দু’জনেরই পরষ্পরের প্রতি ভালোবাসা আছে, বিশ্বাস আছে, নির্ভরতা আছে, একটা বিষয়ে দু’জনের বিশ্বাস গভীর আর সেই বিশ্বাসটা হলো, বন্ধুত্ব। প্রায় বেশিরভাগ বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী একই, হয়ত সে কারণে দু’জনের বন্ধুত্বটা আরো বেশি। স্বার্থের সম্পর্ক নয়, রক্তের সম্পর্ক নয়, সম্মানের সাথে বসবাসের জন্য সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো বাধ্যতামূলক সম্পর্ক নয়, আইন দিয়ে শৃংখলিত প্রাণহীন সম্পর্ক নয়, তাদের সম্পর্কটা একেবারে শর্তহীন, বন্ধনহীন যাকে ইরেজীতে বলে আনকণ্ডিশনাল।
স্নিগ্ধার সঙ্গে শিহাবের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, সবসময় দু’জন দু’জনকে অনুভব করে, নিজের হৃদয়ের আনন্দ-বেদনার কথা বলে উজাড় করে। প্রতিদিন পরষ্পরের মধ্যে কথা হয়, পরষ্পরের সুখ-দুঃখের কথাগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়, তারপর সান্ত্বনা খুঁজে। হয়ত কখনো সান্ত্বনা পায় কিংবা হৃদয়ের কষ্ট বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে থাকে, তাতে হয়ত কোন লাভ হয় আবার কখনো কিছুই হয় না তবে হৃদয়ে চাপা কষ্টগুলো যেন হাল্কা বলে মনে হয়।
স্নিগ্ধার মোবাইলের ম্যাসেজ টোন অফ করা আছে। সে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই তার মোবাইলটা দেখল শিহাব তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। শিহাবের বউ রক্ষণশীল মনের, রক্ষণশীল বললে ভুল হবে বরং গোঁড়া প্রকৃতির বলাই সঙ্গত হবে। স্বামী গভীর রাতে তার বান্ধবীকে মোবাইল করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে এটাই সে মেনে নিতে পারবে না। তাই সে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। স্নিগ্ধা খুব খুশি হলো। সেও একটা থ্যাংকস ম্যাসেজ পাঠালো।
স্নিগ্ধার গ্রামের বাড়ি রংপুর। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর বিয়ে হয়েছে, স্বামীআনিস একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করে। পৈত্রিক সূত্রে আনিস অনেক টাকা-পয়সার মালিক, শান্তিবাগে দুই ইউনিটের একটা পাঁচতলা বাসা আছে। কোন কিছুর অভাব নেই। অত্যন্ত বিলাস বহুল জীবন-যাপন করে, স্নিগ্ধার কোন চাওয়া-পাওয়াকে সে অপূর্ণ রাখে না। সে যখন যা খেতে চায়, নিতে চায় তাতে এক বিন্দু কার্পণ্য করে না। চাওয়া-পাওয়ার দিক থেকে স্নিগ্ধার মনে কোন অতৃপ্তি নেই।
আনিস স্নিদ্ধারস্বামীসে আনিসকে ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে। আনিস খুব দায়িত্ববান, সচেতন এবং হিসেবী যাকে কৃপণ বললে অতিরঞ্জিত করা হয় মার্জিত ভাষায় যাকে ক্যালকুলেটিভ বলাই শোভনীয়। সবকিছুতেই সে ক্যালকুলেশন করে, জীবনের সব ক্যালকুলেশন স্বার্থদিয়ে মিলাতে চায়, কোনকিছু ছাড় দিতে চায় না। অনেক ক্যালকুলেশন যে ইমোশন দিয়ে করতে হয় সেটা সে বুঝতেই চায় না।
স্নিগ্ধা লক্ষ্য করেছে আনিসের মধ্যে ইমোশন বলে কিছু নেই। স্নিগ্ধার সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয় তখন তার বয়স সাতাশ বছর আর স্নিগ্ধার বয়স বাইশ। এ বয়সের সদ্য বিবাহিত একজন পুরুষের নববিবাহিতা বউকে নিয়ে নানান ধরনের স্বপ্নথাকার কথা কিন্তু আনিসের মধ্যে যেন কোনস্বপ্ননেই, কোন ইমোশন নেই, প্রাণচঞ্চল্য নেই। স্নিগ্ধার জন্য তার ভালোবাসারও কমতি নেই, তার প্রতি দায়িত্ববোধের ব্যাপারেও সে খুব সচেতন। স্নিগ্ধার জন্য তার যে বিষয়টির অভাব সেটি হলো ইমোশন।
স্নিগ্ধার জন্ম তারিখটা সে ঠিকই মনে রেখেছে, আজ সকালবেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে দরজার কাছে গিয়ে পিছু ফিরল। তারপর হঠাৎ করে বলল, ও স্নিগ্ধা আজ তোমার জন্ম দিন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
আনিস কথাটা এমনভাবে বলল যেন কোনকিছু ভুলে গেছে তাই ফিরে এসে বলল। তার কথার মধ্যে কোন ইমোশন নেই, মুখে কোন উৎফুল্লতা নেই। স্নিগ্ধার ধারণা ছিল আনিস হয়ত তার জন্ম তারিখ জানে না অথবা ভুলে গেছে। না তেমনটি নয়। তবে সে একই কথা স্নিগ্ধাকে কাছে টেনে নিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতো।
স্নিগ্ধা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, থ্যাংক ইউ।
স্নিগ্ধা সন্ধ্যায় রেডি থেকো, আমরা আজ কোন চাইনিজ রেস্টুরেণ্টে ডিনার করবো।
ওকে।
স্নিগ্ধা দরজা বন্ধ করল।
কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
শিহাব মোবাইল করেছে, স্নিগ্ধা রিসিভ করল, হ্যালো।
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
থ্যাংক ইউ শিহাব, এই না হলো ফ্রেণ্ড।
আজ তোমার কী কী প্রোগ্রাম আছে স্নিগ্ধা? বিয়ের পর আজকেই তো তোমার ফার্স্ট বার্থ ডে।
স্নিগ্ধার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার আনিসের কথা মনে পড়ল। সে তো বলে গেছে রাতে একসঙ্গে ডিনার করবে। তার আগে তো নিশ্চয়ই সে আসবে না।
হ্যালো, শিহাব বলল।
হ্যাঁ বলো।
তুমি কি ব্যস্ত?
না বলো।
তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ তোমার কী কী প্রোগ্রাম আছে?
কোন প্রোগ্রাম নেই তো, রাতে কোন চাইনিজ রেস্টুরেণ্টে ডিনার করবো।
আমরা একসঙ্গে তোমার বার্থ ডে সেলিব্রেট করব না?
তাই?
ইয়েস।
কখন? কোথায়? কীভাবে?
আমাদের সেই ফেভারিট জায়গায়।
কোথায়?
বসুন্ধরা সিটিতে।
কখন?
ঠিক সাড়ে পাঁচটায়।
ওকে।
প্রতিদিন সকালবেলা আনিস বেরিয়ে যায়। বাসায় ফিরে একেবারে রাত ন’টায়। স্নিগ্ধা নিশ্চিৎ যে আনিস আজো রাত ন’টায় বাসায় আসবে তারপরও বিকেলে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে স্নিগ্ধা একবার আনিসকে মোবাইল করল, না আনিস সেরকম কিছু বলল না।
স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আজ আগে আসবে?
না।
স্নিগ্ধা কিছুটা নিরাশ হলো। আনিস আজ একটু আগে আসতে পারতো, স্নিগ্ধাকে নিয়ে কিছু শপিং করতে যেতে পারতো, না আনিস সেরকম কোনদিন ছিল না। আজো তার কথার মধ্যে তেমন কোন লক্ষণ নেই। সে সেজেগুঁজে শিহাবের ফোনের অপেক্ষায় রইল।
বসুন্ধরা সিটিতে এর আগেও তারা কয়েকবার দেখে করেছে তাই কাউকে খুঁজতে হলো না। স্নিগ্ধা একবার এদিক-সেদিক তাকালো, না শিহাব নেই।
সে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে মোবাইলটা বের করছিল এমনসময় শিহাব সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে একটা ফুলের তোড়া।
শিহাব ফুলের তোড়াটা হাতে স্নিগ্ধার হাতে দিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
স্নিগ্ধা খুব খুশি হলো, শিহাব!
শিহাব চেয়ারে বসল। স্নিগ্ধার চোখে চোখ পড়তেই বলল, তোমাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
স্নিগ্ধার বুকটা যেন ভরে গেল, তাই নাকি?
অফকোর্স।
তোমার আর কী খবর?
এই তো চাকরি করছি, সংসার করছি।
তোমার বউ কেমন আছে?
ভালো, ও এখন হাণ্ড্রেট পার্সেণ্ট হাউজ ওয়াইফ, ঠিক তোমার মতো।
হ্যাঁ, তবে ও খুব লাকি।
কেন?
তোমার মতো একটা হ্যাজবেণ্ড পেয়েছে।
আমি হ্যাজবেণ্ড হিসেবে ভালো না।
কেন?
কারণ আমি ফাইন্যান্সিয়ালি সলভেণ্ট না, সেজন্য বেচারিকে খুব ক্যালকুলেশন করে চলতে হচ্ছে।
তাতে কী? তোমার মধ্যে একটা সুন্দর মন আছে, ইমোশন আছে, তুমি মানুষকে বুঝতে পারো।
তোমারও তো ভালো, তোমার হ্যাজবেণ্ডের টাকা আছে আর তোমার আছে ইমোশন।
দু’জনের মধ্যে যে কোন একজনের টাকা থাকলেই হয় কিন্তু ইমোশন দু’জনেরই থাকতে হয় কারণ একজনের ইমোশন দিয়ে আরেকজনের চলে না।
শিহাব আর কথা বাড়ালো না। সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, স্নিগ্ধা কী খাবে?
তুমি দাঁড়ালে কেন? আজ আমি খাওয়াব, তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।
শিহাব দাঁড়িয়ে রইল।
বসো প্লিজ।
শিহাব বসল।
স্নিগ্ধা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এলো।
দু’জনে খেতে খেতে অনেক গল্প করল। অনেকবার পরষ্পরের চোখে চোখ পড়েছে, স্নিগ্ধা লক্ষ্য করেছে শিহাবের চোখের দৃষ্টি একেবারে স্বচ্ছ, কোন চাতুরতা নেই, কোন লোভ নেই।
শিহাবের মোবাইলেররিং বেজে উঠল।
সে রিসিভ করল, হ্যালো সুজানা।
এই তুমি কোথায় বলোতো?
অফিস থেকে বের হলাম।
তাড়াতাড়ি এসো।
হ্যাঁ আসছি।
কথা প্রসঙ্গে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, তোমার বউ কি এখনো আমাকে জেলাস ফিল করে?
আমার বউ বলছ কেন? ও তো তোমারও ফ্রেণ্ড, সুজানা।
এ্যানিওয়ে।
এটা তো মেয়েদরে জেনেটিক প্রব্লেম।
শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও। ভালোবাসার সঙ্গে জেলাসের সম্পর্ক আছে, কেউ তার ভালোবাসাকে অন্যকে দিতে পারে না। সবার রিলেশন তো আর তোমার আমার মতো আনকণ্ডিশনাল না।
ভেরি গুড, তুমি তো দেখি তোমার আমার রিলেশনের একটা সুন্দর নাম দিয়েছ।
হ্যাঁ তোমার আর আমার রিলেশনটা আনকণ্ডিশনাল, শুধু হার্ট টু হার্ট।
এক্সাক্টলি।
আনিস বাসায় ফিরল রাত ন’টায়। প্রায় আধ ঘণ্টা আগে সে মোবাইল করে স্নিগ্ধাকে তৈরি থাকতে বলেছে। স্নিগ্ধা বাইরে থেকে ফিরে আর কাপড় বদলায়নি। সে কাপড়-চোপড় পরে আনিসের জন্য অপেক্ষা করছিল। আনিস কলিং বেল টিপতেই স্নিগ্ধা দরজা খুলে দিল।
আনিস স্নিগ্ধাকে তৈরি থাকতে দেখে বলল, এসো তাড়াতাড়ি এসো।
স্নিগ্ধা খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হতে পারল না। আনিসের কথা শুনে মনে হলো যেন তার তাড়া আছে, সে এখনি তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়। স্নিগ্ধা কোন কথা বলল না। সে আনিসের সঙ্গে বের হলো। রাস্তায় একটা সি.এন.জি’তে উঠে দু’জনে চলে গেল রমনা রেস্টুরেণ্টে। দু’জনে একটা টেবিলের দু’পাশে রাখা চেয়ারে মুখোমুখি বসল। আনিস টেবিলের ওপর রাখা প্রাইজ লিস্টটা স্নিগ্ধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্নিগ্ধা বলো কী খাবে?
স্নিগ্ধা মলিনমুখে বলল, তুমি অর্ডার দাও।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে আনিস অর্ডার দিল।
স্নিগ্ধা চারিদিকে একবার লক্ষ্য করলো। রেস্টুরেণ্টের কোন টেবিল খালি নেই। কথা বলার ষ্পষ্ট শব্দ নেই কিন্তু একটা গুঞ্জণ আছে, স্নিগ্ধা একবার আনিসের মুখের দিকে তাকাল, সে স্বাভাবকিভাবেইবসে আছে।
স্নিগ্ধা মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, আনিস।
হ্যাঁ বলো।
কথা বলছ না কেন?
কী কথা বলব?
দেখো সবাই কেমন কথা বলছে, আমাদের মতো মুখ গোমরা করে কেউ বসে নেই।
আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা পছন্দ করি না।
প্রয়োজনীয় কথাই বলো?
এখানে আর কী প্রয়োজনীয় কথা থাকবে?
স্নিগ্ধা তাদের সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিককরার চেষ্টা করল, বলোতো আজ আমার কততম জন্মদিন?
তেইশতম।
জানো তুমি?
কেন জানবো না?
এটা জানা বুঝি তোমার দায়িত্ব?
অবশ্যই।
আনিস আমি খুব লাকি যে তোমার মতো একজন দায়িত্ববান হ্যাজবেণ্ড পেয়েছি, বলে স্নিগ্ধা আনিসের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল। স্নিগ্ধা আশা করেছিল আনিস হয়ত বলবে, আমিও খুব লাকি যে তোমার মতো সুন্দর একটা মেয়ে পেয়েছি।
কিন্তু আনিস কিছু বলল না।
স্নিগ্ধা আবার বলতে শুরু করল, আনিস তুমি একটু ইমোশনাল হও, এত কম বয়সে কেউ এমন গম্ভীর হয় না। শুধু ক্যালকুলেশন আর সিনসিয়ারিটি দিয়ে জীবন চলে না, জীবনের জন্য ইমোশনেরও প্রয়োজন আছে।
আনিস তবুও কোন কথা বলল না। স্নিগ্ধা আশা করেছিল আনিস রাগ করে হলেও বলবে, আমাকে তোমার জ্ঞান দিতে হবে না।
না তবুও সে কিছু বলল না, স্নিগ্ধা যে তার ওপর রাগ করছে তাতে তার কোন অনুভূতি নেই। সে রেগেও গেল না, স্নিগ্ধাকে ধমকও দিল না, সে যেমন চুপ করে বসেছিল তেমনি চুপ করে বসে রইল।
বয় খাবার নিয়ে এলো। স্নিগ্ধার রাগ তখন চরমে। বয় টেবিলে খাবার রেখে চলে গেল। স্নিগ্ধা আনিসের প্লেটে স্যুপ তুলে দিল। খেতে খেতে আর তেমন কোন কথা হলো না। খাওয়া শেষ করে দু’জনে বাসায় ফিরল। রাতেও আর তেমন কোন কথা হলো না। আনিস বিছানায় শুয়ে পড়ল তারপর এক দীর্ঘ ঘুম।
শুধু তার এই জন্মদিনে নয়, অনেক বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতেও তার কোন অনুভূতি নেই, কোনদিন শপিং করতে গেলেও ঠিক একই। স্নিগ্ধা যা চায় তাই কিনে দেয়, কোনদিন একবার বলেও না, এটা কী দরকার? এখন টাকা নেই, মাসের প্রথম সপ্তাহে কিনে দিব। একবার যদি এরকম কথা বা যদি একটু মিষ্টি তর্কও হতো তবুও স্নিগ্ধা খুশি হতো, যদি একবার বলতো। না তার বলার কিছু নেই, স্নিগ্ধার ইচ্ছাই তার ইচ্ছা।
আনিস অফিস ছুটির দিনে সারাদিন বাসায় বসে পেপার পড়ে, টি.ভি দেখে কোন ভালো খবরে তার উচ্ছ্বাস নেই, টি.ভিতে ভালো নাটক হলে দেখবে কিন্তু কোন ইমোশন নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। ক্রিকেট খেলা দেখবে সে যে দলকে সমর্থন দিবে সেই দল জিতলেও তার কোন ইমোশন নেই, হেরে গেলেও তার কোন কষ্ট নেই, সে যেন একটা রোবট, সমস্ত প্রয়োজন মেটাবে কিন্তু কোনদিন ক্লান্ত হবে না, মুখের ওপর আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন ঘটবে না।
ক’দিন থেকে স্নিগ্ধার শরীরে কিছু অস্বাভাবিকপরিবর্তন দেখা গেল, বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরে, মুখে রুচি নেই। নিজের অবস্থা বুঝেই সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে যে সে মা হতে চলেছে। তারপরও একবার প্রেগনেন্সি টেস্ট করা প্রয়োজন। স্নিগ্ধা সেদিন রাতে আনিসকে বলল।
আনিস সবকিছু শুনে বলল, ঠিক আছে তুমি কাল ক্লিনিকে প্রেগনেন্সি টেস্ট করে এসো।
স্নিগ্ধা কিছুটা হবাক হলো, আমি একাই যাবো!
হ্যাঁ, তুমি ঢাকা শহরে লেখাপড়া করেছ একাই ক্লিনিকে যেতে পারবে না?
আনিস একটা মেয়ে একাই ক্লিনিকে গিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট করাটা খারাপ দেখায় তা তুমি বোঝ?
আনিস আর কিছু বলল না।
শুক্রবার দিন স্নিগ্ধাকে নিয়ে ক্লিনিকে গেল। রেজাল্ট পজিটিভ।
আনিসের মধ্যে তবুও কোন অনুভূতি নেই, বাসায় ফিরে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, আনিস তুমি খুশি হওনি?
হুম।
পরদিন সকালবেলা স্নিগ্ধা শিহাবকে মোবাইল করল। শিহাব প্রথমে একবার লাইন কেটে দিল, কিছুক্ষণ পর সে-ই কল ব্যাক করল।
স্নিগ্ধা রিসিভ করল, হ্যালো।
স্নিগ্ধা তুমি ভালো আছ?
হ্যাঁ, তোমাকে একটা খবর দেওয়ার জন্য এত সকালে রিং দিয়েছি।
তাড়াতাড়ি বলো।
শিহাব আমি মা হতে চলেছি।
কনগ্রাচুলেশন, মিষ্টি খাবো কবে?
তুমি চাইলে আজই।
আজকেই?
কেন? তোমার ব্যস্ততা আছে?
না ব্যস্ততা তেমন নেই কিন্তু-
স্নিগ্ধা বলল, শিহাব আজ আমার মনটা ভালো নেই।
কেন? শিহাবের কণ্ঠেউৎকণ্ঠা।
শিহাব তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আমার বার্থ ডে’তে। আজ তুমি আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ।
ওকে, তাহলে চলে এসো।
তুমি আমার বাসা এসো, ফ্রিজে মিষ্টি আছে খেয়ে যাবে, স্নিগ্ধা বলল।
না স্নিগ্ধা তা হয় না।
কেন?
তোমার হ্যাজবেণ্ড বাসায় নেই, তুমি একা। এ অবস্থায় তোমার বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না।
তবে।
তুমি বাইরে এসো।
কোথায়?
তুমি অসুস্থ বেশি হাঁটাহাঁটি করা ঠিক হবে না। মালিবাগ মোড়ে এসো।
কখন আসবো?
ঠিক ছয়টায়।
আচ্ছা।
আজ স্নিগ্ধার চোখে-মুখে সেই উচ্ছ্বলতা নেই। এ’কদিনে তার মুখ শুকিয়ে গেছে। লিপ স্টিক পরানো কিন্তু ঠোঁট দু’টো শুকনো, কথা বলার সময় স্নিগ্ধা বার বার করে ঢোক গিলছে।
শিহাব জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার স্নিগ্ধা?
আগে বসি, একটু বিশ্রাম নিই।
বসো, বসো।
দু’জনে মুখোমুখি বসল।
বয় এলো, স্যার কী দিব?
শিহাব বলল, মিষ্টি দাও, এই একটা করে রসগোল্লা, ……………
শিহাব প্রথমে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার স্নিগ্ধা বলোতো?
না ব্যাপার কিছু না, অনেকদিন থেকে তোমার দেখা হচ্ছে না।
এবার শিহাব শাসনের সুরে বলল, স্নিগ্ধা তুমি কিন্তু লুকাচ্ছ? একবার আমার চোখের দিকে তাকাও তো।
স্নিগ্ধা মুখ তুলে তাকাল।
শিহাব বলল, স্নিগ্ধা লুকাচ্ছ কেন? ব্যাপারটা যদি একেবারে তোমাদের বেড রুমের হয় তবে আমাকে বলো না। আর তুমি যদি মনে করো আমি তোমার কোন কাজে আসতে পারি তবে আমাকে বলো?
শিহাব আমি মা হতে চলেছি তুমি খুশি হওনি?
অফকোর্স, আমার ফ্রেণ্ড মা হতে চলেছে আমি খুশি হবো না? আমি অবশ্যই খুশি হয়েছি।
থ্যাংক ইউ শিহাব, ইউ আর মাই রিয়্যাল ফ্রেণ্ড।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
শিহাব আমার মা হওয়ার খবরে ও এমন একটা ভাব দেখালো যেন এটা নতুন কিছু না। তার মধ্যে কোন ইমোশন নেই, আগ্রহ নেই। মনে হলো সে মোটেই খুশি হয়নি।
তুমি সেজন্য মন খারাপ করেছ?
স্নিগ্ধা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
শিহাব বলতে শুরু করল, স্নিগ্ধা আনিস নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে। আসলে আমাদের একেক জনের বাচনভঙ্গী একেক রকমের। হয়ত তার বাচনভঙ্গীতে ইমোশন কম। এটা হতেই পারে, সেজন্য মন খারাপ করার কিছু নেই। সেক্রিফাইজ করতে শেখো, আনিস একটা ব্রিলিয়াণ্ট স্টুডেণ্ট, ব্যাংকে একটা বড় পদে চাকরি করছে। তাকে সবসময় চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকে হয়। আসলে আমি ছোট চাকরি করি, কম দায়িত্ব পালন করতে হয় সেজন্য তোমাকে সময় দিতে পারি। আমি যদি ওর মতো ব্যস্ত চাকরি করতাম তবে আমিও হয়ত তোমাকে সময় দিতে পারতাম না। তুমি ওর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা মনে করে একটু সেক্রিফাইজ করো।
শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে শুনতে স্নিগ্ধার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, তুমি খুব ভালো শিহাব, খুব ভালো।
শিহাব পকেট থেকে একটা টিস্যু পেপার বের করে স্নিগ্ধার দিকে বাড়িয়ে দিল, ম্যাডাম টিস্যু।
স্নিগ্ধা হেসে উঠল।
স্নিগ্ধার সঙ্গে শিহাবের প্রতিদিন কথা হয়। কোন কোনদিন একাধিকবার কথা হয়। স্নিগ্ধা লক্ষ্য করেছে শিহাব তাকে সবসময় গঠনমূলক পরামর্শ দেয়। সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে বলে। স্নিগ্ধা অনেক গল্প শুনেছে, অনেকেই মানুষের কষ্টের কথা শুনে খুশি হয়, সুযোগ নিতে চেষ্টা করে কিন্তু শিহাব তা করে না, সে আনিসের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে বলে, দূরত্ব তৈরি না করে সেক্রিফাইজ করতে বলে। সে তার প্রতি কোনদিন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় না, হয়ত এমন কথা কল্পনাও করে না।
কয়েকমাস পরের কথা। ততদিনে স্নিগ্ধার বাচ্চা ডেলিভারীর সময় এগিয়ে এসেছে। একদিন ভোর রাতে স্নিগ্ধার পেটে ব্যাথা শুরু হলো। রাতেই এ্যাম্বুলেন্সেকরে তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো বাচ্চার পজিশন ভালো না, অপারেশন করতে হবে। স্নিগ্ধার বার বার করে শিহাবের কথা মনে পড়ল। একবার মনে হলো শিহাবকে মোবাইল করবে কিন্তু শিহাব তো এখন বাসায়, যদি ওর বউ মোবাইল রিসিভ করে তবে একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে যাবে। স্নিগ্ধা জানে শিহাবের মোবাইলের ম্যাসেজ টোন সাইলেন্ট করা থাকে কাজেই একটা ম্যাসেজ দিতে পারলে মোবাইলটা হাতে নিয়েই তার চোখে পড়বে ম্যাসেজটা কিন্তু কীভাবে লিখবে ম্যাসেজটা? ব্যাথায় তার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। সে আনিসকে বলল, আমার মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে ক্লিনিকের এ্যাড্রেসটা লিখে দাও তো।
আনিস কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে স্নিগ্ধার মোবাইলে ক্লিনিকের এ্যাড্রেসটা লিখে দিল।
শিহাবের মোবাইলনাম্বারস্নিগ্ধার মুখস্ত। সে শিহাবের মোবাইলে ক্লিনিকের এ্যাড্রেসটা পাঠিয়ে দিল।
শিহাব কিছুক্ষণের মধ্যে এলো তার চুলগুলো এলোমেলো, চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। শিহাবের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধার মনে হলো সে তার ক্লিনিকের ঠিকানা পাবার সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো ছুটে এসেছে। শিহাব জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা স্নিগ্ধা?
বেড এর পাশে দাঁড়ানো সিস্টার ঘটনার বিবরণ দিল। শিহাব বলল, আমি ব্লাড দিব।
সিস্টার বলল, আপনার ব্লাড গ্রুপ।
বি পজিটিভ, স্নিগ্ধারও বি পজিটিভ।
স্নিগ্ধা জানে আনিসের ব্লাড গ্রুপও বি পজিটিভ কিন্তু সে নিজে ব্লাড দিতে না চেয়ে ব্লাড কেনার জন্য ক্লিনিকে ছুটছে। স্নিগ্ধার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে অনেক কষ্টে ডাকল, শিহাব।
শিহাব বেড এর কাছে এলো। স্নিগ্ধা শিহাবের হাত ধরে বলল, আমার জন্য দোয়া করবে শিহাব।
অবশ্যই, তুমি কিচ্ছু ভেবো না স্নিগ্ধা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাই যেন হয়।
আনিস ব্লাড নিয়ে এসেছে কিন্তু ততক্ষণে শিহাবের ব্লাড দেওয়া শেষ হয়েছে। আনিস ডাক্তারের কাছে ব্লাড জমা দেওয়ার পর স্নিগ্ধার কেবিনে এলো, স্নিগ্ধা ব্লাড পাওয়া গেছে, একটা ছেলেও ব্লাড দিয়েছে।
স্নিগ্ধা বলল, হ্যাঁ ও আমার ফ্রেণ্ড।
স্নিগ্ধাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিস্টার এলো, আনিস স্নিগ্ধার বেড এর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে কোন কথা নেই।
স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কোথায়?
ল্যাবরেটরীতে, ব্লাড দেওয়ার পর একটু রেস্টে আছে।
স্নিগ্ধা আনিসের হাত ধরল, আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তুমি আমাকে মাফ করো।
আনিস বলল, স্নিগ্ধা কিছু হবে না, তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
স্নিগ্ধার সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে, জ্ঞান ফেরার পর বাচ্চাকে দেখানোর সময় আনিস কাছে এলো কিন্তু কিছু বলল না, অন্ততঃ একটা ধন্যবাদ তো দিতে পারতো। ইতোমধ্যে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনো এসেছে, তাদের একজন স্নিগ্ধার খালা, ঢাকার মিরপুরে থাকে, বয়সে স্নিগ্ধার চেয়ে কয়েক বছরের বড়, সে বলল, জামাই নাতি তো তোমার মতো হয়েছে।
স্নিগ্ধার মুখের ওপর এক খণ্ড কালো মেঘ ঢেকে গেল, সে বলল, বড় হলে বাচ্চাদের জন্মের সময়ের মুখের গড়ন থাকে না খালা।
তা অবশ্য ঠিক বলেছ।
আনিস বলল, স্নিগ্ধা, তুমি এখন সুস্থ, আমাকে একবার অফিস যেতে হবে। খালা আম্মা আছে, বাইরে আরো কয়েকজন গেস্ট আছে, কিছুক্ষণের মধ্যে আম্মা চলে আসবে।
স্নিগ্ধা মন খারাপ করল। সে মলিনমুখে বলল, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি এসো।
আনিস চলে গেল।
স্নিগ্ধা একা। বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। খালা হয়ত বাইরে কোথাও আছে। সে চুপ করে কেউ আসার অপেক্ষা করল। কিছুক্ষণ পর তার খালা এলো।
স্নিগ্ধা মৃদুকণ্ঠে ডাকল, খালা।
খালা কাছে এলো।
খালা দেখো তো আমার মোবাইলটা কোথায়?
এখন মোবাইলটা কী করবি? তুই অসুস্থ, ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছে, রেস্টে থাকতে বলেছে।
স্নিগ্ধা বিণয়ের সুরে বলল, খালা, একটু দাও প্লিজ, আমি কথা বলব না।
খালা স্নিগ্ধাকে মোবাইলটা দিল।
স্নিগ্ধা অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করে মোবাইলের বাটন টিপে টিপে একটা ম্যাসেজ লিখল।
Love & Friendship walk in the field
lover dropped in a hole
why?
because love is blind.
But friend jumpped in the hole
because friend can do everything
for friend.
তারপর আপনমনে একটু হেসে ম্যাসেজটা শিহাবের মোবাইলে পাঠালো।
সমাপ্ত
Leave a Reply