আঁচলে…

বিদ্যার কমতি থাকলেও বুদ্ধির কমতি মোটেই নেই। সমস্ত কিছুতেই যেন সে রাম বলতেই রহিম বুঝতে পারে। মেধা থাকা সত্ত্বেও সে উকিল হতে পারেনি বটে কিন্তু মহুরি হিসাবে অতি অল্প বয়সে সে যেন সমস্ত মহুরির ওস্তাদের স্থান দখল করেছে। ঊর্মির চরে জন্মগ্রহণ করে তিন ভাই বোনের সংসারে খেয়ে না খেয়ে সে যখন প্রথম বিভাগে এস. এস. সি পাস করল তখন শুধু তাদের সংসারেই নয়, চর শৌলমারী গ্রামের ধু ধু বালুচরও যেন আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হলো। কিন্তু অর্থাভাবে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটল সে পর্যন্তই, অবশেষে দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের মাধ্যমে মহুরির চাকরি জুটল কুড়িগ্রাম শহরের এক স্বনামধন্য উকিল খালেক সাহেবের অফিসে। তার চেহারা আর বয়স দেখে উকিল সাহেব প্রথমে নাক ছিটকালেন কিন্তু পরক্ষণেই রফিকের আপাদমস্তক একবার তাকিয়ে বললেন, কাজ করতে পারবে তো?

রফিক বিনয়ের সাথে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলেছিল, জি স্যার।

তখন থেকে প্রায় দশ বছর যাবত বটতলায় বসে মহুরির কাজ করার পাশাপাশি রফিক নাইট কলেজে অধ্যয়ন করে এইচ. এস. সি, বি.এ এবং এল. এল. বি পাস করেছে। মহুরির কাজ করতে করতে আর আইনের বই টানাটানি করতে করতে আইনের অনেক ধারার বিশদ বিবরণ তার কণ্ঠস্থ। তার স্পষ্ট হাতের লেখা আর আর্জির বিবরণ যেন ঘটনার দর্পণ স্বরূপ। কাজে  যোগদানের প্রথম দু’য়েক বছর তার লেখা আরজি খালেক সাহেব সংশোধন করে দিতেন। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি রফিকের লেখা আর্জিতে কলম বসানোর স্থান পান না। বাদী যখন খালেক সাহেবের সামনে বসে ঘটনার বিবরণ দেন রফিক তখন কাগজ কলম নিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে মামলার আরজি এমনভাবে লিখে দেয় যাতে খালেক সাহেব আশ্চর্য না হয়ে পারেন না। অনেক জটিল মামলা নিয়ে খালেক সাহেব যখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তখন দিন রাত আইনের বড় বড় বই খুঁজে রফিক এমন সব আইনের ধারা বের করে দেয় তখন খালেক সাহেব তার প্রশংসায় গদ গদ হয়ে যান।

তাছাড়া কাজকর্মে তার অলসতা বলতে কিছু নেই। কোন দিন ছুটির প্রয়োজন হলে কোর্ট-কাচারি বন্ধের সময় ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায় আবার কোর্ট চালু হবার আগেই এসে হাজির হয়। রফিকের চাহিদাও সীমিত, টাকার কথা সে মুখ ফুটে কোনদিন বলে না। খালেক সাহেব যখন যা দেন তাতেই সে সন্তুষ্ট। ঈদে ছুটির সময় রফিকের হাতে পাঁচ’শ টাকা দিলেই তার দু’চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

দীর্ঘদিন এক সঙ্গে কাজ করায় খালেক সাহেবরও যেন রফিকের প্রতি সহানুভূতি জন্মেছে। তাই রফিকের খাওয়া-দাওয়া, অভাব অভিযোগের খোঁজ-খবর নিতে তাঁর কখনো ভুল হয় না। সেদিন জটিল একটি মামলার রায় তার মক্কেলের অনুকূল হওয়ায় খালেক সাহেবের মনটা বেশ ভালো ছিল। তার উপর পকেটে কিছু টাকা ওঠায় সেই আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। নিত্যদিনের মতো রফিক খালেক সাহেবের বাম পাশে চেয়ারে বসে আইনের বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিল এমন সময় খালেক সাহেব ঘরে ঢুকেই ডাক দিলেন, রফিক?

জি স্যার।

ঊর্মির অপহরণ কেসের ফাইলটা স্টাডি করেছ?

জি স্যার।

কী মনে হলো?

স্যার, বাদী চেয়ারম্যান সাহেব লোকটা সুবিধার নয়। আমাদের একই গ্রামে বাড়ি, আমার মনে হয় কেসটা প্রেম ঘটিত চেয়ারম্যান সাহেব সেটা মেনে না নিয়ে ছেলেটার বিরুদ্ধে অপহরণ কেস করেছে। আজকাল এমন ঘটনা তো অহরহ ঘটছে।

রফিকের কথা শুনতে শুনতে খালেক সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি একটা নিঃশ্বাস টেনে বললেন, দেখ, চেয়ারম্যান সাহেব আমার অনেক দিনের মক্কেল তাই তাঁর কেসটা হাতছাড়া করলে তিনি আর কখনও আমাদের কাছে আসবেন না। আমরা কেসটা না নিলেও অন্য কোন উকিল তো কেসটা অবশ্যই নিবে আর অপহরণ মামলাও হবে ঠিকই, তাই আমি মনে করি ব্যবসার স্বার্থে তাঁর কেসটা আমাদের নেয়া উচিৎ।

রফিক বিনয়ের সাথে বলল, স্যার যদি অভয় দেন তো আমি একটা কথা বলি।

বলও।

রফিক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, স্যার দীর্ঘ দশ বছর থেকে বটতলায় বসে কাজ করতে করতে দেখলাম নারী নির্যাতন আইনগুলো অজামিন যোগ্য হওয়ায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই বেশির ভাগ মামলা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের কেসটাও সে রকম হয়রানী মূলক হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। যেহেতু কেসটা আমার গ্রামের তাই সত্যতা যাচাই না করে নিতে চাই না।

তবে এখন কী করতে চাও?

স্যার মামলার তারিখ আরও এক মাস পর, সামনে পূজার ছুটি আর মাত্র ক’দিন। আমি পূজার ছুটিতে বাড়িতে গেলে ভালোভাবে সবকিছু জানব। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবকে জানিয়ে দিব।

খালেক সাহেব মনে মনে বললেন, ততদিন কি আর তিনি থেমে থাকবেন, অবশ্যই অন্য কোন উকিলের মাধ্যমে কেস করবেন তারপর বললেন, রফিক তুমি এল.এল.বি পাস করার পর থেকে কোন কেস পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি তোমার মতামতকে প্রাধান্য দেই। তাছাড়া কেসটা তোমার গ্রামের হওয়ায় এ কেসের ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এখন থেকে কিছু কিছু কেস তুমি নিজে পরিচালনা করবে প্রয়োজন বোধে আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো। আর তুমি বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আমার মাধ্যমে ইন্টিমেশন পাঠাও।

রফিক মাথা নত করে বসে রইল।

 

দুই

শৈশব থেকে রফিক ধীর, স্থির, শান্ত প্রকৃতির ছেলে, তারুণ্যের চাঞ্চল্য হয়ত তাকে স্পর্শ করেনি। রফিক নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত সে কাজে লাগায়। কোর্ট-কাচারি ও কেস স্টাডি ছাড়া সে অন্য কাজে কখনো সময় অপচয় করে না। অবসর সময়েও আইনের বই পড়াশুনা কিংবা পুরাতন কেস এর কোন ফাইল স্টাডি করে।

খালেক সাহেবের বাড়িতে সে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করলেও বিনা কারণে কোনদিন বাড়ির ভিতরে ঢুকেনি। খালেক সাহেবের পরিবারে একজন অঘোষিত সদস্য হলেও কোনদিন কোন বিষয়ে অযাচিত কৌতূহলও বোধ করেনি। খালেক সাহেবের একমাত্র মেয়ে কবিতা কোন কারণে মুখোমুখি হলে রফিক মাথা নত করে পাশ কাটিয়ে যায়।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা রফিক নিত্যদিনের মতো অফিস কক্ষে বসে একটি মামলার নথি-পত্র গভীর মনোযোগ সহকারে স্টাডি করছিল। এমন সময় কবিতা অফিস কক্ষে ঢুকে টেবিলের উপর মৃদু আঘাত করল। কিন্তু রফিক মাথা নিচু করে পূর্বের মতোই গভীর মনোযোগ সহকারে স্টাডি করতে লাগল। কবিতা রফিকের কোন সাড়া না পেয়ে রফিকের কানের কাছে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, এই যে উকিল সাহেব।

রফিক মাথা নত করেই বলল, বলুন।

কবিতা বিরক্তির স্বরে বলল, উঃ অসহ্য। তারপর রাগান্বিত স্বরে বলল, মাথা তুলুন আমি কবিতা।

রফিক মাথা তুলতেই কবিতার চোখে চোখ পড়ল। তার শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, প্রতিষ্ঠিত উকিল হওয়ার স্বপ্ন আর সাফল্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে যেন রফিকের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ চাপা পড়ে গিয়েছিল  । কবিতার চোখে চোখ রাখতেই রফিক যেন আজ নতুন জীবনের স্বাদ পেল।

রফিক চোখ নামিয়ে বলল, কবিতা, তুমি কী মনে করে?

কিছু মনে করে না এমনি এলাম।

তুমি তো কখনো আসনা।

আসি না, কিন্তু আসতে কোন নিষেধ আছে নাকি?

না, নিষেধ নেই, অবশ্যই আসবে, বসও, বলে রফিক একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিল।

কবিতা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, চা খেয়েছেন?

আমি তো চা খাই না।

আগে খেতেন না, এখন খাবেন। কারণ আপনি আগে মহুরি ছিলেন, এখন এল.এল. বি পাস করেছেন, এখন আপনি উকিল, সব কিছু আগের মতো থাকলে তো হবে না। বলে কবিতা কলিং বেল এ টিপ দিতেই রহিমা ঘরে প্রবেশ করে বলল, আপা আমাকে ডেকেছেন?

দু’কাপ চা নিয়ে আয় তো, কবিতা বলল।

জি আচ্ছা, বলে রহিমা চলে গেলে কবিতা প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আপনি কেমন মানুষ বলুন তো, চা-পান কিছুই খান না, এল.এল.বি পাস করলেন তো একটা মিষ্টি খাওয়ালেন না, কোনদিন ভিতরের বাড়িতে আসেন না, আচ্ছা বলুন তো এমন নিষ্প্রাণ মানুষ হতে পারে?

রফিক নীরবে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বলল, স্যার কি বাসায় আছেন?

কেন আমাকে তাড়াতে চাচ্ছেন? নাকি আমার সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন? ভয় নেই বাবা বাড়ি নেই, অল্পক্ষণের মধ্যেই বাসায় আসার সম্ভাবনাও নেই।

তুমি যেন এবার কোন ক্লাসে পড়ছ?

অনার্স পরীক্ষা দিলাম।

রফিক কপালে চোখ তুলে বলল, বলও কী?

একই বাড়িতে থাকেন অথচ আমি কোন ক্লাসে পড়ি আপনি সে খবরও জানেন না দেখছি।

হু, আসলে বই পুস্তক নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকি তো।

বই পুস্তকের কাজ তো শেষ হলো এখন কী ভাবছেন?

স্যার বলেছেন এখন থেকে আলাদা কেস প্র্যাকটিস করতে। আমি ভাবছি  সামনে ছুটি পেলে একবার গ্রামের বাড়ি যাব, তারপর ব্যবসা জমাতে পারলে বাসা ভাড়া নিয়ে মা আর ছোট বোনকে এখানে নিয়ে আসবো।

তারপর-

রফিক মুচকি হেসে বলল, তারপর আর ভাবতে পারছিনা।

কবিতা শাসনের স্বরে বলল, হাসলেন কেন? ভাবছেন আমি বুঝতে পাচ্ছি না, আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম বিয়ের কথা, আপনি কৌশলে বার বার করে সেটাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। সবার সঙ্গে চালাকি, না! আপনি আইনের বই পড়তে পড়তে আর কৌশল অবলম্বন করতে করতে সহজ কথা ভুলে গেছেন। সহজভাবে কথা বলতে শিখুন, সবাইকে আপন ভাবতে শিখুন, দেখবেন আইন-আদালতের বাইরেও একটা জগত আছে।

রফিক মাথা নত করে বসে রইল। কবিতা আবার বলতে শুরু করল, কত দিন থেকে বাড়ি যাননি?

তিন মাস।

কবে যাবেন?

সামনে ছুটি পেলে।

এবার আমি যাব আপনার গ্রামের বাড়িতে।

রফিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে আমাদের বাড়িতে? তুমি কি জানো আমাদের বাড়ি কোথায়?

যেখানেই হোক আমি যাব।

আগে শোন, তারপর যাবার কথা ভাবিও।

বলুন।

আমাদের বাড়ি যেতে হয় নদী পথে। জিগা বাড়ি ঘাটে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে নদী পথে তিন ঘণ্টা যাবার পর পৌঁছাতে হবে ঘুঘুমারী ঘাটে সেখান থেকে ধু ধু বালুচর দিয়ে হাঁটতে হবে পাঁচ কিলোমিটার পথ, যেখানে বালুচরে হাঁটলে তোমার পা ঢুকে যাবে বালির মধ্যে তারপর আমাদের জীর্ণ কুটির যেখানে শুয়ে তুমি আকাশের চাঁদ দেখতে পাবে অনায়াসে। সারারাত শুনতে পাবে শিয়ালের ডাক। কোন শিয়াল ডাকতে ডাকতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতে পারে।

কবিতা রফিকের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, ব্যস হয়েছে, অনেক শুনেছি। আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। তাহলে তো একবার যেতেই হয়।

সবকিছু জেনে শুনে যদি তুমি যেতে চাও যাবে।

অবশ্যই যাব, কবিতা দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করে বলল।

 

তিন

কয়েকদিন পরের কথা। একদিন খালেক সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অথচ পরদিনই কোর্টে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিদের জামিনের তারিখ নির্ধারিত আছে। তিনি সেদিন অফিসে বসার মতো প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেললেন। তাই রফিককে অফিস কক্ষ থেকে নিজের বেড রুমে ডেকে পাঠালেন।

খালেক সাহেব তখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তাঁর শিয়রে স্ত্রী ফরিদা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন এমনসময় রফিক ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে খালেক সাহেবের বিছানার পাশে বসল। খালেক সাহেব বললেন, রফিক তোমাকে ডেকেছি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ধলডাংগার জমি দখলের মামলাটার ব্যাপারে আলাপ করার জন্য।

জি স্যার, বলুন।

আমার শরীরের অবস্থা তো দেখছ, আমি হয়ত আগামীকাল কোর্টে যেতে পারব না, আমার ইচ্ছা ছিল আমি নিজে থেকে তোমাকে কোর্টে কেস পরিচালনা করতে দেব। কিন্তু তা আর হলো না। আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ নেই, তুমি রাতে মামলার নথি ভালোভাবে স্টাডি করো। কাল আসামিদের জামিনের ব্যাপারে তোমাকে মুভ করতে হবে।

আমি কি পারব স্যার?

আমি দোয়া করছি, তুমি অবশ্যই পারবে। আর শোন তুমি আসামি পক্ষের উকিল বিনয়ের সাথে বিচারককে আসামিদের মানবিক দিক সম্পর্কে তুলে ধরবে।

আপনি দোয়া করবেন স্যার আমি যেন আপনার সম্মান রাখতে পারি, বলে রফিক বের হয়ে এলো।

গভীর রাত পর্যন্ত রফিক কেস নিয়ে স্টাডি করে পরদিন আসামিদের জামিনের জন্য আইনের কৌশল বের করল এবং রফিকের সুন্দর উপস্থাপনা, আইনের যুক্তিতর্কে রফিক আসামিদের জামিন করাতে সক্ষম হলো।

বিকেল বেলা রফিক যখন হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে খালেক সাহেবের রুমে প্রবেশ করল তখন তাঁর বুঝতে বাকী রইল না যে রফিক তার মামলায় সফল হয়েছে। তিনি বিছানা থেকে উঠে সহাস্যে বললেন, আমি আগেই বুঝেছিলাম, তুমি পারবে।

রফিক মিষ্টির প্যাকেটটা পাশের টুলে রেখে খালেক সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি প্রাণ ভরে দোয়া করলেন, আমি দোয়া করি বাবা তুমি একদিন মস্ত বড় উকিল হবে।

রফিক খালেক সাহেবের মুখে একটি মিষ্টি তুলে দিয়ে বলল, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার।

রফিক খালেক সাহেবের কক্ষ থেকে বেরিয়ে অফিস কক্ষে ঢুকে চেয়ারে বসতে না বসতেই কবিতা অফিস কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এই যে উকিল সাহেব, শুনলাম আপনি নাকি আজ মস্ত একটা কাজ করেছেন! বাবাকে মিষ্টি খাওয়াতে দেখলাম, তো আমার মিষ্টি কোথায়?

রফিক মৃদু হেসে বলল, বেশ তো বসও মিষ্টি খেয়ে যাবে, বলে কলিং বলে এ টিপ দিতেই রহিমা ঘরে প্রবেশ করল।

রফিক বলল, রহিমা যাও তো ভিতর থেকে মিষ্টি নিয়ে এস আর দু’কাপ চা।

রহিমা চলে যাবার পর রফিক ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, আগামী বৃহস্পতিবার ছুটি আছে পরদিন শুক্রবার, চলো না বৃহস্পতিবার রৌমারী যাই।

ঠিক আছে।

তোমার সঙ্গে আর কে যাবে?

আমার এক বান্ধবী, শ্রাবণী। খুব সুন্দর, মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে ও আপনাকে খুব পছন্দ করে।

আমি তো ওকে চিনলাম না, আর সেও তো আমাকে কোনদিন দেখেনি তাহলে কীভাবে আমাকে পছন্দ করল?

আপনি ওকে না চিনলেও ও আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনে। প্রায়ই আপনার ব্যাপারে ওর সাথে কথা হয় তো।

কিন্তু সে কি জানে যে আমি গাঁয়ের ছেলে, কৈশোর থেকে তোমাদের আশ্রয়ে বড় হয়েছি।

সে জন্যই সে আপনাকে আরও বেশি পছন্দ করে, ও বলে যারা ঝড়ের মধ্যে বড় হয়, যাদের জীবন শূন্য থেকে শুরু তারা নাকি কখনো পরাজিত হয় না, কখনো ঝরে পড়ে না, সে জন্যই আরও বেশি পছন্দ করে।

আর তুমি বুঝি আমাকে পছন্দ কর না?

কবিতা রফিকের চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলল, এই, কি হচ্ছে আমার সঙ্গেও আসামির মতো জেরা করা হচ্ছে, না?

মুহূর্তেই রফিক হাত জোড় করে বলল, দুঃখিত আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি, এবারের মতো ক্ষমা কর। এমন ভুল আর কখনো হবে না।

তাই যেন হয়, বলে কবিতা রুম থেকে বের হয়ে গেল।

চার

জিগা বাড়ি ঘাট থেকে যখন নৌকা ছাড়ল তখন বেলা দু’টা বাজে। নৌকার ছৈ এর উপর রফিক ও নৌকার মাথার কাছে বসে ছিল কবিতা আর শ্রাবণী। রফিক কখনো গন্তব্যের দিকে কখনো কবিতা আর শ্রাবণীর দিকে তাকাতেই কবিতার চোখে চোখ পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা ব্রহ্মপুত্র আর ধরলার সঙ্গমস্থলে এসে পৌঁছেছে, পাশে খুদিরকুটি চর, চরে সাদা কাশবন। রফিক অনেকক্ষণ থেকে প্রকৃতির রূপ দেখছিল। আর কবিতা রফিকের দিকে তাকিয়ে ছিল।

কবিতা সজোরে ডাক দিল, এই যে উকিল সাহেব, কী দেখছেন?

প্রকৃতি।

এসময় শ্রাবণী ডাক দিল, নীচে নামুন, কাছে আসুন, গল্প করি।

রফিক ছাদের উপর থেকে নেমে কবিতা আর শ্রাবণীর মুখোমুখি বসল।

শ্রাবণী বলল, আপনি কি সত্যি সত্যিই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গেলেন না কি?

দেখ না, কেমন সাদা কাশ বন, অতিথি পাখি, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ কেমন মেঘের খেলা, নদীর দিকে তাকিয়ে দেখ ও কী গাড়োয়াল ভাই গান গাইতে গাইতে মাঝি পাল তোলা নৌকা  নিয়ে ছুটে চলছে। এমন প্রকৃতির প্রেমে কে না পড়বে?

তাহলে আমার বান্ধবীটির কী হবে?

আমি প্রকৃতির প্রেমে পড়েছি, নারী ছাড়া প্রকৃতি অসম্পূর্ণ। কাজেই প্রকৃতির প্রেমে পড়লে আর নারীর প্রেমে পড়তে বাকী কী?

কবিতা হঠাৎ করেই আগুনের মতো জ্বলে উঠল, আবার ওকালতি প্যাঁচ, সোজাসুজি বলুন।

রফিক কবিতার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, কবিতা সব কথা স্পষ্ট করে বলতে হয় না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি কী না, সেটা তোমাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে।

কবিতার চোখে মুখে তৃপ্তির স্পষ্ট আভা ফুটে উঠল। সে অস্ফুট স্বরে বলল, রফিক।

আমি ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ি ভাই, বলে শ্রাবণী ছৈ এর ভিতর চলে গেল।

কবিতা রফিকের আরও গা ঘেঁষে নিবিড়ভাবে বসে রফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এবার সত্যি করে বলুন তো আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন?

এ প্রশ্ন তো আমারও তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসো?

ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, কবিতা আবেগ প্রবণ হয়ে বলল।

তবে এখনো আপনি, আপনি করছ কেন?

কবিতা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চুপ করে রইল।

রফিক মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, কবিতা।

বলও।

তোমাকে ভালবাসতে আমার ভয় হচ্ছে।

কেন?

তোমার বাবা-মা কি আমাদের ভালোবাসা মেনে নেবেন?

অবশ্যই মেনে নেবে, আমার বাবা-মা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবে না। আকাশের চাঁদ যদি পাওয়া যেত আর আমি যদি চাইতাম তবে বাবা আমাকে আকাশের চাঁদ এনে দিত। বলতে বলতে কবিতার চোখ দু’টো সজল হয়ে উঠল।

রফিক কবিতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, কিন্তু ম্যাডাম আমি গাঁয়ের ছেলে তার ওপর একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মেছি। আমাদের বাড়ি ঘর, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু দেখে তোমার কি পছন্দ হবে? তুমি কি সব কিছুই মানিয়ে নিতে পারবে?

এমনভাবে গল্প করতে করতে নৌকা যখন ঘুঘুমারী ঘাটে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শীতের পাখিরা ঝাঁক ঝাঁক বেঁধে নীড়ে ফিরছে। ছুটে চলা পালতোলা নৌকায় মাঝি গান গাইতে গাইতে ঘাটে ফিরছে। সবাই নৌকা থেকে নেমে চরশৌলমারী গ্রামের দিকে রওনা হলো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর রফিক জিজ্ঞেস করল, কবিতা তোমার বুঝি আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে? তাই না?

তুমি সব সময় উল্টা কথা বলও। আমার তো মোটেই রাগ হচ্ছে না, বরং ভালো লাগছে।

ভালো লাগছে কেন? রফিক জিজ্ঞেস করল।

কারণ তোমাদের গ্রামটি একটি আদর্শ গ্রাম, যেখানে আকাশের চাঁদ মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা করতে করতে নেমে আসে নদীর পানিতে, কাশবন থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক এমন মনোরম পরিবেশ তো  আগে কখনো দেখিনি।

বেশ তো তোমার ভালো লাগলেই হলো, বলে রফিক শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, শ্রাবণী তোমার ভালো লাগছে তো?

অবশ্যই।

 

পাঁচ

দীর্ঘদিন পর রফিক বাড়িতে আসবে তাই রফিকের মা মরিয়ম তার আসার চিঠি পাবার পর থেকে এক রকম পথ চেয়ে আছে। এল. এল. বি পাস করে ছেলে উকিল হয়েছে, মা হওয়া সত্ত্বেও আজ ছেলের কাছে কীভাবে কথা বলবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছে। তার সঙ্গে আসবে খালেক সাহেবের অতি আদরের কন্যা কবিতা ও তার বান্ধবী। খালেক সাহেব ধনী লোক কুড়িগ্রাম শহরে তার গাড়ি-বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি আছে। মরিয়মের ছোট ছেলে শফিক গতকাল ঘরের বেড়া ও চালা মেরামত করেছে। ছোট মেয়ে ফিরোজা ঘরের জিনিসপত্র গুছিয়েছে। সবকিছু ঠিক ঠাক করে সবাই বার বার করে পথের দিকে তাকাচ্ছিল। একবার দূরে চোখে পড়ল আবছা আবছা তিনটি ছায়া।

মরিয়ম চোখ মুছে ভালোভাবে তাকাল, হ্যাঁ সত্যিই তো রফিকের কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। মরিয়ম ডাক দিল বাজান শফিক, মাও ফিরোজা তোর ভাইজান আচছে।

ফিরোজা ঘরের ভিতর চেয়ার মুছে দিয়ে আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াল। কয়েক মিনিটের মধ্যে রফিক বাসায় এসে প্রবেশ করলে রফিক কবিতা ও শ্রাবণীকে তার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করে দিল।

কবিতা মরিয়মের পা ছুঁয়ে সালাম করতে যাচ্ছিল মরিয়ম কবিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করল, বেঁচে থাক মা, সুখী হও। তারপর রফিক ঘরের ভিতরে গিয়ে ফিরোজা ও শফিকের সঙ্গে কবিতা ও শ্রাবণীর পরিচয় করে দিল। কবিতা ফিরোজাকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?

ফিরোজা উত্তর দিল, এবার এস.এস. সি পাস করলাম।

কোন গ্রেডে?

”এ’’ গ্রেডে।

শ্রাবণী অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ”এ’’ গ্রেডে পাস করেছ?

ফিরোজা মাথা নত করে জবাব দিল, জি।

শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, কোন কলেজে ভর্তি হবে?

চরশৌলমারী কলেজে, ফিরোজা উত্তর দিল।

কবিতা ফিরোজার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, না তুমি চরশৌলমারী কলেজে পড়বে না, তুমি কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে ভর্তি হবে।

মুহূর্তের মধ্যে ফিরোজার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে মুচকি হাসি হেসে বলল, ভাইজানকে বলে দেখি।

এমন ভালো রেজাল্ট করে তুমি নাকি ভর্তি হবে চরশৌলমারী কলেজে? তোমার ভাইকে আমি বলব। তুমি কুড়িগ্রাম যাবার জন্য তৈরি হও। আর হ্যাঁ শফিক ভাই যেন এবার কোন ক্লাসে পড়েন?

ছোট ভাইজান ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এবার এল. এল. বি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে।

বাঃ এক ভাই উকিল, আর এক ভাই কি হবে ব্যারিস্টার?

দোয়া করিও মা তাই যেন হয়, বলতে বলতে রফিকের মা ঘরে প্রবেশ করল। অল্পক্ষণের মধ্যে রফিকের গ্রামে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ল। চরশৌলমারী গ্রামের এক বৃদ্ধা রফিকের কাছে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

রফিক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কী হইছে চাচী তোমার?

বৃদ্ধা কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, বাজান মোর বাপমরা ছাওয়াটা আইজ এক মাস ধরি জেলখানাত আছে, উয়াক ছোড়ে আনার ব্যবস্থা করি দে বাপ।

কী কচ্ছে তোমার ছাওয়া, জেলখানাত আছে ক্যানে?

তা অনেক গুলা কথা বাজান, বলে বৃদ্ধা একটা খাম বের করে রফিকের হাতে দিল। যেন মেঘ না চাইতেই জল। যে মামলার প্রকৃত ঘটনা রফিকের জানা একান্ত প্রয়োজন ছিল ভাগ্যক্রমে সে মামলার কাগজ-পত্রই তার হাতে এসে পড়ল। রফিক মামলার কাগজপত্র পড়ে বলল, তোমার ছাওয়াতও শক্ত মামলার আসামি, তোমরা তাক জানেন?

না বাজান মুই কিছুই জানো না, মুই মোর ছাওয়াক চাঁও।

ছাওয়াক চাইলেতো হবান নয়, কাগজপত্র দেখনু। তোমার ছাওয়া চেয়ারম্যানের নাবালিকা বেটিক নিয়া ভাগছে। যদি মামলাত অঁয় ঠিকে দোষী হয় তাহইলে উয়ার জেল থাকি ছাড়া পাওয়ার ঘাটা নেই।

বৃদ্ধা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, মোর ছাওয়ার কোন দোষ নেই বাপ, তোমরা উয়াক মোর গোরত ফিরি দেও বাপ ।

রফিক সান্ত্বনার সুরে বলল, ঠিক আছে চাচী, ধৈর্য ধরো দোয়া কর মুই যেন তোমার ছাওয়াক নির্দোষ প্রমাণ কইরবার পারো।

মুই দোয়া কঁরো বাজান আল্লা তোক যোন বিরাট উকিল বানে দেয়।

এলা তোমরা মোর কয়টা কথার জবাব দেও, রফিক বলল।

কন বাজান, কন।

তোমার ছাওয়া কোন ক্লাস থাকি পড়ছে?

মেট্রিক পাস করছে বাপ।

মায়্যাটা মেট্রিক পাস করছে? রফিক জিজ্ঞেস করল।

তায়োঁ মেট্রিক পাস করছে?

তাহইলে তোমরা কাইল তোমার ছাওয়ার মেট্রিকের সার্টিফিকেট খান দেমেন।

ঠিক আছে বাজান, বলে বৃদ্ধা রফিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, মুই দোওয়া করোঁ ছোল বাপ, তুই একদিন বিরাট উকিল হবু।

 

ছয়

পরদিন সকালে রফিক, কবিতা ও শ্রাবণীকে নিয়ে বের হলো। চরশৌলমারী থেকে উত্তর দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেই রাস্তা বরাবর কিছুদূর যাবার পরই ডানদিকের রাস্তাটি চলে গেছে নদীর ঘাটে। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ঘাট সরে গেছে অনেক দূর আর তাই বালুচরে ঘর বেধেছে ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূল মানুষের বস্তির ঠিক মাঝামাঝি পৌঁছাতেই জীর্ণ, মলিন বস্ত্র পরিহিতা এক মহিলা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাঁয়, আগপাকে তো ঘাটা শেষ, তোমরা কার কাছত যাইমেন?

রফিক বলল, মোর নাম রফিক, মোর সাথের মেহমান কুড়িগ্রাম থাকি আচ্‌ছে।

রফিক? কছিরন বলল।

রফিক দাঁড়াল তারপর জিজ্ঞেস করল, মোক চেনছেন, তাহইলে, মুইতো তোমাক চিননু না।

মহিলাটি সামনে এগিয়ে এসে বলল, মোর নাম কছিরন।

রফিক বলল, ও এবার চিনছুঁ তুইতো মোর সাথে পড়ছিলু।

কছিরনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, কতদিন পর তোক দেখনু বাড়িত আয়।

রফিক একবার কবিতা ও শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকাতেই দু’জনে সায় দেওয়ায় রফিক কছিরনের সঙ্গে তার বাড়িতে গেল। পিছনে পিছনে কবিতা ও শ্রাবণী কছিরনের বাড়িতে গেল। নতুন ছনের ছাউনি, সম্ভবত এবারই প্রথম এখানে মানুষ ঘর বেধেছে। পাশাপাশি খড়ের বেড়া দুইটি ঘরের সামনে সঙ্কীর্ণ উঠান, চরের বালি দিয়ে উঁচু করা উঠানের উপর কছিরন একটা পাটি বিছিয়ে দিল, তারপর কবিতা ও শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, হামরা গরিব মানুষ কষ্ট করি এই মাদুরত বইসা নাগবে বইন।

কছিরন জোহরা বলে ডাক দিতেই বার/চৌদ্দ বছর বয়সের একটি মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

কছিরন জোহরার কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে কী যেন বলল তারপর শাড়ির আঁচল থেকে টাকা বের করে জোহরার হাতে দিয়ে বলল, যা মা টপ করে আসিস।

কছিরন কী করিসছোল, হামরা এলায় নাস্তা খায়া বাইর হইনো।

ম্যালাদিন বাদে তোর সাথে দেখা হইল আপার ঘরও আচছে, খালি মুখত বিদায় দিবার পাঁওনা, এমরা তোর কী হয়?

হ্যাঁ তোর সঙ্গে পরিচয় করে দেই বলে রফিক কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল, এ হইল কবিতা, যে উকিলের বাড়িত থাকিয়া মুই ল্যাখা পড়া করনু তার বেটি আর সাথের জন উয়ার বান্ধবী শ্রাবণী।

বিয়া সাদী বোধহয় এলাও করিস নাই? বলে কছিরন মিট মিট করে হাসল।

না কেবল তো ল্যাখা পড়া শেষ করনু। এলা তোর কথা ক।

মুহূর্তে কছিরনের মুখে কাল মেঘে ঢেকে গেল, মোর চাইর বেটি।

বলেন কি চার মেয়ে?  শ্রাবণী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

জোহরার বাপ ছাওয়া নিবার চায় না, কিন্তুক বুজান একটা বেটা ছাড়া কি চলে?

শ্রাবণী প্রতিবাদ করে বলল, কেন হয় না? আমরা শুধু দু’বোন আমদের কি দিন চলছে না? ছেলের জন্য আপনাদের চারটা মেয়ে হয়েছে এখন সংসারে কেমন অনটন যাচ্ছে না?

হ্যাঁ টানাটানি তো আছেই, তার ভিতর দিয়া বড় বেটির বিয়া দিছুঁ।

রফিক গম্ভীরস্বরে বলল, তুই এতকোনা বেটির বিয়া দিছিস?

হ্যাঁ, চরত থাকি, বেটি বড় হইলে মানইষে ম্যালা কথা কয়, বয়স বেশি হইলে ভালো পাত্রর পাওয়া যায় না, কপাল জোরে বোয়ালমারির এক চেংড়া পাওয়া গেল, সবায়ঁ কইলে এরকম পাত্র আর পাওয়া যাবার নেয়, ডিমানও কম, একখান সাইকেল আর পাঁচ হাজার টাকা। সেই জন্যে জোহরার বাপ বিয়া দিয়া দেলে, বলে কছিরন আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে রফিকের মাথায় রক্ত উঠে গেছে সে রাগান্বিত স্বরে বলল, কছিরন তুই এতকোনা বেটির বিয়াও দিছিস, তুই কি জানিস জোহরার বয়স কত? তুঁই জানিস তুই একসাথে কয়টা অবরাধ করছিস?

কছিরন রফিকের কথার কোন জবাব দিতে পারল না, মাথা নত করে নীরবে বসে রইল।

রফিক আবার বলতে শুরু করল, তুই তোর বেটিক স্কুলত পাঠাইস নাই, কম বয়সে বিয়া দিছিস, ফির ডিমান্ডও দিছিস।

হামরা চরের মানুষ স্কুল ম্যালা দূরত সেই জন্যে স্কুল পাঠাইতে ভয় লাগে, বেটি সিয়ানা হইলে দুর্নামের ভয়, বিয়া দিয়া দেই আর তুই কইস ডিমান্ডের কথা, ডিমান্ড ছাড়া এই চরত কোন বিয়াও হয় না।

রফিক কছিরনের  কথার কোন জবাব খুঁজে পেল না, সে মৃদু কণ্ঠে বলল, কছিরন তুই যদি জোহরাক ল্যাখা পড়া শিখালু হয় তা হইলে শিক্ষিত চেংড়ার সাথে বিয়া দিবার পালু হয়, উয়ার জীবনটা অন্যরকম হইল হয়। আর শিক্ষিত হইলে নিজেই কম বয়সে বিয়া বসিল না হয়। ডিমান্ডের কথা বলছিস তোর মেয়ে শিক্ষিত হলে ডিমান্ড দিতে হত না। এই যে মোর সাথে তোর আপাদের দেখছিস ওমরা শিক্ষিত তাই ওদের বিয়েতে ডিমান্ড দিতে হবে না, ডিমান্ড ছাড়াই ওদের বিয়ে হবে।

কছিরনের দু’চোখের কোণা জলে ভরে গেল, রফিক তুই আমার চোখ খুলি দিলু, মুই সউগ বেটিগুলাক স্কুলত পাঠাইম। বেটা হউক আর বেটি হউক আর ছাওয়া নিবার নেও।

এমন সময় জোহরা বাড়িতে ঢুকলে কছিরন একটা প্লেটে করে বিস্কুট আর চানাচুর খেতে দিয়ে বলল, যা মা পানি নিয়ে আয়।

রফিক, কবিতা ও শ্রাবণী নাস্তা খেয়ে যখন বের হলো তখন কছিরন বলল, আপা তোমরা কিছু মনে করেন না আবার আইসেন।

 

সাত

চরশৌলমারী থেকে ফিরে রফিক সুজনের বিরুদ্ধে মাজেদুর চেয়ারম্যানের দায়েরকৃত মামলার সমস্ত কাগজপত্র খালেক সাহেবকে দেখাল। সবকিছু দেখে খালেক সাহেব বললেন, কাগজপত্র অনুযায়ী তো ছেলে-মেয়ে দু’জনে ম্যাচুড, যে কোন ছেলে-মেয়ের নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আছে। মামলার রায় বিবাদীর পক্ষে যাবে, তুমি ডায়েরিতে নোট রাখ, পরবর্তী তারিখের আগের দিন আমাকে স্মরণ করে দিও। মামলাটি তুমি পরিচালনা করো, আমার সহযোগিতার প্রয়োজন হলে বলিও।

রফিক বিনয়ের সাথে বলল, জি স্যার।

পরবর্তী তারিখে রফিক সুজন এবং শারমিনের জামিনের জন্য মুভ করল। কিন্তু দায়েরকৃত মামলাটি অজামিনযোগ্য ধারার মামলা হওয়ায় জামিন মঞ্জুর হলো না। এমনি ভাবে পর পর কয়েকটি তারিখ অতিক্রান্ত হলো এবং বরাবরই জামিন না মঞ্জুর হলো, ফলে সুজন ও শারমিনের হাজতবাসের সময়ও বেড়েই চলল।

মামলার শুনানির আগের দিন রফিক সমস্ত কাগজপত্র স্টাডি করল। খালেক সাহেব মামলার যাবতীয় কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে শুনানির সময় রফিকের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিলেন।

বিচারক গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে বাদী পক্ষের উকিলের যুক্তি শুনছিলেন। আদালতের অন্যান্য উকিলগণও চুপচাপ বসে ছিলেন। আদালতে যেন এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। বাদীর কাঠগড়ায় মাজেদুর চেয়ারম্যান ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাদী পক্ষের উকিল বলতে শুরু করলেন, মহামান্য আদালত আসামি সুজন আমার মক্কেল জনাব মাজেদুর রহমান এর নাবালিকা কন্যা মোছা: শারমিন আখতার ওরফে শারমিনকে অপহরণ করে। অপহরণের পর তাকে নির্যাতন ও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করে। এই দেখুন বিয়ের কাবিননামা বলে তিনি বিচারকের হাতে কাবিননামার সার্টিফাইড কপিটি দিলেন, তারপর তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, তারপর শারমিনকে রৌমারী উপজেলার নূরপুর গ্রামের মোখলেস মিয়ার বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। আমার মক্কেল জনাব মাজেদুর রহমান রৌমারী থানা পুলিশের সহায়তায় মোখলেস মিয়ার বাড়ি থেকে সুজনসহ শারমিনকে উদ্ধার করে, বলে তিনি বিচারকের দিকে কয়েকটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি শারমিনকে অপহরণের প্রমাণ স্বরূপ পুলিশ রিপোর্ট এবং ডাক্তার প্রদত্ত ধর্ষণ প্রমাণের রিপোর্ট মহান আদলতে পেশ করছি, বলে তিনি একটু থামলেন তারপর আবার বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, মাননীয় আদালত, আদালতে উপস্থাপিত কাগজপত্র, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট এবং ডাক্তার প্রদত্ত ধর্ষণ প্রমাণের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে একথা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আসামি সুজন শারমিনকে জীবনের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অপহরণ, জোর পূর্বক বিয়ে এবং ধর্ষণ করেছে তাই আমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৭ এবং ৯ ধারা অনুযায়ী আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ প্রার্থনা করছি। দেটস অল ইয়োর অনার।

এতক্ষণ রফিক গভীর মনোযোগ সহকারে বাদী পক্ষের উকিলের বক্তব্য শুনছিল। এবার সে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়োর অনার, আমি এই মামলার বাদী জনাব মাজেদুর রহমানকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অনুমতি প্রার্থনা করছি।

বিচারক গম্ভীরস্বরে বললেন, অনুমতি দেয়া হলো।

রফিক বলতে শুরু করল, ইয়োর অনার, আসামির কাঠগড়ায় যে হতভাগ্য ছেলেটিকে আমার বিজ্ঞ আইনজীবী বন্ধু দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করছেন আমি তাকে বেকসুর খালাস প্রদানের আদেশ প্রার্থনা করছি। কারণ আমার মক্কেল সুজন আর বাদীর কন্যা শারমিন আখতার ওরফে শারমিন শৈশব থেকে একই পাড়ায় বড় হয়েছে, শৈশব থেকে এক সঙ্গে পুতুল খেলা থেকে শুরু করে কৈশোরে স্কুলগামী কিশোর-কিশোরী একই ছাতার নীচে গলা ধরাধরি করে স্কুল  গিয়েছে। এমনভাবে দিনের পর দিন পাশাপাশি চলতে চলতে তারা পরস্পরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবার জন্য স্বপ্ন দেখে, তখনই বাধা দেয় শারমিনের বাবা জনাব মাজেদুর রহমান চেয়ারম্যান। স্বপ্নে বিভোর তরুণ-তরুণী সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেহেতু বাদী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাই সুজন আর শারমিন রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়ে কাবিন নামায় রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করে একজন যুবক যুবতীকে তাদের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার জন্য রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে হয়।

বাদী পক্ষের উকিল এ সময় বলে উঠলেন, ইয়োর অনার, আসামি পক্ষের উকিল আদালতে যে প্রেমের গল্প শোনালেন সে গল্প বলার স্থান আদালত নয়, তিনি এমন গল্প রচনা করে সিনেমা তৈরি করতে পারেন, সেটা সেখানেই ভালো মানায়।

রফিক আবার বলতে শুরু করল, ইয়োর অনার আমি শারমিনকে (দ্যাটমিনস মিসেস সুজন) কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অনুমতি প্রার্থনা করছি।

বিচারক গম্ভীর স্বরে বললেন, অনুমতি দেয়া হলো।

শারমিন আদালতে বাদীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সুজনের দিকে একবার তাকাতেই তার বুক হাহাকার করে উঠল। সুজনের এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা দাঁড়ি, কোটরাগত চোখ আর কঙ্কালসার দেহ দেখে শারমিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কিছুক্ষণ পর শারমিনের কান্না থামলে আদালতের একজন কর্মচারী তাকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন, যাহা বলিব সত্য বলিব, কোন কথা মিথ্যা বলিব না এবং কোন কথা গোপন করিব না।

শপথ বাক্য পাঠ করার পর রফিক শারমিনকে জিজ্ঞেস করল, শারমিন বলুন তো সুজন কি আপনাকে অপহরণ করেছিল?

শারমিন দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল, না।

তবে কি আপনি স্বেচ্ছায় সুজনের সঙ্গে গিয়েছিলেন?

জি।

রফিক জিজ্ঞেস করল, কেন?

শারমিন আবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি সুজনকে ভালোবাসি এবং আমরা দু’জন যখন ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম তখন ঐ লোকটি বলে শারমিন তার বাবার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ঐ লোকটি আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। তখন আমরা দু’জন রাতের আঁধারে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে কাবিন নামার মাধ্যমে বিয়ে করি।

তারমানে সুজন আপনাকে অপহরণ করেনি? আপনার বাবা আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করেছিল। তাই আপনি সুজনকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে গিয়েছেন?

বাদী পক্ষের উকিল এ সময় রাগান্বিত স্বরে বললেন, অবজেকশন ইয়োর অনার।

বিচারক গম্ভীর স্বরে বললেন, অবজেকশন সাসপেন্ড।

রফিক শারমিনকে বলল, বলুন।

বিয়ের পর আমরা সুজনের দুর-সম্পর্কীয় এক দুলাভাইর বাসায় আশ্রয় নেই। সেখান থেকে একদিন পুলিশ আমাদেরকে ধরে নিয়ে আসে। তারপর ঐ লোকটি বলে তার বাবার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, আমাকে সুজনের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেয়ার জন্য শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং আমি সুজনের বিরুদ্ধে জবানবন্দি না দিলে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দেন বলে শারমিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

রফিক বলল, আচ্ছা মিসেস শারমিন বলুন তো আপনি কি সুজনকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে গিয়েছেন?

জি।

রফিক বলল, তাই আপনি বাধ্য হয়ে নির্যাতন এবং পিতার আত্মহত্যার হুমকিতে পুলিশের নিকট মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছেন?

শারমিন বলল, জি।

বাদী পক্ষের উকিল এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, ইয়োর অনার আমার মক্কেলের মেয়ে শারমিন নাবালিকা আর একজন নাবালিকা মেয়ের কথার উপর ভিত্তি করে আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই আমি শারমিন সাবালক না হওয়া পর্যন্ত আমার মক্কেলের জিম্মায় দেওয়ার আদেশ প্রদানের জন্য বিনীত আবেদন করছি।

রফিক বলল, ইয়োর অনার আমার বিজ্ঞ আইনজীবী বন্ধু শারমিনকে নাবালিকা বলেছেন শারমিনের এস. এস. সি পাসের সার্টিফিকেট এবং বিয়ের কাবিন নামায় জন্ম তারিখ দেখলে জানা যায় যে বিয়ের দিন শারমিনের বয়স আঠার বছর সাত মাস তিন দিন বলে রফিক বিচারকের দিকে কাগজগুলো তুলে ধরে বলল, আমি শারমিনের এস. এস. সি পাসের সার্টিফিকেট এবং কাবিন নামার সত্যায়িত অনুলিপি মহান আদালতে পেশ করছি, বলে রফিক বিচারকের দিকে তাকিয়েই আবার বলতে শুরু করল, ইয়োর অনার শারমিনের সত্য ভাষ্য এবং বয়স প্রমাণের কাগজপত্র বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হয় যে, আসামির কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সুজন শারমিনকে অপহরণ করেনি তারা পরস্পর ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাই আমি সুজনকে বে-কসুর খালাসসহ মামলাটি খারিজ করার আদেশ প্রদানের জন্য বিনীত আবেদন করছি।

বিজ্ঞ বিচারক এতক্ষণ রফিকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। রফিকের বক্তব্য শেষে বিজ্ঞ বিচারক সমস্ত কাগজ-পত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন তারপর কয়েক মিনিট লিখা শেষে রায় পাঠ শুরু করলেন, মিসেস শারমিনের স্বীকারোক্তি এবং মামলা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদালত শারমিন অপহরণ মামলার বিবাদী সুজনকে বে-কসুর খালাস প্রদান করছে। আদালত আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, শারমিনের বয়স আঠার বছর অতিক্রম করায় তার অভিভাবক সে নিজেই। তাই সে স্বাধীন মতামত অনুযায়ী বসবাস করতে পারবে। আদালত আজকের মতো মুলতবি ঘোষণা করা হলো।

বিচারকের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আবেগে সুজন ও শারমিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। দু’জনে কাঠগড়া থেকে নেমে রফিকের বুকে জড়িয়ে পড়ল।

 

আট

এতদিন খালেক সাহেব পরিচালিত মামলায় রফিক তাঁর সহকারী হিসাবে কাজ করত। কোন কোন মামলায় খালেক সাহেবের অনুপস্থিতিতে তাঁর বিকল্প হিসাবে কাজ করত। কিন্তু আজ তার নিজের পরিচালিত মামলায় জয়ী হয়ে রফিকের বুক আনন্দে ভরে গেল। এ মামলার বাদী মাজেদুর চেয়ারম্যান যেদিন খালেক সাহেবের  কাছে এসেছিল সেদিনই রফিকের মনে হয়েছিল। যে মামলাটি মিথ্যা, চেয়ারম্যান সাহেব মিথ্যা অভিযোগ করে আভিজাত্য আর বংশ মর্যাদার অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে নিজের মেয়ের  পছন্দকে শুধু অপমানই করেনি, জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য আদালত পর্যন্ত এসেছেন। ভাগ্যক্রমে সুজনের মা তার কাছে মামলার কাগজপত্র নিয়ে আসায় যেন রফিকের শাপে-বর হয়েছিল। আজ প্রথম তার পরিচালিত মামলায় জয়ী হওয়ার আনন্দে রফিক খবরটি অতি দ্রুত কবিতার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কোর্ট থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল।

প্রায় দিনই কবিতা বিকেলে জানালায় বসে রফিকের পথের দিকে চেয়ে থাকে। রফিক রিক্সা থেকে নামতেই কবিতা একটি মুচকি হাসি হেসে বলে, কী খবর উকিল সাহেব?

কোন দিন রফিক বলে, এই চলে যাচ্ছে কোন রকমে, আবার কোন দিন ঠাণ্ডা করে বলে শান্তি নেই। কবিতা কোনদিন প্রত্যুত্তর দেয় আবার কোনদিন কিছু না বলেই চলে যায়। রফিক বাসার উদ্দেশ্যে রিক্সায় বসে বিভিন্ন রকমের কথা ভাবছিল। আজ তার জীবনের এমন আনন্দময় দিনে রফিক কী বলবে কবিতাকে? আর কবিতাই বা কী বলবে? এমনি অসংখ্য রকমের কথা ভাবতে ভাবতে রিক্সা শাপলা চত্বর পেরিয়ে কবিতাদের বাসার গেটে এসে দাঁড়াল। সত্যিই তো কবিতা আজও জানালা খুলে বসে আছে। রফিক রিক্সা থেকে নেমে জানালার দিকে তাকাতেই কবিতার চোখে চোখ পড়ল। কবিতা বেরিয়ে এসে রফিকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কি খবর উকিল সাহেব?

রফিক বরাবরের মতো না বলে একটু ভিন্নভাবে বলল, খবর ভালো ম্যাডাম।

বলও, বলও, তাড়াতাড়ি বলও, কবিতা রফিকের পিছনে পিছনে তার রুমে প্রবেশ করল।

কী হলো? বলছ না কেন? মামলায় জিতেছ?

রফিক মৃদু হেসে বলল, জি ম্যাডাম।

কবিতা কোনকিছু না বলে দৌড়ে বাসার ভিতরে  চলে গেল এবং যেমন দ্রুত বেগে বের হয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমনি দ্রুত বেগে একটা প্লেটে মিষ্টি নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল।

রফিক জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে মিষ্টি কোথায় পেলে? কয়েকদিন আগে এনে রেখেছ নাকি?

ইচ্ছা ছিল তুমি প্রথম যেদিন তোমার পরিচালিত মামলায় জিতবে সেদিন তোমাকে মিষ্টি মুখ করাব। তাই মিষ্টি এনে রেখেছিলাম।

রফিক অষ্ফুষ্ট স্বরে বলল, তুমি আমাকে নিয়ে এত কিছু ভাব?

তোমাকে ছাড়া আমি আর কাকে নিয়ে ভাববো? বলে কবিতা রফিকের মুখে মিষ্টি তুলে দিল।

রফিক মিষ্টির প্লেট নিজের হাতে নিয়ে কবিতার মুখে একটা মিষ্টি তুলে দিতে দিতে বলল, আর বেশি দিন ভাবতে হবে না ম্যাডাম, সব ভাবনার অবসান করার ব্যবস্থা করছি।

তাড়াতাড়ি করো রফিক, আমি যে আর দেরি করতে পারছি না। তুমি তো সারাদিন কোর্ট কাচারি নিয়ে ব্যস্ত থাক। সারারাত স্টাডি নিয়ে থাক আর আমি সব সময় শুধু তোমাকে নিয়ে ভাবি, তোমাকে নিয়েই ঘর সাজাই তারপর এক সময় দেখি কেউ নেই, শুধু আমি একা। প্লিজ, তুমি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো।

রফিক কবিতার গালে টোকা দিয়ে বলল, তুমি আর কয়েকদিন দেরি করো কবিতা। শীঘ্রই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। মার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই মা প্রস্তাব নিয়ে আসবে। তুমি স্যারকে রাজী করার ব্যবস্থা করো।

রফিক জানালা দিয়ে তাকিয়ে খালেক সাহেবকে দেখতে পেয়ে বলল, স্যার আসছেন, তুমি যাও কবিতা।

আচ্ছা, বলে কবিতা চলে গেল।

 

নয়

ক’দিন থেকে প্রচণ্ড শীত নেমেছে, কোন কোনদিন সকাল বেলার কুয়াশা কাটতে না কাটতেই দুপুর হয়ে যায় বিকেল হতেই আবার শুরু হয় ঘন কুয়াশা। রাত আটটা না বাজতেই যেন মনে হয় গভীর রাত। শ্রাবণী সাতটা বাজতে না বাজতেই রাতের খাবার খেয়ে আরাম করে বিছানায় চুপ চাপ শুয়ে আছে। এমন সময় টেলিফোনের রিং বেজে উঠল। শ্রাবণীর বিছানা থেকে উঠে টেলিফোন রিসিভ করার ইচ্ছা হলো না, ফাল্গুনী জোরে চেঁচিয়ে বলল, শ্রাবণী টেলিফোন ধরো তো।

শ্রাবণী কোন কথা না বলে চুপ করে রইল অবশেষে ফাল্গুনী বিরক্ত সহকারে বলল, শ্রাবণী আমি জানি তুই ঘুমাসনি, বলে টেলিফোন রিসিভ করল তারপর জোরে শ্রাবণীকে ডাক দিয়ে বলল, শ্রাবণী তোর ফোন।

শ্রাবণী বিছানায় শুয়েই জিজ্ঞেস করল, কে?

ফাল্গুনী বলল, মাসুদ।

মাসুদের কথা শুনেই শ্রাবণী একরকম লাফিয়ে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন রিসিভ করল, হ্যালো।

অপর প্রান্ত থেকে মাসুদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো শ্রাবণী।

হ্যাঁ বলও, হঠাৎ কী মনে করে?

তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি?

আরে না শুয়েছিলাম, এখন বলও তুমি কেমন আছ?

হ্যাঁ ভালো আছি, তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছ?

কী যে বলও? তোমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত হব কেন?

তবে শোন, কাল একবার দেখা করতে পারবে।

অবশ্যই কোথায় যাব? ক’টার সময়?

জিয়া পুকুর, বিকেল চারটায়।

শ্রাবণী বিনয়ের সুরে বলল, মাসুদ প্লিজ আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?

বলও।

আজকাল বিকেল হওয়ার আগেই শীতের দাপটে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। যদি বেলা এগারটায় তোমার সময় হয় তবে-

শ্রাবণীর কথা শেষ হওয়ামাত্র মাসুদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এত সঙ্কোচ বোধের কী আছে? ঠিক আছে তুমি বেলা এগারটায় জিয়া পুকুরে আসছ।

আচ্ছা বলে শ্রাবণী টেলিফোন রেখে তার ঘরে যাচ্ছিল। ফাল্গুনী শ্রাবণীর পিছনে পিছনে তার ঘরে গিয়ে বলল, শ্রাবণী তোর সঙ্গে কিছু কথা বলব।

বেশ তো আপা বলও।

ফাল্গুনী শ্রাবণীর বিছানার এক কোনে বসে বলল, তোর বয়স কম আবেগের বসে তুই মাসুদের সাথে যেভাবে মেলামেশা করছিস সেটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।

আপা আমি এবার মাস্টার্স পাস করেছি। আমি মোটেই ছোট নই। আমি যা করছি ভেবে চিন্তে করছি তুমি মাসুদের কথা বলছ ওর উপর আমার এক’শ পার্সেন্ট বিশ্বাস আছে, শ্রাবণী একরকম জোর গলায় বলল।

শ্রাবণী ছেলেদের উপর এত বিশ্বাস রাখা ঠিক না, তুই আমার দিকে দেখ, তোর মতো আমিও তৌফিকের উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম আমাদের কত বছরের সম্পর্ক, কতদিনের স্বপ্ন সে একদিনেই ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে ঘর বাঁধল। তুই বল, তৌফিক কি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে?

শ্রাবণী কোন কিছু না বলে নীরবে বসে রইল।

ফাল্গুনী আবার বলতে শুরু করল, বিয়ে হলো ফয়সালের সঙ্গে প্রথমে বেশ ভালোই কেটে গেল। তারপর সে আমার উপর স্বামী নামের প্রভুত্বের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করল। তাই কী হয় বল? সে আমার স্বামী আমি তার স্ত্রী, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের সমান সমান কিন্তু তা না সংসারে সে আমাকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইল। তুই বল এটা কি মেনে নেয়া যায়? সবাই স্বার্থপর  কেউ তাকায় লোলুপ দৃষ্টিতে সুন্দর দেহের দিকে কেউবা বিয়ে করে দাসী বানাতে চায়।

রাগে শ্রাবণীর সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। একবার বলতে ইচ্ছে করল, নিজে দোষ করে অযথা অন্যের উপর দোষ চাপাচ্ছ কেন আপা? কিন্তু মুখে কিছুই বলল না, আনমনা হয়ে বসে রইল।

ফাল্গুনী বলল, আমি বুঝতে পাচ্ছি আমার কথা তোর ভালো লাগছে না, একবার বলে দেখনা মাসুদকে তোকে বিয়ে করে কি না।

শ্রাবণী অগ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, আপা।

বলে দেখ না একবার তোকে বিয়ে করতে রাজি হয় না কি? একথা বলামাত্রই সে তোমার কাছ থেকে কেটে পড়বে, পুরুষ মানুষ চিনতে আমার আর বাকী নেই বলতে বলতে ফাল্গুনী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

দশ

ফাল্গুনী রুম থেকে বের হয়ে গেলে শ্রাবণী আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। শ্রাবণীর মনের মধ্যে তখন তৌফিকের ছবি ভেসে উঠল। তৌফিক আর ফাল্গুনী দু’জনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। তৌফিক ফাল্গুনীর চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র কিন্তু কুড়িগ্রাম থেকে রাজশাহী  প্রায়ই একসঙ্গে যাতায়াত করত। এমনভাবে তারা দু’জনে পরস্পরের খুব কাছাকাছি হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে তাদের ভালোবাসার গভীরতা বেড়ে যায়, ফাল্গুনী তৌফিকের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মাস্টার্স পাস করার পর তৌফিক একটি বেসরকারি কলেজে চাকরি পায়। তারপর ফাল্গুনী  তৌফিককে বিয়ে করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তৌফিক ভদ্র, মার্জিত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বিয়ের ব্যাপারে তৌফিক তার পছন্দের কথা তার বাবা-মাকে জানালেও নিজের সিদ্ধান্ত অপেক্ষা বাবা-মা’র পছন্দের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে  তৌফিকের বাবা-মা পুত্র বধূ হিসাবে ফাল্গুনীকে অপছন্দ করে এবং তাঁরা তৌফিকের জন্য অন্যত্র কনে দেখা শুরু করেন। অবশেষে তৌফিক তার বাবা-মা’র পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। তারপর ফাল্গুনীর বিয়ে হয় ফয়সালের সঙ্গে, ফয়সাল ছিল সৎ, নীতিমান এবং ধর্মভীরু সরকারি কর্মকর্তা। সে ফাল্গুনীকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কথা বলত। পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে হওয়ায় সরকারি চাকরির সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার চালানো তার জন্য ছিল কষ্টকর। ফাল্গুনী ছিল অহঙ্কারী, অমিতব্যয়ী এবং উচ্চাভিলাষী। ফলে ফাল্গুনীর কাঙ্খিত আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের কাছে ফয়সাল ছিল অসহায়। তাই তাদের দু’জনের মধ্যে দাম্পত্য কলহ প্রায় লেগেই থাকত। একবার ঈদে শপিং করতে গিয়ে ফাল্গুনী একটা দামি শাড়ি পছন্দ করেছিল, ফয়সাল ফিস ফিস করে তার সামর্থ্যের কথা জানালে ফাল্গুনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং দোকানদারের সামনেই ফয়সালকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আরেকদিন শ্রাবণী তার দুলাভাইর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল সেদিনও যেন কী কারণে দু’জনে ঝগড়া করছিল। কৌতূহলও বশত:  শ্রাবণী জানালার ফাঁক দিয়ে তাকাতেই দেখল ফাল্গুনী ফয়সালের গালে একটা চড় মারল। তারপর বলল, তুমি থাক তোমার মা-বোনদের নিয়ে আমি চললাম, বলেই ফাল্গুনী কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বের হলো। শ্রাবণীকে দেখে ফাল্গুনী বলেছিল, চল শ্রাবণী- এ বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়।

শ্রাবণীও চলে এসেছিল। তারপরও একদিন ফয়সাল ফাল্গুনীকে নিতে এসেছিল। সেদিন ফয়সালের উপর শ্রাবণীর খুব রাগ হয়েছিল। নিজের ভাই হলে শ্রাবণী বলত, বউয়ের হাতে চড় খাওয়ার পরও বউকে নিতে আসতে আপনার লজ্জা হলো না?

কিন্তু শ্রাবণী ফয়সালকে কিছুই বলল না, অনেক কষ্টে রাগ সামলে নিয়ে কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, দুলাভাই এতদিন পর আপাকে নিতে এসেছেন?

হ্যাঁ তাছাড়া আর উপায় কি? হাজার হলেও অর্ধাঙ্গিনী তো। তাই আর থাকতে পারলাম না, দেখ না প্লিজ তোমার আপাকে ম্যানেজ করতে পার কি না?

শ্রাবণীও তার আপাকে দুলাভাইর সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিল কিন্তু ফাল্গুনী শুধু শ্রাবণীর অনুরোধ নয় তার বাবা-মাসহ সবার অনুরোধ উপেক্ষা করেছিল। তারপর সমঝোতার মাধ্যমে উভয় পক্ষে ডিভোর্স হয়ে যায়। ফয়সালের  সঙ্গে ফাল্গুনীর ডিভোর্স হওয়ার অনেকদিন পর একদিন ফয়সালের সঙ্গে শ্রাবণীর দেখা হয়েছিল। শ্রাবণী প্রথম কথা বলতে গিয়ে থতমত খেয়ে বলেছিল, ফয়সাল ভাই।

ফয়সাল থমকে দাঁড়িয়েছিল,  শ্রাবণী ভালো আছ?

জি, আপনি?

ফয়সাল শুষ্ক হাসি হেসে বলল, এই কোন রকমে কেটে যাচ্ছে দিনকাল, তুমি এদিকে কোথায় গিয়েছিলে?

আমার এক বান্ধবীর বাসায় কিছুক্ষণ রিক্সার জন্য অপেক্ষা করলাম তারপর হাঁটতে শুরু করলাম।

ফয়সাল আর শ্রাবণী পাশাপাশি হাঁটছিল। একটা খালি রিক্সা পাশ দিয়ে চলে যেতেই ফয়সাল বলেছিল, শ্রাবণী তুমি না হয় রিক্সায় চড়ে চলে যাও।

না ফয়সাল ভাই অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হলো কথা বলতে ভালোই লাগছে, এই তো সামনের মোড়ে গিয়ে তো দু’জন দু’দিকে চলে যাব।

মোড়ে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, ফয়সাল স্নেহ মাখা কণ্ঠে বলেছিল, শ্রাবণী চা খাবে?

শ্রাবণী মাথা বাকিয়ে সায় দিয়েছিল। চা খেতে খেতে ফয়সাল বলেছিল, শ্রাবণী তোমরা সবাই আমাকে হয়ত ভুল বুঝছ?

ভুল বুঝব কেন ফয়সাল ভাই?

এই যে তোমাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক হলো আবার সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত টিকল না। তুমি বিশ্বাস করো  শ্রাবণী-

শ্রাবণী ফয়সালের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলেছিল, আমি সব জানি ফয়সাল ভাই, তবে আমার একটা বিষয় জানতে খুব ইচ্ছা করছে?

ফয়সাল কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, কী?

আচ্ছা ফয়সাল ভাই আপার সব অত্যাচার সহ্য করেও কেন আপনি আপাকে নিয়েই সংসার করতে চেয়েছিলেন?

শ্রাবণী তোমার আপার সঙ্গে যখন আমার দাম্পত্য কলহ চরমে তখন ডিভোর্স করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু উকিল নিষেধ করেছিল।

কেন?

উকিল সাহেব আমার খুব কাছের মানুষ, তিনি আমাকে যৌতুক এবং নারী নির্যাতন আইনের কঠোরতা সম্পর্কে বললেন তারপর বললেন, ফয়সাল মাথা ঠাণ্ডা রাখ, ম্যানেজ করে চলো। তুমি ডিভোর্স করার পর তোমার স্ত্রী যদি তোমার উপর মামলা করে যে সে যৌতুক দেয়নি বলে তুমি তাকে ডিভোর্স করেছ তবে নির্ঘাত হাজতে যেতে হবে। আমি ভাবলাম সরকারি চাকরি করি, ঘরের ভিতরে কেমন আছি তা তো আর কেউ জানে না। একটা মামলায় জড়ালে তো সবাই আমাকে খারাপ বলবে, চাকরিটাও চলে যাবে। তাই বলে ফয়সাল শ্রাবণীর দিকে তাকাল। শ্রাবণী চা শেষ করে মাথা নত করে বসে আছে, ফয়সাল থমকে গেল, ওহ্‌  শ্রাবণী আমি বোধ হয় তোমার সময় নষ্ট করছি।

শ্রাবণী চেয়ার থেকে উঠল, ফয়সাল ভাই আমি আসলে উঠবো।

হ্যাঁ শ্রাবণী চলো বের হই তারপর  শ্রাবণী বাসায় চলে এসেছিল।

শ্রাবণীর কিছুতেই ঘুম আসছে না। ফাল্গুনীর কথাগুলো বার বার করে তার মনের মধ্যে ভিড় করছে। ফাল্গুনী ভালোবেসে প্রতারিত হয়েছে, বিয়ে করে ঘর ভেঙ্গেছে তাই দোষগুণ বিচার না করেই ফাল্গুনী সব বিষয়ে পুরুষদের দোষারোপ করে, সমস্ত কিছুতেই পক্ষ অবলম্বন করে। কিন্তু মাসুদ কি প্রতারণা করতে পারে? তার চলাফেরা কথাবার্তায় কোনদিন শ্রাবণী কল্পনাও করেনি অথচ ফাল্গুনী আজ তার পবিত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাল। এমনি বিভিন্ন ধরনের কথা মনে পড়ায় বার বার করে শ্রাবণীর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল।

কয়েক বছর আগের কথা। একদিন শ্রাবণী তার বান্ধবী ইভাদের বাসায় গিয়েছিল, সেখানে মাসুদের সঙ্গে শ্রাবণীর প্রথম পরিচয় হয়। ইভার বড় ভাই মাসুদ তখন কারমাইকেল কলেজে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। লম্বা, ফর্সা, স্মার্ট ও আকর্ষণীয় ফিগারের, মাসুদের চোখে চোখ পড়তেই শ্রাবণী যেন অসম্ভব রকমের দুর্বল হয়ে গিয়েছিল তার প্রতি। শ্রাবণীর বুকে ঝড় উঠলেও মুখে কিছুই বলতে পারেনি কয়েক সেকেন্ড চোখে  চোখ রেখে একটা ঢোক গিলে বলেছিল, আমি ইভার কাছে এসেছি, ও কি বাসায় আছে?

জি আপনি বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি বলে মাসুদ শ্রাবণীকে সোফায় বসতে বলে ভিতরে চলে গিয়েছিল।

কিছুক্ষণ পর ইভা ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে বলেছিল, শ্রাবণী এসেছিস?

হ্যাঁ, তুই তো দেখি এখনো-

তুই তো জানিস আমার রেডি হতে বেশি সময় লাগে না, বড় জোর দশ মিনিট বলে ইভা  চলে যেতে উদ্যত হলে শ্রাবণী মৃদু কণ্ঠে ডাক দিয়েছিল, ইভা।

ইভা আবার সোফায় বসে বলেছিল, কিছু বলবি?

না, থাক।

থাক কি রে, বল।

না রে তুই যা রেডি হয়ে আয়।

ইভা নাছোড় বান্দা হয়ে বলেছিল, না তোকে বলতেই হবে।

শ্রাবণী থতমত খেয়ে বলেছিল, না বলছিলাম ঐ ছেলেটা কে?

ইভা জিজ্ঞেস করেছিল, কোন ছেলে?

আমাকে যে দরজা খুলে দিল।

ও তুই ভাইয়ার কথা বলছিস আরে ও তো আমার ভাই, মাসুদ, পরিচয় করে দিই বলে ইভা শ্রাবণীর কোন কথা না শুনেই ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাক দিয়েছিল।

পাশের রুম থেকে মাসুদ ড্রয়িং রুমে ঢুকে বলেছিল, কীরে? ডাকছিস কেন?

ভাইয়া বসও, তোমার সঙ্গে পরিচয় করে দিই বলে ইভা শ্রাবণী দিকে তাকিয়ে বলেছিল, শ্রাবণী আমার ভাই মাসুদ কারমাইকেল কলেজে অনার্স পড়ছে। তারপর মাসুদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ভাইয়া আমার বান্ধবী শ্রাবণী।

শ্রাবণী মাসুদকে সালাম দিয়েছিল।

ভাইয়া তুমি বসও শ্রাবণীর সঙ্গে গল্প করো, আমি আসছি বলে ইভা ভিতরে  গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত দু’জনে চুপ করে ছিল, তারপর মাসুদ প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করে বলেছিল, শ্রাবণী তোমার বাড়ি যেন কোথায়?

নাজিরা।

তোমরা কয় ভাই-বোন?

আমাদের কোন ভাই নেই। আমরা শুধু দু’বোন, বড় বোন ফাল্গুনী এন,জি,ও’র ডিরেক্টর আর আমি ছোট ইভার সঙ্গে পড়ছি। শ্রাবণী চোখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কবে এসেছেন?

গতকাল।

কয়েকদিন থাকবেন?

হ্যাঁ কলেজ বন্ধ কয়েকদিন তো আছি।

তবে আসুন না একবার আমাদের বাসায়।

মাসুদ মৃদু কণ্ঠে বলল, দেখা যাক।

শ্রাবণী এক রকম জোর দিয়ে বলল, দেখা যাক না, বলুন আসবেন।

ইভা ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল, কিরে আলাপ হলো?

মাসুদ সোফা থেকে উঠে বলল, ইভা তোরা কোথাও যাবি নাকি?

জি ভাইয়া বলে ইভা আগে রুম থেকে বের হলো। শ্রাবণী বের হবার সময় একবার মাসুদের দিকে তাকাতেই মাসুদের চোখে চোখ পড়ল।

শ্রাবণী মুচকি হেসে বলল, আসি।

এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে শ্রাবণী এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে।

 

এগার

শ্রাবণীর ঘুম ভাঙ্গল তার মায়ের ডাকে। ঘুম থেকে জেগে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ন’টা বাজে, শ্রাবণী সাধারণত সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগেই পেপার পড়ে। আজ আর তার পেপার পড়া হলো না। বিছানা ছেড়ে উঠেই তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে কাপড়-চোপড় পরে জিয়া পুকুরের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।

 

দ্রুতগতিতে রিক্সা চলছে, শ্রাবণী রিক্সার হুড়ের ফাঁক দিয়ে বার বার করে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। কিন্তু মাসুদের দেখা নেই। শ্রাবণী জিয়া পুকুরের পশ্চিম পাড়ে পৌঁছে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটা বেঞ্চে বসল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে এগারটা বাজে শ্রাবণী দুশ্চিন্তায় পড়ল, মাসুদ কখনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করে না দেরিও করে না। কয়েকবছরে একদিনও শ্রাবণী কখনো  মাসুদের আগে কোথাও পৌঁছাতে পারেনি। আজ হঠাৎ মাসুদের দেরি হতে দেখে শ্রাবণী কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ল। অবশেষে মাসুদ পৌঁছল তখন দুপুর বারটা বাজে। শ্রাবণী উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করল, দেরি কেন? কোন সমস্যা?

না, কোন সমস্যা নয়? তুমি কখন এসেছ?

আমি ঠিক সময়ে এসেছি, ভেবেছিলাম তুমি আগেই এসে বসে আছ. বরাবরই তো এমনই হয়, আজ শুধু  ব্যতিক্রম হলো।

কেন দেরি হলো শুনলে তুমি রাগ করবে।

তবু বলও, আমি রাগ করবো না।

আমি তো প্রায়ই তোমার জন্য অপেক্ষা করি আজ তোমাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম কারো জন্য অপেক্ষা করা কত কঠিন।

শ্রাবণী কিছু বলল না, নীরবে বসে রইল। শ্রাবণীর মনে পড়ল ফাল্গুনীর কথাগুলো সে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বসে রইল।

মাসুদ কয়েক মুহূর্ত শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, শ্রাবণী।

শ্রাবণী তবুও চুপ করে রইল। মাসুদ শ্রাবণীর চোখের সামনে হাত নেড়ে বলল, শ্রাবণী।

শ্রাবণী চমকে উঠল, মাসুদ।

শ্রাবণী কী ভাবছিলে?

না কিছু না।

ওহ্‌! তোমাকে একটা কথা বলাই হয়নি। ইভার ছেলে হয়েছে, খুব সুন্দর।

তারমানে তুমি মামা হয়েছ?

মাসুদ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলল, ইয়েস।

তুমি কি সারাজীবন মামাই থাকবে?

অবশ্যই। বোনের ছেলে হলে তো মামাই হবো।

কিন্তু জনাব আমি তা বলছি না।

তুমি কী বলছ?

আমি বলছি আমাদের বিয়ের কথা, মাসুদ তুমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছ?

মাসুদ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, শ্রাবণী হঠাৎ বিয়ের কথা কেন? কোন সমস্যা?

মাসুদ ইভা আমার বান্ধবী, ওর বিয়ে হলো, বাচ্চা হলো অথচ আমাদের এখনো বিয়েই হলো না। অনেকদিন তো হলো, তুমি লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা করছ, আমিও লেখাপড়া শেষ করে এখন বেকার বসে আছি, এখন তো বিয়ে না করার কোন কারণ নেই।

হ্যাঁ শ্রাবণী তুমি ঠিকই বলেছ, আমাদের এখন বিয়ের কথাই ভাবা উচিৎ, তো ঠিক আছে আমি তাহলে এ্যারেঞ্জ করি।

শ্রাবণী মাসুদের বাহুতে একটা হাত রেখে বলল, মাসুদ কোন সমস্যা নেই তো।

মাসুদ বলল, শ্রাবণী বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, বাবা-মা দু’জনে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানে। কাজেই বাবা না করবেন না, আমি ভয় পাই মাকে। মাকে যে কী করে কথাটা বলি?

শ্রাবণী নীরবে বসে রইল। মাসুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে।

কী বুদ্ধি? শ্রাবণী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

ইভার সহযোগিতায়।

কীভাবে?

মা ইভার হ্যাজবেন্ডকে খুব পছন্দ করে, সে যদি মাকে আমাদের বিয়ের প্রপোজাল দেয় তবে মা ম্যানেজ হতেও পারে।

শ্রাবণী উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আর যদি ম্যানেজ না হয়?

মাসুদ খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, তবে আর কী? কোর্ট ম্যারেজ করতে হবে।

শ্রাবণী বলল, শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বিয়ে করতে হবে?

সেটা হলো শেষ রাস্তা, আমার মনে হয় পালিয়ে বিয়ে করতে হবে না, ইভা আছে, ইভার হ্যাজবেন্ড আছে, বাবা আছে, মা ম্যানেজ না হয়ে যাবে কোথায়?

তবে তুমি ইভার সঙ্গে যোগাযোগ করো, মাকে ম্যানেজ করার ব্যবস্থা করো, তারপর-

মাসুদ ইভার কথার মাঝে বাধা দিয়ে শ্রাবণীর ওড়না ঘোমটা বানিয়ে শ্রাবণীর মাথায় দিয়ে বলল, তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে আর নয়, তোমাকে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলব, এবার একটু হাস।

শ্রাবণীর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।

 

বার

রফিক প্রথম যেদিন রৌমারী থেকে খালেক সাহেবের বাসায় আসে সেদিন সে খালেক সাহেবের আদুরে কন্যা কবিতার সঙ্গে কথা বলার সাহস করতে পারেনি। খালেক সাহেবের অফিস কক্ষের চেয়ার টেবিল সরিয়ে রেখে মেঝেতে বিছানা পেতে রফিক বছরের পর বছর কাটিয়েছে। কবিতা প্রথম যেদিন রফিকের সঙ্গে কথা বলে তখন কবিতার বয়স আর কতই বা হবে, বার কিংবা তের বছরের অধিক হবে না। রফিক কবিতার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দু’য়েকবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলেছে  আর আজ কবিতা বউ সেজে বাসর ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ভাবতে ভাবতে রফিকের চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

কবিতা আবেগে দু’চোখ বুজে রইল। রফিক কবিতার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, কবিতা আমাকে বিয়ে করে তুমি খুশি তো?

কবিতা রফিকের মুখে হাত দিয়ে বলল, আজকের এই শুভ দিনে এমন অশুভ কথা বলও না প্লিজ।

আমি তোমাকে বিয়ে করে খুশি বললে ভুল হবে, আমি তো আল্লাহর কাছে তোমাকেই চেয়ে নিয়েছি।

কবিতা আজ আমাদের বাসর রাত জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় রাত। এমন আনন্দময় রাতে আমি তোমাকে আমার জীবনের কিছু কষ্টের কথা বলতে চাই, যা না জানলে তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। আজ থেকে তোমার সাথে আমার জীবন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেল এবং আমরা একটি পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হলাম। কাজেই আজ থেকে আমাদের দু’জনের মধ্যে কোন গোপনীয়তা, সন্দেহ বা অবিশ্বাস থাকতে পারে না বলে রফিক একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল, কবিতা আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। আমার বিধবা মা আমাদের তিন ভাই-বোনকে বাবার রেখে যাওয়া সামান্য কয়েক বিঘা জমির আবাদ আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে লালন-পালন করেন। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মশায়ের অফিসে মহুরির কাজ করে আমি ভাই বোনদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজে সহযোগিতা করি। শফিক ভার্সিটিতে পড়ালেখা করছে আর ফিরোজা সবে মাত্র কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হয়েছে।

কবিতা রফিকের দিকে অগ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, ওসব আমি জানি।

জানো তবুও শোনার প্রয়োজন আছে বলে রফিক আবার বলতে শুরু করল, আমার ছোট ভাই-বোন দু’টিকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা এবং আমার বৃদ্ধা মায়ের সেবাযত্ন করা এখন আমার বাকী আছে। এ দু’টি কাজে আমি তোমার সহযোগিতা চাই বলে রফিক কবিতার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, বলও, তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে?

কবিতা দৃঢ়ভাবে বলল, অবশ্যই সহযোগিতা করবো।

রফিক আবার বলতে শুরু করল, কবিতা তুমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মতো, তুমি শৈশব থেকে বিলাসিতা আর আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়েছ, আমি বড় হয়েছি ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মধ্যে। শৈশবে আমার এমন দিন কেটেছে যে দিনে দু’বার পুরো পেট ভাত খেতে পাইনি। আমার জীবন বড় কষ্টের, সংগ্রামের, যে কষ্ট বা সংগ্রামের সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই। বলতে গেলে আমরা দু’জন দু’মেরু থেকে আজ এক সাথে মিশে গেলাম। কবিতা একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ আমাদের ঘর থেকে আকাশের চাঁদ দেখা যায়, একটু চুপ করে শোন শিয়ালের ডাক শুনতে পাবে। কোন এক সময় বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে শিয়াল ঢুকে যেতে পারে। তাই তোমার প্রতি আমার অনুরোধ কোনদিন তুমি আমার অতীত, আমার দারিদ্র নিয়ে আমাকে কটাক্ষ করবে না। আর এসব বাস্তবতা বোঝাবার জন্য আমি আমাদের শহরের ভাড়া বাসায় বাসর রাত যাপন না করে আমার বাবা-মার কুঁড়ে ঘরে জীবনের আনন্দময় রাত যাপনের ব্যবস্থা করেছি।

কবিতা রাগান্বিত স্বরে বলল, তোমার কি আর কিছু  বলার আছে?

তুমি কিছু বলছ? রফিক জিজ্ঞেস করল।

অবশ্যই।

বলও।

তুমি আজ বাসর রাতে তোমার জীবনের বাস্তবতা বোঝাবার জন্য যে ওকালতি কৌশল অবলম্বন করলে এটা তোমার ঠিক হয়নি। তোমাকেও কথা দিতে হবে তুমি আমার সঙ্গে সর্বদাই সহজ- সরল আচরণ করবে, কোনদিন কোন ওকালতি আচরণ করবে না।

রফিক কবিতার হাতে হাত রেখে বলল, কথা দিলাম।

 

তের

 

বিয়ের পর দু’জনের দিন যাচ্ছিল যেন আনন্দের সাগরে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে নৌকা ভাসিয়ে দেয়ার মতো। প্রতিদিন সকাল বেলা রফিক কোর্টে যাবার সময় কবিতা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত রফিক অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত। আবার রফিকের ফেরার সময় হওয়ার আগেই কবিতা জানালা খুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত। কোনদিন রফিকের ফিরতে দেরি হলে কবিতার মন দুশ্চিন্তায় ছটফট করত। রফিকও ঠিক একইভাবে সকাল বেলা কোর্টে যাবার সময় বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠত আর বারবার পিছনে চেয়ে চেয়ে দেখত। কোর্ট শেষ হওয়া মাত্র বাসায় ফিরে আসত।

কবিতা সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে রফিকের বাহুতে একটা হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, কী হলো? তোমার ঘুম ভেঙ্গেছে?

জি কিছু বলছ?

আজ তো শুক্রবার, চলোনা কোথাও বেড়িয়ে আসি।

কোথায় যাবে?

তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।

কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাবে নাকি কোন দর্শনীয় স্থানে?

কবিতা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, অবশ্যই কোন দর্শনীয় স্থানে।

তবে কোথায় যাবে?

তুমি কোথায় যাবে একটা একটা করে জায়গার নাম বলও, আমি যে কোন একটিতে ইয়েস বলব।

যাত্রাপুর?

কবিতা গম্ভীর স্বরে বলল, ইতিহাস বলও।

ব্রহ্মপুত্রের সাথে দুধকুমর নদীর সংযোগ স্থল, মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য।

তারপর বলও, কবিতা বলল।

দহগ্রাম। তিন বিঘা করিডোর, ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত, যেতে যেতে পথের ধারে তিস্তা ব্যারেজ-

তারপর বলও।

তবে চলো রংপুর, সেখান থেকে যাব মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দ গ্রামে। রংপুর শহরের অদূরে তাজহাট জমিদারবাড়ি, কারমাইকেল কলেজ, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্যাস, ব্যাস, আর না, এরই মধ্যে ঠিক হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে করছে তুমি যে সব স্থানের নাম বললে তার সবক’টি স্থান ঘুরে বেড়াতে।

রফিক বিছানায় উঠে বসে কবিতার চিবুকে চিমটি কেটে বলল, কিন্তু ম্যাডাম একদিনে তো আর সব জায়গায় যাওয়া যাবে না।

তবে চলো আজ রংপুরে।

বেশ তাড়াতাড়ি তৈরি হয় নাও, বলে রফিক বিছানা ছেড়ে উঠল।

সারাদিন মুক্ত পাখির উন্মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়াবার মতো দু’জনে পায়রাবন্দ, জমিদারবাড়ি, কারমাইকেল কলেজ ঘুরে বেড়িয়ে বিকেল বেলা দু’জনে চিড়িয়াখানায় ঢুকল। চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে দেখতে কবিতা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে রফিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, চলোনা কোথাও বসি।

কবিতার কথামতো রফিক অদূরে নরম ঘাসের উপর বসল। কবিতা ও রফিকের গা ঘেঁষে বসল। রফিক কবিতার চুলে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, কবিতা আজকের দিনটা কেমন কাটল?

কবিতা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল, অপূর্ব সারাদিন কেমন করে কেটে গেল টেরই পেলাম না। প্রতিদিন সকালবেলা তোমাকে কোর্টে বিদায় করে দিয়ে সারাদিন আমার খুব কষ্টে কাটে, একেকটি দিন যেন এক একটি বছর মনে হয়। আর আজ সারাদিনকে এক ঘণ্টা মনে হলো। তাছাড়া আজ তোমাকে আমি নতুনভাবে জানলাম।

তাই নাকি?

অবশ্যই এতদিনে আমার মনে হত শুধুমাত্র আইন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা তুমি এক নিষ্প্রাণ মানুষ। আজ থেকে জানলাম তোমার মধ্যে সুন্দর একটা মন আছে।

সুন্দর মন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ভয় ছিল চাকরি হারাবার, তাইতো সযত্নে হৃদয়ের কথা গোপন রেখেছিলাম। আর এখন আমাদের দু’জনের আত্মা এক হয়ে মিশে গেছে। আমাদের সম্পর্ক আইন আর সমাজের অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা হয়ে গেছে।

বাহ! উকিল সাহেব কি কবি হয়ে গেল নাকি?

অবশ্যই, কবি হয়ে আমি কবিতার জীবন ছন্দময় করে তুলব।

আমি কবিতা তুমি ছন্দ জুড়ে দিয়ে আমার মাধুর্য বাড়িয়ে দিলে। আমিও পাশে থেকে তোমার জীবন আনন্দে ভরে রাখব।

রফিক কবিতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, প্রোমিজ?

কবিতা রফিকের হাতে হাত রেখে বলল, প্রোমিজ।

 

চৌদ্দ

বিয়ের পর রফিক আইন পেশা শুরু করেছে স্বতন্ত্রভাবে বাসার বাইরের একটি রুম নির্ধারিত করে দিয়েছে গ্রাম থেকে আসা মক্কেলদের রাত্রি যাপনের জন্য। এতদিন যে সব দরিদ্র মক্কেল রেলস্টেশন বা কোন আত্মীয় স্বজনদের গলগ্রহ হয়ে রাত্রি যাপন করত রফিকের বাসায় রাত্রি যাপনের সুবিধা পেয়ে তারা আনন্দে গদ গদ হয়ে উঠল। তাছাড়া রফিক কোন মক্কেলের কাছ থেকে টাকা দাবি করে না বা কৌশলে অধিক অর্থ আদায়ের চেষ্টাও করে না। মামলায় অধিক সফলতার জন্য অল্প দিনের মধ্যে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল এবং ক্রমশ তার আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হতে শুরু করল। কিন্তু রফিক খেয়াল করেছে কবিতা তার উন্নতিতে সন্তুষ্ট নয়। সে চায় দ্রুত বিশাল সম্পত্তি আর গর্ব করার মতো আভিজাত্য। বিয়ের কয়েকদিন পরেই রফিক তার সামর্থ্যের মধ্যে সংসারের নিত্য ব্যবহার্য জিনিষ-পত্র কিনেছে। সে সময় রফিক একটা সাদা কালো টিভি কিনেছে প্রথম দিকে কবিতা এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু বিয়ের প্রায় ছয় মাস পর একদিন রাতে রফিক একটা মামলার আইনের বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিল এমন সময় কবিতা তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রফিকের চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?

রফিক মৃদু হেসে বলল, কোন আবদার আছে মনে হয়?

কবিতা মুচকি হেসে বলল, তোমাকে নিয়ে এই একটা সমস্যা, কিছু বলবার আগেই বুঝে ফেল।

বুঝেছি কোন আবদার আছে, কিন্তু জিনিষটা কী?

কালার টি.ভি।

কালার টি.ভি নিবে?

জি।

রফিক কবিতার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, কিন্তু ম্যাডাম আমি একজন নতুন আইনজীবী, বলতে পার শিক্ষানবিশ আর একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর পক্ষে এত তাড়াতাড়ি কালার টি.ভি কেনা কি সম্ভব? হ্যাঁ আমি কালার টি.ভি কিনব তাতে কোন সন্দেহ নেই তবে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

কবিতা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি তো সব সময় কোর্ট কাচারি নিয়ে ব্যস্ত থাক তাই সব কথা তোমাকে বলা হয় না, তুমি কি একটু বইটা বন্ধ করবে?

রফিক সঙ্গে সঙ্গে বইটা বন্ধ করে রসিকতার সুরে বলল, যথা আজ্ঞা ম্যাডাম।

মা তো এখানে থাকতে চাচ্ছেন না সে কথা কি তোমাকে বলেছে?

না, আমাকে তো কিছু বলেনি, আর থাকতে চাচ্ছেন না বা কেন?

গ্রামের মানুষ খোলামেলা থাকার অভ্যাস আর এখানে এসে তো পড়েছেন একেবারে বন্দি ঘরের মধ্যে, তাই হয়ত বা গ্রামে ফিরে যেতে চাচ্ছেন, বলে কবিতা জোরে বলল, ফিরোজা টেবিলে ভাত রেডি করো আমরা আসছি।

তারপর টেবিলে এসে দু’জনে মুখোমুখি চেয়ারে বসল। মরিয়ম পাশাপাশি একটা চেয়ারে বসেছে আর ফিরোজা খাবার পরিবেশন করছে। রফিক একবার তার মায়ের মুখে দিকে তাকাল। কয়েকদিনে মায়ের চেহারায় উদ্বিগ্নের ছাপ পড়েছে। রফিক তার মাকে ভালোভাবে চেনে সাধারণত তার মা গম্ভীরভাবে থাকে না। সব সময় তার চোখে-মুখে হাসি লেগেই থাকত অথচ এ’কদিনে মায়ের মুখ চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। রফিক একবার ফিরোজার মুখের দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে যে দারিদ্রের ছাপ ছিল তা আর নেই। চেহারায় লাবণ্য ফুটে উঠেছে কিন্তু চাঞ্চল্য নেই, স্থির-শান্ত, চোখে-মুখে যেন অব্যক্ত দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। রফিক কোন রকমে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল।

ফিরোজা আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রফিকের মন দুশ্চিন্তায় ভরে গেছে, চোখের সম্মুখে সব সময় তার মায়ের হাসিমাখা মুখখানা ভেসে উঠছে। রফিক একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে  কোন কারণ ছাড়াই তার অতি পরিচিত মা এমন রহস্যাবৃত হতে পারে না।

কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন বিকেল বেলা রফিক কোর্ট থেকে ফিরে কলিং বেলে টিপ  দিতেই তার  মা দরজা খুলে দিল।

রফিক মাকে জিজ্ঞেস করল, মা তুমি দরজা খুলতে এসেছ? কবিতা- ফিরোজা ওরা নেই?

বউমা ফিরোজাকে নিয়ে তোর শ্বশুর বাড়ি গেছে বাবা।

রফিক মাকে একা পেয়ে ড্রয়িং রুমে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মা তুমি নাকি গ্রামের বাড়ি যেতে চাচ্ছ?

মরিয়মের দু’চোখ ছলছল করে উঠল। সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, জি বাবা।

মায়ের ছলছল চোখের দিতে তাকাতেই রফিকের দু’চোখ জলে সিক্ত হলো।

সে বিনীত কণ্ঠে বলল, মা তোমার কী হয়েছে? তুমি হঠাৎ এমন করছ কেন? কী হয়েছে আমাকে বলও? আমার আচরণে কি তুমি কষ্ট পেয়েছ?

তোমার কোন দোষ নেই বাবা আসলে আমি ভুল করেছি, গ্রাম ছেড়ে এখানে আসা আমার ভুল হয়েছে। গ্রামে আমার জন্ম, গ্রামে তোর বাবার সঙ্গে আমার জীবনের সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাই আমার জীবনের বাকী দিনগুলো আমি গ্রামেই থাকতে চাই।

মা তোমার বউমা কি কিছু বলেছে?

তুই শুধু শুধু বউমার দোষ দিচ্ছিস কেন?

বউমা লক্ষ্মী মেয়ে তার যেন কোন অযত্ন না হয়, কোনদিন যদি শুনি বউমার প্রতি তুই বিন্দুমাত্র অবহেলা করেছিস তবে আমি খুব কষ্ট পাব, আশা করি আমার কথা তোর মনে থাকবে।

 

পনের

খালেক সাহেবের অফিসে মহুরির চাকরি শুরু করার পর থেকে শফিক এবং ফিরোজার লেখাপড়ার খরচ রফিকই বহন করত। রফিক কবিতাসহ শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাসের পর থেকে তার মা রফিকের বাসায় থাকে এবং ফিরোজাও রফিকের বাসায় থেকে কুড়িগ্রাম মহিলা কলেজে লেখাপড়া করে। শফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এল.এল.বি’তে অনার্স পড়ছে। প্রতি মাসে তার লেখাপড়ার খরচের টাকা মাসের এক তারিখে শফিকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। রফিকের বাসায় তার মা-বোনকে নিয়ে আসার প্রথম দিকে কবিতা সহজভাবে নিলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই তার বাসায় শাশুড়ি এবং ননদের দীর্ঘদিন অবস্থানকে সে সহজভাবে মেনে নিতে পারল না, তার ওপর শফিকের লেখাপড়ার খরচের টাকা রফিক দেওয়াতে সে মাঝে মাঝে বিভিন্নভাবে রফিককে কটাক্ষ করত কিংবা ফিরোজাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করত। ফিরোজা খুব লাজুক আর বুদ্ধিমতী তাই সে তার ভাবীর এসব আচরণ কোনদিন তার ভাইকে বলত না।

শফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে ছোটখাটো ছুটিতে কুড়িগ্রাম আসে না। দীর্ঘ মেয়াদি ছুটিতে আগে গ্রামের বাড়িতে আসত কিন্তু তার মা এবং ফিরোজা শহরে চলে আসাতে গ্রামে যাবার পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেছে। ইদানীং কোন দীর্ঘ মেয়াদি ছুটিতে দু’য়েকদিনের জন্য কুড়িগ্রাম আসে এবং মায়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যায়। তেমনি এক ছুটিতে শফিক কুড়িগ্রাম এলো। রফিক তখনো কোর্ট থেকে ফিরেনি মরিয়ম শফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠল, শুকিয়ে গেছিস কেন বাবা? মুখটা শুকনো কেন?

মা আমি অনেক দূর থেকে এলাম। তো তাই হয়ত এমন লাগছে, আসলে আমি ভালো আছি।

দুপুরে ভাত খেয়েছিস?

জি মা।

তাহলে ফিরোজাকে চা দিতে বলি?

বলও মা, ভাবী কোথায়? বলে শফিক  ভাবী ভাবী বলে কয়েকবার ডাক দিতেই কবিতা সামনে এসে দাঁড়াল, কী রে হঠাৎ চলে এলি কেন?

কেন আবার এই তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করল তাই চলে এলাম।

আমাদের দেখতে ইচ্ছা করল নাকি টাকা লাগবে?

কবিতার কথায় শফিক প্রচণ্ড আঘাত পেল মুহূর্তেই তার মুখ কাল মেঘে ঢেকে গেল। সে একটা ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ টাকাও লাগবে।

তোর ভাই এ মাসে টাকা পাঠায় নি?

হ্যাঁ পাঠিয়েছিল।

শেষ হয়ে গেছে নাকি?

শফিক কবিতার এমন আচরণের কোন অর্থ বুঝতে পারল না, সে মাথা নত করে বসে রইল।

এমনিতেই বাসায় মানুষ গিজগিজ করছে, মা, ভাই-বোন আসা শেষ হলো কোনদিন না জানি ধীরে ধীরে পাড়া গাঁয়ের মানুষও আসা শুরু করবে। এখানে পেয়েছে একটা ব্যাংক যার যখন টাকার প্রয়োজন দিতে হবে। আরও যে ক’বছর পড়ালেখা চলবে আর এমনভাবে মাসে মাসে টাকা দিতে হবে, সব টাকা ওদের পিছনে উড়িয়ে দিতে হবে আমাদের বুঝি ভবিষ্যৎ নেই। বলতে বলতে কবিতা তার রুমে চলে গেল।

শফিক সবকিছু শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে রইল। মা এবং ফিরোজার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল। বিকেলে রফিক কোর্ট থেকে ফিরে শফিককে দেখে চমকে উঠল, কি রে ভালো আছিস।

জি ভাইয়া, তুমি?

হ্যাঁ ভালো আছি, তোর ভার্সিটি বন্ধ নাকি?

জি ভাইয়া।

ভালোই করেছিস, তুই বস আমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হই তারপর কথা বলব।

রাতে রফিকের চেম্বারে বসে দু’ভাইর মাঝে অনেক কথা হলো। শফিক তার সঙ্গে কবিতার আচরণের কথা রফিককে জানাল। সবকিছু শুনে রফিক বলল, হ্যাঁ কবিতা আসলে আগের মতো নেই, আমার মনে হয় আমার অনুপস্থিতিতে সে মাকে কিংবা ফিরোজাকেও কিছু বলে কিন্তু মা আমার মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে আমাকে জানায় না। ফিরোজাও খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে সেও কিছু বলে না।

শফিক জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া তোমার কি টাকা-পয়সার খুব টানাপোড়ন যাচ্ছে?

কেন বল তো।

বলছিলাম যদি সমস্যা হয় তবে মা আর ফিরোজাকে না হয় গ্রামে পাঠিয়ে দাও।

কিন্তু আমার তো টাকা-পয়সার সমস্যা নেই আসলে তোর ভাবী তোকে কী বলেছে বলতো?

ভাবী ছোট পরিবারে মানুষ হয়েছে, তাই বাসায় মানুষের আনাগোনা সে পছন্দ করে না আর টাকা পয়সার ব্যাপার তো আছেই সব টাকা যদি আমাদের জন্য খরচ করো তবে তোমাদের ভবিষ্যৎ কী?

রফিক সবকিছু বুঝতে পারল কবিতাই যে শফিককে এসব কথা বলেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই তাই সে কোন কিছু না বলে মাথা নত করে বসে রইল।

 

ষোল

 

সেদিন বিকেলবেলা রফিক টি.ভি দেখছিল এমন সময় কলিং বেল বাজার শব্দ শুনে কবিতা নিজে দরজা খুলে দিতে দিতে সজোরে চিৎকার করে বলল, শ্রাবণী তুই, এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল। আপা আসুন বলে কবিতা সবাইকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করে রফিককে বলল, এই ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসও তো দেখ কে এসেছে।

রফিক ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই শ্রাবণী দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

রফিক বলল, শ্রাবণী, এতদিন পর, বিয়ের পর তোমাকে এই প্রথম দেখলাম, তোমার সাহেবকেও নিয়ে আসলে পারতে তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি-

আমি শ্রাবণীর আপা, ফাল্গুনী।

রফিক ফাল্গুনীর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখল। ফাল্গুনী পাতলা ছিলছিলে একটা জর্জেট শাড়ি পরেছে যে শাড়ির উপর দিয়ে শরীরের অংশ বিশেষ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সঙ্কীর্ণ ব্লাউজ ইউ আকৃতির গলার ফাঁক দিয়ে বুকের উপরিভাগ বেরিয়ে পড়েছে। তার সমস্ত শরীর আর পোশাক পরিচ্ছদে উ-শৃঙ্খলতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রফিক ফাল্গুনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, আপনি কী করেন?

শ্রাবণী উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল, দুলাভাই আপার আর একটা পরিচয় বুঝি আপনি জানেন না?

না তো, কী পরিচয়?

আঁচল এন. জি. ও’র নাম শুনেছেন?

জি শুনেছি, রফিকের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আপা হলো আঁচলের ডিরেক্টর।

রফিক স্মিত হেসে বলল, বেশ তো, তো আপনার এন. জি. ও’তে কী কী প্রোগ্রাম আছে?

এডুকেশন, মাইক্রো ক্রেডিট, ওম্যান ডেভলাপমেন্ট আর জেন্ডার এডুকেশন সেই সঙ্গে লিগ্যাল এইড।

বাঃ! আপনি তো বেশ সেবা মূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন।

হ্যাঁ সেজন্যই তো আপনার কাছে এলাম। আমার এন. জি. ও’তে আপনার সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

এমন সময়  কবিতা চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে টি টেবিলে চায়ের ট্রে রাখতেই ফাল্গুনী বলল, কবিতা তুমি একটু বসও তো, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

কবিতা সোফায় বসে বলল, বলুন আপা।

কবিতা তুমি তো সোশ্যাল সায়েন্স-এ মাস্টার্স করেছ, তাই না?

জি আপা।

আমার এন. জি.ও’তে ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রামের জন্য একজন কো-অর্ডিনেটর প্রয়োজন, আমি চাচ্ছিলাম তুমি আমার এন.জি .ও’তে সময় দিতে পার।

কবিতার চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল। দু’চোখ ছলছল করে বলল, কিন্তু আমি কি পারব?

পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। তুমি আগামী মাসের এক তারিখেই জয়েন করো।

অবশ্যই জয়েন করবো বলে কবিতা রফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলও?

রফিকের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল সে কোন কথা না বলে উঠে গেল।

রফিকের চলে যাওয়া দেখে শ্রাবণী বলল, কীরে কবিতা তোর সাহেব বুঝি তোকে চাকরি করতে দেবে না, তাই তো রাগ করে চলে গেল।

ফাল্গুনী মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, পুরুষ জাতটাই এমন, মেয়েরা নিজেদের মতো করে কিছু করতে গেলে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চাইলেই যত বাধা। তারা চায় মেয়েরা সব সময় তাদের অনুগত থেকে প্রভুর মতো তাদের উপাসনা করুক। যুগ যুগ ধরে এমনভাবে তারা মেয়েদের বঞ্চিত করেছে। ভেবেছিলাম তোমার সাহেব শিক্ষিত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা মানসিকতার তাইতো তোমার কাছে এসেছিলাম নইলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে কি কর্মীর অভাব? বলে ফাল্গুনী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল শ্রাবণী।

কবিতা বিনীতভাবে বলল, আপা আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি ওকে ম্যানেজ করবো।

দেখ যদি পার তবে এসো, বলে ফাল্গুনী আর শ্রাবণী চলে গেলে কবিতা ঝড়ের বেগে রুমে প্রবেশ করে রফিককে বলল, তুমি ওদের সামনে আমাকে অপমান করলে কেন?

আমি তোমাকে অপমান করেছি, না কি তুমি আমার সম্মতির কথা না জেনে তাদেরকে সম্মতি দিয়ে আমাকে অপমান করেছ?

কেন আমি চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াই তা কি তুমি চাও না? মানুষ হিসাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আমার নেই? কবিতা উত্তেজিত স্বরে বলল।

রফিক কবিতাকে নিজের কাছে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কবিতা তোমার চাকরির কী দরকার? একজন আইনজীবী হিসাবে আমি যা রোজগার করি তাতে আমাদের তো মন্দ চলছে না। আমাদের আরও টাকার কী প্রয়োজন? মনে রাখবে আমাদের যা আছে তার চেয়ে অধিক টাকা হয়তো আমাদের সংসারের সুখ কেড়ে নিবে।

কবিতা সহস্রগুণ জ্বলে উঠে বলল, আসলে আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল হই, নিজের পায়ে দাঁড়াই এটা তুমি চাও না, তাই তো মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে আমার প্রতিভা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি রাখতে চাচ্ছ।

কবিতার চোখে মুখে জিদ আর উগ্রমূর্তি ধারণ করতে দেখে রফিক আর কোন কথা না বলে চুপ করে রইল।

কবিতা রফিককে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলতে শুরু করল, আমি সোশ্যাল সায়েন্স-এ মাস্টার্স করেছি, আমার শিক্ষা দিয়ে আমি যেমন দেশ সেবা করতে পারি, সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারি তেমনি আমি চাকরি করে সংসারে আরও সচ্ছলতাও আনতে পারি। তুমিও একজন শিক্ষিত মানুষ একবার চিন্তা করে দেখ দেশের অর্ধেক নারী এই অর্ধেক নারী যদি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে তবে দেশের উন্নতি হবে কীভাবে? আজকাল মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি কাজ করতে শিখেছে তোমার মতো যারা মুক্ত মনের মানুষ তাদের উচিৎ নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ দেয়া এবং উৎসাহিত করা।

রফিক মনে মনে বলল, তাহলে তুমি ফাল্গুনীকে আগেই কথা দিয়েছ, আমার কাছে ফাল্গুনীর আসাটা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা।

 

সতের

 

নিত্যদিনের মতো রফিক কোর্ট থেকে বাসায় ফিরে কলিং বেল এ টিপ দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সাধারণত এমনটি কোনদিন হয় না।  কবিতা রফিকের কলিং বেল-এ টিপ দেওয়ার ধরণ বুঝে তাই তার কলিং বেল এর শব্দ শুনে দরজা খুলে দেয় কিন্তু আজ হঠাৎ দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় সে কিছুটা বিরক্ত বোধ করল, কয়েক মিনিট পর ফিরোজা দরজা খুলে দিতেই রফিক জিজ্ঞেস করল, কিরে তোর ভাবী নেই?

আছে, ফিরোজার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই টি.ভি স্ট্যান্ডে কালার টি.ভি’র দিকে রফিকের চোখ পড়ল। তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। নিজেকে কবিতার কাছে অসহায় ও অযোগ্য মনে হলো। রফিকের মা আর কবিতা পাশাপাশি বসে টি.ভি দেখছিল। রফিক তার মাকে বলল, মা তুমি পাশের রুমে যাও তো।

মরিয়ম নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে রফিক অগ্নি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে কবিতাকে বলল, কবিতা এই টি.ভি এলো কোথা থেকে?

রফিকের চোখের দিকে তাকাতেই কবিতার বুক কেঁপে উঠল। সে রফিকের ভদ্র, শান্ত ব্যবহার দেখেছে, কোনদিন রাগ দেখেনি। তার ধারণা ছিল কালার টি.ভি দেখে মনে হয় রফিক তার উপর খুশি হবে। কিন্তু বাস্তবে রফিকের চোখ দেখে তার ধারণা মিথ্যে হলো। কবিতা রফিকের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও পরে সব বলব।

না আগে আমাকে জানতে হবে কালার টি. ভি এলো কোথা থেকে? বলে রফিক ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল।

আমি আর মা কিনে এনেছি, কবিতা বলল।

টাকা কোথায় পেলে?

বাবা দিয়েছে।

রফিক গম্ভীর স্বরে বলল, বাবা দিয়েছেন,নাকি তুমি চেয়েছিলে?

কবিতা রফিকের হাত দু’টো ধরে বলল, প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও এখনি বাবা-মা আসবে। তুমি তো জানো বাবা কখনো সময়ের হেরফের করে না। প্লিজ যাও, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।

রফিক সোফা থেকে উঠে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে বসতেই খালেক সাহেব ও তাঁর স্ত্রী ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন।

রফিক সালাম জানিয়ে বিনীতভাবে সোফায় বসার জন্য অনুরোধ করল। খালেক সাহেব সোফায় বসে রফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে বাবা?

রফিক ম্লান হেসে বলল, না তো আব্বা।

না বাবা তুমি কিছু লুকাচ্ছ বলে তিনি কবিতাকে সজোরে ডেকে বললেন, কী রে মা তুই কোথায়?

কবিতা এসে তার মায়ের পাশে দাঁড়াতেই তার মা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মা? তোর মুখটা শুকনা কেন?

কিছু হয়নি মা। তুমি বসতো আমি নাস্তা নিয়ে আসি, বলে কবিতা চলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ সবাই নিস্তব্ধ। খালেক সাহেব প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, রফিক বললে না তো বাবা?

আব্বা আপনি যদি অনুমতি দেন তো একটা কথা বলি?

খালেক সাহেব অভয় দিয়ে বললেন, বলও।

রফিক দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আব্বা কবিতা কি আপনার কাছে কালার টি.ভি চেয়েছিল?

খালেক সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ও ছেলে মানুষ তুমি ওর কথা বাদ দাও।

রফিক গম্ভীর স্বরে বলল, বিষয়টি আমি সহজভাবে মানতে পারছি না আব্বা আমি পেশায় আইনজীবী আর আমার বাসায়-

এমনসময় কবিতা নিজে নাস্তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে টি টেবিলে নাস্তা রেখে সোফায় বসল।

খালেক সাহেব কবিতার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে আমার কাছে একটাই আবদার করেছে, আর আমি পূরণ করবো না তা কি হয়? এটাকে তুমি যৌতুক মনে করো না বাবা। তুমি বা কবিতা দুজনের কেউ-ই আমার উপর বিন্দুমাত্র চাপ প্রয়োগ করনি, আমি খুশি হয়ে দিয়েছি।

না আব্বা এটা ঠিক নয়, আমি মনে করি খুশি হয়েও যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া কোনটাই ঠিক নয়। এই খুশি হয়ে যৌতুক দেওয়াটাও যৌতুক প্রথাকে উৎসাহিত করছে, রফিক বলল।

খালেক সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বাবা তুমি যদি একান্তই আমার দেওয়া কালার টি.ভি না নিতে চাও তবে আমি খুব কষ্ট পাব এবং টি. ভি ফেরত নিয়ে যাব। আশা করি তুমি আমাকে কষ্ট দিবে না।

রফিক বিনয়ের সুরে বলল, আব্বা আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি তবে আপনার প্রতি আমার অনুরোধ আপনি কবিতার এমন কোন অনুরোধ রক্ষা করবেন না যাতে আমি কষ্ট পাই।

কবিতা মুখ বিকৃত করে বলল, বেশ ভালো তবে যত তাড়াতাড়ি পার বাসার সব জিনিস কিনে ফেল।

খালেক সাহেব সহাস্যে বললেন, সব হবে মা সব হবে। রফিকের মতো ভালো একটা ছেলে তুই পেয়েছিস, আমি দোয়া করছি তুই সব পাবি। আর হ্যাঁরে কবিতা তোর শাশুড়িকে তো দেখছিনা, চলে গেছে নাকি?

আছে বাবা ভিতরে, মার সঙ্গে কথা বলছে, কবিতা বলল।

যা ডেকে নিয়ে আয়।

কবিতা ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেল এবং কয়েক মিনিট পরে তার শাশুড়িসহ ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল।

মরিয়ম ড্রয়িং রুমে এসে সালাম দিয়ে সোফায় বসল।

খালেক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বিয়াইন সাহেব কেমন আছেন?

মরিয়ম উত্তর দিল, জি ভালো।

এতদিন হলো একদিনও তো বাসায় এলেন না, বলে তিনি কবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, কবিতা একদিন বিয়াইন সাহেবকে নিয়ে আসিস আর তাঁর স্বাস্থ্যর দিকে খেয়াল রাখিস।

কবিতা মৃদু কণ্ঠে বলল, জি আব্বা।

 

আঠার

 

গভীর রাত, নিস্তব্ধ শহর। কোথাও মানুষের সাড়া নেই। মাঝে মাঝে দু’য়েকটি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ কানে ভেসে আসছে। আজ হঠাৎ করেই মাঝরাতে রফিকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে কবিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রফিক আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পর ধীরে ধীরে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল। রফিক গভীর ঘুমের মধ্যে আবার ডুবে গেল। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার বাবার প্রতিচ্ছবি, ছবি নয় যেন সশরীরে বাবা তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সস্নেহে ডাক দিল, বাবা রফিক।

জি আব্বা।

বাবা তুই ভালো আছিস?

জি আব্বা, রফিক উত্তর দিল।

তোর মা ভালো আছে?

জি, মা তো ভালো আছে।

হঠাৎ করেই বাবা রেগে গেল, না ভালো নেই।

রফিক চমকে উঠল, আব্বা।

তোর মা ভালো নেই, তার মনে অনেক কষ্ট। তুই লেখা পড়া শিখে বড় হওয়াতে তোর মার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিল, কিন্তু গত কয়েকদিনে তোর ব্যবহারে তার বুকটা হাহাকার করছে। গ্রামে খেয়ে না খেয়ে তোর মার মুখে যেমন সব সময় হাসি ভরে থাকত এ’কদিন শহরে থেকে কি সে হাসি দেখেছিস?

রফিক অস্ফুট স্বরে বলল, আব্বা।

হ্যাঁ তুই যখন গাঁয়ের ছেলে ছিলি, যখন মুখে দু’মুঠো ভাত জোটেনি তখন তোর মা তোর মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করত আর এখন তোর বাড়িতে ঝি এর কাজ করছে। তোর ছোট বোনটিকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য শহরের কলেজে ভর্তি করেছিস। আসলে তোর সংসারের কাজ কর্ম সামলানোর পর সে কি কোনদিন বই খুলে দেখতে পারে? লেখাপড়া শিখে কয়েকটা সার্টিফিকেট অর্জন করেছিস মানুষ হতে পারিসনি। দোয়া করি বাবা, আল্লাহ তোকে বুঝবার জ্ঞান দিক। খোদা হাফেজ বলে তার আব্বা রফিককে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল।

রফিক আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করতে করতে বিছানায় উঠে বসল। তার সাথে সাথে কবিতাও বিছানায় উঠে বসে বলল, কী হয়েছে তোমার? স্বপ্ন দেখেছ?

রফিক অস্ফুট স্বরে বলল, জি তারপর একটু থেমে বলল, কবিতা আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো।

কবিতা এক গ্লাস  পানি এনে দিলে রফিক পানি পান করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

নিত্যদিনের মতো টেবিলে শুধু কবিতা আর তার জন্য সাজানো নাস্তার প্লেট দেখে রফিক কবিতাকে বলল, কবিতা মা আর ফিরোজাকে ডাক দাও।

কবিতার মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেল। সে মৃদু কণ্ঠে বলল, ওরা পরে খাবে?

রফিক অগ্নিবিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, পরে খাবে কেন?

কবিতা ভিতরে গিয়ে তার শাশুড়ি আর ফিরোজাকে ডাক দিতেই ডাইনিং রুমে এসে মরিয়ম জিজ্ঞেস করল, আমাকে ডেকেছিস বাবা?

হ্যাঁ মা বসও, নাস্তা খাও।

মরিয়ম এদিক-সেদিক একবার তাকিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।

রফিক ফিরোজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কী রে তুই আবার দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? বস।

ফিরোজা সভয়ে চেয়ারে বসলে রফিক গম্ভীরস্বরে বলল, কবিতা মাকে নাস্তা দাও, ফিরোজাকে নাস্তা দাও।

কবিতা কোন কথা না বলে গম্ভীর মুখে প্লেটে নাস্তা দিতে লাগল। কয়েক মিনিট পর নাস্তা শেষে রফিক ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল, ফিরোজা লেখাপড়া কেমন চলছে?

ফিরোজা মৃদু কণ্ঠে বলল, ভালো না ভাইয়া।

রফিক অবাক বিস্ময়ে কপালে চোখ তুলে বলল, সে কীরে? ভালো নয় কেন?

আমার তো সব বই কেনা হয়নি ভাইয়া।

আমি দেখি যদি রৌমারী থেকে বাসার কাজের জন্য কোন কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করতে পারি তবে কবিতার কাজে হেল্প হবে বলে রফিক মুচকি হেসে বলল, তুমি কী বলও কবিতা?

রফিকের কথায় কবিতা আংশিক মুখ বিকৃত করল মুখে কিছুই বলল না। রফিক কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর ফিরোজাকে বলল, তুই আজ বিকেলে রেডি থাকিস আমি বিকেলে কোর্ট থেকে ফিরে তোকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব আর ভালো টিচারের কাছে কোচিং ঠিক করিস। আগামী মাসের এক তারিখ থেকে কোচিং এ যাস। বলে রফিক মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা তোমার স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখো। আমি আজকের মতো আসি, বলে রফিক বের হয়ে গেল।

কবিতা রফিকের পিছনে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, কিরে ভাইকে তো ভালোই লাগিয়েছিস।

ফিরোজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি তো কিছু বলিনি ভাবী?

কবিতা ক্রোধে জ্বলে উঠে বলল, তুই বলিস নি তাহলে মা বলেছে। কেউ কিছু না বললে তোর ভাইয়ের হঠাৎ করে মা বোনের জন্য দরদ উতলে পড়বে কেন?

মরিয়ম কবিতার কথার দৃঢ় প্রতিবাদ করে বলল, আমরা কেউ কিছু বলিনি বউমা। তুমি অযথা আমাদের ভুল বুঝছ। বলে মরিয়ম ও ফিরোজ ঘরে চলে গেল।

 

উনিশ

 

আর. কে রোডের পাশে একটি বিশালাকার একতলা ভবনে আঁচল-এর অফিস। গেটে একটি আকর্ষণীয় সাইন বোর্ডে এক নারীর ছবি অংকিত তার পাশে লেখা আঁচল ব্রাকেটের মধ্যে লেখা একটি বে-সরকারি নারী উন্নয়ন সংস্থা। কবিতা গেটে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল। প্রথমে রিসিপশনিস্টের রুম। কবিতা রিসিপশনিস্ট কে জিজ্ঞেস করে তার কথা মতো ফাল্গুনীর রুমে ঢুকল। ফাল্গুনী কবিতাকে দেখে মৃদু হেসে বলল, এসেছ তাহলে? আমি আগেই বুঝেছিলাম তুমি আসবে। তারপর ইন্টারকমে রিসিপশনিস্টকে আসতে বলল, কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে রিসিপশনিস্ট রুমে প্রবেশ করলে ফাল্গুনী তাকে বলল, কবিতার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এবং  জয়েনিং লেটার তৈরি করো, আর আমাদের জন্য দু’কাপ কফি পাঠিয়ে দাও।

ফাল্গুনীর কথা বলার সুযোগে কবিতা সমস্ত রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বড় আকারে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের দেয়াল ডিসটেম্পার করা, উন্নত মানের সোফা সেট এবং টেবিলের সামনে বসানো কয়েকটি বিদেশী চেয়ার, বড় আকারের সেক্রেটারিয়েট টেবিলে একটি ডেস্ক ক্যালেন্ডার, দেয়ালে টাঙানো একটি ইয়ার প্লানার, আঁচল প্রকাশিত নারীর সচেতনতামূলক কয়েকটি পোস্টার ও লিফলেট সব কিছুতেই যেন আভিজাত্যের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। ফাল্গুনী কফির অর্ডার দেয়ার কয়েক মিনিটে মধ্যে কফি চলে এলো।

ফাল্গুনী কফির কাপ হাতে নিয়ে কবিতাকে বলল, কবিতা কফি নাও তারপর বলতে শুরু করল, আমাদের এন. জি. ও তে মেইন প্রকল্প তিনটি। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মহিলাদের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ক্রেডিট প্রোগ্রাম, ড্রপ আউট চিলড্রেনদের জন্য উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বিত্তহীন, বঞ্চিতা ও নির্যাতিতা মহিলাদের উন্নয়নের জন্য ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রাম।

আমি তোমাকে ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দিতে চাই।

কবিতা অস্ফুট স্বরে বলল, আপা আমি কি পারব?

অবশ্যই পারবে। তাছাড়া আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি, বলে ফাল্গুনী একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল, ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রামের তিনটি কম্পোনেন্ট (১) অ্যায়ারনেস বিল্ডিং আপ ফর ওম্যান রাইটস (২) হেলথ এডুকেশন প্রোগ্রাম ফর ওম্যান এন্ড চাইল্ড (৩) লিগ্যাল এইড ফর ডিপ্রাইভড ওম্যান। এই তিনটি কম্পোনেন্ট দেখার জন্য তিনজন প্রোগাম অফিসার আছেন, প্রত্যেক প্রোগ্রাম অফিসারদের অধীনে আছেন কয়েকজন করে ফিল্ড অফিসার এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কর্মচারী তোমার কাজ সবকিছু সমন্বয় করা, বলে ফাল্গুনী একটু থামল, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, চলো তোমার সাপোর্টিং স্টাফসহ সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

দু’জনে উঠল। ফাল্গুনী সমস্ত অফিস কবিতাকে ঘুরে দেখাল, সব স্টাফদের সঙ্গে পরিচয় করে দিল। তারপর তার চেম্বারে গিয়ে কবিতার বসার চেয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটাই তোমার চেয়ার, বসও।

কবিতা প্রথমে একটু ইতস্তত করল তারপর চেয়ারে বসল ফাল্গুনী হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই কবিতা হ্যান্ডশেক করে কৃতজ্ঞচিত্তে বলল, ইউ আর সো গ্রেট আপা, থ্যাঙ্কস।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম কবিতা, তুমি তাহলে বসও, তোমার টেবিলের গ্লাসের নীচে একটা ইন্টারকম লিস্ট আছে প্রয়োজনে আমাকে ফোন দিবে কেমন, বলে ফাল্গুনী মৃদু হেসে চলে গেল।

কবিতা অফিসে  কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর বাসায় চলে গেল। বিকেল বেলা রফিক কোর্ট থেকে বাসায় ফিরলে কবিতা চাকরিতে তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাসহ  সমস্ত কর্মকাণ্ড বিশদভাবে বর্ণনা দিল। রফিক কখনও মনোযোগ দিয়ে কখনও বা আনমনাভাবে হ্যাঁ অথবা না বলে এড়িয়ে গেল। কবিতা রফিকের আগ্রহের দিকে খেয়াল না রেখে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকল। কিছুক্ষণ পর রফিককে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলছ না যে?

রফিক বলল, কবিতা আমাদের দেশে ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রয়োজন। ওম্যান ডেভলাপমেন্টের জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি আর নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। কিন্তু কোন কোন সংগঠন নারী উন্নয়নের নামে নগ্নতা আর স্বাধীনতার নামে উশৃঙ্খলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমার ধারণা আঁচল এমনি একটি সংগঠন।

কবিতা প্রতিবাদ করে বলল, না, না তোমার ধারণা ঠিক নয়। আঁচল নারী উন্নয়নের জন্য একটি আদর্শ সংগঠন তুমি দেখ আমি তোমার ধারণা ভুল প্রমাণ করবো।

কবিতা আমি তোমাকে নারী মুক্তির স্বপ্ন দ্রষ্টা বেগম রোকেয়ার রচনা সমগ্র বইটা গিফট করবো।  তুমি বেগম রোকেয়ার মতো গঠনমূলক নারী স্বাধীনতার জন্য কাজ করবে, তুমি যদি বেগম রোকেয়া হও তবে আমি সাখাওয়াৎ হোসেন হয়ে তোমাকে সহযোগিতা করবো। আর তুমি যদি উশৃঙ্খল ও অবাধ স্বাধীনতার জন্য কাজ করো তবে তোমাকে আঁচল ছেড়ে চলে আসতে হবে, বলে রফিক চলে গেল।

 

বিশ

বাবাকে স্বপ্নে দেখার পর থেকে রফিক তার মায়ের সেবা এবং বোনের লেখাপড়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছে। কলেজ এবং কোচিং নিয়ে ফিরোজা আজকাল খুব ব্যস্ত, কবিতা ব্যস্ত তার চাকরি নিয়ে। বাসার কাজ কর্মে সহযোগিতা করার জন্য চরশৌলমারী থেকে কছিরনের একটা  মেয়েকে আনা হয়েছে মেয়েটির নাম আছিয়া, বয়স দশ কিংবা বার বছর হবে এন. জি. ও’র একটা স্কুল থেকে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে। কছিরনের আছিয়াকে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল না তাই এতো অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছিল। রফিক তার বাসায় নিয়ে আসায় এ যাত্রায় আছিয়া বাল্য বিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেল। অল্প কয়েকদিনেই আছিয়া যেন সবকিছু আপন করে নিয়েছে। মরিয়ম বাসার বেশিরভাগ কাজ কর্ম আছিয়াকে নিয়ে করে থাকে। ছেলে, বউমা, মেয়ে সবকিছু নিয়ে মরিয়ম ও যেন বেশ আনন্দে আছে। এখন আর মরিয়মের নিজেকে কাজের মেয়ে মনে হয় না, এ যেন মরিয়মের নিজের ঘর। রফিকের অনেক সময় মনে হয় তার বাবা যদি আর একবার স্বপ্নে তার সঙ্গে দেখা করত তবে হয়ত স্বপ্বে রফিকের জন্য আশীর্বাদ করত। আবার অনেক সময় মনে হয় সবকিছু ঠিক ঠাক আছে ঠিকই কিন্তু কবিতার মনের মধ্যে আছে প্রচণ্ড ক্ষোভ, সে সবকিছু দেখে মনে মনে জ্বলে উঠছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা রফিক বাইরের রুমে একটি মামলার নথি মনোযোগ সহকারে পড়ার সময় আছিয়া ডাক দিল, মামা বাসায় মেহমান এসেছে, ভিতরে আসেন।

রফিক বাইরের রুম থেকে ড্রয়িং রুমে ঢুকে সহস্যে বলল, আরে শ্রাবণী।

শ্রাবণী দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, হ্যাঁ আপনি তো কোনদিন আমাদের বাসায় এলেন না, তাই চলে এলাম। আপনার সঙ্গে পরিচয় করে দেই।

মাসুদ দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আমি মাসুদ, শ্রাবণী আমার-

রফিক মৃদু হেসে বলল, আর বলতে হবে না, আমার বুঝতে বাকী নেই, শ্রাবণী আপনার স্ত্রী।

মাসুদ সাহেব আপনি একটু বসুন, শ্রাবণী বসও আমি আসছি বলে রফিক ভিতরে চলে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসল।

শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, দুলাভাই কবিতা কোথায়?

কবিতা তো এখনো ফিরেনি হয়ত এখনি চলে আসবে, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই আসে আজ কেন জানি দেরি হচ্ছে।

হ্যাঁ একজন দিনরাত কোর্ট আর প্র্যাকটিস আরেকজন চাকরি দু’জনের যেন শুধু ধনী হওয়ার স্বপ্ন কোটিপতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

মাসুদ চাপা ম্বরে শ্রাবণীকে বলল, শ্রাবণী চুপ করো।

শ্রাবণী চুপ করে রইল। আছিয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলো মরিয়মও এসে আছিয়ার পিছনে পিছনে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই শ্রাবণী ও মাসুদ দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

মরিয়ম সালামের জবাব দিয়ে বলল, বসও মা, বাবা বসও।

শ্রাবণী সোফায় বসতে বসতে বলল, আপনিও বসুন খালা-আম্মা।

মরিয়ম সোফায় বসে বলল, খাও মা, তোমার শ্বশুর বাড়ি যেন কোথায়?

শ্রাবণী বলল, সবুজ পাড়া খালা আম্মা।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। মরিয়ম আছিয়াকে বলল, আছিয়া দরজাটা খুলে দে তো, বউমা এলো বোধ হয়।

আছিয়া দরজা খুলে দিল।

কবিতা ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে বলল, শ্রাবণী কখন এসেছিস?

এই তো কিছুক্ষণ হলো বলে শ্রাবণী বলল, তোর সঙ্গে পরিচয় করে দেই।

কবিতা হেসে বলল, তোর বর তাই না? দেখেই বুঝেছি। তোমরা বসও মা বলে মরিয়ম সোফা থেকে উঠে ভিতরে চলে গেল।

মাসুদ সালাম দিয়ে বলল, আমি মাসুদ।

বসুন দুলাভাই বলে কবিতা শ্রাবণীর পাশের সোফায় বসে শ্রাবণীর কানে ফিস ফিস করে বলল, কিরে দিনকাল বুঝি খুব ভালো যাচ্ছে?

শ্রাবণী মুচকি হাসল।

চা নিন প্লিজ, বলে কবিতা মাসুদকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল তারপর বলল, দুলাভাই আপনারা দু’জনে গল্প করুন আমি আর শ্রাবণী আসছি।

কবিতা শ্রাবণীকে তার বেডরুমে নিয়ে গেল। কবিতা শ্রাবণীকে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বলল, বসও শ্রাবণী আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি, বলে কবিতা ড্রেস চেঞ্জ করে শ্রাবণীর কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, সরি শ্রাবণী তোর অনেক সময় নষ্ট করলাম, এখন বল কেমন চলছে তোর সংসার?

 

শ্রাবণী তৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে বলল, খুব ভালো।

আগে যে শুনছিলাম তোর শাশুড়ি-

হ্যাঁ শুনেছি বিয়ের আগে তিনি আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না, বিয়ের প্রথমদিকে আমার সঙ্গে তেমন একটা কথা বার্তা হতো  না। আমি দিনে দিনে তাঁর মন জয় করেছি, এখন তো তিনি আমাকে ছাড়া কিছু বুঝেন না।

আর তোর সাহেব? কবিতা জিজ্ঞেস করল।

আমি ওকে আগে থেকে চিনি, ও আসলে খুব ভালো মানুষ, সব সময় আমাকে খুশি করার চেষ্টা করে।

তবে তো বলতে হয় তুই সুখেই আছিস।

আর তুই বুঝি কষ্টে আছিস।

আমিও কষ্টে নেই তবে খুব সুখেও নেই।

শ্রাবণী শুষ্ক মুখে বলল, কেন?

সেটাই তো জানি না।

তোর কি সমস্যা সেটা তুই জানিস না?

আসলে তোর মতো সেকেলে মেয়েকে বলে কোন লাভ নেই।

মুহূর্তেই শ্রাবণীর মুখ কাল মেঘে ঢেকে গেল, লাভ না হলে বলবি না তবে আমি ফাল্গুনী আপার সঙ্গে তোর চলাফেরা দেখেই বুঝেছি তার চালচলন ঠিক তোর মতোই ছিল, তাই তো তার সংসার টিকেনি।

কবিতা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, সবাইকে সংসার করতে হবে এমন তো কথা নয়।

শ্রাবণী ঘৃণার সুরে বলল, তা অবশ্য ঠিক তারপর বলল, কবিতা চল।

দু’জনে ড্রয়িং রুমে ঢুকল। ততক্ষণে মাসুদ উঠার জন্য অস্থির হয়ে বারবার করে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। শ্রাবণীকে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে দেখে বলল, তোমার এতক্ষণে হলো? এখন চলো।

হ্যাঁ চলো, বলে শ্রাবণী ও রফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই আসি, কবিতা দুলাভাইকে নিয়ে আসিস।

 

একুশ

মরিয়মের বয়স যখন এগার বছর তখন তার বিয়ে হয়। স্বামী সংসার সম্বন্ধে তখনো তার তেমন জ্ঞান হয়নি। মরিয়ম ক্লাস ফাইভ পাস করার পর স্কুল দুরে হওয়ার অজুহাতে বাপ-মা স্কুলে যাওয়া বন্দ করে দিয়ে পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু করে। ভাগ্যক্রমে অল্প দিনের মধ্যে পাত্রের সন্ধান পাওয়ায় কিশোরী মরিয়মের বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েকদিন আগে মরিয়মের দাদী স্বামী-শাশুড়ির সঙ্গে আচার ব্যবহারের যে উপদেশ দিয়েছিলেন মরিয়ম সারাজীবন অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেছিল। শাশুড়ি যেমন তাকে স্নেহ করত মরিয়মও তেমনি তার শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করত। স্বামী যেমন তাকে ভালবাসত তেমনি মরিয়মও তার স্বামীকে ভালবাসত দু’জনের ভালোবাসায় কোন সন্দেহ বা সংশয় ছিল না কারো প্রতি ছিল না কারো ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ঘাটতি। দু’জনের ভালোবাসার গভীরতাও ছিল অসীম। স্বামী-শাশুড়ি সংসার সবকিছু মরিয়ম অল্প বয়সেই সামলে নিয়েছিল। মরিয়মের সংসারে ভাতের অভাব ছিল, একবার পুরো পেট খেলে আরেকবার আধা টেপ ভাত খেয়ে থাকতে হতো কিন্তু তার সংসারে সুখের অভাব ছিল না। আধপেটা ভাত খেয়ে একটা জীর্ণ শাড়ি পরেও মরিয়ম যেন সুখের বন্যায় ভাসত।

রফিকের সংসারে ভাতের অভাব নেই, টাকা পয়সার অভাব নেই মরিয়মের দিনকাল রফিকের সংসারে ভালোই যাচ্ছিল, রফিক তার মাকে খুব শ্রদ্ধা করে মায়ের কোন আবদার রফিক অপূর্ণ রাখে না। কিন্তু তারপরও সবকিছু নিয়ে মরিয়ম যতটা ভালো থাকার কথা তার মনে তত সুখ নেই। মরিয়মের ধারণা ছিল সে যেমন তার দাদীর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নিজের সুখ সংসারে সকলের সুখের জন্য উৎসর্গ করেছিল কবিতাও তেমনি স্বামী-সংসার নিয়ে একটি সুখের স্বর্গ গড়বে কিন্তু তার সে আকাঙ্ক্ষায় গুড়ে বালি। কবিতা এক রকম রফিকের চাপে তাকে লোক দেখানো শ্রদ্ধা করে একথা মরিয়ম বুঝে কিন্তু না বোঝার ভান করে কবিতার দু’য়েকটি অপমানজনক আচরণও হেসে উড়িয়ে দেয়। অনেক সময় কবিতার আচরণ সহ্য করতে না পেরে দু’য়েক কথা বলে ফেলে।

কয়েকদিন আগে কবিতা দু’দিনের একটি ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণের জন্য রংপুর গিয়েছিল মরিয়ম চেয়েছিল কিছু বলবে কিন্তু বলব বলব করে বলা হয়নি। আবার আজ অফিস থেকে ফিরেই কবিতা ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মরিয়ম জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ বউমা?

ঢাকা।

তুমি না এই ক’দিন আগে রংপুর থেকে আসলে?

তাতে কি মা? কাজ থাকলে যেতে হবে না?

মরিয়ম আর কোন কথা বলল না। সোজা রফিকের চেম্বারে চলে গেল। চেম্বারে তখন রফিক একটা আইনের বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিল। হঠাৎ করে মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বলল, মা তুমি?

হ্যাঁ বাবা, বউমা আজ ঢাকা যাচ্ছে তুই কি জানিস?

রফিক বুকে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেল। কিন্তু তার মাকে কিছুই বুঝতে দিল না, স্বাভাবিক ভাবে বলল, হ্যাঁ মা যেতে পারে।

যেতে পারে কি তোকে আগে বলেনি?

না মা আগে বলেনি যাওয়ার আগে বলবে হয়ত?

কী জানি বাবা? তোরা কী রকম স্বামী-স্ত্রী? বউমা কখন কোথায় যায় তোকে বলে না, যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যায় তুইও কিছু জানিস না এভাবে কি সংসার চলে?

মা ও একটা চাকরি করছে, চাকরির প্রয়োজনে যখন যেখানে যাওয়ার দরকার যাবে। বাধা দিলে তো চলবে না।

তুইও বউমার মতো কথা বলছিস? ঠিক আছে আমি কিন্তু বউমার এসব আচরণ সহ্য করতে পারছিনা, ফিরোজার পরীক্ষা শেষ হলে তুই আমাকে রেখে আয় বাবা তারপর তোরা যেভাবে চলবি চলিস আমি কিছু দেখতেও চাই না, শুনতেও চাই না বলে মরিয়ম রফিককে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।

 

বাইশ

চাকরিতে যোগদানের প্রথম দিকে কবিতা নির্ধারিত সময়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরত। তারপর শুরু হলো ছুটাছুটি ঢাকা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অ’লে। রফিক শত কষ্টে সেটাও মেনে নিয়েছে যাকে বলে অনুরোধে ঢেঁকি গিলা। রফিক তাও গিলেছে কিন্তু ইদানীং শুরু হয়েছে পোশাক পরিচ্ছদে উগ্রতা এবং আচরণে উ-শৃঙ্খলতা। অফিস সময় নয়টা থেকে চারটা পর্যন্ত হলেও আজকাল কবিতা প্রায়ই রাত আটটার সময় বাড়ি ফিরে। রফিক কোন কথা জিজ্ঞেস করলেই অফিসে কাজের চাপের কথা বলে এড়িয়ে যায়। কবিতার অফিসে কাজের চাপ বেশি এ কথা সত্য কিন্তু সেই সাথে তার গায়ে প্রগতির নামে উশৃঙ্খলতার হাওয়া লেগেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সেদিন রফিক কোর্ট থেকে ফিরে তার চেম্বারে কয়েকটি মামলার নথি বিশ্লেষণের পর টি. ভি দেখছিল আর বার বার করে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। কবিতা বাসায় ফিরল তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা, কবিতা তার হাতের ছোট্ট- ব্যাগটি ড্রেসিং টেবিলে রেখে রফিককে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভাত খেয়েছ?

রফিক কবিতার কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, এখন রাত ক’টা বাজে?

কবিতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সাড়ে দশটা।

তারপর ড্রেস পরিবর্তন করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কবিতাকে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে রফিক জিজ্ঞেস করল, তুমি ভাত খাবে না?

আমি ভাত খেয়ে এসেছি।

রফিক তিরস্কারের সুরে বলল, বাহ্‌ তোমার এতদূর অগ্রগতি ……… ।

কবিতা ক্রোধের সুরে বলল, তিরস্কার করছ?

রফিক মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, না উৎসাহ দিচ্ছি।

কবিতা সহস্রগুণ জ্বলে উঠল, আমি কী সাধে রাত করে বাসায় ফিরছি? একবারও তো জানতে চাইলে না রাত করে বাসায় ফিরলাম কেন? তবে শোন আমার অফিসে অডিট এসেছে অফিস শেষে রেস্ট হাউজে গিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করে তারপর বাসায় ফিরলাম। সারাদিন কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি আর তুমি আছ শুধু আমার সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত।

রফিক গম্ভীর স্বরে বলল, কবিতা যত কাজই থাকুক না কেন কোন স্বামী তার স্ত্রীর দিনের পর দিন রাত দশটা পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকা মেনে নেবে না। আমিও মানতে পারছি না।

তুমি মানতে পার আর না পার তোমার জন্য তো আমি চাকরি ছাড়তে পারি না, আসলে রাত দশটায় বাসায় ফিরা নিয়ে কথা নয়, মেয়েরা স্বাবলম্বী হোক, নিজের অধিকার নিয়ে ভাবুক তোমরা ছেলেরা তা কোনদিনও চাও না। মেয়েরা বিনা বাক্যে তোমাদের হুকুম তামিল করবে, তোমাদের ইচ্ছায় হাসবে, তোমাদের ইচ্ছায় কাঁদবে, মেয়েরা সব সময় তোমাদের অধীনস্থ থাকবে এটাই তোমরা চাও। তুমি আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পার না।

তোমার মুখে অধিকারের  প্রশ্ন? নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখ তুমি কি আমার অধিকারের প্রতি যত্নশীল? দিনের পর দিন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে তুমি যে আমাকে অ্যাভোয়েড করছ তাতে তুমি কি আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছ না?

কবিতা তুমি অনেক কিছু শিখেছ, এখন তোমাকে শেখাবার মতো জ্ঞান আমার নেই। তোমাকে শুধু আমি গত কয়েক মাস আগের তোমার আচরণ আর আজকের তোমার আচরণ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। যেদিন প্রথম তুমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেলে, ফিরোজার সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো। সেদিনই তুমি তো ফিরোজাকে এখানে মহিলা কলেজে ভর্তি হবার জন্য আসতে বললে, মাকে তোমার কথায় এখানে নিয়ে এলাম তারপর কী হলো? তোমার দূর্ব্যবহারে মা ফিরোজাকে নিয়ে গ্রামে চলে গেল। কান্নায় আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেলেও আমি অনেক কষ্টে বুকে পাথর চেপে রইলাম। শুধু তোমার জন্য আমি মা, ভাই-বোন সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। পরাজয় ভেবে নয় শুধুমাত্র মান সম্মানের সঙ্গে সমাজে বসবাস করার জন্য নীরবে তোমার ক্রমাগত উ-শৃঙ্খলতা ও নগ্নতা সহ্য করলাম। তোমার নিশ্চয় মনে আছে প্রথম যেদিন চাকরিতে জয়েন করে বাসায় এলে এবং প্রথম চাকরিতে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলে সেদিন আঁচলের কাজ-কর্ম সম্পর্কে ধারনা দিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে আঁচল একটি আদর্শ নারী উন্নয়ন সংগঠন। কয়েকদিন পর তোমাকে আমি বেগম রোকেয়ার একটা বই দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম আঁচল নারী উন্নয়নে বেগম রোকেয়াকে অনুসরণ করবে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আমি কী দেখলাম? এ ক’দিনে তোমার এত উন্নতি? তোমার আচরণে এত পরিবর্তন? তোমার শ্রম নারী উন্নয়নে আর বঞ্চিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কী অবদান রেখেছে, সামাজিক উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছে আমার জানা নেই, তবে তোমার পোশাক পরিচ্ছদ আর চলাফেরার যে উন্নতি হয়েছে তাতে পাড়ার ছেলেরা তোমাকে দেখে অশোভন মন্তব্য করে, প্রতিবেশীরা তোমাকে নিয়ে কানাকানি করে, প্লিজ কবিতা তুমি একটু সংযত হও।

কবিতা প্রচণ্ড রাগান্বিত স্বরে বলল, সংযত হতে বলছ কেন? সোজাসুজি বল তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। তবে জেনে রাখ আমি চাকরিটা ছাড়ব না।

তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে চাকরি ছাড়তে বলছি না। আমি তোমাকে, তোমার সংগঠনকে নারী উন্নয়নের নীতি পরিবর্তন করতে বলছি। আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ পুষ্টি-হীনতায় ভুগছে, শতকরা চল্লিশ ভাগ মানুষ ভিটামিন এ’র অভাবে ভুগছে, প্রতি হাজারে ছয় থেকে আটজন শিশু ভিটামিন এ’র অভাবে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশে আয়োডিনের অভাবে ও রক্ত শূন্যতায় ভুগছে পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ, প্রায় সত্তর ভাগ মা ও শিশু লৌহের অভাবজনিত রক্ত স্বল্পতার শিকার, কিশোরী মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার, যৌতুক প্রথা সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশে সার্বিক উন্নয়নের জন্য মানব উন্নয়ন এবং নারী উন্নয়ন দু’টোই প্রয়োজন। চাই নারী শিক্ষা, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া স্বাধীনতার আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু তুমি এবং তোমার সংগঠন শিক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের আগে নারী স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। ফলে সুস্থ নারী মুক্তির আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সমাজের নগ্নতা ও উ-শৃঙ্খলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কবিতা প্রচণ্ড রেগে উঠল, তুমি আর আমার সংগঠন সম্পর্কে একটাও মন্তব্য করবে না. নইলে ভালো হবে না বলছি।

কবিতা আমি তোমার সংগঠন সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। আমি আঁচলের  কবিতাকে নয় আমার কবিতাকে ফিরে পেতে চাই। প্লিজ কবিতা আমি আবার বলছি তুমি সংসার মুখি হও। বলতে বলতে রফিকের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

কবিতা রফিকের কথায় কর্ণপাত করল না। সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রফিক বুঝতে পারল ইতোপূর্বেই কবিতার ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে এবং তাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে যে অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে কবিতা সেই শিক্ষাই গ্রহণ করেছে কাজেই তর্কে তাকে হারাবার চেষ্টা কখনই সফল হবে না। রফিক কবিতার হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল, অধিকারের প্রশ্ন নয় কবিতা, আইন আদালত আর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিতর্কে সংসারে সুখ আসবে না। থাক না আজ এসব কথা তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে এখন বিশ্রাম নাও।

কবিতা সজোরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

 

তেইশ

কয়েক মাসের মধ্যে কবিতা তার কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। ট্রেইনার হিসাবে প্রশিক্ষণে বক্তৃতা দিতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে ইতোমধ্যে কয়েকটি ডোনার এজেন্সির প্রতিনিধির সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। ডোনার এজেন্সির প্রতিনিধিরা কবিতার প্রস্তুতকৃত প্রজেক্ট প্রপোজালের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছে এবং প্রজেক্টে ফান্ড কন্ট্রিবিউট করতে সম্মত হয়েছে। আজকাল আঁচলের ডিরেক্টর ফাল্গুনীর যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কবিতার উপর নির্ভর করে। তাছাড়া বাইরে থেকে কোন ডোনার এজেন্সির প্রতিনিধি এলেই ফাল্গুনী কবিতাকে তাদের সঙ্গে সিটিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী ডোনার এজেন্সির দু’জন প্রতিনিধি আঁচলের মাধ্যমে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এলেন। ফাল্গুনী তাদেরকে তার রুমে বসিয়ে ইন্টারকমের মাধ্যমে কবিতাকে ডেকে পাঠাল। কবিতা পূর্ব থেকেই তাদের জন্য প্রস্তুতকৃত কাগজপত্র ফাইলে রেখে দিয়েছিল। ফাল্গুনীর ডাক পড়তেই কবিতা ফাইল নিয়ে ফাল্গুনীর চেম্বারে প্রবেশ করল।

ফাল্গুনী পরিচয় করিয়ে দিল, কবিতা, ইনি হলেন, বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বিদেশি ভদ্রলোক হ্যালো আই এম রোনাল্ড বলে কবিতার দিকে হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বড়িয়ে দিলেন। কবিতা থতমত খেয়ে একবার বিদেশি ভদ্রলোকের দিকে আর ফাল্গুনীর দিকে তাকাতেই ফাল্গুনী রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, কবিতা, টেক ইট ইজি।

কবিতা হ্যান্ড শ্যাক করতেই অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করায় তার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কবিতা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকতেই রোনাল্ড মৃদু হেসে বলল, নাইস টু মিট ইউ।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক হ্যালো আই এম ডেনিশ বলে কবিতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই কবিতা হ্যান্ডশ্যাক করে বলল, নাইস টু মিট ইউ।

ফাল্গুনী কবিতার কাছ থেকে ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখল তারপর বলল, কবিতা উনারা তোমার কেস স্টাডি, সার্ভে রিপোর্ট আর প্রজেক্ট প্রপোজাল দেখেছেন এখন একবার ফিল্ড দেখতে চান, তুমি উনাদের নিয়ে একবার তোমার সার্ভে এলাকা পাঁচগাছী আর যাত্রাপুর দেখিয়ে নিয়ে এস, বলে ফাল্গুনী একটু থামল তারপর বলল, মিস্টার রোনাল্ড এন্ড মিস্টার ডেনিশ নাউ ইউ মে গো টু ভিজিট ইয়োর ফিল্ড এন্ড দেন উই মিট এগেইন আফটার কাম ব্যাক।

থ্যাঙ্ক ইউ মিস ফাল্গুনী, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ বলে মিস্টার রোনাল্ড ও মিস্টার ডেনিশ চেয়ার থেকে উঠলেন।

ফাল্গুনী কবিতাকে বসার জন্য ইশারা করে বলল, কবিতা তুমি একজন প্রগ্রেসিভ ওম্যান ডেভলাপম্যান্ট ওয়ার্কার। সবকিছু সহজভাবে নিবে। মনে রাখবে তোমার উপর নির্ভর করছে আঁচলের পঞ্চাশ লাখ টাকার ফান্ড। তুমি ঐ দিকটা ম্যানেজ করো আমি তাদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করছি। যাও উনারা বাইরে অপেক্ষা করছেন।

জি আপা, বলে কবিতা মিস্টার রোনাল্ড আর মিস্টার ডেনিশের সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী পাঁচগাছী আর যাত্রাপুর গ্রামের কয়েকটি কেস স্টাডি করতে করতে প্রায় সারাদিন কেটে গেল। সার্ভে শেষ করে গাড়ি যখন কুড়িগ্রামের দিকে রওয়ানা হলো তখন  সূর্যটা পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভা নিয়ে ধরলার কোলে ঢলে পড়েছে। কবিতা প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে গাড়ি কখন শহরে প্রবেশ করেছে খেয়ালই করেনি। ধীরে ধীরে গাড়ি রেস্ট হাউজের গেটের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে সবাই গাড়ি থেকে নামতেই ফাল্গুনী বারান্দায় এসে দাড়িয়ে মৃদু হেসে বলল, কবিতা সবকিছু ঠিক আছে?

কবিতা মুচকি হেসে বলল, জি আপা।

ফাল্গুনী আগে থেকেই রেস্ট হাউজে নাস্তার আয়োজন করে রেখেছিল। সবাইকে হলো রুমে নিয়ে গিয়ে বয়কে নাস্তা আর কফি দিতে বলল। নাস্তা শেষে ফাল্গুনী টেবিলে আগে থেকে রাখা একটি ফাইল খুলতে খুলতে বলল, কবিতা তাহলে আমরা আলোচনা শুরু করতে পারি।

কবিতা মাথা নেড়ে সায় দিলে ফাল্গুনী মিঃ রোনান্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, মিঃ রোনাল্ড নাউ উই কেন স্টার্ট আওয়ার ডিসকাশন।

মিঃ রোনাল্ড আগ্রহের স্বরে বললেন, ওকে থ্যাঙ্কস।

মিসেস কবিতা অলসো প্রিপিয়ার্ড এ থ্রি ইয়ার্স প্লান, বাজেট এন্ড বেনিফিসিয়ারিস কন্ট্রিবিউশন। আই হোপ ইউ উইল এগ্রি উইথ হার প্রপোজাল ফাল্গুনী বলল।

মিঃ রোনাল্ড হাত বাড়িয়ে মিঃ ডেনিশের কাছ থেকে একটা ফাইল নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, ইয়েস আই এ্যাম অলসো এগ্রি উইথ হার প্রপোজাল বাট নাউ উই হ্যাভ সাম লিমিটেশন, সো উই উইল কন্ট্রিবিউট অনলি ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রাম নাউ। অ্যনাদার কম্পোনেন্ট উইল বি কন্ট্রিবিউট লেটার অন।

মিঃ রোনাল্ড ইন দিস এরিয়া দি পিপলস আর ভেরি নিডি অ্যাভরি ইয়ার দে লস দেয়ার হোম এন্ড ল্যান্ড টু রিভার, দেয়ার চিলড্রেন কেন নট গো টু স্কুল ফর পভার্টি, এন্ড দে এড টু পভার্টি, দে ট্রাই টু হেল্প দেয়ার ফ্যামিলি এন্ড এড টু চাইল্ড লেবার। আই হোপ ইফ ইউ কন্ট্রিবিউট উই উইল স্ট্রাট  এ ট্যাকনিক্যাল স্কুল দেয়ার।

মিঃ রোলান্ড বললেন, ডোন্ট ওরি মিস ফাল্গুনী, উই উইল রিম্যামবার ইওর প্রপোজাল।

থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ মিঃ রোনাল্ড।

ওম্যান ডেভলাপমেন্ট প্রোগ্রামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা  করতে করতে দেওয়াল ঘড়িতে রাত নয়টা বাজার ঘণ্টা ধ্বনিত হলো। কবিতা ফাল্গুনীর কানে কানে তার বাসায় ফিরবার কথা বলতেই ফাল্গুনী চাপা স্বরে বলল, কবিতা আন সোশ্যাল মেয়ের মতো কথা বলও না।

কবিতা আর কোন কথা না বলে পূর্বের মতো চেয়ারে বসে রইল।

এমনভাবে এন.জি.ও’র বিভিন্ন প্রজেক্টে ফান্ড কন্ট্রিবিউট, প্রিভিয়াস প্রজেক্টের ইভ্যালুয়েশন বিষয়ে আলোচনা করতে করতে ঘড়িতে দশটা বাজার ঘণ্টা  ধ্বনিত হলো। কবিতা ফাল্গুনীর কানে ফিস ফিস করে কী যেন বলল, তারপর সবাই ডিনার সেরে ফাল্গুনী ও কবিতা বেরিয়ে পড়ল।

 

চব্বিশ

অধিকাংশ দিনে কবিতা রাত আটটার মধ্যে বাসায় ফিরে দু’য়েকদিন  যে এর চেয়ে দেরি হয়নি এমন নয়, কিন্তু কোনদিন রাত নয়টার বেশি বাজেনি। হঠাৎ করে আজ রাত দশটার পরও কবিতা বাসায় না ফিরায় রফিকের মন বিভিন্ন রকম দুশ্চিন্তায় ভরে গেল। রাত সাড়ে দশটার সময় রফিক হাঁটতে হাঁটতে কবিতার অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। হঠাৎ করে কবিতা হয়ত তাকে দেখে খুব খুশি হবে হয়ত খানিকটা অবাকও হবে। তারপর দু’জনে আবার হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরবে এমনভাবে বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে রফিক কবিতার অফিসের গেটে এসে দাঁড়াল। রফিক গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে অফিসের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পরিচালক ফাল্গুনীর রুম ও কবিতার রুমসহ সমস্ত অফিস ঘুরে ঘুরে দেখল, কোথাও কোন সাড়া নেই।

রফিক গেট দিয়ে বের হয়ে আসতেই ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবক স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল, স্যার কি কাউকে খুঁজছেন?

আচ্ছা তোমাদের অফিস বন্ধ হয়েছে কয়টায়?

কী জানি? আমার নাইট ডিউটি রাত দশটা থেকে বলে সে চলে গেল।

রফিক ধীর পদে হাটতে হাটতে বাসায় ফিরল।

সারারাত রফিকের চোখে ঘুম নেই, মনের মধ্যে শৈশব থেকে তার জীবনের আজকের সাফল্যের স্মৃতি ভেসে উঠল। তার জীবনে দারিদ্র ছিল, ক্ষুধা ছিল কিন্তু দু’চোখে ঘুমের অভাব ছিল না, অথচ আজ তার সব থেকেও চোখ থেকে ঘুম হারিয়ে গেছে, মনের সুখ হারিয়ে গেছে। সব সময় তার শুধু কবিতার পরিবর্তনের কথা হৃদয়ে ভেসে উঠছে। কবিতা চাকরিতে যোগদানের পর থেকে অসম্ভব রকম বদলে গেছে, সংসার থেকে তার মন উঠে গেছে। স্বাধীনতার নামে উ-শৃঙ্খলতা আর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আইন আর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে রফিক মুখ বুজে তার সব অত্যাচার সহ্য করছে। কিন্তু আজ বুঝি তার তিলে তিলে অর্জিত সামাজিক মর্যাদা কোনভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কাল সকালে যখন সবাই জানবে আইনজীবীর স্ত্রী ঘরের বাইরে রাত্রি যাপন করেছে তখন তার সামাজিক অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাঁর এতদিনের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এমনভাবে নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে করতে দূর থেকে রাত তিনটা বাজার ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এলো। রফিক ঘুমাবার জন্য বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালবেলা বাড়ির দরজার সামনে গাড়ির হর্নের শব্দে রফিকের ঘুম ভাঙ্গল। রফিক বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেই দরজা খুলে দিল। কবিতা ঘরে ঢুকল, তার ক্লান্ত অবসন্ন  দেহ, এলোমেলো চুল, চোখে মুখে রাত জাগার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রফিক উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কবিতা রাতে কোথায় ছিলে?

ফাল্গুনী আপার বাসায়, কবিতার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আমাকে খবর দিলে আমি তোমাকে নিয়ে আসতাম।

অনেক রাত হয়ে গেল। আপা বলল, চলো আমার সঙ্গে তাই চলে গেলাম, কবিতা খুব সহজভাবে বলল।

কবিতা কাল রাত দশ’টা পর্যন্ত যখন তুমি ফিরে এলে না তখন আমি তোমাকে খুঁজতে তোমার অফিসে গেলাম। তোমাকে অফিসে না পেয়ে ফিরে এলাম দুশ্চিন্তায় আমার মন ভরে গেল। সারারাত বিছানায় ছটফট করলাম, এক মুহূর্তের জন্য ঘুম এলো না। আচ্ছা কবিতা তোমার ফাল্গুনী আপা বলল আর তুমি চলে গেলে একবারও আমার কথা ভাবলে না।

হ্যাঁ তাতে কী হয়েছে? তুমি এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছ না কেন?

কবিতা তোমার ফাল্গুনীর সঙ্গে যাওয়াকে আমি অস্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি না তবে তুমি আমাকে বললেও পারতে।

কেন আপার বাসায় থাকার জন্য আমাকে কি তোমার অনুমতি নিতে হবে?

আমি তোমাকে অনুমতি নেবার কথা বলিনি তবে এখন বলছি বাইরে রাত যাপন করতে চাইলে তোমাকে অবশ্যই আমার অনুমতি নিতে হবে। কারণ তুমি আমার স্ত্রী।

কবিতা সহস্রগুণ জ্বলে উঠল, স্বামীর অধিকার চাপিয়ে দিয়ে তুমি আমাকে ঘরে বন্দি করতে চাও? এখনো কি সেদিন আছে যে স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে স্ত্রী চলবে। তোমার যেমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার আছে, তেমনি আমারও স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করার অধিকার আছে।

ছিঃ কবিতা, ছিঃ তুমি স্বাধীনতার অর্থ বুঝ? তুমি স্বাধীনতার নামে যা করছ তা স্বাধীনতা নয় উ-শৃঙ্খলতা, অগ্রগতির নামে তুমি যে দিকে এগিয়ে যাচ্ছ সেটা আলোর দিক নয়, অন্ধকার দিক।

কবিতা রফিকের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, ব্যাস থাক আর নয় অনেক হয়েছে। আমাকে অবলা ভেবে অনেকদিন জ্ঞানের বুলি বিলিয়েছ এবার চুপ করো। আমার ইচ্ছে হলে বাসায় ফিরব ইচ্ছে হলে বাইরে রাত কাটাব।

নিজের স্ত্রীর বাড়ির বাইরে রাত্রি যাপন শেষে বাড়ি ফিরে উঁচু স্বরে কথা বলা ও মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়ে রফিক সহ্য করতে না পেরে কবিতার গালে একটা চড় মেরে বলল, এই তোমার প্রগতি? এই তোমার স্বাধীনতা? এই তোমার অধিকার?

তুমি ———- তুমি ———— তুমি ————- তুমি আমাকে মারলে?

হ্যাঁ মারলাম,  আমারই ভুল হয়েছে, তুমি অবলা না, তুমি অনেক কিছু শিখেছ, অনেক বড় হয়েছ। কবিতা আজ তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই এখানে যা কিছু করবে তা দু’জনের আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে চাইলে অবশ্যই আগে আমাকে জানাতে হবে। না হলে তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

তুমি আমাকে ডিভোর্সের ভয় দেখাচ্ছ? না থাকলাম তোমার সংসারে, তোমার অনুগ্রহ নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা আমার বিন্দুমাত্র নেই,  বলে কবিতা দ্রুত বেগে বের হয়ে গেল।

 

পঁচিশ

কবিতা বাসা থেকে বের হয়ে সোজা অফিসে চলে গেল। অফিস শুরু হতে প্রায় ঘণ্টা খানেক দেরি কবিতা তার চেয়ারে আনমনা হয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল। একে একে অফিসের প্রায় সব কর্মকর্তা কর্মচারী এলো। কবিতা ইন্টারকম তুলে কয়েকবার রিং করল কিন্তু অপর পাশ থেকে ফাল্গুনীর কোন সাড়া না পাওয়ায় কবিতা কলিং বেলে চাপ দিতেই আয়া আয়েশা ভিতরে ঢুকে দাঁড়াল।

কবিতা গম্ভীর স্বরে বলল, যাও তো ফাল্গুনী ম্যাডাম এসেছেন কি না দেখে আস।

আয়া চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল ফাল্গুনী আপা আসেনি। কবিতা আরও কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে রইল। তারপর আবার ইন্টারকমে ফাল্গুনীকে রিং করে অপর পাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের মধ্যে পায়চারী করতে লাগল এক সময় কবিতার ইন্টারকম বেজে উঠল। কবিতা রিসিভার তুলতেই অপর পাশ থেকে ফাল্গুনীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কবিতা তুমি এখনি আমার রুমে এস তো।

কবিতা রিসিভার রেখে রুমে প্রবেশ করতেই ফাল্গুনী যেন চমকে উঠল, কবিতা তোমার এ কী চেহারা? কী হয়েছে?

কবিতা কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, আপা আমি রফিকের কাছ থেকে চলে এসেছি।

কেন?

আপা আমি সকাল বেলা বাসায় ফিরেছি আর সে আমার কাছ থেকে বাইরে রাত্রি যাপনের কৈফিয়ত চেয়েছে, আমাকে ডিভোর্স করার ভয় দেখিয়েছে। আমিও রাগ করে একেবারে চলে এসেছি।

আমাদের দেশের পুরুষদের এই একটা দোষ, নারীকে তারা মানুষ মনে করে না। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার পুতুল মনে করে, নারীদেরও যে স্বাধীন সত্ত্বা আছে সেটা মেনে নিতে পারে না, নারীর অধিকারকে শ্রদ্ধা করে না, ছোট-খাট কারণে গায়ে হাত তোলার  মতো ঘৃণ্য কাজ করে। তুমি বসও আমি আমাদের লিগ্যাল এ্যাডভাইজার মতিন সাহেবের সঙ্গে আলাপ করি। বলে ফাল্গুনী ইন্টারকমে লিগ্যাল এ্যাডভাইজার মতিন সাহেবকে বলল, মতিন সাহেব আমার রুমে আসুন।

অল্পক্ষণের মধ্যে মতিন সাহেব সালাম জানিয়ে ফাল্গুনীর রুমে ঢুকলেন।

ফাল্গুনী মতিন সাহেব বলে একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল, মতিন সাহেব কবিতার কাছে সবকিছু শুনুন তার পর আমি বলছি, বলে ফাল্গুনী একটু থামল তারপর কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল, কবিতা এখন তুমি বলও।

মতিন সাহেব কবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ম্যাডাম বলুন, ঘটনার বিবরণ দিন আমি আরজি লিখছি।

মতিন সাহেব আগে আপনি শুনুন তারপর সাজিয়ে লিখবেন, কবিতা বলল।

জি ম্যাডাম বলুন।

রফিক আমাকে খুব ভালবাসত কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই সে আমকে পছন্দ করত না, আসলে সে আমার চাকরিটা মেনে নিতে পারেনি। আমি স্বাবলম্বী হই নিজের মতো করে চলি এটাও সে কোনদিন মানতে পারত না। সে চাইত আমি আমার শিক্ষা, মেধা দিয়ে শুধুমাত্র তার সেবা করে কাটিয়ে দেই। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে আমাকে আবার সংসারের কাজ গুছাতে হত, তখন সে কোন কাজে কোনদিন আমাকে বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেনি। গতকাল আমাদের ডোনার এজেন্সির প্রতিনিধি এসেছিলেন আমি তাদের সঙ্গে ফিল্ডে গিয়েছিলাম সার্ভে করতে, সেখান থেকে রেস্ট হাউজে ফিরে আপাসহ তাদের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছি তারপর আপার বাসায় কোন রকমে রাত কাটিয়ে সকাল বেলা বাসায় ফিরলাম। এ নিয়ে দু’য়েকটি কথা কাটাকাটি হতেই সে আমার গালে জোরে চড় মারল।

যৌতুক চেয়েছিল নাকি? ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল।

কবিতা মৃদু কণ্ঠে বলল, ও যৌতুক চায়নি আপা।

কেন তুমি তোমার বাপের বাড়ি থেকে কালার টি.ভি এনে দাওনি, বলে ফাল্গুনী একটু থামল তারপর বলল, মতিন সাহেব দেখুন কালার টি.ভি’র ইস্যুকে যৌতুক হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন কি না?

মতিন সাহেব বললেন, দেখুন আপা, স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে যার ক্ষত চিহ্ন শরীরে নেই, উপযুক্ত সাক্ষী নেই, এমন একটা দুর্বল ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে মামলা করলে বেনিফিট পাওয়া যাবে না। আপনাদের যদি বিবাদীকে শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা থাকে আর যৌতুকের মতো কোন ইস্যু থেকেই থাকে তবে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে মামলা করা যেতে পারে।

যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে মামলা করলে বিবাদীর জামিন হবে না, নিশ্চিত হাজতবাস, বেশিরভাগ মামলায় দেখা যায় ভিক্টিম ততদিন রিজিট থাকতে পারেনা ফলে মামলায় সুফল পাওয়া যায় না। তুমি ভেবে দেখ, তোমার উকিল সাহেবকে হাজতে রেখে তুমি থাকতে পারবে কী না? বলে ফাল্গুনী কবিতার দিকে তাকিয়ে রইল।

কবিতা মুখে কিছুই বলল না, পূর্বের মতো অনড়ভাবে বসে রইল।

 

ছাব্বিশ

রফিকের বিরুদ্ধে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে কবিতা মামলা করেছে এ খবরটি মুহূর্তেই আদালত পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। খবরটি শুনে রফিক লজ্জায় আর ক্ষোভে ভেঙ্গে পড়ল। সেদিন কোর্টে তার একটি মামলা ছিল রফিক মামলাটির পরিচালনা শেষ হওয়া মাত্র বাসায় ফিরল।

রফিক নিজেই আইনজীবী, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের কঠোরতা আর তার নিশ্চিত হাজত বাসের দুঃস্বপ্ন তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল। তিলে তিলে গড়া রফিকের আর্থিক সফলতা আর সামাজিক মর্যাদা সবই আজ ধূলিসাৎ হতে চলেছে। রফিক শৈশব থেকে কঠোর বাস্তবতার মধ্যে বড় হয়েছে। খুব সহজে সে ভেঙ্গে পড়ার মতো নয় কিন্তু আজ সে আগের মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে টিকে থাকতে পারল না। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। রফিক অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করল।

মেয়ে-জামাইয়ের দাম্পত্য কলহ শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ানোর কথা শুনে খালেক সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি প্রথমে কবিতার কাছে গিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু কবিতা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় তিনি রফিকের বাসায় চলে এলেন। খালেক সাহেব রফিকের ড্রইং রুমে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর একটা নিঃশ্বাস টেনে বললেন, বাবা সম্পূর্ণ ঘটনাটা আমাকে খুলে বলতো কী হয়েছে?

আব্বা কবিতা বেশ কিছুদিন থেকে চলাফেরায় খুব অনিয়ম করছিল, প্রায় দিনই সে সকাল বেলা অফিস যেত আর অনেক রাতে বাসায় ফিরত, একজন স্বামী হিসেবে তার খোলামেলা চালচলন, আক্রমণাত্মক কথাবার্তা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। তবুও দিন চলে যাচ্ছিল কোনভাবে, গত রাতে সে বাসায় ফিরেনি।

রফিকের কথার মাঝে বাধা দিয়ে খালেক সাহেব কপালে চোখ তুলে বললেন, বলও কী!

জি আব্বা।

সকালবেলা বাসায় ফিরল তারপর দু’য়েক কথা জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার কাছে যেতেই আমি মদের গন্ধ পেলাম। আমার মাথায় খুন চেপে গেল, জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মদ খেয়েছ?

কবিতা খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, হ্যাঁ খেয়েছি।

আমি সহ্য করতে না পেরে একটা চড় মারলাম।

তারপর কবিতা বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

কোর্টে গিয়ে জানলাম যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে সে আমার উপর মামলা করেছে। বলতে বলতে রফিকের কণ্ঠস্বর বুজে এলো দু’চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

খালেক সাহেব নিজেও অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি বলতে শুরু করলেন, তোমার উপর মামলা করার কথা শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি পরে যখন জানলাম সত্যি সে তোমার উপর মামলা করেছে তখন সোজা তার অফিসে চলে গেলাম। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে আর আমার মেয়ে নয় আমিও যেন তার বাবা নই। আমি পুরুষ হিংস্র প্রাণী, আর সে দুর্বল প্রাণী, তাকে গ্রাস করার জন্য যেন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ এমনকি আমিও তাড়া করছি। ঘৃণায় আমার মন ভরে গেল। আসলে তুমি আগেই ভুল করেছ ওকে আঁচলের মতো একটা নারীবাদী সংগঠনে চাকরি করতে দিয়ে, তোমার কি টাকার এতই অভাব ছিল যে, ও চাকরি না করলে তোমার সংসার চলত না।

রফিক মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি ওকে চাকরি করতে দেই নি আব্বা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফাল্গুনীর প্ররোচনায় সে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া আমি যখন বাধা দিতে পারলাম না তখন ভাবলাম সে যখন তার মেধা কাজে লাগাতে চায় তো অসুবিধা কী? বিভিন্ন অফিস আদালতে মেয়েরা চাকরিও করছে, সংসারও করছে, দেশের উন্নয়নে এবং নিজের সংসারের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু আঁচলের মতো নারী বাদী সংগঠনে তাকে চাকরি করতে দেয়া তোমার ঠিক হয়নি। আঁচল একটি লিঙ্গ বৈষম্য তৈরিকারী সংগঠন। সেখানে চাকরি করে সে পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে আর আঁচলের পরিচালক ফাল্গুনী নিজেও একজন পুরুষ বিদ্বেষী মহিলা। সেজন্য ইতিমধ্যে সে দু’বার সংসার ছেড়েছে। এখন আমার মেয়ের পিছে লেগেছে। ঐ মেয়েটাই তো সব নষ্টের গোড়া, স্বাধীনতার নামে সে কবিতাকে উশৃঙ্খলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে আগে নিজের ঘর ভেঙ্গেছে এখন কবিতার ঘর ভাঙ্গল। আমাদের দেশীয় কালচারকে জলাঞ্জলি দিয়ে কবিতাকে অপসংস্কৃতি শিখিয়েছে। সে এমন ভাবে কবিতার ব্রেইন ওয়াশ করেছে যে কবিতাকে কিছুতেই সংসারে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। হয়ত কোনদিন তাকে সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে না, বলে খালেক সাহেব একটু থামলেন তারপর বললেন, যা হোক এখন মামলা ফেস করা ছাড়া তোমার আর কোন বিকল্প নেই। তোমার মামলা পরিচালনার জন্য আমি হাসেম সাহেবকে দায়িত্ব দেব, কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমাকে বলও আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

রফিক কপালে চোখ তুলে বলল, আপনি কি বলছেন আব্বা? আপনি আমার মামলা পরিচালনা করবেন না? আপনি আমাকে ছেলের মতো মানুষ করেছেন, আমাকে হাজতে রেখে আপনি কি ঘুমাতে পারবেন? খেতে পারবেন? বলতে বলতে রফিকের গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।

না বাবা না মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় আমি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারি, তাতে তোমার ক্ষতি হতে পারে তার চেয়ে আমি হাবিব সাহেব, কাশেম সাহেব আর হায়াত সাহেবকে তোমার মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেব। আর একান্তই যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে তো আমি আছিই, ভেঙ্গে পড়িও না। বলে খালেক সাহেব উঠে পড়লেন।

 

সাতাশ

রফিকের বিরুদ্ধে কবিতার মামলা দায়ের করার কথা শুনে শ্রাবণী স্থির থাকতে পারল না। তার কেবলই মনে হলো, কবিতা এমন ছিল না, এমন হওয়ার কথা নয়। ফাল্গুনী আপাই তার সুন্দর জীবনটা এলোমেলো করে দিল। শ্রাবণী মাসুদকে বলে সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বের হলো।

শ্রাবণীকে দেখে ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল, কী রে তুই? হঠাৎ কী মনে করে?

আপা তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

বেশ তো বল।

কবিতা তার হ্যাজবেন্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেছে?

হ্যাঁ।

কেন?

ওর হ্যাজবেন্ডটা ওকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেছিল।

শ্রাবণী অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই কবিতাকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেছে?

হ্যাঁ, অবাক হচ্ছিস কেন?  স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করা এটাই তো বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্র।

শ্রাবণী রাগান্বিত স্বরে বলল, আপা তুমি ঠিক বলছ না, রফিক ভাই যৌতুক চাইতে পারে না।

সেটা কোর্টে প্রমাণ হবে।

শ্রাবণী ক্রোধে ফেটে পড়ল, তুমি পরামর্শ দিয়ে কবিতাকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করালে। তুমি ওদের সংসার ভাঙ্গলে, রফিক ভাই-এর মতো সহজ-সরল মানুষের জীবনটা তুমি নষ্ট করলে।

ফাল্গুনী চোখ রাঙিয়ে বলল, শ্রাবণী যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না।

আপা আমি কিছু জানি না ঠিকই, কিন্তু তুমি তো সবই জানো, তবে  কী লাভ হয়েছে? তুমি পর পর দু’বার সংসার ভেঙ্গেছ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে নারী পুরুষ বৈষম্য তৈরি করছ, বলতে পার পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব?

তুমি যদি বলও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই, তবে আমি বলব তুমি ভুল পথে চলছ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তোমার মেধা, শ্রম সব বিফলে যাবে। আমি যতটুকু জানি তাতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু তুমি এবং তোমার সংগঠনের কাজ একপেশে এবং পুরুষ বিদ্বেষী।

যেমন?

কবিতার কেসটাই ধরো, আমি একশ পার্সেন্ট কনফার্ম যে রফিক ভাই যৌতুক চায়নি, কেসটা সাজানো এবং রফিক ভাইকে হয়রানী করার জন্য এই কেস করা হয়েছে। অপরদিকে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যৌতুক ছাড়া কোন বিয়েই হয় না। শহরেও অধিকাংশ বিয়েতে প্রকাশ্যে যৌতুক দেয়া-নেয়া হয়। প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা শহরে যৌতুক প্রথা বন্ধের জন্য জনগণকে সচেতন করার মতো তোমার সংগঠনের কি কোন প্রোগ্রাম আছে? তোমার প্রোগ্রাম আছে শুধু নির্যাতিত নারীকে আইনগত সহায়তা দেওয়া। অথচ যৌতুক বন্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের সচেতন হওয়া।

বাহ্‌ তুই তো অনেক কিছু জানিস।

বেশি জানিনা তবে যেটুকু জানি সঠিক জানি। হ্যাঁ তোমাকে আরও একটা পরামর্শ দিতে পারি, আর তা হলো জনসচেতনতার জন্য পোস্টার, ফেস্টুন, ট্রেনিং ছাড়াও তুমি ঘটক, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং ইমামদের সম্পৃক্ত করে নারী-পুরুষ সকলের মাঝে  সচেতনতা সৃষ্টি করতে পার। তুমি যদি সত্যি সত্যিই নারী নির্যাতন বন্ধে ভূমিকা রাখতে চাও, যৌতুক বন্ধ করতে চাও তবে নারী পুরুষ উভয়কে সচেতন করতে হবে। শুধু মাত্র পুরুষ দ্বারাই নারী নির্যাতিত হচ্ছে ধারণাটা এক পেশে। বরং নারী-পুরুষ উভয়ের দ্বারাই উভয়ই নির্যাতিত হচ্ছে।

ফাল্গুনী তিরস্কারের সুরে বলল, বাহ্‌ তুই তো দেখছি ভালোই জ্ঞান দিতে শিখেছিস। এতকিছু জানলি কীভাবে?

পত্রিকা খুললেই দেখি অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা। বিচিত্র ধরনের বর্বরতা। স্বামীর দ্বারা, বন্ধুর দ্বারা, ননদ-দেবর দ্বারা, শ্বশুর শাশুড়ি দ্বারা নারী নির্যাতন। বখাটে যুবকের দ্বারা স্কুলগামী কিশোরী লাঞ্ছিত, গৃহকর্ত্রীর দ্বারা কাজের মেয়ে নির্যাতিত। যারা নারী নির্যাতন করে তারা সমাজের শত্রু, নারী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই নারী নির্যাতন বন্ধে চাই একটি সামাজিক বিপ্লব, নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস। কঠোর আইন আর আইনের মার প্যাঁচে ফেলে নিরীহ মানুষকে হয়রানী নয়, লিঙ্গ বৈষম্য নয়, নারী পুরুষ ভেদাভেদ নয়। এখন সব নারী পুরুষকে এক সারিতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে আমরা সবাই মানুষ।

ফাল্গুনী শ্রাবণীর কথা শুনেও না শোনার ভান করে বসে রইল। শ্রাবণী ফাল্গুনীর গা ঘেঁষে বসে বলল, প্লিজ আপা তুমি কবিতাকে বুঝাও ও যেন মামলা তুলে নেয়।

ফাল্গুনী তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ও তোকে তাহলে উকিল সাহেব পাঠিয়েছে, উকিল সাহেবের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।

আপা আমাকে কেউ পাঠায় নি। আমি নিজেই এসেছি, প্লিজ কবিতার ঘর ভেঙ্গে দিও না।

কবিতার ঘর আমি ভাঙ্গছি, যা না তোর বান্ধবীর কাছ থেকে শুনে দেখ সে তার স্বামীর আচরণে অতিষ্ঠ কি না?

আপা কবিতা আমাদের বাসায় এসেছে?

হ্যাঁ তোর রুমে গিয়ে দেখ।

 

আঠাশ

অফিস সময়ে কবিতা সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। আর অফিস সময়ের পর বাসায় ফিরে বেশির ভাগ দিনই আনমনা হয়ে ঘরে বসে  কাটিয়ে দেয়। কবিতার মনের মধ্যে সব সময় একটা শূন্যতা বিরাজ করে। এ ক’দিনে তার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গেছে। তার চোখে মুখে চিন্তার রেখা পড়েছে। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে কবিতার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। রফিকের কাছ থেকে চলে আসার পর থেকে তার গভীর নিদ্রা হারিয়ে গেছে। সব কিছু থেকেও যেন তার কিছুই নেই। এটা কবিতা যেমন সাইতে পারে না, তেমনি কাউকে বলতেও পারে না।

কবিতা তখন ঘরে বসে ছিল, শ্রাবণী তার ঘরে প্রবেশ করে বলল, কীরে শুয়ে আছিস কেন?

কবিতার চোখে-মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠল, শ্রাবণী কখন এলি শ্বশুর বাড়ি থেকে?

এই তো সবেমাত্র এলাম।

তোর সাহেবকে নিয়ে আসিসনি।

ও তো খুব ব্যস্ত তাই একাই চলে এলাম, তুই এই অসময়ে শুয়ে আছিস কেন?

কবিতা মলিন হেসে বলল, আমার আবার সময় অসময়?

চল কোথাও বেড়াতে যাই, তোর ভালো লাগবে।

তুই না কেবল এলি।

তাতে কী?

কোথায় যাবি?

তোর সময় কাটছে না, আমিও বেড়াতে এসেছি। দু’জনে বিকাল বেলা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াব আর কী।

কিছুক্ষণের মধ্যে দু’জনে রিক্সায় চেপে বেরিয়ে পড়ল, কিছুদূর যাবার পর রিকশাওয়ালা জানাতে চাইল, কোনটে যাইবেন বুজান?

শ্রাবণী বলল, ধরলার পাড়ে যাও।

রিক্সা ছুটে চলল ধরলা নদীর তীরে। কিছুক্ষণের মধ্যে রিক্সা ধরলা নদীর তীরে এসে দাঁড়াল। শ্রাবণী রিক্সা ওয়ালাকে বলল, বান ধরি সিধায় হলোখানার পাকে চলি যাও।

কবিতা জিজ্ঞেস করল, হলোখানায় কেন?

এখান থেকে হলোখানা পর্যন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর, বাঁধের দুপাশে সারি সারি গাছ দেখে, তোর খুব ভালো লাগবে। তাছাড়া তোকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তোর অনেক কিছু শেখার আছে।

এমনভাবে গল্প করতে করতে রিক্সা অনেকদূর এগিয়ে চলল, সামনে রাস্তার ঢালে বিত্তহীন মানুষের কয়েকটি ঘর। শ্রাবণী রিক্সা দাঁড় করিয়ে কবিতাকে বলল, নাম।

দু’জনে রিক্সা থেকে নেমে রাস্তার ঢালের একটি বাড়িতে ঢুকে শ্রাবণী লাকী লাকী বলে কয়েকবার ডাক দিল।

জীর্ণ মলিন শাড়ি পরিহিতা অল্প বয়সের এক মহিলা শ্রাবণীর সামনে এসে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল, বুজান তোমরা?

তারপর একরকম দৌড়ে গিয়ে উঠানে একটি পাটি বিছিয়ে দিয়ে বলল, বসেন আপা, বইসো বুজান বইসো, মুই ভাইববার পাঁও নেই তোমরা হামার মতন গরীব মাইনসের ঘরত আসমেন।

হ্যাঁ এই তো এসেই পড়লাম, বলে শ্রাবণীর সাথে লাকীর পরিচয় করিয়ে দিল। লাকী চলে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিন/চার বছরের একটি মেয়েকে কোলে নিয়ে এসে বলল, বুজান মোর বেটি নদী।

শ্রাবণী মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল, সহিদ কোথায় গেছে?

ও ক্ষেতে গেছে আপা, এখনই চলে আসবে, বলে লাকী চলে গেলে শ্রাবণী বলতে শুরু করল, লাকীর বাবা মা কেউ নেই। খুব ছোট বেলা থেকেই সে আমাদের বাসায় কাজ করত এবং বাবাই লাকীকে বিয়ে দিয়েছেন।

এমনসময় কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে সহিদ বাসায় ঢুকেই সালাম দিল। তারপর কাঁধের লাঙ্গল নামিয়ে রেখে নদীকে কোলে নিয়ে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল, বুজান ভালো আছেন? বাবা-মা ফাল্গুনী বুজান সঁবায় ভালো আছে?

হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। কি ব্যাপার তোমরা অনেকদিন থেকে যাচ্ছ না যে?

ম্যালা কাম বুজান, ২ কানী জমিত ইরি ধান লাগাছি, তোমার দোয়াত দুইটা হালের গরু কিনছি, সেই জন্যে যাওয়া হয় না। তা তোমরা আচছেন হামরা কী যে খুশি হছি, তারপর কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল, বুজান তোমাক তো চিননু না।

আমার বান্ধবী কবিতা।

সহিদ আবার কবিতাকে সালাম দিয়ে চলে গেলে লাকী একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট আর চানাচুর দু’জনের সামনে দিয়ে বলল, খাও বুজান।

কবিতা লাকীকে জিজ্ঞেস করল, লাকী তোমাদের বিয়ের কতদিন হলো?

পাঁচ/ছয় বছর হইল তা বুজান হামরা সংসারত সে রকম কিছু কইরবার পাই নাই, আগত হামরা বাড়ি আছলো ঐ পাকে ঘর দুয়ার সউগ ধরলা নদীতে ভাঙ্গি গেছে। গেলবার ভালো ধান আবাদ হছলো, সেই ধান ব্যাচায়া আর কানের দুল ব্যাচে হরিকেশ পাঁচ শতক বাড়ি কইরবার জমি কিনছি। ওমরা কইছে ধান ব্যাচেয়া মোক কানের দুল কিনি দেবে।

কবিতা লাকীর কাছে এত কিছু শুনতে চায়নি, কিন্তু সহজ-সরল লাকীকে তার সুখের কথা মনের আনন্দে বিড়বিড় করে বলতে দেখে কবিতা মৃদু হেসে চুপ করে বসে রইল।

শ্রাবণী লাকীর দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই কবিতা বলল, শ্রাবণী বলতে দাও না, শুনি। বলে কবিতা একটু থামল। তারপর মৃদু কণ্ঠে লাকীকে জিজ্ঞেস করল, লাকী সহিদ কি কোন কাজ করার আগে তোমাকে জানায়?

লাকী লজ্জায় মাথা নত করে বলল, হ্যাঁ বুজান হামরা সউগ কাম দুইজন এক সাথে করি।

সহিদ নদীকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উঠানের দিকে আসতেই শ্রাবণী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কবিতা হাটে যাই।

দু’জনে সহিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার রিক্সায় উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে রিক্সা ধরলা নদীর তীরে নির্মিত গ্রোয়েনের কাছে পৌঁছল।

কবিতা শ্রাবণীকে বলল, শ্রাবণী চল, আমরা একটু গ্রোয়েনের উপর বসি।

বেশতো চল, বলে দু’জনে রিক্সা থেকে নেমে গ্রোয়েনের উপর একটা বেঞ্চে মুখোমুখি বসল।

বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে নীরবে বসে রইল।

শ্রাবণী মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, কবিতা-

কবিতা মৃদু কণ্ঠে বলল, হুঁ, জ্ঞান তো ভালোই দিলি।

জ্ঞান দিলাম না, চোখ খুলে দিলাম। আভিজাত্য আর অহঙ্কারে অন্ধ তোর বিবেকের চোখ খুলে দিলাম। মলিন শাড়ি পরে জীর্ণ ঘরে বসবাস করে অশিক্ষিত একটি মেয়ে সুখ খুঁজে পায়, আর তুই সুখের মধ্যে থেকেও সুখ ধরে রাখতে পারলি না। এজন্য কারো দোষ নেই, এটা তোরই ব্যর্থতা।

কবিতা কোন কথা না বলে নীরবে বসে রইল।

শ্রাবণী কবিতাকে বলল, আচ্ছা কবিতা আমি তোকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

বল।

রফিক ভাই কি সত্যি সত্যিই তোকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেছিল?

কবিতা যেমনভাবে বসেছিল ঠিক তেমনি অনড় ভাবে বসে রইল।

শ্রাবণী আবার বলতে শুরু করল, আচ্ছা কবিতা তুই তো আমাকে বলেছিলি রফিক ভাই একজন সৎ মানুষ এমনকি তোর জানামতে তিনি মিথ্যা কিংবা কোন সাজানো মামলার ওকালতি করেন না। তাই যদি হয় তবে তুই কীভাবে বিশ্বাস করতে বলিস রফিক ভাই তোকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেছেন?

কবিতা তবুও কিছু বলল না পূর্বের মতো বসে রইল।

শ্রাবণীর কথার কোন উত্তর না দিলেও কবিতার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে গেল। রফিককে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, অনেকদিন তার সঙ্গে সংসার করেছে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে তার মান-সম্মান ধূলিসাৎ করেছে। কবিতার একবার মনে হলো মামলা তুলে নিয়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে রফিকের কাছে ফিরে যেতে। আবার পরক্ষণেই মনে হলো এতকিছুর পরও রফিক কি তাকে আবার আপন করে নিবে?

ভাবতে ভাবতে কবিতার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

 

উনত্রিশ

পর পর কয়েকটি তারিখ অতিক্রান্ত হলো, রফিকের আইনজীবী বার বার জামিন প্রার্থনা করে জামিন নামঞ্জুর হলো। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই হাজতে রফিকের কয়েকমাস কেটে গেল। তারপর একদিন অনুষ্ঠিত হলো শুনানি। জনাকীর্ণ আদালতের কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে রফিক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে মাটি ফেটে সে গর্তের মধ্যে ঢুকে মরে গিয়ে বেঁচে যাক তবুও এই আদালত থেকে সে মুক্তি পাক। এমনি অসংখ্য দিন অনেক আসামিকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সে মামলা পরিচালনা করেছে। তখন কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে তাকে একদিন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, তাও আবার নিজের স্ত্রীর দায়ের করা মামলার আসামি হয়ে। আর আজ আদালতে অনেক উকিল ছাড়াও দর্শনার্থীদের ভিড় হয়েছে। হয়ত আইনজীবীর বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি দেখার জন্য দর্শনার্থীরা ভিড় করছে তাছাড়া কবিতা মামলা করার দিন থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কল্পনা প্রসূত, মুখরোচক নিউজ আসছে, নারীবাদী সংগঠনগুলো মিটিং মিছিল করে রফিকের অপরাধের শাস্তি দাবী করছে, অথচ যে মামলায় রফিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারপরও কোন লাভ নেই কারণ রফিক আইনজীবী হিসেবে জানে যে সত্য মিথ্যার উপর ভিত্তি করে বিচার হয় না, বিচার হয় মামলার আলামত আর সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে।

বাদী পক্ষের উকিল বিচারকের অনুমতি নিয়ে মামলার বিবরণ ধারাবাহিকভাবে বলতে শুরু করলেন, ইয়োর অনার আসামির  কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান যৌতুক নিরোধ আইনের আসামি আমার বিজ্ঞ বন্ধু জনাব মোঃ রফিকুল ইসলাম আমার মক্কেল কবিতার পিতা এই শহরের স্বনাম ধন্য আইনজীবী জনাব আব্দুল খালেকের আশ্রয়ে থেকে মহুরির কাজ নেয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই চরিত্রহীন আসামির কুনজর পড়ে কবিতার উপর। আসামির বিনয়ী ব্যবহার আর সহজ-সরল, কোমলমতি কবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে খালেক সাহেব মেয়েকে আসামির হাতে তুলে দেন। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আসামির আসল চেহারা উন্মোচিত হয়। আসামি বিয়ের কয়েকদিন পরই কবিতাকে যৌতুকের জন্য চাপ দেয়, আমার মক্কেল যৌতুকের জন্য পিতৃগৃহে যেতে অস্বীকার করলে আসামি তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। আমার মক্কেল প্রাণ ভয়ে এবং সুখী দাম্পত্য জীবন যাপনের জন্য পিতার কাছ থেকে একটি কালার টি.ভি এনে আসামিকে দিলে তখনকার মতো আসামি শান্ত হয়। সংসারের অচলাবস্থা ও নিজের মেধা বিকাশের জন্য আমার মক্কেল আঁচল নামক একটি এন.জি.ও’তে চাকরিতে যোগদান করে। আমার মক্কেলের চাকরিতে যোগদানের পর আসামির অর্থের চাহিদা আরো লাগামহীন হয়ে যায় এবং আমার মক্কেলের বেতনের টাকা ছাড়াও তার উপর আরো যৌতুকের টাকার জন্য দুর্ব্যবহারসহ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে, ফলে আমার মক্কেল সুবিচারের আশায় আদালতের শরণাপন্ন হয়, বলে বাদী পক্ষের উকিল একটু থামলেন তার পর বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, মাননীয় আদালত ঘটনার বিবরণ পুলিশের প্রতিবেদনে যৌতুক হিসেবে দেয়া কালার টি.ভি আসামির বাড়িতে থাকার সত্যতা, আমার মক্কেলের শরীরে ক্ষত চিহ্ন, যৌতুক গ্রহণ এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনের সাক্ষ্য বহন করে। তাই আমি আসামির যৌতুক নিরোধ আইনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির আদেশ প্রদানের জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

বাদী পক্ষের উকিলের বক্তব্য শেষে আদালতে উঠে দাঁড়ালেন আসামি পক্ষের আইনজীবী আবুল হাসেম, ইয়োর অনার আমি বাদীকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অনুমতি প্রার্থনা করছি।

বিচারক গম্ভীর স্বরে বললেন, অনুমতি দেয়া গেল।

হাসেম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাডাম কবিতা, আপনি তো একটি নারী উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন?

জি।

আপনার অফিস টাইম কয়টা থেকে কয়টা?

সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা।

আপনি কি প্রতিদিন বিকেল চারটায় বাসায় ফিরতেন?

অফিসের কাজে মাঝে মাঝে ফিরতে দেরি হত, তাছাড়া নরমালি আমি চারটার সময় অফিস থেকে বাসায় ফিরতাম।

আচ্ছা বলুন তো ঘটনার আগের দিন আপনি কয়টায় বাসায় ফিরেছেন?

এ সময় বাদী পক্ষের উকিল প্রতিবাদ করে বললেন, অবজেকশন ইয়োর অনার, আমার বিজ্ঞ বন্ধু মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন।

বিচারক গম্ভীরস্বরে বললেন, অবজেকশন সাসপেন্ড।

আসামি পক্ষের উকিল হাসেম সাহেব বললেন, বলুন ঘটনার আগের দিন আপনি কখন বাসায় ফিরেছেন?

রাত নয়টায়-

আপনি মিথ্যা বলছেন।

কবিতা থতমত খেয়ে বলল, না মানে-

হাসেম সাহেব দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, মানে মানে করছেন কেন আপনি সেদিন রাতে বাসায় ফিরেননি।

কবিতা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

হাসেম সাহেব বললেন, অফিসের কাজ শেষে আপনি ড্রিংক করে অ্যাবনরমাল অবস্থায় বাসার বাইরে রাত্রি যাপন করেন। আমার মক্কেল দিনের পর দিন স্বাধীনতার নামে উশৃঙ্খলতা সহ্য করতে করতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং সেদিন ঘরের বাইরে রাত্রিযাপনের কারণ জিজ্ঞেস করতেই আপনি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বাসা থেকে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। আপনার স্বামীর ঘর ছেড়ে আসাটাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ইস্যু তৈরি করেছেন, নাকি আমার মক্কেল আপনাকে যৌতুক এনে দেওয়ার জন্য শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন?

আমাকে যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করেছে।

হাসেম সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার মক্কেল আপনাকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন?

জি।

আচ্ছা বলুন তো আমার মক্কেল কি এই প্রথম যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করেছেন না কি আগেও করেছেন?

আগেও একবার যৌতুকের জন্য চাপ দিয়েছিল।

তারপর।

আমি বাবার বাড়ি থেকে একটা কালার টি. ভি এনে দিয়েছিলাম।

না, আপনি মিথ্যা বলছেন, আমার মক্কেল আপনাকে যৌতুকের জন্য চাপ দেয়নি বরং আপনি আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাবার কাছে বায়না ধরে টি. ভি নিয়ে আসেন।

এ সময় বাদী পক্ষের উকিল প্রতিবাদ করে বললেন, মাননীয় আদালত আমার বিজ্ঞ’ বন্ধু আমার মক্কেলকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করছেন।

এতক্ষণ কবিতার বাবা খালেক সাহেব আদালতের অন্য একটি এজলাসে একটি মামলা পরিচালনা করছিলেন। এজলাসে ঢুকতে ঢুকতে তিনি কাছে এসে বাদী পক্ষের উকিলের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বললেন, না, আমার বিজ্ঞ বন্ধু আসামি পক্ষের আইনজীবী বাদীকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করেননি বরং বাদী আসামির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। বলে তিনি বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ইয়োর অনার আমি বাদীর বাবা এবং আসামির শ্বশুর রফিক কৈশোর থেকে আমার অফিসে মহুরির কাজ করতে করতে নৈশ কালীন আইন কলেজ থেকে এল. এল. বি. পাস করে। কৈশোর থেকে তার আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আমি আমার ছোট মেয়ে কবিতার সঙ্গে উভয়ের সম্মতিতে বিয়ের বন্দোবস্ত করি। তার বিয়ের সময় কোন যৌতুকের চুক্তি হয়নি এবং রফিক কোনদিন যৌতুক দাবি করেনি। বাদী আসামির নির্যাতনে বাবার বাড়ি থেকে যে টি.ভি নিয়ে আসার অভিযোগ করেছেন। আমি সেই বাবা এবং আমি পেশায় একজন আইনজীবী আমি এই আদালতে হলফ করে বলছি আসামি আগেও যৌতুক দাবি করেনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা এবং হয়রানীমূলক। আমি আসামির বেকসুর খালাস প্রদানের আদেশ প্রদানের জন্য মহান আদালতে প্রার্থনা করছি।

বিজ্ঞ বিচারক একটানা কয়েক মিনিট লিখার পর মুখ তুলে গম্ভীরভাবে মামলার পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করে আদালত মুলতবি ঘোষণা করলেন।

 

ত্রিশ

কবিতার চোখে ঘুম নেই তার চোখের সম্মুখে রফিকের বিষণ্ণ মুখ, ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছবি ভেসে উঠছে। মনের মধ্যে অনেক ভাবনা ভিড় করছে। রফিকের বিরুদ্ধে যৌতুক চাওয়ার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় রফিক দোষী সাব্ব্যস্ত হলে কি তার জেল হবে? আঁচলের লিগ্যাল এ্যাডভাইজার বলেছে দোষী সাব্ব্যস্ত হলে রফিকের জেল হবে। কিন্তু একজন নিরপরাধ মানুষ মিথ্যে অভিযোগে জেল খাটবে? এমনিতেই রফিকের হাজতে কয়েকমাস কেটে গেছে, তার চোখ দু’টো কোটরে বসে গেছে এ ক’দিনে যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে রফিকের চোখে একবার চোখ রাখতেই কবিতার বুক শুকিয়ে গেছে, হৃদয় আঁৎকে উঠেছিল। কবিতার ইচ্ছা হয়েছিল কাঠগড়া থেকে নেমে রফিকের বুকে নিজেকে সমর্পণ করতে কিন্তু নিজেই স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে তার কাছে যেতে তার পা শিথিল হয়ে গিয়েছিল। কবিতা দু’চোখ বন্দ করো অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল কিন্তু চোখে ঘুম নেই ”শেষ পর্যন্ত কি আমার সংসার ভেঙ্গে যাবে? তারপর ফাল্গুনী আপার মতো বাকী জীবন একাই কাটাতে হবে? না না এটা হতে পারে না, আমি একাই জীবনের বোঝা বইতে পারব না, আবার রফিক যদি আমাকে ডিভোর্স করে তবে- তবে কি হবে?’’ না না আর ভাবতে পারছে না কবিতা, কবিতার ইচ্ছা হচ্ছে সবকিছু ভুলে গিয়ে যদি রফিকের কাছে আবার যেতে পারত তবে তার এই দুঃসহ জীবনের সমাপ্তি ঘটত। কিন্তু এত কিছুর পরও রফিক কি তাকে গ্রহণ করবে? হয়ত গ্রহণ করবে না তবে বাবাকে রফিক খুব শ্রদ্ধা করে বাবার অনুরোধ রাখতেও পারে তাছাড়া শ্রাবণীকে রফিক খুব পছন্দ করে শ্রাবণীও ভূমিকা রাখতে পারে। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে কবিতা একবার ফাল্গুনীর দিতে তাকাল ফাল্গুনী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কবিতা বিছানা থেকে উঠে টেলিফোন করল। অপর পাশ থেকে মাসুদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

কবিতা একবার ফাল্গুনীর দিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, দুলাভাই আমি কবিতা।

কী খবর? এত রাতে? কোন দুঃসংবাদ নেই তো?

না দুলাভাই আপনি কি একটু শ্রাবণীকে ডেকে দিবেন?

জি দিচ্ছি তারপরই শ্রাবণীর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো কবিতা কী খবর?

কবিতা বলল, কিছু না রে ভালো লাগছিল না তো তাই।

রাত জাগিস না ঘুমানোর চেষ্টা করো।

শ্রাবণী কথাটা কী করে যে বলি তোকে?

না বলার মতো হলে বলিস না।

শ্রাবণী আমার উপর রাগ করিস না আমার মনটা খুব খারাপ।

তো আমি কী করতে পারি তোর জন্য?

কবিতা ভারী গলায় বলল, আসলে চোখ বন্ধ করলেই শুধু রফিকের ছবি ভেসে উঠছে ও খুব শুকিয়ে গেছে।

শ্রাবণীর কথায় অভিমানের সুর ভেসে এলো, ওর কথা ভাবিস কেন? ও শুকিয়ে গেলে তোর কী?

কবিতার দু’চোখ সজল হয়ে উঠল, কণ্ঠস্বর বুজে এলো, শ্রাবণী আমি ওর কাছে ফিরে যেতে চাই।

তোর জন্য বেচারা কয়েকমাস হাজত খাটল এখন তুই ফিরে যেতে চাইলেই কি সে তোকে নিবে?

শ্রাবণী ও খুব ভালো, ওর মনটা খুব উদার ও বেশিদিন রাগ পুষে রাখতে পারে না।

আমি জানিনা কবিতা তোর জন্য কিছু করতে পারব কী না? তবে আমার মনে হয় তোর বাবা ছাড়া কেউ তোর জন্য কিছু করতে পারবে না।

আমি জানি শ্রাবণী তুই আমাকে সহযোগিতা করবি, আমি বাবার সঙ্গে যোগযোগ করছি, বলে কবিতা রিসিভার রেখে দিল।

তারপর টেলিফোন করল তাদের বাসায়। টেলিফোনে তার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

কবিতা বলল, মা আমি কবিতা।

কী হয়েছে মা?  এত রাতে কেন?

মা একটু বাবাকে দাও তো।

তুই লাইনে থাক মা দিচ্ছি।

কবিতা অনেকক্ষণ রিসিভার কানের কাছে ধরে রাখল। তার বাবার কণ্ঠস্বর কবিতার কানে ভেসে এলো। কবিতার মা ডাক দিলেন, উঠো তো কবিতা ফোন করেছে একবার কথা বলো।

রেখে দাও আমি এখন কথা বলব না, খালেক সাহেব বললেন।

ফরিদা বললেন, ওঠো মেয়েটার নিশ্চয়ই কোন বিপদ হয়েছে তুমি একবার কথা বলো।

ও তো আমার মেয়ে না, ওর বিপদ হলে আমার কী?

ফরিদা কান্নাভাঙ্গা গলায় বলল, ওঠো না কেন? যা বলার বলে দাও।

তারপর খালেক সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

কবিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, বাবা আমার ভুল হয়েছে, বাবা তুমি আমাকে মাফ করে দাও।

খালেক সাহেবের রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এসব কথা বলার জন্য কি এত রাতে ফোন করেছিস।

বাবা আমি তোমার কবিতা, তুমি-

না তুই আমার মেয়ে না। আমার মেয়েকে আমি এভাবে গড়িনি, আমার মেয়ের নাম ছিল কবিতা সে কখনো মিথ্যা কথা বলত না। সে মরে গেছে। আর তুই একটা মিথ্যাবাদী, তুই আমার রফিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করায় আমার নিরীহ ছেলেটা এখন হাজতে আছে, সব সময় ওর নিষ্পাপ মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, কান্নায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

আমিও খুব কষ্টে আছি বাবা। আমি আর পারছিনা, বাবা আমি মামলা তুলে নিয়ে আবার ওর কাছে ফিরে যাব, বলতে বলতে কবিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ফাল্গুনী চোখ মেলে তাকাল কিছু বলল না।

অপর পাশ থেকে খালেক সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওর কাছে ফিরে যেতে চাইলেই কি ও তোকে মেনে নিবে?

ওকে আমি ম্যানেজ করবো বাবা, ও খুব ভালো, খুব বড় মনের মানুষ, বাবা আমার বিশ্বাস ও আমাকে মেনে নিবে, আর যদি মেনে না নেয় তবুও মামলা তুলে নিয়ে সারাজীবন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো। তুমি আমাকে হেল্প করো বাবা, আমি খুব কষ্টে আছি, বাবা আমি কাল বাসায় আসছি, বলে কবিতা রিসিভার রেখে দিল।

ফাল্গুনী  স্নেহ মাখা কণ্ঠে বলল, কবিতা আয় বস।

কবিতা ফাল্গুনীর পাশে বিছানায় গিয়ে বসল। ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল, তুমি মামলা তুলে নিবে?

কবিতা চোখ মুছে মাথা বাকিয়ে বলল, জি।

 

একত্রিশ

জেলখানার গেটে খালেক সাহেব অপেক্ষা করছিলেন। রফিক অনেকক্ষণ পর বের হয়ে এলো। দীর্ঘদিন পর মুক্তির নিঃশ্বাসে রফিকের বুক ভরে গেল। সে খালেক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তারপর দু’জনে রিক্সায় চড়ে রফিকের বাসায় ফিরল।

বাসায় ফিরে কবিতাকে দেখতে পেয়ে রফিকের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। সে কবিতাকে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। খালেক সাহেব রফিকের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তারপর খালেক সাহেব বললেন, তুমি একটু বসো বাবা, বিশ্রাম নাও পরে সব কথা হবে।

রফিক উত্তেজিত হয়ে বলল, পরে না বাবা আমি এখনি সবকিছু জানতে চাই।

খালেক সাহেব বললেন, বলো বাবা তুমি কী জানতে চাও?

আব্বা কবিতা মামলা তুলে নেওয়ার কারণে কি আমি মুক্তি পেলাম?

জি বাবা।

শেষ পর্যন্ত আমরা কি একটা সাজানো মামলার বাদীর সঙ্গে আপোষ করলাম? মামলায় তো আমরা এমনিতেই জিততাম, শুধু শুধু এতদিন হাজতে থাকার পর মামলা আপোষ করলাম কেন?

আমরা আপোষ করিনি বাবা। কবিতা একতরফাভাবে মামলা তুলে নিয়েছে।

তাহলে আমি ক্ষতি পূরণ মামলা করবো।

না বাবা তার আর দরকার নেই, কবিতা তার ভুল বুঝতে পেরেছে।

এমনসময় কবিতা আর শ্রাবণী রুমে ঢুকল। রফিক জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, তুমি আমার বাসায় কেন? তোমার জন্য মানুষের কাছে আমি সম্মান হারালাম, আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় হারালাম।

শ্রাবণী কবিতাকে ঈশারা করল, কবিতা রফিকের দু’হাত জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আমার ভুল হয়েছে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।

রফিক গম্ভীর স্বরে বলল, কিন্তু তোমাকে তো মাফ করা যায় না, তুমি মিথ্যা মামলা করেছ, তোমাকে মাফ করলে তো তোমাকে দেখে অনেক স্ত্রী তাদের স্বামীদের উপরে মিথ্যা মামলা করার উৎসাহ পাবে। আমি মামলা করবো, আমি যতদিন হাজত খেটেছি ততদিন তোমাকেও হাজত খাটাব তারপর মাফ এবং ততদিন তুমি আমার সামনে আসবে না।

কবিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এমন সময় মরিয়ম রুমে ঢুকল। রফিক তার মাকে দেখে চমকে উঠল, মা তুমি?

হ্যাঁ বাবা, আসতে বাধ্য হলাম। তোকে আমি বলেছিলাম, বউমার প্রতি যেন বিন্দুমাত্র অবহেলা বা অযত্ন না হয়। কিন্তু তুই আমার আদেশ অমান্য করেছিস তাই আমাকে আবার আসতে হলো, বলে একটু থামল তারপর আবার বলতে শুরু করল বউমাকে তুই অবহেলা করেছিস, তার সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ করেছিস এটা যে একটা মেয়ের জন্য কত বড় অপমানের সেটা তুই মেয়ে হলে বুঝতিস, বউমার প্রতি আর কোন অযত্ন করিস না, বলে মরিয়ম বলল, তুমি আমার কাছে এস বউমা।

কবিতা তার শাশুড়ির বুকে মাথা রেখে বলল, মা আমার ভুল হয়েছে, আপনার প্রতি আমি-

মরিয়ম কবিতার কথার মাঝে  বাধা দিয়ে বলল, ছিঃ বউমা ওসব এখন বাদ দাও তো, তুমি যে তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ আর কোন ভুল করিও না। একটু-আধটু মনোমালিন্য হতেই পারে, তাই বলে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করা তোমার মোটেই ঠিক হয়নি। কবিতা কোন কথা না বলে শাশুড়ির বুকে মুখ গুজে ডুকরে, ডুকরে কেঁদে উঠল।

মরিয়ম বলল, চলো বউমা অনেকদিন পর রফিক এসেছে, বিহাই সাহেব এসেছেন, খাবার দাবারের ব্যবস্থা করি।

এমন সময় ফাল্গুনী রুমে ঢুকল। সবাই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল।

খালেক সাহেব বললেন, আপনি?

রফিক রাগান্বিত স্বরে বলল, আপনি কেন এসেছেন? আপনার সঙ্গে মিশে আমার সহজ সরল কবিতা জটিল উশৃঙ্খল আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আপনি চলে যান প্লিজ।

ফাল্গুনী মৃদু হেসে সোফায় বসতে বসতে বলল, আপনি রেগে গেলেও আমাকে কিছু বলতে হবে রফিক সাহেব, নারী উন্নয়ন, আমার সংগঠন ও কবিতার চাকরি করা সবকিছু মিলে আপনারা আমার আর আমার সংগঠন সম্পর্কে যা ধারণা করেছেন তা ঠিক নয়। আপনাদের ধারণা আমি কবিতার ব্রেইন ওয়াশ করেছি।

খালেক সাহেব বললেন, আমরা ধারণা করছি না এটাই সত্য।

না আঙ্কল এটা সত্য নয় আপনারা কবিতাকেই জিজ্ঞেস করুন। আসলে আমার সংগঠনের কাজ তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, ড্রপ আউট শিশুদের স্কুল মুখি করা এবং নির্যাতিতা নারীদের আইনগত সহায়তা দেয়া।

সে জন্য আপনি ঘটনার সত্যতা যাচাই না করেই কবিতাকে রফিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে ইন্ধন যুগিয়েছেন, খালেক সাহেব বললেন।

দেখুন কবিতা নির্যাতিতা এতে কোন সন্দেহ নেই, কবিতাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি, ওর কাছ থেকে যৌতুক দাবী করা হয়নি তবুও আমি বলব ওকে মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন করা হয়েছে।

রফিক মাথা তুলে বলল, যেমন-

যেমন মেধা থাকা সত্ত্বেও আপনারা কবিতাকে তার মেধা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন তারপর সে যখন আমার সংগঠনে কাজে যোগ দিল তখন আপনি তার ভালো কাজগুলিরও সমালোচনা শুরু করলেন, তার খোলামেলা চালচলনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেন, এটা আপনি ঠিক করেননি। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন এত দুর্বল হলে চলে না।

খালেক সাহেব সায় দিয়ে বললেন, এটাতে আমি আপনার সঙ্গে একমত, রফিক আর কবিতার বন্ধন আরো বেশি দৃঢ় হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আপনি যাই বলুন স্বামীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে কোর্টে মামলা করা কবিতার ঠিক হয়নি, এমন মামলায় আইনগত সহায়তা দেয়া আপনার ঠিক হয়নি।

ফাল্গুনী বলল, এ বিষয়ে আমরা আমাদের সংগঠনের নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনব, আমরা এখন থেকে শুধুমাত্র ওম্যান ডেভলাপমেন্ট এর জন্য কাজ করবো না বরং এখন থেকে হিউম্যান ডেভলাপমেন্ট এর জন্য কাজ করবো। আপনারা আরো জেনে খুশি হবেন যে, আমরা শীঘ্রই কুড়িগ্রাম জেলখানায় বিনা বিচারে আটক হাজতিদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আইনগত সহায়তা দেব।

রফিক তিরস্কারে সুরে বলল, আপনার হঠাৎ এ পরিবর্তন?

আসলে শ্রাবণী আমার চোখ খুলে দিয়েছে নারী নির্যাতন বন্ধে যে এককভাবে নারীর প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয় তা আমি বুঝতে পেরেছি, নারী নির্যাতন বন্ধে চাই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, চাই একটা সামাজিক আন্দোলন। আঙ্কল, রফিক সাহেব আপনারা আমাদের সঙ্গে কাজ করুন আমরা একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি আর যেন কোন নারী নির্যাতিত না হয় রফিক সাহেবের মতো আর যেন কোন নিরপরাধ মানুষকে হাজত খাটতে না হয়। বলুন আঙ্কল, বলুন রফিক সাহেব আপনারা আমার সঙ্গে থাকবেন?

রফিক খালেক সাহেবের  মুখের দিকে তাকাল। খালেক সাহেব প্রথমে বললেন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি, নারী নির্যাতন বন্ধে আমরা একটা সুস্থ সামাজিক আন্দোলন চাই।

রফিক মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। কবিতা রফিকের পাশে এসে দাঁড়াল।

-০-

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*