গডফাদার-০১

শৈশব থেকেই জামাল অত্যন্ত চঞ্চল, চটপটে আর ডানপিটে ছিল। প্রতিদিন স্কুলে কোন বন্ধুর কান টেনে ধরা, গালে চড় দেয়া বা কারো বই ছিঁড়ে দেওয়া এসব ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। স্কুলে দেরিতে যাওয়া, টিফিন পিরিয়ডে স্কুল থেকে পালিয়ে বাসায় ফেরা, স্কুলের নাম করে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, এসব শুরু হয়েছে সেই ক্লাস সিক্সে ভর্তির পর থেকে। পর পর দু’বার ফেল করার পর তৃতীয় বার এস.এস.সি পাস করল। কলেজে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে তার উশৃঙ্খলতা আরো অনেকগুণ বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে যোগ হলো তারুণ্যের উচ্ছলতা। একদিন জামাল, তার বন্ধু শরীফ ও আরিফ কলেজের মাঠে বসে চিনাবাদাম খাচ্ছিল। তখন পাশ দিয়ে দল বেঁধে যাচ্ছিল তাদের ক্লাসেরই মেয়েরা।
জামাল শরীফকে জিজ্ঞেস করল, শরীফ ঐ মেয়েটা কে রে?
কেন, পছন্দ হয়েছে না কি?
চেহারাটা সুন্দর, তাই না? জামাল জিজ্ঞেস করল।
আরিফ তিরস্কারের সুরে বলল, কথায় আছে না বেল পাকলে কাকের কী?
জামাল রাগের সুরে বলল, তুই কী বলতে চাচ্ছিস?
শরীফ বলল, আরিফ ঠিকই বলেছে, কোটিপতি ফয়সাল সাহেবের মেয়ে ব্রিলিয়াণ্ট, সুন্দরী এবং বাবার একমাত্র সন্তান। ঐশীকে তোর মতো হেট্রিক করে এস.এস.সি পাস করা জামাইর গলায় ঝুলাবেন না।
জামাল বলল, দেখ দোস্ত আমার পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে তামাশা করিস না, আমার বাবাও কোটিপতি এবং আমিও বাবার একমাত্র সন্তান। আসলে ভালোবাসা কখনো পরীক্ষার রেজাল্ট আর ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে হয় না।
শরীফ বলল, তা অবশ্য ঠিক, তোর কথায় যুক্তি আছে, দেখবি নাকি একবার চেষ্টা করে?
আরিফ বলল, ওকে পাত্তা দিলে তো?
জামালের জিদ চেপে গেল, তোরা আমাকে ভাবিস কী? আমি পাত্তা পাবো না?
আরিফ বলল, চ্যালেঞ্জ থাকল, তুই যদি ঐশীকে বলতে পারিস আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর সে যদি তোর প্রস্তাবে রাজি হয় তবে আমি তোকে-।
জামাল কথার মাঝে বলল, তবে কী বল? বিরিয়ানি খাওয়াবি?
হ্যাঁ বিরিয়ানি খাওয়াব কিন্তু যদি না পারিস তবে?
জামাল সঙ্গে সঙ্গে বলল, তবে আমি খাওয়াব।
এসময় ঐশীসহ একদল ছাত্রী হাঁটতে হাঁটতে তাদের অতিক্রম করতেই জামাল উঠে ঐশীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, তুমি নিশ্চয়ই ঐশী?
ঐশী বলল, হ্যাঁ।
আমি জামাল ফার্স্ট ইয়ার আর্টস।
ঐশী রাগান্বতি চোখে তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলে জামাল বলল, চলে যাচ্ছ যে?
তোমাকে তো কোনদিন ক্লাসে দেখলাম না, এমনভাবে ক্লাসের সময় আড্ডা দাও বুঝি, আমার ক্লাস আছে আমাকে যেতে দাও।
ঐশী আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ঐশী রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, ননসেন্স, তোমার মা-বোন নেই, কাউকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? আবার যদি কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো তো ভালো হবে না বলছি, বলে ঐশী চলে গেল।
আরিফ তিরস্কারের সুরে বলল, বলছিলাম না বেল পাকলে কাকের কি এবার বুঝলি?
আমারো নাম জামাল আমি ওর কথার এমন জবাব দিবো যে ওর জীবনে মনে থাকবে। সাহস কত মেয়েটার বলে আরেকদিন একথা বললে ভালো হবে না। আমার ভালোমন্দ আমি বুঝব।
কয়েকদিনের মধ্যে জামাল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের ছাত্র সংগঠনে যোগ দিল। আর সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর থেকে যেন বই পুস্তক এক রকম ছেড়েই দিল। কলেজে গিয়েই পার্টির জন্য ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা, আজ এক প্রোগ্রাম, কাল আরেক প্রোগ্রাম, সন্ধ্যাবেলা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার অফিসে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতা এসবের মধ্য দিয়ে দিন চলতে থাকল।
কয়েকদিন পর কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন। দলের প্রয়োজনে জামালকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি পদে মনোনয়ন দেয়া হলো। ফলে জামালের ব্যস্ততা আরো হাজারগুণ বেড়ে গেল। দেওয়াললিখন, ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যানভাস করা এসবের মধ্যে সে যেন মহা ব্যস্ত। তার সঙ্গে রয়েছে দলের জেলা শাখার সভাপতি, সেক্রেটারি তাঁরা সবসময় কলেজ সংসদের নির্বাচনকে মনিটরিং করছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্টির অফিসে সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা সাহেব সেদিন জামালকে বললেন, জামাল তোমার সর্বশেষ অগ্রগতি কেমন? জিততে পারবে তো?
বড়ভাই আমার জন্য দোয়া করবেন, আপনাদের সহযোগিতা পেলে ইনশাআল্লাহ আমি জিতবোই।
আমার অবশ্যই তোমাকে সহযোগিতা করবো, বলো কোন সমস্যা আছে?
বড়ভাই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ, ইদানীং খুব বাড়াবাড়ি করছে ওর টাকার জোরও বেশি, বড় লোকের ছেলে টাকা তো থাকবেই। আপনি তো জানেন আজকাল টাকা-পয়সা ছাড়া–।
তুমি বলো কী জামাল? টাকার অভাবে তুমি হেরে যাবে? তবে দল আছে কী জন্য? আমরা আছি কী জন্য?
দলের সেক্রেটারি বেলায়েত সাহেব বললেন, অবশ্যই, তুমি অ্যারেঞ্জ করো, ইলেকশনে জিতার জন্য তোমার কত টাকা লাগবে?
জামাল কিছু বলল না।
বেলায়েত সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, হ্যাঁ ইলেকশনের সাত দিন আগে থেকেই ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাবার জন্য পাঁচটা মোটর সাইকেল থাকবে, প্রয়োজন বোধে মাইক্রো বাস ভাড়া নিয়ে ক্যানভাস করবে, এটা শুধু তোমার ইলেকশন না, দলের ইলেকশন, এই ইলেকশনের সঙ্গে আমাদের দলের মান-সম্মান জড়িত। তোমাকে অবশ্যই জিততে হবে।
মোস্তফা সাহেব বললেন, জামাল তুমি আর বসে থেকো না, হাবিব কোথায়?
হাবিব বলল, জি ভাই বলুন।
তুমি একটু কথা বলতে শেখো, জামাল আর তুমি দু’জনে স্টাডি করো, ইলেকশনের দু’দিন আগে আমরা আবার বসব, সেদিন তোমরা আমাদের ইলেকশনের সম্ভাব্য রেজাল্ট জানাবে, আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে এলো কলেজে উত্তেজনা ও নির্বাচনী প্রচারণা ততই বেড়ে চলল। প্রায় দিনই মিছিল, মিটিং এর মধ্য দিয়েই দিন চলতে থাকল। হাবিব আর জামাল নির্বাচনের দু’দিন আগে যে পরিসংখ্যান বের কবল এবং তাতে যে চিত্র ফুটে উঠল তা শুনে সভাপতি মোস্তফা সাহেব ক্ষোভের সঙ্গে দু’জনকেই বললেন, তোমাদের উপর আমার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু তোমরা নিজেরাই যে রেজাল্ট জানালে তাতে আমি আর তোমাদের উপর ভরসা রাখতে পারছিনা। হাই কমান্ডের নির্দেশ, কর্মীদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা, সবকিছুই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াবে, জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাব। উঃ আমি আর ভাবতে পারছি না, হায়দার।
হায়দার সাহেব মৃদু কণ্ঠে সাড়া দিলেন, জি বড়ভাই।
তোমাকে যে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছ, শহরের উপর কলেজে ইলেকশন অথচ তুমি পিছিয়ে আছ, অনেক সময় পেরিয়ে গেছে আর বসে থাকার সময় নেই। তুমি এখনি যাও হিটলারকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি অফিসেই আছি।
জি বড়ভাই, আমি আসছি বলে হায়দার সাহেব চলে গেলেন।
মোস্তফা সাহেব রাগান্বতি স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল-হাবিব তোমরা প্রতিদিন মিছিল বের করো তো, তাই না?
জি ভাই।
কাল সাড়ে দশটায় তোমরা মিছিল বের করবে। তোমাদের সঙ্গে হিটলারের কয়েকজন ছেলে যোগ দিবে, অপরিচিত কাউকে দেখলেও কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
হাবিব জিজ্ঞেস করল, তারপর?
মোস্তফা সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, তারপর কী হবে তা এখন তোমাদের কারো জানার প্রয়োজন নেই। যা ঘটবে তা তোমরা শুধু দেখে যাবে কিছু বলবে না। যা করার আমিই করবো।
হাবিব এবং জামাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, জি ভাই।
তোমরা এখন যাও, মনে রাখবে কাল সকাল সাড়ে দশটায় তোমরা মিছিল বের করছ।

দুই

শহীদ মিনার চত্বরে হাবিব-জামাল প্যানেলের মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ে একের পর একজনের বক্তব্য চলছে। দল বেঁধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আসছে কেউবা বক্তব্য শুনে আবার চলে যাচ্ছে। কেউ মনোযোগ সহকারে বক্তৃতা শুনছে আবার কেউবা ফিস ফিস করে পাশাপাশি বসা বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলছে। জামাল দাঁড়িয়ে একবার মিটিংয়ের শ্রোতাদের দিকে তাকালো। মিটিংয়ে তার চোখে পড়ল কিছু অপরিচিত মুখ। জামালের বুঝতে বাকী রইল না যে অপরিচিত তরুণরা মোস্তফা ভাইয়ের পাঠানো এবং তারা তাকেই সহযোগিতা করতে এসেছে। জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে শ্লোগানের মাধ্যমে মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু করল। মিছিল শহীদ মিনার থেকে বিজ্ঞান ভাবনের পাশ দিয়ে একাডেমিক ভবনের কাছাকাছি পৌঁছাতেই অপর দিক থেকে আগত অপর প্যানেলের মিছিলের মুখোমুখি হলো। হঠাৎ করেই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলো। সবাই ছুটাছুটি করে প্রাণ ভয়ে পালাতে শুরু করল।
হাবিব জামালকে জিজ্ঞেস করল, জামাল কী হলো হঠাৎ?
জামাল হাবিবকে কোনকিছু না বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেল। হাবিবও অন্যদিকে পালিয়ে গেল। বিকট শব্দে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হলো। হিটলার মোবাইলে মোস্তফা সাহেবকে জানাল, বস অপারেশন সাকসেসফুল।
মোস্তফা সাহেব বললেন, হিটলার তুমি তোমার ছেলেদের নিয়ে পালিয়ে যাও, আমি দেখছি।
হিটলার ক্যাম্পাস থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে মোস্তফা সাহেব অ্যাম্বুলেণ্স নিয়ে কলেজে ঢুকলেন। পুলিশ ভ্যানও মোস্তফা সাহেবের ঢুকবার পরপরই কলেজে ঢুকলো। মোস্তফা সাহেব হাবিব এবং জামাল দুইজনকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চললেন। হাসপাতালে ঢুকে হাবিব বলল, ভাই আমার তো কিছু হয়নি।
চুপ করো গাধা, আমি যা বলব তাই করবে। তুমি হাসপাতালের বেড এ শুয়ে থাকো ডাক্তারকে বলে আমি তোমার পায়ে ইঞ্জুর দেখানোর ব্যবস্থা করছি। মোস্তফা সাহেব কথাগুলো চাপা স্বরে বলে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলেন। কয়েক মিনিট পর ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে এসে জামালকে বললেন, জামাল তুমি আমার সঙ্গে চলো, এখনি থানায় যেতে হবে।
জামাল এবং মোস্তফা সাহেব হাসপাতাল থেকে বের হতেই বেলায়েত সাহেব ও হায়দার সাহেব মোটর সাইকেল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মোস্তফা সাহেব বললেন, জামাল তুমি হায়দারের মোটর সাইকেলে উঠো আর আমি বেলায়েতের মোটর সাইকেলে উঠছি, তোমরা থানায় এসো।
সবাই থানায় ঢুকে ওসি সাহেবের সামনে বসে মোস্তফা সাহেব তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ওসি সাহেবকে বললেন আর ওসি সাহেব তাঁর কথামতো সবকিছু লিখে চললেন। জামাল একবার কী যেন বলতে চাইল। মোস্তফা সাহেব জামালের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালেন। জামাল ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে বসে রইল। লিখা শেষে মোস্তফা সাহেব বললেন, জামাল সই করো।
জামাল বেলায়েত সাহেব এবং হায়দার সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, বেলায়েত ভাই সই করবো?
বেলায়েত সাহেব জোর দিয়ে বললেন, অবশ্যই।
জামাল সই করল। তারপর বেলায়েত সাহেব ওসি সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, ওসি সাহেব আপনি তাহলে আসামি এরেস্টের ব্যবস্থা করুন।
অবশ্যই আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবো।
সবাই থানা থেকে বের হয়ে পার্টি অফিসে বসলেন। বেলায়েত সাহেব কথা বলতে শুরু করলেন, জামাল আর্জির ডুপ্লিকেট কপিটা নিয়ে যাও, হাবিবকে সবকিছু ব্রিফ করবে আর সে যেন অপরিচিত কারো সাথে কথা না বলে, হায়দার তুমি বিকেলে প্রেস ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করো।
জামাল পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গেল। হাবিব তখন বেড এ শুয়েছিল। জামালকে দেখে হাবিব উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হলো জামাল?
জামাল একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, হাবিব ভাই আমাদের কোন চিন্তা নেই বেলায়েত ভাই, মোস্তফা ভাই সবকিছু এমনভাবে করেছেন যে, আপনি ভি.পি এবং আমি জি.এস হচ্ছি এতে কোন সন্দেহ নেই। ওদের নামে মামলা হয়েছে, পুলিশ ওদের খুঁজছে, ইলেকশন তো দূরের থাকুক পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া ওদের আর কোন উপায় নেই।
বিকেলে প্রেস ব্রিফিং আছে আগামীকালের পেপারে সন্ত্রাসী হিসেবে ওদের নাম উঠবে, ভোটাররা ঘৃণায় ওদের ভোট দিবে না। কাল বেলায়েত ভাই মোস্তফা ভাইসহ দলের অন্যান্য নেতারা যাবেন আমাদের মিটিংয়ে। হিটলারও আমাদের সঙ্গে আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের খবর খুব ভালো। আপনি শুধু কষ্ট করে এখানে শুয়ে থাকুন এদিকটা আমি দেখছি, বলে জামাল হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
হাবিব জামালের হাত টেনে ধরে বলল, জামাল তুমি একটু বসো না ভাই আমার সঙ্গে।
জামাল বেড এর এক কোনায় বসল।
হাবিব জিজ্ঞেস করল, ওদের বিরুদ্ধে কি মামলা করেছে?
জামাল আর্জির কপিটা হাবিবের হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখুন।
হাবিব আর্জিটা পড়ে দেখে জামালের কানে ফিসফিস করে বলল, জামাল এতো ডাহা মিথ্যা, ওরা তো আমাদের মিছিলে হামলা করেনি।
হাবিব ভাই আপনিও আর্জিটা ভালো করে পড়ে দেখুন, ভবিষ্যতে এটা কাজে লাগবে।
মিথ্যা কথা বলতে হবে?
হাবিব ভাই আপনি আর কিছু বলবেন না, শুধু মনে রাখবেন এটা মোস্তফা ভাই আর বেলায়েত ভাই ‘র নির্দেশ।
হাবিব আর কোন কথা না বলে চুপ করে শুয়ে রইল।

তিন

শহরের সন্নিকটে মহাসড়কের পার্শ্বেই জহির সাহেবের পেট্রোল পাম্প, শহরে বিশালাকার গোডাউন, স্টোক বিজনেস, সবকিছু মিলিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ। সারাক্ষণ তিনি ব্যবসা নিয়ে থাকেন, ঘর সামলান, তাঁর স্ত্রী ফাহমিদা বেগম। তাঁদের একমাত্র সন্তান জামাল বড় আদরের। জহির সাহেবের সঙ্গে ফাহমিদার বিয়ের প্রায় দশ বছর পর জামালের জন্ম হয় তাই আর আদর আরো বেড়ে যায়। জামালের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জহির সাহেব তার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেননি। ফাহমিদাও ছেলেকে শুধুমাত্র আদর দিয়েই বড় করেছেন, কোনদিন শাসন করেননি। তাই বাবা-মা ‘র মাত্রাতিরিক্ত আদর স্নেহ পেয়ে জামালও অত্যন্ত জেদি আর বেপরোয়া হয়েছে একথা ফাহমিদা এবং জহির সাহেব দু ‘জনে বুঝতে পারেন কিন্তু শাসন করতে যেন তাঁর হৃদয় কেঁদে উঠে।
জহির সাহেব প্রতিদিনের মতো সকালবেলা পেপার পড়ছিলেন হঠাৎ করেই তাঁর দৃষ্টি থমকে গেল। তিনি ফাহমিদাকে জোরে ডাক দিলেন।
ফাহমিদা ডাক শুনে ভিতর থেকেই বললেন, কী হয়েছে? তারপর জহির সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
জহির সাহেব পেপারটা ফাহমিদাকে দেখিয়ে বললেন, দেখো তোমার গুণধর ছেলে ছাত্র সংসদের জি.এস ক্যান্ডিডেট হয়েছে।
বেশ ভালো করেছে।
বেশ ভালো করেছে। শুধু ক্যান্ডিডেট হলে তো হতো, কলেজে মারামারি হয়েছে তোমার ছেলে মারামারি করে তারই বন্ধুর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে। এখন থানা-পুলিশ, কোট-কাচারি এসব ঝামেলা কে পোহাবে বলো?
ফাহমিদা শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, জামাল কলেজে মারামারি করেছে? মামলা হয়েছে?
তবে আর কী? কই ডাকো তোমার গুণধর ছেলেকে?
এত করে বলি ছেলেকে একটু শাসন করো, না তুমি আমার কথায় কান দিলে না, বলতে বলতে ফাহমিদার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
এখানে দাঁড়িয়ে আর ফ্যা ফ্যা করো না যাও ওকে ডাকো।
ফাহমিদা ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছতে মুছতে জামাল ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, কী হয়েছে বাবা? এত সকালে ডাকাডাকি করছ কেন?
জহির সাহেব গম্ভীরস্বরে বললেন, কী হয়েছে মানে? তুই কলেজে লেখাপড়া করতে গেছিস নাকি রাজনীতি করতে?
জামাল অষ্ফুট স্বরে বলল, বাবা।
তুই থানায় মামলা করেছিস তোরই বন্ধুর বিরুদ্ধে, এখন থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি এসব বিড়ম্বনাকে সামলাবে? আর পড়ালেখা করতে গিয়ে রাজনীতিই বা কেন?
জামাল অভয় দিয়ে বলল, বাবা তুমি এসব নিয়ে কিছু ভেবো না। আগামীকাল ইলেকশন, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
জহির সাহেব রেগে বললেন, ইলেকশন শেষ হলেই মামলা শেষ হয়ে গেল, তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করলাম। দেখ জামাল আমি তোকে পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছি। তুই পড়ালেখা করবি আর যদি পড়ালেখা করার ইচ্ছা না থাকে তবে পাম্পে বস, ব্যবসা কর। তোকে কলেজে গিয়ে আমি ওএসব রাজনীতি-টাজনীতি করতে দিব না। কত আশা ছিল তুই লেখাপড়া করে বড় অফিসার হবি। অথচ লেখাপড়া করতে গিয়ে তুই শুরু করলি রাজনীতি, জানি না তোর কপালে কী আছে?
বাবা তোমাকে তো বলছি এসব নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না, বেলায়েত ভাই, মোস্তফা ভাই আমাদের সঙ্গে আছেন, সবাই চান আমি কলেজের জি.এস.হই। আমি ভবিষ্যতে বড় নেতা হই। আমি দলের ডিস্ট্রিক লিডার হবো আমার চেখের সামনে এখন অনেক স্বপ্নবলে জামাল একটু থামল তারপর আবদারের সুরে বলল, বাবা।
জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, কী হলো হঠাৎ?
বাবা আমার বিশ হাজার টাকা প্রয়োজন।
জহির সাহেব মুখ বিকৃত করে বললেন, টাকা প্রয়োজন বললেই হলো, পড়ালেখার জন্য যত টাকা প্রয়োজন আমি দিতে রাজি আছি। কিন্তু রাজনীতি করার জন্য আমি একটি পয়সাও দিব না।
জামাল মুখ ভার করে ভিতরে চলে গেল। তারপরই জহির সাহেবের কানে কোন কিছু ভাঙ্গার ধুম ধাম শব্দ ভেসে এলো।
কী রে ধুম ধাম শব্দ কী হচ্ছে? বলতে বলতে ফাহমিদা জামালের ঘরে গেলেন। তারপর কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, কী হলো বাবা? এমন করছিস কেন?
জামাল জোরে চিৎকার করে বলল, মা তুমি সরে যাও বলছি।
কী হয়েছে বলবি তো? ফাহমিদা বললেন।
জামাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, এতদিন থেকে কাজ করছি, কাল ইলেকশন, বাবার কাছে টাকা চাইলাম এখন বলে টাকা দিবে না।
তুই থাম বাবা আমি দেখছি, বলে ফাহমিদা জহির সাহেবের কাছে এসে বললেন, কী হলো? জামাল কত টাকা চাইল? আর তুমি কত টাকার দিতে চেয়েছ?
জহির সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, বিশ হাজার টাকা চায়।
ফাহমিদা বললেন, ও যখন চাচ্ছে দিয়ে দাও।
কী জন্য চাচ্ছে জানতে চাইলে না?
ইলেকশনের খরচের জন্য।
জহির সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন, ইলেকশনের জন্য টাকা দিব আমি?
হ্যাঁ অবশ্যই দিবে, টাকা দিয়ে দিয়ে তো ছেলেটার মাথা নষ্ট করেছ, বলেছিলাম ছেলের হাতে টাকা দিও না একটু শাসন করো। কিন্তু তখন শাসন করোনি, এখন কি আর শাসন করার সময় আছে? তাছাড়া ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে ওর একটা মান-সম্মান আছে না? বলে ফাহমিদা ভিতরে চলে গেলেন।

চার

প্রতিপক্ষের উপর মিথ্যা মামলা দায়ের, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভীতি প্রদর্শন আর দলীয় প্রভার খাটিয়ে জামাল নির্বাচনে জয়ী হলো। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর জামালের চালচলনে হলো আমূল পরিবর্তন। ছোট-খাটো ইস্যুতে ক্লাস বর্জন, মিছিল-মিটিং, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের হুমকি প্রদর্শনসহ কলেজে নিজ দলের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল বলতে গেলে কলেজের জি.এস. নির্বাচিত হওয়ায় সে যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল।
নির্বাচনে জয়ী হয়েই জামাল বাবার কাছে আবদার করেছে মোটর সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য। জহির সাহেব ব্যবসায়ী এবং হিসেবী, তিনি ছাত্রজীবনে ছেলেকে মোটর সাইকেল কিনে দেওয়ার কোন যুক্তি দেখলেন না, তাছাড়া মোটর সাইকেল ব্যয় বহুল এবং নতুন মোটর সাইকেল পেয়ে জামাল বই পুস্তক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
কিন্তু জামাল দেখাল উল্টো যুক্তি, তার যুক্তি হলো আজ কালকার দিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করা প্রয়োজন, কারণ ছাত্র রাজনীতি থেকেই তো সে একদিন হবে চেয়ারম্যান, এম.পি কিংবা মন্ত্রী। কাজেই ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই প্রয়োজন আর রাজনৈতিক কারণে চলাফেরার জন্য মোটর সাইকেল তো জরুরি।
জেলা পর্যায়ের কলেজ সংসদের জি.এস এবং জেলা শাখার ছাত্র নেতা হিসেবেও জামালকে উপজেলা পর্যায়ের কলেজসমূহের ছাত্র সংসদ এবং সংগঠনের উপজেলা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তাকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়। সে কারণে মোটর সাইকেল তার জন্য বেশি জরুরি। জহির সাহেব সবকিছু শুনে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোটর সাইকেল কিনে দিতে রাজি হলেন।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জামাল মনে মনে ঐশীকে অনেকবার খুঁজেছে কিন্তু কোনদিন জামালের চোখে পড়েনি। মোটর সাইকেল কেনার পর থেকে জামাল আরো বেশি ঐশীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অসহিঞ্চু হয়ে উঠল। ভাগ্যক্রমে সেদিন সকালবেলা জামাল মোটর সাইকেল নিয়ে কলেজে যাচ্ছিল এমন সময় একটা রিক্সা অতিক্রম করতেই মোটর সাইকেলের লুকিং গ্লাসে ঐশীর প্রতিবিম্ব দেখে জামাল মোটর সাইকেল সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়ালো, এই রিক্সা একটু দাঁড়াও।
রিক্সা থামতেই জামাল একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, ঐশী রিক্সা ছেড়ে দাও, এসো আমার মোটর সাইকেলে।
ঐশীর রাগ তখন চরমে তার ফর্সা লাল গাল যেন রাগে টগবগ করছে, চোখ দু ‘টো যেন জ্বলজ্বল করছে। সে রাগান্বিত স্বরে রিকশাওয়ালাকে সামনে যেতে বললেও জামাল এমনভাবে মোটার সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছে যে রিক্সা নিয়ে সামনে যাবার কোন সুযোগ নেই। তাই ঐশী রাগ সংবরণ করে রিক্সায় বসে রইল।
রিকশাওয়ালা ভয়ে ভয়ে বলল, আপা আমাকে ছেড়ে দেন, আমি চলে যাই।
ঐশী আরো জোরে চিৎকার করে বলল, জামাল তুমি পথ ছাড়বে নাকি আমি চেঁচাবো?
তাতে কি ব্যাপারটা ভালো দেখাবে? বরং সবাই তোমাকেই খারাপ বলবে।
আমাকে খারাপ বলবে আর তোমাকে কেউ খারাপ বলবে না? সবাই প্রশংসা করবে নাকি?
আমাকে তো কেউ ভালো বলে না, নতুন করে আর কী বলবে?
অগত্যা ঐশী রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জামালকে বলল, বলো? কী বলতে চাও?
এভাবে কেউ কথা বলে? এভাবে কথা বললে মুড নষ্ট হয় না? চলো আমরা কোথাও বসি, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। প্লিজ আমার মোটর সাইকেলে ওঠো।
ঐশী অবজ্ঞার সুরে বলল, তুমি কী করে ভাবলে যে আমি তোমার মোটর সাইকেলে উঠবো?
কেন আমার মোটর সাইকেলটা কি খারাপ? দেখো বাবার কাছ থেকে জোর করে মোটর সাইকেল নেওয়ার সময় আমার বার বার করে তোমার কথা ভেবেছি, এসো না প্লিজ, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
কিন্তু তোমার সঙ্গে তো আমার কথা নেই।
ঐশী রাগ করো না প্লিজ, তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো।
বললাম তো। বলো? কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো?
ঐশী আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ঐশী বিরক্তির সুরে বলল, আবার ভালোবাসার কথা! আমি না তোমাকে বলেছি, ঐসব ভালোবাসাবাসির মধ্যে আমি নেই। আজকেও কি কারো সঙ্গে বাজি ধরেছ নাকি?
ঐশী বিশ্বাস করো বাজি ধরে নয়, আমি তোমাকে মন থেকে ভালোবাসি। ইলেকশনের পর থেকে আমি তোমাকে খুঁজেছি শুধু মনে মনে নয় একরকম হন্য হয়েই খুঁজেছি, ভাবছিলাম আমার বিজয়ের খবরটা প্রথমে তোমাকে জানাবো কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তোমাকে পেলাম না তারপর মোটর সাইকেল কেনার পর থেকে আবারো তোমাকে খুঁজেছি শেষ পর্যন্ত আজ তোমাকে পেলাম। এসো একসঙ্গে একটু ঘুরে আসি।
ঐশী মুখ বিকৃত করে বলল, এসো একসঙ্গে একটু ঘুরে আসি, তুমি বললে আর আমি তোমার সঙ্গে ঘুরতে গেলাম।
জামাল তুমি অযথা আমার জন্য সময় নষ্ট করেছ আমি তোমাকে কোনদিন আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলিনি, তোমাকে একটা কথা আজও স্পষ্ট করে বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। আমি তোমার সঙ্গে আর কোন কথা বলতে চাই না। আমি এখন আসি, বলে ঐশী যেতে উদ্যত হলো।
জামাল জিজ্ঞেস করল, ঐশী তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?
সেটা জেনে তোমার লাভ কী?
লাভ লোকসানের কথা না।
যদি বলি আমি কাউকে ভালোবাসি না তখন কি বলবে তাহলে আমাকে ভালোবাসো?
হুঁম তুমি এখনো বুকড্ না হলে আমি তো আছিই।
আর যদি বলি আমি একজনকে ভালোবাসি, তখন তুমি কী বলবে?
বলেই দেখো না তাকে আমি কী করি?
কী করবে? মারবে?
জামাল যেন গর্জে উঠল, শুধু মারবো না, তোমাকে ভালোবাসার সাধ মিটিয়ে দিব।
তবে তোমাকে আজ স্পষ্ট করে বললাম আমি কাউকে ভালোবাসি না এবং বাসবো না, বললাম তো ঐসব ভালোবাসাবাসির মধ্যে আমি নেই, এখন আমাকে যেতে দাও প্লিজ, বলে ঐশী সামনে এগিয়ে চলল।
জামাল চাপা স্বরে বলল, ঐশী কাজটা তুমি ঠিক করলে না।
ঐশী আর কোন কথা না বলে মাথা নত করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।

পাঁচ

জামালের জীবনে কোন অপ্রাপ্তি ছিল না, সে জীবনে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, তাই ঐশীকে না পাওয়ার আঘাতটাই তার জীবনে প্রথম আঘাত। ফলে তার জীবনের সমস্ত গতিও যেন এলোমেলো হয়ে গেল। কলেজের ছাত্র রাজনীতি আর ঐশীকে এক পলক দেখার জন্য জামাল প্রতিদিন কলেজের সময়ে একবার কলেজে যেত কিন্তু ঐশী তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় জামাল কলেজ যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। আজকাল জামাল রাজনৈতিক কাজে ঘোরাফেরা ছাড়াও প্রতিদিন পাম্পে বসে কিন্তু তাতে পাম্পের কোন উন্নতি হয়নি বরং পাম্প থেকে জামাল কিছু টাকা পকেটস্থ করে একথা জেনেও জহির সাহেব খুশি হয়েছেন। কারণ সে দায়সারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ব্যবসা শিখছে। জামালের লেখাপড়া এইচ.এস.সি ভর্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ একথা তিনি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছেন তাই জামাল পাম্পে বসায় পড়াশুনায় মনোযোগী না হলেও কিছুটা ব্যবসার দিকে নিজেকে নিয়োজিত করেছে।
সেদিন বিকেলবেলা জামাল পেট্রোল পাম্পে বসেছিল। এমনসময় একটা মোটর সাইকেল পাম্পে এসে দাঁড়ালো। জামাল কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, হ্যাঁ আরিফ আর ঐশীই তো।
জামালের মাথায় রক্ত উঠে গেল। যেদিন আরিফ জামালের সাথে বাজি ধরেছিল, ঐশী জামালের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল সেদিনের ছবিগুরো জামালের মনের মধ্যে ভেসে উঠল।
মোটর সাইকেলে পেট্রোল লোড করে আরিফ ক্যাশে টাকা জমা দিতে এসে জিজ্ঞেস করল, কীরে জামাল ভালো আছিস?
আরিফের শেষের কথাটা যেন জামালের হৃদয়ে বিদ্ধ হলো। সে একবার মনে মনে বলল, শালা তুই যদি ওকে ভালোবাসিস তবে আমাকে নিয়ে তামাশা করলি কেন? আর ঐশী তুমি যদি ওকেই ভালোবাসো তবে সেদিন মিথ্যা কথা বললে কেন? কিন্তু জামাল তা বলল না। টাকা নিয়ে শুষ্ক মুখে জবাব দিল, ভালো, তবে তোদের মতো নেই রে।
আরিফ কোন কথা বলল না।
জামাল ক্রোধের সুরে বলল, মোটর সাইকেলটা কার?
আমার মামার, বলে আরিফ টাকা দিয়ে বের হয়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল, ঐশী মোটর সাইকেলে আরিফের গা ঘেঁষে বসল।
দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত জামাল ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।
জামাল ঐশীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল এবং আপনমনে ভালোবাসার ভুবন সাজিয়েছিল। কিন্তু ঐশী কোনদিন জামালের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি বরং বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে। এমন তো হতেই পারে কাউকে ভালোলাগা বা না লাগা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। ঐশী জামালের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে আরিফকে ভালোবেসেছে। এটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার, তার সঙ্গে জামালের কোন সম্পর্ক নেই। জামাল একথা মানতে রাজি নয়। সে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে দাঁত কড়মড় করে আপনমনে বলল, ঐশী তুমি আমাকে চেনোনি। তুমি মনে করো না আরিফকে ভালোবেসে তুমি সুখের সংসার সাজাবে, আমি তোমার স্বপ্ন চুরমার করে দিব। তারপর পাম্প থেকে বের হয়ে জামাল মোটর সাইকেল নিয়ে ছুটে চলল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে জামাল পৌঁছাল হিটলারের আড্ডায়। হিটলার জামালকে দেখে যেন চমকে উঠল, ভাইজান আপনি? আমাকে ডাকলেও তো পারতেন, ঠিক আছে ভিতরে আসেন।
জামাল হিটলারের পিছনে পিছনে ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে তার সংকল্পের কথা বলল।
হিটলার সবকিছু জেনে শুনে আমতা আমতা করে বলল, ভাইজান আপনি তো এ লাইনে নতুন। একথা আপনাকে কী করে যে বলি?
কোন সঙ্কোচ করার প্রয়োজন নেই, আপনি বলুন।
এইসব ছোট-খাটো কাজ আমি সাধারণত করি না কারণ এগুলো কাজে করে পোষায় না।
আমি পুষিয়ে দিব, আপনি বলুন, খরচ করতে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার কাজ হওয়া চাই।
অবশ্যই আপনার কাজ না হলে মাল ফেরত পাবেন, তবে দশ হাজার টাকা দিয়েন।
ঠিক আছে আপনি কালকেই টাকা পেয়ে যাবেন, কবে অ্যাকশনে যেতে চান?
মেয়ে মানুষ তো, ইচ্ছা করলেই হাটে বাজারে তো আর অ্যাটাক করা যায় না, তাই সময় দিতে হবে। আপনি বসে ঠিকানাটা লিখে দিন, বলে হিটলার তার পকেট থেকে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল।
জামাল পকেট থেকে কলম বের করে দিয়ে বলল, আমি বলছি আপনি লিখুন।
হিটলার মৃদু হেসে বলল, ভাইজানের মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে আপনি একদিন বড় নেতা হবেন। এখন নাম, ঠিকানা বলুন।
একথা কেন বললেন?
ভাইজান আজ প্রথম আপনার কেস হাতে নিলাম অথচ আজকেই আপনি আমাকে নাম ঠিকানা লিখে দিলেন না, তারমানে অপারেশনে আপনার কোন সাক্ষী রাখতে চান না। সেজন্যই বললাম।
জামাল নাম, ঠিকানা বলল এবং হিটলার সিগারেটের প্যাকেটে লিখে নিল।
হিটলার বলল, ভাইজান ঐ বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই তো?
না।
কলেজে ঐশী নামে আর কোন মেয়ে?
না, কিন্তু এতকিছু জানতে চাচ্ছেন কেন, বলুন তো?
যদি ঐশী নামে আরো কোন মেয়ে থাকে তবে তো টার্গেট ভুল হতে পারে সেজন্য জেনে নিলাম যেন টার্গেট ভুল না হয়। ভাইজান, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। হিটলার মাল খেলে কাজ করবেই, বলে হিটলার হ্যাণ্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

ছয়

ঐশী আর্টস এর ছাত্রী আর আরিফ সায়েন্সের ছাত্র। তাই সপ্তাহের প্রায় দিনে আরিফের কোন না কোন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস থাকে এবং ঐশীকে ক্লাস শেষ করে আরিফের জন্য অপেক্ষা করতে হয় লাইব্রেরি কিংবা গাছের নীচে বসে কিংবা অন্য কোন বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করে।
আরিফ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরিতে বসে ঐশীর সঙ্গে যোগ দেয়। লাইব্রেরিতে বসার জন্য ওদের দু ‘জনের একটা নির্ধারিত সিটও আছে। কাজেই কেউ কাউকে খুঁজে নিতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। আর লাইব্রেরির শেষ প্রান্তের ঐ সিটে ছাত্র-ছাত্রীরা তেমন একটা যায় না। ঐশী ক্লাস শেষ করে আরিফের জন্য অপেক্ষা করছিল। আরিফ ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরিতে ঢুকলো। আরিফের আসতে দেরি হওয়ায় ঐশী ততক্ষণে মুখ ভার করে বসেছিল দেখে আরিফ বলল, সরি ঐশী আজ একটু দেরি হয়ে গেল, চলো বের হই।
ঐশী জিজ্ঞেস করল, তোমার কি কোন তাড়া আছে?
না কেন?
ভাবছিলাম তোমার আগে ক্লাস শেষ হলে আজ একবার স্বপ্ন কুঞ্জ যাব, কিন্তু তুমি তো দেরি করে ফেললে চলো এখন একসঙ্গে বের হয়ে বাসায় যাই আর কি? বলে ঐশী শুষ্ক হাসি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
আরিফ একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ঐশীর হাত চেপে ধরে বলল, ঐশী মাইন্ড করেছ? প্লিজ একটু বসো এখানে বসেই না হয় একটু গল্প করি। তারপর স্বপ্ন কুঞ্জ যাব।
ঐশী আপত্তি করল না আবার চেযারে বসে বলল, আজ বাংলা ক্লাসে আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিলে কেন?
শুধু তখন কেন এখনো তো তাকাচ্ছি।
কেন?
তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, তাই। তোমার চেহারার সঙ্গে পোশাকটা খুব সুন্দর মানিয়েছে। তাই বার বার তোমার দিকে চোখ যাচ্ছিল।
ঐশী লজ্জায় মাথা নত করল। এসময় লাইব্রেরিয়ান এসে বলল, তোমরা যাবে না? লাইব্রেরি বন্ধ করবো তো।
হুঁম, চলো, বলে আরিফ উঠল সঙ্গে সঙ্গে ঐশীও উঠে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ থেকে বের হলো।
কলেজ থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটার পর একটি ছোট্ট পানের দোকানের সামনে আসতেই কয়েকজন ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন ঐশীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার না ঐশী না?
একসঙ্গে কয়েকজন মাস্তান টাইপের ছেলেকে হঠাৎ সামনে দাঁড়াতে দেখে ঐশীর গলা শুকিয়ে গেল সে একটা ঢোক গিলে বলল, জি।
আর এই ছেলের নাম বুঝি আরিফ?
ঐশী নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। আরিফ সভয়ে মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল। একজন আরিফের শার্টের কলার ধরে বলল, এই শালা তোর বাড়ি কোথায়?
আরিফ একটা ঢোক গিলে বলল, নয়নপুর।
শালা ঐশী আমাদের মহল্লার মেয়ে, তুই কোন অজো পাড়া গাঁ থেকে এসে আমাদের মহল্লার মেয়ের সঙ্গে পিটিস পিটিস করার সাহস করিস।
ঐশী থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, কে আপনারা? আমি তো আপনাদের চিনি না।
একটা কথাও না। পড়ালেখা করতে এসে ঐ ছেলের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বেড়াও না? শহরের একটা মান ইজ্জত আছে। আর যদি তোমাকে কোনদিন ঐ ছেলেটার সঙ্গে দেখছি তবে তোমার এই সুন্দর মুখ খানার চেহারা পাল্টে দিব, বলে জোরে রিক্সা বলে একটা ডাক দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা রিক্সা এস দাঁড়ালো, সন্ত্রাসীদের একজন বলল, এই রিক্সা এই মেয়েকে বাসায় নিয়ে যা বলে সে লম্বা চুল ওয়ালা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই টাইগার বাবু এই শালাকে নিয়ে চল সাইজ করে ওর গ্রামের বাড়িতে বুক করে দিব, শালা হারামজাদা বলে তারা আরিফকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
ঐশী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, আপনারা ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ, ওর কোন দোষ নেই।
দোষ আছে কি না সেটা পরে হবে আগে উত্তম-মধ্যম হয়ে যাক তারপর.. বলে আবার আরিফকে তুলে নিয়ে যাবার জন্য টানতে লাগল এসময় কয়েকজন পথচারী চলে আসায় তারা আরিফকে কয়েকটি কিল ঘুষি মেরে চলে গেল। পথচারীসহ ধীরে ধীরে লোকের ভিড় জমে গেল। কৌতূহলী সকলের একটাই জিজ্ঞাসা কী হয়েছিল? ওরা তোমাদের মারল কেন?
কী জবাব দিবে ঐশী? কিছু বলতে গেলেই তাদের ভালোবাসার কথা জেনে ফেলবে, তার চরিত্রের ওপর কলঙ্ক মেখে যাবে। সারা শহরে খবরটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়বে। ঐশী আর আরিফ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রিক্সায় উঠল।
পথচারীদের কয়েকজন ফিস ফিস করে বলল, নিশ্চয়ই এদেরও কোন দোষ আছে, নইলে কোনকিছু না বলে পালাবে কেন? দু ‘একজন সায় দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই কোন ঘটনা আছে আর আজকালকার ছেলেমেয়েরাও যা হয়েছে।

সাত

স্বপ্ন কুঞ্জ পার্কে দু’জনে আরো কয়েকবার এসেছে। এখানে শহরের হৈ চৈ নেই, যন্ত্র দানবের বিকট শব্দ নেই, পরিচিত মানুষের চোখে পড়ার ভয় নেই। তাই আপনজনদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে মনের একান্ত গোপন কথা বলার মতো স্থান হিসেবে স্বপ্ন কুঞ্জ পার্কের বিকল্প নেই। পার্কে ঢুকতেই একটা সরু ফুটপাথ পার্কের ভিতরে চলে গেছে, ফুটপাথের দু’পাশে সারি সারিভাবে সাজানো পাতাবাহার গাছ। কিছুদূর যাবার পর রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়েছে, ডানের রাস্তাটা চলে গেছে মাটির তৈরি কৃত্রিম প্রাণী জগতে আর বাঁয়ের রাস্তাটা চলে গেছে নদীর দিকে, যেখানে প্রকৃতির অপরূপ শোভা ফুটে উঠেছে। নদীর পাড়ে ঘাট বাঁধানো হয়েছে। এই ঘাটে বসে নদীর দিকে তাকালে মন শান্ত হয়ে যায়, আকাশের দিকে তাকালে অনেক সঙ্কীর্ণ মনের মানুষের মনও আকাশের মতো উদার হয়। এই ঘাট বাঁধা জায়গাটা আরিফের খুব পছন্দ, ঐশীরও। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে তাদের সেই পছন্দের বাঁধানো ঘাটে এসে বসল। অনেকক্ষণ দু’জনে নীরবে বসে রইল। আজ দু’জনের কারো মুখে তেমন কোন কথা নেই একটা অজানা আশঙ্কায় যেন তাদের উচ্ছলতা কেড়ে নিয়েছে। আরিফ অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়েছিল। ঐশীও দূর দিগন্তে তাকিয়ে প্রকৃতির রূপ দেখছিল।
ঐশী নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল, আরিফ তুমি কি কোন ক্লু খুঁজে পেলে?
অনেকক্ষণ পর আরিফ যেন ভয়ঙ্কর এক কল্পনার জগত থেকে ফিরে এলো, সে ঐশীর কথার কোন উত্তর দিতে পারল না সে উল্টো জিজ্ঞেস করল, না, তুমি খুঁজে পেয়েছ?
আমার মনে হচ্ছে জামালই এদেরকে কাজে লাগিয়েছে।
তুমি কীভাবে বুঝলে?
কলেজে ভর্তির পর থেকে জামাল আমার পিছু নিয়েছে, প্রথমে সে আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছিল, আমি অসম্মতি জানানোর পর একদিন কলেজ যাবার পথে আমার পথরোধ করে অনেক কিছু বলেছে, সবদিক ফেল করার পর সে কোন ভাড়াটে সন্ত্রাসীকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার পথ বেছে নিয়েছে।
আরিফ বলল, ঐশী তোমার ধারণাই ঠিক, জামাল পারে না এমন কোন কাজ নেই। তাছাড়া ওর সঙ্গে আছে ক্ষমতাসীন দলের ডিসট্রিক্ট লিডাররা। লিডারদের আছে তাঁদের লালিত সন্ত্রাসী।
ঐশীর মুখ শুকিয়ে গেল, এখন কী হবে?
এভাবে লুকিয়ে দেখা করতে করতে যদি আবার কোনদিন কলেজে কিংবা রাস্তা-ঘাটে আমাদের দেখে ফেলে? তোমার কোন ক্ষতি করে?
আরিফের কথা শুনে ঐশীর কণ্ঠস্বর শুকিয়ে গেল। জামালকে সে ভয় করে, জামাল পারে না এমন কাজ নেই কিন্তু সে আরিফকে তার ভয়ের কথা জানতে দিতে চায় না। সে একটু দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমি আমার কথা ভাবছিনা, তুমি গ্রাম থেকে আসো, ওরা তোমাকে একা পেয়ে যদি-
আরিফ ঐশীর কথার মাঝে তাকে বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু ওরা যেভাবে বলল তাতে তো বুঝলাম আমার সঙ্গে মেলামেশা করলে ওরা এসিড মেরে তোমার মুখ ঝলসে দিবে।
ঐশী আরিফের পাশে এসে গা ঘেঁষে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, আরিফ এখন কী হবে?
আরিফ বলল, এত ভয় পাবার কিছু নেই, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
এমনিতেই তোমাকে না দেখে আমি একদিনও থাকতে পারিনা। বাবা আগে থেকেই আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখে, পরীক্ষাও শেষ কাজেই বাসার বাইরে বের হওয়ার মতো আর কোন কারণ নেই তারপর আছে জামাল দেখে ফেলার ভয়। এতকিছু সামাল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি তোমার সঙ্গে কীভাবে দেখা করবো?
আরিফ সান্ত্বনার সুরে বলল, ঐশী আমি তোমাকে একটা কথা বলব বলে ভাবছি তুমি যদি কিছু মনে না কর তবে বলি।
বলো আরিফ আমি কিছু মনে করবো না।
আরিফ তার কাঁধ থেকে ঐশীর হাতটা নামিয়ে তার হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দিল। ঐশী আরিফের মুখের দিকে তাকালো, আরিফ ঐশীর চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ঐশী চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।
ঐশী যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো তার চোখে-মুখে যেন আলোর ঝিলিক ফুটে উঠল, সে মৃদু হেসে বলল, তুমি আমার মনের কথাটাই বলেছ আরিফ। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার ভয় হয় আরিফ।
কীসের ভয়?
তোমাকে আমার খুব ভীরু আর কেমন জানি খুব দুর্বল বলে মনে হয়।
মানে?
মানে আমার মনে হয় শেষে আমরা যদি কোন ঝামেলায় পড়ি তবে তুমি সামাল দিতে-
আরিফের জিদ চেপে গেল, সে ঐশীর মাথার থুতনিতে উঁচু করে ধরে চাপাস্বরে বলল, ঐশী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার আমার চোখের ভাষা পড়ে দেখোতো আমি তোমার জন্য কী করতে পারবো আর কী করতে পারবো না। আমি তোমার জন্য সব পারবো, সব। চলো এখনি চলো কাজি অফিসে আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাব।
ঐশী কয়েক মুহূর্ত আবেগে চোখ বুজে রইল তারপর তার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো, আমি বুঝতে পারছি আরিফ তুমি আমার জন্য সব পারবে, সব, বলতে বলতে ঐশীর গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
আরিফ ঐশীর চোখের পানি মুছে দিতে দিল।
ঐশী বলতে শুরু করল, আমি জামালকে কোনদিন ভালোবাসিনি, তুমি আর শরীফ দু’জনে অযথা জামালের জেদ উঠিয়ে দিয়ে একটা ঝামেলা পাকিয়েছ।
আরিফ কিছু না বলে নীরবে বসে রইল।
ঐশী রুদ্ধ কণ্ঠে বলতে শুরু করল, আমার এক ফুপু আছে ঢাকায়, ফুপু উকিল। কোনভাবে ফুপুর বাসায় পৌঁছাতে পারলেই আমাদের সব দায়িত্ব ফুপুই নিবে এর মধ্যে আমি ফুপুর সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করি। আরিফ আমাদের বোধ হয় এখন অনেক টাকার প্রয়োজন, তাই না?
তুমি সে চিন্তা করো না। টাকার ব্যবস্থা একটা হবেই।
আমার মনে হয় টাকার সমস্যা আমাদের হবে না, আমার অনেক গয়না আছে, বাবার স্টিল আলমারির চাবি আমার কাছেই থাকে কাজেই টাকার ভাবনাটা তুমি আমার উপরই ছেড়ে দাও, তুমি অন্য সব আয়োজন করো।
আরিফ ঐশীর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো ঐশী, সবকিছু এরেঞ্জ করে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।
তারপর দু’জনে উঠে দাঁড়ালো পরস্পরের হাত ধরে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়ল।

আট

কলেজে নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। মাঠের একাংশে ইট, বালি, রড, স্তূপাকারে রাখা হয়েছে তারই পাশে একদল মিস্ত্রি রড বাইন্ডিং এর কাজ করছে। জামাল তার মোটর সাইকেলে আরো দু’জন সঙ্গী নিয়ে নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রিকে ডাক দিল, হেড মিস্ত্রি, এই হেড মিস্ত্রি আছ নাকি?
একজন মিস্ত্রি সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান আমাকে ডেকেছেন?
জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, তোমার হেড মিস্ত্রি কোথায়? ডাকো।
জামালের উচ্চস্বরে কথা বলা শুনে খরশেদ বেরিয়ে এলো, ভাইজান কি আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ, সেদিন যে বলে গেলাম তোমার কন্ট্রাক্টরকে আমার সঙ্গে দেখা করতে, বলেছিলে?
জি ভাইজান বলেছিলাম।
তারপর-
তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
কবে আসবে?
জি আজই আসবেন আপনারা একটু বসুন বলে খরশেদ আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল জামাল বাধা দিয়ে বলল, না আমাদের বসার সময় নেই, দেখো খরশেদ মিয়া পিছলা পিছলি করে কোন কাজ হবে না। তোমার কন্ট্রাক্টরকে টাকা দিতে বলবা, টাকা না দিলে তুমি রড নিয়ে যতই আঁকা বাঁকা করো ছাদ ঢালাই করতে পারবা না, বলে জামাল মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছিল।
এমুহূর্তে খরশেদ একটা প্রাইভেট কার আসতে দেখে বলল, একটু দাঁড়ান ভাইজান কন্ট্রাক্টর সাহেব আসছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ালো। প্রাইভেট কার থেকে এক ভদ্র লোক নেমে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে খরশেদ?
জামাল হ্যাণ্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিছুটা গর্ব সহকারে নিজের পরিচয় দিল, আমি জামাল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং কলেজের ছাত্র সংসদের জি.এস।
আমি শফিউল ইসলাম, ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাই টেক ইঞ্জিনিয়ার্স লি: বলে শফিউল সাহেব হ্যাণ্ডশ্যাক করে বললেন, তোমরা কী মনে করে এদিকে?
আমাদের সংগঠন থেকে কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান করছি। সেজন্য আপনার কাছে এসেছি।
আমার কাছে কেন?
নবীন বরণে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তো তাই আপনাকেও দশ হাজার টাকা অনুদান ধরা হয়েছে।
তোমাদের নবীন বরণে আমাকে দশ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে?
হ্যাঁ, এত বড় বিল্ডিংয়ের কাজ পেয়েছেন, দশ হাজার টাকা চাঁদা তো সামান্য ব্যাপার।
শফিউল সাহেবের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল, তিনি কোন রকমে নিজেকে সংবরণ করে বললেন, হ্যাঁ আমি অনেক বড় বিল্ডিংয়ের কাজ করছি তাই আমাকেও দশ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে, না? দশ হাজার টাকা সামান্য ব্যাপার, না? এখানো লেখাপড়া করছ তো তাই টাকা রোজগার করা কত কঠিন তা বুঝতে পাচ্ছ না। যখন টাকা রোজগার করবে তখন বুঝবে।
তারমানে আপনি টাকা দিবেন না। তাহলে আমরাও দেখি আপনি কীভাবে কাজ করেন?
শফিউল সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, তিনি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি চিৎকার করে বললেন, আমি কীভাবে কাজ করি দেখতে চাও? তবে আমিও দেখি তোমাকে টাকা না দিয়ে কাজ করা যায় কি না? প্রয়োজন বোধে আমি তোমার নামে মামলা করবো, তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো, আমিও শফিউল ইসলাম জীবনে কোনদিন চাঁদা দিয়ে কাজ করিনি আজকেও চাঁদা দিব না। যাও আমার সাইট থেকে বেরিয়ে যাও। আবার কোনদিন এলে পুলিশে দিব।
আপনি আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন? আপনি আমাকে চিনতে ভুল করছেন। আমি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা পুলিশের কাছে গিয়ে কোন লাভ হবে না। কারণ বলে জামাল বিশেষ ভঙ্গীতে আঙ্গুল তুড়ি মেরে বলল, পুলিশ আমাকে ধরবে না।
আজ তোমাকে ছেড়ে দিলাম আবার যদি কোনদিন চাঁদা চাইতে এসো তবে ফিরে আর বাসায় যেতে পারবে না, হাজতে যেতে হবে মনে রেখো দেশে এখনও আইন আছে এবং আইন সবার জন্য সমান।
বুঝছি সোজা রাস্তায় কাজ হবে না, বাঁকা রাস্তায় টাকা আদায় করতে হবে, চল বলে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে তিনজনই চলে গেল।
শফিউল সাহেব অনেকদিন থেকে ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। প্রতিদিন অজস্র ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে উঠতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার কাছে এসব ঝামেলা অত্যন্ত নগণ্য। তিনি জামালের এসব আস্ফালনে মোটেই ভয় পেলেন না। তিনিও তার স্টাফদের নিরাপত্তা এবং জামালকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

নয়

শফিউল সাহেব থানার সামনে গাড়ি দাঁড় করে ওসি সাহেবের রুমে প্রবেশ করে নিজের পরিচয় দিলেন। ওসি সাহেব একবার শফিউল সাহেবের আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন ঠিকাদার সাহেব আপনার জন্য কী করতে পারি?
আমি কলেজে একটা বিল্ডিংয়ের কাজ করছি। কয়েকদিন থেকে কলেজে নবীন বরণের জন্য কয়েকজন ছাত্র আমার কাছে দশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করছে। প্রথম দিন আমার মিস্ত্রির কাছে টাকা দাবি করার পর আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ সরাসরি আমার কাছে টাকা চাইল, টাকা না দিলে কাজ বন্ধ করার হুমকি দিল। তাই আমি কেস করতে এসেছি।
ওসি সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, দেখুন পুলিশ জনগণের বন্ধু। জনগণের জান মাল রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পুলিশের। আসলে জানেন কী সবাই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে একটা দফা-রফা করে ফেলে আপনি যখন এসেছেন তখন আমরা তো অ্যাকশন না নিয়ে পারি না, বলুন।
শফিউল সাহেব বললেন, জি সবই তো আপনাকে বললাম।
বিবাদীর নাম বলুন।
জামাল।
ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, পিতার নাম?
শফিউল সাহেব বললেন, পিতার নাম তো জানি না।
আর কোন পরিচয়?
যতটুকু জেনেছি ছেলেটা কলেজে পড়ে, খুব সম্ভব সে কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক।
জি হতে পারে, বলে কলমটা টেবিলের ওপর রেখে ওসি সাহেব বললেন, ভালো ছেলে, ধনী মানুষের ছেলে, নিজেদেরই টাকা-পয়সার অভাব নেই অথচ কেন যে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল। কী জন্য টাকা চেয়েছিল যেন? বলেই ওসি সাহেব চেয়ার থেকে উঠলেন।
নবীন বরণ অনুষ্ঠানের জন্য।
ওসি সাহেব যেন অবাক হলেন তিনি যেন এমন কথা জীবনে শোনেন নি, কলেজে নবীন বরণের জন্য, বলে আবার একটা ঢোক গিলে বললেন, ঠিকাদার সাহেব আপনি একটা কাজ করুন।
জি বলুন।
ওরা ছেলে-পেলে মানুষ নবীন বরণ করতে চায় সে জন্য আপনার কাছে কিছু টাকা চেয়েছে আমার মনে হয় সামান্য ক’টা টাকা আপনার দিয়ে দেওয়াই ভালো।
তারমানে আপনিও আমাকে চাঁদা দিতে বলছেন?
বিষয়টাকে ঠিক সেভাবে নিবেন না। ছোট ভাইদের শখ। আপনি না হয় কিছু- আই মিন কন্ট্রিবিউট করলেন।
শফিউল সাহেব হঠাৎ রাগান্বিত স্বরে বললেন, তারমানে আপনি কেস নিবেন না?
ওসি সাহেব মৃদু হেসে বললেন, রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার কেস নিতে আপত্তি নেই কিন্তু তারপর কি হবে ভেবেছেন? রাতের আঁধারে নতুন সিমেন্টের কাজ ভেঙ্গে দিবে, আপনার লেবার মিস্ত্রিদের মারধর করবে। পুলিশ আপনাকে কতক্ষণ প্রটেকশন দিবে? বলুন?
আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারছেন না।
দেখুন জনসাধারণের তুলনায় আমাদের দেশে পুলিশের যে সংখ্যা তাতে শুধু পুলিশ দিয়ে জনগণের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। তাই আমার মনে হয় ছোট-খাট বিষয় নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে চলা উচিত। তারচেয়ে আপনি একটা জি.ডি করুন। দেখি আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারি কি না?
শফিউল সাহেব কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, তাই করুন ওসি সাহেব।
ওসি সাহেব কর্তব্যরত একজন পুলিশ অফিসারকে তাঁর কাছে ডেকে জি.ডি এন্ট্রি করালেন, তারপর হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য শফিউল সাহেবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনি এবার আসুন। ভয় পাবেন না ব্যাপারটা আমি দেখছি।
শফিউল সাহেব বের হয়ে যাওয়ার পর ওসি সাহেব মনে মনে বললেন, জামাল তুমি আমাকে একদিন দলের ক্ষমতা দেখাইছ তাই আজ কেস নিলাম না কেস নিলে তো তোমার দল ক্ষমতায় থাকাকালেই খবর পেয়ে যাবে। তোমার দল চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না সেদিন এই জি.ডি দিয়ে আমি মামলা চালু করে দিব, সেদিন দেখবে পুলিশের সাথে মাস্তানির কী মজা?

দশ

আরিফ ঐশীকে রাত বারোটায় রেডি থাকতে বলেছে, সে অনুযায়ী ঐশী তার বাবার স্টিল আলমারি থেকে নগদ টাকা, তার নিজের এবং মায়ের গয়না সবকিছু নিয়ে আরিফের মোবাইল থেকে মিস কল পাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঐশীর মোবাইল বেজে উঠল ঠিক রাত বারোটা দশ মিনিটে। ঐশী ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হলো। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই ঐশীর চোখে পড়ল একটা মাইক্রো বাস দাঁড়িয়ে আছে। ঐশী মাইক্রো বাসের কাছে যেতেই আরিফ মাইক্রো বাস থেকে বের হলো। তারপর দু ‘জনে মাইক্রো বাসে উঠল।
ঐশী তার ঢাকায় যাবার কথা আগেই তার লিলি ফুপুকে বলেছিল। লিলির ধারণা ছিল ঐশীর পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাই হয়ত ঢাকায় বেড়াতে আসবে কিন্তু ঐশীর সঙ্গে অপরিচিত ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ও কে মা?
ঐশী বলল, ফুপু অনেকদূর থেকে এসেছি আগে-
ও হ্যাঁ, মা তোরা হাত মুখ ধুয়ে বস আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
লিলি ঐশীকে খুব স্নেহ করেন। তিনি ঐশীর বাবার একমাত্র ছোট বোন। ঢাকা থেকে ঐশীর গ্রামের বাড়ি অনেকদূরে হলেও লিলি দু‘য়েক মাস পর পর একবার গ্রামের বাড়িতে যাবেনই। গ্রামের বাড়িতে গিয়েই প্রথমে খুঁজবেন ঐশীকে। ঐশীকে পেলেই কাছে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন, ঢাকা থেকে তার জন্য নিয়ে যাওয়া জিনিস একটা একটা করে হাতে দিয়ে বলবেন, দেখ দেখি মা তোর পছন্দ হয় কি না?
ঐশী ফুপুর বুকে মাথা রাখত।
আজো লিলি ঐশীর পাশে বসে নিজ হাতে ঐশীর প্লেটে খাবার তুলে দিলেন। খাওয়া শেষে তিনি ঐশীকে তার বেড রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বল মা?
ঐশী লিলির বুকে মাথা রেখে আরিফের সঙ্গে তার পরিচয় থেকে শুরু করে বিয়ে করার উদ্দেশ্য তার বাসায় আসা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
সবকিছু শুনে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, তুই ঠিকই করেছিস মা, তোর বাপ জানলে কখনো তোর এই বিয়ে মেনে নিত না।
ঐশী অষ্ফুষ্টস্বরে বলল, ফুপু!
হ্যাঁ মা তোর বাপকে আমি চিনি। ও একটা স্বৈরাচার, ও কখনো তোর মতামতকে মূল্য দিত না।
ফুপু।
হ্যাঁ মা তুই অনেক কিছু জানিস না। এখন তুই বড় হয়েছিস আমি তোকে সব বলব।
বল ফুপু।
আমার অবস্থা ছিল ঠিক তোর মতোই। তোর চেয়ে অল্প বয়স থেকে আমিও আমার এক সহপাঠীকে ভালোবাসতাম। সহপাঠী বললে ভুল হবে আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী। শৈশব থেকে আমরা পাশাপাশি থেকে বড় হয়েছি। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন একদিন তোর বাবা আমার বালিশের নীচ থেকে তার লেখা একটা চিঠি পায়, ভাইয়া আমাকে খুব গালিগালাজ করে এবং তার সঙ্গে মেলামেশা না করার জন্য বলে। কিন্তু তাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারতাম না, লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা দেখা করতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে একদিন ভাইয়া আমাদেরকে রাস্তায় দেখে ফেলে, বাসায় ফেরার পর ভাইয়া আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রচণ্ড মার দেয়। তখন বাবা বেঁচে ছিল। আমার চিৎকার শুনে বাবা দরজা ভেঙ্গে আমাকে ভাইয়ার হাত থেকে উদ্ধার করে, না হলে হয়ত তোর এই লিলি ফুপুকে আর দেখতে পারতিস না।
সেদিনের পর আমিও তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে কোনদিন আমার সামনে আসেনি, আমার ধারণা ভাইয়া তাকেও কিছু বলেছে, হয়তবা জীবন নাশের হুমকি দেখিয়েছে। ছেলেটা ছিল ভদ্র, শান্ত এবং অতি সাধারণ পরিবারের। তার বাবা সরকারি চাকরি করতো, ধীরে ধীরে এ ঘটনাটা হয়তবা তার বাবার কানেও যায় এবং তার বাবা বদলি হয়ে যায়।
আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে এল.এল.বি ভর্তি হলাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও আমি তাকে মনে মনে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। এল.এল.বি পাস করার পর ওকালতি শুরু করলাম, বাবা ভাইয়াসহ আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু আমি সাফ কথা বলে দিয়েছি আমি বিয়ে করবো না। বলতে বলতে লিলির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
ফুপু তুমি-বলে ঐশী কী যেন বলতে যাচ্ছিল লিলি বাধা দিয়ে বললেন, কিছু না মা তোকে আসলে অনেককিছু বলে ফেললাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ মা, তোর মধ্যে আমি যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। আমি নিজে যা পারিনি তোকে দিয়ে তা করতে চাই।
ফুপু।
এই যে, দেখছিস আমার বাড়ি-গাড়ি বিষয়-সম্পত্তি এসব আমি কার জন্য করছি। আমার তো কেউ নেই, এসব আমি তোকে দিব, আরিফকে দিব আর তোকে আমি প্রতিষ্ঠিত করে তোর বাপকে দেখাবো, আমি আজোই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।
ফুপু আব্বা যদি-
তোর বাপ আর কী করবে? হয়ত খোঁজাখুঁজি করবে, আমাকেও টেলিফোন করতে পারে কিন্তু তোদের কিছু করতে হবে না মা তুই আমার কাছে এসেছিস। এখন চল মা আরিফ তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ ফুপু চলো।
লিলিকে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে দেখে আরিফ উঠে দাঁড়ালো।
লিলি বললেন, বসো বাবা, তোমরা দু ’জনে গল্প কর আমি আসছি।
লিলি চলে গেলে আরিফ ঐশীকে জিজ্ঞেস করল, কী হলো ঐশী?
কী হলো মানে? তোমাকে বলেছিলাম না লিলি ফুপুর কাছে পৌঁছাতে পারলে আর কোন সমস্যা নেই। ফুপু এখন আমাদেরকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। দেখ আজোই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
সব ঠিকঠাক মানে?
আরো খুলে বলতে হবে?
বিয়ে? আজই!
ঐশী মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
আরিফ আবেগ আল্পুত হয়ে দু’হাত বাড়িয়ে ঐশীকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, উঁহু, এখন না, একটু দেরি করো।
আরিফও থমকে দাঁড়ালো, তারপর আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ঐশী ইউ আর সো গ্রেট।
ঐশী বিশেষ ভঙ্গীতে বলল, আমি না ফুপু।

এগারো

জামালের চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত অনেকদূর গড়িয়েছে। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত জামালের উপর অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চাঁদা চাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিসে মিটিং বসেছে। জামাল মিটিংয়ে খুব অশ্বস্থি বোধ করছে সবাই কেমন যেন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। মোস্তফা সাহেব প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন, জামাল তোমার চাঁদা চাওয়ার ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে, তুমি কি জানো?
জামালের মুখ শুকিয়ে গেল, না তো বড়ভাই।
ঠিকাদার সাহেব থানায় গিয়েছিলেন কেস করতে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব কেস নেয়নি তবে তোমার নামে জি.ডি করেছে।
বেলায়েত সাহেব বললেন, তারপরও বেটা ক্ষান্ত হয়নি, আমাদের দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা তার কেমন যেন আত্মীয় হয়, তাকে কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছে, তিনি ঢাকা থেকে টেলিফোন করেছিলেন আমরা যেন তার দিকে খেয়াল রাখি। বুঝলাম বেটার হাত অনেক লম্বা, তুমি আর সাইটে যাবে না কখনো।
বড়ভাই আমি মনে করেছিলাম কলেজে নবীন বরণ করবো টাকার প্রয়োজন। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো তাই চলে গেলাম, আসলে এটা যে শেষ পর্যন্ত এতদূর গড়াবে বুঝতে পারিনি।
মোস্তফা সাহেব বললেন, যা হবার হয়ে গেছে এখন আর ভেবে লাভ নেই।
বড়ভাই ছোট বড় সব দলই একের পর এক কলেজে নবীন বরণ করছে, আমি ক্ষমতাসীন দলের লিডার কলেজে নবীন বরণ না করলে তো আমাদের সম্মান থাকে না। তাছাড়া দলের ভাবমূর্তি বলে একটা কথা আছে না?
বেলায়েত সাহেব বললেন, হ্যাঁ তুমি অবশ্যই নবীন বরণ করবে।
কীভাবে? টাকা পাবো কোথায়? জামাল জিজ্ঞেস করল।
মোস্তফা সাহেব জামালের কানে ফিস ফিস করে কী যেন বললেন, তখনই জামাল হেসে উঠল।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে জামাল সোজা পাম্পে এসে বসল। এমনসময় তার মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
অপর পাশ থেকে শরীফের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল একটা খবর শুনেছিস?
শরীফ কথাটা এমনভাবে বলেছে যে শুনেই জামালের বুক কেঁপে উঠেছে, কী খবর?
আরিফ আর ঐশী পালিয়েছে।
পালিয়েছে মানে?
পালিয়েছে মানে পালিয়ে বিয়ে করেছে।
ঐশী আর আরিফের পালিয়ে বিয়ে করার কথা শুনে জামালের মাথায় রক্ত উঠে গেল। ক্ষোভে আর অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। মোটর সাইকেল নিয়ে বাসায় চলে গেল। সারাদিন আর বাসা থেকে বের হয়নি। বাসার বাইরে বের হতেই তার যেন মনে হচ্ছে আকাশ-বাতাস সবকিছু তাকে ব্যঙ্গ করছে। কিন্তু বাসায় থেকেও সে যেন শান্তি পাচ্ছে না। সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো।

রাস্তায় ছোট্ট একটা পানের দোকান এবং দোকানকে ঘিরে কয়েকজন বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জামালকে চিনে ফেলল, জামাল না?
জামাল মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল, আপনাকে তো চিনলাম না।
আমি খোকন প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম।
জামাল একবার খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি।
এখানে কেন বন্ধু?
সে অনেক কথা, তুই এখানে কেন?
আমি অনেকদিন থেকে এখানকার রেগুলার কাস্টমর, তুই বুঝি আজ প্রথম?
জামাল একটা ঢোক গিলে বলল, জি।
জামাল তুই ভুল করলি বন্ধু এটা খারাপ লাইন এখানে কেউ একবার এলে আর ফেরত যেতে পারে না। এখানকার মরণ নেশার ছোবলে সবাই নষ্ট হয়ে যায়। তুই ফিরে যা বন্ধু, প্লিজ।
না বন্ধু তা হয় না, আমার অনেক কষ্ট আমি কষ্ট ভুলতে এসেছি, আমার মনের সব বোঝা হালকা করতে এসেছি।
তোর কীসের কষ্ট? ছেক পেয়েছিস?
জামাল কিছু বলল না, নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
খোকন বলল, বন্ধু আমিও ছেক পেয়ে তোর মতো এখানে কষ্ট ভুলতে এসেছিলাম কিন্তু কষ্ট ভুলতে এসে ফেন্সিডিলের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখন প্রতিদিন এক বোতল ফেন্সিডিল না খেলে হয় না। আমি চাই না তুই আমার মতো আসক্ত হয়ে পড়।
কিন্তু আমি যে আর সইতে পারছি না বন্ধু আমি আজ যখন এখানে এসেছি তখন মাল না খেয়ে যাব না, তোকে আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন আমি এখানে আসবো না, বলে জামাল দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক বোতল ফেন্সিডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যে জামালের দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। সে দ্রুত মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে বাসায় চলে গেল।
জামাল সাধারণত এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে না। আজ তাকে বাসায় ফিরতে দেখে ফাহমিদা কিছুটা বিস্মিত হলেন। তিনি মনে মনে কিছুটা খুশিও হলেন। কিন্তু জামালকে মোটর সাইকেল রেখেই বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে ফাহমিদা জামালের কপালে হাত দিয়ে বললেন, কী হয়েছে বাবা?
জামাল বলল, মা তুমি যাও তো আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
কেন বাবা? তোকে তো কোনদিন একা থাকতে দেখিনি, বল কী হয়েছে তোর?
জামাল বিরক্তির স্বরে বলল, মা তুমি যাও তো।
ফাহমিদা আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে তখন ঐশীর ছবি ভেসে উঠছে। জামাল ঐশীর এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঘুমের মধ্যেও বার বার দাঁত কড়মড় করে উঠল।
চলবে…জামালের চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত অনেকদূর গড়িয়েছে। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত জামালের উপর অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চাঁদা চাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিসে মিটিং বসেছে। জামাল মিটিংয়ে খুব অশ্বস্থি বোধ করছে সবাই কেমন যেন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। মোস্তফা সাহেব প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন, জামাল তোমার চাঁদা চাওয়ার ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে, তুমি কি জানো?
জামালের মুখ শুকিয়ে গেল, না তো বড় ভাই।
ঠিকাদার সাহেব থানায় গিয়েছিলেন কেস করতে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব কেস নেয়নি তবে তোমার নামে জি.ডি করেছে।
বেলায়েত সাহেব বললেন, তারপরও বেটা ক্ষান্ত হয়নি, আমাদের দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা তার কেমন যেন আত্মীয় হয়, তাকে কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছে, তিনি ঢাকা থেকে টেলিফোন করেছিলেন আমরা যেন তার দিকে খেয়াল রাখি। বুঝলাম বেটার হাত অনেক লম্বা, তুমি আর সাইটে যাবে না কখনো।
বড়ভাই আমি মনে করেছিলাম কলেজে নবীন বরণ করবো টাকার প্রয়োজন। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো তাই চলে গেলাম, আসলে এটা যে শেষ পর্যন্ত এতদূর গড়াবে বুঝতে পারিনি।
মোস্তফা সাহেব বললেন, যা হবার হয়ে গেছে এখন আর ভেবে লাভ নেই।
বড়ভাই ছোট বড় সব দলই একের পর এক কলেজে নবীন বরণ করছে, আমি ক্ষমতাসীন দলের লিডার কলেজে নবীন বরণ না করলে তো আমাদের সম্মান থাকে না। তাছাড়া দলের ভাবমূর্তি বলে একটা কথা আছে না?
বেলায়েত সাহেব বললেন, হ্যাঁ তুমি অবশ্যই নবীন বরণ করবে।
কীভাবে? টাকা পাবো কোথায়? জামাল জিজ্ঞেস করল।
মোস্তফা সাহেব জামালের কানে ফিস ফিস করে কী যেন বললেন, তখনই জামাল হেসে উঠল।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে জামাল সোজা পাম্পে এসে বসল। এমনসময় তার মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
অপর পাশ থেকে শরীফের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল একটা খবর শুনেছিস?
শরীফ কথাটা এমনভাবে বলেছে যে শুনেই জামালের বুক কেঁপে উঠেছে, কী খবর?
আরিফ আর ঐশী পালিয়েছে।
পালিয়েছে মানে?
পালিয়েছে মানে পালিয়ে বিয়ে করেছে।
ঐশী আর আরিফের পালিয়ে বিয়ে করার কথা শুনে জামালের মাথায় রক্ত উঠে গেল। ক্ষোভে আর অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। মোটর সাইকেল নিয়ে বাসায় চলে গেল। সারাদিন আর বাসা থেকে বের হয়নি। বাসার বাইরে বের হতেই তার যেন মনে হচ্ছে আকাশ-বাতাস সবকিছু তাকে ব্যঙ্গ করছে। কিন্তু বাসায় থেকেও সে যেন শান্তি পাচ্ছে না। সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো।

রাস্তায় ছোট্ট একটা পানের দোকান এবং দোকানকে ঘিরে কয়েকজন বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জামালকে চিনে ফেলল, জামাল না?
জামাল মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল, আপনাকে তো চিনলাম না।
আমি খোকন প্রাইমারি স্কুলে এক সঙ্গে পড়তাম।
জামাল একবার খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি।
এখানে কেন বন্ধু?
সে অনেক কথা, তুই এখানে কেন?
আমি অনেকদিন থেকে এখানকার রেগুলার কাস্টমর, তুই বুঝি আজ প্রথম?
জামাল একটা ঢোক গিলে বলল, হুঁম।
জামাল তুই ভুল করলি বন্ধু এটা খারাপ লাইন এখানে কেউ একবার এলে আর ফেরত যেতে পারে না। এখানকার মরণ নেশার ছোবলে সবাই নষ্ট হয়ে যায়। তুই ফিরে যা বন্ধু, প্লিজ।
না বন্ধু তা হয় না, আমার অনেক কষ্ট আমি কষ্ট ভুলতে এসেছি, আমার মনের সব বোঝা হালকা করতে এসেছি।
তোর কিসের কষ্ট? ছেক পেয়েছিস?
জামাল কিছু বলল না, নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
খোকন বলল, বন্ধু আমিও ছেক পেয়ে তোর মতো এখানে কষ্ট ভুলতে এসেছিলাম কিন্তু কষ্ট ভুলতে এসে ফেন্সিডিলের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখন প্রতিদিন এক বোতল ফেন্সিডিল না খেলে হয় না। আমি চাই না তুই আমার মতো আসক্ত হয়ে পড়।
কিন্তু আমি যে আর সইতে পারছি না বন্ধু আমি আজ যখন এখানে এসেছি তখন মাল না খেয়ে যাব না, তোকে আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন আমি এখানে আসবো না, বলে জামাল দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক বোতল ফেন্সিডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যে জামালের দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। সে দ্রুত মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে বাসায় চলে গেল।
জামাল সাধারণত এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে না। আজ তাকে বাসায় ফিরতে দেখে ফাহমিদা কিছুটা বিস্মিত হলেন। তিনি মনে মনে কিছুটা খুশিও হলেন। কিন্তু জামালকে মোটর সাইকেল রেখেই বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে ফাহমিদা জামালের কপালে হাত দিয়ে বললেন, কী হয়েছে বাবা?
জামাল বলল, মা তুমি যাও তো আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
কেন বাবা? তোকে তো কোনদিন একা থাকতে দেখিনি, বল কী হয়েছে তোর?
জামাল বিরক্তির স্বরে বলল, মা তুমি যাও তো।
ফাহমিদা আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে তখন ঐশীর ছবি ভেসে উঠছে। জামাল ঐশীর এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঘুমের মধ্যেও বার বার দাঁত কড়মড় করে উঠল।

বারো

ফয়সাল সাহেব খুব জেদি মানুষ। তিনি করো কাছে মাথা নত করার মতো মানুষ নন। ঐশীকে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তিনি লিলিকে মোবাইল করলেন।
অপর পাশ থেকে লিলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো ভাইজান।
ফয়সাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, লিলি তোর কাছে কি ঐশী গেছে?
জি ভাইজান।
একাই।
একাই না আরিফ নামে ওর এক বন্ধুসহ এসেছে।
তুই আমাকে মোবাইল করলি না কেন?
তোমাকে মোবাইল করে কী লাভ হবে? ওরা বলল, ফুপু আমরা বিয়ে করবো। আমি দু’জনের এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেটে দেখলাম ঐশীর বয়স আঠারো বছর দু’মাস, ওদের বিয়েতে কোন আইনত বাধা নাই তাই কাজি ডেকে দু’জনকে বিয়ে দিয়ে দিলাম।
ফয়সাল সাহেব ধমকের সুরে বললেন, লিলি তুই কী বলছিস?
ভাইজান আমি উকিল মানুষ বে-আইনি কাজ তো করতে পারি না।
ফয়সাল সাহেব আবারো ধমকের সুরে বললেন, তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিস?
অপর পাশ থেকে লিলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, তুমি কি আমাকে ধমক দিচ্ছ ভাইজান? তুমি ধমক দিয়ে তোমার স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করেছ, আমার চোখের সামনে ঐশীর জীবন আমি কোনভাবেই নষ্ট হতে দিব না।
ফয়সাল সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, তুই ওদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।
হ্যাঁ তোমার মেয়ে জামাই তো তোমার কাছে পাঠাবো কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে।
ফয়সাল সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, তোর আবার কীসের শর্ত?
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। ঐশীও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারেনি তাই আমার কাছে এসেছে অনেক আশা করে, আমি ওদের কোন শর্ত ছাড়াই তোমার কাছে ফেরত পাঠাবো না।
বল তোর কী শর্ত?
এক. তুমি কোন সিন ক্রিয়েট করতে পারবে না।
দুই. আরিফকে তুমি নিঃশর্তভাবে জামাই হিসেবে মেনে নিবে।
তিন. ওদের বিয়ের শুধু রেজিস্ট্রি হয়েছে তুমি ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে।
বাঃ তুই শর্ত বল্লি আর আমি মেনে নিলাম? তুই এতদিনে আমাকে এই চিনলি? আমি জীবনে কোনদিন কারো কাছে মাথা নত করিনি, আজ নিজের বোন আর মেয়ের কাছে আমাকে মাথা নত করতে হবে? এটা অসম্ভব। সমাজে আমার একটা মান-সম্মান আছে, তোরা দু’জনে এভাবে আমার মান-সম্মান বিলিয়ে দিতে পারিস না।
ভাইজান তাহলে তোমার মান-সম্মান নিয়েই তুমি থাকো, আমাদেরকে নিজেদের মতো করে থাকতে দাও।
তুই আমাকে এত বড় কথা বললি?
হ্যাঁ শুধু তাই নয়, আমার তো কেউ নেই আল্লাহর রহমতে আমার টাকা-পয়সারও অভাব নেই, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওদের দু’জনের লেখাপড়ার টাকা আমিই দিব এবং আমার সমস্ত সম্পত্তি ওদের নামে উইল করে দিব।
তোর টাকা আছে এবং তুই দান করবি, ভালো কথা তাই বলে একটা পথের ছেলেকে দান করবি?
একটা পথের ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করে আমি তোমাকে দেখাব, তুমি ইচ্ছা করলে একটা পথের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারতে, বলতে বলতে লিলির কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
লিলির শেষের কথাগুলো যেন ফয়সাল সাহেবের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করল, আজ এতদিন পর তিনি লিলির কষ্টগুলো অনুভব করলেন। তিনি কিছুটা নরম হলেন, তোর শর্ত শেষ।
জি।
আমারও একটা শর্ত আছে।
তোমার শর্তটা কি এ তিনটা শর্তের বাইরে?
হ্যাঁ।
বলো।
তুই ওদের নিয়ে বাড়ি আয় তখন বলব, বলে ফয়সাল সাহেব মোবাইল অফ করলেন।

তেরো

মোবাইল রেখে দিয়ে ফয়সাল সাহেব শুধু ঘামতে লাগলেন তাঁর বার বার মনে হলো লিলিকে তার পছন্দের ছেলের সঙে বিয়ে না দেওয়ায় লিলি তার ওপর প্রতিশোধ নিল। তিনি মোবাইল রেখে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন।
এমনসময় ফয়সাল সাহেবের স্ত্রী মাহমুদা উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ঐশীর কোন খবর পেলে?
ফয়সাল সাহেব মলিন মুখে বললেন, হুঁ।
কেমন আছে মা আমার? কোথায় আছে?
তোমার মেয়ে খুব ভালো আছে। তোমার আদরের ননদ লিলির কাছে গেছে।
মাহমুদা মুখে ফিসফিস করে কী যেন পড়ে বুকে একটা ফুঁ দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, তুমি আসতে বলেছ?
হুঁ।
মাহমুদা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আসতে বলেছ? কখন এসে পৌঁছাবে?
দেরি হবে না, দিনের মধ্যেই পৌঁছাবে।
আমি যাই খাওয়া-দাওয়া রেডি করি বলে মাহমুদা চলে যাচ্ছিলেন। ফয়সাল সাহেব বললেন, চলে যাচ্ছ যে, কিছু জানতে চাইলে না?
কেন কী হয়েছে?
বিবাহযোগ্য কোন মেয়ে বাড়ি থেকে পালানোর অর্থ তুমি বোঝ না?
মাহমুদা নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তোমার মেয়ে তার বন্ধুর সঙে পালিয়েছে আর তোমার ননদ সেই ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে এখন তুমি অনুষ্ঠানের আয়োজন করো।
মাহমুদার কানে কথাগুলো পৌঁছালো ঠিকই কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে পারল না। তিনি সারাজীবন ফয়সাল সাহেবকে দেখেছেন, তিনি কোনদিন তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে এক পা পিছু সরে আসেননি, তাঁর জিদের কারণে এই পরিবারে অনেক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন, আজ নিজের মেয়ের বেলায় তিনি হঠাৎ করে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটায় তিনি অবাক হয়ে ফয়সাল সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ফয়সাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে তাকাচ্ছ কেন? মনে হয় আমাকে নতুন দেখছ?
হ্যাঁ তোমাকে নতুনই দেখছি, জীবনে তুমি কোনদিন কারো মতামতকে মূল্য দাওনি নিজের সিদ্ধান্তই সবসময় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়েছ, আজ হঠাৎ করে মেয়ের জন্য তোমার দরদ উতলে উঠল?
ফয়সাল সাহেব শান্তভাবে বললেন, মাহমুদা তুমি একটু আমার পার্শ্বে বসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
মাহমুদা ফয়সাল সাহেবের পাশে বসলেন। পঁচিশ বছরের সংসার জীবনে তিনি ফয়সাল সাহেবকে কোনদিন এমন আচরণ করতে দেখেননি। আজ তিনি অবাক হলেন।
ফয়সাল সাহেব বললেন, ঐশী আমাদের একমাত্র মেয়ে, ওকে আমি হারাতে পারবো না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মেয়ে যাকে বিয়ে করেছে, যাকে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে পারবে আমি তাকে মেনে নিতে পারবো না কেন? তুমি সবাইকে খবর দাও, আমি ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিব।
মাহমুদার চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, তুমি মোবাইলে সবাইকে খবর দাও, বিহাই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করো।
হ্যাঁ তুমি যাও তোমার কাজ করো, আমি দেখছি।

চৌদ্দ

জামাল ঐশীকে কোনদিন ভালোবাসেনি, শরীফ আর আরিফ দু’জনে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তাকে উপহাস করেছিল তখন থেকে ঐশীর প্রতি জামালের একটা জিদ কাজ করছিল। তখনো হয়ত আরিফ ঐশীকে ভালোবাসেনি, তা না হলে আরিফ কেন তার প্রেমিকাকে নিয়ে জামালের সঙ্গে ইয়ার্কি করবে? পরবর্তীতে ঐশী আরিফকে ভালোবাসায় জীবনের প্রথম ব্যর্থতায় জামাল প্রথমে কিছুটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হলো তারপর যখন জানতে পারলো ঐশীর বাবা তাদের বিয়েকে সহজভাবে মেনে নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করেছে তখন তার মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন আরো সহস্রগুণ জ্বলে উঠল।
জামাল এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ফেল করল। আরিফ জি.পি.এ-৫ পেয়ে এইচ.এস.সি পাস করল। পরীক্ষায় আরিফ জি.পি.এ-৫ পেয়ে এইচ.এস.সি পাস করায় জামালের কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটা পড়ল। সবসময় তার মনে হলো আরিফ মেধাবী ছাত্র এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি উভয় পরীক্ষায় জি.পি.এ-৫ পেয়ে পাস করায় তার জন্য দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির দরজা উন্মুক্ত। একসময় আরিফ ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড় অফিসার হবে আর তার পক্ষে আরিফের সঙ্গে বিদ্যার দৌড়ে পাল্লা দেয়া সম্ভব হবে না। লেখাপড়া নামক কাজটা আর জামালকে দিয়ে সম্ভব নয়। এখন আরিফের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করার পথ হলো ব্যবসা আর রাজনীতি। তাই সে কলেজ যাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা আর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সেদিন রাতে খাবার টেবিলে জামালকে দেখে জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী রে আজ আবার এত আগে বাসায় ফিরেছিস?
ফাহমিদা রাগান্বিত স্বরে বললেন, কেন? আগে বাসায় ফিরেছে তো কী হয়েছে? দোষের কিছু আছে না কি?
না দোষের কিছু হয়নি, অনেকদিন একসঙ্গে খাওয়া হয় না তো। অনেকদিন থেকে তো দেখাও হয় না। আমি ঘুমিয়ে পড়ি রাত দশটায় তোমার ছেলে বাসায় ফিরে রাত বারোটায়, আমি বাসা থেকে বের হই সকাল দশটায় তখনো তো তোমার ছেলে ঘুমিয়েই থাকে, কাজেই বাপ বেটায় দেখাই হয় না।
ফাহমিদা আবারো রেগে গেলেন, হয়েছে তোমার প্যাক প্যাক একটু থামাও। তারপর জামালের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, খা বাবা।
জামাল এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিল এবার মৃদু কণ্ঠে বলল, বাবা আমার কিছু টাকা প্রয়োজন।
হুঁম সে তো আগেই অনুমান করেছি, তা কত টাকা?
পাঁচ লাখ।
জহির সাহেব যেন চমকে উঠলেন, পাঁচ লাখ।
জি বাবা পাঁচ লাখ।
আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিস,না? বলে জহির সাহেব খাওয়া শেষ না করেই হাত ধুয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলেন।
জামাল খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বাবার মুখোমুখি বসলে ফাহমিদা জামালের পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসে বললেন, কী করবি এতগুলো টাকা বাবা?
মা আমি ব্যবসা করবো।
ফাহমিদা প্রচণ্ড রেগে গেলেন, তুই ব্যবসা করবি, আর লেখাপড়া?
জহির সাহেব বললেন, তোমার ছেলে যা লেখাপড়া করে তাতে ওই লাইনে আর না যাওয়াই ভালো হবে।
জামালের চোখে মুখে একটা তৃপ্তির রেখা ফুটে উঠল, বাবা তাইতো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্যবসা করবো।
এতক্ষণে জহির সাহেব আশ্বস্ত হলেন। যেন তিনি মনে মনে আজই জামালকে ব্যবসার কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন। জামাল নিজেই ব্যবসার কথা বলায় তিনি যেন একরকম নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ব্যবসা করবি ভেবেছিস?
বাবা আমি একটা কন্সট্রাকশন ফার্ম করবো।
তারমানে ঠিকাদারি করবি।
জি বাবা।
তোর ব্যবসাটা আমার পছন্দ হলো না।
কেন বাবা?
ঠিকাদারি ব্যবসাটা আমার কেমন দু’নম্বরি, দু’নম্বরি ব্যবসা মনে হয়। এই যে আমাদের দেশে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বিল্ডিংগুলো হয় এগুলো যদি সঠিকভাবে হতো তবে এগুলো অনেকদিন টিকতো কিন্তু দেখিস না ক’দিন পর পর রাস্তাগুলোর কার্পেটিং নষ্ট হয়ে যায়, সামান্য স্রোতের তোড়ে কালভার্টগুলো ভেঙ্গে যায়, তৈরির কয়েক বছরের মধ্যে বিল্ডিংগুলোর প্লাস্টার ঝরে পড়ে।
জামাল তার বাবার কথার প্রতিবাদ করল, বাবা ভালো-মন্দ সব ব্যবসাতে আছে, যেমন তোমার পেট্রোল পাম্প আছে, এই শহরে তো আরো পেট্রোল পাম্প আছে তারা কি তোমার মতো সততা নিয়ে ব্যবসা করে? যেমন ক’দিন আগের কথা ধরো, যেদিন পেট্রোল, ডিজেল, অকটেনের দাম বাড়ার ঘোষণা হলো সেদিনই সমস্ত পাম্পের পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন হাওয়া হয়ে গেল। আবার পরদিন সকালবেলা বেশি দামে বিক্রি শুরু হলো। অনেকেই রাতারাতি কয়েক লাখ টাকা করে ইনকাম করল, কিন্তু তুমি কি করেছ?
পেট্রোল পাম্প আর ঠিকাদারি ব্যবসার মধ্যে আরো অনেক তফাত আছে, শুনেছি ঘুষ না দিলে নাকি ইঞ্জিনিয়ার বিল পাস করে না, কাজ নিতে গিয়ে নাকি ইঞ্জিনিয়ারকে টাকা দিতে হয় তারপর ঠিকাদাররা আবার অনেক সময় নেগোসিয়েশন করে, সেই টাকা নিয়ে আবার মারামারিও হয়। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসাটা আমার পছন্দ না। আচ্ছা অন্য কোন ব্যবসা করা যায় না?
কী রকম ব্যবসা বাবা?
এই ধর কোন দোকান বা স্টোক বিজনেস? বা কোন পার্মানেন্ট বিজনেস?
বাবা ঠিকাদারিও একটা পার্মানেন্ট বিজনেস, তুমি আমাকে একবার চান্স দাও।
ঠিক আছে তুই যখন চাচ্ছিস তবে আমি টাকা দিব।
থ্যাঙ্ক ইউ বাবা, তুমি খুব ভালো।

পনেরো

ঠিকাদারি লাইসেন্স করার পর জামাল কয়েকটা টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করল কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচিত না হওয়ায় কোন কাজই পেল না। এভাবেই কয়েকমাস কেটে গেল জীবনে এই প্রথম জামাল বুঝতে পারল বাইরে থেকে ঠিকাদারি ব্যবসা যত সহজ ও অতি তাড়াতাড়ি ধনী হওয়ার সিঁড়ি বলে মনে হয় আসলে তা না। অবশেষে অনেক নিম্নদর দিয়ে একটা টেন্ডার ড্রপ করল।
টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীগণের উপস্থিতিতে টেন্ডার বাক্স খোলা হলো। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাক্সে দাখিলকৃত দরপত্রগুলো খুলে একে একে ঠিকাদারগণের দাখিলকৃত দর বলছিলেন। সকল দরপত্র দাতাগণের দরপত্র খোলার পর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঘোষণা করলেন, আজকের টেন্ডারে মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ সর্বনিম্ন দর দাখিল করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজের বরাবরে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হবে।
জামাল পাশে বসা তার এক সিনিয়র ঠিকাদারকে জড়িয়ে ধরে বলল, সাজ্জাদ ভাই আমি একটা কাজ পেয়েছি, সাজ্জাদ ভাই আমি-বলতে বলতে যেন জামাল আনন্দে ফেটে পড়ল।

ওয়ার্ক অর্ডার পাবার পর জামাল মিস্ত্রীর কাছ থেকে মালামালের হিসাব নিতে গিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। জামাল ঠিকাদারি ব্যবসায় একেবারে নতুন হওয়ায় সে নির্মাণ কাজের শিডিউল ড্রয়িং নিয়ে তার পরিচিত ঠিকাদারগণের কাছে গেল। সাজ্জাদ সাহেব সবকিছু দেখে বললেন, তোমার কাজের রেট তো খারাপ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ করে এ কাজে প্রোফিট করতে পারবে না।
তো?
সাজ্জাদ সাহেবের দৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের জন্য জামালের ওপর স্থির হলো, তারপর বললেন, তবে তুমি পারতেও পারো।
জামাল কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?
সাজ্জাদ সাহেব বললেন, তুমি ক্ষমতাসীন দলের নেতা, তুমি বললে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব না করতে পারবেন না।
কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কি আমার কথা শুনবেন?
না শুনলে তুমি শোনাবে।

সাজ্জাদ সাহেবের পরামর্শ মতো জামাল কাজ শুরু করল একদিন তার নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করার জন্য কর্তব্যরত ইঞ্জিনিয়ার সাইটে গেলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কাজের গুণগত মান দেখে মিস্ত্রীকে বললেন, মিস্ত্রী তোমার কাজ তো ড্রয়িং অনুযায়ী হচ্ছে না, তুমি ড্রয়িং এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ করছ না। এ পর্যন্ত যে কাজ করেছ এগুলো ভেঙ্গে ফেল, সাইটে যে সেকেন্ড ক্লাস ইট আর আন্ডার সাইজ রড এনেছ এগুলো চলবে না, বলে তিনি গাড়িতে উঠছিলেন।
এমনসময় জামাল সাইটে ঢুকলো। জামালকে দেখে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গাড়ি থেকে নেমে জামালকে বললেন, এই যে জামাল সাহেব।
জামাল বিনয়ের সাথে মৃদু হেসে বলল, জি স্যার, বলুন প্লিজ!
জামাল সাহেব আপনি আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত এমন একটা কাজ করলেন এখন তো ভেঙ্গে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই।
জামালের মুখ শুকিয়ে গেল। সে অষ্ফুটস্বরে বলল, কেন স্যার?
এই যে আপনি সব সেকেন্ড ক্লাস ইট আর আন্ডার সাইজ রড এনেছেন এগুলো কালকের মধ্যে সরিয়ে ফেলবেন, আর না সরালে কাজ বন্ধ রাখবেন, বলে তিনি আবার গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন।
জামাল আবারো বিনয়ের সুরে বলল, স্যার অনেক লেস দিয়ে কাজ নিয়েছি তার মধ্যে আবার যদি করা কাজ ভেঙ্গে ফেলতে হয় ইট, রড সব ফেরত নিয়ে যেতে হয় তবে আমি খুব লুজার হবো। আমার প্রথম কাজ, নতুন ব্যবসা একটু সেক্রিফাইজ করুন স্যার, প্লিজ!
বিরক্ত করবেন না, যা বলেছি তাই করুন, বলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন।
জামাল মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড রেগে গেল, তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে মুখ বিকৃত করে বলল, আপনি বললেন আর সব ভেঙ্গে ফেললাম, এত সোজা না। আগে ভালো ব্যবহার করেছি, ভেবেছিলাম সোজা কথায় কাজ হবে। এখন দেখছি সোজা কথায় কাজ হবে না। যান মিয়া আমি যেভাবে কাজ করছি সেভাবে করবো দেখি আপনি কী করেন? বলে জামাল ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পথ রোধ করে বলল,এই যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাকে চেনেন, আমি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি আমার কাজে বিন্দুমাত্র ডিস্টার্ব দিলে আমিও দেখে নিব। যান আজকের মতো ছেড়ে দিলাম।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তিনি আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

ষোল

নিম্নমানের কাজ করে দলীয় প্রভাব ও হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে জোর পূর্বক বিল নিয়ে জামাল অল্প দিনের মধ্যে প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেল। জামালের সফলতায় তার বাবা জহির সাহেব ও মা ফাহমিদা দু’জনে অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সেদিন রাতে ফাহমিদা কথা প্রসঙ্গে বললেন, জামালের বিয়ের কথা কি কিছু ভাবছ?
হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ, দেখতে দেখতে জামাল বড় হলে গেল।
শুধু কি বয়সে বড় হয়েছে? টাকা পয়সায় সে এখন সচ্ছল, তুমি সারাজীবনে যা করতে পারোনি ও দু’বছরে তা করেছে। তুমি দেখো ও একদিন আরো অনেক টাকা পয়সার মালিক হবে, রাজনীতি করে একদিন অনেক বড় নেতা হবে। এখন একটা ভালো মেয়েকে বউ করে ঘরে আনতে পারলেই হয় বলে ফাহমিদা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি শুনছ?
জহির সাহেব বললেন, হুঁম বলো।
আমার পছন্দের একটা মেয়ে আছে, তুমি যদি বলো তবে আমি কথা বলি।
জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, ফাহমিদা তোমার আমাদের বিয়ের কথা মনে আছে?
তুমি কী যে বলো? বিয়ের কথা কি কেউ ভুলে?
বাবা তোমাকে দেখে পছন্দ করেছিল, একদিন মাকে এসে বলল, তোমার ছেলের বউ দেখে এলাম আগামী শুক্রবার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে যাব তারপর কোন শুভদিন দেখে ছেলের বিয়ে দিব। বাবা মা সবকিছু ঠিক করল আর তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি একবার জানতেও চাইনি মেয়ে দেখতে কী রকম? লেখাপড়া কতদূর? বংশ বুনিয়াদ ভালো কি না?
ফাহমিদা কিছুটা রেগে গেলেন, তাই বলে আমাকে বিয়ে করে তো তুমি ঠকনি।
ঠকা-জিতার কথা নয় ফাহমিদা, আগের দিনে বিয়ের ব্যাপারে ছেলে মেয়েরা বাপ-মা’র কথার উপর কথা বলতো না।
বলবেই বা কেন? বাপ-মা তো আর কারো অমঙ্গল চায় না।
তবু দিন পাল্টেছে এখনকার দিনে বিয়ের ব্যাপারে ছেলে-মেয়েদের মতামতকে প্রায়োরিটি দিতে হয়। তুমি জামালকে জিজ্ঞেস করিও ওর যদি কোন পছন্দ থাকে তবে সেখানেই বিয়ে হবে।
ফাহমিদা আবার রেগে গেলেন, ওর যেখানে পছন্দ সেখানেই বিয়ে হবে, আমাদের পছন্দ-অপছন্দের দাম নেই?
আমরা ছেলের বিয়ে দিব, ছেলে বউকে নিয়ে সংসার করবে সেখানে তার মতামতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা ছেলের সংসারে সুখ দেখে মরতে পারলেই যেন মরে গিয়ে সুখে থাকব।
ফাহমিদা আর কোন আপত্তি করলেন না, মৃদু হেসে বললেন, তাহলে আমি জামালের কাছ থেকে জেনে নিব ওর কাউকে পছন্দ আছে কি না?
জামাল বাসায় ফিরল রাত এগারোটায়। বেশিরভাগ দিনই ফাহমিদা ডাইনিং টেবিলে জামালের জন্য খাবার ঢেকে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে জামাল বাসায় ফিরলে বুয়া দরজা খুলে দেয়। তখন জামাল নিজেই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ এত রাত পর্যন্ত মাকে জেগে থাকতে দেখে জামাল কিছুটা অবাক হলো।
জামাল জিজ্ঞেস করল, মা তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ?
হ্যাঁ বাবা।
জামাল হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলে ফাহমিদা ভাত বাড়িয়ে দিলেন। জামালের খুব খিদে পেয়েছিল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করল। ফাহমিদা জামালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, বাবা তোকে একটা কথা বলব?
সে আমি আগেই বুঝেছি মা।
কী বুঝেছিস? কী?
তুমি কিছু বলবে বলেই তো জেগে আছ, বলে ফেল।
তোর বাবা বলছিল, তোর বিয়ের কথা।
জামাল তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখনি আমাকে বিয়ে করতে কেন বলছ মা?
কেন বলছি মানে? বিয়ের বয়স হয়েছে, তোকে বিয়ের কথা বলব না?
আমি তো এখন বিয়ে করবো না।
কেন বাবা?
মা তুমি হয়ত জানো না ফয়সাল সাহেবের মেয়ে ঐশীকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমার এক বন্ধুকে বিয়ে করেছে। তখন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি কোনদিন বিয়েই করবো না।
একটা মেয়ের জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করবি?
বিয়ে না করলে মানুষের জীবন নষ্ট হয় না মা। পৃথিবীতে বিয়ে না করেও অনেক মানুষ জীবনে সফল হয়েছে।
তা হোক কিন্তু সেটা জীবন হলো না।
সেটা জীবন হলো না তারমানে তারা বেঁচে নেই।
বেঁচে থাকলেও কিন্তু সেটা স্বাভাবিক জীবন হলো না। মানুষ পৃথিবীতে আসবে বিয়ে শাদী করে সংসারী হবে তার ঘরে বাচ্চা হবে সে পৃথিবীতে তার প্রজন্ম রেখে একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক জীবন।
ধরে নাও আমার জীবনটা স্বাভাবিক হলো না।
না বাবা তুই এমন কথা আর কখনো বলিস না, ঐশীর চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়েকে আমি ঘরে বউ করে নিয়ে আসবো, দেখবি আমার পছন্দ করা বউ খুব সুন্দর হবে, আমার পছন্দ করা বউ হবে এই শহরের সব মেয়েদের চেয়ে সুন্দর, ঐশী না কী বলছিস ওতো দূরের কথা।
জামাল কিছুটা নরম হলো সে বায়নার সুরে বলল, মা তাহলে তো একবার দেখতেই হয়।
মেয়ে দেখবি পরে আগে ছবিটা দেখ, বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন, কিছুক্ষণ পর একটা এ্যালবাম সাইজের ফুলস্ক্যাপ ছবি এনে জামালের হাতে দিয়ে বললেন, দেখতো মেয়েটা সুন্দর কি না?
জামাল ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল আসলে তার মা একটা সুন্দর মেয়ে দেখেছে, জামাল জিজ্ঞেস করল, মা ছবিটা কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?
সেটা তোর না জানলেও চলবে এখন বল তোর পছন্দ হয়েছে কি না?
মা বিয়ে-শাদীর ব্যাপার, একদিন দু’দিনের জন্য তো না সারাজীবনের ব্যাপার, ছবি দেখে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?
ফাহমিদা জামালের কান টেনে ধরে স্নেহ সুলভ ভঙ্গীতে বললেন, ওরে আমার বাঁদরের বাঁদর নিজে দেখবি তাই বল, এত পাকামো করছিস কেন?
মা মেয়েটা যদি ঐশীর চেয়ে বেশি সুন্দর হয় তবে আমি বিয়ে করবো আর যদি ঐশীর চেয়ে কম সুন্দর হয় তবে আমি বিয়ে করবো না।

সতেরো

মেয়েটির নাম অনন্যা। তার নামের সঙ্গে রূপ আর অপূর্ব গুণের সমন্বয় আছে। অনন্যা যেমন ফর্সা, লম্বা, আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারিণী তেমনি আচার ব্যবহারও ভদ্র, মার্জিত উন্নত রুচিসম্পন্ন মেয়ে। ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র আদুরে মেয়ে। মেয়ের রূপ,গুণ,আর বাবা-মা’র নাম শুনে জহির সাহেবও ফাহমিদার কথায় মত দিয়েছেন।
শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো। কিন্তু বাসর রাতেই অনন্যার জীবনে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
অনন্যা বাসর ঘরে অপেক্ষা করছিল। জামাল বাসায় ফিরল নিত্যদিনের মতোই। ততক্ষণে অনন্যার দু’চোখে ঘুম নেমে এসেছে। জামাল ঘরে ঢুকে জামা খুলতে খুলতে বলল, তুমি ঘুমাওনি?
জামালের কথা শুনে অনন্যা চমকে উঠল। সে কয়েক মুহূর্ত জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমে সে জামালের কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না কিন্তু কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে বুঝতে পারল, না জামাল তাকে ইয়ার্কি করে একথা বলেনি। সে সত্যি সত্যিই বলেছে। তার দু’চোখ দিয়ে পানি ছিটকে পড়ল। অনন্যার ইচ্ছা হলো উচ্চস্বরে কেঁদে হৃদয়ের বেদনা হালকা করতে। কিন্তু অনন্যা কিছুই করল না, যেমন চুপ করে বসে ছিল তেমনি নীররে বসে রইল।
জামাল ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে করতে বলল, অনন্যা আমাকে দেরিতে বাসর রাতে বাসায় ফিরতে দেখে তুমি হয়ত কষ্ট পেয়েছ, আমি ব্যবসায়ী মানুষ তাছাড়া রাজনীতিও করি সবসময় ব্যস্ত থাকি। তাই ঠিক সময়ে খাওয়া, ঘুমানো এসব কোন কিছু আমাকে দিয়ে হবে না। বলতে পারো আমার জীবনটা বেশ এলোমেলো।
অনন্যা মৃদু কণ্ঠে বলল, তুমি একটু আমার পাশে বসো।
জামাল অনন্যার পাশে বসল না। আবারো বলতে শুরু করল আরো শুনে তুমি হয়তো কষ্ট পাবে, তবু আমি বলব, আমার দু’বন্ধু শরীফ আর আরিফ দু’জনের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে একবার ঐশী নামের একটা মেয়েকে আমি ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, বলতে পারো ইয়ার্কি করে। কিন্তু ঐশী আমার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ওরা বলেছিল ঐশী ধনী লোকের মেয়ে, ও নাকি আমাকে পাত্তাই দিবে না। ওদের কথা মতোই ঘটনা ঘটল, ঐশী আমাকে পাত্তাই দিল না। আমার বাবার জমি-জমা, পেট্রোল পাম্প আর যা আছে তাতে আমরাও ধনী মানুষ, তারপরও ঐশী আমাকে ভালোবাসেনি। আসলে শরীফ আর আরিফ আমাকে বুঝিয়েছিল ঐশীর ভালোবাসার মাপকাঠি অর্থ কিন্তু তাদের দেওয়া ধারণা আসলে ঠিক নয়। কিছুদিন পর দেখলাম ঐশী আরিফের প্রেমে পড়েছে। শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। প্রথমে ঐশীকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম, পরে দু’জনকে ভয়-ভীতি দেখালাম কোনকিছুতেই কাজ হলো না।
অনন্যা কোনকিছু বলল না। সে মাথা নত করে জামালের কথা শুনতে লাগল।
একদিন ঐশী আর আরিফ পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। আমি ভেবেছিলাম ঐশীর বাবা-মা বিয়েটা মেনে নিবে না কিন্তু দেখলাম তারাও ওদের বিয়েকে মেনে নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করেছে। আমি আরো একবার অপমানিত হলাম। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিরকুমার থেকে যাব। এরই মধ্যে মা আবার তোমার ছবি দেখাল, ছবি দেখে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হলো, শুধু ছবি দেখে নয় তোমাকে সশরীরে দেখেও আমার খুব পছন্দ হয়েছে, তাই আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছি এবং তোমাকে বিয়ে করেছি।
অনন্যা একটা শুষ্ক হাসি হাসল।
জামাল আবারো বলতে শুরু করল, তারপরও আমার জিদ একদিনের জন্য হলেও আমি ঐশীকে বিয়ে করবো কিংবা এসিড মেরে ওর সুন্দর মুখটা ঝলসে দিয়ে আমাকে অপমানের প্রতিশোধ নিব, চরম প্রতিশোধ প্রয়োজনবোধে আমি আরিফকে খুন করবো।
জামালের কথা শুনতে শুনতে অনন্যার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, তার ইচ্ছা করছিল জোরে কান্না করে হৃদয়ের বোঝা হালকা করতে অথচ সে ধৈর্য ধরে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর মৃদু কণ্ঠে বলল, এখন একটু আমার পাশে বসো।
জামাল অবাক হয়ে মনে মনে বলল, এতকিছু শোনার পরও মেয়েটা কাঁদল না, ভেঙ্গে পড়ল না।
জামাল অনন্যার পাশে বসতেই অনন্যা জামালকে বলল, তুমি খুব ভালো আর সহজ-সরল।
তুমি কীভাবে বুঝলে?
কারণ তুমি সত্য কথা বললে, তোমাকে একটা কথা বলব?
হুঁম বলো।
জোর করে আর জিদ করে ভালোবাসা হয় না, একপক্ষেও কখনো ভালোবাসা হয় না।
জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, কিন্তু আমার জীবনে আমি হয়না শব্দটা উচ্চারণ করতে চাই না।
ঐশীর বিয়ে হয়েছে, তোমারও বিয়ে হয়েছে। ঐশী তার নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছে সে আর কোনদিনও তোমার কাছে ফিরে আসবে না। তোমার মধ্যে আবেগটা খুব বেশি তাই তুমি এমন কথা বলছ। এখন আমাদের বিয়ে হয়েছে ঐশীর উপর জিদ করে তুমি আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না, প্লিজ।
জামাল কোন কথা বলল না, নীরবে বসে রইল।
অনন্যা জামালকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
জামাল বলল, বললাম তো তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে বলেই তো চিরকুমার থাকার শপথটা ত্যাগ করেছি।
অনন্যা জামালের একটা হাত ধরে বলল, শোন বিয়ের আগে কারো সঙ্গে প্রেম থাকতেই পারে, কিন্তু বিয়ের পর ওসব ভুলে যেতে হয়।
জামাল মনে মনে বলল, অনন্যা আমি তো ঐশীকে ভুলতে পারবো না, আমাকে অপমানের প্রতিশোধ আমি নিবই নিব। জামালকে চুপ করে থাকতে দেখে অনন্যা বলল, কি ভাবছ?
জামাল বলল, কিছু না।

আঠারো

বিয়ের পরও জামালের চলাফেরায় তেমন কেন পরিবর্তন হলো না। সে সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ফিরে আসে প্রায় দিনই অনেক রাতে। অনন্যা খাবার নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। অবশ্য জামাল একদিন তার ফিরতে দেরি হলে অনন্যাকে খাবার নিয়ে বসে না থাকার জন্য বলে দিয়েছে। কিন্তু অনন্যা তবুও জামালের জন্য খাবার নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকে। জামালের বেপরোয়া চলাফেরা ও উশৃঙ্খল জীবন যাপনকে অনন্যা ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে।
জামাল সারাদিন ছুটাছুটি করে ব্যবসা আর রাজনীতি নিয়ে, সন্ধ্যাবেলা পার্টি অফিসে আড্ডা দেয়। অর্থ বিত্তের পাশাপাশি জামালের বিভিন্ন ধরণের বন্ধুও জুটেছে। তাদের দু’একজনের সঙ্গে জামালের ঘনিষ্ঠতাও বেড়েছে, তেমনই একজন বন্ধু জাহিদ। দু’বোন এক ভাইয়ের মধ্যে জাহিদই সবার বড়। জাহিদের বাবার শহরে কাপড়ের দোকান ছিল। কয়েকমাস আগে আগুনে দোকান পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে। চোখের সামনে দোকান পুড়ে যেতে দেখে তিনি সেখানেই হার্ট এ্যাটাক্ট করে ইন্তেকাল করেছেন। ফলে শূন্য হাতে জাহিদের উপর ভার পড়েছে সংসার চালাবার। জামাল জাহিদকে তার ব্যবসার কাজে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছিল। তখন থেকে বাসায় যাতায়াতের ফলে জাহিদের বোনদের সঙ্গে জামালের ঘনিষ্ঠতা হয়। দু’বোনের মধ্যে বড় বোন জুঁই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী, ছোট বোন যুথি এ বছর ক্লাস নাইনে পড়ে। কয়েকদিনের মধ্যে জামালের লোলুপ দৃষ্টি পড়ল জুঁই এর ওপর।
একদিন সন্ধ্যায় জামাল একরকম হঠাৎ করেই জাহিদের বাসায় গেল। বাইরে মোটর সাইকেলের শব্দ পেয়ে জাহানারা দরজা খুলে দিলেন, বাবা তুমি এসময়? জাহিদ তো বাসায় নেই।
আমি জানি খালা আম্মা, আমি জাহিদকে সাইটে পাঠিয়েছি, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম একবার আপনার খবর নিয়ে যাই।
এসো বাবা, ভিতরে এসো।
আজ থাক খালা আরেক দিন আসবো।
আরেকদিন কেন, এসো।
জামাল ভিতরে ঢুকলো।
জুঁই আর যুথি তখন তাদের রুমে পড়ছিল। পাশাপাশি দু’টা সেমি পাকা রুম, একটা রুমে জুঁই, যুথি ও তার মা, অপর রুমে জাহিদ থাকে। জাহানারা জামালকে জাহিদের রুমে বসতে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
জামাল প্রথমে জিজ্ঞেস করল, খালা কেমন আছেন?
জাহানারা একটা নিঃশ্বাস টেনে বললেন, আমাদের আর ভালো থাকা বাবা। তোমার খালু যেদিন মারা গেছে সেদিন থেকেই আমাদের ভালো থাকা শেষ হয়েছে।
কেন? কী হয়েছে?
তোমার খালু যখন ছিল তখন ব্যবসাও ভালো চলছিল তখন কোন অভাব ছিল না। আর এখন সবসময় একটা না একটা অভাব লেগেই থাকে। মেয়েরা বড় হচ্ছে বিয়ে দিতে হবে। আয় রোজগারের মধ্যে তোমার খালুর রেখে যাওয়া কয়েক বিঘা জমি আর জাহিদের চাকরির বেতন তাই সবকিছু মিলিয়ে ভালো নেই বাবা।
খালা আপনি কিছু চিন্তা করবেন না আল্লাহ কোনভাবে চালিয়ে নিবেন, তাছাড়া আমি তো আছি যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন, আমাকে আপনার ছেলের মতো জানবেন, কোন সমস্যা থাকবে না।
এই দেখ তো বাবা, আমি খালি মুখে তোমাকে বসিয়ে গল্প করছি, তুমি বসো বাবা আমি তোমার চায়ের ব্যবস্থা করছি, বলে জাহানারা চেয়ার ছেড়ে উঠছিলেন।
জামাল জিজ্ঞেস করল, খালা জুঁই, যুথি কোথায়? ওদের পরীক্ষা নাকি?
না বাবা, ডাকবো?
জামাল কিছু বলল না। জাহানারা পাশে রুমে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর জুঁই এবং যুথি দু’জনে রুমে ঢুকে সালাম দিল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, তোমরা যেন কোন ক্লাসে পড়?
জুঁই বলল, আমি এ’বছর এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিব। আর যুথি এবার ক্লাস নাইনে পড়ছে।
তোমাদের পড়ালেখায় কোন অসুবিধা নেই তো?
এতক্ষণ জুঁই মাথা নত করে কথা বলছিল এবার মাথা তুলে বলল, না।
জাহানারা জোরে একবার যুথি বলে ডাক দিতেই যুথি চলে গেল।
জুঁইয়ের চোখে চোখ পড়তেই জামালের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝি খুব কম কথা বলো?
জুঁই মুচকি হাসল।
দেখ আমি তোমাদের খুব কাছের মানুষ। তোমাদের সুবিধা-অসুবিধা সবকিছু আমাকে বলবে। কোন কিছু লুকাবে না।
জুঁই কিছু বলল না।
জামাল আবার বলল, কিছু বললে না যে?
জুঁই মৃদু কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, বলব।
জামাল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওভাবে বললে হবে না। তোমার হাতটা দাও।
জুঁই হাত বাড়াল না।
জামাল তার চেয়ার থেকে উঠে জুঁইয়ের একটা হাত ধরে বলল, বলো ঠিক আছে।
জুঁই এর আগে কখনো পুরুষের স্পর্শ পায়নি তাই প্রথম জামাল তার হাত স্পর্শ করায় তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। জুঁই একটা ঢোক গিলে বলল, জি ঠিক আছে।
জামাল তার মানিব্যাগ থেকে কয়েকটা পাঁচ’শ টাকার নোট বের করে জুঁইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, জুঁই এই টাকাগুলো রাখো।
জুঁই কম্পিত কণ্ঠে বলল, না, লাগবে না।
লাগবে না কেন? রাখো কাজে লাগবে, বলে জামাল একরকম জোর করে টাকাগুলো জুঁইয়ের হাতে দিল। তারপর বলল, ঠিক আছে একথাই থাকল তোমার যে কোন প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে পারলে খুশি হবো।
যুথি চা নিয়ে ভিতরে ঢুকলে জামাল জিজ্ঞেস করল, যুথি তাড়াতাড়ি চা নিয়ে এলে, তাড়াবে নাকি?
তাড়াব কেন? চা আনার মানে তো তাড়িয়ে দেওয়া না। চা খেতে খেতে গল্প করবেন, বলে যুথি চায়ের কাপ জামালের হাতে দেওয়ার সময় জামাল ইচ্ছা করেই যুথির হাত স্পর্শ করল। যুথির মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল, সে হাত সরিয়ে নিল।
জুঁই জামালের যুথির হাত স্পর্শ করা দেখে মনে মনে বলল, লোকটার মতলব তো ভালো না, একসঙ্গে যেন দু’জনকে কাছে পেতে চায়।
জামাল বলল, জুঁই কথা বলছ না কেন?
জুঁই চমকে উঠল, জি বলুন।
চা খেতে খেতে জামাল জুঁই ও যুথি দু’জনের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার পর জাহানারা ঘরে ঢুকতেই জামাল কৃত্রিম অভিমানের সুরে বলল, খালা এভাবে শুধু আপ্যায়ন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমি কিন্তু আর আসবো না।
তা কেন? অবশ্যই আসবে বাবা।
আচ্ছা বলে জামাল উঠতে যাচ্ছিল।
জাহানারা বললেন, উঠছ কেন বাবা?
আরেকদিন আসবো খালা, বলে জামাল বের হলো।

উনিশ

ব্যবসায় দ্রুত উন্নতিতে জামাল অল্প দিনের মধ্যে প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে গেল। শহরে তার অফিস কক্ষ সাজানো উন্নত মানের। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে যাবার আগে জামাল একবার তার অফিসে বসে। তার ব্যবসার মধ্যে ঠিকাদারি, ধান চাউলের চাতাল এসব। একেকটা ব্যবসা দেখার জন্য একেকজন করে ম্যানেজার আছে আর সবকিছু দেখে জাহিদ। তাই প্রতিদিন শুধু জাহিদের কাছে ব্যবসার হিসাব দেখে নেয় জামাল।
জাহিদ হিসাবে বেশ পাকা এবং বিভিন্ন ব্যবসার খুঁটি-নাটি সে খুব অল্প দিনে খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। এত ব্যবসা এবং অল্প বয়সে প্রচুর টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও জামাল আরো নতুন ব্যবসা খুঁজছিল। শুধু ব্যবসা বললে ভুল হবে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাবার মতো ব্যবসা।
সৌভাগ্যক্রমে জামাল একদিন রাতারাতি কোটিপতি বনে যাবার মতো ব্যবসার সন্ধানও পেয়ে গেল। সেদিন জামাল তার অফিসে বসেছিল মধ্যবয়সী একজন লোক তার অফিসে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মিঃ জামাল?
এমন অপরিচিতি ভদ্রলোককে হঠাৎ রুমে দেখে জামাল অবাক হয়ে গেল। লোকটার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। জামাল থতমত খেয়ে বলল, জি বসুন।
তিনি ভিতরে ঢুকেই হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি মিঃ খান ঢাকা থেকে এসেছি, বলে তিনি একরকম নিরীক্ষা করে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই মিঃ জামাল?
জি কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনলাম না।
আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি, আপনি একজন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল, বিজনেস ম্যাগনেট আমি এ অঞ্চলে ব্যবসার জন্য আপনার মতোই একজনকে খুঁজছিলাম।
জামাল কিছুটা অবাক হলো, জানা নেই, শোনা নেই আপনি ব্যবসা করার জন্য হঠাৎ করে আমাকে সিলেকশন করলেন?
ইয়াং ম্যান আমি সবকিছু জেনেই এসেছি। আমার মনে হয় সবকিছু শুনে আপনিও এমন একটা আকর্ষণীয় ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
জি বলুন কি ধরণের ব্যবসা?
খান সাহেব ডানে বাঁয়ে তাকালেন তারপর আস্তে আস্তে কয়েক মিনিট জামালকে কী যেন বললেন। সবকিছু শুনে জামালের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল। জামাল কলিং বেল টিপ দিতেই পিয়ন জাকির ভিতরে ঢুকলো।
জামাল বলল, দু’টা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এসো।
জাকির চলে গেলে। জামাল বলল, আমি এমন একটা ব্যবসার কথাই ভাবছিলাম মিঃ খান। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
দু’জনে কোল্ড ড্রিঙ্কস শেষ করে জামাল মিঃ খান এর সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে বলল, মিঃ খান এ কথাই থাকল আপনি কোন কিছু ভাববেন না, এদিকটা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবেন।
এই নিন আমার কার্ড পরে কথা হবে বলে মিঃ খান বিদায় নিলেন।
মিঃ খান চলে যাবার পর জামাল কিছুক্ষণ দু’চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। তার মনের মধ্যে তখন কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন, বিশাল বাড়ি, বিলাসবহুল দামি গাড়ির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। জামাল কিছুক্ষণ কল্পনার জগতে থাকার পর আপন মনে হেসে উঠল। তারপর পার্টি অফিসে গেল।
পার্টি অফিসে তখন বেলায়েত সাহেব আর মোস্তফা সাহেব পৌরসভার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছিলেন মোস্তফা সাহেব জামালকে দেখে বললেন, এই যে জামাল তোমার কথাই হচ্ছিল বসো।
কেন বড়ভাই? কী হয়েছে?
হয়েছে আর কি? তুমি কি সারাজীবন শুধু দলীয় পলিটিক্স করবে, গায়ে জন প্রতিনিধির সাইন বোর্ড থাকা লাগবে না?
জামাল কোন কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ভাই আসলে আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পাচ্ছিনা।
বেলায়েত সাহেবের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল কিন্তু তিনি মুখে কিছু বললেন না।
মোস্তফা সাহেব বললেন, বুঝলে না সামনে পৌরসভার নির্বাচন তুমি যদি ভালোভাবে কাজ করো তবে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে?
আমি কি পারব?
মোস্তফা সাহেব বললেন, পারবে না কেন, এখন থেকে জনগণের খুব কাছাকাছি চলে যাও, পৌরসভার যেকোনো মানুষের বিপদে-আপদে সহযোগিতা করো মানুষের মনে তোমার স্থান করে নাও। মনে রাখবে জনপ্রতিনিধি হতে চাইলে জনগণের সুখ দুঃখের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তারপর আছে নির্বাচনের কৌশল সেগুলো ধীরে ধীরে শিখবে আপাতত জনগণের কাছে যাও।
জি ভাই দোয়া করবেন।
জামাল তুমি কি জানো তোমার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
হুঁম, রায়হান চেয়ারম্যান।
মোস্তফা সাহেব বললেন, খুব জনপ্রিয় চেয়ারম্যান, পর পর তিনবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন তার ওপর জনগণের আস্থা আছে। তোমাকে তার স্থান দখল করতে হবে।
আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন বড়ভাই আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমি অবশ্যই সাকসেস হবো।
জামাল আরো অনেকক্ষণ পার্টি অফিসে বসে আড্ডা দিল। তারপর বের হয়ে বাসায় ফিরল।
রায়হান চেয়ারম্যান অত্যন্ত জনপ্রিয়। শুধু জনপ্রিয় বললে ভুল হবে জনগণের কাছে তিনি অতুলনীয়। তিনি এই পৌরসভাকে দেশের অন্যান্য পৌরসভার তুলনায় অনেক উন্নত করেছেন। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁর অফিসে বসেন। অফিসে তাঁর কর্মীদের কাছ থেকে তাঁদের এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। মাসে একদিন এলাকাবাসীর সঙ্গে মত বিনিময় করেন।

বিশ

সেদিন রায়হান সাহেব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময় করছিলেন। একজন মুরুব্বী কিছিমের লোক দাঁড়িয়ে বললেন, চেয়ারম্যান সাহেব আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলি।
জি চাচা বলুন।
ডাস্টবিন থেকে আমাদের ওয়ার্ডের ময়লা ইদানীং পৌরসভার গাড়ি এসে নিয়মিত নিয়ে যায় না। ফলে প্রায়ই সময় দুর্গন্ধ ছড়ায়। তাই-
জি চাচা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি আমার পৌরসভার জন্য নতুন কিছু করার কথা ভাবছি। যেমন ধরুন পৌরসভার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, জন্ম-মৃত্যু রেজিস্ট্রেশন, বাল্য-বিবাহ, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু- শ্রমিকদের পুনরায় স্কুল মুখী করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আরেকজন মুরুব্বী কিছিমের লোক চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় সায় দিয়ে বললেন, এটা তো আমাদের সকলের দায়িত্ব।
আপনি ঠিকই বলেছেন চাচা, আমি চেয়ারম্যান হিসাবে এসব সমস্যা দূর করার নেতৃত্ব আসলে আমার উপর বর্তায়। কিন্তু পৌরসভার যা আয় আর উন্নয়নের জন্য আমরা যা পাই তা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। তাই আমি ভাবছি পৌরসভার প্রত্যেক ওয়ার্ডে যদি একটা করে উন্নয়ন কমিটি গঠন করি, সেই কমিটির যদি একটা আলাদা ফান্ড থাকে সেখান থেকে এগুলো করা যাবে।
সামনের সারিতে বসা কাদের সাহেব, শিক্ষিত, সচেতন এবং রায়হান সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি বললেন, এই চেয়ারম্যান তুই কী বলছিস? আমি তো আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না।
হ্যাঁ তুই ঠিকই বলেছিস তাহলে আমি একটা একটা করে বলি। যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথাই বলি, যদি প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রাইভেট ক্লিনার ডাস্টবিন থেকে ময়লা নিয়ে রাস্তা দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে যায় আর সবাই এই সময়ের মধ্যে তাদের বাসার ময়লা প্রাইভেট ক্লিনারের কাছে দেয়, তবে পৌরসভার উপর নির্ভরশীলতা কমবে আসলে আমাদের পৌরসভার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে একথা আমি অগেই বলেছি। এরপর মনে করুন জন্ম-মৃত্যু রেজিস্ট্রেশন, কোন শিশুর জন্ম গ্রহণের দিনেই পৌরসভায় গিয়ে নাম রেজিস্ট্রেশন করার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে তেমন সচেতনতা নেই। এ পর্যন্ত কোনদিন আমার চোখে পড়েনি যে কোন লোক তার শিশুর জন্ম রেজিস্ট্রেশন করার জন্য পৌরসভায় এসেছেন। এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং কাজি সাহেব বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময় পৌরসভার জন্ম রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেখে বয়স নিশ্চিত হবেন। ফলে বাল্য বিবাহ থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যাবে।
উপস্থিত অনেকেই চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় সায় দিল।
চেয়ারম্যান সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, ঝরে পড়া শ্রমজীবী শিশুদের পুনরায় স্কুল মুখী করা অথবা নাইট স্কুল চালু করা, নিজেদের উদ্যোগে একটা ফান্ড তৈরি করা এবং মনিটরিংয়ের জন্য কমপক্ষে দু’জন পরিশ্রমী, উদ্যোগী তরুণকে দায়িত্ব দেয়া।
রায়হান সাহেবের কথা শুনে সবাই হাত তালি দিলেন। কয়েকজন বললেন, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন চেয়ারম্যান সাহেব।
রায়হান সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তো বাদ পড়েছে, তা হলো যৌতুক বন্ধ করা। আমি প্রায়ই দেখি আমার কাছে বিয়ের যৌতুকের জন্য মেয়ের বাবা-মা সাহায্য চাইতে আসে, আমার খুব খারাপ লাগে, খুব খারাপ কিন্তু কি করবো? আমি তাদের খুশি করার জন্য সাধ্যমতো সাহায্য দিয়ে বিদায় করি। আমি বুঝি এটা অপরাধ, এটা সামাজিক অপরাধ। আমি আর এ অপরাধ করতে চাই না। আমাদের পৌরসভায় কেউ যৌতুক দিবে না, যৌতুক নিবে না। যারা যৌতুক দিবে-নিবে এবং যৌতুক আদান প্রদানের বিয়েতে ঘটকালি করবে তাদের সঙ্গে আমরা কোন সামাজিক সম্পর্ক করবো না তাদেরকে আইনের কাছে সোপর্দ করবো।
উপস্থিত অনেকে হাত তুলে বললেন, চেয়ারম্যান সাহেব আমরা আপনার সঙ্গে আছি।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আমাদের সমস্যাগুলোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যেমন স্কুল শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, কাজি, শিক্ষিত এবং সচেতন গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে আমরা একটা উন্নয়ন কমিটি গঠন করতে পারি। আপনারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন। এ বিষয়ে পরবর্তী মিটিংয়ে কমিটি গঠন করা হবে এবং প্রত্যেক মাসের প্রথম শুক্রবার উন্নয়ন কমিটির মিটিং হবে, মিটিংয়ের অগ্রগতি ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আলোচনা হবে।
পিছনের সারি থেকে দু’একজন উঠতে শুরু করল। রায়হান সাহেব বুঝতে পারলেন অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে মিটিংয়ে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
তিনি বললেন, আপনারা সবাই একমত হয়েছেন, সবাই আমাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমি আমাদের পৌরসভাকে একটা আদর্শ পৌরসভায় পরিণত করবো ইনশাআল্লাহ। সবাইকে ধন্যবাদ।

একুশ

জামাল বাসায় ফিরল গভীর রাতে ততক্ষণে অনন্যার দু’চোখে ঘুম নেমে এসেছে, তাই জামালকে কয়েকবার কলিং বেল এ টিপ দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। তারপর অনন্যা দরজা খুলে দিল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি?
অনন্যা রেগে গেল তার ইচ্ছা হলো একবার বলবে শীতের রাত, এত রাত পর্যন্ত কেউ বাইরে থাকে? কিন্তু মুখে কিছু বলল না। গম্ভীর মুখে খাবার বাড়িয়ে দিল। জামাল খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অনন্যা মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি খুব ক্লান্ত?
কেন বলো তো?
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বলো।
তুমি অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকো আমার এতরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে খুব কষ্ট হয়। তুমি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পারো না।
আমার অনেক কাজ, ব্যবসা আর পলিটিক্স সবকিছু নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত থাকি তাই ফিরতে অনেক দেরি হয়।
তোমার এত কী কাজ যে তুমি গভীর রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকো?
আমার কাজ তুমি বুঝবে না। তুমি আমার স্ত্রী তোমার কাজ ঘর সামলানো, সংসার দেখা। আমাকে বড় হতে দাও প্লিজ, আমি এখন রাজনীতি করছি, জনগণের সেবার কাজে নেমেছি, আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান হবো, এম.পি হবো আরো অনেক বড় নেতা হবো। আমার অনেক টাকাও প্রয়োজন, অঢেল অর্থ সম্পদ, লাক্সারিয়াস বাড়ি-গাড়ি সব।
অনন্যা জামালের কথার প্রথম দিকে একটু খুশি হলেও ধীরে ধীরে তার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। অনন্যা ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হলেও তার চাল চলন সাদাসিধে। জামালের রাজনীতি করার ইচ্ছা অনন্যার মনঃপুত হলেও তার অর্থ বিত্তের নেশার কথা জেনে অনন্যার বুক কেঁপে উঠল। সে বলল, রাজনীতি করো সেটা ঠিক আছে, ব্যবসা করো সেটা ঠিক আছে, উন্নতি করো সেটাও ঠিক আছে কিন্তু তোমার সীমাহীন টাকা-পয়সার মালিক হওয়ার ইচ্ছাটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
জামাল কোন কথা বলল না, শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে রইল।
অনন্যার কথা শুনতে জামালের আগ্রহ নেই বুঝতে পেরে অনন্যা আর কোন কথা না বলে শুয়ে পড়ল। অনন্যার চোখে ঘুম নেই। সবসময় তার নিজেকে নিঃসঙ্গ এবং সবচেয়ে অসুখী মনে হয়। অনেক সময় জামালকে তার সন্দেহ হয়। বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলল কিন্তু জামাল একদিনও তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায়নি। দু’জনের সম্পর্ক যেন শুধু আইনের শিকলেই বাঁধা। জামাল সেই সকালে বেরিয়ে যায় আর গভীর রাতে বাসায় ফিরে। এত দীর্ঘ সময় সে কি শুধু ব্যবসা আর রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে নাকি অন্য কোন নারীর উপস্থিতি সবসময় তার হৃদয়ে বাস করছে সে জন্য সে অনন্যাকে ভালোবাসে না। শুধু মাত্র স্বামী-স্ত্রীর আনুষ্ঠানিকতাই পালন করছে। এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে অনন্যা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

বাইশ

সকালবেলা নাস্তার টেবিলে অনন্যার মলিন মুখ আর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ফাহমিদা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বউমা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
অনন্যা বলল, কিছু হয়নি মা।
জামাল চেয়ারে এসে বসল।
ফাহমিদা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে তুই এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী করিস বল তো?
জামাল বলল, আমার অনেক কাজ, ব্যবসা, রাজনীতি আরো কত কী?
হ্যাঁ তোর বাপও তো ব্যবসা করে, এই দেখ সকালবেলা বেরিয়েছে দুপুরে বাসায় ভাত খাবে রাত ন’টার মধ্যে বাসায় ফিরবে। তোর আবার এত রাত হয় কেন? রাজনীতি করিস বলে?
তুমি ঠিকই ধরেছ মা।
তাই বলে সংসার জীবন বাদ দিয়ে রাজনীতি ?
জামাল অনন্যার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, সংসারে তো কোন অসুবিধা নেই মা। আসলে তোমার বউমা তোমার কানে সবসময় আমার বিরুদ্ধে উল্টা-পাল্টা কথা বলে তোমাকে আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে।
ফাহমিদা রেগে গেলেন, কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, চুপ কোন কথা বলবি না, বউমা আমাকে কিছু বলেনি আমি নিজেই তোর চাল-চলন দেখে বলছি, কতদিন হলো তোদের বিয়ে হয়েছে একদিনও বউকে বেড়াতে নিয়ে গেলি না, ইচ্ছা করে ব্যস্ততা দেখিয়ে বউমাকে সময় দিচ্ছিস না। কিছু বললেই শুধু বলিস ব্যবসা আর রাজনীতি, তোর অবস্থা দেখে মনে হয় পৃথিবীতে আর বোধ হয় কেউ ব্যবসাও করে না আর রাজনীতিও করে না।
মা তুমি কিছু বলতে এসো না, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
আমি কিছু বলব না মানে? আমার চোখের সামনে বউমা সারাদিন মুখ ভার করে বসে থাকবে আর আমি কিছু বলব না এটা হয় না, এটা একজন মায়ের দায়িত্ব না। আজ তুই আমাকে বলবি সমস্যাটা কী? বউমার দোষ কী?
জামাল কোন কথা বলল না। তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে বলল, মা আমার একটু তাড়া আছে আমি গেলাম বলে জামাল কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়ল ।
জামাল চলে যাবার পর ফাহমিদা বললেন, বউমা তুমি কিছু বলো এভাবে চুপ করে থেকো না।
অনন্যা শুষ্ক মুখে বলল, আমি কী বলব মা?
সংসারে সুখের জন্য তোমার যা করা প্রয়োজন তাই করো।
অনন্যা কিছু বলল না, মাথা নত করে বসে রইল।
ফাহমিদা অনন্যাকে বললেন, বউমা তোমাদের বিয়ের তো অনেকদিন হলো যদি একটা বাচ্চা থাকতো তবে সেই বাচ্চার সঙ্গে হেসে খেলেই তোমার সময় কেটে যেত অন্তত তুমি সবসময় নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে না। কোন দিক দিয়ে সময় পার হয়ে যেত তুমি বুঝতেই পারতে না।
অনন্যা কিছু বলল না লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইল।
ফাহমিদা আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদেরও বয়স হলো এখনো নাতি-নাতনীর মুখ দেখলাম না। কখন মরে যাই ঠিক আছে? তোমরা যে কেমন স্বামী-স্ত্রী?
অনন্যা মুখে কিছুই বলল না মনে মনে বলল, আমিও তো মা হতে চাই মা।

তেইশ

সন্ধ্যায় জামাল তার অফিসে বসেছিল এমনসময় তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
হ্যালো মিঃ জর্জ শুনুন, খুব গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর।
প্রথমে জামাল ভেবেছিল হয়তো রং নাম্বার থেকে কল এসেছে, সে বলল, সরি এখানে তো জর্জ নামে কেউ নেই।
ইয়েস মিঃ জামাল আমাদের ব্যবসার লাইনে আপনার নাম জর্জ এবং পাস ওয়ার্ড নাম্বার ট্রিপল সেভেন।
অন্যসময় কেউ এমন কথা বললে জামাল হেসে ফেলতো কিন্তু মিঃ টি.আর খানের কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ভয়ঙ্কর, তার সঙ্গে কথা বলতেই বুকটা কেঁপে উঠে। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, ইয়েস মিঃ খান এখন বলুন।
অপর পাশ থেকে মিঃ খান এর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এখন থেকে হ্যালো বলেই আপনি ট্রিপল সেভেন বলবেন, আর হ্যাঁ মাল পাঠানো হয়েছে, যে কোন সময় মাল আপনার হাতে পৌঁছে যাবে আপনি ক্যাশ দিয়ে মাল বুঝে নিবেন।
আমি কীভাবে চিনব?
আমি ম্যাসেজের মাধ্যমে তার বায়োডাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে অনুযায়ী চিনবেন। রিমেম্বার ইট ও এ লাইনে গাদ্দারের পরিণতি মৃত্যু, মিঃ খান এর শেষ কথাগুলো খুব নিষ্ঠুর এবং ভয়ঙ্কর শোনালো।
জামাল যেন বুকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেল, ইয়েস বস।
জামাল মোবাইল রেখে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। মিঃ খান এর সঙ্গে প্রথম আলাপের পরই জামাল মাল মার্কেটিং এর জন্য সবকিছু সাজিয়ে দিয়েছে। তাই জামালের অপেক্ষা শুধুমাত্র মাল হাতে পাবার।
জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সবেমাত্র রাত আটটা বাজে। জামাল অফিস থেকে বের হলো। অফিসের সামনে মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করা ছিল কিন্তু সে মনে মনে ভাবল মোটর সাইকেল নিয়ে জাহিদের বাসায় বেশি যাওয়া ঠিক হবে না, তাতে খুব সহজে মানুষ তার যাতায়াত বুঝতে পারবে। তাই সে রিক্সায় চড়ে জাহিদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
জাহানারা গেট খুলে দিয়ে বললেন, এসো বাবা।
জামাল রিক্সা বিদায় দিয়ে বাসার ভিতর ঢুকলো। জাহানারা জামালকে জাহিদের রুমে বসতে দিল। পার্শ্বের রুম থেকে জুঁই জোরে জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে মা?
তোর জামাল ভাই মা, বলে তিনি বের হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর জুঁই ঘরে ঢুকে বলল, ভাইয়া অনেকদিন পর।
হ্যাঁ তুমিও তো কোনদিন আসতে বললে না, তোমরা আসতে না বললে কীভাবে আসি বলো?
আপনাকে আসতে বলতে হবে কেন? যখন খুশি তখন চলে আসবেন, বলে জুঁই মুচকি হাসি হাসল।
জামাল জুঁইয়ের হাসির প্রশংসা করে বলল, তোমার হাসিটা তো খুব সুন্দর এ কয়েকদিনের মধ্যে তুমি বেশ সুন্দর হয়েছ।
জুঁই লজ্জায় মাথা নত করল।
জামাল আবার বলল, জুঁই তোমার সঙ্গে অনেক দেরিতে দেখা হয়েছে আরো আগে তোমার সাথে দেখা হলে ভালো হতো।
জুঁই মৃদু কণ্ঠে বলল, আগে দেখা হলে কী করতেন?
কী করতাম, বলে জামাল চেয়ার ছেড়ে উঠল তারপর থু থু ফেলার ভান করে বারান্দায় গিয়ে দেখল জাহানারা চা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত আর যুথি তার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। জামাল ঘরে ঢুকে জুঁইয়ের চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়িয়ে জুঁইয়ের দু’হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তার চোখে চোখ রাখল।
জীবনে প্রথম পুরুষের হাতের স্পর্শে জুঁইয়ের গা শিউরে উঠল। হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলতে থাকলো। অজানা আশঙ্কায় মুখ শুকিয়ে গেল। জুঁই হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার মৃদু চেষ্টা করল কিন্তু কেন জানি তার হাত দু’টো শিথিল হয়ে গেল, তার মুখ দিয়ে অষ্ফুটস্বরে একটা কথা বেরিয়ে এলো, ভাইয়া।
জামাল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, জুঁই তুমি খুব সুন্দর!
জুঁই কাঁপা স্বরে বলল, প্লিজ ভাইয়া হাত ছাড়ুন, আমার কথা শুনুন প্লিজ মা দেখে ফেললে-
জামাল হাত ছেড়ে দিয়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসে মনে মনে বলল তারমানে মা দেখে ফেললে সমস্যা, আর কেউ না দেখলে সমস্যা নেই। জুঁই আজ তোমাকে ছেড়ে দিলাম আরেকদিন সুযোগ পেলে তুমি ছাড়া পাবে না।
জুঁই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাইয়া আমি আসি।
তবে আমিও যাই, জামাল অভিমানের সুরে বলল।
না আপনি চা খেয়ে যাবেন।
তুমি না থাকলে আমি একা একা বসে কী করবো?
আপনি বসুন আমি আসছি, বলে জুঁই চলে গেল।
কয়েক মিনিট পর যুথি চায়ের ট্রে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে বলল, কেমন আছেন ভাইয়া?
হুম ভালো, বলে জামাল কয়েক সেকেন্ড যুথির বুকের দিকে তাকিয়ে রইল।
যুথি লজ্জায় মাথা নত করে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,চা নিন ভাইয়া।
জুঁই আবার রুমে ঢুকলো। সেকেন্ড
জামাল একরকম চমকে উঠল, এতসব কী দরকার ছিল যুথি?
যুথির বুকের দিকে জামালকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুঁই মনে মনে বলল, আমি চলে গেলে জামাল ভাই আবার যুথির দিকে নজর দিতে পারে তাই এখানে বসে থাকাই ভালো।
জুঁই আবার চেয়ারে বসল।
যুথি চা দিয়ে চলে যাচ্ছিল জামাল জিজ্ঞেস করল, যুথির পরীক্ষা যেন কবে?
আগামী মাসের সাত তারিখে ভাইয়া।
তবে তো আমি এসে তোমাকে ডিস্টার্ব করছি।
জামালের আগমনে যুথি সত্যি সত্যি বিরক্ত বোধ করছে। সে নিতান্তই ভদ্রতাবশতঃ বলল, এমন কথা বলবেন না ভাইয়া, আপনি আসলে আমরা খুব খুশি হবো।
জুঁই রাগান্বিত চোখে যুথির দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বলল, যুথি পড়তে বস।
যুথি আর কোন কথা না বলে চলে গেল। যুথির আচরণ জামালের চোখ এড়িয়ে যেতে পারল না। সে ঠিকই খেয়াল করেছে যুথির মধ্যে তার রূপ আর যৌবনের একটা অহঙ্কার আছে, জামালের মনে জিদ চেপে গেল, আগে জুঁইকে সাইজ করি তারপর যুথির রূপ আর যৌবনের অহঙ্কার আমি দুমড়ে মুচড়ে দিব।
জুঁই জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছেন ভাইয়া?
না কিছু না বলে জামাল চা শেষ করে বলল, জুঁই আমি আজকের মতো আসি বলে বিদায় নিল।
জুঁই বলল, ভাইয়া আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে?
জামাল হেসে উঠল, আমার সঙ্গে? আমার সঙ্গে কথা বলবে তাতে আবার সঙ্কোচ করছ কেন? বলে ফেল?
ভাইয়া আপনি তো জানেন বাবা মারা যাবার পর সংসারের সমস্ত ভার ভাইয়ার ওপর পড়েছে বেচারা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছে, তাই-
কি জাহিদের বেতন বাড়িয়ে দিতে বলছ?
না ভাইয়া তা বলিনি, আপনি বেতন বাড়াবেন কি না সেটা আপনার ব্যাপার।
তবে?
ভাইয়া আমার একটা চাকরি দরকার।
বেশ তো চাকরিতে দরখাস্ত করো, ইন্টার্ভিউ দাও তারপর আমার যদি কোন হেল্প লাগে তো করবো। সেটা টাকা দিয়েই হোক আর তদবির দিয়েই হোক।
জুঁই জামালের প্রশংসা করে বলল,ইউ আর সো গ্রেট ভাইয়া,আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন।

চব্বিশ

জামাল যেদিন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদিন থেকে তার আচরণে বেশ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সে এখন যেকোনো বয়স্ক লোক দেখলেই মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে সালাম দেয়, ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে, কোন সমস্যার কথা শুনলে সমাধানের আশ্বাস দেয়, কারো অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে সহানুভূতি দেখায়, গরীব-দুঃখী মানুষকে দান-খয়রাত করে। জামালের হঠাৎ এমন পরিবর্তন অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক বলে মনে হলো। অনেক চেনা লোকেরাও যেন জামালকে চিনতে ভুল করে, তুমি কে বাবা?
জামাল উত্তর দেয়, আমাকে চিনলেন না চাচা আমি জামাল।
ওহ এবার চিনেছি তুমি জহিরের ছেলে জামাল?
ইদানীং জামালের কাছে কোন দরিদ্র মানুষ সাহায্যের জন্য হাত পাতলেই সে বিমুখ করে না। বরং যেখানে দু/এক টাকা ভিক্ষা দেওয়ার কথা সেখানে হঠাৎ করে দশ টাকার নোট চাঁদা দিয়ে থাকে আবার যাকে দশ টাকা চাঁদা দিলেই যথেষ্ট তাকে এক’শ টাকার নোট বের করে দেয়, এখন তার মন যেন সাগরের মতো উদার, আকাশের মতো বিশাল।
সেদিন সন্ধ্যায় জামাল তার অফিসে ছিল। হঠাৎ তার কানে এলো এক বৃদ্ধার গলার স্বর, বাবা আমার মেয়ের বিয়ে কিছু সাহায্য দাও বাবা।
গেটে বসা পিয়ন জাকির খুব বিশ্বস্ত এবং অনুগত। সে প্রথমে বলল, ভিতরে ভাইজান আছে যাওয়া যাবে না।
আবার বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, তোমার ভাইজানের সঙ্গে একবার দেখা করবো বাবা।
জাকির বলল, ভাইজান খুব ব্যস্ত, এখন দেখা করা যাবে না।
আমাকে একবার দেখা করতে দাও বাবা, তোমার ভাইজান খুব টাকাওয়ালা মানুষ, আমার মনে হয় আমাকে ফেরাতে পারবে না।
জাকির কর্কশ স্বরে বলল, টাকাওয়ালা মানুষ তাই দু’হাতে টাকা বিলিয়ে দিবে, না?
তুমি আমাকে একবার দেখা করতে দাও বাবা।
জাকির আরো জোরে বলল, বললাম তো ভাইজানের পারমিশন নেই।
জামাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই জাকির ভিতরে ঢুকলো, ভাইজান।
জামাল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে জাকির?
ভাইজান একটা বুড়ি এসেছে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চায়।
জামাল জোরে ধমক দিয়ে বলল, চুপ বেয়াদব, বুড়ি বলবি না। চাচী বলবি। যা পাঠিয়ে দে।
জাকির কয়েক সেকেন্ড জামালের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ভাইজান তো আগে গরীব-দুঃখী মানুষ দেখলেই নাক ছিটকাতেন হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন?
জামাল আবার ধমক দিল, হ্যাঁ করে দেখছ কী?
জাকির চমকে উঠল, জি ভাইজান যাচিছ।
কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে এক বৃদ্ধা জামালের চেম্বারে ঢুকে সালাম দিল, জামাল সালামের জবাব দিয়ে বলল, কী খবর চাচী বলুন?
আমার মেয়ের বিয়ে বাবা, তাই সাহায্যের জন্য এসেছিলাম।
আপনার বাসা কোথায় চাচী?
এই মহল্লায় বাবা।
জামাল জিজ্ঞেস করল, আমাকে চিনতে পেরেছেন?
বৃদ্ধা জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না তো বাবা।
আমার নাম জামাল, আমার বাবার নাম জহির।
তুমি জহিরের ছেলে? অনেক বড় হয়েছ বাবা, তোমাকে ছোটবেলা কত কোলে-পিঠে নিয়েছি। এখন গরীব হয়ে গেছি তাই আর তোমাদের বাসায় যাওয়া যায় না।
আসবেন চাচী আমি ধনী-গরীব তফাৎ করি না, আসলে আমরা সবাই মানুষ। বলুন চাচী এখন আপনার মেয়ের বিয়ের কথা বলুন।
আমার মেয়ের বিয়েতে কিছু সাহায্যের জন্য তোমার কাছে এসেছি বাবা।
যৌতুক কত দিতে হচ্ছে?
বৃদ্ধা জামালের কথা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জামাল একটু জোরে বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম ডিমান্ড কত?
না বাবা ডিমেন্ড না, চেয়ারম্যান সাহেব বলে দিয়েছেন এই পৌরসভায় কেউ ডিমেন্ড দিতেও পারবে না, নিতেও পারবে না। আমার মেয়ের বিয়েও এই পৌরসভারই একটা ছেলের সঙ্গে তাই বিয়ের কোন ডিম্যান্ডের কথা হয়নি, শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ হলেই চলবে।
জামাল বৃদ্ধার দিকে নিরীক্ষার ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল, তা কত খরচ হবে?
কী জানি বাবা? তোমার চাচা অসুস্থ মানুষ সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে সেই আমার এক দূর সম্পর্কীয় ভাগিনাকে নিয়ে হিসেবে করে বলল, তিন হাজার টাকা খরচ হবে।
আপনি কত টাকা যোগাড় করেছেন?
বারো’শ।
চেয়ারম্যান সাহেব টাকা দিয়েছেন?
জি।
কত?
পাঁচ’শ।
আচ্ছা চাচী আমি আপনার মেয়ের বিয়েতে এক হাজার টাকা দিব, আগামীকাল আপনার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসবো।
দোয়া করি বাবা, আল্লাহ তোমাকে অনেক বড় করবে, বলে বৃদ্ধা চলে গেল।

জামাল আরো কিছুক্ষণ থাকল তারপর তার চেম্বার থেকে বের হলো। তার চেম্বারের অদূরে ক্লাব, জামাল ক্লাবে ঢুকলো। তাকে দেখে কয়েকজন উঠতি বয়সের তরুণ উঠে দাঁড়ালো।
জামাল বলল, বসো, তোমরা সবাই বসো।
সবাই বসল একজন জিজ্ঞেস করল, ভাইজান হঠাৎ কী ম¬ন করে?
না এমনি এলাম, পা¬শেই থাকি অথচ তোমাদের এখানে আস¬তে পারি না। আসলে তোমাদের সবার সঙ্গে আমার খুব একটা পরিচয় নেই, বলে জামাল তার পাশে বসা একজ¬নের দি¬কে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আ¬গে নি¬জের পরিচয় দিল, আমি জামাল।
তারপর থেকে একে একে সবাই জামালের সে¬ঙ্গ হ্যান্ডশ্যাককরে তাদের পরিচয় দিল।
জামাল জি¬জ্ঞেস করল, কী কী আ¬ছে তোমা¬দের ক্লা¬বে?
শাহিন নামে একটা চটপ¬টে ছেলে বলল, অল্প কিছু বই আ¬ছে, কেরাম বোর্ড, দাবা এই আর কি।
টি.ভি নেই?
সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। এখন একটা-বলে শাহিন অন্যান্যদের মুখের দিকে তাকালো।
জামার অভয় দিল, বলো, বলো?
একটা ছেলে ফিস ফিস করে শাহিনের কানে কি যেন বলল, শাহিন মৃদু হেসে বলল,তুই বল।
জামাল শাহিনে¬ক জিজ্ঞেস করল, কী হ¬লো শহিন? বলো।
ভাইয়া আসে¬ল আমা¬দের ক্লাবে একটা টি.ভি খুব প্র¬য়োজন।
বেশ তো তোমরা যখন আশা ক¬রছ আমি অবশ্যই দিব।
কয়েকজন এক সে¬ঙ্গ বলল, সত্যি বলে¬ছন ভাইয়া?
হ্যাঁ সত্যি বলছি, তোমা¬দের বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা তোমরা একসময় সব সদস্য মিলে আমার কাছে এসো আমি তোমাদের একটা কালার টি.ভি কিনে দিব। আর হ্যাঁ আসার আ¬গে মোবাইল কে¬র এসো কেমন? বলে জামাল একটা ভিজিটিং কার্ড বের কে¬র শাহিনের হাতে দিল।
জি ভাই ঠিক আ¬ছে।
তোমরা বসো আমি আসি কেমন, ব¬লে জামাল বের হলো।
ক্লা¬বে বসে সবাই এ¬কে অ¬ন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। একজন শাহিনকে জি¬জ্ঞস করল, হঠাৎ করে জামাল ভাই এত দয়ালু হয়ে গেল?
অন্যজন বলল, নির্বাচন করবে নাকি?
শাহিন বিরক্তি সহকারে বলল, তোরা সবকিছু নেগেটিভ সেন্সে এ নিস, সবকিছু বাঁকা দৃষ্টিতে দেখিস। জামাল ভাই বরাবরই উদার, ধনী লোকের ছেলে এখন নিজেও অ¬নেক টাকার মালিক তার কত ব্যবসা, ¬পে¬ট্রাল পাম্প, ধান-চাউ¬লের ব্যবসা, ঠিকাদারি ব্যবসা কা¬জেই একটা কালার টি.ভি তাঁর কা¬ছ কোন ব্যাপারই না। আমি মনে করি তিনি যখন দিতে চেয়ে¬ছন তখন আমা¬দের নিতে না চাওয়ার কোন কারণ থাকতে পা¬রে না।
সকলেই সমস্বরে বলল, না না আমা¬দের ¬দেরি করা ঠিক হবে না। আমরা কালকেই যাব।
শাহিন বলল, তাহলে এ কথাই থাকল আগামীকাল সবাই অবশ্যই সন্ধ্যায় সাতটার মধ্যে চলে আসবি।

পঁচিশ

চেয়ারম্যান সাহেব একে একে সকলের অভিযোগ শুনছেন আর বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। পিছনের সারিতে বসে থাকা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, চেয়ারম্যান সাহেব আমার একটা অভিযোগ আছে।
বলো কী তোমার অভিযোগ?
কয়েকদিন থেকে দেখছি আমার পাশের বাড়ির শাহেদ চাচা প্রাইভেট ক্লিনারের ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে না, পৌরসভার ডাস্টবিনেও ময়লা ফেলে না প্রতিদিন তার বাড়ির কাজের ছেলেটা হয় রাস্তার উপর আর না হয় ড্রেনে ময়লা ফেলে দিয়ে চলে যায় চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে এর একটা বিচার করতে হবে।
চেয়ারম্যান সাহেব তার পাশে বসা এক কর্মীকে বললেন, হাসিব তুই যা তো শাহেদ চাচাকে আমার সালাম দিস।
হাসিব বেরিয়ে গেল।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, করিম চাচা, হারেস চাচা আপনারা একটা মারাত্মক ভুল করতে যাচ্ছিলেন সময় মতো আমাদের ছেলেরা বাধা না দিলে বিয়েটা হয়ত হয়েই যেত।
একে অপরের মুখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন কী হয়েছে?
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না করিম চাচা তার সতেরো বছর বয়সের ছেলের সঙ্গে হারেস চাচার তেরো বছর বয়সের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলেন। বিয়ের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন, কাজি সাহেবও বিয়ে পড়ানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। শুধু কি তাই? বিয়েতে যৌতুকেরও একটা হিসাব ছিল। আমি ঠিক সময়ে না পৌঁছালে এমন একটা গর্হিত কাজ হয়ে যেত বলে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, কাজি সাহেব আপনি তো ছেলে মেয়ের বয়স জানেন তারপরও আপনি বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে রাজি হলেন কেন?
কাজি সাহেব মাথা নত করে বসে রইলেন, করিম চাচা বললেন কাজি সাহেবের কোন দোষ নেই বাবা কাজি সাহেব আমাদের বলেছিলেন কিন্তু আমাদের অনুরোধে তিনি বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে সম্মত হয়েছিলেন।
কিন্তু আপনারা তো জানেন এবং আমিও সবাইকে বলেছি যৌতুক নেয়া কিংবা দেয়া এবং আঠারো বছরের কম বয়সের মেয়ে আর একুশ বছরের কম বয়সের ছেলের বিয়ে দেয়া আইনত দ ণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও আপনারা কেন এই অপরাধ করতে যাচ্ছিলেন?
হারেস বললেন, বাবা মেয়ে বড় হয়েছে করিম আমার অনেক দিনের বন্ধু তার ছেলেও বিয়ের লায়েক হয়েছে যৌতুক কম তাই দু’বন্ধু মিলে বন্ধুত্ব আরো পাকা পোক্ত করতে চেয়েছিলাম।
দেখুন বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত করা কিংবা কম যৌতুকের জন্য অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেয়ার যুক্তি ঠিক না। আপনার মেয়েটা সুন্দর, সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ছে ওকে আরো লেখাপড়া শেখাবেন, মেয়েদের লেখা পড়ার জন্য সরকার উপবৃত্তি চালু করেছে। কাজেই সরকারি সুবিধা গ্রহণ করে আপনি মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলতে পারেন। করিম চাচার ছেলেও ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে ততদিনে সেও আরো লেখাপড়া শিখে বড় হবে তারপর বিয়ে দেবেন তাতে আপনাদের বন্ধুত্বও ঠিক থাকবে, বিয়ের পর মেয়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। আমি আশা করি আপনারা সবাই করিম চাচা আর হারেস চাচার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। কেউ অল্প বয়সে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিবেন না, যৌতুক দিবেন না এবং যৌতুক নিবেন না। কেউ বিয়েতে যৌতুক দাবি করলে বা যৌতুকের জন্য নির্যাতন করলে আমাকে জানাবেন। আর কাজি সাহেব আপনিও শুনুন এই পৌরসভায় কোন বাল্য বিবাহ হবে না, যৌতুকের আদান-প্রদান হবে না। আপনি বয়স সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে কোন বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন না। কারো বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারলে আমাকে বলবেন আমি পৌরসভায় সংরক্ষিত সনদপত্র অথবা তাদের অভিভাবকের কাছ থেকে ভালোভাবে জেনে নিশ্চিত হব। এর কোন পরিবর্তন ঘটলে জন প্রতিনিধি হিসেবে আমি ব্যবস্থা নিব।
এমন সময় শাহেদ সাহেব ও হাসিব রুমে ঢুকলো। চেয়ারম্যান সাহেব শ্রদ্ধা সহকারে শাহেদ সাহেবের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করলেন। তারপর বললেন, চাচা আপনারা সবাই আমাকে এলাকার ভালোমন্দ দেখার জন্য ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। আল্লাহর রহমতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমি এলাকার উন্নয়নের জন্য সাধ্য মতো চেষ্টা করছি। পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে এলাকার উন্নয়নের চেষ্টা করছি। তা আপনারা সবাই এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। আমি মনে করি উন্নয়ন মানে শুধু রাস্তা-ঘাট, ড্রেন এর উন্নয়ন নয়। মানুষের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিও উন্নয়ন। তাই আমি কিছু কাজও এরই মধ্যে শুরু করেছি, যেমন জন্ম-মৃত্যু রেজিস্ট্রেশন, যৌতুক ও বাল্য বিবাহ রোধ এবং প্রাইভেট ক্লিনার দ্বারা এলাকার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা। জন্ম-মৃত্যু রেজিস্ট্রেশন আমরা যেদিন থেকে শুরু করেছি সেদিন থেকে এলাকায় যত শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে সবারই নাম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, যত মানুষ মারা গেছে সকলের নাম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। গত দু’মাসে কোন বাল্য বিবাহ হয়নি, কোন বিয়েতে যৌতুকের আদান-প্রদান হয়নি, করিম চাচা আর হারেস চাচা তাদের অল্প বয়স্ক ছেলে মেয়ের যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে সম্পাদনের চেষ্টা করছিলেন তা বন্ধ করেছি। তারা তাদের ভুল স্বীকার করেছেন বলে চেয়ারম্যান সাহেব একটু থামলেন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, শাহেদ চাচা আপনার বাড়ির উচ্ছিষ্ট ময়লা প্রাইভেট ক্লিনার বা পৌরসভার ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তা বা ড্রেনে ফেলে?
শাহেদ সাহেব বললেন, আমি তো জানি না বাবা।
চাচা বাসায় বলে দিবেন যেন প্রাইভেট ক্লিনারের ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে।
ঠিক আছে বাবা।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি গত দু’মাসে আমাদের এলাকার উন্নয়ন হয়েছে আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। আমি পৌরসভাকে একটা আদর্শ পৌরসভায় পরিণত করব। যা সারাদেশে একটা নজির স্থাপন করবে। আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।

ছাব্বিশ

কয়েকমাসের মধ্যে জামালের হেরোইন-ফেন্সিডিলের ব্যবসা বেশ জমে উঠল। শুধু মাদক ব্যবসা নয় ঠিকাদারি, ধান চাউলের ব্যবসা সবকিছু মিলিয়ে জামালের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হলো।
জাহিদ জামালের জেনারেল ম্যানেজার, জামালের পক্ষ থেকে সেই সবকিছু দেখা ভালো করে। জামাল প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিসে বসে সবকিছু তদারকি করে। কোন কোনদিন অফিসের কাজ শেষ করে পার্টি অফিসে বসে আবার কোনদিন ছুটে যায় জাহিদের বাসায়। তারপর যুথি জোরে চেঁচিয়ে বলে, কে এলো আপা?
জুঁই বলে জামাল ভাই এসেছে। তোর চেঁচামেচি করতে হবে না, তুই ভালোভাবে লেখাপড়া কর।
তারপর জামালের সাথে গল্প করে। তার মা চা তৈরি করে অনেকক্ষণ পর যুথি চা নিয়ে ঘরে ঢুকে।
আজ জামাল ঘরে ঢুকেই জুঁইকে বলল, জুঁই আগে এক গ্লাস পানি দাও পরে অন্য কিছু খাবো।
জুঁই পানি নিয়ে এলো, জুঁইয়ের হাত থেকে পানির গ্লাস নেওয়ার সময় জামাল ইচ্ছা করে জুঁইয়ের হাত স্পর্শ করল। জুঁই এর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল। জামাল পানি রেখে নিজের চেয়ারে বসল। পরপর কয়েকবার পরস্পরের চোখে চোখে পড়ল।
জামাল মুচকি হেসে বলল, জুঁই অনেকদিন থেকে ভাবছি তোমাকে আমি সুন্দর করে সাজাবো।
জুঁই কিছু বুঝতে পারল না, তার মনে হলো হঠাৎ করে জামাল তাকে সাজাতে চাইবে কেন? জুঁই জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে আমাকে সাজানোর কথা আসছে কেন ভাইয়া?
জামাল সেকথার উত্তর না দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, এই ধরো দামি শাড়ি, ব্লাউজ, দামি গয়না এসব পরলে তোমাকে কেমন দেখায়। তুমি এমনিতেই খুব সুন্দর তারপরও শাড়ি পরলে সৌন্দর্য আরো ফুটে উঠবে।
জুঁই লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেল সে মাথা নত করে বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত কারো মুখে কোন কথা নেই।
জামাল বলল, আমাকে খুব কাছের মানুষ মনে করবে।
জুঁই তবুও কিছু বলল না যেমনভাবে বসে ছিল তেমনি অনড়ভাবে কিছুক্ষণ বসে রইল। সে জামালের এসব কথায় অস্বস্থিবোধ করছিল। সে তার চেয়ার থেকে উঠে বলল, যুথির পরীক্ষা তো ও একটু পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি?
জামাল জুঁইয়ের পথ রোধ করে দাঁড়ালো, ওটা যুথি আর খালা আম্মার ডিউটি তুমি একটু বসো গল্প করি।
জুঁই তার চেয়ারে বসল।
জামাল বলল, জুঁই তুমি আমাকে কতটুকু জানো বলো তো।
জুঁই নীরবে বসে রইল জামাল আবার বলল, জুঁই কথা বলো।
জুঁই মৃদু হেসে বলল, কী বলব ভাইয়া? আমি জানি আপনি ভাইয়ার বস, বিশাল ধনী লোক। আপনার অনেক টাকা -পয়সা, বিষয়-সম্পত্তি, আর কিছু জানি না।
এই যেমন বিয়ে করেছি কিনা?
জানি আপনি বিয়ে করেছেন, ঘরে সুন্দরী বউ আছে।
আমি ধনী মানুষ? টাকা-পয়সা বিষয় সম্পত্তির অভাব নেই? ঘরে সুন্দরী বউ আছে? তার মানে আমার সব আছে?
জুঁই মাথা বাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলল, জি।
কিন্তু আমার মধ্যেও যে একটা শূন্যতা আছে। সে কথা কি তুমি জানো?
জুঁই মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, তার জানা নেই।
জুঁই সবকিছু থেকেও আমার প্রায় মনে হয় আমার কিছু নেই যখন আমি ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকি তখন আমি যেন অর্থের নেশায় মত্ত থাকি, তারপর ব্যবসার কাজ গুছিয়ে আমি যখন একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পাই তখন যেন বুক ফেটে যায়, তখন সুখের অভাব অনুভব করি বলতে বলতে জামাল জুঁইয়ের চিবুক উঁচু করে ধরল, জুঁই তুমি আমাকে সুখ দিবে?
জুঁই লজ্জায় চোখ বন্ধ করে বলল, প্লিজ ভাইয়া আপনি আপনার চেয়ারে বসুন।
জামাল জুঁইয়ের চিবুক থেকে হাত নামিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে জুঁইয়ের হাতে দিয়ে বলল, জুঁই রাখো, বলছিলাম না শাড়ি পরলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগবে। শাড়ি কিনবে আবারো যেদিন আমি আসবো সেদিন শাড়ি পরবে, বলে জামাল জুঁইয়ের হাতের মধ্যে টাকা পুরে দিল। কিন্তু জুঁই হাতের মুষ্টি ছেড়ে দিলে টাকা মেঝেতে পড়ে গেল।
মুহূর্তেই জামাল রেগে গেল সে চাপাস্বরে বলল, জুঁই এত অহঙ্কার ভালো না। তুমি এটা না করলেও পারতে।
জুঁই এবার একটু দুর্বল হয়ে পড়ল। সে জামালের হাত ধরে বলল, সরি ভাইয়া আমি বুঝতে পারিনি আপনি এভাবে রেগে যাবেন।
জামাল জুঁইয়ের হাতে টাকা দিয়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসল। এমনসময় যুথি চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
যুথি সবসময় হাসি-খুশি থাকে কোনদিন কেউ তার মুখে সামান্য মেঘের ছায়াও দেখেনি। বরাবরের মত যুথি মিষ্টি হেসে বলল, কেমন আছেন ভাইয়া?
জামাল মৃদু হেসে বলল, বিকেলে কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম জুঁই’র সঙ্গে কথা বলে মনটা ভালো হয়েছিল আর তোমাকে দেখে তো মনটা আরো আনন্দে নেচে উঠল।
যুথি মুখ কালো করল, ভাইয়া আপনি কি থামবেন? না থামলে কালকেই বাসায় গিয়ে ভাবীকে বলব, তিনি যেন আপনার চোখের চিকিৎসা করান।
যুথি এত বড় বেরসিক হলে চলবে কী করে বলো। একটু রোমান্টিক হও।
জুঁই চাপা স্বরে বলল, যুথি তুই একটু যাবি, ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
যুথি চলে গেল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, কী কথা? বলো?
ভাইয়া আমি তো চাকরির জন্য বিভিন্ন অফিসে অনেকদিন থেকে এপ্লিকেশন করছিলাম গতকাল একটা ইন্টার্ভিউ কার্ড এসেছে আগামী শুক্রবার আমার ইন্টার্ভিউ, ঢাকায়।
জুঁই এত বড় একটা খবর তুমি লুকিয়ে রেখেছ। দেখি তোমার ইন্টার্ভিউ কার্ডটা, বলে জামাল জুঁই’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
আপনি বসুন আমি নিয়ে আসছি বলে জুঁই বের হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর ইন্টার্ভিউ কার্ডটা এনে জামালের হাতে দিল। জামাল কার্ডটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখে মনে মনে বলল, জুঁইকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার এই তো সুযোগ। আর একবার যদি ঢাকা নিয়ে যেতে পারি——–।
জামালকে চুপ করে থাকতে দেখে জুঁই জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কি কিছু ভাবছেন?
হ্যাঁ খুঁজে পেয়েছি ঐ অফিসে তো আমার এক ভাই আছে, ভাই মানে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতার ভাই ঐ অফিসের বড় অফিসার। আমার সঙ্গেও বেশ জানা শোনা আছে আমার গলার স্বর শুনলেই চিনবেন বলে জামাল ইন্টার্ভিউ কার্ডে নাম দেখে বলল, হ্যাঁ রাজ্জাক ভাই তো? আচ্ছা আমি একবার মোবাইল করে দেখি যদি পাই তবে এখনই কথা বলব। বলে জামাল মোবাইল করে কথা বলতে শুরু করল, রাজ্জাক ভাই ভালো আছেন?
অপর পাশ থেকে কী বলল তা শোনা গেল না।
ভাইজান আপনার অফিসে আমার একটা ছোট বোন চাকরির এপ্লিকেশন করেছে, খুব ট্যালেন্ট মেয়ে বলে জামাল মোবাইল ফোনটা কানের কাছে ধরে রাখল। তারপর আবার বলল, আমি রোল নাম্বারটা বলি একটু লিখে নিবেন? প্লিজ!
অপর পাশ থেকে কোন কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো কী না তা বোঝা গেল না।
জামাল আবার বলল, মোবাইলে হবে না সরাসরি যেতে হবে?
কবে?
পরীক্ষার আগের দিন?
ক্যান্ডিডেটকে ইন্টার্ভিউ কার্ডসহ পরীক্ষার আগের দিন দেখা করতে হবে।
কোথায় বাসায় নাকি অফিসে?
বাসায় রাত আটটার আগে।
আচ্ছা ভাই ঠিক আছে। আমি নিজে কেন্ডিডেটসহ ইন্টার্ভিউর আগের দিন আসছি। বলে জামাল মোবাইল অফ করল।
জুঁই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ভাইয়া ঐ অফিসের বস আপনার পরিচিত?
হ্যাঁ এতক্ষণ কি শুনলে? রাজনীতিবিদদের হাত সম্পর্কে তো তোমার ধারণা নেই।
জুঁই অবাক হয়ে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জামালের হাতে কার্ডটা থাকা সত্ত্বেও সে জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষা কখন শুরু হবে যেন?
জুঁই বলল, শুক্রবার সকাল ন’টায়।
তারমানে উনার সঙ্গে দেখা করতে হবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, বলে জামাল জুঁই’র দিকে তাকিয়ে বলল, জুঁই তুমি তাহলে সে অনুযায়ী রেডি থাকো। আহ্‌ আজ খুব ভালো লাগছে। তোমার চাকরিটা একেবারে নিশ্চিত।
জুঁইয়ের মুখের ওপর তখন একটা আনন্দের ছাপ ফুটে উঠেছে।
জামাল বলল, আমরা বৃহস্পতিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। জুঁই, যুথি তোমরা তাহলে থাকো আমি আসি, বলে জামাল চেয়ার ছেড়ে উঠে যুথির গালে টোকা দিয়ে বলল, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে বলে জামাল খালা আম্মা আসি বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল।

সাতাশ

জামাল চেয়ারে বসেছিল। জাহিদ একটা খাতা নিয়ে তার রুমে ঢুকলো।
জামাল বলল, জাহিদ বসো।
জাহিদ কোনদিন জামালের সামনের চেয়ারে বসেনি। জামালও কোনদিন জাহিদকে এমন স্নেহ মাখা কণ্ঠ বসতে বলেনি। আজ হঠাৎ জামালের কথা শুনে জাহিদ এদিক-সেদিক একবার তাকিয়ে বলল, আমাকে বলছেন ভাইজান?
হ্যাঁ তোমাকে বলছি বসো।
জামাল বলল, জাহিদ তুমি যখন আমার ফার্মে প্রথম জয়েন করলে তখন কি তোমার বায়োডাটা, ছবি, সার্টিফিকেটগুলো দিয়েছিলে?
জাহিদের মুখ অজানা আতঙ্কে শুকিয়ে গেল, ভাইজান হঠাৎ করে বায়োডাটা, ছবি, সার্টিফিকেট এগুলো কি কাজে লাগছে? হঠাৎ কোন….
তুমি মনে হয় ভয় পেয়েছ? ভয়ের কিছু নেই আসলে আমি স্প্যাশাল শ্রেণীর একটা লাইসেন্স করছি, তাই প্রিকোয়ালিফিকেশনের জন্য ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব স্টাফদের বায়োডাটা, ছবি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট এমনকি ফার্মের মিকচার মেশিন, ভাইব্রেটরসহ সকল মালামালের তালিকা দিতে হচ্ছে। তাই তুমি তোমার বায়োডাটা আর এক কপি ছবি দিও।
জাহিদের চোখে মুখে একটা তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল।
জাহিদ মিষ্টি হেসে বলল, জি ভাইজান, ঠিক আছে বলে জাহিদ চেয়ার ছেড়ে উঠছিল।
জামাল আবার বলল, উঠছ কেন? বস। জাহিদ আমি আমার ব্যবসাকে আরো নতুনভাবে সাজাতে চাই।
জাহিদ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
জামাল বলল, আসলে আমার ইচ্ছা একটা গ্রুপ অফ কম্পোজ করা এই যেমন জামাল কন্সট্রাকশন, জামাল রাইস, জামাল জুট এমনভাবে কয়েকটা ছোট ছোট কোম্পানি মিলে জামাল গ্রুপ অফ কোম্পানীজ। কন্সট্রাকশন, রাইস আর আমার অন্যান্য ব্যবসাগুলো দেখাশুনা করা তোমার একার পক্ষে বেশ কঠিন হচ্ছে আবার এগুলো ব্যবসা আর পলিটিক্স করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে তুমি রাইস আর ঐ বলে জামাল একটু ইঙ্গিত করে ….ব্যবসা দেখাশুনা করবে আর কন্সট্রাকশন দেখার জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার অ্যাপোয়েন্টম্যান্ট দিব।
জাহিদ মৃদু হাসল।
জামাল বলল, হাসছ কেন?
জাহিদ কিছু বলল না নীরবে বসে রইল।
জামাল আপন মনে বলতে থাকল, জাহিদ আমি অনেক কিছু ভাবছি, শুধু ভাবছি বললে ভুল হবে স্বপ্ন দেখছি, আসলে স্বপ্ন না দেখলে উপরে উঠা যায় না।
আপনি ঠিক বলেছেন ভাইজান ।
ও ভালো কথা তোমার আর মাল লাগবে না কি? সব স্পটে খবর নাও আবার মাল লাগলে বলবে।
ভাইজান মার্কেটে যে মাল আছে তাতে এক সপ্তাহ চলবে।
ঠিক আছে আগামী সপ্তাহে মালের অর্ডার দিতে হবে। আর হ্যাঁ তুমি খুব সাবধানে চলাফেরা করবে, অপরিচিত লোকের সঙ্গে এ বিষয়ে কোন কথা বলবে না। কি নাম বললে যেন বলে জামাল একটু হাসল তারপর বলল ফেন্সি কুইন, ফেন্সি কুইনদের সঙ্গে কথা বলার সময় খেয়াল রাখবে কেউ যেন তোমাকে দেখে না ফেলে।
জি ভাইজান।
যেভাবে বললাম তুমি সেভাবে কাজ করো, তোমার বায়োডাটা এক কপি ছবি, সার্টিফিকেট এবং কন্সট্রাকশনের জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার অ্যাপয়েন্টম্যান্ট না হওয়া পর্যন্ত সবকিছু তোমাকে দেখতে হবে। তুমি কাজ করো আমি পার্টি অফিসে যাই বলে জামাল তার অফিস থেকে বের হয়ে গেল।

আটাশ
পৌরসভা নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। পার্টি অফিসে মনোনয়ন প্রার্থীদের আনাগোনা বাড়ছে। যদিও পৌরসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে প্রচারণার নিয়ম নেই তারপরও সবকিছুই হয় দলের প্রত্যক্ষ মদদে। তাই পার্টি অফিসে মনোনয়ন প্রার্থীদের ভিড় ক্রমে বেড়েই চলেছে।
জামালকে দেখে মোস্তফা সাহেব বলে উঠলেন, এই যে ইয়াং লিডার, খবর কী?
জামাল চেয়ারে বসতে বসতে বিনয়ের সঙ্গে বলল, জি বড়ভাই ভালো।
মোস্তফা সাহেব বললেন, কে ভালো? তুমি নাকি জনগণ ভালো?
সবাই ভালো।
বেলায়েত সাহেব বললেন, হ্যাঁ ওর সূত্রটা জনগণের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
মোস্তফা সাহেব বললেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী রায়হান চেয়ারম্যান খুব জনপ্রিয়, তাকে নির্বাচনে পরাজিত করা বেশ কঠিন কাজ।
বড়ভাই আপনারা আমাকে সহযোগিতা করলে আমি অবশ্যই পারবো।
মোস্তফা সাহেব বললেন, মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রেও তোমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো কিন্তু তোমাকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখাতে হবে। তারপর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য তোমাকে কম্পিটিশন করতে হবে রায়হান চেয়ারম্যানের মতো জনপ্রিয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে। আমরা তোমার সঙ্গে থাকব, দল তোমাকে সমর্থন দিবে, সহযোগিতা দিবে। কিন্তু তোমাকে আরো অ্যাকটিভ হতে হবে, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, আরো জনগণের কাছাকাছি যেতে হবে। জনগণের মুখ থেকে বের করতে হবে যে তারা হিসেবে তোমাকেই দেখতে চায়। তা না হলে তুমি দলের নমিনেশন নাও পেতে পারো।
জি বড়ভাই আমি বুঝতে পেরেছি। আপনারা আমাকে নিয়ে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন ইনশাল্লাহ আমি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আপনাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবো, বলে জামাল চেয়ার ছেড়ে উঠল।
বেলায়েত সাহেব বললেন, জামাল কি রাগ করে চলে যাচ্ছ? আসলে মোস্তফা ভাই যা বললেন তা তোমার ভালোর জন্যই বললেন।
জামাল এমন একটা ভাব দেখালো যে সে কিছু মনে করেনি। সে হেসে বলল, আপনারা আমার সিনিয়র আপনাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতায় বড় হতে চাই বলে জামাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বড়ভাই আমার একটু তাড়া আছে।
মোস্তফা সাহেব বললেন, আচ্ছা তুমি এসো।
জামাল বের হয়ে যাওয়ার পর বেলায়েত সাহেব বললেন, মোস্তফা ভাই আপনি জামালকে চাপের মুখে ফেলে দিলেন, ও আসলে টেনশন করবে।
মোস্তফা সাহেব বললেন, বেলায়েত ওকে এভাবে গিয়ার আপ না করলে বসে থাকত, তাই একটু ইচ্ছা করেই টেনশনে ফেলে দিলাম। তাছাড়া রাজনীতিতে টেনশন সহ্য করার ক্ষমতা থাকা দরকার সেটাও শেখালাম।

উনত্রিশ

ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। জুঁই কোনদিন ঢাকা শহরে যায়নি আজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার পর থেকে তার মন আনন্দে ভরে গেছে। জুঁই সবসময় শুধু ভাবছে আর মাঝে মাঝে আপন মনে হাসছে। জুঁই আর জামাল একই সিটে পাশাপাশি বসেছে জুঁই জামালের দিকে তাকিয়ে আছে, জামাল মাঝে মাঝে ঘুমাচ্ছে মাঝে মাঝে জেগে জুঁইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা বলছে কখনোবা ঘুমের ঘোরে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে জুঁইয়ের গা ঘেঁষে বসছে, জুঁইয়ের কাঁধে মাথা রেখে হাত দিয়ে উরু স্পর্শ করছে। জুঁইয়ের শরীর শীর শীর করে উঠছে আবার কখনো জামালের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠছে। গাড়ি একসময় শহরে ঢুকলো। তারপর বাস থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া নিয়ে ছুটে চলল।
জুঁই জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায় যাব ভাইয়া?
জামাল হেসে বলল, জুঁই তুমি প্রথম এসেছ প্রশ্ন করো না, আমি তো তোমার সঙ্গে আছি, তোমার চিন্তার কিছু নেই।
জুঁই কিছুটা লজ্জা পেল, সে বুঝতে পারল এভাবে জিজ্ঞেস করা তার ঠিক হয়নি। তারপর জুঁই আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। জামালকে অনুসরণ করে চলল।
ট্যাক্সি ক্যাব এসে দাঁড়ালো একটি আবাসিক হোটেলের সামনে। ট্যাক্সি ক্যাব ছেড়ে দিয়ে দু’জনে হোটেলের ভিতরে ঢুকতেই একজন বয় এসে ব্যাগ হাতে নিয়ে দু’জনকে রিসিপশনে নিয়ে গেল।
হোটেলের ম্যানেজার প্রথমে সালাম দিয়ে বলল, স্যার এসি রুম লাগবে?
জামাল বলল, হুঁম,একটা এসি রুম দাও তো।
ম্যানেজার জামালের কাছ থেকে তার নাম ঠিকানা লিখে জিজ্ঞেস করে লিখল তারপর একবার উভয়ের দিকে একবার আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি আপনার কে হয়?
জামাল রাগান্বিত চোখে তাকাতেই ম্যানেজার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জুঁইকে জিজ্ঞেস, আপনার নাম প্লিজ?
জিন্নাত আরা জুঁই।
ঠিকানা?
জামাল বলল, আমার ঠিকানাই লিখে দাও।
রেজিস্টারে নাম এন্ট্রি করার পর দু’জনে উঠে গেল হোটেলের তৃতীয় তলায়। বড় আকারের একটা এসি রুম পাশাপাশি দু’টা সিট রাখা আছে, এটাচ্‌ড বাথ রুমে কিছুক্ষণ আগে সুগন্ধি স্প্রে করা হয়েছে। জুঁই রুমে ঢুকে প্রথমে কৌতূহলী হয়ে রুমটা ভালোভাবে দেখল। তারপর একবার জামালের চোখের দিকে তাকাতেই জুঁই লক্ষ্য করল তার দু’চোখ লোভে চিকচিক করছে, জুঁইয়ের বুক আঁতকে উঠল।
সে শুষ্ক মুখে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া আমরা কখন যাব?
আচ্ছা একটু রেস্ট নেই তারপর উনাকে মোবাইল করতে হবে। যদি উনি এখনি যেতে বলেন তবে এখনি যাব।
জামাল মোবাইলের বাটন কিছুক্ষণ টিপে কানের কাছে লাগিয়ে বলল, হ্যালো ভাই, আমি তো ঢাকায় ক্যান্ডিডেটকে নিয়ে এসেছি, আপনার কাছে নিয়ে আসবো?
অপর পাশ থেকে কোন ধ্বনি এলো কী না বোঝা গেল না।
জামাল বলল, আপনি আজ সাতটায় আসতে বলেছিলেন তো তাই এসেছি। আপনার কথা আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। আচ্ছা আমি আবার পরে ফোন করবো। বলে জামাল কানের কাছে মোবাইল রেখে মোবাইল অফ করল।
জুঁই তুমি তাঁর কথা বুঝবে না, তিনি সবসময় শুধু ব্যস্ত, অনেক কাজ, তাঁর কথা বলার সময় নেই। এখন হয়তো কোন মিটিং এ আছে। ফ্রি হলে একটু পরে মোবাইল করে তার বাসায় যাব বলে জামাল বাথ রুমে ঢুকলো।
জামাল বাথরুমে ঢোকার পর জুঁই সাবধানে জামালের কল রেকর্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল। জামালের মোবাইলে দু’ঘণ্টার মধ্যে কোন ডায়ালড কল নেই। তারমানে জামাল কারো সঙ্গে কথা বলেনি! তবে কী সব!
জামাল আসার আগেই জুঁই মোবাইলটা ঠিক যেমনভাবে ছিল তেমনিভাবে রেখে দিল।
বাথরুম থেকে বের হয়ে এক রকম জুঁইয়ের মুখোমুখি বসে জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকাতেই জুঁইয়ের বুক কেঁপে উঠল। অজানা আশঙ্কায় জুঁইয়ের হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল, মুখ শুকিয়ে গেল। জুঁইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জামাল জুঁইয়ের মনের অবস্থা কিছুটা অনুমান করল, জুঁই তোমার মন খারাপ কেন?
জুঁই একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না তো ভাইয়া।
তোমার কি থাকার জায়গা পছন্দ হয়েছে?
জুঁই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
হ্যাঁ এত খোলামেলা রুম, এটাচ্‌ড বাথ, আবার এয়ার কন্ডিশন্ড, সবকিছু মিলিয়ে এ রুমটা আমার খুব পছন্দ, তুমি কিছু খাবে? চা? কফি?
জুঁই মুখে কিছু বলল না মাথা নত করে বসে রইল। জামাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই বয় এসে দাঁড়ালো।
জামাল বলল, দু’টা কফি আধ ঘণ্টা পর একটা জনসন ওয়াকার সঙ্গে কোল্ড ড্রিংক্স আর রাত নটায় ভাত, তরকারি থাকবে মুরগীর মাংস, চিংড়ী মাছ ভুনা, সবজি আর ডাল ভাজি যাও এখন কফি নিয়ে এসো, কথাগুলো জামাল একরকম একটানে বলে ফেলল।
জি স্যার বলে বয় চলে গেল। কয়েক মিনিট পর কফি নিয়ে এলো। জামাল কফি খেতে খেতে মোবাইল করল, হ্যালো আস্‌সালামুয়াআলায়কুম।
অপর পাশ থেকে কোন শব্দই ধ্বনিত হলো না জামাল আবার বলল, বড়ভাই আপনি ঢাকার বইরে? কাল সকালে আসবেন? বলে জামাল একটা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, আচ্ছা আমি আগামীকাল নিয়ে আসবো? বলে জামাল মোবাইল অফ করল।
জুঁই শুষ্ক মুখে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
তিনি হঠাৎ করে ঢাকার বাইরে গেছেন আগামীকাল দেখা করতে বললেন।
কফি শেষ করে জামাল আবার কলিং বেল-এ টিপ দিতেই বয় এসে কাপ নিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দু’জনে গল্প করল তারপর বয় এসে জনসন ওয়াকার এবং কোল্ড ড্রিংক্স দিয়ে গেল।
জামাল গ্লাসে কোল্ড ড্রিংক্স আর জনসন ওয়াকার মিশিয়ে জুঁইয়ের হাতে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জুঁই নাও।
কী ভাইয়া?
কোল্ড ড্রিংক্স।
আপনি খান ভাইয়া আমি খাব না।
জামাল জোর করে জুঁইয়ের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল, খাও খুব ভালো লাগবে, ক্লান্তি দূর হবে।
জুঁই এতক্ষণে জামালের সব কৌশলের কথা বুঝতে পারল। সে এই অজানা বোতলের নাম বুঝতে পারেনি কিন্তু এটা যে মদ এতক্ষণে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সে রাগান্বিত স্বরে বলল, থাক আমার ক্লান্তি দূর করার দরকার নেই।
কিন্তু জামাল জুঁইয়ের কোন কথাই শুনল না। সে একরকম জোর করে জুঁইয়ের মুখে মদ ঢেলে দিতে চাইল। অগত্যা জুঁই মদের গ্লাসটা জামালের হাত থেকে নিয়ে নিজের হাতে নিয়ে এক ঢোক গিলে বলল, ভাইয়া আমি খেতে পারছি না, প্লিজ আমাকে আর খেতে বলবেন না।
জুঁই আনসোশ্যাল মেয়ের মতো কথা বলবে না আর দু’য়েক বার খেলে তোমার কাছে ইজি হয়ে যাবে, দেখবে তোমার খুব ভালো লাগবে, হালকা লাগবে, তুমি রঙিন স্বপ্ন দেখতে থাকবে, বলে জামাল জুঁইয়ের দিকে আরো এক গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও।
কয়েক প্যাক খাওয়ার পর জুঁইয়ের চোখ বন্ধ হয়ে এলো, তার গলার স্বর পরিবর্তন হলো, সে এলোমেলো কথাবার্তা বলতে থাকল জামাল বুঝতে পারল জুঁই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তাই জামাল দরজা বন্ধ করে দিল।
জুঁই জড়ানো গলায় বলল, দরজা বন্ধ করলেন কেন?
জামাল জুঁইয়ের গা ঘেঁষে বসল। জুঁই জড়ানো গলায় বলল, প্লিজ ভাইয়া, আপনি ঐ বেড এ বসুন।
জুঁইয়ের কথা যেন জামালের কানে গেল না। সে জুঁইয়ের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল, জুঁইয়ের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তারপর জুঁইয়ের গালে, ঠোঁটে এলোমেলোভাবে চুমু দিতে লাগল এবং জুঁইয়ের স্পর্শকাতর অংগসমূহে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলল।
ততক্ষণে জুঁই নিজেও মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে, সে মৃদু শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। অবশেষে নিজেকে জামালের কাছে সমর্পণ করল।

জুঁই যখন চোখ মেলে তাকালো তখন সকাল সাতটা বাজে। জামাল তাকে শক্তভাবে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। জুঁই জামালের হাতটা সরিয়ে দিতেই জামাল জেগে উঠল, জুঁই আর একটু শুয়ে থাক প্লিজ।
জুঁই কিছু বলল না, নিজেকে জামালের হাত থেকে মুক্ত করে মুখ ফিরিয়ে নিল।
জামাল মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, জুঁই।
জুঁই তবুও কিছু বলল না।
জামাল বলল, জুঁই কিছু বলো?
জুঁই শুষ্ক কণ্ঠে বলল, কী বলব?
তুমি কী মন খারাপ করেছ?
জুঁই কিছু বলল না তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। জামাল চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, জুঁই তুমি অযথা এমন করছ। এটা আর আজ কালকার দিনে এমন কি? এসব ভুলে যাও এটাকে খুব ইজিভাবে নাও।
জুঁই কানভাঙা গলায় বলল, ভাইয়া এখন আমার কী হবে?
দুর পাগলি তোমার কী হবে। আমরা শুধুমাত্র এনজয় করেছি একথা তুমিও কাউকে বলবে না। বরং আজ থেকে একটা সিস্টেম হলো এখন থেকে তোমাকে আর রিকোয়েস্ট করতে হবে না। তোমাদের বাসাতেই…..বলে জামাল একটা কুৎসিত ইঙ্গিত করে চোখ টিপল।

ত্রিশ
জামালের অফিসে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার বসে আছে। তাদের মধ্যে মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেবও আছেন। জামাল প্রথমে তার ফার্মে নতুন নিয়োগ কৃত ইঞ্জিনিয়ার রশিদ সাহেবের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিল। রশিদ সাহেব সবাইকে সালাম দিলেন।
মোস্তফা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জামাল অফিস থেকে খবর নিয়েছ কোন গ্রুপে কয়টি শিডিউল বিক্রি হয়েছে?
জি পাঁচটা গ্রুপের মধ্যে এক নাম্বার আর তিন নাম্বার গ্রুপে পনেরোটা করে শিডিউল বিক্রি হয়েছে অন্যান্য গ্রুপে সাতটা করে শিডিউল বিক্রি হয়েছে।
জামাল রশিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, এক নাম্বার গ্রুপের কাজটা বোধ হয় বেশি এ্যাট্রাকটিভ?
রশিদ সাহেব বললেন, জি ভাই।
জামাল বিনয়ের সাথে বলল, মোস্তফা ভাই সামনে আমার ইলেকশন, প্রচুর টাকার প্রয়োজন তাই এ সময় যদি কিছু টাকা লাভ করতে পারতাম তবে আমার খুব হেল্প হতো।
বেলায়েত সাহেব আর মোস্তফা সাহেব পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকালেন তারপর মোস্তফা সাহেব বললেন, তারমানে তুমি এক নাম্বার গ্রুপের কাজটা নিতে চাচ্ছ?
জামাল একটু হাসল। মোস্তফা সাহেব বললেন, কিন্তু পনেরোটা শিডিউল ক্লোজ করা তো কঠিন ব্যাপার।
জামাল বলল, বড় ভাই আপনারা যদি আশ্বাস দেন তবে বাকী ব্যবস্থা আমি করবো।
বেলায়েত সাহেব বললেন, ঠিক আছে আমরা এক নাম্বার গ্রুপের কাজে পার্টিসিপেট করবো না। তুমি নেগোসিয়েট করার চেষ্টা কর।
জামালের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, বড়ভাই এর মধ্যে ছয়টা শিডিউল আমি ক্লোজ করেছি। আপনাদের দু’জনের কাছে দু’টা আমার কাছে একটা তাহলে বাইরে থাকল আর ছয়টা। আমার বিশ্বাস আমি পারব আর একান্তই যদি না পারি তবে অফিসের গেটে হিটলারকে বসিয়ে দিব।
এসময় চা এলো।
জামাল বিনয়ের সঙ্গে বলল, চা নিন প্লিজ।
মোস্তফা সাহেব বললেন, সেটা ঠিক হবে না। যে শিডিউলগুলো এখনো ক্লোজ করতে পারনি তাদের নামগুলো বলো দেখি?
জামাল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে নামগুলো পড়ল।
মোস্তফা সাহেব বললেন, তুমি আমার কথা শোন যে ছয়টা শিডিউল এখনো ক্লোজ করতে পারো নি তাদের নামগুলো তো আমি জানলাম তুমি প্রত্যেককে শিডিউলের দাম ফেরত আর পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে শিডিউলগুলো নিয়ে এসো। আর কেউ যদি না দিতে চায় তবে আমাকে বলো। অফিসের গেটে সন্ত্রাসী বসিয়ে দিয়ে অন্যান্য ঠিকাদারদের বাধা দিতে গেলে সিন ক্রিয়েট হতে পারে, তাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে, তুমি এখনি টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়। সবার শিডিউল ক্লোজ করা হলে আমার মোবাইলে একবার রিং দিও।
জি ভাই, বলে জামাল মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করল।
মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেব চলে যাবার পর জামাল রশিদ সাহেবকে বলল, রশিদ সাহেব আমি একটু বের হবো। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি যাবেন না। আমি আসার পর শিডিউল পূরণ করতে হবে। আপনি এখন আপনার রুমে বসুন বলে তিনি জাহিদকে ডেকে পাঠালেন, জাহিদ রুমে আসতেই জামাল উঠে দাঁড়ালো, জাহিদ আমি শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি যাবে না, বলে জামাল বের হলো।
জামাল ফিরে এলো তখন রাত প্রায় এগারোটা বাজে, তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। রশিদ সাহেব এবং জাহিদ তখনো অফিসে জামালের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। জামাল শিডিউলগুলো তার টেবিলের উপর রেখে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। জামালের পিছনে পিছনে রশিদ সাহেব ভিতরে ঢুকলেন। জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রশিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান সবগুলো পেয়েছেন তো?
জামাল বলল, হুঁম, তবে কালেকশন করতে বেশ সমস্যা হলো। আপনি এই শিডিউলগুলো রাখুন আর জামাল কন্সট্রাকশনের রেটটা এট পার করবেন, অন্যগুলো আরো বেশি রেটে প্রস্তুত করবেন। রাতেই সব রেডি করবেন আগামীকাল শুধু বি.ডি লাগিয়ে ড্রপ করবেন।
জি ভাই।
জামাল আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, শিডিউল ড্রপিং বেলা একটা পর্যন্ত।
জি ভাই আমি সব রেডি করছি আপনি এ নিয়ে ভাববেন না, বলে রশিদ সাহেব শিডিউলগুলো নিয়ে তাঁর চেম্বারে গেলেন। রশিদ সাহেব চলে যাবার পর চেম্বারে ঢুকলো জাহিদ, ভাইজান কিছু বলবেন?
হ্যাঁ তোমার ফেন্সি কুইনদের অবস্থা কী?
জি ভাইজান মার্কেটে মাল ভালো চলছে।
দালাল কিংবা কুইনদের সঙ্গে কথা বলার সময় খেয়াল রাখবে, বলে জামাল একটা মোবাইল সেট বের করে জাহিদের হাতে দিয়ে বলল, এই মোবাইলটা তুমি ব্যবহার করবে কিন্তু সাবধান তোমার মোবাইল নাম্বার যেন আমি ছাড়া কেউ না জানে।
জাহিদের চোখে মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল। হঠাৎ করেই হাতে মোবাইল সেট পাবে একথা জাহিদ কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি।
জামাল বলল, এখন ব্যবসা দেখাশুনা করতে তোমার আর কোন অসুবিধা হবে না, বলে জামাল একটু থামল। তারপর বলল, আচ্ছা জাহিদ ফেন্সির মার্কেট তো বেশ জমে উঠেছে এবার হেরোইনটা চালু করতে পারলে হয় না?
জাহিদ বুঝতে না পেরে বলল, কী বললেন ভাইজান?
হেরোইন খুব দামি নেশা কোন কারণে যদি একবার কেউ এই নেশা ধরে তবে আর জীবনে ছাড়তে পারবে না। কোন রকমে একবার ধরাতে পারলেই হয়।
জাহিদ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
তোমার তো বুঝি ফেন্সি লাগবে?
জি ভাই।
আমি তাহলে এক ট্রাক ফেন্সি আর এক কেজি হেরোইনের অর্ডার দেই।
জি ভাইজান, বলে জাহিদ চলে গেল।
জামাল তার ড্রয়ার থেকে আরেকটা মোবাইল সেট বের করে মোবাইল করল, হ্যালো।
দেখ জামাল এক ট্রাক ফেন্সি পাঠিয়ে দিচ্ছি কিন্তু এক কেজি হেরোইনের দাম কোটি টাকা তুমি চালাতে পারবে তো এতগুলো মাল?
বস তাহলে হেরোইন হাফ কেজি পাঠিয়ে দিন।
আচ্ছা ঠিক আছে সময় মতো তুমি মাল পেয়ে যাবে।
জামাল চোখ বুজে রইল তার চোখের সম্মুখে তখন একটা বিলাস বহুল বাড়ি এবং দামি গাড়ির ছবি ভাসছে। এমনভাবে জামাল কয়েক মিনিট চেয়ারে বসে রইল তারপর চেয়ার ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
একত্রিশ

জামাল বরাবরই ঘুম থেকে দেরিতে উঠে। ততক্ষণে জহির সাহেব বাসা থেকে বেরিয়ে যান, কতদিন আগে যে সকাল বেলা জহির সাহেব জামালকে দেখেছেন মনে নেই। শুধু সকাল বেলা কেন জামাল গভীর রাতে বাসায় ফিরে ততক্ষণে জহির সাহেব ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে পিতা-পুত্রের সাক্ষাত হয় খুব কমই। আজ বাসায় ফিরেই জামাল জহির সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল। জহির সাহেব কোন কিছু না বুঝে অবাক হয়ে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জামাল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অষ্ফুটস্বরে বলল, বাবা!
ছেলের হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে জহির সাহেবের দু’চোখ সজল হয়ে উঠল তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী রে? হঠাৎ কী হলো?
জামাল বলল, বাবা কয়েকদিন থেকে লোক জন আমাকে বলাবলি করছে, গতকাল কয়েকজন আমার অফিসে এসেছিল, আমি এখনো সম্মতি দিইনি।
কী রে? ব্যাপারটা খুলে বলবি তো? কীসের সম্মতি?
বাবা সবাই বলছে এবার পৌরসভা নির্বাচনে আমাকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। আমার আসলে নির্বাচন করার ইচ্ছা নেই কিন্তু সবাই খুব ধরেছে, আমি বলেছি বাবার সঙ্গে পরামর্শ করি বাবা যদি অনুমতি দেয় তবে আমি আপনাদের প্রস্তাবে সম্মত আছি।
কিন্তু তোকে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে রায়হান চেয়ারম্যানের সঙ্গে, তুই কি তার সঙ্গে পারবি?
বাবা দল থেকে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে, রায়হান চেয়ারম্যান তিনবার চেয়ারম্যান হয়েছেন। এলাকার অনেক লোক এখন নতুন মুখ চায়।
দোয়া করি বাবা আল্লাহ যেন তোর মনস্কামনা পূরণ করেন।
অতঃপর তার মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করল।
ফাহমিদাও একইভাবে জামালের জন্য দোয়া করলেন। তারপর জামাল তার বেড রুমে ঢুকে অনন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
অনন্যা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, শুনেছি, তুমি চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াবে ভালো কথা তাই বলে স্ত্রীর প্রতি হঠাৎ করে ভালোবাসা উতলে পড়ল কেন? স্ত্রী তো স্ত্রী-ই।
অনন্যা তুমি আমার স্ত্রী, সহধর্মিণী। তোমাকে ছাড়া যে আমি অসম্পূর্ণ। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আগে এই অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারিনি আজ তোমাকে বুকে জড়িয়ে আমার ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করলাম।
অনন্যা জামালের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল, আমার কাছ থেকে তাহলে ভোটের ক্যানভাস শুরু করলে।
জামাল অনন্যার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, হুঁ।
অনন্যা বলল, দেখ আমি তোমার স্ত্রী তুমি ভোট না চাইলেও আমি তোমাকে ভোট দিব, তোমার ভোটের জন্য কাজ করবো। তুমি ভোটে জিতে চেয়ারম্যান হবে তাতে তুমি যেমন আনন্দিত হবে তেমনি আমিও।
জামাল মলিন মুখে বলল, অনন্যা তুমি ভাবলে আমি শুধু ভোটের জন্য তোমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করলাম। আসলে তা না, তুমি প্রথমে আমার স্ত্রী তারপর ভোটার। স্বামী হিসেবে যদি আমি তোমার মন জয় করতে না পারি তবে ভোটারদের মন জয় করবো কীভাবে?
অনন্যা বলল, তুমি কষ্ট পেয়েছ? আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি, সেদিনই তো আমাদের মন এক হয়ে গেছে, এখন মন জয়ের কথা আসবে কেন? তোমার জন্য মানুষের মন জয় করার পালা এখন শুরু হলো।
হ্যাঁ অনন্যা তুমি ঠিকই বলেছ, এখন সময় এসেছে মানুষের মন জয় করার। তুমি আমাকে সহযোগিতা করো আমি যেন চেয়ারম্যান হতে পারি।
দেখ আমি একজন সাধারণ গৃহিণী, জীবনে কোনদিন রাজনীতি করিনি, ভোট সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই, তুমি কলেজে নির্বাচন করেছ, রাজনীতি করছ, কাজেই তুমি যেভাবে বলবে আমি তোমাকে সেভাবে সহযোগিতা করবো।
তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে অনন্যা, আমি মনে করি তুমি তোমার পছন্দের কয়েকজনকে নিয়ে একটা দল গঠন কর। তুমি মেয়েদের কাছে ভোটের ক্যানভাস করবে। আমাকে নির্বাচনে জিততে হবে। আমার দক্ষতা, অর্থ, ক্ষমতা সবকিছু কাজে লাগিয়ে আমাকে জিততে হবে তুমি আমার পার্শ্বে থেকো অনন্যা, বলে জামাল অনন্যার হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিল।
অনন্যা জামালের বুকে মাথা রেখে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, অবশ্যই থাকবো।

ব্যবসা, রাজনীতি সবকিছু সামলে নিয়ে একটু সুযোগ পেলেই জামাল ছুটে যায় জুঁইয়ের কাছে। জুঁইয়ের মুখের দিকে তাকালেই জামালের সমস্ত ক্লান্তি যেন দুর হয়ে যায়। জামাল গেটে গিয়ে কলিং বেল এ টিপ দিলেই জুঁই গেট খুলে দেয়। একদিন কথা প্রসঙ্গে জামাল বলেছিল, জুঁই তুমি আমার কলিং বেল এ টিপ দেয়ার ধরন বুঝ নাকি?
জুঁই মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিল, জি।
জামাল বাসায় ঢুকলেই জাহানারা নাস্তা তৈরি করতে চলে যায়। যুথির আরো কয়েকটা পরীক্ষা বাকী আছে তাই তার ব্যস্ততা এখনো কমেনি। জামাল বাসায় ঢুকতেই জুঁইকে একা পেয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। শুধু আড্ডা বললে ভুল হবে। ঢাকা শহরে দু’জনে একরকম খোলামেলা মেলামেশা করার পর জামাল সুযোগ পেলেই জুঁইর সঙ্গে আদিম আনন্দে মেতে উঠে, জামাল যেমন ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও নতুনত্বের নেশায় মেতে উঠে তেমনি জুঁইও অর্থের লোভ আর বিবাহ পূর্ব যৌন সঙ্গমের স্বাদ পেয়ে আদিম নেশায় মেতে উঠে। ইদানীং জুঁই দু’একদিন জামালের সঙ্গ না পেলেই উতলা হয়ে উঠে। কোনকিছুতেই মন বসে না কাউকে কিছু বলতেও পারেনা। মেয়ের মনের অবস্থা জুঁইয়ের মা বুঝতে পারেন কিন্তু সংসারে অনটন আর জামালের ফার্মে জাহিদ চাকরি করে বলে শত কষ্ট মনের মধ্যে চেপে রেখে কৌশলে জুঁইকে আড়াল করার চেষ্টা করে। কিন্তু জামালের প্রতি জুঁইয়ের আগ্রহ আর আসক্তি দেখে তিনি কিছু বলতে পারেন না।
নিত্যদিনের মতো জামাল বাসায় ঢুকেই সোজা জুঁইয়ের রুমে চলে গেল। যুথি রুমে তখন পড়ছিল তার মা পার্শ্বে বসে ছিল। জামাল এক রকম ইচ্ছা করেই যূথীকে ডাক দিল। যুথি ঘরে ঢুকে সালাম দিল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, তোমার ক’টা পরীক্ষা বাকী আছে যুথি?
দু’টা ভাইয়া।
কবে পরীক্ষা?
পরশু দিন।
তবে তো তোমাকে ডেকে ডিস্টার্ব করলাম।
জুঁই যুথির দিকে রাগান্বিত স্বরে তাকিয়ে বলল, যুথি তুই যা ভালোভাবে লেখাপড়া কর।
যুথি চলে গেল।
যুথি চলে যাবার পর জামাল বলল, জুঁই আজ অনেকক্ষণ থাকবো।
জুঁই বলল, থাকবেন।
কিন্তু খালা তো অন্যান্য দিনের মতোই নাস্তা তৈরি করতে গেল।
নাস্তা খাবার পর তো মা আপনাকে বের করে দিচ্ছে না।
তার চেয়ে তুমি খালা আম্মাকে ডাক দাও, বেশিক্ষণ থাকার একটা ইস্যু তৈরি করি।
জুঁই বের হয়ে গেল কিছুক্ষণ পর খালা আম্মা ভিতরে আসতেই জামাল পা ছুঁয়ে সালাম করল। জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা হঠাৎ সালামের কী হলো?
খালা আম্মা আমি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছি, দোয়া করবেন যেন আমি চেয়ারম্যান হতে পারি।
অবশ্যই দোয়া করবো বাবা তুমি যেন চেয়ারম্যান হতে পারো, আল্লাহ যেন তোমার মনস্কামনা পূরণ করেন বলে তিনি চলে যাচ্ছিলেন।
খালা আম্মা।
জাহানারা ফিরে দাঁড়ালেন, জি বাবা।
খালা আজ আপনার বাসায় ভাত খাবো।
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, তুমি ভাত খাবে আমাদের বাসায়?
হ্যাঁ অবাক হচ্ছেন কেন?
না অবাক হচ্ছি না বাবা, ঠিক আছে তুমি বস আমি রান্না করছি, বলে তিনি চলে গেলেন।
জাহানারা রুম থেকে বের হয়ে যাবার পর জামাল তার চেয়ার থেকে উঠে জুঁইয়ের কাছে গেল। জুঁইয়ের থুতনি উঁচু করে তার চোখে চোখ রাখল। জুঁইয়ের হাত ধরে তাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলল তারপর বাহু বন্ধনে জাড়িয়ে ধরে বুকে সজোরে চেপে ধরল। জুঁইয়ের দু’গাল চুমুতে ভরিয়ে দিল এবং এক পা দু’পা করে হাঁটতে হাঁটতে জুঁইকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ততক্ষণে জুঁই জামালের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরস্পরকে দলিত মোথিত করে ঝড় তুলল। একজনের ঢেউ অপরজনের উপর আছড়ে পড়ল। দু’জনের শরীর বাদ্যযন্ত্রের মতো বেজে উঠল, সুখের যন্ত্রণায় অস্ফুট শীৎকার দিয়ে একসময় ঝড় থেমে গেল। তারপর দু’জনে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
দু’জনে বিছানা থেকে উঠল।
জামাল কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিয়ে বলল, জুঁই আমি এখন আসি।
জুঁই বলল, খেয়ে যাবেন, না খেয়ে গেলে মা খুব মাইন্ড করবে।
তাহলে তুমি একবার দেখে এসো।
জুঁই রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা রান্না কি আরো অনেকক্ষণ দেরি হবে?
জুঁইয়ের এলোমেলো চুল অগোছালো কাপড়-চোপড় এবং বিধ্বস্ত মুখচ্ছবি দেখে জাহানারার মাতৃহৃদয় কান্নায় ভরে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ছিঃ কলঙ্কিনী ছিঃ।
কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। মৃদু কণ্ঠে বললেন, রান্না শেষ মা তুই যা আমি নিয়ে আসছি।
তুমি বসো মা আমি নিজে নিয়ে যাচ্ছি, বলে জুঁই নিজে জামালকে খাবার পরিবেশন করাল। তারপর জামাল বাসা থকে বের হলো।
জামাল চলে যাবার ঘণ্টা খানেক পর জাহিদ বাসায় ফিরল। জাহিদ বাসায় না ফেরা পর্যন্ত প্রতিদিনই রাতের খাবার বন্ধ থাকে। জাহিদ বাসায় ফেরার পর সবাই একসঙ্গে খাবার খায়। আজও সবাই খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসল। জুঁই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল।
জাহানারা জাহিদকে বলল, বাবা জাহিদ তোকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি।
বলো মা?
জুঁই তো লেখাপড়া শেষ করে বসে আছে বয়সও অনেক হয়েছে ওর বিয়ে-শাদী দেওয়া যে খুব জরুরী হয়ে গেছে বাবা।
হ্যাঁ মা আমিও তাই ভাবছি।
তবে আর দেরি না করে-
মা আমি জামাল ভাই’র ফার্মে চাকরি করি, সামনে জামাল ভাই’র ইলেকশন, ইলেকশন পর্যন্ত আমি ব্যস্ত থাকবো। তারপর না হয়-
ঠিক আছে বাবা তবে আমি ততদিনে আত্মীয়-স্বজনদের বলে রাখি ভালো ঘর-বর পাওয়া গেলে ইলেকশনের পর বিয়ে হবে।
ঠিক আছে তুমি সবাইকে বলে দাও।

বত্রিশ

কয়েকদিন পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচনী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। নির্বাচনে মোট প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা পাঁচজন। রায়হান সাহেব সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পর পর তিনবার নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচনে জয়লাভ করার বিষয়ে তিনি বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি তার কৌশল মতো এগিয়ে চলছেন। ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোটের ক্যানভাস করছেন। অন্যান্য প্রার্থীগণও তাদের নিজ মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
নির্বাচনে জামালের কৌশল কিছুটা ভিন্ন। জামাল পৌরসভার ভোটারদের পরিসংখ্যান করেছে। পৌরসভার বিত্তহীন মানুষের মধ্যে প্রত্যেককে শাড়ি-লুঙ্গি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে, তাছাড়া বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সামগ্রী, নগদ অনুদান ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার মাধ্যমে সংগঠনের শ্রমিকদের ভোট পাওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে চলছে। এতকিছুর পরও রায়হান সাহেবের জনপ্রিয়তার কাছে সবাই নিরাশ। রায়হান সাহেব যেখানেই ভোটের ক্যানভাস করতে যান সেখানেই অনেক মানুষের জমায়েত হয়, ভোটাররা তার কথার উপর আস্থা রাখেন। তার বক্তৃতার মাঝে মাঝে হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করেন। রায়হান সাহেব নির্বাচনে তেমন টাকা পয়সা খরচ করেন না। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যান, পৌরসভার উন্নয়নে তার অবদানের বিবরণ দিয়ে, বিনয়ের সঙ্গে ভোটের ক্যানভাস করেন। ভোটারদের মুখের দিকে তাকিয়ে রায়হান সাহেব বুঝতে পারেন। কিন্তু বেশি সমস্যা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া।
সেদিন এক বৃদ্ধা রায়হান সাহেবকে বলল, চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের মহল্লায় আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী সবাইকে একটা করে শাড়ি দিয়েছে আর ছেলে ভোটারদের একটা করি লুঙ্গি দিয়েছে।
দেখুন আপনারা আপনাদের ভোট দিবেন সৎ, নিরপেক্ষ এবং উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে এমন যোগ্য প্রার্থী দেখে। সামান্য দু’একশ টাকার লুঙ্গি বা শাড়ির বিনিময়ে আপনারা যদি সৎ প্রার্থীর পরিবর্তে একজন অসৎ, অদক্ষ এবং দুর্নীতিবাজ প্রার্থীকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করেন তবে পাঁচ বছর যাবত আপনাদেরকে মূল্য দিতে হবে। যে প্রার্থী টাকা দিয়ে আপনাদের ভোট কিনতে চায় নির্বাচনে জিতে সে প্রথমে আপনাদের দেয়া টাকা পৌরসভা থেকে তুলে নিবে। তখন উন্নয়ন কাজের টাকা দিয়ে আগে নিজের নির্বাচনের খরচ তুলে নিবে। আমার অনুরোধ আপনারা কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে, ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ না হয়ে সামগ্রিক উন্নতি দেখবেন। আমি পনেরো বছর যাবত এই পৌরসভার চেয়ারম্যান। আপনারা সবাই জানেন এই পনেরো বছরে আমি এই পৌরসভাকে আমার স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছি। আপনারা সবাই জানেন যে, এখন এই পৌরসভায় প্রত্যেক শিশুর জন্ম নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছি নৈশ কালীন শিক্ষা ব্যবস্থা করেছি। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় যৌতুক, বাল্য বিবাহ এবং একাধিক বিয়ে ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করেছি। পৌরসভায় ময়লা ফেলার গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় আপনাদের সহযোগিতায় প্রাইভেট ক্লিনারের মাধ্যমে শহরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার চেষ্টা করেছি, পৌরসভার রাস্তা ঘাটের উন্নতি করেছি। আপনারা আমাকে আবার আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিলে আমি দরিদ্র বস্তিবাসীদের জন্য শহরে একটা হকার্স মার্কেট করে দিব। বস্তিতে বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করবো। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন, বলে রায়হান সাহেব এক বৃদ্ধ মহিলার দু’হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন এ সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী স্লোগান দিল, ”রায়হান ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে।”

কলেজ মাঠে শুরু হয়েছে জামালের নির্বাচনী মিটিং, মিটিংয়ে জামালের দলীয় নেতৃবৃন্দ জামালকে ভোট প্রদানের জন্য ক্ষমতাসীন দলের গৃহীত উন্নয়নমূলক কাজের বিবরণ এবং জামালকে ভোট প্রদান করলে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একে একে বক্তৃতা প্রদান করেছেন। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শেষে জামাল বক্তৃতা দেয়া শুরু করল, আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, ঢাকা থেকে আগত অতিথিবৃন্দ এবং আমার পরম শ্রদ্ধেয় ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুয়ালায়কুম। আপনারা সবাই কষ্ট করে, ধৈর্য ধরে আমার নির্বাচনী সভায় যোগ দিয়েছেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনারা মঞ্চে উপবিষ্ট যাদের দেখছেন ঢাকা থেকে ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতৃবৃন্দ আপনাদের সবার কাছে ছুটে এসেছেন তারা সবাই পৌরসভার উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। আমি নিজেও ক্ষমতাসীন দলের একজন সক্রিয় কর্মী তারা সবাই আপনাদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে এই পৌরসভার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি ইতোমধ্যে আপনাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ভোট চেয়েছি অনেকে আমাকে ভোট দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন, অনেকে রায়হান সাহেবকে একটানা পনেরো বছরের পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে নারাজ, অনেকে আমাকে রায়হান সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। রায়হান সাহেব গত পনেরো বছরে পৌরসভাকে তার ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তরিত করেছেন। আপনারা সবাই পৌরসভায় ট্যাক্স দেন কিন্তু পৌরসভার টাকা যায় কোথায়? কেন পৌরবাসীকে অতিরিক্ত চাঁদা দিয়ে, প্রাইভেট ক্লিনার দিয়ে পৌরসভার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতে হয়? পৌরসভার এত টাকা যায় কোথায়? জনগণকে পৌরসভার আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। আপনারা যদি সবাই আমাকে নির্বাচিত করেন তবে আমি আমাদের পৌরসভাকে একটা আদর্শ পৌরসভা হিসেবে গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ্, কারো কোন চাঁদা ছাড়াই কাজ বাস্তবায়ন করবো। প্রাইভেট ক্লিনার ছাড়াই পৌরসভার আবর্জনা পরিষ্কারের মালবাহী গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করে শহরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবো।
দর্শকের সারিতে বসা দু’জন দর্শক ফিস ফিস করে বলল, তোকে ক’টাকা দিয়েছে?
অপরজন বলল, ত্রিশ টাকা, আপনাকে?
আমাকেও ত্রিশ টাকা দিয়েছে, কিন্তু মিটিংয়ে থাকার কথা ছিল দু’ ঘণ্টা, এখনো তো মিটিং শেষ হলো না, চল আমরা যাই বলে দু’জনে উঠে পড়ল, তাদের উঠতে দেখে আরো কয়েকজন উঠে দাঁড়াল।
জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে দেখে মোস্তফা সাহেব জামালের হাতে এক টুকরা কাগজে বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ দিলে জামাল তার বক্তৃতা শেষ করল।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপ, পেশী শক্তি ও প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও নির্বাচনে জামালের ভরাডুবি হলো। জনগণের ভোটের রায় তার বিপক্ষে গেল। ভোটের রেজাল্ট ঘোষণার পর জামাল এসে পার্টি অফিসসহ দলীয় সকল কাজ কর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল। জামাল রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম সে পরাজিত হলো, তার বার বার মনে হয় রায়হান সাহেব শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা দিয়েই নির্বাচনে জয়ী হলো। কাজেই আবার নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পূর্বে রায়হান সাহেবের চেয়ে অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে। একথা জামাল তিলে তিলে অনুভব করল। তারপরও সে কোনভাবে বিষয়টা মেনে নিতে পারল না।
নির্বাচনের পর জামালকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে দেখে মোস্তফা সাহেব বেলায়েত সাহেবসহ দলের কয়েকজন নেতা কর্মী একদিন সন্ধ্যায় জামালের অফিসে এলেন। জামাল তখন অফিসে বসেছিল। সে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কী ব্যাপার মোস্তফা ভাই বেলায়েত ভাই আপনারা সবাই আমার অফিসে? কী মনে করে? বসুন।
সবাই চেয়ারে বসলেন তারপর মোস্তফা সাহেব বললেন, জামাল এভাবে পিছিয়ে পড়লে তো চলবে না।
জামাল কলিং বেল টিপ দিতেই জাকির চলে এলো।
জামাল মোস্তফা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, বড়ভাই কী খাবেন বলুন? ঠাণ্ডা না গরম?
কিছু একটা হলেই হয়।
জামাল পিয়নকে কোল্ড ড্রিংক্স আনার অর্ডার দিল। তারপর বলল, বড় ভাই বলুন কী মনে করে?
তুমি নির্বাচনের পর থেকে পার্টি অফিসে আস না, রাস্তা-ঘাটেও কোথাও দেখি না। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। রায়হান সাহেবের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ী হওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরও আমরা যে ভোট আশা করেছিলাম তারচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছি। আমি চাই তুমি আবার আগের মতো দলের জন্য কাজ করো, জনগণের সঙ্গে কাজ করো, জনপ্রিয়তা অর্জন করো।
বেলায়েত সাহেব বললেন, জামাল একবার হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলেই তো চলবে না। তোমাকে পৌরসভার চেয়ারম্যান হতে হবে। তুমি আবার কাজ শুরু করো, দল থেকে আমরা তাকে কখনোই সহযোগিতা করবো না। দেখি বেটা কীভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখে। বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা এতো সহজ কাজ না।
বড়ভাই আমি আসলে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম আপনাদের কথা শুনে একটু ভালো লাগছে। আপনারা আমার সাথে থাকলে আমি অবশ্যই আগামী নির্বাচনে জিততে পারবো।
তারপর সবাই মিলে একরকম আড্ডা দিল। জামালের মন থেকে যেন ব্যর্থতার কষ্ট অনেকটা হালকা হয়ে গেল। অবশেষে মোস্তফা সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে জামালের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে বললেন, জামাল তুমি তাহলে বসো আজ ব্যবসার কাজ গুছিয়ে আগামীকাল থেকে আবার পার্টি অফিসে এসো।
জমাল মৃদু হেসে বলল, জি ভাই।
সবাই চলে গেলে জামাল কয়েক মুহূর্ত বসে রইল, তারপর রশিদ সাহেবকে ডাকল। রশিদ সাহেব জামালের চেম্বারে প্রবেশ করলেন।
জামাল বলল, রশিদ সাহেব বসুন।
রশিদ সাহেব চেয়ারে বসলেন।
জামাল বলল, রশিদ সাহেব কয়েকদিন থেকে কাজের খবর নিতে পারিনি। এখন বলুন কোনটা কাজের অগ্রগতি কতদূর?
ভাইজান ব্রিজের কাজ প্রায় শেষের দিকে এখন শুধু রেলিং আর মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলেই আমরা ব্রিজের কাজটা হ্যাণ্ডওভার দিতে পারি।
তাহলে আপনি তাড়াতাড়ি ব্রিজের কাজটা শেষ করে ফাইনাল বিল করার ব্যবস্থা করুন। বুঝতেই তো পাচ্ছেন ভোটে অনেক টাকা খরচ হয়েছে, হাত একেবারে খালি।
জি ভাইজান ঠিক আছে আমি দেখছি। আর রাস্তার কাজটার খবর কি জানেন ভাইজান?
আমি জানবো কী করে? আমি কি আর এ জগতে ছিলাম? এখন ফিরে এসেছি এখন সব জানবো। বলুন।
আমাদের মোট চার কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে তিন কিলোমিটার রাস্তার সাব বেজ পর্যন্ত হয়ে গেছে। এক কিলোমিটার রাস্তায় সাব বেস করতে আর দু’দিন সময় লাগবে। তারপর সেখানেও একটা বিল করা যাবে।
জামাল হাসল, রশিদ সাহেব আপনি অনেক আশার কথা শুনালেন। এখন তাড়াতাড়ি করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিলের ব্যবস্থা করুন।
রশিদ সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, জি ভাইজান, তারপর চলে গেলেন।
রশিদ সাহেব চলে যাবার পর জাহিদ চেম্বারে ঢুকলো। জাহিদ জামালের চেম্বারে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে দেয়। জাহিদ আজো জামালের চেম্বারে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা জাহিদ আমাদের ফেন্সির ব্যবসাটা আরো বড় করার দরকার তুমি শুধুমাত্র পান-বিড়ির দোকানে চুরি করে আর ক’বোতল ফেন্সি বিক্রি করবে। তারচেয়ে আমি একটা কথা বলি।
জাহিদ কৌতূহলী দৃষ্টিতে জামালের দিকে তাকিয়ে বলল, জি ভাইজান বলুন।
তুমি প্রত্যেক মহল্লায় আরো বেশি করে ফেন্সিকুইন বাড়াও।
জাহিদ বোকার মতো জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জামাল বলল, যেসব মহিলা ফেরি করে শাড়ি কসমেটিক বিক্রি করে তাদের হাতে ফেন্সি দিবা তাহলে ধীরে ধীরে মেয়েরাও আসক্ত হবে। আর মেয়েরা আসক্ত হওয়া মানে ব্যবসা ডাবল হওয়া। তুমি কাল থেকে সেভাবে কাজে লেগে যাও।
জাহিদের মুখে একটা আলোর ঝিলিক খেলে গেল, জি ভাইজান।
আর হ্যাঁ আমি একটা মাইক্রো বাস কিনবো, মাইক্রো বাস কেনার পর আমরা ওপার থেকে সরাসরি ফেন্সি আনবো। সবাই জানবে আমি মাইক্রো বাস দিয়ে রেন্ট-এ কারের ব্যবসা করি কিন্তু আমি আসলে মাইক্রো বাসে করে ফেন্সি আনবো। তুমি ইমেডিয়েট একটা মাইক্রো বাস কেনার আর বিক্রি বেশি করার চেষ্টা করো।
জি ভাইজান।

তেত্রিশ

জুঁইয়ের বিয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে পাত্রের সন্ধান আসছে। কোথাও ঘর মিলে তো বর মিলে না, আবার বর মিলে তো ঘর মিলে না। আবার কোথাও ঘর বর সবকিছু মিললেও পাত্রের বিবরণ আর শিক্ষাগত যোগ্যতা জুঁইয়ের পছন্দ হয় না। এ নিয়ে জাহানারার চিন্তার অন্ত নেই।
অবশেষে একদিন তিনি জুঁইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বস্নেহে বললেন, কী হয়েছে মা? আমরা অনেক কষ্ট করে একটা পাত্রের সন্ধান পেলাম। ঘর-বর সবই ঠিক কিন্তু তুই রাজি হলি না, বিয়েটা ভেঙ্গে গেল, মারে তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
জুঁই নীরবে বসে রইল জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি কোন পছন্দ আছে? যদি থাকে তো বল? আমরা তার সঙ্গেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবো।
জুঁইয়ের মনের মধ্যে তখন জামালের ছবি ভাসছে। জামালের স্ত্রী আছে সে কথা জুঁই বেমালুম ভুলে গেছে। তার সব সময়ই শুধু জামালের কথা মনে পড়ছে। সে কিছুতেই জামালকে তার মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না।
জাহানারা আবার তাড়া দিয়ে বললেন, বল মা তোর কি কাউকে পছন্দ আছে?
জুঁই কিছু বলল না নীরবে বসে রইল তারপর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, মা আমাকে আর কিছুদিন সময় দেয়া যায় না?
হ্যাঁ মা ভেবে দেখ ,তবে খুব তাড়াতাড়ি বলবি।
জুঁই চোখ মুছে বলল, মা আমি একবার চাচীদের বাসা থেকে ঘুরে আসি।
যা মা তাড়াতাড়ি আসিস।
জুঁই বের হয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরই কলিং বেল বেজে উঠল। জাহানারা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, জুঁই তো এইমাত্র ওর চাচার বাসায় গেল বাবা।
জামাল হেসে বলল, খালা আপনি যে কি বলেন? আমি কি শুধু জুঁইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আসি, আমি আপনার, যুথির সবার খোঁজ খবর নিতে আসি।
এসো বাবা বসো।
জামাল ভিতরে ঢুকলো।
জামালের কণ্ঠস্বর পেয়ে যুথি বারান্দায় বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, জামাল ভাই এতদিন পর?
জামাল যুথির মুখের দিকে তাকালো তার চোখে মুখে যৌবনের উচ্ছলতা ফুটে উঠেছে জামাল একবার যুথির বুকের দিকে তাকাতেই তার বুক ধড়াস করে উঠল। জামালের লোভাতুর চোখ দু’টা লোভে চিক চিক করে উঠল।
জামাল বলল, সময় পাইনা, সবসময় কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকি।
আসুন ভিতরে আসুন, বলে যুথি জামালকে ভিতরে নিয়ে গেল।
নিত্যদিনের মতো জামাল যে চেয়ারটাতে বসতো ঠিক সেই চেয়ারে বসল আর যুথি জুঁইয়ের চেয়ারে বসল।
জামাল চেয়ারে বসে যুথির সমস্ত শরীরে একবার চোখ বুলাল। যূথীকে নিবিড়ভাবে পাবার জন্য তার মন উতলা হয়ে উঠল। যুথি জামালের দিকে তাকাতেই পরস্পরের চোখে চোখ পড়ল।
যুথি চোখ সরালো না। জিজ্ঞেস করল, এভাবে কী দেখছেন?
জামাল বলল, তোমাকে দেখছি, দেখতে দেখতে তুমি বড় হয়ে গেলে, তুমি খুব সুন্দরও হয়েছ।
জামাল ভাই আপনি কিন্তু বাড়িয়ে বলছেন।
যুথির চোখের দৃষ্টি আর কথা বলার ধরণ চোখে পড়ার মতো। জামাল আগে একবার যূথীকে টার্গেট করেছিল কিন্তু যুথির রূপ আর যৌবনের অহঙ্কারের কাছে নিজের মনের একান্ত কথাগুলো বলতে পারেনি। আজ যুথির চোখের দিকে তাকিয়ে জামালের মনে আবার তার সেই ইচ্ছা ব্যক্ত করার ইচ্ছা হলো। জামাল চেয়ার থেকে উঠে যুথির কাছে গিয়ে যুথির হাতে কয়েকটা পাঁচ’শ টাকার নোট গুঁজে দিল। যুথি জামালের দিকে তাকাতেই অজানা আশঙ্কায় তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল।
জামাল যুথির থুতনিতে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে ধরে বলল, যুথি।
যুথি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, টাকাগুলো জামালের হাতে দিয়ে বলল, ছিঃ জামাল ভাই, ছিঃ আপনাকে আমি ভালো মানুষ বলে জানতাম, মহানুভব বলে জানতাম, নিজের ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম আর আপনি কি না টাকা দিয়ে—-, ছিঃ জামাল ভাই, ছিঃ।
জামাল শক্তভাবে যুথির একটা হাত চেপে ধরে চাপাস্বরে বলল, তুমি কিসের অহঙ্কার দেখাচ্ছ যুথি? তুমি জানো আমি তোমাদের কে? আমি ইচ্ছা করলে—–।
ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেল বেজে উঠল।
যুথি বলল, আপা এসেছে প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন, আমি যাই দরজা খুলে দেই বলে যুথি চলে গেল।
জুঁই ঘরে প্রবেশ করেই বলল, জামাল ভাই কখন এসেছেন?
যুথি চলে যাবার পর জামাল সহজে স্বাভাবিক হতে পারছিল না, সে মুখ ভার করে বসেছিল।
জুঁই আবার জিজ্ঞেস করল, আমার উপর রাগ করেছেন?
জামাল কোন কিছু না বলে চুপ করে বসে রইল। এমনসময় জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। সাধারণত জুঁইয়ের সঙ্গে জামালের কথাবলার সময় তিনি ঘরে ঢুকেন না। আজ হঠাৎ করে মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে জুঁই বলল, মা তুমি?
জাহানারা জুঁইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মা তুই একটু পাশের ঘরে যা তো।
জুঁই একবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে গেল। জাহানারা চেয়ারে বসে স্নেহ মাখা কণ্ঠে বলল, বাবা জামাল তোমাকে একটা কথা বলব?
জি খালা আম্মা বলুন।
জুঁইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজা হচ্ছে, তোমার জানা যদি কোন ভালো ঘর-বর পাওয়া যায় তবে তুমি একটু দেখ বাবা।
জামাল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মৃদু হেসে বলল, এটা তো খুব আনন্দের কথা খালা আম্মা, জুঁইয়ের বিয়ের কথা শুনে আমি খুব খুশি হলাম, তবে আমি যে একটা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাই খালা আম্মা।
কী দায়িত্ব বাবা?
খালা আম্মা আপনি তো জানেন আমি খুব ব্যস্ত মানুষ তাই জুঁইয়ের জন্য পাত্র দেখার দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দিন, আমি বরং একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ বাবা?
জুঁইয়ের বিয়েতে যা খরচ হবে সম্পূর্ণ টাকা আমি দিব বলে জামাল মনে মনে বলল, জুঁইকে বিদায় করতে পারলেই তো যুথি একা হয়ে যায়। তার পরবর্তী টার্গেট সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, তরুণী যূথীকে কৌশলে কাছে পাবার পথটাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
তোমার কথা শুনে খুব খুশি হলাম বাবা, বলে জাহানারা বের হয়ে গেলেন।
জাহানারা বেরিয়ে যাবার পর জুঁই আবার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, মা কী বলল?
তোমার বিয়ের কথা।
আপনি কী বললেন?
আমি আর কী বলব? বললাম শুনে খুব খুশি হলাম।
জামালকে সত্যি সত্যি খুশি হতে দেখে জুঁই মনে খুব কষ্ট পেল। সে আশ্চর্যজনকভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি সত্যিই খুব খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ তোমার বিয়ে হবে আর আমি খুশি হবো না?
আপনি নিষ্ঠুর, আপনি আমাকে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দিতে পারবেন?
জামাল খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? বিয়ের বয়স হয়েছে তোমাকে তো বিয়ে দিতেই হবে। এটা তো আমাদের সকলের দায়িত্ব।
জুঁইয়ের চোখে-মুখে ঘৃণা আর ক্ষোভ ফুটে উঠল সে মনে মনে বলল, এতদিন আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করলেন, নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে হাজারও অভিযোগ তুলে আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলেন? আজ বিরাট দায়িত্ববান বনে গেলেন। ছিঃ আপনি একটা ভণ্ড, মিথ্যুক, প্রতারক।
যুথি কিছুক্ষণ পাশের রুমে থাকল তারপর সেও জামাল ও জুঁইয়ের কাছে গিয়ে তাদের আলাপে যোগ দিল।
জুঁইকে চুপ করে থাকতে দেখে জামাল বলল, তোমার কথা থাক, তোমার তো বিয়ের প্রস্তুতি চলছে আজ না হয় কাল ভালো ঘর-বর পেলে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, এখন যুথির কথা ভাবা যাক, যুথি তোমার কি পরীক্ষা শেষ হয়েছে?
জি ভাইয়া।
পরীক্ষার পর কোথাও বেড়াতে যাওনি?
না।
পরীক্ষা ভালো হয়েছে?
জি ভাইয়া।
কোথায় ভর্তি হবে?
ভাইয়া আমার রেজাল্ট খুব ভালো হবে তারপরও ভাইয়া তো আমাকে ঢাকার ভালো কোন কলেজে ভর্তি করে দিয়ে হোস্টেলে রেখে পড়াতে পারবে না।
কেন?
আপনি তো সবই জানেন, আমার হোস্টেলে টাকা দেয়ার মতো সামর্থ্য ভাইয়ার নেই।
জামাল দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, তোমার ভাইয়ার টাকা নেই আমার তো আছে, আমি তো টাকার জন্য তোমার জীবন নষ্ট হতে দিতে পারি না।
জুঁই মনে মনে বলল, লম্পট, এবার দেখি যুথির ওপর নজর পড়েছে, ওকে এই লম্পটের হাত থেকে যেমন করে হোক দূরে রাখতে হবে।
হ্যাঁ তুমি ভর্তির চেষ্টা কর আমি টাকা দিব।
যুথি মনে মনে বলল, আপনার মতো একটা চরিত্রহীন, লম্পট, অমানুষের টাকায় লেখাপড়া করার ইচ্ছা আমার নেই, প্রয়োজনবোধে লেখাপড়াই করবো না। তবুও আপনার টাকা আমি নিব না।
জামাল জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষার পর কোথাও ঘুরে আসতে হয় আর ভালো জামা কাপড় নিতে হয়, ঘুরে বেড়ালে এবং ভালো জামা-কাপড় পরলে মন ভালো হয়। রেজাল্ট বের হলে তো আবার লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হতে হয় কাজেই এনজয় করার এটাই সময়, তুমি কি বল জুঁই?
জুঁই একটা ঢোক গিলে বলল, জি।
তুমি কি পরীক্ষার পর কোন জামা কাপড় নিয়েছ?
যুথি কিছু বলল না নীরবে মাথা নত করে বসে রইল।

চৌত্রিশ

জামালের ব্যবসা বাণিজ্য দ্রুত উন্নতি হতে থাকল। ফেন্সিডিলের ব্যবসা, ঠিকাদারি, রাজনৈতিক তদবির সবকিছু মিলিয়ে জামাল যেন অতি দ্রুত অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি করল। তার উন্নতিকে কেউ কেউ ঈর্ষার চোখে দেখল, কেউবা আনন্দিত হলো, কেউবা সন্দেহের চোখে দেখল। জহির সাহেব একজন সৎ ব্যবসায়ী, তিনি পৈত্রিক সূত্রে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন তারপর আর বেশি কিছু করতে পারেন নি। তাই ছেলের অবিশ্বাস্য উন্নতিকে তিনিও কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখলেন। একদিন খাবার টেবিলে তিনি অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, বউ মা জামাল আজ-কাল রাত ক’টায় ফিরে?
ঠিক নেই বাবা কোনদিন বারোটায় কোনদিন একটায়।
তুমি কিছু বলো না?
অনন্যা বলল, আমি কী বলব বাবা?
বউমা তোমার স্বামী রাত বারোটা একটা পর্যন্ত বাইরে থাকে কী করে? সে কথা জানার অধিকার তোমার আছে।
ও খুব ব্যস্ত বাবা, কয়েকটা ব্যবসা, রাজনীতি সবকিছু শেষ করে যখন বাসায় ফিরে তখন ওকে খুব ক্লান্ত দেখায়। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না, আমার মনে হয় তখন ওর বিশ্রাম দরকার। বলতে বলতে অনন্যার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল।
সরি বউমা আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। আসলে একটা সংসারে স্ত্রীর ভূমিকা অনেক, তুমি একটু চেষ্টা করো ওকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে পারো কী না?
অনন্যার একবার বলতে ইচ্ছা করল, আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি বাবা কিন্তু ও আমার কথাকে একেবারে পাত্তাই দেয় না। কিন্তু সে কিছু বলল না চোখ মুছে ভিতরে চলে গেল।
ফাহমিদা জহির সাহেবকে বললেন, বউমা আর জামালের মধ্যে সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। জামাল বাসায় না আসা পর্যন্ত বউমা খাবার নিয়ে বসে থাকতো। আমি ওদের মধ্যে কোন মিলের অভাব দেখিনি, যা একটু দেরিতে বাসায় ফিরে। আজ তুমি একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করে দিলে।
এটাকে ভুল বুঝাবুঝি বলে না ফাহমিদা, আসলে বউমার একটু সচেতন হওয়া দরকার এখনকার দিনে এত সহজ-সরল হলে চলে না। জামালের রাত একটা পর্যন্ত বাইরে থাকার মতো কী কাজ থাকতে পারে? আমি ব্যবসা করিনি? কোনদিন বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছে?
তোমার কথা বাদ দাও, তুমি সারাজীবন ব্যবসা করে কিছু করতে পারোনি, ও যদি দিনরাত পরিশ্রম করে নিজে কিছু করতে পারে তবে অসুবিধা কোথায়?
জহির সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, না আমি তা বলছি না, আমি বলছি নিয়ম মাফিক সবকিছু করেও তো ব্যবসা করা যায়? তুমিও একটু বুঝাও ওকে।
ফাহমিদা রেগে গেলেন, আমি বলব না, ও কখনো আমার কথা শুনে? আমি মনে করি ছেলে এখন বড় হয়েছে, ব্যবসা করছে, ওকে আর হাতের মুঠোয় রাখতে চাইলে হয় না। ওকে ওর মতো চলতে দাও, তুমি একটা ব্যবসা করে সারাজীবনে সামান্য কিছু উন্নতি করেছ আর ও অনেকগুলো ব্যবসা করে, রাজনীতি করে, অনেক মানুষের উপকার করে, ওকে অনেক বড় হওয়ার সুযোগ দাও।
ফাহমিদার কথায় জহির সাহেব সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি রাগান্বিত চোখে ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন।
জামাল বাসায় ফিরল রাত বারোটায় ততক্ষণে অনন্যা জামালের ফিরবার অপেক্ষায় বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। জামাল ফিরবার পর তাকে খেতে দিয়ে অনন্যা নিজেও খেতে বসল। খেতে খেতে অনন্যা একবার কিছু বলতে গিয়ে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারল না। খাওয়া শেষে জামাল কোন কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জামাল সাধারণত বাসায় তেমন একটা কথা বলে না। বাসার বাইরে যে মানুষ কথা না বলে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকতে পারে না, বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে বাসায় সে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলে না। আজো কোন কথা না বলে তেমনি বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অনন্যা জামালের মাথার কাছে বসে বলল, তুমি কি খুব ক্লান্ত?
কেন? কিছু বলবে?
হুঁম।
তুমি প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে যাও ফিরে আসো গভীর রাতে। সারাদিন আমার একা একা খুব কষ্টে কাটে। তবু তুমি কি আরো আগে বাসায় ফিরতে পারো না?
জামাল শান্ত গলায় বলল, অনন্যা তুমি তো জানো আমার কয়েকটা ব্যবসা আছে, তারপর রাজনীতি করি, আমি কোথাও অযথা সময় নষ্ট করি না সবসময় ব্যবসা আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তাই ফিরতে দেরি হয় এটা নিয়ে তুমি মন খারাপ করলে তো চলবে না।
শুধু যে আমি মন খারাপ করছি তা নয়, আজ বাবাও বলছিলেন তোমার জন্য বাবার কাছে আজ আমাকে কথা শুনতে হলো।
বাবা কী বলছিল?
বাবা বলছিলেন তুমি এমন কী ব্যবসা করো যে বাসায় ফিরতে রাত বারোটা বাজে। আর পার্টি অফিসও তো রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে না।
অনন্যার কথা শুনে জামাল রেগে গেল।
সে বলল, অনন্যা তুমি আমার বউ এ পর্যন্তই, তুমি আমার কথা মতো চলবে আমি যা বলব তা শুনবে। আমার জন্য অপেক্ষা করার তোমার প্রয়োজন নেই, খাবার সময় হলে তুমি খাবে, কোনকিছু নিতে ইচ্ছা করলে আমাকে বলবে আমি টাকা দিব, তুমি নিজে বাজারে গিয়ে কিনবে, কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করলে যাবে। কিন্তু বাসায় আমার আসা-যাওয়া কিংবা আমার কাজকর্ম নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন তুলবে না, কথাটা মনে থাকে যেন।
আমি তোমার স্ত্রী, তোমার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমারো আছে। তুমি ব্যবসার নাম করে, রাজনীতির নাম করে প্রতিদিন সারারাত বাসার বাইরে কাটিয়ে দিবে আর আমি সারারাত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো এটাও হতে পারে না।
অনন্যা তুমি কি গভীর রাতে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাও? সিন ক্রিয়েট করতে চাও? তাতে কি আমার মান-সম্মান থাকবে নাকি স্ত্রী হিসেবে তোমার মান-সম্মান বাড়বে?
তোমার মান-সম্মানের দিকে তাকিয়ে তো আমি কিছু বলতে পারি না তাইতো তুমি লাগামহীন হয়ে গেছ, এভাবে বেশিদিন চললে-
অনন্যা তুমি থামবে? আমি এখন ঘুমাবো আমাকে ডিস্টার্ব করবে না, বলে জামাল কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।
পঁয়ত্রিশ

জুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে ধুমধাম করে। বিয়ের যাবতীয় খরচ বহন করেছে জামাল। অবশ্য জুঁইয়ের বিয়েতে অর্থ ব্যয় করার কাজটা মহৎ হলেও এর মধ্যে জামালের কয়েকটা অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে ছিল। জামালের উদ্দেশ্য ছিল জুঁইকে একটা নিম্নবিত্ত বা স্বল্প আয়ের কিংবা কোন বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলে এবং জুঁইয়ের স্বামীকে তার ফার্মে চাকরি দিয়ে অথবা কিছু টাকা দিয়ে ছোট খাট ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দিলে সে তার অধীনস্থ হয়ে থাকবে এবং জুঁই নিজেও সারা জীবন তার উপপত্নী বা রক্ষিতা হয়ে থাকবে। সেজন্য জুঁইয়ের স্বামীর যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়ে জাহিদ বা তার মা প্রশ্ন তুললেও জামাল হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, জাহিদ তুমি আসলে আমার উপর আস্থা রাখতে পারছ না, তুমি বলো একটা ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা কি আমার নেই?
জামালের কথায় জুঁই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পারলেও মুখে কিছুই বলেনি আর জামালের কথায় জাহিদ এবং তার মা বেশ খুশি হলো। তাছাড়া জুঁইয়ের বিয়েতে জামালের আরো একটা অসৎ উদ্দেশ্য ছিল তা হলো জুঁইয়ের বিয়ের পর যুথির সঙ্গে অবাধ মেলামেশার বাধাও অপসারিত হওয়া।
জুঁইয়ের বিয়ের পর জামালের আরো সুবিধা হলো। সেদিন জামাল যুথিদের বাসায় দরজা নক করতেই যুথি দরজা খুলে দিয়ে বলল, ভাইয়া মা তো বাসায় নেই, বাসায় আমি একা।
যুথির ধারণা ছিল তার একা থাকার কথা শুনে জামাল বাসায় ঢুকবে না কিন্তু জামাল তা করল না সে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলল, কোথায় গেছে?
পাশের বাসায়, চাচী অসুস্থ তো তাই দেখতে গেছে।
খালা নেই তো কী হয়েছে? তুমি তো আছ। বলতে বলতে জামাল রুমে ঢুকলো। যুথি জামালের কাছে গেল না একা বাসায় থাকা অবস্থায় জামালের সঙ্গে গল্প করা সমীচীন মনে করেনি। তাই সে পাশের রুমে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই একরকম হঠাৎ করে শুরু হলো মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি। মেঘের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো প্রলয়ঙ্করী ঝড়। কাছেই হয়ত কোথাও বজ্রপাত হলো তারপর বিদ্যুৎ বন্ধ। সমস্ত শহর জুড়ে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার। পাশের রুমে অন্ধকারে যুথি চুপচাপ বসে তার মা আসার জন্য অপেক্ষা করল আর পাশের রুম থেকে জামাল কখন যেন এসে পড়বে, যুথির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার অনেকদিনের কামনাকে চরিতার্থ করবে সে ভয়ে যুথি ঘরের এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে রইল।
দরজা ঠেলে কে যেন যুথির রুমে ঢুকলো। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যুথি স্পষ্ট চিনতে পারল, হ্যাঁ জামালই তো।
জামাল তার দিকে এগিয়ে এলো। ভয়ে যুথি যেন কাঁপতে শুরু করল, সর্বস্ব হারাবার ভয়ে তার হৃৎপি ণ্ড যেন দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করল।
যুথি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে একবার দরজার দিকে তাকালো কিন্তু জামাল এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে তার রুম থেকে বের হওয়ার কোন পথ নেই, সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ভাইয়া আপনি বসুন প্লিজ, আমি মাকে ডাক দিচ্ছি।
জামাল যুথির একটা হাত শক্তভাবে ধরে ফেলল, বসো, তোমাকে কাউকে ডাকতে হবে না।
তাহলে আপনি বসুন, আমি নাস্তা তৈরি করছি।
এই ঝড় বৃষ্টিতে তোমার কিছু করার দরকার নেই।
জামালের চোখ দু’টো লোভে চিকচিক করছে, এ চোখ যেন কোন মানুষের চোখ না, মানুষের মাংস ভক্ষণ করা কোন ক্ষুধার্ত বাঘের চোখ। যুথি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।
যুথি কোন কথা বলল না, সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
জামাল ডান হাত দিয়ে যুথির চুলগুলো পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে থুতনি উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রাখল, রূপের অহঙ্কার না? আমাকে এভয়েড করো?
যুথি কোন কথা বলল না, অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
জামাল আবার বলতে শুরু করল, আমার কী নেই বলো? টাকা, ক্ষমতা সব আছে তারপরও আমি শুধু তোমার মতো একটা মেয়ের কাছে হাত পাতছি কীসের জন্য তুমি বোঝ না? আর তুমি! তুমি আমাকে অহঙ্কার দেখাচ্ছ, না? তুমি জানো আমি ইচ্ছা করলে, আমি জোর করলে তোমার সব অহঙ্কার দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারি কিন্তু আমি জোর করি না, আমি জয় করার চেষ্টা করি। জোর করার মধ্যে আনন্দ নেই, তৃপ্তি নেই।
যুথি মাথা নত করে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মেঝে টিপতে লাগল।
জামালের কণ্ঠস্বর একটু নরম হলো, আমি তোমাকে জয় করতে চাই, তুমি কী চাও বলো? টাকা? অর্নামেণ্টস? বলো কী চাও? আমি শুধু তোমাকে চাই। তুমি আমাকে প্রেম দিবে, ভালোবাসা দিবে। তুমি বিশ্বাস করো, আমি কাউকে কিছু বলবো না, কেউ কিছু জানবে না, শুধু তুমি আর আমি জানবো।
জামাল যুথির হাতে মৃদু চাপ দিল, থুতনি একটু ডানে-বাঁয়ে ঝাকালো, বলো কী চাও বলো?
যুথি বুক এখনো তোলপাড় করছে, আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে কিছু বলতে গিয়ে একটা ঢোক গিলল।
জামাল অগ্রহের সঙ্গে বলল, বলো, বলো।
যুথি কাকুতির সুরে বলল, আমার কিচ্ছু চাই না, আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ!
জামাল যূথীকে একটা ঝাঁকি মেরে বলল, তোমাকে ছেড়ে দেব না?
যুথি মাথা নেড়ে সায় দিল।
এতক্ষণ আমি তোমার সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করেছি, তুমি আমার খারাপ আচরণ দেখোনি, এখন দেখবে, বলে জামাল যুথির ওড়না কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। মুহূর্তেই সে যেন হিংস্র হয়ে উঠল।
যুথি কাঁপতে লাগল, তার দাঁতে দাঁত ঠকঠক করছে।
জামাল যূথীকে জোর করে বুকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে দলিত-মোথিত করতে লাগল। যুথি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু জামাল তাকে শক্তভাবে বুকে চেপে রেখেছে। যুথি নিজেকে মুক্ত করার কৌশল খুঁজতে লাগল। না তার মাথায় কোন বুদ্ধি এলো না। সে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে রাগান্বিত স্বরে বলল, আমিও আপনার সঙ্গে অনেক ভালো আচরণ করেছি, আমাকে ছেড়ে দিন নইলে আমি চিৎকার করবো, সবার সামনে আপনার মুখোশ খুলে দিবো।
জামাল চাপাস্বরে বলল, চিৎকার করবে, না? চিৎকার করলে আমার মুখোশ খুলে যাবে, না? আর তোমার কিছু হবে না?
হোক, আমার যা হয় হোক আপনি ভেবেছেন আমি মান-সম্মানের ভয়ে চুপ করে থাকবো? আর না হয় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করবো? চুপ করে থাকা কিংবা আত্মহত্যা করা দুটোই তো হেরে যাওয়া, আমি হেরে যাবো না, আপনার মতো মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শয়তানগুলোকে সবার চেনা উচিত। আর সে কাজটা আমিই করবো, আমাকে ছেড়ে দিন নইলে এখনি আমি চিৎকার করবো, বলে যুথি জোরে জামালকে একটা ধাক্কা দিল।
জামাল কিছুটা দূরে সরে গেল।
সে আবার কাছে আসতেই যুথি জোরে বাঁচাও শব্দের বাঁ-উচ্চারণ করতেই জামাল যুথির মুখে হাত দিয়ে বলল, প্লিজ চিৎকার করে নিজের সর্বনাশ করো না, আমি চলে যাচ্ছি তবে এতটা করা তোমার ঠিক হয়নি। নিজের জীবনকে এতটা রিস্কি করে তোলা তোমার ঠিক হয়নি।
আমারটা আমি বুঝবো, আপনি আর একটা কথাও বলবেন না, আপনি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান।
জামাল চলে যাবার পর যুথি বাইরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগল।
জামাল প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তাই প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাকানি হলেও জামালের বিষয়ে কথা বলার মতো সাহস কারো নেই। উল্টো যুথিকেই সবাই চরিত্রহীন বলে কলঙ্কের বোঝা ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করবে। হুঁম আসলে যুথি নিজেকে রক্ষা করেছে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে। তা হোক তার একটা আত্মতৃপ্তি আছে সে কোনকিছুর বিনিময়ে আপোষ করেনি। নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে যা করার তাই করেছে।
এতদিন জুঁইয়ের সাথে জামালের মেলামেশার জন্য যুথি শুধু জামালকেই দোষারোপ করেছে। জামাল দোষ করেনি এমন না, হয়ত তার মতো জুঁইকেও জামাল লোভ দেখিয়েছে, জোর করে ভোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু জুঁই যদি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতো তবে হয়তো নিজেকে রক্ষা করতে পারতো। আজ একটা কথা ভেবে যুথির গর্ব হচ্ছে অন্য মেয়েরা যেখানে আপোষ করে যুথি সেখানে জয়ী হয়েছে।
যুথি একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিল।

ছত্রিশ

টেলিফোনের রিসিভার রেখেই জামালের মন দুশ্চিন্তায় ভরে গেল। সমস্ত শরীর ঘামতে লাগল। ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইনের ব্যবসা জামাল অনেকদিন থেকে চালিয়ে আসছে কিন্তু কোনদিন কোন দুঃসংবাদ শুনেনি তাই আজ টেলিফোনে এমন দুঃসংবাদ শুনে সে ভেঙ্গে পড়ল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারী করতে লাগল। এমনসময় জাহিদ তার চেম্বারে ঢুকলো। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো এলোমেলো, মুখ শুকনো যেন ঝড় পেরিয়ে আসা এক বিধ্বস্থ পাখি। ডানা ঝাপটে জামালের চেম্বারে ঢুকলো।
জাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে জামালের বুক কেঁপে উঠল। একটা অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। জামাল কোনকিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে জাহিদ? তোমার এ অবস্থা কেন?
জাহিদ একটা ঢোক গিলে বলল, ভাইজান ফেন্সিকুইন মর্জিনা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, সে পুলিশের কাছে আমার নামও বলে দিয়েছে, আমার মনে হয় পুলিশ আমাকে খুঁজছে।
জামাল কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইল। সে নিজেই ভেঙ্গে পড়েছে জাহিদকে সে কী বলে সান্ত্বনা দিবে? তবু জাহিদকে আশ্বস্থ করার জন্য বলল, জাহিদ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে মর্জিনা তোমার নাম বলল আর পুলিশ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে গেল, তোমার জেল হলো, এত ভীরু হলে তো চলবে না। একটা কথা মনে রেখো তুমি ক্ষমতাসীন দলের লিডারের সঙ্গে কাজ কর। পুলিশ আমার এখান থেকে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে না।
জাহিদ বলল, ভাইজান আমি বলছিলাম পুলিশের সঙ্গে কিছু একটা সিস্টেম করা দরকার তা না হলে তারা ঝামেলা করবে।
সিষ্টেম করতে করতেই তো এমন দুর্ঘটনা ঘটল। তুমি বরং কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকো, অফিসে আসার দরকার নেই, বাসায় কিংবা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না, আমি নিজেই প্রতিদিন তোমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবো।
জি ভাইজান।
জামাল ড্রয়ার থেকে একটা এক’শ টাকার নোটের বান্ডিল বের করে জাহিদের হাতে দিয়ে বলল, তুমি এবার এসো জাহিদ।
জাহিদ বের হয়ে গেলে জামাল আবার গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল, সে জীবনে এই প্রথম এত জটিল সমস্যার মধ্যে পড়ল। অনেকক্ষণ পর একটা সিগারেট টানতে লাগল। চিন্তার ব্যাঘাত ঘটল জাকিরের দরজা খোলার শব্দে, ভাইজান পুলিশ এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
জামালের হৃৎপি ণ্ড দ্রুতগতিতে চলতে লাগল। একবার সিলিংয়ে ফ্যানটা দেখল ফ্যানটা বেশ জোরে চলছে তবু তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। জামাল তোয়ালে দিয়ে একবার মুখের ঘাম মুছে বলল, আসতে বলো।
জাকির চলে গেলে একজন পুলিশ অফিসার ভিতরে ঢুকে তার পরিচয় দিল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ আপনি আমার চেম্বারে কী মনে করে?
পুলিশ অফিসারে কণ্ঠস্বর কিছুটা কর্কশ, জাহিদ আপনার ফার্মে চাকরি করে?
হ্যাঁ।
ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
জামাল না জানার ভান করে বলল, জাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? কী অভিযোগ?
জাহিদ ফেন্সিসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার ব্যবসার সাথে জড়িত।
কিন্তু ওতো আমার ফার্মে আমার ব্যবসা দেখাশুনা করে।
তারমানে কি এই নয় যে আপনার মাদক ব্যবসাটাও সে-ই দেখাশুনা করে?
জামাল রেগে গেল, দেখুন না জেনে কথা বলবেন না আমার ধান চাউলের ব্যবসা, বাস-ট্রাকের ব্যবসা, ঠিকাদারী ব্যবসা আছে, জাহিদ এসব দেখাশুনা করে এর বাইরে ও যদি কিছু করে থাকে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
পুলিশ অফিসার দাঁত কড়মড় করল, জানেন কী না সেটা রিমান্ড নিলেই জানা যাবে।
দেখুন পুলিশে চাকরি করেন দেখে সবাইকে ক্রিমিনাল ভাববেন না, আমি একজন ব্যবসায়ী, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ এসব কিছুই যদি বাদ দেই, যদি মনে করি আমি একজন সাধারণ নাগরিক তারপরও আমার সঙ্গে আপনার ভদ্রভাবে কথা বলা উচিত। একটা গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশকে জনগণের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন তা আপনার জানা উচিত। আমার কোন অপরাধ নেই, জাহিদের অপরাধের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ নেই তারপরও আমাকে রিমান্ডের ভয় দেখাচ্ছেন। আপনার ধারণা আপনি বললেন আর আমি স্বেচ্ছায় আপনার সঙ্গে চলে গেলাম। এত সহজ না মিঃ বুঝলেন?
ইচ্ছা করলে আমি আপনাকে এখনই ফিফটি ফোরে এরেস্ট নিয়ে যেতে পারি কিন্তু তা আমি করবো না।
জামাল প্রচণ্ড রেগে গেল, দেখুন আবারো আপনি আমাকে আইনের ভয় দেখাচ্ছেন? এখন আমার কি মনে হচ্ছে জানেন?
কী মনে হচ্ছে, বলুন?
আসলে জনগণ ঠিকই আইন মানে আপনারা যারা আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করেন তারাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন।
পুলিশ অফিসার এবার বিনয়ের সঙ্গে বললেন, সরি কিছু মনে করবেন না, দেখুন জাহিদ অপরাধী, আর একজন অপরাধীকে আইনের কাছে সোপর্দ করা সকলের দায়িত্ব। দয়া করে বলবেন কী জাহিদ এখন কোথায়?
জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, জাহিদ অসুস্থ তিনদিন আগে ও ছুটি নিয়ে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে, এখনো সে সুস্থ কি না তা আমি জানি না।
আমি যদি বলি জাহিদ অসুস্থ নয় এবং আজকেও সে এখানে এসেছিল আপনি তাকে সরিয়ে দিয়েছেন।
তবে আপনি তখন তাকে ধরলেন না কেন?
দেরিতে জানতে পেরেছি।
বেশ তো এখনো তাকে ধরুন, অপরাধীকে খুঁজে বের করা পুলিশের দায়িত্ব, সেজন্য জনগণ মাসে মাসে পুলিশকে বেতন দেয়।
বুঝেছি আপনি সহযোগিতা করবেন না। পুলিশকেই খুঁজে বের করতে হবে, সরি টু ডিস্টার্ব ইউ, বলে পুলিশ অফিসার চলে গেলেন।
পুলিশ অফিসার চলে যাবার পর জামাল চোখ বুজে চেয়ারে বসে রইল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল জাহিদের প্রতিচ্ছবি। জামাল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পুলিশ অফিসার জাহিদকে এরেস্ট করে রিমান্ডে নিয়েছে। রিমান্ডে পুলিশকে তার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকাসহ জামালের সম্পৃক্ততার কথাও বলে দিয়েছে, পুলিশ হন্য হয়ে জামালকে খুঁজছে।

সাঁইত্রিশ

জামাল চোখ খুলল, তারপর চেয়ার থেকে উঠে একটা সিগারেট টানতে টানতে রুমের মধ্যে পায়চারী করতে লাগল, তার চোখের সামনে জাহিদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল, আমার মাদক ব্যবসার একমাত্র সাক্ষী জাহিদ। বিভিন্ন মহল্লার ফেন্সিকুইনরা জাহিদকে চিনে, যারা ফেন্সি ক্যারি করে তারাও শুধু জাহিদকে চিনে। জাহিদ আমার ফার্মে চাকরি করে একথা সবাই জানলেও মাদক ব্যবসার সঙ্গে আমার সম্পৃক্তার বিষয় কেউ কেউ আঁচ করতে পারলেও তা অনুমান ভিত্তিক, স্পষ্ট করে কেউ জানে না। জাহিদকে পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে, জাহিদ যে কোন মুহূর্তে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে। জাহিদ যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আর রিমান্ডে আমার নাম বলে দেয় তবে আমিও মামলায় জড়িয়ে পড়বো তখন জনগণের কাছে আমার মুখোশ খুলে যাবে। সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দল ক্ষমতায় আসতে না পারলে মামলায় দলীয় প্রভাব কাজে লাগাতে পারবো না। কাজেই জাহিদের উপরই এখন আমার স্ট্যাটাস, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি নির্ভর করছে, জাহিদকে সাক্ষী হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা নিরাপদ নয়। হ্যাঁ জামাল একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে কোন মূল্যে জাহিদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া জামালের নিরাপদ থাকার উপায় নেই। জাহিদকে সরিয়ে দিতে পারলে তার মা বোন একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে, তারা পুরোপুরি আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে আমার এক ঢিলে দু’পাখি না, না বহু পাখি মারা হবে ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে হো হো করে উন্মাদের মতো হেসে উঠল।
জামালের চোখে ঘুম নেই, বিছানায় শুয়ে দুশ্চিন্তায় ছটফট করছে। সাধারণত জামাল গভীর রাতে বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হাজার রকমের কাজ কিংবা কোন দুশ্চিন্তা কিংবা অনন্যার সঙ্গে দু’একটা কথা বলার মতো সামান্যতম সময়ও সে জেগে থাকে না। আজ বিছানায় অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে অনন্যা জিজ্ঞেস করল, তোমার কি শরীরটা ভালো নেই?
জামাল উত্তর দিল, না, ঠিক তা না, কেন জানি ঘুম আসছে না। তুমি ঘুমিয়ে পড়, আমিও ঘুমাবার চেষ্টা করছি।
অনন্যা আর কোন কথা বলল না বিছানায় চুপ করে শুয়ে পড়ল।
জামাল জাহিদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে সাধারণত ছোট-খাট অপারেশন হিটলারই করে থাকে কিন্তু এত বড় অপারেশন সে পারবে কি? আবার এ ব্যাপারে মোস্তফা সাহেব বা বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ নেই কারণ তাতে জাহিদকে হত্যার সাক্ষী থেকেই যায়, এসব কাজে সাক্ষী রাখতে নেই। আবার আজ যে মোস্তফা সাহেব তাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করে রাজনৈতিক কারণে কাল সেই মোস্তফা-ই যে শত্রু হবে না তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে? না না জামাল কাউকে জিজ্ঞেস করবে না যা করার একাই করবে।
জামাল বিছানা ছেড়ে উঠল, পাশের রুমে গিয়ে জাহিদের নামে কেনা মোবাইলের সিম কার্ডটা তার মোবাইল সেটে সেট করল। জামাল সাধারণত হিটলারসহ তার অপরাধ জগতের সমস্ত লোকের কাছে এই সিম কার্ড দিয়েই মোবাইল করে থাকে এবং সকলের কাছে এ নাম্বারটাই সেভ করা আছে। জামাল হিটলারকে মোবাইল করল।
অপর পাশ থেকে হিটলারের কণ্ঠস্বর ভেবে এলো, হ্যালো বস।
হিটলার তুমি একবার আমার সঙ্গে দেখা করো তো।
বস আপনি কোথায়?
আমি যেখানেই থাকি তুমি তিন নম্বর পয়েন্টে এখনই চলে এসো, মোটর সাইকেল নিয়ে আসবে না। খেয়ার রাখবে তোমাকে যেন কেউ দেখে না ফেলে।
জি বস আসছি।
জামাল বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিন নম্বর পয়েন্টে গেল।
হিটলার জিজ্ঞেস করল, বস হঠাৎ কী এত জরুরি প্রয়োজন? কোন কেস আছে?
জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, হিটলার বেশি কথা বলবা না, তুমি তো জানো কেস ছাড়া আমি তোমাকে ডাকি না।
হিটলার বিনয়ের স্বরে বলল, জি বস বলুন।
একটা ট্রান্সফার করতে হবে।
জি বস নাম, ঠিকানা দিন। তো-
তো কী?
হিটলার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, বস খরচ একটু বেশি পড়বে।
বুঝছি, তুমিও খুব কমার্শিয়াল হয়ে গেছ।
হিটলার ঘাবড়ে গেল, বস কি মাইন্ড করলেন?
না, মাইন্ড করবো কেন? বলো কত দিতে হবে?
লাখ খানেক দিবেন।
ঠিক আছে, পাবে।
বস নাম ঠিকানা দিন?
জামাল হিটলারকে জাহিদের নাম এবং তার অবস্থানের কথা বলল, হিটলার একটা কাগজে জাহিদের অবস্থানের ঠিকানাটা লিখে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল, বস কিছু–
জামাল পঞ্চাশ হাজার টাকা হিটলারের হাতে দিয়ে বলল, এই নাও খুব সাবধানে অপারেশন করবে।
জি বস আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আর শোন অপারেশন সাকসেসফুল হলে এই নাম্বারে একটা মিস কল দিবা।
জি বস, বলে হিটলার চলে গেল।
হিটলারকে বিদায় দিয়ে জামাল হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরল। তার চুলগুলো এলোমেলো আর মেজাজটা রুক্ষ্ণ হয়ে গেছে। বাসায় ঢুকে নিজে গেট বন্ধ করে বেড রুমে ঢুকতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলে?
বাইরে।
এত রাতে আবার বাইরে কী জন্য?
জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, এত রাতে কি জন্য বাইরে গিয়েছিলাম সেকথা তোমাকে বলতে হবে?
তুমি এভাবে বলছ কেন? আমার জানতে চাওয়াটাই কি দোষ হয়েছে?
হ্যাঁ দোষ হয়েছে আর কখনো জানতে চাইবে না। আমি কখন কোথায় যাই? কী করি? এসব তোমার জানার বিষয় না। তুমি আমার বাবা-মা’র বেঁধে দেওয়া বউ, তুমি সংসার দেখাশুনা করবে এটাই তোমার কাজ। তোমাকে আমি অনেকদিন বলেছি আমার ব্যবসা, রাজনীতি এসব নিয়ে কোনদিন কথা বলবে না।
দেখ তোমার ব্যবসা, রাজনীতি এসব নিয়ে আমি কোনদিন কিছু বলি না, বলতেও চাইনা কিন্তু আজ হঠাৎ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমি তোমার স্ত্রী, তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমাকে বলো তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?
অনন্যা আমি এখন ঘুমাবো আর কোন কথা বলবে না বলে জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই, একটা অজানা আশঙ্কা তাকে তাড়া করছে? তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে জাহিদ হিটলার আর পুলিশ অফিসারের মুখ। হিটলার জাহিদকে ট্রান্সফার করতে পারবে তো? জাহিদকে ট্রান্সফার করতে গিয়ে হিটলার পুলিশের হাতে ধরা পড়বে না তো? জাহিদ কিংবা হিটলার যে কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই তার পরিচয় বেরিয়ে পড়বে। এমনভাবে বিভিন্ন রকমের চিন্তা করতে করতে জামাল এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

আটত্রিশ

প্রতিদিন সকাল বেলা জহির সাহেবের পেপার পড়ার অভ্যাস। আজ পত্রিকার পাতায় চোখ খুলেই আগে হেড লাইনগুলো পড়ার পর একটা খবরের ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল, “২০ বোতল ফেন্সিডিলসহ ফেন্সি কুইন মর্জিনা গ্রেফতার, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ২০ বোতল ফেন্সিডিলসহ ফেন্সিকুইন মর্জিনাকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত মর্জিনা সে তাদের ফেন্সিডিল সরবরাহকারী হিসেবে জনৈক জাহিদের নাম বলেছে, জাহিদকে পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে পুলিশের ধারণা জাহিদকে পেলে শহরে মাদক ব্যবসার রাঘব-বোয়ালদের মুখোশ উন্মোচিত হবে।” খবরে পাশাপাশি দু’টা ছবি ছাপানো আছে একটা মর্জিনার এবং অপরটা জাহিদের, জহির সাহেব ভালোভাবে নিরীক্ষা করলেন, হ্যাঁ সত্যিই তো জামালের ম্যানেজার জাহিদের ছবি। জহির সাহেবের মন সন্দেহের দোলায় দোলে উঠল। তিনি জোরে বউমা বউমা বলে ডাকলেন, সঙ্গে সঙ্গে অনন্যা সামনে এসে দাঁড়াল, জি বাবা।
জহির সাহেব বললেন, নিউজটা পড়ে দেখ তো।
অনন্যা নিউজটা পড়ল এবং ছবি দু’টা দেখল জাহিদের ছবি সম্পর্কেও সে নিশ্চিত হলো। অনন্যার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। অনন্যা বুঝতে পারল নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে নইলে জামাল গতকাল রাতে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করবে কেন? কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
জহির সাহেব বললেন, বউমা জামালের ঘুম ভেঙ্গেছে।
না বাবা।
জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, ওর সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত আমি বের হচ্ছি না, ও ঘুম থেকে উঠলে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে এখন যাও।
জহির সাহেব আনমনা হয়ে পেপারের পাতা উল্টাতে থাকলেন। তাঁর মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক করছে। জামাল ছোটবেলা থেকে ডানপিটে, চঞ্চল, একথা সত্য, ছাত্র জীবনেও ছিল বেপরোয়া কিন্তু ব্যবসা শুরু করার পর থেকে তার উত্তরোত্তর উন্নতিতে জহির সাহেব অনেক আগেই সন্দেহ করেছিলেন আজ বুঝি তাঁর ধারনাটা সত্য হলো। জামাল ঘুম থেকে উঠে জহির সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল।
জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে জহির সাহেব যেন চমকে উঠলেন, কিরে তোর এ অবস্থা কেন?
কিছু না বাবা।
জামাল সোফায় বসলে জহির সাহেব বললেন, আজকের পেপারে একটা খবর বেরিয়েছে, দেখেছিস?
না বাবা।
এই পড়ে দেখ বলে জহির সাহেব জামালের দিকে পেপারটা এগিয়ে দিলেন। জামাল পেপারটা পড়ে চুপ করে বসে রইল।
জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এখন বুঝতে পাচ্ছি এত তাড়াতাড়ি তুই এত উন্নতি করলি কীভাবে?
জামাল প্রতিবাদ করে বলল, বাবা তুমি আমাকে ভুল বুঝছ জাহিদের ফেন্সিডিল ব্যবসার সঙ্গে আমি জড়িত না, সে যে ফেন্সিডিলের ব্যবসা করতো একথা আমি জানতাম না বাবা, জানলে অনেক আগেই আমি চাকরি থেকে বিদায় করে দিতাম। ও আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছে, ও একটা বিশ্বাস ঘাতক, গাদ্দার।
জহির সাহেব জামালের কথা বিশ্বাস করলেন না, তিনি বললেন, তোর কর্মচারী কি করে তা তুই জানিস না? এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা?
বাবা তুমিও পুলিশের মতো কথা বলছ?
পুলিশের মতো কেন? এটা খুব স্বাভাবিক কথা, পেপারে লিখেছে জাহিদকে ধরতে পারলে মাদক ব্যবসার রাঘব- বোয়ালদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। তাহলে রাঘব-বোয়াল কারা?
সেটা পুলিশ বলতে পারবে।
পুলিশ বলতে পারবে আর তুই বলতে পারবি না, আমি আর তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। রাঘব-বোয়াল হিসেবে তোর নাম বেরিয়ে না আসুক এটাই আমি চাই। মনে রাখিস আমি কোন রাঘব-বোয়ালের বাবা হতে চাই না, বলে জহির সাহেব চলে গেলেন।
জামাল বাসা থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছিল, মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো বড়ভাই।
অপর পাশ থেকে মোস্তফা সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল তুমি আমার বাসায় এসো তো।
জামাল মোবাইল অফ করে সোজা মোস্তফা সাহেবের বাসায় চলে গেল। মোস্তফা সাহেবের ড্রয়িংরুমে পাশাপাশি সোফায় বসে ছিলেন মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেব জামালকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন, বসো জামাল।
জামাল সোফায় বসে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ল। জামাল, মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেবের হাসিমাখা মুখ দেখেছিল কিন্তু গম্ভীর রাগান্বিত মুখ দেখেনি তাই আজ দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে জামাল আঁতকে উঠল। মোস্তফা সাহেব প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, জামাল আজকের পেপার পড়েছ?
জি ভাই।
মাদক ব্যবসায় জাহিদের নাম বেরিয়ে এসেছে জাহিদ তোমার কর্মচারী, তোমার কর্মচারী মাদক ব্যবসায়ী হলে প্রসঙ্গক্রমে তোমার নাম চলে আসে।
কিন্তু বড়ভাই-
তুমি কী বলবে আমি বুঝছি। একটা কথা খেয়াল রাখো জাহিদ যদি পুলিশের কাছে ধরা পড়ে আর তোমার নাম বলে দেয় তবে কী হবে জানো?
জামাল অপরাধীর মতো মাথা নত করে নীরবে বসে রইল।
মোস্তফা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, মাদক ব্যবসায় তোমার নাম বেরিয়ে এলে তুমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দলের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
বেলায়েত সাহেব জামাল সাহেবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন, সামনে নির্বাচন এ সময় এমন একটা দুর্ঘটনা দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে, জেলায় দলের বিপর্যয় হলে আমরা সেন্ট্রাল লিডারদের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।
জামাল সভয়ে বলল, বড়ভাই পুলিশ যদি জাহিদকে খুঁজে না পায় কিংবা জাহিদ যদি পুলিশের কাছে আমার নাম না বলে।
মোস্তফা সাহেব বললেন, পুলিশ যদি তাকে না পায় তবে কোন কথাই নেই, দুর্ভাগ্যক্রমে জাহিদ যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তবে পুলিশের রিমান্ডে সব কথা বেরিয়ে পড়বে।
বড়ভাই আপনারা আমাকে হেল্প করুন।
বেলায়েত সাহেব বললেন, কী হেল্প করবো বলো?
আমার অফিসে পুলিশ এসেছিল জাহিদকে খুঁজতে, আমার কথা হলো পুলিশ জাহিদকে খুঁজবে কিন্তু আমার অফিসে পুলিশ যাওয়াটা আমার জন্য এবং দলের জন্য অপমানজনক।
মোস্তফা সাহেব বললেন, জামাল একটা কথা জেনে রাখো আগে আমাদের তদবিরে যেভাবে কাজ হতো এখন সেভাবে কাজ হবে না।
কেন?
বুঝ না সামনে ইলেকশন দলের ক্ষমতা শেষের দিকে এই মুহূর্তে যে কোন অফিসে টেলিফোন করলেই কাজ হবে এমন আশা করা যায় না। আবার যদি দল ক্ষমতায় আসে তবে তখন আমাদের কথায় কাজ হবে। একটা কথা খেয়াল রেখো জাহিদ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সর্বনাশ হবে।
জি বড়ভাই জাহিদ যেন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে আমি সে ব্যবস্থা করছি তবে আপনাদের সহযোগিতা আমার একান্ত প্রয়োজন।

উনচল্লিশ

দু’দিন কেটে গেল হিটলার কোন যোগাযোগ করল না। জামাল জাহিদের সিম কার্ডটা মোবাইল সেট-এ সংযোজন করে কয়েকবার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু হিটলারের মোবাইল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জামাল লক্ষ্য করেছে পুলিশ তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করলেও সাদা পোশাকে তাকে অনুসরণ করছে। জাহিদকে না পাওয়া পর্যন্ত বোধ হয় পুলিশ তার অফিসের আশে-পাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। কাজেই হিটলারের কাছ থেকে কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত জামাল দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছে না।
জামাল বাসায় ফিরল। তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্যার বুক ফেটে কান্না এলো। জামালের আচরণে অনন্যা বরাবরই অসন্তুষ্ট তারপরও স্বামী তো! জামালের গম্ভীর কালো মুখ দেখলে অনন্যা তার প্রতি জামালের সমস্ত অবহেলা মুহূর্তেই ভুলে যায়। জামালের এলোমেলো চুল, কোটরাগত চোখ আর রুক্ষ্ণ মেজাজ যেন অনন্যাকে চিন্তিত করে তুলল কিন্তু জামালকে কিছু বলার সাহস পেল না।
জামাল পাশের রুমে গিয়ে জাহিদের নামে কেনা সিম কার্ডটা তার মোবাইলে সেট করতেই মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হিটলার কী খবর?
বস অপারেশন সাকসেসফুল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, কোন ঝামেলা হয় নি তো?
না বস এতো কাঁচা কাজ করিনি, আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই, সুইসাইড কেস।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে জামাল মোবাইল অফ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
জামালের চোখে তবুও ঘুম নেই কখনো জাহিদের মুখচ্ছবি বার বার করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কখনো পুলিশ অফিসারের কথাগুলো কানের কাছে বেজে উঠছে। কিন্তু জাহিদ আত্মহত্যা করেছে, তাই জামালের সমস্ত আশঙ্কা যেন কেটে গেল। আবার কখনো যুথির লাবণ্যময় মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। এখন ওদের আপন বলতে আর পৃথিবীতে কেউ থাকল না, যুথির রূপ-লাবণ্যর অহঙ্কার এবার কে রক্ষা করবে! এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল।
অনন্যা জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে বল তো?
তুমি বুঝবে না অনন্যা, তুমি বুঝবে না, বলে জামাল মুখ ফিরিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করল।
পরদিন সকাল বেলা আবাসিক হোটেলে জাহিদের ফ্যান হুকের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনাটা ট্যক অফ দি টাউনে পরিণত হলো। কেউ কেউ জাহিদের আত্মহত্যাকে অপমৃত্যু না পরিকল্পিত খুন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। জামাল নিজ খরচে ঢাকা থেকে এনে জাহিদের লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করল।
জাহিদের লাশ বাসায় পৌঁছামাত্র তাদের বাসায় কান্নার রোল পড়ে গেল। খবর পেয়ে জুঁই তাদের বাসায় এলো। জাহিদের লাশ দেখে তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরল।
জামাল কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না খালা আম্মা, জাহিদ নেই আপনার এই ছেলে তো আছে। আমি থাকতে আপনাদের কোন চিন্তা নেই, আমাকে সবকিছু নিঃসংকোচে বলবেন। ইনশাল্লাহ আমি আপনার ছেলের অভাব পূরণ করবো।
জাহানারা, জুঁই, যুথি দু’জনের হাত একসঙ্গে করে জামালের হাতে তুলে দিয়ে বলল, তুমি একটু ওদের দিকে খেয়াল রেখো বাবা, বলে তিনি যুথির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমার এই এতিম মেয়েটাকে এখন থেকে নিজের মনে করবে।
খালা আম্মা জুঁইয়ের বিয়েতে আমি সহযোগিতা করেছি, এবার যুথির লেখাপড়ার সমস্ত দায়িত্ব নিলাম। যূথীকে আমি এম.এ পাস করার পর যোগ্য পাত্রের সাথে বিয়ে দিব, বলে জামাল যুথির দিকে এগিয়ে যেতেই যুথি সরে গেল।
জামালের গণ্ডদেশ বেয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে আর তার মন বলছে, জাহিদ একদিন আমাকে পরোক্ষভাবে বাসায় আসতে এবং তোমাদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছিল আজ তোমার ভাইও নেই আমার পথে কোন বাধাও নেই। জুঁইর বিয়ে হয়েছে এবার যুথি এখন থেকে তুমি শুধু আমার।
জাহানারা জামালকে ঘরে বসার জন্য বললে জামাল ঘরে বসল। পাশাপাশি চেয়ারে জুঁইয়ের স্বামী এবং মুখোমুখি জুঁই ও যুথি বসল।
জামাল জুঁইকে জিজ্ঞেস করল, জুঁই তোমাদের দিনকাল কেমন চলছে?
জুঁই কিছু বলল না, তার স্বামী বলল, জি ভাইজান ভালো।
একদিন তোমার দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দোকানে মনে হয় আরো কিছু ক্যাশ হলে ব্যবসাটা আরো লাভজনক হতো।
জি ভাইজান।
তুমি এক কাজ করো, তোমার দোকানে আর কত টাকার মাল হলে দোকানটা আরো ভালো চলবে সেটা হিসেব করে দেখ তারপর একদিন অফিসে এসো আমি কিছু টাকা দিয়ে দিব।
জুঁইয়ের স্বামী বিনয়ের সঙ্গে বলল, জি ভাইজান।
জুঁই বুকে হঠাৎ করে একটা ধাক্কা খেল। জামাল তার স্বামীকে টাকা দিতে চাওয়ার অর্থ হলো তার প্রতি জামালের লোলুপ দৃষ্টি এখনো সরে যায়নি বরং এখন তার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে যুথির উপর। যুথি তার বাসায় নিরাপদ নয় জুঁইয়ের একবার মনে হয় যূথীকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে আবার একবার মনে হয় যূথীকে নিয়ে গেলে মা একেবারে একা হয়ে পড়বে তার চেয়ে যূথীকে জামাল সম্পর্কে পূর্ব ধারণা দিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়াই ভালো।
যুথি কিছু বলল না। জামাল জাহানারাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, খালা আম্মা আমি আজকের মতো উঠি কাল আবার আসবো তখন সবকিছু খবর নিব জুঁই, যুথি তোমরা থাকো আবার দেখা হবে।
জামাল বের হয়ে গেলে জুঁই বলল, যুথি সাবধান বোন, তুই একবারে একা হয়ে গেলি। সাবধানে থাকিস। জামাল ভাই’র সঙ্গে তোর মেলামেশা যত কম হয় ততই ভালো। এতদিন ভাইয়া ছিল একরকম অভিভাবক ছিল এখন আর কেউ থাকলো নারে তুই নিজের ভালো মন্দ ভেবে চলিস। বলতে বলতে জুঁই চোখ মুছলো।
যুথির মনে তখন জামালের সেদিনের হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য ভেসে উঠল, সেই সঙ্গে নিজেকে রক্ষা করার একটা দৃঢ় প্রত্যয়। সে গণ্ডদেশ বেয়ে পড়া চোখের পানি মুছে বলল, জি আপা।
জাহিদের মৃত্যুর পর কয়েকদিন কেটে গেল। ইতোমধ্যে জামাল একদিন জাহিদের বাসায় গিয়ে জাহিদের পাওনা স্বরূপ কয়েক হাজার টাকা তার মায়ের হাতে দিয়ে এসেছে। টাকা পেয়ে জাহানারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। জামাল আবারো সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, খালা আম্মা জাহিদ না থাকলেও আমি তো আছি, আমি আপনাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আছি। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন আমি চলে আসবো।
জাহানারা কান্না ভাঙ্গা গলায় বলেছিল, তোমাকে ডাকার মতো তো কেউ নেই বাবা যখন ইচ্ছে চলে আসবে।
খালা আম্মার সঙ্গে কথা শেষ করে যুথির দিকে তাকাতেই জামালের ভিতরের পশুত্বটা জেগে উঠেছিল। শরীরটা শিউরে উঠেছিল।
সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই যুথির লাবণ্যময় আকর্ষণীয় সুন্দর চেহারাটা জামালের চোখের সামনে ভাসছিল। তাই আজ বিকেল থেকেই এক রকম যুথির কথা বার বার করে ভাবছিল। সন্ধ্যায় অফিসে ঢুকে জামাল বেশিক্ষণ বসল না রশিদ সাহেবের সঙ্গে দু’য়েকটা কথা বলে রিক্সায় বসে যুথির বাসায় চলে গেল। যুথিদের বাড়িতে জামালের যাতায়াত অনেকদিনের তাই জামালের কলিং বেল টিপ দেওয়ার ধরণ শুনেই যুথি জামালের আসার কথা বুঝতে পারল। জাহানারা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। যুথি দরজা খুলে দিতে গিয়ে জামাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুথির বুকের দিকে তাকিয়ে রইল।
যুথির বুক কেঁপে উঠল, সে মৃদু কণ্ঠে বলল, আসুন ভাইয়া।
জামাল যুথির গালে একটা টোকা মেরে বাসার ভিতরে ঢুকেই খালা আম্মা খালা আম্মা বলে ডাক দিল।
জাহানারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, কেমন আছ বাবা?
জামাল মৃদু হেসে বলল, ভালো কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে রাখবেন?
চলো বাবা ভিতরে চলো বলে জাহানারা জামালকে ঘরে নিয়ে গেল যুথিও তাদের সঙ্গে ঘরে ঢুকলো।
খালা আম্মা যূথীকে কি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন?
না বাবা।
জামাল যুথির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কলেজে ভর্তি হবে না?
যুথি মাথা নেড়ে বলল সে কলেজে হবে না।
কেন?
পড়বো না।
পড়বো না মানে?
পড়বো না মানে আর লেখাপড়া করবো না।
জামাল কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বলল, তুমি বললেই হলো, আমি আছি কী জন্য? তারপর জামাল জাহানারার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, খালা আম্মা এই টাকাগুলো রাখুন, যূথীকে কলেজে ভর্তি করে দেবেন।
জাহানারা টাকা নিতে অস্বীকার করল। জামাল কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, তাহলে কিন্তু আমি রাগ করবো খালা আম্মা। আমি থাকতে টাকার অভাবে যুথির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে এটা হয় না, বলে জামাল একরকম জোর করে জাহানারার হাতে টাকা গুঁজে দিল।
তুমি বসো বাবা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
জামাল চেয়ারে বসল। যুথিও তার মা’র বেরিয়ে যাচ্ছিল। জামাল মৃদু কণ্ঠ ডাক দিল, যুথি।
যুথি এক পা দরজার ভিতরে আর এক পা বাইরে রেখে বলল, জি বলুন।
জামাল দেখল ততক্ষণে জাহানারা চলে গেছে। সে চাপা স্বরে বলল, খুব দাম হয়েছে না?
যুথির বুক কেঁপে উঠল। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল, আপনি বসুন ভাইয়া, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।

চল্লিশ

ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলো বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল থেকে মোস্তফা সাহেবকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়া হলো। তারপর শুরু হলো নির্বাচনী প্রচারণা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ নানাবিধ অবৈধ কাজের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পয়সার মালিক হওয়ায় তারা নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহে বেশ এগিয়ে চলল। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের প্রতিটি জনসভায় জনসমাগমও ঘটল অনেক। মিছিল মিটিং সবকিছুতেই জনগণের অংশ গ্রহণ দেখে মোস্তফা সাহেব যেন স্বপ্নে বিভোর হলেন। কিন্তু জনগণের রায় বুঝতে মোস্তফা সাহেবের ভুল হয়েছিল। জনগণের রায় তাঁর বিপরীতে গেল। মোস্তফা সাহেব নির্বাচনের রায় সহজভাবে মেনে নিলেন। ভোটের রেজাল্টের পর নেতা কর্মীদের অনেকে মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলো। তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে পাশাপাশি চেয়ারে বসেছেন বেলায়েত সাহেব ও উদীয়মান নেতা জামাল। বেলায়েত সাহেব ও জামালকে বেশ ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল কিন্তু মোস্তফা ভেঙ্গে পড়েননি, নেতা কর্মীদের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে বলতে শুরু করলেন, আমি বুঝতে পাচ্ছি আমি নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় আমার সাথে আপনারাও কষ্ট পেয়েছেন এটা দেখে আমি সান্ত্বনা পাচ্ছি। নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে, জনগণ যাকে পছন্দ করেছে যে দলকে পছন্দ করেছে তাকেই ভোট দিয়েছে। এটাই গণতন্ত্র, নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে, আমি জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান জানাচ্ছি। জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচনে বিজয় শুধুমাত্র প্রার্থীর ওপর নির্ভর করে না, দলীয় কর্মকাণ্ডও সমালোচিত হয় এবং অনেকেই দলীয় কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। দলীয় কর্মকাণ্ডের কারণেই হোক আর আমার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের কারণেই হোক জনগণের সিদ্ধান্তই আজ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল ক্ষমতা থেকে বিদায় দিল। এখন মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণগুলো খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করতে হবে পাঁচ বছরের মধ্যে দলের হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। দলের জন্য কাজ করতে হবে। জনগণের কাছাকাছি যেতে হবে জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে হবে। আশা করি আজকের পরাজয়ের গ্লানি মুছে আপনারা নতুনভাবে দলের জন্য কাজ করবেন পরবর্তী নির্বাচনে ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হবো।
এমন সময় নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী ফরিদ সাহেব মোস্তফা ভাই, মোস্তফা ভাই বলে ডাকতে ডাকতে বাসায় ঢুকলেন। কর্মীদের অনেকেই ফরিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদ সাহেব মোস্তফা সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, মোস্তফা ভাই এটা গণতন্ত্র, জনগণের দ্বারাই সরকার গঠিত হবে এবং জনগণের দ্বারা সরকার পরিচালিত হবে। আমি আপনার ছোট ভাইয়ের মতো, জনগণ আমার পক্ষে, আমার দলের পক্ষে মতামত দিয়েছে। আমি জনগণের মতামতকে শ্রদ্ধা জানাই। এই এলাকা আমাদের, এই দেশ আমাদের আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন জনগণের দেয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি।
মোস্তফা সাহেবের দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি ফরিদ সাহেবকে পার্শ্বের চেয়ারে বসতে বললেন, ফরিদ ভাই বসুন প্লিজ।
ফরিদ সাহেব বসলেন, জামাল একবার ফরিদ সাহেবের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, বেটা ভদ্রতা দেখাতে এসেছে।
ফরিদ সাহেব মোস্তফা সাহেবকে বিনয়ের সাথে বললেন, মোস্তফা ভাই আপনি অনুমতি দিলে আমি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই?
মোস্তফা সাহেব মলিন হেসে বললেন, ফরিদ ভাই এজন্য আমার অনুমতির কোন প্রয়োজন নেই, বলুন প্লিজ।
ফরিদ সাহেব দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, উপস্থিত ভাইয়েরা আমার, আস্‌সালামুয়ালায়কুম। গতকালের নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন।
ফরিদ সাহেবের মুখে একথা শুনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের নেতা কর্মীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো।
ফরিদ সাহেব বললেন, আপনারা হয়ত ভাবছেন আমরা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের কর্মী, আপনারা আমাকে ভোট দেননি। কিন্তু সেকথা ঠিক না আমি মনে করি নির্বাচিত সব নেতারই মনে করা উচিত সকল ভোটার তাকে ভোট দিয়েছে। এই মনে করুন ভোটের আগে আপনারা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের ভোটার ছিলেন এখনো সেই দলেরই কর্মী। কিন্তু আমি যদি আপনাদেরকে বিভক্ত করে ফেলি তবে তো আমি সবার সেবা করতে পারবো না। আমি একটা দলের প্রার্থী ছিলাম এখনো আমি অন্য একটা দলের নেতা কিন্তু ভোটে জয়ী হওয়ার পর আমি সকলের হয়ে গেছি। এখন আমার কাজ দল-মত নির্বিশেষে এলাকার উন্নয়ন করা, আপনাদের সেবা করা, আমি আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবো। মোস্তফা ভাইকে আমার অনুরোধ আপনি কোন সঙ্কোচ না করে আমাকে বলবেন, আপনার যেকোনো কর্মীকে যে কোন কাজে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। আমি যে কথাটা বার বার আপনাদের বলতে চাই আমি আপনাদের সকলের, আপনারা সবাই যেকোনো কাজে আমার কাছে আসবেন। এলাকার উন্নয়নে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আমি আপনাদের সকলের মঙ্গল কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করছি, বলে ফরিদ সাহেব তার বক্তব্য শেষ করলেন।
ফরিদ সাহেব বক্তব্য শেষ করে মোস্তফা সাহেব, বেলায়েত সাহেব ও জামালের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে চলে গেলেন।
ফরিদ সাহেব চলে যাবার পর জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, মোস্তফা ভাই কাজটা আপনি ঠিক করলেন না, আপনার মনে নেই, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ফরিদ সাহেব খুব ছোট খাট ইস্যু নিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছিলেন। আজ ভোটে জিতে এসেছেন দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের বুলি শোনাতে আর আপনিও তাকে আমাদের কর্মীদের সামনে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দিলেন।
জামাল তুমি তো রাজনীতিতে নতুন আর একেবারে তরুণ একটু বয়স হলে সব বুঝবে। ফরিদ সাহেব এসেছেন তাকে তো নিষেধ করা যায় না, আর তিনি বক্তৃতা দেওয়ার মানে এই নয় যে আমাদের দলের সব নেতা কর্মী তার দলে চলে গেল, বলে মোস্তফা সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা সবাই ভোটে আমার জন্য খুব কাজ করেছেন সে জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনারাও সবাই ক্লান্ত, আমার মনে হয় আমি অযথা সময় নষ্ট করছি। একথা বলার পর কর্মীদের অনেকে উঠে চলে গেল। জামাল এবং বেলায়েত সাহেবও বিদায় নিলেন।
নির্বাচনে দলের পরাজয়ের পর জামালের মনোবল অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। মোস্তফা সাহেব এবং বেলায়েত সাহেবও জামালকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাছাড়া জাহিদের মৃত্যুর পর জামাল আর ফেন্সিডিলের ব্যবসা চালু করেনি। তারপর ক্ষমতা হারানোর ফলে জামাল পুনরায় ফেন্সিডিলের ব্যবসা চালু করার সাহস পায়নি তাই জামাল শুধুমাত্র ধান-চাউলের ব্যবসা আর ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত আছে।
আজকাল ঠিকাদারি ব্যবসাও অনেকটা রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ফলে ঠিকাদারি ব্যবসায় কাজ পাওয়া জামালের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে জামালের ঠিকাদারি ব্যবসাও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তাই জামালের অর্থনৈতিক অবস্থাও আগের মতো নেই। কাজ কর্মে তেমন ব্যস্ততাও নেই তাই তার মাথায় দুষ্ট চিন্তা ভর করেছে আরো বেশি। জামাল প্রায় দিনই সন্ধ্যাবেলা ব্যবসায়িক কাজ সেরে ঠিক যুথির কাছে চলে যায়। চোখের সামনে সবসময় যুথির মুখ ও বুকের ছবি ভেসে ওঠে।
যূথীকে লোভ দেখিয়ে এবং জোর খাটিয়ে সে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু হাল ছাড়েনি। সে যুথির ওপর জোর খাটানোর ইচ্ছা ত্যাগ করে তাকে জয় করার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত, বিভিন্ন কৌশলে। যুথি জামালকে হাড়ে হাড়ে চেনে, তাই সেও নিজেকে রক্ষা করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জামাল যুথিদের বাসায় গিয়ে কলিং বেল এ টিপ দিতেই জাহানারা দরজা খুলে দিলেন। কিন্তু বাসায় অনেক আত্মীয় স্বজনের আগমন দেখে জামাল কিছুটা অবাক হলো, কী ব্যাপার খালা? বাসায় এত মেহমান?
আগে ভিতরে এসো বাবা, বলে জাহানারা এবং জামাল দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। জামাল যুথির রুমে গিয়ে ঢুকলো।
জামাল যুথিকেও একই প্রশ্ন করল, যুথি তোমাদের বাসায় এত মেহমান কোথা থেকে এসেছে?
আমার খালাত ভাইয়ের বউ, তার ছেলে আর খালাত বোন।
জামাল একবার দরজার দিকে তাকালো, তাহলে তো খুব আনন্দের ব্যাপার।
কেন আনন্দের কী হলো?
জামাল একটা মুচকি হাসি হাসল।
আপনি বসুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি। যুথি বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই যুথির খালাত বোন ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো।
যুথি ডাক দিল, বীথি এদিকে আয়।
বীথি ভিতরে ঢুকে সালাম দিল। যুথি জামালের সঙ্গে বীথিকে পরিচয় করে দিল। তারপর বলল, জামাল ভাই আপনি বসুন বীথির সঙ্গে গল্প করুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করি।
যুথি চলে যাবার পর জামাল বীথির মুখের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। বীথি চোখ নামাল, সে লজ্জায় জড়সড় হয়ে গেল। জামাল বীথির বুকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, এবার তোমার পালা, দেখি কিভাবে তোমাকে-
বীথি উঠে দাঁড়ালো জামাল জিজ্ঞেস করল, উঠলে কেন বসো? তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
এবার এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিবো।
কোথায় থাক যেন তোমরা?
ঢাকা।
বীথির ভাবী ঘরে ঢুকে সালাম দিল, বীথি তার ভাবীর সঙ্গে জামালের পরিচয় করে দিল। জামাল মনে মনে বিরক্ত বোধ করল কিন্তু মুখে কিছু বলল না, কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, ভাবী বসুন।
না ভাই আপনি বসুন আমার বাচ্চা পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে যেকোনো সময় ঘুম থেকে উঠতে পারে, বলে সে চলে গেল। জামাল যেন মনে মনে খুশি হলো এবং একবার বীথির বুকের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা ঢাকা থাক কোথায়?
মিরপুর।
নিজেদের বাসায় নিশ্চয়ই? বলেই জামাল জিহ্বায় কামড় দিল, সরি।
বীথি মৃদু হেসে বলল, কী যে বলেন ভাইয়া? ঢাকায় বাড়ি থাকা কী কম কথা। আসলে আমরা ভাড়া বাসায় থাকি।
জামাল বলল, তোমার হাসিটা তো খুব সুন্দর।
জামাল বলল, সরি শুধু হাসিটা সুন্দর বললে ভুল হবে, তুমি আসলে খুব সুন্দর বলে আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিল বীথি মৃদু হেসে বলল, ভাইয়া আপনি বাড়িয়ে বলছেন, আমাকে তো আপনি ছাড়া কেউ কোনদিন সুন্দর বলেনি।
দেখ বীথি সুন্দরের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। কেউ তোমাকে মনের চোখ দিয়ে দেখেনি বলে তোমাকে সুন্দর বলেনি, আমি বলছি তারমানে আমার চোখে তুমি সুন্দর হয়ত আর সবার চোখে না। দেখ না অনেক সুন্দর ছেলের সঙ্গে অসুন্দর মেয়ের আবার অসুন্দর ছেলের সঙ্গে সুন্দর মেয়ের মধ্যে প্রেম হয় তার মানে যার চোখে যে সুন্দর।
বীথি হাসল কিন্তু কিছু বলল না।
জামাল আবার বলতে শুরু করল, এই যে ধর তোমাকে আমার সুন্দর লাগছে আর কাউকে তোমার সুন্দর নাও লাগতে পারে। আবার তুমি হয়ত কাউকে পছন্দ কর সে হয়ত তোমাকে পছন্দ করে না।
জামাল কথা বলার সময় বীথি জামালের মুখের দিকে তাকিয়েছিল এবার বলল, আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন?
জামাল কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আর কিছু?
বীথি একটা মুচকি হাসি হেসে মাথা নত করল। যুথি নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই জামাল এবং বীথির দিকে নাস্তার প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জামাল ভাই খান প্লিজ, বীথি খা।
সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্প করল। জামাল বার বার করে বীথি আর যুথির দিকে তাকালো, তার মনের মধ্যে দু’জনের একটা তুলনামূলক ছবি ভেসে উঠল। শেষে যুথি বলল, জামাল ভাই একটা কথা তো আপনাকে বলাই হয়নি। আমি কাল বীথির সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছি।
জামাল বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ খালা বলে পাঠিয়েছেন আমাকে নিয়ে যেতে।
জামাল মনে কষ্ট পেল তারপরও কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, বেশ তো যাবে কিন্তু তুমি আমাকে আগে বললে না। তারপর জামাল পকেট থেকে টাকা বের করে যুথির হাতে দিয়ে বলল, এই টাকাটা রাখো তোমার কাজে লাগবে আর হ্যাঁ আমার মোবাইল নাম্বার তো তোমার মোবাইলে সেভ করা আছে যোগাযোগ করবে।
যুথি মৃদু হেসে বলল, টাকা কেন?
বাহ্ তুমি ঢাকা যাচ্ছ, টাকার প্রয়োজন আছে না।
কিন্তু তাই বলে আপনি-
জামাল যুথির কথার মাঝে বাধা দিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল, কেন আমি দিচ্ছি তো কী হলো? টাকার গায়ে কী লেখা থাকবে আমার দেয়া টাকা?
না, তাই বলে-
কোন কথা নেই তুমি আর কোন কথা বলবে না।
অগত্যা যুথি আর কোন কথা বলল না।
জামাল মনে মনে ভাবল বীথিকে টাকা দিলে কেমন হয়?
জামালকে চুপ করে থাকতে দেখে যুথি বলল, নিলাম তো আবার কী ভাবছেন?
ভাবছি তোমরা যদি কিছু মনে করো।
যুথি এবং বীথি দু’জনে বলল, বলুন আমরা কিছুই মনে করবো না।
জামাল পকেট থেকে আরো টাকা বের করে বীথিকে বলল, তোমার হাতটা বাড়িয়ে দাও তো।
বী হাত বাড়াতেই তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে জামাল বলল, ডন্ট মাইন্ড।
বীথি আমতা আমতা করে বলল, আমাকে কেন ভাইয়া?
রাখো তোমার কাজে লাগবে।
কিন্তু কেন?
এত কেন কেন বলো না তো তোমার ভাইয়া তোমাকে টাকা দিলে কি এত কথা জিজ্ঞেস করো?
তাই বলে আপনি?
জামাল কৃত্রিম মুখ ভার করে অভিমানের সুরে বলল, ও বুঝেছি তোমরা আসলে আমাকে কেউ আপন করে ভাবতে পারছ না।
বীথি মুচকি হাসি হেসে বলল, ছি আপনি মাইন্ড করছেন জানলে কিছু বলতাম না। আপনার একটা কার্ড দেবেন প্লিজ!
অবশ্যই, বলে জামাল বিথীর হাতে তার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, যুথি, বীথি তোমরা তাহলে বসো আমি আসি বলে জামাল বেরিয়ে গেল।
জামার বেরিয়ে যাওয়ার পর বীথি জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে রে এভাবে টাকা বিলায়।
যুথি কয়েক মিনিট ধরে জামালের পরিচয় এবং তার জীবনের বর্ণাঢ্য কাহিনী বলে বলল, লোকটার একটু বলে যুথি একটা চোখ মেরে বলল, ইয়ের দোষ আছে।
তাইনাকি?
হুঁম, যা বললাম, একটু সাবধানে থাকিস।
আচ্ছা।
আর যদি সেরকম ইচ্ছা থাকে, বলতেই দু’জনে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে যুথি বলল, কার্ড তো সঙ্গেই আছে যোগাযোগ করিস।
বীথি জামালের কার্ডে একটা চুমু খেয়ে বলল, ইয়াহু।

একচল্লিশ

যুথি ঢাকা পৌঁছার ক’দিন পরই বীথি মোবাইল করল কিন্তু যুথির আর কোন খবর নেই। যুথির মোবাইল সবসময় বন্ধ, মোবাইল করলেই সেই বেরসিক মহিলার কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন। যুথি কোনদিন যোগাযোগ না করলেও বীথি প্রায়ই জামালের সঙ্গে কথা বলে। প্রথম প্রথম একবার মোবাইল করে কল ব্যাক করতে বলতো তারপর একটা করে মিস কল। জামাল রিং ব্যাক করে অনেকক্ষণ কথা বলে। আজকাল বীথি সঙ্গে কথা বলার সময় জামাল কোনদিন যুথির কথা জিজ্ঞেস করে না। একদিন বীথি নিজেই কথা প্রসঙ্গে বলল, ভাইয়া যুথির কোন খবর জানেন?
জামাল বলল, না তো? কি হয়েছে?
শুনলে অবশ্য আপনি কষ্ট পাবেন।
তবু বলো।
হঠাৎ করে যুথির বিয়ে হয়ে গেছে।
জামালের বুকে যেন হঠাৎ করে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। তার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। তার মনে অনেক কথার ঝড় বইছে, তবে কি যুথির বিয়ের জন্য খালা আম্মা ওকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছে? এতদিন বাসার এমন কোন কথা নেই যে খালা আম্মা, জুঁই-যুথি আমার কাছে লুকাতো আর যুথির বিয়ের মতো একটা এত বড় ঘটনা আমাকে পাশ কাটিয়ে গেল। তবে কি তারা কৌশলে আমাকে পাশ কাটিয়েছে নাকি শুধু আমাকে পাশ কাটানোর জন্যই ঢাকায় খালার বাড়িতে যুথির বিয়ের আয়োজন করেছে?
জামাল কোনমতে সামলে নিয়ে বলল, কষ্ট পাবো কেন? যুথির বিয়ে হয়েছে জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি বিয়ের আগে জানলে একটা সুন্দর গিফট দিতাম।
বীথির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, সত্যিই খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ সত্যিই আমি খুবই খুশি হয়েছি।
কেন?
আমি তোমার মতো সুন্দর একটা মেয়ের সঙ্গ পাচ্ছি বলে। বীথি যেদিন থেকে যুথি কথা বলছে না সেদিন থেকে আমার মনে হচ্ছিল যুথি হয়ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি আমাকে মোবাইল করছ অথচ যুথি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না তখন বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তারপর যখন তোমার সঙ্গে কথা বলাটা নিত্যদিনের একটা অভ্যাসে পরিণত হলো এবং একদিন কথা না বললে আমি একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। সেদিন থেকে যুথির স্মৃতি আমার মন থেকে মুছে যেতে লাগল এবং ওর ছবির জায়গায় তোমার ছবিটা ভেসে উঠল। তাই আমি যুথির বিয়ে হয়েছে শুনে খুশি হলাম, বলে জামাল কৃত্রিম হাসি হাসল।
জামাল অনেক কথা বলার পরও বীথির কোন কথা ভেসে না আসায় জামাল বলল, হ্যালো বীথি।
জি বলুন শুনছি।
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
জি বলুন।
তোমার কি প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না?
ইচ্ছে করে বলেই তো প্রতিদিন আপনার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনদিন কথা না বললে খুবই খারাপ লাগে।
জামাল হেসে বলল, তুমি কি বুঝতে পাচ্ছ? আমরা দু’জনে প্রেমে পড়েছি।
বীথির কোন কথা ভেসে এলো না।
জামাল বলল, বীথি তুমি চাইলে আমি ঢাকা আসতে পারি।
বীথির উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আপনি ঢাকা আসছেন? সত্যি?
বলছি তো তুমি যখন চাইবে তখনই চলে আসবো তবে আমার একটা শর্ত আছে?
জি বলুন আপনার শর্ত?
আমি তোমাদের বাসায় যাবো না, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
আপনার মাথা খারাপ, আপনাকে বাসায় নিয়ে গেলে তো আমিই বিপদে পড়বো। আপনি ঢাকা চলে আসুন আমি গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করবো।
তাহলে একথাই থাকলো কাল যখন তুমি কথা বলবে তখন আমি তোমাকে সব বলবো। তুমি আগামী পরশুদিন সকালে আমাকে রিং দিও তারপর আমি যেখানে আসতে বলবো তুমি চলে আসবে, বলে জামাল মোবাইল অফ করল।
জামাল আজ আনন্দে মেতে উঠল। সে সবসময় নতুনত্বের প্রত্যাশী, জামালের স্ত্রী অনন্যা সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিতা কোনদিক থেকে তার কোন কমতি নেই তবুও অনন্যাকে জামালের ভালো লাগে না। অনন্যাকে জামালের খুব পুরাতন, অসুন্দর এবং একঘেয়ে বলে মনে হয়। তারপর জীবনে এলো জুঁই, জুঁইকে নিয়ে চলল বেশ কিছুদিন। আবাসিক হোটেলে রাত কাটানো থেকে শুরু করে জুঁইদের বাসায় দিনের পর দিন তাকে ভোগ করার পর এক সময় জুঁইকেও তার পুরাতন বলে মনে হলো। তার নজর পড়ল যুথির উপর, যুথি তখন সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়েছে তার মাঝে ছিল রূপ, যৌবন আর সতীত্বের অহঙ্কার কিন্তু জামাল তাকেও কৌশলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হবার পর একরকম জোরপূর্বক যুথির সমস্ত অহঙ্কার দুমড়ে মুচড়ে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা পরিকল্পনাই থেকে গেল। আজ জানলো তাকে না জানিয়ে যূথীকে ঢাকায় তার খালার বাসা থেকে বিয়ে দিয়েছে। অবশ্য বীথিকে দেখার পর থেকে জামালের কুনজর পড়ে বীথির ওপর সে নিজেও যূথীকে পাশ কাটিয়ে বীথিকে পাবার জন্য জাল বুনতে থাকে।
বীথি উচ্চাভিলাষী, তাই প্রথম দিন জামালের সঙ্গে কথা বলার পর আর যুথির মুখে তার অর্থ বিত্তের কথা শুনে সে জামালের আভিজাত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বীথিও জামালের মনে স্থান দখল করার স্বপ্ন দেখতে থাকে। প্রায় দিন জামালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বীথি নিজেই একরকম জামালের কাছে ধরা দিয়েছে। আজ বীথির সঙ্গে কথা বলার পর জামালের মনের মধ্যে বীথির ছবিটা ভেসে উঠল। জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল। এমনসময় রশিদ সাহেব চেম্বারে ঢুকে সালাম দিলেন।
কী খবর রশিদ সাহেব?
ভাইজান কাল টেন্ডার আছে তাই শিডিউলগুলো যদি সই করে দিতেন?
হ্যাঁ নিয়ে আসুন।
রশিদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন এবং কয়েক মিনিট পর কয়েকটি শিডিউল নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন। জামাল শিডিউলগুলো সই করতে করতে বলল, রশিদ সাহেব অনেক তো শিডিউল ড্রপ করলাম কাজ তো পাচ্ছি না। এবার বেশি করে লেস দিবেন যেন দু’একটা কাজ পাই, এভাবে বসে আর কতদিন? ভাগ্যিস চাউলের ব্যবসাটা আছে নইলে তো বাবার পেট্রোল পাম্পে বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না।
ঠিকাদারি ব্যবসা এমনই ভাইজান এক সময় দেখবেন কাজ পেতেই থাকবেন।
জামাল শুষ্ক হাসি হেসে বলল, রশিদ সাহেব আপনার কথাই যেন হয়। আর হ্যাঁ আমি পরশুদিন ঢাকা যাবো ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে আপনি ঐদিকটা সামলে নিবেন আর একান্ত প্রয়োজন হলে মোবাইল তো আছেই কথা বলতে বলতে জামাল সই করা শেষ করল।
ঢাকায় পৌঁছে জামাল হোটেলে সিট বুক করে কেবল বসেছে সেই মুহূর্তে বীথি মোবাইল করল, জামাল মোবাইল রিসিভ করল।
অপর পাশ থেকে বীথির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল ভাই এসেছেন?
হ্যাঁ আমি এখন ঢাকায়? তুমি কোথায়?
আমি বাসা থেকে কলেজের কথা বলে বের হলাম। এখন বলুন কোথায় আপনার সঙ্গে দেখা করবো?
তুমি আমার হোটেলে চলে এসো তারপর হালকা কিছু খেয়ে এক সঙ্গে বের হবো বলে জামাল তার হোটেলের নাম ঠিকানা এবং রুম নাম্বার বলল।
বীথিকে আসার কথা বলেই জামাল তার কথা মনে মনে ভাবতে শুরু করেছে। এমনভাবে জামাল জুঁইকে এই হোটেলে এনেছিল। তাকে বাগে আনতে জামালের বেশ সময় লেগেছিল কিছুটা কৌশলও অবলম্বন করতে হয়েছিল কিন্তু বীথি খোলামেলা, উচ্চাভিলাষী এবং লোভী। হয়তবা বীথিকে বাগে আনতে তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হবে না।
হোটেলের রিসিপশনে ঢুকে বীথি জামালের নাম জিজ্ঞেস করল।
রিসিপশনিস্ট বলল, দু’শ এগারো নাম্বার রুমে যান প্লিজ।
বীথি বুঝতে পারল যে দ্বিতীয় তলার এগারো নম্বর রুম কিন্তু হোটেলের আভিজাত্য দেখে বীথি বিস্মিত হলো এবং দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে তাঁর পা যেন শিথিল হয়ে গেল। তার মনে হলো এখানে জামাল আছে তো? আমি কোন ভুল পথে যাচ্ছি না তো? ভাবতে ভাবতে ধীর পদে বিথী দু’শ এগার নাম্বার কক্ষে দরজা নক করল।
জামাল দরজা খুলে দিয়েই বলল, এসো বীথি, কোন অসুবিধা হয় নি তো।
না।
কেউ কিছু বলেছে?
না, আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম এখানকার চাকচিক্য আর আভিজাত্য দেখে, আপনাকে দেখার পর ভয় কেটে গেছে।
রুমের মধ্যে পাশাপাশি দু’টা সোফা আছে, জামাল সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল, বসো।
বীথি সোফায় বসল। জামাল বীথি পাশাপাশি সোফায় বসে বীথির একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল। বীথি নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার মৃদু চেষ্টা করল।
জামাল বলল, কিছু খাবে?
বীথি মাথা নেড়ে সায় দিল।
শুধু কফি দিতে বলি, বলে জামাল উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ইন্টারকমের মাধ্যমে কফির অর্ডার দিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কফি চলে এলো, দু’জনে কফি খেতে খেতে গল্প করল। জামাল বার বার করে বীথির দিকে তাকাচ্ছিল বীথি কফি খাওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, বার বার কী দেখছেন?
আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
বীথি কিছুটা লজ্জা পেল। জামাল বীথির সোফার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বীথির দু’হাতে হাত রেখে বলল, একবার আয়নার সামনে দাঁড়াও, বলে জামাল একরকম জোর করে বীথিকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল বীথি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, ছি: ছি: জামাল ভাই আপনি কী করছেন।
জামাল বীথিকে বুকের মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল।
বীথি বিনয়ের সাথে বলল, জামাল ভাই ছেড়ে দিন প্লিজ আমি তো আসছি শপিং করে তারপর-
জামাল বীথির মুখের দিকে তাকাল তার চোখে মুখে লজ্জা ও ভীতির একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। কিন্তু কোন ছলনা বা চতুরতার চিহ্ন নেই। জামাল বিথীর কানে ফিস ফিস করে কী যেন বলল তারপর সায় দিতেই জামাল বীথিকে ছেড়ে দিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি খুব ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে।

ইস্টার্ন প্লাজার চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে দু’জনে প্রথমে একটা মোবাইল ফোনের দোকানে গেল। বীথি কিছু বলল না, বীথির একটা হাত জামাল ধরে রেখেছে, জামাল ইচ্ছা করে ঘা ঘেঁষে হাঁটছে বীথিও বুঝতে পেরেছে জামাল তার সান্নিধ্য চায়, তার শরীরের একটু উষ্ণতা চায়। সে জন্যই হয়ত জামাল তাকে খুশি করতে চায়।
দোকানদার কয়েকটা মোবাইল সেট টেবিলের গ্লাসের উপর রাখল।
জামাল বীথিকে বলল, বীথি পছন্দ করো।
বীথি আমতা আমতা করে বলল, জামাল ভাই আসলে আপনার বাজেট-
জামাল বীথির কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, আসলে তোমার জন্য আমার বাজেটের অভাব নেই।
তবুও আপনি দেখুন, কারণ মোবাইল সেট সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই।
তারপর জামাল একটা সেট বীথির হাতে দিয়ে বলল, দেখতো এটা তোমার কেমন মনে হচ্ছে?
বীথি বলল, ভাইয়া এটার দাম অনেক, মোবাইল কথা বলার জন্য, শুধু কথা বলতে পারলেই তো হলো, এতকিছু ফাংশন থাকার তো প্রয়োজন নেই।
জামাল বীথির চোখে চোখ রেখে বলল, বীথি আমি জানতে চাচ্ছি তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?
বীথি মনে মনে খুব খুশি হলো। সে মিষ্টি হেসে মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল। তার মোবাইল সেটের সঙ্গে সিম কার্ড সেট করে নিয়ে বীথি প্রথমে জামালের মোবাইল নাম্বারে রিং দিল। জামাল একটু দুরে সরে গিয়ে মোবাইল রিসিভ করল।
বীথি বলল, ইউ আর সো গ্রেট।
মোবাইলের দোকান থেকে বেরিয়ে আবার দু’জনের হাত এক হয়ে গেল। জামাল বীথির গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বীথির কানে ফিস ফিস করে কি যেন বলতেই বীথির চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর সমস্ত মার্কেট ঘুরে বীথির জন্য অনেক কাপড়-চোপড় কসমেটিকস আরো অনেক কিছু কেনা হলো। শপিং করা শেষে দু’জনে হোটেলে ফিরল। হোটেলে ফিরে বীথি ব্যাগটা মেঝেতে রেখে ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল।
জামাল বলল, তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।
আচ্ছা, বলে বিথী টয়লেটে ঢুকলো। কয়েক মিনিট পরে খাবার চলে এলো। দু’জনে খেতে খেতে জামাল কয়েকবার বীথির দিকে তাকাল, নিজ হাতে বীথির প্লেটে খাবার তুলে দিল।
বীথি জামালের অতি উৎসাহী আচরণ আর লোলুপ দৃষ্টি বুঝতে না পেরে আপন মনে মাঝে মাঝে মৃদু হাসল।
জামাল জিজ্ঞেস করল, হাসছ কেন?
আমাকে এভাবে কেউ কোনদিন তুলে খাওয়ানি তো তাই।
জামাল মনে মনে বলল, আমিও কাউকে এমনভাবে তুলে খাওয়ানি তবে তোমাকে তুলে খাওয়ানোর পিছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
খাওয়া শেষ হলে বয় প্লেট গ্লাস নিয়ে চলে গেল। জামাল বীথির গা ঘেঁষে বসে বীথির দু’বাহুতে হাত রাখল। বীথির সমস্ত শরীর শিউরে উঠল।
বীথি অস্ফুট স্বরে বলল, ভাইয়া।
এতক্ষণে বীথি জামালের আসল রূপ দেখতে পেল। জামাল বলল, বীথি আজ আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছি তাই না?
বীথি মাথা বাকিয়ে সায় দিল।
আচ্ছা বীথি তোমার কি আর কিছু নেওয়ার ইচ্ছা ছিল যা হয়ত তুমি আমাকে বলতে পারোনি।
বিথী মাথা বাকিয়ে বলল, না, আসলে আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি যে আপনি আমার জন্য এতকিছু করবেন।
জামাল বীথির আরো গা ঘেঁষে বসল, আচ্ছা বীথি এখন আমি যদি তোমার কাছে কিছু চাই?
বীথি শুষ্ক কণ্ঠে বলল, আমার তো দেওয়ার কিছু নেই।
জামাল অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল, বীথি তোমার যা আছে তা অফুরন্ত, আমি তোমার কাছ থেকে সেই অফুরন্ত জলরাশি থেকে সামান্য কিছু আশা করছি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। জামালের শেষের কথাগুলো বীথির মনে করুণার সৃষ্টি হলো কিন্তু তবুও বীথি জামালের কথার সায় দিল না।
জামাল বলল, বীথি আমি তোমার অনেকগুলো ইচ্ছা পূরণ করলাম তুমি শুধু-
বীথি জামালের কথায় বাধা দিয়ে বলল, না ভাইয়া, না প্লিজ।
জামাল দু’হাতে বীথিকে জড়িয়ে ধরল, না বলো না, আমি অনেক আশা করে এসেছি।
বীথি নিজেকে জামালের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। জামাল বীথিকে একরকম জোর করেই বিছানায় নিয়ে গেল।
বীথি বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ালো।
মুহূর্তেই জামাল তার কথার সুর পাল্টালো। বীথি একটা কথা মনে রাখবে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় এটাই নিয়ম। তুমি শুধু নিবে কিছু দিবে না তা কী করে হয়? আমি তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছি, এখন তুমি আমাকে কিছু দাও।
বীথি প্রচণ্ড রেগে বলল, তাহলে আপনি আমাকে দেয়া জিনিস-পত্র ফেরত নিন, আমাকে যেতে দিন প্লিজ।
না তা হয় না, বলে জামাল বীথিকে জড়িয়ে ধরে জোরপূর্বক বিছানায় তুলে তার স্পর্শকাতর অঙ্গসমূহ দলিত মোথিত করল।
হয়ত এমনই হয় মেয়েরা প্রথমে নিজেকে ধরে রাখার, নিজের সম্মান, নিজের রূপ, লাবণ্য ধরে রাখার চেষ্টা করে তারপর নিজের অজান্তেই নিজেকে সমর্পণ করে। বীথিও একসময় নিজেকে জামালের কাছে সমর্পণ করল। তারপর অনেকক্ষণ চলল আদিম খেলা। বীথিও নতুনত্বের নেশায় মাতাল হয়ে গেল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউয়ের পর ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ শব্দে সমস্ত ঘরের চার দেয়ালে আছড়ে পড়ল। তারপর ক্লান্ত দেহ, এলোমেলো চুল, আর মুখের চুম্বনের চিহ্ন নিয়ে বীথি বাথরুমে ঢুকলো।
জামাল বীথির গা ঘেঁষে বসে বীথির গালে চুমু দিয়ে বলল, বীথি তুমি খুব সুন্দর, খুব রোমান্টিক, খুব মিষ্টি মেয়ে।
বীথি মুচকি হেসে জামালের বুকে মাথা রেখে বলল, আপনিও-

বিয়াল্লিশ

জামালের জীবনে রাজনীতি শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দলে থেকে। এখন বিরোধী দলে থেকে রাজনীতি করায় জামালের শুধু রাজনৈতিক, অবৈধ ও অনিয়মতান্ত্রিক সুবিধা প্রাপ্তি বন্ধ হয়নি ক্রমাগত ন্যায্যতা থেকেও সে বঞ্চিত হচ্ছে। বিরোধী দলে অবস্থানের পর থেকে জামাল বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে যত টেণ্ডারে অংশগ্রহণ করেছে বেশিরভাগ টেণ্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচিত হওয়ার পরও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইশারায় তাকে কাজ দেওয়া হয়নি ফলে দিনে দিনে জামালের ঠিকাদারি ব্যবসায় পতন শুরু হয়েছে। একের পর এক টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করতে করতে আর শিডিউল কিনে তার ঠিকাদারি ব্যবসা এক রকম গুটিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছে। জামাল লক্ষ্য করেছে দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অফিসের যেসব কর্তা ব্যক্তিরা জামালকে সমীহ করে কথা বলতেন সেসব অফিসের পিয়নও আজকাল জামালকে এড়িয়ে চলে। বিরোধী দলে অবস্থান করে জামাল আজ তিলে তিলে ক্ষমতার মর্ম অনুভব করছে।
শুধু ঠিকাদারি কাজকর্ম পাবার ব্যাপারেই নয় রাজনৈতিক মিটিং কিংবা মিছিলে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলা, মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলা একের পর এক চলছেই। ইতোমধ্যে মোস্তফা সাহেব ও বেলায়েত সাহেবসহ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তারা এখন হাজতে আছে। ভাগ্যক্রমে জামাল সেসময় ঢাকায় ছিল, তাই তাকে আসামি করা হয়নি। মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলার প্রতিবাদে এখনো মিছিল, মিটিং চলছে এবং মিছিল-মিটিংয়ের নেতৃত্বে জামালই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। অনেক সময় জামালের ভয় হয়, হয়ত সামনে তারই হাজত বাসের পালা।
অবশেষে জামালের আশঙ্কাই সত্যি হলো। একদিন জামাল মোস্তফা সাহেব ও বেলায়েত সাহেবের মুক্তির দাবিতে মিছিল চলাকালীন সময়ে হঠাৎ করেই মিছিলের উপর ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলা শুরু হলো। মুহূর্তেই মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জীবন বাঁচানোর জন্য সবাই ছুটাছুটি করে চলে গেল। জামাল কোনরকম পালিয়ে বাঁচলো। জামাল রিক্সায় চেপে সোজা বাসায় চলে গেল। জামালের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা আর তাকে হাঁপাতে দেখে অনন্যা জিজ্ঞেস করল, বসো, কী হয়েছে? এমন হাঁপাচ্ছ কেন?
জামাল চাপা স্বরে বলল, অনন্যা আস্তে কথা বলো, মা শুনতে পাবে।
অনন্যা জামালের পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, এক গ্লাস পানি দেবো।
দাও।
অনন্যা এক গ্লাস পানি জামালের হাতে এনে দিতেই জামাল এক ঢোকে পানি শেষ করে ফেলল।
অনন্যা জামালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কী হয়েছে? আমাকে বলো?
অনন্যা তুমি ওসব বুঝবে না, আমি যাই আমার ফিরতে দেরি হতে পারে, বলে জামাল অনন্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল।
ততক্ষণে সবাই পার্টি অফিসে এসেছে। সবার চোখে-মুখে ভীতি ও অনিশ্চয়তার ছাপ ফুটে উঠেছে। সভাপতি ও জেনারেল সেক্রেটারি জেলে, সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রচার সম্পাদকসহ দলের জুনিয়র নেতারা আন্দোলন পরিচালনা করছে। কেন্দ্রের নির্দেশ আন্দোলন চাঙ্গা করে এখান থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। জামাল জুনিয়র নেতাদের অন্যতম হলেও দলের কর্মসূচী হতে শুরু করে যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য অনেক সিনিয়র নেতাই তার মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। আজকেও পার্টি অফিসের সবাই বসার পর জামাল কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলল, তারপর পরবর্তী কর্মসূচী চূড়ান্ত করল। কর্মসূচী চূড়ান্ত করার পর কর্মীদের উদ্দেশ্যে একে একে বক্তৃতা শুরু করল। জামালও ইতোমধ্যে বক্তৃতায় বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। সে কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলল, উপস্থিত নির্যাতিত বন্ধুগণ আপনারা সবাই জানেন যে, আমাদের প্রিয় নেতা মোস্তফা ভাই এবং বেলায়েত ভাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখন জেল হাজতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমাদের প্রিয় নেতা এবং সারাদেশে নির্যাতিত কর্মীদের প্রতি জানাই গভীর সহানুভূতি ও আমার সশ্রদ্ধ সালাম। আপনারা জানেন এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেকগুণ বেড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশে একরকম নীরব দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা ফ্রি স্টাইলে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এ সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিরোধী কাজ কর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সারাদেশে আমাদের দলের শত শত নেতা কর্মী বিনা দোষে হাজতবাস করছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্য আমাদের দলের নেতা কর্মীদেরকে হত্যা ও নির্যাতনের হুমকিসহ হয়রানীমূলক মামলা করে হাজতবাস করাচ্ছে কিংবা নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য মামলার আসামি এরেস্ট ভয়ে আত্মগোপন করেছে। আপনারা সবাই জানেন মোস্তফা ভাই, বেলায়েত ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কোন অভিযোগ নেই। অথচ তাঁরা আজ হাজতে, তাঁদের মুক্তির জন্য আমরা ধারাবাহিকভাবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। আজ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা করেছে। তার মানে এই দাঁড়ায় যে, একটা গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। এটা হতে পারে না, এদেশের জন্য রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমাদের দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র দেশে এবং বিদেশে সুনাম অর্জন করেছিল আজ সে সুনাম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন দল জনগণের স্বাধীন মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করছে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অপচেষ্টা করছে। আমরা আমাদের নেতা মোস্তফা ভাই ও বেলায়েত ভাইয়ের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। আমি এখন মোস্তফা ভাই ও বেলায়েত ভাইয়ের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে তিন দিনের আন্দোলন কর্মসূচীর ঘোষণা করছি।
০১. আগামীকাল সকাল দশটায় মানব বন্ধন, বিকেলে পার্টি অফিসে আলোচনা সভা,
০২. দ্বিতীয় দিন বিক্ষোভ সমাবেশ,
০৩. তৃতীয় দিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল।
আমি আশা করি আপনারা সবাই এসব কর্মসূচীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহণ করবেন।
উপস্থিত সকল নেতা-কর্মী হাত তালি দিয়ে জামালের ঘোষণা দেয়া কর্মসূচীকে অভিনন্দন জানালো।
জামাল আবার বক্তৃতা দিতে শুরু করল। তিন দিনের মধ্যে মোস্তফা ভাই ও জামাল ভাইয়ের নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচীর ঘোষণা করবো। আপনারা ধৈর্য সহকারে আমার বক্তৃতা শুনেছেন, দলের কর্মসূচীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানিয়েছেন সেজন্য আপনাদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ, বলে জামাল তার বক্তৃতা শেষ করল।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে জামাল বাসার উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠছিল এমনসময় পুলিশের একটা পিক আপ ভ্যান রিক্সার সামনে এসে দাঁড়ালো। জামাল কোন কিছু বুঝার আগেই একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন, হ্যান্ডস আপ, ইউ আর আন্ডার এরেস্ট, তারপর একজন কনস্টেবলকে বললেন, এই হ্যান্ড কাপ পরাও।
জামালকে হ্যান্ড কাপ পরানোর পর জামাল জিজ্ঞেস করল, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ?
আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে।
দেখি ওয়ারেন্টের কাগজ।
পুলিশ অফিসার একটা কাগজ বের করে জামালের হাতে দিলেন।
জামাল আর কোন কথা না বলে নিজেই পুলিশ ভ্যানে গিয়ে উঠল।

তেতাল্লিশ

জামাল গভীর রাতে বাসায় ফিরে। স্বামীর অপেক্ষায় অনন্যা ততক্ষণ জেগে থাকে জামাল বাসায় ফিরলে এক সঙ্গে রাতের খাবার খায়। এ নিয়ে জামাল দু’একবার বকাবকিও করেছে এবং অনন্যাকে সময়মত খেয়ে নিতে বলেছে কিন্তু অনন্যা কোনদিন একা রাতের খাবার খায়নি। অনন্যা বিছনায় শুয়ে জামালের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মাঝে হাত বাড়িয়ে জামালকে না পেয়ে চমকে উঠল। অনন্যা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত তিনটা বাজে জামাল বাসায় ফিরার সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল। জামাল তো এখনো কোনদিন বাসার বাইরে রাত কাটায়নি। অনন্যা কী করবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না পাশের রুমে তার শ্বশুর-শাশুড়ি জানে না জামাল বাসায় ফিরেছে কী না। তাদের জানানো ঠিক হবে কী না। অনন্যা শেষ পর্যন্ত কাউকে জানালো না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
অনন্যার ঘুম ভাঙ্গল তার শাশুড়ির ডাকে। দরজা খুলে বের হতেই ফাহমিদা চমকে উঠলেন, বউমা তুমি ঘুমাওনি? তোমাকে তো কোনদিন ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয় না।
অনন্যা অস্ফুট স্বরে বলল, মা।
হ্যাঁ বউমা বলো কী হয়েছে? জামাল কিছু বলেছে?
মা ও রাতে বাসায় ফিরে নি।
রাতে বাসায় ফিরেনি! তোমাকে বলে যায়নি? ওতো কোনদিন বাসার বাইরে রাত কাটায়নি। আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার শ্বশুরকে বলে দেখি কী করা যায়?
ফাহমিদা তার রুমে গিয়ে জহির সাহেবকে বললেন, শুনছ।
জহির সাহেব যেমনভাবে ছিলেন তেমনিভাবে বললেন, হ্যাঁ বলো?
জামাল রাতে বাসায় ফিরেনি।
জহির সাহেব চমকে উঠলেন, বাসায় ফিরেনি মানে। বউমাকে বলে যায়নি?
না।
আমার মোবাইলটা দাও, দেখি কোথায় গেছে?
জহির সাহেব জামালের মোবাইলে রিং করলেন। কিন্তু মোবাইল বন্ধ দেখে বললেন, মোবাইল তো বন্ধ, এখন কীভাবে খুঁজি বলো তো। ওর ইঞ্জিনিয়ারের মোবাইলও বন্ধ। মোস্তফা, বেলায়েত ওরাও তো হাজতে বলে জহির সাহেব চেয়ারে বসে পড়লেন।
হকার পেপার দিয়ে গেল। জহির সাহেব পেপারটা হাতে নিয়ে বুকে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় জামালের ছবি ছাপানো হয়েছে। ছবির নীচে বড় বড় করে লিখা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গ্রেফতার। জহির সাহেব নিউজটা পড়েই আর পেপার পড়লেন না। ফাহমিদাকে বললেন, ফাহমিদা ভিতরে এসো বউমাকে ডাকো।
ফাহমিদা ও অনন্যা ঘরে ঢুকলো। ফাহমিদা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন, বউমা তুমিও শোন একটা দুঃসংবাদ আছে। শোনার পর কান্নাকাটি করবে না। ভেঙ্গে পড়বে না মনে রাখবে এটা খুব সাধারণ ঘটনা।
ফাহমিদা উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, কেন কী হয়েছে?
জামালকে পুলিশ এরেস্ট করেছে।
জহির সাহেবের বলা শেষ হওয়ামাত্র ফাহমিদা এবং অনন্যা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। জহির সাহেব ধমকের সুরে বললেন, সেজন্য তো আগেই বললাম কান্নাকাটি করবে না। চুপ করো। আমি থানায় গিয়ে দেখি কী করা যায়, বলে জহির সাহেব বেরিয়ে পড়লেন।
জহির সাহেব থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে সালাম দিলেন। পুলিশ অফিসার মুখ তুলে তাকাতেই দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন, চাচা বসুন।
জহির সাহেব বললেন, আমি একবার ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
স্যান্ট্রি চাচাকে ওসি সাহেবের কাছে নিয়ে যাও তো।
ওসি সাহেব জহির সাহেবকে সালাম দিয়ে বসতে বললেন। জহির সাহেব বললেন, ওসি সাহেব জামালকে এরেস্ট করেছেন কেন?
চাচা বসুন, বলে ওসি সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিয়ে বললেন, স্যান্ট্রি চা নিয়ে এসো।
স্যান্ট্রি চলে গেলে ওসি সাহেব বললেন, প্রতিপক্ষের মিছিলে হামলা-ভাংচুর, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন সৃষ্টি এবং জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি বাদী হয়ে জামাল সাহেবসহ আরো চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে।
জহির সাহেব বললেন, ওসি সাহেব আপনি বলুন, আপনি তো আমাকে চেনেন, জামালকেও চেনেন সত্যি করে বলুন তো জামাল কি দোকান ভাংচুর করেছে? আমি চেম্বার অফ কমার্সের একজন পরিচালক শহরে দোকান ভাংচুর হলো, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে না হোক চেম্বার অফ কমার্সের পরিচালক হিসাবেও কেউ তো আমাকে জানালো না। কোন দোকান ভাংচুর হলে চেম্বার অফ কমার্সে জানানোর কথা কিন্তু কেউ তো আমার কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে আসেনি? আসলে বলুন তো কার দোকান ভাংচুর হয়েছে?
ওসি সাহেব কোন কথা বললেন না।
তারমানে কোন দোকান ভাংচুর হয়েছে তা আপনিও জানেন না?
দেখুন কেসটা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে, একজন সাব-ইন্সপেক্টর তদন্ত করছেন। আমরা আসামি এরেস্ট করেছি, আজ কোর্টে চালান দিব। জামাল সাহেব যদি নির্দোষ হন তবে বেরিয়ে আসবেন।
জহির সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে তাহলে আমাকে একটা আর্জির কপি দিন।
ওসি সাহেব স্যান্ট্রিকে ডেকে বললেন এস.আই মামুনের কাছ থেকে কালকের ভাংচুর কেসটার একটা আর্জির কপি নিয়ে এসো তো।
জহির সাহেব রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি কি জামালের সঙ্গে দেখা করতে পারি?
জি অবশ্যই, চলুন, বলে ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে হাজত খানার দিকে গেলেন।
জামাল তখন মেঝেতে বসে ছিল তার বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাবা তুমি!
হ্যাঁ মান-সম্মান আর রাখলে কই?
জামাল বিনয়ের সুরে বলল, বাবা তুমি বিশ্বাস করো আমি কোন দোষ করিনি। আসলে প্রতিপক্ষের মিছিলে হামলা, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক, আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
জহির সাহেবের দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, আমি সব বুঝতে পেরেছি বাবা, আমি আগে তোর জামিনের ব্যবস্থা করি। তুই ভেঙ্গে পড়িস না বাবা, বলে জহির সাহেব চোখ মুছতে মুছতে জামালের কাছ থেকে এসে ওসি সাহেবের চেম্বারে ঢুকলেন। ততক্ষণে স্যান্ট্রি চা নিয়ে এসেছে, আর্জির কপিও ওসি সাহেবের টেবিলে দেখে বললেন, ওসি সাহেব আর্জির কপিটা আমাকে দিন।
জি, প্লিজ বলে ওসি সাহেব আর্জির একটা কপি জহির সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন, চা নিন প্লিজ।
জহির সাহেব চা শেষ করে থানা থেকে বের হলেন।
মোজাহার সাহেব সিনিয়র উকিল, অনেক জটিল মামলায় তিনি তার মক্কেলকে জয়ী করার মাধ্যমে উকিল হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন এবং প্রশংসিতও হয়েছেন। মোজাহার সাহেব জহির সাহেবের বাল্যবন্ধু কিন্তু জহির সাহেব কখনো মামলা মোকদ্দমার শিকার না হওয়ায় কোনদিন মোজাহার সাহেবের কাছে যাবার প্রয়োজন হয়নি। তাই মোজাহার সাহেব জহির সাহেবকে দেখে কিছুটা অবাক হলেন, বন্ধু আমার কাছে কী মনে করে? তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?
জহির সাহেব মলিন মুখে বললেন, মোজাহার গতকাল পুলিশ জামালকে এরেস্ট করেছে।
হ্যাঁ আজ পেপারে পড়লাম।
আমি তো জীবনে কোনদিন মামলা মোকদ্দমায় জড়াইনি আমি এসবের কিছু বুঝিও না।
তোমার কিছু বুঝতে হবে না, আমি দেখছি কী করা যায়? তুমি থানা থেকে আর্জির কপি এনেছ?
জহির সাহেব পকেট থেকে আর্জির কপি বের করে দিলেন।
মোজাহার সাহেব মনোযোগ দিয়ে পড়ে বললেন, তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমি প্রথমে জামিনের জন্য মুভ করবো, ইনশাল্লাহ্‌ জামিন হয়ে যাবে?
কিন্তু যদি জামিন না হয়?
জামিন না হলে হাই কোর্ট থেকে জামিনের চেষ্টা করতে হবে। তুমি কিছু চিন্তা করো না।
দেখ ভাই ওর মা, আমার বউমা সবাই খুব ভেঙ্গে পড়েছে আমি নিজেও খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
মোজাহার সাহেব বললেন, চিন্তা করো না, আমি তো আছি।

চুয়াল্লিশ

জামালের ধারণা ছিল তাকে দেখে মোস্তফা সাহেব ও বেলায়েত সাহেব খুব কষ্ট পাবেন কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই মোস্তফা সাহেব জামালকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন, আরে জামাল এসো ইয়াং লিডার বাইরের খবর কী বলো?
জামাল অবাক হয়ে বলল, বড়ভাই আমি হাজতে এলাম আর আপনি হাসছেন?
আরে হাসবো না তো কী করবো? তুমি শুধু হাসিটাই দেখলে তোমাকে যে আমি আজ লিডার বলে ডেকেছি সেটা বুঝলে না।
না বুঝতে পারিনি।
মানে দু’একবার এরকম হাজত না খাটলে কখনো বড় লিডার হওয়া যায় না, তাই তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি একদিন বড় লিডার হবে। যাক এখন বাইরের খবর বলো।
বড়ভাই আসলে দেশের সার্বিক অবস্থা ভালো না। আমাদের শহরের অবস্থা তো আরো খারাপ। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি তো আছেই তাছাড়া বড় বড় কাজের ঠিকাদারি সব এখন তাদের হাতে। সবকিছুতেই দলীয়করণ। আমরাও একসময় ক্ষমতায় ছিলাম কিন্তু আপনারা তো এমন করেননি। কিন্তু আমরা এখন বিরোধী দল আমাদের উপর অত্যাচার, ভীতি প্রদর্শন এবং হয়রানীমূলক মামলা এসব চালানো হচ্ছে। এই তো সেদিনের কথা আমরা আপনাদের মুক্তির জন্য ধারাবাহিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছিলাম। গতকাল ছিল মিছিল। ব্যাস আমাদের মিছিলের উপর হঠাৎ শুরু হলো হামলা। যে যার মতো ছুটে পালালো। মিটিং শেষে আমরা আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করে পার্টি অফিস থেকে বের হওয়ামাত্র পুলিশ আমাকে এরেস্ট করে নিয়ে এলো, বলতে বলতে জামালের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
মোস্তফা সাহেব জামালের বাহুতে হাত রেখে বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই ইয়াংম্যান। কিছু হবে না, এই দু’চারদিন হাজতে থাকা আর কী? হাই কোর্ট থেকে আমাদের জামিনের জন্য চেষ্টা চলছে হয়ত শীঘ্রই জামিনে বেরিয়ে যাবো। আমরা বেরিয়ে গিয়ে তোমার মুক্তির জন্য আন্দোলন করবো। ফলে নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসাবে তোমার নাম সবার মনের মধ্যে গেঁথে যাবে, যে কোন নির্বাচনে তুমি ভোটারদের সহানুভূতি পাবে। আর এরেস্ট হওয়া মানেই অপরাধী নয়, সবাই জানে রাজনৈতিক মামলার বেশিরভাগই হয়রানীমূলক। রাজনৈতিক মামলায় এরেস্ট হলে মান হানি হয় না। বরং মিথ্যা মামলায় হাজত বাসের কারণ রাজনৈতিক জীবনে সফল হওয়া যায়।
জামাল মোস্তফা সাহেবের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলো। সে অস্ফুট স্বরে বলল, মোস্তফা ভাই।
হ্যাঁ জামাল সারাজীবনে তো এখানে মরে পচবো না, বাংলাদেশ জন দরদী পার্টিও সারাজীবন ক্ষমতায় থাকবে না। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। আর দু’বছর পরই সরকার হটাও আন্দোলন শুরু হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন সম্ভব না হলেও আগামী তিন বছর পর সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হলে তখন তো নির্বাচন হবে। নির্বাচনে আগামীতে আমাদের দল ক্ষমতায় আসবে। সাহসী কর্মী এবং তোমার মতো জনপ্রিয় যুব নেতা আর বেলায়েতের মতো সহকর্মী পেলে ইনশাল্লাহ আমি এম.পি নির্বাচিত হবো। পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে আমি এম.পি নির্বাচিত হলেই মন্ত্রিত্ব পাবো। মন্ত্রিত্ব মানে বিরল সম্মান, সামনে পিছনে পুলিশের গাড়ি, সরকারি সিকিউরিটি, সরকারি গাড়িতে পতপত করে উড়বে ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, বলতে বলতে মোস্তফা সাহেব উদাস হয়ে গেলেন।
জামাল বলল, বড়ভাই।
মোস্তফা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আর তুমি। আমি মন্ত্রী হওয়া মানে তুমি কি সেকথা অনুমান করেছ?
জামাল না বোধক মাথা ঝাকালো।
মোস্তফা সাহেব বললেন, আমি কি তোমার কোন কথা ফেলতে পারবো? আমি তো থাকবো ঢাকায়, তখন পুরো জেলায় ক্ষমতাসীন দলের লিডার হবে তুমি। আজ যারা তোমাকে দেখে নাক ছিটকায় সেদিন তারা তোমাকে দেখে স্যালুট দিবে। যে অফিসে টেন্ডার দিয়ে তুমি কাজ পাও না সেই অফিসের কাজ তুমিই ভাগ করবে। তুমি কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করবে, অল্প দিনের মধ্যে তুমি কোটিপতি হয়ে যাবে। নেপথ্যে তুমি হবে সমস্ত জেলার লর্ড।
অনেক কষ্টের মাঝে জামাল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, বড়ভাই যেভাবে বলছেন তাতে মনে হয় আপনি মন্ত্রী হয়ে গেলেন আর আমিও জেলার লর্ড হয়ে গেলাম।
যেভাবে বলছি ঠিক সেভাবেই, নির্বাচনে জিততে পারলে আর কোন বাধা নেই এখন কাজ হলো আন্দোলন চাঙ্গা করা, জনগণের মাঝে সরকার বিরোধী মনোভাব তৈরি করা।
কিন্তু বড়ভাই আপনি, বেলায়েত ভাই এবং আমি সবাই তো এখানে আন্দোলন করবে কে?
আমাদের জামিনের ব্যবস্থা হচ্ছে খুব শীঘ্রই, বেলায়েত আর আমার জামিন হবে। আমরা জামিন পেলেই তোমার মুক্তির জন্য আন্দোলন করবো। তোমার যত তাড়াতাড়ি জামিনের ব্যবস্থা করা যায় সে ব্যবস্থা করবো। তুমি কিছু ভেবো না। পলিটিকাল কেস এ সাধারণত কোন জেল-জরিমানা হয় না।
বড়ভাই বেলায়েত ভাইকে যে দেখছি না।
বেলায়েত অন্য ব্যারাকে আছে ওর সঙ্গে তোমার কোনদিন দেখা হবে না। ভাগ্যক্রমে তোমার আর আমার থাকার ব্যবস্থা একই ব্যারাকে হয়েছে তাই হয়ত তোমার সঙ্গে অনেক কথা হলো।
এমন সময় ঘণ্টা বেজে উঠল। দু’জনে জেল খানার মাঠ থেকে ব্যারাকে গিয়ে ঢুকলো।
কয়েকদিনের মধ্যে মোস্তফা সাহেব ও বেলায়েত সাহেব জামিনে বেরিয়ে গেলেন। জামাল একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল।
কয়েকদিন আগে জামালের বাবা, মা ও অনন্যা জামালকে দেখতে এসেছিল। জহির সাহেব জামালকে তার জামিনের ব্যাপারে তার প্রচেষ্টার কথা জানালেন এবং শীঘ্রই জামিন হবে বলে জামালকে আশ্বস্ত করলেন। ফাহমিদা গ্রিলের বাইরে থেকে জামালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুই খুব শুকিয়ে গেছিস বাবা, তোর জামিনের জন্য আমি তোর বাবাকে বলেছি। তোর বাবা ঢাকা গিয়ে বড় ব্যারিস্টারের সঙ্গে আলাপ করে এসেছে কাল আবার যাবে, তুই কিছু ভাবিস না বাবা। এবার জেল থেকে বের হলে আমি তোকে আর রাজনীতি করতে দিবো না। তুই শুধু তোর বাবার ব্যবসা দেখবি। তোর পাহাড়ের সমান টাকারও প্রয়োজন নেই আর মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ারও প্রয়োজন নেই। আমি তোকে সবসময় আমার চোখে চোখে রাখবো বাবা, বলতে বলতে ফাহমিদার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল।
জামালের গণ্ডদেশ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে চোখ মুছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি দোয়া করিও মা আমি যেন তাড়াতাড়ি মুক্তি পাই।
আমি দোয়া করছি বাবা তুই তাড়াতাড়ি আমার কোলে ফিরে আসবি।
অনন্যার চোখে পানি নেই, শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জামালও অনেকক্ষণ অনন্যার চোখে চোখ রাখল তার দৃষ্টিতে যেন বেদনা ও হৃদয়ে হাহাকার। জামাল অনন্যার চোখের দৃষ্টি, মনের অবস্থা ও ভালোবাসা কোনদিন বুঝবার চেষ্টাও করেনি। আজ অনন্যার চোখে চোখ রেখে জামাল যেন অনন্যাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল। অনন্যাও কিছু বলল না। শুধু জামালের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। যাবার সময় গ্রিলের কাছাকাছি এসে অস্ফুট স্বরে বলল, ভালো থাকো।
জামাল বলল, তুমি ভালো থাকো আমার জন্য চিন্তা করবে না।
মোস্তফা সাহেব ও বেলায়েত সাহেব জেল থেকে বেরিয়েই জামালের মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। শহরের দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে গেল জামালের ছবি সম্বলিত পোষ্টার, “জামাল ভাইয়ের মুক্তি চাই, জামাল ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা তুলে নাও, নিতে হবে।” প্রায় দিনই জামাল মুক্তি আন্দোলনের নিউজ পেপারে ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকল। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জামালের পরিচিতি একজন যুব সংগঠনের নেতা থেকে বলিষ্ঠ নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। যারা জামালের নামটাও জানতো না তারাও জামালকে একজন জনপ্রিয় নেতা হিসাবে জানাল। অনেক অপরাধের হোতা হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ জনগণের মনেই জামালের জন্য সহানুভূতি স্থান পেল।
প্রায় দু’মাস পর জামাল জামিন লাভ করল, জেলখানার গেটে পুষ্পাঞ্জলি ও ফুলের মালা নিয়ে কর্মীরা অপেক্ষা করতে থাকল তাদের প্রিয় নেতা জামালের অপেক্ষায়। জামাল জেলখানার গেট থেকে বেরিয়ে আসতেই মোস্তফা সাহেব, বেলায়েত সাহেবসহ অসংখ্য নেতাকর্মী তাকে গেট থেকে পার্টি অফিসে নিয়ে গেল। মুহূর্তেই জামালের দীর্ঘদিনের হাজত বাসের কষ্ট মন থেকে মুছে গেল বরং হাজত বাসের কষ্টের চেয়ে আজকের বিরল সম্মান তার জীবনে স্মরণীয় হয়ে রইল।
জামালের মুক্তি উপলক্ষে পার্টি অফিসে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাদের উপর ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতন ও বঞ্চনার নির্মম কাহিনী তুলে ধরল। জামাল তার উপর হয়রানীমূলক মামলার কথা বলল এবং হাজতে তার কষ্টকর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিল। আজ জামালের মোস্তফা সাহেবের কথা মনে পড়ল। জেলখানায় বসে মোস্তফা সাহেব বলেছিলেন, “দু’একবার জেল-হাজত না খাটলে বড় নেতা হওয়া যায় না।” জেল থেকে বেরিয়েই দেখবে তুমি রাতারাতি বড় নেতা হয়ে গেছ। আজ নেতা-কর্মীদের দেয়া বিরল সম্মান ও স্বতঃস্ফুর্ততা দেখে জামালের মনে হলো সে সত্যি সত্যি রাজনীতিতে হঠাৎ করেই কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষে জেলা পর্যায়ের দু’একজন নেতৃবৃন্দ ছাড়া সবাই চলে গেল।
মোস্তফা সাহেব জামালের পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, জামাল বলছিলাম না দু’একবার জেলা-হাজত না খাটলে বড় নেতা হওয়া যায় না। আজ বুঝলে তুমি কত বড় নেতা হয়ে গেছ? আমি তোমার মধ্যে যে মনোবল, দলের প্রতি আনুগত্য, বক্তৃতা দেওযার ধরণ দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে তুমি একদিন বড় নেতা হবে। ভালোভাবে কাজ করো পুলিশ, জেল, জরিমানা এসব কোন বিষয়ই না। দলের জন্য কাজ করো, তাতে যদি তোমার হাজত না জেলও হয়ে যায় তবে দল ক্ষমতায় গেলে তোমাকে জেল থেকে মুক্তি দিবে।
জামাল যেন চমকে উঠল, বড়ভাই দল কি জেল থেকে মুক্তি দিতে পারে?
হ্যাঁ পারে না কেন? আমার কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সামনে সরকার হঠাও আন্দোলন, মরণ পণ লড়াই করতে হবে। রক্ত দিতে হবে, জুলুমবাজ সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেয়া যাবে না। আর আন্দোলন করতে গিয়ে যদি কারো জেল হয় তবে দল ক্ষমতায় গেলে তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তি দিবে।
জামাল অনেকটা আশঙ্কা মুক্ত হলো। তার চোখে-মুখে একটা একটা তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল।
মোস্তফা সাহেব বললেন, সরকারের মেয়াদ দু’বছরেরও বেশি অতিক্রম করল। কেন্দ্রের নির্দেশ আসবে শীঘ্রই সরকার হঠানোর আন্দোলন। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে হঠাতে পারলে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে আর সরকার পূর্ণ মেয়াদ শেষে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে নির্বাচনে জয়ী হতে বেশ কষ্ট পেতে হবে। কাজেই বুঝতেই পাচ্ছ সরকার হঠাও আন্দোলনের বিকল্প নেই।
জামাল বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না বড় ভাই কেন্দ্রের কর্মসূচী পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।
জামালের কথা শুনে বেলায়েত সাহেব একবার আড়চোখে তার দিকে তাকালেন, তার চোখে-মুখে ক্রোধ আর হিংসার চিহ্ন ফুটে উঠল। জামাল বুঝতে পারল তাকে বেলায়েত সাহেব সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। বেলায়েত সাহেব হয়ত অনুমান করছেন একদিন এই জামালই তার সেক্রেটারির পদ দখল করবে। একদিন জামালই তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।
মোস্তফা সাহেব জামালকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন বেলায়েত সাহেব বললেন, বড়ভাই জামাল অনেক দিন পর মুক্তি পেয়েছে এখনো-
ওহ্‌ তাইতো আমি তো এক রকম ভুলেই গেছিলাম।
জামাল ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে বেলায়েত সাহেবের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, বাঃ আমার জন্য বেলায়েত ভাইয়ের দরদ উতলে উঠেছে, শালা আসলে মোস্তফা ভাই’র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারছে না। আমিও দেখি কিভাবে তোমাকে সাইজ করতে হয়?
জামাল মোস্তফা সাহেবকে বলল, বড়ভাই আমি আজকের মতো আসি, তারপর সবার সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে বেরিয়ে গেল।
জামাল বেরিয়ে যাবার পর বেলায়েত সাহেব বললেন, বড়ভাই জামালকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া মনে হয় আপনার ঠিক হচ্ছে না।
মোস্তফা সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বেলায়েত সামনে আন্দোলন এখন তরুণ নেতাদের এগিয়ে দিতে হবে। তা না হলে আন্দোলন বিফলে যাবে, আমরা এবারো এ সিটটা হারাবো। তখন দেখা যাবে দল ক্ষমতায় গেল আর আমরাও গতবারের মতো আসনটা হারালাম। তখন আমাদের সম্মান যাবে কোথায়? এসব কিছু মনে করবে না, মনে রাখবে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। সামনে কে এগিয়ে গেল সেটা বড় কথা নয়, দলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটাতে হবে এবং ক্ষমতায় যেতে হবে। এখন নিজেদের মধ্যে দলাদলি করার সময় নয়, সবাই এক সাথে কাজ করার সময়।
সবাই মোস্তফা সাহেবের বক্তব্যকে সমর্থন জানালো।
বেলায়েত সাহেব বললেন, সরি বড় ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। তারপর মনে মনে বললেন, সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু আমি ভাবছি আমার কথা, সামনের কাউন্সিলে যদি জামাল সেক্রেটারি পদে প্রার্থী হয় তবে আমার কী হবে?
বেলায়েত সাহেবকে চুপ করে থাকতে দেখে মোস্তফা সাহেব বললেন, বেলায়েত কী ভাবছ?
বেলায়েত সাহেব চমকে উঠলেন, কিছু না।

পঁয়তাল্লিশ

অনন্যা ও ফাহমিদা খাবার নিয়ে জামালের জন্য অপেক্ষা করছিল। জামালের মুক্তির কথা জেনে জহির সাহেব আজ কোথাও বের হননি। জামাল এরেস্ট হওয়ার পর থেকে জহির সাহেবকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে জামালের খবর কী? কবে জেল থেকে বের হচ্ছে? কথা শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তাই বেশির ভাগ সময় কেউ জামালের কথা জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। ছেলের জন্য কারো কাছ থেকে এ ধরণের কথার জবাব দিতে তিনি বেশ বিব্রত বোধ করেন।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামায় তিনি একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তিনি জামালের আসার অপেক্ষায় ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। বাসার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতে দেখে জহির সাহেব জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, জামাল গাড়ি থেকে নামল।
তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বললেন, ফাহমিদা, বউমা জামাল এসেছে।
জামাল বাসায় ঢুকে প্রথমে তার বাবাকে সালাম দিল।
জহির সাহেব সালামের জবাব দিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতেই তাঁর বুক হাহাকার করে উঠল। ফাহমিদা জামালকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। জহির সাহেবেরও বুক ফেটে কান্না আসছিল। কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ফাহমিদা কান্নাকাটি করোও না, এতদিন পর ছেলেটা এলো আগে গোসল করে খেতে দাও। বিশ্রাম নিতে দাও তারপর সবকিছু শুনবে।
জামাল একবার অনন্যার মুখের দিকে তাকাল। অনন্যার গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। জামাল তার রুমে গিয়ে ঢুকলো। পিছনে পিছনে অনন্যা রুমে ঢুকলো। অনন্যার মুখে কোন কথা নেই নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
জামাল জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ?
অনন্যা চোখের পানি মুছে বলল, তুমি খুব শুকিয়ে গেছ? চোখ দু’টা বসে গেছে। তোমার খুব কষ্ট হয়েছে, না?
জামাল এ’কথার কোন উত্তর দিতে পারল না, সে নীরবে বসে রইল।
অনন্যা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আগে গোসল করে ভাত খাও, বিশ্রাম নাও তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
জামাল গোসল করে ডাইনিং টেবিলে ভাত খেতে বসল। অনন্যা দাঁড়িয়ে জামালের প্লেটে খাবার তুলে দিল। জামাল খাওয়া সেরে কাপড়-চোপড় পরছিল এমনসময় অনন্যা জিজ্ঞেস করল, কাপড় পরছ?
জামাল খুব সহজভাবে বলল, হুঁম।
এতদিন পর বাসায় এলে তোমার আজ আর না বের হলে হয় না?
জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কেবল রাত আটটা বাজে এখনি বাসায় ঢুকবো? একবার অফিস থেকে ঘুরে আসি।
অনন্যা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, আমি তোমার স্ত্রী আমার একটা অনুরোধ রাখ। আজ রাতে আর বাইরে যেও না।
জামাল অনন্যার কথার কোনরূপ কর্ণপাত না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
জামালকে বের হতে দেখে জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?
জামাল বলল, বাবা একবার অফিস থেকে ফিরে আসি।
জহির সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন, না তুই আজ কোথাও যাবি না, তুই আয় আমার সঙ্গে ড্রয়িং রুমে তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
জামাল তার বাবার সঙ্গে ড্রয়িং রুমে গেল। পিছনে পিছনে ফাহমিদাও ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসলেন। দরজার আড়ালে অনন্যা দাঁড়িয়ে রইল।
জহির সাহেব বললেন, জামাল তুই আমাদের একমাত্র সন্তান, শৈশব থেকে আমরা তোকে অধিক স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করেছি। আমাদের শাসনে দুর্বলতা থাকার কারণে হয়তবা তোকে লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। তারপর তুই ব্যবসা শুরু করলি। বেশ ভালোই চলছিল, তোর ব্যবসার পলিসি দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। দিন দিন তোর উন্নতি আমার খুব ভালো লেগেছিল, গর্বে আমার বুকটা ভরে গিয়েছিল। কিন্তু তোর ঐ রাজনীতিটা প্রথম থেকেই আমার পছন্দ না। রাজনীতি করতে গিয়ে তোকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, বিনা দোষে তোকে হাজত খাটতে হলো। আমাদের যে কী কষ্টে দিন গেছে সেটা আমরা বুঝি? নিজের একমাত্র ছেলেকে জেলে রেখে তোর মা আর আমি কোনদিন ভালোমতো ঘুমাতে পারিনি। তুই বাবা হলে বুঝতিস আমাদের কত কষ্ট গেছে, বউমাও অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছে সবসময় মুখ কালো করে বসে থাকত। দু’মাস আমরা বউমাকে হাসতে দেখিনি।
জামাল বলল, বাবা আমি আগে বাইরে থেকে আসি।
জহির সাহেব রেগে গেলেন, আগে বাইরে থেকে আসবি কেন? আগে আমার কথা শুনবি তারপর বাইরে যাবি। তোকে আর রাজনীতি করতে হবে না। ব্যবসা করবি তো শুধু ব্যবসাই করবি রাজনীতি করতে পারবি না।
জামাল অস্ফুট স্বরে বলল, বাবা।
হ্যাঁ আমি সারাজীবন ব্যবসা করলাম কোনদিন রাজনীতি করি নি, আমি কি সংসার চালাই নি? আমার কী নেই? গাড়ি-বাড়ি, ব্যবসা সব আছে, আমি চাই তুই শুধু ব্যবসা করবি, নিরিবিলি, শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করবি। বেশি ধনী হওয়ার আশা করার দরকার নেই আর রাজনীতি করারও দরকার নেই।
কিন্তু বাবা রাজনীতি যে আমার ছোটবেলার নেশা, আমি অল্প বয়সে রাজনীতিতে অনেকদূর এগিয়েছি। এখন আমি শুধু ছাত্রনেতাই নই, মূল দলের ডিসট্রিক্ট লিডার। আপনার দোয়ায় আগামী কাউন্সিলে আমি দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জেনারেল সেক্রেটারি হয়ে লাভ কি?
বাবা তুমি বুঝতে পাচ্ছ না, আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক দল ক্ষমতায় আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মোস্তফা ভাই মন্ত্রী হবে, মোস্তফা ভাই যদি মন্ত্রী হয় আর আমি যদি ক্ষমতাসীন দলের জেলা সেক্রেটারি হই তবে তিনি কি আমার কোন দাবি না মেনে কাজ করতে পারবেন? জেলার সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজের ভাগ বাটোয়ারার নেপথ্যে থাকব আমি। নেপথ্য থেকে আমার নির্দেশে সব পরিচালিত হবে। শুধু কী তাই ইনশাল্লাহ মোস্তফা ভাইর পরে জেলার নেতৃত্ব আসবে আমার হাতে। তারমানে পরবর্তীতে আবার দল ক্ষমতায় আসলে আমি মন্ত্রী হব। তুমি বল শুধু ব্যবসা করে কি এটা সম্ভব? বাবা রাজনীতি আমার জীবনে সাফল্য এনে দিতে পারে। তুমি আমাকে নিষেধ করো না প্লিজ।
ফাহমিদা কান্না ভাঙ্গা গলায় বললেন, না বাবা না তোকে আমি রাজনীতিতে যেতে দেব না রাজনীতিতে যেমন মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি সারাজীবন জেলের ঘানি টানার ভয় আছে। মিছিল মিটিংয়ে গিয়ে গুলি লেগে মরার ভয়ও আছে। আমি তোকে হারাতে চাই না বাবা।
মা রাজনীতিতে জেল জুলুম আছে একথা সত্য কিন্তু রাজনীতিবিদরা কখনো জেলে পচে না, কোন না কোনভাবে বেরিয়ে আসে, নেতারা কখনো গুলিতে মরে না, মরে কর্মী-সমর্থকরা আমি এখন নেতা মা। তুমি হয়ত জানো না দু’একবার জেল হাজতে না গেলে নেতা হওয়া যায় না।
ফাহমিদা আর কোন কিছু বললেন না, দু’চোখ মুছে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জহির সাহেব বুঝতে পারলেন জামাল বড় হয়েছে সে নিজেই এখন তার ভালোমন্দ বুঝে। তাছাড়া শৈশব থেকে তিনি যতবারই কোন বিষয়ে তাকে বুঝাতে চেয়েছেন কোন বারই কোন লাভ হয়নি আর এখন তো জামাল বড় হয়েছে। ব্যবসা করে, রাজনীতি করে। কোন কোন ক্ষেত্রে সে জহির সাহেবকেও অতিক্রম করেছে। জহির সাহেব মুখে কিছু বললেন না মনে মনে বললেন, আল্লাহ তুমি ওকে হেফাজত করো, ওর মনের সব ইচ্ছাগুলি পূরণ করো।
জামাল সোফা থেকে উঠল, বাবা আমি এখন আসি।
জামাল বের হয়ে গেল। জহির
সাহেব কিছু বললেন না।
ফাহমিদা রাগান্বিত স্বরে বললেন, তুমি ওকে বুঝাতে পারলে না, শাসন করতেও পারলে না।
জহির সাহেব বললেন, ও এখন বড় হয়েছে নিজের ভালোমন্দ নিজেই বুঝবে, শাসন করার কথা বলছ? শাসন করার কথা ছিল তোমার, খুব ছোটবেলায়। এখন শাসন করার সময় নয়।
ফাহমিদা ড্রয়িং রুম থেকে বের হলেন। রাগান্বিত স্বরে বললেন, বউমা তুমিও কিছু বললে না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছ, না?
অনন্যা সহজ সরল প্রকৃতির মেয়ে সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আপনারা বলেই যখন কাজ হচ্ছে না তখন আমি বলে কি হবে মা?
চলবে…
গডফাদার-৪৬
বছর খানেক পর সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবে তারপর নির্বাচন, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয় দলই দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার কাজে ব্যস্ত। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার জন্য উপজেলা ও জেলা কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে। জামাল দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার সেক্রেটারি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সাবেক সেক্রেটারি বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে। আর কয়েক দিন পরই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। কাউন্সিলের ভোটে নির্বাচিত হবে দলের সাংগঠনিক সকল পদ। সভাপতি পদে মোস্তফা সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি কম্পিটিশন হবে সেক্রেটারি পদে অর্থাৎ বেলায়েত সাহেব আর জামালের মধ্যে। তাই জামাল এখন কাউন্সিলের ভোটের জন্য দিন-রাত কাউন্সিলারদের বাড়ি, বাড়ি, পথে ঘাটে ভোটের ক্যানভাস করছে। তবে ভোটে জামালের পক্ষে সাড়া পড়েছে তরুণ নেতা-কর্মীদের মাঝে। সেদিন জামাল পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন কাউন্সিলারের সঙ্গে হ্যাণ্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। হ্যাণ্ডশ্যাক করতে করতে একজন মুরব্বী গোছের লোককে জিজ্ঞেস করল, চাচা ভালো আছেন?
খলিল সাহেব বললেন, জি ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?
জি চাচা ভালো আছি, তবে কাউন্সিল নিয়ে একটু ব্যস্ত আছি।
খলিল সাহেব হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। জামাল বলল, চাচা আমি আপনাদের ভোট পাব বলে অনেক আশা নিয়ে সেক্রেটারি পদে দাঁড়িয়েছি। চাচা, আমার জন্য দোয়া করবেন আর আপনার ভোটটা–
খলিল সাহেব বললেন, কাউন্সিল তো আরো কয়েক দিন দেরি আছে বাবা ভেবে দেখি।
জামাল বিনয়ের সুরে বলল, চাচা আমি আপনার ছেলের মতো। ছেলে যদি বাবার কাছে কোন আবদার করে তবে কি কোন বাবা ছেলের কথা না রেখে পারে?
খলিল সাহেব জামালের মুখের দিকে তাকালেন।
জামাল বলল, জি চাচা আমাকে একবার সুযোগ দিন, বেলায়েত ভাই পর পর তিনবার সেক্রেটারি ছিলেন তিনি ইচ্ছা করলে এবার আমাকে সুযোগ দিতে পারতেন, সুযোগ দিলে আমিও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারতাম। কিন্তু তিনি আজীবন সেক্রেটারি থাকতে চান, তাই কি হয়? এ জেলায় কি আর কারো সেক্রেটারি হওয়ার শখ নেই, আপনি বলুন চাচা।
খলিল সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক, বেলায়েত সাহেব এবার আপনাকে ছেড়ে দিতে পারতেন।
চাচা আমি আপনার ছেলের মতো আমাকে তুমি বলবেন। বেলায়েত ভাই না হয় আত্মকেন্দ্রিক আর অগণতান্ত্রিক মানুষ কিন্তু আপনারা তো গণতন্ত্র মনা মানুষ, আপনারা তো পরিবর্তন চাইতেই পারেন তিন বার বেলায়েত ভাইকে সুযোগ দিয়েছেন একবার আমাকে সুযোগ দিন। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন বলে জামাল খলিল সাহেবের হাতে মৃদু চাপ দিল।
খলিল সাহেব বললেন, জি বাবা থাকব।
জামাল খলিল সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, চাচা আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন।
খলিল সাহেব বাইরে থেকে বেলায়েত সাহেবকে অফিসে বসে থাকতে দেখে আর ভিতরে গেলেন না। দরজা থেকেই উঁকি মেরে ফিরে গেলেন।
দলে খলিল সাহেবের বেশ নাম ডাক আছে। তিনি রাজনীতিতেও বেশ প্রবীণ, তাই তাকে পক্ষে নিতে পেরে জামাল যেন আজ অনেকটা সাহস পেল। জামালের সঙ্গে ছিল তার একনিষ্ঠ কর্মী সাজু। জামাল সাজুকে বলল, সাজু চল তো একবার হামিদ চাচার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ঐ বাড়ীতে দু’জন কাউন্সিলার আছে।
দু’জন কে কে? সাজু জিজ্ঞেস করল।
হামিদ চাচা আর তার ছোট ছেলে।
সাজু বলল, বড় ছেলে রাজনীতি করে না।
করে কিন্তু সে তো বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি করে।
একই বাড়ীতে দু’দল বাপ একদল ছেলে আরেক দল?
হ্যাঁ এখন তো সবাই তাই করছে যেমন ছেলে ক্ষমতাসীন দল, বাপ বিরোধী দল কাজেই বাপের কোন সমস্যা নেই, বাপ ছেলের নামে সুবিধা গ্রহণ করছে আবার যখন বাপ ক্ষমতাসীন দলে থাকবে তখন ছেলে বিরোধীদলে থেকেও ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা ভোগ করবে। এখন চলো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
হামিদ সাহেব বাসায় ছিলেন না তাঁর ছোট ছেলে হায়াৎ দেশপ্রেমিক দলের কাউন্সিলার। জামালকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, জামাল ভাই কি মনে করে? হঠাৎ বাবার কাছে?
না শুধু তোমার বাবার কাছে না তোমার কাছেও এসেছি।
জি আসুন বলে হায়াৎ জামাল আর সাজুকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল।
জামাল প্রথম কথা বলতে শুরু করল, হায়াৎ আমি আসলে চাচা এবং তোমার দু’জনের কাছেই এসেছি।
কেন ভাই বলুন?
তুমি জানো না সামনে কাউন্সিল অধিবেশন, আমি জেনারেল সেক্রেটারি পদে দাঁড়িয়েছি। আসলে দলে একটা চেঞ্জ দরকার। বেলায়েত ভাই বছরের পর বছর পদ দখল করে রাখবেন এটা হতে পারে না। আচ্ছা তুমি বলো আমি যদি সেক্রেটারি হই তবে আমার কাছে তুমি কোন সঙ্কোচ করবে না, নিঃসংকোচে বলতে পারবে কিন্তু বেলায়েত ভাইর মতো সিনিয়র নেতার কাছে গিয়ে কি তুমি তোমার সুবিধা-অসুবিধা সবকিছু বলতে পারবে? সব পদেই তো সিনিয়র নেতারা দখল করে আছেন। শুধু একটা পদ, সেক্রেটারি পদটা আমরা মূল দলে যারা নতুন এসেছি তারা চেয়েছি কিন্তু বেলায়েত ভাই তার পদ ছাড়বেন না। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁর বিশ্বাস তিনি আবারো নির্বাচিত হবেন। আচ্ছা তুমি বলো আমি সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত হলে দল চালাতে পারব না? দল ক্ষমতায় যেতে পারবে না?
হায়াৎ বলল, জামাল ভাই আপনাকে আমি ছাত্র রাজনীতি থেকে দেখছি, আসলে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনি অল্প বয়সে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন।
হায়াৎ একটা কথা মনে রাখবে বয়স বাড়লেই মানুষ বেশি জানবে আর বয়স কম হলেই সে কিছু জানবে না এই ধারণাটা ঠিক নয়। আচ্ছা যা হোক তুমি আমার সঙ্গে থাকছ তো?
হায়াৎ আমতা আমতা করে বলল, জামাল ভাই বাবা এখনই আসবে আপনি একটু বসুন বাবার সঙ্গে কথা বলে যাবেন। কয়েক মিনিট পরেই হামিদ সাহেব ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। জামাল দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জামাল কী মনে করে?
আপনার দোয়া নিতে এলাম চাচা।
কীসের দোয়া?
চাচা সামনে কাউন্সিল অধিবেশন বিভিন্ন পদে প্রার্থীরা সিলেকশনে নির্বাচিত হয়েছেন। বেলায়েত ভাইকে মোস্তফা ভাই বললেন, এবার তুমি ছেড়ে দাও জামাল নতুন ছেলে তাছাড়া ছাত্রজীবন থেকে সে দলের জন্য কাজ করছে তাকে একবার সুযোগ দাও। কিন্তু তিনি চান ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে অবশেষে সবাই আমাকে সেক্রেটারি পদে দাঁড়িয়ে দিল। আমি তো আর সবার মতামতকে উপেক্ষা করতে পারি না। বেলায়েত ভাই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার জন্য কাউন্সিলারদের মতামতকে অশ্রদ্ধা করতে পারেন আমি পারিনা। তাই আমি জেনারেল সেক্রেটারি পদে বেলায়েত ভাইর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। চাচা আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন তো?
হামিদ সাহেব বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন?
হায়াৎ বলল, বাবা আমি মনে করি দলকে চাঙ্গা করার জন্য জামাল ভাই’র মতো তরুণ এবং উদ্যোগী নেতা প্রয়োজন।
হামিদ সাহেব একবার জামাল আর একবার হায়াৎ এর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে রইলেন।
চাচা দোয়া করবেন আমি যেন আপনাদের সেবা করার সুযোগ পাই, চাচা বলুন আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
হামিদ সাহেব সহাস্যে বললেন, অবশ্যই দোয়া করবো বাবা আল্লাহ যেন তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করেন।
আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন চাচা, বলে জামাল হামিদ সাহেব এবং হায়াৎ এর সঙ্গে হ্যাণ্ডশ্যাক করে বের হলো।

সাতচল্লিশ

কাউন্সিলে জামাল জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছে। জেনারেল সেক্রেটারি পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে জামালের আগমনে জেলার রাজনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বেলায়েত সাহেব নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর প্রথম দিকে একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং দলকে দ্বিধাবিভক্ত করার অপচেষ্টা করছিলেন কিন্তু দল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশের ভয়ে সেদিকে আর এগুতে পারেননি তবে আজকাল তিনি দলে খুব কম ভূমিকা রাখেন।
ইতোমধ্যে সরকার বিরোধী আন্দোলনও শুরু হয়েছে, প্রতিদিনই মিছিল, মিটিং তো আছেই কয়েকদিন পর পর পালিত হচ্ছে হরতাল। দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য দেশের উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশের স্বার্থ রক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ ক্ষমতাসীন দলের যেমন জটিলতা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেই তেমনি বিরোধী দলের অবস্থানও ধ্বংসাত্মক। ছোট-খাট ইস্যুতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হরতালের মতো দেশের স্বার্থ-বিরোধী কর্মসূচী দিয়েই চলছে। জামাল জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দেয়া কর্মসূচী পালিত হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খু রূপে।
আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পতন হলো না, মেয়াদ পূর্ণ হবার পর ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা থেকে বিদায় হলো। তারপর শুরু হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশপ্রেমিক দল থেকে মোস্তফা সাহেবকে মনোনয়ন দেয়া হলো। শুরু হলো নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবার আকাঙ্ক্ষা। উভয় দলই ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলো। মোস্তফা সাহেবের প্রত্যেকটা নির্বাচনী মিটিংয়ে জামাল অংশগ্রহণ করে অল্পদিনে জামাল বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বক্তৃতা দিতে শিখেছে। জামাল যখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয় তখন শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনে থাকেন। একদিন কলেজের মাঠে জামাল বক্তৃতা দিচ্ছিল, আজকের এই জনসভার সম্মানিত সভাপতি, মঞ্চে উপবিষ্ট বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং শ্রদ্ধেয় ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুয়ালায়কুম। আপনারা অনেক কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে আজকের জনসভায়, মোস্তফা ভাইয়ের জনসভায়, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জনসভায় এসেছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাদের সবার উপস্থিতি প্রমাণ করে আপনারা সবাই মোস্তফা ভাইকে ভালোবাসেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলকে ভালোবাসেন সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসেন, তাই বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির পাঁচ বছরের দুঃশাসন, অত্যাচার, নির্যাতন ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি দেশের কোন উন্নয়ন করেনি। রাস্তা-ঘাট ব্রিজ কালভার্ট কিছুই করেনি, যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন উন্নতি করেনি, শিক্ষা ব্যবস্থার কোন উন্নতি করেনি। সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের জান মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কিছু করেনি যা করেছে নিজেদের উন্নতির জন্য করেছে। যারা লক্ষপতি ছিল তারা কোটি পতি বনে গেছে। আপনারা সবই জানেন তাই আমি আশা করি বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির অত্যাচার নির্যাতন ও জনগণের জান মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ দলের জবাব আপনারা ব্যালটের মাধ্যমে দিবেন। আপনারা বাংলাদেশ জন দরদী পার্টিকে জানিয়ে দিবেন তাদের ইচ্ছায় নয় দেশ চলবে জনগণের ইচ্ছায়, আপনাদের ইচ্ছায়। আপনারা একবার বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল দেশের উন্নয়ন করেছিল কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছে ফলে আমাদের গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শেষ করা সম্ভব হয়নি আপনারা আমাদের আর একবার সুযোগ দিলে আমরা আমাদের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারব ইনশাল্লাহ। আপনারা অনেকক্ষণ যাবত আমার বক্তৃতা ধৈর্য সহকারে শুনেছেন সে জন্য আপনাদের সকলকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন আপনাদের সামনে মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় জন দরদী নেতা মোস্তফা ভাই।
জামালের বক্তৃতার পর বক্তৃতা শুরু করলেন মোস্তফা সাহেব। আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুয়ালায়কুম। প্রথমে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই আমাদের এ জনসভায় যোগদানের জন্য। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ও তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় নেতা জামাল ক্ষমতাসীন দলের দুঃশাসন নির্যাতন ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের বর্ণনা দিয়েছে। সে বিষয়ে আপনাদের সকলের জানা হয়েছে। কিন্তু আপনারা একবার বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের উন্নয়ন আর বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির উন্নয়নমূলক কাজ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দেশের শান্তি শৃঙ্খলার কথা তুলনা করুন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দ্রব্যমূল্যের দাম জনসাধারণের হাতের নাগালে ছিল, মানুষের হাতে কাজ ছিল, কোন দিন মানুষকে অন্ন, বস্ত্রের জন্য ভাবতে হয়নি, দেশে চাঁদাবাজি সন্ত্রাস বলে কিছু ছিল না। মানুষের মনে শান্তি ছিল, জীবনের নিরাপত্তা ছিল। আজ আপনাদের চোখের সামনে যেসব উন্নয়নমূলক কাজ যেমন রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজের উন্নয়ন দেখছেন এসব বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের অবদান। কিন্তু এত উন্নয়ন সত্ত্বেও তৎকালীন বিরোধী দলের অসহযোগিতার কারণে আমরা দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারিনি। আপনারা সবাই জানেন আমি দেশপ্রেমিক দলের একজন প্রার্থী হিসেবে আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হলে এলাকার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের অভাবে কখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে না, আমার নির্বাচনী এলাকায় কোন কাঁচা রাস্তা থাকবে না, সব রাস্তা পাকা করবো, কোন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় কাঁচা ভবন থাকবে না। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল ক্ষমতায় গেলে কৃষকদের বেশি দামে সার, বিষ কিনতে হবে না। ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে আপনারা বঞ্চিত হবেন না। যোগাযোগের অভাবে শাকসবজি পচে যাবে না যোগাযোগ ভালো হলে আপনাদের কষ্টের ফসল তাড়াতাড়ি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিক্রয় করে অনেক লাভবান হবেন। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। আপনারা আমাকে নির্বাচিত করুন আমি আপনাদের উন্নয়ন দিব, অগ্রগতি দিব, নিরাপত্তা দিব।
এমন সময় দর্শকদের সারিতে বসা কয়েকজন কর্মী স্লোগান দিল, তোমার ভাই আমার ভাই, মোস্তফা ভাই, মোস্তফা ভাই। মোস্তফা ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে।
স্লোগান থামলো। মোস্তফা সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, পরিশেষে আমি আপনাদের দোয়া চাচ্ছি আপনারা আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি আপনাদের সকলের সুখ-শান্তি ও আনন্দময় জীবন কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির জনসভা চলছে। স্টেডিয়ামের মাঠ লোকে-লোকারণ্য। যেন দু’দলের জনসভায় দর্শকের পরিমাণ তুলনা করা কঠিন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জনসভায় মাঠে জনসমাগম দেখে যেমন মনে হতো আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের বিজয় নিশ্চিত তেমনি বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির জন সভাস্থল দেখেও মনে হয় বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির বিজয় নিশ্চিত। দু’দলের জনসভায় এটাই প্রমাণ করে যে নির্বাচনে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আর কোন দল বিজয়ী হবে সে কথা অনুমান করার উপায় নেই। বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির প্রার্থী ফরিদ সাহেব সাবেক সংসদ সদস্য তাঁর যেমন জনসমর্থন আছে তেমনি বক্তৃতায় রয়েছে দর্শকদের আকৃষ্ট করার অসীম গুণ। জনসভার শুরু থেকে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির জুনিয়র নেতারা একে একে বক্তৃতা দিয়ে চলছেন। সবার শেষে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন ফরিদ সাহেব, আজকের এই জনসভায় আমার সহকর্মী ও শ্রদ্ধেয় ভাইয়েরা আস্‌সালামুয়ালায়কুম। আপনারা সবাই দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শোনার জন্য প্রথমে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনারা সবাই জানেন আগামীতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। নির্বাচনে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির প্রার্থী হিসেবে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আপনারা জানেন কয়েকদিন আগেও বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি ক্ষমতাসীন ছিল। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি দেশে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে বিগত দিনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। দেশের মিল কারখানা লোকসানে ডুবে ছিল, রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ করা হয়েছিল, দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না, কারো জান মালের নিরাপত্তা ছিল না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত ছিল। দেশের এমনি এক দুঃসময়ে আপনারা বাংলাদেশ জন দরদী পার্টিকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েই আমরা প্রথমে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করি। কৃষকের কাছে স্বল্প মূল্যে সার বীজসহ প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জাম পৌঁছে দিই। কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয়। সারাদেশে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, কৃষকের মুখে হাসি ফুটে। গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আসে এবং দেশে অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব ফিরে আসে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মান্ধাতার আমলের। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেয়নি। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেকেলে জরাজীর্ণ বিল্ডিংগুলো ভেঙ্গে কিংবা মেরামত করে কোমল মতি শিশুদের উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। আমরা ক্ষমতা গ্রহণের পর শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন স্কুলে নতুন বিল্ডিং নির্মাণ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিসহ সরবরাহ করি। আজ আপনারা অসংখ্য স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় কোন না কোন বিল্ডিং দেখবেন এসব বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির অবদান। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাসপাতালের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ডাক্তার, নার্সের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত ঔষধের ব্যবস্থা করেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমাদের সাফল্য আরো ব্যাপক। সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে, আমার নির্বাচনী এলাকায় কোন কাঁচা রাস্তা নেই, সমস্ত রাস্তা পাকা করা হয়েছে। আমি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের মতো শুধু মুখে উন্নয়নের কথা বলছি না। দেশের সীমিত সম্পদে আমরা দেশকে যথেষ্ট উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছি। আরো উন্নয়ন করা সম্ভব হতো কিন্তু বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে। তারা রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর করেছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করেছে। আপনারা নিশ্চয় জানেন তারা যে সরকারি সম্পদ ভাংচুর করেছে সেটা আমাদের দলের নয়, দেশের, আপনাদের, এ দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কেনা। হরতালে তারা দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করেছে, দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তারা দেশের উন্নয়ন চায় না, অগ্রগতি চায় না তারা নিজেদের উন্নতির জন্য ক্ষমতা দখল করতে চায়। জনগণের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল আর কোনদিন যেন ক্ষমতায় গিয়ে আপনাদের দেয়া পবিত্র দায়িত্বের অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য ব্যালটের মাধ্যমে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টিকে নির্বাচিত করে আমাদের আরেকবার আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। আমরা বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের জন্য যে কাজ সমাপ্ত করতে পারিনি আপনাদের ম্যান্ডেট পেলে সে কাজ সমাপ্ত করবো। আপনারা জানেন ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় আমি কাউকে বিমুখ করিনি। আমার কাছে কোন কাজে গিয়ে কেউ ফিরেও আসেননি। আমি আপনাদের ম্যান্ডেট পেলে এবং বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি পুনরায় নির্বাচিত হলে আমার নির্বাচনী এলাকার স্কুল-কলেজ মাদ্রাসায় কাঁচা ঘর থাকবে না, কোন দরিদ্র মানুষের ঘরে ছনের ঘর থাকবে না সরকারি অর্থ বরাদ্দ না পেলে ব্যক্তিগত অর্থে প্রত্যেক বিত্তহীন মানুষের ঘরে কমপক্ষে একটা করে ঘরে টিনের চালা করে দিব। অশিক্ষিত বেকারদের মাঝে সমিতির মাধ্যমে রিক্সা, ভ্যান কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দিব। শিক্ষিত বেকারদের জন্য যে যে বিষয়ে দক্ষ সে বিষয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিব। এলাকা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে আপনাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসবে। আপনারা আমাকে ভোট দিন আমি আপনাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেখব। এ সময় কয়েকজন কর্মী স্লোগান দিল। তোমার ভাই আমার ভাই, ফরিদ ভাই, ফরিদ ভাই। ফরিদ ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে। ফরিদ সাহেব দু’হাত উঁচু করে থামার ইঙ্গিত দিলেন। শ্লোগান থামলে ফরিদ সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, আপনাদের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা, যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি সে জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

আটচল্লিশ

বেশ কিছুদিন থেকে বিথীর কোন খবর নেওয়া হয়নি। অবশ্য জামাল বিথীকে কোনদিন মোবাইল করার সময় করতে পারে না। বিথী মিস কল দিয়ে জামালকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তারপর জামালই কল ব্যাক করে। তবে বিথী সব সময় মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। জামাল যেদিন প্রথম জেল থেকে মুক্তি পায় সেদিন বিথী প্রথম তাকে মোবাইল করেছিল। আবার যেদিন জামাল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল সেদিনও বিথী প্রথম জামালকে কনগ্র্যাচুলেট করেছিল, তারপর থেকে বিথী আর কোনদিন যোগাযোগ করে না। কিন্তু বিথী তো এমন করার কথা নয়, নাকি বিথীও যুথির মতো কৌশলে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে? বিচিত্র কি প্রবাদ আছে নারীর মন দেবতাও না চিনে!
হাইওয়ে থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে চলে গেছে সেই রাস্তা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পর একটা ছোট্ট নদী। নদীর পাড়ে বিকেলবেলা মাঝে মাঝে কপোত-কপোতীরা বেড়াতে আসে। আজও জামালের চোখে পড়ল দু’জন তরুণ-তরুণী গা ঘেঁষে নিবিড়ভাবে বসে গল্প করছে। জামাল নদীর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে সেদিকে যেতে যেতে তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোটর সাইকেল ব্রেক করে পকেট থেকে মোবাইল সেটটা বের করে দেখল বিথী মিস কল দিয়েছে। জামাল মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করে রিং ব্যাক করল।
অপর পাশ থেকে বিথীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল ভাই কেমন আছেন?
হুঁম, আমি ভালো আছি? তুমি?
ভালো, পরীক্ষা চলছিল তো তাই কয়েকদিন থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, সরি।
কিন্তু আমি তো ভাবছিলাম তুমিও যুথির মতো চলে গেলে।
বিথীর অভিমানী সুর ভেসে এলো, জামাল ভাই সবাইকে এক মনে করবেন না, আমি যুথি নই, বিথী।
তাই নাকি?
হুঁম, দেখবেন, হঠাৎ যাব না, আপনাকে বলে যাব। আর হ্যাঁ আপনি ঢাকা আসছেন কবে?
কেন হঠাৎ ঢাকায় আমার কী প্রয়োজন পড়ল?
কবে আসছেন তাই বলুন?
তোমার মতো সুন্দরী তরুণী বললে কালকেই চলে আসতে পারি।
ইয়ার্কি করবেন না আপনার জন্য অনেকগুলো এ্যাট্রাকটিভ খবর আছে।
বেশ তো আমি আগামী সপ্তাহে ঢাকা আসছি তখন দেখা হবে।
থ্যাংক ইউ সো ম্যাচ আমি নিশ্চিত হলাম এখন রাখি।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জামাল মোবাইল অফ করে একবার ছোট্ট নদীর দিকে তাকাল। নদীর ধারে কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে খোলা মাঠ মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট ছোট গাছ। জামাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর আপন মনে হাসছিল। একজন যুবক এসে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান কী দেখছেন? হাসছেন কেন?
জামাল জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা এই জায়গাটা কার তুমি জানো?
কেন বলুন তো?
এত বড় জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে, কোন ফসল নেই আমার তো মনে হয় সারাবছর অনাবাদী থাকে তাই জিজ্ঞেস করছি।
জায়গাটা আমাদেরই, মাটি ভালো না তাই কোন আবাদ হয় না, বছরের পর বছর ফাঁকাই থাকে, নদীর ধারে দেখে ছেলে মেয়েরা আড্ডা দিতে আসে।
না না ছেলে মেয়েরা আড্ডা দিতে আসে এটা ঠিক না, কখন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় বলা যায় না শেষ পর্যন্ত তোমরাও জড়িয়ে পড়বে।
ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেল, জি ভাইজান আপনি ঠিকই বলেছেন।
জামাল জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে চেনো?
জি আপনি জামাল ভাই, রাজনীতি করেন।
তুমি রাজনীতি করো না?
না।
আচ্ছা যাই হোক আমার মনে হয় এই অনাবাদী জমিটা বিক্রি করে দিয়ে তোমরা অন্য জায়গায় আবাদি জমি কিনলেই পার।
বাবাও বিক্রি করার জন্য অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছেন কিন্তু এই পড়ে থাকা জমি কে কিনবে বলুন?
চাচাকে বলিও তোমরা যদি জমিটা বিক্রি করতে চাও তবে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে, দেখি তোমাদের কোন উপকার করতে পারি কি না?
ছেলেটার চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল।
জামাল বলল, আমরা যারা রাজনীতি করি তারা সব সময় জনগণের সেবা করি, জনগণের মঙ্গলের কথা চিন্তা করি, দেশের উন্নতির কথা চিন্তা করি। এত বড় একটা খালি মাঠ ফাঁকা আছে তুমি দেখ ঠিকই আমার চোখে পড়েছে। এত বড় জমি অনাবাদী রাখা যায় না এটা যেমন তোমাদের ক্ষতি তেমনি দেশেরও ক্ষতি।
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, জি ভাইজান।
ও আচ্ছা তোমার নামটা কি যেন?
আমার নাম বেলাল।
বেলাল তুমি আমার অফিস চেনো?
না।
জামাল পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিয়ে বলল, চাচাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।
জি ভাইজান।
জামাল আর একবার তার কাঙ্ক্ষিত জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মনে হলো এ জায়গায় একটা পার্ক, সেই সাথে একটা বিনোদন কেন্দ্র আর রেস্ট হাউজ তৈরি করলে কেমন হয়। যদি একটা বাগান থাকে যেখানে থাকবে বিভিন্ন ধরণের ফুলের গাছ, নদীর ধারে থাকবে দ্বিতল রেস্ট হাউজ, নীচতলায় কার পার্কিং অফিস, ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা, ড্রয়িং রুমসহ পুরো ফ্যামিলি থাকার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় তলায় থাকবে দু’টা বেডরুম, একটা ভি.আই.পি রুম। রুমের সঙ্গে বেলকনি থাকবে যেন বেলকনিতে বসে নদী দেখা যায়, দেখা যায় চাঁদের সাথে নদীর স্বচ্ছ পানির খেলা। ঘরে আসবে নিত্য নতুন তরুণী। আমার জীবনের পূর্ণতা চাই, আমি জীবনের কোন শূন্যতা নিয়ে মরতে চাই না। বিল্ডিংয়ের নীচে থাকবে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর। সেই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সুড়ঙ্গ বেরিয়ে যাবে নদীর অনেক ভাটিতে। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন ও রাজনৈতিক কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বা আমার যে কোন কাজে কেউ বাধা দিতে এলে টর্চার সেল-এ এনে আমার আদলতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠল।
চলবে…

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস