মিলন মেলা

হ্যালো মা।

হ্যালো। বল মা।

জুঁই হাসতে হাসতে বলল, মা আজ একটা ঘটনা ঘটেছে, শুনলে তুমি খুব খুশি হবে।

কী ঘটনা মা?

মা তুমি তো জানো আজ শিক্ষা ভবনে আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল।

হ্যাঁ জানি।

ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তোমার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা।

আমার ফ্রেন্ড! মিতা কিছুটা অবাক হলো।

হ্যাঁ মা, তোমার ফ্রেন্ড।

সোজাসুজি বলতো, তুই কথা খুব জটিল করে বলিস মিতা অভিমানের সুরে বলল।

মা আজ শিক্ষা ভবনে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি আমার সার্টিফিকেট আর ছবি অ্যাটাস্টেড করা নেই। তারপর কী করি, ভাবতে ভাবতে একজন পিয়নকে জিজ্ঞেস করলাম, আংকেল আমার একটা সার্টিফিকেট আর ছবি অ্যাটাস্টেড করা দরকার একটু হেল্প করবেন প্লিজ!

পিয়ন একটা চেম্বারের ভিতরে গেলেন, একটু পর ফিরে এসে বললেন, যান, ভেতরে স্যার আছেন, স্যারকে বললে অ্যাটাস্টেড করে দিবেন।

আমি চেম্বারে গেলাম। ভদ্রলোকের চেহারায় কেমন যেন শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব আছে, কিছু মানুষ আছে না দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে।

হ্যাঁ, কী হয়েছে বল?

বললাম, স্যার আমার একটা সার্টিফিকেট আর ছবি অ্যাটাস্টেড করে দিবেন প্লিজ!

ভদ্রলোক বললেন, অফকোর্স, অরিজিনাল কপি সঙ্গে আছে?

জি স্যার, বলে আমি এস. এস. সি পাসের সার্টিফিকেটটা বের করলাম।

তারপর…

সার্টিফিকেটে আমার স্কুলের নাম দেখে কয়েকমুহূর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তোমার বাড়ি কোন গ্রামে?

আমি বললাম, মির্জাপুর। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি চেনেন?

হ্যাঁ, আমিও তো তোমাদের স্কুলেরই ছাত্র, বলার পর স্যার কয়েকমুহূর্ত ফিসফিস করে কী যেন বললেন তারপর উনিশ’শ চূরাশি…বলতে বলতে ভদ্রলোক উদাস হয়ে গেলেন। সার্টিফিকেটে তোমার নাম দেখার পর বললেন, তুমি মিতার মেয়ে, এতবড় হয়েছ?

এবার মিতা কৌতূহলী হলো, নাম কী বলতো?

তার আগে তুমি বলতো তোমার এস. এস. সি কি এইটটি ফোর?

এইটটি ফোরে দেয়ার কথা ছিল কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারিনি, পরে এইটটি ফাইভে এস.এস.সি পাস করেছি।

মা উনার নাম জিল্লুর রহমান।

জিল্লুর, জিল্লুর… কিন্তু একটা কথা কী জানিস?

কী?

এইটটি ফোরে এক জিল্লুর ছিল আর এইটটি ফাইভে একজন।

তাহলে তো আরো ভালো হলো। যেহেতু দুই জিল্লুরই তোমার ফ্রেন্ড তাহলে আমি যে তোমাকে বললাম তোমার ফ্রেন্ড খুঁজে পেয়েছি কথাটা হলো তো।

হলো, তাতে কী।

না, কিছু না কিন্তু আমি যে ঠিক কথা বলি এটা তো প্রমাণ হলো। তুমি না বল আমি নাকি সবসময় আন্দাজি কথা বলি।

তোর ইন্টারভিউ কেমন হলো মা? মিতা জিজ্ঞেস করল।

ভালো মা কিন্তু সমস্যা কী জানো, ভালো তো সব ইন্টারভিউ দিই কিন্তু চাকরি তো হয় না।

মিতা সান্ত্বনার সুরে বলল, হবে মা, ধৈর্য ধর, ইনশাআল্লাহ তোর চাকরি হবে।

জুঁই মিতার মেয়ে? এতবড় হয়েছে? বলে জিল্লুর নিজের বয়স হিসেব করল, আটচল্লিশ বছর বয়স কম সময় তো নয়। এস. এস. সি পাস-ই তো করেছে আজ থেকে….তেত্রিশ বছর আগে। তেত্রিশ সংখ্যাটা আসতেই জিল্লুর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, তেত্রিশ বছর কেটে গেল কেউ কথা রাখেনি।….দাদু আমি আর কত বড় হবো।

বড় হতে হতে জিল্লুর নিজেই যে দাদু হতে চলল, হা হা হা।

দাদু বলে জবা ডাক দিল।

জিল্লুর চমকে উঠল, একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কী দাদু।

জবা নূরজাহানের মেয়ে। আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে যখন জিল্লুরের বদলি হলো ঢাকায়, শিক্ষাভবনে, তখন জিল্লুর এক ভাতিজীর বাসায় সাবলেট থাকতে শুরু করল। সাবলেট বললে ঠিক হবে না, পেয়িং গেস্ট বলাই সঙ্গত হবে। সেই নূরজাহানের মেয়ে জবা। নিজের কেউ না কিন্তু নিজের চেয়ে কোনো অংশে কম না। নূরজাহান তাকে বাবার মত শ্রদ্ধা করে, তিন রুমের বাসার একটা রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ আর একটা দক্ষিণের বেলকনি। নূরজাহান, ওর হ্যাজবেন্ড হাশেম, ওদের তিন বছরের মেয়ে জবা, ওরা তিনজন আর জিল্লুর এই চারজনের একটা ছোট্ট সংসার বলা যায়।

জিল্লুরের বড় ছেলে বিদ্যা অর্জন করতে চিন গেছে, ছোট ছেলে মেডিক্যাল কলেজে আর বউ কাঞ্চনের বাসায়। নিজের সংসারটা যখন ইউরোপিয়ান স্টাইলে গড়ে উঠেছে তখন এরকম মেয়ে-জামাই-নাতনীই বা মন্দ কীসে।

জবা জিল্লুরের হাত ধরে টান দিল, এসো তো দাদু, আব্বু-আম্মু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

জিল্লুর জবা’র হাত ধরে ডাইনিংয়ে গেল। নূরজাহান-হাশেম জিল্লুরের জন্য ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছে।

জিল্লুর হাশেমের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল। নূরজাহান ভাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, কী চিন্তা করছেন আংকেল, আমি আপনাকে একবার ডাক দিলাম দেখি আপনি মাথা নিচু করে ভাবছেন।

ও জাহান আজ অফিসে একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

আজ আমার অফিসে এক মেয়ে এলো কিছু কাগজ-পত্র অ্যাটাস্টেড করতে। আমি অ্যাটাস্টেড করতে করতে দেখি আমি যে স্কুলে লেখাপড়া করেছি সেই স্কুলেরই ছাত্রী। আবার আমারই এক ক্লাস ফ্রেন্ডের মেয়ে। দেখে খুব ভালো লাগল।

আর আপনি বুঝি হারিয়ে গেলেন সেই ছাত্রজীবনে।

হ্যাঁ মা।

হাশেম কম কথা বলে, একটু ভাবুক প্রকৃতির মানুষ আর জাহান বিড় বিড় করে সারাদিন কথা বলে। জিল্লুরের সাথে নূরজাহানের সম্পর্কটা যেন বাবা-মেয়ের মত, মাঝে মাঝে বন্ধুর মতো।

জাহান একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, আর কারো কথা মনে পড়ল না আংকেল?

জিল্লুরের বুঝতে বাকি রইল না। আর কারো বলতে জাহান কী বোঝাতে চায়। জিল্লুরও একটা হাসি হেসে বলল, তখন তো আসলে কিশোর বয়স রে মা।

আপনার সেই ফ্রেন্ডের নাম কি আংকেল?

মিতা, কথাটা যেন জিল্লুরের হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো।

মিতা নামের সেই কিশোরীর সঙ্গে বুঝি আপনার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল?

জিল্লুর একটা মুচকি হাসি হাসল।

হাশেম নূরজাহানের দিকে কিছুটা রাগান্বিত চোখে তাকালো।

দু’জন জিল্লুরের মধ্যে কয়েক বছর আগে তো এক জিল্লুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিন্তু সে তো না। আরেক জিল্লুর ছিল হালকা-পাতলা, খুব একটা লম্বা না, একটু বেশি কথা বলতো, সামনের সিটে বসতো। অসাধারণ মেধাবী ছিল। স্যাররা কিছু জিজ্ঞেস করলে সে-ই সবার আগে লাফিয়ে উঠতো। হান্নান স্যার ওর সাইজ দেখে ওকে লিটল বয় বলে ডাকতো।

হুমম হতে পারে কিন্তু ওরা না খুব গরীব ছিল, হতে পারে মেধাবীদের পথ অনেক সময় দারিদ্র আটকাতে পারে না। হয়ত দারিদ্র জয় করেই ওপরে উঠেছে।

মিতা বিছানা থেকে উঠল, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে জুঁইকে ফোন করল, হ্যালো।

জুঁই রিসিভ করেছে, হ্যালো মা এত রাতে? কোনো সমস্যা? জুঁইয়ের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

না, কোনো সমস্যা না। আচ্ছা তুই আমাকে একটা কথা বলতো?

কী কথা মা?

আচ্ছা জিল্লুর কি চিকন, মাঝারী ধরনের লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, চোয়ালগুলো একটু বসা?

মা কত বছর আগের কথা একবার হিসেব করেছ, চেহারা কি একই রকম থাকে, চিকন লোকটা মোটা হতে পারে, কিশোর বয়সে যে মাঝারী ধরনের লম্বা পরিণত বয়সে সে লম্বা হতে পারে, কিশোর বয়সে রোদ বাতাসে চলাফেরা করত তখন গায়ের রং শ্যামলা থাকতে পারে আর চোয়ালগুলো বসার কথা বলছ, আজকাল তো সব মানুষই বয়স হলে ফ্যাট হয়ে যায়।

ও ঠিক বলেছিস্‌।

তুমি এখন ঘুমাও। তেত্রিশ বছর আগের ফ্রেন্ডকে খোঁজার জন্য গভীর রাতে ঘুম নষ্ট করার প্রয়োজন নেই মা। কথাগুলো অত্যন্ত হৃদয়হীনভাবে বলল জুঁই।

মিতা প্রতিবাদ করল, আছে মা, শেকড়ের একটা টান আছে, আমরা হয়ত সেটা ভুলে যাই। আমিও ভুলে গেছিলাম তুই জিল্লুরের কথা বলে সেটা মনে করিয়ে দিলি। ভালোই হলো, অনেক দিন পর আমি যেন কৈশোরে ফিরে গেলাম কথা বলতে বলতে মিতা উদাস হয়ে গেল।

জুঁই কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, মা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, তুমিও ঘুমাও তো।

আচ্ছা মা তুই রাখ, ঘুমা।

শুধু আমি না, তুমিও ঘুমাবে, ঘুম না হলে প্রেশারটা আবার বাড়বে, রাখলাম বাই, বলে জুঁই ফোন রেখে দিল।

কিন্তু মিতার চোখে ঘুম নেই। তার চোখের সামনে তখন কৈশোরের স্মৃতি। ছাত্রজীবনে মনে হতো শুধু পড়া আর পড়া এই জীবনের যে কবে শেষ হবে, ছাত্রজীবন যখন শেষ হলো তখন থেকে বার বার মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। কত মধুর ছিল দিনগুলো, বন্ধুদের মধ্যে কত আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আজও স্কুল জীবনের বন্ধুদের কথা শুনলে বুকের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি জেগে ওঠে, পরবর্তী জীবনের বন্ধুরা আর তেমন আন্তরিকতাপূর্ণ হলো না।

কয়েকদিন পরের কথা জিল্লুর ফেসবুকে চ্যাটিং করছে এমন সময় নিউজ ফিডে মোজাম্মেলের একটা ফটো স্ট্যাটাস দেখে সে অনেকটা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ল। ফেসবুকে তার কত ফ্রেন্ড, কয়েক শ নয়, কয়েক হাজার। তাদের মধ্যে তার কয়েকজন ক্লাস ফ্রেন্ডও আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে নিয়মিত চ্যাটিং হয় না। হাই, হ্যালো যা হয় তাও একেবারে অজানা, শুধু ফেসবুক ফ্রেন্ডদের সাথে। অথচ যাদের সঙ্গে শেকড়ের টান আছে তাদের সাথে তেমন কোনো কথা হয় না। আজকাল এমনই হয়েছে সবাই যেন কাছের মানুষের চেয়ে দূরের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্যই অসি’র হয়ে উঠেছে। পর আপন হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আপন পর হবে এটা তো স্বাভাবিক না।

মোজাম্মেল তার ক্লাস ফ্রেন্ড। আগে মাঝে মাঝে যোগাযোগ করত, অনেকদিন থেকে ওর সাথেও কোনো যোগাযোগ নেই। মোজাম্মেল তার ফেসবুক ফ্রেন্ডও কিন্তু ঐযে ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রয়াস করতে গিয়ে আপনজনদের সাথে যোগাযোগ আরো শিথিল করেছে।

মোজাম্মেল লিখেছে, আগামী ঈদ-উল-ফিতরের তৃতীয় দিন ধর্মপুর ইউ.সি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বৎসর পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। স্কুলের সাবেক এবং অধ্যয়নরত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে নাম রেজিস্ট্রেশন করে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। লিখে মোজাম্মেল তার মোবাইল নাম্বার দিয়েছে।

জিল্লর তখনই মোজাম্মেলকে ফোন করল।

মোজাম্মেল ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালাইকুম আস্‌সালাম।

কে বলছেন প্লিজ? মোজাম্মেল জিজ্ঞেস করল।

জিল্লুর নিজের পরিচয় দিল একটু ব্যাঙ্গাত্মকভাবে, আমি জিল্লুর রহমান, ধর্মপুর ইউ.সি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, এস. এস. সি উনিশ’শ চূরাশি।

মোজাম্মেল বলল, চিনেছি জিল্লুর, চিনেছি আর বলতে হবে না।

চিনেছিস কিন্তু নিজের পরিচয় দিতে পারার পর, এটা দুজনেরই লজ্জার কথা যে শেকড়ের টান কত দুর্বল হলে ক্লাস ফ্রেন্ডের কণ্ঠস্বরটাও অচেনা হয়ে যায়। অথচ আমরা যখন এক সাথে লেখাপড়া করতাম তখন কোনোদিন তোর সাথে আমার দেখা হবে না এমন কথা চিন্তাও করিনি আর এখন যোগাযোগের এত মাধ্যম হয়েছে তবুও আমরা কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করি না। বলে জিল্লুর জুঁই’র সাথে কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হওয়ার কথা বলল।

মোজাম্মেল জিজ্ঞেস করল, তুই আসছিস তো?

অবশ্যই।

স্কুলের মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে। পঞ্চাশ বছর আগের স্কুল, স্কুল তো নয় যেন আলোকবর্তিকা। এই পঞ্চাশ বছরে এই আলোকবর্তিকা আলো ছড়িয়েছে বিশ্বময়। জানা-অজানা কত শহর, বন্দর, শিক্ষালয়, দেশ-বিদেশ আলোকিত করছে এই আলোকবর্তিকার খণ্ড খণ্ড আলো। সেইসব তারকার মেলা বসেছে স্কুলের মাঠে।

স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতেই জিল্লুর উদাস হয়ে গেল। একদল ছেলে-মেয়ে হৈ চৈ করে স্কুলে আসত, সেই কাঁচা, ধুলোবালির রাস্তা দিয়ে, পায়ে হেঁটে। স্কুলে তখন একটা সেমিপাকা বিল্ডিং ছিল, ক্লাসে তেমন বেঞ্চও ছিল না। সামনের সিটে বসার জন্য জিল্লুর অনেক আগে ক্লাসে এসে বসে থাকত। আজ স্কুলে কত বড়, পাকা বিল্ডিং হয়েছে কিন্তু এসব যেন তার চোখেই পড়ছে না। মনে হচ্ছে সে সেই তেত্রিশ বছর আগের ক্লাস রুমটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কালাম, রশিদ, আব্দুল হাই, সাইফুল, সন্তোষ তার খুব কাছের বন্ধু ছিল। তখনকার দিনে মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের কথা বলারও তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত, হয়ত অনেকেই আসবে নাতি-নাতনীকে সঙ্গে নিয়ে। জিল্লুর আপনমনে একবার হাসল, মাথার সামনে একটা বড় টাক পড়েছে, প্রায় সব চুলে পাক ধরেছে। সময়মতো বিয়ে করলে তারও নাতি-নাতনী হতো।

পিছন থেকে একটা হাত কাঁধের ওপর এসে পড়ল, জিল্লুর।

জিল্লুর চমকে উঠল, রশিদ!

কখন এলি?

এই তো।

দেখা হলো আরো কয়েকজন বন্ধু, আনিসুর, নেপাল, লুৎফর, গোলাপ, আব্দুল বারি’র সাথে, সবাই পাশাপাশি চেয়ারে বসল। ততক্ষণে অতিথিগণ আসন গ্রহণ করেছেন। মোজাম্মেল অতিথিদের আপ্যায়ন নিয়ে ব্যস্ত। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে জিল্লুর বন্ধুদের খোঁজখবর নিচ্ছে। আর তার কৌতূহলী দু’চোখ খুঁজছে তার তেত্রিশ বছর আগের আরো বন্ধুদের।

কথা প্রসঙ্গে জিল্লুর জিজ্ঞেস করল, এই আমাদের সঙ্গে পড়ত মিতাকে দেখেছিস?

না তো, দেখিনি, বলে রশিদ কয়েকমুহূর্ত জিল্লুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, তোর আবার মিতার কথা মনে পড়ল কেনো রে? জোৎস্না, হামিদা, রেণু, ফেরদৌসীর কথা তো মনে পড়ল না। ছাত্রজীবনেও দেখতাম তুই সবসময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকতিস।

সবাই হেসে উঠল।

জিল্লুর মৃদু হেসে জুঁই’র সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা বলল।

তখন অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। গান, কবিতা, স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতাও চলছে মাঝে মাঝে।

একটা মেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। জিল্লুর চিনতে পারল, ওই তো জুঁই। পাশে উঠে দাঁড়ালো এক মহিলাও।

জিল্লুর মেয়েটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রশিদকে জিজ্ঞেস করল, ঐ মেয়েটা জুঁই না? পাশে নিশ্চয়ই মিতা?

রশিদ বলল, হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। বলে রশিদ হাত তুলে সেই কিশোর বয়সের মতই ডাক দিল, এই মিতা।

সবাই রশিদের দিকে তাকালো, অনেকেই ফিসফিস করে বলল, ইসস এত জোরে, লোকটার কাণ্ডজ্ঞান নেই নাকি?

কেউ কেউ আবার বলল, আরে ডাকুক আজ জোরেই ডাকুক, কত বছর পরে দেখা আবেগ তো থাকবেই।

মিতা তাকালো। হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে কাছে এগিয়ে এলো।

মিতা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, জিল্লুর! কেমন আছিস?

ভালো, তুই?

জুঁই সালাম দিল, স্যার আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালাইকুম আস্‌সালাম, স্যার না মা আংকেল।

মিতা বলল, ভালো। তোর কথা জুঁই’র কাছে শুনেছি। অনেক বড় হয়েছিস্‌।

জিল্লুর ইয়ার্কির সুরে বলল, হ্যাঁ এখন পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি।

মিতা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, তুই আগের মতই আছিস্‌, আগের মতই ইয়ার্কি করিস।

রশিদ বলল, উঠলি কেনো?

মিতার মোবাইল ফোন বেজে উঠল, সে রিসিভ করে বলল, আসছি তারপর বিণয়ের সুরে বলল, বাসায় একটু সমস্যা…তারপর আবারো মুচকি হাসি হেসে বলল, আসি রে, চল মা, বলে মিতা আর জুঁই যেতে উদ্যত হলো।

মাইকে তখন ভেসে আসছে একটি মেয়ের আবৃতি করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হঠাৎ দেখা কবিতার অংশবিশেষ,

আমাদের গেছে যে দিন

একেবারেই কি গেছে-

কিছুই কি নেই বাকী?

সমাপ্ত।

 

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*