মাস্টার মাইন্ড

গোয়েন্দাদের চোখ এখন দেয়ালে লেখা বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্নের ওপর। এই চিহ্নগুলোর পরিবর্তন আছে যেমন : ডেঞ্জারাস বয়েজ গ্রুপ, ব্রাইট স্টার গ্রুপ, গ্রুপ আন্ডার সিঙটিন, নর্থ সাউথ গ্রুপ ইত্যাদি কিন্তু হাসান সাহেব খুনের ব্যাপারে কিশোরদের কী যায় আসে? হাসান সাহেব বয়সে প্রবীণ, রাজনীতিবিদ এলাকার গণ্যমান্য এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। হাসান সাহেব খুন হওয়ার আজ তিন দিন অতিবাহিত হলো কিন্তু পুলিশ কোনো কুল কিনারা করতে পারলো না। রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় পুলিশের ওপর দ্রুত তদন্তপুর্বক প্রকৃত খুনি গ্রেফতারের জন্য চাপও আছে।

কিন্তু কিশোর গ্যাংগুলো হাসান খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে কেনো? এ যাবৎ কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে যত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে, আর অল্প কিছু আছে সিনিয়রিটি-জুনিয়ারিটি না মানা এবং কিছু ইভ টিজিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে হত্যার কাজে ব্যবহৃত একটি পিস্তলের গুলি এবং মোটর সাইকেলের একটা সিগনাল লাইট উদ্ধার করেছে। খুব সম্ভব খুনি পালানোর সময় তার মোটর সাইকেলের লুকিং গ্লাস খুলে পড়ে গেছে। খুনি এমনভাবে গুলি করেছে যাতে হাসান সাহেবের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। তারপরও বুকে এলোপাতাড়িভাবে গুলি ছুঁড়েছে। তাছাড়া আশেপাশে এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি যাতে ঘটনার স্পষ্ট ক্লু খুঁজে পাওয়া যায় কয়েকটি ক্যাডস পরা পায়ের ছাপ ছাড়া।

সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো, খুনি মোটর সাইকেল দাঁড় করে রেখেছিলো রাস্তার পাশে, সেখানে হয়তো হাসান সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পায়চারিও করেছে। তাই মোটর সাইকেলের আশেপাশে কয়েকটা এলোমেলো ক্যাডস পরা পায়ের ছাপও আছে। পায়ের ছাপগুলোর মডেল তৈরি করে রাখা হয়েছে, মাপ লিখে রাখা হয়েছে, ছবি তুলে রাখা হয়েছে তাতে এটা বোঝা যায় পায়ের ছাপগুলি কম বয়সী মানুষের। কমবয়সী খুনি! এটা যদি সত্যি হয় তবে তো আরো মারাত্মক, কমবয়সী খুনি! মানে যাদের হাতে থাকার কথা কাগজ-কলম তাদের হাতে পিস্তল!

পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া অন্যান্য আলামত ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে। সমস্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির ঐ এলাকার নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা মোবাইল অপারেটরগুলোর ব্যবহারকারীর নাম এবং পরিচয়পত্রের কপি এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করার জন্য সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরদের চিঠি দিয়েছে। সবগুলো রিপোর্ট আসতে কিছুদিন সময় লাগবে আর সবগুলো কাজ শুধু পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরও না, তাই পুলিশের সদিচ্ছা থাকলেও দ্রুত তদন্তপুর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ কাজ নয়। একটা বিষয় আরো উল্লেখযোগ্য যে, খুনের ধরণ দেখে অনুমান করা যায় এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, এর নেপথ্যে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তারা হয়তো প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবান।

ওসি সাহেব ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করতে পারছেন না। তদন্তকারী কর্মকর্তা ইব্রাহিম সাহেব খুব দক্ষ পুলিশ অফিসার, তিনিও দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ইব্রাহিম সাহেব ওসি সাহেবকে ঘটনার আপডেট দিচ্ছিলেন এমন সময় একজন সাংবাদিক ওসি সাহেবের চেম্বারে প্রবেশ করলেন, তার সঙ্গে একজন ক্যামেরাম্যান, হাতে টি.ভি ক্যামেরা এবং স্ট্যান্ড।

ওসি সাহেব শত চিন্তা সত্ত্বেও সহাস্যে অভিবাদন জানালেন, আসুন সাংবাদিক সাহেব, আসুন, বসুন।

সাংবাদিক সাহেব সালাম দিলেন, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছেন বলুন? ওসি সাহেব হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ভালো আলহামদুলিল্লাহ, তবে কাজের চাপ বেশি। একের পর এক অ্যাসাইনমেন্ট।

হ্যাঁ। তা তো হবেই আপনি একটা জনপ্রিয় চ্যানেলের স্বনামধন্য সাংবাদিক, বলে ওসি সাহেব কলিং বেল টিপ দিতেই স্যান্ট্রি এসে স্যালুট দিলো, স্যার।

চা নিয়ে এসো।

আজ থাক ওসি সাহেব, একটু কাজের তাড়া আছে, আরেকদিন চা খাবো।

ক্যামেরাম্যান স্ট্যান্ডে ক্যামেরা সেট করে করলো। সাংবাদিক সাহেব একবার আড়চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ক্যামেরা রেডি?

জি বস।

ওসি সাহেব হাসান ভাই একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুর আজ তিন দিন হলো এখনো খুনি ধরা পড়লো না। তদন্ত কাজ কতদূর এগুলেন?

ওসি সাহেব বলতে শুরু করলেন, দেখুন হাসান ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন জেলা পর্যায়ের নেতা ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে সম্মান করতাম। তার খুন হওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছেও রহস্যজনক। তার কোনো প্রতিপক্ষ আছে বলে আমরা জানি না, তার মৃত্যুতে কে সুবিধাভোগী হতে পারে তাও জানি না। আমরা তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

আপনারা এমন কি তদন্ত করছেন যে আজ তিন দিন হলো অথচ একজন আসামিকেও আপনারা অ্যারেস্ট করতে পারলেন না?

দেখুন কোনো ক্লু খুঁজে না পেয়ে ইচ্ছে করলেই কাউকে আ্যরেস্ট করা যায় না। আমরা তদন্ত করছি, তদন্তকাজ অনেকদূর এগিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা খুনি আ্যরেস্ট করতে পারবো বলে আশা করি।

তা কতদিন লাগতে পারে? আই মিন সাত দিন, দশ দিন?

এভাবে বলা যাবে না। কারণ কোনো মামলার তদন্তকাজ শুধু পুলিশ বিভাগের ওপর নির্ভর করে না। এখানে সরকারের অন্যান্য বিভাগও জড়িত।

অন্যান্য বিভাগ মানে?

দেখুন আমরা লাশ মর্গে পাঠিয়ে দিই সেখান থেকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসতে হয়, টেস্টের রিপোর্ট আমাদের হাতে না। আরো কিছু রিপোর্ট প্রয়োজন হয় আমরা সবগুলো রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি এবং এরকম একটা ষ্পর্শকাতর কেস আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে এবং দ্রুততার সঙ্গে তদন্তকাজ পরিচালনা করছি। দৃশ্যমান না হলেও তদন্তের অনেক অগ্রগতিও হয়েছে।

আমরাও আশা করি শীঘ্রই পুলিশ বিভাগ আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে।

সাংবাদিক সাহেব চলে গেলো।

ওসি সাহেব ক্যামেরার সামনে কিছুটা অপ্রস’ত হয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক সাহেব যাওয়ার পর ওসি সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন, কী বুঝলেন ইব্রাহিম সাহেব?

স্যার।

সবদিকে একটু খবর নিন।

জি স্যার আমি খবর নিচ্ছি।

এমন সময় ওসি সাহেবের টেলিফোন বেজে উঠলো।

ওসি সাহেব রিসিভার তুললেন, হ্যালো।

হ্যালো, ওসি সদর, অপর পাশ থেকে এস.পি সাহেবের ভারি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

ওসি সাহেব চেয়ার থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলেন, স্যার, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

হাসান সাহেব খুনের কেসটার কোনো আসামি আ্যরেস্ট করতে পেরেছো?

স্যার, স্যার আমি দেখছি স্যার।

কেসটা সিরিয়াসলি দেখো। হাসান সাহেব পাওয়ার পার্টির নেতা, এখন পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেফতার করতে না পারার জন্য বার বার বিভিন্ন মহল থেকে প্রেসার আসছে।

স্যার, জি স্যার আমি দেখছি স্যার।

সিরিয়াসলি দেখো। সব কেস একই রকম মনে করবে না। হাসান সাহেবের খুনি ধরা না পড়লে পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি বলে আর কিছু থাকবে না। তোমাকেও জবাবদিহি করতে হবে, এস.পি সাহেবের শেষের কথাগুলো ওসি সাহেবের কাছে বেশ কর্কশ শোনালো, ওসি সাহেবের বুক কেঁপে উঠলো। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, স্যার।

এস.পি সাহেব ফোন রেখে দিলেন।

ওসি সাহেব যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

 

দুই

 

সাধারণত খুন-খারাবির ঘটনাগুলো ঘটে কোনো না কোনো স্বার্থকে কেন্দ্র করে। সেক্ষেত্রে বেনিফিসিয়ারিস মাস্ট বি ইনভলবড দ্যাট কেস অর্থাৎ সুবিধাভোগী অবশ্যই সম্পৃক্ত থাকে কিন্তু কিশোর গ্যাংগুলোর হাসান সাহেবের রাজনীতির সঙ্গে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। বেনিফিসিয়ারিস হিসেবে আগামী নির্বাচনের হাসান সাহেবের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে মোবারক কাউন্সিলর, মোবা কাউন্সিলর বলেই সে শহরে অধিক পরিচিত। মোবা কাউন্সিলর তো কয়েক দিন আগে ইন্ডিয়া গেছে চিকিৎসা করতে। তার হার্টের অসুখ, সে আবার দেবী শেঠী ছাড়া অন্য কোনো ডাক্তারের ওপর ভরসা পায় না। তাই একটু বুক ব্যথা করতেই পাড়ি জমিয়েছে ইন্ডিয়া।

হাসান সাহেবের কোনো নিজের কোনো সন্তান নেই। তিনি তার এক ভাগ্নেকে ছোটবেলা থেকে লালনপালন করছেন, তার ব্যবসা-বাণিজ্য সব সেই ভাগ্নে মোরশেদ হোসেন মিরু দেখাশুনা করে। হাসান সাহেবরা দু’ভাই এক বোন। হাসান সাহেব বড়, ছোট ভাই হোসেন। হোসেনের একটি মাত্র মেয়ে রিশা, লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি। পাড়ারই এক বখাটে ছেলে মন্টুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। হাসান সাহেবের বিশাল সম্পত্তির ওপর তার ভাতিজী এবং ভাতিজী জামাইয়ের কিছুটা লোভ আছে। হাসান সাহেবের ছেলেমেয়ে নেই বলে রিশা বাবার বাড়ি বলতে হাসান সাহেবের বাড়িকেই মনে করে। ঈদ-পরবে হাসান সাহেবের বাড়িতে আসে, হাসান সাহেবকেও বাবা বলেই ডাকে। হাসান সাহেবের স্ত্রী হামিদাকে মা মা বলেই ডাকে। হাসান সাহেব রিশাকে মেয়েই ভাবে, হোসেনের আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে রিশার বিয়েতে প্রথম তার মত না থাকলেও শেষে বিয়ের পুরো খরচ হাসান সাহেবই করেছেন। কথায় কথায় হাসান সাহেব বলতেন আমাদের দু’ভাইর একটা মেয়ে। মা আমার বলে রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।

সেই রিশা প্রায় মাস দু’য়েক আগে এসেছিল বড় আব্বার কাছে। মন্টুর ব্যবসায় কিছু টাকার জন্য, বেশি না পাঁচ লাখ, রিশা অবশ্য বলেছিলো, আপতত ধার হিসেবেই নিবে পরবর্তীতে ফেরত দিবে। রিশার সঙ্গে হাসান সাহেবের সম্পর্ক বাবা আর মেয়ের মতো হলেও কথাটা রিশা সরাসরি হাসান সাহেবকে বলেনি রিশা তার বড় আম্মাকে বলেছিলো। স্ত্রীর কাছ থেকে শুনে হাসান সাহেব টাকাটা দেননি।

হাসান সাহেব বললেন, হামিদা কেবল তো মেয়েটার বিয়ে হলো, আগে দেখি কী হয়। আমার তো ছেলেটাকে এখনো পছন্দই হয় না। ঐ ছেলে সংসারী না, ব্যবসায়ী না। সে ব্যবসা করতে পারবে না, শেষে টাকাটা খোয়া যাবে।

রিশা মন খারাপ করে চলে গেছে। হাসান সাহেবের টাকার প্রতি রিশার না হোক তার স্বামী মন্টুর লোভ আছে। পুলিশ তদন্তে এ পর্যন্ত জানার পর মন্টুকে গ্রেফতার করে, রিমান্ডে নিয়ে জ্ঞিাসাবাদ করেছে কিন্তু সেখানে সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায়নি।

পুলিশের পরের সন্দেহভাজন মিরু, শৈশব থেকে মামার বাড়িতে থাকায় এবং মামার ব্যবসা দেখাশোনা করায় সে লেখাপড়ায় ভালো করতে পারেনি। কোনোভাবে এইচ.এস.সি পাস করে মামার ব্যবসাতে নিজেকে নিয়োগ করেছে। হাসান সাহেবের পেট্রোল পাম্প, স্টক বিজনেস এবং অ্যাগ্রো বিজনেস মিরু দেখাশোনা করে। হাসান সাহেব ব্যবসায় তেমন সময় দিতে পারতেন না তিনি রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। পুরো ব্যবসা দেখাশোনা করতো মিরু।

মিরুর ছোট ভাই তরু। একসময় হাসান সাহেবদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। তখন দেশে যৌতুকের প্রচলনটাও অনেক বেশি ছিলো। এখন যে কমেছে তাও না। তবে আইনের প্রয়োগ না থাকায় তখন অনেকটা খোলামেলা ছিলো আর এখন কিছুটা আইনের প্রয়োগ থাকায় যৌতুকের লেনদেনটা হয় গোপনে। হাসান সাহেবের বাবা মারা গেছেন ছোটবেলা। তাই হোসেন আর ছোটবোনকে হাসান সাহেবই লালনপালন করেছেন। সেসময় যৌতুক দিতে পারেননি বলে হোসনে আরাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারেননি। হোসনে আরার সেই অভিযোগটা বড় ভাইয়ের প্রতি রয়েই গেছে। তাই হোসনে আরার ছেলে মিরুকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। হোসনে আরার ছোট ছেলে তরুকেও তিনি লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু তরু লেখাপড়া শিখতে পারেনি। তরুর আশা ছিলো সেও বড় ভাইর মতো মামার ব্যবসায় শরীক হবে কিন্তু মিরু আবার সেটা ভালো চোখে দেখেনি।

তরু রাজনীতি করে, মামার দলের। ভাগ্নে হিসেবে তো বটেই রাজনীতির দিক থেকেও তারুর প্রতি হাসান সাহেবের কিছুটা সহানুভূতি ছিলো। তাই কয়েক বছর আগে হারু যখন মামার কাছে এসে ব্যবসা করার জন্য কিছু আব্দার করলো সঙ্গে আবার তার মা ছেলেকে টাকা দেয়ার জন্য সুপারিশ করলো তখন হাসান সাহেব কিছু সার, কীটনাশক এবং কিছু টাকা দিয়ে এলাকার বাজারে একটা দোকান করে দিলেন। কয়েকমাসের মধ্যে তরু সেই ব্যবসার পুঁজিসহ হারিয়ে ফেললো।

তারপর আবার এলো তরু টাকার জন্য, এবার নতুন ব্যবসা শুরু করবে বলে।

সেদিন রাতে হাসান সাহেবের সারাদিন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম, ব্যবসার কাজ সেরে যখন বাসায় ফিরলেন তখন দেখলেন হোসনে আরা আর তরু। মা-বেটাকে দেখে হাসান সাহেব কিছুটা অনুমান করতে পারলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।

রাতের খাবারের পর হোসনে আরা কথা তুললো, ভাইজান আমি আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি।

শুধু কাজে কেনো, তুই তো আমার ছোটবোন এমনিতেও আসতে পারিস।

ড্রয়িং রুমে একটা সোফায় হাসান সাহেব বসেছেন, আরেকটা সোফায় হোসনে আরা। তরু একটা সোফার কাছে দাঁড়িয়ে বিনয়ী ছেলের মতো মাথা চুলকাচ্ছে।

হাসান সাহেব কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, তুই আবার দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বস।

তরু বসলো।

হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বল কী কাজ?

ভাইজান আপনাকে কী করে যে বলি কথাটা।

হাসান সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বলতে না চাইলে থাক।

না বললে তো হবে না। আমি বলছিলাম তরুর কথা।

হাসান সাহেব কিছুটা রাগান্বিতস্বরে বললেন, কী হয়েছে তরুর?

তরু তো একেবারে বেকার হয়ে বসে আছে। এতবড় একটা জুয়ান ছেলে কি বাসায় বসে বসে খাবে? আমাদের কি সেই অবস্থা আছে? ওকে তো একটা কিছু করতে হবে।

হাসান সাহেব গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন, হ্যাঁ আমিও তো তাই মনে করি। এতবড় একটা ছেলের কিছু একটা করা উচিত।

হাসান সাহেবের কথা শুনে তরুর মুখ উজ্জ্বল হলো। হোসনে আরা কিছুটা আশাবাদী হলো।

হাসান সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, সেজন্য তো আমি একবার কয়েক লাখ টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করে দিলাম কিন্তু কই চালাতে পারলো।

আর এরকম হবে না ভাইজান। এবার পারবে। আসলে গ্রামের মানুষ একবার বাকি নিয়ে আর টাকা দেয় না। ব্যবসার সব টাকা বাকি পড়ে গেলো।

হাসান সাহেব গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো, এবার আবার কীসের ব্যবসা করবে?

তরু ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললো, মামা ঔষধের।

হাসান সাহেব জোরে ধমক দিলেন, তুই চুপ কর। শুধু টাকা থাকলেই ব্যবসা হয় না, ব্যবসা শিখতে হয়। তুই আগে কখনো ঔষধের ব্যবসা করেছিস?

তরু মিন মিন গলায় বললো, মামা ব্যবসা করতে করতে শিখবো।

তাহলে আগে শিখ। আগে এক বছর ঔষধের দোকানে থাক, সেলসম্যানের চাকরি কর, তাহলে ব্যবসা শিখবি। তারপর আমার কাছে আসিস আমি টাকা দিয়ে শহরে একটা ঔষধের দোকান করে দিবো।

হোসনে আরা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ভাইজান একবার না হয় আমার ছেলেটা আপনার ক’টা টাকা নষ্ট করেছে তাই বলে আপনি এতবড় একটা ছেলেকে, নিজের ভাগ্নেকে তার মায়ের সামনে এভাবে ধমকাবেন?

হাসান সাহেব একবার রাগান্বিত চোখে হোসনে আরার দিকে তাকালেন।

হোসনে আরা তার ভাইকে চিনে তিনি একবার যা বলেছেন তাই করবেন। তাই সে উঠে দাঁড়ালো, আপনি টাকা দিবেন না তো দিবেন না, তাই বলে আমার এতবড় ছেলেটাকে এভাবে অপমান করবেন? ঠিক আছে ভাইজান আমি আর কোনোদিন আপনার কাছে আসবো না। চল তরু বলে চলে যেতে যেতে বললো, সেজন্য তো আল্লাহ কপালে একটা ছেলেমেয়ে দেয়নি। কৃপণের ধন খায় নারায়ণ।

হাসান সাহেব মনে খুব দুঃখ পেয়েছেন। এই বোনটিকে তিনি ছোটবেলা থেকে লালনপালন করেছেন, নিজে টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন এবং যখনই প্রয়োজন তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার বড় ছেলেকে নিজের ছেলের মতো করে গড়ে তুলেছেন আর একবার শুধু টাকা না দেয়াতে এতবড় কথা বললো।

হামিদা পিছন থেকে ডাকছিলো, হোসনে আরা অনেক রাত হয়েছে, আজ থাক। কাল সকালে যাস। হোসনে আরা…

হাসান সাহেব ডাক দিলেন, হামিদা ওদের ডেকো না।

পুলিশ এসব ঘটনা জানার পর সন্দেহভাজন হিসেবে মিরুকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও পুলিশ তার কাছ থেকে কোনো ক্লু খুঁজে পেলো না। তারপর পুলিশ তরুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তার কাছ সেদিনে ঘটনা জানার পর তরুর ওপর পুলিশের সন্দেহ বেড়ে গেছে কিন্তু তরু ক্ষমতাসীন দলের যুব নেতা হওয়ায় পুলিশ তাকে আটক করেনি। উপজেলা শাখার একজন সিনিয়র নেতার জামিনে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেবার সময় পুলিশ তাকে শাঁসিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে থানায় না জানিয়ে কোথাও যাবেন না। প্রয়োজনে পুলিশ ডাকামাত্র থানায় হাজির হতে হবে।

তরুর কাছ থেকে সেই মুচলেকায় সই নিয়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

 

তিন

 

মুরাদ, এই মুরাদ।

মুরাদ ফিরে তাকালো। তার বন্ধু হিরু তাকে ডাকছে।

মুরাদ মলিন মুখ তুলে তাকালো, বল।

তুই ছেড়ে দিবি ওদের?

মুরাদ কোনো কথা বললো না, তার চোখ দুটো ছলছল করছে। হিরু মুরাদের দুই বাহুতে ঝাঁকুনি মেরে বললো, তুই ছেড়ে দিতে পারিস আমি হলে কিন্তু ছাড়তাম না।

মুরাদ তবুও কোনো কথা বললো না, সে একরকম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

শোন, চুপ করে থাকিস না, এটা তোর জন্য একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। তুই না পারিস তো আমাকে বল, আমি দেখি ওদের একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিই, ট্রিট ফর ট্রেট।

কী করবি তুই?

কী করবি মানে, কী করবো না তাই বল। তুই দেখবি? একবার বলে দেখ পারি কী না বলে হিরু মুরাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বললো, দেখবি, চল। তারপর মুরাদের কাঁধে একটা হাত রাখলো, চল।

কোথায়?

আরে চল না। বলে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মোড়ের অদূরে একটা নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে, সেই বিল্ডিংয়ের নিচে কয়েকজন কমবয়সী ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদে একটা বিশেষ ধরনের বৈচিত্র্য আছে। কারো পরনে জিন্সের প্যান্ট, হাঁটুতে কাপড় পট্টি দেয়া, গায়ে গেঞ্জি হরেক রঙের জোড়াতালি দেয়া। একেকজনের চুলের বাহার একেক রকমের, কারো মাথার ওপর এক মুঠো চুল পুরো মাথায় ন্যাড়া, কারো মাথার মাঝখানে কোনো চুল নেই পুরো মাথায় বিশেষ আকৃতিতে চুল কাটা। সবার চেহারায় যেনো রুক্ষ্‌ণতাুটে উঠেছে। চোখ-মুখ কর্কশ, চোখের গোড়া কালিপড়া, এই অল্প বয়সে বেশিরভাগের মুখে দাড়ি।

তাদের একজন হিটলার, মুরাদের পরিচিত, একসময় হিটলার হিরু আর মুরাদের সঙ্গে পড়তো কিন্তু গত বছর ক্লাসে ফেল করায় জুনিয়র হয়ে গেছে। তারপর থেকে হিটলার আর তেমন ক্লাসেও যায় না। অনেকদিন পর মুরাদ আজ হিটলারকে দেখলো। হিটলারের চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। চেহারা রুক্ষচোখের গোড়া দুটো কালো হয়ে গেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হিটলার মুরাদকে দেখেই কিছুটা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, আরে দোস্ত, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, কী খবর তোর?

মুরাদ কিছু বলার আগে হিরু বলতে শুরু করলো, নর্থ সাউথ গ্রুপ…

হিটলারের পাশে থাকা একজন কিছুটা গর্জন করে উঠলো, নর্থ সাউথ গ্রুপ, নর্থ সাউথ গ্রুপ, আবার নর্থ সাউথ গ্রুপ!

হিটলার তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আজকাল নর্থ সাউথ গ্রুপ বেশি সিনিয়রিটি দেখাচ্ছে বস। কিছু একটা করা দরকার।

হিটলার যাকে বস বলে সম্বোধন করলো সে কিছুটা গর্জে উঠলো, আরে রাখ তোর সিনিয়রিটি, ডনের কাছে কোনো সিনিয়র জুনিয়র নেই। আমি যেদিন ধরবো সেদিন নর্থ সাউথ গ্রুপের অস্তিত্ব রাখবো না।

মুরাদ এতক্ষণে বুঝতে পারলো। এই কয়েকজনের বস ডন। হিটলার তার শিষ্য বলা যায় কিন্তু ডন আর হিটলারের বয়সের খুব একটা তফাৎ নেই। সবার বয়স বারো বছর থেকে পনেরো বছরের মধ্যে।

ডনের নামের সঙ্গে চেহারার মিল আছে। গায়ের রং ফর্সা ধবধবে, হালকা উদীয়মান গোঁফ কিন্তু লম্বা। গায়ে জিন্স কাপড়ের কয়েকটা পট্টি দেয়া শার্ট, পকেটে একটা সিংহের ছবিওয়ালা লোগো। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে, দীপ্তিমান।

ডন সিগারেটে একটা স্টাইল করে টান দিয়ে হিটলারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো, কী হয়েছে?

ডনের কণ্ঠস্বর শুনে মুরাদের বুক কেঁপে উঠলো, এই বয়সে কণ্ঠস্বরটা কেমন যেনো গমগমে করছে। মুরাদ ভয় পেয়ে হিরুর কানে কানে বললো, এই হিরু চল, চল এখান থেকে।

হিরু চাপাস্বরে বললো, এখন যাওয়া যাবে না।

কেনো?

ডন মাইন্ড করবে।

ডন নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে ডন দাঁত কড়মড় করে হিরুর দিকে তাকালো। হিটলার হিরুর দিকে এগিয়ে এসে বললো, এটা তুই কী করলি হিরু, বস মাইন্ড করেছেন।

কিছু বুঝতে না পেরেই হিরুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার মনে হলো সে যেনো মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে।

হিটলার হিরুর বাহুতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, সরি বল, বসকে নাম ধরে ডাকতে নেই। বল, বস ভুল হয়ে গেছে।

ডন তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে ক্ষুরে ধার দেয়ার মতো করে মাথায় ঘষে নিতে নিতে আবার হিরুর দিকে তাকালো, তার দীপ্তিমান চোখ দিয়ে যেনো আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ছে।

হিরু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, সরি বস, আমার ভুল হয়ে গেছে।

এবার ডন কিছুটা শান্ত হয়ে হলো। সে বললো, ইংরেজিতে বলো।

হিরু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, সরি বস, আই এ্যাম রং।

হলো না। তোরা তো ভালো স্টুডেন্ট, ইংরেজিটা তো ভালো করে বলতে শিখবি। বলে ডন সুন্দর উচ্চারণ করে বললো, এঙকিউজ মি বস, আই হ্যাভ সামথিং রং।

ডনের মুখ থেকে ইংরেজিতে উচ্চারণ শুনে মুরাদ কিছুটা অবাক হলো। সে ডনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

হিরু ডনের মতো করে বললো, এঙকিউজ মি বস, আই হ্যাভ সামথিং রং।

এখন বল কী হয়েছে?

হিরু মুরাদের দিকে তাকিয়ে হিটলারকে ফিসফিস করে বলছিলো, মুরাদ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো।

ডন জিজ্ঞেস করলো, মুরাদ কে?

মুরাদ একটা ঢোক গিলে বললো, জি, আমি।

বল কী হয়েছে?

আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।

তারপর।

এক ভাইয়া আমাকে।

কোন ভাইয়া? নাম, ঠিকানা কিছু জানো?

হিরু বললো, নর্থ সাউথ গ্রুপের…

ডন হিরুকে থামিয়ে দিয়ে মুরাদের দিকে তাকিয়ে বললো, নর্থ সাউথ গ্রুপকে তুই চিনিস না?

হিরু বললো, না, ও এসব চিনে না।

মহল্লায় থাকিস, কাউকে চিনিস না? এই যে আমি, আমি বলে ডন পিস্তলটা দু’বার নিজের বুকে ঠেকিয়ে বললো, আমাকে চিনিস, আমাকে?

মুরাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। সে না সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, সে চেনে না।

ডন একরকম গর্জে উঠলো, নর্থ সাউথ গ্রুপকে চিনিস না, তুই ডনকে চিনিস না, মহল্লায় থাকিস কী করে ইনোসেন্ট বয়। আমি ডন, ডেঞ্জারার্স বয়েজ গ্যাং সংক্ষেপে ডি.বি গ্যাং এর প্রেসিডেন্ট, ডন কথার শেষ দিকে তার চোখে-মুখে একটা অহংকার ফুটে উঠলো।

মুরাদ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো তার মনের মধ্যে এখন অনেক প্রশ্ন, নর্থ সাউথ গ্রুপ, ডেঞ্জারাস বয়েজ এসব সে কিছুই চেনে না।

হ্যাঁ। এখন বল, বলে ডন মুরাদকে বলার অনুমতি দিলো।

আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। নর্থ সাউথ গ্রুপের একজন আমাকে…

 

চার

 

সিনিয়র গ্রুপ শহরের প্রথম কিশোর গ্যাং। তাই একসময় পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই ছিলো। তারপর মহল্লা ভিত্তিক একে একে গড়ে উঠলো নর্থ সাউথ গ্রুপ, ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ, ব্রাইট স্টার গ্রুপ ইত্যাদি। মহল্লা ভিত্তিক আলাদা আলাদা গ্রুপ গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ গ্রুপের লিডার একসময় সিনিয়র গ্রুপেই ছিলো। তাই খুব সহজে কেউ সিনিয়র গ্রুপকে অসম্মান করে না। কিশোর গ্যাংগুলোর পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে কিন্তু এখনো সিনিয়র গ্রুপ এখনো সিনিয়রিটির অবস্থানটা ধরেই রেখেছে।

কয়েকমাস আগের কথা নিতাইগঞ্জে একটা বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। কিশোর গ্যাংগুলো অনেক আগেই একটা রেওয়াজ চালু করেছে মহল্লায় কোনো বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হলে তাদের মেম্বারদের পিকনিক খাওয়াতে হবে। অসন্তোষ্ট হলেও অনেকেই সামান্য ব্যাপার ভেবে মেনে নিয়েছে আর যারা এটা মানে না তাদের বাড়ির কাজ করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিশোর গ্যাংগুলো শুধু পিকনিকেই সন’ষ্ট থাকেনি তারা শুরু করেছে চাঁদাবাজি। যেকোনো বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হলে বিল্ডিংয়ের আকার অনুযায়ী তারা লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। দুর্বল, সহজ-সরল মানুষরা মেনে নেয় আবার কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেও অবাঞ্ছিত ঝামেলা এড়িয়ে চলার জন্য শেষ পর্যন্ত কষ্ট হজম করে।

নিতাইগঞ্জে তখনো কোনো গ্যাং গড়ে উঠেনি। একাংশের আধিপত্য বিস্তার করতো ডেঞ্জারাস বয়েজ গ্রুপ অপরাংশের বিস্তার করতো নর্থ সাউথ গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই দুই গ্রুপের মধ্যে সবসময় দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো, কোনো বিল্ডিংয়ের কাজে চাঁদা আদায় করা, কারো জমি দখল করে দেয়া বা কারো বেদখল জমি উদ্ধার করে দেয়ার কাজে এই দুই গ্রুপই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতো। ফলে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতো।

নিতাইগঞ্জে সেই নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের মালিক আমিন সাহেব একসময় দেশের বাইরে ছিলেন। সেখান থেকে টাকা পয়সা রোজগার করার পর দেশে ফিরেছেন একবারে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটা বাড়ি করবেন আর বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে বাকি জীবন চালিয়ে নিবেন। তিনি বেশ নীতিবান এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ। তার কাছে প্রথমে পিকনিকের নাম করে টাকা দাবি করলো ডি.বি.গ্যাং, তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন।

আমিন সাহেব একবার আপাদমস্তক তাকালেন। ছেলেগুলোর সবার বয়স তেরো বছর থেকে সতেরো বছরের মধ্যে। একেকজনের মাথার চুল একেকভাবে কাটা, কারো মাথার চারপাশের চুল ছোট আর মাঝখানের চুলগুলো বেশ বড়, আবার কারো কারো মাথায় শুধু সামনের চুলগুলো লম্বা পাশে কোনো চুল নেই। এই বয়সে অনেকেই দাড়ি রেখেছে, কারো কারো থুঁতনিতে ক’টা দাড়ি, কারো দাড়ি সৌদিদের মতো। কারো কারো পরনে গেঞ্জি আর জোড়াতালি দেয়া জিন্স প্যান্ট। এসব বিকৃত রুচির কিশোর দেখে আমিন সাহেবের এমনিতে মেজাজ বিগড়ে গেছে তার ওপর তার কাছে করেছে চাঁদা দাবি।

তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তো বাবারা আগে যে আমি বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করিনি তখন তোমরা পিকনিক খাওনি?

একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বললো, গুড্ডু আংকেল বলে কী?

গুড্ডু বললো, এখানে যত বিল্ডিং হয় সবাই আমাদের পিকনিক খাওয়ায়, আপনি বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করবেন আমাদের পিকনিক খাওয়াবেন।

আমিন সাহেব ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললেন, ও তোমার নাম তাহলে গুড্ডু।

গুড্ডু রুক্ষণ্ঠে বললো, হ্যাঁ আমার নাম গুড্ডু তাতে কী হয়েছে। এখন টাকা দেন।

না দিলে?

না দিলে বলে সবাই বিকৃত হাসি হাসলো।

আমিন সাহেব ধমকের সুরে বললেন, চুপ করো। মুরুব্বী মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও জানো না।

গুড্ডু বললো, জানি বলেই তো এখনো মুখে কথা বলছি, নইলে বলে গুড্ডু হাত দিয়ে ইশারা করে জানালো যে নইলে মুখে নয়, মেরে হাড়গোড় একাকার করে ফেলতো।

আমিন সাহেব বুঝতে পারলেন, বখে যাওয়া এই ধনীর দুলাল, এই বয়সে যাদের চেহারায় লাবণ্য থাকা উচিত ছিলো, কমনীয়তা থাকা উচিত ছিলো, যাদের পরেণে মার্জিত পোশাক থাকা উচিত ছিলো, যাদের পকেটে কলম থাকা উচিত ছিলো তার কোনোকিছুই নেই। তাদের সবার চেহারা রুক্ষবং চোখে-মুখে ছাত্রত্বের কোনো লেশ নেই। অল্প বয়সী এসব বখে যাওয়া ছেলেরা এমন কিছু নেই যা করতে পারে না। তাই তিনি আবার নিজেকে সামলে নিলেন। অসাধারণ শান্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তা তোমাদের পিকনিক খেতে কত টাকা লাগবে?

গুড্ডু এবার তার পাশে থাকা একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই বল।

সে আবার গুড্ডুকে বললো, আরে তুই বল। বস যা বলে দিয়েছে তাই বল।

গুড্ডু একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, বস তো পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে বলেছে।

আমিন সাহেবের চোখ কপালে উঠলো, পঞ্চাশ হাজার। তোমাদের পিকনিক খেতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। তোমাদের বস কে? আমাকে তোমাদের বস এর কাছে নিয়ে চলোতো।

গুড্ডু বললো, সবাই তো তাই দিয়েছে। আপনি না দিলে বুঝবেন।

কী বুঝবো, চলো তোমাদের বস এর কাছে আমাকে নিয়ে চলো। আমি যদি কমাতে পারি।

গুড্ডু বললো, বস কারো সঙ্গে দেখা করবে না। আপনি যদি টাকা না দেন তবে আজ আপনি যে কাজ করবেন আগামীকাল এসে দেখবেন সে কাজ ভেঙ্গে পড়েছে বলে সবাই সমস্বরে বিকৃত হাসি হাসলো।

অসহ্য লাগছে আমিন সাহেবের। তিনি আর কথা বাড়ালেন না, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা দেখি কী করা যায়।

গুড্ডু বললো, আচ্ছা দেখুন তাহলে বলে সবাই চলে গেলো।

আমিন সাহেব মহল্লার মসজিদে নামায পড়েন সেই সুবাদে তার সঙ্গে অনেকের পরিচয় হয়েছে, অনেকেই নতুন বাড়ি করেছেন। আমিন সাহেব তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, সবাই তাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় না জড়ানোর পরামর্শ দিলো সেইসাথে সতর্ক করে দিলো যে, এখানে একাধিক গ্রুপ আছে এবং এক গ্রুপ টাকা নিয়ে যাওয়ার পর আবার আরেক গ্রুপ আসে।

কয়েকদিন পর তারা আবার এলো। আমিন সাহেব তাদের সঙ্গে ত্রিশ হাজার টাকায় একটা দফারফা করলেন। তারা আমিন সাহেবকে আশ্বস্‌ করলো যে ডি.বি গ্যাং যাদের সেল্টার দিবে তার ক্ষতি করার কারো সাহস নেই। আর কেউ যদি আসে তবে আপনি শুধু বসকে একটা ফোন করবেন। বলে গুড্ডু একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে বললো, এটা বসের মোবাইল নম্বর।

আমিন সাহেব টাকা দেয়ার সময় গুড্ডুকে বললেন, আমি কি একটু তোমাদের বসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

গুড্ডু এক মুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো তারপর বললো, আচ্ছা আমি আগে ফোন দিয়ে জেনে নিই, তারপর আপনাকে দিচ্ছি, বলে গুড্ডু তার ডনকে ফোন করলো।

ডন ফোন রিসিভ করলো, গুড্ডু বল।

বস অপারেশন সাকসেসফুল।

কত?

ত্রিশ। বস চাচা একবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

দাও।

আমিন সাহেব ফোন কানের কাছে নিতেই ডন সালাম দিলো, আংকেল আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

কেমন আছেন আংকেল?

ভালো। আপনি?

হ্যাঁ বাবা, ভালো আছি। বাসার কাজ নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম।

ডন আমিন সাহেবকে আশ্বস্‌ করলো, কোনো চিন্তা করবেন না আংকেল। কেউ কিছু বললে আপনি সোজা আমাকে ফোন করবেন।

আচ্ছা বাবা।

সত্যি তাই ঘটলো। ডি.বি গ্যাংকে টাকা দেয়ার কয়েকদিন পরেই এলো নর্থ সাউথ গ্রুপ। কথাবার্তা ঠিক একই রকম। আমিন সাহেব ডনকে ফোন করলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হলো। এতোদিন যে চাঁদাবাজি নীরবে হতো সেটা প্রকাশ হয়ে পড়লো। এই খবর শুনে সিনিয়র গ্রুপের লিডার দুই গ্রুপের ওপরই অসন্তোষ্ট হলো। উভয় গ্রুপের লিডার দুজনই একসময় সিনিয়র গ্রুপের গ্যাং লিডারের শিষ্য ছিলো। তাই বিষয়টির একটা সমাধানের জন্য সেদিন রাতে সিনিয়র গ্রুপের লিডার দুজনকে তার আড্ডায় ডেকে পাঠালো।

আধিপত্য বিস্তারের দিক থেকে সিনিয়র গ্রুপ এখন অনেকটা সংকুচিত হলেও সম্মানের দিক থেকে সবাই সিনিয়র গ্রুপকে এখনো সম্মান করে। সিনিয়র গ্রুপের লিডার দুজনকে কান ধরে উঠবস করালো আর বললো, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সিন ক্রিয়ট করলে পুলিশ, প্রশাসন জড়িয়ে পড়বে। তখন সবার ভবিষ্যৎ কী হবে একবার কেউ ভেবেছো। তোমরা দুজনে একসময় সিনিয়র গ্রুপে ছিলে তোমরা কি কোনোদিন আমাকে মাথা গরম করতে দেখেছো? সবসময় মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করবে। তোমাদের মাথা গরমের কারণে যেনো পুলিশ প্রশাসন কোনো অভিযানে না নামে।

সেদিনের সেই ঘটনার কথা ডন কোনোদিন ভুলবে না। সে সিনিয়র গ্রুপের বসকে চিনে, আবার যদি কোনো গ্রুপিং দেখে, নিজেদের মধ্যে মারামারির কথা শুনে তবে ডেকে পাঠাবে, আবার কী শাস্তি দিবে আল্লাহই জানেন। হয়তো ডেকে দুজনের গালে ঠাস ঠাস করে দুটা চড় মারবে তারপর অন্য কথা। তাই হিরু আর মুরাদ যখন নর্থ সাউথ গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো তখন হিরু নিজেও কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।

ডনের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সে রিসিভ করেই বললো, জি বস। তারপর অনেকক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো। ধীরে ধীরে তার চোয়াল দুটো শক্ত হলো, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেলো। সে হাত ইশারা করে সবাইকে চলে যেতে বললো।

হিটলার সবাইকে দূরে সরে যেতে ইশারা করলো। কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার পর হিটলার মুরাদকে বললো, তুই কাল একবার আয়।

মুরাদ ভয়ে ভয়ে বললো, না এলে হয় না।

হিটলার কিছুটা রাগের সুরে বললো, না, না এলে হয় না। বস একবার যখন শুনেছে তখন একটা অ্যাকশন নিয়েই ছাড়বে। আজ হঠাৎ করে বসের মুডটা অফ হয়ে গেলো। আজ ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে। তোরা কাল আয় হিরু। দু’জনে আসবি কিন্তু।

হিরু মাথা কাত করে জানালো যে কাল সে আসবে।

 

পাঁচ

 

তিন সদস্যের সংসার। স্বামী আরমান ব্যবসায়ী, একাধিক ব্যবসা দেখাশুনা করে, একের পর এক নতুন ব্যবসা, নতুন বিনিয়োগ, নতুন অবকাঠামো। সে সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, সারাদিন টাকার পেছনে ছুটোছুটি করে, টাকা আরো টাকা, আরো প্রতিপত্তি, আরো সফলতা, আকাশ ছোঁয়া সফলতা, সে যেনো টাকার নেশায় আসক্ত এক নেশাগ্রস্‌ মানুষ। স্ত্রী রিনি, গৃহিণী, তার সারাদিন কাটে টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক দেখে আর ফেসবুকে চ্যাট করতে করতে, টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে জিম্মি। সকালবেলা বিছানায় শুয়ে থেকেই বন্ধুদের শুভ সকাল জানাতে হবে আর সেজন্য গুগলে সার্চ সার্চ দিয়ে বের করতে হবে আকর্ষণীয় কোনো ছবি, পোস্ট দিতে হবে, হাই ফ্রেন্ড, গুড মর্নিং।

বন্ধুদের শুরু হলো শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা, কমেন্টস আর রিপ্লাই দেয়ার পালা, শুরু হলো ফেসবুকে চ্যাট।

তিনজন মানুষের রান্না-বান্নাসহ ঘর-দোর দেখার জন্য দু’জন গৃহকর্মী আছে। ঘরের যাবতীয় কাজ তারাই দেখাশোনা করে, আরমান সকালবেলা যখন নাস্তার টেবিলে যায় রিনি তখন ফেসবুকে চ্যাট করতে করতে আরমানের মুখোমুখি চেয়ারে বসে, নাস্তার প্লেট, পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়, তার প্রয়োজনীয় কোনো কথাবার্তা থাকলে সেরে নেয়। আরমান হ্যাঁ বা না বলে উত্তর দেয়, খাবার টেবিলেও মোবাইলে রিং আসে আর আরমান খেতে খেতে কথা বলে তারপর এক হাতে মোবাইল ফোন আর এক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে জোরে জোরে কথা বলতে বলতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

বাসার জন্য একটা প্রাইভেট কার আছে। ড্রাইভার সকালবেলা আসে, তার নিয়মিত শিডিউল ছিলো একমাত্র সন্তান আশরাফুল ইসলাম ডনকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা। আগে নিয়েও যেতো কিন্তু প্রায় এক বছর আগে ডন জিদ করায় আরমান সাহেব তাকে মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছে। তখন থেকে ডন তার মোটর সাইকেল নিয়ে স্কুলে যায়। আগে নিয়মিত স্কুল যেতো কিন্তু ইদানীং স্কুলেও ঠিকমতো যায় না। বেশিরভাগ দিনই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে তারপর স্কুলের কথা বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুপুরে বাসায় আসে, বিকেলে বেরিয়ে গেলে ফিরে আসে একেবারে অনেক রাতে। ডন স্কুল আর আরমান অফিসে চলে যাবার পর রিনি নাস্তা সেরে গৃহকর্মীদের কাজের নির্দেশনা দিয়ে বসে যায় টেলিভিশনের সামনে, কোন সিরিয়াল কখন শুরু হবে, কোন সিরিয়ালের কোন চরিত্রের আজ কী অভিনয় হবে এসব রিনির মুখস’। রিনির চোখ যেনো সবসময় টেলিভিশনের পর্দা আর মোবাইল ফোনের চ্যাট বঙে।

বাসায় ডনের প্রাইভেট টিচাররা সারাদিন আসতেই থাকে। আজকাল স্কুলে তেমন লেখাপড়া হয় না। স্কুলের শিক্ষকরা ব্যস্ত প্রাইভেট টিউশনি, ব্যক্তিগত কাজ, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা রাজনীতি নিয়ে। তাই নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়া এখন অভিভাবকদের নিজ দায়িত্বে করতে হয়। আর তাই প্রাইভেট টিউশনি। প্রাইভেট টিউটরদের পড়া এখন মেপে মেপে ষাট মিনিট, এর মধ্যে নাস্তা এবং ওয়াশ রুম। প্রাইভেট শিক্ষকদেরও পড়াশোনা তদারকি করতে হয় অভিভাবকদের।

ডন বিকেলে বেরিয়েছে। এখনো বাসায় ফিরেনি, এর মধ্যে একজন প্রাইভেট টিচার এসে কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে গেছে। আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। দু’জন কাজের বুয়ার মধ্যে একজন বয়স্ক, নাম মনিরা আরেকজন কম বয়সী, নাম বুবলী, বয়স পনেরো/ষোলো বছর হতে পারে, সে বুয়ার সহকারী। অ্যাসিস্ট্যান্ট বুয়া বলা যায়। সে বয়সের কারণে কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির। কলিং বেল বেজে উঠামাত্রই সে বরাবরের মতোই দৌড়ে দরজা খুলে দিতে চলে গেলো।

বুবলী যৎসামান্য লেখাপড়া শিখেছে তাতেই সে জানে ডনের কোন সাবজেক্ট কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে। বয়সে বুবলী দু’য়েক বছরের বড় হলেও ডনের সঙ্গে বুবলীর সম্পর্কটাও কিছুটা বন্ধুত্বসুলভ। ইয়ার্কি করে সে ডনকে ছোট সাহেব বলে ডাকে। আজ ডন বাসায় নেই, আজকাল ডন প্রায়ই বাসায় থাকে না, অনেক প্রাইভেট শিক্ষক এসে কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যায়। বুবলী দরজা খুলে দেখলো ম্যাথ টিচার, সে কিছুটা ইয়ার্কির সুরে বললো, ছোট সাহেব তো বাসায় নেই। আপনি কাকে পড়াবেন?

টিচার কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে বুবলীর দিকে তাকিয়ে বললো, ডনকে, তুমি জানো না?

ডন তো বাসায় নেই।

কোথাও গেছে?

কী জানি, বাসায় কিছু বলে যায়নি। বাংলা টিচারও এসেছিলেন, কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছেন কথা বলতে বলতে ম্যাথ টিচার ড্রয়িং রুমে ঢুকলো।

বুবলী দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

ম্যাথ টিচার বুবলীকে বললো, তুমি ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করো তো ডন কখন আসবে?

বুবলী কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বললো, আপার নিষেধ আছে।

নিষেধ আছে মানে?

হ্যাঁ। আপা যখন টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখে তখন তাকে ডাকা নিষেধ আছে।

ডাকবে কেনো? শুধু জিজ্ঞেস করবে, ডন যদি আসতে দেরি হয় বা না আসে তবে আমি চলে যাবো।

বুবলী একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, ওরে বাবা এখন স্টার জলসা’য় হচ্ছে শ্রীময়ী হচ্ছে। শ্রীময়ী হওয়ার সময় দরজায় নক করাও নিষেধ আছে।

শ্রীময়ী কখন শেষ হবে?

কেবল তো শুরু হলো, এরপর হবে কে আপন কে পর তারপর হবে ত্রিনয়নী, অন্য চ্যানেলে। আপা সবগুলো দেখে।

তুমিও দেখো নাকি?

বুবলী মুখ কালো করে বললো, দেখি মাঝে মাঝে। আপা প্রতিদিন দেখতে দেয় না। আজ অনিন্দ্য দা জুন-এর বাসায় যাবে তো সেজন্য দেখতে দেয়নি, যেতেও নিষেধ করেছে।

ম্যাথ টিচার কিছুটা অবাক হয়ে বুবলীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কী বলো এসব? তোমারও তো দেখছি সব মুখস্‌।

হ্যাঁ, বলে বুবলী বললো, এখন বলুন আপনি বসবেন নাকি চলে যাবেন?

ম্যাথ টিচার মোবাইল ফোন নম্বর টিপে ফোন কানে ধরে রাখলো। পর পর কয়েকবার ফোন দিলো তারপর বললো, ডনও তো ফোন ধরছে না, তুমি যাও তো ম্যাডামকে বলো ডন কখন আসবে।

বললাম তো, আপার নিষেধ আছে।

এবার ম্যাথ টিচার কিছুটা রেগে গেলো, আমি বলছি তুমি যাও তো। কিছু বললে বলো তুমি নিজে যাওনি, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি।

বুবলী অনিচ্ছা সত্ত্বেও আচ্ছা বলে চলে গেলো।

রিনি মনোযোগ সহকারে টি.ভি দেখছিলো। বুবলী দরজা হালকা ফাঁকা করে উঁকি মারলো। রিনি’র চোখ টেলিভিশনের পর্দায় যেনো সি’র হয়ে তাকিয়ে আছে। বুবলী মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, আপা।

রিনি যেমন করে তাকিয়ে ছিলো তেমনিভাবেই টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বুবলীকে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো।

বুবলী এক পা, দু’পা করে পিছিয়ে দরজার কাছে বিজ্ঞাপন বিরতির জন্য অপেক্ষা করলো। কয়েকমিনিট পর বিজ্ঞাপন বিরতি শুরু হলে রিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বুবলীকে ডাক দিলো, বুবলী।

বুবলী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো, জি আপা।

দরজা নক করলি কেনো? তোকে না বলেছি আমি যখন টি.ভি দেখবো তখন আসবি না।

বুবলী থতমত খেয়ে বললো, আমি আসতে চাইনি আপা, ছোট সাহেবের ম্যাথ টিচার এসেছে, উনি তো আমাকে পাঠালো।

কেনো? কী হয়েছে?

ছোট সাহেব বাসায় নেই, এর আগে বাংলা টিচার এসেছিল, ভাই বাসায় নেই দেখে কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছে। তাই ম্যাথ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ডন ভাই কোথায় গেছে? আসতে দেরি হবে নাকি।

রিনি ডনকে ফোন করলো কিন্তু সে ফোন রিসিভ করলো না।

বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হলো।

রিনি বললো, আচ্ছা আমি দেখছি, তুই এখন যা, স্যারকে বসতে বল। আমি একটু পরে আসছি।

জি আচ্ছা।

আর যখন-তখন দরজায় নক করবি না।

আচ্ছা, আপা অনিন্দ্য দা কি জুন আন্টির বাসায় চলে গেছে?

সেটা জেনে তোর কী।

এমনি বলছিলাম আর কী।

তোকে আর জানতে হবে না, যা বলছি।

আচ্ছা বলে মুখ কালো করে বুবলী চলে গেলো।

বুবলি চলে যাবার পর রিনি একটু নড়েচড়ে বসলো। টিভি’র পর্দায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ের রইলো, তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে পুরো পুরুষ জাতিকে ধিক্কার জানাতে লাগলো, অনিন্দ্য সত্যি সত্যি জুনের বাসায় চলে যাচ্ছে! পুরুষ মানুষ এতো খারাপ হয়! শ্রীময়ী’র মতো সুন্দর বউ ছেড়ে জুনের মতো একটা খারাপ মেয়ের সঙ্গে… ছিঃ ছিঃ অনিন্দ্য। আমি হলে এমন পুরুষ মানুষের মুখে থু থু দিয়ে চলে যেতাম।

রিনি’র মোবাইল ফোন বেজে উঠলো, সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যাঁ বলো।

কী করছো?

টি.ভি দেখছিলাম। ফোন দিয়েছো কেনো?

তোমাকে আমি এমনি এমনি ফোন দিতে পারবো না।

তা পারো কিন্তু পুরুষ মানুষ তো মিনমিনে গলায় কথা বললে মনে সন্দেহ জাগে।

কী রকম?

মনে হয় কোনো একটা ফন্দি আঁটছে, তাই মন গলানোর জন্য নরম সুরে কথা বলছে।

তুমি এগুলো কী কথা বলছো রিনি, আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে কল্পনাও করতে পারি না আর তুমি…

পুরুষ মানুষ বলে কথা, কোন যেনো লেখক বলেছেন পুরুষ মানুষের চরিত্র চিতায় না উঠলে বদলায় না।

রিনি তুমি আসলে টিভিতে সিরিয়াল দেখে খুব একপেশে আর নারীবাদী হয়ে উঠছো।

বলবেই তো, এভাবে বলবেই তো। নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইলে, নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বললে তখন তো তোমরা পুরুষরা সেটাকে নারীবাদী বলবে। এখন কী বলবে বলো বলে রিনি কয়েক সেকেন্ড মোবাইল ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখে বললো, সেটা তোমার কথা বলার নরম সুর শুনেই আমি বুঝেছিলাম, ওকে এখন রাখো। বাই।

 

ছয়

 

ওসি সাহেব একবার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চেয়ারে বসে ছিলেন। তার মাথায় অনেক চিন্তা। যে করেই হোক হাসান সাহেবের হত্যা রহস্য জোট খুলতে না পারলে, অপরাধীদের আইনের কাছে সোপর্দ করতে না পারলে ডিপার্টমেন্ট তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

কয়েক বছর আগের কথা ওসি সাহেবের পোস্টিং ছিলো তখনও নারায়ণগঞ্জ সদর থানায়। ঠিক এরকমই একটা কেস এ আসামি ধরতে দেরি হওয়ায় তার তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হলো। পুলিশ লাইনে পোস্টিং এর মতো খারাপ পোস্টিং আর নেই। কোনো কাজ নেই, চাঞ্চল্য নেই, দিনরাত শুধু বসে বসে মাছি মারা। সেখান থেকে আবার নারায়ণগঞ্জ সদর থানায়। এই অসাধ্য যে তিনি কীভাবে সাধন করেছেন তা শুধু তিনিই জানেন। এস.পি সাহেব শীতল কণ্ঠে জবাবদিহিতা করতে হবে বলে যে হুঁশিয়ারি করেছেন তার অর্থও তাই হয়।

ওসি সাহেব কলিং বেল টিপ দিলেন।

স্যান্ট্রি চলে এলো।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ইব্রাহিম সাহেব আছে?

জি স্যার।

একবার আমার সালাম দিনতো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ইব্রাহিম সাহেব চলে এলো। ওসি সাহেবের চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলো, স্যার।

ভিতরে আসুন। বসুন।

ইব্রাহিম সাহেবের হাতে অনেকগুলো কম্পিউটার প্রিন্ট করা কাগজ। সে কাগজগুলো ওসি সাহেবের সামনে মেলে ধরতে ধরতে বললো, স্যার মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে কল রেকর্ডগুলো পাওয়া গেছে।

ওসি সাহেবের চোখে-মুখে যেনো একটা উজ্জ্বল আলোর আভা ফুটে উঠলো, কোনো ক্লু খুঁজে পেলেন?

এখনো পাইনি স্যার। তবে পাবো আশা করছি।

বলুন তো কেনো আপনি আশাবাদী হলেন?

স্যার, সেদিন ঘটনার সময় একশ ত্রিশটা মোবাইল ফোন অ্যাক্টিভ ছিলো, যার মধ্যে একশ তেইশটা নম্বর ঐ এলাকার আর সাতটা নম্বর বাইরের।

ওসি সাহেব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নম্বরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?

জি স্যার।

কিছু পেয়েছেন?

স্যার, বাকি সাতটা নম্বরের মধ্যে একটা হাসান সাহেবের, একটা তার গাড়ির ড্রাইভারের। আর বাকি পাঁচটা নম্বরের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি।

তাদের মধ্যে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?

জি স্যার।

কোনটা?

ইব্রাহিম সাহেব একটা নম্বর দেখিয়ে বললো, স্যার এই নম্বরটা।

যোগাযোগ করেছেন?

জি স্যার। ফোন বন্ধ।

কবে থেকে।

ঘটনার দিন থেকে।

ওসি সাহেব ভ্রু’কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনার দিন থেকে!

জি স্যার।

সিম কার্ড কার নামে এন্ট্রি করা।

ইব্রাহিম সাহেব নাম বললেন, শুনে ওসি সাহেব যেনো চমকে উঠলেন, বলেন কী?

জি স্যার।

আচ্ছা আগে আরো ভালোভাবে কনফার্ম হোন তারপর আ্যরেস্ট করুন।

জি স্যার। ঘটনার পাঁচ মিনিট পর সেই নম্বর থেকে একটা নাম্বারে শুধু একটা মিস কল যায় তারপর থেকে দুটো নম্বরই বন্ধ।

যে নম্বরটাতে মিস কল দিয়েছে সেই নম্বরটার মালিক পেয়েছেন?

জি স্যার, সেদিক থেকেও কোনো আষাঢ় বাণী নেই।

কেনো?

সেই সিমকার্ডের মালিক সৌদি প্রবাসী।

সিমটা তো চালু নেই?

না স্যার। সেদিনের পর থেকে সিমটা বন্ধ রয়েছে।

উফ্‌। ওসি সাহেবের চোখে-মুখে বিরক্তি, তাহলে আপনি আশাবাদী হলেন কীভাবে?

এই দুই সিম ঘটনার আগে এবং পরে আর কার কার সাথে কথা বলেছে, যদি সিম বন্ধ থাকে তবে এই সেটগুলোতে নতুন যে সিম সেট করা হয়েছে সেই সেটগুলো ট্র্যাকিং করুন।

জি স্যার।

একটা কথা মনে রাখবেন আমরা খুনিকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম সে তার চেয়ে অনেক বেশি চালাক এবং প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন। কাজেই এই কেসটা আমাদের ধৈর্য ধরে বুদ্ধিমত্তার সাথে হ্যান্ডেল করতে হবে। বলে ওসি সাহেব কলিং বেল টিপ দিতেই স্যান্ট্রি চলে এলো, স্যার।

দু’কাপ কফি নিয়ে এসো।

স্যার। বলে স্যালুট দিয়ে স্যান্ট্রি চলে গেলো।

ওসি সাহেব কাগজগুলো হাতে নিয়ে সূক্ষ্‌মভাবেচাখ বুলাচ্ছিলেন। তারপর তিনি মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ইব্রাহিম সাহেব, হাসান সাহেবের গাড়ির ড্রাইভারকে কি আপনার সন্দেহ হয় না?

আমি তাকেও ওয়াচিং এ রেখেছি স্যার কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কিছু চোখে পড়েনি।

হাসান সাহেবের ভাগ্নে, ভাতিজী?

তাদেরও ওয়াচিং এ রেখেছি স্যার।

সবদিক থেকে আমরা কীরকম চাপের মধ্যে আছি তা আপনিও জানেন ইব্রাহিম সাহেব। শীঘ্রই আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলে তো প্রবলেম।

জি স্যার বলে ইব্রাহিম সাহেব একবার ক্রাইম চার্টের দিকে তাকিয়ে বললো, স্যার আমার কিন্তু সন্দেহ মোবা কাউন্সিলর এই খুনের নেপথ্যে আছে।

কিন্তু সেটা তো প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হবে। মোবা কাউন্সিলর এখনো ইন্ডিয়া আছে। সে তো সোজাসুজি সেকথাই বলবে এবং দেখবেন দেশে ফিরে মোবাইল সবচেয়ে বেশি চাপ দিবে এবং মায়াকান্নাও করবে।

আমার সন্দেহও কিন্তু সেজন্য। ঠিক মোবা কাউন্সিলর ইন্ডিয়া গেলো আর হাসান সাহেব খুন হলো।

কিন্তু সেটা প্রমাণ করুন, তবে মোবা কাউন্সিলরকে টার্গেট করে যেনো ইনভেস্টিগেশন করবেন না। ইনভেস্টিগেশন করবেন নিরপেক্ষভাবে তাতে যদি মোবা কাউন্সিলর দোষী হয় তবে সেও শাস্তি পাবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

জি স্যার।

কফি এলো।

কফি খেতে খেতে ইব্রাহিম সাহেব মিনমিন করে বললো, স্যার আমি একটা কাজ করতে চাচ্ছি।

বলুন।

আমার সন্দেহ সেই দুই সিম কার্ড।

ওসি সাহেব ভ্রু’কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, আর সেই মোটর সাইকেলের সিগনাল লাইট?

সোর্সরা হন্য হয়ে খুঁজছে স্যার। আশা করছি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবো।

আমিও আশা করি আপনি পারবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

 

সাত

 

ইব্রাহিম সাহেব সেই প্রবাসীর মোবাইল নম্বরের সঙ্গে কথা বলা কল রেকর্ড নিয়ে একটা মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং করে খুঁজতে খুঁজতে যে বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সেটা তার পরিচিত বাসা। মোবারক কাউন্সিলরের ক্যাডার, কানকাটা মোন্তা’র বাসা। কানকাটা মোন্তা এই শহরের একজন পরিচিত অপরাধী। একসময় আন্ডার ওয়র্ল্ডের ভয়ঙ্কর অপরাধী লম্বু হামিদের সহযোগী ছিলো, কয়েকমাস আগে লম্বু হামিদ ক্রস ফায়ারে নিহত হওয়ার পর অপরাধ জগতের ধারাবাহিকতায় সে এখন দৃশ্যপটে চলে এসেছে।

হাসান সাহেব খুন হওয়ার পর ইব্রাহিম সাহেব একবার কানকাটা মোন্তাকে আ্যরেস্ট করতে চেয়েছিলো কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় তাকে আ্যরেস্ট করতে পারেনি। এবার হয়তো উপযুক্ত প্রমাণসহ কানকাটা মোন্তাকে আ্যরেস্ট করতে পারবে। ইব্রাহিম সাহেব অনেকটা আশাবাদী হলো। তার চোখে-মুখে একটা আলোর আভা ফুটে উঠলো।

ইব্রাহিম সাহেব একবার কলিং বেল টিপ দিতেই এক মধ্যবয়সী নারী দরজা খুলে দিলো। পুলিশ দেখেও মহিলার মধ্যে তেমন কেনো পরিবর্তন নেই। ইব্রাহিম সাহেব কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন যে এই মহিলাই হয়তো কানকটা মোন্তার বউ। কারণ অপরাধীদের বউরা সাধারণত সাহসী হয়।

এটা মোন্তার বাসা?

হ্যাঁ, কেনো? মোন্তা আবার কী করলো?

তুমি মোন্তার বউ?

হ্যাঁ।

কী নাম তোমার?

রিতু।

মোন্তা বাসায় আছে?

না।

কোথায় গেছে?

আমাকে বলে যায়নি। আর কিছু? বলে রিতু দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যোত হলো।

দরজা বন্ধ করছো কেনো? আমরা বাসাটা সার্চ করবো।

কেনো? আমার বাসা সার্চ করার কোনো কারণ আছে?

আছে। সরে দাঁড়াও, বলে ইব্রাহিম সাহেব তার সঙ্গের ফোর্সদের নির্দেশ দিলো, এই তোমরা যাও। দেখো বাসায় কিছু পাওয়া যায় নাকি?

রিতু দু’হাত দিয়ে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রইলো, আপনারা দাঁড়ান, আমি মহিলা মানুষ একাই বাসায় আছি, আমি মোন্তাকে জিজ্ঞেস করি।

ইব্রাহিম সাহেব গর্জে উঠলো, রাখো তোমার মোন্তা। এই তোমরা ভিতরে যাও। সার্চ করো।

ইব্রাহিম সাহেবের টিমে তিনজন পুরুষ এবং দু’জন নারী পুলিশ সদস্য। নারী সদস্য দু’জন রিতুকে দরজা থেকে সরিয়ে দিলো।

পুরুষ সদস্যরা বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো।

কয়েকমিনিট বাসায় তল্লাশি করার পর তিনটি মোবাইল ফোন পাওয়া গেলো। ইব্রাহিম সাহেব একটা একটা করে মোবাইল ফোন চেক করতে লাগলো। একটা মোবাইল ফোনে প্রবাসী খোরশেদের টিপতেই সেভ নম্বর হিসেবে সেই নম্বরটা ভেসে উঠলো। ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, এটা নম্বরটা কার?

এটা তো খোরশেদ দুলাভাই’র নম্বর।

তোমার দুলাভাই কোথায় এখন?

সৌদি আরবে।

তাহলে তার নম্বর থেকে ফোন এলো কীভাবে?

আপা ফোন করেছিলো।

তোমার আপার নম্বর দাও।

রিতু মোবাইল নম্বর বললো আর ইব্রাহিম সাহেব তার মোবাইল ফোনে সেভ করে নিলো। তারপর এই নিয়ে চলো, বলে ইব্রাহিম সাহেব ফোর্সদের রিতুকে পুলিশ ভ্যানে তোলার জন্য নির্দেশ দিলো।

এরপর অভিযান শুরু হলো সেই মোবাইল নম্বরের মালিক খোরশেদ সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িটি শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, শহর নয় কিন্তু এলাকাটি শহরের মতোই। একটি দ্বিতল বাসার দোতলার একটা ফ্ল্যাটে থাকে খোরশেদ সাহেবের বউ আর তার এক ছেলে এক মেয়ে।

কলিং বেল-এ টিপ দিতেই কিশোর বয়সের একটি মেয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজায় পুলিশ দেখে মেয়েটি জোরে চিৎকার করে উঠলো, মা।

মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার একটি ছেলেসহ একজন মহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালো। গায়ের রং ফর্সা, লম্বা, অপূর্ব সুন্দর। পুলিশ দেখে তার ফর্সা সুন্দর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মহিলা যেনো আকাশ থেকে পড়লো, একটা ঢোক গিলে বললো, আপনারা?

এটা কি খোরশেদ সাহেবের বাসা?

মহিলাটি আবার একটা ঢোক গিলে বললো, জি।

খোরশেদ সাহেব কোথায়?

উনি তো সৌদি আরব থাকেন। এখন ওখানে আছে।

ইব্রাহিম সাহেব খোরশেদ সাহেবের মোবাইল নম্বরটা তার মোবাইলের স্ক্রিনে দেখিয়ে বললো, এটা খোরশেদ সাহেবের মোবাইল নম্বর?

জি।

সিম কার্ডটা এখন কার কাছে?

সিম কার্ড, সিম কার্ড বলে ভদ্র মহিলা মনে করার চেষ্টা করলো, কয়েকদিন আগে বাসায় আমার এক বোন ভগ্নিপতি এসেছিল, ও নিয়ে গেছে।

কী নাম আপনার বোনের?

রিতু।

ইব্রাহিস সাহেব তার কাছে থাকা ওয়্যারলেস এ বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ কথা বললো, তারপর মহিলার নম্বরটা তার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে দেখিয়ে বললো, এটা আপনার নম্বর?

জি।

নম্বরটা সবসময় চালু রাখবেন। আর কোথাও যাবেন না।

মহিলাটি একটা ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

ঘটনার পর থেকে মোন্তার মোবাইল ফোন বন্ধ। এমনকি শুধু সিমকার্ড নয় সে মোবাইল সেট পর্যন্ত বদলে ফেলেছে। তাছাড়া তাকে আ্যরেস্ট করার মতো কোনো কারণও ছিলো না কিন্তু ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাবার পর তার মোবাইল ফোন বন্ধ। হয়তো পুলিশ চলে ডালে ডালে তো অপরাধীরা চলে পাতায় পাতায় যদিও শেষ পর্যন্ত পুলিশেরই জয় হয়। হয়তো কোনোকিছু জেনে ফোন বন্ধ করেছিলো অথবা নিজেই ভয় পেয়ে ফোন বন্ধ করেছিলো। অপরাধ করলে কেউ ধরতে পারুক আর না পারুক নিজের থেকেই অপরাধী দুর্বল থাকে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কানকাটা মোন্তা সত্যি সত্যি পুলিশের ফাঁদে পা দিলো। পুলিশ রিতুকে আ্যরেস্ট করলেও তার মোবাইল ফোনটা চালু রেখেছিলো। পুলিশের ধারণাটি ঠিক এমন ছিলো যে মোন্তা তার বউকে ফোন করবে আর তখন তার নতুন নম্বর পেয়ে যাবে এবং তার মোবাইল ট্র্যাক করে তাকে আ্যরেস্ট করবে। রিতুর মোবাইল ফোনে একটা কল এলো কিন্তু রিতুর মোবাইল ফোন তো মুকিদের কাছে।

মুকিদ ফোন রিসিভ করলো না। সে মোবাইল ফোনটা একরকম দৌড়ে ইব্রাহিম সাহেবের কাছে নিয়ে গেলো। ইব্রাহিম সাহেব মুকিদকে কানে কানে চাপাস্বরে কিছু বললো তারপর সে মোবাইল ফোনটা নিয়ে হাজতে গেলো। মুকিদ নারী হাজতের গেটে ডিউটিতে থাকা একজন নারী পুলিশ সদস্য মিথিলাকে ইব্রাহিম সাহেবের পরামর্শ শিখিয়ে দিলো। তারপর মিথিলা হাজতের ভিতরে ঢুকলো রিতুকে মোন্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য কী কী জিজ্ঞেস করতে হবে শিখিয়ে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে চাপাস্বরে বললো, যদি একটু উল্টাপাল্টা করো তবে বলে তার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মারার ইশারা করে বললো, কল দাও।

রিতু ফোন রিসিভ করে মিথিরার ইশারা মতো লাউড স্পিকার দিলো, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

রিতু জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন প্লিজ?

আমাকে চিনতে পারছো না?

রিতু বললো, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, হ্যাঁ বলো।

মোন্তা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় তুমি?

কোথায় আবার বাসায়। তুমি কোথায়? বাসায় আসবা না আজ?

হ্যাঁ। আসবো তো। একটু পরেই আসছি। বাসায় কেউ এসেছিল?

রিতু জিজ্ঞেস করলো, কেউ এসেছিল মানে? কেউ আসার কথা ছিলো নাকি?

না, কেউ আসার কথা ছিলো না। তবে আসতেও তো পারে।

তুমি কখন যে কী বলো, দেরি করো না প্লিজ! আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি এসো প্লিজ!

আচ্ছা আমি আসছি। এই ধরো পনেরো মিনিট।

আচ্ছা।

রিতুকে একটা পুলিশ ভ্যানে নিয়ে পুলিশের একজন এস.আই আবার রওয়ানা হলো মোন্তার বাসার উদ্দেশ্যে।

 

আট

 

নিঃসন্দেহে হাসান হত্যাকাণ্ড একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পুলিশের সন্দেহের জাল অনেকের ওপর। হাসান সাহেবের অবস্থান খুনি কীভাবে জানতে পারলো এর মধ্যে এমন কেউ একজন আছে যে সার্বক্ষণিক হাসান সাহেবের অবস্থান খুনিকে অবহিত করছিলো। খুব সম্ভব সেটা হাসান সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার অথবা হাসান সাহেব যে মিটিংয়ে গিয়েছিলেন সেখানকার কোনো নেতা-কর্মী।

ঘটনার আগে গাড়ির ড্রাইভার খলিল মিয়া একটা নম্বরের সঙ্গে কথা বলেছে মোট তিনবার। ওসি সাহেব কলিং বেল টিপতেই স্যান্ট্রি চলে এলো, স্যার।

মুকিদকে আমার সালাম দাও।

স্যান্ট্রি চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মুকিদ দরজায় এসে স্যালুট দিলো, স্যার।

এসো, বসো।

মুকিদ চেয়ারে বসলো।

ওসি সাহেব একটা মোবাইল নম্বরটা দেখিয়ে কাগজটা মুকিদের হাতে দিয়ে বললো, দেখোতো এই মোবাইল নম্বরটা কার?

স্যার বিলকিস বেগমের।

ওসি সাহেব কয়েকমুহূর্ত মুকিদের মুখের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ওসি সাহেব প্রথম চাকরিতে জয়েন করেছেন কনস্টেবল হিসেবে, বেশিদিন কনস্টেবল হিসেবে চাকরি করতে হয়নি। ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এ.এস.আই হিসেবে প্রমোশন পেয়েছেন তারপর আবার ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এস.আই হিসেবে প্রমোশন পেয়েছেন। এস.আই হিসেবে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। অনেক স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত করে যেমন অনেক দাগি আসামীকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তেমনি দেখেছেন পুলিশের মধ্যে অনেক নীতি-নৈতিকতাহীন, অসৎ পুলিশ অফিসারও। একজন মেধাবী পুলিশ অফিসার হিসেবে তার সুনাম আছে।

ওসি সাহেব একটা মোবাইল নম্বর দেখিয়ে তার পরিচয় জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকিদ বিলকিস বেগমের নাম বলায় ওসি সাহেবের মনের মধ্যে একটু সন্দেহ দেখা দিলো।

ওসি সাহেব ভ্রুকু’চকে বললেন, নম্বরটা তোমার মুখস্‌? তারপর সি’র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

মুকিদ প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে বললো, এই নম্বরটা নিয়ে আমরা ইব্রাহিম স্যারসহ অনেক স্ট্যাডি করেছি তো স্যার তাই মনে আছে।

দাও, বলে ওসি সাহেব কাগজটার জন্য মুকিদের দিকে হাত বাড়ালেন।

মুকিদ কাগজটা ওসি সাহেবের হাতে দিলো।

ওসি সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে আপনমনে বিলকিস বেগম, বিলকিস বেগম বলতে বলতে ইব্রাহিম সাহেবকে ফোন করলো, ইব্রাহিম সাহেব।

জি স্যার।

হাসান সাহেবের ড্রাইভারের নাম খলিল মিয়া?

জি স্যার।

ঘটনার আগে সে বিলকিস বেগম নামে একজনের সঙ্গে তিনবার কথা বলেছে।

জি স্যার।

এই বিলকিস বেগম সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছেন?

জি স্যার।

স্টুডেন্ট, অনার্স পড়ে, খলিল মিয়ার ফেসবুক ফ্রেন্ড।

আচ্ছা। বলে ওসি সাহেব খলিল মিয়ার নাম্বারে ফোন করলো। ফোন বন্ধ। ওসি সাহেবের কপালে একটা ভাঁজ পড়লো, ফোন বন্ধ। ডাল ম্যা কুছ কালা হ্যায়।

ওসি সাহেব মুকিদের কাছ থেকে ফাইলটা নিয়ে খুঁজছিলো সন্দেহভাজনদের কোনো তালিকা আছে কী না।

হ্যাঁ সত্যি সত্যিই ওসি সাহেব পেয়ে গেলেন সন্দেহভাজনদের তালিকা। সেখানে খলিল মিয়ার নাম আছে। কিন্তু বিলকিস বেগম ছাত্রী এবং এ বিষয়ে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই মনে করে ইব্রাহিম সাহেব আর সেদিকে নজর দেয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো হাসান সাহেব খুনের পর বিলকিস বেগমের সঙ্গে আর খলিলের ফোনে কোনো যোগাযোগ হয়নি। আর ওসি সাহেবের সন্দেহটা এখানেই, একজন বন্ধু একটা খুনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেই বন্ধুর সঙ্গে আর যোগাযোগ করবে না?

খলিল মিয়ার ফোন বন্ধ পাওয়ার পর ওসি সাহেব মিরুকে ফোন করলেন।

মিরু ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। ওসি সদর বলছি।

মিরু যেনো আঁৎকে উঠলো, স্যার, জি স্যার।

ওসি সাহেব ভ্রু’কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন মিরু সাহেব?

স্যার, আছি স্যার কোনোমতে।

আচ্ছা হাসান সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার খলিল মিয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেনো?

ওর ফোন তো চালু আছে স্যার। আচ্ছা আমি দেখছি স্যার। কিছু বলতে হবে স্যার?

হ্যাঁ। থানায় পাঠিয়ে দিন।

জি স্যার।

খলিল মিয়া এলো প্রায় এক ঘণ্টা পর। তার চোখে-মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ, চুলগুলো এলোমেলো। সে ওসি সাহেবের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওসি সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে সালামের জবাব দিলেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম।

স্যার আমার নাম খলিল। আপনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।

ওসি সাহেব কলিং বেল টিপতেই স্যান্ট্রি চলে এলো, স্যার।

মুকিদকে আমার সালাম দাও।

কিছুক্ষণের মধ্যে মুকিদ চলে এলো, স্যার।

ওসি সাহেব আদেশের সুরে বললেন, মুকিদ, এ হলো খলিল মিয়া। হাসান সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার। একে নিয়ে যাও।

জি স্যার।

মুকিদ খলিলের শার্টের কলার ধরতেই সে কান্না কান্না গলায় বললো, আমার কোনো দোষ নেই স্যার। আমার কোনো দোষ নেই।

মুকিদ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ধরা পড়ার পর সবাই এই কথা বলে, দোষ আছে কী না সেটা পেদানি পড়লেই বোঝা যাবে।

ছোট একটা ঘর, একটা দরজা, কোনো জানালা নেই। একটা টুল আর কয়েকটা চেয়ার ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় আছে। ঘরের কোনে কয়েকটা ছোট-বড় লাঠি, গামছা আকৃতির কিছু কাপড়, ওপর থেকে ফ্যান হুকের সঙ্গে ঝুলানো একটা রশি, দেয়ালে একটা কম্বাইন্ড সকেটের পাশে পড়ে আছে ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন। ঘরে ঢুকতেই খলিলের বুক কেঁপে উঠলো।

দরজার কাছে গিয়ে মুকিদ এরকম জোর করে খলিলকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্য এলো।

সবাই ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। একজন পুলিশ সদস্য খলিলের চুলগুলো সজোরে টেনে ধরে ধাক্কা দিয়ে তাকে একটা হাতল চেয়ারে বসিয়ে চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো এবং হাত দুটো চেয়ারের পিছনে হেলান দেয়া কাঠের সঙ্গে বেঁধে দিলো।

খলিল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বার বার বললো, আমার কোনো দোষ নেই স্যার, আমি কিছু করিনি।

কিন্তু কেউ তার কথার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না।

খলিলের দু’চোখ বাঁধা, সে কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলো ওসি সাহেব এসেছেন। ওসি সাহেব একটা লাঠি দিয়ে খলিলের থুঁতনি উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন, খলিল মিয়া। যা জিজ্ঞেস করবো ঠিক ঠিক উত্তর দিবা।

খলিলের দু’চোখ বেয়ে তখন চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। সে বললো, জি স্যার বলবো।

সেদিন তুমি যখন হাসান সাহেবকে মিটিং থেকে নিয়ে আসছিলে তখন তিন বার তোমাকে কে ফোন করছিলো?

একটা মেয়ে স্যার, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।

কী বলছিলো তোমাকে?

আমি কোথায় আছি জানতে চাচ্ছিলো।

তুমি কোথায় আছো নাকি হাসান সাহেব কোথায় আছে?

না স্যার আমার কথা।

তোমার মোবাইল ফোন কোথায়?

আমার পকেটে স্যার।

মুকিদ ফোনটা বের করে খলিলের আইডি’তে দেখো।

মুকিদ খলিলের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করতেই দেখলো খলিলের আইডিতে লগ ইন করাই আছে। সে জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটির নাম কী যেনো খলিল মিয়া?

স্যার বিলকিস বেগম, বাংলায় লেখা আছে স্যার।

মুকিদ বিলকিস বেগমের আইডি কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলো। তারপর ওসি সাহেবকে বললো, স্যার আইডিতে তেমন কিছু নেই, প্রোফাইল পিকচারও নেই এবং আইডি’টা খুন হওয়ার তিন দিন আগে খোলা হয়েছে।

খলিলের সঙ্গে চ্যাটিং হয়নি?

দু’য়েকবার হাই-হ্যালো হয়েছে আর খলিলের মোবাইল নম্বরটা নিয়েছে।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, খলিল মিয়া। ক’বার কথা হয়েছে তোমার সঙ্গে ঐ বিলকিস বেগমের?

স্যার যেদিন ফোন নম্বর নিয়েছিলো সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলছিলো তার পরদিন, যেদিন স্যার খুন হোন তার আগের দিন।

কী কী বললো আগের দিন?

আগের দিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আগামীকাল বিকেলে তোমার শিডিউল কী?

আমি বললাম স্যারের একটা মিটিং আছে বিকেলে, ফিরতে সন্ধ্যা হতে পারে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো, যত রাতই হোক আগামীকাল আমি তোমার সঙ্গে মিট করবো।

তারপর-

তারপর যখন স্যারের মিটিং চলছিলো তখন বার বার ফোন দিচ্ছিলো আর জিজ্ঞেস করছিলো তুমি কোথায়, তুমি কোথায়।

আর তুমি বলছিলে তুমি কোথায় আছো।

জি স্যার।

তারপর-

আমি মিটিং থেকে রওয়ানা দেয়ার সময় বললাম আমার মিটিং শেষ আমি এখনই স্যারকে নিয়ে রওয়ানা দিবো। আমি স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করবো। আমরা মিটিং থেকে রওয়ানা দিলাম সাত কি আট মিনিট গাড়ি চালালাম, সামনে একটা মোড়, মোড়ে গাড়ি ঘুরতেই একটা গাছের ডাল দিয়ে রাস্তা আটকানো। আমি গাড়ি থামাতেই কেউ যেনো আমার মাথায় কী দিয়ে জোরে আঘাত করলো। আমি ওরে বাবারে বলে একটা চিৎকার দিলাম তারপর আর মনে নেই। কথাগুলো খলিল মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো।

মুকিদ খলিল মিয়ার দুই চিবুকে দু’টা জোরে থাপ্পড় মেরে বললো, বেটা এখন কাহিনী বানাচ্ছিস?

খলিল কাঁদতে কাঁদতে বললো, না স্যার আমি সত্যি কথা বলছি। আমি কেনো মিথ্যা কথা বলবো। আমার স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আমি কেনো স্যারকে খুন করতে যাবো? তবে স্যার আমি একটা কথা বলতে পারি খুনিরা কম বয়সের এবং দু’জন ছিলো। একজন মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আরেকজন আমার মাথায় পিস্তল দিয়ে আঘাত করেছিলো।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বিলকিসের সঙ্গে তারপর আর তোমার কথা হয়নি?

না স্যার।

তখন থেকে ফোনটা বন্ধ।

ওসি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময় ইব্রাহিম সাহেব দরজায় এসে স্যালুট দিলো, স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব বিলকিসকে আ্যরেস্ট করুন।

জি স্যার।

 

নয়

 

পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে কানকাটা মোন্তাকে, তাকে পেলে হাসান হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে। পুলিশ অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত হয়েছে, এই ঘটনার মাস্টার মাইন্ড মোবা কাউন্সিলর। কাজটি মনিটরিং করেছে কানকাটা মোন্তা, কোনো কিশোর অপরাধীকে দিয়ে এবং খুনি বয়সে কিশোর হলেও বেশ চতুর এবং ভালো প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন।

ইব্রাহিম সাহেব একজন এস.আই’র নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নারী-পুরুষ সম্মিলিত একটি দলকে বিলকিসকে আ্যরেস্ট করার জন্য পাঠিয়ে থানা থেকে বের হলো। কয়েকটা দেয়ালে কিছু নতুন লেখা চোখে পড়লো। ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের পরদিই যখন কিশোর সংগঠনগুলোকে তার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো তখন কয়েকটা কিশোর সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারমূলক দেয়াল লিখনের ছবি তুলে রেখেছিলো। ইব্রাহিম সাহেব পিক আপ থেকে নেমে একটা নতুন লেখা দেয়ালের ছবি তুললো এবং পুরাতন ছবিগুলোর সঙ্গে মিল করার চেষ্টা করলো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ একটা দেয়াল লিখনের ছবির সঙ্গে মিল আছে। আগে লেখা ছিলো, ডিবি গ্যাং তারপর লম্বা করে কতকগুলো তীর চিহ্ন, যা দিয়ে তাদের আধিপত্য বোঝানো হয়েছিলো হয়তোবা। আগের লেখা মিশিয়ে নতুনভাবে লেখা হয়েছে, সবার আগে একটা পিস্তলের ছবি তারপর ’’ফার্স্ট সাকসেস ডিবি গ্যাং’’।

ইব্রাহিম সাহেব ভ্রু’কুচকে আপনমনে বললো, কীসের ফার্স্ট সাকসেস? প্রথম সফলতা, মানে? প্রথম খুন?

ইব্রাহিম সাহেবের ফোন পেয়ে সোর্স হারেজ মিয়া এসে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছো হারেজ মিয়া?

জি স্যার ভালো।

আচ্ছা হারেজ মিয়া এই ডিবি গ্যাং লেখাটা কারা লিখেছে?

স্যার ঐ মোড়ে বলে দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে হারেজ মিয়া বলতে শুরু করলো, ঐ মোড়ে যে বিল্ডিংটা দেখছেন ওখানে কয়েকটা ছেলে আড্ডা দেয়, ওরা একটা ক্লাব করেছে, ঐ ক্লাবটার নাম দিয়েছে ডিবি গ্যাং।

ডিবি গ্যাং এর কোনো সদস্যের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?

জি স্যার, ওদের লিডারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

কী নাম?

ভালো নাম জানি না স্যার, তবে সবাই তাকে ডন নামে চিনে।

তোমার কাছে ফোন নম্বর আছে?

জি স্যার বলে হারেজ মিয়া ডনের নম্বরটা বললো।

ইব্রাহিম সাহেব নম্বরটা সেভ করে নিয়ে হারেজকে বললো, ফোন দাও তো।

হারেজ ফোন করলো।

ডনের ঘুমে জড়ানো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

আপনি কি ডন?

ডনকে ফোন দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন আমি ডন কী না।

কোথায় আপনি?

কেনো? আমি কোথায় আছি জানা খুব দরকার কেনো?

একটা কাজ ছিলো একবার দেখা করতাম।

সন্ধ্যায় ক্লাবে আসেন, এখন রাখেন।

আচ্ছা।

ওসি সাহেব আর ইব্রাহিম সাহেব মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলাপ করছেন। ক’দিন আগেও ওসি সাহেব মামলার অগ্রগতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। আজ ওসি সাহেবের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল, ইব্রাহিম সাহেবের চোখে-মুখে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছে।

ওসি সাহেব একটা কাগজ হাতে নিয়ে বললেন, তাহলে ঘটনা দাঁড়ালো ঘটনাস’লে হাসান সাহেব খুনের পর খুনি মোবাইল করে খোরশেদ সাহেবের মোবাইলে। খোরশেদ সাহেবের মোবাইলের সিমকার্ড ছিলো মোন্তার কাছে। সেই মোবাইল ফোন থেকে মোন্তা ফোন করে তার বউকে। কথায় বলে না, খুনি যত চালাকই হোক না কেনো সে কোনো না কোনো সাক্ষী রাখবেই। সে কী কারণে খোরশেদ সাহেবের মোবাইল থেকে তার বউয়ের মোবাইল ফোনে ফোন করবে।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কানকাটা মোন্তার বউ তো হাজতে আছে?

জি স্যার।

মোন্তাকে পেয়েছেন?

না স্যার, একবার তার বউকে নিয়ে অভিযান চালিয়েছি কিন্তু সে অতি চালাক। সে বুঝতে পেরেছিলো তাই আ্যরেস্ট করা সম্ভব হয়নি।

চেষ্টা করুন।

ঘন ঘন মোবাইলের সিম এবং সেট দু’টোই চেঞ্জ করছে। একটা এরিয়া ট্র্যাক করার পর আমরা সেখানে পৌঁছানোর আগেই এরিয়া চেঞ্জ করছে। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি স্যার।

ঘটনার সময় মোন্তা মোবাইলের যে সিমকার্ড ব্যবহার করছিলো তার কল রেকর্ড কালেক্ট করেছেন?

জি স্যার।

দিন তো বলে ওসি সাহেব হাত পাতলেন।

ইব্রাহিম সাহেব তার ফাইল থেকে কয়েকটা কাগজ খুঁজে খুঁজে মোন্তার কল রেকর্ডের কাগজটা ওসি সাহেবের হাতে দিলো।

ওসি সাহেব কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তারপর হাতের কাছে একটা সাদা কাগজ ছিলো কলম দিয়ে সেই সাদা কাগজে কী যেনো লিখলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এই নম্বরটা দেখুন তো কার?

ইব্রাহিম সাহেব তার হাতের কাগজগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে একটা কগজ বের করে দেখে, মতলুব হোসেন।

ওসি সাহেব ভ্রু’কুঁচকে বললেন, এটা কোন মতলুব? খুঁজে পেয়েছেন?

জি স্যার।

কে?

মোবা কাউন্সিলরের ম্যানেজার।

ওসি সাহেবের মুখ আরো উজ্জ্বল হলো, গুড।

এবার ওসি সাহেব অনেকক্ষণ নিরীক্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, তাহলে খুনি খুন করার পর খোরশেদ সাহেবের মোবাইল ফোনে ফোন করে তাকে জানিয়ে দেয়। খোরশেদ সাহেবের মোবাইল ব্যবহার করে কানকাটা মোন্তা সেই খবর জানিয়ে দেয় মতলুবকে।

মতলুবের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড?

ইব্রাহিম সাহেব ওসি সাহেবকে মতলুবের কল রেকর্ডের কাগজটা এগিয়ে দিলো।

ওসি সাহেব দেখে বললেন, মতলুব কার কার সাথে কথা বলেছে সেগুলো পেয়েছেন?

জি স্যার। উল্লেখযোগ্য কারো সাথে না। সেদিন ঘটনার এক ঘণ্টা আগে মতলুব মোবা কাউন্সিলরের ইন্ডিয়ার মোবাইল নাম্বারে একবার ফোন করে, উনপঞ্চাশ সেকেন্ড কথা বলে আর কানকাটা মোন্তা মিশন সাকসেসফুল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা ফোনে মতলুবকে জানায়। খুন হওয়ার এবং মতলুব জানার সময়ের তফাৎ তিন মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর। ঠিক তিন মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর মতলুব মোবা কাউন্সিলরের সেই ইন্ডিয়ান নাম্বারে দুই মিনিট পাঁচ সেকেন্ড কথা বলে।

গুড। অনেকদূর এগিয়েছেন কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। মতলুব এখন কোথায়?

ঘটনার পর মতলুব চট্টগ্রামেই ছিলো দু’তিন দিন পর মতলুব ঢাকায় একটা হোটেলে ছিলো তারপর থেকে আর তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে ধরার জন্য একটা টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি খুব শীঘ্রই তাকে আ্যরেস্ট করতে পারবো।

থ্যাঙ্ক ইউ ইব্রাহিম সাহেব। একটা কথা নিশ্চিত হাসান সাহেব খুনের মাস্টার মাইন্ড এবং বেনিফিশিয়ারিস মোবা কাউন্সিলর।

আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার।

কিন্তু এখন এটা প্রমাণ করতে হবে এবং কাজটা অনেক কঠিন কারণ মোবা কাউন্সিলর হাসান সাহেবকে খুন করার পর নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখতেই ইন্ডিয়া গেছে। আসলে তার হার্টের কোনো সমস্যা নেই বলে ওসি সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললেন, মোবা কাউন্সিলর দৃশ্যের আড়াল থাকতেই ইন্ডিয়া গেছেন তো এবার আপনার সত্যি সত্যি হার্ট ফেইল করবে।

ইব্রাহিম সাহেব চুপ করে ওসি সাহেবেব কথা শুনছিলেন।

ওসি সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, মোবা কাউন্সিলরের বাড়িতে সি.সি ক্যামেরা আছে কী না দেখুন, যদি থাকে তবে আলামত হিসেবে নিয়ে আসুন। মোবা কাউন্সিলরের বাসায় যাওয়ার এবং তার অফিসে যাওয়ার রাস্তায় আমাদের যে সি.সি ক্যামেরা আছে সেগুলো সংগ্রহ করুন।

জি স্যার।

এ্যনি হাউ কানকাটা মোন্তা আর মতলুবকে আ্যরেস্ট করুন।

জি স্যার।

ইব্রাহিম সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করে বললো, বলো। তারপর কয়েকমিনিট কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রেখে কথা শুনতে শুনতে তার মুখ উজ্জ্বল হলো। ইব্রাহিম সাহেব থানায় নিয়ে এসো বলে ফোন রেখে দিলো। তারপর ওসি সাহেবকে বললেন, স্যার মোটর সাইকেলে সিগনাল লাইটের মালিককে পাওয়া গেছে।

ওসি সাহেব কৌতূহলী হয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলো, কে?

ইব্রাহিম সাহেব সেই মালিকের নাম বলে বললো, তার ছেলে ডন।

ওসি সাহেব একবার মাথা উঁচু-নিচু করে বললেন, ও তাহলে বাপের মোবাইল সিম নিয়ে ছেলে এসব করে বেড়ায়।

আপাতত তাই মনে হচ্ছে স্যার।

কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক জোরে ভটভট শব্দ করে থানায় একটা মোটর সাইকেল ঢুকে গাড়ি বারান্দার নিচে মোটর সাইকেল রেখে মোটর সাইকেলের চালক ওসি সাহেবের চেম্বারের সামনে এসে ইব্রাহিম সাহেবকে দেখে থমকে দাঁড়ালো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। পেয়েছো?

জি স্যার, বলে লোকটি মোটর সাইকেলের একটা সিগনাল লাইট বের করে ইব্রাহিম সাহেবের হাতে দিলো।

ইব্রাহিম সাহেব ওসি সাহেবকে মনুর সঙ্গে পরিচয় করে দিলো, স্যার এ হচ্ছে মনু মেকার। আমরা ঘটনাস’লে মোটর সাইকেলের যে সিগনাল লাইটটা পেয়েছিলাম তারই জোড়াটা খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলাম তাকে।

ইব্রাহিম সিগনাল লাইটটা হাতে নিয়ে বললো, জোড়াটার ঠিকানা বলো?

মনু একবার ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে যেনো একটা ঢোক গিললো।

ওসি সাহেব অভয় দিলেন, ভয় নেই বলো?

স্যার গাড়ি নম্বর বলে গাড়ির নম্বর বললো তারপর মালিকের নাম বললো।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, মনু মিয়া তুমি এবার এসো।

জি স্যার বলে মনু চলে গেলো।

আ্যরেস্ট করে ফেলুন, উইথ আউট এ্যানি সিন ক্রিয়েট, একটা কথা খেয়াল রাখবেন খুনি একজন বিত্তবান পরিবারের বখে যাওয়া ছেলে।

জি স্যার।

এবার ওসি সাহেব হেলে ইব্রাহিম সাহেবের দিকে এগিয়ে এসে চাপাস্বরে এবং ইশারা-ইঙ্গিতে ডনকে আ্যরেস্ট করার কৌশল বুঝিয়ে দিলেন।

 

দশ

 

ইদানীং ডনের অনেক সাঙ্গ-পাঙ্গ জুটেছে। কথায় বলে না খৈ ছিটালে কাকের অভাব? ঠিক তেমনি ডনের হাতে এখন অনেক টাকা। বিত্তবান ঘরের ছেলে হিসেবে ডনের চলাফেরায় আগে থেকেই চাককিচ্যের অভাব ছিলো না এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন কাজের কন্ট্রাক্টের টাকা। পড়াশোনা নিয়ে ডন এখন ভাবে না, পড়াশোনা আর তাকে দিয়ে হবে না। একথা সে তার মাকে বলেও দিয়েছে। ডন পড়াশোনা করে না, রিনি ব্যস্ত তার টি.ভি’র সিরিয়াল নিয়ে বাবা আরমান ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে। আজকাল প্রায় দিনই প্রাইভেট শিক্ষক এসে ফিরে যায় আর বুবলী রিনিকে জানায়। একদিন রিনি রেগে গিয়ে ডনকে জিজ্ঞেস করলো, ডন আজকাল প্রায় দিনই তোর প্রাইভেট টিচার এসে ফিরে যাচ্ছে। তোর ঠিকমতো স্কুল যাওয়াও দেখছি না, সারাদিন কী করে বেড়াস?

তুমি আমাকে নিয়ে কিচ্ছু ভেবো না মা, পড়ালেখায় ভালো না করলেও তুমি দেখো আমি জীবনে সফল হবোই। দুনিয়াতে কতজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট রাষ্ট্রনায়ক হয়েছে? কতজন ফার্স্ট বেঞ্চের স্টুডেন্ট জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে? ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে কতজন বিলিয়নার স্টুডেন্ট লাইফে ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড ছিলো? এসব তুমি বাদ দাও, দেখবে আমি ঠিক ঠিকই একদিন অনেক বড় হবো, শুধু তুমি দোয়া করো।

মায়ের জাত, একবার সন্তান দোয়া চাইলে পৃথিবীতে এমন নিষ্ঠুর মা আছে যে সন্তানের জন্য দোয়া করতে কার্পণ্য করবে। রিনি ডনকে কাছে টেনে নিয়ে আঁচলে মুখ মুছে দিয়ে বললো, আমি দোয়া করি বাবা তুমি অনেক বড় হও।

ডন বাসা থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে ডি.বি ক্লাবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাসা থেকে মোটর সাইকেলে পাঁচ মিনিটের পথ তারপর একটা ফাঁকা জায়গা, ক’দিন থেকে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতি নেই কিন্তু ডন লক্ষ্য করেনি। আজ বাসা থেকে বের হয়ে ডন জোরে মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো। সেই ফাঁকা জায়গায় এসে দেখে একটা মাইক্রোবাস খুব ধীর গতিতে যাচ্ছে। ডন বার বার করে হর্ন দিলো কিন্তু মাইক্রোবাস তার পথ ছাড়লো না।

ডন মোটর সাইকেল দাঁড় করে ড্রাইভারের কাছে যেতে পেছন থেকে দুটো শক্ত হাত তাকে অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে ধরলো। আপনারা কে? আমাকে…বলার আগেই পিছন থেকে একজন তার মুখে মাস্কিং টেপ দিয়ে বন্ধ করে দিলো তারপর চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো।

ডন জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করলো, হাত-পা ছুঁড়োছুঁড়ি করলো, একজন কানের কাছে চাপাস্বরে বললো, চুপ, একদম চুপ করে থাকবি। একটু নড়াচড়া করলে বলে সে তার কোমর থেকে পিস্তল বের করে মাথায় ঠেকিয়ে বললো, জানে মেরে ফেলবো।

ইব্রাহিম সাহেব চেয়ারে বসে হাসান হত্যাকাণ্ডের ফাইলটা বের করে চোখ বোলাতে লাগলো। এমন সময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। পুলিশের সোর্স মাসুদ মণ্ডল ফোন করেছে। ইব্রাহিম সাহেব ফোন রিসিভ করেই বললো, মণ্ডল বলো।

স্যার একটা খবর আছে।

বলো?

স্যার মোন্তা শহরেই আছে। সে পালাতে পারেনি।

ইব্রাহিম সাহেব গম্ভীর স্বরে বললো, কোথায় আছে?

মণ্ডল বলতে শুরু করলো, ইব্রাহিম সাহেব কয়েকসেকেন্ড কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রেখে বললো, আচ্ছা তুমি লক্ষ্য রেখো।

জি স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব চেয়ার থেকে উঠে ওসি সাহেবের চেম্বারে গিয়ে স্যালুট দিলো, স্যার।

আসুন ইব্রাহিম সাহেব। বসুন।

ইব্রাহিম সাহেব চেয়ারে বসলো, স্যার।

হ্যাঁ। বলুন, কতদূর এগুলেন?

অনেকদূর এগিয়েছে স্যার। স্যার মোন্তা এখনো শহরেই আছে।

তাই নাকি?

জি স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ওসি সাহেবকে বললো।

ওসি সাহেব গভীর মনোযোগ সহকারে শোনার পর বললেন, আচ্ছা বিষয়টা আমি দেখছি।

এমন সময় একটা পুলিশ পিক আপ থানায় ঢুকলো।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে এলো আবার?

পিক আপ থেকে নারী পুলিশ সদস্যরা একটা মেয়েকে হাত ধরে নামালো।

ইব্রাহিম সাহেব বললেন, খুব সম্ভব বিলকিস বেগম।

আচ্ছা, আপনার চেম্বারে নিয়ে যান, আগে বিলকিসের কাছে শুনুন, তারপর মোন্তার বউয়ের কাছে। তারপর দু’জনকে মুখোমুখি করুন।

জি স্যার বলে ইব্রাহিম সাহেব ওসি সাহেবের চেম্বার থেকে বেরিয়ে তার চেম্বারে এসে বসলো।

ততক্ষণে বিলকিসকে নিয়ে ফোর্সদল বারান্দায় উঠেছে। ইব্রাহিম সাহেব ইশারা করলেন বিলকিসকে তার রুমে নিয়ে যেতে।

ইব্রাহিম সাহেব তার চেয়ারে বসলেন, বিলকিস বেগমের দু’পাশে দু’জন মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। বিলকিস ইব্রাহিম সাহেবকে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

বসো, তোমার নাম তো বিলকিস বেগম?

বিলকিস জড়োসড়ো হয়ে একটা চেয়ারে বসলো তার পিছনে মহিলা পুলিশ দু’জন দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে বিলকিসের বুক কাঁপতে লাগলো। তার গলা শুকিয়ে গেলো। সে একটা ঢোক গিলে বললো, জি স্যার।

মুকিদ ইব্রাহিম সাহেবের চেম্বারে ঢুকে একটা চেয়ারে বসলো।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, বিলকিস তোমার ফেসবুক আইডি আছে না?

জি স্যার।

তোমার কাছে মোবাইল ফোন আছে?

জি স্যার।

দেখি বলে ইব্রাহিম সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলো।

বিলকিস প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও তার পিছনে থাকা একজন মহিলা পুলিশ বললো, দাও কোনো সমস্যা নেই। স্যার-ই তো

বিলকিস মোবাইল ফোনটা ইব্রাহিম সাহেবের হাতে দিতেই সে মুকিদকে দিয়ে বললো, দেখোতো ওর আইডি’তে লগ ইন করে।

মুকিদ আবার মোবাইল ফোনটা বিলকিসের হাতে দিয়ে বললো, লগ ইন করে দাও।

বিলকিস মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে তার আইডি’তে লগ ইন করে দিলো।

মুকিদ মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বিলকিসের টাইমলাইন, প্রোফাইল দেখে বললো, এটা তোমার আইডি?

জি স্যার।

মুকিদ খলিলের মোবাইল ফোন থেকে স্ক্রিন শর্ট নিয়ে রাখা আইডি দেখিয়ে বললো, এটা কার আইডি?

বিলকিস তার নামে ফেক আইডি দেখে অবাক হয়ে বললো, এটা তো আমার আইডি না স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব ভ্রু’কুচকে জিজ্ঞেস করলো, এটা তোমার আইডি না?

না স্যার, বলে বিলকিস কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি একটাও মিথ্যা কথা বলবো না স্যার। এটা আমার আইডি না, কেউ আমার নামে ফেক আইডি খুলতে পারে।

মুকিদ বিলকিসের মোবাইল নম্বর টা তাকে দেখিয়ে বললো, এটা তোমার নম্বর?

জি স্যার।

মুকিদ এবার বিলকিসের মোবাইল নম্বর দিয়ে সার্চ দিলো, বিলকিসের আইডি চলে এলো।

মুকিদ বললো, বিলকিসের নামে কেউ ফেক আইডি খুলেছে।

মুকিদ বিলকিসের ফোনে খলিলের নম্বর টিপলো কিন্তু কল হিস্ট্রিতে খলিলের নম্বর এলো না। তার মানে কল রেকর্ড মুছে ফেলা হয়েছে।

মুকিদ একটা মুচকি হাসি হেসে বললো, ক্রিমিনাল বেশ চালাক।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, সে আর নতুন কী।

কিন্তু ক্রিমিনাল জানে না তার কল রেকর্ড পুলিশ সংগ্রহ করতে পারবে।

ইব্রাহিম সাহেব কয়েকমুহূর্ত বিলকিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিলকিসের চোখে মুখে কোনো জটিলতা নেই, কোনো ছলনা বা চাতুরী নেই। অপরাধী খুব ধূর্ত এবং নিজে আড়ালে থেকে সবকিছুর কলকাটি নেড়েছে। এমন একটা সহজ-সরল মেয়ের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে সেই অ্যাকাউন্ট দিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে এবং তার মাধ্যমে হাসান সাহেবের অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। খলিল বলেছে তার সেই ফেসবুক ফ্রেন্ড তার সাথে ফোনে কথা বলেছে। তাহলে বিলকিস বেগমের নামে যে ফেক আইডি খুলেছে সে নিঃসন্দেহে একজন মেয়ে।

ইব্রাহিম সাহেব বিলকিসকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বিলকিস মনে করে দেখো তো সাত-ই এপ্রিল তুমি কোথায় ছিলে?

বিলকিস চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে নিলো তারপর বললো, আমার কাজিনের বাড়ি।

তুমি এই মোবাইল ফোন নিয়ে গেছিলে?

জি স্যার।

তোমার কাজিনের নাম কী?

রিতু।

মুকিদ আনন্দে বলে উঠলো, ওয়াও।

ইব্রাহিম সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেনো বিলকিসের একটা কথাতেই মামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হলো। সে মুকিদকে বললো, মুকিদ।

জি স্যার।

রিতুকে হাজত থেকে বের করো আমি আসছি।

রিতুর নাম শুনতেই বিলকিস চমকে উঠলো কিন্তু কিছু বললো না।

মুকিদ চলে গেলো কিছুক্ষণ পর ফিরে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলো, স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মহিলা পুলিশ দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, তোমরা বিলকিসের কাছে থাকো। আমি যখন বলবো তখন নিয়ে এসো।

জি স্যার।

রিতুকে একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে। তার হ্যান্ডকাফ লাগানো হাত দুটো চেয়ারের হেলান দেয়ার কাঠের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। পাশে লাঠি হাতে দু’জন মহিলা পুলিশ। ইব্রাহিম সাহেবকে দেখে মহিলা পুলিশ দু’জন স্যালুট দিলো, স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব রিতুকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা রিতু বেগম, ঘটনার দিন অর্থাৎ সাত-ই এপ্রিল তুমি কোথায় ছিলে?

বাসায়, কোথায় থাকবো আর।

মোন্তা কোথায় ছিলো?

ও তো সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ফিরে আসে রাতে। ও সারাদিন কোথায় কোথায় যায় আমি জানি না।

তোমার বাসায় কি সেদিন কোনো গেস্ট মানে কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিলো?

না।

ভেবে বলো?

আমি ঠিক বলছি স্যার। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন স্যার। আমি একটা কথাও মিথ্যা বলছি না।

ইব্রাহিম সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেলো, সে গম্ভীরস্বরে বললো, রিতু আমি আবারো বলছি ভেবে বলো?

জি স্যার আমি ভেবে বলছি।

তুমি বিলকিস নামে কাউকে চেনো?

বিলকিস, বিলকিস বলে রিতু কৃত্রিমভাবে মনে করার চেষ্টা করে বললো, না স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব দু’জন মহিলা পুলিশের মধ্যে একজন, পারুলকে ইশারা করে বললো, পারুল।

দু’জনের মধ্যে পারুল বেশ লম্বা, চওড়া, শক্তিমান। কোনো আসামির মুখ থেকে কথা বের করতে শক্তি প্রয়োগের কাজটি পারুলই করে থাকে। ইব্রাহিম সাহেব তাকে ইশারা করতেই সে রিতুর দু’গালে দু’টা থাপ্পড় মারলো।

ইব্রাহিম সাহেব দাঁত কড়মড় করে ক্রিমিনালের বউ ক্রিমিনাল, নিজের কাজিনকে চিনে না, বলে পারুলের পাশে থাকা অপর মহিলা পুলিশ মনিরাকে বললো, যাও তো বিলকিসকে নিয়ে এসো।

মনিরা চলে গেলো। প্রায় দু’মিনিট পর বিলকিস ঘরে ঢুকতেই ইব্রাহিম সাহেব বিলকিসকে দেখিয়ে বললো, দেখোতো একে চেনো কী না?

রিতু দৃঢ় চিত্তে বললো, না তো।

বিলকিস মিনমিন করে বললো, আপা তুমি আমাকে চিনতে পাচ্ছ না, আমি বিলকিস।

কোন বিলকিস? আমি তো তোমাকে চিনি না।

ইব্রাহিম সাহেবের চোখ থেকে তখন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। সে দাঁত কড়মড় করে বললো, বিলকিস বেগম তোমার সব জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। বিলকিসকে অস্বীকার করে তোমার লাভ নেই। প্রয়োজনে তোমার মা-বাবাকে নিয়ে আসবো, বিলকিসের মা-বাবাকে নিয়ে আসবো, তারাই প্রমাণ করবে তুমি বিলকিসকে চেনো কী না।

মুকিদের কাছে তখনো বিলকিসের মোবাইল ফোনটা ছিলো সে ফিসফিস করে বিলকিসের কানে কিছু কথা শিখিয়ে দিয়ে একটা নাম্বারে ফোন করলো।

অপর পাশে ফোন রিসিভ হয়েছে, মুকিদ মোবাইল ফোনের লাউড স্পিকার দিলো, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন প্লিজ?

আমি বিলকিস।

এই নম্বরটা তো বিলকিসেরই আমি সেভ করে রেখেছি কিন্তু আপনি তো বিলকিস না।

এই আপনার বিলকিসের সঙ্গে কথা বলুন বলে বিলকিস ফোনটা মুকিদের হাতে দিলো।

মুকিদ ফোনটা রিতুর হাতে দিয়ে বললো, কথা বলো।

রিতু কোনো কথা বললো না।

ইব্রাহিম গর্জন করে উঠলো, কথা বল, চুপ করে আছিস কেনো? কথা বল?

রিতু তবুও কথা বললো না। এবার পারুল রিতুর গালে-মুখে থাপ্পড় দিতেই রিতু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, হ্যালো।

হ্যালো বিলকিস।

বিলকিস আবারো অস্বীকার করলো, বিলকিস না আমি রিতু।

না, না তুমি আমার রিতু, খলিল জোর দিয়ে বললো।

মুকিদ রিতুর হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বললো, খলিল এখন যার সঙ্গে কথা বললো সে কি বিলকিস?

জি।

আমার আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। বিলকিস ষড়যন্ত্রের শিকার, ওকে নিয়ে যাও। রিতু বিলকিসের নামে ফেক আইডি খুলেছে, বিলকিসের মোবাইল ফোন দিয়ে খলিলের সঙ্গে কথা বলেছে এবং খুনিকে হাসান সাহেবের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে, গম্ভীরস্বরে কথাগুলো বলে ইব্রাহিম সাহেব পারুল এবং মনিরার উদ্দেশ্যে বললো, পারুল, মনিরা তোমরা রিতুর চোখ বেঁধে ওকে ইন্টারগেট করো, রিতু যদি ওয়ান সিঙটি ফোরে জবানবন্দী দিতে চায় তবে ভালো আর যদি না দিতে চায় তবে আজ রাতেই বলে ইব্রাহিম সাহেব ইঙ্গিত করলো যে রাতেই তার ক্রস ফায়ার।

রিতু আঁৎকে উঠলো। তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

 

এগারো

 

হত্যাকাণ্ডে দু’জন অংশগ্রহণ করেছিলো। একজন ডন, এখন পুলিশের অঘোষিত হেফাজতে, ডন বলেছে তার সহযোগী আরেকজন ছিলো হিটলার। কিন্তু হিটলার জানতো না সে ডনের সঙ্গে কোথায় কী কাজে যাচ্ছে, সেদিন ক্লাবে এসেই ডন হিটলারকে কোনোকিছু না জানিয়ে বললো, চলো।

হিটলার একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, বস কোথায় যাচ্ছি?

হিটলার রাগান্বিতভাবে বলেছিলো, চুপ করে থাকো আর তোমার মোবাইল ফোন অফ করো।

হিটলার তার মোবাইল ফোন অফ করেছিলো।

হিটলার আর কোনো কথা বলেনি। হাসান সাহেবকে খুন করার পর হিটলার খুব ভয় পেয়েছিলো।

ডন হিটলারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, ভয় পেলে চলবে, গ্যাং চালানোর টাকার জন্য, শক্তি দেখানোর জন্য আরো কত কী করতে হবে।

হিটলার আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলো, তাই বলে খুন!

কিচ্ছু হবে না, কেউ কোনোদিন জানবেও না।

অতঃপর হিটলার আর কোনো কথা বলেনি।

হিটলার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করে, মা গৃহিণী। মা-বাবার মধ্যে বনিবনা নেই দীর্ঘদিন থেকে শুধু সামাজিক কারণে একসঙ্গে বসবাস। তারই প্রভাব পড়েছে হিটলারের ওপর। হিটলার শৈশব থেকে দেখে এাসেছে মা-বাবার মধ্যে এই দাম্পত্য কোলহ। কোনোকিছু হলেই বাবা বলে, সারাদিন ঘরে বসে কী করো, ছেলের দেখাশুনাটাও ভালো করে করতে পারো না।

মা বলে, আমি কেনো, তোমার ছেলেকে তুমি সামলাও।

বাবা অফিস থেকে আসার পর ছেলের খবর আর কী নিবে শুরু হয় দু’জনের মধ্যে ঝগড়া। হিটলার এসব দেখতে পারে না তাই বাসা থেকে বেরিয়ে আসে, অনেকক্ষণ পর বাসায় ফিরে, ততক্ষণে হয়তো দু’জনে ঝগড়া কিংবা মারামারি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নয়তো বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।

এভাবেই একটা অশান্তি আর অসি’র সংসারে বড় হওয়া হিটলার কিশোর গ্যাং এ যুক্ত হয়েছে।

পুলিশ হিটলারকে ফিফটি ফোরে গ্রেফতার করলো। রাতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। হিটলারের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে ডনের কথার মিল আছে। পুলিশ পরদিন হিটলারকে আদালতে সমর্পণ করলো এবং তদন্তের জন্য সাত দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলো, আদালত হিটলারকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলো। পুলিশ প্রথমে নেমেছিলো হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে কিশোর গ্যাং জড়িয়ে পড়ায় পুলিশকে এখন কিশোর গ্যাং তৎপরতা বন্ধে কাজ করতে হচ্ছে।

পুলিশ হিটলারের কল রেকর্ড দেখে দেখে ডিবি গ্যাং এর সদস্যদের মোবাইলের কল রেকর্ড দেখে দেখে তদন্ত করতে শুরু করেছে।

সেদিন ছিলো শুক্রবার, বিকেলবেলা আফজাল সাহেব বাসাতেই ছিলো। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দিতেই সে চমকে উঠলো, নিজের অজান্তে ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে অস্পষ্ট একটা কথা বের হলো, পুলিশ!

পুলিশ অফিসার ইব্রাহিম সাহেব সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, আপনারা?

জি আমরা, ভয় পাবেন না। হিরু আপনার কে হয়?

আফজাল সাহেব একটা ঢোক গিলে বললো, আমার ছেলে, আমার একমাত্র ছেলে, কী করেছে ও।

হয়তো কিছু করেনি তবে করতে পারতো, আমরা একটু কথা বলতে চাই।

অফকোর্স ভিতরে আসুন, বলে আফজাল সাহেব ইব্রাহিম সাহেবসহ তার সঙ্গে দু’জন ফোর্সকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

ইব্রাহিম সাহেব কান খাড়া করে রইলো।

আফজাল সাহেব চাপাস্বরে হিরুকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কী করেছিস যে পুলিশ তোর খোঁজে বাসায় এলো?

আমি কিচ্ছু করিনি বাবা।

আচ্ছা চল।

আফজাল সাহেব হিরুকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ও কিছু করেনি।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, আমি তো বলিনি কিছু করেছে। আচ্ছা বসুন। হিরু তুমিও বসো।

আফজাল সাহেব বসলো, হিরু দাঁড়িয়ে রইলো।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, দাঁড়িয়ে রইলে কেনো হিরু? বসো। আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবো।

হিরু একবার তার বাবার দিকে আরেকবার ইব্রাহিম সাহেবের দিকে তাকাতেই আফজাল সাহেব হাত ধরে হিরুকে তার পাশে বসালো।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, হিরু একদম ভয় পাবে না, আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো তা তা ঠিকভাবে বলবে।

হিরু মাথা কাত করে জানালো সে ঠিক ঠিক বলবে।

তুমি ডিবি গ্যাং এ যাতায়াত করতে?

ডিবি গ্যাং এ, হ্যাঁ তিন চার দিন গেছি।

কেনো?

সেদিন সন্ধ্যায় হিটলার আমাকে মোবাইল করে বললো, হিরু ক্লাবে আয়, পার্টি আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীসের পার্টি?

বললো, আয় ডন আজ সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবে। আসার সময় মুরাদকেও নিয়ে এসো।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, তারপর?

আমি মুরাদকে মোবাইল করেছিলাম। মুরাদ বললো ওর বাবা বাসায় আছে তাই ওর মা ওকে সন্ধ্যার পর বের হতে দিবে না।

মুরাদ কে?

মুরাদ আমার ফ্রেন্ড।

মুরাদও কি ডিবি গ্যাং এর সদস্য?

না। ওকে আমি একদিন নিয়ে গিয়েছিলাম।

কেনো?

একদিন মুরাদ রিকশা পায়নি বলে প্রাইভেট থেকে পায়ে হেঁটে ফিরেছিল। রাস্তা মোড়ে সিনিয়র গ্রুপের কয়েকজন তখন দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। মুরাদ তাদের চিনতো না বলে সালাম দেয়নি সেজন্য ওরা মুরাদকে সরি বলতে বাধ্য করে। আর তাই মুরাদকে ডনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।

কেনো? মুরাদকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে?

হিরু কোনো কথা বললো না।

তারপর কী হলো?

ডন সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলো। তাই মুরাদের বিষয়ে তেমন কথা হয়নি, তবে ডন হিটলারকে বলেছিলো মুরাদের কেসটা স্মরণ করে দিতে একটা ব্যবস্থা নিবে।

তারপর আমি মুরাদকে নিয়ে যেতে চাইছিলাম আবার কিন্তু মুরাদ আর যায়নি।

ভালো করেছে। তুমি কি সেদিন পার্টিতে গিয়েছিলে?

হিরু মাথা নত করে বসে রইলো।

কী হলো পার্টিতে?

ডন সবাইকে চাইনিজ খাইয়েছে।

কেনো খাইয়েছে জানো?

হিরু বললো, সেটা বলেনি।

আফজাল সাহেব এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ইব্রাহিম সাহেব আর হিরুর প্রশ্নোত্তর শুনছিলো আর ভাবছিলো সে তো হিরুর যথেষ্ট যত্ন নিতো তারপরও হিরু গ্যাং কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলো, আসলে ছেলের প্রতি তার আরো বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত ছিলো।

ইব্রাহিম সাহেব এবার আফজাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বুঝলেন আফজাল সাহেব?

কী হয়েছে ঘটনাটা বলুন তো।

এখনো সেটা বলার সময় আসেনি আফজাল সাহেব। ছেলেখে দেখে রাখবেন, কিন্তু গ্যাং কালচারে অভ্যস্‌ হতে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস কোনো কেস-এ ফেঁসে যায়নি।

আফজাল সাহেব একটা ঢোক গিললো।

ইব্রাহিম সাহেব হিরুকে বললো, হিরু তুমি একজন স্টুডেন্ট, তোমার কাজ লেখাপড়া করা। মুরাদকে কেউ অপমান করেছে সেজন্য ও ওর বাবাকে বলবে, স্কুলের হেডমাস্টারকে জানাবে। তুমি ফ্রেন্ড হয়ে তাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে কিন্তু তা না করে তুমি তাকে গ্যাং এ নিয়ে গিয়েছো এটা ঠিক করোনি। আশা করি তুমি আর কখনো কোনো গ্যাং এর সঙ্গে জড়াবে না। ইব্রাহিম সাহেবের শেষের কথাগুলো কিছুটা রূঢ় শোনালো।

আফজাল সাহেব জোর দিয়ে বললো, আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন অফিসার আর এরকম হবে না।

 

বারো

 

কানকাটা মোন্তা এখনো শহরেই আছে। তবে সে অত্যন্ত সতর্ক এবং একেবারে রাস্তায় চলাফেরা করছে না। শহর থেকে বের হওয়ার সব ক’টা রাস্তায় পুলিশের গোয়েন্দা জাল ছড়ানো আছে, সে শহর থেকে পালানোর কোনো রকম চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে আটক করবে।

এর মধ্যে পুরো শহরের সি.সি ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি পুলিশ বিশ্লেষণ করেছে। মোবা কাউন্সিলর ছাড়াও শহরের আরো কয়েকজন রাজনীতিবিদের অফিসে মোন্তার যাতায়াত ছিলো হাসান সাহেব খুন হওয়ার তৃতীয় দিন পর্যন্ত মোন্তা এবং মতলুব স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছে কিন্তু রিতুকে গ্রেফতারের পর তারা গা ঢাকা দিয়েছে। রিতুকে গ্রেফতার করার পর মোন্তা একজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দেখা করতে যায়। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে পুলিশ জানে না। সেই প্রভাবশালী নেতার বাড়ি থেকে তাকে বের হতে দেখা যায়নি। তবে এক ঘণ্টা পর একটা জিপ গাড়ি সেই বাড়িতে ঢুকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যায়, গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ছিলো। সেই গাড়ির গ্লাস কালো, ভিতরে কে ছিলো দেখা যায়নি।

সেই কালো গাড়ির মালিক কে সেটাই ওসি সাহেব এবং ইব্রাহিম সাহেব খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই কিছুক্ষণ আগে ওসি সাহেব ফোন করেছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্টকে, সে কয়েকজন ট্রাফিক কন্সটেবলকে সঙ্গে করে থানায় ঢুকলো।

ট্র্যাফিক সার্জেন্ট স্যালুট দিয়ে দরজায় দাঁড়ালো, স্যার।

আসুন, বসুন।

ট্র্যাফিক সার্জেন্ট একটা চেয়ারে বসলো, তারা পাশাপাশি পিছনের চেয়ারে বসলো। ওসি সাহেব তার বাম পাশে থাকা কম্পিউটার মনিটরে একটা জিপ গাড়ির ছবি দেখিয়ে বললেন, দেখুন তো এটা কার গাড়ি?

ট্র্যাফিক সার্জেন্ট কয়েকমুহূর্ত ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর সিনিয়র ট্র্যাফিক কনস্টেবল জহিরকে জিজ্ঞেস করলো, দেখুন তো জহির সাহেব এটা কার গাড়ি?

জাহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্যার নম্বর প্লেটটা দেখি?

ওসি সাহেব বললেন, নম্বর প্লেট তো ক্যামেরায় আসেনি।

এরকম গাড়ি শহরে তিনটা আছে স্যার।

কার কার? ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

জহির সাহেব গাড়ি তিনটার মালিকের নাম বললো।

ওসি সাহেব ভ্রু’কুচকে বললেন, ওকে আপনারা আসুন।

ট্র্যাফিক সার্জেন্ট তার দলবল নিয়ে চলে যাবার পর ওসি সাহেব ইব্রাহিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, বুঝলেন তো এটা কার কাজ।

জি স্যার।

একটা কথা মনে রাখবেন ড্রাইভারের মুখ থেকে একথা বের করা অনেক কঠিন কাজ আবার ড্রাইভারকে আ্যরেস্ট করাও যাবে না।

জি স্যার, বলে ইব্রাহিম সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

শুরু হলো আরেকটা ঝটিকা অভিযান। আজ রাতের মধ্যেই মোন্তাকে গ্রেফতার করতে হবে আর মোন্তাকে গ্রেফতার করতে হলে আগে গ্রেফতার করতে হবে সেই প্রভাবশালী নেতার ড্রাইভার, হাসুকে। একজন সোর্স হাসু’র গতিবিধির দিকে নজর রাখছে। সে কিছুক্ষণ পর পর ইব্রাহিম সাহেবকে তার অবস্থানের তথ্য দিচ্ছে। ইব্রাহিম সাহেব তার সঙ্গীয় ফোর্সদের নিয়ে থানায় অবস্থান করছে। কয়েকমিনিট চেয়ারে বসে ফাইলের দিকে চোখ বুলাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে চেম্বারের মধ্যে পায়চারি করছে।

সোর্স ফোন করলো।

ইব্রাহিম সাহেব ফোন রিসিভ করলো, বলো।

সোর্স বলতে শুরু করলো। ইব্রাহিম সাহেব কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে ফোন ধরে রাখলো তারপর বললো, তুমি পিছু পিছু রিকশায় চড়ে যাও আর আমাকে আপডেট দাও।

জি স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব ফোন রেখে জোরে চিৎকার করে বললো, মুকিদ।

মুকিদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

সবাইকে নিয়ে এসো।

মুহূর্তের মধ্যে মুকিদসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল থানার গাড়ি বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রোবাসে উঠলো। থানা থেকে বের হতেই ইব্রাহিম সাহেব ড্রাইভারকে বললো, ডানে যাও, তারপর বাঁয়ে।

ইব্রাহিম সাহেব মাঝে মাঝে কানের কাছে ফোন ধরে রাখলো। আর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতে লাগলো। ইব্রাহিম সাহেব মাইক্রো বাসের আলোতে সামনে দু’টা রিকশা দেখতে পেয়ে ড্রাইভারকে বললো, সামনের রিকশার সামনে ব্রেক করো।

ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে সামনের রিকশার সামনে গিয়ে জোরে ব্রেক কষলো।

সামনের রিকশা মাইক্রোবাসের পিছনে ধাক্কা খেলো সে কিছু বলার আগেই মাইক্রোবাস থেকে মুকিদ এবং তার সঙ্গে আরো দু’জন ফোর্স মাইক্রোবাস থেকে নেমে হাসুকে মাইক্রোবাসে তুললো।

ঘটনার আকস্মিকতায় হাসু আতঙ্কিত হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কারা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমার কী দোষ?

তোমার কোনো দোষ নেই। তোমার কোনো ক্ষতিও হবে না। তুমি শুধু বলো কানকাটা মোন্তাকে কোথায় রেখে এসেছো? কথাগুলো ইব্রাহিম সাহেব চাপাস্বরে বললো।

ইব্রাহিম সাহেব মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসেছিলো, মাঝখানে হাসু আর হাসু’র পাশে মুকিদ। ততক্ষণে মুকিদ হাসুর চোখে কালো কাপড় বেঁধে দিয়েছে, মুখে মাস্ক্রিং টেপ জুড়ে দিয়েছে।

হাসু অস্পষ্ট গলায় বললো, আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না।

ইব্রাহিম সাহেব কর্কশ, ভয়ঙ্কর গলায় বললো, মোন্তাকে কোথায় রেখে এসেছো?

আমি জানি না স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না।

মুকিদ গলা চেপে ধরে চাপাস্বরে বললো, বলবি নাকি শেষ করে ফেলবো, বলে অনেকক্ষণ ধরে রাখলো।

হাসু গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো, বলছি স্যার, বলছি।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, মুকিদ মুখের টেপটা খুলে দাও।

মুকিদ টেপ খুলে দিলো।

আমি তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি, কথাগুলো হাসু মাথা নিচু করে বললো।

কিন্তু তার কথা ইব্রাহিম সাহেব বিশ্বাস করতে পারলো না। ইব্রাহিম সাহেব হাসুর গালে মুখে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বললো, চালাকি করছিস? ভালোয় ভালোয় বলছি মোন্তা কোথায় বল, আমাদের মোন্তার ঠিকানায় নিয়ে চল। মোন্তাকে পেলেই তোর জন্য ভালো আর না পেলে আজ তোর শেষ দিন।

মুকিদ আবার হাসুর মুখে টেপ শক্তভাবে জুড়ে দিয়ে গলা টিপে ধরলো।

হাসু হাতমুখ ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো। তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হলো। সে আবার গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো, বলছি স্যার, বলছি।

মুকিদ আবার মুখের টেপ খুলে দিতে দিতে বললো, এবার যদি উল্টা-পাল্টা বলিস তবে কিন্তু প্রাণে মরবি।

হাসু মুখ দিয়ে ইশারা করলো যে তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে এসেছে সেই রক্ত ফেলবে। মুকিদ গাড়ির জানালা খুলে দিলো। হাসু বাইরে রক্ত ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমি জায়গার নাম জানি না, তবে নিয়ে যেতে পারবো সেই জায়গায় কিন্তু একটা কথা আমি সত্যি বলছি মোন্তা আমার গাড়ি থেকে একটা মোড়ে নেমেছে।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় যাবেন? আমি নামিয়ে দিই।

আমাকে হাতের ইশারায় বিদায় দিয়েছিলো।

আচ্ছা ঠিক আছে তুই সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারবি তো।

হাসু ইশারা করে জানালো পারবে।

 

তেরো

 

মাইক্রোবাস ছুটে চললো। হাসুর দেখানো পথে ড্রাইভার মাইক্রোবাস চালাচ্ছে। মুকিদ সি.সি ক্যামেরার ফুটেজগুলো মিলিয়ে দেখছে, হাসু ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু একসময় তো শহর শেষ হয়ে গেলো। মাইক্রোবাস বেরিয়ে এলো সি.সি ক্যামেরার নেটওয়ার্কের বাইরে। প্রায় আধ ঘণ্টা মাইক্রোবাস চললো, পাকা রাস্তা শেষ করে মাইক্রোবাস কাঁচা রাস্তায় চলতে শুরু করলো, গ্রামে ঢুকলো কিন্তু তবু পথের আর শেষ নেই।

মুকিদ রাগান্বিতস্বরে হাসুকে জিজ্ঞেস করলো, ঠিক বলছিস তো?

হাসু মাথা নেড়ে জানালো সে ঠিক বলেছে।

আরো প্রায় পনেরো মিনিট মাইক্রোবাস চলার পর একটা দুই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মোড়ে কয়েকটা কাঁচা-পাকা দোকান। একটামাত্র দোকান খোলা আছে, পান-সিগারেটের দোকান। দোকানে একটা ছেলে বসে আছে, বয়স বিশ-পঁচিশ বছর। মুকিদ মাইক্রোবাস থেকে একটা সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে জায়গার নামটা পড়লো। তারপর হাসুকে জিজ্ঞেস করলো, এই মোড়ে?

হাসু মাথা নেড়ে সায় দিলো।

মুকিদ মাইক্রোবাস থেকে নেমে পানের দোকানের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো, পান আছে?

জি আছে।

একটা পান দাও।

ছেলেটি পান তৈরি করতে করতে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কোথায় যাবেন?

এখানে বলে মুকিদ আরেকবার সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বললো, এই মোড়ের কথাই তো বলেছে, বলেছে এই মোড়ের কাছেই বাসা।

এই মোড়ের কাছে? কিন্তু এখানে তো কোনো বাসা নেই বলে ছেলেটি মনে করার চেষ্টা করলো তারপর ভ্রু’কুঁচকে বললো, একটা বাসা আছে।

এই তো ঠিক বলেছো, কোনদিকে বলো তো?

এই রাস্তা দিয়ে বলে ছেলেটি বাঁদিকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে বললো, এই রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যাবেন তারপর দেখবেন বাঁয়ে একটা একতলা বাড়ি, তবে বাড়িতে কাউকে পাবেন বলে মনে হয় না।

কেনো? কেনো মনে হয় না?

আমি তিন বছর থেকে এখানে দোকান করি কিন্তু ঐ বাড়ির কাউকে কোনোদিন দেখিনি। আপনারা যান যদি আপনাদের লোককে দেখা পান।

মুকিদ পানটা হাতে নিয়ে মুখে পুরে দোকানদারকে পানের দাম দিয়ে বললো, ধন্যবাদ।

বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা একতলা বাসা, কাছাকাছি আর কোনো বাসা নেই। বলা যায় লোকালয় থেকে একেবারে আলাদা। দু’জন পুলিশ বাসার পিছন দিক থেকে দেখে জানালো কোনোদিক পালানোর রাস্তা নেই। তারপর মুকিদ কড়া নাড়লো।

কয়েকবার কড়া নাড়ার পরও ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।

মুকিদ আরো জোরে কড়া নাড়লো।

না, তবুও ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।

ইব্রাহিম সাহেব কয়েকমুহূর্ত কী যেনো ভেবে নিলো। তারপর আপনমনে ফিসফিস করে বললো, ভিতর থেকে বন্ধ, অথচ কোনো আলোবাতি নেই, কারো সাড়াশব্দ নেই…

ইব্রাহিম সাহেবের সন্দেহ আরো প্রবল হলো, নিশ্চয়ই ভিতরে কেউ আছে। মুকিদ দরজা ভাঙ্গো।

ফোর্সদের মধ্যে একজন ছিলো লম্বা-চওড়া, দ্বৈত্যের মতো চেহারা। ইব্রাহিম সাহেব বলামাত্র সে জোরে দরজায় ধাক্কা দিলো কিন্তু দরজা খুললো না। সে আরো জোরে নিজের শরীর দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।

ঘরের ভিতরে কেউ নেই। তবে বিছানায় মোশারি টাঙ্গানো আছে, বিছানা এলোমেলো দেখে বোঝা যায় কেউ একজন ছিলো। ইব্রাহিম সাহেব বিছানায় হাত দিয়ে দেখলো বিছানা এখনো গরম আছে। সে বললো, মুকিদ ও আছে, খোঁজো, ও ভিতরেই আছে। প্রত্যেকটা রুম তন্ন তন্ন করে খোঁজো, বাথরুমে দেখো, ফলস স্লাবের ওপর দেখো।

সবাই পুরো বাসা খুঁজে দেখলো কিন্তু কোথাও মোন্তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না কিন্তু মোন্তা বাসায় ছিলো তার বিছানা এবং টাঙ্গানো মোশারিই প্রমাণ করে। একজন কনস্টেবল ফলস স্লাবের ওপর একটা ছোট আকারের লুভার দরজা দেখে বললো, স্যার ওখানে থাকতে পারে।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, দরজা খোলো। জোরে ধাক্কা দাও।

জোরে ধাক্কা দিয়েও দরজা খোলা গেলো না। ইব্রাহিম সাহেব বললো, আবার জোরে ধাক্কা দাও, ভিতর থেকে বন্ধ নাকি?

পুলিশ কনস্টেবল বললো, বোঝা যাচ্ছে না স্যার, জোরে লাগানো তো।

আরো জোরে ধাক্কা দাও।

আরো জোরে ধাক্কা দিতেই লুভার দরজা খুলে গেলো কিন্তু সেখানেও নেই।

একজন কনস্টেবল বললো, স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব কাছে গেলো। দেয়ালের গায়ে কয়েকটা ইউ আকৃতির রড লাগানো। ইব্রাহিম সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো, সে দেখলো লোহার রডগুলো ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে এবং ছাদের ওপর একটা ছিদ্র আছে যার ঢাকনা আছে কিন্তু ঢাকনাটা এখন বন্ধ। ইব্রাহিম বললো, মুকিদ ও এই রাস্তা দিয়ে পালিয়েছে, এই ক্যাট ল্যাডার দিয়ে ছাদের ওপরে উঠেছে, দেখো এখনো পালাতে পারেনি হয়তো। ছাদে ওঠো, একজন একজন করে ছাদে ওঠো, পুরো বিল্ডিং ঘিরে ফেলো।

ইব্রাহিম সাহেবের কথামতো একজন ক্যাট ল্যাডার বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। সে ল্যাডার বেয়ে উপরে উঠে দরজায় মাথা উঁচু করতেই মাথায় জোরে আঘাত পেয়ে একরকম টলে পড়লো ল্যাডার বেয়ে। ভাগ্যিস নিচে ইব্রাহিম সাহেবসহ অন্যান্য সদস্যরা ছিলো তারা আহত পুলিশ সদস্যকে ধরে ফেললো। তারপর তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে ল্যাডারের শেষ প্রান্তে ছাদে মাঙ্কি হোলের দরজা বন্ধ করে দিলো।

ইব্রাহিম সাহেব জানালা খুলে জোরে বললো, মোন্তা পুলিশ তোমাকে ঘিরে ফেলেছে, নিচে নেমে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করো। কোনো রকম চালাকি করলে আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হবো।

মোন্তা কোনো কথা বললো না। সে ছাদের ওপর পায়চারি করছে। পুলিশ কার্নিশের নিচে অবস্থান নিয়েছে।

মোন্তা ছাদ থেকে লাফ দিলো।

একজন পুলিশ সদস্য তাকে ধরতে গিয়ে ধ্বাধস্তি শুরু হলো। মোন্তা তার মাথায় পিস্তল ধরে, চিৎকার করে বললো, সবাই অস্ত্র ফেলে দাও। কেউ আমার কাছে আসার চেষ্টা করলে একে প্রাণে মেরে ফেলবো।

ইব্রাহিম সাহেব গর্জন করে উঠলো, ওকে ছেড়ে দে মোন্তা নইলে আমি তোকে গুলি করবো।

চালাও গুলি, চালাও। তোমরা মারবে একজন সন্ত্রাসী, আমি মারবো একজন পুলিশ। কার জীবনের মূল্য বেশি। আমি বলছি সবাই অস্ত্র ফেলে দাও। আমি একে নিয়ে দূরে চলে যাবো, তারপর ছেড়ে দিয়ে আমি চলে যাবো। একে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে বা আমাকে ধরার চেষ্টা করলে আমি এর মাথায় গুলি করবো অফিসার। আমি এক থেকে তিন গুনবো, এক…, দুই…

ইব্রাহিম সাহেব সবাইকে নির্দেশ দিলো, অস্ত্র ফেলে দাও, মোন্তাকে যেতে দাও।

মুকিদ কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করলো, স্যার এতো কষ্ট করে বেটাকে পেলাম আর ছেড়ে দিবো।

আমি বলছি সবাই অস্ত্র রাখো। মোন্তা পালাবে কোথায় পুলিশের কাছে মোন্তাকে ধরা পড়তেই হবে।

পুলিশের একজন সদস্য ধীরে ধীরে মোন্তার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। মোন্তা একসঙ্গে এতগুলো পুলিশ সদস্যের দিকে চোখ রাখতে পারছিলো না। আর সেই পুলিশ সদস্য এই সুযোগটিই নিলো।

মোন্তা আবার বললো, সবাই কিন্তু অস্ত্র ফেলোনি আমি কিন্তু তিন বলার সাথে সাথে…

ইব্রাহিম সাহেব আবার সবাইকে অস্ত্র ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়ামাত্র সবাই অস্ত্র ফেলে দিলো। এমন সময় সেই পুলিশ সদস্য মোন্তার চিবুক বরাবর একটা ঘুষি মারতেই পিস্তলটি উপরে উঠে গেলো। সুযোগ পেয়ে আরেকজন পুলিশ সদস্য মোন্তার আরেক চিবুকে একটা ঘুষি মারলো।

মোন্তার চোখে যেনো জোনাকি পোকার মতো আলো জ্বলে উঠলো। সে দ্বিগ্‌িবদিকহারিয়ে ঢলে পড়ছিলো, একজন পুলিশ সদস্য তাকে ধরে ফেললো। তারপর তার হাত পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে মাইক্রোবাসে তোলা হলো।

 

চৌদ্দ

 

আরমান সাহেব আরো দেরিতে বাসায় ফিরে কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। ফিরেই রিনিকে কিছু না বলে ডনের ঘরে উঁকি মারলো, না ডন ঘরে নেই। রিনিকে জিজ্ঞেস করলো, ডন আসেনি?

কী জানি? প্রতিদিন তো আরো আগে আসে।

তুমি একবার ফোন করেছো?

না। আমি ভেবেছি ও চলে এসেছে। ও তো প্রতিদিন তোমার চেয়ে আগে আসে।

আরমান সাহেব কিছুটা রেগে গেলো, প্রতিদিন আগে আসে সেজন্য আজ একবার খবর নিতে হবে না, আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি বলে আরমান সাহেব ডনের মোবাইল ফোনে ফোন করলো।

না, মোবাইল ফোন বন্ধ, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

আরমান সাহেবের বুক কেঁপে উঠলো, ফোন বন্ধ, এখন রাত বারোটা বাজে, ডন এখনো বাসায় ফিরেনি, ফোন বন্ধ!

রিনির দু’ঠোঁট ফাঁকা হয়ে বুক চিরে একটা কথা বের হলো, ফোন বন্ধ! ডনের ফোন তো কোনোদিন বন্ধ থাকে না।

আরমান সাহেব রিনিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে ওর কোনো ফ্রেন্ডের মোবাইল নম্বর আছে?

রিনি থতমত খেয়ে বললো, না তো।

আরমান সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলো, থাকবে কী করে সারাদিন তো থাকো টিভির সিরিয়াল আর ফেসবুক নিয়ে।

রিনি কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, আমি কী করবো বলো। ওকে কিছু বললেই বলে ও নাকি এখন বড় হয়েছে। ও নিজের ভালোমন্দ বুঝে।

আরমান সাহেব হাতমুখ ধুয়ে টি.ভি’র সামনে বসলো। টি.ভি’র স্ক্রল রোল দেখে যেনো চোখ কপালে উঠলো, নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাং ডেঞ্জারাস বয়েজ এর প্রধান আশরাফুল ইসলাম ডন অপহরণ।

আরমান সাহেব চশমা পরিষ্কার করে কাছে গিয়ে দেখলো তারপর জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো, রিনি।

রিনি পাশের রুম থেকে একরকম দৌড়ে এলো, কী হলো?

একবার দেখোতো বলে আরমান সাহেব সোফার ওপর ধপাস করে বসে পড়লো।

রিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।

আরমান সাহেব কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। তারপর চোখ মুছে থানায় ফোন করলো।

অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো, আসসালামুয়ালায়কুম, এস.আই কামরুল বলছি। কীভাবে হেল্প করতে পারি?

আরমান সাহেব কান্না ভাঙ্গা গলায় বললো, আমি একবার ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই প্লিজ একটু কথা বলিয়ে দিবেন।

আপনি কে বলছিলেন প্লিজ?

আমি আরমান চেম্বার অফ কমার্সের ডাইরেক্টর।

জি স্যার আমি দেখছি বলার পর প্রায় এক মিনিট কোনো কথা নেই তারপর কামরুল বললো, স্যার উনি তো চেয়ারে নেই।

একটু দেখুন না প্লিজ কীভাবে হেল্প করতে পারেন!

আপনি স্যারের মোবাইলে ফোন দিন স্যার আমি বলছি বলে এস.আই কামরুল ওসি সাহেবের মোবাইল নম্বর বললো।

আরমান সাহেব ওসি সাহেবের নম্বর অন্য একটা মোবাইল ফোনে সেভ করে নিলো। তারপর ওসি সাহেবকে ফোন করলো।

ওসি সাহেব রিসিভ করেছেন, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি আরমান বলছি ডাইরেক্টর চেম্বার অফ কমার্স।

জি বলুন।

আমার ছেলে আশরাফুল আলম ডন আজ রাতে এখনো বাসায় ফিরেনি। এখন আমি টি.ভি’তে দেখছি সে অপহরণ হয়েছে।

আসলে আপনার মতো আমিও এইমাত্র টি.ভি’তে দেখলাম। ফরমাল কোনো কমপ্লেইন পাইনি আপনি কমপ্লেইন করলে ব্যবস্থা নিবো। আসলে আজকাল টিন এজ ছেলেমেয়েদের খবর রাখতে হয়, কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেলামেশা করে, কোনো কিশোর গ্যাং এর সঙ্গে মিশে কী না।

ওসি সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার কথা শুনতে শুনতে আরমান সাহেবের ধৈর্যচ্যূতি ঘটেছে, আচ্ছা আমি থানায় আসছি বলে আরমান সাহেব ফোন রেখে দিলো।

আরমান সাহেব সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও চেম্বার অফ কমার্সের ডাইরেক্টর হওয়ার কারণে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্য আছে। থানায় যাওয়ার আগে সে ক্ষমতাসীন দলের একজন জেলা পর্যায়ের নেতা মুকুল চৌধুরীকে ফোন করে থানায় আসার জন্য অনুরোধ করলো। থানায় আরমান সাহেবের সঙ্গে তিনিও যোগ দিলেন।

মুকুল চৌধুরীসহ আরমান সাহেব ওসি সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই ওসি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে সালাম দিলেন, আসসালামুয়ালাইকুম লিডার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

কেমন আছেন বলুন? বলেই ওসি সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিলেন।

জি ভালো।

স্যান্ট্রি দরজায় এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালো। ওসি সাহেব বললেন, কী খাবেন লিডার, চা না কফি? নাকি ঠাণ্ডা?

না শুধু চা হলেই চলবে, চিনি কম।

স্যান্ট্রি চলে গেলো।

চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন বলুন?

কেমন আর থাকবো, পুলিশের চাকরি তারপর আবার থানায়। চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। তবুও আল্লাহ যেমন রেখেছেন তেমনই ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।

চা চলে এলো। ওসি সাহেব বললেন, চা নিন প্লিজ!

চৌধুরী সাহেব বলতে শুরু করলেন, এসেছিলাম আমার এই ছোট ভাইর একটা কাজে।

আপনি? বলে ওসি সাহেব আরমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন।

জি আমি আরমান, আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম।

কী হয়েছে বলুন তো? বলে ওসি সাহেব কৌতূহলী দৃষ্টিতে আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমার ছেলে আশরাফুল ইসলাম ডন আজ বাসায় ফিরেনি, আমি অনেকক্ষণ থেকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু ফোন বন্ধ। তারপর টি.ভি’র পর্দায় দেখলাম কে বা কারা তাকে অপহরণ করেছে।

ওসি সাহেব বলতে শুরু করলেন, আসলে শহরে কয়েকটা কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। উঠতি বয়সের ছেলেরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে, তবে ইদানীং খুন-খারাপীও করছে। বেশিরভাগ বিত্তবান পরিবারের ছেলেরা। আজকাল বাবারা ব্যবসার কাজে বেশি ব্যস্ত হয়েছে পড়ছে আর মায়েরা রুপ চর্চা, সমাজসেবা, টি.ভি সিরিয়াল, সোশ্যাল মিডিয়া এসব নিয়ে। তাই ছেলেরা কখন কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে এসব লক্ষ্য রাখেন না ফলে উঠতি বয়সী এসব ছেলেরা লাগামহীন হয়ে পড়ছে। খুব সম্ভব আজ সন্ধ্যায় দু’গ্রুপের মধ্যে এরকমই একটা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, ঘটনাস’লে একটা মোটর সাইকেল পড়েছিলো। পুলিশ সেই মোটর সাইকেল উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

আরমান সাহেবের বুক কেঁপে উঠলো, আমার ছেলের কিছু হয়নি তো।

ওসি সাহেব সান্ত্বনার সুরে বললেন, আপনি টেনশন করবেন না, আপনি একটা জি.ডি করুন। তারপর আমি দেখছি বলে ওসি সাহেব আবার কলিং বেল টিপ দিলেন।

স্যান্টি এসে স্যালুট দিলো, স্যার।

ওসি সাহেব আরমান সাহেবকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই ভদ্রলোককে ডিউটি অফিসারের কাছে নিয়ে যাও। একটা জি.ডি হবে।

আরমান সাহেব স্যান্ট্রির সঙ্গে চলে গেলো।

চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ওসি সাহেব হাসান ভাইয়ের মার্ডার কেসটার কী হলো?

তদন্ত চলছে লিডার, ভেরি সুন আমরা তদন্ত শেষ করতে পারবো।

চৌধুরী সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস মোচন করে বললো, একটা জলজ্যন্ত, ভদ্র মানুষ যার সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ নেই, কারো সঙ্গে মিনিমাম খারাপ সম্পর্ক নেই অথচ মার্ডার হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পর আরমান সাহেব এলো। চৌধুরী সাহেব চেয়ার থেকে উঠলেন।

আরমান সাহেব ওসি সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করতে করতে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, একটু চেষ্টা করুন প্লিজ!

 

পনেরো

 

ডনকে গ্রেফতারের বিষয়টি এখনো আরমান সাহেব, মিডিয়া সবার কাছে এখনো অপহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া আরমান সাহেবের বাসা সার্চ করে ডনের জুতো উদ্ধার করা পুলিশের জন্য একটু কঠিনই ছিলো কিন্তু আরমান সাহেব জি.ডি করায় ডনের জুতো উদ্ধার করা সহজ হলো। পুলিশ তদন্তের নাম করে আরমান সাহেবের বাসায় গেলো।

আরমান সাহেব পুলিশ দেখে খুব একটা অবাক হলো না, দরজা খুলে দিয়েই মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা?

ইব্রাহিম সাহেব বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

ও, ভিতরে আসুন প্লিজ!

ইব্রাহিম সাহেব সোফায় বসতে বসতে বললো, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? এই ধরুন ডনের ফ্রেন্ড বা আপনার কোনো ব্যবসায়ী প্রতিপক্ষ?

আমার কোনো ব্যবসায়ী প্রতিপক্ষ নেই। সাধারণত এখন এগুলো কেউ করে না। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ী প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করে ব্যবসায়িক কৌশলে, এগুলো গ্রামে-গঞ্জে হয়।

ওর কোনো ফ্রেন্ড?

আমি তো সারাদিন বাইরে থাকি। ওর মা জানলে জানতেও পারে বলে আরমান সাহেব বুবলিকে ডেকে বললো, বুবলি তোর আপাকে আসতে বলতো।

বুবলি দরজা সামান্য ফাঁক করে রিনিকে ডাক দিলো, আপা।

রিনি কিছুটা ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলো, কী?

পুলিশ দেখে বুবলি কিছুটা ভয় পেয়েছে, সে একটা ঢোক গিলে বললো, আপা বাসায় পুলিশ এসেছে।

পুলিশ! রিনিও কিছুটা অবাক হলো।

বুবলি বললো, আপা আপনাকে ডাকে।

রিনি কিছুটা ভয় পেলো আমাকে ডাকে, পুলিশ!

আপনাকে ডাকে ভাইয়া।

রিনি তার রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো।

ইব্রাহিম সাহেব আর আরমান তখন কথা বলছিলো। রিনি রুমে ঢুকে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালাইকুম, কোনো খবর পেলেন ভাই?

ওয়ালাইকুম আসসালাম, বলে ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, না, এখনো পাইনি আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বলে ইব্রাহিম সাহেব ভ্রু’কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা আপনি আমাকে একটা কথা বলুন, ডন কার কার সাথে মেলামেশা করতো বা বাসায় ডনের কোনো ফ্রেন্ডে যাতায়াত ছিলো কী না।

রিনি কান্না কান্না গলায় বললো, না, ও তো সারাদিন স্কুল বাসা আর ক্লাব নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।

ইব্রাহিম সাহেব আপনমনে ফিসফিস করে বললো, এই ক্লাবই তো সব সর্বনাশের গোড়া।

আরমান সাহেব বললো, কিছু বললেন?

এমন সময় একজন পুলিশ সদস্য হাতে একজোড়া জুতো নিয়ে এসে ইব্রাহিম সাহেবকে দেখালো, স্যার এই জুতোগুলো।

আরমান সাহেব জিজ্ঞেস করলো, কী এই জুতোগুলো?

ইব্রাহিম সাহেব বললো, কিছু না। এই জুতোগুলো আমরা নিয়ে যাচ্ছি। তদন্তের কাজে লাগবে।

আরমান সাহেব কিছুটা অবাক হলেন, মৃদু কণ্ঠে বললেন, তদন্তের কাজে এই জুতোগুলো লাগবে, অফিসার আপনারা কি কোনো ক্লু খুঁজে পেলেন?

পেয়েছি তো বটেই।

রিনি কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, আমার ছেলে বেঁচে আছে তো স্যার?

বেঁচে আছে, বেঁচে আছে। আপনারা কোনো টেনশন করবেন না।

আপনার ভালো করে খুঁজুন স্যার।

ইব্রাহিম সাহেব কিছুটা উদাস হয়ে বললো, একজন পলিটিশিয়ান নিহত হলো, একজন স্কুল পড়-য়া ছাত্র গুম হলো, পুলিশকে তো ভালোভাবে খুঁজতেই হবে। এই দুই ঘটনার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কী না তাও খুঁজতে হবে।

আরমান সাহেব আবার ইব্রাহিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলছেন অফিসার?

না।

আপনি কিছু গোপন করছেন না তো?

ইব্রাহিম সাহেব একটা রহস্যময় হাসি হেসে বললো, না। পুলিশের যতটুকু বলা দরকার ততটুকুই বলা যায়। কিছু মনে করবেন না। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঠিক সময়ে আপনাকে পুরো ঘটনার আপডেট দিবো।

ধন্যবাদ অফিসার।

রিনি আবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমার ছেলেকে তাড়াতাড়ি আমার কোলে এনে দিন স্যার। আপনি একবার একজন মায়ের আকুতি বোঝার চেষ্টা করুন।

ইব্রাহিম সাহেব তার সঙ্গীয় পুলিশ সদস্যকে ইশারা করলো, চলো।

মোন্তা আগেই মতলুবের উত্তরার একটা বাসার ঠিকানা বলেছে। মাইক্রোবাস উত্তরা পৌঁছানোর পর মুকিদ গুগল ম্যাপ অনুযায়ী মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে দিক নির্দেশ করছে আর ড্রাইভার সেভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। কয়েক মিনিট পর মাইক্রোবাস একটা বহুতল ভবনের নিচে এসে দাঁড়ালো।

মুকিদ মোন্তাকে জিজ্ঞেস করলো, এই বাসা?

মোন্তা বললো, আমি তো কোনোদিন আসিনি, শুধু ওর কাছে ঠিকানাটা শুনেছি।

আচ্ছা।

মুকিদ এবার ঠিকানাটা মিলিয়ে নিলো। বাসা এটাই, সেভেনথ ফ্লোর।

ইব্রাহিম সাহেব মোন্তাকে কীভাবে কাজ করতে হবে বুঝিয়ে দিলো তারপর পিস্তল বের করে মোন্তার মাথায় ঠেকিয়ে চাপাস্বরে বললো, যদি উল্টাপাল্টা করিস তবে…

মোন্তা কাঁপা কাঁপা স্বরে জানালো সে উল্টাপাল্টা করবে না।

মোন্তা বাসার কলিং বেল এ টিপ দিলো। কয়েকবার টিপ দেয়ার পর ভিতর থেকে মানুষ চলাচলের শব্দ পাওয়া গেলো।

মোন্তা দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে, সবাই আড়ালে এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেনো দরজা পুরোটা না খুললে দেখা না যায়। চলাচলের শব্দটা কাছাকাছি এগিয়ে এলো। মোন্তা আবার কলিং বেল টিপ দিলো।

ভিতর থেকে মতলুবের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, কে?

মতলুব ভাই আমি মোন্তা।

মোন্তা…মতলুবের জড়ানো কণ্ঠস্বর।

দরজা খোলো।

তুমি ঢাকা কেনো?

এলাম তোমার সঙ্গে কথা আছে।

তুমি একা নাকি আর কেউ আছে?

আমি একা দরজা খুলে দাও।

মতলুব দরজা খুলতেই মুকিদ আড়াল থেকে মতলুবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁত কড়মড় করে বললো, কোনো কথা বলবে না, চুপ বলে মতলুবকে টেনে হিঁচড়ে নিচে এনে গাড়িতে তুললো।

একটা গোডাউন আকৃতির ঘর, কোনো জানালা নেই। দরজায় মোটা লোহার গ্রিল। ডন দরজায় এসে লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো সামনে একটা সংকীর্ণ বারান্দা তারপর আবার একটা রুমের দেয়াল। না, আসলে ডন যেটা বারান্দা ভেবেছিলো সেটা বারান্দা না, কোরিডর। কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই, কোনো পায়ের শব্দও নেই। ডন মনে করার চেষ্টা করলো গতকাল রাতের কথা, হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। সে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো জোরে চিৎকার করবে কী না। না, সে চিৎকার করবে না। সে একবার পুরো ঘর ভালো করে তাকালো। না, কোনো উপায় নেই, নিশ্‌িছদ্র এক ঘর। সে লোহার দরজা খোলার জন্য ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো, দরজায় বড় একটা তালা লাগানো। তালাটা হাত দিয়ে ছেড়ে দিতেই একটু জোরে শব্দ হলো আর তখনই দৌড়ে এলো দু’জন লোক। ডন কিছু বলার আগেই তার মুখে টেপ লাগিয়ে দিলো। ডন একবার ধস্তাধস্তি করার চেষ্টা করতেই উঁচু, লম্বা, বলবান লোকটি ডনের কান বরাবর একটা থাপ্পড় মেরে চাপাস্বরে বললো, একটা কথা না, একেবারে চুপ।

একজনের হাতে ওয়ারলেস দেখে ডন বুঝতে পারলো সে এখন পুলিশের হাতে বন্দি। ওয়ারলেস হাতে লোকটি বিড়বিড় করে কী যেনো বললো। তারপর দু’জন ডনের দু’হাত দু’পাশে ধরে আরেকটা ঘরে নিয়ে গেলো। এই ঘরটি আরো ভয়ঙ্কর। ঘরে কিছু লাঠি সোটা, ছুরি, রশি, সিলিং থেকে ঝুলানো কয়েকটা ফ্যান হুক, দেয়ালে অনেকগুলো বৈদ্যুতিক পয়েন্ট এবং একটা বৈদ্যুতিক শক দেয়ার মেশিন, যা ডন সিনেমা নাটকে পুলিশ রিমান্ডে দেখেছে।

ঘরে ঢুকে ডন একবার চার পাশে চোখ বুলাতেই তার বুকটা কেঁপে উঠলো। সে ঘরে ঢোকার আগে থেকেই দু’জন পুলিশ অফিসার বসেছিলো। একজনের নেমপ্লেটে লেখা ছিলো আসলাম। তার বাহুতে দু’টা তারকা, তাকে সবাই স্যার, স্যার বলছে। পাশে একটা টেবিলে একটা ফাইল ছিলো, একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে ডনকে বসতে বলে আসলাম সাহেব তার মুখোমুখি বসলো।

ইব্রাহিম সাহেব একটা সুন্দর হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম তো আশরাফুল ইসলাম ডন?

জি।

বাবার নাম আরমান?

জি।

আচ্ছা ডন ঘটনার দিন, অর্থাৎ সাতই এপ্রিল তুমি কোথায় ছিলে বলতো?

ঘটনার দিন মানে? কোন ঘটনা? আমি তো স্কুল আর ক্লাব ঘর ছাড়া কোথাও যাই না।

মনে করে দেখো সাতই এপ্রিল, কথাটা ইব্রাহিম সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললো।

ডন কৃত্রিমভাবে মনে করার চেষ্টা করলো, তারপর বললো মনে পড়ছে না?

এবার ইব্রাহিম সাহেব গম্ভীর স্বরে বললো, ভালো করে মনে করার চেষ্টা করো।

ইব্রাহিম সাহেবের পাশে দাঁড়ানো লোকটি টেবিলের ওপর থাকা ব্যাগ থেকে ডনের মোটর সাইকেলের সিগনাল লাইটটা বের করে দেখিয়ে বললো, এটা তোমার মোটর সাইকেলের?

ডন সিগনাল লাইটটা দেখে বললো, চিনতে পারছি না।

ইব্রাহিম সাহেব এবার তার মোটর সাইকেলের পিছনের ছবি দেখিয়ে বললো, এটা তোমার মোটর সাইকেলের ছবি?

জি।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, দু’টা সিগনাল লাইট দু’রকম কেনো?

একটা হারিয়ে গেছে বলে আরেকটা কিনে লাগিয়েছি তাই কালার মেলেনি।

কোথায় হারিয়েছিলে মনে আছে?

না।

এটা হাসান সাহেব যেখানে খুন হয় সেখানে পাওয়া গেছে।

ডন চমকে উঠলো, হাসান সাহেব খুন! হাসান সাহেব খুনের সঙ্গে আমার কী রিলেশন?

তোমার কোনো রিলেশন নেই?

না, আমি স্টুডেন্ট। লেখাপড়া করি আর সময়-সুযোগ পেলে ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিই।

শুধু আড্ডা! বলে ইব্রাহিম সাহেব একটা তিরস্কারের হাসি হাসলো।

অফকোর্স। খুন খারাপির সঙ্গে আমার কী রিলেশন?

ইব্রাহিম সাহেব এবার একটা ব্যাগ থেকে ডনের জুতো জোড়া বের করে দেখালো, এগুলো কার জুতো?

ডনি খুব সহজভাবে বললো, আমি কীভাবে জানবো?

ইব্রাহিম সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললো, এগুলো তোমার জুতো।

বলতে পারবো না, আমার তো অনেক জুতো চিনে রাখতে পারি না। যেদিন যেটা প্রয়োজন হয় সেদিন সেটা পরি।

ইব্রাহিম সাহেব প্রচণ্ড রেগে বললো, পঞ্চাশ হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে, এই মোটর সাইকেল নিয়ে, এই জুতো পরে তুমি হাসান সাহেবকে খুন করেছো।

এই জুতো, এই মোটর সাইকেল দু’টোই আমার কিন্তু আমি কাউকে খুন করিনি। আমি আরমান সাহেবের ছেলে, আমার বাবার টাকা-পয়সারও অভাব নেই যে সামান্য পঞ্চাশ হাজার আমি টাকার জন্য মানুষ খুন করবো। আমি বাবার কাছে হাত পাতলেই পঞ্চাশ হাজার না, পাঁচ লাখ পর্যন্ত দিতে বাবা একটুও ভাববে না।

এবার ইব্রাহিম সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললো, তোমার সব কথা ঠিক আবার খুনটা যে তুমি করেছো সেটাও ঠিক। এখন সবকিছু বিড়বিড় করে বলে ফেলো ইননোসেন্ট বয়।

যে অপরাধ আমি করিনি সে অপরাধের কথা আমি বিড়বিড় করে বলবো কী করে। হাসান সাহেবকে আমি কেনো খুন করবো?

সেটা তো তুমিই ভালো জানো। তবে খুন যে তুমিই করেছো তার সব প্রমাণ এখন পুলিশের হাতে। তুমি ছেলেমানুষ ভালোয় ভালোয় সব বলে ফেলো নইলে বলে তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দেখিয়ে বললো, এরা তোমার শুধু মুখ থেকে নয় পেট থেকেও থেকে বের করবে।

ডন মাথা উঁচু করে তাকাতেই সেই লম্বা-চওড়া লোকটি দাঁত কড়মড় করলো। ডনের মনে পড়লো ঘরের মধ্যে তার কানে যে থাপ্পড় দিয়েছিলো সেকথা।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, তুমি ধনী মানুষের ছেলে, চাইলে তোমার বাবা তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতো, তুমি যে বন্ধুদের সেই টাকা থেকে পরদিন চাইনিজ খাইয়েছো তোমার বাবা তোমাকে সে টাকাও দিতো। অথচ তুমি কত বোকা পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য একটা মানুষকে খুন করে ফেললে।

পঞ্চাশ হাজার!

ইয়েস পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য তুমি হাসান সাহেবকে খুন করেছো। খুনটা করার কথা মোন্তার কিন্তু সে তোমাকে দিয়ে করিয়েছে। ঠিক না?

না।

ডন না বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই লম্বা-চওড়া লোকটি ডনের কানের কাছে একটা জোরে থাপ্পড় মারলো। ডনের মাথা চক্কর দিলো।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, হাসান সাহেবকে খুন করার পর তুমি এই নাম্বারে একটা মিস কল দিয়েছিলে। এটা কার নম্বর জানো?

ডনি না সূচক মাথা নাড়লো।

এটা যার নম্বর সে প্রবাসী। মোন্তা সেদিন এই নম্বর ব্যবহার করে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। মোন্তা খুব কৌশলে কাজটা তোমাকে দিয়ে করিয়েছে। অথচ দেখো সেই মোন্তাও এখন পুলিশ হেফাজতে, তুমি যদি স্বীকার না করো তবে তোমাকে মোন্তার মুখোমুখি করে প্রমাণ করা হবে যে খুনটা তুমিই করেছো।

ডন কোনো কথা বললো না।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, তুমি বয়সে ছোট, তুমি যদি সবকিছু সহজভাবে বলো তবে পুলিশ তোমার সাজা কমাতে সাহায্য করবে আর যদি পুলিশকে সহযোগিতা না করো তবে পুলিশ তার কৌশল অবলম্বন করে প্রমাণ করবে যে তুমি হাসান সাহেবের খুনি এবং তোমার ফাঁসি হবে।

ডন তবুও কিছু বললো না।

ইব্রাহিম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে কর্কশ স্বরে বললো, আসাদ, মুন্না এই বেটা প্রফেশনাল কিলারদের মতো আচরণ করছে, এতো অল্প বয়সে, এতো ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা আমি আগে দেখিনি। আমরা এই বয়সে পুলিশ দেখলে ভয় পেতাম আর একজন পুলিশ অফিসারে সামনে এতো অল্প বয়সের ছেলে অপরাধ করার পরও কীভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছে, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয় বা জড়তা নেই। তোমরা ডনের মুখ থেকে কথা বের করার ব্যবস্থা করো।

ইব্রাহিম সাহেব আসাদ, মুন্না বলে যাদের বললো তারা তার আশেপাশের লোকরাই। আসাদ এবং মুন্না ডনের হাত দু’টোতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পিঠ মোড়া করে চেয়ারের সঙ্গে শক্তভাবে বেঁধে ফেললো, মুখে টেপ লাগিয়ে দিলো।

 

ষোলো

 

কানকাটা মোন্তা অনেক পেশাদার অপরাধী। তার মুখ থেকে কথা বের করা সহজ কাজ নয়। সে জীবনে এমন অসংখ্য রিমান্ডের মুখোমুখি হয়েছে। কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য লুকাতে হয়, কীভাবে বিভ্রান্ত করতে হয়ে, কীভাবে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা যায় এসব তার জানা আছে।

সে বার বার একই কথা বলছে সে কিচ্ছু জানে না। সে কয়েক বছর আগে খুন-খারাপি ছেড়ে দিয়েছে। ইব্রাহিম সাহেব ডনের জবানবন্দির কপি দেখিয়ে বললো, ডন ওয়ান ছিঙটি ওয়ানে জবানবন্দী দিয়েছে।

মোন্তা বললো, ডন কে?

ডন কে তাই জানো না? যাকে তুমি হাসান সাহেবকে খুন করার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকায় কন্ট্রাক্ট করেছিলে। খুনের পর যে তোমাকে একটা মিস কল দেয় এই নম্বর থেকে বলে ইব্রাহিম সাহেব ডনের মোবাইল নম্বরটা দেখালো।

মোন্তা বললো, এই নম্বর তো আমি চিনি না। আপনারা দেখুন আমার মোবাইলে নম্বরটা সেভ করা আছে নাকি?

তা তো থাকবে না মোন্তা। তুমি খুব চালাক, ডনের নম্বরটা পর্যন্ত সেভ করে রাখোনি। তবে একটা ভুল তুমি করেছো। ডন মিশন সাকসেসফুল হওয়ার পর তার নম্বর থেকে তোমার ভায়রা ভাইয়ের নাম্বারে একটা মিস কল দিয়েছিলো। সবই ঠিক ছিলো কিন্তু ঐ যে একটা কথা বলে খুনিরা কোনো না কোনো সাক্ষী রাখবেই তেমনি তুমিও নিজের অজান্তে সেই নম্বর থেকে আবার রিতুকে ফোন করেছিলে। কী ভেবেছিলে তোমার ভায়রা ভাই বিদেশে থাকে তাই তোমাকে কেউ বুঝতে পারবে না। আড়াল থেকে তুমি অনেক কলকাঠি নেড়েছো। এবার যা সত্যি তাই বলো।

মোন্তা কোনো কথা বললো না।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, তোমার বউ রিতুও ওয়ান সিঙটি ওয়ানে স্ট্যাটমেন্ট দিয়েছে, ওয়ান সিঙটি ফোরেও স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজি হয়েছে। তুমি যদি বাঁচতে চাও তবে গড়গড় করে প্রকৃত ঘটনা বলো। পিছনে আর কার কার হাত আছে তাও বলো আর যদি না বলো তবে বলে ইব্রাহিম সাহেব মুকিদ আর তার সঙ্গে থাকা ফোর্সদের দেখিয়ে বললো, মুকিদ আই এ্যাম সো টায়ার্ড, কীভাবে কথা বের করতে হয় তোমরা করো আমি গেলাম।

মোন্তার দু’হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পিছনে চেয়ারের হেলানের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। এতক্ষণ মোন্তার মুখ খোলাই ছিলো। ইব্রাহিম সাহেব বেরিয়ে যাবার পর মুকিদ একটা লাঠি হাতে নিলো তারপর লাঠি দিয়ে মোন্তার থুঁতনি উঁচু করে বললো, মোন্তা বলবি নাকি…

মোন্তা কিছু বললো না।

মুকিদ মোন্তার পায়ে জোরে জোরে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো। মোন্তা চেয়ারে ছটফট করছে, জোরে চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু তার মুখ টেপ দিয়ে আটকানো। মোন্তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সে করুণ দৃষ্টিতে মুকিদের মুখের দিকে তাকালো। মুকিদ লাঠি দিয়ে মোন্তার থুঁতনি উঁচু করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, কী বলবি নাকি বলে তার পাশে থাকা অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললো, ওদের দিয়ে পিটাতে হবে?

মোন্তা তবুও কিছু বললো না।

এবার মুকিদ লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিরক্তির সুরে বললো, আমি আর পারলাম না। তারপর তার সাথে থাকা দু’জন কনস্টেবলকে বললো, তোমরা দেখো ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারো কী না। বেটা একেবারে প্রফেশনাল ক্রিমিনাল।

মুকিদের পাশে থাকা একজন পুলিশ সদস্য স্যালফ থেকে ইলেকট্রিক শক দেয়ার যন্ত্রপাতি বের করে একটা পয়েন্টে লাগিয়ে দিয়ে মোন্তাকে শক দিতেই সে প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করলো। তার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

মুকিদ নিজেই মোন্তার মুখ থেকে টেপ খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বলবি? এখনো কিন্তু আসল থেরাপি শুরু হয়নি। তুই তো প্রফেশনাল ক্রিমিনাল, জানিস এরপর কোন থেরাপি শুরু হবে। বলে ফেল কার নির্দেশে হাসান সাহেবকে খুন করেছিস?

আমি খুন করিনি।

তুই করিসনি, ডনকে দিয়ে করিয়েছিস তো। নির্দেশটা কার ছিলো?

আমাকে কেউ নির্দেশ দেয়নি।

তো।

ডনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে খুন করিয়েছিস। তুই তো লাভ করেছিস, আমাদেরও কিছু দে?

কত দিলে আপনারা আমাকে ছেড়ে দিবেন?

মুকিদ হা হা হা করে হেসে উঠলো তারপর বলতে শুরু করলো, তোর লাভ থেকে অর্ধেক দে। বেশি চাইলে তো আবার তোর লস হয়ে যাবে।

মোন্তা কোনো কথা বললো না।

মুকিদ আবার বলতে শুরু করলো, পাঁচ লাখ দিবি?

মোন্তা মাথা নেড়ে জানালো সে পাঁচ লাখ দিবে।

মুকিদ আবার হেসে উঠলো, তার মানে দশ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট। থাক তোকে টাকা দিতে হবে না। এবার বল টাকাটা কে দিলো?

মোন্তা কিছু বললো না।

তোকে সেটাও বলতে হবে না। পুলিশ সব উদ্ধার করেছে। মোবা এবং মতলুবের সঙ্গে তোর মোবাইলে কথাবার্তা এবং কল রেকর্ড সব এখন আমাদের হাতে।

মোন্তা তবুও মুখ খুলছে না। তার মুখে টেপ পেঁচিয়ে আবারও ইলেকট্রিক শক দেয়া হলো, সে গোঙ্গাতে লাগলো, মুকিদ আবার তার মুখের টেপ খুলে দিলো। এমন সময় মুকিদের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইব্রাহিম সাহেব ফোন করেছে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিছু জানতে পারলে?

না স্যার, বেটা মুখ খুলছে না।

ওকে বলো সে যদি ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজি হয় তবে প্রাণে বাঁচবে আর সে যদি সহযোগিতা না করে তবে ক্রসফায়ারে দেয়ার ভয় দেখাও।

ওকে স্যার।

মুকিদ আবার ঘরে এসে ঢুকলো। একটা পা মোন্তার উরুর ওপর দিয়ে বললো, মোন্তা, এখনো বলছি ঠিক ঠিক বল। ডন স্বীকার করেছে, তোর বউ স্বীকার করেছে, তোর বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। তুই যদি পুলিশকে সহযোগিতা করিস তবে বাঁচবি নইলে প্রাণে বাঁচবি না। স্যার আমাকে ফোন করে সেটাই বললো।

মোন্তা একবার করুণ দৃষ্টিতে মুকিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনারা আমাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক স্ট্যাটমেন্ট নিতে চান।

জোর করবো কেনো? তোমার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ তো এখন আমাদের হাতে।

তাহলে আপনারা কোর্টে প্রমাণ করবেন আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ।

মুকিদ তার হাতের লাঠিটা দিয়ে মোন্তার থুতনি উঁচু করে বললো, পুলিশকে তুই এতো বোকা মনে করিস। হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে পরে কোর্টে প্রমাণের চেষ্টা করবো।

তা করবেন কেনো? আপনারা ডন না কোন ছেলেকে পিটিয়ে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে একটা স্ট্যাটমেন্ট আদায় করবেন আর সেটা দেখিয়ে আমার কাছ থেকেও জোর করে ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট নিবেন। এটা কোনো সুবিচার হলো?

মুকিদ হা হা করে হেসে উঠলো, তুমি সুবিচার আশা করো।

অবশ্যই। যত বড় অপরাধীই হোক সুবিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। আর আমি তো একজন নিরপরাধ মানুষ। বলতে পারেন আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।

তুমি রাজনীতি করো নাকি?

অবশ্যই। রাজনীতি করি বলেই তো আপনারা আমার প্রতিপক্ষ গ্রুপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমার ওপর নির্যাতন করছেন।

আচ্ছা তুই রাজনীতি কর আর না কর, খুন করেছিস এটা সত্যি এখন বল, তোকে কে টাকা দিয়েছে?

আমাকে কেউ টাকা দেয়নি।

এবার মুকিদ একরকম গর্জে উঠলো, তুই বলবি নাকি আবার…বলে মুকিদ আবার তার সঙ্গের দু’জন কনস্টেবলকে ইলেকট্রিক শক দেয়ার জন্য ইশারা করলো।

মোন্তাকে আরো কয়েকবার ইলেকট্রিক শক দেয়া হলো। সে প্রচণ্ড চিৎকার করলো কিন্তু মুখে টেপ দেয়ার কারণে তার চিৎকারের শব্দ বের হলো না। সে শুধু হাত-পা ছুঁড়োছুঁড়ি করলো এবং বলবে বলে ইশারা করলো।

মুকিদ হাতের ইশারা করতেই ইলেকট্রিক শকের সুইচ বন্ধ করা হলো। মুকিদ মোন্তার উরুর ওপর পা উঠিয়ে দিয়ে বললো, মোন্তা, কেবল শুরু হয়েছে এর শেষ কোথায় জানিস?

মোন্তা ফ্যালফ্যাল করে মুকিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ভেবে দেখ। তুই তো প্রফেশনাল কিলার, সহজে না বললে তোর কী অবস্থা হবে তা তুই নিশ্চয়ই… বলে মুকিদ কোমর থেকে পিস্তল বের করে মোন্তার মাথায় তাক করে বললো, সেই পুরানা নাটক, পুলিশের সাথে মোন্তার সহযোগীদের গুলিবিনিময়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়, পুলিশের গুলিতে ভয়ঙ্কর অপরাধী, অসংখ্য মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, কানকাটা মোন্তা নিহত। মোন্তা নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে।

মোন্তা একটা ঢোক গিললো।

মুকিদ জোরে মোন্তার গলা চেপে ধরলো, তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হলো। মোন্তা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, বুঝছি আপনারা আমাকে ক্রসফায়ারে দিবেন।

এই তো তোর মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। এখনো বলছি বল।

মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কাজ হয়েছে। লাঠির আঘাত আর ইলেকট্রিক শক খেয়ে মোন্তা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে মুখ থেকে বের হলো, লিডার।

কত টাকা দিয়েছে?

পাঁচ লাখ। আমি প্রথমে কাজটা করতে চাইনি।

করলি কেনো?

প্রথমে মতলুব ভাই বলেছিলো কিন্তু আমি রাজি হইনি দেখে লিডার নিজে ডেকে বললো।

কী বললো?

বললো, এটাই শেষ কাজ। লিডারের শেষ ইচ্ছা কাউন্সিলর হওয়ার আর হাসান সাহেব যদি নমিনেশন পায় তবে তার আর কাউন্সিলর হওয়া হবে না।

আমি তবুও রাজি হইনি।

লিডার বললো, তুই না পারিস কাউকে দিয়ে করবি। পাঁচ লাখ তো কম টাকা না।

ভাবলাম ঠিকই তো পাঁচ লাখ অনেক টাকা। আমার হাতেও তেমন কাজকর্ম নেই। তাই কাজটা হাতে নিলাম। লিডার বলেছে যেকোনো ঝুঁক্কি-ঝামেলা লিডারই সামলাবে।

মুকিদ হো হো করে হেসে উঠলো, লিডার সামলাবে? তোর লিডারটা কে রে?

মোবা কাউন্সিলর।

টাকাটা কীভাবে দিলো? কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে?

না, ক্যাশ। মতলুব ভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ওকে। যেভাবে বললি সেভাবে স্ট্যাটমেন্ট দিবি, যদি উল্টা-পাল্টা করিস তবে তো বুঝতেই পাচ্ছিস আবার রিমান্ডে এনে বলে মুকিদ ইশারা ইঙ্গিতে বুঝালো ক্রসফায়ার।

 

সতেরো

 

ডি.বি গ্যাং এর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ডন অপহরণ এবং হিটলার গ্রেফতার হওয়ার পর কিশোরও আসা বন্ধ করে দিলো। যারা ডনের খুব কাছের এবং নেতৃস্থানীয় ছিলো তারা মোবাইল ফোনে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে গ্রুপকে সংগঠিত করার চেষ্টা করলো কিন্তু ডন এবং হিটলার দু’জনকে ছাড়া আসলে গ্রুপ আর সংগঠিত হলো না। বলতে গেলে ডি.বি.গ্যাং এর অস্তিত্ব বিলীন হলো।

শহরের অন্যান্য গ্যাংগুলো ডি.বি গ্যাং এর এই দুর্বলতার সুযোগ নিলো। উত্তর দিকের মহল্লা কিশোর গ্যাংটির নাম ছিলো নর্থ সাউথ গ্যাং, তারা সুযোগ বুঝে ডি.বি গ্যাং এর এলাকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করলো। রাতারাতি দেয়াল লিখন বদলে গেলো। বড় বড় দেয়ালগুলোতে লেখা হলো নর্থ সাউথ গ্যাং। এলাকা হাতছাড়া হওয়ায় ডি. বি গ্যাং এর সদস্যদেরও চোখে পড়েছে কিন্তু ডন ছিলো উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে তার টাকা-পয়সার অভাব ছিলো না। কখনো কখনো কোনো টাকা না পেলে নিজের টাকায় গ্যাং এর সদস্যদের পেছনে টাকা ছিটাতো, তাদের ক’দিন পরপরই চাইনিজ খাওয়াতো, পিকনিকে নিয়ে যেতো কিন্তু বিচ্ছিন্ন সদস্যদের মধ্যে তেমন কেউ ছিলো না আবার তাদের নিজেদের মধ্যে তেমন নেতৃত্বও গড়ে উঠেনি। কিছু সদস্য ছিলো একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের যারা কিছু পাওয়ার আশায় গ্যাং এর সদস্য হয়েছিলো তারা খৈ ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনি খৈয়ের অভাব হলে কাককে ধরে রাখাও যায় না। গ্রুপের এসব সুবিধাভোগী সদস্য কেউ কেটে পড়লো কেউ নর্থ সাউথ গ্রুপে যোগ দিলো।

দেয়াল লিখনের এই পরিবর্তনটা পুলিশের চোখ এড়িয়ে গেলো না। কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে ভিতরে ভিতরে যে একটা প্রতিযোগিতা আছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ পুরো শহরের কিশোর গ্যাংগুলোর এই প্রতিযোগিতা এবং অপরাধপ্রবণ কিশোরদের লেখাপড়ামুখী করতে মাঠে নামলো। তালিকা করলো কিশোর গ্যাংগুলোর, তাদের সদস্যদের নাম-ঠিকানা এবং পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান। গোয়েন্দা কর্মকর্তার চোখ কপালে উঠলো, এ কী অবস্থা? এই উঠতি বয়সের ছেলেরা ক্লাবের নামে গ্যাং তৈরি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, সিন্ডিকেট ব্যবসা, চাঁদাবাজি কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই! যাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা, কলম-জ্যামিতি বঙ তাদের হাতে অস্ত্র, জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা এখন অর্থেরও নেশায় আসক্ত।

কিশোর সংগঠনগুলোর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়লো।

সেদিন নর্থ সাউথ গ্যাং এর ক্লাব ঘরে আড্ডা চলছিলো। এই গ্রুপের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্টকে সবাই বস বলে সম্বোধন করে। গ্যাং এর নিয়ম হলো বস যখন যাকে যে কাজ করতে আদেশ দিবে তাকে সে কাজ করতে বাধ্য থাকতে হবে। আর তা না করলে আছে চড় থাপ্পড় কিংবা আরো বেশি শাস্তি কিন্তু ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।

গ্যাং এ লুকিয়ে লুকিয়ে টুকটাক নেশা করা, এই যেমন : নেশা হিসেবে ফেন্সিডিল, গাঁজা, হিরোইনের টুকটাক অভ্যাস থাকা ওপেন সিক্রেট। বিদ্রোহ রহমান নামে এক কিশোর এই দলের সদস্য। কয়েকদিন আগে বস তাকে পাঠাতে চেয়েছিলো ফেন্সিডিল দু’বোতল আনতে। সে অপরাগতা প্রকাশ করলো আর তার ওপর শুরু হলো নির্যাতন। প্রথমে চড়-থাপ্পড় এবং পরে সবার সামনে কান ধরে উঠবস।

লজ্জায় আর ক্ষোভে সে কয়েকদিন ক্লাবে আসেনি। কিন্তু কোনো উপায় নেই, বস তাকে ফোন করে ডেকে আনল, তাকে ভয়-ভীতি দেখালো, বিদ্রোহ তুমি কি ভেবেছো ক্লাবে না এসে তুমি বাঁচবে, এখন তুমি ক্লাবের সবকিছু জানো, এখন তুমি বেরিয়ে যাওয়া সবার জন্যই রিস্ক।

বিদ্রোহ জোর গলায় বললো, এটা কেমন নিয়ম আমি না আসতে চাইলেও আমাকে আসতে হবে? আমি কি চাকরি করি নাকি?

বিদ্রোহ রহমানের থুঁতনি ধরে উঁচু করে বস তার মোবাইল ফোনে বিদ্রোহ রহমানের একটা ছবি দেখালো। দেখে বিদ্রোহ তো অবাক। এই ক্লাবে যখন সে প্রথম প্রথম আসতো তখন একদিন সে সখের বশে একবার গাঁজায় টানা দিয়েছিলো, বস সেই ছবি ভিডিও করে রেখেছে। ছবিটা দেখে বিদ্রোহ চমকে উঠলো। বস এতো নোংরা কাজ করতে পারে! নিজের গাঁজা টানার ছবি দেখে বিদ্রোহ রহমানের বিদ্রোহের আগুন ক্ষণিকেই নিভে গেলো।

ঘটনাটা কোনোভাবে গোয়েন্দাদের কান পর্যন্ত এসেছিল আর তাই গোয়েন্দারা সোর্সের কাজে লাগিয়েছিল বিদ্রোহকে। বিদ্রোহকে আশ্বস’ করা হয়েছিলো গোয়েন্দাদের সহযোগিতা করার জন্য তার কোনো শাস্তি হবে না। তার অপরাধ মাফ করা হবে।

নর্থ সাউথ গ্যাং এর ক্লাব ঘরে আড্ডা চলছে। কেউ তাস খেলছে, কেউ কেরাম বোর্ড খেলছে, কেউ ফেসবুকে চ্যাটিং করছে। কেউ পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে গাঁজা অথবা ফেন্সিডিলের নেশায় বুঁদ হয়ে আবোল-তাবোল বকছে।

বস একটা ছেলেকে ডেকে বললো, কমপ্লিট।

ছেলেটি বেশ জোরালো গলায় বললো, জি বস।

থ্যাংক ইউ।

বস এর ডান পাশে বসে আছে ইমরান, ইমরান নর্থ সাউথ গ্যাং এর সেকেন্ড ইন কমান্ড বলা যায়। বসকে কথা বলতে দেখে ইমরান জিজ্ঞেস করলো, কী?

বস বললো, ডি.বি গ্যাং এর পুরো এলাকা এখন আমাদের কব্জায়।

ইমরান বললো, তাহলে আজ একটা স্প্যাশাল পার্টি দাও।

দিবো?

ইমরান বললো, অবশ্যই।

বস একজনকে ডেকে তার মোটর সাইকেলের চাবি দিয়ে বললো, যা, সবার জন্য।

ছেলেটি একবার পুরো ঘর চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর মোটর সাইকেলের চাবি নিয়ে সঙ্গে আরো একজনকে নিয়ে চলে গেলো।

ক্লাব ঘরে স্প্যাশাল আড্ডা পার্টি হয়, পার্টিতে সেদিন বস তার টাকায় গাঁজা, ফেন্সিডিল খাওয়ায়। তাছাড়া অন্যান্য দিনের খাওয়া নিজেদের টাকায় কিনে খেতে হয়। স্প্যাশাল আড্ডার কথা শুনে কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ঘর জুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো। গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বিদ্রোহের যোগাযোগ ছিলো। সে ক্লাবে এসে স্প্যাশাল আড্ডার খবর শুনে গোয়েন্দা পুলিশের অফিসারকে ম্যাসেজ দিলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটি ফিরে এলো। তার সঙ্গে পিছনে বসা ছেলেটির হাতে একটা ব্যাগ। ছেলেটি ব্যাগ নিয়ে একে একে সবার কাছে গেলো এবং যার যার পছন্দমতো গাঁজা অথবা ফেন্সিডিল সরবরাহ করলো।

প্রায় সবাই কোনো না কোনো নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ জোরে জোরে কাশছে, কাশতে কাশতে বমি করছে, কারো ফেন্সিডিলের নেশায় চোখ ঢুলতে শুরু করছে।

গোয়েন্দা পুলিশের দলটি ঘরটি আগেই দেখে গেছে। তাদের জানা আছে যে ঘরে দুটো দরজা। গোয়েন্দা পুলিশের দলটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে কয়েকজন পিছনের দরজা গিয়ে দাঁড়ালো এবং কয়েকজন সামনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো।

গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মোক্তার সাহেব জোরে চিৎকার করে বললো, স্টপ। কী হচ্ছে এখানে? আ্যরেস্ট করো সবাইকে।

বস এবং ইমরান পুলিশের উপসি’তি টের পেয়ে পিছনের দরজা দিয়ে দ্রুত পালানোর জন্য চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ পালাতে পারলো না।

অনেকেই নেশার মধ্যে আবোল-তাবোল কথা বলতে শুরু করলো, পুলিশ, কী করবে পুলিশ? আমরা কী করছি? বন্ধুরা একটু মাস্তি করছি।

গোয়েন্দা পুলিশ থানা পুলিশকে ফোন করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সদর থানা পুলিশের একটি পিক আপ ভ্যান এসে সবাইকে থানায় নিয়ে গেলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে নর্থ সাউথ গ্যাং এর সদস্যদের আ্যরেস্ট হওয়ার খবরটি পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়লো। শহরের বেশিরভাগ বিত্তবান লোক থানায় ভিড় জমালো। নিজেদের ছেলেদের থানা হাজতে দেখে অনুতাপ করলো, অনেকেই তাদের ছেলেদের বন্ধুদের দোষারোপ করলো, কেউ কেউ পুলিশের ওপর দোষ দিতেও বাদ রাখলো না।

দলের নেতাকর্মীরা তার স্মরণাপন্ন হয়েছেন বলে মুকুল চৌধুরীও এলেন। তার সঙ্গে শহরের অনেক পরিচিত স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ, বনেদি ব্যবসায়ী এবং কয়েকজন সরকারি চাকুরিজীবীও এসেছেন। যাদের সঙ্গে কথা বলতে ওসি সাহেব বিব্রতবোধ করছেন।

ওসি সাহেবের চেম্বার ভরে গেছে এসব গন্যমাণ্য ব্যক্তির আগমনে। তিনি কথা বলছিলেন মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে। চৌধুরী সাহেব বলছেন, দেখুন ওসি সাহেব আসলে আমি নিজেও লজ্জিত যে আমাদের সন্তানরা এমন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ক’দিন আগে আরমানের ছেলে অপহরণ হলো, এখনো সে নিখোঁজ। এর মধ্যে আবার নতুন করে…

সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে লিডার। একদিন আপনাকে বলেছিলাম আজকাল সন্তানের বাবারা থাকে শুধু টাকা রোজগারের নেশায়, মায়েরা থাকে রূপচর্চা আর টি.ভি সিরিয়াল নিয়ে, সন্তানদের প্রাইভেট কোচিং দিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করেন। সারাদিন সন্তান কোথায় গেলো, কার সাথে মিশলো গার্জিয়ানরা কিছুই খেয়াল করেন না। এগিকে সন্তানরা কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে, মাদকাসক্ত হচ্ছে, মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

ওসি সাহেবের সামনে বসা অভিভাবকরা মাথা নিচু করে বসে আছেন।

চৌধুরী সাহেব অনুরোধের সুরে বললেন, দেখুন, সবাই উঠতি বয়সের ছেলে এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের। আমি মনে করি আপনি একটা মুচলেকা নিন যে ভবিষ্যতে তাদের ছেলেরা আর এরকম কাজে জড়াবে না।

আমরা চাইলেই সবকিছু করতে পারি না লিডার। কারণ এটা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কেস।

ওসি সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, কিশোর গ্যাংগুলোর বেশিরভাগ কিশোরের বাবা-মা’ই শিক্ষিত, সচেতন, স্বনামধন্য ব্যক্তি। আপনারা তো নিজেদের মেধা, অর্থ, শ্রম সবই বিনিয়োগ করছেন নিজেদের উন্নতির জন্য, করেছেনও কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আপনারা যদি সন্তানদের সময় না দেন, তাদের লেখাপড়া, চলাফেরার দিকে লক্ষ্য না রাখেন তবে আপনাদের উন্নতি স্থায়ী হবে না। হয়তো কথাটা আপনাদের কাছে হার্টলেস বলে মনে হবে তবুও আমার অভিজ্ঞতা বলে সন্তানের চেয়ে ভালো বিনিয়োগ আর নেই। আপনার সুসন্তান আপনার মুখ উজ্জ্বল করবে, দুঃসময়ে আপনার এবং জাতির পাশে দাঁড়াবে।

ওসি সাহেবের সামনে বসা অভিভাবকগণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

চৌধুরী সাহেব নিরবতা ভঙ্গ করার জন্য বললেন, ওসি সাহেব সমাজকর্মী হলে ভালো করতেন।

ওসি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।

চৌধুরী সাহেব বললেন, ওসি সাহেব আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি বিষয়টা এস.পি সাহেবের সঙ্গে আলাপ করি। হাজার হলেও সবাই স্কুলের ছাত্র। এই বয়সে যদি কিছু একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যায় তবে শুরুতেই জীবনের ওপর একটা দাগ পড়ে যাবে।

 

আঠারো

 

ডন ওয়ান সিঙটি ওয়ানে স্ট্যাটমেন্ট দেয়নি এবং ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজিও হয়নি, পুলিশ তার কাছ থেকে কথা উদ্ধারের জন্য এই কৌশলের অবলম্বন করেছে। আর মোন্তাও পুলিশের সেই ফাঁদে পা দিয়ে ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজি হয়েছে।

ইব্রাহিম সাহেব ডনের কাছে গেলো। ডনের হাত তখনো হ্যান্ডকাফ পরানো, পিঠমোড়া করে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা, চোখে কালো কাপড়।

ইব্রাহিম সাহেব ডনের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললো, ডন সবকিছু তো ক্লিয়ার, মোন্তা ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজি হয়েছে। ও তোমার সঙ্গে ওর সব কন্ট্রাক্টের কথা বলেছে। তোমার আর কোনোকিছু অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন তুমি ওয়ান সিঙটি ফোরে স্ট্যাটমেন্ট দিতে রাজি হও তবে আগামীকাল তোমাকে কোর্টে চালান করে দিই, আর নয়তো রিমান্ডের পরবর্তী থেরাপি শুরু করি, বলে ইব্রাহিম সাহেব আসাদ আর মুন্নাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কী বলো?

জি স্যার।

আচ্ছা তার আগে আরেকবার চেষ্টা করো। মোন্তাকে এখানে নিয়ে এসো।

মুন্না আর আসাদ চলে গেলো, কয়েকমিনিট পর মোন্তাকে দু’পাশ থেকে দু’জন ধরে নিয়ে এলো। মোন্তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মোন্তাকে ডনের মুখোমুখি বসানো হলো তারপর ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, মোন্তা একে তুমি চেনো?

জি স্যার।

নাম কি এই ছেলেটার?

ডন।

হাসান সাহেবকে খুন করার জন্য তুমি এই ছেলেটাকেই টাকা দিয়েছিলে না?

জি স্যার।

ডন চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু তার মুখে টেপ লাগানো আছে দেখে চিৎকার করতে পারলো না, হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করলো। ইব্রাহিম সাহেব বললো, মুন্না ডনের মুখের টেপটা খুলে দাও, চোখের কাপড় খুলে দাও।

ডন চোখ মেলে দেখলো, মোন্তা। ইব্রাহিম সাহেব যে বলেছিলো দু’জনকে মুখোমুখি করবে সেই মোন্তা। তার বুক কেঁপে উঠলো, আর বুঝি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও সে অস্বীকার করলো, কে আপনি? এভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন?

ইব্রাহিম সাহেব মোন্তাকে ইশারা করলো, বলো কীভাবে মিশন সাকসেসফুল করলে দু’জনে সে গল্পই করো। আমরাও একটু শুনি। বলো মোন্তা ডনকে কত টাকা দিলে?

মোন্তা বললো, পঞ্চাশ হাজার।

ডন প্রতিবাদ করলো, ও মিথ্যা কথা বলছে স্যার। ও মিথ্যা কথা বলছে, আমি ওকে চিনি না।

ইব্রাহিম সাহেব গর্জন করে উঠলো, চুপ ক্রিমিনাল, সবাই মিথ্যা কথা বলছে আর তুমি শুধু সত্য কথা বলছো। মোন্তার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে তুমি সেদিন ডি.বি.গ্যাংয়ের সদস্যদের চাইনিজ খাইয়েছিলে।

আমার গ্রুপের সদস্যদের তো এমনিতেও আমি মাঝে মাঝে খাওয়া দিই, আমার বাবার টাকায়।

বাবার টাকায়, না, বাবার টাকায় গ্রুপের ছেলেদের খাওয়াও কথাটা মুখ বিকৃত করে বলে ইব্রাহিম সাহেব মুন্নাকে ইশারা করলো, একে নিয়ে যাও, আর ওটাকে নিয়ে এসো।

আসাদ আর মুন্না মোন্তাকে নিয়ে গেলো কয়েকমিনিট পর হিটলারকে নিয়ে এলো। এবার ডনের আর অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকলো না।

মুন্না হিটলারকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে ডনের মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো, বস।

ইব্রাহিম সাহেব হিটলারকে বললো, হিটলার বলো তো সেদিন কী হয়েছিলো।

হিটলার আর ডনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, ডন ভেবেছিলো, হিটলার তাকে বাঁচানোর জন্য একটু হলেও কৌশলী হবে কিন্তু হিটলার সত্য ঘটনা হুবহু বললো, একটুও এদিক-সেদিক করলো না।

হিটলার বলতে শুরু করলো, সেদিন সন্ধ্যায় আমি ক্লাবে এলাম, ডন বললো, চল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?

বললো, এতো কিছু বলার সময় নেই, আগে চল একটা অপারেশন আছে।

আমি ভাবলাম, কোথাও বুঝি কোনো গণ্ডগোল বেঁধেছে।

শহর থেকে কিছুটা দূরে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। একটা গাড়ি এলো, গাড়ি থামিয়ে ডন লোকটার বুকে গুলি করলো।

আমি তখনো জানতাম না লোকটা আসলে কে, আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। আসলে ডন যদি আগে আমাকে বলতো তবে আমি ওর সঙ্গে সেদিন যেতাম না। আমার কোনো দোষ নেই স্যার, আমার কোনো দোষ নেই। যত দোষ ডনের কথাগুলো বলে হিটলার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

হিটলার যখন কথা বলছিলো ডন তখন মাথা নিচু করে বসেছিলো।

এবার ইব্রাহিম সাহেব তার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে ডনের মাথা থুঁতনি উঁচু করে বললো, এবার কী বলবে ডন?

ডন আর নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না, সে কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি মেরেছি, আমি মেরেছি হাসান সাহেবকে।

ইব্রাহিম সাহেব তিরস্কারের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, সামান্য পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য তোমার মতো একজন বিত্তবান লোকের ছেলে হয়ে একটা খুন করেছো, তুমি নিজেই তো বললে, চাইলে তোমার বাবা তোমাকে পঞ্চাশ হাজার না, পাঁচ লাখ টাকা দিতো। তাহলে কেনো শুধু পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য…

ডন ইব্রাহিম সাহেবের কথার মাঝে বলতে শুরু করলো, না, শুধু টাকার জন্য না। হাসান সাহেব নর্থ সাউথ গ্রুপকে সেল্টার দিতো। আর নর্থ সাউথ গ্রুপের মাথার ওপর হাসান সাহেবের আশীর্বাদ আছে বলে তারা আমাদের এলাকায় আমাদের রাজত্বে হানা দিতো। যেকোনো একটা কাজে ডি.বি.গ্যাং হাত দিলেই নর্থ সাউথ গ্রুপ সেখানে বাগড়া দিতো।

সেজন্যই…

হ্যাঁ সেজন্যই মোন্তা যখন বললো এবং পঞ্চাশ হাজার টাকাও দিতেই চাইলো, তাছাড়া মোন্তা বলেছিলো মিশন সফল হওয়ার পর সে আমাকে মোবা কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যাবে। তার সঙ্গে পরিচয় করে দিবে। বলেছিলো এ লাইনে বড় হতে চাইলে বড় ভাইদের আশীর্বাদ প্রয়োজন। সবাই বলে এক ঢিলে দু পাখি আমি দেখলাম এক ঢিলে তিন পাখি। মোবা কাউন্সিলরের আশীর্বাদ, কিছু টাকা পাওয়া যাবে আর পথের কাঁটাও দূর হবে। নর্থ সাউথ গ্রুপে ওপর থেকে হাসান সাহেবের হাত সরিয়ে দিলে ডি.বি.গ্যাং এর আধিপত্য আরো বেশিদূর বিস্তৃত হবে।

ইব্রাহিম সাহেব ডনের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলো, এতো অল্প বয়সে কী এক ভয়ঙ্কর নেশায় পেয়ে বসেছে কিশোরদের, একটা গ্রুপকে রীতিমতো একটা রাজত্ব ভাবতে শুরু করেছে। ডনের কথাবার্তাগুলো কত সাজানো-গুছানো, চিন্তাভাবনাগুলো কতো পরিপক্ক। একজন মেধাবী ছাত্র, একজন আগামীদিনের রাজনীতিবিদের মতো পরিপক্ক কথাবার্তা।

ইব্রাহিম সাহেব হাত থেকে লাঠিটা ফেলে দিলেন, তুমি কত সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলছো, কত বিত্তবান পরিবারের সন্তান, তোমার ওপর মা-বাবার কত স্বপ্ন সব ধূলিসাৎ করলে। ছাত্রজীবনে লেখাপড়া করবে, ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, ব্যারিস্টার হবে, জনগণের সেবা করবে। একদিন জাতিকে সেবা দিবে, অনেক বড় নেতা হবে, জাতিকে নেতৃত্ব দিবে অথচ এই বয়সে তুমি অপরাধী হয়েছো। কীসের রাজত্ব, কীসের আধিপত্য এখন তোমার রাজত্ব জেলখানার চার দেয়াল মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত।

 

উনিশ

 

হাসান হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ডকে নিয়ে এখন আর পুলিশের কোনো সংশয় নেই। ঘটনাটা হয়তো এখনো সে আঁচ করতে পারেনি। পুলিশ একের পর এক আসামি গ্রেফতার করছে কিন্তু কাউকে আদালতে সোপর্দ করছে না। মোবা কাউন্সিলর প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে মতলুবকে ফোন করতো। সেসময় আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি।

মতলুবকে একটা রুমে রাখা হয়েছে। মতলুবকে উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতার করার পর থেকে সে শুধু কাঁদছে, কপাল চাপড়াচ্ছে আর বলছে, আমি এ কী করলাম? আমি একটা মানুষকে খুন করতে সহযোগিতা করলাম…

ইব্রাহিম সাহেব মুকিদসহ আরো কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য মতলুবের ঘরে ঢুকলো। মতলুব চেহারায় বেশ সুন্দর। লম্বা, ফর্সা, সাহেবি চেহারা, বিনয়ী কথাবার্তা। ইব্রাহিম সাহেব ঘরে ঢুকতেই সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মতলুব মিয়া?

জি স্যার, ভালো।

আচ্ছা মতলুব মিয়া, তুমি কিন্তু কোনো প্রফেশনাল ক্রিমিনাল না। তুমি মোবা কাউন্সিলরের ম্যানেজার, তুমি শুধু তার নির্দেশমতো কাজ করেছো এই তো?

আমি প্রথমে করতে চাইনি স্যার। স্যার আমাকে চাকরির ভয় দেখালো, বললো আমাকে দিয়েই তো তুমি, আমি যদি কাউন্সিলর হতে পারি তবে তুমিও তো সুবিধা পাবে।

তুমি ক্রিমিনাল না, তাই তোমার সাথে আমাদের আচরণটাও হবে ভদ্রলোকের মতো। একটা কথা মনে রেখো, আমরা হাসান হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শেষ পর্যায়ে। তুমি মোবা কাউন্সিলরের নির্দেশে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে কানকাটা মোন্তাকে কন্ট্রাক্ট করেছো।

মতলুব অস্বীকার করলো, না স্যার।

তো?

আমাকে মোন্তাকে বলতে বলেছিলো, আমি বলেছিলাম কিন্তু মোন্তা আমার কথায় কাজ করেনি।

আচ্ছা বুঝলাম। তারপর মোন্তাকে তোমার মোবা নিজেই বলেছে।

জি স্যার।

মোন্তাকে টাকাটা তুমি দিয়েছো?

একদিন ভাই আমাকে ডেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বললো, মোন্তাকে দিয়ে আসতে।

তারপর তুমি মোন্তাকে টাকাটা দিয়ে এলে।

জি স্যার। বলে মতলুব আবার কাঁদতে লাগলো। আমি একটা খুন করে ফেললাম, আমি একটা খুন করে ফেললাম।

ইব্রাহিম সাহেব অভয় দিয়ে বললো, তুমি তো খুনটা করোনি, তুমি জানতে এবং মোবা কাউন্সিলরের নির্দেশে কাজে জড়িয়ে পড়েছো।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, তারপর কী হলো? মানে ঘটনার দিন?

ঘটনার দিন মোন্তা আমাকে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল।

তারপর আমি ভাইকে খবরটা জানিয়ে দিলাম।

তুমি তো খুন করোনি কিন্তু পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেনো? একবার ঢাকায়, হোটেলে, আরেকবার ভাড়া বাসায়।

ভয় পাচ্ছিলাম স্যার, ভয়!

একথা কি সত্যি যে মোন্তা করতে চাচ্ছিলো না কাজটা?

হ্যাঁ সত্যি।

মোবার কী উদ্দেশ্য ছিলো হাসান সাহেবকে খুন করার?

মতলুব বললো, সেটা আমি জানি না স্যার। ভাই সব কথা আমাকে বলে না, শুধু যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু বলে।

তোমার কি মনে হয়?

মতলুব আবার ইব্রাহিম সাহেবের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আমার কিছু মনে হয় না স্যার। আমি শুধু ভাইর অর্ডার মতো করি।

আচ্ছা ঠিক বলেছো। আরেকটা কথা বলো, এই ঘটনার ব্যাপারে তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছিলো মোবা ছাড়া?

না।

আমরা তোমার সঙ্গে একজন ড্রাইভারকে আ্যরেস্ট করেছি, দেখেছো?

জি স্যার।

সে কার ড্রাইভার তা তো তুমি জানো?

জি স্যার।

তাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?

আমি জানি না স্যার। আমি ছোট চাকরি করি। আমি শুধু আমার ভাইর অর্ডার অনুযায়ী কাজ করি। মোন্তা অনেক আগে থেকে বসের কাজ করে। মোন্তার এই শহরের প্রায় সব নেতার সঙ্গে সখ্য আছে, যাতায়াত আছে। কাজেই মোন্তা কারো কাছে গেলেই সে নেতা জড়িত আমি মনে করি না। আপনি পুলিশ অফিসার, কে কে জড়িত তা নিশ্চয়ই আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন।

কিছু খাবে মতলুব?

মতলুব একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, হাসালেন স্যার।

কেনো? চা, কফি, কী খাবে বলো? এতক্ষণ পর্যন্ত তোমার আচরণে আমি সন’ষ্ট। আমি আশা করি তুমি শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে সহযোগিতা করবে।

মতলুব বললো, এক কাপ চা খাবো স্যার, লাল চা। আমাকে আর কি কি সহযোগিতা করতে হবে স্যার?

ইব্রাহিম সাহেব মতলুবের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে কথা বলছিলো। তার পিছনে দাঁড়িয়েছিল মুকিদ ও তার সঙ্গীয় ফোর্সরা।

ইব্রাহিম বললো, মুকিদ কয়েক কাপ লাল চা আনাও।

জি স্যার।

একজন ফোর্স বাইরে গেলো। কিছুক্ষণ পর কয়েক কাপ চা নিয়ে এলো।

ইব্রাহিম সাহেব চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বললো, মতলুব তোমার সঙ্গে তো প্রতিদিন একবার করে মোবার কথা হয়, তাই না?

ঠিক প্রতিদিন না, উনি যখন ফোন করেন।

প্রায়দিনই তোমার সঙ্গে তোমার বসের রাত দশটায় একবার করে কথা হয়।

হ্যাঁ, উনি যেদিন ফোন করেন, সেদিন রাত দশটায় ফোন করেন।

তাহলে তো একটু পরেই ফোন করবে।

করতে পারে স্যার।

মোবা কবে ফিরবে?

বাইশ তারিখে ফেরার কথা আছে স্যার।

আজ বিশ তারিখ, কালকের দিন বাদে।

জি স্যার।

কথা বলতে বলতে চা খাওয়া শেষ হলো।

ইব্রাহিম সাহেব একটা নিঃশ্বাস টেনে বললো, মতলুব তোমার ভাই তোমাকে ফোন করার সময় হয়ে এলো। তুমি কথা বলবে ঠিক স্বাভাবিকভাবে এবং সে যদি আসতে চায় তবে আসতে বলবে। তুমি অন্যান্য দিন যেমন কথা বলো সেভাবেই বলবে, কোনো রকম চালাকি করবে না।

ইব্রাহিম সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই সত্যি সত্যি মতলুবের মোবাইলের রিং বেজে উঠলো।

মুকিদ ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকার দিয়ে মতলুবের হাতে দিলো।

মতলুব সালাম দিলো, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মতলুব?

জি ভাই ভালো।

কোনো সমস্যা নেই তো মতলুব?

ইব্রাহিম সাহেব ইশারা করে বললো, না কোনো সমস্যা নেই।

মতলুব বললো না ভাই, সমস্যা নেই।

ইব্রাহিম কাগজে লিখে লিখে প্রশ্ন করলো আর মতলুব সেসব কথা মোবা কাউন্সিলরকে জিজ্ঞেস করলো, বস আপনি কবে আসছেন?

পরশুদিন, কেনো, কোনো সমস্যা নেই তো আবার?

না ভাই।

বাইশ এপ্রিল বিকেল তিনটায় আমি ঢাকায় ল্যান্ড করবো, তুমি এয়ারপোর্টে আসতে পারবা?

ইব্রাহিম সাহেব হাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

মতলুব বললো, জি ভাই।

আচ্ছা রাখি তাহলে, কোনো সমস্যা থাকলে ফোন দিও।

জি ভাই।

মতলুব ফোন রেখে দিলো। ইব্রাহিম সাহেব মতলুবকে ধন্যবাদ জানালো।

মতলুব মাথা নিচু করে কী যেনো ভাবছে। ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছো মতলুব?

স্যার ভাবছি আসলে আমি কেনো এমন একটা কাজে জড়িয়ে গেলাম। সবাই যখন জানবে আমি একটা খুনি…ছিঃ, ছিঃ।

 

বিশ

 

হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় সাধারণ জনগণ, রাজনীতিবিদ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডন অপহরণ। পুলিশ ডনকে গ্রেফতারের বিষয়টি গোপন করায় জনমনে আরো বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আবার ডনকে গ্রেফতারের বিষয়টি মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে মোবা কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করাও কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো মোবা কাউন্সিলর ভারতেই থেকে যাবে অথবা পালিয়ে যাবে ভারত থেকে অন্য কোনো দেশে। আর মাঝখানে একটা দিনমাত্র তারপর হাসান হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড ধরা পড়লে জনমনে ক্ষোভ কমবে।

ক’দিন থেকে ওসি সাহেবের ওপর বেশ চাপ যাচ্ছে। আজকাল পুলিশই যেনো সব। আসামি গ্রেফতার করা, আদালতের আদেশ তামিল করা, ভি.আই.পি প্রটোকল দেয়া, পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেয়া, জনসভায় শৃঙ্খলা রক্ষা করা ইত্যাদি, ইত্যাদি। রাষ্ট্র পরিচালনার সব দায়িত্ব যেনো পুলিশেরই। কথাগুলো মনে করে ওসি সাহেব আপনমনে একটু হাসলেন, আমি বেশি ভাবছি না তো।

ওসি সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। ওসি সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে দেখলেন। সাংবাদিক কামাল ফোন করেছে। সাংবাদিক কামাল দেশের শীর্ষ স্থানীয় বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি। ওসি সাহেবের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আসলে পুলিশের সঙ্গে সবাই ভালো সম্পর্ক রাখতেই চায়, ভালোবাসায় হোক আর ভয়ে হোক। সাংবাদিক কামাল সাহেব শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত ভাষায় কথা বলেন। পেশাগত কারণে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য যতটুকু কৌশলী হওয়া প্রয়োজন ততটুকুই কৌশলী।

ওসি সাহেব রিসিভ করলেন, হ্যালো। আসসালামুয়ালাইকুম সাংবাদিক সাহেব।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন ওসি সাহেব?

ভালো তো থাকতেই চাই কিন্তু পারি না তো। তবু যেভাবে আছি সেভাবেই আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?

জি ভালো।

বলুন কী মনে করে…

না, কিছু মনে করে না। এই অনেকদিন থেকে কথা হচ্ছে না তাই ফোন করলাম।

শুকরিয়া, শুকরিয়া। একটা গল্প শুনুন। সময় আছে তো?

বলুন, বলুন আপনার বেলায় কি আর সময়ের অভাব।

আমি তখন এ.এস.আই ছিলাম। বদলি হয়েছি, নতুন কর্মস’লে বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি। একটা বাসা পেলাম, বাসাটা সুন্দর, আমার পছন্দসই। বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, কী করেন?

আমি বললাম, পুলিশে চাকরি করি।

ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমি বাসা ভাড়া দিবো না।

আমি জানতে চাইলাম কেনো?

তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, পুলিশ আর সাংবাদিককে আমি বাসা ভাড়া দিবো না। বলে ওসি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।

কামাল সাহেব বললেন, তার মানে আমরা দু’জনে খারাপ?

আরো একটা পেশা বলেছিলেন কিন্তু সেটা বলা যাবে না।

আসলে কোনো নিউজ করার জন্য আপনাকে ফোন করলে আর নিউজ করা হয় না। এমনভাবে কথা বলেন যে আগেই গুলিয়ে ফেলি।

বলুন কী বিষয়ে জানতে চান, বলুন?

বিষয় তো অনেকগুলো, ঢাকা থেকে আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে নিউজ করতে।

করুন। লিখে দিন দু’য়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিসি’তি স্বাভাবিক আছে। হা হা হা।

কামাল সাহেবও হা হা করে হেসে উঠলেন, তাহলে তো আমার নিউজটা আপনি লিখে দিলেন। বলে কামাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ওসি সাহেব হাসান সাহেব হত্যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন?

অবশ্যই। শীঘ্রই সব জানতে পারবেন।

কিন্তু আজ পর্যন্ত তো উল্লেখযোগ্য কোনো আসামি আ্যরেস্ট করতে পারলেন না।

তদন্তের স্বার্থে সব গোপন আছে। আসামিরা সব পুলিশের গোয়েন্দা জালের মধ্যে আছে।

কবে জানতে পারবো বস? কামাল সাহেব কিছুটা তামাশার সুরে বললেন।

পারবেন, পারবেন। বড়জোর এক সপ্তাহ।

আর সেই যে ছেলেটা অপহরণ হলো, ডন?

অপহরণকারী গোয়েন্দা জ্বালে আছে যেকোনো সময় প্রেস ব্রিফিং করে জানিয়ে দেয়া হবে।

এবার সাংবাদিক সাহেব একটা জটিল প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কি ডন অপহরণের কোনো সম্পর্ক আছে?

ওসি সাহেব কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন, এখনো সেটা বলার সময় আসেনি।

ডন অপহরণের পর এখনো উদ্ধার না হওয়ায় মানুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

ওসি সাহেব দ্বিমত পোষণ করলেন, মোটেই না।

কেনো?

গার্জিয়ানরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো তবে তাদের সন্তানরা রাতের বেলা বাসা থেকে বের হতে দিতো না। বরং গার্জিয়ানরা তাদের সন্তানদের তেমন খোঁজখবর রাখে না বলেই মহল্লায় মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।

তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ডনকে কোনো কিশোর গ্যাং অপহরণ করেছে?

সেটা সময় হলেই জানবেন।

আরেকটা কথা শুনলাম, কানকাটা মোন্তাকে নাকি কয়েকদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

কেউ থানায় কমপ্লেইন করেনি তো, কানকাটার আবার কেউ মাথা কাটলো নাকি? তাহলে তো আবার কাজ বাড়লো। বলে ওসি সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন, আসলে থানায় কেউ কমপ্লেইন করেনি, করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো।

সব তো আইনের কথাই বললেন। আসলে কানকাটা মোন্তা পুলিশ হেফাজতে নাকি?

আপনি বড় বেশি দেখছেন মশাই।

সাংবাদিকতা করি, একটু বেশি তো দেখতেই হয়।

ওকে দেখুন, কয়েকদিন দেখুন, আপনার অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। নতুন নতুন খবরও পাবেন।

জি বুঝছি। আপনি তো সব সময়ের অপেক্ষায় ঝুলিয়ে রাখলেন।

ওসি সাহেব একটা রহস্যময় হাসি হাসলেন।

ধন্যবাদ ওসি সাহেব। আমি কিন্তু কাজের কাজ কিছুই জানতে পারলাম না, দু’য়েকদিন পর থানায় আসবো। আসলে আমাদেরও তো চাকুরি। অ্যাসাইনমেন্ট পেলে তার একটা ফিডব্যক দিতে হয় বলে কামাল সাহেব মোবাইল রাখলেন।

ওসি সাহেব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, উফ্‌।

 

একুশ

 

পুলিশ মোবা কাউন্সিলরকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ডন, মোন্তা কিংবা মতলুবের মতো গোপনীয়তা রক্ষা করবে না। কারণ ডন ছাত্র, বয়সের কারণে তাকে গ্রেফতারের কথা জানাজানি হলে এবং পুরো ঘটনা প্রমাণ করতে পারার আগে ডনকে গ্রেফতার দেখালে জনমনে আরো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো। মিডিয়া, মানবাধিকার সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করতো। আরমান সাহেব নিজেও একজন ব্যবসায়ী নেতা, তার ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সখ্য আছে। ডনকে গ্রেফতারের তারাও প্রতিবাদ করতো। মোন্তাকে গ্রেফতারের কথা জানাজানি হলে মতলুব জানতো এবং মোবা কাউন্সিলর হয়তো দেশে না এসে ভারতেও কিছুদিন থেকে যেতো বা ভারত থেকেই অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যেতে পারতো। সেজন্য তদন্তের স্বার্থেই তাদের গ্রেফতারে পুলিশ অনেকটা কৌশলী হয়েছে।

মোবা কাউন্সিলরকে গ্রেফতারের কথা গোপন রাখলে বা মোবা কাউন্সিলর দেশে ফেরার পর আবার হারিয়ে গেলে পুলিশকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তাছাড়া মোবা কাউন্সিলর হাসান হত্যা মামলার সম্পৃক্ততার অনেকগুলো প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে। কাজেই পুলিশ মোবা কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করার পর বিষয়টি নিয়ে কোনো গোপনীয়তা রক্ষা করবে না।

ইব্রাহিম সাহেব মুকিদসহ কয়েকজন ফোর্স নিয়ে এসেছে, কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশও আছে। তাদের সহযোগী হিসেবে আছে বিমান বন্দর থানা পুলিশ। সবাই অপেক্ষা করছে আন্তর্জাতিক বহিঃগমন গেটে। শিডিউল অনুযায়ী আর মাত্র কয়েকমিনিট বাকি আছে। ইব্রাহিম সাহেব এবং মুকিদ দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ পুলিশে আছে, মোবা কাউন্সিলর তাদের দেখে চিনতে পারে এবং কোনো সিন ক্রিয়েট করতে পারে তাই ইব্রাহিম সাহেব বিমানবন্দর থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ সাদা পোশাকের দু’জন পুলিশ সদস্যকে ভিতরে পাঠিয়ে দিলো এবং তাদের জানিয়ে দিলো যে এয়ারপোর্টের ভিতরে নয় পুলিশ মোবা কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করবে বহিঃগমন গেট দিয়ে বের হওয়ার সময়। ভিতরের সদস্যদের কাজ হলো মোবাকে ওয়াচ করা এবং ইব্রাহিম সাহেবকে মোবাইল করে জানিয়ে দেয়া।

ইব্রাহিম সাহেব বহিঃগমন গেটে অপেক্ষা করছে আর বার বার ঘড়ি দেখছে। বিমান অবতরণের সময় অতিক্রান্ত হলো ইব্রাহিম সাহেব ভিতরে থাকা পুলিশ সদস্যদের একজনকে মোবাইল করলো, হ্যালো।

স্যার।

বিমান অবতরণ করেনি?

না স্যার, বিমান পনেরো মিনিট লেট।

ও আচ্ছা।

ইব্রাহিম সাহেব পায়চারি করতে শুরু করলো। তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইব্রাহিম সাহেব কিছুটা বিরক্তির সুরে আপনমনে বললো, এখন আবার কে ফোন করলো। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে দেখলো। ওসি সাহেব ফোন করেছেন।

ইব্রাহিম সাহেব ফোন রিসিভ করলো, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

ওসি সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইব্রাহিম সাহেব বললো, ফ্লাইট লেট স্যার।

ওকে। অপেক্ষা করুন। টাইম টু টাইম আপডেট দিবেন।

ওকে স্যার।

কয়েকমিনিট পর ইব্রাহিম সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। সে রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, স্যার।

দেখতে পেয়েছেন?

জি স্যার। আপনার কথামতো আমরা তাকে সাইলেন্ট ওয়াচ করছি।

ওকে।

ইব্রাহিম সাহেব মুকিদকে ফিসফিস করে বললো, মুকিদ রেডি হও।

জি স্যার, বলে মুকিদ তার সঙ্গে ফোর্সদেরও সতর্ক করলো।

গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে মোবা কাউন্সিলর।

ইব্রাহিম সাহেব আরো গেটের কাছাকাছি গেলো। অন্যান্য সদস্যরা দূর থেকে একটা বৃত্ত তৈরি করলো যেনো মোবা কোনোভাবে পালাতে না পারে।

মোবা কাউন্সিলর গেট দিয়ে বের হতেই ইব্রাহিম সাহেব আর মুকিদ সামনে এগিয়ে গেলো।

ইব্রাহিম সাহেব কৃত্রিম বিনয়ের সঙ্গে আপ্যায়ন করার মতো হাত দেখিয়ে বললো, আপনার গাড়ি এদিকে স্যার।

মোবা পুলিশ দেখে চমকে উঠলো, মানে?

ইব্রাহিম সাহেব গর্জন করে উঠলো, ইউ আর আন্ডার আ্যরেস্ট।

মোবা কাউন্সিলর কিছুটা ধমকের সুরে বললো, আপনারা কাকে কী বলছেন? আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।

আসুন সেটা দেখা যাবে, গাড়িতে উঠন। পুলিশ যখন আপনাকে রিসিভ করতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এসেছে তখন কোথাও ভুল নেই বলে ইব্রাহিম সাহেব চাপাস্বরে বললো, মুকিদ হ্যান্ডকাফ পরাও।

মুকিদ হ্যান্ডকাফ পরানোর সময় মোবা জিজ্ঞেস করলো, আমার নামে কি ওয়ারেন্ট আছে?

ইব্রাহিম সাহেব বললো, আপনাকে ফিফটি ফোরে আ্যরেস্ট করা হলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আপনাকে আদালতে হাজির করে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হবে।

তবু জানতে পারি।

সেটা আদালতেই জানতে পারবেন। বলে ইব্রাহিম সাহেব মোবাকে হ্যান্ডকাফ পরানোর জন্য আবার মুকিদকে ইশারা করলো।

মুকিদ মোবাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বললো, উঠন জনাব প্লিজ!

মোবা নাক দিয়ে হুঁহ বলে বিড়বিড় করতে করতে গাড়িতে উঠলো।

দুঃসংবাদ বেগে ধায়। মোবা কাউন্সিলর গ্রেফতার হওয়ার খবর যেনো মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো। মোবাকে থানায় আনার কিছুক্ষণের মধ্যে থানায় একরকম ভিড় তৈরি হলো। বিশেষ করে মিডিয়া এবং দলীয় নেতাকর্মীরা ওসি সাহেবকে নানান প্রশ্নে জর্জরিত করলো। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এবং শহরের নামিদামি লোকেরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ পুলিশ বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করলো। কয়েকজন সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে এলো, তাছাড়া বিভিন্ন বহুল প্রচারিত পত্রিকার সাংবাদিকও এলো।

ক্যামেরাম্যানরা স্ট্যান্ডে ক্যামেরা সেট করতে শুরু করলো।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ক্যামেরা তাক করছেন কেনো? আগে তো বলবেন আমার কাছে কী জানতে চান?

একজন কম বয়সের সাংবাদিক রুক্ষ্‌মতারসঙ্গে বললেন, সেটাও আপনি ক্যামেরার সামনে বলবেন।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ওসি সাহেব আমরা জানতে পেরেছি আপনি মোবা কাউন্সিলরকে আ্যরেস্ট করেছেন। এটা কি সত্যি?

জি সত্যি।

কাউন্সিলর সাহেব একজন ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সমাজসেবক এবং শহরের গন্যমাণ্য ব্যক্তি। তিনি এমন কি অপরাধ করতে পারেন যে ইন্ডিয়া থেকে দেশে নেমেই এয়ারপোর্টে তাকে আ্যরেস্ট করা হলো? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?

ওসি সাহেব বলতে শুরু করলেন, মোবা’কে ফিফটি ফোরে আ্যরেস্ট করা হয়েছে।

কোনো অভিযোগ নেই, হঠাৎ করে একজন পলিটিশিয়ানকে ফিফটি ফোরে আ্যরেস্ট কি ফিফটি ফোরের অপব্যবহার না?

আইনে পুলিশকে ফিফটি ফোরে আ্যরেস্ট করার ক্ষমতা দেয়া আছে। আইন অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হবে। তারপর আদালত যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে।

এবার আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, কাউন্সিলর সাহেবকে কি হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে আ্যরেস্ট করা হয়েছে?

সেটা আদালতে জানানো হবে।

হাসান সাহেব হত্যা, ডন অপহরণসহ নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিসি’তির চরম অবনতির জন্য কি পুলিশ প্রশাসন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে।

এবার ওসি সাহেব একটু রসিকতা করে বললেন, শাক দিয়ে কখনো মাছ ঢাকানো যায় না। মাছ দৃষ্টিগোচর না হলেও গন্ধ বের হবে বলে ওসি সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, মোবা কাউন্সিলর যদি সত্যি সত্যি অপরাধ না করে থাকেন তবে আদালতে তিনি ছাড়া পাবেন আর যদি অপরাধ করে থাকেন তবে সত্য বেরিয়ে আসবে।

ওসি সাহেবকে আরো একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, ওসি সাহেব হাত তুলে বললেন, নো মোর টুডে। আগামীকাল আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করা হবে তখন সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে আশা করি। সবাইকে ধন্যবাদ।

 

বাইশ

 

পরদিন মোবাসহ হাসান হত্যাকাণ্ড মামলার সব আসামি হিটলার, মতলুব, মোন্তা ও রিতুকেও আদালতে হাজির করে পুলিশ রিমান্ড প্রার্থনা করলো। মোবা ছাড়া অন্য সব আসামি ইতিমধ্যে একশ চূষট্টি ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হয়েছে। তবুও পুলিশ মোবাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অন্যান্য আসামিদের প্রয়োজন মনে করে রিমান্ডে নিয়ে এলো। বিজ্ঞ আদালত থেকে জিজ্ঞাসাবাদের গুরুত্ব বিবেচনা করে সব আসামির ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করলো কিন্তু পুলিশ কৌশলগত কারণে ডন আর হিটলারকে আদালতে সোপর্দ করলো না।

মোবার মুখ থেকে কথা বের করা সহজ কাজ না। মোবা ফুটপাথ থেকে উঠে এসেছে রাজপথে। মোবার জন্ম নিম্নবিত্ত পরিবারে। বাবা রিকশা চালাতো, তিন ভাইবোনের মধ্যে মোবা সবার ছোট। বড়ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে, একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে। বাড়িতে বাবা-মা আর মোবা। অনেক কষ্ট করে মোবা এস.এস.সি পাস করেছে, হঠাৎ একদিন মোবার মা মারা গেলো। মোবা মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মা নেই এটা মোবা ভাবতেই পারে না।

অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়। মা মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মোবার বাবাও মারা গেলো। মোবার আর পৃথিবীতে কেউ থাকলো না। বাবাসহ দু’রুমের যে সেমিপাকা বাসায় ভাড়া থাকতো সেটা ছেড়ে দিয়ে বোনের বাসায় উঠলো। প্রথম কিছুদিন মোবা বোন-দুলাভাই’র ছাপোষা সংসারে গলগ্রহ হয়ে কাটালো তারপর ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লো।

মোবা’র চিন্তাভাবনাগুলো গতানুগতিক ছিলো না। বাবা রিকশাওয়ালা, দুলাভাই রিকশাওয়ালা বলে নিজেও রিকশা চালাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম একজন রিকশাওয়ালা রিকশাওয়ালাই থাকবে এটা সে মেনে নিতে পারে না। মোবার চিন্তাভাবনাগুলো ছিলো রাতারাতি বড় হওয়ার।

কৈশোর থেকে, না শৈশব মোবা মিছিল-মিটিং এ যেতো। মিটিংয়ে জনসমাগম বাড়াতে, মিছিলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত বাড়াতে এবং হরতালে পিকেটিং এর কাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বস্তির খেটে খাওয়া মানুষকে ব্যবহার করে। কখনো তাদের অধিকারের কথা বলে, কখনো টাকা দিয়ে নিয়ে যেতো। মোবাও সেই সুবাদে কৈশোর থেকে মিছিল-মিটিংয়ে যেতো, কখনো কখনো পার্টি অফিসের আশে-পাশে ঘুরাঘুরি করতো। এই ঘুরাঘুরি তার জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

পার্টি অফিসের আশে-পাশে ঘুরাঘুরি করাতে মোবা কিছু উঠতি রাজনীতিবিদের নজরে পড়লো। মিছিল-মিটিং এ লোক সমাগম ঘটাতে তারা মোবার ওপর ভর করলো। মোবা তখন বস্তি থেকে লোক নিয়ে যেতো এবং মাথাপিছু টাকা নিয়ে বস্তির লোককে দিতো। এভাবে মোবার একটা দল গড়ে উঠলো। এই দলকে কাজে লাগিয়ে বাছাই করা কয়েকজনকে নিয়ে মোবা ক্যাডরবাহিনী গড়ে তুললো। এই ক্যাডারবাহিনীর কাজ মিছিল-মিটিংয়ে গাড়ি ভাঙচুর, দোকান ভাঙচুর, ভয়-ভীতি দেখিয়ে সুবিধা আদায় করা, কারো জমি দখল করে দেয়া বা বেদখল জমি দখল করে দেয়া। তাতে করে মোবা অনেক মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লো। তাতে করে মোবার পরিচিতি আরো বাড়লো।

এবার মোবার খায়েশ হলো সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর দাঁড়ানোর। সে নির্বাচনে মোবা অল্প কয়েক ভোটে পরাজিত হলো কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেলেও সবাই তাকে মোবা কাউন্সিলর বলে ডাকতে শুরু করলো। সেই মোবা কাউন্সিলর অসংখ্য মামলার মুখোমুখি হয়েছে। কয়েকটা হত্যাকাণ্ডের মুল আসামি হয়েও বেঁচে গেছে। পুলিশের রিমান্ডে কীভাবে কৌশলী হতে হয় তা মোবার জানা আছে।

মোবার জিজ্ঞাসাবাদে ইব্রাহিম সাহেব, মুকিদ, দু’জন পুলিশ সদস্য অংশ নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওসি সাহেবও এলেন। ওসি সাহেব কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে কাউন্সিলর সাহেব বলে জিজ্ঞেস করলেন, কাউন্সিলর সাহেব আপনাকে আর নতুন করে কী জিজ্ঞেস করবো যখন আমাদের হাতে সব প্রমাণ আছে এবং কয়েকজন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।

মোবা কোনো কথা বললো না।

ওসি সাহেব কিছুটা রাগের সুরে বললেন, কথা বলছেন না কেনো?

মোবা করুণ মুখটা উঁচু করে বললো, কী বলবো?

হাসান সাহেবকে খুন করলেন কেনো?

হাসান সাহেবকে খুন করেছি আমি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি। আমাদের হাতে সব প্রমাণ আছে।

কী কী প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে?

আপনি যে খুনটা করিয়েছেন তার সব প্রমাণ।

সেগুলো কী কী বলবেন তো, মোবা ঠাণ্ডা গলায় বললো।

আপনি মোন্তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে হাসান সাহেবকে খুন করিয়েছেন।

প্রমাণ কী?

মোন্তা এবং মতলুব দু’জনই বলেছে।

মোবা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ওরা বললেই হলো। এই যে আপনারা আমাকে রিমান্ডে এনে টর্চার করে স্বীকার করতে বাধ্য করছেন এমনটা তো তাদের সাথেও করেছেন। তাই ওরা আপনাদের শিখিয়ে দেয়া কথা বলেছে। আর মোন্তা, মতলুব বললেই হলো যে আমি খুনটা করিয়েছি?

আপনি ইন্ডিয়া গেছেন কত তারিখে?

এপ্রিলের পাঁচ তারিখে।

আর খুনটা হয়েছে সাত তারিখে। আপনি মিশন সাকসেসফুল হওয়ার সব ব্যবস্থা করেই ইন্ডিয়া গেছেন নিজেকে আড়াল করার জন্য।

আর সেজন্যই আপনারা মুল আসামিকে ধরতে না পেরে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।

পুলিশ আপনাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে কেনো?

মোবা জোর দিয়ে বললো, হাসান ভাইকে হত্যার মুল আসামি ধরার ব্যর্থতা ঢাকানোর জন্য।

ওসি সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, চুপ।

মোবা খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো, রেগে যাচ্ছেন কেনো? এখন আপনার গ্রামে যদি একটা খুন হয় আর কেউ নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপনার নাম বলে তবে কি প্রমাণ হবে যে আপনি খুনটা করেছেন?

ওসি সাহেব ইব্রাহিম সাহেবকে বললেন, ইব্রাহিম সাহেব সোজা কথায় কাজ হবে না।

মোবা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো, ঠিক বলেছেন, মোন্তা, মতলুবকে দিয়ে যেভাবে আমার নাম বের করেছেন সেভাবে টর্চার করে আমার মুখ থেকেও বের করুন, আমি ইন্ডিয়া থেকে অলৌকিক ক্ষমতার বলে হাসানকে খুন করেছি।

মোবার যুক্তিযুক্ত কথা শুনে সবাই থ হয়ে গেলো।

ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি মতলুবকে দিয়ে মোন্তাকে টাকা দেননি?

না।

আপনি পাঁচ এপ্রিল ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে মতলুবকে দেননি?

হ্যাঁ দিয়েছি। অনেকদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি, আমার ব্যবসা, পারিবারিক খরচ এসবের জন্য টাকা দিতে হবে না।

তাই বলে পাঁচ লাখ?

হ্যাঁ।

ওসি সাহেব তিরস্কারের সুরে বললেন, কয়েকদিন দেশের বাইরে থাকার জন্য ম্যানেজারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দিলেন?

হ্যাঁ। অসুবিধা কী। আমার টাকা আছে, আমি দিয়েছি। আমি কত টাকা খরচ করবো সেটা কি আমাকে পুলিশ বেঁধে দিবে?

ওসি সাহেব এবার প্রচণ্ড রেগে গেলেন, মুকিদ তোমার কেরামতি দেখাও তো।

মুকিদ তার মোবাইল ফোনের অডিও রেকর্ডি চালু করলো।

মোবার কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন প্লিজ!

মোবার দরদ মিশানো কণ্ঠস্বর, বড়ভাই আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি মোবা, আপনার ছোটভাই মোবা।

অপরিচিত কণ্ঠস্বর, ও মোবা কাউন্সিলর?

জি বড়ভাই কাউন্সিলর আর হতে পারলাম কই। কাউন্সিলর নামটাই হলো কাউন্সিলর তো আর হতে পারলাম না। এবার আমি কাউন্সিলর দাঁড়াবো বড়ভাই। আমার জন্য দোয়া করবেন।

হ্যাঁ দোয়া তো করবোই। তোমার প্রতিদ্বন্‌দ্িবওতো আর রইলো না, মোবাইল ফোনের কথাগুলো শেষের দিকে করুণ শোনালো।

এভাবে বলবেন না বড়ভাই। খবরটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো, আসলে ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচে না।

মুকিদ মোবাইলে কথোপকথন বন্ধ করলো।

ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কার কাছে শুনলেন?

মোবা থতমত খেয়ে বললো, কার কাছে, কার কাছে যেনো শুনলাম মনে নেই।

ওসি সাহেব নিজে মোবার চুলের মুঠি ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, মনে নেই, না? ঘটনার দিন অর্থাৎ সাত-ই এপ্রিল হাসান সাহেব খুনের এক ঘণ্টা আগে মতলুব আপনার সাথে উনপঞ্চাশ সেকেন্ড কথা বলেছে আর ঘটনার তিন মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর মতলুব আপনার সাথে দুই মিনিট পাঁচ সেকেন্ড কথা বলেছে। প্রশ্ন হলো ঘটনা ঘটার তিন মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর মতলুব কীভাবে জানলো হাসান সাহেব খুন হয়েছে?

মোবা বললো, সেটা মতলুব বলতে পারবে।

হ্যাঁ। মতলুবই তো বলেছে। হাসান সাহেব খুনের পর সে আপনাকে ফোন করে জানায়। আপনার মোবাইলে কল রেকর্ডের সঙ্গে মতলুবের কথার মিল আছে।

না। এসব মোটেই সত্যি কথা না।

ওসি সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, শোন তাহলে বলে ওসি সাহেব আবার মুকিদের দিকে তাকাতেই সে আবার মোবাইলে কথপোথনের রেকর্ড চালু করলো।

মতলুবের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, হ্যালো ভাইজান।

মোবা’র কণ্ঠে উদ্বিগ্নের ছাপ, কী হয়েছে মতলুব?

কিছু হয়নি ভাইজান কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।

কেনো?

পুলিশ যদি আমাকে ধরে।

মোবা জোরে ধমকের সুরে বললো, পুলিশ তোমাকে ধরবে কেনো?

জানি না কিন্তু আমার খুব ভয় করছে। ভাইজান আমি না হয় কয়েকদিন নারায়ণগঞ্জের বাইরে চলে যাই।

মোবা বললো, বোকা তাহলে তো পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করবে। কেসটা অনেক ক্লিনভাবে সাকসেস হয়েছে। আমি ইন্ডিয়া হাসান সাহেব খুন হলো। আমার গায়ে আঁচড় লাগার কোনো ভয় নেই। আর তুমি তো আমার ম্যানেজার এবং তুমি সরাসরি ইনভলব না। তুমি জানতে সেজন্যই তোমার ভয় লাগছে?

তবুও আমার ভয় লাগছে ভাইজান।

আচ্ছা তাহলে যাও কোথাও গিয়ে ঘুরে এসো।

জি ভাই।

ওসি সাহেব মোবাকে প্রথম আপনি বলে সম্বধন করছিলেন তারপর তুমি এবার তুই বলে সম্বোধন করলেন। মোবার চুলে মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তুই ইন্ডিয়া আর হাসান খুন হলো, তোকে কেউ ধরতে পারবে না, এই তো? সত্য কখনো চাপা থাকে না মোবা, সে তার আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, বলে মোবার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ইব্রাহিম সাহেব আপনি ইন্টারগেট করুন। মোবা যদি ভালোয় ভালোয় কথা বলে তবে ভালো আর যদি চালাকি করে তবে…. বলে ওসি সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললেন, পুলিশের যত থেরাপি আছে সব এ্যপ্লাই করবেন।

জি স্যার।

ওসি সাহেব একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, মুকিদ রেকর্ডটা একবার আমাকে দাও তো আমি একবার বড়ভাই’র সঙ্গে দেখা করে আসি।

মুকিদ হাত বাড়িয়ে বললো, আপনার মোবাইল ফোনটা আমাকে দিন স্যার আমি আপনার মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।

আচ্ছা দাও, বলে ওসি সাহেব তার মোবাইল ফোনটা মুকিদের হাতে দিলো।

 

তেইশ

 

মাহমুদ সাহেব প্রবীণ রাজনীতিবিদ। জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা। জেলার রাজনৈতিক অভিভাবকও বটে। পুরো জেলার রাজনীতির ওপর আছে তার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হাত। জেলা পর্যায়ের যেকোনো কমিটিতে যেকোনো পদে নির্বাচিত কিংবা বিজয়ী যেকেউ সবার আগে আসে মাহমুদ সাহেবের কাছে আশীর্বাদ নিতে। মাহমুদ সাহেব যেনো পুরো জেলার সব নেতাকর্মীর পরম শ্রদ্ধেয় এবং নির্ভরযোগ্য নেতা। মোবা কাউন্সিলর ইন্ডিয়া গিয়ে সেই নেতার সঙ্গে দু’বার কথা বলেছে। প্রথমবার ইন্ডিয়ার যাওয়ার পরদিন অর্থাৎ হাসান সাহেবের মৃত্যুর আগের দিন আর দ্বিতীয়বার কথা বলেছে হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর। পুলিশের হাতে সেই কল রেকর্ড আছে কিন্তু কী কথা বলেছে মোবা কাউন্সিলর তদন্তের স্বার্থে সেটা জানা দরকার।

ওসি সাহেব মাহমুদ সাহেবের কাছে যাওয়ার আগে এস.পি সাহেবকে ফোন করলেন।

এস.পি সাহেব সবকিছু শুনে বললেন, তার মানে তো আর মাহমুদ সাহেব এই খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলা যায় না।

ওসি সাহেব বললেন, না স্যার আসলে আমিও তা বলতে চাচ্ছি না। একটা কথা এখন মোটামুটি স্পষ্ট নির্বাচনে অপ্রতিদ্বন্‌দ্িব হওয়ার জন্যই মোবা হাসান সাহেবকে খুন করেছে। এ বিষয়ে মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে কথা বললে আরো সবকিছু স্পষ্ট হবে।

ওকে। তাহলে আগে এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেও আর খেয়াল রেখো তোমার কোনো কথায় যেনো তিনি মাইন্ড না করেন। বোঝাই তো মাহমুদ সাহেব পাওয়ার পার্টির নেতা।

জি স্যার।

মাহমুদ সাহেব লাইব্রেরিতে ছিলেন। বিশাল বড় একটা লাইব্রেরি তার বৈঠকখানায়, একটা কাঠের চেয়ারে বিছানো তোয়ালেতে হেলান দিয়ে তিন একটা বই পড়ছিলেন। কোনো এক বিদেশি লেখকের ইংরেজিতে লেখা বই। তার চেয়ারের পিছনে এবং পাশে বড় বড় বুক সেলফে বিভিন্ন রকমের বই, গল্প, কবিতা, উপন্যাস থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আইনের বই। মাহমুদ সাহেবের মাথার চুলগুলো সব পাকা, সাদা শনশনে। মাথায় টাক নেই কিন্তু চুলগুলো পাতলা। লাইব্রেরি আর মাহমুদ সাহেবের চেহারা আর মাথার চুল দেখে দেখা বোঝা যায় তার জ্ঞানের ভাণ্ডার।

ওসি সাহেব সালাম দিলেন, আসসালামুয়ালাইকুম।

মাহমুদ সাহেব বই থেকে মুখ তুলে সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন ওসি সাহেব?

জি ভাই ভালো। আপনি?

যা বয়স হয়েছে আর কী ভালো থাকতে পারি। তবুও আল্লাহ যেভাবে রেখেছেন তাতে আছি ভালো আলহামদুলিল্লাহ।

মাহমুদ সাহেব কলিং বেল টিপতেই পিয়ন চলে এলো, স্যার।

কী খাবেন ওসি সাহেব? চা না কফি?

জি আপনার যা ইচ্ছা।

লেবুর রস দিয়ে চা নিয়ে এসো।

পিয়ন চলে গেলো। মাহমুদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ করে আমার কাছে কী কাছে ওসি সাহেব?

বলতে পারেন সৌজন্য সাক্ষাৎ আর সামান্য কিছু কাজ।

হ্যাঁ বলুন কী করতে পারি।

ভাই আপনার কাছে কিছু তথ্য জানতে এসেছি হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে?

হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমার কাছে? মাহমুদ সাহেব কিছুটা অবাক হলেন।

না কিছু মনে করবেন না। আমরা আসলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব আসামিকে গ্রেফতার করেছি। মাস্টার মাইন্ড এবং বেনিফিসিয়ারিস মোবা কাউন্সিলরকেও গ্রেফতার করেছি।

মাহমুদ সাহেব ওসি সাহেবকে অভিনন্দন জানালেন, কনগ্রাচুলেশনস।

মোবা কাউন্সিলর ইন্ডিয়া থেকে আপনাকে দু’বার ফোন করেছে। একবার ঘটনার আগে আরেকবার ঘটনার কয়েকদিন পরে।

মাহমুদ সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, হুম, ও তো মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করতো।

কিন্তু এই দুদিন ফোন করার বিষয়টার সঙ্গে হাসান সাহেব হত্যার কোনো সম্পর্ক আছে কী না…বলতেই মাহমুদ সাহেব মাথা উঁচু করে ওসি সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন।

ওসি সাহেব কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন কিন্তু তিনি এটাও জানেন বিব্রতবোধ করলেও এটা জানা তার জন্য বেশ জরুরি।

মাহমুদ সাহেব শীতল কণ্ঠে বললেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন ওসি সাহেব?

ওসি সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, না মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম মোবা তো কাউন্সিলর দাঁড়ানোর জন্য তদ্বির করতে পারে আর হাসান সাহেব ছিলেন তার প্রতিদ্বন্‌দ্বী সেজন্য তাকে সরিয়ে দিয়ে আপনার কাছে নমিনেশনের জন্য তদ্বির করলিছেন কী না।

মাহমুদ সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন, তদ্বির তো সবাই করে। মোবাও দীর্ঘদিন থেকে নমিনেশনের জন্য তদ্বির করছিলো আমি তাকে এটা বুঝাচ্ছিলাম যে পার্টি আসলে ক্লিন ইমেজের পপুলার কাউকে নমিনেশন দিবে। মোবা জানতো পার্টিতে হাসান সাহেবের একটা ভালো অবস্থান আছে এবং নমিনেশন সেই-ই পাবে।

ওসি সাহেব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, এঙাক্টলি। আপনি কী মনে করেন সেজন্য মোবা হাসান সাহেবকে খুন করে অপ্রতিদ্বন্‌দ্িব হতে চেয়েছিলো?

এটা তো আমি বলতে পারবো না। পুলিশ বলতে পারবে।

আচ্ছা লিডার আপনার কি মনে পড়ে ফোনে মোবা আপনার সঙ্গে কী বলেছিলো?

মাহমুদ সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, আমাকে বলে যেতে পারেনি প্রথম দিন ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলো এবং তার সুস’তার জন্য দোয়া চেয়েছিলো।

আর পরের দিন?

পরের দিন তার সুস’তার কথা বলে বলেছিলো হাসান মারা যাওয়ার কথা। বলেছিলো এমন একটা ঘটনা ঘটায় সে খুব মর্মাহত হয়েছে।

আর?

মাহমুদ সাহেব ওসি সাহেবের কথাবার্তা বলার ধরণ দেখে বুঝতে পেরেছেন আসলে ওসি সাহেব তার কাছ থেকে কোন ধরনের কথা আশা করছেন। তিনি ওসি সাহেবকে হাত দেখিয়ে বুঝাতে চাইলেন, থামো ধীরে ধীরে সব বলছি।

ওসি সাহেব কৌতূহলী হয়ে মাহমুদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আর ইনিয়ে-বিনিয়ে তার নমিনেশনের কথা বললো।

তাতে কি আপনার মনে হয় না হাসান সাহেব হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড সে?

বলছি তো সেটা পুলিশ বলতে পারবে। তবে বেনিফিসিয়ারিস সে। আপনারা ভালোভাবে তদন্ত করুন, প্রকৃত হত্যাকারী যদি সে হয় তবে তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। পার্টি আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আইনে যদি সে দোষী হয় তবে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

জি লিডার আপনি সহযোগিতা করবেন আশা করি।

পাওয়ার পার্টির একজন নেতাকে আ্যরেস্ট করার পর এখনো কোনো তদ্বির যায়নি, কোনো টেলিফোন যায়নি এটা কি সহযোগিতা করা নয়।

থ্যাঙ্ক ইউ লিডার, থ্যাঙ্ক ইউ।

রাজনীতিতে কিছু আগাছা মুল গাছকেই খেয়ে ফেলছে। ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদরা আজ কোণঠাসা, কিছু সুবিধাভোগী, নীতি-আদর্শহীন মানুষ রাজনীতির ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে যাদের যোগ্যতা নেই, শুধু তোষামোদি আছে। সেই তোষামোদিকে কাজে লাগিয়ে তারা নেতা বনে গেছে তাদের চিহ্নিত করা দরকার, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কারণ তারাই রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে হেয় করছে।

জি লিডার ঠিক বলেছেন।

চা চলে এলো।

ওসি চা খেতে খেতে আরো কিছুক্ষণ গল্প করলেন। তারপর মাহমুদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ওসি সাহেব আপনার আর কিছু জানার আছে?

না লিডার। আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

চব্বিশ

 

ওসি সাহেব চলে যাওয়ার পর ইব্রাহিম সাহেব মোবার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো। অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিতভাবে বললো, মোবা আমরা ঘটনার তদন্তে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এবং উপযুক্ত সাক্ষী-প্রমাণ পেয়ে আপনাকে আ্যরেস্ট করেছি। কাজেই আপনার পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অযথা আমাদের মাথা খাটাতে, আমাদের এই বাহিনী বলে ইব্রাহিম সাহেব বললো, আপনাকে….বলে আবার ইব্রাহিম সাহেব বললো, এই তোমরা পারবে না?

একজন লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী পুলিশ কনস্টেবল দাঁত কড়মড় করে বললো, একবার বলে দেখেন স্যার, ও বলবে না ওর বাপ বলবে, ওর মুখ দিয়ে পেটের সব কথা গড়গড় করে বের হবে।

বুঝলেন কাউন্সিলর সাহেব, আপনি একসময় ক্যাডার ছিলেন, অনেক কেস ফেস করেছেন, অনেক রিমান্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন পুলিশ কী করতে পারে।

মোবা কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ আগেও তার যে চটাং চটাং কথা ছিলো এখন আর সেটা নেই। সে মাথা নিচু করে বসে আছে।

এই তোমরা একটু দেখো তো, মোবার মুখ থেকে পেটের সব কথা বের করতে পারো কী না বলে ইব্রাহিম সাহেব একজন কনস্টেবলসহ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ইব্রাহিম বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই লম্বা-চওড়া পুলিশ তার চোখে-মুখে উপর্যূপরি কিল-ঘুষ মারতে থাকলো। মোবা নিঃশব্দে মার খেতে লাগলো কিন্তু মুখে কোনো কথা বললো না। অনেকক্ষণ পিটানোর পর এবার তার মুখের ভিতর রুমাল এবং মুখ মাস্কিং টেপ দিয়ে আটকে দিয়ে তাকে চেয়ারের সঙ্গে শক্তভাবে বেঁধে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার জন্য যন্ত্রপাতি প্রস’ত করলো।

একবার দু’বার শক দিয়ে মোবা কোনো কথা বললো না। তারপর শক দিতেই মোবা হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো, তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। এবার মুকিদ মোবার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো। তাকে আবার শক দেয়া হলো পর পর কয়েকবার। মোবা হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলো।

মুকিদ জিজ্ঞেস করলো, বলবে?

মোবা কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ পরে ইব্রাহিম সাহেব আবার ফিরে এলো। মোবাকে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ইব্রাহিম সাহেব একটা ঢোক গিলে বললো, মারা গেছে নাকি?

একজন কনস্টেবল একটা মগে করে পানি এনে মোবার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই মোবা চোখ খুললো।

ইব্রাহিম সাহেব মুকিদের হাতে একটা মোবাইলের মেমোরি কার্ড দিয়ে বললো, এটা শোনাও তো মোবাকে তারপর মোবা কী বলে।

মুকিদ মেমোরি কার্ডটা তার মোবাইল ফোনে সেট করে ধারণকৃত কথাগুলো চালু করলো।

মোবা বলছে, মোন্তা একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ বস?

মতলুব তো তোমাকে বলেছে।

বলেছে কিন্তু খুন-খারাপির কাজটা আজকাল ভালো লাগে না।

কাজকে কাজ মনে করবে, যে কাজ করে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে সেই কাজ সম্মানের সঙ্গে করবে।

জি বস, কত টাকা?

পাঁচ লাখ।

দিলেন তো টাকার লোভ ধরাইয়া।

বুঝতেই পাচ্ছ পাঁচ লাখ তো আর কম টাকা না, আজকাল তোমার দিন খারাপ যাচ্ছে আর আমারও কাউন্সিলর হওয়ার সখ।

তুমি আগামীকাল এসো আমি সব বুঝিয়ে বলবো।

জি বস।

ইব্রাহিম সাহেব ইশারা করতেই মুকিদ কথোপকথন বন্ধ করলো।

ইব্রাহিম সাহেব এতক্ষণ মোবাকে আপনি আপনি বলে সম্বোধন করেছে এবার সে রেগে চোখ-মুখ লাল করে মোবার চুলের মুঠি ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে বললো, এবার বল কাজটা কী?

মোবা কোনো কথা বললো না।

ইব্রাহিম সাহেব চাপাস্বরে বললো, বলবি না?

মোবার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

ইব্রাহিম সাহেব সেই লম্বু কনস্টেবলকে ইশারা করে বললো, মোবার তো এই সামান্য চিকিৎসায় কাজ হবে না। বেটা প্রফেশনাল ক্রিমিনাল, কাজেই এতো দুর্বল চিকিৎসায় কাজ হবে না।

জি স্যার আমি দেখছি, বলে একজন কনস্টেবল বেরিয়ে গেলো। ততক্ষণ মোবার ওপর চললো ইলেকট্রিক শক থেরাপি।

ইব্রাহিম সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলো, বলবি না কাজটা কী?

মোবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, বলছি, বলছি। এক গ্লাস পানি।

মোবাকে এক গ্লাস পানি দেয়া হলো। সে এক ঢোকে পানি খেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমি, আমি খুন করিয়েছি হাসানকে।

ইব্রাহিম সাহেব জিজ্ঞেস করলো, কেনো?

আমার কাউন্সিলর হওয়ার সখ দীর্ঘদিনের। আমি একবার কাউন্সিলর দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু হতে পারিনি। হাসান পর পর দু’বার কাউন্সিলর হয়েছে, তার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি আর দলেও তার অবস্থান ভালো। তাই হাসান বেঁচে থাকতে আমার কাউন্সিলর হওয়ার আশা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না।

আর সেজন্য তুই একটা মানুষকে খুন করে ফেললি?

আমি অনেক লিডারের সঙ্গে কথা বলেছি কিন্তু কারো কাছে নমিনেশন পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস’ হতে পারিনি। তাই হাসানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না।

কোন কোন লিডারের সঙ্গে কথা হয়েছে?

মোবা কয়েকজন জেলা পর্যায়ের নেতার নাম বলে বললো কিন্তু কেউ আমাকে আশ্বস’ করেনি যে আমি নমিনেশন পাবো। তাই আমি দেখলাম হাসানকে সরিয়ে দিলেই আমি দলে অপ্রতিদ্বন্‌দ্িব হয়ে থাকবো তখন দল চাইলেও আর আমাকে নমিনেশন না দিয়ে পারবে না।

ইব্রাহিম সাহেব বললো, এখন তো তুই আর নমিনেশন পাবি না, তাহলে দল আর কাউকে পাবে না?

ওসি সাহেব আবার রুমে ঢুকে বললেন, কী হলো আমি বলেছিলাম না। মোবাই হাসান খুনের মাস্টারমাইন্ড এবং বেনিফিসিয়ারিস। তোর ধারণা ছিলো হাসান সাহেবকে খুন করলে দলে যোগ্য বলে শুধু তুমি থাকবে আর দল তোমাকে নমিনেশন দিবে। এখন দেখো দল আরো যোগ্য নেতা পায় কী না।

মোবা কাঁদতে লাগলো।

ওসি সাহেব আবার বলতে শুরু করলো, পৃথিবীতে কাউকে ছাড়া কোনোকিছু থেমে থাকবে না। এখন তুই নমিনেশন পাবি না, আরেকজন নমিনেশন পাবে, সে কাউন্সিলর হবে। আর তোর দিন কাটবে জেলখানায় ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত।

 

পঁচিশ

 

হিটলারকে ফিফটি ফোরে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে হাসান হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে রিমান্ডে নেওয়াতে আরমান সাহেবের মনে সন্দেহ দেখা দিলো। ডনের সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার নাম করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন রকমের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন আরমান জানতে পেরেছে এবং হিটলার যে ডনের সবচেয়ে কাছের সহযোগী সেটাও আরমান সাহেব জানতে পেরেছে। তাই যেদিন পুলিশ হিটলারকে আদালতে সোপর্দ করে সেদিন সন্ধ্যায় আরমান সাহেব অফিসে এসেছিল কিন্তু ডনকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি।

অন্যান্য আসামিদের রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং সবাই এক’শো চূষট্টি ধারায় স্বীকরোক্তীমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হওয়ায় পুলিশ তাদের আদালতে সোপর্দ করলো। ডনকে এর আগে পুলিশ কখনো আদালতে উপস্থাপন করেনি এবং মিডিয়া কিংবা অন্য কারো কাছে স্বীকারও করেনি। কারণ ডনকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ডনকে অপহরণ যে পুলিশই করেছে এটা একটা প্রশ্ন দেখা দিতো। পুলিশ হাসান সাহেবের হত্যাকাণ্ডের সব আসামিকে আইনের আওতায় আনতে চায় কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি না করে। তাই ডন যখন এক’শো চূষট্টি ধারায় স্বীরকোক্তীমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হয়েছে তখনই পুলিশ তাকে একবারে আদালতে সোপর্দ করেছে এবং ডনের জন্য রিমান্ড প্রার্থনা করেনি। আদালত সব আসামিকে কারাগারে প্রেরণ করলো।

থানায় অনেক মিডিয়াকর্মী এলো। অনেকেই পুলিশের সাফল্য নিয়ে প্রশংসা করলো কিন্তু কেউ কেউ ডন এবং হিটলারের সম্পৃক্তা নিয়ে প্রশ্ন তুললো, আচ্ছা ওসি সাহেব, হাসান সাহেব হত্যার সঙ্গে মোবা কাউন্সিলর জড়িত থাকতে পারে, কারণ বেনিফিসিয়ারিস মোবা কাউন্সিলর কিন্তু এই দুটো নির্দোষ কিশোরকে আপনারা গ্রেফতার করেছেন এটা কি ঠিক হয়েছে?

ওসি সাহেব মৃদু হাসলেন, পুলিশ কোনো নির্দোষ কিশোরকে গ্রেফতার করেনি, এই অপরাধে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে বলেই তাদের গ্রেফতার করেছে এবং তারা আদালতে স্বীকরোক্তীমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন শহরে এখন অনেকগুলো কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। যে বয়সে ছেলেদের হাতে থাকা উচিত ছিলো কাগজ-কলম, বই-পুস্তক সে বয়সের কিশোরদের হাতে এখন ছুরি, পিস্তল। যে বয়সের কিশোরদের মিলনমেলা হওয়া উচিত ছিলো ফুটবল-ক্রিকেট খেলা, গান কিংবা কবিতা আবৃত্তির আড্ডা সে বয়সের কিশোররা এখন মেতে উঠে গাঁজা কিংবা ফেন্সিডিলের আড্ডায়। ঘটনাক্রমে আমরা একজন ডন আর একজন হিটলারকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি কিন্তু মহল্লায় মহল্লায় যে কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলোতে অনেক কিশোর এখনো অপরাধে জড়িয়ে আছে। তারা যেনো ডন আর হিটলারের শাস্তি দেখে অপরাধজগত থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। শুধু তারা নয় গার্ডিয়ানদেরও লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের ছেলেদের দিকে, তারা কখন কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে চাইলে, সবাইকে সচেতন হতে হবে যেনো আর কোনো ডন বা হিটলার না জন্মায়।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in কিশোর উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*