শেষ অধ্যায়

শাহাদত হোসেন জন্মগ্রহণ করেছেন গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, বাবার একমাত্র সন্তান, দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি সেকালেও যেমন দেশে সোনার হরিণ ছিল একালেও তেমনিই আছে। সোনার হরিণ একবার কেউ পেলে হাতছাড়া করেছে এমন নজির বুঝি দেশে খুব একটা নেই। অনেকেই ভালো চাকরি পেলে আগে ভালো চাকরিতে যোগদান করে তারপর আগের চাকরিতে ইস্তফা দেয় আর না হয় সেই সোনার হরিণই হয় তার পুরো জীবনের রুটি-রুজির একমাত্র ভরসা, তাতে যদি একটু রয়ে-সয়ে চলতে হয়ে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মন বুঝে কিংবা মর্জি মাফিক চলতে হয় তাই চলে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখের ভাব বুঝে মহোদয় হা করলে হাঁস, হাঙ্গর নাকি হাতি বলতে হয় সেকথাও বুঝতে হয়। কর্মকর্তাদেরও বিভাজন আছে, পদ-পদবি অনুযায়ী আছে তৈল মর্দনের স্তর। যেমন যদি কারো এক ধাপ ওপরের কর্মকর্তা হা করে তাহলে বুঝতে হবে হাঁস, যদি দু’ধাপ ওপরের হয় তাহলে বুঝতে হবে হাঙ্গর আর যদি তিন ধাপ ওপরে হয় তবে বুঝতে হাতি। স্তর না বুঝে তৈল মর্দন করলে হতে পারে হিতে বিপরীত। বিষয়টা মোটামুটি এরকমই।

ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর জন্য কিছু অনিয়ম হয়তো করত, তাছাড়া সাধারণ অফিসগুলো চলতো নিয়ম মেনে, রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন মেনে। শাহাদত সাহেবও তাই জানতেন কিন্তু চাকরি করতে এসে তিনি একাধিক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন। চাকরিতে তিনি বেশিদিন টিকতে পারলেন না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কারণে একে একে তিনটি চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার দ্বিমত হওয়ার কারণও সংগত, তিনি ছিলেন প্রতিবাদী মানুষ। কর্তাব্যক্তিদের কোনো কাজে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিকূলে গেলে তিনি লাফিয়ে উঠতেন, জোরালো প্রতিবাদ করতেন, তার প্রতিবাদের ভাষাটাও ছিল একটু অন্যরকম। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে লিখতেন, বদলি করে দিতেন, তিনি তল্পিতল্পাসহ চলে যেতেন নতুন কর্মস্থলে, যেখানেই যেতেন সেখানেই তার সেই পুরানা রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। আবার চাকরি ছেড়ে বাসায় আসতেন।

শাহাদত সাহেব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সারাজীবন সব পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছেন। তেমন লেখাপড়া করতেন না, ক্লাসের সময়টুকু ক্লাস করতেন নিয়ম মেনে, ক্লাস চলাকালীন কেউ কথা বললে তিনি দাঁড়িয়ে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করতেন, শ্রেণি শিক্ষক অভিযোগ আমলে না নিলে চলে যেতেন প্রধান শিক্ষকের কাছে, এমনকি কোনো ক্লাসে শিক্ষক আসার সময় কয়েকমিনিট পেরিয়ে গেলেই চলে যেতেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। প্রতিটি ছোট ছোট অন্যায়েরও তিনি প্রতিবাদ করতেন সেই শৈশব থেকে। এই প্রতিবাদের ভাষা কখনো কখনো শিক্ষকদের জন্যও বিব্রতকর হতো কিন্তু শিক্ষকরা তার নিয়মানুর্তিতা, তার প্রতিবাদী আচরণ স্নেহের চোখে দেখতেন। দেখার কারণ হলো তিনি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা তার বিদ্যা-বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হতেন। তারা আশাবাদী ছিলেন শাহাদত একদিন অনেক বড় অফিসার হবে, তাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, এলাকার মুখ উজ্জ্বল হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রায় বছর দু’য়েক আগে শাহাদত সাহেবের বাবা মারা গেছে, শাহাদত সাহেব কলেজের ছাত্র ছিলেন। আবেগপ্রবণ, প্রতিবাদী তরুণ শাহাদত মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্থতি নিলেন। মা তাকে যুদ্ধে যেতে দিতে রাজি হলেন না কিন্তু শাহাদত নাছোড়বান্দা, তিনি তার মাকে প্রথমে বুঝালেন কিন্তু তার মা যখন তবুও রাজি হলেন না তখন মায়ের ওপর প্রচণ্ড রেগে বললেন, মা তুমি যদি আমাকে যুদ্ধে যেতে না দাও তবে আমি কিন্তু পালিয়ে যাবো।

মা কেঁদে ফেলল, তুই যদি আমাকে ছেড়ে যাস তবে আমি কাকে নিয়ে থাকবো বাবা। তোর চাচা গেছে, আমাদের মধ্য থেকে তো একজন গেলেই হলো বাবা।

একজন কেনো মা? সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে, তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও, এমনিভাবে সব মায়েরা যদি তাদের সন্তানদের বুকে আগলে রাখে তবে দেশটা স্বাধীন করবে কে?

মা শাহাদতকে বুকে টেনে নিল, তুই আমার একমাত্র সন্তান বাবা, তাই আমি কোনোভাবে তোকে হারাতে চাই না।

যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হয় তবে তোমরা চাইলেও আমাকে বাঁচাতে পারবে না মা আর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমি যদি বেঁচে নাও থাকি তবে লক্ষ লক্ষ মায়ের সন্তান বেঁচে থাকবে। তারাই তোমার সন্তান হবে মা।

তুই এতো কথা জানিস কী করে বাবা, এতটুকু একটা ছেলে সেদিন দুনিয়ার মুখ দেখলি অথচ মাকে কথায় হারিয়ে দিস আর এমন সব আবেগপ্রবণ কথা বলিস… বলে মা শাহাদতের কপালে একটা চুমু দিয়ে কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, যা বাবা, আমি তোকে দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ফিরে আসিস।

শাহাদত মায়ের কথা রেখেছে, কয়েকমাস পর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশে ফিরেছে কিন্তু সেই পতাকা মাকে দেখাতে পারেনি। তখন প্রতিটি বাড়ি খুঁজে খুঁজে মুক্তিযোদ্ধা বের করা হচ্ছে, শাহাদতের পাড়ার অনেকেই প্রাণভয়ে পালিয়ে গেছে, কয়েকজন পুরুষ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কথাটা রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসরদের কানে যায়। একদিন তাদের পাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী অগ্নিসংযোগ করে। পাড়ার বেশিরভাগ ঘর ছিল ছনের, মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল পুরো পাড়ায়। কেউ বাড়ি থেকে কোনো মালামাল বের করতে পারেনি এমনকি অনেকেই জীবন নিয়েও বের হতে পারেনি। তাদের মধ্যে শাহাদতের মা একজন। সে বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি, তার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেদিন শাহাদত সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সেদিন তার চোখের সামনে তাদের ভস্মীভূত বাড়ি আর বিদায়লগ্নে মায়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তিনি অনেকক্ষণ সেই ধ্বংস স্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন, তার দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে, হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। তিনি আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন, স্বাধীনতা, হায় স্বাধীনতা, তুমি এলে না, তোমাকে আমাদের ছিনিয়ে আনতে হলো রক্তের বিনিময়ে, মায়ের জীবনের বিনিময়ে…

শাহাদতের কিছুই বাকি রইল না, তার বাবা-মা নেই, বাড়িঘর নেই, রইল শুধু একটা দেশ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আলোবাতাস, মাটির গন্ধ, সবুজ ধানক্ষেত। শাহাদতের দেখাশুনা দায়িত্ব নিলেন তার এক মামা, শাহাদতের বাড়ি থেকে মামার বাড়ি কয়েক কিলোমিটার দূরে। শাহাদত মামার বাড়ি থেকে কলেজে পড়াশোনা শুরু করলেন। শাহাদতের মা আর মামা এই দুই ভাইবোন। মামা নিঃসন্তান এবং শাহাদত মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় মামার বাড়ির বিষয়-সম্পত্তিও শাহাদতেরই। মামা-মামি দু’জনে তাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন।

শাহাদত এর ঝুলিতে ডিগ্রির কমতি নেই। মাস্টার্স, এল.এল.বি এমনকি হোমিওপ্যাথিতে ডি.এইচ.এম.এস ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। সব চাকরি ছেড়ে তিনি শুরু করলেন ওকালতি, সবাই বলতো যার নেই কোনো গতি সে করে ওকালতি কিন্তু শাহাদত সাহেব সেরকম উকিল না। তার আইনের অনেক ধারা মুখস্থ, যুক্তি খণ্ডনের অসাধারণ যুক্তি, আকর্ষণীয় বচন ভঙ্গি এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি কোনো অন্যায়কারীর পক্ষে ওকালতি করেন না, আগে মক্কেলের কাছে প্রকৃত সত্য ঘটনা শুনেন যদি তিনি মনে করেন মক্কেল সত্যি কোনো অন্যায়ের শিকার হয়েছে তবে সেই মামলা হাতে নেন এবং বেশিরভাগ মামলায় তিনি জয়ী হন। মক্কেলের পক্ষ হয়ে আইনযুদ্ধে সেনাপতি হওয়া ছাড়াও তিনি জনস্বার্থে মামলা করেন নিজ খরচে যেমন বিনা অপরাধে কোন আসমি জেলে খাটছে কী না, কোনো নির্যাতিতা নারী টাকার অভাবে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কী না?

শাহাদতের এসব জনসেবামূলক কাজের জন্য এলাকায় তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত। কেউ কোনো বিপদ-আপদে পড়লে খুব সহজে মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তো, ত্যাগী উকিলের কাছে যান। সবাই ত্যাগী উকিলের কাছে আসতো, যার যার সাধ্যমতো ফি দিতো, ত্যাগী ফি’র জন্য কারো সাথে কোনোদিন বাদানুবাদ করেন না।

শাহাদত তার ত্যাগী নামটা প্রথম প্রথম জানতেন না, যখন জানতে পারলেন তখন নামটা মানুষের মুখে মুখে হয়ে গেছে, যা মানুষের মুখ এবং মন থেকে মুছে দেওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে চেষ্টাও তিনি করলেন না বরং মনে মনে গর্ববোধ করলেন। বন্ধু-বান্ধবরা যখন তাকে ত্যাগী নামেই ডাকতে শুরু করল তখন একদিন তিনি মুচকি হাসি হেসে বললেন, ত্যাগই তো প্রকৃত সুখ। সারা পৃথিবীর মানুষ যদি ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হতো তবে পৃথিবীতে মারামারি হানাহানি তো দূরের কথা স্বার্থের দ্বন্দ্বও থাকতো না। উদাহরণ হিসেবে তিনি ইতিহাসের অনেক ঘটনা তুলে ধরলেন, তুলে ধরলেন মুক্তিযুদ্ধের কথা, এই ধরো মুক্তিযুদ্ধের কথা, মুক্তিযুদ্ধে সবাই যদি নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবতো তবে কি মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করত, দেশপ্রেমিক মা নিজের মৃত্যু এবং মান-সম্মানের কথা না ভেবে ভাতের হাঁড়ি রেখে লাকড়ি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করত, নিজের একমাত্র সন্তানকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে পাঠানোর সময় বলতো, যা বাবা তোকে আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশে ফিরবি। দেশের কৃষক জীবনের মায়া ত্যাগ করে হালের পেন্ডি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরতো তবে কি এই দেশ স্বাধীন হতো?

যুদ্ধ, লেখাপড়া, একের পর এক ডিগ্রি অর্জন আর ওকালতি পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে তার বয়সটা গেল বেড়ে। যখন বিয়ে করলেন তখন বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই, বিয়ের প্রথম দিকে দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখের ছিল না। সাধারণত সচেতন, স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী মানুষের দাম্পত্যজীবন সুখের হয় না। শাহাদতের সংসার টিকে থাকা নিয়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সংশয় ছিল, কেউ কেউ বলতো, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কলিগ আর অধঃস্তনদের সঙ্গে চাকরি করতে পারে না সে একটা মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন কাটাবে কী করে? অবশ্য সংসারটা টিকে গেল, শাহাদতের কারণে না, স্ত্রীর বিনয়ী এবং ধৈর্যশীল হওয়ার গুণে।

বিয়ের কয়েক বছর পরের কথা, ওকালতির টাকায় খুব টানাটানি করে সংসার চলছে একটা দুই রুমের সেমিপাকা ভাড়া বাসায়। একদিন শাহাদত সাহেবের সেই বিনয়ী, ধৈর্যশীল স্ত্রী আলেমা বলল, আচ্ছা তুমি কেমন মানুষ বলতো, মানুষ একটা চাকরিই পায় না আর তুমি একের পর এক চাকরি করেছ আর ছেড়ে দিয়েছ এটা কি ঠিক করেছ, এখন তুমি একা না, আমাদের বিয়ে হয়েছে, সংসার করছি, আজ যদি তোমার একটা সরকারি চাকরি থাকতো তবে আমাদের কত উন্নতি হতো।

শাহাদত সাহেব রেগে গেলেন, তাই বলে কি আমি নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে চাকরি করব। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য জীবন দিতে গিয়েছিলাম, কামানের গোলাকেও আমি ভয় পাই না আর সামান্য জীবিকার জন্য অসৎ হবো, নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতিবাজ, দেশ বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাবো?

সবাই কি দুর্নীতিবাজ, দেশবিরোধী? নিশ্চয়ই ভালোমনুষও আছে।

শাহাদত সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, হ্যাঁ আছে, আছে। ভালোমন্দ সব মানুষই আছে। শুধু আমার কপালে মন্দ মানুষগুলোর সঙ্গে চাকরি পড়েছিল।

তুমি শুধু রয়ে-সয়ে চাকরি করতে। বাংলাদেশে কি আর একটি মানুষ আছে যে এভাবে চাকরি ছেড়ে এসেছে?

কেনো আমার কি ডিগ্রির অভাব আছে? আমাকে চাকরি করেই খেতে হবে, আমি ওকালতি করছি, তাতে কি আমাদের ভালো দিন যাচ্ছে না?

তা যাচ্ছে।

গেলেই হলো, নিজের পেশা, কারো কাছে কোনো ধার ধারতে হবে না। তুমি দেখ আমি ওকালতি করে সংসার চালাতেও পারবো, এলাকার মানুষের সেবা করতে পারবো, গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবো, চাকরি করে কি কারো উপকারে আসতে পারতাম, ওখানে তো হাত-পা বাঁধা। আর টাকার কথা বলছো। আল্লাহ কপালে লিখলে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়িও হবে।

আলেমা কয়েকমুহূর্ত শাহাদতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

শাহাদত সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ? ভাবছ আমি পারব না। এটা তোমার সঙ্গে আমার চ্যালেঞ্জ।

সেই চ্যালেঞ্জে অবশ্য শাহাদত সাহেবই জয়ী হলেন।

সেই থেকে শাহাদত সাহেব আইনপেশায় আছেন তবে সরকারি চাকরি ছেড়ে আইন পেশায় আসাতে তার মধ্যে কোনো অতৃপ্তি নেই বরং তিনি আইন পেশায় বেশ যশ, খ্যাতি অর্জন করেছেন।

দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় স্বাধীন। সে এম.বি.বি.এস এবং এফ.সি.পি.এস করে চিকিৎসা পেশায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। স্বাধীন বাবার নীতি এবং আদর্শে বড় হয়েছে কিন্তু ধৈর্য হয়েছে মায়ের মতো। জনসেবার দিক থেকে সেও বাবার মতোই হয়েছে। গরিব-দুঃখীদের যৎসামান্য ভিজিটে এমনকি বিনা ভিজিটেও সেবা দিয়ে থাকে। স্বাধীনের জমজ এক ছেলে এক মেয়ে রুদ্র ও রানু, দুজনে ক্লাস সিঙে পড়ে, তারা দুজনে শাহাদত সাহেবের খুব প্রিয়। রুদ্র ও রানুও দাদুকে খুব সম্মান করে। সময় পেলেই দুজনে দাদুর কাছে চলে আসে, গল্প করে, আগ্রহ সহকারে দাদুর কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে। শাহাদত সাহেব রুদ্র রানুকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান, তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন। এতটুকু বয়সে রুদ্র ও রানু ক্লাসের বইয়ের বাইরে বাঙালির শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে। এই তো কয়েক মাস আগে স্কুলের যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় রুদ্র বঙ্গবন্ধু সাজলো, টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ দিয়ে আমজনতাকে মুগ্ধ করলো। সবাই রুদ্রকে যেমন বাহাবা দিল তেমনি শাহাদত সাহেবেরও অনেক গুণগান গাইল। বন্ধু সমবয়সীরা শাহাদত সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, ত্যাগী একটা নাতি বানিয়েছে মাশআল্লাহ।

স্বাধীনের পর বিপ্লবী। বিপ্লবীর বিয়ে হয়েছে রংপুর, স্বামী মোস্তাক সরকারি চাকরি করে। বিয়ের পর থেকেই ঢাকা পোস্টিং, তাই চাকরিসূত্রে তারা ঢাকা থাকে। বিয়ের পর ঢাকায় একবার মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন শাহাদত সাহেব, তখন মেয়ে-জামাইয়ের নতুন সংসারে একটু টানাটানিই ছিল। কিছুদিন পরে যখন বিপ্লবী বাবার বাড়িতে বেড়াতে এলো তখন শাহাদত সাহেব মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিলেন প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্র কেনার জন্য। মেয়ে-জামাই প্রথমে না না করলেও শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করলো।

বছর তিনেক পরের কথা। ততদিনে বিপ্লবী একটা ফুটফুটে বাচ্চার মা হয়েছে। প্রথমবার বিপ্লবী যখন মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি এলো তখন বাড়িতে যেন আনন্দের ধুম পড়ে গেল। শাহাদত সাহেব নাতনীকে কোলে নিলেন, আদর করলেন, কিরে তোর নাম কী?

মেয়েটি ফিক করে একটা হাসি দিল, নিষ্পাপ হাসি।

বিপ্লবী মেয়েকে শিখিয়ে দিল, বল মা, বল।

দু’বছর বয়সের বাচ্চা কি আর নিজের নাম বলতে পারে, তবুও সবাই এভাবেই বলে। বিপ্লবী মেয়ের নাম বলল, বাবা ওর বাবা ওর নাম রেখেছে, পিংকি।

শাহাদত সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল, পিংকি!

মোস্তাক শাহাদত সাহেবের মুখোমুখি সোফায় বসে ছিল, পাশের সোফায় বসে ছিল বিপ্লবী, আলেমা ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। সে শাহাদত সাহেবের মুখ কালো দেখে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?

বিপ্লবী বলল, কিছু হয়নি তো মা।

আলেমা হাত পেতে পিংকিকে কোলে নিল।

শাহাদত সাহেব বললেন, তোমার নাতনীর নাম কী জানো?

নাতনীর নাম জানবো না কেনো? আমি তো তোমার মতো শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে ডুবে থাকি না। কেনো, কী হয়েছে বলো?

শাহদাৎ সাহেব মোস্তাকের আপাদমস্তক তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, ছেলেমেয়েদের অর্থপূর্ণ নাম রাখতে হয়, জ্ঞানী-গুণী, স্বনামধন্য ব্যক্তিদের নামের অনুকরণে নাম রাখতে হয়। বিপ্লবী তোমাদের ভাইবোনদের নাম দেখ আমরা কী রকম নাম রেখেছি।

মোস্তাক মাথা নত করে বসে রইল। আলেমা বলল, তুমি ওসব কথা বাদ দাও তো, তোমার মতো তো সবাই না, নাম একটা রাখলেই হয়। বাবা মেয়ের নাম রেখেছে, এটা তাদের বিষয়।

হ্যাঁ আজকাল সবাই এমনই নাম রাখে, নাট, বল্টু, হিটলার, ডলার এসব আর কী।

থাক তোমাকে আর নাম নিয়ে এতো কাহিনি করতে হবে না। জামাই তুমি কিছু মনে করো না বাবা। তোমার শ্বশুর একটু ওরকমই।

মোস্তাক আমতা আমতা করে বলল, না মা, আমি কিছু মনে করিনি।

দুই

ছোট ছেলে বিপ্লব, লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না। কৈশোর থেকে তার রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল, শাহাদত সাহেব তার রাজনীতিতে বাধা দিতেন না। রাজনীতি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য, রাজনীতিবিদরাই তো দেশের দুঃসময়ে হাল ধরেন যেমন ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে যখন একজন বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ প্রয়োজন ছিল ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠলেন, জাতিকে মুক্তির পথ দেখালেন, জন্ম হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

শাহাদত সাহেবের আশা ছিল বিপ্লব একদিন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হবে, জাতিকে সঠিক পথ দেখাবে। বিপ্লব কে. বি. এম কলেজ থেকে বি.এ পাস করলো। ছাত্রজীবনে বিপ্লব রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে, কলেজে মিছিল-মিটিং, উপজেলা এবং জেলা কমিটিতে তার যাতায়াত ছাত্রজীবন থেকেই। শাহাদত সাহেবের ধারণা ছিল বি.এ পাস করে জীবিকার প্রয়োজনে হলেও কোনো ব্যবসা করবে কিন্তু সেদিকে বিপ্লবের মনোযোগ নেই। ইদানীং সকাল-সন্ধ্যা বিপ্লবের খোঁজে বাড়িতে মানুষ জন আসে, দলে এবং শহরে বিপ্লবের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে সেটাও শাহাদত সাহেবের চোখ এড়ায় না। একই বাড়িতে থেকেও প্রায় দিনই বিপ্লবের সঙ্গে শাহাদত সাহেবের দেখা হয় না। শাহাদত সাহেব জেগে থাকেন রাত দশটা কিংবা এগারোটা পর্যন্ত বিপ্লব তখনো বাড়ি ফিরে না, সকালবেলা শাহাদত সাহেব কোর্টে যান তখনো বিপ্লব ঘুমিয়ে থাকে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। শাহাদত সাহেব বাড়িতেই ছিলেন, সকালবেলা নাস্তা খাওয়ার সময় আলেমাকে বললেন, আজকাল বিপ্লবকে তো দেখি না, ও কখন আসে, কখন যায়, কী করে তাও তো জানি না, একই বাড়িতে থাকি অথচ প্রতিদিন দেখা হয় না।

আচ্ছা আমি আজ দেখা করতে বলব।

হ্যাঁ। তাই বলো।

সেদিন বিকেলে নাস্তার টেবিলে দেখা হলো বাপ-বেটায়। মুখোমুখি চেয়ারে বসেছে দুজনে। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আজকাল তোকে খুব একটা দেখি না, সারাদিন কী করিস?

বাবা রাজনীতির কাজে ব্যস্ত থাকি।

রাজনীতিতে এতো কী ব্যস্ততা। আচ্ছা যাহোক ব্যস্ত থাকিস তো ভালো কিন্তু শুধু রাজনীতি করে কি চলবে? ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু একটা তো করতে হবে।

জি বাবা, বলে আপনমনে বলল, মূল উদ্দেশ্য তো টাকা রোজগার করা, সেটা ব্যবসা হোক, চাকরি হোক আর রাজনীতিই হোক বাবা।

শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্ত বিপ্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কিছু ভাবছিস?

না বাবা, আসলে এখনো তেমন কিছু ভাবিনি।

ভেবে দেখ কী করবি, শুধু রাজনীতি করে তো আর জীবন চলবে না।

আসলে ভেবে দেখার সময় পাই না, সারাদিন ছুটতে ছুটতে দিন চলে যায়।

তাই বলে জীবিকার জন্য তো কিছু একটা করা দরকার।

জি বাবা।

কয়েকদিন পর বিপ্লব নিজেই বাবার সঙ্গে বসল। সেদিন রাতে শাহাদত সাহেব চেম্বারের কাজ শেষ করে বাসার ভিতরে ঢুকেছেন এমন সময় বিপ্লব সামাল দিল, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

কিছু বলবি?

জি বাবা।

আয় বসি বলে শাহাদত সাহেব ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালেন। বিপ্লবও বাবার পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। শাহাদত সাহেব একটা সোফায় বসে বিপ্লবকে জিজ্ঞেস করলেন, বল?

বাবা তোমাকে কী করে যে বলি।

কী হয়েছে বল?

বাবা আমি নিজে কিছু একটা করবো সেটা নিয়ে অনেকদিন থেকে চিন্তা করছিলাম তুমি বলার পর একটু এগিয়েছি।

কী করবি ভাবছিস?

বাবা সিকদারহাট একটা মিল চাতাল ভাড়া দিবে, আমি আসলে কারো সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করতে চাচ্ছিলাম কিন্তু মিল-চাতাল ভাড়ার নোটিশ দেখে ভাবছি তুমি যদি হেল্প করো তবে একাই শুরু করবো।

কী বললি তুই? আমি হেল্প করবো!

বাবার কথায় বিপ্লব ভয় পেলো। সে মনে করলো না বুঝে সে বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। সে আমতা আমতা করে বলল, বাবা, আমি কি…

শাহাদত সাহেব ধমকের সুরে বললেন, আমি হেল্প করবো মানে কী? এখনো কথা বলতে শিখিসনি, কথা বলতে না পারলে ব্যবসা করবি কীভাবে, রাজনীতি করবি কীভাবে।

বাবা…

বাবারা ছেলেকে কখনো হেল্প করে না। ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দেয়, এটা সব বাবাদের দায়িত্ব আমি তোর কথায় অবাক হলাম, তুই এটাকে হেল্প মনে করিস।

সরি বাবা আমি কী বলতে কী বলে ফেলেছি।

যখন বাবা হবি তখন বুঝবি বাবাদের কতটা দায়িত্ববান হতে হয়। চাতালটা দেখ, এডভান্স কত, ভাড়া কত, কতদিনের চুক্তি কথা বল।

জি বাবা, আমি জেনে তোমাকে জানাবো।

তোর তো আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, পারবি?

চেষ্টা করবো বাবা। তুমি তো আছই।

আচ্ছা দেখ, এগিয়ে যা।

ধন্যবাদ বাবা।

সেদিনের মতো আলাপ শেষ হলো। বিপ্লব ব্যবসা শুরু করলো, ধানের চাতাল, রাইস মিল এবং পাশাপাশি কয়েকটা সরকারি ডিপার্টমেন্টে ঠিকাদারি লাইসেন্সও করলো। অবশ্য ঠিকাদারি ব্যবসা সম্পর্কে শাহাদত সাহেবের কোনো ধারণা নেই, তাই তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। তিনি ছেলের ব্যবসায় টাকা দিলেন, বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। দিনে দিনে ব্যবসার উন্নতি হতে লাগল। প্রথম প্রথম শাহাদত সাহেব নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন তারপর একসময় ধীরে ধীরে পুরো ব্যবসা বিপ্লবের হাতে ছেড়ে দিলেন।

শাহাদত সাহেবের ধারণা ছিল ছেলে ব্যবসা করে উন্নতি করছে কিন্তু বিপ্লবের ব্যবসায় উন্নতি তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। ব্যবসা শুরুর দু’বছরের মধ্যে বিপ্লব গাড়ি কিনলো, কেনার আগে একবার শাহাদত সাহেবকে বলল, বাবা বাড়িতে একটা গাড়ি থাকার দরকার, তোমার বয়স হয়েছে, কোর্টে রিকশায় চড়ে যাতায়াত করো, মা’র বয়স হয়েছে, এখানে-সেখানে যেতে হয় আর আমার ব্যবসা তো আছেই। ব্যবসার কাজেও গাড়ি দরকার।

শাহাদত সাহেব কিছুটা অবাক হলেন, গাড়ি? আই মিন প্রাইভেট কার?

জি বাবা।

গাড়ি কিনবো আমি? আমার এতো টাকা কোথায়, আমার যা টাকা ছিল তা তো তোকে ব্যবসা করতে দিলাম।

বাবা তোমাকে টাকা দিতে হবে না। আমার কাছে টাকা আছে।

শাহাদত সাহেবের ধারণা বিপ্লব শুধু ব্যবসা করেই এই উন্নতি করেছে, তিনি ছেলের উন্নতিতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন, আলহামদুলিল্লাহ, তা গাড়ি কোথায় কিনবি? ঢাকা নাকি চট্টগ্রাম?

ঢাকায় কিনবো বাবা, তুমিও চলো বাবা?

না, আমার এতো সময় কোথায়, তাছাড়া আমার শরীরের অবস্থাও তো ভালো না, স্বাধীনকে বলেছিস?

না বাবা, এখনো বলিনি।

আমার মনে হয় তুই একাই কিনে আনতে পারবি, তাছাড়া ঢাকায় তো বিপ্লবী আছে, মোস্তাক আছে ওরা তোকে হেল্প করবে।

জি বাবা।

তাৎক্ষণিকভাবে শাহাদত সাহেব বুঝতে পারেননি কিন্তু পরে তার মাথায় একটা চিন্তা ঢুকলো। ব্যবসায় এতো লাভ, এতো উন্নতি, আমি যখন ওকালতি শুরু করলাম তখন মেসে থাকতাম, বিয়ের পর বাসা ভাড়া নিলাম, দু’রুমের একটা সেমিপাকা বাসা। তারপর অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা সঞ্চয় করে আর বাবার কিছু জমি বিক্রি করে এই বাসার জায়গাটা কিনলাম তারপর কয়েকবছর ধরে একটা ফ্লোর কমপ্লিট করলাম। আরো কয়েকবছর সময় লাগলো দ্বিতীয় তলার কাজ সম্পন্ন করতে। সারাজীবন ওকালতি করে এই বাড়িটাই আমার অর্জন, আমি কোনোদিন গাড়ি কেনার কথা চিন্তাও করতে পারিনি আর বিপ্লব দু’বছর ব্যবসা করে গাড়ি কিনছে, ছি : এসব কী ভাবছি আমি নিজের ছেলের উন্নতিতে আমি হিংসা করছি।

শাহাদত সাহেব যতই মন থেকে মুছে ফেলতে চাইলেন ততই তার মনের মধ্যে কথাটা যেন গেঁথে গেল। সেদিন রাতে শাহাদত সাহেবের চোখে ঘুম নেই। গভীর রাতে শাহাদত সাহেব আলেমাকে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলেন, আলেমা।

আলেমা ঘুমায়নি কিন্তু সে ভেবেছিল শাহাদত সাহেব বুঝি ঘুমিয়েছে। আলেমা জিজ্ঞেস করলো, তুমি ঘুমাওনি?

না, ইদানীং ঘুম হয় না।

আলেমা উতলা হয়ে গেল, কেনো? কী হয়েছে তোমার?

না, তেমন কিছু না। আলেমা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি।

বলো। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে এতো সংকোচ করছো কেনো?

আমি ভাবছি বিপ্লবের কথা, বিপ্লব তো এই বছর দুয়েক আগে ব্যবসা আরম্ভ করলো, তাতে এতো টাকা রোজগার করলো।

ও তুমি সেকথা বলছো। নিজের ছেলে উন্নতি করছে তা নিয়েও তোমার দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম।

উন্নতি বেশি করছে আলেমা, আমার কাছে ওর উন্নতি নরমাল মনে হচ্ছে না।

এটা আবার কেমন কথা, উন্নতি তো উন্নতিই।

আমি বলছি বিপ্লবের উন্নতি আমার কাছে নরমাল মনে হচ্ছে না। মানে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

আলেমা সাদাসিধে মহিলা, স্বামী-সংসার ছাড়া আর বেশি কিছু তার মাথায় নেই। সে খুব সহজভাবে বলল, ও কি শুধু ব্যবসা করছে, রাজনীতি করছে না? রাজনীতি থেকেও ইদানীং ওর ভালো ইনকাম হচ্ছে।

আলেমার কথা হঠাৎ করেই যেন শাহাদত সাহেবের বুকে ধাক্কা লাগল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, রাজনীতি থেকে ইনকাম?

আলেমাও বিছানায় উঠে বসল, সে বুঝতে পারল কথাটা বলা তার ঠিক হয়নি। সে একটা ঢোক গিলে বলল, না মানে টাকা-পয়সা তো দেখি ভালোই তাই বললাম।

সেদিন রাতে শাহাদত সাহেবের ঘুম হলো না। ঘুমের ঘোরে বার বার যেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভেসে উঠল। রেডিওতে শোনা বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ কানের মধ্যে বেজে উঠল, এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের ডাক শুনেই তো দেশের মানুষ যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে সম্ভু নামে এক তরুণ ছিল। সে ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত, একদিন খবর এলো আজ রাতে হানাদার বাহিনী হিন্দুপাড়া আক্রমণ করবে। খবর শোনামাত্র সম্ভু চিৎকার করে উঠল, ইচ্ছা করে এখনই ওদের ক্যাম্প বোমা মেরে উড়িয়ে দিই।

মোনাজাত নামে তাদের এক কমান্ডার ছিল। সে বয়সে একটু বেশি, মাথা খুব ঠান্ডা, পরিকল্পনা নিখুঁত। সে সম্ভুর বাহুতে হাত রেখে বলল, মাথা গরম করো না সম্ভু, আক্রমণ করতে হবে পরিকল্পিতভাবে, যেন একটা কুত্তার বাচ্চাও প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারে।

তখনই সবাই বসে গেল যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে, পরিকল্পনা মাফিক সবাই অবস্থান নিল। সিদ্ধান্ত হলো দূর থেকে হানাদার বাহিনীকে ঘিরে ফেলা হবে। তারা যেদিক দিয়ে ঢুকবে সেদিকে ফাঁকা রেখে ঢুকতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তারা ভেতরে ঢুকলেই তাদের ওপর আক্রমণ করা হবে।

তথ্য সঠিক ছিল। রাতে হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ শুরু করার জন্য হানাদার বাহিনী এগিয়ে এলো, তাদের ভিতরে ঢোকার সুযোগ দেওয়া হলো। তারপর পুরো পাড়াসহ তাদের ঘিরে ফেলা হলো, আক্রান্ত পরিবারগুলোকে আগে থেকে সাহস জোগানো হচ্ছিল, রণকৌশল শেখানো হচ্ছিল। তারাও আক্রমণ প্রতিহত করলো। সে রাতে হানাদার বাহিনীও তাদের দোসরদের কেউ প্রাণে বাঁচল না আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বুকে গুলি লাগল সম্ভুর। সম্ভুর পাশেই ছিলেন শাহাদত সাহেব, সম্ভু বলল, শাহাদত আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখে যেতে পারলাম না রে, তোরা দেখবি, নিজ দেশে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবি, আমার, আমার মতো হাজার হাজার শহিদের রক্তের বিনিময়ে তোরা একটা স্বাধীন দেশ পাবি, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ পাবি।

চোখের সামনে কোনো অন্যায় দেখলেই শাহাদত সাহেবের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভেসে উঠে, তাই তো একের পর এক চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন। যে অন্যায়ের সাথে তিনি কোনোদিন আপোষ করেননি, সে অন্যায় এখন তার ঘরেই…

শাহাদত সাহেব ঘুমের মাঝে আবার উঠে বসলেন, সঙ্গে সঙ্গে আলেমাও বিছানায় উঠে বসল, কী হয়েছে তোমার? ঘুম আসছে না?

এক গ্লাস পানি দাও।

আলেমা এক গ্লাস পানি এনে দিল, শাহাদত সাহেব এক ঢোকে পানি শেষ করে আপনমনে বললেন, রাজনীতি থেকে ইনকাম তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

তিন

সবার ছোট মেয়ে আয়েশা পড়ালেখায় তেমন ভালো ছিল না। সে কে.বি.এম কলেজ থেকে বি.এ পাস করে এখন চাকরির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে চেষ্টার পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন আইন কলেজে এল.এল.বি’তে ভর্তি হয়েছে। শাহাদত সাহেবের ইচ্ছা যেদিন কলেজ বন্ধ সেদিন আয়েশা তার চেম্বারে বসবে, তার কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। আয়েশার যে আগ্রহ নেই তা নয়, একসময় আয়েশার ইচ্ছা ছিল সে ভবিষ্যতে বাবার আইন পেশার হাল ধরবে তবে সে এখন কিছুটা তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। তাই প্রথমে যে আগ্রহ নিয়ে বাবার চেম্বারে বসতো এখন তাতে একটু ভাঁটা পড়েছে আর তাই আয়েশা একটু সুযোগ পেলেই চেম্বারে ফাঁকি দেয় আর শাহাদত সাহেব একদিন না বসলেই হইচই বাঁধিয়ে দেন।

শাহাদত সাহেবের দুজন জুনিয়র উকিল আছে, মুকুল আর মিরান। শাহাদত সাহেবের চেম্বারের পাশে আরো একটা রুম আছে সে রুমে তারা দু’জন আর আয়েশা বসে। মুকুল ছেলেটি বেশ মেধাবী, দেখতে ভালো, বংশীয় ছেলে, দোষের মধ্যে মাঝে মাঝে কথাবার্তায় একটু ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় দেয়। দোষে-গুণে মানুষ, শাহাদত সাহেবের ইচ্ছা আয়েশাকে মুকুলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। অবশ্য যদি তাদের দু’জনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে।

রাত আটটা বাজে, মুকুল আর মিরান চেম্বারে বসেছে আরো আগে, শাহাদত সাহেব মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল স্ট্যাডি করছেন। তিনি প্রতিদিন চেম্বারে ঢুকেই সবার খোঁজখবর নেন, কে এলো, কে কী কাজ করছে, আগামীকাল কোর্টে কোন কোন মামলার তারিখ আছে, সেগুলোর স্ট্যাডি চলছে কী না ইত্যাদি ইত্যাদি। শাহাদত সাহেব ফাইলটা বন্ধ করে কলিং বেল এ টিপ দিলেন, পাশের রুম থেকে মিরান এলো। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, মুকুল এসেছে?

জি স্যার।

আয়েশা?

স্যার ও আসেনি।

শাহাদত সাহেব রেগে গেলেন, আসেনি? তারপর চেয়ার থেকে উঠে ভেতরে চলে গেলেন।

মিরান তার চেয়ারে এসে বসল। মুকুল জিজ্ঞেস করলো, কী হলো?

স্যার ক্ষেপেছেন?

কেনো?

আয়েশা এখনো ফিরেনি, তাড়াতাড়ি ফোন লাগা বলে মিরান মিটমিট করে হাসল।

মুকুল আয়েশাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, সুযোগ পেলে আয়েশার সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করে কিন্তু আয়েশার দিক থেকে কোনো সাড়া মেলেনি, তাতেও মুকুলের কিছু যায় আসে না, সে হাল ছাড়েনি, একবার না পারলে দেখো শতবার যুক্তিতে সে তার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।

আইন কলেজে ভর্তি হয়ে আয়েশা যখন প্রথম বাবার চেম্বারের পাশের রুমে মিরান আর মুকুলের পাশাপাশি চেয়ারে বসে কাজ করতে শুরু করলো তখন সুযোগ পেলেই মুকুল আলাপ জুড়ে দিত, আয়েশা কেমন লাগছে তোমার?

কী কেমন লাগছে ভাইয়া?

এই যে ওকালতি।

ওকালতি আর কই করছি, আমি তো কেবল ভর্তি হলাম, এখানে তো শুধু বসে বসে আইনের বইয়ে চোখ বোলাচ্ছি।

তা অবশ্য ঠিক বলেছ, কোর্টে প্র্যাকটিস করার সময় ভালো লাগবে।

সেদিন সন্ধ্যায় মিরান আসেনি, আয়েশা আর মুকুল নিজ নিজ চেয়ারে বসে কাজ করছিল। পাশের চেম্বার থেকে শাহাদত সাহেব মুকুলকে ডাক দিলেন, মুকুল।

মুকুল চেয়ার থেকে উঠে শাহাদত সাহেবের চেম্বারে ঢুকলো, স্যার।

মেহের নিগারের ফাইলটা নিয়ে এসো তো।

মুকুল ফিরে এসে মেহের নিগারের ফাইল নিয়ে আবার শাহাদত সাহেবের চেম্বারে ঢুকলো, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মেহের নিগারের কেস, হৃদয়ঘটিত।

আয়েশা বুঝতে পেরেছে মুকুল আসলে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে যেন সে সাড়া দেয় কিন্তু আয়েশা সাড়া দিল না, সে যেমন একটা ফাইলে চোখ বোলাচ্ছিল তেমনিভাবে ফাইল স্ট্যাডি করতে লাগল, শুধু আপনমনে একটা তিরস্কারের হাসি হাসল।

মুকুল ডাক দিল, আয়েশা।

জি ভাইয়া বলুন।

আমি তোমাকে কিছু বলেছি, শুনেছো?

জি শুনেছি।

কী বলেছি বলতো?

আপনি বলেছেন মেহের নিগারের কেস, হৃদয়ঘটিত।

এঙাক্টলি, তুমি রেসপন্স করলে না যে।

আয়েশা মনে মনে বিরক্ত হলো, সে হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে বলল, এই ফাইলটা স্ট্যাডি করছিলাম বলে সে ফাইলটা বন্ধ করে বলল, এই বন্ধ করলাম, এবার বলেন।

মেহের নিগারের কেসটা তোমার জানা দরকার।

কেনো ভাইয়া?

মেহের নিগার নামে এক তরুণী প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে।

গুড।

গুড কেনো?

কারো যদি গার্ডিয়ানদের ওপর ভরসা না থাকে, কেউ যদি মনে করে গার্জিয়ানরা জানলে তাদের বিয়ে দিবে না তবে তো পালিয়ে বিয়ে করবেই। তাই তাদের ভালোবাসাকে সম্মান জানালাম।

এবার মুকুলও বলল, গুড।

আপনি আবার গুড বললেন কেনো?

মানে তুমি ওদের ভালোবাসাকে সম্মান জানালে তাই। এভাবে নিজের বেলায়ও যদি জানাতে পারো তবে তো ভালোই।

আয়েশা কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলল, ভাইয়া। তারপর বলল, আচ্ছা বলেন এখন তারপর কী হলো?

তারপর আর কী মেয়েটি ধনী মানুষের মেয়ে, তার বাবা মামলা করে দিয়েছে অপহরণের।

কেনো? কোনো মেয়ে স্বেচ্ছায় কাউকে বিয়ে করতে পারে না?

অবশ্যই পারে কিন্তু মেয়ে পক্ষের কাজ করার সুযোগ থাকে। বিচার তো হবে অনেক পরে ততদিনে তো পাত্রের অবস্থা কেরোসিন।

তা ঠিক বলেছেন, তো এখন মেয়ে কোথায় আর ছেলে কোথায়?

মেয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে যাবে না। তাকে রাখা হয়েছে সেফ কাস্টডিতে আর ছেলে তো হাজতে, ছেলের বাবা আবার গরীব মানুষ, মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই। সেই ছেলের পক্ষে আইনজীবীর দায়িত্ব নিয়েছেন…

আয়েশা মুকুলের কথার মাঝে রসিকতা করে বলল, ত্যাগী শাহাদত।

ঠিক বলেছ, আচ্ছা আয়েশা।

জি ভাইয়া।

তুমি কি কাউকে পছন্দ করো, আই মিন হৃদয়ঘটিত কোনো সম্পর্ক আছে কি না?

আয়েশা মুকুলের একথার প্যাঁচ বুঝে, সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেম করতে চাইবে। তাই সে বলল, ভাইয়া আমি স্কুলকলেজ পড়েছি, আমার একটা প্রাণবন্ত হৃদয় আছে, হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক তো থাকতেই পারে।

কথাটা যেন মুকুলের বুকে আঘাত করলো, সে আমতা আমতা করে বলল, না মানে আমি বলছিলাম…

মুকুলের কথা শেষ হওয়ার আগে আয়েশা একবার রাগান্বিত চোখে তাকাতেই মুকুল একটা ঢোক গিলল, না মানে…

মানে মানে করছেন কেনো ভাইয়া, বলে ফেলুন।

থাক, আজ থাক, আরেকদিন বলবো।

আয়েশা মনে মনে হাসল, থাক ভাইয়া তাহলে আরেকদিন বলবেন।

আচ্ছা।

মুকুল আয়েশাকে ফোন করলো কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। মুকুল পর পর তিনবার ফোন করলো কিন্তু আয়েশা ফোন রিসিভ করলো না। মিরান তার চেয়ারে বসে মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মুকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মিরান বুঝতে পারে যে আয়েশা ফোন রিসিভ করছে না। সে মিটমিট করে হেসে বলল, কী হলো?

ফোন রিসিভ করছে না।

আবার দে।

মুকুল আমতা আমতা করে বলল, দিব?

আরে দে, কী আর বলবে, আয়েশা তো আর স্যার না। স্যার খুঁজছেন ওকে ফোন দেওয়া তো আমাদের দায়িত্ব।

মুকুল অসহায়ের মতো কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, মিরান তুই একবার ফোন দিবি?

আরে না। আমার সঙ্গে আয়েশা কথাই বলে না।

অগত্যা মুকুল আবার ফোন করলো।

আয়েশার সঙ্গে প্রবালের পরিচয় হয়েছে আয়েশা যখন কে.বি.এম কলেজে বি.এ ভর্তি হয়েছে তখন। প্রবালের বাসা মুন্সিপাড়া, মাঝে মাঝে মোটর সাইকেলে কলেজে যাতায়াত করত। তখনো আয়েশার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় হয়নি, ক্লাসে দু’য়েকদিন দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে মাত্র। আয়েশা কলেজ থেকে বেরিয়ে গেটে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রবাল মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে বলল, দিনাজপুর যাবে না?

হ্যাঁ।

এসো।

আয়েশা আমতা আমতা করে বলল, না, আপনি যান। আমি এখন রিকশা পেলে চলে যাবো।

প্রবাল আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমেছে, চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে, যেকোনো সময় মুশলধারে বৃষ্টি নামতে পারে। প্রবাল বলল, ওঠো, আকাশ খুব খারাপ করেছে, বৃষ্টি শুরু হলে সহজে থামবে না।

আয়েশা গোঁড়া মেয়ে না, সে আগেও ক্লাস ফ্রেন্ডদের মোটর সাইকেলে উঠেছে, প্রবালকে দেখে তার ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হলো। সে একবার রাস্তার দিকে তাকালো, আশে-পাশে কোনো রিকশা নেই, একটু করে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়েছে, সত্যি সত্যি যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে প্রবালের মোটর সাইকেলে উঠল।

সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো কিন্তু ততক্ষণে মোটর সাইকেল ঈদগাহ আবাসিক এলাকার মোড়ে, শিশু পার্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আয়েশা প্রবালকে মোটর সাইকেল থামাতে বলল।

প্রবাল মোটর সাইকেল দাঁড় করাতেই আয়েশা নামল। আয়েশা জিজ্ঞেস করলো, আসেন আমাদের বাসায়, এই তো কাছেই। আয়েশা কথাটা এমনভাবে বলল, যেন নিতান্তই ভদ্রতাবশত।

না, আরেকদিন আসবো। তাড়াতাড়ি যান, নইলে ভিজে যাবেন, বলে প্রবাল জোরে মোটর সাইকেলে টান মারল।

সেদিনের পর থেকে প্রবালের সঙ্গে আয়েশার প্রায়ই দেখা হতো, আয়েশা একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, আগে প্রবাল খুব কম কলেজে আসতো ইদানীং প্রায়ই আসে, ক্লাসে আয়েশার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ঠিক আয়েশা যখন কলেজ গেট পেরিয়ে এসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায় প্রবালও তখন মোটর সাইকেল নিয়ে আয়েশার পাশে এসে দাঁড়ায়, একটা সুন্দর হাসি হেসে বলে, এসো।

আয়েশা প্রথম প্রথম আমতা করে না বলতো কিন্তু একসময় এটা নিয়মিত হয়ে গেল, শুধু তাই নয়, এখন আর দু’জনে একই মোটর সাইকেলে শুধু বাসায় যাতায়াত করে না, মাঝে মাঝে ঘুরেও বেড়ায়।

সেদিন রামসাগর বেড়াতে গিয়ে আয়েশার মধ্যে একটা অন্যরকম ভালো লাগা অনুভব করলো। রামসাগর সে জীবনে অনেকবার এসেছে। বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে এসেছে, স্কুলজীবনে বন্ধুরা সবাই মিলে বেড়াতে এসেছে কিন্তু আজকের অনুভূতিটাই অন্যরকম। প্রবাল মোটর সাইকেল চালাচ্ছে, প্রবালের পিঠে হাত রেখে গা ঘেঁষে বসেছে আয়েশা। আয়েশা লক্ষ্য করেছে প্রবাল তার মোটর সাইকেলের লুকিং গ্লাসটা এমনভাবে সেট করেছে যেন লুকিং গ্লাসে আয়েশার প্রতিচ্ছবিটা দেখা যায়। প্রবাল মোটর সাইকেল চালাচ্ছে আর আয়েশার ছবির দিকে তাকাচ্ছে। আয়েশা যেন হারিয়ে গিয়েছে এক অসাধারণ মুগ্ধতায়। হঠাৎ করে প্রবাল মোটর সাইকেলে ব্রেক কষল, আয়েশা প্রবালের পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

প্রবাল কিছু বলার আগেই আয়েশা দেখতে পেল তাদের মোটর সাইকেলের সামনেই একটা প্রাইভেট কার মুখোমুখি এসে ব্রেক কষেছে। প্রবাল লজ্জা পেল, আয়েশা মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। প্রবাল মোটর সাইকেল সাইট করে নিল। প্রাইভেট কারের ড্রাইভার প্রবালের চেয়ে বয়সে বড়, সে কিছুটা তিরস্কারের সুরে বলল, মামা একটু সাবধানে মোটর সাইকেল চালাইও।

অন্যসময় হলে প্রবাল প্রতিবাদ করত কিন্তু এমন একটা ভুল সে করেছে যে তার কিছু বলার মুখ নেই। প্রাইভেট কার চলে গেল। আয়েশা প্রবালকে জিজ্ঞেস, আঘাত পেয়েছ?

আয়েশা আমতা আমতা করে বলল, না কিন্তু তোমার একটু সাবধানে গাড়ি চালানো উচিত।

দেখেই তো চালাচ্ছিলাম কিন্তু তুমি মোটর সাইকেলের পিছনে থাকলে একটু অন্যরকম হয়ে যাই।

ততক্ষণে আয়েশা আবার মোটর সাইকেলে উঠেছে, প্রবাল মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে মোটর সাইকেল দাঁড় করালো। আয়েশা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, রাস্তার দিকে না তাকিয়ে পিছনে তাকিয়ে মোটর সাইকেল চালালে তো এমন হবেই, ভাগ্যিস বেঁচে গেছি।

প্রবাল হেসে উঠল, কী করবো, মন যে পড়ে থাকে পিছনে।

দু’জনে নরম ঘাসের ওপর বসে প্রবাল আয়েশার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল, আয়েশা বাধা দিল না, একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, কিন্তু স্যার মোটর সাইকেল চালানোর সময় যে চোখ আর মন একসাথে করতে হবে।

প্রবাল একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, কিচ্ছু হবে না।

না, তবুও তোমাকে পিছনে মন রাখতে হবে না।

কিন্তু আমার যে সবসময় তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আয়েশা।

এসব চাপাবাজি করো না, আমি খুব সুন্দর মেয়ে না আর আমাদের বয়সও নাইন-টেনে পড়-য়া ছেলেমেয়েদের মতো না যে তোমার আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে

আর কারো চোখে না হোক, আমার চোখে তুমি সুন্দর।

আচ্ছা হয়েছে, হয়েছে চাপাবাজ, যখন আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে তখন মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকো আবার যখন মোটর সাইকেল চালাবে তখন চোখ মন দু’টোই সামনের দিকে রেখে মোটর সাইকেল চালাবে কথার শেষের দিকে আয়েশার কণ্ঠস্বর আবেগে জড়িয়ে গেল, দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল।

প্রবাল আয়েশার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, আয়েশা তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো।

আমি, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি প্রবাল।

আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি আয়েশা।

সেই থেকে প্রবাল আর আয়েশার শুরু হয়েছে অনন্তকালের যাত্রা। আয়েশা প্রবালকে সেদিন বলেছিল তাদের বয়স এখন নাইন-টেনে পড়ার মতো না কিন্তু সে নিজেই যেন সেই কৈশোরে হারিয়ে গেছে। সবসময় প্রবালের কথা মনে পড়ে, দিনে কয়েকবার যেন নিজের অজান্তে হাত চলে যায় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে, প্রবালকে ফোন দেয়, দীর্ঘক্ষণ কথা বলে, কোনো প্রয়োজনীয় কথা না কিন্তু কথার কোনো শেষ নেই।

সেদিন সন্ধ্যায় মাসুম হোটেলের কেবিনে প্রবাল আর আয়েশা নাস্তা খেয়ে কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছে। পরিবেশটাও একটু অন্যরকম, হোটেলের দেয়ালে বিভিন্ন রকমের রোমান্টিক পেইন্টিং, শীতল বাতাস, সীমিত আলো, অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুটা জনসমাগম কম, কফি আসতে দেরি হচ্ছে, তাতেও দু’জনের কোনো তাড়া নেই। মাঝে মাঝে দু’জনের দৃষ্টি বিনিময়, একটু একটু খুনসুটি আর চলছে কথার পৃষ্ঠের কথা। আয়েশা জিজ্ঞেস করলো, এই বার বার তাকাচ্ছ কেনো, এটা রেস্টুরেন্ট সবাই কী ভাববে?

কারো ভাবনায় আমাদের কিছু যায় আসে না আয়েশা। এখন আমাদের গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে, দু’জনের চাকরির চেষ্টা করছি হয়তো কোনোদিন আমাদের চাকরিও হয়ে যাবে আর আমরা বিয়ে করে ফেলবো।

সব ঠিক আছে কিন্তু এখনো তো বিয়ে হয়নি।

প্রবাল একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, বিয়ে হয়নি, তাহলে চলো আজকেই বিয়ে করে ফেলি।

বললেই হলো, জানোই তো আমার বাবার নাম ত্যাগী শাহাদত, আমাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করবে।

কফি চলে এলো, প্রবাল আয়েশার দিকে ইশারা করে বলল, নাও কফি খেতে খেতে কথা বলি।

আয়েশা কফিতে একটা চুমুক দিতেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল, সে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে মুকুলের নাম্বার দেখে কিছুটা বিরক্তিবোধ করলো, একবার রিং শেষ হতেই আবার রিং করতেই থাকলো। পর পর তিনবার রিং হওয়ার পর প্রবাল বলল, রিসিভ করো কে ফোন করেছে?

আয়েশা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কে আছে, জানোই তো।

প্রবাল বুঝতে পারল না, সে জিজ্ঞেস করলো, কে?

তোমাকে বলেছিলাম না, বাবার পছন্দের সেই মুকুল। এতো করে অ্যাভয়েড করি তবু ফোন দেয়। রিসিভ করে বলে দাও।

আচ্ছা আবার ফোন দিলে রিসিভ করবো। কয়েকসেকেন্ড পর আবার রিং হলো।

আয়েশা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।

হ্যালো আয়েশা।

আয়েশা গম্ভীর স্বরে বলল, জি বলেন।

স্যার তোমাকে খুঁজছে। তুমি কোথায়?

স্যার খুঁজলে স্যার ফোন দিবে।

তা ঠিক বলেছ কিন্তু স্যার তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে বাসার ভিতরে গেল তো তাই ফোন করলাম।

আয়েশা তিরস্কারের সুরে বলল, খুব ভালো করেছেন, আমাকে উদ্ধার করেছেন। এখন ফোন রাখুন, যতসব, বলে আয়েশা মুকুলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল।

চার

শাহাদত সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘ জীবনে আলেমার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। খুব সামান্য কারণে শাহাদত সাহেব আলেমাকে বকাবকি করতেন। জীবনের শুরুতে আলেমাও প্রতিবাদ করত তাতে করে দু’জনের মধ্যে অনেক বাক বিতণ্ডা হতো, সংসারে অনেক অশান্তি হতো। আলেমা কয়েকবার রাগ করে বাবার বাড়ি গিয়েছে কিন্তু কয়েকদিন পর আবার ফিরে এসেছে স্বামী-সংসারের মায়ায়, সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। এখন বয়স হয়েছে, আলেমা আর শাহাদত সাহেবের কথায় তেমন রাগ করে না, সব সয়ে গেছে। তাছাড়া শাহাদত সাহেব রেগে গেলেও তার মনটা ভালো। সাধারণত যেসব মানুষ সহজে রেগে যায় তাদের মন ভালো হয়, তারা খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে ক্ষমা করে দেয়, আগের সব কথা ভুলে যায়। আর যারা কম কথা বলে, পেটের মধ্যে কথা চেপে রাখে তারা কিছুটা জটিল প্রকৃতির হয়।

শাহাদত সাহেবকে রাগান্বিত দেখে আলেমা এগিয়ে এলো, কী হয়েছে, ভিতরে আসলে কেনো? আমি তো নাস্তা পাঠাচ্ছি।

আমি নাস্তা খেতে আসিনি। তোমার মেয়ে কোথায়?

আয়েশা?

হ্যাঁ আয়েশা। তোমার মেয়ে আয়েশা।

আলেমা বুঝতে পারল শাহাদত সাহেব রেগে গেছেন। তাই সে সহজ করার জন্য একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, শুধু আমার মেয়ে, তোমার না?

শাহাদত সাহেব রেগে গেলেন, ইয়ার্কি করো না। ও কোথায় এখনো চেম্বারে আসলো না কেনো?

ওতো এখনো বাসায় ফিরেনি।

এখনো কেনো ফিরেনি তুমি একবার ফোন করে খবর নিয়েছ?

মেয়ে বড় হয়েছে এখন তো কেবল রাত আটটা বাজে, এখনো তো বাসায় আসার সময় চলে যায়নি। প্রায় দিনই তো রাত করে ফিরে।

বেশি কথা বলো না। যেদিন কলেজ খোলা থাকে সেদিন দেরিতে ফিরলেও সমস্যা নেই কিন্তু আজ তো কলেজ বন্ধ, আজ বাসায় আসতে দেরি হবে কেনো? এতো করে বলি চেম্বারে বস, শুধু এল.এল.বি পাস করলেই হবে না, অভিজ্ঞতা না থাকলে সার্টিফিকেট ধুয়ে কি পানি খাবে?

আচ্ছা তুমি চেম্বারে যাও আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

শাহাদত সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, আবার নাস্তা। আমি বলছি আয়েশার কথা আর উনি আছেন উনার নাস্তা নিয়ে। ফোন দিয়ে খবর নাও কোথায় গেল?

তোমার হাতেও তো মোবাইল ফোন আছে, তুমি ফোন দাও। আমি কিছু বললে আয়েশা কেয়ার করে না।

কেয়ার করে না, না? আচ্ছা আমি ফোন দিচ্ছি, আমার মনে হয়…বলে শাহাদত সাহেব মোবাইলের বাটন টিপতে লাগলেন।

আলেমা বাধা দিয়ে বলল, তোমাকে এতো অসি’র হতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো।

শাহাদত সাহেব আয়েশাকে ফোন করলেন না, বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে তার চেম্বারে ঢুকলেন।

প্রায় দু’বছর আগের কথা। আয়েশার বি.এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তার বিয়ের জন্য পাত্র দেখার দেখাদেখিও শুরু হয়েছে। প্রায় কোনো না কোনো পাত্রপক্ষের সন্ধান আসছে, আয়েশা দেখলো কোনোদিন বুঝি বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে কিন্তু সে ভয়ে প্রবালের কথা বলতে পারছে না। একমাত্র ভরসা তার মা কিন্তু মা তার বাবাকে ভয় পায়, কোনো কথা বলতে গেলে শাহাদত সাহেব রেগে যান। তবুও শেষ পর্যন্ত আয়েশা তার মাকে প্রবালকে তার পছন্দের কথা বলল। সব শুনে আলেমা কয়েকমুহূর্ত আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, এটা তুই কী করলি মা, তোর বাবাকে তুই চিনিস না। একথা শুনে কী যে কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।

আয়েশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি প্রবালকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না মা।

একথা বললে তোর বাবা তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিবে মা।

মা, তুমি বাবাকে বলবে আমি এখনই বিয়ে করবো না, আগে লেখাপড়া শেষ করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর বিয়ে করবো।

আলেমা কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থাকলো তারপর বলল, এটা আমি বলে দেখতে পারি।

কয়েকদিন পরের কথা, একদিন রাতে শাহাদত সাহেবের মন-মেজাজ ভালো দেখে আলেমা কথা তুললো, শাহাদত সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়েছেন, আলেমা শাহাদত সাহেবের মাথার কাছে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দীর্ঘদিনের সংসার, একসাথে দীর্ঘ পথচলায় আলেমা শাহাদত সাহেব দু’জনই যেন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিংবা চালচলন দেখে মনের কথা বুঝতে পারে। আলেমার আচরণেও শাহাদত সাহেবের বুঝতে বাকি রইল না যে তার কোনো আব্দার আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার আলেমা, তুমি আজ হঠাৎ করে…

আলেমা অভিমানের সুরে বলল, আজ হঠাৎ করে মানে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোমার সেবা-যত্ন করি না।

না, তা বলছি না তবে মনে হচ্ছে তোমার কোনো আব্দার আছে।

আমার আবার কী আব্দার থাকবে, তুমি বলো আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কী আছে। যদি কিছু থাকে সেটা ছেলেমেয়েদের জন্য।

হ্যাঁ, কথা না বাড়িয়ে বলে ফেলো।

না, আমি বলছিলাম আয়েশার কথা।

কী হয়েছে আয়েশার?

কিছু হয়নি, ওর বিয়ের জন্য আমাদের তোড়জোড় দেখে ও আমাকে একটা কথা বলেছে।

কী কথা?

ও এখন বিয়ে করবে না, আগে লেখাপড়া শেষ করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর বিয়ে করবে।

শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলেন তারপর বললেন, ঘটনা কি এটাই নাকি এর মধ্যে কোনো কিন্তু আছে?

কিন্তু আর কী থাকবে?

কত কী তো থাকতে পারে। হয়তো কোনো ছেলেকে ওর পছন্দ আছে, বলার সাহস পাচ্ছে না সেজন্য এখন বিয়ে করবে না বলে অ্যাভয়েড করছে।

তুমি সবকিছু শুধু জটিল করে দেখ।

না, আমি জটিল করে দেখি না। দীর্ঘদিন ফৌজদারি কেস নিয়ে কাজ করতে করতে এসব আমার একরকম মুখস্থ হয়ে গেছে। যদি আরো লেখাপড়া করতে চায় তো আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি নিজেই ওর সঙ্গে কথা বলবো কিন্তু এর মধ্যে যদি অন্যকিছু থাকে তাহলে কিন্তু আমি বিষয়টা ভালোভাবে দেখবো না। আমার কাছে কি মনে হচ্ছে জানো?

কী?

মেয়ে বুঝি মায়ের মতোই এগুচ্ছে।

মানে?

মানে আমাদের বিয়ের সময় তুমি কত কী করলে, একদিকে আমরা প্রেম করছি, তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্য মনে মনে বিয়ের পিঁড়িতে পা দিয়ে, হাতে মেহেন্দি, পায়ে আলতা, কপালে টিপ পরে বসে আছ আর আমার শ্বশুর মহাশয়কে বলছ আমি এখনই বিয়ে করবো না, আগে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর বিয়ে করবো।

আর তুমি বুঝি পাত্র সেজে, সেরোয়ানি পরে, মাথায় পাগড়ি দিয়ে বর সেজে ছিলে না, সব দোষ আমার।

না, আমি অস্বীকার করছি না। শুধু বলছি, মেয়ে যেন মায়ের মতো না হয় বলে শাহাদত সাহেব হেসে উঠলেন।

আলেমা ধীর শান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি আমার কাছে একজন রহস্যময় মানুষ।

কেমন?

কখনো তুমি একজন লোহার মতো শক্ত মানুষ আবার কখনো তুমি খুব রোমান্টিক মানুষ।

ঠিকই বলেছ। এখন আমি তোমাকে বলছি ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে।

কী ঘটতে যাচ্ছে বলতো।

আয়েশা ঐ প্রবাল না কী নাম ঐ ছেলেটাকেই বিয়ে করবে তাই এসব ধানাই-পানাই করছে।

ও যদি ঐ ছেলেটাকেই বিয়ে করে তো অসুবিধা কী। সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ছেলে, চাকরি করবে, না হয় ব্যবসা করবে। মেয়ের ভাত কাপড়ের তো আর অভাব হবে না।

শাহাদত সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি কী বললে?

আলেমা আর কিছু বলল না।

আপাতত আয়েশার বিয়ের তোড়জোড় বন্ধ হলো কিন্তু শাহাদত সাহেবের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ রয়েই গেল। একদিন সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে আয়েশাকে শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশা এখন কী করবি ভাবছিস?

বাবা। আমি চাকরির জন্য লেখাপড়া করছি আর একটা কথা ভাবছি যদি তুমি সম্মতি দাও।

কী?

এল.এল.বি ভর্তি হবো, নাইট কলেজে।

তুইও উকিল হবি? শাহাদত সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হলো।

হ্যাঁ। যদি চাকরি হয়ে যায় তো ভালো আর নয়তো ওকালতি করবো।

তাহলে তো বেশ ভালো হবে। তুই এক কাজ কর।

আয়েশা বাবার মুখের দিকে তাকালো, কী কাজ বাবা?

এল.এল.বি ভর্তি হয়ে তোর কলেজ বন্ধের দিনগুলোতে সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে বস। তাহলে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্র্যাকটিসও হবে।

আয়েশা খুব খুশি হলো, জি বাবা।

আয়েশার বি.এ’র রেজাল্ট হলো। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি.এ পাস করেছে। তারপর সে নাইট কলেজে এল.এল.বি ভর্তি হলো। আয়েশার খুব হাসি-আনন্দে দিন যাচ্ছিল। আয়েশার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে থাকতো চাকরির জন্য পড়ালেখা করা, চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজা, চাকরির দরখাস্ত করা আর সন্ধ্যায় আইন কলেজে ক্লাস করতে যাওয়া। প্রায় দিনই প্রবালের সঙ্গে আয়েশার দেখা হতো, দু’জনে একসাথে চাকরির দরখাস্ত করত। এর মধ্যে ঘটল এক নতুন ঘটনা। সেদিন একটা চাকরির দরখাস্ত করতে গিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে দেরি হওয়ায় প্রবাল আয়েশাকে মোটর সাইকেলে বাসায় পৌঁছে দিল। আয়েশা নিজেই প্রবালকে বলল, প্রবাল অবশ্য বলেছিল, আঙ্কেল বাসায় নেই তো, যদি দেখে ফেলে?

আয়েশা ঘড়িতে সময় দেখে বলল, এসময় বাবা কোর্টে থাকে।

ওকে, তাহলে চলো।

আয়েশা অনেকটা নিশ্চিত ছিল যে তার বাবা বাসায় ফেরেনি কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখলো বাবা বাসায়। বাবার মুখ বাংলা পাঁচের মতো ঝুলে গেছে। তখনকার মতো বাবা তাকে কিছু বলল না। আয়েশা হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল ততক্ষণ তার বাবা ড্রয়িং রুমে বসেছিল। আয়েশার খাওয়া শেষ হলে ড্রয়িং রুম থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ডাক দিলেন, আয়েশা।

বাবার ডাক শুনেন আয়েশার বুকটা কেঁপে উঠল, সে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। আয়েশার পিছু পিছু আলেমাও ঢুকলো।

আয়েশা ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?

বাবা আমার ফ্রেন্ড।

নাম পরিচয় বল।

বাবা ওর নাম প্রবাল, বাবার নাম, বাবার নাম দু’বার উচ্চারণ করলো আয়েশা কিন্তু মনে এলো না। ভয়ে সে যেন ভুলে গেছে।

নাম পরিচয়হীন ছেলে তোর ফ্রেন্ড, শুধু ফ্রেন্ড না যে তোকে মোটর সাইকেলে করে বসায় পৌঁছে দিচ্ছে সেতো শুধু ফ্রেন্ড না, খুব কাছের ফ্রেন্ড।

ও মনে পড়েছে, বাবার নাম শফিউদ্দীন, শফি হাজি বলে ডাকে সবাই।

শাহাদত সাহেব ভ্রু’কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, শফি হাজি, বাসা কোথায়?

বাসার কথা শুনে শাহাদত সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি সোফা থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলেন, মানে তুই শফি’র ছেলে প্রবালের কথা বলছিস?

আয়েশা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর ধীরে ধীরে সাহস করে বলল, বাবা প্রবাল আমার শুধু ফ্রেন্ড, ও কার না কার ছেলে তাতে তো আমার কিছু যায় আসে না। কথাগুলো বলার সময় আয়েশার বুক কেঁপে উঠল, সে কী বলছে তার বাবাকে, বলছে শুধু ফ্রেন্ড অথচ প্রবাল তার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে দু’জনের জীবন যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে।

আয়েশার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আলেমা আয়েশাকে বলল, তুই যা তো মা, তুই তোর রুমে যা।

আয়েশার মাথা নত করে তার রুমে চলে গেল।

আলেমা শাহাদত সাহেবকে শান্ত করার জন্য তার পাশে বসে বলতে শুরু করলো, তুমি কী বলছো এসব, আয়েশা এখন বড় হয়েছে, বি.এ পাস করেছে এখন তো ওর দুয়েকজন বন্ধু থাকতেই পারে, তুমি মেয়েটাকে এভাবে অপমান করলে। রাগটা একটু কমাও, এখন বয়স হয়েছে এখন আর আগের মতো রেগে যাওয়ার বয়স নেই।

শাহাদত সাহেব কিছুটা আশ্বস্ত হলেন, ঐ বংশের কারো নাম শুনলেই মাথায় রক্ত উঠে যায়। অথচ আমার মেয়ে প্রেম করছে ঐ বংশের একটা ছেলের সঙ্গে। ওদের টাকা থাকতে পারে কিন্তু বংশ মর্যাদা নেই। একসময় শফি হাজি ইন্ডিয়া বাংলাদেশের মধ্যে চোরাকারবারির ব্যবসা করত, মানে স্মাগলিংয়ের ব্যবসা, যারা ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে মাল আনা-নেয়ার ব্যবসা করে তাদের ব্লাকি বলে। শফি হাজি শহরের মানুষ বলে কিন্তু গ্রামে সবাই তাকে শফি ব্লাকি বলে ডাকে।

আচ্ছা একটা কথা বলো, প্রেম করার সঙ্গে কি কেউ জাত-বংশ দেখে, এটা হলো মনের বিষয়, ভালো লাগার বিষয়, কখন কাকে কার ভালো লাগবে এটা কি বলা যায়?

তাই বলে আমার মেয়ে একটা ব্ল্যাকির ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, প্রেম করবে।

ব্লাকির প্রতি শাহাদত সাহেবের রাগ দেখে আলেমার বুক কেঁপে উঠল, মনে মনে আয়েশাকে বলল, এটা তুই কী করলি মা, আজ না হয় শুধু বন্ধুত্ব বলে কাটিয়ে দিলি কিন্তু একদিন তো সত্যি সত্যি এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।

আলেমাকে আনমনা দেখে শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছো?

ভাবছি আজকাল যে মোবাইল ফেসবুকের যুগ এসেছে তোমার কোন ছেলে কোথায় কী করবে, তোমার মেয়ে কার সঙ্গে প্রেম করবে, কাকে বিয়ে করবে, তোমার নাতি-নাতনীরা কার হাত ধরে বাসায় নিয়ে আসবে কিংবা কার হাত ধরে চলে যাবে আর তুমি রেগে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক করবে সেটাই চিন্তা করছি।

শাহাদত সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আমার হার্ট এতো দুর্বল না যে ছোটখাটো কারণে হার্ট অ্যাটাক করবো।

আল্লাহ তাই যেন করেন।

সেদিনের মতো বিষয়টা মিটে গেলেও শাহাদত সাহেবের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দেখা দিল। তার চোখের সামনে আয়েশার প্রবালের কোমর জড়িয়ে ধরে মোটর সাইকেলে আসার দৃশ্য ভেসে উঠল। তিনি কোনোভাবেই প্রবালের সঙ্গে আয়েশার বন্ধুত্বই হোক আর প্রেমই হোক মেনে নিতে পারলেন না।

আলেমা আয়েশাকে ফোন করার জন্য তার মোবাইল ফোনের বাটন টিপতে লাগল এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। আলেমা নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিল, সে আয়েশাকে দেখে বলল, এত দেরি করে ফেললি, এদিকে তোর বাবা তো তোর ওপর রেগেমেগে অসি’র।

কেনো মা? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?

না, তেমন কিছু বলল না। তোকে খুঁজলো, তুই তো জানিস তোর বাবার পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কাণ্ড করে। যা আগে দেখা কর।

আয়েশা ভিতরের দরজা দিয়ে চেম্বারে ঢুকে বাবা কাঁধে ছোট বাচ্চার মতো দু’হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

আমাকে খুঁজছিলে?

হ্যাঁ। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

একটু বাইরে গিয়েছিলাম। কাজ ছিল।

এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী কাজ থাকে, আজ তো কলেজ ছিল না।

আয়েশা জানে বাবা তার ওপর যত রাগই করুক সে ঠিকই ম্যানেজ করে ফেলবে, কীভাবে কথা বললে বাবার তার ওপর সব রাগ নিমিষেই গলে যাবে। সত্যি সত্যি তাই হলো, শাহাদত সাহেব আয়েশার ওপর রাগ করতে পারলেন না, বাবা আমি এখন বড় হয়েছি আর রাত আটটা খুব বেশি রাত না।

যা এখন তোর চেয়ারে গিয়ে বস, তোকে কী কী কাজ দিয়েছিলাম দেখ, মুকুল মিরানকেও নতুন কেস দিয়েছি, ওগুলো স্ট্যাডি কর।

জি বাবা, বলে আয়েশা চলে গেল।

শাহাদত সাহেব মৃদু হেসে আপনমনে বললেন, পৃথিবীতে সবার ওপর রাগ করতে পারি, ছেলেমেয়েদের ওপরও কিন্তু আয়েশার ওপর, শুধু এই মেয়েটার ওপর রাগ করতে পারি না। মেয়েটার দিকে তাকালে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে, মাগো, তুই কেনো এমন ভুল করলি, শেষ পর্যন্ত আমার জন্য বুঝি তোকে কষ্ট পেতে হয়।

পাঁচ

প্রতিদিন সকালবেলা উঠে শাহাদত সাহেব পত্রিকায় চোখ বোলাবেন, না চোখ বুলাবেন না, মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়বেন একে একে নিউজগুলোর বিশ্লেষণ করবেন, সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে, নির্মাণের এক বছরের মাথায় ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দিয়েছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করেছেন, বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে আগুন, মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ইত্যাদি ইত্যাদি। খবরগুলো পড়ার পর নাস্তা করবেন, নাস্তার সময় এসব খবরের কিছু অংশ আলেমাকে শোনাবেন তারপর কোর্ট-কাচারি খোলা থাকলে কোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবেন আর শুক্রবার হলে বলবেন, আলেমা বাজারের ব্যাগ আর লিস্ট দাও।

আলেমা বাজারের ব্যাগ দিবে, ওপর থেকে নেমে আসবে শাহাদত সাহেবের বড় নাতি রুদ্র, সে বাজারে গিয়ে বাজারের লিস্ট অনুযায়ী শাহাদত সাহেবকে নিয়ে যাবে, শাহাদত সাহেবের একজন মহুরী আছে, মোতালেব, সে বাজারের ব্যাগ ধরবে আর শাহাদত সাহেব দাম দর করবেন, ইলিশ কত করে কেজি?

সবার কাছে তো দেড় হাজার টাকা আপনার জন্য একশ টাকা কম, চৌদ্দশ।

শাহাদত সাহেব ইলিশ মাছের দিকে তাকিয়ে থাকেন, দোকানদার জিজ্ঞেস করে, দিব স্যার?

শাহাদত সাহেব মাছ না নিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, এক কেজি ইলিশ মাছের দাম দেড় হাজার টাকা, এত টাকা দিয়ে ইলিশ মাছ কে কিনে?

শাহাদত সাহেব এগিয়ে যান, রুই-কাতলা মাছের দিকে এক কেজি বা দেড় কেজি ওজনের মাছের দাম জিজ্ঞেস করেন, কাতলা কত করে কেজি?

স্যার আপনার জন্য কম।

কম কত?

সবার কাছে তো তিনশ টাকা, আপনি স্যার দু’শ আশি টাকা দিয়েন।

দু’শ আশি না, দু’শ পঞ্চাশ নাও, হলে কেটে দাও।

স্যার আরেকটু বাড়ান, এই দু’শ সত্তর টাকা দিয়েন।

না, না দু’শ পঞ্চাশ দিব, হলে দাও।

শাহাদত সাহেব কাতলা মাছ কিনেন আর দূর থেকে তাকিয়ে দেখেন ইলিশ মাছের দিকে, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সের এক লোক ইলিশ মাছের দরদাম করছে, দোকানি বেশ ঘনঘন স্যার স্যার বলছে। শেষ পর্যন্ত লোকটি একটা ইলিশ মাছ কিনলো।

রুদ্র বেশ বুদ্ধিমান। সে জানে তার দাদু বেশ জেদী, একবার তার জিদ উঠে গেলে সে কাজটা তিনি করে ছাড়বেন। তার ইলিশ মাছের প্রতি বেশ দুর্বলতা আছে। তার দাদু যখন হনহন করে ইলিশ মাছের দোকান থেকে কাতলা মাছের দোকানের দিকে এলো তখন তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এবার এক ভদ্রলোক ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যাওয়ায় সে তার দাদুকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করলো, দাদু ইলিশ মাছ কিনবা না?

কথায় বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়, এমনিভাবে শাহাদত সাহেব স্বাধীন এবং বিপ্লবকে বাজারে নিয়ে আসতেন, কোনোদিন তারা এভাবে বেশি দামি কোনোকিছু নিতে চাইলে শাহাদত সাহেব বোঝাতেন, বাবা দাম কমুক, সবসময় এতো দাম থাকবে না আর কয়েকদিন পরেই দাম কমবে তখন নিয়ে যাবো।

শাহাদত সাহেব একবার রুদ্র’র মুখের দিকে তাকালেন, স্নেহময় এক মুখ, চোখের দিকে তাকিয়ে শাহাদত সাহেব গালে-মুখে আদর করে বললেন, ইলিশ মাছ খাবি।

রুদ্র মাথা নেড়ে সায় জানালো।

শাহাদত সাহেব আবার ইলিশ মাছের দোকানে গেলেন, একটা ইলিশ মাছ কিনলেন। ইলিশ মাছ কিনে দাদু-নাতি চলে গেলেন কাঁচাবাজারে, পানিকচু দিয়ে ইলিশ মাছ শাহাদত সাহেবের খুব পছন্দের খাবার, একটা পানি কচু কিনলেন। পাশের দোকানে শাহাদত সাহেব সবসময় কাঁচাবাজার কিনেন। আজও সেই দোকানে একেকটা সবজির দাম শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন, এক কেজি পটলের দাম পঞ্চাশ টাকা, এক কেজি ঢেঁড়শের দাম পঞ্চাশ টাকা, বলতে গেলে পঞ্চাশ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি নেই। একটা ফুলকপি নিতে চাইলেন, দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, ফুলকপি কত করে পিস?

দোকানদার বলল, নেন স্যার আপনার জন্য কম রাখবো।

কত?

স্যার ত্রিশ টাকা কেজি।

শাহাদত সাহেব আরো অবাক হলেন, ফুলকপি কবে কেজিতে উঠল?

দোকানদার দাঁত বের করে এক গাল হেসে বলল, আপনাকে কয়েক শুক্রবার দেখিনি স্যার, সেজন্য মনে হয় জানেন না, এবার শুরু থেকে ফুলকপি, বাঁধাকপি সব কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

আচ্ছা দাও, বাজারে তো দেখছি আগুন লেগেছে।

রুদ্র দাদুর কথা বুঝতে পারল না, সে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শাহাদত সাহেব রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তাকিয়ে আছিস কেনো?

আগুন কোথায় দাদু?

দেখছিস না বাজারে সবকিছুর দাম বেশি তাই বলছি বাজারে আগুন।

রুদ্র একটা সরল হাসি হাসল।

তারপর চলে মুদি দোকানে।

তেল নিয়ে তেলেসমাতি দেখে তার পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠল, কয়েকদিন আগেও তেলের লিটার ছিল একশ ত্রিশ টাকা আজ হঠাৎ করে একশ চল্লিশ টাকা। তিনি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, কবে তেলের দাম বাড়ল?

গত পরশুদিন স্যার।

শাহাদত সাহেব আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, বলা নেই কওয়া নেই তেলের দাম বেড়ে গেল।

দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, স্যার কিছু বললেন?

না। ভাবছি বলা নেই, কওয়া নেই দাম বেড়ে গেল।

দোকানদার ক্ষোভের সঙ্গে বলল, কে কাকে বলবে স্যার, আমরা দোকানদার মানুষ, কিনি আর দু’পয়সা লাভ রেখে বেচে দিই কিন্তু দাম বেড়ে যায় তো ওপরে, হঠাৎ করে গিয়ে শুনি তেলের দাম বাড়ে গেছে। আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হয় তাই বেশি দামে বেচি।

শাহাদত সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন, হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন, কে কাকে বলবে, দেখতে দেখতে দেশটা কেমন হয়ে গেল।

জি স্যার।

শাহাদত সাহেব বাসায় ফিরে এসে আলেমাকে বাজারের সব গল্প শোনালেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে আলেমা, তেলের লিটার কেজিতে দশ টাকা বেড়েছে, তেল একটু কম করে দিবা তরকারিতে।

আলেমা ঝাঁঝিয়ে উঠল। কম তেল দিয়ে তরকারি রান্না করলে তখন তো বলবা রান্না ভালো হয়নি। তেলের দাম বেড়েছে বলে কি মানুষ তেল কিনছে না? এই যে তুমি বললা ইলিশ মাছের দাম চৌদ্দশ টাকা তবুও তো তুমি এনেছ। এখন যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তেমনি মানুষের ইনকামও বেড়েছে।

হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ মানুষের ইনকামও বেড়েছে তবে বৈধর চেয়ে অবৈধ ইনকামটা একটু বেশি বেড়েছে।

এসব তুমি চিন্তা করো, তুমি ছাড়া আর কেউ এতো ভাবে না। যার যেখানে সুযোগ আছে সে সেখানে ইনকাম করছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে না এমন মানুষ তুমি ছাড়া আর একটিও আছে বলে মনে হয় না।

শাহাদত সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। নিজের ঘরে যান, আলেমা রান্নার কাজে মনোনিবেশ করে। ওপর তলা থেকে বউমা আসে, স্বাধীনের বউ, সুলতানা রাজিয়া। শাশুড়ির সঙ্গে রান্নায় যোগ দেয়। স্বাধীন আলাদা রোজগার করে তারও টাকার কমতি নেই, বিপ্লবও আজকাল ভালো রোজগার করে কিন্তু ভাতের হাঁড়ি এখনো একটাই। দ্বিতল বাসার ওপর তলার পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা ফ্ল্যাটে থাকে স্বাধীন, তার বউ বাচ্চা নিয়ে, আরেকটা ফ্ল্যাটে থাকে বিপ্লব। অবশ্য বিপ্লবের ফ্ল্যাটের কয়েকটা রুম ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাড়িতে যত মেহমান আসে সব দোতলায় বিপ্লবের ফ্ল্যাটের ফাঁকা রুমে থাকে। নিচতলায় একটা বড় ফ্ল্যাট আর একটু ছোট গ্যারেজ। গাড়ি এখনো নেই কিন্তু ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শাহাদত সাহেব সুযোগটা রেখেছেন।

নিচতলায় সব রান্নার কাজ হয়, রান্নার সময় হলে রাজিয়া নেমে আসে নিচতলায়, রান্না করে, সবাইকে খাওয়ার পরিবেশন করে তারপর ওপরে চলে যায়। সাধারণত বিয়ের পর আজকালকার মেয়েরা যৌথ পরিবার পছন্দ করে না, নিজের স্বামী-সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে যায় কিন্তু সেদিক থেকে রাজিয়া একটু অন্যরকম, সে শৈশব থেকে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে, তাই সে নিজেও যৌথ পরিবার পছন্দ করে। সকালবেলা সবার জন্য নাস্তা তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে দিয়ে দেয়, দুপুরে ঠিক সময়ে ভাত রান্না করে তবে সকাল এবং দুপুরবেলা যার যার মতো খেয়ে নেয় কারণ সবার একসাথে সময় মিলে না কিন্তু রাতে সবাই মিলে একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খাওয়া এই বাড়িতে দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ, যদিও ইদানীং সে রেওয়াজের কিছুটা ব্যতিক্রম হয়, স্বাধীন চেম্বার থেকে দেরিতে ফিরে, বিপ্লব ব্যবসা এবং রাজনীতির কাজ শেষ করে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় তাই এখন বেশিরভাগ দিনে একসাথে রাতের খাবার খান শাহাদত সাহেব, রুদ্র, রানু, আয়েশা, রাজিয়া আর আলেমা।

শাহাদত সাহেব রাগী এবং জেদি মানুষ, কথায় কথায় রেগে যান কিন্তু খাওয়ার টেবিলে তিনি খুব সাধারণ মানুষ, সবার সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলেন। সবাই যত সমস্যার কথা, যত আলোচনা খাওয়ার সময় করে, আলেমা আগে শাহাদত সাহেবকে খুব ভয় পেতো কিন্তু ইদানীং সে ভয় কেটে গেছে, কথায় কথায় বলে আমার তিনকাল কেটে গেছে আর এখন কী করবে আমাকে।

সেদিন রাতে শাহাদত সাহেব রাতের ভাত খেয়ে উঠবেন এমন সময় আলেমা বলল, তোমাকে একটা কথা বলবো ভাবছিলাম।

শাহাদত সাহেব কিছু বললেন না, হাত ধুয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলেন, বলো।

আজ বিপ্লবী ফোন করেছিল।

বিপ্লবীর কথা শোনার পর শাহাদত সাহেবের চোখ-মুখ যেন লাল হয়ে গেল, তিনি রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কেনো?

কেনো আবার মেয়ে মাকে ফোন করবে না?

সেকথা আমাকে বলছো কেনো? সে তো তোমাকে ফোন করেছিল, যা কথা হয়েছে তোমাদের মা-মেয়ের মধ্যে হয়েছে।

ও একবার তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল।

শাহাদত সাহেব একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললেন, কেনো?

কেনো আবার মেয়ে বাপের সঙ্গে কথা বলতে আবার কারণ লাগে। তোমার ভালো-মন্দ খবর নিবে।

তুমি বলোনি তোর বাবা ভালো আছে।

বলেছি।

তাহলে তো হলোই, বলে শাহাদত সাহেব কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তার রুমে চলে গেলেন।

শাহাদত সাহেবের তেমন ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। সেই কয়েক বছর আগে তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন তারপর আর ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ইতোমধ্যে বিপ্লবী এবং মোস্তাক কয়েকবার বেড়াতে এসেছে, ছোট্ট একটি বাচ্চা বারান্দায় ছুটোছুটি করেছে, দেখতে ভালোই লেগেছে শাহাদত সাহেবের, মাঝখানে অনেকদিন আর ঢাকায় যাওয়া হয়নি, তাই বিপ্লবীর বাসায়ও যাওয়া হয়নি। কয়েকমাস আগে শাহাদত সাহেব ঢাকায় গিয়েছিলেন পিংকি ততদিনে আরো বড় হয়েছে, সে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শাহাদত সাহেব তার একটা ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা রওয়ানা হয়েছেন। বাবা ঢাকা রওয়ানা হয়েছে শুনে বিপ্লবী কয়েকবার ফোন করে খবর নিয়েছে। ট্রেন যখন জয়দেবপুর তখন একবার ফোন দিয়েছে, বাবা তুমি কতদূর?

এই তো মা, জয়দেবপুর পার হলাম। এতো দুশ্চিন্তা করছিস কেনো মা?

দুশ্চিন্তা করছি না বাবা, তোমার জামাই গাড়ি নিয়ে কমলাপুর যাবে তোমাকে নিয়ে আসতে।

কী দরকার, আমি তোর বাসায় যেতে পারবো মা।

পারবে তো বাবা তবে একটু কষ্ট হবে, কারণ আমরা তো আগের বাসায় নেই।

ও।

তোমার জামাই যাবে বাবা। তুমি আসবে শুনে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, তোমাকে একবার ফোনও করেছিল তুমি বুঝি ঘুমাচ্ছিলে।

হ্যাঁ একবার ফোন করেছিল, আমি ভাবলাম একটু পরে ফোন দিব আর তুই ফোন দিলি।

বাবা তুমি ট্রেন থেকে নেমে, গেট দিয়ে বের হয়ে কোথাও যেও না, ও তোমাকে নিয়ে আসবে।

আচ্ছা মা।

কথামতো মোস্তাক শাহাদত সাহেবকে নিয়ে বাসায় গেল। মেয়ে-জামাইয়ের নতুন বাসা দেখে শাহাদত সাহেবের চোখ কপালে উঠল। তিন রুমের ফ্ল্যাট, ফ্লোরে বিদেশি টাইলস, দরজা-জানালাসহ সব জায়গায় যেন আধুনিকতা ও আভিজাত্যের ছোঁয়া। বাসার আসবাবপত্র সব নতুন, বিপ্লবী যখন ঘুরে ঘুরে তার বাসা দেখাচ্ছিল তখন শাহাদত সাহেবের মনে নানান রকম প্রশ্ন দেখা দিচ্ছিল। এই তো কয়েক বছর আগে মোস্তাক চাকরিতে জয়েন করলো, কতই বা বেতন, সরকারি চাকরির বেতন সম্পর্কে শাহাদত সাহেবের স্পষ্ট ধারণা আছে। তিনি হিসেব মেলাতে পারলেন না আবার বাসার ভাড়া কত এ কথাটা মেয়ে-জামাইকে বলতেও পারলেন না।

শাহাদত সাহেব যখন বাসায় ঢুকলেন তখন পিংকি শিক্ষকের কাছে পড়ছিল, শিক্ষক চলে যেতেই সে একরকম দৌড়ে ড্রয়িং রুমে এসে শাহাদত সাহেবের কোলে বসল, গুড ইভিনিং গ্র্যান্ড ফাদার।

নাতির মুখে গুড ইভিনিং শুনে শাহাদত সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল, গুড ইভিনিং নানু। কেমন আছিস?

আই অ্যাম অলসো গুড, ইউ?

আমিও ভালো আছি নানু।

হোয়াট অ্যাবাউট মাই গ্র্যান্ড মাদার, মাই আঙ্কেল অ্যান্ড কাজিন?

এভরি বডি অলসো গুড, বলে শাহাদত সাহেব নাতিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আমি তেমন ইংরেজি জানি না নানু ভাই। তুই বাংলায় বল।

বিপ্লবী এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিল সে তার বাবার শেষ কথাটুকু শুনতে পেল। সে কিছুটা লজ্জা পেল। বিপ্লবী ভালোভাবেই জানে যে তার বাবা ইংরেজিতে কথা বলতে এবং লিখতে বেশ দক্ষ কিন্তু নাতিনীর কাছে ইংরেজি জানে না কথাটা যে তার বাবার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হলো না। সে নাস্তার প্লেট নিয়ে কাজের মেয়ের পিছু পিছু ঢুকতে ঢুকতে বলল, পিংকি বাংলায় বল, এটা তো স্কুল না মা।

শাহাদত সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে সিয়ামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আমার নানু অনেক বড় হবে, যা নানু তুই পড়তে বস।

পিংকি চলে গেল। বিপ্লবী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আঁতকে উঠল। বাবাকে কিছু বলতে গিয়ে যেন বুক শুকিয়ে গেল। অনেক ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা কিছু হয়নি তো?

না রে মা কী আর হবে।

তুমি বসো বাবা আমি ভাত রেডি করি বলে বিপ্লবী চলে গেল। শাহাদত সাহেব যেন কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না। জামাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে গাড়িতেই, বাসায় এসে আবার দেখা হলো ডাইনিং টেবিলে। শাহাদত সাহেবের পেটে যেন খাবার যাচ্ছে না। এক গ্রাস ভাত মুখে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিবুচ্ছেন তারপর কোনো রকমে গিলছেন।

বাবার অবস্থা দেখে বিপ্লবী জিজ্ঞেস করলো, বাবা রান্না ভালো হয়নি?

রান্নার দোষ না রে মে, তোর রান্না তো ভালোই, কেনো জানি খেতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া রাতের বেলা তেমন খেতে পারি না তো, বলে শাহাদত সাহেব হাত ধোয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।

বাবাকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেখে বিপ্লবী কিছুটা অপ্রস্তুত হলো, বাবা তুমি তো কিছু খেতে পারলে না, বসো বাবা আমি তোমাকে দুধ কলা ভাত দেই।

লাগবে না মা। আসলে আগের মতো আর খেতে পারি না। জার্নি করে এসেছি তাই এমন লাগছে, রাতে একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।

মোস্তাক বলল, আব্বা কোনো প্রব্লেম ফিল করছেন? গ্যাস হচ্ছে, বাসায় গ্যাসের ঔষধ আছে, বেশি অসুস্থ মনে করলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করি।

কিচ্ছু হবে না বাবা। তোমরা টেনশন করো না। আজকাল আমি যেন কেমন হয়ে গেছি, নিজের নীতি-আদর্শের একটু উনিশ-বিশ দেখলেই অ্যাবনরমাল হয়ে যাই।

বাবা আমি কি কোনো ভুল করেছি, তোমার জামাই…

থাক মা, তোদের আর ব্যস্ত হতে হবে না বলে শাহাদত সাহেব বেসিনে হাত ধুয়ে বেড রুমে ঢুকলেন।

মোস্তাক আর বিপ্লবী পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। বিপ্লবী বাবার পিছু পিছু বেড রুমে ঢুকলো। বাবার আচরণে বিপ্লবী খুব কষ্ট পেয়েছে, একটা অজানা আশঙ্কাও হচ্ছে তার মধ্যে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা, কী হয়েছে বাবা? আমরা কি তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি?

শাহাদত সাহেবের মনের মধ্যে তখন অনেক কথার ঝড় বইছে। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সে তার খুব রাগ ছিল, তখন তিনি রেগে গেলে লুকাতে পারতেন না, রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন আর এই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই তো একে একে তিনটি সরকারি চাকরি ছেড়েছেন কিন্তু এখন বয়স হয়েছে, সব কথা মুখে বলতে পারেন না, অধিকাংশ কথা হজম করতে হয়, লুকাতে হয়। তারপরও মোস্তাক যদি বিপ্লবের মতো তার ছেলে হতো তবে তিনি রাগ লুকাতেন না, শাসন করতেন কিন্তু ছেলেকে শাসন করা গেলেও জামাইকে তো আর শাসন করা যায় না। তবে তার দৃষ্টিতে মোস্তাকের মতো বিপ্লবীও সমান দায়ী কিন্তু একথা তিনি এখানে বলতে চান না। আবার প্রতিবাদ করবেন না তাও হয় না।

সারারাত শাহাদত সাহেবের চোখে ঘুম নেই। ঘুমের ঘোরে বিভিন্ন রকমের চিন্তা মাথায় আসছে, একটু একটু ঘুম নেমে এসেছে, চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মিছিল, সাদা কাফনের কাপড় পরা মানুষের মিছিল, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। মিছিলটি এগিয়ে আসছে, মিছিলের সামনে পুলিশ সরাসরি গুলি চালালো, মাটিতে পড়ে থাকলো কয়েকটি তাজা লাশ, কার্পেটিংয়ের কালো রাস্তা রক্তে রঞ্জিত হলো, মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, সবাই প্রাণপণে ছুটছে, শাহাদত সাহেব নিজেও ছুটছেন, তার পরনে তো কাফনের কাপড় নেই, সাধারণ পোশাক কিন্তু একি তার পিছনে পিছনে কাফনের কাপড় পরা লোকগুলো ছুটছে কেনো? তিনি জোরে দৌড়াচ্ছেন আর তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে কাফনের কাপড় পরা লোকগুলোও। তার ঘুম ভেঙে গেল, তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, তিনি হাঁপাচ্ছেন, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছেন, একি স্বপ্ন দেখলেন তিনি, কাফনের কাপড় পরা লোকগুলো কি ভাষা শহিদরা? তিনি আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন, সারারাত বিছানায় কাটল ছটফট করতে করতে, ভোরবেলা একটু ঘুমের ভাব এসেছে আর মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো, আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাহ…

সকালবেলা নাস্তার টেবিলে বাবার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবী যেন আঁতকে উঠল, বাবা, তোমার কি ভালো ঘুম হয়নি? চোখ লাল দেখাচ্ছে কেনো? তোমাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো?

শাহাদত সাহেব তার স্বপ্নের কথা বললেন, শুনে বিপ্লবী বলল, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, আসালে আমাদের পিংকিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বুঝি তুমি এই স্বপ্ন দেখেছ, আমি পিংকিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে নিয়ে আসবো বাবা।

মোস্তাক যেমন মাথা নত করে নাস্তা খাচ্ছিল তেমনিভাবে খেতে লাগল, শাহাদত সাহেব বলতে শুরু করলেন, পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। অথচ আজ আমার নাতিনী ভর্তি হয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। আগে চাই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দক্ষতা। বাংলা ভাষা জানা দরকার জীবনের প্রয়োজনে আর জীবিকার প্রয়োজনে জানা দরকার বিদেশি ভাষা। অথচ তোমরা পিংকিকে আগে ইংলিশ ভাষা শেখাচ্ছ।

বিপ্লবী আকুতি করে বলল, বাবা, আমাদের ভুল হয়ে গেছে বাবা। তুমি কি বলো বলে বিপ্লবী মোস্তাকের দিকে তাকাতেই মোস্তাক আবার মাথা নত করলো কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না।

নাস্তা শেষ করে শাহাদত সাহেব বের হওয়ার সময় প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বেডরুমে গেলেন। পিছু পিছু বিপ্লবীও তার বাবার রুমে ঢুকলো। বাবাকে প্রস্তুতি নিতে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কোথাও যাবে?

হ্যাঁ চলে যাবো।

তুমি না কালকেই এলে, আজকেই যাবে কেনো? আমাদের বাসায় কয়েকদিন থাকো।

আসলে আমি একটা কাজে এসেছি রে মা, হাইকোর্টে একটা কাজ আছে তারপর আবার দিনাজপুর চলে যাবো।

বাবা, এভাবে কেউ মেয়ের বাড়ি থেকে চলে যায়?

বাবা-মেয়ের কথা বলা শুনে মোস্তাকও দরজায় এসে দাঁড়ালো, আব্বা আপনি চলে যাবেন?

হ্যাঁ। একটা কাজে এসেছি, আজ দিনের মধ্যে কাজটা হয়ে যাবে তারপর চলে যাবো।

শাহাদত সাহেবের ব্যাগ গুছানো হয়ে গেছে। তিনি একবার পিংকির কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমার নানু ভাই কোথায় গেছে?

বাবা ওর তো সকাল সাতটায় স্কুল, তখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে, আমি ভাবলাম তুমি নামাজ পড়ে ঘুমাচ্ছ আর কয়েক দিন তো থাকবে তাই ডাক দিইনি। তুমি থাকো না বাবা অন্তত একটা দিন বলতে বলতে বিপ্লবী কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এলো।

শাহাদত সাহেব বিপ্লবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কাঁদিস না রে পাগলি, আমার নানু ভাইকে ভালোভাবে লেখাপড়া শেখাবি, ওর চোখ দুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, একদিন অনেক বড় হবে।

দোয়া করিও বাবা।

অবশ্যই করব মা। তোমাদের এই বাসাটা বেশ বড় হয়েছে, বেশি ভাড়া দিয়ে এতো বড় বাসা তো তোমাদের প্রয়োজন নেই।

ভাড়া না আব্বা এই ফ্ল্যাটটা তো আমি কিনেছি, নব্বই লাখ টাকায় কথাটা বলার সময় মোস্তাক গর্ব ভরে বলল।

কথাটা যেন শাহাদত সাহেবের বুকে ধাক্কা লাগল, তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেন। মেয়ে না হলেও জামাই হয়তো ভেবেছিল তার ফ্ল্যাট কেনার কথা শুনে তার শ্বশুর খুশি হবে, মেয়ে জামাইয়ের উন্নতি কোন শ্বশুর না চায় কিন্তু শাহাদত সাহেবের কাছে উন্নতির সংজ্ঞাটা অন্যরকম। নিজের পরিশ্রম, মেধা, অর্থ বিনিয়োগ করে মানুষ যা আয় করে সেটাই তার রোজগার, মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব, উদারতা, মহানুভবতা কতটা উন্নত মানের সেটাই তার উন্নতি।

শাহাদত সাহেব একটা কষ্টের হাসি হেসে বিদায় নিলেন, মোস্তাক একবার হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাইল কিন্তু তিনি মোস্তাকের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না।

শাহাদত সাহেব চলে যাওয়ার পর বিপ্লবী মোস্তাককে বলল, তুমি কেনো বললে ফ্ল্যাটটা আমি কিনেছি, কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মুখ কালো করেছেন, বাবা তোমার কথায় খুব মাইন্ড করেছেন। তুমি তো জানো আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি নিজে কোনো অন্যায় করেন না আর কেউ অন্যায় করুক সেটাও তিনি পছন্দ করেন না।

আমি বুঝতে পারিনি, আমি ভেবেছিলাম আব্বা বুঝি খুশি হবে।

আরো একটা বিষয়ে আব্বা মাইন্ড করেছেন, পিংকিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করায়।

মোস্তাক একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, কী সব ব্যাক ডেটেড চিন্তাভাবনা।

কী বললে আমার বাবা ব্যাক ডেটেড? বিপ্লবীর কথায় অভিমানের সুর।

না, ঠিক ব্যাক ডেটেড না, মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাটা কি অপরাধের, ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছি এটাও কি দোষের? আজকাল সুযোগ থাকলে কে না সদ্ব্যবহার করে। ওকে বাদ দাও তোমার সঙ্গে আমি ডিবেটে যেতে চাচ্ছি না।

বিপ্লবী মোস্তাকের কথার প্রতিবাদ করলো না, নীরবে শুনল তারপর বলল, তোমাকে আমি একটা রিকোয়েস্ট করব, রাখবে?

কী?

বাবার একটা অপছন্দের কাজ আমরা বাদ দিই?

কী সেটা?

পিংকিকে আমরা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দিই, ঢাকায় তো অনেক ভালো ভালো স্কুল আছে।

কী বলো তুমি, পিংকিকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন, ওকে আমি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিব, বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, বিদেশে সেটেল হবে, রিটায়ার্ড করার পর আমরাও সেখানে যাবো আর তুমি কী না বলছ ওকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে।

শাহাদত সাহেব ঢাকা থেকে ফিরলেন, আলেমার কাছে তার মেয়ে-জামাইয়ের বিলাসী জীবন-যাপনের বিবরণ ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করলেন, ছেলেমেয়ে সবাইকে মোস্তাক আর বিপ্লবীর পথ অনুসরণ না করার জন্য সতর্ক করলেন সেই সাথে আলেমাকে নিষেধ করলেন বিপ্লবী আর মোস্তাক যেন আমার বাড়িতে না আসে, কোনোদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করে। স্বাধীন অবশ্য মৃদু প্রতিবাদ করলো কিন্তু আলেমা ইশারা করে তাকে থামিয়ে দিল। সেই থেকে আজ অবধি বাপ-বেটির কথা নেই। তা প্রায় পাঁচ বছর তো হলো। শাহাদত সাহেব যখন ভালো থাকেন, হাসি-খুশি থাকেন তখন আলেমা বিপ্লবীর প্রসঙ্গ তোলে কিন্তু কিছুতেই যেন আলেমা বিপ্লবী আর মোস্তাকের বিষয় নমনীয় করতে পারেনি। আজ আবার চেষ্টা করলো কিন্তু আলেমার সে চেষ্টাও বিফলে গেল।

ছয়

শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মির্জাপুর গ্রামে। গ্রামে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া শাহাদত সাহেবের কয়েক বিঘা জমি আছে, গ্রামের মানুষ তাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। তিনি নিয়মিত যেতে পারেন না তবে মাঝে মাঝে যান, হয়তো কোনো শুক্রবার বিকেলে যান আবার স্কুলে মিটিং থাকলে শনিবারেও যান। শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত গ্রামটা ঘুরে দেখেন, শাহাদত সাহেব বাড়িতে এসেছেন শুনে গ্রামের মানুষ দেখা করতে আসে, তিনি সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলেন, মিশে যান শৈশবের সেই বন্ধুদের সঙ্গে।

মির্জাপুর মোড়টা ইদানীং বেশ জমজমাট, সকাল হলেই মোড়ের সব দোকানপাট খুলে, মোড়ে কয়েকটা অটোরিকশা এবং রিকশাভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে, আশেপাশের এলাকা থেকে স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীরা রিকশাভ্যান কিংবা অটোরিকশায় চড়ে তাদের স্কুল-কলেজে যায়। মোড়টা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠে। মোড়ে শাহাদত সাহেবের এক বাল্যবন্ধু সহিদুল্লাহর পানের দোকান দিয়েছে, গ্রামে এলে শাহাদত সাহেব সহিদুল্লাহর দোকানে একবার বসেন, কিছুক্ষণ আড্ডা দেন তারপর দিনাজপুর কিংবা মির্জাপুর হাইস্কুলে যাবেন। হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাহাদত সাহেব। আজ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং আছে সকাল এগারোটায়, শাহাদত সাহেব মোড়ে এসে পৌঁছালেন সাড়ে দশটায়, সহিদুল্লাহর দোকানের সামনে আসতেই সহিদুল্লাহ এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলো, কী রে দোস্ত কেমন আছিস?

ভালো, তুই?

হামার আর ভালো থাকা। আয় ভিতর আইসেক, বইস, বলে সহিদুল্লাহ একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিল।

শাহাদত সাহেব ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, স্কুলে মিটিং আছে।

হ্যাঁ, তুই সভাপতি আছিস দেখি স্কুলটা ভালো চলেছে। নাহইলে কী যে হলি হয়।

এমন সময় একটা মোটর সাইকেল এসে দাঁড়ালো। সহিদুল্লাহ মোটর সাইকেল আরোহীকে দেখে বলল, এই যে কাথা কহিতে কহিতে হেড মাস্টার সাহেব চলি আসিলি।

মোটর সাইকেল আরোহী দোকানের সামনে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই শাহাদত সাহেবকে দেখে থমকে গেল, চাচা আসসালামুয়াইকুম।

শাহাদত সাহেব সালামের জবাব দিলেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম।

সহিদুল্লাহ শাহাদত সাহেবের সঙ্গে হেড মাস্টার সাহেবের পরিচয় করে দিল, এ হইল হামার প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার, হামিদ। এমার বাড়ি জগতপুর এখন টাওনত থাকে, টাওনত থাকি আসি স্কুল পড়ায়।

হামিদ শাহাদত সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, চাচা কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি?

সহিদুল্লাহ মোটর সাইকেল দেখেই পান বানাতে শুরু করেছে, সে পান বানাতে বানাতে বলল, কে বারে মাস্টারের বেটা চিনা পাইছেন?

জি শাহাদত চাচা।

এই তো ঠিক বুঝা পাইছেন।

হামিদ আমতা আমতা করে বলল, আজ একটু দেরি হয়ে গেল, রাস্তায় আবার মোটর সাইকেলে কাঁটা ঢুকে চাকা পাংচার হয়ে গেছিল, তাড়াতাড়ি পানটা দেন চাচা।

তোমাকে দেখি মুই পান বানাবা শুরু কঁইছ। এই নাও, বলে সহিদুল্লাহ হামিদকে পান দিতেই সে মুখে পুরে একরকম দৌড়ে চলে গেল।

এইরকম প্রত্যেক দিন করে কুনো না কুনো ছুঁতো আছে, স্কুলটা শেষ হয়ে গেল। হামার সময় কী একটা স্কুল ছিল আর এখন, দেখলু তো তুই হেড মাস্টার স্কুলত আসিলু বেলা এগারোটার সময়, আরেকজন আছে ওঁয় তো ধানের ব্যবসা করে আর বাকি সবগুলা তো মাস্টারনি, আইজ এই সমস্যা, কাইল এই সমস্যা। স্বামী-সংসার সামলাবি নাকি ছোয়াল পড়াবি। তুই যুদি হাই স্কুলটার হাল না ধরিলু হয় তাহেলে হাইস্কুলটাও গেলি হয়।

কিন্তু তুই কি জানিস স্কুলের মাস্টাররা মোক খুব একটা পছন্দ করে না?

না করউক, তুই স্কুলটা ভালো করি চালা। একটা স্কুল একটা এলাকার সম্পদ।

মির্জাপুর গ্রামে একটা হাই স্কুল এবং একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। এই প্রাইমারি স্কুলটা একসময় বিরল উপজেলার মধ্যে স্বনামধন্য ছিল। এই প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া করে সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছেন, বড় অফিসার হয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা একসময় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়। তখন স্কুলে কোনো পাকা ঘর ছিল না, চারপাশে মাটির দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি, বর্ষাকালে ঘরের মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো, মাটির দেয়ালে ইঁদুর বসতবাড়ি করত, একেকটা বেঞ্চে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী চাপাচাপি করে বসে ক্লাস করত, শীতকালে স্কুলের মাঠে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করত। সেই কাঁচা ঘরে থেকে শিক্ষকরা ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের আলো জ্বালাতেন, সেই আলো পৃথিবী আলোকিত করত।

মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দীর্ঘদিন দায়িত্বে ছিলেন আজিজুর রহমান, গ্রামের সবাই তাকে আজির পণ্ডিত বলে ডাকতো, অন্যান্য শিক্ষকগণের মধ্যে ছিলেন হবিবর মাস্টার, শফিউদ্দীন আহমেদ ও ওসমান গণি। সবাই স্কুলটাকে নিজের বাড়ি, নিজের ফুলবাগান মনে করতেন। নির্ধারিত সময়ে স্কুলে আসতেন, মন প্রাণ উজাড় করে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিকশিত করতেন। সেই ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের বাবার মতো সম্মান করতেন। সেনাবাহিনী প্রধান গাড়ি থেকে নেমে যখন শিক্ষকদের সালাম দিতেন তখন শিক্ষকদের বুক গর্বে ভরে যেতো।

সেই মাটির স্যাঁতস্যাঁতে স্কুল ঘর এখন পাকা বিল্ডিং হয়েছে, মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ-ভূষায় আধুনিকতা এসেছে। শুধু তাই নয় আগে যেখানে মাইনর পাস বা মেট্রিক পাস করে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদে চাকরি করত সেই পদে এখন বি.এ, এম.এ পাস শিক্ষকরা শিক্ষকতা করছেন। তাই স্কুলের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল, ছাত্র-ছাত্রীরা আরো বড় বড় পদে আসীন হয়ে দেশের সেবা করা উচিত ছিল কিন্তু সেই মাইনর পাস শিক্ষক আর মাটির ঘর থেকে যে জ্ঞানের আলো বিকশিত হতো পাকা ঘর আর উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকদের সেবাতেও যেন সেই আলো মিটমিট করে জ্বলতে শুরু করলো। সেই আজির পণ্ডিতের অবসর গ্রহণের পর এই স্কুল থেকে উল্লেখযোগ্য পদে কেউ সরকারি চাকরিতে আসীন হতে পারেনি।

হাই স্কুলের মিটিং শুরু হলো সকাল সাড়ে এগারোটায়। সভাপতি শাহাদত সাহেব, পদাধিকার বলে সদস্য সচিব প্রধান শিক্ষক, দুজন শিক্ষক প্রতিনিধি আর কয়েকজন সদস্য। সবাই উপসি’ত আছেন, শাহাদত সাহেব শুধু সভাপতিই না তিনি বয়সে সবার বড় এবং এলাকার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি তাই তার সামনে সবাই কথা বলতে একটু সংকোচবোধ করে।

প্রতি মিটিংয়ের আলোচনার বিষয়বস’গুলো প্রায় একইরকম স্কুলের লেখাপড়ার মান, ছাত্র-ছাত্রীদের উপসি’তি, শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাসে উপসি’তি, ক্লাসে পাঠদান বিবিধ। শুরুতে প্রধান শিক্ষক সাহেব সভাপতির অনুমতিক্রমে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সভার কাজ শুরু করলেন। লেখাপড়ার মান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উপসি’তি তেমন কোনো আলোচনা নেই কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলো শিক্ষকদের উপসি’তি ও পাঠদান বিষয়ে।

শাহাদত সাহেব দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি মিটিংয়ে দু’জন শিক্ষকের স্কুলে নিয়মিত উপসি’তি ও ক্লাসে পাঠদান নিয়ে আলোচনা হয়। মিটিংয়ে অনিয়মিত শিক্ষকদের নিয়মিত হওয়া ও পাঠদানে মনোযোগী হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। অনিয়মিত শিক্ষকরা কয়েকদিন ঠিকঠাক স্কুলে আসেন, ক্লাস নেন তারপর আবার যেমন ছিল তেমনই। আজকের আলোচনার শুরুতে পূর্ববর্তী সভার আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার শুরু হলো।

শাহাদত সাহেব প্রথমে শিক্ষক প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলেন তাদের কাছ থেকে যে মন্তব্য বেরিয়ে এলো তাতে তিনি সন’ষ্ট হতে পারলেন না তারপর তিনি এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সাহেবের অভিমত জানতে চাইলেন। তিনিও পূর্ববতী শিক্ষকদের সঙ্গে সহমত পেষণ করলেন এবং জানালেন যে, বার বার মৌখিকভাবে সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা স্কুলে নিয়মিত আসেন না।

শাহাদত সাহেব প্রধান শিক্ষককে অভিযুক্ত শিক্ষকদেরকে ডেকে পাঠাতে বললেন। প্রধান শিক্ষক সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিতেই পিয়ন এলো, কবির স্যার আর করিমুল স্যারকে ডাক দাও তো।

কবির সাহেব এবং করিমুল সাহেব রুমে ঢুকে সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে সালামের জবাব দিয়ে শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কবির সাহেব, করিমুল সাহেব আপনারা শিক্ষক মানুষ, আপনাদের জ্ঞান দেওয়ার মতো জ্ঞান আমার নেই, আমি মনে করি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাসহ আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা শিক্ষকদের অনুসরণ করি।

দুই অভিযুক্ত শিক্ষক মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

শাহাদত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি সভাপতি হওয়ার পর থেকে আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে আপনারা নিয়মিত স্কুলে আসেন না এবং ক্লাসে পাঠদানেও তেমন মনোযোগী না।

কবির সাহেব মৃদু প্রতিবাদ করলো, প্রতিদিন তো আমরা এমন করি না, মাঝে মাঝে আসতে একটু দেরি হয়। আপনারা আশেপাশের স্কুলগুলোর দিকে একটু লক্ষ্য করলে জানতে পারবেন আমরা অনেক নিয়মিত।

শাহাদত সাহেব রেগে লাল হয়ে গেলেন, তুলনাটা অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে না, স্কুলে নির্ধারিত সময়ে আসা পুরো টাইম স্কুলে থাকা, ছাত্রদের পাঠদান করা আপনার দায়িত্ব, পাশের স্কুল কী করলো সেটা দায়িত্ব সেই স্কুলের পরিচালনা কমিটির।

কবির সাহেব আর কথা বাড়ালো না। শাহাদত সাহেব সদস্য সচিবকে বললেন, মাস্টার সাহেব আর কোনোদিন যদি ছুটি না নিয়ে কবির সাহেব আর করিমুল সাহেব স্কুলে না আসেন তবে আপনি শোকজ করবেন আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নিবো। আপনারা এখন আসুন।

কবির সাহেব আর করিমুল সাহেব শিক্ষক কমনরুমে ঢুকলো, তাদের চোখ-মুখ কালো মেঘে ঢাকা। তারা কমনরুমে ঢুকে ধপাস করে নিজ নিজ চেয়ারে বসল। দুয়েকজন কৌতূহলী শিক্ষক হা করে তাকিয়ে রইল, হোসেন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ও কবির স্যার কী হয়েছে?

কী আর হবে, এই স্কুলে আর চাকরি করা যাবে না। আমাদের সভাপতি স্কুলটাকে মনে হচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট বানাতে চাচ্ছেন। আরে ভাই আমরা শিক্ষক মানুষ, আমরা কি ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো চাই না, তাই বলে আমাদেরও তো ঘর-সংসার আছে, সুবিধা-অসুবিধা আছে।

কী বলল তাই বলেন? হোসেন সাহেব জিজ্ঞেস করলো।

ঠিক সময়ে স্কুলে আসতে হবে, ছাত্র-ছাত্রীদের আরো মনোযোগ দিয়ে পড়াতে হবে, সময়মতো স্কুলে না এলে নাকি শোকজ করবে। এতদিন ধরে চাকরি করি কোনোদিন এমন কথা শুনিনি। এই বয়সে এসে সভাপতি সাহেব আমাকে শোকজের ভয় দেখালেন।

সভাপতি সাহেবের ভূমিকার কারণে দিনে দিনে স্কুলে শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হতে শুরু করলো। এলাকায় একটা সাড়া পড়ে গেল। সবাই বলতে শুরু করলো, এবার যদি স্কুলটার উন্নতি হয়। কেউ কেউ অবশ্য অন্য কথাও বলতে শুরু করলো, সভাপতি সাহেব ভালো মানুষ কিন্তু কথায় বলে না ভালো মানুষের ভাত নেই, মাস্টাররা ত্যাগীকে টিকতে দিবে না।

সাত

স্কুল থেকে বেরিয়ে শাহাদত সাহেব মোড়ে এলেন। স্কুলের পরিসি’তি দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি জীবনে কখনো রাজনীতি করেন নি, তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনের কোনো সাংগঠনিক পদেও নেই। তিনি বার কাউন্সিলের সদস্য, ভোটের সময় ভোট দেন, সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় কথা উঠলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্কুলের সভাপতি হওয়ার ইচ্ছাও তার ছিল না, এলাকার সবাই তাকে মানে, একজন ভালোমানুষ হিসেবে জানে, তাই সবাই তাকে যখন বলল তখন তিনি আর না করতে পারলেন না। তিনি সভাপতি হওয়ার জন্য সম্মতি দিয়েছেন বলে একজন প্রার্থী আর সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো না। তাই শাহাদত সাহেব স্কুলের সভাপতি হলেন। সভাপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুল এবং শিক্ষকদের সম্পর্কে তার একটা উঁচু ধারণা ছিল। শিক্ষক মানেই তিনি মনে করতেন আজির পণ্ডিতের কথা, একজন আদর্শ মানুষের কথা কিন্তু স্কুলের সভাপতি হওয়ার পর তিনি যা দেখলেন তাতে তিনি মনে অনেক কষ্ট পেলেন।

শাহাদত সাহেব স্কুল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চাচার বাড়িতে গেলেন। শাহাদত সাহেব যখন বাড়িতে ঢুকলেন তখন তার চাচি রান্নাঘরে রান্না করছিল, শাহাদত সাহেব বাড়িতে ঢুকে আঙিনা থেকে ডাকলেন, কে বারে চাচি বাড়িতে আছেন নাকি?

রান্নাঘর থেকে তার চাচি জবাব দিল, আছি বারে, ঘরত যাও তোমার চাচা আছে।

এই চাচা-চাচি তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, কোনোদিন তাকে মা-বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। চাচির শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো, কাজের মেয়েকে নিয়ে এখন রান্নাবান্না নিজেই করে কিন্তু চাচা দীর্ঘদিন থেকে শয্যাশায়ী, শাহদাৎ সাহেবকে দেখে ইশারায় বিছানার কোনে বসতে বললো। শাহাদত সাহেব বিছানায় বসে চাচার মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আছে কী না।

চাচা ইশারায় জানালেন জ্বর নেই এখন তারপর মোহসেনা, মোহসেনা বলে তার স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না, বুকটা জোরে উঠানামা করছে, নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে।

শাহাদত সাহেব বললেন, চাচা, চাচিকে ডাকতে হবে না। চাচি রান্নাঘরে আছে, রান্না করছে।

মোহসেনা ঘরে ঢুকলো, শাহাদত সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন বারে?

ভালো আছি চাচি, তোমরা ভালো আছেন?

হামার আর কী অবস্থা, সবই তো দেখেছেন।

আল্লাহ চাহে তো চাচা সুস্থ হই যাবি।

দোয়া করেন বারে। তোমরা আসিবেন তে আগে একটু কহিবেন না। দুপুরে কিন্তু ডাল-ভাত যা আছে খাই যাবা হবি।

শাহাদত সাহেব বললেন, সেইটা মুঁই চিন্তা করি আসিছঁ, আইজ তোমার বাড়িতে ভাত খাম।

তাইলে একটু আগে কহিলে ভালো হলি হয়।

লাগিবে নাহায় চাচি, মুঁই তো আর বাহিরের কেঁহ নাহায়।

তোমরা বইস গল্প করো, মুঁই তাতে রান্নাটা শেষ কঁরো।

মোহসেনা রান্নাঘরে গেল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহাদত সাহেব যখন ফিরে এলেন, তখন তার কেউ নেই, বাবা তো আগেই মারা গেছে আর যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়িঘরের সঙ্গে ভস্মীভূত হয়েছে তার মা। শাহাদত সাহেবের চাচার বয়স তখন প্রায় চল্লিশ বছর, সুঠাম দেহের অধিকারী, সেই চাচা এখন বিছানায় শয্যাশায়ী, বার্ধক্যজনিত কারণে শরীরের চামড়াগুলো জড়সড় হয়ে গেছে, শরীরে জমাট বেঁধেছে নানান রকমের অসুখ। শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্ত চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার দু’চোখ পানিতে ভরে গেল।

শাহাদত সাহেব কিছুক্ষণ চাচার শিয়রে বসে কাটালেন কিন্তু তিনি বসে থাকলে অসুস্থ চাচা বার বার কথা বলার চেষ্টা করছে আর হাঁপিয়ে উঠছে তাই শাহাদত সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন।

দুপুরে চাচার বাড়িতে ভাত খেয়ে শাহাদত সাহেব দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে বের হলেন। মির্জাপুর মোড়ে দেখলেন সহিদুল্লাহর দোকান খোলা আছে আবার সহিদুল্লাহর দোকানে বসলেন।

শাহাদত সাহেবকে দেখে দোকানে এলো তার এক বাল্য বন্ধু মোকছেদ। এসে সালাম দিল, আসসালামুয়াইকুম উকিল সাহেব।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী রে কেমন আছি?

ভালো আলহামদুলিল্লাহ তবে কিছুটা প্রব্লেমে আঁছ।

কী প্রব্লেম?

বেটাটা লেখাপড়া শেষ করি বসি আছে, চাকরি নাহি।

চাকরির দরখাস্ত করছে না?

দরখাস্ত তো করছে কিন্তু আইজকাইল কি টাকা ছাড়া চাকরি আছে।

কী কহেছি তুই। মুঁই তো জাঁনো আইজকাইল চাকরি নিতে টাকা লাগে না।

এইগুলা খালি রেডিও টিভিত শুনা যায়, কাজকামত দেখা যায় না।

কে কহেছে এইলা কথা, মুঁই তো নিজে সাক্ষী, মোর বেটা স্বাধীন চাকরি পালি, মোর জামাই চাকরি পালি কারো তো টাকা লাগিলিনি, আসলে গ্রামত কিছু কাথা রটে, দালালরা টাকা নিবার জন্য এইগুলা কাথা কহে। মুঁই কী কঁহেছ শুন।

মোকছেদ কিছুটা বিরক্তি বোধ করলো। সে এসেছে ছেলের চাকরির জন্য তদ্বির করতে কিন্তু শাহাদত সাহেবের কথায় সে সন’ষ্ট হতে পারল না। মুখ ভার করে বলল, কহেক।

তোর বেটাক ভালো করি লেখাপড়া করিবা কহেক আর বি.সি.এস দিবা কহেক। দেখিবু এমনিই চাকরি হবি।

যারা খুব মেধাবী ওমার হবা পারে, মোর বেটাক কি মুঁই সেইরকম করি পড়িবা পারিছুঁ, টানিটুনি কুনোভাবে পাস কইছে।

এইকনা হলি আসল কাথা। আইজকাইল চাকরির জন্য চাই সেইরকম মাথা। আইজকাইল যেমনতেমন করি পড়ি কুনো লাভ নাই, পড়িলে ভালো করি পড়িবা হবি। আইজকাইল হাল-গৃহস্থিত মেলা লাভ, শাক-সবজির যা দাম।

মোকছেদ বিরক্ত সহকারে বলল, নাহ। হাল-গৃহস্থিত লাভ নাহি। আসলে হারা যারা কৃষি করেছিয়ে তামার আর বেশিদিন কৃষি করিবা হবে না হায়। জমিজমা সইবগুলা বেচি দিবা হবি।

কেনে? মোর তো মনটা কহেছে গৃহস্থিত মেলা লাভ। এক কেজি ঢেঁড়ষের দাম পঞ্চাশ টাকা, এক কেজি পটলের দাম পঞ্চাশ টাকা।

মোকছেদ চমকে উঠল, কী কহেছি তুই? এতো দাম হইলে তো গৃহস্থরা সবাই বাড়ি-গাড়ি করিলি হয়। এক কেজি পটল হারা বেচিছিয়ে বিশ টাকা আর ঢেঁড়ষ বিশ টাকা।

মানে? তুই কী কহেছি রে, শাহাদত সাহেব বিস্ময়ের সুরে বললেন।

হ্যাঁ, তোরা মনে হয় বেশি দামে কিনেছেন কিন্তু হারা বেচিবা পারিয়ে না। হামারঠে নি যায় ফড়িয়া, ফড়িয়া নিযায় আড়তদারেরঠে, আড়তদারেরঠে কিনি নিযায় দোকানদার, দোকানারেরঠে নি যায় তোমার মতো সাহেবরা, কথার শেষ দিকে মোকছেদের কথায় ক্ষোভ ফুটে উঠল।

কয়েক মাস রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কৃষক পায় বিশ টাকা আর ক্ষেত থেকে আমার হাতে যারা পৌঁছায় তারা লাভ করে ত্রিশ টাকা! দেশে কি বাজার ব্যবস্থাপনা বলে কিছু নেই? শুধু কি কৃষি পণ্য, সব পণ্যের বাজারই তো একই রকম আজকের জিনিসটা কালকে বাজারে গিয়ে দেখা যায় দাম বেড়ে গেছে, কেনো বাড়ল কেউ জানে না। কার কাছে জবাব চাইবো? সেই মানুষটা কে? কথাগুলো শাহাদত সাহেবের মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

আচ্ছা থাকুক হামার দুঃখের কথা হামারঠে থাউক, বলে মোকছেদ চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে এলো মমিনুল, মমিনুল শাহাদত সাহেবের চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোট, দুজনের সম্পর্ক চাচা-ভাতিজা। এসে সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, তুই মমিনুল না বারে?

দোকানের বাইরে একটা বেঞ্চ আছে, সবাই পানের অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনের চেয়ারে বসে গল্পগুজব করে। মমিনুল চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ভালো বেটা? তোমরা ভালো আছেন?

ভালো আলহামদুলিল্লাহ।

বেটা ইদানীং গ্রামত কম আইসেন নকি?

শাহাদত সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আসলে বয়সটা বাড়ি গেইছে তো, শরীলটা সউবসময় ভালো থাকে না।

ঠিকি কহিছেন বেটা। বয়স তো আর কম হইল না বলে মমিনুল শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণ করলো, সংসারের অভাব অভিযোগের কথা শোনালো, মমিনুলের মুখে অভাব-অভিযোগের কথা শুনে শাহাদত সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। মমিনুলের বাবা ছিল গ্রামের উচ্চ মধ্যবিত্ত কৃষক, গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু বলতে যা বোঝায় তার সবই ছিল মমিনুলের বাবার। বাবার একমাত্র সন্তান মমিনুল, সে হিসেবে পুরো সম্পত্তিই মমিনুল পেয়েছে। বি.এ পাস করেছে কিন্তু বাবার একমাত্র সন্তান তাই তার বাবা তাকে চাকরি নিয়ে বাইরে যেতে হবে বলে চাকরিই করতে দেয়নি। তখনকার দিনে তারা গ্রামের বড় কৃষক ছিল কিন্তু বাবার পুরো জমি একাই পাবার পর এবং আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করার পরও মমিনুলের সংসারে অভাব, মুখে হাসি নেই।

মমিনুল মলিন মুখে বলল, গৃহসি’ত লাভ নাহি বেটা। যখন ক্ষেতত সোনালী ধান দেঁখিয়ে তখন বুক জুড়াই যায়, ধান ঘরত তুলবার সময় মনটা কহে এইবার বুঝি অনেক লাভ হবি কিন্তু যখন ধান বেচিবা যাইয়ে তখন দেখি দাম কম। যখন হামার সবার ঘরত ধান থাকে তখন দাম কম। তখন টাকার জন্য সউবগুলা ধান সস্তায় বেচি দিইয়ে, যখন ঘরত আর কুনো ধান থাকে না তখন হই যায় ধানের দাম বেশি, তখন আবার হামাক চাউল কিনি খাবা হয়। তখন অভাব হয় আর হামাক জমি বেচি খাবা হয়।

তুইও জমি বেচিছি নাকি?

হেঁ বেটা, প্রত্যেক বছর একনা না একনা জমি বেচি খাইতে খাইতে জমি পেরায় শেষ। এইভাবে জমি বেচি খাইলে তো আর বেশিদিন হাল বাহিবা হবে নাহায়, সউব জমি বেশি শেষ হই যাবি।

মমিনুল ঠিকই বলেছে, এই তো কয়েকদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম দেশে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে। এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি অঢেল টাকা-পয়সার মালিক হয়ে যাচ্ছে আরেক শ্রেণীর মানুষ বিত্তহীন হয়ে পড়ছে। সমাজের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তা যেন ধীরে ধীরে ভাসমান মানুষে পরিণত হচ্ছে। কোথায় সাততলা আর কোথায় গাছতলা। সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় সম্পদের সুষম বণ্টনের বিকল্প নেই। অথচ দেশের সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা অত্যন্ত ভারসাম্যহীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি জাতির মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার থাকা জরুরি, যা দেশে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এজন্যই তো বলি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু মুক্তির যুদ্ধ অর্থাৎ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।

মমিনুল অনেকক্ষণ শাহাদত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর জিজ্ঞেস করলো, বেটা।

শাহাদত সাহেব যেন চমকে উঠলেন, হেঁ মমিনুল কহেক।

কিছু ভাবেছেন নাকি বারে?

হেঁ। আসলে দেশটা দেখিতে দেখিতে কেমন যেন হই গেল, মাইনষের গলাভরা ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল, কৃষকের মুখে হাসি ছিল। বাহাদুর বাজারত গেইছিনু, এক কেজি হিলশা মাছের দাম চৌদ্দশ টাকা বলে শাহাদত সাহেব মমিনুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ধানের মন কত করি বারে?

ধানের দাম নাহি বেটা, আট’শ টাকা।

তাহিলে একবার চিন্তা করি দেখেক একজন গৃহসে’র এক কেজি হিলশা মাছ কিনিবা চাহিলে পৌনে দু’মন ধান বেচিবা হবি, এটা কুনো কাথা হলি?

তোমার আবার কীসের চিন্তা, আল্লাহ দিলে তোমার এইগুলা চিন্তা করিবা হয় না।

মুঁই কি শুধু মোর চিন্তা করোঁ, দেশের মানুষ ভালো নাহি, গ্রামের মানুষ ভালো নাহি শুধু মুঁই একেলা কি ভালো থাকিবা পারিম।

ঠিকি কহিছেন বেটা।

শাহাদত সাহেব মনে মনে ভাবেন আসলে একা সুখ ভোগে আনন্দ নেই, সবাই মিলে সুখে থাকলে আনন্দ আরো হাজারগুণ বেড়ে যায়। মমিনুল কয়েকমুহূর্ত শাহাদত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

শাহাদত সাহেব উঠে পড়লেন, আচ্ছা মমিনুল থাকেক তাহেলে। শহরত আসিলে বাসাত আসিস। তোমার কাথা খুব মনত পড়ে।

ঠিকি কহিছেন বেটা, হামারো তোমার কাথা খুব মনত পড়ে।

এবার গ্রামের অবস্থা দেখে শাহাদত সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল, তার বার বার মনে হলো এমন একটি দেশ চেয়েছিলাম যেখানে থাকবে না কোনো শোষণ ও বঞ্চনা, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাকে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।

আজ বঙ্গবন্ধু নেই, বেঁচে থাকলে হয়তো শোষিত মানুষের পক্ষে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন।

দেশে শ্রমজীবী কিংবা পেশাজীবীদের সংগঠন আছে, তারা সুবিধা আদায়ের জন্য আন্দোলন করে, বাস শ্রমিক বাস বন্ধ করে দেয়, পেশাজীবীরা তাদের পেশায় কর্মবিরতি পালন করে কিন্তু কৃষকদের কোনো সংগঠন নেই, কৃষি শ্রমিকদেরও কোনো সংগঠন নেই অথচ আজ তারাই বেশি শোষিত, তারা মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছে সব শোষণ ও বঞ্চনা।

আট

শাহাদত সাহেব সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকতেই দেখলেন গ্যারেজে একটা লাল চকচকে গাড়ি। তিনি কয়েকমুহূর্ত কী যেন ভাবলেন তারপর ঘুরে ঘুরে গাড়িটা দেখলেন।

গ্যারেজ থেকে ভিতরের বাসায় ঢুকে দেখলেন সবাই এসেছে, ওপর তলা থেকে বিপ্লব এসেছে, বড় বউমা এসেছে, রুদ্র-রানু এসেছে। শাহাদত সাহেবের বুঝতে বাকি রইল না যে বাড়িতে কী ঘটেছে।

রাজিয়া সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, আব্বা আসসালামুয়ালাইকুম ।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

রুদ্র আনন্দে লাফাতে লাফাতে আবেজড়িত কণ্ঠে বলল, দাদু।

কী হয়েছে দাদু?

রানু কাটা চামচে একটা মিষ্টি নিয়ে এলো, মুখ হা করো দাদু, মুখ হা করো।

কেনো, কীসের মিষ্টি?

বিপ্লব আঙ্কেল গাড়ি কিনেছে, কী মজা, কী মজা!

আমার তো মিষ্টি চলবে না দাদু।

আলেমা রান্নাঘর থেকে ড্রয়িং রুমে এলো, খাও, একটা মিষ্টি খেলে কিচ্ছু হবে না।

রানু আবার বলল, দাদু হা করো, হা করো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহাদত সাহেব মুখ হা করলেন, রানু দাদুর মুখে একটা মিষ্টি পুরে দিল। শাহাদত সাহেব আর দাঁড়ালেন না। তিনি বিপ্লবের আপাদমস্তক একবার তাকিয়ে সোজা ভিতরে চলে গেলেন। তার রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল রাতে খাওয়ার টেবিলে, বেশ কিছুদিন সবাই একসাথে খাওয়া হয়নি, স্বাধীন চেম্বার থেকে রোগী দেখে একটু রাত করেই ফিরে, ব্যবসার কাজে বাসায় ফিরতে বিপ্লবের অনেক রাত হয়, খাওয়ার টেবিলে নিয়মিত আয়েশা আর রানু-রুদ্র। আজ ডাইনিং টেবিল ভরে গেছে, মিষ্টি খাওয়ার সময় স্বাধীন ছিল না কিন্তু ডাইনিং টেবিলে সেও এসেছে।

আলেমা আর রাজিয়া খাবার পরিবশেন করছে, শাহাদত সাহেব রাজিয়াকে বললেন, বউমা তুমিও বসো তারপর আলেমার দিকে মুখ করে বললেন, তুমি আবার দাঁড়িয়ে থাকলে কেনো?

সবার মুখে আনন্দ, শাহাদত সাহেবের মুখে আনন্দ নেই একটা প্রচ্ছন্ন রাগ চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে। আলেমার চোখে-মুখেও একটা কালো মেঘের ছাপ পড়েছে, তিনি কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে জিজ্ঞেস করলেন, তা বিপ্লব গাড়ি কত দিয়ে কিনলি?

বত্রিশ লাখ বাবা।

এতো টাকা দিয়ে গাড়ি কিনলি?

বিপ্লব আমতা আমতা করে বলল, গাড়ির মডেল, ব্রান্ড এসবের ওপর দাম নির্ভর করে তো বাবা।

শাহাদত সাহেব যেন উদাস হয়ে গেলেন স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলেন, আমি যখন চাকরি ছেড়ে-ছুঁড়ে ওকালতি শুরু করলাম তখন একটা মেসে থাকতাম। তারপর তোমার আম্মুকে বিয়ে করলাম, বিয়ের পর একটা সেমিপাকা বাসা ভাড়া নিলাম। তখন আমি কল্পনাও করতে পারতাম না যে আমি একদিন শহরে জায়গা কিনে এরকম পাঁচতলা ভিত দিয়ে দোতলা বাসা করতে পারবো। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমা করে আর পৈত্রিক কিছু জমি বিক্রি করে এই জায়গাটা কিনলাম। বাড়ির জায়গাটা কেনার ধকল কাটতেই আমার কয়েকবছর কেটে গেল। তারপর বাড়ির কাজ শুরু করবো করবো করে সাহস করতে পারছিলাম না। তারপর শুরু করলাম, ক্ষেতের ফসলের টাকা আমার ইনকামের টাকা সবকিছু মিলিয়ে টানাটানি করে এক তলাটা কমপ্লিট করলাম। তারপর ধীরে ধীরে দোতলা। সারাজীবনের আমার সম্পদ বলতে এই বাড়িটাই। তোমরা সবাই জানো, আমি একে একে কয়েকটা সরকারি চাকরি ছেড়েছি, আমারও ব্যবসা করার সুযোগ ছিল, এখন যেটা করছি সেটা চাকরি না, ব্যবসা কিন্তু কই সারাজীবন কী করতে পারলাম অথচ বিপ্লব ক’দিনেই অনেক টাকা ইনকাম করলো।

বিপ্লব মুখ কালো করলো, সে অনুমান করলো নিশ্চয়ই এরপরে তার বাবা যে কথাটা বলবে সেটা তার জন্য ভালো হবে না।

শাহাদত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আমার দেখা অন্যান্য জুনিয়র আইনজীবীরাও বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে কিন্তু তারা কীভাবে করেছে আমার জানা নেই। আমার মনে হয় নীতি-নৈতিকতার মধ্যে থেকে, রাতারাতি বিত্তবান হওয়া যায় না।

বিপ্লব বাবার কথার যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো, আসলে ব্যবসা এমনই বাবা, ল্যাক ফেভার করলে খুব তাড়াতাড়ি বড় হওয়া যায় আবার রাতারাতি পথে বসেও যায়।

শাহাদত সাহেব একটা শ্বাসমোচন করে বললেন, দোয়া করি তোর ল্যাক ফেভার করুক।

ভাত খেতে খেতে একবার শাহাদত সাহেব আলেমার মুখের দিকে তাকালেন। আলেমা বাংলা পাঁচ অক্ষরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আবার কী হলো?

আলেমা নারীসুলভ ভঙ্গিতে বলল, আমার আবার কী হবে? আমি তো মানুষ না একটা যন্ত্র। আমার কোনো স্বাধীনতা নেই, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই।

হঠাৎ করে তুমিও তো দেখছি বিদ্রোহী হয়ে যাচ্ছো, কী হয়েছে বলতে হবে তো।

সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতাকি করছে কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আলেমা ফোঁস ফোঁস করে বলতে শুরু করলো, সবাই আছে, আজ সব ছেলেমেয়ে একসাথে বসে ভাত খাচ্ছে, শুধু আমার একটা মেয়েই তোমার শত্রু হলো।

শাহাদত সাহেব বুঝতে পারলেন, তিনি বললেন, এটা বন্ধু-শত্রুর বিষয় না, আমার মেয়ে আমার কখনো আমার শত্রু হতে পারে না কিন্তু ব্যাপারটা এথিকসের, নীতি-নৈতিকতার।

সারা দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছে হামাগুঁড়ি দিয়ে টাকা কামাচ্ছে আর তোমার কাছে যতসব ফতোয়া। জামাইয়ের সুযোগ আছে করছে, এমন সুযোগ ক’জনের থাকে। অন্য কেউ হলে মেয়ে-জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো আর উল্টো তাদের ওপর রাগ করেছ আমার মেয়েটাকে ত্যাগ করেছ। এমনিভাবে সবাইকে ত্যাগ করতে করতে একদিন দেখবে সবাই তোমাকে ত্যাগ করবে। কতদিন আমি মেয়েটাকে দেখি না বলতে বলতে আলেমার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

শাহাদত সাহেব আর কোনো কথা বললেন না, মুখ বুজে খাওয়া শেষ করে তার বেড রুমে গেলেন।

শাহাদত সাহেব বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছেন। এটা তার অভ্যাস, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়লে যে অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পরিবর্তন করা সম্ভব সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন কিন্তু যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কোনো পরিবর্তন সম্ভব না তখন চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকেন, মনঃকষ্ট ভুগেন।

আলেমা তার স্ত্রী, জীবনসঙ্গী। আলেমার মতো শান্তশিষ্ট, ধৈর্যশীল স্ত্রী পেয়ে তিনি খুশী, চাইলে আজকের ধৃষ্টতার জন্য ধমক দিতে পারতেন কিন্তু ধমক দিয়ে আলেমার মুখ বন্ধ করে কী লাভ। ক’জনের মুখ তিনি বন্ধ করবেন, আলেমা তো একজন না, সমাজে অসংখ্য আলেমা, মোস্তাক, বিপ্লবী। আজকাল পত্রিকায় প্রায়ই চোখে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধেও স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষ গড়ার কারখানা আর শিক্ষক কারিগর, কারিগর সঠিক না হলে তো সেখান থেকে ত্রুটিপূর্ণ পণ্যই তৈরি হবে। তাই গড়ে উঠেছে একটা ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, যে সমাজের প্রতিটি মানুষের কাজই শুধু অর্থ রোজগার করা, অর্থই রোজগারই যখন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নীতি-নৈতিকতা তখন জাদুঘরে। আলেমা, মোস্তাক, বিপ্লবী তো সেই সমাজব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি।

মুক্তিযুদ্ধের কথাগুলো আজ শাহাদত সাহেবের বেশি করে মনে পড়ছে, যে দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করলো, সে দেশের মানুষের নৈতিকতার আজ এই অধ:পতন। মানুষের মন ও মগজে শুধু বিত্তবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যেকোনো উপায়ে কে কার চেয়ে বেশি টাকা রোজগার করবে, কে কার চেয়ে বেশি উঁচু বাড়ি করবে, কে কার চেয়ে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করবে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

আলেমা বেডরুমে ঢুকলো। শাহাদত সাহেবের কপালে হাত দিয়ে বলল, শরীরটা ভালো নেই?

শাহাদত সাহেব কোনো কথা বললেন না, আলেমা আবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমার ওপর মন খারাপ করেছ?

না তোমার ওপর মন খারাপ করবো কেনো? আসলে দোষ আমারই, আমি যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছি না। দিনে দিনে আমি এই সমাজে অচল হয়ে পড়ছি।

এভাবে বলছ কেনো, তুমি তো ঠিকই আছ, আমি বলছি ছেলেমেয়েদের সব বিষয়ে এভাবে কথা বলার কী দরকার, ওরা এখন বড় হয়েছে, ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে…

শাহাদত সাহেব কিছুটা তিরস্কারের সঙ্গে বললেন, ও তাইতো ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে। আসলে এখন ভালো-মন্দের সংজ্ঞাটাই বদলে গেছে, এখন আমি, আমার মতো কিছু সেকেলে মানুষ বদলে গেলেই হয়।

আমি তাও বলছি না। আমি তো সারাজীবন তোমাকে দেখলাম, সারাজীবন তুমি নিয়ম-নীতি মেনে চলেছ, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছ এখন একটু থামো, বিশ্রাম নাও। ছেলেমেয়েদের জীবন-যাপন তাদের ওপরই ছেড়ে দাও।

আমি বুঝি আলেমা, আমিও চাই তারা তাদের মতো চলুক, তাদের মতো করে জীবন সাজাক কিন্তু যখন মনে হয় আমার ছেলে বা আমার মেয়ে কোনো অন্যায় করছে তখন আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। বার বার নিজেকে ধিক্কার দিই, আমি সারাজীবন কী করলাম, যে হাতে একদিন অস্ত্র ধরেছি সে হাতে এখন কেনো নিজের সন্তানদের শাসন করতে পারছি না। তুমি একটা কথা ঠিকই বলেছ, সবাইকে ত্যাগ করতে করতে একদিন সবাই আমাকে ত্যাগ করবে।

আলেমা বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমার ভুল হয়েছে, আমি রাগের মাথায় তোমাকে কী বলতে কী বলে ফেলেছি, তুমি আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ! এখন এসব বাদ দাও, ঘুমাও।

শাহাদত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে চোখ বুঝলেন।

দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেন, আবেগপ্রবণ বক্তৃতা দিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে তার কবিতা আবৃত্তি করলেন, ’’সাত কোটি সন্তানের হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’’

কবিগুরুকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ’’কবিগুরু মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে আমরা বাঙালি আজ মানুষ।’’ পূর্ব পাকিস্তানের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু প্রেরণা দিয়েছেন, মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন, মাথা উঁচু করে, সম্মানের সাথে বাঁচতে শিখিয়েছেন। উনিশ’শ একাত্তর সালের ষোলো ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে দশ জানুয়ারি ভাষণে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরলেন, দেশ গঠনের জন্য সাহায্য চাইলেন, ’’আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই, দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই।’’

দেশের জন্য সাহায্য চাইলেন, দেশ গঠনের কাজ শুরু হলো। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার ফলে মেধাশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ, মেধাশূন্য বাংলাদেশ, ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটা দেশ গড়া ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু থেমে ছিল না ষড়যন্ত্রকারীরাও। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

সেদিন খবরটা শোনার পর শাহাদত সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ আবার অনিশ্চয়তায় পড়ল। একের পর এক ক্ষমতার পালাবদল হলো কিন্তু জনগণের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হলো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার সূচকে দেশের লক্ষ্য অর্জিত হলো না। মানুষে মানুষে সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকলো। দেশের উন্নয়ন যে হয়নি এমন না, মানুষের মাথা পিছু আয় বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, নীতি-নৈতিকতা? মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেওয়ার মতো একটা দেশপ্রেমিক জাতির অস্তিত্বের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় দানা বেঁধেছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার একটি দেশের আত্মা আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন অলংকার। আকর্ষণীয় সাজ-সজ্জায় একটি দেশ বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে শাহাদত সাহেব চোখ খুললেন, আলেমা তখনো শাহাদত সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আলেমা জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছো?

শাহাদত সাহেব মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, না।

তাহলে ঘুমাচ্ছ না কেনো? তোমার মাথায় কোনো টেনশন না থাকলে তো শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড় আর আজ এতক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে আছ কিন্তু তোমার চোখে ঘুম নেই, এই বয়সে এতো চিন্তা করো না, শরীর ভেঙে পড়বে। তাছাড়া আমাদের তো কোনোকিছুর অভাব নেই। ছেলেমেয়েরা সব নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে, তুমি ওকালতি করছো, আমাদের খাওয়া-থাকার চিন্তা নেই। আমার চোখে তুমি একজন সফল মানুষ।

আরো অনেক কাজ বাকি আছে আলেমা।

বেঁচে থাকতে মানুষের কাজ কখনো শেষ হয় না।

এতক্ষণে তুমি একটা খাঁটি কথা বললে, আসলে বেঁচে থাকতে মানুষের কাজ কখনো শেষ হয় না কিন্তু আর দুয়েকটা কাজ এই বিপ্লব আর আয়েশার বিয়ে দিতে পারলেই হয়ে যায়।

তা তুমি দিতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আমি আশা করছি আমরা নাতি-নাতনীর বিয়েও দেখে যেতে পারি।

শাহাদত সাহেব একটা সরল হাসি হেসে বললেন, এত বেশি আশা করোনা আলেমা।

আচ্ছা তুমি এখন ঘুমাও। হায়াত, মউত, রিজিক দৌলত আল্লাহর হাতে, আল্লাহ যা চাইবেন তাই হবে।

আমি ভাবছি বিপ্লব আর আয়েশার বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে দিব। আয়েশার বিয়েটা আমি এতদিনে দিয়ে দিতাম কিন্তু ও এমন একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালো।

আয়েশার বিয়েটা দেওয়া জরুরি, আসলে তুমি যে কেনো এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছো, আজকাল এসব কেউ দেখে না।

শাহাদত সাহেব একবার মাথা উঁচু করে আলেমার মুখের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালেন। আলেমা শাহাদত সাহেবের এই চোখের দৃষ্টিকে ভয় পায়। সে তাড়াতাড়ি তার কথা ফিরিয়ে নিল, আচ্ছা আমি আয়েশার সঙ্গে আলাপ করে দেখি, ওকে ফেরাতে পারি কী না।

নয়

সকালবেলা শাহাদত সাহেব কোর্ট-কাচারির উদ্দেশ্যে বের হবেন, হাতে ব্যাগ পরনে প্যান্ট-শার্ট, কোট-টাই, দরজা খুলে বের হতেই দেখেন বিপ্লব গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে। সুবোধ, বিনয়ী ছেলের মতো মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, বাবা আমি দিয়ে আসি?

শাহাদত সাহেব একবার বিপ্লবের আপাদমস্তক তাকালেন, ততক্ষণে আলেমাও গ্যারেজে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, যাও ছেলেটা আশা করেছে, না গেলে ওর মনটা খাটো হয়ে যাবে।

শাহাদত সাহেব কিছু বলার আগেই বিপ্লব গাড়ির দরজা খুলে ধরলো, শাহাদত সাহেব একবার আলেমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, যাবো!

যাও।

পরদিনও বিপ্লব আর আলেমা একই ঘটনা ঘটালো কিন্তু শাহাদত সাহেব আর বিপ্লবের গাড়িতে উঠলেন না দুটো কারণে প্রথমত তিনি চান না তার গাড়িতে ওঠার অভ্যাস গড়ে উঠুক কারণ তার নিজের গাড়ি নেই, অভ্যাস গড়ে উঠলে একদিন এমন হবে ছেলেরও বাইরে কাজ থাকবে সে নিজে গাড়ি নিয়ে চলে যাবে তখন তাকে আবার রিকশায় চড়ে কোর্টে যেতে হবে যা মানুষের কাছে হাস্যকর বলে মনে হবে। দ্বিতীয়ত কারণটি নৈতিকতার, বিপ্লবের এত তাড়াতাড়ি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পিছনে কোনো অসৎ আয়ের পথ আছে, যা সে এখনো জানতে পারেনি। এটা যদি সত্যি হয় তবে তিনি অত্যন্ত মনঃকষ্টে ভুগবেন। তার প্রতিনিয়ত মনে হবে তিনি ছেলের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের সুবিধাভোগী।

তিনি আলেমাকে বললেন, আলেমা ছেলে গাড়ি কিনেছে একবার লিভ দিতে চেয়েছে ভালো কথা কিন্তু আমি এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে চাই না। একবার তোমার অনুরোধ রেখেছি এবার অন্তত আমার মতো আমাকে চলতে দাও বলে তিনি আর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বিপ্লব মন খারাপ করেছে দেখে আলেমা বিপ্লবকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেন, ত্যাগী ক্ষেপেছে।

গতকাল থেকে শাহাদত সাহেবকে মৃত্যুর চিন্তা আচ্ছন্ন করেছে, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ কেনো জানি আজ তার মৃত্যুর কথা বার বার মনে পড়ছে, মনে পড়ছে জীবনের অসমাপ্ত কাজগুলি, বিপ্লবের বিয়ে দেওয়া, আয়েশাকে কোনো সুপাত্রের হাতে পাত্রস্‌ করা, বিপ্লবের ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ আছে কী না শাহাদত সাহেব জানেন না কিন্তু আয়েশা, আয়েশা তো এক নাম পরিচয়হীন ছেলেকে…, না, না আর ভাবতে পারেন না শাহাদত সাহেব। কাচারি থেকে রিকশায় ফেরার সময় এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে শাহাদত সাহেব বাসার সামনে রিকশা থেকে নামলেন। হঠাৎ করে বাড়িতে একটা আনন্দ, হৈ হুল্লড়ের শব্দ কানে ভেসে এলো, বাড়িতে এতো হৈ, চৈ।

দরজায় কলিং বেল টিপতেই রানু দরজা খুলে দিল, দাদু।

শাহাদত সাহেব রানুর গালে আদর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে দাদু?

রুদ্র আনন্দে লাফাতে লাফাতে শাহাদত সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো, দাদু, ফুপি’র চাকরি হয়েছে, ফুপি’র চাকরি হয়েছে।

আলেমা, আয়েশা এবং রাজিয়া ঘরের ভিতরে ছিল, আয়েশা একরকম দৌড়ে এলো, আবেগে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাবা আমার চাকরি হয়েছে, বাবা আমার চাকরি হয়েছে।

শাহাদত সাহেব সোফায় বসে পড়লেন, আয়েশাকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দেখি মা, দেখি তুই কোথায় দেখলি রেজাল্ট?

আয়েশা তার মোবাইল ফোনে নিয়োগ পরীক্ষার রেজাল্ট তার বাবাকে দেখালো, বাবা দেখ, দেখ বাবা।

শাহাদত সাহেব চশমা পরে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন, তাই তো রে মা প্রাইমারি টিচার পদে, আলহামদুলিল্লাহ।

তোর মা কই রে মা, বিপ্লব কোথায়? বিপ্লবকে পাবনা সুইট থেকে মিষ্টি আনতে বল, বউ মা কোথায়, স্বাধীনকে ফোন করতে বল, আজ যেন প্রাকটিস শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসে। এই হলো ডাক্তারদের দোষ, টাকার নেশায় নেশায় ফ্যামিলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

রুমের ভিতর থেকে আলেমা এলো, পিছু পিছু রাজিয়া এলো, আসসালামু আলাইকুম আব্বা।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বলেছিলাম না বউ মা আমাদের আয়েশার চাকরি হবেই হবে। আল্লাহর রহমতে আমার মন যা বলে তাই হয়।

রাজিয়া মৃদু কণ্ঠে বলল, মা-বাবার দোয়া আল্লাহ কবুল করেন আব্বা।

শাহাদত সাহেব আর নিজের রুমে গেলেন না, সোফায় বসে সবার সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলেন, পেশা হিসেবে শিক্ষকতার চেয়ে বড় কোনো পেশা নেই। একটা কথা কি জানিস রে মা?

কী বাবা?

আলেমা আর রাজিয়া দাঁড়িয়ে বাপ-বেটির গল্প শুনছিল শাহাদত সাহেব কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, তোমরা আবার দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? বসো।

শাহাদত সাহেবের সঙ্গে যখন আলেমা বিয়ে হয় তখন আলেমা শাহাদত সাহেবকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করত, সেই আপনি থেকে তুমিতে আসতে সময় লেগেছে কয়েকবছর। শাহাদত সাহেব খুব কড়া মানুষ ছিলেন, খুব সহজে রেগে যেতেন, তাই আলেমা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতো। একে একে চার সন্তান হলো তখনো আলেমা ভয় ভয় করে চলতো, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত শাহাদত সাহেব একাই নিয়েছেন, তবে সিদ্ধান্ত সঠিকই হয়েছে এটাই আলেমার সান্ত্বনা। ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে শাহাদত সাহেব তাদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছেন, স্বাধীন রাজিয়াকে পছন্দ করত। তার লেখাপড়া শেষ হলো, চাকরি হলো একদিন বাবাকে এসে বলল রাজিয়ার কথা, শাহাদত সাহেব সবকিছু শুনলেন তারপর নিজেই বিয়ের আয়োজন করলেন। বিপ্লবীর বিয়েই একইভাবে হয়েছে। তার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো তিনি যাকে একবার পছন্দ করেন না তাকে জীবনে কোনোদিন মেনে নিতে পারেন না। আয়েশার সেই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ককে যেমন তিনি কোনোভাবে মানতেই পারছেন না।

বিপ্লবের বিয়ের আগ পর্যন্ত আলেমা ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করত, বিপ্লবের বিয়ের পর বউমা আর আলেমা দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করত। তারপর একসময় ধীরে ধীরে আলেমা একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার অনুমতি পেল। রাজিয়া আগে শাশুড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতো, আলেমা যখন একসঙ্গে বসে খাওয়ার অনুমতি পেল রাজিয়া তখন সামনে এগিয়ে এলো।

আগের শাহাদত সাহেব আর নেই, তিনি এখন অনেকটা শান্ত হয়েছেন। সেজন্য অবশ্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রুদ্র আর রানুর। তারা শাহাদত সাহেবকে যেন বন্ধু বানিয়েছে। আর তাই তিনি তার সেই রাগ, গাম্ভীর্য হারিয়ে ফেলেছেন। আজ শাহাদত সাহেবের কথা শোনার পর আলেমা বসল কিন্তু রাজিয়া সোফায় বসতে সংকোচবোধ করলো।

আলেমা বসার পর শাহাদত সাহেব যখন দেখলেন রাজিয়া দাঁড়িয়ে আছে তখন আবারো বললেন, তুমি আবার দাঁড়িয়ে থাকবে কেনো বউমা, বসো।

রাজিয়া সসংকোচে আলেমার পাশে বসল।

শাহাদত সাহেব কথার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী যেন বলছিলাম?

আয়েশা মৃদু কণ্ঠে বলল, বাবা তুমি বলছিলে শিক্ষকতা পেশা বড় কেনো?

একজন শিক্ষককে তার ছাত্ররা শৈশবে স্যার বলে ডাকে, সেই ছাত্র একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হয় কিন্তু কোনোদিন তার শিক্ষকের স্যার হয় না, বুঝলি?

সবাই শাহাদত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ বুঝতে পারোনি?

আলেমা কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল, তোমার এসব প্যাঁচ দিয়ে কথা বলা বাদ দাও, সবাই তো আর তোমার মতো প্যাঁচুক না।

আচ্ছা বুঝতে পারোনি বললেই তো হয়। আমাকে প্যাঁচুক বানানোর কী দরকার। শোনো তাহলে এই মনে করো আয়েশার ছাত্র লেখাপড়া শিখে একদিন অনেক বড় হবে, মনে করো ডি.সি হবে, এস.পি হবে, বড় ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। তারা সবাই কিন্তু আয়েশার চেয়ে অনেক বড় অফিসার কিন্তু তারা যত বড় অফিসারই হোক না কেনো আয়েশার কাছে তারা সেই প্রাইমারির ছাত্র আর তারা সেই আগের মতোই গাড়ি থেকে নেমে, মাথা নত করে স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করবে। এর সম্মান আর অন্য কোনো পেশায় আছে বলে আমার জানা নেই। আজ থেকে আমার মা সেই শিক্ষক। গর্বে আমার বুকটা ভরে গেল বলে শাহাদত সাহেব যেন চমকে উঠলেন, আমি তো আবেগে বিপ্লবকে মিষ্টি আনার কথা বলতে ভুলে গেছিলাম।

এমন সময় গাড়ির হর্ন বেজে উঠল, আলেমা বলল, তোমাকে আর বলতে হবে না। রেজাল্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা রেজাল্ট বিপ্লবকে বলামাত্র সে নিজেই মিষ্টি নিয়ে আসছে।

দশ

কয়েকবছর আগের কথা, যখন দু’জনে কে.বি.এম কলেজে পড়তো তখন আয়েশা আর প্রবাল প্রায়ই রামসাগর, পুনর্ভবার তীরে বেড়াতে যেতো, বাঙ্গিবেচার ঘাট বেড়ি বাঁধের ওপর গাছের নিচে ঘনিষ্ঠভাবে বসে গল্প করত। প্রবালের চোখের মাঝে আয়েশা যেন হারিয়ে যেতো, ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখ তো। একদিন তো প্রবাল বলেই ফেলল, আয়েশা চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।

প্রবাল আর আয়েশা পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসেছিল, প্রবাল একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খেলা করতে করতে কথাটা বলল। আয়েশা তখন প্রবালের হাতের ছোঁয়ায় একটা নতুন অনুভূতিতে, ভালোলাগার এক স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গেছে। প্রবালের কথায় সে সম্বিৎ ফিরে পেল, সেও প্রবালের কাছ থেকে এমন একটা প্রস্তাবই আশা করেছিল। সে বলল, আমারও খুব ইচ্ছে করে প্রবাল, আমার সবসময় তোমার কথা মনে পড়ে, সবসময় তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু…

প্রবাল আয়েশার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, তাহলে আর কিন্তু কেনো আয়েশা?

প্রবাল তুমি তো জানো বাবা খুব রগচটা, বাবা এটা কোনোভাবে মেনে নিবে না। আর আমরাও এখন ছোট নেই প্রবাল, পালিয়ে বিয়ে করার বয়স আমাদের অনেক আগেই চলে গেছে।

তো?

আমি বাবাকে বলেছি, আগে চাকরি হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াই তারপর বিয়ে করবো।

তখন কি রাজি হবে?

বাবা সবার অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায় কিন্তু তোমার বেলায় একটা সমস্যা তো আছেই।

প্রবাল জানে তার বেলায় কী সমস্যা আছে। তাই সে আর সেদিন কথা বাড়ায়নি, মাথা নিচু করে বসেছিল। আজ হোটেলে মুখোমুখি বসে দু’জনের হাসি-খুশি থাকার কথা ছিল কিন্তু আয়েশার চাকরি হয়েছে আর প্রবালের চাকরি হয়নি তাই দু’জনের মনের মধ্যে একটা নতুন আশঙ্কা দিল।

বয় এলো, মামা কিছু দিবো?

আয়েশা বলল, হ্যাঁ, ভালো মিষ্টি আছে?

আছে।

আমাদের দু’জনকে রসগোল্লা দাও।

বয় চলে গেল। প্রবাল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, তোমার চাকরির মিষ্টি?

আয়েশা মাথা উঁচু-নিচু করে জানালো তার চাকরির মিষ্টি তারপর বলল, তোমার চাকরিটাও হলে ভালো হতো, আমরা এক স্কুলে পোস্টিং নিতাম, একসঙ্গে মোটর সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতাম, একসঙ্গে ফিরে আসতাম।

প্রবাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস মোচন করে বলল, জীবনকে নিজের মতো সাজাতে সবাই চায় কিন্তু জীবন আসলে চলে নিজের গতিতে।

আয়েশার মুখের ওপর একটা ঘন কালো মেঘের ছায়া পড়ল, সে বলল, হতে পারে কিন্তু আমাদের দু’জনের নিজের মতো করে সাজানোর অনেক উপায় আছে।

আয়েশা তুমি জানো এটা ছিল আমার লাস্ট ইন্টারভিউ আর কোনো চাকরির অ্যাপ্লিকেশনও করা নেই, বয়সও আর বেশিদিন নেই। এখন তুমি একজন চাকরিজীবী আর আমি বেকার, চাকরি না হলে হয়তো ব্যবসা করবো।

তাতে কী, তুমি ব্যবসা করবা। চাকরিজীবী সব মেয়েদের হ্যাজবেন্ডরা বুঝি সবাই চাকরি করে।

তা করে না তবে আমাদের দেশে সব গার্জিয়ানরাই মেয়েদের জন্য চাকরিজীবী হ্যাজবেন্ড খুঁজে।

মিষ্টি চলে এলো। বয় মিষ্টি দিয়ে চলে গেল, আয়েশা একটা মিষ্টি প্রবালের মুখে তুলে দিল তারপর প্রবালও আয়েশার মুখে মিষ্টি তুলে দিল।

দু’জনে মিষ্টি খেতে খেতে অনেক কথা হলো। প্রবালের প্রতিটি কথার মাঝে হতাশা ফুটে উঠল, শেষে আয়েশা একরকম রাগান্বিত স্বরে বলল, তুমি কী বলতে চাচ্ছো বলতো? তুমি কি আমার চাকরি হওয়াতে খুশি হওনি?

এটা তুমি কী কথা বলছ আয়েশা, তোমার চাকরিতে আমি খুশি হবো না, তোমার যেকোনো সফলতায় তো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো আমি।

তাহলে সেই তখন থেকে মিনমিন করছো কেনো? আমি তোমার মনোভাব বুঝতে পাচ্ছি, তুমি মনে করছো আমার চাকরি হলো আমি বুঝি তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরে চলে যাচ্ছি।

প্রবাল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, বিচিত্র কী?

এই, এই কী বললে তুমি, একটা কথা মনে রেখো আমি কিন্তু ত্যাগীর মেয়ে, বাবা তিন তিনটা সরকারি চাকরি ছেড়েছে, তুমি যদি চাও তবে আমি চাকরিটাও ত্যাগ করতে পারি, বলো আমি কি চাকরিতে জয়েন করবো নাকি করবো না?

আমি সেকথা বলছি না আয়েশা।

তো? আমার চাকরি হয়েছে কী তুমি খুশি হবে, আমরা দু’জন হৈ চৈ করবো, আনন্দ-ফুর্তি করবো তুমি আছ আমাকে হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত। একটা কথা শোনো যারা পাওয়ার আনন্দের সময় হারানোর আতঙ্কে ভুগে তারা কোনোদিন আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। তুমি যদি এভাবে কথা বলো তবে আমি কিন্তু এখন চলে যাবো।

সরি আয়েশা।

আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি প্রবাল, তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে কখনো কল্পনাও করতে পারি না।

আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি আয়েশা।

সত্যিই দু’জনেই পরস্পরকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবার পথটা অত্যন্ত দুর্গম তাইতো রচিত হয়েছে লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শশী-পুন্নু, রাধা-কৃঞ্চ’র মতো কালজয়ী গল্প। ভালোবাসা কোনো বাছ-বিচার করে না, জাতপাত মানে না, তাইতো রাজকন্যার সঙ্গে রাখালের, শাহজাদার সঙ্গে পথের ভিখারির মেয়ের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভালোবাসার যদি চোখ-কান, নাক-মুখ থাকতো, ভালোবাসার যদি অন্তর্দৃষ্টি থাকতো তবে মানুষ হয়তো ভালোবাসার মানুষকে পাবার জন্য কষ্ট পেতে হতো না কিন্তু ভালোবাসার আছে শুধু একটা সহজ-সরল, নিঃস্বার্থ, আবেগপ্রবণ হৃদয়। তাই ভালোবাসার সময় আবেগপ্রবণ মানুষের বিবেক অন্ধ হয়ে যায়, তখন একটাই মনোস্কামনা থাকে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার কিন্তু সমাজের দৃষ্টিশক্তি আছে, নাক-কান আছে, বর্ণবৈষম্য আছে, বিত্ত-বৈষম্য আছে। ভালোবাসার মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় সমাজ তার সমস্ত অনুভূতি শক্তি দিয়ে, জটিল দৃষ্টিশক্তি দিয়ে বিবেচনা করে, সমাজ তার চিরাচরিত সংস্কৃতি দিয়ে বিবেচনা করে, ফলে পান থেকে চুন খসলেই তৈরি হয় অপ্রতিরোধ্য বাধার প্রাচীর।

বাবাকে আয়েশা ভালোভাবেই চিনে কিন্তু প্রবালকে ভালোবাসার সময় সে কি একবার ভেবেছিল প্রবালের বাবা একসময় খুব নিম্নবিত্ত ছিল এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে আর হলেই বা কী আল্লাহ কাকে কখন ধন-দৌলত দিবেন তা তো শুধু তিনিই জানেন। পৃথিবীতে কি এমন নজীর আছে কেউ অপরিচিত কাউকে ভালোবাসার সময় চৌদ্দগুষ্ঠির আমলনামা জেনে ভালোবাসে? এই একটা বাধার প্রাচীরই আয়েশা আর প্রবালের জন্য অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ছিল আবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে আয়েশার চাকরি আর প্রবাল বেকার। আয়েশার যুক্তিবাদী, ত্যাগী বাবা কখনো প্রবালকে মেনে নিবেন না। সেকথা ভেবেই প্রবাল মন খারাপ করেছে, আয়েশা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। একটা আনন্দের খবরে বেদনার সুর বেজে উঠল।

চাকরি পাওয়ার পর থেকে আয়েশা আর তার বাবার চেম্বারে বসে না, বাবাও তাকে ডাকেন না।

চাকরি হওয়ার পর থেকে আয়েশার মধ্যে একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল আর সেটা হলো যেকোনোদিন বাবা তাকে ডাকবেন এবং বিয়ের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে বলবেন। সামনেই আয়েশার জন্য অপেক্ষা করছে একটা জটিল এবং বিব্রতকর পরিসি’তি। অবশেষে সেই দিনটি এলো।

সেদিন ছিল শুক্রবার, শাহাদত সাহেব চেম্বারে বসেন না, সেদিন গ্রামেও যাননি, বিকেলবেলা ড্রয়িং রুমে চায়ের টেবিলে কথা তুললেন, চাকরি কেমন চলছে রে মা?

ভালো বাবা।

শিক্ষকতাকে অনেকেই পেশা বললেও আমি কিন্তু এটাকে পেশা বলি না, আসলে শিক্ষকতা সেবা। ছোট ছোট বাচ্চাদের আদর স্নেহ দিয়ে তাদের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, সর্বোপরি মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার কাজ অন্যান্য পেশার মানুষের মতো করলে হয় না, শিক্ষকদের চাই আন্তরিকতা, চাই সেবার মনোভাব।

জি বাবা।

আমি তখন হাইস্কুলে পড়তাম, অ্যাসেম্বলি করার সময় তখন শপথ বাক্য পাঠ করানো হতো।

এখনো হয় বাবা।

সেই শপথবাক্যের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল, আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমি শপথ করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব। দেশের প্রতি অনুগত থাকিব। দেশের একতা ও সংহতি বজায় রাখিবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকিব। হে আল্লাহ্‌ আমাকে শক্তি দিন-আমি যেন বাংলাদেশের সেবা করিতে পারি এবং বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারি। আমিন।

তোমার এখনো মনে আছে বাবা?

হ্যাঁ, তাইতো মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন দেখলাম আমার দেশের মানুষ মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো, আমার মনে হলো এই তো আসল সময় দেশের জন্য কিছু করার। শপথ বাক্যের সেই কথাগুলো আমাকে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে কথা বলতে বলতে শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেলন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, শিক্ষকের কাজ আসলে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তোলা কিন্তু আজকাল যখন দেখি উচ্চ শিক্ষিত মানুষ কোনো স্বজনপ্রীতি করছে, দুর্নীতি করছে, নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিচ্ছে তখন মনে হয় গলদটা আসলে শিক্ষার মধ্যে। আজকাল আদর্শবান শিক্ষকের বড় অভাব।

আয়েশা মৃদু প্রতিবাদ করলো, সব শিক্ষকরাই খারাপ না বাবা।

তা ঠিক বলেছ, শিক্ষা ব্যবস্থা একটা যন্ত্র, একটা ম্যাকানিজম, এই ম্যাকানিজমের মধ্যে অনেক ত্রুটি দেখা দিয়েছে, তাইতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মানুষ গড়ার কারখানা আর মানুষ গড়তে পারছে না। শিক্ষক, যারা মানুষ গড়ার কারিগর তারা আর ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। একটা জাতির যদি শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো হয়, সুনাগরিক গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তবে দেশের অন্যান্য কাঠামোগুলোর কাজ কমে যায়। যাক আমি আশা করি তুই একজন আদর্শবান শিক্ষক হবি।

দোয়া করো বাবা, আমি যেন তোমার সম্মান রাখতে পারি।

আমার সে বিশ্বাস আছে। তোকে আমি কেনো এত স্নেহ করি জানিস?

আয়েশা কোনো কথা বলল না। মাথা নত করে বসে রইল।

তুই দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো তাই।

বাবার কথা শুনে আয়েশার চোখে পানি এসে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারল না। শাহাদত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, তোর বয়সও কম হলো না, আমি আসলে অপেক্ষা করছিলাম তোর চাকরির জন্য, এখন তো চাকরিও হলো।

আয়েশা এতক্ষণে তার বাবার এতো কথা বলার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল, বাবার কথায় সে একটা বুকে ধাক্কা খেল, সে মিনমিন করে বলল, বাবা!

হ্যাঁ মা, তুই একটা ট্যালেন্ট মেয়ে তাই খুব সহজে আমার কথা বুঝতে পেরেছিস।

তুমি আমাকে আর কয়েকদিন সময় দাও বাবা।

শাহাদত সাহেব মুখ কালো করলেন, আয়েশা বুঝতে পারল বাবা তার ওপর রাগ করেছে। আয়েশা বিনয়ের স্বরে হাতজোড় করে একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, বাবা প্লিজ!

শাহাদত সাহেব আয়েশাকে কাছে টেনে নিলেন, আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ঠিক আছে মা, তবে বেশি সময় নিস না। আমার বয়স হয়েছে, কোনোদিন কী হয়, তাই ভাবছি তোকে আর বিপ্লবকে বিয়ে দিতে পারলে আমার কাজ শেষ, আমি তৃপ্তির সাথে মরতে পারি।

বাবার মুখে তার মৃত্যুর কথা শুনে আয়েশা মনে প্রচণ্ড আঘাত পেল, তার দু’চোখ দিয়ে ছিটকে পানি বের হলো, আয়েশা কিছুটা শাসনের সুরে বলল, তুমি এরকম কথা আর কখনো বলবে না বাবা।

শাহাদত সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, বলা তো যায় না, কোনোদিন আজরাইল এসে বলবে, শাহাদত সব কাজ তো শেষ হলো, এবার চলো।

বাবা এক কাজ করো।

কী কাজ?

আমার বিয়েটা বাকি থাক, তাহলে আজরাইল এলে বলতে পারবা আমার এখনো অনেক কাজ বাকি।

আজরাইল এলে বুঝি খালি হাতে ফিরে যাবে?

এগারো

সকালবেলা পত্রিকা পড়েই শাহাদত সাহেবের মেজাজটা বিগড়ে গেল। অবশ্য এটা নতুন না, প্রতিদিনের পত্রিকায় তো দুঃসংবাদ, দুর্ঘটনার শেষ নেই। এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা, একদিন পত্রিকা পড়ে সে কী হা হুতাশ শাহাদত সাহেবের, প্রতিদিন এতো এতো সড়ক দুর্ঘটনা, এতো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, কারো কোনো খেয়াল নেই, যে যার মতো চলছে। মোটর সাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, মাথায় হ্যালমেট নেই। আরে বাবা রাস্তাটা সরকারের হলেও প্রাণটা তো নিজের, নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সরকার সচেতন করছে, পুলিশ জরিমানা করছে কিন্তু যার প্রাণ তার কোনো টান নেই, কথাগুলো শাহাদত সাহেব বিড়বিড় করে বলেই যাচ্ছিলেন পথে বিভ্রাট ঘটালো আলেমা, চা নিয়ে এসে বলল, আজ আবার কী হলো?

কী হয়নি তাই বলো, বলে শাহাদত সাহেব পত্রিকাটা আলেমার দিকে মেলে ধরে আবার বলতে শুরু করলেন, দেখ একদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজনের প্রাণ গেছে। ট্রাকের চাপায় একই পরিবারের তিন মোটর সাইকেল আরোহীর মৃত্যু। দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক হেলপারসহ তিনজনের মৃত্যু। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু।

এতক্ষণ আলেমা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিল, শাহাদত সাহেবের কথা যতই বাড়ছিল আলেমার বিরক্তির মাত্রাও তত তুঙ্গে উঠছিল, এবার তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, তুমি এই মৃত্যু ঠেকানোর চিন্তা করছো বুঝি?

শাহাদত সাহেব জোরে চিৎকার করে ধমক দিলেন, স্টপ, স্টপ ননসেন্স।

শাহাদত সাহেবের এরকম চিৎকার জীবনের প্রথমদিকে আলেমা অনেক সহ্য করেছে কিন্তু অনেকদিন থেকে শাহাদত সাহেব এত জোরে চিৎকার করেননি। আজ দীর্ঘদিন পর সেই আচরণ দেখে আলেমা হতবাক হয়ে গেল, সে একরকম কুঁকড়ে গেল, বাসার ভিতর থেকে আয়েশা দৌড়ে এলো, বাবা! মা! কী হয়েছে?

আলেমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, না, কিছু হয়নি, তুই যা মা।

কিন্তু আয়েশাও নাছোড়বান্দা সে বাবাকে কিছুটা শাসনের সুরে বলল, বাবা, কী হয়েছে?

পেপারে সড়ক দুর্ঘটনায় এতোগুলো মানুষের প্রাণহানি দেখে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, আমার অনুভূতি প্রকাশ করছিলাম, তোর মা সেকথা শুনে টিজ করছে, বলল, আমি নাকি মৃত্যু ঠেকানোর চিন্তা করছি। আচ্ছা তুই বল, কোনো দুর্ঘটনা বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিবে, সহানুভূতি দেখাবে এটাই তো নিয়ম। কেউ যদি সব অবস্থাতেই স্বাভাবিক থাকে, কোনো অসঙ্গতি যদি মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে তবে সেতো বিবেকবান মানুষ না, সচেতন মানুষ না বরং তাকে বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী মানুষ বলা যায়, নাকি তুই বল।

তুমি ঠিকই বলেছ বাবা, মা বাবার অনুভূতিকে অসম্মান করা তোমার ঠিক হয়নি আর বাবা তুমি কেমন বলো তো, মা না হয় কিছু বলল, তুমি তো একটা বিবেকবান মানুষ নাকি, মা না হয় ভুল করে ফেলেছে তাই বলে তুমি এই বয়সে, এতো জোরে মাকে ধমক দিবে, মাকে বুঝিয়ে বললেই তো হলো।

এতবড় স্পর্ধা, আজকাল আমাকে সবসময় কেমন খোঁচা মেরে কথা বলে, আমি বুঝতে পারি কিন্তু কিছু বলি না। এত সাহস তোর মা কোথা থেকে পেল?

তাইতো, তাইতো, তোমার ওপর কথা বলবে, অসম্ভব, মা তুমি আর কখনো বাবাকে এভাবে বলবে না, এখন যাওতো, আমাকেও এক কাপ চা দাও, বাবার সঙ্গে বসে চা খাবো বলে আয়েশা তার মাকে হাত ধরে ড্রয়িং রুম থেকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিল।

আলেমা চলে যাওয়ার পর আয়েশা বাবার পাশের সোফায় বসে একটা কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, বাবা শুনেছি যুবক বয়সে তুমি খুব রাগী ছিলে, মা নাকি তোমাকে আপনি আপনি করে বলতো আর সবসময় ভয়ে কুঁকড়ে থাকতো।

তুই ঠিকই শুনেছিস, তাইতো আজকাল আমি যখন দেখি তোর মা আমার মুখে মুখে কথা বলছে তখন অবাক হই। সে এতবড় সাহস পেল কোথা থেকে।

আয়েশা খুব সহজভাবে হেসে উড়িয়ে দিল, বাবা তুমি কি আশা করছো মা এখনো তোমাকে সেরকম ভয় পাবে।

হ্যাঁ। তার এমন কী হলো যে সে ফুলন দেবী হয়ে গেল।

বাবা, মায়ের ভিত এখন অনেক মজবুত, তার ছেলে-বউমা, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনী হয়েছে, তিনকাল গেছে আর এককাল আছে। এখন তো মায়ের আগের মতো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সেদিনের তরুণী আলেমা এখন শাখাপ্রশাখা গজিয়ে বটগাছ হয়েছে। এখন আর তার ঝড়-ঝাপটার ভয় কীসের, কথাগুলো বলতে বলতে আয়েশা একটা মুচকি হাসি হাসল।

আলেমা চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, আয়েশা মায়ের হাত থেকে চা নিয়ে বলল, মা বসো।

আলেমা অভিমান করে বলল, তোরা বস, বাপ-বেটি গল্প কর, আমি তোদের কে, আমি তো এ বাড়ির কাজের মেয়ে, বলে আলেমা চলে গেল।

শাহাদত সাহেব বলতে শুরু করলেন, আজকের পেপার পড়েছিস?

না বাবা। কী হয়েছে এখন বলতো।

সড়ক দুর্ঘটনায় আজ এগারো জন মানুষ মারা গেছে।

আজকাল প্রায় দিনই এমন মানুষ মারা যায় বাবা, আজ বোধ হয় এর চেয়ে কোনো ইম্পোর্টেন্ট নিউজ নেই তাই এটা হেডলাইন করেছে।

প্রতিদিন এতোগুলো করে মানুষ মারা যাচ্ছে অথচ কারো কোনো প্রতিবাদ নেই, কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সবার সয়ে গেছে বাবা, শুধু তুমি এটা মেনে নিতে পারছ না।

শাহাদত সাহেব আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, তুই ঠিকই বলেছিস মা। সবার সয়ে গেছে, শুধু আমি মানতে পারছি না। আমি ব্যাক ডেটেডই রয়ে গেলাম।

ব্যাক ডেটেড না বাবা, তুমি খুব আপডেটেড একজন মানুষ, তুমি নীতিবান, বিবেকবান, একজন আদর্শ মানুষ, তোমাকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি বাবা কথার শেষ দিকে আয়েশার কথা আবেগে জড়িয়ে গেল।

গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বিপ্লব বাসা থেকে বের হচ্ছিলো। শাহাদত সাহেব জোরে ডাক দিলেন, বিপ্লব, এই বিপ্লব।

বিপ্লব থমকে দাঁড়ালো, বাবা।

কোথায় যাচ্ছিস?

বাইরে যাচ্ছি বাবা।

আজকাল তো তোকে দেখাই যায় না, কখন আসিস, কখন যাস?

বাবা সারাদিন কাজ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যায় তারপর আবার পার্টি অফিসে যাই।

ভালো। এখন কোথায় যাচ্ছিস, আজ তো বন্ধের দিন।

বাবা তোমার কোর্ট আছে, আয়েশার স্কুল আছে, আমার তো অফিস টাইম নেই।

আচ্ছা ভালো কথা। তুই কি গাড়ি নিয়ে বের হবি?

জি বাবা।

তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?

বিপ্লব আমতা আমতা করে বলল, না মানে?

মানে মানে করছিস কেনো? তুই যে রাস্তায় গাড়ি চালাস, মোটর সাইকেল হোক আর প্রাইভেট কারোই হোক, তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে হবে না।

জি বাবা করব।

পুলিশ তোর কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স চায় না?

বিপ্লব কিছু বলার আগেই আয়েশা জবাব দিল, তুমি কী বলছ বাবা, ভাইয়ার কাছে পুলিশ কাগজপত্র দেখতে চাইবে?

বিপ্লব কিছু বলল না, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল সে জানে বাবা তার এই অন্যায়কে কখনো সমর্থন করবে না। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশ তোর কাছে কাগজপত্র দেখতে চাইবে না কেনো? তুই কি কোনো ভি.আই.পি? আর ভি.আই.পি’দের তো বেশি করে কাগজপত্র থাকতে হয় কারণ সাধারণ মানুষ ভি.আই.পি’দের অনুসরণ করে।

বাবা!

হ্যাঁ। পার্টি করিস তাই পুলিশ কাগজপত্র দেখতে চায় না, তাই না?

বাবা ঠিক তা না।

তো?

বাবা সবাই আমাকে খুব সম্মান করে।

বেশ তো পার্টির পদটা ছেড়ে দে দেখি তোকে কত সম্মান করে। পার্টি করিস ভালো কথা, আমিও পছন্দ করি রাজনীতি করা, রাজনীতি ছাড়া জনগণের অধিকার আদায় করা যায় না। রাজনীতিবিদরা নিজেরা আইন মানবে, নিয়ম-শৃঙ্খলা মানবে, জনগণকে নিয়ম-নীতি মেনে চলতে উৎসাহিত করবে।

জি বাবা।

আচ্ছা। কোথায় যাচ্ছিস যা, আমি চাই আমার ছেলেমেয়েরা সবাই আমার নীতি অনুসরণ করুক।

জি বাবা, বাবা আমি এখন আসি বলে বিপ্লব উত্তরের অপেক্ষা না করে এক পা দু’পাঁ করে ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আয়েশার চা শেষ হয়েছে, সে সোফা থেকে উঠবে এমন সময় দৌড়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো পিংকি, হাই আন্টি, বলেই পিংকি শাহাদত সাহেবকে দেখে চমকে উঠল, গুড মর্নিং।

আয়েশা বিব্রতবোধ করলো, শাহাদত সাহেব পিংকির আপাদমস্তক তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে গুড মর্নিং, বলে আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিপ্লবীর মেয়ে না?

আয়েশা ভয়ে ভয়ে একটা ঢোক গিলে বলল, জি বাবা।

শাহাদত সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, এ কার সঙ্গে এলো?

আয়েশা থতমত খেয়ে বলল, বাবা আপু গতকাল অনেক রাতে এসেছে। ফ্লাইট লেট ছিল তাই আসতে দেরি হয়েছে।

শাহাদত সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, নিশ্চয়ই আসার আগে থেকেই তোরা সবাই জানিস, এ বাড়িতে শুধু আমি আলাদা, আমাকে ছাড়া এ বাড়িতে আলাদা মিটিং হয়, প্লানিং হয়, আমার বাড়ি, আমি কিছু জানি না, সব চলে কার নিয়ন্ত্রণে?

আয়েশা কাঁদো, কাঁদো গলায় বলল, বাবা প্লিজ, একটু শান্ত হও, তুমি বসো।

কী শান্ত হবো, শান্ত হতে হতে তো আমি হিম হয়ে গেলাম। আমি যতই রয়ে-সয়ে চলতে চাই ততই তোরা আমার মাথায় উঠে নাচানাচি করিস। নাতনী নানাকে সালাম দিবে না, গুড মর্নিং বলবে? এটা কি ইউরোপ-আমেরিকা? ভাষার জন্য জীবন দেওয়া একটা জাতির নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে বিদেশি সংস্কৃতিতে? বিপ্লবী, বিপ্লবী কোথায়? বলে কাঁপতে কাঁপতে ড্রয়িং রুম থেকে বের হচ্ছিলেন, আয়েশা বাবার দু’বাহুতে হাত রেখে একরকম জোর করে সোফায় বসিয়ে দিল, বাবা প্লিজ তুমি বসো। একটু শান্ত হও, আপু ঘুম থেকে উঠুক, আমি দেখছি।

শাহাদত সাহেব সোফায় বসে পড়লেন, কপালে দু’হাত রাখলেন।

বারো

শুক্রবার দিন বন্ধুদের আড্ডা বসে। অন্যান্যরা প্রায়ই বসে কিন্তু শাহদাৎ সাহেব নিয়মিত বসেন না। তাছাড়া শহরের বন্ধুরা বেশিরভাগই শাহাদত সাহেবের স্কুল বা কলেজ জীবনের বন্ধু না, পেশাগত কারণে কিছু উকিল, তাদের বন্ধু কোনো সরকারি বা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। জীবনে আড্ডার বিষয়টি বয়সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ছাত্রজীবনের আড্ডার আলোচনায় থাকে কে কত ভালো ছাত্র, কোন স্যার কীভাবে পড়ায়, কে কার কাছে প্রাইভেট পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের আড্ডায় আলোচনা হয় কে কাকে ভালোবাসে, কে কার সঙ্গে প্রেম করে, আর বিবাহিতদের মধ্যে আলোচনা হয় কার দাম্পত্যজীবন কেমন চলছে, বিশেষ বিশেষ দিনগুলো কীভাবে কাটলো। তরুণ-তরুণীদের আলোচনাগুলো বেশ রোমান্টিক হয় কিন্তু এই বয়সে, মানে শাহাদত সাহেবের বয়সের যারা এখানে আড্ডা দেয় তাদের আলোচনাগুলো হেমন্তের গোধূলি লগ্নের মতো ম্রিয়মাণ। তেমন উচ্ছ্বাস নেই, কার ছেলে বা মেয়ে কী করছে, কার বউমা কেমন। সেদিক থেকে শাহাদত সাহেবকে সবাই সুখী মনে করে। শাহাদত সাহেবও আত্মতৃপ্তিবোধ করেন।

আহসান সাহেব সরকারি চাকরি করত। কয়েকবছর আগে অবসরে গেছে। চাকরিকালে গ্রামে প্রচুর জমিজমা করেছে, শহরে একটা চার ইউনিটের পাঁচতলা বাড়ি আছে। একজন সরকারি চাকুরে হিসেবে আহসান সাহেব যে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে তা নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন ধরনের গুঞ্জন আছে। তার ছেলেমেয়ে দু’জন, এক ছেলে এক মেয়ে, দুজনেই কানাডায় থাকে। একসময় আহসান সাহেবের ইচ্ছা ছিল ছেলেমেয়ে দু’জনকে কানাডায় পাঠিয়ে নিজেও চলে যাবে। সেই উদ্দেশ্যে কানাডায় টাকাও পাচার করেছে বলে কথিত আছে। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন একে একে ছেলেমেয়ে দু’জনে কানাডায় চলে গেল তখন আহসান সাহেব তাদের মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দেখে হতাশ হলো। তার আশা ছিল প্রযুক্তির সুবাদে প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা তাকে মোবাইল করবে, ভিডিও কল করবে। তাকে কানাডায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আহসান সাহেব ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে স্ত্রীকেও কানাডায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। ছেলেমেয়েরা কানাডায় যাওয়ার পর সব হিসেব পাল্টে গেল। অনেক অনুরোধের পর মেয়ে একবার কয়েকদিনের জন্য বাংলাদেশে এলো। আসার কয়েকমাস আগেই বলেছে এবার এলে বাবা-মা দু’জনকে নিয়ে যাবে কিন্তু ছেলেমেয়েদের আচরণের কারণে আহসান সাহেবের মন টানে না। আহসান সাহেবের স্ত্রীর অবশ্য আপত্তি নেই, সে ছেলেমেয়েদের কাছে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহসান সাহেব স্ত্রীকে যেতে নিষেধ করলো না। তার কাগজপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল।

আহসান সাহেব মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র দেখেছিল। তারই বন্ধুর ছেলের সঙ্গে, ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছে, দেখতে শুনতে ভালো। আহসান সাহেব মেয়েকে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, ড্যাডি তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, আমি বিয়ে করবো বাংলাদেশে? হাউ ফ্যানি।

আহসান সাহেব বলল, হ্যাঁ। বাংলাদেশি মেয়ে তো বাংলাদেশেই কোনো বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করবে এটাই স্বাভাবিক।

দিজ ইজ কোয়াইটলি ইম্পসিবল।

আহসান সাহেব বলল, তাহলে তোর কাউকে পছন্দ থাকলে বল। আমি বিয়ের আয়োজন করি।

নো নো ড্যাডি। ডোন্ট থিংক অ্যাবাউট মাই ম্যারি।

মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা ভাববে না?

ড্যাডি তুমি একেবারে সেকেলে রয়ে গেছ। আমাদের দেশে মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ ভাবে না।

আহসান সাহেবের চোখ কপালে উঠল, আমাদের দেশে মানে? আমাদের দেশ কোনটা?

বাবা এখন আমি কানাডায় বসবাস করছি, কানাডায় জব করছি। আমি কি আর কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে আসবো। সো এখন থেকে তো কানাডা আমার দেশ।

আহসান সাহেব মেয়ের আচরণে প্রচণ্ড আঘাত পেল, তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হলো না। ইতোমধ্যে তার স্ত্রীর ভিসাসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্রও তৈরি হয়ে গেছে। সে হিসেব করেই মেয়ে এসেছিল। আহসান সাহেবের সঙ্গে সেরকম কথা না হলেও মা-মেয়ের সেরকমই বুঝি একটা শিডিউল ছিল। মেয়ে আসার পর থেকে মায়েরও যাওয়ার জন্য অসি’রতা বেড়ে গেল। কয়েকদিন পর মা-মেয়ে চলে গেল, আহসান সাহেব স্ত্রী এবং মেয়েকে বিমানে উঠিয়ে দিতে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যেতে চাইলো কিন্তু মেয়েই নিষেধ করলো, আননেসেসারি এতদূর তোমাদের যাওয়ার কী দরকার, ড্রাইভার লিভ দিলেই হবে। আমরা মা-মেয়ে বেশ যেতে পারবো।

আহসান সাহেব আবারো মর্মাহত হলো। স্ত্রী যার সঙ্গে দীর্ঘজীবন একসঙ্গে কাটিয়েছে সে চলে যাচ্ছে, মেয়ে যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে সেও চলে যাচ্ছে আবার কবে দেখা হবে আদৌ হবে কী না তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে। যাওয়ার সময় স্ত্রীর দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ঠিকমতো ঔষধ খেয়ো, শরীরের যত্ন নিও।

মেয়ের মধ্যে তেমন কোনো অনুভূতি নেই। বাবাকে একা রেখে যাচ্ছে, আবার কোনোদিন মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে কী না ঠিক নেই। অথচ সে একেবারে স্বাভাবিক, সে আবারো বলল, তুমি ভেবো না বাবা। আমরা ঠিকই যেতে পারবো, বাই বলে সে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

আহসান সাহেবের স্ত্রী অবশ্য যাওয়ার সময় বার বার পিছু ফিরে তাকালো। আহসান সাহেব নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সেদিন চলে যাওয়ার পর মেয়ে ফোন করে আহসান সাহেবকে পৌঁছানোর খবরটা দিয়েছে, তারপর আর কথা নেই। আহসান সাহেবের স্ত্রী মাঝে মাঝে ফোন দেয়। আহসান সাহেব একা বাসায় থাকে। একটা কাজের মেয়ে আছে সে-ই রান্না করে দিয়ে যায়। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন, অঢেল সম্পত্তি, বিলাসবহুল জীবন-যাপন করা একজন মানুষের শেষ জীবনে কাটতে শুরু করলো একেবারে নিঃসঙ্গ। কোনো কাজ নেই, কোথাও যাতায়াত নেই, বসে শুয়ে থাকা আর চোখের জল ফেলা। এমন একটা জীবনের কথা আহসান সাহেব কল্পনাও করতে পারেনি অথচ আজ সে কতটা অসহায় তা একমাত্র সে-ই জানে।

কয়েকদিন আগে আহসান সাহেবের স্ত্রী জানালো মেয়ে একটা ছেলেকে ভালোবাসে। বিদেশি ছেলে। শুনে আহসান সাহেব বলল, বাঙালি না?

না। ছেলেটা কেমন যেন, আমার ভালো লাগে না।

আহসান সাহেব বলল, তাহলে নিষেধ করো।

করেছিলাম, আমার কথা শুনেনি, ও নাকি ঐ ছেলেটাকেই বিয়ে করবে। তুমি কি একবার বলবে?

আহসান সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করলো, তোমার কি মনে হয় আমি বললে শুনবে?

না।

তাহলে মান-সম্মান নষ্ট করে কী কাজ। কথাটা আহসান সাহেব বলল ঠিকই কিন্তু লাজ-লজ্জা ফেলে মেয়েকে ফোন করলো।

মেয়ে ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো ডেডি।

মা কেমন আছিস?

ভালো বাবা। তুমি কেমন আছ?

ভালো আছি। তোর মা কেমন আছে?

ভালো বাবা, সবাই ভালো আছি।

মা রে তোকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

বলো বাবা।

আহসান সাহেব আমতা আমতা করে বলল, তোর মা বলছিল তুই নাকি একটা বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস?

মা ঠিকই বলেছে বাবা।

মা রে আমরা বাঙালি, আমাদের একটা কৃষ্টি কালচার আছে, ঐতিহ্য আছে।

আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি বাবা। আমার বিয়ে নিয়ে তুমি কিছু বলবে না।

আহসান সাহেব আর কথা বাড়ালো না।

অনেকদিন কথা নেই। হঠাৎ করে একদিন আহসান সাহেব ফেসবুকে দেখলো তার মেয়ের সঙ্গে এক বিদেশি ছেলের ছবি। শুধু ছবি না, সে বিয়ে করেছে একটা আইরিশ ছেলেকে। পোস্টে সেটা উল্লেখ করে সবার দোয়া চেয়েছে।

ছবিটা দেখে আহসান সাহেব কষ্ট পেল কিন্তু অবাক হলো না। কারণ যেদিন মেয়ে তার বিয়ে নিয়ে ভাবতে নিষেধ করেছে আহসান সাহেব সেদিন থেকে এমন একটা আশঙ্কাই করছে। ছেলে এর আগে একটা অ্যামেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে। আহসান সাহেব ছেলের সঙ্গে বেশ রাগারাগি করেছে কিন্তু তাতে করে লাভের লাভ কিছু হয়নি, এমনিতেই সম্পর্কের যে অবনতি ছিল সেটা আরো বেড়েছে। তাই মেয়ের বেলায় সে অবাক হয়নি। ছেলেমেয়েকে সে জীবন থেকে বাদ দিয়েছে। যদিও প্রতিমুহূর্তে ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের তার মন কাঁদে, স্ত্রীর জন্য একাকিত্ববোধ করে, নিঃসঙ্গতায় ভুগে।

আহসান সাহেবের এই পারিবারিক অবস্থা সবাই জানে। এই আড্ডায় বসে আহসান সাহেব সবার সঙ্গে শেয়ার করেছে। সবাই শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করে, কেউ কেউ অবশ্য আড়ালে ভিন্ন রকম কথা বলে, আসলে আহসান সাহেব ছেলেমেয়ে দু’টোকে মানুষ করতে পারেনি, দেশের বাইরে তো লেখাপড়া করতে পাঠায়নি, পাঠিয়েছিল টাকা পাচার করার জন্য। সামান্য একটা চাকরি করে কত কী করেছে, এক জীবনে শুধু চাকরি করে এটা সম্ভব?

আবার কেউ কেউ বলে, আহসান সাহেব তার মা-বাবাকেও দেখেনি, গ্রামের বাড়িতে তার ভাই-ভাতিজারা কামলা দিয়ে খাচ্ছে আর আহসান সাহেব কত টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে অথচ কারো দিকে একটু ফিরেও তাকায়না। সে যেমন মা-বাবার সঙ্গে আচরণ করেছে, তার ছেলেমেয়েরাও তেমনি তার সঙ্গে ব্যবহার করছে।

আড্ডার আরেকজন সদস্য আজিম সাহেব। আজিম সাহেব প্রায়ই আসতো, সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করত, সীমিত আয়ের মানুষ তাই একটু হিসেবিই ছিল। চাকরিজীবনে তেমন আড্ডাবাজ ছিল না, সন্ধ্যা হলেই ছেলেমেয়েদের নিজে পড়াতে বসাতো। তার দু’ছেলে, বড় ছেলে মোস্তাকিম লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরি করছে, তার পোস্টিং গাইবান্ধা। সে তার বউ-বাচ্চা নিয়ে যেখানে পোস্টিং হয় সেখানেই চলে যায়। ছোট ছেলে নাজিম লেখাপড়ায় বেশিদূর আগাতে পারেনি। চাকরিজীবনে আজিম সাহেব প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা লোন করে একটা দোকান করে দিয়েছিল কিন্তু সেটা করতে পারেনি, পুঁজি গায়েব করে ফেলেছে। তারপর দীর্ঘদিন বেকার ছিল। আজিম সাহেব রিটায়ার্ড করার পর যখন পেনশন, গ্র্যাচূয়িটি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুললো তখন ছোট ছেলে আবার কথা তুললো সে ব্যবসা করবে। ছেলের বয়স হয়েছে কিন্তু বেকার তাই বিয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। ছেলের একটা জীবিকার ব্যবস্থা আর বিয়ে দিতে পারলে আজিম সাহেবের কাজ শেষ হয়।

এবার আজিম সাহেব আর নাজিমকে নগদ টাকা হাতে দিল না। নিজেই কাজে নামল। লিলির মোড়ে একটা দোকানের পজিশন, ডেকোরেশন আর মালামাল তুলতে আজিম সাহেবের প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা চলে গেল। তবুও ভালো এবার যদি ছেলেটা ব্যবসায় মনোযোগী হয়।

নাজিমের দোকান শুরু হলো ঈদের প্রায় মাসখানেক আগে। বেশ জমে উঠল, ব্যবসায় লাভ দেখে নাজিম ব্যবসায় মনোযোগী হলো। ছেলের উন্নতি দেখে আজিম সাহেব একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিল, যাক এবার বুঝি ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়ালো।

আজিম সাহেবের বড় ছেলে মোস্তাকিম বিয়ের পর থেকে একরকম আলাদা, মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজখবর নেয়, ঈদ-পরবে ইচ্ছে হলে আসে আবার ইচ্ছে না হলে কর্মস্থলেই ঈদ করে। সংসারে তার খুব একটা ভূমিকা নেই। আজিম সাহেব রিটায়ার্ড করার পর যখন প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করে ছোট ছেলেকে দোকান করে দিল তখন সেটা জানতে পেরে বড় ছেলে, বউমার দরদ যেন উতলে পড়ল। যে ছেলে মাসে অন্তেও কোনোদিন খোঁজখবর নিতো না সেই ছেলে দু’য়েকদিন পর পর ফোন করে খবর নেয়া শুরু করলো, বউমা সকাল-সন্ধ্যা ফোন দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির খোঁজখবর নিতে শুরু করলো, পাঁচ-ছয় বছর বয়সের ছেলেকে দাদুর সঙ্গে কথা বলতে দিল।

ছেলে এবং বউমার সঙ্গে কথা বলার সময় আজিম সাহেব খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলে কিন্তু নাতির সঙ্গে কথা বলার সময় আজিম সাহেব আবেগ আল্পুত হয়ে পড়ে। সেই নাতি যখন আজিম সাহেবকে বলল, দাদু আমি এবার গ্রামে ঈদ করবো, তোমার সাথে। তখন আজিম সাহেবের দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল, ঠিক আছে দাদু এসো এবার আমরা বড় মাঠে একসাথে ঈদ করতে যাবো।

আচ্ছা দাদু।

ঈদের সময় মোস্তাকিম, বউমা এবং একমাত্র নাতি এলো। বিয়ের কয়েকবছর হয়েছে কিন্তু কোনোদিন ছেলে বউমা এতো কাপড়-চোপড় নিয়ে আসেনি। যে কয়েকবার এসেছে প্রতিবারই টানাটানি করে কাপড়-চোপড় এনেছে খুব হিসেব করে। বাবার জন্য একটা লুঙ্গি একটা পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর তার ছোট ভাইর জন্য একটা শার্ট বা পাঞ্জাবি কিন্তু এবার অনেক কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছে দেখে আজিম সাহেব খুব খুশি হয়েছে। তাছাড়া বউমার আচরণেও যেন অনেক ভালো হয়েছে, তার আচরণ যেন একজন আদর্শ বউমার মতোই হয়েছে।

কথায় বলে বেশি ভালো ভালো না। শেষ পর্যন্ত তাই-ই হলো, ঈদের পরদিন মোস্তাকিম আর বউমা বসল আজিম সাহেবের সঙ্গে। বিকেলবেলা, নাজিম তখন বাড়িতে ছিল না, আজিম সাহেবের বিকেলের চায়ের সময়। সারাজীবন তো তার স্ত্রীই বিকেলের চা আপ্যায়ন করে, ছেলের বিয়ের পর বউমা কোনোদিন চা আপ্যায়ন করেছে কী না আজিম সাহেবের মনে নেই কিন্তু আজ চা নিয়ে এলো স্বয়ং বউমা, একটা প্রিচে করে বিস্কুট আর চা, পিছু পিছু মোস্তাকিমও ড্রয়িং রুমে ঢুকে একটা সোফায় বসল, বউমা আজিম সাহেবকে চা দিয়ে আবার বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পর আরো বিস্কুট চা এনে মোস্তাকিমের সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাতি এসে আজিম সাহেবের কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো।

প্রথমে কথা শুরু করলো ছেলে, বাবা তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

আজিম সাহেব প্রথমে ছেলে বউমার চালাকি বুঝতে পারেনি। সে সহাস্যে বলল, আরে আমাকে একটা কথা বলবি তো এতো হেজিটেশনের কী আছে, বলে ফেল।

বাবা তোমার বউমার এক মামা আছে, বাসা করেছে রংপুর কেরামতিয়া মসজিদের পাশে। মামার এক ছেলে বিদেশ যাবে লেখাপড়া করতে, ওদের টাকার সমস্যা তাই পাঁচ শতক জমি বিক্রি করবে।

এতক্ষণে আজিম সাহেব কিছুটা অনুমান করতে পারল কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

বাবা জায়গাটা নিতে পারলে খুব ভালো হতো, রংপুর একটা বিভাগীয় শহর, কেরামতিয়া মসজিদ থেকে জিলা স্কুল খুব কাছে।

জিলা স্কুল খুব কাছে বলার সঙ্গে সঙ্গে বউমা বলতে শুরু করলো, বাবা যে দিনকাল পড়েছে, রাস্তাঘাটে প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। জিলা স্কুল আর কেরামতিয়া মসজিদ রাস্তার এপার-ওপার। জায়গাটা নিতে পারলে, আপনার নাতিরও স্কুলে যাওয়া আসার আর কোনো টেনশন থাকবে না। আপনার তো এখন একটাই নাতি আব্বা, তাই না?

এবার বাড়িতে ঈদ করতে আসাটা যে ছেলে ও বউমার প্রিপ্লানিং সেটা এবার আরো স্পষ্ট হলো। আজিম সাহেব গম্ভীর স্বরে বলল, হ্যাঁ আমার তো একটাই নাতি। দেখ যদি নিতে পারো। নিতে পারলে তো ভালোই হয়।

মোস্তাকিম আমতা আমতা করে বলল, বাবা আমার কি এতো টাকা আছে, তুমি তো জানোই আমি কত বেতন পাই। আমি বলছিলাম তোমার তো পেনশনের টাকা আছে। ওগুলো আমার আর নাজিমেরই, নাজিমকে তো তুমি অনেক টাকা দিয়ে দোকান করে দিয়েছ, আমাকেও না হয় একটা জায়গা কিনে দিলে। তাহলে আমাদের যে বাড়ি ভিটি টা আছে সেটা নাজিম নিবে আর রংপুরে আমি আলাদা বাড়ি করব।

আলাদা বাড়ি করতে হবে কেনো? তাও আবার রংপুর, দু’ভাই মিলে তো এটাতেই বেশি করে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি করতে পারিস।

বাবা আসলে আমাদের বাড়ির জায়গাটা বেশ ভিতরে, তাছাড়া দিনাজপুর আর রংপুরের মধ্যে তো অনেক তফাৎ।

তাই বলে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে হবে, আজিম সাহেব কিছুটা রাগের স্বরে বলল।

এবার মোস্তাকিম কথা বলল না, বউমা কথা বলল, আপনি টাকা দিবেন না তো ভালো কথা আব্বা এসব বুঝ না দিলেও পারতেন। আপনার দুটো ছেলে, সব টাকা-পয়সা আপনার দু’জনকে সমান সমান করে ভাগ করে দেওয়া উচিত, তা না করে আপনি সব টাকা একজনকে দিয়ে দিচ্ছেন।

আজিম সাহেব প্রতিবাদ করলো, সব টাকা-পয়সা দিয়ে দিইনি তো বউমা।

আজিম সাহেবের স্ত্রী ড্রয়িং রুমের পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল, এবার সে ভিতরে এলো, আমি একটা কথা বলছি মোস্তাকিমের বাপ, তুমি তোমার টাকা সমান সমান করে ভাগ করে দাও। কাউকে কোলের কাউকে পিঠের করার দরকার নেই।

ষড়যন্ত্রের গভীরতা বুঝতে আজিম সাহেবের আর বাকি রইল না, স্বয়ং তার স্ত্রী পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। সংসারের রাজনীতিও বেশ জটিল। টাকার ভাগ নেয়ার জন্য মোস্তাকিম এবার ঈদে বাড়িতে এসেছে, এসেছে না তার মা তাকে আনিয়েছে এবং টাকার ভাগাভাগি না হলে সংসারে অশান্তি বাড়বে আবার সব টাকা-পয়সা ভাগ করে দিলে ছেলেরা যদি তাদের না দেখে তবে তারা কোথায় যাবে। আজিম সাহেবের স্ত্রী হয়তো সেকথা ভাবেইনি যে ছেলেরা কোনোদিন তাদের দেখবে না।

পৃথিবীতে কারো ওপর ভরসা করতে নেই, সবসময় নিজের ওপর ভরসা করতে হয়। আজিম সাহেব স্ত্রীর পরামর্শে আর সংসারে অশান্তি এড়ানোর জন্য পেনশন, গ্রাচূয়িটি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দু’ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দিল। কথা হলো মোস্তাকিম আর নাজিম মা-বাবার ভরন পোষণের দায়িত্ব নিবে। টাকা ভাগাভাগির সময় দু’জনে এমনভাবে কথা বলল যেন পৃথিবীতে তারা মা-বাবার সবচেয়ে বাধ্য সন্তান।

প্রথম কয়েক মাস মোস্তাকিম টাকা পাঠালো, নাজিম বাবার সঙ্গেই থাকে কাজেই তাকে আর টাকা দিতে হলো না, মোস্তাকিমের পাঠানো টাকার সঙ্গে সে যোগ দিয়ে সংসার পরিচালনা করে। প্রায় বছরখানেক এভাবে চলল তারপর নাজিম বিয়ে করলো। নাজিমের বিয়ে অবশ্য আজিম সাহেবই দিয়েছে। নাজিম একটা মেয়েকে পছন্দ করত, তার বাবা যখন বিয়ের কথা বলল তখন সে জানালো সেই মেয়ের কথা। আজিম সাহেবও না করেনি, সেই মেয়ের সঙ্গে নাজিমকে বিয়ে দিয়েছে।

একসময় মোস্তাকিমের টাকা আসা বন্ধ হলো। প্রথম প্রথম আজিম সাহেব ভেবেছিল হয়তো এটা সাময়িক, ছেলের চাকরিতে টানাটানি যাচ্ছে তাই। একদিন রাতে আজিম সাহেব মোস্তাকিমকে ফোন করলো।

মোস্তাকিম ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো বাবা।

কেমন আছিস বাবা? তোরা সবাই ভালো আছিস তো, তুই, বউমা, আমার দাদু ভাই?

জি বাবা, আমরা সবাই ভালো আছি। তোমার শরীর ভালো তো বাবা, মায়ের শরীর?

সবাই ভালো বাবা। বাবা তোকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, ছেলেকে টাকার কথাটা বলতেই যেন আজিম সাহেবের সংকোচ হলো।

বলো বাবা।

তুই তো গত মাসে টাকা পাঠাসনি বাবা, আমি ভেবেছিলাম তোর বুঝি কোনো অসুবিধা হয়েছে, তাই পাঠাসনি। আবার তো মাস পড়ে গেল।

তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। আসলে আমারও খুব টানাটানি যাচ্ছে, তোমার দাদুভাইকে জিলা স্কুলে ভর্তির জন্য কোচিং করাচ্ছি, ওরা এখন রংপুরে থাকে ভাড়া বাসায় আবার আমি গাইবান্ধায় থাকি সেখানে একটা খরচ তো আছেই, সবকিছু মিলিয়ে খুব হাঁপিয়ে উঠেছি বাবা।

ছেলের কথা শুনে আজিম সাহেবের মাথায় বাজ পড়ল। মোস্তাকিম যেভাবে কথা বলছে তাতে করে তো তার কাছ থেকে মাসে মাসে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আজিম সাহেব মিনমিন করে বলল, তাহলে আমাদের চলবে কী করে বাবা? আমার তো আর কোনো আয় রোজগার নেই, যা ছিল তোদের দু’ভাইকে দিয়ে দিয়েছি।

বাবা নাজিমের ব্যবসা এখন ভালো চলছে না?

জুতার ব্যবসা তো সারাবছর চলে না বাবা, ঈদে-পরবে ভালো চলে আর সারাবছর যেভাবে চলে তাতে দোকান ভাড়া কর্মচারীর মজুরি দিয়ে কোনোভাবে ওর সংসার চলে। আমাদের দু’জন বাড়তি মানুষের খরচ তো তার দোকান দিয়ে চলবে না বাবা।

হঠাৎ করেই মোস্তাকিম অস্থির হয়ে গেল, বাবা আমার একটা জরুরি ফোন এসেছে আমি একটু পরে তোমাকে আবার ফোন দিচ্ছি, বলে আজিম সাহেবকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিল।

সেই যে মোস্তাকিম ফোন রেখে দিল আর কোনোদিন ফোন করলো না। এদিকে বাড়িতে টাকা-পয়সারও সমস্যা তাই লাজ-লজ্জা ফেলে আজিম সাহেব আবার একদিন ফোন করলো। ফোন রিসিভ করলো মোস্তাকিম, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস বাবা?

আছি বাবা, চাকরিতে অনেকটা ঝামেলায় আছি।

আজিম সাহেবের বুক কেঁপে উঠল, ঝামেলা মানে? কোনো বিপদ-আপদ নয়তো।

না, তেমন কিছু না, কাজের চাপ একটু বেশি। তাড়াতাড়ি বলো বাবা।

আজিম সাহেব বুঝতে পারল মোস্তাকিমের এই ব্যস্ততা কৃত্রিম, হয়তো তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততা দেখাচ্ছে কিন্তু আজিম সাহেবকে যে বলতেই হবে। সে মিনমিন করে বলল, বাবা তুই তো আর সেদিন ফোন ব্যাক করলি না। এদিকে টাকা-পয়সারও সমস্যা। তুই কিছু টাকা না পাঠালে তোর মা আর আমি যে…

মোস্তাকিম বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলতে শুরু করলো, বাবা আসলে তুমিও তো সরকারি চাকরি করেছ, সবই জানো, আমার ইনকামও তো লিমিটেড। তোমার নাতির কোচিংয়ে মাসে মাসে অনেকগুলো করে টাকা দিতে হচ্ছে। আবার তোমাদের ওখানে মাসে মাসে টাকা দেওয়া আমার জন্য একটু কষ্টকর।

ছেলের কথা শুনে আজিম সাহেবের চোখে পানি চলে এলো, কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর বুজে এলো, বাবা তাহলে তোর মা, আমি…

বাবা তোমার বউমা একটা কথা বলছিল।

কী কথা বাবা? বউমার কথা শোনার পর আজিম সাহেব একটু আশাবাদী হলো।

আজিম সাহেব কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে মোবাইল ফোনটা ধরে রাখল। মোস্তাকিমের কথা শুনে তার বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠল। সে বিছানায় বসে পড়ল।

আজিম সাহেব যখন ফোনে মোস্তাকিমের সঙ্গে কথা বলছিল তখন তার স্ত্রী রান্নাঘরে রান্না করছিল। আজিম সাহেব ফোন রেখে দেওয়ার পর তার স্ত্রী ঘরে ঢুকলো। আজিম সাহেবের দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে, সে কয়েকমুহূর্ত তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তোমার? এ অবস্থা কেনো?

না, কিছু না।

মোস্তাকিমের সঙ্গে কথা বলেছ?

হ্যাঁ বললাম।

ও কি খারাপ কিছু বলেছে?

না। খারাপ কিছু না। ও আমাদের জন্য একটু বেশিই চিন্তা করে।

আজিম সাহেবের পাশে তার স্ত্রী বসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তুমি বলবে তো, মোস্তাকিম কি তোমাকে অপমান করেছে?

না।

তো, খুলে বলো কী বলেছে?

আসলে ছেলেটার বুঝি খুব টানাটানি যাচ্ছে। আমাদের জন্য টাকা পাঠানো ওর জন্য বেশ কষ্টকর।

তাহলে আমাদের চলবে কী করে?

সেটাও ওরা চিন্তা করে রেখেছে। আমাদের বউমা বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে সে তোমার ছেলেকে একটা পরামর্শ দিয়েছে আজিম সাহেব কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলল।

কী পরামর্শ?

ওরা আমাদেরকে ভাগাভাগি করে নিতে চায়। যাতে ওদের অতিরিক্ত খরচ না হয়।

আমি তোমার কথার কোনো মাথা মুণ্ডু বুঝছি না। ঠিক করে বলতো।

না, ওরা চাচ্ছে আমরা একজন রংপুরে ওদের ওখানে গিয়ে থাকবো আরেকজন দিনাজপুর নাজিমের বাসায় থাকবো।

কী? এই বুড়ো বয়সে আমরা আলাদা থাকবো?

ছেলেরা যখন চাচ্ছে আর আমাদেরও যখন কোনো উপায় নেই তখন তো তাদের কথামতো চলাই লাগবে। এখন তুমি কার কাছে থাকবে সিদ্ধান্ত নাও।

আজিম সাহেবের স্ত্রী স্বামীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

কয়েকদিন কেটে গেল। নাজিমের ব্যবসার অবস্থা আরো খারাপ হলো কিন্তু যতটা না ব্যবসার অবস্থা খারাপ তার চেয়ে বেশি খারাপ নাজিমের স্ত্রীর। সে কথায় কথায় শ্বশুর-শাশুড়িকে খোঁটা দিতে শুরু করলো। নাজিম মুখে কিছু না বললেও তার আচরণে কিছু পরিবর্তন দেখা গেলো।

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কি ভাইয়াকে ফোন করেছিলে?

হ্যাঁ করেছিলাম তো।

তারপর, কী বলল?

আজিম সাহেবের খাওয়া তখন শেষের দিকে, সে খাওয়া শেষ না করতেই খাওয়ার প্লেট ছেড়ে উঠে পড়ল।

নাজিম অবাক হয়ে বলল, বাবা আমি কিছু ভুল করেছি।

না বাবা। তুই ভুল করিসনি। ভুল তো করেছি আমি বলে আজিম সাহেব মোস্তাকের সঙ্গে তার কথাগুলো বলল।

নাজিমের বউ খাবার পরিবেশন করছিল, সব কথা শুনে নাজিম কিছু বলার আগেই তার বউ বলল, ভাইজান তো ঠিকই বলেছে আব্বা। আমাদের অবস্থাও তো বেশি ভালো না, দিনে এনে দিনে খাওয়া। তাছাড়া আপনি তো সব টাকা-পয়সা আমাদেরকে দেননি যে শুধু শুধু আমরা…

বউয়ের কথা শেষ হওয়ার আগে নাজিম রাগান্বিত চোখে তার বউয়ের দিকে তাকালো।

শেষে নাজিমের বউ তার কথা ফিরিয়ে নিল, না আমি বলছিলাম আপনি তো কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যেতেও পারেন।

আজিম সাহেব আর তার স্ত্রীর অবস্থা এখন বালিশ বদল খেলার মতো, যেন দু’ছেলের মধ্যে যে তাকে ফেলতে পারে সেই বেঁচে যায়। সেদিনের পর থেকে নাজিমের বউয়ের ব্যবহার আরো খারাপ হয়ে গেল, নাজিম যখন বাসায় থাকে না তখন বেশিরভাগ সময় খোঁটা দিয়ে কথা বলে অবশেষে একদিন রাতে আজিম সাহেব তার স্ত্রীকে বলল, মোস্তাকিমের মা, অবস্থা তো বুঝছো, এদের দু’জনের মধ্যে এখন ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। কী করা যায় বলতো?

এটা তুমি কী বলছ মোস্তাকিমের বাপ, সারাজীবন একসঙ্গে থাকলাম, বুড়ো বয়সে এখন তুমি থাকবে রংপুর আর আমি থাকবো দিনাজপুর?

আজিম সাহেব বুঝতে পারল সে এটা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছে না। সে আরেকটু সহজ করে বলল, না আমি বলছিলাম আমি না হয় কয়েকদিন থেকেই চলে আসবো, এই মনে করো ছেলের বাড়িতে বাপ যায় না। অনেকদিন থেকে আমাদের একমাত্র দাদুভাইকেও দেখি না।

তা যেতে পারো কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে এসো তাহলে।

সেই থেকে আজিম সাহেব আর তার স্ত্রী আলাদা। এখন প্রতিদিন আজিম সাহেব ছেলের বাসার বাজার করে, নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করে আর নিজের শেষ সম্বল ছেলেদের ভাগ করে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করে।

কথাগুলো বলল এই আড্ডারই এক সদস্য আজিম সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে যখন কথাগুলো বলছিল তখন কয়েকমিনিটের জন্য যেন সবাই হতবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য হাসি-ঠাট্টার এই আড্ডায় করুণ পরিণতি নেমে এসেছিল।

একজন উত্তেজিত হয়ে বলল, ত্যাগী তুমি একটা মামলা করে দাও।

আরেকজন বলল, ছেলের বিরুদ্ধে বাপের মামলা।

শাহাদত সাহেব বললেন, মামলা করলে তো বেনিফিট পাবে, এমন সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করাই উচিত কিন্তু আজিম সাহেব কি মামলা করতে রাজি হবে?

আজিম সাহেবের সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলল, আমি কথা বলছি, আমি ওকে রাজি করাবো। আপনি একবার বলুন আপনি কেসটা নিবেন তো।

শাহাদত সাহেব বললেন, অবশ্যই নিবো। পুরো মামলার খরচ আমি করবো।

 

তেরো

 

সেদিন সন্ধ্যায় বিপ্লবী বাবার সামনে এলো, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

বাবা কেমন আছো?

শাহাদত সাহেবের বিপ্লবীর ওপর থেকে রাগ কমেনি কিন্তু হাজার হলেও নিজের মেয়ে, মেয়ে বাবার বাড়িতে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ভালো। তোরা ভালো আছিস সবাই?

জি বাবা।

বিপ্লবী ভেবেছিল তার বাবা বুঝি মোস্তাকের কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তিনি জিজ্ঞেস করলেন না, বললেন, কোথাও যাবি নাকি?

বিপ্লবী আমতা আমতা করে বলল, না বাবা, মানে এমনিই একটু বাইরে যাবো ভাবছি।

কে কে যাচ্ছিস?

বিপ্লব গাড়ি পাঠিয়ে দিবে আমি আর আয়েশা যাবো, ভাবীকেও নিয়ে যাবো।

শাহাদত সাহেবের মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিল। হঠাৎ করে কাউকে না বলে বিপ্লবী বাড়িতে এলো, এখন আবার তিন ভাইবোন ভাবী মিলে বাইরে যাচ্ছে, কোনো মতলব নেই তো।

বাইরে থেকে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ ভেসে এলো। শাহাদত সাহেব চমকে উঠলেন, ঐ যে গাড়ি চলে এলো।

সবাই চলে গেল, তাদের সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরাও গেল, যাওয়ার সময় রানু, রুদ্র একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, দাদু আসি।

শাহাদত সাহেব মুচকি হাসি হাসলেন। পিংকি হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালো, বাই।

শাহাদত সাহেব ধমকের সুরে বললেন, আবার…

আলেমা গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল, সাবধানে যাস সবাই।

আলেমা ফিরে এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই শাহাদত সাহেব ডাকলেন, আলেমা।

আলেমা ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, বলো।

সবাই চলে গেল?

হ্যাঁ।

বাড়িটা বেশ ফাঁকা, ফাঁকা লাগছে।

হ্যাঁ। তোমাকে চা দিব?

দাও।

কিছুক্ষণের মধ্যে আলেমা চা নিয়ে এলো সঙ্গে একটা ছোট্ট বিস্কুটের প্যাকেট।

শাহাদত সাহেবকে চা দিয়ে আলেমা পাশের সোফায় বসল।

শাহাদত সাহেব বিস্কুটের প্যাকেট খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ করে, কাউকে কিছু না বলে বিপ্লবী চলে এলো।

মেয়ের মা-বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করেছে তাই চলে এসেছে।

জামাই এলো না?

না। জামাই নাকি ইন্ডিয়া গেছে।

ইন্ডিয়া গেছে? কেনো?

সেরকমই তো শুনলাম। তুমি জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবে।

আচ্ছা ওরা ফিরে আসুক।

বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। শাহাদত সাহেব ছেলেমেয়ে কিংবা নাতি-নাতনীদের হইচই পছন্দ করেন না, তিনি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন কিন্তু রানু-রুদ্র বাসায় থাকলে, বউমা বাসায় থাকলে বাড়িতে যেন একটা প্রাণচাঞ্চল্য থাকে, নীরবতার মধ্যে একটা প্রাণবন্ত বাড়ি বলে মনে হয় কিন্তু আজ সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি একটা শূন্যতা অনুভব করলেন।

রাত অনেক হলো কিন্তু কেউ বাসায় ফিরল না। শাহাদত সাহেব যেন অসি’র হয়ে গেছেন, বার বার করে সোফা থেকে উঠে চেম্বারে যাচ্ছেন আবার চেম্বার থেকে ড্রয়িং রুমে ঢুকে পায়চারি করছেন, যদিও আজ তার চেম্বারে বসার কথা না। আজ তার সহকারী দু’জনও আসেনি। শাহাদত সাহেব কখনো রান্নাঘরে ঢুকেন না, আজ এই শূন্য বাড়িটা তার কাছে যেন শ্মশানের মতো লাগছে, তাই চেম্বার আর ড্রয়িং রুম পায়চারি করতে করতে তিনি একবার রান্নাঘরেও গেলেন। দীর্ঘ জীবনে কোনোদিন স্বামী রান্নাঘরে প্রবেশ করেনি আজ হঠাৎ রান্নাঘরে দেখে আলেমা কিছুটা অবাক হলো, তুমি?

হ্যাঁ, বাসাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, প্রতিদিন তুমি বউমা রান্নাঘরে রান্না করো, রুদ্র-রানু বাসায় দৌড়াদৌড়ি করে, আয়েশা এ ঘর-ও ঘর যাতায়াত করে কিংবা টিভি দেখে অথচ আজ বাসাটা কেমন যেন সুমসাম করছে।

আলেমা স্বামীর অসহায়ত্বে অবাক হলেন না, তারও যে এমন লাগেনি তা না কিন্তু তার মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস আছে। বিয়ের পর যখন কোনো সন্তান হয়নি তখন সারাদিন সে বাসায় একা একা থাকতো, একে একে সন্তানরা এলো, সকালবেলা সবাই স্কুল-কলেজে চলে যেতো, বিকেলে আবার বাসা কলকাকলীতে মুখরিত হতো। নিরবতা, উচ্ছ্বাস, হইচই সবকিছু মানিয়ে চলার অভ্যাস আছে কিন্তু শাহাদত সাহেব সারাজীবন নিজের মতো করে জীবন-যাপন করেছেন, কখনো হইচই পছন্দ করতেন না কিন্তু রুদ্র-রানু হওয়ার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক হইচই মানিয়ে নিতে নিতে উপভোগ করতে শুরু করেছেন। তাই আজ যখন বাড়িটা নীরব হয়ে গেছে তখন শাহাদত সাহেবের অবস্থা যেন হয়েছে জলের মাছকে ডাঙ্গায় তোলার মতো। আলেমা জিজ্ঞেস করলো, কেনো খারাপ লাগছে? তুমি তো হইচই পছন্দ করো না। আজ আবার…

একসময় পছন্দ করতাম না কিন্তু সত্যি কথা কী জানো?

কী?

রানু আর রুদ্র আমাকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে আর অভ্যস্ত হতে হতে আমিও ওদের মতো হয়েছি।

আয়েশাকে ফোন দাও, তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলো।

না, না থাক বলে শাহাদত সাহেব আবার ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। আলেমা বলল, আর ড্রয়িং রুমে বসিও না আমি তোমাকে ভাত দিচ্ছি।

ওরা আসবে না?

ওরা আজ বাইরে চাইনিজ খেয়ে আসবে, স্বাধীনও আসার সময় হয়ে এলো, তুমি বসো, তোমরা দু’জন খেয়ে নাও।

শাহাদত সাহেব ডাইনিং এ বসে স্বাধীনকে ফোন করলেন, স্বাধীন রিসিভ করেছে, হ্যালো বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাসায় আসছিস?

জি বাবা, এই আর দু’মিনিট।

আচ্ছা আয়।

স্বাধীন এলো, বাপ-বেটা দু’জনে খেতে বসল। শাহাদত সাহেব ভেবেছিলেন স্বাধীন এসে সবার কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সে কিছু বলল না, সোজা ডাইনিং টেবিলে বসল।

শাহাদত সাহেব নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, আজ ওদের কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি, কিছু জানিস?

কোনো প্রোগ্রাম নেই তো বাবা, রাজিয়া আমাকে বলল আজ নাকি সবাই মিলে চাইনিজ খাবে। আমি টাকা দিলাম।

আলেমা দু’জনকে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল, চলে আসবে বুঝি এখনই।

শাহাদত সাহেব কিছুটা অভিমানের সুরে বললেন, আজকাল অনেক খবরই আমি জানি না তো তাই বললাম।

এতো ছোটখাটো বিষয়ে আবার তোমাকে কী বলবে, আজকাল তুমি সবকিছুতেই খুব খুঁত ধরো, আলেমা বলল।

আলেমার ভাত তরকারি তুলে দেওয়া শেষ হলো। শাহাদত সাহেব খেতে খেতে বললেন, আমি কি শুধু শুধু খুঁত ধরি।

আলেমা কিছু বলল না। স্বাধীন যেমনভাবে খাচ্ছিল তেমনিভাবে খেতে লাগল। শাহাদত সাহেব খেতে খেতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, যেদিন বিপ্লবীর বাসায় গিয়ে আমি ওদের ভোগ-বিলাসিতা দেখেছি সেদিন থেকে আমি ওদের দু’জনকেই পছন্দ করি না। আমার মনে হয়েছে মোস্তাকের এই উন্নতির পিছনে কোনো অসৎ উপার্জন আছে। শুধু বেতনের টাকায় এই উন্নতি অসম্ভব। ওরা এ বাসায় আসুক সেটাও আমি পছন্দ করি না। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে আজ দেখি বিপ্লবীর মেয়ে সামনে এসে বলে গুড মর্নিং।

আলেমা রেগে গেলো, তুমি তো সবকিছু বাঁকা চোখে দেখ। তুমি কি জানো জামাই তার বাবার রংপুরের জায়গা জমি বিক্রি করেছে। কোনোকিছু না জেনেই তুমি ওদের ওপর রাগ করছ। জামাইও এটা মাইন্ড করেছে।

শাহাদত সাহেব তিরস্কারের সুরে বললেন, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

সেকথা তো আমাকে আগে বললেই হতো।

তুমি কি কোনোকিছু সহজভাবে নাও, তুমি একটু অন্যরকম দেখে ছেলেমেয়ে, বউমা-জামাই সবাই কিছু বলতে ভয় পায়। তাছাড়া মেয়ে জামাই ভালো আছে আমরা তো এটুকুই দেখবো নাকি। ওদের উন্নতির পিছনে কী আছে না আছে আমাদের এতো জানার দরকার কী।

শাহাদত সাহেব কিছু বললেন না, আলেমা আবার বলতে শুরু করলো, দেখ তো স্বাধীন, মেয়ে বাবার বাড়িতে আসবে না?

স্বাধীন ভাতের প্লেট থেকে মুখ তুলে মাকে কথা না বাড়ানোর জন্য ইশারা করে বলল, বাবা অনেকদিন আসেনি, মা-বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করেছে হয়তো তাই এসেছে, তাছাড়া বলে স্বাধীন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল শাহাদত সাহেব কথার মাঝে জিজ্ঞেস করলেন, তাছাড়া কী?

মোস্তাক কয়েকদিনের জন্য ইন্ডিয়া গেছে।

শাহাদত সাহেবের খাওয়া শেষ হয়েছে তিনি চেয়ার থেকে উঠে হাত ধোয়ার জন্য বেসিনে গেলেন, হঠাৎ করে ইন্ডিয়া কেনো?

শাহাদত সাহেব হাত ধুয়ে আবার টেবিলে এসে বসলেন, মোস্তাক চেয়ার থেকে উঠে বেসিনে যেতে যেতে বলল, সিরিয়াস কিছু না, কিছুদিন থেকে ডায়বেটিস, হাইপারটেনশন, কিছুদিন যাবৎ ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাই ডাক্তার দেখাতে গেছে।

সিরিয়াস কিছু না আবার ইন্ডিয়া গেছে ডাক্তার দেখাতে। এত অল্প বয়সে ডায়বেটিস, হাইপারটেনশন?

বাবা কয়েকদিন আগে আমাকে ফোন করেছিল, বলল বুকটা একটু ব্যথা। আমি কিছু টেস্ট করতে বললাম, টেস্ট করে দেখলাম সবকিছু নরমাল কিন্তু মোস্তাক বিশ্বাস করছে না।

কী বলিস?

হ্যাঁ তারপর আমি কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে বললাম, বলে ইন্ডিয়া গিয়ে দেখাবে।

তার মানে শুধু টেস্ট না, ডাক্তারদের প্রতিও ওর বিশ্বাস নেই।

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক ভালো বাবা। আসলে দেশের বাইরে চিকিৎসা করাটা একটা ফ্যাশান হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। মন্ত্রী-মিনিস্টারদের অসুখ হলে মাউন্ট অ্যালিজাবেথ হসপিটাল, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়ার ভেলর, বিড়লা সবাই যদি দেশের বাইরে চিকিৎসা করে তবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হবে কী করে।

সবাই দেশের কথা ভাবলে তো দেশটা সত্যি সোনার বাংলা হয়ে যেতো বাবা।

তোর সঙ্গে আমার মতের মিল আছে। আসলে মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমলা, ব্যবসায়ী সবার উচিত দেশেই মান সম্পন্ন হাসপাতাল তৈরি করা আর ডাক্তারদের উচিত রোগিদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা।

জি বাবা। তবে মানুষের মানসিকতাও চেঞ্জ হয়েছে। আজকাল সামান্য জ্বর হলেই, খুব গরীব মানুষও স্প্যাসালিস্ট ডাক্তার দেখায় অথচ তার অসুখের চিকিৎসার জন্য একজন এম.বি.বি.এস ডাক্তারই যথেষ্ট।

কলিং বেল বেজে উঠল। আলেমা দরজা খুলতে গেল।

সবাই বাসায় ঢুকলো। রানু আর রুদ্র দৌড়ে শাহাদত সাহেবের কাছে এলো, দাদু।

শাহাদত সাহেব দু’জনকে হাত ধরে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, স্বাধীন ওপরে তার বাসায় চলে গেল। পিংকি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল, বিপ্লবী ড্রয়িং রুমে ঢুকে সালাম দিল, বাবা আসসালামুয়ালাইকুম।

শাহাদত সাহেব গম্ভীর স্বরে সালামের জবাব দিলেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম।

বাবা তোমার শরীরটা ভালো?

হ্যাঁ।

শাহাদত সাহেব একটা সোফায় বসলেন, রানু আর রুদ্র তার কোলে বসল পিংকির মধ্যে একটা জড়তা আছে, শাহাদত সাহেবের সঙ্গে সহজ হতে পারছে না। সে অদূরে দাঁড়িয়ে রইল।

বিপ্লবী পাশের সোফায় বসতে বসতে ভেজা ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কি আমার ওপর এখনো রেগে আছ?

শাহাদত সাহেব কোনো কথা বললেন না। বিপ্লবী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি বলো বাবা আমার কী করার আছে। ও রংপুরের জমি বিক্রি করলো, আর কী কী করলো তা কি আমি জানি, তুমি কি মাকে কিছু বল।

আচ্ছা থাক। তোরা যে রংপুরের জমি বিক্রি করেছিস তা তো আমি জানি না। তবে আজকাল সবাই ফুঁলে-ফেঁপে কলাগাছ হয়ে উঠছে। আসলে তোকে দোষ দিয়েই কী লাভ, পুরো সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা নেই, বিবেকবোধ, দেশপ্রেম নেই যে যেভাবে পারছে লাগামহীন সম্পদের জন্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

বিপ্লবী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বাবা তোমার মতো সব বাবারা যদি মেয়েদের ত্যাগ করে তবে দেশের এই অবস্থায় কোনো বাবার সঙ্গেই যে সন্তানদের সম্পর্ক থাকবে না বাবা, বাবা, প্লিজ বাবা তুমি আমাকে ভুল বোঝো না।

শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্ত বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মনের মধ্যে তখন অনেক কথা বিড়বিড় করছে, বিপ্লবী ঠিকই বলেছে, সে জামাইকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবে তুমি এত টাকা পেলে কোথায়, দেশে কি মোস্তাক শুধু একজনই, লক্ষ লক্ষ মোস্তাকের বিরুদ্ধে বিপ্লবীর মতো মেয়েরা লড়াই করবে কীভাবে, তাছাড়া তাদেরও তো বিত্তবাসনা আছে, ভোগবিলাসের লোভ-লালসা আছে। আর সত্যি সত্যি এরকম অজুহাতে বাবারা মেয়েদের ত্যাগ করে তবে তো পৃথিবীতে বাবা মেয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হবে।

বিপ্লবী কিছুক্ষণ বসে রইল তারপর ওপরে চলে গেল।

রাজিয়া জোরে ডাক দিল, রানু-রুদ্র আয় পড়তে বসবি।

আসছি মা বলে রানু উঠল রুদ্‌্র শাহাদত সাহেবের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, দাদু একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

রানু রুদ্রকে না বলতে ইশারা করলো, রুদ্র।

রুদ্‌্র রানুর কথাকে গুরুত্ব দিল না। শাহাদত সাহেবের কানে কানে বলল, আমরা মার্টিনে গেছিলাম চাইনিজ খেতে, ওখানে একটা বউ এসেছিল। বিপ্লব কাকুর বউ, ওই বউটার সঙ্গে নাকি বিপ্লব কাকুর বিয়ে হবে। তুমি কিন্তু কাউকে আমার কথা বলো না। তখন সবাই আমার ওপর রাগ করবে বলে রুদ্র উঠে ওপরে দৌড়ে গেল।

শাহাদত সাহেব মুখ কালো করলেন, তিনি আর কাউকে কিছু না বলে তার রুমে চলে গেলেন।

 

চৌদ্দ

 

আজকাল শাহাদত সাহেবের রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায়, দীর্ঘ জীবনের স্মৃতিময় ঘটনাগুলো মনে পড়ে। জীবনে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব চোখের সামনে ভেসে উঠে। দীপ্তি নামের একটি মেয়ে, শাহাদত সাহেবের চেয়ে দু’বছরের জুনিয়র। আগের দিনে এখনকার মতো ছেলেমেয়েরা একসাথে হেঁটে বা অটোরিকশা কিংবা রিকশা ভ্যানে চড়ে স্কুল যেতো না। ছেলেরা আলাদা এবং মেয়েরা আলাদা দল বেঁধে স্কুল যেতো আবার বয়সে একটু বড় হলে বিত্তবান পরিবারের ছেলেরা সাইকেল নিয়ে যেতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমি দল বেঁধে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতাম। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় চাচা একটা সাইকেল কিনে দিলেন। তখনকার দিনে রেলি এবং ফনিঙ ছিল সবচেয়ে দামি এবং সবার পছন্দের সাইকেল। চাচা আমাকে ফনিঙ সাইকেলই কিনে দিলেন।

আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব চার কিলোমিটার, সেই সকালবেলা আমরা ভাত খেয়ে স্কুল যেতাম ফিরতাম বিকেলবেলা। স্কুল থেকে ফেরার সময় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়তো। একদিন আলাদা আলাদা দল বেঁধে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল থেকে ফিরছে। প্রচণ্ড রোদ, আর গরমে সবাই ক্লান্ত, কেউ কেউ গাছের নিচে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আমি সাইকেল নিয়ে মেয়েদের দলকে অতিক্রম করতেই একটা কণ্ঠ আমার কানে ভেসে এলো, ভাইয়া একটু নিয়ে যান না প্লিজ!

একসাথে পাঁচ জন মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাদের মধ্য থেকে কে বলল আমি তা বুঝতে পারিনি। একবার সবার দিকে তাকাতেই একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই তুই যা।

একজন আরেকজনকে এভাবে বলাবলি করতে করতে দীপ্তি রাজি হয়ে গেল। ততক্ষণে আমি সাইকেল চালাতে চালাতে কিছুটা এগিয়েছি, পিছন থেকে একজন মেয়ে জোরে ডাক দিল, এই যে শাহাদত ভাইয়া দীপ্তিকে নিয়ে যান প্লিজ!

আমি এক পা রাস্তায় রেখে সাইকেলের ওপর বসে থেকেই পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, দীপ্তি যাবা?

দীপ্তি লাজুক স্বরে বলল, নিয়ে গেলে তো যাবো।

আচ্ছা ক্যারিয়ারে ওঠো তাহলে।

দীপ্তি কিছু না বলে সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠল। ক্যারিয়ারে পিছনে শক্তভাবে ধরে রাখল। দীপ্তি আগেও বাবার, মামার সাইকেলে উঠেছে তাই তার তেমন সমস্যা হলো না। দীপ্তির বাড়ি অতিক্রম করে আমাদের বাড়িতে যেতে হয়, দীপ্তির বাড়ির কাছে এসে আমি দাঁড়ালাম। দীপ্তি সাইকেল থেকে নেমে বলল, আমাদের বাড়িতে যাবেন? মা আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবে।

ভালো ছাত্র হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি ছিল, তাই দীপ্তির মা আমাকে দেখলে খুশি হবে একথাও সত্যি কিন্তু আমি গেলাম না, বললাম, না, তুমি বাসায় যাও তাড়াতাড়ি, রোদে তোমার চোখ-মুখ কালো হয়ে গেছে।

দীপ্তি অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমার চোখে চোখ রেখে আচ্ছা বলে চলে গেল। দীপ্তির সেদিনের চোখের দৃষ্টি আমার বুকে ঝড় তুলেছিল, সেই চোখ সেই অসাধারণ দৃষ্টি আমার হৃদয়ে আজও অক্ষয়, অম্লান হয়ে আছে। জীবনের শুরুতে হৃদয় থাকে সাদা কাগজের মতো তাই প্রথম প্রেমের সৃ্মতিগুলো যে দাগ কাটে তা আর কোনোদিন মুছে যায় না।

কয়েকদিন পরের কথা, একদিন আমি সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি এমন সময় দীপ্তি একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, দীপ্তিকে অতিক্রম করার সময় আমি বললাম, দীপ্তি আজ আবার দলছুট হয়েছো কেনো? আমার সাইকেলে যাবা?

দীপ্তি চাপাস্বরে বলল, উফ্‌, মনে হয় কিচ্ছু বোঝে না।

দীপ্তির প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার ওপর, সে রাগে লাল হয়ে গেছে। সে বলল, হ্যাঁ। আজ সবাই আগে চলে গেছে, আমাকে একটু নিয়ে যান, ওদের কাছে গিয়ে আমি নেমে পড়ব।

আচ্ছা ওঠো।

দীপ্তি লাফিয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসল।

আমি সাইকেল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলাম, আজ দেরি করে ফেললা কেনো?

মা ভাত রান্না করতে দেরি করেছে।

এমনি কথা বলতে বলতে আমি অনেকক্ষণ সাইকেল চালালাম কিন্তু মেয়েদের দলকে পেলাম না, আমি বললাম, আজ আমারও দেরি হয়ে গেছে।

হ্যাঁ। আপনার সাইকেলে না গেলে আজ আমি ফার্স্ট ক্লাসটা ধরতেই পারতাম না।

আর দেরি করো না।

দীপ্তি মুখ ভেঙচিয়ে আচ্ছা, আর দেরি করো না বলে আবার বলল, একশ বার করবো, হাজার বার করবো।

সেদিন থেকে আমার সাইকেলে চড়ে স্কুল যাওয়াটা দীপ্তির একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি লক্ষ্য করলাম, প্রায় দিনই আমি যখন সাইকেল নিয়ে ঠিক দীপ্তিদের বাড়ি অতিক্রম করি সেসময় দীপ্তি বাড়ি থেকে বের হয়। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমার আসার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকো নাকি, আমিও এসে পড়ি আর তুমিও এসে পড়ো?

দীপ্তি কোনোকিছু না বলেই সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।

আমি সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নামলা কেনো?

আমি আর কোনোদিন আপনার সাইকেলে যাবো না।

কেনো?

দীপ্তি মুখ ভেঙচি কেটে বলল, কেনো, মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না।

আমি একবার ডানে-বাঁয়ে তাকালাম, আশে-পাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে দীপ্তির একটা হাত ধরলাম, দীপ্তি হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো না, আমি আবেগজড়িত কণ্ঠে ডাক দিলাম, দীপ্তি।

দীপ্তি বলতে শুরু করলো, প্রথম যেদিন আপনার সাইকেলে চড়ে আমি বাড়ি ফিরলাম, সাইকেল থেকে নামার সময় আপনার চোখে চোখ পড়ল, আমি যেন আপনার মাঝে হারিয়ে গেলাম। কথায় বলে প্রথম দর্শনে প্রেম, সেদিনই আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। আপনি বুঝি কিচ্ছু বোঝেন না?

আমি বুঝতে পেরেও দীপ্তিকে ক্ষেপানোর জন্য বললাম, তুমি ফাল্গুনীর উপন্যাস খুব বেশি পড়েছ।

উপন্যাস পড়লে বুঝি মানুষ প্রেমে পড়ে আর যারা উপন্যাস পড়ে না তারা প্রেমে পড়ে না।

আমি দীপ্তির থুতনি হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে ডাকলাম, দীপ্তি!

সেদিন থেকে আমি জানালা দিয়ে আপনার আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যখন আপনাকে দেখতে পাই তখন বাড়ি থেকে বের হই কথার শেষদিকে দীপ্তির কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এলো।

আমি দীপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে তখন হাজার কথার ঝড় বইছে, দীপ্তি আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট অথচ সে এতো অল্প বয়সে আমার চেয়ে কত পরিপক্ব, জীবন নিয়ে তার কত ভাবনা।

দীপ্তি জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছেন?

তুমি আমার চোখ খুলে দিলে দীপ্তি।

দীপ্তি অভিমানের সুরে বলল, সত্যি করে বলুন তো আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না?

বাসি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি দীপ্তি।

আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিছু মনে করো না, আজ থেকে সবার আড়ালে যখন শুধু আমরা দু’জন কথা বলবো তখন তুমি করে ডাকবো।

অবশ্যই।

দূর থেকে একটা সাইকেল আসছে দেখে আমি বললাম, চলো, তাড়াতাড়ি চলো।

দীপ্তি ক্যারিয়ারে বসল, আমি আবার সাইকেল চালাতে শুরু করলাম।

সেদিনের কথাগুলো আমার আজও মনে পড়ে, আমি বরাবরই স্পষ্টবাদী মানুষ, কোনোকিছু গোপন করতে পারি না, কোনোকিছু নিয়ে রহস্য তৈরি করি না। যা মনে আসে মুখে তাই বলে ফেলি অথচ প্রথম দীপ্তিকে ভালোবাসার পরও কেনো দীপ্তির মতো সহজভাবে সবকিছু ওকে বললাম না।

আগের দিনে ছাত্র-ছাত্রীরা বই বদল করত। একজনের কাছে হয়তো আছে নীহাররঞ্জন গুপ্তের আরেকজনের কাছে শরৎচন্দ্রের বই, একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজনকে দিতো। বিশেষ দিনে এমনকি কোনো দিবস ছাড়াও একজন আরেকজনকে বই উপহার দিতো। কয়েকদিন আগে আমি দিনাজপুর থেকে কয়েকটা বই কিনে এনেছি, দীপ্তির জন্য কিনে এনেছি ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন। বই পেয়ে দীপ্তি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল, আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, উফ্‌, আমি দেওয়ার আগে তুমি দিয়ে দিলে। আমি ভাবছিলাম এই বইটাই তোমাকে দিব আর তুমি দিয়ে দিলে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো তুমি এই বইটা পড়েছ নাকি?

না। পারুল বলল বইটা নাকি খুব সুন্দর। তুমি পড়েছ?

না।

তাহলে তুমি পড়বে না? দীপ্তি জিজ্ঞেস করলো।

আমি দু’টা বই কিনেছি, একটা তোমাকে দিয়েছি আরেকটা আমার কাছে রেখেছি।

অযথা কেনো টাকা নষ্ট করতে গেলে, আমি পড়ে তোমাকে দিতাম।

ফেরত নিলে তো উপহার হলো না দীপ্তি। আমার দেওয়া উপহার তুমি রেখে দিবে।

তা ঠিক বলেছ।

পরদিন আমি সাইকেল নিয়ে দীপ্তিদের বাড়ি অতিক্রম করলাম কিন্তু দীপ্তি নেই। আমি কিছুটা চিন্তায় পড়লাম, হঠাৎ করে দীপ্তির কোনো অসুখ হলো না তো। সাইকেল চালিয়ে আমি যখন দল বেঁধে যাওয়া মেয়েদের কাছাকাছি এলাম তখন মেয়েদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। পারুল দীপ্তিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, ঐ যে দেখ, তোর…

আমি কাউকে কিছু না বলে মেয়েদের দল অতিক্রম করে চলে গেলাম। স্কুল থেকে ফেরার পথেও আমি দীপ্তির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সাইকেল চালাতে চালাতে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলাম দীপ্তির চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে যেন নির্ঘুম রাতের সাক্ষী বহন করছে, ওর ওপর দিয়ে যেন কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে।

দুদিন কেটে গেল। আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়লাম, একথা নিশ্চিত যে আমার সঙ্গে দীপ্তির সম্পর্কের কথাটা বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে, সেটা শেষ পর্যন্ত দীপ্তির মা-বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি তো! দীপ্তির ওপর আমার প্রচণ্ড রাগ হলো, কী হয়েছে বলবে তো।

সেদিন স্কুল যাচ্ছিলাম, দীপ্তি তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। এ কোন দীপ্তিকে দেখছি আমি, চোখের গোড়া কালো, মুখ শুষ্ক, চুলগুলো উসখু-খুসকু। আমি সাইকেল দাঁড় করিয়ে বললাম, ওঠো।

দীপ্তি উঠল না। খামের মধ্যে থাকা একটা বই আমার হাতে দিয়ে বলল, আমি একা যাবো, এটা তোমার জন্য।

কী এটা?

বই।

ঠিক আছে কিন্তু আমার সঙ্গে যাবা না কেনো? কেউ কিছু বলেছে?

না, কথা বলতে বলতে দীপ্তির চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে উঠল।

ওঠো তো বলে আমি দীপ্তির হাত ধরে টান দিলাম।

দীপ্তি আর না করলো না। সে সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে বসতে বসতে বলল, আজ আমি স্কুলে যাবো না।

স্কুলে যাবোা না মানে? কোথায় যাবা?

কোথাও বেড়াতে যাবো।

কোথায়?

যেখানে তুমি নিয়ে যাবে।

আর স্কুল? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

একদিন স্কুল না গেলে কিচ্ছু হবে না। আমি স্কুল যাবো না, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আজ আমরা সারাদিন একসাথে ঘুরে বেড়াবো, অনেক গল্প করবো।

আমি বললাম, দীপ্তি স্কুল কামাই করা যাবে না, আগে লেখাপড়া, জীবনে বড় হওয়া তারপর ঘুরে বেড়ানো।

দীপ্তি চলন্ত সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।

আমি সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নামলে কেনো?

আগে বলো তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে কি না?

আমি দীপ্তির চোখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম তারপর বললাম, হ্যাঁ নিয়ে যাবো।

দীপ্তির ফিক করে একটা হাসি হেসে বলল, সত্যিই!

হ্যাঁ। তবে স্কুল কামাই করে না।

তো?

স্কুল শেষে।

ফাঁকি দিবা না তো?

না। তুমি স্কুল ছুটির পর সবাই যখন চলে যাবে তখন হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারের দিকে যেও কিছুদূর যাওয়ার পর আমি তোমাকে সাইকেলে তুলে নিব।

দীপ্তি অবাক হলো, সত্যি?

সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি।

পনেরো

 

পুনর্ভবার পশ্চিম তীর। বেড়ি বাঁধ থেকে ঢালু হয়ে একটা সরু রাস্তা নেমে গেছে নদীতে। দু’পাশে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, ছোট-বড় কিছু বনজ গাছ, জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, প্রচণ্ড গরমেও গাছের তলায় একটা শীতল হাওয়া। দু’জনে পাশাপাশি বসলাম, কয়েকমুহূর্ত কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরবতা ভঙ্গ করলো প্রথমে দীপ্তিই, কিছু বলছ না যে?

কথা বলতে আমার মুখে কোনো জড়তা নেই। কথা বলতে শুরু করলে বলতেই থাকি কিন্তু আজ মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না, দীপ্তির সঙ্গে তো আগেও কথা হয়েছে, ওর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে যেন আমার মুখে কথার খৈ ফুটে, দীপ্তির চোখে-মুখেও থাকে উচ্ছলতা কিন্তু আজ দীপ্তিকে কেনো জানি কিছুটা রূঢ় দেখাচ্ছে, আমার মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা কাজ করছে, কিছু বলতে গিয়ে যেন আমার কণ্ঠস্বর শুকিয়ে আসছে। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, তুমি বলো।

বাহ, তুমি না কথা বলতে পটু, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় তো দেখি বলতেই থাকো আর আমার সামনে কথা বের হচ্ছে না। আমাকে ভয় পাচ্ছ?

ভয়, না, না তোমাকে ভয় পাবো কেনো? তোমাকে তো আমি ভালোবাসি।

তোমাকে একটা কথা বলবো?

বলো।

সবার কাছ থেকে শুনি ছেলেরা মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে, ইনিয়ে বিনিয়ে ভালোবাসার কথা বলে আর আমাদের বেলায় আমি দেখছি তোমার তেমন কোনো আগ্রহই নেই।

এটা তুমি কী বললে, আমার আগ্রহ না থাকলে এখানে আসতাম! শোনো ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গি একেকজনের একেক রকম।

তা ঠিক বলেছ বলে দীপ্তি আমার গা ঘেঁষে বসল, আমি একবার আশেপাশে তাকালাম, আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে দীপ্তির একটা হাত নিজের মধ্যে নিলাম। একটা নতুন অনুভূতিতে আমার সমস্ত শরীর শিহরিত হলো। আমি আবেগজড়িত কণ্ঠে দীপ্তিকে ডাক দিলাম, দীপ্তি!

হয়তো দীপ্তির সমস্ত শরীরেও একই অনুভূতি, শরীরের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেছে, সে আবেগে দু’চোখ বন্ধ করে বলল, হুঁ।

আমি দীপ্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।

দীপ্তি চোখ বুজে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে এমনিভাবে সারাজীবন ভালোবাসবে তো?

অবশ্যই।

এমনিভাবে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, একই কথা বার বার আর ভালোবাসি, ভালোবাসি কথার পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে কথা বলতে বলতে কখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে কারো খেয়াল নেই, পাখিরা যখন নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে তখন আমি দীপ্তিকে বললাম, এই চলো, চলো বেলা ডুবে যাচ্ছে তো।

দীপ্তি পরম নির্ভরতায় আমার গায়ে নিজের শরীর এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল আমার তাড়াহুড়োয় একরকম চমকে উঠল, কী বলো এত তাড়াতাড়ি।

হ্যাঁ চলো।

আরেকটু থাকি।

না, না, সন্ধ্যা হয়ে গেল, বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসতে হবে। তাছাড়া তোমাকেও তো বাড়িতে খুঁজবে।

দীপ্তি বিরক্তির সুরে বলল, উফ্‌, সময়টা কেনো একেবারে জল্লাদের মতো, দু’জনকে আলাদা করার জন্য ঘড়ির কাঁটা নিজ হাতে দ্রুত ঘুরিয়ে দেয়, বলে দীপ্তি উঠে বসল।

সেদিন বাড়িতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে দেখে বাড়িতে দীপ্তিকে তার মা অনেক বকাবকি করেছে। শুধু তাই নয় আমার সঙ্গে দীপ্তির সম্পর্কের বিষয়টিও গ্রামে কানাঘুঁষা শুরু হয়েছে, পরদিন স্কুলে এসে আড়ালে ডেকে নিয়ে আমাকে জানালো দীপ্তি। বিষয়টা এপর্যন্তই শেষ হলে ভালো হতো কিন্তু দীপ্তি আমার সাইকেলে চড়ে স্কুল যায়, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় এর সঙ্গে আরো কিছু মুখরোচক কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল।

সম্মান মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য, দীপ্তির স্কুল যাওয়া বন্ধ হলো, আমার সঙ্গে দেখা করো বন্ধ হলো, দীপ্তির সঙ্গে দেখা করতে না পেরে আমি সবসময় ছটফট করতাম, আমার সবসময় মনে হতো আমার কী যেন নেই, আমার সবসময় মনে হতো, আমি শূন্য, আমি রিক্ত। আমার ধারণা ছিল এটা সাময়িক, কয়েকদিন পর হয়তো দীপ্তি আবার স্কুল যাবে, আবার আমাদের দেখা হবে কিন্তু তা হলো না। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। একদিন এলো সেই নিষ্ঠুর দুঃসংবাদ।

কয়েকদিন দীপ্তির সঙ্গে দেখা হয়নি, কথা হয়নি, আমার মাঝে অনেক অজানা দুশ্চিন্তা ভর করছিল। একবার আয়নার সামনে গিয়ে দেখলাম আমারও চোখের গোড়া কালো হয়ে গেছে, সদ্য গজানো গোঁফ-দাড়িতে মুখ ভরে গেছে, সেদিকে আমার খেয়াল নেই। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আমার এই অবস্থা দেখে দেবদাস বলে তিরস্কার করতে লাগল। আমি দেবদাস নাম শুনেছি, ব্যর্থ প্রেমিকদের দেবদাস বলে সবাই তিরস্কার করে এটাও জানি, আমি নিজেও ততদিনে অনেক উপন্যাস পড়েছি কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দেবদাস উপন্যাসটা তখনো পড়া হয়নি।

দীপ্তি আমাকে যে প্যাকেটটা দিয়েছিল সেটা দেখা হয়নি। প্যাকেট দেওয়ার পর কয়েকদিন দীপ্তি জিজ্ঞেস করেছে, প্যাকেটটা খুলেছি কী না। তার দেওয়া প্যাকেট খুলেও দেখিনি শুনে দীপ্তি অভিমান করেছে, অনেক রাগারাগিও করেছে, তোমাকেই আমি দেখলাম একটা ইট, কাঠের মতো কাঠখোট্টা মানুষ, প্রিয়জনদের কোনো গিফট পেলে মানুষ এক সেকেন্ডও দেরি না করে প্যাকেট খুলে দেখে, বুকে জড়িয়ে ধরে আর তুমি!

আসলে দীপ্তি ঠিকই বলেছে, আমারও দীপ্তির দেওয়া প্যাকেট খুলে তার উপহার বুকে জড়িয়ে ধরা উচিত ছিল কিন্তু সেদিনের পর থেকে একের পর এক ঝামেলা চলছে, সেটা দীপ্তি আর আমাকে নিয়েই। আমি প্যাকেটটা খুলে দেখি দীপ্তি দেবদাস উপন্যাসটাই আমাকে গিফট করেছে। একি আজব ঘটনা। দীপ্তি কীভাবে জানলো যে আমাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হবে আর আমি দেবদাস হয়ে যাবো। আমি উপন্যাসটা পড়তে শুরু করলাম। অসাধারণ একটা উপন্যাস, যেন আমার আর দীপ্তির মতো। পার্বতীর বিয়ে হয়েছে, পার্বতীর জন্য দেবদাসের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রতিটি পাতা আমি পড়ছি দীর্ঘশ্বাসে আর বালিশ ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে, আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। স্রষ্টার কী লীলাখেলা, আমি দীপ্তিকে দিলাম শাপমোচন উপন্যাস, উপন্যাসের নায়িকা নায়ক মহেন্দ্র’র জন্য অপেক্ষা করছে অথচ মহেন্দ্র মারা গেছে আবার পারু তার ভালোবাসাকে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে আর দেবদাস মরছে মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে।

দীপ্তির বিয়ে হওয়ার সেই দুঃসংবাদটি এলো, শোনার সঙ্গে আমার হৃদয় ভেঙে গেল, চোখ দুটো যেন ঝাপসা হয়ে গেল, মনে হলো আমি আজ সব হারিয়ে ফেললাম। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। সেদিনের সেই স্মৃতি আমার বুকে আজও দাগ হয়ে আছে।

দীপ্তির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কয়েক মাসের বলা যায়, তাতেই দীপ্তিকে হারানোর বেদনায় আর আমার হৃদয় ভেঙে গেছে অথচ আয়েশার সঙ্গে প্রবালের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, প্রবাল ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে দিলে মেয়েটা…ভাবতে ভাবতে শাহাদত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন।

আলেমা একরকম চমকে উঠল, তুমি ঘুমাওনি?

ঘুমিয়েছিলাম, আজকাল বার বার ঘুম ভেঙে যায়।

তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে টেনশন করছো?

টেনশনের কী আর শেষ আছে।

তুমি এভাবে বলছ কেনো, আমাদের কীসের টেনশন, খাওয়া-দাওয়ার অভাব নেই, টাকা-পয়সার অভাব নেই।

শুধু খাওয়া-দাওয়া আর টাকা-পয়সা থাকলেই টেনশন থাকে না।

আমাকে বলো তুমি কি নিয়ে এতো টেনশন করছো?

ভাবছি আয়েশার কথা, মেয়েটার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ও ধরে আছে ঐ ছেলেকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আমাদের বংশের একটা মান-মর্যাদা আছে। আচ্ছা তুমি বলো শফি হাজিকে কি কেউ ভালো বলে। সবাই বলে মুক্তিযুদ্ধের আগে ওদের কিছু ছিল না। তখন শফি হাজি পানের দোকান করত। সবাই তখন তাকে শফি পানুয়া বলতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেল যে শফি পানুয়া টাকাওয়ালা হয়ে গেল।

তাই বলে তো শফি হাজি রাজাকার ছিল বা কারো বাড়িঘর লুটপাট করেছে এমনও তো কোনো প্রমাণ নেই।

আচ্ছা ধরে নিলাম শফি হাজি রাজাকার ছিল না, সে কারো বাড়িঘর লুটপাট করেনি কিন্তু আমি, এই আমি বলতে বলতে শাহাদত সাহেব বিছানায় উঠে বসল, এই আমি ত্যাগী শাহাদত, মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত শফি পানুয়াকে বিহাই বলে ডাকবো।

আমি তোমার সঙ্গে যুক্তিতর্কে পারবো না স্বাধীনের বাবা। তবে আমি এতদিন জানতাম তুমি সব মানুষকে সমান চোখে দেখো, ধনী-গরীব, জাত-বংশ বাছ বিচার করো না কিন্তু এখন দেখছি…

ছেলেটাও তো বেকার স্বাধীনের মা।

শেষ পর্যন্ত চাকরি না হলে ব্যবসা করবে। তুমি আমার মেয়েটার দিকে একবার দেখবে না? মেয়েটার বয়স হচ্ছে, চাকরি হলো কিন্তু ঐ ছেলেকে ছাড়া ও বিয়েই করবে না। তুমি বলো প্রেম করার আগে কি কেউ কারো বায়োডাটা নিয়ে প্রেম করে। এখন মেয়েটা ওর সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়েছে, এখন চাইলেই কি ও সহজে ঐ ছেলেকে ভুলতে পারবে?

স্বাধীন সবার বড় সন্তান, স্বাধীনের জন্মের পর থেকে আলেমা শাহাদত সাহেবকে স্বাধীনের বাবা বলে ডাকতো, শাহাদত সাহেবও আদর করে আলেমাকে স্বাধীনের মা বলে ডাকতেন। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর থেকে আর স্বাধীনের মা বলে ডাকেন না। দীর্ঘদিন পর আজ আবার স্বাধীনের মা বলে ডাকায় আলেমা খুশি হলো।

শাহাদত সাহেব বললেন, এই যে তুমি বলছিলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই এখন বুঝতে পাচ্ছ কতবড় সমস্যা। আসলে কোনো সমস্যাই ছোট না।

এদিক দিয়ে আবার বিপ্লবের কোনো ঝামেলা নেই।

ওর আবার আরেক ঝামেলা আছে।

আলেমা কৌতূহলী দৃষ্টিতে শাহাদত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বিপ্লবের আবার কী ঝামেলা?

এই তো কয়েকদিন আগে ব্যবসা শুরু করলো, এত তাড়াতাড়ি গাড়ি, টাকা-পয়সা দেখে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে। কোনোদিন আবার ওর কোন কেলেঙ্কারি হয়।

আলেমা ঝাঁঝালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো, তোমার তো সবটাতেই সমস্যা। যখন বেকার ছিল তখন এক সমস্যা আবার এখন ভালো ব্যবসা করছে এখন আরেক সমস্যা।

ব্যবসা করলে তো সমস্যা ছিল না কিন্তু ব্যবসার বাইরে কিংবা ব্যবসার নাম করে কিছু করে বলেই তো আমার মনে হচ্ছে তাই তোমাকে…

আলেমা শাহাদত সাহেবের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, থাকো তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না, এখন ঘুমাও। আমি তোমার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছি, বলে আলেমা শাহাদত সাহেবের চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।

 

ষোলো

 

শাহাদত সাহেব সন্ধ্যায় চেম্বার শেষ করে বাসার ভিতরে ঢুকলেন। স্বাধীন ক্লিনিক থেকে রোগী দেখা শেষ করে বাসায় ফিরেছে। সাধারণত এত আগে স্বাধীন কোনোদিন বাসায় ফেরে না। শাহাদত সাহেব বাসায় ঢুকেই দেখলেন ড্রয়িং রুমে সোফায় স্বাধীন, বিপ্লবী বসে আছে। শাহাদত সাহেবকে ঢুকতে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো।

তাকে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে দেখে আলেমা এলো, আয়েশাও এলো। শাহাদত সাহেব একবার পুরো ড্রয়িং রুম চোখ বোলালেন, কী খবর সবাই?

স্বাধীন আমতা আমতা করে বলল, না বাবা, এমনিতেই।

শাহাদত সাহেব বুঝতে পারলেন কিছু বলার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে কিন্তু স্বাধীন যখন বলল এমনিতেই তখন তিনিও আর ড্রয়িং রুমে ইচ্ছা করে দেরি করলেন না, ও আচ্ছা বলে তিনি তার বেড রুমের দিকে পা বাড়ালেন।

অগত্যা স্বাধীন মিনমিন করে বলল, বাবা।

শাহাদত সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন, কী? কিছু বলবি?

বাবা, একটু বসবে আমাদের সাথে।

শাহাদত সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। একটা সোফায় বসলেন, তোরা কিছু বলবি এটা আমি আগেই বুঝছি, কী হয়েছে?

স্বাধীন বিপ্লবীকে কিছু বলার জন্য ইশারা করলো।

বিপ্লবী না সূচক মাথা নাড়লো।

শাহাদত সাহেব দু’জনের ইশারায় কথা বলা দেখে বললেন, আচ্ছা স্বাধীন তুই বল, কিছু বলবি

বাবা সবাই চাইনিজ খেতে গিয়ে বিপ্লবের জন্য একটা মেয়ে দেখেছে।

শাহাদত সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, চাইনিজ খেতে গিয়ে মেয়ে দেখেছে নাকি মেয়ে দেখার জন্য চাইনিজে গেছে?

ততক্ষণে আলেমা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, যাই হোক মেয়ে দেখেছে এটাই যথেষ্ট। তুমি আবার এতো প্যাঁচ ধরেছ কেনো?

ও তুমিও হাজির। আচ্ছা স্বাধীন বল, তারপর কী হলো?

মেয়েটা শিক্ষিত, বংশ বুনিয়াদ ভালো, বলে স্বাধীন মেয়ের বাবার বাড়ির বংশ বুনিয়াদের বিবরণ দিল।

সবকিছু শুনে শাহাদত সাহেব বললেন, বংশ বুনিয়াদ তো ভালোই দেখছি।

এবার বিপ্লবী কথা বলতে শুরু করলো, বাবা মেয়েটা দেখতেও খুব সুন্দর। দেখলে তোমার খুব পছন্দ হবে, বিপ্লবের সঙ্গে মানাবেও ভালো।

বিপ্লব দেখেছে?

স্বাধীন বলল, জি বাবা।

তুই দেখেছিস? শাহাদত সাহেব স্বাধীনকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি কনে হিসেবে দেখিনি বাবা, তবে আমি ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার, সে হিসেবে দেখেছি।

শাহাদত সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে আলেমার দিকে মুখ করে বললেন, ঘষেটি বেগম।

আলেমা আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠল, ঘষেটি বেগম বলে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেনো? আমি কি ষড়যন্ত্র করলাম?

আচ্ছা যাক, তোমাদের সবার যখন পছন্দ তাহলে আমার আর কোনো আপত্তি নেই। আলোচনা চালিয়ে যাও।

আলেমা জিজ্ঞেস করলো, আর আয়েশার বিয়ের কী হবে?

শাহাদত সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠল, তিনি চশমা পরে মোবাইল ফোন চোখের কাছে নিয়ে দেখলেন। আড্ডার এক সদস্য ফোন করেছে। তিনি ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে তিনি কানের কাছে কয়েকসেকেন্ড মোবাইল ফোন ধরে রাখলেন, তার চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে উঠল, ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে একটু শব্দ করেই বললেন, ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।

সবাই শাহাদত সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। স্বাধীন উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, কে মারা গেছে বাবা?

শাহাদত সাহেব মোবাইল ফোন কানের কাছ থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে বললেন, আহসান সাহেব, আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। বাসায় মরে পড়ে আছে, টিভিতে নাকি দেখাচ্ছে বলে শাহাদত সাহেব আয়েশাকে বললেন, তুই টিভিটা চালু করত মা বলে তিনি সোফা থেকে উঠছিলেন। আয়েশা বলল, বাবা টিভি দেখতে যেতে হবে না, আমি লাইভে দেখাচ্ছি তোমাকে।

আয়েশা ফেসবুকে লাইভ দিয়ে বাবার কাছে মোবাইল ফোন দিল।

শাহাদত সাহেব নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। চোখের সামনে ভেসে উঠল, দিনাজপুরে নিজ বাসভবন থেকে আহসান হাবীব নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার।

শাহাদত সাহেব আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, বুঝলাম না। লাশ উদ্ধার, ডিটেইলস তো চলে গেছে।

আয়েশা বলল, বাবা মোবাইলটা আমাকে দাও, আমার মনে হয় ফেসবুকে পাওয়া যাবে।

শাহাদত সাহেব মোবাইল ফোনটা আয়েশার হাতে দিলেন। আয়েশা ফেসবুকে লগ ইন করতেই টাইমলাইনে ভেসে উঠল বিভিন্ন পত্রিকার নিউজ, দিনাজপুরে নিজ বাসভবন থেকে আহসান হাবীব নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার। সকাল সাতটায় বাসার কাজের মেয়ে দরজায় ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পেয়ে বাসার অন্যান্য ভাড়াটেদের খবর দেয়। বাসা ভিতর থেকে বন্ধ থাকায় এবং অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলায় পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে বিছানায় আহসান হাবীবের লাশ পেয়ে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে, আহসান হাবীবের এক ছেলে এক মেয়ে দীর্ঘ দিন থেকে কানাডায় বসবাস করে এবং কিছুদিন আগে স্ত্রীও কানাডায় চলে গেছে। বাসায় তিনি একাই থাকতেন।

নিউজটা পড়ে শাহাদত সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বললেন, কী লাভ হলো এতো ধন-সম্পদ দিয়ে, শেষ পর্যন্ত তো একাই যেতে হলো, যাদের জন্য আহসান সাহেব এতো কিছু করলো তারাও মৃত্যুর সময় কাছে থাকলো না।

কিছুক্ষণের জন্য আলোচনায় যেন শোকের ছায়া নামলো। বিপ্লব আর আয়েশার বিয়ের আলাপ এ পর্যন্তই থেমে গেল। শাহাদত সাহেব বললেন, তোরা সবাই যার যার রুমে যা। আমি খোঁজখবর নিই, কবে কোথায় দাফন হবে? নিজের বলে তো আহসান সাহেবের কেউ নেই, ছেলেমেয়ে, বউ সবাই কানাডায়। ওদের খবর দেওয়া হয়েছে কী না?

শাহাদত সাহেব মোবাইল করলেন। ওপর পাশ থেকে রিসিভ করেছেন মল্লিক সাহেব, হ্যালো উকিল সাহেব।

শাহাদত সাহেব বললেন, মল্লিক সাহেব আহসান সাহেব তো আপনার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আমারও ছিলাম কিন্তু জানেনই তো আমি তেমন আড্ডায় যেতে পারতাম না। আচ্ছা আহসান সাহেবের ছেলেমেয়ে, বউকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ দেওয়া হয়েছে।

জানাজা কি ওরা আসার পর হবে?

না। আহসান সাহেবের মারা যাওয়ার খবর শুনে গ্রাম থেকে তার ভাইবোনরা এসেছে। তারপর কানাডায় আহসান সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো।

তারপর?

ওরা মনে হয় আসবে না।

স্বামী মারা যাওয়ার কথা শুনে স্ত্রী আসবে না, বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনে ছেলেমেয়েরা আসবে না?

কী আর বলবো উকিল সাহেব। আমি বিষয়টা জানি বলে আপনাকে বললাম। আহসান সাহেব সবার জন্য কষ্ট করেছেন কিন্তু ভোগ করতে পারলেন না। যারা তার সম্পদ ভোগ করছে মৃত্যুকালে তারা মুখে একফোঁটা পানিও দিতে পারল না। এমনকি মাটি দিতেও এলো না।

তাহলে ময়না তদন্তের পর লাশ ফেরত দিবে তারপর গ্রামের বাড়িতে দাফন হবে।

জি। আপনি ঠিক বলেছেন।

আচ্ছা। তাহলে কাল বিকেলের আগে দাফন হবে না। আমিও আসছি কালকে।

জি অবশ্যই। আমি আপনাকে খবর দিব।

আচ্ছা বলে শাহাদত সাহেব মোবাইল ফোন রেখে আপনমনে বললেন, ছেলেমেয়েদের কোটি কোটি টাকা দিয়ে কী লাভ হলো তারচেয়ে আহসান সাহেব যদি ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতো তবে মৃত্যুটাও সম্মানের সঙ্গে হতো, ছেলেমেয়েদের হাতে মাটিও পেতো। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

 

সতেরো

 

কোনো ভালো মানুষের বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্র হয় তখন ষড়যন্ত্রকারীরা একত্রিত হয় আর অন্য ভালো মানুষরা দেখে চুক চুক করে আফসোস করে সমবেদনা জানায়। সমবেদনা ষড়যন্ত্রের শিকার মানুষকে সান্ত্বনা জোগায় বটে কিন্তু ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে পারে না। মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে তেমন কোনো উন্নতি দেখা গেলো না। পরবর্তী মিটিংয়ে যখন অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো তখন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষক প্রতিনিধি, গভর্নিং কমিটির সদস্য এবং ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিল।

একদল বলল, ত্যাগী ঠিকই করেছে, মাস্টাররা যদি স্কুলে আসতে দেরি করে তবে ছাত্র-ছাত্রীরা সময়ানুবর্তিতা শিখবে কী করে, আগে ঠিক হতে হবে মাস্টারদের তারপর না ঠিক হবে ছাত্র-ছাত্রীরা, ত্যাগীকে ধন্যবাদ এবার যদি মাস্টাররা ভালো হয়।

আরেকদল প্রকাশ্য সেই অনিয়মিত শিক্ষকদের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলো, মাস্টারি চাকরিতে কয় টাকাই বা বেতন, চাকরির বাইরে কেউ যদি কিছু না করে তবে মাস্টারদের সংসার চলবে কী করে? চাকরির পাশাপাশি কেউ ব্যবসা করে, কেউ কৃষিকাজ করে বলে মাঝে মাঝে স্কুল যেতে দেরি হয়, এটা আর এমনকি। এই ত্যাগী স্কুলের সভাপতি হয়ে যত্তসব গন্ডগোল শুরু হলো। হেডমাস্টার যে কেনো ত্যাগীকে সভাপতি বানালো।

স্কুলকে কেন্দ্র করে শাহাদত সাহেবকে নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র তৈরি হলো। এই ষড়যন্ত্রে প্রধান শিক্ষকের অবস্থা হলো ধরি মাছ না ছুঁই পানি। সে সবার সামনে এমন একটা ভাব দেখালো যে, স্কুলের জন্য, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার জন্য সে জীবন দিতেও প্রস্তুত কিন্তু নেপথ্যে কলকাঠিতেও তার ভূমিকা সরব। শাহাদত সাহেবকে সভাপতি হিসেবে নিয়ে আসায় তার ভূমিকাই ছিল বেশি কিন্তু শাহাদত সাহেব আসার পরে সে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে।

কমিটির মেয়াদ আর কয়েকমাস আছে। কমিটির আগের সভাপতি কামরান সাহেব আবারো সভাপতি হওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে। সেই অনিয়মিত দুই শিক্ষক ভর করেছে তার ওপর, তারা কামরান সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলের বর্তমান অবস্থা এবং তাদের ওপর সভাপতি ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করলো। একে তো নাচনি বুড়ি তার ওপর ঢোলের বাড়ি। সব শুনে কামরান সাহেব বলল, এজন্যই তো বলে বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। আমি যখন সভাপতি ছিলাম তখন মনে হতো আমি বুঝি সবচেয়ে খারাপ মানুষ। এখন বুঝছেন তো, আরে ভাই আজকাল যে জিনিসপত্রের দাম শুধু মাস্টারি করে কি সংসার চলবে, দুয়েকজন মাস্টার না হয় ব্যবসা করে বলে এক আধ দিন দেরিতে স্কুল আসে তাই বলে হৈ চৈ করলে তো হবে না। অন্য মাস্টারদের নিয়ে চালিয়ে নিতে হবে।

কবির সাহেব বলল, আপনি আবার সভাপতি হোন কামরান ভাই। আপনি এলে সবাই খুব খুশি হবে।

আরে আমি তো থাকতেই চেয়েছিলাম, সমস্যাটা হয়েছে আপনাদের হেড মাস্টারকে নিয়ে। উনি কী যে বুঝলেন উকিল সাহেবকে সভাপতি বানালেন। মানছি উকিল সাহেব ভালো মানুষ কিন্তু শুধু ভালো হলেই তো হবে না। সবার সুখ-দুঃখ বুঝতে হবে।

মুজাহিদ সাহেব বলল, এখন হেড মাস্টারও পোস্তাচ্ছে সেজন্য। হেড মাস্টারও খুব সমস্যায় আছে, শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না। হাজার হলেও উকিল সাহেবকে সবাই খুব সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে।

একজন ভালো মানুষ হিসেবে আমিও উনাকে শ্রদ্ধা করি, উনি উনার সম্মান, শ্রদ্ধা নিয়েই থাকুন, কেনো যে উনি হঠাৎ করে সভাপতি হলেন। আমার মনে হয় উনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না, হেডমাস্টারই উনাকে ধরে নিয়ে এসেছে।

কবির সাহেব বলল, আপনি ঠিক বলেছেন ভাই কিন্তু এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে এখন কোনোভাবে উনাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে।

আচ্ছা আপনারা সহযোগিতা করেন আমি যেন আবার সভাপতি হতে পারি।

আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করবো ভাই। প্রয়োজনবোধে নিজেরাও কাজ করবো, মুজাহিদ সাহেব বলল।

স্কুলে শাহাদত সাহেবের বিরুদ্ধে কেমন একটা চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কেনো তা তিনি জানেন না কিন্তু তিনি এটা জানেন যে, অধিকাংশ শিক্ষক, কমিটির সদস্যগণ, এলাকার মানুষ সবাই তাকে খুব পছন্দ করে। স্বার্থান্বেষী কিছু শিক্ষক, শাহাদত সাহেব যাদের স্কুল ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করেছিলেন, তারা শাহাদত সাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তারা সংখ্যায় কম হলেও বেশ সুসংগঠিত এবং পরিকল্পিত আর নেপথ্য থেকে সাবেক সভাপতি যেন ভস্মে ঘি ছিটাতে শুরু করলো।

স্কুলের মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ের আলোচনা গতানুগতিক তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা নেই। শাহাদত সাহেব এই কয়েকবছরে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করে মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেছেন। বেশিরভাগ মানুষের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন সামান্য কয়েকজন স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন। সেদিন মিটিং শেষে তিনি যখন বারান্দা দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসছেন তখন শিক্ষক কমনরুম থেকে একটা কথা তার কানে ভেসে এলো, কথাটা খুব সম্ভব মুজাহিদ সাহেবের, আর ক’টা দিন কষ্ট করে কাটাতে পারলেই হয়, ত্যাগীর তো এবারই শেষ।

শাহাদত সাহেব কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়লেন, তিনি মনে খুব কষ্ট পেলেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে থাকার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এরচেয়ে অনেক বড় বড় পদে কাজ করার তার সুযোগ এসেছিল কিন্তু এসব তিনি পছন্দ করেন না। এলাকার কিছু হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ, তার কিছু বন্ধু-বান্ধব স্কুলের লেখাপড়ার মান, স্কুলের উন্নয়নের জন্য তাকে সভাপতি হওয়ার অনুরোধ করায় তিনি সম্মত হয়েছিলেন। তখন সভাপতি কামরান সাহেব। স্কুলের লেখাপড়ার মান বলে কিছু ছিল না। শিক্ষকদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলে কিছু ছিল না। যে শিক্ষক যখন ইচ্ছা আসতো, যখন ইচ্ছা চলে যেতো। তখন হেড মাস্টারকে কেউ গুরুত্ব দিতো না। সেজন্য সেসময় হেড মাস্টারও তাকে সভাপতি করার জন্য আগ্রহী ছিলেন কিন্তু তিনি সভাপতি হওয়ার পর হেড মাস্টারেরও কিছু স্বার্থহানি হয়েছে। স্কুলের বিভিন্ন ফান্ড নিয়ে আগে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না, শাহাদত সাহেব সভাপতি হওয়ার পর স্কুলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা শুরু হয়েছে। তাতে করে হেড মাস্টার নিজেও অসন’ষ্ট হয়েছে।

এই গেট, সীমানা প্রাচীর স্কুলের উন্নয়ন ফান্ডের টাকা দিয়ে তার সময় হয়েছে, বিল্ডিংয়ের বাইরের দেয়াল প্লাস্টার এবং ওয়েদারকোটও তার সময় হয়েছে। স্কুলের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা লেখাপড়ার গুণগত মান তিনি সর্বচ্চ্য পর্যায়ে উন্নীত করেছেন কিন্তু এখন স্কুলে তাকে নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তাতে তিনি খুব মর্মাহত হয়েছেন। অথচ সবাই তারই কোনো না কোনোভাবে আত্মীয়। এমন এক সমাজ তৈরি হয়েছে যেখানে রক্ত কিংবা আত্মার সম্পর্ক মূল্যহীন শুধু স্বার্থের সম্পর্কই সম্পর্ক।

শাহাদত সাহেবের মনে হলো আগামীতে তিনি আর সভাপতি হবেন না, যে যতই অনুরোধ করুক না কেনো। সময় থাকতে সম্মানের সঙ্গে এই স্কুলের সভাপতি পদটা ছেড়ে দিতে পারলেই হয়। শাহাদত সাহেব স্কুল থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে একবার তাকালেন। এই স্কুলে তিনি একটা ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক এমনকি স্কুলের প্রতিটি অংশের সঙ্গে একটা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এই স্কুলে তিনি আর সভাপতি থাকবেন না বা এই স্কুলে তার মেয়াদ শেষ হলে তিনি আর আসবেন না এটা ভাবতেই তার দুচোখ পানিতে ছলছল করে উঠল।

স্কুল থেকে বেরিয়ে শাহাদত সাহেব সহিদুল্লাহ’র দোকানের সামনে আসতেই সহিদুল্লা একটা হাসি দিয়ে বলল, দোস্ত আইসেক, ভিতরত আইসেক।

শাহাদত সাহেব বললেন, নারে বসিবে নাহাঁও।

আইসেক, আইসেক বইস। আর কয়টা দিন আছি। সময় তো হই গেল, কোনোদিন আসি দেখিবু মুঁই আর নাই। তখন কেহ তোক বসিবা কহিবে নাহাঁয়, সহিদুল্লাহ খুব সাধারণভাবে কথাগুলো বলল।

শাহাদত সাহেব দোকানে ভিতরে ঢুকলেন। সহিদুল্লাহ আপনমনে বলল, তুই তো আবার পান খাইস না। তোক মুঁই এখন কী খিলাম বলে সহিদুল্লাহ পাশের দোকান থেকে দু’টা লাল চা আনালো।

সহিদুল্লাহ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোর স্কুলত কেনবা গণ্ডগোল শুনেছঁ।

কী শুনেছি?

যেগুলো মাস্টার স্কুলে ঠিকমতো আইসে না, পড়ায় সেগুলো মাস্টার তোর উপরত ক্ষেপি গেইছে।

ক্ষেপি গেইলে কী করিবা কহেছি?

ওরা স্কুলটাক ভালোমতো চালাবা চাহে না। ওরা চাহেছে যেমন-তেমন কেউ একজন সভাপতি হউক আর ওরা যার ব্যবসা আছে ব্যবসা করিবি, যার প্রাইভেট আছে ওয় প্রাইভেট পড়াবি। মাস্টাররা যদি এরকম হয় তাহেলে দেশটাত কেমন করি ভালো মানুষ তৈরি হবি।

হ্যাঁ। মুঁইও একনা সেইরকম বুঝা পানু। মুঁই আর এগুলোর মধ্যে নাহি। এখন মান-সম্মান নি চলি যাবা পারিলে বাঁচো।

তুই যাবে নাহাইস, তুই গেইলে স্কুলটা আবার নষ্ট হই যাবি।

শাহাদত সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আলেমা ফোন করেছে, সাধারণত শাহাদত সাহেব বাইরে থাকলে খুব জরুরি কোনো খবর না থাকলে আলেমা ফোন করে না।

শাহাদত সাহেব ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো তারপর কয়েকসেকেন্ড কানের কাছে ফোন ধরে রেখে ফিসফিস করে বললেন, ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন।

সহিদুল্লাহ শাহাদত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী রে কুনো খারাপ খবর?

শাহাদত সাহেব বললেন, দোস্ত, মোক একনা উঠিবা হবি। আইজ আসি, হ্যাঁ।

আচ্ছা। ভালোভাবে যাইস।

 

আঠারো

 

সেদিন বিপ্লব আর আয়েশার বিয়ের আলোচনা থেমে যাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আর পারিবারিকভাবে আলোচনা হয়নি। কয়েকদিন পর মোস্তাক ইন্ডিয়া থেকে ঢাকায় ফিরেছে, বিপ্লবীও ঢাকায় চলে গেছে। বিপ্লবের বিয়ে নিয়ে তার নিজের কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বিপ্লবের বিয়ের বিষয়ে শাহাদত সাহেবেরও কোনো আপত্তি নেই। এতদিন সমস্যা ছিল আয়েশার বিয়ে নিয়ে, শাহাদত সাহেব বরাবরই বলতেন, প্রবালের সঙ্গে আয়েশার বিয়ে হলে শফি পানুয়াকে আমাকে বিহাই বলে ডাকতে হবে যেটা তার জন্য অপমানজনক। শাহাদত সাহেবের এই সমস্যার সমাধান হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে।

শাহাদত সাহেব বাসার কলিং বেলে টিপ দিতেই আলেমা দরজা খুলে দিল। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল?

জানি না, প্রবাল আয়েশাকে ফোন করেছিল, শুনে আয়েশা খুব কান্নাকাটি করছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম তখন বলল প্রবালের বাবা মারা গেছে।

আয়েশা এখন কোথায়?

ওর রুমে, শুয়ে আছে।

শাহাদত সাহেব ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে জোরে আয়েশা আয়েশা করে ডাক দিলেন।

আয়েশা এলো। তার চুলগুলো এলোমেলো, গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জলের স্পষ্ট আভা তখনো বিদ্যমান। আয়েশা শাহাদত সাহেবের পাশে বসল। শাহাদত সাহেব আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, মানুষের মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই মা। দেখলি না কয়েকদিন আগে আহসান সাহেব মারা গেল আজ আবার শফি মারা গেল। কে কখন মারা যাবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারে না।

আয়েশা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্যই করে বাবা।

মানে?

তুমি তো উনাকে খুব খারাপ মানুষ জানতে বাবা, যাক খারাপ মানুষটাকে আল্লাহ নিয়ে গেছে।

এভাবে বলতে নেই মা। কেউ যতই খারাপ হোক মৃত্যু কামনা করতে নেই।

শাহাদত সাহেব আয়েশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেলেন, আয়েশা শুধু প্রবালকেই ভালোবাসেনি, হয়তো প্রবালদের বাড়িতে গেছে তাদের পরিবারের বউ হিসেবে, ঐ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।

শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, দেখ তো মা ভাত হলো নাকি, তোর মাকে ভাত দিতে বল।

আয়েশা চোখ মুছে উঠে ড্রয়িং রুমে গিয়ে জোরে ডাক দিল, বাবা ভাত রেডি।

অনেকদিন পর শাহাদত সাহেব এই ডাকটা শুনলেন। আয়েশা যখন ছোট ছিল তখন এমনিভাবে ডাক দিতো, সকালবেলা জোরে বলতো, বাবা নাস্তা রেডি, চলে এসো।

এটা যেন তার একটা ডিউটি ছিল, দুপুরে ভাত এবং রাতেও আলেমা ভাত রেডি করে টেবিলে দিলে আয়েশা ডাক দিতো, বাবা চলে এসো।

আজ দীর্ঘদিন পর আয়েশার সেই ডাক শুনে শাহাদত সাহেবের বুকটা ভরে গেল।

কয়েকদিন পরের কথা একদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে স্বাধীন কথা তুললো, বাবা তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

সংসারের ব্যাপারে স্বাধীন তেমন কোনো কথা বলে না আবার কখনো কথা বলার সময় তেমন ভণিতা করে না, যা বলার সোজাসুজি বলে, আজ হঠাৎ করে কিছু বলার আগে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করায় শাহাদত সাহেব কিছুটা অবাক হলেন, বল।

বাবা বিপ্লব আর আয়েশার বিয়ের আলোচনাটা তো সেসময় থেমে গেল, ওদের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি। কারো তো আর কোনোকিছু বাকি নেই। বিপ্লব ব্যবসা করছে, যে মেয়েটাকে আপনার বউমাসহ সবাই দেখে পছন্দ করেছে আমি যতদূর জানি মেয়ের বংশ বুনিয়াদও ভালো।

হ্যাঁ। ওদের ফ্যামিলি আমার আগের পরিচিত।

বাবা তাহলে তুমি যদি বলো তো আমি বিয়ের আয়োজন করি।

হ্যাঁ করতে পারিস।

বাবা আয়েশার বিষয়টায় তুমি যদি…আলেমা এতক্ষণ ছিল না, ডাইনিং টেবিলে খাবার দিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিল, স্বাধীনের কথা শেষ হওয়ার আগে ডাইনিংয়ে ঢুকলো।

শাহাদত সাহেব মুখ তুলে আলেমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘষেটি বেগম।

আলেমা ক্ষেপে গেল।

কেনো আমি আবার কী করলাম?

কী করোনি।

স্বাধীন থতমত খেলো, বাবা মা কিছু বলেনি। আমি নিজে থেকেই তোমার কাছে কথা তুললাম।

শাহাদত সাহেব কিছুটা সহজ হলেন। স্বাধীন আবার বলতে শুরু করলো, বাবা আমি জানি তুমি মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আয়েশা তোমার মেয়ে, তুমি ওর বিষয়টাকে মেনে নাও। তাছাড়া তুমি যেটা বলতে শফি পানুয়াকে তোমার বিহাই বলতে হবে। এখন তো আর শফি পানুয়া বেঁচে নেই।

মেয়েটা যে কোনো এমন ভুল করলো। কোনো সময় তো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলে না।

এখনো তো তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি, কিছু করেনি। আজকাল কত ঘটনা ঘটছে, ছেলেরা মা-বাবাকে না জানিয়ে বউ নিয়ে চলে আসছে, মেয়েরা ছেলেদের হাত ধরে চলে যাচ্ছে। আল্লাহর রহমতে আমার ছেলেমেয়েরা কেউ তেমন কিছু করেনি। সবাই আমাদের মান-সম্মান রেখেছে। মেয়েটা আমার সারাদিন মুখ কালো করে বসে থাকে, কাউকে কিছু বলে না, বলতে বলতে আলেমা কণ্ঠস্বর জড়িয়ে গেল।

ততক্ষণে শাহাদত সাহেবের খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, এই তো শুরু হলো।

প্রতিদিন রাতের খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বসে পারিবারিক বিষয়ে গল্প করেন, আজ আর বসলেন না। সোজা তার রুমে চলে গেলেন।

আলেমা স্বাধীনকে বলতে শুরু করলো, তুই সব ব্যবস্থা কর, আমার মনে হয় কিছু বলবে না, আর বললে বলবে। বিপ্লবের বয়স হয়েছে, ধরে নিলাম ছেলেমানুষের বয়সে কিছু যায় আসে না কিন্তু আয়েশার, আয়েশার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর, মেয়েদের ত্রিশ বছর বয়স অনেক।

এতক্ষণ রাজিয়া রান্নাঘরে ছিল। তার শ্বশুর ডাইনিং থেকে চলে গেছে দেখে সেও এসে জিজ্ঞেস করলো, কী বলল মা?

আলেমা ফিসফিস করে বলল, চুপ, চুপ করো বউমা। এমনিতেই তোমার শ্বশুর মনে করছে আমি সব ষড়যন্ত্র করছি। দেখ না আমার নাম দিয়েছে ঘষেটি বেগম।

সংসারের সমস্যা নিয়ে কথা বলা তো ষড়যন্ত্র না মা। আপনি যা করছেন তা তো সংসারের জন্য করছেন, সন্তানদের ভালোর জন্যই করছেন। আব্বা আপনাকে খুব ভালোবাসে তাই ক্ষেপানোর জন্য ঘষেটি বেগম বলে।

আয়েশাও রাজিয়ার সঙ্গে এসেছে, তার চোখে-মুখে কিছুটা দুশ্চিন্তার ছাপ, সে কিছু বলল না। স্বাধীন আয়েশাকে আশ্বস্ত করলো, কী রে মুড অফ কেনো?

আয়েশা মলিনমুখে বলল, কই, না তো ভাইয়া।

আমি বাবার সঙ্গে কথা বললাম। বাবাকে কিছুটা নরম মনে হলো, তুই কিছু ভাবিস না। আমি দেখছি কী করা যায় বলে সে মাকে বলল, মা তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলো। আমার মনে হয় বাবা না করবে না।

আলেমা বলল, এই লোকটাকে আমি জীবনে চিনলাম না কাজেই কী করবে আল্লাহই ভালো জানে।

আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিলে বাবা কিছু বলবে না মা।

রাজিয়া আয়েশাকে বলল, কী রে খুশি। বড়ভাই বাবার মতো, বড়ভাই দায়িত্ব নিয়েছে, সবাই মিলে আয়োজন করবে, মা কথা বলবে, তুই দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার একটু হাসবি তো।

আয়েশা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, ভাবী তুমি যা বলো না।

 

উনিশ

 

বিপ্লবের ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেছে। ইদানীং বিপ্লব বেলা এগারোটা বারোটার সময় বেরিয়ে যায়, সারাদিন ছুটোছুটি করে, গভীর রাতে ফিরে আসে। বেশ কিছুদিন থেকে শাহাদত সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি। শাহাদত সাহেব বিপ্লবের এই ব্যস্ততার কোনো কারণ খুঁজে পান না কিন্তু এমনিতেই তার কানে অনেক কথা আসে। শহরের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এমনকি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রক হিসেবেও শাহাদত সাহেবের কানে আসে। প্রথম প্রথম শাহাদত সাহেব বিশ্বাস করতেন না কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেই শোনাটা এতো বেশি হলো যে একসময় বিশ্বাস না করে আর উপায় থাকলো না।

একদিন রাতে শাহাদত সাহেব আলেমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিপ্লবকে অনেকদিন দেখি না। কখন যায়, কখন আসে ও?

সকালবেলা তুমি যখন কাচারি যাও তখন ও ঘুম থেকেই উঠে না আর তুমি যখন এক চমক ঘুমিয়ে থাকো তখন বাসায় আসে, তাই দেখা হয় না। কেনো ও আবার কী করলো?

কিছু করেছে কী না জানি না তবে শহরে অনেক কথাই কানে আসে।

কী কথা?

এই ব্যবসা সংক্রান্ত, টাকা-পয়সা সংক্রান্ত।

সব ছেলেমানুষের কোনো না কোনো নেশা থাকে। কারো টাকার নেশা, কারো যশ-খ্যাতির নেশা, কারো মেয়ের নেশা আরো কত কী যে থাকে, আমি অতোসতো বুঝি না। টাকা-পয়সার নেশাটা থাকা স্বাভাবিক, আমি বিপ্লবের মধ্যে এই নেশাটাই দেখি এটাতে আর খারাপ কী বড় হওয়ার নেশা কার না থাকে, আলেমা বলল।

বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকা ভালো কিন্তু নেশা থাকাটা ভালো না আলেমা। সৎভাবে অর্থ উপার্জন করে যত বড় হোক তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু সেটা যদি হয় অসৎ পথে তবে আমি খুব কষ্ট পাবো। তুমি জানো সৎ থাকবো, ভালো থাকবো, নীতি-নৈতিকতার সাথে জীবন-যাপন করবো বলে আমি একে একে তিনটা চাকরি ছেড়েছি।

তুমি অযথাই চিন্তা করছো। আমার বিপ্লব ওরকম না, আচ্ছা তুমি যখন বলছ আজ রাতে যখন ও আসবে তখন ওকে আমি বলে দিব কাল তোমার কাচারি নেই, কাল বের হওয়ার আগে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলবো। এখন তুমি ঘুমাও।

পরদিন সকালবেলা শাহাদত সাহেব বাসাতেই ছিলেন। তখন বেলা এগারোটা, বিপ্লব বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করলো, বাবা তুমি আমাকে দেখা করতে বলেছ?

শাহাদত সাহেব তখন ড্রয়িং রুমে বসে পেপার পড়ছিলেন। বিপ্লব ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই পেপারটা চোখের সামনে থেকে নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ বস।

বিপ্লব বসল।

শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আজকাল তোকে তো দেখাই যায় না, কখন বাসায় আসিস, কখন যাস।

বাবা আসলে ব্যবসা রাজনীতি এসব নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।

তোর ব্যবসা-রাজনীতি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আজকাল শহরে তোকে নিয়ে অনেক কথা কানে আসে।

বিপ্লব না বোঝার ভান করে বলল, কী রকম বাবা?

এই যে ব্যবসার নামে টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেট, রাজনীতির নামে তদ্বিরবাজি, বলে শাহাদত সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বিপ্লব মিনমিন করে বলল, বাবা আসলে ব্যবসা এবং রাজনীতিতে সফলতার জন্য আমার বয়সটা কম হয়ে গেছে। তাই অনেকেই মুখরোচক অনেক কথা বলে বেড়ায়, এসব কিছু না বাবা।

ব্যবসা-রাজনীতি দুটোতেই প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে, প্রতিযোগী থাকবে কিন্তু তাদের বানানো মুখরোচক কথাগুলো যেন সত্যি না হয়।

বিপ্লব বাবাকে আশ্বস্ত করলো, তুমি আমার ওপর ভরসা রাখ বাবা, আমি তোমার মান-সম্মানের কোনো ক্ষতি হতে দিব না।

আচ্ছা তাই যেন হয়।

বিপ্লব উঠে দাঁড়ালো, বাবা আমি আসি।

আচ্ছা আয়।

বিপ্লব বেরিয়ে গেল।

শাহাদত সাহেব আবার পত্রিকায় মনোযোগ দিলেন। আলেমা চা নিয়ে এলো। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ অসময়ে চা, একটু আগেই তো খেলাম।

আরেকবার খেলে কী হবে বলে আলেমা শাহাদত সাহেবের সামনে টেবিলে চা দিয়ে নিজেও একটা সোফায় বসলো।

শাহাদত সাহেব টেবিলে পেপার রেখে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, কোনো তদ্বির আছে?

আলেমা রেগে গেল, তোমার কাছে কিছু বলতে গেলেই সমস্যা। আগেই সব বুঝে ফেলো। আচ্ছা বলতো আমি কীসের তদ্বির করতে এসেছি।

শাহাদত সাহেব একটা মুচকি হাসি হেসে বললেন, তুমি ছেলেমেয়েদের বিয়ের বিষয়ে তদ্বির করতে এসেছো।

আলেমা হেসে ফেলল, তুমি ঠিক বলেছ কিন্তু কীভাবে বুঝলে বলতো।

আমি জানি তোমার এখন একটাই ইস্যু তাই অনুমান করে বললাম।

আচ্ছা স্বাধীনের আব্বা আমি বলি কি তুমি বিপ্লবের বিয়েটা দিয়ে দাও। তাহলে ও সংসারী হবে, বউ বার বার ফোন করবে তখন দেখ সবকিছুতেই একটা শৃঙ্খলা আসবে, একটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

আলেমা উঠে দাঁড়ালো। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, একটা তদ্বির তো করলে আরেকটা তো করলে না?

আরেকটা কি মেয়ের বিয়ে?

হ্যাঁ। মেয়ের বিয়ের তদ্বির করবে না?

না। তোমার মেয়ের বিয়ে তুমি যা করবে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। এটা তোমরা বাপ-মেয়ে বোঝো আমি শুধু চাই আমার মেয়ে যেন সুখে থাকে।

এটা আবার কোন চাইল খাটালে ঘষেটি বেগম।

খবরদার তুমি আমাকে ঘষেটি বেগম বলবে না। সংসারের কোনো বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলবো না। তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো, রাগান্বিতস্বরে কথাগুলো বলে আলেমা ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেল।

আলেমা বেরিয়ে যেতেই শাহাদত সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে মির্জাপুর হাই স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব সালাম দিল, চাচা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে সালামের জবাব দিয়ে শাহাদত সাহেব কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলেন তারপর বললেন, তাহলে ওকেই করো। তারপর আরো কিছুক্ষণ মোবাইল ফোন কানের কাছে ধরে রেখে বললেন, আচ্ছা তুমি এসো আমি করে দিব।

 

 

 

বিশ

 

কিছুদিন আগেও আয়েশার বিয়ের ব্যাপারে শাহাদত সাহেবের যে ঘোর আপত্তি ছিল সেটা এখন অনেকটা শিথিল হয়েছে। সবাই শাহাদত সাহেবের নীরবতায় সম্মতি আছে বলে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন শুরু করলো। বিয়ের সব দায়িত্ব শাহাদত সাহেব স্বাধীনের ওপর ছেড়ে দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো আগে বিপ্লব বউ নিয়ে আসবে পরদিন বউভাত তারপর দিন মেয়ের বিয়ে। বিয়ের কার্ড ছাপানোসহ মেয়েদের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের কেনাকাটার দায়িত্ব পড়ল রাজিয়া আর আয়েশার ওপর, কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া, বাবুর্চি ঠিক করা, কসাই ঠিক করা, বাড়িতে আলোকসজ্জা করার দায়িত্ব পড়ল বিপ্লবের ওপর, রাজনীতিতে অনেক বড় বড় আয়োজন করতে করতে বিপ্লব বেশ সিদ্ধহস্ত। হাতে মোবাইল ফোনটা থাকলেই ঘরে বসে সব আয়োজন করতে পারে। অতিথি তালিকা, অতিথিদের দাওয়াত কার্ড পৌঁছানোর দায়িত্বসহ পুরো দায়িত্বই স্বাধীনের।

ঢাকা থেকে মোস্তাক, বিপ্লবী এলো। দূরদূরান্তের আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করলো, বাড়ি মেহমানে গমগম করতে লাগল। অতিথিদের খাওয়া-থাকার বিষয়টি আলেমা দেখ তো। শাহাদত সাহেব প্রতিদিন রাতে সবার কাছে আপডেট নিয়ে ঘুমাতে যেতেন। মোস্তাকের সঙ্গে শাহাদত সাহেবের শেষ দেখা হয়েছে ঢাকায় যেদিন তিনি একরকম ঘৃণাভরে রাগ করে মোস্তাকের বাসা থেকে এসেছেন সেদিনই।

মোস্তাক আগেও শ্বশুরবাড়িতে এসেছে, শাহাদত সাহেবের সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছে কিন্তু এবার শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে কিছুটা সংকোচ করছে। সংকোচ করে অবশ্য কোনো উপায় নেই, একবার না একবার মুখোমুখি তো হতেই হবে। সেদিন বিকেলবেলা শাহাদত সাহেব ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন এমনসময় মোস্তাক ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, আব্বা আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

আব্বা কেমন আছেন আপনি?

ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছ বাবা?

জি আব্বা ভালো আছি।

শুনলাম তুমি নাকি ইন্ডিয়া ডাক্তার দেখাতে গেছিলে?

জি আব্বা।

কী সমস্যা একেবারে ইন্ডিয়ায় গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হলো।

তেমন কিছু না আব্বা। আসলে দেশে তো একেক ডায়াগোনিস্টিক সেন্টারে টেস্ট করলে একেকরকম রেজাল্ট আসে। ডাক্তাররা কখন কী বলে ভরসা পাওয়া যায় না। অনেক সময় ভুল চিকিৎসাও করে।

দেশে ভালো চিকিৎসা হয় না বলে সবাই যদি দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করে তবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করবে কে?

মোস্তাক এতক্ষণে বুঝতে পারলো তার শ্বশুর তার ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা করতে যাওয়াটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এই একই ভুল সে ঢাকাতেও করেছিল, সে ভেবেছিল তার ফ্ল্যাট কেনা এবং বিলাসবহুল জীবন-যাপনকে তার শ্বশুর সমর্থন করবেন কিন্তু সমর্থন তো করেনি বরং সেদিন থেকে মোস্তাক আর বিপ্লবীকে সেদিন থেকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে শুরু করেন। মোস্তাক তার শ্বশুরের কথার কোনো জবাব দিতে পারলো না, সে মাথা নত করে সোফায় বসে রইল।

আলেমা ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। সে মোস্তাকের অবস্থা দেখে পরিসি’তি কিছুটা আঁচ করতে পারলো। তাই সে মোস্তাককে বলল, জামাই তোমাকে বিপ্লবী খুঁজছে, তুমি একটু উপরে যাও বিপ্লবের রুমে।

মোস্তাক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে সোফা থেকে উঠে মিনমিন করে বলল, আব্বা আমি আসি।

আচ্ছা এসো।

মোস্তাক চলে যাওয়ার পর আলেমা জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী পেয়েছো বলতো।

কেনো, কী হয়েছে?

জামাইকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছ, নইলে এভাবে আসামির মতো বসে থাকবে কেনো?

সেজন্যই বুঝি তুমি মিথ্যা কথা বলে মোস্তাককে বিপ্লবী খুঁজছে বলে বের করে দিলে।

তা নয় তো কী। তোমার ভাগ্য ভালো যে জামাই এসেছে। নইলে তুমি যেভাবে জামাইকে অপমান করে ওদের বাড়ি থেকে চলে এসেছো অন্য কোনো জামাই হলে আসতো না। আবার এখানেও জেরা শুরু করেছ, যদি রাগ করে চলে যায়।

রাগ করার কী হলো, আমি তো শুধু বললাম এভাবে সবাই যদি চিকিৎসা করার জন্য দেশের বাইরে যায় তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করবে কে।

আলেমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুমি জামাইকে এভাবে বলেছ? ছি : ছি : জামাই কী মনে করবে।

আরে না কিচ্ছু মনে করবে না।

জামাই ভদ্র বলে হয়তো গায়ে মাখেনি। তুমি আর কখনো জামাইকে এভাবে বলবে না। দেশ উদ্ধারের দায়িত্ব তুমি নিয়েছ বেশ ভালো, সেটা তুমিই পালন করো। আর কাউকে দেশ উদ্ধারের জন্য ওকালতি করো না, টিটকারিও করো না।

দেশ উদ্ধার করার দায়িত্ব শুধু আমার না আলেমা, এটা দায়িত্ব সবার।

তাহলে তুমি দেশ উদ্ধারের দায়িত্ব অন্য সবাইকে দাও। আমার জামাইকে তুমি কিছু বলো না।

শাহাদত সাহেব আলেমার কথার প্রতুৎত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমনসময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন রিসিভ করলেন, হ্যালো।

চাচা আমি হেড মাস্টার।

হ্যাঁ। তোমার নাম্বার সেভ করা আছে। বলো কী খবর?

এই তো চাচা আপনার সাথে একবার দেখা করতে এসেছি।

কোথায় আছো এখন?

এই তো চাচা আপনার বাসার গেটে।

আচ্ছা ভিতরে চলে এসো।

হেড মাস্টার সাহেব ভিতরে এলো, আসসালামুয়ালাইকুম চাচা।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, বসে শাহাদত সাহেব পাশের সোফায় বসতে বললেন।

হেড মাস্টার সাহেব সোফায় বসল।

শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর বলো?

হেড মাস্টার সাহেব আমতা আমতা করে বলতে শুরু করলো। তার কথার বিষয়বস’ হলো স্কুলের কমিটির মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হবে। বিধি মোতাবেক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে হবে। কমিটির সাবেক সভাপতি আবার সভাপতি হওয়ার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছেন।

শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী ভাবছো?

আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই আপনি সভাপতি থাকুন। আপনি সভাপতি থাকলে স্কুলের লেখাপড়ার পরিবেশ, শিক্ষকদের পাঠদান এবং স্কুলের উন্নয়ন সব ঠিক থাকবে।

আসলে তোমরা সবাই জানো আমি নিরিবিলি চলা মানুষ। আমি আগেও কখনো চাইনি তোমার স্কুলের সভাপতি হতে, এলাকার সবাই ধরলো আমি সভাপতি হলে নাকি স্কুলের উন্নতি হবে। হয়েছে কী না তা তোমরা ভালো করেই জানো।

জি অনেক উন্নতি হয়েছে।

আমি শহরে থাকলেও গ্রামে তো আমার নাড়িপোতা জায়গা তাই সব খবর আমার কানে আসে। আমি এরকম একটা আভাস আগেই পেয়েছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর তোমাদের মধ্যে নেই। তোমরা যেভাবে পারো স্কুল চালাও। সভাপতি যে হয় হোক। আসলে সভাপতি হওয়ার আগে শিক্ষকদের সম্পর্কে আমার ধারণা অনেক উঁচু ছিল। যদি স্কুলের সভাপতি না হতাম তবে আমি সেই ধারণা নিয়েই থাকতাম।

হেড মাস্টার সাহেব কোনো কথা বলল না, মাথা নত করে বসে রইল।

শাহাদত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আগের সভাপতি তো আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে আমি সভাপতি থাকতে চাইলে সে নির্বাচনই করবে না কিন্তু তাকে তোমাদের মাস্টারদের মধ্য থেকে গিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। যাতে করে সে সভাপতি হলে যারা নিয়মিত স্কুলে আসে না এবং যারা প্রাইভেট পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়।

হেড মাস্টার স্বীকার করলো, তা হতে পারে, ওরা অবশ্য আপনার ওপর ক্ষ্যাপা ছিল।

শুধু আমার ওপর কেনো, তোমার ওপর ক্ষ্যাপা নেই কেনো? মানে তুমি ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাও, স্কুল জাহান্নামে যাক।

একসঙ্গে চাকরি করি, একসঙ্গে উঠবস করি, একই এলাকায়…

শাহাদত সাহেব হেড মাস্টারের কথার মাঝে বলতে শুরু করলেন, সেজন্য তো বলি মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষকদের পোস্টিং বদলিযোগ্য হতে হবে, নিজ জেলার বাইরে পোস্টিং দিতে হবে, শিক্ষকদের ব্যবসা এবং রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, কাঙালের কথা বাঁশি হলেই ফলে। আচ্ছা বাদ দাও, তুমি কি কাগজ এনেছো দাও সই করে দিই।

হেড মাস্টার সাহেব তার ব্যাগ থেকে একটা রেজুলেশন খাতা এবং কিছু বিল ভাউচার বের করলো।

শাহাদত সাহেব একে একে সবগুলো বিল ভাউচার এবং রেজুলেশন সই করে দিলেন তারপর বললেন, আমি আর তোমার স্কুলে যাচ্ছি না। কোনো কাগজে সই লাগলে আবার নিয়ে এসো।

হেড মাস্টার সাহেব উঠতে যাচ্ছিলো। শাহাদত সাহেব জোরে ডাক দিলেন, আয়েশা।

আয়েশা এলো, বাবা।

চা নাস্তা দাও আর হেড মাস্টারকে কি কার্ড পাঠিয়েছে নাকি লিস্টে দেখ, যদি না পাঠায় তবে নিয়ে এসো।

আচ্ছা।

আয়েশা ভিতরে গেল, কিছুক্ষণ পর চা-নাস্তা টেবিলে দিয়ে আবার ভিতরে চলে গেল।

শাহাদত সাহেব হেড মাস্টারকে চা নিতে বললেন, নাও, নাস্তা খাও।

চাচা আপনি?

আমি একটু আগেই খেলাম।

আয়েশা একটা বিয়ের কার্ড আর অতিথিদের তালিকা নিয়ে এলো, বাবা মির্জাপুর এখনো কাউকে কার্ড পাঠানো হয়নি।

তাহলে একটা কার্ডে প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারীগণ, মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয় লিখে নিয়ে এসো।

আয়েশা আবার ভিতরে গেল, বাবার নির্দেশমতো লিখে একটা কার্ড নিয়ে এলো।

শাহাদত সাহেব হেড মাস্টারের হাতে কার্ড দিতে দিতে বললেন, আমার ছেলে মেয়ে দুজনেরই একসাথে বিয়ের আয়োজন করেছি। স্কুলের সবার জন্য দাওয়াত রইল এসো।

জি চাচা, আজ তাহলে উঠি।

আচ্ছা এসো।

হেড মাস্টার সাহেব সোফা থেকে উঠল।

আয়েশার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। বিপ্লব ফোন করেছে, সে ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো ভাইয়া।

কোথায় তুই?

বাসায়।

একা আছিস।

না, বাবার সঙ্গে।

একটু আলাদা হয়ে আমাকে ফোন দে তো।

আচ্ছা।

শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে ফোন করেছে, বিপ্লব?

জি বাবা।

কী হলো আবার।

কিছু হয়নি বাবা, আচ্ছা আগে শুনি পরে তোমাকে বলছি।

 

একুশ

 

আগামীকাল বিপ্লবের বিয়ে, পরশু বউভাত। আয়োজনের কোনো কমতি নেই, আনন্দের কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু স্কুলের সভাপতির দায়িত্বটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে শাহাদত সাহেব খুব কষ্ট পেয়েছেন। একটা কথাই তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আলেমার বলা একটা কথা বার বার মনে পড়ছে, একদিন আলেমা বলেছিল, সবাইকে ত্যাগ করতে করতে একদিন সবাই তোমাকে ত্যাগ করবে।

হ্যাঁ তাইতো স্কুল তো আমি ত্যাগ করিনি বরং স্কুলই আমাকে ত্যাগ করেছে, কী অপরাধ করেছি আমি? শিক্ষকদের ঠিক সময়ে স্কুলে আসা, পাঠদানে মনোযোগী হওয়া। এটা তো আমার দায়িত্ব, তবে কি আমি দায়িত্ব নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতাম। বাসায়, সমাজে বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে কিন্তু এড়িয়ে চলে, কেমন যেন একটা পাশ কাটানো ভাব। সবাই মনে করছে আমি কিছু জানলেই বুঝি বাধা দিবো, নীতি-নৈতিকতার বুলি আওড়াবো, আমি কি দিনে দিনে অচল হয়ে পড়ছি এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে শাহাদত সাহেব পাশ ফিরে শুইলেন।

আলেমা জিজ্ঞেস করলো, তুমি ঘুমাওনি?

না, ঘুম আসছে না।

এখনো তুমি কি চিন্তা করছো? আমাদের ছেলেমেয়ে সবাই সেটেল্ড, ছেলেমেয়েদের বিয়েও হয়ে যাচ্ছে আর কী চিন্তা আমাদের, বলো।

তা ঠিক বলেছ। আলেমা তোমাকে একটা কথা বলবো?

বলো। আমাকে কথা বলতে তোমার সংকোচ কীসের?

আচ্ছা আলেমা আমি কি দিনে দিনে অচল হয়ে যাচ্ছি।

আলেমা কিছুটা বিরক্তের স্বরে বলল, উফ্‌, এতো রাতে এসব তুমি কী কথা বলছ, কে বললো তুমি অচল হয়ে যাচ্ছো। সবাই তোমাকে কত শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে, তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তুমি একজন দেশপ্রেমিক, তুমি একজন সৎ মানুষ। তোমাকে নিয়ে আমি, আমরা সবাই গর্ববোধ করি। তুমি অচল হয়ে গেলে কেউ তোমাকে সম্মান করত?

শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে এটা ঠিক কিন্তু এড়িয়েও চলে।

না। এটা তোমার ভুল ধারণা। বয়সের তফাতের কারণেও একটা জেনারেশন গ্যাপ হয়ে যায়। এটা নিয়ে তুমি হীনমন্যতায় ভুগো। এটা ঠিক না।

স্কুলের সভাপতির দায়িত্ব শেষ হয়েছে।

ভালো হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

শাহাদত সাহেব রেগে গেলেন, তুমি আলহামদুলিল্লাহ বলছ?

হ্যাঁ, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। এই বয়সে অযথা এসবে জড়ানোর কী দরকার। আসলে তুমি অচল হয়ে যাওনি, একটা কথা বলে না ভালো মানুষের ভাত নেই, তুমি ভালো মানুষ তাই কোথাও গেলে তুমি সব সাদা চোখে দেখ, সব অনিয়ম, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো কিন্তু এটা কেউ চায় না, সবাই চায় পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করতে।

তাই বলে কেউ প্রতিবাদ করবে না। সবাই স্‌্েরাতে গা ভাসাবে।

সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো, একে একে তিনটা চাকরি ছেড়েছো। তোমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা আর কার বেশি আছে। আমি একটা কথা বলি।

বলো।

সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেছ, অনেক যুদ্ধ করেছ এবার একটু বিশ্রাম নাও ত্যাগী, আলেমা একটা মুচকি হাসি হাসল।

আজ বিপ্লব একবার আয়েশাকে ফোন করেছিল।

একবার কেনো, অনেকবার তো ফোন করে, ওরা ভাইবোনে খুব মিল।

কিন্তু আমি তো কাছেই ছিলাম। বিপ্লব আয়েশাকে আমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে কথা বলতে বলল।

আলেমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। যেন একটা কিছু লুকাচ্ছে। আলেমা একটা ঢোক গিলে বলল, উফ্‌ আবার ছেলেমানুষি কথা বলছ। ওরা ভাইবোন কী কথা বলবে সেটা কি তোমার সামনে বলবে। হয়তো গোপন কিছু, এই যেমন মেয়েদের কেনাকাটা হতে পারে। সেটা কি তোমার সামনে বলবে। তুমি যে দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছো না।

শাহাদত সাহেব আর কথা বাড়ালেন না কিন্তু তার মন বলছে আলেমা, আয়েশা, বিপ্লবসহ সবাই তার কাছে কিছু লুকাচ্ছে। আলেমা উঠে পড়ল, তুমি ঘুমাও, আমি গিয়ে ওদিকে একটু দেখি, সবাই কী করছে।

এতো রাতে সবাই ঘুমায়নি?

এতো রাত কোথায়, সাড়ে বারোটা বাজে। আজ তোমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী সবাই আনন্দ-ফুর্তি করছে, বলে আলেমা চলে গেল।

বিপ্লবের বিয়ে এবং বউভাত সম্পন্ন হলো। আয়েশার বিয়েটা আসলে শাহাদত সাহেব মনে নেননি, মেনে নিয়েছেন কিন্তু আগে যতটা অপছন্দ করতেন বিয়ের দিন পাত্রের চেহারা ছবি, পাত্রের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন সবকিছু দেখে ততটা খারাপ লাগেনি। একই শহরে বসবাস, পাত্র পক্ষের কয়েকজন শাহাদত সাহেবের পূর্বপরিচিত। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। বিয়ের কাবিন হলো, বরযাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। বিয়ের সব শেষ পর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা বরের হাতে কনেকে সমর্পণও শেষ হলো। শাহাদত সাহেব চোখের জলে আয়েশার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, আলেমা কান্নায় একরকম গড়াগড়ি দিল। বাড়ির সবাই সবার ছোট মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে কিছুক্ষণ আগের আনন্দময় অনুষ্ঠানটি হৃদয় বিদারক অবস্থায় পরিণত হলো। বর-কনের প্রাইভেট কারটি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। তখনো সবাই বর কনের প্রাইভেট কারের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় পুলিশের একটা পিক আপ ভ্যান কমিউনিটি সেন্টারের গেটে এসে দাঁড়ালো।

পিক আপ থেকে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কয়েকজন কন্সটেবল নেমে ভিতরে ঢুকলো। শাহাদত সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কি বিপ্লব আছে?

বিপ্লব কাছেই ছিল। পুলিশ দেখে তার বুক কেঁপে উঠল, তবুও সে এগিয়ে এলো, আমি বিপ্লব।

আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।

আয়েশাকে বিদায় দেওয়ার পর, শাহাদত সাহেব, আলেমা, স্বাধীন, মোস্তাক, বিপ্লবী, বিপ্লব সবাই একসাথেই ছিল। শাহাদত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বিপ্লব, কী করেছে বিপ্লব?

বিপ্লব আপনার কে হয়?

আমার ছেলে, আমি বিপ্লবের বাবা।

ও আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত সাহেব, বলে পুলিশ অফিসার স্যালুট দিয়ে বলল, বিপ্লবের নামে ওয়ারেন্ট আছে স্যার, প্লিজ ওকে আমাদের হাতে তুলে দিন।

ওয়ারেন্ট! বলে শাহাদত সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন।

জি স্যার দু’দকের মামলায় তার নামে ওয়ারেন্ট হয়েছে, বলে পুলিশ অফিসার শাহাদত সাহেবের হাতে ওয়ারেন্ট দিতেই শাহাদত সাহেব টলে পড়তে যাচ্ছিলেন। স্বাধীন দাঁড়িয়েছিল সে কোনোরকমে ধরে একটা চৌকিতে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল, অবস্থা ভালো না, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে বলে সে নিজেই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য হাসপাতালে ফোন করলো।

ততক্ষণে কান্নার রোল পড়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সও খুব তাড়াতাড়ি এলো। শাহাদত সাহেবকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দ্রুত এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। আলেমা, স্বাধীন, বিপ্লবী অ্যাম্বুলেন্সে উঠেছে, সামনের সিটে বসেছে মোস্তাক। অ্যাম্বুলেন্স দ্রুতই চলছে তবুও স্বাধীন ড্রাইভারকে বলছে তাড়াতাড়ি চালাও, তাড়াতাড়ি।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে শাহাদত সাহেবকে স্ট্রেচারে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো। কর্তব্যরত চিকিৎসা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগল, স্বাধীন নিজেও পালস চেক করে কান্নায় ভেঙে পড়ল, বাবা।

সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

একজন নীতিবান শাহাদত, একজন দেশপ্রেমিক শাহাদত, জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার খবরে শহরে এবং তার নিজ গ্রামে শোকের ছায়া নেমে পড়ল। দেশ একজন দেশপ্রেমিককে হারালো, দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। নীতি-নৈতিকতাহীন, বিবেক-মনুষত্বহীন এই দেশে ত্যাগী শাহাদত এর মতো মানুষ আর ফিরে আসবে না।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*