, ভাইজান তাড়াহুড়া করে জমি বিক্রি না করে আরো সময় নিয়ে কাস্টমার খুঁজলে জমির দাম হয়ত আরো বেশি পাওয়া যেত। আপনি যে কেন তাড়াহুড়া করে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন?

রেজা সাহেব বললেন, আমিনুল হঠাৎ করে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন হলো, তাই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

ভাইজান কি ঢাকায় বাড়ি করছেন?

এখনো করিনি তবে টাকা হলে হয়ত করব।

ভাইজান কি এবার ঢাকা গেলে আর কোনদিন আসবেন না?

রেজা সাহেব মনে মনে বললেন, শুধু এখানে না আসার জন্যই তো এখান থেকে শিকড় তুলে ফেলা। কিন্তু আমিনুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, না তা কি করে হয়, আদিতমারী আমার জন্মভূমি এখানে আসব না? এখানে আমার শৈশবের স্মৃতি আছে,  তোমরা আছ, বলেই রেজা সাহেব যেন থমকে গেলেন, এ কি বলছেন তিনি? জন্মভূমির নামে মিথ্যা কথা, শৈশবের স্মৃতি নিয়ে প্রতারণা? না এটা বলা বুঝি তার ঠিক হলো না। রেজা সাহেব নিজে বিবেকের দংশনে দগ্ধ হলেও মুখে তার বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটল না।

রেজা সাহেব জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়ে উপজেলা রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে অপেক্ষা করছিলেন এমন সময় ঝুমলাল রেজা সবাহেবকে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল, ভাইজান তু ভাল(ভাইজান কেমন আছেন)?

রেজা সাহেব কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন, হ্যাঁ ভাল আছি।

ঝুমলাল একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ভাইয়া হামার হরলাল ভাল (ভাইজান আমার হরলাল কেমন আছে)?

ঝুমলালের চোখে-মুখে বেদনা ও ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। রেজা সাহেব একবার মনে করলেন ঝুমলালকে ধমক দিয়ে বলবেন, তোমার ছেলেকে তো একেবারে আমার কাছে দিয়ে দিয়েছ এখন আবার জানতে চাও কেন? আবার পরক্ষণেই তাঁর চোখের সামনে কনকের মুখচ্ছবিটা ভেসে উঠল। কনক তাঁর নিজের সন্তান নয়, কনকের সাথে তাঁর রক্তের কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু অতি অল্প দিনে তার প্রতি রেজা সাহেবের যে মায়া জন্মেছে, রক্তের সম্পর্কহীন এক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রেজা সাহেব পিতৃত্বের অহংকার পেয়েছেন। অথচ ঝুমলাল তার নিজের সন্তানকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁর কাছে একেবারে দিয়ে দিয়েছে। ঝুমলাল তার ছেলেকে চিরদিনের জন্য উৎসর্গ করেছে, তার অধিকারের প্রতি আর সে কোনদিন ফিরে তাকাবে না প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু রেজা সাহেবকে দেখার পর হয়ত তার ছেলের জন্য হৃদয়টা হাহাকার করে উঠেছে, তাই সে তার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে ছেলের ভাল-মন্দের খবর জানতে চেয়েছে।

রেজা সাহেব এদিক-সেদিক একবার তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, ভাল আছে।

ওখরাকে লেখাপড়া শেখায়নি লাগি ভাইয়া, লেখাপড়া না করে তো মারে, হাম কোনদিন বাপকে দাবি লেকে না যায়েম, ও তোরা ক্যা বাতোয়া বলেছে ভুল ভাইলভা, ও ভাইয়া হামরা কোনদিন কিছু না জানকে না যায়েম (ওকে ভাল করে লেখাপড়া শেখাবেন ভাইজান, লেখাপড়া করতে না চাইলে শাসন করবেন, আমি কোনদিন বাবার দাবি নিয়ে আপনার কাছে যাব না, আজকেই আমার আপনাকে জিজ্ঞাসা করা ভুল হয়েছে, ভাইজান আর কোনদিন কিছু জানতে চাইব না), বলে ঝুমলাল চলে গেল।

রেজা সাহেব হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আমিনুল তাঁর সাথে যোগ দিল। আমিনুল কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটার পর রেজা সাহেবের গন্তব্য বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন ভাইজান?

এমনি একবার গ্রামটা ঘুরে দেখছি, বলে রেজা সাহেব আবার হাঁটতে থাকলেন। তার মনের মধ্যে তখন শৈশবের স্মৃতি ভেসে উঠল একবার তার বাবা-মা’র মুখের ছবি ভেসে উঠল। এই গ্রামে তিনি শৈশব কাটিয়েছেন, কৈশোর কাটিয়েছেন আজ চিরদিনের জন্য এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন তিনি আর কোনদিন ফিরে আসবেন না, এই যে আমিনুল তাঁর এত আতিথেয়তা করল, নিজের কাজ ছেড়ে যে সারাদিন তাঁকে সঙ্গ দিল, যার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক আছে তার সঙ্গে হয়ত তার আর কোনদিন দেখা হবে না। ভাবতে ভাবতে রেজা সাহেবের দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।

রেজা সাহেব কবরস’ানের কাছে এসে বললেন, আমিনুল আমি তো কবরস’ানটা বিক্রি করিনি তাই না?

জি না ভাইজান।

আমি মারা যাওয়ার আগে যদি মনে করি তবে আমার ঠিকানাটা লিখে তোমার ভাবীর কাছে দিয়ে যাব আমাকে আমার বাবা-মা’র কবরের পাশে কবর দিও, ততদিন পর্যন্ত বাবা-মা’র পাশে আমার আর তোমার ভাবীর জন্য দু’টা কবরের জায়গা ফাঁকা রেখো। অবশিষ্ট জায়গা তুমি গরীব-দুঃখীদের কবর দেওয়ার জন্য দান করে দিও, বলতে বলতে রেজা সাহেবের চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

ভাইজান আপনি এমন কথা বলছেন কেন? আপনি কি আর কোনদিন গ্রামে ফিরে আসবেন না?

আসব না তো বলছি না, হায়াত মউতের কথা তো বলা যায় না, তাই তোমাকে সব কিছু বলে রাখলাম।

আমিনুল রেজা সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। রেজা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, বসত বাড়ির জায়গাটা আমি বিক্রি করলাম না কেন জানো?

না ভাইজান।

বসতবাড়ির জায়গা একটা বংশের ঐতিহ্য, ওটা আমি বিক্রি করব না, আমার কোন ছেলে-মেয়ে না থাকায় আমার মৃত্যুর পর তোমার ছেলেই ঐ সম্পত্তির মালিক হবে। আর যদি আমার ছেলে-মেয়েও হয় তবে আমি বলে যাব তারা বসত বাড়ির এই সামান্য জায়গাটুকু কখনো বিক্রি করবে না।

ঠিক আছে ভাইজান।

তুমি তো জানো আমি নাইট কোচের টিকেট করেছি, আমি আর দেরি করতে চাচ্ছি না, লালমনিরহাটে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে আমার ব্যাগ রেখেছি সেখান থেকে আমি চলে যাব।

আপনি বলেন কি ভাইজান? রাস্তা থেকেই চলে যাবেন?

কেন সকালে তোমার বাসায় নাস্তা খেলাম, দূপুরে ভাত খেলাম এখন আমার যাবার পালা, তুমি আমাকে একটা বাসে তুলে দাও।

আমিনুল রেজা সাহেবের আচরণে কিছুটা বিব্রতবোধ করল। নিজের চাচাত ভাই এভাবে রাস্তা থেকে বিদায় নিবেন কেমন হয়? আমিনুল রেজা সাহেবকে কয়েকবার তার বাসায় আবার আসার জন্য অনুরোধ করল কিন্তু রেজা সাহেব তার কথা না শুনে বাসে উঠে লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

 

সাত

রেজা সাহেবের কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর কাকলী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, তোমার আরো একটা কাজ বাকী আছে।

কি কাজ?

মোবাইলের সিমটা চেঞ্জ করা।

রেজা সাহেব একবার মনে মনে ভাবলেন এতটা না করলেও হয় আবার মনে হলো কাকলী কনকের পূর্ব পরিচয় মুছে দিয়ে তাকে একেবারে আপন করতে চায়, কেউ যেন তার দাবিদার হয়ে কোনদিন আসতে না পারে। রেজা সাহেবও তো তাই চান তবে আর মন্দ কি?

রেজা সাহেব বললেন, ঠিক আছে।

তবে আজ বিকেলে একবার ইস্টার্ন প্লাজায় গিয়ে একটা নতুন সিম কার্ড কিনে ঐদিক দিয়ে বাবাকে দেখে আসব।

আচ্ছা।

ইস্টার্ন প্লাজার চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় কনক খুব আনন্দ পেল এর আগে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে গিয়ে সে একবার লিফটে উঠেছে, চলন্ত সিঁড়িতে উঠেছে কিন্তু তখন সবেমাত্র কনক ঢাকা শহরে এসেছে তাই তখন তার মনের মধ্যে আনন্দ থাকলেও চোখে-মুখে তখনো সংশয় কাটেনি। আজ চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় কাকলী কনককে কোলে নিতে গিয়েছিলেন কিন্তু কনক কোল থেকে নেমে বলল, আম্মু  আমি নিজে উঠব।

কাকলী কোল থেকে কনককে নামিয়ে দিয়ে তার হাতটা ধরতে চাইল। কনক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আম্মু আমি বলছি না আমি নিজে উঠব, এখন আমি বড় হয়েছি না?

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পর কনক যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সে হাত তালি দিতে দিতে বলল, আমি নিজে উঠছি, আমি নিজে উঠছি।

কাকলী কনককে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলল, ওরে বাবা, আমার বাবা তো দেখছি সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছে।

কোনকিছু না জানিয়ে হঠাৎ কাকলীকে তাঁর বাসায় আসতে দেখে কায়সার সাহেব বললেন, মা তুই হঠাৎ? জামাই আসেনি?

এসেছে বাবা, সঙ্গে কনকও এসেছে।

রেজা সাহেব ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে সোফায় বসতেই কাকলী বললেন, তোমরা কনকসহ একটু বস তো, বাবা তুমি এসো আমার সঙ্গে, মা কোথায়?

তোর মা বেলকনিতে বসে আছে।

কাকলী মা মা বলে ডাক দিতেই তাঁর মা সামনে এসে দাঁড়ালেন, মা তুই? কি মনে করে? এমন করে ডাকছিস্‌ কেন?

মা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে চল তো তোমার বেডরুমে, তুমিও এসো বাবা।

কাকলী বেড রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, বাবা, মা তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বল্‌ মা, কায়সার সাহেব বললেন।

কাকলী খাটের এক কোণায় বসলেন। মা ও কায়সার সাহেব পাশাপাশি দু’টা চেয়ার নিয়ে বসলেন।

মা তোমাকে তো আমি কনকের কথা মোবাইলে বলেছি আজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ও আমার ছেলে মা, আমি তোমার জামাইকে ওদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে তোমাদের জামাইর নামে যত জমি-জমা ছিল সব বিক্রি করে এসেছে আজ তোমাদের জামাইয়ের মোবাইলের সিমটাও চেঞ্জ করালাম। আমি ওর কোন পূর্ব পরিচয় রাখতে চাই না মা।

বেশ তো ভালই করেছিস্‌, কায়সার সাহেব বললেন।

মা’র চোখ ছল্‌ছল করে উঠল, তাঁর মেয়ে নিঃসন্তান এটা যে তাঁর মনে কি কষ্ট তা তিনিই বুঝেন। আর কাউকে বুঝাতে পারবেন না। একটা বাচ্চার জন্য কাকলী কত না দেশ-বিদেশের বড় বড় ডাক্তার দেখালেন? কত পীর আউলিয়ার মাজারে গেলেন? কত কবিরাজ দেখালেন? কিন্তু কোন লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত একটা পোষ্য পুত্রকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর চেষ্টা করেছেন। কাকলীর কষ্ট দেখে তাঁর মায়ের বুকটা যেন হাহাকার করে উঠল।

কাকলীর মা বললেন, তুই যা ভাল বুঝিস্‌ তাই কর্‌ মা।

মা তোমাদের আমার জন্য ছোট-খাট একটু মিথ্যা কথা বলতে হবে।

কি কথা মা?

মা কনককে কখনো বুঝতে দেয়া যাবে না যে তোমরা ওর আসল নানা-নানী না। তাহলে আমি খুব কষ্ট পাব। তোমরা আমার জন্য এটুকু কর। আমি যা করতে পেরেছি তোমরা কেন তা পারবে না মা?

অবশ্যই পারব মা।

চল বাবা এখন তোমাদের জামাইয়ের সঙ্গে গল্প কর।

চল্‌ মা, বলে কায়সার সাহেব উঠলেন।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে কায়সার সাহেব স্নেহের সুরে কনককে কাছে ডাকলেন, কনক এদিক এসো তো নানু ভাই।

কনক কায়সার সাহেবের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি?

বাঃ প্রথমে আমার নামটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো, আমার নাম কায়সার রহমান। তোমার নাম কি?

আমার নাম কনক, কনক মানে সোনা। আপনার নামের মানে কি?

আমি তো কোনদিন আমার নামের অর্থ খুঁজিনি নানুভাই। আমি সেকেলে মানুষ, আমার বাবা-মা অর্থ জেনে নাম রাখেনি, মুখে যে নাম এসেছে সে নামই রেখেছে, আমার বাবা-মা তো আর তোমার বাবা-মা’র মতো শিক্ষিত ছিলেন না তাই অর্থ বুঝে নাম রাখতে পারেননি। তবে নানুভাই তোমার নামটা বেশ সুন্দর। তুমি আসলেই সোনা।

এটা বুঝি আপনার নিজের বাড়ি?

হ্যাঁ।

আমার আব্বু বাড়ি করবে, আমরা যেখানে ভাড়া থাকি তার পাশেই বড় যে একটা উঁচু বিল্ডিং হচ্ছে সেই বিল্ডিংটাতে আমরা একটা বাসা নিব। তখন আমাদের খুব ভাল হবে।

তাই নাকি?

আপনি না হয় আব্বুকে জিজ্ঞেস করুন।

রেজা তুমি তাহলে ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্টে উঠছ?

জি আব্বা।

ভালই হবে ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্টের যে কোন একটা ফ্ল্যাট নিজের মতো করে তৈরী করে নিতে পার।

কনকের মন খারাপ হলো, সে বলল, আব্বু আমরা যখন বাসা চেঞ্জ করব তখন আমার বন্ধুদের কি হবে? আমি আবার বন্ধু পাব কোথায়?

কায়সার সাহেব বললেন, কেন আমি আছি না, আমি তোমার বন্ধু হব, তোমার নানী তোমার বান্ধবী হবে, তোমাদের বাড়ির পাশে আরো কত বন্ধু হবে।

কাকলী কনকের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ধানমন্ডিতে আমাদের বাড়ির পাশে একটা লেক আছে সেটা তো তুমি দেখেছ, সেখানে বিকাল হলে কত মানুষ বেড়াতে আসে, আমরাও বিকাল হলে লেকে বেড়াতে যাব, লেকটা আমাদের বাসার খুব কাছে। তখন অনেক মজা হবে।

কনক জিজ্ঞেস করল, আম্মু লেক কি?

কেন আমাদের বাসার পাশে যে একটা ছোট নদীর মতো আছে, সবাই যেখানে বেড়াতে আসে, আমরাও তো প্রতিদিন বিকালে বেড়াতে যাই, ওটাকে তো লেক বলে।

কাকলীর কথায় কনক খুব খুশি হলো, সে হাত তালি দিতে দিতে বলল, কি মজা, কি মজা।

কাকলী কনককে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। কায়সার সাহেব রেজা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, তা বাবা তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?

জি আব্বা ভাল, তবে আগের মতো না, এখন অনেক এ্যাপার্টমেন্ট কোম্পানি হয়েছে, প্রতিযোগীতা অনেক বেড়ে গেছে তাই কম প্রোফিটে বিক্রি করতে হচ্ছে, তবুও মন্দ না। আপনি ব্যবসায় যে গুড উইল তৈরী করেছিলেন সেটাকে আমিও ধরে রেখেছি, সেজন্য আমার ফ্ল্যাট বিক্রি করতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না।

শুনলাম তুমি নাকি তোমার পৈত্রিক ভিটে-মাটি সব বিক্রি করে এসেছ?

জি আব্বা, আপনি তো কনকের বিষয়ে কাকলীর কাছ থেকে সবকিছু শুনেছেন, আসলে আমরা দু’জনে কনকের অতীতের কোন সাক্ষী রাখতে চাই না। তাই গ্রামে যাওয়ার পথটা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে এলাম।

তোমাকে আমি আর কি বলব বাবা, আসলে আল্লাহ কাউকে সবকিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করেন না, কোন না কোন একটা আকাংখা অপূর্ণ রাখেন। দেখ আমার এত ধন-সম্পদ অথচ শুধু একটা মেয়ে, আমার তাও একটা সান্ত্বনা যে আমার একটা মেয়ে আছে। আল্লাহ তোমাদের একটা সন্তানও দিল না, যাহোক এনিয়ে আর মন খারাপ করে লাভ নেই, তোমরা কনককে ভালভাবে মানুষ করে গড়ে তোল ও-ই একদিন তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। কনক খুব বুদ্ধিমান হবে, ওর চেহারার মধ্যে একটা উজ্জ্বলতা আছে, বুদ্ধির দৃপ্তি আছে, আমি বুঝতে পেরেছি ও একদিন অনেক বড় হবে।

দোয়া করবেন আব্বা।

 

আট

সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এর অফিস গুলশানে। আগে কায়সার সাহেব ব্যবসা দেখাশুনা করতেন এখন তাঁর বয়স হয়েছে তাই তিনি নিজ নামে শেয়ার রেখেছেন ২৫%, অবশিষ্ট শেয়ার তাঁর মেয়ে কাকলী ২৫% এবং জামাই রেজা সাহেবকে ৫০% উইল করে দিয়েছেন। সেই সূত্রে রেজা সাহেব এখন এই ফার্মের কর্ণধার। গুলশানে সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এর লাক্সারিয়ার্স অফিস, সমস্ত বিল্ডিং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। অফিসের গেটে প্রাইভেট সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয়। দরজা দিয়ে ঢুকতেই ধব্‌ধবে ফর্সা, লম্বা, দীর্ঘাঙ্গী, কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো চুলে মেহেদী পরানো, ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট, স্মার্ট মেয়েটির নাম লাবন্য, সে রিসিপশনিস্ট। এই অফিসের সঙ্গে জড়িত সাব-কন্ট্রাক্টর, সাপ্লায়ার্স, কনসাল্টেন্ট, সবাই তাকে খুব সমাদর করে ম্যাডাম বলে ডাকে। অপরিচিত কেউ ঢুকলেই সে যেন বুঝতে পারে কাস্টমার নাকি অন্য কেউ? সে অনুযায়ী একটা এট্রাকটিভ হাসি হেসে সালাম দিয়ে বলে, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি স্যার?

আমি মিঃ শওকত একবার এম.ডি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই, তিনি আছেন কি?

জি আছেন, আপনি বসুন প্লিজ, বলে লাবন্য ইন্টারকমে রেজা সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করল, স্যার এক ভদ্র লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

কি জন্য?

লাবন্য রিসিভার কানের কাছে নিয়েই শওকত সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, প্লিজ যদি বলতেন স্যারের সঙ্গে কেন দেখা করতে চান?

আমি একটা ফ্ল্যাট কিনব।

স্যার তিনি একটা ফ্ল্যাট কিনবেন, আমি কি পাঠিয়ে দিব?

আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।

লাবন্য কলিং বেল টিপতেই একজন পিয়ন চলে এলো, ম্যাডাম।

লাবন্য শওকত সাহেবকে দেখিয়ে বলল, স্যারকে এম.ডি স্যারের কাছে নিয়ে যাও।

থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, নাইস টু মিট ইউ, বলে শওকত সাহেব চেয়ার থেকে উঠলেন।

লাবন্য মিষ্টি হেসে বলল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।

রেজা সাহেবের চেম্বারটি অত্যাধুনিকভাবে সাজানো, খুব সম্ভব তাঁর নিজের বসার হুইল চেয়ারটি, তাঁর সামনে রাখা চেয়ারগুলো এবং টেবিলটা বিদেশি কোন কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে, ফ্লোরে ডিজাইন করে বসানো হয়েছে টাইলস্‌, রুমের ডিসটেম্পার অত্যন্ত আকর্ষনীয়, হুইল চেয়ার ঘুরাতেই তাঁর ডান পাশে আছে কম্পিউটার, টেবিলের গ্লাসের নিচে বড় করে তাঁদের কোম্পানির নির্মিত এ্যাপার্টমেন্টের স’ান প্রদর্শিত ঢাকা শহরের একটা ম্যাপ। তাঁর পিছনে মাথার ওপর দেয়ালের সঙ্গে ঝুলানো আছে সমপ্রতি নির্মিত কয়েকটি এ্যাপার্টমেন্টের ছবি।

শওকত সাহেব রেজা সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই রেজা সাহেব দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি রেজা এম.ডি।

আমি শওকত, আমার পরিচয়ে কি বলব? আমি একজন প্রবাসী বাঙ্গালী।

রেজা সাহেব হেসে ফেললেন, প্রবাসী বলবেন না মশাই, বলবেন বাংলাদেশী, বিদেশে চাকরি করি তারপর গ্রামের ঠিকানা বলবেন।

জি আমার বাড়ি সিলেটে। অনেকদিন যাবত লন্ডনে আছি, ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনব তাই আপনার কাছে এসেছি।

আপনি কিছু মনে করলেন না তো।

না বুঝতে পারলাম ইউ আর সো রোমান্টিক।

রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি খাবেন? চা না কফি? নাকি ঠান্ডা কিছু?

এজ ইয়োর উইস।

রেজা সাহেব কলিং বেল টিপে পিয়নকে কফি আনার অর্ডার দিলেন। তারপর কয়েকটা এ্যাপার্টমেন্টের ক্যাটালগ তাঁর সামনে দিয়ে বললেন, দেখুন আগে চয়েজ করুন, তারপর কথা বলছি।

শওকত সাহেব ক্যাটালগগুলোর পাতা উল্টিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কোথায় এখন আপনাদের এ্যাপার্টমেন্টের কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক চলছে?

আমাদের বর্তমান এ্যাপার্টমেন্টের কাজ চলছে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা। আপনি কোথায় কিনবেন?

ধানমন্ডি।

রেজা সাহেব ধানমন্ডিতে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের ক্যাটালগটা শওকত সাহেবের হাতে দিলেন।

শওকত সাহেব মনোযোগ দিয়ে ক্যাটালগটা হাতে নিয়ে ফ্লোরপ্লান, এলিভেশনগুলো দেখলেন তারপর প্রাইজ লিস্ট বের করলেন।

সবকিছু দেখে শওকত সাহেব খুব খুশি হলেন, তিনি বললেন, আপনারা ক্যাটালগটা এত ডিটেইলস্‌ করেছেন যে জিজ্ঞেস করার কিছুই নেই। একবার চোখ বুলালেই হয়। আচ্ছা মিঃ রেজা আমি তো ফ্লোর প্লান, এলিভেশন, প্রতি স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের মূল্য সবকিছু দেখলাম এখন আমি একবার এ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে চাই।

অফ কোর্স, এই নিন আমাদের সাইট ইঞ্জিনিয়ারের ভিজিটিং কার্ড, আপনি যখন ইচ্ছা গিয়ে এ্যাপার্টমেন্ট দেখে আসতে পারেন।

এমন সময় কফি এলো, দু’জনে কফি খেতে খেতে আরো অনেক গল্প করলেন। তারপর শওকত সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, সো মিঃ রেজা নাউ আই উইল ভিজিট  ইয়োর এ্যাপার্টমেন্ট এন্ড দেন আই উইল টেক মাই  ফাইনাল ডিসিশন। আই মে কনফার্ম দ্যাট আই উইল পারচেজ এ ফ্ল্যাট এন্ড ভ্যারি সুন।

থ্যাংক ইউ মিঃ শওকত ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

শওকত সাহেব যাওয়ার পর রেজা সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল, স্যার।

আইয়ুব সাহেবকে আমার সালাম দাও।

কয়েকমিনিটের মধ্যে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার আইয়ুব সাহেব এসে বসলেন, স্যার আমাকে ডেকেছেন?

বসুন।

আইয়ুব সাহেব চেয়ারে বসলেন। রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আইয়ুব সাহেব আমাদের ধানমন্ডিতে এ্যাপার্টমেন্টের কাজ কতদূর?

শেষের দিকে স্যার, স্ট্রাকচারের কাজ শেষ হয়েছে এখন শুধু ফিনিশিংয়ের কাজ বাকী।

দেখুন তো পাশেই থাকি অথচ কোনদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনা।

যাবেন স্যার মাঝে মাঝে আপনি গেলে স্টাফরা আরো সিনসিয়ার হবে।

তা অবশ্য ঠিক, আচ্ছা কাজটা শেষ করতে আর কতদিন লাগবে?

স্যার মোটামুটি চার মাস তো লাগবেই।

রেজা সাহেব আঙ্গুলে গুনলেন কনকের স্কুলে ভর্তি হতে আরো পাঁচ মাস বাকী। তিনি মনে মনে বললেন, ভালই হল কনকের স্কুলে ভর্তির সময় হবে আর নতুন বাসায় উঠব, স্কুল চেঞ্জের আর কোন সমস্যা নেই।

স্যার কিছু ভাবছেন?

আমাদের ক’টা ফ্ল্যাট বুকিং এখনো বাকী আছে?

স্যার এটা জি.এম সাহেব বলতে পারবেন।

আচ্ছা আপনি আসুন একবার জি.এম সাহেবকে ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্ট বুকিং এর ফাইলটা নিয়ে আসতে বলুন।

কিছুক্ষণের মধ্যে জি.এম সাহেব রুমে ঢুকলেন, স্যার।

বসুন জি.এম সাহেব, আচ্ছা বলুন তো আমাদের ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির কি অবস’া?

মোট ষাটটা ফ্ল্যাটের মধ্যে আর দশটা ফ্ল্যাট বিক্রি বাকী আছে।

দেখুন তো সেকেন্ড ফ্লোর কিংবা থার্ড ফ্লোরে কোন ফ্ল্যাট বাকী আছে কি না?

জি.এম সাহেব বললেন, শুধু মাত্র সেকেন্ড ফ্লোরে দু’টা আর থার্ড ফ্লোরের দু’টা ফ্ল্যাট বিক্রি বাকী আছে। আপনি বলছিলেন এ চরটা ফ্ল্যাট বিক্রির আগে যেন আপনাকে জানাই। আপনার নির্দেশ পেলে এতদিন বিক্রি হয়ে যেত।

আমি না বলা পর্যন্ত সেকেন্ড ফ্লোর আর থার্ড ফ্লোরের এ্যাপার্টমেন্টগুলো বিক্রি করবেন না।

জি স্যার।

জি.এম সাহেব বেরিয়ে যাবার পর রেজা সাহেব কাকলীকে মোবাইল করলেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে কাকলীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বল।

কাকলী আজ একবার রেব হব, নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাব, তুমি ফ্ল্যাটটা চয়েজ করে দিলে সেটার ফিনিশিং কাজ আগে শুরু করতে বলে দিব।

বেশ তো যাব।

তাহলে তুমি ঠিক পাঁচটায় রেডি থেকো।

আচ্ছা ঠিক আছে, কনকের সঙ্গে কথা বল।

দাও।

হ্যালো আব্বু তুমি দূপুরে ভাত খেয়েছ?

খেয়েছি আব্বু, তুই তোর আম্মুর সঙ্গে রেডি থাকিস্‌ আজ বিকেলে নতুন বাসা দেখতে যাব।

ক’টায়?

বিকেল পাঁচটায়।

রেজা সাহেব মোবাইল রেখে আপন মনে মৃদু হাসলেন, এতটুকু বাচ্চা জিজ্ঞেস করে ক’টায় যাবে, এখনই সময় সম্পর্কে সচেতন।

 

নয়

ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্টের সেকেন্ড ফ্লোরের একটা ফ্ল্যাটে রেজা সাহেব বাসা শিফ্‌ট করেছেন, ফ্ল্যাটটা কাকলী এবং কনকের খুব পছন্দ। দু’টা বেডরুম, একটা গেস্টরুম, একটা রিডিং রুম, স্টোর এবং দক্ষিণের বারান্দা, বাসাটার দক্ষিণে এখনো কোন বাসা না হওয়ায় বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত দিগন্ত বিসতৃত হয়। পূর্ণিমা রাতে আকাশের চাঁদ যেন বারান্দায় লুটোপুটি খায়। পাশেই একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে কনককে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে, ভর্তি পরীক্ষায় কনক ফার্স্ট হয়েছে দেখে রেজা সাহেব এবং কাকলী দু’জনে খুব খুশি হয়েছেন। কনক পড়াশুনায় খুব রেগুলার, কোনদিন কোন পড়ার কথা তাকে বলে দিতে হয় না, ক্লাসের পড়া সে নিজেই সব মুখস্ত করে, মাঝে মাঝে কাকলী তার পড়া মুখস্ত নেয় আর পড়াশুনায় খুশি হয়ে আদরে আদরে তার মুখ ভরিয়ে দেয়। কাকলী সারাদিন কনকের স্কুল, কনকের লেখাপড়া আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কনকের পূর্বপরিচিত আর কেউ নেই এই এ্যাপার্টমেন্টের সবাই জানে কনক তাদের সন্তান কোনদিন কনকের দাবি নিয়ে ঝুমলালের বাসায় আসার সুযোগ একেবারে বন্ধ। একথা ভেবে কাকলী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

সেদিন বিকেলবেলা কনক আর কাকলী দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তে তাকিয়ে ছিল, আগে যে বাসায় ভাড়া ছিল সে বাসা থেকে দিগন্ত দেখা যেত না, ঢাকা শহরে যে উঁচু উঁচু বিল্ডিং হয়েছে তাতে কোন বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠেও দিগন্ত দেখা যাবে না এটাই স্বাভাবিক। কোন উঁচু বিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে দিগন্ত দেখতে চাইলে শুধু বিল্ডিংয়ের ছাদ দেখা যায় আর কোন দোতলা কিংবা তিনতলা বিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে দিগন্ত দেখতে চাইলে অদূরের কোন বিল্ডিংয়ে দিগন্ত শেষ হয়ে যায়, পাশাপাশি কোন উঁচু বিল্ডিংয়ের জন্য ঢাকা শহরে আকাশ দেখাও সমস্যা। ভাগ্যিস রেজা সাহেব যে এ্যাপার্টটা তৈরী করেছেন তার দক্ষিণ পাশটা এখনো ফাঁকা থাকায় দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাটে যারা থাকে তারা এখনো আকাশ দেখতে পারে। কিন্তু তাতেও কনকের মন ভরে না প্রায় ছাদে যাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আজও কাকলী কনককে ছাদে নিয়ে গিয়ে আকাশ দেখাচ্ছিলেন কনক হঠাৎ প্রশ্ন করল, আম্মু আকাশ দেখলে কি হয়?

কাকলী এ প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন তিনি নিজেই জানেন না, তিনি কয়েকমুহূর্ত কি যেন ভেবে নিলেন, তারপর বললেন, আকাশ দেখলে মন উদার হয়, আকাশের মতো।

আম্মু তোমার মনটা কি আকাশের মতো?

কাকলী বিব্রতকর অবস’ার মধ্যে পড়লেন, হ্যাঁ বাবা, তোর মনটাও আকাশের মতো উদার।

আম্মু আকাশে তো চাঁদ থাকে, তারা থাকে, মানুষের মনের মধ্যেও কি চাঁদ থাকে? তারা থাকে?

যারা ভাল মানুষ তাদের মনটা উজ্জ্বল, মেঘহীন, আকাশের পূর্ণিমার চাঁদের মতো।

কনক চাঁদ তারা নিয়ে আর কোন প্রশ্ন করল না, কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আবার হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আম্মু আজ কত তারিখ জানো?

আজ ২৪ শে মার্চ।

আম্মু আমার জন্মদিন কত তারিখ তোমার মনে আছে?

কাকলী একদিন কনককে তার জন্মদিনের কথা বলেছিলেন কিন্তু সেটা তো তাঁর মনে নেই। তিনি কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তারপর বললেন, বাপজান তুই বলত তোর জন্মদিন কবে?

২৬ শে মার্চ।

ও তাই তো, তাহলে তো আমার অনেক কাজ।

কি কাজ আম্মু?

কেন তোর জন্মদিন পালন করতে হবে না? কেকের অর্ডার দিতে হবে, তোর নানা বাড়িতে দাওয়াত দিতে হবে, তোর বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত দিতে হবে।

কনক হাত তালি দিতে দিতে বলল, কি মজা? কি মজা? আমার জন্মদিন হবে, আমি কেক কাটব, বেলুন উড়াব, সবাই বলবে হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। খুব মজা হবে তাই না আম্মু?

হ্যাঁ খুব মজা হবে, চল্‌ তো তোর আব্বুকে খবরটা দেই, তোর আব্বু কেকের অর্ডার দিয়ে আসবে।

রুমে এসে কনক নিজেই রেজা সাহেবকে মোবাইল করল, আব্বু বল তো আমার জন্মদিন কবে?

কি জানি বাবা আমার তো মনে নেই।

আব্বু তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না, সব ভুলে যাও।

তুই বল্‌ তো তোর জন্মদিন কত তারিখে?

২৬ শে মার্চ। আব্বু আম্মু বলেছে খুব বড় অনুষ্ঠান হবে, খুব মজা হবে। অনেক কিছু কিনতে হবে আম্মু তোমার সঙ্গে কথা বলবে, বলে কনক মোবাইলটা কাকলীর হাতে দিল।

কাকলী মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে রেজা সাহেবের কন্ঠস্বর ভেসে এলো, শোন কনকের জন্মদিন, কি কি করতে হবে? তুমি সব আয়োজন কর।

হ্যাঁ তুমি আসার সময় শুধু কেকের অর্ডারটা দিয়ে এসো। বাকী আয়োজন আমি করব।

২৬ শে মার্চ কনকের জন্মদিন। রেজা সাহেব তাঁর শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, সদ্য পরিচিত সব বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করেছেন, কাকলী কনকের কয়েকজন বন্ধুর মা এবং পাশাপাশি কয়েকটি ফ্ল্যাটের যে কয়েকজন ভদ্র মহিলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে তাঁদের দাওয়াত করেছেন। কনক নিজেও তার কযেকজন বন্ধুকে দাওয়াত করেছে। বিকেলবেলা জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হলো। দলে দলে অতিথিরা আসতে শুরু করলেন। কনককে কাকলী আজ সুন্দর করে সাজিয়েছেন, তার পরনে পায়জামা-পানজাবি, মাথায় টুপি যে কোন অতিথি বাসায় ঢুকার সময় কনক এবং কাকলী দরজায় দাঁড়িয়ে অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছেন। কোন কোন অতিথি কনকের গালে ঠোকা মেরে আদর করছেন, কেউ বা কনকের থুতনি উঁচু করে ধরে বলছেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। বিভিন্ন সাজে সজ্জিত তাদের ড্রয়িং রুম এবং ডাইনিং স্পেস ভরে গেল। ডাইনিং স্পেসে জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হল। আগত অতিথিদের উদ্দেশ্যে রেজা সাহেব বললেন, সম্মানিত আমন্ত্রিত ভদ্রলোক এবং ভদ্র মহিলাগণ আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি স্বাগতম। এখন আমাদের প্রাণপ্রিয় একমাত্র ছেলে কনকের জন্মদিনের কেক কাটা হবে বলে তিনি এবং কাকলী কেক কাটলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।

আগত অতিথিদের মধ্যে অনেকে নেচে গেয়ে খুব আনন্দ ফুর্তিতে সমস্ত ফ্ল্যাটে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিল। কনক নিজেও একটা কবিতা আবৃত্তি করল, আমি এখন একটা কবিতা আবৃত্তি করব কবিতাটা আমি নিজে লিখেছি।

আমার দেশ

এই দেশেতে জন্মেছি আমি,

দেশের নাম বাংলাদেশ।

এই দেশেতে জন্মেছি আমি

গর্বের আমার নেই যে শেষ।

বন্দি ছিল আমার দেশ,

অত্যাচারের ছিল না শেষ।

সবাই মিলে করল বশ,

অত্যাচারী হইল শেষ।

কনকের কবিতা আবৃত্তি শেষ হলো। উপসি’ত সবাই হাত তালি দিয়ে কনককে শুভেচ্ছা জানালেন, অনেকে কনকের প্রশংসা করতে লাগলেন। অনুষ্ঠানে উপসি’ত এক ভদ্রলোক রেজা সাহেবকে বললেন, রেজা সাহেব আপনি দেখবেন আপনার কনক একদিন অনেক বড় হবে। আপনার মুখ উজ্জ্বল করবে।

রেজা সাহেব বললেন, দোয়া করবেন ভাই সাহেব আল্লাহ যেন আপনার দোয়া কবুল করেন।

কাকলীর এক দূর সম্পর্কের খালাত বোন রেবেকাও এসেছিলেন। রেবেকাদের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে, বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজ থেকে রেবেকা এইচ.এস.সি পাস করার পর যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন কায়সার সাহেবই তখন তাঁর বাবাকে রেবেকাকে তাঁর বাসায় থেকে লেখাপড়া করার জন্য প্রস্তাব দেন। কাকলীদের বাসা থেকে রেবেকা অনার্স পাস করেন। রেবেকা শুধু কাকলীর খালাত বোনই নয় ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও। ভার্সিটিতে পড়ার সময় রেবেকা তারই এক বন্ধু ফিরোজ সাহেবের প্রেমে পড়েন। রেবেকার বাবা-মা রেবেকাকে ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হননি। কায়সার সাহেবের মধ্যস’তায় এবং অনুরোধে রেবেকাকে তাঁর বাবা ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে বিয়ে দেন। ফিরোজ সাহেবের লেখাপড়া শেষ হলে কায়সার সাহেব ফিরোজ সাহেবকে তাঁর কোম্পানিতে চাকরি দেন। পরবর্তীতে কায়সার সাহেবের সহযোগিতায় ফিরোজ সাহেব নিজেই একটা এ্যাপার্টমেন্ট কোম্পানির মালিক হয়ে যান।

ছেলের আশায় আশায় রেবেকার একে একে তিনটি মেয়ে হয়েছে। রেবেকা সারাজীবন কাকলীকে বিয়ানি বলে ডাকতেন কিন্তু কাকলী কোনদিন মা হবেন না একথা জানার পর কাকলী যখন তাঁর একটা মেয়েকে আদর যত্ন করে মানুষ করতে চাইলেন তখন রেবেকা কাকলীকে কোন মেয়েকেই দিতে রাজি হলেন না। বরং তিনি কাকলীকে উল্টো প্রশ্ন করলেন, তোর সন্তান হলে কি তুই আমাকে দিতে পারতিস্‌?

কাকলী খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, হ্যাঁ আমি হলে তোকে ফিরাতাম না।

কাকলী এটা তোর মুখের কথা আপন সন্তানকে কেউ অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে না। আর নিজের সন্তান কখনো নিজেকে ভারি মনে হয় না।

তখন থেকে কাকলীর সঙ্গে রেবেকার সম্পর্কের অবনতি হয়। কনককে পাবার পর কাকলীর মনের বেদনা কিছুটা হাল্কা হয়। তখন থেকে দু’জনের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়। আজ কনকের জন্মদিনে এসে কনকের চেহারা আর বুদ্ধিমত্তা দেখে রেবেকা আবার পুরানো প্রসঙ্গটা তুললেন, কাকলী আমাদের সম্পর্কটা তাহলে পাকাপাকি হবে আশা করা যায়।

কাকলী জিজ্ঞেস করলেন, সম্পর্ক পাকাপাকি মানে?

তোর মনে নেই আমরা বিয়াইন হতে চেয়েছিলাম।

কাকলীর মনের মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠল। তিনি মনে মনে বললেন, আমি যখন তোর একটা মেয়ে চেয়েছিলাম তখন তো না করেছিলি এখন আমার ছেলেকে দেখে আমাকে বিয়াইন করতে ইচ্ছা হচ্ছে না?

কিন্তু কাকলী মুখে তা বললেন না। তিনি মুখ আংশিক কালো করে বললেন, আজকালকার ছেলে মেয়েদের কথা কি আর বলা যায়? যা দিনকাল পড়েছে ছেলেমেয়েরা কাকে বিয়ে করবে এ বিষয়ে বোধ হয় আমাদের মতামতকে তারা প্রয়োজন মনেই করবে না।

 

দশ

কয়েক বছর পরের কথা। ততদিনে কনক এইচ.এস.সি পাস করে সবেমাত্র বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয়েছে। কনককে নিয়ে রেজা সাহেব এবং কাকলী সব সময় গর্ববোধ করেন এখন তাঁদের আর কখনো কনককে হারানোর কথা মনে হয় না। প্রতিদিন সকালবেলা গাড়ি প্রথমে কনককে বুয়েটে নামিয়ে দিয়ে আসে তারপর রেজা সাহেবকে অফিসে নিয়ে যায়। কনকের ক্লাস শেষ হলে কনক রিক্সায় করে বাসায় ফিরে। তাছাড়া ধানমন্ডি থেকে বুয়েট বেশি দূরে  না হওয়ায় কনকের রিক্সায় চড়ে বুয়েটে যেতে কিংবা ক্লাস শেষে রিক্সায় করে ফিরতে তেমন কষ্ট হয় না। আর কনকের মধ্যে তেমন অহমিকা নেই, সে সব সময় সাধারনভাবে চলতে পছন্দ করে।

কনক নির্ধারিত সময়ে ক্লাসে পৌঁছে যায় এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস, ক্লাসের ফাঁকে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয় কিংবা কোন গাছের নীচে বসে কবিতা লিখে। প্রথম কয়েকদিন কনকের একা গাছের নীচে বসে থাকার কারণ অনেকেই বুঝতে পারেনি কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তার কবিতা লেখার কথাটা সবাই জেনে ফেলে। একদিন কনক ক্লাসের ফাঁকে একটা গাছের নীচে বসে কবিতা লিখছিল এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল মেঘলা, আঁখি আর শাওন। কনককে দেখে তিনজনে দাঁড়াল, মেঘলা জিজ্ঞেস করল, এখানে বসে বসে কি কবিতা লিখা হচ্ছে?

মেঘলা কনকের রেবেকা খালার ছোট মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই মেঘলাদের বাসায় কনকের যাতায়াত আছে। মেঘলা তার মা’সহ প্রায়ই কনকদের বাসায় আসত, কনকও তার মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে মেঘলাদের বাসায় যেত। রেবেকা প্রায়ই বলতেন, কাকলী তোর কনকের সঙ্গে আমার মেঘলাকে মানাবে ভাল।

কাকলী কথাটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু কনক যখন নটরডেম কলেজে পড়ত মেঘলা তখন হলিক্রস কলেজে পড়ত। দু’জনে বয়সে তরুণ-তরুণী। তখন মেঘলা তার মায়ের সঙ্গে এলে রেবেকা নিজেই মেঘলাকে বলতেন, মেঘলা যা না মা কনক খুব ভাল ছাত্র, ওর কাছ থেকে ভাল নোট নিয়ে একটু ভালভাবে লেখাপড়া কর্‌ না। কনক ভাল রেজাল্ট করবে তোকেও যে ভাল রেজাল্ট করতে হবে মা।

কনক এবং মেঘলার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কি না তা কাকলী কোনদিন জানতেন না, তবে সে বিষয়ে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি একদিন রেবেকাকে বললেন, রেবেকা আমার মনে হচ্ছে কনক আর মেঘলা একজন আর একজনকে খুব একটা পছন্দ করছে না, তারা যদি পরষ্পরকে পছন্দ না করে তবে আমাদের এগিয়ে তো কোন লাভ নেই।

রেবেকা বেশ চালাক। কাকলী কৌশলে কথাটা বললেও রেবেকার সে কথার অর্থ বুঝতে তাঁর বেশি অসুবিধা হয়নি। তিনি আর সেদিকে এগুলেন না। কিন্তু তাঁর মনে কাকলীর ওপর একটা জিদ চেপে রইল।

কনক নতুন কবি তার কোন কবিতা এখনো কোন পেপারে ছাপানো হয়নি, বলতে গেলে একেবারে নতুন। তাই কনক তার কবিতার খাতাটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রাখল।

মেঘলা জিজ্ঞেস করল, কবিতার খাতা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, না?

কনক কিছুটা লজ্জা পেল, দেখ্‌ আমি আসলে কবিতা লিখতে পারিনা, ছোটবেলায় একটা অভ্যাস ছিল তাই এখন আবার সেটা ঘষামাজা করে নতুন করে চেষ্টা করা হচ্ছে আর কি। যদি কখনো কবিতা লিখি তবে সবাইকে পড়ে শুনাবো।

আঁখি একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লাস আরম্ভ হতে এখনো অনেক দেরি আছে, মেঘলা, শাওন বস্‌ কবি সাহেবের সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। কবির ভাষায় বলে না, মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন…………

শাওন বলল, কথায় বলে না সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।

তোরা সবাই আমাকে নিয়ে তামাশা করছিস্‌, না?

তামাশা করব কেন? কোন্‌টা মিথ্যা বল্‌? কবিরা কি জ্ঞানী না? আঁখি বলল।

কিন্তু আমি তো এখনো কবি হইনি, আমি তোদের বন্ধু, আমি মহাজ্ঞানী হলাম কিভাবে? এভাবে আমাকে তিরস্কার করা কি ঠিক হচ্ছে? আর শাওনকে বলছি তুই কি আমার সঙ্গে স্বর্গবাস করতে চাচ্ছিস্‌ নাকি?

শাওন বলল, এটা আবার নতুন কথা নাকি একেবারে মহাজ্ঞানীদের কথা।

কনক জিজ্ঞেস করল, কথাটা কি তুই মনে প্রাণে বিশ্বাস করিস্‌ নাকি মহাজ্ঞানীদের কথা আবৃত্তি করলি?

শুধু আবৃত্তি করিনি মনে প্রাণে বিশ্বাসও করি কিন্তু মহাজ্ঞানী তো আমার দিকে একবার ফিরেও তাকায় না।

কথাটা কি মন থেকে বললি?

এবার শাওন থমকে গেল, সবাই বুঝতে পারল কনকের এর পরের কথাটা কি হবে?

কবি সাহেবের কথায় বেশ মারপ্যাঁচ আছে, বলে আঁখি নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে বলল, বেশ রোমান্সের গন্ধ পাচ্ছি।

রোমান্স তো বটে, রোমান্স ছাড়া কি কবিতা হয় নাকি? কনক বলল।

আঁখি বলল, আমার মামা বলেন ইঞ্জিনিয়াররা নাকি রোমান্টিক হয় না, সব সময় ইট-কাঠ নিয়ে কাজ-কারবার তো। কিন্তু এখন তো দেখছি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কবি হয়ে গেছেন আবার রোমান্টিকও বেশ, মামা তো এতদিন আমাকে ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিয়েছিলেন আজ বাসায় গিয়ে মামার ধারণা ভেঙ্গে দিতে হবে।

সবাই কনকের মুখোমুখি গোল হয়ে বসল। এবার শাওন বলল, এই ধর্‌ টি.ভিতে একটা টক শো হচ্ছে সেখানে উপসি’ত আছেন আমাদের কবি সাহেব। আমি কবি সাহেবের ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ নেই, তোরা চুপ কর্‌।

আচ্ছা কবি সাহেব আপনি কবে থেকে কবিতা লিখেন? শাওন জিজ্ঞেস করল।

কনক একটু ভাব নিয়ে নড়েচড়ে বসে গম্ভীর গলায় বলল, ছোটবেলা থেকে।

আপনার কবিতায় কি কি বিষয়কে আপনি বেশি প্রাধান্য দেন?

আগে দেশ, মাটি, মানুষ এবং প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিতাম কিন্তু এখন আসলে টিন এজার পাঠকই বেশি তো তাই এখন প্রেমের কবিতাকে বেশি প্রাধান্য দিই।

আপনার কবিতার প্রেরণা কে?

ছোটবেলা যখন কবিতা লিখতাম তখন মা আমাকে উৎসাহ দিত। কিন্তু বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আরেকজনকে দেখে আমি কবিতা লিখতে উৎসাহ পাচ্ছি।

সেই মেয়েটা কি আঁখি কিংবা মেঘলা?

সেটা বলা যাবে না।

তাহলে কি অন্য কারো প্রেমে পড়েছেন?

মনে মনে।

তাকে কখনো বলেননি?

না।

বলে ফেলুন।

বুয়েট খোলা থাকলে তো সব সময় দেখা হয়, কথা হয় এসব কথা মুখ ফুটে বলাটা আমি একেবারে পছন্দ করি না, এটা হলো মনের ব্যাপার, দেখি আমার সেই কাংখিত নায়িকা যদি কোনদিন আমার মনের কথা বুঝতে পারে।

দেখা হয়, কথা হয় মানে? শাওন জিজ্ঞেস করল।

একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি, একসঙ্গে ক্লাস করি তবে কি বলব দেখা হয় না? কথা হয় না?

আপনি কাকে মিন করছেন?

দেখুন এটা টি.ভি চ্যানেলের টক শো অনুষ্ঠান এই অনুষ্ঠানে কবির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে টানাটানি করাটা ঠিক হবে বলে আমি সঙ্গত মনে করি না।

আঁখি বলল, ও তাই বুঝি, শাওন তুই তাড়াতাড়ি কবি সাহেবের সাক্ষাতকার নেয়া শেষ কর্‌ কবি সাহেবের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগত কিছু আলাপ করব। কবি সাহেবের আবার সময় খুব মূল্যবান।

শাওন বলল, কবি সাহেব অনেক ব্যস্ততা সত্ত্বেও আমাদের অনুষ্ঠানে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা আপনার ইন্টারভিউ ধারণ করতে পেরে গর্ব বোধ করছি।

আপনাকেও ধন্যবাদ, বলে কনক উঠে দাঁড়াল।

শাওন কনকের হাত টেনে ধরল, যাচ্ছিস্‌ কোথায়? ইন্টারভিউ শেষ হলো এখন তো আর টি.ভি চ্যানেলে নেই এখন ব্যক্তিগত কথা বলতে তো আর অসুবিধা নেই।

আঁখি জিজ্ঞেস করল, কার প্রেমে পড়েছিস্‌?

বললাম তো এখনো প্রেমে পড়িনি, মনে মনে একজনকে ভালবেসেছি, যাকে ভালবেসেছি সেও জানে না।

কিন্তু সিভিল ফ্যাকালটিতে তো আমরা মেয়েই মোট সাতজন তার মধ্যে এখানে আছি তিনজন, তুই কি আমাদের তিনজনের মধ্যে কারো কথা বলছিস্‌? মেঘলা বলল।

আঁখি একটু অধৈর্য্য হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বল্‌, দাম বাড়াচ্ছিস্‌ কেন?

বাঃ তোদের মনে হয় আমি তোদের বলতে বাধ্য।

শাওন বলল, বাধ্য না হলে এতটুকু বল্‌লি কেন? কোনকিছু না বললেও তো পারতিস্‌?

দেখ্‌ আমি কাকে ভালবাসি তা কি তিনজনকে বলা যায়? তাতে দু’জন তো মাইন্ড করবে।

তুই বলে ফেল্‌ আমরা কিছু মনে করব না। এই মেঘলা তুই কি বলিস্‌? আঁখি বলল।

শাওন এবং মেঘলা দু’জনে আঁখির কথাকে সমর্থন দিল।

বলতে পারি এক শর্তে আমি বলব কবিতার ছন্দে তোরা শোনার পর আজ আর এ বিষয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবি না, সবাই চলে যাবি।

সবাই মাথা বাকিয়ে সায় দিল।

কনক বলতে শুরু করল,

আমি ভালবাসি মেঘলা আকাশ,

শাওনের রাত,

প্রেয়সীর গভীর কালো ছল্‌ছল আঁখি।

আমি ভালবাসি——

কনকের কবিতা শেষ হওয়ার আগেই শাওন উঠে দাঁড়াল, এই তোরা চল্‌, একটা কথা শুনতে গিয়ে এত প্যাঁচাল।

আঁখি, মেঘলা ও শাওন এক সঙ্গে উঠে চলে গেল। যাবার সময় শাওন বার বার করে পিছনে ফিরে তাকাল। আঁখি বলল, কি রে মনে হয় কনক তোর প্রেমেই পড়েছে?

কনক দুষ্টামির হাসি হেসে বলল, দিলাম তো প্যাঁচ লাগাইয়া এখন তিনজনে টেনশনে থাক্‌ দেখি বাছাধন।

 

এগার

শাওনের চোখে ঘুম নেই বার বার শুধু কনকের কথা মনে পড়ছে। কনক আসলে কাকে ভালবাসে? কার প্রেরণায় সে কবিতা লিখছে? শাওন একবার মেঘলার কথা কল্পনা করল, মেঘলার গায়ের রং শ্যামলা, মুখের গড়ন গোলগাল তার চেহারার মধ্যে একটা গেঁয়ো গেঁয়ো ভাব আছে কনকের মতো ট্যালেন্ট, স্মার্ট, সুদর্শন ছেলে কখনো মেঘলার মতো সেকেলে মেয়েকে ভালবাসতে পারে না। তবে কি আঁখিকে ভালবাসে? আঁখি ফর্সা, লম্বা, সুন্দর, স্মার্ট, এ্যাট্রাক্টিভ, লাবন্যময় চেহারার মধ্যে কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে, কথা বলার সময় গালে টোল পড়ে। কনক আঁখির প্রতি দুর্বল হতে পারে, হতে পারে কনকের কবিতা লেখার প্রেরণা আঁখি, হয়তবা আঁখিকে সে ভালবাসতে পারে? কিন্তু আমি? আমিই বা কম কিসে? আঁখির আর আমার মধ্যে তুলনা করলে কোন কোন বিচারকের দৃষ্টিতে আমি আবার কোন কোন বিচারকের দৃষ্টিতে আঁখি বেশি সুন্দরী হতে পারি। ভাবতে ভাবতে শাওন আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পাশাপাশি আঁখির সৌন্দর্য্য কল্পনা করল, না তার হিসাব মিলছে না। শাওন তার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করল। তারপর একটা কাগজে লিখল মেঘলা, আঁখি আর আমি টস্‌ করলে যে জিতবে আমি মনে করব কনক তাকেই ভালবাসে। প্রথমবার টস্‌ করতেই আঁখি জিতে গেল, শাওনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে নিজে জিতবার জন্য সিদ্ধান্ত নিল পর পর তিনবার টস্‌ করবে তাতে যে দু’বার জিতবে সে কনককে ভালবাসবে কিন্তু দু’বারই আঁখি জিতল শাওন আর মেনে নিতে পারল না। তার বার বার করে কনকের কথা মনে পড়ল। কনকের সাথে কথা বলার সময় একবার কনকের চোখে তার চোখ পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল কি এক নতুন অনুভূতি, নতুন স্বাদে তার হৃদয়টা ভরে গিয়েছিল। না নিশ্চিন্ত না হয়ে সে আজ সারারাত ঘুমাবে না। প্রথমে কনককে জিজ্ঞেস করবে সে আসলে কাকে ভালবাসে? কিন্তু কনক যদি জিজ্ঞেস করে জেনে তোর লাভ কি? তখন কি বলবে সে? কিংবা যদি বলে আঁখিকে ভালবাসি তবে কি করবে সে? না আর ভাবতে পারছে না শাওন। আবার কনকের সাথে ব্যাপারটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তার ঘুমও আসছে না। অবশেষে শাওন কনককে মোবাইল করল। কনকের মোবাইল ব্যস্ত। কনক আঁখির সঙ্গে কথা বলছে না তো। শাওন বার বার চেষ্টা করেই চলছে, কনকের মোবাইল ফ্রি হলো সতের মিনিট পর। অপর পাশ থেকে কনকের কন্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

শাওন বলল, কি ব্যাপার মোবাইল এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল কেন? এত রাতে কার সঙ্গে এত কথা হচ্ছিল?

শাওন? কেমন আছিস্‌?

ভাল।

তুই এত রাতে আমাকে কি মনে করে মোবাইল করেছিস্‌? কোন সমস্যা?

সমস্যা তো বটেই আর সে সমস্যাটা তুই।

আমি কি সমস্যা করলাম?

আগে বল্‌ এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বল্‌লি?

আচ্ছা একজন মানুষের কতজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে, কথা হতে পারে, তুই এত জানতে চাচ্ছিস্‌ কেন? আগে তুই বল্‌ এত রাতে মোবাইল করেছিস্‌ কেন?

আগে আমার জানতে হবে কার সঙ্গে কথা  হচ্ছিল?

তোর মতোই একটা মেয়ের সঙ্গে।

ওর সঙ্গে কি তোর প্রতিদিন কথা হয়?

প্রতিদিন না তবে মাঝে মাঝে।

কে মোবাইল করেছিল ঐ মেয়েটা না তুই?

ও করেছিল।

আমার সঙ্গে কথা বলার সময় বলিস্‌ তাড়া আছে তাড়াতাড়ি শেষ করতে আর সে কি না কোথাকার কোন্‌ মেয়ে তার সঙ্গে কথা বলিস্‌ সতের মিনিট।

সতের মিনিট না উনিশ মিনিট।

শাওনের মাথায় রক্ত উঠে গেল, সে একরকম নিশ্চিন্ত হলো কনকের কবিতা লেখার প্রেরণা অন্য কেউ। শাওন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না তার মাথাটা হঠাৎ করে ব্যথা শুরু করল। কিন্তু এভাবে নয় সে ষ্পষ্ট করে কনকের কাছে জানতে চায় সে আসলে কাকে ভালবাসে?

শাওন জিজ্ঞেস করল, কনক আমি কি ধরে নিব তোর কবিতা লেখার প্রেরণা অন্য কেউ?

হলে অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে, তুই আমাকে সত্য করে বল্‌ কনক, তোর কথার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

কি নির্ভর করছে?

সেটা আমি তোকে বলে বুঝাতে পারব না, তুই সত্য করে বল্‌, প্লিজ?

শাওন মাথাটা খারাপ করিস্‌ না, এখন ঘুমা কাল সকালে আবার ক্লাস আছে।

তুই আমার সঙ্গে ভালভাবে কথা না বললে আমি কাল ক্লাসে যাব না, আগে বল্‌।

কি বলব?

তুই কি কাউকে ভালবাসিস্‌?

না।

কাউকে ভালবাসতে ইচ্ছা করে না?

না।

তবে মোবাইলে এতক্ষণ কথা বল্‌লি যে?

শাওন একজনের সঙ্গে কথা বলা মানে তাকে ভালবাসা না, তার প্রেমে পড়াও না। শাওন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আমি এখন ঘুমাবো, তুই ঘুমা কাল তো দেখা হচ্ছেই।

আর কারো সঙ্গে কথা বল্‌বি না তো?

না।

কনকের মোবাইলে হঠাৎ করে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো। ম্যাসেজটা এসেছে মেঘলার মোবাইল থেকে, কয়েক লাইনের ম্যাসেজ, ম্যাসেজটা ঠিক এ রকম।

Mind says to miss you

Heart says to feel you

Legs say to go you

Mouth says to love you

I love you, I miss you Kanok

Meghla.

ম্যাসেজটা পাঠিয়ে মেঘলা কিছুক্ষণ পড়ার সময় দিল তারপর মোবাইল করল, কেমন আছিস্‌ কনক?

কনক বলল, ভাল আছি কিন্তু হঠাৎ করে ম্যাসেজ পাঠানোর মতো কি হলো?

সেটা তো ম্যাসেজে লেখা আছে কনক, তুই ম্যাসেজের উত্তর দিবি না?

আজ অনেক রাত হয়েছে মেঘলা ঘুমা, কাল তো দেখা হচ্ছেই।

মেঘলা বুঝতে পারল কনক পাশ কাটতে চাচ্ছে। সে বলল, কনক মা খালাকে বিয়াইন বলে।

তা জানি কিন্তু সেকথা এত রাতে কেন?

তুই কি জানিস্‌ মা খালাকে বিয়াইন বলে ডাকে কেন?

জানি।

তবে বুঝেও না বুঝার ভান করছিস্‌ কেন?

শুনেছি আগের দিনে মানুষ ছোটবেলায় নাকি সই পাততো তারপর সম্পর্ককে পাকাপাকি করার জন্য একজনের ছেলে অন্য জনের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিত। তাতে ছেলে-মেয়েদের মতামত কমই প্রাধান্য পেত। দিন পাল্টেছে এখন বিয়ের ব্যাপারে ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়।

তুই কি প্রেম করে বিয়ে করতে চাচ্ছিস্‌?

এখনো তো আমি ছাত্র, এখন বিয়ের কথা কেন?

আচ্ছা কনক সত্যি করে একটা কথা বল্‌বি?

আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি না।

তুই কি কাউকে ভালবাসিস্‌?

মেঘলা তোদের তিনজনেরই খালি ভালবাসাবাসির কথা, রাখ্‌ তো এখন মোবাইল আমি এখন ঘুমাবো।

আচ্ছা বাবা রাখছি, কাল দেখা হবে।

মেঘলা মোবাইল রেখে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

কনকের কথায় শাওন নিশ্চিন্ত হতে পারল না, তার মাথায় যেন বাজ পড়ল, আঁখির উপর তার প্রচণ্ড রাগ হল। ইচ্ছে হলো কাল আঁখিকে দু’য়েক কথা শুনিয়ে দিবে। কিন্তু কনক তো আঁখির কথাও বলল না তবে তাকে বলবে কিভাবে? তবু আঁখির সঙ্গে কথা বললে বোঝা যাবে সে কনকের সঙ্গে কথা বলল কি না? যেই কথা সেই কাজ সঙ্গে সঙ্গে আঁখিকে মোবাইল করল, হ্যালো আঁখি।

কিরে শাওন এত রাতে? ঘুমাস্‌নি?

আমি একটু পড়ালেখা করলাম, এখন ঘুমাবো মনে করছি, তাড়াতাড়ি বল্‌?

কেন এখন এত তাড়া কেন? এতক্ষণ তো মোবাইল ব্যস্ত ছিল, কার সঙ্গে এত কথা বল্‌লি?

আমার মোবাইল ব্যস্ত ছিল? সন্ধ্যার পর তো আমি কারো সঙ্গে মোবাইলে কথাই বলিনি।

কেন কনকের সঙ্গে তুই কথা বলিস্‌নি?

বলিস্‌ কি আমি তো কনকের মোবাইল নাম্বারই জানি না, মোবাইল করব কিভাবে?

হঠাৎ করে শাওন থমকে গেল, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না তো? আঁখি এখন রাখি কাল দেখা হবে।

শাওনের প্রচণ্ড রাগ হলো কনকের উপর আবার কিছুটা অভিমানও হলো, কনক তার সঙ্গে এমন আচরণ করবে কেন? আবার মনটা আনন্দে ভরে গেল কনক নিজের অজান্তে একটা সত্য কথা বলে ফেলেছে সে কাউকে ভালবাসে না। কিন্তু কনক অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বললে শাওনের খারাপ লাগবে কেন? কনকের সঙ্গে দু’দিন কথা হয়েছে এমনি ক্লাসের বিষয়ে, অন্য কোন বিষয়ে নয় আর মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়েছে কয়েকদিন তাতেই কেন জানি কনকের প্রতি শাওনের ভালবাসা জন্মেছে। তার প্রতি একটা অধিকার জন্মেছে, একটা অদ্ভুত অনুভূতি জন্মেছে তার মনে একটা নতুন অপ্রত্যাশিত শিহরণ জেগেছে। বলতে গেলে শাওন কনককে ভালবেসে ফেলেছে। শাওনের ইচ্ছা করছে কনককে আবার মোবাইল করে তার মনের গভীরে জমিয়ে থাকা কথাগুলো এখনি বলবে। শাওন আবার মোবাইল করল কিন্তু ততক্ষণে কনকের মোবাইল বন্ধ, সেই মহিলার বিনীত বেরসিক কন্ঠস্বর, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।

শাওন আশ্বস’ হলো, কনক মোবাইল অফ করে ঘুমিয়েছে, তবে কি কনক তাকে ক্ষেপানোর জন্য কোন মেয়ের প্রসঙ্গ টেনেছিল? আসলে সে কাউকে ভালবাসে না? আবার আমার সঙ্গে কথা বলা শেষ হবার পর পরই মোবাইল অফ করে দিয়েছে। শাওন আপন মনে বলল, কনক ইউ আর সো নাইস, গুড নাইট মাই সুইট হার্ট বলে শাওন মোবাইলে একটা চুমু দিয়ে মোবাইল অফ করল।

 

বার

আজ সকালবেলা কনকের ক্লাসে আসতে দেরি হয়েছে। শাওন কনকের সঙ্গে ক্লাস শুরুর আগে দেখা করার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে কিন্তু কনক না আসায় একরকম নিরাশ হয়ে ক্লাসে গিয়ে বসেছে। কনক হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে ঢুকেছে। কনক ক্লাসে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে টিচার ক্লাসে ঢুকেছেন। ক্লাস চলাকালীন সময় কনকের চোখে শাওনের চোখ পড়েছে কনকও বার বার করে শাওনের দিকে তাকিয়েছে। ক্লাসে শাওনের মন বসছিল না বার বার করে মনে হচ্ছিল কখন ক্লাস শেষ হবে। কিন্তু একটা ক্লাস শেষ হয়েও কোন লাভ নেই, পর পর তিনটা ক্লাস তারপর বিরতি। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতেই চায় না, দীর্ঘ রাবারের মতো বেড়েই চলেছে। শাওন ক্লাস থেকে বের হলো, সঙ্গে মেঘলা আর আঁখিও বের হলো। আঁখি পিছন থেকে ডাক দিল, এই যে কবি সাহেব, শুনুন।

কনক আঁখির কথাকে কোন পাত্তা দিল না এমন একটা ভাব দেখাল যে সে কিছুই শুনেনি। আঁখি বলল, বাঃ কবি সাহেবের মনের মধ্যে কবিতার ভাব এসেছে।

কনক যেমন যাচ্ছিল তেমনি হাঁটতে হাঁটতে কেন্টিন থেকে হালকা নাস্তা খেয়ে আবার গাছের নীচে এসে বসল। আজ মেঘলা ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে ঢুকলো, আঁখি আর শাওন কনকের কাছে এসে বসল।

কনক এমন একটা ভাব দেখাল যেন আঁখি আর শাওন বসাতে তার লেখার ডিসটার্ব হচ্ছে। কনক যেমন মাথা নত করে লিখছিল তেমিনভাবে বলল, কি হলো ম্যাডাম এই ক্যাম্পাসে কি আর কোথাও বসার জায়গা নেই?

শাওন বুকে প্রচণ্ড আঘাত পেল। আঁখি রাগান্বিত স্বরে বলল, গোটা ক্যাম্পাসটা পড়ে আছে কিন্তু তুই কি এই গাছতলাটা লিজ নিয়েছিস্‌ যে আর কেউ বসতে পারবে না?

না তা অবশ্য নিইনি, ঠিক আছে বস্‌।

কবিতা লিখা কেমন চলছে?

ভাল, বলে কনক খাতাটা একদিকে সরিয়ে রেখে বলল, তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বল্‌, তুই আমার সঙ্গে কথা বল্‌বি এটা তো আমার ভাগ্যের বিষয়।

ইভ টিজিং বলে একটা কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, এই যেমন তোর মতো, শাওনের মতো সুন্দরী মেয়েরা রাস্তা দিয়ে চলার সময় ইভ টিজিং এর শিকার হয়, এটা কি জানিস্‌?

আঁখি দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, জানব না মানে এটা তো ১০০% সত্য।

ইভ টিজিং এর শিকার কি শুধু মেয়েরাই হয় নাকি আমার মতো নিরীহ, সাদাসিধে ছেলেরাও হয়?

তাহলে আমি তোকে টিজ করলাম?

অফ কোর্স।

পড়ালেখায় তো অলওয়েজ ফার্স্ট, প্রেম করা, কবিতা লেখা সবকিছুতেই ফার্স্ট এখন তো দেখছি যুক্তি তর্কেও ফার্স্ট, যেন কোনদিক থেকে সেকেন্ড নয়, আঁখি বলল।

তোর হিংসা হচ্ছে বুঝি?

না হিংসা হচ্ছে না, তবে হিংসা হচ্ছে আরেকজনের কথা ভেবে।

কার কথা?

যে তোর ভালবাসা পেয়েছে, যার প্রেরণায় তুই কবিতা লিখছিস্‌।

আমি কি কাউকে ভালবেসেছি? আমি কার প্রেরণায় কবিতা লিখছি সেকথা কি বলেছি?

বলিস্‌নি তবে সবাইকে নিয়ে একটা খেলা শুরু করেছিস্‌ একটা কথা খেয়াল রাখিস্‌ আমরাও কিন্তু বসে নেই আমরাও তোর একটা পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা এক রকম পাকাপাকি করেছি, বলে আঁখি একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, শাওন তুই বস্‌ আমি একবার লাইব্রেরী যাব, পরে দেখা হবে।

কনক বলল, একজনকে আবার রেখে গেলি কেন? সঙ্গে নিয়ে যা।

না ওকে দিয়ে গেলাম তোকে প্রেরণা দেওয়ার জন্য, বলে আঁখি চলে গেল।

কি রে তুই আবার গেলি না কেন?

আমার লাইব্রেরীতে কাজ নেই, তাই তোর এখানে বসলাম।

ওরা আবার তোকে দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য আমার কাছে রেখে গেল না তো পরে আবার এ নিয়ে বলাবলি করবে।

শাওন বলল, কে কি বলাবলি করছে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

কিছু আসে যায় না আবার অনেক কিছু আসে যায়, এখন যেমন একটা ঠেস মারা কথা বলে গেল হয়ত আবারো বলবে তখন দেখিস্‌ তোরও খারাপ লাগবে, তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবি না।

বলব না বাবা বলব না সব দোষ আমার তোমার কোন দোষ নেই এবার হলো তো।

কনক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, শাওন এখন বল্‌ কেমন আছিস্‌?

শাওন অভিমানের সুরে বলল, কেমন রেখেছিস্‌ তুই বল্‌?

বাঃ আমি তোকে ভাল বা মন্দ রাখার কে বল্‌ তো?

কেউ না, না? এতদিন পর এই কথা। আচ্ছা কনক সত্যি করে একটা কথা বল্‌বি?

কনক হঠাৎ করেই গম্ভীর স্বরে বলল, আমি বরাবরই সত্য কথা বলি।

তুই কি কখনো অনুভব করিস্‌ একটা মেয়ে রাত বারটায় তোর মোবাইল ব্যস্ত দেখে কেন রেগে যায়? অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলা দেখে কেন সহ্য করতে পারে না? কি এমন অধিকার তুই অর্জন করেছিস্‌ যার কারণে সে সব সময় তোকে অন্য মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলা এবং ক্যাম্পাসে কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়?

কনক দুষ্টামির হাসি হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে বুঝে না।

কিছু বুঝিস্‌ না? না? সবকিছু মনের মধ্যে চেপে রাখতে চাস্‌? বলে শাওন উঠে দাঁড়াল, তুই থাক্‌ তোর গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে আমি চললাম, মনে রাখিস্‌, মনে রাখিস্‌ এই শাওনের মতো তোকে কেউ ভালবাসবে না, একদিন বুঝ্‌বি তুই নিজের দোষে এই শাওনকে হারালি।

কনক শাওনের হাত টেনে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, শাওন একটু বস্‌, মাই সুইট হার্ট।

কনকের চোখের দিকে তাকিয়ে শাওন আর রাগ ধরে রাখতে পারল না, সে হেসে ফেলল।

কনক বলল, শাওন একটু বস্‌।

শাওন কনকের পাশে নিবিড়ভাবে বসল। কনক শাওনের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, শাওন সব কথা মুখ ফুটে বলতে হয় না। অনেক না বলা কথা মুখ দেখে বুঝে নিতে হয়, হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে অনুভব করতে হয়।

আমি বুঝতে পারিনি কনক, তুই কবিতা লিখতে পারিস্‌, তুই মুখ দেখে মনে কথা বুঝতে পারিস্‌, তুই কল্পনা করে তোর মনের সামনে আয়নার মতো কাউকে উপস’াপন করতে পারিস্‌ আমি পারি না।

কনক শাওনের চোখে চোখ রাখল, শাওনের গভীর কালো চোখ দু’টিতে পানি ছল্‌ছল করছে যেন পদ্মপাতায় পানি যেমন টলমল করে ঠিক তেমনি। কখন যেন শাওনের চোখ থেকে আষাঢ়ের বর্ষা নামবে।

কনক বলল, শাওন তুই কাঁদছিস্‌?

না কাঁদিনি, আমার চোখে যে পানি দেখছিস্‌ এটা দুঃখের পানি না, আনন্দের। তোকে পাবার আনন্দের, এতদিন তোকে নিয়ে আমার যে সংশয় ছিল তা আজ কেটে গেল, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন কনক। আজকের দিনটা আমার মনে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

এমন সময় আঁখি আর মেঘলা চলে এলো, এই চল্‌ ক্লাসে যাই, তারপর একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, আর সময় নেই।

শাওন আঁখির দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল, শাওন তোর চোখে পানি, এই যে কবি সাহেব আমার এমন হাসি খুশি বন্ধুটিকে রেখে গেলাম আর তুই তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরালি, চুক্‌, চুক্‌, চুক্‌, ঘটনা কি?

শাওন চোখ মুছে বলল, কিছু না রে, শুধু এটুকু জেনে রাখ্‌, আমি ভাগ্যবতী।

তুই যা চেয়েছিস্‌ তা পেয়েছিস্‌?

শাওন মাথা নেড়ে সায় দিল।

থ্যাংক ইউ কবি সাহেব, আমার বন্ধুকে কাছে টেনে নেবার জন্য ধন্যবাদ।

আঁখি চালাক মেয়ে কনকের প্রতি তার দুর্বলতা থাকলেও কনক শাওনকে ভালবেসেছে জেনে এক রকম চেপে গেল। মেঘলার দু’চোখ ছল্‌ছল করে উঠল।

কনক লজ্জায় সংকুচিত হলো। এমন সময় ক্লাসের ঘন্টা পড়ল।

 

তের

ইদানিং আঁখি তার এক সহপাঠির প্রেমে পড়েছে। ছেলেটার নাম আশিক সুন্দর, স্মার্ট, মেধাবী ছাত্র। তার সঙ্গে ক্লাসে সব সময় কনকের কম্পিটিশন চলে। ক্লাস টেস্ট পরীক্ষাগুলোতে কনক এবং আশিকের মধ্যে কম্পিটিশিন হয়, গত সেমিস্টার পরীক্ষায় কনক এবং আশিক দু’জনে এ-প্লাস পেয়েছে।

দিনে দিনে কনক আর শাওন আরো খুব কাছাকাছি হলো, প্রতিদিন ক্লাসে দু’জনের দেখা হয় সুযোগ হলেই দু’জনে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ায়। ছুটির দিন মোবাইলে দু’জনে প্রোগ্রাম করে দূরে কোথাও আশুলিয়া, ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দন পার্ক, বলধা গার্ডেন ঘুরে আসে। তারপরও রাত জেগে কথা বলে অনেকক্ষণ করে যেন কথার শেষ নেই, মনের টানে, প্রাণের টানে সব সময় কাছে থাকার একটা আকাংখা দু’জনের মধ্যে অত্যন্ত বেড়ে গেছে। আজ সেকেন্ড সেমিস্টার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কথা, শাওন সেই সকাল বেলা রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার অনেক আগেই ক্যাম্পাসে এসেছে, গতরাতে কথা হয়েছে কনকও সকালে ক্যাম্পাসে আসার কথা। শাওন ক্যাম্পাসে এসে কয়েকবার কনকের মেরবাইলে রিং দিয়েছে কিন্তু কনকের মোবাইল বন্ধ, তাই শাওন গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বার বার করে কনকের মোবাইলে রিং দিচ্ছিল আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। কনকের সঙ্গে শাওনের পরিচয় হয়েছে প্রায় এক বছর হলো, তখন থেকে দু’জনের সময়গুলো গেছে যেন বিদ্যুৎ গতিতে বয়ে গেছে আর আজ অপেক্ষার সামান্য সময়টুকুও যেন শাওনের কাছে অনেক অনেক বছর বলে মনে হচ্ছে। অবশেষে অনেকক্ষণ পর কনক ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। শাওনকে দেখে কনক মৃদু হেসে বলল, সরি শাওন দেরি হয়ে গেল।

কনকের হাসিটা অদ্ভুত ধরণের, হাসির মধ্যে এক রকম সরলতা আছে, এক ধরণের নিষ্পাপ মানুষের প্রতিচ্ছবি আছে, যেন চুম্বকের আকর্ষণ আছে, যে হাসিতে কঠিন বরফ মুহূর্তেই গলে যায়, যে হাসি শাওনের হৃদয়ে ঝড় তোলে, শাওন কনকের হাজার রকমের দোষত্রুটি মুহূর্তে ভুলে যায়। শাওনের হৃদয়ে এক রকম সহানুভুতি জাগে। কনকের মুখে এমন হাসি দেখে শাওন কোনদিন রাগ করতে পারেনি। আজও পারল না, দেরি হতে পারে তাই বলে মোবাইলটা বন্ধ রাখবি?

আমার মোবাইলটা বন্ধ নাকি? বলে কনক তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল, হ্যাঁ সত্যি তো মোবাইলটা কখন বন্ধ করলাম? দেখছিস্‌ মোবাইলটা চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

থাক্‌ আমাকে দেখাতে হবে না, আর কখনো যেন এমন না হয়, তোর জন্য আমি খুব চিন্তায় ছিলাম, বলে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নীচে বসল।

শাওন কনকের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, কনক তোর রেজাল্ট ভাল হবে তো?

আশা তো করি।

তোর?

আমার রেজাল্ট ভাল হবে না, আমি আমাকে নিয়ে চিন্তাও করি না। তোর রেজাল্ট ভাল হলেই আমি খুশি।

বাঃ নিজের রেজাল্ট নিয়ে কষ্ট নেই, বন্ধুর রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা।

আমি যে অনেকের কাছে তোর জন্য বড় মুখ করে কথা বলেছি কনক, অনেকের কাছে বাজি ধরেছি তুই এবারও এ-প্লাস পাবি। তুই এ-প্লাস না পেলে তো আগে আমি হেরে যাব। তুই এ-প্লাস পেলে আমি খুব খুশি হব, সবার কাছে আমি জিতে যাব।

আমার রেজাল্টের জন্য তুই বড় মুখ করে কথা বলেছিস্‌?

হ্যাঁ।

কাকে কাকে বলেছিস?

আঁখি, মেঘলা আর আশিককে।

এমন পাগলামি আর করিস্‌ না, বলা যায় আমি কোন কারণে যদি এ-প্লাস না পাই তখন সবাই তোকে কি বলবে? আর আমাকে নিয়ে তুই বড় মুখে কথা বললে সবাই কি মনে করবে, বল্‌?

এমন সময় আশিক আর আঁখি এলো, কি রে কনক ভাল আছিস্‌ তো?

আমি ভাল আছি, তুই?

ভাল নেই রে পরীক্ষা ভাল হয়নি এবার বোধ হয় আমি এ-প্লাস পাব না।

কনক শাওনের মুখের দিকে তাকাল, শাওনের চোখে-মুখে যেন একটা তৃপ্তির ষ্পষ্ট আভা ফুটে উঠল। আঁখি শাওনকে জিজ্ঞেস করল, কি রে খুশি হয়েছিস্‌? এবারও তোর কনক এ-প্লাস পাবে।

আশিক বলল, কি ব্যাপার আঁখি? তোদের আবার-

আঁখি আশিকের কথা পাশ কাটাবার জন্য বলল, ও তুই বুঝ্‌বি না।

ঠিক আছে তোদের আকার-ইঙ্গিত আমাদের না বুঝলেও চলবে, তো কনক চল্‌ নোটিশ বোর্ডের দিকে যাওয়া যাক।

হ্যাঁ চল্‌।

সবাই হাঁটতে হাঁটতে নোটিশ বোর্ডের দিকে গেল। ততক্ষণে অনেক ছাত্র-ছাত্রী নোটিশ বোর্ডের কাছে গিয়ে ভীড় করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট শীট টাঙ্গানো হলো। কনক আর শাওন ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল।

শাওন রেজাল্ট শীটে শুধু কনককে এ-প্লাস পেতে দেখে আবেগে আল্পুত হয়ে বলল, কনক শুধু তুই এ-প্লাস পেয়েছিস্‌।

শাওনের রেজাল্ট দেখে কনকের মুখ কালো হয়ে গেল, শাওন তুই তো এ-প্লাস পেলি না।

শাওন কনকের হাত টেনে ধরে বলল, কনক তুই বেরিয়ে আয়, তুই এ-প্লাস পেয়েছিস্‌ তাতেই আমি খুব খুশি হয়েছি, আমি এ-প্লাস পাব না এটা আমি জানতাম এনিয়ে তোর মন খারাপ করার কোন দরকার নেই। দু’জনে নোটিশ বোর্ডের কাছ থেকে ভবনের গেটের দিকে সরে এসেছে। কখন যে আশিক কনকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কনক খেয়াল করেনি। আশিক হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য কনকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন কনক।

কনক বলল, থ্যাংক ইউ।

আশিক এ-প্লাস না পাওয়ায় আশিক যতটা কনককে হিংসা করেনি আঁখি তার চেয়ে বেশি কনকের উপর হিংসা করেছে। কারণটা কনক নয়, শাওন। শাওন আগেই কনক সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিল তা আজ সত্য হওয়ায় শাওনের গর্ব আঁখির চোখের বালি হয়ে দেখা দিল।

আঁখি শাওনকে নিরাশ করার জন্যই বলল, তোর রেজাল্ট কি রে শাওন?

আমি বি পেয়েছি, তুই?

আমি এ, বলে আঁখি আর আশিক চলে যাচ্ছিল।

শাওন নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, আমি বলেছিলাম না কনক এ-প্লাস পাবেই, দেখ্‌ কনক ঠিক ঠিকই এ-প্লাস পেয়েছে।

আঁখি কনককে লক্ষ্য করে বলল, কনক তুই এ-প্লাস পাওয়াতে শাওন তোর চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে, ও নিজের রেজাল্টের জন্য কষ্ট পায়নি, তোর রেজাল্টের জন্য খুশি হয়েছে। আসলে শাওন তোকে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসে এমন খাঁটি বন্ধু পাওয়া, অকৃত্রিম ভালবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, তুই যেন ওর ভালবাসাকে কোনদিন অমর্যাদা করিস্‌ না।

আঁখির কথাগুলো কনকের মনে মধ্যে গেঁথে গেল। শাওন কনককে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসে, ওর ভালবাসাকে কোনদিন অমর্যাদা করিস্‌ না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কনক আর শাওন ভবন থেকে বের হয়ে কনক হঠাৎ করে রাস্তায় দাঁড়াল।

শাওন জিজ্ঞেস করল, দাঁড়ালি কেন?

কনক শাওনের চোখে চোখ রেখে বলল, আচ্ছা শাওন তুই কি আমাকে খুব ভালবাসিস্‌?

এখনো কি তোর জানতে বাকী আছে?

কনক আপন মনে বলল, না।

তারপর দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বুয়েটের গেট থেকে বের হলো। কনক শাওনকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবি শাওন?

আজ তোকে নিয়ে আমি অনেক প্রোগ্রাম সাজিয়েছি কনক, প্রথমে শাহবাগ চল্‌।

দু’জনে একটা রিক্সায় চেপে শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। শাওনের আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে। কনকের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তার খুব ক্লোজ বন্ধু, শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে, ভালবাসার মানুষ, ভবিষ্যতের জীবন সঙ্গী।

রিক্সায় হুড আগে থেকেই ফেলানো ছিল। শাওন একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কনক আমার কখনো কখনো কি ইচ্ছা হয় জানিস্‌?

কি ইচ্ছা হয়?

ইচ্ছা হয় তুই আকাশ ছুঁয়ে দেখ্‌ আর আমি তোর সফলতা দেখে গর্ব করে সবাইকে বলি, সবাই দেখ আমার কনক আকাশ ছুঁয়েছে। আল্লাহ যেন তোকে সে সফলতা দেয়।

তাতে যে তোর হেল্প লাগবে শাওন।

শাওন কনকের একটা হাত চেপে ধরে বলল, আমি সব সময় তোর পাশে থাকব।

 

চৌদ্দ

কাকলী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর সিঁথির সামনের কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে, কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই মনে মনে একবার নিজের বয়স হিসেব করলেন। তাঁর বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে অথচ তাঁর মনে হচ্ছে এই সেদিনই তো তিনি ছোট্ট ছিলেন, মা হাত ধরে সকালবেলা প্রাইমারী স্কুলে নিয়ে যেত, তারপর একা একা হেঁটে হাইস্কুলে যেত। সেখান থেকে এস.এস.সি পাস করার পর ভর্তি হলো সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে, সেখান থেকে এইচ.এস.সি পাস করার পর ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স পড়ার সময় রেজা সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় তারপর বাবা-মা নিজেই রেজা সাহেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। তারপর কতদিন কেটে গেল একটা সন্তানের জন্য দেশ-বিদেশের অসংখ্য ডাক্তার, কবিরাজ, পীর আউলিয়ার দরবারে গিয়েও আল্লাহ তাঁর কোল জুড়ে সন্তান দিল না। তারপর শুরু হয়েছিল নিজের সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়ে কোন এতিমখানা থেকে পোষ্য সন্তান নেওয়ার, সিস্টেম দেখে তিনি কোন সন্তান নেননি, কারণ তিনি এমন একটি সন্তান চেয়েছিলেন যাকে তিনি একেবারে পাবেন, অনেক বছর পর যে কেউ সন্তানের দাবি নিয়ে তাকে ফেরত নিতে আসবে না। আল্লাহ তাঁর এই ইচ্ছাটা পূরণ করেছে, ঝুমলাল তাদের ঠিকানা জানে না, কাজেই সে কোনদিন কনকের দাবি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে না। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে কাকলী দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবির দিকে তাকালেন। রেজা সাহেব, কনক আর তাঁর নিজের ছবি। কনককে পাবার কয়েকদিন পরেই তোলা ছবিটা, কনকের বয়স তখন চার বছরের বেশি হবে না। অথচ সেই কনক আজ বুয়েটে পড়েছে, আজ তার সেকেন্ড সেমিস্টার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কথা কনকের রেজাল্ট খুব ভাল হবে খুব সম্ভব সে এবারো এ-প্লাস পাবে। কারণ কনক জীবনে কোনদিন সেকেন্ড হয়নি এবারো সেই একমাত্র এ-প্লাস পেয়েছে। কিন্তু কনক এখনো ফিরছে না কেন?

কাকলী কনকের মেবাইলে কয়েকবার রিং দিলেন কিন্তু কনক মোবাইল রিসিভ করল না। সাধারণত এমন হয় না কনক তো মোবাইল রিসিভ না করার কথা নয়। কাকলী কিছুটা চিন্তিত হলেন, কনকের কিছু হলো না তো?

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল, কাকলী বুঝতে পারলেন কনক কলিং বেল বাজিয়েছে, তাই তিনি কাজের বুয়াকে না পাঠিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিলেন। কনক ভিতরে ঢুকেই কাকলীর পা ছুঁয়ে সালাম করল।

কি রে? সালাম কিসের?

কনক আবেগ প্রবণ হয়ে বলল, মা আমি এ-প্লাস পেয়েছি।

কাকলী কনককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, আমি জানতাম বাবা তুই এ-প্লাস পাবি, আয় বস্‌ ভাত খাবি।

মা আমি আজ খেয়ে এসেছি, আসলে শাওন এমনভাবে ধরল চাইনিজ না খাইয়ে ছাড়লো না, বলেই কনক জিহব্বায় কামড় দিয়ে বলল, আমি খাব না মা।

শাওন কে রে?

কনক লজ্জায় মাথা নত করে বলল, মা শাওন আমার সঙ্গে পড়ে, ভাল ছাত্রী, আমার ভাল বন্ধু।

তুই বুঝি রাত জেগে জেগে ওর সঙ্গে কথা বলিস্‌?

কনক কোন কথা না বলে মাথা নত করে বসে রইল। কাকলী বললেন, আমি তো দোষের কিছু দেখছি না, তুই সারারাত জেগে মোবাইলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলিস্‌ আবার ক্লাসেও একাই এ-প্লাস পাস্‌, সবদিক ভালভাবে সামলে নিতে পারিস্‌ এ যুগে এটাই তো চাই। যাক বাবা নিজের পড়াশুনার বেলায় ঠিক থাকলেই হয়? তা মেয়েটা কি খুব সুন্দর?

কনক যেমনভাবে বসেছিল তেমনিভাবে বসে রইল।

কাকলী আবার বলতে থাকলেন, তোর ওপর আমার সে ভরসাও আছে, যেমন-তেমন মেয়েকে তুই পছন্দ করবি না, একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিস্‌ তো।

কনকের মোবাইলের রিং বেজে উঠল। কনক মোবাইলের লাইন কেটে দিল।

লাইনটা কেটে দিলি কেন? কথা বল্‌? আবার রিং দিলে  আমাকে দিবি, আমি কথা বলব, বলে কাকলী এমনভাবে চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন যে কনক কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।

মোবাইলে আবার রিং বেজে উঠল।

কাকলী ধমকের সুরে বললেন, দে, মোবাইলটা আমাকে দে।

কনক সভয়ে মোবাইলটা কাকলীর হাতে দিল। কাকলী মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে শাওনের কাঁপা কাঁপা স্বর ভেসে এলো, হ্যালো এটা কনকের নাম্বার না?

হ্যাঁ বল।

আপনি কে বলছেন প্লিজ?

আমি ওর মা বলছি, তুমি কে?

মা আমার নাম শাওন।

শাওনের কন্ঠে মা ডাক শোনার পর কাকলী আর কৃত্রিম রাগান্বিত স্বর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি স্নেহমাখা কন্ঠে বললেন, তোমাকে নিয়েই কনকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল মা, তুমি নাকি আজ কনককে চাইনিজ খাইয়েছ?

শাওনের কোন কন্ঠস্বর ভেসে এলো না, কাকলী আবার বলতে শুরু করলেন, তুমি খাওয়ালে আর ও খেল, ও এ-প্লাস পেয়েছে আর ও তোমাকে খাওয়াল না।

ও কেন খাওয়াবে মা? ও তো অনেক পরিশ্রম করে এ-প্লাস পেয়েছে, ওর পরিশ্রমের পুরস্কার স্বরুপ সবার উচিত ওকে খাওয়ানো, এ ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে আমি একমত না মা।

বাঃ তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলতে পার, তোমার রেজাল্ট কেমন হয়েছে মা?

আমার রেজাল্ট ভাল হয়নি মা, আমি বি-গ্রেডে পাস করেছি।

তোমার বাবা-মা ভাল আছেন মা?

আমার তো মা নেই, শুধু বাবা আছেন, আমরা এক ভাই এক বোন, ভাইয়া অস্ট্রেলিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করছে আর আমি এখানে।

তোমাকে কষ্ট দিলাম মা, তুমি কিছু মনে কর না।

আজ আপনার সঙ্গে কথা বললাম আপনাকে মা বলে ডাকলাম আমার মনে আর কোন কষ্ট নেই মা। আপনাকে মা বলে সারাজীবন ডাকতে পারলে আমার আর কোন কষ্ট থাকবে না। একদিন আসুন না মা আমাদের বাসায়, আপনি এলে বাবা খুব খুশি হবেন।

আগে তুমি এসো মা একদিন কনকের সঙ্গে চলে এসো, তারপর না হয় আমি যাব, তুমি কথা বল আমার বাঁদরটার সাথে, বলে কাকলী মোবাইলটা কনকের হাতে দিলেন।

কনক মোবাইলটা নিয়ে তার রুমে গেল, শাওন তুই আমাকে ডুবালি, মা আজ সবকিছু জেনে ফেলল তো, তোর জন্য।

মা জানল তাতে কি? মা তো খুব সোশ্যাল, দেখ্‌লি না আমাকে কত তাড়াতাড়ি আপন করে নিলেন।

তুই বা কম কিসে? আমার মাকে আমার চেয়ে তুই বেশি আপন করে নিলি, মাকে কি যে বল্‌লি মা তোকে পেয়ে একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন।

সে তুই বুঝ্‌বি না, মেয়েদেরকে মা বলে একবার ডাকতে পারলেই হয়, যত কঠিন মনই হোক একবার মা ডাক শুনলে যেন মেয়েদের মনের সমস্ত বরফ সব মুহূর্তেই গলে যায়। মেয়ে হলে বুঝতিস্‌।

যাক মেয়েদের ব্যাপার আমার না বুঝলেও চলবে।

তোর কাছে আমার দাম না থাকতে পারে মা’র কাছে আমার দাম এখন অনেক, আরো আগে মা’র সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে তুই যখন তখন আমাকে অবহেলা করতে পারতিস্‌ না।

এই, এই নেমকহারাম আমি তোকে কখন অবহেলা করলাম? এমন কথা বললে কিন্তু আমি ঠিকই তোকে অবহেলা করব।

সরি কনক আর এমন কথা বলব না।

ঠিক আছে এমন ভুল যেন আর না হয়, এখন বল্‌ কি জন্য রিং করেছিস্‌?

আচ্ছা তুই বল্‌ আমি যে বললাম তুই আমাকে অবহেলা করিস্‌ কথাটা কি মিথ্যা? আমি তোকে রিং করলাম এখন তোর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তোকে রিং করে ভুল করলাম। তুই বল্‌ ভালবাসার মানুষের সঙ্গে মানুষ এমন করে কথা বলে?

ঠিক আছে এখন খুব ভাল করে বলছি, হ্যালো বন্ধু কি খবর বল্‌?

খবর ভাল বন্ধু ঠিক মতো বাসায় পৌঁচেছি এবং ভাল আছি, তোর কথা খুব মনে পড়ছে, বলে কনক হেসে ফেলল।

এই যে আবার মিথ্যা কথা, আমাকে খুশি করার মতো কথা। আমাকে তোর মনে পড়েনি, তোর আমাকে মনে পড়েছে তাই আমি মোবাইল করলাম।

শাওন এখন রাখি, বাবাকে আবার রেজাল্টটা জানাতে হবে।

আবার কখন কথা হবে?

রাতে।

এখন তো সবেমাত্র বিকেল, একেবারে রাতে কথা হবে, তুই কি খুব ব্যস্ত থাক্‌বি? আমি কিন্তু সুযোগ পেলেই তোকে মোবাইল করব।

আচ্ছা করিস্‌।

 

পনের

কাকলী রেজা সাহেবকে শাওন সম্পর্কে সবকিছু বলেছেন, শাওন লেখাপড়ায় কেমন? বাবা-মা কি করে? ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কেমন? সবকিছু কাকলী বিড় বিড় করে রেজা সাহেবকে বলছিলেন। রেজা সাহেব কখনো হ্যাঁ কখনো না বলে পেপারে চোখ বুলাচ্ছিলেন। কাকলী ক্ষেপে গিয়ে বললেন, আমি কি বলছি তুমি কি শুনছ?

রেজা সাহেব যেমন বসেছিলেন তেমনিভাবে বললেন, শুনছি।

বল তো আমি কি বললাম?

রেজা সাহেব মাথা তুলে বললেন, তুমি বললে, কি যেন বললে আবার বলতো।

কাকলী রাগান্বিত স্বরে বললেন, কিছু  শোননি, আবার বলছি শোন।

বল।

কনক একটা মেয়েকে ভালবাসে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ আমিও মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছি, মেয়েটার গলার স্বর খুব মিষ্টি আর খুব সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে।

এটা তো খুব খারাপ কথা।

খারাপ কথা মানে! কাকলীর চোখে বিস্ময়।

এই যে মেয়েটা সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, তারমানে সে শুধু সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেই জানে না, জোড়া তালি দিয়েও কথা বলতে পারে। মানে মেয়েটা ঝগড়াটে হবে।

দেখ, না জেনে কথা বলবে না। আগে ভাল করে শোন।

মোবাইলে কথা বলেই মেয়েটা তোমাকে জয় করে ফেলেছে? কি মারাত্মক মেয়ে রে বাবা!

এভাবে ঠেস্‌ মেরে কথা বলছ কেন?

ঠেস্‌ মেরে কথা বললাম কই, এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা প্রেমে পড়তেই পারে, তারমানে এই নয় যে গার্জিয়ান হয়ে তুমি মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে, তাকে বউমা বানানোর জন্য স্বপ্ন দেখবে?

মেয়েটাই বা খারাপ কিসে? বুয়েট থেকে কনকের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, কম শিক্ষিত মেয়ে তো না, মেয়ের বাবা শিল্পপতি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে কোনদিক দিক দিয়ে কমতি নেই, তবে আর স্বপ্ন দেখতে দোষ কিসের?

মেয়েটাকে দেখেছ?

না, আমি মেয়েটাকে আসতে বলেছি আজ বিকেলে আসবে তুমি আজ একটু আগে ফিরবে, ও এলে তোমাকে আমি ফোন করব, যত কাজই থাকুক তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে এসো।

রেজা সাহেব চলে গেলেন। কাকলী সকাল থেকেই শাওনকে কি খাওয়াবে? কি কি জিজ্ঞেস করবে? মেয়েটা সুন্দর তো, কথাবার্তায় ভদ্র তো, নাকি আবার রেজা সাহেবের কথাই ঠিক হবে। এমনি নানান কথা কাকলীর মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারল। তিনি এরই মধ্যে কনককে মোবাইল করে আসতে দেরি আছে কি না জেনেছেন।

কনক এলো ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক বেলা দু’টার সময়। কলিং বেলে টিপ দিতেই কাকলী দরজা খুলে দিলেন। শাওন ফর্সা, লম্বা, অত্যন্ত সুন্দর, আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারিণী একটা মেয়ে, মেয়েটার চেহারায় আভিজাত্যর ছাপ আছে, চেহারায় আকর্ষণ আছে, গালে একটা তিল আছে যা তার মুখোমন্ডলকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাকলীকে দেখে মেয়েটা পা ছুঁয়ে সালাম করল।

কনক পরিচয় করে দিল, মা ও হচ্ছে শাওন।

সে আমি দেখেই বুঝেছি, আমার কনকের সঙ্গে তোমাকে মানিয়েছে ভাল, আমার এই বাঁদরটার রুচিবোধ আছে। এসো মা ভিতরে এসো।

কনক এবং শাওন তার মা’র পিছনে পিছনে ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঢুকলো। তোমরা একটু বস আমি একটা ফোন করে আসি, বলে কাকলী ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সোফায় বসে কাজের বুয়াকে ডাক দিলেন, বুয়া টেবিলে খাবার দাও। তারপর বললেন, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে নাও মা, এই কনক যা তুই তোর রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে হাত-মুখ ধুয়ে আয়।

শাওন টয়লেট থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বের হলে কাকলী শাওনকে নিয়ে ডাইনিং রুমে গেল। ততক্ষণে কনক ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে বসেছে। কাকলী নিজ হাতে শাওনের প্লেটে পোলাও তুলে দিতে দিতে বললেন, প্রথম যেদিন তোমার কথা কনকের মুখে শুনলাম সেদিনই আমার মনে হয়েছে, কনক ভুল করেনি। কনককে আমি সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি সে কখনো ভুল করবে না, সে সারাজীবনে অংকে একশ’র মধ্যে একশ’ই পেয়েছে আর নিজের জীবনের অংকে ভুল করবে? এটা হতে পারে না। আজ তোমাকে দেখে বুঝলাম সে তার বন্ধু বাছাইয়েও ভুল করেনি। তোমার মতো সুন্দর প্রতিভাবান মেয়েকে সে ঠিকই খুঁজে বের করেছে।

আমি খুব সুন্দর মেয়ে নই মা আর প্রতিভাবানও না, কোনভাবে বি-গ্রেডে পাস করেছি। আসলে প্রতিভাবান হলো কনক, আমার জীবনে কনকের মতো প্রতিভাবান ছাত্র আমি আর দেখিনি মা।

শুধু তুমি কেন মা, তোমার চেয়ে তো আমি অনেক বড়, আমিও কনকের মতো প্রতিভাবান ছেলে দেখিনি। আল্লাহ যেন ওর মাথাটাকে কম্পিউটার বানিয়েছেন, আর ওর মুখস’ বিদ্যা আমি দেখেছি একটা পড়া ওকে কখনো দু’বার পড়তে দেখিনি।

তবে মা আপনি কিন্তু আপনার ছেলে সম্পর্কে একটা কথা বাড়িয়ে বলছেন।

কাকলী যেন থমকে গেলেন, কি কথা মা?

আমাকে খুঁজে বের করায় কনকের কিন্তু কোন কৃতিত্ব নেই মা, আসলে ও আমাকে খুঁজে বের করেনি আমি ওকে খুঁজে বের করেছি বলতে পারেন আমি সিন্ধু সেঁচে মুক্তা এনেছি।

কাকলী মনে মনে বললেন, তুমিও কম কথা জানো না মা, আমার ছেলের সঙ্গে তোমাকে মানাবে ভাল, দু’জনের চেহারায় যেমন মিল আছে, তেমনি কথা-বার্তা এবং মেধা মননেও পাশাপাশি।

কাকলী শাওনের প্লেটে আবারো পোলাও তুলে দিচ্ছিলেন, শাওন বলল, আপনি এতকিছু কেন করেছেন মা? আপনার তো আজ অনেক কষ্ট হয়েছে।

তোমাকে একটা কথা বলি মা কনক আমাদের একমাত্র সন্তান, এই যে আমরা কনককে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি, আমাদের বিষয়-সম্পত্তি তিলে তিলে গড়ে তুলেছি সব তো শুধু ওর জন্য আর তুমি ওর ভালবাসার মানুষ, এমন সন্তানের জন্য কষ্ট করা যে কি আনন্দের সেটা তুমি আমার মতো মা না হলে বুঝবে না, বলতে বলতে আনন্দাশ্রুতে কাকলীর চোখ ভিজে গেল।

খাওয়া সেরে শাওন ড্রয়িং রুমে যাচ্ছিল এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। কাকলী বুয়াকে ডেকে বললেন, বুয়া দেখ তো তোমার খালু এসেছে।

বুয়া দরজা খুলে দিল। রেজা সাহেব বাসায় ঢুকে কাকলী কাকলী বলে ডাক দিতেই কাকলী ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে রেজা সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, এত জোরে ডাকছ কেন?

কই তোমার মেহমানকে খেতে দিয়েছ? কোথায় ওরা?

তুমি আগে হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও, তারপর দেখা কর।

রেজা সাহেব খাওয়া সেরে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, শাওন তখন ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। রেজা সাহেব ড্রয়িং রুমে ঢুকামাত্র শাওন পা ছুঁয়ে সালাম করল।

রেজা সাহেব শাওনের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন, বেঁচে থাক মা, দীর্ঘজীবী হও।

রেজা সাহেব পাশের সোফায় বসলেন। শাওন লজ্জায় জড়সড় হয়ে সোফায় বসে রইল। কিছুক্ষণ পর রেজা সাহেব শাওনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কি করেন মা?

শাওনের সংক্ষিপ্ত উত্তর, বাবা ব্যবসা করেন।

কি নাম যেন তোমার বাবার?

মোঃ জাকারিয়া।

কি ব্যবসা করেন?

বাবার দু’টা গার্মেন্টস্‌ ফ্যাক্টরি আছে?

সাভার ই.পি.জেড এ না? বলে রেজা সাহেব তাঁর পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বললেন, দেখ তো মা এটা তোমার বাবার ভিজিটিং কার্ড কি না?

শাওন মাথা নেড়ে সায় দিল এটা তার বাবারই ভিজিটিং কার্ড।

তুমি হয়ত ভাবছ আমার কাছে কিভাবে এলো তোমার বাবার কার্ড। তোমার বাবার এক বন্ধু আমাদের কোম্পানির একটা ফ্ল্যাট কিনলেন, সঙ্গে তোমার বাবাও এসেছিলেন। অনেকক্ষণ কথা হলো ভদ্রলোক খুব রসিক মানুষ। খুব দিল খোলা মানুষ একদিন কথা বলেই আমি বুঝেছি হি ইজ ভেরি নাইস ম্যান। কথা প্রসঙ্গে তোমার বাবা একবার বলেছিলেন তাঁর মেয়ে বুয়েটে পড়ে। আমি ভাবলাম বুয়েটে তো অনেক ছেলেমেয়ে পড়ে কিন্তু তুমি যে তাঁরই মেয়ে–। যাক ভালই হলো।

শাওন চুপ করে রইল রেজা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আজ যখন জানলাম তুমি তাঁরই মেয়ে তখন তো একবার কথা বলতেই হয়, বলে জাকারিয়া সাহেবকে মোবাইল করলেন, হ্যালো জাকারিয়া সাহেব।

আপনি কে বলছেন প্লিজ?

আমি রেজাইল ইসলাম, সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

রেজা সাহেব বলুন।

আপনার মেয়ে বুয়েটে পড়ে, শাওন না?

জি কেন? কি হয়েছে?

কিছু হয়নি আমার ছেলেও তো বুয়েটে পড়ে এবং ওরা দু’জনে একসঙ্গে পড়ে। মেয়েটা আমার বাসায় এসেছে কথায় কথায় আপনার নাম চলে এলো তাই মোবাইল করলাম।

খুব ভাল করেছেন।

খুব ভাল মেয়ে, খুব ভদ্র মেয়ে, কথা বলুন শাওনের সঙ্গে, বলে রেজা সাহেব শাওনের হাতে মোবাইলটা দিলেন।

শাওন মোবাইলটা হাতে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, বাবা তুমি দুপুরে ভাত খেয়েছ?

আমি খেয়েছি মা, তুমি?

বাবা আমিও খেয়েছি তুমি তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় যাব।

ঠিক আছে মা, মোবাইলটা একবার রেজা সাহেবকে দাও।

শাওন কথা বলা শেষ করে মোবাইলটা রেজা সাহেবকে দিল।

রেজা সাহেব মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললেন, জাকারিয়া সাহেব বলুন।

রেজা সাহেব একদিন আসুন আমাদের বাসায়।

আপনি আগে আসুন তারপর যাব, কেমন?

আচ্ছা।

জাকারিয়া সাহেবের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে রেজা সাহেব শাওনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কয় ভাইবোন, কে কি করে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

শাওন মাথা নত করে মৃদু কন্ঠে উত্তর দিল।

তারপর রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এবার পরীক্ষায় তোমার রেজাল্ট কেমন হয়েছে মা?

বি-গ্রেডে পাস করেছি।

কনক এ-প্লাস পেল আর তুমি বি পেলে তারমানে ও তোমাকে কোন হেল্প করেনি।

কনকের কোন দোষ নেই, ও আমাকে খুব হেল্প করে আসলে আমি তেমন ভাল স্টুডেন্ট না, তাই রেজাল্ট ভাল হয়নি।

তবে আরেকটু ভাল করে লেখাপড়া করলে তুমিও আরো ভাল রেজাল্ট করতে পারতে মা।

শাওন কোন কথা বলল না যেমন মাথা নত করে বসে ছিল তেমনি নীরবে বসে রইল।

রেজা সাহেব শাওনের মনের অবস’া বুঝতে পেরেছেন যে, শাওন লজ্জা পাচ্ছে তাই তিনি শাওনকে বললেন, তুমি বস মা, কাকলী শাওনের সঙ্গে গল্প কর, আমার আবার অফিস যেতে হবে, বলেই তিনি চলে গেলেন।

 

ষোল

রেজা সাহেব এবং কাকলীর আচরণে কনক এবং শাওন দু’জনে খুব খুশি হয়েছে। এতদিন কনক মনে করত শাওনের সঙ্গে মেলামেশার কথা জেনে তার মা কিংবা বাবা বিষয়টাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু সে তার বাবা-মা’র শাওনের প্রতি আচরণে কল্পনাতীত খুশি হয়েছে। কাকলী সেদিনের পর থেকে প্রায়দিনই কনকের কাছ থেকে শাওনের খোঁজখবর নেন, মাঝে মাঝে শাওনের মোবাইলে রিং দিয়ে কথা বলেন। বলতে গেলে কাকলী এবং রেজা সাহেব মন থেকে শাওনকে তাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন। আজকাল প্রায় দিনই শাওন কনকের কাছে চলে আসে তখন কাকলী নিজে শাওনকে কাছে বসিয়ে আপ্যায়ন করেন। আবার কোনদিন শাওন কনককে মোবইল করে তাদের বাসায় ডেকে পাঠায়।

জাকারিয়া সাহেবের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলায়। এক সময় গ্রামে তাঁদের সব ছিল, অনেক জমি ছিল, গোলাভরা ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল। সর্বনাশা নদী ভাঙ্গনে কয়েকদিনের মধ্যে তাঁদের বেশিরভাগ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তিনি তখন বি.কম পাস করে বেকার অবস্থায় ছিলেন, চাকরি নেই, জমি কমে গেছে, যা জমি আছে তাতে বছরের ভাত হয় না তারওপর আছে নদী ভাঙ্গনের হুমকি, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নদী যেন বাকী জমিটুকুও গ্রাস করতে চায়। সরকারি চাকরিতে দরখাস্ত করতে করতে আর ব্যাংক ড্রাফ্‌ট জমা দিতে দিতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এদিকে চাকরির বয়সও চলে যাচ্ছিল তখন বাধ্য হয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোন একটি চাকরির জন্য একদিন ঢাকা শহরে চলে আসেন। প্রথম চাকরি হয় একটা গার্মেন্টসে, একাউন্টেন্ট পদে, খুব সামান্য বেতনের চাকরি। তবু উপায় কি একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তো হয়েছে। সেখানে চাকরি করতে করতে তাঁর পরিচয় হয় এক গার্মেন্টস এক্সোসিরস্‌ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। জাকারিয়া সাহেব তখন তাঁর বাবাকে বুঝিয়ে তাঁর ভাগের জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে পার্টনারশিপে গার্মেন্টস এক্সোসিরস্‌ এর ব্যবসা শুরু করেন। দিনে দিনে তিনি তাঁর পরিশ্রম, মেধা, আর সততা দিয়ে এগিয়ে যান। তারপর আর কোনদিন তাঁকে পিছু ফিরতে হয়নি। জাকারিয়া সাহেব সেই সকালবেলা অফিসে বেরিয়ে যান সারাদিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন ফিরে আসেন সেই রাত আটটায় এমনি কঠোর পরিশ্রম করে তিনি আজ দু’টা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক হয়েছেন। শান্তিবাগে বিলাসবহুল নিজস্ব বাড়ি করেছেন, দামি গাড়িতে চড়ে বেড়ান।

জাকারিয়া সাহেব তাঁর স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন, তিনি ছিলেন তাঁর সুখ-দুঃখের একমাত্র সঙ্গী, তিনি কষ্টের সময় জাকারিয়া সাহেবকে সাহস দিয়েছেন, দুশ্চিন্তাগ্রস’ দিনে তাঁকে প্রেরণা দিয়েছেন। জাকারিয়া সাহেবের সেই প্রিয়তমা স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে কয়েকবছর আগে। তখন শাওনের বয়স আট বছর, শাওনের চেয়ে সৈকত দু’বছরের বড়। এই দুই ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং স্ত্রীর অম্লান স্মৃতি বুকে জড়িয়ে তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।

এখন সৈকত অস্ট্রেলিয়া থাকে শাওন বুয়েটে লেখাপড়া করে আর জাকারিয়া সাহেব তাঁর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জীবন জীবিকার কাছে তিনি যেন অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে গেছেন। সারাদিন যেখানেই থাকেন না কেন বাপ-মেযের সংসারে তাঁরা রাতের খাবার দু’জনে একসঙ্গে খান। কথা প্রসঙ্গে শাওন তার বাবাকে কনকের কথা বলেছে কিন্তু কোনদিন কনকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়নি। কনকের কথা উঠলেই জাকারিয়া সাহেব বলেন, ছেলেটা কেমন রে মা একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিস্‌ তো।

কনক কোনদিন শাওনের বাসায় গেলে গেটে গিয়ে কলিংবেল এ টিপ না দিয়ে শাওনের মোবাইলে একটা মিস্‌ কল দেয় তখন শাওন নিজে এসে গেট খুলে দেয়। কনক আজও তাই করল। মিস্‌ কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাওন দরজা খুলে দিল।

কনক জিজ্ঞেস করল, তুই কি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলি নাকি?

ধানিমন্ডি থেকে শান্তিবাগে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে সেটা আমার অনুমান করা হয়ে গেছে, সে অনুযায়ী আমি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম।

ভিতর থেকে জাকারিয়া সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে এলো রে মা?

বাবা কনক এসেছে।

জাকারিযা সাহেব তাঁর বেড রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, ততক্ষণে কনক ড্রয়িং রুমে সোফায় বসেছে। কনক জাকারিয়া সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল।

শাওন পরিচয় করে দিল, বাবা ও হচ্ছে কনক আমার বন্ধু।

তোমার বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আজ তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুব ভাল লাগছে। তো বাবা তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?

জি আংকেল ভাল।

তোমার কথা শাওনের কাছে অনেক শুনেছি, তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ভালভাবে লেখাপড়া কর একদিন অনেক বড় হবে।

আমার জন্য দোয়া করবেন। আংকেল আপনি ভাল আছেন?

আল্লাহর রহমতে এখন ভাল আছি? তবে ডায়বেটিসটা সামান্য বেড়েছে।

শাওন রাগান্বিত স্বরে বলল, সামান্য না অনেক বেড়েছে, কনক শোন্‌ বাবা কি কাজ করেছে?

কি করেছে?

জাকারিয়া সাহেব অসহায়ের মতো শাওনের দিকে তাকিয়ে বললেন, শাওন কনকের সঙ্গে আমার আজকেই প্রথম পরিচয় হলো, কথাটা কনককে না বললে হয় না রে মা?

না হয় না, কনক শোন্‌ কালকে বাবা বলল, মা রে আমার ডায়বেটিসটা একটু বেড়েছে, তারপর জিজ্ঞেস করে জানলাম একটু না অনেক বেড়েছে। তখন আমার সন্দেহ হলো, খাবার দাবারের নিয়ম ঠিক মতো মেনে চললে ডায়বেটিস বাড়বে কেন? তখন আমি ফ্রিজটা চেক করে দেখলাম আমার ফ্রিজের সব মিষ্টি উধাও। তুই বল্‌ এটা কি একজন সিনসিয়ার ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মানুষের করা ঠিক হয়েছে?

হঠাৎ আবার আমার শিক্ষাকে তিরস্কার করলি কেন মা? আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারি কিন্তু সে আমলের বি. কম পাস। অনেক বড় গার্মেন্টেসের একাউন্টেন্ট ছিলাম, গর্ব করে বলতে হয় এখন নিজেই গার্মেন্টস এর মালিক। তাহলে আমার শিক্ষা কম না বেশি তুই বল্‌।

শাওন বলল, চাকরি জীবনে পানচুয়্যাল একাউন্টেন্ট ছিলে, ব্যবসা জীবনে তুমি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কিন্তু নিজে স্বাস’্য সচেতন না।

ডায়বেটিস রোগীর যে মিষ্টির প্রতি কি আসক্তি তা যদি তুই জানতিস্‌ তবে আমাকে কিছু বলতে পারতিস্‌ না।

কনক জাকারিয়া সাহেবের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বলল, আংকেল এটা কিন্তু ঠিক না।

কনকের কথা শেষ হওয়ার আগেই জাকারিয়া সাহেব শিশুসুলভ ভঙ্গীতে বললেন, মা শাওন তুই শুনে রাখ্‌, বাবা কনক তুমিও শোন আমি আর কোনদিন মিষ্টি খাব না।

আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিলেন আর কোনদিন মিষ্টি খাবেন না। আপনি নিজেই বললেন ডায়বেটিস রোগীর নাকি মিষ্টির প্রতি আসক্তি বেশি। এই অজুহাতে আবার প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গবেন না। আপনার মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করলে আমাকে বলবেন আমি আপনাকে সুগার ফ্রি মিষ্টি এনে দিব, আপনি খাবেন।

সরি মা ভুল হয়ে গেছে, সামান্য ক’টা মিষ্টি খেয়েছি তাতে তোমরা আমাকে যে হেনস’া করলে তা আমার বাকী জীবন মনে থাকবে।

জি আংকেল মনে থাকলে আমরাও খুশি হব, তুই কি বলিস্‌ শাওন?

শাওন মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

তুমি বস বাবা, আমার গাধা মেয়েটাকে একটু মানুষ বানাও, বলে জাকারিয়া সাহেব চলে গেলেন।

জাকারিয়া সাহেব ভিতরে যাবার পর শাওন বলল, তুই যেভাবে শাসন করছিস্‌ তাতে মনে হয় তুই বাবার জামাই হয়ে গেছিস্‌?

আর তুই? তুই যেভাবে আমার মা’র মন জয় করেছিস্‌ তাতে তো মনে হয় তুইও আমার মায়ের পুত্র বধু হয় গেছিস্‌? ঠিক আছে এখন বের কর্‌ কি বুঝতে পাচ্ছিস্‌ না।

আজকের স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইন ক্লাসে আমি কিছু বুঝিনি, তুই আমাকে বুঝিয়ে দে।

কেন ক্লাসে মনটা কোথায় ছিল?

আজ সারাক্ষণ ক্লাসে তোকে নিয়ে ভেবেছি।

ব্যাস্‌, ব্যাস্‌ আর বলতে হবে না, টিন এজার মেয়েদের মতো কথা বলিস্‌ না, এখন বই বের কর্‌।

শাওন বই বের করল। কনক ক্লাসের পড়াটা হুবহু টিচারের মতো করে শাওনকে বুঝিয়ে দিল। শাওন মুগ্ধ হয়ে কনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পড়া শেষ করে কনক জিজ্ঞেস করল, এখন বুঝতে পেরেছিস্‌?

পন্ডিত মশাই আপনি যেভাবে বুঝান তাতে গাধাও বুঝতে পারবে আর আমি তো মানুষ।

না তুই মানুষ না, আংকেল এখনি বললেন, তুই গাধা।

দেখ আমাকে গাধা বললে কিন্তু আমি মা’কে সব বলে দিব তোকে মা’র কাছ থেকে গালি শুনাবো।

বেশ তো তোর মাকে বল্‌ না।

দাঁড়া বলছি, বলে শাওন কাকলীর কাছে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে কাকলীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বল মা।

মা কনক কি বাসায় আছে?

না ও তো বাসায় নেই।

দেখুন তো মা কি সমস্যায় পড়লাম, আজ স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইন ক্লাস ছিল, এমনিতেই আমি ম্যাথমেটিক্যাল সাবজেক্টগুলো কম বুঝি, ভাবছিলাম কনকের কাছ থেকে বুঝিয়ে নিব। কিন্তু আজ কনক ক্লাস করেনি, আবার এখন মোবাইল করলাম মোবাইল রিসিভ করছে না।

কি কনক আজ ক্লাস করেনি? কিন্তু ক্লাসের কথা বলে তো বাসা থেকে বের হয়ে গেছিল।

মা ওর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন, ও কিন্তু আগের মতো আর পড়াশুনায় মনোযোগী নেই।

আচ্ছা মা আমি দেখছি তুমি কিছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

শাওন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, ঠিক হলেই ভাল মা।

আচ্ছা মা আমি বিষয়টা দেখছি, বলে কাকলী মোবাইলের লাইন কেটে দিল।

কনক ক্ষেপে গেল, তুই এত মিথ্যা কথা বলতে পারিস্‌, বানিয়ে বলতে পারিস্‌, দিলি তো মা’র মনটা খারাপ করে।

 

সতের

অক্লান্ত চেষ্টা আর কনকের ক্রমাগত সহযোগিতায় শাওন ফাইনাল পরীক্ষায় এ-গ্রেডে পাস করতে পারল না। কনক বরাবরের মতো ফাইনাল পরীক্ষাতেও এ-প্লাস পেয়ে পাস করল। পরীক্ষার রেজাল্ট জানার পর কনক আর শাওন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কনক জিজ্ঞেস করল, শাওন আঁখিকে দেখেছিস্‌?

না তো, আঁখি আবার তোর কি দরকার পড়ল?

কনক মৃদু ধমকের সুরে বলল, শাওন সব সময় ঈর্ষা করতে হয় না, আমাদের ফেয়ারওয়েল আগেই হয়ে গেছে আজ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে গেল, আজ থেকে আমাদের গত কয়েক বছরের এক সাথে পথচলা শেষ হলো। আর আগের মতো করে কারো সাথে দেখা নাও হতে পারে।

তুই অবশ্য ঠিকই বলেছিস্‌, আজ সবার সাথে একবার দেখা হওয়া উচিত।

শাওন তুই কিছু মনে না করলে আজ শেষ দিনটা আমি সবার সাথে এনজয় করে কাটাতে চাই।

তারমানে-

তারমানে আঁখি, মেঘলা সবার সাথে খোলামেলা কথা বলতে চাই তাতে তোর ঈর্ষা হতেও পারে।

বাঃ তুই আমার এত অবিডিয়েন্ট ফ্রেন্ড? ঠিক আছে অনুমতি দিলাম।

এমনিভাবে কথা বলতে বলতে দু’জনে তাদের সেই-ই অতি পরিচিত গাছটার নীচে এলো, কনক গাছটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বিদায় বন্ধু, বিদায়।

পাশ দিয়ে আশিক আর আঁখি হেঁটে যেতে যেতে কনক আর শাওনকে দেখে গাছের নীচে এলো, কনক গাছটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আশিক গাছটাকে বিদায় জানালাম, অনেক দিনের বন্ধু, কতদিন ছায়া দিয়েছে, ছায়ায় বসে কবিতা লিখেছি, আড্ডা দিয়েছি, অক্সিজেন দিয়েছে শাওনের সঙ্গে আমার প্রেমে প্রেরণা যুগিয়েছে এমন অকৃত্রিম বন্ধু আর কে আছে বল্‌? বলতে বলতে কনকের দু’চোখ সজল হয়ে উঠল।

আশিক বলল, তুই ঠিকই বলেছিস্‌ বন্ধু কতদিন একসঙ্গে লেখাপড়া করলাম, কিছুদিন আগেও মনে হতো কবে বুয়েট ছাড়ব, অথচ আজ বুয়েট ছেড়ে যাবার সময় খুব খারাপ লাগছে।

দূরে একটা রাস্তা দিয়ে মেঘলা একাই হেঁটে যাচ্ছিল আঁখি জোরে ডাক দিল, এই মেঘলা এদিকে আয়।

মেঘলা ধীর গতিতে এসে দলে যোগ দিল।

আঁখি জিজ্ঞেস করল, তোর রেজাল্ট কি রে?

মেঘলা মন খারাপ করে বলল, বি-গ্রেড।

শাওন বলল, তাতে অসুবিধা কি? তুই তো আগে থেকেই বলিস্‌ ভাল রেজাল্টের দরকার কি? তুই তো লেখাপড়া করে চাকরি করবি না, ঘর-সংসার করবি, ঘর সংসার করার জন্য তো আর অনেক ভাল রেজাল্ট দরকার নেই, তাছাড়া দেখ্‌ এবারের রেজাল্টে বি- গ্রেডে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।

মেঘলা মুখ ভার করে বলল, শাওন আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস্‌, না? আমার তো তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট বন্ধু নেই, কনকের মতো ব্রিলিয়ান্ট বন্ধুর সহযোগিতা পেলেই আমি এ-গ্রেড পেতাম।

আঁখি মেঘলার কথাকে সমর্থন দিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক।

শাওন আশিকের দিকে তাকিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক।

কনক মেঘলাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, তোরা সাবই জানিস্‌ কি না, মেঘলা কিন্তু আমার খালাত বোন। আমরা আজ এখান থেকে বেরিয়ে গেলে এরপর হয়ত দেখা হবে পথে-ঘাটে, চাকরির খোঁজে কোন অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে কিন্তু মেঘলা আমার কাজিন ওর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে যা কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। আমরা সারাজীবন কাছাকাছি থাকব।

আঁখি বলল, তাহলে শাওনের কি হবে?

শাওনের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে গম্ভীর মুখ তুলে কনকের দিকে তাকাল।

কনক শাওনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, শাওনের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক, তুই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানে বুজম ফ্রেন্ড আর মেঘলা আমার কাজিন।

মেঘলা কনককে ভালবাসে, পারিবারিকভাবে এক সময় দু’জনের বিয়ের প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু কনক শাওনকে ভালবাসে কাজেই মেঘলার সঙ্গে কনকের বিয়ে হওয়ার সুযোগ নেই, তাছাড়া কনক আজ একরকম ষ্পষ্ট করে জানিয়ে দিল মেঘলা শুধুমাত্র তার কাজিন এর বেশি কিছু নয়। একথা জেনে মেঘলার দু’চোখ ছল্‌ছল করে উঠল।

আঁখি বলল, বাঃ শেষদিন কবি সাহেব সবকিছু যেন ষ্পষ্ট করে দিচ্ছে, কে কি কার সাথে কি সম্পর্ক, তো বন্ধু আমি কিভাবে বুঝব যে তুই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু?

প্রমাণ করতে চাস্‌?

অফ কোর্স।

সবাই কনকের দিকে তাকিয়ে রইল। শাওন অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল, তবে কি কনক আঁখিকে—?

না না আর ভাবতে পারছে না শাওন, মনে কষ্ট আর কৌতুহল চেপে রেখে কনকের দিকে তাকিয়ে রইল।

কনক বলল, আঁখি আজ তোর জন্মদিন?

আঁখি চমকে উঠল, হ্যাঁ তবে তুই জানলি কিভাবে? আমি তো কাউকে আমার জন্মদিনের কথা বলিনি, আর আমাদের বাসায় কারো জন্মদিন পালন করা হয় না, কখনো কখনো আমি নিজেই আমার জন্মদিনের কথা ভুলে যাই।

কিন্তু দেখ্‌ আমি ঠিকই তোর জন্মদিন সংগ্রহ করে মনে রেখেছি, শুধু তাই নয় তোর জন্মদিন উপলক্ষে একটা কবিতাও লিখেছি, তোরা সবাই আমাকে কবি বলে খোঁটা দিয়েছিস্‌ কিন্তু আমার লেখা কবিতা কোনদিন শুনতেও চাস্‌নি। তাই তোর জন্মদিনে তোকে দেবার জন্য একটা কবিতা লিখেছি, এখন আমি তোদের সবাইকে আমার লিখা কবিতাটা আবৃত্তি করে শুনাবো। সবাই কনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

কনক কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করল, কবিতার নাম শুভ জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন-

কবিতার ছন্দে, মনের আনন্দে,

মনের মাধুরী মিশিয়ে

এক গোছা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দেই

কামনা করি হৃদয়ের অন্তঃস’ল থেকে

শুভ হোক তোমার জন্মদিন।

পড়ে থাকা আমি এক অবহেলিত কবি

আমি এক নবীন কবি

হৃদয়ে আঁকা তোমারই প্রতিচ্ছবি

তোমারই জন্মদিনে কি-ই বা দেব আমি?

তাই শুধু কামনা করি শুভ হোক তোমার জন্মদিন।

হয়তবা সেদিন সন্ধ্যাবেলা কাটা হবে এক বিশালাকার কেক,

অজস্র কন্ঠে ধ্বনিত হবে হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ,

সুদূর থেকে আমি তখন মনে মনে বলি

শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন।

দল বেঁধে আসবে মেহমান সারি সারি,

তখন ডাস্টবিনে লুটোপুটি খাবে আমার কবিতাখানি

তবুও করুণ নেত্রে রুদ্ধ কন্ঠে বলবে,

”শুভ হোক তোমার জন্মদিন।”

শৈশব থেকে আজ অবধি,

তোমার হৃদয়ে যত বেদনা নিরবধি,

ধুয়ে যাক, মুছে যাক, নিভে যাক সবি

হৃদয়ের হার্ড ডিস্ক থেকে

নতুন হৃদয়ের হোক আজ নতুন জন্মদিন।

সম্মুখে দীর্ঘ পথ, সোনালী ভবিষ্যত,

সুখী সুন্দর উজ্জ্বল হোক তোমার জীবন

লাল কৃঞ্চচূড়া আসুক বারে বার,

এমন জন্মদিন আসুক আরো শতবার

বলবে সেদিন ধুলোয় মিশে আমার কবিতাখানি

শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন।

কনকের কবিতা আবৃত্তি শেষ হলে সবাই হাত তালি দিল। কনক শাওনের মুখের দিকে তাকাল, তার চোখ দু’টো ছল্‌ছল করছে। আঁখির গণ্ডদেশ বেয়ে অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল। মেঘলা অপলক দৃষ্টিতে কনকের দিকে তাকিয়ে রইল।

আঁখি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলল, তুই খুব ভাল কনক, তোর মনটা খুব বিশাল, শাওন খুব ভাগ্যবতী যে তোর মতো একজন উদার মনের মানুষের সঙ্গ পেয়েছে। শাওন তোকে বলছি কোনদিন যেন এমন মানুষকে হাতছাড়া না করিস্‌, যেন কষ্ট দিস্‌ না।

কবিতা আবৃত্তি করার পর কনক কবিতাটা আঁখির হাতে দিল। আশিক এবং আঁখি দু’জনে বলল, ইউ আর সো নাইস কনক, আমাদের শেষ দিনটাকে তুই স্মরনীয় করে রাখ্‌লি, ভাল থাক বন্ধু আল্লাহ যেন তোর সব ইচ্ছা পূরণ করেন।

কনক সবার উদ্দেশ্যে বলল, বিদায় বন্ধু, আবার দেখা হবে।

আশিক, আঁখি আর মেঘলা চলে গেল। মেঘলা যেতে যেতে কয়েকবার পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর একসময় দৃষ্টির আড়াল হলো। কনক শাওনের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ এর একটা কবিতা আবৃত্তি শুরু করল।

”কতো দিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর

খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে;-সন্ধ্যায় ধূসর সজল।”

 

আঠার

কাকলী রেজা সাহেবকে কনকের রেজাল্টের কথা টেলিফোনে জানিয়েছেন, রেজা সাহেব অফিস থেকে ফেরার পথে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, তাঁর শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ী দু’জনকে বাসায় ডেকেছেন রাতে বাসায় কনকের রেজাল্ট উপলক্ষে পোলাও মাংসের আয়োজন করা হয়েছে। এই এ্যাপার্টমেন্টের পরিচিত ফ্ল্যাটগুলোতে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। অনেকেই কনকের রেজাল্ট শুনে রেজা সাহেবকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। উপর এবং নীচতলার বসবাসকারী প্রতিবেশীরা সিঁড়িতে দেখা হলেই কনকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষে কাকলী, রেজা সাহেব তাঁর শ্বশুর কায়সার সাহেব এবং শ্বাশুড়ী সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছেন। কনক তার রুমে কম্পিউটারে কাজ করছিল। কায়সার সাহেব জোরে ডাক দিলেন, কনক নানু ভাই এসো, তোমার সাথে একটু কথা বলব।

কনক ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসল। রেজা সাহেব প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তোর নানু জিজ্ঞেস করলেন তুই কি করবি ভেবেছিস্‌?

বাবা সবে তো রেজাল্ট বের হলো, কিছুদিন যাক, তারপর না হয় সিদ্ধান্ত হবে। তবে আমার ইচ্ছা বি.সি.এস দেওয়া যদি চান্স পাই তবে সরকারি চাকরিতে জয়েন করা।

রেজা সাহেব কপালে চোখ তুলে বললেন, বাবা তুই যে রেজাল্ট করেছিস্‌ তাতে তুই যেখানে চাকরির দরখাস্ত করবি সেখানেই চাকরি পাবি কিন্তু তুই যদি সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাস্‌ তবে আমরা কি করব? আমার যেমন ব্যবসা ছেড়ে কোথাও যাবার সুযোগ নেই তেমনি তোর মা’রও সংসার ছেড়ে তোর সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াবার উপায় নেই। আমার বয়স হয়েছে, আমার ইচ্ছা ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু তোকে দিয়ে অবসর নেয়া। আমার ব্যবসাটাও ছোট না। এ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায় আমার সুনাম আছে আমার কয়েক কোটি টাকা ইনভেস্ট আছে, ব্যবসা করলেও তোর দিন বেশ ভালভাবে কেটে যাবে। তাছাড়া তুই ব্যবসায়ীর ছেলে ছোটবেলা থেকে যথেচ্ছা টাকা-পয়সা খরচ করে মানুষ হয়েছিস্‌ সরকারি চাকরির সামান্য বেতনে তোর চলবে না।

কায়সার সাহেব বললেন, আমি ভাবছি অন্য কথা, আমার কথা হলো লেখাপড়া তো শেষ হলো। আমাদের নিজেদের ব্যবসা আছে, আমাদের ফার্মে কত ইঞ্জিনিয়ার চাকরি করছে, তোমার তো আর চাকরি খুঁজতে যেতে হচ্ছে না। শুধু গিয়ে চেয়ারে বসতে হবে। আমিও অনেকদিন অফিসে যাই না। তোমাকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়ার জন্য আমিও না হয় একদিন অফিসে যেতাম। নাকি আগে বিয়ে তারপর অফিস?

রেজা সাহেব চলে গেলেন, কনক কিছু বলল না, নীরবে মাথা নত করে বসে রইল।

কায়সার সাহেব বললেন, কি নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ? তা ম্যাডাম করেন কি?

আমার সঙ্গে এবার এ-গ্রেডে পাস করেছে।

তাহলে তো আরো ভাল, আমি ননটেকনিক্যাল মানুষ ছিলাম ব্যবসা বুঝলেও ইঞ্জিনিয়ারিংটা বুঝতাম না, তোমরা এক সঙ্গে দু’জন ইঞ্জিনিয়ার কাজ করবে, ব্যবসাও বুঝবে টেকনিক্যাল সাইটটাও বুঝবে। বাঃ দিনে দিনে ব্যবসার আরো অনেক উন্নতি হবে।

কনক মৃদু হাসল, এমন সময় কনকের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। কনক মোবাইলের মনিটরে শাওনের নাম দেখে মোবাইলের রিং কেটে দিল। কায়সার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কার মোবাইল এসেছিল যে আমার সামনে রিসিভ করা গেল না?

কনক আমতা আমতা করে বলল, নানু শাওন মোবাইল করেছিল।

তাহলে ম্যাডামের নাম শাওন।

কনক নীরব সমর্থন জানাল। আবার মোবাইলের রিং বেজে উঠল, কায়সার সাহেব বললেন, লাইন কেটে দিও না, আমাদের সামনে রিসিভ করা না গেলে তোমার রুমে যাও, কথা বলে এসো।

কনক কিছু না বলে সোফা থেকে উঠে তার রুমে গেল, হ্যালো শাওন, কি হলো?

কি হল মানে কথা বলতে ইচ্ছা করল তাই মোবাইল করলাম, কোন অসুবিধা করে ফেললাম নাকি?

কোন অসুবিধা করে ফেলিস্‌নি, নানু এসেছে, মা ছিল, সবার সামনে থাকতেই তোর মোবাইল এসেছে, তাই উঠে আসতে হল।

মা তো আমাকে আগে থেকেই চিনে, তোর নানু ভাইকে কি এখনো আমার পরিচয় দিস্‌নি নাকি?

দিয়েছি তোর কথা নিয়েই আলাপ হচ্ছিল।

আমার কথা নিয়ে মানে?

শুধু তোর কথা না, আমি  এখন কি করব? চাকরি করব নাকি ব্যবসা করব? এখনি বিয়ে করব কি না? বিয়ের কথা উঠতেই তোর কথা উঠল। মা তো তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ যেন তোর মতো মেয়ে আর দুনিয়াতে নেই।

তুই কি বল্‌লি?

আমি চাকরি করতে চাইলাম, কিছুদিন চাকরি করার পর বিয়ে। কিন্তু সবার কথা ব্যবসা করতে হবে, আর বিয়েতে দেরি করা যাবে না, নানু ভাইর একান্ত ইচ্ছা আমি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করি, তাঁর আবার নাত বউকে দেখার শখ হয়েছে।

খুব ভাল বলেছেন সবাই, সরকারি চাকরি করতে গেলে ঢাকার বাইরে যেতে হবে আর বেসরকারি চাকরি করতে গেলে অন্য মানুষের ফার্মে কেন? নিজেদের ব্যবসা দেখাশুনা করাই ভাল। তুই একটু আমাকে নানুভাইর সঙ্গে পরিচয় করে দিতে পার্‌বি?

কনক গম্ভীর স্বরে বলল, শাওন।

তোর পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, আমি মা’র কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার নিয়ে নানু ভাইর সঙ্গে কথা বলতে পারব।

শাওন বেশি বাড়াবাড়ি করিস্‌ না, আমি সব এ্যারেঞ্জ করছি।

তুই মাইন্ড করিস্‌ না কনক, আমার বাবাও আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। সেদিন বাবাও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি এখন কি করব? আমি তোর সঙ্গে আলাপ না করে কিছু বলতে পারলাম না। শেষে বাবাও তোর গার্জিয়ানদের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন।

সবাই যখন চান তবে আর কি-

কনক বের হয়ে যাবার পর রেজা সাহেব আবার ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, কি হলো আব্বা?

সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ওর জন্য চেম্বার ঠিক কর, আমি একদিন গিয়ে না হয় চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আসব।

আব্বা কোন সমস্যা হবে না তো?

কি রকম সমস্যা?

এই যেমন আমাদের ফার্মের সবাই জানে আমার কোন ছেলে-মেয়ে নেই, এখন কনককে ছেলের পরিচয় দিতে গিয়ে যদি তারা কনক সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করে?

তুমি শুধু কনকের পরিচয় দাওনি তা তো নয়, সবাই তো কাকলীকেও চিনে না, তুমি বলবে কোনদিন কারো সঙ্গে পরিচয় করে দেবার প্রয়োজন হয়নি তাই পরিচয় করে দিইনি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কেউ মালিকের বিরুদ্ধে কন্সপেসি করার সাহস পাবে না।

আব্বা আপনি আছেন দেখে আমি সব বিষয়ে সাহস পাই।

ইনশাআল্লাহ কোন অসুবিধা হবে না, বলে কায়সার সাহেব কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, রেজা সাহেব ইশারায় বাধা দিয়ে বললেন, আব্বা কনক এসেছে।

কি হল নানু ভাই কথা হলো?

কনক কিছু বলল না নীরবে সোফায় বসে রইল।

কায়সার সাহেব বললেন, তুমি আর না করিও না নানু ভাই, আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ কর।

কনক মৃদু হাসল। কায়সার সাহেব বললেন আমি বলছিলাম না মা কাকলী কনক আমার কথা না করতে পারবে না। এবার হলো তো।

কাকলীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল। কাকলী মোবাইল রিসিভ করে বলল, কি রে রেবেকা? কেমন আছিস্‌?

ভাল, তুই?

আমিও ভাল আছি, কাকলীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

কনক তো খুব ভাল রেজাল্ট করেছে, তুই আসলে একটা জিনিয়াস ছেলে পেয়েছিস্‌।

কথাটা কাকলীর মনে প্রচণ্ড আঘাত করল। কথাটা আসলে রেবেকা এভাবে না বললেও পারতো। রেবেকা এমনভাবে বলল যেন কনককে সে রাস্তা-ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছে। কাকলী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা, আচ্ছা এখন বল্‌ কি মনে করে এতদিন পর মোবাইল করেছিস্‌?

অনেকদিন পর কেন? তোকে তো আমি মাঝে মাঝেই মোবাইল করি, তোকে মোবাইল করব না তো কাকে মোবাইল করব, বল্‌? তুই আমার খালাত বোন, বান্ধবী আবার হবু বিয়াইন। আচ্ছা তুই কি কাল বাসায় থাক্‌বি?

কেন? বল্‌ তো।

আমি একবার আসব ভাবছিলাম, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

কাল তো আমি বাসায় থাকব না, অন্য একদিন মোবাইল করে আসিস্‌।

কায়সার সাহেব কাকলীকে জিজ্ঞেস করলেন, কে রে মা?

কাকলী বললেন, বাবা রেবেকা।

আমাকে একবার দে তো, মেয়েটা অনেকদিন থেকে আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করছে না।

রেবেকা আমার বাসায় বাবা এসেছে তোর সঙ্গে কথা বলবে, বলে কাকলী মোবাইলটা কায়সার সাহেবের হাতে দিলেন, হ্যালো কেমন আছিস্‌ মা?

জি খালু ভাল আছি।

অনেকদিন থেকে যোগাযোগ করছিস্‌ না কেন?

আসব খালু খুব তাড়াতাড়ি আসব একদিন আপনাকে মোবাইল করে আসব। আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী আলাপ আছে।

ঠিক আছে মা চলে আসিস্‌।

 

উনিশ

জালাল সাহেব কোম্পানির চিফ একাউন্টেন্ট, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কর্মরত আছেন। তিনি খুব বিশ্বস্থ বলে দীর্ঘদিন যাবত কায়সার সাহেবের সঙ্গে চাকরি করেছেন এবং রেজা সাহেবও তাঁকে খুব বিশ্বাস করেন। কায়সার সাহেব অফিসে না এলেও মাঝে মাঝে রেজা সাহেবের কাছ থেকে তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তাছাড়া তিনিও মাঝে মাঝে কায়সার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতেন। রেজা সাহেবও অফিসের যাবতীয় কাজের পরামর্শ জালাল সাহেবের সঙ্গে করতেন। কয়েকদিন আগে জালাল সাহেবকে রেজা সাহেব একজন ইঞ্জিনিয়ার বসার জন্য অত্যাধুনিকভাবে একটা চেম্বার সাজাতে বলেছিলেন। জালাল সাহেব একবার মুখ তুলে জানতে চাননি কোম্পানিতে তো অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছে তাদের জন্য যেমন চেম্বার আছে তেমনি একটা চেম্বার হলেই তো হয়, চেম্বার আবার অত্যাধুনিক কেন? রেজা সাহেবকে খুশি করার জন্য তিনি খুব যত্ন করে একটা চেম্বার সাজিয়েছেন। অত্যাধুনিক হুইল চেয়ার, বিশিষ্ট কোম্পানির সেক্রেটারিয়েট টেবিল, টেবিলে একটা টেলিফোন সেট এবং একটা ইন্টারকম সেট, টেবিলের গ্লাসের নিচে কোম্পানির নির্মিত এবং নির্মাণাধীন এ্যাপার্টমেন্টগুলোর স’ান নির্দেশিত ঢাকা শহরের ম্যাপ, ইন্টারকমের ইনডেক্স, একটা গ্লোব, পেন স্ট্যান্ড, ফুলদানি, হাতের ডানে একটা কম্পিউটার বাঁয়ে একটা ছোট টেবিলে নির্মাণাধীন একটা এ্যাপার্টমেন্টের মডেল। দেয়ালে টাঙ্গানো কোম্পানির নির্মিত কয়েকটা এ্যাপার্টমেন্টের ছবি। সবকিছু মিলিয়ে রেজা সাহেবের ইচ্ছা মতো জালাল সাহেব চেম্বারটাকে সাজিয়েছেন। চেম্বার সাজানো শেষ হলে রেজা সাহেব সবকিছু দেখে জালাল সাহেবকে বললেন, জালাল সাহেব আমি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর কিন্তু আপনি তো দেখছি আমার চেম্বারের চেয়ে একজন সদ্য জয়েন করা ইঞ্জিনিয়ারের চেম্বার বেশি জাকজমকপূর্ণভাবে সাজিয়েছেন।

ঠিক তা না স্যার, আপনি আমাকে যেমন জাকজমকপূর্ণভাবে চেম্বার সাজাতে বলেছেন আমি তেমনিভাবে সাজিয়েছি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বসবে নাকি সদ্য জয়েন করা ইঞ্জিনিয়ার বসবে সেটা আপনার বিষয়।

রেজা সাহেব আর কিছু বলেননি শুধু মনে মনে জালাল সাহেবের রুচিবোধের প্রশংসা করেছেন।

কয়েকদিন থেকে জালাল সাহেবের চেম্বার সাজানো দেখে অনেকেই সমালোচনা করেছে কোম্পানিতে এমন কে জয়েন করছেন যার জন্য স্প্যাশালভাবে চেম্বার সাজানো হবে। কিন্তু একথা মুখ ফুটে কেউ বলার সাহস পায়নি। কারণ এটা প্রাইভেট কোম্পানি মালিকের সমালোচনা করলে চাকরি চলেও যেতে পারে।

আজ কোম্পানির চেয়ারম্যান কায়সার সাহেব আসবেন। বিকেল চারটায় অফিসে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করবেন তা গতকালই নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কায়সার সাহেবের একটা নিয়ম ছিল তিনি প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহে সবার টেবিলের সামনে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকটা খেয়াল রাখতেন। যারা আগের স্টাফ, যারা এ বিষয়টা জানেন তারা এবং যারা নতুন জয়েন করেছেন তারা একথা শোনার পর তাদের ডেস্ক এবং ফাইল পত্র পরিষ্কার করেছেন।

রেজা সাহেব প্রতিদিনের মতো সকালবেলা অফিসে এসেছেন এবং তাঁর প্রস’তি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। বিকেলবেলা কায়সার সাহেব অফিসে এলেন তাঁর সঙ্গে এলো কনক। অফিসের গেটে ঢুকতেই স্টাফরা কায়সার সাহেবকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। তারপর বিকেল ঠিক চারটায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনুষ্ঠানের শুরুতেই কায়সার সাহেব কনককে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমারস্নেহের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আপনারা সবাই আমার সঙ্গে যে সুদর্শন, স্মার্ট যুবককে দেখছেন ওর নাম কামাল রেজা কনক। আমার নাতি অর্থাৎ আমার একমাত্র মেয়ে-জামাই রেজা-কাকলীর একমাত্র সন্তান।

কায়সার সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, কনক এ বছর বুয়েট থেকে বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং এ এ-প্লাস পেয়ে পাস করেছে। ওর ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরি করা, ওর যা মেধা তাতে সরকারি চাকরি পাওয়া ওর জন্য খুব কঠিন হতো না। কিন্তু একমাত্র আমার অনুরোধে ও আমার কোম্পানিতে জয়েন করতে রাজি হয়েছে। আমাদের কোম্পানিতে এতদিন টেকনিক্যাল সাইট এবং ম্যানেজম্যান্ট সাইট একজন জেনারেল ম্যানেজারই দেখতেন। এখন থেকে টেকনিক্যাল সাইটটা দেখবে ডিইরেক্টর টেকনিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ার কামাল রেজা কনক। আপনারা সবাই মনে রাখবেন কনক শুধু এ কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারই না ও কোম্পানির একজন ডিরেক্টর এবং ভবিষ্যত কর্ণধার।স্নেহের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আপনারা অনেকেই আমার কোম্পানির উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এমনও দিন গেছে আপনারা নিজের পরিবার পরিজনদের কথা ভুলে গিয়ে দিন রাত পরিশ্রম করেছেন। আজকের আমার কোম্পানির এ উন্নতির জন্য আমি আপনাদের কথা কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করছি। আমার এখন বয়স হয়েছে। তাই আমি ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল দায়িত্ব আমার মেয়ে-জামাইয়ের হাতে ন্যস্ত করেছি কিন্তু আমি দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেও আপনাদের অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে এবং রেজার কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি যে আপনারা এখনো ঠিক আগের মতোই কঠোর পরিশ্রম করে কোম্পানির উন্নতি ও সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন। একদিন আমার মতো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে রেজাও অবসর নিবে তখন এ কোম্পানির দায়িত্বভার গ্রহণ করবে আমাদের নবাগত ইঞ্জিনিয়ার কামাল রেজা কনক। সে একেবারে নতুন, সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার তাকে আপনারা সবাই সহযোগিতা করবেন সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু শিখে নিতে পারে।

এতক্ষণ সবাই কায়সার সাহেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। কনকের কোম্পানিতে জয়েন করাটা অনেকের স্বার্থে আঘাত হানবে দেখে তাঁদের মুখ শুকিয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি স্বার্থে লেগেছে কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার রাহাত সাহেবের। তিনি তাঁর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না। দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি একটা কথা বলতাম।

কায়সার সাহেব অনুমতি দিলেন, বল।

স্যার একজন নতুন ইঞ্জিনিয়ারের ওপর এতবড় দায়িত্ব দেয়া কি ঠিক হবে? বলে তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, না মানে আমি বলছিলাম তিনি কি এতকিছু সামলাতে পারবেন?

কায়সার সাহেব শান্ত মানুষ, সহজে রেগে যান না কিন্তু কারো ওপর রেগে গেলে তাঁর সমস্ত শরীরে যেন প্রভাব পড়ে। তাঁর চোখের দিকে তাকালেই রাগ বোঝা যায়। তাঁর শান্ত, নির্লিপ্ত চোখ দু’টা তখন যেন জ্বল্‌জ্বল্‌ করে। তিনি একবার রাগান্বিত চোখে রাহাত সাহেবের দিকে তাকালেন তারপর চোখ নামালেন।

রেজা সাহেবের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনের অবস’া বুঝতে পারলেন। জালাল সাহেব বিড় বিড় করে আস্তে আস্তে বললেন, এটা প্রাইভেট কোম্পানি মালিকের ইচ্ছাই সব। মালিক যাকে ইচ্ছা প্রমোশন দিতে পারেন যাকে ইচ্ছা ডিমোশন দিতে পারেন, তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু বলার নেই।

কায়সার সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেন তাঁর চোখে-মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি বললেন, রাহাত তুমিও একদিন তরুণ, ফ্রেস হ্যান্ড হিসেবে এ কোম্পানিতে জয়েন করেছিলে, তখন তুমিও কিছু জানতে না। এখন তুমি অনেক কিছু জানো। ঠিক তেমনি কনকও এখন ব্যবসার কিছু জানে না তবে সে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। তোমরা সবাই সহযোগিতা করলে সে খুব সহজে সবকিছু শিখে নিতে পারবে।

রাহাত সাহেব লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইলেন।

এবার রেজা সাহেব এবং কনক সকলের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন। তারপর কায়সার সাহেব সকলকে নিজ নিজ কাজে যাবার জন্য অনুমতি দিলেন। সবাই নিজ নিজ কাজে চলে গেলে কায়সার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, রেজা চল দেখি আমাদের কনক সাহেবের চেম্বারটা একবার দেখিয়ে দাও।

রেজা সাহেব কায়সার সাহেব ও কনককে কনকের চেম্বারে নিয়ে গেলেন, সঙ্গে জালাল সাহেবও রইলেন।

কায়সার সাহেব বললেন, বাঃ খুব সুন্দর করে চেম্বার সাজিয়েছ তো।

রেজা সাহেব বললেন, এ কৃতিত্ব আমার না আব্বা, আমি শুধু অর্ডার দিয়েই খালাস। আসলে চেম্বারটা সাজিয়েছে আমাদের জালাল সাহেব।

বাঃ জালাল সাহেব বাঃ, আপনার রুচিবোধ আছে, বলে তিনি কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে কনক, এই হচ্ছে আমাদের জালাল সাহেব, আমি যখন প্রথম ব্যবসা শুরু করি তখন থেকে তিনি আমার সঙ্গে কাজ করছেন। জালাল সাহেব খুব অবিডিয়েন্ট তিনি কোম্পানির একাউন্টস্‌ এর দায়িত্ব পালন করছেন। মুলতঃ তিনি শুধু একাউন্টেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও এ কোম্পানির উন্নতিতে তাঁর অবদান অপরিসীম। আর জালাল সাহেব আপনি তো বুঝতেই পাচ্ছেন আমি কনককে কত ভালবাসি। সে আমার একমাত্র উত্তরাধিকারী আপনি ওর দিকে খেয়াল রাখবেন। সো ইয়াং ম্যান নাউ ইউ উইল সিট ডাউন ইয়োর চেয়ার।

কনক চেয়ারে বসল তারপর চেয়ার থেকে উঠে কায়সার সাহেব, রেজা সাহেব এবং জালাল সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে বলল, থ্যাংক ইউ এভরি বডি।

ইউ শুড বি গুড ল্যাক ইয়াংম্যান, তুমি তাহলে তোমার চেয়ারে বস আমি রেজার চেম্বারে কিছুক্ষণ বসব তারপর একসঙ্গে বাসায় যাব, বলে সবাই চলে গেলেন।

সবাই চলে গেলে কনক শাওনকে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে শাওনের কন্ঠস্বর ভেসে এলো, জি স্যার বলুন।

জি ম্যাডাম, কোম্পানিতে যোগদানের কাজ আপাতত শেষ।

কেমন লাগছে?

খুব ভাল এ যেন একটা নতুন ইমেজ। আমার খুব ভাল লাগছে। তবে তুই থাকলে আরো বেশি ভাল লাগত।

বেশ তো তোর কোম্পানিতে আমারও চাকরির ব্যবস্থা কর্‌ তারপর একসঙ্গে বসে চাকরি করব, খুব ভাল হবে।

সেদিন তো আর বেশি দেরি নয় শাওন, ক’টা দিন অপেক্ষা কর্‌।

হ্যাঁ এটাই তো তুই বল্‌বি, তুই তো আর ত্যাগী পুরুষ না যে রাগ করে বল্‌বি আজই চলে আয়। বল্‌বি ধৈর্য্য ধর্‌ আমি দেখছি।

এখন রাখি আবার নানু চলে আসবে।

 

কুড়ি

কয়েকদিন থেকে রেবেকা কাকলীর সঙ্গে দেখা করতে আসতে চাচ্ছে কিন্তু কাকলী আজ কাল করে, কোথাও যাবার অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছেন কারণ কাকলী জানে রেবেকা কেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ইদানিং বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। রেবেকার বার বার একটাই কথা কনকের সঙ্গে মেঘলার বিয়ে, যা কাকলী একেবারেই পছন্দ করে না। আজ সকালে রেবেকা মোবাইল করে কাকলীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, কাকলী এবারও এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে আর কতদিন পাশ কাটিয়ে চলবে, রেবেকাও নাছোড়বান্দা তিনিও সহজে পিছু ছাড়ছেন না। কাকলী সিদ্ধান্ত নিলেন একদিন না একদিন তো রেবেকার মুখোমুখি হতেই হবে তবে আর পাশ কাটিয়ে চলার দরকার কি? কাকলী আজ রেবেকাকে আসতে বলেছেন।

রেবেকা এলেন বিকেল চারটায় সঙ্গে মেঘলাও এসেছে। বাসায় ঢুকেই রেবেকা প্রথমে কনকের খবর নিলেন, কি রে কাকলী তোর ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটা কোথায়?

ওর রুমে আছে, কম্পিউটারে কাজ করছে।

রেবেকা একটু বেশি কথা বলে, কোনকিছু ভেবে চিন্তে বলে না। মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে। মেঘলা আর রেবেকা পাশাপাশি বসেছিল ডান পাশের সোফায় বসেছিলেন কাকলী। মেঘলার সামনেই রেবেকা কাকলীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, কাকলী আজ আমি তোর সঙ্গে কিছু সিরিয়াস কথা বলব, তুই আমাকে ষ্পষ্ট করে তোর মতামত বল্‌বি। কোনকিছু নিয়ে রহস্য কর্‌বি না, কোনকিছুকে তামাশা বা ইয়ার্কি মনে কর্‌বি না।

ঠিক আছে বল্‌।

আমি কনক আর মেঘলার বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য তোর কাছে এসেছি।

কনক আর মেঘলার কি বিষয়?

মেঘলা লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে রইল।

কাকলী মেঘলার দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস’া বুঝতে পেরে বললেন, মেঘলা তুই একটু পাশের রুমে যা তো মা কনক আছে গিয়ে গল্প কর।

মেঘলা বুঝতে পারল তার মা আর তার খালা কনক আর তাকে নিয়ে কথা বলবে আসলেই আগে তার চলে যাওয়া উচিত ছিল। মেঘলা নিজেও জানে কনক শাওনকে ভালবাসে এবং খালাও তাদের ভালবাসাকে কোনদিন আঘাত করবে না। সুতরাং শাওনের সঙ্গে কনকের বিয়েতে কোন বাধা নেই। মেঘলা নিজেও কনককে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু কনক মেঘলার ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই মেঘলা তার মা’র সঙ্গে খালার আলাপের সময় আসতে চায়নি তার মা একরকম জোর করে নিয়ে এসেছে। মেঘলা কনকের সঙ্গে শাওনের ভালবাসার কথা তার মাকে জানিয়েছে। রেবেকা মেঘলার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেছে, ছাত্রজীবনে ছেলেমেয়েদের একটু-আধটু প্রেম থাকতেই পারে তাই বলে কাকলীর সঙ্গে আমার কমিটমেন্ট তো আর ফিরিয়ে নিতে পারি না।

রেবেকা বললেন, কাকলী এখন মেঘলা আর কনক দু’জনের লেখাপড়া শেষ হয়েছে, কনক ব্যবসা দেখাশুনা করছে। ওকে বিয়ে দিবি না?

রেবেকা তুই এখনো সেকেলে রয়ে গেছিস্‌, আজকাল ছেলে-মেয়েদের বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী খুঁজতে হয় না, এ কাজটা তারা নিজেরাই করে থাকে।

তুই কি বলতে চাচ্ছিস্‌?

কনক শাওন নামে একটা মেয়েকে ভালবাসে ওদের দু’জনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভাল। মেয়েটা আমাদের বাসায় কয়েকবার এসেছে, আমরাও ওর বাবার কাছে গিয়েছিলাম। কথাবার্তা একরকম পাকাপাকি।

রেবেকা যেন জ্বলে উঠলেন, কথাবার্তা পাকাপাকি করার আগে তুই একবার চিন্তা কর্‌লি না, তোর সঙ্গে আমার কি কথা ছিল?

রেবেকা আমাদের কথা দিয়ে কিছু যায় আসে না, আমার কনক যাকে ভালবাসে ও যাকে বউ করে নিয়ে আসতে চায় আমি তাকেই মেনে নিব। কনক যদি মেঘলাকে ভালবাসতো তবে মেঘলার সঙ্গেই কনকের বিয়ে হতো। তুই মেঘলাকে জিজ্ঞেস করে দেখ্‌ মেঘলাও সবকিছু জানে।

রেবেকা বললেন, মেঘলাও আমাকে বলেছিল কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ছেলে বয়সে তেমন কিছু থাকতেই পারে এখন দেখছি ব্যাপারটা অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। তুই একটা কথা মনে রাখিস্‌ কাকলী আমি কনককে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখেছিলাম, তাই তোর কাছে এসেছি আমার মেঘলাই বা কম কিসে সেও তো ইঞ্জিনিয়ার, ওর বাবাও ব্যবসায়ী কনকের মতো ছেলে আমরা পাব না তা কিন্তু নয়।

বেশ তো ভাল আমিও চাই মেঘলার খুব ভাল একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক, ও জীবনে সুখী হোক।

এতদিন জানতাম কাকলী নামে আমার একটা বোন আছে, একটা বান্ধবী আছে, একটা বিয়াইন আছে আজ থেকে সে সম্পর্কটা শেষ হলো। আর কোনদিন তোর বাসায় আসব না। তবে আমিও দেখতে চাই কত উচ্চ শিক্ষিত আর কেমন রুপসী বউ তোর কনক নিয়ে আসে?

কাকলীর দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, আমার কনকের কারণে যদি তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয় তবে আমার কিছু করার নেই, তুই বস্‌ আমি চা নিয়ে আসি।

রেবেকা মনে মনে জ্বলে উঠলেন। তিনি মনে মনে বললেন, তোর কিছু করার নেই আসলে তুই ঠিকই বলেছিস্‌, তুই তো পরের ছেলে নিয়ে পদ্দারি করিস্‌, আমি তোর পরের ছেলেকে নিয়ে পদ্দারি শেষ করব।

মেঘলাকে দেখে কনক অবাক হয়ে গেল, কি রে মোবাইল না করে হঠাৎ আমার কাছে? কি মনে করে?

কনক তুই ট্যালেন্ট, স্মার্ট, সুদর্শন বটে কিন্তু তোর মধ্যে ভদ্রতার বেশ অভাব আছে।

আমার মধ্যে ভদ্রতার বেশ অভাব আছে? একথা তো তুই ছাড়া আর কেউ বলল না। বল্‌ তোর সঙ্গে কি অভদ্রতা করলাম?

আমি কতদিন পর বাসায় এলাম তুই বসতে বল্‌বি, ভাল আছি কি না জিজ্ঞেস করবি, তা না করে তুই বলছিস্‌ হঠাৎ কি মনে করে এলাম? এটা নিশ্চয় কোন ভদ্র আচরণ না। এটা আমার খালার বাড়ি আমি যখন ইচ্ছা তখন আসতে পারি। যেদিন এ বাড়িতে শাওন আসবে সেদিন থেকে আসতে চাইলে কারণ বলে আসব আর না হয় আসব না।

সরি মেঘলা আমার ভুল হয়ে গেছে, বস্‌ তারপর বল্‌? কেমন আছিস্‌?

মেঘলা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ভাল আছি।

চা খেয়েছিস্‌? নাকি দিতে বলব?

সে কাজ আর তোকে করতে হবে না। যতদিন খালা আছে ততদিন খালাই করবে। এখন বলব কেন এসেছি?

কনক কম্পিউটারের মনিটর থেকে মুখ মেঘলার দিকে করে বলল, বল্‌ তো কি মনে করে এসেছিস্‌?

আমি আসতে চাইনি কনক, মা এসেছে, আমি মা’র সঙ্গে এসেছি।

খালা কেন এসেছে?

শুনে আমার ওপর রাগ করতে পার্‌বি না, বল্‌ প্রোমিজ?

প্রোমিজ।

মা’র মাথা থেকে সেই পুরানো ভূত নামেনি।

কি পুরানো ভূত?

তোর আর আমার বিয়ে।

খালা সেই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে নাকি?

হ্যাঁ।

তুই খালাকে আমার আর শাওনের কথা বলিস্‌নি?

বলেছিলাম মা সবকিছু খালার মুখ থেকে শুনতে চায় তাই এসেছে।

আমাদের আবার ডাক পড়বে না তো?

খালাকে আমি চিনি, তিনি মাকে বুঝাতে পারবেন। এখন বল্‌ তোর চাকরি কেমন লাগছে?

চাকরি তো না ব্যবসা, ভাল লাগছে, খুব ভাল। তুই কি করছিস্‌?

এখনো কিছু করছি না, আমার ইচ্ছা সরকারি চাকরি করা যদি হয়ে যায় তবে চলে যাব।

কাকলী জোরে ডাক দিলেন, মা মেঘলা আয় চা খাবি, বাবা কনক তুইও আয়।

 

একুশ

কনক কিছুক্ষণ নির্মাণাধীন ভবনটির মডেলের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একটা ড্রয়িং টেবিলের ওপর মেলে তার চারপাশে পেপার ওয়েট চাপা দিল। তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ক্যালকুলেটর এবং কাগজ বের করে ড্রয়িং দেখে ক্যালকুলেশন করল। কিছুক্ষণ আপন মনে ক্যালকুলেশন করার পর একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, কনক বিল্ডিং ডিজাইনার্স কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিঃ এর অফিসে টেলিফোন করল।

অপর পাশ থেকে মহিলা কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বিল্ডিং ডিজাইনার্স কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিঃ থেকে বলছি, আপনি কাকে চান প্লিজ?

আমি ডিজাইনার হাসান সাহেব কিংবা আর্কিটেক্ট জাফর সাহেবকে চাচ্ছি, আছেন কি?

প্লিজ একটু লাইনে থাকুন আমি দেখছি, বলে ভদ্র মহিলার ইন্টারকমে কথা বলার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। তারপর উত্তর এলো, স্যার উনারা তো সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এ গেছেন।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলে কনক টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিল।

কয়েকমিনিটের মধ্যে দু’জন ভদ্র লোক কনকের চেম্বারে ঢুকে পরিচয় দিলেন, আমি হাসান স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, বিল্ডিং ডিজাইনার্স এন্ড কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিঃ।

তারপর অপরজন হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমি জাফর আর্কিটেক্ট।

কনক দু’জনের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করার পর চেয়ারে বসে কলিং বেল এ টিপ দিল। পিয়ন এসে দাঁড়াল, কনক হাসান সাহেব এবং জাফর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, কি খাবেন প্লিজ? চা না কফি? নাকি ঠান্ডা কিছু?

হাসান সাহেব বললেন, কিছু একটা হলেই হয়?

কনক পিয়নকে বলল, তিনটা কফি নিয়ে এসো।

কনক বলল, তাহলে আমরা কাজ শুরু করতে পারি।

অফ কোর্স।

আগে জাফর সাহেবের সঙ্গে কথা বলি, আচ্ছা জাফর সাহেব আমরা বিভিন্ন স’ানে এ্যাপার্টমেন্ট করেছি। এই যেমন ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, শান্তিনগর, মিরপুর এই সব জায়গায় কিন্তু আমি দেখেছি এ্যাপার্টমেন্টগুলোর ধরণ যেমন ডিফারেন্স হওয়া উচিত ছিল তেমন ডিফারেন্স হয়নি। সামান্য পরিবর্তন করে একই ফ্লোর প্লান বার বার করা হয়েছে। অথচ স্থানভেদে এ্যাপার্টমেন্টগুলোর আমুল পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল।

তাই তো করা হয়েছে, জাফর সাহেব বললেন।

গুলশান, বনানীর এ্যাপার্টমেন্টগুলো হওয়া উচিত ছিল খোলামেলা, লাক্সারিয়ার্স এসব এ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে মূল্যের চেয়ে খোলামেলা ডিজাইনকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে হতো, আবার মিরপুর, শান্তিনগর এলাকার এ্যাপার্টমেন্টগুলো হওয়া উচিত ছিল ছোট এবং কমার্শিয়াল কিন্তু আমি আমাদের তৈরী কয়েকটা এ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িং দেখেছি। আমাদের এ্যাপার্টমেন্টগুলো গতানুগতিক হয়েছে।

জাফর সাহেব মুখ কালো করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

গুলশান, বনানীর ফ্ল্যাটগুলোতে থাকা উচিত ছিল প্রশস’ বারান্দা, বেশি কার পার্কিং ব্যবস্থা এবং সম্ভব হলে এ্যাপার্টমেন্টের একটা ফ্লোরে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা।

জাফর সাহেব কিছু বললেন না তিনি মাথা নত করে বসে রইলেন তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল।

কনক বলল, যাহোক আগে যা হয়েছে তা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই, তবে এখন থেকে আমাদের এ্যাপার্টমেন্টগুলোতে কিছুটা ভিন্নতা আনতে হবে। যেমন এ্যাপার্টমেন্টগুলো নির্মাণের ধরণ হবে এলাকা ভিত্তিক কি ধরণের মানুষ বসবাস করে তার ওপর দ্বিতীয়তঃ সব স’ানের এ্যাপার্টমেন্ট যত বেশি কমার্শিয়াল ছিল ততবেশি কমার্শিয়াল না করে পরিবেশ বান্ধব এ্যাপার্টমেন্ট তৈরী করতে হবে, তৃতীয়তঃ প্রত্যেক এ্যাপার্টমেন্টে একটা করে ফ্লোরে শিশুদের বিনোদনের জন্য ব্যবস্থা থাকবে।

জাফর সাহেব মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, কিন্তু কনক সাহেব তাতে কি এ্যাপার্টমেন্টগুলো কমার্শিয়াল হবে এবং তাড়াতাড়ি বিক্রি হবে? কারণ মানুষ এখন চায় কম টাকায় বেশি সুবিধা।

না, মানুষ সুবিধা পেলে এখন টাকা খরচ করতে দ্বিধা করে না, মানুষ এখনো খোলামেলা বাসা চায় আর আমরা সেটাই দিব যা অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে একটু এক্সেপশনাল হবে। আমরা কয়েকটা তৈরী করে দেখি। তারপর না হয় আবার আগের নীতিতে চলে যাব।

আপনি আমাদের ক্লাইন্ট আপনি যেভাবে চাইবেন আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে।

কনক জাফর সাহেবের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে হাসান সাহেবকে বলল, হাসান সাহেব আমরা যে এ্যাপার্টমেন্টগুলো ইতিমধ্যে করেছি এগুলোর ডিজাইন কত মাত্রার ভুমিকম্প কনসিডার করে করা হয়েছে?

হাসান সাহেব বললেন, সাত রিখটার স্কেলের।

থ্যাংক ইউ সো মাচ।

কনক জিজ্ঞেস করল, উইন্ড লোড কত কিলোমিটার স্পিড কনসিডার করে ডিজাইন করা হয়েছে?

হাসান সাহেব বললেন, দু’শ কিলোমিটার।

আমি সেদিন পেপারে পড়লাম, এনিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করলাম। পেপারে লিখেছে কোন কোন এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে এসব কনসিডার করা হচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে ভুমিকম্প কিংবা উইন্ড লোড কিছুই কনসিডার করে ডিজাইন করা হচ্ছে না। মানুষ লাখ লাখ টাকা খরচ করে এ্যাপার্টমেন্ট কিনবে আর তারা জীবনের নিরাপত্তা পাবে না তা কি করে হয়?

জাফর সাহেব বললেন, দেখুন আমরা আগে সবকিছু ডিটেইলস্‌ এম.ডি স্যারের সঙ্গে আলাপ করে তাঁর কথামতো সবকিছু করেছি। তিনি সব সময় কমার্শিয়াল, মোস্ট কমার্শিয়াল বলতেন এবং আমরাও তাই করতাম বুঝেনই তো আমাদের সব সময় ক্লাইন্টের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়। তাছাড়া আমরা কোন এ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িং ফাইনাল করার আগে এম.ডি স্যারের সঙ্গে আলাপ করতাম এবং ড্রয়িংয়ে তাঁর স্বাক্ষরও আছে।

সবকিছুই বুঝলাম আব্বাও ড্রয়িংয়ে সই করেছেন তাও ঠিক আছে। কারণ আব্বা ননটেকনিক্যাল মানুষ তিনি বুঝে না বুঝে কিংবা বেশি লাভের আশায় বিষয়টাকে সামান্য মনে করতে পারেন কিন্তু আসলে তো বিষয়টা সামান্য না। এখন থেকে আমাদের যে সমস্ত এ্যাপার্টমেন্টের কাজ হবে সেগুলোর ড্রয়িং ফাইনাল করার আগে আমাকে একবার দেখাবেন।

জাফর সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আপনি ক্লাইন্টের প্রতিনিধি, আপনি চাইলে আমরা অবশ্যই ডিজাইন ফাইনাল করার আগে আপনাকে দেখাব।

কফি চলে এলো। কফি খেতে খেতে জাফর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমার মনে হয় আপনি যেভাবে চাচ্ছেন এম.ডি স্যার সেভাবে নাও চাইতে পারেন। কাজেই আপনি স্যারের সঙ্গে একবার আলাপ করে ডিসিশন নিন।

আচ্ছা সে দেখা যাবে।

কনকের চেম্বার থেকে বের হয়ে জাফর সাহেব হাসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, হাসান সাহেব কি বুঝলেন?

জাফর ভাই কনক সাহেব নতুন জয়েন করেছেন তো তাঁর একটু জানার আগ্রহ বেশি, তাই হয়ত সবকিছু জেনে নিলেন আর কি।

রাহাত সাহেব সামনে এসে দাঁড়ালেন, আরে জাফর সাহেব? কি মনে করে? আসুন আসুন আমার চেম্বারে আসুন।

জাফর সাহেব এবং হাসান সাহেব দু’জনে রাহাত সাহেবের সঙ্গে তার চেম্বারে ঢুকলেন। রাহাত সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, বলুন কার কাছে এসেছিলেন?

ঐ যে আপনাদের নতুন ডিরেক্টর টেকনিক্যাল এর কাছে, জাফর সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন।

কি আলাপ হলো?

আর বলবেন না এতদিন থেকে স’াপত্য নিয়ে কাজ করছি কোনদিন কেউ আমাকে কোন প্রশ্ন করেনি, ঢাকা শহরে নামী আর্কিটেক্ট হিসেবে আমার অনেক সুনাম আছে অথচ আজ পিচ্চি একটা ছেলের কাছে কত কি জবাব দিতে হল?

হাসান সাহেব বললেন, জাফর ভাই আপনি শুধু শুধু তাঁর ওপর রাগ করছেন।

জাফর সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আমিও বুয়েট থেকে পাস করেছি, সে হিসেবে কনক সাহেব আমার অনেক জুনিয়র কিন্তু দেখলেন কথা বলার সময় কিভাবে কথা বললেন। এটা কি করেছেন? সেটা কি করেছেন? আরো কত কি?

রাহাত সাহেব বুঝতে পারলেন জাফর সাহেব কনক সাহেবের ওপর ক্ষেপেছেন, তিনি যেন তুষের আগুনে ঘি ঢাললেন। তিনি তাঁকে ক্ষেপানোর জন্য বললেন, আগে ডিরেক্টর টেকনিক্যাল ছিল না তাই বলে কি আগের এ্যাপার্টমেন্টগুলো বিক্রি হয়নি? নাকি সব ভেঙ্গে পড়েছে?

জাফর সাহেব বললেন, আগে আমরা সব ড্রয়িংয়ে এম.ডি স্যারের সই নিতাম। এতদিন এ কোম্পানিতে শুধু কাজ সুপারভিশনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার ছিল এখন আবার এ্যাপার্টমেন্টের প্লান, ডিজাইন দেখার জন্য ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ হল। আবার বললেন কি রাহাত সাহেব জানেন?

কি বললেন?

আমি বললাম ডিসিশন নেওয়ার আগে এম.ডি স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করতে, তিনি বললেন সে দেখা যাবে তাঁর কথায় মনে হলো তিনি কোম্পানির সবকিছু।

হাসান সাহেব বললেন, জাফর ভাই কনক সাহেব কোম্পানিতে চাকরি করেন না, তিনি কোম্পানির মালিকদের মধ্যে একজন, ডিরেক্টর।

জাফর সাহেব রেগে গেলেন, ডিরেক্টর হলেই এভাবে কথা বলতে হবে, বয়সের একটা ব্যাপার আছে না?

রাহাত সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আপনার একদিনে এ অবস’া তাহলে একবার বুঝুন আমাদের কি অবস’া? কিছু না বুঝলেও তিনি এম.ডি স্যারের ছেলে, তিনি ডিরেক্টর টেকনিক্যাল। আমাকে তো তাঁর সঙ্গে কাজ করতে হবে। একটা জুনিয়র ছেলে বার বার হেনস’া করছে, এত জুনিয়র একটা ছেলেকে স্যার বলতে হচ্ছে।

জাফর সাহেব বললেন, আচ্ছা রাহাত সাহেব আমি তো শুনছিলাম এম.ডি স্যারের কোন ছেলে-মেয়ে নাই, এখন আবার হঠাৎ করে একেবারে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা ছেলে কোথায় পেলেন?

রাহাত সাহেব বললেন, আপনি তো দূরের কথা আমি এ কোম্পানিতে পনের বছর থেকে কাজ করছি, তখন থেকেই জেনে এসেছি এম.ডি স্যারের কোন ছেলে-মেয়ে নেই তারমানে তিনি নিঃসন্তান, আঁটকুড়া। হঠাৎ একদিন ডিরেক্টর টেকনিক্যাল বানিয়ে নিজের ছেলে পরিচয় দিয়ে চেয়ারে বসালেন। আমিও কাঁচা লোক নই, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না কনক সাহেব এম.ডি স্যারের ছেলে। আমি এর সত্যতা যাচাই করে ছাড়বো।

জাফর সাহেব হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, রাহাত সহেব আজকের মতো আসি।

বসুন চা খেয়ে যাবেন।

কনক সাহেবের চেম্বারে কফি খেলাম , আর খাব না।

রাহাত সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তিনি মলিন মুখে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে আসুন।

জাফর সাহেব এবং হাসান সাহেব চলে গেলেন, রাহাত সাহেব একরকম ধপাস্‌ করে চেয়ারে বসে পড়লেন।

 

বাইশ

সংসারে শুধু শাওন আর তার বাবা। তার যেন কথা বলার মতো কেউ নেই। আগে লেখাপড়া ছিল, বুয়েটে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে তার দিন ভালভাবে কেটে যেত। কিন্তু লেখাপড়া শেষ হতেই সে যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। এখন সব সময় তার একা একা দিন কাটে খুব কষ্টে। আগে কখনো মন খারাপ থাকলে কনককে মোবাইল করত, তখন কনক ছাত্র ছিল তার হাতেও গল্প করার মতো অঢেল সময় ছিল। কিন্তু এখন কনকও প্রায় দিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। তবুও শাওন মোবাইল করলে কখনো সময় দেয় না এমন নয়।

বিকেলবেলা শাওন কনককে মোবাইল করল, কয়েকবার কনকের মোবাইলে রিং করল কিন্তু কনক রিসিভ না করায় শাওন কিছুটা বিরক্ত হলো।

অবশেষে কনক মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো শাওন সরি তোর মোবাইল রিসিভ করতে পারিনি, বল্‌ কেমন আছিস্‌?

আমি ভাল আছি, তুই?

ভাল, তবে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আজ অফিসে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং সাইট ইঞ্জিনিয়াদের নিয়ে মিটিং করলাম তো তাই তোর মোবাইল রিসিভ করতে দেরি হলো, প্লিজ ডন্ট মাইন্ড।

ঠিক আছে আর কারণ দর্শাতে হবে না, আমি তোর এমন কেউ না যে আমার কাছে কারণ দর্শাতে হবে?

কনকের আবেগপ্রবণ কন্ঠস্বর ভেসে এলো, শাওন তুই তো আমার সব, তুই এভাবে বললে আমি কার প্রেরণা নিয়ে কাজ করব, বল্‌?

কনক আমি খুব একা হয়ে গেছি, আমার যে আর দিন কাটছে না। তোর কোম্পানিতে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দে না, প্লিজ।

শাওন তুই চাকরি কর্‌বি? আমাদের কোম্পানিতে?

হ্যাঁ, বসে বসে কি করব?

কনক বুঝতে পারল শাওন পরোক্ষভাবে তাকে বিয়ে করার কথাই বলছে, আর সে নিজেও শাওনকে বিয়ে করতে আগ্রহী এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। মাকে শাওন মোবাইল করলে মা ব্যাপারটা বুঝবে তখন হয়ত বিয়ের উদ্যোগ নিবে। তাই সে বলল, আমি তো ডিরেক্টর টেকনিক্যাল, এটা ডিরেক্টর এডমিনিস্ট্রেশনের কাজ। তুই বরং একবার মাকে মোবাইল কর্‌ কাজ হয়েও যেতে পারে।

আসলে কখনো চাকরি করিনি তো, তাই কার কি কাজ বুঝতে পারিনি, আচ্ছা আমি মাকে মোবাইল করছি।

তুই ক্যান্ডিডেট, তুই মোবাইল করলেই চাকরি হবে না, তোকে নিজে গিয়ে একবার রিকোয়েষ্ট করতে হবে।

তবে তুই টেলিফোন করে দিলেই তো হয়।

নিজে গিয়ে চাকরির কথা বলতে কি তোর সংকোচ হচ্ছে?

না, মার কাছে আমার কোন সংকোচ নেই। তবে যাই আজ একবার দেখা করে আসি, বলে শাওন মোবাইল রেখে দিয়ে ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে বের হলো।

শান্তিবাগ থেকে ধানমন্ডি সি.এন.জিতে মাত্র কয়েকমিনিটের পথ। কিন্তু রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে শাওনের প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগল।

কলিং বেল টিপতেই কাজের বুয়া দরজা খুলে দিল, আপা আপনি? আসেন।

কাকলী ভিতর থেকে জোরে জিজ্ঞেস করলেন, কে এলো রে?

বুয়া বলল, আম্মা শাওন আপা আইছে।

কাকলী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, মা তুমি?

শাওন পা ছুঁয়ে সালাম করল। কাকলী শাওনের থুতনিতে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে ধরে বললেন, খুব শুকিয়ে গেছ মা, তোমার কি কোন অসুখ করেছে?

না মা।

তবে-

শাওন মুচকি হেসে বলল, মা বসতে দিবেন না?

এসো মা, বলে কাকলী চলে গেলেন, তুমি একটু বস মা আমি রান্নাটা দেখে আসি।

কয়েকমুহূর্ত পরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, বল মা এত শুকিয়ে গেছ কেন?

আসলে আমার কিছু হয়নি মা। আপনি অযথা আমাকে নিয়ে চিন্তা করছেন?

কনক মোবাইল করে এখন?

শাওন লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেল, সে মৃদু কন্ঠে বলল, জি মা।

কি খাবে মা? আইসক্রিম?

শাওন মাথা নেড়ে সায় দিল সে আইস ক্রিম খাবে।

কাকলী বুয়াকে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম আনার কথা বলে শাওনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কেমন আছে মা?

ভাল মা।

আইসক্রিম চলে এলো, কাকলী শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেস্নেহ মাখা কন্ঠে বললেন, খাও মা।

কাকলীর আদরে শাওনের চোখে পানি ছল্‌ছল করে উঠল। সে রুদ্ধ কন্ঠে বলল, মা পৃথিবীর সব মা কি একই রকম?

এ প্রশ্ন কেন মা?

মা আমাকে ঠিক এভাবেই আদর করত, আপনিও ঠিক আমার মা’র মতোই আদর করছেন। আসলে পৃথিবীর সব মা’রা বুঝি একই রকম।

হয়ত তাই মা, তুমি যেদিন মা হবে সেদিন ভাল বুঝবে।

শাওন আইসক্রিম খাচ্ছিল কাকলী পাশে বসে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। শাওন আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে বলল, আমি আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি মা।

আমার কাছে কি কাজ?

আমার লেখাপড়া তো শেষ হলো, এবার আমার একটা চাকরি দরকার মা। তাই আপনার কাছে এসেছি। কনককে মোবাইল করেছিলাম ও বলল, আমি তো ডিরেক্টর টেকনিক্যাল, চাকরি পেতে হলে ডিরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, বলে শাওন মুচকি হাসল।

ও রে দুষ্ট কোথাকার ও তাহলে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে।

শাওন কোন কথা বলল না, মাথা নত করে একবার হাসল।

কাকলী বললেন, তুমি চাকরি করবে কেন মা?

আগে তো লেখাপড়া করতাম, সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম এখন তো আমার কোন কাজ নেই, সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না। তাছাড়া লেখাপড়া শিখেছি আমার মেধাকে তো কাজে লাগাতে হবে মা।

কাকলী মুখে কিছু বললেন না, মনে মনে বললেন, এখন তোমাকে চাকরি দিয়ে তারপর কনকের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিলে সবাই বলবে রেজা সাহেবের ছেলে তার কোম্পানিরই একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে। তারচেয়ে আগে বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর কোম্পানিতে জয়েন করানোই ভাল হবে।

শাওন মৃদু কন্ঠে বলল, মা।

তোমার মেধাকে আমি অপচয় হতে দিব না মা, আমি সবকিছু ওর বাবার সঙ্গে কথা বলি তারপর দেখা যাক কি করা যায়।

ততক্ষণে শাওনের আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়েছে, শাওন বলল, তাহলে আমি আসি মা, আমি আবার কাল একবার আপনার কাছে খবর নিব।

কালকেই না মা তোমাকে কয়েকদিন দেরি করতে হবে।

আমি তাহলে আসি মা, বলে শাওন উঠতে যাচ্ছিল।

কাকলী বাধা দিয়ে বললেন, সে কি মা এতদিন পর এলে ভাত না খেয়ে আমি তোমাকে যেতে দিব তুমি কিভাবে ভাবলে?

বাবাকে বলে আসিনি মা।

তোমার বাবাকে মোবাইল করে আমি বলে দিচ্ছি মা, তুমি বস।

শাওন আর কোন কথা বলল না।

 

তেইশ

রেজা সাহেব বাসায় ফিরলেন তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। প্রতিদিন সকালবেলা রেজা সাহেব এবং কনক একসঙ্গে অফিসে যায় আবার অফিস শেষে এক সঙ্গে বাসায় ফিরে। কিন্তু আজ রেজা সাহেবকে একা ফিরতে দেখে কাকলী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একা কেন? কনক কোথায়?

তোমার ছেলে এখন বড় হয়েছে, আজ বলল, একবার গুলশান সাইটে যাবে, আমি বললাম, বেশ তো যাও। তারপর আমি গাড়ি দিয়ে বললাম, সাইটে যাবে যখন, গাড়ি নিয়ে যাও। আমি না হয় একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে বাসায় যাব। গাড়ি ছাড়া কি সাইটে মানায়? তুমিই বল?

বেশ ভাল করেছ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলেকে আর একটা গাড়ি কিনে দাও। আর-

আর কি?

ছেলের লেখাপড়া শেষ হলো, চাকরি বল আর ব্যবসাই বল সেটাও হলো। এখন ছেলে আমার একটা এ্যাপার্টমেন্ট কোম্পানির ডিরেক্টর, ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে না।

ও তাই তো তুমি তো খুব ভাল কথা মনে করেছ। আচ্ছা ঐ যে একটা মেয়ের সঙ্গে একবার আমাকে পরিচয় করে দিয়েছিলে, মেয়েটা কনকের সঙ্গে লেখাপড়া করে। কি নাম যেন মেয়েটার?

শাওন, খুব সুন্দর মেয়ে, খুব মিষ্টি মেয়ে।

এখনো কনকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে না? তুমি কি জানো?

জানি তো মেয়েটা আজকেও এসেছিল।

শুধু কনকের সঙ্গে না তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ আছে, খুব ভাল তো। কি বলল তোমাকে?

চাকরির জন্য এসেছিল, বলল মা আমার একটা চাকরি প্রয়োজন তাই আপনার কাছে এলাম।

তুমি কি বললে?

আমি চিন্তা করে দেখলাম এখন যদি আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করে তারপর কনকের সঙ্গে বিয়ে হয় তবে বিষয়টা কেমন হয়ে যাবে না? তারচেয়ে আগে বিয়ে দিয়ে তারপর যদি কোম্পানিতে জয়েন করে তবে আর কারো কিছু বলার থাকবে না।

বাঃ বাঃ তুমি তো দেখি সবকিছু ভেবে-চিন্তে ঠিক করে রেখেছ। একবার আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করলে না।

কেন মেয়েটা কি তোমার পছন্দ না? মেয়ের বংশ বুনিয়াদ ভাল, বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, গাড়ি আছে, ঢাকায় বাড়ি আছে। এমন সুন্দর মেয়ে আবার বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার। এরকম হাই কোয়ালিফাইড মেয়ে ক’টা পাওয়া যাবে বল, লাখে একটা।

আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি না, কনকের পছন্দ, তোমার পছন্দ আমার কি বলার আছে? তাহলে তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন কর। আর হ্যাঁ মেয়েটাকে কি বলে বিদায় করলে?

বলেছি তোমার সঙ্গে কথা বলে তারপর জানাব।

নাস্তা খেতে খেতে কাকলী রেজা সাহেবের সঙ্গে আরো অনেক গল্প করলেন। কনক এবং শাওনকে নিয়ে তাঁদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করলেন। তারপর রেজা সাহেব বললেন, দেখি তো একবার কনকের আসতে দেরি আছে নাকি? কিন্তু কয়েকবার রিং দেওয়ার পরও কনক মোবাইল রিসিভ না করায় কাকলীকে জিজ্ঞেস করলেন, গাধাটা মোবাইল রিসিভ করছে না কেন?

কাকলী বললেন, তাহলে বাসার গেটে এসে পড়েছে সেজন্য তোমার মোবাইল রিসিভ করছে না।

কাকলীর কথাই ঠিক হলো। কয়েকমিনিটের মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠল। কাকলী বললেন, দেখলে তো আমি যে বললাম, দেখ তোমার ছেলে কত ক্যালকুলেটিভ।

কনক বাসায় ঢুকলো। রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি রে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল করছি কিন্তু মোবাইল রিসিভ করছিস্‌ না কেন?

বাবা বাসার গেটে ঢুকে পড়েছিলাম তো তাই তোমার মোবাইল রিসিভ করে টাকা নষ্ট করলাম না।

আগে স্টুডেন্ট ছিলি তখন এসব ক্যালকুলেশন ঠিক ছিল কিন্তু এখন চলবে না, এখন মোবাইল করলে রিসিভ করবি।

না বাবা তোমার থিওরি ঠিক না। আমি খালি খালি মোবাইল কোম্পানিকে টাকা খাওয়াব না। আমি আমার থিওরিতে চলব, আমি যদি কখনো তোমার মোবাইল রিসিভ না করি তাহলে বুঝবে আমি তোমার খুব কাছাকাছি আছি এবং তোমার কাছে চলে আসব, বলতে বলতে কনক তার রুমে চলে গেল।

রেজা সাহেব নাস্তা খেয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। তারপর কনক ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে বসল, মা বাবা নাস্তা খেয়েছে?

হ্যাঁ, অনেকক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষা করল তারপর নাস্তা খেয়ে ড্রয়িং রুমে গেল।

কাকলী নাস্তার প্লেট বাড়িয়ে দিলেন। কনক নাস্তা খেতে শুরু করল। কাকলী জিজ্ঞেস করলেন, কনক আজ তোর সঙ্গে শাওনের কথা হয়েছিল?

হয়েছিল, কেন? কি হয়েছে? কনক বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠল।

কি হয়েছে আবার তোর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল তাই বল্‌?

কনক কাকলীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার কাছে চাকরি চাচ্ছিল, আমি বললাম আমি কোম্পানির ডিরেক্টর টেকনিক্যাল। চাকরি দেওয়াটা ডিরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাজ তুমি বরং তাঁর কথা বল। তারপর তোমার কাছে রেফার্ড করে দিয়েছি।

বাসায় এসেছিল, আমি তো অবাক। মোবাইল বা টেলিফোন না করে হঠাৎ আসার কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, মা ক্যান্ডিডেট আমি নিজেই আমি মোবাইল করলে কি চাকরি হবে? তাই চলে এলাম।

তুমি কি বললে? কনক জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে জানাব কিন্তু আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোর বাবাকেও জানিয়েছি।

কি সিদ্ধান্ত?

আগে চাকরি না, আগে ওকে বউ করে ঘরে আনব, তারপর ডিরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন পোস্টে এপোয়েন্টমেন্ট দিব। আর আমার শেয়ার শাওনের নামে উইল করে দিব।

কনক যেন আকাশ থেকে পড়ল, মা তুমি ওকে বানাবে ডিরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন? ও কি বুঝবে এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের? মেয়ে মানুষ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাতে পারে নাকি?

সেটা তোর না বুঝলেও চলবে, সেটা চেয়ারম্যান বুঝবে।

মা তুমি তাড়াতাড়ি শাওনের পক্ষ নিলে, আসলে ওকে তোমার কাছে আসতে বলাই আমার ঠিক হয়নি। আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে তাই কর।

কাকলী মৃদু হেসে মনে মনে বললেন, এটাই তো চাচ্ছিলাম। তবে সবার আগে বিয়ে।

 

চব্বিশ

গতকালের নির্দেশ মতো গুলশান সাইটের সাব-কন্ট্রাক্টর মনু মিয়া সকালবেলা অফিসে এসে হাজির হয়েছে। কনক অফিসে ঢুকতেই মনু মিয়াকে দেখে বলল, মনু মিয়া আমার চেম্বারে এসো।

মনু মিয়া কনককে সালাম দিয়ে বলল, জি স্যার আসছি।

কনক তার চেয়ারে বসে বলল, মনু মিয়া তোমার সাইটের মালামাল এবং কাজের মান দেখে আমি সন্তোষ্ট হতে পারিনি।

সমস্যাটা স্যার আমার না, আসলে মাল খারাপ হলে তো কাজ খারাপ হবেই।

অফ কোর্স তুমি খুব ভাল কথা বলেছ। আচ্ছা বলতো আমাদের মালামাল কিনে কে?

স্যার জি.এম স্যার নিজে মালামাল কিনেন।

জি.এম সাহেব ননটেকনিক্যাল পার্সন কিন্তু প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো টেকনিক্যাল পার্সন, কন্সট্রাকশন কাজের মালামাল সম্পর্কে তাঁর তো খুব একটা ধারণা থাকার কথা নয়, তিনি মাল কেনার সঙ্গে জড়িত থাকবেন কেন? আর প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেবই বা মালামালের কোয়ালিটি ভাল না হলে মালামাল সাইটে গ্রহণ করবেন কেন? আচ্ছা তুমি একটু পরে এসো আমি আগে জি.এম সাহেবের সঙ্গে কথা বলি।

জি স্যার, বলে মনু মিয়া বের হয়ে গেল।

মনু মিয়া বের হয়ে যাবার পর কনক কলিং বেল-এ টিপ দিল। পিয়ন গেটে এসে দাঁড়ালে কনক বলল, রাহাত সাহেবকে একবার আমার সালাম দাও।

পিয়ন চলে গেল। কয়েকমিনিট পর রাহাত সাহেব এলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার?

কনক গম্ভীর স্বরে বলল, হ্যাঁ বসুন।

গুলশান সাইটের মালামাল আপনি কিনেছেন?

রাহাত সাহেব কোন কথা বললেন না।

কনক রাগান্বিত স্বরে বলল, আমি জানতে চাচ্ছি গুলশান সাইটের মালামাল আপনি কিনেছেন কি না?

জি স্যার।

আমি গতকাল সাইটে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার কেনা মালামাল দেখে আমি খুব অসন্তোষ্ট হয়েছি। আপনি ননটেকনিক্যাল মানুষ মালামালের কোয়ালিটি যদি না বুঝেন তবে এম.ডি সাহেবকে বলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিবেন। আসলে মালামাল কেন উচিত প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের। যাহোক এম.ডি সাহেব আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনার উচিত ছিল আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।

স্যার আসলে নতুন সাপ্লায়ার তো, শুধু বেশি লাভের ধান্দা করে। আমি একবার সেম্পল দেখেছিলাম কিন্তু সেম্পল অনুযায়ী মাল সাপ্লাই দেয়নি। অবশ্য মালামাল ব্যবহারের আগে আমরা সব মাল বুয়েট থেকে টেস্ট করি, টেস্টে ফেইল করলে সেই মাল তো অবশ্যই সাপ্লায়ারকে সাইট থেকে নিয়ে যেতে বলতাম।

আপনার কথা বুঝলাম কিন্তু সাইটে আমি যে মালামাল দেখলাম তার কোয়ালিটি তো চোখের দেখায় বুঝা যায়, তারপর না টেস্টের ব্যাপার। যাহোক এখনো সাইটে কাজ শুরু হয়নি আপনি সাপ্লায়ারকে মাল ফেরত নিয়ে যেতে বলুন। আর হ্যাঁ সেকেন্ড টাইমস এমন ভুল হলে তাকে সাপ্লায়ারের লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিবেন। শুধু তাই নয় আমি সব প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং সাইট ইঞ্জিনিয়ারদের বলে দিব কোন সাইটে মাল পৌঁছামাত্র তারা যেন কোয়ালিটির দিকে খেয়াল রাখে। এখন থেকে কোন সাইটে নিুমানের মাল পাওয়া গেলে জি.এম, প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং সাইট ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাহাত সাহেব একটা ঢোক গিলে বললেন, জি স্যার ঠিক আছে।

এখন থেকে মালামাল টেস্টের রিপোর্ট আমাকে দেখাবেন।

জি স্যার, বলে রাহাত সাহেব চলে গেলেন।

রাহাত সাহেব চলে যাবার পর কনক মনু মিয়াকে ডাক দিল। মনু মিয়া কনকের চেম্বারে ঢুকল।

কনক বলল, মনু মিয়া আমি মালামালের কোয়ালিটি নিশ্চিত করলাম সাইটে কোন নিুমানের মাল গেলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে। এরপর কাজের মান খারাপ হলে আমি তোমার বিল পেমেন্ট করব না। তুমি এখন এসো।

কনক নিজেও বুঝতে পারল রাহাত সাহেবকে এভাবে কথা বলা তার ঠিক হলো না। তিনি সিনিয়র মানুষ হয়ত মাইন্ড করতে পারেন, তাছাড়া বা উপায় কি? একজন জেনারেল ম্যানেজার, কোম্পানির সিনিয়র মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্বে যে অবহেলা করেছেন অথবা মালামাল ক্রয়ে যে অসততার পরিচয় দিয়েছেন তার কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনিভাবে নানান কথা কনকের মনে হলো। রাহাত সাহেব আবার বাবার কাছে বলবে না তো। রাহাত সাহেবের সঙ্গে ব্যবহারের জন্য বাবা যদি মাইন্ড করেন। হাজার হলেও তিনি অনেক দিনের কর্মচারী।

কনকের ধারণাই সত্য হলো। রাহাত সাহেব তার ক্ষোভের কথা প্রথমে জালাল সাহেবকে জানালেন তারপর রেজা সাহেবকে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, স্যার যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনাকে কিছু কথা বলতাম?

ব্যাপার কি রাহাত তুমি তো কথা বলার সময় সংকোচ কর না।

স্যার আগে সংকোচ করিনি এখন করতে হচ্ছে।

বল, নিঃসংকোচে বল।

স্যার বলছিলাম কনক সাহেবের কথা।

রেজা সাহেব এতক্ষণ একটা ফাইলের ওপর চোখ বুলাচ্ছিলেন। এবার ফাইল থেকে চোখ তুলে বললেন, কি হয়েছে কনকের?

স্যার আমি আজ অনেক বছর থেকে আপনার সঙ্গে কাজ করছি, কোনদিন কোন সমস্যা হয়নি, আজ কনক সাহেব আমাকে বললেন, আমি নাকি মালামালের কোয়ালিটি সম্পর্কে কিছু বুঝি না, এটা নাকি ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ। তিনি গতকাল গুলশান সাইটে গিয়েছিলেন, সাইটের মাল দেখে তিনি পছন্দ করেননি। তাই আজ আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করলেন।

রেজা সাহেব কিছু বললেন না মনোযোগ দিয়ে রাহাত সাহেবের কথা শুনতে লাগলেন।

রাহাত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আমাকে বললেন এরপর কোন সাইটে কোন মাল খারাপ গেলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনি বলুন স্যার এতদিন থেকে আপনার সঙ্গে কাজ করছি কোনদিন আপনি আমাকে এমন কথা বলেননি আর তিনি কয়েকদিন আগে জয়েন করেই আমাকে এমন কথা বললেন। শুধু কি আমাকে অপমান করেছেন? এর আগে তিনি কনসাল্টেন্টদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। এমনিভাবে সবার সঙ্গে মিস্‌বিহেভ করলে তো আমাদের কোম্পানির দুর্নাম হয়ে যাবে স্যার।

রেজা সাহেব সবকিছু শুনে বললেন, রাহাত সাহেব আপনি কিছু মনে করবেন না, ও একেবারে নতুন মানুষ, সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার তো একটুতেই মনে করে বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ল। বয়সেও তরুণ সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। সহজে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। দেখি আমি এখন ওকে বলব আর যেন কারো সাথে মিস্‌বিহেভ না করে।

রাহাত সাহেব চলে গেলেন কিন্তু তিনি রেজা সাহেবের কথাবার্তায় সন্তোষ্ট হতে পারলেন না। রাহাত সাহেব চলে যাবার পর রেজা সাহেব কনককে ডাকলেন।

কনক রেজা সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই রেজা সাহেব বললেন, কনক এসেছিস্‌?

জি বাবা।

আগে কফি দিতে বলি, বলে রেজা সাহেব কনকের উত্তরের অপেক্ষা না করে পিয়নকে কফির অর্ডার দিলেন।

রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বল্‌ কেমন লাগছে?

জি বাবা, ভাল।

আর্কিটেক্ট জাফর সাহেব খুব ভাল মানুষ, আমাদের সঙ্গে অনেকদিন থেকে কাজ করছেন। ঢাকা শহরে আর্কিটেক্ট হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম আছে। তাঁর সঙ্গে যে ডিজাইনার সাহেব ছিলেন হাসান সাহেব তিনিও খুব ভাল ডিজাইন করেন। খুব এক্সপার্ট আর ইকোনমি ডিজাইনের জন্য তাঁরও বেশ নাম ডাক আছে। আসলে কি জানিস্‌ বিল্ডিং ডিজাইনার্স এন্ড কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিঃ এর সহযোগিতায় আমরা আমাদের সুনাম ধরে রাখতে পেরেছি।

কনক বুঝতে পারল ষড়যন্ত্র শুধু রাহাত সাহেবই করেননি, জাফর সাহেবও ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যুগিয়েছেন। কনক রেজা সাহেবকে কিছু বলল না নীরবে মাথা নত করে বসে রইল।

কফি চলে এলো।

রেজা সাহব বললেন, নে কফি খা, খেতে খেতে গল্প করি।

কনক নীরবে কফি খেতে শুরু করল। রেজা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, গতকাল তো তুই সাইটে গিয়েছিলি?

জি বাবা।

মালামাল দেখে বোধ হয় তোর পছন্দ হয়নি?

তুমি ঠিকই বলেছ বাবা।

আসলে আমাদের কাজটা একটা টিম ওয়ার্ক, এই টিমে সব সদস্য সমান কাজ করবে, সবাই সমান সিনসিয়ার হবে, সবাই অনেস্ট হবে এমন আশা করা যায় না। এখানে অলস লোক থাকবে, উদাসীন লোক থাকবে, ডিজ অনেস্ট লোক থাকবে সবাইকে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

কনক আর সহ্য করতে পারল না। সে মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো, বাবা আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

আমাদের জেনারেল ম্যানেজার সাহেব রাহাত সাহেবকে আমি খুব ভাল করে চিনি। মালামাল ক্রয়ে সাপ্লায়ারের সঙ্গে খুব সম্ভব তার একটা দফা-রফা আছে কিন্তু কি করব বল্‌? আজকাল দক্ষ আর সৎ মানুষ পাওয়া খুব কঠিন কাজ তাই জেনে শুনে অনেককিছু মেনে নিতে হয়। আর মালামাল কেনার কথা বলছিস্‌ তবে এখন থেকে নতুন যে সাইটগুলো চালু হবে সেগুলোর মাল কেনার দায়িত্ব প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারদের দেয়া হবে তাহলে তারাও আর মালামালের মান নিয়ে কথা বলতে পারবে না। অনেকদিন থেকে তারাও মালামালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

থ্যাংক ইউ বাবা।

রেজা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, সেদিন জাফর সাহেব টেলিফোন করেছিলেন, তিনি আগেই জেনেছেন তুই আমার ছেলে এবং কোম্পানির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর তাই বেশি কিছু বলেননি, তবে তাঁর কথায় বুঝলাম তিনি তোর আচরণে সন্তোষ্ট না। কিন্তু হাসান সাহেব তোর খুব প্রশংসা করেছেন। আমি নিজেও তোর মেধা এবং দক্ষতাকে রেসপেক্ট করি।

বাবা তুমি যেভাবেই বল জাফর সাহেব আরেকটু পরিশ্রম করলে আমাদের এ্যাপার্টমেন্টগুলো আরো সুন্দর, আকর্ষনীয় এবং এক্সেপশনাল করা যেত কিন্তু তিনি একই আর্কিটেকচারাল ভিউ সামান্য এদিক-সেদিক করে দায়সারা কাজ করেছেন। কিন্তু ডিজাইনার তা করেননি, তিনি সুক্ষ্নভাবে ডিজাইন করেছেন। আমি জেনে অবাক হলাম তিনি সাত রিখটার স্কেলের ভুমিকম্প এবং দু’শ কিলোমিটার বাতাসের স্পিড ধরে বিল্ডিং ডিজাইন করেছেন আমার মনে হয় আমাদের দেশে সব ডিজাইনাররা এসব বিষয় কনসিডার করে ডিজাইন করে না।

জাফর সাহেব হয়ত সামনে থেকে তাঁর প্লান চেঞ্জ করবেন। আমি বলে দিয়েছি ডিরেক্টর টেকনিক্যাল যেভাবে চাইবেন সেভাবে আপনাদের কাজ করতে হবে। তবে রাহাত সাহেব তোর কথায় সাংঘাতিক মাইন্ড করেছেন।

বাবা তুমি যদি গুলশান সাইটে গিয়ে একবার মালামালগুলো দেখে আসতে তবে তুমিও তাঁর ওপর রাগ না করে পারতে না। আমি জানতে চাইলাম বললেন, নতুন সাপ্লায়ার নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাই তারা বেশি লাভের ধান্দা করছেন। কিন্তু আসলে আমার কি মনে হয় জানো বাবা?

কি মনে হয়?

সাইটে মালামালের কোয়ালিটি তোমার কথা এবং রাহাত সাহেবের কথা শুনে আমি একটা ব্যাপার মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি তিনি সাপ্লায়ারের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে নিুমানের মাল নিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করছেন। যাহোক সামনে থেকে মালামাল কেনার দায়িত্ব প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে দিলে তার আর কিছু করার থাকবে না। আমি মনে করি এসব ডিজঅনেস্ট স্টাফদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

বাবা তুই সবেমাত্র কোম্পানিতে জয়েন কর্‌লি আর আমি সবাইকে অনেকদিন থেকে চিনি। তবে এসব স্টাফ ডিজঅনেস্ট হলেও অভিজ্ঞ তো। একজন দক্ষ স্টাফ গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগে। তুই ধীরে ধীরে অনেস্ট স্টাফ গড়ে তুল্‌বি তারপর একে একে ডিজঅনেস্ট স্টাফদের বিদায় করে দিবি।

আমি তাই করব বাবা।

ধীরে ইয়াং ম্যান, ধীরে, বলে রেজা সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন।

কনক হ্যান্ডশ্যাক করে বিদায় নিল।

 

পঁচিশ

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মানুষের সুখ দেখতে পারে না, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সব সময় মানুষের খুঁত খুঁজে বেড়ায়। অন্যের সুখ, অন্যের ভাল কাজগুলো যেন তাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। তারা নিজের কাজের চেয়ে সব সময় মানুষের সমালোচনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। রাহাত সাহেব তাঁদের মধ্যে একজন, তাঁর আরো একজন সহকর্মী আছে দেলোয়ার সাহেব। একটু সুযোগ পেলেই দু’জনে ফিস্‌ফিস্‌ করে কারো না কারো সমালোচনা করে। কনক কোম্পানিতে জয়েন করার পর থেকে তাঁদের সমালোচনার তীর ছুঁড়েছে কনকের দিকে। কনক গুলশান সাইটের মালামাল বাতিল করে দেওয়ার পর যেন কনক রাহাত সাহেবের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। রাহাত সাহেব যেন কনকের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রেজা সাহেব অফিসে ছিলেন না কনকও ধানমন্ডি সাইটে গিয়েছেন। রাহাত সাহেব দেলোয়ার সাহেবের চেম্বারে ঢুকলেন।

দেলোয়ার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, স্যার আপনি?

আরে দেলোয়ার সাহেব বসুন বসুন।

দেলোয়ার সাহেব যে ফাইলটা নিয়ে কাজ করছিলেন সে ফাইলটা সরিয়ে রেখে বললেন, স্যার বলুন।

রাহাত সাহেব একবার উঁকি মেরে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, কনক সাহেবের সাথে কোনদিন কথা হয়েছে নাকি?

জি না স্যার।

না হওয়াই ভাল, ব্যবহার খুব খারাপ। একদিন কথা বললেই আপনার কথা বলার রুচি নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি আর কোনদিন কথা বলতে চাইবেন না।

স্যার আমি একজন জুনিয়র একাউন্টেন্ট, টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের সঙ্গে আমার তেমন কাজ নেই তাই হয়ত কোনদিন কথা হয়নি।

দেলোয়ার সাহেব আমার কি মনে হয় জানেন?

কি মনে হয় স্যার?

আমার মনে হয় কনক সাহেব স্যারের ছেলে নয়।

দেলোয়ার সাহেব যেন থমকে গেলেন, আপনি কি বলছেন স্যার?

আমি ঠিকই বলেছি, আপনি কতদিন থেকে এই কোম্পানিতে চাকরি করছেন কোনদিন কি শুনেছেন স্যারের কোন ছেলে-মেয়ে আছে?

তা অবশ্য শুনিনি।

এই ধরুন আপনি দশ বছর ধরে এই কোম্পানিতে চাকরি করছেন। এতদিন কনক সাহেব এস.এস.সি পাস করেছেন, এইচ.এস.সি পাস করেছেন। কোনদিন শুনেছেন স্যারের ছেলে খুব ভাল রেজাল্ট করেছে? স্যারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে?

তা আমরা না শুনলেই বা কি, স্যার যাকে নিজের ছেলে পরিচয় দিতে পারেন তাকে আমাদের বস্‌ বলে মেনে নিতে আপত্তি কিসের?

আপত্তি আছে, মানুষের আচার ব্যবহার নির্ভর করে বংশ বুনিয়াদের ওপর, কনক সাহেবের বংশ বুনিয়াদ ভাল হলে তার আচরণ আরো ভাল হতো। আমার মনে হয় কনক সাহেব স্যারের পোষ্যপুত্র, নিজের ছেলে-মেয়ে নাই বলে স্যার পোষ্যপুত্রকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিচ্ছেন।

স্যার যদি তাঁর পোষ্যপুত্রকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেন তবে আমাদের করার কি আছে?

করার আছে দেলোয়ার সাহেব, করার আছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই কোম্পানিতে কাজ করছি, এই কোম্পানিতে আমাদের একটা কন্ট্রিবিউশন আছে। আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমরা সবাই স্যারের কাছে কমপ্লেইন করব।

দেলোয়ার সাহেব মুখ আংশিক বিকৃত করে বললেন, আমার মনে হয় এটা এম.ডি স্যারকে বলে কোন কাজ হবে না।

আপনি যা-ই বলেন দেলোয়ার সাহেব আমি এর আসল রহস্য উদ্‌ঘাটন করেই ছাড়ব।

দেলোয়ার সাহেব খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। তিনি সরিয়ে রাখা ফাইলটা আবার সামনে টেনে নিলেন।

রাহাত সাহেবের ধারণা ছিল দেলোয়ার সাহেব তাকে অন্যান্য বিষয়ের মতো অন্ধভাবে সমর্থন দিবে কিন্তু দেলোয়ার সাহেবের আগ্রহ না থাকায় তিনি কিছুটা নিরাশ হলেন। রাহাত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, থ্যাংক ইউ দেলোয়ার সাহেব, কাউকে যেন কিছু বলবেন না। আমি ঠিকই সবকিছু উদ্‌ঘাটন করে আপনাকে জানাব, বলে রাহাত সাহেব দেলোয়ার সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে জালাল সাহেবের চেম্বারে ঢুকলেন।

জালাল সাহেব সৎ, ধর্মভীরু এবং সদালাপী মানুষ। এ কোম্পানিতে প্রথম থেকে চাকরি করছেন। তিনি কায়সার সাহেব এবং রেজা সাহেবের খুব বিশ্বস্থ। তিনি সকালবেলা অফিসে এসে কাজ শুরু করেন, মাথা নীচু করে সারাদিন কাজ করতে থাকেন। এতবড় অফিসের একাউন্টস্‌ তিনি দেলোয়ার সাহেবের সহযোগিতায় করে থাকেন। একাউন্টস্‌ দেখা ছাড়াও তিনি অফিসের ম্যানেজমেন্ট তদারকি করে থাকেন এম.ডি সাহেব এবং চেয়ারম্যান সাহেবের পছন্দের লোক হিসেবে। অফিসের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে রেজা সাহেব জালাল সাহেবের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। বলতে গেলে জালাল সাহেব বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্‌ এর কেউ না হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তার ভূমিকা অসামান্য।

রাহাত সাহেবকে দেখে জালাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর রাহাত সাহেব? কি মনে করে?

আপনি খুব ব্যস্ত না কি?

না ব্যস্ত না বসুন, বলুন কেমন আছেন?

কই আর ভাল থাকলাম।

কেন কি হয়েছে? আল্লাহ যাকে যেমন রেখেছে তাতেই সন্তোষ্ট থাকতে হবে একটা কবিতা ছিল, ছোটবেলায় পড়েছিলাম।

রাহাত সাহেব বিরক্ত সহকারে বললেন, ওসব কবিতা-টবিতা এখন আর মনে নেই জীবন গদ্যময় হয়ে গেছে, বুঝলেন?

তাহলে শুনুন কবিতাটা, মন ভাল হবে, বলে জালাল সাহেব কবিতাটা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন,

একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে,

দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে

ধীরে ধীরে চুপি চুপি দূঃখাকুল মনে,

গেলাম ভোজনালয়ে ভোজন কারণে।

দেখি সেথা একজন পদ নাহি তার

অমনি জুতার ক্ষেদ ঘুচিল আমার।

কবিতা আবৃত্তি শেষ করে জালাল সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করুন, আপনার ঢাকা শহরে একটা ভাল বেতনের চাকরি আছে, বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করে খাচ্ছেন। ঢাকা শহরে এমন অনেক মানুষ আছে যারা তিনবার পেটপুরো ভাত পাচ্ছে না। সেদিক দিয়ে আপনি অনেক ভাল আছেন।

আগে তো ভাল ছিলাম জালাল সাহেব টেকনিক্যাল ডিরেক্টর জয়েন করার পর থেকে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।

কেন কনক সাহেব তো খুব ভাল মানুষ, ইয়াং, এনার্জেটিক দেখছেন না ক’দিনে কোম্পানিতে একটা চেঞ্জ আসতে শুরু করেছে। বিল্ডিংয়ের ডিজাইন কেমন হচ্ছে? মালামালের মান কেমন হচ্ছে? কাজের মান কেমন হচ্ছে? একাউন্টস্‌ ঠিক মতো মেইনটেইন হচ্ছে কি না? আমার তো ধারণা ছিল ইঞ্জিনিয়ার মানুষ শুধু টেকনিক্যাল সাইট দেখবেন কিন্তু কনক সাহেবের দেখছি একাউন্টস্‌ সম্পর্কে খুব ভাল জ্ঞান আছে। এত অল্প বয়সে এত বেশি অভিজ্ঞ মানুষ পাওয়া কঠিন। তবে একটা ব্যাপার কি বয়স কম তাই একটু বেশি সিনসিয়ার যে কারণে আমরা তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশম খাচ্ছি।

রাহাত সাহেব মনে মনে বললেন, এ তো দেখি মালিকের খাস চাম্‌চা, কনক সাহেবের কথা বলা হবে কি না? বলেই দেখি তিনি কনক সাহেবের পরিচয় জানেন কি না?

কি ভাবছেন রাহাত সাহেব? জালাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

আচ্ছা জালাল সাহেব আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি?

জি বলুন।

স্যারের যে ছেলে আছে এটা আপনি কতদিন থেকে জানেন?

জালাল সাহেব মুখ গম্ভীর করে বললেন, দেখুন রাহাত সাহেব আমি অফিসে চাকরি করি, আমার সঙ্গে এম.ডি স্যারের সম্পর্ক অফিস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। স্যারের ক’জন ছেলে-মেয়ে এটা আমি কোনদিন জানার প্রয়োজন মনে করিনি।

রাহাত সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন, স্যারের ছেলে আছে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে একথা তো আগে কোনদিন শুনিনি। হঠাৎ করে একদিন স্যারের ছেলে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদে জয়েন করলেন।

জালাল সাহেব বিরক্তবোধ করলেন, তাতে আপনার কি? আপনি চাকরি করেন বেতন পান, স্যারের ছেলে সম্পর্কে আপনার এতকিছু জানার আগ্রহ কেন? আপনি কনক সাহেবকে স্যারের ছেলে কি না সন্দেহ করছেন একথা স্যার জানলে আপনার চাকরিটা চলে যেতে পারে একথা কি আপনি জানেন?

রাহাত সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি জালাল সাহেবের হাত চেপে ধরলেন, জালাল সাহেব প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না।

প্রথম বার বলেছেন তাই কিছু বলছি না আবার যদি কোনদিন এমন বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন বা অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করেছেন তবে আমি স্যারকে বলতে বাধ্য হব।

রাহাত সাহেব একটা ঢোক গিলে বললেন, সরি জালাল সাহেব এমন ভুল আর হবে না।

রাহাত সাহেব চলে যাবার পর জালাল সাহেব ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন, সত্যিই তো চেয়ারম্যান স্যার এবং এম.ডি স্যার দু’জনের সঙ্গেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। এম.ডি স্যার তাঁর পরিবারের যাবতীয় কথা আমাকে বলতেন কিন্তু কোনদিন তো তাঁর ছেলের কথা বলেননি তবে কি রাহাত সাহেবের কথাই সত্যি?

 

ছাব্বিশ

রাহাত সাহেব কনকের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। খুঁজতে লাগলেন কনকের দুর্বল দিকগুলো। কিন্তু কি বা দুর্বল দিক আছে কনকের? তাও যেমন তেমন দুর্বল দিক দিয়ে তাকে ঘায়েল করা যাবে না বা এম.ডি স্যারের কাছে খারাপ করা যাবে না। কারণ কনক এম.ডি স্যারের ছেলে। এখন একটাই উপায় তার জন্মসূত্র খুঁজে বের করা যদি সে সত্যি সত্যি স্যারের ছেলে হয়ে থাকে তবে তো আর কিছুই করার নেই আর যদি এম.ডি স্যারের পোষ্যপুত্র হয়ে থাকে তবে কনক সাহেব নিজেই সকলের কাছে হেয় হয়ে থাকবেন, লজ্জায় আর ক্ষোভে কোম্পানি ছেড়ে চলে যাবেন বা দেশের বাইরে চলে যাবেন।

রাহাত সাহেব ফিরোজ সাহেবের দূর সম্পর্কের ভাতিজা। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলায়। এম.কম পাস করার পর তিনি চাকরির সন্ধানে ঢাকা শহরে আসেন। কিন্তু সরকারি চাকরি তো নয়ই কোনরকমে একটা মাথা গোঁজার মতো ঠাঁইও তার হচ্ছিল না। তখন ফিরোজ সাহেবের সুপারিশে রেজা সাহেব তাকে চাকরি দেন। কয়েকটা সাইটে তিনি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর রেজা সাহেব তার কাজকর্মে সন্তোষ্ট হয়ে জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রমোশন দিয়ে হেড অফিসে নিয়ে আসেন। রেজা সাহেবের সঙ্গে সখ্যতা রাখার জন্য রাহাত সাহেব মাঝে মাঝে ফিরোজ সাহেবকে দিয়ে রেজা সাহেবকে টেলিফোন করিয়ে রাহাত সাহেবের দিকে সুদৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ফিরোজ সাহেব এলাকার মানুষ হিসেবে রাহাত সাহেবের জন্য এই কাজটুকু করতেন।

রাহাত সাহেব যখন কনকের সঙ্গে একটা ঠান্ডা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল তখন তাঁর ফিরোজ সাহেবের কথা মনে পড়ল। তাছাড়া ফিরোজ সাহেবের স্ত্রী রেবেকা কাকলীর খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তাঁর কাছে গেলে একটা কাজ হতেও পারে আর না হয় কনক সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে রেজা সাহেবের সঙ্গে রাহাত সাহেবের যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে সেটা তো দূর করা যাবে।

সেদিন অফিস বন্ধ ছিল। রাহাত সাহেব ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর বাসায় গেলেন। রাহাত সাহেব রেবেকার কাছে জানতে পারলেন ফিরোজ সাহেব বাসায় নেই, সাভার গেছেন, আসতে দেরি হবে। মেঘলাও বাসায় ছিল না। রেবেকা সোফায় বসতে বসতে বললেন, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, বল বাবা কেমন আছ?

ভাল আছি আন্টি।

বউমা? তোমার ছেলে-মেয়েরা?

ওরাও ভাল আছে।

তোমার চাকরি ভাল চলছে?

চাকরি ভাল চলছে না আন্টি।

কেন?

আন্টি আমাদের কোম্পানিতে একজন নতুন ডিরেক্টর জয়েন করেছেন, নাম কনক, স্যারের নাকি ছেলে। এম.ডি স্যার আর আমাদের চেয়ারম্যান স্যার নিজেই পরিচয় করে দিয়েছেন। আপনি চেনেন না কি?

হ্যাঁ চিনি তো, বলে রেবেকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কেন? কি হয়েছে?

ঐ কনক সাহেবই তো আমার চাকরির বারটা বাজিয়েছে।

রেবেকার মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এই তো সুযোগ রাহাতকে দিয়ে যদি কনকের পরিচয়টা ফাঁস করা যায় তাতে কনকের প্রেমিকা তার প্রেমকে হয়তবা প্রত্যাখান করবে। কনককে সেই মেয়ের ভালবাসার পিছনে যে শুধু কনকের বুদ্ধিমত্তা কাজ করছে তা নয় রেজা সাহেবের পরিচয় এবং আভিজাত্যও কাজ করছে। আর রেজা সাহেবের পোষ্য পুত্র একথা জানার পর মেয়েটা কনককে ভালবাসলেও মেয়ের গার্জিয়ান কখনো এই বিয়ে মেনে নিবে না। অপরদিকে সবাই যখন জানবে কাকলী কনকের জন্মদাত্রী মা নয় তখন কাকলীর মাতৃত্বের সমস্ত অহংকারও ভূলুন্ঠিত হবে। কিন্তু রেবেকা নিজেও জানেন না কে কনকের আসল বাবা-মা, শুধু জানেন কনক রেজা সাহেবের গ্রামের কোন এক লোকের সন্তান। কাকলী তাঁকে প্রকৃত পরিচয় দেয়নি। তবে রাহাতকে একবার রেজা সাহেবের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে কনকের বাবা-মা’র আসল পরিচয় বের হতে পারে। রেবেকার চোখে-মুখে একটা আলোর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল।

রেবেকা রাহাত সাহবকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কি করতে চাও?

আন্টি আমি এই কোম্পানিতে অনেকদিন থেকে চাকরি করছি কিন্তু কোনদিন তো শুনিনি স্যারের কোন ছেলে-মেয়ে আছে হঠাৎ করে স্যারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করলেন। আমার মনে হয় কনক সাহেব রেজা সাহেবের ছেলে না।

রেবেকা একটু রাহাত সাহেবের পরিকল্পনার কথা জানার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, কনক যদি রেজা সাহেবের ছেলে না হয়েও থাকে তাতে তোমার লাভ কি?

আন্টি এই ধরুন যদি সত্যি সত্যি কনক সাহেব রেজা সাহেবের ছেলে না হয়ে থাকেন তবে এ পরিচয় জানার পর কনক সাহেব আমাদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করার সাহস হারিয়ে ফেলবেন। লজ্জায় এবং ক্ষোভে তিনি চাকরি ছেড়ে চলেও যেতে পারেন। তাছাড়া রেজা সাহেব নিজেও আত্মমর্যাদাবান মানুষ এ পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবার পর তিনিও কনক সাহেবকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তখন আমি আবার আগের মতো বহাল তবিয়তে চাকরি করতে পারব।

রাহাত সাহেবের কথাবার্তায় রেবেকা খুব খুশি হলেন। তিনি তো এমনই চেয়েছিলেন, তিনি রাহাত সাহেবকে বললেন, তবে মনোযোগ দিয়ে শোন।

জি আন্টি বলুন।

সবকিছু খুব ঠান্ডা মাথায় করতে হবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার আগে কখনো যেন কিছু ফাঁস না হয়।

হবে না আন্টি।

আমার নাম কারো কাছে বলতে পারবে না, কারণ আমি এই তথ্য কোনদিন ফাঁস করব না কাকলীর কাছে এমন প্রোমিজ করেছি। তুমি যদি আবার আমার নাম বলে ফেল তবে আমি খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ব।

আপনি বলুন আন্টি আমি কাউকে আপনার নাম বলব না।

কনক রেজা সাহেবের ছেলে না।

রাহাত সাহেব যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, আপনি কি ঠিক বলছেন আন্টি?

তোমাকে আমি মিথ্যা কথা বলব কেন?

তবে কনক সাহেব কার ছেলে?

সেকথা আমি জানি না। তবে একথা জানতে চাইলে তোমাকে একবার লালমনিরহাট যেতে হবে। কাকলী আমাকে বলেছিল ওদের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। তোমার আগে জানা দরকার কনকের আসল বাপ-মা কারা?

জি আন্টি আমি প্রয়োজনবোধে লালমনিরহাট যাব। কনক সাহেবের আসল পরিচয় খুঁজে বের করব। তারপর জনসমক্ষে তা জানিয়ে দিয়ে কনক সাহেবকে সমাজের কাছে, স্টাফদের কাছে এমনভাবে ডুবাবো যে কনক সাহেব আর একদিনও অফিস আসতে চাইবেন না, রেজা সাহেবও আর মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবেন না।

তাহলে তুমি সোজা লালমনিরহাট চলে যাও। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায়। আমি একবার গিয়েছিলাম সেখানে কাকলীর এক দেবর আছে ওর নাম আমিনুল। আমিনুল সবকিছু জানতে পারে। তুমি আমিনুলের সঙ্গে কৌশলে কথাবার্তা বলে সবকিছু জানতে পারবে।

কলিং বেল বেজে উঠল। বুয়া বাসার দরজা খুলে দিল। মেঘলা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বাসার ভিতরে ঢুকলো। মায়ের প্রতি আজ তার ঘৃণায় মন ভরে গেল। যে মা দু’দিন আগেও তার মেয়েকে কনকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেই মা আজ প্রতিশোধের নেশায় দু’টি সাজানো সংসারে অভিশাপ ডেকে আনার জন্য আদা নুন খেয়ে লেগেছে। মেঘলা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার স্বরে বলল, ছিঃ মা, ছিঃ তুমি এত খারাপ, নিজের স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পার। আমি তোমাকে এমন কাজ করতে দিব না মা।

রেবেকা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, কি আমাকে করতে দিবি না?

আমি দরজার আড়াল থেকে সব শুনেছি মা। তুমি তোমার মেয়ের মতোই আরেকজন মেয়ের পবিত্র ভালবাসা এভাবে ভেঙ্গে দিওনা, স্বার্থের জন্য নিজের খালাত বোন এবং এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করিও না, দু’টি সংসারের শান্তি ভেঙ্গে দিও না। রাহাত ভাই আপনি যান প্লিজ আর কোনদিন এমন ঘৃণ্য কাজ নিয়ে মা’র সঙ্গে কুপরামর্শ করতে আসবেন না, প্লিজ।

রাহাত সাহেব সালাম দিয়ে চলে গেলেন, আন্টি আমি আসি ফোনে কথা হবে।

রাহাত সাহেব চলে গেলেন। মেঘলা সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

 

সাতাশ

হরলালকে রেজা সাহেবের কাছে দিয়ে আসার পর থেকে তাকে ভুলে যাবার জন্য ঝুমলাল অনেক চেষ্টা করেছে, ঝরনাকেও হরলালকে ভুলে যাবার জন্য বলেছে কিন্তু বাবা-মা’র মন থেকে সন্তানের স্মৃতিচিহ্ন মুছে যাবার মতো নয়। ঝুমলাল প্রায়ই রাতে হরলালকে স্বপ্নে দেখত, ঘুমের মাঝে হরলাল, হরলাল বলে চিৎকার করে ডাকত তারপর বড় ছেলে মোহন লালের মুখের দিকে তাকিয়ে হরলালকে ভুলে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। হরলালকে রেজা সাহেবের কাছে দিয়ে আসার অনেক বছর হল, কিন্তু হরলালের শেষমুহূর্তের বাবা ডাকটা আজও ঝুমলালের কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে আছে। হরলাল কেমন আছে? তার নামই বা রেজা সাহেব কি রেখেছেন? এতদিন হয়ত অনেক বড় অফিসার হয়েছে, তার কপাল থেকে সুইপারের কলংক মুছে গেছে। হয়ত রেজা সাহেবের মতো ভদ্র লোকের ছেলে হয়ে সমাজের উঁচু তলার মানুষের ভীড়ে মিশে গেছে। ঝুমলালের অনেকবার মনে হয়েছে একবার ঢাকা গিয়ে হরলালকে দূর থেকে দেখে আসবে শুধু রেজা সাহেব আর তার স্ত্রী জানবে হরলাল নিজেও জানবে না যে সে হতভাগা সুইপার ঝুমলালের ছেলে কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে রেজা সাহেবকে সে কথা দিয়েছে কোনদিন হরলালের দাবি নিয়ে তাঁর কাছে যাবে না। ঝুমলাল সুইপার হতে পারে কিন্তু অকৃতজ্ঞ নয়, প্রতারক নয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী নয়। সে কোনদিন যাবে না। তাই এতদিন ঝুমলাল হরলালের কথা মনে হলে মোহন লালের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন হরলালের স্মৃতি হৃদয় থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।

কয়েকদিন আগে ঝুমলালের বড় ছেলে মোহন লাল অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মোহন লাল মারা যাওয়ার আগে ঝুমলাল তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু হাসপাতালে সিট না পেয়ে কয়েকদিন মেঝেতে পড়ে থাকতে থাকতে একদিন বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। ঝুমলালের বদ্ধমুল ধারণা মোহন লাল সুইপারের ছেলে না হয়ে কোন ধনী মানুষের ছেলে হলে ঢাকা শহরে নিয়ে গিয়ে তাকে ভাল ক্লিনিকে চিকিৎসা করলে হয়ত মোহন লাল মরতো না।

মোহন লাল মারা যাওয়ার পর ঝুমলালের যেন মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে সে সব সময় হরলালয়া আর মোহনলালয়া বলে চিৎকার করে কাঁদছে। দিনের বেশির ভাগ সময় শ্মসানে গিয়ে বসে বসে কাঁদে অন্যমনস্কভাবে রাস্তা দিয়ে কোন অপরিচিত ভদ্র লোক যেতে দেখলেই জিজ্ঞেস করে, তোহারা কি ঢাকা থেকে আইলবানি? তোহারা কি হামার হরলালয়াকে দেখকে লিবানি? যব বহুত বড় সাব ভইলবানি, হামার হরলাল মেথর ক্যা লাইকা না, ওখর সাব ক্যা লাইকা যব বহুত বড় বনগিয়া, বহুত বড় হগিয়া (আপনি কি ঢাকা থেকে এসেছেন? আপনি কি আমার হরলালকে দেখেছেন? এতদিন অনেক বড় হয়েছে, হরলাল কোন সুইপারের ছেলে না, সে ভদ্র লোকের ছেলে এতদিনে অনেক বড় অফিসার হয়েছে, অনেক বড় সাহেব হয়েছে)।

অনেকেই ঝুমলালকে পাগল মনে করে এড়িয়ে যায়, অনেকের কাছে ঝুমলাল কিছু জানতে চায় কিন্তু কেউ কোন সদুত্তর দিতে পারে না। যারা ঝুমলালকে সুইপার বলে জানে তারা নাকে হাত দিয়ে চলে যায় তখন ঝুমলালের মন খারাপ হয়ে যায়। সেদিন বিকেলবেলা ঝুমলাল মদ খেয়ে আদিতমারী হাটে এলোমেলোভাবে কথাবার্তা বলছিল, তাকে ঘিরে অনেক লোকজন জড় হয়েছিল কেউবা ঝুমলালকে নিয়ে তামাশা করছিল, কেউবা মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছিল আর ঝুমলাল মদের নেশায় আরো বেশি পাগলামি করছিল।

রাহাত সাহেব আদিতমারী নেমে একজন লোককে আমিনুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ঐ যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ওর নাম আমিনুল।

রাহাত সাহেব এগিয়ে গিয়ে আমিনুলকে সালাম দিলেন, ভাইজান আপনার নাম কি আমিনুল?

জি আপনি?

আমার নাম রাহাত আমি ঢাকা থেকে এসেছি, রেজা সাহেব কি আপনার ভাই?

জি আপনি রেজা ভাইকে চিনেন? কতদিন থেকে ভাইজানকে খুঁজছি, সেই-ই যে জমিজমা বিক্রি করে গেলেন আর ফিরে এলেন না। আমি কত মোবাইল করেছি আর কোনদিন যোগাযোগ করতে পারিনি।

আমি আপনার ভাইয়ের কোম্পানিতে চাকরি করি, লালমনিরহাট আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম, আমি লালমনিরহাট আসব জেনে স্যার কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, রাহাত লালমনিরহাট যখন যাচ্ছ তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেও, ওখানে আমিনুল আছে ওর সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। কি ভাগ্য আমার আপনাকে বেশি খুঁজতে হলো না।

রাহাত ভাই চলুন বাসায় বসবেন।

জি চলুন।

রাহাত সাহেব কিছুক্ষণ আমিনুলের বাসায় বসলেন। কথায় কথায় আমিনুলকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার কতদিন থেকে গ্রামে আসেন না?

তা পনের বছরের কম না।

স্যার বললেন, রাহাত ইচ্ছ করে তোমার ভাবী আর কনককে নিয়ে একবার গ্রামে গিয়ে বেড়িয়ে আসি কিন্তু সময় করতে পারি না।

কনক কে?

আপনি জানেন না বুঝি, স্যার একটা ছেলে পোষ্য হিসেবে নিয়েছেন, ছেলেটার নাম কনক।

না তো আমি এ বিষয়ে জানি না।

রাহাত সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন, কিছুটা নিরাশও হলেন। আমিনুল তাহলে কোন কিছু বলতে পারবে না। তারমানে খাটনি আরো বেড়ে গেল।

আমিনুল সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ, সে যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারে না। পৈত্রিক সূত্রে সে যে জমি ভাগ পেয়েছে তা চাষাবাদ করে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তার চেহারার মধ্যে সরলতার ছাপ আছে। সে রাহাত সাহেবকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, ভাইজান কি কিছু ভাবছেন?

ভাবছি স্যারের সবগুলো কাজ আর করে যেতে পারলাম না।

আর কি কাজ ছিল ভাইজান? আমাকে বলেন আমি আপনাকে হেল্প করব।

স্যার বলছিলেন যাচ্ছ যখন কনকের বাবা-মা’র একবার খবর নিয়ে এসো। কোথায় যেন বাড়ি? আর কি যে নাম সব তো ভুলে গেছি, বলুন তো কি করি এখন?

কিচ্ছু মনে করতে পারছেন না। কনকের বাবার নাম কি? বাড়ি কোথায়?

শুধু শুনেছি গ্রাম থেকে নিয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম আপনি সবকিছু জানেন।

না তো ভাইজান।

আচ্ছা আমিনুল ভাই আপনি কি বলতে পারবেন, আপনার এলাকার কেউ কি ছেলেকে পোষ্য দিয়েছে?

তা জানি না তবে ঢাকা গিয়ে একজন সুইপারের ছেলে হারিয়ে গেছে কিন্তু তা হবে কেন? ভাইজান ছেলে পোষ্য নিতে চাইলে তো অনেক ছেলে পেতেন তিনি সুইপারের ছেলেকে নিবেন কেন?

রাহাত সাহেবের মন আনন্দে নেচে উঠলেন। তাঁর চোখে-মুখে একটা আলোর আভা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আচ্ছা আমিনুল ভাই আপনি কি আমাকে সেই সুইপারের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?

জি ভাইজান, আপনি অনেকদূর থেকে এসেছেন আগে বসুন, নাস্তা খান তারপর আপনাকে আমি নিয়ে যাব।

আমিনুল রাহাত সাহেবকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করল। তাঁর কাছে রেজা সাহেবের মোবাইল নাম্বার নিল, তারপর রাহাত সাহেবকে ঝুমলালের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। কিন্তু ঝুমলালের বাসা পর্যন্ত যেতে হলো না, কিছুদূর যেতেই ঝুমলালের উচ্চস্বরে চেঁচামেচি দেখে রাহাত সাহেব এগিয়ে গেলেন। ঝুমলাল তখন আপন মনে বলে চলেছে, হামনিকুল মেথর হনিযা ওহি খাতিন হামনিকুলকে দাম নেইখে, হামনিকুল হোটেল মে বইঠে নাসখিনাযা, সবকই হামনিকুলকে দেখকে ঘৃণা লাসন না হলে সে ক্যা হাম আপনা হাতসে হরলালয়াকে রেজা ভাইয়াকে হাত ম্যা উঠা দেতি (আমরা সুইপার তাই বলে কি মানুষ নই? আমরা হোটেলের সিটে বসতে পারি না, সবাই আমাদের দেখে নাক সিটকায় নইলে কি আমি হরলালকে নিজ হাতে রেজা সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে আসি)?

রাহাত সাহেব ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলেন। ঝুমলাল অপরিচিত লোককে দেখে জিজ্ঞেস করল, তু ক্যা ঢাকা সে আইলবারো? তু ক্যা হামার হরলালয়াকে দেখলে বারো? হামতো হরলালয়াকে রেজা ভাইয়া ক্যা হাত ম্যা উঠাকে দে আইলবানি (আপনি কি ঢাকা থেকে এসেছেন? আপনি কি আমার হরলালকে দেখেছেন? আমি তো হরলালকে রেজা সাহেবের তাতে তুলে দিয়ে এলাম)।

যেন মেঘ না চাইতেই জল। রাহাত সাহেব বললেন, রেজা সাহেবকে তো আমি চিনি, তুমি কি তোমার ছেলেকে তাঁর হাতে দিয়ে এসেছ?

হঁ হাম আপনা হাতসে রেজা ভাইয়াকে হাত ম্যা হামার লাইকাকে উঠা দেআইলবানি, রেজা ভাইয়া বহুত নিমন আদমি হামরাকে বললাহন ঝুমলাল তোহার লাইকাকে হাম আদমি ক্যা নিহন আদমি বানায়েম। ল্যাকিন এগো বাত তু কোনদিন লাইকাকে দাবি লেকে না আইবে। হাম ওখরাকে হামার পরিচয়সে আদমি বানায়েম, হাম রেজা ভাইয়াকে বাত বাখলেবানি কেহুকে কিছু নাইখে বলনি খালি দারু পিলেসে কব যে কা বলেনি হাম আপনে না জানি না। স্যার তু জানেল হামার লাইকা কেতনা বড় ভইলবা? রেজা ভাইয়া হামার লাইকাকে আদমি নিহন আদমি বানাওতা (জি আমি তো নিজ হাতে আমার ছেলেকে রেজা সাহেবের হাতে দিয়ে এলাম। রেজা সাহেব খুব ভাল মানুষ, আমাকে বলল, ঝুমলাল তোমার ছেলেকে আমি মানুষের মতো মানুষ করে তুলব। তবে একটা শর্ত তুমি কোনদিন ছেলের দাবি নিয়ে আসতে পারবে না। কোনদিন কাউকে কিছু বলতে পারবে না। আমি ওকে আমার পরিচয়ে মানুষ করব। আমিও রেজা সাহেবের কথা রেখেছি কাউকে কিছু বলিনি শুধু মদ খেলে কখন যে কি বলি তা নিজেই জানি না। আপনি জানেন নাকি স্যার আমার ছেলে কত বড় হয়েছে? রেজা সাহেব কি ওকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছে)?

রাহাত সাহেব ঝুমলালের কথা পুরোপুরি বুঝতে পারলেন না, তবে তার কথার অর্থ অনুমান করতে পারলেন, স্যার তোমার কথা রেখেছেন, তোমার ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বড় অফিসার হয়েছে, তুমি কি তোমার ছেলেকে দেখতে যাবে?

হঁ জায়েম তু ক্যা হামরাকে লে যাইবা? (জি যাব আপনি কি আমাকে নিয়ে যাবেন)?

রাহাত সাহেবের মনে যেন আনন্দ ধরে না, তিনি ভাবতেই পারেননি এত সহজে কনক সাহেবের জন্মসূত্র বের করতে পারবেন। তিনি মনে মনে বললেন, আমার সন্দেহই অবশেষে ঠিক হলো। শালা সুইপারের বাচ্চা আমার উপর মাতব্বরি করিস্‌, এম.ডি স্যার তোকে যতই ছেলের পরিচয় দিক যখন সবাই জানবে তুই একটা সুইপারের বাচ্চা তখন কেউ তোর কথা শুনবে না। তোকে দেখলে নাক ছিটকাবে, ছিঃ ছিঃ সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এর ডিরেক্টর একজন সুইপারের ছেলে। কালই সারা রাষ্ট্রময় হয়ে যাবে তখন সুইপারের বাচ্চা তুই যাবি কোথায়?

ঝুমলাল আবার জিজ্ঞেস করল, তু ক্যা হামরাকে সচ সচ লে যাইবা স্যার (আপনি কি আমাকে সত্যি সত্যি নিয়ে যাবেন স্যার)?

অবশ্যই নিয়ে যাব।

 

আঠাশ

রাহাত সাহেব এমন একটা আনন্দের সংবাদ যেন মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারলেন না। ঝুমলালকে বাসায় প্রস’তি নেওয়ার কথা বলে রেবেকাকে মোবাইল করলেন, আন্টি অপারেশন সাক্‌সেসফুল।

বল, তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে?

আন্টি কনক সাহেব একটা সুইপারের বাচ্চা। আদিতমারীহাটে কনক সাহেবের বাবা এখনো ঝাড়- দেয়। কনক সাহেবের আগে নাম ছিল হরলাল। আমি কনক সাহেবের বাবা ঝুমলালকে নিয়ে ঢাকায় আসছি।

রাহাত তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব? একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ হলো। কনক সাহেবের উপর তোমার প্রতিশোধ নেয়া হল, কাকলীর মাতৃত্বের অহংকার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এতদিন যাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিল সে তার নিজের ছেলে নয় এই পরিচয় যখন ফাঁস হয়ে যাবে তখন কোন্‌ লোক কনকের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়? দেখা যাবে। কনকের কারণে সে আমাকে অপমান করেছে, আমার মেয়েকে অপমান করেছে। কাকলী এখন সবাই তোকে ঘৃণা করবে, কনককে দেখে সবাই নাক ছিটকাবে। রাহাত তুমি সবকিছু তোমার প্লান মতো কর। কোনকিছু যেন এলোমেলো করে ফেল না।

না আন্টি আপনি আমার ওপর ভরসা রাখবেন।

রাহাত সাহেব সারাটা রাস্তায় ঝুমলালকে দিয়ে কিভাবে কনকের পিতৃ পরিচয় উম্মোচন করে কনককে হেয় প্রতিপন্ন করবে? কিভাবে কোম্পানিতে কনকের অবস্থান দুর্বল করবে? সে বিষয়ে একটা নীলনক্সা করলেন কিন্তু কনককে হেয় প্রতিপন্ন করার অর্থ যে রেজা সাহেবকেসহ সমস্ত কোম্পানিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা একথা রাহাত সাহেব একবারও ভাবলেন না। তিনি প্রতিহিংসায় অন্ধ হয়ে গেলেন। তিনি সারাটা রাস্তায় ঝুমলালকে সবকিছু শিখিয়ে দিলেন। ঝুমলাল অশিক্ষিত মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি সীমিত সে শুধু একবার তার হারিয়ে যাওয়া হরলালকে দেখতে চায়। কথা বলার সুযোগ হলে বলবে নয়তো দূর থেকে দেখেই বিদায় নিবে। রাহাত সাহেব ঝুমলালকে বললেন, এতদূর থেকে এসেছ একবার ছেলের সঙ্গে কথা বলবে, রেজা সাহেবের সঙ্গে কথা বলবে, তারপর যাবে, তাতে রেজা সাহেব খুব খুশি হবেন।

ঝুমলাল রাহাত সাহেবের দূরভিসন্ধি বুঝতে না পেরে তাঁর কথায় সায় দিল এবং রাহাত সাহেবের কথা মতো কনক অফিসে ঢুকবার পর পরই অফিসে ঢুকলো। ঝুমলালের বেশ-ভূষা দেখে লাবন্য জিজ্ঞেস করল, কার কাছে যাবেন?

রেজা সাব কিহেঁ, কনক সাব কিহেঁ (রেজা সাহেবের কাছে, কনক সাহেবের কাছে)।

কোথা থেকে এসেছেন?

লালমনিরহাটসে (লালমনিরহাট থেকে)।

রিসিপশনিস্ট লাবন্য অনেকদিন থেকে কোম্পানিতে চাকরি করছে সে রেজা সাহেবের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে একথাও জানে তাই সে আর কিছু না বলে হাত দিয়ে কনক এবং রেজা সাহেবের চেম্বার দেখিয়ে দিল।

ঝুমলাল প্রথমে কনকের চেম্বারে ঢুকবার চেষ্টা করল কিন্তু পিয়ন গেটে বাধা দিল। ঝুমলাল জোরে চেঁচিয়ে বলল, হাম লালমনিরহাটসে আইলবানি, তোহার সাবসে দেখা করেম (আমি লালমনিরহাট থেকে এসেছি তোমার স্যারের সঙ্গে দেখা করব)।

পিয়ন বলল, স্যারের পারমিশন নেই।

কনক ঝুমলালের সঙ্গে পিয়নের কথোপকথন শুনে কলিং বেল টিপ দিতেই পিয়ন ভিতরে গেল। কনক পিয়নকে জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে? কার সঙ্গে দেখা করতে চায়?

স্যার বলল নাম ঝুমলাল, লালমনিরহাট থেকে এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

পাঠিয়ে দাও।

ঝুমলাল কনকের চেম্বারে ঢুকে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ল। সে রুমে ঢুকেই রাহাত সাহেবের শিখিয়ে দেয়া পরামর্শ মতো বলল, বাবা হরলালয়া (বাবা হরলাল)।

কনক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সে আশ্চর্যন্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে আপনার হরলাল? আপনি কার কাছে এসেছেন?

তু হামার হরলালয়া, তোহার কপাল ক্যা ফাটল দাগ দেখকে হাম চিনলেবানি তু হামার হরলালয়া হরে, ছোট কাল ম্যা তোহার বড়ভাই প্লেট ফেককে মারলে রহল তব তোর কপাল কাট গইল রহল, উহে ফাটল দাগ দেখকে হাম চিনলেবানি তু হামার হরলালয়া হরে (তুমি আমার হরলাল বাবা আমি তোমার কপালে কাটা দাগ দেখে বুঝতে পেরেছি তুমি আমার হরলাল, ছোটবেলা তোমার বড়ভাই মোহন লাল তোমার দিকে রাগ করে প্লেট ছুঁড়ে মেরেছিল সেই কাটা দাগটা দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি বাবা তুমি আমার হরলাল), বলতে বলতে ঝুমলাল মেঝেতে বসে পড়ল।

নিচে বসেছেন কেন? চেয়ারে বসুন, আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমার বাবার নাম রেজাউল ইসলাম, তিনি এই কোম্পানির এম.ডি।

হাম তোহাকে খবরকে লে নাইখা আইনি। হাম তোকে দেখে আইলবানি তু কইসন বারে? হামনিকুল মেথর জাত সমাজ ম্যা হামনিকুল ক্যা দাম নেইখে, হামনিকুল নায্য অধিকারসে বরাবরে বঞ্চিত হনি যা। হামনি কুলকে দেখকে আদমি ঘৃণা করেলসন ওহি খাতিন তোর বয়স যব চার কি পাঁচ রহল তব হাম তোরাকে রেজা সাবকে দে গইলবানি উনখর পরিচয়সে তোহাকে আদমি বানায়ে খাতিন। তু একবার খেয়াল করকে দেখ। রহেদে বাবা তোরাকে মনে করেকে না পড়ি। তু বহুত বড় ভইলবারে ইহে হামার শান্তি হাম অব কুচ নেইকে জানে চাহতানি। হাম অব জাতানি বাবা (আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে আসিনি বাবা। আমি শুধু দেখতে এসেছি তুমি কেমন আছ? আমি সুইপার জাত সমাজে আমাদের কোন স’ান নেই, আমরা আমাদের নায্য অধিকার থেকে বরাবরই বঞ্চিত। আমাদের দেখে সবাই নাক ঘৃণা করে তাই তোমার বয়স যখন চার বছর কিংবা পাঁচ বছর তখন আমি তোমাকে রেজা সাহেবের কাছে দিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর পরিচয়ে তোমাকে মানুষ করার জন্য তুমি একবার খেয়াল করে দেখ। থাক বাবা থাক আর মনে করতে হবে না। তুমি অনেক বড় হয়েছে এটাই আমার সান্ত্বনা আর আমি কিছু জানতে চাচ্ছি না। আমি এখন চলে যাব বাবা)।

কনক ঝুমলালের কথা পুরোপুরি বুঝতে পারল না তবে কিছুটা অনুমান করতে পারল। তাতেই কনকের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার মনের মধ্যে অষ্পষ্ট একটা স্বপ্নের স্মৃতি ভেসে উঠল। সে এক সময় গ্রামে বাস করত একটা কাঁচা ঘরে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ বাস করত। কোনদিন তিনবার ভাল খাবার জুটতো না, তার সমবয়সী কয়েকজন ছেলে-মেয়ে ছিল। তারপর একদিন একটা লোকের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিল সেই লোকটি তাকে ঢাকায় রেখে চলে গিয়েছিল। তবে, তবে কি এই বৃদ্ধের কথাই ঠিক? আমি কি তাহলে সুইপারের ছেলে? না, না কনক আর ভাবতে পারছে না। আবার এর একটা সঠিক সমাধান না হলেও হচ্ছে না। কনকের মাথার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো চিন্তা ভীড় করল, এখন কি করবে সে? সে কয়েকমুহূর্ত ঝুমলালের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চেহারার মধ্যে সরলতার ছাপ আছে গ্রামের একেবারে সহজ-সরল মানুষ সাধারণত এরা চালাকি করে না, কারো সঙ্গে চাতুরতা করে না, হতে পারে রক্তের টানে সে এতদিন পর তাকে খুঁজে বের করতে এসেছে। কোন লোভ বা মোহর বশবর্তী হয়ে নয়, নিখাদ ভালবাসার টানে, গ্রাম-গঞ্জের এসব মানুষের ভালবাসার মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নেই। শহরের শিক্ষিত, ভদ্র, মুখোশপরা মানুষের মতো এদের মধ্যে সুকৌশলে সুবিধা আদায়ের ধান্দা নেই। কনক ভালভাবে লক্ষ্য করল অনেকদিন আগে যে লোক তাকে রেখে গিয়েছিল তার সঙ্গে এই লোকটার চেহারার হুবহু মিল আছে শুধু বয়সের কারণে কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, চুলে পাক ধরেছে। কনক ইন্টারকমে রেজা সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করল, বাবা তুমি কি আমাকে একটু সময় দিতে পার?

চলে আয়।

কনক রেজা সাহেবের চেম্বারে ঢুকলো তার চেহারা দেখে রেজা সাহেব অবাক হয়ে গেলেন, কি হয়েছে বাবা? তোর এই চেহারা যেন তোর ওপর দিয়ে এক্ষুণি ঝড় বয়ে গেল।

জি বাবা।

রেজা সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তিনি শুষ্ক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?

বাবা লালমনিরহাট থেকে ঝুমলাল এসেছে।

রেজা সাহেব কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন, কোন্‌ ঝুমলাল?

বাবা তুমি ঝুমলালকে চেনো?

রেজা সাহেব আর কোন কথা বললেন না। মাথা নত করে বসে রইলেন।

কনক জিজ্ঞেস করল, বাবা ঝুমলাল যা বলছে তা কি সত্যি?

তুই একটু বস্‌, আমি ঝুমলালের সঙ্গে কথা বলি।

বলতে পার তবে সেটা আমার সামনে।

ঠিক আছে বলে রেজা সাহেব কলিং বেল-এ টিপ দিতেই পিয়ন চলে এলো। রেজা সাহেব বললেন, কনকের চেম্বারে একজন লোক বসে আছে আসতে বল তো।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুমলাল রেজা সাহেবের চেম্বারে ঢুকে সালাম দিল।

রেজা সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, ঝুমলাল তোমার সঙ্গে আমার কি কথা ছিল?

হাম তো খাতিল দেখে আইলবানি, হাম কেহুকে কুচ নাইখে বল্‌নি (আমি তো শুধু দেখতে এসেছি ভাইজান, আমি তো কাউকে কিছু বলিনি)।

তোমাকে এই অফিসের ঠিকানা কে দিয়েছে?

ইহে অফিসক্যা এক সাব গইলে রহলন, হামক্যা বললং তোহার লাইকা বহুত বড় ভইলবা দেখ্‌খে যাইবে (এই অফিসের এক সাব গেছিলেন, আমাকে বললেন, তোমার ছেলে অনেক বড় হয়েছে দেখতে যাবে)?

হাম বলনি ঠিক বা খালি দেখিয়ে কে চলিয়াম। উ বললহন, তোহার লাইকাকে একবার দেখকে রেজা সাবকে দেখিয়াও, সাব তোকে দেখিয়ন তো খুশি হইয়ন (আমি বললাম ঠিক আছে আমি শুধু দেখেই চলে আসব। তিনি বললেন, একবার তোমার ছেলে আর রেজা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যাও, স্যার তোমাকে দেখলে খুশি হবেন)।

তুমি দেখিয়ে দিতে পারবে যে সাহেবের সঙ্গে তুমি এসেছ?

হঁ পারেম (জি পারব)।

রেজা সাহেব কলিং বেল টিপে পিয়নকে ডেকে বলল, একে নিয়ে যাও, গোটা অফিস দেখিয়ে নিয়ে এসো, ও যাকে দেখিয়ে দিবে তাকে আমার সালাম দিবে।

জি স্যার।

ঝুমলাল পিয়নের সঙ্গে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো সঙ্গে রাহাত সাহেবসহ।

রেজা সাহেব গম্ভীর এবং ভয়ংকর কন্ঠে রাহাত সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, রাহাত সাহেব আপনি ঝুমলালকে চিনেন?

রাহাত সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি এর পরিনতি বুঝতে পেরে আতংকিত হয়ে পড়লেন। তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, জি স্যার।

আপনি এখন আসুন।

রাহাত সাহেব চলে গেলেন। রেজা সাহেব ঝুমলালকে বললেন, ঝুমলাল তুমি কাউকে কিছু বলনি কিন্তু তারপরও আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।

হাম চল যায়েম ভাইয়া, অব্‌বে চল যায়েম তু হামরা খাতিন বহুত কইলেবারো, তু হামার বাত রাখলেবারো হাম তোহার বাত রাখলেম। হাম অভিয়ে চল যায়েম (আমি চলে যাব ভাইজান, এখনি চলে যাব আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, আপনি আমার কথা রেখেছেন আমিও আপনার কথা রাখব। আমি এখনি চলে যাব)।

কনক বলল, বাবা আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে?

বাবা এটা অফিস তোর সঙ্গে যা কথা বলার তোর মা’সহ বাসায় বলব, বলে পিয়নকে দিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে পাঠালেন। ড্রাইভার এলে রেজা সাহেব ঝুমলালের হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, যাও তো একে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে লালমনিরহাটের কোচে তুলে দিয়ে এসো।

জি স্যার, বলে ড্রাইভার চলে গেল।

ঝুমলালও সালাম দিয়ে কনকের দিকে কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রেজা সাহেব কোন কিছু না বলে নীরবে বসে রইলেন। তিনি ঘামতে লাগলেন, তাঁর হৃৎপিন্ড দ্রুত গতিতে চলতে লাগল। কনক রেজা সাহেবের মনের অবস’া বুঝতে পারল। সে রেজা সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, বাবা তুমি এমন করছ কেন? তোমার কি অস্বসি’ লাগছে?

বাবা তুই আমাকে একটা ট্যাক্সি ক্যাব ডেকে দে তো আমি বাসায় যাব।

একটু অফিসে বস বাবা, এ.সি’টা বাড়িয়ে দেই। গাড়িটা গাবতলী থেকে ফিরে আসুক তারপর যাও।

রেজা সাহেব আর কোন আপত্তি করলেন না। ঠিক আছে বাবা তুই কাজ কর্‌ গাড়ি এলে আমি চলে যাব আর অফিসের কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসিস্‌।

জি বাবা।

 

ঊনত্রিশ

রেজা সাহেব কনককে নিজের ছেলের মতো করেই লালন-পালন করেছেন। আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশীদের কাছে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছেন। ঝুমলাল যেন কোনদিন ঠিকানা খুঁজে না পায় সেজন্য বাসা চেঞ্জ করেছেন, তার মোবাইল সিম পর্যন্ত চেঞ্জ করেছেন, গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য পৈত্রিক ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। কনককেও কোনদিন বুঝতে দেননি তিনি তার অন্য কেউ অথচ আজ থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। কনক জানতে পারল রেজা সাহেব তার বাবা নয়। শৈশব থেকে যাকে বাবা-মা বলে জেনেছে তার পরিচয় আজ মিথ্যা পরিণত হলো।

রেজা সাহেবকে অসময়ে বাসায় ঢুকতে দেখে কাকলী কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি রেজা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে তাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন। রেজা সাহেব বেড রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কাকলী রেজা সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি হয়েছে?

কাকলী শক্ত হয়ে বিছানায় বস তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।

কাকলীর মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি শুষ্ক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, বল কি হয়েছে?

আজ ঝুমলাল অফিসে এসেছিল।

কাকলী আঁতকে উঠলেন, তুমি কি বলছ?

হ্যাঁ কাকলী, কপাল খারাপ আসবি তো আয় একেবারে সোজা কনকের রুমে ঢুকেছে।

তারপর।

তারপর কনক সবকিছু শুনে আমার কাছে এসেছে, সে অনেকটা সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেছিল আমি বললাম, এটা অফিস রাতে বাসায় তোর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হবে বলে আমি কোন রকমে বাসায় চলে এসেছি।

কনক কি বুঝতে পেরেছে?

পেরেছে, সে যে আমাদের সন্তান না এটা সে কনফার্ম হয়েছে।

কাকলী আর কিছু বলতে পারলেন না, তাঁর গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। তাঁর ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল, প্রতিবেশীদের কাছে, বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে যাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছেন। তার সমস্ত কিছু যেন আজ হারাতে বসেছেন, তিনি যেন রাজরাণী থেকে পথের ফকির হতে বসেছেন। তাঁর এই যে ধন-সম্পদ, আভিজাত্য, বংশের ধারাবাহিকতা, যাকে দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন তাকে হারাবার ভয়ে তিনি যেন মুষড়ে পড়লেন। কনক তাকে ছেড়ে চলে যাবে, সে অন্যের হয়ে যাবে কিংবা এ নিয়ে কোন বিব্রতকর অবস’ার সৃষ্টি হবে কাকলী সেটা কোনদিন ভাবতেও পারেন নি। অথচ আজ রেজা সহেবের কাছ থেকে সবকিছু শুনে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বার বার তাঁর একটা কথাই মনে হলো এতদিন যাকে আদর যত্ন দিয়ে, মাতৃ্লেহ দিয়ে লালন-পালন করলাম তার উপর কি আমাদের কোন অধিকার বলতে কিছু নেই? সব অধিকার কি জন্মদাতার? হ্যাঁ আসলে তাই, আইনেই হোক আর সামাজিকতাই হোক রক্তের সম্পর্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অধিকার কেউ ছিন্ন করতে পারবে না। ঝুমলালের ক্ষেত্রেও তাই, ঝুমলালের সঙ্গে কনকের সম্পর্ক রক্তের, আর আমাদের সঙ্গে কনকের সম্পর্ক আত্মার। সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্রে আত্মার সম্পর্ক মূল্যহীন। কাকলী কান্নাভাঙ্গা গলায় বললেন, ঝুমলাল কি কনককে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল?

না তা চায়নি সে শুধু কনককে একবার দেখতে এসেছিল আমি তাকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বিদায় করে দিয়েছি।

এখন কনককে কি জবাব দিবে?

কনককে আমাদের কিছু বলার নেই কাকলী, সে অলরেডি সবকিছু জেনে ফেলেছে।

তুমি কি ঝুমলালকে জিজ্ঞেস করেছিলে সে আমাদের ঠিকানা পেল কিভাবে?

রাহাত সাহেব ওকে নিয়ে এসেছে।

কেন?

আসলে কনক কোম্পানিতে জয়েন করাতে রাহাত সাহেবের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। একদিন কনকসহ একটু ঠান্ডা লড়াইও হয়েছে, সেই থেকে তিনি কনককে সবার কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন।

কিন্তু তাতে তো কনকের জন্মসূত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা না কারণ এটা তো কেউ জানার কথা না।

তাহলে নিশ্চয়ই এটা আমাদের খুব কাছের কেউ তাকে তথ্য দিয়েছে যে আমাদের সবকিছু জানে।

কাকলী কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তরপর বললেন, এটা তো শুধু আমার বাবা-মা আর রেবেকা জানে আর রেবেকার বাসায় রাহাত সাহেবের যাতায়াত আছে আমি মোটামুটি নিশ্চিত রেবেকাই আমার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় অন্ধ হয়ে রাহাত সাহেবকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে।

রেজা সাহেব বললেন, এক্সাক্টলি, তোমার ধারণাই ঠিক।

তুমি আগে রাহাত সাহেবকে বিদায় করার ব্যবস্থা কর। আসলে রাহাত সাহেবকে তোমার আগেই বিদায় করা উচিত ছিল, আর আমি দেখি রেবেকার সঙ্গে কথা বলি আমি এমন কি দোষ করেছি যে সে আমার অস্তিত্বে আঘাত করবে?

আসলে আগে তো রাহাত সাহেবের কোন দোষ পাইনি, কারো কোন দোষ না পেলে বিনা দোষে তো হঠাৎ করে কাউকে চাকরি থেকে বিদায় করা যায় না।

এখন দোষ পেলে তবে এমন দোষ পেলে যে ওর চাকরি যাওয়ার আগেই আমাদের সব গেল।

রেজা সাহেব কিছু বললেন না।

কাকলী বললেন, তুমি ওকে নিয়ে এলে না কেন? ও তো মন খারাপ করে বসে আছে আবার কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তখন ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে না?

তুমি ঠিকই বলেছ কাকলী, এখনি মোবাইল করে ওকে আসতে বল।

কাকলী মোবাইল করল। অনেকক্ষণ মোবাইল করার পর কনক মোবাইল রিসিভ করল।

কনকের মুখে মা ডাক শুনে কাকলী আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না, তাঁর বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। তিনি বললেন, বাবা তুই একবার বাসায় চলে আয় তো।

অপর পাশ থেকে কনকের খুব স্বাভাবিক কন্ঠস্বর ভেসে এলো যেন কিছুই হয়নি, কেন মা?

তোর বাবার শরীরটা ভাল নেই বাবা, তুই এক্ষুণি চলে আয়।

মা ডাক্তার ডেকেছ? নাকি আমি ডাক্তার নিয়ে যাব?

না বাবা তোর কিছু করতে হবে না, তুই চলে আয়।

আমি আসছি মা।

কাকলী মোবাইল রেখে দিয়ে রেজা সাহেবের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। কারো মুখে কোন কথা নেই। যেন দু’জনে পাষাণ হয়ে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব থাকার পর কাকলী প্রথম কথা বলতে শুরু করলেন, আচ্ছা এখন কনকের বিয়ের কি হবে?

বিয়ের আবার কি হলো? বিয়ে হবে।

সবকিছু জানার পর শাওনের বাবা যদি কনকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হয়।

সে দেখা যাবে, শাওনের বাবা শিক্ষিত মানুষ, এখনকার দিনে শিক্ষিত মানুষেরা জাত-পাত নিয়ে ভাবে না।

তোমার কথাই যেন সত্য হয়, তুমি বিশ্রাম নাও আমি রান্নার ব্যবস্থা করি, বলে কাকলী রান্না ঘরের দিকে গেলেন।

অনেকক্ষণ কেটে গেল কিন্তু কনক এলো না দেখে কাকলী আবার মোবাইল করলেন। কয়েকবার রিং হওয়ার পরও কনক মোবাইল রিসিভ না করায় কাকলী কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন। মনে মনে বললেন, অন্যদিন না হয় বাসার কাছাকাছি এলে মোবাইল রিসিভ করত না ঠিক আছে কিন্তু আজকের দিনেও ছেলেটা এমন করবে।

কলিং বেল বেজে উঠল। কাকলী কলিং বেল এর ধরণ শুনে বুঝতে পারলেন কনক এসেছে। কাকলী নিজে দরজা খুলে দিলেন। তার চোখে-মুখে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ক্লান্ত দেহ, বিধ্বস’ চেহারা যেন শত মাইল দূর থেকে ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে এসেছে। কাকলী কনকের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলেন না।

কনক জিজ্ঞেস করল, মা বাবা কোথায়?

বেড রুমে বাবা।

কনক কাকলীর সঙ্গে বেডরুমে গেল। রেজা সাহেব বিছানায় শুয়ে ছিলেন, কনককে ভিতরে ঢুকতে দেখে বিছানায় উঠে বসলেন।

কনক বলল, কি হলো বাবা হঠাৎ করে?

বাবা হঠাৎ করে মনে হয় প্রেসারটা বেড়ে গেছে তাই ঘাড়টা একটু ব্যাথা করছে।

কনক বুঝতে পারল আসলে তার বাবা অসুস’ নন। কনককে অফিস থেকে নিয়ে আসার জন্য কাকলী মোবাইল করেছেন।

কনক একটা চেয়ারে বসল। কাকলী খাটের এক কোণে বসলেন। কনক একবার রেজা সাহেব এবং একবার কাকলীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে বসে রইল। রুমে পিনপতন নীরবতা, কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আসলে কে কি দিয়ে শুরু করবে এ নিয়েই প্রত্যেকেরই মধ্যে একটা সংশয় কাজ করছে। রেজা সাহেব একবার কি যেন বলতে গিয়ে থমকে গেলেন। তারপর কনকই নীরবতা ভঙ্গ করল, বাবা, মা তোমাদের কাছে আমার কিছু জানার আছে?

রেজা সাহেব পাংশু মুখ তুলে কনকের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন।

কনক জিজ্ঞেস করল, বাবা ঝুমলাল কে? সে যা বলল তা কি সত্যি?

সে কি বলেছে বাবা? কাকলী জিজ্ঞেস করলেন।

সে নাকি সুইপার আর আমি নাকি তার ছেলে। নিচু জাতের কলংক ঘুচিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য সে নাকি অনেকদিন আগে আমাকে তোমাদের কাছে দিয়ে গেছে।

রেজা সাহেব এবং কাকলী পরষ্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার আগের মতো নীরবে বসে রইলেন। কনক আবার বলতে শুরু করল, আমারও স্বপ্ন দেখার মতো মনে পড়ে আমাকে কে একজন লোক তোমাদের কাছে দিয়ে গেছে তার আগে আমি একটা গ্রামে ছিলাম আমার আরো কয়েকজন ভাইবোন ছিল এখন আমার সব মনে পড়ছে। আমার কাছে কিছু লুকাবে না মা, ঝুমলাল যা বলেছে তা কি সত্যি?

কাকলী কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, ঝুমলাল তোকে জন্ম দিয়েছে সত্যি কিন্তু আমরা তোকে বাবা-মা’র আদর যত্ন দিয়ে অনেক কষ্ট, অনেক পরিশ্রম করে মানুষের মতো মানুষ করেছি। তোকে শেয়ার দিয়ে কোম্পানির ডিরেক্টর বানিয়েছি। আমাদের সঙ্গে যে তোর আত্মার সম্পর্ক জড়িয়ে গেছে বাবা। জন্মদাতা হলেই কি বাবা হওয়া যায়? আর কোন দায়িত্ব নেই? ঝুমলাল তো জন্ম দিয়েই তোকে আমাদের কাছে দিয়ে গেছে বাকী সব দায়িত্ব তো আমরাই পালন করেছি। তুই আমাদের ভুল বুঝিস্‌ না বাবা।

আমি তোমাদের ভুল বুঝছি না মা। তোমরা সবাই যা করেছ ঠিকই করেছ। একজন অধিকার বঞ্চিত মানুষ সমাজে মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাদের কাছে দিয়ে গেছে আর তোমরা নিজের মুখের, ঠোঁটের খাবার খাইয়ে সন্তানের আদর যত্ন দিয়ে দেশের সর্বচ্চ্য বিদ্যাপীঠ থেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছ। এখানে আমি কারো মধ্যে কোন দোষ দেখি না মা। আসলে তোমরা সবাই খুব ভাল মানুষ বাবা। মা, তুমি এবং আমার জন্মদাতা বাবাও, বলতে বলতে কনকের কন্ঠস্বর বুজে এলো।

কাকলী কনকের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, কাঁদিস্‌ না বাবা, আমরা তোর চোখ থেকে কোনদিন পানি ঝরতে দিই নি বাবা, সব সময় মনে করবি আজ একটা দুঃস্বপ্ন দেখ্‌লি এটা ভুলে যাবি বাবা। আর কাঁদবি না, ঠিক আগের মতোই হাসি খুশি থাক্‌বি।

তা হয় না মা একটা দুঃস্বপ্ন যে আমার জীবনের স্বাভাবিক ধারাকে বাধা গ্রস’ করল, মা তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবে? বাবা তোমাকেও?

রেজা সাহেব মাথা নত করেই বললেন, বল্‌ বাবা।

আমার বিয়ের ব্যবস্থাটা আপাততঃ বন্ধ কর বাবা। আগে সবকিছু জানাজানি হোক তারপর যদি শাওনের বাবা ওকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায় তবে হবে। শাওনের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, অনেক উঁচু লেভেলের মানুষ তিনি একজন সুইপারের ছেলের হাতে নিজের ইঞ্জিনিয়ার মেয়েকে তুলে নাও দিতে পারেন তাছাড়া শাওনেরও মতামতের একটা ব্যাপার আছে একথা জানার পর শাওনও তো আমাকে বিয়ে করতে না চাইতে পারে?

তোমার কথাই হবে বাবা।

বাবা তুমি বিশ্রাম নাও, বিকেলবেলা আমি তোমাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব, বলে কনক কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল।

 

ত্রিশ

বিয়ের আয়োজন পুরোপুরি শুরু হয়েছে। জাকারিয়া সাহেবের আপন ভাই-বোন কেউ নেই, তাঁর এক চাচার ছেলেমেয়েরাই তার আপন ভাই-বোনের মতো। শাওন নিজেই তাঁদের বাবার আপন ভাই-বোন বলে জানে। জাকারিয়া সাহেবের চাচাতো তিন ভাই এক বোন, বড় ভাই তাঁদের গ্রামের বাড়ি মনপুরায় থাকেন বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হওয়ার আগের দিন তিনি এসেছেন সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েরাও এসেছে। মেজ ভাই মিরপুরে থাকেন, তিনি সরকারি চাকরি করেন আজ তিনি এবং তাঁর ছেলেমেয়েরাও এসেছেন। একমাত্র চাচাতো বোন চট্টগ্রামে থাকেন। তিনি দুই ছেলের মা, তাঁর নিজের কোন মেয়ে না থাকায় তিনি শাওনকে নিজের মেয়ের মতো ্লেহ করেন। তিনি বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার আগের দিন এসেছেন। গাজীপুরে শাওনের এক মামা থাকেন, শাওনের মা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি খুব একটা আসেন না, শাওনের বিয়ে উপলক্ষে তিনিও সপরিবারে এসেছেন। বাড়িতে যেন আনন্দের সীমা নেই। থাকার জায়গা নেই, তবুও কারো কোন অভিযোগ নেই সবাই হাসি মুখে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। বিয়ের কার্ড বিতরণ, বাজার খরচ, ডেকোরেশন, বিহাই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগসহ সমস্ত অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে জাকারিয়া সাহেবের চাচাতো ভাইদের মধ্যে ছোট কাদের সাহেবের ওপর। তিনি বয়সে ছোট হলেও এসব কাজে পটু। সমস্ত কিছু তিনি সামলাচ্ছেন দক্ষভাবে। তিনি যাকে যা করতে বলছেন তিনি সেই কাজই করছেন।

বিয়ের আয়োজন প্রায় শেষ পর্যায়ে। সমস্ত কিছু খুব ভালভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ দিতে আসবে কাল বিয়ে, বিকেলবেলা সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছেন। যেন সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। জাকারিয়া সাহেব কাদের সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, কাদের সব আয়োজন ঠিক আছে তো?

জি ভাইজান।

সবাইকে দাওয়াত দেয়া, বাজার, ডেকোরেশন, কাজী সাহেবকে আসতে বলা?

জি ভাইজান সবকিছু ঠিক মতো হয়েছে, আপনি কিছু ভাববেন না।

জাকারিয়া সাহেবের মোবাইলের রিং বেজে উঠল। তিনি মোবাইল রিসিভ করলেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠের ধ্বনি ভেসে এলো, আপনি কি জাকারিয়া সাহেব বলছেন?

জি বলুন।

আমি আপনার মেয়ের বিয়েতে একজন আমন্ত্রিত অতিথি।

ইয়েস ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

আচ্ছা জাকারিয়া সাহেব কথাটা এ মুহূর্তে আপনাকে বলা আমার ঠিক হচ্ছে না, তবু আমি আপনাদের একজন হিতাকাংখী বলেই বলছি এটা জানা আপনার খুব প্রয়োজন।

জাকারিয়া সাহেব কৌতুহলী হয়ে বললেন, জি বলুন।

আপনি কি কনকের পিতৃ পরিচয় জানেন?

অফ কোর্স।

রেজা সাহেবকে কি আপনি কনকের বাবা বলে জানেন?

জি এবং এটাই তো সত্য।

না এটা সত্য না।

জাকারিয়া সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কনক রেজা সাহেবের ছেলে না, এতদিন পর এই কথা, এটা কিভাবে সম্ভব? রেজা সাহেব কনককে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন, এ্যাপ্যার্টমেন্ট কোম্পানির পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছেন, নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিয়েছেন, একসঙ্গে এতগুলো মিথ্যা রেজা সাহেব কিভাবে বলতে পারলেন? কিভাবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন? জাকারিয়া সাহেব যেন ভেবে কূল কিনারা করতে পারলেন না। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

তিনি পাংশু মুখে বললেন, তবে সত্যিটা কি?

কনক রেজা সাহেবের পোষ্য পুত্র।

তবে কনকের বাবা-মা কোথায়?

কনক শুধু রেজা সাহেবের পালিত পুত্রই নয়, সে একজন সুইপারের ছেলে। সেই সুইপারের নাম ঝুমলাল, গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায়। খুব ছোটবেলায় ঝুমলাল তাঁদের কাছে কনককে দিয়ে যায়। তখন থেকে নিঃসন্তান রেজা সাহেব কনককে নিজের পুত্র পরিচয়ে লালন-পালন করেছেন। কনকের পিতৃপরিচয় মুছে ফেলার জন্য রেজা সাহেব তাঁর গ্রামের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, কিন্তু তবুও সত্য গোপন করতে পারেননি, সত্য তার আপন ধর্মে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

আপনি যে সত্য কথা বলছেন তার প্রমাণ কি?

আপনি আপনার হবু বিহাই সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।

আপনি কে?

আমার পরিচয়টা বেশি জরুরী নয়, বলে অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

জাকারিয়া সাহেব ধপাস্‌ করে সোফায় বসে পড়লেন।

সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে জাকারিয়া সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কাদের সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান কোন সমস্যা?

জটিল সমস্যা, কাদের তুই বিয়ের সব আয়োজন বন্ধ কর। এ বিয়ে হবে না।

ভাইজান আগে সবকিছু খুলে বলুন, কি হয়েছে?

রেজা সাহেব, কনক আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

কেন কি হয়েছে?

এক ভদ্র মহিলা মোবাইল করে বললেন, কনক নাকি রেজা সাহেবের ছেলে না।

ভাইজান কোন এক মহিলা মোবাইল করে কি বললেন আর বিয়ে ভেঙ্গে গেল। তা কি করে হয়? আগে বিহাই সাহেবের কাছ থেকে সবকিছু জানা হোক তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আজ গায়ে হলুদ, কাল বিয়ে আর এখন এসব কথা!

সবাই কাদের সাহেবের কথার সঙ্গে সুর মিলালেন, হ্যাঁ তাই তো।

জাকারিয়া সাহেব সবার সিদ্ধান্তে সম্মত হয়ে রেজা সাহেবকে মোবাইল করলেন, হ্যালো, রেজা সাহেব।

জি বিহাই সাহেব বলুন।

জাকারিয়া সাহেব বললেন, রেজা সাহেব আপনার কাছে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে আশা করি ঠিক উত্তর দিবেন।

জি বলুন।

কনক কি আপনার ছেলে?

এখন একথা কেন?

রেজা সাহেব চালাকি করবেন না, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি আপনি উত্তর দিবেন।

যদি কনক আমার ছেলে না হয় তবে কি বিয়ে হবে না?

তারমানে কনক আপনার ছেলে না, আমরা যা শুনেছি তা-ই সত্যি।

অপর পাশ থেকে রেজা সাহেবের কোন জবাব এলো না। জাকারিযা সহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, আপনি একটা প্রতারক, আপনি কনকের পরিচয় লুকিয়ে একজন সুইপারের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এ বিয়ে হবে না।

অপর পাশ থেকে রেজা সাহেবের শান্ত কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বিহাই সাহেব, কনক রেজা সাহেবের ছেলে নয় কিন্তু সে এ-প্লাস পেয়ে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং সৃষ্টি এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডার্স এন্ড ডেভলাপার্স লিঃ এর ডিরেক্টর। এতকিছুর পরও কি কনেকের পিতৃপরিচয়টাই বেশি জরুরী?

অবশ্যই জরুরী, সোসাইটিতে আমার একটা মান-সম্মান আছে, মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর সবাই যখন জানবে আমি একটা সুইপারের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তখন আমি কি জবাব দিব? আপনি বলুন। এ বিয়ে সম্ভব না, বলে জাকারিয়া সাহেব মোবাইল রেখে দিলেন।

সবার কাছে একই প্রশ্ন এখন কি হবে? সবাই জাকারিয়া সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাদের সাহেব প্রগতিবাদী মানুষ তিনি মানুষে মানুষে কখনো ভেদাভেদ করেন না। পৃথিবীতে সব মানুষই সমান, সব শিশুই মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে তারপর সমাজই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ধোপা, মুচি, সুইপার ইত্যাদি শ্রেনীতে বিভক্ত করে তিনি এই আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি কয়েকমুহূর্ত জাকারিয়া সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন, ভাইজান আজকাল মানুষ এসব কিছু দেখে না, আমি যতদূর জেনেছি ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এ-প্লাস পেয়ে পাস করেছে এটাই তার যোগ্যতা। আমার মনে হয় এর বেশি কিছু দেখার আমাদের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া শাওন কনককে ভালবাসে সে যখন জানবে কনকের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে না তখন সে কি বিষয়টা মেনে নিতে পারবে?

জাকারিয়া সাহেব রাগান্বিত চোখে কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাদের তুই আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবি না। আমি বলছি এ বিয়ে হবে না। দ্যাটস্‌ ফাইনাল। তুই সবকিছু বন্ধ কর।

খবরটা কয়েকমুহূর্তের মধ্যে সারা বাড়িতে যেন শোকের ছায়া ছড়াল। শাওনের হৃদয় ভেঙ্গে গেল। সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল, বাবা আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না, কনক রেজা সাহেবের ছেলেই হোক আর সুইপারের ছেলেই হোক আমি কনককে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না।

জাকারিয়া সাহেব শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুই কাঁদিস্‌ না মা, আমি কোনদিন তোর কান্না দেখিনি আজও তোর চোখে কান্না দেখতে চাই না। আমি বুঝতে পাচ্ছি তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস্‌, আমিও কষ্ট পেয়েছি কিন্তু কি করব বল্‌? যার পিতৃ পরিচয় ঠিক নেই, যে কিনা সুইপারের ছেলে তার কাছে তোকে আমি কিভাবে তুলে দেই? বল্‌।

আমি শুধু কনককে চিনি বাবা, সে কার ছেলে? তার বংশ মর্যাদা কি? এসব কিছু আমার দেখার কোন প্রয়োজন নেই।

জাকারিয়া সাহেব রেগে গেলেন, তোর দেখার প্রয়োজন না থাকলেও আমার প্রয়োজন আছে, সমাজে আমি আমার মান-সম্মান বিলিয়ে দিতে পারি না।

বাবা আমি সারাজীবন তোমার কথার অবাধ্য হয়নি। আজও হতে চাই না তবে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। তাতে যদি তোমার অবাধ্য হতে হয় তবুও আমি পিছ পা হব না।

জাকারিয়া সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললেন, না আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দিব না।

 

একত্রিশ

গভীর রাত, রাজধানী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, গভীর ঘুমে। ঢাকা শহরকে কনক আগে কোনদিন এত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে দেখেনি, যেন সবকিছু নিশ্চুপ, মাঝে মাঝে পুলিশের বাঁশির শব্দ কানে ভেসে আসছে। কনকের চোখে ঘুম নেই যেন আজ সে ঘুমাতে ভুলে গেছে। কিছুতেই চোখে তন্দ্রা ভাবও আসছে না। এরই মাঝে শাওন কয়েকবার রিং দিয়েছে কিন্তু কনক তার মোবাইল রিসিভ করেনি। সে বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। হঠাৎ করে তার মনে পড়ল কয়েকমাস আগে কনকের একবার বুকে ব্যথা হয়েছিল, আজকাল ডাক্তাররা কোন দায়িত্ব নিতে চান না, প্রোপার ইনভেস্টিগেশন ছাড়া কোন ট্রিটমেন্ট দিতে চান না, বরং অযথা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় একগাদা টেস্ট দিয়ে নিজের সব দায়িত্ব দিতে চান ডায়োগোনিস্টিক সেন্টারের ওপর। তারপর রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশন দেন। তাতে একদিকে রোগ নিশ্চিত হয়ে ট্রিটমেন্ট করতে পারেন একথা সত্য কিন্তু টেস্ট করতে রোগীর হৃৎপিন্ড, রক্তের শিরা এবং পকেট সবকিছুই ছিদ্র হয়ে যায়। কনক ধনী মানুষের ছেলে একগাদা টেস্ট করতে তার পকেটের ওপর তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। কনক প্রথমে দেখিয়েছিল মেডিসিনের ডাক্তারকে তিনি সবকিছু জেনে কনককে রেফার্ড করে দিলেন গ্যাস্ট্রোলজির ডাক্তারের কাছে ডাক্তার তো এন্ডোসকপি করার পরামর্শ দিলেন। কনক এন্ডোসকপি করতে গিয়ে মুখের ভিতর দিয়ে পেটে পাইপ ঢোকানোর বিবরণ শুনে ডায়োগোনিস্টিক সেন্টারের গেট থেকে ফিরে এসেছে তারপর ডাক্তার অনুমানের ওপর একটা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ আর একটা ঘুমের ঔষধ দিয়েছিলেন। তখন কয়েকদিন ডাক্তারের পরামর্শ মতো ঔষধ খেয়েই কনক সুস’ হয়ে গিয়েছিল। আজ নিদ্রাবিহীন রাতে কনকের মনে পড়ল ঘুমের ঔষধের কথা। কনক তার রুমে ঢুকে দেখল ঘুমের ঔষধ আছে। ডাক্তারের পরামর্শ ছিল রোজ রাতে একটা করে, কনক আজ ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে দু’টা ট্যাবলেট খেল। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমাবার ব্যর্থ চেষ্টা। আবার কনকের মোবাইলে রিং বেজে উঠল।

কনক ইচ্ছা করে আবারো মোবাইল রিসিভ করল না। কিন্তু শাওন নাছোড় বান্দা হয়ে বার বার রিং দিতে থাকল। অবশ্য এটা কনক আর শাওনের নিত্য দিনের অভ্যাস প্রতিদিন সকালবেলা উঠে দু’জনের শুভেচ্ছা বিনিময় কে কি স্বপ্ন দেখল এনিয়ে অনেকক্ষণ গল্প, দিনে কার কি কাজ তা নিয়ে আলোচনা তারপর দিনে সুযোগ পেলেই মোবাইলে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া আবার রাতে ঘুমাবার আগে একবার শেষ কথা হওয়া চাই। রাতে একবার কথা না বললে যেন কারো চোখে ঘুম নেই। কনক একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দু’টা বাজে এখনো শাওন ঘুমায়নি তারমানে কথা না বলা পর্যন্ত সে ঘুমাবে না।

কনক মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো।

কনক আমার মোবাইল রিসিভ করছিস্‌ না কেন?

শাওন আমার মনে হয় আমাকে মোবাইল করা তোর ঠিক হয়নি। অনেক পরে হলেও তো জেনেছিস্‌ আমি সুইপারের ছেলে, আমার বাবার নাম ঝুমলাল, আদিতমারী হাটের ঝাড়-দার।

কনক আমি তোকে ভালবাসি, তোকে ভালবাসার আগে আমি কোনদিন জানতে চাইনি তু্‌ই রেজা সাহেবের ছেলে নাকি কোন সুইপারের ছেলে?

কিন্তু এখন তো জানিস্‌ যে আমি সুইপারের ছেলে, তোর বাবা জানে আমি সুইপারের ছেলে একথা জানার পর তোর বাবা আমার বাবাকে প্রতারক বলে অপমান করেছে, আমার সঙ্গে তোকে বিয়ে দিবে না বলে আমার বাবাকে সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে। বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে দিয়েছে এখন আর করার কিছু নেই।

কিন্তু আমি যে তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।

এটা তোর আবেগের কথা।

আবেগের কথা না আমার মনের কথা। তুই বল্‌ কি করলে তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি?

শাওন বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, সমাজে তোদের স্ট্যাটাসের প্রশ্ন, তোদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। তুই ইচ্ছা করলেই সমাজের এ শিকল ছিঁড়তে পারবি না। তোর বাবা মেনে নিবে না, তোর আত্মীয়-স্বজন কেউ মেনে নিবে না। আমার জন্য তোর সবাইকে ছোট করার কি দরকার? বল্‌।

কনক তুই আমার সব, আমার আর কারো দরকার নেই। তুই পাশে থাকলেই আমার সব পাওয়া হবে। আমি সব ছেড়ে চলে আসব কনক, চল্‌ কালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করি।

শাওন আপাততঃ বিয়ের আলাপ বন্ধ, পরে কি হবে সেটা না হয় ভেবে চিন্তে তুই সিদ্ধান্ত নিবি, শাওন আমি এখন ঘুমাবো, রাখছি, বলে কনক অপর পাশ থেকে শাওনের কোন কথা না শুনেই লাইন কেটে দিল।

কনক আবার ঘুমানোর চেষ্টায় বিছানায় শুয়ে রইল কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না, দুশ্চিন্তা আর অসি’রতার কাছে যেন ঘুমের ঔষধ আজ পরাজয় বরণ করেছে। কনকের মনের মধ্যে আজ অনেক এলোমেলো চিন্তা ভীড় করছে। কনকের মনে হল কাজের মেয়েটার কথা এ বাড়িতে কাজ করে সে মাস গেলে টাকা পায়, মালিকের সঙ্গে অলিখিত হলেও তার একটা চুক্তি আছে। সে চুক্তির বলে এ বাসায় সে কিছু অধিকার ভোগ করে। সারামাস কঠোর পরিশ্রম করে মাস গেলে সামান্য ক’টা টাকা পায়। হোক সামান্য কিন্তু পারিশ্রমিক তো। অথচ কত বছর যাবত আমি এ সংসারে বিনা পারিশ্রমিকে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি যার না আছে কোন লিখিত বা অলিখিত চুক্তি। একজন আমার জন্ম কলংক ঘুচিয়ে আমাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য আরেকজনের কাছে সমর্পন করেছে অন্যজন নিজের মনে করে কোলে পিঠে করে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলেছে। এখানে কারো কোন দোষ নেই, দোষ আমার কপালের। কিন্তু তারপরও তার এ বাড়িতে নিজেকে অবাঞ্চিত এবং পরগাছা বলে মনে হল। এখন কি করবে সে? এমনিভাবে অনেক এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কনকের মনে নেই।

সাধারণত কনক সকাল সাতটায় বিছানা ছেড়ে উঠে আজ তার ব্যতিক্রম হলো, সকাল আটটা পেরিয়ে গেল কনককে বিছানা ছেড়ে উঠতে না দেখে কাকলী কনককে ডেকে তুলল।

কনক তার বেড রুম থেকে বেরিয়ে এলো, কি হয়েছে মা?

কিন্তু কাকলীকে মা বলতে আজ কনকের জিহব্বা আড়ষ্ট হয়ে গেল, কাকলী সেটা খেয়াল করলেন। আটটা বাজে অফিস যাবি না। তোর বাবা নাস্তার টেবিলে বসে আছে, আয় বাবা।

কনক আরো অবাক হলো। এতকিছুর পরও বাবা ঠিকই নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছে কনক তাড়াতাড়ি গোসল সেরে রেজা সাহেবের সঙ্গে নাস্তা করতে বসল।

নাস্তা খেতে খেতে প্রতিদিন অফিসের কিছু কিছু কথা রেজা সাহেব আলাপ করেন আজ কনকের চোখের দিকে তাকাতেই তাঁর চোখে পড়ল কনকের দু’চোখ লাল, যেন চোখে রক্ত জমেছে। আজ রেজা সাহেব নাস্তার টেবিলে শুধু বললেন, যে স্মৃতি, যে ইতিহাস মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে টেনে ধরে, পিছনের দিকে টেনে ধরে সে স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে হয় বাবা। তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে অফিস চল্‌।

কনক মাথা নিচু করে বলল, আজ আমি অফিস যাব না বাবা, তুমি যাও।

তবে আমি গাড়ি রেখে যাই তোর যখন ইচ্ছে হবে তখন অফিসে আসিস্‌।

আমার গাড়ি লাগবে না বাবা, তুমি গাড়ি নিয়ে যাও।

তবে থাক্‌ বাবা কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর অফিস যাবি, এ ক’দিন আমার বেশ পরিশ্রম হবে।

রেজা সাহেব আশা করেছিলেন কনক হয়ত বলবে দু’য়েকদিন পর আমি যাব বাবা অথবা তোমাকে আর বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না বাবা। আমিই সব কাজ করব। কিন্তু কনক কোন কথা বলল না। সে মাথা নত করে খাওয়া শেষ করে তার রুমে চলে গেল।

রেজা সাহেব কনকের আচরণে ব্যথিত হলেন। তিনি কাকলীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, কাকলী কনককে তুমি বুঝাবে, তোমার কোন কথা সে না করে না। সবকিছু খুলে বলবে। ওকে বলবে যা কিছু ঘটেছে তাতে কারো কোন হাত নেই। আমরা তার পরিচয় লুকানোর জন্য বাসা চেঞ্জ করেছি, মোবাইলের সিম চেঞ্জ করেছি কাউকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য সম্ভব সবকিছু করেছি তবু অপ্রত্যাশিতভাবে যা কিছু ঘটেছে তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না। তার মতো আমরাও সমানভাবে কষ্ট পেয়েছি। আমি অফিসে গিয়ে দেখি সবার আগে রাহাত সাহেবকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা দরকার। যে আমার মান-সম্মান নিয়ে খেলা করছে, যে আমার অস্তিত্ব নিয়ে খেলা করছে, সে একটা নেমকহারাম, আমার কোম্পানিতে তার চাকরি করার অধিকার নেই।

কাকলী কিছু বললেন না তাঁর দু’চোখ বেয়ে অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, তুমি যা-ই কর আমি অনেক সাধনা করে কনককে গড়ে তুলেছি, অনেক পরিশ্রম করে ওকে মানুষ করেছি, কনককে নিয়ে আমি আমার জীবনের শূন্যতা পূরণ করেছি এখন ওকে হারালে আমি বাঁচবো না। প্লিজ তুমি খুব ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ম্যানেজ কর। কনককে স্বাভাবিক করার জন্য যা করার দরকার তাই কর, আমি ওকে বুঝিয়ে দেখি যদি অন্য কোথাও বিয়ে করতে রাজি হয় তবে মেয়ে দেখি।

 

বত্রিশ

হাতে যে ক’টা টাকা ছিল সেই টাকা আর তার কোর্ট ফাইলে রক্ষিত সার্টিফিকেটগুলো নিয়েই কনক বের হলো। বাসা থেকে বের হবার সময় কাকলী একবার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবি বাবা?

কনক তার মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাসা থেকে বের হলো উদ্দেশ্যহীনভাবে, কোথায় যাবে? হঠাৎ পৃথিবীটা তার কাছে সংকুচিত মনে হলো। মনে হলো সব লোকগুলো তাকে চিনে ফেলছে যে সে একজন সুইপারের ছেলে আর তাকে দেখে নাকে হাত দিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার যেন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সুইপারের ছেলের সঙ্গে জাকারিয়া সাহেব মেয়ে বিয়ে দিবেন না বলে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে একথা গতকালই আমন্ত্রিত অতিথিদের জানিয়ে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। আজ অফিসে বিষয়টা নিয়ে কেউ কেউ হয়ত তামাশা করছে। কনক নিজেকে প্রশ্ন করল, সে কি আর অফিসে যাবে? না সে আর অফিসে যাবে না। অন্য কোথাও যাবে দূরে কোথাও যেখানে কেউ তাকে চিনবে না, তার পিতৃপরিচয় গোপন থাকবে, কে তার বাবা? ঝুমলাল নাকি রেজা সাহেব এ প্রশ্ন কেউ করবে না।

কনক উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখন কাকরাইল মোড় অতিক্রম করেছে খেয়ালই করেনি। হঠাৎ মনে হলো বন্ধুদের মধ্যে একবার দেখি তো কাউকে পাই নাকি? মোবাইলের সিমকার্ডের যা দাম কমেছে তাতে খুব সহজে অনেকেই মোবাইল সিমকার্ড চেঞ্জ করে ফেলে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর আশিকের মোবাইলে রিং হলো।

অপর পাশ থেকে আশিকের উল্লাসিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো, বন্ধু অনেকদিন পর, ভাল আছিস্‌?

হ্যাঁ বন্ধু ভাল আছি, তুই?

হ্যাঁ ভাল আছি, বন্ধু শুনলাম তুই নাকি নিজের কোম্পানিতে ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছিস্‌? খুব ভাল করেছিস্‌ বন্ধু আমার আসলে ঢাকা শহরে তেমন কেউ নেই, এক বড় ভাইর রেফারেন্সে একটা কনসাল্টিং ফার্মে জয়েন করেছি।

কনক জিজ্ঞেস করল, তুই এখন কোথায়?

আমার অফিসে, মতিঝিল।

আশিক তোর সঙ্গে আমি একবার দেখা করব, তোর ঠিকানাটা বল্‌বি?

অপর পাশ থেকে আশিকের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। কনক মনোযোগ দিয়ে ঠিকানাটা শুনে বলল, আশিক আমি তোর অফিসে আসছি।

কনক একটা রিক্সায় চেপে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। কয়েকমিনিট পরই আশিকের অফিসে পৌঁছালো। আশিক কনককে দেখে জড়িয়ে ধরল, বন্ধু অনেকদিন পর দেখা, আমার খুব ভাল লাগছে, বস্‌ কি খাবি বল্‌? চা নাকি ঠান্ডা?

কনক মলিনমুখে বলল, কিছু খাব না আশিক।

সে কি তোর মুখ শুকনা দেখা যাচ্ছে, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, রাতে মনে হয় ভাল ঘুম হয়নি। বস্‌ চা খাই ভাল লাগবে, এনার্জি পাবি।

কনক আশিকের কথার কোন প্রতিবাদ করল না।

চা খেতে খেতে আশিক জিজ্ঞেস করল, কি খবর বল্‌? ফাইল হাতে কোথায় যাচ্ছিস্‌?

কনক একটা ঢোক গিলে বলল, আশিক আমার অনেক সমস্যা, আমার এই মুহূর্তে একটা চাকরি প্রয়োজন।

আরে আমি থাকতে তোর কোন সমস্যা নেই। শুধু একটা চাকরি কেন আরো কিছু প্রয়োজন হলেও পারব।

আশিক এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন চাকরিটা তার হাতের মোয়া আর তার জমিদারী আছে যে খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাও করবে।

কনক বলল, আশিক ইয়ার্কি না, সত্যি সত্যি বলছি।

কিন্তু তার আগে বল্‌ বাসা ছেড়ে চলে এসেছিস্‌ কেন?

ওসব পরে হবে আশিক আমার একটা চাকরি খুব প্রয়োজন, আমার একটা খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা দরকার, আমার কিছু টাকা দরকার।

সব হবে, সব হবে তোর মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টকেই তো স্যার খুঁজছিলেন, স্যার তোকে পেলে খুব খুশি হবেন। আমাদের ফার্মে আরো একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার দরকার তোকে পেলে স্যার খুব খুশি হবেন। বুয়েট থেকে এ-প্লাস পেয়ে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার তুই, তোর আবার চাকরির অভাব? আমি স্যারকে বললে তোর চাকরি এখনই হয়ে যাবে আর খাওয়া-থাকা, যদি তুই কিছু মনে না করিস্‌ তবে আমার ম্যাসে থাক্‌বি।

কনক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে বন্ধু আগে তোর স্যারের সঙ্গে কথা বল্‌।

আচ্ছা তুই বস্‌ আমি দেখছি বলে আশিক ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, স্যার তোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আয় বলে কনককে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের রুমে নিয়ে গেল।

লম্বা, ফর্সা, মধ্যবয়সী এক ভদ্র লোক ম্যানেজিং ডিরেক্টর দরজায় নেমপ্লেটে লেখা আছে আলমগীর হোসেন। তাঁর চেহারায় লাবন্য আছে, আভিজাত্য আছে, মাথায় টাক আছে কিন্তু পার্শ্বের চুল দিয়ে টাক ঢাকানোর চেষ্টা করেছেন। মাথার চুল সম্ভবত সবগুলো পাকা কলপ করে ভদ্র লোক বয়স ঢাকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। খুব সম্ভবত ডায়েট কন্ট্রল করেন, রুপচর্চা করেন। তাঁর নিজের পোশাক পরিচ্ছদ আর চেম্বারের সাজ-সজ্জা দেখেই বোঝা যায় তিনি একজন উন্নত রুচিসম্পন্ন এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

কনক তাঁর চেম্বারে ঢুকে সালাম দিতেই তিনি বললেন, বস।

কনক চেয়ারে বসল, আশিক তার মুখোমুখি চেয়ারে বসল। আলমগীর সাহেব কনককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় লেখাপড়া করেছ?

বুয়েটে স্যার।

রেজাল্ট কি রকম ছিল?

এ-প্লাস।

আলমগীর সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে তো তুমি এখানে চাকরি করবে না।

কনক বিনয়ের সুরে বলল, চাকরিটা আমার খুব প্রয়োজন স্যার।

বুঝতে পাচ্ছি কিন্তু কনক আমার ফার্ম খুব ছোট অনেক ভাল ছাত্র আমার ফার্মে প্রথমে জয়েন করে তারপর যখন কিছুদিন যায় অভিজ্ঞতা হয় তখন বড় কোন ফার্মে চলে যায় অথবা সরকারি চাকরিতে যায়। সরকারি চাকরিতে চলে গেলে আমার মন খারাপ হয় না কারণ সরকারি চাকরি সোনার হরিণ, কেউ যদি আমার ফার্মে চাকরি করে সোনার হরিণ পায় তাতে আমি খুব আনন্দ পাই কিন্তু যখন আমার ফার্ম ছেড়ে অন্য ফার্মে চলে যায় তখন খুব খারাপ লাগে, আমাকে আবার নতুন মানুষ খুঁজতে হয়। আমি শুধু গড়ি আর সুবিধা ভোগ করে বড় বড় ফার্ম। তুমিও তো তাই করবে।

কনক কিছু বলল না। আলমগীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথাও চাকরি করেছ আগে?

না স্যার।

তারমানে একেবারে ফ্রেস। সবকিছু শিখিয়ে নিতে হবে আমি তোমাকে চাকরি দিতে পারি তবে এক কন্ডিশনে?

কনক করুণসুরে বলল, আমি আপনার যে কোন কন্ডিশনে রাজি আছি স্যার কিন্তু চাকরিটা আমার খুব প্রয়োজন।

তোমাকে একটা ব্লাংক স্ট্যাম্পে সই করে দিতে হবে মৌখিক কথা থাকবে তুমি কমপক্ষে পাঁচ বছর আমার ফার্মে চাকরি করবে এর মধ্যে যদি তোমার সরকারি চাকরি হয়ে যায় তবে তুমি চলে যাবে গোল্ডেন হ্যান্ডশ্যাক করে তোমাকে তোমার ব্লাংক স্ট্যাম্প ফেরত দিয়ে বিদায় দিব। আর যদি অন্য ফার্মে চলে যাও তবে ব্লাংক স্ট্যাম্প দিয়ে আমি তোমার উপর মামলা করে দিব। বল তুমি রাজি?

জি স্যার আমি রাজি।

থ্যাংক ইউ ইয়াং ম্যান, তুমি আরো একবার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলে।

তুমি বায়োডাটা নিয়ে এসেছ?

জি না স্যার।

আগামীকাল শুক্রবার এবং শনিবার দুই দিন তো অফিস বন্ধ তুমি রবিবার বায়োডাটা নিয়ে এসো আর হ্যাঁ তোমাকে ব্লাংক স্ট্যাম্প দিতে হবে না এটা আমি এমনি বললাম তোমার কাছ থেকে আমি ব্লাংক স্ট্যাম্প নিব না। সেদিনই তুমি চাকরিতে জয়েন করবে।

থ্যাংক ইউ স্যার, বলে কনক আর আশিক তাঁর চেম্বার থেকে বের হয়ে আবার কনক আশিকের চেয়ারের সামনে বসল। আশিক তুই আমার খুব উপকার করলি, আই এ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

আমার কোন কৃতিত্ব নেই কনক, তোর সার্টিফিকেটগুলো স্যারকে দেখালে এমনিতেই তোর চাকরি হয়ে যেত। স্যার মেধার মূল্যায়ন করেন। এখন তোর খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, আমার রুমমেট বদলি হয়েছে, খুব শীঘ্রই তিনি চলে যাবেন এই ভাঙ্গা মাসের ক’দিন তুই আমার সঙ্গে ডাবলিং করবি আর কি।

কনক আরো কিছুক্ষণ আশিকের টেবিলের সামনে বসে রইল। তার মোবাইলে ততক্ষণে রেজা সাহেব, কাকলী এবং শাওনের রিং আসতে শুরু করেছে। কনক মোবাইলটা অফ করে দিল।

আশিক জিজ্ঞেস করল, শাওনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ আছে। তোর কি আঁখির সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ আঁখি একটা ফার্মে চাকরি করছে। প্রায় দিনই কথা হয়। গার্জিয়ান লেভেলে কথাবার্তা চলছে শীঘ্রই বিয়ের কথা পাকাপাকি হবে। তোদের কি অবস’া?

পরে শুনিস্‌।

কনক একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আশিক আজ আমি উঠি, কাল আমি ঢাকার বাইরে থাকব পরশুদিন তোর ম্যাসে দেখা হবে।

আশিক তার ভিজিটিং কার্ডের উল্টা পার্শ্বে তার ম্যাসের ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বলল, ঢাকায় ফিরে ম্যাসে চলে আসিস্‌।

আচ্ছা।

 

তেত্রিশ

ঝুমলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে রেজা সাহেবের মন ভীষণ খারাপ হয়েছে। এতদিন তিনি তিলে তিলে কনককে লালন-পালন করে যে পিতৃত্বের অহংকার অর্জন করেছিলেন ঝুমলাল অফিসে আসার পর তা দুমড়ে মুচড়ে চুরমার হয়ে গেছে। রাতে তাঁর ভাল ঘুম হয়নি শুধু তাই নয় কনক এবং শাওনের ভালবাসার পবিত্র বন্ধনও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর চোখ দু’টা যেন ফেটে রক্ত বের হচ্ছে একদিনেই মেজাজটা রুক্ষ্ন হয়ে গেছে। আজ তিনি অফিসে ঢুকতেই দেখলেন রাহাত সাহেব আর দেলোয়ার সাহেব ফিস্‌ ফিস্‌ করে গল্প করছে। তিনি প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। অফিসের কাজে রেজা সাহেবের কিছুতেই মন বসছিল না কিছুক্ষণ পর পর অনেকেই বিয়ে ভেঙ্গে যাবার কারণ জানতে চাচ্ছেন রেজা সাহেব কৌশলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি এক রকম অস্বস্থিবোধ করছিলেন। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর জালাল সাহেব একটা ফাইল আর চেক বই নিয়ে তাঁর চেম্বারে ঢুকলেন। রেজা সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে জালাল সাহেব কপালে চোখ তুলে বললেন, স্যার আপনার শরীরটা কি অসুস’?

রেজা সাহেব এ প্রশ্নের কি জবাব দিবেন বুঝতে পারলেন না তবে জালাল সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর সন্দেহ হল জালাল সাহেব কিছু লুকাচ্ছেন। রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জালাল সাহেব আপনি এ কোম্পানির অনেক পুরাতন মানুষ, এ কোম্পানিতে আমার চেয়ে আপনার বয়স বেশি। আমার শ্বশুর আপনাকে খুবস্নেহ করেন এবং আপনাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন।

এসব কথা কেন বলছেন স্যার?

জালাল সাহেব আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেছে, আমার মান-সম্মান, আমার অহংকার, আমার পরিবারের অহংকার দমকা হাওয়ায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সে তো আপনি জানেন এবং আপনিও আমাদের মতো খুব কষ্ট পেয়েছেন।

জালাল সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তিনি বললেন, জি স্যার।

রেজা সাহেব আবেগ প্রবণ হয়ে বললেন, জালাল সাহেব আপনার মতো সবাই যদি আমার এবং আমার কোম্পানির মান-সম্মান নিয়ে ভাবত তবে তো এ রকম ঘটনা ঘটত না।

জালাল সাহেব কোন কথা বললেন না। মাথা নত করে বসে রইলেন। রেজা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জালাল সাহেব আপনি কি জানেন সেই ক্রিমিনালটা রাহাত সাহেব?

জি স্যার, জানি।

রেজা সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, জালাল সাহেব আমি সেই ক্রিমিনালটাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে চাই।

জালাল সাহেব কোন কিছু বললেন না তিনি নীরবে বসে রইলেন। রেজা সাহেব বললেন, দিন কি ফাইল এনেছিলেন সই করে দিই।

ফাইল এবং চেক সই করা শেষ হলে জালাল সাহেব চলে গেলেন। রেজা সাহেব কলিং বেল টিপতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল, স্যার।

রাহাত সাহেবকে আমার সালাম দাও।

পিয়ন চলে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে রাহাত সাহেব ঢুকলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার?

রাহাত সাহেব আপনি অনেকদিন যাবত এই কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। এই কোম্পানিতে চাকরি করে আপনি ফ্যামিলি নিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করছিলেন। আমার কোম্পানিতে চাকরি করে আমার কোম্পানির টাকা আত্মসাত করে আপনি ঢাকা শহরে অন্য কোম্পানির এ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন এসব কিছু আমি জানি কিন্তু আপনাকে কিছু বলিনি কারণ আপনি আমার ভায়রা ভাই ফিরোজ সাহেবের রেফারেন্সে এ কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকেছেন। আপনাকে চাকরি থেকে বিদায় করলে তিনি হয়ত আমার ওপর অসন্তোষ্ট হতেন তাই সবকিছু জেনে-শুনেও আমি আপনার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিইনি কিন্তু আপনি আমার পরিবারে যে অশান্তির সৃষ্টি করেছেন, সোসাইটিতে আমার মান-সম্মান নিয়ে আমাকে হেনস্তা করেছেন তাতে আপনাকে চাকরিতে রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আপনি আগামীকাল থেকে আর অফিসে আসবেন না, আমি জালাল সাহেবকে বলে দিচ্ছি হিসাব করে আপনার পাওনা এবং তিন মাসের এ্যাডভান্স পেমেন্ট দিয়ে দিবে।

রাহাত সাহেব বুঝতে পারলেন তার জারি-জুরি সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি মনে মনে বললেন, জালাল সাহেব ঠিকই বলেছিলেন কোম্পানির চাকরিতে মালিকের মান-সম্মান নিয়ে খেলা শুরু করলে চাকরিটাই চলে যাবে। এখন আর চাকরিটা রক্ষা করা গেল না। মাসে মাসে অনেকগুলো টাকা করে বেতন তারপর মালামাল কেনার কমিশন সব মিলিয়ে চাকরিটা বেশ এ্যাট্রাকটিভ ছিল, কনক সাহেবকে ডুবাতে গিয়ে নিজেও ডুবে গেলাম।

রাহাত সাহেবকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে রেজা সাহেব বললেন, রাহাত সাহেব আপনি এখন আসুন প্লিজ।

রাহাত সাহেব কোনকিছু বললেন না। মাথা নত করে বসে রইলেন, তাঁর সমস্ত শরীর ঘামতে শুরু করল, তাঁর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। তিনি নিশ্চিত হলেন তাঁর চাকরি আর থাকবে না। তবু শেষ বারের মতো রেজা সাহেবকে অনুরোধ করলেন, স্যার আমার ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ে মাসে মাসে তাদের পিছনে অনেক টাকা খরচ এখন যদি আমার চাকরিটা চলে যায় তবে ছেলে-মেয়েদের আর লেখাপড়া শেখাতে পারব না স্যার, আমার ছেলে-মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে স্যার। আমি খুব বিপদে পড়ব।

একটা কথা আপনার মনে রাখা উচিত ছিল, কনক একজন ডিরেক্টর, লিমিটেড কোম্পানিতে একজন ডিরেক্টরের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে। তারওপর আমি যাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছি সে আমার ছেলে কি না এ নিয়ে আপনার কৌতুহলী হওয়া কি ঠিক হয়েছে?

রাহাত সাহেব কোন কথা বললেন না। তাঁর চোখে-মুখে অপরাধ বোধের চিহ্ন ফুটে উঠল। কিন্তু রেজা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর কিছু বলার সাহস পেলেন না।

রেজা সাহেব বললেন, রাহাত সাহেব আপনি একটা নেমকহারাম, গাদ্দার, আপনি যে পাতায় খান সে পাতাই ছিদ্র করেন। আপনি মানুষ নামের কলংক। আমার কোম্পানিতে নেমকহারামের কোন স’ান নেই। বললাম তো আমি জালাল সাহেবকে বলে দিচ্ছি আপনি আপনার পাওনা নিয়ে আজই আমার অফিস থেকে চলে যাবেন কাল থেকে আর আপনার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। আপনি এখন যান, প্লিজ ডন্ট ডিস্টার্ব মি।

রাহাত সাহেব কি যেন বলত গিয়ে থমকে গেলেন। তাঁর জিহব্বা আড়ষ্ট হয়ে গেল, তিনি বেরিয়ে আসতে গিয়ে তাঁর পা দু’টো শিথিল হয়ে গেল। তিনি বিনয়ের সুরে বললেন, স্যার অনেকদিন থেকে এ কোম্পানিতে কাজ করছি একটা ভুল করে ফেলেছি আমাকে কি এবারে মতো মাফ করা যায় না?

আপনাকে মাফ করা আমার নীতি বিরুদ্ধ কাজ হবে। ক্ষমা পরম ধর্ম কিন্তু আমি মনে করি ক্ষমা অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়। তাই অপরাধীকে আমি কখনো ক্ষমা করি না।

রাহাত সাহেব আর কিছু বললেন না। তিনি রেজা সাহেবকে ভাল করে চিনেন রেজা সাহেব একবার মুখ দিয়ে যা বলেন তাই করেন তা আর বাতিল করেন না। তিনি ধীর পদে রেজা সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

রাহাত সাহেব চলে যাবার পর রেজা সাহেব আবার কলিং বেল টিপে জালাল সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। কয়েকমিনিটের মধ্যে জালাল সাহেব তাঁর রুমে ঢুকলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার?

বসুন।

জালাল সাহেব চেয়ারে বসলেন। রেজা সাহেব বললেন, জালাল সাহেব কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী রাহাত সাহেবের যা পেমেন্ট হয় দিয়ে দিন। কাল থেকে আমি অফিসে আসতে নিষেধ করে দিয়েছি।

জি স্যার।

আর হ্যাঁ রাহাত সাহেবের সঙ্গে যারা উঠা বসা করে তাদের সবাইকে বলে দিবেন এ বিষয়ে কারো মুখ থেকে কোন কথা বের হলে তার অবস’াও রাহাত সাহেবের মতোই হবে।

জি স্যার, সবাইকে বলে দিব।

আগামী কালকের কয়েকটা দৈনিক পেপারে রাহাত সাহেবের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিন তিনি আর এই কোম্পানির কেউ না। যদি কেউ তাঁর সঙ্গে কোন ধরনের আর্থিক লেনদেন করে তবে সেজন্য কোম্পানি দায়ী থাকবে না।

জি স্যার।

জালাল সাহেব চলে গেলেন এমন সময় রেজা সাহেবের মোবাইলের রিং বেজে উঠল, কাকলী কি হয়েছে?

তুমি তো বললে কনক অফিসে যায়নি, তারপর থেকে আমি মোবাইলে রিং দিচ্ছি প্রথম কয়েকবার মোবাইলে রিং হলো কিন্তু রিসিভ করল না তারপর মোবাইল অফ করে দিল, আমার খুব ভয় হচ্ছে ও কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে না তো।

তুমি কোন চিন্তা কর না কাকলী আমি দেখছি।

কিন্তু সে তো তুমি যাবার কিছুক্ষণ পরই বাসা থেকে চলে গেছে।

বললাম তো আমি দেখছি তুমি কিছু চিন্তা কর না, বলে রেজা সাহেব কনককে মোবাইল করলেন কিন্তু বার বার মোবাইল করার পরও কনক মোবাইল রিসিভ না করায় রেজা সাহেব ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন।

 

চৌত্রিশ

কনক আগে কখনো ঢাকা শহরের বাইরে বের হয়নি। তার এক বন্ধুর বাড়ি লালমনিরহাট, বুয়েটে পড়ার সময় তাকে অনেকবার গাবতলী  গিয়ে কোচে উঠতে শুনেছে তাই আজ লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার সময় কনকের সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ল। কনক তাকে মোবাইল করে আদিতমারী যাবার রুট জেনে নিল। গাবতলী থেকে লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়লো। সারাটা রাস্তায় কনকের নানান কথা মনে পড়ল। কি করবে সে? শাওনকে কি বলবে? যতই লুকিয়ে থাকুক না সে ছোট্ট এই ঢাকা শহরে ক’দিন লুকিয়ে থাকবে সে? কোন না কোন বন্ধু বা বান্ধবীর মাধ্যমে শাওন তার ঠিকানা জেনে ফেলবে তখন তো তাকে শাওনের মুখোমুখি হতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে। এভাবে কতদিন পালিয়ে বেড়াবে সে রেজা সাহেবও একদিন তার ঠিকানা জেনে ফেলবে, এতদিন যাকে বাবা-মা বলে জেনেছে তাদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে সে তো নিজেকে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে। তাছাড়া তাদেরও তো কোন দোষ নেই। চোখের সামনে ভেসে উঠল ঝুমলালের মুখচ্ছবিখানা, শরীরের চামড়া হাড়ের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে. চোখ দু’টা কোটরে বসে গেছে, কপালের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে, মলিন বস্ত্র, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দীর্ঘ জীবনে বয়ে যাওয়া দুশ্চিন্তা আর ধকলের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

কনককে দেখে তার চিন্তাযুক্ত চোখে-মুখে এক ঝিলিক সূর্যের আভা ফুটে উঠল, তু আইলবারো সাব, তোহারাকে বইঠে খাতিন ক্যাসে দেইম (আপনি এসেছেন স্যার, আপনাকে কি যে বসতে দেই)? বলে ঝুমলাল একটা চটের টুকরা টেনে দিতে দিতে ঝরনা বলে ডাক দিল।

আমি আপনার ছেলে বাবা, হরলাল, আপনি আমাকে হরলাল বলেই ডাকবেন।

না বাবা তু হামার হরলালয়া না হবে, হাম তোহারকে রেজা সাবকে দিহল নামসে বলায়েম, তোহারকে হাম কনক সাবসে বলায়েম (না বাবা আপনি আমার ছেলে হরলাল না, আমি আপনাকে রেজা সাহেবের দেয়া নাম ধরেই ডাকব, আপনাকে আমি কনক নামেই ডাকব)।

ঝরনা বাড়িতে ঢুকলো, ক্যা ভইলবা ভ্যা ভ্যা করকে কা বলোতার (কি হয়েছে এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ডাকছ কেন)? বলে ঝরনা কনককে দেখে জিহব্বায় কামড় কাটল।

ঝুমলাল কনকের সঙ্গে ঝরনার পরিচয় করে দিল, ঝরনা ই হরন কনক সাব যেকর বাত হাম বললে রহনি (ঝরনা এ হচ্ছে কনক সাহেব যার কথা তোমাকে বলেছিলাম), তারপর কনককে বলল, বাবা ই হ ঝরনা, হামার জানানা (বাবা এ হচ্ছে ঝরনা আমার স্ত্রী)।

কনক পা ছুঁয়ে সালাম করল, মা আমি তোমার ছেলে হরলাল।

ঝরনা কনকের মাথা ছুঁয়ে বলল, বচ ক্যা রহ বাপ (বেঁচে থাক বাবা)।

বাবা হাম বহুত দিন আগে তোহারাকে রেজা সাবকে দে আইলবানি তোহারাকে আদমি ক্যা নিহন আদমি বানায়ে খাতিন, সেদিন যব তোহারাকে দেখলেবানি উদিন হামার বুক গরবসে ভর গইল রহল। হাম তোহারাকে জীবনসে মেথর ক্যা কলং মুছা দেয় চাহলে বহনি ওহি খাতিন তোহারকে রেজা সাবকে কিহে দে আইল রহনি। রেজা সাব উনকর দায়িত্ব পালন করলে বারন, হাম ভগবান কিহে প্রার্থনা করতানি উ যেন উনকার মঙ্গল করেন। হাম আপন আঁখি সে দেখ আইলবানি তু বড় সাব ভইলবারো। হামার জীবনে ম্যা অব মাংগে কুস নেইখে। (বাবা আমি অনেকদিন আগে আপনাকে রেজা সাহেবের কাছে দিয়ে এসেছিলাম আপনাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য, সেদিন যখন আমি আপনাকে দেখেছি তখন আমার বুকটা গর্বে ভরে গেছে। আমি আপনার জীবন থেকে সুইপারের কলংক মুছতে চেয়েছিলাম তাই আপনাকে রেজা সাহেবের কাছে দিয়ে এসেছিলাম। রেজা সাহেব তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, আমি ভগবানের কাছে আশীর্বাদ করি ভগবান যেন তার মঙ্গল করেন। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি আপনি বড় অফিসার হয়েছেন। আমার জীবনে আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই বাবা), বলতে বলতে ঝুমলালের দু’চোখের কোণায় পানি জমে গেল।

তু তানি বইঠ তোহার খাতিন চা-নাস্তা লে আই (আপনি একটু বসুন বাবা, আমি আপনার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসি), বলে ঝরনা চলে গেল।

ঝরনা চায়ের দোকানে নিজের প্লেট আর গ্লাস দিয়ে বলল, তিন গো পরঠা, দু’গো মিঠাই তনিসে ভাজি দে তো (তিনটা পরটা, দু’টা মিষ্টি আর ভাজি দেন তো) তারপর চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বলল, নিমন সে তিন কাপ চা দে তো (ভাল করে তিন কাপ চা দাও)।

দোকানদার নাক সিটকিয়ে বলল, এই ভিতরে ঢুকেছ কেন, বের হও ভাল করে আবার কি চা যেমন হয় তেমন করেই দিব। সুইপারের ঘরে এমন কে এসেছে যে ভাল করে চা খাওয়াবে?

বহুত বড় মেহমান আইলবা। হামার ঘরে এগো বহুত বড় মেহমান আইলবা, ঢাকা ম্যা রহেলা, ইঞ্জিনিয়ার হ, বহুত রুপিয়া মাহিনা পায়লা। এতনা বড় ইঞ্জিনিয়ার এই আদিতমারী ম্যা এককো নাইখে (অনেক বড় মেহমান এসেছে। আমার বাসায় অনেক বড় মেহমান এসেছে, ঢাকায় থাকে, ইঞ্জিনিয়ার, অনেক টাকা মাইনে পায়। এতবড় ইঞ্জিনিয়ার এই আদিতমারী থানায় আর একটাও নেই)।

এতবড় ইঞ্জিনিয়ার আবার তোমার বাসায় এলো কেন? সে কি আর আসার জায়গা পেল না, বলে দোকানদার নিজে নিজে হো হো করে হেসে উঠল তার সঙ্গে আরো কয়েকজন হাসিতে যোগ দিল।

আই না কাঁহে খাতিন। উ যে হামার বেটা হরলালয়া হ। বহুত আগে ওখর বাপ ওখরাকে হেরা দেলে রহল তব যাকে এক ভদ্র লোক ওখরাকে পড়ালিখা শিখাকে বহুত বড় কইলেবা। দেখ রক্ত ক্যা টান। লাইকা বড় হকে ঠিক চলিয়াল বাপকি হে (আসবে না কেন সে যে আমার ছেলে হরলাল। অনেক আগে ওর বাবা ওকে হারিয়ে ফেলেছিল তারপর এক ভদ্রলোক তাকে পেয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করেছে। দেখেন রক্তের টান বড় হয়ে ছেলে ঠিকই বাবা-মা’র কাছে চলে এসেছে)।

সবাই আরেকবার হেসে উঠল। তারপর একজন বলল, তাহলে তো তোমার ছেলেকে একবার দেখতে যেতে হয়।

ঝরনা কিছু বলল না মুখ বুজে সব কথা সহ্য করে চা-নাস্তা নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো।

ঝরনা কনককে চা-নাস্তা দিয়ে বলল, খা লে বাবা (খাও বাবা)।

কনক জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি খাবে না?

হামনিকুল সেবেবে নাস্তা খাইলেবনি, তু রাত জাগকে আইলবারো বাবা, তু খা। হাম খালি এক কাপ চা পিলে (আমরা সকালবেলা নাস্তা খেয়েছি বাবা, তুমি রাত জেগে এসেছ, তুমি খাও। আমি শুধু এক কাপ চা খাব)।

কনক নাস্তা খেতে শুরু করল। ঝরনা পাখা দিয়ে কনককে বাতাস করল। চা খেতে খেতে কনক গল্প করল। তার ভাই-বোন, বাবা-মা’র সংসার কিভাবে চলে সব জেনে শুনে কনকের মন বেদনায় ভরে গেল। বার বারই তার নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার বাবা-মা এত কষ্ট করে এখানে পড়ে থাকবে আর সে ঢাকা শহরে এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে টাকা রোজগার করবে। সে অনেক ভেবে চিন্তে তার বাবাকে বলল, তোমরা চল বাবা আমার সঙ্গে, আমি ঢাকা শহরে তোমাদের জন্য ভাল খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করব। আমি যেভাবে খাব, যেখানে থাকব তোমরাও সেভাবে থাকবে বাবা। তোমাদের কিছু করতে হবে না, সেখানে কেউ তোমাদের চিনবে না।

ঝুমলাল প্রবল আপত্তি জানাল। অবশেষে কনক নাস্তা শেষ করে ঢাকায় ফিরবার জন্য বাসা থেকে বের হলো। ততক্ষণে ঝুমলালের বাসার সামনে মানুষের ভীড় জমে গেছে। কনক কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল, আপনারা?

দাড়িওয়ালা একজন বয়স্ক লোক বলল, শুনলাম আপনি নাকি ঝুমলালের হারিয়ে যাওয়া হরলাল?

জি আপনার ঠিকই শুনেছেন।

আরো শুনলাম আপনি নাকি ইঞ্জিনিয়ার?

জি আমি বুয়েট থেকে বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি।

আগত লোকেরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, আল্লাহ ইচ্ছা করলে কি না করতে পারেন, সুইপারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে আর আমাদের ছেলেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়ার সুযোগই পায় না।

হ্যাঁ তাই তো, এখন থেকে আমার বাবাকে মানুষ মনে করবেন, আপনারা অনেকে যা পারেন নি আমার বাবা তা পেরেছেন। সেক্ষেত্রে আমার বাবাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নাই। আমি যদি আপনাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে জন্মগ্রহণ কারে চাঁদাবাজ বা কোন পেশাদার সন্ত্রাসী হতাম তাহলে কি ভাল হতো নাকি সুইপারের ঘরে জন্মগ্রহণ করে অনেক বড় হয়েছি এটা ভাল হয়েছে? সুইপার একটা পেশার নাম, আজকাল সুইপার পদে অনেক উঁচু জাতের, সম্মানী সমপ্রদায়ের মানুষও চাকরি করছে, কই তাদের দেখে তো কেউ নাকে ঢাকা দেয় না, তাদের তো কেউ হোটেলে ঢুকতে নিষেধ করে না তবে আমার বাবাকে দেখে, আমাদের সমপ্রদায়ের মানুষকে দেখে এমন আচরণ করবেন কেন? এমন একদিন আসবে যখন ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয় আর সুইপার বলে মানুষে মানুষে কোন ভোদাভেদ থাকবে না। এখন থেকে মনে রাখবেন আমার বাবা সুইপার পেশার একজন ইঞ্জিনিয়ারের বাবা তাকে মানুষের মতো সম্মান করবেন।

উপসি’ত লোকজন গভীর মনোযোগ দিয়ে কনকের কথা শুনতে লাগল। দু’য়েকজন কনকের কথায় মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

কনক খেয়াল করল, তার বাবার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আগত লোকজন যারা ঝুমলাল এবং ঝরনাকে তিরস্কার করার জন্য এসেছিল তারা চলে গেল।

কনক বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

বাস দ্রুতগতিতে চলছে, বাসের গতিতে যেন সীমাবদ্ধতা নেই, কত কিলোমিটার গতিতে চলছে কে জানে? বাস তিস্তা ব্রীজের কাছাকাছি পৌঁছালো। অপর দিক থেকে আগত বাসকে ব্রীজ পারাপারের সুযোগ দিতে কনক যে বাসটাতে বসে আছে সেটাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। হয়তবা এখানে বাসগুলোকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সে কারণে এ লাইনের বাসগুলোকে সময় মতো গন্তব্য পৌঁছানোর জন্য দ্রুতগতিতে চালাতে হয়।

 

পঁয়ত্রিশ

রাতে কনক বাসায় ফিরেনি। রাত আটটা পর্যন্ত রেজা সাহেব মনে করেছিলেন হয়ত কোন বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে পারে কিন্তু রাত দশটা অতিক্রম করার পরও কনক বাসায় না ফেরায় রেজা সাহেব এবং কাকলী দু’জনে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সেই দুপুরের পর থেকে কাকলী বার বার করে মোবাইল করেছেন, প্রথম দু’য়েক বার মোবাইলে রিং করার সময় মোবাইল চালু ছিল তারপর থেকে মোবাইল বন্ধ রয়েছে। কনক কখনো বাসার বাইরে রাত কাটায়নি। তাকে ছাড়া আজ রেজা সাহেব এবং কাকলী দু’জনে বেশ নিঃসঙ্গ বোধ করলেন তাদের মাথায় অনেক অনাকাংখিত দুশ্চিন্তা ভীড় করল। কনক কোন অপহরণকারীর খপ্পরে পড়েনি তো! রেজা সাহেব শুনেছেন অপরহণকারীরা নাকি চাঁদা দাবি করার ক্ষেত্রে মোবাইল অপেক্ষা টেলিফোনকে বেশি প্রাধান্য দেয় কারণ এখনো দেশে সব টেলিফোন সেট এর সঙ্গে কলার আই.ডি সংযুক্ত হয়নি। রাত দশটার পর রেজা সাহেবের এমনি নানান কথা মনে হলো যতবার টেলিফোন এসেছে ততবারই তিনি আতংকিত হয়ে টেলিফোন রিসিভ করেছেন নিষ্ঠুর কর্কশ ধ্বনিতে টাকার দাবি শুনতে হবে না তো!

রাত যত গভীর হলো তাঁদের আশংকা ততই বাড়তে থাকল। কাকলী কনকের গর্ভধারিনী মা নয় কিন্তু দিনে দিনে তিনি কনকের গর্ভধারিণী মায়ের অধিকার অর্জন করেছেন। সেই মায়ের মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। কিছুক্ষণ পর পর রেজা সাহেবকে অদ্ভুত এবং অবাস্তব সব কাজ করতে বলছেন একবার বললেন, থানায় ফোন কর আবার একবার বললেন হাসপাতালে খবর নাও।

রেজা সাহেব কাকলীর মুখের দিকে তাকাতেই তাঁর বুক ভেঙ্গে গেল। কাকলীর দু’চোখে পানি টলমল করছে তাঁর মুখচ্ছবিতে হৃদয়ের নীরব কান্নার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

রেজা সাহেব বললেন, কাকলী আমি তোমার মনের অবস’া বুঝতে পারছি কিন্তু কি করব বল আমারও আর মাথায় কুলাচ্ছে না। কাল সকাল হোক তখন না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

তুমি কাল সকালে ব্যবস্থা করবে কিন্তু আমি যে আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না, একদিনও ও বাসার বাইরে রাত কাটায়নি আমরাও ওকে ছেড়ে এক রাত কাটায়নি। তুমি কি বিষয়টাকে সহজভাবে নিচ্ছ? কোন অসুবিধা না হলে ও কেন হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে? আর যাবেই বা কোথায়? ওর তো আমরা ছাড়া কোথাও যাবার জায়গা নেই। তাছাড়া মোবাইল অফ করে রাখবে কেন? আমার মনে হচ্ছে ওর  কোন বিপদ হয়েছে। তুমি তো একবার জালাল সাহেবকে মোবাইল করতে পার, তোমার কোন্‌ পুলিশ বন্ধু আছে, আমাদের কোম্পানির লিগ্যাল এ্যাডভাইজার আছে তাদের সঙ্গে তো একবার কথা বলতে পার। তুমি হাত পা গুটিয়ে বসে আছ কেন?

কাকলী এখন রাত বারটা বাজে এত রাতে কাউকে মোবাইল করা যায় না বলছি তো সকাল হোক। তখন দেখা যাবে।

কাকলী রাগান্বিত স্বরে বললেন, আর আমরা সারারাত এভাবে জেগে কাটাব। তোমার মোবাইলটা আমাকে দাও আমি জালাল সাহেবকে একবার মোবাইল করে দেখি।

কাকলী রেজা সাহেবের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে জালাল সাহেবকে মোবাইল করলেন।

অপর পাশ থেকে জালাল সাহেবের কন্ঠস্বর ভেসে এলো, ম্যাডাম এত রাতে আপনি মোবাইল করেছেন, কোন সমস্যা হয়নি তো?

কাকলী বললেন, জালাল সাহেব সমস্যা হয়েছে বলেই তো এত রাতে আপনাকে মোবাইল করেছি।

জি ম্যাডাম বলুন, কি হযেছে?

কাকলী কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, জালাল সাহেব কনক সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে এখনো বাসায় আসেনি।

মোবাইল ধরছে না?

না।

ম্যাডাম ওর বন্ধু-বান্ধবদের কারো মোবাইল নাম্বার জানেন? তাদের কারো কাছে গেছে কি না?

আমরা তো ওর বন্ধু-বান্ধব কারো মোবাইল নাম্বার জানি না। কোথায় খুঁজব? কি করব বলুন তো?

ম্যাডাম আমার মনে হয় মন ভাল নেই তাই কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যেতে পারে। আমি কনক সাহেবের মোবাইলে চেষ্টা করছি যদি মোবাইলে পেয়ে যাই তবে তো ভাল আর যদি না পাওয়া যায় তবে কাল দিনের বেলা থানা, হাসপাতাল সব জায়গায় খবর নিতে হবে। আমার মনে হয় তেমন কিছু হয়নি হয়ত তিনি নিজেই কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায় গিয়ে আটকা পড়েছেন বা দূরে কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আজ আর ফিরতে পারেন নি। কাল ঠিকই চলে আসবেন ইনশা আল্লাহ।

কাকলী বললেন, জালাল সাহেব আপনি যত সহজ মনে করছেন আসলে তত সহজ নয়। আমার মনে হয় নিশ্চয়ই কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ম্যাডাম আপনি অযথা বেশি দুশ্চিন্তা করছেন। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এতক্ষণে জানতেন।

কিভাবে জানতাম?

এই ধরুন আল্লাহ না করুন কোন দুর্ঘটনা ঘটলে থানা কিংবা হাসপাতাল থেকে এতক্ষণ খবর পেয়ে যেতাম। ম্যাডাম আপনি ধৈর্য্য ধরুন ইনশাআল্লাহ কাল স্যারকে খুঁজে বের করব।

কাকলী মোবাইল রেখে দিয়ে বললেন, তোমার স্টাফরা সব তোমার মতোই।

শাওন সারাদিনে অনেকবার কাকলীকে মোবাইল করে কনকের খবর নিয়েছে। সে নিজেও তার বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে যাদের মোবাইল নাম্বার তার কাছে ছিল তাদের কাছ থেকে কনকের খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু কনককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শাওনও ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছে। সে বার বার করে কাকলীকে মোবাইল করেছে। কাকলী মোবাইল রাখতেই তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

কাকলী মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

মা কোন খবর পেলেন?

তুমি আর আমাকে মা বলিও না মা। তোমার বাবা তোমাকে কনকের সঙ্গে বিয়ে দিবে না বলে আজ এই দুর্ঘটনা। যেখানে তোমার বাবা বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে, আমার ছেলে ঠিকানাবিহীন, সেখানে তুমি খালি খালি আমাকে মা বলে অপমান করছ কেন মা?

আপনাকে তো আমি একবার মা বলে ডেকেছি মা, মা মেয়ের সম্পর্ক যে ছিন্ন হবার না। আমি আপনাকে মা বলেই ডাকব, আপনি খুশি হলেও মা বলে ডাকব, আপনি রাগ করলেও মা বলে ডাকব।

কাকলী আর শাওনকে না করতে পারলেন না।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন খবর পেলে মা?

মা আমার কাছে আমাদের বন্ধুদের যাদের মোবাইল নাম্বার ছিল সবাইকে রিং করেছি কিন্তু সে কোথাও যায়নি।

কাকলী রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, তবে গেছে কোথায় মা?

অপর পাশ থেকে শাওনের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো, আমার খুব ভয় হচ্ছে মা? কনক কোন অপহরণকারীর হাতে পড়েনি তো?

তোমার মতো আমারও খুব ভয় হচ্ছে মা। নিশ্চয়ই তেমন কিছু না হলে একটা জলজ্যান্ত মানুষ যাবে কোথায়?

মা থানা কিংবা হাসপাতালে খবর নেয়া হয়েছে?

কাকলী বললেন, না মা, কাল সব জায়গায় খবর নিতে হবে।

কাকলী মোবাইল রেখে দিলেন। রেজা সাহেব এবং কাকলী সারারাত কনকের স্মৃতিচারণ করে পুরো একরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন। শাওন রাত দশটার দিকে কনকের কথা তার বাবাকে বলেছে।

জাকারিয়া সাহেব শাওনের মুখে কনকের কথা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন, যার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই সে কোথায় গেল না গেল তা জেনে আমাদের কি প্রয়োজন? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা ছেলে যাবে কোথায়? হারিয়ে যাবার বয়স অনেক আগেই পার হয়ে গেছে, এতদিন রেজা সাহেবের পরিচয়ে মানুষ হয়েছে এখন সুইপার হিসেবে পরিচয় দিতে হবে তাই লজ্জায় গা ঢাকা দিয়েছে। ক’দিন পরে ঠিকই চলে আসবে।

শাওন তারপর থেকে তার বাবাকে আর কিছু বলেনি অপ্রত্যাশিতভাবে কনকের বাসায় না ফেরার কথা শোনার পরও তার প্রতি সহানুভূতিশীল না হওয়ায় শাওন তার বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ করেছে। শাওন আর কাউকে কোন কথা বলতে পারেনি। তার মনের মধ্যে শুধু বার বার কনকের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠেছে আর গুমরে গুমরে সারারাত কেঁদেছে। না ঘুমিয়ে একটা রাত কেটে গেল শাওনের, নির্ঘুম রাত, তাও আবার বোবার মতো কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে একাই কখনো রুমের মধ্যে কখনো বেলকনিতে পায়চারি করতে করতে।

জাকারিয়া সাহেবের সকালবেলা শয্যা ত্যাগের অভ্যাস। তিনি বিছানা থেকে উঠে শাওনের রুমে আলো জ্বলতে দেখে দরজা নক করলেন।

শাওন দরজা খুলে দিল।

জাকারিয়া সাহেব শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। শাওন ফর্সা, তার চোখ দু’টা খয়েরি রংয়ের সারারাত না ঘুমানোর ফলে তার চোখ দু’টা যেন জবা ফুলের মতো রক্তিম আকার ধারণ করেছে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

জাকারিয়া সাহেব স্লেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, পৃথিবীতে তো অনেক মানুষ আছে কে কোথায়? কি অবস্থায় আছে? সেজন্য তো সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়া তোর একেবারে ঠিক হয়নি মা।

শাওন তার বাবার মুখের দিকে তাকাল। তার বাবার মুখে বিন্দুমাত্র চিন্তার ছাপ নেই, মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে মেয়ের ভালবাসাকে অপমান করে তিনি যেন মহাকর্তব্য কাজ করেছেন। তাকে একেবারে ফ্রেস দেখাচ্ছে। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, মা রবীন্দ্রনাথের একটা ছোটগল্পে পড়েছিলাম শেষের ডায়লগটা ছিল এরকম, ফিরিয়া ফল কি পৃথিবীতে কে কাহার? কনকের সঙ্গে বিয়ে হলো না তোকে আমি তার চেয়ে ভাল ছেলের সাথে বিয়ে দিব। তোর বিয়ে নিয়ে আমি মোটেই ভাবিনা।

শাওন কিছু বলল না। তার বাবার কাছ থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল।

 

ছত্রিশ

কনক সকালবেলা আশিকের ম্যাসে ফিরেছে। সেদিন ছিল শনিবার আশিকের অফিস ছিল না। কনক অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিল। ততক্ষণে আশিক বিছানা ছেড়ে উঠে কনকের নাস্তার ব্যবস্থা করেছে। তারপর কনককে মৃদুকন্ঠে ডাক দিল, কনক, কনক।

কনক বিছানায় উঠে বসল।

আশিক বলল, বেলা দশটা বাজে আগে নাস্তা কর্‌ পরে আবার ঘুমাস্‌।

কনক বিছানায় উঠে বসল, না রে আর ঘুমাবো না।

তোর চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে, শরীরের যত্ন নিস্‌ না বুঝি?

কনক একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, আর শরীরের যত্ন!

তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে নে, কোথাও বের হব।

কনক বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে নাস্তা খেয়ে বলল, টি.ভি’টা একবার চালু কর না, খবরটা শুনি।

আশিক টি.ভি’টা চালু করল। খবরের মধ্যে বিরতিতে টি.ভি’র পর্দায় ভেসে উঠল, “একজন মুমূর্র্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ” যোগাযোগের ঠিকানা লিখে পঙ্গু হাসপাতালের সিট নাম্বার, কক্ষ নাম্বার এবং শাওনের মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে, হ্যাঁ শাওনের মোবাইল নাম্বারই তো।

কনক ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল। শাওনের কিছু হয়নি তো?

কনক সঙ্গে সঙ্গে শাওনকে মোবাইল করল, হ্যালো শাওন।

কনক তুই? কোথায় গিয়েছিলি? তুই কিছু জানিস্‌ না?

না শাওন আমি তো কিছু জানি না।

বাবা পঙ্গু হাসপাতালে তুই এখনি চলে আয় কনক, বাবার অবস’া ভাল না, যে কোন সময় বড় ধরনেব দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমার খুব ভয় লাগছে, প্লিজ তুই আমার এই দুঃসময়ে আমার কাছে থাক্‌ কনক।

তুই কিছু চিন্তা করিস্‌ না শাওন আমি আর আশিক আসছি। আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’ আমি রক্ত দিব প্রয়োজন বোধে আমার সব রক্ত দিয়ে তোর বাবাকে আমি সুস’ করে তুলব, তুই কোন চিন্তা করিস্‌ না, বলে কনক মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে আশিকসহ বের হলো।

কমলাপুর থেকে পঙ্গু হাসাপাতাল পৌঁছাতে কনকের প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। শাওন হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে কনকের জন্য অপেক্ষা করছিল। কনককে দেখে শাওন হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। কনক সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কাঁদিস্‌ না শাওন আমি তো এসে পড়েছি, আর চিন্তার কিছু নাই। চল্‌ ভিতরে চল্‌। আমি ডাক্তারকে বলছি যে কয়েক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয় আমি দিব। চল্‌ ভিতরে চল্‌ বলে কনক আশিক এবং শাওনসহ ডাক্তারের কাছে গেল। শাওন ডাক্তারকে বলল, ডাক্তার সাহেব ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত পাওয়া গেছে আপনারা ব্যবস্থা করুন ডাক্তার সাহেব আমার বাবাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব।

ডাক্তার সাহেব বললেন, হ্যাঁ আপাতত এক ব্যাগ রক্ত পাওয়া গেল তাই রক্ষা কিন্তু রক্ত তো প্রয়োজন কমপক্ষে তিন ব্যাগ।

কনক আবেগ প্রবণ হয়ে বলল, আমি দিব ডাক্তার সাহেব আমি দিব তিন ব্যাগ রক্ত।

ডাক্তার সাহেব বললেন, সরি, একজনের কাছ থেকে এক ব্যাগের বেশি রক্ত নেয়া যায় না। আপনারা অন্য কোথাও আরো দু’ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করুন। আপনি আসুন আমি আপনার রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করছি।

শাওন কনক রক্ত দিক, আমার রক্তের গ্রুপ ‘বি পজেটিভ’ না হলে আমিও রক্ত দিতাম। আমি একবার ঢাকা শহরের সমস্ত ব্লাড ব্যাংক চেক করে দেখি, যে করেই হোক আমি রক্ত না নিয়ে ফিরছি না, বলে আশিক চলে গেল।

কনক এক ব্যাগ রক্ত দিল তবুও জাকারিয়া সাহেবের জ্ঞান ফিরল না। প্রায় দু’ঘন্টা পর আশিক আরো দু’ব্যাগ রক্ত নিয়ে হাসপাতালে ফিরল। কনক, আশিক এবং শাওন হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জাকারিয়া সাহেবের জ্ঞান ফিরবার জন্য অপেক্ষা করছিল।

জাকারিয়া সাহেবের যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি হাসপাতালের বেড-এ শুয়ে আছেন। চারপাশের বেড এ শুধু আহত মানুষ, কারো চোখে-মুখে আঘাতের চিহ্ন, কারো হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, কারো মাথায় ব্যান্ডেজ, হাসপাতালের এই ওয়ার্ডটি যেন আহত মানুষে ভরে গেছে। জাকারিয়া সাহেবের পাশের বেড-এ একজন রোগী শুয়ে আছে, গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হাতে স্যালাইন পুশ করা আছে। ডান পাশের বেড-এ আরেকজন রোগী নিদ্রাবিহীনভাবে বিছানায় ছট্‌ফট করছে পায়ে ব্যান্ডেজ, চিবুকে ব্যান্ডেজ, প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। জাকারিয়া সাহেবের হাতে পায়ে এবং মাথায় ব্যান্ডেজ কিন্তু ব্যাথা নেই, হাতে স্যালাইন পুশ করা আছে।

এখন সময় কত? জাকারিয়া সাহেব একবার অনুমান করার চেষ্টা করলেন। জাকারিয়া সাহেব কখনো হাতঘড়ি ব্যবহার করেন না। তিনি একবার মোবাইলটা খোঁজার চেষ্টা করলেন। তিনি অনুমান করলেন প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা আছে কিন্তু পকেট থেকে মোবাইলটা বের করার মতো প্রাণশক্তি যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। জাকারিয়া সাহেব একবার এপাশ-ওপাশ করে দেখলেন কিন্তু তিনি কিছুতেই চিনতে পারলেন না। এটা হাসপাতাল এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু কোথায়? কোন্‌ হাসপাতাল? কাউকে একবার দেখতে পেলে জানা যেত জায়গাটা কোথায়? তিনি কিভাবে এখানে এলেন? ধীরে ধীরে ডান পাশের লোকটার ব্যাথা বোধ হয় বেড়ে চলেছে, সে আরো জোরে কাতরাচ্ছে, অনেকক্ষণ পর একজন নার্স এলো। সে লোকটার কাছে কি যেন শুনলো জাকারিয়া সাহেব বুঝতে পারলেন না। নার্স চলে যাচ্ছিল জাকারিয়া সাহেব মৃদু কন্ঠে ডাক দিলেন, সিস্টার একটু শুনুন।

সিস্টার কাছে এলো, কিছু বলবেন?

এটা কোন্‌ হাসপাতাল?

ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল।

আমি কিভাবে এখানে এলাম?

একটু মনে করার চেষ্টা করুন।

সিস্টার দাঁড়িয়ে রইল। জাকারিয়া সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, আমি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে সাভার ই.পি.জেড এ যাচ্ছিলাম রাস্তায় একটা ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, তারপর, তারপর………আর মনে করতে পারছি না।

সিস্টার একটু হাসল, যাক তাহলে মনে করতে পারছেন, ডাক্তাররা আপনাকে নিয়ে খুব আশংকা করছিলেন। যাহোক আপনার স্মৃতি শক্তি ঠিক আছে।

সিস্টার চলে যাচ্ছিল। জাকারিয়া সাহেব ডাক দিলেন, সিস্টার।

সিস্টার আবার ফিরে দাঁড়াল।

জাকারিয়া সাহেব কি যেন বলতে চেয়েছিলেন মনে নেই। তিনি কিছু বললেন না।

সিস্টার বলল, যাই আপনার আত্মীয়-স্বজনরা সবাই আপনার ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করছেন, গিয়ে পাঠিয়ে দিই।

সিস্টার চলে গেল। প্রথমে শাওন জাকারিয়া সাহেবের বেড এর কোণায় এসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এখন কেমন লাগছে বাবা?

ভাল রে মা।

বাবা তোমাকে না জানিয়ে আমি তোমার শরীরে একটা নীচু জাতের মানুষের রক্ত ঢুকিয়েছি ।

আর লজ্জা দিস্‌ না মা। তুই নিশ্চয়ই কনকের রক্ত আমার শরীরে ঢুকিয়েছিস্‌। আমি জানি আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’ যা পাওয়া খুব দুস্কর। কনকের রক্তের গ্রুপও নিশ্চয়ই ‘ও নেগেটিভ’ ও আমাকে রক্ত দিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ মা। আসলে আমি অর্থ আর ক্ষমতার মোহে পড়ে মানুষকে মানুষ মনে করতাম না। মানুষে মানুষে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ করে তোর প্রতি অন্যায়, কনকের প্রতি অন্যায় করেছি। কনক আমাকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে প্রমাণ করল মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সব মানুষই একই রক্ত মাংসের তৈরী। আসলে জন্মের জন্য আমরা কেউ দায়ী নই, উঁচু বংশে বা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটা কারো ক্রেডিট না। আমরা সবাই দায়ী নিজের কর্মের জন্য। মা শাওন আমি তোদের কষ্ট দিয়েছি মা, আমি তোদের পবিত্র ভালবাসাকে অপমান করেছি, যা আমি মোটেই ঠিক করিনি। তুই একবার কনককে আমার কাছে নিয়ে আসতে পার্‌বি?

ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বাবা তোমার ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করছে, আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।

ততক্ষণে কাকলী এবং রেজা সাহেবও হাসপাতালে এসে পৌঁচেছেন। শাওন কাকলীকে সালাম দিয়ে বললেন, ভিতরে আসুন মা, বাবার জ্ঞান ফিরেছে সবাই আসুন, কনক, আশিক তোরাও আয়।

সবাই ভিতরে চলে গেল, কনক গেল না। সে বলল, সরি শাওন আমি যেতে পারছি না, আমি এখন আসি।

না, না কনক তুই যাবি না।

আমি তোদের এই সমাজের মানুষ না শাওন, আমি একজন সুইপারের ছেলে।

তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না কনক, আমি শুধু তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে, বলতে বলতে শাওন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল।

বাঃ এতদিন তুই তুই করে বলার পর আজ হঠাৎ করে তুমি বলতে শুরু করলি। সবকিছু জানার পরও-

তবুও আমি তোমার।

 

সমাপ্ত।

আমাকে ফেসবুকে এড করতে ভিজিট করুন: https://web.facebook.com/profile.php?id=100000449437795

আমার লেখা গল্প এবং উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি শর্ট ফিল্ম দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন: https://www.youtube.com/watch?v=cMxZl1-ACMY&t=360s

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস