রুপার বিয়ে

ক’দিন থেকে রুপা অসুস্থ বোধ করছে, মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে, সবসময় একটা বমি বমি ভাব লেগেই আছে, সে লক্ষ্য করেছে তার শরীরে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। কাকে বলবে রুপা তার এই অসুস্থতার কথা? তার মনে হচ্ছে এটা যেন অন্যরকম অসুস্থতা, অন্যরকম কষ্ট, যার সঙে সে কোনদিনই পরিচিত না। তবে কি সেদিনের পর থেকে, সেদিন তমালের সঙে-
না, না আর ভাবতে পারছে না রুপা। তবে কি সে তার শরীরে তমালের অস্তিত্ব লালন করছে? সে কি মা হতে চলেছে? তমালের সন্তানের মা!!
কিন্তু তমালের সঙে তো তার বিয়ে হয়নি, তমাল যদি তাকে অস্বীকার করে? খালা আম্মা, খালু আব্বা যদি অসতী বলে তাকেই দোষারোপ করে? না আর ভাবতে পারঠে না রুপা, তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে, পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।
আজ সকাল থেকেই রুপা ভাবছে এই কথাটা সে প্রথমে তমালকেই বলবে, কারণ তমারে সঙে মেলামেশা করার কারণেই তার মধ্যে এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তমাল কলেজ থেকে এসে কাপড় ছাড়ল। রুপা তমালের কাছে কথাগুলো কীভাবে উপস্থাপন করবে সাজিয়ে নিল তারপর তমালের ‍রুমে ঢুকল, কী রে কেমন আছিস?
রুপার বুকটা কাঁপছে, তার মুখ শুকিয়ে গেছে, সে বলল, আমি ভালো নেই তমাল।
কেন?
আমার শরীরটা খুব খারাপ করছে।
মাকে বলিসনি? ডাক্তার দেখাতো।
কিন্তু আমি ভাবছি কথাটা আগে তোমাকে বলব।
কেন?
রুপা তমালের কাছে গেল। গা ঘেঁষে বসে একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তমাল চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।
বিয়ে!
হুঁম বিয়ে।
হঠাৎ করে তোর মাথায় আমাকে বিয়ে করার চিন্তা এলো কেন? তোর বিয়ের জন্য তো গ্রামের বাড়িতে ছেলে দেখা হয়েছে, তোর বাবা আসছে তোকে নিয়ে যেতে সেখানে তোর বিয়ে হবে।
রুপা যেন আকাশ থেকে পড়ল। দু’চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। মুহূর্তেই তার কণ্ঠস্বর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, কিন্তু তুমি যে বলেছিলে আমাকে বিয়ে করবে?
ও তুই সেকথা ধরে আছিস?
এখন তুমি এভাবে বলছ!! আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করে তোমাকে সবকিছু উজাড় করে দিলাম আর এখন তুমি, তুমি আমাকে অস্বীকার করছ, তাহলে আমি যাবো কোথায়? আমার অসুস্থতার কারণও যে তুমি- বলতে বলতে রুপা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল।
মানে!
মানে। আরো খুলে বলতে হবে?
হ্যাঁ আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পাচ্ছি না।
বুঝতে পাচ্ছিস না? তবে শোন আমার পেটের ভিতর তোমার সন্তান বড় হচ্ছে, তোমার সন্তান, তুমি যদি অস্বীকার করো তবে আমি খালা আম্মাকে, খালু আব্বাকে সব কথা বলব।
কী বলবে?
বলব তমাল আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আমার সবকিছু নিয়ে এখন আমাকে অস্বীকার করছে।
তমাল রেগে গেল, তুমি আমাকে জিম্মি করছ?
জিম্মি করছি না আমি যা বলছি, সত্য বলছি।
বল, তুই তোর খালা আম্মাকে বলবি আর খালা আম্মা তোর কথা বিশ্বাস করল।
রুপা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

আরো কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করে রুপার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তারপর বমি। তার বমির শব্দ শুনে ইয়াসমিন তার রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তাকে হাত ধরে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, এ্যাসিডিটিটা বেড়ে গেছে? তোর তো সাধারণত এমন হয় না। বলে সে তার রুম থেকে একটা ঔষধ এনে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে একটু শুয়ে থাক, ঠিক হয়ে যাবে।
রুপা তবুও কিছু বলল না। ইয়াসমিনের কথামতো ঔষধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকল কিন্তু বমি বন্ধ হলো না। রুপাও কিছু বলল না, সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার খালার দিকে তাকিয়ে রইল।
পরদিন সকালবেলা ইয়াসমিন রুপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারের কাছে রুপা তমালের সঙে তার মেলামেশার কথা গোপন করল। ডাক্তার রুপার চোখ, জিহব্বার নিচে পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করল, প্রস্রাবের রঙ হলুদ হয়?
রুপা বলল, না।
মুখে সবসময় অরুচি লেগেই থাকে?
রুপা মাথা নেড়ে সায় জানালো।
ডাক্তার ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করল, পেশেণ্ট আপনার কে হয়?
ইয়াসমিন বলল, আমার আত্মীয়, মানে আমার বাসায় থাকে।
বিবাহিতা?
ইয়াসমিন তো আকাশ থেকে পড়ল, না!!
ডাক্তার কয়েকমুহূর্ত ইয়াসমিন আর রুপার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, একবার বিলিরুবিনটা দেখা দরকার আর-বলেই ডাক্তার যেন থমকে গেল। তারপর একটু সহজ হয়ে বলল, আচ্ছা ব্লাড আর ইউরিনের টেস্ট দিয়েছি রিপোর্ট নিয়ে আবার দেখা করবেন।
ডাক্তার যখন জিজ্ঞেস করল রুপা বিবাহিতা কী না তখনই ইয়াসমিনের সন্দেহ হয়েছিল তারপর আর- বলে ডাক্তার যখন থমকে গিয়েছিল তখন সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয়েছিল। তাই ইয়াসমিন টেস্ট-এর রিপোর্ট হাতে পেয়ে বোঝার চেষ্টা করল। সে চমকে উঠল বুকটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেল, ডাক্তার রুপার প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে দিয়েছিল। রেজাল্ট পজেটিভ!!
ইয়াসমিন কয়েকমুহূর্ত রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় এলো, রাস্তায় একটা কথাও বলল না। তখন বাসায় কেউ ছিল না। মুহিত উত্তরায় তার এক বন্ধুর সঙে দেখা করতে গেছে আর তমাল গেছে তার কলেজে। ইয়াসমিন বাসায় ঢুকেই রুপাকে শাসনের সুরে জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বলবি, কোন চালাকি করবি না।
রুপা ইয়াসমিনের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সে একটা ঢোক গিলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
বাসায় কেউ নেই। তারপরও আগে ইয়াসমিন কথাটা জোরে বললেও এবার চাপা স্বরে বলল, কার সঙে ঘটনাটা ঘটিয়েছিস?
রুপা কোন কথা বলল না। সে ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল। কী বলবে সে, তমাল ইয়াসমিনের একমাত্র সন্তান। ইয়াসমিন তাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে তার কথা বললে ইয়াসমিন কি বিশ্বাস করবে? কিন্তু তবু রুপাকে সত্য কথা বলতেই হবে।
ইয়াসমিন আবার ধমকের সুরে বলল, কী কথা বলছিস না কেন? বল?
রুপা তবু কোন কথা বলল না। সে শুধু বার বার করে ঢোক গিলছে আর কাঁপছে।
ইয়াসমিন এবার রুপার চুলের মুঠি ধরল, কথা বলছিস না কেন? বল?
রুপার বুকের ভেতর থেকে একটা অপমান এবং তমালের প্রতি ঘৃণা মেশানো কথা বেরিয়ে এলো, তমাল।
রুপার ধারণাই সত্যি হলো। ইয়াসমিন তার কথা বিশ্বাস করল না। চুল আরো শক্ত করে ধরে বলল, মিথ্যা কথা, তমাল এমন কাজ করতেই পারে না। আমার ছেলেকে আমি চিনি না? বল সত্যি করে বল?
বললাম তো।
ইয়াসমিন গর্জন করে উঠল, না তুই মিথ্যা বলছিস, একথা আর কখনো বলবি না, কাউকে বলবি না। যদি বলিস তো তোকে আমি, বলে ইয়াসমিন চোখ বড় বড় করে রুপার দিকে তাকিয়ে আরেক হাতে তার গলা চেপে ধরে বলল, তোকে আমি প্রাণে মেরে ফেলব।
রুপা কী করবে ভেবে পেল না। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, সে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তার কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে আসছে।
ইয়াসমিন রুপাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, কাউকে কিছু বলবি না। আমি যা যা বলব ঠিক তা তা করবি, এর এক বিন্দু ব্যতিক্রম করবি না বলে রুপাকে শাসিয়ে ইয়াসমিন তার রুমে চলে গেল।
মুহিতের এক বন্ধু আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় এক মাস হলো। আজকাল করে তার সঙে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। আজ শনিবার কিছুক্ষণ আগে সে তার বন্ধুর সঙে দেখা করার জন্য উত্তরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। ইয়াসমিন মুহিতকে ফোন করল, হ্যালো।
মুহিত কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, হ্যালো, কী হলো আবার?
ইয়াসমিন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, এই তুমি একটু বাসায় আসো তো।
আমি তো এখনো উত্তরায় পৌঁছাইনি।
আজ উত্তরা যেতে হবে না।
কেন? এত তাড়া কীসের?
আজ তোমাকে উত্তরা যেতে হবে না। তুমি এখনই বাসায় আসো।
মুহিত কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, কী হয়েছে আগে বলোতো?
ফোনে বলা যাবে না, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।
মুহিত কোনকিছু না বলে মোবাইলের লাইন কেটে দিল।

প্রায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মুহিত এলো। বাসায় ঢুকেই ইয়াসমিনের ওপর এক চট নিল, কী হয়েছে বলোতো?
আগে ভেতরে আসো, বাইরে থেকে চেঁচামেচি করো না, বলে ইয়াসমিন দরজা বন্ধ করে দিল।
মুহিত ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আগে বেড রুমে চলো, তারপর বলছি।
মুহিত বেড রুমে ঢুকল। ইয়াসমিন বেড রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চাপাস্বরে শোনো, বলে বলতে শুরু করল।
মুহিত দাঁড়িয়ে ইয়াসমিনের কথা শুনছিল সবকিছু শুনে তার মাথাটা যেন এলোমেলো হয়ে গেল, আমাদের ছেলে, তমাল এমন কাজ করেছে!! বলে সে ধপাস করে খাটে বসে পড়ল।
হুঁম আমাদের ছেলে, কী পাপ করেছিলাম যে এমন ছেলে পেটে ধরেছি!
কিছুক্ষণের নিরবতা। তারপর ইয়াসমিন প্রথমে কথা তুলল, এখন সবার আগে প্রয়োজন এই পাপ থেকে মুক্ত হওয়া।
মুহিত সরল প্রকৃতির মানুষ, একটু উদাসীন টাইপেরও। খুব সহজে ঘাবড়ে যায়, মাথার ঘিলু এলোমেলো হয়ে যায়। সে ভেঙে পড়ল। মাথা নত করে বসে রইল।
ইয়াসমিন তাড়া দিল, চুপ করে বসে থাকো না, কিছু একটা করো?
আমি কী করবো? এই কলঙ্কের কথা কাকে বলব? কাকে বলব যে আমার ছেলে–, বলে সে আর বলতে পারল না, ঘৃণার সুরে বলল, ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!

তমাল বাসায় ফিরল সন্ধ্যা নাগাদ। প্রতিদিন মা দরজা খুলে দিয়েই তমালকে জিজ্ঞেস করে, কী রে দেরি করলি কেন? মুখটা শুকনা কেন? ইত্যাদি, ইত্যাদি। সাধারণত মায়েরা যেসব কথা বলে কিন্তু আজ ইয়াসমিন তার মুখের দিকে তাকালো না। তমাল কিছুটা অনুমান করল, মায়ের মাথা নিচু করে মুখ কালো করে দরজা খুলে দেয়ায় ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। সে কিছু বলল না। সোজা তার রুমে চলে গেল।
তমালের ডাক পড়ল কয়েক মিনিট পরই। মায়ের গম্ভীর কণ্ঠের ডাক, ডাকটা তমালের কানে ভয়ঙ্কর শোনাল, তমাল এ রুমে আয় তো।
তমাল কোন কথা বলল না। তার রুম থেকে মায়ের রুমে গেল। বাবা যে বাসায় আছে তমাল আগে বুঝতে পারেনি। সাধারণত মুহিত বাসায় থাকলে চুপ করে রুমে বসে থাকে না। তমাল বাসায় পা দিয়েই বাবার উপস্থিতি টের পায়। অবশ্য বাবা-মা’র সঙে তার সম্পর্কটা ভয় পাবার মতো না, আতঙ্কেরও না, গার্জিয়ান আর সন্তানের মতো না, যেন একেবারে বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু আজ যেন বাবাকেও তার ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো। তার চিরপরিচিত বাবা-মা’কে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হলো।
মুহিত বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে, ফ্যানটা জোরে চালু করা আছে কিন্তু তারপরও সে শুধু ঘামছে। ইয়াসমিন মুহিতের পায়ের কাছে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে আছে। দু’জনের চোখে-মুখে যেন একটা দুশ্চিন্তা, একটা অনিশ্চয়তা, একটা গভীর আতঙ্কের ছাপ পড়েছে।
এতক্ষণে তমালের কাছে বিষয়টা ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার মুখের ওপরও একটা কালো মেঘ জমেছে, হৃৎপিণ্ডটা দ্রুতগতিতে চলছে। সে রুমে ঢুকে মাথা নত করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ইয়াসমিন বরাবরই কোন কথা বলার আগে ভনিতা করে, অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে কথা বলে, আজ তার কোনটিই করল না। সোজাসোজি জিজ্ঞেস করল, রুপার সবর্নাশ করেছিস কেন?
তমাল অস্বীকার করার চেষ্টা করল, রুপার!!
ইয়াসমিন তমালর গালে ঠাস করে একটা চড় মারল, মনে হয় বুঝতে পাচ্ছিস না?
তমাল আর কোন কথা বলতে পারল না।
এজন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম, না? এজন্য তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চাচ্ছি, না? একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের জীবনটা নষ্ট করার জন্য…
তমালর দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। সে আর অস্বীকার করতে পারল না।

রুপার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চরে। চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে রুপা সবার বড়। বাবা দিনমজুর। এই অষ্টমীর চরে সারা বছর কাজ থাকে না, আশ্বিন-কার্তিক এই দু’মাসকে এ অঞ্চলে মঙ্গার মাস বলে। মঙ্গার এ দু’মাস বাবা হারু মিয়া প্রায় বেকার থাকে, তখন প্রায় দিনই ভাত রান্না হয় না। কোনদিন কারো বাড়ি থেকে ভাত চেয়ে এনে ভাগাভাগি করে খেয়ে দিন কাটাতে হয়। অনেক দিন ক্ষুধার জ্বালায় ঘুম হয়নি, তখন রুপার মনে হতো পৃথিবীতে ক্ষুধার জ্বালাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট।
রুপার দূর-সম্পর্কের এক ফুপু এমনি এক মঙ্গার দিনে এলো তাদের বাড়িতে। কথায় কথায় রুপার মা তাদের অভাব অভিযোগের কথা বলল। হরুরই বা দোষ কী? খালি হাতের ওপর এতবড় একটা সংসার ও চালাবে কী করে? তারওপর মঙ্গার সময় তো আবার কাজ থাকে না।
রুপার মা ফিসফিস করে বলল, আপা বাচ্চাগুলো আজ সারাদিন কিছু খায়নি, মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আপনার ভাই গেছে জোড়গাছ হাটে, পকেটে একটা টাকাও নেই, কী যে বাজার থেকে আনবে আর বাচ্চাগুলোর মুখে দিব সেই চিন্তায় কুলোতে পারছি না, বলতে বলতে রুপার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল।
রুপার এই ফুপুটিও গরীর কিন্তু তার তার স্বামী নৌকার মাঝি, কাজেই তার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। তাদের দিনে দু’য়েকবার ভাত জোটে।
তছিরন বলল, আমি তোমার কাছে একটা কাজে এসেছি।
রুপার মা কষ্টের হাসি হেসে বলল, আমাদের কাছে আবার কী কাজ?
ক’দিন আগে তোমার দুলাভাই বাড়িতে গিয়ে বলল, ঢাকার এক সাহেব একটা মেয়ে চেয়েছে তার বাড়িতে কাজ করার জন্য।
রুপার মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হলো, সাহেবের বাড়ি কোথায়?
কুড়িগ্রাম।
আজ রাতে একবার হারুর সঙে আলাপ করো যদি দিতে চাও তো তোমার দুলাভাইকে বলো, ও এসে রুপাকে নিয়ে যাবে। তবে প্রথমবার রুপার সঙে হারুকেও ঢাকা যেতে হতে পারে।
রুপা অদূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুপু আর তার মায়ের কথা শুনছিল। মা তাকে কাছে ডেকে নিল, রুপা যাবি?
কোথায় মা?
ঢাকা।
রুপা সারাদিন কিছু খায়নি। দূপুর এবং বিকেলে পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছে। তার এই দূর-সম্পর্কের ফুপুকে তার খুব আপন, খুব কাছের মনে হলো। রুপার চোখের সামনে এক থালা ভাতের ছবি ভেসে উঠল। তার দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। রুপা জিজ্ঞেস করল, ওরা ভাত খেতে দিবে?
রুপার একথার উত্তর দিল তার ফুপু, হ্যাঁ শুধু ভাত কেন? কাপড়-চোপড়ও দিবে, বড়লোক মানুষ ওদের কি আর টাকার অভাব আছে? বলে তছিরন রুপার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রুপা বড় হলে ওর বিয়ের সময় ডিমান্ডের জন্য টাকাও দিবে।
রুপার মায়ের দু’চোখ পানিতে ভরে গেল। দু’য়েক ফোঁটা পানি গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। সে রুপাকে আবার জিজ্ঞেস করল, যাবি মা?
রুপা একবার মাথা উঁচু আরেকবার নিচু করে তার সম্মতি জানালো।

কয়েকদিন পরই হারু আর মুহিতের ভাই রুপাকে রেখে গেল ঢাকা। রুপার ভাতের কষ্ট দূর হলো, ক্ষুধার জ্বালা থেকে সে মুক্তি পেল। মুহিত ভালো মানুষ, ইয়াসমিনও খারাপ নয়। তিনবেলা ভাত খেতে দেয়, ঈদ, কোরবানি ঈদে জামাকাপড় কিনে দেয়। তার বাবা-মাকেও শাড়ি-লুঙি কিনে দেয়। রুপা মুহিতকে খালু এবং ইয়াসমিনকে খালা আম্মা বলে ডাকে। দীর্ঘ সাত/আট বছর এবাড়িতে থাকতে থাকতে সে এ বাড়িটাকে অনেকটা আপন করে নিয়েছে। আপন করে নিয়েছে খালা, খালু আর তাদের একমাত্র সন্তান তমালকে।

রুপার বয়স এখন কত হবে? ষোল কিংবা সতেরো। কয়েকমাস আগে রুপা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। তখন বাবা-মাকে বলতে শুনেছে তার বিয়ের কথা। কথাটা তার বাবা মুহিতকেও বলেছে, মুহিত তার প্রতিশ্রুতি মতো যৌতুকের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে। ইয়াসমিন দিতে চেয়েছে কানের দুল। তারপর শুরু হয়েছে রুপার জন্য পাত্র দেখা। ক’দিন আগে হারু ফোন করে মুহিতকে জানিয়েছে রুপার বিয়ের কথা। আগামীকাল বাবা রুপাকে নিতে আসবে অথচ আজ তার জীবনে এক চরম অনিশ্চয়তা।

রুপা আর অষ্টমীর চরের সেই শ্যামলা বর্ণের, চোয়াল ভাঙা রুপা নেই। দীর্ঘদিন ঢাকা শহরে ছাদের নিচে আর ফ্যানের বাতাসে থেকে তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল রুপাকে দেখে আর সহজে কেউ সেই রুপাকে খুঁজে পাবে না। তার চেহারায় যেন এক প্রকার ঔজ্জ্বলতা এসেছে, শরীরে মাংস বেড়েছে, সে এখন ভরপুর যৌবনের এক তরুণী। শুধু চেহারায় নয়, শৈশবে রুপা একটা এন.জি.ও’র স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে তার সেই একাডেমিক শিক্ষার কোন উন্নতি হয়নি কিন্তু ঢাকায় সে তার খালা আম্মার গল্পের বই আর প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে পড়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তার কথাবাতার্য় আধুনিকতা এসেছে রুপা এখন শুধু তরুণীই নয়, আধুনিক এক তরুণী।

তমাল রুপার চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়। একসঙে ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছে। মুহিত আর ইয়াসমিন দু’জনকে ছোটবেলা থেকে একই চোখে দেখেছে, ধীরে ধীরে রুপা ভুলতে বসেছে যে সে এ বাড়ির গৃহপরিচারিকা। তমাল এখন কলেজে পড়ে। দু’জনের এক সময়ের খেলার সাথীর মধ্যে যেন একটা অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
রুপর জগত খুব ছোট, শৈশবে ব্রহ্মপুত্র নদের অষ্টমীর চর এবং কৈশোর আর তারুণ্যে ঢাকা শহরের একটি বাসার চার দেয়াল। তার জীবনে পুরুষ মানুষ বলে তার বাবা, খালু আর তমাল। বাবার কথা মনে পড়লে তার দু’চোখে পানি এসে যায়, খালুকেও সে শ্রদ্ধা করে বাবার চেয়ে কোন অংশে কম নয় কিন্তু তমালর বেলায় যেন বুকটা অন্যরকম হয়ে যায়। তমালের চোখের দিকে তাকাতেই রুপার বুক যেন কেমন কেমন করে, রুপার বুকে একটা ঢেউ বার বার করে প্রতিরোধের পাড় ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। রুপা ব্রহ্মপুত্র নদের ঢেউ দেখেছে, পাড় ভাঙ্গা ঢেউ। কাশবন দেখেছে, ছোটবেলা কাশবনে লুকোচুরি খেলেছে, শরতে আকাশের চাঁদ দেখেছে, দেখেছে চাঁদের সঙে মেঘের লুকোচুরি খেলা কিন্তু তমালের চোখের দৃষ্টি রুপার হৃদয়ের প্রতিরোধের দেয়াল ভাঙ্গা ঢেউ, তমালের সঙে তার লুকোচুরি খেলা। এসব তমালকে তার ভালোবাসা কী না।

তমালের সঙে তার শুধু লুকোচুরি খেলাই না কখনো কোন কারণে দরজা খুলে দিতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ কিংবা ইচ্ছাকৃত দুষ্টামির কারণে তমালর হাতের সামান্য ছোঁয়ায় তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়। রুপা জানে না এটাকে প্রেম বলে কী না।

একদিন তমাল কলেজ থেকে এলো নিত্যদিনের চেয়ে অনেক আগে। এমন যে কোনদিন আসে না তা নয়। আবার বাসায় কেউ না থাকলেও তমাল আর সে বাসায় থেকেছে খুব স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেদিন যেন রুপার একটু ভিন্ন রকম মনে হলো। রুপার মনের মধ্যে তখন বিয়ের বউ সাজসাজ ভাব। সে তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। তমালর কলিং বেল এর ধরণ সে বোঝে। তাই সে একটু লজ্জা পেল। কয়েক সেকেন্ড আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সহজ হলো। তারপর দরজা খুলে দিল, কী রে দরজা খুলে দিতে দেরি হলো যে?
রুপা লজ্জায় কিছুটা রাঙা হয়ে গেল, কাজ করছিলাম।
কী কাজ?
বাসায় কত কাজ থাকে, তুমি ছেলেমানুষ তুমি আর কাজের কী বুঝবে।
আচ্ছা, বলে তমাল তার রুমে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পর তমাল কাপড় ছেড়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, এই রুপা, একটু এদিকে আয় তো।
ডাকটা স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু রুপা যেন চমকে উঠল।
রুপা কোনকিছু না বলেই তমালর রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। এমন কতদিন তো বাসায় কেউ না থাকলেও রুপা তমালের রুমে ঢুকেছে, কাজ করেছে, দু’য়েকটা খোশগল্পও করেছে কিন্তু আজ তার বুকের তেতরটা কেমন যেন ওলট-পালট করে উঠল, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? ভিতরে আয়।
রুপা মাথা নত করে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। এক অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, নিজের অজান্তে মুখ থেকে অষ্ফুট একটা কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো, না!
তমাল রুপার একটা হাত ধরে তাকে রুমের ভেতরে নিয়ে গেল। তমাল তার হাত ষ্পশ করতেই আগের আছড়ে পড়া ঢেউটা আরো যেন উত্তাল হলো, রুপা একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার হাত যেন ততক্ষণে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে।
রুপা তমালর রুমে যাওয়ার আগে মাথায় ওড়না দিয়ে ভালো করে বুক ঢেকেছে, ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। তমাল রুপার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুপার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে তার থুতনি উঁচু করে ধরে বলল, তুমি খুব সুন্দর রুপা, খুব সুন্দর!!
নিজের প্রশংসা শুনে রুপার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।
রুপা একবার ডাইনে-বাঁয়ে তাকালো, তার তাকানো দেখে মনে হলো কেউ নেই জেনেও সে যেন কাউকে খুঁজছে, যেন একটা আশ্রয়।
তমাল রুপার একটা হাত ধরে আরেকটা হাত পিঠে দিয়ে এক’পা-দু’পা করে বিছানার দিকে নিয়ে গেল। রুপা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার মৃদু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। একটা লজ্জা, একটা অজানা আশঙ্কায় রুপা কিছু বলতে পারছিল না। তার তোলপাড় বুকের ভিতর থেকে একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো, আমার খুব ভয় লাগছে তমাল।
কীসের ভয়?
কেউ যদি জানে? যদি কিছু হয়?
কেউ জানবে না, তোর কিচ্ছু হবে না।
আমাকে ছেড়ে দাও তমাল, তুমি তো জানো আর ক’দিন পর আমার বিয়ে, আর তুমি কী না-
তমাল রুপার কথা শেষ হতে দিল না। তার মুখে হাত দিয়ে বলল, না অন্য কারো সাথে তোর বিয়ে হবে না।
তারমানে?
মানে, আমিই তোকে বিয়ে করবো।
সত্যি বলছ?
তমাল আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, সত্যি, সত্যি, সত্যি।

আজ গভীর রাতে, নিদ্রাহীন, দুশ্চিন্তগ্রস্থ, অনিশ্চয়তার এই রাতে তমালর কথাগুলো রুপার কানে বার বার বেজে উঠল। সে বিছানা থেকে উঠে তমালর রুমের দিকে গেল। তমাল কোনদিন রুমের দরজায় ছিটকানী লাগায় না। রুপা দরজায় হাল্কা ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। রুপা দরজার ছিটকানীটা লাগিয়ে দিয়ে তমালর বিছানায় কোণায় বসে চাপাস্বরে ফিসফিস করে ডাক দিল, তমাল, এই তমাল।
তমাল চমকে উঠল, ঘুমের মধ্যে জিজ্ঞেস করল, কে?
এই চুপ, আমি রুপা।
রুপা তুই আমার রুমে? কেন?
হুঁম তোর সঙে আমার কথা আছে।
তমাল দু’হাতে চোখ কোচলাতে কোচলাতে বলল, আমার সাথে কী কথা?
রুপা কিছুটা রাগের সুরে বলল, কী কথা, না? মনে হয় কিছু হয়নি।
কী হয়েছে বলোতো?
তমাল তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে না?
আমি তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম? কই না তো। আমি তোকে বিয়ে করতে চাবো কেন? আর আমি তোকে বিয়ে করতে চাইলেই বুঝি বাবা-মা মেনে নিবে?
রুপা তমালর বাহুতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই তমাল তুমি কী বলছ? তুমি কি এখনো ঘুমের মধ্যে আছ?
এবার তমাল স্বাভাবিক গলায় বলল, না আমি ঘুমের মধ্যে নেই একেবারে জেগে আছি।
চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।
তমাল দৃঢ় কণ্ঠে বলল, অসম্ভব, আমি তোকে বিয়ে করবো?
হ্যাঁ, আমাকে বিয়ে করবে। সেদিন যে তুমি আমাকে বললে, আমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে হতে দেবে না। আমাকে তুমি বিয়ে করবে। আর সেজন্যই তো আমি-বলতে বলতে রুপার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
রুপা তুমি এত বোকা কেন? কখন কোনদিন আবেগের বশে আমি তোকে বলেছি আমি তোকে বিয়ে করবো আর তুই বিশ্বাস করেছিস। সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না।
তুমি বিয়ে করতে না চাইলে কি আমি… ছিঃ ছিঃ ছিঃ রুপা নিজেকে ধিক্কার দিল।
তমাল কোন কথা বলল না।
রুপা বলল, তুমি একটা ভণ্ড, প্রতারক, আমাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন সাধু সেজেছো, না?
তমাল বিরক্তির সুরে বলল, যা ভাগ, এতরাতে সিনক্রিয়েট করিস না।
আমি সিনক্রিয়েট করছি? এখনো সিনক্রিয়েট করিনি, তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, আমার পেটের বাচ্চাকে অস্বীকার করো তবে মনে বেখো, আমিও তোমাকে ছাড়বো না।
কী করবে তুমি?
তোমাকে কিছু করবো না, এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে আমি নিজেই দুনিয়া থেকে চলে যাবো।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
না ভয় দেখাচ্ছি না, সত্যি কথা বলছি। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো তবে এই ঘুম থেকে উঠে তুমি আমার লাশ দেখবে।

লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে মুহিত যেন মাটির সঙে মিশে গেছে। সে দিনের বেলা বাসায় থাকলে সবসময় কারো না কারো সঙে কথা বলে, অনেক রাত অবধি ইয়াসমিনের সঙে কথা বলে কিন্তু আজ তার মুখে কোন কথা নেই। উত্তরা থেকে ফিরে ইয়াসমিনের কাছ থেকে সবকিছু শুনে তার মুখের ওপর একটা গভীর কালো মেঘের ছায়া পড়েছে। এখন রাত বারোটা বাজে। সাধারণত এত রাত মুহিত জেগে থাকে না, আজ তার চোখে ঘুম নেই। ইয়াসমিন সেই যে সন্ধ্য্যা থেকে কাকে কাকে ফোন করছে তার কোন শেষ নেই এখন সেও অনেকটা ক্লান্ত। কিন্তু ঘুম আসছে না, বিছানায় সেও ছটফট করছে।
মুহিত জিজ্ঞেস করল, কী হলো?
কই কিছু তো হলো না, কাল ওকে নিয়ে ক্লিনিকে যেতে হবে। আগে এম.আর করা দরকার, তারপর যা হয় হবে।
কোন সমস্যা হবে না তো?
কী সমস্যা হবে?
ছোট মেয়ে এম.আর করতে গিয়ে যদি কোন সমস্যা হয়।
আমি সে চিন্তা করছি না।
তো?
আমি ভাবছি হারুর কথা।
হারুর কথা বলতেই মুহিত চমকে উঠল, ও তোমাকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম।
কী কথা?
কাল হারু ফোন করেছিল।
কী বলল? ইয়াসমিন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
বলল রুপার বিয়ে এক সপ্তাহ পিছিয়েছে।
ইয়াসমিন যেন প্রাণ ফিরে পেল, এমন একটা খবর তুমি আমাকে বলতে ভুলে গেলে? যাক বাঁচা গেল।
কেন?
এই এক সম্পাহের মধ্যে রুপাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আল্লাহর অশেষ রহমত, রুপার বিয়েটা না পেছালে আরো কী যে হতো।
কী করবে এখন?
সবার আগে রুপাকে পাপ মুক্ত করতে হবে। পাপ মুক্ত।
মুহিত বিছানা থেকে উঠল। ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকালো। আজ একদিনেই ইয়াসমিনের চেহারায় যেন বয়সের ছাপ বেড়ে গেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মুহিত ইয়াসমিনের কপালে একটা হাত রাখল। ইয়াসমিনও বিছানা থেকে উঠে বসল। মুহিত কথাটা উপস্থাপন করতে গিয়ে একটা ঢোক গিলল, ইয়াসমিন তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি?
ইয়াসমিন ধীর শান্ত কণ্ঠে বলল, বলো।
আচ্ছা রুপা তো আমাদের সঙে অনেক বছর থেকে আছে।
হ্যাঁ।
তুমি কি মেয়েটার খারাপ কিছু দেখেছ?
ইয়াসমিনের চোখের সামনে ফুটে উঠল রুপার সুন্দর জ্বলজ্বলে, নিষ্পাপ একটা মুখ। এই মুখ ইয়াসমিন সাত-আট বছর থেকে দেখে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে রুপা কোনদিন একটা মিথ্যা কথা বলেনি, যেকোন বিষয়ে এতটুকু চালাকি করেনি। কোনদিন খাবার পাতিল থেকে একটা দানা না বলে খায়নি, এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে সে দোষারোপ করবে কীভাবে? আর তমাল? যাকে সে নিজের পেটে দশ মাস দশ দিন ধারণ করেছে, শৈশব থেকে তিল তিল করে লালন-পালন করেছে। নিজের আদর্শ দিয়ে মানুষ করেছে সে তার আদর্শকে এমনভাবে জলাঞ্জলি দিলো? তার মান-সম্মান এমনভাবে মিশিয়ে দিল। এই ঘটনা যদি ফাঁস হয়ে যায় তবে তাদের সম্মান থাকবে কোথায়? আত্মীয়-স্বজন, মিডিয়া, নারী অধিকার সংগঠনগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগবে। এতো গেল আইন আর সমাজের কথা। আর বিবেক? নিজের বিবেকের কাছে সে কী জবাব দিবে?
ইয়াসমিন না সূচক মাথা নাড়ল।
এত অল্প বয়সে মেয়েটা এতবড় একটা ধকল সইতে পারবে?
তাছাড়া আর কী করার আছে?

সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই ইয়াসমিন রুপার কাছে গেল। ইয়াসমিনকে দেখে রুপা চমকে উঠল, খালাম্মা।
ইয়াসমিন রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মা।
রুপা বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করল, কেন খালাম্মা?
তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
কোথায় খালাম্মা?
এত কথা জানতে চাবি না রুপা। আমার ওপর তোর বিশ্বাস নেই।
রুপা কিছুটা অনুমান করতে পারল। সে মনে করেছিল ইয়াসমিন তাকে খোলামেলা করে বলবে। কিন্তু সে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে শুরু করল, তুই তো বুঝতেই পাচ্ছিস আমরা সবাই তোর ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আর কিছু প্রশ্ন করবি না মা, আমি যা যা বলছি ঠিক তা তা করবি। মনে কর আমি তমাল আর তোর দু’জনেরই মা।

রুপা ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকালো, না ইয়াসমিনের চোখে মুখে কোন চাতুরতা নেই একটা অসহায়ত্ব আছে, দুঃশ্চিন্তায় এই এ’কদিনেই তরতাজা মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। রুপা আর কথা বাড়ালো না।

এতক্ষণ ইয়াসমিন রুপার চৌকির কোণায় বসেকথা বলছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মা। আমি আসছি।

রাজধানীর কোন নামী-দামি ক্লিনিক না। হাসপাতালে চাকুরি করা এক নার্সের বাসা। এ ধরণের কেইসে কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে গেলে অনেক ঝুঁক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়, অনেক সময় পুলিশ কেইস হয়ে যায়। এসব ভেবেই ইয়াসমিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই নার্সের ঠিকানা পেয়েছে। তার সঙে মোটা অঙ্কের টাকার দফা-রফা হয়েছে। সবকিছু ঠিকই ছিল, সফলভাবে এম.আর সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু শেষ র্পযন্ত মুহিত যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। নার্স বলেছিল কিছুক্ষণ পরই ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরও বন্ধ হলো না। মুহিত বেশ চিন্তায় পড়ল। সে বার বার করে ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করল, দেখো আর মনে হয় দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। নাকি কোন ক্লিনিকে নিয়ে যাবো?

কিন্তু শেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াসমিন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অবস্থার আরো ‍অবনতি হওয়ায় মুহিত আর ইয়াসমিনের কথা শুনল না। ফোন করে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলো কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম, এ্যাম্বুলেন্স এগোচ্ছ খুব ধীর গতিতে আর রুপার অবস্থার অবনতি হচ্ছে দ্রুতগতিতে। আর কয়েক’শ ফুট দূরেই ক্লিনিক, রুপা একবার চোখ তুলে তাকালো, ইয়াসমিন রুপার মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে বলল, এখন ভালো লাগছে মা?

ঢাকা শহর কত বড়, এখানে কত বিচিত্র মানুষ, চোখের সামনে বিল্ডিংগুলো কীভাবে তরতর করে বেড়ে উঠছে। ব্রম্মপুত্রের চর থেকে ঢাকা আসার সময় ক্ষুধার্ত রুপার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল এক থালা ভাত আর একদিন চিলমারীতে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে টি.ভি’তে দেখা ঢাকা শহর। খুব সুন্দর আলো ঝলমলে রুপকথার মতো শহর ঢাকা। ঢাকায় এসে সেই স্বপ্নের এক থালা ভাত পেয়েছে, ক্ষুধা কী তা এই ক’বছরে সে টেরও পায়নি। রুপার ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে, ক্ষুধার জ্বালা থেকে মু্ক্তি পেয়েছে কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে গিয়ে সে যা হারিয়েছে তা তার জীবনের অমূল্য সম্পদ। তার সম্ভ্রম, যা নারীরা জীবন দিয়ে রক্ষা করে। আর সে! সে কী না সরল বিশ্বাসে উজাড় করে দিয়েছে মিথ্যা বিয়ের প্রুতিশ্রুতিতে। নিজের ওপর রুপার ঘৃণা হলো।

আর তার কাছে রুপকথার মতো আলো ঝলমল ঢাকা শহর! তার কাছে ঢাকা শহর আবার আলাদা কী? সেতো সেই যে চার দেয়ালে বন্দি বাসায় ঢুকেছে আর বেরোতে পারেনি। এই ক’বছরে রুপা বাসা থেকে বেরিয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার। সে ঢাকা শহর দেখেছে জানালায় দাঁড়িয়ে। আগে বাসা থেকে দূরে দেখতে পেতো, অন্ততঃ কয়েক’শ ফুট দূরে, তারপর কাছাকাছি অনেক বড় বড় বিল্ডিং গড়ে উঠল। রুপা আগে বাসার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে যে ঢাকা শহর দেখতো তা আর দেখা হলো না।

এই তো কয়েক মাস আগে ইয়াসমিন একবার রুপাকে মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল। মার্কেক কী? না মার্কেট না মেলায়। আসলে ইয়াসমিন তাকে নিয়ে গিয়েছিল মেলায় কিছু কেনাকাটার জিনিস ক্যারি করার জন্য। এই যেমন: ঝাড়ু, বালতি, পিঠা বানানোর বেলন ইত্যাদি। রুপার চোখ ঝলসে গেছে সেই আলোক সজ্জায়। এটা যেন মেলা না রুপার কাছে অন্য এক পৃথিবী। হ্যাঁ সত্যি রুপার কাছে অন্য এক পৃথিবী! ব্রম্মপুত্রের চরে আমাবশ্যার অন্ধকারে রুপার কাছে সবকিছু আলোর মতো পরিস্কার। আর এই ঢাকা শহর! আলো ঝলমল এই ঢাকা শহর যেন রুপার কাছে আমাবশ্যার চেয়ে অন্ধকার। এখানকার অনেক কাছের মানুষগুলোও যেন একেবারে অপরিচিত। এই যে ইয়াসমিনকে রুপা খালাম্মা বলে ডাকে সে কি রুপাকে কোনদিন আপন করে নিয়েছে? প্রথম থেকেই রুপাকে তুই তুই বলে সম্বোধন করেছে। আজ রুপা যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন রুপাকে মা বলে সম্বোধন করেছে এটা কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত না? রুপার চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রতারক তমালের ছবি, সে একবার চোখ মেলে তাকালো তার চোখের সামনে বসে আছে বসে আছে ইয়াসমিন। রুপা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। দু’চোখ বন্ধ করতেই স্নেহময়ী মায়ের ছবি ভেসে ‍উঠল, ভেসে উঠল এক নৌকা বরযাত্রীসহ এক অপরিচিত বরের ছবি। রুপা একটা জোরে নিঃশ্বাস নিল, যেন কষ্টের শেষ নিঃশ্বাস। মেহেদি মাখা হাত দু’টো ছড়িয়ে পড়ল এ্যাম্বুলেন্সের সিটে।
সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*