পরীর স্বপ্ন

মেয়েটির হাসিটি খুব সুন্দর কিন্তু তার শব্দ করে হাসতে মানা, মেয়েটির কান্নার শব্দটি অত্যন্ত করুণ কিন্তু তার কাঁদতে মানা। মেয়েটির হাঁটুনিতেও একটা আর্ট আছে কিন্তু তার ঘর থেকে বের হতে মানা। মেয়েটি এখন ক্লাস এইটের ছাত্রী, আগামীতে তার জে.এস.সি পরীক্ষা কিন্তু তার স্কুল যেতে মানা। তার সবকিছু যেন আটকা পড়েছে পারিবারিক বেড়াজালে। সে বাসায় বন্দি, তার কাজ শুধু ঘরে বসে অপেক্ষা করা। বিয়ের জন্য অপেক্ষা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চিরদিনের মতো উৎসর্গ করে সমাজের চিরাচরিত নিয়মে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে স্বামী-সংসার নিয়ে দিন কাটানোর জন্য তার শুধু অপেক্ষা।
কিন্তু সেও সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয়। সে মোটেই ভেঙ্গে পড়েনি। সে যেন ঘরের মধ্যে বন্দি থেকেও স্বাভাবিক। সে তার এই বন্দি দশা থেকে পালিয়ে, বাল্য বিবাহের অভিশপ্ত জীবন থেকে নিজেকে রক্ষা করে, সমাজের চিরন্তন সংস্কার ভেঙ্গে একদিন অনেক বড় হওয়ার, আকাশ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নে বিভোর। প্রতিকূল অবস’া থেকে বড় হয়ে কীভাবে সে একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে সে কৌশলও তার জানা আছে।
মেয়েটির বিয়ের জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো প্রস্তাব আসছে। বর মিলছে তো ঘর মিলছে না, ঘর মিলছে তো সবদিক থেকে বর মিলছে না আর এই ঘর ও বরের সমন্বয় করে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তার ঘর থেকে বের হতে মানা।
হাতে গোনা কয়েকজন বান্ধবী ছাড়া তার সঙ্গে দেখা করা নিষেধ। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কোনো পাত্রের হাতে পাত্রস’ করার পরই তার এই চার দেয়ালে বন্দি জীবনের অবসান ঘটবে। তখন মেয়েটি শৃঙ্খলিত হবে আরেক শিকলে। সমাজ-সংস্কারের এক অদৃশ্য শিকলে। ।
সেদিন বিকেলে মালা এলো। মালা মেয়েটির ক্লাস ফ্রেন্ড। দরজা নক করতেই মেয়েটির মা, সাবিনা জিজ্ঞেস করলো, কে?
খালা আম্মা আমি মালা।
মালাকে সাবিনা চেনে, সেই শৈশব থেকেই এ বাড়িতে তার আনাগোনা। তাই এ বাড়িতে এখনো তার আসা-যাওয়ার ওপর কোনো বিধি-নিষেধ জারি হয়নি।
সাবিনা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো মা?
ভালো খালা আম্মা। আপনি?
হ্যাঁ মা, ভালো আছি। বলে সাবিনা মেয়েটির ঘরের দরজায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মালা এসেছে মা, তুই দেখা কর্‌বি?
হ্যাঁ মা।
কোনো সমস্যা নেই তো?
মেয়েটি বললো, না মা।
ও কাউকে তোর কথা বলবে না তো?
মেয়েটি না সূচক মাথা নেড়ে জানালো সে কাউকে জানাবে না।
সাবিনা বাইরে এসে মালাকে বললো, এসো মা, আমার সাথে এসো। বলে সাবিনা মেয়েটির ঘরে গেলো, মালাও তার পিছনে পিছনে ভেতরে ঢুকলো।
সাবিনা মালাকে মেয়েটির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা গল্প করো।
সাবিনা চলে যাওয়ার পর মেয়েটি ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, কাউকে বলে আসিস্‌নি তো?
না।
তোকে কেউ দেখেছে?
হ্যাঁ।
কে?
মালা বললো, কে আবার, ঐ যে তোর…
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, তাহলে এলি কেনো?
মালা বললো, কয়েক দিন থেকে তুই স্কুলে যাচ্ছিস্‌ না, তাই তোর সাথে দেখা করতে এলাম।
মেয়েটি বললো, বেশ করেছিস্‌ কিন্তু যাওয়ার সময় ওরা যদি তোকে দেখে ফেলে? যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে?
মালা বললো, বলবো তুই বাড়ি নেই।
মেয়েটি একটু আশ্বস্ত হলো। তার মুখটা একটু উজ্জ্বল হলো, তোর অনেক বুদ্ধি আছে রে মালা। তোর মতো যদি আমার মাথায় বুদ্ধি থাকতো তাহলে আমাকে আজ ঘরে বন্দি হয়ে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।
আমার মাথায় বুদ্ধি? তাহলে তো আমিই ক্লাসে ফার্স্ট হতাম?
হ্যাঁ, মাথায় বুদ্ধি আছে বলে, ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি বলেই তো…বলে মেয়েটির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
মালা সান্ত্বনার বাণী শোনালো, তুই কিচ্ছু ভাবিস্‌ না। দেখবি ক’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হবে নাকি আমিই শেষ হয়ে যাবো সেটা কীভাবে বুঝ্‌লি?
তোর হয়তো সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে কিন্তু এটা তো আর বেশিদিন থাকবে না।
মেয়েটি কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, আসলে তুই কিছু জানিস্‌ না বলে সবকিছু সহজ ভাবছিস্‌।
কেনো? কী হয়েছে?
বুঝছিস্‌ না?
না তো?
বাবা-মা আমাকে আর স্কুল যেতে দিবে না।
মালা জিজ্ঞেস করলো, তুই কোনো দোষ করিস্‌নি, তোকে খালা আম্মা স্কুল যেতে দিবে না কেনো?
স্কুলের কথা শুনতেই মেয়েটির দু’চোখ ছল ছল করে উঠলো, কণ্ঠস্বর বুজে এলো। সে না সূচক মাথা নাড়লো।
মালা জিজ্ঞেস করলো, তো?
মেয়েটি শুষ্ক হাসি হেসে বললো, বিয়ে দিবে, বিয়ে।
বিয়ের কথা শুনেই মালা যেন চমকে উঠলো, বিয়ে!
মেয়েটি মাথা একবার উঁচু একবার নিচু করে জানালো তাকে বিয়ে দিবে।
তারমানে তোর আর লেখাপড়া করা হচ্ছে না?
বাবা-মা’র সেরকমই ইচ্ছা।
একটা ছেলে স্কুল যাওয়া-আসার পথে তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিলো আর তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ? তারপর বিয়ে-
মেয়েটি রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ, যদি কোনো কেলেংকারি হয় তবে তো বাবা-মা’র মান-সম্মান থাকবে না।
ও আর অল্প বয়সে কোনো রাস্তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে মান-সম্মান থাকবে?
মেয়েদের তো একদিন বিয়ে দিতেই হবে, আমি লেখাপড়া শিখে তো আর জজ-ব্যারিস্টার হবো না।
কে বলে তুই জজ-ব্যারিস্টার হবি না। আজকাল তো মেয়েরাও জজ-ব্যারিস্টার হচ্ছে, তুই ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল, তুই বড় হবি না তো কে হবে?
ওসব তাত্ত্বিক কথা। ক্লাসে ফার্স্ট হলেই সবাই বড় হয় না। অনেক মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েও কত রকমের কাণ্ড করছে। আমি যে করবো না তারই বা বিচিত্র কী।
সেই ভয়ে এত অল্প বয়সে খালা-খালু তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে?
এত অল্প বয়সে কেনো? অনেক মেয়ের তো আমার চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হচ্ছে। কেনো আমাদের সঙ্গে যে মনিকা পড়তো, ঝুমা পড়তো ওদের বিয়ে হয়েছে, না? আমারও তো দু’বোনের বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সে। তারা সংসার করছে না?
সবই ঠিক আছে কিন্তু এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তুই প্রতিবাদ কর্‌, বলে মালা মেয়েটির দু’হাত চেপে ধরে বললো, আমি তোর পাশে আছি তুই…
আমিও তাই ভাবছি রে, আমি প্রতিবাদ করবো। জন্ম থেকেই তো কষ্ট করে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে, প্রতিবাদ করে এতদূর পর্যন্ত এসেছি এখন যদি আমি হেরে যাই তবে যে আমার সব গেলো। আমার খুব খারাপ লাগছে। ক’দিন থেকে স্কুল যেতে পারছি না দেখে আমার মনে হচ্ছে…বলতে বলতে মেয়েটির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
কয়েক মুহূর্ত দু’জনের মুখে কোনো কথা নেই।
মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো, মালা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
মালা কৌতূহলী হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, বল্‌?
বলছি, বলে মেয়েটি জানালা ফাঁক করে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে মালাকে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো। মালা মাথা নেড়ে সায় দিলো। এভাবে কয়েক মিনিট কথা বলার পর মালার মুখ উজ্জ্বল হলো।
মালা মেয়েটির মাথা নেড়ে বললো, সেজন্যই তো বলছিলাম তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। তারপর দু’জনে হেসে উঠলো।
সাবিনা আবার ঘরে ঢুকলো, কী হচ্ছে? এতো হাসাহাসি কীসের?
কিছু না মা।
সবকিছু জেনেও মালা জিজ্ঞেস করলো, খালা আম্মা মালা আর স্কুল যাবে না?
না মা।
কেনো?
ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বিয়ের পর যদি ওর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন পড়াতে চায় তো স্কুল পাঠাবে।
মালা আর কোনো কথা বললো না।
সাবিনা চলে গেলো। মেয়েটির গালে আদর দিয়ে বললো, তুই কিচ্ছু ভাবিস্‌ না, আমি তো আছি, তুই যেভাবে বল্‌লি সেভাবেই হবে। এখনি যেন কাউকে কিছু বলিস্‌ না। ঠিক…
আচ্ছা। মালা চলে গেলো।
দুই

মেয়েটির প্রতি অবহেলা শুরু হয়েছে তার জন্ম গ্রহণের পর থেকে। একটা পুত্র সন্তানের আশায় আশায় আতার ঘরে একে একে তিনটি কন্যা সন্তান এলো। এই তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে মেয়েটির স’ান তৃতীয়। জন্মের পর থেকেই সে বড় হয়েছে অনাদর আর অযত্নের মধ্য দিয়ে। দিনে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত নয় যেন বড় হয়েছে প্রতিবেশীদের বাড়ির উচ্ছিষ্ঠ খাবার খেয়ে।
সবার বড় মেয়ে শাপলা। তেরো চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। কিশোরী বয়সে সে এক সন্তানের মা। তারপর দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে আরেক বছর পরই। এই অল্প বয়সে দু’টি সন্তান প্রসব করায় তার শরীরে অনেক অসুখ বাসা বেঁধেছে। প্রকৃত বয়স কুড়ি অতিক্রম করার আগেই যেন সে বুড়ি হয়েছে।
শাপলার যখন বিয়ে হয় তখন তার স্বামী কামাল রিক্‌শা চালাতো। বাবার কিছু জমিজমা ছিলো কিন্তু বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত সেগুলোর ভাগ পায়নি। বাবার মৃত্যুর পর পৈত্রিক জমিজমা ভাগ পাওয়ায় তার আর্থিক অবস’ারও উন্নতি হলো। রিক্‌শা বেচে কিনলো অটো রিক্‌শা। আগের চেয়ে আয় বাড়লো। জমির ফসলের টাকা আর প্রতিদিন অটো রিক্‌শা ভাড়ার টাকায় তার কাঁচা বাড়ি পাকা হলো। তার উন্নতি যদি এ পর্যন্তই থাকতো তবে ভালোই হতো কিন্তু প্রতিদিন হাতে এতগুলো কাঁচা টাকা আসায় তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা দিলো। কথায় আছে টাকার গরম সবাই হজম করতে পারে না।
আগের দিনে কামাল রিক্‌শা নিয়ে বাড়িতে এসেই বাইরে থেকে জোরে ডাক দিতো, শাপলা, শাপলা বলে তারপর যখন তাদের ঘরে প্রথম সন্তান মেয়ে হলো তখনো শাপলাকে অনেক আদর করতো, প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় শাপলাই বরং একটু মন খারাপ করেছিলো কিন্তু কামাল তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, তুমি এতো মন খারাপ করছো কেনো, বাচ্চা-কাচ্চা আল্লাহ যাকে যা দিবে তাই নিয়ে সন্ত্বোষ্ট থাকতে হবে। চাইলেই তো আর পাওয়া যাবে না। আমার ইচ্ছা ছেলে হোক মেয়ে হোক আমাদের দু’টা বাচ্চা হবে। আমি আব্বার মতো ভুল করবো না। ছেলের আশায় দু’য়ের বেশি বাচ্চা নিবো না।
কিন্তু পুত্র সন্তানের জন্য দু’য়ের অধিক বাচ্চা নিতে হলো না। সেদিন গভীর রাতে শাপলার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলো। কামাল প্রতিবেশীদের খবর দিলো। প্রতিবেশী এক মেয়ে ক’বছর আগে ধাত্রী বিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। সে এখন একটা এন.জি.ও’তে স্বাস’্য কর্মী হিসেবে চাকরি করে, সে বেশির সময় কামিজের ওপর এপ্রোন চাপিয়ে বেড়ায় বলে সবাই তাকে সিস্টার বলে ডাকে। সেই সিস্টার খবর পাওয়া মাত্র তার যন্ত্রপাতি নিয়ে এলো। সে শাপলার ঘরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে বললো, কামাল ভাই ভাবীর কন্ডিশন ভালো আছে ভয়ের কিছু নেই। কোনো টেনশন করবেন না।
কিছুক্ষণ পরই নবাগত শিশুর কান্নার শব্দ পৃথিবীতে তার আগমন ধ্বনি ঘোষণা করলো। সে বাইরে এসে বললো, কামাল ভাই আপনার ছেলে হয়েছে।
সমাজের সবকিছুতেই লিঙ্গ বৈষম্য এবং এই বৈষম্যকে সবাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে বরং এর ব্যতিক্রমই অস্বাভাবিক। সিস্টার নিজে একজন মেয়ে হয়েও কামালকে তার পুত্র সন্তানের আগমন সংবাদ জানানোর সময় শাপলার নামটা উহ্যই রেখে বললো, কামাল ভাই আপনার ছেলে হয়েছে।
তারপর ঘটলো আরেক ঘটনা।
পুত্র সন্তানের কথা শুনে কামাল খুব খুশি হলো। সে দৌড়ে বাইরে গেলো। কিছুক্ষণ পর মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে আনলো।
ইমাম সাহেব কামালের বাড়িতে আযান দিয়ে পুত্র সন্তানের আগমন বার্তা ঘোষণা করলো। বৈষম্য কোথায় নেই? কী সমাজ? কী ধর্ম? কন্যা সন্তান জন্মের সঙ্গে তো আযানের নিয়ম নেই, আছে শুধু পুত্র সন্তান জন্মের পর।
পর পর দু’টি সন্তান প্রসবের পর শাপলার অনেক অসুখ-বিসুখ দেখা দিলো। শাপলার স্বাস’্য ভেঙ্গে গেলো। কামালের কাছে শাপলার আদরও কমতে লাগলো। আগে কামাল অটো রিক্‌শা নিয়ে বাইরে এসে জোরে ডাক দিয়ে বলতো, ময়নার মা বাইরে আসো। ব্যাগটা নাও।
তখন তাদের দিন ভালো যাচ্ছিলো না। শাপলা দেখতো ব্যাগের মধ্যে চাউল আর দু’য়েকটা সবজি, বড় জোর এক হালি ডিম। তাতেই শাপলা খুশি থাকতো। রাতে যখন দুজন এক বিছানায় ঘুমাতো তখন যেন স্বর্গের সুখ নেমে আসতো। তাদের ঘরে একটা পুত্র সন্তান আসার পর কামাল বাইরে এসে জোরে ডাক দিয়ে বলতো, বাবুর আম্মা বাইরে আসো।
শাপলা তার রোগাক্রান্ত মুখে একটা হাসি দিয়ে বলতো, এতো দেরি করে আসলে, বাবু তোমার জন্য অনেকক্ষণ থেকে ছটফট করছে।
কামাল বাবুকে কোলে নিতেই বাবুর কান্না থেমে যেতো।
এই ঘর-সংসার, সুন্দর ফুটফুটে এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে তাদের দিন ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু সেই ভালো বেশিদিন টিকলো না। ধীরে ধীরে কামালের আচরণে পরিবর্তন শুরু হলো। বাড়িতে এসেই সে শাপলার ওপর রেগে যেতে লাগলো। মেজাজটা সবসময় খিট্‌মিটে করতে শুরু করলো। অটো রিক্‌শা নিয়ে বাড়িতে আসার সময় বাজারের বড় ব্যাগ নিয়ে এসে ধপাস করে রেখেই বাইরে চলে যেতো। ফিরে আসতো গভীর রাতে। রান্নার সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই বাড়িতে রাগারাগি করতো। শাপলা কিছু বললে আরো প্রচণ্ড রেগে যেতো। রেগে গেলে তার আর হিতাহিত জ্ঞান থাকতো না। ছোট-খাটো কারণে শাপলার গায়ে হাত তুলতো।
শাপলা কামালের এসব আচরণের প্রতিবাদ করতো না, সে শুধু বসে বসে কাঁদতো। একদিন কান্না ভাঙ্গা গলায় শাপলা বললো, তুমি যদি প্রতিদিন আমাকে মারো তাহলে আমি কিন্তু বাবার বাড়ি চলে যাবো।
কামাল মুখ বিকৃত করে অনেকটা অবজ্ঞার সুরে বললো, যাও, যেতে চাও তো যাও, কে তোমাকে ধরে রেখেছে?
শাপলা চোখ মুছে বললো, ও আমি চলে গেলেই তো তুমি বেঁচে যাও, না?
বুঝেছই তো।
শাপলা এবার চড়া গলায় বললো, চলে যাবো কেনো? তোমাকে ছেড়ে, আমার সোনার টুকরা বাবুকে ছেড়ে আমি চলে যাবো কেনো?
এমনিভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে কামালের সঙ্গে শাপলার ঝগড়া হতো। শাপলা তার দোষ-ত্রুটি সংশোধন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কোনো সংশোধনই কাজে এলো না। কয়েক দিন পর সে জানতে পারলো তার ওপর কামালের রেগে যাওয়ার কারণ।
উত্তর পাড়ার এক মেয়ে কামালের অটো রিক্‌শায় প্রায় যাতায়াত করে। মেয়েটির আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু সংসার টিকেনি। তারপর মায়ের বাড়িতে থেকে বিরলে গিয়ে দর্জির কাজ করে। প্রতিদিন কামাল যখন অটো রিক্‌শা নিয়ে বের হয় সে তখন মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায় আর কামাল যখন শহর থেকে ফিরে আসে তখন কামাল মেয়েটির দোকানের সামনে গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। এমনিভাবে যাতায়াত করতে করতে তাদের মধ্যে একটা হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। না, সম্পর্কটা হয়তো হৃদয়ঘটিত না, তার চেয়ে অনেক বেশি। কামাল সময় অসময়ে সেই বাড়িতে গিয়ে সময় কাটায়। এই ঘটনাটা শাপলা জানার আগেই পাড়ায় গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শাপলা যখন জানতে পেরেছে ততদিনে ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে।
সেদিন রাতে কামাল অটো রিক্সা নিয়ে আসার পর যখন আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন শাপলা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো এত রাতে?
বাইরে।
বাইরে কোথায়?
এবার কামাল ঘুরে দাঁড়ালো, সেটা তোমাকে বলে যেতে হবে?
শাপলা পথ রোধ করে দাঁড়ালো, না, আমি তোমাকে যেতে দিবো না।
কেনো?
সেটা তুমিই বলো।
ও বুঝতে পেরেছি। তুমিও জেনে গেছো।
পাড়া গ্রামের সব মানুষ জানবে আর আমি জানবো না?
জেনেছো তো ভালোই হয়েছে, এখন কেটে পড়ো। তুমিও বাঁচো আর আমিও বাঁচি।
শাপলা বললো, আমি কেটে পড়বো কেনো? আমি তো যাওয়ার জন্য আসিনি।
এখন পথ ছাড়ো। আমাকে যেতে দাও।
শাপলা পথ ছাড়লো না। সে আরো শক্তভাবে প্রতিরোধ করলো, না।
কামাল তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য জোরে ধাক্কা দিতেই শাপলা পড়ে গেলো। তার কোলে ছিলো এক বছর বয়সের ছোট ছেলে। সেও মা’র কোল থেকে ছিটকে পড়ে কাঁদতে লাগলো।
ঘর থেকে একমাত্র মেয়েও বেরিয়ে এসে মাকে পড়ে থাকতে দেখে কাঁদতে লাগলো।
গভীর রাতে মা, মেয়ে, ছেলে সবার কান্নার শব্দ শুনে প্রতিবেশীদের অনেকেই আসতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির সামনে জটলা তৈরি হলো। কামাল আর বাইরে যেতে পারলো না।
প্রতিবেশীদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বউমা?
কেউ জানতে চাইল, কী হয়েছে কামাল ভাই?
ও ভাবী কী হয়েছে এত রাতে?
কামাল দাঁড়িয়ে শাপলার ওপর রাগে ফুঁসছে। শাপলা অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
পাড়ার সম্পর্কে কামালের এক চাচা বললো, না কামাল, তুমি এটা ঠিক করছো না বাবা? গরীব হতে পারো কিন্তু তোমাদের বংশের একটা মান-মর্যাদা আছে, আমাদের পাড়ারও একটা মান-সম্মান আছে। কিন্তু তোমার কথা যা শুনছি তাতে করে তুমি আর কারো মান-সম্মান রাখছো না। মান-সম্মানের কথা না হয় বাদই দিলাম ধর্ম বলে তো একটা কথা আছে। এই পাড়ায় থেকে তুমি এরকম একটা অবৈধ কাজ করে বেড়াবে এটা তো গ্রামের মানুষ কেউ মেনে নেবে না। তোমার ঐ মেয়েকে ভালো লাগে তো বিয়ে করে ফেলো।
কামাল দাঁত কড়মড় করে শাপলার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
কামাল আর বাইরে গেলো না। কিছুক্ষণ পর সবাই চলে গেলে কামাল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো, ভালো, ভালো করলে। আজ পাড়ার মানুষকে জড়ো করলে তো। কাল থেকে পাড়ার মানুষকে নিয়েই সংসার করো। আমার সংসারে আর তোমার ভাত নেই।
কামাল বিছানায় শুয়ে রাগে গজগজ করছিলো। শাপলা কামালের পা ধরে বললো, তুমি আমার ওপর রাগ করো না, আমি তো কাউকে ডাকিনি, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আর তুমি অন্য মেয়ের কাছে যাবেই বা কেনো? আমার মধ্যে কী নেই। যে তুমি অন্য মেয়ের কাছে গিয়ে…
কামাল জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, কী নেই মানে? তোমার মধ্যে কী আছে যে তুমি আমাকে ধরে রাখবে?
কী নেই তুমিই বলো, তুমি আমাকে দেখে বিয়ে করোনি?
হ্যাঁ করেছি কিন্তু তুমি কি আর সেই তুমি আছো? তোমার চেহারাটা একবার আয়নায় দেখেছো?
আমার চেহারা আয়নায় দেখার দরকার নেই। আমি কারো সাথে লুকিয়ে প্রেম করি না যে আমার আরো সুন্দর হওয়ার দরকার আছে।
লুকিয়ে প্রেম করবে কী, তোমার কাছে কি আর দেয়ার কিছু আছে?
না নেই। আসলে শাপলার মধ্যে আর আকর্ষণ বলে কিছু নেই। অল্প বয়সে বিয়ে আর বিয়ের পর পর দু’টা বাচ্চা হওয়ার ফলে তার শরীরের ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে তাতে তার চোয়াল বসে গেছে, গলার হাড় বেরিয়ে গেছে, হাত-পায়ের গিট বেরিয়ে গেছে। শাড়ি-ব্লাউজ পরে সে যখন বাইরে বের হয় আর তার শাড়ির আঁচল যখন উড়ে তখন দেখে মনে হয় সেও বুঝি বাতাসের সঙ্গে উড়ে যাবে। এমনি ভাঙ্গা চেহারার তাল পাতার সেপাইয়ের শরীরে বা কী আকর্ষণ থাকতে পারে যা কামালের মতো নব্য টাকাওয়ালা পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়সের তরুণকে ধরে রাখবে?

তিন

একদিন সন্ধ্যায় শাপলা বাবার বাড়ি এলো। বাড়িতে ঢুকেই হাউ মাউ করে কান্না। বিয়ের পর সাবিনা তাকে বার বার করে বলে দিয়েছে, স্বামীর আদেশ নিষেধ মেনে চল্‌বি, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের সঙ্গে মিলে মিশে চল্‌বি।
শাপলা মা’র কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তাই স্বামীর শত অত্যাচার সহ্য করেও কোনোদিন মাকে কিছু বলেনি। সব অত্যাচার নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেছে। বাবার বাড়িতে এসেছে যখন ধৈর্য-সহ্য করার সব সীমা কামাল অতিক্রম করেছে তখন। শাপলা বাড়িতে ঢুকেই কাঁদতে কাঁদতে তার আসার কারণ বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু সাবিনা বললো, এখন থাক্‌ মা। আগে হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। তোর বাবা হাট গেছে, আগে আসুক তারপর বলিস্‌।
রাতে আতা হাট থেকে ফিরে শাপলাকে দেখে প্রথমে কিছু বললো না। তার ধারণা ছিলো হয়তো বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। শাপলাও কিছু বলেনি। রাতে খাবার পর সাবিনা প্রথম কথা তুললো।
সবকিছু শুনে আতা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো, শাপলার মা তাহলে এখন কী করা যায়?
সাবিনা কিছুটা রেগে গেলো, আমি কী করে বলবো, তুমি ছেলেমানুষ তোমার মতো কী আর আমরা বুঝবো?
আচ্ছা আমি কাল একবার মেম্বার সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে দেখি।
তাই দেখো।
সারারাত আতার চোখে ঘুম নেই। এই তো কয়েক বছর আগেও আতার অবস’া ভালোই ছিল কিন্তু সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে গিয়ে এক বিঘা জমি বেচতে হলো তারপর একে একে দু’মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে আরো কিছু জমি বেচে দিতে হলো। আবার সে নতুন করে সঞ্চয় করতে শুরু করেছে সবার ছোট মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। বিয়ে দেয়া মেয়ে যদি আবার ফিরে আসে তবে সে কীভাবে এতগুলো মুখে খাবার তুলে দিবে? শাপলা কাঁদতে কাঁদতে বলে কামাল নাকি ওকে তালাক দিতে চেয়েছে। সত্যি সত্যি যদি কামাল শাপলাকে তালাক দেয়…
না আতা আর ভাবতে পারে না। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
দবিরুল মেম্বার আতার কাছ থেকে সবকিছু শুনে বললো, তাহলে আগে পরিষদ থেকে কামালকে নোটিশ করি। নোটিশে উপসি’ত হলে একটা আপোষ বসার ব্যবস’া করি।
আতা বললো, মেম্বার সাহেব একটু তাড়াতাড়ি করেন। আপনি তো আমার অবস’া জানেন। একা মানুষের ইনকাম দিয়ে এতগুলো মুখে খোরাকি দিতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি। একটা জমি নষ্ট করে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম, আরেকটা বিক্রি করে মেজো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি এখন সেই বড় মেয়ে যদি আবার আমার বাড়িতে ফিরে আসে তবে আমি ওকে কীভাবে বিয়ে দিবো?
মেম্বার সাহেব আতাকে আশ্বস’ করলো, আতা তুমি তো এত তাড়াতাড়ি মেয়েকে নিয়ে বেশিই ভাবছো। সংসারে এরকম টুকটাক হতেই পারে তাই বলে তালাক দিবে নাকি? তালাক এতো সহজ! আমি আছি, প্রয়োজনবোধে চেয়ারম্যান সাহেবও আছে, তুমি দেখো আমরা সবাই মিলে একটা ব্যবস’া করে দিবো।
দবিরুল মেম্বার ভালো মানুষ। গ্রামের মানুষের যেকোনো বিপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার সমস্যাকে সে নিজের সমস্যা বলে মনে করে। তাই সে পর পর তিনবার মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে। কথায় কথায় এই গ্রামের মানুষ বলে, দবিরুল কম শিক্ষিত হতে পারে কিন্তু তার মতো মানুষ হয় না। শিক্ষিত মানুষরা কত ভালো হয় তা তো আজকাল সবাই নিজের চোখে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে। দলাদলি, দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতি, সন্ত্রাস সবকিছুর হোতাই যখন কোর্ট টাই পরা, সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষেরা তখন দবিরুলের মতো কম শিক্ষিত মানুষের সমাজে আজ বড়ই প্রয়োজন।
এই গ্রামের মানুষ তাকে আজীবন মেম্বার হিসেবে দেখতে চায়। কেউ কেউ চেয়ারম্যান দাঁড়ানোর কথাও বলে কিন্তু দবিরুল সাহস করতে পারে না। আজকাল ভোট করতে গেলে টাকার দরকার, আর সে টাকা দরিরুল পাবে কোথায়? চেয়ারম্যান হওয়া কী সোজা কথা। শুধু একটা গ্রাম না, একটা ইউনিয়নের মানুষের কাছে যেতে হবে ভোটের জন্য। দবিরুল এসব কিছু নিয়ে ভাবে না। সে ভাবে তার গ্রামের মানুষের কথা। গ্রামের মানুষ তাকে যতটুকু দায়িত্ব দিয়েছে সে তা পালন করবে অক্ষরে অক্ষরে। তার কথা, যতদিন আমি মেম্বার আছি ততদিন গ্রামের মানুষের পাশে থাকবো।
সে চেয়ারম্যানকে দিয়ে পরিষদ থেকে কামালের নামে নোটিশ পাঠালো। কিন্তু কামাল এলো না। কয়েক দিন পর খবর এলো কামাল সেই মেয়েকে বিয়ে করেছে।
দবিরুল মেম্বার কামালের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো।
সে আতাকে বললো, শোনো আতা আমি তো চেষ্টা করেছি। চেয়ারম্যান সাহেবকে দিয়ে নোটিশ পাঠিয়েছি। কিন্তু দেখো বেটার এতবড় সাহস প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছে। তুমি ওর দ্বিতীয় বিয়ের কাবিন নামা ম্যানেজ করো। তারপর উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা মামলা করে দাও। দেখবে বেটা কেমন সাইজ হয়ে যায়। আইনে আছে প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করলে শাস্তি নির্ঘাত জেল।
আতা খেটে খাওয়া মানুষ, তার বিচরণ লাঙ্গল-জোয়াল, ক্ষেত-খামার, কাজিপাড়ার হাট আর বিরলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে কোনোদিন কোর্ট কাচারির বারান্দায় পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করেনি। মেম্বারের পরামর্শে আর তার এলাকার এক মহুরির মাধ্যমে সে যখন দিনাজপুর কাচারিতে গিয়ে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ ফি আরো আনুষঙ্গিক খরচাদি মিলে প্রায় হাজার দু’য়েক টাকা খরচের হিসাব শুনলো তখন লুঙ্গির কোচ থেকে উকিলের ফি বাবদ পাঁচ’শ টাকা দিয়ে বললো, আচ্ছা উকিল সাহেব আমি যদি ক’দিন পর মামলা করতে চাই, পারবো না?
উকিল সাহেব কয়েক সেকেন্ড আতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটাই আপনাদের সমস্যা। শেষ পর্যন্ত এসে হাল ছেড়ে দেন। আমি তো বলছি এটা জেতা মামলা। ঐ বেটা কোর্টে হাজিরা দিলে জামিন পাবে না আর হাজিরা না দিলে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে, পুলিশ যখন হাজতে নিয়ে যাবে তখন ঠিকই তোমার মেয়েকে নিয়ে যাবে।
আতা আমতা আমতা করে বললো, তখন যদি ক্ষেপে গিয়ে আমার মেয়েকে তালাক দেয়?
তালাক দিলে দেনমোহর দিবে, খোরপোষ দিবে।
আতা কয়েক মুহূর্ত মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় তখন নানান কথা বিড়বিড় করছে, শেষ পর্যন্ত মেয়েকে কোর্টে তুলবো? মানুষ কী বলবে? আতা শেষ পর্যন্ত টাকার জন্য মেয়েকে কোর্টে তুললো? জামাইকে যখন পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে তখন সবাই কী বলবে? আতার জামাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো? তাহলে আর তার মান-সম্মান থাকলো কোথায়?
উকিলের পরামর্শ মতো মামলা করলে জামাই’র যদি জেল হয় তারপর মেয়ের কী হবে? জেল থেকে বের হয়ে সে কি আবার আমার মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে? কোর্ট-কাচারিতে মামলা-মোকদ্দমা করে আবার তার সঙ্গে মেয়েটা আমার সংসার করবে কী করে? এমনি সহস্র চিন্তা আতার মাথায় ভিড় করছে।
আতাকে চুপ করে থাকতে দেখে উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছেন?
আতা মিন মিন করে বললো, আচ্ছা উকিল সাহেব মামলাটা পরে করা যাবে না?
উকিল সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, হ্যাঁ যাবে।
তাহলে আজ আমি যাই। আগে মেয়েটার সঙ্গে একবার পরামর্শ করি।
আচ্ছা।
আতা বাড়ি ফিরলো বিকেলে।
শাপলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উঠানে একটা পাটি বিছিয়ে দিয়ে আতাকে পাখার বাতাস করতে লাগলো। সাবিনা সামনে খাবার এনে দিলো।
আতা টিউবওয়েল থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো। কিন্তু সে খেতে পারছে না। পেটে খিদে আছে কিন্তু মুখে রুচি নেই। শাপলা তার বাবাকে ভাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল আতা বাধা দিয়ে বললো, না রে মা। থাক আর খাবো না।
শাপলা জিজ্ঞেস করলো, কেনো বাবা? দুপুরের খাবার বিকেল হয়ে গেছে তবুও খেতে পারছো না?
আতা কোনো কথা বললো না। এতক্ষণ শাপলার ছেলেটা ঘুমাচ্ছিল, ঘুম থেকে জেগে সে কান্না করতেই শাপলা ভিতরে চলে গেলো। ছোট্ট বাবুটিকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাবিনা পাটি থেকে থালা বাটি সরিয়ে নিতেই শাপলা তার বাবার পাশে বসলো। শাপলার মেয়ে এক পা, দু’পা করে হাঁটতে হাঁটতে আতার কোলে এসে বসলো।
শাপলা কয়েক মুহূর্ত আতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, বাবা।
আতা যেভাবে ছিলো সেভাবেই বললো, বল্‌।
কী হলো বাবা?
আতা কী বলবে মেয়েকে, উকিল সাহেবের কথা কীভাবে শাপলার কাছে উপস’াপন করবে তা নিয়ে ভাবছিলো। শাপলা আতার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে একটু অসি’রই হলো, কী হলো বাবা? তুমি কিছু বলছো না কেনো?
কী বলবো রে মা।
উকিল সাহেব কী বললো?
উকিল সাহেব আর কী বলবে, কেইস করতে বললো।
শাপলা চমকে উঠলো, বাবা কেইস করলে কি বাবুর আব্বাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে?
আতা শাপলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাপলা তার স্বামীকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা অনুমান করেই আঁতকে উঠেছে সত্যি সত্যি পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে তার মনের অবস’া কী হবে ভেবে আতা আর মুখের ওপর আরো শক্ত কথাটা বলতে পারলো না, সে মাথা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে জানালো পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।
শাপলা আবেগে আল্পুত হয়ে আতার দু’হাত জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, বাবা, আমি বাবুর আব্বার নামে কেইস করবো না, বাবুর আব্বাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে এটা আমি দেখতে পারবো না, বাবা।
আতা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
শাপলা আবার বলতে শুরু করলো, আমি এখানেও থাকবো না বাবা, কাল আমি বাড়ি যাবো।
ততক্ষণে আতার দু’চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে, তোকে যদি বাড়িতে ঢুকতে না দেয়?
দিবে। আমি বাবুর আব্বাকে চিনি, আমি আমার দু’বাচ্চাকে নিয়ে গেলে ও আমাকে বাড়িতে ঢুকাবে।
সাবিনা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপ-মেয়ের কথা শুনছিলো আর আঁচলে চোখ মুছছিলো। এবার রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, সতীনের সঙ্গে সংসার কর্‌বি?
শাপলা মুখে কিছু বললো না। মাথা উঁচু-নিচু করে জানালো, সে সতীনের সঙ্গেই সংসার করবে।
বয়স কম হলেও বিয়ের জন্য ঘরে আটকে রাখা কিশোরী মেয়েটি সতীন এবং সতীনের সঙ্গে সংসার করার অর্থ বুঝে আর এতো সব ঝামেলা যে শাপলার ছোটবেলা বিয়ে হওয়ার কারণে তাও সে জানে। তাই সে যেকোনোভাবে এই বাল্য বিবাহের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে।

চার

এলোমেলো পা ফেলে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঘরে ঢুকলো মিশু। গায়ের রং ফ্যাকাসে, রোগা রোগা, হাত দু’টো ধরতেই যেন মেয়েটি ভয় পেলো। কখন জানি ভেঙ্গে যায়। সে খুব সাবধানে মিশুকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিলো, কী রে মিশু, কেমন আছিস্‌?
মিশু কিছু বুঝতে পারলো না। সে মেয়েটির কোলে চড়ে তার চোখ-মুখ আঙ্গুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে মা মা বলে ডাকতে শুরু করলো।
মিশুর মুখে মা মা ডাক শুনে মেয়েটির দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো, সে রুদ্ধ কণ্ঠে মিশুকে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে মা মা বলে ডাকছিস্‌ কেনো? আমি তো তোর মা না। কে তোকে আমাকে মা ডাকতে শিখিয়েছে রে? কে শিখিয়েছে আমাকে বল্‌ তো?
মিশু অবোধ শিশু এখনো মাকে চিনে না। তার কাছে শুধু মা ডাকটাই পরিচিত। যে জন্মের সময় মাকে হারিয়েছে সে তার মাকে চিনবে কী করে?
মিশু। এই নিষ্পাপ শিশুটির মায়ের নাম নূরী। বিয়ের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ মেয়েটির মেজো বোন নূরী। শুধু নামেই নূরী নয় সৌন্দর্যের দিক থেকেও সে নূরীর মতোই ছিলো। নূরীর মুখের গড়ন তার মায়ের মতো সুন্দর আর গায়ের রং বাবার মতো। বাবার গায়ের রংটাও ফর্সা, খুব ফর্সা হওয়ার কারণে তার বাবাকে কিছুটা ফ্যাকাসে দেখাতো। নূরীও খুব ফর্সা কিন্তু তাকে রোগা রোগা দেখাতো না। তার গায়ের রংয়ের ওপর একটু আলতা মিশানো তাই গায়ের রংটাও দুধে-আলতা। ঠোঁট দু’টো লাল, না নূরীর ঠোঁটে কোনো কসমেটিক ছিলো না, গরীব মানুষ, যাদের ভাত খাওয়ার টাকার অভাব তাদের ঠোঁটে লিপস্টিক পরার সামর্থ্য কোথায়? তারপরও দেখলে মনে হতো ঠোঁটে লিপস্টিক পরানো আছে। হাল্কা গরমে নূরী যখন সামান্য ঘেমে যেতো তখন তাকে আরো সুন্দর দেখাতো। নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম সঞ্চারিত হতো। আর নাকের ওপর এই বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে নূরীর দূরসম্পর্কের এক দাদি বলতো, নাক ঘামা কন্যা স্বামী সোহাগী হয়। স্বামী খুব আদর করে।
নূরী তখন কিছু বুঝতো না, শুধু স্বামী তাকে আদর করবে শুনে বুঝে কিংবা না বুঝে হাসতো।
সেই দাদির কথাই সত্যি হলো। খুব অল্প বয়সে নূরীর বিয়ের সম্পর্ক আসতে শুরু করলো। অনেক ভালো ভালো সম্পর্ক। গৃহস’, ব্যবসায়ী, এমন কী সরকারি চাকরিজীবীও। তার বিয়ের জন্য যেসব সম্পর্ক আসতো তাদের বেশিরভাগেরই চাওয়া সুন্দর বউ। আর বেশির ভাগ পাত্রের গায়ের রং কালো। বিয়ের ব্যাপারে নূরীর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, পছন্দ-অপছন্দ নেই। বাবা-মা তাকে যার হাতে তুলে দিবে সে তার ঘরেই চলে যাবে। তবে কোনো কালো পাত্রের কথা শুনলে তার ফর্সা মুখের ওপর একটা গাঢ় কালো মেঘের ছায়া পড়তো। তাতে তো গার্জিয়ানদের কিছু যায় আসে না। বিয়ের বর পছন্দের বেলায় গার্জিয়ানরা বলে এখনো যে মেয়ের দুধ দাঁতই ওঠে নি বিয়ের ব্যাপারে তার পছন্দ-অপছন্দে কী যায় আসে। আবার বিয়ের বেলায় তারা যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবেন ততই মঙ্গল। নূরী যেন সবার ঘাড়ের ওপর বোঝা হয়ে ছিলো।
অবশেষে নূরীর বিয়ে ঠিক হলো। গার্জিয়ানদের দৃষ্টিতে নূরীকে বিয়ে করার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা এবং সামর্থ্য তাদের আছে কিন্তু দোষের মধ্যে পাত্রের বয়সটাই একটু বেশি। কত আর হবে? সাতাশ কিংবা আটাশ। আর মেয়ের বয়স? বারো তেরো বছরের বেশি হবে না। তাতে কী। কনের চেয়ে বরের বয়স বেশি হবে এটাই সমাজের নিয়ম! কত বেশি হবে তার কোনো নিয়ম নেই। নূরীর অনেক আত্মীয় আছে যাদের স্বামী-স্ত্রীর বয়সের তফাৎ অনেক। তারাও তো দিব্যি সংসার করছে। সন্তানাদিও আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মহব্বতও আছে।
নূরীর বিয়ে হলো। পর পর দু’টো মেয়ের বিয়ে দিয়ে আতা একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললো।
নূরীর শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস’া ভালো। কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় শ্বশুর মারা গেছেন, একই দুর্ঘটনায় শাশুড়িও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। শুধু পঙ্গুত্ব না, আরো দুরারোগ্য রোগ-ব্যধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। বাংলাদেশ এমনকি ভারতে পর্যন্ত বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও তাকে আরোগ্য করা সম্ভব হয়নি। তার শাশুড়ির ইচ্ছায় মুকুলের বিয়েকে আরো ত্বরান্বিত করেছে আর সেই শাশুড়ির একান্ত ইচ্ছা মৃত্যুর আগে নাতি-নাতনির মুখ দেখে যাওয়া।
কয়েক মাস পর অন্ত:স্বত্তা নূরী এলো বাবার বাড়ি। অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে নূরীর ডানাকাটা পরীর মতো সুন্দর চেহারা ততদিনে ভেঙ্গে গেছে। গায়ের ফর্সা রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, গলার হাড় বেরিয়ে গেছে। মেয়ের এই রুগ্ন চেহারা দেখেও সাবিনার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যেন সন্তান ধারণের সময় মেয়েদের চেহারা একটু-আধটু শুকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। দিনে দিনে নূরীর স্বাসে’্যর অনেক অবনতি হলো। ডেলিভারির ক’দিন আগে থেকে ডাক্তার ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল, বাসায় সেরকম প্রস’তিও নেয়া হচ্ছিল কিন্তু প্রস’তি নিয়ে ক্লিনিকে যাওয়ার আগেই একদিন গভীর রাতে নূরীর প্রসব বেদনা শুরু হলো। রাতেই নিয়ে যাওয়া হলো ক্লিনিকে। রাতেই ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, আলট্রাসনোগ্রাম করা হলো। ডাক্তার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো, পেশেন্টের অবস’া ভালো না। রাতেই অপারেশন করতে হবে।
রাতেই অপারেশন হলো। অনেকক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। মুকুল এগিয়ে গেলো। সিস্টার মুকুলকে জিজ্ঞেস করলো, পেশেন্ট আপনার কে হয়?
আমার স্ত্রী।
সিস্টার বললো, আপনি বাবা হয়েছেন।
মুকুল সিস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সিস্টার বললো, আপনার মেয়ে হয়েছে।
প্রথম সন্তান মেয়ে কিংবা ছেলে নিয়ে মুকুলের কোনো প্রশ্ন নেই। তার মায়েরও নেই। বাবা হয়েছে শুনেই সে যথেষ্ট খুশি হয়েছে। আতা এবং সাবিনাও নানা-নানি হওয়ার খবর শুনে খুশি হলো। কিন্তু দু’জনে তখনো তাকিয়ে আছে সিস্টারের মুখের দিকে, সিস্টার আবার বলতে শুরু করলো, কিন্তু ব্যাপারটা এমন ছিলো যে মা এবং মেয়ে দুজনকে বাঁচানো আমাদের জন্য কঠিন ছিলো, শেষ পর্যন্ত পেশেন্টকে বাঁচানো সম্ভব হলো না।
আতা এবং সাবিনার নানা-নানি হওয়ার আনন্দ মুহূর্তে হারিয়ে গেলো। আতা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সাবিনা হাউ-মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
আজ মিশুকে কোলে নিয়ে কিশোরী মেয়েটির মনের মধ্যে নূরীর ছবি ভেসে উঠলো। পিঠাপিঠি করে দু’জনে মানুষ হয়েছে। নূরীর সঙ্গে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অথচ শুধু কম বয়সে বিয়ে দিয়ে তার জীবনটা যেন অকালে ঝরে গেলো। এবার শুরু হয়েছে তারও অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার আয়োজন। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে মেয়েটির গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
এমন সময় সাবিনা ঘরে ঢুকলো। সাবিনা মেয়ের চোখে পানি দেখে বললো, কীরে কাঁদছিস্‌ কেনো?
মেয়েটি তখনো মিশুকে কোলে নিয়েই ছিলো এবার মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে চৌকির ওপর বসিয়ে দিয়ে ওড়নায় চোখ মুছলো কিন্তু কোনো কথা বললো না।
সাবিনা আবার জিজ্ঞেস করলো, কী হলো? কিছু বলছিস্‌ না যে?
আমি আরো লেখাপড়া করবো মা।
সাবিনা প্রচণ্ড রেগে গেলো, লেখাপড়া করে কী কর্‌বি? লেখাপড়া শিখলে তখন তোকে ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। আর ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে তো অনেক টাকা ডিমান্ডও দিতে হবে। তখন কে টাকা দিবে, বল্‌?
মেয়েটি কথাটা বলেই যেন অপরাধী সেজেছে। মা’র এতগুলো কথার সে কী জবাব দিবে ভেবে পেলো না। সে মাথা নত করে আঙ্গুল দিয়ে মেঝের মাটি আঁচড়াতে লাগলো।
সাবিনা ধমকের সুরে বললো, কোনো আজেবাজে চিন্তা কর্‌বি না। কোনো বন্ধু-বান্ধবীর কথা শুন্‌বি না। যেদিন থেকে তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়েছে সেদিন থেকেই দেখছি তোর মতি-গতি আরো পাল্টে গেছে। তুই মা হলে বুঝতিস্‌, যতক্ষণ তুই স্কুলে থাকিস্‌ ততক্ষণ আমার মনটা যেন আটকে থাকে। সবসময় মনটা আতঙ্কে থাকে, মোড়ের ছেলেরা যদি কোনো অঘটন ঘটায়, যদি কোনো দুর্নাম রটায় তবে আর রক্ষা নেই। আমরা গরীব মানুষ, তোর যদি কোনো একটা দুর্নাম হয়ে যায় তবে আমরা কি আর তোকে বিয়ে দিতে পারবো?
এবার সে একটু সাহসী হলো, আমাকে বিয়ে দিতে হবে না মা। আমি লেখাপড়া করে অনেক বড় হবো, অনেক বড় চাকরি করবো তখন দেখবে আমাকে বিয়ে দিতে আর ডিমান্ড দিতে হবে না।
কত দেখলাম। বি.এ, এম.এ পাস করা কত মেয়েকেও অনেক টাকা ডিমান্ড দিয়ে বিয়ে দিতে হচ্ছে। তারচেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। তুই আর কোনো কথা বল্‌বি না। বাড়ি থেকে বের হবি না। কাল তোর বাবা বাড়ি আসার সময় দেখেছে ওরা এখনো মোড়েই আড্ডা দেয়।
তাতে কী মা, মোড়ে আড্ডা দিলেই বা অসুবিধা কী। কীভাবে এইসব বখাটেদের প্রতিরোধ করতে হয় তা আমরা ব্র্যাক স্কুলে থাকতেই শিখেছি আর এখন তো আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমি এখন অনেক বড় হয়েছি।
থাক্‌, তোকে আর কোনো কথা বলতে হবে না। প্রতিরোধ-টতিরোধ তোকে করতে হবে না। তোর বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোকে বিয়ে দিবে। এটাই শেষ।
মেয়েটি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আবদারের সুরে বললো, মা তুমি বাবাকে একটু বোঝাও না, প্লিজ।
আমি বুঝাতে যাবো তোর বাবাকে!
হ্যাঁ। তুমিই তো বোঝাবে। মা তোমাকে একটা কথা বলি।
সাবিনা রাগান্বিত চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মা তুমি একবার ভেবে দেখো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছো দেখে শাপলা আপা কেমন অল্প বয়সে বুড়ির মতো হয়ে গেছে আর সেজন্যই তো দুলাভাই আরেকটা বিয়ে করেছে।
করেছে তো কী হয়েছে? দেখ তবু আমার মেয়ে সংসার করছে তো। তালাক তো আর দেয়নি। ছেলেমানুষ দু’টা বউকে যদি খাওয়াতে পারে, পরাতে পারে তো বিয়ে করবে। অসুবিধা কী।
মা তুমি মিশুর দিকে তাকাও। নূরীকে তোমরা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলে দেখে…সে আর কথা বলতে পারলো না তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
চুপ তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে, যা বুঝিস্‌ না তা নিয়ে কথা বল্‌বি না। দে মিশুকে আমাকে দে। শোন্‌ তোর বাবা বলেছে তুই যেন আমাকে না বলে ঘর থেকে বের না হোস্‌।
সে আর কোনো কথা বললো না।

পাঁচ

মেয়েটির নাম পরী। আতা আর সাবিনার তৃতীয় মেয়ে। একটা পুত্র সন্তানের আশায় আশায় তাদের ঘরে একে একে তিনটি মেয়ে এসেছে। সবার ছোট মেয়ে পরী। তার ওপর অবহেলা আর বঞ্চনার মাত্রাটাও ছিলো ক্রমাগত বেশি। প্রথম মেয়ে হিসেবে শাপলা একটু আদর যত্ন পেয়েছিলো, নূরীর বেলায় একটু কমেছিলো আবার পরীর বেলায় আদর যত্ন বলে কিছু ছিলো না। সে ছিলো তাদের অনেক আকাঙ্ক্ষার একটা পুত্র সন্তানের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া ফসল। বাবা-মা তাকে খুব কমই আদর করেছে। পরী যেটুকু লেখাপড়া শিখেছে তা নিজে থেকেই।
পাড়ার একাংশে ব্রাকের একটা স্কুল আছে। স্কুলের নাম চাঁদের হাট প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়। নামে চাঁদের হাট কিন্তু কোনো চাঁদ নেই, তারকাও নেই। আছে শুধু ঝরে পড়া উল্কা। স্কুল যাওয়ার বয়স পেরিয়ে যাওয়া এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরী। কিশোর তেমন নেই, বেশিরভাগই কিশোরী। এই এলাকায়, না শুধু এই এলাকায় না, সারাদেশেই বেশিরভাগ বাবা মা’ই সন্তান জন্মদানের পর পুত্র সন্তান এবং কন্যা সন্তানের জন্য আলাদা আলাদা স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেন। ছেলে হলে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার বানানোর, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর কিংবা বড় কোনো অফিসার বানানোর আর কন্যা সন্তান হলে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন একজন ভালো ছেলের কাছে, সুপাত্রের কাছে দায়িত্ব ন্যস্ত করে দায় শোধ করানোর। সেভাবেই গড়ে তোলা হয় জন্মের পর থেকে।
পুত্র সন্তানের জন্য বেছে বেছে মাছের মাথা, গাইয়ের দুধ, খাসির কলিজা প্লেটে তুলে দেন আর কন্যা সন্তানের জন্য রাখেন অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টির খাবার। পুত্র সন্তানের জন্য খোঁজা হয় ভালো মানের স্কুল, কিন্ডার গার্টেন ইত্যাদি আর পুষ্টি মানহীন খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠা কন্যা সন্তানকে গড়ে তোলা হয় বিয়ের জন্য। আর এই ভগ্ন স্বাস’্য, দুর্বল মেধার কিশোরীরাই চাঁদের হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী।
বেশির ভাগ ছাত্রীর লাবণ্যহীন মুখ, উসকোখুসকো চুল, চেহারায় দারিদ্রের ছাপ। গায়ে ইউনিফর্ম নেই, নেই কোনো ভালো জামা কাপড়। কিন্তু চোখে আছে এক রাশ স্বপ্ন। বেশিরভাগ মেয়ের বাবা-মা’ই তাদের লেখাপড়ার কোনো খোঁজখবর রাখে না। নিজেদের চেষ্টাই বড় হওয়ার অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে চলছে এইসব মেয়েরা।
শিক্ষিকার নাম ময়মুনা। ময়মুনা নিজেও তাদের মতো, ব্র্যাক স্কুলের অনেক শিক্ষিকাই সমাজ-সংসারে অবহেলা কিংবা বঞ্চনার শিকার হয়ে লেখাপড়ার কোনো এক ধাপে ঝরে পড়ার পর সংসারে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দূরে গিয়ে, কোনো ভালো চাকরি করার সুযোগ না পাওয়ায় একরকম বাধ্য হয়ে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করছে। তাই শিক্ষিকা যখন ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে পড়ায় তখন এই সব মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে সেও তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে, তার অতীতের স্মৃতিগুলো তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেও তাদের লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হয়। ছাত্রীদের বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।
কৌতূহলবশত: পরী মাঝে মাঝে স্কুলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তার ইচ্ছা সে এই স্কুলে ভর্তি হবে কিন্তু সে এটাও জানে বাবা-মা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিবে না। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন সাহস করে দরজার কাছে গিয়ে চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আজ যখন সে দরজায় এসে দাঁড়ালো তখন ময়মুনা নিজেই তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তুমি স্কুলে পড়বে?
পরী কী বলবে বুঝতে পারলো না। তার শুধু মনে হলো সেও একদিন এই স্কুলে লেখাপড়া করা মেয়েদের মতো স্কুলে আসবে, সবার সাথে বসে লেখাপড়া করবে। অনেক আনন্দ হবে। আনন্দ আর গর্বে পরীর দু’চোখে পানি এসে গেলো। সে মুখে কিছু বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো, সে মাথা উঁচু-নিচু করে সায় দিলো।
ময়মুনা বললো, তাহলে কাল থেকে স্কুলে এসো।
পরী ময়মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ময়মুনা জিজ্ঞেস করলো, আসবে না?
সে আবার মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো, আপা বই লাগবে না?
হ্যাঁ লাগবে তো।
পরী মিনমিন করে বললো, বাবা তো আমাকে বই কিনে দিবে না।
তোমার বাবাকে দিতে হবে না। আমি তোমাকে বই দিবো।
আর খাতা?
সব দিবো, আমি তোমাকে বই, খাতা সবকিছু দিবো। তুমি শুধু স্কুলে এসো।
পরী মাথা কাত করে জানালো সে কাল থেকে স্কুলে আসবে।

পরদিন থেকে শুরু হলো পরীর স্কুলে যাওয়া। এই স্কুলের নিয়ম-কানুন কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। ক্লাসে কোনো চেয়ার টেবিল নেই। শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের দল তৈরি করে চটের ওপর বসেছে। ক্লাসে কোনো ব্লাক বোর্ড বা হোয়াইট বোর্ড নেই। এই পাঁচ জনের দলের কাছে গিয়ে শিক্ষিকা পড়া দেখিয়ে দেয়। তারা সেভাবে তাদের পড়া তৈরি করে, কেউ বুঝতে না পারলে দলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে শিখিয়ে দেয়। স্কুলে শিক্ষা উপকরণ আছে, লেখাপড়ায় কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো একঘেয়েমি নেই। শিক্ষা উপকরণ নিয়ে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার মতো আনন্দের মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে। এছাড়া তাদের উপায়ও নেই।
প্রায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বাবা-মা’ই তো তাদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী নয় তারওপর স্কুলে ক্লাস শেষ করে যদি বই নিয়ে বাড়ি গিয়ে পড়া প্রস’ত করে নিয়ে আসতে চায় তবে তা হয়তো কোনোদিনই হবে না। তাই ক্লাসের পড়া ক্লাসেই তৈরি করে নেয়া। এ যেন শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষা নয়, বাস্তবমুখী, কর্মমুখী, জীবনমুখী, প্রতিকূল অবস’ায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শিক্ষা।
ময়মুনা পরীকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিলো। পরিচয় করে দেয়ার পন’াটাও একটু ভিন্ন। ময়মুনা তার কাছে পরীকে ডেকে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, তোমরা সবাই শোনো।
সবাই ময়মুনার প্রতি মনোযোগী হলো। আমাদের স্কুলে আজ একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে, ওর নাম বলে ময়মুনা পরীকে বললো, বলো তোমার নাম বলো, বলো আমার নাম…
পরী বললো, আমার নাম পরী।
পরী কোন দলের সাথে পড়বে বলে সে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর একে একে সব দলের নাম ধরে ডাক দিলো, শিউলি…তোমাদের দলে কজন আছো?
দলনেতা বললো, আপা পাঁচজন।
এভাবে পর পর কয়েকটি দলের নাম বলার শেষে জিজ্ঞেস করলো, বেলি তোমরা কজন আছো?
দলনেতা বললো, আপা চারজন।
ময়মুনা বললো, তাহলে পরী বেলি দলের সঙ্গে পড়বে।
বেলি দলের ছাত্রীরা একসঙ্গে বললো, বন্ধু তোমাকে আমাদের দলে স্বাগতম। তারপর দলনেতা এসে পরীকে তাদের দলের কাছে নিয়ে গেলো।
ময়মুনা বললো, এখন তোমরা বসো, নিজ নিজ পড়া শুরু করো।
শৈশবে প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যেতো পরী তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতো, তারও স্কুল যেতে ইচ্ছা করতো একদিন তার মাকে বলেছিলো কিন্তু কথাটা শুনেই সাবিনা একরকম খিঁচিয়ে উঠেছিলো, স্কুল গেলে বই লাগবে না?
লাগবে না মা।
খাতা?
খাতার কথা বলতে পরী একটা ঢোক গিললো। তারপর মিনমিন করে বললো, বাবা দিবে।
সাবিনা আরো প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলো, তোর বাবা দিবে, না? ভাতের টাকা যোগাড় করতেই তোর বাবা হিমশিম খাচ্ছে তারওপর আবার তোর স্কুলের টাকা।
মাকে আর সে তার পড়ার বিষয় কিছু বলেনি, বাবাকেও বলেনি। সে প্রতিদিন তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের স্কুল যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো, তারপর ব্র্যাক স্কুলের দরজায়। আজ সে ব্র্যাক স্কুলের ভেতরে।
ময়মুনা পরীর হাতে কয়েকটা বই এনে তাকে বইয়ের সাথে পরিচয় করে দিলো। কোন খাতায় কোন লেখা লিখতে হবে শিখিয়ে দিলো। পরী মুখে কিছু বলতে পারলো না। তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আনন্দে সে যেন বোবা হয়ে গেলো।
ময়মুনা পরীর মনের অবস’া বুঝতে পেরে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখও পানিতে ভিজে গেলো।

ছয়

পরীর আজও মনে আছে। একদিন তাদের স্কুলের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে জানালায় উঁকি মেরে বাইরের দিকে তাকালো। পরীও মাথা উঁচু করতেই তার চোখ জুড়িয়ে গেলো। কী সুন্দর ঝক্‌ঝকে, তক্‌তকে একটা গাড়ি, সেই গাড়ি থেকে এক ভদ্র মহিলা নামলো। পরী কয়েক মুহূর্ত মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরীর মনে হলো এত সুন্দর, স্মার্ট মহিলা সে আগে কখনো দেখেনি, ইসস্‌ সে যদি এত বড় হতে পারতো।
ময়মুনা সবাইকে তাদের নিজ নিজ দলের সাথে বসে পড়ায় মনোযোগী হতে বললো।
ভদ্র মহিলা তাদের ক্লাসে ঢুকলো।
ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম আপা।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছো তোমরা সবাই?
সবাই উত্তর দিলো, ভালো আপা। আপনি কেমন আছেন?
ভালো। তোমাদের লেখাপড়া কেমন চলছে?
ভালো।
ময়মুনা সবার উদ্দেশ্যে বললো, তোমাদের আজকের ভাবনা কী?
সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।
ময়মুনা একটা মেয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, শাকিলা তুমি বলো?
শাকিলা বললো, আমাদের আজকের ভাবনা, মিথ্যা কথা বলবো না।
ভদ্র মহিলা ময়মুনাকে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবনা থাকে?
জি আপা।
বাহ্‌ খুব ভালো তো।
ময়মুনা বললো, তোমরা সবাই বসো।
আবার সবাই তাদের দল অনুযায়ী বসলো। তারপর ময়মুনা তাদের সবার পরিচয় দিতে বললো। ভদ্র মহিলা ময়মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আগে আমার পরিচয় দিই, বলে সে নিজের পরিচয় দিলো, আমি কাঁকন, তোমাদের বোন।
একটা মেয়ে খিক্‌খিক্‌ করে হেসে উঠলো।
কাঁকন জিজ্ঞেস করলো, এই কে হাসলে?
যে মেয়েটি হেসেছিলো সে ভয় পেয়ে চুপ করে রইলো।
কাঁকন আশ্বস’ করলো, ভয় নেই, আমি তো বলেছি আমি তোমাদের বোন, বোনকে আবার ভয় করে।
এবার মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে মুখে তবুও একটা আশঙ্কার ছাপ আছে। সে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছে।
কাঁকন জিজ্ঞেস করলো, তুমি হাসলে কেনো বলোতো? কোনো ভয় নেই।
ময়মুনা অভয় দিলো, বলো, বলো।
এবার মেয়েটি বলতে শুরু করলো। আপা আমার একটা ভাই আছে দোকানে দোকানে কাজ করে খায়, আরেকটা বোন আছে মানুষের বাড়ি বাড়ি বুয়ার কাজ করে। আর আপনি তো হইলেন কত বড় মানুষ, আপনি কীভাবে আমাদের…
ও তাই হাসছো? আমি তোমাদের বোন হতে পারি না?
তোমার ভাইবোনরা আমার মতো হতে পারেনি কারণ তারা লেখাপড়া করেনি, হয়তো করতে চেয়েছিলো কিন্তু বাবা-মা লেখাপড়া শেখাতে পারেনি কিংবা বাবা-মা’র সে সামর্থ্যও ছিলো না। তোমাদের বড় বোনদের দিকে তাকিয়ে, আমাকে দেখে তোমরা লেখাপড়া করো দেখবে তোমরা একদিন সত্যি সত্যি অনেক বড় হবে। তোমরা আমার চেয়ে অনেক বড় হবে।
মুহূর্তে ক্লাসের পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। কয়েক মিনিট পর কাঁকন আবার তাদের পরিচয় দিতে বললো। শুধু পরিচয় না, সেই সাথে যোগ হলো লেখাপড়া শিখে তারা ভবিষ্যতে কে কী হতে চায়।
একে একে সবাই তাদের নাম, পরিচয় এবং কে কী হতে চায় তা বলতে শুরু করলো।
আমি মহুয়া, আমি বড় হয়ে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হতে চাই।
কাঁকন বললো, বাহ্‌, খুব ভালো, সবাই তোমাদের বন্ধু মহুয়াকে হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানাও। সে একদিন শিক্ষক হবে, মানে দেশ গড়ার, সমাজ গড়ার কারিগর হবে।
সবাই হাত তালি দিয়ে মহুয়াকে অভিনন্দন জানালো।
ছাত্রীদের মধ্যে থেকে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করার মেয়ে বের হলো। তাদের অনেকের আকাঙ্ক্ষা আছে কিন্তু আকাঙ্ক্ষা পূরণের সামর্থ্য নেই। তারা কেবল চারাগাছ, তাদের লালন-পালন করে একদিন পরিপূর্ণ এক বৃক্ষে পরিণত করতে হবে। তারপর তারা একদিন এই সমাজে ফুল দিবে, ফল দিবে।
আমি মনিরা, আমি বড় হয়ে…বলে সে ডানে-বাঁয়ে তাকালো।
তার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বললো, বলো।
কাঁকন অভয় দিলো, বলো।
আমি বড় হয়ে পুলিশ হবো।
কাঁকন বললো, সবাই হাত তালি দিয়ে তোমাদের পুলিশ বন্ধুকে অভিনন্দন জানাও।
সবাই হাত তালি দিলো কিন্তু ফেন্সি চুপ করে রইলো।
হাত তালি থামলে কাঁকন ফেন্সিকে জিজ্ঞেস করলো, এই মেয়ে তোমার নাম কী যেন?
ফেন্সি সাহসী মেয়ে, সে ভয় পেলো না। বললো, আমার নাম ফেন্সি।
মনিরা বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হবে এটা তুমি চাও না?
ফেন্সি না সূচক মাথা নাড়লো।
কাঁকন জিজ্ঞেস করলো, কেনো?
পুলিশ খালি মানুষকে মারে। আমাদের মহল্লায় একদিন মারামারি হয়েছিলো, আমার ভাইয়া সেদিন মহল্লায় ছিলো না। ও রিক্‌শা নিয়ে শহরে গেছিলো তারপরও পরদিন পুলিশ এসে ওকে থানায় ধরে নিয়ে গেলো। তারপর রাতে নাকি ওরা ভাইয়াকে খুব মেরেছিলো। পরদিন বাবা ভাইয়ার রিক্‌শাটা বেচে পুলিশকে টাকা দিয়ে ভাইয়াকে ছাড়িয়ে এনেছিলো। তখন থেকে ভাইয়া আর রিক্‌শা কিনতে পারেনি। বলতে বলতে ফেন্সির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে একটা থমথমে অবস’া বিরাজ করলো।
কাঁকন বললো, সব পুলিশই ওরকম না। সব মানুষের মধ্যে যেমন ভালো মানুষ মন্দ মানুষ আছে, পুলিশের মধ্যেও তেমনি ভালো পুলিশ দুষ্টু পুলিশ আছে। মনিরা খুব ভালো পুলিশ হবে। পুলিশ জনগণের বন্ধু, মনিরা ঠিকই জনগণের বন্ধু হবে। বলে কাঁকন মনিরার দিকে তাকালো, কি মনিরা হবে না?
মনিরা মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এবার তাহলে হাত তালি দাও।
আবার সবার সাথে মনিরা হাত তালি দিলো।
এবার পরীর পরিচয় দেয়ার পালা এলো।
আমি পরী, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো।
বরাবরের মতো কাঁকন সবার উদ্দেশ্যে বললো, তোমাদের ডাক্তার বন্ধুকে হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানাও।
সবাই হাত তালি দিলো।
কাঁকন জিজ্ঞেস করলো, তুমি ডাক্তার হয়ে কী করবে?
আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো।
কাঁকন বললো, গুড।

সাত

এতদিন সাবিনা মনে করতো বিয়ে নিয়ে পরীর কোনো ইচ্ছা বা অনিচ্ছা নেই। শাপলা আর নূরীকে যেমন তারা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছে পরীকে তেমন করে বিয়ে দিবে। তারা দু’জনে যেমন বাবা-মা’র পছন্দ অপছন্দের ওপর কোনো কথা বলেনি তেমনি পরীও তাদের পছন্দ করা পাত্রের সাথেই বিয়েতে বসবে কিন্তু আজ পরী যখন সাবিনাকে তার ইচ্ছার কথা জানালো তখন সাবিনা তার বাসা থেকে বের হওয়া, তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দিলো।
মঙ্গলপুর থেকে পরীর বিয়ের একটা সম্বন্ধ এসেছে। পাত্র দেখতে শুনতে ভালো। বিঘা পাঁচেক জমি আছে, সারা বছর ঘরের ভাত খায়, মঙ্গলপুর বাজারে একটা দোকান আছে। সেই দোকানের আয় দিয়ে সংসারের আনুষঙ্গিক খরচাদি ছাড়াও প্রতি বছর আগের জমির সাথে আরো জমি যোগ হতেই চলছে। উঠতি টাকাওয়ালা বলা যায়। কথায় বলে নিম্নগামী রাজার চেয়ে উর্দ্ধগামী প্রজাও ভালো।
বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হলো। আগামী পরশু গায়ে হলুদ, পরদিন বিয়ে। বিয়ের আয়োজন শুরু হলো বেশ ধুমধাম করে। সাবিনার কথা টাকার অভাবে সে শাপলা আর নূরীর বিয়েতে তেমন কিছু করতে পারেনি তাই পরীর বিয়েতে সে আনন্দের কমতি রাখবে না। এর মধ্যে যোগ হয়েছে সাবিনার বাবার বাড়ির টাকা। সাবিনার বাবা-মারা গেছে কয়েক বছর আগে। বাবার কিছু জমি ছিলো যা এতদিন ভাইয়েরা দেখাশোনা করতো কিন্তু সাবিনার বড় বোন ক’দিন আগে থেকে তার ভাইদের কাছে বায়না ধরেছে সে তার বাবার জমির ভাগ নিবে।
প্রথম কিছুদিন ভাইবোনদের মধ্যে একটু মনোমালিন্য হয়েছে, তিক্ততা হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা দফা-রফা হয়েছে। তারা বোনদের তাদের অংশ বাবদ টাকা দিবে। সেই বড় বোনের চেষ্টায় সেও বাবার জমি থেকে কিছু টাকা পেয়েছে। তাই পরীর বিয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে আর বিয়ের আয়োজনও হয়েছে ধুমধাম করে।
বিয়ের চেষ্টা চলছে এ পর্যন্ত পরী জানে কিন্তু সেটা যে এতো হঠাৎ করে হবে তা সে বুঝতে পারেনি। আজ বাড়িতে একটা বিয়ের সাজ সাজ ভাব দেখে পরী আরো বেশি দুশ্চিন্তায় পড়লো। এদিকে সে মালাকে বলেছিলো তারো কোনো খবর হলো না। শেষ পর্যন্ত কী পরীকেও শাপলা আর নূরীর মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে?
না। পরী তা করবে না। যেমন করেই হোক সে নিজেকে রক্ষা করবে। সে প্রতিবাদ করে যদি না পারে তবে প্রতিরোধ করবে। তাও যদি না পারে তো…
বিয়ের আগের দিন ব্র্যাকের আপা এলো। ব্র্যাকের আপাকে দেখে সাবিনার মুখে কালো মেঘ ঢেকে গেলো। সে গম্ভীর মুখে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম আপা।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন আপা?
ভালো। আপনি?
হ্যাঁ ভালো আছি।
বসেন আপা। নাস্তা দিচ্ছি। বলে সে ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর একটা প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর এনে আপার সামনে রেখে বললো, নেন আপা নাস্তা খান।
আপা চানাচুর হাতে নিয়ে মুখে পুরে বললো, পরী কোথায় আপা?
আছে, ও একটু অসুস’ আপা। ঘরে শুয়ে আছে।
শুনলাম আপনারা নাকি পরীর বিয়ে দিচ্ছেন?
সাবিনা আমতা আমতা করে বললো, না। বিয়ে ঠিক না। এই কথাবার্তা চলছে আর কী।
কথাবার্তা যদি মিলে যায় তবে কি বিয়ে দিবেন?
জি আপা।
কিন্তু ওর তো এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি।
বেশি বয়স হলে বিয়ে দেয়া যায় না আপা, তাই ওর বাপ বলছে আর একটা মেয়ে বিয়ে দিতে পারলে আমাদের ঝামেলা শেষ।
মেয়ের বিয়ে দেয়াটা ঝামেলার কাজ?
ঝামেলারই তো, ভালো পাত্র পাওয়া, ডিমান্ডের টাকা যোগাড় করা, অনুষ্ঠান করা এসব তো ঝামেলাই। এসময় আমি বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা পেয়েছি, তাই সেই টাকাটা দিয়েই ঝামেলা বিদায় করতে চাচ্ছি।
আপনাদের ঝামেলা বিদায় হলো কিন্তু ওর জীবনে তো ঝামেলা শুরু হলো।
কেনো আপা, ঝামেলা শুরু কেনো? মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মাইছে পরের ঘরে তো যেতেই হবে।
তাই বলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে? ওতো এখন ক্লাস এইটে পড়ছে। সামনে ওর জে.এস.সি পরীক্ষা।
সাবিনা বললো, লেখাপড়া শিখে কী হবে আপা? মেয়ে শিক্ষিত হলে তো শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। শিক্ষিত ছেলের তো অনেক টাকা ডিমান্ড দিতে হবে। আমাদের কি অতো টাকা আছে আপা?
কেনো? মেয়েকে শিক্ষিত করলে যৌতুক দিতে হবে কেনো? মেয়ে যদি লেখাপড়া শিখে একটা চাকরি পায় তবে এমনিই শিক্ষিত পাত্র পাওয়া যাবে।
সাবিনা যেন কথার খেই হারিয়ে ফেললো। সে আর কোনো কথা বললো না।
আপা আবার বলতে শুরু করলো, আজকাল তো মেয়েদের লেখাপড়ায় টাকাও লাগে না। সরকারই সব টাকা খরচ করে, তারপর ব্র্যাক থেকেও স্টাইপেন্ড পাওয়ার ব্যবস’া আছে। আপনি তো দু’টা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা সেরেছেন কিন্তু মেয়ে দু’টা কি সুখে আছে?
সাবিনা নরম সুরে বললো, আছে তো আপা।
শুনলাম শাপলার স্বামী নাকি আরেকটা বিয়ে করেছে?
সাবিনার মুখ শুকিয়ে গেলো। সে মিনমিন করে বললো, টাকা-পয়সা হলে ছেলেমানুষের একটু আধটু ওরকম হয় আপা বলে সাবিনার মুখ একটু আলোকিত হলো, এখন ভালো আপা, জামাইর অনেক টাকা পয়সা আছে, মোটা ভাত মোটা কাপড়ের কোনো অসুবিধা নেই।
সতীনের সঙ্গে সংসার করেও ভালো আছে, না? আর নূরী…
সাবিনা বললো, ওর কথা আর বলবেন না আপা, আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়ে গেছে।
আল্লাহই নিয়ে গেছে ঠিক কথা কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে না দিলে কি বাচ্চা হওয়ার সময় এরকম অপুষ্টিতে ভুগে? রক্তশূন্যতায় ভুগে? দু’টা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝামেলা বিদায় করেছেন এখন একজন সতীনের ঘরে, আরেকজনকে তো আল্লাহ নিয়ে গেছে।
আতা বাড়িতে ঢুকলো, আস্‌সালামুয়ালাকুম আপা।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।
আতাকে দেখে সাবিনা উঠে দরজার কাছে গিয়ে ঘরের ভেতর যাওয়ার জন্য ইশারা করলো।
আতা ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে উঠানে বিছানো পাটিতে বসলো।
আপা প্রথম কথা তুললো, এসব কী শুনছি আতা ভাই?
কী আপা?
পরীর বিয়ে নিয়ে।
জি আপা।
এবার আপা একটু গম্ভীর হলো, কিন্তু পরীর তো এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। আপনি কি জানেন বাল্য বিবাহ আইনত: দণ্ডনীয় অপরাধ?
কী করবো আপা? পথে-ঘাটে ছেলেরা ডিস্টার্র্ব করে।
আর সেজন্য আপনি মেয়ের লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়েই দিয়ে দিবেন। ছনের ঘরে আগুন ধরতে পারে সেজন্য কি মানুষ ছনের ঘর বানায় না? বখাটে ছেলেরা টিজ করবে সেজন্য ব্যবস’া আছে, দেশে আইন আছে।
আতা মিন মিন করে বললো, কিছু একটা হয়ে গেলে…
কিন্তু বিয়ে দিতে গিয়ে যদি কিছু একটা হয়ে যায়?
আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দিবো তাতে কী হবে?
বললাম না, বাল্যবিবাহ আইনত: দণ্ডনীয় অপরাধ। পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে, মেয়ের বাবা-মাসহ বিয়ের অনুষ্ঠানে উপসি’ত সবার জেল হতে পারে।
এবার আতার মুখ শুকিয়ে গেলো। সে একটা ঢোক গিললো।
আপা আবার বলতে শুরু করলো, শোনেন আতা ভাই, পরী লেখাপড়ায় ভালো, ও যখন আমাদের স্কুলে পড়তো তখন প্রত্যেক ক্লাসে ফার্স্ট হতো।
আতার মুখ উজ্জ্বল হলো, এখনো হয় আপা।
এরকম একটা সুন্দর মেয়েকে আপনি বিয়ে দিয়ে জীবনটা নষ্ট করতে যাচ্ছেন। ওর বিয়ের সব বন্দোবস্ত বন্ধ করে ওকে স্কুলে পাঠিয়ে দিন। দেখবেন ও একদিন অনেক বড় হবে, ও আপনার মুখ উজ্জ্বল করবে। আর বখাটে ছেলেদের কথা বলছেন, প্রয়োজনবোধে পুলিশ ওদেরকে ঐ মোড় থেকে তাড়িয়ে দিবে।
চা খান আপা, ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যে।
আপা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, শোনেন আতা ভাই, এখনি একদম বিয়ের কথা ভাববেন না। এখন বিয়ে দিলে যে টাকা যৌতুক দিতে হবে সে টাকা খরচ করলে মেয়েটা লেখাপড়ায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তখন দেখবেন ওর কোনো যৌতুকও লাগবে না। ভালো ছেলেরা বিয়ে করার জন্য লাইন দিবে। বুঝতে পেরেছেন?
জি আপা।
আমি তাহলে আসি আতা ভাই।
আচ্ছা আপা।
আপা যখন আতা আর সাবিনার সঙ্গে কথা বলছিলো তখন পরী ঘরে চুপ করে বসে সবকিছু শুনছিলো। সে মনে মনে কিছুটা আশ্বস’ হলো। সে লা ইলাহা ইল্লা আন্‌তা সুব্‌হানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্‌যোয়ালেমিন বলে বুকে একটা ফু দিলো।

আট

বাল্য বিবাহ এই অঞ্চলে অহরহই হচ্ছে, ধুমধাম করে হচ্ছে। বাল্য বিবাহ আইনত দণ্ডনীয় হলেও যারা এই আইনকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্বে আছে তারা যেন জেগে জেগে ঘুমায়, দেখেও না দেখার ভান করে। মাঝে মাঝে দু’য়েকটা মিটিং-সিটিং, সভা-সেমিনার, ব্যানার-ফেস্টুন, র‌্যালি-সমাবেশ করেই বিনোদনের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে। তা না হলে বিয়ের মতো বড় ঘটনা ঘটবে আর প্রশাসন জানবে না এটা ডিজিটাল যুগে কী করে সম্ভব? কী করে সম্ভব যখন প্রশাসনের শাসনের জাল বিছানো আছে সমস্ত দেশ জুড়ে। না, প্রশাসনের সব ক্ষমতা আছে তা দেখা যায় কেউ যখন অভিযোগ করে এবং সেই অভিযোগের পর পেছনে পেছনে লেগে থাকে। তখন ঠিকই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র নড়েচড়ে উঠে। সৈন্য সামন্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
কয়েক মাস আগের কথা। জগতপুরে এরকম একটা ঘটনা ঘটলো। বিয়ের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন। সন্ধ্যায় বরযাত্রী এসেছে। বর এসেছে মুখে রুমাল ঢাকা দিয়ে। কিশোরীকে সাজানো হয়েছে বধূ বেশে। বাইরে খাওয়া-দাওয়া তখন শেষ পর্যায়ে, খাওয়ার পরপরই কাবিন, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কিশোরী কন্যাকে বিদায় করে দিয়ে পিতা দায়মুক্ত হবেন। কাজিও এসেছে। কাজি সাহেব তার বড় রেজিস্টার নিয়ে মজলিশে হাজির হয়েছে। রেজিস্টারে পাত্র-পাত্রীর নাম ঠিকানাও লেখা হয়েছে এমন সময় দু’টা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সবার দৃষ্টি তখন আগত গাড়ির দিকে। বাইরে থেকে একটা গুঞ্জন শোনা গেলো, পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে, পুলিশ…
গাড়ি আসার পর থেকেই কাজি সাহেবের কান খাড়া ছিলো। সে ঘটনা আঁচ করতে পেরে সটকে পড়তে যাচ্ছিলো কিন্তু বিধি বাম। ততক্ষণে পুলিশের বাঁশি বেজে উঠেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাড়ি থেকে নেমে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, আপনারা যে যেভাবে বসে আছেন সেভাবেই চুপচাপ বসে থাকবেন, কেউ যেন পালানোর চেষ্টা করবেন না।
রেজিস্টার হাতে দেখে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আর বুঝতে বাকি রইলো না। তারপরও তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাজি?
কাজি সাহেব কাঁপতে শুরু করলো, তাঁর হাত থেকে রেজিস্টার পড়ে গেলো, জি স্যার।
দেখি আপনার রেজিস্টার?
কাজি সাহেব মেঝে থেকে রেজিস্টার তুলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে দিলো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পাতা উল্টিয়ে দেখে বললেন, রেজিস্টারে লেখাও কমপ্লিট?
উপসি’ত উভয় পক্ষের লোকজন অনেকটা ভীত হয়ে পড়লো। এমন অনাকাঙ্খিত পরিসি’তির কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বর-কনে, বর-কনের গার্জিয়ান, উভয় পক্ষের সাক্ষী সবাইকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।
পুলিশ অফিসার স্যালুট দিলো, স্যার।
ততক্ষণে উপসি’ত লোকজন একটা চেয়ার টেনে দিলো। একজন মুরুব্বী গোছের লোক বিনীত স্বরে বলল, স্যার আপনি বসুন।
আরেকজন চেয়ারের সামনে একটা টেবিল টেনে দিলো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নির্দেশমতো পুলিশ অফিসার সবাইকে হাজির করলো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একবার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
আনিতা।
আনিতা। লকলকে চেহারার একটি মেয়ে। মায়াবী চোখ-মুখ। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
মেয়েটি একবার সবার দিকে তাকালো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অভয় দিলেন, তোমার ভয়ের কিছু নেই। সত্যি করে বলো?
ক্লাস সেভেনে।
তোমার বাবা-মা…বলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সবার মুখের দিকে তাকালেন।
আনিতা মুখ তুলে তার বাবা-মা’র দিকে তাকালো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কাজি সাহেবের রেজিস্টার থেকে আনিতার বাবা-মা’র নাম পড়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা?
আনিতার বাবা-মা দু’জনে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
শিপন।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একবার শিপনের আপাদমস্তক দেখলেন। শিপনের বয়স প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর। বেশ লম্বা-চওড়া, স্বাস’্যবান, সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক।
বরের গার্জিয়ান? বলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সবার মুখের দিকে তাকালেন।
শিপনের বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, স্যার আমি।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিয়ের সাক্ষীদের নাম বলে ডাক দিলেন। পুলিশ অফিসার সবাইকে পাশাপাশি দাঁড় করালো। এবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কাজি সাহেব আপনি যে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে যাচ্ছিলেন আপনার কাছে মেয়ের জাতীয় পরিচয় পত্র আছে? কিংবা জন্ম নিবন্ধন সনদ?
কাজি সাহেব মাথা নত করে একটা কাগজ বের করে দিলো, স্যার।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কাজির কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখে বললেন, এটা তো মেম্বারের দেয়া প্রত্যয়নপত্র। বিয়ে রেজিস্ট্রির সময় পাত্র-পাত্রীর বয়স প্রমাণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম-নিবন্ধন সনদ। আপনারা একবার আনিতার দিকে তাকিয়ে দেখুন ওর বয়স কি আঠারো বছর হয়েছে?
সবাই চুপ করে রইলো।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আনিতার বাবা-মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা বলুন, আপনারা তো আনিতার বাবা-মা আনিতার বয়স কি আঠারো বছর হয়েছে?
আনিতার বাবা-মা না সূচক মাথা নাড়লো।
আর আপনি… বলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব শিপনের বাবার দিকে তাকালেন।
বর পক্ষ, কনে পক্ষ, বরযাত্রী, পুলিশ সব মিলে প্রায় এক’শ লোক দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই, কারো নি:শ্বাসের শব্দ পর্যন্ত নেই। নীরবতা বলতে যা বোঝায়। কেউ জানে না আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন বাল্য বিবাহ আইনত: দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও সবাই মিলে একটা বাল্য বিবাহের আয়োজন করেছিলেন যথাসময়ে হস্তক্ষেপ না হলে এতক্ষণ বিয়ে সম্পন্ন হতো। অভিশাপের খাতায় যুক্ত হতো আরো একটি মেয়ের নাম। আপনারা কি এই কাজটি ঠিক করেছেন?
সবাই বললো, স্যার আমাদের ভুল হয়ে গেছে, আমাদের মাফ করে দেন।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, আপনারা নিজেদের ভুল স্বীকার করেছেন সেজন্য আজকের মোবাইল কোর্ট বলে তিনি একে একে নাম এবং কার কত মাস জেল ঘোষণা করলেন।
পুলিশ দ্রুত সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুললো।
কিছুক্ষণ আগেই যে বাড়িতে বিয়ের আনন্দ-উল্লাস ছিলো, পটকা ও আতসবাজির ঝলমল আলো ছিলো সেই বাড়ি যেন এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হলো।
পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি দ্রুত চলে গেলো।
ঘটনাটি পরদিনই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পরে জানা গেলো, জগতপুর গ্রামেরই এক ছেলে সেই মেয়েকে ভালোবাসতো, তার প্রেমিকার বিয়ে মানতে না পেরে সে এলাকার আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনের কাছে এই বিয়ে ঠেকানোর জন্য তদবির করেছে, শুধু তাই নয় প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য, তার প্রেমিকার বিয়ে ঠেকানোর জন্য কয়েকটি এন.জি.ও এবং নারীবাদী সংগঠনগুলোর কাছেও ধর্ণা দিয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনায় বাল্য বিবাহ ঠেকানো গেছে সত্যি কিন্তু সেই ঠেকানোর তো উদ্দেশ্য আলাদা।
তা হোক তারপরও সেই ঘটনার পর প্রথম প্রথম কয়েক মাস বিয়ে হতো অতি গোপনে। তারপর আবার শুরু হলো ঢাকঢোল পিটিয়ে। একটা দৃষ্টান্ত কখনো পুরো ব্যবস’াকে পরিবর্তন করতে পারে না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো যেমন সবাই ঘৃণা করে, অনৈতিক কাজ বলে মনে করে, প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধ করে তেমনি বাল্য বিবাহকেও যেদিন মানুষ অপরাধ বলে গণ্য করবে, সামাজিকভাবে ঘৃণা করবে, প্রতিবাদ করবে, প্রতিরোধ করবে সেদিনই বাল্য বিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে আর সেজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।
বিয়ের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ঘটক যখন ব্র্যাক আপা আসার কথা শুনলো তখন কয়েক সেকেন্ড ঝিম মেরে রইলো। আতা জিজ্ঞেস করলো, কী, খারাপ কিছু?
ঘটক বললো, না, খারাপ কিছু না, ঘটনাটা এতো জানাজানি হলো কীভাবে?
বিয়ের ব্যাপার কি লুকিয়ে থাকে ভাই? আতা বললো।
সাবিনা ঘটকের জন্য চা তৈরি করতে রান্না ঘরে গিয়েছিলো। সে চা নিয়ে এসে পিঁড়িতে বসতে বসতে বললো, কী হয়েছে ভাই?
না, আমি বলছিলাম ঘটনাটা এতো জানাজানি হলো কীভাবে?
তাতে কী? আমাদের মেয়ে আমরা বিয়ে দিবো তাতে কে কী বলবে?
আতা মিনমিন করে বললো, বলতে পারে শাপলার মা, বলতে পারে।
সাবিনা ক্ষেপে গেলো, তুমি বেশি কথা বলো নাতো, ব্র্যাক আপা এলো আর উনি গেলেন একেবারে…যেন পুলিশ এসে এখনি ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক মিনিট কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঘটক বললো, তবে একটা বুদ্ধি করা যায়?
আতা কৌতূহলী হলো, কী বুদ্ধি?
ও ভাবী আপনার বাবার বাড়ি কোথায়?
কাহারোল।
বিয়েটা ওখানে করা যায় না?
আতা উত্তরের অপেক্ষায় সাবিনার মুখের দিকে তাকালো।
এখানে করলে কি অসুবিধা হবে ভাই?
আতা বললো, হয়তো হবে না, তবে হতে কতক্ষণ, সাবধানের মার নেই।
আতা বললো কিন্তু তার কথার প্রতি কারো যেন গুরুত্ব নেই। কথাটা কেউ আমলেই নিলো না।
আতা আবারো বললো, শাপলার মা বিয়েটা ক’দিন পিছিয়ে দিলে হয় না? ভেবে দেখ শেষ পর্যন্ত জগতপুরের সেই ঘটনার মতো যদি পুলিশ এসে সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
পুলিশের কথা শুনে সাবিনাও একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো, ঘটক ভাই আপনি কী বলেন?
ঘটক বললো, বিয়ের সবকিছু কমপ্লিট, আর এখন বিয়ে পেছানো…
দেখুন না একটু বিহাই-বিহানীর সঙ্গে কথা বলে।
ঘটক মুখ কালো করে বললো, আচ্ছা দেখি।

নয়

বিকেলে এলো ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার, শাকিলা। শাকিলার বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিন্তু বয়স বোঝা যায় না। স্মার্ট, কথাবার্তায় আধুনিকতা আছে। বিরল কলেজ থেকে বি.এ পাস করেছে। আর রাজনীতির শুরুও কলেজ জীবনের শুরু থেকেই। কলেজ জীবনে সে যখন মিছিল-মিটিংয়ে যেতো তখন গ্রামের মানুষ অনেক কানাকানি করতো। কিন্তু তারপরও সে কারো নিন্দাকে পরোয়া করতো না। সে তখন থেকেই গ্রামের মানুষের যেকোনো বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তো। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের সব সমালোচনার অবসান হলো। তারপর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সে প্রার্থী হলো তখন গ্রামের মানুষও তাকে জয়ী করার জন্য মাঠে নেমে পড়লো। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলো শাকিলা।
এই গ্রামে বাড়ি, বিয়েও হয়েছে এই গ্রামেই। তাই কারো সাথে কথা বলতে বা কারো বাড়িতে যেতে তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। সে ভাবী, ভাবী বলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।
শাকিলাকে দেখে সাবিনা চমকে উঠলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না হঠাৎ করে শাকিলার আগমনের কারণ সে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি হেসে বললো, মেম্বারনি আপা, আপনি? কেমন আছেন?
শাকিলা আপা না, শাকিলা। আমি আপনার চেয়ে কত ছোট।
সাবিনা কিছুটা লজ্জা পেলো। সে ঘর থেকে একটা পাটি এনে উঠানে বিছিয়ে দিয়ে বললো, বসো।
শাকিলা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন ভাবী?
আমাদের আর ভালো থাকা।
কেনো? কী হয়েছে?
না, তেমন কিছু না। গরীব মানুষ, সংসারে টানাটানি বোঝো না।
টানাটানি থাকবেই। এভাবে চলতে হবে। সংগ্রাম করে টিকে থাকাই জীবন।
হ্যাঁ। বলে সে আবার ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর এনে নিজেও শাকিলার পাশে বসলো, খাও।
শাকিলা একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে মুখে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো, আতা ভাই বাড়ি নেই?
আছে, ও এখুনি কোথায় যেন গেলো।
বলতে বলতেই আতা বাড়িতে ঢুকলো। সাবিনা বললো, ঐযে বলতে বলতে এসে পড়েছে।
শাকিলা সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম আতা ভাই।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম।
কেমন আছেন আতা ভাই?
ভালো। তুমি?
আমিও ভালো আছি।
আতাও বসলো।
সাবিনা শাকিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কখন যে শাকিলা পরীর বিয়ের কথা বের করবে সেটা ভেবে তার বুক টিপ টিপ করতে লাগলো।
হ্যাঁ সত্যি, সত্যি শাকিলা সেই অপ্রিয় কথাটিই বলে ফেললো, আতা ভাই শুনলাম আপনি নাকি পরীর বিয়ে দিচ্ছেন?
আতা মুখ কালো করলো। সে কী জবাব দিবে ভেবে পেলো না। সে একবার সাবিনা আর একবার শাকিলার মুখের দিকে তাকালো, কে বললো তোমাকে?
শাকিলা কী যেন লুকালো, কেউ বলেনি, আমি এই ওয়ার্ডের মেম্বার, এই গ্রামেরই মানুষ তাইতো কেমন কেমন করে জানি সব কথা আমার কানে চলে আসে। শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো, আতা ভাই’র দুই মেয়েরই কী দূরাবস’া তারপর আবার সবার ছোট মেয়েকে এই অল্প বয়সে বিয়ে দিবে?
আতা মিন মিন করে বললো, না, ঠিক বিয়ে না, বলে সে শাকিলার দিকে তাকিয়ে সাবিনার সম্মতি নিয়ে বললো, এই মানে দেখতে আসবে…এই আর কী…
শাকিলা বললো, দেখতে এসে যদি পছন্দ হয় তো বিয়ে?
সাবিনা বললো, দেখতে এলেই কি পছন্দ হয়?
হতেও তো পারে তখন তো বিয়েই হয়ে যাবে।
আতা মাথা নত করে বসে রইলো। সাবিনা দাঁতে শাড়ির আঁচল কাটলো।
দেখ ভাবী এখন মেয়েদের লেখাপড়া করার বয়স, এখন যদি তোমরা ওর বিয়ের কথা তোলো তবে তো লেখাপড়ার ওপর থেকে ওর মন উঠে যাবে।
সাবিনা আবার বললো, বিয়ের পরও তো লেখাপড়া করতে পারবে। আমরা সেই কন্ডিশনে বিয়ে দিবো।
তা হয় না ভাবী। বিয়ের পর আর লেখাপড়া হয় না। তাছাড়া পরী তো কেবল ক্লাস নাইনে পড়ছে, ওর তো বিয়ের বয়সও হয়নি।
বিয়ের বয়স হয়েছে। তাছাড়া স্কুল যাওয়া আসার পথে দেখছো না কেমন বখাটে ছেলেরা ডিস্টার্র্ব দিচ্ছে।
বখাটে ছেলেদের ভয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিয়ে দেয়া? দেশে কি আইন নেই? বখাটেদের শায়েস্তা কোনো ব্যাপার হলো। বলুন তো কালকেই ইউ.এন.ও স্যারকে বলে মোবাইল কোর্ট বসাই। দেখি কত বখাটে আছে যে মেয়েদের ডিস্টার্র্ব করে। আপনারা পরীর বিয়ে বন্ধ করুন।
আতা এবং সাবিনা কোনো কথা বললো না।
শাকিলা জিজ্ঞেস করলো, কী আতা ভাই, বিয়ে বন্ধ করবেন না?
সাবিনা বললো, কিন্তু বিয়ের কথা যে এক্কেবারে পাকাপাকি। এখন কি আর বন্ধ করা…
শাকিলা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললো, সম্ভব ভাবী, সব সম্ভব, যখন ইউ.এন.ও স্যার পুলিশ নিয়ে এসে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে তখন সবই সম্ভব।
পুলিশের কথা শুনে আতা একটা ঢোক গিললো।
সাবিনা বললো, কিন্তু এখন না হয় তুমি পুলিশের ভয় দেখিয়ে বিয়ে বন্ধ করলে কিন্তু পরে যদি আর ভালো পাত্র না পাওয়া যায় তবে কি তুমি একটা ভালো পাত্র জোগাড় করে দিতে পারবে?
পরী যদি লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হয় তবে আমাকে পাত্র জোগাড় করে দিতে হবে না, আপনাদেরও বিয়ের সময় যৌতুক দিতে হবে না। অনেক ভালো পাত্র বিনা যৌতুকে ওকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। আর যদি ওকে এখনই বিয়ে দেন তবে আগের দু’মেয়ের মতো ওর জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে।
এতক্ষণ দু’জনে চুপ করেছিলো এবার আতা সাবিনার দিকে তাকিয়ে বললো, শাপলার মা তুমি কী বলো? বিয়ে…
শাকিলা বললো, বিয়ে অবশ্যই বন্ধ করবেন। যদি না করেন আর পুলিশ এসে যদি ধরে নিয়ে যায় তবে আমি কিন্তু আপনাদের জন্য থানায় যাবো না। বলে শাকিলা একটু থামলো তারপর আবার বললো, কী আতা ভাই? কথা বলছেন না কেনো?
ঠিক আছে শাকিলা তুমি যখন বলছো…
শাকিলা চলে গেলো। আতা বিড়বিড় করে বললো, আমার আগেই মনে হয়েছিলো এই দারগা মেয়েকে মেম্বার বানানো ঠিক হবে না। তবু সবাই ওকেই ভোট দিলো, সবার দেখাদেখি আমিও ভোট দিলাম। এখন নিজের মেয়েকে নিজে বিয়ে দিতে ওর পারমিশন নিতে হবে। বাহ্‌।
সাবিনা বললো, তুমিও তো আমাকে শাকিলাকে ভোট দিতে বলেছিলে এখন ঠেলা সামলাও। আবার ভোট দিবে কী না সেটা পরের ব্যাপার আপাতত: যে ঝামেলায় পড়েছ সেটা থেকে উদ্ধার পাও।

দশ

বাড়িতে ব্র্যাক আপা আর শাকিলার আসার সময় পরী তার ঘরেই ছিলো কিন্তু বাড়িতে কেউ এলে তার বাইরে আসতে নিষেধ তাই সে ঘরে বসেই একরকম নি:শব্দে সবকিছু শুনছিলো। শাকিলা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সাবিনা পরীর ঘরে এলো। রেগে সে যেন সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। পরী তখন একটা উপন্যাস পড়ছিলো। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস সাতকাহন।
বই পড়ার অভ্যাসটা পরীর অনেক দিন আগের। ক্লাস ফাইভ পাস করে সে যখন সিক্সে উঠলো। তখন থেকে শুরু হলো বই পড়া। তাদের স্কুলে একটা লাইব্রেরি আছে। ব্রাকের লাইব্রেরি। সেখানে অনেক রকমের বই আছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস। পরীর পছন্দ উপন্যাস। সাতকাহন পড়া শুরু করেছে কয়েক দিন আগে। বইটা তাকে নেশার মতো আঁকড়ে ধরেছে। দীপাবলীর চরিত্র সে যতই পড়ছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। তার চোখের সামনে স্বপ্নটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। বাস্তব হচ্ছে। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তার মতো কষ্ট, অবহেলা আর অনাদরে লালিত একটা মেয়ে কীভাবে তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু সে লক্ষ্য করেছে দীপাবলীর মতো তার জীবনেও একের পর এক বাধা আসছে। আর সে অতিক্রম করে যাচ্ছে। এবারের বাধা সে অতিক্রম করবে কীভাবে?
পরী একবার তার মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো, তার বুক কেঁপে উঠলো, মা!
সাবিনা রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তোর বিয়ের কথা ব্র্যাক আপা জানলো কীভাবে?
পরী কোনো কথা বললো না।
সাবিনা দাঁত কড়মড় করে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো, কথা বলছিস না কেনো? আমি জানতে চাচ্ছি ব্র্যাক আপা তোর বিয়ের কথা জানলো কীভাবে?
পরী যেমন মাথা নত করে বসে ছিলো তেমনিভাবে মৃদু কণ্ঠে বললো, আমি জানি না।
তুই জানিস্‌ নাতো কে জানে?
বললাম তো আমি জানি না।
তুই না জানালে ব্র্যাক আপা জানলো কী করে?
আমি তো বাড়ি থেকেই বের হইনি। বললাম কীভাবে?
তাহলে নিশ্চয় মালা-ই বলেছে। সেদিন মালা তোর কাছে এলো দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিলো। ঐ মেয়েটাই সব গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে।
ব্র্যাক আপাকে না হয় মালা বলেছে কিন্তু মেম্বারনিকে?
ওকেও মালা-ই বলেছে। আর এসব ষড়যন্ত্র তোর। আমি যদি জানতাম মালা এমন কাণ্ড করে বসবে তবে সেদিন ওকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দিতাম না। সবাই বিশ্বাস ঘাতক। বলে সাবিনা পরীর হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে বললো, বইটা আমার কাছে থাক। এসব আজেবাজে বই তোর মাথাটা নষ্ট করেছে। আজ থেকে বই পড়াও বন্ধ। ভেবেছিলাম লেখাপড়া করছিস্‌ মানুষ হবি। বাবা-মা’কে সম্মান কর্‌বি, বাবা-মা’র আদেশ-উপদেশ মেনে চল্‌বি, এখন দেখছি সব উল্টো। সবসময় তুই উল্টো পথে চলছিস্‌। এতটুকু মেয়ে বিয়ে ঠেকাতে মেম্বারনির কাছ পর্যন্ত গেছে।
কথা বলতে বলতে পরীর আতঙ্ক কেটে গেছে। সে প্রচণ্ড ক্ষোভের মধ্যেও হেসে ফেললো, এতটুকু মেয়ে তো বিয়ে দিতে চাচ্ছ কেনো মা? আমি আগে বড় হই তারপর আমাকে বিয়ে দিও।
চুপ, একেবারে চুপ। আগের দিনে বাবা-মা আমাদের ধমক দিলে আমরা ভয়ে কান্না করে ফেলতাম আর তুই হাসছিস্‌। বেয়াদব কোথাকার।
এবার পরী আরো স্বাভাবিক হলো, সে তার মায়ের দু’হাত চেপে ধরে বললো, দিন পাল্টেছে মা। আগে তোমরা বাবা-মা’র আদেশ-উপদেশ মেনে চলতে, অন্যায় আদেশও মেনে নিতে। আর আমরা প্রতিবাদ করছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তারুণ্যের ধর্ম।
কী বললে, তারুণ্য না কী?
হ্যাঁ, তারুণ্যের ধর্ম। মানে বয়সের ধর্ম।
আসলে কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তুই যখন ব্র্যাক স্কুলে যাওয়া শুরু কর্‌লি তখন যদি তোকে নিষেধ করতাম, তবুও ভালো হতো। তা না করে তুই হাই স্কুলে ভর্তি হতে চাইলি আর হয়ে গেলি।
কিন্তু আমার জন্য তোমরা টাকা খরচ করোনি মা। আমি তো ব্র্যাক আর স্কুল থেকে যে স্টাইপেন্ড পেয়েছি তা দিয়েই লেখাপড়া করছি।
টাকা না হয় দিলো কিন্তু মান-সম্মান?
তোমাদের মান-সম্মানের ক্ষতি হয় এমন কাজ আমি করবো না মা।
তুই না করলেও ওরা তো তোকে ছাড়বে না। স্কুল যাওয়া-আসার পথে যদি ওরা কোনো অঘটন ঘটায়। তখন আমাদের মান-সম্মান থাকবে কোথায়?
এটা কথার কথা মা। আসলে ঐ বখাটে ছেলেটা আমাকে টিজ করছে দেখে তোমরা আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছ এটা মোটেই ঠিক না। তাই যদি হতো তাহলে শাপলা আপা বা নূরী আপাকে তো কেউ টিজ করেনি। তবুও তোমরা ওদের বিয়ে দিয়েছো। আসলে একটা কথা কী বলবো?
সাবিনা কথার খেই হারিয়ে ফেললো। সে পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
পরী আবার বলতে শুরু করলো, আসলে তোমরা আমাদের বোঝা মনে করো। তা না হলে তোমাদের এই ভাবনাটা কেনো আসবে যে মেয়ে মানে তাড়াতাড়ি কাঁধ থেকে নামিয়ে কারো হাতে সঁপে দিতে পারলেই হয়? আমাকে যদি তোমাদের এতোই বোঝা মনে হয় তবে আমাকে পৃথিবীতে এনেছিলে কেনো? কেনো আমি পৃথিবীতে এসে যখন কান্না করেছিলাম, যখন তোমরা বুঝতে পারলে আমি তোমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত ছেলে সন্তান নই তখন আমাকে টুটি চেপে মেরে ফেলোনি? তখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছো তাহলে এখন আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো কেনো? বলতে বলতে পরী আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
সাবিনারও চোখের কোণে পানি জমে গেলো। সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, বিয়ে দেয়া আর মেরে ফেলা এক না। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস্‌ বিয়ে তো একদিন দিতেই…
পরী সাবিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলতে শুরু করলো, একই কথা মা। আমি লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার জন্য সেই ব্র্যাক স্কুলে ভর্তির পরদিন থেকে তিলে তিলে যে স্বপ্ন লালন করছি তোমরা আমার সেই স্বপ্নকে টুটি চেপে মেরে ফেলছো আবার বলছো বিয়ে করা আর মেরে ফেলা এক নয়। একটা মানুষের স্বপ্ন মরে গেলে, আশা শেষ হয়ে গেলে আর থাকে কী? স্বপ্নই তো মানুষের আগামী দিনের প্রেরণা, মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। সেই অবলম্বনই যদি মরে যায় তবে আমার দেহটা বেঁচে থাকার আর প্রয়োজন কী, বলতে বলতে পরী তার মার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি লেখাপড়া করবো মা। তুমি দেখো আমি লেখাপড়া শিখে সত্যি সত্যি একদিন অনেক বড় হবো। তোমরা আমাকে সেই সুযোগটাই দাও। ঐ বখাটে ছেলেদের রাস্তা থেকে সরানোর দায়িত্বও আমার। শুধু তোমরা…
সাবিনা পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কান্না ভাঙ্গা গলায় বললো, থাম মা, আর কাঁদিস্‌ না।
পরী মায়ের বুকে মাথা রেখেই বললো, মা তুমি আমাকে স্কুলে যেতে দিবে তো?

এগারো

বই। ক্লাসের বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ে ব্র্যাক কিশোরী ক্লাবের মেয়েরা টুকটাক লিখতে শিখেছে। তারা স্বনামধন্য লেখক কবিদের বই পড়ে নিজেদের তাই ভাবতে শুরু করেছে। আর সে সুযোগ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ব্র্যাকই। প্রতি বছর ব্রাকে গল্প লেখা প্রতিযোগিতা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহনের জন্য মেয়েরা সারা বছর তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লিখে রাখে। তারপর প্রতিযোগিতায় তাদের লেখা গল্প উপস’াপন করে সবাইকে অবাক করে দেয়।
কল্পনার কোনো অস্তিত্ব নেই, ভাষার গাঁথুনী নেই, ঘটনার ধারাবাহিকতা নেই তবুও গল্প। জীবনের গল্প। আজকাল তো অনেক গল্পই রচনা হয়, বড় বড় সাহিত্যিকদের গল্প। কী এক অদ্ভুত ভাষা শৈলী দিয়ে লেখা গল্প। কিন্তু ক’জনের লেখা মানুষের মনে দাগ কাটে, গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ক’জনের লেখা সমাজে বিপ্লব আনে, পরিবর্তন আনে। মানুষের চোখ খুলে দেয়। আজকাল বেশিরভাগ লেখাই অনেকটা বাণিজ্যিক।
কোন লেখকের কতগুলো বই বের হলো, কোন লেখকের বই বেস্ট সেলার পুরস্কার পেলো, কোন লেখক কত টাকা রয়্যালটি পেলেন। এসবের হিসেব। বিদ্যার পরিমাপ যখন অর্থের মাপকাঠিতে হয়, তখন সেখানে আর জ্ঞান থাকে না। আজকাল বই লেখাটাও তেমন হয়েছে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। তাই চিরদিন মনে রাখার মতো বই দেবদাস, চিতা বহ্নিমান, শাপমোচন, মানবজমিন, রুটি কাপড়া মোকান এর মতো কালজয়ী বই আর তেমন লেখা হয় না। কিন্তু ব্রাকের সেই ক্ষুদে শিশু-কিশোরদের লেখা গল্প তাদের জীবনেরই গল্প। সেখানে না থাক ভাষা শৈলী, না থাক প্রতিশব্দের সঠিক প্রয়োগ তারপরও সেগুলো যেন গল্প নয়, সত্যি সত্যি সেগুলো গল্প নয়। সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, একেবারে প্র্যাকটিক্যাল, মানুষের জীবন থেকে, সমাজের বিত্তহীন পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের কষ্ট গাঁথা। গল্পের শুরুতেই হৃদয়ে দাগ কাটে আর তার বহি:প্রকাশ ঘটে চোখের পানিতে। প্রতিটি গল্পই করুণ। ক্ষুধা, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত, পিতা-মাতার আদর, স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত শিশু-কিশোরদের জীবনের গল্প।
পরী মনে করতো পৃথিবীতে সেই-ই সবচেয়ে কষ্টে বড় হচ্ছে কিন্তু কয়েক বছর আগে ফেলানীর জীবনের গল্প যখন জেলা প্রতিযোগিতায় প্রথম স’ান অধিকার করলো তখন তার কষ্ট নিজের কাছে কোনো কষ্টই মনে হলো না।
ফেলানীর জীবনের গল্পটা ঠিক একরকম ফেলানীর নিজের হাতের লেখা।
ুবাবাকে আমি দেখিনি। শুনেছি বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতে দিনাজপুর এসে মাকে বিয়ে করে। আমি যখন মায়ের পেটের মধ্যে তখন বাবা তার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যায়। বাবা বলে গেছিলো এক সপ্তাহ পরে ফিরে আসবে কিন্তু বাবা তার কথা রাখেনি, আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। মা তখন একা, সবাই মাকে খারাপ খারাপ কথা বলে, নানি বলে তোকে আমি আবার বিয়ে দিবো। প্রথম প্রথম মা আমাকে ফেলে যেতে রাজি হয়নি কিন্তু আমাকে আমার হবু বাবারা কেউ নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। অবশেষে একদিন মা’র বিয়ে হলো, কন্ডিশন হলো মা আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না, আর কোনোদিন আমিও মা’র কাছে যেতে পারবো না।
একদিন সবাই মাকে বউ সাজালো। আমাকে কেউ সামনে যেতে দিলো না। আমি ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম মাকে ওরা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছিলো। তখনো আমি বুঝতে পারিনি আমার মা একটু পরেই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, অন্য কারো বউ হবে এবং অন্য কারো মা হবে। মা যখন চলে যাচ্ছিলো তখন আমি বুঝতে পারলাম আমি আর কোনোদিন মাকে কাছে পাবো না, মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা পাবো না। বাবাকে তো জীবনে দেখিনি, কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারিনি এবার আমার মা বলে ডাকাও বন্ধ হলো।
মা চলে যাবার পর আমি নানির কাছে থাকলাম, তখন আমার বয়স আর কত হবে, পাঁচ কিংবা ছয় বছর। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আমার নানিও মারা গেলো। যাবেই তো, আমি তো ফেলানী, আমাকে সবাই ফেলে যাবে এটাই নিয়ম। দুনিয়াতে এতগুলো মানুষ অথচ আমার কেউ নেই যে আমি কাউকে মা ডাকবো, কাউকে বাবা ডাকবো, কাউকে নানি ডাকবো, কাউকে দাদি ডাকবো। এত একা মানুষ পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার মনে নেই। আমি শুধু একা।’’
গল্পের নাম একা। এই একা গল্পটি যখন ফেলানী গল্প প্রতিযোগিতায় অভিনয় করে দেখালো তখন মঞ্চের সামনে এমন কেউ নেই যার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েনি।
এমনি অসংখ্য ফেলানীর সাথে লেখাপড়া করে, প্রতিদিন নতুন নতুন রূঢ় বাস্তবতার সাথে মিশে আর বই পড়ে দীপাবলীর মতো মেয়েদের বড় হওয়ার কাহিনী পড়ে পরীর মনে অনেক বল হয়েছে। দিনে দিনে সে অনেক স্বপ্ন লালন করেছে।
পরী দীপাবলী শেষ করলো। বইয়ে একটা চুমু দিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, দীপাবলী, আমিও তোমার মতো হবো। পৃথিবীর সব বাধা অতিক্রম করে একদিন আমি অনেক বড় হবো। আমি আকাশ ছুঁয়ে দেখবো দীপাবলী।
পরীর কাছে আর নতুন বই নেই। আবার তাকে যেতে হবে বই আনতে স্কুলে, লাইব্রেরিতে কিন্তু তার তো ঘরের বের হওয়ার অনুমতি নেই।
তার একটা বই আছে, সে যখন সমাপনী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলো তখন স্কুল থেকে তাকে পুরস্কার দিয়েছিলো। মাইকেল এইচ হার্ট এর লেখা ু১০০ মণীষীর জীবনী’’। বইটা পরী একবার পড়ে শেষ করেছে তারপর একটু সময় পেলেই হাতে নিয়ে যেকোনো একজন মণীষীর জীবনী পড়ে। আর মুগ্ধ হয়।
পরী একে একে কয়েকজন মণীষীর জীবনী পড়লো। ক্ষুধা, দারিদ্র, অযত্ন, অবহেলা আর বঞ্চনার মধ্যেই বেশিরভাগ মণীষী বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। বেশিরভাগ মণীষীর জীবনীই তো কষ্টের, লড়াই ও সংগ্রামের। অনেক মণীষীর জীবন খুব এলোমেলো। উচ্চ বিত্ত, নিয়মতান্ত্রিক ও ছকে বাঁধা জীবন যাপন করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন খুব কম মণীষীই।
সে মণীষী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না আবার বই পড়ার পর মনে হয়, ইসস্‌ আমি যদি এতোবড় হতে পারতাম।
এমনিভাবে বই পড়তে পড়তে সে নিজে নিজেই হাসে, নিজে নিজে কাঁদে। বইয়ের এক মহাজগত তাকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগ্রাম করার প্রেরণা যুগিয়েছে। সে তার বাবা-মা’র পছন্দমতো এখনই বিয়ে করবে না। যেমন করেই হোক সে একদিন সব বাঁধা পেরিয়ে উপরে উঠবেই।
বারো

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলো আর পরীর বিয়ের বিষয়ে আর কোনো কথা হলো না। কিন্তু পরী লক্ষ্য করেছে তার অজান্তে বাড়িতে একটা চাপা আলোচনা চলছে। মা তার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। বাবাও প্রয়োজনে দু’য়েকটা কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। পরীর সন্দেহ হচ্ছে নিশ্চয়ই তাকে ঘিরে আবার কিছু একটা ঘটনা ঘটবে। এমনকি এবার তাকে না জানিয়েও হঠাৎ করে বিয়ে হতে পারে। হয়তো সে মালাকে বলার সময় পর্যন্ত পাবে না, ব্র্যাক আপা কিংবা শাকিলা মেম্বারনি তো দূরের কথা।
কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। বরং উল্টো ঘটনা ঘটলো, অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটলো। সে প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘর থেকে উচ্ছ্বিষ্ঠ থালা-বাসন নিয়ে ধুয়ে রাখলো। তারপর তার সেই শত মণীষীর জীবনী বইয়ে সক্রেটিসের জীবনীর একাংশ পড়তে পড়তে সে আপনমনে হেসে উঠলো।
সাবিনা কাছে এলো, কীরে হাসছিস্‌ কেনো?
বই পড়ে মা, বইটা যা ভালো। তুমি যদি পড়তে!
যা আমাকে পড়তে হবে না। কী পড়্‌লি বলতো?
পরী তার মা’র মুখের দিকে তাকালো। তার মা তার কোনো বই-ই দেখতে পারে না। তবু অসহ্য হলেও ক্লাসের বই কিংবা ধর্মীয় বই দেখে রেগে যায় না কিন্তু ক্লাসের বইয়ের বাইরের বই দেখলেই রেগে যায়। ক্লাসের বই ছাড়া আর সব বই সাবিনার কাছে আজেবাজে বই। মানুষকে নষ্ট করার বই। আজ সেই মা তার বই পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখ পরী তার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো, মা তুমি শুনবে? সক্রেটিসের জীবনী।
সক্রেটিস কে?
একজন দার্শনিক।
কী হয়েছে তার জীবনে?
আমি আমার মতো করে বলবো নাকি পড়ে শোনাবো?
গল্পটা তার স্ত্রীকে নিয়ে।
আচ্ছা পড়ে শোনা।
ুতার স্ত্রী জ্যানথিপি (ঢধহঃযরঢ়যব) ছিলেন ভয়ংকর রাগী মহিলা, সাংসারিক ব্যাপারে সক্রেটিসের উদাসীনতা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। একদিন সক্রেটিস গভীর একাগ্রতার সাথে একখানি বই পড়ছিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে জ্যানথিপি গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণ সক্রেটিস স্ত্রীর বাক্যবাণে কর্ণপাত করলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা করতে না পেরে বাইরে গিয়ে আবার বইটা পড়তে আরম্ভ করলেন। জ্যানথিপি আর সহ্য করতে না পেরে এক বালতি পানি এনে তাঁর মাথায় ঢেলে দিলেন।
সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন, আমি আগেই জানতাম যখন এত মেঘগর্জন হচ্ছে তখন শেষ পর্যন্ত একপশলা বৃষ্টি হবেই’’।
সক্রেটিসের জীবনের গল্প শুনে সাবিনাও হেসে উঠলো।
পড়া শেষ করে পরী বইটা বন্ধ করে তার মা’র মুখের দিকে আবার তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, মা তুমি কি আমার মাথায়ও পানি ঢেলে দিবে?
এগুলো কী কথা বলছিস্‌? আমি তোর মাথায় পানি ঢেলে দিবো কেনো?
না, তুমিও তো আমার ওপর রেগে গেছো।
তুই বুঝিস তাহলে?
পরী আবার অনুনয়ের সুরে বললো, মা, আমি আবার স্কুলে যাবো মা।
যাবি?
যা।
আজ সাবিনার সব কথায় পরীর কেমন যেন মনে হলো। মাকে কেউ অবিশ্বাস করে না কিন্তু সাবিনা খুব সহজে কোনো কথা বললেও পরীর মনে হয় এর মধ্যেও কোনো চালাকি বা ষড়যন্ত্র আছে।
পরী আবার জিজ্ঞেস করলো, মা সত্যি বলছো?
সত্যি নাতো কী?
পরী যেন মুক্ত পাখির মতো উড়াল দিলো। বইটা নিয়ে দৌড়ে তার ঘরে রেখে খুব তাড়াতাড়ি প্রস’ত হয়ে বই নিয়ে বের হলো। সাবিনা এত তাড়াতাড়ি পরীকে বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, এত তাড়াতাড়ি?
সময় নেই মা, বলে একরকম দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলো, আসি মা।
সাবিনা আপনমনে বললো, আয়। এতটুকু মেয়ে শেষ পর্যন্ত বিয়ে ঠেকালি। দাঁড়া তুই মনে করেছিস্‌ সব মিটে গেছে। ক’টা দিন পর…

তেরো
স্কুল যাওয়ার পথের মোড়ের আড্ডায় আজও কয়েকজন বখাটে ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। সে একা হেঁটে গেলো, ওদের মধ্যে কেউ কেউ এদিক-সেদিক তাকালো, একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করে কথা বললো কিন্তু পরীকে কিছু বললো না।
অনেকদিন পর স্কুলে এলো বলে কমন রুমে তার বান্ধবীরা তাকে একরকম ঘিরে ধরলো। মালা তো তাকে দেখে মহাখুশি, কীরে এসেছিস তাহলে?
আসবো না, তু্‌ই যেভাবে আমাকে হামজার মতো উদ্ধার কর্‌লি।
মালা জিজ্ঞেস করলো, হামজা কীরে?
হামজা জানিস্‌ না। কোথাও কোনো লঞ্চ ডুবে গেলে শুনিস্‌ না উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা গেছে উদ্ধার করতে।
অ, তাই বল্‌।
আমি মনে করছি হামজা নামে কেউ আবার…
না, হামজা নামে কেউ নেই তোর হিংসে করার কিছু নেই, বলে দু’জনে হেসে উঠলো। তারপর মালা জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে এলি?
মা পাঠিয়ে দিলো।
জলি এলো। জলি পরীর ক্লাস ফ্রেন্ড। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের আধুনিক মেয়ে। কোনো কোনো দিন ক্লাস চলাকালীনও জিন্সের প্যান্ট পরে স্কুলে আসে। এনিয়ে ক্লাস টিচারও তাকে কয়েকবার বকাবাকি করেছে। কিন্তু তার কাউকে হিসেব করার সময় নেই।
সে জলিকে দেখে এক হাত উঁচু করলো, তার দেখাদেখি পরীও একটা হাত উঁচু করলো তারপর দু’জনে হাতে হাত ঠেকিয়ে জলি বললো, ওয়াও। পরী তুই এসেছিস্‌ দোস্ত?
পরী মাথা নেড়ে জানালো, সে এসেছে।
শুনলাম তোর নাকি বিয়ে?
হতে যাচ্ছিলো কিন্তু হয়নি।
তোকে কেনো বিয়ে দিতে চাচ্ছিল রে? তুই কি কারো সঙ্গে ইয়ে করে, মানে…
দূর, আমি কারো সঙ্গে…
তো?
দেখছিস্‌ না, রাস্তায় বখাটে ছেলেরা আমাকে দেখলেই…
রাস্তার বখাটে ছেলেদের আর দোষ কী? তোকে দেখলে তো আমারই ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। তুই যা সুইট, বলে জলি পরীর থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করলো।
যাহ্‌। বলে পরী জলিকে মৃদু ধাক্কা দিলো।
শোন, তোর জায়গায় যদি আমি হতাম। রাস্তায় বখাটে ছেলেদের অত্যাচারে যদি আমার স্কুল যাওয়া-আসা বন্ধ হতো তবে আমি ওদের দেখে ছাড়তাম।
কী করতিস্‌ তুই?
কী করতাম মানে? কী করতাম না তাই বল্‌।
আমাকে বল্‌?
জলি দুই হাত কোমরে রেখে বললো, হুঁ। তারপর কোমর থেকে হাত নামিয়ে বললো, আমার সাহস তো দেখিস্‌নি। আমি হলে রাস্তার মোড়ে থাপ্পড়াতাম, কান ধরে উঠবস করাতাম।
আশেপাশে আরো যে মেয়েরা তাদের কথা শুনছিলো তারা সবাই হাততালি দিলো।
আর যদি বাবা-মা তোকে এমনিতেই বিয়ে দেয়? মালা জিজ্ঞেস করলো।
তোর মাথা খারাপ, আমি বিয়েই করতাম না।
কী করতিস্‌ শুনি?
আমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলবো বলে জলি গলা ঝেড়ে বললো, এই বিয়েতে আমার মত নেই। আমি বিয়ে করবো না।
মালা বললো, এটা কী সম্ভব?
জলি মালার কাঁধের ওপর হাত রেখে বললো, কিন্তু একটা কথা কি জানিস্‌?
মালা এবং পরী দু’জনে জলির মুখের দিকে তাকালো।
বাবা-মা যখন বিয়ের কথা তোলে তখন মেয়েরাও মনে মনে বউ সেজে বাসর ঘরে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। বলে জলি পরীর কাছে গিয়ে ওড়না দিয়ে ওর মাথায় ঘোমটা বানিয়ে পরীর থুতনি উঁচু করে বললো, তাই না রে দোস্ত?
পরী হাত দিয়ে জলিকে দূরে ঠেলে দিয়ে বললো, যাহ্‌।
এমনসময় ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠলো। সবাই ক্লাসে গেলো। অনেকদিন পর ক্লাসে ঢুকে পরী একবার পুরো ক্লাস রুমটা ভালো করে দেখলো। সে কল্পনার রাজ্যে ডুবে আছে। তার মনে হচ্ছে এখানে আসার অধিকার সে হারিয়েই ফেলেছিলো সে অধিকার আবার পাবার পর ক্লাস রুমটাকে সে যেন আজ নতুন করে আবিস্কার করলো।
ক্লাস টিচার পরীর রোল নাম্বার বলে ডাক দিলো, এক। রোল নাম্বার ওয়ান।
পরী কল্পনায় এতোই ডুবে ছিলো যে সে শুনতেই পেলো না।
ক্লাস টিচার আবার ডাক দিলো, রোল নাম্বার এক। পরী।
সবাই পরীর দিকে তাকিয়ে আছে, মালা তার পাশে বসেছিলো, সে মৃদু ধাক্কা দিলো, এই পরী।
পরী চমকে উঠলো।
স্যার তোর রোল কল করেছে। দাঁড়া।
পরী প্রথমে থতমত খেল। তারপর দাঁড়িয়ে বললো, প্রেজেন্ট স্যার।

চৌদ্দ

সেদিনের ঘটনাটা যেন বাংলা সিনেমাকেও হার মানায়। বাংলা সিনেমায় যেমন নায়িকা খলনায়কের দ্বারা আক্রান্ত হলে হঠাৎ নায়ক এসে নায়িকাকে উদ্ধার করে তেমনি। সেদিন ক্লাস শেষে পরী বাড়ি ফিরছিলো, সঙ্গে আরো কয়েকজন মেয়ে তার জুনিয়রও ছিলো। নিত্যদিনের মতো রাস্তার মোড়ে কয়েকজন বখাটে ছেলে দাঁড়িয়েছিলো। তবে জলির কথা শুনে আজ পরীর বুকে অনেকটা সাহস হয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগের দিনের মতো বখাটে ছেলেরা তাকে টিজ করলে সে অপরাধ না করেও আর অপরাধীর মতো মাথা নত করে পালিয়ে যাবে না। আজ তার পা দু’টো আর শিথিল হয়ে আসবে না। সে সোজা হয়ে দাঁড়াবে, ঠিক জলি যেমন কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তেমন করে।
এই বখাটে ছেলেদের দলনেতার নাম হিটু। এই হিটুকে পরী চেনে, ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর আর লেখাপড়া করেনি। হিটুর চোয়ালের মাংস বসে গেছে, চোখ দু’টো বসে গেছে কোটরে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো। একটা ভালো নাম আছে কিন্তু সবাই তাকে হিটু বলে ডাকে, এই এলাকার বখাটে হিসেবে তার অখ্যাতি আছে। শুধু অখ্যাতি না। রাজনীতির খাতায় নাম থাকার সুবাদে এলাকার বড় বড় নেতাদের সঙ্গে তাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় আর সবার আতঙ্ক সেখানেই। সে যাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে তাদের সাথে পুলিশের ওপর মহলের সখ্যতা আছে। সে পর্যন্ত হলেও বেশি আতঙ্ক ছিলো না। সাধারণ মানুষের ধারণা হিটু যাদের সাথে ঘোরাফেরা করে তারা শুধু পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে তো বটেই, স্বয়ং পুলিশ অফিসাররা পর্যন্ত তাদের নামে আতঙ্কে থাকে। আর সেজন্যই সবাই হিটুকে সমীহ করে চলে।
এতক্ষণ হিটু তার মোটর সাইকেলের ওপর শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। পরীকে মোড়ে আসতে দেখে তাকে শুনিয়ে হিটু তার এক চ্যালাকে জিজ্ঞেস করলো, এই বাটু দেখতো পাখিটা খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো নাকি? দেখতে তো আমার ময়না পাখিটার মতোই লাগে।
জি বস। আপনি ঠিকই বলেছেন।
এদিকে আসতে বল্‌।
হিটুর চ্যালা পরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়ালো বললে ঠিক হবে না বলা যায় পথ রোধ করে দাঁড়ালো, এই যে ম্যাডাম বস আপনাকে ডাকে।
পরী দাঁড়ালো। চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকাতেই চ্যালা কিছুটা ভয় পেলো। পরী বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে তোর বস?
সে একটা ঢোক গিলে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, ঐ যে মোটর সাইকেলে।
পরী একবার এদিক-সেদিক তাকালো। দূর থেকে একটা মোটর সাইকেলে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আসছে। তারা তার পরিচিত না। কিন্তু মানুষ তো, মানুষ তো মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে। আমি বিপদে পড়ছি দেখে হয়তো তারা আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। পরী একবার পিছু ফিরে তাকালো। তার আশেপাশে যে ছোট ছোট মেয়েরা আছে তাদের দিকে তাকিয়ে সে আরো সাহসী হলো এজন্য যে আজ জলি যখন কমন রুমে গল্প করছিলো তখন এই ছোট ছোট মেয়েরাও তার কথা শুনে হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিল। কেউ তার বিপদে এগিয়ে আসবে এটাও একটা সাহস আর জলি তাকে আজ যা ট্রেনিং দিয়েছে তাতে তার বুকে অনেকটা সাহসও জন্মেছে।
পরী একটা মেয়েকে তার বইগুলো দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, এই তোরা একটু দাঁড়া তো আমি আসছি, যাবি না কিন্তু।
মেয়েরা দাঁড়ালো। পরী সাহস করে হিটুর দিকে এগিয়ে গেলো। চ্যালাও তার সঙ্গে সঙ্গে গর্ব ভরে গেলো। চ্যালার বিশ্বাস ছিলো হিটুর কথায় পরী রাজি হবে। হিটুর কথার বাইরে যায় এই অঞ্চলে এমন কে আছে।
পরী হিটুর মোটর সাইকেলের কাছে গিয়ে জলি যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলো সেভাবে দু’হাত কোমরে বেঁধে দাঁড়ালো, আপনি আমাকে ডেকেছেন?
হিটু নিজেও কখনো ধারণা করেনি যে পরী সাহসী হতে পারে। সে পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
বলুন কী বলবেন?
হিটু গম্ভীর স্বরে বললো, একদিন তো বলেছি, এক কথা কয়বার বলতে হবে?
কী কথা?
কী কথা মনে নেই?
আপনাকে ভালোবাসতে হবে?
হিটু মৃদু হেসে বললো, অসুবিধা কী।
বিয়ে করতে হবে?
হিটু আবারো একইভাবে মাথা উঁচু নিচু করে জানালো বিয়ের কথা।
ভালোবাসার কথা, বিয়ের কথা শুনে হিটুর মুখ একটু উজ্জ্বল হলো, বুঝেছই তো। তুমি তো খুব ট্যালেন্ট মেয়ে, না বোঝার তো কথা না। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সারাজীবন শুনেছি ফার্স্ট বয় হয়, তুমি তো আবার ফার্স্ট গার্ল। সব নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছো।
ও সব নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছি। ফার্স্ট বয় হয় আমি গার্ল হয়ে ফার্স্ট হয়েছি। বুঝেছেনই তো, আমি সব নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছি। আপনি কী করে ভাবলেন আপনি দু’য়েকদিন রাস্তায় আমাকে ভয় দেখাবেন আর আমি সুড়সড় করে গিয়ে আপনাকে বিয়ে করবো?
হিটু কোনো কথা বললো না।
আমি আরো কিছু নিয়ম ভঙ্গ করবো। আপনি কি জানেন আপনার এই ভালোবাসা, বিয়ের জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে?
নষ্ট হবে কেনো? আমি তো আছি। আমাকে বিয়ে করে ফেলো।
আমি আপনাকে বিয়ে করবো?
কাউকে না কাউকে তো বিয়ে করবাই। আমি কি দোষ করলাম?
পরী রাগে ফেটে পড়ছে। সে মাথা একবার উঁচু আরেকবার নিচু করে বললো, কাউকে না কাউকে আমি বিয়ে করবো, না? তাই কাউকে বিয়ে না করে আপনাকে করতে হবে?
হিটুর কয়েক জন চ্যালা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তারা দূর থেকে দেখে বুঝতে পাচ্ছে যে তাদের বসের সঙ্গে পরীর তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, জোর করে ভালোবাসার তর্ক।
পরীর একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলো মোটর সাইকেলটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কেনো জানি মনে হলো এই মোটর সাইকেলের ছেলেটা তার পাশে দাঁড়াবে। সে আরো সাহসী হলো। এবার সে তার পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিয়ে হিটুর গালে উপর্যুপরি মারতে মারতে বললো, তোকে বিয়ে করতে হবে, না? তোর জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তোর ভয়ে, তোর অত্যাচারের অজুহাতে বাবা-মা আমাকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি আজ তোকে ছাড়বো না। তোর মতো…
হিটুর চ্যালারা দৌড়ে কাছে আসছিলো ততক্ষণে সেই ছেলেটি মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করে দৌড়ে এগিয়ে এলো। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হলো মারামারি, ধ্বস্তাধ্বস্তি। মোটর সাইকেলের পিছনে যে মেয়েটি বসে ছিলো সে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললো, এই মেয়েরা তোমরা কী দেখছ, এসো আমার সাথে, ওদের ধরো।
মেয়েরা সাবাই হিটু এবং তার দলবলকে আক্রমণ করতেই হিটুর দলবল ছুটে পালাতে লাগলো।
মোড়ে আরো পথচারী জড়ো হলে। অনেকেই দূর থেকে দেখে মিট্‌মিট করে হাসছে আবার কেউ কেউ বলছে, হিটুর গায়ে হাত! মেয়েটার এতবড় সাহস!
মার খেয়ে হিটুর ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। সে রক্ত মুছে মাথা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে বললো, হুঁ।
মোটর সাইকেল ওয়ালা ছেলেটা হিটুর শার্টের কলার ধরে বললো, হুঁ কীরে। আরেকদিন পেলে দেখে নিবি এই তো? তার আগে কান ধরে উঠবস কর। আর বল্‌ আর কোনোদিন কোনো মেয়েকে টিজ কর্‌বি না।
হিটু প্রথমে অস্বীকৃতি জানালো।
ছেলেটি হিটুর কান ধরে বললো, তুই উঠবস কর্‌বি, নাকি আমি কান ধরে উঠবস করাবো?
হিটু অসহায়ভাবে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে কান ধরে উঠবস করতে করতে বললো, আর কোনোদিন কোনো মেয়েকে টিজ করবো না।
মেয়েরা সবাই হাত তালি দিলো।
এবার হিটু থামলো।
ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো, এই মোড়ে আর আড্ডা দিবি?
হিটু ডানে-বাঁয়ে মাথা বাঁকা করে জানালো সে আর কোনোদিন এই মোড়ে আড্ডা দিবে না।
আর তোমরা বলে ছেলেটি অন্য মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো, আর তোমরা, তোমাদের একজন বোনকে একটা বখাটে ছেলে টিজ করছে দেখে তোমরা দাঁড়িয়ে আছো, না? কাল যখন আরেকজনকে টিজ করবে তখন? এভাবে সবাই মিলে বখাটেদের ধরে সাইজ করবে, বুঝলে? একতাই বল। তোমরা সবাই মিলে এভাবেই নিজেদের রক্ষা করতে হবে। পারবে না?
মেয়েরা সবাই সমর্থন দিলো।
হিটু অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে ছিলো, সে মিনমিন করে বললো, ভাই আমি যাবো?
যাবি, তবে আর কোনোদিন এই মোড়ে আসবি না, কোনোদিন কোনো মেয়েকে টিজ কর্‌বি না। আমি যদি কোনোদিন শুনি… তো বলে ছেলেটি দাঁত কড়মড় করলো।
হিটু মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো।
ছেলেটি আবার বললো, যা কোনোদিকে তাকাবি না, সোজা নেড়ি কুত্তার মতো চলে যাবি।
হিটু মোটর সাইকেল নিয়ে চলে গেলো।
ছেলেটিও মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো।

পনেরো

সেই বাংলা সিনেমার কথাটা পাড়া গ্রামে রটে গেলো। কেউ কেউ এর সঙ্গে আরো রঙচঙ মিশিয়ে হাট-বাজারে, চায়ের দোকানে গালগল্প করতে লাগলো। পরী বাড়ি ফিরে সোজা তার রুমে এমনভাবে ঢুকলো যেন কিছুই হয়নি। সে যে হিটুর মতো একজন সন্ত্রাসীর গায়ে হাত তুলেছে এবং এটা যে ভয়ংকর রুপ ধারণ করতে পারে বিষয়টিকে সে সেভাবে গ্রহণ করলো না। তার মনে তখন বিজয়ের অহংকার।
পরী ভাবতে থাকে সারা দেশের মেয়েরা যদি এমনিভাবে নিজেরাই প্রতিরোধ করতে শেখে তবে একদিন বখাটে, উত্যক্তকারী বলে শব্দটা ডিকশনারি থেকে উঠে যাবে। হিটুর মতো সন্ত্রাসীর গায়ে হাত তোলা তো শুধু সাহসের ব্যাপার না, দু:সাহসেরও।
পরী ফিরে আসার আগেই আতা বিরল হাটে গেছে। সাধারণত আতা হাটে গেলে বাড়িতে ফিরে আসে অনেক দেরিতে কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো। তার চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ। বাড়ি ফিরেই সে জোরে জোরে পরী পরী বলে ডাক দিলো।
পরী বুঝতে পেরেছে সাধারণত পরীকে তার বাবা এভাবে ডাকে না। সুন্দর করে আদরের সুরে ডাকে, পরী এদিক আয় তো মা।
গরমের দিনে পরীকে এভাবে তার বাবা ডাক দিলে সে উঠানে পাটি বিছিয়ে দেয়, বাবার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পাখা দিয়ে বাতাস করে। তারপর একসময় আতা নিজেই বলে, থাক মা, তুই যা পড়তে বস্‌।
তখন পরী টিউবওয়েল থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দেয়। তারপর সে তার ঘরে চলে যায়। লেখাপড়ায় মন দেয়।
কিন্তু তার বাবার আজকের ডাক শুনে পরীর বুক কেঁপে উঠলো। সে তার ঘরের দরজার কাছে এসে অপরাধীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
সাবিনা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে কয়েক মুহূর্ত আতার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
আতা রাগান্বিত স্বরে বললো, কী হয়নি তাই বলো? তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো?
সাবিনা দরজার দিকে উঁকি মেরে দেখলো, পরী চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ-মুখ অন্ধকার।
সে আতাকেই জিজ্ঞেস করলো, ও কেনো, তুমিই বলো?
আতা পরীর স্কুল থেকে আসার সময় মোড়ের সেই সিনেমাটিক ঘটনার বিবরণ দিতেই, সাবিনার মুখ শুকিয়ে গেলো, কী বলছো তুমি?
হ্যাঁ, তোমার মেয়ের সাহস দেখ, হিটুর মতো সন্ত্রাসীর গালে সে জুতো মেরেছে। আবার রাস্তার কোন ছেলেকে দিয়ে কান ধরে উঠবস করিয়েছে।
সাবিনা কয়েক মুহূর্ত ঝিম মেরে বসে রইলো। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাবিনা মুখ ভার করে বসে আছে, আতার চোখ-মুখ লাল আর পরীর দু’চোখ পানিতে ছল্‌ছল্‌ করছে।
অনেকক্ষণ পর সাবিনা আপনমনে বলতে শুরু করলো, আমি আরো দু’টো মেয়ে মানুষ করেছি কারো বিরুদ্ধে কোনো কপ্লেইন আসেনি, পাড়া-গাঁয়ের সবাই বলতো আতার মেয়ে দু’টো খুব ভালো, শান্ত-শিষ্ট। মেয়েদের বিয়ের কথা হলো, মুখ ফুটে একটা কথা পর্যন্ত বললো না। কোনোদিন স্কুলে যায়নি অথচ বাবা-মা’র প্রতি কত ভক্তি, শ্রদ্ধা, বলে সাবিনা একবার পরীর দিকে তাকিয়ে বললো, আর তুই, তুই লেখাপড়া শিখেছিস্‌, ভেবেছিলাম লেখাপড়া শেখা মেয়ে ভালো হবে? এই তোর ভালো? আমার মূর্খ মেয়েরা আমাদের সব কথা বিনা বাক্যে মেনে নিলো আর তোর বিয়ের কথা উঠতেই ব্র্যাক আপা এসে হাজির। বিয়েতে একটা প্যাঁচ লাগলো। তারপর এলো শাকিলা মেম্বারনি। দেশে এতকিছু হচ্ছে, প্রকাশ্যে মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে তাতে আইন ভাঙ্গে না আর আমরা আমাদের মেয়ে বিয়ে দিবো তাতে এমন কী দোষ যে আমাদের জেল হবে, জরিমানা হবে। ব্র্যাক আপার কথা তুই ভরসা পেলি না একেবারে মেম্বারনিকে নিয়ে এলি।
পরী মিনমিন করে বললো, আমি কীভাবে আনলাম মা, আমি তো বাড়িতেই আছি।
থাক আর কথা বলতে হবে না। তারপর তো আবার স্কুল যেতে শুরু করলি এবার এমন একটা কাণ্ড করলি…
এই তো কয়েক মাস আগের কথা। ঠিক এরকমই একটা ঘটনা। বিরলের এক ছেলে একটা মেয়েকে প্রায় টিজ করতো, প্রেমের প্রস্তব দিতো, বিয়ের প্রস্তাব দিতো। কথাটা জানাজানি হওয়ার পর মেয়েটির বাবা নিজেই তার মেয়েকে মোটর সাইকেলে করে স্কুল দিয়ে আসতো এবং নিয়েও আসতো।
একদিন মেয়েটির বাবা হঠাৎ অসুস’ হয়ে পড়লো। মেয়েটির পরীক্ষা। কীভাবে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? আগের দিনে স্কুল অনেক দূরে দূরে ছিলো এবং যাতায়াতের তেমন কোনো যানবাহনও ছিলো না। তখন ছেলেমেয়েরা পায়ে হেঁটে আলাদা আলাদা দলবেঁধে স্কুলে যেতো। এখন ঘন ঘন স্কুল হয়েছে, দূরত্ব কম হলেও ছেলেমেয়েরা আর পায়ে হেঁটে স্কুল যায় না, যার যার মতো রিক্‌শা, ভ্যান বা অটো রিক্‌শায় চড়ে স্কুল যায়। তাই আগের দিনের সেই দল আর নেই, ক্লাস ফ্রেন্ডদের মধ্যে সেই আন্তরিকতাও নেই। এখন সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসে, সামনে রিক্‌শা, ভ্যান বা অটো রিক্‌শা পায় তারপর হাত তুলে, সেই ত্রিচক্রযান পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়, আবার স্কুল থেকে বেরিয়েই ঠিক একইভাবে বাড়িতে ফিরে।
সেই মেয়েটির মা প্রথম প্রথম কয়েকদিন মেয়েটিকে স্কুল এবং বাড়ি আনা-নেয়া করতো কিন্তু একদিন কী মনে করে মেয়েটিকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে একটা অটো রিক্‌শায় তুলে দিয়ে বললো, যা মা, সাবধানে যাবি।
মেয়েটি হাত তুলে জানালো সে সাবধানেই যাবে।
কারো কোনো ত্রুটি ছিলো না। মেয়েটি ঠিক মতোই স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা অটো রিক্‌শায় উঠলো। অটো রিক্‌শায় আরো কয়েকজন যাত্রী ছিলো। রাস্তা যেতে যেতে প্রায় সব যাত্রী নেমে গেলো। তখন অটো রিক্‌শায় থাকল শুধু সেই মেয়েটি।
মেয়েটির অটো রিক্‌শার সামনে একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ালো। অটোর ড্রাইভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন তরুণ নেমে এসে মেয়েটির মুখে কাপড় চেপে ধরে তাকে মাইক্রোবাসে তুললো। তারপর দ্রুতবেগে মাইক্রোবাসটি চলে গেলো। রাস্তায় তখন অনেক পথচারী যাতায়াত করছিলো কিন্তু কেউ কিছু বললো না, কেউ প্রতিবাদও করলো না। আগের দিনে কেউ কোনো অন্যায় করলে মানুষ সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, প্রতিরোধ করতো। কিন্তু এখন অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে মানুষ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। চোখের সামনে ছিনতাই হয়, স্কুলগামী মেয়েদের বখাটেরা উত্যক্ত করে, এমনকি জোর করে তুলে নিয়ে গেলেও মানুষ প্রতিবাদ করে না। দুর্বৃত্তরা এতো প্রভাবশালী আর ক্ষমতাবান যে তাদের সামনে কেউ চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায় না। প্রতিবাদের ঝান্ডা তোলার মতো মনোবল মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মানুষ যদি ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিবেক মনুষত্ব, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতা, মনোবল ও মানসিকতা হারিয়ে ফেলে তবে মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে তফাৎ কোথায়? শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার মানুষ আর শ্রেষ্ঠ কীসের? প্রভাব প্রতিপত্তি আর পেশী শক্তি যদি শাসনের হাতিয়ার হয় তবে আর সমাজ কীসের? রাষ্ট্রের শাসন কীসের? জোর যার মুল্লুক তার।
পরী যখন ব্র্যাক স্কুলে পড়তো তখন সে ব্র্যাক কিশোরী ক্লাবের সদস্য ছিলো। সদস্য এখনো আছে কিন্তু আগের মতো আর যাওয়া হয় না। সেই কিশোরী ক্লাবের অনেক মেয়ে খেলোয়াড় আছে, ক্রিকেটার, ফুটবলার, আরো অনেক খেলোয়াড়। সেই ক্লাবে একদিন একটা মেয়ে এলো। তার হাঁটুনি, চলাফেরাই অন্য রকম। পরে জানা গেলো সে কারাত জানে। কিশোরীদের সামনে সে দেখালো কীভাবে প্রতিপক্ষকে শারীরিক শক্তি দিয়ে মোবাবেলা করতে হয়।
তার এমন আচরণ দেখে মেয়েদের মধ্যে ফিসফিস শুরু হলো, আমরা মেয়ে মানুষ আমরা কারাত শিখে কি ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতে যাবো?
মেয়েটি বললো, হ্যাঁ যাবে।
মেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করতে লাগলো।
মেয়েটি বললো, যাবে, কারণ যারা অত্যাচার করে, নির্যাতন করে, টিজ করে তারা ছেলেও না, মেয়ে না, মানুষও না। কাজেই তাদের ফেস করার সময় ছেলে না মেয়ে এটা চিন্তা করবে না।
আজ হিটুর ভয়ে যখন আতা অসি’র হয়ে পড়েছে তখন পরীর সেই কারাত জানা মেয়েটির কথা মনে পড়লো, ইসস আমার যদি কারাত জানা থাকতো তবে…
কিশোরী ক্লাবে শুধু খেলাধুলাই শেখানো হয় না, প্রতিকূল অবস’ায় কীভাবে মেয়েদের মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় সেটাও শেখানো হয়। ক্লাবে শেখানো হয় রাষ্ট্রের কোন সংস’া কীভাবে মেয়েদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য কোথায় যেতে হয়।
দেশে যে শুধু মেয়েদের টিজ হওয়া, অপমান হওয়া, অপহরণ হওয়া কিংবা নির্যাতনের ঘটনাই ঘটে তা না। এর বিপরীত চিত্রও আছে। ইদানীং বিভিন্ন স’ানে মেয়েদের টিজ করার অপরাধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বখাটেদের শাস্তির নজিরও প্রায় দেখা যায়। কিশোরী ক্লাবে গিয়ে পরী তাও জেনেছে। তার বাবাকে দুশ্চিন্তগ্রস’ দেখে পরী বললো, বাবা তুমি কিছু চিন্তা করো না তো, দেখবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। হিটু আর কোনো কিছু করার সাহসই পাবে না। আবার কেউ যদি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করে তবে আমি নিজেই ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে ফোন করে ওদের জেলে পাঠিয়ে দিবো।
পরীর কথা শুনে আতা চমকে উঠলো, তুই ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্‌বি?
হ্যাঁ, পুলিশও ডাকবো।
আতা রেগে তোতলাতে লাগলো, শুনেছো শাপলার মা? শুনেছো? তোমার মেয়ে কী বলছে?
সাবিনা দাঁত-মুখ খিচিয়ে চাপা স্বরে বললো, এই চুপ, চুপ, তুই তোর ঘরে যা।
পরী আর কোনো কথা বললো না। সে তার ঘরে চলে গেলো।

ষোলো

পরী ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে আর সহজে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না। তার বার বার করে মনে হচ্ছে বিয়ে বন্ধের ব্যাপরটা সাময়িক আবার কোনো না কোনো দিন বাবা-মা ঠিকই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলবে। তাহলে আর লেখাপড়া শিখে কী হবে।
অনেক দিন পর স্কুলে আসাতে তার মনে হচ্ছে সেও হয়তো হারিয়ে গেছে আলেয়ার মতো। পরীর ক্লাস ফ্রেন্ড আলেয়া। পরী তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো একদিন ক্লাস টিচার ময়মুনা ক্লাসে ঢুকে রোল কল করতে শুরু করলো, রোল নাম্বার এক।
পরী উঠে দাঁড়ালো, প্রেজেন্ট আপা।
রোল নাম্বার দুই
প্রেজেন্ট আপা।
এভাবে নাম ধরে ডাকতে ডাকতে রোল নাম্বার সাত ডাকার পর কোনো সাড়া না পেয়ে ময়মুনা মাথা উঁচু করে একবার পুরো শ্রেণি কক্ষ চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আলেয়া, আলেয়া নেই?
কেউ কথা বললো না।
পিছনের একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে ফিস ফিস করে বললো, তুই বল্‌।
সেই মেয়েটি আবার আরেকটি মেয়েকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে একটা লাজুক হাসি হেসে বললো, না, তুই বল্‌।
ময়মুনা বললো, কী হয়েছে ববি তুমি বলো তো?
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো, তার লাজুক মুখ রাঙা হয়ে গেলো, সে একবার বললো, আপা আমি বলতে পারবো না।
কেনো? কী হয়েছে?
ময়মুনা অন্য একটা মেয়ের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, এই মমতা তুমি বলো তো?
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো, সে একটা লাজুক হাসি হাসতে হাসতে তার ওড়নার কোণা মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো, আপা ওর বিয়ে।
ময়মুনার মুখের ওপর একটা কালো মেঘ ঢেকে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্রেণি কক্ষটা নীরবাতায় ডুবে গেলো। তারপর ময়মুনা আবার রোল নাম্বার ডাকতে শুরু করলো, বিলকিস।
প্রেজেন্ট আপা।
সেদিন ক্লাসের নির্ধারিত পড়ার পর ময়মুনা ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বাল্য বিবাহের কুফলের ওপর আলোচনা করলো। তারপর একে একে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলো, এই ববি তুমি বলো তো অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের কী কী সমস্যা হয়?
আপা অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের স্বাস’্য নষ্ট হয়ে যায়।
আর-
মেয়েদের শরীর দুর্বল হয়ে যায় ও নানান রকম অসুখ হয়।
ববির পর ময়মুনা জিজ্ঞেস করলো মমতাকে।
মমতা তুমি বলো তো?
মমতা উঠে দাঁড়ালো, আপা অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের বাচ্চা দুর্বল হয় এবং অপুষ্টিতে ভুগে।
এমনিভাবে বাল্য বিবাহের ওপর সবাইকে নানান রকম প্রশ্ন করলো।
সেদিনের ময়মুনার বক্তৃতা আর ছাত্রীদের প্রশ্ন উত্তর পরী মনে গেঁথে গিয়েছিলো। ময়মুনা শুধু বাল্য বিবাহের কুফলের ওপরই বক্তৃতা দেয়নি ছাত্রীদের বড় হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নও দেখিয়েছিলো আর সেই স্বপ্নই হৃদয়ে ধারণ করেই পরী এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।
বিয়ের পর আলেয়া আবার স্কুলে এলো।
তখনো ময়মুনা ক্লাসে আসেনি। আলেয়াকে দেখে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা হাসাহাসি শুরু করলো।
আলেয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
হ্যাপি মাঝখানে কয়েক দিন স্কুলে আসেনি। সে বরাবরই একটু ডানপিটে প্রকৃতির। সে আলেয়ার কাছে গিয়ে ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, শুনলাম তোর নাকি বিয়ে হয়েছে?
আলেয়া কোনো কথা বললো না।
তুই আমাদের একবার বল্‌লি না। আমরাও যেতাম।
আলেয়া লজ্জায় সংকুচিত হয়ে দাঁত দিয়ে ওড়নার কোণা কামড়াচ্ছিল। হ্যাপি ওর হাত থেকে ওড়না সারিয়ে দিয়ে বললো, লজ্জা করিস্‌ না তো, বল্‌।
আলেয়া তবুও কিছু বললো না।
হ্যাপিও নাছোড়বান্দা। সে আবারো বললো, তুই আমাদের বল্‌লি না কেনো?
আমি কি আগে থেকে জানতাম যে আমার বিয়ে হবে।
তুই জানতিস্‌ না?
না। সেদিন স্কুল থেকে গেলাম, তবুও কোনো কথা নেই। রাতে হঠাৎ করে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো।
আলেয়াকে তার বিয়ের কথা বলতে শুনে হ্যাপির সঙ্গে তার আরো কয়েকজন বান্ধবী যোগ দিলো।
হ্যাপি জিজ্ঞেস করলো, দুলাভাই কী করে রে?
আলেয়া বললো, ঢাকায় থাকে।
তোকে নিয়ে যাবে না?
যাবে, ঢাকায় বাসা ঠিক করে তারপর আমাকে নিয়ে যাবে।
হ্যাপি বললো, ইসস্‌ তুই ঢাকা থাক্‌বি?
আলেয়া গর্বভরে জানালো সে ঢাকায় থাকবে।
কয়েকদিন পর থেকে আলেয়া আর স্কুল এলো না। পরে জানা গেলো। আলেয়া তার স্বামীর সঙ্গে ঢাকা চলে গেছে।

সতেরো

যে বিয়ের আয়োজনকে কেন্দ্র করে এতোসব ঘটনা সে বিয়ের আলাপটা তো শেষ হয়ে গেছে। বিয়ের আলাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পুরো দোষটাই চাপলো পরীর কাঁধে। হ্যাঁ দোষটা তো পরীরই বটে। মেয়েরা হবে সরলা, অবলা, স্বামী ভক্ত। বাপ-মা’র কথা নীরবে মেনে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে এটাই মেয়েদের জন্য শোভনীয়। বিয়ের পর স্বামীর সেবা যত্ন করবে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের মন জয় করে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে এটাই হওয়া বাঞ্চনীয়। কিন্তু বিয়ে ঠেকাতে যে মেয়ে ব্র্যাক আপাকে ডেকে আনতে পারে, যে মেয়ে হিটুকে প্রকাশ্য জুতা মারতে পারে, প্রয়োজনে যে মেয়ে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ডাকতে পারে সে মেয়ে তো উশৃঙ্খল, বেহায়া, বখে যাওয়া মেয়ে। সে মেয়েকে বিয়ে করার সাহস কোন বাপের বেটার?
এলাকা জুড়ে পরীর দুর্নাম রটে গেলো। এই দস্যু মেয়েকে নিয়ে আতা এখন কী করবে। স্কুল পাঠাতে গেলে আশঙ্কা আছে হিটুর প্রতিশোধ নেয়ার, বিয়ে দিতে গেলে কঠিন হয়ে গেলো পাত্র পাওয়ার। মেয়েদের গায়ে একবার দাগ পড়লে তা সহজে মুছে যায় না।
মোড়ের আড্ডাটা আর নেই। তবে থমথমে ভাবটা আছে। আজকাল মেয়েরা স্কুল যাওয়ার পথে মোড়ে একটু সাবধানে যায়। কোনো কোনো মেয়ের গার্জিয়ান মেয়েদের স্কুলে দিয়ে আসে। তাছাড়া সেদিনের ঘটনার পর স্কুলের প্রধান শিক্ষকও সচেতন হয়েছেন আর তার উদ্যোগে মাঝে মাঝে সেই মোড়ে পুলিশ মহড়ারও আয়োজন হয়েছে। এরকম ঘটনা থেকে যেন পাতি মাস্তানরাও শিক্ষা নিয়েছে। পরীর মনে হলো সবকিছু থেমে গেছে আপাতত: সে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
পরীর চলাফেরা আবার স্বাভাবিক হয়েছে। সে আগের মতো স্কুল যায়, টিফিনের সময় ব্র্যাক লাইব্রেরিতে বসে, সপ্তাহে দুই দিন কিশোরী ক্লাবে যায়।
কিশোরী ক্লাবে খেলার সব সরঞ্জাম আছে। ফুটবল, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, দাবা, লুডু ইত্যাদি। পরী দাবা খেলতে পারে। একবার কিশোরী ক্লাবে সে দাবায় জেলা চ্যম্পিয়ান হয়েছে। তারপর আর এগুতে পারেনি। পরীর অনেক ইচ্ছা ছিলো সে ফুটবল খেলবে কিন্তু বাবা-মা তার ফুটবল খেলায় সম্মতি দেয়নি। সাবিনা তো ফুটবল খেলার নাম শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলো, মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলবে কেনো? দাবা খেল, লুডু খেল ঠিক আছে কিন্তু হাজার হাজার পুরুষ মানুষের সামনে ফুটবল খেল্‌বি?
সেই থেকে পরী আর ফুটবল খেলার দিকে পা বাড়ায়নি। তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি।
আজ পরী ক্লাবে এসে দেখে পাশের বাড়ি থেকে ক্লাব ঘরে একটা টেলিভিশন আনা হয়েছে। পরী কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে পুরো ঘরটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর অন্তরাকে জিজ্ঞেস করলো, কীরে অন্তরা ক্লাবে টি.ভি কেনো?
অন্তরা উল্টো জিজ্ঞেস করলো, তুই জানিস্‌ না?
নাতো? কী হয়েছে?
আজ ব্র্যাক কিশোরী ক্লাবের কিশোরীদের ফুটবল খেলা টি.ভি’তে দেখাবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সেজন্যই তো এতসব আয়োজন।
কোন্‌ কোন্‌ দল?
কিশোরী ক্লাবেরই দু’টা দল হয়েছে। একদল আর্জেন্টিনা আরেক দল ব্রাজিলের জার্সি পরে খেলবে।
এভাবে আরো দু’য়েকটা কথা বলতে বলতে খেলা শুরু হয়ে গেলো।
শুরুতেই খেলায় উত্তেজনা চরমে। মেয়েরা খুব ভালো খেলছে, খেলার ধারা ভাষ্যও উত্তেজনা আছে। ধারা ভাষ্যকার বার বার করে একটা নাম বলছে। পরীর খুবই পরিচিত নাম। কী যেন নামটা বলছে স্বপ্না।
অনেকক্ষণ পর পরী অন্তরাকে জিজ্ঞেস করলো, এই অন্তরা এই স্বপ্না আমাদের স্বপ্না না?
হ্যাঁ।
বলতে বলতে স্বপ্না একটা গোল দিলো। ধারা ভাষ্যকার জোরে চিৎকার দিলো, গোল।
সব মেয়েরা যেন মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠলো।
পরীর বুকটা গর্বে ভরে গেলো। সেই সাথে সে বুকের মধ্যে একটা ব্যথা অনুভব করলো। স্বপ্না আর সে এক সঙ্গে এই কিশোরী ক্লাবেই খেলতো। দাবায় সে বরাবরই পরীর কাছে হেরে যেতো। স্বপ্না প্রায়ই বলতো আমি তোর মতো বুদ্ধি দিয়ে খেলা খেলতে পারবো না। আমি খেলবো ধুমধাম। বল পাবো, বল নিয়ে মাঠে ছুটে বেড়াবো, সুযোগ পেলে দিবো গোল। আর তুই চিন্তা কর্‌বি কিস্তির চাল দেবো নাকি ঘোড়ার, আমি ঘোড়া চাল দিলে প্রতিপক্ষ কীসের চাল দিতে পারে। এত ভাবনা-চিন্তার সময় আমার নেই।
পরীও কিছুদিন ফুটবল খেলেছে, বলা যায় লুকিয়ে লুকিয়ে। জানার পর সাবিনা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। তবু এলাকার মাঠে খেলতে তেমন নিষেধ করেনি। কিন্তু যখন বাইরে গিয়ে মাঠে খেলার কথা শুনলো তখন তো আর রাজি হলো না। পরীর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো।
স্বপ্না আজ সত্যি সত্যি গোল দিলো।
সারা দেশের মানুষ টি.ভি’তে স্বপ্নাকে দেখছে আর তার প্রশংসা করছে। স্বপ্না এখন স্টার। আজ যদি সাবিনা তাকে ফুটবল খেলতে দিতো তবে সেও স্বপ্নার মতো না হলেও এরকম মাঠেই খেলতে পারতো। সারা দেশের মানুষ তাকেও দেখতো। টি.ভি’তে পরীকে দেখে সবাই চিৎকার দিতো। টি.ভি দেখতে দেখতেই মায়ের ওপর পরীর রাগ হলো।
সেই স্বপ্না আজ গ্রামে এসেছে। সারা গ্রামের মানুষ তাকে দেখতে এসেছে। সবাই কত প্রশংসা করছে। কথায় কথায় সে বললো, আর ক’দিন পর সে বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে যাবে মহিলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় হয়ে। স্বপ্না এখন শুধু তার নিজের নয় পুরো দেশের স্বপ্ন।
স্বপ্না একদিন বিদেশের মাটিতে ফুটবল খেলবে, তখন সারাদেশের মানুষ স্বপ্নার জন্য হাত তালি দিবে। স্বপ্না যখন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে গোল দিবে সারাদেশের মানুষ তখন হাত তালি দিবে।
পরীও গিয়েছিলো স্বপ্নাকে দেখতে। পরী ভেবেছিলো স্বপ্না তাকে চিনতে পারবে না কিন্তু স্বপ্না তাকে চিনতে পেরেছে। সেই পরী কে দূর থেকে ডাক দিলো, এই পরী এদিকে আয়।
পরী কাছে গেলো।
স্বপ্না তাকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছিস্‌?
ভালো, তুই?
এই তো ভালো আছি। তুই কি দাবা খেলা ছেড়ে দিয়েছিস্‌?
স্বপ্নার কথা শুনে পরীর চোখে পানি এসে গেলো। সে মাথা উঁচু-নিচু করে জানালো সে খেলা ছেড়ে দিয়েছে।
স্বপ্না জিজ্ঞেস করলো, কেনো?
চাল ভুল হয়ে গেছে।
তুই ভুল করেছিস?
না।
তো?
বাবা-মা।
তারমানে?
একবার ঢাকা খেলতে যাওয়ার কথা ছিলো। বাবা-মা যেতে দিলো না। তখন থেকে আমি খেলা ছেড়ে দিয়েছি।
এখন লেখাপড়া করছিস্‌ তো?
হ্যাঁ।
এবার কোন্‌ ক্লাসে?
ক্লাস এইটে।
ভালোভাবে লেখাপড়া কর্‌, দেখ্‌বি একদিন তুইও অনেক বড় হবি। খেলার একটা বয়স থাকে, সময় থাকে, সেই সময়ের পর খেলোয়াড়ের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। কিন্তু লেখাপড়ার গুরুত্ব সারাজীবন। ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর্‌।
পরী মাথা নেড়ে সায় জানালো।
স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করে এসে পরী মুখ ভার করে বসেছিলো। সাবিনা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কীরে, তোর কী হলো?
কিছু না মা।
মুখ ভার করে বসে আছিস কেনো?
পরী কোনো কথা বললো না।
সাবিনা আবার জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গেছিলি?
স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করতে।
কী বললো?
কিছু না।
তোর মন খারাপ হলো কেনো?
পরীর চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
ও তোকে কিছু বলেছে?
না।
তো?
পরী মৃদু কণ্ঠে বললো, শুনলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে মা।
তবু বল্‌।
পরী যেভাবে মাথা নিচু করে বললো, মা, স্বপ্না আর আমি একসঙ্গে খেলতাম। আজ স্বপ্না কত বড় হয়েছে, তুমি যদি আমাকে ফুটবল খেলতে দিতে তবে হয়তো আমি এতদিনে স্বপ্নার মতোই হতাম।
থাক্‌ অত বড় হয়ে তোর কাজ নেই। মেয়ে মানুষ সারা দুনিয়ার পুরুষ মানুষের সামনে লাফালাফি করে বড় হওয়ার দরকার নেই।
পরীর তার মায়ের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ হলো, মা!
হ্যাঁ। আমাদের পরিবারের কেউ এটা মানতো না।
আর দাবা খেললে?
সাবিনা আর কোনো কথা বললো না।
পরী আবার বলতে শুরু করলো, মা আমার যখন দাবা খেলার জন্য ঢাকা যাওয়ার সুযোগ এলো তখনো তোমরা আমাকে যেতে দিলে না। তোমাদের কাছে মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করা মানে পৃথিবীতে আসা, বিয়ে করা, দু’য়েকটা বাচ্চা লালন-পালন করা, স্বামীর সেবাযত্ন করা এই। এর বাইরে যে মেয়েদের আরো অনেক কিছু করার আছে এটা কোনোভাবে মানতে চাও না। তোমরা কোনোদিন আমাকে কোনো কিছু করার সুযোগ দাওনি, আমি নিজের যোগ্যতায় যদি কোনো দিন কোনো সুযোগ পেয়েছি সেই সুযোগটাও তোমরা কাজে লাগাতে দাওনি। আমি তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলছি মা। তোমরা যদি আমাকে লেখাপড়া করতে না দাও, আমাকে যদি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দাও তবে আমি তোমাদের সে সিদ্ধান্ত কোনোভাবে মেনে নিবো না। বলতে বলতে পরী তার মায়ের কাছ থেকে চলে গেলো।

আঠারো

আবার পাত্র দেখা শুরু হলো। তবে এবার গোপনে। অতি গোপনে। এবার বাড়িতে ঘটক এলো না। বিয়ের আলোচনা হলো কখনো পরীর ফুপুর বাড়িতে, কখনো তার মামার বাড়িতে। তাতে দু’দিকে সুবিধা এই আলোচনার কোনোকিছু পরীর জানার কোনো সুযোগ নেই। আরেকদিকে প্রতিবেশীদের কারো কাছ থেকে মেয়ের সম্পর্কে জানারও কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবেশীদের কেউ জানতে পারলে বিয়ে ভেঙ্গে যেতেও পারে। কারণ পরী এখন আর সাধারণ মেয়ে নয়। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া খুঁতওয়ালা মেয়ে, দাগী মেয়ে। বিয়ের যে দু’য়েকটা ঘর এলো তারাও ডিমান্ড চায় আতার সাধ্যের বাইরে। সেই দোষও এলো পরীর ওপর।
সেদিন সকালবেলা শাপলা এলো কিছুক্ষণ পরেই আতা আর সাবিনা পরীর ফুপুর বাড়িতে চলে গেলো। যাবার আগে তেমন কিছু বললো না একরকম তাড়াহুড়া করে তার মা বললো, পরী বাড়ি থেকে কোথাও যাবি না। আমরা তোর ফুপুর বাড়ি যাচ্ছি। কালকেই চলে আসবো।
পরী প্রথমে ভেবেছিলো শুধু তার মা যাবে কিন্তু যাবার সময় দেখালো তার বাবা-মা দু’জনে গেলো।
পরীর একমাত্র ফুপু রুবিনা। রুবিনা আতার চেয়ে বড়। শৈশবে মা মারা যাওয়ায় রুবিনাই আতাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। তাই রুবিনা আতাকে খুব স্নেহ করে। পরী শৈশব থেকে দেখে আসছে এই দু’ভাইবোনের মিল-মহব্বত। খুব ছোটো-খাটো কারণে রুবিনা আতাকে ডেকে পাঠায়, আতাও বাড়িতে একটা মুরগী জবাই করলেই যেন তার মায়ের তূল্য বড় বোন-দুলাভাইকে দাওয়াত করে।
পরী মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেলো না।
বাবা-মা চলে যাবার পর পরী শাপলাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে আপা? বাবা-মা এভাবে, হঠাৎ করে।
কী হয়েছে আবার, দেখছিস্‌ না, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বাবা-মা খুব সামান্য কারণে ফুপুর কাছে যায় আবার ফুপুও আসে।
পরী বললো, আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমিও যেতাম।
তোর পরীক্ষা কবে শেষ হবে?
পরীক্ষা তো এখনো শুরুই হয়নি আপা।
তুই পরীক্ষার পর যেতে পার্‌বি।
আমার তো আজকেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো আপা। পরীক্ষা তো এখনো দেরি আছে। একদিন ফুপুর বাড়ি বেড়াতে গেলে আর এমন কী ক্ষতি হতো। অনেক দিন থেকে ফুপুকে দেখি না। আমাকে না নিয়ে যাওয়াতে ফুপুও বাবার ওপর রাগ করবে।
শাপলা বললো, তুই জানিস্‌ ফুপু রাগ করবে?
অবশ্যই করবে। ফুপু আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার পরীক্ষার পর একসঙ্গে যাবো আপা।
শাপলা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, আমি কি তোর মতো যে চাইলেই যেতে পারি?
কেনো?
বুঝিস্‌ না, আমার স্বামী-সংসার আছে না। কোথাও যেতে চাইলে কতো কৈফিয়ত? কোথায় যাবে? কেনো যাবে? না গেলে হয় না। কখনো কখনো তোর দুলাভাই এভাবে বলে আর কখনো কখনো তো সোজাসুজি বলে দেয়, যাওয়া হবে না।
এগুলো আমাদের মতো গরীব মানুষের ঘরে আছে আপা। যারা অনেক লেখাপড়া শিখেছে চাকরি করছে তাদের বেলায় একটু সহজ আছে। তাদের স্বামীরাও শিক্ষিত, তারাও সবকিছু বোঝে।
ওদের কথা আলাদা। ওরা চাকরি করে মাসে অনেকগুলো করে টাকা স্বামীর হাতে এনে দেয়, তাই স্বামীরা ওদের প্রতি দুর্বল থাকে। আর আমরা…
পরী শাপলার কথা মাঝে বাধা দিয়ে বললো, সেজন্যই তো লেখাপড়া করার দরকার আপা। আমি যদি লেখাপড়া করি, নিজের পায়ে দাঁড়াই তারপর বিয়ে করি তবে তোমার সঙ্গে দুলাভাই যেমন ব্যবহার করেছে আমার হ্যাজবেন্ড তেমন আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না।
কিন্তু বাবা-মা তোকে লেখাপড়া শেখালে তো। যদি তার আগে বিয়ে দেয়?
পরী কিছুটা জোর দিয়ে বললো, আমি বিয়ে করলে তো।
তুই বিয়ে কর্‌বি না, বাবা-মা’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বল্‌বি?
ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেনো কথা বলবো, বাবা-মা’কে বোঝাবো।
যদি বুঝতে না চায়, জোর করে বিয়ে দেয়?
পরী একটা অহংকারের হাসি হেসে বললো, পারবে না আপা, পারবে না।
কী কর্‌বি তুই?
আমি বিয়েতে রাজিই হবো না।
বাবা-মা’র মান-সম্মানের দিকে তাকাবি না?
মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া বাবা-মা’র অপমান না আপা? এখনো আমি লেখাপড়া করছি, এখনো আমার বিয়ের বয়স হয়নি, তাতেই বাবা-মা যদি আমাকে বিয়ে দিতে চায়, আমার জীবনটা নষ্ট করতে চায় তবে আমি তো প্রতিবাদ করবোই। তাতে যদি বাবা-মা’র অপমান হয় তাতে আমার কিছু করার নেই। বলতে বলতে পরী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো।
শাপলা পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
পরী আবার বলতে শুরু করলো, তুমি তো বাবা-মা’র কথামতো বিয়ে করেছো আপা, এখন কি তুমি সুখে আছো? নূরী আপাও বাবা-মা’র সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেনি, বাবা-মা’র মান-সম্মানের কথা ভেবে বিয়েতে বসেছে। অল্প বয়সে বিয়ে করে বেচারিকে জীবনটাই দিতে হলো। তুমিই বলো আপা আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে, তোমার সতীনের সঙ্গে সংসার করার চেয়ে, নূরী আপার জীবনের চেয়ে কি বাবা-মা’র মান-সম্মানটাই বড়?
পরীর কথা শুনতে শুনতে শাপলার চোখে পানি এসে গেলো। সে পরীর কাছে এলো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, তুই অনেক কিছু বুঝিস্‌ রে। তোর মতো বয়সে আমরা কিছু বুঝতাম না। আমরা মনে করতাম বাবা-মা যা করছে আমাদের ভালোর জন্য করছে। তাই আমরা বিনাবাক্যে মেনে নিতাম।
আমিও মনে করি আপা বাবা-মা’রা যা করে সন্তানদের ভালোর জন্যই করে। কিন্তু দিন পাল্টেছে, আগের দিনের যুক্তি দিয়ে এখনকার দিনে সিদ্ধান্ত নিলে তো চলবে না। কাজেই বাবা-মা’র যুক্তি তাদের বিবেচনার সাথে আমাদের বিবেচনা মিলবে না। তফাতটা এখানেই।
শাপলা চোখ মুছলো। আদর করে পরীর মাথা টিপে ধরে বললো, তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। আসলে আমিও যদি তোর মতো বুঝতাম তবে আজ আমার জীবনটা এমন হতো না। আমি বলছি তুই লেখাপড়া কর্‌, অনেক বড় হ, জজ-ব্যারিস্টার হ।
দোয়া করো আপা।

উনিশ

অবশেষে পাত্র পাওয়া গেলো। ঘটক আর কেউ নয় পরীর ফুপু। পাত্র তারই দেবরের ছেলে। পাত্রের বাড়ির অবস’া মোটামুটি ভালো। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। গ্রামে কয়েক বিঘা জমি যা দিয়ে সারা বছর ভাতের যোগান হয়। গ্রাম গঞ্জে ভালো পাত্র হিসেবে তার চাহিদা আছে। উপরন্ত নিজের একটা অটোরিক্‌শা আছে, সময় সুযোগ বুঝে নিজেই চালায়। ছেলে মেয়েকে চেনে কাজেই নতুন করে আর কনে দেখার প্রয়োজন নেই। মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি মেয়ের বাবা-মা’ই দেখবেন।
বিয়ের আলোচনা বসেছে আঙিনায়। সবাই গোল হয়ে চেয়ারে বসেছে। পাত্র পক্ষের শুধু ছেলের বাবা-মা। সেও তো আগে থেকেই আত্মীয়, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা বলা যায়। রুবিনা বিয়ের আগের প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা ও অগ্রগতি বলে বললো, এখন শুধু ডিমান্ডের বিষয়টা আর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে বাকি।
পরীর ফুপা আহসান ভাব গম্ভীর মানুষ। কথা বলে খুব মেপে মেপে। সে একটা বড় হাতল চেয়ারে বসে সবকিছু শুনলো। তারপর সে গলা ঝেড়ে ছেলের বাবা মানে তারই ছোট ভাই’র দিকে তাকিয়ে বললো, আমান তুই বল্‌ দেখি?
আমান সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ, সেও আহসানের ওপরই সব ব্যাপারে নির্ভরশীল। কাজেই এই বিয়ের সবকিছু আসলে নির্ভর করছে রুবিনা আর আহসানের ওপরই।
আমান রুবিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি আর কী ভাবী। আপনি, ভাইজান, আপনারাই তো আমার গার্জিয়ান। বলতে গেলে আপনারা ছেলে-মেয়ে দু’জনেরই গার্জিয়ান।
আতা সম্মতি দিয়ে বললো, জি দুলাভাই। যা করার আপনি করুন।
আলাপ আলোচনায় ডিমান্ডের যে টাকার অঙ্ক দাঁড়ালো তা প্রায় লাখের কাছাকাছি। শুনে আতা একবার সাবিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, সাবিনা একটু ভেতরে এসো। আপা আপনিও…
আঙিনা থেকে তিনজন ঘরের ভেতর ঢুকলো। আতা চাপা স্বরে বললো, আপা আপনি তো আমাদের অবস’া জানেন, আমরা এতগুলো টাকা কীভাবে দিবো?
রুবিনা কিছু বলার আগেই সাবিনা রাগান্বিত স্বরে আতার দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বললো, দিবে না, মেয়ে তো আর যেনোতেনো না। এক্কেবারে…
আতা একথার প্রতিবাদ করলো, যেনোতেনো না, কী হয়েছে আমার মেয়ের? কী করেছে ও?
কিছু করেনি, তবে যা করেছে তাতেই মানুষ ছি:ছি: করছে। এখন মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারো ততই ভালো।
কিন্তু এত টাকা আমি কীভাবে দিবো?
সাবিনা আতাকে একটা ধমক দিলো, আগে তুমি রাজি হয়ে যাও। আমি বাবার অংশ থেকে কিছু টাকা দিবো তবু তুমি রাজি হয়ে যাও। ও যে কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে তাতে ওকে আর আমি এক মুহূর্ত বাড়িতে রাখতে চাই না। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বিদায় করো।
রুবিনা বললো, আতা টাকা তো আর একবারে দিতে হচ্ছে না। এমন ছেলে হাতছাড়া হলে আর পাবি?
আতা কিছু বলার আগেই সাবিনা বললো, আপনি ঠিক করে ফেলেন আপা। ওর মতো ঝিমালে তো চলবে না। আবার যদি কিছু করে বসে, হিটু এবার যদি কিছু করে তবে মেয়ের নামে কিন্তু পেপারিং হবে, সারা দুনিয়া জুড়ে ওর দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে। তখন মেয়ে বিয়ে দেয়া আরো কঠিন হবে।
ওরা তিনজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, আহসান আতাকে জিজ্ঞেস করলো, কী বলো আতা? তুমি যদি বলো তো ঠিক করে ফেলি।
সাবিনা বললো, আপনি ঠিক করে ফেলুন দুলাভাই।
বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হলো। আগামী পরশু। বিয়েতে বরযাত্রী থাকবে একান্তই নিজেদের কয়েকজন আত্মীয়, যাদের না বললেই নয়, শুধু তারাই আসবেন। দিনের বেলা কোনো প্রস’তি থাকবে না। রাতের বেলায় আঙিনায় চেয়ার টেবিল বিছিয়ে সেখানেই খাওয়া-দাওয়া আর বিয়ের কাবিন হবে।
আহসান বার বার করে সবার উদ্দেশ্যে বললো, কথাটা যেন ফলাও করে প্রকাশ না পায়।
আতা মিনমিন করে বললো, সেজন্যই তো আপনার এখানে আয়োজন করেছি দুলাভাই।
হ্যাঁ। সেটা সবাই মনে রেখো।

ফুপুর বাড়িতে বিয়ের আলোচনা হওয়াতে পরী এর এক বিন্দুও জানতে পারলো না। সে তার মতো প্রতিদিন সকালবেলা স্কুল যায়, ক্লাস শেষে কিছুক্ষণ লাইব্রেরিতে বসে, বড় বড় লেখকদের বই পড়ে। বেগম রোকেয়ার জীবনী, ম্যাডাম কুরির জীবনীসহ বিশ্বের বিখ্যাত নারীদের জীবনী পড়ে আর মুগ্ধ হয়। তাদের মাঝে নিজের ছবি দেখে। মনের মধ্যে বড় হওয়ার, বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন লালন করে। বিকেলে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতেও বই নিয়ে আসে। ক্লাসের বইয়ের বাইরেও তার আরো বই চাই। নিজেকে সমৃদ্ধ করার বই।
সেদিন স্কুল থেকে পরী একটা বই নিয়ে বাড়িতে ফিরলো। তারপর বই-পুস্তক রেখে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর তার মা বললো, পরী তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় পরে নে তো মা।
কেনো মা?
তোর ফুপুর বাড়ি যেতে হবে।
ফুপুর বাড়ি?
হ্যাঁ।
কেনো?
এমনিতেই।
এমনিতেই কেনো মা? এই না তুমি কালকেই ফুপুর বাড়ি থেকে এলে।
এতোকিছু জিজ্ঞেস করিস্‌ না তো। তোর ফুপু কেনো জানি ডেকে পাঠিয়েছে।
কে কে যাবো মা?
তোর বাবা, তুই আর আমি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
পরীর বুকটা কেঁপে উঠলো। সে আজকের এই হঠাৎ করে ফুপুর বাড়ি যাওয়ার ভেতরে যেন একটা রহস্যের গন্ধ খুঁজে পেলো। সে একবার কাপড়-চোপড় পরতে গিয়ে কেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো।
সাবিনা আবার তাড়া দিলো, পরী।
আসছি মা। বলে পরী তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় পরে তার মা’র সঙ্গে বের হলো।

বিশ

প্রতি বছর পরীক্ষার পর পরী কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। আগে বেড়াতে যেতো শাপলার বাড়িতে। শাপলার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তার বাড়িতে যাওয়া পরীর বন্ধ হলো। পরের বছর গিয়েছিলো নূরীর বাড়িতে তারপর থেকে প্রতি বছর নূরীর বাড়িতেই যেতো কিন্তু নূরীর মৃত্যুর পর তার সে বাড়িতে যাওয়াও বন্ধ হলো।
আগে নানার বাড়ি যেতো কিন্তু তার মা সম্পত্তির অংশ নিয়ে মামাদের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হওয়ায় সেখানেও যাওয়া বন্ধ হয়েছে। তবে তার ফুপুর বাড়ির রাস্তাটা খোলা আছে ঠিক আগের মতোই।
রুবিনার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আতার যখন ছেলের আশায় আশায় একে একে তিনটি মেয়ে হলো তখন নাকি রুবিনা পরীকে একেবারে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আতা রাজিও ছিলো কিন্তু সাবিনা রাজি হয় নি। রুবিনা প্রথমে মন খারাপ করেছিলো কিন্তু তারপরই আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো।
তারপর থেকে রুবিনা পরীকে খুব স্নেহ করতো। রুবিনা প্রায় আসতো, কোনোদিন এসে পরীর স্কুল বন্ধ আছে জানলে তাকে নিয়ে যেতো আবার চলে আসতো ঠিক স্কুল খোলার আগের দিন। পরীর অবহেলা আর বঞ্চনার জীবনে যেটুকু ভালোবাসা, আদর পেয়েছে সেটুকু তার রুবিনা ফুপুর কাছ থেকেই।
পরীর আজও মনে আছে তখন রুবিনার শ্বশুর বেঁচে ছিলো। তিনি কম শিক্ষিত লোক হলেও শিক্ষিত মানুষকে তিনি সমাদর করতেন। পরী নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া করছে জেনে তিনি পরীকে আদর করে কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, কীরে তুই কি লেখাপড়া শিখে বিদেশি মেম হবি নাকি? নাকি জজ ব্যারিস্টার হবি?
পরী হেসে বলতো, দোয়া করো দাদু।
দাদুর সব দাঁত উঠে গেছে। মুখ ফোকলা, সেই ফোকলা মুখে পান পিষে খেতেন। তিনি মুখে পান দিয়ে বলতেন, ভালো তোকে যদি জজ-ব্যারিস্টার দেখে মরতে পারি তবে আমার খুব ভালো লাগবে।
আহসানের কোনো ছেলেমেয়ে নেই আর আমানের তো শুধু একটা ছেলে। বুড়ার কোনো নাতনি নেই। তাই হয়তো পরীকেই নাতনির মতো স্নেহ করতেন।
পরীর সেই দাদু আর বেঁচে নেই। আজ হঠাৎ করে ফুপুর বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে পরীর বুকটা যখন কেঁপে উঠলো তখন পরীর মনে হলো তার এই শঙ্কিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত পথযাত্রায় সেই বুড়োই হতে পারতো অবলম্বন।
আজ ইজিবাইকে চড়ে ফুপুর বাড়ি যেতে পরীর নানান কথা মনে পড়ছে। পরী মনে করেছিলো পরীক্ষার পর ফুপুর বাড়ি যাবে। যদি সেটা ধীর-সি’রভাবে পরীক্ষার পর হতো তবে হয়তো আজ এতো কথা মনে পড়তো না। কিন্তু হঠাৎ…এই বিষয়টাকে পরী কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না।
এখন পরীর শেষ অবলম্বন তার একমাত্র ফুপু রুবিনা।
রুবিনার কথা মনে পড়তেই মনের মধ্যে নানান স্মৃতি ভেসে উঠলো। রুবিনা তাদের বাড়িতে এলে পরীর জন্য নতুন নতুন কাপড়-চোপড় কিনে নিয়ে আসতো। যাওয়ার সময় পরীর হাতে কিছু টাকাও দিয়ে যেতো। পরী সেই টাকা দিয়ে কাগজ-কলম কিনতো, মাথার ক্লিপ, বেন্ড এসব কিনতো।
তাই রুবিনা তাদের বাড়িতে এলে সে রুবিনার পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো। পরীর আজও স্বপ্নের মতো মনে আছে। একবার রুবিনা এলো কিন্তু পরীকে কোনোকিছু দিলো না। পরী মন খারাপ করলো। সে রুবিনার পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতে লাগলো আর ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। পরীর এমন আচরণে রুবিনা হেসে ফেললো, কীরে আমার পিছনে পিছনে এমন ঘুর ঘুর করছিস্‌ কেনো?
পরী মলিনমুখে বললো, না ফুপু, এমনিই।
এমনি কেনো?
এবার পরী বললো, ফুপু তোমার ব্যাগে কী? ব্যাগটা এতো বড় করছে কেনো?
শোন তোকে আর এভাবে ঘুর ঘুর করতে হবে না। তোর জন্য আমি জামাকাপড় নিয়ে এসেছি কিন্তু আজ না কাল দেখাবো। কাল দেখাবো, তোকে…বলে কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
পরদিন সকালবেলা বাড়ির পাশ থেকে কাঁচা হলুদ এনে বললো, পরী আয় তো তোকে একটু হলুদ মাখিয়ে দিই।
কথাটা শুনতে পেয়ে সাবিনা বললো, কেনো আপা? ওকে হলুদ মাখাবেন কেনো?
এমনিই, হলুদ মাখাতে তো আর কারণ লাগে না আপা।
তা লাগে না।
রুবিনা পরী বলে জোরে ডাক দিতেই পরী আঙিনায় এলো। রুবিনা পরীকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে দিয়ে বললো, এখন এ পর্যন্তই দুপুরে খাওয়ার পর তোর জন্য আমি যে কাপড়-চোপড়গুলো নিয়ে এসেছি সেগুলো পরিয়ে দেব, তুই দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু রেস্ট নিবি। তারপর আমাকে না বলে আর কোথাও যাবি না।
পরী নতুন কাপড়-চোপড়ের কথা শুনে খুশি হলো। পরীক্ষার পর পরী প্রতিদিন দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিতো কিন্তু গতকাল তার ফুপু তার জন্য কী নিয়ে এসেছে এবং এমনকি কাপড়-চোপড় যেগুলো নিয়ে এসেছে সেগুলোও দেখার আর পরার জন্য তার চোখে ঘুম এলো না।
রুবিনা তাকে দেখে হেসে ফেললো, কী রে মা, ঘুমাবি না?
পরী না সূচক মাথা নাড়লো।
কেনো?
পরী বুঝি আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। সে বলে ফেললো, ফুপু আপনি নাকি আমার জন্য কী এনেছেন?
হ্যাঁ, এনেছি তো।
সাবিনা রান্না ঘরে বিকেলের চা তৈরি করছিলো। সে রুবিনার কাছে আসতে আসতে বললো, কী এনেছেন আপা? যদি কিছু নিয়ে এনেছেন তো দেন, কাল রাত থেকে পরী তো শুধু উসখুস করছে।
আগে চা খাই।
চা শেষে রুবিনা তার ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় বের করে পরীকে পরিয়ে দিলো।
ছোট, শাড়ি ব্লাউজ, পেটিকোট, নাকে নাক ফুল, কপালের টিপ, হাতে কাঁচের চুড়ি পরিয়ে বউ সাজিয়ে উঠানে থাকা জলচৌকিতে বসিয়ে ঘোমটা পরিয়ে দিয়ে জোরে ডাক দিলো, সাবিনা এসো তো।
সাবিনা রান্না ঘর থেকে বললো, জি আপা বলুন?
এখানে এসো, বলা যাবে না।
সাবিনা এলো। রুবিনা হেসে গড়াগড়ি দেয়ার উপক্রম, দেখো, দেখো পরীকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। মেয়ে তো নয় যেন বেহেশত থেকে হুর-পরী নেমে এসেছে।
ওমা, তাইতো।
তারপর রুবিনা সবাইকে ডেকে এনে দেখালো, দেখ, তোমরা সবাই দেখ পরী কত সুন্দর হয়েছে। বলতে বলতে রুবিনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
রুবিনার বিয়ের বয়স হলো প্রায় পঁচিশ বছর কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে নেই। দেশ বিদেশের অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে কোনো লাভ হলো না। তাই সে এই অভিনব কাণ্ড করে বসলো।
আজ ফুপুর বাড়িতে এসে পরীর সেদিনের কথা বার বার করে মনে পড়লো।
আজ আসার পর থেকে রুবিনা সবসময় পরীর কাছে কাছে আছে, আগেও থাকতো। সন্ধ্যার পর তার ফুপুর বাড়ির এবং পাশের প্রতিবেশীদের কয়েকজন ছেলে আঙিনায় চেয়ার টেবিল জড়ো করতে শুরু করলো। আরো একটু রাত হতেই আঙিনায় লোক জমায়েত হতে শুরু করলো। সব মিলিয়ে বিশ-পঁচিশ জন লোক, আর পাঁচ-ছয় জন মহিলাও এসেছে। কেউ কেউ পরীর পরিচিত আর দু’য়েকজন অপরিচিত। মহিলাদের কয়েকজন তার ঘরে ঢুকলো। পরী কিছু বুঝতে পারলো না। সে একবার উঁকি মেরে দেখলো আঙিনায় একটা ছেলে বর সেজে বসে আছে। হ্যাঁ পরীর পরিচিত। পরী তাকে আগেও অনেকবার দেখেছে।
কিছুক্ষণ পর রুবিনা এলো। রুবিনার হাতে একটা ব্যাগ। সে কাপড়ের ব্যাগটা চৌকির ওপর রেখে বললো, পরী এই কাপড়গুলো পরে নে তো মা।
পরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না। সে এতক্ষণে বুঝলো তাকে স্কুল পাঠানো, বাবা-মা’র ঘন ঘন ফুপুর বাড়িতে আসা, তাকে বেড়ানোর কথা বলে ফুপুর বাড়িতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য। তার বুক কেঁপে উঠলো। আগের দিন জানতে পেরেছিলো বলে সে মালার সহযোগিতায় ব্র্যাক আপা আর মেম্বারনিকে দিয়ে তার বিয়ে প্রতিরোধ করেছিলো। কিন্তু আজ তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য তার বাবা-মা, ফুপা-ফুপু সবাই মিলে যে সুন্দর পরিকল্পনা করেছে তা থেকে সে নিজেকে রক্ষা করবে কীভাবে?
পরী একবার এদিক-সেদিক তাকালো। সে মনে মনে তার বাবা-মা’কে খুঁজছে। কিন্তু তার বাবা-মা কাউকে আশেপাশে না দেখে রুবিনাকে জিজ্ঞেস করলো, ফুপু মা কোথায়? বাবা?
আছে কোথাও।
একটু আসতে বলোতো।
রুবিনা রেগে গেলো, বললাম তো আছে কোথাও। এখন আসতে পারবে না। তোকে বললাম কাপড় পরে নে।
পরী তবুও বসেছিলো। কিন্তু বরযাত্রীদের মধ্যে এক জাদরেল মহিলা ছিলো। পরী এই জাদরেল মহিলাকে তার ফুপুর বাড়িতে আগেও দেখেছে। পরীকে বসে থাকতে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর একরকম জোর করে পরীকে কাপড় পরিয়ে দিলো।

একুশ

বিয়ের সময় কনের কান্না নিয়ে একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে মেয়েরা বাবার বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য সবকিছু ত্যাগ করে চলে যাবে একটু আধটু তো কাঁদবেই। কনের কান্নার কারণ যে অন্য কিছুই হতে পারে সে চিন্তাই কেউ করে না। বিয়ে জীবনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটা ভালো চাকরি কিংবা ব্যবসায় লাখ লাখ টাকা রোজগারের চেয়ে বিয়ের বিষয়টিতে আরো বেশি সচেতন ও আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন কিন্তু সমাজব্যবস’ায় বিয়েটাকে খুব হাল্কাভাবে ধরে নেয়া হয়।
একটা ছেলে লেখপাড়া শেষ করে হন্য হয়ে একটা চাকরি খুঁজে নিজের মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োজনবোধে তদবিরসহ যত রকম পন’া আছে তার কোনোকিছু করতে কার্পণ্য করে না। অথচ বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা হয় তড়িৎ গতিতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। টিউটবওয়েলের এক গ্লাস পানির মতো গিলে ফেললেই হলো।
এ তো গেলো ছেলেদের কথা। মেয়েদের তো বিয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজের বিয়ের কথা আগে থেকে জানতেই পারে না। বিয়ের দু’য়েকদিন আগে কোনোভাবে তাকে জানানো হয়। সে বিয়ে করবে কী না, তার পছন্দ আছে কী না এসব বিষয়ে গার্জিয়ানদের কাছ থেকে জানতে চাওয়াও অশোভনীয়।

কয়েক বছর আগের কথা পরী তার পাড়ার সম্পর্কে এক চাচাতো বোনের বিয়েতে কনের পাশে বসেছিলো। কনের নাম ময়না। পরী জানতো তার সেই চাচাতো বোন একটা ছেলেকে পছন্দ করতো। সেদিন বিকেলবেলা যখন তার ভাবী বিয়ের কথা জানালো তখন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ধীরে ধীরে বাড়িতে মেহমান আসতে শুরু করলো আর সবাই তার ঘরে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কী কর্‌বি মা, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস স্বামীর ঘরে তো যেতেই হবে।
আবার কেউ বললো, বিয়ের আগে মেয়েরা একটু আধটু কাঁদবেই, কাঁদতে দাও আজকের কান্নাই তো বাবার বাড়ির শেষ কান্না।
আবার কেউ কেউ বললো, মেয়েদের জীবনটাই এমন, জন্ম থেকে বাবা-মা’র কাছে মানুষ হয়ে একদিন সবকিছু ছেড়ে পরের ঘরে যেতে হয়। এটাই নিয়ম।
সামাজিক অসঙ্গতিকে যখন সবাই সমাজের নিয়ম বলে মেনে নেয় তখন সমাজ থেকে অসঙ্গতিগুলো দূর হবে কীভাবে?
ময়নার কান্নার অর্থকে সবাই এভাবে মুল্যায়ন করলো। ময়নার যে অন্য কাউকে পছন্দ করতে পারে, সে বিরহ বেদনা থেকে যে তার হৃদয় ভেঙ্গে যেতে পারে একথা কেউ একবারো চিন্তা করা প্রয়োজন মনে করলো না।
ময়নার মনের মধ্যে তখন তার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি ভাসছে। ময়নার সঙ্গে ছেলেটির পরিচয় প্রায় দু’বছর আগে। এই দু’বছরে ময়নার জীবনে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তারা দুজনে কতদিন একসাথে পাশাপাশি ঘুরে বেড়িয়েছে, কতদিন তারা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে, অথচ আজ সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হতে বসেছে।
ময়নার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে তার বিয়ের খবর জানার পর ছেলেটি কী রকম উদ্মাদ হয়ে যাবে। আগে একবার এমন হয়েছিলো। ময়নার সাথে ছেলেটির একটু মনোমালিন্য হয়ে কয়েকদিন কথাবার্তা বন্ধ ছিলো তাতেই সেই ছেলেটি চুল দাড়ি রেখে একেবারে বাউলের মতো হয়ে গিয়েছিলো।
তার অবস’া দেখে ময়নাই আবার কথা বলতে শুরু করেছিলো। যেদিন প্রথম দেখা হলো সেদিন ময়না জিজ্ঞেস করলো, ক’দিন কথা হচ্ছে না তাতেই তুমি কেমন বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমার বিয়ে হয়ে গেলে কী করবে?
ছেলেটি বললো, আমার রাস্তা সোজা।
কী রকম?
ছেলেটি দৃঢ়তার সাথে বলেছিলো, আমি যদি কোনোদিন জানি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তবে আগে তোমার মতামত জানতে চাইবো, যদি তুমি বলো বিয়েতে তোমার মত ছিলো না তাহলে তো বেঁচেই গেলে।
আর যদি জানো আমি রাজি ছিলাম?
আমি তোমাকে খুন করবো। বলে ছেলেটি একটু হাসলো।
ময়নাও কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলো। তারপর কিছুটা ইয়ার্কির সুরে বললো, যদি জানো আমি রাজি ছিলাম না।
ছেলেটির চোখ দিয়ে তখনা আগুনের ফুলকি বেরিয়ে এলো, তবে যে তোমাকে বিয়ে করবে তাকে খুন করবো।
যদি ওরও কোনো দোষ না থাকে, ওর বাবা-মা যদি ওকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেয়?
তারপরও খুন করবো।
কেনো? একটা নির্দোষ মানুষকে তুমি খুন করবে কেনো?
তবুও করবো কারণ তোমার জীবনে দুজন পুরুষ থাকতে পারে না, তুমি শুধু আমার।
ময়না ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ভালোবাসায় কোনো খুঁত নেই, সহজ-সরল, নির্ভেজাল দু’টি চোখ জ্বলজ্বল করছে। ছেলেটির কথা শুনে ময়নার বুকটা ভরে গেলো, সে অষ্ফুটস্বরে বললো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো!
ছেলেটি কয়েক মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেলো। তারপর উদাস অবস’ায় হাতড়ে হাতড়ে ময়নার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, আরো একটা কথা আছে।
বলো?
ছেলেটি ময়নার থুঁতনি উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বললো, যদি কোনোটাই না পারি তবে আমি নিজেই চলে যাবো না ফেরার দেশে।
তারপর থেকে ময়না খুব সাবধানে ছিলো যেন কোনোভাবেই কোনের মনোমালিন্য না হয়।
অথচ আর তার বিয়ে হচ্ছে এই খবর জানার পর তার অবস’া কী হবে?
ছেলেটি যদি কোনোকিছু করতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসে তবে ময়নার সারাজীবন নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবে, ময়নার সারা জীবন মনে হবে তার জন্য একটা নিরপরাধ ছেলে জীবন দিয়েছে। আইনের কাঠগোড়ায় না হোক বিবেকের আদালতে তো জবাব দিতেই হবে। মানুষকে নয়ছয় বুঝ দিয়ে পারা যায় কিন্তু নিজেকে মানানো বেশ কঠিন। এমনি সেই ছেলেটির সাথে তার প্রেমের পরিণতি আর বিগত দিনের স্মৃতি নিয়ে যখন মেয়েটি কান্নায় গড়াগড়ি যাচ্ছিলো তখন আরেকদিকে চলছিলো বিয়ের আয়োজন।
একবার ময়না পরীর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, দেখতো পরী একটু বাইরে যেতে পারি নাকি?
পরী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে মলিন মুখে বললো, কোনো উপায় নেই আপা, আঙিনা মানুষে ভরা, বাইরেও লাইট জ্বলছে, অনেক লোক।
ময়না পরীর কথা শুনে হতাশ হলো, কোনো উপায় নেই?
পরী না সূচক মাথা নাড়লো।
ময়নার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে ময়না পরীর কানে ফিস ফিস করে চাপাস্বরে বললো, ও যদি তোকে কোনোদিন কিছু বলে তো বলিস আমার কোনো উপায় ছিলো না। দেখছিস্‌ তো ওরা আমাকে জোর করে…
কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেব একটা বড় রেজিস্টার নিয়ে এলো। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক এসেছে সাক্ষী হিসেবে। কাজি সাহেব উভয় পক্ষের বাবা-মা’র নাম, ঠিকানা বলে জিজ্ঞেস করলো, আপনি রাজি আছেন?
ময়না তখন কান্নায় গড়াগাড়ি যাচ্ছে। কাজি সাহেব পর পর তিনবার একই কথা বলার পর বরাযাত্রীদের মধ্য থেকে একজন বললো, বলেছে, রাজি বলেছে।
সবাই তখন আলহামদুলিল্লাহ বলে চলে গেলো, শুকরানা বিতরণ হলো, ধুমধাম করে খাওয়া-দাওয়া হলো।
পরী তেমনিভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তার রাজি কিংবা নারাজি হওয়ার সুযোগটা অন্য কাউকে দিতে চায় না। তাই সবকিছু জানার পরও পরীর চোখে পানি নেই। পরী ঝড়ে ঝড়ে বড় হয়েছে। সে কাঁদতে জানে না, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে জানে। সে ভেঙ্গে পড়তে জানে না, সোজা হয়ে দাঁড়াতে জানে।
সে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করেছে। যেমন করেই হোক এই বিয়ে তাকে প্রতিহত করতে হবে। তাতে যে যা বলবে তো বলবেই।
বাহির থেকে বর পক্ষের একজন ভেতরে এসে বললো, কনেকে বাইরে নিয়ে এসো। আগে সবাই বউ দেখবে তারপর কাবিন।
সবাই একরকম ধরাধরি করে পরীকে উঠানে নিয়ে বসালো।
বরযাত্রীরা সবাই তখন আঙিনায় চেয়ারে বসে আছে। কাজি সাহেবের সামনে একটা টেবিল। সে রীতিমতো রেজিস্টার পূরণ করতে শুরু করেছে। আর কয়েক মিনিট পরই পরীর সামনে কাজি সাহেব রেজিস্টার নিয়ে এসে উভয় পক্ষের নাম ঠিকানা বলে দায়সারা গোছের একটা কথা বলবে, আপনি রাজি আছেন তো?
পরী আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে মৃদু স্বরে গলা ঝেড়ে নিয়ে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করলো।
আঙিনা থেকে কেউ কেউ পরীকে প্রশ্ন করলো। কিন্তু পরী কোনো উত্তর দিলো না। তখন সবাই ফিসফিস করে নানান রকমের কথা বলতে শুরু করলো। তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, এতো সমালোচনার কী আছে একটু পরেই তো বুঝতে পাচ্ছ কনে বোবা নাকি ভালো।
পরী ঘোমটার আড়াল থেকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
কাজি সাহেব রেজিস্টার নিয়ে পরীর সামনে এলো। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন চেয়ার থেকে উঠে এলো কাজি সাহেবের সঙ্গে।
কাজি সাহেব পরীর নাম, তার বাবা-মা, তাদের ঠিকানা এবং পাত্রের নাম, তার বাবার নাম ঠিকানা সবকিছু বলে জিজ্ঞেস করলো, আপনি রাজি আছেন তো?
পরী চোখ মুছলো। মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, না।
সবাই হতবাক। কাজি সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। কাজি সাহেব জীবনে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখোমুখি হয়নি। সে তার রেজিস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
পরী এবার কোমরে শাড়ি পেঁচালো। বড় বড় চোখ করে কাজি সাহেবের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললো, কী হলো? আপনি শুনতে পাননি? আমি তো বলেছি আমি এই বিয়েতে রাজি নই, আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আমি বিয়ে করবো না।

দশ বছর পরের কথা। এই দশ বছরে পরী সত্যি সত্যি ডাক্তার হয়েছে! এম.বি.বি.এস ডাক্তার! আজ সে বাড়িতে আসবে। আতা আর সাবিনা বার বার করে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে।
বাসার সামনে একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো। পরী রিকশা থেকে নেমে বাবা-মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
আতা পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, মা, মা আমার। তুমি ডাক্তার হয়েছো! বলতে বলতে আবেগে আতার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*