সাইক্রিয়াটিস্ট

আজ সকাল থেকে ইরার মনটা খারাপ। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা উঠে নাস্তা তৈরি করেনি। ড্রয়িং রুমের ছোট্ট চৌকিটায় শুয়ে শুয়ে টি.ভি দেখছে ঠিক সেভাবে বসে সেভাবে জয় যেভাবে জয় এই চৌকিটায় এসে বসতো সেভাবে। সেদিন ইরার সকালবেলা উঠেই ব্যস্ততা শুরু হয়েছিলো। তার জয় আসবে, দুপুরে লাঞ্চ করবে, ইরা আগেই ফোন করে বলেছিলো, কাল কিন্তু তুমি সময় নিয়ে আসবে, ঘোড়া বেঁধে রেখে আসবে না।
জয় হাসতে হাসতে বললো, না, না। সময় নিয়েই আসবো।
ইরা তামাশা করে বললো, ক’টায় পৌঁছাবেন মহাশয় আপনি?
একটায়।
তার আগে এলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
না। মহাভারত লেখা হয়ে গেছে, অশুদ্ধ হওয়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই।
কিন্তু আগে এলে সমস্যাটি কী? তুমি বারোটার মধ্যে চলে এসো।
তোমার স্কুল টিফিন ক’টায়?
সারাদিন।
জয় চমকে উঠলো, সারাদিন মানে? ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে তে স্কুল ছুটি থাকে নাকি?
না, থাকে না কিন্তু আমি ছুটি নিয়েছি।
কেনো? শরীরটা অসুস্থ নাকি? তোমার গলার স্বরটা যেনো কেমন করছে।
আরে না, তুমি তো সবসময় একলাইন বেশি বোঝো। কাল ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে। তুমি আসছো। আমি ভালো, ভালো রান্না করবো, স্কুলে গেলে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাবে না। এই বলো না, তোমার পছন্দের খাবার কী কী?
জয় বললো, এটাই তো তোমাকে আবিস্কার করতে হবে ইরা, আমার পছন্দ-অপছন্দ তোমাকে আবিস্কার করতে হবে। ভালোবাসার মানুষের পছন্দ-অপছন্দটাই যদি না বুঝলে তবে আর ভালোবাসলে কীভাবে।
ঠিক বলেছো, তোমাকে আর বলতে হবে না। দেখো আমি ঠিক ঠিক তোমার পছন্দের খাবারগুলোই রান্না করবো।
সেদিন খাসির মাংস, মুরগির মাংস, রুই মাছের সঙ্গে ইরা রান্না করলো ইলিশ মাছ দিয়ে কচু পাতা, ঢেঁকিশাক, আর শুঁটকি মাছের ভর্তা। খেয়ে জয় খুব খুশি হলো। জয়ের সেই তৃপ্ত মুখখানা আজো ইরার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। খাওয়া শেষে জয় যখন বেসিনে হাত ধুতে গেলো তখন একবার মোশারফের দিকে লক্ষ্য করলো, মোশারফ ততক্ষণে ছাদে গিয়ে সিগারেট টানছে।
জয় ফিসফিস করে বললো, রান্না খুব ভালো হয়েছে, অপূর্ব। তুমি আমার পছন্দ-অপছন্দ বোঝো।
ইরা ডাইনিং থেকে কিচেনে যাবার অজুহাতে বেসিনের কাছে গিয়ে জয়ের গালে একটা টোকা মেরে বললো, তুমিও।
জয় একরকম চমকে উঠলো, মানে? আমি আবার কী করলাম?
কিছু করোনি, না? ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে মোশারফের পায়ের শব্দ পেয়ে ইরা আবার কিচেনে ঢুকলো।
সেই ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে’র একবছর হলো কিন্তু ইরার ভালোবাসার মানুষটা আর ফিরে এলো না। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ইরা গণ্ডদেশ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
মোশারফ জোরে ডাক দিলো, ইরা।
ইরা কিছু বললো না।
মোশারফ আবার ডাক দিলো, ইরা নাস্তা দাও।
ইরা তবুও কিছু বললো না।
মোশারফ তার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে এলো, তুমি না কোনোদিন টি.ভি দেখো না আজ প্রায় বারো বছর থেকে। আজ আবার টি.ভি দেখতে দেখতে নাস্তা তৈরি করার কথাও ভুলে গেলে?
মোশারফের পাঁয়ের শব্দ পেয়ে ইরা চোখের জল সংবরণ করেলো। সে বললো, দেখি না কিন্তু দেখতে তো নিষেধ নেই।
টি.ভি দেখতে দেখতে নাস্তা তৈরি করার কথা ভুলে গেছো?
ইরা মনে মনে বললো, ভুলিনি। আজ আরো বেশি করে মনে পড়েছে কিন্তু নাস্তা তৈরি করবো কার জন্য।
মোশারফ ইরার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো, ঠিক আছে, আমি বাইরে নাস্তা খেয়ে নিচ্ছি। তুমি ওঠো, নাস্তা খেয়ে স্কুল যেও।
ইরা তবু বিছানা থেকে উঠলো না। আজ তার যেনো প্রাণশক্তি বলে কিছু নেই। জয়ের সঙ্গে ইরার পরিচয় হওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে বলতে ইরার জীবনে তেমন কিছু ছিলো না। ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েই শেষ করতো। কিন্তু জয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে সে যেনো তার ভ্যালেন্টাইনস্‌ খুঁজে পেয়েছে। পঁচিশ বছরের এই প্রেম-ভালোবাসাহীন ঘরও একসময় তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিলো। ভাবতে ভাবতে ইরার দু’চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, ইরার সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে এলো।
জয়! ইরা ঠোঁট দু’টো একটু ফাঁকা হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বের হলো।

ইরা রিমোট টিপে একের পর এক টি.ভির চ্যানেল পরিবর্তন করছিলো আর বিছানায় একরকম ছটফট করছিলো। একসময় ইরার দু’চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো, শরীরটা অবশ হয়ে গেলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সাথী নার্সারি। এই সাথী নার্সারিতে আছে জয় আর ইরার অনেক স্মৃতি। এই তো কয়েকবছর আগের কথা একদিন ইরা বললো, আমি আগামীকাল জয়পুরহাট যাবো।
জয় বললো, তাহলে আমার কাছে চলে এসো।
তোমার কাছে মানে? একেবারে?
একেবারে, বলে জয় হো হো করে হেসে উঠলো, তারপর বললো, মানে ফোন দিয়ে এসো।
ও তাই বলো আমি ভাবছিলাম বুঝি একেবারে তোমার কাছে যেতে বলছো।
পরদিন সকালবেলা ইরা জয়পুরহাট রওয়ানা দেয়ার আগে আরো কয়েক দফা ফোনে কথা হলো, ইরা কখন রওয়ানা দিবে, কোথায় দেখা করবে এসব নিয়ে।
জয় বললো, তুমি পাঁচুর মোড় থেকে রিকশা নিয়ে পাঁচবিবি রোড দিয়ে রওয়ানা দিও, আমি তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিবো।
পাঁচবিবি রোড দিয়ে কতদূর যাবো? কোথায় যাবো, জানবো না? অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখো কেনো? আমাকে বলো?
ভালোবাসা মানেই তো অনিশ্চয়তা ম্যাডাম, অনিশ্চয়তার পথে হেঁটে নিশ্চয়তা চাইবে তা কী করে হয়।
না, আমি অনিশ্চয়তা চাই না, নিশ্চয়তা চাই, গন্তব্য জানতে চাই।
নিশ্চয়তা তো আমিই। আমি রাস্তা দিয়ে যেতে বলেছি, তুমি যাবে, আমি তোমাকে মোটর সাইকেলে তুলে নিবো। নির্ভর করতে শেখো। মেয়েদের নিয়ে এই একটা সমস্যা, যারা নিজের পাঁয়ে দাঁড়িয়েছে তারা অন্যের ওপর নির্ভর করতে ভুলে গেছে আর যারা অন্যের পাঁয়ে ভর করে আছে তারা নিজেরা জানেই না যে তাদেরও পাঁ আছে।
ওকে বাবা, ওকে আর বলতে হবে না। আমি কিন্তু বাসের মধ্যে ফোনে বার বার কথা বলতে পরবো না।
করতে হবে না, তুমি বাসে ওঠার সময় একটা ম্যাসেজ দিও।
ওকে।
নেমে আরেকটা ম্যাসেজ দিও।
ওকে।

ইরা বাসে ওঠার সময় এবং বাস থেকে নেমে আবারো ম্যাসেজ দিলো। তারপর পাঁচুর মোড়ে এসে একটা রিকশা নিলো। রিকশা এগিয়ে চলছে পাঁচবিবি রোড দিয়ে। ইরার সেদিন একটা অন্যরকম অনুভুতি। জীবনের এই মধ্যবয়সে এসে জীবনটা আরো রঙিন হবে একথা ইরা কোনোদিন কল্পনাই করেনি। সে তার বর্ণহীন জীবন শুভ’র লেখাপড়া, আর চাকরি করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো। চলছেও সেভাবে তার সাথে যোগ হয়েছে জয়, জয়ের ভালোবাসা ইরাকে তারুণ্য দিয়েছে, প্রাণচাঞ্চল্য দিয়েছে, বাঁচার প্রেরণা যুগিয়েছে। ইরা আপনমনে মৃদু হেসে উঠলো।
একটা মোটর সাইকেল রিকশার একেবারে সামনে এসে ব্রেক করলো।
ওয়াও জয়, বলে ইরা রিকশা থেকে নেমে জয়ের মোটর সাইকেলে উঠলো।
জয় জোরে মোটর সাইকেল টান মারলো।
ভাগ্যিস ইরা জয়ের কাঁধে হাত রেখেছিলো নইলে হয়তো পড়েই যেতো।
ইরা বললো, এভাবে কেউ মোটর সাইকেল চালায়, আরেকটু হলে তো আমি পড়েই যেতাম।
পড়বে না, তোমাকে বলেছি না নির্ভর করতে শেখো। আমার মোটর সাইকেলে উঠেছো, আমার কাঁধে হাত রেখেছো তারপরও ভয় পাচ্ছো?
ইরা জয়ের পিঠের ওপর মাথা রেখে নিবিড়ভাবে মিশে গেলো, আমি ঠিক তোমার মতোই একজন মানুষ খুঁজছিলাম জয়।
কয়েকমিনিটের মধ্যে মোটর সাইকেল একটা নার্সারির সামনে এসে দাঁড়ালো। নার্সারির নাম সাথী নার্সারি। ইরা মোটর সাইকেল থেকে নেমেই জয়ের হাতে একটা গোলাপ ফুল দিলো, থ্যাঙ্ক ইউ ইরা।
ওয়েলকাম।
জয় ইরার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। ইরা জয়ের হাতের মধ্যে একটা হাত রেখে তার সাথে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে নার্সারির সরু রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রাস্তার দু’পাশে পাতাবাহার গাছ, ছোট ছোট আয়তাকারভাবে সাজানো জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ।
ইরা গোলাপ ফুলের কাছে এসে অনেকগুলো ফুল দেখে বললো, ওয়াও, এতো ফুল।
ইরা আর জয় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে অনেকগুলো ছবি তুললো।
বাগানে একটা লোক কাজ করছিলো। সে একবার তাদের দিকে দেখে আবার না দেখার ভান করে কাজ করছিলো। ছবি তোলা শেষে জয় ডাক দিলো, এই যে ভাই।
লোকটি কাছে এলো, গাছ কিনবেন?
হ্যাঁ।
দেখেন, পছন্দ করেন।
জয় একে একে কয়েকটা ফুল গাছ কিনে ইরাকে বললো, এগুলো তোমার বাগানে লাগাবে।
ইরা বললো, অবশ্যই জনাব, গাছের দাম কিন্তু আমি দিবো।
না। আমি কিনেছি, দাম আমিই দিবো।
আমি তোমাকে দিলাম ফুল, আর তুমি দিলে পুরো ফুল গাছ। তবুও তোমাকে জিততেই হবে। তা না হলে তোমার নাম জয় হবে কেনো। তোমার নামটাকে তুমি সার্থক করে তুলবেই।
কাজের ফাঁকে, চাকরির সুযোগে একটু সময় পেলেই দু’জনে এই নার্সারিতে ছুটে আসতো। ইরা ফোন করে বলতো আসছি, বাস ছাড়লো। আর জয় সময় হিসেব করে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।
কিন্তু আজ তো আমি তোমাকে আসতে বলিনি, তুমি বুঝলে কীভাবে যে আমি এখানে আসবো আজ?
জয় বললো, আমি বলেছিলাম না, মন থেকে চাইলেই তুমি আমাকে পাবে।
আজ ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে, তুমি মন থেকে আমাকে চাইবে আমি জানি, তাই চলে এসেছি।
চাপাবাজি, আমি যদি না আসতাম?
ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয় ইরা। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমি এসেছি। তুমি যদি না আসতে তবে আমি বুঝতাম তোমার ভালোবাসায় বিশ্বাসের অভাব আছে।
এক্সাক্টলি। এই নাও, তুমি যে গাছ কিনে দিয়েছিলে সেই গাছের ফুল।
থ্যাঙ্ক ইউ ইরা।
আজ অনেক ফুল ফুটেছে। গাছগুলোও হয়তো বুঝতে পেরেছে আজ তুমি আসবে।
ইরা জয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো কিন্তু জয় তার হাত ধরলো না।
ইরা ফিসফিস করে ডাক দিলো, জয়, জয়, হাতটা দাও একটু, প্লিজ! জয়, আমার জয়।
জয় তবুও হাত বাড়ালো না।
জয় প্লিজ একটু হাতটা দাও, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ! বলে জোরে চিৎকার করতে করতে ইরা বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো।
ইরা হাঁপাচ্ছে, বুকটা জোরে উঠানামা করছে, মেঝেতে পড়ে সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, আমি কোথায়? আমি কি বাসায়? এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখলাম? জয়, জয় আসেনি?
ইরা একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে অথচ এখনো রান্না শুরুই করতে পারলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে মোশারফ খেতে আসবে। কিন্তু রান্নার প্রতি ইরার মন নেই, সে সকাল থেকে নাস্তাই খায়নি, খিদে আছে কিন্তু মুখে রুচি নেই। ইরা কী ভেবে একবার মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো, মোবাইলের বাটন টিপে কয়েকবার রিং করলো তারপর মোবাইল ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মেরে বললো, যাহ…
তারপর কিচেনে ঢুকলো।
রান্না খুব সহজ কাজ না। খুব কম সময়েরও কাজ না। তরকারি কুটা, মসলা বাটা, ঠিক ঠিক মতো মরিচ মসলা দেয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে মোশারফ বাসায় এলো। ইরা দরজা খুলে দিলো।
মোশারফ বাসায় ঢুকেই বললো, ইরা তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
ইরা কৃত্রিম হাসির চেষ্টার করে বললো, একটু বসো রান্না করছি।
মোশারফ কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, এখনো করছি মানে, তারপর ইরার পিছু পিছু রান্না ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বললো, এখনো তরকারি কাটছো? উফ্‌্‌, কী করলে এতক্ষণ? আজ তো স্কুলেও যাওনি, বলতে বলতে সে ইরার রুমে গিয়ে তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চেক করলো, নিশ্চয়ই এতক্ষণ ফোনে কথা বলেছো?
ইরাও মোশারফের সঙ্গে তার রুমে ঢুকে বললো, না।
অবশ্যই বলেছো, নিশ্চয়ই কথা বলে কল রেকর্ডও ডিলিট করে দিয়েছো।
একদম বাজে কথা বলবে না। একদিন রান্না দেরি হতে পারে না? তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে কথা বলবে?
পারে কিন্তু দেরি হওয়ার একটা কারণ থাকে। কী করছিলে এতক্ষণ?
শুয়েছিলাম।
ইরা মোশারফের মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত চেয়ে রইলো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো, ও আজ তো ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে, তাই না, তাই কারো স্মৃতিচারণ করছিলে নিশ্চয়ই?
ইরা মনে মনে বললো, জানোই তো।
ঠিক আছে আজ তারই স্মৃতিচারণ করো। আমি গেলাম, ক’দিন থেকেই বলছি চলো, বগুড়া চলো, তোমাকে সাইয়াক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে আনি, বলে মোশারফ দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলো।
দরজা বন্ধ করতে করতে ইরার আপন মনে বললো, সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে, না? দেখাতে হয় তোমাকে দেখাও। আমার সাইক্রিয়াটিস্ট আছে, তুমি তার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে এনেছো, আমার সাইক্রিয়াটিস্টের হ্যালো কথাটাই আমাকে সুস্থ করে তুলবে। যদি এখনই আমাকে ফোন করে তবে এখনই আমি সুস্থ হয়ে উঠবো।
ইরা কিছুক্ষণ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বারান্দার সামনেই জয়ের দেয়া ফুলগাছগুলো, প্রতিটি গাছ কেনার সময় জয়ের সঙ্গে তার কোনো না কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারি।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল। না, সম্রাট শাহজাহান-মমতাজের তাজমহল না। জয়-ইরার তাজমহল। এই বিল্ডিংয়ের কাজ করতে এসেই জয়ের সঙ্গে ইরা পরিচয় হয়েছিলো। তাই ইরা এই বিল্ডিংয়ের নাম দিয়েছে তাজমহল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইরার চোখ দু’টো পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো।
রাস্তা দিয়ে কত মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ইরার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার জয় এলো। কোনো মোটর সাইকেল যেতে দেখলেই তার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠছে, জয়, আমার জয়, এসেছো?
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইরার পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে, এমনিতেই জয়পুরহাট থেকে আসার পর থেকেই ইরার শরীরটা ভালো নেই, তারওপর আজ সকাল থেকে না খেয়ে তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাই যেনো হারিয়ে গেছে। ইরা দেয়ালে হাত দিয়ে এক পা দু’পা করে কোনো রকমে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
কয়েকমিনিট পর ইরার কানে বেজে উঠলো তার মোবাইল ফোনের রিং। ইরা ভেবেছিলো তার জয় হয়তো কোনোভাবে তার নাম্বার জোগাড় করে তাকে ফোন করেছে। কিন্তু না, তার স্কুলের এক কলিগ, সাহেদা ফোন করেছে।
ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আপা।
আপা একটা সুখবর আছে।
সুখবর কথাটা শোনার পরও ইরার কোনো কৌতূহল নেই, কণ্ঠে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। যেনো স্কুলের কোনো সুখবর তার কাছে মূল্যহীন। তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখবর হলো তার জয়ের খবর।
ইরা প্রাণহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কী সুখবর আপা?
আপনি খুশি হোননি?
আগে বলুন আপা, না জানলে কীভাবে খুশি হবো?
আমি জানি, যা শুনলে আপনি সবচেয়ে খুশি হবেন। কল্পনা করুনতো।
আমাদের স্কুল সরকারি হয়েছে?
ধুর আপা, আপনি কী যে বলেন? স্কুল সরকারি হওয়া, বেতন বেশি হওয়া এগুলো আপনার কাছে কোনো সুখবরই না।
বলুন আপা, আমার ভালো লাগছে না। আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি, আমার খুব দুর্বল লাগছে।
সাহেদা বললো, জানি তো, সেজন্যই তো বলছি, সুখবরটা শুনলে আপনি এখনই সুস্থ হয়ে উঠবেন, এখনই স্কুলে ছুটে আসবেন।
বলুন আপা প্লিজ!
আপনার জয় আপনাকে নিয়ে ফেসবুকে একটা গল্প লিখেছে, অসাধারণ!
জয়, আমার জয়, আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছে, ভালো হয়েছে?
হালিম স্যার পড়েছে, তারপর সবাইকে দেখিয়েছে। সবাই তো লেখা পড়ে অবাক। সবাই বলছে এটা আপনাকে নিয়েই লেখা। লোকটা আপনাকে এখনো খুব ভালোবাসে আপা। প্রত্যেকটা লাইনে যেনো আপনার প্রতি তার ভালোবাসাই ফুটে উঠেছে।
আমি জানি আপা, পৃথিবীতে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। আমারো ও ছাড়া কেউ নেই। জয়পুরহাট থেকে আসার পর থেকে আমার ফোনটা নিয়ে নিয়েছে আপা। তাই আমি নেট ব্যবহার করতে পারি না, আমি আসছি আপা, আপনার মোবাইল ফোনে একবার পড়বো আমার জয়ের লেখা গল্প, আমি এখনই আসছি, বলে ইরা যে কাপড়ে ছিলো সে কাপড়ের ওপরই কোনো রকমে বোরকা চাপিয়ে ক্ষুধা-তৃঞ্চা ভুলে বাসা থেকে বের হলো।
সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*