বিজয়িনী


রাতের আঁধারে সবুজ যেদিন শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে এলো সেদিন শীতের রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার, শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে রাজিবপুর পৌঁছাতে পায়ে হাঁটার পথ তিন কিলোমিটার, উঁচু-নিচু রাস্তা, ধুধু বালুচর আর সাদা কাশবন। তারপর  সোনাভরি নদী। মনের ভিতরে আছে কেউ দেখে ফেলার আশঙ্কা। এতোকিছুর মধ্যেও সবুজের মনে হলো একবার যদি রেণুর মুখটা দেখে যেতে পারতো… 

না, রেণুকে সে শেষবারের মতো দেখে আসতে পারেনি। মান-সম্মানের ভয়ে, সালিসের নামে, বিচারের নামে প্রহসনের আশঙ্কায় রুদ্ধ শ্বাসে ছুটে চললো সবুজ। কাশবন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই শীতের রাতেও তার শরীর থেকে ঘাম ঝরলো। সে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ালো। না, এতো রাতে নদীতে খেয়া নৌকা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেউ যদি তাকে দেখে ফেলে তবে আর রক্ষা নেই। নদীতে তখনো কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা থেকে কুয়াশা ভেদ করে চার্জারের ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে পড়ছে। এই নদীর জেলেরা বেশিরভাগই তাকে চেনে, কাউকে বললে হয়তো নদী পার করে দিবে কিন্তু যদি তাদের মধ্যে কেউ তাকে পালিয়ে যেতে দেখে তবে শুরু হবে গ্রাম্য সালিসের নামে প্রহসন, শত শত মানুষের সামনে কান ধরে উঠবস, চুল কেটে দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরানো কিংবা জুতোপেটা করা।

এই তো প্রায় এক মাস আগে শঙ্কর মাধবপুর বাজারে সালিস বসলো। কুদ্দুসের সঙ্গে তার প্রতিবেশী ভাইদের জমি-জমা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছিলো। প্রতিপক্ষ কুদ্দুসকে জব্দ করার জন্য সুযোগ খুঁজছিলো। কুদ্দুস আর শফি ছোটবেলার বন্ধু। দু’জনে ব্রহ্মপুত্র নদে একসঙ্গে সাঁতার কেটেছে, গরু-ছাগল চরাতে গেছে, এই ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সেও দু’বন্ধু একসঙ্গে শঙ্কর মাধবপুর হাটে কোনো হোটেলে বসে ভি.সি.ডি’তে সিনেমা দেখে, আড্ডা দেয়। এই দু’বন্ধুর পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াতও অবাধ। সেদিন সন্ধ্যায় শফি শঙ্কর মাধবপুর বাজারে যায়নি দেখে বাড়িতে ফেরার সময় কুদ্দুস দরজায় শফি শফি বলে ডাকতে ডাকতে শফির বাড়িতে ঢুকলো।

শফির বউ হেমা তখন রান্না করছিলো। সে উঠোনে একটা পাটি পেতে দিতে দিতে বললো, বসেন ভাই।

শফি কোথায় গেছে?

ও রাজিবপুর গেছে ভাই।

হঠাৎ করে?

এসে পড়বে এখনি, আপনি বসেন।

না, থাক। ও এলে আমার কথা বলবেন।

চলে আসবে তো, এই খেয়াতেই হয়তো আসবে।

কথা বলতে বলতে হেমা একটা প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর এনে কুদ্দুসের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে সে একটা মোড়ায় বসলো। গল্প করতে করতে কিছুটা সময় কেটে গেলো। পারিবারিক গল্প, সংসারে টানাপোড়েনের গল্প। হঠাৎ করেই বাইরে একটা হৈ চৈ এর শব্দ ভেসে এলো। প্রথম প্রথম কুদ্দুস বুঝতে পারলো না কিন্তু দরজায় জোরে জোরে শিকল নাড়ার শব্দে কুদ্দুস দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

দরজায় পাড়ার কয়েকজন লোক জমায়েত হয়েছে। কুদ্দুসকে দেখে একজন মুুরুব্বী কিছিমের লোক কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে বললো, কুদ্দুস তুমি এত রাতে শফির বাড়িতে?

কুদ্দুস তখনো অনুমান করতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে। সে স্বাভাবিকভাবে বললো, হ্যাঁ, সারাদিন শফির সঙ্গে দেখা হয়নি তো।

আরেকজন জোরে চিৎকার করে বললো, তাই এতো রাতে আপনি এসেছেন শফির বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে?

হেমা সামনে এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, কুদ্দুস ভাই’র কোনো দোষ নেই। বাবুর আব্বা আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি নাস্তা খেতে দিয়েছি।

সমবেত লোকদের মধ্যে একজন জোরে ধমক দিয়ে বললো, তুমি চুপ করো। স্বামী বাড়িতে নেই আর সেই সুযোগে তুমি স্বামীর বন্ধুকে নিয়ে… 

কথাটা হেমার কানে তীরের মতো বিদ্ধ হলো। তার হৃদপিণ্ড যেনো কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। এ কী শুনছে সে, সবাই তাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা বলছে। সে আবারও প্রতিবাদ করলো, না কুদ্দুস ভাই’র কোনো দোষ নেই, আমারও কোনো দোষ নেই, আপনারা আমাদের নিয়ে খারাপ কিছু বলবেন না। আল্লাহর গজব পড়বে।

কে শোনে কার কথা। কয়েকজন জোর করে টেনে হেঁচড়ে কুদ্দুসকে বাইরে নিয়ে গেলো।

পরদিন সকালবেলা শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে সালিস বসলো। হেমা, শফি আর কুদ্দুসের কথা কেউ শুনলো না। সালিসে সিদ্ধান্ত হলো কুদ্দুসকে সবার সামনে দশ বার কান ধনে উঠবস করতে হবে।

কী অপমানজনক দৃশ্য। সবাই দেখেছে আর কতো আনন্দ করেছে। এখনো সবুজের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনা দোষে কুদ্দুসের শাস্তির দৃশ্য।

না, সবুজ কাউকে নদী পার করে দেয়ার কথা বললো না। সে নদীর ঘাট থেকে আরও ভাটিতে গিয়ে একটু একটু করে পানিতে নামলো। শীতে পা যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে। নদীতে তেমন পানি নেই। কোথাও কোথাও হাঁটুর সামান্য ওপরে আবার বেশিরভাগ জায়গায় হাঁটুর নিচেই।

নদী পার হয়ে সে রাজিবপুর ঢুকলো না। মেঠো পথ দিয়ে রৌমারী জামালপুর রোডে এসে উঠলো। তারপর সে আবার হাঁটতে শুরু করলো । রাস্তায় তখনো গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। সে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর একটা ট্রাকে উঠলো। 

সবুজ টাকাগুলো গুণে বালিশের নিচে রাখলো। অনেক টাকা! সবুজের অনেকদিনের শখ ছিলো মোবাইল ফোন কিনবে। একটা না দু’টো। তার কাছে একটা থাকবে আরেকটা থাকবে রেণুর কাছে। যখন ইচ্ছা তখন রেণুর সঙ্গে কথা বলবে, সে দেখেছে ফজু মাতব্বরের মেয়েটা ওদের বাড়ির পাশে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কী কথা এতো! যেনো কথাই ফুরায় না। ওকে দেখেই সবুজ বলেছিলো, আমার টাকা হলে তোমাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিবো, আমিও একটা নিবো।

তারপর-

সবসময় কথা বলবো।

রেণু মিষ্টি হেসে বলেছিলো, আমার সঙ্গে তো তোমার সবসময় কথা হচ্ছেই, দেখাও হচ্ছে।

সবুজ প্রতিবাদ করেছিলো, না, সবসময় হচ্ছে না। আমি যখন রাজিবপুর চলে যাই, যখন ভ্যান চালাই তখন তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি না।

রেণু আঁতকে উঠেছিলো, তুমি ভ্যান চালাতে চালাতে আমার সঙ্গে কথা বলবে।

হ্যাঁ, ফাঁকা রাস্তায় যখন প্যাসেঞ্জার থাকবে না তখন রিকশা ভ্যানের প্যাডেল ঘুরাতে ঘুরাতে তোমার সঙ্গে কথা বলবো।

রেণু সবুজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরেছিলো, না, তোমাকে মোবাইল ফোন কিনতে হবে না। আমারও দরকার নেই।

তখন টাকা থাকলে সবুজ রেণুর কোনো কথা শুনতো না। আর আজ সবুজের হাতে ক’টাকা উঠেছে, ইচ্ছা করলে এখনই মোবাইল ফোন কিনে আনতে পারে কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলবে সবুজ? তার রেণুর তো কোনো মোবাইল ফোন নেই, তার কাছে গ্রামের কারও মোবাইল নাম্বারও নেই।

রেণুকে নিয়ে সবুজের কত স্বপ্ন? সে রেণুকে রাজিবপুর নিয়ে যাবে, লাল শাড়ি কিনে দিবে, লাল শাড়িতে রেণুকে খুব ভালো মানাবে। রেণুর সঙ্গে সবুজের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটা রেণুর বাবা-মা জানতো, বিয়ের প্রস্তাব গেলে হয়তো তারা আপত্তি করতো না। কিন্তু কেনো যে সবুজ বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো না। সেকথা ভেবে সবুজ কূলকিনারা পায় না। এই চার মাসে গ্রামের কারও সঙ্গে সবুজ’র যোগাযোগ হয়নি, গ্রামের পরিসি’তি কী তাও সে ভালো করে জানে না। আবার গ্রামে গিয়ে যদি তাকে সালিসের মুখোমুখি করা হয় তবে…

সবুজ টাকাগুলো বার বার করে গুণে একবার মৃদু হাসলো। এখানে নিয়মিত ডিউটির বাইরেও সবুজ ওভার টাইম করে অনেক টাকা রোজগার করে। ব্রহ্মপুত্রে বড়শী ফেলে একটা মাছের আশায় সারাদিন টুকটুক করে বসে থাকা, রাজিবপুর থেকে ভ্যান চালিয়ে সামান্য ক’টা টাকা নিয়ে বাড়িতে ফেরার চেয়ে এ যেনো অনেক অনেক টাকা। শুধু কি টাকা? থাকার জায়গাটাও সবুজের অনেক পছন্দ। শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে নিত্য ব্রহ্মপুত্রের হুঙ্কারে আতঙ্কগ্রস’ সেই টিনের চালা কিংবা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকার চেয়ে এ যেনো হাজার গুণ ভালো। অন্ন বস্ত্রের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত।

সবুজের মনে পড়লো শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের নাজির পণ্ডিতের কথা। গ্রামের মানুষ সবাই তাকে পণ্ডিত বলতো, না তিরস্কার করে না, সম্মান করে, তার জ্ঞান গরিমার জন্য। পণ্ডিত মশাই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গ্রামের যে কেউ কোনো বিষয়ে সৎ পরামর্শের জন্য একসময় তাঁর কাছে আসতেন। সেই পণ্ডিত মশাই বলতেন, মানুষের সব পাওয়া হবে যখন তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে। চাকরির শুরুতে বেতন কম, নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সংসার চালাতে সবাই হিমশিম খায়। প্রতি বছর বেতন বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বেশি বেতন হয় রিটায়ার্ড করার সময়। রিটায়ার্ড মানে তো অবসর, মানে কাজ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলা, মানে বুড়ো হওয়ার কারণে কাজে অক্ষম। বুড়ো বয়সে মানুষের টাকা কী দরকার। বার্ধক্যের জন্য যখন ইচ্ছা করলেও ভোগ করার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি বলে কিছু থাকে না। তখন আর টাকা কী কাজে লাগবে। আরে বাবা সরকার মহাশয় বেতন দিবি তো যুবক বয়সে বাড়িয়ে দে। বৃদ্ধ বয়সে যখন হাই প্রেসার, ডায়াবেটিস ধরবে তখন তো খাওয়ার কিছু নেই, ভালো কাপড়-চোপড় পরার মানসিকতা নেই, তখন আর বেশি বেতন দিয়ে কী হবে। কথাগুলো পণ্ডিত মশাই হাসতে হাসতে বলেছিলেন তার পাড়ার সম্পর্কের এক নাতনি যখন প্রাইমারি স্কুলের চাকরি পেয়ে তাঁর কাছে দোয়া নিতে এসেছিলো। সবুজ তখন রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। পণ্ডিত মশাইয়ের এই নাতনিটি আবার সবুজের বান্ধবী। পণ্ডিত মশাইয়ের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখে সবুজ দাঁড়িয়েছিলো। দাদু নাতনির কথা শুনে সবুজ হেসেছিলো। সেই নাতনিটিও হেসে গড়াগড়ি দেয়ার মতো অবস’া। পরে পণ্ডিত মশাই নাতনির মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছিলেন।

আজ টাকাগুলো গুণতে গুণতে সবুজের পণ্ডিত মশাইয়ের কথা মনে পড়লো। যখন সবুজ শঙ্কর মাধবপুর ছিলো, যখন ইচ্ছা করলেও রেণুকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবার মতো পরিবেশ ছিলো না এমন কি সবুজের সামর্থ্যও ছিলো না। এখন ঢাকা শহরে সবুজের রেণুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে কোনো বাধা নেই। সবুজের যে চাকরি জুটেছে তাতে তার বেতন দিয়ে দু’জনের সংসার কষ্ট করে হলেও চলে যাবে আর দু’জনে চাকরি করলে তো তাদের দিন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলবে। কিন্তু এখন রেণুকে বিয়ে করে নিয়ে আসার সুযোগইবা কোথায়? ব্যাপারটা যেনো পণ্ডিত মশাইয়ের কথার মতোই। আগে রেণুকে পাওয়া সম্ভব ছিলো কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি ছিলো না আর এখন আর্থিক সঙ্গতি আছে কিন্তু রেণুকে পাবার সুযোগ নেই। বিষয়টা যেনো সাধ ও সাধ্যের মতো, ক্ষুধা ও খাবারের মতো। যাদের খাবার রুচি আছে তাদের খাবার নেই আবার যাদের অঢেল আছে তাদের মুখে রুচি নেই।

তারপরও সবুজ রেণুকে পাবার হাল ছেড়ে দেয়নি। এই পাকা ঘর, থাকা-খাওয়ার একটা পাকা বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে সবুজের মন বসে না। তার  মন পড়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের চরে, নড়বড়ে সেই ঘরে। ব্রহ্মপুত্রের চর যেনো তার অস্তিত্ব, তার হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে সেই শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম। গ্রামের সেই নদীর ঘাটে তার পথের দিকে চেয়ে থাকা রুপালী রঙ্গের সেই কিশোরী রেণু। কোনো কোনো দিন রাজিবপুর থেকে ফিরতে রাত হলে রেণু কোনো না কোনো অজুহাতে শঙ্কর মাধবপুর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতো। দূর থেকে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সবুজ চিনতে পারতো রেণু তার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। নৌকা ঘাটের কাছাকাছি যেতেই রেণু হারিয়ে যেতো। সবুজ রেণুকে খুঁজতে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতো। সবাই চলে যাওয়ার পর বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে রেণু বেরিয়ে পড়তো। তারপর দু’জনে এক সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে যেতো। সবুজ আগে রেণুকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিতো, কোনো কোনো দিন তাদের বাড়িতে ঢুকে কিছুক্ষণ রেণুর মা, বড় বোন বানুর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে তার বাড়িতে চলে যেতো। তখন সবুজের কখনো মনে হয়নি তার আর রেণুর মধ্যে কোনো এমন বিচ্ছেদ হতে পারে, এই সমাজ আর সামাজিকতার নামে রাতের আঁধারে তাকে রেণুকে ছেড়ে চলে আসতে হতে পারে।

এখানে আসার তার তিন মাস হয়ে গেলো আর ঢাকা আসার হলো প্রায় চার মাস। সবুজের প্রায়ই মনে হয় সে রেণুকে ঢাকায় নিয়ে আসবে, রেণুও তার সঙ্গে গার্মেন্টসে চাকরি করবে, বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে। কিন্তু রেণুকে ঢাকা নিয়ে আসা সবুজের জন্য অনেক কঠিন। সালিসের ভয়ে সে যখন গ্রামেই যেতে পারছে না তখন রেণুকেই বা নিয়ে আসবে কীভাবে?

দুই

নুরু উদাস দৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ আগে ফুলি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কয়েকবার ডাকও দিয়েছে কিন্তু নুরুর সেদিকে লক্ষ্য নেই। তখন নুরুর বয়স কতই বা হবে? সতেরো কিংবা আঠারো, তখন থেকেই শুরু হলো বিয়ের জন্য কনে দেখা। বিয়ের বাজারে নুরু তখন পাত্র হিসেবে আকর্ষণীয়। শুধু এই গ্রামেরই নয়, আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষ থেকে নুুরুর বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান আসতে শুরু করলো। অবশেষে বিয়েও ঠিক হলো। নিষ্পাপ ফুলের মতোই একটা মেয়ের সঙ্গে। ব্রহ্মপুত্রের চরে বিয়ের বয়স শুরু হয় আরও আগে থেকেই। কনের অনেক বান্ধবীরও ইতোমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছে। ফুটফুটে ফুলের মতো এই মেয়েটির নাম ফুলবানু। শৈশব থেকে সবাই ফুলি বলে ডাকতে ডাকতে শেষ পর্যন্ত ফুলবানুর নাম দাঁড়িয়েছে ফুলি।

সেই তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের ফুলিই এখন তিন কন্যা আর এক পুত্র সন্তানের জননী। জীবন যন্ত্রণায় এই বয়সে যেনো বার্ধক্য ধরেছে। চোয়াল দু’টো বসে গেছে, ফর্সা মুখ যেনো তামাটে, চোখ দু’টো বসে গেছে কোটরে। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই কিন্তু চেহারায় যেনো ষাট পেরিয়েছে। ফুলির বড় মেয়ে নুর বানুরও বিয়ে হয়েছিলো তেরো কিংবা চৌদ্দ বছর বয়সে, দিনের পর দিন স্বামী এবং সতিনের নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর ঘরে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু কোনোভাবে টিকতে পারলো না। প্রেম-ভালোবাসাহীন সংসার ছেড়ে একদিন বানু চলে এলো।

গ্রামের মাতব্বরদের পরামর্শে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাও করলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলা করেও কোনো লাভ হলো না। পনেরো বছর বয়সে আবার ফিরে এলো বাবার বাড়িতে। সে এখন হায়দার সর্দারের দলে শ্রমিকের কাজ করে বাবা-মা’র সংসারের কিছুটা বোঝা বহন করে। আজও নদী পার হয়ে গেছে ঐ দূর গ্রামে, মাটি কাটার কাজ করতে। প্রথম প্রথম তাকে নিয়ে নুরুর দুশ্চিন্তা হতো কিন্তু একসময় তার ভালোমন্দ তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। প্রতিদিন সকালবেলা বানু বেরিয়ে যায়, ফিরে আসতে আসতে বেশিরভাগ দিনই রাত হয়ে যায়। কোনোদিন রাতের অন্ধকারে নৌকায় একদল শ্রমিকের সাথে এসে বাড়ির পাশেই নামে, আবার কেনোদিন রাস্তা দিয়ে এলে অনেক দূর থেকে হেঁটে আসে। ততক্ষণ নুরু বাইরে দাঁড়িয়ে বানুর জন্য অপেক্ষা করে। আজও নুরু নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বানুর নৌকা আসার জন্য অপেক্ষা করছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো এখনো কোনো ইঞ্জিন নৌকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

নুরু একবার দূর দিগন্তে তাকালো। ব্রহ্মপুত্র আরও কতদূর ছিলো! অনেকদূর! অথচ আজ! পাশ দিয়ে পশ্চিম পাড়ার দুলু যাচ্ছিলো। নুরুকে দেখে বললো, নদী যে একেবারে উঠানে এসে দাঁড়ালো নুরু, ঘর সরাবি না?

দুলুর কথা নুরুর কানে যেতেই সে চমকে উঠলো। সে পাশ ফিরে তাকালো ফুলিও দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু বললো না। পাড়ের বড় এক খণ্ড মাটি নদীতে ভেঙে পড়ার শব্দে নুরু বুকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো। নদীর পাড় ভাঙ্গার শব্দ না, যেনো বুকের পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ, হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ। তার চোখ থেকে ছিটকে পানি বের হলো। কী বলবে নুরু। সে দুলুর দিকে ফিরেও তাকালো না। বোবা দৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ফুলি মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, বাড়িতে এসো।

কিন্তু নুরু শুনেও না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে রইলো উদাস দৃষ্টিতে। তার বুকের মধ্যে বার বার করে যেনো পাড় ভাঙ্গার শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হৃদয়ে ভেসে উঠছে এই মাটিকে ঘিরে শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতি। ফুলি আরও কিছুক্ষণ নুরুর পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, চলো, বাড়ি যাবে না?

নুরু অন্যমনস্কভাবে বললো, বাড়ি! হ্যাঁ বাড়ি তো যেতেই হবে কিন্তু আর ক’দিন? ব্রহ্মপুত্র তো আবারও হুঙ্কার দিচ্ছে। তারপর তো আবারও বাড়ি সরাতে হবে। এটা তো আর নতুন না। আমরা চরের মানুষ নদী ভাঙ্গার ভয় করলে কি আমাদের চলে? বলে নুরু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপর আপনমনে বলতে শুরু করলো, তা চলে না কিন্তু এই এক জীবনে আর কতবার বাড়ি সরাবো? আমাদের বাড়ি ছিলো ঐযে ছোট্ট একটা নৌকা আসছে ওখানে, এখন নদীর মাঝখানে। তার আগে আরও কতদূর ছিলো। সারা বছর আমাদের আঙিনা ফসলে ভরে থাকতো, সরিষা, মসুর, গম, তিল আরও কত ফসল। গ্রামের মধ্যে আমরাই বড় গৃহস’ ছিলাম। অথচ ব্রহ্মপুত্র সব জমি খেয়ে ফেললো, থাকলো শুধু বাড়ি ভিটেটা আর বিঘা দুই জমি। যেভাবে নদী এগিয়ে আসছে তাতে আর ক’দিন…বলে নুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

ফুলি বললো, তুমি এত চিন্তা করওনা তো। ব্যবস’া একটা হবেই।

এই ব্রহ্মপুত্রের চরে নুরুর জন্ম হয়েছে, বেড়ে উঠেছে এই চরেই, নদীর গতি তার জানা আছে এখন ভিটেমাটির যে অবস’া তাতে যেকোনো মুহূর্তে ভিটেমাটি তলিয়ে যেতে পারে বুভুক্ষ ব্রহ্মপুত্রের অতলে। তারপর ছিন্নমুল মানুষের মতো তাকেও কারও গলগ্রহ হয়ে আশ্রয় নিতে হবে কোনো পাড়া পড়শির ভিটেমাটিতে, বেড়িবাঁধের ওপর কিংবা তার স্মৃতি বিজড়িত শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম ছেড়ে জীবিকার প্রয়োজনে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। ক’বছরের ব্যবধানে একজন মধ্যবিত্ত কৃষক এখন ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষ।

ফুলি আমাদের বিয়ের কথা তোমার মনে আছে? নুরু জিজ্ঞেস করলো।

আছে কিন্তু এই কথাগুলো কি তোমাকে বলতে হবে এই নদীর ঘাটে?

নদীর ঘাট আর বাড়ি। নদীর ঘাট সেই বাড়ি তো একটাই। আর ক’হাত বাকি আছে, বলো?

তবু বাড়ির চারপাশে তো একটা বেড়া আছে। ওখানে কথা বললে কেউ শুনতে পাবে না। আর এখানে? এটা তো ঘাট, মানুষ নৌকা থেকে নামবে তোমার এই সব কষ্টের কথা শুনলে…

কেউ শুনলে কী হবে? এই শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের পূর্ব পাড়ে সোনাভরি নদী আর পশ্চিম পাড়ে ব্রহ্মপুত্র। আজকের ধনী কালকের পথের ভিখারী, বলে নুরু একটা কষ্টের হাসি হাসলো।

আজ ফুলি যেনো নুরুকে অন্যরকম দেখছে, নুরুর সঙ্গে ফুলির সংসার জীবন প্রায় দুই যুগের কিন্তু কেনোদিন তাকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। অবশ্য আগে নুরুর মনে বল ছিলো। বিশ বিঘা জমির মধ্যে দু’বিঘা নদীতে ভেঙ্গে গেলে মানুষ নি:স্ব হয় না কিন্তু শেষ সম্বলটুকুও যদি বিলীন হয়, বসতবাড়ি যদি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় তবে আর মানুষের থাকলো কী?

নুরুর কথা শুনতে শুনতে ফুলির চোখ পানিতে ভরে গেলো। তার কণ্ঠস্বর ভিজে গেলো, সে রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, তুমি এভাবে বলোনা তো, বাড়ি চলো।

নুরু ফুলির মুখের দিকে তাকালো, ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, চাঁদের আলো ফুলির মুখের ওপর পড়েছে, নুরু দেখতে পেলো ফুলির গণ্ডদেশ পানিতে চকচক করছে। নুরু কয়েকমুহূর্ত ফুলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর জিজ্ঞেস করলো, বানু এসেছে?

ফুলি না সূচক মাথা নাড়লো।

অল্প বয়সে মেয়েটার জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। নিজের সংসার ছেড়ে বাবা-মা’র সংসারের জন্য হায়দার সর্দারের দলে লেবারের কাজ করতে হচ্ছে।

দূর থেকে একটা ইঞ্জিন নৌকার শব্দ ভেসে এলো। ফুলি বললো, ঐ বোধ হয় আসছে। তুমি বাড়ি চলো, ও আসবে এখন।

একটু দাঁড়াই মেয়েটাকে নিয়ে যাই। তুমি বরং যাও বাড়িটা ফাঁকা আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ইঞ্জিন নৌকা ঘাটে এসে দাঁড়ালো। নৌকা থেকে নামলো নারী-পুরুষ মিলে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের একটা দল। বানু নৌকা থেকে নেমেই বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো, বাবা।

সবাই বাড়িতে ঢুকলো। নুরু আঙিনায় থাকা একটা চেয়ারে বসলো। বানু হাত মুখ ধুয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়ালো। নুরুর মুখে কোনো কথা নেই। আজ নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে সে যেনো বোবা হয়ে গেছে। বানু কয়েকমুহূর্ত বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। সাধারণত প্রতিদিন কাজ থেকে আসার পর বাবা মেয়ে কিছুক্ষণ কথা হয় কিন্তু আজ বাবাকে যেনো নতুন দেখছে বানু। সে কিছুটা বিচলিত হলো, বাবা তোমার মনটা কি খারাপ?

নুরু কোনো কথা বললো না। বানু আবার জিজ্ঞেস করলো, ও বাবা কী হয়েছে তোমার?

কিছু হয়নি রে মা।

মনটা খারাপ কেনো?

মন খারাপের কারণের কী আর অভাব আছে। নদী কাছে এসে পড়লো, তোর কোনো একটা…

বানু বাধা দিয়ে বললো, আমার কথা বাদ দাও বাবা।

বাদ দিবো কেনো? তোকে বিয়ে দিতে হবে, রেণুকে বিয়ে দিতে হবে।

ও বাবা ভালো কথা বলেছো, যাও না বাবা, কাল রেণুকে বাড়িতে নিয়ে আসো।

সেটা তো আমিও ভাবছি কিন্তু কেউ যদি কিছু বলে?

ফুলি উঠোন থেকে আঙিনায় আসতে আসতে বললো, ও বানুর বাবা আমিও বলছিলাম এখন তো সবকিছু মিটে গেছে, সবুজ তো গ্রাম থেকে চলে গেছে, এখন যাও না রেণুকে নিয়ে আসো।

যদি কেউ কিছু বলে?

কে কী বলবে?

গ্রামে কতো মানুষ, তাদের কার কতো ধরণের মতলব থাকে।

ফুলি জোর দিয়ে বললো, তুমি বাদ দাও তো অত চিন্তা।

তাহলে আমি এক কাজ করি বানুর মা?

ফুলি এবং বানু দু’জনে নুরুর মুখের দিকে তাকালো।

নুরু বললো, কাল একবার ফজু মাতব্বরকে বলে দেখি।

বানু কিছুটা ধমকের সুরে বললো, ফজু মাতব্বর কি তোমাকে আনতে বলবে নাকি?

কিন্তু নিয়ে আসার পর যদি…

কথাটা শেষ করতে পারলো না নুরু, তার কণ্ঠ বুজে এলো। সে আপনমনে বিড় বিড় করছে, সালিসের নামে এই গ্রামে কত কী যে হচ্ছে তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত রেণুকেও যদি কোনো শাস্তি দেয়, মাথা চুল কেটে দেয়, মুখে কালি মেখে যদি গ্রামে…

আগের দিনে এই চরের মানুষ খুব সহজে কোর্ট-কাচারি যেতো না। বড়দের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধা ছিলো, তাই ছোট-খাটো ঝগড়া বিবাদ গ্রামের মুরুব্বীদের মাধ্যমে গ্রাম্য সালিসেই মীমাংসা করে নিতো। গ্রামের মানুষের এই মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিলো। তাদের সালিস ছিলো নিরপেক্ষ, ধর্ম ও সামাজিকতার আলোকে স্বজনপ্রীতি মুক্ত, ছিলো ন্যায় বিচার।

তখনকার সেই ন্যায় বিচার এখন আর নেই কিন্তু সালিস নামটা আছে। আজকাল সালিসের নামে ব্রহ্মপুত্রের এই চরে হয় প্রহসনের বিচার, পক্ষপাতমূলক, মানুষকে হেয় করার বিচার। সেদিনের মাতব্বররা ছিলো সবার শ্রদ্ধার পাত্র, তাদের দেখলে সবাই পথ ছেড়ে দিতো। মহিলারা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকতো।

এখনো এলাকার মাতব্বরকে দেখলে সবাই পথ ছেড়ে দেয় কিন্তু শ্রদ্ধায় না আতঙ্কে, এখনো মহিলারা গ্রাম্য মাতব্বরদের দেখলে পথ ছেড়ে দেয়, মাথায় ঘোমটা দেয় তবে শ্রদ্ধায় না। তাদের কু-প্রবৃত্তি থেকে, তাদের খারাপ নজর থেকে নিজেদের আড়াল করার জন্য। মাতব্বররা যখন স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার করার মতো বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তখন আবার সালিস কীসের?

আজকাল সালিসের নামে ব্রহ্মপুত্রের চরে এক প্রকার আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোনো কিছু ঘটলেই সালিস। সেই সালিসের রায় যাবে তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাবান, প্রভাবশালীদের পক্ষে। নির্যাতিত মানুষকে আইন আদালতে যাওয়া থেকে বিরত রাখার পক্ষে। আর দু’পক্ষই সমান হলে রাতের আঁধারে চলে বিচারককে ম্যানেজ করে রায় নিজের অনুকূলে নেওয়ার তদবির। যে মাতব্বরকে ম্যানেজ করতে পারে রায় যায় তার অনুকূলেই। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সালিস এখন অপমান আর আতঙ্কের। 

তিন

রেণুর বিয়ের আলোচনা শুরু হলো রাতের খাবারের পর। তার আগে শুরু হলো মফিজ মণ্ডলের সংসারের টুকটাক আলোচনা। নুরু এই পরিবারের বড় জামাই। নুরুর সঙ্গে যখন ফুলির বিয়ে হয় তখন মফিজ মণ্ডলের আর্থিক অবস’া ভালো ছিলো না। সব জমি ছিলো নদী গর্ভে। সেই দুর্দিনগুলোতে নুরু শুধু জামাই হিসেবেই নয় বড় ছেলের মতো শ্বশুরের পাশে দাঁড়িয়েছে। তখন থেকে শ্বশুরের সংসারের সব সিদ্ধান্তের বিষয়ে নুরুর সঙ্গে আলোচনা করে। ফুলির ছোট বোনের যখন বিয়ে হয় তখন নুরু অনেক টাকা খরচ করেছিলো। টাকার অভাবে নুরুর শ্যালকের লেখাপড়া যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো তখন নুরুই তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলো। নুরুর সেই শ্যালক মজিদুল কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে এখন একটা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করছে। মজিদুলের বউ শিক্ষকতা করছে প্রাইমারি স্কুলে। এই সংসারে নুরু অবদান অনেক।

এই দুই পরিবারের আর্থিক অবস’া এখন ঠিক উল্টো হয়ে গেছে। একদিনের মধ্যবিত্ত কৃষকের সব জমিজমা ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে সে এখন ছিন্নমুল মানুষ, আরেক পরিবারের জমিতে চর জেগে ওঠায় সে এখন মধ্যবিত্ত কৃষক। তবে এই বাড়িতে নুরুর কদর একটুও কমেনি। নুরুর শ্বশুর তাকে ঠিক আগের মতোই সম্মান করে, শ্যালক-শ্যালিকা তাকে ঠিক আগের মতোই শ্রদ্ধা করে। আজ বিকেলের নৌকায় নুরু আসার সঙ্গে সঙ্গে তার শাশুড়ি খাঁচা থেকে মুরগি বের করলো, মজিদুল ছুটে গেলো চিলমারী বাজারে, সে বাজার থেকে একটা বড় আইড় মাছ নিয়ে এলো। নুরু রাতের খাবার খেলো তৃপ্তি সহকারে।

আঙিনায় পাশাপাশি তিনটা চেয়ারে বসেছে নুরু, তার শ্বশুর মফিজ মণ্ডল আর মজিদুল। উঠোনে একটা মোড়ায় বসেছে নুরুর শাশুড়ি আর তার বউমা। নুরুর শ্বশুরই প্রথম কথা তুললো, জামাই রেণুর বিয়ের জন্য একটা ঘর এসেছে, আলাপটা হয়েছে আরও ক’দিন আগে, আমি ভাবছিলাম তোমাকে খবর দিয়ে পাঠাবো, যাক তুমি এসেছো, ভালোই হয়েছে।

নুরু কোনো কথা বললো না।

মফিজ মণ্ডল আবার বলতে শুরু করলো, আমি বউমার কাছে শুনেছি ছেলেটার বাড়ির অবস’া ভালো, কয়েক বিঘা আবাদি জমি আছে, সারাবছর ঘরের ভাত খায়, মাস্‌আল্লাহ। ফকিরের হাটে বড় মুদির দোকান আছে, সবই জানাশোনার মধ্যে। আমার মনে হয় বিয়েটা হলে ভালোই হবে।

নুরুর চোখের সামনে রেণুর মুখচ্ছবিটা ভেসে উঠলো, সবুজ আর রেণু শৈশব থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে তাদের মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের দু’জনের এই সম্পর্কটা নুরু জানতো, ফুলিও জানতো। ছেলে হিসেবে সবুজ খারাপ না, শুধু আর্থিক অবস’াটাই যা দুর্বল। তা হোক, মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার মনের অবস’া বুঝে নুরু তাকে সবুজের সঙ্গেই বিয়ে দিতো কিন্তু আজ সবুজ কোথায়?

নুরুকে চুপ করে থাকতে দেখে তার শ্বশুর জিজ্ঞেস করলো, জামাই কী ভাবছো?

না আব্বা, কিছু না।

তুমি তোমার গ্রামের কথা ভেবো না। রেণুকে আমি আমার বাড়ি থেকে বিয়ে দিবো।

নুরু মৃদু কণ্ঠে বললো, আব্বা আপনি তো আমার অবস’া জানেন। রেণুর বিয়েতে ডিমান্ড, বিয়ের খরচ…

মফিজ বাধা দিয়ে বললো, বলছি তো তুমি সেকথা ভেবো না, আমি বলেছি না রেণুকে আমি বিয়ে দিবো।

মজিদুল বললো, দুলাভাই শুধু বাবা কেনো আমিও আছি। তুমি আমার জন্য কতকিছু করেছো আর আমি শুধু আমার একটা ভাগিনীর বিয়েতে কিছু টাকা খরচ করতে পারবো না। তুমি সম্মতি দিলে আমি আর বাবা মিলে সব আয়োজন করবো। শাপলা বলছিলো বলে মজিদুল একবার বারান্দার দিকে তাকাতেই মজিদুলের বউ শাপলা বললো, হ্যাঁ দুলাভাই আমিই তো আব্বাকে বলেছি, সবাই আমার পরিচিত, এমন ঘর হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।

রেণু এতক্ষণ ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিলো। আজ সবুজ যদি থাকতো তবে তার বিয়ের প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গে সে সবুজের হাত ধরে চলে যেতো। সবুজের টাকা-পয়সা না থাক, তার একটা সুন্দর মন আছে। রেণু জন্ম থেকে বন্ধু এবং প্রেমিক বলে একজনকেই জেনেছে, স্বামী হিসেবে একজনকেই কল্পনা করেছে। আজ তার বিয়ে নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা তার কানে আসামাত্র সে সবুজের হাত ধরে চলে যেতো। রেণু তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বার বার ফিসফিস করে বললো, বাবা, তুমি না বলো বাবা। তুমি না বলো বাবা, আমি সবুজ ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।

মফিজ বললো, জামাই।

জি আব্বা।

কিছু বলছো না যে।

আব্বা আমার আপনজন বলতে, মুরুব্বী বলতে তো আপনিই। আপনি যদি ভালো মনে করেন তো…

মফিজ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো, আলহামদুলিল্লাহ।

রেণুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।

সারারাত রেণুর চোখে ঘুম নেই। কিছুক্ষণ পর পর ঘুমের ভাব আসছে আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। এমন নির্ঘুম রাত তার জীবনে এই প্রথম। সবুজের সাথে তার বিয়ে হবে না এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। সবুজ একদিন বলেছিলো, রেণু চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।

রেণু অপ্রস’ত হয়ে গিয়েছিলো। সবুজকে সে ভালোবাসে, একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, প্রতিদিন অন্তত: দু’বার দেখা হবেই। সকালবেলা দেখা হওয়ার সময় পেরিয়ে গেলে রেণুর মন খারাপ হয়ে যেতো। সেই সবুজকে ছেড়ে আজ প্রায় চার মাস সে চিলমারীতে আছে মনের মধ্যে একটা আশা নিয়ে, আবার সবুজের সঙ্গে তার দেখা হবে, সে বউ সেজে সবুজের পাশে দাঁড়াবে কিন্তু তার সেই ক্ষীণ আশাও আজ চিরদিনের জন্য ভেঙ্গে যাচ্ছে। এমনি হাজার চিন্তা করতে করতে রেণুর ঘুমের তন্দ্রা এসেছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সবুজের ছবি। সবুজ একটা লাল চেকের শার্ট পরেছে, জিন্সের প্যান্ট, চোখে বড় সানগ্লাস, কী রে রেণু কেমন আছিস্‌?

রেণু শুষ্ক মুখে উত্তর দিলো, কেমন আছি তুই জানিস্‌ না। কতদিন থেকে তুই নেই আমি কীভাবে ভালো থাকি বল্‌?

সবুজ মুচকি হাসি হেসে বললো, আমি চলে আসবো রেণু। আমিও আর তোকে ছেড়ে থাকতে পারছি না।

তুই এখন কোথায় সবুজ?

ঢাকা। আমি গ্রামে আসবো রেণু, তোকেও ঢাকা নিয়ে আসবো।

রেণু অভিমানের সুরে বললো, আয় আর ক’টা দিন পরে আয় ততদিনে আমার বিয়েটা হয়ে যাক।

তোর বিয়ে হবে? তুই অন্য ছেলেকে বিয়ে কর্‌বি? বলে সবুজ এমনভাবে বললো যেনো সে কথাটা আমলেই নিলো না।

হাসছিস্‌ কেনো?

সবুজ বললো, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিস্‌?

ইয়ার্কি করবো কেনো?

ইয়ার্কিই তো।

আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। যেকোনো দিন বিয়ে হতে পারে।

তুই আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে কর্‌বি?

আমি বিয়ে না করতে চাইলেই কি পারবো? বাবা-মা আমাকে ছাড়বে? তুই মনে হয় গ্রামের অবস’া জানিস্‌ না?

এবার সবুজের মুখ শুকিয়ে গেলো, রেণু!

আমার কিছু করার নেই সবুজ। আমিও তোকে ছাড়া বাঁচবো না, তোকে ছাড়া…বলতে বলতে রেণুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

রেণু বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রেণুর মনে হাজার চিন্তা। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, রেণু একবার চিন্তা করলো পালিয়ে যাবে। পালিয়ে না গেলে সবাই মিলে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিবে। তখন তার কিছুই করার থাকবে না। আবার কখনো মনে হলো পাত্র পক্ষ দেখলেই তো বিয়ে হলো না। তাদের পছন্দ হতে হবে। তার মধ্যে এমন কী আছে যে পাত্র পক্ষ তাকে দেখেই বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কনে দেখতে এসে বিয়ে না করে ফিরে যাওয়ার ঘটনাও অহরহ। এমনি হাজারও কারণ আছে, ছেলের পছন্দ-অপছন্দ, বংশের মান-মর্যাদা, ডিমান্ড ইত্যাদি। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণের তো অভাব নেই। কিন্তু যদি এসব না হয়, ভালোই, ভালোই যদি সবকিছু হয়ে যায় তবে তো বিয়ে হবেই। তারপর তাকে তুলে দিবে তার অচেনা-অজানা পাত্রের হাতে। সবুজের কাছে তার ফিরে যাওয়ার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। না, না, সবুজকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সবুজ, সবুজ তুমি কোথায়? আমাকে ফেলে এভাবে তুই কেনো চলে গেলি, আপনমনে ফিসফিস করে বলতে বলতে রেণু বারান্দা থেকে আঙিনায় নামলো।

রেণুর পাশের ঘরে তার মামা-মামি থাকে। দরজা খোলার শব্দে তার মামি জেগে উঠলো। সে মফিজুলকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আস্তে আস্তে ডাক দিলো, এই, এই ওঠো তো।

মফিজুল জেগে উঠলো, কী?

শাপলা চাপা স্বরে বললো, কার যেনো পায়ের শব্দ পেলাম। চোর এলো না তো?

মফিজুল কান খাড়া করলো, কই আর কোনো শব্দ নেই তো।

তুমি ওঠো তো। একবার আঙিনায় গিয়ে দেখো।

উঁহু, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

ঘুমাতে হবে না। একবার দরজাটা খুলে দেখো।

এমনসময় দরজা খোলার শব্দে মফিজুল বিছানা থেকে উঠে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

চার

সবুজের সঙ্গে রেণুর বিয়েতে কোনো বাধা ছিলো না। এই দুই পরিবারের মধ্যে একটা নীরব সম্মতিও ছিলো। সবুজের মা মারা যাওয়ার পর সবুজ আর তার বাবার রান্না এবং সংসারের কাজ দেখাশুনা করার জন্য একজন নারীরও প্রয়োজন ছিলো। অপেক্ষা ছিলো শুধু আনুষ্ঠানিকতার। কিন্তু এর মধ্যে ঘটলো আরেক দুর্ঘটনা। মাছ ধরা সবুজের পেশা না হলেও এই গ্রামের অনেকেই যেমন শখের বশে নদীতে মাছ ধরতে যায় তেমনি সবুজ আর তার বাবাও মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যেতো। তাদের মাছ ধরার একটা জাল আর একটা পাল তোলা নৌকা ছিলো।

তখন বৈশাখ মাস। নদীতে তেমন পানি ছিলো না কিন্তু বৈশাখ এলে প্রায়ই কালবৈশাখী ঝড় হয়। সবুজ তার বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলো। হঠাৎ করে এক খণ্ড কালো মেঘ আকাশের অনেকটা অংশ ছেয়ে ফেললো। অল্প সময়ের মধ্যে অন্ধকার নেমে এলো। সবুজের বাবা নৌকা নিয়ে নদীর তীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করলো। বাপ-বেটা মিলে প্রাণ পণ চেষ্টা করলো তীরে নৌকা ভিড়ানোর কিন্তু ততক্ষণে নদীতে ঢেউ শুরু হয়েছে। উত্তাল ঢেউ। তাদের নৌকার মাথা একবার উঁচু হচ্ছে আরেকবার পানিতে আছড়ে পড়ছে। সবুজের বাবা শক্তভাবে হাল ধরেছে কিন্তু পাল যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। নৌকা পানিতে ভরে গেলো, হঠাৎ করে বাতাসে একটা কুণ্ডলীর সৃষ্টি হলো। নৌকার পাল দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। কোথায় গেলো নৌকা? কোথায় সবুজ আর তার বাবা? সবই নিয়তি পরদিন নদীর চর থেকে সবুজকে সংজ্ঞাহীন অবস’ায় গ্রামের লোকজন উদ্ধার করলো, আর তার বাবার লাশটা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেলো না।

সবুজের বাবার জন্ম জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে সে বিয়েও করেছিলো। প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েরা সেখানেই তার পৈত্রিক ভিটেমাটিতে থাকে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবুজের বাবা একসময় চলে আসে রাজিবপুর উপজেলার শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে। এখানে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যায়। দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান সবুজ।

প্রায় এক বছর আগে সবুজের মা মারা যাওয়ার পর সবুজের দূর-সম্পর্কের এক খালা সবুজ আর তার বাবাকে রান্না করে খাওয়াতো। বাবা মারা যাওয়ার পর সবুজ আরও একা হয়ে পড়লো। এতদিন বাবার সংসারে তাকে কেনোদিন আয় রোজগারের কথা ভাবতে হয়নি, বাবা মারা যাওয়ার পর জীবিকার জন্য তাকে কাজ খুঁজতে হলো। কিন্তু শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে কাজ পাওয়া কঠিন। এখানে তো ক্ষেতমজুর ছাড়া আর কোনো কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। সবুজ ঠিক করলো ভ্যান চালাবে। প্রতিদিন সকালবেলা সবুজ সোনাভরি নদী পার হয়ে রাজিবপুর যাবে আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় ভ্যান জমা দিয়ে চলে আসবে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে। শুরু হলো সবুজের নতুন জীবন।

সবুজ প্রতিদিন সকালবেলা রাজিবপুর চলে যায়। রৌমারী রাজিবপুর রাস্তায় ভ্যান চালিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে। রেণু সোনাভরি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সবুজের জন্য অপেক্ষা করে। সবুজ দূর থেকে দেখে বাঁশ ঝাড়ের কাছে একটা নারী মূর্তি। এই নারী মূর্তি সবুজের কাছে নতুন না। এটা যে রেণুই তার জন্য অপেক্ষা করছে তা সে দূর থেকেই বুঝতে পারে। সেদিন শঙ্কর মাধবপুর ঘাটে নৌকা থেকে নামার তেমন যাত্রী ছিলো না। সবুজ নৌকা থেকে নেমে একবার এদিক-সেদিক তাকালো।

না, আজ রেণু নেই। সবুজ একটু চিন্তায় পড়লো, রেণু নেই কেনো? হঠাৎ করে তো রেণু এরকম করে না। সবুজ সোজা তার বাড়িতে না গিয়ে রেণুদের বাড়িতে গেলো। কিন্তু বাড়িতেও কেউ নেই। দরজা খোলা। সবুজ বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। না, আঙিনায়ও কেউ নেই। সে দেখতে পেলো রেণু ঘরের ভিতরে। সে এক পা, দু’পা করে রেণুর ঘরে ঢুকলো। না, রেণু ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই।

রেণু সবুজকে দেখে চমকে উঠলো, সবুজ তুই?

হ্যাঁ।

বাড়িতে কেউ নেই?

না।

মামা কোথায় গেছে?

রাজিবপুর।

মামি?

চিলমারী, নানার বাড়ি।

বানু আপা?

রেণু না সূচক মাথা নাড়লো।

সবুজ আরও দু’য়েক পা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো। রেণুর থুতনি উঁচু করে ধরে রেণুর চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, রেণু আমি তোকে ভালোবাসি, আমি তোকে বিয়ে করবো।

বিয়ে কর্‌বি তো বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাস্‌ না কেন?

পাঠাবো, বলে সবুজ রেণুকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালো।

রেণু প্রথমে বাধা দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না। সে শৈশব থেকে সবুজের সঙ্গে বড় হয়েছে। কতোদিন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছে, হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে কিন্তু এমন অনুভূতি তার জীবনে এই প্রথম। তার রক্তেও যেনো একটা ঢেউ বার বার আছড়ে পড়ছে। তার পা দু’টো শিথিল হয়ে গেছে। সবুজকে দূরে সরিয়ে দিতে গিয়েও পারলো না। সবুজ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সেও নিজের অজান্তে সবুজের বুকে মাথা রাখলো। 

রেণুর দূর-সম্পর্কের দাদি নুরী বুড়ি। সবসময় তাদের বাড়িতে আসে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করে। আবার এখান থেকে শুনে হাজার গুণ রঙচঙ লাগিয়ে আরেক বাড়িতে গিয়ে গল্প করে। সারাদিন কোনো কাজ নেই। ছেলের সংসারে খায় আবার ছেলে-বউমার নামেও হাজার রকমের দুর্নাম ছড়িয়ে বেড়ায়। এই ক’দিন আগে একদিন হঠাৎ করে রেণুকে জিজ্ঞেস করলো, ও রেণু ঐ ছেলেটার সঙ্গে এতো কী রে? ওকি তোর সোয়ামী হয় নাকি?

রেণু লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেলো, তুমি কী বলছো দাদি? কারও সঙ্গে কথা বললেই বুঝি সোয়ামী হয়?

সোয়ামী না কিন্তু কথা বলিস্‌ তো আবার সোয়ামীর চেয়ে বেশি।

রেণু রেগে গেলো, ছি: দাদি তোমার মনটা খুব ছোট।

আমার মনটা ছোট কী রে, তুই সবসময় কথা বলিস্‌ তাই আমি একটু ঠাট্টা-খিচুড়ি করছি।

আর আমার সঙ্গে ঠাট্টা-খিচুড়ি করবে না দাদি। ঠাট্টা-খিচুড়ি করতে করতে সবাই সত্যি বলে মনে করবে। তখন আমার দুর্নাম হবে।

দুর্নাম কী আর বাকি আছে। পাড়ার সবাই ছি: ছি: করছে।

রেণু প্রচণ্ড রেগে গেলো, সবাই বলুক দাদি। তুমি বলো না।

ঠিক আছে বলবো না, তবে যদি কেনোদিন দেখি সেদিন কিন্তু আমাকে আর থামাতে পার্‌বি না।

নুরী বুড়ি কোথা থেকে যেনো সবুজকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে এবং তখন থেকে একটা ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছে। সবুজ দরজা ভিড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজায় শিকল তুলে দিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো, ওগো, তোরা কে কোথায় আছিস্‌, সবাই আয়, দেখ রেণু আর সবুজ…

বানু টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে ফিরে এলো। নুরী বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললো, দাদি একটু থামো, দাদি তোমার পায়ে পড়ি আর চেঁচামেচি করো না। সবাই জেনে ফেলবে, রেণুর দুর্নাম হবে। রেণুর…

কিন্তু নুরী বুড়িকে থামানো গেলো না। তার চিৎকারে অল্পক্ষণের মধ্যে রেণুদের বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো। সবাই ছি: ছি: করতে লাগলো। এতদিন রেণুকে যারা ভালো বলে প্রশংসা করতো তারাও মুখ বিকৃত করে বলতে লাগলো, এতদিন তো মেয়েটাকে ভালো বলে জানতাম, তলে তলে যে এতদূর গড়িয়েছে এটা কে জানতো। বাবা-মা বাড়িতে নেই আর সেই সুযোগে পুরুষ মানুষ নিয়ে ফুর্তি করবে। ছি:, ছি:, ছি:।

কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন বখাটে ছেলে এসে হাজির হলো। ফজু মাতব্বর মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাড়ি যাওয়ার পথে নুরুর বাড়িতে হৈ চৈ দেখে এগিয়ে এলো। মসজিদের কিছু মুছল্লি এবং পাড়া-গাঁয়ের কিছু কৌতূহলী মানুষও এলো। কোনো কোনো সরল চিন্তার মানুষ বললো, যা হবার তা তো হয়ে গেছে, ওদের যখন একজন আরেকজনকে পছন্দ তাহলে কাজি ডেকে বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভালো।

এই প্রস্তাবে বখাটে ছেলেরা উত্তেজিত হলো, সবুজকে পিটিয়ে তক্তা বানাও। বেটার এতো বড় সাহস।

ফজু মাতব্বর তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করলো। কেউ কেউ বললো, না, গায়ে হাত দেয়ার দরকার নেই। ওদের আটকে রাখো, নুুরু আসুক, পাড়া-গাঁয়ের সবাইকে খবর দাও। এতোবড় একটা অশ্লীল কাজ, ব্যাভিচার… বলে ফজু মাতব্বর উয়া, উয়া করে বমি করার ভাব করে বললো, কাল আগে সালিস হোক, সালিসে যা সিদ্ধান্ত হয় তাই হবে।

ততক্ষণে রেণু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ভয়ে সবুজের গলা শুকিয়ে গেছে। সে বোবার মতো বিছানায় বসে আছে।

অবশেষে ফজু মাতব্বরের প্রস্তাবেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।

পাঁচ

না। রেণুর কথা আর শুনবে না সবুজ। রেণু যখন তাকে মোবাইল ফোন কিনতে নিষেধ করেছিলো তখন সবুজ ছিলো ভ্যানের ড্রাইভার আর এখন গার্মেন্টসের হেলপার সে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের বেকার, জেলে কিংবা ভ্যানের ড্রাইভার আর গার্মেন্টসের হেলপার এক সবুজ নয়। সবুজ বদলে গেছে, তার ভাগ্য খুলে গেছে।

সেদিন সেই ট্রাকে উঠে সবুজ প্রথমে উঠলো দেওয়ানগঞ্জ তার বাবার ভিটেমাটিতে, তার সৎ মা’র কাছে। সেখানে তার আগের পক্ষের দু’ভাই এক বোন আছে। তারা মুখে ভালো ভালো কথা বললেও তাদের মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা দেখা দিলো যে সবুজ হয়তো তার বাবার রেখে যাওয়া জমিতে ভাগ বসাতে এসেছে। তাই তারা আড়ালে সবুজকে নিয়ে নানান কথা বলতো। কিন্তু সবুজের মনের মধ্যে সেরকম কোনো আশা নেই, তার ইচ্ছা ছিলো এখানে ক’দিন থেকে ঢাকা চলে যাবে। ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাবে তারপর পরিসি’তি বুঝে রেণুকেও ঢাকায় নিয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত সৎ মা এবং ভাইবোনেরা তাকে ভালোভাবে নেয়ার ফলে দেওয়ানগঞ্জ এসে সবুজের সব চিন্তাভাবনা পাল্টে গেলো। সবুজের বড় দুই সৎ ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। বাড়িতে শুধু ছোট বোন আর তার সৎ মা। একদিন তার এই সৎ মা’ই তাকেও পরামর্শ দিলো ঢাকা গিয়ে তার বড় দু’ভাইর সঙ্গে চাকরি করতে। তার উদ্দেশ্যটা সবুজের উন্নতির উদ্দেশ্যে ছিলো নাকি সবুজকে সম্পত্তির ভাগ থেকে বিদায় করার ছিলো তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলেও তার পরামর্শে সবুজ তার জীবনটাকে নিয়ে অন্যরকম ভাবনা ভাবতে শুরু করলো।

দু’দিন পরেই সবুজ চলে এলো ঢাকা। তার সৎ ভাইদের কাছে। তাদের সহযোগিতায় গার্মেন্টসে চাকরি হলো। প্রথমে তাদের সঙ্গেই মেসে উঠেছিলো তারপর অন্য গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে এই মেসে এসে উঠলো।

সবুজ যখন তার ঘরে ঢুকলো তখন ছালু রুমে এসে কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ছালু, পুরো নাম আব্দুস ছালাম, সবুজের পাশে চৌকিতে থাকে। বাড়ি গাইবান্ধা। এই ক’দিনে ছালুর সঙ্গে সবুজের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ছালু সবুজের কয়েক মাস আগে এই মেসে উঠেছে। মোবাইল ফোনে সবসময় তার বউ’র সঙ্গে কথা বলে দেখে সবুজের মনে মোবাইল কেনার সখটা আরও প্রবল হলো।

ছালু যখন তার বউ’র সঙ্গে কথা বলতো তখন সবুজের মনের মধ্যে রেণুর ছবি ভেসে উঠতো। তাই সবুজের মোবাইল ফোন কিনলো। সবুজ ঘরে ঢুকেই মোবাইল ফোনের প্যাকেট খুললো।

ছালুর চোখে-মুখে আনন্দ, মোবাইল ফোন কিন্‌লি?

হ্যাঁ, কিনে ফেললাম।

দেখি, দেখি বলে ছালু মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো, খুব ভালো তো।

হ্যাঁ কিন্তু এখন কিছু গান আর ছবি নিতে হবে।

ছবি আবার কার?

সবুজ মুচকি হাসি হেসে বললো, আছে!

তুই না বল্‌লি বিয়ে করিস্‌নি?

করবো।

কবে?

সেটা তো এখনো ঠিক করিনি।

বাড়ি যাবি কবে?

বাড়ির কথা শুনতেই সবুজের বুকটা কেঁপে উঠলো। তার বাড়ি বলতে তো সেই শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম। যে গ্রাম তার জন্য নিষিদ্ধ। যে গ্রামে যাওয়ামাত্র তাকে আর রেণুকে নিয়ে সালিস বসবে। প্রহসনের বিচার, অপমানের বিচার। সালিস! সে আর কোনো কথা বললো না।

ছালু জিজ্ঞেস করলো, কথা বলছিস্‌ না কেনো?

একটু সমস্যা আছে।

কী সমস্যা? তোর সাথে বিয়ে দিবে না?

সেরকম না।

তো?

সমস্যা আছে।

আমি বলি মেয়েটাকে নিয়ে চলে আয়। এখানে এসে বিয়ে কর্‌বি।

হ্যাঁ সবুজেরও ইচ্ছা তাই। সে রেণুকে নিয়ে আসবে। জীবনে আর কেনোদিন শঙ্কর মাধবপুর গ্রামেই যাবে না। ছালুর কথা শুনে সবুজের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হলো, তাই তো, ছালু ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন।

সবুজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে রাজিবপুর যাবে। রাজিবপুরে তার মামাতো ভাইয়ের দোকান আছে তার কাছে গ্রামের খবর শুনবে তারপর রেণুর সঙ্গে দেখা করবে। না, শুধু দেখা করবে না। রেণুকে নিয়ে চলে আসবে ঢাকা। 

পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়েছে। শুক্রবার দিন সবুজ ইচ্ছা করেই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। পুরো সপ্তাহ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ওভার টাইম করার পর শরীরে আর কিছু থাকে না। বিছানা থেকে ওঠার মতো প্রাণ শক্তিও থাকে না। ঘুম থেকে উঠে সবুজ মোবাইল ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো। একবার ঘর থেকে বের হয়ে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে এলোমেলোভাবে কয়েকটা ছবি তুললো। সবুজকে ছবি তুলতে দেখে সেই মেয়েটি ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ালো।

সবুজ অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছে সে প্রতিদিন সকালবেলা গার্মেন্টসে যাওয়া-আসার পথে মেসের মুখোমুখি সেমি পাকা ঘর থেকে দু’টো চোখ তার দিকে সবসময় তাকিয়ে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর জোরে অপ্রয়োজনীয় চিৎকার করে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। সবুজ প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি কিন্তু সেই চোখ ওয়ালী মেয়েটি আজ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বয়স চৌদ্দ কিংবা পনেরো, লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, সুন্দর একটি মেয়ে।

সবুজ মেয়েটিকে সামনে থেকে সরে যেতে বলতেই সে বললো, আমার একটা ছবি তুলুন না?

সবুজ ক্যামেরা সরিয়ে নিলো, না তুমি সরে যাও।

তুলুন। প্লিজ! প্লিজ!

ঘর থেকে একটা নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ছবি।

মেয়েটি জোরে চিৎকার করে বললো, আসছি ভাবী।

সবুজ আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারলো না, হেসে ফেললো, তোমার নাম ছবি?

হ্যাঁ। নামটা আপনার পছন্দ হয়েছে?

তোমার নাম আমার পছন্দে-অপছন্দে কী যায় আসে?

তবু নামটা ভালো না?

সবুজ মুখ বিকৃত করে বললো, ভালো, খুউব সুন্দর বলে একটা তিরস্কারের হাসি হাসলো।

ছবি কৃত্রিম অভিমান করে বললো, সুন্দর তো, ছবি তুলুন।

সবুজ বিরক্ত হয়ে বললো, সরে যাও, সরে যাও, দেখ না আমি ছবি তুলছি।

আপনি তো কারও ছবি তুলছেন না। ঘর-বাড়ি, দোকানপাট আর আবর্জনার ছবি তুলছেন, তারচেয়ে আমার ছবি তুলুন।

সবুজ রেগে গেলো, না, আমি তোমার ছবি তুলবো না। তুমি ক্যামেরার সামনে থেকে সরে যাও।

ছবি মুখ বিকৃত করে বললো, হুঁ, আমি বুঝি দেখতে সুন্দর না?

সুন্দর, তুমি তো খুউব সুন্দর। বললাম তো তুমি চান্দের মতো সুন্দর। এত সুন্দর দিয়ে আমার কাজ নেই।

কাজ না থাকুক তবুও আমার ছবি তুলুন। বলে ছবি একটা সুন্দর হাসি দিয়ে মডেল তারকার মতো আর্ট করে দাঁড়ালো, তুলুন।

না। তুমি সরে যাও।

কেনো? আমাকে আপনার ভালো লাগে না?

তোমাকে আমার ভালো লাগবে কেনো? আমার ভালো লাগার মানুষ আছে, তাকে ভালো লাগে। তাকেই আমি বিয়ে করবো।

সে বুঝি আমার চেয়ে সুন্দর।

হ্যাঁ। অবশ্যই তোমার চেয়ে সুন্দর, দুনিয়ার সব মেয়ের চেয়ে সুন্দর।

ছবি নাক ছিটকিয়ে বললো, হুঁ, বেশি সুন্দরী মেয়েরা ভালো হয় না। কথায় আছে না সুন্দরী আমে পোকা থাকে।

ও তুমি সুন্দর হলে ভালো আর অন্য কেউ সুন্দরী হলে পোকা। তাই না? বলে সবুজ মোবাইল ফোন সরিয়ে নিয়ে রাগ করে বললো, থাক আর ছবিই তুলবো না। বলে সে তার ঘরে এলো। কিছুক্ষণ মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাটন টিপতে টিপতে দু’চোখ বুজে এলো।

রেণু সবুজের কাঁধে হাত রেখে নিবিড়ভাবে বসেছে আর সবুজ মোবাইল ফোনের বাটন টিপে রেণুকে মোবাইল ফোনের ব্যবহার করা শিখিয়ে দিচ্ছে।

সবুজ কিছুক্ষণ মোবাইলের বাটন টিপে বললো, বুঝছিস্‌?

রেণু ইয়ার্কি করে বললো, জি স্যার।

আজ এ পর্যন্তই। আগে এগুলোই শিখে রাখ্‌।

হ্যাঁ আমিও তাই বলি। শেখার জন্য তো গোটা জীবনটাই পড়ে আছে, বলে রেণু উঠলো।

এই দাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়া তোর একটা ছবি তুলি।

রেণু ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালো। সবুজ রেণুর কয়েকটা ছবি তুললো। তারপর রেণুর কাছে গিয়ে তার মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা বানিয়ে দিয়ে তার থুঁতনি উঁচু করে কয়েকমুহূর্ত তার চোখে চোখ রাখলো।

রেণু আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, এই কী দেখছিস্‌?

তোকে!

আমাকে মনে হয় নতুন করে দেখছিস্‌?

নতুনই, তোকে যতই দেখছি ততই যেনো তোকে আমার নতুন বলে মনে হচ্ছে। রেণু আমি তোকে ঢাকা নিয়ে যেতে এসেছি, চল্‌ আর না করিস্‌ না।

আগে বিয়ে কর। তারপর যেখানেই নিয়ে যেতে চাইবি যাবো। আমি তো শুধু তোরই অপেক্ষায় আছি।

সবুজ রেণুকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলো কিন্তু রেণু পিছিয়ে যেতেই সবুজের ঘুম ভেঙ্গে গেলো, মোবাইল ফোনটা বিছানায় পড়ে গেলো।

সবুজ আপন মনে হেসে ফিসফিস করে বললো, রেণু।

সবুজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে যাবে। রেণুকে ছেড়ে তার মনটা আর একমুহূর্তও ঢাকায় টিকছে না। রাজিবপুর সবুজের মামাতো ভাইয়ের দোকান আছে, সে কি রাজিবপুর গিয়ে তার কাছে খবর নিবে? তার গ্রামের খবর? তার রেণুর খবর! তারপর হয় সে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে যাবে আর না হয় রেণুর কাছে তার নাম্বারটা পাঠিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবে।

নাকি সে সোজাসুজি গ্রামে যাবে? রেণুদের বাড়িতে চলে যাবে? সবাইকে সে বলবে, আমি রেণুকে বিয়ে করবো। আজই! এখুনি! তার মামা, মামাতো ভাই আর পাড়া-পড়শিরা কাজি ডাকবে বিয়ে দিয়ে দিবে।

বিষয়টা কি এতোই সহজ? গ্রামের কিছু মানুষের তো এই সালিসই জীবিকার মাধ্যম। তারা সবসময় গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর নজরদারি করে, কারও দাম্পত্য কলহ মেটাতে সালিস, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নামে সালিস, যৌতুকের টাকা কমাতে বা বাড়াতে সালিস, প্রেম-ভালোবাসার কথা মানুষ জেনে ফেলার নামে সালিস। তবে এই সালিসও আছে অপরাধীর সামাজিক এবং আর্থিক অবস’া ভেদে। যে অপরাধ কোনো ধনীর দুলালীর জন্য আমলযোগ্যই না সেই একই অপরাধে একজন দরিদ্র ঘরের মানুষের জন্য ঘৃণিত, সামাজিক অপরাধ। সবুজ আর রেণু এরকম পরিবারেরই, তাদের বেলায় খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অপরাধ।

তারপরও সবুজ গ্রামে যাবে। রেণুকে বিয়ে করবে। বিয়ের মধ্যে তো আর অপরাধের কিছু নেই। আর সালিস! এতোদিন পর আবার কীসের সালিস? হোক সালিসের মুখোমুখি হতে হলেও সবুজ গ্রামে যাবে। পৃথিবীর সব কাজ ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে করতে চাইলে হয় না। অন্তত: হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে। প্রেম-ভালোবাসা পুরোটাই আবেগের, ইমোশনের। এখানে ক্যালকুলেশনের স’ান নেই। যারা প্রেমের সম্পর্ককে সামাজিক, আর্থিক কিংবা বয়সের মানদণ্ডে পরিমাপ করতে চেয়েছে তাদের প্রেম সফল হয়নি। ইমোশনের কাজ ক্যালকুলেশনে হয় না। হোক, যা হয় হোক, সবুজ এবার মাঠে নামবে শুধু তার হৃদয় নিয়ে, মান অপমানের ভয়ই করবে না সে।  

সেদিন বিকেলে সবুজ বের হলো রেণুর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। রেণু কেনোদিন শাড়ি পরেনি কিন্তু সবুজের মনে হয়েছে রেণুকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর মানাবে। সে রেণুর জন্য একটা লাল শাড়ি কিনলো, তার সঙ্গে ম্যাচিং করে শাড়ি ব্লাউজ, পেটিকোট। তারপর ঢুকলো কসমেটিকসের দোকানে।

প্রতিবছর বড়চর, কর্তিমারী, দাঁতভাঙ্গায় মেলা হয়। ছোটবেলা থেকে রেণু আর সবুজ বাবা-মা’র সাথে মেলায় যেতো, বড় হওয়ার পরও কোনো না কোনো অজুহাতে দু’জনে মেলায় যাবেই। সবুজ রেণুকে কাঁচের চুড়ি, কপালের টিপ, চুল বাঁধার ফিতা কিনে দিতো। রেণু কোনো ক্রিম ব্যবহার করে না, চুলে কোনো শ্যাম্পুও ব্যবহার করে না। তবু সুন্দর! রেণুর মুখ যেনো একেবারে অকৃত্রিম। ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করার সময় অনেক সময় সবুজের নাকে আসে প্রসাধনীর তীব্র গন্ধ। সবুজের নাকে এরকম গন্ধ এলেই সে আশেপাশে তাকায়। সেই কসমেটিকসের গন্ধ ওয়ালী মহিলার মুখের দিকে তাকায়, সে গর্ব ভরে মনে মনে বলে, এতো ক্রিম, স্নো, পাউডার মাখার পরও তোমার যা অবস’া। একবার আমার রেণুকে দেখো, কোনো ঘঁষা-মাজা ছাড়াই আমার রেণুর মুখটা কতো সুন্দর, চুলগুলো কতো লম্বা আর চকচকে।

ছোট কসমেটিকসের দোকান। সবুজ একবার দোকানের ওপর চোখ বুলালো। দোকানের খরিদদাররাও বেশির ভাগ তার মতোই। সবুজের চোখের সামনে এখন রেণুর ছবি ভাসছে। লাল শাড়িতে রেণু যেনো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ মনে মনে রেণুর লাল শাড়ি পরা ছবির ওপর কপালে একটা টিপ বসিয়ে দিলো, ঠোঁটের ওপর হালকা মেরুন রঙের লিপ স্টিক, হাতে লাল কাঁচের চুড়ি। কসমেটিকসের দোকানে রেণুর জন্য কেনাকাটা করতে করতে সবুজ উদাস হয়ে গেলো। দোকানদার মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, ভাই আর কিছু?

সবুজের সামনে টেবিলের ওপর টিপ, লিপ স্টিক, কাঁচের চুড়ি। সবুজ চমকে উঠলো, আর-

ছয়

শেষ পর্যন্ত রেণুর পালিয়ে যাওয়া হলো না। সে দরজা খুলে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মামা তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকে তার ওপর একরকম সবার নজরদারি আছে। তার বার বারই মনে হচ্ছে সবুজের সঙ্গে সে প্রতারণা করছে। সবুজের সঙ্গে তার সম্পর্ক সেই শৈশব থেকে। সে কেনোদিন ভাবেনি সবুজ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সে সারাজীবন কাটাতে পারবে। তার শৈশবের খেলার সাথী, ব্রহ্মপুত্রে চরে বেড়ানো, ছুটে বেড়ানো হৃদয়ের একান্ত আপন মানুষটিকে সে আজ সারাজীবনের জন্য বিদায় দিতে যাচ্ছে।

শৈশবে সবুজ আর রেণু মিলে চরে পুতুল খেলা খেলতো। এ-পাড়া, ও-পাড়ার মধ্যে পুতুলকে বর করে সাজিয়ে বিয়ে হতো। সবার বাড়ি থেকে এক মুঠো দু’মুঠো করে চাউল, কারও বাড়ি থেকে একটা বা দু’টো ডিম, কারও ক্ষেত থেকে সবজি তুলে নিয়ে বিকেলে বিয়ের অনুষ্ঠান হতো। ছোট কোনো ছেলেকে কাজি সাজিয়ে বিয়ে পড়ানো হতো। আগে কনের সম্মতির সময় কেউ পিছন থেকে কবুল বলে দিতো। বিয়ে হতো নিষ্প্রাণ দু’টো পুতুলের মধ্যে, তবু সবার সে কী আনন্দ। পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো। কিন্তু তাতে পুতুলের তো কিছু যায় আসে না। খেলা শেষে সবাই পুতুল ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যেতো। কেউ একবার ভুল করেও ফিরে তাকাতো না পুতুলের কী হলো। খেলার সামগ্রী পুতুল ভেসে যেতো, তলিয়ে যেতো ব্রহ্মপুত্রের অতলে।

আজ তার বিয়ের জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। নিছক আনন্দের জন্য নয় বরং মাথা থেকে একটা বোঝা নামানোর জন্য। তার মনের কথা কী কেউ একবারও ভেবেছে? বাবা-মা তো জানেই তার সঙ্গে সবুজের সম্পর্কের কথা, ভালোবাসার কথা। সবুজ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলে যে সে সুখী হবে না এটা তার বাবা-মা জানে, হয়তো স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হলে বাবা-মা তাকে সবুজের সঙ্গেই বিয়ে দিতো। পুতুল ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিয়ে সবাই হয়তো হাততালি দিয়ে আনন্দ উপভোগ করে, আনন্দে চোখে পানি আসে। কিন্তু রেণুর বাবা-মা তাকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দিয়ে কান্নায় বুক ভাসাবে। নদীতে পুতুল নিক্ষেপ করে নয়, পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাকে প্রতিমা বিসর্জনের মতো উৎসর্গ করে।

কিন্তু সবুজ! সবুজ রাতের আঁধারে পালিয়ে গেলো কেনো? সবুজের সঙ্গে রেণু অনেকদিন রাজিবপুর গিয়ে রূপালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখেছে। নায়িকাকে অত্যাচারী বাবার হাত থেকে, খল নায়কের কাছ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে নায়ক রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে পর্যন্ত।

না…, জীবন দেয়ার কথা মনে পড়তেই রেণুর বুকটা কেঁপে উঠলো। না, সবুজের কোনো খারাপ কথা সে ভাবতে পারে না। একদিন সন্ধ্যায় সবুজ রাজিবপুর থেকে বাড়ি ফেরার পথে রেণুকে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা বললো, এই রেণু সিনেমা দেখতে যাবি?

রেণু প্রথমে না করলো, এই ক’দিন আগেই তো সিনেমা দেখে এলাম।

নতুন সিনেমা এসেছে।

কী নাম?

লাইলি মজনু।

কেমন ছবি?

ফাটাফাটি প্রেমের ছবি।

রেণু হাসলো।

আমি তো সকালে ভ্যান নিয়ে চলে যাবো। তুই বিকেলে নদী পার হয়ে আসিস্‌, আমি ঘাটে এসে তোকে নিয়ে যাবো। দুপুরের শো দেখবো।

রেণু বললো, না, তোকে আসতে হবে না। আমি হলে যাবো।

আচ্ছা।

সিনেমা শুরু হলো। খুব ভালো সিনেমা। রেণু তো সিনেমার শুরু থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আর যখন গান শুরু হলো, লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজুন গো আাঁখি খোলো।

নায়কের চোখের সামনে তখন মরুভূমির ওপর হাজার হাজার লাইলি আর নায়ক লাইলিকে ধরার জন্য বার বার করে উত্তপ্ত বালির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তবু মজনু ছুটে চলছে লাইলির পেছনে।

সবুজ কেনো মজনুর মতো রেণুর কাছে ছুটে এলো না। এলে রেণু রাতের আঁধারে সবুজের হাত ধরে চলে যেতো। অন্য এক পৃথিবীতে, যে পৃথিবীতে ফজু মাতব্বর নেই, বিচার-সালিসের নামে অপমানের ভয় নেই, এমনকি কলঙ্কের ভয়ও নেই। সবুজ রেণুকে ভালোবাসে। অনেক বেশি ভালোবাসে। রেণুর জন্য সবুজ করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সবুজ যদি জানতো সে পালিয়ে গেলে রেণুকে তার বাবা-মা অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে তবে সে কেনোদিনও পালিয়ে যেতো না। হয়তো সেও রেণুকে খুঁজছে কিন্তু কোনোভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। হয়তো একদিন যোগাযোগও হবে, রেণুর সঙ্গে তার দেখাও হবে কিন্তু তখন দেখা হয়ে আর কী হবে। ততদিনে রেণুর জীবন অন্য কারও সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, গেঁথে যাবে চিরদিনের জন্য।

যেদিন বিয়ের কথাবার্তা হলো তারপর দিনই তার ছোট খালা এলো। রেণু তার ছোট খালাকে দেখে কিছুটা আশ্বস’ হলো। ছোট খালা রেণুর চেয়ে দু’বছরের বড়। তার সঙ্গে রেণুর একটা ভালো সম্পর্কও আছে। বিয়ের আগে তার ছোট খালাও একটা ছেলেকে ভালোবাসতো কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে বিয়ে হয়নি। বিয়ের আগে সেও অনেক কান্নাকাটি করেছিলো। রেণু ভেবেছিলো ছোট খালা তার কষ্টের কথা বুঝবে। এই বিয়েতে তার অমতের কথা তার বাবা-মা ও নানা-নানিকে জানাবে। কিন্তু তার সে আশায় গুঁড়ে বালি। উল্টো সে-ই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, হবু জামাইকে আমিও দেখেছি। দেখতে খুব সুন্দর, বাড়ির অবস’াও ভালো। এরকম বর পাওয়া তোর জন্য ভাগ্যের। দেখিস্‌ তুই খুব সুখী হবি।

রেণু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, খালা তুমি বলছো আমি সুখী হবো। দেখতে সুন্দর, বাড়ির অবস’া ভালো এসবের মধ্যেই কি সুখ? যাকে আমার পছন্দ সে যেমনই হোক, তার বাড়ির অবস’া যতো খারাপই হোক তার সঙ্গে বিয়ে হলেই আমি সুখী হতাম। খালা তুমি আমার হয়ে একবার নানা-নানি, মামা-মামিকে বলো সবুজ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলে আমার সারাজীবন…বলতে বলতে রেণু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ছোট খালা রেণুর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কাঁদিস না, সবাই খারাপ মনে করবে।

করুক, কে ভালো মনে করলো আর কে খারাপ মনে করলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, বলতে বলতে রেণু উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ছোট খালা রেণুর মুখে হাত দিয়ে বললো, চুপ, চুপ আর একটা কথাও বলবি না। এমনিতে একটা কেলেঙ্কারি আছে তারওপর এরকম করলে শেষ পর্যন্ত বিয়েটাই ভেঙ্গে যাবে।

রেণু আরও জোরে চিৎকার করে উঠলো, যাক, যে বিয়েতে আমার মনের কোনো সম্পর্ক নেই সে বিয়ে ভেঙ্গেই যাক।

এবার তার ছোট খালা রেণুর মুখ চেপে ধরলো চাপাস্বরে বললো, চুপ, চুপ। এখন তোর বিয়েটা শুধু তোর আর তোর বাবার মান-সম্মানের বিষয় না। এটা এখন আমাদেরও মান-সম্মানের বিষয়। এভাবে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে সমাজে আমাদেরও কেলেঙ্কারি হবে।

রেণু আর কোনো কথা বললো না। সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

বিয়ের সাদামাটা আয়োজন। সকালবেলা তেমন বোঝার উপায় ছিলো না যে এটা বিয়ে বাড়ি। বিকেলে আশে-পাশের বাড়ি থেকে কয়েকটা চেয়ার টেবিল এনে আঙিনায় সাজানো হলো। বিকেলে প্রতিবেশী কিশোর-কিশোরীদের আগমন বেড়ে গেলো। রেণু তখনো তার ঘরে শুয়ে ছিলো। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তার দূরসম্পর্কের মামাতো বোন এবং ভাবীরা এলো। রেণুর নানি ঘরে ঢুকে তাকে বিছানা থেকে তুলে বসালো, বিয়ের দিন এই সন্ধ্যাবেলা কেউ বিছানায় শুয়ে থাকে?

রেণু কোনো কথা বললো না।

নানি সবাইকে কিছুটা ধমকের সুরে বললো, এই তোরা কী করছিস্‌ এখানে? কনে সাজাবি না? তোরা কনে সাজা, কিছুক্ষণের মধ্যে বরযাত্রী চলে আসবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেলো। কয়েকজন কিশোর-কিশোরী বর এসেছে, বর এসেছে বলে দৌড়ে আঙিনায় এলো। আরও কয়েকমিনিট পর রেণুর ছোট খালা এলো। তার হাতে কাপড়-চোপড়ের একটা ব্যাগ। সে সবার উদ্দেশ্যে বললো, এই তোরা যা তো আমাদের কনে সাজাতে দে। তারপর কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বললো, এই ভাবী, আপা তোরা একটু থাক। এই কাপড়-চোপড় নে, রেণুকে একটু সাজিয়ে দে।

ছোট খালাকে বলেও কাজ হলো না। রেণুর সে চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এখন তার একটাই রাস্তা পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু তার পালাবারও তেমন কোনো জায়গা নেই। তার পালাবার জায়গা এখন একটাই, এই লোক সমাজের বাইরে, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো জগতে, না ফেরার দেশে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ প্রয়োজনে তাই করবে রেণু। তার ভালোবাসার জন্য সে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে।

সাত

চোখের সানগ্লাসটা মাথার ওপর ওঠানো। কালো শার্টের ওপর সোল্ডার, জিন্সের প্যান্ট পরা ছেলেটি কাউন্টারে এসে দাঁড়ালো। ডানে-বাঁয়ে কয়েকবার তাকালো। তারপর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো, এই যে ভাই রাজিবপুরের একটা টিকেট হবে?

কবেকার?

আজকের।

হ্যাঁ হবে।

কতো?

চার’শ পঞ্চাশ টাকা।

সবুজ মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলো।

ম্যানেজারে কাছ থেকে টিকেট নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ক’টায় ছাড়বেন ভাই?

রাত ন’টায়।

আচ্ছা ভাই কতক্ষণ সময় লাগবে?

সাত ঘণ্টা তো লাগবেই। রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।

সবুজ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, ইস্‌স।

কাউন্টারে একটা টি.ভি আছে, দর্শক তেমন নেই। সবুজ একটা চেয়ারে বসলো। কিন্তু টি.ভিতেও তার মন বসছে না। শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে একটা ছোট্ট বাজার আছে। বাজারে হাতে গোনা কয়েকটা হোটেলও আছে। বেচাকেনার প্রতিযোগিতার জন্য হোটেলগুলোতে টি.ভি আছে, ডিশের সংযোগ নেই তাই টি.ভি’তে সবসময় ভি.সি.ডি চলতেই থাকে। বিক্রি তেমন নেই, বাজারে তেমন লোকজনও নেই কিন্তু দোকানে টি.ভি দেখার জন্য হোটেলগুলোতে লোকের অভাবও নেই। সবুজ বয়সে ছোট তাই চেয়ারে বসে তেমন টি.ভি দেখতে পারতো না। তাই প্রায় সময়ই সে সবার পিছনে অথবা বাইরে দাঁড়িয়ে টি.ভি দেখতো। টি.ভি দেখার সময় সে যেন চলে যেতো অন্য জগতে, টি.ভি’র নায়কের মতো নিজেকেও নায়ক ভাবতো, নায়ক যখন নায়িকাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতো তখন কিংবা নায়ক নদীতে ডুবে যাওয়া নায়িকাকে উদ্ধার করতো তখন সেও রেণুকে নিয়ে ডুবে যেতো তার জগতে, কল্পনায় ঝাঁপ দিতো ব্রহ্মপুত্র নদে। কখন যে দুপুর গড়িয়ে যেতো, পেট খিদে চোঁ, চোঁ করতো তবু টের পেতো না। আজ কাউন্টার ফাঁকা, সেও একটা চেয়ারে বসে টি.ভি দেখছে কিন্তু টি.ভি’তে তার মন নেই। কিছুক্ষণ পর পর সে মোবাইল ফোন বের করে সময় দেখছে। আর চেয়ার থেকে উঠে কাউন্টারের সামনে পায়চারি করছে।

কাউন্টারের সামনে একটা বাস এসে দাঁড়ালো। হেল্পার জোরে চেঁচিয়ে বললো, রৌমারী, রাজিবপুর, বকশীগঞ্জ, শেরপুর… রাত ন’টার গাড়ি।

কাউন্টারে কয়েকজন লোক বসে ছিলো সবাই উঠে দাঁড়ালো।

সবুজ গাড়িতে উঠে তার সিটে বসলো।

বাস দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে। সবুজ তার মোবাইল ফোনের সাথে হেডফোন জুড়ে দিয়ে গান চালু করে দিয়েছে। গান চলছে, সবুজের হৃদয়পটে রেণুর ছবি। আজ কতোদিন পর রেণুর সঙ্গে তার দেখা হবে। সবুজের আজও মনে পড়ে একবার সে তাদের জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো, প্রথম দু’য়েকদিন সবুজের খুব কষ্টে কেটেছিলো সবুজ ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে সৎ মা কিংবা সৎ ভাইবোনেরা সাধারণত ভালো হয় না। নিজের বাবার আদর স্নেহের ভাগ, বিষয়-সম্পত্তির ভাগ কেউ কাউকে দিতে চায় না। তাই পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ থাকে, কুটিলতা থাকে, ষড়যন্ত্র থাকে। তার মা তাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলো, বাবা সাবধানে থাকবি, কোনো কিছু খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলে খাবি। আমি তো তোকে পাঠাতেই চাইনি তোর বাবা-ই নিয়ে যেতে চাইল আর তুইও একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে গেলি। এখন ভালোয়, ভালোয় ফিরে এলেই হয়।

সবুজ তার মা’র কথামতো সাবধানেই ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিরকালীন শত্রু সৎ ভাইবোনদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠলো। কয়েক দিনে সবুজের মনে হলো যে বোন তাকে এত স্নেহ করে, নিজের ভাগের খাবার তাকে খেতে দেয়, যে বড়ভাই তাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। কথায় কথায় বলে সবুজ এদিকে আয়, চল একটু ধানক্ষেত থেকে ঘুরে আসি। বাজারে গিয়ে এটা-সেটা কিনে দেয়। তাদের সবার আচরণে সে মুগ্ধ হয়েছে। তার বারবারই মনে হয়েছে এই ভাইবোন তার মায়ের পেটের ভাইবোন না হোক কিন্তু এরা তার পরমাত্মীয়। এদের অবিশ্বাস করা যায় না। সৎ মা বা সৎ ভাইবোন বলতে প্রচলিত অর্থে যে খারাপ ধারণা আছে তা তার কাছে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হলো। কীভাবে যে দিন কেটে গেলো সবুজ টেরই পেলো না।

সবুজের বয়স তখন তেরো কিংবা চৌদ্দ। রেণুর সঙ্গে তার সখ্যতা আছে বটে, একটা টানও আছে কিন্তু সেই সখ্যতা বা টানের অর্থ ভালোবাসা কীনা সবুজ তখনো জানতো না। সে জানতো রেণু তার ব্রহ্মপুত্র নদে ঘুরে বেড়ানোর সাথী, যার সাথে সে বালুচরে খেলতে যায়, কেনোদিন সখের বশে মাছ ধরতে গেলে রেণু মাছের ঝুড়ি ধরে, কেনোদিন বৃষ্টি এলে দু’জনে মাথায় কলাপাতা দিয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে আসে।

রেণুদের অনেকগুলো ছাগল ছিলো। রেণু কাশবনে এ ছাগলগুলো ছেড়ে দিতো আর সবুজদের ছিলো কয়েকটা গরু। প্রয়দিনই দু’জনে একসঙ্গে গরু-ছাগল চড়াতে যেতো। একদিন হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। গরু-ছাগলগুলো ছুটোছুটি করে বাড়ির দিকে দৌড়তে লাগলো। অনেকদূর যাওয়ার পর কয়েকটা বাড়ি, বাড়ির পাশে কয়েকটা কলাগাছও আছে। সবুজ বড় একটা কলাপাতা কেটে নেয়ার জন্য কাস্তে বের করে কলাপাতা কাটতেই এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কলাপাতা কাটে কে?

সবুজ কিছু বলতে গিয়েই রেণু সবুজের হাত টেনে ধরলো, চল।

ততক্ষণে একটা কলাপাতা কাটা হয়ে গেছে। দু’জনে কাটা কলাপাতা নিয়ে টিপ টিপ বৃষ্টিতে রওয়ানা হলো।

সবুজ একহাতে কলাপাতা ধরে আরেক হাত রেণুর বাহুতে। এমনি করে দু’জনে বাড়িতে এলো। তখনো সবুজ বুঝতে পারেনি রেণুর সঙ্গে তার অন্যরকম একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয় পর্যন্ত।

সবুজ জামালপুর থেকে ফিরলো প্রায় পনেরো দিন পর। রেণু ছুটে এলো। সবুজের ঘরের দরজা খোলা ছিলো তারপরও রেণু জিজ্ঞেস করলো, ফুপু তোমার ছেলে বাড়িতে এসেছে?

হ্যাঁ মা এসেছে।

এই তো আমি এসেছি।

রেণু সবুজের কথাকে পাত্তাই দিলো না।

আবার বলতে শুরু করলো, আমি তো ভেবেছিলাম আর বুঝি কেনোদিন আসবেই না। তোমাকে ছেড়ে বুঝি একেবারেই চলে গেলো, বলতে বলতে রেণু আঙিনায় পেরিয়ে উঠানে গিয়ে উঠলো।

আসবে না কেনো মা? ছেলে কি কখনো মাকে ছেড়ে থাকতে পারে? বলে ফুপু প্রসঙ্গ পাল্টালো, এসেছিস্‌ তো বস একটু তরকারি কুটে দে, আমি টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসি, বলে ফুপু কলস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

রেণু তরকারি কুটা ছেড়ে সবুজের ঘরের দরজায় এসে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, শেষ পর্যন্ত তুই এলি?

হ্যাঁ, চলে এলাম।

এতদিন পর! তুই খুব নিষ্ঠুর। পাথরের মতো, বলতে বলতে রেণুর দু’চোখের পানি গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো, গলার স্বর বুজে এলো।

আহ চুক্‌ চুক্‌ চুক্‌।

ইয়ার্কি করছিস্‌, না? আমি এদিকে…রেণু আর কথা বলতে পারলো না।

কী? তুই এদিকে কী?

তোর জন্য মরে যাচ্ছি আর তুই…

ইসস, এদিকে আয়, একটু এদিকে আয় তোর চোখের পানি মুছে দিই।

দিবি, বলে রেণু সবুজের ঘরে ঢুকলো।

সবুজ রেণুর চোখ মুছে দিতে দিতে তার চোখে চোখ রেখে বললো, তোর খুব কষ্ট হয়েছিলো, না? 

আর তোর বুঝি হয়নি?

সবুজ মাথা নেড়ে জানালো তারও কষ্ট হয়েছে।

হয়নি, তুই খুব খারাপ, তুই আমাকে ছেড়ে এতদিন থাকতে পারলি। তুই…

বাইরে দরজা খোলার শব্দে রেণু বেরিয়ে গিয়েছিলো।

সেদিনের সেই অনুভূতির কথা মনে পড়তেই সবুজের বুকে একটা অন্যরকম ঢেউ আছড়ে পড়লো। সেদিনের কথা সবুজ কেনোদিন ভুলতে পারবে না, আজ সবসময় তার সেদিনের কথা মনে পড়ছে। পনেরো দিনের না দেখায় রেণুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছিলো, কণ্ঠে ছিলো এক রাশ অভিমান অথচ আজ কয়েক মাস যাবৎ রেণুর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। রেণু কি তাকে শুধু নিষ্ঠুর, পাথরের মতো হৃদয় বলেই ক্ষান্ত হবে নাকি তাকে ভীরু, কাপুরুষ…

সবুজ আপন মনে হাসলো। আবেগ ও আনন্দ মেশানো হাসি।

বাস থামলো। হেল্পার বকশীগঞ্জ, বকশীগঞ্জ বলে বকশীগঞ্জ পৌঁছার ঘোষণা দিলো। বাস আবার চলতে শুরু করলো।

বাস যখন রাজিবপুর এসে পৌঁছালো তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। সবুজ একবার মোবাইল ফোনের ঘড়িতে দেখল সকাল সাড়ে ছ’টা বাজে। সে একটা দোকানের বারান্দায় রাখা বেঞ্চে বসলো। সাতটার আগে খেয়া পারাপার শুরু হয় না। এখনই রওয়ানা দিলে সে প্রথম নৌকা পেতো কিন্তু এখন বটতলায় কোনো ভ্যান নেই। এখান থেকে খেয়া ঘাট প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। বৃষ্টির ঝাপটা কমলো আরও এক ঘণ্টা পর।

একটা ভ্যান এসে দাঁড়ালো। সবুজকে দেখে বললো, কে রে সবুজ না?

সবুজ মাথা নেড়ে সায় দিলো।

তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না। সাহেব, সাহেব মনে হচ্ছে।

সবুজ কোনো কথা বললো না।

এতোদিন কোথায় ছিলি?

ঢাকা।

এখন ঢাকা থেকে এলি?

হ্যাঁ।

ঘাট যাবি?

হ্যাঁ।

চল্‌ যাই।

সবুজ ভ্যানে উঠলো। ভ্যানে চড়েও ভ্যান চালকের সঙ্গে কথা হলো, সবুজ হ্যাঁ অথবা না বলেই কথা শেষ করলো। সে যখন ঘাটে পৌঁছালো তখন নৌকা নদীর ওপারে।

সে ঘাটে একটা মাচার ওপর বসলো। খেয়া ঘাটের ঘাটিয়ালের সঙ্গেও সবুজের দু’য়েক কথা হলো কিন্তু কেউ তার সঙ্গে রেণুর বিষয় নিয়ে কথা বললো না। সবুজ অনেকটা আশ্বস’ হলো। 

সোনাভরি নদী এখন দু’কূল ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়েছে। ঐ দূরে শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে রেণু। কতোদিন পর রেণুর সঙ্গে সবুজের দেখা হবে ভাবতেই সবুজের মন আরও বেশি উতলা হয়ে উঠছে। সবুজ একবার মোবাইল ফোনের ঘড়িতে দেখলো, উঃ অসহ্য।

ঐ দূর দিগন্তে শঙ্কর মাধবপুর ঘাট থেকে একটা নৌকা আসছে। সবুজের মনটা আনন্দে ভরে গেলো। স্রোত অনুকূলে নৌকা ঘাটে আসতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।

ঘাটে নৌকা এলো। নৌকা থেকে নামলো তার মামাতো ভাই রুস্তম। সবুজ এগিয়ে গেলো, এই রুস্তম শোন্‌।

রুস্তম এগিয়ে এলো। সবুজ কিছু বলতে যাচ্ছিলো। রুস্তম তাকে বাধা দিয়ে বললো, এদিকে আয় তোর সাথে কথা আছে। নৌকা কেবল এলো ছাড়তে এখনো অনেক দেরি আছে।

সবুজের বুকটা কেঁপে উঠলো। আবার সালিস নয় তো? হোক সালিস হোক রেণুকে ভালোবাসা যদি তার পাপ হয়ে থাকে, অন্যায় হয়ে থাকে তবে সেই পাপের, সেই অন্যায়ের শাস্তি হোক। তবু সবুজ এখান থেকে ফিরে যাবে না।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাট থেকে কয়েক ফুট দূরের একটা মাচার ওপর বসলো। রুস্তম কয়েকমুহূর্ত সবুজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

সবুজ কিছুটা উত্তেজিত হলো, কিছু বল্‌বি?

হ্যাঁ।

ফজু মাতব্বর কিছু বলেছে?

রুস্তম না সূচক মাথা নাড়লো।

যাক অনেকটা চিন্তা মুক্ত কর্‌লি, তো তুই আম্‌তা আম্‌তা করছিস্‌ কেনো?

শোন্‌ রেণু তো আর তোর নেই।

নেই মানে?

রেণুর তো বিয়ে হয়ে গেছে।

রেণুর বিয়ে হয়ে গেছে! তুই কী বলছিস্‌? রেণু আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে পারলো! বলতে বলতে সবুজের কণ্ঠ স্বর বুজে এলো।

রুস্তম উঠে দাঁড়ালো, আমি রাজিবপুর যাচ্ছি। তুই থাক্‌ এখনই নৌকা ছেড়ে দিবে।

সবুজ উঠে দাঁড়ালো, তুই যা আমিও একটু পরে রাজিবপুর আসছি।

রুস্তম চলে গেলো। নৌকার মাঝি জোরে চিৎকার করে ডাক দিলো, শঙ্কর মাধবপুর, কোদালকাটি, কারিগরপাড়া…

সবুজ ঘাটের দিকে গেলো না। একপা, দু’পা করে নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। রেণুর জন্য আনা প্যাকেটে একবার চুমু দিয়ে আপনমনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফিস্‌ফিস্‌ করে বললো, রেণু তোর জন্য এনেছিলাম। তোকে পেলাম না, তোর জিনিস আমি সোনাভরিকে দিয়ে গেলাম। তোর জিনিস নিয়ে গেলে আমি কখনো শান্তি পেতাম না। এই নে, বলে প্যাকেটটা সোনাভরি নদীতে ছুঁড়ে মারলো। ভরা খরস্রোতা নদীতে মুহূর্তেই প্যাকেটটা ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে গেলো।

আট

রেণুর নতুন জীবন শুরু হলো। বিয়ের আগে আড়ালে দাঁড়িয়ে কিংবা মামি, ছোট খালার কাছে রেণু তার শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস’ার যে বিবরণ শুনেছিলো তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। রেণুর শ্বশুর মধ্যবিত্ত কৃষক, বাউন্ডারি ঘেরা বাড়ি। খোলা আঙিনায় কয়েকটা সুপারি গাছ, টিউবওয়েল পাড় আলাদাভাবে ঘেরা। পুরো বাড়িতে একটা সচ্ছলতার ছাপ।

রিয়াজ বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। শ্বশুর-শাশুড়ি, রিয়াজ আর রেণু এই চার সদস্যের পরিবার। বাড়ির কাজ করার জন্য একজন কাজের মহিলা আছে। রান্নার কাজও শাশুড়িই করে থাকে। রেণুর তেমন কোনো কাজ নেই।  এল প্যাটার্নের বড় আকারের চারটি  সেমিপাকা রুম, মেঝে পাকা। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে চুনকাম ও রংয়ের কাজ করা হয়েছে। রেণুর থাকার ঘরটা পরিপাটি করে সাজানো। একটা বোম্বে খাট, পাশে বসানো দু’টো সিঙ্গেল সোফা, ওয়্যার ড্রপ, সোকেজ, ড্রেসিং টেবিল। রেণুর রুমে একটা টি.ভি আছে, টি.ভিতে আছে ডিসের কানেকশন। বাড়ির কোথাও কোনো কমতি নেই। রেণুর ছোট খালা ঠিকই বলেছিলো রেণুর ভাগ্য ভালো যে তার জন্য এতো বড় ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। সত্যিই তাই! রেণু এমন সাজানো গুছানো সংসারের কথা কেনোদিন কল্পনাও করেনি।

শুধু কি ঘর? বর হিসেবেও রিয়াজ অতুলনীয়। লম্বা, ফর্সা সুস্বাস’্যর অধিকারী। বাবা-মা’র লেখাপড়া করানোর যথেষ্ট ইচ্ছা এবং চেষ্টা ছিলো, গ্রামের খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে পর পর দু’বার এস.এস.সি ফেল করে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়েছে কিন্তু তার চালচলন, কথা বলার ধরণ দেখে তার লেখাপড়া পরিমাপ করা কঠিন। কথাবার্তার স্মার্টনেস দেখে তাকে উচ্চ শিক্ষিত ভাবাই স্বাভাবিক।

তারপরও রেণুর মন ভালো নেই। তার সবসময় মনে পড়ে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের কথা, সবুজের কথা। এই পাকা ঘর, খোলা আঙিনা, ঘরে রঙিন টেলিভিশন ছেড়ে তার মন চলে যায় ব্রহ্মপুত্র নদের নিত্য বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কম্পমান  ভিটেমটিতে, এই সুপুরুষ রিয়াজের কাছ থেকে মন চলে যায় তার প্রথম প্রেম, কৈশোরের প্রেম সবুজের কাছে। মনের কোনো শরীর নেই, মনকে দেখারও কেউ নেই তাই মন চলে যেতে পারে যেখানে ইচ্ছা সেখানে কিন্তু শরীরের তো আকার আছে। শরীর যদি কাউকে না জানিয়ে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারতো তবে রেণুও এই সোনার খাঁচা ভেঙে সারা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে সবুজকে খুঁজে বের করতো। রেণু ছুটে যেতো সবুজের কাছে।

রেণুকে সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে তার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলো, সবসময় কী চিন্তা করও বউমা?

কোনো চিন্তা করি না তো মা।

তোমার কি মন খারাপ?

না তো মা।

দিন রাত ঘরে বসে থাকো। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলো না, যখনই দেখি তুমি মন খারাপ করে বসে আছো। আজ বিয়ের পনেরো দিন হলো, এখনো তোমার মধ্যে জড়তা কাটলো না।

রেণু কোনো কথা বললো না।

আমি ভেবেছিলাম নানা-মামার বাড়ি থেকে ঘুরে এলে, তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা হলে মনটা একটু ভালো হবে। কিন্তু ওদের বাড়ি থেকে আসারও তো আজ তিনদিন হলো তুমি গোমড়া হয়ে বসে থাকো দেখে পড়শিরা নানান কিছু জিজ্ঞেস করছে।

রেণু কোনো আগ্রহ দেখালো না।

রেণুর শাশুড়ি আবার বলতে শুরু করলো, আজকাল বিয়ের পরদিন থেকেই মেয়েরা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তুমি তো এখনো নতুন বউ ভাবটাই কাটিয়ে উঠতে পারলে না। তোমার খারাপ লাগলে না হয় রিয়াজসহ একবার তোমার বাবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসো।

তাদের বাড়িতে রিয়াজকে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে রেণুর বুকটা কেঁপে উঠলো, রিয়াজকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে! সে যদি জানতে পারে বিয়ের আগে সবুজের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো তবে…

কথা বলছো না কেনো বউমা?

কী বলবো আম্মা?

আমি ভেবেছিলাম কয়েকদিন গেলে তোমাকে সবকিছু বুঝে দিবো।

সে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কী বুঝে দিবেন মা?

তোমার সংসার! ওমা ধীরে ধীরে তুমি সংসারের হাল ধরবে না?

এবার রেণু আরও স্বাভাবিক হলো, আপনি থাকতে আমি কেনো সংসারের হাল ধরবো মা?

ছেলেদের বিয়ের পর আর সংসার ধরে রাখতে হয় না। এটাই এই সংসারের নিয়ম।

এবার রেণু হেসে ফেললো, আমি নিয়ম-কানুন কিছু বুঝি না আম্মা। আপনি বেঁচে থাকতে…বলে রেণু হেসে ফেললো।

শাশুড়ি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ঠিক আছে বউমা তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমার কথা তুমি সবসময় হাসি-খুশি থাকবে। গোমড়া মুখ তোমার শ্বশুরও পছন্দ করে না। রিয়াজও পছন্দ করে না।

রাতে রিয়াজ বাড়ি এলো। রাতের খাবারের পর রিয়াজ বিছানায় শুয়ে পড়েছে, রেণু রাতের খাবার শাশুড়ির সঙ্গে বসে খায়, আজও সে ভাত খেয়ে তার ঘরে ঢুকলো। রিয়াজ বিছানায় শুয়ে টি.ভি রিমোট টিপে বার বার করে বিভিন্ন চ্যানেল পরিবর্তন করছে। রেণু রিয়াজের গা ঘেঁষে শুয়ে তার চোখে চোখ রেখে মাথার চুলগুলো এলিয়ে দিতে দিতে মুচকি হাসি হেসে বললো, তুমি মাকে কিছু বলেছো?

রিয়াজ কিছুটা অবাক হলো, না তো। কী বলবো?

না, কিছু না। তোমাদের বাড়ি যে হাসি-খুশির বাড়ি তা তো আগে বুঝিনি।

ও সে কথা।

তুমি কিছু বলেছো?

না, সেরকম কিছু না।

রেণু বিশেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বলেছো। আমাকে বলতে পারতে।

তোমার কি মন খারাপ?

না, মন খারাপ হবে কেনো?

এই যে তুমি সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকো এটা কেউ পছন্দ করে না।

আচ্ছা বাবা হয়েছে, আর হবে না।

রিয়াজ রেণুকে বুকে টেনে নিলো, তার চোখে চোখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, রেণু!

বলো?

আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি?

রিয়াজের একথার কী উত্তর দিবে রেণু বুঝতে পারলো না। সবুজের চেয়ে রিয়াজ কোনো অংশে কম নয়। পাত্র হিসেবে রিয়াজ যেনো হাজারে একটা কিন্তু সবুজ! রেণুর কাছে সবুজের তুলনা হয় না। সবুজের তুলনা সবুজই। রেণু রিয়াজের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, এটা তুমি কী বলছো, তোমাকে আমার পছন্দ হবে না। তোমার মতো স্বামী পেয়ে তো আমি হাতে বেহেশত পেয়েছি। আমি তো ভেবেছিলাম উল্টোটা।

রিয়াজ জিজ্ঞেস করলো, কী উল্টো?

আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে কী না।

পছন্দ হয়েছে বলেই তো আমি…

কী তুমি?

বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি।

তুমি আমাকে কোথায় দেখেছিলে বলো তো? আমি তো কেনোদিন ফকিরেরহাট আসিনি।

আমি চিলমারী গিয়েছিলাম।

তারপর-

তোমাকে দেখে খুব সুন্দর লাগলো।

আর বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে?

রিয়াজ মাথা একবার উঁচু এবং একবার নিচু করে সায় দিলো। তারপর রেণুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, রেণু তুমি খুব সুন্দর, তুমি আমার…

রেণুও আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, তুমিও।

নয়

ঢাকা থেকে মজিবর এসেছে। মজিবর এই গ্রামেই বড় হয়েছে, শঙ্কর মাধবপুর স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করে ঢাকা গেছে প্রায় একবছর আগে। মাঝখানে একবার এসেছিলো একদিনের জন্য। সেই একদিনের জন্য বাড়িতে এলেও সে একবার বানুদের বাড়িতে আসবেই। মজিবরের নানা বাড়ি চিলমারী সে সম্পর্কে ফুলিকে খালা বলে ডাকে। তাছাড়া এই শঙ্কর মাধবপুর আসার আগে ঐ দূরের চরেও মজিবর আর বানুদের বাড়ি পাশাপাশি ছিলো। সে সকালবেলা বাড়িতে এসে বিকেলে বানুদের বাড়িতে বেড়াতে এলো। সঙ্গে তার বউও এসেছে। মজিবর খালা, খালা বলে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকলো।

তখন সন্ধ্যা। ফুলি রান্না চড়িয়েছে। ছোট মেয়ে ইতি জোরে জোরে তার ক্লাসের পড়া মুখস’ করছে আর মানিক অঙ্ক কষছে। মজিবরের কণ্ঠস্বর পেয়ে মানিক পড়া থেকে চটকে উঠে দৌড়ে দরজা খুলে দিলো, মজিবর ভাই।

ততক্ষণে ফুলি চুলোয় বেশি করে জ্বাল দিয়ে দরজার কাছে এসেছে, কে মজিবর?

হ্যাঁ খালা। কেমন আছেন খালা?

ভালো, তুমি?

ভালো খালা।

এসো বাবা ভেতরে এসো। বলে ফুলি মজিবরকে উঠানে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার বউ নাকি মজিবর?

মজিবর তার বউর সঙ্গে ফুলির পরিচয় করে দিলো, জি খালা।

মারুফা সালাম দিলো।

ফুলি হাসতে হাসতে বললো, বিয়ে করার আগে একবার বললেও না, একবারে বউ নিয়ে বাড়িতে চলে এলে…।

হঠাৎ করে বিয়ে হলো খালা।

ফুলি মারুফাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী মা?

আমার নাম মারুফা।

তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?

মারুফা বললো, পাবনা।

ফুলি চমকে উঠলো, পাবনা, অনেক দূর না! কীভাবে বিয়ে হলো?

মজিবর বললো, খালা মনে হয় চমকে উঠলেন?

হ্যাঁ। অতদূর থেকে বউমার সঙ্গে কেমন করে দেখা হলো?

খালা। আমরা একসঙ্গে চাকরি করি।

ওমা। বউমা চাকরি করে?

মজিবর বলতে শুরু করলো, খালা দূরের কথা বলছেন। আমাদের গার্মেন্টসে তো সারাদেশের ছেলেমেয়েরা চাকরি করে। ও খালা রেণু, বানু আপা ওরা কোথায়?

তুমি তো অনেকদিন পর এলে, কয়েকদিন আগে রেণুর বিয়ে হয়েছে।

জামাই কী করে?

কৃষিকাজ। ওরা গৃহস’ মানুষ, অনেক জামি-জমা আছে। বাড়ির ভাত খায়।

ইতির পড়ার শব্দ একটু কমেছে আর মানিক বইখাতা রেখে ফুলি আর মজিবরের গল্প শুনছে দেখে ফুলি মানিককে বললো, মানিক পড় বাবা, তোমরা বসো আমি তোমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করে নিয়ে আসি।

মজিবর জিজ্ঞেস করলো, আর বানু আপা?

ওকে নিয়েই তো সমস্যায় আছি।

কী সমস্যা খালা?

ফুলি একটা নিঃশ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো, তুমি তো ওর আগের বিয়ের কথা জানো। মেয়েটার সংসার টিকলো না। আবার বিয়ে দেয়ার কোনো উপায় দেখছি না। এখন তো হায়দার সর্দারের দলে কাজ করে, একদিন কাজ আছে তো তিন দিন নেই।

তারচেয়ে এক কাজ করেন খালা।

ফুলি আগ্রহ সহকারে মজিবরের মুখের দিকে তাকালো, কী কাজ বাবা?

ওকে আমাদের সঙ্গে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।

কোথায়?

ঢাকা।

ও ঢাকা গিয়ে কী করবে?

চাকরি করবে। আপনার বউমা চাকরি করছে না?

কী বলো তুমি, বানু চাকরি করতে পারবে?

অবশ্যই পারবে। চাকরি করলে মাসে মাসে নিজের খাওয়া খরচের পর বাড়িতেও মাসে মাসে টাকা পাঠাতে পারবে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ খালা। বানু আপার একটা চাকরি হলে দেখবেন বিয়ে দিতেও আর কোনো সমস্যা হবে না।

এমনসময় বানু বাড়িতে ঢুকলো। মজিবরকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কে রে মজিবর নাকি? কেমন আছিস্‌?

তোমরা বসো আমি নাস্তার ব্যবস’া করি, বলে ফুলি চলে গেলো।

ভালো আপা। আপনি?

বানুর কণ্ঠে হতাশা, আমাদের আর ভালো থাকা বলে মারুফার দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করলো, তোর বউ নাকি?

হ্যাঁ।

মজিবর বানুর সঙ্গে মারুফার পরিচয় করে দিলো।

মারুফা সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম আপা।

ওয়ালেকুম আসসালাম। কেমন আছো?

জি ভালো। আপনি?

হ্যাঁ ভালো আছি।

আপনি একটু এখানে বসেন আপা। এতক্ষণ তোমার কথাই হচ্ছিলো।

আমার কথা?

হ্যাঁ মা। মজিবর বলছিলো ঢাকায় গেলে নাকি তোর গার্মেন্টসে চাকরি হবে।

কী রে মজিবর ঠিক কথা? ও মারুফা তুমি বলোতো বোন মজিবর ইয়ার্কি করছে না তো?

এবার মারুফা কথা বললো, জি আপা ও ঠিকই বলেছে। আপনি আমাদের সঙ্গে ঢাকা চলেন। আপনাকে গার্মেন্টসে একটা চাকরি জোগাড় করে দিবো, অনেক টাকা বেতন পাবেন।

মারুফার কথা বানুর বিশ্বাস হলো। তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হলো, সে কিছুটা আবেগজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ঠিকমতো বেতন দিবে তো?

মজিবর কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, আপনি তো আবার আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। মারুফার কাছ থেকে শুনে তারপর বিশ্বাস করবেন। তুমি বলোতো মারুফা। তুমি কতো বেতন পাও?

চাকরিতে ঢুকেই তিন হাজার টাকা তো পাবেনই। তারপর কিছুদিন চাকরি করলে বেতন আরও বাড়বে, মারুফা বললো।

তুমি কতো বেতন পাও বোন?

আমিও তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, এখন পাঁচ হাজার টাকা বেতন পাই।

বানু মারুফার থুত্‌নি ধরে আদর করে বললো, ওরে আমার বোন রে। কী সুন্দর চেহারা, আবার চাকরি করে মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন, ও মজিবর তুই তো খুব ভালো বউ পেয়েছিস্‌। একেবারে লক্ষ্মী বউ।

মারুফা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।

ফুলি সবাইকে নাস্তা দিয়ে আবার বসলো।

মজিবর বানুকে জিজ্ঞেস করলো, আপা যাবেন?

মজিবরের কথার উত্তর দিলো ফুলি, তোরা যাবি কবে?

আমরা আর কালকের দিন আছি খালা, পরশু দিন চলে যাবো মজিবর বললো।

ফুলি বললো, তোর খালু আসুক বাবা।

বানু বললো, হ্যাঁ আগে বাবাকে বলি।

নুরু রাজিবপুর বাজার থেকে ফিরলো অনেক রাতে। ততক্ষণে মজিবর আর মারুফা চলে গেছে। রাতের খাবারের পর ফুলি বানুর ঢাকায় যাওয়ার বিষয়ে কথা তুললো। সবকিছু শুনে নুরু বললো, আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। ভালো ছেলে। ও যখন বলেছে তখন আর ভয় কীসের। তাছাড়া ওর বউও তো আছে। বলে নুরু ফুলির মুখের দিকে তাকালো, বানু কী বলে?

মজিবরের কথা শুনে ফুলি খুশি হয়েছিলো কিন্তু তার মনে হয়েছিলো নুরু হয়তো বানুকে ঢাকা পাঠাতে রাজি হবে না। বাবার সম্মতি পেয়ে ফুলির মুখ উজ্জ্বল হলো, ও তো রাজি। ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছে।

নুরু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো, বানুর মা ওকে একবার ডাকোতো শুনি।

ফুলি জোরে ডাক দিলো, বানু।

মজিবরকে বানু ছোটবেলা থেকে চেনে। একই পাড়ায় ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে। প্রথমে বানু ভেবেছিলো মজিবর তার সঙ্গে তামাশা করছে কিন্তু সত্যি সত্যি মজিবর তাকে ঢাকা যাওয়ার এবং চাকরি করার কথা বলার পর থেকে বানুর চোখের সামনে সেই স্বপ্নের শহরের ছবি ভেসে উঠছে। বানুর চোখের সামনে মারুফার ছবি ভেসে উঠলো। মারুফার চেয়ে সে কোনো অংশে কম নয়। অথচ মারুফা চাকরি করছে, মজিবরের মতো একটা ভালো ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। মারুফাও সত্যিই ভাগ্যবতী। আর সেই অল্প বয়সে তার বিয়ে হলো, সংসার হলো, সতিনের সংসার। সে কী অমানুষিক নির্যাতন! ভাবতেই বানুর শরীর শিউরে উঠলো। তারপর শ্রমিকের কাজ করতে শুরু করলো হায়দার সর্দারের দলে। সেখানেও সারাদিন বানু মাটি কাটার কাজ করেছে, ঢালাইয়ের কাজ করেছে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়েছে। আর যখন কাজের অভাব তখন  হায়দার সর্দারের হয় নতুন মতলব।

হায়দার সর্দারের দু’বউ। তারপরও দলে কোনো কম বয়সী মেয়ে কাজে যোগ দিলে তাকে নিয়ে তার শুরু হবে নতুন মতলব। বানু লক্ষ্য করেছে কাজের অভাব হলে হায়দার সর্দার শুধু তার অনুগত কম বয়সের মেয়েদের কাজে নেয়। সে বানুকে ইশারা ইঙ্গিতে সেকথা বুঝিয়েছে কিন্তু বানু তার মতলব বুঝতে পেরে তাকে এড়িয়ে গেছে। তাই খুব প্রয়োজন না হলে হায়দার সর্দার তাকে কাজে ডাকে না। যেদিন বানু কাজ পেতো না সেদিন বাবা-মা’র মুখের দিকে তাকাতেই তার নিজেকে বাবা-মা’র বোঝা বলে মনে হতো।

মা’র ডাক শুনে বানু বিছানা থেকে এক রকম চমকে উঠলো, জি মা।

এ ঘরে আয় তো মা। তোর বাপ ডাকে।

আসছি মা বলে বানু তার বাবা-মা’র কাছে এলো।

নুরু বিছানায় শুয়ে ছিলো। সে বিছানা থেকে উঠলো না। বানুকে বিছানার কোনে বসার ইঙ্গিত করলো। বানু বিছানায় বসলো। নুরু বানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো। তার দু’চোখ পানিতে ছল ছল করে উঠলো। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো, যাবি রে মা?

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বানুর চোখে পানি এলো। সেও কোনো কথা বলতে পারলো না। সে মাথা একবার উঁচু একবার নিচু করে জানাল সে যাবে।

এবার নুরু বিছানা থেকে উঠে বসলো, বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যায় আর বাবা-মা’র সংসারের হাল ধরে ছেলেরা। অথচ মেয়ে হয়ে তোকে বাবা-মা’র সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে। যে বয়সে নিজের স্বামী সংসার থাকার কথা সে বয়সে….

ফুলি কিছুটা শাসনের সুরে বললো, তুমি থামবে? মেয়েটাকে সাহস না দিয়ে ওর মন ভেঙ্গে যাওয়ার মতো কথা বলছো।

কয়েক মুহূর্ত কারও মুখে কোনো কথা নেই। নুরুই প্রথম কথা বললো, মজিবর কবে ঢাকা যাবে? কিছু শুনেছো বানুর মা?

ওতো তেমন ছুটি পায় না। বললো দু’য়েকদিনে যাবে।

নুরুর বুক চিরে একটা কথা বেরিয়ে এলো, আচ্ছা।

দশ

বানু গার্মেন্টস কর্মীদের ভিড়ে মিশে গেছে। প্রতিদিন সকালবেলা নাস্তা খেয়ে হাতে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে লক্ষ লক্ষ মেয়ের মধ্যে বানুও একজন। ব্রহ্মপুত্র নদের চরে বড় হওয়া বানু, সতিনের সংসারে নির্যাতিত বানু, হায়দার সর্দারের নারী শ্রমিক বানু এখন গার্মেন্টস কর্মী বানু। এমনি লক্ষ লক্ষ বানুরা দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গার্মেন্টসে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে উন্নত করছে, দেশকে সমৃদ্ধ করছে। সারাবিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করছে। আর বিত্তবানরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেশকে ধ্বংস করছে, সারা দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশকে দুর্নীতিগ্রস’ দেশ হিসেবে উপস’াপন করছে। অথচ দেশে বানুদের চেয়ে সেইসব লুটেরা রাজনীতিবিদরা আজ পূজনীয়। আর বানুরা বরাবরই উপেক্ষিত।

প্রতি বছরই কোনো না কোনো গার্মেন্টসে দুর্ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, নেতা-নেত্রীরা দোষীদের শাস্তির জন্য তোড়জোড় শুরু করেন, বানুদের সমবেদনা জানান, তাদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার কথা বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করেন। তারপর ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম, তদন্ত কমিটি সময় বৃদ্ধির পর সময় বৃদ্ধি। তারপর একসময় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তলিয়ে যায় ডিপ ফ্রিজে। বানুদের অধিকারও চাপা পড়ে যায়।

বানুদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং বানুদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিদেশিরা প্রেসক্রিশন দেয়, মেধা, অর্থ, শ্রম বিনিয়োগ করে অথচ যারা রাজনীতিবিদ, যারা পাঁচ বছর পর পর ভুরি ভুরি স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করে তারা বানুদের জন্য কতোটা করছে। এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য বানুরা বসে নেই। তারা জেনে অথবা নিজের অজান্তে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ বানুদের স্যালুট।

বানুর চোখে স্বপ্ন অনেক। দেশের জন্য, নিজের জন্য, বাবা-মা ভাইবোনের জন্য। প্রথম মাসে বেতন পেয়ে বানু এক হাজার টাকা বাবা-মা’র কাছে পাঠিয়েছে। টাকা পেয়ে ফুলি আর নুরুর চোখে পানি এসে গেছে। ফুলির আজও মনে আছে তার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে ছিলো। মেয়ে হয়েছে বলে তার শ্বশুর-শাশুড়ি মন খারাপ করেছিলো। তার শ্বশুরের মনের অবস’া মুখে দেয়া যায়নি কিন্তু তার শাশুড়ি তো মুখে বলেই ফেললো, প্রথম সন্তান মেয়ে হলো!

নুরু অবশ্য মন খারাপ করেনি, সে বরং বানুকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, হোক, ছেলে হোক আর মেয়েই হোক আল্লাহ আমাদের একটা বাচ্চা দিয়েছেন এটাই যথেষ্ট। ফুলি তুমি মা’র কথায় কিছু মনে করও না।

নুরুর কথা শুনে ফুলির মন ভরে গিয়েছিলো। কিন্তু বানুর পর যখন রেণু হলো তখন নুরু মুখে কিছু বললো না বটে কিন্তু তারও মন খারাপ হলো। ততদিনে অবশ্য নুরুর বাবা-মা দু’জনে মারা গেছে।

বিয়ের পর যেকোনো দিন বাচ্চা নেয়ার কথা হলেই নুরু বলতো, ছেলে হোক আর মেয়েই হোক দু’টার বেশি না কিন্তু বানুর পর যখন রেণু হলো তখন শুধু নুরু না ফুলিও মন খারাপ করলো। এবার পড়শিরা নানান কথা বলতে শুরু করলো। ফুলি আর নুরুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো।

এবার ফুলির যমজ সন্তান হলো। এক ছেলে এক মেয়ে। সেই যমজ ছেলে মানিক এখন রাজিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটের ছাত্র। অনেক কষ্টে হলেও মানিকের লেখাপড়ার জন্য নুরু মানিকের স্কুল কিংবা প্রাইভেটের টাকা দিতে কার্পণ্য করে না। এই ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ফুলি আর নুরু অনেক স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অনেক যত্নের পরও মানিকের পরীক্ষার ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না। সে ছোটখাটো কারণে স্কুল না যাওয়ার অজুহাত তৈরি করে, স্কুলের কথা বলে রাজিবপুর গিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাকে নিয়ে নুরু আর ফুলির স্বপ্ন আজ দু:স্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে।

জমোজ সন্তানের আরেক জন ইতি। শৈশব থেকেই সে লেখাপড়ায় ভালো। প্রাইমারি স্কুল থেকে সে ক্লাসে বরাবরই প্রথম স’ান অধিকার করেছে। ইতি যখন ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠলো তখন এক সঙ্গে দু’জন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবে না বলে ইতির আর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া হলো না।

একদিন আনোয়ার মাস্টারের সঙ্গে নুরুর দেখা হলো শঙ্কর মাধবপুর বাজারে। এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন কয়েক কিলোমিটার দূরে সাদাকাত হোসেন হাই স্কুল কিংবা কোদালকাটি গার্লস হাই স্কুলে যেতো না কিংবা সোনাভরি নদী পার হয়ে রাজিবপুর যেতো না তখন আনোয়ার মাস্টার এলাকাবাসীর উদ্যোগে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে একটা জুনিয়র হাই স্কুল করলেন। সেই জুনিয়র হাই স্কুল এখন শঙ্কর মাধবপুর হাই স্কুল। ক্লাস ফাইভ পাস করে যেসব ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে মেয়েরা ঝরে পড়তো বাড়ির কাছে স্কুল হওয়াতে তারাও এখন এস.এস.সি পাস করার সুযোগ পেলো। আনোয়ার মাস্টার শুধু একজন শিক্ষকই না, এই গ্রামের মানুষের কাছে একজন জ্ঞানী মানুষও। আগের দিনে যেকোনো কাজে ভালো পরামর্শের জন্য সবাই নজির পণ্ডিতের কাছে যেতো। বার্ধক্যজনিত কারণে পণ্ডিত মশাই কাহিল হয়ে পড়েছেন। তাই তার স’ান ধীরে ধীরে কিছুটা পূরণ করছেন আনোয়ার মাস্টার।

নুরু আনোয়ার মাস্টারকে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম মাস্টার সাহেব।

ওয়ালেকুম আসসালাম। নুরু ভাই আপনার ছোট মেয়েটাকে কোথায় ভর্তি করে দিলেন? 

ভর্তি করিনি মাস্টার সাহেব।

কেনো?

আমাদের অবস’া তো আপনি জানেন। খালি হাতে এতোগুলো ছেলেমেয়ের…

আনোয়ার বাধা দিয়ে বললেন, আজকাল তো মেয়েদের লেখাপড়ায় টাকা লাগে না, সরকারই টাকা দেয়, আপনি জানেন না?

জানি, ওর মা বললো, এমনিতেই এতগুলো ছেলেমেয়ের খাওয়া-পরা নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, ছেলেটাকে রাজিবপুর পাইলট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি তারওপর আবার মেয়েটার লেখাপড়ার খরচ…

আনোয়ার কিছুটা বিরক্ত হলেন, এতোকিছু খরচ করতে পারবেন আর মেয়েটাকে স্কুল পাঠাতে পারবেন না?

একথা উত্তরে নুরু মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো কথা বললো না।

আনোয়ারও আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে এখন থাক, আজ সন্ধ্যায় আমি তোমার বাড়িতে যাবো।

আচ্ছা মাস্টার সাহেব।

সেদিন সন্ধ্যায় আনোয়ার নুরুর বাড়িতে এলো। নুরু দরজা খুলে দিয়ে উঠানে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে নিজেও বসলো। নুরু ফুলিকে আগেই বলেছিলো তারপরও ফুলি আনোয়ার মাস্টারকে দেখে কিছুটা অপ্রস’ত হলো। সে মাথায় ঘোমটা টেনে সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম মাস্টার সাহেব।

কেমন আছেন ভাবী?

আমাদের আবার ভালো থাকা।

এভাবে বলতে হয় না আল্লাহ যেভাবে রেখেছেন সেভাবেই শুকরিয়া আদায় করতে হয়। 

হ্যাঁ মাস্টার সাহেব ঠিকই বলেছেন।

আপনার ছোট মেয়েটা কোথায় ভাবী? কী নাম যেনো?

ইতি। বলে সে ইতি বলে ডাক দিতেই ইতি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সালাম দিলো।

আনোয়ার সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এদিকে এসো মা। আমার কাছে এসো।

ইতি আনোয়ারের কাছে এলো। আনোয়ার ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো এবার এ-প্লাস পেয়েছো মা, তাই না?

ইতি মাথা উঁচু-নিচু করে সায় দিলো।

আর পড়বে না?

ইতি’র মুখ কালো হলো। দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। সে মাথা নেড়ে জানালো, পড়বে।

এবার আনোয়ার ফুলির দিকে তাকালেন, ইতিকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দেন ভাবী।

ফুলি মিনমিন করে বললো, স্কুলে ভর্তি করে দিতে তো অনেক টাকা লাগবে মাস্টার সাহেব। তারপর আছে মাসে মাসে অনেকগুলো টাকা বেতন, ভালো জামা-কাপড়।

স্কুলে লেখাপড়া করতে মেয়েদের এখন কোনো বেতন লাগে না। উল্টো সরকার উপবৃত্তি দেয়। বলে আনোয়ার নুরুকে বললেন, নুরু ভাই কাল ইতিকে স্কুলে নিয়ে আসবেন।

আচ্ছা মাস্টার সাহেব।

আনোয়ার ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, যাও মা। কাল স্কুলে ভর্তি হয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করবে দেখবে একদিন তুমি অনেক বড় হবে। এই চরের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করবে।

ইতি চলে গেলো। আনোয়ারের কথা শুনতে শুনতে নুরু এবং ফুলির চোখে পানি এসে গেছে। আনোয়ার পাটি থেকে উঠছিলেন এমনসময় ফুলি মোড়া থেকে উঠলো, একটু বসুন মাস্টার সাহেব। আমি পান নিয়ে আসি।

দিন কতো দ্রুত চলে যায়। ইতি এখন শঙ্কর মাধবপুর স্কুলে ক্লাস এইটের ছাত্রী, মানিকও ক্লাস এইটে, রাজিবপুর পাইলট স্কুলে। রেণুর বিয়ে হয়েছে সে এখন শ্বশুরবাড়িতে।

আর বানু? সেদিনের সেই বানু, যে বানুর পৃথিবীতে আগমনকে তার দাদি এবং পড়শিরা স্বাগত জানায়নি সেই বানুই আজ গার্মেন্টসে চাকরি করে বাবা-মা’র জন্য টাকা পাঠিয়েছে।

শঙ্কর মাধবপুর বাজারে একটা কমার্শিয়াল ফোনের দোকান আছে সেই দোকানে ফোন করে বাবা-মা’কে ডেকে নিয়ে তাদের  ভালো-মন্দ খবর নিয়েছে আর বার বার করে বলেছে ইতির লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। অনেকদিন পর আজ নুরু এবং বানু বুঝতে পারলো প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে ছেলে মেয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।

মানিক আর ইতি তখন বারান্দায় পড়ছিলো। ফুলি তাদের পড়ার পাটির এক কোণে এসে বসলো। ইতি বই থেকে মুখ তুললো না, সে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে আর মানিক তার মা আসামাত্র পড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী মা?

মানিক এমনই, পড়াশোনার প্রতি তার মনোযোগ তেমন একটা নেই। বই সামনে রেখে কোথায় একটু উচ্চ স্বরে শব্দ হলো, বাবা-মা কী বললো সেদিকে তার কান খাড়া থাকে। মানিকের এই অভ্যাসটা ফুলির খুবই অপছন্দ। সে কিছুটা ধমকের সুরে বললো, কিছু না, তুই ভালো করে পড়।

মানিক পড়তে শুরু করলো। ফুলি কয়েক মিনিট পাটির কোণায় বসে থাকলো। তার বার বার করে মনে হলো সে এতোদিন ভুল করেছে, ইতিকে তার সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আর সে এমন ভুল করবে না, তার চারটি সন্তান, চারটির মধ্যে কোনো তফাৎ করবে না। ইতিকে সে লেখাপড়া শেখাবে, মানিককে যত দূর পর্যন্ত লেখাপড়া শেখাবে ইতিকে ততদিন লেখাপড়া শেখাবে। ইতি যদি তার চেয়ে বেশি লেখাপড়া করতে চায় তবে তাকে তার ইচ্ছামতো লেখাপড়া শেখাবে। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ফুলির চোখের পাতা ভিজে গেলো।    

এগারো

রাজিবপুর থেকে ফিরে সবুজের দিন কাটলো ঘরে বসে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখে কাটিয়েছে। রাতে ঘরে ফিরে ছালু জিজ্ঞেস করলো, কীরে আর ক’দিন ছুটিতে থাকবি?

সবুজ কোনো কথা বললো না।

ছালু আবার বললো, মন খারাপ?

সবুজ মাথা নেড়ে সায় দিলো।

কেনো? তুই না গেলি বিয়ে করতে? বউ কোথায়?

সবুজের দু’চোখ ছলছল করে উঠলো।

ছালু আবার জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, না?

সবুজ মাথা কাত করে সায় দিলো।

মন খারাপ করার কিছু নেই। মেয়েরা এমনই হয়। তুই ঢাকা এসেছিস্‌ আর মেয়েটা আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললো। এই না হলো মেয়েমানুষ!

সবুজ রেগে গেলো, এভাবে বলবেন না ছালু ভাই, রেণু এরকম মেয়েই না।

তো?

হয়তো গার্ডিয়ানরা জোর করে বিয়ে দিয়েছে।

সেটা ঠিক আছে কিন্তু জোর করলো আর বিয়েতে বসলো। বেঁকে বসলেও তো পারতো। শোন আমি একটা কথা বলি।

সবুজ আগ্রহ সহকারে ছালুর মুখের দিকে তাকালো।

এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকার কোনো মানে নেই। তোর প্রেমিকা তো ঠিকই বিয়ে করে সংসার করছে। তো তুই আর দেরি করবি কেনো?

তো?

তুইও বিয়ে করে ফেল্‌।

আপনি কী বলছেন!

কেনো? তুই কি ঐ মেয়েটার জন্য সারাজীবন বিয়ে না করেই কাটিয়ে দিবি নাকি?

সবুজ একবার মাথা উঁচু একবার নিচু করে জানলো সে রেণুর জন্য সারাজীবন কাটিয়ে দিবে।

প্রথম প্রথম সবাই এভাবে বলে তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। আমি বলি সময় নষ্ট না করে তুইও বিয়ে করে ফেল্‌, বিয়ে করলে তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যাবি।

সবুজ একটা শুষ্ক হাসি হাসলো।

ছালু সবুজের রুমমেট, একই রুমে থাকতে থাকতে দু’জনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আজকাল দু’জনের ব্যক্তিগত বলে কোনো কথা নেই। সবসময় দু’জনে খোলামেলা কথা বলে। ছালু আবার বলতে শুরু করলো, তোর কপালটাই ভালো।

ভালো?

হ্যাঁ, তুই যেদিন গেছিস্‌ সেদিন থেকে ছবি বার বার করে বাসার বাইরে আসছে, সবসময় তোকে খুঁজছে। এই দু’টা দিন মেয়েটার খুব কষ্টে গেলো। আমি বলি কী এভাবে বাড়ি থেকে ফিরে এসে তুইও কষ্ট পাচ্ছিস্‌ আর মেয়েটাও কষ্ট পাচ্ছে। কী দরকার বল্‌, তারচেয়ে তুই রাজি থাকলে বল আমি চেষ্টা করে দেখি।

সবুজ একটা কষ্টের হাসি হাসলো। সে কোনো আগ্রহ দেখালো না।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। না সবুজের চোখে ঘুম নেই। সবসময় রেণুর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিকেলে সবুজ তার মোবাইল ফোনে একটা সিনেমা দেখছিলো ছবি দরজায় এসে দাঁড়ালো, কেমন আছেন আপনি?

সবুজ মাথা উঁচু করে দেখলো, ভালো।

গ্রামের বাড়িতে সবাই ভালো আছে?

সবুজ কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, হ্যাঁ ভালো।

আপনার রূপবতী বান্ধবীটা ভালো আছে তো?

রূপবতী কথাটা শুনে সবুজের বুকটা কেঁপে উঠলো, তুমি কার কথা বলছো?

ঐযে যার টানে আপনি ছুটে যান।

কথা বলতে গিয়ে সবুজের কথা যেনো গলায় আটকে গেলো, ভালো, খুব ভালো আছে।

এভাবে বলছেন কেনো? পাখি ফুড়ুৎ কইরা পলাইছে নাকি?

সবুজ কোনো কথা বললো না।

বলেছিলাম না সুন্দরী আমে পোকা থাকে।

একথাটা সবুজ কখনোই মানতে পারে না। রেণু তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে কিন্তু সে রেণুর মধ্যে কোনোদিন কোনো দোষ দেখেনি। শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে বিয়েতে মেয়েদের নিজস্ব মতামত বলে কিছু নেই। বাপ-মা যাকে যার সঙ্গেই বিয়ে দেয় তাকেই স্বামী বলে, ভাগ্য বলে মেনে নেয়। তারওপর রেণুর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে যাওয়ায় রেণুর কথা বলার পথটা চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাই হয়তো রেণু…

ছবির কথা শুনে সবুজ রেগে গেলো, ছবি তুমি যাও।

কেনো? আপনার সঙ্গে একটু গল্প করি।

না, আমার তোমার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে না।

আমার লাগে।

আচ্ছা ছবি তুমি যে এভাবে আমার সাথে গল্প করও, এই যে আমি একা শুয়ে আছি আর তুমি আমার ঘরের দরজায় এসে কথা বলছো তাতে তোমার মা কিছু বলে না?

ছবি হাসি-খুশি মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো, আমার তো মা নেই।

বাবা?

বাবাও নেই।

তুমি কার সাথে থাক?

ভাই-ভাবীর সঙ্গে।

তোমার ভাই-ভাবী কী করে?

গার্মেন্টসে চাকরি করে।

তুমিও তো কোনো গার্মেন্টসে চাকরি করতে পারো?

ভাবীর বাচ্চা ছোট, তাই ভাবী আমাকে চাকরি করতে দিবে না, ভাই-ভাবীর কথা বলতে বলতে ছবির গলার স্বর ভারী হয়ে এলো।

ছবির ওপর সবুজের রাগ কিছুটা কমে এলো। এতোদিন সবুজ যে মেয়েটিকে হাসি-খুশি আর উচ্ছল দেখেছে সেই মেয়েটির মনের মধ্যে কষ্ট অনেক। হাসি-খুশিটা তার বাইরের রূপ।

সবুজকে চুপ করে থাকতে দেখে ছবি আবার বলতে শুরু করলো, আমার ভাই-ভাবীর কাছে থাকতে ইচ্ছা করে না। ভাবী খুব অত্যাচার করে, ছোটখাটো কারণে আমার গায়ে হাত তোলে, খারাপ ভাষায় কথা বলে, আমিও একটা চাকরি খুঁজছি পেলে চলে যাবো…

না, না এভাবে চলে যাবে না। চাকরি করতে চাইলে তাদেরকে বলো, তারাই একটা চাকরির ব্যবস’া করে দিবে।

অনেক বার বলেছি। ভাবী শুধু তার স্বার্থ দেখে, আমি চাকরি করলে তার বাচ্চা মানুষ করা হবে না। তাই আমাকে চাকরি করতে দিবে না। আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে তাই অনেক দিন আপনাকে বিরক্ত করলাম আর কেনোদিন আপনাকে বিরক্ত করবো না। থাকেন আমি গেলোম। মেয়েটা বোধ হয় ঘুম থেকে উঠলো, বলে ছবি সবুজকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো।

বারো

রেণু শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে এলো প্রায় এক মাস পর। এই এক মাস আগেও এই গ্রামটাকে যেনো তার নিজের গ্রাম বলে মনে হতো। মনে হতো এই শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের চেয়ে সুন্দর গ্রাম বুঝি পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এই গ্রামকে ছেড়ে অন্য কোথাও সে একদিনও থাকতে পারবে না। অবশ্য এই গ্রাম ছেড়ে থাকতে না পারার আরও একটা বড় কারণ ছিলো। এই এক মাসের ব্যবধানে কত কী যে ঘটে গেলো। এই গ্রাম থেকে অপরাধের গ্লানি নিয়ে রেণু চলে গেলো চিলমারী। তবু সবুজের প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দুমাত্রও কমেনি। সবসময় তার সবুজের কথা মনে পড়তো। তারপর ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক রিয়াজের সঙ্গে তার বিয়ে হলো। আইন এবং সমাজের দৃষ্টিতে সে এখন রিয়াজের স্ত্রী। রিয়াজ তার সঙ্গে আসায় শুধু রেণু না তার মা-বাবা দু’জনেই চিন্তিত। যদি কোনো কারণে রিয়াজ রেণুর সবুজের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলে তবে কেলেঙ্কারির আর কিছু বাকি থাকবে না।

রেণুও এই ব্যাপারে সচেতন। সবুজের ভালোবাসাকে সে কখনো পাপ বা অন্যায় মনে করে না। কিন্তু তাকে নিয়ে গ্রামে সালিস বসার কথাটাকে তার কাছে খুবই নিন্দনীয় বলে মনে হয়। সকালবেলা রিয়াজ একবার বাইরে যেতে চেয়েছিলো। রাজিবপুর কিংবা কোদালকাটি বাজারে। শুনে ফুলি রেণুকে ঘরে ডেকে নিয়ে চাপা স্বরে বললো, জামাইকে কোথাও একা যেতে দিবি না, সবসময় তুই সঙ্গে যাবি।

রেণু রিয়াজের সঙ্গে গিয়েছিলো। সেখান থেকে পাড়াতো আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো। রিয়াজ একা তেমন কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি কিন্তু পরদিন বিকেলে যখন রাজিবপুর হাট যাওয়ার জন্য রিয়াজ তৈরি হচ্ছিলো তখন আর রেণুর সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হলো না। তবুও রেণু মানিককে রিয়াজের সঙ্গে পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু বিকেলে মানিকের প্রাইভেট থাকায় রিয়াজ একাই রাজিবপুর বাজারে গেলো। যাওয়ার আগে ফুলি রেণুকে ডেকে কয়েকটা টাকা হাতে দিয়ে বললো, যা মা জামাই’র হাতে দিস্‌।

রেণু রিয়াজকে একা ছেড়ে না দেয়ার শেষ চেষ্টা করলো। সে রিয়াজের হাতে টাকা দিয়ে বললো, তোমার না গেলে হয় না?

রিয়াজ জিজ্ঞেস করলো, কেনো?

রেণু কৃত্রিম অভিমান করে বললো, তুমি গেলে একা একা আমার থাকতে ইচ্ছা করবে না। তাছাড়া বাড়িতে থাকলে তোমাকে কারিগরপাড়া নিয়ে যেতাম, আমার এক ফুপুর বাড়িতে।

ফুপুর বাড়িতে তো কালকেও যাওয়া যাবে রেণু।

রেণুর শেষ চেষ্টাও বিফলে গেলো। সে আর কথা বাড়ালো না, সে রিয়াজকে এগিয়ে দেয়ার জন্য নৌকা ঘাট পর্যন্ত গেলো।

নৌকায় রিয়াজের সঙ্গে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামেরই এক ছেলের জয়নালের সঙ্গে পরিচয় হলো। রিয়াজকে দেখে সে-ই প্রথম কথা বলতে শুরু করলো, আপনি কি রেণুর বর নাকি?

রিয়াজ কিছু লজ্জা পেলো। সে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

কবে এসেছেন?

গতকাল?

রাজিবপুর যাবেন?

জি।

সে-ই রিয়াজকে আপ্যায়ন করলো। তার সুবাদে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে রিয়াজের পরিচয় হলো। তাদেরই একজনের সঙ্গে রিয়াজের অনেক সময় কাটলো, নাম মোন্তাজ। ফেরার পথে মোন্তাজসহ রিয়াজ একই ভ্যানে নৌকা ঘাটে এলো। নৌকা তখন নদীর অপর পাড়ে। নৌকার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরও পরিচিত দু’য়েকজন ঘাটে এসে দাঁড়ালো। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। একজন মোন্তাজের কাছে রিয়াজের পরিচয় জানতে চাইলো। মোন্তাজ পরিচয় করে দিলো, চেনো না, আমদের গ্রামের জামাই।

কার জামাই?

নুরুর।

ও তাইতো শুনলোাম শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ে দিলো।

আরেকজন বললো, হ্যাঁ দু’টা মেয়েই দু’রকম কীর্তি করলো।

কথাটা রিয়াজের কানে বেজে উঠলো। বানুর বিয়ে তারপর তালাক এসব বিষয় সে রেণুর কাছে শুনেছে কিন্তু দু’টা মেয়ে? আরেকটা মেয়ে কি…

রিয়াজের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে কী শুনছে এসব। বড় আপার বিয়ে হয়েছিলো, স্বামী তালাক দিয়েছে তাতে রিয়াজের কিছু যায় আসে না। কিন্তু রেণু? রেণুর বিষয়ে তো সে কেনোকিছু মেনে নিবে না। নৌকা ঘাটে ভিড়তে অনেক দেরি হলো আর রিয়াজকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হলো স্ত্রীর বিগত জীবনের কলঙ্কের কাহিনী।

রিয়াজের সঙ্গে রেণুর বিয়ে হয়েছে কিন্তু প্রেম হয়েছে কী না রেণু তা কেনোদিন চিন্তা করেনি। রেণু জানে রিয়াজ তার স্বামী। রিয়াজও স্বামী হিসেবে রেণু সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। রেণু হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছে। এই দু’জনের ভালোবাসায় যদি বিন্দুমাত্র দূরত্ব থাকে তবে সেটা রেণুর জন্য একথা রিয়াজ বলুক বা না বলুক রেণু জানে। রেণুও রিয়াজের সঙ্গে স্ত্রীর দায়িত্বে কোনো কমতি করেনি। সম্পর্কটা এতো সুন্দর ছিলো যে রেণু কেনোদিন বুঝতে পারেনি।

একসময় রেণুর মনে হতো এই শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম আর তার হৃদয়ের জুড়ে থাকা সবুজকে ছাড়া সে বাঁচবে না। চিলমারী নানার বাড়িতে গিয়েও তার মন পড়ে থাকতো এই গ্রামে, মনের মধ্যে সবসময় লালন করতো সবুজের স্মৃতি। রিয়াজের সঙ্গে বিয়ের পর প্রথম প্রথম তার খুব সবুজের কথা মনে পড়তো, তার কাছে রিয়াজ, তাদের সুন্দর পরিপাটি বাড়িঘর সবকিছুই মধ্যে থেকেও তার কাছে মনে হতো রিয়াজের এসব যেনো তার কাছে সোনার খাঁচা। সবসময় মনে হতো কখন সে এই সোনার খাঁচা থেকে মুক্তি পাবে।

প্রতিদিন রিয়াজ সন্ধ্যায় যখন দোকান বন্ধ করে বাড়িতে আসতো তখন ঘরে ঢুকে রেণুর হাতে ছোট্ট একটা পটলা দিয়ে বলতো, এই নাও তোমার মিষ্টি।

রেণু মিষ্টির পটলা হাতে নিয়ে নিতেই রিয়াজ রেণুকে বুকে জড়িয়ে ধরতো, উঁহু। আমাকে খেতে দিবে না।

রেণু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পটলা খুলে আগে রিয়াজের মুখে তুলে দিতো। রিয়াজও তার মুখে একটা মিষ্টি তুলে দিতো।

একদিনের সেই সোনার খাঁচা তার কাছে দিনে দিনে স্বর্গে রূপ নিতে যাচ্ছিলো। রিয়াজের  ভালোবাসা দিনে দিনে তাকে সবুজের সবকিছু ভুলিয়ে দিতে বসেছিলো। রেণু অপেক্ষায় ছিলো রিয়াজ আজ প্রথম শ্বশুরবাড়ি থেকে রাজিবপুর হাটে গেছে। আজ হাট থেকে ফিরে আসবে ঠিক ফকিরের হাট থেকে ফেরার পথে সে যেমন হাসিমুখে বাড়িতে ফিরতো তেমনিভাবে।

রিয়াজের বাড়িতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছে। বাড়ির দরজা পর্যন্ত কে যেনো তাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো। রিয়াজ তাকে চেনে না। নৌকায় চড়েই তার সঙ্গে রিয়াজের প্রথম কথা হলো।

রেণু বাইরের দরজা খুলে দিলো কিন্তু রিয়াজের এমন অবস’া কেনো? তার মুখের দিকে তাকিয়ে রেণুর বুক কেঁপে উঠলো। তার বুকে যেনো একটা ঢেউ জোরে ধাক্কা দিলো।

রিয়াজ রেণুর হাতে মিষ্টির পটলা দিলো কিন্তু একবারও তার মুখের দিকে তাকালো না।

পূর্ণিমা রাত। মেঘহীন আকাশ। ব্রহ্মপুত্রের এখন ভরা যৌবন। রেণু ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখা যায়। ব্রহ্মপুত্র  আজ নতুন সাজে সেজেছে। রূপালী চাঁদের আলো যেন নেমে এসেছে ব্রহ্মপুত্র নদে। রিয়াজ শুয়েছে জানালার পাশে, ভেতর থেকে রেণু অনেকক্ষণ ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে রিয়াজের ওপর একটা হাত দিয়ে। রিয়াজ ঘুমায়নি কিন্তু তার কোনো কথা নেই।

রেণু রিয়াজের হাতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে ডাক দিলো, ঘুমিয়েছো?

রিয়াজ প্রথমবার সাড়া দিলো না।

রেণু আবার ডাক দিলো, এই…

রিয়াজের সংক্ষিপ্ত উত্তর, বলো।

কী হয়েছে তোমার?

রিয়াজ অভিামনের সুরে বললো, কিছু না।

মন খারাপ কেনো?

রিয়াজ কোনো কথা বললো না।

রেণু আবার রিয়াজকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, চুপচাপ কেনো?

এবার রিয়াজ রেগে গেলো, কী করবো?

কথা বলো?

কী বলবো?

তোমার কি কোনো কথা নেই? বাড়িতে থাকতে তো অনেক কথা বলতে।

রিয়াজ কোনো উত্তর দিলো না।

রেণু আবার একটা ঝাঁকুনি দিলো, এই।

রিয়াজ রেগে গেলো, ডিস্টার্ব দিও না তো।

কেনো? কী হয়েছে তোমার?

রিয়াজ বললো, আমার কিছু হয়নি, তোমার হয়েছে।

আমার কী হয়েছে? বলো আমাকে?

বলতে হবে কেনো, তুমি জানো না?

কিছু না বললে আমি কীভাবে বুঝবো?

থাক আর বলতে হবে না। আমি কাল সকালে বাড়ি যাবো।

কালকেই বাড়ি কেনো?

আমি আর এখানে থাকবো না।

তুমি না ক’দিন থাকতে চেয়েছিলে? এখন আবার কালকেই চলে যাবে কেনো? আর দু’টা দিন থেকে যাই।

না, আমি আর থাকবো না। থাকলে যে আরও কতো কী শুনতে হবে। তারচেয়ে আমার চলে যাওয়াই ভালো। তুমি যদি থাকতে চাও তো থাকো। একদিন দু’দিন না সারাজীবন থাকো।

রেণু কোনো কথা বললো না, তার মুখ শুকিয়ে গেলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে রিয়াজ কারও কাছে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সবুজের সম্পর্কের বিষয়টা শুনে ফেলেছে। সে আর কোনো কথা বললো না।

এতক্ষণ রেণু রিয়াজের বাহুতে একটা হাত দিয়ে কথা বলছিলো এবার রিয়াজ রেণুর হাতটা সরিয়ে দিলো।

রেণুর দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো, শোনো তোমাকে কে কী বলেছে জানি না। তুমি ওদের কথা বিশ্বাস করও না। এই গ্রামে আমাদের শত্রু-মিত্র অনেক আছে। তাদের কেউ তোমাকে আমার সম্পর্কে বানিয়ে অনেক কিছু বলতে পারে। বিশ্বাস কর আমার কোনো দোষ নেই।

না, তোমার দোষ থাকবে কেনো? আমার দোষ যে আমি তোমাকে ভালোভাবে না জেনে শুধু একবার দেখেই পছন্দ করেছি আর বাবা-মা আমার পছন্দমতো তোমাকে বউ করে এনেছে। বাবা জানতে পারলে কী হবে? আর মা? মা জানতে পারলে তো…বলে রিয়াজ কয়েকবার ছি: ছি: করলো।

তেরো

পরদিন সকালবেলা রিয়াজ বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। রিয়াজকে তৈরি হতে দেখে রেণু জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো এখন?

বাড়ি।

আজ কেনো?

সেটা তো কালকেই তোমাকে বলেছি।

রেণু রিয়াজের বুকে মাথা রেখে বললো, দেখ তুমি যদি চলে যাও তো বাবা-মা খুব রাগ করবে। প্রতিবেশীরাও নানান কিছু বলবে। আমাদের গ্রামে নতুন জামাই এলে কয়েকদিন থাকে তারপর পুরানা হয়ে গেলে আর তেমন কেউ খোঁজখবর রাখে না। দোহাই তোমার গ্রামের মানুষের কাছে আমদের…

রিয়াজ রেণুকে বুক থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। রেণু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চোখ মুছলো। তারপর বাইরে গিয়ে তার মাকে বললো। ফুলি তো শুনে অবাক, কেনো রে জামাইর হঠাৎ কী হলো?

রেণু কী বলবে বুঝতে পারলো না। সে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রেণু বুঝতে পারলো তার মা হয়তো রিয়াজ রাগ করে চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে। ফুলি কিছুক্ষণ রেণুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, কাল রাজিবপুর থেকে আসার পর থেকে এরকম নাকি রে?

রেণু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

ফুলি আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সে রেণুকে বললো, তুই রেডি হও মা। তুইও যা।

রেণু তার মায়ের আশঙ্কার কথা বুঝতে না পেরে বললো, মা আমি না হয় ক’দিন থেকে যাই।

এবার ফুলি একটু রাগের স্বরে বললো, আমি বলছি তুই রেডি হ। জামাইর সঙ্গে তুইও যা। আমি তোর বাবাকে ডাক দিচ্ছি।

রেণু মন খারাপ করলো কিন্তু প্রতিবাদ করলো না, সেও কাপড়-চোপড় পরতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে নুরু এলো। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো? এত জরুরি করে ডাকলে কেনো?

ফুলি নুরুকে আস্তে কথা বলার ইশারা করে বললো, তুমি এদিকে এসো তো।

ফুলি নুরুকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে সবকিছু খুলে বললো। তারপর নুরু বেরিয়ে গেলো, তুমি থাক আমি বাজার থেকে কারও কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসি। বলে নুরু যেমন তাড়াহুড়া করে এসেছিলো তেমনি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো।

সেদিন আসার পথে দু’ঘণ্টার নৌকায় রেণুর পাশে বসে থেকেও রিয়াজ কোনো কথা বলেনি। রেণু বার বার করে কথা বলেছে কিন্তু সে কোনো কিছু না শুনেই হ্যাঁ অথবা না বলে এড়িয়ে গেছে। সেদিন বাড়িতে আসার পর থেকে সে রেণুর সঙ্গে আর আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কথাও বলছে না। রিয়াজকে রেণু আগে কখনো এত গম্ভীর থাকতে দেখেনি। স্বামীর গম্ভীর কালো মুখ দেখে রেণুর একটা অজানা আশঙ্কায় মন সবসময় ছটফট করেছে।

রেণুর আজও মনে পড়ে সেদিন হঠাৎ করেই ব্রহ্মপুত্রের আকাশ গাঢ় কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে। তারপর শুরু হয়েছিলো নদীতে উত্তাল ঢেউ, প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়। তারপর শোনা গেলো মাছ ধরতে যাওয়া সবুজ আর তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে সবুজ বেঁচে গেলেও তার বাবাকে আর পাওয়া গেলো না। রেণু যেদিনই ব্রহ্মপুত্রে কালো মেঘ দেখেছে, সেদিনই ব্রহ্মপুত্র কারও না কারও জীবন কেড়ে নিয়েছে, কারও না কারও ঘর ভেঙ্গেছে। রেণুর জীবনের অভিজ্ঞতা খুব কম তবু রিয়াজের মুখের ওপর সবসময় একটা গাঢ় কালো মেঘ যেনো তার বুক কেঁপে উঠছে।

শাশুড়ির কথা শুনে রেণুর মাথায় একটা চক্কর খেলো। রিয়াজের এক চাচাতো ভাবী প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসে। রেণুর সঙ্গে দু’য়েকটা কথাও বলে কিন্তু তার শাশুড়ির সঙ্গে রেণুর এই জায়ের সম্পর্ক ভালো। রিয়াজের সঙ্গে প্রায়ই ইয়ার্কি-ফাজলামি করে। সেদিন রেণুর সেই জা জাকিয়া দুপুর বেলা তাদের বাড়িতে এলো। রেণু তখন দুপুরের রান্নার জন্য রান্না ঘরে তরকারি কুটছিলো। জাকিয়া রেণুকে দেখলো কিন্তু কোনো কথা বললো না।

রেণু তরকারি কুটার ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ি আর জা’র কথায় কান রাখলো।

জাকিয়া বার বার করে দরজার দিকে তাকালো আর চাপাস্বরে কিছুক্ষণ কথা বললো। তারপর তার শাশুড়ি বলতে শুরু করলো, এরকমই যদি হবে তাহলে উলিপুরের মেয়েটাই বা কী খারাপ ছিলো। কলেজে পড়ে, তোমার শ্বশুর কার না কার কাছে মেয়েটার সম্পর্কে কী আজেবাজে কথা শুনেছে আর সম্পর্কটাই হলো না। তারপর রিয়াজের মুখে শুনে যখন শুনলো গ্রামের মেয়ে, মেয়েটার স্বভাব চরিত্র ভালো আর ওমনি কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করে একেবারে বিয়ে করে নিয়ে এলো। আসলে বউমা আজকাল শহর আর গ্রাম বলে কোনো কথা নেই। শহরের মেয়েও ভালো হতে পারে আবার অজো পাড়াগাঁয়ের মেয়েও খারাপ হতে পারে। এরকম কিছু আছে বলেই বিহাইরা চিলমারীতে বিয়ের আয়োজন করেছে। উলিপুরের মেয়েটার সঙ্গে ছেলেটার বিয়ে হলে কতগুলো টাকা ডিমান্ডও পেতাম। এখন কি পেলাম, ভালো মেয়ে, ভালো বংশ মর্যাদা নাকি ডিমান্ড? ছোটবেলা থেকে ছেলেটা আমার কোনো কষ্ট পায়নি। নিজের বউ সম্পর্কে এরকম কথা শুনে তাই আমার ছেলেটার মনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেলো। আমার কী সুন্দর ছেলেটা হাসি মুখ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলো আর একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি এলো, বলতে বলতে রেণুর শাশুড়ির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

জাকিয়া চুপ করে রইলো।

রেণুর শাশুড়ি আবার বলতে শুরু করলো, ছেলেটার মুখটা দেখলে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বউমা। আমি নিজেই ওকে জিজ্ঞেস করবো তারপর তোমার শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলবো। যেকোনো মূল্যে আমি আমার ছেলেকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চাই বউমা।

রেণু আর রান্না ঘরে বসে থাকতে পারলো না। সে তার ঘরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর তার শাশুড়ি তাদের বাড়ির কাজের মেয়েকে দিয়ে রেণুকে ডেকে তুললো।

ক’দিন আগেই রেণু যদি এমনিভাবে তার ঘরে শুয়ে থাকতো তবে তার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করতো, বউমা তোমার শরীরটা কি খারাপ করছে?

নিজেই রেণুর ঘরে এসেছে কপালে হাত দিয়ে জ্বর হয়েছে কিনা অনুভব করেছে আর আজ দুপুরের খাওয়ার জন্য শাশুড়ি তাকে কাজের মেয়েকে দিয়ে ডেকে পাঠালো।

রেণু গেলো না। গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির দাগ ধুয়ে দরজা পর্যন্ত গেলো তারপর দরজা থেকে মাথা বের করে বললো, আপনি খান আম্মা, আমি একটু পরে খাচ্ছি।

রেণুর শাশুড়ি রেণুর দিকে একবার মুখ তুলে তাকালোও না। আর একবার অনুরোধও করলো না। এ ক’দিনেই তার শাশুড়ি যেনো তার পর হয়ে গেলো। যে শাশুড়ি ক’দিন আগেও তাকে সংসারের চাবি বুঝে নিতে বলেছিলো সেই শাশুড়ি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজার গুণ রেগে গেলো। ক’দিনের কথাবার্তায় যে শাশুড়ি তার মায়ের স’ান দখল করেছিলো আজ সেই শাশুড়ির সামনে যেতেই রেণুর পা শিথিল হয়ে গেলো। কোনো কথা বলতে গিয়ে যেনো জিহব্বা আড়ষ্ঠ হয়ে হলো। শাশুড়ির শেষের কথাটা যেনো রেণুর কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো, আগে তোমার শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলবো। তারপর যত কঠিন সিদ্ধান্তই হোক নিবো। যেকোনো মূল্যে আমি আমার ছেলেকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চাই। এই যেকোনো মূল্যের অর্থটা রেণুর কাছে খুব ভয়ঙ্কর মনে হলো।

ক’দিনের মধ্যে বাড়ির সবকিছু পাল্টে গেলো। যে শাশুড়ি ক’দিন আগেও রেণুকে বাড়ির চাবি বুঝে নিতে বলছিলো। সেই শাশুড়ি এখন রেণুর সঙ্গে ভালোমতো কথাও বলে না। যে স্বামী দোকান থেকে ফেরার সময় রেণুর জন্য পটলায় করে কোনোকিছু খাবার জিনিস নিয়ে আসতো সে এখন বাড়িতে ফেরার পর কোনো কথা বলে না। আগে রেণু রিয়াজকে ভাত খেতে দিতো আর এখন রিয়াজ বাড়িতে ঢুকে মা বলে ডাক দিয়ে তার মাকে ভাত দিতে বলে।

রেণুর শ্বশুর বরাবরই এসবের মধ্যে নেই। তিনি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এতোদিনে রেণুর সঙ্গে তার শ্বশুরের কথা হয়েছে দু’য়েকদিন মাত্র। বাবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকে রেণুকে আর তার শাশুড়ি কোনো কাজে ডাকে না। কোনো কথা বলে না। খাবার আগে কাজের মেয়েকে দিয়ে একবার ডেকে পাঠায় তারপর রেণু গেলে মুখ বন্ধ করে শাশুড়ি বউমা একই ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খায়। আর রেণু না গেলে শাশুড়ি একাই খেয়ে ওঠে পরে রেণু অবহেলা আর অবজ্ঞার সামান্য খাবার খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটিয়ে দেয়।

রেণু এসব কথা কাকে বলবে? রেণু সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রথমে সে এসব কথা রিয়াজকেই বলবে। রিয়াজ কার কাছে কী শুনেছে তা না বলে এমন আচরণ করবে এটা হয় না।

মেয়েদের স্বামীর কাছে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা, অভাব অভিযোগের কথা বলার সময় তে ঐ একটাই। রাতে স্বামী যখন বিছানায় যাবে তখন মাথার কাছে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে বলা, এটাই বোধ হয় মেয়েদের কথা বলার মোক্ষম সময়। আর অধিকাংশ স্বামী সারাদিন হাটে-মাঠে কাজ করে এসে বিশ্রামের এই সময়টুকুতে কিছু শুনতে চায় না। যারা শুনে তারাও বুঝি তেমন আগ্রহ দেখায় না। ঘুমের মাঝে হ্যাঁ কিংবা না বলে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু রিয়াজ ছিলো একেবারে ব্যতিক্রম। সে বাড়িতে এসে, রাতের খাবার খেয়ে টি.ভি দেখতো আর রেণুর সঙ্গে কথা বলতো। সেই রিয়াজ এখন ঠিক উল্টো হয়ে গেছে। সে দোকান থেকে এসে, রেণুর সঙ্গে কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে না কিন্তু ঘুমের ভাব করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। রেণু কয়েকদিন রিয়াজের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেলো না। কিন্তু দিনে দিনে বসবাস করা তার জন্য যখন অসহনীয় হয়ে পড়লো তখন একদিন রাতে সে সেই মেয়েদের চিরাচরিত সময়টুকুতে রিয়াজের মাথার কাছে বসে তার বাহুতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, এই।

রিয়াজের কোনো সাড়া নেই।

রেণু আরও একটু জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ঘুমিয়েছো?

এবার রিয়াজ সাড়া দিলো, কেনো?

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বলো?

কী হয়েছে বলোতো?

কী হয়েছে মানে?

আমাদের বাড়ি থেকে তুমি এভাবে চলে এলে তারপর থেকে সবাই আমার সঙ্গে কেমন কেমন ব্যবহার করছে। আমি কোনো দোষ করে থাকলে আমাকে বলো?

রিয়াজ রেগে গেলো, কী বলবো? তুমি বুঝতে পাচ্ছো না?

রেগে যাচ্ছো কেনো? কী হয়েছে আমাকে বলো?

প্রচণ্ড রাগে রিয়াজ বিছানা থেকে উঠে বসলো, যে মেয়ে বিয়ের আগে অন্য ছেলের সঙ্গে চরে চরে ঘুরে বেড়াতে পারে, হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারে তার পক্ষে সবকিছু বুঝেও চুপ করে থাকা কোনো ব্যাপার না।

রেণুর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো। তাদের বাড়ি থেকে রিয়াজের চলে আসা আর শ্বশুরবাড়িতে এমন অবহেলা আর অবজ্ঞার পেছনে যে এরকম একটা কারণ থাকতে পারে তা সে আগেই বুঝেছিলো কিন্তু সে ভেবেছিলো ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, দিন দিন অবস’া আরও খারাপের দিকে।

রেণুর মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, শোনো প্রতিবেশীদের মধ্যে সবারই শত্রু-মিত্র থাকে। তোমাকে কে কী বললো আর তা শুনে তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, আম্মা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিবে, এটা কি ঠিক?

রিয়াজ গর্জে উঠলো, কে কী বললো, না? সবাই মিথ্যা কথা বলছে?

রেণু কোনো কথা বললো না।

রেণুর শাশুড়ি রাহেলা একরকম দৌড়ে এলো। দরজায় নক করে রিয়াজ, রিয়াজ বলে ডাকতে শুরু করলো।

কেউ কোনো কথা বললো না।

আবার দরজা নক করার শব্দ, রিয়াজ, রিয়াজ…

রেণু দরজা খুলে দিলো।

রাহেলা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বউ মা?

রেণু কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

রাহেলা রাগে গিজ গিজ করতে করতে বললো, শোনো বউমা, গ্রামে আমাদের একটা মান-সম্মান আছে, রাত বিরাতে তুমি রিয়াজের সঙ্গে ঝগড়া করবে আর প্রতিবেশীরা আমাদের নিয়ে কানা-ঘুষা করবে এটা তো এ বাড়িতে হবে না।

রেণু তবুও কোনো কথা বললো না। তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো, দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

রাহেলা আবার বলতে শুরু করলো, আমার বাড়িতে কোনো ঝগড়া-বিবাদ চলবে না, যে ক’দিন থাকবে এভাবেই থাকবে। তারপর… বলে রাহেলা দ্রুতবেগে বের হয়ে গেলো।

যে ক’দিন থাকবে এভাবেই থাকবে তারপর… বলে কথাটা রেণুর বুকে যেনো বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো।

চৌদ্দ

সেদিন রাতে সবুজ মেসে ফিরলো শরীরে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে। হাত পায়ের অনেক জায়গার চামড়া উঠে গেছে। দেখে ছালু জিজ্ঞেস করলো, কী রে কি হয়েছিলো?

সবুজ কোনো রকমে বিছানায় শুয়ে বললো, এক্সিডেন্ট।

কীসের সঙ্গে?

রিকশার।

সাবধানে রাস্তা চলতে পারিস্‌ না।

সাবধানেই তো চলি।

ছালু সবুজের মাথায় হাত দিয়ে বললো, শরীর গরম তো, জ্বর আসবে মনে হয়।

সবুজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললো, না, কিচ্ছু হবে না।

কিচ্ছু হবে না বললেই হলো। চল্‌, আমার সঙ্গে চল্‌ মোড় থেকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি।

বললাম তো কিচ্ছু হবে না। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।

এমনিতেই তো ঠিক হবে কিন্তু ক’দিন কষ্ট করতে হবে। তুই ওঠতো কষ্ট করার কোনো দরকার নেই।

সবুজ বিছানা থেকে উঠলো। ছালু তাকে একরকম জোর করে ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে এলো। রাতে বিছানা শুয়েও বার বার সবুজের দিকে লক্ষ রাখলো। সবুজ ঘুমের ঘোরে বিছানায় ছটফট করছে দেখে ছালু মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, সবুজ, এই সবুজ।

সবুজ সাড়া দিলো, হুঁ।

ঘুম আসছে না?

সবুজ চুপ করে রইলো।

ছালু জিজ্ঞেস করলো, রাস্তায় হাঁটার সময় অমনোযোগী ছিলি?

কী জানি।

কী জানি কী রে? মন রাস্তার দিকে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবে কেনো?

সবুজ চুপ করে রইলো।

শোন্‌ তোকে আমি ভালো বুদ্ধি দিয়েছিলাম। বিয়ে করে ফেললে কাজে মনোযোগী হতে পারতিস্‌। নাহলে সবসময় শুধু ঐ মেয়ের কথা মনে পড়বে। আর কাজ-কামে, রাস্তা-ঘাটে পথ চলতে অমনোযোগী হয়ে পড়্‌বি।

সবুজ তবুও কোনো কথা বললো না। ছালুর কথায় সে কিছুটা বিরক্ত হলো, ছালু ভাই আপনি শুধু আজাইড়া কথা বলেন। বিয়ে করলে যদি এক্সিডেন্ট বন্ধ হতো তবে তো সবাই রাস্তায় উঠার আগে বিয়ে করতো। তারপর যখন বিয়ের পরও এক্সিডেন্ট হবে তখন কি আবার বিয়ে করবে? বলে সবুজ ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসলো।

হাস্‌ছিস্‌, না? আমি কি বলেছি যে বিয়ে করলে আর এক্সিডেন্ট হবে না। আমি বলেছি ঐ মেয়েটার কারণে তুই কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছিস্‌ না। তাই বিয়ে করে ফেললে মন থেকে ঐ মেয়েটার চিন্তাটা মুছে যাবে, তখন শুধু রাস্তায় চলার সময় না কাজ-কামেও মনোযোগী হবি।

এবার সবুজ বিছানায় উঠে বসলো। একটা কষ্টের হাসি হেসে বললো, ছালু ভাই আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?

ছালু না সূচক মাথা নাড়লো।

তাহলে আপনি এসব বুঝবেন না। কাউকে ভালোবাসলে সবসময় শুধু তার ছবিটাই চোখের সামনে ভাসে। এ অবস’ায় কাউকে বিয়ে করলেও তার নাম কখনো মন থেকে মুছে যায় না। আপনি একটা কথা ঠিকই বলেছেন ঐ মেয়ের কথা মনের মধ্যে ভাসে বলে আমি কাজ-কামে মনোযোগী হতে পারি না।

হ্যাঁ সেজন্যই কোনো মেয়েকে দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস্‌, যাকেই দেখি তাকেই তোর সেই মেয়ে বলে মনে হয়। কেনোদিন কোনো ট্রাক বা পিক আপ দেখে তুই সেই মেয়ে বলে জড়িয়ে ধরে চাপা পড়্‌বি।

তাহলে তো ভালোই হতো ওকে না পেলে আমার মরে যাওয়াই ভালো।

ছালু একটা ধমকের সুরে বললো, হ্যাঁ একটা মেয়ের জন্য মরে যাবি। দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব হলো?

সেজন্যই তো বললাম, আপনি প্রেম করেননি তাই এসব কথা আপনার ভালো লাগবে না। আমি ওকে ছাড়া কাউকে বিয়েই করবো না।

তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে প্রেম করে তুই একটা মহান কাজ করেছিস্‌। শোন্‌, এসব আগে ছিলো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করতো, চিরকুমার থাকতো, এখন আর সেদিন নেই। সিনেমা দেখিস্‌ না। আগে নায়িকা প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছে, নায়ক চিরকুমার থেকেছে আর এখন হলো ডিজিটাল প্রেম, কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে না। নায়িকা চলে যায় তো নায়ক আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করে। আর নায়ক চলে গেলে নায়িকার আগে থেকে সিরিয়ালে থাকা কারও হাত ধরে চলে যায়। সবকিছুর মতো প্রেমেরও আধুনিকায়ন হয়েছে। বলে ছালু হা হা করে হেসে উঠলো।

আমি আমার মতোই। দুনিয়াতে কী হলো আমি জানতে চাই না। আমি আমার রেণুর জন্যই অপেক্ষা করবো। সারাজীবন!

হ্যাঁ, তাই কর্‌। তোর কি ধারণা ঐ মেয়ে স্বামী ছেড়ে তোমার কাছে আসবে?

অবশ্যই আসবে।

তুই কীভাবে বুঝলি?

আমার প্রেম যদি সত্যি হয় তবে অবশ্যই আসবে।

ছালু তিরস্কারের সুরে বললো, ভালো, তোর প্রেম যদি সত্যি হয় তো তুই… বলে ছালু ছোট্ট বাচ্চার মতো খিক্‌খিক করে হেসে উঠলো।

আপনি দেখবেন আমার রেণু একদিন সত্যি, সত্যি আমার কাছে চলে আসবে। 

হ্যাঁ। আসবে। সেই আশায় বসে থাক। শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষ পাগল হয় আগে বিশ্বাস করতাম না এখন চোখের সামনে দেখছি। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না।

হ্যাঁ আমি পাগল, আমি পাগল… বলে সবুজ হো হো করে হেসে উঠলো।

আজ শুক্রবার। ছালু সকালবেলা বাইরে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে সে ফিরতে বিকেল হবে। সকাল দশটা বাজে সবুজ তখনো বিছানা থেকে ওঠেনি। তার জ্বর একটু কমেছে কিন্তু শরীরটা পুরোপুরি সুস’ হয়ে ওঠেনি। সে বিছানায় শুয়েই ছিলো। ছালু চলে যাবার পর সবুজ চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে ছিলো। আজ তার খুব একা লাগছে। পৃথিবীতে তার মতো মানুষ কি আর একটাও আছে যার পৃথিবীতে কেউ নেই। বাবা-মা মারা গেছে, মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। বাবার পৈত্রিক ভিটে জামালপুরে তার সৎ ভাইবোনরা আছে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। কোনো বিপদে-আপদে কাউকে ফোন করলে রক্তের টানে কেউ ছুটে আসবে এমন কেউ নেই। হৃদয়ের টানে যে ছুটে আসতো সেও চলে গেছে। মানুষ আসলে এতো একা হতে পারে? গার্মেন্টস, এই মেস আর ছালু। তার পৃথিবীটা যেনো এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

দরজাটা চাপানো ছিলো। হঠাৎ দরজাটা ফাঁকা হয়ে এক খণ্ড সূর্যের আলো সবুজের চোখে পড়লো, কে?

আমি।

সবুজ চিনতে পেরেছে কিন্তু পাশ কাটানোর জন্য বললো, আমি কে?

আমি ছবি। আসতে পারি?

কেনো?

আপনার খবর নিতে।

আমি ভালো আছি এই খবর নিয়ে চলে যাও।

ছবি সবুজের কথা শুনলো না। সে বিছানার কোনায় এসে বসে সবুজের কপালে হাত দিলো, জ্বর নেই তো। এখন কি একটু ভালো লাগছে?

তোমার তো খবর নেয়া হয়েছে, আমার জ্বর নেই। এখন যাও।

আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেনো? এলাম একটু বসি।

না, না, তুমি যাও।

নাস্তা খেয়েছেন?

তোমার ভাবী কি এটাও খবর নিতে বলেছে?

হ্যাঁ।

না, খাইনি। আর কিছু?

হ্যাঁ। অনেক কিছু, বলে ছবি সবুজের কপালের চুলগুলো পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে তার চোখে চোখ রাখলো, অনেক, অনেক কিছু। তারপর চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বললো, আপনি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নিন আমি আসছি, বলে ছবি চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে পিঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন দিয়ে ভাজা চিড়া নিয়ে। সবুজ তখনো শুয়েই ছিলো। প্লেটটা রেখে বললো, উঠুন তো, এখন উঠুন। আগে নাস্তা খেয়ে নিন। তারপর আবার শুয়ে থাকবেন। বলে ছবি পানির জগ-গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

ততক্ষণে সবুজ হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। ছবিও পানি নিয়ে ঘরে এসেছে।

সবুজ নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এগুলো কেনো আনতে গেলে?

আমি না, ভাবী পাঠিয়ে দিলো।

সবুজ একটা মুচকি হাসি হাসলো, তাইতো, তোমার মতো উড়নচণ্ডী মেয়েকে দিয়ে তো এতো সুন্দর চিড়ে ভাজা হওয়ার কথা না।

ছবি রেগে গেলো, আমি উড়নচণ্ডী?

উড়নচণ্ডী না তো কি? সারাদিন ঢ্যাং, ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াও।

তাতে আপনার কী? আমি কি আপনার বউ নাকি যে আমাকে এভাবে বলবেন?

তুমি আমার বউ হবে? হাসালে।

আমি হবো না, যাকে বউ করতে চেয়েছিলেন সেতো গেছে। আপনার ঐ ফুড়-ৎ পাখি তো আর আসবে না।

না আসলে নাই। তাই বলে কি আমি তোমাকে বিয়ে করবো নাকি?

নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। ছবি সবুজের কাছ থেকে প্লেটটা সরিয়ে সবুজের গা ঘেঁষে বসে সবুজের কাঁধে হাত রেখে বললো, কেনো? আমাকে বিয়ে করবে না কেনো? আমি কি ভুতুম পেঁচা?

ছবি বলে তার ভাবী জোরে ডাক দিতেই ছবি উঠে দাঁড়ালো। তারপর সে নাক দিয়ে হুঁ বলে চলে গেলো।

বিকেলে বেলাল এলো। বেলাল সবুজের সৎ ভাই। এই ভাই সবুজকে গার্মেন্টসে চাকরি করে দিয়েছে। তারপর সবুজ যখন সেই গার্মেন্টস ছেড়ে চলে এলো তখনো বেলাল কিছুটা মন খারাপ করেছিলো কিন্তু সবুজকে মুখে কিছু বলেনি। তবে মাঝে মাঝে সবুজের এখানে আসতো সবুজের এখানে আসার পর একবার তার মেসে গিয়েছিলো। আজ অনেক দিন পর বেলাল আবার এলো। অনেকক্ষণ দু’ভাই গল্প করলো। কথায় কথায় সে সবুজকে জিজ্ঞেস করলো, তোর তো একটা প্রমোশন হয়েছে?

হ্যাঁ, আমি এখন মেশিন অপারেটর।

কতটাকা বেতন দেয়?

পাঁচ হাজার।

মাত্র। তুই আমাদের গার্মেন্টসে আয়, আমাদের গার্মেন্টসে তোর বেতন কমপক্ষে সাত হাজার টাকা হবে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আপনি তাহলে আগে দেখুন অপারেটরের পদ খালি আছে নাকি? যদি খালি থাকে তো আমি যাবো।

আমি তো জানি পদ খালি আছে। সুপারভাইজারের সঙ্গে আমার ভালো খাতির আছে আমি বললে তোর চাকরি হবে। তুই যদি রাজি থাকিস্‌ তো বল আগামী মাসে জয়েন কর্‌বি।

আচ্ছা।

পনেরো

রেণুর জীবনের পরের ঘটনাগুলো ঘটলো দ্রুত গতিতে। সেদিনের পর থেকে তার প্রতি স্বামী ও শাশুড়ির শুধু অবহেলাই নয় অত্যাচারও শুরু হলো। তারপরও রেণু সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলো। কিছুদিন পর তার কানে এলো তার শাশুড়ি রিয়াজের বিয়ের জন্য নতুন করে কনে দেখছে। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে এই অঞ্চলে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পাত্রীর অভাব হয় না। আর রিয়াজ তো পাত্র হিসেবে অনেক যোগ্য। যেদিন রিয়াজের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার কথাটা প্রথম রেণুর কানে এলো সেদিন তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পৃথিবীর কোনো মেয়েই স্বামীর ভাগ দিতে চায় না। সব মেয়েই চায় তার স্বামী শুধু তারই হবে। রেণু জানে মেয়ে দেখতে দেখতে একসময় রিয়াজের জন্য তার মতো কিংবা তার চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যাবে। আর সেদিনই এবাড়িতে বসবাস করা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমন একটা আঘাত রেণু কীভাবে সহ্য করবে একথা ভাবতে ভাবতে দিনে দিনে রেণুর মুখের খাবার এবং চোখের ঘুম উঠে যাচ্ছিলো।

না। রেণু ঘটনাটা যত সহজ ভেবে সতিনের সঙ্গেই সংসার করতে চেয়েছিলো তত সহজ নয়। রিয়াজদের এক চাচাতো বোনের সঙ্গে রেণুর ভালো সম্পর্ক ছিলো তার মাধ্যমে সে এই বাড়ির গোপন সব সংবাদ পেতো। সে যে কথা বললো তা রেণুর জন্য আরও আতঙ্কের।

সেই মেয়েটি যে কথা বললো তার বিষয়বস’ হলো: রিয়াজের জন্য একটা ভালো পাত্রী পাওয়া গেছে, মেয়েটি দেখতে অসাধারণ সুন্দরী, চিলমারী ডিগ্রি কলেজের এইচ.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্রী, নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলেও একসময় তাদের নাম-ডাক ছিলো, কালের বিবর্তনে এখন অর্থ বিত্ত কমে গেলেও বংশ মর্যাদাটা আছে। রিয়াজ মেয়েটিকে দেখে পছন্দ করেছে, শুধু পছন্দ নয় একরকম বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে কিন্তু মেয়ের পরিবার একটি শর্ত দিয়েছে আর তা হলো রিয়াজকে তার আগের বউকে তালাক দিতে হবে। কথাটা শুনে রেণু পড়ে যাচ্ছিলো কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলো। তবে এই ভেবে রেণু আশ্বস’ হলো যে রিয়াজ এখনো রেণুকে তালাকের ব্যাপারে সম্মত হয়নি।

কিন্তু রেণু রিয়াজকে যতটুকু চেনে তাতে রিয়াজের সম্মত হওয়া আর না হওয়ার তফাত সামান্যই। হলোও তাই! ইদানীং রিয়াজ কোনো অজুহাত পেলেই রেণুর ওপর রেগে যায়, জোরে চিৎকার করে গালাগালি করে, গায়ে হাত তোলে, সহ্য করতে না পেরে রেণু ঘরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রেণুর যেনো কাঁদতে মানা। রেণুকে কাঁদতে দেখলে তার শাশুড়ি রেগে যায়, রেণুকে বকাবকি করে। রেণু বোঝে স্বামী আর শাশুড়ি তাকে বিদায় করার অজুহাত খুঁজছে আর রেণু খুব চিন্তা করে করে পা ফেলছে। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। রেণু গর্তে পা না ফেললেও গর্ত যে তাকে টেনে নিচে নামাবে তা তো রেণু জানে না।

কয়েক মাস পর রেণু তার বাবার বাড়িতে এলো। আর রিয়াজ তার এই সুযোগটিও নিলো। রেণু যেদিন তার বাবার বাড়িতে এলো সেদিন রিয়াজের আচরণ খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। রেণু তাকে আসতে বললো কিন্তু রিয়াজ স্বাভাবিকভাবে বললো, না তুমি ফিরে আসো।

রিয়াজের কোনো ব্যবহারে রেণুর মনে হয়নি যে রিয়াজ তাকে তালাক দেয়ার মতো নিষ্ঠুর কাজটি এত ঠাণ্ডা মাথায় সম্পন্ন করতে পারে। কয়েক দিন পরই বাড়িতে চলে এলো রেণুর তালাক নামা। নুরু রেণুর তালাক নামা নিয়ে মামলা করার উদ্যোগ নিচ্ছিলো, কুড়িগ্রামের এক উকিলের সঙ্গে পরামর্শও করেছিলো কিন্তু রেণু মামলা করতে রাজি হয়নি। তার একই কথা, সংসার তো আর একদিন বা দু’দিনের ব্যাপার না যে জোর করে দু’টা দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হবে। সারাজীবনের ব্যাপার, জোর করে কারও বোঝা হয়ে সারাজীবন কাটানো যায় না। তারচেয়ে জীবনে যদি আর বিয়ে না হয় তবে আমি একাই কাটিয়ে দিবো।

বানু গার্মেন্টসে চাকরি করতে যাওয়ার পর থেকে নুরুর সাহস হয়েছে, বানুকে নিয়ে তার যতটুকু ভাবনা ছিলো বানু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর আর রেণুকে নিয়ে তার ততটুকু দুশ্চিন্তা নেই।

বানু প্রায়ই শঙ্কর মাধবপুর বাজারের কমার্শিয়াল ফোনে ফোন করে নুরু সঙ্গে কথা বলে। বানু বলেছে বাড়ি আসার সময় নুরুর জন্য একটা মোবাইল ফোন নিয়ে আসবে। প্রায়ই নুরুর সঙ্গে বানুর কথা হলেও এর মধ্যে রেণুর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নুরু বানুকে বলেনি। আজ রাতের বাসে বানু আসবে। বটতলা বাস থেকে নেমে ভ্যানে আসবে নৌকা ঘাটে। তখনো খেয়া পারাপার শুরু হবে না, মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ঘাটে অপেক্ষা করতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে একথা ভাবতে ভাবতে কয়েক বার নুরুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

মসজিদে ফজরের আযান হলো। নুরু আর বিছানায় থাকতে পারলো না। সে বিছানা থেকে উঠে ঘাটের দিকে গেলো। যাওয়ার সময় ফুলিকে বলে গেলো বানুর জন্য ভাত রান্না করতে।

ইতি প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে, প্রতিদিন স্কুল যায়, সবসময় সে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে এখন শঙ্কর মাধবপুর স্কুলের ক্লাস নাইনের ফার্স্ট স্টুডেন্ট। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। যত সমস্যা মানিককে নিয়ে। সে প্রতিদিন রাতে ইতির চেয়ে আগে ঘুমায় আর অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। পড়াশোনায় সবসময় ইতির পেছনে, অথচ বানু আর রেণুর জন্মের পর নুরু যখন আর সন্তান নিতে চায়নি তখন শুধু ফুলির একটি ছেলে সন্তানের আগ্রহের জন্যই আরেকটি সন্তান নিতে গিয়ে ইতি আর মানিক জমোজ জন্মগ্রহণ করেছে। এই দুই সন্তানের মধ্যে প্রথম পৃথিবীতে আসে ইতি, ইতির আসার কথায় ফুলি মন খারাপ করেছিলো কিন্তু যখন আয়া জানালো আরেকটি বাচ্চা আছে তখন সে কিছুটা আশ্বস’ হলো এবং ইতির প্রায় ঘণ্টা খানেক পর পৃথিবীতে এলো মানিক। অনেক কষ্টে ফুলি একবার তার ছেলে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলো, মানিক।

ছোটবেলা থেকে মানিককে অত্যন্ত আদর যত্নে লালন করছে। মানিকের জন্য ইতিকে বঞ্চিত করেছে। সেই ছেলে সন্তান মানিক এখন ভালোমতো লেখাপড়া করে না, স্কুলের কথা বলে সিনেমা দেখে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।

ইতি আর মানিককে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে এসে ইতিকে একবার ডাক দিতেই সে লাফিয়ে উঠলো, মা।

ওঠ্‌ মা।

ইতি দু’চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করলো, মা আপা এসেছে?

এখনো আসেনি তোর বাবা ঘাটে গেছে।

ইতি আর কোনো কথা বললো না। সে বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

কয়েক বার ডাক দেয়ার পরও মানিকের কোনো সাড়া নেই। ফুলি চৌকির পাশে দাঁড়িয়ে মানিকের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে  রইলো। ফুলির মনে অনেক কথা বিড়বিড় করছে। মানিককে নিয়ে তাদের কতো স্বপ্ন। এই মানিককে লেখাপড়া শিখিয়ে জজ-ব্যারিস্টার বানাবে, এই মানিকই শুধু তাদের সংসারের হাল নয় বড় হয়ে চরের মুখ উজ্জ্বল করবে। অথচ মানিকের লেখাপড়ার দিনে দিনে যে অবনতি হচ্ছে তাতে করে চরের মানুষের মুখ উজ্জ্বল নয়, সংসারের হাল নয় নিজের ভবিষ্যতই যে কী হবে আল্লাহই জানেন। মানিকের জে.এস.সি’র রেজাল্ট নুরু আর ফুলিকে হতাশ করেছে।

ছোটবেলা থেকে মানিককে তারা অত্যন্ত আদর যত্নে মানুষ করেছে। আর অধিক আদর যত্নে সে মাথায় উঠেছে। আজকাল সে কারোই শাসন মানে না। যা ইচ্ছা তাই করে। আজকের মানিকের অধ:পতনের জন্য ফুলি আর নুরুর মাত্রাতিরিক্ত আদর স্নেহই দায়ি। আগে থেকে মানিককে যদি একটু শাসন করতো তবে মানিক হয়তো সত্যি সত্যি একদিন অনেক বড় হতো। কিন্তু শাসন তো দূরের কথা মানিকের মুখ একটু শুকনো দেখলেই ফুলির বুক শুকিয়ে যায়, চোখ দিয়ে পানি বের হয়।

ফুলি এবার মানিককে ঝাঁকুনি দিয়ে একটু জোরে ডাক দিলো, মানিক, এই মানিক।

মানিক ঘুমের তন্দ্রা থেকে সাড়া দিলো, কী। ডিসটার্ব দিও না তো।

ফুলি শাসন করতে গিয়েও পারলো না, ওঠ্‌, তোর আপা আসছে, আজ একটু তাড়াতাড়ি ওঠ্‌।  

উঁহুঁ, বলে মানিক বিরক্ত সহকারে বিছানায় উঠে বসলো।

ফুলি হাত ধরে টেনে নিচে নামালো, ওঠ্‌ তো, তোর আপা ফোন করলেই শুধু তোর কথা জিজ্ঞেস করে, আমি বলি তুই ভালোভাবে লেখাপড়া করছিস্‌, আজ এসে যদি দেখে তুই এখনো ঘুম থেকে উঠিস্‌নি…।

তো কী বলবে? বলে জোরে শব্দ করে পা ফেলতে ফেলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

বানু এলো। তার চোখ-মুখে ক্লান্তি, সারারাত ঘুম জেগে আসতে আসতে তার শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়িতে ঢুকে উঠানে ব্যাগ রেখে পাটিতে বসলো। ততক্ষণে ইতি আর মানিক পড়তে বসেছে, রেণু চুলোয় ভাত বসিয়েছে। বানুকে দেখে রেণু চুলোর পাড় থেকে উঠানে এলো, ইতি আর মানিক বই বন্ধ করে বানুর পাশে এসে বসলো। ফুলি একটা হাতপাখা নিয়ে বানুকে পাখার বাতাস করতে করতে তার চাকরি, খাওয়া-থাকার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

কথার ফাঁকে বানু রেণুকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কবে এসেছিস্‌ রে?

রেণু থতমত খেলো। সে কী বলবে বুঝতে পারলো না। ফুলি একবার রেণু আরেকবার বানুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, এই তো মা, ক’দিন হলো।

রিয়াজ আসেনি?

এবার আর ফুলি লুকাতে পারলো না। সে বললো, ওসব এখন রাখ্‌ তো পরে শুনিস্‌।

বানু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কিন্তু সে বানুর নির্লিপ্ততা আর তার মা’র লুকোচুরি দেখে কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখতে পেলো। বানু তার ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে ইতি বললো, ইতি খুল্‌ তো তোর জন্য এক সেটা থ্রি-পিস এনেছি আর… বলে মানিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

মানিকের মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠলো, আমার জন্য?

বানু ইয়ার্কির সুরে বললো, তোর জন্য তো কিছু আনিনি ভাই।

মানিক বুঝতে পারলো যে বানু তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে। সে কৃত্রিম মুখ কালো করলো।

বানু ইতির কাছ থেকে ব্যাগটা নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা জিন্সের প্যান্ট আর একটা গেঞ্জি বের করে মানিকের হাতে দিয়ে বললো, তুই আমাদের একমাত্র ভাই, তোর জন্য কিছু না এনে কি পারি?

মানিক ফিক করে হেসে উঠলো।

ফুলি কৃত্রিম ধমকের সুরে বললো, ওর জন্য টাকা খরচ করতে গেলি কেনো? আগে ওর পড়ালেখার খবর জানার পর ওর জন্য কিছু আনতে হতো।

বানু আদরের সুরে বললো, তাই নাকি ভাই?

মানিক কিছু বললো না। সে তার প্যান্ট আর গেঞ্জি নিয়ে চলে গেলো।

ষোল

অনেক আনন্দ নিয়ে বানু বাড়িতে এসেছিলো। তার চাকরি করার ফলে বাবা-মা’র সংসারে অনেকটা সচ্ছলতা ফিরেছে, দীর্ঘ ক্ষুধা সংসারে টানাপোড়েনের পর এবার বাবা-মা’র মুখে হাসি দেখবে। ইতি আর মানিকের লেখাপড়ার খরচও সে-ই দিবে, ইতি লেখাপড়ায় ভালো তাকে তার আর রেণুর মতো লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়ে দিবে, তাকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া শেখাবে, তাকে মানুষের মতো মানুষ বানাবে। সে যে গার্মেন্টসে চাকরি করে সেই গার্মেন্টসের জি.এম এক মেয়ে, প্রতিদিন সকালবেলা গাড়িতে চড়ে আসে, অনেক দামি গাড়ি। এসি রুমে বসে, বানু একদিন তার রুমের সামনে দিয়ে যেতেই তিনি বের হয়েছিলেন আর তার সঙ্গে বের হয়েছিলো একটা হিমেল হাওয়া। বানু তখন ঘামে ভিজে লেপ্টে গিয়েছিলো। এই হিমেল হাওয়ায় যেনো তার মনে হয়েছিলো সে পৃথিবীর বাইরে কোনো এক শান্তির জগতে এলো।

কয়েকদিন আগে কারখানার সামনে একটা গণ্ডগোল বাঁধলো। খবর পেয়ে এক গাড়ি পুলিশ এলো, সেই পুলিশের সবচেয়ে বড় অফিসার একজন মহিলা পুলিশ। সবাই তাকে স্যার, স্যার বলে স্যালুট দিচ্ছিলো। তারপর আরেকটা জিপে এলো এক মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট। মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের জিপ এসে দাঁড়াতেই পুলিশ অফিসার স্যালুট দিলো। দেখে বানুর বুকটা ভরে গেলো। তার মতোই একটি মেয়ে পুলিশ অফিসার হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। বানু কয়েক মুহূর্ত এই দুই গুণী মহিলার দিকে তাকিয়েছিলো, ইস্‌ আমি যদি পুলিশ হতে পারতাম, আমি যদি ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতাম?

পরক্ষণেই বানুর তন্দ্রা কেটে গেলো। না তার আর বড় হওয়ার সুযোগ নেই। সে এই গার্মেন্টসের একজন হেল্পার, এখানে বড় হওয়া মানে মেশিন ম্যান, সুপারভাইজার…ইত্যাদি। তখনই তার মনে পড়েছিলো ইতির কথা। ইতির তো এখনো অনেক বড় হওয়ার সুযোগ আছে। তাকে সে লেখাপড়া শেখাবে যত দূর সে যেতে পারে ততোদূর পর্যন্ত। ইতিকে দিয়ে সে তার স্বপ্ন পূরণ করবে।

ততক্ষণে বানু ভাত খেয়ে আঙিনায় একটা মোড়ায় বসেছে। ইতি তার থ্রি পিসটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বানু ইতিকে ডাক দিলো, ইতি।

জি আপা, বলে ইতি তার দিকে এগিয়ে এলো।

কোথায় যাচ্ছিস্‌?

বাজারে।

কেনো?

থ্রি পিসটা সেলাই করতে দিবো।

এদিকে আয়। বস্‌।

ইতি বানুর কাছে গিয়ে বসলো। বানুর চোখের সামনে তখন সেই মহিলা পুলিশ আর মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের ছবি ভেসে উঠলো। ইতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে পানি চলে এলো। সে ইতির কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ভালোভাবে লেখাপড়া কর্‌ বোন। যা সাবধানে যাস্‌।

রেণুর জন্মের কথা বানুর মনে নেই কিন্তু রেণু একটু বড় হতেই বানু তার মাকে বলতো একটা ভাইয়ার জন্য, আম্মু একটা ভাইয়া আনো না।

বানুর মা’র মুখটা আজও মনে পড়ে। ফুলি লজ্জা পেতো, মুখে কিছু বলতো না। বানু দেখলো একদিন সত্যি সত্যি তার একটা ভাইয়া এলো। বানু খুব খুশি হলো। ততোদিনে বানু বুঝতে শিখেছে, সেও কিছুটা লজ্জা পেলো। বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক বানুর হাসি দেখে রেণুও হাসতে লাগলো।

মানিক বয়সে ছোট হলেও শৈশব থেকেই বানু মানিককে সবসময় স্নেহের সুরে ভাই বলে ডাকে। ছোটবেলা মানিককে আদর করতে করতে বানু মানিককে তাদের গার্ডিয়ান বলতো। সেই থেকে বানুরও আশা মানিক সত্যি সত্যি একদিন তাদের গার্ডিয়ান হবে। কিন্তু বাড়ি এসে সে যখন মা’র কাছে মানিকের লেখাপড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো তখন ফুলি মুখ কালো করে বললো, ওকেই জিজ্ঞেস কর্‌। 

বানু মানিক বলে জোরে ডাক দিতেই মানিক ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বানু আদর করে কাছে ডেকে বললো, ও ভাই আমার পাশে একটু বস্‌ দেখি।

মানিক বানুর পাশের মোড়ায় বসলো।

বানু আঙ্গুল দিয়ে মানিকের মাথার চুলগুলো এলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, লেখাপড়া কেমন চলছে ভাই?

মানিক মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জানালো তার লেখাপড়া ভালো চলছে।

তোর রোল নাম্বার কতো?

ফুলি দূর থেকে বললো, বল্‌, এখন লজ্জা পাচ্ছিস্‌ কেনো?

মানিক কোনো কথা বললো না।

ফুলি বললো, তিপ্পান্ন।

ওমা তোদের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী কতো জন?

মানিক বললো, আশি জন।

আশি জনের মধ্যে তোর রোল নাম্বার তিপ্পান্ন হলে তো তুই লেখাপড়ায় পিছিয়ে গেছিস্‌ ভাই।

মানিক জোর দিয়ে বললো, আমি পিছিয়ে যাইনি আপা, স্যারদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে রোল নাম্বার আগানো যায় না।

তুইও প্রাইভেট পড়্‌বি।

টাকা?

আমি দিবো ভাই, আমি দিবো। তুই লেখাপড়া শিখে একদিন অনেক বড়ো হবি। কি হতে পার্‌বি না?

মানিক অবোধ বালকের মতো মাথা বাঁকা করে সায় দিলো।

বানু জিজ্ঞেস করলো, আজ স্কুল যাবি না?

আজ স্কুল বন্ধ।

কাপড়-চোপড় পরেছিস্‌ যে, কোথায় যাবি এখন?

রাজিবপুর।

রাজিবপুর কেনো?

প্যান্ট সেলাই করতে দিতে।

ফুলি চুলোর পাড় থেকে বললো, যাবে না, স্কুল বন্ধ থাকুক আর খোলা থাকুক, প্রতিদিন একবার করে ওর রাজিবপুর যাওয়া চাই।

ঠিক ভাই?

মানিক কোনো কথা বললো না। সে মাথা নত করে বসে রইলো।

বানু মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, যা আজ গিয়ে প্যান্টটা সেলাই করতে দিয়ে আয় আর কেনোদিন স্কুল না থাকলে রাজিবপুর যাস্‌ না।

মানিক মাথা নেড়ে জানালো যাবে না।

রেণুর বিয়ের পর বানু ঢাকা গিয়েছিলো। রেণু স্বামী সংসার দেখে বানুর মন ভরে গিয়েছিলো। সে মনে মনে একটা সান্ত্বনা পেয়েছিলো। তার নিজের জীবনে স্বামী-সংসার হয়নি কিন্তু তার সুখ আল্লাহ যেনো পুষিয়ে দিয়েছেন রেণুর কপালে। মোবাইল ফোনে রেণুর কথা জিজ্ঞেস করলেই তার বাবা যেনো অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করে দিতো। এমনকি বাড়িতে আসার আগে এক বিন্দুও রেণুর বিষয়ে কিছু বলেনি। বাড়িতে এসেও সকালবেলা বানুকে কিছু বুঝতে দেয়নি। বানু যখন শুনলো তখন তার তার বুক ভেঙ্গে গেলো। সে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে ধপাস্‌ করে একটা মোড়ায় বসে পড়লো। তার দু’ঠোঁট সামান্য ফাঁকা হয়ে অষ্ফুটস্বরে বের হলো, তোর কপালেও…

রেণু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বানু রেণুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কান্নাভাঙ্গা গলায় বললো, আমাকে যখন আমার স্বামী তালাক দিলো তখন আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করেছিলাম চরম শত্রু হলেও কারও জীবনে যেনো এমন অভিশাপ নেমে না আসে। অথচ আমারই বোন, আমার মতোই বিনা দোষে এমন… বানু আর কথা বলতে পারলো না। তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো। 

সিদ্ধান্ত হলো রেণুও বানুর সঙ্গে ঢাকা যাবে। তার সঙ্গে গার্মেন্টসে চাকরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ইতি আর মানিককে মানুষের মতো মানুষ করবে।

সতেরো

সবই স্বপ্নের মতো কিন্তু স্বপ্ন না, সবই বাস্তব। এতোদিন রেণু যা স্বপ্নেও ভাবেনি আজ তা একেবারেই বাস্তব। ব্রহ্মপুত্রের চরে বাস করে আসলে ঢাকা শহরের কথা স্বপ্নও দেখা যায় না। স্বপ্নেরও তো একটা সীমানা আছে। অবশ্যই আছে কিন্তু বাস্তবের? বাস্তবের সীমানা তো আরও সঙ্কুচিত। রেণুর সেই সঙ্কুচিত সীমানাও আজ আকাশ ছুঁয়েছে। একথা কাকে বলবে রেণু। 

কুইন্স ফ্যাশন। রাণীর ফ্যাশন, রাণীর পোশাক তৈরির কারখানা। সেই কারখানার একজন কর্মী রেণু। আজ তার চাকরির প্রথম দিন। রেণুর চাকুরী হয়েছে হেল্পার পদে। একসময় প্রায় সবাই হেল্পার পদে চাকরিতে জয়েন করে তারপর নিজের মেধা, দক্ষতা, চেষ্টা দিয়ে একদিন অনেক বড় হয়। রেণু হেল্পার হিসেবে যে অপারেটরের সঙ্গে কাজ করছে তার নাম মনছুরা। বানু আর মনছুরা কয়েকদিন আগ-পিছ করে চাকরিতে ঢুকেছে। সেই মনছুরা এখন অপারেটর। বানু আর মনছুরা একই গার্মেন্টসে চাকরি করে, একই মেসে থাকে।

গতকাল বানু আর রেণু ঢাকায় পৌঁচেছে বিকেল পাঁচটায়। বানুু ফিরে দেখে তার রুম ফাঁকা। বুয়াকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, ও অন্য গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। এখান থেকে দূরে তাই মেসও ছেড়ে দিয়েছে।

বানু মনে মনে খুশিই হলো। সে রেণুকে নিয়ে আসার সময় একবার মনে মনে মেসের সিট হিসাব করেছিলো, কোনো সিট ফাঁকা না থাকায় একটু চিন্তিত ছিলো। তার রুম মেট চলে যাওয়ায় সে রেণুর থাকার বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলো।

মনছুরা মেসে ফিরলো রাতে। তার ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখেই বানুর ঘরে এলো, কীরে বানু কেমন আছিস্‌?

ভালো। তুই?

ভালো আছি তবে তুই নেই তাই ভালো লাগছিলো না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

ও তোকে পরিচয় করে দিই, আমার ছোট বোন রেণু আর রেণু ও হচ্ছে মনছুরা, আমরা একসঙ্গে চাকরি করি।

রেণু সালাম দিলো, আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসসালাম, কেমন আছো তুমি?

জি ভালো। আপনি?

এই তো বোন দিন চলে যাচ্ছে। আগে কয়েকদিন চাকরি করও, তখন বুঝবে আমি কেমন আছি।

রেণু ফিক করে একটা হাসি হাসলো।

অনেক রাত পর্যন্ত বানু, রেণু আর মনছুরা আড্ডা দিলো। তিনজনের জীবনই প্রায় একই রকম। তিনজনই ডিভোর্স। তবে মনছুরাকে তার স্বামী ডিভোর্স করেনি। মনছুরাই তার স্বামীকে তালাক দিয়েছে।

মনছুরা খুব সহজ-সরল মেয়ে, প্রথম রাতেই রেণুকে তার জীবনের সব ঘটনা বিড় বিড় করে বলে ফেললো, বাবার বাড়ি ভিটেটা আর দশ কাঠা জমি ছিলো। আমার বিয়ের সময় যৌতুক দেয়ার জন্য পাঁচ কাঠা জমি বেচে দিলো। বাবাকে এতো করে বললাম, বাবা শুধু আমি তোমার মেয়ে না, তোমার একটা ছেলেও আছে, আমার বিয়ে হোক আর না হোক তুমি জমি বেচে আমার যৌতুকের টাকা দিও না। যারা একবার যৌতুকের জন্য হাত পাতে তারা যৌতুকের টাকা শেষ হলে আবারও যৌতুক চায়।

বাবা বললো, আমার এক ছেলে এক মেয়ে দশ শতক জমি দু’জনকে ভাগ করে দিবো। আমার কাছে ছেলেমেয়ে সমান। বাবার কথা শুনে আমার বুকটা ভরে গেলো। আমার বাবার মতো বাবা পৃথিবীতে কম আছে। সব বাবা-মা’ই ছেলেদের একটু বেশি আদরের চোখে দেখে কিন্তু আমার বাবা কোনোদিন আমাকে আলাদা করে দেখেনি। বলতে বলতে মনছুরা তার আঁচলে চোখ মুছলো।

মনছুরার কথা শুনতে শুনতে রেণুর চোখেও পানি এলো। সে বললো, আজ থাক আপা।

কেনো? তোমার শুনতে ভালো লাগছে না?

রেণু কোনো কথা বললো না। মনছুরা আবার বলতে শুরু করলো, অনেক দিন থেকে কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারি না, আজ তোমাকে কাছে পেয়ে সবকিছু বলতে ইচ্ছা করছে। আমার মনে অনেক কষ্ট আর আমার কষ্টগুলোর কথা কাউকে বলতে পারিনা দেখে আমি নিজে নিজে ফাঁপড়ে উঠি। বুকটা যেন জ্যাম হয়ে থাকে। নিজের কষ্টের কথা সবাইকে বলা যায় না। মানুষ কষ্টের কথায় সুযোগ খুঁজে।

রেণু মনোযোগ দিয়ে মনছুরার কথা শুনছিলো, তার মনের মধ্যেও যেনো জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে পড়লো।

মনছুরা আবার বলতে শুরু করলো। তোমার মতো যদি আমার একটা ছোট বোন থাকতো তবে আমার খুব ভালো লাগতো।

আমি তো আপনার বোনের মতোই আপা।

বানুর চৌকিটা ছোট দেখে মনছুরাই রেণুকে তার চৌকিতে শুইতে বলেছিলো। রাতে খাওয়ার পর মনছুরা আর রেণু এক চৌকিতে শুয়েছে। এতোক্ষণ একই চৌকিতে পাশাপাশি শুয়ে কথা বলছিলো। এবার মনছুরা রেণুকে কাছে টেনে নিলো, বোনের মতো না, আজ থেকে তুমি আমারও বোন। বলতে বলতে মনছুরার কণ্ঠস্বর ভিজে গেলো।

প্রথম দিন চাকরি হলেও রেণুর তেমন কষ্ট হলো না। তারপরও গার্মেন্টস থেকে বের হয়ে যখন বানুর সঙ্গে রেণুর দেখা হলো তখন বানু তার মুখের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কী রে তোর খুব কষ্ট হয়েছে, না?

রেণু না সূচক মাথা নাড়লো।

কষ্ট হতো যদি মনছুরার সঙ্গে কাজ না করে অন্য কোনো অপারেটরের সঙ্গে কাজ করতিস্‌।

রেণু একটা স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললো, আপনি ঠিকই বলেছেন। মনছুরা আপা না হলে আমি বোধ হয় কাজই করতে পারতাম না।

মনছুরা বললো, রেণু খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছে, তুই দেখিস্‌ বানু রেণু খুব অল্প দিনে অপারেটর হয়ে যাবে।

এমনি নানান কথা বলতে বলতে সবাই গার্মেন্টস থেকে মেসে এসে পৌঁছালো।

সপ্তাহের অবশিষ্ট কয়েকদিন কাটলো মনছুরার সঙ্গে ডাবলিং করে তারপর শুক্রবার দিন সকালবেলা বানু, মনছুরা রেণু সবাই মিলে বাজার থেকে একটা চৌকি, বিছানা বালিশ নিয়ে রেণু বানুর রুমে উঠলো। রেণুর জীবনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। এই অল্প দিনে কতোকিছু ঘটে গেলো। ব্রহ্মপুত্রের চরে ঘুরে বেড়ানো, সবুজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, গ্রাম্য মাতব্বরদের সালিসের ভয়ে চিলমারী গিয়ে নানার বাড়িতে থাকা। তারপর বিয়ে-সংসার, তারপর…

না, বিচ্ছেদের কথা রেণু ভাবতে চায় না। তালাকের কথা মনে হলে তার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। অথচ তার কোনো অপরাধ নেই। আজ ক’দিন থেকে রেণুর খুব সবুজের কথা মনে পড়ছে। সবুজ ঢাকা এসেছে আগে রেণুর মনে হতো ঢাকা গেলে সে তার সবুজের সঙ্গে দেখা করতে পারবে কিন্তু ঢাকা আসার পর তার মনে হয়েছে এতো বড় শহরে আসলে কাউকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তার বিশ্বাস তার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তবে একদিন সে তার সবুজকে খুঁজে পাবে। কিন্তু সবুজ কি তাকে গ্রহণ করবে? সবুজ যদি জানে তার বিয়ে হয়েছিলো। সেই স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে তবে কি সে তাকে বিয়ে করবে?

করবে। সবুজকে রেণু চিনে। বুঝিয়ে বললে সবুজ নিশ্চয়ই বুঝবে রেণু তার ইচ্ছায় বিয়ে করেনি তাকে তার বাবা-মা, নানা-নানি, মামা-মামি তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আর সবুজকে ভালোবাসার কারণে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে। সবুজ নিশ্চয়ই বুঝবে এবং তাকে ক্ষমা করবে। তারপর সবুজ আর রেণু চলে যাবে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে যেসব মাতব্বরের সালিসের ভয়ে সবুজকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, তাকে চিলমারী যেতে হয়েছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছে সেসব মাতব্বরের সামনে সে সবুজকে নিয়ে দাঁড়াবে, তাদের মুখের ওপর বলবে, সবুজ আমার স্বামী, একদিন আপনাদের সালিসের ভয়ে সবুজ আর আমি দু’জন দু’দিকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই পালিয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আপনারা ফিরিয়ে দিন আমাদের জীবনের সেই দিনগুলি। পারবেন?

রেণুকে চুপ করে থাকতে দেখে বানু ডাক দিলো, রেণু? 

জি আপা।

চুপ করে আছিস কেনো রে?

এমনি আপা।

তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

কর?

সবুজের সঙ্গে কি তোর যোগাযোগ আছে?

না আপা।

সেই যে সবুজ শঙ্কর মাধবপুর ছেড়ে পালিয়েছে আর ফিরে যায়নি, না?

না।

বানু আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করলো না। রেণুর মনে নতুন একটা প্রশ্ন দেখা দিলো, বানু কি এখনো তার আর সবুজের সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখে? না, হয়তো সন্দেহের চোখে দেখে না। বানু নিজেও সবুজকে খুব স্নেহ করতো। তাই হয়তো জিজ্ঞেস করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে রেণুর সন্দেহ দূর হলো। বানু আবার জিজ্ঞেস করলো, ছেলেটা ভালো ছিলো রে, ওর সঙ্গে তোর বিয়ে হলে ভালো হতো।

রেণু কোনো কথা বললো না।

আঠারো

প্রায় এক মাস আগে সবুজের প্রমোশন হয়েছে। এখন সে অপারেটর। তার অনেক টাকা বেতনও বেড়েছে। তবে বেলাল বলেছে তার গার্মেন্টসে চাকরি করলে সে আরও বেশি বেতন পাবে। সবুজ আরও এক মাস আগের গার্মেন্টসেই চাকরি করলো তারপর চলে এলো গাজীপুর। বেলালের সঙ্গে জয়েন করলো তার সঙ্গে ফ্রেন্ডস এ্যাপারেলসে। এখানে এসে তার আরও বেতন বেড়েছে। তাছাড়া এই গার্মেন্টসে বেশির ভাগ কর্মী জামালপুর, শেরপুর, বকশীগঞ্জ, রৌমারী, রাজিবপুর এলাকার। সে যে মেসে উঠলো সেই মেসের রাজিবপুরের কয়েকজন ছেলেও আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে আগে সবুজের পরিচয়ও ছিলো না। এখানে এসে প্রথম পরিচয় হলো।

এখানে আসার পর সবুজের সবসময় রেণুর কথা মনে পড়ছে। প্রথম যখন সে ঢাকা এলো তখন সে ভাবতো রেণুকে ঢাকা নিয়ে আসবে, দু’জনে গার্মেন্টসে চাকরি করবে। গার্মেন্টসের অনেক চাকরিজীবী আগে যারা পুরো পরিবারই গার্মেন্টসে চাকরি করে। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে জীবিকার সন্ধানে, রাতে সবাই বাসায় ফিরে। মাসে অনেক টাকা রোজগার করে গ্রামের বাড়িতে জমিজমা কিনে। তারা দু’জনে গার্মেন্টসে চাকরি করে রাজিবপুর জমি কিনতো, বাড়ি করতো তারপর যখন বয়স বাড়তো তখন এই গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতো। সবুজের মনে কত আশা ছিলো! সেই এক বুক আশা নিয়েই তো রাজিবপুর গিয়েছিলো তারপর…

রাজিবপুর থেকে ফেরার সময় রাগ করে সে রুস্তমের মোবাইল নাম্বারটাও নিয়ে আসেনি। যদি আসতো তবে রেণুর না হলেও শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের তার মামাতো ভাইবোনদের, বন্ধু-বান্ধবদের তো খোঁজখবর নিতে পারতো। হাজার হলেও শঙ্কর মাধবপুর তার জন্মস’ান, মাতৃভূমি। রেণুর বিয়ের পর তাদের সালিসের বিষয়টিও হয়তো এতদিনে চাপা পড়েছে। আগামী ঈদে যখন গার্মেন্টস বন্ধ হবে, এই গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভারের সব গার্মেন্টস কর্মী যখন ছুটে যাবে গ্রামের বাড়িতে তখন সেও শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে যেতো। মামা-মামি, মামাতো ভাইবোনদের সাথে ঈদ করতো।

সবুজের রুম মেট মোন্তার বাড়ি বালিয়ামারী। বালিয়ামারী আর শঙ্কর মাধবপুর সোনাভরি নদীর এপার-ওপার। সে আগামীকাল বাড়ি যাবে। সবুজ তাকেই বললো রাজিবপুর গিয়ে রুস্তমের মোবাইল নাম্বার আনার জন্য।

মোন্তা রাজিবপুর রুস্তমের দোকানে গিয়ে ফোন করলো, হ্যালো সবুজ।

হ্যালো। মোন্তা বল্‌।

আমি রুস্তমের দোকানে এসেছি। এই কথা বল্‌ রুস্তমের সঙ্গে।

হ্যালো রুস্তম কেমন আছিস্‌?

ভালো, তুই?

এইতো আছি আর কী। মামা-মামি সবাই ভালো আছে?

হ্যাঁ সবাই ভালো আছে।

রুস্তম জিজ্ঞেস করলো, তুই বাড়ি আস্‌বি নাকি?

আমি? বাড়ি? কথাগুলো সবুজ এমনভাবে বললো যে তার আবার বাড়ি-ঘর? তারপর বললো, ও ভালো কথা বলেছিস্‌ আমাদের যে ঘরটা ছিলো ওটার কী অবস’া?

তুই আসছিস্‌ না দেখে বাবা তোর ঘরের বেড়া, টিনের ছাউনি এনে আমাদের বাড়িতে ঘর তুলেছে। এখন তোর ঘরে আমি থাকি।

ভালোই করেছিস্‌।

তুই আয়, তুই শঙ্কর মাধবপুর এলে তোর ঘরে থাক্‌বি।

হ্যাঁ যেতে তো চেয়েছিলাম। কিন্তু…

ও ভালো কথা। তুই কি রেণুর কোনো খবর জানিস্‌?

রেণুর কথা শুনতেই সবুজের বুকটা ধক্‌ করে উঠলো, কী খবর বলতো?

রুস্তম বলতে শুরু করলো। সবুজ অনেকক্ষণ কানের কাছে মোবাইল ফোন ধরে রাখলো। তারপর বললো, তোর কাছে রেণুর মোবাইল নাম্বার আছে?

না।

বানু আপার?

না। তবে মনে হয় যোগাড় করে দিতে পারবো। শঙ্কর মাধবপুর বাজারের একটা দোকানে বানু ফোন করে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে। ঐ দোকান থেকে তোকে বানু আপার ফোন নাম্বার যোগাড় করে দিতে পারবো।

তুই তো সন্ধ্যায় বাড়ি যাবি, না?

হ্যাঁ।

তাহলে রাতে নাম্বারটা দিস্‌ আমাকে।

আচ্ছা।

আর তোর নাম্বারটা দিয়ে আমাকে রিং দে তো আমি তোর নাম্বারটা সেভ করে রাখি।

আচ্ছা, বলে রুস্তম মোবাইল ফোনটা মোন্তার হাতে দিলো।

মোন্তা ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, কীরে এতোকিছু তো আামাকে কেনোদিন বলিস্‌নি। জানলে আমি গাজিপুর, আশুলিয়া, সাভার, চন্দ্রার সব গার্মেন্টসে গিয়ে গিয়ে রেণু নামের কোনো মেয়ে আছে নাকি খুঁজে বের করতাম। আহারে কী প্রেম?

এই, এই ইয়ার্কি হচ্ছে, না?

ইয়ার্কি কীরে, আমি হলে সত্যি, সত্যি খুঁজে বেড়াতাম।

আচ্ছা আয়, আমি তো এখানকার তেমন কিছু চিনি না। খুঁজে বেড়ানোর কাজটা তোকেই করতে হবে, বলে সবুজ ফোন রাখলো।

রাজিবপুর গিয়ে রেণুর বিয়ে হয়েছে শুনে সবুজ সেই-ই যে ফিরে এসেছে তারপর থেকে মুখে রেণুকে ফিরে পাবার কথা বললেও মনে মনে সে রেণুকে ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। রেণুকে ফিরে পাবে বলে প্রকৃত প্রেমকে নিয়ে সে যে কথাগুলো বলতো তাও তার স্ববিরোধী কথা, নিজের সাথে প্রতারণা করা বলে মনে হতো। কিন্তু আজ রুস্তমের মুখে রেণুর কথা শুনে তার মনের মধ্যে আবার রেণুকে কাছে পাবার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে গেলো।

রেণু ঢাকায় আছে, কোনো না কোনো গার্মেন্টসেই চাকরি করছে অথচ সে একথা কেনোদিন চিন্তা করেনি। সবুজের মনে হচ্ছে এখনই সে বের হবে রেণুকে খুঁজতে, সেই মজনুর মতো রেণুকে খুঁজতে খুঁজতে সে…

সবুজ আপন মনে হেসে উঠলো। এমনসময় তার পাশের রুমের মেস মেম্বার ইলিয়াস দরজায় উঁকি মেরে বললো, সবুজ ভাই একা একা হাসছেন কেনো? ভাবীর কথা মনে পড়েছে নাকি?

ইলিয়াস সবুজের সমবয়সী। পাশের রুমে থাকে, প্রথম দিন পরিচয় হয়েছে আর প্রতিদিন সকালবেলা বেরিয়ে যাবার সময় মুখ দেখাদেখি হয় এই মাত্র। আজ ছুটির দিন তাই সবুজের রুমে উঁকি মেরেছে।

সবুজ কিছুটা লজ্জা পেলো, নারে ভাই এখনো বিয়েই করতে পারলাম না।

করে ফেলেন, আপনি তো এখন অপারেটর হয়েছেন। অনেক টাকা বেতন পান। আর না হয় কোনো চাকরিজীবী মেয়েকে বিয়ে করবেন, দু’জনে মিলে সুন্দর সংসার চলবে।

আপনি বিয়ে করেছেন নাকি?

আরে ভাই সেটাই তো ভুল হয়েছে। ছোট থাকতে বিয়ে করেছি, এখন বিয়ে করলে একটা চাকরিজীবী মেয়ে বিয়ে করতে পারতাম। তবে আমার মনে কোনো কষ্ট নেই। ভাবছি আর ক’দিন পর বউকে নিয়ে আসবো। দু’জনে চাকরি করলে আমাদের সংসার ভালো চলবে, নাকি বলেন?

অবশ্যই।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করলো, আজ কোথাও বের হবেন নাকি?

রেণুর কথা শোনার পর সত্যি সত্যি সবুজের আর ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। রুস্তম বানুর ফোন নাম্বার দিবে রাতে, তারপরও ফোন নাম্বার যোগাড় করে দিতে পারবে কী না ঠিক নেই। শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম তো সবুজের কাছে নতুন না। রেণুর বাবাও তো দোকানদারকে বানুর নাম্বার কাউকে দিতে নিষেধ করে দিতে পারে তখন তো আর রেণুর সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হবে না। তখন হয়তো মজনুর মতো করেই হন্য হয়ে খুঁজে বের করতে হবে রেণুকে। আর খুঁজতেই যদি হয় তবে আর দেরি কেনো? সবুজ এখনই লেগে যাবে রেণুকে খুঁজে বের করার কাজে।

সবুজকে চুপ করে থাকতে দেখে ইলিয়াস জোরে বললো, কী হলো? চুপ করে আছেন কেনো?

সবুজ চমকে উঠলো, ও কী বলছিলেন যেনো?

বের হবেন না?

অবশ্যই।

ইলিয়াস ভাই আপনি কোনো গার্মেন্টসে আছেন যেনো?

কুইন্স ফ্যাশনে, আপনি?

ফ্রেন্ডস এ্যাপারেলস। আচ্ছা আপনার গার্মেন্টসে তো আমাদের এলাকার, মানে রৌমারী রাজিবপুরের লোকও কাজ করে?

হ্যাঁ, সারা দেশের মানুষ কাজ করে। অনেক বড় গার্মেন্টস।

আপনার রৌমারী রাজিবপুরের কারও সাথে পরিচয় হয়েছে?

আমি তো মাত্র ক’দিন আগে কুইন্সে জয়েন করেছি।

ও।

খুঁজবেন তো।

আচ্ছা। এখন উঠুন, চলুন বের হই।

চলুন। 

উনিশ

ইতির বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে আরও দু’বছর আগে, কোনো কোনো সম্বন্ধ এসেছে অনেক ভালো ঘর থেকে। নুরুর, ফুলি, বানু, রেণু সবার ইচ্ছা ইতিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। কিন্তু কোনো কোনো সম্পর্ক এতো ভালো ঘর থেকে এসেছে যে নুরু এবং মাঝে মাঝে একরকম বিয়ে দিতে রাজিও হয়েছে, পারেনি শুধু বানু আর রেণুর বাধার কারণে।

ইতি আর মানিক এ বছর এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। ইতির পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তারপর পরীক্ষার পর থেকে আরও বেশি করে সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে। এই তো গতকাল একটা সম্পর্ক এসেছে কুড়িগ্রাম থেকে, ছেলে বি.এ পাস করে একটা এন.জি.ও’তে চাকরি করছে। কুড়িগ্রাম শহরে নিজস্ব বাড়ি আছে। বাবার আর্থিক অবস’াও মোটামুটি ভালো। সবকিছু শুনে নুরু রাতে বানুকে ফোন করলো।

ফোনের রিং শেষ হওয়ার পর বানু ফোন ব্যাক করলো, হ্যালো, বাবা আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। তোরা কেমন আছিস্‌ মা?

ভালো বাবা। তোমরা ভালো আছো তো?

হ্যাঁ মা। ভালো।

রেণু কোথায় মা?

ওর কেবল খাওয়া হলো বাবা। হাত ধুয়ে আসছে।

মানিক, ইতি কী করছে বাবা? ওরা ভালো মতো লেখাপড়া করছে তো?

ওরা তো পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছে। ইতি তবুও লেখাপড়া করছে আর মানিক তো সারাদিন টো টো করে ঘুর বেড়াচ্ছে। কখন কোথায় যায় আসে তার ঠিক নেই।

তুমি মানিককে বুঝাও বাবা। আর ইতির লেখাপড়ার দিক একটু বেশি খেয়াল রেখো। ও যতদূর লেখাপড়া করতে চায় আমরা ততোদূর লেখাপড়া শেখাবো।

ঠিক আছে মা, আমার, তোর মা, সবার ইচ্ছা ওকে লেখাপড়া শেখানো। আবার বিয়ের জন্য ভালো, ভালো ঘরও আসছে। এই তো কাল একটা সম্পর্ক এসেছে বলে নুরু ছেলের বাড়িঘরের অবস’া, ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা সবকিছু বিড়বিড় করে বলতে থাকলো।

বানু বাবার বড় মেয়ে। বড় মেয়ে হিসেবে বাবা যেমন তাকে স্নেহ করে বানুও তেমনি নুরুকে অন্যান্য সন্তানদের চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করে। বানুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নুরু তাকে বিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে তার সংসার টিকেনি। তার নিজের বিষয়ে বানু মন খারাপ করেছে কিন্তু তার বাবাকে কেনোদিন কিছু বলেনি। তার বিয়ে এবং তালাককে সে তার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। রেণুর বিয়েতেও বানুর মত ছিলো না কিন্তু তার নিজেরই তখন এমন অবস’া ছিলো যে রেণুর হয়ে তার প্রতিবাদ করার মতো অবস’া ছিলো না। কিন্তু ইতির বেলায় সে তার বাবার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে তো পারলোইনা বরং তার বাবার ওপর তার প্রচণ্ড রাগ হলো, বাবা তোমাকে না বলেছি ইতি লেখাপড়ায় ভালো, ওকে আমরা লেখাপড়া শেখাবো। তবু বার বার করে তুমি ইতির বিয়ের কথা বলছো।

নুরু চুপ করে রইলো।

বানু আবার বলতে শুরু করলো, বাবা।

বল্‌ মা।

আর কখনো ইতির বিয়ে নিয়ে তুমি ভাববে না। ইতির জন্য আমরা ভাববো, আমি আছি, রেণু আছে। আমরা তো আগের মতো ঘরে বসে তোমার মাথার ওপর বোঝা হয়ে নেই। আমরা ছেলে মানুষের মতো রোজগার করে তোমার পাশে দাঁড়িয়েছি। তুমি দেখ ইতিকেও আমরাই লেখাপড়া শেখাবো। মানুষের মতো মানুষ করে তুলবো।

ঠিক আছে মা।

ততক্ষণে রেণু হাত ধুয়ে এসে বানুর পাশে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে বানুর কথাবার্তা শুনছে। বানু মোবাইল ফোনটা রেণুর হাতে দিলো।

রেণু সালাম দিয়ে কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো, বাবা আমি এসব কী শুনছি?

কী রে মা?

তুমি আবার ইতির বিয়ের কথা বলছো?

থাক্‌ রে মা। আর বলতে হবে না।

রেণু আর কথা বাড়ালো না।

নুরু জিজ্ঞেস করলো, তুই বেতন পেয়েছিস্‌ রে মা?

আজ তো মাসের পঁচিশ তারিখ বাবা, আমি তো বেতন পাবো আরও এক সপ্তাহ পর।

নুরু চুপ করে রইলো।

বেতনের কথা জিজ্ঞেস করলে কেনো বাবা? টাকার দরকার?

নুরু আমতা আমতা করে বললো, দরকার নেই, আবার আছে।

নেই আবার আছে কেমন বলোতো?

মানিক পাঁচ’শ টাকার জন্য খুব জিদ ধরেছে।

ওর তো এখন স্কুল নেই, ও টাকা কী করবে?

ও কি কেনোদিন বলে ও টাকা কী করবে? টাকা চায়, টাকা না দিলে তোর মার ওপর, আমার ওপর রাগারাগি করে, বাড়ি থেকে চলে যেতে চায় আর তোর মা তখন কান্নাকাটি করে, এটা তো নতুন না রে মা। তোরাও তো জানিস্‌।

রেণু বললো, হ্যাঁ টাকা দিয়ে দিয়ে তো ও এরকম জেদি হলো। তুমি দোকানে বসো বাবা আমি আপাকে বলে এখনই টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আচ্ছা।

আনোয়ার মাস্টার দোকানে ঢুকলো। নুরু বেঞ্চ থেকে উঠে সালাম দিলো, আস্‌সালামুয়ালায়কুম মাস্টার সাহেব।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। কেমন আছেন নুরু ভাই?

ভালো। আপনি কেমন আছেন মাস্টার সাহেব?

ভালো আছি। কী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা হলো?

হ্যাঁ হয়েছে।

ভালো আছে ওরা সব?

আছে।

খুব ভালো। তোমার মেয়ে দু’টা হয়েছে ছেলের কান কেটে দেয়া মেয়ে। আর ছোটটা যে আছে, ইতি ও দেখো একদিন অনেক বড় হবে। রেজাল্ট কবে জানো?

না মাস্টার সাহেব।

আগামী বৃহষ্পতিবার। তোমার ইতি ইনশাআল্লাহ গোল্ডেন এ প্লাস পাবে।

দোয়া করবেন মাস্টার সাহেব।

দোকানদার বললো, নুুরু ভাই টাকা এসেছে।

নুরুর মুখ উজ্জ্বল হলো, দাও।

আনোয়ার জিজ্ঞেস করলো, মেয়েরা টাকা পাঠালো নাকি নুরু ভাই?

নুরু টাকা হাতে নিয়ে বললো, হ্যাঁ মাস্টার সাহেব চলেন চা খাই।

এখন চা খাবো না। আগে ইতির রেজাল্ট হোক তারপর মিষ্টি খাবো।

আচ্ছা মাস্টার সাহেব, আসি তাহলে, আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন।

নুরু টাকা নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। মানিক তখন রান্না ঘরে ফুলির পাশে বসে টাকার জন্য গজ গজ করছে, আমি পাইলট স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিলাম। আমার বন্ধুরা সব ধনী লোকের ছেলে, সবাই মিলে একদিন লাউচাপড়া যাবো, লাউচাপড়ায় সারাদেশ থেকে কত মানুষ পিকনিক খেতে আসে, বেড়াতে আসে আর আমি যদি রাজিবপুর থেকে একদিনও বেড়াতে না যাই তাহলে তো কাজটা ঠিক হবে না। আর যাবোই যখন তখন তো ভালো কাপড়-চোপড় পরে যাবো। আমি কি ওদের সঙ্গে ফকিরের মতো যাবো নাকি?

আঙিনায় ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো নুরু কানে এলো, না ফকিরের ছেলের মতো যাবি কেনো? ধনী লোকের ছেলের মতো যাবি, ওদের সঙ্গে যেনো তোকে মানায় সেভাবে যাবি কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টও যেনো ওদের মতো হয়।

হ্যাঁ হবে, তুমি দেখো।          

আচ্ছা তাই দেখি বলে নুরু মানিকের হাতে টাকা দিতেই সে বাইরে চলে গেলো।

নুরু ফুলির পাশে মোড়ায় বসতে বসতে বললো, বানুর মা ছেলে ছেলে করছিলে এখন ছেলের জ্বালা বোঝ।

আমি একা করিনি, তুমিও বলেছিলে। আর একটা কথা শোন বানুর বাবা, ছেলেরা একটু একটু দুষ্টু হয়। তুমি দেখ বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।

ঠিক হয়ে গেলেই ভালো হয় কিন্তু মানিক আসলে কোনো দিকে যাচ্ছে তাই তো বুঝে উঠতে পারছি না।

তুমি সবসময় খারাপ কথা বলো। কোনো দিকে যাচ্ছে আবার?

আজকাল ছেলেরা কতো রকমের নেশা করছে…

ফুলি ধমকের সুরে বললো, চুপ করও, নিজের ছেলের সম্পর্কে আর এমন খারাপ কথা বলো না।

নুরু আর কোনো কথা বললো না।

বিশ

কয়েকদিন থেকে রুস্তমের কোনো খবর নেই। সবুজ কয়েক বার ফোন দিয়েছে কিন্তু রুস্তমের ফোন বন্ধ। সবুজের রুস্তমের ওপর রাগও হয়েছে কিন্তু রাগ হয়ে তো লাভ নেই। রুস্তমকে না পাওয়া পর্যন্ত সেই রাগের বহি:প্রকাশও সম্ভব নয়। আজ ডিউটি থেকে ফিরে সবুজ আবার রুস্তমকে ফোন করলো, হ্যাঁ রুস্তমের ফোন চালু আছে। সে রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আস্‌সালাম। এই রুস্তম তোর কী হয়েছে রে? ফোন ধরিস্‌ না কেনো?

ও সবুজ আমার ফোনটা হারিয়ে গেছিলো আজ আবার ফোন আর সেই সিমকার্ড তুললাম।

তুই তো একটা ফোন করে জানাতে পারতিস্‌?

কী করে তোকে ফোন করবো, তোর নাম্বারও তো সেই সেটে সেভ করা ছিলো।

আচ্ছা এখন বল্‌ বানু আপার নাম্বার পেয়েছিস্‌?

হ্যাঁ, লিখে নে।

সবুজের বুকটা ধক্‌ করে উঠলো। রেণুকে সে হারিয়েই ফেলেছিলো। শৈশব থেকে রেণু আর সে একসঙ্গে বড় হয়েছে। কৈশোরে এসে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা গাঢ় হলো। আর সেই গাঢ় সম্পর্ক যৌবনে এসে রূপ নিলো প্রেমে, ভালোবাসায়। তারপর থেকে সবুজের মনে হতো রেণুকে ছাড়া তার জীবন অচল। সত্যি সত্যি হয়তো তার জীবন অচলই ছিলো, প্রতিটা কাজে তার ভুল হচ্ছিলো, সোজা রাস্তায় চলতে গিয়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলো। আর সেজন্য তো সে পিক আপের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়েছিলো। পরে সে তার রুম মেটকে শোনার জন্য গল্পে পিক আপকে রিকশা বানিয়েছিলো। আর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে বেঁচে যাওয়াকেও সে বানিয়েছিলো সামান্য একটু ধাক্কা।

কারও জন্য রাস্তায় চলতে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়াটা কি জীবন অচল হয়ে যাওয়া নয়? তারপর থেকে সবুজ রাস্তা চলতে একটু সতর্ক হয়েছিলো কিন্তু রেণুর চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারেনি। তার সবসময় মনে হতো রেণু তার, রেণু তার কাছে একদিন ফিরে আসবেই।

হ্যাঁ, হ্যাঁ রেণু তার কাছে ফিরে এসেছে, এখন তার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করতে পারলেই হয়। কিন্তু সালিসের ভয়ে রেণুকে ছেড়ে পালিয়ে আসাটা তার ঠিক হয়নি। আজ এতোদিন পর সবুজের মনে হলো রেণু যদি তাকে ভীরু, কাপুরুষ বলে। রেণু তো এখন আর শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের অবলা মেয়ে নয় যে সবকিছুতেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। সে এখন গাজীপুরে গার্মেন্টসে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো মেয়ে।

বানুর নাম্বারটা নিয়ে সবুজ তখনই ফোন দিলো।

রেণুই ফোন ধরেছে, হ্যালো আসসালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসসালাম। রেণু আমি, রেণু…বলতে বলতে সবুজ আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো।

রেণু চিনতে পেরেছে, সবুজ? কোথায় আছিস্‌ তুই? কেমন আছিস্‌? বলতে বলতে রেণুও আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো।

ভালো, তুই ভালো আছিস্‌?

হ্যাঁ। তুই কোথায় বলতো? রেণুর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

আমি তো গাজীপুর। আচ্ছা শোন্‌ বলে সবুজ তার ঠিকানা বললো।

রেণু বললো, আমি তো অল্প কয়েকদিন হলো এসেছি, আমি কেনোকিছু চিনবো না। আপা চিনবে।

আচ্ছা তাহলে তুই তোর ঠিকানা বল্‌, আমি কালকেই তোর সঙ্গে দেখা করবো।

রেণু বাধা দিলো, নারে তাড়াহুড়া করিস্‌ না। আমি আগে আপাকে বলি।

আপাকে বল্‌বি মানে? তোর আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না?

করছে। অবশ্যই করছে, আমারও মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে এখনই তোর কাছে যেতাম। কিন্তু এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে সবুজ। যার সবকিছু হয়তো তুই জানিস্‌ না।

জানি, আমি সব জানি।

সব জেনে শুনেও তুই আমাকে ভালোবাস্‌বি? আগের মতো আপন করে নিতে পার্‌বি?

হ্যাঁ পারবো, আমি সব বুঝি রেণু। আমি সব বুঝি, তুই তো আর ইচ্ছা করে বিয়ে করিস্‌নি, তোর বাবা-মা তোকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তাদেরও উপায় ছিলো না। গ্রামের যা অবস’া, তাতে যা কিছু হয়েছে সব আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হয়েছে। আমি সবকিছু মেনে নিয়েই তোকে…

রেণু বাধা দিয়ে বললো, কী আমাকে? আমাকে বিয়ে কর্‌বি?

হ্যাঁ। অবশ্যই বিয়ে করবো, বিয়ে করে তুই আর আমি শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে যাবো, যারা আমাদের নিয়ে সালিস বসাতে চেয়েছিলো, বিয়ে করে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।

শোন্‌ মাথা গরম করিস্‌ না। তুই তো ইদানীং আমাকে দেখিস্‌নি। আমাকে এখন তোর ভালো নাও লাগতে পারে, এর মধ্যে আমার ওপর দিয়ে কতো ঝড় বয়ে গেছে। আমার বিয়ে হয়েছে, আবার ছাড়াছাড়িও হয়েছে। সব জেনে শুনে একটা খুঁত ওয়ালা মেয়েকে তুই বিয়ে কর্‌বি?

এবার সবুজ রেগে গেলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ তোর মধ্যে যত খুঁতই হোক আমি তোকে বিয়ে করবো।

আচ্ছা, আমি তাহলে আপার সঙ্গে আজ একবার কথা বলি।

সবুজ অভিমান করে বললো, রেণু একসময় কিন্তু তুই পালিয়ে আমাকে বিয়ে করতেও রাজি ছিলি আর এখন আমাকে বিয়ে করতে আপার সঙ্গে আলাপ করতে হবে?

বুঝিস্‌ না কেনো? এখানে আমার অভিভাবক বলতে তো আপাই। তাছাড়া আপাকে না জানালে বিয়ের আয়োজন করবে কে?

আপা কিছু বলবে না তো?

সেটা তো বলতেই পারে।

সবুজ বুকে একটা আঘাত পেলো। কিছুটা উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললো, যদি আপা নিষেধ করে?

তখন দেখা যাবে।

না। আমি আগে তোর সঙ্গে দেখা করবো। তুই তোর গার্মেন্টসের নাম বল্‌।

রেণু বললো, কুইন্স ফ্যাশন।

ও, আমি তো তোর গার্মেন্টস চিনি। আমি আর দেরি করবো না রেণু আমি কালকেই আসছি। আগে তোর সঙ্গে দেখা হোক তারপর যা হবার হবে।

রেণু একবার জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে তাকালো। বানু আঙিনায় দাঁড়িয়ে মনছুরার সঙ্গে গল্প করছে। রেণু আঙিনার দিকে তাকাতেই বানুর চোখে চোখ পড়লো। রেণু ফিস্‌ফিস্‌ করে বললো, আপা আসছে, আমি রাখি।

রেণুর এতোদিনের ধীর, সি’র, শান্ত মনটা আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। ঘুমানোর জন্য চোখ বুজতে গিয়ে বার বার সবুজের কথা মনে পড়লো। সত্যি সত্যি সবুজের সঙ্গে তার দেখা হবে। রেণুর মনে একটা বিশ্বাস ছিলো তার সঙ্গে যদি সবুজের কেনোদিন দেখা হয় তবে তার জীবনের ঘটনাগুলো সে সহজভাবে মেনে নিবে। হলোও তাই। রেণু কাত ফিরে শুইলো।

বানু কিছুক্ষণ রেণুর দিকে তাকিয়ে রইলো। রেণু বানুর পাশে মুখ ফিরিয়ে ডাক দিলো, আপা।

কী রে?

ঘুমিয়েছিস্‌?

না।

আপা তোকে একটা কথা বল্‌বো?

বল্‌?

তুই কিছু মনে কর্‌বি না তো?

আগে বল্‌।

আপা আজ সবুজ ফোন করেছিলো।

সবুজ! বানু অবাক হয়ে বললো।

অবাক হচ্ছিস্‌ কেনো আপা?

ও কোথায় আমার নাম্বার পেলো?

আমি জিজ্ঞেস করিনি।

আচ্ছা থাক্‌, কী বললো, বল্‌?

আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

তুই কোথায় থাকিস্‌ ও জানে? বানু জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ। ও নাকি আমাদের আশে-পাশে থাকে, ফ্রেন্ডস্‌ এ্যাপারেলসে চাকরি করে।

বানু চোখ বন্ধ করে আপনমনে কয়েকবার ফ্রেন্ডস এ্যাপারেলস, ফ্রেন্ডস এ্যাপারেলস বলে বললো, ও তাইতো। আমাদের কয়েক বিল্ডিং পরে। তারপর কী বললো?

বললো আমাদের সঙ্গে তোর সঙ্গে দেখা করবে।

তারপর-

রেণু বানুর মনোভাব বুঝতে পারলো না। সবুজ তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে সেকথা বলার সাহস পেলো না। রেণুকে চুপ করে থাকতে দেখে বানু আবার জিজ্ঞেস করলো, কীরে কথার মাঝে মাঝে চুপ করে থাকছিস্‌ কেনো? একটা কথা সত্যি করে বলতো, সবুজ কি তোকে বিয়ে করবে?

বড় বোনকে বিয়ের কথা বলতে রেণুর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।

বানু আবার জিজ্ঞেস করলো, কী সবুজ তোকে বিয়ে করবে?

রেণু মৃদু কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ।

আচ্ছা তাহলে আমি বাবাকে বলে দেখি।

রেণু জানে বাবা তাকে খুব ভালোবাসে। সবুজকে তার বাবা পছন্দ করে। শুধু বাবা কিংবা মা নয়, বানু, ইতি এবং মানিকও সবুজকে খুব পছন্দ করে এবং সবুজের সঙ্গে তার বিয়ে প্রস্তাব গেলে বাবা না করবে না ভেবে রেণুর বুকটা ভরে গেলো।

একুশ

আজ বানু আর রেণু ঢাকা থেকে বাড়িতে আসবে। বাড়িতে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। দু’জনে এ বাড়িরই মেয়ে, এই তো কয়েক বছর আগে বানু যখন তার স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসতো, ক’দিন আগেও রেণু যখন তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে এলো তখনো বাড়িতে এরকম আনন্দ ছিলো না। কিন্তু এবারে বানু আর রেণু বাড়িতে আসার মধ্যে একাধিক আনন্দের কারণ যোগ হয়েছে।

নুরুর আজও মনে পড়ে যখন তার বাবা বেঁচে ছিলো, যখন তাদের অনেক জমিজমা ছিলো তখন তাদের বাড়িতে প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো অজুহাতে এমন ধুমধাম করে বাড়িতে অনুষ্ঠান হতো। নুরুর ফুপুরা আসতো, চাচাতো ভাইবোনেরা আসতো, পাড়া প্রতিবেশীরা আসতো। বাড়িতে খাসি জবাই হতো। তাছাড়া নবান্ন উৎসব, পহেলা বৈশাখে অনেক আনন্দ হতো। তারপর শুরু হলো ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাস। জমি জমা নদী গর্ভে বিলীন হতে লাগলো। কৃষি কাজে লোকসান বাড়তে লাগলো। নুরু তার বাবাকে আফসোস করে বলতে শুনেছে, আগে হালচাষ করে অনেক লাভ হতো। আর এখন সারাবছর কৃষিকাজ করে ঘরের টাকা গচ্ছা যায়। এর কারণ হিসেবে তার বাবা একটা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছিলো। তার বাবা বলতো, আমরা সারাবছর আবাদ করে ফসল বিক্রির পর লোকসান করি আর ফড়িয়ারা আমাদের জমি থেকে ফসল কিনে নিয়ে গিয়ে লাভ করে।

একদিন রাজিবপুর হাট থেকে ফিরে নুরুর বাবা বললো, আমরা ক্ষেতে বেগুন বেচলাম পাঁচ টাকা কেজি আর রাজিবপুর বাজারে সেই বেগুনের দাম দশ টাকা কেজি। আমার এক বিঘা জমিতে বেগুন আবাদ করে লোকসান হলো দু’হাজার টাকা আর আমার জমি থেকে বেগুন কিনে রাজিবপুর হাটে বিক্রি করে তবারক ফড়িয়া লাভ করলো পাঁচ’শ টাকা। কৃষকরা নিঃস্ব হয় আর ফড়িয়ারা ধনী হয়।

নুরুর বাবা স্বল্প শিক্ষিত মানুষ ছিলো বটে কিন’ খুব বাস্তববাদী মানুষ ছিলো, সমাজব্যবস’ার বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলো তার মনের মধ্যে দাগ কাটতো। সেই সামান্য অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মানুষটির কথাবার্তাগুলো ছিলো দার্শনিকের মতো। নুরুর বাবা বলতো দুনিয়াতে সব শ্রেণী পেশার মানুষের দল আছে, সংগঠন আছে, ধোপা, কুলি, মুচিদের পর্যন্ত সংগঠন আছে। তাদের ওপর কোনো জুলুম হলে, নির্যাতন হলে তারা প্রতিবাদ করে, আন্দোলন করে কিন্তু বাংলাদেশে কৃষকই সবচেয়ে বৃহৎ গোষ্ঠী হওয়ার পরও হাজার রকমের বঞ্চনা সহ্য করেও সংগঠিত হয় না। কৃষকদের কোনো দল নেই। আর কোনো কারণে না হোক অন্তত: সার, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য, কৃষি শ্রমিকের হাজিরা হিসেব করে কৃষকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আবাদ করা ফসলের নায্য মূল্য পাওয়ার ব্যবস’া করার জন্য তাদেরও একটা সংগঠন থাকা উচিত।

নুরুর বাবা যা-ই বলুক না কেনো, কৃষকদের দুর্দশা যতই বাড়-ক না কেনো ব্রহ্মপুত্রের চরে কোনো কৃষক কী বললো তা নিয়ে সেবা করার নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে ভাববার সময় কোথায়। এমনি করে কৃষকরা একদিন মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্তরা ভূমিহীন হয়ে যাবে। 

হ্যাঁ নুরুর বাবার কথাই ঠিক হয়েছে। নুরুর নিজের চোখে দেখা তাদের অবস’া, দিনে দিনে কীভাবে তারা মধ্যবিত্ত কৃষক থেকে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত থেকে ছিন্ন মূল মানুষে পরিণত হলো। এক পর্যায়ে নুরু তো ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে ভেসেই যাচ্ছিলো।

নুরুর বড় মেয়ে বানু যখন স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে এলো, মেজো মেয়ে রেণু যেদিন তার নানার বাড়ি চলে গেলো, গ্রামে যখন রেণুকে নিয়ে সালিস বসার প্রস’তি চলছিলো তখন তো নুরু একবার এই শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে রাস্তায় থাকা ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেই চেয়েছিলো। তারপর হঠাৎ করেই তার ভাগ্য খুলে গেলো। বানুর গার্মেন্টসে চাকরি হলো। রেণু ফিরে আসার পর সেও বানুর সঙ্গে গার্মেন্টসে চাকরি করতে চলে গেলো।

আজকের আনন্দের একটা কারণ হলো বানু আর রেণুর গ্রামে আসা। শুধু তাই নয়, সঙ্গে সবুজও আসছে। সবুজের সঙ্গে রেণুর বিয়ে হয়েছে। গ্রামের মাতব্বরদের সালিসের ভয়ে যে সবুজ একদিন গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলো সেই সবুজ রেণুকে বিয়ে করে গ্রামে ফিরছে। মেয়ে জামাই একসঙ্গে আসবে। নুরু আর ফুলির কাছে এ যেনো অনেক বড় একটা আনন্দের ঘটনা।

এই আনন্দের মাঝেও নুরু ফুলিকে একবার বানুর কথা বললো, ও বানুর মা, আমার বানুরও যদি একটা বিয়ে হতো। দু’মেয়ে জামাই যদি একসঙ্গে আসতো…

ফুলি ধমকের সুরে বললো, তুমি থামো তো। রেণুর বিয়ে হয়েছে তাই জামাইসহ আসছে। তুমি দেখো এভাবে একদিন বানুরও বিয়ে হবে। সেদিনটার জন্য তো অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। 

নুরু মৃদু হেসে বললো, হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো। আল্লাহ যেনো তোমার কথা কবুল করে।

আনন্দের আরেকটি ঘটনা হলো ইতির পরীক্ষা রেজাল্ট। ইতির পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে, সে এস.এস.সি’তে এ প্লাস পেয়েছে। অবহেলা আর অসামর্থ্যের অজুহাতে নুরু আর ফুলি যে মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধ করে বানু আর রেণুর মতো মনে মনে বিয়ের জন্য সুপাত্র সন্ধানের কথা চিন্তা করছিলো সেই ইতি আজ নিজের, স্কুলের এবং বাবা-মা’র মুখ উজ্জ্বল করেছে। এই আনন্দ যেনো শুধু নুরুর বাড়িতেই নয়, স্কুলে, শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে এবং বাজারে চায়ের টেবিলেও।

নুরু আর ফুলির অনেক আকাঙ্ক্ষার, অনেক স্বপ্নের ছেলে যাকে একদিন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার বানানোর স্বপ্ন দেখছিলো সেই আদরের একমাত্র সন্তান মানিক বি-গ্রেডে এস.এস.সি পাস করেছে। পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার পরও তার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। পরীক্ষার রেজাল্টের আগেও সে যেমন উদাসীন, বিলাসী এবং আনন্দ উৎফুল্লের মধ্যে দিন যাপন করছিলো রেজাল্টের পরও তার সেই অবস’া অব্যাহত আছে। তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তার রেজাল্ট শুনে যখন তাকে কিছুটা তিরস্কারের সুরে বললো, কীরে তোর বোন এতো ভালো রেজাল্ট করলো আর তুই কেনো এরকম রেজাল্ট কর্‌লি?

তখন তার যুক্তি হলো, পাস করেছি সেই যথেষ্ট, ফেল তো আর করিনি।

একই বাড়িতে রেজাল্টের দিন কেমন একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মেয়ে ভালো রেজাল্ট করার জন্য যেমন আনন্দ আছে তেমনি ছেলে কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট করতে না পারার একটা কষ্টও আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফুলি আর নুরুও মানিকের যুক্তিকেই সমর্থন করেছে, ফেল তো আর করেনি।

বানু, রেণু আর সবুজ ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছে ডে কোচে। বটতলায় কোচ থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে সবাই নদীর ঘাটে এলো। নদীর ঘাটে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। কিছুক্ষণ পরেই নৌকা ছেড়ে দিলো।

নৌকা যখন সোনাভরি পার হয়ে শঙ্কর মাধবপুর ঘাটে এসে ভিড়লো তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবাই নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো। সোনাভরির পাড় থেকে রেণুদের বাড়ি কয়েক মিনিটের পথ। বাজারের পাশে একটা মসজিদ থেকে তখন ফজু মাতব্বর নামাজ পড়ে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো একসঙ্গে কয়েক জনকে পেছন থেকে আসতে দেখে সে দাঁড়ালো। সবাই কাছে যেতেই ফজু মাতব্বর জিজ্ঞেস করলো, কে? তোমরা কে?

সবুজ ফজু মাতব্বরের কাছে গিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো, স্লামুয়ালায়ক মাতব্বর সাহেব।

ওয়ালেকুম আসসালাম। তুমি সবুজ না?

সবুজ আরও কাছে গেলো, হ্যাঁ আমি সবুজ।

তুমি না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছিলে? আবার এসেছো?

হ্যাঁ, আবার এসেছি। সালিস বসাবেন নাকি? রেণুও এসেছে।

রেণু সমানে এসে দাঁড়ালো। ফজু মাতব্বর একবার রেণুর আরেকবার সবুজের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বিয়ে করেছো?

সবুজ রেণুর কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বললো, হ্যাঁ করেছি। রেণু এখন আমার বউ।

ফজু মাতব্বর আর কোনো কথা বললো না। সে মাথা নত করে চলে গেলো।

সমাপ্ত

বিজয়ীনি

জিল্লুর রহমান

রাতের আঁধারে সবুজ যেদিন রাতে শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে এলো সেদিন শীতের রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার, শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে রাজিবপুর পৌঁছাতে পায়ে হাঁটার পথ তিন কিলোমিটার, উঁচু-নিচু রাস্তা, ধুধু বালু চর আর কাশবন। তারপর  সোনাভরি নদী। মনের ভিতরে আছে কেউ দেখে ফেলার আশঙ্কা। এতকিছুর মধ্যেও সবুজের মনে হলো একবার যদি রেণুর মুখটা দেখে যেতে পারতো…

সালিসের ভয়ে, সালিসে অপমানের ভয়ে সে রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছে ঢাকায়। একটা চাকরিও জুটেছে গার্মেন্টসে। কিন’ গার্মেন্টসে চাকরিতে তার মন নেই। তার মনের মধ্যে সবসময় রেণু, আর শুধু রেণু।

সেদিন সবুজ পালিয়ে যাওয়ার রেণুও চলে যায় নানার বাড়ি চিলমারী। ক’দিন যেতে না যেতেই শুরু হয় তার বিয়ের আয়োজন। রেণু নানার বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয় রিয়াজের সঙ্গে। রিয়াজ বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। পাকা বাড়ি, অন্ন বস্ত্রের অভাব নেই। ব্রম্মপুত্রের চরে ক্ষুধা তৃঞ্চার সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া রেণু এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহ বধু। তারপরও রেণুর মনে সুখ নেই। তার মন শুধু সবুজের জন্য ছটফট করে।

এর মধ্যে ঘটে আরেক ঘটনা। রিয়াজ রেণুকে নিয়ে বেড়াতে আসে শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে, শ্বশুরবাড়িতে। আর বেড়াতে এসেই হয় যত বিপত্তি। সে রেণুর প্রতিবেশীদের মাধ্যমে জানতে পারে রেণুর সঙ্গে সবুজের হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের কথা। সে রেণুকে তার বাবার বাড়িতে রেখে পরদিনই পালিয়ে যায়। রেণুও পরের নৌকায় ব্রম্মপুত্র পাড়ি দিয়ে চলে যায় পিছনে পিছনে রেণু চলে যায় তার শ্বশুরবাড়ি কিন’ সম্পর্কটা আর আগের মতো স্বাভাবিক হয় না। রেণুর ওপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে রেণু তার বাবার বাড়ি চলে আসে। ক’দিন পরেই চলে আসে বিচ্ছেদের চিঠি, তালাকনামা।

রেণুর বড় বোন বানু। কিশোরী বয়সে তারও বিয়ে হয়েছিলো কিন’ সতিনের সংসারে টিকতে না পেরে সেও ফিরে এসেছিলো বাবার বাড়িতে সে অনেক আগের কথা। তারপর সে চলে যায় ঢাকা, সেখানে গার্মেন্টসে চাকরি করে বাড়িতে মাসে মাসে টাকা পাঠায়, তাদের দুর্দিন কেটে যায়, সংসারে সুখ আসে।

রেণু বাবার বাড়িতে ফিরে এলে সেও বানুর সঙ্গে ঢাকা গিয়ে বানুর সঙ্গে গার্মেন্টসে চাকরি করে। দু’মেয়ের চাকরির টাকায় সংসার আরও সচ্ছল হয়।

বানু, রেণু আর ইতি। নুরুর তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলে মানিক। ইতি মেধাবী ছাত্রী। সে যখন ক্লাস ফাইভ পাস করে হাই স্কুলে ভর্তি হবে তখনো বানুর চাকরি হয় নি, রেণু শ্বশুরবাড়িতে। তখন তাদের টানপোড়েনের সংসার। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সঙ্গতির অভাবে নুরু তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো কিন’ শঙ্কর মাধবপুর হাই স্কুলের হেড মাস্টারের পরামর্শ আর আশ্বাসের ফলে সে ইতিকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করে দেয়।

ইতি আর মানিক জমোজ। নুরুর একমাত্র ছেলে, বানু, রেনু, ইতির একমাত্র ভাই হওয়ায় সে বড় হয়েছে অনেক আদর যত্নে। ক্লাস ফাইভ পাস করার পর সে জিদ ধরলো রাজিবপুর হাই স্কুলে ভর্তি হবে। নুরু তাকে রাজিবপুর হাই স্কুলেই ভর্তি করে দিলো। কিন’ রাজিবপুর ভর্তি হওয়ার পর সে লেখাপড়ায় আরও পিছিয়ে গেলো।

ছেলে সন্তানের জন্য নুরু আর ফুলির সংসারে একে একে তিন মেয়ে হয়েছে, মেধাবী হওয়ার পরও ইতির লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে মানিককে রাজিবপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে অথচ সেই অবহেলার মেয়ে ইতি এ-প্লাস পেয়ে এস.এস.সি পাস করলো আর মানিক পাস করলো বি গ্রেডে।

সবুজ তার মামাতো ভাইয়ের কাছে সব খবর নিয়ে শেষ পর্যন্ত রেণুকে খুঁজে পেয়েছে। শুধু খুঁজে পাওয়াই নয়, সে রেণুকে বিয়ে করেছে। ইতি আর মানিকের রেজাল্ট এবং সবুজের সঙ্গে রেণুর বিয়ে সব মিলিয়ে নুরু আর ফুলির সংসারে আজ আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। 

বানু, রেণু আর সবুজ ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছে ডে কোচে। বটতলায় কোচ থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে সবাই নদীর ঘাটে এলো। নদীর ঘাটে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। নৌকা কিছুক্ষণ পরেই নৌকা ছেড়ে দিলো।

নৌকা যখন সোনাভরি পার হয়ে শঙ্কর মাধবপুর ঘাটে এসে ভিড়ল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবাই নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো। সোনাভরির পাড় থেকে রেণুদের বাড়ি কয়েক মিনিটের পথ। বাজারের পাশে একটা মসজিদ থেকে তখন ফজু মাতব্বর নামাজ পড়ে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো একসঙ্গে কয়েক জনকে পেছন থেকে আসতে দেখে সে দাঁড়ালো। সবাই কাছে যেতেই ফজু মাতব্বর জিজ্ঞেস করলো, কে? তোমরা কে?

শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের সালিসের ধারক এবং বাহক ফজু মাতব্বরকে দেখে সবুজের রেগে ফেটে পড়লো।

সে ফজু মাতব্বরের কাছে গিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো, স্লামুয়ালায়ক মাতব্বর সাহেব।

ওয়ালেকুম আসসালাম। তুমি সবুজ না?

সবুজ আরও কাছে গেলো, হ্যাঁ আমি সবুজ।

তুমি না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছিলে? আবার এসেছে?

হ্যাঁ, আবার এসেছি। সালিস বসাবেন নাকি? রেণুও এসেছে।

রেণু সমানে এসে দাঁড়ালো। ফজু মাতব্বর একবার রেণুর আরেকবার সবুজের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বিয়ে করেছ?

সবুজ রেণুর কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বললো, হ্যাঁ। রেণু এখন আমার বউ।

ফজু মাতব্বর আর কোনো কথা বললো না। সে মাথা নত করে চলে গেলো।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in Uncategorized

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*