দুঃখবিলাস

দুঃখবিলাস

হৃদয়ে বাঁধতে না পারলে শিকলে বাঁধা যায় না তবু শিকলে বাঁধার চেষ্টা কোথায় না চলে, রাষ্ট্রীয় জীবন, সমাজ জীবন থেকে ব্যক্তি জীবন, দাম্পত্য জীবন পর্যন্ত শিকলে বাঁধার চেষ্টা চলে অবিরত। শিকলে বাঁধা মানুষটি খাঁচায় বন্দি পাখির মতো মুক্তির জন্য ছটফট করে, তার অন্তরে আগুনের লেলিহান শিখা যখন তাকে দগ্ধ করে তখনও সবাই বলে সেতো বেশ সুখেই আছে। আহারে মানুষের চোখ শুধু বাইরেই দেখে, রক্ত মাংসের ভিতরে লুকানো অদৃশ্য হৃদয়টা কেউ দেখতে পায় না।

সংসার কখনো মায়ার বাঁধন, কখনো শাসনের শৃঙ্খল আর কখনোবা সামাজিক অনুশাসনে বাঁধা। ইরা তেমনি এক শিকলে বাঁধা জীবন কাটিয়ে দিলো পঁচিশ বছর। কেউ জানতো না তার মনের অবস্থা, আসলে তার মনের অবস’াটা যেনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর সবুজের সমারোহ। তার ফর্সা, সুন্দর, হাস্যজ্জ্বল মুখের আড়ালে যে পুড়ে কয়লার মতো কালো হয়ে যাওয়া একটা হৃদয় আছে তার খবর কেউ কোনোদিন রাখেনি। ইরা যখনই এই শেকল ছিন্ন করে মুক্তির স্বাদ নিতে চেয়েছে তখনই বাধা এসেছে, বহুমুখী বাধা। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-সংসার, সামাজিকতা আর একমাত্র সন্তান শুভ’র মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য চাপ এসেছে। কখনো ইরা সেই বাধা অতিক্রম করতে পারেনি, কখনো শেকল ছিন্ন করতে পারেনি কিন’ যেদিন সে শেকল ছিন্ন করে, পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবন, তেইশ বছরের সন্তান, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠা বাড়ি ছেড়ে চলে এলো তখন পুরো এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠলো, এমন কী অসুবিধা ছিলো? সারাজীবন তো দেখেছি মেয়েটা হাসি-খুশিই ছিলো। সংসারে তেমন কোনো অসুবিধাই ছিলো না। চলে যাবার আগে একবার তো অন্তত: বলতে পারতো সবাইকে? সবাই মিলে মিশে একটা মিটমাট করে দিতো।

অনেকেই ইরার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললো, আসলে মতির বিরুদ্ধে ইরার অভিযোগগুলো তার বানানো, পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে ও ঘর ছেড়েছে আর এতদিন পর মতির মতো ভদ্র একজন স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সেই চলে যাওয়াকে যুক্তিযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করছে।

কেউ একবারও প্রশ্ন তুললো না, সাজানো-গুছানো সংসার ছেড়ে কেনো ইরা কোথা থেকে চাকরি করতে আসা এক ইঞ্জিনিয়ারের নাকি লেখকের হাত ধরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো?

সমাজের বিচার চিরকালই একপেশে। সমাজের কাছে তার সামাজিকতা, বেঁধে দেয়া নিয়ম-কানুনই বড়, বড় যান্ত্রিক সমাজের নিয়ম-কানুনগুলো। যেনো মিলে যেতে চাই এক’শতে একশো। এর বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হলেই যেনো হৈ চৈ পড়ে। সমাজের চোখে হয়ে যায় নিন্দনীয়। মানুষের অধিকার যেনো সমাজের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইরা ফোন করেছে, হ্যালো।

হ্যালো।

কোথায় তুমি?

আমার অফিসে, তুমি?

আমি এখন বটতলী, আর দশ মিনিটের মধ্যে বাস থেকে নামবো, তুমি বাস স্ট্যান্ডে চলে এসো, ওকে?

ওকে।

 

ইরা বাস থেকে নামলো। দু’হাতে দু’টো বড় ব্যাগ। জয় জিজ্ঞেস করলো, এতো বড় বড় ব্যাগ কেনো?

ইরার মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো, আমি তোমাকে বলিনি আমি একেবারে আসছি? এখন ন্যাকামি করছো, না?

না, ন্যাকামি করিনি, তবে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এমনি এমনি বলছো। তাই আমি বলেছি চলে এসো, তুমি যে সত্যি সত্যি….

ইরা জয়ের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললো, হ্যাঁ সত্যিই, তোমাকে বাসা দেখতে বলেছিলাম, দেখেছো?

না মানে, বলে জয় একটা ঢোক গিলতেই ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, মানে মানে করবে নাকি একটা অটো ডাকবে?

অটো ডাকবো? যাবো কোথায়?

ইরা জ্বলে উঠলো, যাবো কোথায় মানে? তার মানে তুমি সত্যি সত্যি বাসা দেখোনি? তবে অটো ডাকো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, মেরুদণ্ডহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাপুরুষ বউকে আসতে বলে বাসা দেখোনি। এখন কি বউ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে? আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি আসতে বলেছো আমি চলে এসেছি। বাকি সব দায়িত্ব তোমার।

জয় একটা অটোরিকশা ডাকলো।

দু’জনে একটা অটোরিকশায় উঠলো। জয় যেনো কয়েকমিনিটের জন্য উদাস হয়ে গেলো। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, কী ভাবছো?

জয় চমকে উঠলো, হ্যাঁ আমারই তো।

কী আমারই তো? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

ঐ যে তুমি বললে সব দায়িত্ব।

থ্যাঙ্ক ইউ। জাতে মাতাল তালে ঠিক। দায়িত্ববোধ ঠিকই আছে, তো কোথায় যাবে এখন?

জয় মিন মিন করে বললো, আমি অবশ্য মাহফুজ ভাই, মিনা ভাবীকে বলে রেখেছি।

বাসা ফাঁকা আছে?

হ্যাঁ। এক রুমের বাসা, তবে খুব সুন্দর।

কিচেন, বাথ রুম?

সব আছে।

তাহলে ওখানেই নিয়ে চলো। আর মিনমিন করবে না। পুরুষ মানুষ, পুরুষ মানুষের মতো কথা বলবে।

ততক্ষণে অটো রেলগেট অতিক্রম করেছে। জয় ইরার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, জো হুকুম।

 

কলিং বেল-এ টিপ দিতেই মিনা বেলকনি থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, ও জয় ভাই, আসছি, বলে গেট খুলে দিলো।

খাটে বিছানা-বালিশ বিছানোই ছিলো। অভ্যাসবশত: জয় বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় বসলো। ইরা জয়ের মাথার কাছে বসলো।

জয় মিনার সঙ্গে ইরার পরিচয় করে দিলো, ভাবী ও হচ্ছে ইরা। ওর একটা ট্রেনিং আছে, আজকের রাতটা ও এখানে থাকবে।

মিনা একটা মিষ্টি হাসি হেসে বললো, কে হয় আপনার ভাই?

জয় একবার মিনা আর একবার ইরার দিতে তাকিয়ে আবারও মিন মিন করে আমার! আমার বলতে বলতে ইরা বলে ফেললো, বলো, আবার মিনমিন করছো কেনো? তোমাকে না বলেছি পুরুষ মানুষের মতো কথা বলবে।

জয় বললো, ফেসবুক ফ্রেন্ড।

ইরার সঙ্গে জয়ের প্রায় তিন বছরের হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক, জয়ের জন্যই ইরা আজ স্বামী-সংসার ছেড়ে একেবারে চলে এসেছে। কত ভালোবাসলে কোনো মেয়ে স্বামী-সন্তান ছেড়ে, ঘর-সংসার ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে আসতে পারে তা সহজে অনুমেয়। ইরা জয়ের কথায় আশাহত হলো। সে প্রচণ্ড রেগে গেলো, মানে? আমি তোমার শুধু ফেসবুক ফ্রেন্ড। আর কিছু না। বলে ইরা বলতে শুরু করলো, ভাবী আমি বলছি, আমরা দু’জন ভালো বন্ধু, মানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি ওকে খুব ভালোবাসি, ও আমাকে ভালোবাসে। ও আমার জন্য সবকিছু করতে পারে, আমিও পারি, আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছি, তাই না? বলে ইরা জয়ের থুতনি উঁচু করে ধরে আবারও বললো, তাই না?

জয় মাথা নেড়ে সায় দিলো।

মাহফুজ এলো, আরে জয় ভাই কেমন আছেন?

ভালো।

ইরা সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কখন এলেন? মাহফুজ সাহেব ইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

ইরা বললো, এই তো একটু আগে।

মাহফুজ সাহেব জয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, জয় ভাই…

জয় কিছু বলার আগেই মিনা ইশারায় মাহফুজকে চুপ করে থাকতে বললো।

মিনা মাহফুজকে বললো, ইরার কাল ট্রেনিং আছে, রাতটা আমাদের বাসায় থাকবে।

মাহফুজ ভ্রু’কুঁচকে জয়কে জিজ্ঞেস করলো, আর আপনি?

জয় থতমত খেয়ে বললো, আমি বাইরে থাকবো।

মাহফুজ আর মিনা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো। ইরা জয়ের চুলে আঙ্গুল এলিয়ে দিতে দিতে বললো, তুমি এমন করছো কেনো?

কেমন?

ইরা কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, মনে হচ্ছে আমি জোর করে তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমাকে পরিচয় দিতেই ভয় পাচ্ছো?

না ঠিক ভয় না। সংকোচ করছি।

কেনো? আমাকে দেখো আমি তো একটা মেয়ে, আমি কি কখনো তোমাকে পরিচয় দিতে লজ্জা পাচ্ছি? লজ্জা মেয়েরা পায় জয়, পুরুষ মানুষ লজ্জা পায় না, প্রেমে পড়লে তো আরও পায় না।

সব মানুষ একই রকম হয় না ইরা।

তা হয় না, আমার মতো কিছু মেয়ে হয় পুরুষের মতো আর তোমার মতো কিছু পুরুষ মানুষ হয় মেয়েদের মতো। তুমি এতো ভীরু কেনো? ইরা তিরস্কারের সুরে বললো।

জয় ইরার কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না।

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, দেখো জয় আমি কিন’ কোনো ভীরু-কাপুরুষের জন্য ঘর ছাড়িনি, তুমি একটু সাহসী হও। তোমার সাথে আমি আছি তোমার এতো ভয় কীসের।

জয় কৃত্রিম বুক ফুলিয়ে বললো, হবো, তোমার জন্য আমিও অনেক সাহসী হবো।

ইরা জয়কে একটু ঠেলে দিয়ে বললো, ওঠো তো।

জয় খাট থেকে উঠে দাঁড়ালো।

ইরা জয়ের হাত ধরে তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো। আয়নায় দু’জনের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হলো, ইরা জয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বললো, একবার আয়নার দিকে তাকাও, আমাদের সুন্দর মানিয়েছে না?

ইরার চোখে-মুখে কোনো লজ্জা, ভয়, সংকোচ নেই। একটা তৃপ্তির আভা ফুটে উঠেছে, যা তার ফর্সা সুন্দর মুখকে আরও দীপ্তিময় করেছে।

জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, সত্যি আমাদের সুন্দর মানিয়েছে ইরা।

আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি জয়, আমাদের ওপর যত ঝড়ই আসুক আমরা সবকিছু কাটিয়ে উঠবো, আমাদের ভালোবাসার জোর থাকলে আমরা অবশ্যই দু’জনে মিলে সুখের স্বর্গ রচনা করতে পারবো, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক… বলতে বলতে ইরা উদাস হয়ে গেলো।

জয় ইরার দুই কাঁধে হাত রেখে ওর দু’চোখে চোখ রেখে বললো, অবশ্যই পারবো ইরা।

কিছুক্ষণ পর মাহফুজ এলো সঙ্গে মিনা একটা ট্রে’তে নাস্তা নিয়ে এলো। নাস্তা খেতে খেতে শুরু হলো গল্প, ইরার সঙ্গে কীভাবে জয়ের পরিচয় হলো, কতদিন থেকে সম্পর্ক চলছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

দুই

 

কয়েকমাস আগের কথা। জয়ের লেখালেখি যেনো থমকে গিয়েছিলো। লেখায় কোনো গতিই ছিলো না। একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলো কিন’ একটা পর্যায়ে গিয়ে থমকে ছিলো। প্রতিদিন সে যখন সকালবেলা লেখার টেবিলে বসতো তখন লেখার কিছুই পেতো না। উপন্যাসের ধারাবাহিকতা নয় যেনো বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন চিন্তায় সে লেখার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলতো। জয় গভীর রাতে লেখার টেবিলে বসতো সাধু-সন্ন্যাসীদের ধ্যানে বসার মতো দু’চোখ বন্ধ করে লেখার ধারাবাহিকতা নিয়ে চিন্তা করতো, গল্পের প্লট নিয়ে চিন্তা করতো কিন’ ধ্যান আসতো না। আসলে ধ্যানে বসতে চাইলে হয় না, ধ্যান করতে চাইলেও হয় না, ধ্যান আসতে হয় হৃদয় থেকে। লিখতে চাইলেই হয় না লেখাও আসতে হয় হৃদয় থেকে। কিন’ জয়ের চিন্তাগুলো কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো?

জয় শুনেছে জীবনে কোনো বিরহ-বঞ্চনা, কষ্ট-যাতনা, ঘাত-প্রতিঘাত না থাকলে নাকি কেউ লিখতে পারে না। জয়ের জীবনেও তো সবকিছুই আছে, আর সেসব অপ্রাপ্তি থেকেই তো একে একে আঠারোটি বই লিখে ফেলেছে। জয় সেসব স্মৃতিচারণের চেষ্টা করলো, না কোনোভাবেই বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করে, ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তার সাথে রং-রস মিশিয়ে একটা উপন্যাসও লিখে শেষ করতে পারলো না। এমনসময় জয়ের পরিচয় হলো ইরার সঙ্গে।

 

পাড়ার শেষ প্রান্তে একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটু খোলা উঁচু জায়গায় এক তরুণী হেমন্তের বিকেলে মিষ্টি রোদে চেয়ারে বসে বই পড়ছে। বাড়ির সামনে খোলা মাঠে সোনালী রংয়ের বিশাল ধানক্ষেত। সুর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সেই তরুণীর গালে। ফর্সা ধবধবে তরুণীও যেনো মিশে গেছে হেমন্তের মিষ্টি রোদ আর সোনালী রংয়ের ধানক্ষেতের সঙ্গে। প্রকৃতির সবটুকু রূপ যেনো আজ নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে।

জয় হাঁটছে সেই তরুণীর স্বামী স্কুলের হেডমাস্টার মতি’র পিছু পিছু। মতি আর জয়কে কাছাকাছি যেতে দেখে তরুণী চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত বাড়িতে ঢুকলো।

বাড়িতে ঢুকে মতি জয়কে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

কয়েকমিনিট পর মতি এবং তার পিছু পিছু সেই তরুণী ড্রয়িং রুমে এলো। সেই অপরূপা জয়কে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কেমন আছেন আপনি?

ভালো, আপনি?

ভালো না থেকে উপায় কী বলুন! আমাদের খবর আর কে রাখে।

তাই নাকি?

যাক, তবু যে এতোদিনে মহাশয়ের সময় হলো। বিল্ডিংয়ের কাজ তো আর ক’দিন হলে শেষ হয়ে যাবে কী দরকার ছিলো পদধুলি দেবার। তরুণীর কণ্ঠে মৃদু অভিমান।

মতি পরিচয় করে দিচ্ছিলো, তরুণী বাধা দিয়ে বললো, আপনি জয় রহমান, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, লেখালেখিও করেন। ফেসবুকে আমি আপনার কয়েকটা লেখা পড়েছি, রূপার বিয়ে, কাজের মেয়ে। অসাধারণ লেখা আপনার । মেয়েদের সম্মান দিয়ে লেখেন।

মতি এবার তরুণী সঙ্গে পরিচয় করে দিলো, ইরা, আমার স্ত্রী।

ইরার ফর্সা গায়ের রং লাল হয়ে গেলো, সে অভিমানের সুরে মতির দিকে তাকিয়ে বললো, শুধু কি তাই?

মতি থতমত খেয়ে বললো, আর…

ইরা বললো, আমি ইরা, হাই স্কুলের ইংলিশ এন্ড আইসিটি টিচার।

অ, আপনার এই পরিচয় তো জানতাম না। নাইস টু মিট ইউ।

জানবেন কী করে, দেখলেন তো চোখের সামনে আমার পরিচয় স্ত্রী পর্যন্তই শেষ হলো। মেয়েদের নিজেদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে আপনাদের পুরুষদের একটা লিমিটেশন আছে। কোনো এক জায়গায় গিয়ে আমাদের পরিচয়টা যেনো শেষ হয়ে যায়।

মতি মৃদু শাসনের সুরে বললো, ইরা, যাও তো আগে আমাদের নাস্তা দাও।

ইরা মৃদু হেসে সরি মাফ করবেন বলে মতিকে বললো, তুমি আমাকে আগে বলবে তো।

আসতে তো প্রায়ই বলি কিন’ আসেন না তো। সবসময়ই শুধু ব্যস্ত।

সে আমি জানি কিন’ ব্যস্ত বলে তো কোনো কবি-লেখক ভক্তদের পদধুলি দেন না এমন না। আপনার মাস্টার সাহেব আপনাকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জানলেও আমার কাছে আপনি একজন লেখক। আমি দু’টো ছোটগল্প পড়েই আপনার ভক্ত হয়ে গেছি।

মতি কিছুটা অসহিঞ্চু হয়ে উঠলো, তুমি যাও তো, নাস্তা খেতে খেতে গল্প করতে পারবে।

ওকে। আপনি বসুন। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।

 

কয়েকমিনিট পর ইরা ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে এলো। এক ট্রে ভর্তি পাকুয়ান, পাটিসাপটা, নারিকেল পুরি। আলাদা আলাদা প্রিচে করে পিঠাগুলো সাজিয়ে দিয়ে ইরা একটা মিষ্টি হাসি হেসে বিনয়ের সঙ্গে বললো, প্লিজ!

মতিও বললো, নিন প্লিজ!

জয় আর মতি পিঠা খেতে শুরু করলো। ইরা পাশের সোফায় বসলো। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ইরা জয়কে তার লেখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, কতদিন থেকে লিখেন আপনি?

প্রায় দশ বছর থেকে।

কতগুলো বই লিখেছেন?

আঠারোটা।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ওয়াও। ইউ আর এ গ্রেট রাইটার। আমি ভেবেছিলাম আপনি সখের বশে লেখালেখি করেন এখন তো দেখছি আপনি পুরোপুরি লেখক।

লেখক বলে লজ্জা দিবেন না, আমি লিখতে শুরু করেছি, দোয়া করবেন যেনো একদিন লেখক হতে পারি।

মতি একবার আড়চোখে ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, ইরা চা নিয়ে এসো। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আবার জয়পুরহাট যাবেন। ছোট দিনের বেলা।

ইরার মুখ মলিন হয়ে গেলো। সে সোফা থেকে উঠে ভিতরে গেলো, কয়েকমিনিট পর কফি নিয়ে এলো। মতি কয়েকচুমুকে চা শেষ করে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার তাকানোর ভঙ্গিটা এমন যেনো জয়ও তাড়াতাড়ি চা শেষ করে চলে যায়।

মতির তাড়াহুড়ো দেখে ইরার চোখে-মুখে একটা রাগের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো।

জয় চা শেষ করে তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে অটোগ্রাফ লিখে ইরার হাতে দিতেই সে আবারও আবেগেজড়িত কণ্ঠে বললো, ওয়াও। লেখকের হাত থেকে বই।

জয় কিছু বললো না।

ইরা বললো, আপনার মতো একজন স্বনাম ধন্য লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। বলে ইরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বললো, আমি আপনাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবো এক্সেপ্ট করবেন তো? নাকি হাজার হাজার ভক্ত-পাঠকের ভিড়ে…

জয় বাধা দিয়ে বললো, এভাবে বলবেন না প্লিজ! আমি সেরকম মানুষ না।

সরি।

মতি ততক্ষণে গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে, জয়-ইরার কথা শেষই হচ্ছে না দেখে সে আবার তাড়া করলো।

জয় একবার মতির দিকে তারপর ইরার দিকে তাকিয়ে ইরাকে বললো, ওকে। ভালো থাকবেন।

ইরার ঠোঁট দু’টো সামান্য ফাঁকা হয়ে যেনো হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো, আপনিও ভালো থাকবেন, বাই।

 

তিন

 

খঞ্জণপুর থেকে যে রাস্তাটা গতন শহরের দিকে চলে গেছে জয় সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। কার্পেটিংয়ের সরু রাস্তা, বাঁয়ে বয়ে চলছে ছোট যমুনা নদী। রাস্তায় মাঝে মাঝে মোটর সাইকেল বা অটো রিকশার শব্দ হয় তাই জয় প্রায়ই নদীর পাড়ে বসে। আজও বসলো। নদীতে হাঁটু পরিমাণ স্বচ্ছ, নির্মল পানি। সে নদীর পাড়ে একটা উঁচু জায়গায় বসলো। বহমান স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয়ের জীবনের বয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। জয়ের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর। কতদিন, কতঘণ্টা, কতমিনিট, কতসেকেন্ড কেটে গেছে এই বহমান স্রোতের মতোই। ক্ষুধা-দারিদ্র, প্রেম-বিরহ, প্রাপ্তি-বিচ্ছেদ। জীবনে কত ঝড় ঝাপটা, কত উঁচু-নিচু, বন্ধুর জীবন মানুষের। অথচ নদীর! নদীর কিচ্ছু নেই, সারাজীবন, জন্ম থেকে পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত একই নিয়মে চলতে থাকা। মানুষের জীবনটাও যদি নদীর মতো একই ধারায় চলতে চলতে শেষ হয়ে যেতো! কেনো? জীবনে জটিলতা থাকবে কেনো? সবার জীবনে সবকিছু দিয়ে দিলেই বা স্রষ্টার কী ক্ষতি হতো? তাতে কি স্রষ্টার সৃষ্টিতে কোনো ব্যাঘাত হতো নাকি স্রষ্টার কৃতিত্বের কোনো ঘাটতি ঘটতো?

বিকেলের এই সময়টায় জয়ের বেশিরভাগ ফোন আসতে থাকে পাঠক-ভক্তদের, কতজনের কত প্রশ্ন, বেশির ভাগই মেয়ে ভক্তদের প্রশ্ন থাকে, দাগ উপন্যাসের শেষে কী হলো? শুভ্র কি মায়াকে বিয়ে করেছিলো? আপনি এমন জায়গায় উপন্যাসটা শেষ করলেন কেনো? আপনার শুভ জন্মদিন কবিতাটা অসাধারণ হয়েছে, আমার জন্মদিনে একটা কবিতা লিখে দিবেন, প্লিজ? আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রশ্নও করে, আপনি কার অনুপ্রেরণায় লেখা শুরু করেছেন? নিশ্চয়ই কোনো নারীর? ইসস্‌ আমি যদি সেই নারীর মতো ভাগ্যবতী হতে পারতাম?

ছেলে ভক্তদের প্রশ্নগুলো থাকে আপনার গডফাদার কবে শেষ হচ্ছে? আগামী বইমেলায় কোন্‌ কোন্‌ উপন্যাস আসছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেদিন বিকেলে ফোন করলো ইরা, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কেমন আছেন?

ভালো। আপনি?

ভালো। আমি আপনার ছায়াপুরুষ উপন্যাসটা পড়লাম। খুব সুন্দর লেগেছে, অসাধারণ।

ধন্যবাদ।

আমাকে একটা কথা বলবেন? যদিও এটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত।

বলুন।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, তন্দ্রা কেমন আছে?

জয় মনে করতে পারছে না, তন্দ্রা, তন্দ্রা, কোন্‌ তন্দ্রা?

ইরা অভিমানের সুরে বললো, তন্দ্রাকে আপনি চেনেন না?

নাতো। তন্দ্রা নামে তো আমার পরিচিত কেউ নেই।

বাহ্‌, উপন্যাস লেখা শেষ হতে না হতেই তন্দ্রাকে ভুলে গেলেন?

জয় এবার বুঝতে পারলো, অ আমার ছায়াপুরুষ উপন্যাসের মুল চরিত্রের তন্দ্রা? তন্দ্রা তো আমার উপন্যাসের নায়িকা, আমার কেউ না তো?

এবার ইরা ভারী গলায় বললো, তন্দ্রা কেমন আছে?

জয় আর না হেসে পারলো না, বললাম তো তন্দ্রা আমার উপন্যাসের নায়িকা এ নামে আমার কেউ নেই।

লেখকরা সমাজের আলোকবর্তিকা, তাদের বিচ্ছুরিত আলো পৃথিবীকে আলোকিত করবে। তারা সত্য কথা বলবে এটাই আমার ধারণা ছিলো। ধারণা ছিলো এজন্য বলছি যে কোনো লেখকের সঙ্গে আমার কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি। আপনি প্রথম লেখক যার সঙ্গে আমি পরিচিত হতে পেরেছি। কিন’ পরিচিত হয়ে জানলাম লেখকরা মিথ্যা কথা বলে। আমি হান্ড্রেন্ট পার্সেন্ট সিওর তন্দ্রা নামের কোনো মেয়ের সঙ্গে আপনার খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, যে আপনাকে ছায়াপুরুষ মনে করে। আর আপনি কী না বই প্রকাশের দু’বছর যেতে না যেতেই তার নামটা পর্যন্ত ভুলে গেছেন।

সরি, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি মিথ্যা কথা বলি না।

আচ্ছা থাক। আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?

আগে তো বলুন?

আমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন, প্লিজ!

জয় কিছুটা অবাক হলো। সাধারণত দু’য়েকদিনের পরিচয়ে কেউ এরকম কথা বলে না। তাছাড়া মেয়েরা তাদের ব্যক্তিজীবন কাউকে জানাতে চায় না। জয় জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তো আগে আপনার জীবনী শুনতে হবে।

বলবো। আমার জীবনী শুনলে আপনি নিশ্চয়ই লিখতে আগ্রহী হবেন এবং একটা সুন্দর উপন্যাস হবে।

আমার কিন’ তা মনে হয় না।

কেনো?

আমার মনে হয়েছে আপনি খুব সুখী মানুষ।

ইরা কিছুটা অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করলো, সুখী মানুষ বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? আলেকজান্ডার পোপ-এর হ্যাপি দ্য ম্যান কবিতার মতো যার গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আছে সেরকম।

না। তা ঠিক না।

তো?

জয় জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলুন তো আপনাদের বিয়ে কি স্যাটেল ম্যারেজ?

না। আপনার ধারণা কি লাভ ম্যারেজ হলেই দাম্পত্য জীবন সুখের হয়?

সরি, আমাকে আগে শুনতে হবে। অনুমান করতে পারছি না।

আপনার শুনতে অনেকদিন সময় লাগবে। আপনি কি আমাকে সময় দিবেন?

অবশ্যই।

আপনি সাধারণত কোন্‌ সময় ফ্রি থাকেন?

বিকেলে।

ওকে। আমিও বিকেলেই ফ্রি থাকি।

ওকে। ভালো থাকবেন। বাই।

বাই।

ইরা ফোন রেখে দিতেই একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন এলো। ফোন রিসিভ করতেই বললো, হ্যালো রশিদুল।

জয় বললো, সরি ভাই আমি রশিদুল না। রং নাম্বার।

ইরা আবার ফোন করলো, একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম।

বলুন।

আমি আপনাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট করবেন প্লিজ!

অবশ্যই।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, আপনার ফ্রেন্ড কতজন? পাঁচ হাজার অতিক্রম করেনি তো?

অনেকদিন আগেই করেছে, মাঝে মাঝে কিছু ইনএক্টিভ ফ্রেন্ড রিমুভ করি।

ইনএক্টিভ নাকি যাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়? বলেই ইরা বললো, সরি।

জয় কিছু বললো না।

ইরা আবার বললো, নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মেয়ে?

কখনো গুণে দেখিনি।

তাদের অনেকের সঙ্গে আপনার ফোনে যোগাযোগ আছে?

আছে, কারও কারও সাথে।

ইরা অভিমানের সুরে বললো, সেজন্যই তো দেখলাম আমি ফোন রাখতে না রাখতেই আরেকটা ফোন এসেছে।

কিন’ যে ফোনটা এসেছিলো সেটা রং নাম্বার, ভুল ঠিকানায় এসেছে, পথ ভুলে, বলে জয় মৃদু হাসলো।

আমি হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিওর সেটা ঠিক নাম্বারে এসেছিলো এবং আপনার কোনো মেয়ে ভক্ত।

সরি ম্যাডাম আপনি ঠিক বলছেন না।

ওকে। আমি কবে থেকে আপনার সাথে কথা বলতে পারবো?

আগামীকাল থেকে।

লিখবেন তো?

যদি লেখার মতো হয় তবে অবশ্যই লিখবো।

ওকে। ভালো থাকবেন। আর আপনার অন্য ভক্তদের সময় নিতে চাই না। বাই। কথাগুলো যেনো ঝটপট করে বলে ইরা ফোন রেখে দিলো।

 

চার

 

ইরা বলতে শুরু করলো, আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম। আমাদের বাসার পাশে একটা ছাত্র মেস ছিলো। সেই মেসে থাকতো মতি। ও লেখাপড়া করতো কী না জানি না কিন’ আমি দেখতাম সারাদিন ও জানালার তাকিয়েই থাকতো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, ও তখন কী করতো?

ও জয়পুরহাট সরকারি কলেজে এইচ.এস.সি পড়তো।

জি তারপর বলুন।

আমি সকালবেলা যখন স্কুলে যেতাম তখন সে ঠিক রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতো। আর ওকে দেখলে আমি খুব লজ্জা পেতাম। আমার পা দু’টো যেনো শিথিল হয়ে আসতো। প্রথম প্রথম আমি বুঝতাম না। আমি একদিন বড় আপাকে বললাম, আপা ওকে খুব গালিগালাজ করলো।

জয় বললো, কাজটা কিন’ আপনি ঠিক করেননি।

সেদিনের কথা মনে পড়লে আমি আজও লজ্জা পাই। পরদিন ওকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না। আমি ভাবলাম আপদ দূর হয়েছে কিন’ তার পরদিন আবার ওকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এতোদিন ও আমার সাথে কোনো কথা বলেনি সেদিন আমার পিছু পিছু আসতে আসতে একটা রাস্তার বাঁকে একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে আমাকে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, ইরা।

কথাটা কানে আসতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আমার প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিলো সেদিন। আমি ভেবেছিলাম একা পেয়ে ও বুঝি আমাকে মারবে। আজকালকার দিনে কত ছোট মেয়েরা প্রেম করে অথচ আমি কী বোকা ছিলাম ক্লাস সেভেনের ছাত্রী হয়েও প্রেম-ভালোবাসা বলতে কিছু বুঝতাম না। তখনকার কথা মনে হলে আমার হাসি পায়। আমি একবার মনে করলাম আরও জোরে জোরে হেঁটে রাস্তার মোড়ে যাই কিন’ ও আমার চেয়ে আরও বেশি বেগে হেঁটে আমার সামনে এসে ডাক দিলো, ইরা!

আমি দাঁড়ালাম। আমার বুক তখন বড় আপার ভয়ে কাঁপছে, আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত কাঁপছে। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পাঁয়ের আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার মাটিতে আঁচড় কাটছি।

ও বললো, ইরা তুমি আমার ওপর রাগ করেছো?

আমি কচি শিশুর মতো মাথা উঁচু-নিচু করে জানালাম আমি রাগ করেছি।

ইরা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আমি লজ্জায় যেনো মাটির সঙ্গে ঢুকে গেলাম। আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হলো, নিজেকে অপরাধী মনে হলো, আমি বুঝি কোনো দোষ করেছি না হলে দুনিয়াতে এতো মেয়ে থাকতে আমাকে ভালোবাসবে কেনো?

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবেগজড়িত কণ্ঠে ডাক দিলো, ইরা!

ওর সেদিনের কণ্ঠস্বরটা আজও আমার কানে ভাসে। ওর সেই কণ্ঠস্বরটা শোনার পর যেনো আমি আমার সবকিছু হারিয়ে ফেললাম একবার চোখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকাতেই আমার বুকের ওপর দিয়ে যেনো একটা ঝড় বয়ে গেলো। আমি ওর ভালোবাসার আহবানের জবাবে কী জবাব দিবো খুঁজেই পেলাম না। বলে ইরা জয়ের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বললো, হ্যালো।

জয় বললো, শুনছি, বলুন।

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, আমি ওর মুখের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। অদ্ভুত সুন্দর ওর চোখ, আমি যেনো মুহূর্তেই ওর চোখের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ আগেও আমি ভাবতাম ওকে গালি দিবো বা চিৎকার করবো কী না আর চোখে চোখ পড়ার পর মনে হলো আপাকে বলে ওকে গালি দেয়াও আমার মারাত্মক ভুল হয়েছে। আমার নিজের প্রতিই ভীষণ রাগ হলো। আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম, আমাকে যেতে দিন প্লিজ! আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ও চলে গেলো। যাওয়ার সময় আজকের ঘটনাটা যেনো আমি বড় আপাকে না বলি সেজন্য অনুরোধ করলো।

তারপর-

না। সেদিন ক্লাসে আমার মন বসছিলো না। কমন রুমে আগে আমি হাসি গানে সবাইকে মাতিয়ে রাখতাম। অবশ্য আমি শিল্পী না, গানের কণ্ঠও হয়তো ভালো ছিলো না কিন’ ক্লাসের ফাঁকে আমরা যখন কমন রুমে থাকতাম তখন সবাই আমাকে বলতো, ইরা একটা গান গাইবি। আর আমি গান গাইতাম। কিন’ সেদিনের আমার মনে অবস’া দেখে কেউ গান গাইতে বললো না। তখন আমার সবসময় মতি’র আমাদের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা, আপার গালিগালাজ আর সকালে ওর সেই ডাক আমার কানে ভেসে এলো।

আমি অনেকক্ষণ থেকে কিছু বলছি না দেখে রিনা বললো, হ্যালো। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ শুনছি তো, বলুন প্লিজ!

রিনা আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ও আমাকে এ্যাবসেন্ট মাইন্ড দেখে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে রে তোর?

আমি চমকে উঠলাম।

রিনা বললো তোকে এ নিয়ে আমি তিনবার ডাক দিয়েছি। আমি ইয়ার্কি করে একবার আপনি বলে ডেকেছি আর তুইও আপনি বলে উত্তর দিয়েছিস। কোথায় ছিলি বলতো?

এখানেই তো ছিলাম।

কচু ছিলি। শরীরটা এখানে ছিলো কিন’ মনটা ছিলো অন্যখানে। বলবি কী হয়েছে?

রিনা আমার পাশে বসলো, আমার থুতনি উঁচু করে চোখে চোখ রেখে বললো, বল?

আমি রিনাকে সবকিছু বললাম। শুনে ও আমার গালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ইস্‌ আমি যদি তোর মতো সুন্দর হতাম তবে আমাকেও কেউ ভালোবাসতো রে। কেনো যে আল্লাহ আমাকে তোর মতো সুন্দর করে দুনিয়াতে পাঠালো না।

জয় ইরার কথার উত্তর দিলো, এক্সাক্টলি! রিনা ঠিকই বলেছে।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, কী?

আপনি সত্যিই খুব সুন্দর।

ইরা বললো, ধন্যবাদ।

জয় বললো, তারপর বলুন।

ইরা কটাক্ষের সুরে বললো, আপনার ব্যস্ততা নেই তো? আমি কি আপনার ভক্তদের বঞ্চিত করছি?

জয় একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো, তাতো একটু করছেনই।

ইরা জয়ের কথায় ভীষণ রেগে গেলো। সে ফোনের লাইন কেটে দিলো। তারপর জয় কয়েকবার ফোন করলো কিন’ ইরা আর ফোন রিসিভ করলো না।

ইরার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে জয় যেনো ওকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। ইরা বলেছে ওদের লাভ ম্যারেজ। লাভ ম্যারেজে অবশ্য অনেক ঝুঁক্কি-ঝামেলা থাকে। কিন’ সবকিছু কাটিয়ে ইরা তো এখন একজন সুখী মানুষই। স্বামী-স্ত্রী আর এক সন্তান। দু’জনে চাকরিজীবী, স্বচ্ছল সংসার, ইরার সঙ্গে মতির কথাবার্তায়ও কখনো তাদের মধ্যে কোনো প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় নেই বলে মনে হয় না কিন’ এতোকিছুর পরও ইরার চোখে-মুখে একটা কষ্টের ছাপ আছে। ইরা যখন হাসে তখন ওর হাসিটাকে অনেকটা কৃত্রিম বলে মনে হয়। যেনো হাসিতে উৎফুল্লতা নেই, প্রাণ নেই।

 

মতি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। একাডেমিক শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত হলেও তার কথাবার্তায় শিক্ষার তেমন একটা গুণ প্রতিফলিত হয় না। আর প্রযুক্তি জ্ঞান? প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকাটাই যেনো মতির কাছে বড় কৃতিত্ব। সেদিন নাস্তা খাওয়ার সময় তার মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। তারপর ইরা যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকলো তখন সে ইরাকে বললো, ইরা দেখোতো মোবাইলটা বেজে উঠলো কেনো?

ইরা বললো, তুমি দেখো।

ইরার কথাটা বলার সময় এমনভাবে বললো যেনো সে জেনে-শুনে মতিকে অপমান করার জন্যই বললো।

মতি একবার রাগান্বিত চোখে ইরার দিকে তাকালো।

জয় মতিকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি ম্যাসেজ চেক করতে পারেন না?

মতি যেনো কিছুটা গর্বের সুরেই বললো, না, আমি ওগুলো পারি না।

আর ইন্টারনেট।

ইরা তিরস্কারের সুরে বললো, আপনারও মাথা খারাপ হয়েছে, যে মোবাইলের ম্যাসেজ পড়তে এবং লিখতে জানে না সে জানবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে, আপনি কী যে বলেন।

জয় বললো, আপনি শেখাবেন। ইন্টারনেটের ব্যবহার জানা প্রত্যেকের জন্য জরুরি।

আমিও তো শিখতে বলি কিন’ উনি শিখবেন না। শিখতে বললে বলবেন, আমার আর লেখাপড়া করার মতো ধৈর্য নেই। আমি মহোদয়কে এতো করে বোঝাতে চেষ্টা করি। কিন’ মহোদয় শিখবেন না। কথাগুলো ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে ইরা জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা বলুনতো যার সামনে কম্পিউটার থাকবে একটা ফাইল বের করে পড়তে পারবে না, লিখতে পারবে না সেতো শিক্ষিত মূর্খই, নাকি বলেন।

মতির চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। সে রাগান্বিত স্বরে বললো, ইরা তোমার বক বক একটু থামাবে।

ইরা বললো, সরি।

সেদিনের ঐ অল্প সময়ে তাদের দাম্পত্য জীবনের শীতল সম্পর্ক আর ইরার আজকের কথায় জয়ের মনে হলো নিশ্চয়ই ইরা আর মতির মধ্যে একটা বড় ধরণের শূন্যতা আছে। তাছাড়া একটা মেয়ে যে কী না ভালোবাসা কী তাই বুঝতো না এমনসময় প্রেম করে বিয়ে করেছে তার জীবনে তো প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার তফাৎ থাকার কথা নয়।

জয় আবার ইরাকে ফোন করলো কিন’ না, তার অভিমান কমেনি সে ফোন রিসিভ করলো না।

 

পাঁচ

 

বড় বোন রিচি। জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এখন একটা বেসরকারি সংস’ায় চাকরি করে। লম্বা, গায়ের রং ফর্সা তবে একটু রোগা রোগা। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই কিন’ এখনো বিয়েই হয়নি, তাকে নিয়ে এখন আর বিয়ের আলাপ-আলোচনাও হয় না। গায়ের রং ফর্সা হলেও তাকে সুন্দর বলা যায় না কিন’ সে নিজেকে সুন্দর বলে জাহির করতে পিছপা হয় না। রূপ নেই কিন’ রূপের অহংকার আছে। সাধারণত এটাই স্বাভাবিক যার কিছু নেই তার অহংকার আছে আর যার সব আছে তার অহংকার নেই। মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ, খুঁতখুঁতে, অহংকারী। তার চরিত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সে অত্যন্ত নেতিবাচক। খুব সুন্দর জিনিসেরও সে একটা না একটা খুঁত বের করবেই।

 

মধু নামে এক ছেলে ছিলো। নাম মধু হলেও তার মুখ ছিলো সবসময় তিক্ততায় ভরা। সে সবকিছুতেই নেতিবাচক মন্তব্য করতো। একদিন তার এক বন্ধু একটা সুন্দর নতুন শার্ট পরে কলেজে এলো। সবাই তার শার্ট দেখে অনেক প্রশংসা করলো, দোস্ত হেব্বি শার্ট পরেছিস তো। কোথায় কিনেছিস?

ছেলেটি মৃদু হেসে বললো, নিউ মার্কেটে।

মধু পাশেই ছিলো, সে বললো, ঠিক আছে তবে কলারটা আরেকটু লম্বা হলে ভালো হতো। আমার মনে হয় তুই মৌসুমী মার্কেটে কিনলে ভালো শার্ট কিনতে পারতিস।

তাদের সঙ্গে পড়তো মৌমিতা। ক্লাসের মধ্যে সেই মেয়েটিই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। লম্বা, ফর্সা দুধে আলতা, স্লিম, কথা বলার সময় গালে টোল পড়ে, হাঁটার সময় আর্ট করে হাঁটে। মৌমিতা যখন কলেজে আসে তখন ছেলেরা তাকে এক পলক দেখার জন্য গেটের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। মৌমিতার সঙ্গে কথা বলতে পারাটাকে অনেকেই যেনো গর্বের বিষয় বলে মনে করে। সেই মৌমিতা সম্পর্কেও সে নানান ত্রুটি বের করে, কখনো বলে হাসিটা আরেকটু প্রাণ খোলা হওয়া উচিৎ ছিলো। গালে টোলটা একটু বেশি গভীর, ঘূর্ণিপাকের মতো।

অল্প দিনের মধ্যে মধুর তিক্ত মুখের কথা কলেজে সবার জানা হয়ে গেলো।

কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান ছিলো। অনুষ্ঠানের শেষে সবার হাতে হাতে প্যাকেট চলে এলো। প্যাকেটে ছিলো বিস্কুট, চানাচুর, সিঙ্গারা, মিষ্টি, সন্দেশ, আপেল আর কয়েকটা আঙ্গুর। সবার কাছে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের নাস্তা হিসেবে বেশ ভালোই ছিলো। বন্ধুদের অনেকেই মধুর দিকে লক্ষ্য করছিলো আর ভাবছিলো দেখি মধু কী বলে?

মধুর পাশে বসেছিলো রনি। সে জিজ্ঞেস করলো, দোস্ত নাস্তাটা কেমন হলো?

বন্ধুদের অনেকেই মধুর সঙ্গে রনির কথা বলতে দেখে এরকমই একটা অনুমান করছিলো। মধু কী বলে তা শোনার জন্য সবাই কৌতূহলী হয়ে মধুর দিকে তাকিয়েছিলো।

মধু আমতা আমতা করে বললো, ভালো তবে আঙ্গুর আরও কয়েকটা পিস দিতে পারতো আর সিঙ্গারা দিয়েছে না, ওটাতে যে পিঁয়াজগুলো দিয়েছে ওগুলো একটু ভাজা কম হয়েছে।

মধুর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই নাস্তার প্যাকেট নিয়ে মাঠে এলো। নাস্তা খেতে খেতে রনি বললো, এত ফাটাফাটি নাস্তা তারপরও তোর পছন্দ হলো না। শোন তোকে একদিন শর্মায় মিষ্টি খাওয়াবো। তুই তো জানিস জয়পুরহাটের সবচেয়ে ভালো মিষ্টির দোকান শর্মা। দোকানে যত আইটেমের মিষ্টি আছে তুই সবগুলো খাবি, দই, মিষ্টি, সন্দেশ, রস মঞ্জুরি, দুধ মালাই,্‌ আরও যত আইটেমের মিষ্টি আছে তোকে আমি খাওয়াবো তুই যেনো কোনোদিন বলতে না পারিস যে শর্মার এই মিষ্টটা তোর পছন্দ হয়নি।

বন্ধুদের মধ্যে যে নিউ মার্কেট থেকে শার্ট কিনেছিলো সে বললো, শুধু তুই না, আমিও টাকা দিয়ে মধুকে খাওয়াবো, মধুর মুখে একটু মিষ্টি ঢেলে দেয়া দরকার। আরে আমি নিউ মার্কেটের সব দোকান তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা শার্ট কিনলাম আর ও বলে কলারটা আরেকটু লম্বা হলে ভালো হতো।

আরেকজন বললো, মৌমিতার মতো মেয়েরও ও খুঁত বের করে। তোরা না একদিন চল সবাই মিলে ওকে মিষ্ট খাওয়াই তবু যদি মধু নামটা সার্থক হয়।

 

সত্যি সত্যি সব বন্ধুরা মধুকে মিষ্টি খাওয়ালো, শর্মায়। মধু প্রায় সব আইটেমের মিষ্টি তার ইচ্ছামতো খেলো। তারপর রনি জিজ্ঞেস করলো, দোস্ত খাওয়াটা কেমন হলো?

বন্ধুরা সবাই মধুর দিকে তাকিয়েছিলো। সবার ধারণা ছিলো আজ মধু কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারবে না।

মধু একবার সবার দিকে তাকালো।

সবাই অসি’র হয়ে পড়লো, বলছিস না কেনো? বল? আজ আবার মিষ্টিতে কী দোষ পেলি?

মধু ডানে-বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে বললো, দোস্ত এতো ভালো ভালো না।

মধু কোনোদিন কোনোকিছুর প্রশংসা করতে শেখেনি। সে খুব সহজভাবে বলতে পারতো, খুব ভালো হয়েছে।

রিচির অবস’াও ঠিক মধুর মতোই। যখনই কোনো ভালো পাত্রের প্রস্তাব এসেছে তখনই সে বলেছে এতো ভালো ভালো না। আর সে কারণে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে খুঁজতে বিয়ের বয়সই চলে গেছে।

ইরার মধ্যে রিচির কিছুটা ছায়া আছে। ইরাও অত্যন্ত সন্দেহ প্রবণ। সেদিন বিকেলে জয় নিত্য দিনের মতো খঞ্জণপুর থেকে গতন শহরের দিকে যে রাস্তা গেছে সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ফোনে কথা বলছে। এমনসময় ইরা ফোন করলো।

জয় কথা সংক্ষেপ করে ইরাকে ফোন করলো, হ্যালো।

ইরা সালাম দিলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন আপনি?

ভালো ছিলাম কিন’ আপনাকে ফোন করে তো মুডটাই নষ্ট হয়ে গেলো।

কেনো বলুন তো?

আপনার ফোন বিজি।

জয় আমতা আমতা করে বললো, আর বলবেন না। বড় সার্কেল তো, চাকরি, লেখালেখি, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু মিলিয়ে…

ইরা অভিমানের সুরে বললো, থাক, থাক আর বলতে হবে না।

রাগ করেছেন?

রাগ করেছি তবে আপনার ওপর না, নিজের ওপর।

কেনো?

আমার কপালটাই খারাপ।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কেনো?

আপনার ছায়াপুরুষ উপন্যাসের নায়ক তারেকের মতো আমার যদি একজন ছায়াপুরুষ থাকতো।

কেনো? আপনার আসল পুরুষটিই তো অনেক ভালো মানুষ।

ভালো মানুষ না ছাই।

আপনি তো পুরো কাহিনী শুনলেনই না।

শোনার দিনও তো শেষ হয়নি। বলুন?

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, প্রেম করার সময় আমার গুণধর প্রেমিকটি বলেছিলো আমি নাকি তার জীবনে প্রথম নারী।

তারপর-

কিন’ বিয়ের পর জানলাম আমার আগে সে আরও দু’জনের সঙ্গে প্রেম করেছে। আমার নিজের ওপর খুব রাগ হলো। যে মানুষটাকে ভালোবেসে আমি লেখাপড়া, আমার বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে একেবারে ঘোর মফ:স্বলে এলাম আর সে কী না একটা মিথ্যাবাদী। ওকে নিয়ে আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো। জানার পর আমি খুব কাঁদলাম। ও আমাকে সান্ত্বনা দিলো, প্রতিশ্রুতি দিলো যে জীবনে সে আর কোনোদিন কোনো নারীর সঙ্গে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবে না।

জয় জিজ্ঞেস করলো, এখনো কি কারও সাথে…

সে খুব জোর দিয়ে বললো, হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিওর মতি ঐ মহিলার সঙ্গে প্রেম করছে।

কোন মহিলা?

আপনাকে বিশ্বাস করি বলেই বলছি, কোনোদিন বলবেন না তো?

জয় দৃঢ় কণ্ঠে বললো, আপনি নিশ্চিৎ থাকতে পারেন। ভক্ত-পাঠকদের জীবন কাহিনী গোপন রাখা লেখকের দায়িত্ব, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।

এক্সাক্টলি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। প্রথম দিন দেখেই আমার মনে হয়েছে আপনার ওপর নির্ভর করা যায়। ওর স্কুলে একজন মহিলা ডাক্তার আসে, এন.জি.ও’তে চাকরি করে। ঐ এন.জি.ও স্কুলের সঙ্গে কাজ করে। ওর সঙ্গে মতির অনেক ভালো সম্পর্ক।

জয় ইরাকে সান্ত্বনা দিলো, ভালো সম্পর্ক থাকতেই পারে সেটা তো প্রেমের সম্পর্ক নাও হতে পারে?

আমি হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিওর। যেদিন সেই ডাক্তারনি আসার কথা থাকে সেদিন সকাল থেকে মতির তৎপরতা দেখলেই বোঝা যায়।

কী রকম?

সেদিন সকালবেলা মতি সেভ করবে, চুলে শ্যাম্পু দিবে, ভালো শার্ট-প্যান্ট পরবে, বডি স্প্রে করবে।

এগুলো তো এমনিতেই করতে পারে। সবাই চায় নিজেকে স্মার্ট রাখতে। তাতে তো দোষের কিছু নেই।

নেই কিন’ প্রতিদিন তো স্মার্ট থাকে না। ঐ বিশেষ দিনে, বিশেষ কারও আগমন উপলক্ষে স্মার্ট থাকতে হবে এটা তো সন্দেহজনক।

হ্যাঁ সন্দেহজনক হতে পারে তবে হান্ড্রেট পার্সেন্ট হতে পারে না।

ইরা বুঝতে পেরেছে তার হান্ড্রেট পার্সেন্ট কথাটা মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। সে হেসে ফেললো, ঠিক বলেছেন।

জয়ও হাসলো, সন্দেহের ওপর কাউকে দোষারোপ করা যায় না।

আপনার কথা মানলাম। কিন’ ও আর যেগুলো কথা আমাকে মিথ্যা বলেছে সেগুলোকে আপনি কী বলবেন।

কী মিথ্যা বলেছে?

বিয়ের আগে আমাকে ওদের বাড়ির অবস’া সম্পর্কে যা যা বলেছিলো তাতে তাকে একজন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে আমার মনে হতো। অবশ্য ওসব বিষয় চিন্তা করার মতো মানসিক অবস’া আমার ছিলো না। তারপরও সেসব বিষয়েও ও আমার সাথে অনেক লুকোচুরি করেছে।

তাই নাকি?

জি, আমরা ঘর ছাড়লাম এক শীতের সন্ধ্যায়। ঠিক সন্ধ্যা বলা যায় না, বিকেলে। আগের দিন বিকেলে আমার সাথে ওর কথা হলো, ও বললো, কাল অথবা পরশু প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বের হয়ে এসো, আমরা চলে যাবো।

আমি খুব সহজভাবে মনে করেছিলাম আমি ওর সাথে চলে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কেনো যাচ্ছি কিছুই মনে করলাম না। আমার ওর ওপর খুব রাগ হচ্ছিলো, আমার বলতে ইচ্ছা করছিলো, কাল অথবা পরশু কেনো, আজই নয় কেনো? কিন’ আমি কিছু বললাম না।

ততদিনে আমাদের বিষয়টা বড় আপা, আব্বা সবাই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করেছে। মতি আর মোড়ে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারে না। তখনকার দিনে মোবাইল ফোনও ছিলো না। আমাদের যোগাযোগটা ছিলো স্কুলের সময় আর প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময়। তবুও সুযোগ বুঝে। বড় আপা বাসা থেকে মেইন রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। আর ও বেশির ভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকতো বাটার মোড়, রেলগেট কিংবা পাঁচুর মোড়ে। ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতো। আমি চিঠি পড়ে আবার উত্তর দিতাম। সেদিনের চিঠিতে ও শুধু লিখেছে, তুমি প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় প্রাইভেট না গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে আসবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, তারপর-

সেদিন রাতে আমি এক মিনিটের জন্য ঘুমাতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আমি বাস স্ট্যান্ডে গেলাম আর ওর সঙ্গে আমার দেখা হলো। তারপর আমরা চলে গেলাম এক অজানা জায়গায়, কোন্‌ জায়গায় যাচ্ছি, আমি বাবা-মা’র আদর স্নেহ ছেড়ে কার সাথে, কোথায় যাচ্ছি একবারও আমার মাথায় আসেনি। আমি শুধু জানি আমি ওর সাথে যাচ্ছি, দুনিয়াতে আমার আর কারও দরকার নেই। একজন মানুষ হলেই আমার চলবে সারাজীবন, কথা বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো।

কয়েকসেকেন্ড ইরার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো না। জয় ভেবেছিলো বুঝি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জয় বললো, হ্যালো।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে আবার বলতে শুরু করলো, বিশ্বাস করুন আমি স্কুল ড্রেস পরে যে মানুষটার সঙ্গে চলে এলাম এসে যদি দেখি তার কথা আর বাস্তবতায় অনেক তফাৎ তখন আমার কেমন মনে হবে। ওদের বাড়ি একেবারে অজো গ্রামে। শহর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে প্রথমে হেরিং বন্ড রাস্তা তারপর প্রায় এক কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। আমরা ওদের বাড়ি পৌঁছালাম সন্ধ্যায়। আমরা পৌঁছার পর পরই বাড়িতে কাজি এলো। রাতেই বিয়ে হলো আমাদের বলে ইরা একটা ঢোক গিললো, তারপর তিরস্কারের সুরে বললো, শুভ বিবাহ!

কথা বলতে বলতে ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদাছিলো। জয় ইরাকে সান্ত্বনা দিলো, আপনি কাঁদছেন কেনো? আমি তো আপনার জীবনে কোনো কষ্ট দেখছি না। আপনি তো একজন সুখী মানুষ। আমাদের দেশে মেয়েদের কত কষ্ট, কত নির্যাতন সহ্য করে মেয়েরা দিব্যি হাসি মুখে সংসার করছে।

ইরা একটা অদ্ভুত ধরণের অট্টহাসি হেসে বললো, আমিও তো দিব্যি সংসার করছি। আপনি কি জানেন আমি কত কষ্টে আছি, আমি কীসের রোগী।

রোগী? কী অসুখ আপনার?

বুঝবেন না। মন এক অদ্ভুত যন্ত্র যার পাঠ করার যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। সেজন্য আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি।

প্লিজ বলুন? আপনার কী অসুখ?

ইরা একটা উদ্মাদের মতো হাসি হেসে বললো, ক্যান্সার।

জয় যেনো আহত বাঘের মতো চিৎকার দিয়ে উঠলো, ক্যান্সার। কী বলছেন আপনি? না, না আপনার কিছুই হয়নি। আপনি একজন সুস’, জলজ্যান্ত মানুষ।

ছিলাম কিন’ এখন আর নেই। আমার ক্যান্সার। ক’দিন আগেও আমি বেশ অসুস’ হয়ে পড়েছিলাম। যেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হলো সেদিন থেকে আমি যেনো পরশ পাথরের ছোঁয়া পেয়েছি। আমি সুস’ হয়ে উঠছি। আমারও এখন মনে হচ্ছে আমার কিচ্ছু হয়নি। আচ্ছা যাক একদিন সবাইকে মরতে হবে, ক্যান্সারই হোক আর হার্ট এ্যাটাক্ট করেই হোক। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, আমি ভয় পাই প্রাণহীন বেঁচে থাকাকে, জীবন্ত লাশকে। অসুখের কথা আপনাকে আরেক দিন বলবো, আমাদের বাসর রাত কীভাবে হলো জানেন?

না, বলুন প্লিজ!

আমাদের বাসর ঘর হলো একটা মাটির ঘরে, স্যাঁত স্যাঁতে মেঝে, হারিকেনের আলো আর মশার বিজয় উল্লাসের মিউজিকের মধ্য দিয়ে। আমি ওর দারিদ্রকে মেনেই নিয়েছিলাম, যদিও এবিষয়ে আমার সাথে অনেক মিথ্যা কথা বলেছে, ওদের বাড়ির কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলেছে।

জয় বললো, তা বলুক কোনো প্রেমিক যদি তার প্রেমিকাকে পাবার জন্য মিথ্যা কথা বলে তবে সেটাও তার ভালোবাসারই বহি:প্রকাশ।

কিন’ বিয়ের তৃতীয় দিন আমি যে কথা শুনলাম তাতে করে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো আমার বার বার মনে হলো আমি কী ভুলটাই না করলাম।

কী?

ইরার বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো, প্লিজ কলিং বেল বাজছে দেখি কে এলো?

ইরা ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে চলে গেলো দরজা খুলে দিতে কিন’ আর ফোন করলো না। কিছুক্ষণ পর জয়ের মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো, সরি, ও এসেছে, আগামীকাল কথা হবে। বাই।

 

ছয়

 

কবিদের কথাবার্তায় কবিত্ব থাকবে, কথায় কথায় থাকবে প্রকৃতি, প্রেম। কথার মাঝে কবিরা উদাসীন হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে ভাবের জগতে। ঘর-সংসারের প্রতি থাকবে দায়িত্বজ্ঞানহীন। কোথায় পরিবার-পরিজন, কোথায় আত্মীয়-স্বজন এসব থেকে কবিরা থাকবে একেবারে আলাদা। কবিতা লেখার উপাত্ত খোঁজার জন্য ঘর ছাড়া হবে, দিনের পর দিন বনে-জঙ্গলে, নদী-সমুদ্‌্ের, পথে প্রান্তরে এটাই তো কবিত্ব হওয়া উচিৎ। কবিরা তো জগতে আসে প্রকৃতি, প্রেম এবং বিশ্ব শান্তির জন্য, জগতকে আলোর পথ দেখানোর জন্য, কবি সংসারের মায়া জালে আবদ্ধ হলে তার আর কবিত্ব থাকে না।

কবি কবিতার জগতে হারিয়ে যাবে। কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগ থেকে পান্ডুলিপি বের করে কবিতার একটা পংক্তি লিখবে, গাছের তলায় বসে, ডালে বসে থাকা পাখিদের প্রেম নিয়ে কবিতা লিখবে, কবিতার পংক্তি বের না হলে লেখার যন্ত্রণায় কাতর কবি মাথার চুল ছিঁড়বে। একটা কবিতার পংক্তি লেখা শেষ হলে সৃষ্টির আনন্দে আত্মহারা হবে। কবির কথায় থাকবে ছন্দ। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে বেশ-ভূষাহীন কবির ছন্দময় কথার জন্য স্বমহিমায় নিজের পরিচিতি বেরিয়ে পড়বে। কবিদের জন্য ভক্তদের ত্যাগ প্রয়োজন, ভক্তের ভক্তি, ভালোবাসা কবিকে প্রেরণা যোগাবে।

জয় পেশায় প্রকৌশলী। রড, ইট, বালু, সিমেন্ট, কাঠ ইত্যাদি নিয়ে তার কাজ। তার উঠবস ব্যবসায়ীদের সাথে, যাদের সাথে সবসময় কথাবার্তা হয় জনগণের অর্থে নির্মিত বিল্ডিংয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে, যেখানে সবসময় থাকে তাদের সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। সাইটে কাজ দেখতে দিয়ে কাজের ভালো নির্দেশনা দিতে হয় মিস্ত্রিদের। যাদের সাথে মনোমালিন্য লেগেই থাকে। প্রয়োজনে মন্দ কথা না বললে জনগণের স্বার্থ রক্ষাই দায় হয়ে পড়ে। জয়ের হাতে যে ছোটো ব্যাগ ঝুলানো থাকে সেখানে থাকে ক্যালকুলেটর, পরিমাপ লিপিবদ্ধ করার জন্য মেজারম্যান্ট বুক আর সিডিউল। তাকে প্রতি পদে পদে থাকতে হয় সচেতন। সবাই বলে পান থেকে চুন খসলেই দোষ আর ইঞ্জিনিয়ারদের বেলায় দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসলেই দোষ।

এতো সচেতন আর পদে পদে স্বার্থের দ্বন্দ্বের সঙ্গে বসবাস করে জয়ের কবিগিরি শেষ হয়েছে অনেক আগেই। হয়তো সে কারণেই জয় কবিতা ছেড়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে, সবাই অবশ্য জয়কে কবি বলে না, লেখকই বলে। লেখকরা তুলনামূলকভাবে কম উদাসীন। বেশির ভাগ লেখকই সমাজ-সংসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও সাহিত্য চর্চা করে থাকে। তাদের কারও কারও বেশ-ভূষাও দেখা যায় না। কিন’ তাদের বসবাসও প্রকৃতি, প্রেম, সাহিত্য আসরের মধ্যে। লেখকদের নেশা ও পেশার মধ্যে কিছুটা মিল আছে কিন’ জয়ের লেখা ও পেশার মধ্যে আছে বৈপরিত্য।

জয়ের লেখা ও পেশার এই বৈপরিত্য দেখে একদিন ইরা বললো, আচ্ছা একটা কথা বলুনতো, সবসময় মিস্ত্রি আর কন্ট্রাক্টরদের সাথে উঠবস করে আর সারাদিন ইট, কাঠ, রডের মতো কঠিন বস’র সাথে বসবাস করে আপনি রোমান্টিক উপন্যাস লিখেন কীভাবে?

 

সেদিন কাজ দেখতে গিয়ে মতি একরকম জোর করে জয়কে বাসায় নিয়ে গেলো লাঞ্চ করার জন্য। ইরা ঠিক জয়ের পছন্দের খাবারগুলোই রান্না করেছে। কুচি কুচি করে আলু পিঁয়াজ দিয়ে চিংড়ি মাছ, ঢেঁকি শাক, পাবদা মাছ আর মুরগির মাংস।

জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, অসাধারণ, আমার পছন্দের রান্নাগুলো সব মিলে গেলো কীভাবে? আপনি জানতেন নাকি আমি আজ আসবো আর এগুলো আমার পছন্দের খাবার?

ইরা একটু গর্ব সহকার বললো, আপনি তো জানেন না আমার থার্ড আই সবকিছু আগে আগে দেখতে পায়। আমার মনে হচ্ছিলো আজ আপনি আসবেন আর আপনি চলে এলেন। কিন’ আপনার জানিয়ে আসা উচিৎ ছিলো জনাব। ও আর একটা কথা বলি মাংসটা কিন’ দেশি মুরগির আপনি তো কালচারাল মানুষ বিদেশি প্রজাতির বিজাতীয় মুরগির মাংস তো আপনি পছন্দ নাও করতে পারেন।

না, আসলে আসার সিডিউল ছিলো না এটাও ঠিক, এটাও ঠিক বলেছেন আমি দেশি মুরগির মাংসই পছন্দ করি।

মতি বললো, আসলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আসতে চাননি, আমি একরকম জোর করে নিয়ে এলাম।

জয় আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেলো, আপনার তো দেখছি থার্ড আই’র ওপর অগাধ বিশ্বাস।

মতি কিছুটা তিরস্কারের সুরে বললো, ওর থার্ড আই সবসময় ভুল দেখে, ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে। কোনোদিন এসে দেখবেন ও নাই, স্কুলে চলে গেছে।

ইরা বললো, সেটা হতেই পারে, নিজের চোখও তো কখনো কখনো ভুল দেখে। তবে আপনার থার্ড আই’র দৃষ্টি আরও বেশি দূরদর্শী হওয়ার কথা।

তা ঠিকই বলেছেন আমিও থার্ড আই দিয়ে দেখি কিন’ আপনার মতো হান্ড্রেট পার্সেন্ট বিশ্বাস করি না।

ইরা জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাকে টিজ করছেন?

জয় মুচকি হাসি হেসে বললো, না।

 

লাঞ্চের পর জয় ড্রয়িং রুমের জলচৌকিতে শুয়ে টি.ভি দেখছে কিন’ তার মন রয়ে গেছে দরজার দিকে, ইরার যাওয়া-আসার পথের দিকে। ইরা বার বার করে ড্রয়িং রুম থেকে কিচেনে যাচ্ছে আর জয়ের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। জয়ও তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লে ইরার একটা মুচকি হাসি।

জয় উঠছিলো মতিও তাকে বিদায় দেয়ার জন্য সোফা থেকে উঠলো এমনসময় ইরা এলো চা নিয়ে। চায়ের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, উঠছিলেন যে, চলে যাচ্ছিলেন নাকি?

জয় আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ।

ইরা জয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, দিন।

জয় তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে দিলো।

ইরা পড়লো, প্রিয়ন্তী, খুব সুন্দর উপন্যাস, এটা ঐযে আপনার লেখা সেই উপন্যাসটা, যে উপন্যাসে একই নায়ক-নায়িকার সঙ্গে তিনবার বিয়ে হয়েছে ।

মতি কিছুটা তিরস্কারের সুরে বললো, না পড়তেই বুঝলে খুব সুন্দর।

ইরা মতির কথার প্রতিবাদ করলো, না পড়তেই মানে, আমি প্রিয়ন্তীর সামারিটা পড়েছি।

জয় বুঝতে পাচ্ছিলো মতি তার আর ইরার কথাগুলো পছন্দ করছে না। সে তাড়াতাড়ি চা শেষ করছিলো ইরা জয়ের তাড়ার কারণ বুঝতে পেরেছিলো। সে বললো, আপনি এতো তাড়াতাড়ি চা খাচ্ছেন কেনো? যার জন্য বইটা নিয়ে এসেছিলেন সে ডাকছে বুঝি। তাহলে নিয়ে যান আপনার বই, আহা রে বেচারি।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কোন্‌ বেচারি?

যাকে দেয়ার জন্য বইটা এনেছিলেন।

কারও জন্য আনিনি তো। ব্যাগে সবসময় দু’য়েকটা বই থাকে।

অ, তাহলে আপনি আমার জন্য বই আনেননি, এমনিতেই বই ছিলো তাই দিলেন।

জয়ের মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠলো কিন’ সে রিসিভ করলো না।

ইরা যেনো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। সে বই নিয়ে দ্রুত গতিতে ভিতরে চলে গেলো। তার রুমে গিয়ে টেবিলের ওপর বইটা জোরে শব্দ করে রেখে দিয়ে আবার ডাইনিংয়ে, যেখান থেকে জয়কে দেখা যায় সেখানে এসে দাঁড়ালো। জয় সেদিকে তাকাতেই সে মুখ বিকৃত করলো।

জয় মতিসহ ড্রয়িং রুম থেকে বের হলো। ইরাও তাদের সঙ্গে বাসা থেকে বের হলো। জয় আর মতি দু’জনে সামনে হাঁটছিলো, ইরা পেছন থেকে ডাক দিলো, একটু দাঁড়ান প্লিজ!

জয় দাঁড়ালো, মতি রাগান্বিত স্বরে বললো, তোমাকে না কতদিন বলেছি পেছন থেকে ডাকবে না।

জয় মতির কথা শুনে হেসে ফেললো, কেনো? পেছন থেকে ডাকলে কী হয়?

মতি বললো, অমঙ্গল হয়, আপনি প্রগ্রেসিভ রাইটার তাই হয়তো মানেন না কিন’ কিছু কিছু প্রবাদ আছে যেগুলো মানতে হয়।

জয় ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, বলুন ম্যাডাম?

আমার বাড়ির সামনে এই জায়গায় ফুলের বাগান করবো, আপনি ডিজাইন করে দিবেন?

আমি তো বাড়ির ডিজাইন করতে জানি ফুল বাগানের তো কোনোদিন ডিজাইন করিনি।

করেননি, করবেন। ইঞ্জিনিয়ারদের শুধু ইট, কাঠ, বালু নিয়ে কাজ করতে হয় কিন’ লেখকদের সবকিছু নিয়েই কাজ করতে হয়। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে একটা ভালো ফুলের বাগানের ডিজাইন করতে পারবেন। কোথায় গোলাপ ফুলের গাছ হবে, কোথায় রজনীগন্ধা, কোথায় বাগানবিলাস… আর… আপনি ভালো বুঝবেন।

ওকে। আমি চেষ্টা করবো।

অবশ্যই চেষ্টা করবেন, মনের মাধুরী মিশিয়ে বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো।

জয় ইরার দিকে তাকাতেই দেখলো ওর দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে। মতি ক্রমেই অসহিঞ্চু হয়ে পড়ছিলো। জয় ভয় পাচ্ছিলো কখন জানি সে ধৈর্যের বাঁধ হারিয়ে তাকে কিছু বলে ফেলবে।

জয় বললো, ওকে ম্যাডাম, আসি।

ইরা অভিমানের সুরে বললো, ওকে আসুন। এদিকের পথ যেনো ভুলে যাবেন না, আমার নাম যদি মনে থাকে তো আমার নামে একটা বই নিয়ে আসবেন আর ঘোড়ায় চড়ে এসে বিদ্যুৎ গতিতে চলে যাবেন না।

জয় বললো, ওকে বাই।

 

সাত

 

মতি বিয়ে করেছে, খুব সুন্দর, স্মার্ট এক মেয়েকে। জয়পুরহাট শহরের এক নামী-ধামী পরিবারের মেয়ে। খবরটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। আর পরদিন থেকে শুরু হলো নতুন বউ দেখার ভিড়। আমি মাথায় ঘোমটা পরে বসে আছি আর দর্শনার্থীদের পান তুলে দিচ্ছি।  প্রথম দু’দিন বেশ ভিড় ছিলো তারপর একটু ভিড় কমলো। তৃতীয় দিন একটা মেয়ে এলো, বয়স আমার মতোই হবে বারো কিংবা তেরো বছর। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। গত দু’দিনে কত মেয়ে এলো সবাই আমাকে দেখে হাসি মুখে কথা বললো, কেউ বললো, মতি ভাই পরী বিয়ে করে এনেছে, কেউ বললো, মানুষ এতো সুন্দর হয়! কিন’ আমাকে দেখে তো কেউ চোখের জল ফেলেনি।

মেয়েটা আমার সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যেনো একটা চাপা উত্তেজনা দেখা দিলো, আমার শাশুড়ি চাপাস্বরে বললো, এই মেয়েটা আবার এলো কেনো? আমার ছোট ননদ আফরোজা ওকে ডাক দিলো, এই শাকিলা এদিকে আয়তো।

মেয়েটি গেলো না। ওর চোখ দিয়ে তখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির পরিবেশ আর শাকিলার চোখের জল দেখে আমার বুকটা ক্বেঁপে উঠলো।

অবশেষে শাকিলাকে আফরোজা হাত ধরে একরকম জোর করে নিয়ে গেলো।

তারপর-

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, বিকেলে আমি আঙিনায় চুল শুকাচ্ছিলাম। আফরোজা আমার পাশে একটা পিঁড়ি নিয়ে বসে আমার চুলে চিরুনি করে দিতে শুরু করলো।

ইরা বললো, আফরোজা কিছুক্ষণ আমার চুলে চিরুনি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, ভাবী আপনার মন খারাপ নাকি? আমি কিছু বললাম না। আফরোজা আমার বাহুতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, কী হলো ভাবী? কথা বলছেন না কেনো? আপনি তো এমন না, এই দু’দিনে আপনাকে দেখেছি আপনি কখনো চুপ করে থাকতে পারেন না, সবসময় হাসি-খুশি থাকেন আজ হঠাৎ কী হলো আমার লক্ষ্মী ভাবীর বলে আফরোজা আমার থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করলো।

আমি কোনো ভণিতা না করে আফরোজাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আফরোজা শাকিলা নামে যে মেয়েটা এসেছিলো মেয়েটা কে রে?

আফরোজা থতমত খেয়ে বললো, কেউ না ভাবী।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে শাকিলা বাড়িতে আসার পর তোরা সবাই ওকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেলি কেনো? আর মেয়েটা কাঁদছিলোইবা কেনো?

শাকিলা চুপ করে রইলো। আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, বলছিস না কেনো? ঐ মেয়েটার সঙ্গে নিশ্চয়ই তোর ভাই’র কোনো রিলেশন আছে।

আফরোজা আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। রাতে আমি মতিকে জিজ্ঞেস করলাম কিন’ মতির কথাতেও আমি সন’ষ্ট হতে পারলাম না। কয়েকদিন পর বেরিয়ে এলো আসল ঘটনা।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী ঘটনা?

মতি আমাকে বিয়ে করার আগে আরও তিনজন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে, আমি ওর ফোর্থ লাভার। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মতিকে নিয়ে আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।

জয় ইরাকে বললো, বিয়ের আগে এরকম রিলেশন থাকতেই পারে ম্যাডাম, এটা দেখতে হয় না। আপনি দেখবেন বিয়ের পর সে কিছু করছে নাকি।

ইরা বললো, তাইতো দেখছিলাম কিন’ ওর আচরণে আমি কখনোই সন্দেহ মুক্ত হতে পারছিলাম না। সবসময় আমার মনে হতো ও বুঝি ওর আগের প্রেমিকাদের সাথে আগের মতোই রিলেশন রেখেছে, একটা সন্দেহ আর অবিশ্বাস আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চলে যাবো কিন’ কোথায় যাবো! আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই এই পৃথিবীতে, আমার বাবা-মা তখনো আমাদের বিয়েকে মেনে নেয়নি, কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো আমি! ভাবছিলাম বাবা-মা’র হাত ধরে মাফ চাইলে হয়তো তারা মাফ করে দিবে কিন’ হায়, তাও হলো না ততদিনে আমি মা হতে চলেছি। আর কোথাও যাওয়া হলো না, আমি অনাগত সন্তান আর সংসারের মায়াজালে আটকা পড়ে গেলাম।

জয় চুপ করে ইরার কথা শুনছিলো। কোনো সাড়া না পেয়ে ইরা বললো, হ্যালো।

হ্যাঁ, বলুন।

এখন তো আপনি স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছেন?

টিজ করছেন?

কেনো আপনি কি এখন সুখে নেই? কীসের অভাব আপনার? স্বামী-সন্তান-সংসার সব আছে আপনার।

আবার… আমি আপনার অনেকগুলো উপন্যাস পড়েছি। আপনার কল্পনা শক্তি অত্যন্ত প্রখর। আপনার খুঁজে ফিরি তারে উপন্যাসে যখন আপনি ফিরোজ সাহেবের চরিত্র লিখেছেন, দাগ উপন্যাসে মায়ার চরিত্র লিখেছেন, ছায়াপুরুষ উপন্যাসে যখন আপনি তন্দ্রার কষ্টগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন তখন আমার মনে হয়েছে আপনি সত্যিই মেয়েদের কষ্টগুলো বোঝেন এবং আমার কষ্টগুলোও আপনি বুঝবেন কিন’ এখন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন যেনো আপনি কিছুই বোঝেন না। অথচ আপনার লেখা পড়ে আমি আপনাকে ছায়াপুরুষ ভাবতে শুরু করেছি।

তাই নাকি?

অবশ্যই। মতি যখন আমাকে অবহেলা করে, স্কুলের সময় হতে না হতেই যখন ও স্কুলে চলে যায়, বিকেলে স্কুল থেকে এসে তাড়াহুড়ো করে ও যখন বাজারের কথা বলে চলে যায় আর ফিরে আসে অনেক রাতে তখন আমার মনে হয়, ইসস আমার যদি একজন ভালো ফ্রেন্ড থাকতো, আমি যদি আমার সুঃখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো তার সাথে শেয়ার করতে পারতাম তবে আমার জীবনে আর কোনো অপ্রাপ্তি থাকতো না। ঠিক এমনসময় আমার আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো, আপনার ছায়পুরুষ উপন্যাস পড়লাম। আপনার ছায়াপুরুষ উপন্যাসের তারেক চরিত্রটা আমার খুব পছন্দ। আমি যখন একা থাকি, এই ফসলের মাঠের মধ্যে একটা বাড়িতে নিঃসঙ্গতা যখন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ঠিক তখনই আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে আপনার ছবি, আপনার হাসিমুখ যেনো আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আমি নিজের কাছে একটা সান্ত্বনা খুঁজে পাই যে আমার একজন ভালো ফ্রেন্ড আছে, আমার একজন ছায়াপুরুষ আছে যে আমার মনের কষ্টগুলো বোঝে, আমার দুঃসময়ে ঠিকই পাশে এসে দাঁড়ায় তার ছবি। আমি সারাজীবন তোমার মতোই একজন মানুষ খুঁজছিলাম জয়। বলতে বলতে আবেগে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ইরার কথা শুনে জয়ের দু’চোখ ছলছল করে উঠলো। আসলে জয় নিজেও জীবনের শুরু থেকে একজন ছায়াসঙ্গীই খুঁজছিলো।

 

আজ থেকে সাতাশ বছর আগে জয়ের বয়স যখন একুশ বছর তখন থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। জয় নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছে। অশিক্ষা আর কুসংস্কার যেনো জয়ের জন্মসূত্রে পাওয়া। তার মামাতো-ফুপাতো ভাইবোনদের বিয়ে শুরু হয়েছে আরও আগে। জয় লেখাপড়া করতো বলে তারই বিয়েতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই বিয়ের জন্য কনে খোঁজা। যদিও জয় তখনও ছাত্র তবুও সহপাঠী ও কনিষ্ঠদের বিয়ে দেখে সেও যেনো মনে মনে বিয়ের পিঁড়িতে পাঁ দিয়েছে।

কয়েকদিনের মধ্যে পাত্রীর সন্ধান পাওয়া গেলো। জয়ের বাবা আর ছোট ভাই কনে আর তাদের বাড়ি-ঘর দেখে এসে যেমন বর্ণনা দিলো তার বিবরণ মোটামুটি নিম্নরূপ:

কনের নাম সামিনা। পাঁচ বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। গায়ের রং শ্যামলা, লম্বায় খাটো বললে ভুল হবে তবে লম্বা নয়। দীর্ঘাঙ্গী মেয়েদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারের কারোই পছন্দ না। তবে মুখের গড়ন সুন্দর। তখনো তাদের পরিবারের ছেলেরা বিয়ের আগে নিজে কনে দেখতো না, বাবা-মা, ভাই-বোনরাই কনে দেখে তার বিবরণ দিতো আর ছেলেরা তাদের ওপর নির্ভর করেই বিয়ে করতো। জয়ও তার বাবা আর ছোটো ভাই’র দেখা মেয়ের বিবরণ এবং তাদের খুব পছন্দ বলে বিয়েতে মত দিলো। একথা মনে পড়লে আজও জয় নিজেকে ধিক্কার দেয়, কী অসেচতনই না ছিলো সে যে তার নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলো।

সামিনা কয়েকবছর আগে এস.এস.সি পাস করেই লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়েছে। লেখাপড়ায় ইস্তফা দেয়ার কারণ হিসেবে তার বাবার যুক্তি হলো, “মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে আর কী হবে বাহে। যত লেখাপড়াই শিখুক শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তো ভাত রান্নাই করতে হবে। তাই মেয়েদের লেখাপড়া শেখার চেয়ে রান্না শেখাটাই বেশি জরুরি।’’

 

বিয়ের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হলো। কাজি সাহেব একটা বড় রেজিস্টার নিয়ে জয়ের সামনে এলো, জয় রেজিস্টারে স্বাক্ষর করবে এমনসময় তার এক বন্ধু বিলাস কুমার বসাক জয়কে জিজ্ঞেস করলো, জয় বউ দেখেছিস?

জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

বউ না দেখে বিয়ে করছিস?

জয় ওর কথা শুনলো না, পকেট থেকে কলম বের করলো। বিলাস জয়ের হাত চেপে ধরলো, জয় এখনি সই করিস না আগে কনে দেখ দোস্ত।

জয় কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো। তারপর কলমটা পকেটে রেখে কাজি সাহেবকে বললো, আমি আগে মেয়ে দেখবো।

কাজি সাহেব একবার ডানে একবার বাঁয়ে তাকাতেই কনে পক্ষের একজন বললো, কেনো কী হয়েছে?

বিলাস মিনমিন করে বললো, না মানে ও বলছিলো আগে কনে দেখবে।

কনে পক্ষের কয়েকজন জড়ো হলো, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

জয়ের পাশে তার এক দুলাভাই ছিলো, সে বললো, আমরা আগে কনে দেখবো।

কনে পক্ষের লোকজন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলো, না আর কনে দেখানো হবে না, বরের বাবা-ভাই কনে দেখে পছন্দ করেছে, আগে বিয়ে রেজিস্ট্রি হোক, খাওয়া-দাওয়া হোক তারপর যাওয়ার সময় কনে দেখানো হবে।

এখবর শুনে জয়ের পক্ষের লোকজন কিছুটা সন্দেহ পোষণ করলো, কোনো লুকোচুরি নেই তো! কনে দেখাতে এতো আপত্তি কেনো?

কিন’ কনে পক্ষের লোকজনের অগ্নিমূর্তি দেখে জয়ের পক্ষের লোকজন কনে দেখার কথা আর বলার সাহসই পেলো না।

জয় কাজির রেজিস্টারে দু’টা স্বাক্ষর করে দিলো। কিছুক্ষণ পর মৌলভী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে আলহামদুল্লিাহ বলে নতুন দম্পতির দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলো। বিয়ে বাড়ির সবাই আমিন আমিন বলে আল্লাহর কাছে হাত তুললো।

হায় শুভ বিবাহ! অশান্তির বীজ বপন করে শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।

বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর আঙিনায় বিশাল সামিয়ানার নিচে কনে দেখানোর আয়োজন করা হলো। জয় একবার আড়চোখে সামিনার দিকে তাকালো। সে আঁৎকে উঠলো, তার বুক ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে এলো, হায় আল্লাহ কী দেখলাম আমি! এই মেয়েটি, এই কৃঞ্চবর্ণের, নাক বোচা, খাটো মেয়েটি আমার বউ! আল্লাহ তুমি এ কি করলে?

জয়ের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন’ সেদিকে কারও খেয়াল নেই। সবার চোখ এখন পাত্র-পাত্রীর চেহারায় মিল হয়েছে কী না। কেউ কেউ বললো, সামিনা খুব ভালো বর পেয়েছে।

জয়ের মনে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে, সামিনা তো ভালো বরই পেয়েছে কিন’ আমি! আমি কী পেলাম? বিয়ে বিয়ে খেলায় আমি যে হেরে গেলাম।

ততক্ষণে কাবিন নামায় দু’টি স্বাক্ষরের মাধ্যমে জয় আইন আর সমাজের শৃঙ্খলে আটকা পড়ে গেছে।

 

ফুলশয্যার রাত জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রাত যদি সেই রাত হয় কাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গে কিন’ যদি সেটা হয় অপছন্দের, আবেগহীন, অনিচ্ছার আর হৃদয়ের সম্পর্কবিহীন কারও সঙ্গে, জোর করে কিংবা কৌশলে ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া কারও সঙ্গে তবে!

তবে সেটাই হয়ে যায় তার জন্য জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত, কলঙ্কিত রাত। ফুলশয্যার রাতটাও জয়ের জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কিত রাত। সেই রাতেই জয় সামিনাকে স্পষ্ট বলেই দিলো, তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি। তোমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন জোর করে, কৌশলে তোমাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।

সামিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। জয়ের জন্য সেই রাতটা কলঙ্কিত হলেও সামিনার জন্য তো কাঙ্ক্ষিতই। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার কী দোষ, বলো? যদি দোষ হয়ে থাকে তবে আমার বাবা-মা’র হয়েছে আমি তো কোনো দোষ করিনি।

তুমি দোষ করোনি? তুমি সব জানতে…

হ্যাঁ জানতাম। বিয়ের আগে আমি তোমার ছবি দেখেছি। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সেই ছবি দেখার পর থেকে আমি মনে মনে তোমাকেই খুঁজছি আর আজকের এই রাতটার জন্য অপেক্ষা করছি, প্লিজ তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিও না। বলতে বলতে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় আর সামিনার দাম্পত্য জীবন শুরু হলো হৃদয়হীন, আবেগহীন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নেয়া স্ত্রীর সাথে জয়ের জীবন-যাপন। সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে জয় মেনেই নিলো।

তাদের ঘরে একে একে দু’সন্তান এলো। আগে যখন শুধু সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে জয় মেনে নিয়েছিলো তার সাথে যোগ হলো দু’সন্তানের ভবিষ্যৎ, যখনই সামিনার সাথে জয়ের কোনো বিষয় নিয়ে মতোবিরোধ হতো, মনোমালিন্য হতো তখনই জয় মনে মনে ভাবতো, সামিনাকে বিদায় করে দিবে কিন’ সেই পথে বাধা পড়তো দু’সন্তানের ভবিষ্যৎ।

 

এই সাতাশ বছরের দাম্পত্য জীবনে জয় একটা মানুষ খুঁজেছে, তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে সে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। বলতে গেলে জয়ের জীবন অনেকটা যাযাবরের মতোই। জনপদ, মেঠোপথ, রাজপথ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র ঘুরে বেড়িয়েছে কিন’ কোথাও নঙ্গর করেনি। পথে চলতে চলতে, কাজের মাঝে কিংবা লেখার মাঝে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, অনেক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সখ্যতা হয়েছে, কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে কিন’ হৃদ্যতা হয়নি। কাউকে আপন করতে পারেনি, কোথায় যেনো একটা দূরত্ব রয়েই গেছে কিন’ ইরার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার মনে হয়েছে সে বুঝি তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, হৃদয়ের ঠিকানা! ইরার ফোন এলেই জয়ের বুকটা ধক করে উঠে, সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ক্ষণিকের অনুপসি’তিতে জয় ছটফট করে, অসি’র হয়ে উঠে।

জয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে ইরা বললো, হ্যালো।

জয় বললো, বলুন শুনছি।

কী ভাবছেন?

না কিছু না।

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, আমার থার্ড আই বলছে আপনিও ব্যক্তিজীবনে সুখী না, আপনার মধ্যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে। আপনি এতক্ষণ তাই ভাবছিলেন।

ও, আপনার থার্ড আই তো আবার হান্ড্রেট পার্সেন্ট সিওর।

অবশ্যই। আমার থার্ড আই’র ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কোনো কষ্টে না থাকলে কেউ লেখক হয় না।

জয় একটা কষ্টের হাসি হাসলো।

ইরা বললো, কী হলো ছায়াপুরুষ? আমি কি ভুল বলছি?

ঠিক বলেছেন।

আমি এখন থেকে তোমাকে ছায়াপুরুষ বলে ডাকবো, তুমি আমার ছায়া, আমার হৃদয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়, আমার মাথার ওপর তীব্র রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে তুমি আমাকে ছায়ার মতো রক্ষা করবে। পারবে না?

অবশ্যই।

কোনোদিন যেনো আমার ওপর থেকে তোমার ছায়া তুলে নিও না বলতে বলতে আবেগে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

 

আট

 

ইরা তার বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান করেছে। সেই বাগানে লাগিয়েছে বাগানবিলাস, মাধবীলতা, শেফালি, বেলি ফুল ছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ। এই বাগান, চোখের সামনে দিনে দিনে তরতর করে বেড়ে ওঠা স্কুলের একাডেমিক ভবন আর জয়ই এখন ইরার দিনরাত সবসময়ের চিন্তা ও চেতনায় মিশে আছে।

সেদিন জয় বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ইরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে এলো । জয় তখন ছাদের ওপর ছিলো। ইরা সোজা ছাদে চলে এলো, হাই রাইটার।

জয় বললো, হাই।

কেমন আছো ছায়াপুরুষ?

ইরার জয়কে তুমি সম্বোধন করা দেখে মতি একবার তাদের দু’জনের দিকে তাকালো।

জয় বললো, ভালো।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, আমাদের বাড়িতে একবার আসবে?

কেনো?

এমনি, বাহ রে কাজ না থাকলে কেউ বুঝি কারও বাড়িতে যায় না বলে ইরা মতিকে বললো, এই তুমি বলো না তোমার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বাসায় আসতে।

মতি আমতা আমতা করে বললো, চলুন ভাই, বাসায় চলুন, ইরা তুমি বাসায় গিয়ে নাস্তা রেডি করো আমরা আসছি।

না, আমিও তোমাদের সাথে যাবো বলে ইরা এগিয়ে যেতে শুরু করলো, জয় আর মতি দু’জনে ইরার পেছনে পেছনে যেতে শুরু করলো।

ইরা বাসায় ঢুকলো না, বাগানে দাঁড়িয়ে তার বাগানের গাছগুলির সঙ্গে জয়কে পরিচয় করে দিতে শুরু করলো।

মতি তাড়া দিয়ে বললো, আগে নাস্তা খেতে দিবে নাকি তোমার বাগানের…

মতির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইরা মতির দিকে রাগান্বিত চোখে তাকাতেই মতি বললো, ওকে বাবা, তুমি থাকো, আমি বাসায় গিয়ে ততক্ষণে হাত-মুখ ধুয়ে নিই।

মতি বাসায় ঢুকলো। ইরা একটা জবা ফুলের গাছের পাশে দাঁড়িয়েছে। শেষ বিকেলের রোদ ইরার ফর্সা গালের ওপর পড়েছে, পাশে ফুটন্ত জবা ফুল ইরার সেই গালের ওপর খেলা করছে। অসাধারণ এক সৌন্দর্যে যেনো সেজেছে সবকিছু, প্রকৃতি, ইরা আর তার বাগান। জয় ইরার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো।

ইরা জয়ের কাছে এলো, জয়ের চোখের কাছে হাত নেড়ে বললো, এই যে ছায়াপুরুষ কী দেখছো? সবাই বলে রাইটাররা নাকি রোমান্টিক হয়, কেউ কেউ বাড়িয়ে বিষয়টাকে অন্যভাবে উপস’াপন করে। আমি অবশ্য বাঁকা দৃষ্টিতে দেখি না। কারণ কি জানো?

জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

কারণ তুমি আমার শেষ বিকেলের রোদ্দুর।

ইরার কথায় জয় হাসলো।

ইরা জয়ের হাসি দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, হাসছো কেনো! হাসবে না, সবসময় হাসবে না। তোমার হাসিটা দেখলে দুনিয়াতে এমন কোনো মেয়ে নেই যার বুকে ঝড় উঠবে না। তোমার হাসির আমি একটা নাম দিয়েছি, কী জানো?

না।

ভুবন মোহিনী হাসি।

জয় একটা মুচকি হাসি হাসলো তারপর আমতা আমতা করে বললো, আসলে তুমি অনেক অনেক পজিটিভ একটা মেয়ে। তাই আমার সবকিছুকেই পজিটিভলি দেখো।

শুধু পজিটিভলি দেখি এটুকু! অনেক হার্টলেস কথা বলে ফেললে ছায়াপুরুষ। খুব কষ্ট পেলাম তোমার কথায়, আমি এদিকে যেনো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি আর তুমি বলছো আমি সবকিছু পজিটিভলি দেখি…

সরি, কিছু মনে করবে না।

ওকে। এখন আমার বাগানের ডিজাইন সম্পর্কে তোমাকে বলছি, তুমি যখন ডিজাইন করবে তখন আমার কথাগুলো মনে রাখবে।

বলো।

ইরা বলতে শুরু করলো, পাকা রাস্তা থেকে আমার বাসায় আসা পর্যন্ত থাকবে গার্ডেন লাইট, সরু রাস্তার দু’পাশে থাকবে পাতাবাহার গাছ, আর এই যে ফাঁকা জায়গাটা দেখছো, বলে ইরা লাফিয়ে পশ্চিম পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, এখানে আরও ফুল গাছ থাকবে, এগুলো তুমি পছন্দ করে দিও।

জয় ইরাকে আরও কয়েকটা গাছের কথা বললো।

ইরা আবেগে চিৎকার দিয়ে বললো, ওয়াও।

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বললো, আমার আর একটা ইচ্ছা আছে।

কী ইচ্ছা?

ইরা তার বেলকনির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো, গভীর রাতে আমি এই বেলকনিতে বসে থাকবো, টবে ঝুলবে তোমার পছন্দ করা পাতাবাহার গাছ, বাগানে থাকবে তোমার পছন্দ করা ফুল গাছ, সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের তাজমহল, বলতে বলতে ইরা উদাস হয়ে গেলো।

তাজমহল!

হ্যাঁ, তোমার ঐ বিল্ডিংটাইতো আমার কাছে তাজমহল আর এই বাগানেরও একটা নাম রেখেছি।

কী?

সাজগার্ডেন, বলে দু’জনে হাসলো।

মতি ভেতর থেকে তাড়া দিলো, ইরা।

আসছি, বলে ইরা আবার বলতে শুরু করলো, আমার আর একটা ইচ্ছা আছে।

বলো?

এখানে আমি একটা ক্রিস্টমাস ট্রি লাগাবো। প্রতি বছর বড়দিনে আমি এই খ্রিস্টমাস ট্রিকে আলোকিতো করবো। তুমি যেখানেই থাকো বড়দিন ঠিক সন্ধ্যায় তুমি ফেসবুকে লগইন করে বসে থাকবে আর আমি থাকবো ক্রিস্টমাস ট্রি আলোকিত করে। তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ক্রিস্টমাস ট্রি’র ছবি, আমি দেখবো আমার জয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা একসাথে বড়দিন উদযাপন করবো, একসাথে! ওকে? বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে গেলো।

জয় বললো, ওকে। তবে আমি একটা রিকোয়েস্ট করবো।

বলো?

জয় বললো, সেই ক্রিস্টমাস ট্রিটা আমি কিনে দিবো।

আবারও?

কেনো? কোনো সমস্যা?

না, কোনো সমস্যা না। তুমি তো আমাকে অনেক দিয়েছো আমি যে তোমাকে কিছুই দিতে পারছি না।

ভণিতা করো না।

ওকে, আমি খুব শীঘ্রই জয়পুরহাট আসবো। বলে ইরা মনে মনে হিসেব করে বললো, ওয়াও আজ তো ডিসেম্বরের বিশ তারিখ। তাহলে আমি পঁচিশ তারিখে জয়পুরহাট আসবো, বড়দিনে। সেদিন তুমি গাছ কিনে দিও আমি সেদিনই গাছ লাগাবো, আলোকিত করবো। খুব সুন্দর হবে, তাই না?

অবশ্যই।

ভেতর থেকে মতি আবারও তাড়া দিলো, ইরা, তুমি বাগানে বক বক করে কথা বলবে নাকি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বাসায় আনবে?

আসছি বাবা, আসছি। তোমার কাছে ও ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে আমার কাছে ও একজন রাইটার। রাইটার ভক্তের সম্পর্ক তুমি বুঝবে না। ইরা কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকলো, জয়ও বাসায় ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসলো।

ইরা সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো। পেছনে পেছনে মতিও রান্না ঘরে ঢুকলো।

মতি ইরাকে চাপা স্বরে বকাবকি করছে, ইরা তোমার খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। একটা কথা মনে রেখো কোনো কিছুরই বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না।

ইরা প্রতিবাদ করলো, কী বলতে চাচ্ছো তুমি? বাগানে একটু কথা বললাম তাতে এমন কী হলো যে তুমি আমাকে…

মতি বললো, না আমি তোমাকে খারাপ কিছু বলছি না।

না, খারাপ বলছো না কিন’ ভালোও তো বলছো না। আসলে তুমি শিক্ষকতা করো কিন’ শিক্ষকতার কতটুকু আছে তোমার? না আছে বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক, না আছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক। তুমি এখন আর শিক্ষক নেই, সমন্বয়কারী হয়ে গেছো।

বাহ, তুমি তো দেখছি ভালো শিক্ষক হয়ে গেছো।

বলছি তো, তুমি কি বুঝবে। জয় কতকগুলো উপন্যাস লিখেছে, কত বড় লেখক!

ওসব আমার বুঝে কাজ নেই।

তা থাকবে না তো। একটা কথা বলি মনে রেখো।

মতি আগ্রহভরে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ইরা বললো, রতনে রতন চেনে আর শুয়োরে চেনে কচু।

এবার আর চাপাস্বরে নয়, মতি জোরে চিৎকার করে বললো, ইরা, সংযতভাবে কথা বলো, কাকে কী বলছো তুমি।

ইরা বললো, সরি। এটা একটা প্রবাদ বাক্য, তোমার ক্ষেত্রে হয়তো পুরোপুরি প্রযোজ্য নয় কিন’ একটা কথা একবার ভেবে দেখো। তুমি শিক্ষক অথচ ক্লাস নাও না, স্কুলের সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে কোনো কথা বলো না, মেয়েদের খেলাধুলাকে তুমি ইন্সপায়ার্ড করো না। অথচ তুমি গার্লস স্কুলের হেড মাস্টার। আসলে তুমি এখন বেশি ব্যস্ত স্কুল থেকে টাকা ইনকাম করা নিয়ে। শিক্ষকের কোনো পদ শূন্য আছে কী না, সেই পদে নিয়োগ দিলে কত টাকা পাওয়া যাবে এসব নিয়ে। ওকে তোমার সঙ্গে আর এনিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। তুমি ড্রয়িং রুমে বসো, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।

মতি কিছু বললো না, রাগে গজ গজ করতে করতে ড্রয়িং রুমে গেলো।

 

নয়

 

সাথী নার্সারি। নার্সারিটা বেশি বড় না কিন’ বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ আর ফুলে ফুলে ভরা। আগেও জয় আর ইরা কয়েকবার এসেছে এই নার্সারিতে। গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা ছোট্ট ঘর, ওপর গোলাকৃতি ছনের চালা। ইরা এই ছনের ঘরেরও একটা নাম দিয়েছে, সাজঘর। সাজঘরের ভেতর একটা টেবিল আর গোটা দুই তিন চেয়ার সাজানো আছে। আগে কোনোদিন এই ঘরের ভেতর ওরা ঢুকেনি আজ ইরা ঘরের দরজায় উঁকি মারতেই ভেতর থেকে নার্সাারির মালিক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, আসেন আপা, ভেতরে বসেন।

ইরা একবার জয়ের দিকে তাকাতেই জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো, হাসতে হাসতে বললো, ভিতরে বসুন ভাই, বলে সে তার একজন মালিকে বললো, এই এন্তাজ দু’টা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আয়তো, আগে গাছ দেখেন আপা ও ততক্ষণে কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আসুক। বাড়িতে কি বাগান করেছেন নাকি আপা?

হ্যাঁ, এই ছোটোখাটো আর কি।

হুম, যতদিন থেকে গাছ নিয়ে যাচ্ছেন ততদিনে তো একটা বাগানই হয়ে যাওয়ার কথা।

হয়েছে।

আমি এখানে আছি আপা, আপনারা দেখে আসুন, কোন্‌ কোন্‌ গাছ নিবেন।

আচ্ছা।

জয় সামনে আর ইরা জয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে হাঁটছে। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভিতরে গেলো। সরু পথ, দু’পাশে সারি সারি করে সাজানো ফুল গাছ, দু’জনে যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। হঠাৎ করে ইরা জয়কে টেনে ধরলো, এই এভাবে জোরে জোরে হেঁটে বেড়াবে নাকি একটু দাঁড়াবে?

জয় থমকে দাঁড়ালো।

ইরা জয়ের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি তুললো। তারপর আবেগপ্রবণ হয়ে বললো, দেখো, দেখো, খুব সুন্দর হয়েছে না?

জয় হাসতে হাসতে বললো, তাইতো, খুব সুন্দর হয়েছে।

তুমি খুশি হওনি?

হয়েছি।

কিন’ এমনভাবে কথাটা বললে যেনো তুমি খুশিই হওনি। তোমার পাশে আমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। ইস্‌ কেনো যে আগে তোমার সাথে দেখা হয়নি।

জয় ইয়ার্কি করে বললো, হলে কী করতে?

ইরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে জয়ের চোখে চোখ রেখে বললো, এই দুষ্টুমি হচ্ছে আমার সঙ্গে না? কী করতাম তুমি বোঝোনি?

জয় মুচকি হাসি হেসে না সূচক মাথা নাড়লো।

তোমাকে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতাম।

ও এখন তাহলে তুমি কয়েকদিনের জন্য আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করছো?

ইরা এবার প্রচণ্ড রেগে গেলো, ভালো হচ্ছে না কিন’, তুমি আমার ভালোবাসাকে অপমান করছো।

জয় কৃত্রিম মুখ কালো করে বললো, সরি ইরা।

ওকে। সরি বলার দরকার নেই।

আজ প্রথমে কিনতে হবে একটা ক্রিস্টমাস ট্রি আর কী গাছ কিনবে বলো?

এই নার্সারির প্রায় সব ফুলের গাছ নেয়া হয়েছে।

জয় বললো, না হয়নি।

কোনটা?

জুঁই।

ও তাইতো।

জুঁই ফুলের নামটা আমি দিনরাত এতোবার মনে করি অথচ গাছ কেনার সময় মনেই থাকলো না, বলে ইরা জয়ের আরও কাছে এলো, শোনো আমাদের যদি বিয়ে হতো, আর যদি আমাদের একটা মেয়ে হতো তবে ওর নাম রাখতাম জুঁই। নামটা ভালো হতো না?

অবশ্যই হতো, তবে এতোগুলো যদি থাকলে কিছুই হয় না।

মানে?

মানে, যদি আমাদের আগে দেখা হতো, যদি আমাদের বিয়ে হতো, যদি আমাদের বেবি হতো, কয়টা যদি হলো?

ইরা বললো, তিনটা।

তিনটা যদি দিয়ে কিছু হতো না ইরা।

দিলে তো মুডটা নষ্ট করে। আমি অনেক চিন্তা করে নামটা ঠিক করেছি। আর তুমি কি না দিলে সব এলোমেলো করে। এই তুমি না বলো কথার সময় ছন্দপতন ঘটাতে হয় না। আবার তুমি নিজেই ছন্দপতন ঘটাও। তুমি না বলো পজিটিভ হতে আবার তুমি নিজেই নেগেটিভ হয়ে যাও।

ঠিক বলেছো।

ইরা আংশিক মুখ বিকৃত করে বললো, জি স্যার। জয় থেকে জ আর ইরা থেকে ই নিয়ে আমি রাখতাম জুঁই।

সুন্দর নামতো।

শুধু নামটা সুন্দর, আর কিছু না? আমি তোমাকে নিয়ে কতকিছু ভাবছি সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছো?

অবশ্যই দেখেছি।

না দেখোনি।

তুমি ভুল বলছো, তোমার থার্ড আই নাকি সব বুঝতে পারে আর তুমি এটা বুঝতে পারলে না যে আমি তোমাকে নিয়ে কিছু ভাবছি কী না?

এন্তাজ কাছে এলো, কী কী গাছ নিবেন স্যার?

জয় বললো, তোমার ম্যাডামকে বলো, তবে আমার জন্য একটা ক্রিস্টমাস ট্রি আর একটা জুঁই গাছ।

জি ম্যাডাম আপনি বলুন।

ইরা কয়েকটা গাছের নাম বললো।

এন্তাজ বললো, ম্যাডাম আপনারা বসুন, আমি আপনাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি। আপনারা নাস্তা খেতে খেতে আমি গাছ প্যাকেট করে দিচ্ছি।

জয় আর ইরা গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। সাজ ঘরের কাছে যেতেই মালিক ভদ্রলোক বললো, আপা ভিতরে বসেন।

জয় বললো, আপনি আবার এগুলোর আয়োজন করতে গেলেন কেনো? শুধু শুধু টাকা খরচ করলেন।

না, খরচ আর কি, আপা তো আমার এখান থেকে অনেক গাছ কিনেছেন, কোনোদিন এক কাপ চা খাওয়াতে পারিনি। বলে সে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললো, আপা ভিতরে বসেন।

দু’জনে সাজ ঘরে ঢুকলো।

ভদ্রলোক নিজে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল খুলে দিতে দিতে বললো, আপার গ্রামের বাড়ি কোথায়?

ইরা তার গ্রামের নাম বললো।

ভদ্রলোক ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, কী কী গাছ নিবেন বলেছেন আপা?

ইরা বললো, হ্যাঁ বলেছি।

তাহলে আপনারা বসুন আমি দেখি তাড়াতাড়ি প্যাকেট করে দিচ্ছি। বলে সে চলে গেলো।

ভদ্রলোক চলে যেতেই ইরা জিজ্ঞেস করলো, এই ভদ্রলোক আমাদের কী ভাবছে বলোতো, এভাবে সাজঘরে আমাদের রেখে চলে গেলো।

জয় বললো, ভদ্রলোক জানে বলেই চলে গেলো।

ইরা বললো, তাতে কী হয়েছে?

না কিছু হয়নি।

ইরা বললো, জানুক, তাতে কী হয়েছে। আমাদের রিলেশনটা কি এখনো অনেক দূরের আছে, কত কাছের, কত আপন, কত গভীর একটা রিলেশন আমাদের বলতে বলতে ইরা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে উদাস হয়ে গেলো।

জয় ইরার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

ইরা আবেগ আল্পুত হয়ে বললো, তুমি, তুমি আমার সব জয়, আমি আজকাল তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারি না। অথচ দেখো তুমি আরেকজনের, তুমি কেনো আমার না? কেনো?

আমিও তো বলতে পারি ইরা তুমি কেনো আমার না?

হবে! তুমি আমার হবে! আমিও তোমার হবো, আমি একেবারে তোমার কাছে চলে আসবো, তুমি বিশ্বাস করো ওখানে আমার মন টিকে না, আমি সারারাত মতির পাশে শুয়ে তোমাকে নিয়ে ভাবি, আমার মনে হয় আমি যেনো তোমার পাশে শুয়ে আছি। অথচ যখন জেগে দেখি তুমি না, আমি মতির পাশে শুয়ে আছি তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগে, তখন মনে হয় কেনো আমরা কেউ কারও না বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

কেউ কারও না বলবে না ইরা। আমরা তো দু’জনে দু’জনার। সারাজীবন আমরা দু’জনেরই থাকবো। ওসব আইনের শেকল কখনো আমাদের হৃদয়ের বন্ধন আলাদা করতে পারবে না।

ইরা জোর গলায় বললো, তুমি ঠিক বলেছো।

আজ বড়দিন। প্রতিবছর এই দিনে আমি তোমার ক্রিস্টমাস ট্রিকে নানান রংয়ের আলোয় আলোকিত করবো, সন্ধ্যায় আমার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমার তাজমহলের দিকে তাকিয়ে দেখবো আর বলবো, আমার সব আছে, আমার জয় আছে, আমার তাজমহল আছে, আমার ক্রিস্টমাস ট্রি আছে, বলতে বলতে ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিলো।

ইরা ভেজা কণ্ঠে বললো, তুমি এমনিভাবে সারাজীবন আমার চোখের পানি মুছে দিবে, আমার পাশে থাকবে তো?

অবশ্যই।

ইরা এবার কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বললো, কথা না আমি কাজে প্রমাণ চাই, তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

এন্তাজ বাইর থেকে ডাক দিলো, স্যার। গাছ প্যাকেট করা হয়েছে।

এন্তাজের কথা বলা শেষ হতেই মালিক ভদ্রলোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো, আপা।

ইরা তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো, জি ভাই বলুন।

ভদ্রলোক ভিতরে এলো, ইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা বুঝি খুব ভালো বন্ধু।

ইরার মধ্যে কোনো সংকোচ নেই, সে বললো, জি, খুব ভালো বন্ধু আমরা। না, না শুধু ভালো বন্ধু বললে ভুল হবে, ওই আমার সব…

 

দশ

 

দু’জনের প্রতিদিন ফেসবুকে বসার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। দু’জনে সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। সেদিন বাসায় গিয়ে ইরা ক্রিস্টমাস ট্রিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলো, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন। আজকের দিনটি জীবনে না এলে আমার এই পৃথিবীতে আসাই বুঝি সার্থক হতো না। আমার জীবনের সমস্ত শূন্যতা পূর্ণ হয়েছে আজ। হায় ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ! এই পবিত্র, আনন্দময় দিনে সবাইকে জানাই বড় দিনের শুভেচ্ছা’’।

ইরা স্ট্যাটাস দেয়ার সাথে সাথে জয় লাইক দিলো এবং কমেন্টস করলো। তারপরই রিচি কমেন্টস করলো। রিচি বরাবরই গোঁড়া প্রকৃতির প্রকৃতির মেয়ে। ফেসবুকে তার কাজ হলো জ্ঞান বিতরণ করা, ধর্মীয় বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া, নৈতিকতার বুলি আওড়ানো আর মাঝে মাঝে কোনো মানবিক দিক লিখে স্ট্যাটাস দেয়া।

রিচি কমেন্টসে লিখেছে, ইরা এ তুই কী লিখেছিস? কী হয়েছে আজ তোর? বলতো?

ইরা লিখলো, আজ আমার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটেছে আপু।

কী বলছিস এসব? তুই তো সবকিছু পেয়েছিস অনেক আগেই। তোর জীবন তো কানায় কানায় পূর্ণ। তোর জীবনে আরও কী অপ্রাপ্তি ছিলো? আর মুসলমান হয়ে তুই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছিস মানে? তুই কি দিন দিন ধর্ম-কর্ম সব ভুলে যাচ্ছিস নাকি?

না আপা আমি কিছু ভুলিনি। আমি সারাজীবন একজন ভালো মনের মানুষ খুঁজছিলাম। জীবনে অনেকেই এসেছিলো আবার চলেও গেছে কারণ তাদের মধ্যে সবারই কোনো না কোনো স্বার্থ ছিলো। আর আমি একজন নিঃস্বার্থ, অকৃত্রিম বন্ধু খুঁজছিলাম। আমি পেয়ে গেছি আপা। আমার জীবন আজ সত্যি কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে।

এসব কী বলছিস তুই! তোর বিয়ে হয়েছে স্বামী-সংসার সবই আছে তারপরও বন্ধু মানে?

জি আপা স্বামী আর বন্ধু এক না। স্বামী আইন আর সামাজিকতার শিকলে বেঁধে দেয়া একটা সম্পর্ক। স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক, প্রেম থাকুক আর নাই থাকুক কেটে যেতে পারে সারাজীবন, সেখানে কোনো বৈচিত্র থাকুক আর না থাকুক দায়িত্ববোধের কারণে স্বামী-স্ত্রী একই ছাদের নিচে থেকে কাটিয়ে দিতে পারে সারাজীবন, জীবন্ত লাশ হয়ে। আর বন্ধু! বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক যে সম্পর্কে পরস্পরের মধ্যে একটা সুন্দর, আনন্দময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা বুঝতে পারে। আমি ঠিক তেমনই একজন মানুষ খুঁজে পেয়েছি আপা।

ছি: এসব কী বলছিস তুই? তুই কি পরকীয়া প্রেমে পড়ে গেছিস নাকি? কে সেই…

রিচি এই কথাগুলো ইনবক্সে দিলেও পারতো কিন’ তা না করে সে ইরার টাইমলাইনে লিখেছে আর ইরা-ই কত বোকা যে টাইমলাইনে এসব কমেন্টের উত্তর দিয়েই যাচ্ছে।

জয়ের ইরা, রিচি দু’জনের প্রতিই রাগ হলো। সে ইরাকে লিখলো, ইরা এসব কী হচ্ছে? তোমাদের দু’বোনের কথা ইনবক্সে হতে পারে। তোমাদের দু’জনের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে তুমি বুঝি রিচির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক ফেসবুকের বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছো।

ইরা প্রতিবাদ জানালো, হ্যাঁ, জানালে সমস্যা কী? আমরা বন্ধু, বন্ধুত্ব তো দু’জনের মধ্যে থাকতেই পারে, এতে দোষের কী?

দোষের কিছু নেই, আবার কেউ যদি মনে করে তবে অনেক কিছুই দোষের হতে পারে।

হোক, যা হয় হোক। আমার দিকটা আমি বুঝবো…

ওকে, বোঝো, কোনো প্রবলেম হলে আমাকে দোষারোপ করো না।

করবো না, তবে তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তোমার কোনো খারাপ মতলব আছে?

জয় ইরার কথায় কিছুটা আশ্চর্য হলো, মানে?

মানে তুমি কি আমার কাছ থেকে চলে যেতে চাচ্ছো তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড, ভক্ত আর এন.জি.ও’র মেয়েদের কাছে? সেজন্য সবাইকে জানাতে ভয় পাচ্ছো?

না। তা না। তবে তোমার একটা কথা মনে রাখা উচিত আমাদের দু’জনের হৃদয়ের টান থাকলেও আলাদা আলাদা শিকলে বন্দি। তাছাড়া আমরা দু’জনে এখন আর শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আমরা দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসি। দেখো আমাদের ভালোবাসার কথা বুঝতে পেরে তোমার আপা কী লিখেছে। আমরা নাকি পরকীয়া প্রেম করছি।

ইরা লিখলো, লিখুক। ও খুব সেকেলে মেয়ে, খুব গোঁড়া, দুনিয়া এখন অনেক এগিয়েছে কিন’ ও ওর জায়গা চেঞ্জ করতে পারেনি সেই মান্ধাতার আমলেই রয়ে গেছে। তুমি বলো আজকের দিনটা আমাদের জন্য একটা বিশেষ দিন না? এই দিনে আমাদের স্মৃতিগুলোকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে পারবো না? তুমি বলো আজকের দিনটা তোমার কাছেও অসাধারণ না?

অবশ্যই।

তবে ভয় পাচ্ছো কেনো?

না, ভয় পাচ্ছি না।

শোনো, আমাকে স্কুলের খাতা আনতে যেতে হবে রাজশাহী, তুমি যাবে কিন’, ওকে?

কবে?

আগামী সপ্তাহে। ডেট হলে আমি তোমাকে জানাবো, তুমি কিন’ না করতে পারবে না।

চেষ্টা করবো।

চেষ্টা করবো মানে?

মানে, যদি অফিসের কাজ থাকে।

ছুটি নিবে, বলেই ইরা তাড়াহুড়ো করে বললো, আপা ফোন করেছে, তুমি একটু ওয়েট করো প্লিজ!

কয়েকমিনিট পর ইরা ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

ইরা হাসতে হাসতে বললো, শোনো আপা সব বুঝে ফেলেছে।

সব বুঝে ফেলেছে মানে?

আপা তোমার আর আমার স্ট্যাটাস, কমেন্টস সব পড়েছে। পড়ে আমাকে বললো, তুই ঐ ইঞ্জিনিয়ার-কাম-লেখকের প্রেমে পড়েছিস, না? ওসব বাদ দে ইরা, বাবা শুনলে খুব রাগ করবে, আমাদের বংশের একটা মান-মর্যাদা আছে। ছি: কী রকম একটা বিশ্রী কাজ করছিস তুই।

জয় বললো, দেখেছো সবাই আমাদের ওয়াচ করতে শুরু করেছে, রিলেশনটাকে ফেসবুক থেকে হাইড করতে হবে ইরা।

করতে হয় তুমি করো, আমি আমাদের আনন্দময় মুহূর্তগুলোর ছবি আপলোড দিবো, স্ট্যাটাস দিবো, তুমি একটা ভীরু, কাপুরুষ… তুমি ভালোবাসতে ভয় পাও, ভালোবাসার কথা মানুষকে জানাতে ভয় পাও। আমার ভয় হচ্ছে কোনো কারণে যদি সাহসী হতে হয় তবে তুমি হতে পারবে না। তখন আমাদের রিলেশনটা আর টিকবে না কিন’ আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না, আমার তোমাকে চাই। সো, তোমাকে সাহস সঞ্চয় করতে হবে, অনেক সাহসী হতে হবে, পারবে না, আমার জন্য, আমাদের ভালোবাসার জন্য…

জয় আমতা আমতা করে বললো, পারবো।

ইরা দৃঢ় কণ্ঠে বললো, আমি জানতাম আমার জন্য তুমি সব পারবে।

অবশ্যই পারবো ইরা।

ইরার বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। সে বললো, মতি এসেছে, আজ রাখি, ওকে।

ওকে ইরা, ভালো থেকো।

ওকে, বাই।

 

এগারো

 

এই প্রথম জয় আর ইরা দূরে কোথাও যাচ্ছে। অবশ্য বেড়াতে না, ইরার স্কুলের পরীক্ষার খাতা আনতে। কোথাও তেমন ঘোরাফেরা হবে না তবু দীর্ঘক্ষণ একসাথে পাশাপাশি বাসের সিটে বসে তো যাওয়া যাবে। ইরা সেদিন যখন ফোনে বললো আমরা আগামী সোমবার সকাল সাতটার বাসে রাজশাহী রওয়ানা দিচ্ছি তখন ইরার আবেগ আল্পুত মুখচ্ছবি জয়ের হৃদয়ে ভেসে উঠলো। ইরার কণ্ঠস্বর ছিলো অত্যন্ত উচ্ছল। জয়ের বুকের মধ্যেও একটা তোলপাড় শুরু হলো। জয় কিছু বলার আগেই ইরা জিজ্ঞেস করলো, এই তুমি খুশি হওনি?

হ্যাঁ খুশি হবো না কেনো?

কিন’ তোমার কথায় তো তা মনে হচ্ছে না, মনে হয় খবরটা শুনে তুমি একটুও খুশি হওনি, তোমার মধ্যে একটুও আবেগ নেই। আচ্ছা তুমি কী করে উপন্যাস লেখো বলোতো, এতো প্রাণহীন, আবেগহীন মানুষ তো লেখক হওয়ার কথা না।

সেজন্য তো লেখক হতে পারিনি।

ঠিক বলেছো, শুধু আমি তোমাকে লেখক বলি আর কেউ বলে তো মনে হয় না। অবশ্য তোমার যা লেখা তাতে করে আমিই যে ক’দিন তোমাকে লেখক বলবো।

আমার লেখা খারাপ? জয় কিছুটা আহত গলায় বললো।

অবশ্যই খারাপ, তোমার লেখায় আবেগ নেই, গভীরতা নেই। এই…বলে ইরা কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো তারপর বললো, কেমন যেনো ঝুনঝুনি মার্কা লেখা, তোমার লেখা হৃদয় পর্যন্ত সাড়া জাগাতে পারে না।

জয় একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, ধন্যবাদ। আমি ভালো লেখার চেষ্টা করবো।

আমার কথায় রাগ করলে?

না, রাগ করবো কেনো? তুমি ঠিকই বলেছো সবাই যদি শুধু বলে লেখা ভালো হয়েছে, আপনি অসাধারণ লিখেন। তবে তো লেখককে পিছিয়ে দেয়া হবে।

তুমি আরও স্বনামধন্য লেখকদের বই পড়, দেখবে তোমার লেখার মান আরও ভালো হবে। আজ আমার কথা তোমার খারাপ লাগতে পারে, দেখবে যেদিন তুমি অনেক বড় লেখক হয়েছো, ভুলে যেতে চাইলেও এই ইরাকে সেদিন তুমি ভুলতে পারবে না। মনে পড়বে এই ইরা একদিন তোমার লেখার সমালোচনা করেছিলো বলেই তুমি বড় লেখক হতে পেরেছো, কথাগুলো তড়িৎ গতিতে বলে ইরা হেসে ফেললো, শোনো তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য বললাম, আমরা রবিবার দিন সকাল সাতটায় বাসে উঠবো।

ওকে।

 

ইরা রাতে বাবার বাড়ি থাকবে বলে আগের দিন বিকেলে জয়পুরহাট চলে এলো। বাস থেকে নেমে জয়কে ফোন করলো, তুমি কোথায়?

অফিসে।

তাড়াতাড়ি চলে এসো তো।

কোথায়?

ক্যাটস পো’তে

ক্যাটস পো’তে কেনো?

ইরার কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলো, চলে এসো, এতো কেনো কেনো বলছো কেনো?

নিশ্চয়ই তুমি আবার শার্ট-প্যান্ট কিনে টাকা নষ্ট করবে?

আবার কথা, আর কোনো কথা না বলে সোজা চলে এসো।

ওকে আসছি।

ইরা একটা গোলাপী রংয়ের থ্রি-পিস পরেছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপী রংয়ের লিপ স্টিক, কপালে থ্রি-পিস আর লিপ স্টিকের সঙ্গে মিল করে টিপ পরেছে। ইরাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। জয় যেনো চোখের পলক ফেলতে পারছিলো না। ইরা জয়কে বললো এভাবে দেখছো কেনো? সেলসম্যানরা সব হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আর এই যে কপালে টিপ দিয়েছো তাতে তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে। আমি যে তোমাকে বলতাম তুমি টিপ পরলে খুব সুন্দর লাগবে।

সেজন্যই তো পরেছি।

কথা বলতে বলতে দু’জনে যেখানে শার্টগুলো ঝুলানো আছে সেখানে গেলো। জায়গাটা একটু আড়ালে পড়েছে। ইরা ডানে-বাঁয়ে একবার তাকিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে জয়ের হাতে দিলো, তোমার জন্য আমার এই সামান্য উপহার।

সামান্য নয় ইরা অসামান্য, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার, এটা তো শুধু ফুল নয়, তোমার ভালোবাসা। এটা নিশ্চয়ই তোমার বাগানের প্রথম ফোটা গোলাপ ফুল!

হুঁম।

সত্যিই আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি।

তোমার ভালোবাসা পেয়ে আমিও নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমাকে সারাজীবন ধরে রেখো জয়, বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ইরা দু’টা শার্ট নিয়ে জয়ের গায়ের ওপর মেলে ধরলো, দেখো তো কেমন মানিয়েছে? বলেই আবার বললো, ও তুমি তো দেখতে পাচ্ছ না। চলো, চলো আয়নার সামনে চলো, বলে হাত ধরে জয়কে আয়নার সামনে নিয়ে গেলো।

ইরা জয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার গায়ের ওপর একটা শার্ট মেলে ধরেছে, জয় একবার নিজের গায়ের দিকে আর একবার ইরার চোখের দিকে তাকালো। ইরার চোখে আনন্দে আর আবেগে পানি ছলছল করছে। জয় ইরার কাঁধে একটা হাত রাখলো, দু’জনে আয়নার দিকে তাকালো, খুব সুন্দর মানিয়েছে ইরা। তোমার পছন্দ খুব সুন্দর।

অসুন্দর হলে আমি তোমাকেও পছন্দ করতাম না জয় বলে দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলো।

আজ দু’জনের যেনো কোনো ভয়, লজ্জা, সংকোচ কিছুই। কেউ একবারও ভাবলো না দোকানদার বা সেলসম্যানরা কিছু ভাবছে কী না। একে একে দু’টা শার্ট সিলেক্ট করে ইরা জয়কে জোর করে ট্রায়াল রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে একটা শার্ট হাতে দিয়ে বললো, এটা পরে এসো।

জয় ট্রায়াল রুম থেকে একটা শার্ট পরে বের হলো।

জয় কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিলো, ইরা পেছন থেকে হালকা করে তার শার্ট টেনে ধরলো, এই কোথায় যাচ্ছো?

কাউন্টারে।

তুমি এতো বেরসিক কেনো বলোতো?

কেনো? কী হলো আবার?

এদিকে এসো, একটু আমার পাশে দাঁড়াও, বলে ইরা তার ট্যাব বের করে কয়েকটা সেলফি তুললো।

জয় মৃদু হেসে ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, আবার সেলফি, আবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর তোমার বেরসিক রিচির কটাক্ষ।

ইরা মুখ আংশিক বিকৃত করে বললো, ভীরু, কাপুরুষ কোথাকার। আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলোতো, তুমি রিচিকে ভয় পেলে আমার দজ্জাল বাপকে দেখলে কী করবে?

তোমার দজ্জাল বাপ মানে?

আমার বাপকে তো তুমি চেনো না। একটা ঘটনা তো তোমাকে বলাই হয়নি।

কী ঘটনা?

দু’জনে দোকানের সংকীর্ণ স’ানে দাঁড়ালো। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ইরা বলতে শুরু করলো, আপা একটা ছেলেকে ভালোবাসতো। ছেলেটার বাবা চাকরি করতো আর আমাদের পাড়ায় ভাড়া থাকতো। কথাটা বাবার কানে এলে বাবা সেই ছেলেকে আমার এক কাজিনকে দিয়ে মেরে পাড়া থেকে বের করে দিয়েছিলো। সেই দুঃখে তো রিচি আপা আর বিয়েই করলো না।

খুব ভুল করেছে তোমার বাবা।

অবশ্যই ভুল করেছে। আপা সেজন্য সারাজীবন বাবাকে দোষারোপ করে। এখন তুমি বোঝো বাছাধন তোমাকে মারলে তুমি কী করবে?

আমাকে মারতেই পারবে না।

কেনো? তুমি কোন্‌ রথী-মহারথী হয়ে গেছো যে তোমাকে মারতেই পারবে না।

আমি কী করবো জানো?

কী?

কিছু বলার আগেই পাঁ ছুঁয়ে সালাম করবো আর তুমি পরিচয় করে দিবে, বাবা তোমার জামাই।

সে আমার বোঝা হয়ে গেছে, তুমি হয় আমাকে ফেলে পালিয়ে যাবে, নয়তো তো হার্ট এ্যাটাক করবে।

জয় বললো, ছি: আমরা এসব কী ভাবছি ইরা।

ছি: বলছো কেনো? হলেই বা সমস্যা কী?

জয় ইরার মুখের দিকে তাকালো, ইরা!

ইরা একটা মুচকি হাসি হাসলো।

 

বারো

 

সেদিন রাতে কারও চোখে ঘুম নেই্‌ ইরা কিছুক্ষণ পর পর ইরা ম্যাসেজ দিচ্ছে আর জয় তার ম্যাসেজের উত্তর দিচ্ছে। কালকের দিনটাকে ইরা সাজিয়ে নিচ্ছে ক’টায় বাস ছাড়বে, কখন পৌঁছাবে, পরীক্ষার খাতা নেয়ার পর কোথায় কোথায় যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ইরা ফোন করলো, রাত এগারোটার পর। ফোন করেই কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো, উফ্‌ কতক্ষণ থেকে কথা বলতে চাচ্ছি, আপা ঘুমাচ্ছেই না কিছুক্ষণ পর পর পাশের রুম থেকে বলছে এতো রাত জেগে কার সাথে চ্যাটিং করছিস, তাড়াতাড়ি ঘুমা, ভোরবেলা উঠবি আবার। কোথাও শান্তি নেই, তোমার সাথে একটু মন খুলে কথা বলবো সে সুযোগ কোথাও নেই। দুনিয়াটা বড়ই বেরসিক।

জয় বললো, আমার মতো?

তুমি বেরসিক?

তুমিই তো বলো।

বলি সেটা কথার কথা বেরসিক হলে কি তুমি এতোগুলো প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারতে, আর আমাকে…

কী তোমাকে?

বোঝোনি, বলে দু’জনে হেসে উঠলো।

ভোরবেলা ইরা একটা ম্যাসেজ পাঠালো, শোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

কী দুর্ঘটনা?

আমার সঙ্গে বাবা যাবে।

বাবা যাবে মানে?

বেশিদূর না, মঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত। এখন কী হবে?

তুমি কীভাবে যাবে?

আমাকে কী তোমার বাবা চেনে?

তোমাকে একবার আমাদের বাড়িতে দেখেছে না?

ও, তাইতো একবার তো দেখেছে তবে বয়স্ক মানুষ নাও চিনতে পারে। তাছাড়া তো আর বিকল্পও নেই।

তাইতো দেখছি।

আমি খঞ্জণপুর মোড়ে অপেক্ষা করবো। তুমি বাস ছাড়ার আগে একবার ফোন দিও। যা আছে কপালে।

ওকে।

 

বাস ছাড়ার সময় ইরা জয়কে একটা ম্যাসেজ পাঠালো, বাস ছাড়লো, তুমি তোমার মতো করে বাসে ওঠো। সামনের সিটে বাবা আছে, আমার দিকে একবারও তাকাবে না। বাবা মঙ্গলবাড়ি নেমে গেলে তুমি আমার পাশে এসে বসো, কেমন?

জয় বাধ্য শিশুর মতো বললো, ঠিক আছে।

জয় ইরার বাবাকে ছবিতে দেখেছে। তাই বাসে উঠেই চিনতে পেরেছিলো ইরার বাবাকে। অনেকদিন আগে ইরার বাড়িতে একবার পরিচয় হয়েছিলো তাঁর সাথে, বয়সের কারণে হয়তো তিনি জয়কে চিনতে পারেননি কিন’ জয় ঠিকই চিনেছে। জয় বাসে উঠে এদিক-সেদিক না তাকিয়ে একটা ফাঁকা সিটে মাথা নত করে বসে রইলো। মঙ্গলবাড়ি ইরার বাবা নেমে যাওয়ার পর জয় ইরার পাশে গিয়ে বসলো।

ইরা জয়ের একটা হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, আমার জন্য শীতে খুব কষ্ট পেলে, তাই না?

জয় একটা মিষ্টি হাসি হেসে বললো, তা তো একটু পেয়েছিই।

ইরাও হাসলো, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললো, শোনো তোমার জন্য পিঠা নিয়ে এসেছি। বলেই সে তার ব্যাগ থেকে একটা কয়েক তাকওয়ালা টিফিন বাটি বের করে একটা বাটি খুললো।

জয় বললো, এখনি খুলছো কেনো?

খাবে, তোমার খিদে লেগেছে না?

না, পরে খাবো।

ইরা জয়ের কথা শুনলো না সে জোর করে জয়ের মুখের দিকে একটা পিঠা তুলে ধরে কানের কাছে কৃত্রিম চাপাস্বরে ফিসফিস করে বললো, হা করো, হা করো।

জয় হা করলো।

খুব সুন্দর! অসাধারণ এক পিঠা তৈরি করেছে ইরা। চালের আটা দিয়ে পুরির মতো তৈরি করে ভিতরে তেলে ভাজা নারিকেল, মচমচে ভাজা লালচে ধরণের পিঠা। এই পিঠা এই অঞ্চলে বহুল পরিচিত, জয় জীবনে অসংখ্যবার এই নারিকেল পুরি খেয়েছে। কিন’ ইরার তৈরি নারিকেল পুরি যেনো ভিন্ন এক স্বাদের সৃষ্টি করেছে। জয় ইরার মুখের দিকে তাকালো, ইরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জয়ের মুখের দিকে, জয়ের চোখে চোখ পড়তেই ইরা একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, খুব খারাপ হয়েছে না? অখাদ্য?

তুমি সবসময় নেগেটিভ কথা বলো ইরা। খুব ভালো হয়েছে। জীবনে এতো সুন্দর পিঠা খাইনি।

ইনসাল্ট করছো?

জয় না সূচক মাথা নেড়ে জানালো ইনসাল্ট করছে না। তারপর বললো, আসলে পিঠা ভালো হওয়ার জন্য শুধু আটা, নারিকেল, তেল ভালো হওয়াই যথেষ্ট না। তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই পিঠাওয়ালীর মন ও মনন, আন্তরিকতা, আদর, ভালোবাসা। পিঠাওয়ালী যখন রাত জেগে চালের আটা তৈরি করে, নারিকেল ভেঙ্গে গুঁড়ো করে হৃদয়ের আয়নায় তার প্রিয় মানুষটির জন্য পিঠা তৈরি করে তখন কি পিঠা ভালো না হয়ে পারে।

থাক, থাক আর চাপাবাজি করতে হবে না।

চাপাবাজি না, সত্যি বলছি। তুমি একটা খাও, বলে জয় ইরার মুখে একটা পিঠা তুলে ধরলো।

ইরা পিঠা খেতে খেতে বললো, সত্যি তো খুব সুন্দর হয়েছে। তবে এটা অবশ্য আমার তৈরির গুণে নয়, তোমার হাত থেকে খেয়েছি বলে, তোমার হাতের গুণে।

দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠলো।

 

ইরা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো, শোনো আমরা রাজশাহী পৌঁছাবো সাড়ে দশটায়। তারপর বোর্ডে যাবো, আমার কাজ শেষ হবে বেলা দু’টায়।

তো?

তুমি এতক্ষণ কী করে বেড়াবে?

শহরে ঘুরে বেড়াবো।

ইরা জয়ের কাঁধ থেকে মাথা তুলে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো, একা?

হুম্‌। তো কাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো?

তোমার মানুষের অভাব! না জানি কাকে আগেই বলে রেখেছো, শুধু আমার বোর্ডে যাওয়া বাকি, গেলেই তো তুমি খুশি। তুমি কাকে নিয়ে যে ঘুরে বেড়াবে, বলতে বলতে ইরার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।

জয় ইরার হাতে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললো, ইরা, এসব কী ভাবছো বলোতো।

ইরা বিলোপ করার মতো করে বললো, ইসস আমি কী যে ভুলটা করলাম, খাল কেটে কুমির আনলাম।

কেনো?

তোমাকে এনে, তোমার তো এখন জয়জয়কার। আমি বোর্ডে যাবো আর তুমি ঘুরে বেড়াবে তোমার বন্ধু-ভক্তদের সাথে, উহ্‌, তোমাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে শান্তি নেই। সবসময় একটা টেনশন কারও সঙ্গে বুঝি… ছি:

ছি: বলছো কেনো বলোতো?

আচ্ছা বলোতো এতো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে তোমার রুচিতে বাঁধে না।

এভাবে কথা বলছো কেনো ইরা বলোতো, তুমি কি আমাকে কোনোদিন কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখেছো?

দেখিনি, তবে সন্দেহমুক্তও হতে পারিনি।

এটা তোমার মনের ব্যাপার। ঐ যে বলো না তোমার থার্ড আই। তোমার থার্ড আই আমাদের সর্বনাশ করবে তুমি দেখো।

চুপ করো, আর কোনো কথা বলো না।

ওকে ইরা তাহলে আমি নেমে যাচ্ছি?

ইরা সন্দেহ প্রবণ দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তাতেই কি আমি টেনশন ফ্রি থাকতে পারবো।

তো?

নেমে অন্য বাসে আবার রাজশাহী যাবে।

জয় বিরক্তবোধ করলো, উফফ।

ইরা কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো তারপর হঠাৎ করে তার মুখে একটা আলোর আভা ফুটে উঠলো, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

কী বুদ্ধি?

দেখি তোমার মোবাইলটা, বলে ইরা জয়ের হাত থেকে একরকম জোর করে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বললো এখন থেকে এটা আমার কাছে থাকবে। এবার, এবার কী করবে বাছাধন। তুমি কারও সাথে কথা বলতে পারবে না, দেখাও করতে পারবে না।

ইরার ওপর জয়ের কিছুটা রাগ হলো, আমার ফোন আসতে পারে না?

তা তো পারেই, আমি রিসিভ করবো।

যদি অফিসের ফোন হয়?

আজ তুমি ছুটি নিয়েছো, আজ আবার অফিসের ফোন আসবে কেনো? ও তুমি ভেবেছো অফিসের ফোনের কথা বলে তুমি ফোনটা রেখে দিবে আর আমি চলে যাওয়ামাত্র তুমিও, বলে ইরা হি হি করে হেসে উঠলো।

ইরা এতোটা অবিশ্বাস করা ঠিক না।

শোনো কোনো চালাকি করবে না। আমি ঠিক দু’টোয় বিন্দু হোটেলে আসবো, ওখানে লাঞ্চ করবো।

ওকে।

 

জয় সে-ই দু’টো থেকে বিন্দু হোটেলে বসে আছে, ইরা এলো প্রায় তিনটায়। এসেই বললো, তাড়াতাড়ি খেতে হবে নইলে ট্রেন তো এখন পাওয়া যাবে না, বাসের টিকেটও পাওয়া যাবে না।

লাঞ্চের ফাঁকে ফাঁকে ইরার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। জয় বললো, দেখো তুমি যদি আমার ফোনটা নিয়ে না রাখতে তবে আমাকে এতো আগে এসে বসে থাকতে হতো না আর টিকেট পেতেও সমস্যা হতো না। অন্তত: আমি টিকেট কিনে রাখতে পারতাম।

টিকেট যদি না পাওয়া যায়, রাজশাহী থেকে যদি হেঁটে জয়পুরহাট যেতে হয় তবুও আমি রাজি কিন’ তোমাকে ফোন দিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় ভুগতে রাজি না। এনিয়ে আর কোনো কথা বলবে না। ইরার শেষের দিকের কথায় অভিমান ফুটে উঠলো।

 

তেরো

 

বাস ছাড়লো তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। ইরা খুব আফসোস করলো, ইসস, ভেবেছিলাম দু’টোয় ফ্রি হয়ে তোমাকে নিয়ে একটু নিউমার্কেট যাবো। তোমাকে একটা ব্লেজার কিনে দিবো।

জয় বললো, তাহলে তো দেরি হয়েই ভালো হয়েছে।

ইরা কিছুটা রেগে গেলো, তুমি তো বলবে, তুমি কখনো আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দাও?

জয় মৃদু হেসে বললো, দিই না?

ইরার অভিমানী মুখ বিকৃত করে বললো, না।

সিরিয়াসলি বলছো?

হ্যাঁ।

জয় একবার পুরো বাসে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর ইরা থুতনি উঁচু করে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, এই যে আমি অফিস ছুটি নিয়ে সারাদিন তোমার সাথে এসেছি।

এবার ইরা হেসে ফেললো, থ্যাংকস মাই সুইট হার্ট।

 

অনেকক্ষণ দু’জনে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ, গাছ-গাছালি, নদী। কিছুক্ষণ আগেই পিছনে ফেলে এলো আত্রাই নদীর ওপর নির্মিত মান্দা ব্রিজ। এই নদীতে এক সময় ফেরি চলাচল করতো, তখন এই নদীর ঘাটকে বলতো ফেরিঘাট। নদীতে ব্রিজ হয়েছে কিন’ জায়গাটার নাম পরিবর্তন হয়নি। এখনো সবাই ফেরিঘাটই বলে।

এই নদীর কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে আত্রাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। এই নদীকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাস তার হাঁটুজল থাকে। আজ সবই স্মৃতি। এই যে জয় আর ইরা আজ রাজশাহী গেলো এটাও তো হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতলে! ইরা, আমার ইরা! ইরাও কি একদিন স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে! আমার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে শুধু চোখের জল। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয়ের চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো।

কয়েকমিনিটের জন্য বাস মহাদেবপুর থামলো। অনেক যাত্রী নেমে গেলো। বাস একেবারে ফাঁকা, জয় আর ইরার সামনের এবং পেছনের দুই সারিতে কোনো যাত্রী নেই।

বাসের সুপারভাইজার একবার সামনের সিটে গিয়ে বসতে বললো কিন’ দু’জনে সেকথায় কান দিলো না। বাস গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু করলো। শোঁ শোঁ শব্দে বাস চলছে দ্রুত গতিতে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। ইরা জয়ের গা ঘেঁষে বসলো, তার চোখে হাত দিয়ে বললো, তোমার চোখে পানি কেনো?

এমনি।

এমনি মানে?

ভাবছিলাম কত দ্রুত আমাদের জীবনের আনন্দময় মুহূর্তগুলো স্মৃতি গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে।

তুমি কি ভাবছো এমনিভাবে আমাদের রিলেশনটাও একদিন হারিয়ে যাবে?

ঠিক তাই।

আমাদের কি একটা অদ্ভুত মিল দেখো। আমিও ঠিক এটাই ভাবছিলাম। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার, আশা-আকাংখার কত মিল। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তোমার চোখ যখন পানিতে ছলছল করছিলো তখন আমি ঠিকই বুঝতে পাচ্ছিলাম তোমার অনুভূতি, তোমার মনের কথা। আমাদের দু’জনের যেনো এক আত্মা। অথচ টুডে অর টুমরো তুমি একদিন চলেই যাবে, বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, ইরা সবসময় নেগেটিভ কথা ভাববে না তো। তুমি সবসময় হারানোর ভয়ে পাওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করো।

কিন’ পাওয়ার আনন্দ যে একসময় কষ্ট দিবে সোনা। পেয়ে হারানোর চেয়ে না পাওয়াই কি ভালো না?

তাই বলে সুখের মুহূর্তগুলো এভাবে…

ইরা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো, তোমাকে যদি সারাজীবনের জন্য একেবারে পেতাম, পথে যদি কোনো বাধা না থাকতো, আহা কী নির্ভরতা, তৃপ্তি, সুখ, শান্তি। এমনিভাবে সারাটা জীবন যদি আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম, হায় আল্লাহ! কেনো? তুমি কেনো এভাবে পাওয়ার আনন্দকে বেদনার স্মৃতিতে ডুবিয়ে দাও?

ইরা আল্লাহ ঠিকই করেছন। সব কিছু পেয়ে গেলে জীবনটা গদ্যময় হয়ে যেতো, সুখ-দু:খের আলাদা অনুভূতি না থাকলে তো মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকতো না।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, আজকের দিনটা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। যতদিন বাঁচবো ততদিন এই স্মৃতি নিয়েই আমি বেঁচে থাকবো, এই সুখটুকু নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে পারবো বলে ইরা জয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, অনেক মানুষের তো অসুখ হয় যে অসুখে আগে থেকে বোঝা যায় মৃত্যুর দিন তারিখ। আমার যদি এমন কোনো অসুখ হয়, আমি যদি আগে থেকে বুঝতে পারি তবে আমি তোমার বুকে মাথা রেখে মরবো, আমাকে একটু ঠাঁই দিও জয়, সেই সুখটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না প্লিজ!

ইরা জয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে আর ওর বুক জয়ের বুকের বাম পাশের সঙ্গে, হৃদপিণ্ডের সঙ্গে মিশে গেছে, জয় ওর হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করছে, গভীরভাবে, ইরার ভালোবাসা, ইরার প্রেম, ইরার কান্না বেরিয়ে আসছে হৃদয়ের গভীর থেকে। কী প্রেম! আহা! জীবনে ইরা না এলে, এই ভালোবাসা না পেলে আমার জীবন অপরিপূর্ণই থাকতো, একটা অতৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হতো।

ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে জয়ের চোখ থেকেও কয়েকফোঁটা তপ্ত পানি ইরার চিবুকে গড়িয়ে পড়লো। ইরা জয়ের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, কেনো? কেনো এমন হলো? কেনো জেনেশুনে আমরা এতো গভীরভাবে ভালোবাসতে গেলাম, এখন কী হবে? আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো?

ইরার ট্যাব বেজে উঠলো। রিচি ফোন করেছে। ইরা জিজ্ঞেস করলো, রিসিভ করবো?

করো।

রিং শেষ হয়ে গেলো। কিন’ ইরা ফোন রিসিভ করলো না।

জয় রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, এটা তোমার খুব খারাপ অভ্যাস, সহজে কারও ফোন রিসিভ করতে চাও না।

ইরাও উল্টো জয়ের ওপর রেগে গেলো, রিসিভ করলে কী বলবে জানো?

কী বলবে?

আমাকে নেয়ার জন্য রেলগেট আসতে চাইবে।

তো?

আমি ভাবছিলাম একসঙ্গে রেলগেট নামবো, তুমি রাতের খাবার খেয়ে রুমে ঢুকবে কিন’ আপা যদি রেলগেট আসে তাহলে তো তোমাকে আগেই নামতে হবে তখন তুমি রাতে খাবে কোথায়?

বাদ দাও, একদিন না খেলেও চলবে।

ইরা রিচির উদ্দেশ্যে বললো, এই মেয়েটা আমাকে সারাজীবন জ্বালালো, সেই ছোটোবেলা থেকে সব কাজে আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওখানে যাস না, ওর সাথে কথা বলিস না।

ইরার ট্যাব আবার বেজে উঠলো।

যা ভেবেছিলাম তাই বলবে, তুমি দেখো।

তবু রিসিভ করো।

যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে আমি ওকে এভোয়েড করছি তবে হাজারটা প্রশ্ন করবে, বলে ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আপা।

তুই কোথায় রে?

এইতো আপা আসছি, এখন বাসে।

তাতো বুঝছি কিন’ বাস কোথায়?

মঙ্গলবাড়ি পার হলাম মনে হয়।

রিচির কণ্ঠস্বর একটু ঝাঁঝালো, তোর সাথে আর কে আছে?

কেউ নেই তো আপা।

শোন, তরিকুল চাচা রাজশাহী গেছিলো, তোর বাসে এলো।

ইরার বুক কেঁপে উঠলো, কোন্‌ তরিকুল চাচা?

রিচি রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, কোন তরিকুল চাচা মানে? মল্লিকপুরের, বলে রিচি তার নিজের বাবার নাম উচ্চারণ করলো, মল্লিকপুরের, আহসানুল ইসলামের চাচাতো ভাই। এবার চিনেছিস?

ইরা থতমত খেয়ে বললো, চিনেছি আপা।

বললো তোকে দেখেছে, মতিও নাকি গেছে তোর সাথে কিন’ মতি দিনের বেলা ফোন করেছিলো, ওতো রাজশাহী যাওয়ার কথা বললো না।

ইরার বুক কেঁপে উঠলো। সে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, চাচা মনে হয় ভুল দেখেছে আপা। বাসে তো অনেক যাত্রী, কাকে কী মনে করেছে।

ভুল দেখলেই ভালো। আচ্ছা আমি কাউন্টারে আসছি বলে রিচি ফোন রেখে দিলো।

ইরার বুক কাঁপছে। তরিকুল সত্যি দেখেছে। ভাগ্যিস জয়কে মতি মনে করেছে। যদি কথা বলতো…

জয় ইরাকে বললো, আমি তাহলে খঞ্জণপুর নামি ইরা?

না, তুমি রেলগেট নামবে, আমি নেমে কাউন্টারে ঢুকবো আর তুমি নেমে সোজা তোমার মতো চলে যাবে, হোটেলে ভাত খেয়ে তারপর যাবে।

যদি রিচি দেখে ফেলে।

ওতো তোমাকে চেনে না।

তবু রিস্ক নেয়ার কী দরকার।

ইরা জয়ের কথার উত্তরে মুখে একটা অভিমানী হাসি হেসে বললো, একটু সাহসী হও।

বাস ততক্ষণে খঞ্জণপুর অতিক্রম করে রেলগেটের কাছাকাছি পৌঁছেছে। দু’জনে বাস থেকে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে। ইরা দূর থেকে লক্ষ্য করেছে রিচি কাউন্টারে না, বাস যেখানে থামবে সেখানে একেবারে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই ইরার কথায় রিচি আশ্বস’ হতে পারেনি তাই স্বচোক্ষে দেখার জন্য গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

ইরার মুখ শুকিয়ে গেলো। সে জয়কে বিদায় দেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, তুমি নেমে সোজা চলে যাও। পিছনের ফিরে তাকাবে না, ওকে?

ওকে।

বাস থামার সঙ্গে সঙ্গে জয় নামলো। রিচির সঙ্গে একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। তারপর জয় তাকে না চেনার ভান করে চলে গেলো।

 

চৌদ্দ

 

কয়েকদিন ইরার বেশ ব্যস্ততা গেলো। ইরার অনুপসি’তি জয়কে উতলা করে তোলে। ঠিক ইরাও জয়ের অনুপসি’তিতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে কিন’ পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে এর ব্যতিক্রম ঘটলো। আজ সারাদিন ইরা একবার ফোন পর্যন্ত করলো না। তখন রাত দশটা বাজে জয় ইরাকে ফোন করলো।

ইরা প্রথম বার রিসিভ করলো না কিন’ জয় বার বার ফোন দেয়ার পর সে রিসিভ করলো, হ্যালো।

কী করছো ইরা?

খাতা কাটছি।

খাতা কেটো না, দেখো।

সরি, বুঝতে পারিনি যে আমি একজন লেখকের সাথে কথা বলছি।

জয় অভিমানের সুরে বললো কিন’ একটা কথা কি তোমার কখনো মনে হয়েছে?

কী কথা?

খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে তুমি যে জলজ্যান্ত মানুষটাকেই অবমূল্যায়ন করছো ইরা।

ছি: এমন কথা ভেবোনা প্লিজ! তোমাকে অবমূল্যায়ন করবো আমিই। সেই শক্তি, সাহস, মনোবল আমি যে সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি।

মুহূর্তেই জয় গম্ভীর হয়ে গেলো, তোমাকে আমার কখনো কখনো খুব কাছের মনে হয়, খুব আপন, মনে হয় এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া বুঝি আমার আর কেউ নেই আবার কখনো কখনো মনে হয় তুমি অনেক দূরের তখন তোমাকে আমি ভালোভাবে চিনতেও পারি না। মনে হয় তোমার মুখের ওপর একটা ঝাপসা কুয়াশা ঢেকে দিয়েছে।

একদম বাজে কথা বলবে না তো। খাতা মূল্যায়ন শেষ করে জমা দিতে হবে খাতা গ্রহণের দশ দিনের মধ্যে। রাজশাহী থেকে আসার ক’দিন হলো মনে আছে। আর তিন দিন তারপর খাতা জমা দিতে যেতে হবে। বলেই মনে হলো ইরা কথাটা বলতে ভুলে গেছিলো, ও ভালো কথা। আমি তো খাতা জমা দিতে যাবো পাঁচবিবি, সেদিন পাথরঘাটা যাবো।

পাথরঘাটা আবার কোথায়?

যাওনি কোনোদিন?

না।

তবে এতোদিন কী করলে পাঁচবিবি থেকে।

আমি কি সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াই নাকি?

না, না তুমি ঘুরে বেড়াবে কেনো? তুমি তো কাজের মানুষ, আচ্ছা কাজের মানুষ সেদিন কিন’ আমাকে কাজ দেখাবে না ফ্রি থেকো।

আবার ফ্রি! আমার চাকরির বুঝি এবার বারোটা বাজবে।

ওকে। তোমাকে যেতে হবে না। তুমি তোমার চাকরি নিয়ে থাকো, আমি রাখলাম, বলে ইরা ফোন রাখতে গিয়েও রাখলো না।

তারচেয়ে তুমি অফিস বন্ধের দিন গেলে হয় না।

আচ্ছা ঠিক আছে বাবা তোমার অফিস বন্ধের দিনই যাবো। তুমি তো আবার দায়িত্ববান মানুষ।

সমস্যা তো দায়িত্ববান মানুষ বলেই, যদি উদাসীন হতে পারতাম তবে তো সুখীই হতে পারতাম। একটা কথা মনে রাখবে দায়িত্ববান, সচেতন মানুষরা কখনো সুখী হতে পারে না। কোনো না কোনো দুশ্চিন্তা তাদের সুখে ব্যাঘাত ঘটায় আর যারা উদাসীন, যারা বলতে পারে, কোথায় অগ্নি জ্বলে, কে নয়ন মেলে তারাই জীবনে সুখী হয়।

এমনসময় ইরার বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা বললো, হয়েছে, হয়েছে, মহাশয় এলো। ভালো থেকো। বাই।

 

পাথরঘাটা। সব ধর্মের এবং বর্ণের একটা অসাধারণ মিল আছে। পথে যেতে যেতে প্রথমে হিন্দু পল্লী, কিছুদূর পর খ্রিস্টানদের গির্জা, তারপর মসজিদ। এই খ্রিস্টানদের মধ্যে আবার আছে সাঁওতাল। কত জাতি-উপজাতিতে ভাগ আছে অথচ সবার মধ্যে এক অদ্ভুত মিল। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, শান্ত, স্নিগ্ধ। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ভরা।

জয় ইরার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। ইরা জয়ের কানে কানে মৃদু কণ্ঠে বললো, জায়গাটা খুব সুন্দর না?

হুঁম। তোমার মতো শান্ত, স্নিগ্ধ… বলে জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ইরার মুখ উজ্জ্বল হলো, তার মুখের ওপর একটা তৃপ্তির আভা ফুটে উঠলো। তারপর জয় যখন বললো, অবশ্য যখন তুমি স্বাভাবিক থাকো। তখন ইরার মুখ রাগে আর ক্ষোভে লাল হয়ে উঠলো, তারমানে আমি স্বাভাবিক না থাকলে উদ্মাদ হয়ে যাই।

না, তা আমি বলিনি। তবে তোমার রাগটা একটু…

ইরা বললো, রাগালে রাগবো না। তুমি তো শুধু আমার রাগটাই দেখলে, ভালোবাসাটা দেখলে না। আমি তোমার মতো রোবট না বুঝলে?

রোবট মানে?

তুমি তো একটা রোবট। না হলে কোনো কিছুতেই তোমার কোনো ফিলিংস নেই কেনো? রাগ নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই, আনন্দের অনুভূতি নেই। আমি খুঁজেই পাই না তোমার মতো একটা রোবটিক ম্যান কীভাবে রোমান্টিক উপন্যাস লিখে ফেললো?

জয় ইরার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দু’হাত কোমরে বেঁধে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বললো, রাগ দেখাবো?

ইরা জয়ের হাতটা টেনে ধরলো, না, না, দেখাতে হবে না।

না আমি আজ তোমাকে রাগ দেখাবো।

না সোনা, প্লিজ!

দু’জনে হেসে ফেললো।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গেলো। নদীর ধারে বড় বড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নদীতে সামান্য পানি বাঁকে বাঁকে চলছে বড় বড় পাথর খণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে। ইরা জয়ের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, এই চলোতো পাথরের ওপর একটু বসি।

বসবে? যদি পড়ে যাও?

পড়বো কেনো তুমি আছো না?

তা অবশ্য ঠিক বলেছো।

নদীর পাড়ে জুতো খুলে রেখে খুব সাবধানে দু’জনে পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে একেবারে স্‌্েরাতস্বীনিরি কাছে গেলো। জয় একটা বড় পাথরের ওপর বসলো। ইরা তার ডান হাত আর মাথা জয়ের কাঁধে রাখলো। দু’জনের নগ্ন পা পানিতে খেলা করছে। ইরা ক্ষণিকের জন্য উদাস হয়ে গেলো।

জয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তন্ময় হয়ে।

ইরা উদাসীনতা কাটিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে ডাক দিলো, এই! কী দেখছো?

তোমাকে, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। রাণীর মতো। পাল রাজার রাণী নয় তুমি আমার রাণী ইরা।

মানে? ইরা অভিমানের সুরে বললো।

তুমি পাথরঘাটার ইতিহাস জানো?

না।

এই পাথরগুলোর ইতিহাস জানো।

পাথরের আবার ইতিহাস?

তোমার মনে একবার প্রশ্ন জাগলো না এই কাদামাটির এলাকায় পাথরগুলো এলো কোথা থেকে।

আরে বাবা বললাম তো জানি না। তুমি বলো। এতো প্রশ্নের কী আছে।

পাল রাজা প্রথম মহীপালের এক রাণীর রাজপ্রাসাদ ছিলো এখানে। রাজা রাণীকে খুব ভালোবাসতেন।

ইরা জয়ের কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটলো। রাজা তো রাণীকে ভালোবাসবেনই, রাজার মন তো তোমার মতো সংকীর্ণ না, উদার। ভালোবাসার মতো উদার মন সবার হয় না, বুঝলে?

জয় রাগান্বিত চোখে ইরার দিকে তাকালো, তোমাকে না কতবার বলেছি কথার মাঝে কথা বলবা না, ছন্দপতন ঘটাবে না।

ইরা দু’হাত জোড় করে বিনয়ের সঙ্গে বললো, সরি রাজা মশাই, গোস্তাফি মাফ করবেন। আপনি বলুন। রাণী অধীর আগ্রহে আপনার কথায় মনোনিবেশ করছে।

জয় হেসে ফেললো, সেই রাণী জোছনা রাতে সখীদের নিয়ে এই নদীতে গোসল করতে ভালোবাসতেন। তাই রাজা অনেক দূর-দূরান্ত থেকে পাথর এনেছিলেন রাণীর জন্য।

শুনতে শুনতে ইরা কয়েকমুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে গেলো। তারপর বললো, ইসস আমি যদি জোছনা রাতে তোমার সাথে…

এখানে?

এখানে কেনো, চাঁদ জোছনায়। একটা গান আছে না, শোনোনি, এসো না চাঁদ জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে দু’জনে গল্প করি।

করবে?

অবশ্যই।

মনে রেখো কিন’।

ইরা বিশেষ ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে বললো, আমার মনে থাকবে মহারাজ।

আজ সেই রাজাও নেই, রাণীও নেই। সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথর খণ্ডগুলো আর রাজপ্রাসাদের সীমানা প্রাচীরের অংশ বিশেষ। এই নদীটার নাম কী জানো?

ইরা না সূচক মাথা নাড়লো।

জয় মুচকি হাসি হেসে শার্টের কলার নেড়ে বললো, জানবে না তো, কিচ্ছু জানো না। কোনোদিন জ্ঞানী মানুষের সাহচর্য পাওনিতো জানবে কী করে। নদীটার নাম তুলসীগঙ্গা।

তারপর দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলো কিন’ দু’জনের এই হাসি দীর্ঘস’ায়ী হলো না। ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। তার মুখ শুকিয়ে গেলো। সে শুষ্ক কণ্ঠে বললো, মতি, মতি ফোন করেছে, কী বলবো এখন?

জয় কিছু বলার আগেই ফোনের রিং শেষ হয়ে গেলো।

ইরা বললো, আমি ফোন রিসিভ করবো না। পরে যা হয় হবে।

 

পনেরো

 

ইরার খুব ইচ্ছা জয়ের হাত থেকে অটোগ্রাফ দেয়া বই কিনবে। অবশ্য ইরাকে জয় তার বাসায় গিয়ে অটোগ্রাফ দেয়া বই দিয়েছে কিন’ ওর ইচ্ছা বইমেলায় যাবে, হাজার পাঠকের ভিড় ঠেলে জয়ের কাছ থেকে একজন সাধারণ পাঠকের মতো, একজন ভক্ত হয়ে তার বই কিনবে, অটোগ্রাফ দেয়া বই।

ইরা ঢাকা যাওয়ার একটা অজুহাতও দাঁড় করালো। যাবার তারিখ হিসেবে বেছে নিলো এমন একটা তারিখ যেদিন তার সাথে কেউ যেতে পারবে না। তখন ইরা বলবে, আমি একা যাবো।

ইরা সবকিছু করলো তার পরিকল্পনা মতো কিন’ এবার বাধা সাধলো তার বড় আপা, রিচি।

তুই ঢাকা যাবি, একা?

ইরা বললো, হ্যাঁ, কেনো? পারবো না?

পারবি কিন’ তুই কি দেখেছিস আমরা কোনোদিন কেউ একা কোথাও গেছি? তুই তারিখ চেঞ্জ কর।

চেঞ্জ করলে কি তুই আমার সাথে যেতে পারবি?

রিচি আমতা আমতা করে বললো, না, তা অবশ্য পারবো না।

ইরা কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বললো, সবকিছুকে নেগেটিভলি দেখো কেনো আপা। তুমি সারাজীবন একা কোথাও যাওনি তাই বলে আমিও যেতে পারবো না। আমি এখন ছোট না, একজন স্কুল টিচার, আমার ছেলে অনার্স লেভেলে লেখাপড়া করছে।

রিচি রাগান্বিত স্বরে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, যাস, আমি তাহলে তোকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসবো আর গাবতলী থেকে হিমেল এসে তোকে নিয়ে যাবে।

ইরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে মনে মনে বিরক্ত হলো কিন’ মুখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো, তা হতে পারে।

তোর টিকেট কাটা হয়েছে?

না।

তাহলে কাল আমি অফিস থেকে ফেরার সময় টিকেট কেটে আনবো।

ইরা প্রতিবাদ করলো, না না তোমাকে যেতে হবে না। আমি নিজে কেটে আনবো।

রিচি কয়েকমুহূর্ত ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বললো, ইরা, কী হয়েছে বলতো? তুই কি কারও সাথে যাচ্ছিস?

কারও সাথে মানে?

না, আমি বলতে চাচ্ছি তুই কেনো জানি আমাকে এভোয়েড করছিস?

না আপা, আসলে আমাদের তিনজন একসাথে যাবার কথা। আমাদের এক ম্যাডাম, তার হ্যাজবেন্ড আর আমি। টিকেট কাটার দায়িত্ব নিয়েছে সেই ম্যাডাম।

ওরা কোথায় উঠবে?

এখনো বলেনি, কোথায় যে উঠবে। ওরা যেখানেই উঠুক, তুমি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসো আপা।

আচ্ছা, বলে রিচি তার রুমে চলে গেলো।

ইরা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, উফফফ্‌

রিচি চলে যাবার পর জয়কে ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যালো। কী অবস’া ইরা?

অনেক ঝামেলা ফেস করলাম সন্ধ্যা থেকে।

কী রকম ঝামেলা?

আরে বড় আপার হাজার রকমের জেরা। কার সাথে যাচ্ছি, আমি তাকে এভোয়েড করছি কেনো?

তুমি কী বললে?

কী বলবো বলো, মিথ্যা কথা বললাম। যা তোমার কাছে শিখেছি।

মানে? আমার কাছে তুমি মিথ্যা বলতে শিখেছো?

হ্যাঁ। তুমি বানিয়ে বানিয়ে একটা উপন্যাস লিখো এটা কি মিথ্যা না বলে ইরা হি হি করে হেসে উঠলো।

 

বাস ছাড়লো বিকেল চারটায়। ইরা বাস কাউন্টারে উঠলো। রিচি তাকে বাসে উঠিয়ে দিতে এসেছিলো। বাসে উঠিয়ে দিতে এসে নাকি আবারও অনেক জেরা করেছে। এসব কথা ইরা জয়কে ম্যাসেজ দিয়ে জানালো। জয়ের ধারণা ছিলো ঘটনার সমাপ্তি এখানেই কিন’ সে বাসে উঠবে এমনসময় ইরার একটা ম্যাসেজ পড়ে তার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। ম্যাসেজের বিবরণ মোটামুটি এরকম।

ইরার এক খালা আর খালু বাসে উঠেছে, তারা বগুড়া যাবে। কাজেই বগুড়া পর্যন্ত তার সাথে কথা বলা যাবে না। রিচি তার খালা-খালুকে বলে দিয়েছে তাকে বগুড়া পর্যন্ত দেখে নিয়ে যেতে।

ইরার খালা-খালু বাস থেকে নামলো বগুড়া চার মাথায়। তারপর জয় ইরার পাশে বসলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, রাস্তার দু’পাশে সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে, বাসের ভেতরে আবছা আবছা অন্ধকার। জয় ইরার পাশে বসতেই ইরা জয়ের হাতটা তার হাতের মধ্যে নিয়ে জয়ের কাঁধের ওপর মাথা রেখে বললো, উফফফ।

কী হলো ইরা?

আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি জয়, আমিও কি কম কষ্ট পেয়েছি বলো।

আমি কিছু মনে করিনি ইরা। আসলে সব দোষ রিচির। রিচি একটা…

ইরা জয়ের মুখে হাত দিয়ে বললো, এভাবে বলতে হয় না। হাজার হলেও আমার বড় আপা। আমার বড় আপা মানে তোমারও বড় আপা। বড় আপাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে, ওকে?

ইরার শেষের কথাগুলোতে কৃত্রিম শাসনের সুর ফুটে উঠলো।

জয় সুবোধ বালকের মতো বললো, ওকে।

 

বাস চলছে দ্রুতগতিতে। ইরা কখনো জয়ের কাঁধে কখনো তার কোলে মাথা রাখছে, কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে ফিসফিস করে জয়ের কানে কানে বলছে আজকের দিনটা আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইসস এমনিভাবে যদি সারাজীবন তোমার কোলে মাথা রাখতে পারতাম।

জয় ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, আমাদের আসলে অনেক পরে দেখা হয়েছে ইরা। যদি আরও আগে দেখা হতো…

ইরা জয়ের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, না, ওকথা বলবে না, দেরিতে দেখা হয়েছে তাতে কী? এখনো সম্ভব। আমরা চাইলেই হবে, সব সম্ভব।

তুমি কী বলছ্‌ো ইরা?

ইরার ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো হিমেল।

কী রে কোথায়?

ইরা মোবাইল ফোন হাত দিয়ে ঢেকে ধরে বললো, এই কোথায় আমরা বলোতো?

জয় বললো, সামনে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ।

ইরা হিমেলকে বললো, এই তো বঙ্গবন্ধু ব্রিজে উঠবো, উঠবো ভাব।

কার সাথে আসছিস রে?

কার সাথে মানে?

না মানে কার সাথে আসছিস? নাকি একা?

একা।

তোর কোন কলিগসহ নাকি আসছিস, বড় আপা বললো।

ইরা থতমত খেলো, হ্যাঁ, না মানে। বলে ইরা নিজেকে সামলে নিলো। মনে পড়লো রিচিকে সে বলেছে তার কলিগ, কলিগের বউ আর সে একসঙ্গে যাচ্ছে।

ইরা বললো, হ্যাঁ। ওরা হ্যাজবেন্ড ওয়াইফ দু’জন আর আমি। আমি তো তাহলে একাই হলাম, তাই না?

আচ্ছা ঠিক আছে। তুই টেকনিক্যাল গেট নামবি। আমি কাউন্টারে থাকবো।

ওকে। বলে ইরা ফোন রেখে জয়কে জিজ্ঞেস করলো, হিমেল টেকনিক্যাল কাউন্টারে থাকবে। তাহলে তুমি কোথায় নামবে?

জয় ইরাকে ক্ষেপানোর জন্য বললো, কোথায় নামবো মানে? আমি তোমার সাথে যাবো।

ইরা হেসে উঠলো, চলো আমার কী।

কী পরিচয় দিবে আমাকে?

বলবো আমার ফ্রেন্ড।

জয় ইরার হাত ধরে পালস চেক করার চেষ্টা করে বললো, দেখি সাহস আছে কী না?

ইরা চুপ করে থাকলো।

জয় ইরার হাত ছেড়ে দিতেই সে জিজ্ঞেস করলো, আছে?

জয় মুখ কৃত্রিম মলিন করে বললো, না, তোমার পালসের স্পিড বেড়ে গেছে, থাক আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না। তুমি টেকনিক্যাল নামবে আর আমি নামবো কল্যাণপুর।

কল্যাণপুর কেনো? ওখানে কাউকে দাঁড়িয়ে রেখেছো নাকি?

ইরার আচরণে জয় কিছুটা বিরক্ত হলো। তোমাকে না কোনোকিছু বলতে গেলেই সমস্যা। তাহলে কি তার আগে নামবো, গাবতলী।

তখন কি আমাকে একাই যেতে হবে?

হুঁম, যেতে পারবে?

না।

তাহলে সরি বলো।

কেনো?

এই যে আমাকে অযথা সন্দেহ করলে।

সরি।

ওকে।

 

ষোলো

 

জয় লেখক পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে। অবশ্য এর কোনো কারণ নেই। জয়ের চেয়ে অনেক কমবয়সী, কম সংখ্য বইয়ের লেখক এবং তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত লেখকরাও নিজেদের লেখক বলে জাহির করে কিন’ জয় পারে না। জয়ের বেশ-ভূষাতেও লেখকের ছাপমাত্র নেই। লেখক আড্ডায় আড্ডাও দেয় না সে। বইমেলায় ঢুকে সোজা চলে যায় নওরোজ কিতাবিস্তানে।

স্টলের এক পাশে ঝুলানো আছে জয়ের ছবিসহ পোস্টার। প্রচার বলতে এই যা। সেই ছবিসহ পোস্টার দেখেই পাঠকরা ভিড় করে। লেখকের হাত থেকে অটোগ্রাফসহ বই কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেদিন বিকেলে জয় স্টলে বসার পর থেকেই স্টলের সামনে একটা ছোট্ট ভিড় তৈরি হয়েছে। জয় পাঠক-ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছে। পর পর কয়েকজন পাঠককে অটোগ্রাফ দেয়ার পর ভিড়টা একটু কমলো। জয় ইরাকে ফোন দেয়ার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করলো।

ইরা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। একটা ম্যাসেজও দিয়েছে, গুড গুড গুড লিখে।

এটা ইরার অভিমানী ম্যাসেজ। কখনো ফোন ব্যস্ত দেখলে অথবা সঙ্গত কারণেও ফোন রিসিভ করতে না পারলে ইরার ম্যাসেজ চলে আসবে, গুড গুড গুড।

জয় ফোন ব্যাক করলো।

কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ইরা রিসিভ করলো। ইরার অভিমানী কণ্ঠ, কী হলো?

কোথায় তুমি?

লেখক কুঞ্জে।

থাকো আমি আসছি।

তার আর দরকার নেই। যাদের জন্য এসেছো তাদের নিয়েই থাকো।

জয় ইরাকে ক্ষেপানোর জন্য আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।

ইরা ফোন ব্যাক করলো, ফোন রেখে দিলে কেনো?

তুমি না বললে যাদের জন্য এসেছো তাদের নিয়েই থাকো। আমি কি কোনোদিন তোমার কথার অন্যথা করেছি?

ইরা হেসে ফেললো, আচ্ছা এখন চলে এসো লেখক কুঞ্জে এসো।

জয় নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে বেরিয়ে লেখক কুঞ্জে যাবার পথে, এক ভদ্র মহিলার সাথে জয়ের দেখা হলো। জয় মনে করতে পারছিলো না কিন’ তার মনে হচ্ছিলো খুব পরিচিত।

ভদ্র মহিলা সামনে এসে নিজের পরিচয় দিলো, আমি রূপা।

জয় কয়েকমুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো, রূপা, রূপা।

জয়ের মনে পড়লো, রূপা তার ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড, চ্যাটিং-এ অনেক কথা হয়েছে কিন’ সামনা-সামনি দেখা হলো এই প্রথম।

জয় সৌজন্যবশত: বললো, নাইস টু মিট ইউ।

হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে লেখক কুঞ্জের দিকে এগিয়ে গেলো।

জয়কে দেখে ইরার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো, এই তোমার সময় হলো? তাও আবার….সেজন্য দেরি হলো বুঝি?

জয় ইরার কথা বুঝতে পারলো না, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

লেখক কুঞ্জে তেমন একটা আড্ডা নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কয়েকজন লেখক কবি যাদের অধিকাংশই নতুন।

ইরা সবার সাথে জয়ের পরিচয় করে দিলো গম্ভীর কালো মুখে, আপা চিনেছো নিশ্চয়ই, আর বলে ইরা কোঁকড়ানো চুলের এক মোটা ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বললো, আমার মেজো আপা, চায়না।

জয় চায়নাকে সালাম দিলো।

চায়না ভ্রু কুঁচকে জয়ের আপাদমস্তক একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন?

জয় বললো, ভালো।

আর বলে রূপার দিকে তাকিয়ে মুখ কিছুটা বিকৃত করে ইরা বললো, রূপা ফুপুকে তো তুমি নিশ্চয়ই চেনো?

ইরার এই নিশ্চয়ই চেনো কথার মধ্যে যে একটা প্রচ্ছন্ন অভিমান আছে জয়ের তা বুঝতে বাকি রইলো না। সে মৃদু প্রতিবাদ করলো, চিনি মানে, একটু আগে পরিচয় হলো, অন দ্যা ওয়ে।

ফেসবুকে চ্যাটিং হয় না বুঝি?

জয় থতমত খেলো, এই মাঝে মাঝে।

রূপা ইরা আর জয়ের কথা শুনে বিব্রতবোধ করছিলো। সে নিজেই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ইরা চায়নাকে বললো, আপা আমি একটু আসি?

কোথায় যাবি?

এই একটু… বলে জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, রাইটারের সাথে একটু মেলাটা চক্কর দিয়ে আসি।

চায়না ভ্রু কুঁচকে বললো, যাবি? যা, তাড়াতাড়ি আসিস।

সেদিন বইমেলায় যেনো জনস্রোত নেমেছিলো। লেখক কুঞ্জের সামনেই নজরুল মঞ্চ। নজরুল মঞ্চে তখন লেখক-কবিদের ভিড়। সরাসরি ইন্টারভিউ প্রচারিত হচ্ছে। জয় একবার দাঁড়াতে চাইলো কিন’ ইরা তার হাতে মৃদু টান দিলো, না, তোমাকে যেতে হবে না।

কেনো?

না, যেটুকু সময় পেয়েছি সেটুকু সময় শুধু তোমার আর আমার। আমি তোমাকে সারা দুনিয়ার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিবো না বলে ইরা জয়ের গা ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলো।

জয় আর ইরা বইমেলায় হাঁটছে আর ইরা মাঝে মাঝে সেলফি তুলছে। অনন্যা প্রকাশনার স্টলের সামনে অনেক ভিড়। ইরা দূর থেকে ইমদাদুল হক মিলনকে দেখে আনন্দে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, ওয়াও। ইমদাদুল হক মিলন। আমি একটা বই কিনবো তোমার জন্য।

কিনবে?

হ্যাঁ।

বই কেনার জন্য কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হলো। ততক্ষণে চায়না ইরাকে দু’বার ফোন করেছে। ইরা শেষে বিরক্ত হয়ে বললো, আপা আমি ইমদাদুল হক মিলনের একটা বই কিনছি, অনেক ভিড় তাই দেরি হচ্ছে বলে চায়নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইন কেটে দিলো।

ইরা কিনলো নুরজাহান। ইমদাদুল হক মিলনের বিখ্যাত উপন্যাস।

অটোগ্রাফে লেখক লিখেছেন, “ভালোবাসা থাকলে সব হয়’’।

ইরা বইটা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, দেখছো কত সুন্দর অটোগ্রাফ দিয়েছেন, ভালোবাসা থাকলে সব হয়। তোমার মাথা দিয়ে এতো সুন্দর অটোগ্রাফ আসবে না।

জয় ইরার কথা মেনে নিলো, সেজন্যই তো তিনি স্বনাম ধন্য লেখক হতে পেরেছেন।

ইরা বইটা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, এটা পড়ো। ভালো লিখতে চাইলে আগে পড়তে হবে। দেখো একদিন তুমিও অনেক বড় লেখক হবে।

থ্যাঙ্ক ইউ ইরা, আল্লাহ তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করুন।

আমার খুব ইচ্ছা একদিন তোমার স্টলের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দেয়া বই কিনবো।

জয় খুব নরম সুরে বললো, ইরা লম্বা লাইন না হোক আমি যখন স্টলে বসি তখন আমার স্টলের সামনেও দু’য়েকজন পাঠক ভিড় করে।

ইরার চোখে-মুখে একটা উজ্জ্বল আলো উদ্ভাসিত হলো, সত্যি বলছো?

ততক্ষণে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে কফি কর্নারের কাছে এসে গেছে। জয় ইরার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, চলো কফি খাই।

কিন’ আপা যদি আবারও ফোন দেয়।

দিবে, বলবা কফি খাাচ্ছি।

দু’জনে কফি হাউজে দু’টো মুখোমুখি চেয়ারে বসলো।

কফি খেতে খেতে কয়েকবার ইরা বার বার করে জয়ের দিকে তাকাচ্ছে। জয় জিজ্ঞেস করলো, তুমি আজ আমাকে নতুন দেখছো নাকি?

এতোদিন বন্ধু হিসেবে দেখতাম আজ লেখক হিসেবে দেখছি। আমার ভাবতে গর্ব হচ্ছে যে আমি বইমেলায় একজন লেখকের সাথে বসে কফি খাচ্ছি বলতে বলতে ইরার দু’চোখ পানিতে ভরে গেলো।

ইরার মোবাইল ফোন সত্যি সত্যি আবার বেজে উঠলো। সে রিসিভ করলো, হ্যালো আপা।

কী রে তুই কোথায়?

কফি কর্নারে আপা।

আচ্ছা তুই ওখানে থাক আমরা আসছি। কয়েকমিনিটের মধ্যে চায়না, রূপাসহ চলে এলো।

জয় বিনীত কণ্ঠে বললো, ইরা আমি আসি, আপা, ফুপু, আসি।

চায়না কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো, না, যাবেন কেনো, আসুন কফি খাই।

আমাকে আবার স্টলে বসতে হবে।

ইরা বললো, এই থাকো না আমাদের সাথে, নাকি তোমার ভক্তরা স্টলে অপেক্ষা করছে?

জয় একবার রাগান্বিত চোখে ইরার দিকে তাকাতেই ইরা বললো, ওকে বাবা তুমি যাও।

আমি আসি আপা বলে জয় বিদায় নিলো।

চায়না ইরাকে চাপা স্বরে বললো, কীরে তুই ঐ লোকটাকে তুমি বলিস? তলে তলে এতোদূর…

 

সতেরো

 

নওরোজ কিতাবিস্তানের সামনে কিছুটা ভিড় জমেছে। নওরোজ থেকে সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, আনিসুল হকসহ দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখকদেরও বই প্রকাশিত হয়। কাজেই ভিড় হওয়াটা স্বাভাবিক কিন’ জয়ের মতো নবাগত লেখকের জন্য পাঠক ভিড় করবে এটা সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। জয় স্টলের সামনে আসতেই এতোক্ষণ যারা তার ছবির দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো তাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হলো, লেখক এসেছে, লেখক এসেছে।

জয় স্টলে ঢুকলো। প্রকাশক মঞ্জুর খান চৌধুরী চন্দন জয়কে দেখে রাগ আর অভিমানে মুখটা বাংলা অক্ষর পাঁচ এর মতো করে রেখেছে। জয় ভিতরে ঢুকতেই জয়ের কানে একটা চাপাস্বর ভেসে এলো, আপনি কি বইমেলায় স্টলে বসতে এসেছেন নাকি ঘুরে বেড়াতে এসেছেন? আপনাকে আমি কোনোদিন বোঝাতেই পারলাম না যে আপনি একজন লেখক।

চন্দনের কথা শুনে গর্বে জয়ের বুকটা গর্বে ভরে গেলো, সত্যিই আমি লেখক!

চন্দন বললো, আপনাকে কয়েকজন এসে খুঁজে গেলো, আপনি থাকলে আরও কয়েকটা বই বেচা যেতো।

স্টলে চন্দনের দোকানের কয়েকজন প্রমোটর আছে। তাদের মধ্যে একজন মেয়ে মুক্তা। মেয়েটির গায়ের রং ফর্সা, মুখের গড়ন সুন্দর, একটু স্টাইল করে কথা বলে।

প্রমোটর মিলন ক্রিকেটার তূর্য বইটা এগিয়ে দিয়ে বললো, স্যার এই ছেলেগুলো এই বইটা কিনবে।

তিনজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনের পরনে একই রকমের ময়লা হাফ শার্ট, প্যান্ট আর পায়ে স্যান্ডেল, চেহারায় দারিদ্র্যের ছাপ।

লম্বা মতো ছেলেটিকে জয় জিজ্ঞেস করলো, তুমি নিবে?

জি স্যার, আমরা তিনজনে কিনবো।

বাকি দু’জন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

জয় কিছুটা অবাক হলো, তিনজনে একটা বই কিনবে?

জয় তিনজনের নাম শুনে তিনজনের নামে অটোগ্রাফ দিলো। ছেলে তিনটি পকেট থেকে টাকা বের করে মিল করে দাম শোধ করলো।

জয় একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার বই পড়েছো?

জি স্যার, গতবছর আমি সেই ছেলেটি বইটা কিনেছিলাম। ওরাও পড়েছে, এবার আমার বই কেনার টাকা ছিলো না। ওরা বললো, ওরাও শেয়ার করবে তাই তিনজনে মিলে কিনছি।

জয়ের দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। তার বেশিরভাগ পাঠকই এমন। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। যাদের একটা বই কিনতে গেলে আরেকটা বই কেনা হয় না আর না হয় এক কাপ চা কম করে খেতে হয়।

এই তো কয়েকবছর আগের কথা। তখনো জয়ের কোনো কিশোর উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি। স্টলের সামনে এলো এক দম্পতি আর তাদের তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলে। স্টলে টাঙ্গানো পোস্টার আর স্টলে সাজানো তার বই দেখে ভদ্রমহিলা অপেক্ষা, তবুও আমি তোমার, খুঁজে ফিরি তারে বইগুলো হাতে নিয়ে দেখলো। খুঁজে ফিরি তারে বইটা অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়লো, তারপর জিজ্ঞেস করলো, কত দাম?

প্রমোটর মনির বললো, এক’শো বিশ টাকা।

ভদ্রমহিলা একবার তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো, নিবো?

ভদ্রলোক না সূচক মাথা নাড়লো।

ভদ্রমহিলা মুখ কালো করলো, দাও না প্লিজ!

ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে মহিলার কানে কানে চাপাস্বরে বললো, ইমনকে বই কিনে দিতে হবে না, আমার কাছে আর টাকা নেই।

আমি একটা বই নিতে চাইলাম তাতে তোমার এতো আপত্তি।

বোঝার চেষ্টা করো, আমার কাছে বই কেনার জন্য আর দু’শ টাকা আছে যদি তুমি নাও তবে ইমনের কিন’ বই হবে না। ভেবে দেখো কী করবে?

ভদ্র্রমহিলা রাগ করে বইটা টেবিলের ওপর রাখলো। মনির জিজ্ঞেস করলো, ম্যাডাম প্যাকেট করে দিবো?

ভদ্রমহিলা একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, না ভাই, আগামীবছর এই বইটা পাওয়া যাবে না?

চন্দন পিছন থেকে বললো, যাবে।

মনির জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সত্যজিতের বই নেন।

ভদ্রলোক বললো, না ও বই সিলেক্ট করে রেখেছে।

ওরা চলে যাবার পর চন্দন জয়কে বললো, বুঝছেন, তারমানে আপনার সব ধরনের বই থাকতে হবে। যদি একটা কিশোর উপন্যাস থাকতো তবে সেটা বিক্রি হয়ে যেতো। আগামীবার একটা কিশোর উপন্যাস দিবেন আমাকে।

জয় কিছুটা সংশয়ের সঙ্গে বললো, আমি পারবো?

অবশ্যই পারবেন।

তার পরের বছর প্রকাশিত হলো জয়ের প্রথম কিশোর উপন্যাস সেই ছেলেটি। অনেক বিক্রি হলো, চন্দনের মুখ তখন জয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

প্রমোটর মুক্তা পরীর স্বপ্ন বইটা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, স্যার এই মেয়েটি বইটা কিনবে।

বারো তেরো বছর বয়সের একটি মেয়ে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে গভীর কৌতূহল নিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। জয় জিজ্ঞেস করলো, কী নাম তোমার?

মনিকা রায়।

কোন ক্লাসে পড়ো?

ক্লাস সিক্সে।

জয় অটোগ্রাফ দিচ্ছে আর কথা বলছে, কোন স্কুল?

ভিকারুননিসা নূন।

জয় বই থেকে মুখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকালো, বুদ্ধি দীপ্ত চোখ।

বড় হয়ে কী হতে চাও?

পাইলট।

পারবে, তুমিই পারবে। আমি আশীর্বাদ করে দিলাম তুমি একদিন পাইলট হবে। মেয়েদের মধ্যে চেঞ্জ আসতে শুরু করেছে, কয়েকবছর আগেও যেখানে মেয়েরা নিজেদের নারী ভেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখতো এখন তারা নিজেদের মানুষ ভাবতে শুরু করেছে।

জয় অটোগ্রাফে লিখলো, আকাশ ছোঁয়া সফলতা।

মনিকা বইটা হাতে নিলো। অটোগ্রাফ দেখে মনিকার মায়ের চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো, আশীর্বাদ করবেন দাদা ভগবান যেনো আমার মেয়েটার মনস্কামনা পূরণ করেন।

মনিকা আর তার মা বই নিয়ে যেতেই না যেতেই একটা মেয়ে জয়ের সামনে এসে হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, হাই ভাইয়া।

জয় মেয়েটির দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি লম্বা, গায়ের রং মিষ্টি, উজ্জ্বল শ্যামলা, চোখ-মুখ খাড়া, স্মার্ট, কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো চুলগুলো মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। মেয়েটির পরনে জিন্সের প্যান্ট, পায়ে পাতলা স্যান্ডেল।

জয় হ্যান্ড শ্যাক করলো।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, চিনতে পারেননি আমাকে? আমি নাইয়াদ।

নাইয়াদ, নাইয়াদ…

তবু চিনতে পারেননি, না?

আমি নাইয়াদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ফার্মেসি থার্ড সেমিস্টার।

ও এবার মনে পড়েছে তুমি ব্লগে লেখো।

কী যে বলেন ভাইয়া লিখি না, লিখতে পারিও না আড্ডা দিই বলতে পারেন। তবে আপনার লেখার একজন ভক্ত। আপনার লেখার একজন অসাধারণ ভক্ত আমি। যদিও আপনার সব লেখা আমি ব্লগে পড়েছি তবু আপনার হাতে অটোগ্রাফ দেয়া একটা বই কিনবো, বলতে বলতে নাইয়াদ কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। তারপর নাইয়াদ টেবিলের ওপর  থেকে ছায়াপুরুষ বইটা হাতে নিয়ে বললো, এই বইটা কিনবো। অটোগ্রাফ দিন প্লিজ!

জয় অটোগ্রাফ দিয়ে নাইয়াদকে বইটা দিয়ে দিয়েছে। তারপর সে বায়না ধরলো, ছবি তুলবে।

জয় স্টল থেকে বেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। নাইয়াদ জয়ের হাত থেকে বই নিচ্ছে এমন অবস’ায় তার এক ফ্রেন্ড কয়েকটা ছবি তুললো।

নাইয়াদ থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ বলে আবার হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।

জয় হ্যান্ড শ্যাক করছে এমনসময় ইরা স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার চোখ-মুখে যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমেছে। জয় মৃদু হেসে বললো, ইরা।

ইরা কোনো কথা না বলে চলে গেলো।

ইরার পিছনে পিছনে চায়না আর রূপাও চলে গেলো।

তখন থেকে জয় ইরাকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছে, ম্যাসেজ দিয়েছে কিন’ ইরা রিসপন্স করেনি। রাতে ইরার একটা ম্যাসেজ পাঠালো, আমি জানি তোমার অনেক ফ্যান এন্ড ফ্রেন্ড আছে তুমি তাদের নিয়েই থেকো আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিও না, ম্যাসেজ দিও না, কন্টাক্ট করো না প্লিজ! আমার সার্কেল খুব ছোট, আমার দৃষ্টিসীমা অনেক সংকীর্ণ, আমার জগৎ অনেক ক্ষুদ্র,  আমি আমার খুব ছোট্ট পৃথিবী নিয়েই থাকতে চাই।

 

আঠারো

 

ইরার সঙ্গে জয়ের সম্পর্কের বিষয়টি দুই-ই পরিবারে একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি করেছে। ইরার সঙ্গে সামিনার ফোনে পরিচয় আছে, দু’য়েকদিন কথাবার্তাও হয়েছে। সেসব কথাবার্তায় সামিনার সন্দেহপ্রবণতাই ফুটে উঠেছে।

কয়েকমাস আগের কথা একদিন ইরা জয়কে ফোন করে বললো, এই ভাবীকে তুমি আমার মোবাইল নাম্বার দিয়েছো?

জয় মনে করার চেষ্টা করলো, না, আমি তো কোনোদিন ওকে তোমার নাম্বার দিইনি।

তাহলে আমার নাম্বার পেলো কীভাবে?

তোমাকে তো বলেছি ও খুব জটিল আর সন্দেহপ্রবণ, হয়তো আমি তোমাকে ফোন করে বা ম্যাসেজ দিয়ে ঘুমিয়েছি অথবা টয়লেটে গেছি এমনসময় আমার ফোন থেকে নিয়েছে।

তুমি সাবধানে থাকবে না?

আগে তো কিছু মনে করিনি এখন থেকে সাবধান থাকতে হবে। কী বললো তোমাকে?

তেমন কিছু না। তবে আমাদের সন্দেহ করছে।

জয় ইরাকে অভয় দেয়ার জন্য হেসে উড়িয়ে দিলো, সন্দেহটা তো অমূলক না ম্যাডাম।

ইরা হেসে ফেললো, ও তাইতো।

তারপর থেকে ইরা আর সামিনা মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতো। তেমন কিছু না, খুব স্বাভাবিক কথা, সংসারের খুঁটিনাটি কথা।

আজ জয় বইমেলা থেকে রুমে এলো এমনসময় সামিনা ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যাঁ, বলো।

কোথায় তুমি?

হোটেলে।

ভাত খেয়েছো?

খেয়েছি।

তোমার বই কেমন বিক্রি হচ্ছে?

ভালো।

সামিনা খোঁচা মেরে বললো, হবেই তো সুন্দরীকে নিয়ে গেছো যে বিক্রি তো হবেই।

মানে?

মনে হয় বুঝতেই পাচ্ছো না। তুমি ইরাকে মেলায় নিয়ে গেছো, না?

জয় কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, আমি ইরাকে নিয়ে গেছি মানে?

ইরাও তো মেলায় গেছে।

যেতে পারে, তার অর্থ কি আমি নিয়ে গেছি?

ঐ হলো, তুমি না নিয়ে গেলেও মেলায় গিয়ে তো দেখা হয়েছে। আরও কত কী করেছো আমি কি তোমাকে চিনি না ভেবেছো।

কতো কী করেছো কথাটা শুনে জয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো, কত কী করেছো মানে কী? কী বলতে চাও তুমি?

সামিনা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো, আচ্ছা থাক এখন রেস্ট নাও।

সামিনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইরা কয়েকবার ফোন দিয়েছে, তারপর তার সেই চিরাচরিত ম্যাসেজ, গুড, গুড, গুড।

জয় কল ব্যাক করলো।

ইরা ফোন রিসিভ করেই জয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চাপা স্বরে বললো, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও জয়, থামলে কেনো? সবার মন জয় করে বেড়াও।

বাসা থেকে ফোন করেছিলো।

হ্যাঁ করবেই তো, বাসা থেকে করবে, ইউনিভার্সিটি থেকে করবে, সামিনা করবে, নাইয়াদ করবে, আমি তো তোমার কাছে তুচ্ছ। তুমি কেমন করে মেয়েটার সঙ্গে ছবি তুললে। দেখে আমার মনে হচ্ছিলো আল্লাহ তুমি এই দৃশ্য দেখার আগে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলে না কেনো?

আমি কী করেছি ইরা? একজন পাঠক কি লেখকের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইতে পারে না?

কেনো? ছবি তুলতে হবে কেনো? তোমার বই পড়ে ভালো লাগে, আরও পড়বে তাই বলে ছবি তুলতে চাইবে, আর তুমি ছবি তুলবে।

জয় ইরাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো, ইরা এটা খুব সামান্য ব্যাপার, তুমি এটাকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করবে এটা ঠিক না।

ইরা প্রচণ্ড রেগে গেলো, ওকে, ঠিক না। তুমি ওদের নিয়েই থাকো। তুমি লেখক, যা ছাইপাস লেখো, তার আবার পাঠক-ভক্ত। থাকো, তুমি তোমার পাঠক-ভক্তদের নিয়েই থাকো। আমি একজন সামান্য স্কুল টিচার, আমার সার্কেল ছোট, আমি জানি তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তুমি শুধু আমারই ফ্রেন্ড থাকবে, আজ, কাল এবং সারাজীবন। আমি আমার ফ্রেন্ডকে কারও সাথে শেয়ার করতে পারবো না।

আছি তো, তুমিই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কল্পনাও করি না।

স্টপ, স্টপ। আর একটা কথাও বলবে না, পাঠক-ভক্তের নামে হাজার হাজার মেয়ের সাথে….ছি: আমার ঘেন্না হচ্ছে।

ইরা আজেবাজে কথা বলবে না। লেখকদের চিন্তাভাবনা অনেক উদার। আর সেই উদারতাকে তুমি ভুল বুঝছো, নোংরাভাবে উপস’াপন করছো। তোমার ঘেন্নাবোধটা একটু বেশি।

ওকে, তুমি উদার হও, সারা দুনিয়ার মেয়েদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলো, বলে ইরা অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে বকাবকি করলো আর কানের কাছে ফোন ধরে রাখলো।

অনেকক্ষণ থেকে বকাবকি করতে করতে ইরা হাঁপাচ্ছে, তবু যেনো রাগ থামেনি, সে আবার বলতে শুরু করলো, আমাকে আর কখনো ফোন দিবে না, কোনোদিন ম্যাসেজও দিবে না। বাই ফর এভার, বলে ইরা জয়কে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিলো।

জয় বার বার ইরাকে ফোন দিলো কিন’ ইরা আর ফোন রিসিভ করলো না, ম্যাসেজ দিলো কিন’ ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো না।

 

উনিশ

 

সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কারণে দীর্ঘ দিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলো। রয়ে গেলো সম্পর্কের যোগসূত্র আনন্দ-বেদনার স্মৃতি সেই তাজমহল, সেই সাজগার্ডেন। ঝড় আসে, মানুষের বাড়ি-ঘর ভাঙ্গে, মন্দির-মসজিদ ভাঙ্গে, সভ্যতা বিলীন হয়ে যায় আবার একদিন সবকিছু গড়ে উঠে। একদিন সেই ঝড়ের কথা মানুষ ভুলেও যায়। কিন’ হৃদয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় হৃদয় চুরমার করে যে স্মৃতি রেখে যায় সেই স্মৃতি দগদগে দাগ হয়ে জ্বলতে থাকে সারাজীবন।

ইরা লালন করতে চেয়েছিলোও তাই, চোখের আড়ালে, দৃষ্টি সীমার বাইরে, সমাজ-সংস্কৃতির অন্তরালে এমন একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ থাকবে তার। যোজন-যোজন দূরে থেকেও যার নাম মনে পড়তেই ইরা একটা তৃপ্তির নি:শ্বাস ফেলতে পারবে, মনের গভীরে তার একটা আশ্রয় থাকবে। ইরা খুঁজেও পেয়েছিলো একটা আশ্রয় সেই আশ্রয়টি সে নিজেই হারিয়েছে, দু’চোখ বন্ধ করে মনের গভীরে হাজার খুঁজেও ইরা আর তাকে পাবে না তা কী করে হয়। ইরার স্মৃতি, তার বাড়ির সামনে সাজগার্ডেন, চোখের সামনে তাজমহল আর বাড়িতে তার শোয়ার জলচৌকি, সোফায় বসে মগ্ন হয়ে বই পড়ার ছবি যা আজও তার চোখের সামনে ভাসছে। পাথরঘাটায় ছোট্ট নদীর তীরে বসে চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখার স্মৃতি সে ভুলবে কীভাবে।

ইরার বুক চিরে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে, জয়, থাকবে না যদি তবে আমাকে স্বপ্ন দেখালে কেনো? কেনো আমার সাজগার্ডেনে তোমার স্মৃতি রেখে গেলে? কেনো তোমার বিল্ডিং দেখে তাজমহল ভেবে আমি আমাদের প্রেমকে অমর করে তুললাম আর তুমি চলে গেলে? আমি এতো স্মৃতি নিয়ে সারাজীবন কীভাবে কাটাবো জয়, কীভাবে!

জয়কে ফোন করার জন্য মোবাইল ফোনটা হাতে নেয়। রিং দিতে গিয়ে ফিরে আসে। নিজের মুখে এতো অপমানের পর আবার কীভাবে ফোন করবে ইরা? তাকে ফোন করবে কীভাবে? এমনি অনেকবার ইরা তাকে অপমান করেছে আবার পরে ফোন করে সরি বলে নিজের ভুল স্বীকার করেছে।

জয় বার বার বলেছে, ইরা তোমার থার্ড আইটা বন্ধ করো প্লিজ! কারণ তোমার থার্ড আই সবসময় ভুল দেখে আর তুমি কল্পনাপ্রবণ হয়ে আমাকে সন্দেহ করো। আর তোমার এই না জেনে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক কথাটা বাদ দাও। নিজের চোখে না দেখে, নিজের কানে না শুনে তুমি কীভাবে বলো আমি অন্য কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করছি? আমার ফোন ব্যস্ত দেখে কীভাবে বলো আমি কোনো মেয়ের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি?

ইরা কোনোকিছুই বুঝতে চায় না। সে বলে তুমি যদি কারও সাথে কিছু না করো তাহলে আমাকে এমন লাগবে কেনো? আমার বুকের ভেতর এমন মোচড় দিবে কেনো? তুমি বাইরে গেলে সবসময় অসি’র অসি’র লাগবে কেনো?

এটা তোমার মনের ভুল। এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্ট করো ইরা।

না। ইরা তার স্বভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেদিন জয়ের মোবাইল ফোন অনেকক্ষণ ব্যস্ত ছিলো। আর তার কথা বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরা তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করলো, লুচ্চা, তোমার এক সঙ্গে ক’টা মেয়ে লাগে? তুমি হাজারটা মেয়ের সাথে কথা বলবা তো আমাকে ভালোবেসেছিলে কেনো?

জয় প্রতিবাদ করলো, ইরা, মাথা ঠাণ্ডা করো, আমার অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে সেজন্য আমি ফোনে এসব সামাল দিচ্ছি।

ফোনে সামাল দিচ্ছো, না? আমি তোমাকে চিনি না, আর কোনোদিন আমাকে ফোন করবে না, কোনোদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। কোনোদিন না, কোনোদিন…

জয় কোনো কথা বলেনি। ইরা এভাবে আগেও বলেছে তারপরও জয় ইরাকে ফোন করেছে সেদিন বারো শিবালয় মন্দিরের পাশে বড় বট গাছের নিচে যখন দু’জনে একান্তে বসেছিলো তখন ইরা জয়কে জিজ্ঞেস করলো, জয় তোমাকে যে এতো খারাপ ভাষায় বকাবকি করি তবু তুমি মুহূর্তে সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার আমার সাথে যোগাযোগ করো কীভাবে? বলোতো তোমার কি অপমান বোধ নেই?

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বলে, আছে। তারপরও যোগাযোগ করি কেনো জানো?

ইরা জয়ের চোখে চোখ রেখে বলে, না।

কারণ আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো, আর সেজন্য তুমি অন্যকে হিংসা করো, তুমি তোমার ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে চাও না কিন’ যখন তুমি রেগে যাও তখন তুমি আর আমার ইরা থাকো না। আমি দেখেছি তুমি রেগে গেলে আর মানুষ থাকো না। আমি মনে করি যে আমাকে অপমান করে সে ইরা না, অন্য কেউ। আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার ইরা। সেজন্য যখন তোমার রাগ থেমে যায় তখন তুমিও ফোন রিসিভ করো আর ভুলে যাও রাগের সময় তুমি আমাকে কী কী বলেছো।

ইরা জয়ের বুকের ওপর মাথা রাখে। তুমি ঠিকই বলেছো। যখন তোমার ফোন ব্যস্ত থাকে, যখন তুমি ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাসে লাইক দাও বা কমেন্টস করো তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় যে আমি তোমার মতো বাস্তববাদী একজন মানুষ পেয়েছি। অন্য কেউ হলে আমার মুখের ভাষা শোনার পর একদিনই বাই বাই বলে চিরদিনের জন্য চলে যেতো। আমাকে আজ কথা দাও, এই মন্দিরে দাঁড়িয়ে আমাকে কথা দাও তুমি আমাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না তো?

জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, না।

শুধু না বললে হবে না, বলো কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবো না তো।

আমি তোমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যাবো না কিন’ আমারও তো একটাই প্রশ্ন তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো?

না জয়, আমিও তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তবে আমার একটা ভয় হয়।

কী বলো?

তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না ঠিকই, যে বুকে আমাকে রেখেছো সে বুক থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিবে না ঠিকই কিন’ আমার ভয় এ বুকে অন্য কেউ মাথা রাখলে তুমি তাকেও…

জয় প্রতিবাদ করে, ছি: ইরা এমন কথা বলতে হয় না। তোমার একটা সমস্যা হলো তুমি সবসময় নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করাও।

যেমন?

যেমন আমি যদি তোমার কাছে একটু সেজেগুঁজে আসি তখন তুমি মনে করো আমি বুঝি অন্য কারও জন্যও এভাবে সেজেগুঁজে যাই। তোমার জন্য যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি তেমনি যেকেনো মেয়ে ডাকলেই আমি এভাবে অপেক্ষা করি। অথচ আমি আমার চাকরির কারণে সবসময় অনেক ব্যস্ত থাকি, লেখালেখির কারণে সবসময় কোনো না কোনো লেখার চিন্তায় মগ্ন থাকি আর এর ফাঁকে তোমার ডাকে ছুটে আসি। প্লিজ ইরা তোমার থার্ড আইটা একটু বন্ধ করো, দেখবে কোনোদিন যদি আমাদের রিলেশনটা নষ্ট হয়ে যায় তবে তোমার থার্ড আই’র কারণে, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই নষ্ট হবে।

তাহলে তোমার কথা মনে হলে আমার মনে হবে কেনো যে তুমি অন্য কারও সাথে…

এমন কথা কখনো ভাববে না।

ঠিক তখনই আমি খুব কষ্ট পাই যখন দেখি তোমার ফোন ব্যস্ত অথবা বার বার ফোন দিয়েও তুমি ফোন রিসিভ করছো না তখন।

জয় জিজ্ঞেস করলো, আমি কখন তোমার আচরণে খুব কষ্ট পাই, জানো?

না। বলোতো কী সেটা?

তুমি আমাকে কোনোকিছু না বলে ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দাও। তখন আমার মনে হয় তোমার প্রতিশ্রুতিগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই।

ইরা বললো, তখন আমি কী করি জানো?

জানি।

বলোতো?

তখন তুমি নিজের ওপর প্রতিশোধ নাও। আমার ওপর রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দাও, বিকেলে বাসায় শুয়ে কাঁদো।

ইরা বললো, ঠিক বলেছো।

জয় ইরার হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, দেখতে হবে না। আমার থার্ড আই বলে কথা।

এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ইরা জানালায় এসে দাঁড়ালো। জানালার পাশে সাজগার্ডেন আর কয়েক’শ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে জয়-ইরার তাজমহল।

এতো স্মৃতি বুকে নিয়ে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে ইরা? সময়টা অল্পদিনের কিন’ স্মৃতিগুলো…

স্মৃতিগুলো যেনো অক্ষয় হয়ে হৃদয়ে দাগ কেটেছে, ইরার হৃদয়ে। আজ জানালায় দাঁড়িয়ে নিজের ওপর খুব ক্ষোভ হচ্ছে ইরার, কেনো? কেনো এমন অশ্লীল ভাষায় জয়কে গালি দিলাম আমি? তবে এমন গালি তো অনেকবারই দিয়েছি জয়কে কিন’ জয় কোনো বার দিব্যি দেয়নি, কোনো বার বলেনি, তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তবে আমাকে আর কোনো দিন ফোন দিবে না, আমি ফোন দিলেও রিসিভ করবে না, যদি করো তবে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে।

সেদিন দিব্যির কথা শুনে জয় থমকে গিয়েছিলো। কয়েকমুহূর্ত যেনো বাতাসের তরঙ্গও থমকে গিয়েছিলো তাই জয়ের শান্ত, গম্ভীর, ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বরটা ইরার কানে এসেছিলো কয়েকমুহূর্ত পরে, ইরা ভেবে বলছো তো?

ইরা সহস্‌্রগুণ উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো, হ্যাঁ হ্যাঁ ভেবে বলছি, ঠাণ্ডা মাথায় বলছি, সি’র চিত্তে বলছি, তুমি আর কোনোদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। যদি আবার তুমি আমাকে ফোন করো তবে আমি আমাকে টিজ করার জন্য কোর্টে যাবো, তোমার শাস্তি হওয়া উচিৎ, সবাই দেখুক মেয়েদের টিজ করার অপরাধে তোমার মতো একজন মুখোশধারী, ভালো মানুষের শাস্তি হয়েছে। তোমার শাস্তি দেখে সবাই শিক্ষা নিবে।

জয়ের বুকে যেনো কথাটা শেলের মতো আঘাত হেনেছিলো, আমি তোমাকে টিজ করি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ করো, যদি আবারও আমাকে ফোন দাও তবে সত্যি সত্যি তুমি…

ইরার কথা শেষ হওয়ার আগে জয়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, সরি ইরা, সরি ফর এভরিথিং। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার কোনোদিন অমঙ্গল হোক আমি চাই না। আমি আর কোনোদিন তোমাকে ফোন করবো না, কোনোদিন তোমার ফোন রিসিভও করবো না, কোনোদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগও করবো না।

ইরা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, নিজের অমঙ্গলও চেয়ো না।

ওকে, ওকে ইরা আর বলতে হবে না। ভালো থেকো বাই, বাই ফর এভার।

 

তারপর থেকে জয় তাকে আর কোনোদিন ফোন দেয়নি, ফেসবুকেও তাকে ডাকেনি। ইরা সেদিন থেকে জয়কে ভুলে যেতে চেয়েছে, চেষ্টা করেছে কিন’ যতই সে ভুলতে চায় ততই তার নাম, তার স্মৃতিগুলো হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে গেঁথে যায় কিন’ কোন্‌ লজ্জায় জয়কে ফোন করবে ইরা।

বিকেলটা ইরার সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতায় কাটে। মতি স্কুল থেকে এসে কয়েকমিনিটের জন্য বসে এক কাপ চা খেয়ে চলে যায় বাজারে। ফিরে আসে একেবারে রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে।

সাজগার্ডেনে জয় অনেকগুলো গাছ লাগিয়েছে। যেগুলো জানালার কাছে, জানালায় চোখ খুলতেই ইরার চোখে পড়ে, তখন মনের ভেতর জয়ের ছবিটা ভেসে উঠে। একটু দূরে তাকাতেই চোখে পড়ে তাজমহল। তখন জয়কে ফোন করার জন্য মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় ইরা কিন’ ফোন করতে পারে না। কানের কাছে প্রতিধ্বনি হয়ে ভেসে আসে তার নিজের কথাগুলো। ইরা ভাবে জয়কে সে যেভাবে অপমান করেছে তারপরও আবার তার সঙ্গে কথা বলবে কীভাবে?

 

বিশ

 

সেদিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের পর জয়ের ধারণা ছিলো হয়তো ইরা তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে আবার ফিরে আসবে। হয়তো বরাবরের মতোই একটা ম্যাসেজ দিয়ে বলবে, সরি জয় আমার ভুল হয়ে গেছে, প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না।

জয় এমনই একটা ম্যাসেজ বা একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তার কানের কাছে যেনো কিছুক্ষণ পর পর মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠতো আর জয় ফোন বের করে দেখতো। ফোনে কখনো একটা ম্যাসেজ এলেই চমকে উঠতো, তার মনের মধ্যে ইরার ছবিটা ভেসে উঠতো, বুকে ঢেউ আছড়ে পড়তো, এই বুঝি ইরার ম্যাসেজ এলো। কোনো অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন এলে জয় সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করতো। মনে হতো এই বুঝি ইরা ফোন করলো কিন’ না, ইরা আর ফোন করলো না।

জয় ফোন করতে গিয়েও পারেনি মোবাইল ফোন হাতে নিতেই তার কানের কাছে ভেসে আসতো ইরার কথাগুলো, তুমি যদি আবার আমাকে ফোন করো, আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো তবে আমি তোমার বিরুদ্ধে ইভ টিজিং মামলা করবো আর না হয় আত্মহত্যা করবো।

না, জয় আর ভাবতে পারছে। তার চোখের সামনে ইরার বিধ্বস’, রোগাক্রান্ত এক মৃত্যু পথযাত্রী নারীর ছবি ভেসে উঠছে। জয় যেনো আপনমনে আঁৎকে উঠতো, না, না, আমি ইরার এ চেহারা দেখতে পারবো না।

অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় সবাই যেমন রোগীকে সান্ত্বনা দেয়, কিচ্ছু হবে না একটু ফুটো করে…

কিন’ সেই সান্ত্বনাটাই যখন নিজের বেলায় হয় তখন সবাই বুঝতে পারে এই একটু ফুটোই কত আতঙ্কের, কত ঝুঁকিপূর্ণ। জয়ের বেলায়ও হয়েছে তাই, জয় কোনোদিনও দিব্যি-টিব্যি বিশ্বাস করতো না কিন’ দিব্যি দিয়ে ফোন করতে নিষেধ করার পর যখন ফোন করতে গিয়ে ইরার ছবিটা ভেসে উঠতো তখন মনে হতো দিব্যি বলে কিছু আছে নিশ্চয়ই।

অনেক কষ্টের মাঝেও ইরার একটা কথায় জয় না হেসে পারতো না, আবার যদি তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো তবে আমি তোমাকে উচিৎ শিক্ষা দিবো? তোমার বিরুদ্ধে কোর্টে যাবো।

ইরা ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো আইনের কাছে সোপর্দ করে না, ভালোবাসার মানুষের মুখ কেউ কখনো এসিডে ঝলসে দেয় না কিন’ তুমি আমাকে কোর্টে সোপর্দ করার ভয় দেখিয়েছো, তুমি আমার হৃদয় এসিডে ঝলসে দিয়েছো। যা কোনোদিন কেউ জানবে না কিন’ সারাজীবন আমাকে দগ্ধ করবে, সারাজীবন আমাকে যন্ত্রণা দিবে।

আসলে জয় বুঝতে পাচ্ছে না ইরাকে ফোন করলে সে খুশি হবে নাকি রেগে যাবে। জয় জানে ইরা তাকে ভালোবাসে, প্রচণ্ড ভালোবাসে আর সেজন্যই অভিমান করে, ইরা তুমি রাগের বশে আমাকে অপমান করেছো। আমাকে কষ্ট দিয়ে নিশ্চয়ই তুমিও কম কষ্ট পাচ্ছো না, এসব কষ্ট কষ্ট খেলা বন্ধ করো ইরা, আমাকে ফোন করো প্লিজ!

ইরার সঙ্গে জয়ের একটা সিডিউল ছিলো। প্রতিদিন রাত ন’টায় ফেসবুকে আসা। এতোদিন তাই ছিলো কিন’ সেদিনের পর থেকে ইরা ফেসবুকে আসাও ছেড়ে দিয়েছে। জয় ইরাকে অনেকবার বলেছে, ইরা তোমার রাগটা একটু কমাও।

ইরা বলেছে, রাগ না, অভিমান। কী যে লেখো তুমি রাগ আর অভিমানই আজ পর্যন্ত চিনলে না।

রাগ হোক আর অভিমানই হোক, তার লাগামটা একটু টেনে ধরো।

তাই বলে তুমি যাচ্ছেতাই করে বেড়াবে আর আমার মধ্যে রাগ-অভিমান কিছুই থাকবে না। আমি তো তোমার মতো রোবটা না, রক্ত মাংসে তৈরি জলজ্যান্ত এক মানুষ।

তা তো জানি শুধু মানুষ না, হৃদয়বতী এক মানুষ।

ইরা হেসে ফেলতো।

একটা কথা মনে রাখবে রাগ-ক্ষোভ-অভিমান সব মানুষের মধ্যেই থাকবে এবং তা থাকবে মানুষের নিয়ন্ত্রণে, বিবেকের নিয়ন্ত্রণে কিন’ তোমার বিবেক তো তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বরং তোমার রাগই বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে তুমি যখন রেগে যাও তখন তুমি আর মানুষ থাকো না।

ইরা রেগে গেলো, তারমানে আমি মানুষ না?

জয় বললো, তুমি মানুষ না একথা তো আমি বলিনি, আমি বলেছি রেগে গেলে তুমি আর মানুষ থাকো না।

ওকে, ওকে বেশ ভালো বলেছো, তাহলে আমার মতো অমানুষের সঙ্গে আর কথা বলো না। কোনো যোগাযোগ করো না। ওকে বাই।

 

সে যাত্রায় ইরা তিন দিন জয়ের সঙ্গে কথা বলেনি। ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট থেকেও তাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলো। জয় ভেবেছিলো ইরা বুঝি আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলবে না।

তিনদিন পর বিকেলে ইরা ফোন করলো, তুমি কোথায়?

খঞ্জণপুর।

কী করছো?

হাঁটাহাঁটি।

ফেসবুকে আসোতো।

ফেসবুকে গিয়ে কী হবে তুমি তো আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছো।

তাতে তো তোমার ভালোই হয়েছে সারা দুনিয়ার তোমার বন্ধু-ভক্তদের সাথে আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছে।

জয় বললো, তুমি তোমার সে ধারণা নিয়েই থাকো। আমি আর ফেসবুকে যাবো না।

আসো প্লিজ! তুমি এসেই দেখো।

জয় ফেসবুকে লগ ইন করে দেখে ইরা আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে অসংখ্য বার সরি লেখা। জয় তবুও ইরার বন্ধুত্বের আহবান গ্রহণ করলো না।

কিছুক্ষণ পর ইরা আবার ফোন করলো, তুমি কোথায়?

ফেসবুকে।

আমি কেনো দেখতে পাচ্ছি না তোমাকে?

তুমি আবার রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছো?

হ্যাঁ।

কেনো?

ফাজলামি করো না তো। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করো।

জয় অভিমান করে বললো, আমি তো খারাপ মানুষ, আমার সঙ্গে তুমি বন্ধুত্ব করবে?

করবো বলেই তো তোমাকে আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। প্লিজ! এক্সেপ্ট করো। তুমি তো বলেছো কেউ সরি বললে আর বাহানা খুঁজতে হয় না।

এমন আর করবে না তো?

না।

আবার যদি তুমি এমন করো তবে আমি কিন’ তোমাকে আনফ্রেন্ড করবো।

এমনিভাবে ইরার সঙ্গে জয়ের সম্পর্কটা যাচ্ছিলো এলোমেলোভাবে, চৈতের হাওয়ার মতো, আষাঢ়ের দিনের মতো কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি আর কখনো রৌদ্রের উত্তাপের মতো ভালোবাসার উত্তাপ। কিন’ শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা চিরদিনের জন্য ছিন্ন হয়ে যাবে জয় কোনোদিন চিন্তাও করেনি।

 

ইরা ফোন করলো। জয় ফোনের দিকে তাকিয়ে যেনো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। ইরা তো…

জয় ফোন রিসিভ করলো, ইরা।

ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে বললো, জয়, জয় তুমি কেমন আছো জয়?

জয় অভিমান করে বললো, কেমন আছি তা তুমি ভালো করেই জানো ইরা।

আমি ভালো নেই জয়, সেদিন তোমাকে ওভাবে বলার পর থেকে আমি খুব কষ্টে আছি। আমার ভুল হয়ে গেছে জয়, প্লিজ জয়! প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আমার আর কখনো এমন হবে না।

 

একুশ

 

খঞ্জণপুর-গতনশহর রোডের পাশে বারো শিবালয় মন্দির। মন্দিরের পাশে একটা বিশালাকৃতির শতবর্ষী বটগাছ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোটযমুনা নদী। এই জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। জয় আর ইরা প্রথম যেদিন এখানে আসে সেদিন ইরা খুব খুশি হয়েছিলো। এই জায়গাটা ওর খুব পছন্দ হয়েছিলো। এসেই আবেগআল্পুত হয়ে বললো, ওয়াও, এতো সুন্দর জায়গা তুমি কীভাবে খুঁজে পেলে?

জয় বললো, আমি এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি, একদিন মন্দিরে ঢুকেছিলাম তারপর দেখি পাশে একটা বটগাছ, মন্দির থেকে বেরিয়ে বটগাছের নিচে এলাম, জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগলো, তখনই আমার মনে হয়েছিলো তোমাকে নিয়ে আসবো। আর তাই…

ইরা জয়ের কথা মাঝে বাধা দিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, আর তাই তুমি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে চলে এলে।

জয় ইরাকে ক্ষেপানোর জন্য বললো, তুমিই বলো এতো সুন্দর একটা জায়গায় কি একা আসা যায়?

মুহূর্তেই ইরার রেগে লাল হয়ে গেলো, জয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’বাহুতে হাত রেখে একটা ঝাঁকি মেরে বললো, এই আমার চোখের দিকে তাকাওতো।

জয় ইরার চোখে চোখ রেখে হেসে ফেললো।

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে। সত্যি, সত্যি বলছো?

জয়ও ইরার দু’বাহুতে হাত রেখে কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বললো, ইরা তুমি তো জানো আমি মিথ্যা কথা বলিনা।

ইরা কেঁদে ফেললো, তুমি তুমি অন্য কাউকে নিয়ে আসতে পারলে?

অন্য কাউকে মানে? আমি কি তোমাকে বলেছি আমি অন্য কাউকে নিয়ে এসেছি?

তো?

তোমাকে নিয়ে এসেছি, তুমিই তো আমার গার্লফ্রেন্ড, আমার ভালোবাসা, তুমিই আমার সব। তোমাকে ছাড়া কি এখানে একা আসা যায়, বলো।

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিলো। ইরা হেসে ফেললো, কী অসাধারণ সেই হাসি, যেনো আষাঢ়ে বৃষ্টির পর হঠাৎ এক চিলতে রোদ।

ইরা সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলো জয়ের জন্মদিন পালন করবে বারো শিবালয়ে। জয় তো শুনে অবাক, এখানে জন্মদিন পালন করবে? কাকে কাকে ইনভাইট করবে এখানে আসতে?

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কাকে কাকে মানে?

জয় থতমত খেয়ে গেলো, জন্মদিনে কাউকে ইনভাইট করবে না?

ইরা কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, তোমার কি অনেক গেস্ট দরকার?

জয় ইরার কথা বুঝতে পারলো না, তুমি কীভাবে জন্মদিন পালন করতে চাচ্ছো বলোতো?

আমি চাই তোমার জন্মদিন পালন করবো শুধু আমরা দু’জন, তুমি আর আমি।

ওকে কিন’ এটা হবে একটা এক্সেপশনাল ঘটনা।

আমাদের সবকিছুই তো এক্সেপশনাল, তাই না?

ঠিক বলেছো।

তাতে অবশ্য তোমার বন্ধু-ভক্তরা তোমাকে খুব মিস করবে, বলে ইরা আমার দুই কাঁধে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে জয়ের চোখে চোখ রেখে বললো, তুমিও তাদের কম মিস করবে না বাছাধন, আহারে, চুক, চুক, চুক।

জয় ইরাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললো, মোটেই না।

না মানে আমি গত বছরের তোমার জন্মদিনে ফেসবুকের টাইমলাইনে দেখেছি। আর তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার জন্মদিনে তুমি শুধু আমার থাকবে। কেউ যেনো তোমার জন্মদিন উইশ করতে না পারে। শুধু কি টাইমলাইন, তোমার ফোনে যে সেদিন কত ম্যাসেজ এসেছে আর কতজন ফোনে উইশ করেছে।

করলো তাতে সমস্যা কী? কেউ আমার জন্মদিনে উইশ করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

না, মহাভারত অশুদ্ধ হবে না কিন’ তোমার হৃদয়ে তো একটু ঝড় উঠতেই পারে। আমিইবা কেনো সেটুকুই মেনে নিবো। তুমি আমাকে দেখো, তুমি ছাড়া আমার একজন বন্ধু আছে? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

জয় চুপ করে ছিলো।

ইরা আবার বললো, চুপ করে আছো কেনো? বলো?

জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

আর তোমার হাজার হাজার বন্ধু-ভক্ত আছে, আছে না।

জয় সুবোধ বালকের মতো হাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

ইরা প্রচণ্ড রেগে গেলো, মানে, আছে?

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, তুমি যখন বললে তো আছে, তোমার কথার বিরুদ্ধে আমি কথা বলবো সে সাহস কি আমার আছে?

আছে, আছে, তুমি মিচকি শয়তান। তোমার হাজার হাজার বন্ধু আছে, ভক্ত আছে। এবার তোমার জন্মদিনে সেসব বন্ধু-বন্ধুনীদের আমি ছেঁটে দিবো কথার শেষের দিকে ইরা মুখ বিকৃত করলো।

ইরার সাথে জয় এমনভাবে কথা বলছিলো যেনো সে টিচার জয় খুব অবিডিয়েন্ট স্টুডেন্ট। এবার জয় মুখ তুলে একটা সরল হাসি হেসে বললো, বন্ধুনী শব্দটার অর্থ বুঝলাম না।

ওটা আমার আবিষ্কার, শুধু বন্ধুনী না আরও কত কি আবিষ্কার করবো আমি, পুরাতনকে নতুনভাবে সাজানোর নামই তো প্রেম।

প্রেমের এই সংজ্ঞাটাও কি তোমার আবিষ্কার?

জি মহাশয়। আরও অনেক আবিষ্কার আছে। এবার জন্মদিনে আমি তোমার জন্য যে কত কি করবো, আমার মহাপরিকল্পনা আছে।

তোমার সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা আমাকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, তাই না?

এই তো বুঝেছো। তুমি ট্যালেন্ট আছো নইলে এতোগুলো বই লিখলে কীভাবে। সেদিন সকালবেলা আমি আসবো, সারাদিন তোমার সাথে থাকবো। একসাথে খাবো, ঘুরবো, খুব মজা করবো।

সেদিন তোমার স্কুল নেই?

আছে, ছুটি নিবো। তুমি ভেবেছো আমি স্কুলে যাবো আর তুমি সবাইকে নিয়ে হৈ চৈ করে জন্মদিন পালন করবে, ওতোটা বোকা ইরা না। সেদিন তোমার নামটাও পাল্টে দিবো।

জয় কৃত্রিম আতংকের সুরে বললো, নামটাও পাল্টে দিবে, ভেড়া কিংবা কুত্তার নামে নাম রাখবে নিশ্চয়ই।

ইরা হো হো করে হেসে ফেললো। তারপর আঙ্গুলে মাস হিসেব করে বললো, এখনো কতদিন বাকি…

 

বাইশ

 

পহেলা বৈশাখ আসতে এখনো প্রায় পনেরো দিন বাকি। ইরা এখনই শুরু করেছে পহেলা বৈশাখ তার বাড়ি যেতে কিন’ জয় বার বারই না করেছিলো। একদিন বিকেলে ইরা জয়কে না জানিয়ে চলে এলো জয়পুরহাট, এই তুমি কোথায়?

জয়পুরহাট।

সেতো জানি। জয়পুরহাট কোথায়?

অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম।

আজ না তোমার অফিস বন্ধ।

হুঁম।

আচ্ছা আগে ক্যাটস পো চলে এসো।

কেনো? তুমি কোথায়?

আমি ক্যাটস পো’তে আসতে বলেছি, আসবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবে আর যদি বেশি সময় লাগে তবে বুঝবো তুমি মিথ্যা কথা বলেছো।

আর যদি জোরে মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট হয়।

কথাটা শুনেই ইরা আঁৎকে উঠলো, এই সবসময় এমন করে কথা বলো কেনো? আমার বুঝি কষ্ট হয় না। তুমি সাবধানে এসো, একটু তাড়াতাড়ি এসো।

ওকে আসছি।

 

খঞ্জণপুর থেকে ক্যাটস পো’র দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। পথটুকু মোটর সাইকেলে যেতে যেতে ইরা তিনবার ফোন দিয়েছে। জয় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই ইরার চোখ-মুখ রেগে লাল হয়ে গেছে, চোখে পানি ছলছল করছে, এতো দেরি হলো কেনো?

জয় একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, সাত মিনিটে এসেছি।

আচ্ছা থাক, আর ঘড়ি দেখতে হবে না, আগে তোমার জন্য বৈশাখী পাঞ্জাবি কিনতে হবে। তুমি আসতে আসতে আমি কয়েকটা পাঞ্জাবি দেখে রেখেছি, বলে ইরা জয়কে হাত ধরে আয়নার কাছে নিয়ে গেলো। তারপর জয়ের গায়ে একে একে কয়েকটা পাঞ্জাবি মেলে ধরে আয়নায় দেখে বললো, দেখোতো কোনটা ভালো মানাচ্ছে?

ওকে, তার আগে আমি একটু আসছি, বলে জয় কাউন্টারের কাছে গিয়ে কাউন্টার থেকে ইরার জন্য কেনা শাড়িটা এনে ইরার হাতে দিয়ে বললো, এটার সঙ্গে মিলিয়ে কিনতে হবে।

ইরা শাড়ির প্যাকেট খুলতে খুলতে একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, তুমি জানতে নাকি আমি আসবো?

হ্যাঁ। আমি জানতাম এতবড় একটা উৎসবে তুমি আমাকে কিছু কিনে দিবে না এমনতো কখনো হয়নি। এবারো হবে না। তাই লাঞ্চ করতে এসে শাড়িটা কিনে রেখে গেছি।

ইরা জয়ের কানের কাছে মুখ এনে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো! তুমি আমার মনের ভাষা বোঝো সেজন্য আমি যা ভাবি তুমি তার আগেই তা করে ফেলো।

ইরা জয়ের গায়ের ওপর পাঞ্জাবি মেলে ধরলো জয়ও ইরার গায়ের ওপর শাড়িটা মেলে ধরে মিলিয়ে নিলো।

ওয়াও, খুব সুন্দর হবে। পহেলা বৈশাখে তুমি পাঞ্জাবিটা পরে আর আমি এ শাড়িটা পরে ছবি তুলবো, ওকে?

ওকে।

 

ক্যাটস পো থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইরা বললো, আজও তুমি জিতলে, তুমি কি কোনোদিন আমাকে জিততে দিবে না। তুমি কি আগেই ভেবে রেখেছিলে আর আমাকে বলছিলে যাবো না, যাবো না।

জয় একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, চলো।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, কোথায়?

আমি যেখানে নিয়ে যাবো।

ইরা জয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে তার কানে বললো, ইসস.,. সত্যি সত্যি তোমার সাথে যদি যেতে পারতাম!

যদি বলছো কেনো? চলে এসো।

সিরিয়াসলি বলছো তো। ভেবে দেখো, চলে এলে যেনো ফিরিয়ে না দাও।

কথা বলতে বলতে দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো।

জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো। ইরা জয়ের কাঁধে হাত রেখে মোটর সাইকেলে উঠলো।

 

কয়েকমিনিটের মধ্যে দু’জনে উর্বী নার্সারিতে পৌঁছালো। ইরা মোটর সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেনো?

জয় বললো, বলোতো আমি তোমাকে কেনো এখানে নিয়ে এলাম?

জানি কিন’ বলবো না।

বলবে না, নাকি তুমি পারবে না।

পারবো কিন’ বলবো না। এই দেখো আমি লিখে রাখছি তুমি দেখো ঠিক মিলে যাবে, বলে ইরা জয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাড বের করে লিখে আবার প্যাডটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।

দু’জনে নার্সারিতে ঢুকতেই একজন মালী এগিয়ে এলো, স্যার কী গাছ নিবেন?

জয় বললো, কৃঞ্চচূড়া।

ইরা বললো, আর রাধা চূড়া?

আগে দেখে গেছি, রাধা চূড়া নেই।

তুমি ভালোভাবে খোঁজোনি?

খুঁজেছি, পুরো জয়পুরহাট খুঁজেছি কিন’ কোথাও নেই। আমি তোমাকে দিনাজপুর থেকে এনে দিবো, ওকে। তুমি কিন’ কিছু মনে করও না প্লিজ!

এনো কিন’, একটা কথা মনে রেখো রাধা চূড়া-কৃঞ্চ চূড়া একসাথে না থাকলে রিলেশন পুরিপূরক হয় না। যেমন গোলাপ আর রজনীগন্ধা একে অপরের পরিপূরক, তুমি আর আমি একে অপরের পরিপূরক তেমনি রাধা চূড়া-কৃঞ্চ চূড়া একে অপরের পরিপূরক।

আমি তোমাকে অবশ্যই এনে দিবো ইরা।

এখন দেখবে আমি কী লিখে রেখেছিলাম, বলে ইরা প্যাডের পাতা বের করলো। সেখানে লেখা আছে, তুমি রাধা চূড়া-কৃঞ্চ চূড়া গাছ কিনে দিবে বলে আমাকে এনেছো।

জয় অবাক হলো। আবেগজড়িত কণ্ঠে ইরাকে বললো, ইরা আমাদের পছন্দ, আকাংখা সব মিলে যাচ্ছে কী করে?

আমাদের আত্মা এক হয়ে গেছে জয়। আমরা একজনকে ছাড়া অন্যজন বাঁচবো না।

ঠিক বলেছো।

 

তেইশ

 

আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। ইরার প্রস’তি শুরু হয়েছে আরও কয়েকদিন আগে থেকে। স্কুল বন্ধ থাকলে ইরা প্রায়ই দুপুরে একটু বিশ্রাম নেয় কিন’ আজ দুপুরে বাসার কাপড়-চোপড়, বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার সব ধুয়ে দিয়েছে। পুরো বাসা বার বার ঘুরে দেখছে কোথাও কোনো ময়লা লেগে আছে নাকি। সবকিছু দেখে ইরা ড্রয়িং রুমে এলো। সেই জলচৌকি! জয় এলেই যে জলচৌকির ওপর আধশোয়া হয়ে টি.ভি দেখে সেই জলচৌকির বিছানার চাদর বালিশের কভার একবার উল্টেপাল্টে দেখলো। তারপর ধোয়ার জন্য তুলে নিতেই মতি বললো, এটা তো ময়লা হয়নি, সেদিনই ধুয়ে দিলে।

হোক, কাল নববর্ষ, নববর্ষের দিনে সবকিছু ধুয়ে দিতে হয়।

এতো ধুমধাম শুরু করেছো কেনো? নববর্ষ তো প্রতিবারই আসে কিন’ এবার যে একেবারে মহাপ্রস’তি শুরু করলে। বিশেষ কেউ আসবে নাকি? মতি তীর্ষক দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু’কুঁচকে বললো।

বিশেষ কেউ মানে? একজন লেখক বিশেষ কেউ না?

হুঁম, যা ছাইপাস লিখে!

কী বললে? তুমি উনার লেখা পড়েছো? ক’টা বই লিখেছেন জানো?

জানি না, আমার জানার দরকারও নেই।

জানার দরকার থাকবে না তো। উনার লেখা খুব ভালো, সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে সমকালীন লেখা লিখেন। আর উনি ক’টা বই লিখেছেন জানো? আঠারোটা।

লেখা ভালো হলে তো এতোদিনে সবার মুখে মুখে থাকতেন।

লেখা ভালো হলেই সবার মুখে মুখে থাকবেন এমন কথা না। অনেক কবি-লেখক আছেন যারা সবার মুখে মুখে নেই কিন’ ভালো লিখেছেন। বিখ্যাৎ হওয়াটা বাণিজ্যিক। ইঞ্জিনিয়ার মানুষ কবি-লেখকদের সাথে আড্ডা দেন না, পত্রিকা অফিসে কিংবা টি.ভি চ্যানেলে ঘোরাঘুরি করতে পারেন না, শুধু বই লিখে বাজারে ছেড়ে দিলে তো প্রচার হয় না, তাই খুব পরিচিতি নেই অথচ দেখো উনার চেয়ে কম এবং অনেক পঁচা বই লিখেও অনেককে সবাই চিনে। তুমি দেখো উনিও একদিন অনেক বড় লেখক হবেন।

মতি তিরস্কারের সুরে বললো, সেজন্য তো তোমার অনুরোধে ফোন করে ইনভাইট করলাম। হাজার হলেও একজন স্বনামধন্য লেখক আমার বাড়িতে পদধুলি দিবে এটা তো কম কথা না।

অন্যসময় হলে ইরা মতির কথার উপযুক্ত জবাব দিতো কিন’ ইরা জানে জয়কে নববর্ষে দাওয়াত দেয়াতে মতি খুশি হতে পারেনি, ইরা একরকম জোর করে মতিকে দিয়ে জয়কে আসতে বলেছে। তাই ইরা মতির সঙ্গে তর্কে না গিয়ে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলো, অনেক খুশি হয়েছি জনাব, ধন্যবাদ। এখন বাজার যাও, লিস্ট করে রেখেছি, এই টাকা নাও, আমার ফ্রেন্ড আসবে তুমি আবার তোমার টাকা খরচ করে বাজার করবে কেনো, বলে ইরা টাকা, বাজারের লিস্ট আর ব্যাগ মতির হাতে দিয়ে বললো, যাও, আমি আবার বাগানে পানি দিবো। তুমি তো দিবে না। বাগানের সব গাছ মরে গেলেও একবার পানি দিবে না।

আচ্ছা ব্যাগ দাও। আমি বাজার থেকে আসি।

 

ইরা বাজারের ব্যাগ মতির হাতে দিয়ে বালতিতে করে পানি এনে বাগানে দিতে লাগলো। বাগানের প্রত্যেকটা গাছের সঙ্গে তার আর জয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। গাছগুলোর জন্য ইরার কত মায়া, কত আদর-যত্ন, এই গাছগুলো যেনো ইরার প্রাণ। গাছ থেকে একটা পাতা ঝরে পড়লে যেনো ইরার বুকটা আঁৎকে উঠে, এই বুঝি আমার জয় কষ্ট পেলো।

এইতো ক’দিন আগের কথা একদিন বাগানের বেড়া ভেঙ্গে একটা গরু ঢুকে বাগানের কয়েকটা গাছের ডাল ভেঙ্গে ফেলেছিলো, বাগানের গাছগুলো এলোমেলো করে ফেলেছিলো। স্কুল থেকে এসে তার বাগানের এই অবস’া দেখে ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মতি স্কুল থেকে এসে ইরার কান্না দেখে ভেবেছিলো হয়তো কারও মৃত্যু সংবাদ এসেছে, খুব আপন কারও।

কী হয়েছে ইরা? কেউ ফোন করেছিলো? কোনো দুর্ঘটনা? কোনো দুঃসংবাদ? কথাগুলো মতি খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।

না, কোনো দুঃসংবাদ নয়। সুসংবাদ। আমার গাছগুলো তো তোমার শত্রু তাই কতদিন থেকে বলছি বাগানটাতে একটু ভালো করে, মজবুত করে বেড়া দেয়ার ব্যবস’া করো, বেড়া দেয়ার ব্যবস’া করো। গরু-ছাগল ঢুকে সব নষ্ট করে দিবে।

মতির সহানুভূতি দেখানো উচিৎ ছিলো কিন’ তা না করে সে বরং একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বললো, দু’য়েকটা ডাল ভেঙ্গেছে হয়তো তাতেই এতো কান্না।

তোমার কাছে সামান্য দু’য়েকটা ডাল ভেঙ্গেছে কিন’ আমার কাছে অনেক, গাছের ডাল না আমার হৃদয় ভেঙ্গেছে। আমি একটা একটা করে গাছ কত যত্ন করে লালন করছি আর তুমি…

শুধু কি যত্ন করে লালন করছো নাকি আরও বেশি কিছু।

টিজ করছো, না?

না, টিজ করবো কেনো?

কাল আমি টাকা দিবো, কত টাকা লাগবে বাগানে কাঁটাতারের বেড়া দিতে আমি দিবো। তোমাকে বাড়ি করার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দিচ্ছি আর সামান্য কাঁটাতারের বেড়ার জন্য কয়েক হাজার টাকা দিতে পারবো না। কালই বেড়া দিতে হবে, আমি স্কুল যাওয়ার সময় তোমাকে চেক লিখে দিয়ে যাবো তুমি কাঁটাতার কিনে আনবে পরশুদিন সকালে বেড়া দিবে।

মতি কিছুটা রেগে গেলো, কাল আমার স্কুল নেই?

ইরাও রাগান্বিত স্বরে বললো, ও, তাইতো, কাল তো তোমার স্কুল আছে। কাল কালাই যাওয়া যাবে না। তাইতো। এমনিতে তো প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে কালাই যাও আর আমি যেতে বললে যাওয়া যাবে না, তাই না। ওকে আমি নিজেই যাবো।

পরদিন ইরা নিজেই কালাই থেকে কাঁটাতার কিনে আনলো তারপর দিন বেড়া দিলো।

বাগানে পানি দিতে দিতে ইরার কানে মোবাইল ফোনের রিং ভেসে আসলো।

মোবাইল ফোনটা বারান্দায় রেখে ইরা বাগানে পানি দিচ্ছিলো। সে দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো জয়।

হ্যালো ইরা একটা নতুন প্রবলেম দেখা দিয়েছে।

ইরা কিছু শোনার আগেই অগ্নিষ্ফুর্লিংয়ের মতো জ্বলে উঠলো, প্রবলেম দেখা তো দিবেই। আমি আসতে বলেছি, আর তুমি অন্য কাউকে সিডিউল দিয়ে রেখেছো এখন সেই সিডিউল পূরণ করার জন্য একটা ছুঁতো বের করতে হবে এবং করেছো, এই তো।

ইরা রেগে যাচ্ছো কেনো? আগে শুনবে তো প্রবলেমটা কী?

আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি যাই-ই বলো না কেনো তোমার শেষটা হলো তুমি আসতে পারবে না, এই তো?

না, তা না।

তো? বলে ইরা কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো তার রাগান্বিত মুখের ওপর থেকে কালো মেঘ সরে গেলো। তারপর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললো, ওয়াও, খুব ভালো তো। চলে এসো।

কিন’ আমি ইজি ফিল করবো না।

কেনো?

কাজটা কেমন হচ্ছে না?

না, কাজটা খারাপ হবে না। আমরা সবাই মিলে দিনটাকে এনজয় করবো।

এখন পজিটিভলি নিচ্ছো আর শোনার আগে কীভাবে তুমি চটকে উঠলে।

সরি জয়। এক্সটিমলি সরি। তাড়াতাড়ি এসো কিন’, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। তুমি আসার পর একসাথে পান্তা-ভাত খাবো।

না তুমি খেয়ে নিও।

না, না, না। যদি সারাদিন না খেয়েও থাকি তবু একসাথে খাবো। পরে পান্তা টক হয়ে গেলে আমার দোষ দিতে পারবে না কিন’ বলে দিলাম।

ওকে দোষ দিবো না। ভালো থেকো। বাই।

 

চব্বিশ

 

সেই সকালবেলা থেকে মতির স্কুলে মাইক বাজতে শুরু করেছে। মতি সকালবেলা উঠে পান্তা খেয়ে স্কুলে চলে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, তুমিও কাজকাম গুছিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। কালাই থেকে আমার ফ্রেন্ডরা আসবে। তুমি তো জানো ওরা সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করে।

তোমার স্কুলে অনুষ্ঠান শুরু হবে কখন?

জানো না বুঝি, প্রতিবছরই তো অনুষ্ঠান হয়। তুমি এগারোটার মধ্যে চলে এসো।

আমি বুঝি যেতে পারবো না।

মতি প্রচণ্ড রেগে গেলো, ওকে এসো না।

মতির রাগকে ইরা কোনো গুরুত্বই দিলো না। কোনোদিন দেয়ও নি। সে চলে যাবার পর ইরা রান্না ঘরে গেলো কিন’ তার বার বার করে মনে হচ্ছে, এখনো আসছে না কেনো?

সে জয়কে ফোন করলো, এই তুমি কখন আসছো?

এই তো আমি স্টেশনে অপেক্ষা করছি। ট্রেন এখন ফুলবাড়ি।

তাড়াতাড়ি এসো। আমি একা তোমাকে খুব মিস করছি। তাড়াতাড়ি এসো ওকে?

ওকে।

মতি চলে যাওয়ার পর ইরা জয়ের দেয়া শাড়ি পরলো, আয়নায় ঘুরে ঘুরে কয়েকবার নিজেকে দেখলো। কয়েকমুহূর্তের জন্য সে উদাস হয়ে গেলো, যেনো এখনই তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জয়, কেমন মানাবে জয়ের পাশে আমি দাঁড়ালে? ইরা নিজেকে প্রশ্ন করলো। তারপর নিজে নিজেই বললো, সুন্দর, খুব সুন্দর মানাবে আমাদের দুজনকে, ইসস আরও আগে তোমার সাথে কেনো দেখা হলো না জয়? কেনো?

 

ইরা রান্নাঘর থেকে বারান্দায় এসে গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। প্রতিবছর সকালবেলা বিছানা থেকে উঠে হলুদ শাড়ি পরে ইরা মতির সাথে স্কুলে যেতো। স্কুল কমিটির সদস্যরা, এলাকার গন্যমাণ্য লোকেরা কালাই-জয়পুরহাট থেকে আগত মতির বন্ধুরা সবার কাছে ইরাই যেনো মধ্যমণি হয়ে থাকতো। পান্তা খাওয়া ইরা-ই দেখভাল করতো। ইরার কত আগ্রহ ছিলো এই বৈশাখী অনুষ্ঠানকে ঘিরে। এবারো আছে কিন’ সেই আনন্দ এই বৈশাখী অনুষ্ঠানকে ঘিরে না বিশেষ একজনকে ঘিরে। এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে তার মন ছুটে যায় যার কাছে, একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় শুয়ে থাকার পরও ইরার মন ছুটে যায় যার কাছে, ইরার সেই মানুষ আসছে। এই যে মতির স্কুলের শত শত ছাত্রী, স’ানীয় লোকজন, শহর থেকে আসা মতির বন্ধুরা সবাই তার কাছে মূল্যহীন। ঐ একজনই তার কাছে সব।

ইরা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের তাজমহল। এই তাজমহল, সাজ গার্ডেন আর জয়কে ঘিরেই এখন তার সব।  গতকাল ইরা অনেক যত্ন করে সাজ গার্ডেনে পানি দেয়াতে গাছগুলো যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছে? পাতা সব ঝরে গেছে কিন’ তবুও ডালপালাগুলোই খুব সতেজ আর প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। ইরা তন্ময় হয়ে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, আপনমনে বিড়বিড় করে গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। তার মনের মধ্যে অসংখ্য স্মৃতি ভিড় করছে, এক একটা গাছ তার কাছে এক একটা মধুর স্মৃতি। সেই জয় আজ আসছে শুধু গাছগুলো কি তার বন্ধুর আগমনে প্রাণবন্ত হয়েছে, ইরা কি কম আনন্দিত আজ!

এইতো কয়েক দিন আগেই জয়ের সঙ্গে ইরার দেখা হলো কিন’ ইরার কেমন যেনো মনে হচ্ছে, কতদিন থেকে জয়ের সাথে তার দেখা হয়নি। আজ দেখবে, দু’চোখ ভরে জয়কে দেখবে। ইরা জয়ের দেয়া শাড়ি পরবে আর জয় ইরার দেয়া পাঞ্জাবি পরবে। খুব সুন্দর মানাবে জয়কে।  ইরা চোখের সামনে ভেসে উঠলো জয়ের ছবি।

হঠাৎ করে একটা মোটর সাইকেল বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের অজান্তে ইরার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ওয়াও জয়।

কিন’ জয়ের মোটর সাইকেল থেকে সামিনাকে নামতে দেখে ইরার মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। ইরা মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, শুভ নববর্ষ।

জয় সামিনা দু’জনে বললো, শুভ নববর্ষ।

এসো, ভেতরে এসো। আপা আসুন।

সবাই ভেতরে ঢুকলো। বরাবরের মতো জয় ড্রয়িং রুমে সেই ছোট্ট জলচৌকিতে শুয়ে টি.ভি দেখতে শুরু করলো।

ইরা সামিনাকে হাত ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেলো।

ইরা মতিকে ফোনে ডেকে পাঠালো। কিছুক্ষণের মধ্যে মতি এলো। মতি জয়ের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, শুভ নববর্ষ।

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, শুভ নববর্ষ।

মতি ইরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ইরা সব রেডি তো।

হ্যাঁ বসো।

আসুন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।

রান্না ঘর থেকে ইরার সঙ্গে সামিনা বেরিয়ে এলো।

ইরা সামিনাকে মতির সঙ্গে পরিচয় করে দিলো, আপা…

ইরা কিছু বলার আগেই সামিনা বললো, বুঝেছি, মাস্টার সাহেব তো?

ইরা মাথা নেড়ে সায় দিতেই সামিনা শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, শুভ নববর্ষ।

শুভ নববর্ষ।

কেমন আছেন ভাই?

মতি বললো, ভালো।

ইরা বললো, বসো, খেতে খেতে কথা বলতে পারবে।

হুঁম, বসুন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। ভাবী বসুন।

ইরা বললো, লেখক সাহেব বসুন।

জয় মতির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো।

ইরা প্রথমে জয়ের প্লেটে পান্তা তুলে দিলো। তারপর একে একে ভর্তা, শাক, ইলিশ মাছসহ কত রকমের রান্না যে করেছে ইরা, জয় নিজে ওপর থেকে ঢাকনা তুললো, জয় তো দেখে অবাক, এতো রান্না? কখন করেছো এসব?

মতি কিছুটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললো, আরে ভাই ক’দিন থেকে যা শুরু করেছে।

জয় কিছুটা হালকা করার জন্য বললো, তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কেনো এতো কষ্ট করতে গেলে ম্যাডাম অযথা।

সামিনা মতির সাথে সুর মিলালো, আর লেখক সাহেবও যা শুরু করেছে, ক’দিন থেকে শুধু নববর্ষ, নববর্ষ করে অসি’র, যেনো জীবনে এবারই প্রথম বৈশাখ এলো।

ইরা বললো, ঠিক বলেছেন ভাবী এবছরের পহেলা বৈশাখটা অন্যরকম।

ইরার কথা বলার সাথে সাথে মতি আর সামিনা প্লেট থেকে মুখ তুলে ইরার মুখের দিকে তাকালো। মতি মুখ গম্ভীর করে, চোয়াল শক্ত করে বললো, কী রকম?

এই যে আমাদের বাসায় একজন লেখক আসবে। এটা তো প্রতিবার হয় না। তবে এখন থেকে প্রতিবছর হবে। তাই না লেখক সাহেব? ইরা বললো।

জয় কী বলবো বুঝতে পারলো না। আমতা আমতা করে বললো, তা হতে পারে।

ইরা যেনো জ্বলে উঠলো, হতে পারে মানে?

ইরার প্রশ্নের উত্তর দিলো সামিনা, হতে পারে মানে অবশ্যই হবে। এবার লেখকও প্রথম ভক্ত পেয়েছে। লেখক-ভক্ত সম্পর্ক যে এতো গভীর হয় তা এবারই প্রথম জানলাম।

জয় মৃদু হেসে বললো, তা জানবে কী করে আমি তো আর বড় লেখক না। যদি বড় লেখক হতে পারতাম তবে দেখতে, এখন থেকে দেখবে।

ইরা চমকে উঠলো, এখন থেকে দেখবে মানে?

দেখবে মানে একজন লেখকের কি একজন ভক্ত থাকে নাকি? অনেক ভক্ত থাকে। বলে মতি খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে গেলো।

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো।

মতি হাত ধুয়ে বাইরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, ইরা তুমি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আর ভাবীকে নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।

জয় খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বললো, ইরা তুমিও খেয়ে নাও, চলো একসঙ্গে যাই সবাই।

ইরা ফুলকির মতো জ্বলে উঠলো, না তোমাকে যেতে হবে না অনুষ্ঠানে। এখানে তিনজনে বসে আমরা গল্প করবো। তিনজনে বেলকনিতে বসে স্কুলের অনুষ্ঠান দেখবো ।

ইরার মুখে জয়কে আগেও তুমি সম্বোধন করতে শুনেছে সামিনা কিন’ খেয়াল করেনি। এবার তুমি সম্বোধন শুনে সামিনা যেনো আঁৎকে উঠলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, কেনো আপা?

ইরা একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, ওখানে আবার কোনো ভক্ত জুটাবে।

জয় হা হা করে হেসে উঠলো, না, না আমার আর ভক্ত লাগবে না। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হও ইরা। চলো সবাই একসঙ্গে যাবো।

 

পঁচিশ

 

মতি ইরাকে ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো।

মতি কিছুটা ঝাঁঝালো গলায় বললো, তোমরা আসবে না?

হ্যাঁ আসবো তো।

তোমাকে কয়েকবার ফোন করলাম।

ফোনটা রুমে, চার্জে দিয়েছিলাম।

তাই বলে ফোন ধরবে না।

বেলকনিতে বসে আপার সঙ্গে গল্প করছিলাম।

মতি অভিমানের সুরে বললো, হুঁম, আজ গল্পই করো এখনে আর আসতে হবে না।

কেনো?

প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান তো শেষ। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে তিনটায়।

ইরা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, তাহলে তুমিও বাসায় এসো বিকেলে একবারে যাবো।

মতি কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলো।

ইরা জানে মতি রেগে গেলে ফোনে রাগ দেখানোর এটাই তার প্রতিক্রিয়া। কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিবে। ইরার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিলো, মতি কি সামিনার সঙ্গে কথা বলার জন্য রেগে গেছে নাকি জয় এসেছে বলে সন্দেহ করছে। জয় আসার কথা শোনার পর থেকে মতি ইশারা-ইঙ্গিতে বিভিন্নভাবে তার বিরক্তি ও অনিচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে কিন’ সন্দেহ কী।

না এই সন্দেহ দূর করার জন্যই তো সামিনাকে দিনাজপুর থেকে আনা হলো, কত পরিকল্পনা করা হলো। তারপরও কি মতি সন্দেহ করবে?

 

দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমে শুরু হলো স্কুলের ছাত্রীদের অংশ গ্রহণে সকালবেলা অনুষ্ঠিত ক্রীড়ায় বিজয়ী ছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এই পুরস্কারের মধ্যে জয়ের কিছু বইও আছে আর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা হয়েছে জয়কে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে ইরা।

ইরা বলতে শুরু করলো, সম্মানিত সুধী আজকের এই পহেলা বৈশাখের বর্ণিল অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম, শুভ নববর্ষ।

অনুষ্ঠানের সবাই সমস্বরে বললো, শুভ নববর্ষ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে জয় এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব মো: জয়নাল আবেদিনকে সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।

জয়নাল সাহেব হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন।

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, সম্মানিত সুধীগণ আজ আমাদের মাঝে উপসি’ত আছেন আমাদের স্কুলের একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজের দক্ষ ও অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার এবং স্বনামধন্য লেখক জনাব জয় রহমান। আমি এখন ইঞ্জিনিয়ার ও লেখক জয় রহমানকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।

জয় মঞ্চে উঠে উপসি’ত জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসন গ্রহণ করলো।

জয়ের পর একে একে অন্যান্য সম্মানিত অতিথিগণ আসন গ্রহণ করলেন।

অনুষ্ঠান শুরু হলো।

প্রতিটি পুরস্কার প্রদানের সময় ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে। ইরার একজন ছাত্রীও ছবি তুলছে একবার ইরা ইশারা করে তার সেই ছাত্রীকে কাছে ডেকে নিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বললো, এই রিতু আমি যখন লেখকের পাশে থাকবো তখন আমার ছবি তুলবা তো। একটা না, অনেকগুলো। সেখান থেকে ভালো ভালো কয়েকটা ছবি যেনো বাঁধাই করে রাখা যায়।

রিতু একটা স্নিগ্ধ হাসি হেসে মাথা কাত করে সায় দিলো।

ইরা অনুষ্ঠান উপস’াপনার সময় বার বার জয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তার উপস’াপনায় প্রসঙ্গক্রমে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গ তৈরি করে বার বার জয়ের নাম টেনে আনছে।

জয় যখন কোনো বিজয়ীকে পুরস্কার প্রদান করছে ইরা তখন ইচ্ছা করেই জয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিষয়টা যেনো অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিলো। কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি যেনো ইরার দিকে বার বার প্রশ্ন ছুঁড়ে মারছে কিন’ ইরার সেদিকে খেয়াল নেই। আজ তার জীবনের যেনো এক বিশেষ দিন। জয় রহমান, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ লেখক, তার প্রেম তার কাছে এসেছে।

মতি একবার জয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করলো।

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ইরা একবার জয়কে বললো, এই যে লেখক সাহেব একটু আসবেন এদিকে প্লিজ!

জয় কিছুটা অপ্রস’ত হয়ে গেলো।

এবার ইরা একটু জোরে বললো, আসুন না প্লিজ আপনার সাথে ছবি তুলবো।

জয় তার চেয়ার থেকে উঠে ইরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

রিতু পর পর কয়েকটা ছবি তুললো।

অনুষ্ঠান শেষ হলো। সবাই মঞ্চ থেকে নামলো। ইরা আর সামিনা পাশাপাশি হাঁটছে জয় আর মতি একটু পেছনে পেছনে। বাসার কাছে এসে ইরা মতিকে বললো, তুমি একটু বাজার যাও তো হঠাৎ করে চিনি শেষ হয়ে গেলো। এক কেজি চিনি নিয়ে এসো।

মতি বাজারের দিকে চলে গেলো।

 

ইরা বাসার তালা খুলে বাসায় ঢুকতেই সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো। রান্না ঘর থেকে নাস্তা এনে টেবিলে সাজাতে লাগলো।

সামিনা জিজ্ঞেস করলো, আবার কী করছেন আপা?

কেনো? নাস্তা খাবেন না?

আবার?

হুঁম। সেজন্য তো মাস্টারকে চিনি আনতে পাঠালাম।

এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠলো, মতি এলো চিনি নিয়ে।

আমি খুলে দিচ্ছি আপা, বলে সামিনা গেট খুলে দিতে গেলো।

ইরা আবেগপ্রবণ কণ্ঠে ফিসফিস করে জয়কে বললো, আজ আমার জীবন ধন্য জয়। এতোদিন আমরা একা একা গোপনে ছবি তুলতাম, আজ মঞ্চে শত শত মানুষের উপসি’তিতে ছবি তুলে সবাইকে জানিয়ে দিলাম, জয়, তুমি শুধু আমার! জয়!

জয়ও চাপা স্বরে উত্তর দিলো, কাজটা কি ভালো হলো? সবার চোখের দিকে একবার তাকিয়েছো, সবার চোখে কত প্রশ্ন ছিলো।

থাক, যত প্রশ্নই থাক আমি আর কিছু ভয় পাই না। ভালোবাসায় ভয় থাকতে নেই, বুঝলে।

জয় একটা সরল হাসি হেসে ইরার কথায় সায় দিলো।

সামিনা আর মতি ড্রয়িং রুমে ঢুকলো।

নাস্তা শেষে ইরা, মতিসহ জয় আর সামিনাকে থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করলো কিন’ সামিনা রাজি হলো না।

অবেশেষ বিদায়ের সুর বেজে উঠলো।

 

কয়েকদিন থেকে ইরা খুব আনন্দেই ছিলো। এবার পহেলা বৈশাখ তার জীবনে বয়ে নিয়ে আসবে এক বিশেষ দিন। জয় এলো, ইরা অনেক খুশি হলো। সত্যি সত্যি ইরা যেভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে চেয়েছিলো সেভাবেই তো সব হলো কিন’ তারপরও জয়কে বিদায় দিতে গিয়ে ইরার দু’চোখ পানিতে ভরে গেলো। ইরা জয়ের কাছাকাছি এসে সিক্ত কণ্ঠে বললো, চলে যাবে!

জয়ের দু’চোখ পানিতে ভরে গেলো কিন’ কোনো কথা বের হলো না।

সামিনা একবার জয়ের দিকে আর একবার ইরার দিকে তাকালো, তার ভ্রু’কুঞ্চিত হলো, চোয়াল শক্ত হলো কিন’ সে কিছু বললো না।

জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো, মতির দিকে তাকিয়ে বললো, মাস্টার সাহেব আসি। তারপর ইরার দিকে তাকিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, ইরা…

জয় আর কোনো কথা বলতে পারলো না।

সামিনা মোটর সাইকেলে উঠে জয়ের কাঁধে হাত রাখতেই ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার মনের মধ্যে তখন ঝড় বইছে, কেনো চলে যাচ্ছো জয়? কেনো? তুমি শুধু আমার, তুমি নিজেই বলেছো তুমি শুধু আমার। আমিও বলেছি আমি শুধু তোমার। আমরা দু’জনে দু’জনার কিন’ কেনো? সমাজটা এমন কেনো? কেনো তুমি আরেকজনের সঙ্গে চলে যাবে আর আমি কেনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে মতির সঙ্গে থাকবো? জয়, আমার জয়!

সামিনা হাত তুলে বিদায় জানালো, আসি ভাই, আপা আসি রে।

ইরা কোনো কথা বলতে পারলো না। হাত তুলে বিদায় জানালো।

 

ছাব্বিশ

 

ইরার দাম্পত্য জীবন কখনোই সুখের ছিলো না। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ এমনকি মতির সাথেও কোনো না কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য লেগেই থাকতো। ইরা রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যেতো। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতো, শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু মানিয়ে চলতে হয় মা। বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়িকে বাবা-মা আর দেবর-ননদকে ভাইবোন মনে করতে হয়। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য সব সংসারেই আছে, তাই বলে কি কেউ সংসার ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে আসে। চল মা কাল বিকেলে তোকে আমি নিজে গিয়ে রেখে আসবো।

মা অনেক রাত পর্যন্ত ইরাকে বুঝাতো, মেয়েদের জীবন খুব কঠিন মা। আসলে তুই যেভাবে ভাবিস এভাবে ভাবলে চলে না। মেয়েদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চলতে হয়। সবাইকে ম্যানেজ করে চলতে হয়। কানে তুলা দিয়ে থাকবি। কে কী বলে বলুক তুই কিছু বলবি না। এটাই সমাজের নিয়ম। তাছাড়া এখন তোর একটা ছেলে হয়েছে, অন্তত: ছেলেটার মুখের দিকে একবার তাকা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মেনে নেয় মা।

ইরা প্রতিবাদ করে, না মা আমি এতোকিছু মেনে চলতে পারবো না। আমি সমাজের এসব পক্ষপাতমূলক নিয়ম মেনে চলতে পারবো না। মেয়েদের মাথা নিচু করে সারাজীবন কাটাতে হবে কেনো? দুনিয়া এখনো সেই চৌদ্দ’শ বছর আগে দাঁড়িয়ে নেই। এখন মেয়েরা অনেক শিক্ষিত হয়েছে, স্বনির্ভর হয়েছে, তারপরও এসব শাসন-শোষণের কি কোনো পরিবর্তন নেই?

না মা নেই। মেয়েদের জন্য সমাজের অবস’া আগে যা ছিলো এখনো তাই আছে। শুধু শাসন-শোষণের ধরণ পাল্টেছে। তোকে একটা কথা বলে রাখি মা। সচেতন, প্রতিবাদী, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষেরা কখনো সুখী হতে পারে না। যারা এসব ভাবে তারা শুধু কষ্টই পায়। আর যারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অচেতন, সবকিছু মেনে মুখ বুজে সয়ে যায়, নিজেদের মান-সম্মানের কথা ভাবে না তারাই সুখী হয়।

আমার সেরকম সুখ লাগবে না মা।

মা শাসনের সুরে বলে, বেশি কথা বলিস না, তোর বাবা জামাই’র সঙ্গে কথা বলেছে, বিয়াই-বিয়ানীর সঙ্গে কথা বলেছে। কাল বিকেলে তোর বাবা নিজে গিয়ে তোকে রেখে আসবে।

 

মতির হাত ধরে ইরার চলে যাওয়াটা পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ-ই মেনে নেয়নি। তারপরও সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ইরার বাবা-মা কিছুটা সুর নরম করেছিলো কিন’ ইরার ভাইবোনেরা তার চলে যাওয়ায় তাকে সবসময় খোঁচা মেরে কথা বলতো।

ইরার বড় বোন রিচি ইরা বাবার বাড়িতে গেলে বৈমাত্রেয় বোনের মতো আচরণ করতো। ইরার বাবা-মা যখন তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা করতো রিচি তখন বলতো, কেনো গেলি? বাবা-মা ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে? আবার কেনো শেয়ালের মুখ লেজের দিকে?

ইরা বড় বোনের মুখের ওপর কথা বলতো না। আর সে সুযোগে রিচি ইরাকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলতো, সেজন্য বাবা আমি ওসব প্রেম ভালোবাসার মধ্যে নেই। প্রয়োজনে একা থাকবো কিন’ বাবা-মা’র মান-সম্মান ডুবিয়ে কারও হাত ধরে পালাবো না। আরে বাবা যাবি তো যা আবার এদিকে কেনো? তোর লজ্জা হয় না যে বাবা-মা’র মান-সম্মান ডুবিয়ে স্বামীর হাত ধরে চলে গেলি আবার সেই স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাবার কাছে ফিরে আসতে?

ইরা কোথায় যাবে জায়গা খুঁজে পায় না। এতো বড় একটা পৃথিবীতে তার কি কোথাও মাথা গোঁজার একটু জায়গা নেই। সে আবার বাবার হাত ধরে মতির ঘরেই ফিরে আসে।

এভাবে পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে পঁচিশ বার তো বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে। ঘটনাটা শুধু বাবা-মা ভাইবোন পর্যন্ত সীমিত ছিলো না। পাড়া-পড়শি পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইরার দাম্পত্য অশান্তির কথা কম-বেশি সকলেরই জানা।

ইরা শুভ’র মুখের দিকে তাকিয়েইছিলো। শুভ বড় হলো, সে এখন গ্রাজুশেয়ন করছে। আর ক’দিন পরে ঈদ, শুভ আসছে, বাড়িতে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে ঠিকই, ইরা-ই অন্যান্য বছরের মতো সব কাজ করছে কিন’ তার মনে কোনো আনন্দ নেই। এরকম যান্ত্রিকভাবে শুধু দায়িত্ব পালন করছে।

ইরার মনটা জয়ের জন্য হাহাকার করছে। বছরের সবচেয়ে আনন্দময় দিনটা ইরা জয়কে ছেড়ে পালন করবে! ইরার কাছে ঈদকে যেনো আনন্দময় দিন মনেই হবে না।

সেদিন ঈদ বোনাসের টাকা তুলে ইরা জয়কে ফোন করবে ঠিক এমনসময় জয়ের ফোন এলো, হ্যালো ইরা।

হ্যালো।

তুমি কবে আসছো?

যেদিন তুমি নিয়ে যাবে।

মানে? জয় চমকে উঠলো।

হুঁম। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না? আমাকে ছাড়া তুমি ঈদ করতে পারবে?

সেজন্যই তো ফোন করেছি।

সত্যিই। আমি কিন’ একবারে তোমার কাছে চলে যাবো। তোমাকে ছেড়ে আমি ঈদের আনন্দই পাবো না।

জয় খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, আচ্ছা এসো।

মনে রেখো কিন’ তুমি আসতে বলেছো। এখন তোমাকে একটা কথা বলবো?

বলো, এতো ফরমালিটিজ করছো কেনো?

তুমি যে কারণে আমাকে ফোন করেছো ঠিক একই কারণে আমিও তোমাকে ফোন করবো বলে মোবাইল ফোন হাতে নিয়েছি, ইরা বললো।

তুমি আগেই বুঝতে পেরেছো?

পেরেছি জনাব, পেরেছি। আচ্ছা একটা কাজ করি। তুমি কী জন্য ফোন করেছো সেটা লিখে তোমাকে মেইল করছি আর আমি কেনো ফোন করেছি সেটা লিখে তুমি আমাকে মেইল করো, ওকে?

দু’জনে ফোন রেখে একজন আরেকজনকে মেইল করলো। তারপর ইরা আগে ফোন করলো, মেইল চেক করেছো?

হ্যাঁ।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, ঠিক বলেছি?

জয় বললো, হার্ন্ডেট পার্সেন্ট ঠিক বলেছো, আমি তোমাকে ঈদের শপিং করার জন্য আসতে বলবো বলে ফোন করেছিলাম। তুমি আমার মেইল চেক করেছো?

হ্যাঁ, তুমিও ঠিক বলেছো ইরা। আসলে আমাদের দু’জনের দেহ আলাদা কিন’ আত্মা এক হয়ে গেছে।

ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো, জয়, জয়, এটা কীভাবে সম্ভব আমরা কীভাবে একজন আরেকজনকে ছাড়া এতোবড় জীবন পাড়ি দিবো। তুমি দেখো আমি সত্যি সত্যি একদিন তোমার কাছে একেবারে চলে আসবো, একেবারে, চিরদিনের জন্য!

আসবে, আসবে ইরা। তার আগে এসো ঈদের শপিং করি।

ইরা হাসতে হাসতে বললো, তারপর বিয়ের, তাই না?

জয়ও হাসলো।

 

ঈদ বোনাস তুলে ইরা বাসে উঠে জয়কে ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো।

কোথায় তুমি?

অফিসে।

চলে এসো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কোথায়?

ঈদের শপিং করতে হবে না, তুমি তো দেখি সব ভুলে গেছো। আমাকে কিছু দিতে হবে না, ভয় পেও না। তুমি এসো তাড়াতাড়ি আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি। কথাগুলো ইরা একটানে বলে ফেললো।

জয় প্রতিবাদ করলো না, নরম সুরে বললো, আচ্ছা।

ইরা কানের কাছে কয়েকমুহূর্ত ফোন ধরে রাখলো তারপর বললো, এই তুমি খুব সহজভাবে বললে যে, মনে হয় দায়মুক্তি পেয়েছো। ঘটনা কী?

না, তুমি যখন চাইছো না তখন জোর করার কি প্রয়োজন? তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। এখন রাখছি একটু কাজ আছে তারপর বের হবো।

আজও কাজ। আমার জন্য একটা দিনও সময় নেই?

আছে বলেই তো বের হচ্ছি। এখন বলো কোথায় আসবো?

আগে নিউমার্কেট এসো।

আচ্ছা।

 

নিউ মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা জমে উঠেছে। জয় মার্কেটের সামনে দাঁড়াতেই ইরা রিকশা থেকে নামলো। একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বললো, অনেকক্ষণ আগে এসেছো বুঝি? আরও কারও সাথে দেখা করেছো নিশ্চয়ই?

না, এই মাত্র এলাম বলে জয় কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, ইরা, সবকিছু বাঁকাভাবে দেখবে না।

ইরা একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো, আরে ইয়ার্কি করছি।

জয় এতোক্ষণ ব্যাগটা হাতের পেছনে আড়াল করে রেখেছিলো এবার ইরার হাতে দিয়ে বললো, আমি তোমার জন্য শপিং করে রেখেছি ইরা, এই নাও।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ওয়াও। ও সেজন্য তুমি আচ্ছা, আচ্ছা করছিলে? তুমি পারো বটে।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানে ঢুকলো। তারপর ইরা ব্যাগটা খুলে একে একে শাড়ি, থ্রি-পিস, কসমেটিকস দেখলো তারপর ভ্রু’কুঞ্চিত করে বললো, তুমি একা কিনেছো?

হ্যাঁ, কেনো তোমার পছন্দ হয়নি?

খুব সুন্দর হয়েছে বলেই তো সন্দেহ হচ্ছে তোমার পছন্দ এতো সুন্দর হলো কবে থেকে।

কতদিন থেকে দেখছি তোমার শাড়ি, থ্রি-পিস, কসমেটিকস। সব চেনা হয়ে গেছে তাই সবকিছু তোমার পছন্দ হয়েছে।

কিন’ ইরা জয়ের কথায় সন’ষ্ট হতে পারলো না। জয়ের একটা হাত তার মাথার ওপর নিয়ে বললো, আমার মাথা ছুঁয়ে বলোতো সত্যি তুমি একা শপিং করেছো?

জয় ইরার মাথায় হাত রেখেই বললো, একা শপিং করেছি।

এবার আশ্বস’ হলো, উফফ তুমি আমাকে বাঁচালে। আচ্ছা এখন তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি দেখি, এই যে ভাই ঐ পাঞ্জাবিটা দেন তো দেখি।

দু’জনে একে একে অনেকগুলো পাঞ্জাবি দেখে একটা পাঞ্জাবি কিনেলো তারপর ক্যাটপো’তে শার্ট দেখলো। সব কেনাকাটা করার পর যখন যাবার সময় হলো তখন ইরা দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। কথা বলতে গিয়ে যেনো কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয়ও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো, ইরা একটা রিকশা ডাকি?

ইরা জয়ের কাছাকাছি এলো, আমার যেতে ইচ্ছা করছে না জয়। আমার মনে হচ্ছে যদি তোমার সাথে থেকে যেতে পারতাম। একসাথে ঈদ করতাম, কত আনন্দ হতো!

হয়তো এই ঈদটাই আমাদের জীবনে আলাদাভাবে পালন করা শেষ ঈদ, আগামী ঈদ আমরা একসাথে উদযাপন করবো।

ইরা আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো, সত্যি বলছো!

হ্যাঁ। অবশ্যই সত্যি বলছি।

একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, বাস স্ট্যান্ড যাবে?

যাবো।

ইরা রিকশায় উঠলো, যেতে যেতে ইরা বার বার রিকশার হুডের ফাঁক দিয়ে জয়ের দিকে ফিরে ফিরে তাকালো। রিকশা ভিড়ের মধ্যে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত জয় দাঁড়িয়ে রইলো।

 

সাতাশ

 

জয়ের জীবনে ঈদ আনন্দময় হয়েছে খুব কমই। প্রতিবছর কোনো না কোনো ইস্যুতে ঈদের আগের দিন অথবা ঈদের দিন সামিনার সাথে কোনোকিছু নিয়ে মনোমালিন্য হবেই। এবছরও শুরু হয়েছে ঈদে জয়ের মাকে শাড়ি দেয়া নিয়ে। সেদিন জয় সামিনাকে নিয়ে শপিং করতে গিয়েছিলো। রোজা রেখে বাহাদুর বাজার, মালদহপট্টি, গুলশান মার্কেট ঘুরে ঘুরে জয় সামিনার সাথে তার পছন্দমতো সব কেনাকাটা করার পর যখন জয় সেলসম্যানকে বয়স্ক মহিলার জন্য শাড়ি দিতে বললো তখন সামিনা মুখ কালো করলো, কার জন্য শাড়ি?

মা’র জন্য।

তোমার মা’র না একটা ট্র্যাংক ভর্তি শাড়ি আছে। বয়স্ক মানুষ ওগুলো শাড়িই তো পরে শেষ করতে পারবে না। আবার শাড়ি কেনো?

জয় রাগান্বিত চোখে সামিনার দিকে তাকিয়ে বললো, অনেকগুলো আছে বলে কি মা’কে ঈদে একটা শাড়ি দিতে হবে না? তোমারও তো অনেক শাড়ি, থ্রি পিস আছে।

সামিনা দোকানে গজগজ করে বলতে লাগলো, কী, তোমার মা’র মতো বুড়ি মহিলার সঙ্গে তুমি আমার তুলনা করছো।

জয় আর কথা বাড়ালো না কিন’ সামিনা আর স্বাভাবিক হলো না। সেই যে তার মা’র শাড়ি কেনার জন্য মনোমালিন্য শুরু হলো ঈদের আনন্দ আর ফিরে এলো না। আজ ঈদের দিন সকাল বেলা যখন জয় দু’ছেলেসহ সেমাই খেতে বসেছে তখন সামিনা জয়ের প্লেটটা একটু জোরে শব্দ করে তার সামনে এগিয়ে দিলো, খাও।

জয় কোনো কথা বাড়ালো না।

নাস্তা খেয়ে কাপড়-চোপড় পরতে শুরু করলো।

 

ঈদের দিন সকালবেলা ইরার রান্না শুরু হয়েছে, আগের বছরগুলোতেও ঠিক এভাবেই রান্না করতো তবে এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জয়ের অনুভূতি। কিছুক্ষণ পর পর জয়কে ম্যাসেজ করছে, কী করছো?

এই তো, রেডি হচ্ছি। তুমি?

রান্না করছি। ইসস্‌ কবে যে তোমার জন্য রান্না করতে পারবো।

পারবে। খুব শীঘ্রই।

নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরবে কিন’…

অবশ্যই।

খুব সহজে রাজি হয়ে গেলে যে? আর কেউ দিয়েছে নাকি?

আরে না, আর কে দিবে?

তোমার যত বন্ধু-ভক্ত।

ঈদের দিন একবারে বাজে কথা বলবে না।

তুমি রেগে গেলে কেনো, নিশ্চয়ই অন্য কেউ দিয়েছে।

উফফ।

যতই বিরক্ত হও আমি কিন’ সন্দেহমুক্ত হতে পারছি না। এক কাজ করো নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ছবি দাও।

ওকে, দেখো।

রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ইরা এভাবে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিলো। আর জয় রিপ্লাই দিচ্ছিলো।

জয় কাপড়-চোপড় পরে ম্যাসেঞ্জারে কয়েকটা ছবি পাঠালো।

ইরা লিখলো, টুপিটা অন্য কেউ দিয়েছে নাকি? কালারটা একটু…

মার খাবা কিন’…

আসছি, সেদিন কোনো ভুল করলে কিন’ সত্যি সত্যি মারবো, তখন বলো না কী বউ রে বাবা স্বামীর গায়ে হাত তোলে।

ওকে এসো। নারীর শাসন আমার কাছে মধুর মনে হয়।

ওকে মধুর শাসনের জন্য এখন তৈরি হও। এখন নামাজ পড়তে যাও আর দোয়া করবে।

জয় লিখলো, কী দোয়া করবো?

তাও জানো না?

জানি, জানি।

কী বলোতো?

বলবো, আল্লাহ তুমি ইরা আর আমার মনস্কামনা পুরণ করো।

ইরা লিখলো, আমিন।

 

সন্ধ্যায়, জয় তখন বাসায় টি.ভি দেখছিলো এমনসময় ইরার একটা ম্যাসেজ ঢুকলো, তুমি কোথায়?

বাসায়।

বউ-বাচ্চা নিয়ে খুব ফূর্তিতে আছো, না?

না।

কেনো?

কাল বলেছিলাম না, মাকে শাড়ি দেয়া নিয়ে ঝগড়া হয়েছে।

শোনো, শুভ আর মতির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে, এদের সঙ্গে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

কেনো?

সে অনেক কথা। আমি আসছি, তোমার কথা ঠিক আছে তো?

অবশ্যই।

তাহলে তুমি জয়পুরহাট বাসা ভাড়া করো। শুভ ঈদের দু’য়েকদিন পর যাবে, ও চলে গেলে আমিও একবারে তোমার কাছে চলে আসবো, ওকে?

ওকে। চলে এসো।

 

আঠাশ

 

ঈদের কয়েকদিন পরের কথা। ততদিনে শুভ চলে গেছে, ইরার স্কুল খুলেছে। সেদিন ফোন করে ইরা জানালো আগামী রবিবার থেকে তার স্কাউটের ট্রেনিং হবে চার দিন ব্যাপী।

জয় বললো, এটা তো খুব ভালো খবর, খুব মজা হবে।

তুমি বাসা ভাড়া করেছো? আমি শনিবার দিন ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ চলে আসছি, গিয়ে নতুন বাসায় উঠবো, ট্রেনিংয়ের সময় ওখানে থাকার ব্যবস’া আছে। ট্রেনিং শেষে আবার নতুন বাসায় যাবো, ওকে।

ওকে।

তুমি মেন্টাালি প্রিপিয়ার্ড তো জয়?

অবশ্যই।

ইরা কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপর বললো, এই তুমি এমন করছো কেনো?

কেমন করছি?

তোমার কথায় কোনো প্রাণ নেই কেনো?

ইরা আমি এমনই। আমি ঠিক আছি, তুমি চলে এসো।

ওকে। আমি শনিবার দিন বাসে ওঠার সময় তোমাকে রিং দিবো। তুমি বাস স্ট্যান্ডে থেকো। আমার কাছে থাকবে দু’টা বড় বড় ব্যাগ।

হ্যাঁ, ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ আমি বুঝি গাধা।

দু’জনে কথাগুলো এমনভাবে বলছিলো যেনো একটা সংসার ভাঙ্গা আরেকটা সংসার গড়া খুব সামান্য ব্যাপার। ফোন রেখে ইরা একবার তার রুমটায় চোখ বুলালো। তার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য প্রশ্ন বিড়বিড় করছে, কী পেয়েছে সে মতির কাছে? একদিন তো শুধু তার হাত ধরেই চলে এসেছিলো। কী মর্যাদা রেখেছে মতি তার। মতি সবাইকে বলে বেড়ায় ক্লাস সেভেনে পড়া একটা মেয়েকে সে বি.এ পাস করিয়েছে, স্কুলে চাকরি দিয়েছে কিন’ আমার লেখাপড়ায় মতির অবদান কতটুকু। আমি বাবার কাছ থেকে টাকা এনে লেখাপড়া করেছি। শুভ তখন আমার কোলে, সেই কোলের ছেলেকে নিয়েই আমি লেখাপড়া করেছি আর চাকরির সময় উন্নয়ন ফান্ডের টাকা বাবার কাছ থেকে এনে দিয়েছি। আবার বলে বেড়ায় আমার চাকরির কোনো টাকা সে ছুঁয়ে দেখেনা। কত মিথ্যা, কত চাতুরী মতির মধ্যে। এই বাসাটা, যে বাসায় আমি শুয়ে আছি সেটার ক’টা টাকা মতির? সব তো আমারই অথচ সে বলে বেড়ায় একটা টাকাও ছুঁয়ে দেখেনি, রড কেনার সময়, সিমেন্ট কেনার সময় ব্যাংকে আমার যত টাকা ছিলো সব তুলে ওর হাতে দিয়েছি। ব্যাংকে লোন করেছি, এন.জি.ও’তে কিস্তি করেছি।

ও সরি, মতি ঠিকই বলেছে ওতো আমার টাকা ছুঁয়ে দেখেনি, ব্যাংকের চেক ছুঁয়ে দেখেছে। বলে ইরা একটা শুষ্ক হাসি হাসলো।

এই তো ক’দিন আগে বাসার টাইলস কেনার সময়, মতি টাকা চায়নি কিন’ ইনিয়ে-বিনিয়ে কত কী বললো, বাসায় টাইলস লাগানো দরকার, কী যে করি। মানে ও বলতেই চাচ্ছিলো যে আমি বলি ঠিক আছে টাইলসগুলো আমি কিনে দিই। আর আমিও বোকামি করে বলে ফেললাম আমি কিনে দিচ্ছি। কত টাকা খরচ হলো আমার, আশি হাজার টাকা।

টাকার প্রশ্ন যা-ই হোক, আমার মনের অবস’াটাই কি কোনোদিন বুঝেছে মতি। বিয়ে করে মনে হয় আমার মাথা কিনে নিয়েছে। সেই সকালবেলা স্কুলের সময় হওয়ার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, দুপুরে কয়েকমিনিটের জন্য আসে লাঞ্চ করতে তারপর বিকেলবেলা সেই-ই যে বেরিয়ে যায় আসে রাত দশটা কিংবা এগারোটায়। আমি যে একটা মানুষ, সারাদিন যে আমি তার অপেক্ষায় থাকি তার কি মূল্য দিয়েছে মতি?

শুধু কি সময় দেয়া! এমন কোনো নির্যাতন নেই যা মতি আমাকে করেনি। বিয়ের কয়েকবছর পরেই গায়ে হাত তুলেছে, আগে তো একবার মেরে হাতই ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তখন কয়েকদিন স্কুলেই যেতে পারিনি। অবশ্য তার একটা কারণও জোগাড় করেছিলাম, বলে ইরা আবারও একটা শুষ্ক হাসি হাসলো।

সবাইকে বলেছিলাম বাথ রুমে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে গেছে কিন’ আত্মীয়-স্বজন, কলিগরা ঠিকই বুঝেছিলো। বিয়ের পঁচিশ বছর হলো। জীবনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথচলায় আমি একজন ভালো বন্ধুই খুঁজেছিলাম, একজন ভালো মানুষ, ভালো মনের মানুষ।

ইরা আপন মনে ইউরেকা, ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠলো। পেয়েছি, আমি আমার আপন মানুষ, মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছি। জয়! প্রতিদিন সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই একবার খবর নেয়, মতি স্কুল যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। মতি স্কুল যাওয়ার পর ফোনে কথা বলে অনেকক্ষণ, ভিডিও কল দেয়। আর বিকেলটা তো পুরোই আমার জন্য বরাদ্দ। তাছাড়াও মাঝে মাঝে ম্যাসেজ দিয়ে খোঁজখবর নেয়। সবসময় আমাকে নিয়ে ভাবে। আমার ভালো-মন্দ, সুযোগ-সুবিধার খেয়াল রাখে। একজন পুরো মানুষকে কাছে পেয়েও মূল্য বুঝলো না আরেকজন দূর থেকে, শত মাইল দূর থেকে এক মুহূর্ত কাছে পাবার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে। জয়, জয় আমার কত আপন। জয়! আমার জয়! বলে ইরা তার মোবাইল ফোনে জয়ের ছবি বের করে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

 

জয়ের দাম্পত্য জীবন কখনো সুখের ছিলো না। কেউ যখন নারীকে সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী বলে সংজ্ঞায়িত করে তখন জয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠে কৃঞ্চাঙ্গী, রাগান্বিত, উগ্রমূর্তির এক নারীর প্রতিচ্ছবি। প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্তে জয় তার দূর্ব্যবহারের আতঙ্কে থাকতো। শুধু তার সাথেই নয়। সামিনা জয়ের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কাউকে দেখতে পারতো না। এসব কারণে জয়ের মন সবসময় কাঁদতো। সুযোগ পেলে সামিনা জয়ের বন্ধু-কলিগদের কাছে তার দুর্নাম করে বেড়াতো। আর তাই জয় সারাজীবন একজন ভালো মানুষ, বন্ধু খুঁজছিলো। তারও সেই আপন মানুষটি ইরা। ইরার নাম উঠতেই জয়ের চোখের সামনে ইরার ছবি ভেসে উঠলো। সুন্দর, লাবন্যমীয় এক নারী। কত বিনয়ী, কত ভদ্র, মার্জিত ইরার ব্যবহার। রূপে-গুণে অনন্যা এক নারী ইরা। জয় ইরাকে খুঁজে পেলো সাতাশ বছর পর।

ইরা, ইরা তার হবে। সেই রূপবতী, গুণবতী, মহীয়সী নারী তার স্ত্রী হবে। তাকে নিয়ে জয় নতুন সংসার বাঁধবে। তার সারাজীবনের স্বপ্ন একটা ঘর হবে, সংসার হবে। এখন একটা বাসা খুঁজতে হবে। দু’কামরার ছোট্ট একটা বাসা। ইরা সকালবেলা উঠে নাস্তা তৈরি করবে, দু’জনে একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে জয় ইরাকে মোটর সাইকেলে করে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে তুলে দিয়ে আসবে। লাঞ্চ একটু কষ্টই হবে জয়ের জন্য কারণ ইরার স্কুল শেষ হবে বিকেল চারটায়। ইরার স্কুল খোলার দিন জয়কে একা একাই লাঞ্চ করতে হবে। সন্ধ্যায় ইরা যখন ভাত রান্না করবে জয় তখন পেছন থেকে ইরার কাঁধে হাত রেখে গান গাইবে, তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার।

ইরার একটা মেয়ে বাচ্চার খুব ইচ্ছা। ইরা একটা নামও ঠিক করে রেখেছে, জুঁই। জয় এর প্রথম অক্ষর জ আর ইরার ই নিয়ে অনেক ভেবে চিন্তে ইরা নামটা সিলেক্ট করেছে। ছোট্ট একটা বাচ্চা মেঝেতে এবড়ো থেবড়ো করে হেঁটে বেড়াবে। কত সুন্দর দেখাবে। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয় আপনমনে একবার হেসে উঠলো, কী ভাবছি আমি এসব! ইরা আসবে মতির সঙ্গে তার ডিভোর্স হবে, আমার সঙ্গে বিয়ে হবে তারপর না এসব চিন্তা। অথচ কোনোকিছু না হতেই জয় ইরাকে নিয়ে এতোদূর ভাবতে শুরু করেছে। অথচ এখনো একটা বাসা-ই পাওয়া হলো না।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। জয় রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

কী করছো?

এই তো শুয়ে শুয়ে ভাবছি।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, বাসা পেয়েছো?

না।

মানে? এখনো বাসা পাওনি?

পাইনি খুঁজছি, তবে পেয়ে যাবো।

খোঁজো। আমি কিন’ আর ফিরে আসতে পারবো না।

তুমি আমার ওপর ভরসা রেখো ইরা।

ভরসা আছে বলেই তো…

চলে এসো।

 

সবকিছু শুনে মিনা বললো, আপনাদের আগামী দিনগুলো সুন্দর হোক ভাই দোয়া করি।

মাহফুজ সাহেব বললো, কিন’ অনেক সংগ্রাম করতে হবে, আগামী দিনগুলো বেশ কঠিন হবে, অনেক ঝড়-ঝাপটা সামলাতে হবে।

 

উনত্রিশ

 

সেদিন রাতে ইরা আর জয় দু’জনে ঘুমায়নি। কিছুক্ষণ পর পর কখনো জয় আর কখনো ইরা ফোন করেছে। ইরা বললো, তুমি আমাকে রেখে গেলে কেনো বলোতো? তুমি কি আমার সঙ্গে কোনো চালাকি করছো?

না, চালাকি কেনো?

তুমি আমাকে রেখে গেলে কেনো?

তো কী করতাম?

আমরা আজই বিয়ে করতাম।

কিন’ আজ বিয়ে করে কাল সকালে উঠে আবার ট্রেনিংয়ে যেতে?

তো?

তোমার ট্রেনিং শেষ হোক, তারপর বিয়ে করবো।

ইরা শুষ্ক কণ্ঠে বললো, জয় তুমি আমার সঙ্গে কোনো চালাকি করছো না তো?

কী চালাকি করবো, বলো?

শোনো আমি কিন’ বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছি আর কোনোদিন যাবো না একথা মতিকে বলেও এসেছি তুমি যেনো আমাকে ফিরিয়ে দিওনা প্লিজ!

জয় সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তুমি টেনশন করো না ইরা। তোমার ট্রেনিং শেষ হোক তারপর সব ব্যবস’া হবে।

ইরা জয়ের কথায় সন’ষ্ট হতে পারলো না। একটা নি:শ্বাস মোচন করে ফোন রাখলো।

 

পরদিন থেকে ইরার ট্রেনিং শুরু হলো। চার দিনের ট্রেনিং। ট্রেনিং এর মাঝেও ইরার সাথে কথা হয়েছে, হাই, হ্যালো মাত্র।

ট্রেনিং শেষে ইরা ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

কী করবে এখন? আমি কোথায় যাবো?

তুমি মাহফুজ ভাই’র বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে এসো।

তারপর-

আগে এসোই না, তারপর কী হয় একটা ব্যবস’া হবে।

এভাবে কথা বলছো কেনো জয়? তুমি কি আমার আবার ঐ জাহান্নামে ফেরৎ পাঠাবে?

আমি কি একথা বলেছি ইরা, জয় ঠাণ্ডা গলায় বললো।

ইরা আর কথা বাড়ালো না। কথা প্রসঙ্গে ইরা একদিন বলেছিলো, তুমি যখন শীতল গলায় কথা বলো তখন আমি খুব ভয় পাই, এমন করে বলো না প্লিজ!

প্রায় এক ঘণ্টা পর ইরা তার ব্যাগ নিয়ে এলো খঞ্জণপুর মোড়ে। জয় ততক্ষণে একটা অটোরিকশা নিয়ে ইরার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ইরা তার রিকশা ছেড়ে দিয়ে জয়ের অটোরিকশায় উঠলো।

ইরা অটোরিকশায় উঠেই জয়ের কাঁধে মাথা রাখলো। জয় ইরার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, এখন কী করবে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

কোথাও না ইরা, আমি ভাবছি এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।

ইরা প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে যেনো আঁৎকে উঠলো, মানে?

জয় মৃদু কণ্ঠে বলতে শুরু করলো, ইরা আমি ভাবছি কাজটা আমাদের খুব আবেগের হয়ে যাচ্ছে।

হুঁম আবেগেরই তো, এটা আবার নতুন কী?

তোমাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর বললো, তুমি কী বলছো জয় এসব। আমি যে মতিকে বলে এলাম যে আমি আর কোনোদিন ফিরে আসবো না।

ইরা, তুমি তো সবকিছুই জানো। আমার একটা সংসার আছে, বউ-বাচ্চা আছে। তারা যখন জানবে তখন তারা খুব কষ্ট পাবে। তারপরও সেটাকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ আমার কাছে আমার ভালোবাসা বলে জয় ইরার থুতনি উঁচু করে ধরে বললো, আমি আমার ভালোবাসার জন্য সবকিছু করতে পারি।

তো?

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। জয় আবার বলতে শুরু করলো, আমি ভাবছি তোমার কথা।

আমার কথা মানে?

মনে করো অফিস ছুটি হলেই আমি দিনাজপুর যাই, বিয়ের পরও আমি যখন দিনাজপুর যাবো তখন তুমি মেনে নিতে পারবে তো?

ইরা কোনোকিছু না ভেবেই বললো, হ্যাঁ। কেনো আমি তোমাকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য জয়পুরহাট ট্রেনে উঠিয়ে দিই না? কই কোনোদিন তো আমি তোমাকে বাধা দিইনি।

জয় ইরার হাতে মৃদু একটা চাপ দিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, ইরা ভেবে দেখো, তখন আমি তোমার ফ্রেন্ড ছিলাম, তুমি সহজভাবে মেনে নিতে আর বিয়ের পর আমি তোমার হ্যাজবেন্ড হবো, তোমার ফ্রেন্ড জয়ের মোবাইল ফোন কয়েকমিনিট ব্যস্ত দেখলেই তোমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠে, তোমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায় আর তোমার হ্যাজবেন্ড আরেকটা বউ নিয়ে থাকবে আর তুমি একা বিছানায় শুয়ে থাকবে এটা তুমি কী করে মানবে?

ততক্ষণে অটোরিকশা জয়-ইরার অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত বারো শিবালয় মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছেছে। ইরা জয়ের একটা হাত নিজের মাথার ওপর নিয়ে বললো, জয় তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো না, সত্যি করে বলোতো তুমি আমাকে ভালোবাসোতো?

জয় জোর দিয়ে বললো, সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি।

ইরা জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়! আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জয়!

আমি জানি ইরা। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন’ আমি চিন্তা করছি, আজ তুমি যা সহজভাবে মেনে নিচ্ছো কাল সেটা তুমি কোনোভাবেই মানতে পারবে না, তখন কী হবে।

ইরার মুখে একটা কালো মেঘের ছাপ পড়লো, আমি তো বিষয়টা এভাবে ভাবিনি জয়।

ততক্ষণে অটোরিকশা গতনশহর মোড় অতিক্রম করে বাইপাশের মোড়ে এসে পৌঁছেছে। জয় ইরার হাতের ওপর আলতো করে নিজের হাতটা রেখে বললো, ইরা!

বলো।

কোথায় যাবো এখন?

আমি কিচ্ছু জানি না জয়, কিচ্ছু জানি না আমি শুধু জানি তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে এসেছি জয়। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ!

আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না ইরা। তোমাকে ভাববার সময় দিচ্ছি, তুমি আরও কয়েকদিন ভেবে দেখো ইরা। তারপর যদি তুমি সবকিছু মেনে নিতে পারো তবে আবার এসো।

ইরা জয়ের কাঁধের ওপর মাথা রেখে জয়ের একটা হাত তার মাথার ওপর নিয়ে অদূরে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে বললো, এই যে দেখছো সাথী নার্সারি, আমাদের প্রেমের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে এই সাথী নার্সারি। এই নার্সারি সাক্ষী রেখে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলো তুমি আমার সঙ্গে কোনো চালাকি করছো না তো!

জয় দৃঢ় কণ্ঠে বললো, না ইরা আমি তোমার সঙ্গে কোনো চালাকি করছি না। প্লিজ তুমি আমাকে ভুল বোঝো না।

অটোরিকশার ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, স্যার কোন দিকে যাবো?

জয় একবার ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, বাঁয়ে যাও।

অটোরিকশা বাইপাশ রোড দিয়ে চলতে শুরু করলো। ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে তখন অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তুমি আমাকে বাসায় ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছো! জয়!

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলতে শুরু করলো, না ইরা তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি না। আমি তোমাকে ভাববার সময় দিচ্ছি। আজ থেকে তুমি ভাবতে শুরু করবে, তোমার বাড়িটা তুমি নিজ হাতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছো, তোমার শুভকে তুমি কোলেপিঠে করে মাতৃস্নেহ দিয়ে মানুষ করেছো, মতির সঙ্গে তোমার পঁচিশ বছরের সংসার, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তোমার তার সাথে। সবকিছু ছেড়ে তুমি আমার কাছে আসবে যেখানে আমার আরেকটা বউ আছে, দু’টো ছেলে আছে। তুমি সবকিছু মানিয়ে নিতে পারবে কী না আগে ভেবে দেখো ইরা। তারপর এসো ইরা, বলতে বলতে জয়ের কণ্ঠস্বর বুজে এলো, গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।

এমনি নানান কথা বলতে বলতে অটোরিকশা বটতলী এসে পড়লো। জয় অটোরিকশা থামতে বললো, ইরা হু হু করে কেঁদে উঠলো, আমি মতিকে বলে এসেছিলাম আমি আর কোনোদিন ফিরে আসবো না। আর তুমি আমাকে…

তুমি তো আমারই ইরা। মতি যদি তোমাকে এনিয়ে একবিন্দু খোঁটা দেয় তবে তুমি সঙ্গে সঙ্গে চলে এসো ইরা। আমি তোমাকে আর কোনোকিছু ভাবতে বলবো না।

আমি শুধু তোমার জয়, শুধু তোমার! তুমি যেতে বলছো তাই আমি যাচ্ছি কিন’ মনে রেখো আমি যেকোনো সময় তোমার কাছে চলে আসবো সেদিন তুমি যেনো ফিরিয়ে দিও না।

না ইরা, ফিরিয়ে দিবো না।

দু’জনে অটোরিকশা থেকে নেমে জয় ইরাকে আরেকটা অটোরিকশা ভাড়া করে ইরার ব্যাগ দু’টো তার অটোরিকশায় তুলে দিলো।

ইরা অনেকক্ষণ জয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। এটা যে একটা সদর রাস্তা আর তারা দু’জন ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে যেনো ওদের কোনো খেয়াল নেই। ইরা জয়ের কানে বার বার ফিস ফিস করে বলছে, জয়, আমার জয়!

ইরার অটোরিকশা চলে যাচ্ছে জয় ইরার অটোরিকশার দিকে তাকিয়ে আছে, জয়ের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইরা বার বার পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। জয় হাত নেড়ে ইরাকে বিদায় জানালো।

 

ত্রিশ

 

ইরা কলিং বেল-এ টিপ দিতেই মতি গেট খুলে দিয়ে একবার ইরার আপাদমস্তক তাকালো। ইরার সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে উঠলো, মতি, মতি তো এমন করে না কখনো।

এই ক’দিনে বাসার মেঝেতে বালি জমে গেছে, ডাইনিংয়ে থালা-বাসনগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ইরা তার রুমে ঢোকার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। মতি গেট বন্ধ করে দিয়ে ইরার পিছনে পিছনে তার রুমে চলে যেতে যেতে বললো, এলে তাহলে?

মতির এই তীর্যক কথায় ইরার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বিষয়টা সহজ করার জন্য বললো, তুমি কি ভেবেছিলে একেবারে গেছি?

মতি তার রুম থেকেই বললো, না আমি তা ভাবিনি। আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে, দুনিয়াতে আসলে চলে যাওয়ার মতো বেশি জায়গা নেই।

যাবো, যাবো, যেদিন সত্যি সত্যি চলে যাবো সেদিন বুঝবে, সেদিন ফিরিয়ে আনার জন্য কান্নাকাটি করবে।

মতি তার রুম থেকে উচ্চ স্বরে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললো, আচ্ছা যেদিন যাবে সেদিন চলে যেও, আমি তোমাকে আটকাবো না, এখন কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে কাজে লেগে যাও।

আটকাবে না তো, কথাটা মনে রেখো, বলে ইরা তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে জয়কে একটা ম্যাসেজ দিলো, পৌঁছেছি।

এ্যানি প্রবলেম?

ম্যানি ম্যানি প্রবলেম, পরে কথা বলবো, বাই।

মতি কিছুক্ষণ তার রুমে পায়চারি করে রুম থেকে বের হয়ে বললো, কিছু বাজার লাগবে নাকি দেখো?

হুঁম দেখবোই তো, কাজের মেয়ে রহিমা এসেছে দেখবেই তো। তুমি তো বিয়ে করে বউ ঘরে আনোনি, কাজের মেয়ে এনেছো, বলে ইরা রান্না ঘরে গেলো। সবকিছু দেখে মতিকে বাজারের ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ছোট মাছ যেনো এনো না।

মতি কোনো কথা না বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেলো।

 

ইরার সঙ্গে মতির ঠাণ্ডা লড়াই যা হয়েছে আসার পরপরই তারপর থেকে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে কিন’ কোথায় যেনো একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রাতে মতি তার রুমে চলে গেলো, ইরা তার নিজের রুমে।

বিকেলের পর আরও কয়েকবার ইরার সাথে জয়ের কথা হয়েছে। মতি অনেক রাত পর্যন্ত টি.ভি দেখে, ইরা তার রুমে শুয়ে বই পড়ে, ফেসবুকে আড্ডা দেয় এটা তাদের দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ দিনের প্রচলন। দু’টো প্রাণি সারাদিন বাসায় থাকলেও কারও সাথে কারও প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা হয় না। এই গতানুগতিক, ফ্রেমে বাঁধা জীবন ইরার পছন্দ না। তাই সে একটা আশ্রয় খুঁজছিলো, একটা উম্মুক্ত আকাশে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে দু’টো পাখি চরে বেড়ানোর মতো জীবন। রাতে একটা নীড়ে থাকবে, হোক সে নীড় খড়ের, মাথার ওপর পানি পড়-ক, ইরা তার ওড়না দু’জনের মাথার ওপর ধরবে। পাখির মতো কল-কাকলিতে ভরিয়ে তুলবে সারাজীবন। জয় ঠিক সেরকমই, ইরা যতক্ষণ জয়ের কাছে থাকে ততক্ষণ কথা বলতেই থাকে, কত কথা! মন ভরিয়ে দেয়। একবার ফোনে কথা শুরু হলে জয় ফোন ছাড়তেই চায় না।

ইরা জয়কে ফোন করলো। জয় আগে মোবাইল ফোনে সময় দেখলো, রাত সাড়ে বারোটা বাজে। সে কিছুটা অবাক হলো, ইরা এতো রাতে! মতির সঙ্গে কোনো ঝগড়া-বিবাদ লাগেনি তো? আমাকে নিয়ে?

জয় কিছুটা দ্বিধাগ্রস’ মনে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

ফোন রিসিভ করতে দেরি হলো কেনো? আরেকটা ফোনে কারও সাথে কথা বলছিলে বুঝি?

না, আমার একটাই ফোন।

তো?

একটু একটু  ঘুম আসছিলো। তুমি এতো রাতে ফোন দিবে ভাবিনি। তাই রিসিভ করতে সময় লাগলো। কী অবস’া তোমার?

কী অবস’া? অবস’া ভালো না।

কেনো?

কেনো তুমি জানো না? আমি তো মতিকে বলে গেছিলাম আর কোনোদিন আসবো না। ফিরে এসে দেখছি ও আমার সঙ্গে অন্যরকম আচরণ করছে। আমার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। তুমি, তুমি আমাকে কেনো ফিরিয়ে দিলে জয়! কেনো! বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

জয় হেসে উড়িয়ে দিলো, আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি? হা হা হা…

তুমি হাসছো, নিষ্ঠুর, পাষাণ, আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে গেলাম তুমি কী না আমাকে… বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা ফুটে উঠলো।

আস্তে কথা বলো ইরা, আস্তে, মতি বাসায় আছে না?

ইরার কণ্ঠস্বর কিছুটা নরম হলো, আছে।

যদি তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

পাবে না, ও মনোযোগ দিয়ে টি.ভি দেখছে, ড্রয়িং রুমে, বলে ইরা কিছুটা বায়নার সুরে বললো, আমি এখানে থাকতে পারবো না জয়, প্লিজ আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে যাও।

এভাবে বলছো কেনো, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোমাকে ভালোবাসি না, আমার মন বুঝি তোমাকে চাচ্ছে না। তুমি যেদিন খুশি চলে আসবে তবে তার আগে কিছু কাজ আছে ইরা।

কী কাজ?

যেমন একজন ভালো উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, কাজির সঙ্গে কথা বলতে হবে, বাসা ভাড়া নিয়ে রাখতে হবে।

হুঁম ঠিক বলেছো, এবার কিন’ আমি তোমার কোনো বড়ভাই’র বাসায় গিয়ে থাকতে পারবো না।

আমি সব ঠিক করে রাখবো ইরা, প্রস’তির কোনো ত্রুটি যেনো না থাকে। তারপর তোমাকে বলবো, ইরা চলে এসো।

আর আমি সোজা চলে আসবো একেবারে তোমার বুকে…

দু’জনে হেসে উঠলো।

 

একত্রিশ

 

জয় উকিল সাহেবের সাইনবোর্ড দেখে দাঁড়ালো, ভদ্রলোক জজকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। হ্যাঁ উনার নাম ডাকও আছে। একদিন জয় তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলো একজন ভালো উকিলের কথা এই ভদ্রলোকের নামই তো বলেছিলেন। দরজা খোলাই ছিলো, চেয়ারে বসা একজন ভাবগম্ভীর মধ্যবয়সী লোক।

জয় দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসসালাম, আসুন।

আমি একটু উকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ভদ্রলোক একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিলেন, এবার বই থেকে মুখ তুলে মৃদু হেসে বললেন, জি আমি উকিল, বসুন।

জয় চেয়ারে বসলো।

উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বলুন।

মানে, মানে আমার এক ফ্রেন্ড বলতে গিয়ে জয় একটা ঢোক গিললো, মানে ওর দীর্ঘদিন থেকে দাম্পত্য জীবনে ঝামেলা যাচ্ছে, তাই হ্যাজবেন্ডকে ডিভোর্স করবে।

উকিল জিজ্ঞেস করলেন, কাবিননামা নিয়ে এসেছেন?

না তো, আচ্ছা আমি ওকে জিজ্ঞেস করি বলেই জয় ইরাকে ফোন করলো।

ইরা রিসিভ করেছে, হ্যালো।

আচ্ছা তোমার কাছে তোমাদের বিয়ের কাবিননামাটা আছে?

ইরা কিছুটা অবাক হলো, আমার বিয়ের কাবিননামা? আমার বিয়ের কাবিননামাটা আবার কী কাজে লাগছে?

আরে আমি উকিলের কাছে এসেছি তাই উনি জানতে চাচ্ছেন।

না, অতোদিন আগে বিয়ে হয়েছে, আদৌ কাবিন হয়েছে কী না তাই-ই তো আমার মনে নেই। তুমি আবার কাবিন নামার কথা বলছো।

ওকে ঠিক আছে রাখো, পরে কথা বলবো বলে জয় ইরাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে উকিল সাহেবকে বললো, না, কাবিননামা নেই।

উকিল সাহেব বললেন, তাহলে আগে এ্যাফিডেভিট করতে হবে তারপর তালাক দিতে হবে। স্ত্রীর স্বামীকে তালাক দিতে নয়টি কারণ প্রয়োজন। এই নয়টি কারণের যেকোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে।

আর সেই স্ত্রীর যদি আবার বিয়ে করতে চায়? জয় জিজ্ঞেস করলো।

পারবে, আইনে কোনো বাধা নেই তবে শরিয়ত অনুযায়ী ইদ্দত কাল অতিক্রম করতে হয়।

ইদ্দতকাল?

ইদ্দত কাল তিন মাস।

তারমানে তিন মাস আগে সেই স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারবে না।

শরিয়তে তাই বলা আছে, আমি আবারও বলছি আইনে কোনো বাধা নেই।

জয় উকিল সাহেবের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে ইরাকে ফোন করলো, হ্যালো ইরা।

ইরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী বললেন উকিল সাহেব?

সমস্যা, শুনলে তোমার গা জ্বলে উঠবে।

বলোই না কী বললেন?

তোমার তালাকের পর থেকে তিন মাসের আগে বিয়ে করার সুযোগ নেই।

ইরাকে প্রচণ্ড রেগে গেলো, এই, এই-ই তুমি কী বলছো? আমাকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে এখন, এখন মই টেনে নিচ্ছো?

এভাবে বলছো কেনো? আমি তো চাই আজকেই, এখনই আমরা বিয়ে করি।

তবে ফতোয়া বের করছো কেনো?

আমি করিনি এটা শরিয়তের ভাষা তবে উকিল সাহেব বলেছেন আইনে কোনো বাধা নেই।

উকিলরা এরকম বলেই থাকে, শোনো ডাক্তাররা অসুখকে বেশি ভয় পায়, ইঞ্জিনিয়াররা মনে করে এই একটু রড কম হলেই বুঝি বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়লো আর উকিলরা আইনকে বেশি ভয় পায়। তুমি ওসব বাদ দাও তো। আমি আর এখানে থাকতে পারবো না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো?

হ্যাঁ। আমি তোমার মতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি না। একবার যখন পা উঠিয়েছি তখন সেই পা আর নামাবো না।

ইরা শোনো?

বলো?

আমি বলছি ডিভোর্সের পর আপাতত: থাকার জন্য মেসে তোমার জন্য আমি একটা সিট নিই, তিন মাস না হলেও কিছুদিন তুমি ওখানেই থাকো কারণ তুমি আজ এসে কালই যখন আবার বিয়ে করবে তখন এই বিয়েটা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে।

আমি মেসে উঠবো?

হ্যাঁ, আমাদের এক কন্ট্রাক্টর, মোস্তাক কমিশনারের মেস আছে, বেশিরভাগ কলেজের মেয়েরাই ওখানে থাকে কিছুদিন তুমি থাকো তারপর আমরা বিয়ে করবো, বাসা ভাড়া নিবো।

উঁহু, আমি মেসে থাকবো না। তাছাড়া  জয়পুরহাট বাবার বাড়ি, ঘটনাটা লুকিয়ে থাকবে না। বাবা এসে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মাস্টারের বাড়িতে আবার পাঠিয়ে দিবে।

তাহলে কী করতে চাচ্ছো?

তোমার মাথা, তোমার মাথা করতে চাচ্ছি? আমাকেই আবার জিজ্ঞেস করছো তাহলে কী করতে চাচ্ছো, বলে ইরা ফোন রেখে দিলো।

জয় বার বার ফোন করলো কিন’ ইরা আর ফোন রিসিভ করলো না।

 

ইরা ফোন করলো রাতে, হ্যালো জয়।

বলো।

কী করছো?

রাতে মানুষ কী করে, শুয়ে আছি।

ভাব নিচ্ছো কেনো?

ভাব মানে?

হুঁম গম্ভীর স্বরে কথা বলছো।

জয় হেসে ফেললো, আসলে তোমার ওপর রাগ করতে চাই কিন’ পারি না।

ওসব বাদ দাও, আমাদের রিলেশনটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমরা একজনকে ছাড়া আরেকজন বাঁচবো না। ভাব নিয়ে, রাগ করে, অভিমান করে কোনো লাভ নেই।

আমিও তো তোমাকে সেটাই বোঝাতে চাই ইরা কিন’ তুমি তো সবসময় ভাব নাও, এই যে বিকেলে হঠাৎ করে ফোনটা রেখে দিলে আমি কতবার ফোন দিয়েছি জানো। তুমি রিসিভই করলে না।

সরি জয়, এক্সটিমলি সরি।

ওকে, আর এমন করো না।

করবো না, তুমি কষ্ট পাও এমন কাজ আর আমি কখনো করবো না। শোনো আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কী সিদ্ধান্ত?

কাল সকালবেলা আমি চলে আসবো ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ।

ওয়েলকাম।

কালকেই মতিকে ডিভোর্স দিবো, কালকেই আমরা বিয়ে করবো কিন’ আমাদের বিয়েটা থাকবে গোপন।

ওকে।

আমি আগামীকাল ছুটি নিয়েছি, সকাল দশটায় বাসা থেকে বের হবো, তুমি কিন’ আমাকে নিতে এসো, মোটর সাইকেল নিয়ে।

অবশ্যই।

বত্রিশ

 

সারারাত জয়ের চোখে ঘুম নেই, সেই অপরূপা, সুন্দরী, শিক্ষিতা, রমণী তার চকচকে বাড়ি, স্বামী-সংসার ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে, একেবারে! চিরদিনের জন্য! আমার মধ্যে এমন কী আছে যে ইরা এতোবড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে! জয় বিছানা থেকে উঠে আয়নায় ডানে একবার বাঁয়ে একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো, নাহ্‌ আমাকে নিজের কাছেই নিজেকে সুন্দর লাগছে না। আসলে মানুষের সৌন্দর্য বুঝি লুকিয়ে থাকে যে দেখে তার চোখে। ইরা সবসময় আমাকে সুন্দর চোখে দেখে তাই তাকে সুন্দর লাগে, তাই বলে আমার জন্য সবকিছু ছেড়ে আসবে…

হ্যাঁ, এমন একজন জীবন সঙ্গী-ই তো সারাজীবন খুঁজছিলো জয়। জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার পর আজ সেই মানুষটিকে জয় পেতে যাচ্ছে। কতক্ষণ, আর কতক্ষণ সকাল দশটা বাজতে বাকি। দেয়াল ঘড়িতে একবার সময় দেখলো, রাত তিনটা বাজে, জয়ের চোখে তবু ঘুম নেই, সে রুমের মধ্যে পায়চারি করলো। তারপর শুয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

 

ইরার মধ্যে ভয় কিংবা সংকোচ বলে কিছু নেই। সকালবেলা মতি নাস্তা খেয়ে স্কুলে যাবার সময় ইরা বললো, কোথায় যাচ্ছো তুমি?

স্কুলে।

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

স্কুল থেকে আসি, বিকেলে বলো।

না আমাকে এখনই বলতে হবে, আমি চলে যাবো।

মতি ইরার কথায় তেমন গুরুত্ব দিলো না। সে তার মতো স্কুলে চলে গেলো।

ইরা তবুও কিছু মনে করলো না। মতির প্রতি তার কোনো রাগ-অনুরাগ, ভয়-ভালোবাসা কোনোকিছু নেই। তার মনের মধ্যে যেনো আনন্দের জোয়ার বইছে। এই বাড়ি, যার প্রতিটি ইটের সঙ্গে আছে তার পরিশ্রম, মেধা, অর্থ সব, এই ঘর, যে ঘরের প্রতিটি জিনিস সে নিজ হাতে সাজিয়েছে এসবের প্রতি তার কোনো মায়া নেই, আগ্রহ নেই। তার মন এখন উতলা হয়ে উঠেছে জয়ের কাছে যাওয়ার জন্য, তার জয়, তার ভালোবাসা তার জন্য অপেক্ষা করছে, ইরার যেনো মনে হচ্ছে যদি এখনই পাখির মতো উড়ে যাওয়া যেতে পারতো তবে তার জীবনটা পরিপূর্ণ হতো। ইরা আপন মনে বললো, জয়, আমার জয়…

ইরা বাসে উঠে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকালো, না পরিচিত কাউকে চোখে পড়লো না। সে জয়কে ফোন করলো, এই কোথায় তুমি?

অফিসে, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

আমি বাসে উঠলাম, তুমিও রওয়ানা দাও। ক্ষেতলাল পৌঁছে আমি বাস থেকে নেমে তোমার মোটর সাইকেলে উঠবো, ওকে?

ওকে।

জয় মোটর সাইকেল নিয়ে রওয়ানা দিলো, আবেগ আর অজানা আশংকায় জয়ের বুক কাঁপছে।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ইরা ফোন করেছে, জয় রিসিভ করলো, হ্যালো ইরা।

কোথায় তুমি?

জয় বললো, বটতলী, তুমি?

ক্ষেতলাল, শোনো এখানে নেমে তোমার মোটর সাইকেলে উঠতে চাইছিলাম কিন’ আমার খুব ভয় করছে। কেউ যদি দেখে ফেলে। শোনো আমি আরও কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেকে নামবো, তুমি বটতলী থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে সোজা চলে এসো। আমি রাস্তায় তোমার বাইকে উঠবো।

যথা আজ্ঞা রাণী, আজ্ঞা শিরোধার্য।

ইরা হেসে ফেললো।

জয় আবার মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো। কয়েকমিনিট পরেই সেই রাজকুমারীর দেখা মিললো, ইরা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে দু’টো ব্যাগ।

জয়কে দেখে ইরা একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বললো, ব্যাগ দু’টো তাড়াতাড়ি মোটর সাইকেলে বেঁধে নাও সোনা, তাড়াতাড়ি চলো এখান থেকে।

কেনো?

আমার খুব ভয় করছে এটা সদর রাস্তা, কেউ যদি দেখে ফেলে। তুমি কিন’ বটতলী গিয়ে সোজা জয়পুরহাটের রাস্তায় না গিয়ে বাঁ দিকে যে রাস্তাটা গেছে সেই রাস্তা দিয়ে গিয়ে আক্কেলপুরের রাস্তায় উঠবে।

ততক্ষণে ইরার ব্যাগ দু’টো জয়ের মোটর সাইকেলে বাঁধা হয়ে গেছে জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো। ইরা জয়ের মোটর সাইকেলের পিছনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। জয় দ্রুতবেগে মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো।

বটতলী এসে ইরার কথামতো বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো, রাস্তা বেশ ফাঁকা, মানুষজনের চলাচল কম। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাছ। নিজের অজান্তে জয়ের মুখ দিয়ে বের হলো সেই পরিচিত গান, এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো…

ইরা জয়ের পিঠের ওপর কয়েকবার টোকা মারলো, এই, এই গাড়ি থামাও তো।

কেনো?

ইরা অভিমানের সুরে বললো, থামাও বলছি, আমি নামবো, আমি তোমার সঙ্গে যাবো না। আমাকে নামিয়ে দাও।

জয় মোটর সাইকেল থামালো।

ইরা মোটর সাইকেল থেকে নেমে জয়ের চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে কিছুটা ধমকের সুরে বললো, আমার চোখের দিকে একবার তাকাও তো?

জয় ইরার চোখের দিকে তাকালো।

একটা নতুন অনুভূতি জয়কে আচ্ছন্ন করলো। বুকের মধ্যে একটা অন্য ধরণের সুখ।

ইরা কয়েক মুহূর্ত জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী হলো?

তোমার গান শুনে আমার সন্দেহ হলো, তাই তোমার চোখ একবার দেখে নিলাম।

কী দেখলে?

তোমাকে বলবো কেনো? বলে ইরা জয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো, জয় আমাদের এই পথ কোনোদিন শেষ হবে না, এই পথ চলবে অনন্তকাল, আজ দু’জনার দু’টো হাত এক হয়ে গেলো। প্লিজ! আমার হাতটা শক্তভাবে ধরো, কোনোদিন ছেড়ে দিও না।

জয় ইরার হাত দু’টো আমার হাতের মধ্যে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, এই তোমার হাত ধরলাম, জীবনে যত ঝড়ই আসুক কোনোদিন তোমার হাত ছেড়ে দিবো না।

তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে সোনা, বলে ইরা আবার মোটর সাইকেলে উঠে জয়ের পিঠে মাথা রাখলো।

 

কাজি অফিসের সামনে এসে মোটর সাইকেল থেকে দু’জনে নামলো। ইরা মৃদু কণ্ঠে বললো, শোনো তোমাকে একটা কথা বলি?

বলো?

এখানে শুধু ডিভোর্সটা করি আর বিয়ে অন্য কোনো কাজি অফিসে।

হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো ইরা, তাতে করে একটা সুবিধা হলো বিয়েটা কিছুদিন গোপন রাখা যাবে। কারণ তালাকের কাগজ তো পাঠাতে হবেই মতির কাছে।

কাজি অফিসের দরজা নক করতেই মধ্যবয়সী এক লোক দরজা খুলে দিলো। জয় জিজ্ঞেস করলো, কাজি সাহেব আছেন?

জি আমি কাজি, বলে সে একটা হেলান দেয়া বেঞ্চের ধুলোবালি ঝেড়ে দিয়ে বললো, বসেন, বিয়ে করবেন? বলে সে একটা মুচকি হাসি হাসলো।

ইরা না সূচক মাথা নাড়লো, জয় বললো, না একটা ডিভোর্স হবে।

ডিভোর্স দিতে হলে বিয়ের কাবিননামার কপি আর দু’জন পুরুষ স্বাক্ষী লাগবে যে।

ইরা বললো, কিন’ আমরা সাক্ষী পাবো কোথায়?

কমপক্ষে একজন পরিচিত সাাক্ষী আর একজন অপরিচিত হলেও চলবে, সেটা না হয় আমি ম্যানেজ করে নিবো। তবে কিছু বাড়তি টাকা খরচ হবে।

আচ্ছা কাজি সাহেব দু’জন স্বাক্ষীই টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায় না? জয় জিজ্ঞেস করলো।

কাজি সাহেব আমতা আমতা করে মাথা চুলকালো, জয় বললো, আপনি দু’টো সাাক্ষীই ম্যানেজ করবেন, কাজটা করে দেন।

আর কাবিননামার কপি?

অনেক আগের বিয়ে তো কাবিন হয়নি। তাহলে তো আবার খরচ বেড়ে যাবে, কাজি একটা দুষ্টুমির হাসি হাসলো।

ইরা বললো, আপনি সাাক্ষী, কাবিননামার কপি সব ম্যানেজ করবেন, কত টাকা নিবেন?

কাজি বললো, এই হাজার পাঁচেক টাকা দিয়েন।

ইরা বললো, পাঁচ হাজার না, তিন হাজার টাকা দিবো, হলে করে দেন।

অবশেষে কাজি সাহেবের সঙ্গে চার হাজার টাকায় একটা দফারফা হলো। কাজি সাহেব তার ড্রয়ার থেকে একটা রেজিস্টার বের করে লিখতে শুরু করলো, ইরা তার ব্যাগ থেকে তার ন্যাশনাল আই.ডি কার্ড বের করে দিলো।

কাজি সাহেব লেখা শেষ করে ইরাকে বললো, আপা সই করেন?

এদিকে যখন কাজি তালাকের রেজিস্টার পূরণ করছে তখন জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ইরার মধ্যে কোনো ভয়, সংকোচ, লজ্জা বলতে কিছু নেই।

ইরা স্বাক্ষর করবে এমনসময় জয় সি’র শান্ত গলায় বললো, ইরা, ভালোভাবে ভেবে দেখেছো তো?

ইরা কোনো কথা বললো না, স্বাক্ষর করে একটা স্বসি’র নি:শ্বাস ফেললো।

জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনের মধ্যে তখন অনেক কথার ঝড় বইছে, ইরা হাসতে হাসতে মতির সঙ্গে তার পঁচিশ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করলো! এতোদিন কীসের ওপর ভিত্তি করে ইরার সঙ্গে মতির দাম্পত্য জীবন টিকে ছিলো, আদৌ কি এক বিন্দু ভালোবাসাও ছিলো না, শুধু সামাজিকতা আর লোক লজ্জার ভয়ে একই ছাদের নিচে দু’টো প্রাণি বসবাস করতো! জগৎ বড়ই বিচিত্র!

জয় আবার মোটর সাইকেল স্টার্ট করে ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, এখন?

কোথায় যাবে তাও জানো না, না? মনে হয় ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানো না?

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, সেজন্যই তো মাছ ভাজা আর উল্টে দেয়ার জন্য তোমাকে নিয়ে আসা।

ইরা জয়ের গাল টেনে ধরলো, জি না, আমি মাছও ভাজবো, তোমাকেও ভাজবো, এখন নিয়ে চলো অন্য একটা কাজি অফিসে। আজই বিয়ে হবে।

দু’জনে একসাথে শুভবিবাহ, বলে হেসে উঠলো।

 

তেত্রিশ

 

কত ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলছে। ইরার পঁচিশ বছরের সংসার ভেঙ্গে গেলো। এই পঁচিশ বছরে মতির সঙ্গে কি ইরার কোনো সুখের স্মৃতি নেই যে কারণে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র কষ্ট হতে পারে, ইরার একমাত্র ছেলে শুভ, যে শুভকে ইরা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছে, তেইশ বছর যাবৎ লালন-পালন করছে, তার জন্যও কি ইরার মন একটুও খারাপ করছে না! ইরার নিজ হাতে গড়া একতলা চকচকে বাড়িটা! না, সেই বাড়ির প্রতিও ইরার কোনো লোভ নেই। ইরা একটু ভালোবাসার জন্য ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় মতির হাত ধরে বাবার বাড়ি ছেড়েছিলো কিন’ ইরার সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, মতি ইরাকে সারাজীবন একবিন্দু ভালোবাসা দিতে পারেনি। তাই একটু ভালোবাসার সন্ধানে ইরা সেই প্রেম-ভালোবাসাহীন ঘর ছেড়ে, জয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছে।

আজ ইরার কোনো কষ্ট নেই। তার সারাজীবনের স্বপ্ন, এক টুকরো ভালোবাসা, মনের মতো একজন মানুষ যে কী না তাকে সারাজীবন ভালোবাসা দিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখবে। ইরা সেই মানুষের বুকে মাথা রেখেছে। ইরার আর কী চাই! ইরার আজীবনের স্বপ্ন কিছুক্ষণের মধ্যে পূরণ হতে চলেছে।

ইরা জয়কে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কাজি অফিস চেনো?

ঠিক চিনি না তবে নওগাঁ যাওয়া-আসার পথে পাহাড়পুর একটা কাজি অফিসের সাইনবোর্ড দেখেছি।

পাহাড়পুর আর কতদূর?

এই তো সামনে…

 

কাজি অফিস খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হলো না। দু’য়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই কাজি অফিস পাওয়া গেলো। কাজি সাহেব বয়স্ক মানুষ। তার পক্ষে তার ছেলেই এখন কাজ করে। একথা বলে কাজি সাহেব ছেলেকে ফোন করলেন।  ছেলেটির নাম আব্দুল মোমিন। কয়েকমিনিটের মধ্যে মোমিন এসে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কী করবেন ভাইজান?

বিয়ে।

পাত্র-পাত্রী?

ইরা হেসে ফেললো, পাত্র-পাত্রী স্বয়ং আপনার সামনে।

মোমিন একবার একবার ভ্রু’ কুঁচকে দু’জনের আপাদমস্তক তাকিয়ে বললেন, আপনাদের আগে বিয়ে হয়নি?

জয় মোমিনকে সব ঘটনা খুলে বললো।

মোমিন বললো, ভাইজান তাহলে বিয়ের কথাটা গোপন রাখতে হবে। ইদ্দত কাল পার হওয়ার পর আমি আপনাকে বিয়ের কাবিন দিবো।

জয় একবার ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের অবস’া বোঝার চেষ্টা করলো, ওকে, তাই করো।

মোমিন মৃদু হাসলো, সাক্ষী লাগবে যে ভাইজান।

আগে জয় ইরা দু’জনের কিছুই জানা ছিলো না কিন’ ইরা মতিকে ডিভোর্স দিতে গিয়ে দু’জনের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। জয় মোমিনকে বললো, ছোটোভাই দু’টো সাক্ষী তুমি ম্যানেজ করে নিও।

মোমিন মৃদু হেসে বললো, তাহলে খরচ কিছু বেশি পড়বে ভাইজান। স্বাক্ষীদের আবার পাহাড়পুর বাজারে বিরিয়ানি খাওয়াতে হয়, টাকা দিতে হয়।

জয় বললো, শুধু ওদের কেনো, তুমিও খেও। তোমাদের বিরিয়ানি খাওয়াসহ সব মিলিয়ে কত খরচ পড়বে বলো?

মোমিন আমতা আমতা করে বললো, হাজার দশেক দিয়েন ভাইজান।

মোমিন বয়সে অনেক ছোটো, কথাবার্তায় এখনো লাজুক ভাবটা আছে। জয় বললো, তুমি আমাকে ভাইজান ডেকেছো কিছুক্ষণ পরে এই সুন্দর মেয়েটি তোমার ভাবী হবে, ভাই-ভাবীর কাছ থেকে কেউ বেশি টাকা নেয়, তুমি আব্দার করেছো ভালো কিন’ তোমার ভাবী যা বলবে তার ওপর আর কথা বলো না, ওকে?

কাজি সাহেব জয় আর মোমিনের কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার তিনি বললেন, মোমিন, কমবেশি করে কাজটা করে দাও।

মোমিনের সঙ্গেও একটা দফা-রফা হয়ে গেলো।

মোমিন রেজিস্টারে পাত্র-পাত্রীর নাম-ঠিকানা লিখে জয়কে স্বাক্ষর করতে বললো।

জয় স্বাক্ষর করার পর মোমিন ইরা স্বাক্ষর করার জায়গায় টিক চিহ্ন দিয়ে বললো, ভাবী আপনি এখানে সই করবেন, আমি আসছি বলে হয়তো মোমিন একরকম দু’জনকে একান্তে কথা বলার জন্য বেরিয়ে গেলো।

জয় পকেট থেকে আংটি বের করে ইরার আঙ্গুলে পরিয়ে দিতে দিতে বললো, এই আংটি শুধু অলংকার নয় ইরা এটা আমাদের ভালোবাসার বন্ধন। কোনোদিন যেনো আমাদের এই বন্ধনকে অসম্মান করো না।

ইরা রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে তার ব্যাগ থেকে একটা ঘড়ি বের করে জয়ের হাতে পরিয়ে দিলো, আমার এই উপহারকেও কোনোদিন অসম্মান করো না জয়।

জয় ইরার দু’কাঁধে হাত রেখে ওর চোখে চোখ রাখলো।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, জয়! আমার জয়! আজ তোমার বুকে মাথা রাখলাম জয়, আজ থেকে আমি তোমার…

 

জয় আর ইরা যখন কাজি অফিস থেকে বের হলো তখন বিকেল তিনটা বাজে। মোটর সাইকেলে পাহাড়পুর বাজারে এসে দু’জনে একটা হোটেলে ঢুকলো। হোটেলের রান্না তেমন ভালো না খাওয়ায় জয়ের অরুচি দেখে ইরা বললো, রান্না ভালো হয়নি, খেতে  খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না? ইস আজ রাতেই যদি তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে পারতাম!

জয় মুচকি হাসলো। দু’জনে ভাত খেয়ে হোটেল থেকে উঠলো। হোটেল থেকে বেরিয়ে ইরা জিজ্ঞেস করলো, এখন কোথায় যাবো?

চলো আগে বৌদ্ধ বিহারে যাই, তারপর ওখানে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের গেট দিয়ে ঢুকেই জয় ইরার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। ইরা জয়ের দিকে হাত এগিয়ে দিতেই জয় ইরার হাত ধরলো।

ইরা বললো, শক্ত করে ধরো কিন’…

জয় মাথা ঘুরিয়ে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, শক্ত করেই তো ধরেছি। আর কেউ নিয়ে যাবারও সুযোগ নেই, আর কারও কাছে ছুটে চলে যাবারও সুযোগ নেই।

ইরার বরাবরের মতো সন্দেহ প্রবণ কথা, ছুটে পালাবার সুযোগ খুঁজছো নাকি?

আবার সন্দেহ!

ইরা বিনয়ের সাথে বললো, সরি।

শুধু সরি বললে হবে না, বলতে হবে আর এমন কখনো হবে না। বিশ্বাসই ভালোবাসার মুল ভিত্তি, ভিত্তি যদি দুর্বল হয় তবে কোনো বিল্ডিং টিকে না, সহজে ভেঙ্গে পড়ে।

ইরা জয়ের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিলো এবার ইরার কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে করজোড়ে বললো, গোস্তাখী মাফ করবেন জাঁহাপনা, এমন ভুল আর কখনো হবে না।

জয় হেসে ফেললো।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, এই হাসলে কেনো? ভেবেছো আমি সরি বলেছি আর সব মিটে গেলো, আমার মন থেকে সব সন্দেহ দূর করে তোমাকেই বিশ্বাসের ভিত মজবুত করতে হবে। বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়লে কিন’ দু’জনেই মরবো মিস্টার ইঞ্জিনিয়ার।

এমনি হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ বিহার দেখে দু’জনে রেস্ট হাউজের সামনের ছোট্ট ফুল বাগানের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইরা অনেকগুলো সেলফি তুললো। কোনো কোনো ছবিতে ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে, কোনো কোনো ছবিতে জয় ইরার কাঁধে হাত রেখে।

ইরা বললো, এই ছবিগুলো আমাদের বিয়ের দিনের ছবি, আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তের, আজ আমার কী যে ভালো লাগছে, আমার স্বপ্ন, আমার সাধনা সব, সব আজ সফল হয়েছে। বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

আমারও ইরা। আজকের দিনটাও আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আমি সারাজীবন একটা মানুষ খুঁজেছি, আজ পেলাম।

ইরা মুচকি হাসি হেসে বললো, পেলাম মানে! ইদ্দত কাল বাকি আছে না, আরও তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে।

ও তাইতো মনে হচ্ছে আজ থেকেই তুমি আমার। শরিয়ত মোতাবেক না হোক আইন মোতাবেক কিন’ আজ থেকে আমরা হ্যাজবেন্ড-ওয়াইফ।

ইরা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একরকম চমকে উঠলো, এই সাড়ে পাঁচটা বাজে বাসায় যেতে…বলেই ইরা চমকে উঠলো, বাসা, কোথায় আমাদের বাসা, কোথায় যাবো আমরা এখন স্বামীধন।

জয় হেসে বললো, মোস্তাকের মেসে, ফোন করবো?

ততক্ষণে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, এ-ই আমি তোমার কাছে যাবো…

আমার কাছে?

হ্যাঁ। আমি তোমার বউ না, বউকে কি কখনো মেসে রাখে, তারওপর নতুন বউ।

সত্যি যাবে? তবে চলো আজ হোটেলে সিট নিই।

ইরার মুখে একটা কালো মেঘের ছায়া পড়লো, না না, জয়পুরহাট আমাকে অনেকেই চেনে, দেখে ফেললে বিপদ, ধুর কি বিয়ে করলাম আবার তাকে পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একদিন দু’দিন না তিন মাস। তিন মাস কি কম সময়? একটা দিনই বা কীভাবে কাটবে।

দেখতে দেখতে কেটে যাবে ইরা।

ইরা মুখ বিকৃত করে বললো, দেখতে দেখতে কেটে যাবে ইরা। হয়েছে আর বলতে হবে না এখন আমাকে কোথায় রাখবে বলো?

বললাম তো হোটেলে নয়তো মোস্তাকের মেসে।

না, আমি হোটেলে তো যাবো না, মোস্তাকের মেসেও যাবো না, ওখানে গেলে দু’য়েকদিন পর বাবা এসে নিয়ে গিয়ে মতির বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে।

তো?

আমি বাবার বাড়িতেই যাবো।

তোমার বাবা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে?

বলবো না, আগে কিছুদিন গোপন থাক, তারপর সুযোগ বুঝে বাবাকে বলবো।

আর তখন যদি মতির কাছে পাঠিয়ে দেয়?

বাহ্‌ দিলেই আমি চলে যাবো?

জয় ইরার মুখটা উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বললো, পারবে তো ইরা, দেখো শেষে যদি চাপাচাপি করে আর তোমাকে যদি ডিভোর্সের কথা বলতে হয়?

বলবো, তবে এটাও বলবো যে আমি আর কোনোদিন মতির কাছে ফিরে যাবো না। আমি একজনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে আমি তাকে বিয়ে করবো।

জয় মৃদু হেসে বললো, এখনো করবো! করাই তো হয়ে গেছে ইরা।

তাহলে চলো আমরা বিয়ে করেছি এখন আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না, আমি আমার স্বামীর কাছেই থাকবো, বলে ইরা হঠাৎ করে জয়ের পাঁ ছুঁয়ে সালাম করলো।

 

চৌত্রিশ

 

ইরা যখন মতির হাত ধরে বাবার বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো তখন বাবা-মা’সহ পুরো পরিবার সেটা মেনে নেয়নি। তখন একটানা দু’বছর ইরা বাবার বাড়িতে আসেনি এমন কি কারও সাথে যোগাযোগও ছিলো না, তারপর থেকে একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়েছিলো। সে অনেক বছর আগের কথা। সময়ের পরিবর্তনে সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছিলো। ইরা কখনো বাবার বাড়ি এলে বাসে উঠেই মা’কে ফোন করে বলতো, মা আসছি, বাসে উঠলাম।

মা দরজা খুলে দিয়েই বলতো, ইসস্‌, মুখটা শুকিয়ে গেছে একেবারে, খিদে লেগেছে বুঝি!

ইরা মৃদু হেসে বলতো, মা আমি মোটেই শুকাইনি, খিদেও লাগেনি, আমি খেয়েই বেরিয়েছি।

মা হেসে বলতো, মায়ের মন তো।

ইরা বলতো, হ্যাঁ মা আমিও এখন মা হয়েছি।

মা বাড়িতে না থাকলে রিচিকে ফোন করে বলতো, আপা আসছি রে।

রিচি দরজা খুলে দিয়েই বলতো, এসেছিস, ভালো করেছিস কতদিন তোর সাথে দেখা হয় না।

হ্যাঁ আপা আমারও তোকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো।

 

আজ দরজার কলিং বেল-এ টিপ দিতেই রিচি দরজা খুলে দিলো। রিচি গাল ফুলিয়ে আছে, দরজা খুলে দিয়ে কোনো কথা বললো না। ইরা জিজ্ঞেস করলো, কী রে আপা কেমন আছিস?

হুঁম, আছি, বলে রিচি তার রুমে চলে গেলো।

আগে ইরা এলে মা রান্না ঘর থেকে এরকম দৌড়ে আসতো ইরাকে দেখার জন্য। আজ এলো না।

রিচির পাশের রুমটা গেস্ট রুম। ইরা কখনো এলে সেই রুমেই থাকে। ইরা গেস্ট রুমে ব্যাগ রেখে রান্না ঘরে গেলো। বরাবরের মতোই মা’র গলা জড়িয়ে ধরে বললো, মা কেমন আছো?

মা’র গলার স্বর অনেকটা থমথমে, ভালো আছি মা, তুই হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি চা দিচ্ছি।

রিচির আচরণ আর মা’র গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ইরার বুক কেঁপে উঠলো, তারমানে নিশ্চয়ই মতি ফোন করে তার চলে আসাটা বলে দিয়েছে। মতি বরাবরই এমন করেছে, যতবার ইরা রাগ করে তার বাবার বাড়ি চলে এসেছে, ততবারই তার বড় বোন রিচি, মেজো বোন চায়না আর না হয় তার ছোট ভাই হিমেলকে তদ্বির ধরেছে, তারা তখন বাবা-মা’কে বলেছে আর বাবা-মা বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরৎ পাঠিয়েছে। আবার মতি, আবারও সবাইকে আগেই ফোন করেছে! ইরা নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করলো, আপনমনে ফিসফিস করে বললো, বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান…মতি মিয়া এবার আর আমি যাচ্ছি না, তোমার সব সম্পর্ক, সব আইনি আর সামাজিক শেকল আমি ছিন্ন করেছি। এবার তদ্বির করে কোনো লাভ নেই।

ইরার মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো। জয়ের ম্যাসেজ।

ইরা পড়ে দেখলো, কোথায়?

ইরা রিপ্লাই দিলো, বাসায় পৌঁছেছি। আমি পরে তোমাকে ম্যাসেজ বা রিং না দেয়া পর্যন্ত তুমি কন্ট্রাক্ট করো না প্লিজ, দেখি এদিকে অবস’া কী।

ওকে।

ইরার মা ডাক দিলো, ইরা।

আসছি মা।

ইরা তার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে এলো, রিচিও ড্রয়িং রুমে এলো। কিন’ কারও চোখ-মুখ স্বাভাবিক না, কোথাও একটা কিছু লুকিয়ে আছে।

ইরাও কিছু বললো না, প্রথমে কথা তুললো রিচি, কী রে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে এসেছিস কেনো? কোথাও যাবি নাকি?

যাবো না আপা আমি একেবারে চলে এসেছি।

একেবারে মানে?

মানে আমি একেবারে এসেছি আর কোনোদিন ও বাড়িতে যাবো না।

কেনো? কী হলো আবার?

সেতো তোরা সবাই জানিস আপা, ওর সঙ্গে আমার কোনোদিন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি আর হবেও না। তাই আমি একেবারে চলে এসেছি।

তুই বললেই হলো, একবার মতির সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে মানুষ হাসিয়েছিস এবার আবার মানুষ হাসাতে চাচ্ছিস, তাই না?

আপা!

ঠিকই বলেছি তো, বার বার এসব নাটক করিস না।

ইরার মা কিছুটা শাসনের সুরে বললো, রিচি তুই থামতো। এসেছে তো এসেছে, কী হয়েছে, মেয়ে বাবার বাড়ি আসবে, তুই এভাবে বলিস না তো। তোর বাবা আসুক, মেয়েটা দু’য়েকদিন থাক, তারপর যা হয় হবে।

রিচি আর কিছু বললো না। কোনো রকমে নাস্তা খেয়ে গজ গজ করতে করতে তার রুমে চলে গেলো।

 

ইরার বাবার নাম আহসানুল। সরকারি চাকুরি করতেন। চাকুরি করা কালীন এসোসিয়েশন করতেন আর রিটায়ার্ড করার পর যোগ দিয়েছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তিনি বিকেল নাগাদ বাসা থেকে বেরিয়ে যান, সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফিরেন। তিনি বাসায় ফিরলেন রাত ন’টায়। ইরা ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ এসেছে শুনে কিছুটা মন খারাপ করলেন। হাত-মুখ ধুয়ে খাবারের টেবিলে বসে ইরাকে ডাক দিলেন, ইরা, আয় মা।

ইরা যাবে কী না কয়েকমুহূর্ত ভেবে নিলো তারপর ডাইনিং গিয়ে বাবার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো।

আহসানুল সাহেব বললেন, ভাত খা মা।

আমি খাবো না বাবা।

কেনো?

আমার খিদে নেই, তাছাড়া আমি তো এমনিতেই রাতে কিছু খাই না। তুমি খাও।

আজ খাবি মা আমার সঙ্গে।

ইরার তার বাবার মুখে কিছুটা বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলো কিন’ তার বাবা মুখে তেমন কিছু বললেন না। ইরা বাবার কথা মতো খাবার নিয়ে বসলো কিন’ খেতে পারলো না। আজ খাবার সময় কেনো জানি বেশি বেশি করে জয়ের কথা মনে পড়ছে। বিয়ের কাবিননামায় দু’টো সই মানুষকে এতো কাছাকাছি করে দেয়। মুখে ভাত তুলতে গিয়ে জয়ের মুখটা ভেসে উঠছে। ইরা বাবার অনুরোধে দু’য়েক গ্রাস ভাত মুখে তুলে কোনোভাবে গিলে ফেললো। তারপর বললো, বাবা আমি হাত ধুই?

আচ্ছা হাত ধুয়ে একটু আমার পাশে বস।

বাবার কথায় ইরার মনে সন্দেহ দেখা দিলো, বাবার পাশে বসার অর্থটার মধ্যে সে কিছু অনুমান করতে পারলো।

ইরা হাত ধুয়ে এসে বাবার পাশে বসলো। বাবাও খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, সব সংসারে মনোমালিন্য হয় মা, ঝগড়া-বিবাদ হয় এটা নতুন কিছু না। আজকাল টি.ভি’তে সিরিয়াল দেখে, মোবাইল ফোনে আড্ডা দিয়ে আর ফেসবুকে বসে তোদের মাথায় সব ভূত চেপেছে, একটুতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলিস্‌। সংসারে সেক্রিফাইজ করতে হয় মা, এই তোর মাকে দেখ, আমি কত শাসন করি, তোরা কত কষ্ট দিস কিন’ ঠিকই তোর মা সব সামলে নেয়। সেক্রিফাইজ করতে হয় মা। সবকিছু চুলচেরা হিসেব করতে হয় না। অনেক কিছু হাসি মুখে উড়িয়ে দিতে হয়। কেউ সেক্রিফাইজ না করলে পৃথিবীতে কোনো সংসারই বুঝি টিকতো না। সেক্রিফাইজ, সেক্রিফাইজ! বলে তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

ইরা বাধা দিয়ে বলতে যাচ্ছিলো, বাবা…

আহসানুল সাহেব আবারও বলতে শুরু করলেন, আমি সব বুঝেছি মা আর বলতে হবে না, তুই এখন যা ঘুমা। কাল যা হয় হবে।

বাবা আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আমি ও বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছি, ওখানে আর ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না বাবা…

আহসানুল সাহেব একবার রাগান্বিত চোখ তুলে ইরার মুখের দিকে তাকাতেই ইরার বুক কেঁপে উঠলো। তবু ইরা সাহস করে বললো, বাবা তুমি কিন’ আমাকে ওখানে যেতে বলো না।

আহসানুল সাহেব নিজের রাগ সামলে গম্ভীর গলায় বললেন, বললাম তো তুই এখন যা, ঘুমা।

ইরা আর কোনো কথা বললো না। সে তার রুমে গিয়ে শুয়ে জয়কে ম্যাসেজ দিলো, জয় কী করছো?

কিছু না, তোমার ম্যাসেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এতো দেরি হলো?

এবার ইরা জয়কে ফোন করলো, হ্যালো।

বলো ইরা, কী খবর ওদিকের?

ইরা চাপা স্বরে ফিস ফিস করে বললো, খবর ভালো না। মতি আগেই বুঝি সবাইকে বলে দিয়েছে। সবাই আমার ওপর খুব রাগ করছে।

তাহলে?

তাহলে মানে? যা হবার হবে। সবাই রাগারাগি করলেই আমি ফিরে যাবো নাকি, এতো সহজ। কিন’ তোমার কথা শুনে তো আমি তোমার ওপর ভরসা পাচ্ছি না। তুমি বুঝি ভয় পেয়েছো।

আরে না।

শোনো আমি তোমার নাম বলবো না। হাজার হলেও আজ থেকে তুমি আমার হ্যাজবেন্ড না।

জয় হাসলো, এক্সাক্টলি।

কাপুরুষের মতো করো না। এখন তোমার বউকে রক্ষা করা তোমার দায়িত্ব। প্রয়োজনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে বলতে হবে ইরা আমার, মনে নেই শক্ত করে আমার হাত ধরে বলেছো কোনোদিন আমার হাত ছাড়বে না।

অবশ্যই।

শোনো সবকিছু কেমন যেনো থমথমে করছে। কেউ রাগারাগি করছে না কিন’ ভেতরে ভেতরে একটা তর্জন-গর্জন আছে। আমাদের ডিভোর্স এবং বিয়ে এসব কিছু কেউ জানে না, সবাই মনে করেছে এরকম তো বছরে দু’য়েকবার আমি আসি, এবারো সেভাবেই এসেছি। আমি অবশ্য সবাইকে বলেছি, বাবা বলেছে আজ ঘুমা যা হবার কাল হবে।

ইরা কান পেতে শুনলো, ড্রয়িং পায়চারি করার শব্দে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতেই রিচি একরকম দৌড়ে তার রুমে ঢুকলো।

ইরা ফিসফিস করে বললো, বড় আপা আমাকে খুব ওয়াচ করছে জয়। এখন রাখি, প্রয়োজনে আমি তোমাকে ম্যাসেজ দিবো, ওকে?

ওকে ইরা, বাই।

 

পঁয়ত্রিশ

 

ইরার মা’র নাম ফাতেমা বেগম। খুব ছোটবেলা বিয়ে হয়েছে। আহসানুল সাহেব তার সম্পর্কে মামাতো ভাই। মামাতো ভাই আর ফুপাতো বোনের মধ্যে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। ভদ্রমহিলা খুব সহজ-সরল প্রকৃতির। সারাজীবন নিজের ভালো-মন্দ, সুখ-সুবিধার কথা কিছু চিন্তা করেননি। স্বামীর আদেশ-নিষেধ মেনে চলেছেন বিনা বাক্য ব্যায়ে। বলতে গেলে স্বামী সংসারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

আহসানুল সাহেব সকালবেলা গ্রামের বাড়ি গেছেন। যাবার আগে ফাতেমাকে বলে গেছেন, তুমি কিন’ ইরাকে প্রশ্রয় দিবে না। ওকে বোঝাবে, ও যেনো কোনো ঝামেলা না করে। আমি ফিরে আসি, দেখি কী করা যায়।

বিকেলে ইরা বিছানায় শুয়ে জয়ের সাথে কথা বলছিলো, কলিং বেল বেজে উঠলো।

ইরা দরজা খুলে দিলো।

রিচি এসেছে, ইরাকে দেখে বিরক্তির স্বরে বললো, তুই যাসনি?

ইরা না শোনার ভান করে তার রুমে চলে গেলো।

রিচি তার রুমে ঢুকে কাপড় বদলে ডাইনিংয়ে এসে ইরা ইরা বলে ডাক দিলো।

ইরা তার রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

রিচি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কীরে তুই যাসনি কেনো?

ইরা মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে বললো, আমি তো বলেছি আপা, আমি আর ওবাড়িতে যাবো না।

যাবি না মানে, তোর ঘাড় যাবে। একবার পালিয়ে গেলি, আমরা অনেকদিন কলংকের অপবাদ সইলাম। আবার শুরু করলি, এই বয়সে। আজ মতি আমাকে ফোন করেছিলো, তুই আসতে বললে ও এসে তোকে নিয়ে যাবে।

কিন’ আমি তো এবার যাবার জন্য আসিনি আপা।

তুই ভাবিস না যে তুই বার বার কেলেংকারি করবি আর আমরা মেনে নিবো।

ইরা এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে কথা বলছিলো এবার যেনো তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো, শুধু আমি কেলেংকারি করিনি আপা।

তুই কী বলতে চাস্‌?

আমি মতির সাথে প্রেম করে বিয়ে করাটা যদি কেলেংকারি হয় তবে এতো বয়সে দু’বোন বিয়ে না করাটাও কেলেংকারি।

রিচি গর্জে উঠলো, কী, তোর এতোবড় সাহস, তুই আমাদের নিয়ে কথা বলিস?

সবাই আমার জন্য যেমন তোদের দিকে মানুষ আঙ্গুল তুলে কথা বলে তেমনি তোদের জন্যও আমাকে কথা শুনতে হয় আপা, মতিই তো বলে।

আমাদের জন্য মতি তোকে কথা বলে? ঠিক আছে তাহলে তুই আমাদের বাড়ি থেকে চলে যা, এখনই যা নইলে আমি তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।

তুই আমাকে বের করে দিবি, এটা তোর বাড়ি? এটা আমারও বাবার বাড়ি। তোর যেমন এবাড়িতে থাকার অধিকার আছে তেমনি আমারও আছে।

আমাদের নিয়ে কথা বলার পর তুই আবার অধিকার খাটাস, বলে রিচি ইরার চুলের মুঠি ধরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে শুরু করলো।

ইরা জোরে চিৎকার করে মা মা বলে ডাকতে শুরু করলো।

ফাতেমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললো, রিচি ছেড়ে দে, রিচি ছেড়ে দে বলছি।

রিচি তবুও ছাড়লো না।

ইরাও গর্জে উঠলো, আপা ছেড়ে দে বলছি, নইলে কিন’ আমিও হাত তুলতে বাধ্য হবো।

ফাতেমা দু’জনকে আলাদা করে দিয়ে রিচিকে ধমকের সুরে বললো, রিচি। তুই ওর গায়ে হাত তুলছিস কেনো? ওতো ঠিকই বলেছে, এটা তোর বাবারও বাড়ি ওর বাবারও বাড়ি। ও এবাড়িতে থাকবে নাকি চলে যাবে সেটা তোর বাবা বুঝবে।

বাবা বুঝবে তাই না? তুমিও ওর পক্ষেই কথা বলছো। বেশ তবে আমিও আজ বাবাকে বলবো, তোমাকেও বলছি মা শোনো, তোমরা হয় ইরাকে নিয়ে থাকবে নয়তো আমাদের দু’বোন আর ভাইকে নিয়ে থাকবে।

ফাতেমা বললো, আমরা তোদের বাবা-মা, আমরা চাই সব সন্তানকে নিয়ে একসাথে থাকতে, তোর বাবা আসুক, তোর বাবা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে।

আমিও একটা কথা বলে দিলাম মা, ইরা যদি এ বাড়িতে থাকে তবে আমি এবাড়িতে থাকবো না, চায়না, হিমেলও এবাড়িতে কোনোদিন আসবে না বলে রিচি ছাদে চলে গেলো।

ইরা তার রুমে ঢুকে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ইরার মা তার রুমে ঢুকলো, ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কাঁদিস না মা। মেয়েদের জীবন এমনই, মেয়েদের জীবনে অনেক সেক্রিফাইজ করতে হয়। আমাকে দেখ, সেক্রিফাইজ করতে করতে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। কোনোদিন তোর বাবার ওপর একটা কথাও বলিনি। তোর বাবা আসুক, মতিকে ফোন করুক, কাল মতি এসে তোকে নিয়ে যাক।

ইরা নিজেও জানে মা’র কিছু করার নেই, তবুও কাঁদতে কাঁদতে বললো, না মা, আমি আর কোনোদিন মতির কাছে যাবো না। তোমরা যদি না রাখো তবে আমার যেদিকে খুশি চলে যাবো।

যেদিকে খুশি মানে?

হ্যাঁ মা, আমি মতিকে তালাক দিয়েছি,

তালাক দেয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমা ইরার মুখ চেপে ধরলো, এভাবে বলিস না মা, এটা মুখে উচ্চারণ করার সাথে সাথে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে মা। আর একবারও উচ্চারণ করিস না।

ইরা প্রচণ্ড রেগে তিনবার বললো, তালাক, তালাক, তালাক।

ফাতেমা অত্যন্ত ধৈর্যশীল, অন্য কোনো মা হলে সঙ্গে সঙ্গে গালে ঠাস্‌ করে একটা থাপ্পড় মারতো। কিন’ ফাতেমা খুব শান্ত, শীতল কণ্ঠে বললো, এতো ক্ষোভ নিয়ে সংসার করছিস মা। তবু বলি কী করবি মেয়েদের জীবন এমনই। আমার মনে কত কষ্ট আছে কোনোদিন কাউকে বলেছি, নাকি তোর বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছি। তোর বাবার মতো একটা নিষ্ঠুর মানুষের সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম দাসিগিরি করে। কোনোদিন দেখেছিস এই সংসারে আমার কথার কোনো মূল্য তোর বাবা দিয়েছে। যদি দিতো তবে আমিও তোকে বলতাম ঠিকই করেছিস মা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একেবারে মরাই ভালো।

ইরা মায়ের কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

 

রাতে আহসানুল সাহেব এলেন। তিনি বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে রিচি তার রুম থেকে বেরিয়ে এলো, চোখ-মুখ লাল করে, রাগান্বিত স্বরে বললো, বাবা বিকেলে মাকে বলেছি এখন তোমাকেও বলছি ইরার ব্যাপারে কিন’ তোমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আহসানুল সাহেবকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো, তিনি সোফায় ধপাস করে বসে পড়লেন, তারপর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী সিদ্ধান্ত?

ইরা যদি এবাড়িতে থাকে তবে আমরা কেউ এবাড়িতে থাকবো না।

আমরা বলতে কে কে?

আমরা দু’বোন এক ভাই। তোমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি একজনকে চাও নাকি তিনজনকেই?

আহসানুল সাহেব বললেন, সবাই আমার সন্তান, আমি সবাইকে নিয়েই থাকতে চাই।

তাই বলে ও বার বার করে আমাদের মান-সম্মান ডুবাবে, পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধবরা আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলবে আর আমরা সেটা মেনে নিবো। ইরা যদি সত্যি সত্যি মতিকে তালাক দেয় আর তুমি যদি ওকে বাড়িতে রাখো তবে আমরা সবাই বাড়ি থেকে চলে যাবো।

ইরা শুয়ে শুয়ে কথা শুনছিলো আর ভাবছিলো কখন বুঝি বাবা ডাক দিবে। এবার সত্যি সত্যি আহসানুল সাহেব ইরা বলে ডাক দিলেন।

ইরার বুক কেঁপে উঠলো, কী জানি আজ কী আছে তার কপালে!

ইরা তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়ালো।

আহসানুল সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, কী হয়েছে বলতো?

আমি ওকে তালাক দিয়েছি বাবা।

আহসানুল সাহেব গর্জে উঠলেন, কী!

ইরা সি’র, শান্ত কণ্ঠে বললো, জি বাবা।

আহসানুল সাহেব বললেন, কিন’ তুই কি জানিস মেয়েদের তালাক দেয়ার ক্ষমতা শরিয়তে দেয়া হয়নি।

আইনে দেয়া হয়েছে আমি সেই ক্ষমতা বলে ওকে তালাক দিয়েছি বাবা।

এটা তালাক হবে না, রাগের মাথায় কেউ কাউকে তালাক দিলে তালাক হয় না।

আমি আর ওর কাছে যাবো না বাবা।

তবে কী করবি?

এখানে থাকবো, তোমাদের সাথে।

রিচি আগুনের মতো জ্বলে উঠলো, বললেই হলো, তুই এখানে থাকতে পারবি না। আমি কিন’ তোমাকে বলে রাখছি বাবা তুমি যদি ওকে রাখো তবে আমরা তিনজনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।

আহসানুল সাহেব রিচিকে ধমক দিলেন, তুই চুপ কর। যেখানে আমি কথা বলছি সেখানে তুই কথা বলছিস কেনো? বলে আহসানুল সাহেব ইরাকে বললেন, তোর ওপর নিশ্চয়ই শয়তান ভর করেছে নইলে এতো সুন্দর, ঘর-সংসার ছেড়ে, স্বামী-সন্তান ছেড়ে চলে আসবি কেনো? সংসারে টুকটাক ভুল-ত্রুটি, মনোমালিন্য হয় তাই বলে খুব সহজে কেউ সংসার ভাঙ্গে না।

ইরার মনে তখন কথার ঝড় বইছে, সংসার, তুমি সংসার বলছো! দু’জন মানুষ একই ছাদের নিচে থাকলেই সংসার হয় না বাবা। মনের মিল থাকতে হয়, ভালোবাসা থাকতে হয়। যে সংসারে ভালোবাসা নেই সেটা সংসার না বাবা।

আহসানুল সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, শয়তান ভর না করলে তুই এমন করতিস না, যা নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, কাল ভোরবেলা উঠবি, আমার সঙ্গে ফজরের নামাজ পড়বি, আল্লাহ যেনো তোকে সঠিক পথ দেখায়।

ইরা তার রুমে চলে এলো। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে জয়কে একটা ম্যাসেজ দিচ্ছিলো এমনসময় ইরার মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো, কী খবর ইরা?

ইরা লিখলো, আল্লাহ’ই ভালো জানেন। কী যে হতে যাচ্ছে। লিখে ইরা অনেকক্ষণ ধরে রাতে বাবার সঙ্গে তার কথাবার্তাগুলো ম্যাসেজের মাধ্যমে জয়কে লিখলো।

ফোন দিই ইরা, একটু কথা বলি?

ইরা ম্যাসেজে লিখলো, না, এখন কথা বলা যাবে না। কাল বাবার সঙ্গে নামাজ পড়বো, দেখি বাবাকে ম্যানেজ করতে পারি কী না, আমি ফোন না দেয়া পর্যন্ত তুমি কিন’ আর কন্ট্রাক্ট করো না।

ওকে।

বাই।

 

সারারাত ইরার চোখে ঘুম নেই। হাজার রকম দুশ্চিন্তা মনের মধ্যে ভিড় করছে। বাবাকে তার শান্তই মনে হলো কিন’ সে সারাজীবন বাবাকে যা দেখে এসেছে তাতে করে এই ঘটনা জানার পর বাবা শান্ত থাকার কথা নয়। ইরা প্রায়ই এভাবে চলে আসে আবার ক’দিন থেকে ফিরে যায়। এসব দেখে দেখে কি বাবাও মতির ওপর বিরক্ত, সেজন্য ইরা মতিকে তালাক দেয়ার পরও যেভাবে রেগে যাওয়ার কথা ছিলো সেভাবে রেগে গেলো না। ইরার কাছে যেনো রহস্যময় মনে হলো।

ইরা জয়কে ম্যাসেজ দেয়ার জন্য মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো, ম্যাসেজ লিখতে গিয়ে ডাইনিংয়ে পায়চারি করার শব্দে ইরা কান পেতে রইলো।

রিচি ডাইনিংয়ে পায়চারি করছে। ইরা ম্যাসেজ লেখা বন্ধ করে মোবাইল ফোন রেখে দিলো।

ফজরের নামাজের সময় আহসানুল সাহেব ইরা বলে ডাক দিতেই ইরা সাড়া দিলো, ওজু করে আসছি বাবা।

ইরা বাবার সঙ্গে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে আহসানুল সাহেব ইরাকে কাছে ডেকে নিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, সংসারে একটু আধটু মনোমালিন্য হতেই পারে মা, তাই বলে সংসার ভাঙ্গতে হয় না। তালাক আল্লাহর কাছে খুব অপছন্দীয় কাজ, কোনো পুরুষ যখন কোনো নারীকে তালাক দেয় তখন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আর শরিয়তে তো মেয়েদের তালাক দেয়ার কোনো নিয়ম নেই।

আমি বিশ্বাস করি না বাবা যে মেয়েদের তালাক…

আহসানুল সাহেব ইরার মুখ চেপে ধরলেন, এই কথাটা বার বার উচ্চারণও করতে নেই। আমি মতিকে ফোন করেছি মা, ধমকও দিয়েছি। ও আর তোর সঙ্গে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করবে না।

বাবা…

আহসানুল সাহেব ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুই কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নে, আমি তোকে বটতলী পর্যন্ত রেখে আসি।

ইরা আবার আপত্তি করলো, বাবা।

আমি বুঝতে পেরেছি তোর ওপর শয়তান ভর করেছে, আয় মা আল্লাহ’র কাছে মোনাজাত করি আল্লাহ যেনো আমাদের শয়তানের ওয়াছ-ওয়াছা থেকে রক্ষা করে। তারপর ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে চল তোকে আমি রেখে আসি।

 

ছত্রিশ

 

সারারাত মতির চোখে ঘুম নেই। ইরার মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সেই-ই কিশোরী বয়সে ইরাকে সে বিয়ে করেছে, তারপর তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে স্কুলে চাকরি দিয়েছে। একমাত্র সন্তান শুভ গ্রাজুয়েশন করছে। আচ্ছা ইরার বয়স কত হলো, মতি মনে মনে হিসেব করলো চল্লিশের কাছাকাছি। চল্লিশ বছর বয়সের ইরা স্বামী-সংসার-সন্তান, চাকুরি, এই ঝকঝকে বাড়ি সব ছেড়ে চলে যাবে। এটাও কী সম্ভব?

মতির চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক যুগল অস্পষ্ট ছবি কোনো এক পুরুষ হাত যেনো কোনো এক নারীকে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তার ইরার মতোই। মতো না, ইরা, হ্যাঁ ইরাই তো! ইরা, কোথায় যাচ্ছো ইরা? আমাকে ছেড়ে তুমি কার কাছে যাচ্ছো, যে সুখের জন্য তুমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছো তার কাছে গিয়ে আদৌ কি তুমি সুখে থাকবে? ইরা, যেওনা ইরা, তুমি ভুল করছো। তুমি যার কাছে যাচ্ছো সে তোমাকে ক’দিন ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। ইরা, আমার ইরা!

ইরা পিছু ফিরে তাকালো, তুমি কি আমাকে সম্মানে রেখেছো? আর যাই হোক তোমার মতো অসম্মান করবে না?

তুমি কার সাথে যাচ্ছো একবার বলো।

সেটা জেনে তোমার লাভ নেই?

না আমি লাভ ক্ষতির কথা ভাবছি না কিন’ আমাদের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক, তুমি এই সম্পর্ক নষ্ট করে কার কাছে যাচ্ছো সেটা জানারও কি আমার কোনো অধিকার নেই?

ইরা রেগে জ্বলে উঠলো, না নেই। তোমাকে ডিভোর্স করার পর আমার ওপর আর তোমার কোনো অধিকার নেই। কাজেই আমি কার কাছে যাচ্ছি এটা জানারও তোমার কোনো অধিকার নেই। আর হ্যাঁ তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, কোনোদিন যেনো আমাকে ফলো করো না। আমাদের নতুন জীবনে কোনো অশান্তি সৃষ্টি করো না।

ইরার প্রত্যেকটি কথা যেনো মতির বুকের মধ্যে শেলের মতো আঘাত করলো, ইরা, তুমি কি আমার ইরা, যাকে আমি সেই ছোটবেলা হাত ধরে নিয়ে এসেছিলাম, তারপর তোমার সাথে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত সুখের স্মৃতি, কত মধুর স্মৃতি।

ইরা মতি’র কথার প্রত্যুৎত্তরে তীর্ষক দৃষ্টিতে বললো, শুধু কি মধুর স্মৃতি আর সুখের স্মৃতিই আছে। কোনো কষ্টের স্মৃতি নেই। আমার আজও মনে আছে আমি সেই ছোটবেলা কিশোরী মেয়েটি তোমার বাড়িতে এসেছিলাম, আর সেই শীতের রাতে ধান সিদ্ধ করেছিলাম শুভকে কোলে নিয়ে।

আমি তোমাকে লেখাপড়াও শিখিয়েছিলাম।

তুমি শেখাওনি আমি নিজে পড়েছি আর বাবা টাকা দিয়েছে। তারপরও যেটুকু সুযোগ তুমি দিয়েছো সেটুকু তোমার প্রয়োজনে। আমার সব টাকা তুমি নিয়েছো কোনো না কোনো ছুঁতো দেখিয়ে। অবহেলাও আমাকে কম করোনি। আমি তোমার অবহেলা আর অত্যাচার সহ্য করে কত বার বাবার বাড়ি গেছি, আর তুমি তদ্বির করে ফিরিয়ে এনেছো। প্লিজ আর এসব ঝামেলা করো না আমি তোমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য যাচ্ছি, চিরদিনের জন্য।

মতি আবেগপ্রবণ হয়ে বললো, ইরা তুমি! ইরা তুমি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারছো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ পারছি। একদিনে না, দিনের পর দিন তোমার অবহেলা আর বঞ্চনায় আমি নিষ্ঠুর, পাথর হয়ে গেছি। আমাকে আর আবেগের কথা বলে লাভ নেই।

যাও, তবে এখনই যাও বলতে বলতে উত্তেজনার বশে মতি বিছানা থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলো।

কয়েকমুহূর্তের মধ্যে মতি নিজেকে সামলে নিলো, ইরা, আমার ইরা, আমি কি তবে ঘুমের মাঝে…

মতি বিছানায় বসে চিন্তা করতে লাগলো। রাতে রিচি বলেছে ইরা তাকে তালাক দিয়েছে আর তখন থেকেই মতির ঘাড়ের রগ ব্যথা করতে শুরু করেছে। দু’চোখে যেনো ঝাপসা হয়ে আসছে। মতি রাতে কোনোকিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। ও মনে পড়েছে রাতে একবার শুভ ফোন করেছিলো। মতি শুভ’র সঙ্গে কথা বলেছে, কী কী যেনো বলেছে মতি মনে করার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, হ্যাঁ রাতে শুভকে ফোন করেছিলো তারপর…

শুভ ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো বাবা।

বাবা বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে গেছে, কথাটা বলার আগে মতি অনেক সাজিয়ে নিলেও শুভকে বলতে গিয়ে মতি সব গুলিয়ে ফেলেছে।

শুভ তাড়া করলো, বাবা বলো, কী হয়েছে? তুমি এমন করছো কেনো? বাড়িতে কী অঘটন ঘটে গেছে?

শুভ তোর মা আমাকে ডিভোর্স করেছে।

শুভ আঁৎকে উঠলো, বাবা! তুমি কী বলছো! কে বললো তোমাকে?

আমি ঠিকই বলেছি বাবা, তোর রিচি আন্টিকে কাগজ দেখিয়েছে।

কয়েকমুহূর্ত শুভ’র কণ্ঠ থেকে কোনো কথা বের হলো না। তারপর তার অস্ফুটস্বর ভেসে এলো, বাবা!

ডিভোর্স করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মা কোথায় বাবা?

তোর নানার বাড়ি।

আমি একবার মা’র সঙ্গে কথা বলি বাবা, তার আগে তুমি আমাকে বলো তোমার সঙ্গে কি মা’র কিছু হয়েছে, মানে কোনো ঝগড়া-ঝাটি, কথা কাটাকাটি…

না বাবা কিছু হয়নি। আমার ধারণা তোর মা কারও সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে।

বাবা তুমি কী বলছো এসব! ছিঃ বাবা, মা’র সম্পর্কে তুমি এমন নোংরা কথা বলছো!

আমি কনফার্ম বাবা, তাছাড়া কোনোকিছু না থাকলে তোর মা এমন একটা কাণ্ড করে বসবে কেনো?

বাবা সামনে আমার পরীক্ষা নইলে আমি কালই বাড়ি আসতাম। তুমি একটু ধৈর্য ধরো বাবা, আমি মা’র সঙ্গে একটু কথা বলি।

শুভ’র সাথে কথা বলার পর থেকে মতি শুয়ে পড়েছে, ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন’ ঘুম! এতো দুশ্চিন্তার মধ্যে কী আর ঘুম আসে।

মতি ডাইনিংয়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করার পর একটা ঘুমের তন্দ্রা তাকে আচ্ছন্ন করলো, পাশের রুম থেকে যেনো কারও নিঃশ্বাস ধ্বনি ভেসে এলো, ইরা, ইরা এলো নাকি?

ইরার সঙ্গে মতির মধুর সম্পর্ক ছিলো খুব কম দিনই। বেশিরভাগ সময় কোনো না কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হতো আর ইরা চলে যেতো পাশের রুমে কয়েকদিন এভাবে চলার পর আবার মতি তার মান ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসতো। এ যেনো দীর্ঘদিনের খেলা। মতির কাছে ইরার শ্বাস-প্রশ্বাসের ধ্বনিও যে অনেক দিনের চেনা।

মতি বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে গেলো, হ্যাঁ ইরা-ই তো। ইরা, কখন এলে তুমি?

ইরা চিৎকার করে উঠলো, কে? কে তুমি?

মতি মৃদু কণ্ঠে বললো, আমি।

কেনো? তুমি কেনো? তুমি তোমার রুমে যাও।

কেনো?

ইরা অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠে বললো, বললাম তো আমি তোমাকে ডিভোর্স করেছি।

মতি রিচি’র সঙ্গে তার কথা বলার বিষয়ে একেবারে চেপে গেলো, আমাকে ডিভোর্স করলে তো আমার কাছে নোটিশ আসবে ইরা।

সময় হলে কাজি অফিস থেকে ডিভোর্সের নোটিশ চলে আসবে।

মতি কয়েকসেকেন্ড হতবাক হয়ে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর শান্ত স্বরে বললো, ইরা, ইরা তুমি কি কারও সাথে কোনো রিলেশনে জড়িয়েছো? জড়ালে বলো আমিও তোমাকে তার কাছেই পাঠিয়ে দিবো।

কারও সঙ্গে জড়ানোর কথা আসছে কেনো? আমি তোমাকে ডিভোর্স করেছি, যা হবার তোমার সঙ্গেই হবে।

মতি না সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, অসম্ভব, কারও সাথে না জড়ালে তুমি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিবে কেনো? আমাদের পঁচিশ বছরের সংসার, কতকিছুই তো হয়েছে, কত ঝগড়া হয়েছে, মারামারি হয়েছে, তুমি বাবার বাড়ি চলে গেছো আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি কিন’ তুমি তো এমন সিদ্ধান্ত নাওনি। অথচ এখন কোনোকিছু না হতেই তুমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলে, এর মধ্যে অবশ্যই কারও ইন্ধন আছে, কারও সাথে রিলেশন না হলে তুমি এতো সাহস করতেও পারতে না।

ইরা কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, শোনো কারও সঙ্গে রিলেশনের কথা বলছো কেনো? আমাদের পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে পঁচিশ মিনিট কি তুমি আমাকে সুখ দিতে পেরেছো? শান্তি দিতে পেরেছো? অন্যের ইন্ধন না দেখে নিজের ব্যর্থতা খোঁজো। তুমি কি সারাজীবন কখনো আমার কথা ভেবেছো? তোমার কাছে এসে এই সংসারের ঘানি টানতে টানতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমি একটু আমার মতো করে বাঁচতে চাই। তাই তোমাকে ডিভোর্স করেছি।

তাহলে ডিভোর্সের পর আমার বাড়িতে এলে কেনো?

আমি তো তোমার বাড়িতে আসিনি।

মানে?

মনে নেই বাড়ির কাজ শুরু করার আগে তুমি আমার আর শুভ’র নামে বাড়িটা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছো।

অ তাইতো, তাহলে তো আমাকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় বলে মতি মাথা ঝাঁকাতে লাগলো।

না, তা যেতে হবে না। আমিই চলে যাবো। চিরদিনের জন্য, তোমাকে সব ছেড়ে দিয়ে যাবো।

ইরার কথা শুনে মতিরও প্রচণ্ড রাগ হলো, ঠিক আছে তুমি যখন যাবেই তাহলে তুমি লিখে দিয়ে যাও।

কী লিখে দিয়ে যাবো?

তুমি যে নিজ ইচ্ছায় যাচ্ছো। সেটা লিখে দিয়ে যাও।

ওকে। বলে ইরা তার রুম থেকে কাগজ-কলম এনে বললো, বলো কী লিখে দিবো?

লিখো আমি নিজ ইচ্ছায় কারও প্ররোচনা ছাড়াই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।

ইরা মতির কথামতো লিখে দিয়ে কিছুটা অহংকারের সুরে বললো, ওকে! এবার তাহলে আমি আসি?

মতি ইরার হাত ধরার চেষ্টা করলো কিন’ ইরা তার হাত জোরে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, আমাকে ছুঁবে, আমি চলে যাচ্ছি।

মতি আকুতি করে বললো, যেওনা ইরা, যেওনা। আমি যদি কিছু ভুল করে থাকি তবে মাফ করে দাও। তুমি থাকো, বাকি জীবনটা একসাথে কাটিয়ে দিই। নিজেদের জন্য না হোক অন্তত: শুভ’র জন্য হলেও তুমি তোমার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করো।

সরি, বলে ইরা মতিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

মতি ইরা, ইরা বলে পেছন থেকে কয়েকবার ডাকতে ডাকতে হাত বাড়ালো কিন’ তার হাত শূন্য ভাসতে লাগলো। মতির ঘুম ভেঙ্গে গেলো

 

সাঁইত্রিশ

 

ইরা জয়কে একবার বলে দিয়েছে বাবার বাড়িতে থাকা অবস’ায় সে যেনো ফোন বা ম্যাসেজ না দেয় ইরা নিজেই যোগাযোগ রাখবে কিন’ এই ইরার যোগাযোগ রাখার নমুনা। নাকি ইরা বাবার বাড়িতে গিয়ে নতুন কোনো সমস্যায় পড়েছে। জয় একবার ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকসেকেন্ড ভেবে নিলো ফোন দিবে কী না, তারপর ফোন রেখে দিলো।

ইরা ফোন করলো তখন সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। জয় ফোনটা হাতে নিয়েই উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, ইরা! কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? তুমি ঠিক আছো তো?

অনেক সমস্যা জয়, বলে ইরা বাবার বাড়িতে তার আর রিচি’র ঝগড়া এবং বাবার তাকে বটতলী পৌঁছে দেয়ার সব ঘটনা বললো।

জয় আঁৎকে উঠলো, তারমানে তুমি এখন বাড়ি গেছো?

না বাড়ি যাবো কেনো?

তো?

আমি এখন আমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

ইয়ার্কি করো না, সবসময় ইয়ার্কি ভালো না।

আমার গন্তব্য কোথায় তুমি জানো না জয়! বুঝতে পারলে না। আমি এখন তোমার উদ্দেশ্যে।

সত্যি বলছো? তুমি কি ভাবছো আমি চলে যাবো কোথাও?

ইরা! কীভাবে কী হলো ইরা, বলো প্লিজ!

সেটা পরে জেনো আগে বাসা ঠিক করো, সেদিন যে তুমি বললে মাস্টারপাড়ায় একটা বাসা দেখেছো, সেদিন ফাইনাল করোনি, ওটা এখনই ফাইনাল করো।

তুমি কোথায়?

আমি আসছি, এই এক ঘণ্টার মধ্যে।

জয় একরকম চমকে উঠলো, এক ঘণ্টার মধ্যে?

হ্যাঁ। এখনই কথা বলো। এবার যেনো আমাকে পথে পথে ঘুরে নিয়ে বেড়াইও না।

ওকে চলে এসো।

ইরা অটোবাইক জয়পুরহাটের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ইরার মনে কোনো ভয় বা সংকোচ নেই। আজ সে মুক্ত, মতিকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়িতে উঠেছিলো বাবা আবার তাকে মতির বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ইমোশনালি ব্লাকমেইল করেছিলো। ইরা সবকিছু কাটিয়ে এখন অটোবাইক নিয়ে সে তার প্রাণের টানে ছুটে চলেছে।

বটতলী এসে জয়কে ফোন করলো, তুমি একটু এগিয়ে এসো আমাকে নিয়ে যাও।

কোথায় আসবো বলো?

বটতলী থেকে যে রাস্তাটা আক্কেলপুর রোডে এসে উঠেছে সেই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াও।

কী হতে চলছে এই ভাবনা যেনো কারও নেই। ইরা জয়ের সাথে চলে যাবার পর শুভ’র কী হবে, জয় ইরাকে বিয়ে করার পর সামিনা তা কীভাবে মেনে নিবে তার দুই ছেলে মানিক-রতন মেনে নিবে কী না। এসব চিন্তা করার সময় তাদের নেই। ইরা সারাজীবন এমন একজন মানুষকে খুঁজেছে যে তার মনের ভাষা বুঝবে, পেয়েছেও। তাইতো ইরা আজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে কোনো পিছুটান তাকে আর আটকাতে পারবে না। আজ সে অনিচ্ছার সংসার, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলবে, জয়, আমার জয়!

জয়ও সারাজীবন এমন একজন সঙ্গীই খুঁজেছে। সেই অপরূপা, সেই হৃদয়বতী আজ থেকে তার স্ত্রী তার হৃদয় মন্দিরে তাকে সারাজীবন ধরে রাখবে। জয় মোটর সাইকেল চালিয়ে রাস্তার মোড়ে আসার আগেই ইরা পৌঁছেছে। দূর থেকে দেখে জয় ইরাকে চিনতে পারলো, ইরা, হ্যাঁ ইরা-ই তো। ইরা! আমার ইরা! আমার সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন আমার চোখের সামনে। জয়ের বুকটা ধক ধক করে উঠলো।

ইরার সামনে দু’টো বড় বড় ব্যাগ। জয় ব্যাগ দু’টো মোটর সাইকেলে বেঁধে নিতে নিতে ইরা বললো, তুমি ব্যাগ বাঁধার রাবার নিয়ে এসেছো? এই না হলো আমার যোগ্য…

জয় ইরার কথা শেষ হওয়ার আগেই বললো, স্বামী।

তারপর দু’জনে হেসে উঠলো।

জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো, ইরা জয়ের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে জয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, কী বললে তুমি?

কী বললাম মানে?

স্বামী? মানে হ্যাজবেন্ড?

কক্ষনো না, আমরা স্বামী-স্ত্রী বটে কিন’ আমার কাছে তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। স্বামী সম্পর্কটার মধ্যে কেমন যেনো একটা শাসন-শোষণ ভাব আছে। বন্ধু সম্পর্কটাতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্য বোধ করি।

জয় মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে কিছুটা পিছু ফিরে বললো, তবে তাহাই হোক।

দু’জনে আবারও হেসে উঠলো।

কিছুদূর যাওয়ার পর ইরা জিজ্ঞেস করলো, তো আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো মহারাজ?

তুমি না এখনই বললে আমাকে বন্ধু ভাবতে তুমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, তবে আবার মহারাজ কেনো মহারাণী?

বলবোই তো আমি তোমাকে সব বলবো, তুমি আমার বন্ধু, আমার স্বামী, আমার সাত রাজার ধন, তুমি, তুমিই আমার সব বলে ইরা জয়ের পিঠে মাথা রাখলো।

জয় জোরে মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো।

ইরা আবার জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো বলো না গো?

কেনো আমার সাথে যেতে তোমার কি ভয় করছে?

ভয় করবে কেনো? নির্ভরতা না থাকলে আমি তোমার কাছে চলে আসি? তবু কোথায় যাচ্ছো একবার জানতে ইচ্ছা করছে।

সবার আগে তো কাজি অফিস যেতে হবে ইরা।

আবার কাজি অফিসে কেনো?

বিয়ে করতে হবে না।

সেদিন তো হলোই।

জয় মৃদু হেসে বললো, সেদিন বিয়ে হয়নি ইরা, রেজিস্ট্রি হয়েছে। আর আজ বিয়ে হবে।

ও তাইতো।

মোমিনকে জয় আগেই ফোন করে বাসায় থাকতে বলেছিলো। মোমিনের বাসার গেটে মোটর সাইকেলের হর্ন দিতেই সে বেরিয়ে এলো, ভিতরে আসেন ভাইজান।

ইরা আর জয় মোমিনের বাসায় ঢুকলাম। সে দু’জনকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে বললো, জি ভাইজান বলুন এখন কী করতে চান?

জয় কিছু বলার আগেই ইরা বললো, মোমিন আমি ওর কাছে একেবারে চলে এসেছি, মানে চিরদিনের জন্য। এখন তুমি আমাদের বাকি কাজ করে দাও।

মোমিন একবার জয়ের দিকে তাকাতেই জয় সায় দিলো, তুমি সব ব্যবস’া করো মোমিন।

ভাইজান একজন হুজুর লাগবে, ওকে কিছু হাদিয়া দিতে হবে। আর বলে… মোমিন কী যেনো একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো।

জয় আশ্বাস দিয়ে বললো, আর কী বলে ফেলো।

বিয়েতে মিষ্টিমুখ করাবেন না ভাইজান?

হ্যাঁ অবশ্যই।

মোমিন জোরে মহসিন বলে ডাক দিতেই একটা ছেলে দরজায় এসে দাঁড়ালো। ভাইজান ওকে মিষ্টি আনার টাকা দেন বলতেই জয় পকেট থেকে মিষ্টি কেনার টাকা মহসিনকে দিতেই মহসিন চলে গেলো।

মোমিন পাশের রুমে গেলো। জয় ইরার গা ঘেঁষে বসলো, তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিতেই ইরা জয়ের চোখে চোখ রাখলো, জয়, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো!

জয় ইরার থুতনি উঁচু করে ধরে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ইরা, কী বলছো তুমি? আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো এটা তুমি ভাবছো কী করে। আমরা বিয়ে করছি আর তুমি বলছো আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো!

ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, জয়! আমার জয়!

 

আটত্রিশ

 

পৃথিবীর সব মানুষের জন্য বাসররাত একটা কাঙ্ক্ষিত রাত। ইরা তার সেই কাঙ্ক্ষিত রাতটির স্বপ্ন দেখতো সিনেমার মতো করে, সেই কিশোরী বয়স থেকে। সে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরবে, ম্যাচিং করে লিপস্টিক, আলতা, টিকলি, হাতে মেহেদি পরবে, কপালে আর চিবুকে আলপনা আঁকা থাকবে। বাসরঘর ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করবে। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে তাজা ফুল। তার বর আসবে সেরোয়ানি পরে, মাথায় থাকবে পাগড়ি। ইরার মুখ উঁচু করে চোখে চোখ রাখবে, আবেগে ইরা চোখ বুজবে। তার সেই স্বপ্নের রাজকুমার বলবে, তুমি খুব সুন্দর, তোমার মতো রূপে, গুণে অনন্যা বউ পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। ইরা এমন একটা বাসররাত কল্পনা করেছে সারাজীবন।

ইরার সঙ্গে মতির বাসররাতটা ইরার আকাংখামতো হয়নি। পালিয়ে বিয়ে করার পর দু’জনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিলো কখন জানি ইরার বাবা সিনেমার বাবাদের মতো ইরাকে মতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এমনি আতঙ্কের মধ্যে ইরার বাসর রাত হয়েছিলো মতির এক বন্ধুর বাড়িতে। গভীর রাতে ওরা পালিয়ে গিয়ে উঠেছিলো সেই বন্ধুর বাড়িতে। মতির সেই বন্ধুই কাজি ডেকে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো কোনোরকম প্রস’তি ছাড়াই, অনেকটা গোপনীয়তার মধ্যে। তারপর একটা মাটির দেয়ালের বাড়িতে হয়েছিলো বাসররাত, জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রাত!

ইরা মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন অপূর্ণই ছিলো। ইরা ভেবেছিলো তার এই স্বপ্ন বুঝি কোনোদিন পূরণ হবে না। না হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক। জয়ের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ার পর থেকে ইরার মনের মধ্যে আবার সেই স্বপ্নটা যেনো বার বার তার হৃদয়ে ভেসে উঠছিলো। ইরার ভাবছিলো জয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হলে বাসররাতটা হবে তার স্বপ্নের মতো। তার মনের মতো মানুষের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত রাতটাও সে সাজাবে মনের মতো করে।

দু’রুমের একটা ছোট্ট বাসা। একটা ছোট ডাইনিং স্পেস, কিচেন, একটা এটাচড বাথ। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে বাসাটা ঠিক করেছে জয়। বাসা দেখে ইরা বললো, খুব সুন্দর তো। কীভাবে পেলে এতো তাড়াতাড়ি?

পেয়েছি, তোমার পছন্দ হয়েছে তো।

অফকোর্স। এমন সুন্দর মনের মানুষ, ছোটখাটো সুন্দর একটা বাসা আর একটা ছোট্ট সংসার। আর কী চাই জীবনে বলো। সবকিছু আমার খুব পছন্দ হয়েছে জয়! খুউব! বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

জয় ইরার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিতেই ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, আবেগজড়িত কণ্ঠে ইরা বললো, জয়! আমার জয়! আমার স্বপ্ন, সাধনা, আমার রাজকুমার জয়!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ইরা, আমার ইরা!

দু’জনের হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের বুকে মাথা রেখে আবেগে দু’চোখ বুজে চুপ করে রইলো। জয় মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, ইরা!

বলো।

চুপ করে আছো কেনো?

তোমার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন অনুভব করছি জয়।

কী পেলে?

পেলাম শান্তি, তৃপ্তি, নির্ভরতা। তুমি আমার, শুধু আমার! তোমার হৃদপিণ্ডে প্রতিটি স্পন্দন বলছে তুমি আমার। তুমি কিছু বুঝতে পাচ্ছো না জয়?

পাচ্ছি ইরা, পাচ্ছি। তুমি আমার জন্য এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছো তোমার প্রতিটি স্পন্দন যেনো সে কথা-ই বলছে। আজ থেকে আমরা শুধু দু’জনের।

ঠিক বলেছো জয় কোনোদিন যেনো আমাকে তোমার এই বুক থেকে দূরে সরিয়ে দিও না জয়। তাহলে আমি যে মরে যাবো। আমি সব ছেড়ে শুধু তোমার ভালোবাসার টানে এতোদূর এসেছি জয়।

জানি ইরা, জানি। সেজন্য আমিও তোমাকে আমার বুক আশ্রয় দিয়েছি জয়। কোনোদিন আমি তোমাকে কষ্ট দিবো না।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখেই ফিসফিস করে বললো, জয়, আমার জয়!

জয় মৃদুকণ্ঠে ডাক দিলো, ইরা।

বলো।

রাতে কিছু খাবে না?

না, আমি কিচ্ছু খাবো না। আমি তোমার বুকে মাথা রাখতে পেরে আমার খিদে, তৃঞ্চা, ক্লান্তি সব যেনো হারিয়ে গেছে।

জয় ইরা বুক তার মাথা থেকে তুলে চোখে চোখ রাখলো, তবু খেতে তো হবে।

না। আমি কিচ্ছু খাবো না।

জয় একটা মুচকি হাসি হাসলো, তুমি থাকো, আমি রুচিতা থেকে দু’টা বিরিয়ানির প্যাকেটটা নিয়ে আসি।

কতক্ষণ সময় লাগবে যেতে আসতে?

এই ধরো যেতে পাঁচ মিনিট আসতে পাঁচ মিনিট আর নিতে পাঁচ মিনিট, সর্বমোট পনেরো মিনিট।

ওকে যাও, দেরি করো না যেনো।

জয় ইরার থুতনি ধরে আদর করে বললো, না সোনা।

 

ততক্ষণে ইরা তার ব্যাগ থেকে বিছানা চাদর বের করে মেঝেতে বিছিয়েছে, ব্যাগের অন্যান্য কাপড়গুলো দিয়ে বালিশ বানিয়েছে। কয়েকমাস আগে জয় ইরাকে একটা মগ কিনে দিয়েছিলো, কোনো এক সিমেন্ট কোম্পানির সৌজন্যে, ইরা সেই মগটাতে পানি খেতো। আসার সময় ইরা সেই মগটা নিয়ে এসেছিলো।

জয় এলো। প্যাকেট দু’টো ইরার হাতে দিতেই ইরা একটা প্যাকেট খুলেই বললো, একটা প্যাকেটে এতোগুলো ভাত, কে খাবে এতোগুলো? একটা প্যাকেট খুলি, হ্যাঁ।

খোলো।

ইরা প্যাকেট থেকে ভাত তুলে জয়ের মুখে দিতেই জয় বললো, না।

ইরা অবাক হলো, কেনো?

আমি কখনো কারও হাতে তুলে দেয়া ভাত খাইনি।

মানে?

মানে আমি কারও হাত থেকে তুলে দেয়া ভাত খাইনি।

এতো বছর সংসার করার পরও তুমি কোনোদিন মুখে তুলে দেয়া ভাত খাওনি?

না।

আগে না খাও, আজ থেকে খেতে হবে, এখন থেকে।

জয় হেসে বললো, এখন থেকে শাসন করতে শুরু করছো?

হুঁম। শাসনের আর দেখেছো কী।

জয়ের মুখে কয়েকবার ভাত তুলে দেবার পর ইরা মুখ হা করলো, জয় ইরার মুখে ভাত তুলে দিতেই ইরা বললো, অমৃতের স্বাদ।

মানে?

মানে বই লেখো অথচ এটাই জানো না। প্রিয়জনের হাত থেকে খাওয়া ভাতের স্বাদ সবসময় অন্যরকম হয়। অসাধারণ স্বাদের হয়।

খাওয়া শেষে ইরা বললো কাল সারাদিনে সব বাজার করতে হবে, পুরো একটা সংসারের কেনাকাটা।

জয় বললো, হ্যাঁ। তোমাকেও যেতে হবে।

আমাকে?

হ্যাঁ। আমি কি সব কেনাকাটা করতে পারি নাকি?

পারবে আমি লিস্ট করে দিবো।

আচ্ছা কাল আগে হোক তারপর দেখা যাবে।

ইরা খাবারের উচ্ছিষ্ঠ প্যাকেট বাইরে রেখে হাত ধুয়ে এসে মেঝেতে পাতানো বিছানায় জয়ের পাশে বসতে বসতে বললো, একে একে দু’বার বিয়ে হলো আমার কিন’ পছন্দমতো বাসরঘর হলো না।

জয় কিছুটা অবাক হলো, কেনো, কী রকম বাসররাত চেয়েছিলে তুমি?

সিনেমা-নাটকে দেখোনি, নতুন বউ সেজগুঁজে বিছানায় বসে অপেক্ষা করবে, বর ঘোমটা তুলে…

জয় ইরার কথা শেষ করতে না দিয়ে ইরার ওড়নাটা তার মাথায় দিয়ে ঘোমটা বানিয়ে ইরার থুতনি উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো, ইরা, আমার ভালোবাসা, আমার প্রেম আজ তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য, তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া ইরা।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, আমাকে সারাজীবন তোমার বুকে মাথা রাখতে দিও জয়, সারাজীবন!

এবার জয় হেসে বললো, খুশি।

ইরা বললো, অসম্ভব রকমের খুশি কিন’ তোমার কথাগুলো কেমন কৃত্রিম, কৃত্রিম মনে হচ্ছিলো।

হয়তো কৃত্রিম শোনাচ্ছিলো কিন’ মোটেই কৃত্রিম ছিলো না।

সেতো আমি তোমার বুকে মাথা রেখে, হৃদপিণ্ডে স্পন্দন শুনেই অনুভব করেছি জয়! বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে গেলো।

এমনসময় জয়েরে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ইরা যেনো আঁৎকে উঠলো। সে জয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, দেখি কে ফোন করেছে?

ইরা ফোন হাতে নিয়ে থাকতেই আবারও ফোন বেজে উঠলো, হ্যালো আসসালামুয়ালায়কুম।

অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওয়ালেকুম আসসালাম।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন প্লিজ?

আমারও তো একই প্রশ্ন আপনি কে বলছেন? নারী কণ্ঠস্বর অনেকটা রুক্ষ্ম।

আমি ইরা, জয়ের ওয়াইফ।

জয়ের ওয়াইফ? আমি তো জানি জয়ের ওয়াইফের নাম সামিনা।

আজ থেকে আমিও ওর ওয়াইফ, আজই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আপনি কে?

নারীকণ্ঠ কিছুটা অস্পষ্ট স্বরে বললো, আমি একবার জানলাম না।

ইরা একটু রাগান্বিত স্বরে বললো, আপনি কে?

আমি আরশী, আর আমি কে আমার পরিচয়টা জয়ের কাছ থেকে আপনি জেনে নিবেন। এখন ওকে একটু ফোনটা দিন। ওর বিয়েতে কনগ্রাচূলেশন জানাই, কথার শেষের দিকে আরশীর কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো।

ইরা জয়কে ফোনটা দিয়ে রাগান্বিতস্বরে বললো, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, বলো।

জয় ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, ফোন করেছো কেনো?

ইরা জয়ের কানের কাছে নিজের কান পেতে রইলো। তার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেছে, রাগে আর ক্ষোভে কপালের শিরা দু’টো টনটন করতে শুরু করেছে।

আরশী একরকম জোরে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, আমি ফোন দিলে তুমি ফোন রিসিভ করো না, আমার নাম্বার ব্লক করে রেখেছো, এতোদিন আমি বুঝতে পারিনি আজ ঠিক সময়ে ফোন করেছি।

জয় আমতা আমতা করে বললো, ঠিক সময়ে যখন ফোন করেছো তখন ফোনটা একটু রাখো, কাল আমি তোমাকে ফোন দিবো।

আরশী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শুরু করলো, তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে জয়, প্রতারণা। তুমি আমাকে আগেও জানাতে পারতে, তাহলে আমি তোমাকে ফোন করতাম না। তোমার বাসররাতে আমিও দোয়া করতাম।

জয় ফোন কেটে দিলো।

জয়ের সঙ্গে আরশীর কথা শুনে ইরা বুক ফেটে আর্তনাদ করে উঠলো, জয়, জয় তুমি না আমাকে বলতে আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। আরশী, আরশী তোমার কে? বলো, বলো জয়, বলো আরশী তোমার কেউ না।

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, আরশী আমার কেউ না।

মিথ্যাবাদী, বেঈমান, প্রতারক আজ থেকে প্রায় দু’বছর আগে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কারও সাথে লুকোচুরির সম্পর্ক আছে কী না? তুমি অস্বীকার করেছিলে, অথচ আজ, আজ হাতেনাতে আমি তার প্রমাণ পেলাম। ভণ্ড কোথাকার বলে ইরা উঠে দাঁড়িয়ে কান্নাভাঙ্গা গলায় জোরে চিৎকার করে বললো, মাস্টার, মাস্টার আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, মাস্টার আমি তোমাকে ভুল বুঝে একটা প্রতারকের কাছে চলে এসেছি। মাস্টার, মাস্টার বলে ইরা জোরে দরজা খুলে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলো। জয় ইরার পিছু পিছু তাকে ছুটে চললো।

 

উনচল্লিশ

 

আরশীর সঙ্গে জয়ের একসময় সম্পর্ক ছিলো কিন’ সেটা কয়েকবছর আগের কথা। আরশীর বিয়ে হয়েছে, এখন তার এক ছেলে এক মেয়ে। সে তার চাকরি, সংসার সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছে, দাম্পত্য জীবনে সুখী না হলে খুব অসুখীও নয়। বিয়ের পর থেকে জয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বললে চলে। তবে কোনো বিপদে-আপদে বিশেষ করে টাকার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে জয়কে ফোন করে, জয় সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করে কিন’ কয়েকমাস থেকে জয়ের সঙ্গে আরশীর কোনো যোগাযোগ নেই। আজ হঠাৎ করে আরশী ফোন করবে একথা জয়ের মাথায় ছিলো না, আর ফোন করলেই বা কী আরশী এখন তার কেউ না কিন’ ফোন করে জয়ের বিয়ের কথা শোনার পর আরশী এবিষয়ে বাড়াবাড়ি না করলেও পারতো।

আরশীর বাড়াবাড়ি জয় এবং ইরার সঙ্গে কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো কিন’ জয় ইরা বিষয়ে তার বাড়াবাড়ি করার সঙ্গত কোনো কারণ না থাকলেও সে থেমে রইলো না। জয়ের সঙ্গে সে কথা বলা শেষ করে সামিনাকে ফোন করলো। সামিনা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসসালাম।

কে বলছেন?

আপনি আমাকে ভালো করে চেনেন, আমার নাম আরশী।

আরশীর সঙ্গে সামিনার পরিচয় আছে, জয়ের সঙ্গে একসময় আরশীর সখ্যতা ছিলো বলে সামিনা জানে, ফোনে একবার আরশীর পরিচয়ও হয়েছিলো, শুধু পরিচয় না জয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা তর্ক-বিতর্কও হয়েছিলো। সেসময় আরশীর সঙ্গে সামিনার পরিচয় ছিলো। তারপর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ নেই। আজ হঠাৎ করে আরশী ফোন করায় সামিনা অবাক হলো, আপনি?

হ্যাঁ আপনাকে একটা সুখবর দেয়ার জন্য ফোন করেছি।

কী সুখবর?

আপনি তো সবসময় আপনার হ্যাজবেন্ডের জন্য আমাকে দোষারোপ করেছেন, আপনি কি জানেন আপনার হ্যাজবেন্ড এখন কোথায়? কার সাথে?

আমার হ্যাজবেন্ড যেখানেই, যার সাথেই থাকুক সেটা আমি বুঝবো, আপনার ফোন করার কারণ কী সেটা বলুন?

জয় বিয়ে করেছে।

সামিনা প্রতিবাদ করলো, মিথ্যা কথা, আমি বিশ্বাস করি না।

আমি মিথ্যা কথা বলছি না, আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন জয় এখন নতুন বউ নিয়ে শুয়ে আছে।

আপনি সত্যি বলছেন?

বলছিই তো, বিশ্বাস না হয় আপনি ফোন করুন।

 

জয় ইরাকে একরকম জোর করে বাসায় এনে দরজা বন্ধ করে দিলো। ইরা তখনো হাউ-মাউ করে জোরে চিৎকার করে কাঁদছিলো। জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, ইরা বিশ্বাস করো আরশীর সঙ্গে অনেকদিন থেকে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি ওর কথাতেও বুঝেছো হয়তো। প্লিজ চুপ করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

জয়ের মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠলো।

সামিনা ফোন করেছে। এতো রাতে, সামিনা তো এতো রাতে কখনো ফোন করে না। জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো।

জয় ফোন রিসিভ করতেই সামিনার কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো।

কোথায় তুমি?

জয়পুরহাট।

কে আছে তোমার সঙ্গে?

কে আছে মানে?

আমাকে আরশী ফোন করেছিলো, তুমি নাকি বিয়ে করেছো?

হ্যাঁ করেছি।

সামিনা চিৎকার করে উঠলো, এখন কি ঐ মাগিকে নিয়ে আছো?

জয় ধমকের সুরে বললো, সামিনা মুখ ঠিক করে কথা বলো।

কী মুখ ঠিক করে কথা বলবো, আগে কাল সকাল হোক তারপর দেখবে আমি কী করি, দেতো কোন মাগিকে বিয়ে করেছিস একটু কথা বলি তোর নতুন বউর সঙ্গে।

সামিনা, আবার মুখ খারাপ করছো, এখন তো শুধু বিয়ে করেছি যদি খারাপ ব্যবহার করো তবে আমি তোমাকে তালাক দিবো।

তালাক দিবি, দিস, দেখি না তুই কী করিস আর আমি কী করতে পারি বলে সামিনা রতনের হাতে ফোনটা দিতেই রতন চিৎকার বলে বলে উঠলো, এই, এই তুই নাকি বিয়ে করেছিস?

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ করেছি, শুনছো তো।

বিয়ে করেছিস, কাল সকাল হোক আগে তোকে আর ঐ বেয়াদব মহিলাকে খুন করবো।

এবার জয় ধমকের সুরে বললো, মুখ সামলে কথা বলো বাবা, আমি তোমার বাবা, তুমি ছেলে ছেলের মতো থাকো। তোমাদের দেখাশোনার কোনো ত্রুটি হবে না।

দেখাশোনা, শুধু দেখাশোনা না। আগে সকাল হোক কালকেই যদি ঐ মহিলাকে বিদায় না করিস তবে তোদের দু’জনকে আমি খুন করবো, খুন।

জয় আবার ধমক দিলো, রতন আস্তে কথা বলো, আমার সঙ্গে বেয়াদবি করার ফল ভালো হবে না।

না হোক, ভালো না হোক। তুই তোর আর তোর ঐ মহিলার কথা চিন্তা কর্‌। আমাদের ফল নিয়ে আর তোকে ভাবতে হবে না।

ওকে, এখন থেকে তাহলে তুমি তোমার ভালো-মন্দ চিন্তা করো আর আমি আমার চিন্তা করবো।

চিন্তা করে দেখ ভালো করে কাল সকালে তোর সঙ্গে দেখা হবে।

জয় ফোনের লাইন কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিলো।

জয় যখন সামিনা আর রতনের সঙ্গে কথা বলছিলো তখন ইরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলো। জয় কথা বলা শেষ করে ইরাকে বুকে টেনে নিলো। তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে ইরা।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, জয় পারবে তো?

অবশ্যই পারবো ইরা। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে আমি সব পারবো।

আমি জানি জয় তুমি আমার জন্য সবকিছু করতে পারবে, জয়, আমার জয়!

 

সেই কাঙ্ক্ষিত মধুময় রাত কীভাবে কাটছে জয় আর ইরার। আসলে পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মায় তারা প্রকৃতিগত কারণে জন্মের পর পরই চিৎকার করে কান্না করলেও তাদের জীবনে আসলে কান্না থাকে না। তাদের সারাজীবন কেটে যায় হাসি-খুশির মধ্যে দিয়ে আর কিছু মানুষ সত্যিকার কান্না নিয়ে জন্মায়, জন্মের পর পরই হাত-পাঁ ছুঁড়ে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধ চলে আমৃত্যু।

সেই কাঙ্ক্ষিত রাতেও জীবনযুদ্ধ তাদের পিছু ছাড়েনি। আরশীর পরে ফোন করলো সামিনা আর রতন, তারা যেনো প্রস’তি নিচ্ছে আরেক যুদ্ধের। সবার শেষে ফোন করলো শুভ। শুভ ফোন নাম্বার দেখে ইরার বুক কেঁপে উঠলো। পৃথিবীতে মায়ের কাছে সন্তানের জবাবদিহিতা থাকে, সন্তান মায়ের ভয়ে আতঙ্কিত থাকে কিন’ এ যে সন্তানের ভয়ে মায়ের বুক কেঁপে উঠলো। ইরা ফোন রিসিভ না করে জয়কে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো, শুভ ফোন করেছে, কী বলবো?

জয় অভয় দিলো, যা সত্যি তাই বলো।

ইরা এক হাত বুকে রেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, হ্যালো।

হ্যালো মা, শুভ’র কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর।

ইরা কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বললো, বল।

মা তুমি কোথায়?

আছি কোথাও? কেনো, কী হয়েছে?

মা আমি যা শুনছি, তা কি সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। আর কিছু বলবি?

না মা আমি আর কিছু বলবো না। আমি বুঝতে পেরেছি বাবা তোমাকে সুখ দিতে পারেনি বলে তুমি সুখের নেশায় বাবাকে ছেড়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছো।

তোকে ছেড়ে তো আসিনি। আমি যার সঙ্গে চলে এসেছি সে খুব ভালো মানুষ। সে তোকে নিজের ছেলের মতো দেখবে। তুই দেখিস্‌ সত্যি কী না।

তা লাগবে না মা। আমি আমার বাবার কাছেই থাকবো। আজ থেকে মনে করবো আমার মা নেই, মরে গেছে। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি মা। তোমাকে যে নিয়ে গেছে সে একদিন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে।

আমাকে জ্ঞান দিবি না শুভ।

ওকে মা। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি মা তুমি তো সুখের আশায় গেছো কোনোদিন যদি ওখানেও সুখ না পাও তবে ফিরে এসো মা। আমি বাবাকে বলবো, বাবা আবার তোমাকে ফিরিয়ে নেবে।

সেটা তোকে বলতে হবে না শুভ, আমি আর কোনোদিন তোর বাবার কাছে ফিরে যাবো না।

ওকে মা। তাহলে আমার কাছে ফিরে এসো। আমি তোমার ছেলে, আমি কোনোদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিবো না মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে শুভ ফোন রেখে দিলো।

ইরা ফোন রেখে দিয়ে যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, হায় আল্লাহ!

 

চল্লিশ

 

সকালবেলা ইরা জয়কে ডাক দিলো, এই ওঠো, বাজারের ব্যাগ নাও, বাজার করতে হবে না, এই উঠছো?

জয় চোখ মেলে তাকালো, ওয়াও, তুমি?

ইরা হেসে উঠলো, কেনো? অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি?

জয় কয়েকমুহূর্ত ইরার দিকে তাকিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করলো তারপর একটা সরল হাসি দিয়ে ইরাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো।

ইরা বিছানা থেকে উঠেই গোসল করেছে, তার ভেজা চুলগুলো তার পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে, নির্মল, শান্ত, স্নিগ্ধ মুখ, অসাধারণ এক চাহনিতে তাকিয়ে আছে জয়ের দিকে। জয় ইরাকে কাছে টেনে নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ইরা পিছিয়ে গেলো, উহুঁ। আগে গোসল করে এসো, তারপর বাজার যেতে হবে।

জয় কিছুটা কৃত্রিম আশ্চার্যন্বিত হয়ে বললো, বাজার করতে হবে!

বাজার করতে হবে না! জানোই তো ঠেঁকির কাজ ধান ভানা সেটা স্বর্গই হোক আর নরকই হোক ইরা বললো।

হুঁম তাই তো বুঝছি আগে নরকে ধান ভানতাম আর এখন স্বর্গে।

আমিও ঠিক তাই আগে মতির বাসার হাঁড়ি-পাতিল মাজতাম আর এখন জয়ের বাসার, কাজের বেটি রহিমার আর কোনো উন্নতি হলো না বলে ইরা হেসে উঠলো।

জয় দু’হাত বাড়িয়ে দিলো, তুমি কাজের বেটি রহিমা না, জয়ের ইরা। আমাকে একটু তুলে দাও না সোনা, প্লিজ!

না, আমি গোসল করেছি, তোমাকে ছুঁবো না।

তুমি না বলতে আমাকে বিছানা থেকে তুলে দিবে, নাস্তা তৈরি করে তুলে খাওয়াবে। একদিন না যেতেই আমাকে ছুঁতে চাচ্ছো না। এখনো পুরো জীবন তো পড়েই আছে বলে জয় হা হা করে হেসে উঠলো।

তুমিও তো বলতে আমি যা বলবো তাই নাকি তুমি শুনবে, একদিন না যেতেই তো একটা কথাও শুনছো না সারাজীবন তো পড়েই আছে।

জয় নিজে বিছানা থেকে উঠছিলো কিন’ ইরা হাত বাড়িয়ে দিলো, দাও, তোমার হাতটা দাও।

জয় হাত বাড়িয়ে দিতেই ইরা হাত ধরে জয়কে টেনে তুলতে চাইলো কিন’ জয় ইরাকে জোরে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো।

ইরা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো না। জয়ের সঙ্গে মিশে গেলো। তারপর একটা মিষ্টি হাসি হেসে বললো, এই দুষ্টু কোথাকার! এখন আমাকে আবার গোসল করতে হবে।

মানুষ প্রেমের জন্য সাগরে ঝাঁপ দেয় আর তুমি তো শুধু ঝরনার পানিতে গোসল করবে ইরা।

ইরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বুঝি সাগর পাড়ি দিইনি।

দিয়েছো, দিয়েছো।

তাহলে বললে কেনো? সরি বলো, সরি বলো।

জয় বিনয়ের সঙ্গে বললো, সরি মাই লাভ।

 

জয়পুরহাট পৌর বাজার। ব্যাগ নিয়ে জয় কাঁচাবাজারে ঢুকলো। এই বাজারের পাশ দিয়ে ভেতরের রাস্তা দিয়ে জয় অনেকদিন স্টেশন কিংবা সরকারি কলেজে গেছে খুব স্বাভাবিকভাবে কিন’ আজ বাজার করতে এসে সে কিছুটা অস্বসি’বোধ করছে। জয় ইরার লিখে দেয়া লিস্ট দেখে দেখে বাজার করছে আর ভাবছে, দিনাজপুর সে বাজার যাবার আগে রতন বাজারের লিস্ট করে আর মানিক-রতন দু’জনকে নিয়ে জয় বাজার যায়। রতন একটা একটা করে নাম বলে মানিক ব্যাগ নেয়। আজ জয়পুরহাটে বাজার করতে গিয়ে জয় কেনো জানি নিজেকে লুকাতে চাইছে। দূর থেকে চোখে পড়লো শামিম সাহেব বাজার করছে। শামিম সাহেব জয়ের খুব কাছের মানুষ কিন’ আজ দূর থেকে দেখে জয় আড়ালের একটা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা শুরু করলো।

বাজার করতে করতে ইরা একবার ফোন দিলো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো। এতো দেরি হচ্ছে কেনো? আমি বাসায় একা আছি না।

আসছি তো।

জয় বাজার করে রিকশায় উঠবে এমনসময় মানিক ফোন করলো, হ্যালো।

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, বলো কেমন আছো?

কেমন আছি সেটা তুমি ভালো করেই জানো। তুমি নাকি আরেকটা বিয়ে করেছো?

হুঁম।

আমি আগামী সপ্তাহে বাড়ি যাবো, তার আগে তুমি ঐ বউকে ছেড়ে দিও মানিক কথাগুলো কর্কশ স্বরে বললো।

কেনো?

আমি বলছি তোমাকে করতে হবে।

জয় বললো, যদি না করি।

এবার মানিক অত্যন্ত রুক্ষ্ম ভাষায় বলতে শুরু করলো, আমি আগামী সপ্তাহে বাড়ি যাবো তার আগে তোকে ঐ বেয়াদব মহিলাকে ছেড়ে দিতে বলেছি যদি না দিস তবে তোকে আমি জবাই করবো, জবাই।

জয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কার সাথে কথা বলছে। মানিক, যাকে সে জন্ম দিয়েছে, ছোটবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে, যাকে সে হাঁটি হাঁটি পাঁ পাঁ করে স্কুলে নিয়ে গেছে। এই তো দু’বছর আগে যে মানিককে সে ময়মনসিংহ নিয়ে গিয়ে কলেজে ভর্তি করলো, তখনো তো সে ভালোভাবে পথঘাট চিনতো না, এই ছোট্ট ছেলেটা তাকে আজ তুই তুই করে কথা বলছে, জবাই করতে চেয়েছে। সে ঠিক শুনেছে তো।

জয়কে চুপ করে থাকতে দেখে মানিক বললো, হ্যালো।

বলো।

কথা বলছিস না কেন? তুই কি দুনিয়াতে বেঁচে থাকবি নাকি মারবি? সেটা সিদ্ধান্ত নিবি।

জয় অস্ফুটস্বরে বললো, তুমি আমাকে মারবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুধু মারবো না, তোকে আমি মেরেই ফেলবো, জবাই করে মেরে ফেলবো। আমি যা বলছি তা-ই করবি।

জয় ফোনের লাইন কেটে দিলো।

মানিক আবারও ফোন করলো, হ্যালো।

লাইন কেটে দিলি কেন?

কী করবো?

আমি যা বলছি তাই করবি, যদি জানে বাঁচতে চাস্‌।

আচ্ছা।

কী আচ্ছা?

যদি বাঁচতে চাই তবে ইরাকে ছেড়ে দিবো।

হ্যাঁ মনে থাকে যেনো। এর যেনো কোনো উল্টাপাল্টা না হয়, বলে মানিক ফোন রেখে দিলো।

 

মানিকের সঙ্গে জয় কথা বলার সময় ইরা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। মানিক ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে ইরা আবারও ফোন করলো।

জয় ফোন রিসিভ করতে না করতেই ইরা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও জয়, থামলে কেনো? চালিয়ে যাও। সেজন্যই তো বলছি বাজার থেকে আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেনো?

আমি আসছি ইরা।

আসবা কেনো? কথা বলো, আরও ম্যারাথন কথা বলো। আর ক’জনের সঙ্গে নটর-পটর করেছো তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে এসো। বাসায় এলে তো আর কথা বলতে পারবে না। সব সেরে এসো। আমি কী ভুলটাই না করলাম।

ইরা, আমি আসছি ইরা, আসার পর সব বলবো।

না, না তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সব বুঝেছি। আল্লাহ আমার কপালে শেষ পর্যন্ত এই ছিলো।

ইরা আমাকে ভুল বোঝো না প্লিজ!

ভুল বুঝছি না, ঠিক বুঝছি। আমাকে একা রেখে তুমি…না, না, আমি আর এক মুহূর্ত থাকবো না। আমি…বলে ইরা আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলো।

 

একচল্লিশ

 

পুরাতন ছাদওয়ালা একটি বাড়ি। বাড়ির দেয়ালগুলো প্লাস্টার করা হয়নি সেই শুরু থেকেই। সিলিংয়ের প্লাস্টারগুলো খসে পড়তে শুরু করেছে। এই বাড়িকে নিয়েই সামিনার কত গর্ব ছিলো। একসময় এ পাড়ায় এই একটি বাড়িই ছিলো ছাদওয়ালা। মিরাজ সাহেবের বাড়ি। এই বাড়ি নিয়ে কথিত আছে যে মিরাজ সাহেব ভাইদের সঙ্গে এক সংসারে থাকা অবস’ায় নিজের নামে এই বাড়ি এবং কিছু জমিও করেছেন। অবশ্য কয়েকবছর পর তার সত্যতাও মিললো।

জয়ের সঙ্গে সামিনার বিয়ের সময় এই বাড়িটি তথাকথিত প্রভাবশালী মিরাজ সাহেবের বাড়ি বলে পরিচিত ছিলো। কালক্রমে মিরাজ সাহেবের অবস’ার অনেক অবনতি হয়েছে। পাড়ায় আরও কয়েকটি পাকা বাড়ি উঠেছে কিন’ মিরাজ সাহেব আর ছেলেমেয়েদের সেই অহংকারটা এখনো রয়েই গেছে। যা নিত্যদিন সামিনার মুখ থেকে জয়কে শুনতে হয়েছে।

জয়ের ইরাকে বিয়ে করার কথাটা সামিনা সেদিন রাতেই ফোন করে তার বাবাকে বলেছে। পরদিন সকালবেলা সামিনা রতনকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। মিরাজ সাহেব তখন আঙ্গিনায় খালি গায়ে একটা কাঠের চেয়ারে বসেছিলো। সামিনা বাড়িতে ঢুকেই মিরাজ সাহেবের গলা জাড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সামিনার মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কান্নায় যোগ দিলো। বাড়িতে যেনো একটা মরাকান্না শুরু হলো।

মিরাজ সাহেব সামিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, চুপ কর্‌ মা, চুপ কর্‌, আমি তোর খলিল মামাকে আসতে বলেছি, শহীদ ভাইকে আসতে বলেছি ওরা আসুক তারপর কী করা যায় দেখা যাক। বেটার এতোবড় সাহস, আমার মেয়েকে রেখে আরেকটা বিয়ে করে। ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো। বেটা আইন জানে না, বলে মোবাইল ফোনের বাটন টিপলো।

অপর পাশ থেকে খলিল সাহেব ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো দুলাভাই।

খলিল সাহেব মিরাজ সাহেবের শ্যালক, সামিনার মামা। মিরাজ সাহেব যেকোনো বিপদে-আপদে খলিল সাহেবের স্মরাণাপন্ন হয়।

খলিল একটু আমাদের বাড়িতে আয় তো।

মিরাজ সাহেবের কণ্ঠস্বরে অসি’রতা আর কণ্ঠস্বরে জড়তা শুনে খলিল সাহেব বললো, কেনো দুলাভাই, কী হয়েছে?

মিরাজ সাহেব আবেগজড়িত কণ্ঠে ঘটনার বিবরণ দিলো। সবকিছু শুনে খলিল সাহেব বললো, দুলাভাই মাথা গরম করবেন না, মেয়ে জামাই’র ব্যাপার। আমি আসছি তারপর যা হয় দেখা যাবে।

খলিলের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে মিরাজ সাহেব শহীদকে ফোন করলো।

শহীদ সামিনার দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাই। ছোটবেলা থেকে সামিনাদের বাড়িতে বড় হয়েছে, সামিনাসহ তার ছোট ভাইবোনদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। আর সেই অধিকারে সে তাদের বাড়ির আশ্রিত থেকে নিজেকে মিরাজ সাহেবের ছেলে ভাবতে শুরু করেছে। কোনো কোনো ঘটনায় সে বাড়ির অভিভাবকের মতো আচরণ করে এমনকি কখনো কখনো মিরাজ সাহেবের ওপরও তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। তারপরও মিরাজ সাহেব যেকোনো বিষয়ে শহীদের শরণাপন্ন হয়। আর স্বল্প শিক্ষিত এই ট্রাক ড্রাইভার শহীদই তখন মাতব্বর সেজে বসে। এবারও তাই হলো, মিরাজ সাহেব খলিল সাহেবকে ফোন করে আসার পর শহীদকে ফোন করলো।

শহীদ ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো মামা, আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসসালাম। বাবা শহীদ।

মিরাজ সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনে শহীদ যেনো চমকে উঠলো, মামা! কী হয়েছে?

মিরাজ সাহেব খলিল সাহেবকে যেভাবে ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলো শহীদের কাছেও সেভাবে বিবরণ দিয়ে বললো, তুমি একবার আসো বাবা।

শহীদ অতি উৎসাহের সঙ্গে বললো, আমি এখনই আসছি মামা।

 

প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খলিল সাহেব এলো। খলিল সাহেব বাড়িতে ঢুকতেই সামিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, মামা! এখন কী হবে মামা?

খলিল সাহেব সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কিচ্ছু হবে না মা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

শহীদ এলো। তার আসার সাথে সাথে সামিনা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো, ভাই, ও ভাই এখন আমার কী হবে রে ভাই?

খলিল সাহেব ধমকের সুরে বললো, সামিনা তুমি চুপ করো, তোমার কী হবে, কিচ্ছু হবে না। মাথা ঠাণ্ডা করো।

রতন এতোক্ষণ কখনো উঠানে আর কখনো আঙ্গিনায় হাঁটাহাঁটি করছিলো শহীদ কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, কী হয়েছে মামা?

রতন বললো, মা তো বললো মামা।

তোমরা কী করছো?

রতন বুঝতে না পেরে শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

শহীদ বললো, তুমি আর তোমার মা জয়পুরহাট চলে যাও, মানিকও ঢাকা থেকে জয়পুরহাট আসুক। তারপর ওকে পিটিয়ে সোজা করো।

খলিল সাহেব শহীদকে মৃদু ধমক দিলো, না রতন, বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না।

মিরাজ সাহেব খলিল সাহেবকে ধমক দিলো, তুই নিষেধ করবি না, জামাইকে একটু শাসন করা দরকার। আর তোকে আমি বলছি তুই উকিলের সঙ্গে কথা বল, আমি মামলা করবো। আমার মেয়ে থাকতে আরেকটা বিয়ে করবে…

খলিল সাহেব মৃদু অথচ রাগান্বিতস্বরে বললো, দুলাভাই মাথা ঠাণ্ডা করো, আগে জামাইর সঙ্গে কথা বলি। তারপর যা হয় করা যাবে। রতন তোরা দু’ভাই যেনো বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না।

কিন’ রতনের মুখে সেই প্রথম থেকে রাগান্বিত ভাবটা ছিলো সেটা এখনো আছে, তার চোখ-মুখ লাল আর চোয়াল দু’টো যেনো এখনো শক্ত হয়ে আছে।

মিরাজ সাহেব খলিল সাহেবের কথা কোনোভাবে মেনে নিলো না। সে শহীদের সুরে সুর মেলালো, আমি তোর কথা মেনে নিতে পারছি না খলিল। আমি দেখতে চাই বেটার কতবড় সাহস। আমি ওর চাকরি খাবো।

শহীদ বললো, তার আগে ওর একটা পেদানি দরকার।

খলিল রাগান্বিতস্বরে বললো, দুলাভাই তুমি যদি আমার কথা শোনো তবে আমি তোমাদের সঙ্গে আছি আর যদি মাথা গরম করে জামাইয়ের গায়ে হাত তোলো বা মামলা মোকদ্দমা করো তবে আমি তোমাদের সাথে নেই।

সামিনা আসার পর থেকেই কাঁদছে এবার খলিল সাহেবের কথা শুনে সে যেনো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলো, আমি কোনো কথা শুনবো না মামা। আমি কেস করবো, ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।

 

বিয়াল্লিশ

 

ইরা তিন দিনের ছুটি নিয়েছিলো। আজ স্কুল যেতে হবে। সকালবেলা উঠেই ইরা নাস্তা তৈরি করছে, নাস্তা তৈরি করতে করতে একবার বেড রুমে এসে জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাক দিলো, এ-ই, ওঠো, নাস্তা করবে না, আমাকে বাস স্ট্যান্ড নামিয়ে দিয়ে আসবে না।

জয় ইরাকে জড়িয়ে ধরলো, না, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না।

ইরা জয়ের চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, আমার একটা স্বপ্ন ছিলো আমি সকালবেলা নাস্তা তৈরি করবো, দু’জনে একসাথে বসে নাস্তা করবো তারপর তুমি আমকে মোটর সাইকেলে বাসে তুলে দিয়ে আসবে। আবার আসার সময় আমি বটতলী এসে তোমাকে বলবো, এই এসো, আমাকে নিয়ে যাও।

তখন আমি কী বলবো জানো?

বলো।

আমি বলবো সরি, আমি ব্যস্ত তুমি অটোতে এসো।

ইরা জয়ের চিবুক টেনে বললো, দুষ্টু কোথাকার! ওঠো। বলে ইরা উঠে দাঁড়ালো।

জয় ইরাকে আবারও টেনে ধরলো, আমাকে মারলে কেনো?

ইরা হো হো করে হেসে উঠলো, মারলাম! আমি তোমাকে আদর দিলাম আর তুমি বললে মারছি তবে এখন মারবো, তোমার কান টেনে তুলবো। ওঠো। বলে ইরা হাত বাড়াতেই জয় মাথা সরিয়ে নিলো।

ইরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে রান্নাঘরে চলে গেলো।

ইরা চুলোয় আলু ভাজি তুলে দিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে রুটি তৈরি করছিলো আর গুণগুণ করে গান গাইছিলো, আমার স্বপ্ন তুমি, ওগো চিরদিনের স্বামী…

জয় পাঁ টিপে টিপে খুব সাবধানে পেছন থেকে গিয়ে ইরার কোমর জড়িয়ে ধরতেই ইরা চমকে উঠলো, এই, আগে বলবে তো।

তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার…

ইরা একটা রুটি তোয়ায় দিয়ে বললো, সারাজীবন যেনো আমারই থেকো সোনা।

জয় ইরাকে তার মুখোমুখি করে ধরলো, বিশ্বাস হচ্ছে না?

হচ্ছে, তোমার বুকে তো অনেক লোম তাই মনে হচ্ছে তুমি সবার বেলায় দয়াবান। কাউকেই না করতে পারো না। হা হা হা।

নাস্তা শেষ করে দু’জনে বাসা থেকে বের হবে এমনসময় ইরা হঠাৎ করে জয়ের পাঁ ছুঁয়ে সালাম করলো।

জয় ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, এই, এই তুমি পাঁ ছুঁয়ে সালাম করলে কেনো? তুমি জানো না তোমার স’ান আমার বুকে।

তাই বলে আজ আমি প্রথম চাকরিতে যাচ্ছি তোমাকে সালাম করে যাবো না।

দু’জনে বাসা থেকে বের হলো। ইরা মোটর সাইকেলে উঠে জয়ের পিঠে মাথা রেখে বললো, আমার খুব ভয় করছে জয়।

কেনো?

কেউ যদি দেখে ফেলে?

ভয় কীসের ইরা, আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী।

তবু আমার যেনো কেমন কেমন করছে।

কিচ্ছু হবে না। তোমাকে আমি বাসে উঠিয়ে দিবো, বাস থেকে নেমে সোজা স্কুলে যাবে আবার স্কুল থেকে নেমে সোজা বাসে উঠবে। কেউ যদি কিছু বলে তবে আমাকে ফোন করবে।

আচ্ছা।

বিয়ের আগে জয় আর ইরা একসাথে মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়িয়েছে। তখন তাদের মধ্যে ভয় বা সংকোচ থাকাই সঙ্গত ছিলো কিন’ তখন যেনো কিছুই ছিলো না, তারা দিব্যি চষে বেড়িয়েছে জয়পুরহাটের মেঠোপথ, রাজপথ সব। অথচ এখন তারা স্বামী-স্ত্রী, আইনসঙ্গতভাবে এবং সামাজিকভাবে। তারা একসঙ্গে সংসারও শুরু করেছে অথচ দু’জনের মধ্যে যেনো একটা ভয়, সংকোচ কাজ করছে। সবসময় মনে হচ্ছে কেউ বুঝি দেখে ফেললো।

মাস্টারপাড়া থেকে বাস স্ট্যান্ড মোটর সাইকেলে কয়েকমিনিটের রাস্তা এই কয়েকমিনিট দু’জনের কাটলো অস্বসি’তে। জয়ের মাথায় হ্যালমেট আর ইরা মুখ লুকিয়েছে জয়ের পিঠে। মোটর সাইকেল থেকে নেমে ইরা একবার জয়ের দিকে তাকালো। জয় আশ্বাস দিলো, ভয় পেও না ইরা। আমি তো আছি তোমার সাথে ফোনে।

ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, তুমি কিন’ ফোন দেয়ামাত্র রিসিভ করো, ফোন ব্যস্ত রেখো না।

ওকে।

বাসে উঠতে গিয়ে ইরা আবার পিছনে ফিরে তাকালো, তার চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করে উঠলো। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আর কারও সাথে কথা বলো না সোনা।

বলবো না।

ইরা হাত তুললো, বাই।

ইরার বাস না ছাড়া পর্যন্ত জয় দাঁড়িয়েই রইলো। ইরাও বার বার পিছনে ফিরে তাকাতে লাগলো।

 

জয় অফিসে এসে দেখলো তার চেয়ারের সামনে দু’জন লোক বসে আছে। একজন রহিম মাস্টার, মতি যে স্কুলের হেড মাস্টার সে স্কুলের সহকারী শিক্ষক। স্কুলের কাজ চলাকালীন রহিম মাস্টারের সঙ্গে জয়ের সখ্যতা ছিলো। জয়কে দেখে মৃদু হাসি হেসে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম স্যার।

জয় হ্যান্ডশ্যাক করে বলতো, ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

তারপর জয়ের লেখালেখি, চাকরিসহ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কথা বলতো কিন’ আজ জয় তার রুমে ঢুকতেই রহিম মাস্টার গম্ভীর স্বরে বললো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

আরেকজন অন্য স্কুলের সহকারী শিক্ষক এতোদিন জয় তাকে শুধু শিক্ষক হিসেবেই চিনতো কিন’ আজ পরিচয় দেয়ার সময় নিজের পরিচয় দিলো ঠিক এভাবে, আমি মো: আনিসুর রহমান, সাংবাদিক, দৈনিক সারাবাংলা।

জয় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মৃদু হেসে বললো, কেমন আছেন আপনারা?

আনিসুর সাহেব বললেন, ভালো আর কই রাখলেন?

জয় সাংবাদিক সাহেবের কথার বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালো না। আনিসুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমরা এসেছিলাম ইরা ম্যাডামের বিষয়ে কিছু জানতে।

জয় বললো, বলুন কী জানতে চান?

ইরা ম্যাডাম তো এখন আপনার স্ত্রী?

হ্যাঁ।

আপনাদের কি বিয়ে হয়েছে?

অবশ্যই।

আপনি কি বিয়ের কাবিননামা দেখাতে পারবেন?

অবশ্যই পারবো।

একবার দেখাবেন প্লিজ!

জয় তার ড্রয়ারে কাবিননামার ফটোকপি রেখে দিয়েছিলো। আনিসুর সাহেবকে একটা কপি দিলো।

রহিম সাহেবও কাবিননামাটা দেখে মুখ কালো করলো। তারপর চেয়ার থেকে উঠে একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। তারপর কিছুটা বিনয়ের সঙ্গে বললো, আসলে আমরা আসতে চাইনি, হেড স্যার আসতে বললেন তাই এলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।

আনিসুর সাহেব আর রহিম সাহেব চলে গেলো।

 

তেতাল্লিশ

 

স্কুলের টিচার্স রুমে একটা থমথমে ভাব। কেউ কোনো কথা বলছে না। ইরা একবার চোখ বুলোতেই তার বুকটা যেনো কেঁপে উঠলো। ইরার ছিলো ক্লাস সেভেনের প্রথম ক্লাস, নিত্যদিনের মতো সে স্টুডেন্টদের হাজিরা খাতা নিয়ে ক্লাসে গেলো। ছাত্র-ছাত্রীরা  একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।

এমনিতেই ইরা দুশ্চিন্তায় আছে তারওপর ছাত্র-ছাত্রীদের এমন অপ্রত্যাশিত আচরণে ইরা যেনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। ইরা রোল কল শুরু করলো, রোল নাম্বার ওয়ান।

রোল নাম্বার এক একটি মেয়ের রোল নাম্বার। সে উঠে দাঁড়ালো না। ইরা একবার পুরো ক্লাস রুম চোখ বুলালো ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা অসহিঞ্চু ভাব লক্ষ্য করলো। সে আবার ডাকলো, রোল নাম্বার ওয়ান।

মেয়েটি দাঁড়ালো না। ইরা যে মেয়েটির রোল নাম্বার ওয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলো, এই শিরিন, কথা বলছো না কেনো? কী হয়েছে?

শিরিন কিছু বললো না সে ক্লাস ক্যাপ্টেন শরীফের দিকে তাকালো।

শরীফ বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো, ম্যাডাম আমরা আপনার ক্লাস করবো না।

ইরা ষড়যন্ত্রের গভীরতা অনুধাবন করতে পারলো। সে তবুও জিজ্ঞেস করলো, কেনো?

শরীফ কোনো কথা না বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। ক্লাসের সব ছাত্ররা ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লো। ক্লাস সেভেনের ছাত্র-ছাত্রীদের বেরিয়ে আসতে দেখে একে একে সব ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে এলো। স্কুল ক্যাম্পাসে স্টুডেন্ট ক্যাবিনেটের মিটিং শুরু হলো, কিছুক্ষণ পর শুরু হলো মিছিল, ইরা ম্যাডামের ক্লাসে কেউ যাবো না, যাবো না। ইরা ম্যাডামের অপসারণ চাই।

আরও অশোভনীয়, বিশ্রী ভাষায় ইরার বিরুদ্ধে তারা স্লোগান দিতে শুরু করলো।

ইরা কোনোমতে হাজিরা খাতা নিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকলো। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল থেকে কয়েকজন ছাত্র টিচার্স রুমের দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। এসব ছাত্র ইরার পরিচিত, এর সঙ্গে স্কুল কমিটির একটা পক্ষের যোগাযোগ আছে।

রাজনীতি আগে ছিলো সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষের কাছে, তারা নিজেদের টাকা খরচ করে জনগণের কল্যাণ করতেন। হয়তোবা সেজন্য জনকল্যাণমূলক কাজ যারা করতেন তাদেরকে রাজনীতিবিদ বলা হতো। কালক্রমে রাজনীতি রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে চলে এসেছে। ফলে রাজনীতি এখন মানুষের জনকল্যাণ করার সখের স’লে টাকা রোজগারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

ছাত্র রাজনীতি আগে ছাত্ররাই করতো, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্ররা। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ছাত্ররা রাজনীতি করতে শুরু করলো। ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সেই নেতৃত্ব শুরু হওয়া উচিত একজন ছাত্রের মধ্যে ভালো-মন্দ বোঝার পরিপক্কতা গড়ে ওঠার পর কিন’ গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের নামে রাজনীতি চর্চা শুরু হয়েছে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, যারা বয়সে কিশোর তাদের মধ্য থেকে।

প্রসঙ্গতঃ দেশের রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। মাথায় পঁচন ধরলে যা হয়, সেই পঁচন সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। দেশে একসময়ের ছাত্র রাজনীতির গর্বিত ইতিহাস আছে একথা অনস্বীকার্য কিন’ বর্তমানে সেই গর্ব করার মতো তেমন কিছু দেখা যায় না। তবে ঐ যে মাথার পঁচন। দলীয় রাজনীতির পঁচন ছড়িয়ে পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতেও। তা আগে ছিলো শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে সেই দলীয় রাজনীতির পঁচন এখন ধরতে শুরু করেছে হাইস্কুল পর্যায়েও।

ইরার বিষয়টি শতভাগ তার ব্যক্তিগত। তা সত্ত্বেও স্কুলে তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতি। কতিপয় শিক্ষক এবং কমিটির সদস্য সরাসরি এই রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে পরোক্ষভাবে স্টুডেন্টস ক্যাবিনেটের ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছে।

বড় একটা রুমের মাঝখানে পার্টিশন। পার্টিশনের বড় অংশ টিচার্স রুম আর ছোট অংশ প্রধান শিক্ষকের অফিস। প্রধান শিক্ষক পাশের রুম থেকে জোরে ডাক দিলেন, ইরা ম্যাডাম একবার আসুন।

ইরা ক্লাস থেকে ফিরে টেবিলের ওপর হাজিরা খাতাটা রেখে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বসেছিলো। হেড মাস্টারের ডাক শুনে তার বুকটা কেঁপে উঠলো, হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেলো।

স্কুলের হেড মাস্টার বদিউল সাহেবের বয়স প্রায় আটান্ন বছর। পরণে পাঞ্জাবি-পায়জামা, লম্বা দাড়ি, মাথায় সার্বক্ষণিক টুপি। স্কুলের শিক্ষিকাদের কথায় কথায় মেয়ের মতো বলে পিতৃত্ব দাবি করেন যা তার চোখের দৃষ্টি ও কথাবার্তার মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীয়মান হয় না।

গতবছর স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইরাকে নিয়ে ঘটলো এক ঘটনা। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তিনিও মঞ্চে উঠে গান গাইতে শুরু করলেন। শুধু গান না, নাচও।

প্রথম একটা গান গাইলেন ছাত্রীদের সাথে তারপর আরেকটা গান শুরু করার আগে তিনি মঞ্চ থেকে ইরাকে প্রথমে হাতের ইশারায় ইরাকে ডাকলেন। ইরা প্রথমে বুঝতে পারলো না, সে নিজেকে ইশারা করে বললো, আমি।

এবার বদিউল সাহেব নাম ধরে ডাক দিলেন, ইরা ম্যাডাম, ইরা।

ইরা না সূচক মাথা নাড়লো। পাশ থেকে আরেকজন শিক্ষিকা বললেন, যান ম্যাডাম। স্যার ডেকেছেন।

ইরা আবারও না সূচক মাথা নাড়লো।

বদিউল সাহেব আবার ডাকলেন, ইরা ম্যাডাম আসুন।

অগত্যা ইরা মঞ্চে উঠলো।

বদিউল সাহেব নেচে নেচে গান শুরু করলেন, তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর তোমার সাথে ছিলো পরিচয়, বুঝি ছিলো পরিচয়…

গানের কথা শুনেই ইরা কিছুটা বিব্রতকর অবস’ায় পড়লো। ততক্ষণে দর্শকদের মধ্যে হাততালি পড়তে শুরু করেছে। গানের সুরে সুরে, নৃত্যের তালে তালে বদিউল সাহেব হাত ধরতেও সংকোচ করলেন না। ইরাকে তার পারদর্শিতা দেখাতে হলো, নাচে গানে দর্শকদের মধ্যে চরম আনন্দ উত্তেজনা আর হাত তালি শুরু হলো। গান শেষে ইরা যখন মঞ্চ থেকে নামলো তখন কেউ কেউ সুর করে গান গেয়ে ইরাকে টিজ করতে লাগলো।

ইরার বিরুদ্ধে একরকম জোর করে মঞ্চে নিয়ে গান করায় হেড স্যারের প্রতি তার শ্রদ্ধায় কিঞ্চিৎ ফাটল দেখা দিয়েছে। তখন থেকে ইরা বদিউল সাহেবকে এড়িয়ে চলে। প্রয়োজন ছাড়া কোনোদিন তার চেম্বারে যায় না। ইরা লক্ষ্য করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন বাইরে মিছিল করছিলো হেড মাস্টার সাহেব তখন তার রুমের মধ্যে পায়চারি করছিলো, যেনো তার মধ্যে অসি’রতা কাজ করছিলো। তখনই ইরার মনে হয়েছে সে যেনো একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে চলেছে।

ইরা হেড মাস্টারের রুমে ঢুকলো, আসসালামুয়ালায়কুম স্যার।

হেড মাস্টার সাহেবের গায়ের রং কালো। ইরাকে দেখে তারে চোখে-মুখে যেনো আষাঢ়ের কালো মেঘে ঢেকে গেছে। তিনি ইরার মুখের দিকে না তাকিয়ে সালামের জবার দিলেন, ওয়ালেকুম আসসালাম।

তিনি কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলেন।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, স্যার আমাকে ডেকেছেন?

হেড মাস্টার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বসুন।

ইরা একটা চেয়ারে বসলো।

হেড মাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি কী করলেন ম্যাডাম?

ইরা একটু সাহস সঞ্চয় করে বললো, কী করলাম স্যার?

কী করেছেন সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।

হ্যাঁ তা আমি জানি, ঠিকই বলেছেন স্যার কিন’ সেটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে স্কুলে এমন পরিসি’তি তৈরি হবে কেনো স্যার?

সেটা তো আমারও প্রশ্ন কিন’ একটা কথা মনে রাখবেন। ব্যক্তির চরিত্র খারাপ হলে প্রতিষ্ঠানও তার দায় থেকে মুক্ত না। তাছাড়া আপনি একজন শিক্ষক হয়ে… ছিঃ ছিঃ ছিঃ

ব্যাপারটা এখন আর শুধু স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কালাই পর্যন্ত জানাজানি হয়েছে। আমাকে দু’য়েকজন সাংবাদিক ফোন করেছিলেন। তারা আজকেই আসতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি এটা স্কুলের ব্যাপার আমরা বিষয়টা দেখছি, তবে আজ থামিয়ে রাখতে পারলেও কাল হয়তো আর তাদের থামানো যাবে না।

ইরা মাথা নিচু করে বসে রইলো।

মাস্টার সাহেব একটা নিঃশ্বাস টেনে আবার বলতে শুরু করলেন, নিজের স্কুলের ছাত্ররাই যখন মিছিল বের করেছে তখন বাইরের লোককে আমি আর ঠেকাবো কীভাবে।

ইরা মৃদু কণ্ঠে বললো, স্যার আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল বের করার পেছনে কারও ষড়যন্ত্র আছে। শুধু তাই নয় স্কুলের শিক্ষক এবং কমিটির লোকজনের হাত আছে। একটা কথা আমি না বলে পারছি না স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব চোয়াল শক্ত করে বললেন, কী কথা?

আমি কাকে ডিভোর্স করবো কাকে বিয়ে করবো এটা একমাত্র আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ ব্যাপারে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের নয় শিক্ষক ও কমিটির কারও হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়।

ঐ যে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বলে একটা কথা আছে না। আচ্ছা যাক আপনি বেশি টেনশন করবেন না। আমি দেখছি বিষয়টা কী করা যায়। তবে ঝড় সামাল দেয়া সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

ইরা আপনমনে বললো, আপনি নিজে যদি ঝড় তোলেন তবে আর সামাল দেয়া সহজ হবে কীভাবে। আর মিটিংয়ে আপনি যা চাইবেন তাই হবে। কিন’ মুখে কিছু বললো না।

হেড মাস্টার সাহেব আবার বললেন, তাছাড়া এতবড় একটা ঘটনা আমাকে তো কমিটিকে অবহিত করতে হবে, দেখি মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়।

 

চুয়াল্লিশ

 

রহিম সাহেব আর আনিসুর সাংবাদিক চলে যাবার পর জয় একটা স্বস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেললো। কয়েকমুহূর্ত চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলো। জয়ের মাথায় কত আকাশ-পাতাল চিন্তা। এ যেনো চিন্তার এক অথৈ সাগর। জয় একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, এখন ইরার ক্লাস। ইরা যাওয়ার সময় তার ক্লাসের সময় ফোন দিতে নিষেধ করেছে এমনকি স্কুলে থাকার সময়ও, প্রয়োজনে সে-ই ফোন দিবে। তবু জয়ের মনটা দুশ্চিন্তায় ছটফট করছে। ইরা বলে, তুমি যখন তোমার কোনো মেয়ে বন্ধু বা ভক্তের সঙ্গে কথা বলো কিংবা কোনো দুশ্চিন্তায় থাকো তখন আমি ঠিকই টের পাই, আমার মনটা শুধু ছটফট করে।

ঠিক জয়ের মনটাও আজ ছটফট করছে, একটা অসি’রতায় তার বুকটা যেনো ধড়ফড় করছে। ইরা নিষেধ করেছিলো তারপরও জয় ইরাকে ফোন করলো কিন’ ইরা রিসিভ করলো না, একটা ম্যাসেজ দিলো, অনেক জটিল সমস্যা জয়। আমি পরে তোমার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করছি।

 

শামিম সাহেব এলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কেমন আছেন ভাই?

ভালো।

শামিম সাহেবের সঙ্গে জয়ের পরিচয় প্রায় একবছর আগে। জয় প্রথম যখন জয়পুরহাট এলো তখন একটা কাজের কন্ট্রাক্ট পেলো শামিম সাহেব। সেই থেকে প্রায় দিন একসঙ্গে সাইটে যাতায়াত। দিনে দিনে দু’জনের সম্পর্ক অনেকটা ঘনিষ্ঠও হয়েছে। জয়ের চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই কোনো সমস্যা?

জয় একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, না, তেমন কিছু না।

আপনাকে তো কখনো চিন্তা করতে দেখি না, সবসময় হাসিখুশিই দেখি। কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই।

তেমন কিছু না শামিম সাহেব, বলে জয় কলিং বেল টিপতেই পিয়ন এলো, স্যার।

জয় পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললো, চা নিয়ে এসো।

পিয়ন চলে গেলো।

শামিম সাহেব কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর বললো, খুব বড় সমস্যা?

জয় আবারও একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, না, তেমন কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

পিয়ন চা নিয়ে এলো।

শামিম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ভাই আমরা একসঙ্গে অনেকদিন কাজ করছি। আমি তো আপনার কোনো সমস্যা দেখি না। কিছু হয়েছে? আমাকে বলুন?

জয় তবুও কিছু বললো না।

শামিম সাহেব বললো, টাকা-পয়সার সমস্যা?

না।

ভাই একটা কথা বলে রাখি সমস্যাটা যদি ব্যক্তিগত হয় তবে বলার প্রয়োজন নেই তবে আমার কোনো সহযোগিতা লাগলে বলবেন। আমি আপনার পাশে থাকবো।

আমি জানি শামিম সাহেব দুঃসময়ে আপনি আমার পাশে থাকবেন।

শামিম সাহেব চেয়ার থেকে উঠলো। জয় জিজ্ঞেস করলো, কোনো কাজে এসেছিলেন শামিম সাহেব?

শামিম সাহেব হয়তো কোনো কাজেই এসেছিলো কিন’ জয়ের মনের অবস’া দেখে আর কথা বাড়ালো না। শামিম সাহেব চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। বড় ছেলে, মানিক ফোন করেছে।

জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো। ছেলে বাবাকে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক কিন’ বাবা ছেলেকে ভয় পাবে এটা স্বাভাবিক না। জয়-সামিনার দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের অশান্তি মানিক-রতন দু’ভাই দেখেছে এখন তারা বড় হয়েছে। প্রথমে সামিনা ভালো হয়ে যাবে বলে জয় আশা করেছিলো কিন’ জয়ের সে আশা পূরণ হয়নি। শেষ সান্ত্বনা ছিলো মানিক-রতন। তারা এখন বড় হয়েছে। মানিক এখন এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে হায়ার এডুকেশনে এ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করছে আর রতন এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। বয়স তো একেবারে কম নয়। জয়ের আশা ছিলো তারা বিষয়টাকে বাবার একান্ত ব্যক্তিগত বলে মেনে নিবে, বাবার প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করবে কিন’ তারা মা আর মা’র পক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের ইন্ধনে জয়ের সঙ্গে দূর্বব্যহার করতে শুরু করেছে।

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

কোথায় তুমি?

অফিসে।

কোন অফিসে?

জয়পুরহাট, আমার অফিসে।

তুমি ইরার কী করলে?

কী করলাম মানে?

কী করলাম মানে, তুমি ওকে ডিভোর্স করেছো কী না?

না।

করবে না?

মানিক জোরে চিৎকার করে বললো, এই শুয়োরের বাচ্চা তুই ওকে ডিভোর্স করবি কী না?

মানিকের কথা শুনে জয়ের মাথায় যেনো বজ্রপাত পড়লো, এই কি আমার ছেলে মানিক। যাকে আমি জন্ম দিয়েছি, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। এ কি পিতা-পুত্রের সম্পর্ক।

জয় মানিকের কথার কোনো জবাব দিলো না। সে মোবাইল ফোন হাতে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

মানিক আবারও চিৎকার করে বললো, এই, এই শুয়োরের বাচ্চা কথা বলছিস না কেনো? আমি আগামী শুক্রবার দিনাজপুর যাবো। এর মধ্যে যদি তুই ওকে বিদায় না করিস তবে আমি তোকে জবাই করবো, জবাই, বুঝলি।

জয় কোনো কথা বললো না। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। কথা বলার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে।

তার হাত থেকে মোবাইল ফোন পড়ে গেলো।

 

পঁয়তাল্লিশ

 

ইরা স্কুল থেকে বের হয়ে ফোন করলো, কোথায় তুমি?

ইরার কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা। ইরার কথা শুনে জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো, আমি তো অফিসে।

তুমি বাস স্ট্যান্ডে এসো। আমি বাসে উঠলাম।

জয় জিজ্ঞেস করলো, ইরা কোনো খারাপ খবর? কণ্ঠস্বর এমন করছে কেনো?

ইরা কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো, আমি তো আসছি জয়, তুমি এমন করছো কেনো?

ওকে ইরা এসো। আমি বাস স্ট্যান্ডে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

ইরার সঙ্গে কথা বলার পর জয়ের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেলো। একটা অসি’রতায় সে চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি করতে লাগলো।

জয় কয়েকমিনিট পর ইরাকে ফোন করলো, হ্যালো।

ইরা গম্ভীর স্বরে বললো, বলো!

কতদূর এলে?

বটতলী।

ওকে আমি অফিস থেকে রওয়ানা দিচ্ছি বাসস্ট্যান্ডে।

জয় বাস স্ট্যান্ডে যেতেই ইরা বাস থেকে নেমে জয়ের মোটর সাইকেলে উঠলো। ইরা ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছে। জয় তার চোখ দু’টো দেখেই বুঝতে পারলো তার ওপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে গেছে। বাসায় ঢুকে ইরা ওড়না সরাতেই জয় যেনো চমকে উঠলো, ইরা! কী হয়েছে?

এই কয়েকঘণ্টায় ইরার চেহারা বিদ্ধস’ হয়ে গেছে। ঝড়ের কবল থেকে পালিয়ে আসা পাখি যেমন কোনো রকমে ডানা ঝাপটে বাঁচে ইরার অবস’াও যেনো ততটাই খারাপ। জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো, তার কপালে চুমু দিয়ে বললো, ইরা, তুমি এমন করছো কেনো ইরা? ভেঙ্গে পড়ছো কেনো? আমি তো আছি।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, জয়! আমার জয়! আমার ওপর অনেক ঝড় আসবে জয় আমি বুঝতে পারছি।

তুমি শুধু তোমার ওপর ঝড় আসবে কেনো বলছো ইরা। যদি কোনো ঝড় আসে সেটা আমাদের দু’জনের ওপরই আসবে। আমি সবকিছু ঠিকই সামলে নিবো।

আমার সে বিশ্বাস আছে জয় আর সেই বিশ্বাস আছে বলেই গোটা পৃথিবী ছেড়ে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমাকে শক্তভাবে ধরে রেখো জয়।

জয় আরও নিবিড়ভাবে ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো অনেকক্ষণ তারপর ইরা বললো, আজ স্কুলে কী হয়েছে জানো?

জয় নিষেধ করলো, এখন না ইরা আগে ভাত খাও, তারপর কথা বলি।

ইরা কাপড়-চোপড় ছেড়ে রান্নাঘরে গেলো।

ইরা সকালবেলা রান্না করে রেখে স্কুল থেকে এসে খাবার গরম করে ভাত বাড়িয়ে দিলো।

নতুন সংসার। খাট, ডাইনিং টেবিল এখনো তেমন কিছু কেনা হয়নি। এমনকি মেঝেতে একটা পাটি বিছানোর মতোও কিছু কেনা হয়নি। ইরা একটা তোয়ালে বিছিয়ে দু’জনের জন্য ভাত বাড়লো। গতকাল বাজার থেকে দু’টো প্লেট আর কোনো রকমে দিন চলার মতো কিছু তৈজষপত্র কিনেছে। দু’টো চিনামাটির মগ আগে একটা জয় ইরাকে গিফট করেছিলো আরেকটা জয়ের অফিসে ছিলো। একটা প্লাস্টিকের জগ কেনা হয়েছে, কয়েকটা বাটি। এই যেনো সংসার। জয় একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, আমাদের সংসারটা খুব ছোট তাই না?

ইরা মৃদু হাসলো, ধীরে ধীরে সব হবে।

আজ বিকেলে চলো একবার বাজারে বের হই। আরও কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে।

হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছি।

ইরা পাশাপাশি দু’টো প্লেট আর ভাতের গামলা রেখে তরকারি আনতে গেছে। গতকাল বাজার থেকে জয় ইলিশ মাছ কিনে এনেছে। মাছ কাটার বটি এখনো কেনা হয়নি। তাই জয় বাজার থেকেই মাছ কেটে এনেছে। ইরা বলে দিয়েছে বাসার সব তৈজষপত্র কেনার আগে তরকারি কিনতে গিয়ে একবার বিষয়টা মাথায় রাখে। জয় ঠিক সেভাবে কাঁচাবাজার করে। ইরা ইলিশ মাছ আর একটা সবজি রান্না করেছে। ইরা তরকারি নিয়ে আসতে আসতে জয় ইরার প্লেটে ভাত তুলে দিলো। মাছের গামলা মেঝেতে রাখতেই জয় মাছের মাথাটা ইরার প্লেটে তুলে দিলো।

ইরা বললো, তুমি খাও।

না, তুমি।

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো?

জয় মুচকি হাসি হেসে বললো, আরে না আমি তোমাকে ভালোবাসি না। মাছের কাঁটা বাছতে কষ্ট তাই তোমাকে মাছের মাথা খেতে দিলাম।

দু’জনে হেসে উঠলো।

 

ইরা ভেবেছিলো জয় আজ বাসাতেই থাকবে কিন’ জয় খাবার পরপরই অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। ইরা জিজ্ঞেস করলো, তোমার বিকেলে অফিস না গেলেই কি নয়?

জয় মৃদু হেসে বললো, অফিস যেতে হবে না ইরা। আমি কখনো দায়িত্বে অবহেলা করি না।

সে তো আমার অজানা নয়।

ইরা জয়ের হ্যালমেটটা খুব যত্ন করে মুছে দিলো। জুতো পরিয়ে দিচ্ছিলো কিন’ জয় বললো, না, না আমি নিজে পরবো।

ইরা কিছুটা শাসনের সুরে বললো, চুপ, আমি যা বলবো তা-ই করতে হবে তুমি একথা বলেই আমাকে নিয়ে এসেছো মনে নেই। আমি জুতো পরিয়ে দিচ্ছি।

ইরা জয়কে জুতো পরিয়ে দিয়ে পাঁ ছুঁয়ে সালাম করতেই জয় তাকে বুকে টেনে নিলো।

ইরা জয়ের কানে ফিসফিস করে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তাড়াতাড়ি এসো সোনা। আমি একাই বাসায় থাকবো।

অবশ্যই, ঠিক পাঁচটা বাজবে আর অফিস থেকে বের হবো। অফিস থেকে বাসায় আসতে পাঁচ মিনিট।

পাঁচটা এখন তো সবেমাত্র তিনটা বাজে। আরও দু’ঘণ্টা…

জয় ইরার থুতনি ধরে আদর করে বললো, এই তো মাত্র দু’ঘণ্টা।

আমি কিন’ মাঝে মাঝে ফোন দিবো।

অবশ্যই।

ফোন ব্যস্ত পেলে…

জরুরি ফোন তো থাকতে পারে ইরা।

সেটা আমি বুঝবো কোনটা জরুরি আর কোনটা তোমার বন্ধু-ভক্তদের।

ওকে দিও। আর একটা কথা তুমি রেডি থেকো বিকেলে আমরা আলতাদিঘী বেড়াতে যাবো।

ইরা ভ্রু’কুঁচকে বললো, আলতাদিঘী কোথায়?

ধামইরহাট।

মানে তোমার সেই পুরানা কর্মস’ল। যেখানে তোমার সাথে অন্য কোনো বান্ধবীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

ছিঃ ইরা এভাবে বলতে হয় না। তুমি রেডি থেকো কিন’-

ইরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। তারপর হাত নেড়ে বিদায় জানালো।

 

ছেচল্লিশ

 

দু’জনে রওয়ানা হলো আলতাদিঘীর উদ্দেশ্যে। জয় দ্রুত বেগে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে আর ইরা জয়ের সিটের পেছনে বসে বার বার বলছে, আস্তে চালাও, আস্তে। তুমি তো এতো জোরে মোটর সাইকেল চালাও না। আজ আবার এতো জোরে চালাচ্ছো কেনো?

রওয়ানা দিতে দেরি হয়ে গেছে ইরা। তাড়াতাড়ি যেতে না পারলে ভালোভাবে দেখাই হবে না।

তাই বলে এতো জোরে।

ইরা জয়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো জয় মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে ওর বাম হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, এমন সুন্দরী তরুণী পিছনে বসে থাকলে মোটর সাইকেল কি আস্তে চলতে পারে? কেমন করে যেনো গতি বেড়েই যাচ্ছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।

তাহলে স্বীকার করছো সুন্দরী তরুণীই থাকলে গতি এমনি বেড়ে যায়।

অবশ্যই।

আর লেখার?

জয় ইরার কথা বুঝতে না পেরে বললো, বুঝিনি।

ইরা এবার একটু জোরে বললো, তোমার লেখার সময়ও কোনো তরুণী এমনিভাবে তোমার হৃদয়ে বাস করে নাকি সেজন্য লেখায় গতি থাকে, ছন্দ থাকে, প্রাণ থাকে?

জয় ইরার কথা না বুঝেই বললো, হুঁম।

তাই? বলে ইরা জয়ের হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর জয়ের কানের কাছে মুখ এনে রাগান্বিত স্বরে উচ্চ কণ্ঠে বললো, তাহলে আগের বইগুলো লিখেছো কোন তরুণীর প্রেরণায় মি. রাইটার।

এই হলো, তোমাকে আমি বলি কী আর তুমি বোঝো কী। তাই বলে কি একজন লেখক যতগুলো বই লিখবে ততগুলো নারীর সঙ্গে রিলেশনে জড়াবে। আমি তোমার সাথে ইয়ার্কি করছিলাম। আর তুমি সেটাকে নিয়ে…

ইরা জয়ের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললো, আমিও তো তোমার সাথে ইয়ার্কি করছি মি. রাইটার। তোমার না হয় অসংখ্য ভক্ত-পাঠক আছে যাদের সঙ্গে তুমি ইয়ার্কি করতে পারো, টিজ করতে পারো একটু-আধটু ভালোবাসা ভালোবাসা খেলাও খেলতে পারো কিন’ আমার তো আর কেউ নেই। যা করবো তোমার সাথেই করবো।

জয় ইরার কথায় মৃদু হেসে বললো, ব্রেক, ব্রেক, ব্রেক।

ইরা চমকে উঠলো, কী সব ব্রেক, ব্রেক, ব্রেক বলছো, ব্রেক তো তুমি করবে, আমি ড্রাইভার নাকি?

আরে গাধা আমি তো মোটর সাইকেল ব্রেক করার কথা বলিনি, মোটর সাইকেল ব্রেক করতে হলে তো আমিই করতাম। আমি তোমাকে তোমার কথা ব্রেক করতে বলেছি।

কেনো? তুমি কি ভক্ত-পাঠকদের সাথে ভালোবাসা ভালোবাসা খেলো না?

জয় জোরালো গলায় বললো, না।

তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করলাম।

ততক্ষণে দু’জনে জয়পুরহাট ধামইরহাট রোড ছেড়ে আলতাদিঘী রোডে ঢুকে পড়েছে। অনেকদূর এগিয়েছেও, একটা রাস্তা এসে দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো সাইনবোর্ড নেই, জিজ্ঞাসা করার মতো আশেপাশে কোনো লোকজনও নেই।

জয় মোটর সাইকেল ব্রেক করে দাঁড়ালো। ইরা জয়ের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, দাঁড়ালে কেনো?

জয় গম্ভীর স্বরে বললো, ইরা ভক্তি আর ভালোবাসা এক না। যারা আমার ভক্ত তারা আমাকে ভক্তি করে হৃদয় দিয়ে তাদের সাথে ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা করলে ভক্তি যে উধাও হয়ে যাবে। ভক্ত’র কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করতে হয় না।

আর ভালোবাসা?

ভালোবাসার মানুষ অন্য, যাদের সাথে ভালোবাসা ভালোবাসা খেলতে হয় না। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হয়।

বাহ্‌। খুব ভালো বলেছো তো। মি. রাইটার, ও সরি ড্রাইভার এতক্ষণ যে জোরে চালালে তাড়াতাড়ি পৌঁছার জন্য আবার এখন দাঁড়িয়ে রইলে যে।

বুঝতে পারোনি? চিনি না তো কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।

একজন পথচারী এলো। জয় জিজ্ঞেস করলো, ভাই আলতাদিঘী কোন্‌ দিকে?

পথচারীর দেখিয়ে দেয়া রাস্তা দিলো জয় মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো।

ইরা বললো, এই তুমি না একসময় ধামইরহাট চাকরি করতে। তখন কোন্‌ মেয়ের সঙ্গে যেনো তোমার প্রেম ছিলো। ওকে নিয়ে নাকি তুমি আলতাদিঘী এসেছিলে। আর এখন আবার নাটক করছো, মনে হয় কোনোদিন যাওনি।

অনেকদিন আগের কথা সেজন্য পথ ভুলে গেছি। আর তুমি যে বললে কোন্‌ মেয়ের সাথে, না কোনো মেয়ের সাথে না। ধামরইহাটে আমার কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম তো দূরের কথা বন্ধুত্বও ছিলো না, সখ্যতাও ছিলো না।

ইরা একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, রেগে গেলে মনে হয়?

না, খুশি হয়েছি। তুমি সবসময় এমন সন্দেহ করলে আমি খুব খুশি হ্‌ই। মনে হয় আমি খুব সুন্দর, স্মার্ট আর দুনিয়ার সব মেয়ে আমাকে দেখে তাদের সবকিছু ছেড়ে আমার কাছে চলে আসছে তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। জয় অনেকটা রাগান্বিত স্বরে বললো।

সুন্দরই তো, স্মার্টই তো। আমার জয় স্মার্ট হবে না। আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর। সেজন্যই তো আমার ভয় হয় কখন যে কে তোমাকে নিয়ে যায় বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো।

কথা বলতে বলতে আর মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে দু’জনে বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। শালবনের ভিতর দিয়ে সরু কার্পেটিং বিছানো রাস্তা। জয়ের মনে হচ্ছিলো তারা বুঝি সুন্দরবনের কোনো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।

ইরা জয়ের কাঁধে হাত দিয়ে তার পিঠের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। জয় মোটর সাইকেল চালাচ্ছে ধীর গতিতে। একটা নির্দেশনা সাইন বোর্ড, আলতাদিঘী বাম দিকে।

জয় মোটর সাইকেল বাম দিকে ঘুরিয়ে কয়েকমিনিটের মধ্যে তারা আলতাদিঘী পৌঁছালো। জয় মোটর সাইকেল দাঁড় করতেই ইরা মোটর সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে গেলো।

পুকুরের কাছে গিয়ে আবেগ আল্পুত হয়ে বললো, ওয়াও। কী সুন্দর!

তারপর ইরা পুকুরের পাড় থেকে একটু দূরে এক খণ্ড কংক্রিট দেখে এক লাফে সেই কংক্রিট খণ্ডের ওপর দাঁড়ালো। ইরা এখন যেনো একটা দ্বীপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জয়কে বললো, আমার কয়েকটা ছবি তোলো তো।

জয় ইরার ট্যাব দিয়ে কয়েকটা ছবি তুললো।

ইরা বললো, ভালোভাবে তুলছো তো, পুকুরের অনেকটা অংশ, পিছনের জঙ্গলসহ যেনো আসে।

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, জো হুকুম রাণী।

ইরাও হেসে ফেললো।

জয় ইরার আরও কয়েকটা ছবি তুললো।

তারপর ইরা যেমন লাফিয়ে গিয়েছিলো তেমনি লাফিয়ে আবার পাড়ে চলে এলো। এবার জয় সেই কংক্রিট খণ্ডের ওপর উঠলো ইরা তার কয়েকটা ছবি তুললো।

তারপর দু’জনে হাত ধরাধরি করে পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

অদূরে একটা ফুচকা-চটপটির দোকান। সেই দোকানের সামনে একটা কংক্রিটের বড় ছাতা। ছাতার নিচে বৃত্তাকার কংক্রিটের বেঞ্চ।

দু’জনে কংক্রিটের বেঞ্চে বসলো।

 

ফুচকার দোকানের নাম আলতা। প্রথমে জয়ের মনে হয়েছিলো হয়তো দিঘীর নাম অনুসারে নাম রেখেছে কিন’ কিছুক্ষণ পর দোকানদার আলতা বলে ডাক দিতেই পাঁচ ছয় বছর বয়সের একটা মেয়ে দৌড়ে এলো। সুন্দর, ফুটফুটে একটা মেয়ে।

ইরা হাত তুলে ডাক দিলো, আলতা।

মেয়েটি ইরার কাছে এলো, ইরা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো, মেয়েটির থুঁতনি উঁচু করে ধরে বললো, তোমার নাম আলতা?

মেয়েটি মাথা উঁচু-নিচু করে বললো, হুঁম।

ইরা জয়ের কাঁধের ওপর মাথা রেখে বললো, ইসস আমাদের যদি এমন একটা মেয়ে হতো।

জয় ইরার কানে ফিসফিস করে বললো, হবে ইরা। সময়টা দিবে তো।

ইরা হাসলো, তুমি আমাকে এরকম একটা মেয়ে দিও, আমি আর তোমার কাছে কিচ্ছু চাইবো না, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি কিচ্ছু চাই না, শুধু তোমাকে আর আলতার মতো একটা মেয়ে।

জয় মৃদু হাসলো।

 

ইরা মৃদু হেসে জোরে ডেকে বললো, এই যে আলতার বাপ আমাদের দু’টা চটপটি দেন।

জি আপা, দিচ্ছি।

ইরা জয়ের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে হেলান দিয়ে কয়েকটা সেলফি তুললো। তারপর বললো, এই জায়গাটা খুব সুন্দর। দেখোতো আমাদের ছবি তোলার জন্য কাউকে পাওয়া যায় কী না?

ইরার কথা শুনে দোকানদার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে ডাক দিলো, শরিফুল একবার এদিকে আয়তো বাবা।

শরিফুল এলো, চাচা বলেন।

ও বাবা, আপা আর ভাইজানের কয়েকটা ছবি তুলে দেতো। আমি তো ছবি তুলতে পারি না।

ইরা শরিফুলকে তার ট্যাব দিয়ে কীভাবে ছবি তুলতে হয় দেখিয়ে দিলো। তারপর জয়ের পাশে বসলো।

শরিফুল কয়েকটা ছবি তুললো। তারপর দু’জনে চটপটি খেয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠলো।

দিঘীর চার পাশে সরু রাস্তা। পশ্চিম পাশে ঘন বন। দু’জনে মোটর সাইকেল নিয়ে দিঘীর চারপাশে একবার চক্কর দেয়ার জন্য মোটর সাইকেলে উঠলো। ইরা পশ্চিম পাশে গিয়ে জয়ের পিঠে মৃদু আঘাত করে বললো, একটু দাঁড়াওতো।

কেনো?

একটু দাঁড়াওনা প্লিজ!

জয় মোটর সাইকেল দাঁড় করলো।

শেষ বিকেলের রক্তিম বিচ্ছুরিত আভা পাতার ফাঁক দিয়ে ইরার মুখের ওপর পড়েছে। ইরাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। জয় অনেকক্ষণ ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। ইরা জয়ের চোখের সামনে হাত নেড়ে বললো, এই কী দেখছো এভাবে?

জয় বললো, ইরা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে, অপূর্ব।

হয়েছে, হয়েছে আর চাপা মারতে হবে না।

চাপা না সত্যি বলছি।

ইরা আবার কয়েকটা সেলফি তুললো। তারপর হঠাৎ করে জোরে হাত তালি দিলো, ওয়াও, এই দেখোতো এটা কী? তুমি চেনো?

জয় বললো, হ্যাঁ, চিনবো না কেনো। উইপোকার ঢিবি। তুমি আগে দেখোনি?

দেখিনি তবে তোমার একটা বইয়ে পড়েছি।

কোন বইয়ে বলোতো?

ট্রেন টু ভিলেজ। আমি ওখানে একটু দাঁড়াই তুমি আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও।

জয় ইরার কয়েকটা ছবি তুলে দিলো।

ইরা বললো, এরকম একটা জায়গায় আমাকে আগে আনবে তো।

 

অনেক দিন থেকে আলতাদিঘী যাওয়ার কথা কিন’ ইরার পিছুটান আছে। ইরার পিছুটান থাকারও কারণ আছে। আসলে ওদের দাম্পত্য জীবন, সংসার সবকিছু যেনো নাগরদোলায় দোল খাচ্ছিলো। প্রতিদিন কোনো না কোনো সাংবাদিক ফোন করতো, ইরার ছেলে শুভ তাকে ফিরে যাওয়ার জন্য মা’র কাছে কান্নাকাটি করতো, ইরার আগের পক্ষের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে তাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দিতো। প্রতিদিন তারা মনে করতো আজকের দিনটাই বুঝি শেষ দিন, আজকের রাতটাই বুঝি শেষ রাত। আগামীকাল নতুন সকাল আসার সাথে সাথে কেউ এসে বুঝি তাদের দু’জনকে দু’দিকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। দাম্পত্য জীবন তাদের হৃদয়ে থাকবে বেদনাময় স্মৃতি হয়ে। আর সেজন্যই ইরা চাচ্ছিলো তাদের বিয়ের বিষয়টা যেনো শহরে ছড়িয়ে না পড়ে। ইরার পিছুটানের কারণ শুধু এটাই না। এটা তার মনস্তাত্বিক সমস্যা। ইরা ভোগের সময় ত্যাগে বিশ্বাসী।

জয় ভাবছিলো অন্য কথা। সে সময় ও সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বাসী। তার চিন্তা ছিলো সত্যি সত্যি তাদের দাম্পত্য জীবন যদি স্মৃতির যাদু ঘরে চলে যায়, দাম্পত্য জীবনের বেদনাময় স্মৃতিগুলো যদি সারাজীবন হৃদয়ে দাগ কাটে তবে সেই সময়গুলোকে আনন্দময় করে তুলতে।

জয় ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর তাই না ইরা?

অবশ্যই, খুব সুন্দর।

ইরা হাঁটতে হাঁটতে জয়ের কাছে এলো। তার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে মিশে গেলো। তারপর জয়কে সুর্যের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, আজকের বিকেলটা কত সুন্দর। আজকের বিকেলটা যদি জীবনের শেষ বিকেল হতো। বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর ভিজে গেলো।

জয় ইরার মুখে হাত দিয়ে বললো, ইরা সবসময় নেগেটিভ কথা বলবে না তো। তুমি সবসময় আনন্দময় মুহূর্তে কোনো না কোনো নেগেটিভ কথা বলবেই। এই অভ্যাসটা ত্যাগ করো।

ইরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো, আমি করতেই চাই কিন’ পারছি কই?

কেনো? নতুন করে আবার কী হলো?

কিছু না।

জয়ের মনে হলো ইরা কিছু লুকাচ্ছে, আমার কাছে লুকাচ্ছো কেনো ইরা? বলো প্লিজ! কী হয়েছে?

না, কিছু হয়নি। দেখছো না, পৃথিবীতে কেউ আমাদের রিলেশনটাকে মেনে নিতে পারছে না। প্রতিদিন কত নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দুনিয়ার সবাই চায় আমরা বিচ্ছিন্ন হই। তুমি আর কত সামাল দিবে।

জয় ইরার মুখটা সুর্যের দিকে উঁচু করে ধরলো, তুমি দেখো আমরা সবকিছু কাটিয়ে উঠবো, আমাদের প্রতিটি বিকেল হবে আজকের বিকেলটার মতো সুন্দর, গোধূলির মতো লাল টকটকে সূর্য, হালকা শীতল বাতাস, মেঘহীন মুক্ত আকাশ, ঐ দূরে দেখো বলে জয় ইরাকে দূরে আঙ্গুল দেখালো।

ইরা বললো, কী?

জয় বললো, দেখো দু’টো পাখি নীড়ে ফিরলো। আমরা এমন সুন্দর বিকেল শেষে গোধূলিতে বাড়িতে ফিরবো।

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ইরা তার ফোন বের করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম দেখে চমকে উঠলো। তার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো, বুক কেঁপে উঠলো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, রিসিভ করো।

ইরা জয়ের দিকে ফোনটা ধরলো, তোমাকে বলেছিলাম না, মিহির নামে এক সাংবাদিক আমাদের রিলেশন নিয়ে অনেক আজেবাজে প্রশ্ন করছে। বলছে শুভ, ওর বাবা চাইলে নাকি যেকোনো সময় আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলতে পারে, আমাদের জেল হাজতে নিতে পারে।

জয় কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, আগে ফোন রিসিভ করো ইরা।

না। রিসিভ করবো না, এই লোকটাকে আমার খুব ভয় করে।

তবু রিসিভ করো।

না।

কথা বলতে বলতে ফোনের রিং শেষ হলো।

ইরার ওপর জয়ের রাগ হলো। সে বললো, তুমি সহজে কারও ফোন রিসিভ করতে চাও না।

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো, রিসিভ করি না। কারণ মিহির সাংবাদিকের কথা আমি কোনো জবাব দিতে পারি না তাই।

এবার ফোন করলে আমাকে দিও।

ইরার রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, ওকে দিবো, কথা বলতে ইচ্ছা করে তুমি করো।

ইরার মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠলো।

জয় রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালাকুম।

অপর পাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠের ভারী কর্কশ কণ্ঠস্বর, আমি তো ইরাকে চাচ্ছিলাম। আপনি কে বলছেন?

জয়ও তার মতো গম্ভীর স্বরে বললো, ইরার ফোন এখন কে রিসিভ করেছে এটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে?

আমি তো ইরার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, প্লিজ ফোনটা একটু তাকে দিবেন?

না। ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।

দেখুন, আমার সঙ্গে কথা না বললে ওর, এমনকি আপনারও অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

আমাকে বলুন।

অবশ্যই আপনার সঙ্গেও বলবো কিন’ আগে ওর সঙ্গে কথা বলবো। আমার কিছু তথ্য জানার আছে।

জয় আর না করতে পারলো না।

ইরা প্রথমে না না করছিলো কিন’ মিহিরের অনুরোধে এবং কথাবার্তায় ভদ্রতার সীমা অতিক্রম না করার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইরাকে ফোনটা দিলো।

ইরা সালাম দিয়ে কানের কাছে মোবাইল ফোনটা ধরে রাখলো। ক্রমে ক্রমে তার মুখ কালো হয়ে গেলো, সে ফোন কানের কাছে ধরে থাকতে থাকতে তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

জয় ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, ইরা খারাপ কিছু বলছে? ইরা?

ইরার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা পড়ে গেলো।

 

সাতচল্লিশ

 

গভর্নিং বডির মিটিং বসেছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গভর্নিং বডি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হওয়ার নিয়ম থকালেও বেশির প্রতিষ্ঠান প্রধানই কৌশলে পছন্দমতো ব্যক্তিদের নিয়ে গভর্নিং বডি নিয়োগ করে আর প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগ দেয়া গভর্নিং বডির সদস্যরা যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। গভর্নিং বডির সদস্যদের কারও কারও ইরার প্রতি সহানুভূতি থাকলেও হেড মাস্টারের মুখের ওপর কোনো কথা বলার মতো সাহস গভর্নিং বডির সদস্য এমনকি সভাপতিরও নেই।

ইরা স্কুলে এসে হাজিরা খাতায় সই করে টিচার্স রুমে বসে আছে। হেড মাস্টার তাকে ক্লাসে যেতে নিষেধ করেছে। ইরা বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে বড় আকারের কোনো ষড়যন্ত্র চলছে।

 

হেড মাস্টারের রুমে ইরার ভাগ্য নির্ধারণে মিটিং চলছে। হেড মাস্টার প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই শুনেছেন বিষয়টা। এমন একটা কলঙ্কজনক ঘটনা যা বলতেই লজ্জা লাগে, ছিঃ! কাল থেকে আমার শুধু ফোন আসছে তো আসছেই। একেকজনের একেক রকমের প্রশ্ন, কাকে কী জবাব দিই বলুন। অন্যান্য স্কুলের হেড মাস্টার, শিক্ষক সমিতির নেতারা, সাংবাদিক সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি হয়রান হয়ে গেছি। অনেকেই প্রশ্ন করছেন আমরা কি প্রশাসনিক ব্যবস’া নিচ্ছি। এ অবস’ায় আপনারাই বলুন এখন কী করা যায়?

গভর্নিং বডির বেশিরভাগ সদস্য এমনকি সভাপতিও হেড মাস্টারের ছাত্র। তাই কোনোদিন কেউ তার মুখের ওপর কথা বলেনি। কমিটির একজন সদস্য আছেন তিনি অবশ্য মৃদু প্রতিবাদ করলেন, স্যার এটা ইরা ম্যাডামের ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

হেড মাস্টার সাহেব এরকম গর্জে উঠলেন, তুমি চুপ করো, যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না।

ইরা ম্যাডামের এই ঘটনা নিয়ে আমরা কোথাও কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না। আর তুমি বলো এটা তার ব্যক্তিগত। কোনো প্রতিষ্ঠানের কেনো সদস্য যখন কোনো কেলেঙ্কারি করে তখন সেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়। এমনকি স্টুডেন্ট ক্যাবিনেটের ছাত্র-ছাত্রীরাও মিছিল বের করেছে। তারা আমার কাছে আল্টিমেটামও দিয়েছে। এর একটা প্রশাসনিক ব্যবস’া না নিলে ছাত্র-ছাত্রীদের মনেও বিরুপ প্রভাব পড়বে। তারাও এমন বলে হেড মাস্টার সাহেব আবারও ছিঃ, ছিঃ করলেন।

ইরা টেবিলে মাথা রেখে খুব মনোযোগ সহকারে হেড মাস্টারের কথাগুলো শুনছিলো। এতোদিন হেড মাস্টারকে তার খুব আপন মানুষ মনে হয়েছিলো কিন’ আজ হেড মাস্টারের আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। হেড মাস্টারের প্রতি ঘৃণায় ইরার মন ভরে গেলো।

হেড মাস্টার সভাপতি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, সভাপতি সাহেব বলুন, এখন কী করা যায়? এমন একটা ব্যবস’া নেয়া উচিৎ যাতে করে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন না হয়। সবাই যেনো বলে উপযুক্ত ব্যবস’া নেয়া হয়েছে। তাছাড়া ইরার শাস্তি দেখে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এমন কাজ করতে সাহস পাবে না।

পাশের রুমে যখন ইরার ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে, শাস্তি নির্ধারিত হচ্ছে তখন স্কুলের সামনে একটা মোটর সাইকেল এসে দাঁড়ালো।

মোটর সাইকেল যাত্রী মোটর সাইকেল রেখে সোজা হেড মাস্টারের রুমে গেলো, আসতে পারি?

হেড মাস্টার কিছুটা আনন্দের সঙ্গে বললেন, আরে সাংবাদিক সাহেব আসুন। তবে একটু বসতে হবে, আমাদের একটা মিটিং চলছে তো…

সাংবাদিক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইরার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো।

ওকে। আপনারা মিটিং করুন তবে আমি একবার ইরা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে চাই বলে ভদ্রলোক টিচার্স রুমে ঢুকে ইরাকে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম।

ইরা মৃদু কণ্ঠে সালামের জবাব দিলো, ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

ভদ্রলোক একরকম নিশ্চিৎ হয়েই বললো, আমি যদি ভুল না করে থাকি তবে আপনি নিশ্চয়ই ইরা ম্যাডাম?

জি।

আমি আব্দুল কুদ্দুস মিহির। সাংবাদিক, দৈনিক অন্তরালের খবর।

জি বসুন প্লিজ!

সাংবাদিক সাহেবের শার্টের ওপর একটা কোটি, কোটির ওপর বড় হলুদ চকচকে কাপড়ে লেখা সাংবাদিক, কাঁধে ঝুলানো একটা ক্যামেরা, হাতে ছোট একটা ক্যামেরা স্ট্যান্ড। সাংবাদিক সাহেব টেবিলের ওপর ক্যামেরা স্ট্যান্ড করে ইরার কাছে এলো।

ততক্ষণে স্কুলের প্রথম ক্লাস শেষ হয়েছে, দু’য়েকজন শিক্ষক ক্লাস থেকে ফিরতে শুরু করেছে। ইরা লজ্জায় আর ক্ষোভে যেনো মাটির সঙ্গে মিশে গেলো।

সাংবাদিক সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি নিশ্চয়ই ইরা।

ইরা কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললো, জি, ইরা রহমান।

সাংবাদিক সাহেব ভ্রু’কুঞ্চিত করে বললেন, ইরা রহমান? রহমান কি আপনার স্বামীর নাম?

জি।

বাই দি বাই, আপনি তো আগে মতি সাহেবের বউ ছিলেন?

ইরা সংক্ষেপে বললো, একসময়।

জানতে পারি কি হঠাৎ করে এমন কী হলো যে আপনি পঁচিশ বছরের সংসার ছেড়ে চলে গেলেন?

আমার আগের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিলো না। পঁচিশ বছরের পঁচিশ মিনিটও আমি সুখ পাইনি।

এটা নাকি পরকীয়া প্রেমে মত্ত হয়ে আপনি ঘর ছেড়েছেন?

ইরা পরকীয়া কথাটা সহ্য করতে পারে না। প্রেম যে কোনো সময় হতে পারে, সেটা বিয়ের আগে কিংবা পরে।  বিয়ের আগের প্রেম পবিত্র আর বিয়ের পরে পরকীয়া এটা সে কোনোভাবে মেনে নিতে পারে না। সাংবাদিক সাহেবের মুখে পরকীয়া কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইরার মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো। সে রাগান্বিত স্বরে বললো, আপনি আপত্তিকর এবং ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন? আপনার কি আর কিছু জানার আছে?

সাংবাদিক সাহেবও রেগে গেলেন, আছে।

বলুন। সাংবাদিকতার সীমা লঙ্ঘণ করবেন না।

কতদিন আগে বিয়ে হয়েছে আপনাদের?

এটা তো আপনার বিষয় না, আপনি জানতে চাইতে পারেন বিয়ে হয়েছে কী না?

ও তাই বলুন। আপনার স্বামীর নাম কী?

জয় রহমান, বলে ইরা তার ব্যাগ থেকে কাবিননামার কপি বের করে দিয়ে বললো, এই দেখুন।

আপনি তো ক’দিন আগেও মতি’র বউ ছিলেন, স্কুলে শিক্ষকতা করে, পরকীয়া প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করলেন এটা কি অনৈতিক না?

আমি তো কারও হাত ধরে পালিয়ে যাইনি, মতিকে ডিভোর্স করেছি এবং জয়কে বিয়ে করেছি। ডিভোর্স এবং বিয়ে দু’টো অধিকারই আমার আছে।

সাংবাদিক সাহেব কিছুটা তিরস্কারের সুরে বললেন, ঠিক আছে তবে তা করেছেন পরকীয়ার টানে।

সাংবাদিক সাহেব চলে গেলেন।

 

এতক্ষণ ইরা পাশের রুমের কোনো কথা শুনতে পায়নি। এদিকে যখন সে সাংবাদিকের কাছে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলো ততক্ষণে পাশের রুমে যে কী হয়েছে ইরা তা জানে না। ইতোমধ্যে মিটিং শেষ হয়েছে। গভর্নিং বডির সদস্যরা চলে গেছে। একটা অজানা আশংকায় ইরার বুকটা যেনো কাঁপছে। কয়েকমিনিট পর স্কুলের অফিস সহকারী ইরার হাতে একটা হলুদ খাম এনে দিলো।

 

আটচল্লিশ

 

ইরা সেই যে সকালবেলা স্কুলে গেছে তারপর থেকে কোনো খবর নেই। জয় কয়েকবার ম্যাসেজ দিয়েছে কিন’ ইরা ফোন রিসিভ করেনি কোনো ম্যাসেজও দেয়নি। অথচ আজকের দিনটা একটা দুশ্চিন্তাগ্রস’ দিন। ইরার স্কুলের গভর্নিং বডির মিটিং, সাংবাদিক। ইরা এমনই, কোনোকিছুতেই যেনো সিরিয়াস না। হয়তো ফোন ব্যাগে রেখে দিয়েছে নয়তো ক্লাসে আছে। তবু একটা ম্যাসেজ তো দেয়া দরকার।

জয় আবার ইরাকে ফোন করলো। এবার ইরা ফোন রিসিভ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি চলে এসেছি, তুমি বাসায় এসো।

জয় অফিস থেকে বাসায় এলো। ইরা দরজা খুলে দিলো। জয় বাসায় ঢুকতেই ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, জয়, আমার জয়, তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা জয়! প্লিজ, তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা। সেদিন যেমন শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছিলে তেমনি করে সারাজীবন ধরে রেখো।

জয় ইরাকে নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, এমন করে কথা বলছো কেনো ইরা? আমি কি তোমাকে খারাপ কিছু বলেছি, কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি।

না জয়, তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করোনি আর সেজন্যই তো আমি এখনো বেঁচে আছি, শুধু তোমার জন্য জয়! শুধু তোমার জন্য! বলতে বলতে ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় ইরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কী হয়েছে ইরা বলবে তো, তুমি এমন করছো কেনো?

ইরা তার ব্যাগ থেকে হলুদ খামটা বের করে দিলো।

জয় চিঠিটা পড়লো। তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। শেষ পর্যন্ত ইরার চাকরিটা বুঝি আর থাকবে না কিন’ মুখে কিছু বললো না। ইরাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, এটা কোনো ব্যাপার না। সাসপেনশন কোনো বিষয় না, যেকোনো কর্তৃপক্ষ কোনো স্টাফকে চাইলেই সাময়িরকভাবে বরখাস্ত করতে পারে। তারপর বিচার হবে, বিচারে শাস্তি হলে চাকরি থাকবে না আর যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তবে চাকরির সব বেতন ভাতা পাবে। এটাই নিয়ম। তুমি তো কিছু করোনি তবে ভেঙ্গে পড়ছো কেনো?

ইরা জয়ের বুক থেকে মাথা তুললো। তার চোখে চোখ রাখলো তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়, আমার চাকরিটা না থাকলে তুমি আমাকে রাখবে তো?

জয় ইরা থুতনি উঁচু করে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ইরা, আমার ইরা! আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, তুমি আমার জীবন। আমাদের সম্পর্কের বন্ধনটা তো তোমার চাকরিকে কেন্দ্র করে নয় ইরা। আমাদের বন্ধনটা হৃদয়ের, অদৃশ্য এবং অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন।

ইরা অস্ফুট স্বরে বললো, জয়, আমার জয়!

 

ইরা ভাত বাড়লো একটা প্লেটে। তারপর বললো, বসো।

জয় ভ্রু’কুঁচকে বললো, একটা প্লেটে কেনো?

আমি পরে খাবো।

পরে খাবো মানে?

পরে কেনো? আমরা না প্রতিদিন একসঙ্গে খাই।

খাই কিন’ আজ আমার খিদে নেই। তুমি খাও প্লিজ! বলে ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, তুমি অফিস যাবে না?

জয় এক পা দু’পা করে রান্নাঘরে গেলো। পাতিল উল্টে দেখলো, পাতিলে আর ভাত নেই। জয় রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে মৃদু কণ্ঠে বললো, আর ভাত নেই তো আমাকে বললে না কেনো?

শোনো কাল আমি বলতে ভুলে গেছিলাম যে চাল নেই, স্কুল থেকে এসে দেখলাম চাল নেই তখন মনে করলাম তুমি খেয়ে অফিস যাও আমি পরে এখন কিছু খেয়ে নিবো।

চাল কম আছে , দু’জনের ভাত হবে না সেজন্য দু’জনে ভাগাভাগি করে খাবো তাই বলে আমি সব খেয়ে চলে যাবো আর তুমি না খেয়ে থাকবে জয় কিছুটা ধমকের সুরে বললো। তারপর বললো, আরেকটা প্লেট দাও।

ইরা মুচকি হাসি হেসে বললো, আরেকটা প্লেট কী দরকার?

তো?

ইরা মুখ হা করলো।

জয় ইরার মুখে ভাত তুলে দিলো।

দু’য়েক গ্রাস খাওয়ার পর ইরা বললো, একটু থামো একটা লঙ্কা নিয়ে আসি।

লঙ্কা? লঙ্কা আবার কী? জয় ভ্রু’কুঁচকে বললো।

ইরা রান্নাঘর থেকে একটা মরিচ নিয়ে এলো, ভাতের সঙ্গে মরিচ মিশিয়ে খাবো।

তা খাও কিন’ তুমি আবার মরিচকে লঙ্কা বলতে শুরু করলে কবে?

আগে খাওয়া হোক তারপর বলবো।

জয় কিছুটা কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বললো, তোমার এই অভ্যাসটা বড় খারাপ।

তোমার কাছে?

হ্যাঁ তোমার কাছে। তুমি যেমন উপন্যাস লেখার আগে আটকে রাখো পাঠককে পরের পৃষ্ঠায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমনি। ঔপন্যাসিকের স্ত্রী বলে কথা।

দু’জনে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলো। তারপর ইরা বলতে শুরু করলো, শোনো নির্মলেন্দু গুণ-এর একটা কবিতা আছে, কবিতার নাম, আমার কিছু স্বপ্ন ছিল বলে ইরা কবিতা আবৃতি করতে শুরু করলো।

 

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল

 

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,

একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,

একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে

একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার।

 

সামনে বাগান, উঠোন চাইনি, চেয়েছিলাম

একজোড়া হাঁস, একজোড়া চোখ অপেক্ষামাণ

এই তো আমি চেয়েছিলাম।

 

স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার, আর কিছু নয়,

তোমায় শুধু অনঙ্গ বউ ডাকার।

চেয়েছিলাম একখানা মুখ আলিঙ্গনে রাখার।

 

অনঙ্গ বউ, অনঙ্গ বউ, একজোড়া হাঁস,

একজোড়া চোখ, কোথায়? তুমি কোথায়?

 

কবিতা আবৃতি শেষ করে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে বললো, অনেক স্বপ্ন ছিলো একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার। আজ একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খেলাম, তোমার হাতে, আমার জীবনে আর কিছু চাওয়ার পাওয়ার সবকিছু শেষ হয়েছে জয়। আমার আর কিচ্ছু চাইনা। শুধু আমার থেকো। মি. গুণ তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কী না জানি না কিন’ আমার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।

জয় ইরাকে কাছে টেনে নিলো। এমনসময় জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ইরার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।

জয় ফোন কেটে দিলো। ইরা প্রচণ্ড রেগে গেলো। কেটে দিলে কেনো? রিসিভ করো।

আবার ফোন বেজে উঠলো। জয় মোবাইল ফোনের স্ক্রিন ইরাকে দেখাতেই ইরার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।

ইরা বললো, আমাকে দাও আমি কথা বলি।

 

কয়েকদিন আগের কথা। ইরার সঙ্গে জয়ের বিয়ে হয়েছে। ততদিনে সবাই জেনে ফেলেছে। সেদিনও জয়ের মোবাইল ফোন এভাবে বার বার বেজে উঠছিলো আর জয় লাইন কেটে দিচ্ছিলো। ইরা জিজ্ঞেস করলো, কে ফোন দিচ্ছে তোমাকে বার বার?

জয় ইরার হাতে ফোনটা দিলো।

আমাকে দাও তো আমি কথা বলি।

জয় ইরার হাতে ফোনটা দিলো বটে কিন’ তার বুক কাঁপছিলো, ইরা যে কী বলে ফেলবে কিন’ ইরা খুব ধৈর্য আর জ্ঞানের পরিচয় দিলো, হ্যালো আপা।

হ্যালো, কে ইরা?

ইরা খুব শান্ত এবং বিনয়ী কণ্ঠে বললো, আমি ইরা আপা। ভালো আছেন আপনি?

সামিনা কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, হ্যাঁ আছি তো যেভাবে তুমি রেখেছো।

কী করবেন আপা যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমাকে ছোট বোন মনে করবেন আপা। আপনি আমার বড় বোনের মতো, আপনি ঠিক যেভাবে বলবেন আমি সেভাবে চলবো আপা প্লিজ রাগ করবেন না।

সেদিনের পর থেকে ইরার সঙ্গে আর সামিনার কথা হয়নি। আজ জয় যখন বার বার করে ফোন কেটে দিচ্ছিলো তখন জয় ইরাকে ফোনটা দিলো, হ্যালো আপা আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন আপা?

এই তো আছি আর কী।

ও অফিস যাওয়ার জন্য কাপড় পরছে আপা। ওকে একটু আমার সঙ্গে কথা বলতে বলোতো।

আচ্ছা আপা বলে ইরা ফোনের লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল ফোনটা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, তুমি কিন’ আমার সামনে ওর সাথে কথা বলবে, ওকে?

ওকে।

ইরা জয়ের কথায় আশ্বাস’ হতে পারলো না। সে বললো, আমি কিন’ তোমাকে মাঝে মাঝে ফোন দিবো। যদি ফোন ব্যস্ত পাই তবে বুঝবো তুমি লুকিয়ে ওর সাথে কথা বলছো।

জয় একটা মুচকি হাসি হাসলো।

 

উনপঞ্চাশ

 

জয় শুয়েছিলো। ইরা জয়ের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। ইরা মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছো?

জয় বললো, কিছু না।

কিছু তো অবশ্যই ভাবছো। আমাকে বলো।

জয় একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, না। সত্যি বলছি কিছু ভাবছি না।

ঠিক আছে লুকাচ্ছো তো, বেশ আমিও কিন’ লুকোচুরি করবো।

জয় ইরার একটা হাত নিজের মধ্যে নিয়ে মুচকি হাসি হেসে বললো, আমার সাথে লুকোচুরি করো না ইরা প্লিজ! লুকোচুরিতে মেয়েদের সঙ্গে ছেলেরা কোনোদিন পেরে উঠে না।

ইরা জয়ের গাল টেনে ধরে বললো, এই, এই কী বললে তুমি! মিচকি শয়তান, তোমার সঙ্গে আমি কোনোদিন পারবো সে লুকোচুরিতেই হোক আর ঢাক-ঢোল পেটাতেই হোক।

দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর ইরা বললো, শোনো একটা কথা।

জয় আবারও ঠাট্টা করে বললো, একটা না ইরা অনেকগুলো কথা বলো।

আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুমি একটু মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো।

জয় ইরার কোলে মাথা রেখে বললো, ওকে বলো।

তোমাকে গতকাল আমি স্কুল থেকে এসে স্কুলের পরিসি’তি বললাম, সাংবাদিকের কথা বললাম, আজ তোমাকে আমার সাসপেন্স অর্ডার হাতে এনে দিলাম। তুমি কিছুই বলছো না যে, কী হবে শেষ পর্যন্ত?

জয় কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলো তারপর বললো, আমি যে কিছু ভাবছি না বা করছি না তা নয় ইরা। আপাতত: কিছু করার নেই। তোমার সাসপেন্স অর্ডারের ভাষাটা বুঝেছো, লিখেছে বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে না আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করা যাচ্ছে। তারমানে স্কুলের পরিবেশ স্বাভাবিক হলে হেড মাস্টার আবার তোমাকে চিঠি দিবে তারপর তুমি আবার স্কুল যাবে।

আমার চাকরিটা থাকবে তো জয়? ইরা কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো।

তোমার চাকরি যাবে কেনো ইরা, আসলে তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি ডিভোর্স করেছো আবার বিয়ে করেছো এর সঙ্গে স্কুলের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন’ স্কুলগুলোতে গভর্নিং বডি’র সবাই স’ানীয় হওয়াতে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এখন আবার নতুন করে হয়েছে স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট।

শেষ পর্যন্ত যদি আমার চাকরিটাই খেয়ে ফেলে ওরা।

পারবে না, কারণ শুধু কমিটি আর স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট চাইলেই তোমার চাকরি খেয়ে ফেলতে পারে না। এর সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয় আছে। সর্বশেষ আছে কোর্ট। তুমি কোনোকিছু ভেবো না ইরা। ওরা ততদূর পর্যন্ত যাবে না, এসব আইন-কানুন ওরাও ভালো করে জানে। তবে এর পেছনে মতি’র হাত আছে। নেপথ্য থেকে সে-ই কলকাঠি নাড়ছে।

ইরা রেগে গেলো, তুমি শুধু শুধু মতিকে দোষ দিচ্ছো। মতি এর মধ্যে নেই।

তুমি কীভাবে বুঝলে?

সেদিন যখন স্টুডেন্টস ক্যাবিনেটের মিছিল হচ্ছিলো তখন সেটা মতি’র কানে যেতেই ও হেড স্যারকে ফোন করে বন্ধ করতে বলেছে।

জয় ভ্রু’কুঁচকে বললো, তুমি কীভাবে জানলে?

আমাকে শুভ বলেছে। তারপর আজকের সাংবাদিককেও মতি ম্যানেজ করেছে। না হলে সাংবাদিকরা দেখতে কত হৈ চৈ শুরু করতো।

জয় প্রশ্ন করলো, এটাও কি শুভ বলেছে?

হ্যাঁ। আজ শুভ ফোন করেছিলো তখন বলেছে।

তুমি একটু শুয়ে থাকো আমি রান্নার ব্যবস’া করি বলে ইরা রান্নাঘরে গেলো।

শুভ ইরাকে বলেছে নাকি ইরা লুকিয়ে লুকিয়ে মতি’র সঙ্গে কথা বলে। জয়ের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলো। ইরা তার চাকরি রক্ষার জন্য মতিকে যে ফোন করে তার সহযোগিতা চায়নি তারই বা বিচিত্র কী।

ইরা কয়েকমিনিট পর ফিরে এলো। জয়ের মুখ গম্ভীর দেখে জিজ্ঞেস করলো, মুড অফ কেনো?

না, এমনিতেই। মুড খারাপ না।

তোমাকে একটা কথা বলবো?

জয় ইরার মুখের দিকে তাকালো, তুমি তো কোনোকিছু বলতে সংকোচ করো না ইরা।

না, ভাবছি তুমি যদি কিছু মনে করো।

কিছু মনে করবো না, তুমি বলো।

আজ শুভ ফোন করে অনেক কথা বললো, বললো আমাদের যে বাড়িটা আছে সেটা তো অর্ধেক শুভ’র নামে আর অর্ধেক আমার নামে আছে, মতি নাকি বলেছে ওটা শুভ’র নামে লিখে দিতে।

তুমি কী বললে? জয় জিজ্ঞেস করলো।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু বলবো না। আমি বলেছি আমাকে ভাবতে সময় দাও। শুভ বলছিলো বাবা তার নামে দিতে বলেনি। আমি তোমার ছেলে আমার নামেই দিতে বলেছে।

তুমি কী ভাবছো?

বিষয়-সম্পত্তির প্রতি ইরার কোনোদিন লোভ ছিলো না, এখনো নেই। ইরা সারাজীবন যত টাকা বেতন পেয়েছে তার একটা টাকাও ব্যাংকে জমা নেই। বাড়ির কাজে বেশি ব্যয় করেছে, যদিও মতি বলে সে তার কোনো টাকা নেয়নি। বাড়িটাকে ইরা খুব যত্ন করে নিজের সন্তানের মতো করে গড়ে তুলেছে। তার যেনো দু’টো সন্তান একটা শুভ আর একটা সেই বাড়িটা। প্রথমে শুভ যখন কথাটা বললো তখন ইরা খুব কষ্ট পেয়েছিলো কিন’ শুভ যখন বললো, তার নামে দিতে বলেছে তখন কিছুটা কষ্ট লাঘব হয়েছে। তবু বাড়ি রেজিস্ট্রি করে নেয়ার সিদ্ধান্তটা যে শুভ’র নয় মতির, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ইরা যেভাবে বললো শুভ কথাটা সেভাবে বলেনি। অনেকটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলছে, মা, বাবা বলছিলো তোর মা তো আর কোনোদিন আসবে না। সব যখন ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে তবে বাড়িটা আর নিজের নামে রেখে লাভ কী। যে গেছে চলে যাক কিন’ বাড়িটা তোর নামে লিখে দিলে ভালো করতো। আমার তো আর টাকা-পয়সা, বাড়ি-ঘর দরকার নেই, তোর মা তোর নামে লিখে দিলেই পারতো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছো ইরা?

তুমি বলো আমি কী করবো? এখন তো তুমিই আমার সব। তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।

কিন’ এই বিষয়টা তোমার ইরা। তবে আমি মনে করি তুমি লিখে দিতে চাও দিও কিন’ একটু দেরি করো।

কেনো?

কারণ আমার বিশ্বাস স্কুলে তোমার সমস্যাটার পেছনে মতি’র হাত আছে আর যতদিন বাড়িটা তোমার নামে আছে ততদিন সে প্রকাশ্যে তোমার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পাবে না। মনে করবে তখন তুমি যদি বাড়ির অংশটা অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দিয়ে একটা ঝামেলা তৈরি করো।

ইরা কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, তুমি সবসময় সবকিছু জটিল করে দেখো। যেখানে আমি কোনোদিন যাবো না, সেখানে ওটা রেখে আমার লাভ কী?

তোমার টাকা বা বাড়ির প্রতি আমার কোনো লোভ নেই ইরা। আমি তোমাকে দিতে নিষেধও করিনি। শুধু দেরি করতে বলেছি, আমি আমার অভিমত তোমাকে জানালাম। কী কবে সেটা তোমার বিষয়।

ইরা এতক্ষণ জয়ের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এসব কথা বলছিলো এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো, আমি ভাতটা নামিয়ে তরকারি চুলোয় চড়িয়ে দিয়ে আসি বলে চলে গেলো।

 

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সামিনা ফোন করেছে। জয় রিসিভ করবে কী না কয়েকমুহূর্ত ভেবে নিলো। তারপর রিসিভ করে চাপা স্বরে বললো, হ্যালো।

সামিনা জিজ্ঞেস করলো, কী করছো?

কিছু না, শুয়ে আছি।

ঐ মাগীটা কী করছে?

জয় চাপা স্বরে দাঁত-মুখ কড়মড় করে বললো, সামিনা, ইরা আমার স্ত্রী তুমি ওকে এভাবে বলতে পারো না।

সামিনা চিৎকার করে বললো, তোমার স্ত্রী হতে পারে কিন’ যে মেয়ে নিজের স্বামীকে ছেড়ে আরেকজনের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে সে মাগী ছাড়া আর কী।

জয় ধমকের সুরে বললো, সামিনা আর একটা কথাও বলবে না। আমি এখন রাখছি বলে জয় ফোন রাখছিলো এমনসময় সামিনা বললো, তোমার সঙ্গে রতন কথা বলবে, এই নাও বলে জয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে সামিনা রতনের হাতে মোবাইল ফোনটা দিলো।

রতন ফোন হাতে নিয়েই জোরে চিৎকার করে বললো, এই, এই তুই আমার মাকে কী বলছিস?

আমি তো কিছু বলিনি। তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো?

রতন আরও জোরে চিৎকার করে উঠলো, কীভাবে বলবো? তুই কাল বাড়ি আসবি না?

ঠিক নেই বলে জয় কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখলো তারপর দু’চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলো। তার মনের মধ্যে তখন অনেক কথার ঝড় বইছে, এই ছেলে তার! ছেলে বাবাকে তুই তুই করে কথা বলে! এমন কথা শুনতে হবে এটা জয় কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। জয়ের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে কী শুনলো নিজের ছেলের মুখ থেকে।

ইরা এলো। জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, কী হয়েছে?

জয় কোনো কথা বললো না।

ইরা আবার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে আমাকে বলো?

জয় সামিনার ফোন করার কথাটা গোপন করলো, কিছু হয়নি ইরা। রতন ফোন করেছিলো।

নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে।

জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো, না, ও ছেলে মানুষ একটু-আধটু মাথা গরম করতেই পারে।

কী বললো বলোতো, সত্যি করে বলো।

আমার খুব খিদে লেগেছে ইরা। প্লিজ আগে খেতে দাও।

বলবে না আমাকে?

কাল শোনো ইরা।

কেনো? আজ বলতে তোমার অসুবিধা কী?

জয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললো, খারাপ কথা না শোনা-ই ভালো ইরা, আর যদি শুনতেই হয় তবে যত দেরিতে শোনো ততই ভালো। কাল শোনো। আজ আর পীড়াপীড়ি করো না প্লিজ!

 

পঞ্চাশ

 

ইরা চলে যাবার পর থেকে মতি কেমন যেনো হয়ে গেছে। আগের মতো গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে না, বলতে গেলে দিনের বেলায়ও বাসা থেকে তেমন একটা বের হয় না। শুধু বাসা আর স্কুল। স্কুলে গিয়ে সোজা তার চেয়ারে বসে অফিসিয়াল কাজ-কর্ম করে তারপর বাসায় চলে আসে। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা মতিকে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। বাইরে গেলে মতিকে দেখে তার বন্ধুরা বিভিন্ন ধরণের ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা বলে। মতি আর মাথা উঁচু করে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না।

মহসিন চৌধুরী মতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুখ-দুঃখে মতি তার সাথে মন খুলে কথা বলে, কোনো সমস্যায় পড়লে মহসিন চৌধুরীরই শরণাপন্ন হয়। ইরা চলে যাবার পর মতি একবার মহসিন চৌধুরীর সাথে কথা বলেছে। মহসিন চৌধুরী বিরোধী রাজনীতি করে, তার নামে কোর্টে অনেক মামলা-মোকদ্দমা আছে, তাই কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর হাইকোর্ট থেকে জামিনের জন্য ঢাকা গেছে। সেদিন মতি যখন ফোন করলো তখন সে খুব ব্যস্ত ছিলো। মতির সব কথা শুনে বললো, আমার জামিনের ব্যবস’া হচ্ছে, হলে আমি এসে দেখবো কী করা যায়।

কয়েকদিন পর মহসিন ঢাকা থেকে এলো। এসেই মতি’র বাসায় এলো। দরজায় ঢুকতে না ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো, কী খবর বলতো?

খবর তো তোকে বলেছি।

এখন কী করবি ভেবেছিস?

আমার মাথা কাজ করছে না মহসিন, তুই বল কী করা যায়?

না মানে আমি বলছিলাম তুই কি ওকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে চাচ্ছিস কিংবা ও যদি ফিরে আসে তাহলে আবার নিবি নাকি যে গেছে যাক তুই নতুন করে জীবন শুরু করবি?

আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না মহসিন। আমি চাই ও ফিরে আসুক আবার সংসারটা যেমন ছিলো তেমন হোক।

মহসিন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, এগুলো সম্পর্ক সাধারণত বেশিদিন টিকে না। ক’দিন পর মোহ কেটে গেলে আবার ফিরে আসবে কিন’ দেরি করতে হবে। তবে আমার মতে তাকে আর ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে না। যে মেয়ে একবার অন্য মানুষের হাত ধরে চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী আমি না।

তুই একটা কথা ঠিক বলেছিস মহসিন এগুলো সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। অন্তত: কিছুদিন দেরি করি ওর মোহ যদি কেটে যায় তবে ফিরে আসতেও পারে। আমি তবুও ইরাকে গ্রহণ করবো। বুঝছিস তো সেই ছোট্ট মেয়েটিকে হাত ধরে নিয়ে এলাম। লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি নিয়ে দিলাম। পঁচিশ বছরের কত স্মৃতি আমাদের। আজও স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসছে। এতো সহজে ভুলে যাই কী করে! বলতে বলতে মতি’র চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করে উঠলো, কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

তোর কথা সবই বুঝছি দোস্ত কিন’ ভালোবাসা তো একপক্ষে হয় না। ও যদি তোকে ভালো না বাসে, তোকে ছেড়ে চলে যায় তবে তুই কী করে ওকে নিয়ে সংসার করবি?

ঐ তুই যে বললি মোহ, মোহ কাটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

চলে যাবার পর তোর সঙ্গে ভাবীর কথা হয়েছে?

না।

ফোন দিসনি?

না।

শোন তোকে আবারও বলছি আমি হলে অন্য কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে চলে যাবার পর সেই বউয়ের নাম আর মুখেও আনতাম না কিন’ তোর মধ্যে আবার ভালোবাসা বেশি। ওকে থাক তোর ভালোবাসা নিয়ে থাক। যদি ওকে আবার ফিরিয়ে আনতে চাস্‌, তবে যোগাযোগ রাখ্‌, ভাবীর খোঁজখবর রাখ্‌।

মতি মিনমিন করে বললো, করতে চেয়েছিলাম কিন’ করা কি ঠিক হবে? হাজার হলেও ও এখন অন্য একজনের স্ত্রী।

তা মানলাম, নৈতিকভাবে ঠিক না কিন’ ওখানে ওর তো কোনো সমস্যাও হতে পারে।

মতি হাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

ও আরেকটা কথা, শুভ কী বলছে?

ও আর কী বলবে, অন্য কেউ হলে মা’র সাথে তুলকালামকাণ্ড করে বসতো কিন’ জানোই তো ওকে আমরা অনেক আদর যত্ন করে বড় করেছি, শাসনও করেছি। কাজেই শুভ ওর মা’র সঙ্গে এবিষয়ে কোনো বাকবিতণ্ডায় জড়াবে না।

তোর সঙ্গে শুভ’র কথা হয়নি।

না, তেমন কথা হয়নি। আবার হয়েছেও। শুভ অনেক কান্নাকাটিও করেছে ওর মা’র সঙ্গে কিন’ ইরা তার সিদ্ধান্তে অটল। ইরার সঙ্গে কথা বলার পর শুভ বলছে, মা যদি চলে যায় আর তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে তবে আমরা কী করবো বাবা। আমি মাকে অনেক বুঝিয়েছি।

মহসিন কিছুটা বিরক্তবোধ করলো, তারপরও তুই তার জন্য অপেক্ষা করতে চাচ্ছিস কেনো?

কিছুদিন দেখি মহসিন।

মতিনের বিরক্তি বেড়ে গেলো, আচ্ছা তুই যেটা ভালো বুঝিস্‌ কর্‌।

মতি একবার ইরা… বলে ডাক দিতে গিয়ে থেমে গেলো। তারপর মতি সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিলো।

মহসিন বললো, কোথায় যাচ্ছিস?

তুই বস মা’কে চা-নাস্তা দিতে বলি।

না, না চা-নাস্তার কোনো দরকার নেই। তুই বস, আমি দেখি কী করা যায়। শেষ পর্যন্ত খালাম্মা এসে তোকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে?

মা এসেছে, বাবা মাঝে মাঝে আসছে আবার ঐ বাসায় যাচ্ছে। কখনো কখনো ছোট ভাই’র বউরা আসছে ওরাও রান্না করছে।

মহসিন মতি’র মুখের দিকে একবার তাকালো। এ ক’দিনে মতির চোখ দু’টো বসে গেছে। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। মতি মতিনের স্কুল জীবনের ক্লাস ফ্রেন্ড, মতির জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে কিন’ মহসিন মতিকে কোনোদিন এতো দুশ্চিন্তাগ্রস’ হতে দেখেনি। মতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মতিনের চোখ দু’টো পানিতে সজল হয়ে উঠলো।

 

একান্ন

 

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। জয় নাস্তা খেয়ে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। ইরা শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বললো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? বলবে?

বলো ইরা। সংকোচ করছো কেনো?

কাল তুমি আমাকে বলতে চেয়েছিলে খারাপ কথা যত দেরিতে শোনা যায় ততই ভালো। এখন বলবে কী?

কিছু নিষ্ঠুর কথা একসময় বলতেই হয় ইরা। কাল তুমি যখন রান্না করছিলে তখন সামিনা আর রতন আমাকে ফোন করেছিলো।

ইরা বললো, আমি বুঝতে পেরেছিলাম খারাপ কিছু বলেছে?

জয় কথাটা কীভাবে বলবে ইরাকে বুঝতে পারছিলো না। তার মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করছিলো। কিছু বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর বুজে আসছিলো।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, বলো, তুমি এমন করছো কেনো? যত খারাপ আর কষ্টেরই হোক না কেনো? তুমি বলো?

ওরা আমাকে আজ দিনাজপুর যেতে বলছে ইরা।

ইরার মাথায় যেনো বজ্রপাত পড়লো,  মাথায় একটা চক্কর দিলো। তার মুখ ঠোঁট দু’টো সামান্য ফাঁক হয়ে হৃদয় চিরে একটা কথা বের হলো, দিনাজপুর!

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, কিন’ আমি যাচ্ছি না ইরা।

ইরার মুখটা যেনো একটু উজ্জ্বল হলো, যেনো মেঘের আড়ালে এক চিলতে সূর্যরশ্মি বিচ্ছুরিত হলো কিন’ যখন জয় বললো, আগামীকাল সকালে যাবো। তখন আবার তার মুখের ওপর একটু কালো মেঘ জমে উঠলো।

জয় ইরার বুকে মাথা রাখলো, তুমি আমার জয়, শুধু আমার।

তুমি ঠিকই বলেছো ইরা, আমি তোমার! শুধু তোমার!

তবে কেনো যেতে চাচ্ছো? কেনো? বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এলো।

না গেলে ওরা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে ইরা। সামিনা হয়তো মামলা-মোকদ্দমাও করতে পারে। একটা কথা মনে রেখো ইরা ওদের সাথে আমার সম্পর্কটা দায়িত্ববোধের আর তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালোবাসার, হৃদয়ের। দু’টো এক জিনিস না।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, তার হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছিলো।

জয় আবার বলতে শুরু করলো, আমি গেলেও আমার মন পড়ে থাকবে তোমার কাছে। তুমি তো আমাকে চেনোই। আমি কি ওখানে গিয়ে সামিনার সঙ্গে থাকবো ভেবেছো? যাবো, ওদের বাজার করে দিয়ে চলে আসবো।

ফিরবে কবে তুমি?

পরদিন, শনিবার সকালে।

ইরা জয়ের মুখ থেকে মাথা তুললো তারপর জয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো।

 

বৃহস্পতিবার দিনে অফিসে কাজের তেমন ভিড় থাকে না। তেমন একটা লোকজনের আনাগোনাও থাকে না কিন’ আজকের দিনটা যেনো ব্যতিক্রম। অনেকেই নানান কাজের অজুহাতে আসছে আর প্রায় সকলের যেনো একই ধরণের প্রশ্ন, ভাই কী যেনো শুনলাম?

কথাটার উত্তর সোজা এবং জয় কোনো অনৈতিক কাজও করেনি কিন’ তারপরও কথাটা বলতে গিয়ে সে কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। আবার কেউ কেউ একটু মুচকি হাসি হেসে বলছে, আরে ভাই বিয়ে করেছেন খারাপ তো আর কিছু করেননি। অনেকেই তো ঘরে একটা বউ রেখে বাইরে হাজারটা গার্ল ফ্রেন্ড রাখে এতে লজ্জার কী আছে।

যে যা-ই বলুক জয় বিব্রতবোধ করছে। সে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে আর বার বার করে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। একসময় ভিড় কিছুটা কমে এলো। জয় চেয়ারে বসে একরকম হাঁফ ছেড়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। এমনসময় জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

রতন ফোন করেছে। জয় রিসিভ করতেই রতনের গম্ভীর কণ্ঠের জিজ্ঞাসা, রওয়ানা দিয়েছো?

রতনের কথা শুনে জয়ের পাঁয়ের রক্ত যেনো মাথায় উঠে গেলো, না।

কখন রওয়ানা দিবা?

দেখি কখন দেয়া যায়।

কখন দেয়া যায় মানে, তুমি আবার আজ না আসার চিন্তা করছো নাকি?

হুঁম, কাল আসবো ভাবছি।

রতন জোরে চিৎকার করে বললো, এই, এই তুই যদি আজ না আসিস তবে তোকে আমি খুন করবো, খুন।

জয় কিছু বলার আগেই রতন মোবাইল ফোন রেখে দিলো। রতনের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার কয়েকমিনিট পর ফোন দিলো মানিক। কণ্ঠস্বর ঠিক রতনের মতোই। কোনো কুশলাদি বিনিময় নেই, কোনো সৌজন্যবোধ নেই। জয় ফোন রিসিভ করতেই আক্রমনাত্মক কণ্ঠে বললো, রতন বললো তুই নাকি আজ বাড়ি আসবি না?

মানিক রতনের আচরণে জয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। তবু সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, এভাবে কথা বলছো কেনো? একটু ভদ্রভাবে কথা বলো।

তোর সাথে আর কোনোদিন ভদ্রভাবে কথা বলবো ভেবেছিস, শুনলাম তুই নাকি আজ দিনাজপুর যাবি না।

না।

কেনো?

আজ জয়পুরহাট থাকবো।

এই, এই তুই যদি আজ দিনাজপুর না যাস তবে আমি জয়পুরহাট এসে তোদের দু’জনকে জবাই করবো, জবাই।

জয় আতঙ্কিত অথচ শান্ত কণ্ঠে বললো, করো।

কী, তোর সাহস বেড়ে গেছে না? তুই আজ বাড়ি যাবি, বাড়ি গিয়ে আমাকে ফোন দিবি।

জয় জিজ্ঞেস করলো, তোমার আর কিছু বলার আছে?

আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে।

আমি তো তোমাকে এ মাসের কোচিং, ম্যাসের সিট ভাড়াসহ সব টাকা দিয়ে পাঠিয়েছি। এখন আমি কোথায় টাকা পাবো?

মানিক আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলো, টাকা কোথায় পাবি সেটা আমি জানি, তোর টাকা আছে বলেই তুই দু’টা বিয়ে করেছিস আর আমি চাইলে দিতে পার্‌বি না, তাই না?

তুমি ভালো করেই জানো আমি চাকরি করি, আমি অঢেল টাকার মালিক না যে তুমি যখন চাইবে তখনই টাকা দিতে পারবো।

তাহলে তুই টাকা দিবি না?

না।

ঠিক আছে রাখ্‌, রাখ্‌ শুয়োরের বাচ্চা, দেখি কীভাবে তোর কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায়। আর শোন দিনের মধ্যে দিনাজপুর গিয়ে আমাকে রিং দিবি যদি না দিস তবে আমি রাতের বাসে উঠবো, দিনাজপুর হোক আর জয়পুরহাট-ই হোক তোকে আমি জবাই করবো, জবাই, বুঝলি বলে মানিক ফোন রেখে দিলো।

 

বায়ান্ন

 

বিয়ের আগে জয় আর ইরার জন্য শুক্রবারটা ছিলো বিশেষ দিন। ইরা বি.এড ক্লাসের কথা বলে জয়পুরহাট চলে আসতো, সারাদিন দু’জনে ঘুরে বেড়াতো মুক্ত পাখির মতো সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারি, বারো শিবালয় মন্দিরের পাশে শতবর্ষী বটগাছ, ছোট যমুনা নদীর পাড়ে। তারপর বাসায় গিয়েই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতো হ্যাপি ফ্রাইডে।

আজ শুক্রবার কিন’ আজ ইরার হ্যাপি ফ্রাইডে না। ইরার জীবনে বুঝি আজ সবচেয়ে খারাপ শুক্রবার। কারণ গতকালই জয়ের দিনাজপুর যাওয়ার কথা ছিলো কিন’ জয় যায়নি। তাতে কিছুটা হলেও ইরা একটু খুশি হয়েছিলো। আজ তো আর রক্ষা নেই। বাস্তবতা যত নিষ্ঠুরই হোক ইরাকে যে মেনে নিতে হবে।

নাস্তা খাওয়ার পর ইরা জয়কে আলনা থেকে একে একে কাপড়-চোপড় এনে দিলো চোখের পানি মুছতে মুছতে। তারপর শার্টটা পরিয়ে দিলো, শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছিলো এমনসময় জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ফোনটা চার্জে দেয়া ছিলো একটু দূরে ইরা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রতন ফোন করেছে।

ইরা রিসিভ করে লাউড স্পিকার দিয়ে জয়ের কানের কাছে ধরে রাখলো।

জয় বললো, হ্যালো।

রতন বললো, কোথায়?

জয়পুরহাট।

এখনো বের হইসনি?

না।

কখন বের হবি?

এই তো বের হবো এখন।

তাড়াতাড়ি আয় দুপুর বারোটার আগে এসে পৌঁছাবি।

এভাবে বলছো কেনো? রওয়ানা হচ্ছি যেতে যা সময় লাগে।

রতন গর্জন করে উঠলো, আরে কুত্তার বাচ্চা যা বলছি তাই করবি যদি কোনো উল্টাপাল্টা করিস তবে তোকে খুন করবো, খুন!

রতনের কথা শুনে জয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেলো।

জয় যখন কথা বলছিলো ইরা তখন জয়ের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছিলো। বোতাম লাগানো শেষে জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, জয়, যেওনা জয়! ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে বলেই ইরা জয়ের বুক থেকে মাথা তুলে বললো, জয় একটু বসো প্লিজ তোমার হার্টটা খুব জোরে চলছে। একটু বসো আমি এক গ্লাস পানি এনে দিচ্ছি।

ইরা এক গ্লাস পানি এনে দিলো। খাটের ওপর বসে পানি খেলো।

ইরা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, আমার খুব ভয় করছে জয়, ওরা যদি তোমাকে মেরে ফেলে।

বিয়ের পর এবারই তো প্রথম যাচ্ছি ইরা। দেখা যাক এবার যদি তেমন দেখি তবে আর কোনোদিন যাবো না।

ইরা জয়কে জুতো পরিয়ে দিলো। জয় মোটর সাইকেলে রাখা হ্যালমেটটা মাথা দিতে যাচ্ছিলো। ইরা হ্যালমেটটা জয়ের হাত থেকে নিয়ে কাপড় দিয়ে মুছে দিতে দিতে ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

জয় ইরা চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, কেঁদো না ইরা। তুমি না বলতে তোমার কিচ্ছু হবে না তবে এখন কেনো…

জয়, আমি বুঝতে পারিনি জয়, আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম তুমি যাবে আর আমি বুঝি খুব সহজে মেনে নিতে পারবো কিন’ এখন কেনো এমন মনে হচ্ছে জয়, কেনো? আমার ভালোবাসায় কেনো আরেকজনের ভাগ থাকবে? তুমি শুধু আমার জয়, শুধু আমার।

আমি তো তোমারই ইরা।

তবে যে সামিনার কাছে যাচ্ছো।

সেটা ভালোবাসা না ইরা দায়িত্ববোধ। ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের মধ্যে তফাৎ আছে। তোমার সঙ্গে যে আমার সম্পর্ক এটা ভালোবাসা আর সামিনা এবং মানিক-রতনের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সেটা দায়িত্ববোধ। তুমি এই দু’টোকে এক করে দেখো না প্লিজ।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমি জানি জয়, আমি জানি। ওদের কাছে সারাজীবন তুমি সুখ পাওনি, ভালোবাসা পাওনি, তুমি ওদের শুধু দিয়েই গেছো। তারপরও রতন যেভাবে কথা বললো অন্য কোনো বাপ হলে জীবনে কোনোদিন এরকম ছেলের মুখ দেখতো না। তুমি খুব ভালো জয়। এতোকিছুর পরও তুমি তোমার দায়িত্ববোধ থেকে সরে দাঁড়াওনি।

কেঁদো না ইরা। কোথাও রওয়ানা দেয়ার সময় কাঁদতে নেই।

কিচ্ছু হবে না জয়। আমি দোয়া করছি তুমি যেনো নিরাপদে পৌঁছাও। আর হ্যাঁ রাস্তায় যেনো আবার কারও সঙ্গে কথা বলো না, দেখা করো না। তোমার তো আবার বিরামপুর নাকি ফুলবাড়িতে ফ্যান না কে আছে কথাগুলো ইরা হাসি-কান্না মিশ্রিত মুখে বললো।

জয় বললো, না তো।

কেনো তুমি যে প্রিয়ন্তী বইয়ে লিখেছো।

জয় ইরার নাকটা টেনে ধরলো, তোমার নাক লম্বা তাই একটু বেশি খুঁতখুঁতে।

ইরা কান্না মিশ্রিত হাসি হেসে বললো, আমি কিন’ মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে তোমার আপডেট জানবো।

ওকে জেনো। কোনো সমস্যা নেই।

দিনাজপুর গিয়ে যেনো আমাকে ভুলে যেও না জয়। আমি কিন’ তোমাকে নিয়ে খুব টেনশনে থাকবো।

জয় মোটর সাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। ইরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকালো। ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। জয়ও হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে মোটর সাইকেল চালাতে লাগলো।

জয় আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ইরা দাঁড়িয়ে রইলো।

 

তিপ্পান্ন

 

জয় চলে যাবার পর ইরা দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আগেও ইরা জয়কে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য ট্রেনে তুলে দিয়েছে হাসি মুখে। সেই জয় তো আজ দিনাজপুর গেলো। জয় ইরাকে বলেছে সে শুধু দায়িত্ববোধের কারণেই যাচ্ছে। ইরা-ই তার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ কিন’ ইরার মন এখন তা মানছে না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো জয় আর সামিনার ছবি। তার হৃদয় ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে এলো। সে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো, কেনো চলে গেলে জয়? কেনো চলে গেলে?

বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ইরার একসময় ঘুমের তন্দ্রা এসেছে। হঠাৎ ইরা চমকে উঠলো, জয়! আমার জয়! আমি কোথায়? ইরা মনে করার চেষ্টা করলো। সব মনে পড়েছে। ইরা চোখ মুছে ঘড়িতে সময় দেখলো। তারপর সময় হিসেব করলো। এক ঘণ্টা হলো, কতদূর গেছে জয় এতোক্ষণ, ইরা কোনোদিন দিনাজপুর যায়নি। এর আগে জয় যখন দিনাজপুর যেতো তখন ইরা সময় হিসেব করতো। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে আদেশের সুরে জিজ্ঞেস করতো, কোথায়?

জয়ও ঠিক একইভাবে উত্তর দিতো, পার্বতীপুর।

এতো দেরি কেনো?

জয় হেসে বলতো আমি কি ট্রেনের ড্রাইভারের কাছে মোবাইল ফোনটা দিবো?

কেনো?

কারণ ট্রেন তো ড্রাইভার চালাচ্ছে। কাজেই সে যখন নিয়ে যাবে তখনই তো যেতে পারবো।

ইরা কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে থাকতো, ট্রেন চলছে নাকি থেমে আছে তারপর জিজ্ঞেস করতো, তুমি তো ট্রেনে নেই?

কীভাবে বুঝলে?

কোনো সাউন্ড পাচ্ছি না যে।

এখন পার্বতীপুর ট্রেন থেমে আছে। হয়তো ক্রসিং আছে। অবশ্য তুমি যদি বলো ট্রেন থেমে আছে কেনো তবে আমি ট্রেন থেকে নেমে দৌড় দিচ্ছি। কী বলো?

ইরা হেসে ফেলতো, এই না হলে তুমি আমার কথাসাহিত্যিক।

 

অনেক কষ্টের মাঝে ইরা হেসে ফেললো। তারপর জয়ের মোবাইল ফোনে রিং দিলো। কয়েকবার ফোন দেয়ার পর জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

কতদূর জয়?

এই তো দিনাজপুরের কাছাকাছি।

আর কতক্ষণ লাগবে জয়?

এই মনে করো আধ ঘণ্টা।

কী করলে এতোক্ষণ ইরা?

শুয়েছিলাম।

জানো আমার ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিলো, তুমি বুঝি আমার পাশে শুয়ে আছো। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখলাম তুমি নেই আর আমার বুকটা ধক করে উঠলো।

জয় প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো, শোনো এখন আমি ঠিক ব্রিজের মাঝখানে। এখানে একটা রাবার ড্যাম আছে।

ইরা বুঝতে পারলো না, রাবার ড্যাম?

রাবার ড্যাম হলো, স্লুইস গেটের মতো রাবার দিয়ে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে সেই পানি ইরিগেশনের কাজে ব্যবহার করা হয়, বুঝেছো বালিকা?

ইরা হেসে উঠলো, আমি বালিকা?

শোনো জায়গাটা খুব সুন্দর। নদীর পশ্চিম পাড়ে কংক্রিটের ব্লক, কংক্রিটের তৈরি সবুজ ছাতা, মাঝে মাঝে কংক্রিটের বেঞ্চ বানানো আছে। অনেকেই দিনাজপুর থেকে বিকেলবেলা এখানে বেড়াতে আসে। আমরাও আসবো ইরা। খুব সুন্দর লাগবে তোমার।

ইরা জোর দিয়ে বললো, তোমার যখন সুন্দর লেগেছে তখন আমারও তো সুন্দর লাগবেই। আমাদের পছন্দের মিল আছে না।

ঠিক বলেছো।

সেদিন আমি তোমাকে জড়িয়ে অনেক অনেক ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিবো। গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিবো, জয় আমার, শুধু আমার বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো। তারপর ইরা গলা ঝেড়ে বললো, তুমি তো আবার ফেসবুকে আমার ছবি দেয়া পছন্দ করো না। সেদিন কিন’ তুমি কিছু বলো না আমাকে, ওকে?

ওকে।

আচ্ছা একটা কথা বলোতো, ওখানে কি এখন খুব সুন্দর সুন্দর তরুণীরা বেড়াতে এসেছে?

নাতো।

তাহলে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে বক বক করছো কেনো? কান-মুখ রেখেছো আমার দিকে আর চোখ দু’টো রেখেছো ঐ সুন্দরী তরুণীদের দিকে।

তুমি তো আমাকে ফোন দিলে ইরা তাই দাঁড়ালাম, কথা বলবো না তোমার সঙ্গে?

ঠিক আছে আর দেরি করো না। এখন মোটর সাইকেল স্টার্ট দাও। বাসায় ওঠার আগে আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাবে। নামাজ পড়তে যাবে। নামাজে যাবার আগে পাঞ্জাবি-টুপি পরা ছবি তুলে আমার ইনবক্সে দিবে। যাবে তো নামাজ পড়তে?

অবশ্যই যাবো।

মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। ওদের সঙ্গে যেনো কোনো ঝগড়া-বিবাদে না জড়াও। আমার খুব ভয় হচ্ছে জয়। রতন যেভাবে তোমাকে বললো…

টেনশন করো না ইরা। তুমি কিন’ দুপুরে ভাত রান্না করো। আমি নেই দেখে রান্না করার ভয়ে না খেয়ে থেকো না।

ওকে। এখন মোটর সাইকেল স্টার্ট দাও। আর বকবক করো না। বাই।

ওকে বাই।

 

চুয়ান্ন

 

পাঁচতলা বাসা। জয় ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে উঠেছে। দরজার সামনে ব্যাগটা করে রেখে কলিং বেল-এ টিপ দিলো। রতন দরজা খুলে দিলো, তার চোখ-মুখ লাল, চোয়াল দু’টো শক্ত। আগে আসার সময় দরজা খুলে দিয়েই রতন ব্যাগটা ভিতরে নিয়ে যেতো। আজ সে হন হন করে ভিতরে চলে গেলো। রতনের চোখ-মুখের অবস’া দেখে জয় কিছু বললো না। সে কোনোরকমে ব্যাগটা নিয়ে বেড রুমের মেঝেতে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

সামিনা রান্নাঘরে ছিলো। কয়েকমিনিটের মধ্যে বেড রুমে এলো জয়ের চিরচেনা ভয়ঙ্কর উগ্রমূর্তি ও রাগান্বিত চেহারা নিয়ে,  শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলে তাহলে?

জয় কোনো কথা বললো না।

সামিনা আবার বলতে শুরু করলো, ঐ মাগীটার সঙ্গে তোমার নটং-পটং দেখে আমার আগেই মনে হয়েছিলো…

জয় সামিনার কথার প্রতিবাদ করলো, সামিনা, ভদ্রভাবে কথা বলো। ইরা আমার স্ত্রী, ওকে মাগী বলবে না, ওর সম্পর্কে তুমি কোনো কথা বলবে না।

সামিনা মুখ বিকৃত করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললো, মাগী বলবো না, যে অন্যের স্বামীকে কেড়ে নিতে পারে সে মাগী নাতো কী?

ও অন্যের স্বামীকে কেড়ে নেয়নি। আমি ভালোবেসে ওকে বিয়ে করেছি। যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে তবে আমি দোষ করেছি।

সামিনা চরম উত্তেজিত হলো, তার মুখের ভাষা তুমি থেকে তুইয়ে নেমে এলো, যদিও সামিনা বেশিরভাগ সময় জয়কে তুই তুই করে তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বলে, কেনো কর্‌লি, কেনো? আমি কী দোষ করেছি?

তুমি কোনো দোষ করেছো কী না সেটা নিজেকে প্রশ্ন করো। সারাজীবন তুমি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো, আমি বাসায় এসে কোনোদিন তোমার কাছে শান্তি পাইনি। সারাজীবন তুমি আমাকে শাসিয়েছো, তোমার কাছে আমি এতোটুকু ভালো ব্যবহার পাইনি। তোমার রাগ, অহংকার, জিদ আমাকে সবসময় আতঙ্কিত করেছে, তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তোমার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য আমি কুড়িগ্রাম থাকা অবস’ায় রাজিবপুর, নওগাঁ থাকা অবস’ায় ধামইরহাট আর পাঁচবিবি পোস্টিং থাকা অবস’ায় জয়পুরহাট থেকেছি।

আমার জন্য থেকেছো নাকি মাগীবাজী করার জন্য থেকেছো?

জয় গর্জন করে উঠলো, সামিনা!

সামিনাও সমান জোরে চিৎকার করে উঠলো, চুপ।

তোমার এসব আচরণের কারণেই আমি সারাজীবন একজন ভালো জীবনসঙ্গী খুঁজেছি, যে আমি বাসায় আসার অপেক্ষায় থাকবে, কলিং বেলে টিপ দিলে দরজা খুলে দিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে আমাকে গ্রহণ করবে, আমি ওয়াশরুমে গেলে একটা তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে, ডাইনিং টেবিলে আমি যখন ভাত খেতে বসবো তখন সুন্দরভাবে আপ্যায়ন করবে, আমি যখন দুশ্চিন্তায় থাকবো তখন আমার মুখ দেখে আমার মনের কথা বুঝতে পারবে। আমি এসব গুণ ইরার মধ্যে পেয়েছি। তাই আমি ইরাকেই আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বিয়ে করেছি। ও আমার বউ, স্ত্রী, বিবাহিতা স্ত্রী। আমার স্ত্রীকে মাগী বলার তোমার কোনো অধিকার নেই।

ভালো করেছিস, খুউব ভালো করেছিস। দেখি না ঐ মাগীকে ক’দিন রাখতে পারিস আর ঐ মাগী ক’দিন তোর কাছে থাকে?

আবার ওকে মাগী বলছো? জয় চাপা স্বরে বললো।

মাগী বলবো না তো কী বলবো?

জয় আবার গর্জে উঠলো, সামিনা!

সামিনাও আঙ্গুল তুলে জয়ের চেয়ে জোরে চিৎকার করে বললো, চুপ, চুপ বেয়াদব!

সামিনার জোরে চিৎকার শুনে রতন পাশের রুম থেকে একরকম দৌড়ে এলো, জয়ের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই, এই চিৎকার করছিস কেনো রে, চিৎকার করছিস কেনো?

রতন জয়ের বাহুতে ধাক্কা দিতে পারে জয়ের এমন ধারণা ছিলো না। মোবাইল ফোনে দু’টো গালাগালি করেছে এটাই জয় কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না তারওপর…

জয় আর সহ্য করতে পারছে না। তার শরীর কাঁপতে শুরু করলো, গলা শুকিয়ে গেলো। সে নিজেই ডাইনিং স্পেসে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে খেয়ে আবার বেড রুম ঢুকছিলো, সামিনা গজ গজ করতে করতে বললো, আবার রুমে ঢুকছিস কেনো? বাজার যাবি না।

একটু রেস্ট নিই।

শরীর ক্লান্ত করে এসেছিস, না? আগে বাজার করে নিয়ে আয়। বাজার দেরিতে এলে আমার রান্না করতে দেরি হবে, বলে গজ গজ করতে করতে রান্নাঘরে গেলো, রান্নাঘর থেকে বাজারের ব্যাগ এনে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এই নে বাজারের ব্যাগ।

রতন মেঝে থেকে ছুঁড়ে দেয়া বাজারের ব্যাগ তুলে নিয়ে আঙ্গুলে তুড়ি মেরে বললো, চল্‌।

জয় মিন মিন করে বললো, চলো।

 

মানিক-রতনসহ বাজার করার অভ্যাসটা জয়ের অনেকদিনের। মানিক যখন হাঁটতে শিখেছে তখন থেকে জয় তাকে বাজারে নিয়ে যায়। মাছের বাজারে পানি জমে থাকে বলে জয় মানিককে কোলে নিয়ে বাজার করেছে তার পছন্দমতো। মানিক তখনও মাছের নাম বলতে পারতো না। আঙ্গুল দেখিয়ে দিতো, আব্বা, আব্বা…

জয় মৃদু হেসে বলতো, নিবা?

মানিক হাঁ সূচক মাথা নাড়তো।

তারপর তাদের সংসারে এলো আরও একজন অতিথি, রতন। রতন হাঁটতে শেখার পর থেকে মানিকের সঙ্গে রতনও যোগ হলো। ততদিনে অবশ্য মানিক হাতে হালকা ব্যাগ নিতে শিখেছে, দোকানদারের সামনে ব্যাগ বাড়িয়ে দিতে শিখেছে। তখন জয় দোকানদারকে টাকা দিতো আর মানিক ব্যাগ বাড়িয়ে মাল বুঝে নিতো। এমনিভাবে তিন পিতা-পুত্রের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।

মানিক-রতন যখন আরও বড় হলো তখন বাজারের লিস্ট করার দায়িত্ব পড়লো রতনের ওপর। রতনের হাতের লেখা ভালো তাই মাসের প্রথম সপ্তাহের বাজারের তালিকা এবং প্রতি শুক্রবার কাঁচা বাজারের তালিকা রতনই করতো।

মাসের প্রথম সপ্তাহে জয় যখন বাজার করতো তখন পকেটে অনেক টাকা থাকতো, তখন বড় মাছ বা মাংস কিনতে গিয়ে জয়কে চিন্তা করতে হতো না কিন’ মাসের শেষ দিকে এসে যখন টাকার টানাটানি শুরু হতো তখন মানিক-রতন কোনো বড় মাছ পছন্দ করলে জয় বলতো, মাসের শেষ বাবা, আবার আগামী মাসে যখন বাজার করবো তখন কিনে দিবো।

মানিক একটু শান্ত প্রকৃতির, সে মাথা নেড়ে সায় জানাতো কিন’ রতন রেগে যেতো, টাকা নেই কেনো?

জয় বলতো, আমি যে ছোট চাকরি করি বাবা, তাই মাস শেষ হওয়ার আগে টাকা শেষ হয়ে যায়। তুমি যখন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় চাকরি করবে তখন অনেক টাকা বেতন পাবে, তখন অনেক বড় বড় মাছ কিনবে, ঠিক আছে?

রতন হাত লম্বা করে দেখিয়ে বলতো, এত্তোবড়।

জয় বলতো, হ্যাঁ এতোবড়।

এই তো গত মাসে জয় যখন বাজার করেছে তখনও সব কথাগুলো ঠিক একইভাবে চলেছে কিন’ আজ প্রথমে মাছের বাজারে ঢুকে একটা বড় চিতল মাছ দেখে রতন আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, এই মাছটা নাও তো।

জয় মাছটার দাম জিজ্ঞেস করে জানলো দাম তিন হাজার টাকা।

জয় বললো, আজ থাক বাবা আরেকদিন নেয়া যাবে।

রতন জিদ ধরলো, না আজকেই নিতে হবে।

জয় মৃদু রাগের সুরে বললো, বলছি তো আরেকদিন নিয়ে দিবো। আজ মাসের পঁচিশ তারিখ তুমি তো জানোই মাসের শেষ দিকে আমার কাছে তেমন টাকা থাকে না।

রতন চাপাস্বরে বললো, আগে তো তাই জানতাম কিন’ এখন জানি তোমার কাছে অনেক টাকা আছে।

জয় রতনের কথা শুনেও না শোনার ভান করে অন্য মাছ কিনে মাছের বাজার থেকে বের হলো। তারপর মুদি দোকানে ঘটলো আরেক ঘটনা। জয় প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরো মাসের বাজার করে আর তারপরের বাজারগুলো হয় সংক্ষিপ্ত, প্রয়োজন অনুসারে কিন’ রতন মুদির দোকানে যে লিস্ট বের করলো তার বিল হলো পুরো মাসের বাজারের চেয়েও বেশি। জয় জিজ্ঞেস করলো, এতো বাজার কেনো?

রতন গম্ভীর স্বরে বললো, লাগবে।

জয় আর কোনো কথা বললো না। পুরো বাজারই রতনের লিস্ট অনুযায়ী করলো।

 

দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে জয় যখন তাদের গ্রামের বাড়ি যাবার কথা সামিনাকে বলতো তখন সামিনা বাজারের লিস্ট লম্বা করতো, তার জামাকাপড় নেই বলে নানান বাহানা করতো যেনো জয় তার মা’র হাতে কোনো টাকা তুলে দিতে না পারে। আগে সামিনা যেখানে তার শাশুড়ির সঙ্গে এরকম আচরণ করতো আর এখন তো ইরা, তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সে-ই রতনকে বড় লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে যেনো জয়পুরহাট যাওয়ার সময় জয়ের হাতে আর কোনো টাকা না থাকে।

জয়ের বাবা বলতো সংসারের রাজনীতি বড় জটিল। বাবার সেই কথাটা জয় অনুভব করেছে দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে তিলে তিলে, প্রতিটি মুহূর্তে। তবে সামিনার এই কুশিক্ষাটা অর্জন পৈত্রিক সূত্রে। বিয়ের কয়েকবছর পরের কথা, জয় একটা জমি ঠিক করেছিলো তার গ্রামের বাড়ির কাছে, একথা শুনে সামিনার বাবা বললো, গ্রামের জমি কিনে কী লাভ জামাই। ওগুলোর ফসল তো তোমার বাবা-মা’ই খাবে।

জয় শুধু মাথা উঁচু করে রাগান্বিত দু’চোখ মেলে একবার তাকিয়েছিলো কিছু বলেনি। তাতেই তার শ্বশুরের কথা থেমে গিয়েছিলো সে পর্যন্তই। কাজেই সামিনা স্বার্থপরতা শিখেছে পরিবার থেকেই। আগে তার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি ভর করতো শাশুড়ি, দেবর আর ননদের বিরুদ্ধে আর এখন ইরার বিরুদ্ধে। তবে শাশুড়ি, ননদ আর দেবরের বিরুদ্ধে রাজনীতির চেয়ে ইরার বিরুদ্ধে রাজনীতিটা অনেক ভয়ংকর।

বাজারের ব্যাগ নিয়ে জয় আর রতন উপরে উঠে জয় সামিনাকে উদ্দেশ্য করে বললো, মাসের এসময় এতগুলো বাজার।

সামিনা ঝাঁঝিয়ে উঠলো, প্রয়োজন হলে আনতে হবে না।

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, আনতে তো হবে কিন’ খেয়াল রাখতে হবে মাসের তারিখটা।

সামিনা প্রচণ্ড রেগে গেলো, আমি আর কেনো মাসের তারিখের দিকে খেয়াল রাখবো। তোমার টাকা আছে বলেই তুমি দু’টা বিয়ে করেছো। এখন আমিও যথেচ্ছা চলবো। আমার যখন যা প্রয়োজন তাই চাইবো যদি না পাই তবে দেখো আমি কী করি।

জয় আর কথা বাড়ালো না। সে বাজারের ব্যাগ রেখে বাথরুমে ঢুকছিলো এমনসময় জয়ের মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ রিং টোন বেজে উঠলো।

জয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই সামিনা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, দেখ দেখ মাগীটা ম্যাসেজ দিলো বুঝি।

জয় মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ইরার ম্যাসেজটা দেখলো।

ইরা লিখেছে, কী অবস’া সোনা তোমার?

এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠলো।

সামিনা একরকম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। জয় কান পেতে রইলো একাধিক পুরুষ কণ্ঠের চাপা কণ্ঠস্বর। তারপর সামিনা ভিতরে এলো, তার চোখে-মুখে অনেকটা আনন্দের ছাপ, বাবা আর মামা এসেছে।

জয়ের বুঝতে আর বাকি রইলো না তাদের আসার কারণ। সে ইরার ম্যাসেজের রিপ্লাই লিখছিলো।

সামিনা এবার একটু জোরেই কর্কশ স্বরে বললো, ড্রয়িং রুমে যাও, নাকি এখনো মাগীটার সাথে চ্যাটিং করবা। আমার বাবা-মামা এসেছে তাদের বুঝি কোনো গুরুত্ব নেই।

বসতে বলো।

বলেছি, ওরা তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

যাও আসছি।

তবু মাগীটাকে তোমার ম্যাসেজ দিয়ে যেতে হবে বলে সামিনা বেরিয়ে গেলো।

জয় ইরার ম্যাসেজের উত্তর দিলো, অবস’া থমথমে, তুমি টেনশন করো না সোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

পঞ্চান্ন

 

জয় ড্রয়িং রুমে ঢুকে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম।

কুশলাদি বিনিময়ের পর সামিনার মামা খলিলই প্রথম কথা তুললো, আমরা একটা কথা শুনলাম জামাই।

জয় আর শোনার প্রয়োজন মনে করলো না কী কথা। তারা যে সেটা নিশ্চিৎ হয়ে, সামিনা সঙ্গে কথা বলে, কোনো ষড়যন্ত্র করে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সেই যড়যন্ত্র যে অনেক গভীর তা সামিনার বাবা মিরাজের শক্ত চোয়াল দেখে জয়ের বুঝতে বাকি রইলো না। সে মৃদু কণ্ঠে বললো, ঠিকই শুনেছেন।

কেনো করলে এমন কাজ?

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, আপনারা তো আমাদের দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই জানেন মামা।

মিরাজ সাহেব গর্জে উঠলেন, কী হয়েছে দাম্পত্য জীবনের, সব সংসারে ঝগড়া-বিবাদ হয় তাই বলে কেউ এক বউ থাকতে দ্বিতীয় করে না। তারওপর প্রথম বউয়ের বিনা পারমিশনে।

জয় চুপ করে মিরাজের কথা শুনছিলো। সে বলতেই থাকলো, অনেকেই আমাকে বলেছে মামলা করতে, মামলা করলে তোমার চাকরির ক্ষতি হবে তাই মামলা করিনি।

খলিল সাহেব বললো, তুমি থামো দুলাভাই। জামাই একটা ভুল করে ফেলেছে এখন কীভাবে সেটা সংশোধন করা যায় সেই পথ বের করতে হবে।

জয় কোনো কথা বললো না। খলিল সাহেব জয়কে উদ্দেশ্য করে বললো, জামাই বলো দেখি এখন কী করতে চাচ্ছো?

জয় মিনমিন করে বললো, আমি আর কী বলবো।

এবার খলিল সাহেব একটু কর্কশ কণ্ঠে চোয়াল শক্ত করে বললো, দুলাভাই ঠিকই বলেছে। মামলা করলে তোমার ক্ষতি হবে জেনে আমি মামলা করতে দিইনি। এখন তুমি যদি ঐ মেয়েকে তালাক দাও তবে বিষয়টা এ পর্যন্তই থেমে যায়, অবশ্য আমরা তোমাকে সময় দিবো। তুমি যেকোনোভাবে মেয়েটাকে বিদায় করে দাও।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জয়ের পায়ের রক্ত যেনো মাথায় উঠে গেলো। হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুত বেড়ে গেলো। মাথাটা একটা চক্কর খেলো। সে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, তা হয় না মামা।

মিরাজ সাহেব গর্জে উঠলো, তুমি বললেই হবে হয় না। ঠিক আছে তুমি যদি ঐ মেয়েকে তালাক না দাও তবে আমিও দেখে নিবো।

সামিনা এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলো এবার জোরে চিৎকার করে বললো, দিবি না, তোর বাপ দিবে। ঐ মাগীকে না ছাড়লে আমি তোকে জেলের ভাত খাওয়াবো।

জয় সোফা থেকে উঠলো।

খলিল জিজ্ঞেস করলো, কী করলে জামাই?

জয় শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, আপনার ভাগ্নির আচরণ তো নিজের চোখে দেখলেন মামা। এরকম আচরণ আমি সারাজীবন সহ্য করেছি। আপনারা সারাজীবনে কমপক্ষে বিশ বার তাকে শাসনও করেছেন কিন’ তার কণ্ঠস্বর নামাতে পারেননি। আমি বাঁচার একটা শেষ আশ্রয়স’ল খুঁজেছি। আমি মনে করেছি এটাই আমার কাছে ভালো সমাধান তাই বিয়ে করেছি বলে জয় কোনো উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বেডরুমে চলে গেলো।

জয়ের কানে পিছন থেকে সামিনা আর তার বাবার গজ গজ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিলো। মিরাজ বলছে, ছাড়বি না বেটা, যখন জেলের ভাত খাবি তখন ঠিকই ছাড়বি।

খলিল সামিনাকে ধমকের সুরে বললো, সব তোমার দোষ, কেউ স্বামীর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে। আমি তোমার মামা আর তোমার বাবা যখন জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি তখন তোমার কথা বলার কী প্রয়োজন ছিলো। এভাবে দিনের পর দিন খারাপ আচরণ করতে করতে জামাই তোমার ওপর অতীষ্ঠ হয়েই তো বিয়ে করেছে।

মিরাজ গজগজ করে বলতে লাগলো, তাই বলে আরেকটা বিয়ে করবে?

খলিল মিরাজকেও ধমকের সুরে বললো, তুমিও বেশি বোঝো এভাবেই তো মেয়েটাকে মাথায় তুলেছো। বার বার মেয়ে বাবার কাছে জামাই সম্পর্কে অভিযোগ করেছে আর তুমি তাকে সাপোর্ট দিয়েছো। প্রথম প্রথম যখন মেয়ে তোমার কাছে জামাই সম্পর্কে অভিযোগ করতো তখনই যদি তুমি শাসন করতে তবে আজ এ অবস’ায় দাঁড়াতো না।

জয় কান পেতে শুনছিলো সামিনা দরজা বন্ধ করে দিলো। কথা বলার শব্দ পরিবর্তন হলো, স্পষ্ট এবং জোরে কথা বলার শব্দ ক্রমেই অস্পষ্ট হলো। কিছুক্ষণ পর বাইরের দরজা খোলার শব্দ। তারপর সামিনা রুমে এলো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, ওরা চলে গেলো?

হ্যাঁ।

কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দিলে?

ওরা তোমার বাসায় খেতে আসেনি।

হুঁম তা তো বুঝতেই পাচ্ছি।

সামিনা গর্জন করে উঠলো, কী, কী বুঝতে পাচ্ছো? বাবা তোমার বিরুদ্ধে মামলা করতো। মামা তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না, না করছে।

জয় বিছানা থেকে উঠে বাইরে বের হবার জন্য কাপড়-চোপড় পরছিলো সামিনা জয়ের শার্ট টেনে ধরে বললো, কোথায় যাচ্ছো?

বাইরে।

হঠাৎ বাইরে কেনো?

এমনি।

এমনি মানে?

এমনি বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে তাই।

বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে, তাই না? নাকি ঐ মাগীটার সঙ্গে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে?

সামিনা তোমাকে আমি আগেও বলেছি ইরা আমার স্ত্রী, আমার বিবাহিতা স্ত্রী।

বিবাহিতা কিন’ দ্বিতীয়। কোনো ভালো মেয়ে কারও দ্বিতীয় স্ত্রী হয় না।

জয় তীর্যক দৃষ্টিতে সামিনার দিকে তাকিয়ে বললো, নাকি কোনো ভালো স্ত্রীর স্বামীরা দ্বিতীয় বিয়ে করে না।

আমি খারাপ, আমি খারাপ তাই না? এতোদিন ভালো ছিলাম এখন ঐ মাগীটাকে বিয়ে করার পর আমি খারাপ হলাম? কথা বলতে বলতে সামিনা উত্তেজিত হলো।

না, ওকে বিয়ে করার পর শুধু না, সারাজীবনই তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছো। সারাজীবন এক মুহূর্তের জন্য তুমি আমাকে একটু সুখ দিতে পারোনি, একটু শান্তি দিতে পারোনি।

পারবো না তো। কারণ তুমি কোনোদিন ঘরে সুখ খুঁজোনি, শান্তি খুঁজোনি। সারাজীবন বাইরে বাইরে সুখ খুঁজেছো।

ঘরে সুখের অভাব বলেই তো বাইরে খুঁজেছি।

জয়ের কাপড় পরা শেষ হলো। সে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সামিনা বললো, কোথায় যাচ্ছো?

বললাম তো বাইরে।

আমিও যাবো।

তুমি কোথায় যাবে?

তুমি যেখানে যাবে সেখানে, বিকেলে তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবো।

সরি, আমার কাজ আছে।

সামিনা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, যা, কাজ তো থাকবেই, ঐ মাগীটার সঙ্গে কথা বলাই এখন তোর কাজ।

জয় বাসা থেকে বের হলো।

ছাপ্পান্ন

 

জয়ের বয়স তখন বারো চৌদ্দ বছর হবে। এই পূণর্ভবা নদীতে তখন নৌকা চলতো। জয় অনেকবার নৌকায় চড়ে নদী পাড়ি দিয়েছে। কয়েকবছর পর নদীতে ব্রিজ হলো। যেদিন ব্রিজ উদ্বোধন হলো সেদিন পূণর্ভবা ব্রিজে যেনো আনন্দের ঢল নামলো। জয় ততদিনে এস.এস.সি পাস করে দিনাজপুর পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছে। এই ব্রিজের ওপর দিয়ে জয় বাইসাইকেল নিয়ে পলিটেকনিকে যাতায়াত করতো। ফেরার পথে দেখতো ব্রিজের ওপর কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী এমনকি মধ্যবয়সী মানুষও সপরিবারে বিকেলে এই ব্রিজের ওপর আসতো। জয় বাইসাইকেল নিয়ে যেতো আর হাসতো ব্রিজে আবার কেউ বেড়াতে আসে? কিন’ আজ এই ব্রিজের ওপর আসতেই তার মনের মধ্যে ইরার ছবি ভেসে উঠলো।

নদীর ভাটিতে, কয়েক’শ ফুট দূরেই লোহার ব্রিজ। এই লোহার ব্রিজের ফাঁকা ফাঁকা স্লিপারের ওপর পাঁ দিয়ে জয় কৈশোরে কতবার হেঁটে গেছে। এই গোধূলি লগ্নে জয়ের সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লো। মনে পড়লো ইরার কথা, একদিন জয়পুরহাট রেল স্টেশনে জয় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলো, ইরা জয়কে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলো। কথা প্রসঙ্গে ইরা বলেছিলো, চলো না রেল লাইনের ওপর দিয়ে একটু হাত ধরাধরি করে হাঁটি। তোমার হাত ধরে রেল লাইনের ওপর দিয়ে সমান্তরালভাবে হাঁটার আমার খুব ইচ্ছা। তারপর নিজেই কথা ফিরিয়ে নিয়েছিলো, না থাক কেউ দেখে ফেলবে আবার।

সমান্তরালভাবে কেনো ইরা? তুমি কি কোনোদিন এক লাইনে হাঁটবে না, বলেই জয় হেসে ফেলেছিলো।

ইরার সাথে জয়ের বিয়ে হয়েছে। এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কিংবা রেলের ওপর দিয়ে হাত ধরাধরি করার হাঁটতে আর কোনো বাধা নেই। একবার ইরাকে নিয়ে আসবে এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে গোধূলি দেখবে। এরকম এক গোধূলিতে জয় ইরাকে দেখেছিলো  ওর চিবুকের ওপর যখন গোধূলির লাল সুর্যের আভা পড়ে ওর ফর্সা গাল যেনো জবা ফুলের মতো লাল টকটকে হয়ে গিয়েছিলো। তারপর…

জয় ইরাকে ফোন করলো। ফোন রিসিভ হলো না। জয় কয়েকবার ফোন করলো তারপর ইরা ফোন রিসিভ করলো। ইরার কণ্ঠ ঘুমে জড়ানো, হ্যালো।

কী করছো? ঘুমিয়েছো নাকি?

হুঁম। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কী করছো?

আমি ব্রিজে এসেছি। জায়গাটা খুব সুন্দর।

আমাকে কেনো নিয়ে গেলে না জয়। আমিও যেতাম।

আমি একবার ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে আসবো কিন’ বিয়ের পর এই প্রথম বার এলাম তো তাই বলিনি।

আমি শুধু তোমার বলার অপেক্ষায় ছিলাম জয়।

এরপর যখন তুমি যাবে তখন আমাকেও নিয়ে যেও, ওকে?

ওকে।

এখানে আর কতক্ষণ থাকবে?

এই তো শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্য এলাম। কথা বলা শেষ হলেই চলে যাবো।

জয়, আমার জয়! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জয়! তুমি কেনো আমাকে একা রেখে চলে গেলে, আমি এখন সারারাত কীভাবে কাটাবো? আমার যে এক পলক ঘুমও হবে না। বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ইরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে জয়ের মোবাইল ফোনে সামিনা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। জয় রিসিভ করেনি।

তোমাকে একা রেখে আমারও ঘুম হবে না ইরা। আমি ফোনে তোমার সঙ্গে থাকবো।

কীভাবে?

ম্যাসেজ দিবো, তুমি দেখো আমি সারারাত তোমার সঙ্গে জেগে থাকবো।

ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে বললো, জয়! আমার জয়! তুমি ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকবো জয়।

রাখবো ইরা।

ইরা কয়েকমুহূর্ত মোবাইল ফোন কানের কাছে ধরে রাখলো তারপর বললো, তোমার মোবাইলে ফোন আসছে জয়? সত্যি করে বলবে।

হ্যাঁ।

কে ফোন দিচ্ছে?

সামিনা।

যাও, এখন বাসায় যাও।

আরেকটু কথা বলি ইরা।

না, তুমি এখনই যাও।

রাগ করলে ইরা?

ইরা খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো, না, রাগ করিনি। তুমি তাড়াতাড়ি না গেলে ওরা আবার তোমার ওপর রাগারাগি করবে জয়। তোমার জন্য আমারও খুব ভয় হয়।

কিচ্ছু হবে না ইরা।

কিছু যেনো না হয় বলে ইরা এবার হেসে উঠলো।

জয় বুঝতে পারলো না। সে জিজ্ঞেস করলো, মানে?

মানে বোঝোনি?

না। ক্লিয়ার করে বলো।

ইরা একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, ডন্ট শেয়ার মাই লাভ জয়!

 

সাতান্ন

 

ইরা জয়ের সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলো তারপর বিছানা থেকে উঠে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। জানালার পাশে খোলা মাঠ। ইরা জানালায় দাঁড়িয়ে গোধূলি দেখছে। দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেলো। আকাশে চাঁদ উঠলো ইরা তবু জানালায় চোখ রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা চাঁদের দিকে তাকিয়ে কত কথা-ই না ভাবছে, এবার জয় এলে ছাদে উঠবো, ছাদে দু’জনে বসে জয়ের কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখবো, জয় গান গাইবে…কী গান গাইবে। নিশ্চয়ই জয় গাইবে চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা। আর, আর… আমি কী গান গাইবো, ভাবতে ভাবতে ইরা গুণ গুণ করে গান গাইতে শুরু করলো, এসো না চাঁদ জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে দু’জনে গল্প করি।

এমনসময় ইরার মোবাইল ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ইরা গান বন্ধ করে হেসে উঠলে আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো, জয়, নিশ্চয়ই আমার জয় ম্যাসেজ দিয়েছে, দিবেই তো আমি জানি তো আমি যখনই তোমাকে নিয়ে ভাববো ঠিক তখনই তুমি ম্যাসেজ দিবে আর না হয় ফোন করবে, জয়! তুমি শুধু আমার জয় বলতে বলতে ইরা একরকম দৌড়ে গিয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজটা পড়লো।

সত্যি জয় ম্যাসেজ দিয়েছে। ইরা মোবাইল ফোনটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ওয়াও মিলে গেছে।

জয় লিখেছে, কী করছো ইরা?

ইরা উত্তর দিলো, আমি জানালায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম আর তোমার কথা ভাবছিলাম জয়। আর ঠিক এমনসময় তোমার ম্যাসেজ এলো। তোমাকে বলেছিলাম না যখনই আমি তোমার কথা ভাবি তখনই তুমি কেমন করে যেনো জেনে ফেলো যে আমি তোমাকে মিস করছি আর অমনি তোমার ম্যাসেজ চলে আসে। এটাকেই বলে মনের টান জয়।

ইরার ম্যাসেজের উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে জয় ইরার মোবাইলে রিং করলো। ইরা জয়ের কাছে ম্যাসেজ সেন্ড করলো।

কয়েকমিনিট ইরার জয়ের সঙ্গে ম্যাসেজ আদান-প্রদান করলো। তারপর জয়ের ম্যাসেজ আসা বন্ধ হলো। ইরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জয়ের সম্পর্কে তার অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঢুকলো, কতক্ষণ থেকে জয়ের ম্যাসেজ নেই, নিশ্চয়ই জয় এখন সামিনার সঙ্গে….

না, না আর ভাবতে পারছে না ইরা। ইরা একবার তার মোবাইল ফোনের ঘড়িতে সময় দেখে নিজেই লজ্জিত হলো। এখন তো কেবল রাত আটটা বাজে। রতন বাসায় আছে, নিশ্চয়ই জয় এখন লিখছে আর না হয় শুয়ে শুয়ে টি.ভি দেখছে। কিন’ ম্যাসেজ লেখা বন্ধ করলো কেনো?

ইরা যখন জয়কে নিয়ে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে ঠিক এমনসময় ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। মতি ফোন করেছে। ইরার বুকটা কেঁপে উঠলো, মতি আবার ফোন করলো কেনো? স্কুলে কোনোকিছু হয়নি তো। বাড়িতে? শুভ’র? এভাবে ফোন রিসিভ করবে কী না ভাবতে ভাবতে রিংটোন শেষ হলো। মতি আবার ফোন দিলো। এবার ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

ফোন দিয়েছো কেনো? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

এমনি তুমি কেমন আছো ইরা?

ভালো।

সত্যিই ভালো আছো?

তুমি তো জানো মতি আমি মিথ্যা কথা বলি না।

হুঁম তা ঠিক, তা ঠিক। তোমার সাহেব কোথায়?

মতির মুখে এই প্রথম ইরা তোমার সাহেব কথাটা শুনলো। মতি তাহলে মেনেই নিয়েছে। আর কিছু করবে না হয়তো তাকে আর জয়কে নিয়ে। ইরা চুপ করেছিলো। মতি বললো, হ্যালো।

কেনো ফোন দিয়েছো তাই বলো?

জানার জন্য তুমি কেমন আছো কিন’ জেনে তো মনটা খারাপ হয়ে গেলো, ঐ শালাবেটা তোমাকে একা রেখে গেছে।

জয়কে গালি দেয়ায় ইরার গায়ে যেনো আগুন জ্বলে উঠলো, জয় এখন আমার হ্যাজবেন্ড, তাকে তুমি এভাবে বলতে পারো না। এখন বলবে কেনো ফোন করেছো? তুমি তো কারণ ছাড়া কোনো কাজ করো না।

ঠিক বলেছো। একটা কারণ আছে সেজন্যই ফোন করেছি।

তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, আমার ফোন ব্যস্ত রাখা যাবে না। জয় ফোন করবে। আমি কারও সাথে কথা বলছি জানলে মাইন্ড করবে।

এবার মতি সুর পাল্টালো, শোনো তোমাকে যেটা বলার জন্য ফোন করেছি।

বলছি তো তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।

তুমি তো চলেই গেছো, তাই বলছিলাম…বলতে গিয়ে মতি একটা ঢোক গিললো। তারপর বললো, বাড়ির তোমার অংশটা যদি শুভ’র নামে লিখে দিতে…

কেনো আমি লিখে দিবো কেনো?

না আমি বলছিলাম শুভ তো তোমারই সন্তান। অবশ্য তোমার স্বামী যদি অনুমতি দেয়। কথার শেষ অংশটুকুতে জয়ের প্রতি মতির কটাক্ষ ফুটে উঠলো।

জয়কে কটাক্ষ করা ইরা মেনে নিতে পারলো না। সে রাগান্বিতস্বরে বললো, তুমি ভালো করেই জানো আমার হ্যাজবেন্ড আমাকে না করবে না কারণ ওর টাকা-পয়সার প্রতি কোনো লোভ নেই আর তার প্রমাণ তুমি নিজেও।

মতি অস্বীকার করলো, না, তুমি ঠিক বলোনি।

তুমি বাসায় এসে হাজার বার বলেছো যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খুব ভালো মানুষ। কারও কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেয় না। আর আজ বলছো অন্য কথা।

হ্যাঁ ঠিক বলেছি তো। যদি বিশ্বাস না হয় তবে একবার বলে দেখো আমি চাকরি ছেড়ে দিবো তোমাকে রাখে নাকি।

ও তোমার মতো লোভী না, ও শুধু আমাকে চায়, আমার চাকরি, টাকা-পয়সায় ওর কোনো লোভ নেই। ও তোমার মতো লোভী, সুযোগ সন্ধানী না যে সুযোগ বুঝে বাড়ি লিখে নিতে চাইবে।

মতি প্রসঙ্গ পাল্টালো, তাহলে আমি কি রেজিস্ট্রি অফিসে যোগাযোগ করবো? তুমি একদিন এসে রেজিস্ট্রি করে দিও।

সারাজীবন টাকা-ই দেখলে আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারলে না।

আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, তোমাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করিনি।

না তখন আমি ছোট ছিলাম তুমি আমাকে ইমোশনালি ব্লাক মেইল করেছিলে। না হলে আমার সারাজীবনের রোজগারের টাকা তুমি কৌশলে হাতিয়ে নিতে না। ওকে বাদ দাও, যেখানে আমি কোনোদিন যাবো না সেখানে আর রেখে লাভ কী। তুমি রেজিস্ট্রি অফিসে কথা বলো। তবে আমার একটা কন্ডিশন আছে।

বলো কী তোমার কন্ডিশন?

তুমি আমার চাকরিতে কোনো ডিস্টার্ব করবে না।

সেটা তো আমি আগেই তোমাকে বলে রেখেছি।

বলে রেখেছো কিন’ আমার সাসপেনশনটাও তুমি করিয়েছো।

না, আমি কিছু করিনি। কে বলেছে তোমাকে বলো?

আমাকে কেউ বলেনি আর তুমি তো কাউকে সাক্ষী রেখে কিছু করো না কাজেই দুনিয়াতে তোমার শয়তানী কে বুঝবে।

আমি কিছু করিনি। আর ভবিষ্যতেও করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি কোনোদিন তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।

ওকে, ভুল করছি জেনেও আবার তোমাকে বিশ্বাস করলাম। তুমি রেজিস্ট্রির কাগজ-পত্র রেডি করো। এমনসময় ইরা মোবাইল ফোনে জয় ফোন করলো।

ইরা মতির ওপর প্রচণ্ড রেগে গেলো, রাখো, রাখো। যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। তুমি আর আমাকে ফোন দিও না।

আমি তাহলে রেডি করি?

বলেছি তো করো। এক কথা বার বার বলে ঝামেলা করছো কেনো? বলে ইরা মতির কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

 

আটান্ন

 

সারারাত ইরার চোখে ঘুম নেই। মতির সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের বেশিরভাগ সময় ইরা আলাদা রুমে থেকেছে কিন’ জয়ের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে দু’জনে একই বিছানায় ঘুমায়। এই ক’দিনে ইরা যেনো অভ্যস’ হয়ে পড়েছে। তাই ঘুমাতে গিয়ে বার বার তার আধঘুমানো হাত যেনো জয়কে হাতড়ে খুঁজছে আর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। এমনিভাবে কখন যে ইরা ঘুমিয়ে পড়েছে ঠিক নেই। ঘুম থেকে জেগে ইরা কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো তারপর ফিসফিস করে আপনমনে বললো, আমি কোথায়? তারপর মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সকাল ন’টা বাজে। জয় তিনবার ফোন দিয়েছে, এক ঘণ্টা আগে একটা ম্যাসেজও দিয়েছে, ইরা স্টার্ট করছি, এসে নাস্তা করবো একসাথে।

ইরার মনের মধ্যে জয়ের প্রতি পুঞ্জীভূত রাগ-ক্ষোভ যেনো মুহূর্তে মিইয়ে গেলো। সে বিছানা থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলো, এক ঘণ্টা আগে রওয়ানা দিয়েছে, বাসা থেকে কিছু না খেয়েই!

ইরা মোবাইল ফোনটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, জয় আমার জয়।

তারপর চুল বাঁধলো।

ইরা নাস্তা তৈরি করছে কিন’ তার কান যেনো খাড়া। কখন যেনো জয় দরজার কলিংবেল দেয়, ইরার কানে কলিং বেলের মিউজিক বেজে উঠলো, ইরা আবেগেজড়িত কণ্ঠে বললো, ওয়াও, জয় এসেছে!

কিন’ দরজা খুলে দেখলো জয় তো নেই। ইরা আপনমনে একবার হাসলো তারপর আবার রুটি তৈরি করতে শুরু করলো। আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা আবার দরজার দিকে গেলো, দরজা খুলে দিলো। এবার সত্যি সত্যি জয় এসেছে। ইরা দরজা খুলে দিতেই জয় গান শুরু করলো,

খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর

বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।

দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও

এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।।

ইরা দু’হাত বাড়িয়ে বললো, বেঁধেছি তো চুল, তুলেছি তো ফুল

গেঁথেছি তো মালা মুকুলে।

জয় ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তুমি! তুমি কী করে জানলে জয় আমার মনের কথা। আমি ঘুম থেকে উঠেই চুল বেঁধেছি আর ভেবেছি তুমি যদি এসে এই গানটা গাও?

সত্যিই।

হুঁম। এই দেখো, দেখো। বলে ইরা তার খোঁপা দেখিয়ে বললো আর তুমি এসে সেই গানটাই গাইতে শুরু করলে, জয়! আমার জয়!

একেই বলে হৃদয়ের সম্পর্ক ইরা। যখন দু’জনের হৃদয় এক হয়ে যায় তখন একজনের হৃদয়ের ব্যকুলতা অন্যজনও বুঝতে পারে। ইরা, আমার ইরা।

ইরা বুক থেকে মাথা তুললো, কীসের পোড়া গন্ধ পাচ্ছি? ছাড়ো ছাড়ো চুলোয় রুটি, পুড়ে গেলো বলে ইরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রান্না ঘরে গেলো।

জয় ব্যাগ নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো।

ইরা রান্না ঘর থেকে জোরে ডেকে বললো, তাড়াতাড়ি ফ্রেস হও আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।

 

নাস্তা করতে করতে ইরা জিজ্ঞেস করলো, আজ তো শনিবার  কোনো কাজ নেই, তাই না?

আছে। ইঞ্জিনিয়ারদের কোনো বন্ধ খোলা নেই। এটা শিক্ষকদের বেলায় আছে।

ইরা কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, যত কাজই থাকুক, নাস্তা খেয়ে একটু রেস্ট নাও তারপর কোথায় বের হবা হও।

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, যথা আজ্ঞা মহারাণী।

ইরাও হেসে উঠলো, পারো বটে।

জয় নাস্তা শেষ করে, হাত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হাতে একটা বই। এটা জয়ের অভ্যাস কখনো বিছানায় শুয়ে পড়লে হাতে একটা বই থাকবেই। ইরা উচ্ছ্বিষ্ঠ থালাবাসন রান্নাঘরে রেখে এসে জয়ের মাথার কাছে বসে তার চুলে আঙ্গুলে বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, এখন বইটা রাখুন মহারাজ। সবসময় শুধু কাজ আর কাজ।

বই পড়া শুধু কাজ না ইরা, বিনোদনও। বই মানুষের মনের খোরাক জোগায়। আসলে জীবনে কখনো জ্ঞানী-গুণী মানুষের সান্নিধ্য পাওনি তো তাই কিছু জানোও না।

ইরা হা হা হা করে হেসে উঠে বললো, তা ঠিক বলেছো।

হঠাৎ করেই ইরা প্রসঙ্গ পাল্টালো, আজ এতো সকালে এলে যে, আমি ভেবেছিলাম তুমি আরও দেরিতে আসবে। বিকেলে আসবে অথবা সকালবেলা অন্তত: নাস্তা খেয়ে তারপর রওয়ানা দিবে সেজন্য আমি একটু আয়েশ করে ঘুমাচ্ছিলাম। কেনো চলে এলে গো এতো তাড়াতাড়ি?

তাড়াতাড়ি এলেও দোষ!

না দোষ না। বলো না প্লিজ!

তোমার জন্য এসেছি ইরা। তোমাকে ছেড়ে ওখানে থাকতে ভালো লাগছিলো না। সবসময় মনে হচ্ছিলো কখন তোমার কাছে আসবো।

তবে কাল যে গেলে। তখন কি মনে হচ্ছিলো না যে কখন সামিনার কাছে যাবে?

না।

তো।

এখানেই তোমার বুঝতে সমস্যা আছে ইরা। আমি ওখানে গিয়েছিলাম দায়িত্ববোধের কারণে তাই ওখানে যাওয়ার পিছনে কোনো আবেগ-অনুভূতি ছিলো না। আর তোমার কাছে এসেছি হৃদয়ের টানে, ভালোবাসার টানে। একটা কথা মনে রাখবে ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ এক না।

বাহ্‌ এই না হলে আমার কথাসাহিত্যিক। বলে ইরা জয়ের কপালে একটা চুমু দিলো।

জয় ইরার চোখের দিকে তাকালো। ইরা চোখ দু’টো যেনো আনন্দাশ্রুতে চিকচিক করছে। সে ইরার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো। আমার দায়িত্ববোধকে তুমি কখনো ভালোবাসার শেয়ারিং মনে করো না ইরা। সামিনার সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলে আর তোমার যদি মতির সঙ্গে হৃদয়ের টান থাকতো তবে আমরা দু’জন ঘর ছেড়ে আসতাম না।

ঠিক বলেছো। তুমি একদিন সত্যিই অনেক বড় লেখক হবে।

জয় কয়েকমুহূর্ত ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, দেখো তো ক’টা বাজে?

ইরা মৃদু রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, আবার সময় দেখছো কেনো? কোথাও যাবে নাকি?

জয় আমতা আমতা করে বললো, একবার যেতে হবে সাইটে।

সেজন্য বুঝি এসেই আমাকে আবেগপ্রবণ কথাগুলো বললে। এখন আমাকে ম্যানেজ করে ফেলেছো তাই সাইটে যাবে।

না ইরা কখনোই না। কত কাজ চলছে আমি না গেলে কোনো একটা ভুলও তো হয়ে যেতে পারে।

সবকিছুই তোমার দায়িত্ববোধ আর আমাকে সময় দেয়া বুঝি তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

অবশ্যই পড়ে। আমি তো শুধু তোমারই ইরা। সবসময় তো তোমারই আছি।

তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি, এখন বলবো নাকি রাতে?

এখনই বলো। বলবো বলে আবার রাতে কেনো?

গতকাল মাস্টার ফোন করেছিলো। তুমি যখন ফোন ওয়েটিং পেয়েছিলে। তুমি তো একবারও জানতে চাইলে না কে ফোন করেছিলো।

তা জানতে চাইবো কেনো? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস হারানোর মতো কোনো কাজ করবে না। বলো, কী বললো?

তুমি তো জানো বাড়ির অর্ধেক অংশ আমার নামে আর অর্ধেক অংশ শুভ’র নামে আছে।

হ্যাঁ।

ও বাড়িটা শুভ’র নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে বলে।

তুমি নিশ্চয়ই দিতে চেয়েছো।

হুঁম।

আমি জানি তো। তুমি দিতে চাইবে।

কেনো? দিলে সমস্যা কী? আমি তো আর ঐ বাড়িতে যাবো না।

দিতে চেয়েছো অবশ্যই দিবে কিন’ একটা কথা মনে রেখো। মতি এখন পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে লাগেনি এই বাড়িটার জন্যই, তুমি বাড়িটা রেজিস্ট্রি করে দেয়ার পর ও প্রকাশ্যে তোমার বিরুদ্ধে নামবে।

ও প্রমিজ করেছে কোনোদিন আমার ক্ষতি হোক এমন কাজ করবে না।

না করলেই ভালো।

ইরা চোয়াল দু’টো শক্ত করে বললো, ক্ষতি করলে করবে। আমি দিতে চেয়েছি দিবো।

জয় ইরাকে সহজ করার জন্য বললো, তুমি তো জানো ইরা তোমার টাকা-পয়সার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। দিতে চেয়েছো দিবা কিন’ আমি তোমাকে বলে রাখলাম এটা লিখে নেয়ার সাথে সাথে সে চোখ উল্টাবে।

আর একটা কথা বলেছে।

কী কথা?

বলেছে তুমি নাকি লোভী, তুমি নাকি চাকরির লোভে আমাকে বিয়ে করেছো। আমার চাকরিটা না থাকলে তুমি নাকি আমাকে রাখবে না।

ছিঃ ইরা।

তুমি বিশ্বাস করো আমি ওকে খুব বকাবকি করেছি। বলেছি জয় এখন আমার হ্যাজবেন্ড। ওর সম্পর্কে তুমি আর একটাও খারাপ কথা বলবে না, বলেই ইরা একটা ঢোক গিলে বললো, তুমি আমার ওপর রাগ করেছো?

না।

ও বলেছে। রেজিস্ট্রি অফিসে কাগজ-পত্র ঠিক করে আমাকে ফোন দিবে তখন আমি গিয়ে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসবো।

দিও ইরা।

ইরার মুখে যেনো একটা আলোর রশ্মি ঝলকে উঠলো, আমি জানি জয় তুমি আমাকে না করবে না। এই না হলে তুমি আমার যোগ্য স্বামী। মতি হলে কখনোই দিতে বলতো না।

বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ ইরা।

 

উনষাট

 

জমির কাগজপত্র ঠিক করে রেজিস্ট্রি করার ঠিক আগের দিন মতি ইরাকে ফোন করলো। ফোনে শুধু দু’য়েক কথা, ইরা কাল চলে এসো কাগজপত্র সব রেডি।

ইর বললো, ক’টায় যাবো?

এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে এসো।

ওকে।

তোমার সাহেব কোথায়?

আমার পাশেই আছে। কথা বলবে?

না।

সত্যি সত্যি জয় তখন ইরার পাশেই ছিলো। ইরা মতির সঙ্গে কথা বলছে দেখেও কিছু বললো না। ইরা মতির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে জয়কে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কিছু বললে না যে?

কী বলবো আমি?

আমি মতির সঙ্গে কথা বলছি দেখেও তোমার মধ্যে কোনো রিএ্যাকশন নেই। তোমার স্ত্রী তার সাবেক স্বামীর সঙ্গে কথা বলছে তোমার একটুও হিংসা করে না।

না। কারণ আমি জানি তুমি এখন আমার স্ত্রী এবং আমাকে তুমি ভালোবাসো। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের রিলেশন বা ভালোবাসার কোনো অমর্যাদা করবে না কিন’ কোনোদিন যদি জানি তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছো বা তার সঙ্গে তোমার কোনো গোপন যোগাযোগ আছে তবে সেদিন আমি খুব কষ্ট পাবো।

কথাগুলো জয় খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো কিন’ এই স্বাভাবিক কথাগুলোও যেনো ইরার হৃদপিণ্ডে আঘাত করলো। তার বুক কেঁপে উঠলো। ইরা কিছু বলতে গিয়ে একটা ঢোক গিললো, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। সেদিন রাতে মতি ফোন করে জমি রেজিস্ট্রি করার কথা বলেছে। সেসময় তুমি ফোন করে আমার ফোন ওয়েটিং পেয়েছিলে সেজন্য আজ একথা বললে তাই না?

না ইরা আমি সেদিনের কথা মনে করিনি।

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো, আগামীকাল তুমিও চলো।

না। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

আচ্ছা।

 

পরদিন ইরা পৌঁছালো ঠিক সময়মতো। মতি রেজিস্ট্রি অফিসের গেটে দাঁড়িয়েছিলো। এই ক’দিনে মতির চেহারাটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এলোমেলো চুল, চোখ দু’টো যেনো কোটরে বসে গেছে। ইরা একবার মতির মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামালো। মতি মাথা নিচু করে আছে। সেভাবেই সামনে হাত দেখিয়ে বললো, চলো, সাব রেজিস্টার ওদিকে বসে। বলে ইরাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো।

মতির সঙ্গে তার এক মামাতো ভাই ছিলো। সে ইরাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ভাবী শেষ পর্যন্ত…

মতি বাধা দিয়ে বললো, থাক কিছু বলিস না।

ইরা না শোনার ভান করে মতির দেখিয়ে দেয়া পথে সাব রেজিস্টারের রুমে ঢুকলো।

সাব বেজিস্টারের রুমে অনেক ভিড়। রেজিস্ট্রি করতে কিছুটা সময় লাগলো।

রেজিস্ট্রি করার সময় সাব রেজিস্টার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি শুভ’কে জমি দান করছেন?

জি।

শুভ আপনার কে হয়?

ছেলে।

পরে ছেলে যদি আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়?

ইরা চোখের সামনে বাড়ির ছবিটা ভেসে উঠলো। কত যত্ন করে ইরা বাডির কাজ করেছে। প্রতিদিন সকালবেলা বিল্ডিংয়ে পানি দিয়েছে। বেতনের সব টাকা এই বিল্ডিংয়ে ঢেলেছে। আজ জয়ের ভালোবাসার কারণে সে স্বেচ্ছায় বাড়িটা শুভকে দান করছে। আসলে দান নয় মতির কৌশলের কাছে সে বাড়িটা শুভকে রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। তার ভালোবাসা জয়, জয় থাকলে তার আর জীবনে কোনোকিছুর দরকার নেই।

ইরা সাব রেজিস্টারের কথায় কিছু বলতে গিয়ে একটা ঢোক গিললো, যদি দেয় তো দিবে।

আচ্ছা বলে সাব রেজিস্টার সই করে দিলেন, ওকে। আপনি আসুন।

রেজিস্ট্রি শেষ করে ইরা বেরিয়ে আসছিলো। মতি জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবে এখন?

ইরা বললো, জয়পুরহাট।

ভাত খেয়ে যাও।

না। বাসায় গিয়ে খাবো।

একদিন বাইরে খেলে কিছু হবে না, বলেই মতি থমকে গেলো। তার বুক ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে এলো, ইরা এখন আর তার কেউ না। তাকে এভাবে বলা বুঝি ঠিক হলো না।

ইরা আমতা আমতা করে বললো, না আমি না যাওয়া পর্যন্ত ও খাবে না।

বাহ্‌ ভালোই মিল তো তাহলে তোমাদের মধ্যে।

ইরা মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।

মতি তার মামাতো ভাইকে বললো, যা তো তোর…বলে মতি আবার যেনো থমকে গেলো হয়তো ভেবেছিলো ভাবী বলবে কিন’ বললো না। সে বললো, যা তো বাসে উঠিয়ে দিয়ে আয়।

লাগবে না। শুধু শুধু অসি’র হচ্ছো কেনো? বলে ইরা দ্রুত পাঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো।

মতি পিছন থেকে ইরার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এমনসময় ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

জয় ফোন করেছে, হ্যালো।

হ্যালো ইরা।

হঁম, কী করছো?

কিছু না এই তো বাসায় বসে আছি।

তোমার কী খবর? আসছো?

হ্যাঁ। রেজিস্ট্রি শেষ হলো। এখন বাসে উঠবো।

আমি কি মোটর সাইকেল নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যাবো।

আসবে?

আসি।

ওকে। এসো তাহলে। আমি বটতলী গিয়ে তোমাকে ফোন দিবো তখন এসো।

ওকে।

 

ষাট

 

জয় অফিস থেকে ফিরলো হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগে কাজি পেয়ারা নিয়ে। ইরা দেখেই খুব খুশি হলো, ওয়াও আমি ভাবছিলাম আর তুমি নিয়ে এলে! আজ দুপুরে তুমি যখন আমাকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে এলে তখন রেলগেটে কাজি পেয়ারা দেখে আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছিলো। দেখো আমার ইচ্ছা করছিলো আর তুমি নিয়ে এলে। তুমি কী গো! সবকিছু আমি বলার আগেই বুঝে ফেলো।

এটাই বলে হৃদয়ের সম্পর্ক ইরা।

আরেকটা কাজ করবে, না, না সরি তুমি বাথরুমে যাও হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাও আমি নিয়ে আসছি।

কী? তুমি কী নিয়ে আসবে?

তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। বলে ইরা তোয়ালেটা জয়ের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে বললো, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে বের হওয়ার আগেই আমি ফিরে আসবো।

যাচ্ছো কোথায়?

পাশের দোকানে।

আমি এনে দিই?

না, আমি নিয়ে আসবো। তুমি যাও বাথরুমে আমি আসছি বলে ইরা জয়কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জয়ের কথা বলার অপেক্ষা না করে বাইরে চলে গেলো।

জয় বাথরুম থেকে বের হয়ে আসতে না আসতেই ইরা বাসায় ঢুকলো, হাতে একটা বোতল।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী এটা?

ইরা নামটা হাত দিয়ে ঢেকে ধরে বললো, দেখে বলোতো এটা কী?

জয় দেখলো কিন’ বলতে পারলো না।

ইরা বললো, কাসুন্দি। কাসুন্দি দিয়ে মেখে কাজি পেয়ারা খেতে খুব ভালো। তুমি বসো আমি পেয়ারা কেটে কাসুন্দি দিয়ে মেখে দিচ্ছি। খেয়ে দেখো তোমার খুব ভালো লাগবে। তার আগে বলে রান্নাঘর থেকে চিড়াভাজা নিয়ে এলো। ততক্ষণে এগুলো খাও।

তুমি খাবে না?

আমি ততক্ষণে পেয়ারা কেটে কাসুন্দি দিয়ে মেখে দিই।

জয় খাটের ওপর বসলো। ইরা মেঝেতে বসে পেয়ারা কেটে কাসুন্দি মেখে দিতে লাগলো। জয় প্রথমে চিড়াভাজা হাতে নিয়ে ইরার মুখে তুলে ধরে বললো, হা করো, হা করো।

ইরা বললো, আগে তুমি খাও।

কথা বলো না, হা করতে বলেছি আগে হা করো।

ইরা হা করলো, জয় ইরার মুখে চিড়াভাজা দিলো। আবেগে ইরার দু’চোখ ভিজে গেলো। সে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো।

না, আমি আর তোমাকে ভালোবাসি নাকি। শুধু তুমি আমাকে ভালোবাসো আর আমি তোমার সঙ্গে ফাজলামি করি।

দু’জনে চিড়াভাজা খেতে খেতে অনেক গল্প করলো। তারপর ইরা কাসুন্দি মাখা পেয়ারার প্লেট নিয়ে জয়ের কাছে খাটের ওপর বসলো।

ইরাও জয়ের মুখে কাসুন্দি মাখা পেয়ারা তুলে দিলো।

খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন জয় বললো, শোনো তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।

শুধু আমার জন্য! ইরা কিছুটা অবাক হলো।

মনে হয়।

বলো, তাড়াতাড়ি বলো আর কত দুঃসংবাদ আছে বলো।

আগামী পরশু রাজশাহীতে আমাদের একটা অফিসিয়াল মিটিং আছে।

ইরা যেনো অগ্নিষ্ফুর্লিংয়ের মতো জ্বলে উঠলো, কী বললে?

আমার কিছু করার নেই ইরা। আমি তোমাকে শুধু খবরটা দিলাম।

সেজন্য বুঝি তুমি আমাকে মুখে তুলে খাওয়ালে?

ছিঃ এসব কী বলছো ইরা? আমি কি তোমাকে শুধু এখন মুখে তুলে খাওয়ালাম। আগের সব কথা ভুলে গেলে।

ইরা জোরে চিৎকার করে বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাইয়েছো কিন’ যেদিনই তুমি খাইয়েছো সেদিনই তোমার কোনো না কোনো মতলব ছিলো। মিটিংটা রাজশাহী পড়তে হবে, দুনিয়াতে আর জায়গা নেই?

তুমি রাগ করছো কেনো ইরা? রাজশাহী মিটিং হলে সমস্যা কী?

ইরা আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলো, কেনো তুমি জানো না? তোমার আর কী তোমার তো ভালোই হলো। রথ দেখাও হবে আর কলা বেচাও হবে।

মানে?

মানে মানে করছো কেনো? মনে হয় কিছুই বুঝতে পারছো না? নিশ্চয়ই ঐ ছুঁড়িকে বলেছো যে তুমি রাজশাহী যাচ্ছো?

না, এখনো কাউকে বলিনি। তবে বলতে হবে এবং তোমার সামনেই।

আমার সামনে, দেখি তো তোমার কত বড় সাহস। আমার সামনে তুমি ঐ ছুঁড়ির সঙ্গে কথা বলোতো দেখি…

ছিঃ বার বার করে ছুঁড়ি ছুঁড়ি বলছো কেনো? ওর নাম আরশী, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, আরশী। দাও ফোনটা দাও তো একবার কথা বলি।

জয়ের মোবাইল ফোনটা চার্জে দেয়া ছিলো। ইরা ফোনটা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, লাউড স্পিকার দিয়ে কথা বলো। দেখি আজ তোমার কতবড় সাহস, আর তুমি কী বলো।

জয় মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করলো।

অপর পাশ থেকে রিসিভ করলো, হ্যালো।

জয় বললো, হ্যালো দেওয়ান সাহেব, কেমন আছেন?

আছি ভালো আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

এই তো আছি ভালো।

দেওয়ান সাহেব জিজ্ঞেস করলো, আপনি মিটিংয়ে আসছেন তো?

হ্যাঁ আসছি। আপনাকে আরও একটা কাজে ফোন করেছি।

জি বলুন? দেওয়ান সাহেব জিজ্ঞেস করলো।

আমি আপনার ভাবীসহ আসছি, আপনি একটা ভালো হোটেলে একটা রুমের ব্যবস’া করবেন।

অবশ্যই, অবশ্যই, নতুন ভাবী নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

আসুন, আমি হোটেলে সিট বুকিং দিয়ে রাখবো।

থ্যাঙ্ক ইউ দেওয়ান সাহেব।

দেওয়ান সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, জয়! তুমি পারো বটে। এতক্ষণ আমার সাথে মজা করলে না?

জয় হা হা করে হেসে উঠলো।

একষট্টি

 

জয়ের সাথে ইরার বাড়ির বাইরে প্রথম দেখা হয়েছিলো সাথী নার্সারিতে, সেদিন ছিলো শুক্রবার। সেদিন নার্সারিতে ইরা অনেকগুলো ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলো হ্যাপি ফ্রাইডে লিখে। সেদিন বি.এড কলেজে ইরা প্রথম এসেছিলো তারপর থেকে ইরা প্রায় বি.এড কলেজে আসতো, তার ক্লাস হতো প্রতি শুক্রবার। সেই সুবাদে প্রতি প্রতি শুক্রবার জয়পুরহাট আসতো আর ক্লাসের পর অথবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আর জয় কাজের কথা বলে দিনাজপুর না গিয়ে ইরাসহ ঘুরে বেড়াতো কোনোদিন পাথরঘাটা, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার আর কোনোদিন দু’জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে সময় কাটাতো বারো শিবালয় মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট যমুনা নদীর তার পাশে শতবর্ষী বটগাছের নিচে। জায়গাটা ইরার খুব পছন্দ হয়েছিলো। একসময় দু’জনে হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো। সেই স্বপ্ন সত্যিই হলো কিন’ সেই হ্যাপি ফ্রাইডে যেনো রূপ নিলো বিষাদে।

বিয়ের পর সামিনা ধরে বসলো, কোনো কথা নেই শুক্রবার হলেই বাড়ি আসতে হবে নইলে সে কিছু মেনে নিবে না। শুধু সেই-ই না বুধবার আসতেই মানিক-রতন ফোন করে খোঁজখবর নিতো বৃহস্পতিবার কখন রওয়ানা দিচ্ছে। আর একথা শুনে ইরার বুক কেঁপে উঠতো, হৃদয় ভেঙ্গে যেতো।

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার ইরা রান্নাঘরে রান্না করছিলো জয় বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়েছিলো। সামিনা ফোন করলো। জয় প্রথম বার রিসিভ করলো না কিন’ সামিনা বার বার ফোন দিতে থাকলো। অবশেষে জয় ফোন রিসিভ করে চাপাস্বরে বললো, হ্যালো।

সামিনার বরাবরের মতোই ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, তুমি আজ এলে না?

না।

কাল সকালেও আসবে না?

বলছি তো না।

তুমি যদি কাল পরশুর মধ্যে না আসো তবে রবিবার আমি তোমার অফিসে গিয়ে হাজির হবো। সবাইকে তোমার কুকর্মের কথা জানাবো।

কী বলবে তুমি?

আগে না এসে দেখো আমি কী করতে…

সামিনার কথা শেষ হওয়ার আগে রতন বলা শুরু করলো, এই এই তুই যদি কাল না আসিস তবে তোকে আমি খুন করবো, শুধু তোকে না, তোর ঐ বেয়াদব মহিলাকেও, বুঝেছিস, ভালো চাস্‌ তো কাল সকালে উঠে রওয়ানা দিবি, বুঝ্‌লি।

এমনসময় ইরা দরজায় এসে দেখলো জয় কথা বলছে। ইরা একরকম দৌড়ে এসে জয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিতে চাইলো কিন’ জয় ছাড়লো না, শুরু হলো মোবাইল ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি, ধস্তাধস্তি। জয় খালি গায়ে ছিলো ইরার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে তার কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে জয়ের বুক চিরে গিয়ে রক্ত বের হলো কিন’ ইরা আবেগে এতোটাই অন্ধ ছিলো যে তার চোখেই পড়লো না। অবশেষে জয় মোবাইল ফোন ছেড়ে দিলো। ইরা মেঝেতে কয়েকবার আছাড় মেরে মোবাইল ফোনটা ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো।

জয় আলনায় ঝুলানো তোয়ালে দিয়ে রক্ত মুছতে গিয়ে ইরার চোখে পড়লো জয়ের বুক থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত। ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, তোমাকে আমি মারলাম, আমি তোমাকে রক্তাক্ত করলাম। জয়! আমার জয়! আমাকে ক্ষমা করো জয়!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, তুমি তো ইচ্ছা করে করোনি ইরা। আমি কিছু মনে করিনি।

তবু তুমি কিছু মনে করোনি কেনো? তোমার মনটা কী দিয়ে তৈরি, তোমার ধৈর্য এতো বেশি কেনো? তোমার মাথা এতো ঠাণ্ডা কেনো? অন্য কেউ হলে তো বউকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতো বলতে বলতে ইরা জয়ের বুক থেকে মাথা তুলে এন্টিসেপটিক ক্রিম এনে জয়ের ক্ষতের ওপর আলতো করে লাগিয়ে দিলো।

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, এতো দামি ফোনটা ভেঙ্গে ফেললে ইরা!

তারচেয়ে অনেক বড় জিনিস আমি ভেঙ্গে ফেলেছি জয়। ফোন ভেঙ্গে ফেলেছি সেটা না হয় কালই আমি কিনে দিবো কিন’ তোমার যে দামি মনটা আমি ভেঙ্গে ফেলেছি সেটা যে আমি আর কোনোদিন জোড়া দিতে পারবো না জয়।

বলছি তো আমি কিছু মনে করিনি ইরা। তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই তোমার ভালোবাসার শেয়ার কাউকে দিতে পারোনি বলে এমন করেছো।

তুমি এটাকেও পজিটিভ দেখছো! সত্যিই তুমি অসাধারণ জয়! অপূর্ব তোমার ভালোবাসা!

তুমিও অনেক ভালো ইরা।

ইরা একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, হ্যাঁ যে বউ স্বামীর বুক চিরে রক্তাক্ত করে সেও তো ভালো। তুমি তো সারাজীবন ভালোই দেখলে। খারাপটা দেখলে না।

ইরা কাউকে ঘৃণা করতে চাইলে তার দোষত্রুটিগুলো দেখতে হয় চোখ দিয়ে আর কাউকে ভালোবাসলে তার গুণগুলো দেখতে হয় হৃদয় দিয়ে। আমি তোমার গুণগুলো হৃদয় দিয়ে দেখছি ইরা। তুমি সত্যিই খুব সুন্দর, তোমার হৃদয়ে ভালোবাসার জ্যোতি দেখছি।

ইরা এবার হো হো করে হেসে উঠলো, এই না হলো আমার কথাসাহিত্যিক কিন’ কথাগুলো হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসছে তো জনাব।

একেবারে হৃদয়ের গভীর থেকে আমার বুকে একবার হাত দিয়ে দেখো।

ইরা জয়ের বুকে কান রেখে জয়ের হৃদয়ের ভাষা বোঝার চেষ্টা করলো, না, উপন্যাসের ডায়লগ না, সত্যি! সত্যি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো!

ওরা কি তোমাকে খুব খারাপ ভাষায় বকাবকি করেছে?

জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

তো? আমাকে বলো প্লিজ!

তোমার না শোনাই ভালো।

শোনো তুমি যখন ওদের সাথে কথা বলছিলে তখন দরজার আড়াল থেকে সব শুনেছি। তুমি কানের কাছে মোবাইল ধরে রেখে কথা বলছিলে আর তোমার মুখের রং বদলে যাচ্ছিলো। বলো না প্লিজ!

আমি দিনাজপুর না গেলে সামিনা চলে আসবে ইরা।

তবে যেও নাতো দেখা যাক কী করে।

আমিও তাই ভাবছি।

কাল শুক্রবার তুমি সকালবেলা বাজার করতে যাবে, জুম্মার নামায পড়তে যাবে, আমি নিজ হাতে তোমাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে দিবো, মাথায় টুপি পরিয়ে দিবো। কী অপূর্ব লাগবে তোমাকে। তুমি শুধু আমার জয়! শুধু আমার!

আর তুমি বুঝি আমার না!

ইরা মুচকি হাসি হেসে বললো, এটা কি বলতে হয়?

কাল বিকেলের সিডিউল মনে আছে তো!

থাকবে না, বলে দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলো।

 

একষট্টি

 

এই জয়পুরহাট রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে ইরা অনেকবার জয়কে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য বিদায় জানিয়েছে আর ভেবেছে যদি কোনোদিন তার সৌভাগ্য হয় তবে জয়ের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে কোথাও যাবে। ইরা অবশ্য ভাবতো দিনাজপুর যাওয়ার কথা, জয় বলেছে আর ক’দিন পর কোরবানী ঈদ। কোরবানী ঈদে জয় ইরাকে নিয়ে দিনাজপুর তাদের গ্রামের বাড়ি যাবে। বিয়ের পরদিন জয়ের ছোট ভাই এসেছিলো সেও বলেছে ঈদের সময় যেনো ইরাকে নিয়ে যায়। ইরার কাছে শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটা যেনো এখন স্বপ্ন হয়ে গেছে। কৈশোরে যখন মতি তাকে নিয়ে যায় তখন শ্বশুরবাড়ি কাকে বলে ইরা তা বুঝতে পারেনি আর যাবার পর হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে শ্বশুরবাড়ির সবাই যেনো তাকে কাজের বুয়ার মতো কাজ করিয়েছে এখন সেদিন নেই আর জয়ের ভাইবোনরাও ইরাকে খুব আপন করে নিয়েছে। ফোনে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের সবাই ইরাকে ভাবী ভাবী বলে অসি’র করে তুলেছে। সবাই যেনো ইরার জন্য ফুলের মালা গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা এসব কথা ভাবছিলো রেল স্টেশনের প্লাটফরমে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে, জয়ের কাঁধে মাথা রেখে।

ইরা জয়কে জিজ্ঞেস করলো, ট্রেন আর কতক্ষণ লেট জানো?

জয় কিছুক্ষণ মোবাইল ফোন টিপাটিপি করে বললো, ট্রেন এখন কেবল ফুলবাড়ী স্টেশনে ঢুকবে।

আর কতক্ষণ সময় লাগবে?

প্রায় একঘণ্টা।

তুমি জেনেশুনে বাসা থেকে এতো আগে এলে কেনো?

জয় ইরার মাথাটা তার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে মুখোমুখি করে একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, আমার কাঁধে মাথা রাখতে কি তোমার খারাপ লাগছে ইরা?

ইরা একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, মোটেই না। তোমার কাঁধে মাথা রাখতে আমি যেনো স্বর্গসুখ অনুভব করছি।

তাই!

তুমি অবিশ্বাস করছো?

মোটেই না।

ইরা উঠে দাঁড়িয়ে জয়ের একটা হাত টেনে ধরে বললো, চলোতো একবার মধুর ক্যান্টিনে যাই।

চলো।

 

জয়পুরহাট রেল স্টেশনের প্লাটফরম শেষ হতেই হাতের বাঁ দিক দিয়ে চলে গেছে জয়পুরহাট সান্তাহার রেলপথ আর হাতের ডানে বারোঘাটি পুকুর। এই পুকুরের উত্তর দিকে মাচা দিয়ে তৈরি একটা দোকান আছে। দোকানের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে অদূরে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে। কয়েকমাস আগের কথা ইরার তখন বি.এড পরীক্ষা চলছিলো। পরীক্ষা শুরুর আগের দিন ইরা জয়পুরহাট তার বাবার বাড়িতে এসে থাকতো। পরদিন পরীক্ষার সময় হবার আগেই সে এই দোকানে এসে বসতো ঠিক সময়মতো জয়ও আসতো। দু’জনে কিছুক্ষণ এই দোকানে বসে কথা বলতো। চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখতো। ইরা এই দোকানের নাম দিয়েছে মধুর ক্যান্টিন।

ইরা জয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনে এলো। যে বেঞ্চে বসে জয় আর ইরা চোখে চোখ রেখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো তারা ঠিক সেভাবে বসলো। হোটেলের বয় চিনতে পেরেছে সে একগাল হেসে বললো, আপা চা দিবো?

জয় বললো, শুধু চা না আগে বেগুনি দাও তারপর চা দিও।

আচ্ছা ভাইজান।

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, এই আমি তোর আপা হলে ও তোর ভাইজান হয় নাকি দুলাভাই।

বয় মাথা চুলকে বললো, ভুল হয়েছে, আপা সরি।

ওকে আর যেনো ভুল না হয়।

জি আপা।

মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে ইরা জয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে আবার প্লাটফরমের কাছে এলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে, আবছা আবছা অন্ধকার। প্লাটফরমটা রাস্তা থেকে খানিকটা উঁচু। জয় আগে প্লাটফরমে উঠলো। ইরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার হাতটা একটু ধরো।

জয় ইরার হাত ধরে তাকে একরম টেনে তুললো। ইরা জয়ের কানে ফিসফিস করে বললো, এভাবে আমাকে শক্তভাবে ধরে রেখো জয়, কোনোদিন যেনো ছেড়ো না।

জয় ইরার কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, অবশ্যই।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। যাত্রী নামা শেষ হতেই জয় ইরাকে ট্রেনে উঠতে বলতেই ইরা বললো, আগে তুমি ওঠো, আমার হাতটা ধরো, তারপর আমি উঠবো।

জয় আগে ট্রেনে উঠে ইরাকে হাত ধরে টেনে তুললো। ট্রেনে তেমন ভিড় ছিলো না। দু’জনে তাদের নির্ধারিত সিটে বসতেই ইরা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো, একসময় আমি ভাবতাম কবে তোমার সাথে ট্রেনে চড়ে দিনাজপুর যাবো। আজ হয়তো দিনাজপুর যাওয়া হলো না কিন’ রাজশাহী যাচ্ছি তোমার পাশে বসে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে আজ আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে, জয়, আমার জয়…বলতে বলতে ইরা আবেগে চোখ বুজলো।

জয় ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনে জয় অনেকবার রাজশাহী গেছে। ট্রেনে যেতে যেতে একঘেঁয়েমি লাগে, সময়গুলো যেনো কাটতেই চায় না। ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লেগে যায়। আজ তেমন মনে হলো না। ইরা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে একরকম ঘুমিয়ে পড়েছে আর মাথা গড়িয়ে পড়তে পড়তে জয়ের কোলে এসে পড়েছে। তাদের সিটের কাছে লাইটটাও জ্বলছে না। ইরার চোখে-মুখে আবছা আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জয় ইরার সেই আধোআলো ছায়াতে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। সেও মাঝে মাঝে ঘুমে টলে পড়ছে। হঠাৎ ট্রেন জোরে ব্রেক করার শব্দে এবং ধাক্কায় জয় জেগে উঠলো। ইরা তো ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো, জয়! কী হলো! ট্রেন এক্সিডেন্ট হলো নাকি?

জয় বললো, না।

কোথায় এলাম আমরা?

জয় জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখে বললো, আব্দুলপুর। তারপর ইরাকে বললো, ইরা তুমি একটু বসো আমি প্লাটফরম থেকে কিছু নাস্তা নিয়ে আসি।

জয় ইরার শার্ট টেনে ধরলো, না, তুমি যাবে না।

কিছু খাবে না? খিদে লাগেনি তোমার?

লাগুক তবু কিছু খাবো না, তখন ট্রেন ছেড়ে দিবে।

জয় ইরাকে বোঝানোর চেষ্ট করলো যে আব্দুলপুরে ট্রেন কিছুক্ষণ থামবে কিন’ ইরা মানলো না, না, তুমি যাবে না। তখন ট্রেন ছেড়ে দিবে, তুমি আলাদা আর আমি আলাদা হয়ে যাবো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না জয়। আমি কিচ্ছু খাবো না। তুমি এখানে আমার পাশে বসো। ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে নিজেই জানালার দিকে তাকিয়ে জোরে ডাক দিলো, এই যে ভাই দু’টা ডাব দেন তো।

ডাবওয়ালা দু’টো ডাব কেটে জানালা দিয়ে ইরার হাতে দিলো। ইরা জয়ের হাতে দিয়ে বললো, আপাতত: এটুকুই খাই, ঠিক আছে?

জয় মুখ ভার করে বললো, ঠিক আছে।

ইরা মৃদু অভিমানের সুরে বললো, এভাবে বলছো কেনো? আচ্ছা তুমি বলো তুমি যদি নাস্তা কিনতে যাও আর ট্রেনটা যদি ছেড়ে দেয় তবে কী হবে বলো? তুমি কি একবার ভেবেছো?

হ্যাঁ ভেবেছি বলেই তো বলছি ঠিক আছে।

আচ্ছা আর কতক্ষণ লাগবে রাজশাহী যেতে?

এই ধরো এক ঘণ্টা।

খিদে পেলেও এক ঘণ্টায় কিছু হবে না। রাগ করো না আমার কথা ভেবে একটু কষ্ট করো প্লিজ! আমি কোনোভাবে তোমাকে হারাতে চাই না।

জয় আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলো না। হেসে ফেললো, বললাম তো ঠিক আছে।

ইরা বললো, হ্যাঁ এবার ঠিক হয়েছে। ঠিক আছে বলো।

 

বাষট্টি

 

হোটেল ডালাস। রাজশাহী শহরের বিলাসবহুল হোটেল। বিশাল আকৃতির লবি। লবিতে দামি সোফাসেট, মেঝেতে বিদেশি মিরর পলিশ টাইলস, মাথার ওপর দামি সিলিংয়ের ফাঁক দিয়ে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। জয় আর ইরা রিসিপশনে ঢুকতেই বয় ইরার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে রিসিপশনে গেলো।

জয় ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো, দেওয়ান সাহেব সিট বুকিং দিয়েছিলেন?

জি স্যার, বলে ম্যানেজার রেজিস্টারে নাম ঠিকানা লিখতে শুরু করলো, স্যারের নাম?

জয় রহমান।

তারপর একে একে বয়স, পেশা ইত্যাদি লেখা শুরু করলো। লেখা শেষে জয়ের স্বাক্ষর নিয়ে ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার নাম?

জয় কিছু বলতে যাচ্ছিলো ইরা নিজে তার নাম বললো, ইরা রহমান।

ইরার লেখা শেষ হওয়ার পর ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের রিলেশন?

জয় কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, দেওয়ান সাহেব কিছু বলেননি?

কিন’ ইরা তর্কে গেলো না, সে খুব সহজভাবে বললো, হ্যাজবেন্ড-ওয়াইফ।

ম্যানেজার আর কথা বাড়ালো না।

 

ইরা প্রতিবছর পরীক্ষার খাতা নিতে শিক্ষা বোর্ডে এসেছে, কখনো এদিকে তাকিয়ে এই হোটেলটি দেখেছে বলে মনে হয়নি। এই তো গত পরীক্ষার খাতা নিতে ইরা রাজশাহী এসেছিলো সঙ্গে জয়ও এসেছিলো। খাতা নিতে আসার দিনটা ইরার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটতো আর জয় ততক্ষণ রাজশাহী শহরে ঘুরে বেড়াতো। তখন জয়ের সঙ্গে এক রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য, এতটুকু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ইরা কত চেষ্টা করতো! ইরা মনে মনে বলতো খাতা দিতে যদি দেরি হয়, যদি আজ যাওয়া না হয় তবে আমি আমার জয়ের সঙ্গে থাকতে পারবো কিন’ সেরকম সুযোগ কোনোদিন হয়নি। ইরা খাতা নিয়ে এরকম দৌড়ে আসতো, কোনোরকমে বিন্দু হোটেলে বসে চোখে-মুখে ভাত ছিটিয়ে দিয়েই ছুটতো বাসে উঠার জন্য। তখন জয়ের চোখে একবার চোখ রাখতে গিয়ে ইরার মনে হতো, ইস জয় যদি তার হতো! জয়ের বুকে মাথা রেখে যদি সে একটা তৃপ্তির এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারতো।

ইরা টয়লেট থেকে বেরিয়ে জয়ের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাক দিলো, জয়।

জয়ের কোনো সাড়া নেই।

ইরা আবার ডাক দিলো, এ-ই।

তবুও জয়ের কোনো সাড়া নেই।

এবার ইরা জয়ের বাহুতে মৃদু ঝাঁকুনি দিতেই জয় একরকম চমকে উঠলো, কী? কী হয়েছে?

ইরা হেসে উঠলো, তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি?

না, একটু ঘুমের ভাব এসেছিলো।

ইরা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো, ঘুমের ভাব নাকি অন্যকিছু?

কী অন্যকিছু।

তুমি তো কতকিছু ভাবতে পারো, তোমার তো আবার বন্ধু ভক্ত’র অভাব নেই।

জয় রাগান্বিতস্বরে বললো, ইরা!

ইরা হাত জোড় করে বললো, সরি, সরি জয়!

তারপর জয়ের মাথার কাছে বসে তার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আমরা যখন রাজশাহী খাতা নিতে আসতাম তখন আমার খুব ইচ্ছা হতো একসঙ্গে নিরিবিলি বসে একটু কথা বলার, তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করতো জয়! একসময় আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম তুমি যদি আমার হতে। আর আজ সত্যি সত্যি তুমি আমার! জয়! আমার জয় বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

জয় ইরাকে দু’হাতে বুকে টেনে নিলো।

এমনসময় ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইরা কিছুটা বিরক্তবোধ করলো, ইস্‌ একটুও শান্তি নেই।

ইরা ফোন হাতে নিয়েই দেখলো মতি ফোন করেছে। সে কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কে ফোন করেছে?

মতি।

রিসিভ করো।

ইরা রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, ফোন করেছো কেনো?

মতির কণ্ঠে অভিমানের সুর, জানি তুমি বিরক্ত হয়েছো কিন’ আমি তোমার ভালোর জন্যই ফোন করেছি।

আমি তো এখন তোমার বউ না, তুমি এখনো আমার ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবছো কেনো?

তাহলে রাখি, পরে তোমার কোনো ক্ষতি হলে কিন’ আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

আচ্ছা বলো।

মিহির সাংবাদিক ফোন করেছিলো, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

মিহির সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কেনো?

ওতো অনেককিছুই লিখতে চায় তোমাকে আমাকে নিয়ে, আমি অনেক রিকোয়েস্ট করে ম্যানেজ করেছি।

আমাকে এসব বলার মানে কী?

তোমাকে বলার কারণ হলো যদি ফোন করে তুমিও ওকে ম্যানেজ করও। বিষয়টা মিডিয়ায় চলে গেলে শুধু তোমার একার দুর্নাম হবে না, তোমার স্কুলের, পুরো শিক্ষক সমাজের এবং তোমার বর্তমান স্বামীরও দুর্নাম হবে। সেজন্য তোমাকে আগাম জানালাম। তুমি কী করবে সেটা তোমার বিষয়।

ওকে। ও কী করবে সেটা আমি দেখবো কিন’ কোনোকিছুতে ইনভলভ হবে না আশা করি, বলে ইরা মতিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

জয় ইরার মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তারপর জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ইরা?

নতুন ঝড় জয়, বলে ইরা জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইরা ভেবেছিলো নতুন ঝড়ের কথা শুনে জয় বুঝি আঁৎকে উঠবে কিন’ জয়ের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। সে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কী?

সেই সাংবাদিক।

মিহির?

হ্যাঁ, আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

তুমি কথা বলো না, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলো।

ইরা জয়ের কথার উত্তর না দিয়ে তার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, জয়! আমার জয়! তুমি এতো ঝড় সামাল দিয়ে আমাকে ধরে রাখতে পারবে তো?

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি সব পারবো ইরা। সব পারবো!

 

তেষট্টি

 

সামিনার রাগ ও জিদ জয়ের অজানা নয়। সারাজীবন সামিনা তার ইচ্ছামতো চলেছে। যদি কোনোদিন বলেছে যে আগামীকাল আমি এই কাজটা করবো তবে করেই ফেলেছে। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে জয়ের কোনো কথা সে রেখেছে এমনটি কখনো হয়নি। এটা ছিলো তার স্বাভাবিক আচরণ আর ইরাকে বিয়ে করার পর তো তার আচরণ আরও হাজারগুণ খারাপ হয়েছে। ইরাকে বিয়ে করার পর থেকে সে জয়কে কথায় কথায় দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগে মামলা করে তার চাকরি খাওয়ার, তাকে জেল খাটানোর হুমকি দিচ্ছে। সেই সামিনা যখন বলেছে শুক্রবার দিনাজপুর না গেলে সে জয়পুরহাট আসবে কাজেই সে তার ব্যতিক্রম করবে না। সত্যি সত্যি সে চলে আসবে।

সেদিন রাতে সামিনা ফোন করলো।

ইরা তখন রান্নাঘরে রান্না করছিলো। জয় ফোন রিসিভ করবে কী না ভাবছিলো এমনসময় মোবাইলের রিং শুনে ইরা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। জয় ফোন রিসিভ করছে না দেখে ইরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, রিসিভ করছো না কেনো? কে ফোন করেছে? ঐ মাগীটা নিশ্চয়ই?

জয় তবু ফোন রিসিভ করলো না। সামিনা আবার ফোন করলো। ইরা বললো, রিসিভ করছো না কেনো? নাকি বাসায় বসে ঐ মাগীর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। বাইরে গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে, আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করবে, বলে ইরা মুখ বিকৃত করে বললো, হ্যালো। রিসিভ করো বলছি, নইলে আমি বুঝবো তুমি সত্যি সত্যি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো বলে আমার সামনে রিসিভ করতে ভয় পাচ্ছো।

অগত্যা জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

সামিনা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, এই ফোন রিসিভ করছিস না কেনো? নাকি ঐ মাগীটা তোকে ফোন রিসিভ করতে দিচ্ছে না?

ইরা জয়ের পাশে বসে মোবাইল ফোনের কথা শুনতে লাগলো।

জয় গম্ভীর স্বরে বললো, কোনো? কী হয়েছে বলো?

কাল সকালের ট্রেনে আমি জয়পুরহাট আসছি।

কেনো?

কেনো জানিস না? তুই শুক্রবার বাসায় আসিসনি তাই যাবো। আমি গিয়ে তোর অফিসের সবাইকে এক করে ফেলবো, সবাই জানুক তুই একটা ভণ্ড, লুচ্চা।

জয় ধমকের সুরে বললো, সামিনা। নিজের হ্যাজবেন্ড সম্পর্কে মুখ সামলে কথা বলো। ভালো স্ত্রীরা কখনো স্বামীর মান-সম্মানের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করে না।

সেরকম স্বামী তুই হতে পারিসনি।

আমি সেরকম স্বামী হতে পরিনি তো ভালো স্বামী পেলে চলে যাও।

চলে যাবো! আমি চলে যাবো! আমাকে বিদায় করে দেখ আমি তোকে জেলের ভাত খাওয়াই কী না। আমাকে বিদায় করা এতো সোজা কাজ না। আমার সোজা কথা আমি তোর বউ, আমি তোর সাথে থাকবো, তুই এক বউকে নিয়ে জয়পুরহাট থাকবি আর আমি তোর বাসা পাহারা দিবো নাকি? আমিও জয়পুরহাট থাকবো। দুই রুমের বাসা নিয়েছিস তো আমি একটা রুমে থাকলে ক্ষতি কী?

সামিনা আমি সিরিয়াসলি বলছি তুমি যদি কাল জয়পুরহাট আসো তবে আমি তোমাকে ছাড়বো না।

কী করবি তুই? কী করবি?

আমি তোমাকে তালাক দিবো।

দিস, একবার দিয়ে দেখ। আমার পারমিশন না নিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিস, আমি ইচ্ছা করলে কোর্ট-কাচারি যেতে পারতাম কিন’ যাইনি। আমাকে যদি তালাক দিস তবে আমি তোকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো, আমিও চাই তুই আমাকে তালাক দে বলে সামিনা উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিলো।

জয় যখন সামিনার সঙ্গে কথা বলছিলো ইরা তখন মুখ বিকৃত করে জয়কে আরও উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিলো জয় ফোন রাখার পর ইরা প্রচণ্ড রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি মিনমিন করে কথা বলে ওকে আরও মাথায় উঠাচ্ছো। আর কেউ হলে মেরে হাড্ডি-হুড্ডি ভেঙ্গে দিতো। তুমি তো সাহিদা আর সফিকুলের ঘটনাটা জানো। সফিকুলের বউ একদিন সাহিদা সম্পর্কে টু শব্দ করেছিলো সেদিনই ওকে এমন মার মেরেছে যে ওর বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। আর তুমি সামিনার সঙ্গে কথা বলছো মধুর সুরে বলে ইরা মুখ বিকৃত করে বললো, হ্যালো।

ইরার মুখে হ্যালো কথা শুনে জয় হেসে ফেললো।

জয়ের হাসি দেখে ইরা আরও সহস্‌্রগুণ জ্বলে উঠলো, হাসবে না, হাসবে না। তুমি হাসলে আমার মাথায় আগুণ জ্বলে। শোনো তোমাকে একটা কথা বলি।

জয় ইরাকে সহজ করার জন্য বললো, একটা না ইরা অনেকগুলো কথা বলো। আমি বুঝতে পাচ্ছি তোমার মনের মধ্যে অনেক কথা জমা হয়েছে অন্তত: কিছু কথা বের করে ফেলে দাও।

ইরা বলতে শুরু করলো, কাল যদি তোমার ঐ বউ সত্যি সত্যি বাসায় আসে আর যদি কোনো সিন ক্রিয়েট করে তবে আমিও তোমাকে ছাড়বো না।

তুমি কী যে বলো ইরা। আমি ওকে বাসায় নিয়ে আসবো?

সেটাই, ওকে এই বাসা দেখাবে না।

জো হুকুম রাণী।

ইরা হেসে ফেললো, তুমি পারো বটে।

ইরা জয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বললো, তুমি শুয়ে থাকো আমি রান্না করছি।

ফোনটা নিয়ে যাচ্ছো কেনো?

ইরা ফোনটা দেখিয়ে বললো, এটা তোমার হাতে রাখা নিরাপদ না।

মানে?

মানে তুমি ম্যাসেজ দিতে পারো।

সামিনা তো ম্যাসেজ লিখতে পারে না।

আমার টেনশন কি শুধু সামিনাকে নিয়ে?

তো?

সামিনা, আরশী আরও কত কে আছে, তোমার ঠিক আছে। তুমি রেস্ট নাও আমি রান্না করছি বলে ইরা জয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।

 

চূষট্টি

 

পরদিন সকালবেলা সামিনা ফোন দিলো সকাল ন’টা বাজার কয়েকমিনিট আগে। নিত্যদিনের মতো ইরা তখন নাস্তা তৈরি করছিলো আর জয় অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো, শুধু ব্যতিক্রম ছিলো আগে মোবাইল ফোনটা জয়ের হাতে থাকতো আর আজ ইরার হাতে।

ইরা মোবাইল ফোনটা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেডরুমে এসে জয়ের হাতে দিলো, নাও, তোমার ফোন এসেছে।

জয় ফোন হাতে না নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে ফোন করেছে?

হাতে নিয়েই দেখো।

জয় ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সামিনা ফোন করেছে। তার বুকটা কেঁপে উঠলো, এই বুঝি সামিনা এলো জয়পুরহাট।

ইরা মুখ কিছুটা বিকৃত করে বললো, রিসিভ করো, সাত সকালে উঠে ফোন করেছে রিসিভ করো। আহারে বেচারা…

জয় ফোন রিসিভ করলো, তার আশঙ্কাই সত্যি হলো। ফোন রিসিভ করতেই তার কানে ভেসে এলো গাড়ির শব্দ। কী করবে এখন জয়, ইরা তার কানের কাছে কান ধরে রেখে জয়কে হ্যালো বলার জন্য ইশারা করছে।

হ্যালো, হ্যালো শুনতে পাচ্ছো না? কথা বলছো না কেনো?

অবশেষে জয় বললো, হ্যালো।

এই কোথায় তুমি?

বাসায়, তুমি?

বাসার ঠিকানা দাও।

বাসার ঠিকানা কেনো?

আমি দ্রুতযানে আসছি, ট্রেন এখন ফুলবাড়ি পার হলো।

তোমাকে না আসতে নিষেধ করেছিলাম, তবু আসছো?

সামিনা গলার স্বর কর্কশ হলো, হ্যাঁ আসছি, তুমি বাসার ঠিকানা দাও।

আমি তোমাকে বাসার ঠিকানা দিবো না।

তাহলে আমি তোমার অফিসে আসছি।

অফিসে কেনো?

তোমার সঙ্গে দেখা করবো, তুমি এখন বলো বাসায় আসবো নাকি অফিসে। আমি চাই না আমি অফিসে আসি আর হৈ চৈ হোক, তারচেয়ে তুমি বাসার ঠিকানা দাও না হয় স্টেশনে এসো আমাকে নিয়ে যেতে।

জয় কোনো কথা বললো না।

সামিনা তাড়া করলো, হ্যালো। চুপ করে আছো কেনো?

ইরা লাইন কেটে দেয়ার জন্য ইশারা করলো।

আমি তোমাকে পরে জানাচ্ছি, বলে জয় ফোন রেখে দিলো।

ইরা জয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, পরে জানাচ্ছি মানে কী? বাইরে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবে নাকি কোথাও ডেটিং করবে?

জয় ইরার কথার কী জবাব দিবে বুঝতে পারলো না। সে চুপ করে রইলো।

ইরা আবার চিৎকার করে বললো, বলো, চুপ করে আছো কেনো?

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, ইরা সবসময় এভাবে কথা বলো না। এখন কী করা যায় বলো।

আমি কিচ্ছু বুঝতে পাচ্ছিনা জয়, কিচ্ছু না। আমি শুধু জানি তুমি আমার, তুমি আমার বলে ইরা জয়ের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

জয় কয়েকমুহূর্ত চোখ বুজে বসে রইলো তারপর মৃদুকণ্ঠে বললো, আমি একটা কাজ করি ইরা।

ইরা যেমনভাবে ছিলো তেমনিভাবে বললো, কী কাজ?

আমি স্টেশনে গিয়ে ওকে ফিরতি ট্রেনে উঠিয়ে দিই।

না, তুমি ওর সাথে দেখা করতে যাবে না।

জয় তার কোল থেকে ইরার মাথা টেনে তুলে চোখ মুছে দিয়ে বললো, বোঝার চেষ্টা করো ইরা। আমি যদি স্টেশনে না যাই তবে ও সোজা বাসা কিংবা অফিসে চলে আসবে। তাতে করে কেলেঙ্কারি আরও বাড়বে, বাড়বে কী না বলো?

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের চোখে চোখ রেখে হাসি কান্নার এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললো, তুমি ওকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে বুকে তুলে নিবে না তো?

না ইরা।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, প্রমিজ?

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, প্রমিজ।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তোমার এই বুক, তোমার বুকের কাশফুল, তোমার হৃদয়, তোমার সব, সব আমার জয় তোমার শেয়ার আমি কাউকে দিতে পারবো না, প্লিজ তুমি ওকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে…

জয় ইরার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, প্রমিজ বলেছি তো ইরা। তারপর আর কোনো কথা…

ইরা জয়ের বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, চুলোয় রুটি ছিলো, পুড়ে গেলো বুঝি বলে রুম থেকে বের হতে গিয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বিছানা থেকে জয়ের মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে বললো, এটা তোমার কাছে রেখে যাওয়া নিরাপদ না।

জয় মৃদু হাসলো।

 

পঁয়ষট্টি

 

দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেন ঠিক সময়ে স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। জয় সামিনা’র জন্য প্লাটফরমের বাইরে অপেক্ষা করছিলো ফোনে সেকথা সামিনাকে জানিয়েও দিয়েছে। সামিনা ট্রেন থেকে নেমে গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো। সামিনার গায়ের রং এমনিতেই কালো তারওপর রাগে আর ক্ষোভে সেই কালো বর্ণ যেনো কয়লার রূপ ধারণ করেছে। চোখ-মুখ রুক্ষ্ম, জয়কে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কখন এসেছো?

এইতো কয়েকমিনিট আগে।

কথা বলতে বলতে জয় তার মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো।

সামিনা জিজ্ঞেস করলো, আমি কিছু খাইনি আগে কিছু খাবো।

ঠিক আছে। বলে জয় সামিনাকে নিয়ে রুচিতা হোটেলে গেলো।

হোটেল রুচিতা জয়ের অনেকদিনের পরিচিত কিন’ আজ রুচিতাতে ঢুকতে গিয়ে জয় কেমন যেনো ইতস্ততঃ করছিলো। সামিনা নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় বাসা ভাড়া নিয়েছো?

মাস্টারপাড়া।

তাহলে তো কাছেই বাসা ভাড়া নিয়েছো।

আমার আসার কথা ইরা জানে?

হুঁম।

তাহলে তো ভালোই হলো।

মানে? জয় সামিনার কথায় যেনো চমকে উঠলো।

মানে নাস্তা খেয়ে বাসায় চলো।

না। তোমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।

কেনো? তুমি আমার স্বামী, জয়পুরহাটে দু’রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছো আমি একটা রুমে থাকলে অসুবিধা কী।

সামিনার কথা শুনে জয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আগে নাস্তা খাও তারপর কথা বলি।

নাস্তা শেষ করে জয় সামিনাকে মোটর সাইকেলে নিয়ে হোটেল স্বাদ এর সামনে এসে দাঁড়ালো।

সামিনা জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেনো?

এখানে এসো আগে তোমার সাথে কথা বলি তারপর দেখি কী করা যায়।

সামিনা কোনো কথা বললো না, জয়ের পিছু পিছু হোটেলের রুমে গিয়ে ঢুকলো।

জয়ের অনেক আশঙ্কা ছিলো সামিনা বুঝি হোটেলে আসার আগে রাস্তায় কোনো ঝামেলা করবে, হয়তো রাস্তার ওপর হোটেলে আসা না আসা নিয়ে তর্ক করবে কিন’ সেরকম কিছু করলো না। জয় যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জয় দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা সোফায় ধপাস করে বসলো, এখন বলো কেনো এসেছো?

বলেছি তো তোমার সঙ্গে থাকবো বলে এসেছি। তুমি আমার স্বামী, আমি তোমার কাছে থাকবো। তুমি আরেকটা বিয়ে করেছো, দু’রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছো আরেকটা রুমে আমি থাকলে অসুবিধা কী।

জয় কিছুটা ধমকের সুরে বললো, সামিনা পাগলামী করবে না। এটা শহর আর আমি এখানে চাকরি করি, একই বাসায় তোমরা দুু’জন ঝগড়া-বিবাদ করবে এটা হয় না।

ঝগড়া-বিবাদ হবে কেনো, বলে সামিনা রাগে দাঁত কড়মড় করে বললো, ঐ মাগীটা তো তোমার সামনে থেকেই আমাকে ফোন করে বলেছে বলে সামিনা মুখ বিকৃত করে বললো, আপা আপনি বড়, আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই মিলেমিশে চলবো।

ইরা তো ঠিকই বলেছিলো কিন’ তোমার যা মুখ, আর যা আচরণ তাতে স্বামী হয়েও আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারলাম না আর ওতো তোমার প্রতিপক্ষ, ও তোমার সঙ্গে কীভাবে থাকবে।

আমার সঙ্গে কীভাবে থাকবে সেটা ও আগে চিন্তা করেনি, ঐ মাগীটা কী জানে না। তোমার বউ আছে, দু’টা ছেলে আছে জেনেও তোমাকে বিয়ে করেছে আর এখন থাকতে পারবে না কেনো? আমি তোমার সঙ্গে থাকবো, বাসায় এখনই ফোন করে বলো ঐ মাগীটাকে।

জয় এবার জোরে ধমক দিলো, সামিনা, ইরা আমার স্ত্রী ওকে মাগী মাগী বলবে না। একটা কথা মনে রেখো তুমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জয়পুরহাট এসেছো, বিকেলের ট্রেনে দিনাজপুর ফিরে যাও।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

জয় রিসিভ করলো না। ইরা আবার ফোন করলো এবার জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

তোমার ললনা এসেছো?

হ্যাঁ।

যাবে কখন?

বিকেলের ট্রেনে।

বিকেলের ট্রেন মানে?

তিনটার আগে তো আর ট্রেন নেই।

তারমানে তুমি দুপুরে বাসায় ভাত খাবে না?

খাবো একটু দেরিতে, তুমি খেয়ে নিও।

না, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি খাবো না। দেখি তুমি কী করো, বলে ইরা জয়কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

জয় যখন ইরার সঙ্গে কথা বলছিলো সামিনা তখন জয়ের কানের কাছে কান রেখে তার কথা শুনছিলো। জয় ফোন রেখে দিতেই সামিনা চিৎকার করে উঠলো, তুমি আমাকে বিকেলের ট্রেনে উঠিয়ে দিবে মানে?

জয় শান্ত কণ্ঠে বললো, সামিনা তোমাকে আমি বলেছি তুমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জয়পুরহাট এসেছো আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি এখন তুমি আমার কথামতো বিকেলের ট্রেনে চড়ে দিনাজপুর চলে যাবে। যদি না যাও তবে তোমার সঙ্গে আমি সব সম্পর্ক শেষ করবো, কথার প্রথম দিকে জয় শান্তস্বরে বলতে শুরু করলেও শেষ দিকে তার কণ্ঠস্বর ভারী হলো, আমি তোমাকে তালাক দিবো।

সামিনাকে তালাক দেয়ার কথা জয় অনেকবার বলেছে, এমনি নরম-শান্ত সুরে বলেছে, গম্ভীরস্বরে বলেছে আবার চিৎকার করেও বলেছে কিন’ সামিনা কোনোদিন গুরুত্ব দেয়নি। আজ শান্ত কণ্ঠের শেষদিকে সামান্য ভারী কণ্ঠে তালাক দেয়ার কথা শুনে সামিনার বুকটা যেনো কেঁপে উঠলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমাকে তালাক দিওনা প্লিজ! বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্য এসেছি। আগে তুমি কোনো বৃহস্পতিবার বাড়ি না গেলে আমি মনে করতাম তুমি কাজে ব্যস্ত আছো তাই বাড়ি আসছো না আর এখন আমি তাকিয়ে থাকি সেই বৃহস্পতিবারের অপেক্ষায় আর ভাবি তুমি কখন আসবে। যখন শুনলাম তুমি আসছো না তখন আর নিজেকে কোনো বুঝ দিতে পারলাম না। তাই আমি এসেছি, তুমি বলছো আমি বিকেলের ট্রেনে চলে যাবো। তুমি ছুটির দিনগুলোতে বাড়িতে এসো, আমার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝে কথা বলো তাহলে আমি কোনোদিন জয়পুরহাট আসবো না, তোমাকে কোনোদিন ডিস্টার্ব করবো না বলতে বলতে সামিনার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

 

ছেষট্টি

 

জয়ের সঙ্গে যখন সামিনার বিয়ে হয় তখন জয়ের আর্থিক অবস’া তেমন ভালো ছিলো না। চারপাশে মাটির দেয়ালের ওপর  ছনের চালাওয়ালা দু’টি ঘর আর মাটির দেয়াল দিয়ে বেড়া দেয়া সংকীর্ণ আঙিনা। ঘরের ছনের চালা কিছুটা ভালো থাকলেও দেয়ালের ওপর ছনের চালার জীর্র্ণ শীর্ণ অবস’া যেনো ঠিক তাদের মতোই দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ছিলো। দেয়ালের ছনের চালা কোনো কোনো অংশে না থাকায় মাটির দেয়াল বৃষ্টিতে কয়েক স’ানে ভেঙ্গে পড়েছিলো।

প্রথম শ্বশুরবাড়িতে এসে সামিনা বাবার বাড়ির ধন-দৌলতের কথা এমনভাবে প্রচার করেছিলো যে প্রতিবেশীদের অনেকেই এরকম একটা দরিদ্র পরিবারে তাকে বিয়ে দেয়া নিয়ে নানারকম কথা বলছিলো আর সামিনা তার প্রতুত্তরে বলতো আসলে বিয়ের আগে সে শুনেছে তার শ্বশুর গরীব মানুষ কিন’ এরকম চাল নেই চুলো নেই, বাড়ির দেয়ালটাও ঠিক নেই একদিক দিয়ে কুকুর ঢুকে তো আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায় জানলে হয়তো তাকে এখানে বিয়েই দিতো না।

কথাটা শুনে জয় আর তার বাবা-মা খুব কষ্ট পেয়েছিলো। শুধু তাই নয় সামিনা কথায় কথায় জয় এবং তার পরিবারের সবাইকে দরিদ্র বলে খোঁটা দিতো। তাই জয়ের পরিবারের সবার সঙ্গে সামিনার সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো। জয়ের বাবা-মা ভাইবোন সামিনাকে পছন্দ করতো না।

জয়ের দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে সামিনার সঙ্গে অসংখ্যবার ঝগড়া বিবাদ হয়েছে এবং এনিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিচার সালিসও হয়েছে। সামিনার বাবা-মা তাকে অনেকবার শাসনও করেছে কিন’ সামিনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার রাগ, জিদ, অহংকার বিন্দুমাত্রও কমেনি।

সামিনা সংসারের বড় বউ, সে হিসেবে তার ওপর জয়ের পরিবারের অনেক আশা ভরসাও ছিলো কিন’ সামিনা সে দায়িত্বও পালন করতে পারেনি। দাম্পত্য কলহের কারণে জয় যেমন সারাজীবন একটা সুন্দর মনের ভালো সঙ্গী খুঁজেছে তার পরিবারও তেমনি এই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সামাজিকভাবে বসবাসের জন্য ভালো মেয়ে খুঁজেছে। তাই জয় যখন ইরার সঙ্গে তার বিয়ের কথা তার গ্রামের বাড়িতে বললো তখন তাদের বাড়িতে যেনো একটা আনন্দের ধুম পড়ে গেলো।

জয় আর ইরা জয়পুরহাটের বাসা থেকে বের হলো বিকেলে। জয় মোটর সাইকেল চালাচ্ছে আর ইরা পিছনে বসে আছে। কয়েকমিনিটের মধ্যে পৌঁছালো তাদের সেই স্মৃতিময় বারো শিবালয় মন্দির। তারপর লম্বা পথ।

ইরা জয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো, আজ আমার জীবন পূর্ণ হয়েছে জয়। কতদিন ভেবেছি আমি তোমার বউ হয়ে তোমার বুকে মাথা রাখবো, তোমার মোটর সাইকেলের পিছনে বসে তোমার পিঠে মাথা রাখবো। বলে ইরা জয়ের পিঠে মাথা রেখে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে বললো, আহ্‌ কী নির্ভরতা! কী সুখ! কী শান্তি! আজ আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। একদিন আমি যা স্বপ্ন দেখতাম আজ তা-ই সত্যি হয়েছে। তোমার সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। ইরা নিবিড়ভাবে জয়কে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিস ফিস করে বললো, জয়! আমার জয়!

জয় মোটর সাইকেল চালাচ্ছে, ইরার কথাগুলো তার কানে আসছে, সে একবার পেছন ফিরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন’ পেছন থেকে একটা ট্রাক হর্ন দিলো একেবারে কাছে এসে। তারপর থেকে জয় সাবধানে মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো।

ইরা জয়ের কোনো কথা শুনতে না পেয়ে তার কানের কাছে জোরে চিৎকার দিয়ে বললো, এ-ই!

জয় মোটর সাইকেল জোরে ব্রেক কষলো। কয়েকমুহূর্তে স্বল্প দূরত্বের মধ্যে জোরে ধাক্কা খেয়ে মোটর সাইকেল থেমে গেলো।

জয় ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো ইরা?

কিছু হয়নি তো, তুমি এতো জোরে ব্রেক কষলে কেনো?

তুমি যে জোরে চিৎকার করলে।

আমি তো জোরে বললাম তুমি আমার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছো না বলে।

ও তাই বলো, আমি তো মনে করেছিলাম তোমার বুঝি বসে থাকতে কোনো সমস্যা হয়েছে।

ইরা জয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো। জয় ইরার চোখে চোখ রাখলো।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তুমি এতো বেরসিক কেনো জয়। মোটর সাইকেলে একসঙ্গে যাচ্ছি একটু কথা বলতে বলতে যাবো না। একেবারে রোবটের মতো তুমি মোটর সাইকেল চালাবে আর আমি পিছনে বসে থাকবো।

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, ওকে ইরা। এবার ওঠো, তবে একটা কথা মনে রাখবে মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে কথা বলতে নেই।

বাহ্‌ রে আমি বুঝি তোমার সামনে দেখছি না। আমি যখন ফাঁকা দেখছি তখন তো শুধু কথা বলছি। তোমার কাছাকাছি কোনো গাড়ি দেখলে তো আমি কোনো কথা বলছি না। ওকে আমিও আর কোনো কথা বলবো না। বাইক স্টার্ট করো।

জয় ইরার গালে টোকা মেরে বললো, রাগ করো না ইরা প্লিজ!

জয় আবার মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর হিলি স’ল বন্দরে পৌঁছে ইরা শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য জামা-কাপড় কিনলো। তারপর আবার দু’জনে চলতে শুরু করলো দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে।

 

মোটর সাইকেল একটা উঁচু ব্রিজের ওপর উঠতেই ইরা জিজ্ঞেস করলো, এটা কোন ব্রিজ?

মোহনপুর।

আর নদীর নাম?

আত্রাই।

ও এই নদী তো আমরা আরও পার হয়েছি। কোথায়, কোথায় যেনো বলে ইরা মনে করার চেষ্টা করলো। জয় বললো, মান্দা ফেরিঘাট।

একটু থামো তো।

জয় মোটর সাইকেল থামালো। নদীর উজানে একটা রাবার ড্যাম। রাবার ড্যামের উজানে নদীর পশ্চিম তীরে গ্রোয়েনের ওপর কয়েকটা কংক্রিটে বেঞ্চ, মাথার ওপর কংক্রিটের ছাতা।

ইরা কিছুটা আব্দারের সুরে বললো, একটু যাবে।

চলো।

বলে দু’জনে গ্রোয়েনের ওপর মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে একটা কংক্রিটের ছাতার নিচে কংক্রিটের বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসলো তারপর জয় ইরার একটা হাত ধরে বললো চলো নদীর তীরে কয়েকটা ছবি তুলি।

সুর্যের তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে। বিকেলে গড়িয়ে গোধূলি আগতপ্রায়। নদীর স্বচ্ছ পানিতে গোধূলির ছাপ যেনো এক অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করেছে। ইরা জয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, জায়গাটা খুব সুন্দর তাই না?

হ্যাঁ, বলে জয় একটা হাত বাড়িয়ে ইরাকে কাছে টেনে নিয়ে কয়েকটা ছবি তুললো। এমনসময় জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

সে রিসিভ করলো, হ্যালো মা।

কোথায় তোমরা এখন?

এই তো মা মোহনপুর ব্রিজ।

তাড়াতাড়ি এসো বাবা বেলা ডুবে যাচ্ছে তো।

আচ্ছা মা আসছি, বলে জয় মোবাইল ফোন রেখে মৃদু হেসে বললো, তোমার শ্বাশুড়ি, ব্যস্ত হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, তাইতো দেখলাম।

হঠাৎ করে ইরার মুখ একটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। সে জয়কে জিজ্ঞেস করলো, একটা কথা বলবে?

বলো।

সামিনা, তোমার মানিক-রতন ওরা কি জানে আমি তোমার সঙ্গে আসছি?

জয় মৃদু কণ্ঠে বললো, জানে।

কিছু বলেনি?

না।

ইরা জয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললো, জয় তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো না তো।

না ইরা।

ওরা কোনো ঝামেলা করবে না তো।

পারবে না।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, তুমি যেনো সবকিছুতে ঠিক থাকো জয়। আমি শুধু তোমার হাত ধরে তোমার ওপর ভরসা করে এসেছি। আমাকে যেনো ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দিও না।

 

সাতষট্টি

 

ইরা চলে যাওয়ার পর মতির ছোট বোন আফরোজা এসেছে কয়েকদিন আগে, মাঝে মাঝে মা আসছে আর বাবা তো লেগেই আছে কিন’ এত কোলাহলের পরও বাড়িটাতে যেনো একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। মতি বাইরে থেকে বাসায় এলে যখন দরজায় বেল টিপ দেয় তখন মনে হয় ইরা বুঝি এসেছে তাকে দরজা খুলে দিতে কিন’ দরজা খোলার পর ইরাকে না পেয়ে তার বুকটা ফেটে যেনো হু হু করে কান্না বেরিয়ে আসছে। এই ক’দিনে মতির চোখ দু’টো কোটরে বসে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো, মেজাজটা সবসময় রুক্ষ্ম। ইরা চলে যাওয়ার পর বাড়িতে প্রতিবেশী বা মতির বন্ধু-বান্ধবরা বাড়িতে খোঁজখবর নিতে এসে ইরাকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিতো কিন’ আজকাল আর কেউ সে পরামর্শ দেয় না।

গতকাল শুভ এসেছে। বাড়িতে এসে মন খারাপ করে বসে থাকছে। ছেলেটা বাইরে থেকে বাড়িতে এলে কল বেল টিপতো না, গেটে দাঁড়িয়ে মা, মা বলে ডাকতো। গতকাল বাড়িতে এসে বাবার গলা জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। খাওয়া, ঘুমানো কোনোকিছু ঠিকমতো করছে না, বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

শুভ আগে ভোরবেলা বিছানা থেকে উঠে নামায পড়তো অথচ আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেছে প্রায় ন’টা বাজে। চোখে-মুখে ক্লান্তি আর নিদ্রাহীনতার ছাপ। মতি আর তার বন্ধু মহসিন তখন ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছিলো।

মহসিন জিজ্ঞেস করলো, মতি এখন কী করবি ভেবেছিস?

মতি মিনমিন করে বললো, এখনো কিছু ভাবিনি।

ভাবতে তো হবে, এমন করে তো আর বাকি জীবন কাটাতে পার্‌বি না। ক’দিনে তোর শরীরের অবস’া কী হয়েছে দেখেছিস। এভাবে বেশি দিন থাকলে তুই অসুস’ হয়ে পড়বি, মারা যাবি।

তো কী করবো?

তুই একটা বিয়ে কর, এমনসময় শুভ ড্রয়িং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই মতি মহসিনকে থামার জন্য ইশারা করে বললো, আমি ভাবছি শুভকে বিয়ে দিবো।

শুভ তার বিয়ের কথা শুনে দরজায় থমকে দাঁড়ালো।

মহসিন শুভ বলে ডাক দিতেই সে ধীর পায়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো।

মতি বললো, বস শুভ।

শুভ একটা সোফায় বসলো। মহসিন জিজ্ঞেস করলো, তোমার বিয়ের কথাই হচ্ছিলো।

শুভ থতমত খেলো, আমার বিয়ে!

মহসিন বললো, হ্যাঁ, আজ না হয় তোমার ফুপু এসেছে, দাদা-দাদি এসেছে কিন’ এটা তো আর পারমানেন্ট না। বাড়িতে তো একটা মেয়ে মানুষ থাকা দরকার।

শুভ কোনোকিছু না বলে সোফা থেকে উঠে বেরিয়ে গেলো।

 

কয়েকবছর আগের কথা। ইরা যে স্কুলে চাকরি করে সেই স্কুলে একটা মেয়ে ভর্তি হলো ক্লাস সিক্সে। ফুটফুটে সুন্দর, পুতুলের মতো একটা মেয়ে। মেয়েটির নামও পুতুল। মেয়েটিকে দেখে ইরার খুব পছন্দ হলো। ইরা ক্লাসে পড়ার ফাঁকে পুতুলের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ইরা মনে মনে ভাবতো এই মেয়েটি যদি তার মেয়ে হতো আবার কখনো কখনো মনে হতে পুতুলের সঙ্গে যদি শুভ’র বিয়ে দিতে পারতো তবে পুতুলকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে পারতো।

পুতুলের বাবা সরকারি চাকুরে, স্কুলের কাছেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। দিনে দিনে পুতুলের বাবা-মা’র সঙ্গে ইরার কথাবার্তা এবং উভয়ের বাড়িতে যাতায়াত শুরু হলো। অবশেষে ইরা একদিন পুতুলের বাবাকে বলেই ফেললো, ভাই আপনাকে একটা কথা বলবো?

বলুন।

আপনার পুতুলকে আমার খুব পছন্দ। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি ওকে শুভ’র সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই।

মতি পাশের সোফায় বসে ছিলো। সে ইরার সাথে সাথে বললো, হ্যাঁ মেয়েটাকে আমারও খুব পছন্দ। এখন আপনাদের দিক থেকে…

ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললো, ঠিকই বলেছেন কিন’ ওতো কেবল ক্লাস সিক্সে পড়ছে আর আমি যতদূর জানি শুভ এবছর কেবল এস.এস.সি পাস করলো, ওদের তো এখনো বিয়ের…

ইরা কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললো, না, না আমি এখনই বলছি না। ওরা ওদের মতো লেখাপড়া করুক, লেখাপড়া শেষে আমরা অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিবো।

ভদ্রলোক তার স্ত্রীর দিকে তাকালো, তার স্ত্রীকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে দেখে বললো, তা হতে পারে।

 

সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন অনার্সের স্টুডেন্ট আর শুভ অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছে।

শুভ চলে যাওয়ার পর মহসিন মতিকে জিজ্ঞেস করলো, কী বলছো মতি?

শুভ তো কিছু বললো না।

শুভ কিছুটা রাগের সুরে বললো, শুভ কী বলবে, ও নিরবে চলে যাওয়ার মানে কী তুই বুঝিস্‌নি?

তাহলে কি বিহাই সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করবো?

হ্যাঁ। করতেই যখন হবে তখন আর দেরি করে লাভ কী। ঈদের ছুটিতেই করে ফেল্‌।

মতি বিহাই-বিহাইনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলো। দীর্ঘদিন থেকে পাকাপাকি কথা এমনকি শুভ এবং পুতুলের মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হলেও বিয়ের বেলায় পুতুলের বাবা কিছুটা আপত্তি তুললো, বিহাই সাহেব সবকিছু তো ঠিকই আছে কিন’ আপনাদের বাড়িতে এ অবস’ায়…

মতি আশ্বস’ করে বললো, সেজন্যই বিয়েটা আরও তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে বিহাই সাহেব।

সেজন্যই তো বিষয়টা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে বিহাই সাহেব। আমাকে একটু সময় দিন।

মতি বিনয়ের সুরে বললো, বিহাই সাহেব আমি ভেবেছিলাম ঈদের ছুটিতেই…

কালকের দিনটা সময় দিন বিহাই সাহেব। আসলে বিহাইনী এমন একটা কাজ করলো…আচ্ছা আমি একটু ভেবে দেখি, আমি আমাদের পক্ষের সবার সঙ্গে আলাপ করে জানাবো।

মতি বিহাই’র কথায় কিছুটা অবাক হলো, আজ থেকে কয়েকবছর আগের পাকাপোক্ত একটা সিদ্ধান্ত। উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াত, পুতুল নিজেও ইরাকে আম্মা আর আমাকে আব্বা বলে ডাকে, এলাকার সবাই জানে শুভ’র সঙ্গে পুতুলের বিয়ে হবে অথচ বিহাই সাহেব মেয়ের বিয়ে দিতে ইরার ঘটনাকেই অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। ইরা, তুমি শুধু আমার না, শুভ’সহ আমাদের পুরো পরিবারের মান-সম্মানকে ধুলিসাৎ করেছো। আমি এমন কি অপরাধ করেছিলাম।

 

আটষট্টি

 

চার ভাই চার বোনের মধ্যে জয় চতুর্থ এবং ভাইদের মধ্যে বড়। বাড়ির বড় বউ হিসেবে সামিনার প্রতিও সবার এরকম আগ্রহ ছিলো কিন’ তার প্রতি সবার আশা শেষ পর্যন্ত গুড়েবালি পড়েছে। বিয়ের পরদিন জয়ের ছোটভাই বাবু জয়পুরহাট গিয়েছিলো জয়পুরহাট থেকে ফিরে সে ইরা সম্পর্কে যে কথা বলেছে তাতে করে ইরার প্রতি সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জন্মেছে। জয়ের চার ভাই’র মধ্যে সবার ছোট দু’ভাই এই বাড়িতে থাকে, তাদের তিন মেয়ে রেখা, শিখা আর আঁখি এবং তাদের বউরাও ইরার আসার জন্য একরকম পথ চেয়ে আছে।

জয়ের মা মরিয়ম নামায পড়ার পর অনেকক্ষণ দোয়া পাঠ করে, আজও নামায পড়া শেষে দোয়া পাঠ করছিলো, জয়ের ছোট দু’ভাইর বউ মিতু ও মিনু রান্না করছিলো এমনসময় একটা মোটর সাইকেল বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। রেখা, শিখা, আঁখি জোরে চিৎকার করে বললো, বড় আম্মু এসেছে।

বাইরে মোটর সাইকেল আর কোলাহলের শব্দ শুনে জয়ের মরিয়ম দোয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।

জয় ইরাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ছোট ছোট ভাতিজীরা সালাম দিলো, বড় আম্মু আসসালামুয়ালায়কুম।

ইরা হেসে হেসে সালামের জবাব দিলো।

বাবুর বউ মিতু রান্না ছেড়ে সামনে এসে সালাম দিলো তারপর ইরাকে তার শ্বাশুড়ির ঘরে নিয়ে গেলো।

ইরা তার শ্বাশুড়ির পাঁ ছুঁয়ে সালাম করতে যাচ্ছিলো মরিয়ম তাকে বুকে টেনে নিলো, তোমার স’ান পাঁয়ে নয় মা, তোমার স’ান আমার বুকে। তুমি জানো না জয় আমার কত প্রিয়, আমার তিন মেয়ের পর এক ছেলে সেই জয় আর তুমি আমার সেই জয়ের বউ। ছেলেটা আমার খুব কষ্টে জীবনটা পার করছিলো মা। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছে তুমি ওকে সুখী করতে পারবে বলতে বলতে মরিয়ম আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলো, তার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো।

ইরার দু’চোখও পানিতে ছলছল করে উঠলো। তার কণ্ঠস্বরও আবেগে বুজে এলো, আমার জন্য দোয়া করবেন মা।

জয়ের বিয়ের খবরটা আগেই প্রতিবেশীদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো আজ যে জয় তার নতুন বউকে নিয়ে আসবে সে খবরও প্রতিবেশীদের অজানা ছিলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে দু’একজন করে পড়শি আসতে শুরু করলো। শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে মিতু ইরাকে তাদের ঘরে নিয়ে গেলো।

ইরা খাটের ওপর বসলো তার পাশে জয়। পাশাপাশি সোফায় কয়েকজন প্রতিবেশী বসেছে। তাদের চোখে অনেক কৌতূহল, অনেক প্রশ্ন। একেকজন একেকরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে তাদের প্রশ্নের মধ্যে কিছু আপত্তিকর ও বিব্রতকর প্রশ্নও আছে।

জয়ের এক ভাবী এলো, সঙ্গে তার দুই জমোজ মেয়ে ছোট ও বড়। তাদের আলাদা আলাদা নাম থাকলেও এই পাড়াগাঁয়ে ইঁচড়ে পাকা মেয়ে দু’টি ছোট ও বড় বলে পরিচিত।

জয় ইরাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিলো।

ভাবী ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, জয় আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমার যখন বিয়ে হয় তখন জয় ক্লাস নাইন কী টেনে পড়তো। আর তুমি জয়ের বউ তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি।

ইরা মৃদু হেসে বললো, বলুন ভাবী, আমাকে তুমি করেই বলুন।

শুনেছি তুমি নাকি ওখানে একটা স্কুলে চাকরি করো।

জি ভাবী।

ওখানে চাকরির কোনো সমস্যা হবে না তো।

ইরা জোর দিয়ে বললো, হলে হবে ভাবী, জীবনের চেয়ে তো চাকরিটা বড় না।

ঠিকই বলেছো। আচ্ছা ইরা শুনেছি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি কিছু মনে করবে না তো।

বলুন ভাবী।

তোমার তো আগে স্বামী-সন্তান আছে তাই না?

ইরা মাথা নেড়ে সায় জানালো।

এমন কী হলো যে তুমি সবকিছু ছেড়ে চলে এলে। আমি যতদূর জানি তুমি জয়ের সবকিছু জানো। মানে ওর বউ আছে, ছেলে আছে। তুমি যাই বলো ইরা তোমার একটা সংসার ভেঙ্গে চলে আসা ঠিক হয়নি।

ইরার মুখের ওপর একটা কালো মেঘ ঢেকে গেলো। সে কী বলবে ভেবে পেলো না। ভাবী আবার বলতে শুরু করলো, শুনেছি সামিনা মামলা করবে। ও যদি মামলা করে আর জয়ের চাকরিটা চলে যায় কিংবা চাকরি রক্ষার জন্য জয় যদি তোমাকে ছেড়ে যায় তবে তোমার কী হবে একবার ভেবেছো।

ইরার মাথাটা যেনো চক্কর দিয়ে উঠলো। জয় কয়েকমুহূর্ত ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর ইরার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, তেমন ঘটনা ঘটবে না ভাবী। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যে আমাদের আলাদা করতে পারে। আমি ইরার হাত শক্ত করে ধরেছি, মৃত্যুর আগে কোনোদিন ইরাকে আমি হাতছাড়া করবো না।

জয়ের মনোবল দেখে ইরার বুকটা ভরে গেলো। সে জয়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো, আমি জয়কে চিনি ভাবী, ও কখনো মচকে যাবে না। যদি ভেঙ্গে পড়ে তবে আমরা দু’জন একসাথে পড়বো।

ছোট আর বড় এতক্ষণ নীরবে শুনছিলো এবার ছোট যেনো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলো, আঙ্কেল আপনাদের প্রেম দেখে তো মনে হচ্ছে লাইলি মজনুর প্রেম। আপনারা অনেক বড়, আমাদের মুরুব্বী, আপনারা যদি এমন করেন তবে আমরা আপনাদের কাছে কী শিখবো।

বড় মুখ আংশিক বিকৃত করে বললো, তবু যদি দু’জনে অবিবাহিত হতেন তো হতো। আপনারা এই বয়সে পরকীয়া প্রেম করেছেন। ছিঃ আঙ্কেল, ছিঃ

জয় ধমকের সুরে বললো, ছোট, বড় তোমরা ছোট ছোটর মতোই থাকো। ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করো না।

ছোট বললো, উচিৎ কথায় গুরু বেজার।

জয় প্রচণ্ড রেগে গেলো। আরও জোরে ধমক দিলো, ছোট আর একটা কথাও বলবে না। তোমরা যাও এখান থেকে। ভাবী আপনার মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

সানোয়ারা সোফা থেকে উঠলো, ওরা তো ছোট ওদের কাণ্ডজ্ঞান দেখছো কেনো, একবার নিজের কাণ্ডজ্ঞানের কথা ভাবো। এই বয়সে অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে…ছিঃ

এবার ইরা কথা বললো, আপনাকে আর ছিঃ ছিঃ বলতে হবে না ভাবী। আপনি নিজেদের কথা ভাবুন। আমাদের নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আর একটা কথা বলি আপনাকে মেয়েদের আদব-কায়দা দিতে পারেননি, মুরুব্বীদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শেখাননি।

সানোয়ারা, ছোট, বড় গজগজ করে কথা বলতে বলতে চলে গেলো।

জয় ইরাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, তুমি কিছু মনে করো না ইরা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সামিনা ফোন করেছে, সে রিসিভ করলো, হ্যালো।

সামিনার বরাবরের মতো রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এই তুমি নাকি ঐ মাগীটাকে বজরাপুর নিয়ে এসেছো?

সামিনা মুখ সামলে কথা বলো। ও আমার স্ত্রী। হ্যাঁ ওকে আমি নিয়ে এসেছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে, তোমার কোনো সমস্যা।

সমস্যা তো হবেই। আমি তোমার বউ, কোরবানী ঈদে তুমি আমার কাছে না এসে একটা মাগীকে নিয়ে তোমার বাবার বাড়িতে থাকবে আর আমার কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোমার স্ত্রী তুমি আমার কাছে এসো।

তুমি স্ত্রীর মতো আচরণ করলে তো আর আরেকজনকে প্রয়োজন হতো না। তুমি আমাকে সুখী করতে পারলে, শান্তি দিতে পারলে তো আর ইরাকে প্রয়োজন পড়তো না। আমি ওকে বিয়ে করেছি, এখন ও আমার স্ত্রী। কোনোদিন ওর সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলবে না।

তুমি বাড়ি আসবে না?

না।

না মানে?

না মানে, আসবো না।

তুমি এখনই এসো। ওকে তোমার মা-ভাইদের কাছে রেখে এসো।

জয় প্রচণ্ড রেখে গর্জন করে উঠলো, কী বলছো?

হ্যাঁ তুমি এখনই আমার কাছে এসো, যদি না এসো তবে আমি এখনই তোমার কাছে যাবো।

একবার এসে দেখো। তুমি এখানে আসামাত্র আমি তোমাকে তালাক দিবো।

দিও, তুমি কতবড় বাপের ব্যাটা আমাকে তালাক দিও। আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াতে না পারলে আমিও বাপের বেটি না। তবে আজ না, কাল যাবো। কাল তুমি যদি না এসো তবে আমি সোজা বজরাপুর চলে যাবো।

কথা বলতে বলতে সামিনা ফোনটা মানিকের হাতে দিলো। মানিক চিৎকার করে বললো, এই, এই তুই আসবি না? তুই যদি কাল না আসিস তবে আমি তোকে জবাই করবো, জবাই। যদি…

জয় ফোনের লাইন কেটে দিলো।

জয় ফোন রেখে দিতেই ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইরার বুক কেঁপে উঠলো, এই বুঝি জয় ফোন কেটে দেয়ায় মানিক ইরাকে ফোন করলো।

কিন’ ইরা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো শুভ ফোন করেছে। শুভ তো ইরাকে খুব সহজে ফোন করে না। আজ হঠাৎ ফোন করায় ইরার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো। ইরা ফোন রিসিভ না করে জয়কে জিজ্ঞেস করলো, রিসিভ করবো?

করো।

ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

শুভ’র কান্না কান্না কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো মা।

ইরা কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো, বল, ফোন করেছিস কেনো?

মা। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।

বিয়ে করবি, মেয়ে তো ঠিক করাই আছে।

মা তুমি খুশি হওনি?

এভাবে বলছো কেনো? আমি খুশি হয়েছি শুভ দোয়া করি তোরা সুখী হ। আর একটা কথা বলি এভাবে যখন-তখন আমাকে ফোন দিবি না।

মা।

হ্যাঁ। সবই তো জানিস, আমি দিনাজপুর এসেছি, তুই বার বার ফোন দিবি না। আমি যেদিন তোর বাবার কাছ থেকে চলে এসেছি সেদিন তোকেও তোর বাবার কাছে রেখে এসেছি।

মা, মা তুমি এভাবে বলতে পারছো। কিন’ তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে আরও ফোন করবো মা। তুমি যত সুখেই থাকো আর তোমার নতুন স্বামীকে নিয়ে ব্যস্তই থাকো।

এখন রাখি শুভ। ভালো থাকিস্‌, বাই, বলে ইরা শুভ’র উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিয়ে ইরা মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিকর শব্দ বেরিয়ে এলো, উফফফফ, কোথাও একটু শান্তি নেই।

 

উনসত্তর

 

গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে খুব ছোট্টএকটা পুকুর। পুকুরের চারপাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। বড় বড় গাছগুলো এমনভাবে ডালপালা মেলেছে যেনো পুকুর ঢেকে গেছে। পুকুরের নীলাভ, স্বচ্ছ পানি, ওপরে গাছের সবুজ ডালপালা। পুকুরের ঘাট বাঁধানো, পাড়ে রাজপ্রাসাদের কারুকার্যখচিত কংক্রিটের বেঞ্চ, চেয়ার।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ওয়াও।

জয় একটা হাত বাড়িয়ে দিলো ইরা জয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, জয় আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি।

কী।

তুমি বেছে বেছে আমার জন্য ভালোটাই খোঁজো, এই যেমনঃ ভালো জামাকাপড়, ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। সেই যে তুমি আমাকে নিয়ে গেলে পাথরঘাটা, বারো শিবালয় মন্দির আজ আবার নতুন একটা আকর্ষণীয়

ইরা জয়ের হাত টেনে ধরলো, এই এতো জোরে হাঁটছো কেনো? একটু বসি। বলে ইরা একটা চেয়ারে বসলো।

জয় ছবি তোলার জন্য তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে বললো, তোমার ছবি খুব সুন্দর হয়েছে ইরা। এই রাজপ্রাসাদের রাজাদের চেয়ারের মতো কারুকার্যখচিত কংক্রিটের চেয়ারে তোমাকে ঠিক রাণীর মতোই মানিয়েছে।

ইরা আংশিক মুখ বিকৃত করে বললো, হুঁম আজাইড়া কথা। তুমি পাথরঘাটাতেও এই কথা বলেছিলে, পাথরঘাটায় না হয় রাণীর প্রাসাদ ছিলো কিন’ এখানে তো কিছু ছিলো না। এটা কোনো ঐতিহাসিক স’ানও না।

জয় অভিমান করে বললো, এ জায়গার কোনো ইতিহাস থাকবে না তো। এখানে আমি এসেছিলাম আমি তো কোনো রাজা নই তাই আমার কোনো ইতিহাসও থাকবে না।

ইরা চেয়ার থেকে উঠে জয়ের কাছে এলো, তার কাঁধে একটা হাত রেখে মোবাইল ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে বললো, কে বললো তুমি রাজা না, তুমি তো রাজাই, তুমি আমার মনের রাজা। আমাদের কোনো ইতিহাস থাকবে না কিন’ আমাদের তো একটা রাজ্য আছে, যে রাজ্যের রাজা তুমি আর রাণী আমি।

জয় ইরাকে কাছে টেনে নিলো, তুমি ঠিকই বলেছো ইরা।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। জয় মোবাইলের মনিটরে দেখলো সামিনা ফোন করেছে।

আজকাল সামিনা কিংবা মানিক-রতন ফোন করলে জয়ের বুক কেঁপে ওঠে। রাগ, ক্ষোভ, জিদ, অহংকার যেনো ওদের বিবেক মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে দিয়েছে। পিতা-পুত্র কিংবা স্বামী-স্ত্রী’র স্বাভাবিক সম্পর্কও যেনো হিংস্র হয়ে উঠেছে। ইরাকে নিয়ে আসার পরদিন জয় বাসায় গিয়েছিলো। বরাবরের মতোই মানিক-রতনকে সঙ্গে করে বাহাদুর বাজারে গিয়ে বাজার করে দিয়েছে। জয় তার আচরণে কোনো ব্যতিক্রম করেনি কিন’ মানিক-রতন ও সামিনা আচরণ ছিলো আক্রমণাত্মক। ফোনেও মানিক রতন চরম অশ্রদ্ধা ও অপমানজনক কথা বলে। তাই মোবাইলের মনিটরে সামিনার নাম দেখে জয়ের বুক কেঁপে উঠলো।

সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

সামিনার বরাবরের মতোই ক্রদ্ধ কণ্ঠস্বর, তুই বাসায় আসবি না?

কালকেই তো বাসায় গেলাম।

কালকেই আস্‌লি তো কী হয়েছে। আমি অসুস’ হলে তোকে বাসায় আসতে হবে না।

জয় কোনো কথা বললো না। কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো।

জয় অনেকক্ষণ থেকে কানের কাছে ফোন রেখে চুপ করে আছে দেখে ইরাও মোবাইল ফোনের কাছে কান পেতে রইলো।

সামিনা উত্তেজিত হয়ে বললো, কথা বলছিস না কেনো, বল?

কী বলবো?

আমি অসুস’, তুই আজ বাসায় আসবি।

তুমি অসুস’ তা তো জানি না।

জানবি কেনো তুই, তুই তো ঐ মাগীকে নিয়ে ফূর্তি করতে ব্যস্ত, আমার কথা আর তোর কী মনে থাকবে। তুই আজ সারাদিন যেখানেই ব্যস্ত থাক, রাতে বাসায় আসবি।

আজ রাতে তুই দিনাজপুর আসবি। যদি না আসিস তবে আমি কাল সকালে তোর গ্রামের বাড়ি যাবো। তোর পাড়াপড়শি সবাইকে বিচার দিবো।

আচ্ছা দিও।

তবুও আমার অসুখ জানার পরও তুই আসবি না?

জয় কোনো কথা বললো না।

এবার রতনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এই, এই তুই আসবি না।

জয় রতনকে শাসনের সুরে বললো, রতন, বাবার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না?

না, জানি না। তুই বাবার মতো বাবা হতে পারিসনি। তোর সঙ্গে আর ভালো ব্যবহারটা কীসের। তুই আজ রাতে বাসায় আসবি, আমার আম্মু অসুস’। আমার আম্মুর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে আমি তোকে খুন করবো, বলে রতন জয়কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলো।

ফোনে কথা বলা শেষে জয় একটা ঢোক গিললো। একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, চলো ইরা।

ইরা কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে রইলো তারপর ভারী শান্ত কণ্ঠে বললো, একটু বসি জয় বলে জয়কে হাত ধরে একটা কংক্রিটের বেঞ্চে নিয়ে গিয়ে দু’জনে পাশাপাশি বসলো। তারপর বললো, জয়! তুমি কী জয়!

জয় ইরার কোনো কথার জবাব দিলো না।

ইরা আবার বললো, তোমাকে ওরা যে কথাগুলো বললো তারপরও তুমি কিছু বললে না। সব কথাগুলো নীরবে হজম করলে আর একটা শুষ্ক হাসি হেসে উড়িয়ে দিলে।

কী করবো ইরা?

কী করবো মানে? শাসন করবে।

যে অপমানের শাস্তি দেয়া কঠিন সে অপরাধ হেসে উড়িয়ে দেয়াই ভালো ইরা। ওরা এখন শাসনের উর্দ্ধে, ওরা উগ্র হয়ে গেছে। ওরা এখন যাচ্ছেতাই করতে পারে।

জয় আমিও তো একটা সংসার ছেড়ে এসেছি। সেখানে আমারও একটা ছেলে আছে। শুভ কি কোনোদিন আমাকে কিছু বলেছে। শুভ শুধু একটা কথা বলে, মা বাবার সঙ্গে তোমার বনিবনা হচ্ছিলো না বলে তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে গেছো। তোমার ভালো-মন্দ তুমি নিজে বুঝবে আমি কোনোদিন তোমাকে কিছু বলবো না, তবে কোনোদিন যদি শুনি তুমি ভালো নেই তবে আমি তোমার পাশে দাঁড়াবো মা। ছেলেটা আমার একটা খারাপ কথা বা উচ্চস্বরে কথা বললো না। এখন রতনের কথা শোনার পর তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভয় হচ্ছে জয়। ওরা যেকোনো সময় তোমার গায়ে হাত তুলতে পারে জয়।

কিচ্ছু হবে না ইরা। আল্লাহ আছেন।

আল্লাহ তোমার সহায় হোন জয়।

 

দু’জনে বাসায় ফিরলো সবকিছুই যেনো স্বাভাবিক। বাসায় ঢোকার সময় মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গেছিলে মা?

ইরা হাসতে হাসতে বললো, একটা সুন্দর জায়গায় গিয়েছিলাম মা। কী যেনো নাম, কী যেনো নাম বলে ইরা মনে করার চেষ্টা করলো।

কোথায় গিয়েছিলে রামসাগর, কড়াই বিল?

না মা, নাম মনে পড়ছে না। বলে ইরা জয়কে বললো, এই বলো না গো, চুপ করে আছো কেনো?

জয় বললো, তোমাকে এতো সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে গেলাম আর তুমি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটার নামটা ভুলে গেলে।

মরিয়ম ইরার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, পাগলি মা আমার।

ও মনে পড়েছে বলে ইরা বললো, এল.জি.ই.ডি’র খামার।

ইরা কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে আবার বেরিয়ে এলো। জয় কিছুক্ষণ পর ইরা ইরা বলে ডাক দিলো।

আসছি বলে ইরা আবার রুমে ঢুকলো কিছুক্ষণ অনেক খোঁজাখুঁজি করলো তারপর ইরা জোরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো, আমাদের ভালোবাসার বন্ধন, আমাদের চিরজীবনের বন্ধনটা তুমি হারিয়ে ফেললে! একটা জিনিস তোমার হাত থেকে খুলে পড়লো আর তুমি বুঝতে পারলে না। আমার অনুভূতি তোমার মনে কতটুকু তা আর আমার বুঝতে বাকি নেই। এমনি করে একদিন আমিও তোমার জীবন থেকে চলে যাবো জয়, চলে যাবো তবুও তুমি বুঝতে পারবে না। না পারবে আমি চলে যাওয়ার পর বুঝতে আমি তোমার জীবনে কত আপন ছিলাম।

জয় বললো, আমি তো ইচ্ছা করে হারাইনি ইরা, কখন যে হাত থেকে পড়ে গেছে আমি বুঝতে পারিনি। প্লিজ তুমি একটু থামো।

আমি থামলেই তো আর জিনিসটা ফেরৎ আসছে না।

এখন কী করবে বলো। যা হারাবার তা তো হারিয়েই গেছে।

এটা হারানো সামান্য কিছু হারানো না জয়। মেয়েদের বিয়ের নাকফুল ছেলেদের বিয়ের উপহার এসব বিয়ের সঙ্গে রিলেডেট। এগুলো সারাজীবন ধরে রাখতে হয়, সবসময় হৃদয়ে লালন করতে হয় জয়। তুমি পারলে না, তুমি পারলে না। এই দেখো তোমার দেয় আংটিটা আমার আঙ্গুলে এক মুহূর্তের জন্য খুলি না। মাঝে মাঝে চমকে উঠি, দেখি আংটিটা আছে কী না আর তুমি এতবড় একটা জিনিস হারিয়ে ফেললে।

জয় আর কোনো কথা বললো না, সে অপরাধীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে।

ইরার কান্নার শব্দ শুনে বাড়ির সবাই দরজায় এসে দাঁড়ালো। মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেনো?

ইরা জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এই সম্পর্ক টিকবে না মা, এই সম্পর্ক টিকবে না। বিয়ের উপহার হারিয়ে গেলে বিয়ে টিকে না মা।

মরিয়ম ধমকের সুরে বললো, এভাবে বলতে হয় না মা, কী হয়েছে বলবে তো।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমাদের বিয়ের ঘড়িটা আপনার ছেলে হারিয়ে ফেলেছে মা।

মরিয়ম কয়েকমুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর ইরার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, কেঁদো না মা। ওসব কথা বিশ্বাস করতে হয় না।

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

ইরা মোবাইল ফোনের মনিটরে দেখলো শুভ ফোন করেছে।

ইরা ফোন রিসিভ করলো না। একটা ম্যাসেজ লিখে সেন্ড করলো।

 

সত্তর

 

বিয়ের ধুমধাম আয়োজন শুরু হয়েছে। ঈদের দ্বিতীয় দিন বিয়ে, দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে তাই বিয়ের কেনাকাটা সব ঈদের আগেই শুরু হয়েছে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের আসা-যাওয়া বেড়েছে। শুভ’র এক ফুপা দেশের বাইরে থাকে সেই ফুপু বিয়ে উপলক্ষে একেবারে ঈদের আগেই চলে এসেছে। আশেপাশের আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় যাতায়াত করছে। অনেকেই বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করছে। মতির এক দূর সম্পর্কের বোন অঞ্জলী ইরাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতো না। যেদিন মতি ইরাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে সেদিনই অঞ্জলী ইরাকে দেখে মুখ বাঁকা করে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো, ক্যা বারে মতি বিয়া করে আনিচ্চু তো হুর-পরী, টাউনের মেয়ে, শুনিচ্ছি মেয়েরা নাকি…

মতি ধমকের সুরে তাকে থামিয়ে দিয়েছিলো, তুই সবসময় এমন করে কথা বলিস না তো অঞ্জলী।

সেদিন অঞ্জলী থেমে গিয়েছিলো মতির ধমকে তারপর অনেক বছর কেটে গেছে ইরার ছেলে হয়েছে সেই ছেলের বিয়ের আয়োজন চলছে। আজও অঞ্জলী এসেছে। সে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, শুভ, এ বারে শুভ।

শুভ ড্রয়িং রুমে ঝিম মেরে বসেছিলো। মতি তার এক ভাই আর ছোট ভাই বিয়ের আয়োজন নিয়ে কথা বলছিলো।

মতি অঞ্জলীকে পছন্দ করতো না। তাকে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে দেখে ভ্রু’কুঁচকে বললো,  এই তুই কেনো?

এ মতি কী বলিচ্চু, বিয়ে বাড়িতে মানুষ আসবি না। বলে অঞ্জলী শুভকে জিজ্ঞেস করলো, এ বারে শুভ তোর মাও আসবি না?

এবার মতি ধমকের সুরে বললো, তুই এখন যাবি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছিস, না।

যাচ্চি, যাচ্চি। ক্যাংকা মাও এতবড় ছল ছ্যাড়ে অন্য মরদ মানুষের হাত ধরে ভ্যাগে যায়।

মতি রাগান্বিত চোখে অঞ্জলীর দিকে তাকাতেই অঞ্জলী বললো, ছলের বিয়াতে মা থাকপিনা এডা কী হয়, আমাকে না হয় শাটা মারে মুক বন্ধ করিচ্চু, ব্যাবাক লোক বলিচ্চে ক’জনের মুক মুক বন্ধ করবু? বলে অঞ্জলী চলে গেলো।

অঞ্জলীর কথায় মতি থ হয়ে গেলো। শুভ’র গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

মতি আমতা আমতা করে শুভ’কে বললো, ফোন দিয়েছিলি?

শুভ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

মতি নিজেও জানে ইরা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, সে এখন অন্যজনের বউ তাকে আসতে বলাও সমীচীন না কিন’ তার মন মানে না তার মন বলছে কোনো না কোনো ছুঁতোয় ইরা যদি একবার আসতো। ইরাকে ছেড়ে মতি কোনোদিন বাইরে থাকতো না। ইরার কয়েকমুহূর্তে অনুপসি’তি মতিকে উতলা করে তুলতো। ইরাও মতিকে ছেড়ে থাকতে পারতো না। আর শুভ, শুভ ইরার একমাত্র সন্তান তাকে ছেড়ে ইরা? মতি আর কল্পনা করতে পারে না কিন’ এটা মতি কোনোভাবে মেনেও নিতে পারছে না। ছেলের বিয়ে মা থাকবে না এটা কী করে হয়। এটা তো শুধু অঞ্জলী বলছে তা না। প্রতিবেশী, পরিচিত বন্ধু-বান্ধবরাও বলছে কিন’ মতির কী করার আছে। ইরা আর একবার যদি তার জীবনে আসতো তবে মতি তার গায়ে ফুলের টোকাও লাগতে দিতো না। তা না হোক, অন্তত: শুভ’র বিয়েতে যদি আসতো তবে মতি একপলক ইরাকে দেখতে পেতো।

মতি জিজ্ঞেস করলো, কী বললো?

ফোন রিসিভ করেনি। পরে ব্যাক করবে। বলে শুভ মতিকে কিছু না বলে বাইরে চলে গেলো।

 

কত আনন্দ, কত হৈ চৈ করে শুভ’র বিয়ের কথা ছিলো। শুভ তার বন্ধুদের দাওয়াত করতে চেয়েছিলো তাদের দাওয়াত করা হলো না। শুভ’র মামা-খালারা ধুমধাম করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো শুভ’র অথচ এখন তারা বলে দিয়েছে, যে বাড়িতে ইরা নেই সে বাড়িতে তারা আসবে না। একটা আনন্দের বিয়ে কেমন শুধু দায়িত্ববোধের বিয়েতে পরিণত হলো। শুভ’র বিয়ে এখন শুধু দায়িত্ববোধেরই বিয়ে। শুভ কারও সঙ্গে তেমন মন খুলে কথা বলছে না। বিয়ে অথচ তার মধ্যে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য নেই। শুভ সন্ধ্যায় ছাদের ওপর পায়চারী করছিলো এমনসময় ইরা ফোন করলো।

শুভ রিসিভ করলো, হ্যালো মা।

হ্যাঁ। বল, ভালো আছিস শুভ?

এই আছি মা, কোনোমতে। মাকে ছেড়ে ছেলে কেমন থাকতে পারে তুমি বলো মা।

সে কথাটা তো মা থাকতে বলতে হতো বাবা। সময় থাকতে সাধন করতে হয়। এখন বল ফোন দিয়েছিলি কেনো?

মা, ছেলের বিয়েতে মা থাকবে না, তা কী করে হয়! মা তুমি না আমাকে বর সাজিয়ে দিতে চেয়েছিলে! মা তুমি দোয়া না করলে আমি কোনোদিন সুখী হবো না মা! মা তুমি এসো মা। আমার জন্য দোয়া করে চলে যেও মা। আমি কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে কিছু বলবে না মা! মা তুমি একবার এসো বলতে বলতে আবেগে শুভ’র কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

এটাও কীভাবে সম্ভব বাবা। আমি দোয়া করছি পুতুল মা আমার তোরা সুখে থাকিস।

তুমি না এলে তুমি আমাদের জন্য দোয়া না করলে আমরা কীভাবে সুখে থাকতে পারি মা। মা তুমি এসো, তুমি আমাকে গায়ে হলুদ দিয়ে, আমাকে দোয়া করে চলে যাবে মা।

তা আর হয় না শুভ।

মা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বাবা তোমাকে কিছু বলবে না। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো মা, তুমি গাড়িতে করে এসে আমার গায়ে হলুদ দিয়ে, আমার জন্য দোয়া করে আবার সেই গাড়িতেই চলে যাবে মা।

শুভ’র সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইরাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো, আচ্ছা আমি জয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখি। যেতে দেয় কী না।

মা, তুমি দিনাজপুর থেকে ফিরবে কবে মা?

ঈদের পরদিন।

তুমি এসো মা, তুমি জয়পুরহাট আসার পর আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো, এসো মা আমি তোমার একমাত্র ছেলে, আমার বিয়েতে তুমি থাকবে না এটা হয় না মা।

আচ্ছা আমি এখন রাখছি।

মা, তুমি কিন’ না করো না।

আমি তো বলছি শুভ আমি জয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখি।

তুমি একটু বুঝিয়ে বলো মা। আমি কথা দিচ্ছি আব্বা তোমাকে কিছু বলবে না, কেউ কিছু বলবে না। এসো মা।

ইরা শুভ’র কথার উত্তর না দিয়েই ফোন রেখে দিলো।

 

একাত্তর

 

জয়ের কাছে ইরার কোনো বিষয়ে গোপন নেই। শুভ’র বিয়ের কথা ইরা আগেই জয়কে বলেছে, শুনে জয় একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, তাহলে তো তুমি শাশুড়ি হতে চলছো, আর ক’দিন পর দাদী হবা।

ইরা জয়ের কথা শুনে অভিমানের সুরে বললো, তুমি তো সবসময় সববিষয় হাল্কা করে দেখো।

জয় মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেলো, সবকিছু সহজ করে দেখতে হয় ইরা। আমরা প্রতিদিন যত সমস্যার মুখোমুখী হই সবগুলো যদি আমরা সিরিয়াসলি দেখি তবে তো পাগল হয়ে যাবো আর না হয় হার্ট ফেল করবো।

তুমি ঠিকই বলেছো জয়, সেজন্য তুমি এতো ঝড়ের মাঝেও টিকে থাকো। কত আশা ছিলো, শুভ আর পুতুলের বিয়েতে অনেক আয়োজন করবো। ধুমধাম করে বিয়ে দিবো বলতে বলতে ইরা উদাস হয়ে গেলো।

জয় ইরার বাহুতে হাত রেখে বললো, ইরা!

ইরা চমকে উঠলো, হ্যাঁ বলো।

এমন করছো কেনো ইরা?

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, জয় আমি তোমার জন্য সব ছেড়েছি জয়। তুমি আমাকে শক্তভাবে ধরে রেখো জয়। সেদিন যখন সানোয়ারা ভাবীর সামনে তুমি বললে, সারাজীবন আমাকে শক্তভাবে ধরে রাখবে তখন আমার মনে হলো আমি তোমাকে পেয়েছি আমার আর কিচ্ছু চাই না জয়, শুধু তুমি আমার থেকো।

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে ইরা?

না জয়।

 

আজ ঈদ। ইরার ঈদের নামাযের আগে জয়কে পাঞ্জাবি পরিয়ে দিয়েছে, নিজ হাতে মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়েছে। ঈদের নামাযের পর বাইরে গরু জবাই হয়েছে, ইরা সবার সাথে হাসিমুখে মাংস কাটাকাটি করেছে। বিকেলে জয়সহ মোটর সাইকেলে কান্তজীউ মন্দির বেড়াতে গেছে। ঈদের সারাটা দিন কোথাও কোনো আনন্দের ত্রুটি ছিলো না। জয়, জয়ের মা, ভাই, ভাতিজী, ছোট ভাইদের বউরা সবাই ইরাকে যথেষ্ট আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেছে কিন’ ইরার মনে সবসময় শুভ’র ছবিটা ভেসে উঠেছে। সেই ছোটবেলা থেকে শুভকে লালন পালন করেছে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের স্মৃতি অসীম। সেই অসীম স্মৃতি ইরাকে আজ সারাদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ইরার চোখের সামনে শুভ’র সেরোয়ানি পরা, মাথায় পাগড়িওয়ালা একটা ছবি ভেসে উঠেছে পাশে বসা সেই পুতুলের মতো ছোট্ট মেয়ে পুতুল। ইরা লুকানোর চেষ্টা করেছে, করতে পেরেছেও। কিন’ শুভ’র সেই কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মা, ছেলের বিয়েতে মা থাকবে না, তা কী করে হয়! মা তুমি না আমাকে বর সাজিয়ে দিতে চেয়েছিলে! মা তুমি দোয়া না করলে আমি কোনোদিন সুখী হবো না মা! মা তুমি এসো মা। আমার জন্য দোয়া করে চলে যেও মা। আমি কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে কিছু বলবে না মা!

রাতের খাবারের পর জয় বিছানায় শুয়ে বালিশে হেলান টি.ভি দেখছিলো। ইরা জয়ের মাথার কাছে বসে অন্যমনস্কভাবে জয়ের মাথায় আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছিলো। জয় কয়েকমুহূর্ত ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, ইরা অন্যমনস্কভাবে টি.ভি’র দিকে তাকিয়ে আছে। জয় মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, ইরা।

ইরার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। জয় আবার ডাক দিলো, ইরা।

ইরার তবুও কোনো সাড়া নেই। এবার জয় ইরার হাতে মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিলো, ইরা।

ইরা চমকে উঠলো, জয়!

কী হয়েছে ইরা?

ইরা প্রথমে অস্বীকার করলো, কিছু না জয়।

কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। ইরা তুমি অনেকক্ষণ থেকে খুব অন্যমনস্ক ছিলে।

ইরা কোনো কথা বললো না।

জয় বললো, ইরা কোনো সমস্যা? আমাকে বলো, তুমি তো আমাকে কোনোদিন কোনো কথা বলতে সংকোচ করো না ইরা। আজ এমন কী হলো যে তুমি আমাকে বলতে গিয়ে সংকোচ করছো।

জয় তোমাকে একটা কথা বলবো, তুমি কিছু মনে করবে না তো।

জয় কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, করবো তারপর হো হো করে হেসে উঠলো, আমাকে কিছু বলতে তুমি সংকোচ করো আজই প্রথম দেখলাম। বলো ইরা।

পরশুদিন শুভ’র বিয়ে, ও ফোন করেছিলো, আমাকে যেতে বলছে।

ও এই কথা।

ইরা কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো, জয়, এটাও হেসে উড়িয়ে দেয়ার মতো কথা না জয়। তুমি একটু সিরিয়াস হও। কী করবো আমাকে বলো, সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে একটু হেল্প করো।

এবার জয় গম্ভীর হলো। আবার কয়েকমুহূর্ত ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বললো, ইরা তুমি কি যেতে চাচ্ছো?

যেতে তো মন চাচ্ছে, বুঝছোই তো ছেলের বিয়ে আমি মা হয়ে কীভাবে… বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ইরা তুমি জানো আমি কোনোদিন তোমার ইচ্ছার ওপর কোনো প্রভাব ফেলিনি।

কিন’ আজ ফেলতে হবে জয়। ভালো-মন্দ ভেবে-চিন্তে তোমাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। তাছাড়া তুমি আমার হ্যাজবেন্ড, তোমার অনুমতি ছাড়া তো আমি যাবো না।

জয় কৃত্রিম গম্ভীরস্বরে বিচারকের ভঙ্গিতে বললো, অনুমতি দেয়া গেলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

ইরা জয়ের মুখটা চেপে ধরলো, আবারও হেঁয়ালী।

জয়ের হাসি থামলো।

ইরা বললো, একটু ভেবে-চিন্তে বলো জয় গেলে কী হবে আর না গেলে কী হবে।

জয় গলা ঝেড়ে গম্ভীরস্বরে বললো, ইরা তুমি যদি না যাও তবে তুমি খুব কষ্ট পাবে। হাজার হলেও তোমার ছেলে যাকে নিয়ে তোমার অনেক স্বপ্ন ছিলো, পুতুল তোমার বউমা যাকে তুমিই সিলেক্ট করেছো। সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আর যদি যাই-

গেলে তুমি যে খুব খুশি হবে তা না ইরা। কারণ তুমি সবকিছু ছেড়ে একেবারে আমার কাছে চলে এসেছো। তুমি যে স্মৃতি ছেড়ে এসেছো, যে অধিকার ত্যাগ করে চলে এসেছো আবার সেখানে গেলে তোমার কষ্টই বাড়বে। তুমি হয়তো ভাবছো গেলে তোমার ভালো লাগবে এটা আমি মনে করি না।

ইরা জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনছিলো।

তোমার প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা সামনে পেয়ে তোমাকে অপমান করতে পারে ইরা, তোমাকে খুব খারাপ বলবে।

আমারও তাই মনে হয় যদিও শুভ বলেছে ও কাউকে কিছু বলতে দিবে না কিন’ কেউ যদি সত্যি কিছু বলে তবে শুভ কিছু করতে পারবে না, ও আর ক’জনের মুখে হাত দিবে।

জয় ধীর শান্ত কণ্ঠে বললো, আরও একটা আশঙ্কা আছে ইরা।

জয়ের এই কথাটা যেনো ইরার বুক কাঁপিয়ে তুললো। জয় কখনো যদি শান্ত কণ্ঠে কোনো কথা বলে তবে ইরা ভয় পায় কারণ জয় খুব সহজে শান্ত কণ্ঠে কিছু বলে না, প্রায় সময় খুব সহজভাবে, হেসে, হেঁয়ালী করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলে ফেলে আর যদি শান্ত কণ্ঠে কোনো কথা বলে তবে অনেক ভয়ঙ্কর কথা বলে এটা ইরা এতোদিন দেখে এসেছে।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, কী আশঙ্কা জয়?

ওরা তোমাকে আটকে দিতে পারে ইরা। মায়ার বন্ধন, সামাজিকতার শৃঙ্খল, তোমার বাপ-ভাই’র শাসন, আর না হয় অন্য কোনো অজুহাতে। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে ইরা তোমার বাপ-ভাই সবাই তোমার বিপক্ষে। শুধু তোমার না, আমাদের বিপক্ষে এবং শুধু তোমার বাপ-ভাই না পুরো সমাজই আমাদের বিপক্ষে। আমরা পুরো একটা সমাজ ব্যবস’ার বিপক্ষে আমাদের ইচ্ছা ও অধিকারের জন্য লড়ছি।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়! আমার জয়! আমি যাবো না জয়! তোমার আমার ব্যাপারে আমি কোনো ঝুঁকি নিবো না জয়। আমার যত কষ্টই হোক আমি মেনে নিবো জয়। তোমার জন্য আমি সব কষ্ট মেনে নিবো।

 

বাহাত্তর

 

দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না। তবে দুধকে ঘোলের সান্ত্বনা বলা যায় বিকল্প বলা যায় না। শুভকে বিয়ে দিয়ে পুতুলকে বউ করে ঘরে তোলা হলো, যে বাড়িটা হয়তো এতোদিনে শূন্যতায় খাঁ খাঁ করতো সে বাড়িতে পুতুল, বিবাহ পরবর্তী আত্মীয়-স্বজনের কলকাকলীতে ভরে গেলো কিন’ তাতে কী আসে যায় হৃদয়ের শূন্যতা তো আর মানুষের কলকাকলীতে পূর্ণ হয় না। মানুষের কলকাকলী কখনো হৃদয়ের শূন্যতা বা একাকীত্ব দূর করতে পারে না।

বিয়ের কয়েকদিন পর শুভ পুতুলকে বাড়িতে রেখে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলো। শুভ’র যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে মতির বাবা-মা, ভাইবোন সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিলো মতির ভাগিনী আফরোজার মেয়ে তনু এখন থেকে মতির বাড়িতে থেকে মতির স্কুলে লেখাপড়া করবে। ফলে শুভ চলে যাওয়ার পর বাড়িতে রইলো মতি, পুতুল আর তনু।

যে বাড়িটা হয়তো সন্ধ্যার পর একাকী এই ফাঁকা মাঠের গাঢ় অন্ধকারে ডুকে থাকতো সে বাড়িতে সান্ধ্যবাতি দেয়ার মতো মানুষ হলো, বাড়ির উজ্জ্বল বাতিগুলো জ্বলে উঠলো কিন’ মতির হৃদয়ের অন্ধকার, একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতার অবসান হলো না। আজকাল মতি স্কুলে গিয়ে সারাদিন ঝিম মেরে বসে থাকে, আগে যেমন বিকেল হলেই বাজারে গিয়ে আড্ডা দিতো এখন আর বাজার যায় না। বাজারে গেলেই একেকজন একেকরকম প্রশ্ন করে, মতি কারও প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। তাই খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যায় না। বিকেলবেলা বিছানায় শুয়ে থাকে, সন্ধ্যায় ছাদের ওপর পায়চারি করে।

 

মহসিনের দোকানে তখন ছলিম চাচা ছিলো। ছলিম চাচার পুরো নাম ছলিমউদ্দীন, ছলিমউদ্দীন কার চাচা ছিলো কেউ জানে না কিন’ এলাকার সবাই তাকে চাচা বলে ডাকে। দিনে দিনে তার নামের সঙ্গে চাচা সম্বোধনটা জুড়ে গেছে। ইরা যে স্কুলের শিক্ষকতা করে ছলিম চাচা সেই স্কুলের গভর্নিং বডির একজন সদস্য। স্কুলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তার মতামতের অনেক গুরুত্ব আছে। মতির বাড়িতে তার আগে থেকে যাতায়াত আছে, মতি এবং ইরা দু’জনের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ভালো। ইরা জয়ের সঙ্গে চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর ছলিম চাচা ইরাকে একবার ফোন করেছিলো, হ্যালো, মা ইরা।

ইরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সে কথা বলতে গিয়ে থতমত খেয়েছিলো, জি, জি চাচা।

এডা তুই কী করলু মাও?

আমি ঠিকই করেছি চাচা।

এমন কী সমিস্যা আছলো যেডা তুই হামাদের কসনি এডাবারো, এতবড় সিদ্ধান্ত নিলু।

সমস্যাটা অনেকদিনের চাচা। সামাজিকতা রক্ষার জন্য আমি অনেক সেক্রিফাইস করেছি। মতির সব অত্যাচার মেনে নিয়েছি। আমি ওবাড়িতে তিলে তিলে মরে যাচ্ছিলাম চাচা। এতোদিন শুধু শুভ’র মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম কিন’ রোজার ঈদের দিন শুভ ওর বাবাসহ আমাকে অপমান করেছে। আমি আর ওদের কোনো অপমান সহ্য করবো না বলে একেবারে চলে এসেছি চাচা।

হামাকি এডাবার কবার পারতু মাও। হামি মতিক কতাম। মতি হামাক খুব সোনমান করে, দরকার হলি অকি হামি শাসন করলাম হিনি।

এরকম ঘটনা তো আগেও ঘটেছে চাচা। আমার বাবা, আমাদের আত্মীয়-স্বজনসহ অনেকবার বিচার সালিসও করেছে কিন’ কোনো লাভ হয়নি। কয়েকদিন পর মতি আবার আমার ওপর অত্যাচার করে। আমি ওর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য একটা অবলম্বণ খুঁজছিলাম চাচা, পেয়েছিও। তাই চিরদিনের মতো মতির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এসেছি।

তোর চাকরিডার কী হবে মাও? ইস্কুল যদি তোর বিরুদ্দে কোনো একশন লয়?

এটাতো স্কুলের কোনো বিষয় না চাচা। এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি স্কুলে ঠিক সময় গেলাম কী না, ক্লাস নিলাম কী না, ছাত্র-ছাত্রীদের ঠিকমতো পড়াচ্ছি কী না এগুলোর কোনো ব্যতিক্রম হলো কী না সেটাই আপনারা দেখবেন।

তাও মাও, তুই এডা ইস্কুলের মাস্টার। ছাত্রদের ওপর তো মাস্টারের আচার ব্যবহারের প্রবাব পড়ে মাও। তাছাড়া তুই তো এটকার পরিবেশ জানিস। কোনো মাস্টার এট্রু ভুল করলেই কমিটি চাকরি খায়, মেলা প্রকারের হয়রাণী করে। তুই ভুল করলো মাও, বড় ভুল করলো।

আমি কোনো ভুল করিনি চাচা।

ভেবেচিন্তে দেখ মাও, তুই একনি চলে আয়, মতিকে হামি বুজে-সুজে ঠিক করে নেমুনি।

সরি চাচা আমি আর কোনোদিন আসবো না। এমন কোনো প্রস্তাব নিয়ে আমাকে আর কোনোদিন ফোন দিবেন না।

তারপর ছলিম চাচা একবার ফোন করেছিলো স্কুল থেকে যেদিন ইরাকে সাসপেন্স করে সেদিন। সেদিন অবশ্য ইরা বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলো, চাচা আপনি আমার বাবার মতো, আমার যেনো কোনো ক্ষতি না হয় সেটা দেখবেন চাচা প্লিজ!

হামি তোর কোনো ক্ষতি চাই না মাও, কিন’ বুজিস তো কমিটির সব মানুষ তো সমান লয়। তাও হামি চেষ্টা করমু যেনো তোর কোনো ক্ষতি না হয়। বলে ছলিম চাচা একটু থামলো তারপর বললো, তুই আবার ফ্যারত আয় মাও, ইরা, মাও হামার একবার ফ্যারত আয়, হামি মতিক কমু, তোর শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যাবাকগুলোক বুজে কমু। মানুষই তো ভুল করে।

না চাচা আপনি কাউকে কিছু বলবেন না, মতির কাছ থেকে চলে আসায় আমি কোনো ভুল করিনি।

ছলিম চাচা নিরাশ হয়ে ফোন রেখে দিলো, ঠিক আছে মাও, তুই যেডা ভালো বুজিস কর।

 

সেদিনের পর থেকে ইরার সঙ্গে আর ছলিম চাচার কথা হয়নি। আজ সন্ধ্যায় ছলিম চাচা মতিনের দোকানে এলো। কথা প্রসঙ্গে মহসিন জিজ্ঞেস করলো, ইরার চাকরিটার কী অবস’া চাচা এখন?

ছলিম চাচা মুখ আংশিক বিকৃত করে বললো, কী আর অবস্তা, আগে যিংকা ছিলো শিংকাই আছে। সাসপনি।

মেয়েটা ভুল করলো। এই বয়সে এসে এমন একটা কাজ করলো যে সংসারটাই নষ্ট হয়ে গেলো।

হয়। মতিরও শরীলের অবস্তা ভালো লয়।

 

আচ্ছা চাচা ইরাকে একবার নিয়ে আসার চেষ্টা করা যায় না?

ওই কি আসপার চ্যাচে?

তবু একবার চেষ্টা করা যায়?

ক্যাংকা করে আসপি।

মহসিন ছলিম চাচার কানে কানে চাপাস্বরে অনেকক্ষণ কী যেনো বললো। শুনে ছলিম চাচা জিজ্ঞেস করলো, তুমি যকন কচ্চো তখন একবার চেষ্টা করমো কিন’ মতি কি ওক লিবি?

সেটা না হয় আমি আলাপ করে দেখি, বলে মহসিন মতিকে ফোন করলো, হ্যালো।

হ্যালো।

মতি কোথায় আছিস? মহসিন জিজ্ঞেস করলো।

বাসায়।

বাসায় কী করিস সন্ধ্যাবেলা?

কিছু না।

একবার দোকানে আয় তো।

কেনো?

আয় তোর সঙ্গে কথা আছে।

বাইরে যেতে ভালো লাগছে না রে। তুই বাসায় আয় না!

তুই আয় একসঙ্গে চা খাই আর গল্প করি। তোর সঙ্গে অনেক গল্প আছে। আমার দোকানে ছলিম চাচাও আছে।

মতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো, আচ্ছা আসছি তাহলে।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে মতি এলো।

তেহাত্তর

 

ইরা দিনাজপুর থেকে আসার কয়েকদিন হলো। এই ক’দিনে জয়পুরহাটের কারও সঙ্গে ফোনে তেমন কোনো কথা হয়নি। সেদিন সকালবেলা জয় তখন অফিসে, ইরা রান্নার আয়োজন করছিলো এমনসময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইরা মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সাইদুর সাহেব ফোন করেছে। সাইদুর সাহেব ইরার স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। ইরার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালোই ছিলো। ইরার বিরুদ্ধে যেদিন ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল বের করে তারপর সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে সেদিন ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে সাইদুর সাহেবের অসহায় চোখ দু’টো যেনো পানিতে ছলছল করছিলো। সাইদুর সাহেবের সেই তাকিয়ে থাকা মুখের ছবিটা ইরার চোখের সামনে আজও ভেসে উঠলো।

ইরা ফোন রিসিভ করলো, আসসালামুয়ালায়কুম স্যার।

ওয়ালেকুম আসসালাম। কেমন আছো ইরা?

ভালো স্যার। আপনি?

এই তো আছি আর কী।

আজ স্কুল যাননি স্যার?

স্কুল তো খুলেনি। আগামীকাল খুলবে।

ইরা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, আসলে অনেকদিন থেকে স্কুল যাইনা তো কখন স্কুল খোলা আর কখন বন্ধ জানি না। আসলে জানার উপায় তো নেই।

তোমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই ইরা?

না স্যার।

আসলে স্কুলটাকে হেড স্যার এমন বানিয়েছেন কেউ মন খুলে কথা বলতে পারে না। সবাই সবসময় আতঙ্কে থাকে। আমারও মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন’ ভয় পাই যদি কোনোভাবে হেড স্যারের কানে যায় তো রক্ষা নেই। তোমার স্কুল আসতে ইচ্ছা করে না ইরা?

করে স্যার, করে। স্কুলের সময় হলেই আমার মনে হয় আমি স্কুলে ছুটে যাই। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার সন্তানের মতো, ওদের মুখ না দেখে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হয় স্যার বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এলো।

সরি ইরা তোমাকে কষ্ট দিলাম।

না, স্যার ঠিক আছে। আপনি তো খুব স্বাভাবিক একটা কথা বলেছেন। স্যার আপনি তো এ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার আপনি তো একটা উদ্যোগ নিতে পারেন আমার জন্য।

তুমি ঠিকই বলেছো ইরা আমি এ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার তো বটেই কিন’ সেটা শুধু কাগজে-কলমে। আসলে আমি কি স্কুলে কোনো ভূমিকা রাখতে পারি। স্কুলে আসলে হেড স্যারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হয় না। কেউ একটু টু শব্দ করলে আর রক্ষা নেই। দেখলে না হামিদ সাহেবের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বিরোধটাকে কীভাবে স্কুলে টেনে এনে তাকে হেস্তনেস্ত করলো।

ইরা চুপ করে রইলো।

তুমি ওয়েট করো ইরা। দেখো সিচুয়েশন কোন দিকে যায় আর না হয় তুমি সরাসরি হেড স্যারের সঙ্গে কথা বলো।

আমার খুব ভয় করে স্যার।

তবু বলতে হবে ইরা। আল্টিমেটলি স্কুলেরও তো ক্ষতি হচ্ছে। তোমার ক্লাসগুলো অন্য টিচাররা নিচ্ছে, তাদের ওপর বেশি চাপ পড়েছে, তারা ভালোমতো পড়াতেও পারছে না।

এটা ভেবেও তো হেড স্যার আমার সাসপেনশন তুলে নিতে পারেন। আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে যে ছাত্র-ছাত্রীরা শাস্তি পাচ্ছে স্যার।

সেটা হেড স্যারকে বোঝাও ইরা। তুমি কমিটির সভাপতিকেও ফোন করতে পারো।

দেখি, স্কুলে আমাকে নিয়ে কোনো খারাপ কিছু হলে আমাকে জানাবেন স্যার। আমার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।

ঠিক আছে ইরা বলে সাইদুর সাহেব ফোন রেখে দিলো।

 

সেদিন সন্ধ্যায় জয় একটা বই পড়ছিলো ইরা জয়ের পাশে বসে তার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর মাঝে মাঝে জয়ের লেখালেখির বিষয় কথা বলছিলো। কিছুক্ষণ পর ইরা বললো, আমার একটা কথা শুনবে জয়?

জয় বইয়ে চোখ রেখেই বললো, বলো।

একটু সিরিয়াস হও জয়।

জয় একটা মুচকি হাসি হেসে একটু নড়েচড়ে বসলো।

ইরা জয়ের হাত থেকে বইটা নিয়ে অভিমানের সুরে বললো, সবসময় শুধু কাজ আর কাজ, বই আর বই তারপর কৃত্রিম শাসনের সুরে বললো, শোনো।

জয় মৃদু হেসে অসহায়ের মতো বললো, নড়েচড়ে বসলাম, বইটা রেখে দিলাম আমি তো তোমার কথা শোনার জন্য কান দু’টো খাড়া করে রেখেছি তবু ধমকাচ্ছো কেনো ইরা?

না জয়, ধমকাচ্ছি না। শোনো আজ সাইদুর স্যার ফোন করেছিলো।

সাইদুর স্যার, মানে তোমার স্কুলের এ্যাসিস্টেন্ট হেড।

হ্যাঁ, কী বললো?

আমাকে একবার হেড স্যাররে সঙ্গে কথা বলতে বললো। বললো কাল থেকে স্কুল খুলবে, আমি স্কুলে না গেলে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। এভাবে বলে আমি যেনো স্যারকে রিকোয়েস্ট করি আমার সাসপেন্স অর্ডার তুলে নিতে।

আমি তো তোমাকে আগেও বলেছিলাম ইরা। তোমার হেড স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিৎ। তার পেছনে কমিটির সভাপতি, সদস্য যারাই থাকুক না কেনো সিদ্ধান্ত তো তাকেই নিতে হবে।

ইরা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, এখন হেড স্যার বাসায় আছে, এখন ফোন করবো জয়?

করো।

ইরা ফোন করলো, হেড স্যার রিসিভ করেছে, তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

ইরা বিনীত স্বরে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম স্যার।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কেমন আছেন স্যার?

ভালো। তোমার কী খবর?

আমার খবর তো আপনার কাছেই স্যার। স্যার একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

বলো।

স্যার কাল থেকে তো স্কুল খুলবে। আমার খুব স্কুল যেতে ইচ্ছা করছে স্যার। আমার খুব ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মনে পড়ছে। আমার জন্য তো ওদের ক্লাসেরও সমস্যা হচ্ছে, ওদের ভবিষ্যত নষ্ট হচ্ছে, বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

হেড মাস্টার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে বললো, তা তো হচ্ছে কিন’ কী করি বলো কমিটির দু’য়েকজন সদস্য বলছে তোমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে, এভাবে তো আর কেসটা ঝুলিয়ে রাখা যায় না।

ইরা খুব আশাবাদী হলো, আমিও তো তাই চাচ্ছি স্যার আপনি আমার সাসপেন্সটা তুলে নিন আমি স্কুল যেতে শুরু করি।

হেড মাস্টার সাহেব কর্কশ কণ্ঠে বললেন, কিন’ তারা তো তা বলছে না। সবাই চায় তোমাকে পারমানেন্টলি বরখাস্ত করে নতুন শিক্ষক নিতে।

ইরার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এতোদিনের চাকরি, তার স্কুল, তার ছাত্র-ছাত্রী সব চলে গেলে সে বাঁচবে কীভাবে। জয় ইরার ফোনের কাছে কান রেখে শুনছিলো হেড মাস্টারের কথা শুনে সে একটা ঢোক গিললো। ইরাকে ইশারা করলো কথা চালিয়ে যেতে।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, এটা করবেন না স্যার, আমি তো স্কুলের কোনো ক্ষতি করিনি। আমি…

হেড মাস্টার ধমকের সুরে বললেন, করোনি, তুমি যা করেছো তা শুধু স্কুলের না, আমাদেরও ক্ষতি করেছো। আমরা কোথাও মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারছি না। সবাই আমাদের আঙ্গুল তুলে কথা বলছে। বলছে ওমুক স্কুলের টিচার পরকীয়ার টানে ঘর ছেড়েছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ ইরা তুমি এমন একটা কাজ করলে, ছিঃ।

আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার কথা ভেবে আমাকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিন।

এবার হেড মাস্টার সুর পাল্টালেন, অবশ্য তুমি যদি আবার ফিরে এসো তবে এটা আমি, কমিটি তোমাকে মাফ করতে পারে।

কথাটা ইরার বুকে প্রচণ্ড আঘাত করলো, সে একবার জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, এটা আপনি কী বলেন স্যার! আমি এখন জয়ের বউ, ও আমার স্বামী, স্কুল কি আমার সংসার ভাঙ্গবে?

তুমি ভেবে দেখো ইরা, তুমি যদি আসতে চাও তবে তোমার বিষয়টা কমিটিতে উপস’াপন করবো, আশা করি তাহলে কমিটি তোমাকে মাফ করবে।

জয় ইরাকে ফোন রেখে দেয়ার জন্য ইশারা করলো, ঠিক আছে স্যার আমি ভেবে দেখি। আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

 

চুয়াত্তর

 

শহীদ জয়ের বাসায় আগে থেকেই আসতো। জয় শহীদের বাসায় আসাটাকে সহজভাবে দেখতো। জয় ইরাকে বিয়ে করার পর থেকে সে প্রায় দিনই বাসায় আসে। জয় ইরার বিয়ের কয়েকদিন পর সামিনা শহীদকে জয়পুরহাট পাঠিয়েছিলো। শহীদ জয়পুরহাট গিয়ে তার পরিচিত দু’য়েকজন ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে এবং মতির সঙ্গে দেখা করে ইরাকে যেমন করেই হোক জয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে বলে এসেছে। তখন থেকে শহীদ মাঝে মাঝে মতির সঙ্গে কথা বলে। সামিনাও মাঝে মাঝে কথা বলে ইরাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মতিকে চেষ্টা করতে বলে।

আজ বিকেলে শহীদ এলো। কথা প্রসঙ্গে সামিনা জিজ্ঞেস করলো, মাস্টারের সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন ভাই?

কবে?

এই দুয়ে-চারে?

না বলিনি।

একবার কথা বলবেন নাকি ভাই?

তুই বল। আমার চেয়ে তুই বললে আরও ভালো হবে।

আচ্ছা বলি তাহলে, বলে সামিনা মতিকে ফোন করলো।

মতি রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। ভালো আছেন ভাই?

মতি মিনমিন করে বললো, এইতো আছি আপা কোনোমতো।

কিছু করতে পারলেন ভাই? সামিনা জিজ্ঞেস করলো।

এখনো কিছু করতে পারিনি আপা।

আপনি ওর চাকরিটা খাওয়ার ব্যবস’া করুন ভাই, দেখবেন চাকরির ভয়ে ইরা আপনার কাছে চলে যাবে।

চেষ্টা চলছে আপা, দেখা যাক।

আমার কোনো হেল্প লাগলে বলবেন ভাই। আমি আছি, শহীদ ভাই আছে। আমরা আপনার পাশে থাকবো ভাই বলে সামিনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো শহীদ সামিনার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, ওই শালাকে একটা পেদানি দেন দেখবেন ও ভয়ে জয়পুরহাট থেকে চলে আসবে আর ও চলে এলে ইরাও আপনার কাছে ফিরে যাবে।

মতি কোনো কথা বললো না।

সামিনা আবার ফোনটা নিয়ে বললো, আপনার বাসায় এতো গেছে, কথাবার্তা বলেছে, জয়পুরহাট ঘুরে বেড়িয়েছে আপনি কিচ্ছু খেয়াল করেননি ভাই।

মতি কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, আপনিও তো খেয়াল করেননি আপা।

ঠিক বলেছেন ভাই, ঠিকই বলেছেন। দু’ দু’টা সংসার তছনছ হয়ে গেলো, বলতে বলতে সামিনার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

রাখি আপা বলে মতি ফোন রেখে দিলো।

কলিং বেল বেজে উঠলো।

শহীদ দরজা খুলে দিতেই রতন বাসায় ঢুকলো। রতনের পরনে স্কুল ড্রেস, কাঁধে স্কুল ব্যাগ। রোদে আর গরমে ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। সে সামিনার চোখে-মুখে পানির ছাপ দেখে বললো, কী হয়েছে আম্মু?

সামিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, কিচ্ছু হয়নি, তুমি ড্রেস চেঞ্জ করো।

শহীদ কাটা ঘায়ে নুঁনের ছিটা দিলো, কী আর হবে, তোমরা দু’ভাই আছো, তোমার মা’র কষ্ট তোমরা দেখতে পাচ্ছো না? তোমরা তোমার বাবার একটা ব্যবস’া করতে পারছো না?

রতন সামিনার কাছ থেকে তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে জয়কে ফোন করলো।

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

রতন উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, এই, এই তুই কী শুরু করেছিস এগুলো বলতো?

কী শুরু করেছি মানে?

তুই ঐ মাগীকে ছেড়ে দিবি না?

জয় ধমকের সুরে বললো, রতন মুখ সামলে কথা বলো, বাপের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না।

না, জানি না, তুই আমার বাপ না, তুই বাপ হতে শিখিসনি। আমি তোর কাছ থেকে একটা কথা জানতে চাই তুই ওকে ছেড়ে দিবি কী না?

না।

এই, এই তোকে আমি খুন করবো, আমার পরীক্ষাটা শেষ হোক, এর মধ্যে যদি তুই ওকে ছেড়ে না দিস তবে আমি তোকে খুন করবো, বলে রতন জয়কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা সামিনার হাতে দিয়ে তার রুমে গেলো।

শহীদ চোখ টিপ্পনি মেরে বললো, হুঁম, এরাই পারবে, সামিনা তুই একটা কাজ করবি, সবসময় মানিক-রতনকে দিয়ে ওর বাবাকে ফোন করাবি। এখন রতন ফোন করলো তো, আজ রাতে কিংবা কাল দিনের বেলা একবার মানিককে দিয়ে ফোন করাবি।

ঠিক আছে ভাই।

আমি মামাকে বলি, একটা কেস করো। দেখি জয় ক’টা সামাল দেয়।

সামিনা কিছু বললো না, সে মাথা নত করে কাঁদছিলো। তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

শহীদ বললো, কাঁদিস না, কাঁদিস না। ধৈর্য ধর আমি সব ঠিক করে দিবো, তুই আমাকে চিনিস না।

যেভাবে হোক ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দেন ভাই। ইস্‌ আমার এখন কী হবে।

বলছি তো তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। শোন্‌ আমি একবার জয়পুরহাট যেতে চাচ্ছি।

যান ভাই। আপনি যা ভালো মনে করবেন তাই করুন।

আমাকে ক’টা টাকা দে দেখি।

কত ভাই?

দে, কত দিবি।

সামিনা তার রুমে গেলো ফিরে এসে শহীদের হাতে টাকা দিলো।

শহীদ টাকা হাতে নিয়ে বললো, কত দিলি?

এক হাজার ভাই।

হুঁম সেতো দেখতেই পাচ্ছি কিন’ এই টাকাটা তো যেতে আসতেই চলে যাবে। ওখানে আমার এক ড্রাইভার আছে, ওর বাড়ি ওখানে, ভাবছি ওকে কাজে লাগাবো।

লাগান ভাই।

টাকা লাগবে না পাগলি। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয়।

আমি আর কোথায় টাকা পাবো ভাই।

জয়ের কাছ থেকে নিবি, রতনকে দিয়ে ফোন করাবি, টাকা নিবি, এখন বেশি বেশি করে টাকা নিবি। দু’টা বিয়ে করেছে আর টাকা দিতে পারবে না?

ভাই আপাতত: আপনি ঘুরে আসুন।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমি জয়পুরহাট থেকে আসি। আমার বন্ধুটার সঙ্গে কথা বলে আসি, টাকা লাগলে কিন’ তোকে দিতে হবে। আমি সেভাবে ওকে বলে আসবো আর আসার পর টাকা পাঠিয়ে দিবো।

আচ্ছা ভাই।

 

পঁচাত্তর

 

জয় জীবনে অনেক যুদ্ধ করেছে। সেসব যুদ্ধের একটা ধারণ ছিলো একমুখী যুদ্ধ। নদীতে যেমন স্রোতের একটা ধারা থাকে, পানি সবসময় উজান থেকে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয় অথবা জোয়ারের সময় পানি ভাটি থেকে উজানের দিকে প্রবাহিত হয় আর ভাটার সময় উজান থেকে ভাটির দিকে। জয় স্রোতের প্রতিকূলে চলে বড় হয়েছে। স্রোতের প্রতিকূলে চলে সে অভ্যস’ই বলা যায় কিন’ এবার তার জীবনে যে ঝড় ধেয়ে আসছে বলে সে আগাম কিছু নমুনা প্রত্যক্ষ করছে তা কীভাবে সামাল দিবে ভেবে জয়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না।

আজ বিকেলবেলা জয় যখন অফিসে কাজ করছিলো তখন মানিক ফোন করলো।

জয় রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো। কোথায় তুমি?

অফিসে।

আমার কিছু টাকা লাগবে।

কত?

পাঁচ লাখ।

জয়ের চোখ কপালে উঠলো। তার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো, পাঁচ লাখ।

হ্যাঁ।

এতো টাকা আমি কোথায় পাবো?

সেটা তুমি বোঝো, আমি চাইছি দিতে হবে।

কী করবে এতো টাকা?

আমি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবো।

ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে টাকা লাগে?

টাকা লাগে না। যারা কম্পিটিশন করে চান্স পাবে তারা এমনিতেই পাবে আর যারা তদ্বির করে ভর্তি হবে তাদের তো টাকা লাগবেই।

তুমিও কম্পিটিশন করবে জয় বললো।

আমি কম্পিটিশন করে চান্স পাবো?

কেনো পাবে না?

কেনো পাবো না সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আমার এ্যাডমিশন টেস্টের সময় তুমি এমন একটা কাজ করলে যে আমার ভবিষ্যতটাই তুমি নষ্ট করে দিলে।

আমার কারণে তুমি চান্স পেলে না?

তোমার কারনেই তো। এখন আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দাও আমি টাকা দিয়ে ভর্তি হবো, টাকা দিলে ওরা ভর্তি করে দিবে।

শোনো আমি জীবনে কোনোদিন তদ্বির করে কিছু করিনি, আমি এটাতে বিশ্বাসীও না। তুমি পরীক্ষা দাও, চান্স পেলে ভর্তি হবে আর না পেলে অন্য ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করবে।

তারমানে তুমি টাকা দিবে না?

না।

মুহূর্তেই মানিকের কণ্ঠস্বর বদলে গেলো, সে চিৎকার করে বললো, এই, এই তুই যদি আমাকে টাকা না দিস আর আমি যদি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারি তবে তোকে আমি জবাই করবো, জবাই। এমনিতেই ইরাকে বিয়ে করেছো আমরা কিছু বলিনি। এখন টাকার অভাবে যদি আমি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারি তবে আমি তোকে জবাই করবো, বুঝলে!

জয় কয়েকমুহূর্ত মোবাইল ফোন কানে ধরে রাখলো, তার ঠোঁট দু’টো সামান্য ফাঁক হয়ে হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো, মানিক, তুমি আমার মানিক, আমার ছেলে মানিক, বলতে বলতে জয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা টেবিলে পড়ে গেলো। সে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো।

 

জয় অফিস থেকে বাসায় ফিরলো। প্রতিদিন ঠিক পাঁচটায় ইরা জয়কে ফোন করে বলে, হ্যালো জয়, তাড়াতাড়ি এসো সোনা, আমি তোমাকে খুব মিস করছি।

জয়ও যেনো ইরার ফোনের অপেক্ষায় থাকে। আজও জয় পাঁচটার পর থেকে ইরার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে কিন’ ইরা ফোন করলো না। অবশেষে জয় বাসার দিকে রওয়ানা হলো।

প্রতিদিন জয় কলিং বেলে টিপ দিতেই ইরা দরজা খুলে দেয়। জয় বাসা ঢোকামাত্র ইরা তার বুকে মাথা রাখে কিন’ আজ জয় কয়েকবার কলিং বেল টিপলো, ইরা দরজা খুললো না। তারপর ইরার মোবাইল ফোনে রিং দিলো।

ইরা দরজা খুলে দিলো তার চোখ-মুখ অন্ধকার, গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার ছাপ এখনো মিশেনি।

ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে জয়ের বুকটা যেনো কেঁপে উঠলো, কী হয়েছে ইরা?

ইরা কোনো কথা বললো না রুমে গিয়ে ঢুকলো।

জয় ইরার পিছনে পিছনে রুমে ঢুকে উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, ইরা, কী হয়েছে ইরা?

ইরার দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে কিন’ মুখে কিছু বলছে না। জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো, ইরা, কী হয়েছে ইরা আমাকে বলো?

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আজ ছলিম চাচা ফোন করেছিলো।

ছলিম চাচা, ছলিম চাচা বলে জয় মনে করার চেষ্টা করলো কিন’ মনে করতে না পেরে ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, ছলিম চাচা কে ইরা?

ছলিম চাচা আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য জয়।

খারাপ কিছু বলেছে ইরা?

ইরা মাথা উঁচু-নিচু করে জানালো খারাপ কিছু বলেছে।

জয় জিজ্ঞেস করলো, আমাকে বলো ইরা কী বলেছে?

এতো শক্ত কথা আমি তোমাকে বলতে পারবো না।

কেনো কী বলেছে? তুমি বলো ইরা, সেটা যত শক্ত আর নিষ্ঠুরই হোক।

জয় আমাদের ওপর অনেক ঝড় আসছে জয়, জানি না তুমি এই ঝড় সামাল দিতে পারবে কী না।

তুমি বলো ইরা যত বড় ঝড়ই আসুক আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।

জয়, জয় বলে ইরা জয়ের বুকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মিশে দিয়ে বললো, জয় ছলিম চাচা বলছে ওখানে না গেলে নাকি আমার চাকরিটা থাকবে না।

ইরা!

আমি বুঝতে পাচ্ছি জয় মতিই এসব চাল চালছে। মতি খুব ঘিরিঙ্গিবাজ জয়, ওর সঙ্গে নোংরামিতে তুমি পারবে না।

জয় ইরা মুখটা তার বুক থেকে উপরে তুললো, তার চোখে চোখ রেখে বললো, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি সব পারবো ইরা, সব। যত বড় ঝড়ই আসুক আমরা একসঙ্গে লড়াই করবো, আমরা এক থাকলে দুনিয়ার কোনো শক্তি আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ইরা।

আল্লাহই ভালো জানেন জয় কী আছে আমাদের কপালে।

ওপরে আল্লাহ আর নিচে আমার ওপর ভরসা রাখো ইরা, আর তুমি আমার সঙ্গে থেকো ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের সফল করবেন।

তাই যেনো হয় জয়।

জয় ইরা আবার বুকে টেনে নিয়ে বললো, তাই হবে ইরা।

 

ছিয়াত্তর

 

মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। জয় আর ইরার স্বপ্ন ছিলো বিয়ের পর জয় বগুড়া বাসা ভাড়া নিবে এবং ভবিষ্যতে বগুড়ায় বাড়ি করবে, তাদের ঘরে ছোট্ট একটা মেয়ে আসবে, দু’জনে তার নামও ঠিক করেছিলো, জুঁই। প্রতিদিন সকালবেলা ইরা নাস্তা তৈরি করবে, দু’জনে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়বে যার যার কাজে, বিকেলে দু’জনে বাসায় ফিরবে, কলকাকলীতে ভরে উঠবে তাদের ছোট্ট নীড়। ছোট্ট একটা মেয়ে বাসায় এলোমেলো পাঁয়ে দৌড়াদৌড়ি করে খেলবে মা’র কোল থেকে বাবার কোলে পিঠে।

যেদিন স্কুল বন্ধ থাকবে সেদিন জয় মোটর সাইকেলে করে ইরাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসবে আবার বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসবে। আর সেজন্যই বিয়ের পর জয় প্রথম ফোন করেছিলো তার বন্ধু এবং সি.বি.এ নেতা সিরাজকে। সিরাজ জয়ের বিয়ে করার কথা শুনে কয়েকমুহূর্ত চুপ করেছিলো তারপর ধীর শান্ত কণ্ঠে বলেছিলো, ভুল করে ফেলেছো বন্ধু। তোমার এতোদিনের সংসার, দুই ছেলে, তাদের লেখাপড়া…

সিরাজ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো। জয় মিনমিন করে বললো, যা হবার হয়ে গেছে লিডার এখন আমার এখান থেকে বগুড়া বদলি হওয়া দরকার, তুমি চেষ্টা করে দেখো।

বগুড়া কেনো?

তোমার ভাবীর স্কুল থেকে বগুড়া কাছে।

তুমি এখন কোথায়?

জয়পুরহাট।

বাসায়।

ভাবী আছে পাশে।

হুঁম, কথা বলবে, বলে জয় ইরাকে ফোনটা দিলো।

ইরা সালাম দিলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন ভাবী?

জি ভাই ভালো, আপনি?

এই তো আছি আর কী বলে সিরাজ একটু তিরস্কারের সুরে বললো, তবে আপনাদের মতো ভালো নেই ভাবী।

ইরা বললো, আরেকটু ভালো থাকার ব্যবস’া করে দিন ভাই। ওর বদলিটা যদি বগুড়ায় হয় তবে আমি ওখান থেকে স্কুল করতে পারবো।

সিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললো, তা তো বুঝছি, আমি তো বদলি করবো না, আমি চেষ্টা করতে পারি। দেখি চিফ স্যারকে বলে।

প্লিজ ভাই! আমাকে ছোট বোন মনে করে চেষ্টা করুন।

আচ্ছা ভাবী, জয়কে একটু ফোনটা দিন।

জয় ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, হ্যালো।

সিরাজ কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, কাজটা তুমি ঠিক করোনি। তুমি আমার বন্ধু মানুষ আমি চেষ্টা করছি কিন’ চিফ স্যার বিষয়টা কীভাবে ন্নিে আমি জানি না।

তুমি চেষ্টা করো বন্ধু, বাকিটুকু আল্লাহ ভরসা।

সিরাজের সঙ্গে কথা বলার পর জয় বদলির দরখাস্ত দিলো। সিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলো মাঝে মাঝে জয়ের ফোনে ইরাও সিরাজের সঙ্গে কথা বলে অনুরোধ করে কিন’ সেদিক থেকেও কোনো ভালো সাড়া পাওয়া গেলো না।

 

সেদিন সন্ধ্যায় ইরা রান্না করছিলো আর জয় বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় শুয়েছিলো। ইরা রান্না শেষ করে রুমে এলো, জয়ের মাথার কাছে বসে চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কী ভাবছো জয়?

জয় শুষ্ক মুখে বললো, কিছু না।

আমার কাছে লুকাচ্ছো কেনো? তুমি খুব দুশ্চিন্তা করছো। আমি আমার জয়কে চিনি, যে হাসি দেখে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি সে হাসিটা আজ ক’দিন থেকে দেখছি না। কী ভাবছো জয়?

জয় একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, কিছু না ইরা।

ইরা বললো, তোমাকে একটা কথা বলবো?

জয় ইরার মুখের দিকে তাকালো, বলো।

তোমার বদলির কি কোনো খবর হলো?

জয় না সূচক মাথা নাড়লো।

চেষ্টা করো জয়, আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমি সবসময় শুধু বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকছি। বাইরে বের হলে মনে হয় কেউ বুঝি আমাকে দেখে ফেলছে।

তুমি ঠিকই বলেছো ইরা বলে জয় তার মোবাইল ফোনে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর সিরাজকে ফোন করলো।

সিরাজ ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো।

হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম বলে সালামের জবাব দিয়ে সিরাজ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, বলো কী খবর তোমার?

লিডার খবর তো আপনার কাছে।

তোমার খবর খারাপ। সেজন্য আমি তোমাকে ফোন দিইনি।

জয়ের বুকটা যেনো কেঁপে উঠলো, কী খারাপ লিডার।

চিফ স্যার তোমার ওপর খুব ক্ষেপে গেছে। আমি তোমার বিয়ে করার কথা বলিনি কিন’ স্যার কার কাছে শুনেছেন জানি না। তোমার বদলির কথা বলতেই বললেন, তুমি ঐ ছেলের কথা বলো না। ও চাকরি করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। নিজের সংসার তো গেলো ডিপার্টমেন্টেরও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো।

জয় কিছুক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো।

সিরাজ বললো, হ্যালো।

বলো।

স্যার বললেন, ওকে বগুড়া বদলি করলে তো ওর প্রাইজ পোস্টিং হয়, ওকে রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ি বদলি করে দিই।

সিরাজের কথা শুনে জয়ের মুখ শুকিয়ে গেলো। বুক কেঁপে উঠলো।

সিরাজ বললো, তবে তুমি দিনাজপুর বদলি হতে চাইলে চেষ্টা করতে পারি, তখন হতেও পারে।

ইরা মোবাইল ফোনের কাছে কান রেখে সেও সিরাজের কথা শুনছিলো। এবার সে না সূচক মাথা নাড়লো।

তুমি কী বলেছো লিডার?

আমি বলেছি তাহলে ওখানেই থাক।

ভালো করেছো লিডার।

সিরাজ কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললো, তুমি এমন একটা কাজ করেছো যে জোর দিয়ে তদ্বিরও করা যায় না। তবু আমি চেষ্টা করছি, তুমি একটু ধৈর্য ধরো।

ধন্যবাদ লিডার।

মোবাইল ফোন রেখে দিতেই ইরা জয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, জয়, এখন কী হবে জয়! তোমাকে যদি দূরে কোথাও বদলি করে দেয় তবে আমার চাকরির কী হবে জয়! আর চাকরির কথা ভাবলে তো তোমাকে ছাড়তে হবে জয়! জয় আমি তোমাকে হারাতে পারবো না! জয় আমার জয়!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, তুমি কিছু ভেবো না ইরা। আমি কোথাও যাবো না। বগুড়ায় বদলি হতে না পারলে আমি এখানেই থাকবো। তোমাকে ছাড়া আমিও বাঁচবো না ইরা বলতে বলতে জয়ের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

 

সাতাত্তর

 

সকালবেলার এই সময়টা, যখন জয় অফিস চলে যায় তখন ইরার বেশ কষ্ট হয়। স্কুলের স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আগে যখন তার চাকরি ছিলো তখন সকালবেলা উঠে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা তৈরি করতো, মতি নাস্তা খেয়ে স্কুল চলে যেতো, ইরাও তার স্কুল চলে যেতো। ক্লাসে যাওয়ার আগে স্কুলের সহকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, কয়েকমিনিটের একটা ছোট্ট আড্ডা। এই আড্ডার মধ্যে কারও কারও দাম্পত্য জীবনের অম্লমধুর সম্পর্কের টুকটাক বিষয়াদিও উঠে আসতো হাসি-ঠাট্টার ছলে। তারপর ইরা ক্লাসে চলে যেতো।

একজন শিক্ষক হিসেবে ইরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলো। ক্লাসে যাওয়ামাত্র ছাত্র-ছাত্রীরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতো, আসসালামুয়ালায়কুম ম্যাডাম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। ভালো আছো তোমরা সবাই?

জি ম্যাডাম।

 

ক’দিন থেকে জয় অফিস যাওয়ার সময় ইরার স্কুলের স্মৃতিগুলো যেনো হৃদয়ে বেশি করে ভেসে উঠছে। স্কুলের সঙ্গে তার কত বছরের সম্পর্ক। অথচ আজ তার স্কুল নেই, চাকরি থাকবে কী না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও গতকাল জয় অফিস থেকে ফিরে বললো, মুকুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, কোন মুকুল?

মুকুলকে চেনো না, তোমার বান্ধবীর হ্যাজবেন্ড, হেডমাস্টার মুকুল।

কী বললো?

ওর সাথে তোমার চাকরির বিষয়ে পরামর্শ করলাম, বললো বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি খাওয়া সহজ কাজ না। আপাকে ধৈর্য ধরতে বলেন।

ইরা কিছুটা উত্তেজনার সঙ্গে বললো, কিন’ কতদিন?

এটা কমিটির বিষয় ইরা। তারা যদি এভাবে কেসটাকে ঝুলিয়ে রাখে তবে কিছু করার নেই। তারা যদি ভাবে একজন শিক্ষক কম থাকায় ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে তবে তারা তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিবে।

এটা তারা করবে না জয়। তাদের কাছে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতিটাই বড়। এলাকার সবাই এখন আমার চাকরিটা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে।

একসময় থেমে যাবে ইরা।

তাই যেনো হয় জয়।

ইরা তার মোবাইল ফোনে সময় দেখলো, সকাল দশটা বাজে। ঠিক তার ক্লাসে যাওয়ার সময়। ইরার চোখের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখগুলো ভেসে উঠলো। ইরা বুক চিরে একটা করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, হায় আল্লাহ আমার জীবনটা কতদিনে স্বাভাবিক হবে।

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

পুতুল ফোন করেছে। এই পুতুলও একদিন ইরার ছাত্রী ছিলো। তারপর ইরা বউমা, বউমা বলে ডাকতো। সেই পুতুল এখন তার সত্যিকারে বউমা। বিয়ের আগে পুতুল ফোন করেছিলো। অনেক কান্নাকাটিও করেছিলো, ইরা সান্ত্বনা দিয়েছিলো। বিয়ের পর কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন’ কী বলবে ইরা ভেবে পাচ্ছিলো না তাই ফোন রিসিভ করেনি।

ইরা ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো ততক্ষণে কল শেষ হয়েছে। আবার ফোন বেজে উঠলো। ইরা ফোন রিসিভ করলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম আম্মা।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কেমন আছো মা?

ভালো নেই আম্মা।

কেনো?

আপনি না থাকলে আমি কীভাবে ভালো থাকি আম্মা। সবসময় শুধু আপনার কথা মনে পড়ে। আগে কত এসেছি এ বাড়িতে, আপনি কত আদর করে খাওয়াতেন, আমার চুল বেঁধে দিতেন। অথচ এখন আমি একেবারে এসেছি আর আপনি নেই।

ইরা কানের কাছে ফোন রেখে চুপ করে ছিলো। ইরার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছিলো, চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসছিলো।

পুতুল ইরার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বললো, হ্যালো আম্মা।

বলো মা।

আপনি চলে আসেন আম্মা, আপনি নেই, আমাদের কারও মনে শান্তি নেই আম্মা।

ইরা অভিমানের সুরে বললো, শান্তি নেই কেনো? আমি তো তোমাদের সবকিছু দিয়ে এসেছি বউমা। বাড়ি-ঘর সবকিছু, তোমার শ্বশুর বাজার করবে, তুমি রান্না করবে।

ঠিকই বলেছেন আম্মা, আপনি সবকিছু দিয়ে গেছেন, বাড়ি-ঘর দিয়ে গেছেন কিন’ বাড়ির প্রাণটাই নিয়ে গেছেন, শান্তিটাই নিয়ে গেছেন। শুভ কয়েকদিন থাকলো কেমন যেনো ঝিম মেরে, কারও সাথে তেমন কোনো কথা নেই, আমার সাথেও কেমন যেনো রুক্ষ্ম ব্যবহার করলো। আপনার ছেলেও কেমন যেনো হয়ে গেছে আম্মা।

তুমি সবকিছু ঠিক করে নাও বউমা। প্রাণহীন বাড়িকে প্রাণবন্ত করো, তোমার ভালোবাসা দিয়ে শুভকেও তুমি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো বউমা। তুমি হয়তো জানো না শুভ আর তোমার শ্বশুর মনে করতো ঐ বাড়িতে আমি সব অশান্তির মুল তাই তারা আমাকে যথেচ্ছা অপমান করতো। তাই আমি চলে এসেছ বউমা, অশান্তির বিষবৃক্ষ তোমাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছে এখন তোমরা প্রাণবন্ত, শান্তিময় সংসার গড়ো। শুভ তোমার স্বামী, তুমি যেভাবে গড়ে তুলবে তোমার স্বামী-সংসার সেভাবে গড়ে উঠবে, কথাগুলো বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

পুতুল বললো, এসব কথা আমাকে কেনো বলছেন আম্মা? আমি ছোট মানুষ বড়দের এসব মান-অভিমান, মান-অপমানের মধ্যে আমাকে টেনে আনলে তো আমি কিছু বুঝবো না আম্মা। আমি শুধু জানি স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাইকে নিয়ে আমি সংসার করবো কিন’ আমার কপালই খারাপ। নতুন বিয়ে হলো স্বামী সবসময় মনমরা হয়ে থাকে, ঘুমের মাঝে ছোট বাচ্চার মতো মা, মা বলে চিৎকার করে উঠে, কিছু বলতে গেলে তেড়ে আসে। এভাবে কয়েকদিন থেকে তো চলে গেলো এখন দশবার ফোন দিলে একবার ধরে, বার বার ফোন দাও কেনো বলে ধমক দেয়।

ওরা এরকমই বউমা। এটা ওদের বংশগত সমস্যা। ওরা বউদের কখনো সম্মান দিতে জানে না, শুধু ধমক দিতে জানে, শাসন করতে জানে, তুমি শান্ত মেয়ে, তুমি সবকিছু ম্যানেজ করে চলতে পারবে বউমা।

আপনার ধারণা ঠিক না আম্মা। ওরা এরকম না। আপনি শুভ’র মনের অবস’াটা একবার ভেবে দেখুন আম্মা। এ অবস’ায় কোনো সন্তানের মন তো এমন রক্ষ্ম হওয়াই স্বাভাবিক। আপনি হয়তো আব্বাকে দোষ দিবেন কিন’ আমি কীভাবে একটা মেনে নিবো যে লোক গভীর রাত পর্যন্ত একা ছাদের ওপর পায়চারি করে, স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করে, বিড়বিড় করে কথা বলে, হু হু করে কেঁদে ওঠে। আপনি ভুল বুঝেছেন আম্মা। আপনি আসুন আম্মা, আপনি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মা….বলে পুতুল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন’ ইরা মোবাইলের ফোন কেটে দিলো।

আটাত্তর

 

নিত্যদিনের মতো জয় অফিস থেকে বাসায় ফিরলো। ইরা দরজা খুলে দিলো কিন’ ইরার মুখে প্রতিদিনের মতো হাসি নেই। সে দরজা খুলে দিয়েই বেডরুমে চলে গেলো। জয় পেছনে পেছনে বেড রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, ইরা?

ইরা মলিন কণ্ঠে বললো, বলো।

কী হয়েছে ইরা?

কিছু না।

জয় ইরার দু’বাহুতে হাত রেখে চোখে চোখ রাখলো, ইরা, সত্যি করে বলো তো ইরা কী হয়েছে?

বলছি তো জয় কিচ্ছু হয়নি।

জয় ইরার বাহুতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ইরা, আমি যে আজ বাইরে লাঞ্চ করবো সেকথা তো তোমাকে বলেই গেছিলাম। আমি তোমাকে বলেছিলাম আজ আমাদের মঙ্গলবাড়ী কলেজের ঢালাই আছে, ওখানে লাঞ্চের ব্যবস’া আছে। তুমি একবার মনে করে দেখো সকালে যাওয়ার সময় বলেছিলাম কী না।

ইরা মৃদু শান্ত কণ্ঠে বললো, আমার মনে আছে জয়।

ইরা তুমি লাঞ্চ করেছো? রান্না করেছিলে?

জয় একথা তুমি এখন জিজ্ঞেস করবে? লাঞ্চ করার সময় কি আমাকে একবার ফোন করেছিলে?

জয় ইরার কথায় যেনো চমকে উঠলো, তারমানে তুমি দুপুরে রান্নাও করোনি, লাঞ্চও করোনি। সরি ইরা, সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। আসলে ঢালাই’র সময় প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হয় তো তাই তোমাকে ফোন করতে পারিনি। ইসস্‌, এখন তো সাড়ে পাঁচটা, আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে নাও আমি তোমাকে রুচিতাতে লাঞ্চ করাবো।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রাখলো, আমার জন্য এতো চিন্তা করোনা জয়। একদিন লাঞ্চ না করলে কিচ্ছু হবে না।

আচ্ছা লাঞ্চ করোনা ইরা তবু চলো, তুমি রেডি হয়ে নাও। আগে রুচিতায় যাই তুমি কিছু খাও, তারপর দু’জনে বের হবো।

কোথায়? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

সেকথা না হয় গিয়েই বলি।

উফফ্‌, তুমি এমন করে আমাকে বলো, যে আমি তোমাকে না করতে পারি না। বলে ইরা কাপড়-চোপড় পরলো। তারপর দু’জনে বের হলো।

 

রুচিতা থেকে সেই দুপুরের লাঞ্চ বিকেলে করে দু’জনে মোটর সাইকেলে উঠলো। ইরা মোটর সাইকেলে উঠে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবে জয়?

বারো শিবালয়।

বারো শিবালয় কেনো?

কোনো কারণ নেই, আমাদের প্রিয় জায়গা, বারো শিবালয়, ছোট যমুনা নদী তীর, শতবর্ষী বটগাছ, তোমার ভালো লাগে না ইরা?

অবশ্যই। আমারও খুব প্রিয় জায়গা। আমি জানি তুমি বেছে বেছে আমার পছন্দের ভালো কাজগুলোই করবে। আজ আমি মন খারাপ করেছি তাই আমাকে আমার পছন্দের জায়গাগুলোতে নিয়ে যাবে।

ঠিক বলেছো কিন’ আজ নিয়ে যাওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে ইরা।

এভাবে থেমে থেমে বলছো কেনো? তুমি না উপন্যাস লিখতে লিখতে জটিল হয়ে গেছো। উপন্যাসে যেমন প্রত্যেক পাতায় পাতায় আকর্ষণ ধরে রেখে কৌশলে পাঠককে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নিয়ে যাও আজকে আমাকে বারো শিবালয় নিয়ে যাবার কারণটাও বলতে বলতে কি আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে?

জয় হো হো করে হেসে উঠলো, তুমি ঠিকই ধরেছো।

জয় সত্যি সত্যি তাই করলো। কথা বলতে বলতে মোটর সাইকেল নিয়ে বারো শিবালয় মন্দিরের পাশ দিয়ে শতবর্ষী বটগাছের নিচে, ছোট যমুনার তীরে এসে দাঁড়ালো।

দু’জনে মোটর সাইকেল থেকে নামলো।

ইরা জিজ্ঞেস করলো, এবার বলো।

ইরা দেখো দেখো দৃশ্যটা কত সুন্দর। নদী, নদী পারাপারের ছোট নৌকা, নদীর তীরে বটগাছ, দু’পাশে কাশফুল।

হুঁম। অবশ্যই সুন্দর বলে ইরা জয়কে জিজ্ঞেস করলো, কিন’ জনাব আজ এখানে আসার হেতু কী? একটা তো আমার মন ভালো করা, আর একটা?

জয় মাথা উঁচু করে বটগাছের ডালপালার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেলো। ইরা আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই বটগাছে দু’টো পাখি প্রথম বাসা বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলো। সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়েছে ইরা তাই এই বিশেষ দিনে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা ইরা।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে আবেগ আল্পুত হয়ে বললো, জয়! আমার জয়! তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো! তুমি ঠিকই মনে রেখেছো আমাদের স্মৃতিময় দিনটার কথা। তুমি আমাকে নিয়ে, আমাদের ভালোবাসা নিয়ে ভাবো কখন জয়। সারাদিন তো অফিসে বসে আর না হয় স্কুল-কলেজে ঘুরে ঘুরে কাজ দেখে বেড়াও এতো ব্যস্ততার পর তুমি এতোকিছু মনে রাখো কীভাবে?

ইরা।

জয় আমার এখন মনে পড়েছে গতবছর এই দিনে আমরা প্রথম এখানে এসেছিলাম তারপর এই ছোট যমুনা আর এই বটগাছের নিচে বসে আমরা কত স্বপ্ন দেখেছি। বলে ইরার মুখ যেনো একটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো, জয়!

বলো ইরা।

আমার খুব ভয় করছে জয়।

কীসের ভয় ইরা?

ঝড়ের, আমাদের ওপর কত ঝড় আসছে আর যাচ্ছে, কোনদিন জানি এমন ঝড় আসে যেদিন আমাদের ভালোবাসাই শুধু নয় ভালোবাসার শেকড় পর্যন্ত উপড়ে যায়।

জয় কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, ইরা, তুমি সবসময় নেগেটিভ কথা বলো কেনো, বলোতো?

আমার খুব ভয় করে জয়।

আমি আছে ইরা, আমরা সবকিছু কাটিয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ।

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

সামিনা ফোন করেছে।

জয় কয়েকমুহূর্ত মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখে লাইন কেটে দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, রিসিভ করলে না কেনো? কে ফোন করেছে রিসিভ করো?

জয় আমতা আমতা করে বললো, না থাক।

মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠলো। ইরা ধমকের সুরে বললো, রিসিভ করো বলছি।

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে সামিনার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এই তুমি আজ আসছো না?

জয় আমতা আমতা করে বললো, না।

কাল সকাল সকাল চলে এসো।

আমি যেতে পারবো না, আমার কাজ আছে।

সামিনা আরও সহস্রগুণ জোরে চিৎকার করে বললো, এই, এই তোর কী কাজ আছে আমি জানি না। তুই ঐ মাগীকে নিয়ে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছিস্‌ আর বলছিস কাজ আছে। কাল সকালবেলা এসে তুই আগে যেমন দু’ছেলেকে নিয়ে বাজার করতিস তেমনি  বাজার যাবি। যদি না আসিস তবে আমি তোর কোনো কথা শুনবো না। একটা কথা ভুলে যাস না, আমার বিনা অনুমতিতে তুই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিস, আমি চাইলে এখনো তোর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি, বলে সামিনা জয়কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

জয়ের কথা বলা শেষ হতে না হতেই ইরা প্রচণ্ড রেগে বললো, ও এতোক্ষণে আমি বুঝেছি কাল তুমি দিনাজপুর যাবে সেজন্য তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে। শোনো জয় তোমাকে একটা কথা বলে রাখি তুমি যদি কাল দিনাজপুর যাও তবে আমিও তোমাকে দেখে ছাড়বো।

জয় ইরার দু’হাত ধরে বললো, ইরা প্লিজ মাথা ঠাণ্ডা করো, একটু ধৈর্য ধরো, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, এভাবে হয় না জয়। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তবে কাল তুমি যাবে না।

 

উনাশি

 

ঘরের টান জয়ের কোনোদিনই ছিলো না। আসলে ঘর বলতে তো একটা চার দেয়ালের বাসস’ান না, ঘরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ঘোরণী, আর ঘোরণী তো সেই যে রমণী চার দেয়ালের ভেতরে একটা ঘোরের মধ্যে সুখ-শান্তি দিতে পারে সেই-ই। সামিনা কোনোদিন সেরকম রমণী ছিলো না। বাসায় এলেই কোনো না কোনো ছুঁতোয় জয়ের সাথে সামিনার মনোমালিন্য হতো। আর সেজন্য সারাজীবন জয় কাজের অজুহাতে বাসার বাইরে থেকেছে। সারা সপ্তাহ বাসার বাইরে থাকার পরও সামিনার প্রতি আকর্ষণ জয়কে কাছে টানতো না কিন’ ঐ মানিক-রতন! মানিক-রতন সেই বুধবার হতে না হতেই ফোন দিতো, আব্বা কাল কখন আসবে? তাড়াতাড়ি এসো কিন’।

জয় ছুটে আসতো সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কিন’ বাসায় এসে যখন সামিনার সঙ্গে তার মনোমালিন্য হতো তখন সামিনা মানিক-রতনকেও পড়ার টেবিল থেকে নিয়ে আসতো। বেড রুম কিংবা ডাইনিং স্পেস থেকে জোরে ডাক দিতো, মানিক-রতন এদিকে আয়তো।

মানিক-রতন দু’জনে পড়ার টেবিল থেকে দৌড়ে আসতো। মা-বাবার ঝগড়ার মধ্যে সম্পৃক্ত হতো। খুব অল্প বয়স থেকে তারা সংসারের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছে। জয় সামিনাকে অনেকবার নিষেধ করেছে মানিক-রতনকে সম্পৃক্ত না করতে কিন’ সামিনা মানিক-রতনকে জয়কে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছে। দিনে দিনে বাবার বিরুদ্ধে সন্তানদের বিষিয়ে তোলা সন্তানরা বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে। আগে যে সন্তানদের টানে দূর থেকে বাসায় ছুটে আসতো তারাও যখন বাবা-মা’র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে তখন এই বাসাটাও জয়ের আর নিজের বাসা বলে মনে হয় না।

আজকাল সকালবেলা জয় যখন জয়পুরহাট থেকে রওয়ানা দেয় তখন তার মন টানছিলো না। বিশেষ করে এই ক’দিনে মানিক-রতনের আচরণ আর ইরার সেই ছলছল করা চোখ আর করুণ মুখচ্ছবি যেনো তাকে বার বার বলছিলো, জয় যেওনা, জয়। জয় আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। ওরা তোমাকে মারবে জয়।

ইরা হয়তো সত্যিই বলেছিলো, ওরা তোমাকে মারবে জয়।

সন্ধ্যায় সামিনা কথা তুললো, বরাবরের মতো রুক্ষ্ম স্বরে, তুমি ও মাগীটার কী করলে?

জয় রেগে গেলো, সামিনা মুখ সামলে কথা বলো। ইরা আমার স্ত্রী।

মাগী না তো কী। যে মেয়ে স্বামী-সংসার ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে আসতে পারে সেতো মাগীই। ইসস্‌ কেমন মেয়ে স্বামীটা ওর জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চাকরিটা চলে যাচ্ছে। তবু মাগীটার সখ মিটে না।

জয় গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কীভাবে জানো এসব?

জানবো না, আমাকে জানতে হবে। আমি সব খবর জানি, তোমার কাছে থাকলে ও আর কোনোদিন চাকরিটা ফিরে পাবে না। চাকরি করতে চাইলে ওকে মাস্টারের কাছে ফিরে যেতে হবে, বলে সামিনা বেড রুম থেকে বারান্দায় গিয়ে আবার ফিরে এসে সুর পাল্টে বললো, তুমি ওকে ছেড়ে দাও মানিকের আব্বা, মাস্টার ওর জন্য পাগল হয়ে গেছে। লোকটা যেকোনো দিন মারা যাবে।

জয় জিজ্ঞেস করলো, তাহলে মাস্টারের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?

হ্যাঁ আছে তো। মাস্টার আমাকে ফোন করে বলে আপা আপনি আপনার স্বামীকে বোঝান, আমার ইরাকে আমাকে ফিরিয়ে দিক।

ও মাস্টার তাহলে তোমাকে তদ্বির ধরেছে?

ধরবেই তো, আমাকে তদ্বির ধরেছে, ঐ মাগীটার সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করেছে।

ইরা মতির সঙ্গে কথা বলে?

অবশ্যই বলে, তুমি না থাকলে বাসাতেও আসে কী না আল্লাহই ভালো জানেন।

সামিনা! জয় জোরে ধমকের সুরে বললো।

আমাকে ধমক দিবে না। যে পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলে তাকে ধমকাও।

জয় ইরার মোবাইলে ফোন করলো কিন’ ইরার ফোন ওয়েটিং। ইরা কথা বলছে।

জয় বার বার ফোন করলো কিন’ ইরার কথা চলছেই যেনো ম্যারাথন গতিতে। অনেকক্ষণ পর ইরার কথা বলা শেষ হলো। সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

জয় গম্ভীর স্বরে বললো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো।

কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

একটা ফোন এসেছিলো।

ফোন এসেছিলো সেটা তো বুঝতে পারলাম কিন’ সেই ফোনটা কার?

ইরা মৃদু কণ্ঠে বললো, মতি ফোন করেছিলো জয়।

কী বললো?

খুব খারাপ খবর দিলো জয়।

খারাপ খবর! জয় অস্ফুটস্বরে বললো।

হ্যাঁ।

সেটা আমি থাকতেও দিতে পারতো! মতি কি জানে নাকি যে আমি দিনাজপুর এসেছি।

হয়তো জানে, আবার অনুমানও করেও ফোন করতে পারে।

যা-ই হোক আমার অনুপসি’তিতে তুমি মতির সঙ্গে কথা বলা ঠিক করোনি ইরা।

আমি তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করিনি জয়। প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। তুমি আগে এসো কী বলেছে তোমাকে সব বলবো। তুমি কাল সকাল সকাল এসো জয় আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

আচ্ছা বলে জয় ফোন রেখে দিলো।

জয় যখন ইরার সঙ্গে কথা বলছিলো সামিনাও তখন মোবাইল ফোনের কাছে কান রেখে দু’জনের কথা শুনছিলো। জয় ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে সামিনা তিরস্কারের সুরে বললো, শুনলে তুমি নেই আর তোমার স্ত্রী তার সাবেক স্বামীর সঙ্গে কথা বলছে। অন্য কোনো স্বামী হলে…

জয় ধমকের সুরে বললো, সামিনা।

সামিনাও গর্জে উঠলো, আমাকে ধমক দিবি না। ধমক দিতে হলে ঐ মাগীকে দে, আমিও একটা কথা বলে রাখছি আগামীকাল আমি তোকে যেতে দিবো না।

জয় বললো, তুমি বললেই হলো।

হ্যাঁ, আমি বললেই হলো। আমার কথা হলো তুই আগে যেমন শুক্রবার শনিবার আমার কাছে থাকতিস সেভাবে থাকবি। এর ব্যতিক্রম হলে আমি তোকে ছাড়বো না।

জয় রাগান্বিতস্বরে বললো, কী করবে তুমি?

রতন তার পড়ার রুমে ছিলো এবার সে তার রুম থেকে বেরিয়ে জয়কে ধমকের সুরে বললো, এই কী হয়েছে? এতো চিৎকার করছিস কেনো?

জয় শান্ত রাগান্বিতস্বরে বললো, রতন তুমি তোমার পড়ার টেবিলে যাও। এটা বাবা-মা’র বিষয় তাদেরকে বুঝতে দাও।

রতন গর্জে উঠলো, না এটা শুধু বাবা-মা’র বিষয় না। আমাদেরও বিষয়। আমি সব শুনেছি, শোন্‌ তুই কাল যেতে পারবি না। ব্যস, এর বেশি আমি তোকে কিছু বলতে চাই না, বলে রতন জয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো।

 

আশি

 

দরজা খুলে দিয়ে ইরা হন হন করে বেড রুমে ঢুকলো। জয় মৃদুকণ্ঠে ইরা ইরা বলে ডাকতে ডাকতে বেড রুমে ঢুকলো, ইরা, কী হয়েছে ইরা?

ইরার চুলগুলো এলোমেলো, চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ। জয় ইরার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। ইরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বললো, না, তুমি আমাকে ছুঁবে না।

কেনো?

বলছি তুমি আমাকে ছুঁবে না। সারারাত সামিনার সঙ্গে ফূর্তি করে এসে তুমি এখন এসেছো আমাকে বুকে টেনে নিতে, না?

ইরা!

এভাবে হয় না জয়, এভাবে হয় না। আমি তোমাকে এভাবে চাইনি, আমি তোমার খণ্ডিত প্রেম চাইনি। আমার সব ছিলো, সব, আর আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছি শুধু একটু ভালোবাসার জন্য কিন’ তুমি আমাকে একটু ভালোবাসা দিতে পারোনি, যা দিয়েছো তা আংশিক, কৃত্রিম ভালোবাসা।

তুমি এসব কী বলছো ইরা! আমি তোমাকে একদিন বলেছি না ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ কাকে বলে। আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরা, পুরোপুরি, শতভাগ, আমার সম্পুন্ন হৃদয় দিয়ে। যদি দেখানো যেতো তবে আমি তোমাকে হৃদয় খুলে দেখাতাম। তুমি যেমন একটু ভালোবাসার জন্য সবকিছু ছেড়ে এসেছো তেমনি আমিও একটু ভালোবাসার জন্য সারাজীবন ছুটে বেড়িয়েছি। অনেক সাধনার পর আমি তোমাকে পেয়েছি।

তাহলে তুমি শুধু আমার হতে জয়! শুধু আমার হতে!

আমি তো তোমারই ইরা দায়িত্ববোধের কারণেই শুধু ওখানে যাই, তুমি বলো ওখানে গিয়েই কি একমুহূর্ত তোমাকে ভুলে থাকতে পারি। সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবি তোমাকে নিয়েই চিন্তা করি, বলতে বলতে জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জয়, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে এসেছি প্লিজ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও না।

জয় মৃদু ধমকের সুরে বললো, ইরা এসব তুমি কী ভাবছো, আমি তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো, এটা কি আমি কখনো মনে আনতে পারি।

সবাই বলছে জয়, আমার চাকরিটা চলে যাবে, তুমি বদলি হয়ে চলে যাবে, তখন, তখন আমার কী হবে জয়!

আমি বুঝতে পাচ্ছি ইরা, আমার সম্পর্কে কেউ তোমার কান ভারী করেছে। এসব কথা আসছে কেনো, আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তোমার চাকরি না থাকলে তোমাকে আমি ছেড়ে চলে যাবো, বলে জয় ইরার মুখ উঁচু করে চোখের দিকে তাকালো, তুমি আমাকে বলোতো কে তোমাকে এসব কথা বলছে, কে আমাদের সম্পর্কের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করছে। ও আমি বুঝেছি গতকাল মতি তোমাকে এসব কথা বলেছে, না?

শুধু মতি না জয়, আরও অনেকে বলেছে।

জয় ইরাকে ছেড়ে দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো, মতি তোমাকে আর কী কী বলেছে?

মতি বলেছে, আমার চাকরির বিষয়ে নাকি স্কুল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে স্কুলে গভর্নিং কমিটির মিটিং হবে, মিটিংয়ে তারা আমার বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে।

আর?

আর বলেছে, সামিনার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে।

কী কথা?

সামিনা বলেছে তোমার বড় ছেলে এ্যাডমিশন টেস্ট দিচ্ছে, আগামী মাসে ছোট ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলে ওরা জয়পুরহাট এসে কোমরে দড়ি বেঁধে তোমাকে নিয়ে যাবে।

মাস্টার বলেছে, আমাদের স্কুলের কমিটি আর হেড স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, কোনোকিছু ঘটে যাওয়ার আগে আমি যেনো চাকরিটা রক্ষা করার চেষ্টা করি। ও আর একটা ফোন এসেছিলো, বলে ইরা তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, এই নাম্বার থেকে, দেখোতো তুমি এই নাম্বারটা চেনো নাকি?

জয় ফোন নাম্বারটা দেখে তার ফোনটা বের করে নাম্বারটা টিপতেই শহীদের নাম ভেসে উঠলো, হ্যাঁ, এটা তো শহীদের নাম্বার। কী বলেছে শহীদ?

তার আগে বলো শহীদ কে?

শহীদ সামিনার ফুপাতো ভাই। ট্রাকের ড্রাইভার, ওই তো সামিনাকে সবসময় গাইড করে। কী বলেছে বলোতো?

বলেছে সামিনার নাকি এক মামাতো ভাই আছে এম.পি, ঐ এম.পি’কে বলে তোমাকে বদলি করে নিয়ে যাবে।

ষড়যন্ত্র ইরা, সব ষড়যন্ত্র, সব মিথ্যাচার।

ইরা শুষ্ক কণ্ঠে বললো, ঠিক বলেছো জয়। আসলে সব ষড়যন্ত্র। ঘরে, বাইরে এমনকি রাজনৈতিক ময়দানেও আমাদেরকে নিয়ে ষড়যন্ত্র। জানি না আমাদের কপালে কী আছে।

জয় কিছু বললো না।

ইরা আবার বলতে শুরু করলো, এসব মতি আর তোমার ঐ সামিনার কাজ। ওরা দু’জনে আমাদের চেয়ে বেশি চতুর, বেশি ঘিরিঙ্গিবাজ। আমার চাকরির বিষয়ে কমিটির দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারেও মতির হাত আছে। তোমার ছেলেদের উশৃঙ্খল করে তোলা, শহীদকে দিয়ে আমাকে ফোন করানো এসব ব্যাপারে সামিনার হাত আছে।

ঠিক বলেছো ইরা।

জয় আমরা কি পারবো ওদের সাথে? তুমি নিজেকে যতই চালাক ভাবো কূটবুদ্ধিতে মতির সঙ্গে তুমি পারবে না। আবার আমি নিজেকে যত বুদ্ধিমতী ভাবী তোমার ঐ মাসিনীর সঙ্গে আমি পারবো না। একদিকে দু’জন আবেগপ্রবণ মানুষের ভালোবাসা আরেকদিকে যেনো সারা পৃথিবীর সমস্ত শক্তি, জয়! আমরা হেরে যাবো না তো জয়! বলতে বলতে ইরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।

আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না ইরা।

তাই তো ভাবছি। শোনো মন্টু চাচাকে তো তুমি চেনো?

হ্যাঁ। পাওয়ার পার্টির নেতা।

চাচাকে বললে হেল্প করতে পারে। তাছাড়া মেজো আপাও তো পাওয়ার পার্টির নেতা। কাউকে লাগতো না জয় যদি শুধু বাবা আমার পক্ষে থাকতো। বাবা যদি একবার ফোন করে হেড স্যারকে বলে তবে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন’ বাবা, বাবা তো আমার পাশে দাঁড়াবে না জয়। বাবাকে যদি বড় আপা নিষেধ করে তবে বাবা কোনোদিন আমার কথা শুনবে না। মন্টু চাচা, মন্টু চাচা-ই একমাত্র ভরসা। মন্টু চাচা নিজে আর না হয় বাবাকে বুঝিয়ে… উহ আমি আর ভাবতে পারছি না জয়।

তুমি ভেঙ্গে পড় না ইরা। আমারও তো কিছু মানুষ আছে যারা দুঃসময়ে আমার পাশে দাঁড়াবে।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, জয়! আমার জয়!

 

একাশি

 

মন্টু ইরার বাবার মামাতো ভাই, সে সম্পর্কে ইরার চাচা। ইরা যখন খুব ছোট তখন মন্টু ইরাদের বাসায় থেকে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে লেখাপড়া করতো। বলতে গেলে ইরাকে সে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। মন্টুর শহরের বাসা মাস্টারপাড়ায়, জয় আর ইরা যে বাসা ভাড়া নিয়েছে সেই বাসা থেকে কয়েকটা বাসা পরেই কিন’ ইরা কোনোদিন যায়নি।

মন্টু ভাবগম্ভীর মানুষ। সে ইরার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে ইরার মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তারপর মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস, তুমি এতোবড় ভুলটা কেমন করে করলে মা?

মতি আমার সঙ্গে কোনোদিন ভালো ব্যবহার করতো না চাচা।

তাই বলে এতো বছর পর, জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তো চলে গেছে।

আমি বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম চাচা, ভেবেছিলাম শুভ আমাকে সম্মান করবে, আমি তো শুভ’র জন্য আগে মতিকে ত্যাগ করিনি কিন’ শুভও তার বাবার পক্ষ নিয়ে আমাকে সবসময় অপমান করতো, ঈদের দিন যদি ওরা বাপ-বেটা মিলে আমাকে অপমান না করতো তবে আমি কখনো চলে আসতাম না চাচা। তাছাড়া জয় আমাকে খুব ভালোবাসে।

মন্টু ইরার কথা শুনে কিছুটা রেগে গেলো। সে গম্ভীর স্বরে বললো, জয় যদি তোমাকে খুব ভালোবাসে তবে সে আবার আগের বউয়ের কাছে যাচ্ছে কেনো?

মন্টুর কথা শুনে ইরার মাথাটা যেনো চক্কর দিয়ে উঠলো, চাচা এসব কথা জানলো কী করে? তবে কি মতি এগুলো আগেই চাচাকে জানিয়ে দিয়েছে। মতি জানে যে আমি মন্টু চাচার কাছে যাবো। সেই বলেছে, আমার যাবার সব পথগুলো মতি বন্ধ করে দিয়েছে। আমি যেনো ঘুরেফিরে তার কাছেই যাই। হায় আল্লাহ! আমি এখন কী করবো?

মন্টু আফসোস করে বললো, এতোবড় ভুল করে ফেললে…

ইরা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, তুমি এসব কথা কার কাছে জানলে চাচা?

মন্টু স্বীকার করলো, হ্যাঁ, তোমার ছেলের বিয়েতে গেছিলাম, মতি তো তোমার জন্য খুব কষ্টে আছে। আমার সাথে কথা বলতে বলতে তো কেঁদে ফেললো।

মতির এসব মায়াকান্না চাচা, ও প্রয়োজনে কাঁদতেও পারে, প্রয়োজন ফুরালে কাঁদাতেও পারে।

মন্টু জিজ্ঞেস করলো, এখন কী করতে চাচ্ছো মা?

চাচা আমি চলে আসার পর তো স্কুল আমাকে সাসপেন্স করেছে। শুনছি স্কুল আমার চাকরির বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, মানে আমাকে স’ায়ীভাবে বরখাস্ত করতে যাচ্ছে। তুমি একবার চেষ্টা করো চাচা, আমার চাকরিটা… বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

আমি একবার চেষ্টা করে দেখি মা, আমি হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলি, তারপর যা হয় করা যাবে। তুমি ভেঙ্গে পড় না মা।

চাচা তুমি একবার বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে?

তোমার বাবার সঙ্গে! তুমি তো তোমার বাবাকে ভালো করেই চেনো মা। আমি যতদূর জানি তোমার বাবা, ভাই-বোন সবাই মাস্টারের পক্ষ নিয়েছে আর বেচারি তোমার মা শুধু কেঁদে কেঁদে মরছে।

তুমি ঠিকই বলেছো চাচা।

মন্টুর বউ এতক্ষণ ইরার সাথে মন্টুর কথা শুনছিলো। আর নাস্তার আয়োজন করছিলো। এবার সে নাস্তার ট্রে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, আমি একটা কথা বলি মা, তুমি মতির কাছেই ফিরে যাও।

ইরা মৃদুকণ্ঠে বললো, তা আর হয় না চাচী।

আমি তোমার ভালোর জন্য বললাম মা। তুমি ফিরে গেলে স্বামী-সংসার পাবে। আর এখন যা শুনছি এখানেও তো তুমি সুখে নেই, তুমি যেমন সবকিছু ছেড়ে একেবারে চলে এসেছো সেও যদি তার আগের বউ-বাচ্চা সব ছেড়ে আসতো তাহলে তুমি সুখী হতে বলে সে নাস্তার ট্রে রেখে চলে গেলো।

ইরা বুঝতে পারলো মতি শুধু তার চাচাকেই বলেনি, চাচীকেও বলেছে। সে মন্টুকে জিজ্ঞেস করলো, চাচা বিয়েতে কি চাচীও গেছিলো?

হ্যাঁ।

ও।

ইরা নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে এলো, আসার সময় মন্টু বললো, তুমি ভেঙ্গে পড় না মা, আমি দেখি কী করা যায়।

 

ইরা মন্টুর বাসা থেকে ফিরলো আশা ও হতাশার দ্বন্দ্ব নিয়ে। যার মধ্যে হতাশাই বেশি। সে দরজা খুলে বাসায় ঢুকে বিছানায় এলিয়ে পড়লো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপনমনে বললো, হায় আল্লাহ! আমাদের সহযোগিতা করো! আমরা তোমার দু’টি বান্দা খাসমনে একে অন্যকে চাচ্ছি, চাওয়ার মতো চাইলে নাকি খোদার দেখা পাওয়া যায়। আমরা তো চাওয়ার মতোই চাচ্ছি, আমাদের চাওয়ার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই, আমাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।

ইরার ছাত্রজীবনের এক বন্ধু সেলিম। স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতির মেয়েকে বিয়ে করেছে। ইরার সঙ্গে অনেকদিন থেকে যোগাযোগ নেই কিন’ ছাত্রজীবনে ইরার সঙ্গে ভালো, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। ইরার কাছে সেলিমের ফোন নাম্বার নেই, সে আরেকজনের কাছ থেকে সেলিমের ফোন নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করলো।

সেলিম ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছিস সেলিম?

ভালো, আপনি?

আমি ভালো নেই বলেই তোকে ফোন করেছি বন্ধু।

সেলিম ইরার কণ্ঠস্বর না বুঝেই আগে কথা বলেছে এবার সে ইরার পরিচয় জানতে চাইলো, আপনি কে বলছেন প্লিজ!

চিনতে পারিসনি, আরে আমি ইরা।

সেলিমের সঙ্গে ইরার কথা হয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর আগে, তখনো মোবাইল ফোন আবিষ্কারই হয়নি। কাজেই ইরার সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে কোনোদিন কথাও হয়নি। সেলিম জিজ্ঞেস করলো, কোন ইরা।

ইরা নামে তুই ক’জনকে চিনিস। আমি ইরা কে.বি স্কুল, এস.এস.সি নাইনটি ফোর ব্যাচ। এবার চিনেছিস?

ও এবার চিনেছি, সরি দোস্ত অনেকদিন পরে তো আর আগে তো কোনোদিন মোবাইল ফোনে কথা বলা হয়নি, তাই চিনতে পারিনি। বল কী খবর তোর?

এই তো আছি কোনোমতে, তোর কী খবর বল?

এই তো ভালো আছি। বউ, এক ছেলে, এক মেয়ে সবাইকে নিয়ে বেশ ভালো আছি।

ইরা মৃদুকণ্ঠে বললো, তোকে আমি একটা কাজে ফোন করেছি।

সেলিম হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছে ইরার তাকে ফোন করার কারণ। সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, বল।

দোস্ত তুই হয়তো শুনেছিস।  আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

ঘটে গেছে নাকি ঘটিয়েছিস?

ইরা বললো, হ্যাঁ ঘটিয়েছি।

এই বয়সে এসে, এরকম একটা ঘটনা…বলে সেলিম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো ইরা বাধা দিয়ে বললো, আর থাকা যাচ্ছিলো না দোস্ত।

হুঁম এখন আমাকে কী করতে বলছিস?

আমি তোর কাছে হেল্প চাই দোস্ত।

কী রকম হেল্প?

তুই তো আমাদের স্কুলের সভাপতির জামাই।

তো?

তুই জানিস কী না আমি জানি না। আমি জয়কে বিয়ে করার পর স্কুল থেকে আমাকে সাসপেন্স করেছে।

সেলিম তিরস্কারের সুরে বললো, বেশ করেছে।

ইরা সেলিমের কথা হতাশ হলো, দোস্ত তুইও বলছিস?

হ্যাঁ, স্কুল তো ঠিকই করেছে, আমি হলে তোর চাকরি খেয়ে ফেলতাম।

সেলিমের কথা শুনে ইরা প্রচণ্ড কষ্ট পেলো, সে কাঁদো, কাঁদো গলায় বললো, সেলিম তুই আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। আমি অনেক আশা নিয়ে তোকে ফোন করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এই দুঃসময়ে তুই আমার পাশে দাঁড়াবি। শোন তোকে একটা কথা বলে রাখি আমি কম কষ্টে জীবনের অর্ধেক সময় পার করিয়ে মতির কাছ থেকে চলে আসিনি। আমার বন্ধু হিসেবে তুইও আমার কষ্টটা বুঝলি না। আসলে তোকে ফোন করাই আমার ভুল হয়েছে।

ইরা সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জয়ের ফোন ঢুকলো কিন’ ইরা জয়ের ফোন রিসিভ করলো না। সে আবার বলতে শুরু করলো, আমি আর কোনোদিন তোকে ফোন করবো না। ভালো থাকিস দোস্ত, বলে ইরা সেলিমকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

সেলিমের সঙ্গে কথা শেষ করতেই জয় আবারও ফোন করলো। ইরা রিসিভ করলো, হ্যালো।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, বলো।

জয় চমকে উঠলো, কী হয়েছে ইরা?

না, কিছু না জয়।

ইরা তুমি কাঁদছিলে, তাই না?

ইরা কোনো কথা বললো না।

ইরা।

বলো।

কী হয়েছে আগে বলোতো।

আগে তুমি বাসায় এসো জয়।

আচ্ছা।

বিরাশি

 

শিক্ষক কমনরুমে ইরা একা। অন্যান্য শিক্ষকরা সবাই ক্লাসে গেছে। এমনি করে ইরাও আগে ক্লাস নিতো, ছাত্র-ছাত্রীরা ইরাকে খুব পছন্দ করতো, ইরা প্রথম ক্লাসে গেলে সবাই উঠে দাঁড়াতো, জোরে চিৎকার করে বলতো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম ম্যাডাম। অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষকরা ইরার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের এই ভালোবাসা দেখে কিছুটা হিংসা করতো। ইরাও ওদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতো, ওদের মুখের দিকে তাকালে ইরার শুভ আর পুতুলের মুখচ্ছবি ভেসে উঠতো। অথচ ইরা আজ ক্লাসে যেতে পারছে না। হয়তো আর কোনোদিন ক্লাসে যাওয়াও হবে না, হয়তো আর কোনোদিন ক্লাসে তাদের সাথে দেখাও হবে না।

ইরা শিক্ষক কমনরুমে একথা ভাবছে আর তার পাশের রুমে, হেড মাস্টারের রুমে স্কুল গভর্নিং বডির মিটিং চলছে, কয়েকজন সদস্য, সভাপতি, হেড মাস্টার সব মিলিয়ে আট দশজন মানুষ কিন’ কোনো কথাবার্তা নেই, কয়েকমিনিট আগে কিছু চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিলো কিন’ এখন সেটাও বন্ধ। নীরবতা, যেনো একটা রহস্যময় নীরবতা।

স্কুলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাইদুর সাহেব ইরার সঙ্গে দেখা করলো। সাইদুর সাহেব দেখা করতে আসায় ইরা কিছুটা আশ্বস’ হয়েছিলো। কিন’ তার কথাবার্তাগুলো যেনো আগের মতো ছিলো না কী রকম একটা জটিল আর আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা, কী ভাবলে ইরা?

কী বিষয়ে স্যার?

তোমার চাকরির বিষয়ে।

চাকরির বিষয়ে আমি আর কী ভাববো স্যার, আমি তো চাকরি করবো, বলে ইরা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, আমি ক্লাসে যাওয়ার জন্য এসেছি স্যার, আপনি বলেন তো এখনই ক্লাসে যাই।

কেসটা তো এতো সহজ না ইরা।

খুব জটিলও না স্যার। আমিতো আসলে স্কুলের কোনো নিয়ম-শৃংখলা ভঙ্গ করিনি। যা করেছি তা আমার ব্যক্তিগত, স্কুল তার গণ্ডি পেরিয়ে আমার পরিবারে না ঢুকলেই হয়। আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছি না স্কুল কেনো আমার পরিবারিক বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। দেখুন স্যার এমদাদ স্যার তো দু’বিয়ে করেছে, মোকসেদ স্যার তার মেয়েকে স্কুল পড়-য়া কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষকই তো বিয়েতে মোটর সাইকেল যৌতুক নিয়ে স্কুল আসছে, অহরহ ছেলেমেয়েদের বিয়েতে যৌতুক দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তবে স্কুল কি তাদের বিরুদ্ধে কেনো ব্যবস’া নিয়েছে? আর আমি তো আইনসঙ্গত কাজই করেছি। অসুখী দাম্পত্য জীবন ছেড়ে আমার পছন্দমতো বিয়ে করেছি। এখানে তালাক বা বিয়েতে কোনো আইন বা সামাজিকতার ব্যত্যয় ঘটেনি।

সাইদুর সাহেব গম্ভীর স্বরে বললো, এটা স্কুল ইরা।

অন্য শিক্ষকদের বেলাতেও তো এটা স্কুল স্যার।

কিন’ তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো অভিযোগ উঠেনি।

আমার বেলাতেও তো কোনো অভিযোগ ওঠেনি স্যার।

তুমি ভালো করেই জানো ইরা তোমার বিরুদ্ধে স্টুডেন্ট কেবিনেট অভিযোগ করেছে, ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করেছে, কয়েকজন অভিভাবকও অভিযোগ করেছে।

এগুলো সব বানানো, এর পেছনে কারও ইন্ধন আছে।

ইন্ধন যারই থাকুক, অভিযোগ তো। এখন তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে।

আমি তো দোষীই না স্যার। তাহলে আমাকে কী করে প্রমাণ করতে হবে যে আমি দোষ করেছি আমাকে ক্ষমা করুন।

সাইদুর সাহেব শীতল কণ্ঠে বললো, তোমাকে মতির কাছে ফিরে আসতে হবে, স্কুলে দোষ স্বীকার করে দরখাস্ত দিতে হবে ইরা।

ইরা প্রচণ্ড রেগে গেলো, অসম্ভব। আমি আবার মতির কাছে ফিরে আসার কথা কল্পনাও করতে পারি না। স্কুল আমার চাকরিকে জিম্মি  করে এটা করতে পারে না। জয়, এখন জয় আমার স্বামী, আমার প্রাণ, জয়কে ছাড়া আমি…বলে ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

পাশের রুম থেকে ছলিম চাচা এলো। ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আয় মাও, ঘরের লক্কী, ঘরে ফ্যারত আয়।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, না চাচা, তা আর হয় না।

হামি মতিক বুজামু, ও তুকি আর কোনোদিন কিছু কবে না। আয় মাও, ফ্যারত এলে দামান পাবি, ছল পাবি, শুব’র বিয়া হছে, দু’দিন পর লাতি-লাতনি পাবু। মাতা ঠাণ্ডা কর পাগলি, কি সুকের সংসার তোর, বাড়িত থাকে কয়েক পাঁও হাঁটলেই ইস্কুল। বাড়িত লাতি-লাতনি থাকবে, তোর বাড়ি কলকাকলীতে ভরে উঠপে।

আমি কত সুখে ছিলাম সেটা আমি ভালো করেই জানি চাচা।

এটিও তুই সুকে থাকপ্যা পারবু পারবু না মাও, শুনিচি ইঞ্জিনিয়ারের আগে পক্কের ছেলেরা নাকি উটে পড়ে লেগিচে। ইঞ্জিনিয়ার বদলি হয়ে যাবে, ছেলেরা ওকি মাজাত দড়ি ব্যান্দে লিয়ে যাবে, তোর চাকরিও থাকপে না, তোর বাবা-মা’ও তোকে লিবে না, তুই পতে পতে ঘুরবু পাগলি। তুই দরখাস্ত দে পাগলি, বাকি সব হামি দেকিচ্চি।

না চাচা, আমি আমার জয়কে ছাড়তে পারবো না, তাতে যদি আমার চাকরি চলে যায় তো যাবে। আমি পথে পথে ঘুরবো, ভিক্ষা করে খাবো।

এবার ছলিম চাচা কঠোর হলো, সে দৃঢ় কণ্ঠে বললো, হামার কয়ার কতা কলাম, তুই শুনলু না। লিজের জীবনটা লিজে লষ্ট করলু। একদিন পোস্তাবু। একদিন তোর এই ছলিম চাচার কতাগুলা মনে করবু আর বিলাপ করে মরবু, কথাগুলো বলে গজগজ করতে করতে ছলিম চাচা পাশের রুমে চলে গেলো।

তখন থেকে ইরা বসে অপেক্ষা করছে শিক্ষক কমনরুমে আর পাশের রুমে চলছে ইরার জীবন-জীবিকা নিয়ে ষড়যন্ত্র। হয়তো ইরার জন্য অপেক্ষা করছে নিষ্ঠুর দুঃসংবাদ। একসময় সেই দুঃসংবাদও এলো। পিয়ন চিঠি নিয়ে এলো, খাকি খাম বন্দি চিঠিটা ইরার হাতে দিয়ে পিয়ন বুক খুলে দিলো, নিজের পকেট থেকে কলমটা বের করে দিয়ে বললো, সই করুন আপা।

ইরা প্রচণ্ড রাগে ও ক্ষোভে দ্রুত স্বাক্ষর করে খামটা খুললো, এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা পড়লো তারপর পাশের রুমে মিটিংয়ে উপসি’ত সদস্যগণের সামনে গিয়ে জোরে চিৎকার করে বললো, অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হলো। আমি কি অনৈতিক কাজ করেছি?

কেউ কোনো কথা বলছে না, সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

ইরা উত্তেজিত হয়ে বললো, বলুন, আমি কি অনৈতিক কাজ করেছি? আপনারা কি আমার চাকরি জিম্মি করে মতির সঙ্গে সংসার করতে বাধ্য করবেন? এটা স্কুল নাকি কারও ব্যক্তিগত প্রপার্টি? কোন ধারায় আছে কোনো নারী তার স্বামীকে তালাক দিলে স্কুল থেকে তার চাকরি চলে যাবে?

সবাই চুপ করে আছে। মাথার ওপর ফ্যান চলছে, তবুও হেড মাস্টার যেনো ঘেমে যাচ্ছে। সে মাথা থেকে টুপিটা টেবিলের ওপর রেখে মিনমিন করে বললো, সেটা তোমার বরখাস্ত আদেশে লেখা আছে।

আমি অনৈতিক কাজ করেছি? হ্যাজবেন্ডকে তালাক দেয়া অনৈতিক কাজ আর স্কুলের টাকা লুটেপুটে খাওয়া, ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করা অনৈতিক না?

হেড মাস্টার সাহেব ধমকের সুরে বললেন, ইরা তুমি এখন যাও।

ইরা গর্জে উঠলো, আপনি তো আমাকে বরখাস্ত করেছেন, আমাকে ধমকানোর কোনো অধিকার নেই আপনার। এবার আমি আপনাকে দেখবো, ধমক খাওয়ার কাজ তো আপনি করেছেন। দেশে এখনো আইন-আদালত উঠে যায়নি, সব ক’টাকে আমি কাঠগড়ায় উঠাবো।

হেড মাস্টার সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, যাও, যাও। যা পারো করো।

ইরা হন হন করে বেরিয়ে এলো।

স্কুল থেকে বেরিয়ে ইরা বাসে উঠলো। বাসে উঠে বার বার জয়কে ফোন করলো কিন’ জয় ফোন রিসিভ করলো না। ইরা জয়কে ম্যাসেজ দিলো কিন’ জয় ম্যাসেজেরও রিপ্লাই দিলো না। ইরা জয়পুরহাট পৌঁছা পর্যন্ত জয়কে বার বার ফোন করলো, ম্যাসেজ দিলো কিন’ জয় সাড়া দিলো না।

ইরা বাসায় এসে কলিং বেল-এ টিপ দিতেই জয় দরজা খুলে দিয়ে না চেনার ভান করে জিজ্ঞেস করলো, আপনি?

ইরা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললো, জয়!

আমি তো জয় কিন’ আপনি কে?

জয় আমি ইরা, আমি তোমার ইরা, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না?

না।

জয় ইয়ার্কি করো না, আমি মতিকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি বলে আমার চাকরিটা চলে গেলো, আর তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। জয়, আমি তোমাকে…বলে ইরা জয়ের গলা চেপে ধরে চিৎকার করে বললো, আজ আমি তোমাকে…

জয় বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ইরাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডাক দিলো, ইরা।

ইরাও বিছানায় লাফিয়ে উঠলো। ইরা তখনো হাঁপাচ্ছে, ইরা ঘেমে ভিজে গেছে।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ইরা?

আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম জয়, একটা দুঃস্বপ্ন!

জয় লাইট জ্বালিয়ে ইরাকে এক গ্লাস পানি এনে দিয়ে বললো, পানি খাও ইরা।

আমি খুব খারাপ একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি জয়।

পরে শুনবো ইরা, আগে তুমি পানি খাও।

 

তিরাশি

 

মতির দুলাভাই সফিকুল। মতিকে ফোন করে সবকিছু শুনে ইরাকে একবার ফোনও করেছিলো। ইরাকে মতির কাছে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলো কিন’ ইরা সফিকুলের অনুরোধ রাখেনি বরং মতির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেছিলো। শুভ’র বিয়েতে মতি দাওয়াত করেছিলো কিন’ কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারেনি।

সফিকুল ঢাকায় থাকে, একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। সে আজ ঢাকা থেকে এসেছে। সে আসার পর থেকে বার বার ইরার কথা বলছে, মতি একবার দেখনা ইরাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায় নাকি।

মতি বললো, চেষ্টা চলছে দুলাভাই।

কী মনে হচ্ছে? আসবে? বলে সফিকুল আগ্রহভরে মতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

দেখা যাক।

আচ্ছা ওর আগের বউ বাচ্চারা চেষ্টা করছে না? ওদের সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?

আছে দুলাভাই।

ওর চাকরিটার কী অবস’া?

ওভাবেই আছে।

স্কুল থেকে ওকে চাপ দিচ্ছে না?

হ্যাঁ, ওরাও চাপ দিচ্ছে।

ইরা কি ওখানে ভালো আছে?

মতি এতক্ষণ বিরক্তবোধ করছিলো কিন’ প্রকাশ করেনি এবার সে কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, আপনি একবার ইরাকেই জিজ্ঞেস করুন।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, দেখি একবার ফোন করে বলে সফিকুল ইরাকে ফোন করলো।

ইরা রিসিভ করেছে, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছিস ইরা?

ইরার মলিন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভালো দুলাভাই।

মনটা খারাপ কেনো? তোর কথা শুনে তো ভালো মনে হচ্ছে না।

না দুলাভাই, ভালোই আছি।

শুনলাম তোর স্বামীর ঐ পক্ষের বউ-বাচ্চারা নাকি খুব অত্যাচার করছে?

আপনি এসব কথা কার কাছে শুনলেন দুলাভাই?

আজ তোদের বাড়িতে এসেছি। মতিই বললো এসব কথা, বললো তোর ওখানকার সমস্যা, চাকরির সমস্যা। আমি ভাবছি ঐ লোকটা যদি বউ-বাচ্চার চাপে তোকে ছেড়ে চলে যায় আর চাকরিটাও যদি না থাকে তবে তুই কোথায় গিয়ে দাঁড়াবি।

কথাটা শুনে ইরার বুকটা কেঁপে উঠলো, জয় আমাকে ছেড়ে যাবে, আমার চাকরিটা চলে যাবে, সে স্বপ্নে দেখছে, দুলাভাইও বলছে, সত্যি সত্যি… না, এমন কথা ভাবতে পারে না ইরা।

ইরাকে চুপ করে থাকতে দেখে সফিকুল বললো, হ্যালো।

গেলে যাবে দুলাভাই, কেউ চলে গেলে তাকে তো আর জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। আমি চলে এসেছি আপনারা তো আমাকে জোর করে বেঁধে রাখতে পারেননি।

তা ঠিক বলেছিস, শোন, এখনো মতি বিয়ে করেনি, করবে না বলছে কিন’ একসময় তো ওকে বিয়ে করতে হবে, নতুন করে বাঁচতে হবে। তখন তো আর ফিরে আসতে পারবি না, আমি বলছি তুই চলে আয়। আমি সব ব্যবস’া করবো।

তা আর হয় না দুলাভাই।

কেনো হয় না? মানুষ ভুল করে তার সংশোধনও আছে, তুই চলে গেছিস, আমরা তোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো, আমি মতির দুলাভাই, আমি বললে মতি সব মেনে নিবে, ভবিষ্যতেও মতি যেনো তোকে আর কিছু করতে না পারে আমি দেখবো। তুই একবার মনে করে দেখ, যতবার তুই আমাদের ডেকেছিস ততবার আমি মতিকে শাসন করেছি না? তুই চলে যাবার আগে আমাকে বললে আমি ছুটি নিয়ে চলে আসতাম। ফিরে আয় ইরা, তুই এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তা আর হয় না দুলাভাই। এখন রাখি, আস্‌সালামুয়ালায়কুম, বলে ইরা ফোনের লাইন কেটে দিলো।

সফিকুল যখন ফোনে কথা বলছিলো মতি তখন অধীর আগ্রহে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলো সফিকুল ফোন রাখতেই মতি জিজ্ঞেস করলো, কী বললো দুলাভাই?

একটু নরম হয়েছে মনে হলো। আগের বারে যখন আমি ফিরে আসার জন্য বলেছিলাম তখন খুব জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেছিলো এবার তো একটু নরম মনে হলো। তুই একটু ধৈর্য ধর, আমি আশা করি চলে আসবে।

মতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

 

পাশাপাশি এ দুই স্কুলের বিরোধ প্রথম থেকেই। ইরা যে স্কুলের শিক্ষক সে স্কুলের জন্ম আগে পরে যখন মতি স্কুল করে তখন ইরার স্কুলের শিক্ষক কমিটি এবং অভিভাবকরা চরম বিরোধিতা করেছিলো কিন’ শেষ পর্যন্ত বিরোধী পক্ষ পেরে ওঠেনি। সেই থেকে দ্বন্দ্বের শুরু, আর তখন থেকে দুই প্রধান শিক্ষক একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলে। ইরা যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন বদিউল সাহেব মনে মনে খুশিই হয়েছিলো, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো তার কিছু ব্যঙ্গাত্মক কথাতেও। কথা প্রসঙ্গেও সে নিজেকে ইঙ্গিত করে বলেছিলো, আমার স্কুলে এতো পুরুষ মানুষ থাকতে আমার স্কুলের শিক্ষিকা প্রেম করে বাইরের মানুষের সঙ্গে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ বড়ই লজ্জার কথা।

আজ সফিকুলের সঙ্গে কথা বলে মতি বাজারে যখন মহসিন চৌধুরীর দোকানে ঢুকলো তখন বদিউল সাহেবও মতিনের দোকানে ছিলেন।

মতি দোকানে ঢুকে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

মহসিন এবং বদিউল সাহেব সালামের জবাব দিলো, ওয়ালেকুম আস্‌সালাম তারপর বদিউল সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, মহসিন আমি আসি তাহলে।

বসুন স্যার।

বাজার করতে হবে তো, তোমরা বসো।

আচ্ছা স্যার বলে মহসিন চৌধুরী সালাম দিলো।

বদিউল সাহেব চলে গেলেন। রতন মতিকে বললো, স্যারের সঙ্গে কথা হলো।

কী কথা?

যা হবার হয়েছে। একটা কথা মনে রাখিস। আমি যেহেতু হাত দিয়েছি ভাবীকে আমি এনেই ছাড়বো। দেখিস ক’দিনের মধ্যে ভাবী চলে আসবে।

মতির মুখ উজ্জ্বল হলো, দেখ যদি পারিস।

মতির মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সে রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

অপর পাশ থেকে সামিনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন ভাই?

এই তো কোনোরকমে বেঁচে আছি আপা।

কিছু করতে পারলেন ভাই?

না আপা এখনো কিছু করতে পারিনি, তবে চেষ্টা করছি আপা, এখন দেখা যাক বলার পর মতি অনেকক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো আর মাঝে মাঝে হ্যাঁ না বলে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো তারপর বললো, সবদিক থেকে চেষ্টা করতে হবে আপা।

করুন ভাই, আমিও চেষ্টা করছি। আপনি আপনার বউকে ফিরিয়ে নিয়ে যান আমার স্বামীকেও আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।

দেখা যাক আপা, বলে মতি ফোন রেখে দিলো।

 

চুরাশি

 

বিয়ের প্রথমদিকে জয় কিংবা ইরার মধ্যে কোনো সংশয় ছিলো না। তখন দু’জনে ছুটে বেড়িয়েছে নিঃসংকোচে কিন’ ক’দিন থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আর ষড়যন্ত্রের ফলে ইরার সেই বিশ্বাসের ভিতটা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে অবশ্য এর কারণ হিসেবে ইরা জয়কে কখনো দায়ী করে না। জয় এতো ঝড়ের মাঝেও সবসময় হাসি খুশি, প্রাণবন্ত থাকে। প্রতিদিন বিকেল হলেই ইরাকে বলে, ইরা চলো একটু বেড়িয়ে আসি।

আগে ইরাও যেতো, জয়ের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে তার মনে হতো সে এতোদিন তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেয়েছে, তার বুকটা গর্বে ভরে উঠতো কিন’ আজকাল জয়ের সঙ্গে বাইরে বের হলে তার মনে হয় এই বুঝি সংসারটা ভেঙ্গে গেলো, জয় চলে গেলো, তখন এই জয়পুরহাটে তাকে একা ঘুরে বেড়াতে হবে হৃদয়ে স্মৃতির দংশন নিয়ে। সবাই আঙ্গুল তুলে কথা বলবে, তাকে জয়ের উচ্ছ্বিষ্ঠ বলবে।

 

আজ বিকেলে জয় অফিস থেকে ফিরে বললো, ইরা, চলো কোথাও বেড়িয়ে আসি।

ইরা মলিন মুখে বললো, না জয়, আমার ভালো লাগছে না।

জয় ইরার মুখটা উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো, ইরা চলো প্লিজ!

ইরা জয়ের হাত সরিয়ে দিলো, না জয়। আমি যাবো না।

কেনো?

ইরা গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে বললো, জয় আমি আজ মন্টু চাচার বাড়ি গেছিলাম।

জয় কৌতূহলী হয়ে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী বললো ইরা?

চাচা বাবার সঙ্গে কথা বলেছে, বাবা আমাকে ত্যজ্য করেছে, আমাকে তার মেয়ে থেকে খারিজ করে দিয়েছে, আমাকে আর কোনোদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে নিষেধ করেছে, চাচাকে সাবধান করে দিয়েছে আমার কথা না বলতে।

জয়ের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।

চাচা আমার চাকরির ব্যাপারেও কথা বলেছে, চাচা আমার একটাই দোষ ধরেছে।

কী দোষ?

শুনলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে জয়।

বলো, তবু বলো। নিষ্ঠুর, দুঃসংবাদ শোনার মতো আমার মানসিক শক্তি আছে ইরা সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

চাচা বার বার করে বলছে, এতোবড় ভুল তুমি কেমন করে করলে মা।

আমি বলেছি, ভুল হোক আর ঠিক হোক আমি একটা কাজ করেছি চাচা এখন তুমি শুধু আমার চাকরিটার একটা ব্যবস’া করে দাও।

চাচা বললো, কাজটা সহজ না মা, আমি চেষ্টা করলে হয়তো তোমার চাকরির বিষয়টা দেখতে পারবো কিন’ একটা বিষয় আমি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না।

কী বিষয় চাচা?

তুমি একটা সংসার ছেড়ে যার হাত ধরে চলে এলে সে কী না তোমাকে একা রেখে আগের বউ’র কাছে যায়? আমি কখনো চাই না তুমি আবার মতির সংসারে ফিরে যাও কিন’ একটা বিষয় আমি নিশ্চিৎ ও তোমাকে ছেড়ে পালাবে মা। তখন তুমি কী করবে?

চাচার কথা শুনে আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি জয়।

চাচা বললো, আমি মাঠে নামলে তোমার চাকরিটা রক্ষা হবে কিন’ মতি যদি এখন বিয়ে করে ফেলে আর ক’দিন পর যদি ও ওর আগের বউর কাছে চলে যায় তখন কী হবে মা? তুমি জামাইকে বলো ও আগে ওর আগের বউকে ডিভোর্স করুক, তা না হলে তুমি মতির কাছে ফিরে যাও। মতির কাছে ফিরে গেলে তোমার চাকরিতে আর কোনো সমস্যা হবে না।

ইরার কথা শুনে জয়ের মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো, ষড়যন্ত্র ইরা, সব ষড়যন্ত্র। তাহলে তোমার চাচার কথাতেও বোঝা গেলো তুমি মতির কাছে ফিরে গেলে তোমার চাকরি রক্ষা হবে নয়তো চাকরি থাকবে না।

চাচার আরেকটা কথা শুনলে না?

কী কথা?

তুমি তোমার আগের বউকে ডিভোর্স করলে চাচা আমার চাকরি রক্ষার জন্য মাঠে নামবে। আর চাচা নামলে তো চাকরির কোনো সমস্যা নেই, বলে ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, জয় প্লিজ, তুমি শুধু আমার হও জয়!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আমি তো শুধু তোমারই ইরা।

না, তুমি শুধু আমার না জয়। আমি পুরোপুরি তোমাকে চাই, আমি আমার ভালোবাসার শেয়ার দিতে পারবো না। আমি চাই তুমি শুধু আমারই থাকবে।

আছি তো।

তাহলে আমার কথাটা রাখো প্লিজ! আমি মতির বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছি আমাকে ফিরিয়ে দিওনা প্লিজ!

ইরা আমি তো তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না।

তাহলে ঐ যে চাচা বলছে…

ইরা তোমাকে আমি আগেও বলেছি আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি আর সামিনাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি, এখনো বাসি না। দিনাজপুর যাই দায়িত্ববোধের কারণে। তুমি এখনো ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের অর্থ বুঝলে না।

ইরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো, না, না, আমি তোমার কাছে ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের সংজ্ঞা জানতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই, তোমার হৃদয়ের সব ভালোবাসা চাই, তোমার খণ্ডিত ভালোবাসা নয়।

ও বুঝেছি তাহলে এসব তোমার চাচার কথা না, তুমি কৌশলে সামিনাকে তালাক দিতে বলছো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে করো আমি তোমাকে সামিনাকে তালাক দিতে বলছি। আমি তো সবকিছু ছেড়ে এসেছে তুমি আসবে না কেনো? আমি তো প্রেম করে বিয়ে করা স্বামী ছেড়ে এসেছি, আমি মা হয়ে ছেলেকে ছেড়ে আসতে পেরেছি আর তুমি ওমন বিশ্রী একটা মহিলাকে, বাবা হয়ে ছেলেকে ছেড়ে আসতে পারবে না। আমি তো ছেলেদের ছেড়েও আসতে বলছি না। তুমি ওদের টাকা-পয়সা পাঠাবে ওরা লেখাপড়া শিখবে ইরা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন’ তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠায় সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো হেড মাস্টার ফোন করেছে। সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম স্যার।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছো ইরা?

ইরা আমতা আমতা করে বললো, আছি স্যার, কোনোরকমে বেঁচে আছি, আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। ইরা স্কুলে তো শিক্ষকের সঙ্কট তুমি জানো, তুমি চলে যাওয়ার পর তো আরও একজন কমে গেলো।

ইরা কিছুটা আনন্দিত হলো, জানি স্যার, আমিতো স্কুলে আসতেই চাই স্যার, আপনি বলেনতো কালকেই চলে আসি।

আমি তো আসতে বলতেই চাই কিন’ তুমি তো জানোই কমিটির কাছে বেসরকারি স্কুলের হেড মাস্টারদের হাত-পা বাঁধা। তোমার এভাবে চলে যাওয়াটা তারা কেউ মেনে নিতে পারছে না। আসলে সবাই চাচ্ছে তুমি আমাদের মাঝে ফিরে এসো।

আমি তো আসতেই চাই স্যার।

তাহলে ওখান থেকে একেবারে চলে এসো।

ইরার মাথায় যেনো বজ্রপাত পড়লো, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন স্যার?

আমি ঠিকই বলছি ইরা, তোমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে গভর্নিং বডির মিটিং আছে, তুমি তার আগে তোমার সিদ্ধান্ত জানাইও।

ইরার বুকে যেনো উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তার মুখ ঠোঁট দু’টো সামান্য ফাঁক হয়ে হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো, আচ্ছা স্যার।

 

পঁচাশি

 

ইরা জয়ের ব্যাগ গুছাচ্ছিলো আর মাঝে মাঝে চোখের পানি মুছছিলো, কষ্টে তার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। জয়ের এমন কী কাজ যে তাকে ঢাকা যেতে হবে। জয় বলেছে সে মানিকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, মানিকের আগামীকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিকেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কিন’ ক’দিন আগে যে সিরাজ বললো তার বদলির বিষয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করতে। জয় কি তবে…

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, ইরা কাঁদছো কেনো? আমি তো শুধু যাবো আর আসবো। আজ রাতের কোচে যাচ্ছি আর কাল রাতের কোচে ফিরে আসবো, শুধু দিনটা ঢাকায় থাকবো।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়, জয় তুমি অন্য কাজে যাচ্ছো নাতো।

অন্য কাজে মানে?

মানে তুমি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছো না তো?

জয় ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো, ইরা আমার চোখের দিকে তাকাও আমি সত্যি বলছি কী না, তুমি বিশ্বাস করো ইরা আমি শুধু মানিকের ভর্তি পরীক্ষা জন্য যাচ্ছি। তুমি তো সবই জানো, তাছাড়া ওরা তো এখন আমার সঙ্গে যড়যন্ত্র করছে। সেদিন বললো না ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য ওকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। আমি যদি না যাই তবে হয়তো চান্স পেলেও বলবে টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছে, তখন টাকা চাইবে, আসলে তুমি তো জানো আমি কখনো অসততা পছন্দ করি না আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া যায় এটা আমি বিশ্বাসও করি না।

তুমি সোজা বলে দাও আমি টাকা দিয়ে তোমাকে ভর্তি করাবো না।

বলেছি, তখন বলে আমার দু’টো পরীক্ষা তুমি একবারও আসবে না। সবার গার্জিয়ানরা আসবে…

ইরা প্রচণ্ড রেগে গেলো, ও তাহলে যাও, যাও, যাও। ছেলে ডেকেছে বাপ যাবে না এটা কী করে হয়। আমিই শুধু সব ছাড়লাম জয় আর তুমি এক কানাকড়িও ছাড়লে না, বউ-বাচ্চা সব ঠিক রেখেছো।

জয় ইরাকে কাছে টেনে নিলো, ইরা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিচ্ছু ঠিক হবে না। তুমি পারবে না। শুধু, শুধু আমি… বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো, ইরা আমি জানতাম না তুমি এতো কষ্ট পাবে, তুমি বিয়ের আগে বলতে না শুভ, মানিক, রতন  আমাদের তিন সন্তান। তোমার সেই তিন ছেলের একটার কাছেই তো আমি যাচ্ছি ইরা। দোয়া করো ও যেনো ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পায়। আমি কালই ফিরে আসছি।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, জয় আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জয়, খুব। আমাকে ছেড়ে যেওনা জয় প্লিজ!

জয় ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ইরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক বাঁক ঘুরার আগে জয় একবার পিছন ফিরে তাকালো, জয় হাত নেড়ে বিদায় জানালো ইরাও হাত নেড়ে বিদায় জানাতে গিয়ে তার বুক কান্নায় ভেঙ্গে গেলো। সে রুমে এসে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।

 

জয়ের ঢাকা যাওয়া ইরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না। কোনোভাবে চোখের জল থামছে না, একটা প্রশ্ন তার মন থেকে দূর করতে পারছে না, জয় কোনো ষড়যন্ত্র করছে না তো। মানিক ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে সে তো ছোট বাচ্চা নয় যে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে। আর ভর্তির বিষয়ে তো সোজা না করে দিতে পারতো, এতোই যদি ছেলেদের প্রতি তোমার টান তবে আমাকে বিয়ে করেছিলে কেনো জয়! আমার তো সব ছিলো স্বামী-সংসার-সন্তান। সব ছেড়ে আমি চলে এলাম আর তুমি শুধু তোমার ছেলের পরীক্ষার জন্য ঢাকা যাচ্ছো, এটুকু ছাড়তে পারলে না জয়! এটুকু!

যেদিন আমি চলে আসি সেদিন মতি বিলোপ করে কেঁদেছিলো আর বলেছিলো, যেওনা ইরা, যেওনা, আমাদের কত বছরের সংসার, কতদিনের ভালোবাসা, কীসের মোহে তুমি চলে যাচ্ছো, তুমি যার কাছেই যাও আমার চেয়ে কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না ইরা। প্রয়োজন শেষে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। তুমি আমার কাছে রাজরানী হয়ে আছো, তুমি পথের ভিখারি হবে ইরা।

আমার চলে আসার খবর প্রথম শোনার পর শুভ ফোন করেছিলো, হুঁ হুঁ করে কেঁদেছিলো, বার বার সেদিনই আমাকে ফিরে যেতে বলেছিলো। আমার একমাত্র সন্তান, শুভকে আমি জন্ম দিয়েছি প্রায় দু’যুগ লালন-পালন করেছি, আমার কত স্বপ্ন ছিলো শুভকে নিয়ে, শুভ’র বিয়ে হবে, বিয়েতে ধুমধাম আয়োজন করবো আর সেই বিয়েতে আমি থাকতে পারলাম না, মা ছাড়া আমার ছেলেটার বিয়ে হলো। আর তুমি শুধু ছেলের পরীক্ষাটা ছাড়তে পারলে না! আমি কী তোমাকে ভালোবেসে ভুল করেছি জয়!

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। শুভ ফোন করেছে। ইরা লক্ষ্য করেছে যখনই সে খুব কষ্টে থাকে, মন খারাপ থাকে তখনই শুভ’র ফোন আসে, ছেলের মন হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে। পারবেই তো, যে মায়ের পেটে দশ মাস দশ দিন থেকেছে সে মায়ের মধ্যেকার রক্ত মাংসের খবর, হৃদয়ের আকুতি তো সে বুঝতে পারবেই, আমিও তো বুঝতে পারি শুভ’র মনের খবর। ইরা ফোন রিসিভ করলো না, ফোন বাজতে বাজতে রিংটোন শেষ হয়ে গেলো।

শুভ আবার ফোন করলো, পর পর কয়েকবার কিন’ ইরার কান্না থামছেই না তাই সে কথা বলতে পারবে না বলে ফোন রিসিভও করছে না।

এবার শুভ একটা ম্যাসেজ দিলো, মা, ফোন রিসিভ করছো না কেনো মা? মা তুমি কি অসুস’? মা তোমাকে কি ঐ লোকটা আমার ফোন রিসিভ করতে দিচ্ছে না? যদি আমার সঙ্গে তোমাকে কথা বলতে না দেয় তবে বলো না শুধু আমাকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে জানাও যে তুমি ভালো নেই।

ম্যাসেজটা পড়া শেষ করতেই আবার ফোন বেজে উঠলো। এবার ইরা রিসিভ করলো, হ্যালো শুভ।

মা, তুমি কেমন আছো মা?

ইরার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে, সে কী করে বলবে ভালো আছে।

মা তোমার কী হয়েছে? মা, আমাকে বলো মা। আমি তোমার ছেলে মায়ের যেকোনো কষ্টে তো আমিই তোমার পাশে দাঁড়াবো মা।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমি ভালো আছি শুভ, তুই তোর কথা বল?

মা, কাঁদছো কেনো মা, আমাকে বলো তোমার কী হয়েছে? কথাগুলো আবেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললো।

বলছি তো শুভ আমার কিছু হয়নি।

মা ঐ লোকটা কি তোমাকে অত্যাচার করছে, মেরেছে?

না, ওসব কিছু না।

তবে ফোন রিসিভ করছিলে না কেনো? ঐ লোকটা আমার ফোন রিসিভ করতে দিচ্ছিলো না বুঝি?

না, বাসায় নেই।

বাসায় নেই? একটা বাসায় তুমি একা? আছো কী করে মা? তোমার ভয় করছে না? তুমি না…

শুভ আমার খুব খারাপ লাগছে, আমি এখন রাখবো।

না মা, তুমি রাখবে না। তুমি ওখান থেকে চলে এসো।

না।

মা, তুমি ওখান থেকে চলে এসো, আমি এখনই মন্টু নানাকে ফোন করছি, মন্টু নানা গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে। বাবাকে ফোন করছি, বাবা এখন তোমার সব ব্যবস’া করবে, মা বাবা তোমাকে কোনোদিন অবহেলা করেনি মা।

তোর বাবার কথা শোনার জন্য আমি ফোন রিসিভ করিনি শুভ।

আচ্ছা মা থাক, বাবার কথা আমি বলবো না, আমি তোমার ছেলে, তুমি কষ্টে আছো জেনে আমি তো চুপ করে থাকতে পারবো না মা। কোনো সন্তানই পারবে না। মা তুমি চলে যাওয়ার পর আমি তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম, মা তুমি সুখে আছো জানলে আমি তোমাকে কোনোদিন ডিস্টার্ব করবো না কিন’ কোনোদিন যদি জানি তুমি যে সুখের আশায় সব ছাড়লে সেই সুখে যদি ঐ লোকটা তোমাকে দিতে না পারে তবে আমি ঐ লোকটাকে ছাড়বো না মা শুভ’র শেষের দিকের কথাগুলো ইরার কাছে হিংস্র মনে হলো।

ইরা শুভকে শান্ত করার জন্য বললো, না শুভ, ওর দোষ না। ওতো আমাকে মারেনি, কোনো খারাপ কথাও বলেনি। তুমি ওর ওপর রেগে যাচ্ছো কেনো, ও খুব ভালো মানুষ।

মা, আমি আর তোমার কোনো কথা শুনবো না। আমি এখনই মন্টু নানাকে ফোন করবো, মন্টু নানা গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে, আর ঐ লোকটা যদি বাধা দেয় তবে ওকেও আমি খুন করে ফেলবো।

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, শুভ।

না মা আমি আর কোনো কথা শুনবো না। এখনই মন্টু নানা গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে।

না আমি যাবো না।

আমি আর তোমার কোনো কথা শুনবো না মা। মা যেমন ছেলের চোখের জল দেখতে পারে না তেমনি ছেলেও মায়ের কষ্ট দেখে থাকতে পারে না। তোমার সুখের প্রয়োজনে আমি তোমার চলে যাওয়াটাকেও মেনে নিয়েছিলাম কিন’ তোমার কষ্টে থাকাটা আমি কোনোভাবে মেনে নিবো না মা। আমি তোমার সুখের জন্য সবকিছু করবো। এখন রাখি মা বাই।

ইরা ফোন রেখে আবার বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।

ইরার মোবাইল ফোন আবার বেজে উঠলো। মন্টু ফোন করেছে, ইরা ফোন রিসিভ করলো।

 

ছিয়াশি

 

সকালবেলা বাস থেকে নেমেই জয় ইরাকে ফোন করলো কিন’ ইরা রিসিভ করলো না। জয় ভেবেছিলো ইরা বুঝি তখনো ঘুমিয়েই আছে আবার ফোন করলো সকাল দশটায়, মানিককে পরীক্ষা হলে ঢুকিয়ে দিয়ে। প্রথম বার ইরা রিসিভ করলো না, দ্বিতীয় বার ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

ইরার কণ্ঠস্বর গম্ভীর সেই সঙ্গে রাস্তায় রিকশা আর মোটর সাইকেলের হর্নের শব্দ। জয় জিজ্ঞেস করলো, হ্যালো ইরা।

বলো।

কোথায় তুমি?

একটু বাইরে বেরিয়েছি, তুমি কখন পৌঁছেছো?

সকাল আটটায়, তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম ইরা।

আজ একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি তো।

আমিও তাই ভেবেছিলাম।

নাস্তা খেয়েছো?

হ্যাঁ, তুমি?

খেয়েছি, এখন কী করছো?

মানিক পরীক্ষা দিচ্ছে আর আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

তুমি কখন ফিরবে জয়? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

রাতের কোচে।

ফিরবে তো?

জয় ইরার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো, ফিরবো না মানে? আমার ফেরা না ফেরা নিয়ে তুমি মনে হয় আমাকে সন্দেহ করছো?

না, আমি বলছিলাম আজ আসবে নাকি আগামীকাল, ইরার কণ্ঠস্বর জয়ের কাছে একটু অন্যরকম মনে হলো, একটু ভেজা ভেজা এটা ইরার খুব কষ্ট পাওয়ার কণ্ঠস্বর। ইরা যখন মতির বাড়িতে ছিলো, কোনোদিন মতির কিংবা জয়ের আচরণে কষ্ট পেলে তার কণ্ঠস্বরটা এমনি করে বদলে যেতো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ইরা?

না, কিছু হয়নি তো।

তবে তোমার গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেনো? আমাকে বলো।

আমার কিচ্ছু হয়নি জয়, প্লিজ আজই এসো।

তা আসবো ঠিক আছে কিন’ তুমি এমন করছো কেনো?

আমার কিছু হয়নি জয়, আমি ঠিক আছি। এখন রাখি, পরে ফোন দিবো।

ইরার আচরণ জয়ের কাছে অন্যরকম মনে হলো, রহস্যময়। ইরা তো খুব সহজে ফোন রাখতে চায় না, বরং জয় কখনো ফোন রাখতে চাইলে ইরা রেগে যায়, তুমি আমাকে সময় দিতে চাও না, অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারো আর আমার বেলায় তোমার সময় নেই।

অন্য দিন হলে জয় মানিকের পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষা করছে জেনে ইরা সারাক্ষণ ফোনে থাকতো আর বলতো, আজ সারাদিন তুমি ফোনে আমার সাথে থাকবে, ভেবেছো পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে আবার অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিবে, তোমাকে তো বিশ্বাস নেই কখন কাকে জুটিয়ে নাও।

অথচ আজ ইরা নিজে ফোন রাখতে চাইলো। জয়ের মন থেকে সন্দেহ দূর হচ্ছে না। মানিকের একে একে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হলো জয় অপেক্ষা করছিলো ইরা ফোন দিয়ে তার লাঞ্চ করার খবর নেয় কী না কিন’ ইরা ফোন করলো না, ইরার এমন অদ্ভুত আচরণে জয়ের সন্দেহ আরও বেড়ে গেলো, অবশেষে জয় ইরাকে ফোন করলো বিকেলে, কী হয়েছে ইরা?

ইরা কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক শান্ত, কিছু হয়নি তো।

দুপুরে লাঞ্চ করেছো?

না।

কেনো?

দুপুরে ঠিক লাঞ্চের সময় ইলেকট্রিসিটি ছিলো না, পরে যখন এসেছে তখন আমার খিদে ছিলো না।

সরি ইরা, আমার আরও আগে তোমাকে গ্যাসের সিলিন্ডার কিনে দেয়া উচিৎ ছিলো, কালকেই আমি তোমাকে গ্যাসের সিলিন্ডার, চুলো কিনে দিবো।

থাক, আর লাগবে না।

লাগবে না কেনো? ক’দিন টাকা-পয়সার খুব টানাটানি ছিলো। যত টানাটানি থাকুক কাল কিনে দিবোই।

বাদ দাওতো, আগে বলো তুমি ক’টার গাড়িতে টিকেট করেছো?

রাত ন’টার।

আচ্ছা, তুমি কাউন্টারে এসে আমাকে ফোন দিও।

ওকে।

 

আসার পর থেকে মানিকের সঙ্গে তার ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কথা হয়েছে। আর জয় তেমন সময়ও পায়নি। মানিকের রুমে গিয়ে আবার কিছুক্ষণের মধ্যে দু’জনে বেরিয়েছে। তারপর তো একে একে দু’টো পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে রুমে ফিরে পরীক্ষা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মানিক বললো, তুমি চাওনি তাই আর তদ্বির করে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করিনি।

জয় জিজ্ঞেস করলো, পরীক্ষা ভালো হয়েছে বাবা?

হয়েছে মোটামুটি।

টেনশন করো না। ভালো ভার্সিটিতে না পড়লে বা ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র না হলে কেউ জীবনে সফল হয় না এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি আমার জীবন দিয়েই পরীক্ষা করেছি। আমাদের ক্লাসের এক থেকে দশ পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের আমি দেখেছি যে যত ভালো ছাত্র সে জীবনে তত পিছিয়ে আছে। তাই বলে আমি বলছি না কেউ ভালোভাবে লেখাপড়া করবে না। আমি শুধু তোমাকে বলতে চেয়েছি ভালো কোনো ভার্সিটিতে চান্স না পেলে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো এটা ভেবে কখনো মন খারাপ করো না।

আমি জানি এমন ভুরি ভুরি নজীর আছে, বলে মানিক প্রসঙ্গ পাল্টালো, তুমি ইরার বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?

কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি মানে?

ইরাকে তুমি কবে বিদায় করছো?

ইরাকে বিদায়ের কথা আসছে কেনো? আমি এবিষয়ে তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।

কিন’ আমি চাচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বিদায় করবে, বুঝলে? মানিক যখন কথা বলছিলো তখন চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছিলো আর দাঁতগুলো কড়মড় করছিলো।

জয় কোনো কথা বললো না, সে মাথা নত করে বসে রইলো। তার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো।

জয় আবার বলতে শুরু করলো, আর কয়েকটা ভার্সিটিতে আমার এ্যাডমিশন টেস্ট বাকি আছে, শেষ হলে আমি বাড়ি আসবো। তুমি তার আগে ইরাকে বিদায় করবে, যদি না করো…

কিছু বলতে গিয়ে মানিক থেমে গেলো।

জয় আর কথা বাড়ালো না। সে তার ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, আসি।

মানিক বললো, চলো আমি তোমাকে সি.এন.জি’তে তুলে দিয়ে আসি।

 

ইরার কথামতো জয় কাউন্টারে এসে তাকে ফোন করলো। ইরা রিসিভ করেছে, হ্যালো

হ্যালো।

কোথায়? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

জো হুকুম মহারাণী, কাউন্টারে এসে তোমাকে ফোন দিয়েছি। বলে জয় অনেক কষ্টের মাঝেও হেসে উঠলো।

হেসো না, হেসো না। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি যখন ফোনে কথা বলবো তখন কোনো কথা বলবে না, চুপ করে শুনবে।

জয় গলা ঝেড়ে বললো, শুনছি, বলো। বলে জয় কয়েকমিনিট ইরার কথামতো কানে ফোন ধরে রাখলো, তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

ইরা ধমকের সুরে বললো, তোমাকে না আমি হাসতে নিষেধ করেছি।

কিন’ এতো হাসির কথা, ইয়ার্কির কথা বললে আমি হাসবো না।

ওকে, আগে এসো।

রাগ করো না প্লিজ! আমি তোমার জন্য ফুড ভিলেজ থেকে সন্দেশ নিয়ে যাবো।

 

সাতাশি

 

ইরা চোখে ঘুম নেই বার বার কানের কাছে যেনো কলিং বেল বাজার শব্দ ভেসে আসছে, এই বুঝি জয় এলো, এই তো গতকাল রাতেই তো জয় গেলো আবার আজ রাতেই ফিরে আসছে তাহলে জয়কে দেখতে আমার এতো ইচ্ছা করছে কেনো? আজ এই ক’ঘণ্টার মধ্যেই আমি জয়কে দেখার জন্য অসি’র হয়ে পড়েছি, বাকি জীবন জয়কে না দেখে থাকবো কী করে? জয়কে দেখার জন্য ঠিক এমন অসি’র হয়ে গেছিলাম আসার দিন, আমার শুধু মনে হচ্ছিলো কখন আমি জয়ের কাছে যাবো। আমি সবকিছু ছেড়ে এলাম, জয় তুমি কেনো কাউকে ছাড়তে পারলে না? আমাকে আবার মতির কাছে ফিরে যেতে হবে, সেই একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, নির্যাতন। এবার তো আরও নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে, কথায় কথায় মতি খোঁটা দিবে, গেলে তো আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলে কই, আবার তো আমার কাছে ফিরে আসতেই হলো মাঝখান থেকে শুধু একটা কেলেঙ্কারি করলে। প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরাও…না, না আর ভাবতে পারছে না ইরা।

এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ইরা একটা ঘুমের তন্দ্রা এসেছে এমনসময় ইরার কানে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। ইরা বিছানায় উঠে বসলো। ইরা হাঁপাচ্ছে, হৃদপিণ্ডটা দ্রুতগতিতে চলছে, ইরা এক গ্লাস পানি খেলো কী হয়েছে মনে করার চেষ্টা করলো। ঘুমের মধ্যে ইরা বারো শিবালয় গিয়েছিলো কিন’ মানুষ রুপী না, পাখির মতো, পাখি হয়ে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন ইরা আগেও দেখতো। কৈশোরে যখন সে স্কুলের মাঠে গোল্লাছুট খেলতো তখন, আর দিনের সেই গোল্লাছুট যেনো সে ঘুমের মাঝেও খেলতো। গোল্লাছুট খেলতে গিয়ে যখন কেউ তাকে ছুঁতে আসতো তখন সে পাখি হয়ে উড়ে পালিয়ে যেতো। আজকের স্বপ্নটাও ঠিক তেমনি। ইরা বারো শিবালয় সেই বটগাছের ডালে বসে আছে, কুচকুচে কালো একটা শিকারি বট গাছের ডালে ডালে পাখি খুঁজছে, তার হাতে একটা খাঁচা, খাঁচায় কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে, এখনো প্রাণটা বেরিয়ে যায়নি কিন’ যাবে হয়তো এক্ষুণি। ইরা নিচের দিকে তাকাতেই শিকারি তার দিকে ধনুক উঁচু করলো। ইরা আরেকটা ডালে গিয়ে বসে দূর দিগন্তে তাকালো, ঐ যে জয় আসছে, দূর থেকে, অনেক দূর থেকে আসতে আসতে জয় হাঁপিয়ে উঠেছে, জয় কাছে এসে ইরার পাশে বসলো আর এমনসময় ইরার বুকে একটা তীর বিদ্ধ হলো। ইরা কোঁক করে একটা শব্দ করে নিচে পড়লো, এমনসময় কলিংবেলের শব্দটা তার কানে ভেসে এসেছিলো আর তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

এবার সত্যি সত্যি কলিং বেল বেজে উঠলো। ইরা একরকম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। জয় বাসায় ঢুকতেই ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

কী হয়েছে ইরা?

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, জয়, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম জয়, খুব! তোমার জন্য আমি সবকিছু ছেড়ে এসেছি জয়!

জয় ইরাকে জড়িয়ে ধরে ডাইনিং স্পেস থেকে বেডরুমে ঢুকলো।

ইরা চোখ মুছতে মুছতে জয়ের ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় বের করতে করতে সন্দেশের প্যাকেটটা দেখে তার কান্না আরও বেড়ে গেলো। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, এগুলো কেনো এনেছো জয়?

তোমার জন্য, তোমাকে বলেছিলাম না, আমি ফুড ভিলেজ থেকে সন্দেশ নিয়ে আসবো আর এসে তোমাকে গ্যাসের চুলো কিনে দিবো।

ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় বললো, ইরা কাঁদছো কেনো?

ইরা একটা প্লেটে করে সন্দেশ এনে জয়ের সামনে দিলো।

জয় ইরার মুখে একটা সন্দেশ তুলে দিতেই ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় ইরার দু’বাহুতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, কাঁদছো কেনো সবসময়, বলোতো?

ইরা কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, আমি কাল সকালে চলে যাবো জয়।

জয় একটা সন্দেশের অর্ধেক ইরার মুখে তুলে দিয়ে বাকি অর্ধেক নিজের মুখে দিচ্ছিলো। ইরার কথা শুনে তার হাত থেকে সন্দেশের টুকরোটা পড়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে যেনো একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লাগলো। জয়ের বুক চিরে দু’ঠোঁট সামান্য ফাঁকা হয়ে বেরিয়ে এলো, চলে যাবে! কেনো?

আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছিলাম জয় একটু সুখের আশায়, আমার আত্মীয়-স্বজন এমনকি শুভও মেনে নিয়েছিলো শুধু আমার সুখের কথা ভেবে কিন’ সবাই যখন জানতে পেরেছে আমি সুখে নেই তখন তারা আমাকে আর এখানে থাকতে দিবে না জয়।

তুমি সুখে আছো নাকি দুঃখে আছো এটা তারা জানলো কী করে ইরা?

আমি বলেছি।

কী বলেছো?

বলেছি তোমার কাছে আমি সুখে নেই।

ইরা যাওয়ার সময় তো আমি তুমি আমাকে কিছু বললে না। হঠাৎ এমনকি হলো যে তুমি নিজেকে অসুখী মনে করলে আর তোমার আত্মীয়-স্বজন, শুভকেও বললে যে তুমি সুখে নেই আর তারা তোমাকে সুখী করার জন্য আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো।

তুমি আগের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছো, প্রতি শুক্রবার এলেই তুমি আগের বউ’র কাছে যাও এটা আমি মেনে নিতে পারিনি জয়, আমার পক্ষের কেউ-ই এটা মেনে নিতে পারেনি। তবে মন্টু চাচা একটা প্রস্তাব দিয়েছে।

কী প্রস্তাব?

আমার মতির কাছে ফিরে যাওয়াটা মন্টু চাচা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না আবার আমাকে বিয়ে করে তুমি আগের বউ’র কাছে যাবে এটাও মেনে নিতে পারছে না। চাচা বলেছে তুমি যদি আগের বউকে তালাক দাও তবে এখানেই থাকতে আর যদি না দাও তবে ফিরে যেতে।

ইরা তুমি তো সব জেনেশুনেই এসেছো, এমন কথাতো কোনোদিন ছিলো না। তারপরও আমি কিন’ ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। ওরা দিনাজপুর ওদের মতো থাকবে, তুমি আর আমি এখানে থাকবো।

তোমার একথায় ওরা মানবে না জয়।

জয় কিছুটা রাগের সুরে বললো, এখন তুমি আর তুমি নেই ইরা, এখন তোমার সব বিষয়ে ওরা-ই সব ইরা। তাহলে তো আর তোমার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তোমাকে একটা কথা বলি ইরা, তুমি ট্র্যাপে পড়েছো, ওরা সবাই ভালো করেই জানে আমি সামিনাকে তালাক দিবো না, তবে কারণটা সামিনা না।

তো?

সামিনাকে তালাক দিলে আমার ছেলে দু’টো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ওদের ভবিষ্যৎটা নষ্ট করতে চাই না ইরা। প্লিজ তুমি যেওনা, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তা আর হয় না জয়।

তাহলে তুমি যাবেই ইরা ক্ষোভের সুরে বললো।

ওরা রাতেই যেতে বলেছিলো জয়, আমি তোমাকে বলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

জয় ইরাকে বুকে টেনে নিলো, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, যেওনা ইরা, যেওনা, তুমি ভুল করছো।

আমার জীবনটা ভুলে ভরা জয়। কিশোর বয়সে মতির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়াটা ভুল ছিলো, মতির কাছ থেকে তোমার কাছে চলে আসাটা ভুল ছিলো আবার তোমার কাছ থেকে মতির কাছে ফিরে যাওয়াটাও ভুল করছি জয়। ভুলে ভরা আমার জীবন, অনেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে জানি। একসময় মতির কাছে থেকে তোমাকে দেখার জন্য, তোমার কাছে আসার জন্য অসি’র হয়ে যেতাম, তোমার কাছে আসার পর খুব তাড়াতাড়ি আমার মোহ কেটে গেলো।

আমার কাছে আসাটা তোমার ভুল ছিলো ইরা? আমাদের ভালোবাসাকে তুমি ভুল বলছো?

আমাদের বলোনা জয়, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম জয়, তুমি বাসোনি। আমি পুরো পৃথিবী ছেড়ে এসে কানাকড়িও পেলাম না জয়!

কানাকাড়িও পাওনি?

আমি স্বামী-সংসার ছেড়ে এসেছি। আর তুমি তোমার বুড়ি বউ ছেড়ে আসতে পারছো না, ভালোবাসার টানে মা হয়ে সন্তান ছেড়ে এসেছি আর তুমি বাবা হয়ে ছেলেদের ছাড়তে পারছো না, আমি তো তোমাকে ছাড়তেও বলছি না, তুমি ওদের দেখাশোনা করো দূর থেকে।

আমিও তো তাই চাচ্ছি ইরা।

কিন’ ঐ বুড়ি বউকে তো ছাড়তে চাচ্ছো না।

ওকে ছেড়ে দিলে যে ছেলে দু’টো ভেঙ্গে পড়বে ইরা। তুমি আমাকে একটু সময় দাও ইরা, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে, আমিও দিনাজপুর যাবো না, ওরাও আসবে না। আমি শুধু দূর থেকে ওদের দেখাশোনা করবো।

সরি জয়।

আমি তোমাকে বার বার বলছি ইরা তুমি ভুল করছো। আমার কাছ থেকে গিয়েও তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না, তখন আমার কাছে তুমি আর আসতেও পারবে না।

আমি জানি জয়, আমি উম্মুক্ত আকাশ থেকে সোনার খাঁচায় বন্দি হতে যাচ্ছি, আর কোনোদিন সেই খাঁচা থেকে বের হতে পারবো না। বাকি জীবন ডানা ঝাপটে মরতে হবে। এটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত জয়। তুমি যাও তোমার স্বর্গে আমি যাচ্ছি সোনার খাঁচায়।

 

সকালবেলা উঠেই ইরা সবকিছু গুছাতে শুরু করলো। ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছছে আর জয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের পানি মুছছে আর কিছুক্ষণ পর পর বলছে ইরা, যেওনা ইরা, যেওনা। ইরার ব্যাগ গুছানো প্রায় শেষ কান্নাজাড়িত কণ্ঠে জয়কে ডাক দিলো, জয় ওঠো।

জয় দু’হাত উঁচু করে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ইরা প্রথম যেদিন তুমি এলে সেদিন থেকে প্রায় দিনই তুমি আমাকে বিছানা থেকে হাত ধরে তুলতে, আজ একবার তোলো ইরা, আর শুধু একবার।

ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, জয়, সব কী হয়ে গেলো জয়! আমাদের ঘর-সংসার, আমাদের ভালোবাসা, সব, সব যে শেষ হয়ে গেলো! জয় আমরা হেরে গেলাম! আমাদের ভালোবাসার পরাজয় হলো! ষড়যন্ত্রের কাছে আমাদের ভালোবাসার পরাজয় হলো!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কেনো! কেনো চলে যাচ্ছো ইরা! আমিতো তোমাকে বলেছি, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা দু’জনে একসঙ্গে ফাইট করবো ইরা, আমাদের জীবনে যুদ্ধ তো করতেই হবে, তবে আলাদা আলাদাভাবে কেনো, আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করবো।

আর সেসময় নেই জয়, সব শেষ হয়ে গেছে। আগে আমি না গেলে ওরা আমার চাকরিটা খেয়ে ফেলতো আর গতকাল থেকে যে পরিসি’তি হয়েছে তাতে করে আমি না গেলে ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে যাবে, তোমাকেও ওরা ছাড়বে না জয়। বলে ইরা জয়ের কপালে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বললো, জয় শুনেছি আমাদের চাকরি সরকারি হবে, তখন আর কমিটির হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। চাকরিতে বদলিও হওয়া যাবে, তখন তুমি আমাকে বদলি করে নিয়ে যেও জয়, অনেক দূরে, যেখানে নিয়ে যেতে চাও সেখানে।

ইরার চোখ থেকে কয়েক ফোটা চোখের পানি জয়ের চোখের ওপর পড়লো, দু’জনের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। জয় কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, ইরা তোমার চাকরিটা ছেড়ে দিলে হয় না?

তবুও শুভ আমাকে ছাড়বে না। শুভ বলেছিলো, মা যতদিন তুমি সুখে আছো বলেছো ততদিন আমি তোমাকে কিছু বলিনি কিন’ তুমি যখন বলেছো তখন ছেলে হয়ে তো আমি মা’র কষ্ট দেখে থাকতে পারবো না। শুভ উশৃংখল হয়ে গেছে, ও আর তোমাকে ছাড়বে না জয়। ওকে তো আসলে বুদ্ধি দিচ্ছে মাস্টার, এসব মাস্টারেরই কুচক্র, এখন না গেলে শুভ মন্টু চাচাকে বলবে আর মন্টু চাচা দলের কয়েকজন হোমড়-চোমড়াকে পাঠিয়ে দিবে।

মতি এভাবে তোমাকে জোর করে নিয়ে যাবে ইরা, জোর করে ভালোবাসা হয়, জোর করে বিয়ে হয়।

সবই হয় জয়। জোর করে ভালোবাসা হয়, বিয়ে হয়। এভাবেই তো চলছে পৃথিবীটা, শুধু আমি কেনো, অসংখ্য মেয়ে তো এভাবেই নিজের জীবন উৎসর্গ করে কোরবানীর গরুর মতো। কোরবানীর গরুকে তো জোর করেই কোরবানী দিতে নিয়ে যায়, গরু তো বুঝতে পারে তারপরও তো নিজ পায়ে হেঁটেই যায় জয়।

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

শুভ ফোন করেছে।

ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

শুভ’র কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো মা।

ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, বল।

দশটা বাজে মা, তুমি দশটায় বের হয়ে আসতে চেয়েছিলে।

আসছি বাবা।

মা, ঐ লোকটা কি তোমাকে আসতে দিচ্ছে না? জোর করে ধরে রেখেছে?

না বাবা।

যদি রাখে তো বলো আমি এখনই মন্টু নানাকে ফোন করছি, পিটিয়ে ঐ হারামজাদার হাড়গড় একাকার করে ফেলবে।

না বাবা আমাকে আর আধ ঘণ্ট সময় দে আমি মেসে গিয়ে তোকে রিং দিচ্ছি।

ওকে আধ ঘণ্টা কিন’ একত্রিশ মিনিট না।

ইরা কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিয়ে জয়কে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

কয়েক মিনিট পর জয়ের দু’হাত ধরে বিছানা থেকে তুললো।

তাড়াতাড়ি রেডি হও জয়, শুনলে তো সেজন্য তো তোমার কানের কাছে ফোন রেখে দিয়েছিলাম। ওঠো, রেডি হও। দু’জনে একসঙ্গে বের হই।

 

দু’জনে একসঙ্গে বের হলো। জয় ইরাকে একটা রিকশা ডেকে দিলো, ইরা রিকশায় উঠে হুড তুলে দিলো, হাত তুলে জয়কে বিদায় জানালো। মুখের কোনো কথা দিয়ে নয়, এক হৃদয় চোখের পানি দিয়ে। জয় মোটর সাইকেলে বসে ইরার রিকশার দিকে তাকিয়ে রইলো।

 

আটাশি

 

জয় ইরাকে বিয়ে করার পরপরই সামিনার বাবা এক বোতল পানি, কয়েকটা টুকরো কাগজে হিজিবিজি লেখা তাবিজ এনেছিলো। আর বলেছিলো পানিগুলো যেকোনোভাবে জয়কে খাওয়াতে আর কাগজের টুকরোগুলো জয় যে বালিশে মাথা দেয় সেই বালিশের নিচে রাখতে। সামিনা বাবার কথামতো ঠিক ঠিক তাই করেছে। সেই পানিগুলো আগেরবার জয় যখন এসেছিলো তখন শেষ হয়ে গেছে। জয় শুক্রবার আসার কথা ছিলো বলে আগের দিন আবারও একবোতল পানি নিয়ে এসেছে কিন’ জয় দিনাজপুর না এসে ঢাকা চলে গেলো।

সামিনার বাবা জিজ্ঞেস করলো, জামাই তো কাল এলো না। আজ আসবে নাকি মা, আজ তো শনিবার ওর অফিস বন্ধ।

সামিনা বললো, না বাবা।

তুমি আসতে বলেছিলে?

বলেছিলাম, আসবে না।

কবিরাজ দু’মাসের সময় নিয়েছিলো, বলেছিলো দু’মাসের মধ্যে জামাই ঐ বউকে ছেড়ে দিবে। আজ কতদিন হলো মা?

সামিনা আঙ্গুলে গুনে গুনে বললো, দু’মাস তো প্রায় হয়ে এলো বাবা। তবে আমার মনে হয় কাজ হবে বাবা। সবকিছু একরকম গুছানো হয়ে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, শহীদ ভাই’র কোন ড্রাইভার আছে জয়পুরহাট ওদের এলাকায়, ও সবসময় খোঁজখবর রাখছে। মানিক শুভ’র সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, আমিও মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি বাবা।

মাস্টারকে বলো ওর চাকরিতে হাত দিতে, তাহলে সমাধানটা তাড়াতাড়ি হবে।

বলেছি বাবা, দু’য়েক দিনে একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে, আজও পাওয়া যেতে পারে বাবা।

সামিনার বাবার মুখ উজ্জ্বল হলো, তাহলে তো কাজ হচ্ছে বুঝি মা।

কাজ হচ্ছে বাবা কিন’ এখন কবিরাজের পানি পড়া, বালিশের নিচে তাবিজ এর জোরে নাকি আমাদের চেষ্টায় আল্লাহই ভালো জানেন।

হোক মা, হোক, যেকোনো উছিলায় ঐ মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলেই হয়।

সামিনার ফোন বেজে উঠলো। সে রিসিভ করলো, হ্যালো।

শোনো।

বল, বলে সামিনা প্রায় এক মিনিট ফোনটা কানের কাছে ধরে রাখলো, তারপর আহলহামদুলিল্লাহ বলে ফোনটা রেখে দিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, বাবা, কাজ হয়েছে বাবা, কাজ হয়েছে!

কী হয়েছে মা? সামিনার বাবা অধীর আগ্রহে সামিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

বাবা, চলে গেছে বাবা, ইরা চলে গেছে।

সত্যি, সত্যি বলছিস মা, কে বললো?

মানিক ফোন করেছিলো বাবা। ওকে নাকি শুভ বলেছে।

আলহামদুলিল্লাহ, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। তুমি একটু যাচাই করে দেখো তো, মাস্টারকে ফোন দাও।

সামিনা মতিকে ফোন করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম ভাই।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কেমন আছেন ভাই?

আছি আপা, কোনোমতে বেঁচে আছি।

ভাই একটা কথা শুনলাম।

কী কথা আপা?

ইরা নাকি চলে গেছে?

হ্যাঁ আপা।

কোথায় গেলো ভাই? আপনার বাড়িতে নাকি…

না আপা আপাতত: একটা মেসে উঠেছে।

আপনি নিয়ে যান ভাই, আপনার বউকে আপনি তাড়াতাড়ি নিয়ে যান। এখন থেকে সবসময় চোখে চোখে রাখবেন, একা কোথাও ছাড়বেন না।

মতি কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, আপনিও আপনার হ্যাজবেন্ডকে নিয়ে যান আপা। একেবারে দিনাজপুর নিয়ে যান। এখানে থাকলে আবার যোগাযোগ করতে পারে।

ঠিকই বলেছেন ভাই। দেখি আমি আমার ভাই’র সঙ্গে কথা বলি।

 

সামিনার চোখে-মুখে যেনো আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সে উত্তেজনায় একবার বেডরুম থেকে ড্রয়িং রুম, বারান্দা, রান্নাঘর পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করে ইরাকে নিয়ে নানান রকমের কথা বলছে। এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠলো। সামিনা দরজা খুলে দিয়েই উত্তেজনার বশে বললো, শহীদ ভাই কিছু শুনেছেন?

কী হয়েছে সামিনা এমন করছিস কেনো?

শহীদ ভাই, শহীদ ভাই ঐ মাগীটা চলে গেছে।

চলে গেছে মানে?

চলে গেছে মানে, চলে গেছে আজ সকালে।

আমি বলছিলাম না সামিনা, সবদিক থেকে যেভাবে শুরু করেছি তাতে ও বেশিদিন থাকতে পারবে না। দেখলে তো।

আপনিও অনেক কাজ করেছেন ভাই।

এখনো কাজ শেষ হয়নি, মাথা ঠাণ্ডা করে আমার কথা শোন। মামা কোথায়?

ও, আমার কী যে হলো, আপনাকে দরজায় দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলছি। তুমি বসো বলে সামিনা জোরে ডাক দিলো, বাবা।

মিরাজ সাহেব ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসলো।

শহীদ সালাম দিয়ে বললো, কাজ তো হয়ে গেছে মামা।

হ্যাঁ তাইতো শুনছি। আমি বলেছিলাম না, কমল কবিরাজ কন্ট্রাক্ট দিয়ে কাজ করে, ও বলেছিলো, দু’মাসও টিকতে পারবে না, সত্যি, সত্যি তাই হলো।

আমিও ওখানে কয়েকবার গেলাম, আমার লোকজনদের কাজে লাগালাম, সবকিছু মিলিয়ে কাজটা হলো। তবে এখনো কাজ শেষ হয়নি। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে তালাক দেয়াতে হবে, ও মাস্টারের বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত কাজ শেষ না রে পাগলি।

এখন আপনি যা ভালো বুঝবেন করেন ভাই। আমি আর কী বুঝবো।

আর জয়কে জয়পুরহাট থেকে বদলি করে দিনাজপুর নিয়ে আসতে হবে। তবে জয়পুরহাট এখন জয়ের জন্য নিরাপদ না, বুঝলি?

কেনো ভাই?

বুঝিস না আগে বিষয়টা বেশি জানাজানি হয়নি কিন’ আমি যতদূর শুনেছি এখন পুরো জয়পুরহাটে ঘটনাটা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া আগে ইরাসহ একসঙ্গে ছিলো এখন তো ইরাও নেই। ইরা এখন ওদের, এমনকি ইরাও ওকে কাউকে দিয়ে মারতে পারে।

তাহলে এখন কী করবো ভাই?

তুই এখনই জয়কে ফোন কর। ওকে দিনাজপুর আসতে বল।

আচ্ছা ভাই, ঠিক আছে আমি একটু পরে ফোন করবো, বলে সামিনা তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো।

 

উননব্বই

 

সংকুচিত হতে হতে ইরার জগৎ এখন এই চার দেয়ালে বন্দি। নিবেদিতা ছাত্রীনিবাসের ছোট্ট একটি রুম, রুম তো নয় যেনো কবুতরের খোপ। ইরা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। হৃদয় ভাঙ্গা কান্না! তার তিন বছরের প্রেম, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য, জয়ের সাথে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বাদ সব শেষ!

আসার পর পরই শুভ ফোন করেছিলো, হ্যালো মা।

ইরা কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, আমি এসেছি। বলে ইরা শুভকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিলো। শুরু হলো আবার কান্না। প্রথমে হাউ মাউ করে তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে কখন অচেতন হয়ে গেছে ইরার মনে নেই। যখন চেতনা ফিরে এলো তখন একবার ওপরের দিকে তাকালো, ডানে-বাঁয়ে তাকালো, ধীরে ধীরে সব কথা মনে করার চেষ্টা করলো। নিজেকে সামলে নিলো। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো, দু’টো বাজে। মোবাইল ফোনটা সজোরে বিছানার ওপর আছাড় দিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বললো, জয়! আমার জয়! জয় লাঞ্চ করেছো? তোমাকে না প্রতিদিন আমি একটা বাজার কয়েক মিনিট আগে ফোন দিতাম, জয় এসো, জয় এসো। আমি না তোমাকে কতবার বলেছি একটা বাজলেই লাঞ্চ করবে, জয় তুমি লাঞ্চ করেছো? নিশ্চয়ই করোনি, তুমি কোনোদিন আমার কোনো কথা শোনোনি, আমি নিশ্চিৎ তুমি লাঞ্চ করোনি। বলে ইরা জয়কে ফোন করলো, হ্যালো।

জয়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যা-লো।

জয়ের কান্না শুনে ইরা আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, জয়, কাঁদছো কেনো জয়? তুমি লাঞ্চ করেছো?

জয়ের দিক থেকে কোনো কথা এলো না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে এলো।

ওঠো জয়, ওঠো, লাঞ্চ করো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, ক’টা বাজে?

তুমিও কাঁদছিলে জয়! বলতে বলতে ইরা আবার কাঁদতে লাগলো।

জয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, এখন কাঁদছো কেনো ইরা? চলে যাবার পর কেঁদে আর কী হবে? তুমিও লাঞ্চ করোনি নিশ্চয়ই।

আমার খিদে নেই।

আর আমার বুঝি আছে।

তবুও যাও জয়, হোটেল থেকে লাঞ্চ করে এসো। ভেবো না আমি চলে এসেছি বলে তুমি আবার অগোছাল জীবন শুরু করবে। সকালে নাস্তা খাবে না, দুপুরের লাঞ্চ বিকেলে করবে আর রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে, আমি ঠিক ঠিক তোমাকে সময়মতো ফোন করে সবকিছু করাবো।

এটা আবেগের কথা ইরা। এখন একা আছো তাই। যখন আবার মতির কাছে যাবে তখন তুমি তারই হয়ে যাবে। আমার কথা কি আর তোমার মনে থাকবে?

আমাদের সম্পর্কটা কি ভুলে যাবার মতো, মনে ঠিকই থাকবে জয় হয়তো প্রকাশ করতে পারবো না কিন’ তুমি ঠিকই পারবে, তোমার তো বন্ধু আর ভক্ত’র অভাব নেই, তাদের সঙ্গ তোমার আমার কথা মন থেকে মুছে দিবে।

ঠিক উল্টোটা হবে ইরা, তুমি ঠিকই সংসারী হবে আর আমি আগের মতো ভবঘুরেই থেকে যাবো। এই রেস্ট হাউজ থেকে সেই রেস্ট হাউজ। জীবনে কোনোদিন সংসারে মনোযোগী হতে পারিনি, তোমার ভালোবাসা আর মধুর শাসন আমাকে অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছিলো কিন’ তা আর হলো না। আমি যেমন অগোছাল ছিলাম তেমনই থাকবো আর তুমিও ঠিক আগের মতোই সংসারী হবে। মাঝখানে তুমি এসে শুধু শুধু… বলতে বলতে জয়ের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয় একটু ফোনটা রাখোতো জয়, একটু লাইনটা কাটোতো মতি ফোন করেছে।

ইরার কথা শুনে জয়ের বুকটা কান্নায় ভেঙ্গে গেলো, ইরা, মতি ফোন করেছে বলে ইরা আমাকে ফোন রেখে দিতে বললো। ইরা তুমি পারলে, একথা বলতে পারলে, এই তো কয়েক ঘণ্টা আগেও তুমি আমারই ছিলে, এখনো আইনত তুমি আমার স্ত্রী আর তুমি কী না আমাকে বলতে পারলে ফোন রাখতে। মতিই তোমার কাছে বেশি হলো।

কয়েক মিনিট পর জয় ইরাকে ফোন করলো, ইরার মোবাইল ব্যস্ত।

 

ইরা মতির ফোন রিসিভ করলো কিন’ মতির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় তার মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। সে ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে।

মতি বললো, হ্যালো, চুপ করে আছো কেনো?

কী বলছো বলো, ইরা বললো।

কোথায় তুমি এখন?

যেখানে আনার জন্য ষড়যন্ত্র করেছো সেখানে।

মতি কিছুটা অভিমানের সঙ্গে বললো, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ষড়যন্ত্র করবো কেনো, সময়মতো এসে তুমি বেঁচে গেলে। আরও দেরি করলে আমি যদি বিয়ে করে ফেলতাম তবে তোমার আসার পথটা বন্ধ হয়ে যেতো। আমি শুধু শুভ’র কথা চিন্তা করে…

ইরা প্রচণ্ড রাগ হলো, সে মতির কথার মাঝে প্রচণ্ড রেগে গেলো, ব্যস, ব্যস আর বলতে হবে না। আমি কিন’ এখনো জয়ের বউ, জয় আমাকে আসতে দিচ্ছিলো না, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আমাদের ভালোবাসা নষ্ট করে দিলে আবার এখন উল্টাপাল্টা কথা বলছো। শুভ’র কথা ভেবে বলছো কেনো, বরং নিজের কথা ভেবে শুভকে কাজে লাগিয়েছো আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করার জন্য। আমি তোমাকে চিনি না। সেই ছোটবেলা থেকে চিনি, তুমি খুব জটিল প্রজাতির মানুষ।

মতি কোনো কথা বললো না। ইরা বললো, হ্যালো।

মতি গম্ভীর স্বরে বললো, শুনছি।

আমি ভাবতাম জয় লেখক, হৃদয়বান মানুষ সে তার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে সারাজীবন বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারবে। সব ঠিক ছিলো সেও রাখতে পারতো কিন’ আমাকে আগলে রাখার জন্য যে শুধু হৃদয়বান হওয়াই যথেষ্ট না, চাই তোমার মতো একটা জটির প্রজাতির মানুষের সঙ্গে চতুরতায় পেরে ওঠার মতো কূটকৌশল জানা মানুষ। তুমি ষড়যন্ত্র করে জয়ের কাছ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছো। ওকে ভালোই করেছো তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি, তুমি আমার দেহটা পাবে কিন’ মন কোনোদিন পাবে না।

ইরা ভেবেছিলো একথা শোনার পর মতি হয়তো রেগে যাবে, হয়তো বলবে তাহলে তুমি ওর কাছে ফিরে যাও কিন’ মতি অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললো, ইরা, আমি অনেক আশা নিয়ে তোমাকে ফোন করেছি, আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে মাফ চাইবে কিন’ তুমি যেভাবে কথা বলছো তাতে তোমার প্রতি আমার মন ভেঙ্গে গেছে। যাক তোমার ভালোবাসা পাবো কী না জানি না, আমি জীবনে আর কিছু আশাও করি না, তোমার কাছেও না, কারও কাছেও না।

তাহলে আমাকে ছাড়িয়ে আনলে কেনো?

আমি তোমাকে ছাড়িয়ে আনিনি ইরা, বলতে পারো আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি, শুভ যখন বললো তুমি ভালো নেই তখন আমি ভাবলাম, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনি, শুভ’র বিয়ে হয়েছে, ক’দিন পর ঘরে নাতি-নাতনী আসবে, তুমি থাকলে আমার ঘরটা ভরে যাবে।

ইরার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ের ছবি, এলোমেলো পাঁ ফেলে হাঁটছে, ইরা তার পিছু পিছু তার ভঙ্গিতে হাঁটছে, পুতুল ডাইনিংএ নাস্তা দিয়ে ডাকবে, আম্মা।

ইরা বলবে, একটু থামোতো বউমা, দেখোনা আমরা দাদী-নাতনী খেলাধুলা করছি, দিলে তো মুডটা নষ্ট করে।

মতি বললো, হ্যালো।

ইরার ধ্যান ভেঙ্গে গেলো, সে চমকে উঠলো, ওহ বলো।

তুমি একটু নিজেকে গুছিয়ে নাও। এসব কথা আর বলো না। সামনে অনেক কাজ।

কী অনেক কাজ।

তোমার চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে হবে, দেখি ওরা কী বলে, কত টাকা চায়।

টাকা চাইবে কেনো?

বাহ্‌ তুমি ভাবছো এমনি এমনি পার হবে, তবু আমি আছি বলে হয়তো কম টাকায় হবে।

তাতো হবেই, চাকরিতে সাসপেন্সটাও তো তুমি আছো বলেই হয়েছিলো।

মতি কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, ইরা সবসময় বাঁকা কথা বলো নাতো।

আমার কী আর বাঁকা কথা বলার উপায় আছে, এখন তো তুমি যা বলবে আমাকে তাই করতে হবে, তুমি আমার চাকরিটা ফিরিয়ে দিবে, আর আমি তোমার কোনো কথায় না করবো তা তো হয় না মাস্টার বলে ইরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তবে কাজে লেগে যাও, আমাকে তো উদ্ধার করলে এবার চাকরিটা উদ্ধার করো।

তুমিও নিজেকে গুছিয়ে নাও ইরা মহসিন চৌধুরী বলেছিলো আগে সবকিছু ঠিক হোক তারপর…

মানে?

মানে আগে তোমার সঙ্গে জয়ের ছাড়াছাড়িটা।

তারমানে জয়কে না ছাড়লে চাকরিটা থাকবে না?

মতি কোনো কথা বললো না।

ইরা বললো, তাহলে সেটাও করো।

আমি এখন রাখি ইরা, বলে মতি ফোন রাখার জন্য যেনো ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মতির ফোন রাখার ব্যস্ততা দেখে ইরার মনে হলো সে যেনো জয়ের সঙ্গে তার ডিভোর্সের বিষয়টা শুরু করার জন্য তাকে ফোন করেছিলো।

ইরা বললো, ওকে, রাখো।

 

নব্বই

 

ইরার সঙ্গে কথা বলার পর জয় ফোন রেখে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করেছে, সারাদিন আর রেস্ট হাউজ থেকে বের হয়নি। রাতেও কিছু খায়নি। রাতে একবার ইরাকে ফোন করেছিলো কিন’ ইরার ফোন ব্যস্ত। ইরা পরে আর ফোন ব্যক করেনি, ইরা জয়ের একবার খোঁজখবরও নেয়নি। মানুষ এতো তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে। কোথায় সেই ইরা যে কীনা জয়ের জন্য স্বামী-সংসার ছেড়ে জয়ের সঙ্গে চলে এসেছিলো।

জয়ের একবার মনে হলো আর কোনোদিন ইরাকে ফোন করবে না কিন’ নিজের অজান্তে জয়ের হাত মোবাইল নাম্বারে টিপ পড়ছে। বার বার ফোন দেয়ার পর ইরা একবার ফোন রিসিভ করলো, বার বার ফোন দিচ্ছো কেনো?

আমি তোমাকে খুব মিস করছি ইরা, খুউব বলতে বলতে জয়ের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

এখন আর মিস করে কী হবে জয়, সব তো শেষ।

ইরা শেষ পর্যন্ত তুমি চলেই গেলে। ইরা, তুমি থাকতে পারবে ইরা! আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে!

থাকতে হবে জয়, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না বলেই তো তোমার কাছে চলে এসেছিলাম, কই আমাকে তো ধরে রাখতে পারলে কই, বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

তুমি যেওনা ইরা। ফিরে এসো যত ঝড়ই আসুক আমরা একসঙ্গে লড়বো।

তা আর হয় না জয়। তুমি রাতের খাবার খেয়েছো?

না।

দুপুরে?

দুপুরেও খাইনি।

এভাবে না খেতে খেতে তো অসুখ বাঁধিয়ে ফেলবে। তখন তোমাকে কে দেখবে?

আমার কথা ভেবো না, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।

তা ঠিক বলেছো। আমি এখন রাখবো জয়।

কেনো?

এখন কী করবে?

কিছু না। শুয়ে থাকবো।

তো?

মতি ফোন ব্যস্ত দেখলে রাগ করবে জয়। দিনের বেলা যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখনই বলেছে, আমি যেনো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না করি। ফোনটা যেনো ব্যস্ত না থাকে।

জয় ইরার কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, তুমি একথা বলতে পারলে ইরা, বলতে পারলে!

ইরা শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বললো, আমাকে যে সব পারতে হবে জয়। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক যার সঙ্গে বাকী জীবন কাটাতে হবে তাকে আর রাগিয়ে কী হবে।

ওকে ইরা আমি রাখছি। ভালো থেকো। বাই, বলে জয় ফোন রেখে দিলো।

 

বিদায়ের পালা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো বিচ্ছেদের সুর। পরদিন বিকেলে মুকুল মাস্টার এলো। বললো, শিক্ষা অফিসে একটা কাজ ছিলো তাই এলাম। ভাবলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই, আর একটা কথা শুনলাম, ইরা নাকি চলে গেছে?

মুকুল মাস্টার মতির বন্ধু, ইরার সঙ্গেও তার ভালো জানাশোনা আছে। জয়ের সঙ্গে চাকরির সুবাদে পরিচয়, অনেকটা আন্তরিকতাও আছে।

জয় গম্ভীর মুখে বললো, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন কিন’ এতো তাড়াতাড়ি শুনলেন কার কাছে?

মতির সঙ্গে তো প্রতিদিনই কথা হয়, ওই বললো। ক’দিন আগে থেকে শুনছিলাম ইরা চলে যাবে, চলে যাবে।

ও, আপনি তাহলে সব খবরই রাখেন?

আমার আগ্রহ ছিলো না, মতিই প্রতিদিন বলতো। এরমধ্যে একটা ঘটনাও ঘটতে যাচ্ছিলো কিন’ আপনার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে বলে আমি সেটা ঘটতে দিইনি।

কী ঘটনা?

ইরার চলে আসা নিয়ে মতি শিক্ষক সমিতিতে বিচার দিয়েছিলো। মতি বিষয়টা শিক্ষকদের মান-সম্মানের বিষয় বলে সবাইকে নিয়ে এম.পি সাহেবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করতে চেয়েছিলো কিন’ আমি বললাম এটা তোমার ব্যক্তিগত বিষয়, তাছাড়া বউ চলে গেছে এটা যতই প্রচার হবে ততই তোমারই মান-সম্মান যাবে, তাই চেপে গেছে।

জয় বললো, হ্যাঁ খবরটা আমিও শুনেছি। আপনাকে ধন্যবাদ মাস্টার সাহেব।

মুকুল মাস্টার একবার জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামালো তারপর বললো, এখন কী করতে চাচ্ছেন ভাইজান?

কী করা যায় বলুন মাস্টার সাহেব? আমার মাথা আর কাজ করছে না। আসলে ইরা চলে যাবে আমি কখনো ভাবিনি। আসলে ও যেতো না, ওর চাকরিটা জিম্মি করে আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে গেলো। বাকি জীবন আমারই কীভাবে কাটবে আর ওরই কীভাবে কাটবে বলুন।

আপনি হয়তো সারাজীবন কষ্ট পাবেন কিন’ ইরা ক’দিন পর ভুলে যাবে।

মুকুল মাস্টারের কথায় জয় প্রচণ্ড আঘাত পেলো, তিন বছরের প্রেম, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাদের আর মুকুল বলছে ভুলে যাবে। জয় মুকুলকে জিজ্ঞেস করলো, কী বলেন আপনি? এতোকিছু ভুলে যাবে?

মেয়েদের হয়তো আপনি চেনেন না ভাইজান, মেয়েরা হলো পানির মতো, যে পাত্রে রাখা যায় সে পাত্রেরই আকার ধারণ করে। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে কিন’ একবার ভাবুন মতি ইরার প্রথম প্রেম, তাদের প্রায় পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবন সবকিছু ছেড়ে ইরা আপনার কাছে চলে এলো। আপনার তখনই ভাবা উচিৎ ছিলো ভাইজান যে মেয়ে তার প্রথম প্রেম, পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবন, তেইশ বছরের সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন, নিজ হাতে গড় চকচকে বাড়ি ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসতে পারে সে এক মুহূর্তেই আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। আপনাকে একটা কথা বলি ভাইজান।

বলুন?

মুকুল খুব সহজভাবে বললো, যা হবার তা তো হয়েছে এখন আপনি যত তাড়াতাড়ি ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারেন ততই মঙ্গল।

মুকুলের কথাগুলো প্রথম থেকে জয়ের কেমন যেনো হৃদয়হীন এবং অনেকটা বাণিজ্যিক বলে মনে হচ্ছিলো। তবে তার কথায় যথেষ্ট বাস্তবতা ছিলো। এবার যখন জয় ইরার সম্পর্ককে সে ঝামেলা বললো আর তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলার কথা, মানে তালাক দেয়ার কথা বললো তখন জয়ের বুকটা যেনো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। ইরাকে সে তালাক দিবে!

জয় শুষ্ক কণ্ঠে বললো, আপনি আমাদের সম্পর্ককে ঝামেলা বলছেন?

একসময় এটা একটা সম্পর্ক ছিলো এখন এটা ঝামেলাই ভাইজান। একটা কথা মনে রাখবেন ইরা এখন আপনার কাছে নেই। ওদের কথায় ওঠবস করে, যদি ইরাকে নিয়ে মতি কোনো ঝামেলা তৈরি করে তবে আপনি বিপদে পড়বেন। আমি আপনার একজন হিতাকাংখী হিসেবে বলছি, ঝামেলা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলাই ভালো। আপনি বাইরে থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছেন, শেষে আপনি চাকরিতে কোনো বিপদে পড়-ন এটাও আমি চাই না। আপনি যদি বলেন তবে আমি মতির সঙ্গেও কথা বলি। ইরার সঙ্গেও বলতে পারি।

জয় কোনো কথা বললো না।

ইরার চলে যাওয়ার বিষয়টা এখনো তেমন জানাজানি হয়নি। জানাজানি হলে বিপদ হতে পারে, আপনি বাইরের লোক, এটাকে যদি সবাই ইজম ভাবে, জয়পুরহাট বাসীর জন্য অপমানজনক মনে করে তবে অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে। তখন হয়তো পরিসি’তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

আপনি যা ভালো বুঝুন, করুন মাস্টার সাহেব।

জয়ের সম্মতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকুল মাস্টার উঠে দাঁড়ালো। তার ব্যস্ততা দেখে জয়ের মনে হলো মুকুল মাস্টার হয়তো শুধু এটুকু শোনার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো।

 

একানব্বই

 

জয় ইরার ভালোবাসা এখন বাজারের বিক্রয়যোগ্য পণ্য। মুকুল মাস্টার জয়ের সঙ্গে আলাপ করার পর সেদিন সন্ধ্যায় আবার ফোন করলো। তার কথাগুলো যেনো শতভাগ বাণিজ্যিক বলে জয়ের মনে হলো। তার কথার বিষয়বস’ মোটামুটি নিম্নরুপ:

মতির সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। মতি বলেছে ইরার দেনমোহর এক লাখ, তিন মাসের ভোরণ-পোষণ ত্রিশ হাজার এটা ইরার পাওনা। ইরার চাকরি ফেরানো অতো সহজ কাজ না। স্কুল কমিটি তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ তুলে চাকরিতে বহাল করতে তিন লাখ টাকা নিবে বলেছে, টাকা ছাড়াও তাদের খুশি করার জন্য একদিন স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রী কমিটির সদস্যদের গরু জবাই করে খাওয়াতে হবে। সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।

মুকুলের কথা শুনে জয় যেনো বজ্রাহত বাঘের মতো চিৎকার করে উঠলো, কী বলছেন আপনি?

আমি বলিনি ভাই, এগুলো মতির কথা, তবে টাকা ছাড়া যে চাকরি হবে না এটাও নিশ্চিৎ। মতি বলেছে এরকম ঘটনা না ঘটলে তো ইরার চাকরি সাসপেন্স হতো না। যে ওর চাকরির ক্ষতি করেছে সেই চাকরি ফেরাবে।

কিন’ স্কুল কমিটির সদস্য, হেড মাস্টার সবাই যে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে চাকরিতে বহাল করার জন্য অসি’র হয়ে পড়েছিলো। ওদের শিক্ষক দরকার, মতির বউ দরকার সবই তো পাচ্ছে তারা। আর পাবার জন্যই তো সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে, ইরার চাকরিকে জিম্মি করে ওকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো।

সবই ঠিক আছে। মতির কথা হলো এতোবড় একটা অপরাধ করে এমনি এমনি ছাড়া পেয়ে যাবে। যদি টাকা দিতে না চায় তবে মামলা করবো।

মামলার কথা শুনে জয় অবাক হলো, কী মামলা করবে?

ইরা এখন ওদের হাতে ভাই, ইরাই তো এই মামলার ট্রাম কার্ড। এখন মতি যা বলবে ইরা তাই করবে। মতি যদি ইরাকে নিয়ে গিয়ে একটা মামলা করে দেয় তো আপনার চাকরির ক্ষতি হয়ে যাবে।

কী মামলা করবে ইরা?

মামলা তৈরি করতে কী আর কারণ লাগে ভাই, একটা নারী নির্যাতন মামলা করলেই তো ওয়ারেন্ট হয়ে যাবে, আপনি চাকরিজীবী মানুষ, আপনি তো আর পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না। কোর্টে হাজিরা দিবেন, জামিন হবে না। এখন ওরা চাইলে কত কী করতে পারে। এখন ট্রাম্প কার্ড যার হাতে গেম তার হাতে।

মুকুলের কথা শুনে জয়ের বুক কেঁপে উঠলো, ইরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করবে এটাও কি সম্ভব? মুকুল খুব বাস্তববাদী মানুষ। সে এ পর্যন্ত যা বলেছে সবই সত্য এবং বাস্তবসম্মত কথাই বলেছে। কিন’ পাঁচ লাখ টাকা কোথায় পাবে জয়?

জয়কে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল বললো, বেশি দেরি করবেন না ভাইজান। আমি তো দেখছি পরিসি’তি দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ইরা এখন আপনার শরীরের পঁচনশীল, যন্ত্রণাদায়ক অংশ যত তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে পারেন ততই মঙ্গল। আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, লেখক মানুষ। আমার চেয়ে আপনি অনেক জ্ঞানী। একটা কথা মনে রাখবেন ছোট্ট ঘা থেকে ক্যান্সার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন’ আর ছড়িয়ে পড়ার কী আছে, ইরা চলে গেছে, মতি ইরাকে ফিরে পাবে স্কুল তাদের শিক্ষক পাবে কিন’ আমি তো কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু পেলাম না।

আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি কিন’ কী করবেন। বিষয়টা যদি রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তবে তো আর কিছু করার থাকবে না।

আচ্ছা মাস্টার সাহেব আমি একটু ভেবে দেখি।

 

মতির নিষেধ সত্ত্বেও ইরার সঙ্গে জয়ের প্রতিদিনই দু’চার বার কথা হয়। তাদের কথার মধ্যে থাকে পরস্পরের কুশলাদি বিনিময়, স্মৃতিচারণ, মৃদু তর্ক-বিতর্ক, থাকে শুষ্ক হাসি কিংবা চোখের জল। কখনো কথাকাটাকাটির শেষ পর্যায়ে ইরা বলে, তুমি আমাকে আর কোনোদিন ফোন দিবে না, আমি মরে গেলেও না কিন’ পরক্ষণেই আবার ইরা-ই ফোন দেয় তখন শুরু হয় চোখের জল দিয়ে, জয়, সরি জয়, আমার ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমার মাথা ঠিক নেই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না জয়, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

আজ কিছুক্ষণ আগে জয় একবার ফোন দিয়েছিলো। তখন ইরার ফোন ব্যস্ত ছিলো। তারপরই ফোন করলো মুকুল। জয় মুকুলের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ইরাকে ফোন করলো।

ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো, ইরা।

ইরার কণ্ঠস্বর গম্ভীর, বলো।

ইরার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে জয় উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললো, কী হয়েছে ইরা?

ইরা অভিমানের সঙ্গে বললো, কিছু না।

ইরা, প্লিজ বলো।

তুমি কেনো ফোন করেছো সেকথা বলো। আমার কিচ্ছু হয়নি।

ইরা আজ মুকুল মাস্টার এসেছিলো।

তো?

ওর সাথে কথা বলার পর আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম কিন’ তোমার ফোন ব্যস্ত ছিলো। তারপর আর তোমার সঙ্গে কথা হয়নি। এখন আবার ফোন করেছিলো।

কী বলছে?

তার আগে বলো আজ দিনের মধ্যে তোমার কি মতি কিংবা মুকুল মাস্টারের সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ। আজ সারাদিনে অনেকবার কথা হয়েছে।

তাহলে তো নিশ্চয়ই জেনেছো। ইরা, ইরা তুমি কি সত্যি সত্যি আমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছো? এখনো ফিরে এসো সোনা, ফিরে এসো, যত ঝড়ই আসুক আমরা একসাথে ফাইট করবো ইরা।

তা আর হয় না জয়।

ইরা ওরা এখন বলছে…বলতে বলতে জয়ের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

আমার সঙ্গেও আজ মতি, শুভ আর মুকুল মাস্টারের সঙ্গে কথা হয়েছে। জয়, সব যে শেষ হয়ে গেলো জয়। ষড়যন্ত্রের কাছে আমাদের ভালোবাসা হেরে গেলো। আমি আবার কীভাবে ঐ বাড়িতে যাবো, মতি আমার সাথে কি আর ভালো ব্যবহার করবে, আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা। মতি যখন বললো সে ডিভোর্সের ব্যবস’া করছে তখন আমার মনে হলো আমার হৃদপিণ্ডের রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলো, আমার চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে গেলো। তুমি বিশ্বাস করো জয় আমি বুঝি কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে ছেড়ে আমি কীভাবে বাঁচবো জয় বলতে বলতে ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় সান্ত্বনার সুরে বললো, সেজন্যই তো বলছি, যেও না ইরা, ফিরে এসো।

তাও আর সম্ভব না ইরা। আমি এখন না করলে ওরা আমাকে ছাড়বে না জয়, তোমাকেও ছাড়বে না। এমনিতেই শুভ’র তোমার ওপর প্রচণ্ড রাগ আছে। আজ শুভ আমাকে অনেক শাঁসিয়েছে, বলেছে আবার যদি কোনোদিন শুনি আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি আর যোগাযোগ করছি তবে দু’জনকে খুন করবে। আচ্ছা যাক, মুকুল আর কী কী বললো জয়?

বললো তোমার দেনমোহর, স্কুলের চাকরি ফেরাতে আর গরু জবাই করে খাওয়াতে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে সে টাকা আমাকেও দিতে হবে।

ইরা চিৎকার করে উঠলো, উঃ কী নিষ্ঠুরতা। তোমার কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করে ওরা গরু জবাই করে খাবে। আমাকে যখন মতি কথাটা বললো তখন আমার মনে হলো গরু না ওরা আমার জয়কেই জবাই করবে। মাঠ গরুর রক্ত না, আমার জয়ের রক্তে রঞ্জিত হবে। আমার জয় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করবে আর সবাই উল্লাস করবে।

আমিও এতোটা আশা ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম তাদের শিক্ষক সংকট সেজন্য তারাও চাচ্ছে তুমি ফিরে যাও। কিন’ তোমার সাসপেন্সশন অর্ডার উইথড্র করতে টাকা লাগবে, এটা তো ঘুষ। তোমার দাম্পত্য জীবনকে স্কুলে টেনে নিয়ে গিয়ে তারা তোমার কাছ থেকে ঘুষ নিবে। এরাও কি শিক্ষক!

এটা শুধু আমার বেলায় না, সবার বেলায় জয়, আমার চাকরির সময় তো পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে, স্কুলে এটাকে উন্নয়ন ফান্ড বলে কিন’ আমার কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে তো একটা ইটও কিনতে দেখিনি।

কিন’ এখন তো স্কুলের উন্নয়ন সরকারিভাবেই হয়।

হ্যাঁ স্কুলের উন্নয়ন সরকারিভাবে হয় আর স্কুলের উন্নয়নের টাকা দিয়ে শিক্ষকদের বাড়ি হয়। আমাদের স্কুলে গত কয়েক বছরে যত টাকা উন্নয়ন ফান্ড তোলা হয়েছে, সেই টাকাগুলো দিয়ে স্কুলের উন্নয়ন হলে স্কুলে একটাও ভাঙ্গাচুরা রুম থাকতো না। এগুলো দেখে নিজেকে শিক্ষক পরিচয় দিতে আমার খুব কষ্ট লাগে। ইনকামের এতোবড় একটা সুযোগ হেড স্যার আর কমিটি হাতছাড়া করবে না জয়।

জয় মিন মিন করে বললো, ইরা মুকুল পাঁচ লাখ টাকার কথা বলছে।

শুভ আমাকে দশ লাখ টাকার কথা বলছিলো। আরও বলছিলো, ওই বেটার চাকরিটাই খেয়ে ফেলা উচিৎ ছিলো, এখন টাকা জরিমানা দিয়ে চাকরিটা রক্ষা করুক।

ইরা তুমি তো আমার টাকার অবস’া জানো।

আমি চেষ্টা করবো জয় যেনো কম টাকায় হয়। আমার ইচ্ছা শুধু আমার চাকরিটা ফেরাতে যা টাকা লাগে সেটুকুই তুমি দাও। এর বাইরে আমি তোমার টাকা নিতে পারবো না জয়। যদি চাকরিতে টাকা না লাগতো তবে আমি তোমার কাছ থেকে একটা টাকাও নিতাম না কিন’ আমি ছাড়লেও মতি আর শুভ তোমাকে ছাড়বে না, স্কুল আমাকে ছাড়বে না। আমি সেটা ভাবছি না জয়, আমি ভাবছি আমাদের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িপাল্লায় উঠলো বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, ইরা, তুমি খুব ভালো ইরা। ইরা আমার ইরা…

চিন্তা করো না জয় আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। আমি দূর থেকে সারাজীবন তোমাকেই ভালোবাসবো। আমার শরীরটা শুধু ওখানে পড়ে থাকবে জয়, জীবন্ত লাশ হয়ে আর হৃদয়টা থাকবে তোমার কাছে।

ইরার দরজা নক করার শব্দ শুনে জয় জিজ্ঞেস করলো, কে ইরা?

এখন রাখি জয়, খালা খাবার দিতে এলো বুঝি। তুমি রাতের খাবার খেয়েছো জয়?

না, এখন খেতে যাবো।

ওকে জয়। ভালো থেকো।

বাই।

 

বিরানব্বই

 

অবশেষে অনেক আলাপ-আলোচনা, দর কষাকষির পর ভালোবাসার দণ্ড, সম্পর্ক বেচাকেনার মূল্য ধার্য হলো দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। মানুষের সম্পর্কও বেচাকেনা হয়। হ্যাঁ হয়ই তো, সব বিয়েতে অর্থের একটা সম্পর্ক থাকে, সেটা যৌতুক, ডিমান্ড, খুশি হয়ে দেয়া, যা-ই হোক না কেনো। এখনো দেশে বেশির ভাগ বিয়েই হয় অভিভাবকদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ, আভিজাত্য আর সামাজিক মর্যাদা। অথচ বিয়ের আসল উদ্দেশ্যই ছিলো নতুন দম্পতির দাম্পত্য জীবনে সুখ, শান্তি ও প্রেম-ভালোবাসাময় একটি জীবন। অর্থের লেদদেনের অমিলের কারণে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকার পরও বিয়ে ভেঙ্গে যায়, বংশ মর্যাদা এবং সামাজিক মর্যাদার তফাতের কারণে প্রাণপ্রিয় দু’টি মানব-মানবী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর পছন্দের প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে বিয়ে করতে হয় সমাজের বেঁধে দেয়া কারও সঙ্গে, যার সঙ্গে তার রুচি এবং পছন্দের কোনো মিল নেই। তাহলে বিয়েতে ভালোবাসার স’ান কোথায়? তারপরও মানুষ কাটিয়ে দেয় সারাজীবন যেনো এক দগ্ধ খাঁচায়। খাঁচাই তো, প্রেম-ভালোবাসাহীন জীবন তো খাঁচা-ই।

অবশ্য ইরার সঙ্গে মতির বিয়ে হয়েছিলো কোনো অর্থের লেনদেন ছাড়াই। সেটাও প্রেমের বিয়ে ছিলো না। তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেমেদের হৃদয়ে ভালোবাসার চেয়ে আবেগের স’ান বেশি। তাইতো ইরা আবেগবশত মতির হাত ধরে চলে এসেছিলো আর যখন সে বাস্তবতায় ফিরে এলো তখন বুঝতে পারলো, ভালোবাসায় নয় সে আবেগে মতির হাত ধরে চলে এসেছে। তখন থেকে বার বার খাঁচা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে, হাত-পাঁ ছুটোছুটি করেছে ঠিক যেনো ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যাকারীর মতো।

ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যাকারীর রশিতে ঝুলে পড়ার আগের অংশটুকু আবেগের আর ঝুলে পড়ার পর যখন সে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে তখন সে ফিরে আসে বাস্তবতায়, তাই হাত-পাঁ ছুটোছুটি করে বাঁচার জন্য কিন’ ততক্ষণে সব শেষ। ইরাও হাত-পাঁ ছুটোছুটি করেছে সারাজীবন। জয়ের হাত ধরে সে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন’ হায়! তা আর হলো না আবার সেই খাঁচা। জীবনের সঙ্গে যোগ হলো জয়ের স্মৃতি যা ইরাকে সারাজীবন দগ্ধ করবে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিবে জয়ের কাছ থেকে টাকা নেয়া। জয়ের প্রতি তার ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধও করবে।

 

কাজি অফিসে মুকুল মাস্টার এবং আরও দু’য়েকজন জয়ের অপরিচিত লোক ছিলো। জয় ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

সবাই সালামের জবাব দিলো, ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।

কাজি সাহেব জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন।

কাজি সাহেবের সামনে একটা রেজিস্টার ছিলো। তিনি রেজিস্টারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একবার মুকুল মাস্টারের দিকে তাকালেন।

আমরা রেজিস্টারে সই করে এনেছি, বলে জয় মুকুল মাস্টারের দিকে হাত বাড়ালো।

জয় মুকুলের হাতে টাকা দিতেই সে টাকা গুণে নিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে কাজি সাহেবের দিকে রেজিস্টার এগিয়ে দেয়ার জন্য ইশারা করলো।

কাজি সাহেব জয়ের দিকে রেজিস্টারটা বাড়িয়ে দিলো।

জয়ের বুকটা যেনো হাহাকার করে উঠলো, হৃদয়ের মধ্যে কথার ঝড় বয়ে গেলো, ইরা, আমার ইরা, আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে আমরা আর কেউ কারও না। আমাদের ভালোবাসা মিথ্যা, আমাদের সম্পর্ক মিথ্যা। একটা স্বাক্ষরের বিনিময়ে সব ভালোবাসা, সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।

জয় স্বাক্ষর করছে না দেখে মুকুল মাস্টার মৃদু কণ্ঠে বললো, ভাই।

জয় চমকে উঠলো, ও, করছি, বলে সে দ্রুতগতিতে স্বাক্ষর করলো।

স্বাক্ষর শেষ করার পর মুকুল বলতে শুরু করলো, ইরার কাছে যখন সই নিতে গেছিলাম তখন সেও অনেক কাঁদছিলো, আসলে জীবন এমনই যেনো এক অনিশ্চিৎ যাত্রা।

কাজি সাহেব বললেন, তিনবার তালাক বলুন, এক তালাক, দুই তালাক, তিন…

জয় কাজি সাহেবের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললো, সরি, আমি বলতে পারবো না।

কাজি সাহেব বললেন, আইনে তালাক হলো কিন’ মনের বা শরিয়তের দিক থেকে তালাক হলো না। খোলা তালাকের নিয়ম হলো প্রকাশ্যে উভয় উভয়কে তালাক দেয়া।

মুকুল বললো, বাদ দেন তো, আপনি অনুলিপিটা দিন তো।

কাজি সাহেব রেজিস্টারটা নিয়ে একটা অনুলিপি জয়ের হাতে দিলো। জয় কাগজটা হাতে নিলো তার দু’চোখ বেয়ে অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়লো, সবকিছু রেডিই ছিলো, ইরাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে, আগের স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ করবে না জেনেও তাকে আগের স্ত্রী-সন্তানকে ত্যাগ করতে বলতে হবে, যখন সে রাজী হবে না তখন জয়ের বিরুদ্ধে ইরাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে, জয়ের সন্তানদের তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে, জয় একা আর ক’দিক সামলাবে। সবকিছু মিলিয়ে জয়ের কাছ থেকে ইরাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে সেজন্য যত রকম ষড়যন্ত্র প্রয়োজন সব করতে হবে এমনকি কাজির রেজিস্টারে আগেই লিখে রাখতে হবে এমনকি অনুলিপিটাও। জয় ইরাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কত পরিকল্পনা, কত ষড়যন্ত্র! এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

মুকুল মাস্টার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, ভাই চলেন।

জয় চমকে উঠলো, ও হ্যাঁ।

সবাই কাজি অফিস থেকে বের হলো। মোড়ে এসে মুকুল মাস্টার জয়ের সাথে হ্যান্ড শ্যাক করে বিদায় নিলো। জয় মোড়ে দাঁড়িয়ে মুকুলের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। মুকুল কয়েকসেকেন্ড মোবাইল ফোন কানে ধরে রাখলো। তারপর হাত নামালো। কয়েকমিনিটের মধ্যে মুকুল জনসমুদ্রে মিশে গেলো। জয় রিকশায় উঠবে এমনসময় তার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো।

জয় ম্যাসেজটা পড়লো, ইরা লিখেছে, নিজের বউকে টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলে।

আমি তো দিইনি ইরা, তুমি চলে গেলে।

তুমি কি এখনো ওদের সাথে আছো জয়, নাকি একা?

জয় লিখলো, একা।

ইরা জয়কে ফোন করলো, জয় ফোন রিসিভ করলো। ইরার কোনো কথা নেই, শুধু হাউ-মাউ করে কান্না আর কান্নার মাঝে মাঝে হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা বয়ান, সব কী হয়ে গেলো জয়! আমরা হেরে গেলাম, ষড়যন্ত্রের কাছে আমাদের ভালোবাসা হেরে গেলো। আমি কীভাবে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো। আমি জীবন্ত লাশ হয়ে ছিলাম তুমি আমার জীবন্ত লাশে প্রাণের সঞ্চার করেছিলে জয়, আবার আমি লাশ হয়ে গেলাম। আজ থেকে আমি তোমার সাথে কথা বলার অধিকারও হারালাম। আমি তোমার সঙ্গে কথা না বলে, তোমাকে না দেখে কীভাবে বাঁচবো বলো।

জয় একটা রিকশায় উঠলো। তার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে রিকশার হুড তুলে চোখের পানি মুছতে মুছতে ইরাকে বললো, দেখা হবে ইরা। ছোট্ট পৃথিবী, মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগ, দেখতে চাইলেই দেখা হবে।

তুমি কিন’ আমাকে কথা দিয়েছো, তুমি অন্য কারও সঙ্গে রিলেশনে জড়াবে না, আমার স্কুল সরকারি হবে, সরকারি হলে কমিটির আর কোনো হাত থাকবে না, তখন তুমি আমাকে বদলি করে নিয়ে যাবে তোমার কাছে, আবার আমরা বিয়ে করবো। ততদিন আমি বেঁচে থাকবো ঠিক আই সি উ’তে যেমন করে মানুষ বেঁচে থাকে তেমন করে। জয়, আমার জয়, তুমি শুধু আমার থাকবে তো।

জয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, থাকবো ইরা, থাকবো।

নিজের স্বাসে’্যর প্রতি লক্ষ্য রেখো জয়। এখন তো আর তোমাকে দেখার কেউ থাকলো না, তুমি আবার যেনো বেপোরোয়া জীবন শুরু করো না। আমি কিন’ সারাজীবন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো। কোনোদিন যদি জানি তুমি আবার বেপোরোয়া জীবন-যাপন শুরু করেছো তবে আমি খুব দুঃখ পাবো। আমি মনে করবো তোমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো। তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছো।

তেমন হবে না ইরা।

 

তিরানব্বই

 

এই ক’দিনে সামিনা অনেকবার ফোন করেছে, দিনাজপুর যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে কিন’ জয়ের অফিসের কাজের জন্য যাওয়া হয়নি। সপ্তাহ শেষে আবার বৃহস্পতিবার এলো। জয় ঠিক আগের মতোই দিনাজপুর যাওয়ার জন্য কাপড়-চোপড় পরছিলো এমনসময় ইরা ফোন করলো।

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

ইরা বললো, দিনাজপুর যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছো?

জয় আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ কিন’ তুমি জানলে কীভাবে?

এটা আমার থার্ড আই জয়।

তোমার থার্ড আই সবসময় মিথ্যা দেখে ইরা, এটা মিলে গেছে, ঐ যে সেই প্রবাদ আছে একটা ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে।

ঝড়ে বক মরেনি জয়। আমি জানি আজ বৃহস্পতিবার একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে তুমি দিনাজপুর যাবে। তাই ফোন দিলাম। তোমার সবই তো ঠিক থাকলো জয়, রবিবার সকালবেলা দিনাজপুর থেকে এসে অফিস আর বৃহস্পতিবার একতা এক্সপ্রেস টেনে দিনাজপুর। আবার সেই রুটিন।

দু’দিন তো অফিস বন্ধ ইরা, তুমিও চলে গেলে এখানে থেকে আমি কী করবো বলো?

আমি থাকতেও তুমি গেছিলে জয়। আমার জন্য তুমি এক কানাকড়িও ছাড় দাওনি। সামিনা, মানিক, রতন সবার সবকিছু ঠিক রেখে তুমি অবশিষ্ট একটু সময় আমাকে দিয়েছিলে। অথচ আমি তোমাকে পরিপূর্ণরুপে পাবো ভেবে এসেছিলাম। আমার সব শেষ হয়ে গেলো জয়, শেষ হয়ে গেলো বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয় ইরাকে সান্ত্বনার সুরে বললো, ইরা বুঝতে চেষ্টা করো।

জয়, আমার তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে জয়, খুব। আজ ক’দিন হলো তোমাকে দেখিনি। আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে বাকী জীবন কাটাবো জয়।

স্টেশনে এসো ইরা, আমারও তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

না জয়। এই মেসের যে মালিক সে মাস্টারের পরিচিত। আমাকে বাইরে যেতে দেখলে মাস্টারকে ফোন করতে পারে।

তাহলে?

জয় আমার রুমে পশ্চিম জানালা থেকে স্টেশন দেখা যায়। স্টেশনের একেবারে দক্ষিণ দিকে একটা তালগাছ আছে সেই তালগাছটার গোড়া পর্যন্ত দেখা যায়। তুমি ঐ তালগাছটার নিচে এসো, আমি দূর থেকে তোমাকে এক পলক দেখবো জয়।

ওকে ইরা।

 

কয়েকমিনিটের মধ্যে জয় স্টেশনে এসে পৌঁছালো। ট্রেন এক ঘণ্টা লেট আছে। ট্রেনের সঙ্গে লেট সম্পর্কটা যেনো ওতোপ্রতভাবে জড়িত। এক ঘণ্টা লেট জেনে জয় একটু খুশিই হলো যাই হোক, নিজের অজান্তে ফিসফিস করে বললো, যাক, অনেকক্ষণ ইরাকে দেখা যাবে।

ইরাকে ফোন দিলো, ইরা।

তালগাছটার নিচে এসো জয়। পূর্বদিকে তাকাও, একটা জানালা দেখতে পাবে।

জয় ফোনে ইরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তালগাছটার নিচে এসে দাঁড়ালো।

জয়, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি জয়, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, ইরার কথাগুলো এমন শোনাচ্ছিলো যেনো ঠিক হাসপাতালে কোনো চোখের রোগীর অপারেশন সফল হওয়ার পর নতুনভাবে পৃথিবীকে, আপনজনদের দেখার আনন্দে যেমন উল্লাসিত হয় তেমন।

জয় জানালা খুঁজছে কিন’ অনেক জানালা কোথাও কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে না।

ইরা আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো জয়, দেখতে পাচ্ছো?

না।

একটা জানালা দেখতে পাচ্ছো?

অনেকগুলো জানালা তো।

ইরার হাসি কান্না মাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, দেখতে পাবে তো, তুমি তো অনেকগুলো জানালা দেখতে পাবেই। অনেকগুলো বন্ধু দেখতে পাবে, অনেকগুলো ভক্ত দেখতে পাবে শুধু ইরাকেই দেখতে পাবে না।

সত্যি বলছি ইরা।

একটু থামো আমি রুম থেকে আমার লাল ওড়ানটা নিয়ে আসি। বলে ইরা দৌড়ে তার রুমে গেলো এবং একমিনিটের মধ্যে আবার জানালায় এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকের জানালাগুলোর দিকে তাকাও। একটা জানালায় লাল ওড়না দেখতে পাবে, আমি সেই জানালায়।

জয় ইরার কথামতো দেখতে দেখতে বললো, ও পেয়েছি। ইরা আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।

জয়, আমার জয়, তুমি কোথায় যাচ্ছো জয় আমাকে ছেড়ে।

আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাইনি ইরা, তুমি তো জানো আমি দিনাজপুর যাই শুধু দায়িত্ববোধের কারণে।

ইরা মুহূর্তেই রেগে গেলো, আবার সেই পুরাতন ডায়ালগ, দায়িত্ববোধের কারণে। যাও জয়, যাও। চলেই তো গেছো আবার মিছে ধরে রাখা কেনো।

ইরা!

আমি আর কথা বলতে পারছি না জয়, তুমি যাও, প্লিজ, আমার মুড নষ্ট হয়ে গেছে।

 

জয়ের ধারণা ছিলো ইরা চলে যাবার পর সামিনা ভালো হবে, তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে, ইরাকে বিয়ে করায় সামিনার তো আর কম অপমান হলো না, কম শিক্ষাও হলো না। স্বামীকে হারানোর পর আবার ফিরে পেয়ে সে বুঝি জয়কে ভালোবাসা দিয়ে জয় করে ইরাকে হারানোর কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে কিন’ সামিনার চিন্তা হলো ধমক দিলে বা শাসন করলেও জয় আর কিছু করতে পারবে না। তাই তার আচরণে যেনো আরও হাজার গুণ অহংকার, দাম্ভিকতা, দূর্ব্যবহার ফুটে উঠলো। সেদিন জয়পুরহাট থেকে বাসায় ফিরে জয় হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে। সামিনা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে কিছুটা তিরস্কারের সুরে বললো, ইরা নাটক শেষ হলো!

ইরাকে হারানোর কষ্টে জয়ের মানসিক অবস’া অত্যন্ত খারাপ ছিলো। না পাওয়ার চেয়ে পেয়ে হারানোর বেদনা যে আরও কত কষ্টের তা সে কী করে বোঝাবে সামিনাকে। জয়ের এই মানসিক অবস’া সামিনার বোঝা উচিৎ ছিলো কিন’ তা না করে সামিনা জয়ের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। জয়ের বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা আগুনে ঘি ছিটিয়ে সেই আগুন আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে তুলছে।

সামিনা আবার বললো, কিছু বলছো না যে।

কী বলবো?

মাঝখানে শুধু শুধু এতোগুলো টাকা নষ্ট করলে।

জয় খাবার ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

পিছু পিছু সামিনাও বেডরুমে ঢুকলো, কী হলো? খাবে না?

না।

খাবারের আবার কী হলো?

বলেছি তো খাবো না।

কেনো খাবে না? তুমি আসছো বলে আমি রান্না করলাম।

জয় গম্ভীর স্বরে বললো, সামিনা খাওয়া তো শুধু মুখের বিষয় না, মনেরও বিষয়। তুমি আমার খাওয়ার মনটা নষ্ট করে দিয়েছো।

মনটা তো আমি নষ্ট করিনি, মনটা নষ্ট করেছে ঐ মাগীটা। শুধু মনটা না, আড়াই লাক্ষ টাকাও। আমি আগেই বলেছিলাম ঐ মাগীটা তোর কাছে থাকার জন্য আসেনি ক’দিন রুচি বদলানোর জন্য এসেছো। ক’দিন পরে আবার চলে যাবে।

ও চলে যায়নি, তোমার আর মাস্টারের ষড়যন্ত্রের কারণে ও চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।

এখন আমি ছাড়া তোমার কোনো গতি নেই। যেখানেই যাও ঘুরে-ফিরে আবার আমার কাছেই আসতে হবে।

জয় অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা স্বরে বললো, সামিনা আমি ফিরে আসার পর তোমার উচিৎ ছিলো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করা কিন’ তুমি উল্টো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছো।

এগুলো উচিৎ কথা, এগুলো তো তোমার খারাপ লাগবেই। অন্য কেউ হলে আরও কত কী করতো, আমি বলেই এখনো তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করছি।

হ্যাঁ ভালোই তো, এগুলোই তোমার কাছে ভালো ব্যবহার। কোনটা ব্যবহার ভালো আর কোনটা খারাপ সেটাই তো তুমি কোনোদিন জানলে না।

সামিনা প্রচণ্ড চিৎকার করে বললো, জানি না তো, আগে জানতাম না এখন থেকে দেখবে।

সামিনার চিৎকার শুনে রতন তার রুম থেকে বেরিয়ে এলো, কারও কাছ থেকে কিছু না শুনেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, এই কী হয়েছে রে তোর?

জয় ধমকের সুরে বললো, রতন, ভদ্রভাবে কথা বলো।

এতোদিন তো ভদ্রই ছিলাম, ভদ্র থাকা ভুল হয়েছে। তাই আর ভদ্র থাকবো না।

কী করবে তুমি?

রতন মুখ বিকৃত করে বললো, কী করবো মানে? তুই যদি আম্মুর, আমাদের কথামতো না চলিস তবে এবার তোকে খুন করবো।

জয় একবার রতনের মুখের দিকে আরেকবার সামিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, এই রতন, মানিক আর সামিনার জন্য আমি ইরাকে ত্যাগ করলাম। ইরা ঠিকই বলেছিলো তুমি ওদেরকে ছাড়তে পারলে না তো, ওদের জন্য আমাকে ছাড়লে, সামিনা সারাজীবন যেমন তোমার ওপর অত্যাচার করছে আমাকে ছেড়ে দেবার পর তোমাকে আরও বেশি অত্যাচার করবে। ছেলেদের দিয়েও তোমাকে সারাজীবন শাসন করবে। জয়ের দু’চোখ বেছে অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়লো।

 

চুরানব্বই

 

দ্রুতযান এক্সপ্রেসের সঙ্গে জয়ের দীর্ঘ দিনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে ইরার সঙ্গে। ইরার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে জয় দিনাজপুর ট্রেনে উঠেই ইরাকে ফোন দিতো। সারা রাস্তা ইরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আর না হয় ম্যাসেজ আদান-প্রদান করতে করতে যেতো। ইরা চলে যাবার পর এই প্রথম জয় দিনাজপুর থেকে জয়পুরহাট যাচ্ছে। ট্রেনে উঠেই জয়ের ইরার কথা মনে পড়লো। কত কথা, কত স্মৃতি সব হারিয়ে গেলো। সব যেনো দুঃস্বপ্ন।

ইরা, ইরা আজ কোথায়! সেদিন আসার পর ইরা রাগ করে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলো তারপর ইরাকে জয় অনেকবার ফোন দিয়েছে কিন’ ইরা ফোন রিসিভ করেনি। ম্যাসেজ দিয়েছে কিন’ ইরা ম্যাসেজের রিপ্লাইও দেয়নি। আজ সকালবেলা ট্রেনে ওঠার পর থেকে একটা কথা জয়ের বার বার মনে পড়েছে, ইরা এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলো?

জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। জয় খুব আগ্রহ সহকারে ফোনো মনিটরে দেখলো, ইরা ফোন করেছে। আবেগ ও উত্তেজনায় জয়ের বুকটা ধক ধক করে উঠলো, ইরা, আমার ইরা ফোন করেছে। কিছুক্ষণ আগেও জয় ইরাকে দোষারোপ করেছিলো। ভাবছিলো ইরা বুঝি সব ভুলে গেছে।

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

ইরার কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জয়, আমার জয় তুমি ঠিক আছো তো!

ইরা কাঁদছো কেনো ইরা? কিছু হয়েছে? জয় উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো তারপর বললো, আমি ঠিক আছি ইরা।

জয় আমার খুব, খুব, খুউব তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে জয়।

ইরার কথা শুনে জয়ের কণ্ঠস্বরও আবেগে জড়িয়ে এলো, আমাকে দেখতে এতো ইচ্ছা করলে কাল থেকে ফোন রিসিভ করোনি কেনো ইরা?

আমি তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম জয় কিন’ কই পারলাম, কই! তুমি যখন ফোন দিচ্ছিলে তখন মোবাইল ফোনের একেকটা রিং যেনো আমার বুকে একেকটা পাথরের মতো আঘাত করছিলো, জয়! আমি তোমাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবো, জয়!

এই দু’দিনে যদি আমাকে না দেখে থাকতে না পারো তবে সারাজীবন কীভাবে থাকবে ইরা?

আমি পারবো না জয়, পারবো না। আমি যতই তোমাকে ভুলতে চাচ্ছি ততই তোমার স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়ে দাগ কাটছে জয়। আমি জানি না আমি এখন কী করবো?

আমিও তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারছি না ইরা। চলে এসো ইরা, যত ঝড়ই আসুক আমরা একসাথে ফাইট করবো।

কয়েকমুহূর্ত ইরা কোনোর কথা শোনা গেলো না। তারপর ইরার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তুমি কখন পৌঁছাবে জয়?

এই তো দেড় থেকে দু’ঘণ্টার মধ্যে।

আমি তোমাকে দেখবো জয়। তুমি ট্রেন থেকে নেমে সেদিনের মতো প্লাটফরমে তালগাছটার নিচে এসো, আমি দূর থেকে তোমাকে দেখবো।

ওকে ইরা।

 

জয় ট্রেন থেকে নেমে তালগাছে নিচে দাঁড়ালো। সেই স্মৃতিময় তালগাছ, দক্ষিণ পশ্চিমে বারোঘাটি পুকুর, পুকুরের পাড়ে জয় ইরার সেই মধুর কেন্টিন। সব ঠিকই আছে। শুধু যাকে নিয়ে এসব স্মৃতি সে নেই। জয় ট্রেন থেকে নেমে তালগাছের নিচে দাঁড়াতেই দেখলো ইরা সেই জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। ইরা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালো। জয় লক্ষ্য করেছে ইরা ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছছে যা দূর থেকে স্পষ্ট নয় কিন’ অনুমান করা যায় জয়।

জয় ফোন করলো, ইরা!

আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি জয়, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি দেখতে পাচ্ছো জয়! তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছো?

পাচ্ছি ইরা।

কিন’ এতো দূর থেকে, এতো দূর থেকে দেখে আমার মন ভরছে না জয়। কাছ থেকে, খুব কাছ থেকে আমি তোমাকে দেখবো। এসো ইরা, তুমি বেরিয়ে এসো। আমি তোমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছি।

না জয়। তুমি রুমে যাও। আজ বিকেলে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবো। তোমার সময় আছে তো।

অবশ্যই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছো আর আমার সময় থাকবে না। এটা তুমি কী করে ভাবলে ইরা?

আমি জানি জয় আমার জন্য তোমার সময়ের অভাব হবে না। বিকেলে তুমি মোটর সাইকেল নিয়ে এসো, আমরা আজ অনেকদূর যাবো। অনেকদূর! ঠিক আছে?

অবশ্যই।

 

ইরা ফোন করলো ঠিক পাঁচটায়, জয়।

বলো ইরা। কোথায় তুমি?

আমি তো বের হচ্ছি, তুমি মোটর সাইকেল নিয়ে সরকারি কলেজের পিছনে এসো জয়।

জয় সঙ্গে সঙ্গে মোটর সাইকেল নিয়ে বের হলো। জয়ের অফিস থেকে সরকারি কলেজ কয়েক মিনিটের পথ। জয় কলেজের পিছনে যেতেই একটা হুড তোলা রিকশা এসে দাঁড়ালো। ইরার মুখ ওড়নায় ঢাকা ছিলো তবুও জয় চিনতে পেরেছে। ইরা রিকশা থেকে নেমে জয়ের মোটর সাইকেলে উঠেই জয়ের পিঠে মাথা রেখে জয়কে জড়িয়ে ধরে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়, আমার জয়!

জয় ইরার হাতে ঝুলানো প্যাকেট দেখে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি ইরা?

তোমার জন্য একটা ব্লেজার কিনেছি জয়।

জয় একটা শুষ্ক হাসি হাসলো তারপর তার মোটর সাইকেলের লুকিং গ্লাস ঠিক এমনভাবে এ্যাডজাস্ট করে নিলো যে লুকিং গ্লাসে ইরার মুখ জয় মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে দেখতে পাচ্ছে। ইরা মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলেছে, তার গণ্ডদেশ বেয়ে অজস্র ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। জয় মোটর সাইকেল থামালো।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, থামলে কেনো জয়?

জয় মোটর সাইকেল থেকে নেমে ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, কাঁদছো কেনো ইরা?

ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না জয়, আমি না পারছি তোমাকে ভুলতে, না পারছি তোমার কাছে চলে আসতে।

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, এটা রাস্তা ইরা। তুমি একটু ইজি হও। আগে কোথাও গিয়ে বসি তারপর কথা বলবো।

ইরা মোটর সাইকেলে উঠলো। জয় আবার মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো, কোথায় যাবে ইরা?

আমাদের সেই বারো শিবালয়, কথাটা বলেই ইরা যেনো উদাস হয়ে গেলো।

বারো শিবালয় জয় ইরার স্মৃতিময় জায়গা। বিয়ের আগেও এই ছোট যমুনার ধারে সেই বটগাছের নিচে জয় আর ইরা অনেকবার এসেছে। এই গাছের নিচে বসে পাখিদের নীড় বাঁধা দেখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলো, সেই স্বপ্ন একদিন সত্যও হয়েছিলো, যা এখন অতীত, সামিনা আর মতির কূটকৌশলের তাদের বিচ্ছিন্ন করেছে কিন’ তাদের হৃদয় বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তাই হৃদয়ের টানে আজ দু’জনে আবার তাদের সেই স্মৃতিময় বটতলায়।

ছোট যমুনায় তেমন পানি নেই, একটা চিকন নালার মতো সামান্য, স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পাড়ে কাশফুল সাদা ডানা মেলেছে। কাশফুল ইরার খুব প্রিয়। সে মোটর সাইকেল থেকে নেমে কাশফুল, কাশফুল বলতে বলতে ইরা কাশবনে ঢুকলো। জয় ডাক দিলো, ইরা, ইরা যেওনা, সাপ আছে।

ইরা দৌড়ে এলো। জয়ের শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে তার বুকে মাথা রেখে বললো, কাশফুল, আমার কাশফুল!

জয় ইরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ইরা! আমার ইরা!

জয় তুমি হয়তো খেয়াল করোনি আজ বছরের শেষ দিন, বছরের শেষ গোধূলি। এই শেষ গোধূলিতে আমরা আজ আমাদের প্রিয় জায়গায় এসেছি। তুমি আজ আমাকে কথা দাও তুমি তোমার কাশফুলে আর কাউকে স’ান দিবে না তো।

জয় ইরার মুখ উপরে তুলে চোখে চোখ রেখে বললো, না ইরা। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে চিন্তা করি না ইরা।

আমিও করি না জয়। ওখানে হয়তো আমার শুধু দেহটা পড়ে থাকবে আর মনটা পড়ে থাকবে তোমার কাছে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস আমরা… বলতে বলতে ইরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

জয় ইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো, ইরা প্লিজ কেঁদো না ইরা, মানুষ দেখে ফেলবে।

ইরা অভিমানের সুরে বললো, দেখুক, গোটা দুনিয়া দেখুক আমি তোমাকে কত ভালোবাসি অথচ আমরা আজ কেউ কারও নই। এই পৃথিবীর কাছে মানুষের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। ঐ সবুজ রেজিস্টারে দু’টো সই করে প্রেম-ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্ক রচিত হয় আবার ঐ একটা সবুজ রেজিস্টারে দু’টো সই করে দু’টো অবিচ্ছিন্ন হৃদয়ের সম্পর্কও বিচ্ছেদ হয় আমি মানি না, এই সমাজ আমি মানি না। যে সমাজে মানুষের আশা আকাংখার কোনো দাম নেই সে সমাজের কোনো নিয়মই আমি মানবো না।

সমাজ তোমাকে মানতে বাধ্য করবে ইরা। চলো আমরা একটু ঘুরে বেড়াই, ঐ যে দেখো কার্পাস ফুল ফুটেছে, সাদা কাশফুলের মতোই।

ইরা মাথা তুলে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বললো, ওয়াও। খুব সুন্দর তো। চলো।

দু’জনে কার্পাস ফুলের দিকে গেলো। ইরা জয়ের বুকে মাথা রেখে কয়েকটা সেলফি তুললো।

সুসময় যেনো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। এই তো কিছুক্ষণ আগে ওরা এলো আর দ্রুত গোধূলিও যেনো তার আভা বিলিয়ে সন্ধ্যার আগমন বার্তা দিতে শুরু করলো।

ইরা একবার পশ্চিম দিকে তাকিয়ে বললো, জয়, বেলা ডুবে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, চলো ইরা।

কিন’ আমার যে যেতে ইচ্ছা করছে না জয়, আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আজকের পর তোমার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না। তাই যদি হয় তবে আমি যেনো আজকেই মরে যাই, আল্লাহ তুমি কি দেখছো না? তুমি কি আমার হৃদয়ের আকুতি দেখতে পাচ্ছো না? আমি আমার জয়কে ছাড়া…

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। মতি ফোন করেছে। ইরার বুক কেঁপে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো না।

মতি আবার ফোন করলো। জয় বললো, রিসিভ করো ইরা।

না। মতি জানতে চাইবে আমি কোথায়, তখন কী বলবো?

বলো, আমি বাইরে।

না।

বলতে বলতে মতি আবার রিং করলো।

এবার ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

ইরা তুমি কোথায়?

একটু বাইরে বেরিয়েছি।

ঐ শয়তান লোকটার সাথে নিশ্চয়ই?

ইরা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, মতি এখনো আমি তোমার বউ না। এখনই যদি তুমি এরকম করো তবে আমাকে আবার নিয়ে গিয়ে কী করবে।

মতিও পাল্টা ধমকের সুরে বললো, ইরা এখনো বলছি ঐ বেটার সঙ্গে তুমি সম্পর্ক শেষ করো।

সেটা আমি বুঝবো বলে ইরা ফোনের লাইন কেটে দিলো।

চলো জয়, ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো।

জয় বললো, ইদ্দৎ কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তালাক প্রত্যাহারের সুযোগ থাকে সে হিসেবে তুমি যদি এখনো তালাক ফিরিয়ে নাও তবে আমরা এখনো স্বামী-স্ত্রী। অথচ মতি এখনই তোমার সঙ্গে শাসনের সুরে কথা বলছে, ও তোমাকে সুখে রাখবে না ইরা। যেও না প্লিজ!

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে মোটর সাইকেলের কাছে এলো। ইরা মোটর সাইকেলের পিছনে বসলো। জয় মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো।

ইরা জয়ের কানে কানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয় আর কোনোদিন যদি আমাদের দেখা না হয়, তবে আমি প্রতিদিন এই গোধূলিতে তোমাকে খুব মিস করবো জয়। হয়তো আমি তোমাকে দেখতে পাবো না কিন’ তোমার স্মৃতি সেই সাজ গার্ডেনের কাছে বসে, আমাদের তাজমহলের দিকে তাকিয়ে শুধু চোখের জল ফেলবো। দুঃখ, আমার বাকি জীবন যেনো দুঃখই আমার সঙ্গী।

এমন কথা বলো না ইরা, আমাদের দেখা হবে আরও অনেকবার, হাজার বার।

তাই যেনো হয় জয়। তোমাকে ছাড়া আমি জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকবো। আবার যদি তোমাকে ফিরে পাই তবে প্রাণ ফিরে পাবো।

 

পঁচানব্বই

 

সেদিন জয় নওগাঁ যাওয়ার জন্য জয়পুরহাট রেল স্টেশনের প্লাটফরমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। একদিন ফোনে কথা বলার সময় ইরা বলেছিলো সে ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালা দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও কয়েকদিন থেকে ইরার সাথে তার কথা হয়নি। কয়েকদিন আগে ইরা জয়কে ফোন করলো। জয় ফোন রিসিভ করতেই ইরার কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

জয় জিজ্ঞেস করলো, ইরা কী হয়েছে?

জয় তোমার সঙ্গে আমি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবো না জয়, কোনোদিন না!

কেনো ইরা, নতুন করে আবার কী হলো?

জয় কাল রাতে আমি যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন মতি কয়েকবার ফোন করেছিলো কিন’ আমি বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষণ পর যখন তোমার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলো তখন শুভ ফোন করে কতকগুলো বিশ্রী কথা বললো। নিজের সন্তান হয়ে মা’র সঙ্গে এতো বিশ্রীভাবে আচরণ করতে পারবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

সেজন্যই তো বলছি ওখানে যেওনা ইরা। ওরা তোমাকে সবসময় অপমান করবে।

জয় ইরার কথা না শোনার ভান করে বললো, শুভ আমাকে দিব্যি দিয়েছে জয়, আমি যেনো তোমার সঙ্গে কথা না বলি।

ইরার কথাটা জয়ের বুকে প্রচণ্ড আঘাত করলো, ইরা! তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, আমি, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না।

ইরা কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, তুমি আর আমাকে ফোন দিও না জয়।

ইরা! বজ্রাহত বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো।

প্রয়োজনে আমি তোমাকে ফোন করবো জয় বলে ইরা জয়কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলো।

ইরার নিষেধ সত্ত্বেও জয় ইরাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে, ফেসবুকে নক করেছে কিন’ ইরা সাড়া দেয়নি।

আজ জয়পুরহাট রেল স্টেশনে এসে জয় তালগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সেই জানালার দিকে তাকালো। ইরা যদি একবার জানালার দিকে তাকায় আর তাকে দেখতে পায়, যদি দেখতে পেয়ে সব দিব্যি ভুলে গিয়ে ফোন দেয়। ভালোবাসার মানুষকে এক পলক দেখতে পাওয়া, কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়ার জন্য যে কত ব্যাকুলতা থাকে তা যারা ভালোবাসে শুধু তারাই জানে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার সাধ মানুষের কোনোদিন হারায় না। জয় ইরার জানালার দিকে কতক্ষণ তাকিয়েছিলো মনে নেই, জানালায় ইরা নেই কিন’ সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয়ের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সে চোখ মুছলো, তার হাতের ডান দিকে বারোঘাটি পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসতো, চা খেতে খেতে গল্প করতো। ইরা এই দোকানের একটা নাম দিয়েছিলো, মধুর ক্যান্টিন। জয় দু’য়েক পা করে হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনের দিকে গেলো। তার দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।

 

এই জয়পুরহাট প্লাটফরমে ইরার সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ইরাসহ একবার রাজশাহী যাচ্ছিলো। ট্রেন অনেক দেরিতে ছিলো, ওরা অনেকক্ষণ এই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে দু’জনে গল্প করেছিলো। রেললাইন পার হয়ে ওপারে গিয়ে পিঁয়াজি-বেগুনি খেলো। তখন সন্ধ্যা, প্লাটফরমের লাইটপোস্টে বাতি নেই, আবছা আবছা অন্ধকার। রেল লাইন থেকে প্লাটফরম বেশ উঁচুতে, প্লাটফরমে উঠতে গিয়ে ইরাকে জয় হাত ধরে টেনে তুললো, তারপর প্লাটফরম দিয়ে দু’জনে হাঁটছিলো, ইরা জয়ের কাঁধে ভর করে গা ঘেঁষে হাঁটছে। হঠাৎ করে ইরা জয়কে টেনে ধরলো, তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, আমাকে সারাজীবন এভাবে ধরে রাখবে তো?

জয় ঘুরে দাঁড়ালো। অন্ধকারে দু’জনে মুখোমুখি, পাশ দিয়ে যাত্রীরা যাচ্ছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। জয় ইরার থুঁতনি উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রাখলো, ইরার দীপ্তিময় দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে। জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, সারাজীবন রাখবো!

এমনি হাজারও চিন্তা করতে করতে জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

সিরাজ ফোন করেছে, জয়ের কলিগ। তার দুঃসময়ের সবচেয়ে আপনজন।

জয় রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কেমন আছো জয়?

ভালো, তুমি?

ভালো আছি, তোমার তো বদলি হয়েছে।

ক’দিন আগেও জয় বদলি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলো, যেদিন ইরা বাসা থেকে চলে গেলো, তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করলো, জয় আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছিলাম, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো, আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবো, তোমার চাকরি খাবো, তোমাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।

তখন ইরার কথা শুনে জয়ের মনে হচ্ছিলো সে আর তার নেই, এক সময়ের বন্ধুই এখন তার দিকে বন্দুক তাক করে সুট করার অপেক্ষায় আছে। সামনে পেলে গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিবে। তাই সেও বদলির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কিন’ ইরার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর পরিসি’তি এখন অনেকটাই শান্ত, জয় মাথা থেকে বদলির সিদ্ধান্তটা মুছে ফেলেছিলো। ঠিক এমনসময় সিরাজের কথা শুনে জয়ের বুকটা যেনো ভেঙ্গে গেলো। সে কিছুটা আর্তচিৎকারের মতোই বললো, বদলি!

হ্যাঁ, তুমি না এতোদিন বদলির চেষ্টা করছিলে এখন আবার এমন করে বলছো কেনো?

জয় মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো, কোথায়?

ঠাকুরগাঁও।

ততক্ষণে ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে, ইঞ্জিন ইরার দিকে তাকানোর জানালাটা ঢেকে দিয়েছে।

জয় ট্রেনে উঠলো।

 

কয়েকমাস আগের কথা। ইরার সঙ্গে তখনো জয়ের বিয়ে হয়নি। ইরা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো কাজের অজুহাতে জয়পুরহাট আসতো। দু’জনে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো, সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারি, শিশু উদ্যান, বারো শিবালয়, ছোট যমুনার পাড়। কেনাকাটা করতো নিউ মার্কেট, মৌসুমী মার্কেট, মাড়োয়ারী পট্টি, ক্যাটস পো। ক্যাটস পো’তে ইরা জয়ের জন্য শার্ট পছন্দ করে তার গায়ে এলিয়ে দিয়ে জয়কে আয়নার কাছে নিয়ে যেতো, তার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলতো, তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে না?

জয় বলতো, শার্টটা সুন্দর মানিয়েছে, তবে তারচেয়ে সুন্দর মানিয়েছে আমাদের দু’জনকে।

ইরা লজ্জায় সংকুচিত হতো।

জয় বলতো যেমন ঝলমলে শার্ট তেমনি রাঙ্গা তরুণী।

ইরা মুখ বিকৃত করে বলতো, তরুণী? ছত্রিশ বছর বয়সেও তরুণী, তাহলে বুড়ি হবো কবে?

যারা প্রেম করে তারা নব্বই বছর বয়সেও তরুণ-তরুণীই থাকে ইরা।

জয় কয়েক মিনিট আগেই গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছলো। আবার তাদের আনন্দময় স্মৃতির কথা মনে করে হাসছে তাকে কেউ পাগল বলছে না তো? ডানে-বাঁয়ে একবার তাকালো, না কেউ তার দিকে তাকায়নি। পৃথিবীতে কারও দিকে তাকানোর মতো সময় কারও নেই। যে যার সে তার।

 

সেদিন জয় দিনাজপুর যাবে এদিকে ট্রেনের সময়ও হয়ে গেছে আবার ইরাকেও বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেয়ার সময় হয়েছে। ইরা জয়কে বললো, প্রতিদিন তো তুমি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসো আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো।

তোমার দেরি হয়ে যাবে ইরা।

হোক, প্রতিদিন তো তুমি আমাকে হ্যাজবেন্ডের কাছে যাবার জন্য তুলে দিয়ে আসো হাসিমুখে। আমি বুঝতে পারি কষ্টে তোমার বুক ফেটে যায় কিন’ হাসিটা মুখে লেগেই থাকে। তুমি আমার জন্য খুব চিন্তা করে করে এমন সিচুয়েশন তৈরি করো যেনো আমি কোনোভাবে কষ্ট না পাই। আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো। দেখি তোমাকে তোমার বউয়ের কাছে পাঠাতে আমার কষ্ট হয় কী না।

ইরার কথাটা যেনো জয়ের বুকে একটা ধাক্কা দিলো, ইরা তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিবে? অনেক কষ্ট পাবে ইরা। ওর বুক ফেটে যাবে। জয় নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বললো, না ইরা, ট্রেনের এখনো দেরি আছে, চলো তোমাকে আমি রেখে আসি।

না। ট্রেন যত দেরিই হোক আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর যাবো।

জয়ের দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। কারণ ইরা সত্যি বলেছে ওকে ওর স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য যখন সে বাসে তুলে দিতে যায় তখন তার বুকটা ফেটে যায়। তার সবসময় মনে হয় ইরা আমার, শুধুই আমার। আমার ইরা কেনো আরেকজনের কাছে যাবে। ইরা এই কষ্ট সইতে পারবে না বলে জয় আবার ইরাকে বললো, না তোমাকে দেরি করতে হবে না। আমি তোমাকে রিক্সায় তুলে দিই, তুমি যাও।

জয়ের চোখে পানি দেখে ইরার দু’চোখ ছলছল করে উঠলো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো? আমি কষ্ট পাবো বলে তুমি… বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জয় ইরাকে একটা রিক্সায় তুলে দিলো। ইরা চলে গেলো।

 

বদলির আদেশ পাবার পর জয়ের যাবার প্রস’তিও সম্পন্ন হলো। জয় এই দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক জায়গায় চাকরি করেছে। কোথাও তার হৃদয় গেঁথে যায়নি। অথচ জয়পুরহাটে শুধু তার হৃদয় গেঁথেই গেলো না, হৃদয় খণ্ডিত হলো, রক্তাক্তও হলো। তার এই রক্তাক্ত হৃদয় থেকে এখনো সবসময় রক্ত ঝরছে, দু’চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছে।

জয়পুরহাটে জয়ের চার বছরের চাকরি জীবন, তিন বছরের প্রেম, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য জীবনের অবসান হলো।  সে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কিনে স্টেশনের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা অনেকদিন তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কষ্ট পাবে ভেবে সে তার আগেই ইরাকে ওর বাসে তুলে দিয়েছে। আজ যদি ইরার সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতো তবে হয়তো ইরা এই প্লাটফরমে তাকে বিদায় জানাতো।

জয় সেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তার সেই জানালার দিকে। হয়তো ইরাও তাকিয়ে আছে। ইরার সঙ্গে তখন সেপারেশন হয়েছে কিন’ ডিভোর্স হয়নি। তখন একদিন ইরা বলেছিলো, ট্রেনের হর্ন শুনলেই তার বুকটা কেঁপে ওঠে, মনে হয় এই বুঝি ট্রেন এলো আর তুমি বুঝি ট্রেনে চড়ে দিনাজপুর চলে গেলে। আবার কখনো মনে হয় বিকেল হলেই প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি তোমাকে এক পলক দেখতে পাই। যে ইরা প্রতিদিন ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো সে যখন জানবে তার হৃদয় রক্তাক্ত করে, হৃদয় টুকরো টুকরো করে জীবনের শেষ ট্রেনটিও চলে গেছে তখন এতো বড় কষ্ট ইরা সইবে কী করে? জয় ইরার মোবাইলে কয়েকবার ফোন দিলো কিন’ ইরা রিসিভ করলো না।

ইরা, ইরা বুঝি এখনো জানালার কাছে বসে প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ সজল হলো। আজ ট্রেন এক ঘণ্টা দেরিতে আসবে। প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্লাটফরমে আবছা আবছা অন্ধকারে তার মনে হলো একটা অস্পষ্ট ছায়া তার পাশে এসে দাঁড়ালো। নিজের অজান্তে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ইরা!

সেই অস্পষ্ট ছায়াটি জয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার কানে একটা করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো, চলে যাবে!

কথাটা জয়ের বুকে প্রচণ্ড আঘাত করলো।

ইরা অভিমানের সুরে বললো, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।

ভালোবাসি না মানে?

ভালোবাসলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে না।

আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাইনি ইরা তুমি তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। এখন আর থাকা না থাকার মধ্যে তফাৎ কী।

তাই বলে তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে! ডিভোর্স হয়েছে কিন’ হৃদয়ের সব স্মৃতি তো মুছে যায়নি, হৃদয়ের সম্পর্ক তো আর ছিন্ন হয়নি। আবারও বলছি, একটা কথা মনে রেখো হৃদয় কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

দূর থেকে ট্রেনের আলো জয়ের চোখে পড়তেই সে চমকে উঠলো। সে ডানে-বাঁয়ে তাকালো, না তার আশে পাশে তো কেউ নেই।

ট্রেন আসতে দেখে স্টেশনে চাঞ্চল্য দেখা দিলো। যাত্রীরা ছুটোছুটি শুরু করলো। জয় ট্রেনে উঠলো। এই জয়পুরহাট রেল স্টেশন, বারোঘাটি পুকুর, বৈরাগীর মোড়, এই সব অতি চেনা জায়গায় তার আর কোনোদিন আসা হবে না। ভাবতেই বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

জয়ের সিট পড়েছে পূর্বদিকের ঠিক জানালায়। এই জানালা থেকে ইরার জানালা চোখে পড়ছে। একটা অস্পষ্ট নারী মূর্তি যেনো জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, এটাই কী আমার ইরা? নিশ্চয়ই ইরা জানালায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা বলেছিলো ট্রেনের শব্দ শুনলেই সে জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

জয়ের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, ইরা, আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে আছে ইরা, তোমাকে রেখে আমি চলে যাচ্ছি, হয়তো চিরদিনের জন্য, তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। যাকে কয়েকদিন না দেখলে আমি অসি’র হয়ে যেতাম, দু’য়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ না হলে আমার কানের কাছে মোবাইল ফোনের শব্দ বেজে উঠতো, তার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন কথা হবে না, তার কণ্ঠস্বর আর কোনোদিন আমার কানে ভেসে আসবে না।

ট্রেন ছাড়ার করুণ বাঁশি বেজে উঠলো। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে চললো জয়ের হৃদয়হীন দেহ নিয়ে গন্তব্য দিনাজপুরের দিকে, পিছনে পড়ে রইলো তার প্রেম, তার হৃদয়, তার বুক ভেঙ্গে যেনো হু হু করে কান্না বেরিয়ে এলো। নিজের অজান্তে হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো, ইরা, আমার ইরা, বিদায়! চিরবিদায়!

 

ছিয়ানব্বই

 

সংসারটা জটিল হয়ে গেলো। এইতো ক’মাস আগেও জয়ের সংসারটাকে নিজের মনে হতো অথচ আজকাল ঘরের প্রতিটি জিনিস কেমন যেনো মনে হচ্ছে। ঘরটাকে যেনো মনে হচ্ছে হোটেল আর নিজেকে এই বাড়ির একজন অতিথি বলে মনে হচ্ছে। নিজের সন্তান মানিক-রতন, স্ত্রী সামিনা সবাইকে যেনো তার কত অচেনা মনে হচ্ছে। সবার কথাবার্তায় যেনো কোনো আন্তরিকতা নেই। সামিনার কথাবার্তার ধরণও পাল্টায়নি। বলতে গেলে সেই রুক্ষ্মতা, সেই দাম্ভিকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কথায় কথায় সামিনা খোঁচা মেরে কথা বলে।

সেদিন রাতে জয় লিখতে বসেছিলো। নিজের জীবনে ইরার সঙ্গে তার জীবনে ঘটে যাওয়া আনন্দ-বেদনার স্মৃতি নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। লেখায় যেনো আবার প্রাণ ফিরে এসেছে, গতি ফিরে এসেছে। লিখতে লিখতে কত রাত হয়েছে মনে নেই কিন’ লেখা চলছিলো। জয় একবারও সময়ের দিকে তাকায়নি। সামিনা বেডরুমে ঘুমাচ্ছিলো কিছুক্ষণ পর সামিনা বিছানা ছেড়ে উঠে এলো জয়ের কাছে, তুমি ঘুমাবে না?

সামিনা চলে গেলো। জয় আবার লিখতে শুরু করলো। জয় লেখা শুরু করলে সাধারণত যতক্ষণ লেখা আসে ততক্ষণ লিখতে থাকে নইলে লিখতে না পারার যন্ত্রণা তাকে খুব কষ্ট দেয়। কিছুক্ষণ পর সামিনা বেডরুম থেকে জোরে কর্কশ স্বরে ডাক দিলো, এই তুমি আসবে না?

আসছি।

আমি গেলে কিন’ তোমার ল্যাপটপ ভেঙ্গে দিবো।

জয় সামিনার কথা না শোনার ভান করে লিখতে থাকলো। সামিনা বেডরুম থেকে আবার বেরিয়ে এলো, ওঠো, ঘুমাবে।

সামিনা আরেকটু। লেখাটা শেষ করে উঠছি।

না, তুমি এখনই উঠবে।

কেনো? আমি তো তোমাকে কোনো ডিসটার্ব করছি না।

ডিসটার্ব করছো না, না? তুমি ড্রয়িংরুমে খটখট করে কি-বোর্ডের শব্দ করলে ডিসটার্ব হয় না?

জয় শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, সামিনা যাও বলছি, আমি আসছি।

সামিনা মনিটর জোরে নামিয়ে দিয়ে বললো, রাখ তোর লেখা।

জয় আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না, জোরে গর্জন করে উঠলো, সামিনা! যাও বলছি, আমার লেখার মুড নষ্ট করো না।

না গেলে কী করবে, কী করবে, মারবে? মারো, আমাকে মারো বলে সামিনা একরকম জয়ের গায়ে ওপর এসে পড়লো।

জয় সামিনা দিকে হাত বাড়াতেই সামিনা জয়ের হাত চেপে ধরে জোরে চিৎকার করে উঠলো, মানিক, রতন, ওঠ তো, তোর বাবা আমাকে মারছে।

সঙ্গে সঙ্গে মানিক আর রতন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মানিক কিছু শোনার আগেই জয়ের ওপর গর্জে উঠলো, এই কী হয়েছে রে তোর? কী হয়েছে?

জয় মিনমিন করে বললো, আমার তো কিছু হয়নি, আমি লিখছিলাম তোর মা তো এসে আমার লেখা বন্ধ করে দিলো। ওর নাকি ডিসটার্ব হচ্ছে।

রতন চিৎকার করে বললো, ডিসটার্ব হয় তো। আমাদেরও ঘুমের ডিসটার্ব হয়।

কি-বোর্ডের শব্দে তোমাদের ঘুমের ডিসটার্ব হয়! তাহলে তো তোমাদের সঙ্গে আমার থাকা চলবে না। আমি কাল সকালে বাসা থেকে চলে যাবো।

সামিনা চিৎকার করে বললো, যা না, যা। এখনই যা। কোন মাগী তোর সঙ্গে সংসার করে, আমি বলে সংসার করছি। দেখলি তো একটাকে এনে, ক’দিনেই চলে গেলো।

মানিক চিৎকার করে বললো, চলে যাবি, গিয়ে দেখ, তোকে আমি…বলে জয়ের গলা টিপে ধরার জন্য হাত বাড়ালো।

রতন নিষেধ করলো, এই মারিস না, মারিস না।

যদি চলে যাস তবে আমি তোকে বলে… মানিক দাঁত কড়মড় করে বললো, তোকে আমি জবাই করবো, জবাই।

সামিনা আবার চিৎকার করে বললো, মারবি না কেনো, ওকে মার, দেখি ও কী করে বলে জয়ের গায়ের ওপর এলো।

জয় সামিনাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই সামিনা বলে উঠলো, দেখলি, আমাকে মারলো, দেখলি। তোরা সন্তান হয়ে মায়ের মার খাওয়া দেখে থাকবি।

এই মারলি কেন? আমার মাকে মারলি কেন? বলে মানিক জয়ের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলো।

জয়ের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো, সিলিংয়ের বন্ধ পাখাটা যেনো উল্টো গতিতে চলতে শুরু করলো। সে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো।

জয় কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে পিতা হিসেবে তার এই ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী করলো। জয় তখন ক্লাস নাইনে পড়তো। সিলেবাসে একটা কবিতা ছিলো ’’ক্যাসাবিয়াঙ্কা’’। জয়ের বাবা বিছানায় শুয়ে জয়ের পড়া শুনতো, বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করতো, অনেক কথা বলতো, বাপ-বেটায়। যেদিন সে ক্যাবাবিয়াঙ্কা কবিতাটা পড়ছিলো তখন বাবা বিছানা থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, এই কবিতাটা এখনো সিলেবাসে আছে বাবা?

জয় বললো, হ্যাঁ। ক্যাসাবিয়াঙ্কা।

জয়ের বাবার চোখ দু’টো যেনো পানিতে চিকচিক করছিলো, খুব ভালো কবিতা, মনোযোগ দিয়ে পড়। আর মনে রাখবি বাবার আদেশ কখনো অমান্য করতে হয় না।

কবিতাটা জয়ের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো, সেই সঙ্গে বাবার স্মৃতি। ক’দিন আগে সামিনার সঙ্গে রতনও যেদিন তার সাথে ধমকের সুরে কথা বলছিলো সেদিন রাতে জয় গুগল সার্চ দিয়ে বের করলো। হঠাৎ করে মনে পড়লো, দেখিতো কবিতাটার বাংলা ভার্সন হয়েছে কী না।

সত্যি সত্যি বাংলা ভার্সনও হয়েছে। জয় বাংলা ভার্সনটা পড়লো। কবিতাটি লিখেছেন ফেলিসিয়া ডরোথিয়া হেমেন্স আর বাংলায় অনুবাদ করেছেন বাপ্পা দত্ত। কবিতার প্রথম লাইন পড়তেই যেনো জয়ের বাবার মুখ খানা ভেসে উঠলো।

 

ক্যাসাবিয়াঙ্কা

 

জ্বলন্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে ছেলেটা,

জাহাজ ছেড়েছে বাকি সবে;

যুদ্ধের আগুনের লেলিহান শিখা,

ধায় মৃত্যুর উৎসবে।

 

তবু সেথা উজ্জ্বল ঋজু সে দাঁড়িয়ে,

ঝড়ের লাগাম যেন হাতে;

বীরের রক্তে গড়া গর্বিত প্রাণী,

ছোট বালক চেহারাতে।

 

আগুন যতই হোক-যাবে না সে কভু

পিতার আদেশ ছাড়া কোথা;

পিতা তার প্রাণহীন পড়ে নিচতলে

কণ্ঠে শুধুই নীরবতা।

 

শুধায় বালক জোরে-’বলো, বাবা বলো

হয়েছে কি কাজ মোর সারা?’

জানা নেই প্রভু তার নিঃশেষ আজি

পায় না সে ছেলের ইশারা।

 

’বলো, বাবা!’ আবার সে শুধায় সজোরে,

’এবার আমি যেতে পারি যদি!’

গোলা গর্জনই শুধু ফেরে উত্তরে,

আগুন ছড়ায় নীরবধি।

 

ভুরুতে সে পায় সেই আগুনের আভা

আর তার কুঞ্চিত চুলে;

তাকায় সে অসহায় সাহসের সাথে,

মৃত্যুর মাস’লে।

 

চিৎকার করে ওঠে শেষ নিঃশ্বাসে,

’বাবা! থেমে থাকতে কি হবে?’

যখন আরও দ্রুততায়, আগুন ছড়িয়ে যায়,

পালের চাদর সহ সবে।

 

গিলে নেয় জাহাজটা পুরো গোগ্রাসে,

উঁচু পতাকাটা গ্রাস করে,

আগুনের লকলকে জিভ যায় দেখা,

ছেলেটার মাথার উপরে।

 

তারপর বিকট এক বিষ্ফোরণেতে-

ছেলে-ওহ! কি যে হয় তার?

দূরবাহী হাওয়া জানে সেই পরিণতি

বিদীর্ণ শিশু দেহটার।

 

মাস’ল, অরিত্র, ধ্বজা সব সহ,

জাহাজের হয় অবসান,

সঙ্গে ধ্বংস হয় বেশি কিছু যদি

অবিচল সাহসী সে প্রাণ।

 

বাবার আদেশ ছাড়া জাহাজ ত্যাগ না করায় কীভাবে প্রাণ দিলো ক্যাসাবিয়াঙ্কা। আজ মানিক যখন তার গালে চড় মারলো তখন জয়ের নিজের ওপরই আক্ষেপ হলো, কেনো সে নিজের ছেলেদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারেনি। জয়ের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো।

 

পরদিন সন্ধ্যায় বাসায় সালিস বসলো। সালিসে সামিনার বাবা-মামাসহ মুরুব্বী গোছের কয়েকজন লোক উপসি’ত হলো। জয়ের পক্ষে তার ছোট ভাই, দুলাভাইসহ কয়েকজন উপসি’ত হলো। সালিসে জয় ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললো, এভাবে ওদের সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না, এতে করে যেকোনো সময় সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে। আমি শুধু ওদের দোষ দিচ্ছি না, ওদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে আমিও তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারি।

সামিনা, মানিক-রতন সব অস্বীকার করলো।

জয় হতবাক হয়ে গেলো। যে সন্তানদের সে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তারা তার গায়ে হাত তুললো, তারপর অনুশোচণা তো দূরের কথা অস্বীকার করলো।

সামিনার বড় মামা বললো, ওরা তো বলছে ওরা নাকি কিছু করেনি জামাই। এখন ওরা বলছে ওরা কিছু করেনি আর তুমি বলছো ওরা তোমাকে মেরেছে। আমরা কার কথা বিশ্বাস করবো বলো?

জয় বললো, তাহলে কি আমি মিথ্যা কথা বলছি, আজ ওরা আমাকে মেরে অস্বীকার করছে, ওরা তো তিনজন এক পক্ষে আর আমি একা। এই একা বাসায় ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলে তবুও তো আমি সাক্ষী খুঁজে পাবো না।

তুমি এসব কী কথা বলছো জামাই। ছেলেরা তোমাকে মেরে ফেলবে কেনো?

ওদের ওপর আমার ভরসা নেই মামা। আমি আর ওদের সঙ্গে থাকবো না।

তাহলে তুমি কী করতে চাচ্ছো?

আমি আলাদা থাকবো।

সামিনা ফোঁস করে উঠলো, মানে?

মানে আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকবো না।

অবশেষে সবাই মিলে একটা সিস্টেম করে দিলো। প্রতি মাসে জয় সংসার খরচের জন্য বিশ হাজার টাকা দিবে। কোনোদিন যদি সে মনে করে বাসায় আসবে, তো আসবে, নয়তো আসবে না।

জিদের বশে একটা চুক্তি হলো বটে কিন’ চুক্তির পর জয়ের বুক ফেটে হু হু করে কান্না বেরিয়ে এলো। সে একবার সামিনা, মানিক-রতনের মুখের দিকে তাকালো। তাদের কারও মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই, যেনো সবকিছু ঠিকই আছে। জয় সেই ছোটবেলা থেকে মানিক-রতনকে সঙ্গে নিয়ে বাজার যেতো, রতনের হাতের লেখা ভালো সে বাজারের লিস্ট করতো, মানিক বাজারের ব্যাগ নিতো। বাপ-বেটা মিলে বাহাদুর বাজারে বাজার করতো। আর কোনোদিন জয়কে বাজার করতে হবে না। রতন চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ করে। বড় বড় চিংড়ি দেখে কেনার জন্য জিদ করে, রতন আর কোনোদিন জিদ করবে না। বাপ-বেটার আবেগ, ভালোবাসা চুক্তিবদ্ধ হলো। জয় কী চেয়েছিলো আর কী হচ্ছে তার জীবনে এসব।

 

সাতানব্বই

 

ঠাকুরগাঁও রেস্ট হাউজ। রেস্ট হাউজ আর ডাকবাংলো জয়ের জীবন থেকে গেলো না। চাকরি জীবনের শুরুতে কন্সট্রাকশন কাজের সাইটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মনপুরা আর সরকারি চাকরিতে জয়েন করেই রৌমারী-রাজিবপুর ডাক বাংলো। জয়ের পোস্টিং যখন হলো ধামইরহাট তখন থাকতে শুরু করলো নওগাঁ ডাকবাংলো। সবশেষ পাঁচবিবি এবং জয়পুরহাট ডাকবাংলোয়।

জয় যে শুধু চাকরির প্রয়োজনে রেস্ট হাউজ আর ডাকবাংলোতে জীবন কাটিয়েছে তা না। দাম্পত্য জীবনের অশান্তি এড়িয়ে চলার জন্য, সামিনার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য কাজের অজুহাতে জয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়ে দিলো স্বেচ্ছা নির্বাসনে। ইরাকে বিয়ে করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো একটা মধুর দাম্পত্যের মধ্যে দিয়ে। কিন’ ইরা, ইরা এখন কোথায়!

ঠাকুরগাঁও রেস্ট হাউজে শুয়ে থাকতে থাকতে জয় ইরার কথা ভাবছিলো। কত স্বপ্ন ছিলো দু’জনের মাঝে, জয়পুরহাটের রাস্তায় দু’জনে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় ইরা পিছন থেকে জয়কে জড়িয়ে ধরে বলতো, জয়, কবে আমরা ঘর বাঁধবো জয়, কবে! বারো শিবালয় মন্দিরের পাশে সেই শতবর্ষী বটগাছের নিচে বসে পাখিদের বাসা বাঁধা দেখে বলতো, জয় দেখো পাখিরাও তো বাসা বাঁধে, আমরা কেনো বাঁধবো না জয়, আমরা কেনো না?

জয় বলতো, ইরা তোমার তো বাসা আছে, ঘর আছে।

জয় দু’জন মানুষ একসাথে থাকার মানে সংসার না, বাসাও না। ওখানে আমার মনটা থাকে না, শুধু দেহটা থাকে, মতি সারারাত পাশের রুমে নাক ডেকে ঘুমায় আর আমি পাশের রুমে শুয়ে তোমার মতোই একজনকে ভাবতাম যে আমার সুখ-দুঃখ বুঝবে, যে আমাকে নিয়ে ভাববে। পেয়েও গেছি জয়, তুমি আমার সেই মনের মানুষ। আমি তোমাকে চাই জয়, তোমাকে! তুমি আর আমি যে ঘর বাঁধবো সেটা হবে ঘর, সেটা হবে শান্তির নীড়।

সেই নীড় বাঁধাও হলো কিন’ ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেলো। আজ ইরা বৈরাগীর মোড়ে ছাত্রীনিবাসে আর জয়, জয় সেই-ই রেস্ট হাউজে। মাঝখানে করিডোর আর দু’পাশে দু’টো রুম। করিডোরের পাশে কোনো জানালা নেই আর বাইরের পাশে যে একটা জানালা আছে সেটা খোলার কোনো উপায় নেই। পৌরসভার ড্রেনের সব মশা সবসময় দরজায় হুল নিয়ে তৈরি আছে জয়ের রক্ত দিয়ে পিপাসা মেটানোর জন্য। তাই দিনরাত জয়ের রুমটা বন্ধই থাকে, অন্ধকারই থাকে। থাক জীবন যখন অন্ধকার তখন বাইরের আলো-বাতাস তো আর জীবনের অন্ধকার দূর করতে পারবে না।

 

সেদিন জয়পুরহাট থেকে আসার সময় এবং আসার পরও জয় ইরাকে অসংখ্যবার ফোন করেছে কিন’ ইরা রিসিভ করেনি। জয় ম্যাসেজ দিয়েছে কিন’ ইরা ম্যাসেজের রিপ্লাইও দেয়নি। তাই জয়ও আর ইরাকে ফোন দেয় না। সেদিন জয় তখন বিছানায় শুয়ে ছিলো এমনসময় ইরা ফোন করলো।

ইরার ফোন পেয়ে জয় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। আজ কতদিন ইরার সঙ্গে তার কথা হয়নি, সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনার জন্য জয় কতই না চেষ্টা করেছে অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন এলো, হ্যালো ইরা।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়! কেমন আছো জয়!

জয় অভিমানের সুরে বললো, ভালো আছি ইরা, খুউব ভালো আছি।

জয়, সত্যি করে বলো কেমন আছো? কোথায় আছো?

তুমি এমন করে কথা বলছো কেনো ইরা, মনে হচ্ছে আমি বুঝি কোনো বিপদে পড়েছি।

আমি সব শুনেছি জয়। আমি সব শুনেছি। সরি জয় আমার ভুল হয়ে গেছে।

আজ কী মনে করে ফোন দিলে ইরা। আমি তো তোমাকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছি কিন’ তুমি রিসিভ করোনি, ফোন ব্যাক করোনি, রিসপন্স করার মতো ন্যূনতম ভদ্রতাটুকুও দেখাওনি।

সরি জয়, সরি।

এখন কেনো ফোন দিয়েছো বলো?

জয়, তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছো কেনো জয়? একটু স্বাভাবিক হও।

আমি স্বাভাবিকই আছি ইরা। আমাকে কখনো রাগ করতে দেখেছো?

আজ মা’কে ফোন করলাম। মা সব বললো, প্রথম যখন শুনলাম তুমি বদলি নিয়ে চলে গেছো তখন খুব রাগ হয়েছিলো কিন’ যখন শুনলাম তোমার বউ, ছেলেরা তোমাকে… বলতে বলতে ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

জয় গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে বললো, ইরা, কাঁদছো কেনো? আমি তো ঠিক আছি।

না জয় তুমি ঠিক নেই। তোমার কণ্ঠস্বর আমি চিনি। তোমার ভালো থাকা মন্দ থাকা কণ্ঠস্বর, তোমার রাগী অভিমানী কণ্ঠস্বর আমি সব চিনি জয়। আমি আগেই বলেছিলাম ওরা তোমাকে মারবে জয়, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। আজ মা’র কাছে সত্যি সত্যি শুনলাম ওরা তোমাকে…

কোন মা ইরা?

কোন মা মানে? তোমার মা, মানে আমার শাশুড়ি।

আমার মা’কে তুমি এখনো মা বলো ইরা?

হ্যাঁ। মাতো মা-ই। একবার কাউকে মা ডাকলে সে তো সারাজীবনের জন্য মা হয়ে যায় জয়।

আমার মা তোমার হাত ধরে বলেছিলো, আমার ছেলেটার সারাজীবন খুব কষ্টে কেটেছে মা, তোমাকে পেয়ে ওর জীবন ধন্য হয়েছে, ও এখন নিজেকে খুব সুখী মনে করছে। দেখো না ওর চোখে-মুখে একটা তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। তুমি আমার ছেলেটাকে ছেড়ে যেওনা মা। ঠিক এভাবেই নাকি বলেছিলো আর তুমি আমার মাকে কথা দিয়েছিলে তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না।

ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, কেনো আমাকে রাখতে পারলে না জয়, কেনো? আমি তো সবকিছু ছেড়েই তোমার কাছে গিয়েছিলাম। তুমিও তো আমার হাত ধরেছিলে, তুমিও তো কথা দিয়েছিলে সারাজীবন আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে কিন’ পারলে না কেনো! তুমিও কেনো পারলে না আমাকে শক্তভাবে বুকে জড়িয়ে রাখতে!

পারবো ইরা, আমিও সবকিছু ছেড়ে তোমাকে ডাকবো তখন যেনো না করো না ইরা। তখন যেনো আমার কাছে চলে এসো।

আসবো জয়, আসবো কিন’ তখন তুমি আমাকে তোমার বুকে স’ান দিবে তো যখন আমার সব চুল পেকে যাবে, সামনের দু’চারটে দাঁত উঠে যাবে তখনও তুমি আমাকে গ্রহণ করবে তো?

আমি তো আগেই বলেছি ইরা তোমার সব চুল পেকে যদি সাদা হয়ে যায়, সব দাঁত যদি উঠে যায়, তোমার চিবুকের চামড়ার ভাঁজ যদি মৌজা ম্যাপের মতো হয়ে যায় তখনও তুমি যদি আমার কাছে এসো তবুও তোমার জন্য আমার হৃদয়ের দরজা খোলা থাকবে ইরা।

জয়, আমার জয়। তোমার মতো করে মতি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি আর বাসবেও না জয়। আমি আসবো জয়, আমি আসবো।

এসো ইরা।

এখন কোথায় আছো জয়? এখন কী করছো? ইরা জিজ্ঞেস করলো।

শুয়ে আছি।

এখন? ইরা অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো।

কেনো?

এখন গোধূলি জয়, এসময় শুয়ে থাকতে নেই।

আমার আবার সকাল আর গোধূলি।

ওখানে কি রেস্ট হাউজে থাকো?

হ্যাঁ।

ওঠো জয় এখন একটু বাইরে বের হও। আমি কী করছি জানো?

জয় বললো, তুমি এখন জানালায় দাঁড়িয়ে তালগাছটার দিকে তাকিয়ে আছো।

ইরার হাসি কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ঠিক বলেছো জয়, ঠিক বলেছো।

তুমি কী করে পারো। আগেও, তোমার সঙ্গে আমি চলে আসার আগে প্রতিদিন আমি যখনই তোমাকে মিস করতাম তখনই তোমার ফোন চলে আসতো। তুমি ঠিকই বুঝতে আমার মনের কষ্ট। জয়! আমার জয়!

কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা নেই, দু’জনের শুধু কান্না। তারপর ইরা বললো, তোমাকে ওরা মেরেছে শুনে আমার খুব ভয় করছে জয়। তোমাকে যদি ওরা মেরে ফেলে।

আমার জন্য চিন্তা করো না ইরা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিচ্ছু ঠিক হবে না জয়। সাবধানে থেকো। আল্লাহ আমার জয়কে তুমি দেখে রেখো। এখন ওঠো জয়, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি এমনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তোমাকে খুব মিস করবো জয়, খুউব। ওখানে কোনো নদী নেই জয়?

আছে, টাঙ্গন নদী।

ওঠো জয়, তুমি নদীর ধারে যাও। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সেই গোধূলি লগ্নে বারো শিবালয় যেতাম, সেই গোধূলিটা আমি সারাজীবন মিস করবো জয়। সবসময় মনে করবে তোমার ইরা আমাদের সেই সাজ গার্ডেনে বসে, তোমার তৈরি বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে প্রতিটি গোধূলিতে।

 

আটানব্বই

 

একটা ছোট্ট দ্বিতল বাসা। বাসায় একটা লাইব্রেরি থাকবে, আশেপাশের মানুষ বই নিয়ে যাবে, পড়ে আবার দিয়ে যাবে। লাইব্রেরিতে কয়েকটা চেয়ার টেবিলও থাকবে যেনো পাঠকরা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তে পারে। সাহিত্য চর্চা আর আলোকিত মানুষ গড়ার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হবে জয়ের সেই বাসা। ছাদের ওপর থাকবে কারুকার্য খচিত প্যারাপেট ওয়াল, টবের ওপর বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ। ইরার সাজ গার্ডেনের মতো করে একটা বাগান করবে ছাদের ওপর। ছাদের ওপর কয়েকটা কংক্রিটের ছাতার নিচে গেলাকার কংক্রিটের টেবিল। মাঝে মাঝে এই ছাদে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা হবে। কবি-সাহিত্যিকরা কংক্রিটের টেবিলের চারপাশে চেয়ার বিছিয়ে বসবে, কবিরা স্বরচিত কবিতা পাঠ করবে, সাহিত্যিকরা তাদের লেখা ছোটগল্প পড়ে শোনাবে। জয় গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে বসে লেখালেখি করবে। তখন আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ, পাশ দিয়ে বয়ে যাবে স্রোতস্বীনি নদী। চারপাশে বসতি থাকবে ফাঁকা, প্রকৃতি যেনো তার সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিতে পারে। যেনো জোনাকিরা আলো দেয়, ঝিঁঝিরা উলু ধ্বনি দেয়, বর্ষাকালে ব্যঙ ডাকে, শরৎ কালে মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখা যায়। এমন একটা বাসার স্বপ্ন দেখেছিলো জয় অনেকদিন থেকে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অনেক কষ্টে, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা লোন করে একটা জায়গা কিনেছে পূণর্ভবা নদীর পশ্চিম তীরে। তারপর সেই জায়গায় বাসা করার জন্য প্লান ডিজাইনের কাজ চললো কয়েক মাস। জয়, মানিক-রতন মিলে প্রায় ড্রইং নিয়ে বসে আবার কয়েক দিন পর সেটা বদলে ফেলে।  জয়ের পরিকল্পনা দেখে একবার তো সামিনা বলেই ফেললো, আমার মনে হচ্ছে তুমি বাসা করতে পারবে না। যারা বেশি তর্জন-গর্জন করে তারা কিছুই করতে পারে না। মানিক-রতন অবশ্য সামিনার কথার প্রতিবাদ করেছিলো। তারপর সেই বাড়ির কাজ শুরু হলো। শেষও হলো কয়েক মাস আগে। একসময় জয় ভাড়া বাসায় থাকতো কিন’ তার বাসার মানুষগুলো ছিলো তার নিজের আর এখন জয় নিজের বাসায় থাকে কিন’ তার বাসার মানুষগুলো তার নিজের না।

তবুও জয় দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু করার জন্য কয়েক মাস আগে লোনের জন্য দরখাস্ত করেছিলো। কয়েকদিন আগে সেই লোনও হয়েছে কিন’ কাজ শুরু করতে গিয়ে জয়ের মাথায় একটা চিন্তা এলো। যাদের সংগে এই বাড়িতে জয়কে থাকতে হবে তাদের সংগে সে থাকতে পারবে তো?

যতবার সামিনার সঙ্গে জয়ের ঝগড়া হয়েছে ততবারই জয় তাকে তালাক দেয়ার চেষ্টা করেছে, ততবারই চেষ্টা করেছে আর কোনোদিন বাড়িতে যাবে না, কোনোদিনই না কিন’ বৃহস্পতিবার তার অসি’, মজ্জা ও রক্তের শিরায় যেনো মিশে গেছে। বৃহস্পতিবার এলেই জয় ফিরে যায় দিনাজপুর। এবার শুক্রবার সকালবেলা রতন বাজারের লিস্ট করলো না, মানিক বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো না, আব্বু চলো।

হ্যাঁ, চুক্তি সত্যি সত্যি কার্যকর হয়েছে, স্বামী-স্ত্রীতে চুক্তি, বাপ-বেটায় চুক্তি। ত্রি-পাক্ষিক চুক্তি। বাপ-বেটা-স্বামী ত্রি-পাক্ষিক চুক্তি। বাসা এখন মেস, জয় টাকা দিবে আর খাবে। জয় রতনকে বললো, রতন আজ বাজার করতে হবে না?

রতনের মুখ একটু উজ্জ্বল হলো। জয়ের কণ্ঠস্বর শুনে মানিক পাশের রুম থেকে ড্রয়িং রুমে এলো, বাবা বাজার যাবে?

জয় বললো, হ্যাঁ, বাজারের লিস্ট করো, ব্যাগ নাও।

সামিনা রান্নাঘরে কাজ করছিলো। মানিক ড্রয়িং রুম থেকে সামিনাকে জিজ্ঞেস করলো, আম্মু বাজার লাগবে না?

সামিনা ঝাঁঝিয়ে উঠলো, কালকেই বাজার করলে মনে নেই, যেতে হবে না।

মানিক মুখ কালো করলো, রতনের ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেলো।

জয় বুকে একটা প্রচণ্ড আঘাত পেলো। শুক্রবার সকালবেলা দুই ছেলেকে নিয়ে বাজার করতে যাওয়া তার অনেক দিনের অভ্যাস। জয়পুরহাট থাকা অবস’ায় মাঝে মাঝে আসতো না তাই যাওয়া হয়নি। তারপর চুক্তি হলো। চুক্তি হলো তাতে কী, জয় মানিককে বললো, তবুও চলো।

সামিনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে তার চিরাচরিত উগ্র মূর্তি ধারণ করে বললো, বাজার যেতে হবে না। কাল আমি মানিককে দিয়ে সব বাজার করিয়েছি।

 

সেদিন রাতে জয় টি.ভি দেখছিলো। মানিক আর রতন পাশের রুমে পড়তে বসেছিলো। জয় ড্রয়িং রুমে পানি খেতে গিয়ে দেখলো সামিনা গ্যারেজে দাঁড়িয়ে ফোনে ফিস ফিস করে কথা বলছে। সে আবার তার রুমে এসে শুয়ে পড়লো। জয় লক্ষ্য করেছে সামিনা ইদানীং ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলে। জয়ের ধারণা শহীদের সঙ্গে এবং কথাবার্তাগুলো যে জয়কে কেন্দ্র করে তা প্রায় শতভাগ সত্যি। জয় আবার রুমে এসে শুয়ে শুয়ে টি.ভি দেখতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণ পর সামিনা মানিক-রতনের রুমে ঢুকলো, কয়েক মিনিট সবাই মিলে চাপাস্বরে কথা বললো, তারপর সামিনা রুমে এলো। তার পিছু পিছু রতন এলো। রতন জয়ের মাথার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তুমি বাড়ির দোতলার কাজ শুরু করবে কবে?

জয়ের কানের কাছে কথাটা যেনো অন্যরকম শোনালো কিছুটা আদেশের সুর। জয় না শোনার ভাণ করলো। রতন আবার বললো, তুমি বাড়ির কাজ শুরু করবে না?

জয় মিনমিন করে বললো, দেখি কী করা যায়।

এবার সামিনা গর্জে উঠলো, দেখি মানে? বাড়ি করার জন্য লোন করেছো এখন দেখি কেনো?

পাশের রুম থেকে মানিক এলো। সে কোনোকিছু না শুনেই রাগান্বিত স্বরে বললো, কী বলছো? বাড়ির কাজ শুরু করবে না?

সামিনা বললো, বলছে বাড়ির কাজ শুরু করবে না। আবার কোনো মাগীর পিছনে লোনের টাকাগুলো ঢালবে।

মানিক দাঁত কড়মড় করে জয়ের গালের কাছে থাপ্পড় তুলে বললো, এই, এই তুই বাড়ির কাজ শুরু করবি না?

রতন বললো, এই মারিস না, মারিস না।

মানিক দৌড়ে বাইরে গেলো। গ্যারেজ থেকে একটা লম্বা রড হাতে আবার রুমে ঢুকলো। তারপর জয়ের মাথার ওপর রড তুলে বললো, বলতো দেখি তুই বাড়ির কাজ শুরু করবি কী না?

জয় তাদের আচরণে হতবাক হয়ে গেলো। এই বাড়িতে, এদের সঙ্গে বাকি জীবন সে কীভাবে কাটাবে। মানিক তো সত্যি সত্যি তার মাথায় রডের আঘাত করতে পারবে।

বল, কথা বলছিস না কেনো এখন, বল। সামিনা চাপা স্বরে বললো।

ভয়ে জয়ের মুখ শুকিয়ে গেছে। সে আতঙ্কগ্রস’ গলায় বললো, আমি তোমাদের সঙ্গে বাকি জীবন থাকতে পারবো কী না আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি একটু ভেবে দেখি।

এই, এই কী বললি তুই! ভেবে দেখবি বলে মানিক জয়ের মাথার ওপর আবার রড তুলে ধরলো। রতন হাত থেকে রডটা নিয়ে ড্রয়িং রুমে ছুঁড়ে মারলো।

তারমানে তুই দোতলার কাজ শুরু করবি না? সামিনা বললো।

তুই করবি না, তোর বাপ করবে, সাতদিনের মধ্যে যদি তুই দোতলার কাজ শুরু না করিস তবে আমি তোকে জবাই করবো, জবাই বলে মানিক জয়ের বাহুতে একটা ঘুষি মারলো। তারপর দৌড়ে গিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে রডটা নিয়ে এলো।

জয় মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই সামিনা বললো, কাকে ফোন করছিস, তোর ভাই, দুলাভাই, প্রতিবেশী দেখি কে এখন তোকে রক্ষা করে।

জয় তার কলিগ আউয়াল সাহেবকে ফোন করলো, হ্যালো। জয় সাহেব এতো রাতে? কী ব্যাপার?

জয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আউয়াল সাহেব ওরা আমাকে মেরে ফেলছে, আউয়াল সাহেব…

সামিনা জয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিলো।

সামিনার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।

সামিনা তার মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বললো, আউয়াল সাহেব ফোন করেছে। সে রিসিভ করলো, হ্যালো ভাই।

আউয়াল সাহেব জিজ্ঞেস করলো, হ্যালো ভাবী কী হয়েছে?

কিছু না তো ভাই, সামিনা এমনভাবে কথা বললো যেনো কিছুই হয়নি।

আউয়াল সাহেব ধমকের সুরে বললো, আপনি জয় সাহেবের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলেন কেনো?

সামিনা চুপ করে রইলো।

আউয়াল সাহেব বললো, এতো রাতে মানুষ ঝগড়া করে! ছিঃ ভাবী, ছিঃ।

ও আপনাকে এমনি ফোন করেছে ভাই।

এতো রাতে জয় সাহেব আমাকে এমনি ফোন করেছে?  কম বিপদে পড়ে ফোন দিয়েছে? এখন ঘুমিয়ে পড়-ন, যা হবে কাল দিনের বেলা সবাই মিলে করবেন।

সামিনা আবার কথা বাড়াচ্ছিলো। আউয়াল সাহেব ধমকের সুরে বললো, এখন রাত বারোটা বাজে ভাবী, এখন কথা শোনার সময় না। আপনাকে শুধু একটা কথা বলে রাখি, সারাজীবন অনেক শুনেছি আপনার কথা কিন’ আজ এতো রাতে একজন মানুষের বাঁচার আকুতি শুনে আমার আর আপনার কাছ থেকে কিছু শোনার আগ্রহ নেই। এভাবে শাসন করে আর মৃত্যুর হুমকি দেখিয়ে কাউকে জোর করে সংসারে বেঁধে রাখা যায় না।

 

নিরানব্বই

 

জয় তার স্বপ্নের বাড়িটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো কিন’ তার কোনো অনুভূতি নেই। ইরা যখন তার কাছে চলে এসেছিলো তখন জয় কিছুটা অবাকই হয়েছিলো, এতো সুন্দর তকতকে বাড়িটা ছেড়ে ইরা কীভাবে চলে এলো কিন’ ইরা এসেছিলো বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে। আসলে বাড়ি তো অবকাঠামো, রড, সিমেন্ট, ইট, বালু দিয়ে তৈরি একটা নিষ্প্রাণ জিনিষ, বাড়ির ভিতরে যে প্রাণবন্ত মানুষগুলো বসবাস করে তাদের সঙ্গে যদি শ্রদ্ধা, সম্মান, সহানুভূতি, ভালোবাসার সম্পর্ক না থাকে তাহলে আর নিষ্প্রাণ বাড়ির প্রতি টান থাকবে কী করে।

বাড়ি থেকে যখন জয় কাঁধে ল্যাপটপ আর মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসে তখন সামিনা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো?

চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছি মানে?

চলে যাচ্ছি মানে একেবারে যাচ্ছি আর কোনোদিন এই বাড়িতে আসবো না।

সামিনা খেঁকিয়ে উঠলো, এগুলো নাটক তো জীবনে অনেক করেছো, এখন ভালো হয়ে যাও।

জয় সামিনাকে কিছু বলেনি, বাড়ি থেকে মোটর সাইকেল বের করতে করতে আপনমনে বললো, হ্যাঁ, নাটকই তো, জীবনে তো অনেক নাটকই করেছি কিন’ নাটকের তো একটা যবনিকা আছে, এবার তাই-ই টানবো।

জয়কে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামিনা গেট থেকে জোরে চিৎকার করে বললো, যাও, যাচ্ছো না কেনো? যাও, আবার ক’দিন পর কুকুরের মুখ লেজের দিকে ফিরবে।

জয় আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকেনি। দ্রুত মোটর সাইকেল নিয়ে চলে এলো।

 

বিরল থানায় জয় কখনো যায়নি। অনেকদিন আগে জয় একবার কুড়িগ্রাম সদর থানায় গিয়েছিলো সামিনার বিরুদ্ধে জি.ডি করতে। ওসি সাহেব জয়ের ওপর প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলো, স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর জি.ডি, তারমানে বউকে মেরে ফেলার রাস্তাগুলো আগে থেকেই ক্লিয়ার করে রাখছেন।

জয় ওসি সাহেবের কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিলো, আমি ওকে মেরে ফেলবো কেনো?

সেজন্যই তো জি.ডি করতে এসেছেন। যারা সব কাজ পরিকল্পনা করে করে তারা স্ত্রীকে মেরে ফেলার আগে এভাবে মেরে ফেলার যুক্তি তৈরি করে। নিজেকে বাঁচানোর পথ তৈরি করে কিন’ দূর্ভাগ্যে কেউ বাঁচতে পারে বলে মনে হয় না।

ওসি সাহেব আমি মনে করতাম জি.ডি মানে সাধারাণ ডায়েরি, পুলিশকে অবহিত করে রাখা। আর পুলিশ তা গ্রহণ করতে বাধ্য কিন’ এখন দেখছি এটাও পুলিশের ইচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল। তাহলে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগীরা যাবে কার কাছে?

এবার ওসি সাহেব একটু নরম হলো, কী করেন আপনি?

জয় তার পরিচয় দিলো।

ওসি সাহেব কয়েক মুহূর্ত জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, আপনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, আপনি থানায় এসেছেন স্ত্রীর নামে জি.ডি করতে তাহলে আপনি এতোবড় একটা চাকরি করেন কীভাবে যেখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো কন্ট্রাক্টরের সাথে কাজ নিয়ে দরকষাকষি করতে হয়? মানুষ জানলে হাসবে বলে ওসি সাহেব কলিং বেল টিপ দিলো।

স্যান্ট্রি দরজায় দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলো, স্যার।

চা দাও।

ওসি সাহেব বলতে শুরু করলো, শুধু আপনি না আরও দু’য়েকজন পুরুষ মানুষ এসেছে থানায় জি.ডি করতে, মামলা করতে কিন’ মেয়েদের বিরুদ্ধে মামলা করে কোনো লাভ নেই। আইনের দৃষ্টিতে নারীরা দুর্বল আর পুরুষরা তাদের নির্যাতন করে তাই রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের পক্ষেই যায়। আপনি জি.ডি করবেন, আপনার স্ত্রী যদি আত্মহত্যাও করে, পুলিশ আপনাকেই ধরবে কারণ তখন ধরে নেয়া হবে আপনি মেরে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছেন আর সে কারণে নিজে বাঁচার জন্য আগেই জি.ডি করে রেখেছেন। কাজেই ম্যানেজ করে চলুন।

চা চলে এলো।

ওসি সাহেব বললো, চা নিন।

জয় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, তাহলে আমি এখন কী করবো বলুন?

ওসি সাহেব রসিকতা করে বললো, সবাই যা করে আপনিও তাই করুন।

মানে? জয় ভ্র’কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।

ওসি সাহেব চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলো, আমার কী মনে হয় জানেন, নির্যাতনের ঘটনাটা আসলে তিন ভাগে বিভক্ত। নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীরা নির্যাতিত, খুব সামান্য ঘটনায় একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের পুরুষ তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়, প্রথম স্ত্রীর পারমিশন না নিয়েই দ্বিতীয় বিয়ে করে। মধ্যবিত্ত পরিবারে পুরুষরা মানসিক নির্যাতনের শিকার। তারা মান-সম্মানের ভয়ে না পারে ঢাকঢোল পিটিয়ে কাউকে বলতে কিংবা কারও কাছে বিচার চাইতে, তারা শুধু গুমরে গুমরে কাঁদে আর উচ্চ বিত্ত পরিবারে কেউ কারও খবর রাখে না। স্বামী সারাদিন টাকার পিছনে ছুটে বেড়ায়, গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে ফূর্তি করে গভীর রাতে বাসায় ফেরে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে। এসেই ঘুমিয়ে পড়েন তার স্ত্রী সন্তানের খবর নেয়ার সময়ই নেই আর সেই সুযোগে কোনো কোনো স্ত্রীও সময় কাটান বয় ফ্রেন্ডের সাথে।

ওসি সাহেব বিড়বিড় করে বলছিলো জয় তখন তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলো।

এবার ওসি সাহেব চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললো, আপনার আমার অবস’ান মধ্যবিত্ত পরিবারে। কাজেই ম্যানেজ করে চলুন। ম্যানেজ করে চলুন জনাব।

 

জীবনের শুরু থেকে জয় তো ম্যানেজ করেই চলছে। আর কত! ম্যানেজ করতে করতে যে জীবনই শেষ হয়ে গেলো। না জয় আর ম্যানেজ করে চলবে না। সামিনার আচরণ একসময় মনোমালিন্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো, তারপর ঝগড়া এখন তো মানিক রতনকে নিয়ে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার মতো অবস’া।

ডিউটি অফিসার পুলিশি ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, কী চাই?

জয় বললো, আমি একটা জি.ডি করবো।

ডিউটি অফিসার জিজ্ঞেস করলো, কী বিষয়ে বলুন?

জয় বললো, আমি লিখে নিয়ে এসেছি।

ডিউটি অফিসার বিরক্তির ভঙ্গিতে বললো, ওতো পড়ার সময় নেই, শর্ট-কাট করে বলুন। বলে সে কাগজ-কলম নিয়ে লিখবে এমন একটা ভাব দেখালো।

শর্ট-কাট করা যাবে না ভাই। একবার পড়ে দেখুন।

অগত্যা ডিউটি অফিসার কাগজটা জয়ের হাত থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। জয় ডিউটি অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ডিউটি অফিসার কয়েক লাইন পড়ছে আর জয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। পড়া শেষ করে জয়ের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, এতোদিন ছাড় দেয়া ঠিক হয়নি, প্রথমবার যখন তারা আপনার গায়ে হাত তুললো তখন এলেন না কেনো?

জয় মিনমিন করে বললো, আমি ভেবেছিলাম ছোট মানুষ ভুল করেছে হয়তো আর করবে না।

এটা ঠিক হয়নি, তখনই ওদের শাসন করতে হতো।

ছোটবেলা থেকে খুব আদর করেছি তো। তাই শাসন করতে পারিনি।

ঘটনা পড়ে যা বুঝলাম তাতে এসব মায়ের ইন্ধন পেয়েই করেছে। কেমন মা বাবার বিরুদ্ধে ছেলেদের ক্ষেপিয়ে তুলে, ছেলেকে দিয়ে বাপকে শাসন করায়। আসলে মা ভালো না হলে সন্তান ভালো হয় না। সেজন্য নেপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে একজন মা দাও আমি একটা জাতি উপহার দিবো।

ডিউটি অফিসার জয়ের লেখা ডায়েরিতে নাম্বার বসিয়ে দিলো।

জয় ডিউটি অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলো।

 

এক’শ

জয়ের আসার পরদিন মানিক ঢাকা গেলো। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েও ভর্তির সুযোগ পায়নি। আবার দু’য়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগও পেয়েছে কিন’ সেসব সাবজেক্ট মানিক কিংবা জয়ের পছন্দ না। তাই আবার ছুটতে হলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

পাশাপাশি মানিক দেশের বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কন্সাল্টিং ফার্মগুলোতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো। কয়েক দিন পর মানিক ফোন করলো, হ্যালো।

অনেকদিন আগে থেকেই মানিক কিংবা রতন জয়কে বাবা বলে সম্বোধন করে না। প্রথম প্রথম জয় বিষয়টা লক্ষ্য করেনি কিন’ দিনে দিনে সেটা সয়ে গেছে। এখনো মানিক বাবা সম্বোধন করলো না। জয় কষ্ট পেলেও কিছু বললো না, সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, হ্যালো।

কেমন আছো?

ভালো, তুমি?

এইতো ভালো আছি। শোনো আমার তো সবগুলো ইউনিভার্সিটিতে এ্যাডমিশন টেস্ট শেষ হয়ে গেলো কিন’ ভালো সাবজেক্টে চান্স পেলাম না। তাই আমি একটা চিন্তা করছি।

জয় জিজ্ঞেস করলো, কী চিন্তা?

দেশের বাইরে যাবো।

কোন দেশে?

চীন যাবো, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।

তোমার পরিচিত কেউ আছে? কথা বলেছো?

হ্যাঁ আমি একটা কন্সাল্টিং ফার্মের সঙ্গে কথা বলেছি, কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে অনলাইনে পরীক্ষাও দিয়েছি।

জয় কিছুটা আগ্রহী হলো, তারপর-

রেজাল্ট হবে দু’য়েকদিনে।

আল্লাহ আল্লাহ করে যদি চান্স হয় তবে তো ভালোই হয়।

হবে, আশা করা যায়।

টাকা কী রকম লাগতে পারে?

কম, বাংলাদেশের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর মতোই, কমও লাগতে পারে।

জয়ের চীনে লেখাপড়া সম্পর্কে ধারণা নেই। সে কিছুটা অবাক হলো, তাই নাকি?

হ্যাঁ, স্কলারশিপ পেলে শুধু যাওয়ার সময় কিছু টাকা লাগবে তারপর শুধু খাওয়ার টাকা লাগবে। সবকিছু মিলিয়ে তোমার সাধ্যের মধ্যেই থাকবে।

তাহলে এগিয়ে যাও।

তুমি কি গত শুক্রবার বাড়ি গেছিলে?

না।

আগামী শুক্রবার যাবে না?

জয় এবার কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, না। তুমি তোমার লেখাপড়ার কথা বলো। এর বাইরে কিছু বলবে না।

মানিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, স্কলারশিপ পেলে বেশিদিন সময় পাবো না বাংলাদেশে থাকার। তুমি টাকা জোগাড় করে রেখো।

রাখবো, তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও।

মানিকের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে জয়ের মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিলো, এটা আবার নতুন কোনো ষড়যন্ত্র নয়তো? যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাডমিশনের সময় মানিক চেষ্টা করেছিলো।

কয়েক বছর আগের কথা। জয়ের পোস্টিং তখন রাজিবপুর। একদিন নৌকায় নদী পাড়ি দেয়ার সময় এক লোক গল্প করছিলো। লোকটির পরনে ছিলো লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। বয়স ষাটের কোঠায়। তার গল্পের বিষয়টা ঠিক এমন: তার ছেলে গাজীপুরে থেকে একটা বেসরকারি পলিটেকনিকে লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অনেক টাকা নেয়। বাবা ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর আশায় টাকা পাঠাতে থাকে আর কবে ছেলের লেখাপড়া শেষ হবে সেই হিসেব গুণতে থাকে। প্রতিবেশী আরও একটা ছেলে তার সঙ্গে পড়তো। এই বৃদ্ধ লোকটি তার মাধ্যমে ছেলের খোঁজখবর রাখতো। একবার সেই প্রতিবেশীর ছেলের কাছে জানতে পারলো তার ছেলে সিক্সথ সেমিস্টারে ফেল করেছে এবং একটা মেয়েকে বিয়েও করেছে।

ছেলে বাড়িতে এলো। বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে সত্যতাও জানতে পারলো কিন’ বাবা ছেলের লেখাপড়া বন্ধ করে দিলো না।

জয় সেই লোকটি পাশে বসে তাদের গল্প শুনছিলো। এবার সে আর চুপ থাকতে পারলো না। সে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, এরপরও আপনি ছেলেকে টাকা দিবেন লেখাপড়া করার জন্য?

লোকটি জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, টাকা না দিয়ে কী করবো স্যার, তখন যদি লেখাপড়া করতে না পারে তো সারাজীবন আমাকে দুষবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতেই থাকবো, আল্লাহর কাছে দোয়া করবো আল্লাহ যেনো তাকে জ্ঞান দেয়। বাবাদের সবসময় সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়, সন্তানের জন্য দোয়া করতে হয়।

সেদিন সেই একাডেমিক অর্থে অশিক্ষিত লোকটির কথা শুনে জয় অবাক হয়ে গিয়েছিলো। বাবা হওয়ার কী অসাধারণ শিক্ষা সে আজ অর্জন করলো। হ্যাঁ, জয়ও তাই করবে, বাবা হিসেবে সন্তানদের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করবে। আসলে সন্তানরা বাবার কষ্ট সেদিনই বোঝে যেদিন সে বাবা হয় ততদিনে হয়তো বাবার জীবনাবসান নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে।

 

মানিক স্কলারশিপ পেয়েছে খবরটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে জয়ের চোখ পানিতে ভরে গেলো। একসময় অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের ছেলে চীন যাবে লেখাপড়া করতে! এইতো ক’দিন আগেও কত ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে জয় মোটর সাইকেলে করে কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে যেতো, ধামইরহাট থাকা অবস’ায় চকময়রাম স্কুলে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যেতো। ছোটবেলায় মানিকের খুব ইচ্ছা ছিলো বিকেলে মোটর সাইকেল নিয়ে বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর। জয়েরও খুব সখ ছিলো শরতের গোধূলিতে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। বাপ-বেটা যখন মোটর সাইকেল নিয়ে বের হতো তখন প্রতিবেশীদের অনেকেই বাপ-বেটার মিল দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখে থাকতো।

মানিককে নিয়ে জয় যেদিন নটরডেম কলেজে যায় সেদিনও তো ছেলেটি ছোটই ছিলো। সেদিন মানিককে রেখে আসার সময় জয়ের খুব কান্না পেয়েছিলো, এতোটুকু ছেলে কীভাবে একা থাকবে অথচ সে নটরডেম কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে চীনে লেখাপড়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছে।

জয় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে একরকম বিহব্বল হয়ে ভাবছিলো।

মানিক বললো, হ্যালো।

জয় চমকে উঠলো, হ্যাঁ বাবা বলো।

আমি কি কন্সাল্টন্টের সাথে কথা বলবো?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

 

এক’শ এক

 

ইরার সঙ্গে প্রায় দিনই জয়ের কথা হয়। ম্যাসেজ আদান-প্রদান হয় ঠিক বিয়ের আগে যে সময়গুলোতে কথা বলতো সেভাবেই, প্রতিদিন সকালবেলা মতি স্কুল যাওয়ার পর আবার বিকেলে মতি স্কুল থেকে ফিরে বাসায় কয়েক মিনিটের বিরতির পর যখন বাজার যায় তারপর কিন’ দেখা হয় না। আগে প্রায়ই ইরা কথা বলতে বলতে ভিডিও কল দিতো, একদিন না দেখলে ইরাই বেশি অসি’র হয়ে পড়তো। ইরা চলে যাবার পরও মাঝে মাঝে ভিডিও কলে ইরার সঙ্গে কথা হয়েছে কিন’ কয়েকদিন থেকে শুধু ফোনে কথা-ই হয়েছে। জয়ের চোখের সামনে ইরার ছবি ভেসে উঠলো, এই ইরা একদিন তার কত আপন ছিলো, কত কাছের ছিলো।

জয় ইরাকে ফোন করলো।

ইরা ফোন রিসিভ করলো না।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা ম্যাসেজ এলো জয়ের মোবাইল ফোনে। ইরা লিখেছে, প্লিজ আমাকে ফোন করো না জয়। আমি ফ্রি হয়ে তোমাকে ফোন করবো।

ইরার ম্যাসেজ পড়ে জয় কিছুটা আশ্চর্য হলো কিন’ আর ফোন করলো না, ইরার ফোনের অপেক্ষায় রইলো কিন’ ইরার কোনো খবর নেই। সেদিন তো নয়ই পরদিনও কেটে গেলো কিন’ ইরা ফোন করলো না।

 

ইরা ফোন করলো আরও দু’দিন পর বিকেলবেলা। এই দু’দিন জয়ের কাটলো বেশ দুশ্চিন্তায়। ইরার এমন কী ব্যস্ততা যে জয়ের সঙ্গে কথা বলারও সময় পেলো না। ইরা কি এখন তাকে এড়িয়ে চলছে?

জয় ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো ইরা!

ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, বলো জয়।

জয় উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ইরা? তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

না জয়। কোনো সমস্যা হয়নি তো।

তোমার গলার স্বর এমন করছে কেনো?

না কিছু হয়নি। বলো কী খবর তোমার?

আমি তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ইরা। তোমার এমন কি কাজ ছিলো যে এই দু’দিন আমার সঙ্গে একবার কথা বলার সময়ও পেলে না। ফেসবুকেও তোমাকে পেলাম না।

আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না জয় ইরার শেষদিকে তার ভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

জয় প্রচণ্ড আঘাত পেলো ইরার কথায়, সে কিছুই বুঝতে পারলো না, মানে?

মানে এই দু’দিন ফোনটা আমার কাছে ছিলো না। সবসময় আমি ফ্রিও থাকবো না আবার ফ্রি থাকলেও তোমার সঙ্গে কথা বলার মতো পরিবেশও থাকবে না।

তুমি এসব কী বলছো ইরা, আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে? তুমি কষ্ট পাবে না?

যত কষ্টই পাই না কেনো তোমাকে ছেড়েই তো আমার সারাজীবন থাকতে হবে জয়।

এসব তুমি কী বলছো ইরা, সত্যি করে বলো তো? বলে জয় কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো তারপর ইরাকে বললো, তুমি একবার নেটে এসো তো আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। এসো।

না জয়। প্লিজ জিদ করো না।

প্লিজ তুমি একবার এসো। আমার তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

ইরা সি’র শান্ত কণ্ঠে বললো, তুমি ঠিকই বলেছো জয়, আসলে তোমাকে… বলতে বলতে ইরা কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

ইরা, ইরা তুমি চলে গেছো, আমাকে না বলে! জয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো।

তাছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিলো বলো? জেনে তোমার শুধু কষ্টই বাড়তো। আমিও আরও বেশি কষ্ট পেতাম। এখানে আসার দিন আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেনো আমার জয়কে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আর কোনোদিন আমার জয়ের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। যতদিন জয়পুরহাট ছিলাম ততদিন একটা সম্ভাবনা ছিলো, তুমি ঠাকুরগাঁও থেকে হলেও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারতে। আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না জয়! দেখা হবে না! বলতে বলতে ইরা কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেলো।

জয় কোনো কথা বলতে পারলো না। তার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়লো।

ফেসবুকে এসো জয়।

জয় ফেসবুকে লগ ইন করতেই ইরা ভিডিও কল দিলো। জয়কে দেখে যেনো আঁৎকে উঠলো, জয়! আমার জয়! এ কী অবস’া হয়েছে তোমার?

আমার কিছু হয়নি ইরা, আমি ঠিক আছি। এই দেখো তোমার দেয়া বিছানার চাদরে শুয়ে আছি আর শুধু তোমাকেই ভাবছি, আর তুমি স্বামী-সংসার নিয়ে… তুমি তো সবকিছু ঠিক করে ফেললে ইরা শুধু শুধু আমাকে সবার কাছে…

আমিও ভালো নেই জয়। এই ক’দিন তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে আমি শুধু ছটফট করেছি আর বার বার জানালায় দাঁড়িয়ে তোমার বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। আমার আজও চোখের সামনে ভেসে উঠছে তোমার ছবি। আর আমাদের সাজ গার্ডেন! সাজ গার্ডেনের গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি বুঝি পাগল হয়ে যাবো জয়! পাগল হয়ে যাবো!

তোমার কিচ্ছু হবে না ইরা, ক’দিন পরে তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে, জয় শুষ্ক কণ্ঠে বললো।

না জয়, হবে না, তোমার কি সব ঠিক হয়েছে? বলেই ইরা একরকম চমকে উঠলো, জয় আজ তো বৃহস্পতিবার তুমি দিনাজপুর যাবে না।

না ইরা, আর কোনোদিন যাবো না। একেবারে চলে এসেছি।

ইরা একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললো, সেতো তুমি সারাজীবনে হাজার বার বলেছো, ক’দিন রেস্ট হাউজে থেকে আবার ফিরে গেছো।

আর যাবো না ইরা। কেউ হাজার বার পারে না বলে কি সারাজীবন পারে না। বলে জয় বিছানার নিচ থেকে থানায় করা ডায়েরির কপিটা বের করে ক্যামেরার সামনে ধরলো।

ইরা পড়া শেষ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, জয়, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে জয়! ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।

তুমি ঠিকই বলেছো ইরা ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি আর কোনোদিন ওখানে যাবো না।

জয় তুমি ভেবেছিলে ওদের কাছে ফিরে গেলে বুঝি আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমিও ভেবেছিলাম কিন’ এ কি দেখলাম আমি জয়, কী দেখালে তুমি আমাকে।

কিন’ তোমার সব ঠিক হয়ে গেছে ইরা। তোমরা মেয়েরা আসলে সবই পারো। কথায় বলে না গাড়ি, বাড়ি আর নারী যখন যার কাছে থাকে তারই।

ইরা চোখ মুছে অভিমানের সুরে বললো, এভাবে বলো না জয়। তুমি ছেলে মানুষ, একা রেস্ট হাউজে থাকতে পারছো কিন’ আমি কি পারতাম, যেকোনো মেয়ে কি পারতো? মেয়েদের মানিয়ে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মেয়েদের মাথার ওপর একটা ছাদ থাকতে হয়, সেখানে তার মন থাকুক আর না থাকুক জীবন্ত লাশটা তো থাকবে। তোমার ইরা এখন আর জলজ্যান্ত মানুষ নয় জয় একটা জীবন্ত লাশ মাত্র। একটা লাশ কখনো পড়ে থাকে এই চার দেয়ালের মধ্যে, কখনো সাজ গার্ডেনে আর কখনো আমাদের সেই তাজমহলে। তোমার এতো স্মৃতি নিয়ে জীবনের এতো লম্বা সময় আমি কীভাবে কাটাবো জয় বলতে বলতে ইরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বেশিদিন থাকতে হবে না ইরা। আমি আবার তোমাকে নিয়ে আসবো! তোমার জীবন্ত লাশে আমি আবার প্রাণের সঞ্চার করবো।

ইরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, তা আর হয় না জয়।

তুমি রেডি থেকো ইরা, আমি সত্যি সত্যি তোমাকে বলে জয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো এমনসময় ইরার বাসার কলিং বেল বাজার শব্দ ভেসে এলো।

এখন রাখি জয় বলে ইরা ফোন রেখে দিলো।

 

এক’শ দুই

 

মানিকের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। জয় যে ছোট্ট ছেলেটিকে হাত ধরে একদিন স্কুলে নিয়ে যেতো, যে কিশোরকে একদিন এই একতা এক্সপ্রেস ট্রেনেই নটরডেম কলেজে ভর্তি করে দিতে গিয়েছিলো সেই ট্রেনেই জয় আর মানিক রওয়ানা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ট্রেন যথাসময়েই ছাড়লো। ট্রেন ছাড়ার তিন চার মিনিটের মধ্যে মানিক জানালায় উঁকি মারলো।

জয় কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো, জানালায় মাথা বাড়িয়ে দিও না।

মানিক মাথা টেনে নিয়ে মৃদু হেসে বললো, তুমি কি আমাকে নিয়ে খুব ভয় পাও, না?

জয় বললো, শুধু আমি না সারা দুনিয়ার সব বাবারাই ভয় পায়।

আর ভাবে তার ছেলে ছোটই আছে।

তুমি যখন বাবা হবে তখন তুমিও তাই ভাববে।

হয়তো। জিলা স্কুলটা একবার দেখে নিলাম। আমার আর রতনের ভর্তির সময় হেড স্যার তোমাকে খুব ভুগিয়েছিলো।

ওসব কথা মনে রাখতে নেই বাবা। তোমাদের দু’ভাইকে জিলা স্কুলে পড়ানোটা ছিলো আমার একটা স্বপ্ন ছিলো। আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এটাই বড় কথা।

 

অনেক বছর আগের কথা। জয় তখন এস.এস.সি পাস করে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন জিলা স্কুলের সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় ভাবতো, ইসস আমি যদি জিলা স্কুলে পড়তাম।

জয়ের জিলা স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি কিন’ তার মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিলো কোনোদিন যদি তার ছেলে হয় তবে দিনাজপুর জিলা স্কুলে লেখাপড়া করাবে।

একে একে মানিক রতন হলো। দু’জনেরই স্কুলে যাওয়ার বয়স হলো। জয়ের পোস্টিং তখন ধামইরহাট, মানিক ক্লাস ফাইভের ছাত্র আর রতন ক্লাস টু’র। জয় মাঝে মাঝে অফিসের কাজে নওগাঁ যেতো আর ভাবতো মানিক রতনকে প্রথমে নওগাঁ জিলা স্কুলে ভর্তি করতে পারলে বদলি হয়ে দিনাজপুর যাবে তারপর দু’জনকে ভর্তি করবে দিনাজপুর জিলা স্কুলে।

মানিক রতনের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে নওগাঁয় বাসা ভাড়া নিলো। শুরু হলো কোচিং, প্রাইভেট এবং জয় নিজেও দু’জনের প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হলো। জয় মাঝে মাঝে দু’ছেলেকে নিয়ে মুক্তির মোড় যেতো আর জিলা স্কুল দেখিয়ে বলতো, ভালোভাবে লেখাপড়া করো বাবা তোমাদের দু’জনকে নওগাঁ জিলা স্কুলে ভর্তি হতে হবে।

নওগাঁ জিলা স্কুলে দু’জনে এ্যাডমিশন টেস্ট দিলো এবং ভর্তির সুযোগ পেলো। জয়ের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার একটা ধাপ এগিয়ে গেলো। এবার সে চেষ্টা করলো বদলি হওয়ার। এই ধাপ অতিক্রম করতে জয়ের বেশি বেগ পেতে হলো না। ইনিয়ে বিনিয়ে একটা দরখাস্ত লিখে জয়ের বদলিও হলো দিনাজপুর।

যখন দিনাজপুর জিলা স্কুলে মানিক রতনের ভর্তির সব শর্ত পূরণ করলো তখন বাধ সাধলেন স্বয়ং হেড মাস্টার সাহেব। তার এক কথা, ’’আমি ভর্তি নিবো না’’।

জয়ও নাছোড়বান্দা। সে স্কুলের সভাপতি জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হলো।

জেলা প্রশাসক নীতিমালা দেখে হেড মাস্টার সাহেবের ওপর নাখোশ হলেন। নীতিমালার শর্ত পূরণ করায় ভর্তি নেয়ার জন্য সুপারিশ করে চিঠি দিলেন। হেড মাস্টার সাহেব জেলা প্রশাসকের আদেশও গুরুত্ব দিলেন না। তার কথা, ডি.সি স্যার এরকম চিঠি প্রায়ই দিয়ে থাকেন।

জয় হেড মাস্টার সাহেবকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারলো, নীতিমালার সব শর্ত পূরণ করার পরও আপনি যদি আমার ছেলেদের ভর্তি না নেন তবে আমি প্রশাসন, আদালত, মিডিয়াসহ সবার কাছে যাবো। সারাদেশের মানুষ জানুক একজন প্রধান শিক্ষক নীতিমালার সব শর্ত পূরণ করার পরও যখন একজন সরকারি কর্মচারীকে হয়রাণী করে তখন সেই প্রধান শিক্ষকের কাছে সাধারণ মানুষের স’ান কোথায়!

প্রধান শিক্ষক মানিক রতনকে ভর্তি নিলেন। জয়ের আরও একটা স্বপ্ন পূরণ হলো কিন’ মানুষের স্বপ্নের তো শেষ নেই। বলা যায় মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা, অবলম্বনই তো স্বপ্ন। মানুষের একটা স্বপ্ন পূরণ হলে আরেকটা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আবার শুরু হয় বাঁচার স্বপ্ন।

 

মানিকের ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা। জয়ের ধারণা ছিলো দেশের কোনো একটা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো সে ভর্তির সুযোগ পাবে কিন’ মানিক কোথাও ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় জয় মানিকের প্রতি কিছুটা মন খারাপ করেছিলো কিন’ হাল ছেড়ে দেয়নি। জয়ের কাছে জীবনটা যেনো একটা ফুটবল খেলা। প্রত্যেকটি সফলতা এক একটি গোল একবার আউট সাইড, ফাউল করে অমনোযোগী হওয়া কিংবা প্রতিপক্ষের আঘাত বা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে খেলা থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আবার উঠে দাঁড়াতে হয়, দৃঢ় মনোবল নিয়ে এবং মেরুদণ্ড সোজা করে। মানিকের দেশের কোনো প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়াকে জয় একটা হোঁচট হিসেবেই দেখেছিলো।

স্বপ্ন দেখতে হয় না, হৃদয়ে লালন করতে হয়। সাধ্যহীন স্বপ্নের লালন শুধু কষ্টই দেয়। স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করতে হয় সাধ্যের সঙ্গতি রেখে কিন’ অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া একজন স্বপ্নবিলাসী জয়ও কখনো মানিককে দেশের বাইরে লেখাপড়া করার স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করেনি। তাই মানিক সেদিন যখন চীনে লেখাপড়ার জন্য তার স্কলারশিপ হয়েছে জানালো তখন থেকে জয়ের মনে একটা নতুন স্বপ্ন উদয় হলো। এ স্বপ্ন যেনো আকাশ ছোঁয়া।

ট্রেন দ্রুতগতিতে চলছে। জয় একবার মানিকের মুখের দিকে তাকালো। মানিক ঘুমাচ্ছে। জয় জানালার দিকে তাকালো, বাইরে একটু একটু কুয়াশা পড়েছে বলে মনে হলো। আকাশে চাঁদ আছে কিন’ জ্যোৎস্না ম্রিয়মাণ। কুয়াশা ভেদ করে চাঁদটা একটা পিতলের প্লেটের মতো রূপ ধারণ করেছে। জয় জায়গাটা চেনার চেষ্টা করলো, না কোনোকিছু বোঝা যাচ্ছে না। চেনার কোনো উপায়ও নেই। রেল লাইনের দু’পাশে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত। জয় এই স’ানটা জানার জন্য রেলের নির্ধারিত নাম্বারে একটা ম্যাসেজ পাঠালো। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো, ট্রেন পাঁচবিবি অতিক্রম করেছে, এখন জয়পুরহাট থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস’ান করছে। জয় আপনমনে একবার হিসেব করলো ট্রেন এখন পুরানাপৈল এর কাছাকাছি হবে একটু পরেই ট্রেন রেল লাইনের পূর্ব পাশে সাথী নার্সারি এবং বি.এড কলেজ অতিক্রম করবে। এই সাথী নার্সারির সাথে জয়ের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ইরা আর জয় প্রথম প্রথম এই সাথী নার্সারিতে দেখা করতো। ইরা বি.এড কলেজে ক্লাসের কথা বলে দু’জনে সাথী নার্সারিতে বসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো। একসময় জয় আর ইরা ভাবতো তারা বুঝি একজনকে ছাড়া আরেকজন একমুহূর্তও বাঁচবে না। জয় আর ইরা ঘর বাঁধলো সেই ঘর ভেঙ্গেও গেলো। দু’টি পাখি আবার দু’দিকে ফিরে গেলো। এখন দিব্যি দু’জনে বেঁচে আছে। যে বাঁচাকে হয়তো বাঁচা বলে না।

ট্রেনের গতি কমে আসছে। জয় বুঝতে পারলো ট্রেন জয়পুরহাট রেল স্টেশনে ঢুকছে। ট্রেনের গতি একেবারে থেমে গেলো তারপর খস করে ব্রেক কষে ট্রেন থেমে গেলো। জয় একবার ট্রেনের জানালা দিয়ে ইরার সেই জানালার দিকে তাকালো। হায় ইরা! কোথায় তুমি? সেই জানালা, জানালায় একটা লাইট জ্বলছে, সামান্য আলো যেনো মিটমিট করে জ্বলছে।

জয় পশ্চিম দিকে তাকালো। বারো ঘাটি পুকুরে হালকা কুয়াশায় ঢেকে গেছে, মধুর কেন্টিনের সামনে একটা আলো জ্বলছে। জয়পুরহাট সরকারি কলেজের গেটের আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। পাঁচতলা একাডেমিক ভবনটি দূর থেকে আবছা আবছা চোখে পড়ছে। এই বিল্ডিংটি আর গেট দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশের ছাত্রীনিবাসটি জয়ের সুপারভিশনে নির্মিত হয়েছে, ওরা জানে না যে ওদের  স্রষ্টা পাশ দিয়ে যাচ্ছে আর ওদের স্মৃতিচারণ করছে। ইট, সিমেন্ট, রড দিয়ে নির্মিত প্রাণহীন ভবনটিরই বা দোষ কী! জীবন্ত, প্রাণবন্ত মানুষই যখন কারও কথা মনে রাখে না তখন প্রাণহীন ভবনটারই বা দোষ কী।

তখনো জয়ের সঙ্গে ইরার বিয়ে হয়নি। ইরার বি.এড পরীক্ষা হচ্ছিলো জয়পুরহাট সরকারি কলেজে, তখন জয় প্রায় দিনই ইরাকে নিয়ে আসতো পরীক্ষা কেন্দ্রে। কোনোদিন অনেক আগে আসতো, দু’জনে মধুর কেন্টিনে বসে চা খেতো, একবার একাডেমিক ভবন আরেকবার ছাত্রীনিবাসে যেতো। জয়ের কাছে সেই স্মৃতিময় জয়পুরহাট সরকারি কলেজ এখন শুধু ইতিহাস।

ট্রেন ছাড়লো। একটু একটু করে ট্রেনের গতি বাড়তে থাকলো আর ইরার সঙ্গে স্মৃতিময় জায়গাগুলো দূরে সরে যেতে লাগলো। ইরার কথা ভাবতে ভাবতে জয়ের চোখ দু’টো পানিতে ভরে গেলো। ট্রেন আলোকিত শহর পেরিয়ে আবার ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে চলতে শুরু করলো। জয়ের শরীরটা শিথিল হয়ে এলো, চোখ দু’টো বুজে এলো।

 

এয়ারপোর্টে ঢুকে মানিকের শুরু হলো কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা। সে নিজেই সব কাজ করছে একজন দক্ষ যাত্রীর মতো। মানিকের দক্ষতা দেখে জয়ের চোখ দু’টো পানিতে ভরে গেলো। তার সেই ছোট্ট ছেলেটি এতোকিছু জানলো কী করে। আসলে ছোট্ট সন্তানই একসময় বাবার বাবা হয়ে যায় আর বাবা হয়ে যায় সন্তান।

সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনসের বিমানটি রাত এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে বিমান বন্দরে অবতরণ করলো। মাইকে বিমান এবং গন্তব্যস’লের নাম ঘোষিত হলো। মানিক জয়ের সামনে এসে মাথা নত করে দাঁড়ালো। জয়ের চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো কিন’ মানিকের কোনো অনুভূতি নেই, তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের ছাপ ফুটে উঠেছে।

জয় মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, সাবধানে থেকো বাবা, ভালোভাবে লেখাপড়া করো।

মানিক মাথা কাত করে সায় দিলো। তারপর চলে গেলো।

জয় এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক মিনিট পর মানিক ফোন করলো।

জয় রিসিভ করেই আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, বাবা।

মানিক বললো, এখন মোবাইল ফোন বন্ধ করতে হবে। আমার জন্য ভেবো না, নেটে থেকো আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।

ওকে বাবা।

প্রায় এক মিনিট পর জয় আবার মানিককে ফোন দিলো কিন’ ততক্ষণে মানিক ফোন বন্ধ করেছে। একটা বিমান আকাশে উড়লো, হ্যাঁ এই বিমানটাই তো। জয় বিমানটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশালাকৃতির বিমানটি ক্রমশ: ছোট হতে হতে এক টুকরো আলোয় পরিণত হলো তারপর একসময় দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো। জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে আপনমনে বললো, বাবা, উপরে উঠেছো, কত উপরে, আকাশ ছুঁয়েছো? ওপরে ওঠো বাবা আকাশ ছুঁয়ে দেখো আমি আনন্দে চিৎকার করে সবাইকে বলছি আমার স্বপ্ন আজ আকাশ ছুঁয়েছে।

 

এক’শ তিন

 

পুতুলের একটা মেয়ে হয়েছে, ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে। পুতুল মা হয়েছে, শুভ বাবা হয়েছে। ইরা দাদী হয়েছে। বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশীরা দল বেঁধে দেখতে আসছে। কেউ কেউ বলছে দাদীর মতো সুন্দর হয়েছে। কেউ বলছে শুভ’র মতো। পুতুলের বাবার বাড়ির লোকেরা বলছে পুতুলের মতো হয়েছে। আগামী শুক্রবার আকিকা করার আয়োজন চলছে, নাম রাখার জন্য কেউ কেউ নাম প্রস্তাব করছে। কেউ কেউ নাম রাখার জন্য ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইরা বললো, তোমরা ওরা পুরো নাম যা-ই রাখো, ডাক নামটা আমি রাখবো।

মতি কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো, কী নাম রাখবে তুমি? বলো?

আমি ওর নাম রাখবো জুঁই।

মতি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললো, এটা একটা নাম হলো।

কেনো না, জুঁই একটা ফুলের নাম।

শুভ একবার তীর্যক দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেনো বললো, তারপর বললো, না মা, তুমি অন্য নাম রাখো।

কেনো, জুঁই রাখলে সমস্যা কী।

মতি বললো, শুভ তুই ওর কথা বাদ দেতো। ওর মাথা থেকে এখনো ভুত নামেনি।

ইরা ফোনে ফেসবুক লগ ইন করাই ছিলো। হঠাৎ করে চ্যাট করা শব্দ হলো। শুভ ইরার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো, মা তোমার ফোনটা দাও তো।

কেনো?

দাও বলছি, শুভ কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললো।

ইরা ভয়ে ভয়ে মোবাইল ফোনটা শুভকে দিলো। শুভ কিছুক্ষণ মোবাইল ফোনটা চেক করে অস্বাভাবিক শান্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বললো, মা, তুমি এখন দাদী হয়েছো।

কী হয়েছে শুভ? মতি কিছুটা উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললো।

ইরা একটা ঢোক গিললো।

শুভ বললো, কিছু না বাবা।

মতি বললো, তোর মা কি দাদি নাতনি একসঙ্গে প্রেম করতে চাচ্ছে নাকি? ছিঃ মানুষ শুনলে কী বলবে, স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রী পরপুরুষের হাত ধরে পালায় এটা করেছে এবার কি নাতনিকে রেখে পালাতে চায় নাকি?

শুভ এবার মতিকে অভিমানের সুরে বললো, বাবা!

এবার ইরা মুখ খুললো, একবার তো পালিয়েছিলাম, তোমরা বাপ-বেটা মিলে আমাকে চালাকি করে নিয়ে এসেছো। বলে ইরা মতির দিকে তাকিয়ে বললো, আমার সাথে আর কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করবে না, আমাকে শাসন করবে না, আমাকে শুধু ভালোবাসবে, ভালোবাসা দিয়ে আমার মন জয় করবে বলে আমাকে নিয়ে এসেছো। আর এখন! এখন সবসময় শাসন করছো, আমাকে জোর করছো। মানুষের মন জয় করতে হয় মতি জোর নয় কিন’ তুমি সারাজীবন আমাকে জোর করলে কোনোদিন জয় করার চেষ্টাও করলে না বলতে বলতে ইরার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

মতি আবার ধমক দিলো, ইরা।

শুভ ইরার মোবাইল ফোনটা তার হাতে দিয়ে বললো, ঐ লোকটাকে ফেসবুকে আনফ্রেন্ড এবং চ্যাট ব্লক করে দিয়েছি, তোমার ফোন থেকে মোবাইল নাম্বারটা ডিলিট করে দিয়েছি। আর কোনোদিন ঐ লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ করো না মা। বলে শুভ পাশের রুম থেকে তার মেয়েকে এনে ইরার কোলে দিয়ে বললো, মা, আমি, আমার মেয়ে মানে তোমার একমাত্র নাতনির মাথা ছুঁয়ে বলো, তুমি আর কোনোদিন ঐ লোকটার সঙ্গে কথা বলবে না, কোনোদিন যোগাযোগ করবে না।

ইরার হৃদয়ে ভেঙ্গে গেলো, জয়! আমার জয়ের সঙ্গে আমি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবে না! কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারবো না! কিন’ জয় যে আছে তার হৃদয়ে, রক্তের শিরায় শিরায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, আমার সমস্ত অনুভূতিতে, শুভ তোমরা ফেসবুকে, মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করতে পারো কিন’ আমার হৃদয় থেকে তো মুছতে পারবে না।

শুভ বললো, মা।

ইরা গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, সে চোখের পানি মুছতে মুছতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শুভ’র কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তারপর সোফা থেকে উঠে একরকম দৌড়ে ছাদে চলে গেলো।

 

ইরা একবার স্মৃতিময় স্কুলের ভবনটির দিকে তাকালো। বাইরে সিকিউরিটি লাইটগুলো অন্ধকার ভেদ করে বিচ্ছুরিত আলো ছড়িয়েছে, ইরা একবার মনে মনে বললো, জয়, তুমি কি দেখছো আমি এখন ছাদের ওপর থেকে আমাদের স্মৃতিময় তাজমহলের দিকে তাকিয়ে আছি, সামনে আমাদের সাজানো বাগান সাজ গার্ডেন, একটা একটা করে গাছ আমরা দু’জনে পছন্দ করে কিনেছিলাম সেই সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারি ঘুরে ঘুরে। ওরা আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলো জয়, পারলে আমার স্মৃতি, আমার সব নিঃশ্বাস, আমার রক্তের শিরায় শিরায় জেগে থাকা তোমার স্মৃতিগুলো, অনুভূতিগুলোও কেড়ে নিতো কিন’ তা কোনোদিন পারবে না। কোনোদিন পারবে না আমাদের ভালোবাসার আকাশ থেকে আমাদের আলাদা করতে।

এই আকাশ, সেই পূর্ণিমার রাত একদিন আমাদের ছিলো। সেই পূর্ণিমার রাত আজ নেই কিন’ আমরা আছি এই আমাবস্যার রাতেও একই আকাশের নিচে আমি তোমাকে খুঁজছি, তুমিও হয়তো সারাজীবন আমাকে খুঁজবে। আমাদের দু’জনের মাঝে একটা অদৃশ্য যোগাযোগ, একটা কথোপকথন থাকবে শুধু দু’জনের হৃদয়ে। ওরা আমার কাছ থেকে পৃথিবীর সব কেড়ে নিতে পারবে কিন’ তোমাকে কেড়ে নিতে পারবে না আমার স্মৃতি থেকে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস থেকে, জয়! আমার জয়!

 

এক’শ চার

 

বন্ধন এবং বিচ্ছেদ দু’টোই জীবনের অংশ। সম্পর্ক যখন মধুর এবং আনন্দদায়ক হয়, যতক্ষণ সম্পর্কের মধ্যে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকে ততক্ষণ বন্ধনই শ্রেয় কিন’ সম্পর্ক যখন সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা হারায়, মধুর সম্পর্ক যখন বেদনা ও যন্ত্রণাদায়ক হয়, সম্পর্ক যখন সহিংস হয় তখন তো বন্ধনের চেয়ে বিচ্ছেদই শ্রেয়। ঠিক শরীরের অঙ্গগুলোর মতোই যতক্ষণ ঠিক ঠিক মতো কাজ করে ততক্ষণই শরীরের অংশ কিন’ যখন যন্ত্রণাদায়ক হয় তখনই অপারেশন করতে হয় নইলে এক অঙ্গের ক্ষতের যন্ত্রণা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, জীবনকে অসি’র করে তোলে, কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এমন যন্ত্রণাদায়ক অঙ্গের চেয়ে তো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই উত্তম।

যন্ত্রণাদায়ক বন্ধনের চেয়ে মধুর বিচ্ছেদই ভালো। কিন’ সমাজের চিরাচরিত ধারণা অন্যরকম। কোনো নারী-পুরুষ একবার বিবাহ বন্ধনের আবদ্ধ হলে তাদের জীবন যত যন্ত্রণাদায়কই হোক না কেনো এক সাথে, একই ছাদের নিচে থাকতে হবে নইলে দুর্নাম হবে, মানুষ খারাপ বলবে, সমাজের কাছে মুখ দেখানো কঠিন হবে। এই মানুষের কাছে ভালো আর সমাজের কাছে মুখ দেখানোর জন্য কত মানুষের জীবন যে নষ্ট হয়ে গেছে, কত মানুষ যে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে, কত মানুষ যে অভিনয় করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই, হয়তো কেউ কোনোদিন জানবেও না।

শুধু কী তাই। যন্ত্রণাদায়ক দাম্পত্যের কারণে পরকীয়া, পারিবারিক নির্যাতন এমন কী অহরহ সহিংস ঘটনাও ঘটছে অথচ সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্যই বিবাহ কিন’ মানুষ সহিংস ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর চুক চুক করে অথচ একটা শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদও মেনে নিতে চায় না। শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদ অনেক অনৈতিক এবং খুনোখুনির ঘটনা সহজে এড়িয়ে যেতে পারে।

হ্যাঁ বিচ্ছেদ, জয় এখন বিচ্ছেদই চায়। একটা মধুর বিচ্ছেদ। জীবনে অসংখ্য বার জয় সামিনাকে ডিভোর্স করার উদ্যোগ নিয়েছে কিন’ প্রথম জীবন কাটিয়েছে ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে বলে, তারপর এলো মানিক-রতন, তখন সবাই বলতে শুরু করলো সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে, সন্তানরা বড় হলো। জয়ের শেষ ভরসা ছিলো তার দু’ছেলে কিন’ সামিনা ছেলেদের জন্মের শুরু থেকে জয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে বাবা সম্পর্কে একটা অসম্মান ও অশ্রদ্ধার তৈরি করেছে। যার ফলে তারা এখন বাবার গায়ে হাত তুলতে সাহস পেয়েছে। পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী সব মিলিয়ে একটা মধুর পারিবারিক সম্পর্ক সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। এমন অবস’ায় জয়ের শেষ ভরসা আর কী?

জয় যখনই সামিনাকে ডিভোর্স করবে বলে সতর্ক করেছে তখনই সামিনা তার চিরাচরিত রূপ, অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলেছে, কর না, কর, আমাকে ডিভোর্স কর, আমি তোকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।

জয় অনেক উকিলের সাথে পরামর্শও করেছে, উকিলের পরামর্শও তাই। কেউ স্ত্রীকে তালাক দিলে স্ত্রীর আইনসঙ্গত পাওনা হলো দেনমোহর আর ইদ্দতকালীন ভোরণ-পোষণ কিন’ আজকাল কেউ স্ত্রীকে তালাক দিলে স্ত্রী স্বামীর ওপর যৌতুক ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করে। আইনের এই ধারাগুলো অজামিনযোগ্য হওয়ায় যেকোনো নারী খুব সহজে তার স্বামীকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারে।

সবকিছু শুনে জয় জেলের ভাত খাওয়ার ঝুঁকি নেয়নি বরং ইরাকে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছিলো, আইনসঙ্গত পদ্ধতি ডিভোর্স পরিহার করে প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করে আইন ভঙ্গ করেছিলো। তাতে করে জয়ের জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকি বেড়ে গিয়েছিলো তার যন্ত্রণাদায়ক জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিলো। ইরার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর জয় আশা করেছিলো সামিনা আর মানিক-রতন বুঝি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। আর সামিনা সেটাকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো। সামিনার ধারণা ছেলেদের দিয়ে শাসন করায় সে ইরাকে ছেড়েছে এবার সে যখন যা বলবে জয় তাই করবে। সামিনা চেয়েছিলো সে জয়কে ছেলেদের দ্বারা পিটিয়ে সোজা করবে কিন’ দূর্ভাগ্য পিটালে যে শুধু সোজা হয় না বাঁকাও হয় এটা সামিনা চিন্তা করেনি।

 

ঠাকুরগাঁও রেস্ট হাউজে জয়ের কয়েক মাস কেটে গেলো। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা হোটেল থেকে দু’টো রুটি কিংবা পরোটা খেয়ে আসা দুপুরে কাজ দেখতে গিয়ে যেখানে জোটে সেখানেই এক প্লেট অন্ন। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে শুরু হয় অফিসের স্টাফদের বাড়ি যাওয়ার ধুম। ঘরের টানে সবাই যেনো ছুটে যায় এমন একটা ঘর জয়ের জীবনে হলো না যে ঘরের টানে সে অফিসে কাজ ফেলে ছুটে যাবে। কাজের চাপে প্রতিদিন অফিস টাইমের পরও দু’য়েক ঘণ্টা ধুমধাম অফিস আর বৃহস্পতিবার অফিস টাইম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত অফিসটা অস্বাভাবিক নীরবতায় ডুবে যায়। তখন অফিসে একা থাকে জয়, সে সময়ের দুঃসহ যন্ত্রণার চাইতে জেলখানাটাই বা জয়ের জীবনে কষ্টকর কীসে।

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। অফিস শেষে সবাই চলে গেছে। জয় একা রেস্ট হাউজে শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবছিলো। জয়ের মন ক’দিন থেকেই ক্ষুদ্ধ, এর মধ্যে সামিনাকে তালাক দেয়ার জন্য কাজি, উকিল সবার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়ে গেছে। সবাই একটা কথা বলেছে, কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ তারপরও যদি আপনি করতে চান তবে আসবেন।

বাঁচার প্রয়োজন মানুষকে নিষ্ঠুর করে। হ্যাঁ, জয় নিজে বাঁচার জন্য নিষ্ঠুর হবে, স্বার্থপর হবে। সে সামিনাকে তালাক দিবে, সেটা তার জন্য যত ঝুঁকিপূর্ণই হোক না কেনো।

জয় রেস্ট হাউজ থেকে বের হলো।

 

কাজি সাহেব একটা রেজিস্টারে চোখ বুলাচ্ছিলেন। জয়কে দেখে মাথা উঁচু করতেই জয় সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। আপনি এসেছেন?

জি।

বলুন আজ কী মনে করে?

ডিভোর্স করবো।

ডিসিশন নিয়েছেন তাহলে?

হ্যাঁ ডিসিশন ফাইনাল, বলে জয় তার পকেট থেকে কাগজপত্রগুলো বের করে কাজি সাহেবকে দিলো।

কাজি সাহেব কাবিননামা বের করে বললেন, বিয়ের আটাইশ বছর পর!

জয় কোনো কথা বললো না। তার মনের মধ্যে হাজার কথা যেনো বিড়বিড় করছে, হ্যাঁ, আটাইশ বছর দু’যুগেরও বেশি। সারাজীবনই একসাথে থাকতে চেয়েছিলাম আর সেজন্যই তো একে একে সব চেষ্টাই করলাম কিন’ শেষ পর্যন্ত কোনো চেষ্টাই কাজে লাগলো না। ডিভোর্সই করতে হলো।

জয় জীবনের এতোবড় এবং নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কিন’ তার মধ্যে কোনো কষ্ট নেই, ঠিক ইরাও এমনভাবে মতিকে ডিভোর্স করেছিলো। ইরাও মতিকে ডিভোর্স করেছিলে হাসতে হাসতে। কারও ওপর কতটা রাগ আর ক্ষোভ থাকলে দীর্ঘদিনের সব সম্পর্ক হাসতে হাসতে বিচ্ছিন্ন করা যায় ইরা তাই দেখিয়েছিলো। জয় পাশে বসেছিলো, ইরা যখন সই করার জন্য ব্যাগ থেকে কলম বের করছিলো তখন জয় বলেছিলো, ইরা আরেকবার ভাবো!

ইরা একটা কষ্টের হাসি হেসেছিলো, সব ভাবনা শেষ করেই তো এসেছি জয়।

ইরা সই করে বাইরে এসে জয়ের মোটর সাইকেলে উঠে জড়িয়ে ধরেছিলো, জয়! আমার জয়! তুমি আমাকে একটু সুখ দিও জয়, একটু শান্তি দিও, ভালোবাসা দিও।

কাজি সাহেব জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, দু’জন সাক্ষী লাগবে যে ভাই।

জয় বললো, আমি তো কাউকে আনিনি কাজি সাহেব। আপনার এখানে কেউ নেই। আপনার কোনো স্টাফ।

কাজি সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, আছে তবে আমরা সাধারণত স্বাক্ষী দিই না।

একটু আমার জন্য দিন প্লিজ!

কাজি সাহেব আর আপত্তি করলেন না। বললেন, আচ্ছা আপনি সই করুন, আমি করে নিবো বলে জয়ের দিকে রেজিস্টারটা এগিয়ে দিলেন।

জয়ের কোনো অনুভূতি নেই। সই করতে গিয়ে তার হাত একটুও কাঁপলো না। সে দ্রুত সই করে দিয়ে কাজি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো।

কাজি অফিসের অদূরে টাঙ্গন নদী। জয় ধীর পদে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপর এলো। কত মানুষের ছুটোছুটি, কত যানবাহন, সবাই ছুটছে বাড়ির উদ্দ্যেশে। সবার একটা ঠিকানা আছে। দিন শেষে সবাই সেই ঠিকানায় যাবে, অপেক্ষামাণ স্ত্রী-পুত্র পথচেয়ে আছে। অনেকের হয়তো প্রিয়জনকে দেয়ার মতো কিছু নেই। অনেক শ্রমজীবী মানুষ আছে যারা সারাদিন কাজ করে চাল, ডাল, লবন, তেল কেনার সামর্থ্যও ভালোভাবে নেই তবুও আছে প্রিয়জনের মুখে হাসি। যে হাসি, যে অপেক্ষামাণ চোখ বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাইতো দিনশেষে সবাই ছুটে চলে নিজ ঘরে, নিজ ঠিকানায়।

জয়ের কী নেই! সম্মানজনক চাকরি, স্বচ্ছলতা, সামাজিক মর্যাদা, দেশে-বিদেশ কত বন্ধু-ভক্ত অথচ সব থেকেও যেনো তার কেউ নেই, কিছু নেই। একটা ঠিকানাও নেই, যে ঠিকানায় তার জন্য কেউ পথ চেয়ে থাকবে। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে তাকে বরণ করবে কিংবা অভিমান করে বলবে, এতো দেরি করে এলে!

হঠাৎ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলো। জয় একবার আকাশের দিকে তাকালো, আমাবশ্যার রাত। নেমে এলো গাঁঢ় অন্ধকার। অন্ধকারেরও যেনো একটা রূপ আছে। তারাগুলো যেনো ফুটে উঠেছে জ্বলজ্বল করে। পূর্ণিমার রাতে যে তারাগুলোর আলো ম্রিয়মান আমাবশ্যার রাতে সেই তারাগুলোও যেনো জ্বলজ্বল। আকাশে বিচিত্র একটা তারার খেলা লক্ষ্য করলো জয়। হঠাৎ করে একটা তারকা যেনো আকাশ থেকে খসে পড়লো। না, তারকা নয় উল্কা। তারকা কখনো খসে পড়ে কী না জয় জানে না, খসে পড়ে তো উল্কা। ভালোবাসার জগতে তো তারকা তো লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শশী-পূণ্য, রাই-বিনোদিনী। তারা ভালোবাসার জগতে ইতিহাস, ভালোবাসার তারকা। ভালোবাসার ইতিহাসে তারা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। জয় ইরা তো ভালোবাসার জগতে উল্কা মাত্র। ইতিাহসে তাদের নাম কেউ জানবে না, কেউ জানবে না হৃদয়ে এক বুক দুঃখ নিয়ে খসে পড়া উল্কা জয় ইরার ভালোবাসার কথা।

সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*