গডফাদার-০২

সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল নির্বাচনে জয়ী হলো, কয়েকবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর এবারই প্রথম মোস্তফা সাহেব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। তাঁর আনন্দের সীমা রইল না। তাঁর সঙ্গে জামাল এবং দলের অন্যান্য নেতা কর্মীরাও যেন আনন্দে মেতে উঠল। জামাল একবার আনন্দ মিছিল বের করার জন্য উদ্যোগ নিল কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষেধ থাকায় মোস্তফা সাহেব জামালকে আনন্দ মিছিল করা থেকে বিরত রাখলেন। জামাল মোস্তফা সাহেবের কথায় আপাতত মনক্ষুন্ন হলেও শান্ত হলো।

কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কথা মতো মোস্তফা সাহেবকে একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো এবং তাঁর স্বপ্ন পূরণ হলো। একদিন জেলখানায় বসে তিনি ভাবতেন তিনি মন্ত্রী হবেন, তাঁর গাড়িতে পতপত করে জাতীয় পতাকা উড়বে সামনে পিছনে থাকবে সিকিউরিটি। উচ্চ পদস্থ অফিসাররা তাকে স্যার স্যার বলে সম্বোধন করবে মোস্তফা সাহেবের বুকটা গর্বে ভরে যাবে। আজ জাতীয় পতাকা উড়ানো গাড়িতে উঠে মোস্তফা সাহেব মনে মনে একটু হাসলেন। মোস্তফা সাহেবের গাড়ির পিছনের গাড়িতে জামাল এবং আরো কয়েকজন কর্মী ছুটে চলছে। গাড়ি এক জেলার সীমানা অতিক্রম করে অন্য জেলায় ঢুকতেই সেই জেলার পুলিশ সিকিউরিটির দায়িত্ব গ্রহণ করল। মোস্তফা সাহেব আপন মনে আবার তৃপ্তির হাসি হাসলেন। গাড়ি শহরে ঢুকলো কোথাও কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই, পুলিশ আগেই সব ফাঁকা করে দিয়েছে। মোস্তফা সাহেব পার্টি অফিসে ঢুকলেন। জামাল মোস্তফা সাহেবের পাশের চেয়ারে বসল। মোস্তফা সাহেবের পাশে বসে জামালের মনে পড়ল হাজতে বসে মোস্তফা সাহেবের কথাগুলো। সত্যি সত্যি মোস্তফা সাহেব মন্ত্রী আর জামাল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি। জামাল যেন বড় নেতা হয়ে গেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।

জামালকে আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখে মোস্তফা সাহেব  বললেন, জামাল।

জামাল চমকে উঠল, জি বড় ভাই।

          অনুষ্ঠান শুরু হলো, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলেন। অনুষ্ঠানে একে একে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তৃতা দিয়ে চললেন। তারপর শুরু হলো জামালের বক্তৃতা। আজকের কর্মী সভার সভাপতি ও মাননীয় মন্ত্রী এবং দলের সহকর্মী ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুআলায়কুম। আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আমরা সবাই বেশ আনন্দিত, কারণ একটানা পাঁচ বছর দীর্ঘ আন্দোলন, নির্যাতন ও বঞ্চনার পর আমরা জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছি। আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা ও মাননীয় মন্ত্রী জনাব গোলাম মোস্তফা। দলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘ দিন যাবত জনগণের কাছ থেকে অর্জিত ভালোবাসা তাঁকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সে জন্য প্রথমেই মাননীয় মন্ত্রীকে সকলের পক্ষ থেকে জানাই ধন্যবাদ। মাননীয় মন্ত্রী আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের দলের কর্মীরা দলের জন্য অনেক নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে। বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদারি জোরপূর্বক তারা নিয়েছে ফলে আমাদের কর্মীদের অনেকের ঠিকাদারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়েও তদবিরের জোরে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির কর্মীরা সব চাকরি দখল করে নিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কিছু হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, নেতাকর্মীদের সুবিধার্থে, প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে নয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে সব এলাকায় আমাদের ভোটার বেশি আমাদের কর্মীরা সক্রিয় সে সব এলাকার রাস্তাঘাটের কোন উন্নয়ন হয়নি, বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি তাই মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন যে সব এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ কম হয়েছে সে সব এলাকায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া। যেসব কর্মী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পায়নি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যেসব কর্মী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখনো জেল খাটছে তাদেরকে মুক্তি দেয়া। আমি আশা করি মাননীয় মন্ত্রী আমাদের সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের দাবিগুলো পূরণ করবেন। মাননীয় মন্ত্রী অনেকদূর থেকে জার্নি করে আমাদের মাঝে এসেছেন। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জামালের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর মাননীয় মন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন, আজকের এ সভায় উপস্থিত সকল সমর্থক, কর্মী ও সহকর্মী ভাই ও বোনেরা আস্‌সালামুআলায়কুম। আপনাদের সমর্থন, অক্লান্ত পরিশ্রম করে জনগণের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটের ক্যানভাস করে আপনারা আমাকে যে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন সে জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সৌভাগ্যক্রমে আর আপনাদের দোয়ায় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, আরো সৌভাগ্যের কথা যে, আমি একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছি। আমি জানি বিরোধী দলে থাকাকালীন আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা  ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির নেতা-কর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার পাবার কথা থাকলেও আমাদের দলের নেতা কর্মীদেরকে পদে পদে ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমি নিজেও বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জেল খেটেছি। বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি বিরোধী দলের উপর নির্যাতন করেছে। সে জন্য জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু আমরা তাদের মতো ভুল করব না, আমরা সহনশীল রাজনীতি করব, প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়। টেন্ডার বাজি, চাঁদাবাজি, তদবির একেবারে নিষিদ্ধ এসবের মধ্যে কোন নেতার অংশ গ্রহণ প্রমাণিত হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কোন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব কাজের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার মন্ত্রিত্ব যাবে এবং দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। আমি জানি আপনারা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসেন, আপনাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে আমি নির্বাচিত হয়েছি এবং মন্ত্রিত্ব পেয়েছি। মন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য চাই আপনাদের সকলের সহযোগিতা। আপনারা কেউ টেন্ডার বাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি করবেন না যদি কেউ এসব করে আইনের কাছে ধরা পড়েন তবে আমি কোন হস্তক্ষেপ করব না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

মাননীয় মন্ত্রীর কথা শুনে মুহূর্তেই মিটিংয়ের পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। নেতা-কর্মীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। জামাল গম্ভীর মুখে মাথা নত করে বসে রইল।

মাননীয় মন্ত্রী আবার বলতে শুরু করলেন, আপনারা সবাই আইন মেনে চলবেন, এলাকার উন্নয়নের জন্য আমার কাছে আসবেন, কোন তদবির নিয়ে আসবেন না। আমি কোন অবৈধ কাজ করব না। আমি যেন সরকারের পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারি, এলাকার উন্নয়ন করতে পারি সে জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই। আশা করি আপনারা আমাকে পূর্ণ মেয়াদে মন্ত্রিত্ব করার সুযোগ দিবেন। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এই কামনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

মাননীয় মন্ত্রীর ড্রয়িং রুমে নেতা-কর্মী ও হিতাকাঙ্খীদের ভিড় জমেছে। বিভিন্ন রকমের দাবি কারো চাকরি, কারো স্কুলের উন্নয়ন কাজ, কারো রাস্তার সাথে বাড়ির সংযোগ সড়কের  উন্নয়ন এমনি নানান রকমের তদবির নিয়ে এসেছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণ। মাননীয় মন্ত্রী জনপ্রতিনিধি, জনগণ তাঁর কাছে আসতেই পারে। জনগণের অভাব অভিযোগের কথা শোনা এবং সম্ভাব্য সমাধান করাই জনপ্রতিনিধির কাজ। মাননীয় মন্ত্রীর পিছনের সোফায় তাঁর এ.পি.এস আশরাফ সাহেব ডায়েরীতে আগত জনগণের নাম, ঠিকানা ও সমস্যা লিখছেন। অপর একটা সোফায় জামাল বসে আছে। রহমতপুর থেকে আগত কয়েকজনের একটা দল এসেছে। তাদের একজন বলল, মাননীয় মন্ত্রী আমরা রহমতপুর থেকে এসেছি, আমাদের ছো- একটা দাবি আছে।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, আশরাফ ডায়েরীতে লিখে নাও তো।

আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?

তবিবর রহমান।

বলুন কি দাবি আপনাদের? মাননীয় মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।

আমাদের গ্রাম থেকে মেইন রাস্তা প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা এবং খুব নিচু, বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তাটা কাদায় ভরে যায় আর বেশি বৃষ্টি হলে তো রাস্তার উপর এক হাঁটু পানি জমে যায়। আপনি যদি রাস্তাটা একটু উঁচু আর পাকা করার ব্যবস্থা করেন তবে আমাদের খুব উপকার হবে।

হ্যাঁ আপনাদের উপকার করার জন্যই তো আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছেন। আমি যতদূর সম্ভব আপনাদের উপকার  করার চেষ্টা করব।

আশরাফ সাহেব ডায়েরীতে লিখে নিলেন।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, আপনারা জামালের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন ইনশাআল্লাহ্‌ করে দিব।

আমরা খুব খুশি হয়েছি মাননীয় মন্ত্রী, বলে তবিবর তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই হেলাল, হায়দার আমি বলেছিলাম না আমাদের মন্ত্রীর মনটা বিশাল, সাগরের মতো, তিনি আমাদের কথায় না করতে পারবেন না। চল যাই, আসি মাননীয় মন্ত্রী  আস্‌সালামুআলায়কুম, বলে তবিবর তার দলসহ চলে গেল।

তারপর ড্রয়িংরুমে ঢুকলো চণ্ডীপুরের কয়েক জনের একটি দল। ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সালাম দিলেন, মাননীয় মন্ত্রী আমরা চণ্ডীপুর থেকে এসেছি। আপনার সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, খুব ভালো করেছেন চাচা, বলুন আপনাদের জন্য কি করতে পারি?

আপনি এই এলাকার এম.পি এবং মন্ত্রী, আপনি জানেন চণ্ডীপুর গ্রামে এখনো কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এখনো রাস্তাঘাট পাকা হয়নি, বিদ্যুৎ নাই, বলতে গেলে অজোপাড়া গাঁ। আমার মনে হয় চণ্ডীপুরের মতো পিছিয়ে পড়া গ্রাম আর নাই। আপনি যদি দয়া করে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার ব্যবস্থা করেন তবে আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা সবাই অনেক আশা করে আপনাকে ভোট দিয়েছি।

চাচা কাকে ভোট দিয়েছেন সেটা বড় বিষয় নয়। ভোটে জিতার পর আমি মনে করি এই সংসদীয় এলাকার সবাই আমাকে ভোট দিয়েছে, আপনারা আসবেন আপনাদের কোন কাজ করতে পারলে আমি সার্থক হয়েছি বলে মনে করব। আশরাফ ডায়েরীতে লিখে নাও আর ঢাকায় আমাকে স্মরণ করে দিও, আমাকে সব সময় কাছে না পেলে আপনাদের যে কোন সমস্যার কথা জামালকে জানাবেন সেই আমাকে বলবে।

জি আচ্ছা মাননীয় মন্ত্রী আমরা এখন আসি বলে সবাই চলে গেল।

তারপর ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন কাশিমপুর গ্রামের দেলোয়ার সাহেব তাঁর হাতে একটা ইন্টার্ভিউ কার্ড।

মোস্তফা সাহেব নিজেই তাঁকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চাচা আসুন, কি মনে করে?

দেলোয়ার সাহেব বললেন, আমার ছেলেটা চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছে সবাই বলল তুমি সুপারিশ করলেই চাকরিটা হয়ে যাবে। তাই আসলাম।

দেখি বলে মাননীয় মন্ত্রী ইন্টার্ভিউ কার্ডটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আশরাফের কাছে দিন আমি টেলিফোন করে দিব।

দেলোয়ার সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, যদি তুমি কোন সুপারিশ করে দিতে?

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, চাচা আজকাল সুপারিশ-টুপারিশ করে কিছু হয় না, কোন কিছু করতে চাইলে বার বার টেলিফোনে তাগাদা দিতে হয় কাজের সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। আমি দেখি কিছু করতে পারি কি না।

তুমি চাইলে অবশ্যই পারবে, বলে তিনি মাননীয় মন্ত্রীর হাতে ইন্টার্ভিউ কার্ডের একটা ফটোকপি দিয়ে চলে গেলেন।

এমনভাবে একে একে আগত সকলের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে কখন বারোটা বেজেছে জামাল খেয়াল করেনি। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বড় ভাই তো কাল চলে যাবেন?

জি।

আমি এ দুদিনে যা দেখলাম তাতে আপনার কাজ কর্ম ভালো মনে হচ্ছে না।

কেন?

আপনি কর্মীদের টেন্ডার বাজি, চাঁদাবাজি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেভাবে হুমকি দিলেন তাতে তো কর্মীদেরকে ধরে রাখা যাবে না। কথা বলার সময় আপনি কি একবার তাদের মুখের দিকে তাকিয়েছেন? বছরের পর বছর তারা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলে শ্রম দিয়েছে, বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালীন যত উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে সব তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে, মুদির দোকান, ফুটপাথ থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক হারে চাঁদা তুলেছে। আমাদের কর্মীরা টেন্ডারে কোন কাজ পায়নি, তাদের বৈধ ব্যবসাও অনেকের বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মীদের ধারণা ছিল দল ক্ষমতায় এসেছে তারা কাজ পাবে। বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির দখলে থাকা চাঁদাবাজির স্পটগুলো দখল করে নিবে। তারা দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু আপনার বক্তৃতায় তারা নিরাশ হয়েছে।

          মাননীয় মন্ত্রী বললেন, জামাল সব কথা মুখ ফুটে বলতে হয় না, একটা কর্মী সভায় আমার যা বলা উচিত তাই বলেছি। তারমানে এই নয় যে, দলের বঞ্চিত নেতা কর্মীরা কোন সুবিধা ভোগ করবে না। এখানকার রাজনীতি তুমি দেখবে, রাজনৈতিক কারণে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ তুমি দেখবে। প্রতিদিনের এলাকার খবর আমাকে মোবাইলে জানাবে। কোন কাজ থাকলে ঢাকা আসবে। তুমি দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি। আমি মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকব তুমি দেখবে এলাকার রাজনীতি। নেতা কর্মীরা যেন মনক্ষুন্ন না হয়, দলে যেন গ্রুপিং  সৃষ্টি না হয় সে জন্য যা করার দরকার তুমি করবে।

          কিন্তু আপনি যে বললেন রহমতপুরের রাস্তাটা পাকা করে দিবেন, আপনি কি জানেন রহমতপুরের একটা ভোটও আমরা পাইনি, তারা কোনদিন আমাদের দলকে ভোট দেয়নি আর ভবিষ্যতেও দিবে না। অথচ আপনি রাস্তা পাকা করে দেওয়ার কথা বললেন। আগে আমাদের দলের লোকদের গ্রাম উন্নয়ন করতে হবে তারপর রহমতপুরের উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে।

          মাননীয় মন্ত্রী গম্ভীরস্বরে বললেন, জামাল যে কোন নেতা কর্মী কোন কাজে এলে না বলবে না, তাতে নেতা কর্মীরা অসন্তুষ্ট হবে। বলবে করে দিব তারপর রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি হয়, করতে চাও তবে আমাকে বলবে আমি করে দিব আর তুমি না বললে আমি কোন কিছু করব না।

জামালের মুখে তৃপ্তির একটা স্পষ্ট আভা ফুটে উঠল। সে বলল, বড় ভাই আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে, আপনি বিশ্রাম নিন। আমি আজকের মতো আসি।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, আমি সকাল আটটায় রওয়ানা দিব।

বড় ভাই আমি তার আগে একবার আসব, বলে জামাল বেরিয়ে গেল।

একচল্লিশ

জামালের ব্যবসা বাণিজ্য আবার আগের মতোই চালু হয়েছে। ঠিকাদারি ব্যবসা দেখাশুনা করে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ সাহেব আর অন্যান্য ব্যবসা দেখাশুনা করে আমীর হোসেন। জামাল সব সময় ব্যস্ত থাকে ব্যবসা আর রাজনীতি নিয়ে প্রতিদিন সকাল বেলা একবার আর সন্ধ্যায় একবার অফিসে বসে।

সেদিন সন্ধ্যা বেলা জামাল অফিসে ঢুকেই আমীর হোসেনকে ডাক দিল। আমীর কম শিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমান। তার কথাবার্তা আর চালচলন অনেক উচ্চ শিক্ষিতকেও হার মানায়। সে সুচতুরও বটে, আগে জাহিদের সঙ্গে ফেন্সিডিল ব্যবসার সহকারী হিসেবে কাজ করত। জাহিদের মৃত্যু এবং জামাল বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ব্যবসা বন্ধ ছিল তখন আমীর অন্য ব্যবসা দেখাশুনা করত। দেশপ্রেমিক দল ক্ষমতা গ্রহণের পর আমীর জামালের কাছে চলে আসে এবং জামালও তার ফেন্সিডিল ব্যবসার অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আমীর হোসেনকে দিয়েই ফেন্সিডিল ব্যবসা আবার শুরু করেছে। আমীরের পরামর্শে জামাল ফেন্সিডিল পরিবহনের জন্য একটা মাইক্রো বাস কিনেছে। সীমান্তের ওপার থেকে ফেন্সিডিল এনে জমা করা হয় সীমান্তের কাছাকাছি কোন বাড়িতে, সেখান থেকে এনে রাখা হয় গোডাউনে, সেখান থেকে চলে যায় ফেন্সিকুইন, চায়ের দোকান কিংবা পানের দোকানদারদের কাছে। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের আড্ডাস্থল কিংবা স্কুল কলেজের কাছাকাছি কোন দোকানের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। তাছাড়া সুচতুর আমীর হোসেন শুধু কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মাঝেই নয় গৃহিণীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে সমস্ত মহিলা ফেরি করে কসমেটিকস, শাড়ি, চুড়ি বিক্রি করে তাদেরকে কাজে লাগিয়েছে। আমীর হোসেনের অভিনব মার্কেটিং সিস্টেমের দরুন ফেন্সিডিল ব্যবসা বেড়ে গেছে আরো অনেকগুণ। তাছাড়া আমীর হোসেনের সঙ্গে জামালের ঘনিষ্ঠতা আর আমীর হোসেন যে শুধু ফেন্সিডিল ব্যবসা দেখাশুনা করে ব্যবসার মূল মালিক  যে জামাল এ কথা এক রকম ওপেন সিক্রেট। কথিত আছে জামাল ক্ষমতাসীন দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন দেখেও না দেখার ভান করে কিংবা আমীর হোসেন তাদের সঙ্গে মাসোয়ারা ঠিক করে ব্যবসা চালাচ্ছে।

জামাল জিজ্ঞেস করল, আমীর হোসেন সকালে তুমি কি যেন বলতে চাইছিলে? শোনার সময় পেলাম না, বল তো কি ব্যাপার? কোন সমস্যা?

আমীর নাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ভাইজান কাল যখন গাড়ি নিয়ে মাল আনতে যাচ্ছিলাম তখন ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ি আটক করেছিল।

তারপর।

আমি বললাম এটা জামাল ভাইয়ের গাড়ি কিন্তু তিনি কোন গুরুত্বই দিলেন না, বললেন যার গাড়িই হোক রাস্তায় নামলেই কাগজ-পত্র নিয়ে নামতে হবে।

আমার নাম বলার পরও কাজ হলো না?

না, কোন কাজ হলো না, আমাকে সব কাগজ-পত্র দেখাতে হলো কিন্তু গাড়ির ইনস্যুরেন্স নাই বলে কেস দিল।

কি?

গাড়ির নামে কেস দিয়েছে।

কি নাম ঐ সার্জেন্টের?

হেদায়েত সাহেব।

জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, বুঝেছি হেদায়েত সাহেবকে একটু হেদায়েত করা দরকার। তুমি যাও আমি দেখছি।

জামাল টেলিফোন করল, অপর পাশ থেকে হেদায়েত সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো।

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, হেদায়েত সাহেব আছে?

জি বলুন।

আপনি আজ আমার গাড়ির নামে একটা কেস দিয়েছেন?

কি গাড়ি আপনার?

মাইক্রো বাস।

হ্যাঁ দিয়েছি।

জামাল বলল, আমার লোক আমার নাম আপনাকে বলেনি?

জি বলেছে।

জামাল প্রচণ্ড রেগে গেল, তারপরও আপনি আমার গাড়ির নামে কেস করে দিলেন?

অপর পাশ থেকে হেদায়েত সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, দেখুন আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। গাড়ির ইনস্যুরেন্স ছিল না তাই কেস দিয়েছি সেটা আপনি হোন আর যেই হোক আইনের চোখে সবাই সমান।

বাহ্‌ বাহ্‌ আইনের বড় রক্ষক হয়েছেন? আপনার চোখের সামনে দিয়ে যখন পাঁচ টনের ট্রাকে আট টন মাল নিয়ে যায় তখন তো আটক করেন না। কেন করেন না তা আমি জানি না, ঘুষ খান সে কারণে পাঁচ টনের ট্রাকে যখন আট টন মাল যায়, কাল ধোঁয়া ছেড়ে যখন আনফিট গাড়ি যায়, তখন তো দেখেন না আর আমার গাড়ির শুধু ইনস্যুরেন্সটা নাই তাতেই কেস করে দিলেন, হেদায়েত সাহেব আমি আপনাকে হেদায়েত করে ছাড়বো। কথাটা মনে থাকে যেন, বলে জামাল টেলিফোন রেখে দিল।

আমীর আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, যা বলেছেন ভাইজান ঐ সার্জেন্ট আপনার নাম শুনলে আর জীবনে আপনার গাড়ি আটক করবে না।

জামাল গম্ভীর হয়ে বলল, আমীর তুমি ফেন্সিডিল ব্যবসার পাশাপাশি পুরিয়ার ব্যবসা চালাতে পারবে না?

আমীরের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল, জি ভাইজান পারব।

তোমাকে তাহলে খুলে বলি এক পার্টির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ঢাকা গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে সবকিছু ঠিকঠাক করা যাবে। তবে এতে তোমার দায়িত্ব বেশ বেড়ে যাবে।

কি রকম ভাইজান?

হেরোইন খুব দামি জিনিস, ফেন্সির একটা চালান মার খেলে যেমন লস হবে লক্ষ টাকা তেমনি হেরোইনের একটা চালান মার খেলে লস হবে এক কোটি টাকা। কাজেই তোমাকে খুব সতর্কতা আর গোপনীয়তার সঙ্গে ব্যবসা চালাতে হবে।

ভাইজান আমি সব সময় সতর্ক থাকি এবং হেরোইন যত মূল্যবান আর ফেন্সি যত কম দামেরই হোক না কেন সেটা বিষয় না আপনার একটা টাকাকেও আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশি দাম দেই। আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাইজান নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনার প্রত্যেকটা টাকা রক্ষা করব। তাছাড়া আপনার মাল আটক করার ক্ষমতা রাখে এখন এমন কেউ নাই।

জামাল মনে মনে একটু হাসল তারপর বলল, আমীর তুমি যাও আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আমার সালাম দাও।

আমীর চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে রশিদ সাহেব চেম্বারে প্রবেশ করলেন। জামাল বলল, বসুন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।

রশিদ সাহেব চেয়ারে বসলে জামাল বলল, রশিদ সাহেব আমি একটা গোডাউন করতে চাই। গোডাউন ছাড়া সারের লাইসেন্স করা যাচ্ছে না।

জি ভাই, ঠিক আছে আমি কালকেই সাইটে গিয়ে দেখে ডিজাইন, এস্টিমেট করে আপনাকে দেখাব।

আর হ্যাঁ টেন্ডারের খোঁজখবর রাখবেন। কন্সট্রাকশন ফার্মের যাবতীয় কাজ দেখার দায়িত্ব আপনার, খেয়াল রাখবেন। কোন টেন্ডার যেন হাতছাড়া না হয়। টাকার প্রয়োজন হলে সকাল বেলা আমার কাছ থেকে চেক সই করিয়ে নিবেন আর রাতে আগামী দিনের কাজ নিয়ে আলোচনা করবেন। আপনারা আমাকে একটু ফ্রি রাখুন আমি যেন রাজনীতিতে সময় দিতে পারি।

আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাইজান।

আচ্ছা আপনি এবার আসুন।

জি ভাই, বলে রশিদ সাহেব চলে গেলেন।

বিয়াল্লিশ

রশিদ সাহেব গোডাউনের প্লান ডিজাইন এবং এস্টিমেট তৈরি করে জামালের কাছে নিয়ে গেলেন। জামাল দেখে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আপনি গোডাউনের কাজ শুরু করে দিন। আগামী এক মাসের মধ্যে যেন গোডাউন তৈরির কাজ শেষ হয়। সেই সঙ্গে গোডাউন তৈরির মূল্য বাড়িয়ে একটা এস্টিমেট তৈরি করবেন। আমি কয়েকদিনের মধ্যে ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে একটা ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করব।

জি ভাই।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল।

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ শাকিল বল।

বড় ভাই আগামীকাল টেন্ডার ড্রপিং আছে আপনি জানেন কি?

তুমি একটু লাইনে থাক।

রশিদ সাহেব আগামীকাল টেন্ডার আছে?

রশিদ সাহেব জবাব দিলেন, জি ভাই।

হ্যাঁ শাকিল ঠিক আছে, ক’টা শিডিউল বিক্রি হয়েছে? কে কে কিনেছে? লিস্ট কালেকশন করেছ?

জি ভাই লিস্ট আমার কাছে আছে, আমরা কয়েকজন একসাথে আছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

হ্যাঁ চলে এসো।

রশিদ সাহের আমরা সব গ্রুপের শিডিউল কিনেছি?

জি ভাই।’

ক’টা গ্রুপ? কত টাকা করে প্রতি গ্রুপ?

ছয়টা গ্রুপ ভাই, প্রত্যেকটা গ্রুপ পঞ্চাশ লাখ করে।

আচ্ছা ঠিক আছে আপনি আসুন।

রশিদ সাহেব চলে যাবার পর রহমত দরজা ঠেলে ঢুকলো, রহমত কি খবর তোমার?

ভাইজান আপনি মাল আনার পর খবর দিতে বলেছিলেন। মাল এনেছি খুব সুন্দর, কমবয়সী, আপনি দেখলে-

জামালের চোখ দু’টো লোভে চিক চিক করে উঠল। এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, রহমত আমি রাত এগারোটার পর তোমার বাসায় যাব, তুমি যাও।

জি ভাইজান, বলে রহমত চলে গেল।

কয়েক মিনিট পর শাকিল, শওকত, রাজুসহ আরো কয়েকজন জামালের চেম্বারে ঢুকলো।

জামাল সহাস্যে বলল, শাকিল, শওকত, রাজু বাহ্‌ সবাইকে দেখছি বলে কলিং বেল টিপ দিতেই পিয়ন জাকির এসে দাঁড়াল।

জামাল বলল, ম্যানেজারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাও, চা নাস্তার ব্যবস্থা কর, আর রশিদ সাহেবকে আসতে বল।

রশিদ সাহেব ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসতেই জামাল বলল, শাকিল বল।

বড় ভাই আমরা এসেছিলাম আগামীকালের টেন্ডারের ব্যাপারে।

হ্যাঁ বল কি করতে চাও?

শাকিল একটা ঢোক গিলে বলল, বড় ভাই কাজগুলোতে যদি কম্পিটিশন হয় তবে অনেক লেস পড়বে। কাজ করে কোন বেনিফিট হবে না তারপরও কে কাজ পাবে এটা অনিশ্চিত, কাজ করার পর যে টাকা সাশ্রয় হবে তা সরকারী কোষাগারে ফেরত যাবে অযথা এলাকার উন্নয়নের টাকা ফেরত দিয়ে কি লাভ? তাই আমি বলছিলাম কাজগুলো যদি নেগোসিয়েট করা যেত তবে আমরাই বেনিফিটেড হতাম।

শওকত বলল, তাছাড়া আমরা দিনের পর দিন দলের জন্য কাজ করছি, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি অনেক পাওয়া কাজ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই এখন থেকে যত কাজ হবে আমরা চাই।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, শওকত কাজ করতে হয় বেশি কথা বলতে হয় কম।

শওকত মাথা নত করে বলল, জি বড় ভাই।

জামাল জিজ্ঞেস করল, শাকিল মোট ক’টা শিডিউল বিক্রি হয়েছে? কে কে কিনেছে লিস্ট নিয়ে এসেছ?

জি বড় ভাই, বলে শাকিল একটা লিস্ট বের করে জামালের হাতে দিল।

জামাল লিস্ট দেখে কখনো মুখ উজ্জ্বল করল কখনো মলিন করল। কোন কোন লিস্টের ক্রমিক নাম্বার এর উপর টিক চিহ্ন দিল। তারপর লিস্টটা শাকিলের হাতে দিয়ে বলল, আমি ছয় জনের নামের পার্শ্বে টিক চিহ্ন দিয়েছি তুমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবশিষ্ট শিডিউলগুলো ক্লোজ কর। কেউ যদি শিডিউল দিতে না চায়, আমার কথা বলবে তারপরও যদি কেউ টেন্ডার ড্রপ করতে চায় তবে রাতের মধ্যে আমাকে জানাবে আমি ব্যবস্থা নিব।

শাকিল বলল, জি বড় ভাই।

জামাল বলল, রশিদ সাহেব আপনি শিডিউল পূরণের ব্যবস্থা করুন, একটা শিডিউল এট পার আর অন্য দু’টা এবাভ রেট এ পূরণ করুন।

জি ভাই আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমি সব ঠিক করে রাখব।

শাকিল তাহলে একথাই থাকল। তোমরা যাও টাইম টু টাইম আমাকে জানাবে।

জি বড় ভাই বলে সবাই চলে গেল।

সবাই চলে গেলে জামাল রহমতের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

রহমত কয়েক বছর আগে গার্মেন্টসে চাকরির উদ্দেশ্যে ঢাকা গিয়েছিল। কিন্তু আরাম প্রিয় রহমত গার্মেন্টসের চাকরি করতে পারেনি। তারপর চাকরি  করেছিল ঢাকা শহরের একটা আবাসিক হোটেলে। সেই আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা চলতো অবাধে। সেখানে চাকরি করার পর ঢাকা থেকে চলে আসে মফস্বল শহরে এখানেও সে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ থেকে কৌশলে সুন্দরী মেয়েদের এনে প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা জোরপূর্বক দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে।

রহমত আর তার স্ত্রী দু’জনে মিলে এই জঘন্য কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। রহমতের বাসায় যে অবাধে অসামাজিক কার্যকলাপ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে একথা ওপেন সিক্রেট কিন্তু তার বাসায় সমাজের উঁচু স্তরের কিংবা সরকারী- বেসরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের যাতায়াত থাকায় কেউ কথা বলার সাহস পায় না।

জামাল রহমতের বাসায় ঢুকলো তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। রহমতের বউ রাশেদা জামালকে দেখে বলল, ভাইজান বসুন।

জামাল জিজ্ঞেস করল, রহমত বাসায় নাই?

আপনার অপেক্ষায় ছিল, সঙ্গে খুব সুন্দর, কম বয়সী একটা মেয়ে ছিল। বলল রাতে থাকবে না তাই বাসায় রাখতে গেছে। এই তো অল্প কিছুক্ষণ আগে গেল। ফিরতে দেরি হবে মনে হয়।

জামালের মন খারাপ হলো। সে ধীর পদে রহমতের ঘরে ঢুকলো। রাশেদা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, ভাবী বাইরের দরজা খোলা নেই তো?

না আমি বন্ধ করে দিয়ে এসেছি।

দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ভিতরে বসুন।

রাশেদা ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসল। জামাল রাশেদার চোখে চোখ রাখতেই তার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। লোভে জামালের চোখ দু’টো চিক চিক করে উঠল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, তাহলে কি আমি ফিরে যাব?

ও আসলে দু’একদিনে আমি আপনার জন্য স্প্যাশাল মাল আনতে বলব।

জামাল চেয়ার থেকে উঠে রাশেদার গা ঘেঁষে বসে কুরুচিপূর্ণ ভঙ্গীতে তাকিয়ে বলল, ভাবী-

রাশেদা সরে বসল, জামাল ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাশেদাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবী।

নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে রাশেদা বলল, জামাল ভাই আমি কখনো ঐ সব কাজ করি না।

জামাল পকেট থেকে টাকা বের করে রাশেদার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, কোনদিন করেননি। আজ করবেন।

তারপর জামাল রাশেদাকে বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরল।

তেতাল্লিশ

দল ক্ষমতা গ্রহণের পর জামাল এই প্রথম একটা টেন্ডারে কাজ ভাগাভাগি করার উদ্যোগ নিল। তা যদি ভেস্তে যায় তবে ভবিষ্যতেও দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে কাজ পাইয়ে দেয়া কিংবা নিজের নামে বেশি কাজ নেয়া সম্ভব হবে না। আর প্রথম বারেই প্রথম একটা পরাজয়ও জামাল সহজভাবে মেনে নিতে পারবে না।

মোবাইলে জামাল জিজ্ঞেস করল, শাকিল ক’টা শিডিউল ক্লোজ করেছ?

বড় ভাই আমরা পঞ্চাশটা শিডিউল ক্লোজ করেছি আর ছ’টা শিডিউল কোনভাবেই নিতে পারছি না।

জামাল রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে কে শিডিউল দিচ্ছে না?

পাঁচ জন বিরোধী দলের, আমাদের দলের মধ্যে শুধু বেলায়েত ভাই শিডিউল দিচ্ছে না?

জামাল গর্জন করে উঠল, বেলায়েত ভাই শিডিউল দিচ্ছে না? কি বলল?

বলল তোমরা নেগোসিয়েট করবে ভালো কথা কিন্তু আমাকে তো একবার জানাতে পারতে, আমি কি তোমাদের কাজে বাধা দিতাম? আমিও তো চাই তোমরা যারা দলের জন্য নির্যাতিত হয়েছ, বঞ্চিত হয়েছ তারা লাভবান হবে এতে তো আমার বাধা দেওয়ার কিছু নাই।

হ্যাঁ বুঝছি তুমি রাখ আমি দেখছি।

জামাল কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল, বেলায়েত ভাই ঠিক কথাই বলেছেন নেগোসিয়েশন করার আগে একবার বেলায়েত ভাইকে  জানান উচিত ছিল। তিনি যদি সত্যি সত্যি টেন্ডার ড্রপ করতে যান তবে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। জেলা কমিটির নির্বাচনে বেলায়েত ভাই হেরে গেলেও দলে তার অনেক কর্মী এবং সমর্থক আছে।

জামাল মনে মনে অনুতপ্ত হলো। তারপর বেলায়েত সাহেবের মোবাইলে রিং করল।

কি খবর লিডার?

জামাল আমতা আমতা করে বলল, বেলায়েত ভাই এভাবে লজ্জা দিবেন না। আমরা সবাই এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে পরস্পরের মধ্যে সৌজন্য বিনিময়টাও কমে গেছে। আসলে আমরা দিন দিন সবাই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি।

হ্যাঁ এখন কি মনে করে হঠাৎ সৌজন্য দেখাচ্ছ তাই বল?

বেলায়েত ভাই আজকের টেন্ডারের কাজগুলো নেগোসিয়েট করার জন্য আমাদের দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী আমার কাছে এসেছিল। আমি বললাম তোমরা সবাই যখন চাচ্ছ তবে কর। সর্বমোট ছয়টা শিডিউল এখনো ক্লোজ করতে পারেনি তারমধ্যে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির কার কার কাছে যেন পাঁচটা শিডিউল আছে আর একটা আপনার কাছে।

এখন আমাকে কি করতে বলছ? বেলায়েত সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

বেলায়েত ভাই সবাই শিডিউল দিয়েছে আপনার শিডিউলটা ক্লোজ করার জন্য আমি বললাম তোমরা সবাই গেলেই বেলায়েত ভাই-

তারমানে তুমি শিডিউলটা দিয়ে দিতে বলছ।

জি ভাই যদি আপনি কিছু মনে না করেন।

জামাল নেগোসিয়েট করার আগে তুমি আমাকে জানালেও পারতে। আমি তোমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতাম। কিন্তু কোন কাজ কে পেল? কাজের ডিস্ট্রিবিউশনটা ঠিক হলো কিনা? এসব না জেনেই শিডিউল দিয়ে দিব। বয়সে বড় হয়েছি জানি সে কারণে সব সময় আমাকেই সেক্রিফাইজ করতে হবে? আর তোমরা আমাকে অবমূল্যায়ন করবে?

বেলায়েত ভাই আমি লজ্জিত, আপনি এবারের মতো সহযোগিতা করুন, সামনে যে কোন কাজের টেন্ডার হলে আপনি কোনভাবেই বঞ্চিত হবেন না।

ঠিক আছে তোমার কাউকে পাঠাতে হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আমি টেন্ডার ড্রপ করব না।

থ্যাংক  ইউ ভাই, আমি জানতাম আপনি না করবেন না।

তো জামাল ঠিক আছে তাহলে দোয়া করি তুমি সফল হও।

জি ভাই আল্লাহ যেন আপনার দোয়া কবুল করেন, বলে জামাল লাইন কেটে দিয়ে শাকিলকে মোবাইল করল, হ্যালো শাকিল, বেলায়েত ভাই শিডিউল ড্রপ করবে না বলেছে তোমার যাওয়ার দরকার নাই। তুমি বাকী শিডিউলগুলো ক্লোজ করার চেষ্টা কর। কোনটা ক্লোজ করতে না পারলে আমাকে জানাও সবকিছু সুষ্ঠুভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি  শহরে আছি।

জি বড় ভাই।

জামাল মোবাইল অফ করল?

জামাল মোবাইলের মাধ্যমে শাকিলের সঙ্গে টেন্ডারের খবরাখবর মনিটরিং করল। টেন্ডার বক্স বন্ধ করার শেষ সময় ছিল দুপুর একটার সময়।

জামাল শাকিলকে মোবাইল করল, শাকিল সব কিছু ঠিক আছে?

জি বড় ভাই।

কেউ শিডিউল ড্রপ করতে আসেনি?

হ্যাঁ দু’জন শিডিউল ড্রপ করতে এসেছিল, আমরা শিডিউল কেড়ে নিয়েছি।

তাহলে অপারেশন সাকসেসফুল, বলে জামাল হো হো করে হেসে উঠল তারপর বলল, ওপেনিং ক’টায়?

দু’টায়।

ঠিক আছে তোমরা থাক, আমি বেলা দু’টায় অফিসে আসছি।

জামাল বেলা দু’টায় অফিসে গিয়ে তার নিজের পরিচয় দিল, আমি মোঃ জামাল হোসেন, জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল, জেলা শাখা।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার নিজের পরিচয় দিলেন, আমি ইঞ্জিনিয়ার সফিয়ার রহমান, বসুন প্লিজ।

জামাল চেয়ারে বসল। সফিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মনে করে?

আমি টেন্ডারে পার্টিসিপেট করেছি।

দু’টা বাজে এখনি বক্স ওপেন করা হবে বলে সফিয়ার সাহেব কলিং বেল-এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল, স্যার।

হুমায়ুন সাহেব আর হেলাল সাহেবকে আসতে বল, টেন্ডার বক্স খুলতে হবে।

হুমায়ুন সাহেব ও হেলাল সাহেব এলেন, টেন্ডার বক্স খোলা হলো। প্রত্যেক গ্রুপে তিনটা করে শিডিউল ড্রপ হয়েছে দেখে সফিয়ার সাহেব বললেন, প্রত্যেকটা গ্রুপে তিনটা করে শিডিউল ড্রপ হয়েছে তারমানে নেগোসিয়েট হয়েছে?

জামাল কোন মন্তব্য করল না, মনে মনে একটু হাসল তারপর বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঠিকাদাররা যদি টেন্ডারে পার্টিসিপেট না করে তবে আপনার কি করার আছে বলুন?

অনেক সময় ঠিকাদারদেরকে টেন্ডার ড্রপ না করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়, বলে সফিয়ার সাহেব সর্বনিম্ন দর দাতাগণের নাম পড়ে শোনালেন। তারপর জামাল অন্যান্য অংশ গ্রহণকারী ঠিকাদারগণের দিকে ওপেনিং সি. এস এর কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ আপনারা ওপেনিং সি. এস. এ সই করুন।

জামাল ওপেনিং সি. এস. এ স্বাক্ষর করে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আসি, বলে জামাল অফিস থেকে বের হলো। তার সঙ্গে শাকিলসহ আরো দু’য়েক জন বেরিয়ে গেল। শাকিল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, বড় ভাই দেখলেন আপনি পাওয়ার পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কিছু মনেই করলেন না।

প্রথম দিন তো তাই ভদ্রভাবে পরিচয় দিলাম। বাড়াবাড়ি করলে আমার ক্ষমতা দেখিয়ে দিব।

চুয়াল্লিশ

পার্টি অফিসে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের মাসিক মিটিং চলছে। মিটিংয়ে দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছেন। দলের জেলা শাখার সভাপতি ও মাননীয় মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে দলের সহ-সভাপতি কামরান সাহেব সভায় সভাপতিত্ব করছেন। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতনের প্রতিবাদের কথা বলতে থাকল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকেই প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠল। কথা প্রসঙ্গে বেলায়েত সাহেব বললেন, তখন যেন দলের কাজ ছিল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই আর এখন ক্ষমতা গ্রহণের পর অস্তিত্বের লড়াই নাই, নির্যাতিত হবার ভয় নাই এখন যেন দলের মধ্যে শুরু হয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

মিটিংয়ের শুরুতে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে কাজ ভাগাভাগিতে বঞ্চিতদের কয়েকজন তাঁদের ক্ষোভের কথা বললেন। বেলায়েত সাহেব নিজেও তাঁর বক্তৃতায় বললেন, আমি নিজেও দেখেছি দলের  মধ্যে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেশি শুরু হয়েছে, এমনভাবে চলতে থাকলে দলের মধ্যে বঞ্চিত নেতাকর্মীরা দলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে, ক্ষমতার শেষদিকে নেতাকর্মীরা দলত্যাগ করবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে যে সব কাজের টেন্ডার বের হয়েছে তা কয়েকজনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যারা সরকার বিরোধী মিছিলের প্রথম সারিতে থাকত যে কোন সুবিধা গ্রহণের বেলায় তারা আজ বঞ্চিত, শুধুমাত্র দলের মধ্যে নতুনভাবে গজিয়ে উঠা কিছু নেতা-কর্মী সমস্ত কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে এবং দলকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গুছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি মনে করি যারা দলের জন্য শ্রম দিয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে দলে তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা উচিত  নয়। আমি আশা করি আজকের সভার সভাপতি এবং জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বিষয়গুলি সুবিবেচনার দৃষ্টিতে দেখবেন। দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে আরো গতিশীল করার জন্য উপজেলা কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনসমূহকে সমন্বয় করার উদ্যোগ নিবেন। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ সকল নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে দিক নির্দেশনা দিবেন। আপনারা সবাই দলের ভাবমূর্তি বজায় রেখে দলীয় সকল কর্মসূচী সফলভাবে পালন করবেন এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জয় হোক, খোদা হাফেজ।

বেলায়েত সাহেবের বক্তৃতার পর জামাল বক্তৃতা শুরু করল। আজকের সভার সভাপতি, উপস্থিত আমার প্রিয় দলের সকল নেতা-কর্মীগণ আস্‌সালামুআলায়কুম। আপনারা সবাই দলের সক্রিয় নেতা কর্মী হিসেবে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন তাই আমার এবং দলের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইতোপূর্বে কয়েকজন নেতা-কর্মী বিরোধী দলের নির্যাতন ও নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন যা অত্যন্ত মর্মান্তিক বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের উপর স্টিম রোলার চালিয়েছে কিন্তু আপনারা পথভ্রষ্ট হননি, দলত্যাগ করেননি, দলের কোন কর্মকাণ্ড থেকে পিছপা হননি। আমি নিজেও মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলায় হাজত খেটেছি। আমাদের সকলের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। জনগণের এই রায়কে আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে ও দলের ভাবমূর্তি বজায় রেখে আমাদের চলতে হবে। আমরা যেন কোন ক্রমেই জনগণের রায়কে ধরে রাখতে ব্যর্থ না হই। আমি কয়েকজন সম্মানিত নেতা-কর্মীর বক্তব্য আমাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে শুনেছি। কিন্তু আপনাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দল ক্ষমতা গ্রহণের এখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি। সবকিছু গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা নিরাশ হবেন না, হতাশায় ভুগবেন না আমি দলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কাউকে কোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করব না, করো প্রতি অবিচার করব না। বেলায়েত ভাই তাঁর বক্তৃতায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও বঞ্চনার কথা বলেছেন, তিনি দলের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছেন। যারা দলে নতুন, তরুণ, যারা দলে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনেছে তাদেরকে নতুনভাবে গজিয়ে উঠা নেতা বলে অপমান করেছেন। আসলে রাজনীতিতেই হোক আর অন্য যে কোন ক্ষেত্রেই হোক বয়সটাই বড় বিষয় নয়। দলে এখন নতুনদের আগমন বেশি তারমানে এই নয় যে নতুনরা দলকে পিছিয়ে দিবে। নতুনরা যেমন সিনিয়রদের পরামর্শ মেনে চলবে, সিনিয়রদের শ্রদ্ধা করবে ঠিক তেমনি সিনিয়রদেরও উচিত জুনিয়রদের স্নেহ করা, সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দেয়া।

এমন সময় বেলায়েত সাহেব গম্ভীর কালো মুখ তুলে জামালের দিকে তাকালেন এবং জামালের চোখে চোখ পড়ল।

জামাল আবার বলতে শুরু করল, দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য আমার পরম শ্রদ্ধেয় বেলায়েত ভাই যে পরামর্শ দিয়েছেন, যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপনারা সবাই দলকে আরো গতিশীল করার জন্য আমাকে সহযোগিতা করবেন আপনাদের প্রতি এই আহবান জানিয়ে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করছি।

মিটিং শেষ হলো। বেশির ভাগ নেতা-কর্মী চলে গেল। জামাল দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক শাকিলকে নিয়ে বসল।

শাকিল বলল, বড় ভাই সিচুয়েশন তো ভালো মনে হচ্ছে না।

ফরহাদ বলল, বেলায়েত ভাই মনে হয় দলে গ্রুপিং তৈরির চেষ্টা করছে।

তোমরা মনে করছ আমি বুঝতে পারছি না, তোমরা এরপর কোন টেন্ডার হলে বেলায়েত ভাইর সঙ্গে যারা গ্রুপিং-এ যোগ দিয়েছে তাদেরকেও ধীরে ধীরে কাজ দিয়ে বুক্‌ড করবে যেন তারা কাজের জন্য বেলায়েত ভাইর পিছু পিছু না ঘুরে। সবাই যেন বুঝতে পারে বেলায়েত ভাই’র পিছনে ঘুরে কোন লাভ নেই। তারা সবাই যেন আমাদের সঙ্গে থাকে আর এমনভাবে রাজনীতিতে বেলায়েত ভাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। হ্যাঁ বেলায়েত ভাইকেও কাজ দিতে হবে, না হলে তিনি আবার মাননীয় মন্ত্রীর কাছে কমপ্লেইন করবেন বলে জামাল মনে মনে বলল, ধীরে ধীরে পথের কাঁটা সরিয়ে আমাকে হতে হবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

শাকিল জিজ্ঞেস করল, বেলায়েত ভাই এবং তার গ্রুপকে কাজ দিলে কি লাভ হবে?

হ্যাঁ আমি জানি তোমরা এটা জানতে চাইবে, বেলায়েত ভাইকে কাজ দিতে হবে নইলে তিনি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে কমপ্লেইন করবেন এবং শুনে মাননীয় মন্ত্রী মাইন্ড করবেন। আর তাঁর শীষ্যদের কাজ দিতে হবে তারা যেন বুঝতে পারে ক্ষমতা কোন দিকে এভাবে বেলায়েত ভাইর গ্রুপকে পঙ্গু করে দিতে হবে।

শাকিল এবং ফরহাদ পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, জি বড় ভাই বুঝতে পাচ্ছি।

পঁয়তাল্লিশ

জামাল অফিসে ঢুকতেই পিয়ন বলল, ভাই বিকেলবেলা আনন্দ নগর থেকে এক লোক এসেছিলেন কিছুক্ষণ আগে আবার এসে বসে আছেন।

জামাল বলল, পাঠিয়ে দাও।

পিয়ন চলে গেলে কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধ জামালের চেম্বারে ঢুকলেন। জামাল সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি?

আমার নাম হেলাল উদ্দিন, আমি আনন্দনগর থেকে এসেছি।

বলুন কি মনে করে?

আনন্দনগর নদীর ধারে আমার কিছু জমি আছে। আমি জমিটা বিক্রি করতে চাই। বেলাল আমার ছেলে ও একদিন আপনার কার্ডটা হাতে দিয়ে বলল, আপনি নাকি জমিটা কিনতে চান?

জি চাচা আপনি বসুন, বলে জামাল কলিং বেল টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল।

ভালো মিষ্টি আর চা নিয়ে এসো।

পিয়ন চলে গেল জামাল জিজ্ঞেস করল, চাচা বলুন তো ওখানে আপনার কতটুকু জমি আছে?

দু’একর।

কত করে দাম নিবেন?

আমার আসলে দু’লাখ টাকার প্রয়োজন, সেজন্যই জমিটা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

চাচা জমিটা তো অনাবাদী, এই জমির দাম তো এত বেশি হবে না।

কিন্তু জমিটা বিক্রি করে যদি আমার কোন কাজ না হয় তাহলে তো আমি জমিটা বিক্রি করব না।

জামাল বলল, চাচা জমির কি কোন কাগজ-পত্র এনেছেন?

এনেছি।

পিয়ন চা নাস্তা নিয়ে এলো জামাল বলল, চাচা আমি তো জমির কাগজপত্রের বিষয়ে কিছু বুঝি না আপনি কাগজগুলো দিন আমি ফটোকপি করে নিই।

হেলাল সাহেব কাগজগুলো জামালকে দিলেন।

জামাল পিয়নকে কাগজগুলো দিয়ে বলল, যাও তো এগুলো ফটোকপি করে নিয়ে এসো তারপর হেলাল সাহেবকে বলল, নিন চাচা, প্লিজ মিষ্টি খান।

হেলাল সাহেব মিষ্টি খেতে খেতে বললেন, জমিটা আমি পেয়েছি পৈত্রিক সূত্রে। জমিটাতে ফসল আবাদ হয় না ঠিকই কিন্তু জমিটার উপর একটা মায়া জন্মেছে তাই কোনদিন বিক্রির কথা মুখে আনিনি। হঠাৎ করে দু’লাখ টাকার প্রয়োজন হলো তাই আপনার কাছে এলাম।

জামাল মনে মনে বলল, দু’লাখ টাকায় দু’একর জমি দামেও বেশ সস্তা তাছাড়া খামারবাড়ি হিসেবে জায়গাটা অতুলনীয়। তারপর বলল, চাচা আমি একজন রাজনীতিবিদ, জননেতা। আপনারা ভোট দিলেই আমি হব জনপ্রতিনিধি। জমিটার দাম হয়ত দু’লাখ টাকা একটু বেশি হচ্ছে। কিন্তু দু’লাখ টাকার কম হলে আপনার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। একজন জন প্রতিনিধি হিসেবে আপনার দিকটা দেখাও আমার দায়িত্ব। তাই আপনার জমিটা আমি কিনব। আগামী সপ্তাহে আপনাকে নগদ টাকা দিয়ে জমিটা রেজিস্ট্রি নিব।

হেলাল সাহেব চা শেষ করে বললেন, তাহলে আমি আসি। আপনি খবর দিলেই যেদিন বলবেন সেদিনই জমি রেজিস্ট্রি করে দিব।

পিয়ন জমির কাগজপত্রগুলো ফটোকপি করে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। জামাল বলল, মূল কপিগুলো চাচাকে দাও আর ফটোকপিগুলো আমাকে দাও।

হেলাল সাহেব জমির কাগজপত্রগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। জামাল জমির দলিলটা ভালোভাবে পড়ল। তারপর তার লিগ্যাল এ্যাডভাইজার তারেক সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো তারেক তুমি একবার আমার চেম্বারে এসো তো।

এখনি।

হ্যাঁ এখনি চলে এসো, আমি অফিসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

জি আসছি।

জামাল মোবাইল অফ করে কলিং বেল-এ টিপ দিল।

পিয়ন দরজায় এসে দাঁড়াতেই জামাল বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আসতে বল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে রশিদ সাহেব চেম্বারে ঢুকলেন।

জামাল বলল, গোডাউনের কাজটা খুব স্লো চলছে। কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করুন তো আমি গত সপ্তাহে ঢাকা যেতে চেয়েছিলাম তা তো হলো না আগামী সপ্তাহে আমি অবশ্যই ঢাকা যাব। এর মধ্যে আপনি কাজটা শেষ করবেন। গোডাউনের কাজটা শেষ হলেই ব্যাংকের লোনটা স্যাংশন হবে। এরই মধ্যে কাজটার ওয়ার্ক অর্ডার হয়ে যাবে। লোনটা স্যাংশন না হলে টাকার সমস্যা হবে আপনি একটু  সবদিক খেয়াল রাখবেন। আর হ্যাঁ কাল একবার অফিসে যাবেন নতুন কাজ বের হলো কি না?

জি ভাই ঠিক আছে।

এমন সময় তারেক সাহেব ভিতের ঢুকলেন।

জামাল বলল, এসো উকিল সাহেব, তোমার আইন ব্যবসা কেমন চলছে?

জি ভালো।

জামাল জমির কাগজ-পত্রগুলো তারেক সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, তুমি কাগজ-পত্রগুলো দেখে বল তো কোন গড়মিল আছে না কি?

তারেক সাহেব কাগজ-পত্রগুলো কিছুক্ষণ নিরীক্ষা করে বললেন, কাগজ-পত্র ঠিক আছে। আপনি কিনতে পারেন।

দেখ তারেক তুমি আমার লিগ্যাল এ্যাডভাইজার জমির কাগজ-পত্র আমি বুঝি না, তুমি বলছ কাগজ-পত্র ঠিক আছে এখন আমি নিশ্চিন্ত হলাম।

জমিটা তো দেখছি আনন্দনগর মৌজায়, মৌজা ম্যাপ দেখে মনে হচ্ছে নদীর ধারের ঐ অনাবাদী জমিটা। ঐখানে জমি কিনে কি করবেন?

জামাল সহজভাবে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, কি করব সেটা পরে হবে জমি তো কিনে রাখলেই লাভ। ওসব এখন রাখ তোমার বার কাউন্সিলের খবর কি? আগের কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে কবে? নির্বাচন কবে?

আগের কমিটি আর তিনমাস আছে তারপর  নির্বাচন।

তাহলে এখন থেকে ভালোভাবে কাজ কর যেন ফুল প্যানেলে জিততে পারো।

জি ভাই আপনার দোয়া পেলে অবশ্যই পারব। তবে প্যানেল লিস্টটা আপনাকে করে দিতে হবে।

জামাল মৃদু হেসে বলল, সময় আসুক দেখা যাবে।

ভাইজান আমি তাহলে এবার আসি বলে তারেক সাহেব চলে গেলেন।

জামাল বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আনন্দ নগর নদীর ধারে যে জমিটা আছে ঐ জমিটা নিয়েই কথা হলো। আগামীকাল আপনাকে একবার নিয়ে যাব। আমি ওখানে একটা খামারবাড়ি করতে চাই। ভালো হবে না?

জি ভাই ভালো হবে।

এই ধরুন চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া থাকবে, গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ফুটপাথ থাকবে। ফুটপাথের দু’পাশে থাকবে সারি সারি ফুলগাছ। বাগানের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে থাকবে একটা দোতলা বাংলো, নীচতলায় অফিস, ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, পুরো একটা ফ্যামিলি থাকার ব্যবস্থা থাকবে। উপরে থাকবে একটা ভি.আই.পি রুম, দু’টা বেড রুম, দু’টা রুমের সঙ্গেই থাকবে এ্যটাচ্‌ড বাথ। বাথরুমে বসানো থাকবে টাইলস এবং অত্যাধুনিক স্যানিটারি ফিটিংস, বাথরুমে থাকবে গরম এবং ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা। বিল্ডিংয়ের ছাদ হবে টাইলস দিয়ে তৈরি, সেগুন কাঠের সিলিং, রুমে যে বাতিগুলো থাকবে সেগুলো থাকবে সিলিংয়ের কাঠ দিয়ে ঢাকা, কাঠের ফাঁক দিয়ে শুধু আলো বের হয়ে আসবে কিন্তু টিউব লাইট দেখা যাবে না। তাছাড়া সিলিংয়ের নীচে থাকবে বাজারের সব চেয়ে দামি লাক্সারিয়াস ঝাড় বাতি, সম্ভব হলে সেগুলো বিদেশ থেকে আনাবেন। নদীর পার্শ্বে থাকবে একটা  বেলকনি, যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে দেখা যাবে নদী এবং উপরের দিকে তাকালে দেখা যাবে আকাশ। পূর্ণিমার রাতে যেন বেলকনিতে বসে জ্যোৎস্না উপভোগ করা যায়, বলে জামাল আপন মনে কল্পনা করতে থাকল তার মনের মধ্যে পশুত্বটা জেগে উঠল, যেখানে প্রতিদিন আসবে নিত্য নতুন নারী সঙ্গে থাকবে বিদেশি মদের বোতল আরো ভোগ বিলাসের সব সরঞ্জাম। নেশার রঙ্গিন চোখে সুন্দরী নারীকে মনে হবে বেহেস্তের হুর, নীচ দিয়ে যাবে নহর। আমার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে আমি এখানে বেহেস্ত বানাতে চাই, বেহেস্ত।

রশিদ সাহেব বললেন, ভাই আমি কি আসতে পারি?

জামাল চমকে উঠল, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি এখন আসুন।

ছেচল্লিশ

জামাল যে মন্ত্রীর খুব নিকটতম মানুষ এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এ কথা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন সকলেরই জানা তাই মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে জামালকে সিকিউরিটি কখনো চেক করে না। কিন্তু ঢাকায় মন্ত্রীর বাসার গেটে যেতেই একজন পুলিশ জামালকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করল তারপর খাতায় তার নাম ঠিকানা ও আগমনের উদ্দেশ্য এন্ট্রি করল।

জামাল গেটে দাঁড়িয়ে মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো জামাল।

বড় ভাই আমি গেটের ভিতরে ঢুকেছি আপনি কোথায়?

তুমি ড্রয়িং রুমে বস আমি আসছি।

কয়েক মিনিট পর মাননীয় মন্ত্রী নেমে এসে সহাস্যে বললেন, আরে জামাল কেমন আছ?

জি ভাই ভালো।

উঠেছ কোথায়?

হোটেলে।

তুমি আমার এখানে থাকতে পারতে।

না ভাই এই যে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা হলো কথা হলো, দু’একটা কাজ নিয়ে এসেছি এগুলো করতে হয়ত দু’একদিন সময় লাগবে। এ দু’একদিন বিরক্ত করব তারপর চলে যাব।

মাননীয় মন্ত্রী গম্ভীর স্বরে বললেন, জামাল এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি এসেছ আমি বিরক্ত হব নাকি?

সরি বড় ভাই।

জামাল তার ব্রিফকেস থেকে কিছু কাগজ-পত্র বের করল।

মাননীয় মন্ত্রী আশরাফ সাহেবকে ডেকে বললেন, আশরাফ জামালের কাগজ-পত্রগুলো দেখে ব্যবস্থা নাও তো।

আশরাফ সাহেব চলে গেলেন।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, খবর কি বল?

বড় ভাই নতুন কোন খবর নেই তবে বেলায়েত ভাই মাঝে মাঝে দলের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, গ্রুপিং দলের জন্য ক্ষতিকর এটা যেন কোনভাবেই না হয় সে দিকে খেয়াল রাখবে। আচ্ছা বেলায়েত তো এমন ছিল না!

জামাল একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, কি আর বলব বড় ভাই, এই ধরুন আপনি মন্ত্রী, সবাই আপনাকে বলে মাননীয় মন্ত্রী, এলাকার লোকজন  থেকে শুরু করে সারাদেশের মানুষ আপনাকে সম্মান করে। আর আমি একজন জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি আপনার মতো সম্মান আমি চাইলেই তো আর হবে না। আর হিংসা করলেও হবে না। কিন্তু বেলায়েত ভাই একটু ভিন্ন, আমি দলের জেনারেল সেক্রেটারি, দলের নেতা-কর্মীরা যে কোন কাজে আমার কাছে ছুটে আসে এটা তিনি মানতে পারেন না। এই প্রতিহিংসায় তিনি দলে গ্রুপিং তৈরির চেষ্টা করছেন। আপনি কোন চিন্তা করবেন না বড় ভাই সব ঠিক হয়ে যাবে।

দেখ ঠিক হলেই ভালো।

এমন সময় আশরাফ সাহেব ভিতরে ঢুকলেন।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, কি ব্যাপার?

আশরাফ সাহেব বললেন, স্যার কয়েকটা কাজ আমাদের মন্ত্রণালয়ের আর কয়েকটা অন্য মন্ত্রণালয়ের।

মাননীয় মন্ত্রী কাগজগুলো নিয়ে স্বাক্ষর করে দিয়ে বললেন, জামাল তুমি কবে যাবে?

বড় ভাই আমি দুই/তিন দিন আছি।

তবে যাবার আগের দিন এসো আমার মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো করে নিয়ে যাবে আর অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো হয়ে গেলে আমি তোমাকে জানিয়ে দিব।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলে মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর জামাল উঠতে যাচ্ছিল। মাননীয় মন্ত্রী বললেন, এখন কোথায় যাবে?

না কোথাও যাব না।

তবে চল একবার পার্টি অফিসে যাই, তুমি বস আমি রেডি হয়ে আসি, আশরাফ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল, বলে মাননীয় মন্ত্রী ভিতরে গেলেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলেন। তারপর জামাল গাড়িতে উঠল। মন্ত্রীর গাড়ি যেদিক দিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই ট্রাফিক পুলিশ যানজট সরিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে দিচ্ছে।

জামাল মৃদু হেসে বলল, বড় ভাই আজ যখন আমি হোটেল থেকে আপনার বাসায় আসছিলাম তখন ট্রাফিক জ্যামে এক ঘণ্টা রাস্তায় আটকে ছিলাম, আমার খুব বিরক্ত লাগছিল, এখন তো দেখি রাস্তা একেবারে ফাঁকা।

মাননীয় মন্ত্রী একটু হাসলেন তারপর বললেন, জামাল এটা তো নতুন না, এটা সিস্টেম।

জামাল মনের চোখ দিয়ে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একদিন সেও মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা পত পত করে উড়নো গাড়িতে চড়ে বেড়াচ্ছে, তার সামনে পিছনে সিকিউরিটি বাঁশি বাজিয়ে চলছে, রাস্তা একেবারে ফাঁকা, মোড়ে মোড়ে দাঁড়ান পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে বড় অফিসার পর্যন্ত স্যালুট দিচ্ছে এমনভাবে কল্পনা করতে করতে জামাল আপন মনে একবার হেসে উঠল।

গাড়ি এসে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দাঁড়াল। মাননীয় মন্ত্রী নামলেন সঙ্গে জামালও নেমে মাননীয় মন্ত্রীর পিছনে পিছনে অফিসের ভিতরে ঢুকলো। অনেকে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে মাননীয় মন্ত্রীকে সালাম দিলেন আবার কাউকে মাননীয় মন্ত্রী সালাম দিলেন। মাননীয় মন্ত্রী কেন্দ্রীয় জয়েন্ট সেক্রেটারি ইমরান সাহেবের সঙ্গে জামালের পরিচয় করে দিলেন।

ইমরান সাহেব জামালের পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, বাহ্‌ এত অল্প বয়সে জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি! দলের কাজ-কর্ম ঠিক মতো চলছে তো?

জি ভাই সবকিছু ঠিক মতো চলছে।

কাজ কর, দলের জন্য কাজ কর, দেশের জন্য কাজ কর একদিন অনেক বড় নেতা হবে।

জামাল বিনীতভাবে বলল, জি বড় ভাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

অবশ্যই বলে ইমরান সাহেব চলে যাচ্ছিলেন। জামাল বিনয়ের সাথে বলল, বড় ভাই প্লিজ আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড দিবেন?

অবশ্যই বলে ইমরান সাহেব জামালকে তাঁর একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে চলে গেলেন।

জামাল কিছুক্ষণ পার্টি অফিসে কাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলো। জামাল প্রায় সকলের কাছ থেকে ভিজিটিং কার্ড সংগ্রহ করল এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখার জন্য অনুমতি নিল।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, জামাল যদিও তুমি জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি কিন্তু তুমি বয়সে একেবারে নবীন। আমার তো মনে হয় সারাদেশে জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারিদের মধ্যে তুমি বয়সে সবার ছোট। যা হোক বয়সটা ফ্যাক্টর না আমি তো মন্ত্রণালয়ের কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকব আজ তোমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিলাম। এখন থেকে নিজের পরিচয়ে অথবা আমার রেফারেন্সে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।

জি বড় ভাই।

তুমি না হয় আমার বাসায় থাক।

না বড় ভাই আমি হোটেলে থাকব।

তবে চল তোমার হোটেল আমাদের যাবার রাস্তায় পড়বে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।

জি বড়ভাই।

সাতচল্লিশ

          মিঃ টি. আর খানের সঙ্গে জামালের শুধুমাত্র কয়েকবার মোবাইলে কথা হয়েছে। জামাল ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী এবং রাজনীতিবিদ এ কথা জানার পর মিঃ টি. আর. খান নামে একজন জামালকে মোবাইল করে হেরোইনের ব্যবসা করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। জামালও তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। ঢাকায় আসার আগে জামাল মিঃ টি. আর. খানের সঙ্গে কথা বলেছে এবং হোটেলে উঠার পর হোটেলের রুম নাম্বার মিঃ টি. আর. খানকে জানিয়েছে। তারপর টি. আর. খান নিজেই জামালকে খুঁজে নিবেন বলে জানিয়েছেন। তবে জামাল খেয়াল করেছে টি. আর. খান কখনো একই মোবাইল নাম্বার থেকে মোবাইল করে না। জামালের সঙ্গে টি. আর. খানের যতবার কথা হয়েছে ততবারই তিনি ভিন্ন ভিন্ন মোবাইল থেকে কথা বলেছেন। হয়তবা টি. আর. খান অনেকগুলো মোবাইল সিম ব্যবহার করেন যাতে মোবাইলের কলচার্ট দেখে টি. আর. খানের প্রকৃত পরিচয় এবং তাঁর কি ধরণের লোকের সঙ্গে উঠাবসা বুঝা না যায়। টি. আর. খান জামালের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল গতকাল কিন্তু জামাল তাঁর জন্য গতকাল অপেক্ষা করলেও তিনি আসেননি। যে সমস্ত মোবাইল থেকে জামালের কথা হয়েছে সে সব মোবাইলে মোবাইল করেও জামাল যোগাযোগ করতে পারেনি।  জামাল মনে মনে ভাবছে আমি কোন দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভুয়া, প্রতারকের পাল্লায় পড়িনি তো? জামাল হোটেলের রুমে শুয়ে মিঃ টি.আর. খানকে নিয়ে ভাবছিল এমন সময় দরজা নক করার শব্দে জামাল চমকে উঠল।

জামাল দরজা খুলে দিল। ফর্সা ধবধবে চুলে মেহেদী লাগানো ফ্রেন্সকার্ভ দাড়ি, কোট, প্যান্ট, টাই পরা উন্নত রুচিসম্পন্ন এক ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

জামাল একবার আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি?

ভদ্রলোক বললেন, আমি টি. আর. খান, আপনি নিশ্চয়ই জামাল হোসেন?

জামাল মনে মনে বলল, আগে একবার পরিচয় দিয়ে বলেছিল মিঃ খান আবার এখন বলল মিঃ টি. আর. খান। দু’জনে আলাদা আলাদা মানুষ।

মিঃ টি. আর. খান জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ জামাল কি ভাবছেন?

সে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, আপনি গতকাল আসার কথা ছিল তো।

হ্যাঁ তা ছিল কিন্তু আমি আসিনি, তারপরও আমি বলব আমি সময়ের প্রতি যথেষ্ট মূল্যবান।

জামাল অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকাল। টি. আর. খান বললেন ভাবছেন যে লোক চব্বিশ ঘণ্টা স্লো সে আবার বলে সময়ের মূল্য সম্পর্কে সচেতন।

জামাল কিছু বলল না মৃদু হাসল।

মিঃ জামাল আপনি এ ব্যবসায় নতুন তাই সবকিছু বুঝবেন না। আমার এখানে আসার সময়টা যদি কোন কারণে ফাঁস হয়ে যায় আর পুলিশ ওঁত পেতে থাকে তবে কি তা বিপজ্জনক হতো না?

জি বুঝতে পেরেছি।

বাই দি বাই আপনার সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি আপনি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, পাওয়ার পার্টির নেতা, অতি অল্প বয়সে আপনি রাজনৈতিক এবং আর্থিক দিক থেকে অনেকদূর এগিয়েছেন, এ লাইনের ভাষায় যাকে বলে বিজনেস ম্যাগনেট। তবুও আপনাকে বলা প্রয়োজন হেরোইন খুব দামি জিনিস, এক হাজার বোতল ফেন্সি বা একমন গাঁজা কোন কারণে খোয়া গেলে কিছু যায় আসে না কিন্তু এক কেজি হেরোইনের দাম এক কোটি টাকা সেদিকটা আপনি ভালোভাবে খেয়াল রাখবেন বলে টি. আর. খান বললেন, আমি যতদূর জেনেছি আপনার ফেন্সি এবং গাঁজার ব্যবসাটা খুব ভালো চলছে  সঙ্গে হেরোইন চালাতে পারলে আপনি রাতারাতি কোটিপতি বনে যাবেন। যদিও আপনি এখনই একজন কোটিপতি।

জামাল মৃদু হাসল। তার মাথায় তখন অনেক চিন্তা ভিড় করছে যে লোকটার সঙ্গে তার কোনদিন দেখাই হলো না তিনি তার সম্পর্কে এতকিছু  জানলেন কিভাবে? শুধু তাই নয় আমার ফেন্সি আর গাঁজার ব্যবসাটা ভালো চলছে সেটাও তিনি খবর নিয়েছেন।

টি. আর. খান তাঁর ব্রিফকেস থেকে একটা আইডেন্টি কার্ড বের করে বললেন, কার্ডে কোন নাম ঠিকানা বা ছবি নাই শুধু ইংরেজিতে আট ডিজিটের একটা সংখ্যা আছে। এই সংখ্যার মধ্যে প্রথম তিন সংখ্যা হলো আন্তর্জাতিক কোড, দ্বিতীয় তিন সংখ্যা হলো দেশের কোড এবং শেষের দুই সংখ্যা হলো জেলা কোড এক জেলায় দু’জনকে আইডেন্টি কার্ড দেয়া হয় না বলে তিনি জামালকে একটা কার্ড দিলেন।

জামাল কার্ডটা হাতে নিল, তার মনে হলো কার্ডটা কাগজের তৈরি নয়, বিশেষ কোন পদার্থের তৈরি। সফট অথচ ছেঁড়া যায় না এবং পানিতে ভিজলেও নষ্ট হবে না বলে জামালের মনে হলো। জামাল কার্ডটা নাড়াচাড়া করে দেখে পকেটে রেখে দিল। মিঃ টি. আর. খান এবার তাঁর ব্রিফকেস থেকে কয়েকটা ছেঁড়া টাকার অংশ বের করলেন।

জামাল কোন কিছু  না বুঝে মিঃ টি. আর. খান এর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিঃ টি. আর. খান জামালের হাতে পাঁচটা ছেঁড়া টাকার অর্ধাংশ দিতেই জামাল জিজ্ঞেস করল, ছেঁড়া টাকা কেন?

মিঃ টি. আর. খান রেগে গেলেন, মিঃ জামাল এ লাইনে বেশি কথা বলতে হয় না, চুপ করে থাকতে হয়, আগে বুঝতে হয়, না বুঝে কিছু বলতে হয় না।

জামাল বিনয়ের সাথে বলল, জি বস।

মিঃ টি. আর. খান জামালের হাতে পাঁচটা ছেঁড়া টাকার অংশ বিশেষ দিয়ে বললেন, মিঃ জামাল এই টাকাগুলো রাখুন যে মাল ডেলিভারি দিবে এবং নিবে কিংবা টাকা আদান-প্রদান করবে তাদের দু’জনের কাছে টাকার দু’অংশ থাকবে যদি দু’টা অংশই মিলে যায় তবে তারা কনফার্ম হবে।

জামাল টাকাগুলো নিয়ে মিঃ টি. আর. খানের বুদ্ধি আর তাঁর কথা বলার কৌশল দেখে অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিঃ টি. আর. খান এবার বললেন, মাল আমার সঙ্গে আছে আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারেন।

কিন্তু আমি তো টাকা নিয়ে আসিনি।

আমার লোক গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে এই নিন মাল, বলে মিঃ টি. আর. খান জামালের হাতে এক প্যাকেট পাউডার জাতীয় জিনিস দিয়ে বললেন, এখানে আছে দু’শ পঞ্চাশ গ্রাম হেরোইন যার মূল্য পঁচিশ লক্ষ টাকা। এখন টাকা দিতে হবে না, কবে টাকা দিবেন সেটা বলে দিন কিন্তু সময়ের যেন কোন হেরফের না হয়।

জি বস।

কবে টাকা দিবেন?

আগামী মাসে।

আগামী মাসে বললে হবে না, যা হোক আপনি মাসের ত্রিশ তারিখ সন্ধ্যা সাতটায় টাকা রেডি রাখবেন। মিঃ জামাল যত সহজে এ ব্যবসায় ঢুকে পড়লেন তত সহজে কিন্তু বের হওয়া যায় না। এ ব্যবসা থেকে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তা মৃত্যু বলে মিঃ টি. আর খান তাঁর ব্রিফকেস থেকে পিস্তল বের করে জামালের মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, এই ব্যবসা এক’শ পার্সেন্ট গোপনীয়, টাকা লেনদেনসহ সব কমিটমেন্ট ঠিক রাখা আবশ্যক। আর এই ব্যবসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা মৃত্যু! রিমেম্বার ইট।

জামাল ভয়ে কেঁপে উঠল তাঁর সমস্ত শরীর থেকে ঘাম ঝরল, নিঃশ্বাস দ্রুত বইতে লাগল। অথচ মিঃ টি.আর খান যেন বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে নিলেন। তিনি হো হো করে রুম কাঁপান হাসি হেসে উঠলেন। তারপর হঠাৎ করেই থামলেন, ভয় পাবেন না এই লাইনে যেমন রিস্ক আছে তেমনি আছে কোটি কোটি টাকা রোজগারের সুযোগ এই বলে মিঃ টি. আর. খান হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।

মিঃ টি. আর. খানকে বিদায় দিয়ে জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। যেন তার জীবনে হঠাৎ করে এক প্রলয়ঙ্করী দমকা হাওয়া  বয়ে গেল। জামালের স্বাভাবিক হতে আরো কিছুক্ষণ সময় লাগল, ক্লান্তিতে তার দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। জামালের মোবাইল বেজে উঠল।

সে মোবাইল রিসিভ  করে বলল, বেলি তুমি কোথায়?

আমি আপনার হোটেলের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি, আপনি কি রুমে আছেন?

হ্যাঁ, তুমি রিসিপশনে এসে বলবে ৩১৫ নাম্বার রুমে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বেলি কয়েক মিনিটের মধ্যে হোটেলে এসে পৌঁছাল। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা বলল। বেলি তার জীবনের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। তারপর একসময় হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, বেলি কি ভাবছ?

বেলি বলল, না আমি কিছু ভাবছি না।

জামাল বেলির মুখোমুখি বসে বলল, বেলি এখন বল?

কি বলব?

হঠাৎ করে থেমে গেলে কেন? তোমার সব কথা বল, দূর থেকে অনেক কথা বলতে পার, বলেছিলে যেদিন প্রথম দেখা হবে সেদিন সব কথা বলবে।

আমি তো সব বললাম এবার আপনার বলার পালা।

জামাল বেলির দুই কাঁধে হাত রাখতেই বেলি এক রকম চমকে উঠল, কাঁপা স্বরে বলল, জামাল ভাই।

হ্যাঁ বেলি প্রথম যেদিন তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে সেদিন থেকে আমি আজকের এই দিনটার কথা ভেবেছি। একদিন তোমার সাথে দেখা হবে, ঠিক এমনভাবে যেমনভাবে আজ দেখা হলো। আমরা দু’জনে পরস্পরকে জানবো এক সঙ্গে থাকব। ও বেশ ভালো কথা তোমার মোবাইলটা দেখি।

বেলি তার মোবাইল সেটটা জামালকে দিল।

জামাল বলল, বেলি তুমি সুন্দর, স্মার্ট, তোমার চেহারার মধ্যে একটা বিশেষ ধরণের আর্ট আছে, তোমার চেহারায় আভিজাত্য আছে, তোমার সাজ-সজ্জা বেশ দামি। তবুও আমার সঙ্গে আজ তোমার প্রথম দেখা হলো। এই দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তোমাকে কিছু দিতে চাই। প্রথমে ভাবছিলাম একটা মোবাইল সেট দিব কিন্তু তোমার মোবাইল সেটটা দেখছি খুব সুন্দর কাজেই আর মোবাইল সেট না, অন্য কিছু দিব সেটা হবে অবশ্যই স্বর্ণের।

বেলি বলল, আপনি কি আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন?

না লোভ দেখাচ্ছি না আজ আমাদের প্রথম দেখা হলো আজকের দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই, বলে জামাল বেলির দু’বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল।

অজানা এক নতুন অনুভূতিতে বেলির সমস্ত শরীরে শিহরণ জেগে উঠল। বেলি নিজেও জামালের বুকে নিবিড়ভাবে মিশে গেল।

বেলির সবেমাত্র টেলিফোনে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে আজ পর্যন্ত নিজের স্বামীকে সে চোখেও দেখেনি, কোন পুরুষের আলিঙ্গন পর্যন্ত সে ইতিপূর্বে পায়নি আজ সে জীবনের প্রথম স্বাদ পেল। নতুনত্বের স্বাদে সেও যেন মাতাল হয়ে গেল। লোক-সমাজ, পাপ-পুণ্য, নৈতিকতা, ধর্ম কোন কিছুই তার মনে রইল না। এমনভাবে অনেকক্ষণ আদিম খেলায় দু’জনে মত্ত থাকার পর এক সময় দু’জনে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপর জামাল হো হো করে হেসে উঠল।

বেলি জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নত করল। জামাল বেলির থুতনি উঁচু করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আর লজ্জা করবে আমাকে?

বেলি কিছু বলল না।

জামাল আবার বলল, বেলি ক্রস কানেকশনের মাধ্যমে মোবাইলে পরিচিত হওয়ার পর থেকে আজকের কথা চিন্তা কর আমরা আমাদের সম্পর্ককে কতদূর এগিয়ে নিয়েছি। তোমার টেলিফোনে বিয়ে হয়েছে অথচ বিয়ের স্বাদ পাওনি আজ পেলে আর আমি তোমাকে সেই স্বাদ দিলাম একবার থ্যাংক ইউ বল?

বেলি কোন কথা বলল না, লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইল।

জামাল বলল, বেলি কিছু খাবার দিতে বলি?

বেলি মাথা বাঁকিয়ে সায় দিলে জামাল ইন্টারকম তুলে নাস্তার অর্ডার দিল। তারপর বেলির গা ঘেঁষে বসে বলল, বেলি তুমি কি কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছ?

কেন?

বাহ্‌ রাতে থাকতে হবে না?

বেলি মাথা বাঁকিয়ে জানাল সে রাতে থাকছে না।

জামাল বেলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, প্লিজ আজ থাক এমন দিন হয়ত আর আসবে না।

আপনি ক’দিন ঢাকায় আছেন?

তুমি রাত থাকতে চাইলে আমি কোথাও বের হব না, তুমি চাইলে দু’একদিন থেকে যেতে পারি।

না আমি সারাদিন আছি সন্ধ্যায় আমাকে অবশ্যই ফিরতে হবে।

জামাল মনে মনে বলল, কিন্তু আমি তো তোমাকে রাতে ছাড়ছি না, যেমন করেই হোক তোমাকে রাতে থাকতেই হবে।

বেলি বলল, কি ভাবছেন?

জামাল চমকে উঠল, না ভাবছি তুমি যখন থাকতে চাচ্ছ না তবে সন্ধ্যায় যেও, যেটুকু সময় আছি সেটুকু সময় তুমি আমাকে একটু সুখ দাও, আমিও তোমাকে সুখ দিব।

বেলি মাথা মাথা নত করে বসে রইল।

আটচল্লিশ

আমীর হেরোইনের প্যাকেট দেখে খুব খুশি হলো। সে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, ভাইজান এতটুকু হেরোইনের দাম পঁচিশ লক্ষ টাকা?

হ্যাঁ তোমাকে পঁচিশ লক্ষ টাকার হেরোইন বিক্রি করতে হবে চল্লিশ লক্ষ টাকায়, তা না হলে সবদিক ম্যানেজ করে তুমি লাভ করতে পারবে না।

আমীর বলল, কাজটা খুব কঠিন ভাইজান।

কি কঠিন?

ভাইজান এই এতটুকু জিনিসকে চল্লিশ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে হলে আগে হিসাব করতে হবে পঞ্চাশ টাকা করে পুরিয়া বিক্রি করলে কত পুরিয়া তৈরি করতে হবে। এত পুরিয়া তৈরি করাও তো কঠিন কাজ।

জামাল ধমকের সুরে বলল, আমীর বোকার মতো কথা বলবে না।

আমীর মাথা নত করে রইল।

জামাল বলল, তুমি খুচরা বিক্রি করতে যাবে না, তুমি বিশ্বস্ত দেখে কয়েকজন ফেন্সি কুইনকে দিয়ে দাও, তারা ফেন্সিডিলের পাশাপাশি হেরোইন বিক্রি করবে। আর হ্যাঁ পনের দিনে মাল বিক্রি করতে হবে।

জি ভাইজান।

জামাল চেয়ার ছেড়ে উঠে আমীরের কাছে এসে আমীরের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমীর তুমি এ ব্যবসার সবকিছু জেনে ফেলছ। আজ খুব সহজে তুমি যে জগতে ঢুকলে এখান থেকে বের হওয়ার পথ কি জানো?

আমীর মাথা বাঁকিয়ে জানাল সে জানে না।

জামাল বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, মৃত্যু। এ পথে ঢুকার রাস্তা সহজ কিন্তু বের হওয়ার রাস্তা কঠিন। কথাটা মনে থাকে যেন।

আমীর বিনয়ের সঙ্গে বলল, জি ভাইজান মনে থাকবে।

ঠিক আছে তুমি এখন যাও, খুব সাবধানে চলবে, খুব গোপনীয়তা বজায় রাখবে।

জি ভাইজান, বলে আমীর বের হয়ে গেল।

আমীর যাবার পর জামাল আবার চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা মোবাইল সেট বের করে হিটলারকে মোবাইল করল।

আস্‌সালামুআলায়কুম ভাইজান।

জামাল বলল, হিটলার একবার দেখা করত।

কখন ভাইজান?

রাত এগারোটার পর, অফিসে।

জি ভাইজান।

জামাল মোবাইল অফ করে আবার ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর কলিং বেল-এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল।

জামাল বলল, রশিদ সাহেবকে আমার সালাম দাও।

কয়েক মিনিটের মধ্যে রশিদ সাহেব জামালের চেম্বারে ঢুকলেন। জামাল জিজ্ঞেস করল, রশিদ সাহেব গোডাউনের কাজ তো আর শুধু চুনকাম করলেই হয়ে যায় তাই না?

জি ভাইজান।

আচ্ছা আপনি হাসকিং মিলসহ জায়গাটার একটা ভ্যালুয়েশন করে দিবেন। আমি কাল একবার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলব, আমি মিল, চাতাল, গোডাউন এবং গোডাউন ভর্তি চাউলের উপর লোন নিতে চাই।

জি ভাইজান ঠিক আছে।

ঠিক আছে আপনি এবার আসুন।

ভাইজান কথা ছিল।

কি কথা?

ভাইজান রাস্তার কাজটার ওয়ার্ক ওয়ার্ডার হয়েছে, কাজটা শুরু করার দরকার।

ব্যাংক লোনটা হলেই কাজটা শুরু করে দিতে পারি।

কিন্তু ভাইজান এটা মার্চ মাস এখনি কাজ শুরু না করলে তো জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না।

জামাল গম্ভীরস্বরে বলল, রশিদ সাহেব আপনি এখন আসুন।

রশিদ সাহেব বের হয়ে গেলেন। জামাল মনে মনে বলল, মে মাসে কাজ শুরু করে জুন মাসের প্রথম দিকে একটা রানিং বিল নিব। জুন মাসে তো ইঞ্জিনিয়ারকে বিল দিতেই হবে। তখন এডভান্স বিল নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করব। নিজের আর টাকা ইনভেস্ট করতে হবে না। ভাবতে ভাবতে জামাল আপন মনে হেসে উঠল।

জামালের অফিসের কাজ শেষ হলে সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল। এটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। অভ্যাস বশত: জামাল অনেকক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল। হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠল।

মোবাইলে বেলির নামটা দেখে জামালের মনটা হঠাৎ করেই আনন্দে মেতে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে মধুর সুরে বলল, হ্যালো ডার্লিং।

অপর পাশ থেকে বেলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যাঁ আপনি তো যাবার পর একবারও মোবাইল করলেন না। আমার বার বার করে শুধু আপনার কথা মনে পড়ছিল। তাই মোবাইল করলাম।

আমার কি তোমার কথা মনে পড়ে না, অবশ্যই পড়ে, সব সময় তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কি করব, বল, ব্যবসা, রাজনীতি নিয়ে খুব ব্যস্ত সুযোগ পেলেই তোমার কাছে চলে আসব। তাছাড়া তোমার সাথে-

কথা শেষ হবার আগেই বেলির লাজুক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, দেখুন ভালো হবে না বলছি, আবার কবে আসবেন?

সুযোগ পেলেই তোমার কাছে ছুটে আসব, এবার তোমাকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য কক্সবাজার যাব।

বেলির আনন্দিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, সত্যি বলছেন? নাকি আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন?

তোমাকে আমি মিথ্যা সান্ত্বনা দিব কেন?

আপনি আগেই আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছেন, এখন আরো স্বপ্ন দেখিয়ে আমাকে পাগল করলেন। আপনাকে ছাড়া আমার আর কিছু ভালো লাগছে না, প্লিজ তাড়াতাড়ি সময় করে চলে আসুন।

এমন সময় পিয়ন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বলল, ভাইজান হিটলার ভাই এসেছে।

আসতে বল।

কি সব আজে বাজে বলছেন? কাকে আসতে বলছেন?

তোমাকে না।

আমি তো মনে করছিলাম আপনার আবার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো?

হ্যাঁ মাথা তো খারাপ হয়েছে সে শুধু তোমার জন্য, এখন রাখি ডার্লিং।

অপর পাশ থেকে বেলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আপনি বুঝি কাজে খুব ব্যস্ত আছেন, এখন রাখি।

হ্যাঁ আমি পরে তোমাকে রিং দিব, ভালো থাক মাই সুইট হার্ট।

বেলির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আপনিও ভালো থাকুন।

এমন সময় হিটলার রুমে ঢুকলো, বস হঠাৎ করে অনেকদিন পর ডাকলেন।

জামাল বলল, হ্যাঁ একটা কাজ আছে বস।

উনপঞ্চাশ

জামাল সাধারণত ব্যাংকে যায় না, টাকা-পয়সার আদান-প্রদান ইঞ্জিনিয়ার এবং ম্যানেজারদের মাধ্যমেই করে থাকে। ব্যাংকের ব্যালেন্স সীটে লক্ষ লক্ষ টাকার লেন-দেন হলেও জামাল শুধুমাত্র ব্যাংকের একাউন্ট খোলার জন্য একদিনই গিয়েছিল। কিন্তু জামাল ব্যাংকে না গেলেও শহরে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে জামালের পরিচিতি ব্যাপক তেমনি ব্যাংকের কাছেও জামাল একজন বড় গ্রাহক।

জামাল ব্যাংকে ম্যানেজার সাহেবের রুমে ঢুকতেই ম্যানেজার সাহেব দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন।

জামাল ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে চেয়ারে বসল। ম্যানেজার সাহেব পিয়নকে চায়ের অর্ডার দিয়ে  জিজ্ঞেস করলেন, জামাল ভাই বলুন আপনি কি  মনে করে?

জামাল বলল, ম্যানেজার সাহেব আপনি মনে হয় দেখেছেন আমার চাতালের সঙ্গে একটা গোডাউন করেছি। ঐ গোডাউনে আমি চাউল স্টক করব, তারপর দাম বাড়লে বাজারে ছেড়ে দিব, যাকে বলে স্টক বিজনেস। ঐখানে আমার জমি আছে তিন একর তাছাড়া হাসকিং মিল, চাতাল, গোডাউন এই সব কিছু মিলিয়ে আমি একটা লোন নিতে চাই।

ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার একাউন্ট নাম্বারটা যেন কত?

জামাল একাউন্ট নাম্বারটা বলতেই ম্যানেজার সাহেব পিয়নকে ডেকে হাতে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, লেজার বইটা নিয়ে এসো তো।

পিয়ন চা দিয়ে স্লিপটা নিয়ে চলে গেল।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, নিন প্লিজ।

কয়েক মিনিটের মধ্যে পিয়ন একটা বড় রেজিস্টার নিয়ে এলো। ম্যানেজার সাহেব জামালের একাউন্ট নাম্বারে টাকার আদান-প্রদান ও স্থিতি দেখে মনে মনে বললেন, পার্টি তো বেশ বড়। তারপর জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, জামাল ভাই লোন নেওয়ার তো কিছু ফরমালিটিজ আছে। এই যেমন জমির কাগজ-পত্র, মিল, চাতাল, গোডাউন এসবের ভ্যালুয়েশন সার্টিফিকেট সবকিছু প্রসেস করতে হবে।

ম্যানেজার সাহেব আসলে আমার সর্বমোট এক কোটি টাকার প্রয়োজন এক সপ্তাহের মধ্যে।

ম্যানেজার সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, আগে প্রোপার্টির ভ্যালুয়েশন করতে হবে তারপর অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। আপনি নিজে এত সময় দিতে পারবেন না। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার কোন লোক দিয়ে কাগজ-পত্র নিয়ে ব্যাংকে পাঠিয়ে দিন, আমি সব ব্যবস্থা করব। আর যদি কোন প্রয়োজন হয় আমি নিজে আপনার কাছে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি আমার ইঞ্জিনিয়ারকে কাগজ-পত্র নিয়ে পাঠিয়ে দিব, আপনি সপ্তাহের মধ্যে আমাকে লোনের ব্যবস্থা করে দিবেন।

আচ্ছা সবকিছু পাঠিয়ে দিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ব্যবস্থা করব।

তাহলে আজ উঠি, বলে জামাল হ্যান্ডশ্যাক করে ব্যাংক থেকে বের হলো।

জামাল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আবার তার চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে বলল, রশিদ সাহেব একবার আসুন তো।

রশিদ সাহেব জামালের পিছনে পিছনে তার চেম্বারে ঢুকলেন। জামাল তার ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে জমির দলিল বের করে বলল, এই দলিলগুলো নিয়ে ব্যাংকে যাবেন। ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা লোন নেওয়ার কথা হয়েছে আপনি একটু বিষয়টা তদারকি করুন। টাইম টু টাইম আমাকে প্রগ্রেস জানাবেন।

রশিদ সাহেব দলিলগুলো নিয়ে বললেন, জি ভাই ঠিক আছে।

রশিদ সাহেব বের হয়ে গেলে জামালও তার চেম্বার থেকে বের হলো।

জামালের মোবাইলের রিং বেজে উঠল, জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

বড় ভাই আমি পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি মোজাফফর।

হ্যাঁ কি খবর বলুন।

আমাদের ওয়ার্ড কমিটির সেক্রেটারি আছে না জয়নাল সাহেব, উনাকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে গেছে।

জামাল গম্ভীরস্বরে বলল, কেন?

রাস্তায় একটা মরা শুকনা গাছ ছিল, জয়নাল সাহেব ঐ গাছটা কেটে এনেছেন বলে।

আপনি এখন কোথায়?

আমি থানার সামনে, জয়নাল সাহেবকে হাজত খানায় আটকে রেখেছে, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।

আচ্ছা আসছি, বলে জামাল মোটর সাইকেল নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। জামালকে দেখে ওসি সাহেব সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল ভাই আপনি?

হ্যাঁ আসতে হলো আর কি।

বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?

আপনি আমার দলের এক নেতাকে ধরে এনেছেন?

কি নাম?

জয়নাল সাহেব।

জি এনেছি।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ?

রাস্তার পাশ থেকে সরকারী গাছ চুরি।

তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে?

তা হয়নি আপাতত তাকে ফিফটি ফোর-এ এরেস্ট করা হয়েছে।

দেখুন ওসি সাহেব জয়নাল সাহেব খুব ভালো মানুষ, তিনি গাছ চুরি করতে পারেন না, আমার দলের সদস্য এবং নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। আপনি তাঁকে ছেড়ে দিন।

দেখুন জামাল ভাই ইচ্ছে করলেই তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।

হঠাৎ করেই জামাল রেগে গেল, ইচ্ছা করলেই যখন নিরপরাধ মানুষকে ফিফটি ফোরে এরেস্ট করা যায় তখন ইচ্ছা করলেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না কেন?

আমরা নিরপরাধ মানুষকে এরেস্ট করি না। জয়নাল সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাই তাকে ফিফটি ফোর-এ এরেস্ট করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সত্যতা পাওয়া না গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে অথবা কোর্টে চালান দেয়া হবে।

জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, তারমানে আপনি ছেড়ে দিবেন না।

ওসি সাহেব কোন কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

জামাল মোবাইল করল, অপর পাশ থেকে মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল কি খবর?

বড় ভাই আমাদের এক ওয়ার্ড কমিটির সেক্রেটারিকে পুলিশ ফিফটি ফোরে এরেস্ট করেছে। আমি থানায় এসেছি ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু ওসি সাহেব ছাড়বেন না।

হঠাৎ করে ফিফটি ফোরে এরেস্ট করল কেন?

কি জানি হঠাৎ করে কেন একজন ভদ্রলোককে এরেস্ট করল? বড় ভাই আপনি এস.পি সাহেবকে বলে দিন না, জয়নাল সাহেব আমাদের খুব একনিষ্ঠ কর্মী। তাকে ছাড়িয়ে নিতে না পারলে আমার সম্মান থাকবে না, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, কর্মীরা দলের জন্য কোন রিস্ক নিতে সাহস পাবে না।

মাননীয় মন্ত্রীর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ঠিক আছে তুমি বসে থাক আমি দেখছি।

জামাল বসে রইল আর বিড় বিড় করে বলতে থাকল, ওসি সাহেবকে  বললাম ছেড়ে দিন। এখন দেখি আপনি কিভাবে ছেড়ে না দেন?

কয়েক মিনিটের মধ্যে ওসি সাহেবের টেলিফোনের রিং বেজে উঠল, ওসি সদর, জয়নাল সাহেবকে আপনি ফিফটি ফোরে এরেস্ট করেছেন?

জি স্যার।

ওকে ছেড়ে দিন।

জি স্যার, বলে ওসি সাহেব টেলিফোনের রিসিভার রেখে কলিং বেল টিপতেই স্যান্ট্রি এসে দাঁড়াল, স্যার।

জয়নাল সাহেবকে ছেড়ে দিন।

জামালের মুখে অহংকারের হাসি ফুটে উঠল।

জামাল জয়নাল সাহেবকে নিয়ে ওসি সাহেবের দিকে একবার তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থানা থেকে বের হয়ে গেল।

ওসি সাহেব অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন।

পঞ্চাশ

কয়েকদিনের মধ্যে জামালের লোন অনুমোদন হওয়ার পর ম্যানেজার সাহেব নিজেই একদিন সন্ধ্যাবেলা জামালের অফিসে এসে লোন অনুমোদনের খবর জানালেন। জামাল ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করে বলল, বসুন ম্যানেজার সাহেব, কি খাবেন বলুন ঠাণ্ডা না গরম?

না কিছু লাগবে না।

বলেন কি আপনি এমন একটা খবর নিয়ে এসেছেন খালি মুখে ফিরে যাবেন তা কি হয়? তারপর কলিং বেল টিপে পিয়নকে চা, মিষ্টি আনার অর্ডার দিল।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, জমিজমার দলিল তো ব্যাংকের কাছে জমা আছে এখন চাউল আপনি কবে নাগাদ গোডাউনে ঢুকাতে পারবেন?

আগে বসুন দু’ভাই মিলে এক সঙ্গে চা নাস্তা খাই তারপর সব ঠিক করা যাবে।

চা নাস্তা নিয়ে পিয়ন চেম্বারে ঢুকলো। চা খেতে খেতে জামালের সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবের অনেক গল্প হলো। এমন বড় পার্টি এবং প্রভাবশালী লোকের কাছ থেকে ম্যানেজার সাহেব কখনো এত সুন্দর ব্যবহার আশা করেন নি। কৃতজ্ঞতায় ম্যানেজার সাহেবের মন ভরে গেল। চা শেষ করে জামাল তার ড্রয়ার থেকে একটা পাঁচ’শ টাকার নোটের বান্ডিল বের করে ম্যানেজার সাহেবের হাতে দিতে দিতে বলল, ম্যানেজার সাহেব আপনি আমার এক কোটি টাকার লোন পাস করে দিয়েছেন, টাকাটা আমার কি যে কাজে লাগবে, আপনার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আসলে আপনাকে কি দিয়ে যে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনি এ টাকাগুলো রাখুন। আর চাউল রেডি আছে, এই ধরুন আগামী সোমবার থেকে গোডাউনে চাউল ঢুকতে শুরু করবে, তিন/চার দিনের মধ্যে চাউল ঢুকানো শেষ হবে।

ম্যানেজার সাহেব এদিক-সেদিক একবার তাকিয়ে টাকাটা পকেটে রেখে বললেন, না মানে বলছিলাম চাউল গোডাউনে ঢুকানোর সময় ব্যাংকের একজন অফিসার থাকবে তো।

তারমানে আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?

ম্যানেজার সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, না মানে অবিশ্বাস করছি না এটা ব্যাংকের সিস্টেম, আসলে আমরা ইচ্ছা করলেই তো সিস্টেমের বাইরে কিছু করতে পারিনা।

জামাল কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, ম্যানেজার সাহেব আমি আপনার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ নিয়েছি তারচেয়ে বেশি মর্টগেজ দিয়েছি এটা হলো আমার ফাইন্যান্সিয়াল গ্যারান্টি আমি জহির সাহেবের ছেলে এবং নিজেও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এটা আমার সামাজিক গ্যারান্টি। তাছাড়া আমি পাওয়ার পার্টির জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি এটা আমার রাজনৈতিক গ্যারান্টি। আর কি গ্যারান্টি চান বলুন? ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে আমি এতকিছু হারাবো না নিশ্চয়ই।

আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?

জামালের অভিমান আরো বেড়ে গেল, না রাগ করব কেন?

আচ্ছা ঠিক আছে আপনি গোডাউনে চাউল ঢুকাবেন, চাউল ঢুকানো শেষ হলে আমাকে বলবেন। আমি গিয়ে গোডাউন সিল গালা করে দিয়ে আসব।

জামাল মনে মনে বলল, এটাই তো আমি চাচ্ছিলাম।

জামালকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জামাল ভাই কি কিছু ভাবছেন?

হ্যাঁ ভাবছিলাম গোডাউনে চাউল ঢোকালাম কি না আপনি দেখবেন না তা কি করে হয়?

দেখুন আমার আসলে বুঝতে ভুল হচ্ছিল,  আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ, বলে ম্যানেজার সাহেব চলে গেলেন।

ম্যানেজার সাহেব চলে যাওয়ার পর জামাল আমীরকে মোবাইল করল, আমীর তোমাকে যে সরদার হাসকিং মিলের সঙ্গে তুষ কেনার জন্য আলাপ করতে বলেছিলাম, আলাপ করেছ?

জি ভাই আলাপ করেছি।

হ্যাঁ সামনের সারিতে দু’শ বস্তা চাউল আর ভিতরের বস্তাগুলোয় তুষ থাকবে।

জি ভাই।

আগামী সোমবার থেকে কাজ শুরু করবে।

জি ভাই।

জামালের মন আজ আনন্দে ভরে গেল। আজ জামালের পার্টি অফিসে যেতেও ইচ্ছা হলো না কোন কাজে মনও বসল না। হঠাৎ করে মনে পড়ল আজ তো রহমতের বাসায় যাওয়ার কথা। জামাল রিক্সায় চড়ে রহমতের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সুখ কিংবা দুঃখ, আনন্দ কিংবা বেদনা সবকিছুতেই জামালের সঙ্গী যেন নিত্য নতুন নারী। এটা তার যেন একটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, কোনকিছু হলেই রহমতের বাসায় গিয়ে কোন তরুণী কিংবা কিশোরীকে একবার ভোগ করতে পারাটাই যেন তার সবকিছু ভুলিয়ে দেয়ার মহা ঔষধে পরিণত হয়েছে।

জামালকে বাসায় ঢুকতে দেখে রহমত বলল, ভাইজান।

হ্যাঁ চলে এলাম।

ভাইজান ভিতরে আসুন।

জামাল রহমতের পিছনে পিছনে তার ঘরে গিয়ে বসল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, খবর কি?

রহমত আমতা আমতা করে মাথা চুলকিয়ে বলল, জি ভাইজান আছে।

আচ্ছা রহমত তোর কাছে আর কি আছে?

রহমত মুচকি হেসে বলল, সব আছে ভাইজান এই ধরুন গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইন্ডিয়ান মদ, হেরোইন  এই আর কি?

ইন্ডিয়ান মদ মানে অফিসার্স চয়েজ আছে নাকি?

জি।

তাহলে একটা অফিসার্স চয়েজ নিয়ে এসো আর-

রহমত মুচকি হেসে বলল, জি ভাইজান নিয়ে আসছি বলে রহমত চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর রহমত একটা অফিসার্স চয়েজ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস এর বোতল নিয়ে এলো। রহমতের পিছনে পিছনে পনের/ষোল বছর বয়সের একটা মেয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলো।

রহমত বলল, ভাইজান আপনি বসুন, কথা বলুন বলে রহমত চলে গেল। মেয়েটা চৌকির এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসল। আগে থেকেই টেবিলের উপর পানির বোতল এবং গ্লাস ছিল।

জামাল মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?

দোলন।

তুমি কয়বার এসেছ এখানে এর আগে?

দোলন আপন মনে বিড় বিড় করে বলতে শুরু করল, আগে কোনদিন আসিনি সৎ মায়ের সংসারে থাকি। রহমত ভাই আমার ঐ দজ্জাল সৎ মাকে খালা বলে ডাকে। রহমত ভাই আমাদের বাসায় গিয়েছিল। আমার সৎমা আর রহমত ভাই ঘরের ভিতরে গল্প করছিল আর আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। রহমত ভাই বলছিল, খালা এক বিশাল বড়লোক আসবে শুধু এক রাতের ব্যাপার এক হাজার টাকা দিবে, তুমি দোলনকে পাঠিয়ে দাও। আর এক বার নিয়ে যেতে পারলে প্রায় প্রায় নিয়ে যাব, তখন তুমিও রেগুলার টাকা পাবে। তোমার এই দুর্দিন আর থাকবে না। তখন আমার সৎ মা বলেছিল, তুমি বস, আমি ওকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি বলে মা বেরিয়ে এসে বলল, দোলন তোর রহমত ভাই তোকে নিতে এসেছে  মা।

আমি সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে বলেছিলাম, কেন মা?

নিতে এসেছ যা না এক রাতের ব্যাপার কালই তো চলে আসবি।

আমি জানি ঐ দজ্জাল মহিলার কথায় রহমত ভাই’র সাথে না এলে আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে আসবে। তারচেয়ে এক রাত না হয় আমার এই সুন্দর দেহটা নিয়ে এক বিশাল বড়লোক খেলা করবে। আমি গরীব মানুষ এমন বিশাল বড়লোকের স্পর্শ পাওয়াটাও তো আমার জন্য ভাগ্য।

জামাল মনে মনে বলল, তারমানে একেবারে টাটকা যাকে কেউ-ই স্পর্শ করেনি আমিই প্রথম। জামাল টেবিলটা নিজে চৌকির কাছে নিয়ে গেল। তারপর দোলনের গা ঘেঁষে বসে মদের বোতলটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এটা কি জানো?

দোলন মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে জানে না।

জামাল বলল, এটা মদের বোতল, অফিসার্স চয়েজ, এটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়। তুমি খাবে?

আমি মদ খেলে আপনি খুশি হবেন?

এভাবে বলছ কেন?

রহমত ভাই বলেছেন আপনাকে খুশি করতে, তাই আমি মদ খেলে যদি আপনি খুশি হন তবে খাব।

জামাল মনে মনে বলল, আজ তো আমি রহমতকে এখানে আসার কথা বলিনি, সে এই মাল আনল কেন? তবে কি তার আরো বড় পার্টি আছে? থাকতেই পারে এটা রহমতের ব্যবসা আমার মতো আরো অনেক পার্টি থাকা খুব স্বাভাবিক, আবার মনে হলো নাও তো থাকতে পারে এমন লোভনীয় প্রস্তাব না দিলে দোলনের সৎ মা হয়ত তাকে আসতেই দিত না। জামাল এনিয়ে আর তেমন কিছু চিন্তা করল না।

দোলন আমি মদের সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্কস মিশিয়ে দিচ্ছি তুমি খাও, আমিও খাই দু’জনে এনজয় করি, বলে জামাল মদের সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্কস মিশিয়ে গ্লাস দোলনের হাতে দিয়ে বলল, খাও।

দোলনের চোখে মুখে ঘৃণা ফুটে উঠল। কিন্তু সে মুখে কিছুই বলল না চোখ বন্ধ করে এক ঢোকে মদ  গিলে ফেলল। জামাল নিজেও গ্লাসে মদের সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্কস মিশিয়ে খেতে শুরু করল। দোলনকে একের পর এক প্যাক মদ ঢেলে দিল এবং নিজেও খেল। এক সময় দোলনের গলার স্বর জড় হয়ে এলো। সে এলোমেলো কথা বলতে শুরু করল এবং জামালের গায়ের উপর এলিয়ে পড়ল।

একান্ন

জামাল বাসায় ফিরল তখন রাত প্রায় দু’টা বাজে। দরজায় বার বার কলিং বেল টিপেও দরজা না খোলায়  জামাল জোরে মোটর সাইকেলের হর্ন দিতে লাগল। অনেকক্ষণ পর জহির সাহেব নিজে দরজা খুলে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললেন, আজ না ফিরলে হতো না।

জামাল কোন কথা না বলে বাসায় ঢুকলো। অনন্যা তখনো ঘুমায় নি জামাল এর আগে কখনো বাসায় ফিরতে রাত বারোটা অতিক্রম করেনি। আজও রাত বারোটা পর্যন্ত অনন্যা স্বাভাবিকভাবেই জেগেছিল তারপরও জামাল না ফিরায় অনন্যার রাগ ক্রমে বেড়েই চলছিল। অনন্যা জামালের অপেক্ষায় বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল। জামাল ঘরে প্রবেশ করল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, এখন রাত দু’টা বাজে বাকী সময়টুকু কি বাইরে কাটানো যেত না?

জামাল জোড়ানো গলায় বলল, হ্যাঁ একটু দেরি হয়ে গেল।

জামালের গলার স্বর শুনে  অনন্যা জামালের চোখের দিকে তাকাল। জামালের চোখ দু’টা লাল টকটকে যেন রক্ত ফুটে বের হচ্ছে, যেন ছলছল করছে। অনন্যা অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত জামালের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। জামাল চোখ সরিয়ে নিয়ে শার্ট খুলে অনন্যার হাতে দিল। জামালের হাত থেকে শার্ট নিতে গিয়ে অনন্যা বিকট গন্ধ পেল।

অনন্যা জিজ্ঞেস করল, তুমি মদ  খেয়েছ?

জামাল বলল, অনন্যা আস্তে বল বাবা শুনতে পাবে।

এখন শুনতে না পেলেও কাল আমি বলব, তোমার অনেক অত্যাচার আমি সহ্য করেছি, তুমি কখন কোথায় যাও? কি কর? কোন দিন জানতে চাইনি, সকালবেলা চলে যাও গভীর রাতে বাসায় ফির, এতকিছু নিয়ে আমি কোনদিন বাবা-মা’র কাছে কোন অভিযোগ করিনি। কিন্তু আর না তুমি পতনের সীমানার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছ এখনো বাবা-মাকে না জানালে বাবা মা’র কাছে আমি অপরাধী হব, বলে জামালের হাত থেকে শার্টটা নিয়ে আলনায় রাখতে গিয়ে অনন্যার চোখে পড়ল জামালের শার্টে লিপস্টিক এর দাগ। অনন্যা হাতে নিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করল, হ্যাঁ লিপস্টিক এর দাগই তো।

অনন্যার মাথায় রক্ত উঠে গেল শার্টটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে প্রচণ্ড রেগে বলল, তোমার শার্টে লিপস্টিক এর দাগ এলো কোথা  থেকে? কোন মাগীর কাছে এতরাত পর্যন্ত কাটিয়ে এলে?

জামাল প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল, অনন্যা চুপ কর এত রাতে সিনক্রিয়েট কর না।

তুমি ব্যবসার কথা বলে, রাজনীতির কথা বলে মদ, মাগী নিয়ে ফুর্তি করবে আর আমি স্ত্রী হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব, এটা হতে পারে না।

জামাল জোরে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ দেখবে তুমি আমার স্ত্রী, আমি কিভাবে চলব তোমার কাছ থেকে সেটা অনুমতি নিতে হবে নাকি? মদ, মাগী, জুয়া সবকিছু নিয়ে আমি যেভাবে চলছি  সেভাবেই চলব এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে। যদি পার তবে থাকবে, যদি না পার তবে চলে যাবে ব্যাস, এটাই আমার শেষ কথা। এরপর আর কোনদিন কোন কাজে তুমি বাধা দিবে না।

জহির সাহেব ড্রয়িং রুম থেকে জোরে ডাক দিলেন, বউমা, জামাল দু’জনে ড্রয়িং রুমে এসো তো।

অনন্যা ড্রয়িং রুমে চলে গেল। পাশাপাশি সোফায় বসে আছেন জহির সাহেব এবং ফাহমিদা। জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, ফাহমিদা জামালকে আসতে বল।

ফাহমিদা কয়েকবার ডাকার পর জামাল এলো।

জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, জামাল বাসায় ফিরতে এত রাত হলো কেন?

জামাল কোন কথা না বলে নীরবে বসে রইল।

জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমরা এতক্ষণ যা শুনলাম তা কি সত্যি?

জামাল কোন কথা বলল না, অনন্যা দ্রুতবেগে পার্শ্বের রুমে গেল এবং যেমন দ্রুতবেগে গিয়েছিল তেমনি দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকে ফাহমিদার কাছে শার্টটা দিয়ে বলল, দেখুন মা এটা লিপস্টিক এর দাগ কি না?

ফাহমিদা শার্টটা পরীক্ষা করে বললেন, ছিঃ তুই আমার ছেলে এটা আমার ভাবতে ঘৃণা হয়। তোর মতো একটা চরিত্রহীন ছেলে আমি পেটে ধরেছিলাম।

জামালের কোন পরিবর্তন হলো না, তার মধ্যে অপরাধ বোধের কোন চিহ্ন ফুটে উঠল না। অনন্যার চোখে মুখে ক্রোধ আর ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠল তার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল। সে তার শাশুড়ির মুখের দিকে একবার এবং জামালের মুখের দিকে একবার তাকাতে লাগল।

জহির সাহেব এতক্ষণ ফাহমিদার কথা শুনছিলেন। তাঁর মনে পড়ল জামাল ছোটবেলা সামান্য অপরাধে বলতো, সরি মা আর এমন হবে না অথবা কোনদিন মায়ের বুকে মাথা রেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদত। জহির সাহেবের ধারণা ছিল জামালের মনে অপরাধ বোধ জাগবে জামাল বড় হয়েছে সে কারণে হয়ত মায়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠবে না। অন্তত পক্ষে ভুল স্বীকার করে সরি বলবে। কিন্তু এর কোনটিই ঘটল না। জামালের চোখে মুখে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল। সে অনন্যার দিকে রাগান্বিত চোখে একবার তাকাল।

জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বউমা জামাল যে এতদিন থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরে তা তো তুমি কিছু বলনি?

অনন্যা মৃদু কণ্ঠে বলল, বলেছিলাম বাবা ও বলছিল ব্যবসা আর রাজনীতির কাজে ওর খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

ঠিক হয়েছে কি?

অনন্যা মাথা বাঁকিয়ে বলল, না বাবা, ঠিক হয়নি।

জহির সাহেব ধমকের সুরে বললেন, তুমি আমাকে না বল তোমার শাশুড়িকে বললেও তো পারতে।

অনন্যা কোন কথা বলল না নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। জহির সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, জামাল ছোট বেলা থেকে আমি তোকে শাসন করতে পারিনি বলে তুই নষ্ট হয়ে গেছিস। ভাবছিলাম এখন তোর বুঝার বয়স হয়েছে ব্যবসা করছিস, রাজনীতি করছিস হয়ত তোর পরিবর্তন হবে। তোর পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু  উত্থান নয়, নৈতিক পতন হয়েছে। আমি বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না, আমি তোর একটা পরিবর্তন চাই, ব্যবসা করবি, রাজনীতি করবি ভালো কথা কিন্তু আমার মান হানি হয়, সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয় এমন সব কাজ বাদ দিতে হবে। যদি দু’এক মাসের মধ্যে তুই এসব ছাড়তে না পারিস তবে তোকে বাড়ি ছাড়তে হবে তোর সঙ্গে আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করব। আর বউমা তুমিও শুনে রাখ জামাল কোন দিন ক’টায় ফিরে? কি করে? তুমি সব কিছু আমাকে ঠিকঠাক জানাবে এর যেন এক বিন্দু ব্যতিক্রম না হয়। ঠিক আছে তোমরা এখন যাও।

জামাল আর অনন্যা দু’জনে ড্রয়িং রুম থেকে তাদের বেডরুমে ঢুকে পড়ল।

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, খুব ভালো করলে? এতদিন থেকে লুকিয়ে ড্রিংক করতাম, মাগীবাজি করতাম এখন আর লুকানো থাকল না, প্রকাশ্যে সব করব তোমাকে জানিয়ে করব। তুমি থাকতে পারলে থাকবে, না থাকতে পারলে চলে যাবে, বলে জামাল কিছু না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

বাহান্ন

বিকেলবেলা জামাল রশিদ সাহেবকে মোটর সাইকেলে নিয়ে চলল আনন্দ নগরের উদ্দেশ্যে, কিছুদূর যাওয়ার পর রশিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান আমরা কোথায় যাচ্ছি?

জামাল মৃদু হেসে বলল, বসে থাকুন না, দেখুন আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?

রশিদ সাহেব আর কিছু বললেন না, মোটর সাইকেলে বসে রইলেন। জামাল মোটর সাইকেল নিয়ে সোজা আনন্দ নগর গিয়ে থামলো।

রশিদ সাহেব মোটর সাইকেল থেকে নেমে বললেন, এবার বুঝেছি।

জামাল বলল, রশিদ সাহেব বলুন তো কি বুঝেছেন?

আপনি আনন্দ নগর যে জায়গা কিনেছেন এটা সেই জায়গা।

হ্যাঁ তা ঠিক আছে কিন্তু জানেন কি জায়গাটা আমি কি জন্য কিনেছি?

রশিদ সাহেব বললেন, না জানি না।

মনোযোগ দিয়ে শুনুন কাজটা আপনাকেই করতে হবে, এখানে  একটা বাগান বাড়ি বানাবো, এই ধরুন চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া থাকবে, গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ফুটপাথ থাকবে। ফুটপাথের দু’পাশে থাকবে সারি সারি ফুলগাছ। বাগানের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে থাকবে একটা দোতলা বাংলো, নীচতলা অফিস, ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, পুরো একটা ফ্যামিলি থাকার ব্যবস্থা থাকবে। উপরে থাকবে একটা ভি.আই.পি রুম, দু’টা বেড রুম, দু’টা রুমের সঙ্গেই থাকবে এ্যটাচ্‌ড বাথ। বাথরুমে বসানো থাকবে টাইলস এবং অত্যাধুনিক স্যানিটারি ফিটিংস, বাথরুমে থাকবে গরম এবং ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা। বিল্ডিংয়ের ছাদ হবে টাইলস দিয়ে তৈরি, সেগুন কাঠের সিলিং, রুমে যে বাতিগুলো থাকবে সেগুলো থাকবে সিলিংয়ের কাঠ দিয়ে ঢাকা, কাঠের ফাঁক দিয়ে শুধু আলো বের হয়ে আসবে কিন্তু টিউব লাইট দেখা যাবে না। তাছাড়া সিলিংয়ের নীচে থাকবে বাজারের সব চেয়ে দামি লক্সারিয়াস ঝাড় বাতি, সম্ভব হলে সেগুলো বিদেশ থেকে আনাবেন। নদীর পার্শ্বে থাকবে একটা  বেলকনি, যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে দেখা যাবে নদী এবং উপরের দিকে তাকালে দেখা যাবে আকাশ। পূর্ণিমার রাতে যেন বেলকনিতে বসে জ্যোৎস্না উপভোগ করা যায় এই কথাগুলো বোধহয় আগেও আপনাকে আমি বলেছি।

সবকিছু শুনে রশিদ সাহেব একটু হাসলেন, জি বলেছেন।

জামাল মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বলল, রশিদ সাহেব  আমি হাসির কথা বলছিনা।

রশিদ সাহেব থমকে গেলেন, ভাইজান আপনার পরিকল্পনা খুব সুন্দর এবং রুচিও খুব উন্নত, তাই হাসছি।

জামাল বলল, রশিদ সাহেব এখানেই শেষ নয়।

জি ভাইজান বলুন।

সমস্ত বিল্ডিংয়ের দেওয়াল হবে দু’টা করে। আপনার ভাবীর গয়না, টাকা, দামি জিনিস-পত্র যেন দু’দেওয়ালের ফাঁকে রাখা যায়। দেওয়ালের গোপন স্থান খোলার ব্যবস্থা থাকবে।

রশিদ সাহেব কিছু বললেন না মনোযোগ সহকারে নীরবে শুনতে লাগলেন।

জামাল বলল, এবার ভাবুন আন্ডার গ্রাউন্ডের কথা। বিল্ডিংয়ের নীচে থাকবে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর। সেখানে ছোট ছোট কয়েকটা রুম থাকবে। ঠিক জেলখানার সেল-এর মতো। জানেনই তো রাজনীতিতে আমার প্রতিপক্ষ আছে, বিরোধী দল আছে, আমার শত্রুর অভাব নাই। কেউ একজন উপরে উঠতে চাইলে তাকে টেনে নীচে নামানোর লোকের অভাব নেই। শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য এখানে একটা টর্চার সেল-এর ব্যবস্থা করতে হবে।

রশিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন, তাঁর বুক ভয়ে কেঁপে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল।

জামাল রশিদ সাহেবের মনের অবস্থা বুঝলো। তবুও আবার বলতে শুরু করল। আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে একটা সুড়ঙ্গ বেরিয়ে যাবে এখান থেকে এক কিলোমিটার নদীর ভাটিতে, বলে জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, আমার পথকে নিষ্কণ্টক করতে যদি কাউকে ট্রান্সফার করে দিতে হয় তবে তাকে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে যেন এক কিলোমিটার ভাটিতে ফেলে দিতে পারি।

রশিদ সাহেব একটা ঢোক  গিলে বললেন, জি ভাইজান বুঝেছি।

আরো বলার আছে এখনো শেষ হয়নি।

খামার বাড়ির গেটে থাকবে গার্ড রুম সেখানে সব সময় প্রাইভেট সিকিউরিটি থাকবে। গেট দিয়ে ঢুকতেই যে রাস্তা বাংলো পর্যন্ত আসবে সেই রাস্তার দু’পার্শ্বে থাকবে বিভিন্ন ধরণের ফুলগাছ। আমি আমার এই খামার বাড়িটাকে অতুলনীয় করে তুলতে চাই।

রশিদ সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, জি ভাইজান।

খামার বাড়িটার নাম কি দিব জানেন?

না ভাইজান।

মধুকুঞ্জ, আপনার পছন্দ হয়নি নামটা?

জি ভাইজান, পছন্দ হয়েছে?

তাহলে আপনি আপনার কাজ শুরু করে দিন। এক মাসের মধ্যে প্লান এস্টিমেটসহ সব কিছু রেডি করুন।

জি ভাইজান।

আর হ্যাঁ একটা কথা খেয়াল রাখবেন মধুকুঞ্জের নির্মাণ এবং কোথায় কি আছে সেটা আপনি ছাড়া কেউ জানবে না। কথাটা মনে থাকে যেন।

আনন্দনগর থেকে ফিরে জামাল তার অফিসে বসল। ততক্ষণে রাত আটটা বেজে গেছে। জামাল চেয়ারে বসতেই তার মোবাইলে রিং বেজে উঠল। সাধারণত এই বেনামী মোবাইলের সিমটা জামাল মাদক ব্যবসাসহ অপরাধ জাগতের কাজে ব্যবহার করে থাকে। মোবাইলের মনিটরে অপরিচিত নাম্বার দেখে জামাল কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিল রিসিভ করবে কি না? তারপর মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

ভদ্রলোক আগে তাঁর পাসওয়ার্ড নাম্বার বলে নিজের পরিচয় দিলেন এবং তারপর জামালকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পাসওয়ার্ড নাম্বার কত?

জামালের আর বুঝতে বাকী রইল না।

জামাল স্বীকার করল, জি বলুন তারপর তার পাসওয়ার্ড নাম্বার বলল।

আগামীকাল আপনার পঁচিশ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা।

জি কিন্তু-

অপর পাশ থেকে জোর আপত্তির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, না কোন কিন্তু নাই, এ লাইনে কমিটম্যান্ট ফেল করা চলেনা এবং কাউকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় না। আপনি প্রথম তাই আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

জামালের চোখের সম্মুখে টি. আর. খানের ভয়ংকর চোখ এবং মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়ার দৃশ্য ভেসে উঠল।

জামাল কাঁপা স্বরে বলল, জি ঠিক আছে।

অপর পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, তাহলে শুনুন টাকা নিয়ে আপনার কোন বিশ্বস্ত লোককে মাইক্রো বাস নিয়ে পাঠিয়ে দিবেন। রাস্তার পাশে যেখানে একটা মাইক্রো বাস চাকা খুলে পাংচার সারানো দেখবে সেখানে আপনার গাড়ি দাঁড়াবে তখন আমার গাড়ি থেকে হালকা-পাতলা একটা ছেলে বের হবে, তার এক হাতে থাকবে একটা ব্রিফকেস অপর হাতে থাকবে একটা ছেঁড়া টাকা। যে টাকার অর্ধেক অংশ থাকবে আমার পাঠানো হালকা-পাতলা ছেলেটার কাছে অপর অংশ থাকবে আপনার পাঠানো লোকের কাছে।

জামাল বলল, জি বুঝতে পেরেছি।

এখন টাকার নম্বর লিখে নিন।

জামাল মোবাইলে শুনে টাকার নাম্বারটা লিখে নিয়ে বলল, লিখেছি।

তাহলে কি দাঁড়াল গাড়ি রওয়ানা দিবে রাত দশটায় আর এবার আপনার কাছে চল্লিশ লক্ষ টাকার মাল পাঠানো হলো। তারপরই লোকটার ভয়ংকর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মনে রাখবেন এসব ব্যবসায় বস এর নির্দেশ এক বিন্দু এদিক-সেদিক হলেই-

জামাল ভয়ে ভয়ে বলল, জি বস বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না।

মনে থাকে যেন, বলে অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।

তিপ্পান্ন

জামাল তার চেম্বারের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজ হাতে ব্রিফকেস এ টাকা সাজালো। টাকাগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ব্রিফকেস বন্ধ করে ব্রিফকেসে চুমু দিয়ে বলল, যা নিরাপদে জায়গা মতো চলে যা।

জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকাল রাত দশটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকী। জামাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই জাকির এসে দাঁড়াল, ভাইজান।

আমীরকে আসতে বল।

আমীর চেম্বারে প্রবেশ করলে জামাল তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বলল, আমি টাইম টু টাইম তোমার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ রাখব।

আমীর ব্রিফকেস আর টাকার অর্ধেক অংশ হাতে নিয়ে বলল, জি ভাইজান।

মুহূর্তেই জামাল ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করে বড় বড় চোখ করে আমীরের মাথায় ধরল, যদি কোন রকমের চালাকি করার চেষ্টা কর তবে মনে রাখ জানে মেরে ফেলব। তুমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানো।

আমীর থরথর করে কেঁপে উঠল, ভাইজান আমার খুব ভয় লাগছে।

ভয়ের কোন কারণ নাই। তুমি হয়ত জানোনা এই লাইনে যারা ব্যবসা করে তারা সবাই ক্ষমতাবান, শুধু ক্ষমতাবান বললে ভুল হবে আমার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান।

আমীর মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।

জামাল বলল, তুমি বাসায় কারো সাথে কোন কথা বলবে না। এলোমেলো করে ফেলতে পার শুধু ড্রাইভারকে  বলে দিবে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ঢাকা যাচ্ছি, গাড়ি রেডি।

আমীর মাথা নত করে বলল, জি ভাইজান।

তুমি এবার এসো।

আমীর সালাম দিয়ে চলে গেল।

জামাল জীবনে এত টাকার রিস্ক নেয়নি। এ লাইনে নতুন হওয়ায় এত বড় রিস্ক নিতে আজ জামালের বুক কেঁপে উঠল।  তাছাড়া জামাল যাদের সঙ্গে এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে তারা সবাই জামালের চেয়ে অনেকগুণ ক্ষমতাবান এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কোন কারণে তারা যদি জামালের সঙ্গে প্রতারণা করে তবে তার কিছুই করার থাকবে না। এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, আমীর চলে যাবার এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

জামাল আমীরের মোবাইলে রিং করল, আমীর কি খবর?

ভাইজান আমরা রাস্তায় এখনো গাড়ির দেখা পাইনি।

জামাল বলল, ঠিক আছে, অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর এই নাম্বারে রিং দিও।

জি ভাইজান।

গাড়ি দ্রুতগতিতে চলছে। আমীর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে কোথাও রাস্তার পার্শ্বের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কি না। ড্রাইভার দুলাল খুব বুদ্ধিমান সেও দু’পার্শ্বে চোখ রেখে সতর্কভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি কাছে যেতেই পুলিশ হর্ন বাজিয়ে গাড়ি থামার নির্দেশ দিল।

আমীর চমকে উঠল, এই বুঝি বিপদে পড়লাম। কিন্তু দুলাল ঘাবড়ে যাবার মতো মানুষ নয়।

পুলিশ জিজ্ঞেস করল, গাড়ি কোথায় যাবে?

দুলাল জোর দিয়ে বলল, এটা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি জামাল ভাই’র গাড়ি, আমরা ঢাকা যাচ্ছি।

পুলিশের একজন কনস্টেবল তার ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের কানে ফিস ফিস করে বলল, স্যার ছেড়ে দিন, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নাই, মাল পাওয়া যাবে না।

পুলিশ অফিসার নিজে একবার নাম্বার প্লেট দেখে বলল, ঠিক আছে যাও।

গাড়ি আবার ছুটে চলল আগের গতিতে, আরো ঘণ্টা খানেক পর একটা ব্রিজের পাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুলাল বলল, আমীর ভাই দেখুন তো এই গাড়িটা কি না?

আমীর বলল, একটু স্লো চালাও।

দুলাল ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে লাগল আমীর একবার জামালের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল হ্যাঁ সত্যিই তো জামালের দেওয়া ইন্সট্রাকশন মিলে যাচ্ছে। গাড়িটার একটা চাকা খুলে পাংচার সারানোর চেষ্টা করছে। আমীর এক রকম নিশ্চিত হয়ে দুলালকে বলল, দুলাল গাড়ি থামাও।

দুলাল দাঁড়ান গাড়িটার পার্শ্বে গাড়ি দাঁড় করাল। গাড়ি থেকে জামালের দেওয়া বর্ণনা মোতাবেক হালকা-পাতলা গড়নের কম বয়সী একটা ছেলে বেরিয়ে এলো তার এক হাতে ব্রিফকেস অন্য হাতে টাকা দেখে আমীর সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে বলল, নাম্বার বলুন।

ছেলেটা তার টাকার নাম্বার বলতে থাকল আর আমীর মিলিয়ে দেখল। উভয় টাকার নাম্বার মিলে যাবার পর পরস্পর ব্রিফকেস বদল করল।

ব্রিফকেস হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠেই আমীর বলল, দুলাল গাড়ি ব্যাক কর।

দুলাল গাড়ি ব্যাক করে জোরে গাড়ি চালাতে লাগল। আমীর গাড়িতে বসে জামালের দেওয়া মোবাইল নাম্বারে রিং করল।          কি খবর আমীর?

আমীর উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, ভাইজান অপারেশন সাকসেসফুল।

থ্যাংক ইউ আমীর সোজা অফিসে চলে এসো আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

জামাল চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমের তন্দ্রা এসেছে এমন সময় গাড়ি এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রিফকেসসহ আমীর জামালের চেম্বারে ঢুকলো।

জামাল আমীরকে কৌশলে সরিয়ে দেয়ার জন্য বলল, আমীর তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। দুলাল তোমাকে রেখে  আসবে। আর হ্যাঁ দুলালকে গাড়ি নিয়ে অফিসে পাঠিয়ে দিও। গাড়ি আসার পর আমি যাব। নির্দেশ মোতাবেক নাম্বার এডজাষ্ট করে ব্রিফকেস খুলতেই তার চোখে মুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠল।

সে আপন মনে  বলল, বাহ চল্লিশ লক্ষ টাকার মাল, প্রথমে পঁচিশ লক্ষ টাকার মাল বিক্রি করে লাভ করেছি পনের লক্ষ টাকা এবার চল্লিশ লক্ষ টাকার মাল বিক্রি করব সত্তর লক্ষ টাকায়। আমার টাকা চাই, প্রতিপত্তি চাই, ক্ষমতা চাই, গাড়ি চাই, বাড়ি চাই, প্রতিদিন নতুন নতুন নারী চাই। আমি জীবনকে উপভোগ করতে চাই পরিপূর্ণভাবে তারপর জামাল আপন মনে হেসে উঠল।

চুয়ান্ন

মোটর মালিক সমিতির নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মধ্যে নানা রকম গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মোটর মালিক সমিতি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও প্রত্যেক নির্বাচনেই একাধিক প্যানেলে কোন না কোন দলের মৌন সমর্থন থাকে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মিছিল মিটিং পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা ভোটে প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করেন। ফলে বেশিরভাগ সময় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলেরই বিজয় হয়।

জামাল মোটর মালিক সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল পূর্ণ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তাই আজকাল জামালের ব্যস্ততা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। দিন যতই এগিয়ে আসতে লাগল নির্বাচনী তৎপরতা ততই বেড়ে চলল। জামাল লক্ষ্য করেছে তাকে দলীয়ভাবে মোটর মালিক সমিতির সভাপতি পদে মনোনয়ন দিলেও বেলায়েত সাহেব তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রাজনীতিতে ক্রমাগত বঞ্চনার কারণে তিনি নির্বাচনে খুব একটা সক্রিয় নন। অবশ্য রাজনীতিতে বেলায়েত সাহেবের যে অবস্থান তাতে তিনি আর কোনদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো অবস্থান করে নিতে পারবেন না। তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বীকে কখনো ছোট ভাবতে হয় না। জামাল  মুখে বেলায়েত সাহেবকে নির্বাচনে তাকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানালেও সে নিজে বেলায়েত সাহেবের উপর কোন বিষয়ে নির্ভর করল না। তবু জামাল বেলায়েত সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, বেলায়েত ভাই আমি আপনাদের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছি। এত ছোট-খাট কাজে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করলে আমাদের জেলা কমিটির অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। প্লিজ আপনি আমাকে সহযোগিতা করুন। আমি কথা দিচ্ছি সামনে চেম্বার  অফ কমার্স এর নির্বাচনে আমি দল থেকে আপনাকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যবস্থা করব। শুধু তাই নয় চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি পদে আপনাকে বিজয়ী করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন আমি তাই করব, বলে বেলায়েত সাহেবের হাত ধরেছিল।

বেলায়েত সাহেব ততটা  জটিল প্রকৃতির লোক নন।

তিনি খুব সহজভাবে বললেন, জামাল তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, আমি তোমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছি। তারমানে এই নয় আমি দলের কেউ না। দলে আমার কিছু ভক্ত আছে, মোটর মালিক সমিতিতে আমার কিছু বিশ্বস্ত সদস্য আছে। আমি তাদেরকে বললে তারা তোমার বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। তুমি মোটর মালিক সমিতির সভাপতি হতে পারবে  না। কিন্তু এ নির্বাচনের সঙ্গে দলের ভাবমূর্তির সম্পর্ক রয়েছে, আমি এ দলকে ভালোবাসি, দলের জন্য আমি সারাজীবন সংগ্রাম করেছি, তোমার উপর রাগ করেতো দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারিনা। তবে একটা কথা খেয়াল রাখবে গত দু’বছরে দল ক্ষমতায় আসার পর আমি যে বঞ্চনার শিকার হয়েছি শুধু এটুকু বললে ভুল হবে তুমি আমাকে যেভাবে বঞ্চিত করেছ, দলীয় নেতাকর্মীদের সামনে আমাকে ছোট করেছ এটা তোমার ঠিক হয়নি।

জামাল বিনয়ের সুরে বলল, বেলায়েত ভাই পিছনের কথা ভুলে যান, আমাকে আর লজ্জা দিবেন না। আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট, আমি ভুল করতেই পারি কিন্তু আপনি তো সেগুলো শুধরে দিবেন। আপনি দেখবেন আপনাকে ছাড়া আমি কোন বিষয়ে আর কোন একক সিদ্ধান্ত নিব না। আমি কথা দিচ্ছি আগামী চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাচনে আমি আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

বেলায়েত সাহেব মনে মনে বললেন, এসব তোমার ভণ্ডামি ছাড়া কিছু না। তুমি এর আগেও আমাকে অনেক কথা দিয়েছ কিন্তু বিপদ পার হয়ে গেলে তুমি ঠিকই আমাকে জন বিচ্ছিন্ন করতে চাইছ। রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছ। তুমি জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারির পদটা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য আমাকে সরিয়ে দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাচ্ছ। এসব কি আমি বুঝি না? সবকিছু বুঝতে পারি কিন্তু দেখছি-

বেলায়েত সাহেবকে চুপ করে থাকতে দেখে জামাল বলল, বেলায়েত ভাই কিছু ভাবছেন?

বেলায়েত সাহেব চমকে উঠলেন, না মানে ভাবছিলাম, তুমি নির্বাচনে হেরে গেলে তো শুধু তোমার লস হবে না, একটা সংগঠনে দল নেতৃত্ব হারাবে। তাই যে করেই হোক তোমাকে জিততে হবে।

জামাল বেলায়েত সাহেবের দু’হাত আবার চেপে ধরে বলল, বলুন বেলায়েত ভাই আপনি আমার সঙ্গে আছেন?

বেলায়েত সাহেব মনে মনে বললেন, তুমি তো একটা গাদ্দার, অমানুষ, নেমকহারাম, মানুষের কাছ থেকে কিছু আদায় করার বেলায় তুমি পটু। তোমার চোখের পর্দা বলে তো কিছু নেই। তুমি যে পাতে খাও সে পাতই ছিদ্র কর। তোমার সঙ্গে না থাকলে দল হেরে যায়। আর তোমার সঙ্গে থাকলে আমি হেরে যাই। কাজেই দলের স্বার্থটাই বড় হোক।

বেলায়েত সাহেব জামালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি জামাল। দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করেন।

জামাল আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, বেলায়েত ভাই আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন, আপনি আমার সঙ্গে থাকলে আমি অবশ্যই নির্বাচনে জয়ী হব।

নির্ধারিত দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। জামাল পুরো প্যানেলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলো। ভোটের রেজাল্ট হওয়ার খবর শুনে জামাল যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল। জামালের মনে হলো তার ক্ষমতা যেন আজ অনেকগুণ বেড়ে গেল। জেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার খায়েশটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। জেলার সমস্ত নেতৃত্ব নিজের হাতে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। জেলা মোটর মালিক সমিতির নির্বাচিত সকল সদস্য জামালকে ঘিরে দাঁড়াল, জামাল সকলের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করল।

বেলায়েত সাহেব পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জামাল দেখেও এক রকম না দেখার ভান করে সকলের সঙ্গে কথা বলতে থাকল। বেলায়েত সাহেব একবার জামালের মুখের দিকে তাকালেন জামাল তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ায় তিনি আপন মনে বিড় বিড় করে বললেন, অকৃতজ্ঞ, নেমকহারাম আবার কোন কাজে আসিও তোমার সঙ্গে আর কোন আপোষ নাই। ভেবেছ চেম্বার অফ কমার্স নির্বাচনেও আমাকে অনুরোধ করে বসিয়ে দিয়ে তুমি চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হবে।

তারপর ঘৃণায় একবার থু থু ফেলে চলে গেলেন।

পঞ্চান্ন

জামাল একরকম ইচ্ছা করেই এডভান্স বিল পাবার আশায় রাস্তার কাজটা বন্ধ রাখল। তাছাড়া কাজের গুণগত মানের কোন বালাই নাই। কয়েকদিন আগে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করে স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত কাজ অপসারণ করে ড্রয়িং এবং স্পেসিফিকেশন মোতাবেক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু জামাল ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশকে গুরুত্ব না দিয়ে এডভান্স বিল গ্রহণের আশায় ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ বন্ধ রেখে এডভান্স বিল গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করল। কারণ জামাল জানে জুন মাসে ইঞ্জিনিয়ার বিল দিতে বাধ্য হবে। বিল উত্তোলনের পর ইঞ্জিনিয়ার আর কাজের কোয়ালিটি দেখার সুযোগ পাবে না তখন যেমন-তেমন কাজ করলেই চলবে।

সফিয়ার সাহেব ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে  যেমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ তেমনি নীতিমান। তিনি স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত কাজের বিল দিতে অস্বীকৃতি জানালেন, শুধু তাই নয় কোন এডভান্স বিল প্রদান না করতেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন। রশিদ সাহেবের কাছে এ কথা শোনার পর জামালের মাথায় রক্ত উঠে গেল।

সে রশিদ সাহেবকে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মোবাইল নাম্বার আছে আপনার কাছে?

না, স্যারের তো মোবাইল নাই।

জামাল কিছুটা অবাক হলো এত বড় ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে বছরে কয়েক কোটি টাকা বিল দেয়, কয়েক লক্ষ টাকা পার্সেন্টেস পায় অথচ একটা মোবাইল পর্যন্ত কিনেনি, বেটা তো একটা কঞ্জুস।

কঞ্জুস না ভাইজান, লোকটা আসলে অনেস্ট।

বলেন কি আপনি? ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যেও অনেস্ট লোক আছে?

জি ভাইজান আছে, তিনি পার্সেন্টেস খান  না। পছন্দমতো ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে টাকা নেন না। তিনি কারো অন্যায় আবদারও রক্ষা করেন  না।

জামাল আড় চোখে তাকিয়ে বলল, রশিদ সাহেব ঠিক আছে আপনি যান।

রশিদ সাহেব বলে চলে গেলে জামাল শাকিলকে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে শাকিলের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, বড় ভাই।

জামাল জিজ্ঞেস করল, শাকিল তুমি রাস্তার কাজটা শেষ করেছ?

জি বড় ভাই।

বিল নিয়েছ?

জি।

শাকিল আমি তো কাজটা শেষ করিনি ভাবছিলাম সামনে জুন মাস কিছু এডভান্স বিল নিয়ে কাজটা করে দিতাম। এখন তো শুনলাম এডভান্স বিল তো দূরের কথা যে কাজ করেছি সেটাই নাকি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়নি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আগের কাজ ভেঙ্গে আবার করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বড় ভাই লোকটার ঘাড় একটু বাঁকা, আমি প্রথমে কিছু এডভান্স বিল নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু নিতে পারিনি আর সব কাজ করে নিয়েছে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী। তিনি যেটাই বলেন সেটাই করেন।

আচ্ছা ঠিক আছে রাখি, বলে জামাল মোবাইল রেখে অভ্যাসবশত: কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। তারপর হাতের মোবাইল সেটটা রেখে অন্য একটা মোবাইল সেট হাতে নিয়ে হিটলারকে মোবাইল করে বলল, হিটলার আধঘণ্টার মধ্যে আমার অফিসে চলে এসো তো।

জামাল মোবাইল রেখে আবার কলিং বেল এ টিপ দিতেই পিয়ন এসে দাঁড়াল।

জামাল বলল, রশিদ  সাহেবকে রাস্তার কাজের ফাইলটা আনতে বল।

রশিদ সাহেব রাস্তার কাজের ফাইল নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

জামাল জিজ্ঞেস করল, রশিদ সাহেব ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি আমাদেরকে শুধুমাত্র স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যেটুকু কাজ হয়েছে সেই কাজটুকুর বিল দেয় তবে কত টাকা বিল হবে?

রশিদ সাহেব ক্যালকুলেটর দিয়ে কিছুক্ষণ হিসেব করলেন তারপর বললেন, এই ধরুন দশ লাখ।

আমরা যদি আর কাজটা না করি তবে ডিপার্টমেন্ট কি ব্যবস্থা নিতে পারে?

ডিপার্টমেন্ট প্রথমত: মিনিমাম এক পার্সেন্ট থেকে ম্যাক্সিমাম দশ পার্সেন্ট পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে।

জামাল চমকে উঠল তারমানে পঞ্চাশ লাখ টাকার কাজে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে।

জি।

আর কি করতে পারে?

যে পরিমাণ কাজ হয়েছে সে পরিমাণ কাজের বিল দিয়ে কন্ট্রাক্ট বাতিল করতে পারে।

জামাল জিজ্ঞেস করল, আর কি করতে পারে?

লাইসেন্স ব্লাক লিষ্ট করতে পারে।

জামালের মাথায় যেন বাজ পড়ল, সে বুকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, রশিদ সাহেব আসলে এমন হতে পারে আমার ধারণা ছিলনা। আমি ভেবেছিলাম ইঞ্জিনিয়ার মানুষ পার্সেন্টেস্‌ পাবে বিল দিবে। আর এডভান্স বিল দেওয়াতো একটা ট্র্যাডিশন। কিন্তু শাকিলের কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে ঐ বেটার কাছ থেকে ভালো ফল আশা করা যায় না। তারপরও কাল একবার চেষ্টা করে দেখি।

এসময় দরজা ঠেলে হিটলার এবং তার একজন সহযোগী ভিতরে ঢুকলো।

জামাল রশিদ সাহেবকে বলল, রশিদ সাহেব আপনি এখন আসুন।

রশিদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন, হিটলার চেয়ারে বসল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, ও কে?

হিটলার বলল, বস ওর নাম গালপোড়া সেলিম, আমার খুব বিশ্বস্ত, ওকে আপনি আগেও দেখেছেন খেয়াল করেননি হয়ত, আপনি বলুন কোন অসুবিধা নাই।

জামাল বলল, হিটলার আমি একটা রাস্তার কাজ করছিলাম, কাজটা এখনো শেষ হয়নি, ভাবছিলাম কিছু এডভান্স বিল পেলে বাকী কাজটা শেষ করতাম। কিন্তু এখন শুনছি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নাকি খুব নীতিমান।

কোন ইঞ্জিনিয়ার বস? হিটলার জিজ্ঞেস করল।

সফিয়ার সাহেব।

হিটলার বলল, জি বস শুনেছি ঐ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নাকি খুব নীতিমান আর কড়া।

জামাল অবাক হয়ে বলল, তুমিও একথা বলছ?

জি বস তাই তো শুনছিলাম।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কাল ঠিক দশটার সময় ঐ অফিসের সামনে থাকিও আমি যাব।

জি বস, ঠিক আছে।

ছাপ্পান্ন

সফিয়ার সাহেবের গায়ের রং ফর্সা, লম্বা, স্বাস্থ্যবান, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। সর্বদাই হাস্যজ্বল, বিনয়ী এবং অসাধারণ ভদ্র। তাঁর গুণ আর ব্যবহারের কথা শুধু এটুকু বলেই শেষ করলে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হবে। তিনি সৎ, নীতিমান, দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধা।

ব্যক্তি জীবনে সফিয়ার সাহেব এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রী সায়মা বেগম গৃহিণী, সায়মা খুব সাধারণ মহিলা তাঁর কোন অতিরিক্ত চাহিদা নাই, জীবনে মুখ ফুটে কোনদিন কিছু চান না বরং সফিয়ার সাহেব অনেক সময় বেশি খরচ করলে টাকার উৎস জানতে চান। সফিয়ার সাহেব সৎ থাকার পিছনে সায়মার ভূমিকা অপরিসীম। সায়মার সীমিত চাহিদা, সাধারণ চলাফেরা সফিয়ার সাহেবকে সৎ থাকতে সহযোগিতা করেছে। শুধু তাই নয় সায়মা তাঁর ছেলে-মেয়ে দু’টোকেই গড়ে তুলেছেন খুব সাধারণভাবে। ছেলেটা বড় নাম শান্ত আর মেয়েটার নাম শান্তা, বেতনের সামান্য টাকায় দু’জনের লেখাপড়ার খরচ আর সংসার চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবুও তিনি কখনো অবৈধ টাকার দিকে হাত বাড়ান নি।

সফিয়ার সাহেব পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন এখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর। তাঁর এই পঁচিশ বছরের চাকরি জীবনে তাঁকে সতের বার বদলি করা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে খারাপ কর্মস্থলগুলোতে সব সময় তাঁকে বদলি করা হয়েছে। তাও আবার শুধু বদলি নয় বেশির ভাগ বদলিই ছিল স্ট্যান্ড রিলিজ। তাঁর অপরাধ তিনি সৎ, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা প্রভাবশালী ঠিকাদারগণের অন্যায় আবদার পূরণ করেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবান ঠিকাদার গণের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন। জীবনে অনেক বড় ঝুঁকি এসেছে কিন্তু তিনি নমনীয় হননি, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন কঠোরভাবে।

          চাকরি জীবনে সফিয়ার সাহেব অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক, তিনি কোনদিন অফিস ফাঁকি দিয়েছেন এমন নজির নাই। নিয়মিতভাবে কাজ শেষ করে বিল পাননি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি আবার কাজ না করে বিল দিয়েছেন এমন কাজও তিনি করেননি। নিত্যদিনের মতো তিনি কাজ করছিলেন এমন সময় জামাল চেম্বারে ঢুকলো।

সফিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি?

জামাল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি জামাল, ডিসট্রিক্ট জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল।

সফিয়ার সাহেব হ্যান্ড শ্যাক করে বললেন, বসুন প্লিজ, আপনি আগেও একবার এসেছিলেন। তারপর মনে মনে বললেন, এটা আবার নতুন কোন বিপদ এলো? আবার রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী লোকের অফিসে আনাগোনা মানে আমি যেটা অ্যাভোয়েড করতে চাই, আবার সেটাই হলো।

জামাল বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব  ভালো আছেন?

সফিয়ার সাহেব যেন চমকে উঠলেন, হ্যাঁ ভালো আছি, আপনি?

জামাল বলল, এতদিন ভালোই ছিলাম।

কেন? হঠাৎ কোন অসুখ?

না অসুখ না বিপদ আর সেই বিপদটাতে তো আপনিই ফেললেন।

আমি আপনাকে বিপদে ফেললাম? কিভাবে?

আমি আপনার ডিপার্টমেন্টে একটা কাজ করেছি, কিন্তু বিল পাচ্ছি না।

কেন? কাজ করলে বিল পাবেন না কেন? কি নাম আপনার ফার্মের?

মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ।

তারমানে আমি যে রাস্তার কাজটা স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত বলে ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছি, এতদিনে যে কাজটার মাত্র টুয়েন্টি পার্সেন্ট প্রগ্রেস হয়েছে।

দেখুন কাজ কর্মে একটু-আধটু ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক তাই বলে এত টাকার কাজ কি ভেঙ্গে করা সম্ভব? আর আমি পলিটিকাল কাজে ব্যস্ত থাকায় কাজটা একটু পিছিয়ে গেছে। আপনি বিলটা দিয়ে দিন দেখবেন কয়েক দিনের মধ্যে কাজটা শেষ হয়ে যাবে।

সফিয়ার সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু তা যে সম্ভব না।

সম্ভব না মানে?

সম্ভব না মানে স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত কোন কাজের এবং কাজ না করেই বিল দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

কাজ না করেই বিল দিবেন কেন? এডভান্স বিল দিবেন এটা তো একটা ট্র্যাডিশন, বিলটা পেলেই আমি কাজটা শেষ করে দিব।

জামাল সাহেব আমি কখনো এডভান্স বিল দেই না, আর স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত কোন কাজের বিল তো দেই না।

তারমানে আপনি বিল দিবেন না?

না।

মুহূর্তেই জামাল প্রচণ্ড রেগে গেল, ভাবছিলাম সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে এখন দেখছি সোজা কায়দায় কাজ হবে না।

সফিয়ার সাহেব জামালের কথায় কোন পাত্তাই দিলেন না। নীরবে বসে রইলেন।

জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমি একা আসিনি, কিছু পোষা কুত্তা নিয়ে এসেছি, আমি এখনি ইশারা করলে আমার পোষা কুত্তাগুলো আপনাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। আপনি বলুন এটা কি ঠিক হবে?

সফিয়ার সাহেব তিরস্কারের হাসি হেসে বললেন, রেগে যাবেন না জামাল সাহেব একটু শান্ত হয়ে বসুন আমি একটা গল্প বলি। তারপর না হয় আপনার পোষা কুত্তাই হোক আর বেওয়ারিশ কুত্তাই হোক ছেড়ে দিবেন।

জামাল কিছু বলল না, দাঁত কড়মড় করে নীরবে বসে রইল।

সফিয়ার সাহেব বলতে শুরু করলেন, জামাল সাহেব আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। শুধু আমি নই সারাদেশের মুক্তি পাগল মানুষ যেমন হালের পেন্ডি নিয়ে কামানের গোলার সামনে বুক পেতে দিয়েছিল আমিও তেমনি একটা বন্দুক নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। একদিন পাকিস্তানি বাহিনীর একটা শিবিরে অপারেশনের ডিসিশন হলো। তখন বর্ষাকাল, সন্ধ্যায় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আমরাও অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি খুব সাবধানে ধীরে ধীরে আমরা শিবিরের দিকে এগিয়ে চলছি। বারান্দায় হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে দু’জন পাকিস্তানি সেনা পাহারা দিচ্ছিল। অবশিষ্ট সেনারা সবাই বুঝি ঘুমাচ্ছিল। আমাদের অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষে আমরা খুব সহজেই শিবিরের সমস্ত পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু মুখোমুখি সংঘর্ষে আমার পেটের বাম পাশে একটা গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর সবাই আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সে যাত্রায় আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না কিন্তু আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। আমি মুসলমান, আমি বিশ্বাস করি জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তারপর যখন আমি এত বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম তখন আমার মনে হলো এতদিনে থিওরিতে জানতাম জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে, বেঁচে যাওয়ার পর প্র্যাক্‌টিক্যালি জানলাম আসলে কারো হায়াত থাকলে কেউ মারতে পারে না। তখন থেকে আর ভয় পাইনা। পেটে গুলি লাগার পরও যখন বেঁচে গেছি তখন দু’একটা কুত্তার কামড়ও সইতে পারব ইনশাআল্লাহ্‌। খুব বেশি হলে মরে যাব আর কি দু’দিন আগে আর পরে তো মরতেই হবে না কি বলেন? বলে সফিয়ার সাহেব জামালকে কটাক্ষ করে হাসলেন।

জামাল মনে মনে বলল, এই বেটা তো বেশ সেয়ানা, ভয় পাবার লোক নয়, একে আসলে অন্যভাবে সাইজ করতে হবে।

সফিয়ার সাহেব বললেন, কি ভাবছেন? বদলি করাবেন?

বিল তো আমি নিবই আপনার কাছে থেকে যদি না পাই তবে আপনাকে সরিয়ে দিতে হবে। তারপর যিনি আসবেন তিনি ঠিকই বিল দিবেন।

দেখুন বদলির ভয় দেখাবেন না, আমার পঁচিশ বছরের চাকরি জীবনে সতেরো বার বদলি হয়েছি। তারমধ্যে পনের বারই স্ট্যান্ড রিলিজ। প্রতিবারই প্রায় একই ধরণের কেস, প্রভাবশালী অথবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা, এবারও না হয় তাই হবে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি যদি আপনাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করতে না পারি তবে আমার নাম জামালই নয় আর আমি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি নই। রাজনীতি ছেড়ে দিব, বলে জামাল চলে গেল।

সফিয়ার সাহেব বুঝতে পারলেন জামাল ক্ষমতাসীন দলের জেলা শাখার সেক্রেটারি তার ক্ষমতা অনেক তার মতো ইঞ্জিনিয়ারকে সরিয়ে দেয়া জামালের জন্য কোন ব্যাপারই নয়।

সাতান্ন

জামাল ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের রুম থেকে বের হতেই হিটলার জিজ্ঞেস করল, বস কি খবর?

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, খবর ভালো না।

বলুন বেটাকে সাইজ করে দিই।

না তোমরা চলে যাও পরে কথা হবে বলে জামাল তার অফিসে এসে বসল।

তারপর মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল, হ্যালো বড়ভাই আস্‌সালামুআলায়কুম।

হ্যাঁ জামাল বল কি খবর?

বড় ভাই ঐ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কথা শুনছে না।

কোন ইঞ্জিনিয়ার?

জামাল সফিয়ার সাহেবের নাম এবং ডিপার্টমেন্টের নাম বলল।

এখন বল কি হয়েছে?

বড় ভাই আপনি তো সবই জানেন ঠিকাদারি কাজে টুকটাক ত্রুটি থাকতেই পারে আর এডভান্স বিলেরও একটা ট্র্যাডিশন আছে সেটাও তো আপনার অজানা নয়। আমি দুই কিলোমিটার রাস্তার কাজ করছিলাম তিনি হঠাৎ একদিন সাইটে গিয়ে অনেকগুলো কাজ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়নি বলে বাতিল করে দিয়েছেন। সামনে জুন ক্লোজিং আমি বিলটা না পেলে রাস্তার কাজটাও হবে না। তাই আমি বিলটা দেয়ার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিলাম।

তারপর-

আমি প্রথমে দলের জেনারেল সেক্রেটারি পরিচয় দিলাম কিন্তু  তিনি কোন গুরুত্বই দিলেন না বললেন, তিনি স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত কোন কাজের বিল কিংবা এডভান্স বিল দিবেন না। আপনার মান-সম্মানের কথা ভেবে আমি গায়ে হাত তুলি নি। তখন হয়ত আপনি বলতেন কাজটা তোমার ঠিক হয়নি। তাই আমি বলে এসেছি-

কি বলে এসেছ?

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বদলি করার কথা।

অপর পাশ থেকে মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে জামাল বিনয়ের সুরে বলল, বড় ভাই আমার কাজটা যে করে দিতে হবে।

কোন কাজ?

সফিয়ার সাহেবকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্ট্যান্ড রিলিজ করতে হবে। এটা আমার প্রেস্টিজ ইস্যু। শুধু আমার না, আমি দলের জেনারেল সেক্রেটারি হওয়ায় এটা এখন দলীয় ইস্যু।

আচ্ছা আমি দেখছি।

জি বড় ভাই ঠিক আছে।

জামাল দলের কি অবস্থা?

সব কিছু ঠিক আছে বড় ভাই।

কিন্তু আমি তো দলের মধ্যে গ্রুপিং দেখতে পাচ্ছি।

বড় ভাই বেলায়েত ভাই মাঝে মাঝে গ্রুপিং করার চেষ্টা করে তাঁর সমর্থনে বর্তমানে কেউ নেই। ঐরকম একজন বেলায়েত ভাই এখন দল থেকে চলে গেলেও দলের কিছু হবে না।

মাননীয় মন্ত্রীর রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল বেলায়েতের সমর্থনে একটা লোকও নাই আর বেলায়েত চলে গেলেও দলের কোন ক্ষতি হবে না এটা ঠিক না, বেলায়েত এক্স-জেনারেল সেক্রেটারি, দলে তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছে বুঝলে?

জামাল কোন কিছু বলল না, চুপ করে রইল।

আবার মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, গ্রুপিং দলের জন্য খুব ক্ষতিকর। তুমি দলে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য বেলায়েতকে কোণঠাসা করছ। মনে রাখবে দেয়ালে জখম মানুষের পিঠ ঠেকে যায় তখন মানুষ লড়াই করে। তুমি বেলায়েতকে এমন বঞ্চিত কর না যাতে সে তোমার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

জি বড় ভাই ঠিক আছে।

দেখ তোমার ভালোর জন্য বলছি সবকিছু ম্যানেজ করে চল, সেক্রিফাইজ কর , রাজনীতিতে ছাড় দিতে শেখ।

জি ভাই ঠিক আছে।

ঠিক আছে তাহলে রাখি।

জামাল আবার স্মরণ করিয়ে দিল, বড় ভাই সফিয়ার সাহেবের বদলিটা?

বলছি তো আমি দেখছি।

জি ভাই আস্‌সালামুআলায়কুম, বলে জামাল মোবাইল অফ করল।

এবার দেখি বেটা সৎ ইঞ্জিনিয়ার তোকে কে রক্ষা করে? বলে জামাল ভয়ংকর হাসি হেসে চেয়ারে বসে রইল। হঠাৎ পিয়ন দরজা ঠেলে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান  ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

আসতে বল।

ম্যানেজার সাহেব দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সালাম দিলেন।

জামাল মুখ গম্ভীর করে সালামের জবাব দিয়ে বসতে বলল।

ম্যানেজার সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, জামাল ভাই কেমন আছেন?

জামাল মুখ বিকৃত করে বলল, না ভালো নেই।

কেন হঠাৎ কোন অসুখ?

একটা রাস্তার কাজ করছিলাম সেই কাজের বিলটা নিয়ে শালা ইঞ্জিনিয়ার খুব ঝামেলা করছে, অনেক টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছি। এখন সব টাকা আটকে গেছে।

ম্যানেজার সাহেব বুঝতে পারলেন জামাল লোন পরিশোধ না করার  অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য বিলের কথা বলছে।

কিন্তু তিনিও নাছোড় বান্দার মতো বললেন, জামাল ভাই আপনার লোনটা পরিশোধের মেয়াদ তো শেষ হয়ে গেছে। আমি কয়েকদিন থেকে আপনাকে টেলিফোনে খুঁজছিলাম।

আমি ব্যস্ত মানুষ তাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, ম্যানেজার সাহেব আমি তো আগেই আপনাকে বললাম আমার একটা বড় অংকের বিল আটকে গেছে তাই লোনটা পরিশোধ করতে পারছিনা। তাছাড়া আমি মর্টগেজ দিয়ে লোন নিয়েছি আমি লোন পরিশোধ না করতে পারলে আমার প্রোপার্টি নিলামে উঠবে। এতে তো আপনার টেনশন করার কিছু নাই।        জামাল ভাই আপনি একজন সম্মানী মানুষ, আপনি ঋণ খেলাপি হলে বা আপনার প্রোপার্টি নিলামে উঠলে আপনার মান-সম্মান থাকবে না, তাছাড়া আমার চাকরিতেও অসুবিধা হবে।

এটা তো চিন্তা করিনি ঋণ খেলাপি হলে তো আমি ইলেকশনে অংশগ্রহণ করতে পারব না।

ম্যানেজার সাহেব মাথা বাঁকিয়ে সায় দিলেন।

জামাল বলল, ম্যানেজার সাহেব তাহলে এক কাজ করি।

জি বলুন।

এখন গোডাউনের সব চাউল বিক্রি করে দিলে হয়ত আমার কিছু লস হবে তারপরও আমি চাউল বিক্রি করেই লোনটা পরিশোধ করি আপনি কি বলেন?

মুহূর্তেই ম্যানেজার সাহেবের মুখে আলোর স্পষ্ট আভা ফুটে উঠল। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তাহলে তো খুব ভালো হয়।

দেখি এ সপ্তাহেই চাউল বিক্রি করে লোনটা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করি। গোডাউনের চাবি তো আপনার কাছে, তাই না?

ম্যানেজার সাহেব বললেন, জি।

তাহলে এভাবেই কথা থাকল আপনার সঙ্গে কথা বলে চাউল বিক্রির দিন ঠিক করব।

থ্যাংক ইউ জামাল ভাই, বলে ম্যানেজার সাহেব হ্যান্ড শ্যাক করে জামালের চেম্বার থেকে  বের হলেন।

জামাল মনে মনে বলল, বেটা ম্যানেজার গোডাউন খুলে দেখ, চাউল আছে না কি আছে? তখন বুঝবে।

আটান্ন

সফিয়ার সাহেবের মুখের  দিকে তাকাতেই সায়মার মুখ শুকিয়ে গেল। সফিয়ার সাহেব কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হয়েছেন এ কথা তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। তাঁর হাতে তল্পি তল্পা দেখে তিনি সফিয়ার সাহেবের বদলি সম্পর্কেও অনেকটা নিশ্চিত হলেন। কিন্তু তিনি মুখে কিছু বললেন না। সফিয়ার সাহেবের এ অবস্থা তিনি অনেকবার দেখেছেন। বলতে গেলে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সফিয়ার সাহেব ড্রয়িং রুমে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ রেখে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন।

সায়মা বাথরুমে লুঙ্গি তোয়ালে দিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে বললেন, যাও আগে গোসল সেরে এসো, ভাত খাবে। এখনি শান্ত আর শান্তা এসে পড়বে।

সফিয়ার সাহেব বললেন, সায়মা একটু বস গল্প করি।

সায়মা কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বললেন, আগে তুমি গোসল করে ভাত খাও তারপর গল্প করব।

সফিয়ার সাহেব বাথ রুমে গেলে সায়মা তাঁর ব্যাগগুলো বেডরুমে নিয়ে গেলেন।

সফিয়ার সাহেব গোসল সেরে বের হতেই শান্ত আর শান্তা চলে এলো, বাবা তুমি হঠাৎ করে?

সফিয়ার সাহেব খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ইচ্ছা হলো তাই চলে এলাম।

শান্ত ভিতরে চলে গেল।

শান্তা শাসনের সুরে বলল, বাবা তুমি কি কিছু  লুকাচ্ছ?

সায়মা ধমকের সুরে বললেন, শান্তা তোর বাবা কেবল এলো তোরাও খেতে আয়। খাওয়ার পর তোর বাবাকে যত প্রশ্ন করার আছে করিস।

সফিয়ার সাহেব, শান্ত এবং শান্তা খেতে বসল। সায়মা খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন।

সফিয়ার সাহেব বললেন, সায়মা তুমিও বস।

সায়মা বললেন, আচ্ছা আমি কোনদিন তোমার পাশে বসে খেয়েছি, তাছাড়া সবাই খেতে বসলে খাবার পরিবেশন করবে কে?

শান্তা জোর দিয়ে বলল, মা তুমি বস তো।

সায়মা একবার সফিয়ার সাহেব আর একবার শান্ত ও শান্তার দিকে তাকাতেই শান্ত বলল, বস মা।

সায়মাও সবার সাথে খেতে বসল। খাওয়া শেষে সবাই ড্রয়িং রুমে বসতেই সফিয়ার সাহেব বললেন, শান্ত-শান্তা তোরা দু’জনেই আমাকে আজ ঢাকায় দেখে অবাক হচ্ছিস্‌ তাই না? তোর মা হয়ত কিছুটা বুঝতে পেরেছে।

সবাই সফিয়ার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তিনি বলতে শুরু করলেন, আমাকে বদলি করা হয়েছে।

কোথায় বাবা? ঢাকায়? শান্তা জিজ্ঞেস করল।

না মা, বলে সফিয়ার সাহেব তার বদলিকৃত কর্মস্থলের নাম বললেন।

সবার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। সফিয়ার সাহেব সান্ত্বনার সুরে বললেন, চিন্তার কিছু নাই, আমাকে তো আর কোন কর্মস্থলে বেশিদিন চাকরি করতে হয় না। ছয় মাস, নয় মাস না হয় এক বছর তারপর হয়ত আবার অন্য কোথাও বদলি করবে। আসলে একটা কথা কি তোরা জানিস? চাকরিতে স্বাধীনতা নাই, ইচ্ছামতো একই স্থানে দীর্ঘদিন থাকার সুযোগ নাই। চাকরি করছি যখনই বদলির অর্ডার আসবে তখনই চলে যেতে হবে এতে মন খারাপের কিছু নাই।

শান্ত বলল, বাবা আমার এক বন্ধুর মামা মন্ত্রী ওকে বললে হয়তো ওর মামা বদলির অর্ডার বাতিল করে দিতে পারবে।

বাবা চাকরিতে কখনো তদবির করতে হয় না, তাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ  নাখোশ হয়, সার্ভিস রুল ভাইলড করা হয়, জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা চলে না।

শান্ত বলল, বাবা এখন আর ওসব চলে না, এখন যাদের তদবিরের জোর বেশি তারাই ভালো ভালো পোস্টিং পায়।

সফিয়ার সাহেব রাগান্বিত চোখে একবার শান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা আমার কাছে থেকে এই শিখলি?

শান্ত বিনয়ের সুরে বলল, সরি বাবা আমি তোমাকে এভাবে বলতে চাইনি।

সফিয়ার সাহেব হেসে বললেন, তোর মা কিন্তু কিছু বলছেনা একেবারে নরমাল যেমন ছিল ঠিক তেমনি, কেন জানিস?

শান্ত এবং শান্তা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো, মা তুমি কিছু বলছ না কেন?

সফিয়ার সাহেব বললেন, তোর মায়ের সঙ্গে বিয়ের প্রায় এক বছর পর আমি সরকারী চাকরিতে জয়েন্ট করি। একদিন এক পার্টি আমাকে দু’হাজার টাকা দিল, আমি ভেবে পেলাম না হঠাৎ করে আমাকে টাকা দিবে কেন? আমি অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তিনি বললেন, স্যার রাখুন পরে কথা হবে।

আমি কি করব ভেবে পেলাম না, পঁচিশ বছর আগে দু’হাজার টাকা আমার কয়েক মাসের বেতনের সমান, এতগুলো টাকা তার আগে এক সঙ্গে আমি কখনও দেখিনি, আমার খুব লোভ হলো। আমি টাকাটা নিলাম। আমার ধারণা ছিল তোর মা এক সঙ্গে এতগুলো টাকা পেয়ে খুশি হবে কিন্তু তোর মা কি করেছিল জানিস?

শান্ত এবং শান্তা সফিয়ার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তোর মা টাকাগুলো হাতে নিয়ে একবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আমাকে বলেছিল, আজ মাসের বিশ তারিখ তুমি এতগুলো টাকা পেলে কোথায়?

আমি তোর মায়ের কথার কোন জবাব দিতে পারিনি।

তখন তোর মা আরো প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল, বল এতগুলো টাকা তোমাকে কে দিল? কেন দিল?

আমি অপরাধীর মতো তোর মায়ের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। তোর মা আমার হাতে টাকাগুলো ফেরত দিয়ে বলেছিল, টাকাগুলো রাখ, যার টাকা তাকে ফেরত দিও। একটা কথা মনে রেখো তুমি পরিশ্রম করে যা বেতন পাবে তা নিয়ে আসবে তা যত কমই হোক, আর কোনদিন অবৈধ টাকা নিয়ে আসবে না, কেউ জোর করে দিলেও নিবে না। বলে সফিয়ার সাহেব শান্তাকে কাছে টেনে নিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, তোর মায়ের মতো যদি দেশের সব গৃহিণীরা হতো তবে দেশে দুর্নীতি অনেকটা কমে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তোর মায়ের মতো গৃহিণীর সংখ্যা নাই বললেও চলে। বেশির ভাগ গৃহিণী স্বামীর অবৈধ টাকায় বিলাসিতা করে, আর স্বামীরা স্ত্রীর মন জয় করা ও নিজে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার জন্য লাগামহীন দুর্নীতি করে। মা তুই আজ আমাকে একটা কথা দিবি?

কি কথা বাবা?

তুই তোর মায়ের মতো আদর্শ গৃহিণী হবি।

শান্তা মাথা বাঁকিয়ে জানাল সে আদর্শ গৃহিণী হবে না।

সফিয়ার সাহেব কপালে চোখ তুলে বললেন, সে কি মা?

না বাবা আমি শুধু মায়ের মতো আদর্শ গৃহিণী হব না, একজন আদর্শ ডাক্তার হব, তুমি দোয়া কর বাবা আমি যেন মায়ের মতো গৃহিণী, আদর্শ ডাক্তার এবং তোমার মতো নীতিমান অফিসার হতে পারি।

সায়মা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনছিল এবার শান্তর কাছে গিয়ে বসে বললেন, মেয়েটার তো বড় হওয়ার জন্য দোয়া করলে আর ছেলেটার জন্য তো কিছু বললে না। আমি দোয়া করি শান্তা যেমন আমাকে অতিক্রম করবে তেমনি শান্ত যেন তোমাকে অতিক্রম করে।

ঊনষাট

সফিয়ার সাহেবকে স্ট্যান্ড রিলিজ করার পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে হায়দার সাহেবকে, হায়দার সাহেবের সঙ্গে জামাল দেখা করেই বুঝেছে তাঁর কাছ থেকে সকল প্রকার সুবিধা আদায় করা সহজ হবে।

হায়দার সাহেব জামালকে আপ্যায়ন করে বললেন, জামাল ভাই বলুন আপনার কি কাজ আছে?

আমার একটা বিল আছে, অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি, অনেক রিকোয়েস্ট করেছি কিন্তু তিনি কথা শুনলেন না ফলে তাঁকে স্ট্যান্ড রিলিজ করাতে বাধ্য হলাম। আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি, আমরা কাজ করি, সময়মতো বিল চাই এই তো।

হায়দার সাহেব সায় দিয়ে বললেন, সে তো বটেই কাজ করলে আপনি বিল পাবেন না কেন? আমি কাল একবার সাইটে গিয়ে দেখি সম্ভব হলে বিলটা ছেড়ে দিব।

জামাল হেসে বলল, সম্ভব হলে না, বলুন ছেড়ে দিবেন, আগামীকাল বিকালবেলা আমি আমার ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠিয়ে দিব চেকটা দিবেন। বুঝেনই তো আমি ব্যবসা করি টাকা আটকে থাকলে মাথা ঠিক থাকে না আর রাজনীতি করে বিভিন্ন ধরণের ঝামেলায় মেজাজটাও হয়েছে খিটখিটে, সহজে কোন কিছু মেনে নিতে পারিনা, বলে জামাল হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল, খেয়াল রাখবেন আগামীকাল বিকালে আমার ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠিয়ে দিব, চেকটা দিয়ে দিবেন, আপনার পার্সেন্টেস আপনি পেয়ে যাবেন।

হায়দার সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।

জামাল সোজা তার অফিসে চলে গেল। সাধারণত জামাল সকালবেলা অফিস থেকে বের হলে আর সারাদিন অফিসে ফিরে না। সারাদিন কাজ আর মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অসময়ে জামালকে অফিসে ঢুকতে দেখে রশিদ সাহেব কিছুটা অবাক হলেন।

জামাল তার চেম্বারে ঢুকেই কলিং বেল না টিপে কয়েকবার রশিদ সাহেব বলে ডাক দিল। জামালের এমন অস্বাভাবিক আচরণে রশিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি জামালের চেম্বারে ঢুকে চেয়ার বসতে বসতে বললেন, ভাইজান কি মনে করে হঠাৎ?

হ্যাঁ শুনুন ঐ রাস্তার কাজটা তো অনেকদিন ধরে বন্ধ আছে, এখন চালু করতে কি কি লাগবে বলুন তো, আগামীকালই খুব জোরে শোরে কাজটা শুরু করতে হবে। ঐ শালা ইঞ্জিনিয়ার নাকি কালকে সাইটে যাবে দেখে এসে বিল দিবে।

ভাইজান তাহলে একবার আমাকে গিয়ে দেখে আসতে হবে।

শুধু আপনি কেন চলুন আমিও একবার যাই, বলে জামাল কলিং বেল টিপতেই জাকির এসে দাঁড়াল, ভাইজান?

মাইক্রো বাস বাইরে আছে?

জি ভাইজান।

চলুন রশিদ সাহেব।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি নির্ধারিত স্থানে এসে দাঁড়াল। সাইটে তখন নাইট গার্ড ছাড়া কেউ নাই। জামাল রশিদ সাহেবসহ সমস্ত সাইট ঘুরে দেখল। তারপর বলল, রশিদ সাহেব সাইটে তো মালামাল কিছু নাই, বলুন তো কাল সকালে কিভাবে কাজ চালু করা সম্ভব?

ভাইজান সবচেয়ে বেশি সমস্যা খোয়ার, বালি তো এখন অর্ডার দিলে রাতেই পর্যাপ্ত বালি পাওয়া যাবে কিন্তু ইট ভেঙ্গে খোয়া তৈরি করা এত অল্প সময়ে কঠিন।

হ্যাঁ আসলে তো তাই-

তবে ভাইজান একবার শাকিল ভাই’র ভাটায় খবর নিলে জানা যেত?

আচ্ছা দেখি বলে জামাল শাকিলকে মোবাইল করল।

বড় ভাই কি মনে করে আমাকে স্মরণ করলেন?

শাকিল একটা বিপদে পড়ে তোমাকে মোবাইল করলাম।

জি বড় ভাই বলুন।

আমার রাস্তার কাজটা শুরু করব আগামীকাল ঐ শালা ইঞ্জিনিয়ার নাকি সাইট দেখতে আসবে তারপর গিয়ে বিল সই করবে।

বড় ভাই আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন?

তোমার ভাটায় কি খোয়া আছে?

জি আছে, তবে রেডিমেড খোয়া সাধারণত ভালো ইটের হয় না, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আবার মানবে তো?

ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা হয়েছে কৌশলে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি বিল না পেলে সফিয়ার সাহেবের মতো তাঁকেও স্ট্যান্ড রিলিজ হতে হবে। তাতে মনে হলো ঐ বেটা ভয় পেয়েছে, কাজেই শুধু মালামালের পরিমাণ আর কাজটা চালু দেখলেই বোধ হয় বিলটা পাওয়া যাবে। তারপর ধীরে ধীরে বাকী কাজটুকু করে দিব।

ঠিক আছে বড় ভাই আপনি যদি চালাতে পারেন তবে পাঠিয়ে দিব, বলুন কত সি.এফ.টি খোয়া লাগবে?

একটু লাইনে থাক, রশিদ সাহেব কতগুলো খোয়া পাঠাতে বলব?

পাঁচ হাজার সি.এফ.টি খোয়া আর বিশ হাজার ইট।

শাকিল পাঁচ হাজার সি.এফ.টি খোয়া আর বিশ হাজার ইট পাঠানোর ব্যবস্থা কর।

জি বড় ভাই ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ কাল সকালের আগেই ইট পৌঁছে যাবে।

আচ্ছা রাখি পরে কথা হবে।

বড় ভাই রাখবেন না।

জামাল বলল, কেন? কি হয়েছে? বল।

আজ মোটর মালিক সমিতির মিটিং আপনার মনে আছে তো?

মনে ছিল না তুমি মনে করে দিয়ে ভালোই করলে। ঠিক আছে আমি আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব বলে জামাল মোবাইল অফ করে রশিদ সাহেবকে বলল, রশিদ সাহেব তাহলে বড় সমস্যা খোয়া ম্যানেজ করা সেটা তো হলো আপনি এখন অন্যান্য মালামাল সংগ্রহ করুন, মিস্ত্রীকে খবর দিন আমি আগামীকালই যেন কাজটা শুরু করা যায়।

জি ভাইজান।

ষাট

গোডাউনের ভিতর চাউল নেই সমস্ত গোডাউন তুষ দিয়ে ভরা। তারপরও জামাল চাউল বিক্রির জন্য পার্টি ঠিক করেছে। ম্যানেজার সাহেবকে চাবি নিয়ে সকাল ন’টায় গোডাউনে উপস্থিত হওয়ার জন্য মোবাইল করেছে। ম্যানেজার সাহেব তাঁর এক প্রতিনিধিকে গোডাউনের চাবি দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি জামাল সাহেবকে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি আব্দুল বারী, সেকেন্ড অফিসার।

জামাল নিজের পরিচয় দিতেই বারী সাহেব বললেন, আমি আপনাকে চিনি।

জামাল বলল, তো আমাদের বোধ হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না, ট্রাক লেবার সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিল।

বারী সাহেব জামালের হাতে চাবি দিয়ে বললেন, চাবি নিন আপনি গোডাউন থেকে চাউল বের করুন। গোডাউনে যা চাউল আছে সব বিক্রি করবেন, তাই না?

জি।

জামাল চাবিটা নিয়ে লেবার সর্দারকে দিয়ে বলল, চাবি নিয়ে যাও, চাউল বের কর।

লেবার সর্দার চাবি নিয়ে গোডাউন খুলে প্রথমে কয়েক বস্তা চাউল বের করল। তারপর একজন লেবার বলল, ভাইজান এত হালকা কেন? চাউল তো এত হালকা হওয়ার কথা না।

জামাল কৃত্রিমভাবে মুখ কালো করল, বারী সাহেব ছুটে গেলেন বস্তার কাছে, না বস্তায় তো চাউল নাই। বারী সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল, তিনি জামালকে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল ভাই আপনি গোডাউনে চাউল রাখেন নি?

জামাল ভয়ংকর রূপ ধারণ করে বলল, চাউল রাখিনি মানে? গোডাউন ভর্তি চাউল রেখেছি ম্যানেজার সাহেব নিজে  গোডাউনে চাউল দেখে সিল গালা করে দিয়েছেন, এতদিন চাবি ছিল ম্যানেজার সাহেবের কাছে এবং আপনি নিজেও সিল গালা দেখলেন তাহলে চাউল গেল কোথায়? দেখি দেখি বস্তায় কি আছে বলে জামাল নিজে গিয়ে একটা বস্তা খুলে এক মুঠো তুষ দেখে কৃত্রিম আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, কি আশ্চর্যের ব্যাপার রাখলাম চাউল আর হয়ে গেল তুষ।

বারী সাহেব বললেন, জামাল ভাই কোন ভুল হচ্ছে না তো?

না কোন ভুল না নিশ্চয়ই এটা ম্যানেজার সাহেবের কাজ, সমস্ত চাউল সরিয়ে তুষ দিয়ে গোডাউন ভর্তি করে রেখেছে, আমার সঙ্গে বাটপারি?

বারী সাহেব বললেন, জামাল ভাই একটু মাথা ঠাণ্ডা করুন, আমি স্যারকে খবর  দিচ্ছি।

জামাল তার মোবাইলটা বারী সাহেবকে দিয়ে বলল, ডাকুন, ম্যানেজারকে ডাকুন, কি করে আমার চাউল তুষ হয়ে গেল নিজ চোখে দেখে যাক।

বারী সাহেব মোবাইল নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে মোবাইল করে গোডাউনে আসার জন্য অনুরোধ করলেন।

জামাল মোবাইলটা হাতে নিয়ে লেবার সর্দারকে বলল, দেখতো দু’একটা বস্তায় তুষ নাকি সব বস্তায় তুষ, তারপর তার লিগ্যাল এ্যাডভাইজার এডভোকেট তারেক সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো তারেক।

জি ভাই।

তুমি একবার আমার গোডাউনে এসো তো।

বড় হঠাৎ আমাকে গোডাউনে-

হ্যাঁ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

দুর্ঘটনা।

হ্যাঁ আমি আমার গোডাউন ভর্তি চাউলের বিপরীতে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলাম, এখন গোডাউন খুলে দেখি চাউল নাই, চাউল তুষ হয়ে গেছে, তুমি এক্ষণই চলে এসো ভাই আমি কি করব বুঝতে পারছি না।

জি বড় ভাই আমি আসছি।

জামাল তারেক সাহেবের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ওসি সাহেবকে মোবাইল করল, হ্যালো ওসি সাহেব।

জামাল ভাই বলুন।

হ্যাঁ ওসি সাহেব আপনি আমার হাসকিং মিল আর গোডাউন চিনেন?

জি চিনি।

আপনি একটু আসুন প্লিজ।

জি আসছি।

জামাল একটা চেয়ার  টেনে নিয়ে বসল, অপর একটা চেয়ার দেখিয়ে বারী সাহেবকে বলল, বসুন বারী সাহেব, আপনার ম্যানেজার, উকিল সাহেব, ওসি সাহেব সবাই আসুক তারপর কথা বলা যাবে।

কিন্তু জামাল ভাই এটা কিভাবে সম্ভব?

কেন সম্ভব নয়? আমি তো গোডাউনে চাউল রেখে নিশ্চিন্তে লাভ গুনছি। আর ম্যানেজার সাহেব চাউল বিক্রি করে তুষ দিয়ে গোডাউন ভরে রেখেছে।

ম্যানেজার সাহেব রিক্সা থেকে নেমে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বারী সাহেব দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে চেয়ারে বসতে বললেন।

ম্যানেজার সাহেব বারী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, কি  ব্যাপার বারী সাহেব?

স্যার গোডাউনে তো চাউল নাই।

ম্যানেজার সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন, তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। তিনি উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস  করলেন, চাউল নাই মানে?

জামাল বলল, নাই মানে চাউল বিক্রি করে তুষ গোডাউনে ঢুকিয়ে রাখলে চাউল থাকবে কিভাবে?

ম্যানেজার সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন, আপনি বলছেন কি জামাল ভাই?

জামাল উত্তেজিত হয়ে বলল, দেখুন ম্যানেজার সাহেব ভণ্ডামি করবেন না, গোডাউনের চাউল বিক্রি করে তুষ ঢুকিয়ে রেখেছেন আর ভাব দেখাচ্ছেন আপনি কিছুই জানেন না।

এভাবে দু’জনের কথাবার্তার মাঝে কয়েক মিনিট কেটে গেল। তারেক সাহেব এবং ওসি সাহেব এসে দাঁড়ালেন। ওসি সাহেব একবার সকলের মুখের দিকে তাকালেন, কি হয়েছে জামাল ভাই? কোন সমস্যা?

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, হ্যাঁ সমস্যা তো বটেই, তারেক তুমিও শোন আমি ব্যাংক থেকে আমার হাসকিং মিলের জায়গা, গোডাউন আর চাউলের বিপরীতে লোন নিয়েছিলাম। গোডাউনের চাবি ছিল ম্যানেজার সাহেবের কাছে। আর আমি শুয়ে শুয়ে লাভের স্বপ্ন দেখছিলাম, আজ চাউল বিক্রি করব বলে লেবার, ট্রাক এনেছি কিন্তু গোডাউন খুলে দেখি চাউল নাই, বস্তায় তুষ ঢুকানো হয়েছে। আপনি বলুন ওসি সাহেব আমি এখন কি করতে পারি?

ওসি সাহেব ওয়্যারল্যাস সেট-এ বিড়বিড় করে কি যেন বললেন, তারপর ম্যানেজার সাহেব এবং জামালকে বললেন, চলুন তো একবার গোডাউনের ভিতরে গিয়ে দেখি।

আপনি ম্যানেজার সাহেবকে নিয়ে যান আমি দেখছি।

ম্যানেজার সাহেব এবং ওসি সাহেব গোডাউনের ভিতরে গেলেন জামাল তারেক সাহেবকে বলল, তারেক তুমি আমার সঙ্গে চল আজই মামলা করার ব্যবস্থা কর।

জি ভাই।

ওসি সাহেব এবং ম্যানেজার সাহেব গোডাউন থেকে বেরিয়ে এলেন। ম্যানেজার সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখে মুখে কালো মেঘের ছায়া পড়েছে।

জামাল ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, দেখলেন, দেখলেন তো ওসি সাহেব সত্যি কিনা।

জি জামাল ভাই, আপনার কথা সত্যি।

তবে আর কি আইনগত ব্যবস্থা নিন।

পুলিশের একটা পিক আপ ভ্যানে কয়েকজন কনস্টেবল এবং একজন অফিসার এলো। ওসি সাহেব অফিসারকে বললেন, আপনি গোডাউনটা সীলগালা করার ব্যবস্থা করুন।

ম্যানেজার সাহেব বিনয়ের সুরে বললেন, জামাল ভাই বিশ্বাস করুন গোডাউন সীলগালা করার পর গোডাউন খোলা তো দূরের কথা আমি কোনদিন দেখতেও আসিনি।

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, বিশ্বাস করেছিলাম বলেই তো আজ এ অবস্থা।

ততক্ষণে গোডাউন সীলগালা করা হয়েছে, পুলিশ অফিসার ওসি সাহেবকে স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার সীলগালা করা হয়েছে। এই নিন চাবি।

ওসি সাহেব বললেন, ম্যানেজার সাহেব আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে, চলুন।

ম্যানেজার সাহেবের দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল, লজ্জায় তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গেল, সমস্ত শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। তিনি একবার জামালের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থুথু ফেললেন তারপর পুলিশের পিক আপে উঠলেন।

জামাল তারেক সাহেবকে বলল, চল তারেক ব্যাংকের কাগজ-পত্রগুলো নিয়ে মামলা করার ব্যবস্থা কর।

জি ভাই।

একষট্টি

রশিদ সাহেব মধুকুঞ্জের ড্রয়িং টেবিলে বিছিয়ে জামালকে একটা একটা করে অংশ ব্রিফ করছিলেন। জামাল গভীর মনোযোগ সহকারে ড্রয়িং বুঝছিল আর রশিদ সাহেবের পরিশ্রম, মেধা আর অভিজ্ঞতার প্রশংসায় মনে মনে হাসছিল। বিল্ডিংয়ের প্লান দেখানোর পর রশিদ সাহেব যখন মধুকুঞ্জের বিভিন্ন পার্শ্বের এলিভেশন দেখাচ্ছিলেন তখন জামাল আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, আচ্ছা রশিদ সাহেব মধুকুঞ্জ তৈরির পর কেমন দেখা যাবে সেই ছবি আপনি এখনই তৈরি করে ফেলেছেন?

জি ভাইজান, শুধু ছবি নয় মডেলও তৈরি করেছি।

মডেল মানে?

আপনি একটু বসুন আমি নিয়ে আসছি বলে রশিদ সাহেব তাঁর রুমে গেলেন, কয়েক মিনিট পর মধুকুঞ্জের মডেল নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

রশিদ সাহেব গ্লাসের ফ্রেমের ভিতরে রাখা মধুকুঞ্জের মডেল টেবিলে রাখতেই জামাল কপালে চোখ তুলে বলল, এটা কি  আপনি করেছেন?

রশিদ সাহেব বললেন, ধরুন গ্লাস দিয়ে বেড়া দেয়া জায়গাটা মধুকুঞ্জ। আপনি যেমন চিন্তা করেছিলেন মধুকুঞ্জের মাঝ দিয়ে ঢুকতেই ফুটপাথ, ফুটপাথের দু’পাশে ফুলগাছ। তারপর মধুকুঞ্জ ঠিক যেমন বলেছিলেন, মধুকুঞ্জ তৈরির পর কেমন হবে সেটাই তৈরি করা হয়েছে।

জামাল টেবিলের চার পাশ ঘুরে ঘুরে বিল্ডিংয়ের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ পাশ থেকে দেখলে কেমন দেখাবে সেটা দেখল। তারপর উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, রশিদ সাহেব আপনি আমাকে অবাক করেছেন, আসলে কি জানেন? আমরা মেধার মূল্যায়ন করতে পারিনা। আপনি এতকিছু  জানেন আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। আমি আপনার মেধার অবমূল্যায়ন করেছি।

জামাল তার প্রশংসা করায় রশিদ সাহেব লজ্জায় মাথা নত করে বসে রইলেন।

জামাল বলল, রশিদ সাহেব দিন দিন আমার ব্যবসার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে এতদিন আমার ঠিকাদারি ব্যবসার সবদিক দেখাশুনা করেছেন, আপনি শীঘ্রই একজন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করুন। আপনি শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কাজগুলো দেখবেন।

জি ভাইজান।

আর হ্যাঁ এই মধুকুঞ্জ তৈরি করতে কত টাকা লাগবে আপনি এস্টিমেট করেছেন?

জি ভাইজান।

কত টাকা লাগবে?

প্রায় এক কোটি।

আপনি কাজ শুরু করে দিন আগামীকাল থেকেই।

জি ভাইজান।

রশিদ সাহেব আমি বুঝতে পেরেছি মধুকুঞ্জ তৈরির ব্যাপারে আপনি আমার চেয়ে ভালো বুঝবেন। আপনি শুধু আমাকে বলবেন কখন কত টাকা লাগবে? আর একটা কথা খেয়াল রাখবেন মধুকুঞ্জ তৈরির জন্য আমার কাছে টাকার অভাব নাই।

জি ভাইজান।

আচ্ছা রশিদ সাহেব কতদিন সময় লাগবে।

তা প্রায় ছ’মাস।

তবে আর দেরি নয়, আগামীকাল সকালে আপনি মধুকুঞ্জের কাজ শুরুর জন্য কত টাকা লাগবে চেক সই করিয়ে নিবেন।

জি ভাইজান।

কাল একটা সুন্দর দেখে টেবিল কিনবেন টিভির পার্শ্বে টেবিলটা রেখে তার উপর মধুকুঞ্জের মডেলটা রাখবেন।

জি ভাইজান ঠিক আছে।

মডেলটা আজ আমার টেবিলের উপর রাখুন।

রশিদ সাহেব মডেলটা টেবিলের উপর রেখে বের হয়ে গেলেন।

জামাল মডেলটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল এমন একটা বিল্ডিং হবে এ অঞ্চলের নজির। আমার অফিস, পলিটিক্স, এনজয় সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হবে মধুকুঞ্জ। বাইরে থাকবে সুন্দর ফুল বাগান আর বিলাসবহুল বাড়ি, অভ্যন্তরে থাকবে আমার বিরুদ্ধে যারা মাথা চাড়া দিবে তাদের জন্য টর্চার সেল। লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। বাংলোর  দ্বিতীয় তলায় আসবে নিত্য নতুন নারী, বিদেশী মদ। আমার জীবনটা হবে আনন্দের, মহা আনন্দের বলতে বলতে জামাল নিজের অজান্তে হো হো করে হেসে উঠল।

কিছুক্ষণ পর আমীর রুমে ঢুকলো।

জামাল জিজ্ঞেস করল, আমীর তোমার কি খবর?

ভাইজান মাল লাগবে।

কি ফেন্সি নাকি হেরোইন?

ভাইজান ফেন্সির প্রয়োজন হলে তো আমি নিজেই নিয়ে আসি।

কত তারিখে যেন হেরোইন নিয়ে আসার কথা?

আগামীকাল।

তুমি ঠিক সময়ে আমাকে বলেছ, টাকা সব দিয়েছ তো?

না ভাইজান বাকী টাকা নিন বলে আমীর কয়েকটা টাকার বান্ডিল দিল।

জামাল টাকাগুলো নিয়ে বলল, কতগুলো লাগবে?

এবার এক কেজি নিয়ে আসি।

চালাতে পারবে তো।

জি ভাইজান, বলে আমীর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ভাইজান যদি পারমিশন দেন তবে একটা কথা  বলি।

বল।

ভাইজান মাইক্রো বাসটা অনেক পরিচিত হয়ে গেছে, পুলিশ এমন কি আমার মনে হয় পাবলিকও জেনে ফেলেছে যে এই গাড়িতে ফেন্সি আনা-নেওয়া হয়। তাছাড়া গাড়িটাও পুরানা হয়ে গেছে।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, পুলিশ এবং সবাই জানলেও আমার কিছুই যায় আসে না। তবে পুরানা হয়ে গেছে একটা নতুন গাড়ি প্রয়োজন।

আমীর মৃদু হেসে বলল, জি ভাইজান।

আমীর আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

জি ভাইজান বলুন।

এবার একটা অ্যাম্বুলেন্স কিনলে কেমন হয়? সবাই জানবে রোগী নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স  যাচ্ছে আর ভিতরে থাকবে ফেন্সি। অন্যান্য দিন ভাড়া পেলে নিয়ে যাবে। আর মাঝে মাঝে গরীব দুঃখী রোগী পেলে ফ্রি সার্ভিস দিব তাতে এটা যে আমি মানুষের  সেবার জন্য করেছি সেটাও সবাই বুঝবে। তুমি কি বল?

আমীর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, জি ভাইজান খুব ভালো হবে।

আচ্ছা আমি ভেবে দেখি কিভাবে একটা অ্যাম্বুলেন্স কেনার ব্যবস্থা করতে পারি।

জি ভাইজান, বলে আমীর চলে যাওয়া মাত্র ড্রয়ারে রাখা মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

আগামীকাল মাল পাঠানোর কথা।

জি বড় ভাই ঠিক আছে।

টাকার নাম্বারটা লিখে নিন বলে অপর পাশ থেকে ভেসে আসা টাকার নম্বর লিখে নিল।

জামাল বলল, বড় ভাই সিস্টেম কি আগের মতোই।

হ্যাঁ আগের মতোই তবে গাড়ি পাঠানোর আগে গাড়ির নাম্বারটা আমাকে বলবে। তোমার গাড়ি রওয়ানা দিবে জাস্ট রাত ন’টায়। আর হ্যাঁ কতগুলো মাল লাগবে?

জি ভাই এক কেজি।

ও তাইতো, তুমি তো আগেও বলেছ, বলে জামাল মোবাইল রেখে দিল।

মোবাইল রেখে দিতেই টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলের রিং বেজে উঠল। জামালের কয়েকটা মোবাইল সিম কার্ড এবং একেকটা সিম একেক কাজে ব্যবহৃত হয় এবং শুধু সেই কাজের সঙ্গে জড়িতরাই সে নাম্বার জানে। কিন্তু সচরাচর জামাল যে নাম্বারটা ব্যবহার করে।

জামাল মোবাইল রিসিভ করে বলল, হ্যালো।

বস  আসসালামুআলায়কুম।

হ্যালো কে বলছেন?

বস আমি রহমত।

কি খবর বল?

বস আজকে একবার আসবেন?

জামাল মৃদু হেসে বলল, কেন ভালো আয়োজন আছে বুঝি?

জি বস, সেজন্য আপনাকে মোবাইল করেছি।

ঠিক আছে আমি আসছি, বলে জামাল মোবাইল রেখে দিয়ে অভ্যাসবশত: চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে রইল। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বাজে জামাল চেম্বার থেকে বেরিয়ে রিক্সায় চেপে রহমতের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

বাষট্টি

সারারাত অনন্যার কেটেছে বিছানায় ছটফট করতে করতে। জামালের ক্রমাগত নৈতিক অবনতি এবং নিজের প্রতি অবহেলায় অনন্যার নিজেকে অসহায় ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছিল। তবু কোনদিন অনন্যা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। কোনদিন  ফাহমিদা অনন্যার চোখে-মুখে মেঘের ছায়া দেখে কারণ জানতে চাইলে অনন্যা শুষ্ক হাসি হেসে এড়িয়ে গেছে।

কিন্তু গত রাতে জামাল বাসায় না ফেরার বিষয়টা জহির সাহেব ও ফাহমিদা কারো দৃষ্টি এড়াতে পারল না। সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই ফাহমিদা অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, বউমা জামাল রাতে বাসায় ফিরেনি?

অনন্যা কোন কথা না বলে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

ফাহমিদা আবার জিজ্ঞেস করলেন, বউমা তোমার সঙ্গে কি জামালের ঝগড়া হয়েছে?

না মা।

ফাহমিদা আর কোন কথা না বলে তার বেড রুমে চলে গেলেন। ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা জহির সাহেবের অনেক দিনের অভ্যাস। ফাহমিদা বিছানার কোণায় বসে জহির সাহেবকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, এই শুনছ।

বল।

জামাল আজ রাতেও বাসায় ফিরেনি।

জহির সাহেব কিছু বললেন না। কিন্তু ফাহমিদা বুঝতে পারলেন সামান্য রাগে জহির সাহেব ফেটে পড়েন আর অধিক রাগে গম্ভীর হয়ে যান। ফাহমিদা আর কিছু বললেন না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

জহির সাহেব ফাহ্‌মিদার একটা হাত ধরে বললেন, উঠলে কেন? বস।

ফাহমিদা বসলেন, জহির সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা ফাহমিদা আমার শ্যালিকা মানে ফারহানার তো কোন ছেলে-মেয়ে নাই, তাই না?

ফাহমিদা কিছু বললেন না।

ফাহমিদা মনে কর আমাদের যদি কোন ছেলে মেয়ে না থাকত তবে আমরা কি বাঁচতাম না?

ফাহমিদার দু’চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

জহির সাহেব বললেন, কাঁদবে না, ফাহমিদা কাঁদবে না। আমি জামালের ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিদ্ধান্তগুলো বেশ কঠিন এখনই যদি কেঁদে ফেল তবে আমার সিদ্ধান্ত জানার পর তো তুমি ভেঙ্গে পড়বে। তবে একটা কথা জেনে রেখো কর্তব্য কাজে নিষ্ঠুর হতে হয়। আমি আশা করি তুমি আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত হবে।

জামাল বাসায় ফিরল তখন সকাল আটটা বাজে তার চোখে-মুখে ক্লান্তি আর মুখে মদের গন্ধ শুঁকে অনন্যার পায়ের রক্ত মাথায় উঠল কিন্তু সে উত্তেজিত হলো না তার শান্ত নির্লিপ্ত মুখে ঘৃণার চিহ্ন ফুটে উঠল, রাতে কোথায় ছিলে?

সে কথা না জানলে হয় না?

না  হয় না, এটা জানা আমার জরুরী।

জামাল খুব সহজভাবে বলল, অনন্যা আমি রাজনীতি, ব্যবসা এসব কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

ব্যস্ত থাক না? সারারাত মদ আর মাগী নিয়ে ফুর্তি কর আর বল ব্যবসা আর রাজনীতিতে ব্যস্ত থাক। ওসব আর বলতে হবে না, আমার প্রতি তুমি যে অবিচার করছ আল্লাহ যেন  তোমার বিচার করেন, বলতে বলতে অনন্যার দু’চোখ পানিতে ভরে গেল।

জামাল ধমকের সুরে বলল, দেখ অনন্যা তুমি আমার স্ত্রী,  স্ত্রীর মতোই থাকবে, আমার কোন কাজে বাধা দিবে না। থাকতে পারলে থাক, না থাকতে পারলে চলে যাও একই কথা আর ক’বার বলব তোমাকে।

অনন্যা কান্নায়  ভেঙ্গে পড়ল, তুমি এ কথা আমাকে আগেও বলেছ আমাকে না রাখতে চাইলে বিদায় করে দাও।

জামাল উচ্চ স্বরে বলল, হ্যাঁ বিদায় করে দিব আর কোনদিন আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে তোমাকে আমি তালাক দিব।

ড্রয়িং রুম থেকে জহির সাহেব জোরে ডাক দিলেন, জামাল, বউমা তোমরা এদিকে এসো তো।

জামাল আর অনন্যা দু’জনে ড্রয়িং রুমে গেল।

জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বস।

জামাল, অনন্যা এবং ফাহমিদা সবাই জহির সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

জহির সাহেব গম্ভীরভাবে বলতে শুরু করলেন, আমি তোমাদের সবাইকে ডেকেছি কিছু কথা বলব বলে, তোমরা সবাই শুনবে, যাকে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলব শুধু সে প্রশ্নের উত্তর দিবে, কেউ কথার মাঝে কথা বলবে না, বলে জহির সাহেব জামালকে জিজ্ঞেস করলেন, জামাল রাতে কোথায় ছিলি?

জামাল মাথা নত করে চুপ করে বসে রইল। কোন কথা বলল না।

জহির সাহেব বললেন, তুই যেমন সুবোধ বালকের মতো বসে আছিস এটা তোর আসল চেহারা না। তোর আসল চেহারাটা ঠিক এর উল্টো। যা হোক তুই কোথায় থাকিস? কি করিস? এটা তদারকি করার একটা সময় ছিল এখন সে সময় নাই, তোর অনেক বয়স হয়েছে। শুধু তাই নয় তুই একজন জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা, জনসেবক, আরো অনেক বড় বড় পরিচিতি তোর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তোকে ছোটবেলা থেকে বড় করার স্বপ্ন দেখেছিলাম, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরির চেষ্টাও করেছিলাম। আমার সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, তুই ব্যবসা শুরু করলি তখন মনে হলো বড় ব্যবসায়ী হবি, প্রতিষ্ঠিত হবি, বড় রাজনীতিবিদ হবি। সবকিছুই হয়েছিস্‌ হয়ত তোর আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষার ভরাডুবি হয়েছে।

জামাল অস্ফুষ্ট স্বরে বলল, বাবা।

জামাল পৈত্রিক সূত্রে আমি যে সম্পত্তি পেয়েছি তার পরিমাণ কম নয় তবুও বেশি কিছু করতে পারিনি, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের অতিরিক্ত বলতে শুধু পেট্রোল পাম্পটা করতে পেরেছি আর তোকে আমি কয়েক বছর আগে মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছি তাতে তোর যা উন্নতি দেখেছি এটা কি করে সম্ভব?

বাবা ব্যবসায় লাক ফেইভার করলে আসলে ধনী হতে বেশি দিন সময় লাগে না।

জহির সাহেব ধমকের সুরে বললেন, চুপ আর একটা কথাও না। এডভান্স বিল দিতে অস্বীকার করায় সফিয়ার সাহেবকে স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়েছে কে?

ডিপার্টমেন্ট।

গোডাউনে তুষ ঢুকিয়ে  চাউলের উপর লোন নিয়ে ম্যানেজারকে ফাঁসিয়েছিস কেন?

জামাল কোন কিছু না বলে মাথা নত করে বসে রইল।

জহির সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, শহরের সোনার ছেলেরা মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে অকালে ঝরে পড়ছে, শুনেছি তুই নাকি শহরের একমাত্র মাদক ব্যবসায়ী।

জামাল এবারও কোন কথা বলল না চুপ করে বসে রইল।

কথা বলছিস না কেন? অবৈধ ব্যবসা করাকে লাক ফেইভার করা বলে না? তুই অন্যায়, অসত্য ও অবৈধভাবে টাকার পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিস। কিন্তু আমি বাবা হয়ে এটা মেনে নিতে পারিনা। তাই আমি একটা  সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ফাহমিদার বুক কেঁপে উঠল দীর্ঘদিনের সংসার জীবনে তিনি জহির সাহেবকে চিনেন। তিনি জীবনে কখনো কোন অন্যায় মেনে নেননি। তাঁর সহায় সম্পত্তির মধ্যে একটা টাকাও অবৈধ নয়। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা যে অত্যন্ত কঠোর হবে এটা তিনি জহির সাহেবের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছেন।

জহির সাহেব স্বাভাবিকভাবে বললেন, জামাল আমার এই পবিত্র ঘরে আমি অবৈধ টাকা তুলতে চাই না। তাই তুই এ মাসের মধ্যে বউমাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যাবি। আমিও আজ থেকে মনে করব আমার কোন ছেলে নাই।

জামাল অনড়ভাবে বসে রইল অনন্যার দু’চোখ জলে ছলছল করে উঠল, ফাহমিদা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিও না। জামাল আমার একমাত্র ছেলে, ভালো হোক, মন্দ হোক ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

অনন্যা কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, আমি কোথায় যাব বাবা?

বউমা তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে যাবে। তোমরা এখন যাও।

জামাল কোন কথা বলল না নীরবে চলে গেল, অনন্যা চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেল।

জহির সাহেব ফাহমিদার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, ফাহমিদা জামাল শুধু তোমার ছেলে না, ওকে বের করে দিতে আমারও হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে কিন্তু আমি আর পারছি না। শহরে মাদক ব্যবসা, ব্যাংক ম্যানেজারকে ফাঁসিয়ে দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা, ইঞ্জিনিয়ারকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে নতুন দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে বিল নিয়ে নিম্নমানের কাজ করা। আরো শুনলে তুমি অবাক হবে সে আনন্দ নগরে জমি কিনেছে সেখানে নাকি মধুকুঞ্জ তৈরি করবে। এমন একজন দুর্নীতিবাজ অমানুষের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই। তাই বাড়ি থেকে বের করে দিলাম। অনেকদিন থেকে সবাই আমাকে জামাল সম্পর্কে আজে-বাজে কথা বলতো আমি নিজের ছেলে সম্পর্কে সব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতাম। এখন কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব জামাল নামে আমার কোন  ছেলে নাই, বলতে বলতে জহির সাহেব নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

তেষট্টি

জামাল শহরে একটা দ্বিতল বাসা ভাড়া নিয়েছে। আগে যেখানে অফিস ছিল সেটা স্থানান্তর করে তার ভাড়া করা বাসার নীচতলায় অফিস এবং উপর তলায় বাসা হিসেবে ব্যবহার করছে। জামালের বাসায় ফেরার ব্যাপারে যে সামান্য শৃঙ্খলা ছিল নতুন বাসায় উঠার পর এখন সেটুকুও নাই। অনন্যা তার বাবার বাড়ি থেকে বাসার কাজ করার জন্য একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার বয়স দশ কিংবা বারো বছর। অনন্যার সঙ্গে তার বয়সের তফাৎ অনেক তাই তাকে দিয়ে শুধু কাজে সহযোগিতা ছাড়া মন খুলে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেওয়ার উপায় নাই। তাই সারাদিন অনন্যাকে বোবার মতো কাটিয়ে দিতে হয়। অনন্যা সারাদিন জামালের বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে কিন্তু কোনদিন জামাল ফিরে গভীর রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে, কোনদিন মুখে মদের গন্ধ আর শার্টে লিপস্টিক এর দাগ নিয়ে। তখন অনন্যার মাথায় রক্ত উঠে যায় কোনদিন অনেক কষ্টে রাগ সামলিয়ে নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, কোনদিন জামালের সঙ্গে দু’এক কথা বলতেই ঝগড়া বেঁধে যায়। তখন জামাল উচ্চ স্বরে বকাবকি করে কিংবা অনন্যার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করে না।

বরাবরের মতোই জামাল গভীর রাতে বাসায় ফিরল। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল।

অনন্যা বিছানার এক কোণায় বসে বলল, শোন তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

জামাল যেমনভাবে শুয়েছিল তেমনিভাবে বলল, বল।

আমি মা হতে চলছি, তুমি বাবা হতে চলছ।

তাই নাকি?

কেন তুমি খুশি হওনি?

জামাল হঠাৎ করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, খুশি হইনি মানে, আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমার কাছ থেকে এমন একটা উপহারই তো আমি আশা করেছিলাম বলে জামাল অনন্যাকে জড়িয়ে ধরল।

অনন্যার মনে হলো সে যেন আজ আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। জামাল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। সে মা হতে চলেছে আজ যেন তার জীবন সার্থক হলো। সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এমন সময় জামালের মোবাইল সেট একটা বিশেষ ধরণের শব্দে বেজে উঠল, জামাল মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে বলল, অনন্যা তুমি বিশ্রাম নাও। শুয়ে পড় আমি কথা বলা শেষ করে ঘুমাবো, বলে জামাল মোবাইল নিয়ে পাশের রুমে গেল।

অনন্যা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করল।

জামাল মোবাইল রিসিভ  করে বলল, হ্যালো।

হ্যালো তারপর পাসওয়ার্ড নাম্বার বলল।

জামাল তার নিজের পাসওয়ার্ড নাম্বার বলে বলল, জি বস বলুন?

আপনি কি জানেন? আপনার এলাকায় অন্য পার্টির মাল মার্কেট দখল করে নিচ্ছে।

না বস আমার এলাকায় অন্য কোন পার্টির মাল ঢুকছে না এখানে শুধু আমার রাজত্ব।

না জেনে কথা বলবেন না। আগে খবর নিয়ে দেখুন তারপর ব্যবস্থা নিন একটা কথা মনে রাখবেন, এই লাইনে না জেনে কোন কিছু বলতে হয় না। এক’শ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই বলতে হয়।

জি বস আমি দেখছি।

আগে সবকিছু দেখুন তারপর আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিন, সময় মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আপনি আপনার ব্যবসায় একক আধিপত্য বিস্তার করে আমাকে কনফার্ম করবেন বলে তিনি লাইন কেটে দিলেন।

মোবাইল অফ করার পর জামাল ভয় আর দুশ্চিন্তায় ঘামতে শুরু করল। জামালের আধিপত্যে অন্য কেউ ভাগ বসানোর সাহস পাবে এটা সে কোনদিন ভাবতেও পারেনি। অথচ ভদ্রলোক মোবাইলে যেভাবে বললেন, তাতে জামাল বুঝতে পারল তিনি নিশ্চিত হয়েই বলেছেন। কিন্তু আমার শহরের খবর আমি জানার আগে তিনি জানলেন কিভাবে? তাহলে আমার চেয়ে তাঁদের মনিটরিং অনেক বেশি। জামাল সঙ্গে সঙ্গে আমীরকে মোবাইল করল। প্রথমে কয়েকবার রিং হওয়ার পরও রিসিভ না হওয়ায় জামাল কিছুটা বিরক্ত হলো।

তারপর আমীর মোবাইল করল, ভাইজান এত রাতে আমাকে কি মনে করে স্মরণ করেছেন?

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, আচ্ছা আমীর শহরে কি আর কারো মাল ঢুকছে?

না তো ভাইজান।

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, দেখ আমীর আমি খবর পেয়েছি শহরে অন্য পার্টির মাল ঢুকছে, আমি জানতে চাই কার এত বড় সাহস আমার সাথে টেক্কা দেয়? তুমি কালকের মধ্যে খুঁজে বের করে আমাকে জানাবে।

ভাইজান কয়েকজন ফেন্সি কুইন আমার কাছ থেকে মাল নিচ্ছে না। আমাকে বলছিল তারা আর ব্যবসা করবে না, আমার মনে হয় তারা অন্য কোনভাবে মাল কালেকশন করছে।

তাহলে তাদের কাছে কাউকে মাল কেনার জন্য পাঠিয়ে দাও যদি তারা মাল দিতে পারে তবে বুঝবে অন্য কারো কাছ থেকে মাল নিচ্ছে আর যদি মাল দিতে না পারে তবে বুঝবে তথ্যটা ঠিক না।

জি ভাইজান বুঝতে পাচ্ছি আমি কালই আপনাকে জানাবো।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন রাখ, বলে জামাল মোবাইল অফ করে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করল। তারপর হিটলারের মোবাইলে রিং দিল।

ভাইজান এত রাতে?

হ্যাঁ শোন, শহরে অন্য পার্টির মাল ঢুকছে তুমি কি জানো?

না তো ভাইজান।

শোন কাল তুমি আর আমীর খোঁজ খবর নিয়ে আমাকে জানাবে কার এত বড় সাহস আমার এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায়?

জি ভাইজান।

জামাল কথা শেষ করে মোবাইল অফ করতেই অনন্যা দরজার আড়াল থেকে সরে আবার আগের মতো বিছানার কোণায় বসে রইল।

জামাল পাশের রুম থেকে বেড রুমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

অনন্যা জামালের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পেল না।

চুষট্টি

সারারাত আমীরের চোখে ঘুম নাই। জামালের মাদক ব্যবসার পুরোটাই নির্ভর করে তার উপর। শহরে অন্য পার্টির মাল ঢুকেছে এই খবরটা জামাল জানার আগেই তার জানা উচিত ছিল এবং জামালকে জানানো উচিত ছিল। জামাল আমীরকে খুব পছন্দ করে এবং বিশ্বাস করে এই প্রথম আমীরের নিজেকে জামালের কাছে অপরাধী মনে হলো। আমীর মনে মনে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করেই হোক আগামীকালের মধ্যে খুঁজে বের করে জামাল ভাইকে আমার দক্ষতা দেখাতে হবে।

আমীর বিছানা ছেড়ে উঠে তার খাতা বের করল। খাতায় তার কাছে শহরের সমস্ত ফেন্সি কুইন, ছো- দোকান আরো যে সব বাসায় মাল সাপ্লাই দিত তার লিস্ট বের করে দেখল মোট সাত জন কাস্টমর এখন তার কাছ থেকে মাল কিনে না। এখন দেখতে হবে তারা আদৌ ব্যবসা করছে কি না? আমীর মোবাইলের ঘড়িতে একবার সময় দেখে হিটলারকে মোবাইল করল, হ্যালো।

আমীর ভাই কি খবর?

আমীর বলল, জামাল ভাই আপনাকে মোবাইল করেছিল।

হ্যাঁ বস তো আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে। আপনি বলুন তো এখন কিভাবে এটা বের করা যায়?

আমীর বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

কি বুদ্ধি?

আমার কাছ থেকে সাতটা পার্টি একমাস থেকে মাল নিচ্ছে না এখন যদি তাদের কাছে মাল না পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে এবং অন্য পার্টির মাল আসছে না, আর যদি তাদের কাছে মাল পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে তারা অন্য পার্টির কাছ থেকে মাল নিচ্ছে।

আমীর ভাই আপনি শুধু যারা আপনার কাছ থেকে মাল নেয় না তাদের লিস্টটা দিবেন। তারপরের কাজ আমার, কার এত বড় সাহস এই শহরে আমাকে ট্যাক্স না দিয়ে ব্যবসা করে। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।

ঠিক আছে হিটলার ভাই আগামীকাল দেখা হবে বলে আমীর মোবাইল অফ করল।

পরদিন সন্ধ্যায় আমীর হিটলারের হাতে লিস্টটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে হিটলার তার কয়েকজন সহযোগীকে বলল, এই কান কাটা কামাল তুই যাবি ফেন্সি কুইন কোহিনুরের কাছে, বাই-া কাদের তুই যাবি ফেন্সি কুইন লাইলীর কাছে ফেন্সিডিল, হেরোইন আছে কি না? থাকলে এক পুরিয়া হেরোইন আর এক বোতল ফেন্সিডিল নিয়ে তাড়াতাড়ি আস্‌বি, বলে হিটলার বলল, আমীর ভাই আপনার আর কাজ নাই এখন সব দায়িত্ব আমার অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর আমি আপনাকে মোবাইল করব।

আচ্ছা হিটলার ভাই আমার আবার কালেকশন আছে, আমি আপনার মোবাইলের অপেক্ষায় রইলাম বলে আমীর চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে কানকাটা কামাল এবং বাই-া কাদের  এক পুরিয়া হেরোইন আর এক বোতল ফেন্সিডিল নিয়ে এলো।

হিটলারের ধারণা ছিল সবাই খালি হাতে ফিরে আসবে কিন্তু তাদের হাতে ফেন্সিডিল আর হেরোইন দেখে হিটলার প্রচণ্ড রেগে গেল, কামাল, কাদের আমার মোটর সাইকেলে উঠ। আর বসে থাকার সময় নাই, বলে হিটলার জোরে মোটর সাইকেল নিয়ে চলল ফেন্সি কুইন কোহিনুরের বাসায়।

হিটলারকে দেখে কোহিনুর চমকে উঠল, হিটলার ভাই আপনি?

মুহূর্তেই হিটলার মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড করে কোহিনুরের চুলের মুঠি ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, চুপ মাগী একটা কথাও বলবি না। মাল কার কাছে নিয়েছিস বল?

মোস্তাক ভাই’র কাছে।

কোন মোস্তাক।

চিনি না তবে তার সঙ্গে আর একজন আসে তাকে চিনি।

বল মাগী তোর ঐ ভাতারের নাম বল?

কালা মাহবুব।

তোর অন্য ভাতারের কাছ থেকে আর মাল নিবি।

কোহিনুর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, না ভাইজান আর অন্য কারো কাছ থেকে মাল নিব না।

মনে থাকে যেন বলে কোহিনুরকে ধাক্কা দিয়ে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল। কানকাটা কামাল ও বাই-া কাদের মোটর সাইকেলে উঠল।

কানকাটা কামাল জিজ্ঞেস করল, ওস্তাদ কোথায় যাবেন এখন?

কালা মাহবুবের আড্ডায়।

কয়েক মিনিটের মধ্যে হিটলার মোটর সাইকেল নিয়ে কালা মাহবুবের আড্ডায় হাজির হলো। কিন্তু তাকে না পেয়ে এক রকম পাগলা কুকুরের মতো শহরের বিভিন্ন ক্রাইম স্পটে হন্য হয়ে তাকে খুঁজতে লাগল। অবশেষে ফেন্সিকুইন লাইলীর বাসার দরজায় নক করতেই হিটলার কালা মাহবুবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। হিটলার ফিস ফিস করে কি যেন বলল তারপর দরজা নক করল।

কামাল, হিটলার ও কাদের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।

লাইলী ভিতর থেকে বলল, দেখ তো কে এলো?

তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটা ছেলে দরজা খুলে দিতেই কামাল তার মুখ চেপে ধরে  কানে  ফিস ফিস করে বলল, বেটা তোর খালা আম্মাকে ডাক।

ছেলেটা খালা আম্মা বলে ডাক দিতেই লাইলী বেরিয়ে এলো, কাদের লাইলীর মুখ চেপে ধরে কানে ফিস ফিস করে বলল, চেঁচামেচি করলে ফুটা করে ফেলব। কালা মাহবুবকে ডাক মাগী, হারামজাদী।

লাইলীর মুখ ছেড়ে দিতেই লাইলী ডাক দিল মাহাবুব একটু বাইরে এসো তো।

মাহবুব বের হয়ে দরজায় আসা মাত্র হিটলার কালা মাহবুবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গলা চেপে ধরে বলল, একটা কথা বললে মাথার খুলি উড়ে যাবে, বেটা মাগীর বাচ্চা আজ তোকে সাইজ করে ফেলব। কামাল বাঁধ শালাকে।

কামাল এবং কাদের কালা মাহবুবকে রশি দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে দিল।

হিটলার লাইলীকে বলল, মাগী একটা কথা বলবি না, যদি একবিন্দু চালাকি করিস তবে বুঝতেই পাচ্ছিস, জানে বাঁচবি না।

তারপর হিটলার মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল। হিটলারের পিছনে কামাল তার পিছনে কালা মাহবুবব এবং সবার পিছনে কাদেরকে নিয়ে হিটলার ছুটে চলল।

শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা বিশাল পুকুর তার চার পার্শ্বে উঁচু পাড়ে কবরস্থান। আমাবস্যার রাত, গাঢ় অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ পোকা অবিরত ডেকেই চলছে। রাতের বেলা তো দূরের কথা দিনের বেলাতেও অনেকেই ভয়ে এই কবরস্থানে আসে না। তাছাড়া এই পুকুর, কবরস্থান আর পাড়ে দাঁড়ান বিশাল আকৃতির বটগাছকে নিয়ে অনেক ভীতিকর কাহিনী আছে। তাই দিনের বেলাতেও পুকুর পাড়ে যেতে বা পুকুরের পানি স্পর্শ করতে অনেকের গা শিউরে উঠে। এই কবরস্থানকেই হিটলারের টর্চার সেল বলা যায়। হিটলার মোটর সাইকেল নিয়ে কবরস্থানে এলো।

মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে সবাই মোটর সাইকেল থেকে নেমে হিটলার বলল, কামাল  এই হারামজাদার মুখের টেপটা খুলে দে।

কামাল মুখের টেপ খুলে  দিতেই হিটলার কালা মাহবুবের দু’গালে সজোরে দু’ধাপ্পড় মেরে বলল, বল এই বেটা হারামজাদা তোর বাপ কে?

কালা মাহবুব কিছু বলল না।

হিটলার আরো দু’থাপ্পড় দিয়ে বলল, বুঝিসনি  না? তোর বস কে? কার শক্তিতে তুই আমার সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছিস?

কালা মাহবুব তবুও কিছু বলল না।

হিটলার কালা মাহবুবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, আমি এক থেকে তিন গুনবো এর মধ্যে যদি তুই কার মাল বেচিস না বলিস তবে তোর জন্য একটা গুলি খরচ করব, এক।

কালা মাহবুব কান্না জড়িত কণ্ঠে কাঁপা স্বরে বলল, মোস্তাক ভাই’র।

মোস্তাক কে?

ইসতিয়াক ভাই’র ম্যানেজার।

তারমানে জন দরদী পার্টির ইসতিয়াক?

জি।

থাম বস এর কাছে জেনে নিই বলে হিটলার জামালের মোবাইলে রিং করে বলল, বস জন দরদী পার্টির ইশতিয়াকের মাল।

কিভাবে জানলে?

কালা মাহবুবকে ধরে এনেছি এই শালাই তো আমার উপর টেক্কা দিচ্ছিল।

আচ্ছা আমি দেখছি।

বস কালা মাহবুবকে কি করব?

ওকে ট্রান্সফার করে দাও। এসব কাজে সাক্ষী রাখতে হয় না।

ওকে বস  বলে হিটলার মোবাইল অফ করে বলল, কামাল ওর মুখে টেপ লাগা।

কামাল কালা মাহবুবের মুখে টেপ লাগাল তারপর একটা ভাঙ্গা কবরে কালা মাহবুবকে ফেলে দিয়ে হিটলার তার মাথায় কয়েক রাউন্ড গুলি করল।

পঁয়ষট্টি

কালা মাহবুব তার বাপ-মা’র একমাত্র সন্তান কিন্তু অসৎ সঙ্গের কারণে সে নষ্ট হয়ে গেছে। ইতোপূর্বে কোথাও গেলে মাকে বলে যেত আবার দুয়েকদিন পর ফিরে আসতো এবার যাওয়ার বেশ কয়েকদিন হলেও সে ফিরে না আসায় তার মা শয্যাশায়ী হলো, সন্তান সন্ত্রাসী হলেও মায়ের কাছে তার আদরের কমতি নাই, মায়ের চোখে প্রত্যেক সন্তানই নিষ্পাপ। কালা মাহবুবের বাবা মিরাজ সাহেব সম্ভাব্য সকল স্থানে হন্যে হয়ে খুঁজলেন। কিন্তু কোথাও মাহবুবের হদিস না পেয়ে কয়েকদিন পর থানায় একটা জিডি করলেন।

লাশ দাফন করতে গিয়ে লাশের পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় লোকজন খোঁজাখুঁজি করে একটা ভাঙ্গা কবরে লাশ দেখতে পেয়ে থানায় খবর দিল। পুলিশ ভাঙ্গা কবর থেকে লাশ তুলে প্রথমে জিডির সূত্র ধরে মাহবুবের বাপ-মাকে লাশ সনাক্ত করার জন্য বললে মাহবুবের মা লাশ সনাক্ত করল। পুলিশ লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে মাহবুবের বাবাকে থানায় ডেকে পাঠালো।

পুলিশ কালা মাহবুব খুন হওয়ার বিষয় নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু কে কি কারণে তাকে খুন করেছে তার কোন ক্লু খুঁজে পেল না।

ওসি সাহেব কালা মাহবুবের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? কারো সঙ্গে তার পূর্ব শত্রুতার জের ধরে খুন হতে পারে বা কারো সাথে তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বিরোধ থাকতে পারে অথবা তাকে হত্যা করে কে লাভবান হতে পারে এমন কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?

মিরাজ সাহেব কোন কিছু না বলে নীরবে বসে রইলেন।

ওসি সাহেব বললেন, তাহলে আপাতত একটা ইউ.ডি.এ মামলা করুন । আমরা প্রকৃত আসামীকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করব।

এমন সময় জামাল ওসি সাহেবের চেম্বারে ঢুকলো।

ওসি সাহেব দাঁড়িয়ে জামালকে সালাম দিলেন।

বসুন ওসি সাহেব বসুন আমি আপনার কথা শুনেছি এমন একটা হত্যাকাণ্ডের দৃস্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া দরকার, বলে জামাল কালা মাহবুবের বাবাকে দেখে একরকম চমকে উঠল, চাচা আপনি? এত সুন্দর ছেলেটাকে নৃশংসভাবে খুন করল কে? বলতে বলতে জামাল কৃত্রিমভাবে চোখের পানি মুছার ভান করে বলল, চাচা আপনার কাউকে সন্দেহ হলে নাম বলুন আমি ওসি সাহেবকে বলছি এক্ষণই তাকে এরেস্ট করতে, তারপর রিমান্ডে নিলে সবকিছু  বেরিয়ে আসবে।

মিরাজ সাহেবের দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, বাবা আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

চাচা আপনি মনটাকে শক্ত করুন অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক না কেন আপনি কোন ভয় করবেন না।

মিরাজ সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুমি দেখ বাবা অপরাধীরা যেন কোনভাবে পার না পায় সে ব্যবস্থা কর। আমি যাই, বলে মিরাজ সাহেব চলে গেলেন।

জামাল ওসি সাহেবকে বললেন, কালা মাহবুব হত্যার কোন ক্লু খুঁজে পেলেন?

কালা মাহাবুব একজন পেশাদার সন্ত্রাসী সে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এরই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিংবা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কালা মাহবুব খুন হতে পারে। আমরা বিষয়টা দেখছি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না জামাল ভাই।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, আপনি বললেই তো আর চিন্তা না করে থাকতে পারি না, কারণ আইন শৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক, সরকারের সঙ্গে পাওয়ার পার্টির সম্পর্ক। পাওয়ার পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হোক এটা যেন কোনভাবেই  না হয় সেটা দেখা আমার দায়িত্ব। আপনি বরং প্রথমে কালা মাহবুবের কয়েকজন সহযোগীকে এরেস্ট করে রিমান্ডে নিন, কোথায় কোথায় তার যাতায়াত ছিল? কার সঙ্গে ওঠা-বসা ছিল সব পেয়ে গেলেই তো ক্লু পেয়ে যাবেন।

ওসি সাহেব বিনয়ের সাথে বললেন, জি জামাল ভাই।

আর হ্যাঁ খুব সাবধান আগের ওসি সাহেবের অবস্থার কথাটা একবার ভেবে দেখবেন। অসৎ উদ্দেশ্যে আমাদের দলের এক কর্মীকে এরেস্ট করার জন্য তাকে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার করা হয়েছে। কাজেই উল্টা-পাল্টা কাউকে এরেস্ট করলে বুঝতেই পাচ্ছেন আপনার চাকরির গোড়ায় পনি ঢালা লাগবে।

ওসি সাহেব আবারো বললেন, জি জামাল ভাই বুঝতে পাচ্ছি।

হ্যাঁ মনে থাকে যেন, বলে জামাল বেরিয়ে গেলে। ওসি সাহেব কলিং বেল এ টিপ দিতেই একজন পুলিশ কনস্টেবল এসে স্যালুট দিল, স্যার।

সেকেন্ড অফিসার সাহেবকে আমার সালাম দাও।

ওসি সাহেবের টেলিফোনের রিং বেজে উঠল। ওসি সাহেব টেলিফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে এস.পি সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওসি সাহেব।

ওসি সাহেব দাঁড়িয়ে স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার

কালা মাহবুব হত্যাকাণ্ডের কোন ক্লু খুঁজে পেয়েছেন?

জি স্যার।

কি বলুন তো?

          স্যার কালা মাহবুবকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তারমানে তাকে কোন প্রফেশনাল কিলার খুন করেছে।

হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিক আছে শহরের এ্যানলিস্টেড ক্রিমিনালদের গতিবিধি লক্ষ্য করুন। কোন ক্রিমিনাল যেন পালাতে না পারে তাদের উপর নজরদারি বাড়ান। মন্ত্রী টেলিফোনে বার বার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। দ্রুত অ্যাকচুয়াল আসামী গ্রেফতারের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

জি স্যার আমি-

হ্যাঁ মনে রাখবেন দ্রুত আসামী এরেস্ট করতে না পারলে আমি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।

স্যার, আমি দেখছি, বলে ওসি সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর সমস্ত শরীর ঘামতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন।

সেকেন্ড অফিসার হারেস সাহেব স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার।

বসুন হারেস সাহেব কালা মাহবুবের খুনিদের না ধরা পর্যন্ত শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না বলে তিনি তাঁর ড্রয়ার থেকে ছবিসহ একটা সন্ত্রাসীদের তালিকা বের করে বললেন, এই দেখুন হারেস সাহেব, এই দেখুন বলে ক্রিমিনাল লিস্ট দেখালেন, আমি বলছি কালা মাহবুবের সহযোগীদের নাম আগে লিখুন, গি-ু সেলিম, লম্বু নাসির, পিচ্চি রাব্বী এদের ধরার জন্য এখনি ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।

হারেস সাহেব বললেন, স্যার কালা মাহবুবকে তার সহযোগীরা খুন করবে কেন? আমার মনে হয় আমাদের কালা মাহবুবের  অপজিশন ক্রিমিনালদেরও এরেস্ট করা উচিত।

ওসি সাহেব প্রচণ্ড রেগে গেলেন, কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত সেটা আপনি আমার চেয়ারে বসলে বুঝতে পারতেন।

জি স্যার, বলে হারেস সাহেব স্যালুট দিয়ে চলে গেলেন।

ওসি সাহেব ওয়ারল্যাস সেট নিয়ে বিড়বিড় করে বিভিন্ন স্থানে ডিউটিরত পুলিশ অফিসারদের ম্যাসেজ পাঠাতে লাগলেন।

ছেষট্টি

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ কালা মাহবুবের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এলো কালা মাহবুবের সঙ্গে মাদক ব্যবসার সংশ্লিষ্টতার কথা। কালা মাহবুবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী লম্বু নাসির জিজ্ঞাসাবাদে প্রসঙ্গ এড়াতে এবং চতুরতায় বেশি দক্ষ তার মুখ থেকে কথা বের করা পুলিশের পক্ষে বেশ কঠিন হলো। অথচ কালা মাহবুবের যে কোন বিষয় জানতে লম্বু নাসিরের মুখ থেকে কথা বের করা একান্ত প্রয়োজন।

ওসি সাহেব লম্বু নাসিরকে হাজতখানা থেকে একটা কক্ষে নিয়ে একটা টুলে বসতে দিলেন। তাঁর সঙ্গে আরো তিনজন কনস্টেবল, পাশে লম্বু নাসিরের বক্তব্য রেকর্ডের জন্য একটা টেপ রেকর্ডার রাখা আছে। ওসি সাহেব লম্বু নাসিরের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন। লম্বু নাসিরের চোখে-মুখে আতংক আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওসি সাহেবের হাতে একটা লাঠি ছিল সেটা লম্বু নাসিরের থুতনিতে দিয়ে উঁচু করে গম্ভীর স্বরে বললেন, লম্বু কালা মাহবুবকে কে মেরেছে?

লম্বু নাসির বলল, আমি জানি না স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না।

তবে কে জানে?

আমি জানি না স্যার।

লম্বু তুই সব জানিস সহজভাবে বলবি না, বলে ওসি সাহেব লম্বু নাসিরকে লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে মারতে লাগলেন।

লম্বু নাসির কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, স্যার বলছি স্যার।

ওসি সাহেব থামলেন, বল।

ওস্তাদ আমাকে বলল, লম্বু আমি আজ একবার মার্কেটটা ঘুরে দেখব, তুই রাত দশটায় আমার সঙ্গে দেখা করবি। আমি রাত দশটায় ওস্তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে দেখা পাইনি তারপর আর দেখাই করতে পারিনি।

কিসের মার্কেট?

ফেন্সিডিল, হেরোইনের মার্কেট।

ওসি সাহেব কিছুটা অবাক হলেন, ফেন্সিডিল, হেরোইনের মার্কেট!

লম্বু নাসির কোন কথা বলল না।

ওসি সাহেব বললেন, বল বেটা কালা মাহবুব কোথায় হেরোইন পেত? সে নিজে ব্যবসা করত নাকি কারো হেরোইনের ব্যবসা দেখাশুনা করত?

ওস্তাদ মোস্তাকের হেরোইনের ব্যবসাকে শেল্টার দিত।

মোস্তাক কে?

আমি চিনি না।

স্যান্ট্রি এই বেটার হাত দু’টা পিছনে বাঁধ মুখে টেপ লাগাও, সোজা কথায় কাজ হবে না।

ওসি সাহেবের কথা মতো দু’জন কনস্টেবল নাসিরের হাত দু’টো পিছনে করে হ্যান্ড কাপ লাগিয়ে দিল এবং মুখে টেপ লাগিয়ে দিল।

ওসি সাহেব এলোপাতাড়িভাবে লম্বু নাসিরকে মারতে লাগলেন, মুখে টেপ লাগানো থাকায় নাসির কিছু বলতে পারল না। তার চিৎকার ধ্বনি চোখে-মুখে ফুটে উঠল। ওসি সাহেব নিজে মুখের টেপ খুলে দিয়ে বললেন, বল বেটা মোস্তাক কে?

স্যার আমি চিনি না।

মোস্তাক কার কার কাছে মাল পৌঁছে দিত।

স্যার আমি জানিনা।

ওসি সাহেব লম্বু নাসিরের পায়ের গিটে কয়েকবার লাঠির আঘাত করে বললেন, তুই সব জানিস যখন আরো পেঁদানি পড়বে তখন ঠিকই বলবি।

লম্বু নাসির কিছু বলল না, নীরবে মাথা নত করে বসে রইল।

ওসি সাহেব আবার লম্বু নাসিরের পায়ের গিটে কয়েকবার লাঠির আঘাত করতেই লম্বু নাসির বলল, ফেন্সি কুইন কোহিনুর, ফেন্সিকুইন লাইলী, ফেন্সি কুইন রহিমা আরো বিভিন্ন স্পটে।

তুই দেখিয়ে দিতে পারবি?

নাসির কোন কথা বলল না।

ওসি সাহেব বললেন, স্যান্ট্রি হারেস সাহেবকে আমার সালাম দাও।

একজন কনস্টেবল রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে হারেস সাহেবসহ রুমে প্রবেশ করলেন।

ওসি সাহেব দাঁত কড়মড় করে বললেন, হারেস সাহেব ওদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলেন?

না স্যার ওরা মনে হয় কালা মাহবুবের তেমন ঘনিষ্ঠ না।

ঠিক আছে আপনি এই ক্রিমিনালটাকে নিয়ে যান ফেন্সি কুইন কোহিনুর, ফেন্সি কুইন লাইলী আর ফেন্সি কুইন রহিমাকে নিয়ে আসুন, বলে ওসি সাহেব তাঁর চেম্বারে গিয়ে বসলেন।

ওসি সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কালা মাহবুব হত্যাকাণ্ড, লম্বু নাসিরের বক্তব্য আর ফেন্সি কুইনদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।

এমন সময় টেলিফোনের রিং বেজে উঠল।

ওসি সাহেব চমকে উঠে টেলিফোন রিসিভ  করলেন, হ্যালো।

ওসি সাহেব কতদূর এগিয়েছেন?

স্যার আমি আগামীকাল সকালে আপনার কাছে রিপোর্ট করব।

আচ্ছা ঠিক আছে একটা কথা মনে রাখবেন এই কেসটার উপর আপনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

জি স্যার।

তারপর ওসি সাহেব টেলিফোনের রিসিভার রেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর সমস্ত শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। এভাবেই চেয়ারে বসে তাঁর কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। তাঁর দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। এমন সময় থানার সামনে পিক আপ এসে দাঁড়াল। হারেস সাহেব ফেন্সি কুইনদের হাজতে ঢুকিয়ে এবং লম্বু নাসিরকে পুরুষ হাজতে ঢুকিয়ে রেখে ওসি সাহেবের সামনে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালেন, স্যার।

ইউ আর সাকসেসফুল?

ইয়েস স্যার।

ওসি সাহেব গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য বেরিয়ে এলো তাতে কালা মাহবুব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত খুনি চিহ্নিত হলো না। কালা মাহবুবকে হিটলার ধরে নিয়ে গেছে ফেন্সি কুইন লাইলীর বাসা থেকে তারপর কালা মাহবুবের সঙ্গে আর কারো কথা হয়নি। এখন হিটলারকে ধরতে পারলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। হিটলার জামালের ক্যাডার তাকে ধরা ঠিক হবে কি না এ নিয়ে ওসি সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন তারপর ফোর্স পাঠালেন হিটলারকে ধরার জন্য। কিন্তু হিটলারকে ধরার খবর পুলিশ পৌঁছার আগেই হিটলার জেনে ফেলেছে হিটলারও সে খবর জানিয়েছে জামালকে।

হিটলারকে ধরার জন্য ফোর্স পাঠিয়ে ওসি সাহেব চেয়ারে বসে ছিলেন তাঁকে ক্লান্ত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি যে কঠিন পরীক্ষায় পড়েছেন এবং তাঁর এ পরীক্ষায় সফল হওয়া যে সহজ হবে না সে কথাও তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন মাদক ব্যবসার প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে কালা মাহবুবকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু হিটলারকে ধরা কিংবা ধরে রাখা সহজ কাজ না। এমনভাবে ওসি সাহেবের মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক করছিল।  আবার টেলিফোনের রিং বেজে উঠল।

ওসি সাহেব টেলিফোন রিসিভ করে বললেন, হ্যালো।

অপর পাশ থেকে জামালের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ওসি সাহেব আপনি নাকি হিটলারকে এরেস্ট করতে যাচ্ছেন?

জি জামাল ভাই।

আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন কালা মাহবুব হত্যার সঙ্গে হিটলার জড়িত?

জিজ্ঞাসাবাদে হিটলারের নাম বেরিয়ে এসেছে। হিটলার মাহবুবকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে আর কেউ দেখেনি কারো সঙ্গে তার কথাও হয়নি। কাজেই মাহবুব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হিটলারের সম্পৃক্ত থাকার নানাবিধ কারণ আছে। এখন হিটলারকে ধরতে পারলেই কালা মাহবুব হত্যার প্রকৃত খুনিদের সনাক্ত করা যাবে।

দেখুন আপনাকে আগেই বলেছিলাম যা করবেন ভেবেচিন্তে করবেন। এখন বলছেন হিটলারকে এরেস্ট করবেন। কিন্তু হিটলারকে এরেস্ট করার পরও যদি কালা মাহবুব হত্যার ক্লু খুঁজে না পান তখন আবার কাকে এরেস্ট করবেন?

সাতষট্টি

কালা মাহাবুব হত্যাকাণ্ড মামলা ধামাচাপা পড়ে গেছে এবং মাদক ব্যবসায় জামালের একক আধিপত্য অটুট রয়েছে। জামালের ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে কয়েক মাসে জামালের মধুকুঞ্জ তৈরির কাজও অনেক দূর এগিয়েছে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জামাল কিছুটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছে। জামাল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে তার দূরত্ব ক্রমাগতই বাড়ছিল শেষ পর্যন্ত বেলায়েত সাহেব বিষয়টা মন্ত্রী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা সাহেবকে অবহিত করায় তিনি দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল রোধ করার জন্য দু’জনকে তাঁর বাসায় নিয়ে বসলেন। মাননীয় মন্ত্রী প্রথমে বেলায়েত সাহেব কে জিজ্ঞেস করলেন, বেলায়েত বল তো কি হয়েছে?

বড় ভাই আপনি ইলেকশনে জিতার পর থেকে জামাল ব্যবসা বাণিজ্য, বিভিন্ন সংগঠনসহ যাবতীয় নেতৃত্ব তার হস্তগত করার চেষ্টা করছে, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ঠিকাদারি কাজসহ সব ডিপার্টমেন্টের উপর চাপ প্রয়োগ করে সব ক্ষমতা একাই কুক্ষিগত করছে। সে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেনারেল সেক্রেটারি, মোটর মালিক সমিতির সভাপতি। মোটর মালিক সমিতির নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তখন সে আমাকে কথা দিয়েছে এর পরবর্তী যে কোন নির্বাচনে সে অংশ গ্রহণ করবে না। সামনে চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাচন তারপর পৌরসভার নির্বাচন এখন শুনছি সে চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তারপর পৌরসভার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। তারমানে দিনে দিনে জেলার রাজনীতিতে একক আধিপত্য বজায় রাখতে চাচ্ছে। আমি আজ পনেরো বছর থেকে দলের জন্য কাজ করছি, কয়েকবার জেল-হাজত পর্যন্ত খেটেছি দলে আমার অবদান আপনার অজানা নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি কি পেলাম? দলে প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ নেতারা আজ কোণঠাসা। নতুন এবং  স্বার্থান্বেষী তরুণরাই আজ দলের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল জনগণের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা হারাবে নির্বাচনে দলের ভরাডুবি হবে। কাজেই দলকে শক্তিশালী করা এবং ঐক্য ধরে রাখতে হলে দলের সকল ক্ষমতা বা নেতৃত্বের বণ্টন থাকতে হবে, বলতে বলতে বেলায়েত সাহেব আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লেন।

মাননীয় মন্ত্রী বেলায়েত সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বেলায়েত আমি তোমার ক্ষোভের কথা শুনলাম, দলে তোমার কন্ট্রিবিউশন অনেক, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আমার সঙ্গে তুমিও অনেক হয়রানীর শিকার হয়েছ। আসলে এদিকে আরো আগে আমার মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল, বলে তিনি জামালকে বললেন, জামাল রাজনীতির ক্ষেত্রেও অনেক শেখার আছে তুমি অল্প বয়সে রাজনীতিতে অনেকদূর এগিয়েছ তারপরও অভিজ্ঞতার অবশ্যই গুরুত্ব আছে। আমি পিছনের কথা তুলতে চাই না তবে সামনে দু’টা নির্বাচন একটা চেম্বার অফ কমার্স অপরটা পৌরসভা। এতদিন আমি তোমাকে পৌরসভার নির্বাচনে প্রতিন্দন্দ্বিতা করার জন্য বলছিলাম এখন বলছি তুমি যদি চেম্বার অফ কমাসের্র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কর তবে পৌরসভা নির্বাচনে বেলায়েত অংশগ্রহণ করবে, তোমাকে যে কোন একটা ছাড় দিতে হবে।

বেলায়েত সাহেব আপত্তি করে বললেন, বড় ভাই আমি অনেক ছাড় দিয়েছি কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনে আমি ছাড় দিতে রাজি নই। আমি জয়ী হই আর হেরেই যাই আমি পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।

জামাল আড় চোখে একবার বেলায়েত সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে বসে রইল।

মাননীয় মন্ত্রী একবার জামাল ও বেলায়েত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন দু’জনে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত মনে করে তিনি বললেন, আচ্ছা চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাচন কবে?

জামাল বলল, আর দু’মাস পর।

আর পৌরসভার?

আরো দু’বছর পর।

আচ্ছা ঠিক আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরো অনেক সময় আছে তোমরা দু’জনে বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও। তবে আজ তোমাদের একটা কথা দিতে হবে।

দু’জনে মাননীয় মন্ত্রীর দিকে তাকাল।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, তোমরা আজ আমাকে কথা দাও নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করবে না। বেলায়েত, জামাল আমাদের জুনিয়র কিন্তু জুনিয়র হলেও অল্প দিনে রাজনীতিতে সে বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে। আমাদের উচিত জামালকে স্নেহ করা এবং তার দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা। আর জামাল তুমি দলের জেনারেল সেক্রেটারি হলেই যে সিনিয়রদের উপেক্ষা করবে, অসম্মান করবে এটা হতে পারে না বলে তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, জামাল এখন থেকে বড়দের সম্মান করবে বেলায়েত তোমাকেও বলছি দলে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। চল এখন বিল্ডিংয়ের শুভ উদ্বোধন করে আসি, বলে জামাল বেলায়েতসহ মাননীয় মন্ত্রী বাসা থেকে বের হলেন।

ততক্ষণে স্কুলের মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। সবাই তাদের প্রিয় নেতা এবং মাননীয় মন্ত্রীর কণ্ঠের বক্তৃতা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। মাননীয় মন্ত্রীর গাড়ি দেখে মাইকে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, মাননীয় মন্ত্রীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।

মাননীয় মন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চের দিকে রওয়ানা হলেন। মাননীয় মন্ত্রীর গাড়ি থেকে মঞ্চ পর্যন্ত দু’পাশে স্কুলের ছাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়ে মাননীয় মন্ত্রীকে স্বাগত জানাল। তিনি মঞ্চে গিয়ে উঠলেন। সামনের সারিতে মাননীয় মন্ত্রী জামাল, শাকিল বসল। পিছনের সারিতে কয়েকজন প্রবীণ নেতা ও মাননীয় মন্ত্রীর সেক্রেটারি আশরাফ সাহেব বসলেন। মিটিং শুরু হলো শুরুতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বক্তৃতা দিতে শুরু করল। মিটিং চলাকালীন সময়ে এলাকার বিভিন্ন জনগণ তাদের বিভিন্ন রকমের সমস্যা, কেউবা প্রতিষ্ঠানের অনুদান কেউবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রকল্প ভুক্ত করার জন্য মঞ্চের নীচ থেকে উপরের দিকে দরখাস্ত তুলে ধরছেন। মাননীয় মন্ত্রী আবেদন পত্র গ্রহণ করে আবেদন পত্রের উপর নির্দেশ উল্লেখ করে পিছনের সারিতে বসা আশরাফ সাহেবের কাছে দিচ্ছেন।

          অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে জামাল বক্তৃতা দেয়া শুরু করল। আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় মন্ত্রী, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের সকল নেতাকর্মী, স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আমার প্রাণপ্রিয় এলাকাবাসী আস্‌সালামুআলায়কুম। আজ আমাদের জন্য একটা আনন্দের দিন, এই স্কুলে কয়েকমাস আগেও সব ছাত্র-ছাত্রীরা একটা ভাঙ্গা টিনের ঘরে তীব্র গরমে এক অসহনীয় পরিবেশে লেখাপড়া করত। লেখাপড়ার পরিবেশ উন্নত না হলে লেখাপড়ার মান উন্নত হয় না। একথা বুঝতে পেরে মাননীয় মন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকা বিল্ডিং নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন এবং কয়েকটা কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই তাঁর এই শুভ উদ্যোগের জন্য। শুধু স্কুল কলেজে বিল্ডিং নির্মাণ নয়, মাননীয় মন্ত্রী রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ এলাকার ব্যাপক উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা দেখেছেন গত কয়েক বছর যাবত আমাদের এলাকার যা উন্নতি হয়নি গত দু’বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নতি হয়েছে। এটা হয়েছে শুধু আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং মাননীয় মন্ত্রীর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে এবং আপনারা অনেকক্ষণ যাবত মাননীয় মন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার জন্য অপেক্ষায় আছেন তাই সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করছি।

জামালের বক্তৃতার পর পরই মাননীয় মন্ত্রী বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন তিনিও তাঁর বক্তৃতায় সবাইকে সালাম জানিয়ে বলতে শুরু করলেন, আপনাদের অনেকের হয়ত মনে আছে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে এই মাঠে দাঁড়িয়ে আমি পাকা বিল্ডিং নির্মাণের ব্যবস্থা করব বলেছিলাম। আপনাদের ভোটে আমি এম.পি নির্বাচিত হয়েছি এবং অবহেলিত এলাকা হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন, শুধু তাই নয় আমি এই জেলার ডিসট্রিক্ট মিনিস্টার। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী  আমাকে জেলার সমস্ত উন্নয়ন দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা দেখেছেন আমাদের দেশ পরিচালনা শুরু করার মাত্র দু’বছর হয়েছে। এই দু’বছরে দেশে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দেশে দারিদ্রের হার কমেছে। মানুষের হাতে কাজ আছে, পকেটে টাকা আছে। কয়েক বছর আগে দেশে দারিদ্রের যে চিত্র দেখা যেত আজ আর সে রকম চিত্র দেখা যায় না। যেসব রাস্তায় বর্ষাকালে যাতায়াত করা যেত না সেগুলো রাস্তা পাকা করা হয়েছে। যেসব স্কুলে কাঁচা ঘর ছিল পর্যায়ক্রমে সে সব স্কুলে পাকা বিল্ডিং নির্মাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয় দেশে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা পেলে উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আপনারা জানেন উন্নয়নের এ ধারা ব্যাহত করার জন্য একটা চিহ্নিত গোষ্ঠী সর্বদাই তৎপর রয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আপনারা সচেতন থাকবেন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের সঙ্গে থাকবেন। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াবো। আপনারা সবাই জানেন গত দু’বছরে আপনাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমার কাছে এসেছেন আর আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার দরজা আপনাদের জন্য সব সময় খোলা থাকবে। এমনসময় হাত তালি দিয়ে সবাই তাঁর বক্তব্যকে স্বাগত জানালেন।

মাননীয় মন্ত্রী আবার বলতে শুরু করলেন। আজ আমি বলছি আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন আমরা যদি আবার আপনাদের সেবা করার সুযোগ পাই তবে এই স্কুলের পাশে একটা কলেজ স্থাপন করব। আপনাদের ছেলে-মেয়েদের যেন আর দূর-দূরান্তের কলেজে লেখাপড়া করতে যেতে না হয়। এই বলে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

সমবেত জনতা শ্লোগান দিল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল, জিন্দাবাদ।

আটষট্টি

এতদিন সন্তান গর্ভে ধারণ করে অনন্যা আজকের এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার মনের মধ্যে সব সময় একটা ফুটফুটে সন্তানের ছবি ভেসে উঠছিল। অনন্যা কেবলই ভাবত তার মাতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করছে। আজ সেই দিন সেই মুহূর্ত যখন এলো তখন তার আর আনন্দের সীমা রইল না। পুত্র সন্তানের মুখ দেখেই সে যেন আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করল মনে মনে ভাবল এতদিনের বিবাহিত জীবনে তার মনে হয় শুধু একদিনই জামাল তাকে ভালোবেসেছিল যেদিন জামালকে তার গর্ভে নতুন অতিথির আগমনের কথা বলেছিল। আজ প্র্রসব বেদনা শুরু হওয়ার কথা শুনেই জামাল সমস্ত কাজ ছেড়ে অনন্যাকে শহরের একটা অত্যাধুনিক ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছে। একটু পরেই জামাল আবার আসবে সন্তানের মুখ দেখেই হয়ত হাতে স্বর্গ পাবে তাকে ভালোবাসবে পাগলের মতো।

জামাল কেবিনে ঢুকে ছেলেকে কোলে নিয়ে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।

অনন্যা বলল, একটু সাবধানে, ছোট বাচ্চা তুমি যেভাবে আদর করছ ব্যথা পাবে তো।

না পাবে না, কিচ্ছু হবে না, আমার ছেলে আজ থেকে ওর হাড় মাংস সব কিছু আমি শক্ত করে গড়ে তুলব।

ছেলে হতে না হতেই স্বপ্ন দেখা শুরু করলে?

হ্যাঁ ছেলে হয়েছে শুধু স্বপ্ন দেখব কেন? আমার শ্রম, মেধা, বিষয়-সম্পত্তি সবই তো ওর জন্য, আজ থেকে ওর জন্য নতুন করে ভাবতে হবে।

অনন্যা বিনয়ের সাথে বলল, তুমি একটু আমার পাশে বস।

জামাল নবাগত শিশুর গালে চুমু দিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর অনন্যার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অনন্যা আবেগে কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে রইল। জামালের ভালোবাসায় সে যেন আজ স্বর্গের সুখ পেল। অনন্যা জামালের মাদক ব্যবসা, ব্যাংক জালিয়াতি, নারী কেলেঙ্কারি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সবকিছু জানে। এমন একজন সমাজের ঘৃণ্য মানুষের মনেও যে ভালোবাসা থাকতে পারে অনন্যার যেন ভাবতেও অবাক লাগে। জামালের সমস্ত অতীত অপকর্ম যেন অনন্যার কাছে মিথ্যা মনে হলো। তার মনে হলো জামালের মনে কোন পাপ নাই সে একজন আদর্শ স্বামী, একজন আদর্শ পিতা।

অনন্যা জামালের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব, রাখবে?

বল।

তুমি যেমন তোমার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছ তেমনি তোমার বাবা-মাও তো তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল, তাই না?

জামাল চুপ করে রইল।

অনন্যা বলল, তোমাকে না জানিয়ে আমি আব্বা-আম্মাকে খবর দিয়েছি, হয়ত এখনি এসে পড়বেন। তাঁরা না আসা পর্যন্ত তুমি একটু বস।

না আমি বাবার সঙ্গে দেখা করব না অনন্যা আমি বরং আসি, বলে জামাল অনন্যাকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল। জামাল যাবার কয়েক মিনিট পর জহির সাহেব ও ফাহমিদা এলেন সঙ্গে বড় একটা প্যাকেট।

ফাহমিদা অনন্যার মাথার কাছে বসলেন, জহির সাহেব একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বউমা কি নাম রেখেছ আমার দাদু ভাই’র?

আমরা কেন নাম রাখব বাবা? নাম তো রাখবেন আপনি।

ফাহমিদা বললেন, আমি ওর নাম রাখব।

জহির সাহেব বললেন, তোমার যা বিদ্যার দৌড়, তুমি রাখবে ওর নাম?

ফাহমিদা অয়নকে কোলে নিয়ে আদর দিতে দিতে বললেন, তুমি যা-ই বল না কেন? আমি ওর নাম রাখলাম অয়ন, দাদু ভাই একটু হাস তো, আমার লক্ষ্মী সোনা।

জহির সাহেব দেখে মৃদু হাসলেন।

ফাহমিদা অয়নকে জহির সাহেবের কোলে দিয়ে বললেন, নাও, দাদু ভাইকে কোলে নাও, দেখ একেবারে তোমার মতো হয়েছে।

জহির সাহেব অয়নকে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তার মনের মধ্যে জামালের ছবি ভেসে উঠল তিনি এমনভাবে জামালকে কোলে নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন। জামাল বড় হয়নি, প্রতিষ্ঠিত হয়নি এমন না। জামাল অনেক বড় হয়েছে এই শহরের প্রথম সারির একজন নেতা হয়েছে। তার নামে এখন সবকিছু চলে। শহরের মাদক ব্যবসা পরিচালনা, চাঁদাবাজি, বিভিন্ন অফিসের অফিসারদের উপর প্রভাব খাটিয়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা। জামাল অনেক বড় হয়েছে যেমনটা তিনি প্রত্যাশা করেননি। ভাবতে ভাবতে তাঁর দু’চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি অয়নের কপালে চুমু দিয়ে বললেন অনেক বড় হও দাদু। বিদ্যা সাগর হও, অনেক বড় জ্ঞানী হও। আকাশ ছুঁয়ে দেখ, বলতে বলতে জহির সাহেবের কণ্ঠস্বর বুজে এলো। তিনি অয়নকে ফাহমিদার কোলে দিয়ে বললেন, নাও ফাহমিদা।

ফাহমিদা প্যাকেট থেকে বের করে একসেট জামা পরিয়ে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেকে দেখে জামাল কি বলল বউমা? খুশি হয়েছ তো?

জি মা ও খুব খুশি হয়েছে।

বউমা জামাল কি এখনো দেরিতে বাসায় ফিরে? খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করে?

অনন্যা মলিন মুখে বললেন, না মা ও এখন অনেকটা ভালো হয়েছে।

জহির সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বউমা আমি জামালকে ঘৃণা করি, কিন্তু তোমাকে খুব স্নেহ করি।

অনন্যা পূর্বের মতোই বলল, আমি জানি বাবা।

বউমা তুমি মিথ্যা কথা বললে।

অনন্যা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, আমার ভুল হয়েছে বাবা।

জহির সাহেব শাসনের সুরে বললেন, বউমা আর কোনদিন মিথ্যা কথা বলবে না।

বলব না বাবা।

ফাহমিদা বললেন, তুমি সব সময় এমন কথা বল না তো, জামাল এখন ছেলের বাপ হয়েছে এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

জহির সাহেব রাগান্বিত স্বরে বললেন, ফাহমিদা চল।

ফাহমিদা প্যাকেট থেকে একটা একটা করে কসমেটিক্স, জামা-জুতা এবং একটা স্বর্ণের চেইন বের করে অয়নের গলায় পরিয়ে দিলেন।

জহির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বউমা বিহাই-বিহাইনকে খবর দিয়েছ?

জি বাবা।

বিহাই বিহাইন এলে একবার আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিও।

ঠিক আছে বাবা।

ফাহমিদা বললেন, বউমা আমার দাদু ভাইকে যেন ঠাণ্ডা না লাগে তুমি খাবার-দাবারের নিয়ম কানুন মেনে চলবে, আমার দাদু ভাইজ্ঞর যেন কোন কষ্ট না হয়।

জহির সাহেব বললেন, বউমা আমরা আসি।

অনন্যা চোখ মুছে বলল, বাবা।

বল বউমা।

বাবা আমি, অয়ন আপনার কাছে কি কোন দোষ করেছি?

একথা কেন বলছ বউমা?

বাবা আপনি অনুমতি দিলে আমি অয়নকে একবার আপনার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাব।

জহির সাহেব আর চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি অনন্যার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, লক্ষ্মী বউমা আমার, তুমি এসো বউমা, যখন মন চাইবে তখনই এসো।

জহির সাহেব ও ফাহমিদা বের হয়ে গেলেন।

উনসত্তর

মধুকুঞ্জের কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন জামাল মনে মনে ঠিক করল সমস্ত কাজ শেষ হলে উদ্বোধন করবে, আনুষ্ঠানিকভাবে নয় একেবারে নিরিবিলিভাবে। সেদিন এই মধুকুঞ্জে থাকবে বিদেশি মদ, একাধিক তরুণী যারা গ্লাসে মদ ঢেলে জামালকে আপ্যায়ন করবে। জামাল মদ আর মেয়ের সাথে এনজয় করে সারারাত কাটিয়ে দিবে। নিজের পরিকল্পনা মোতাবেক জামাল মনে মনে একটা তারিখ ঠিক করে রহমতকে অর্ডার দিল।

রশিদ সাহেব কাজ শেষ হওয়ার খবর জানানোর পর জামাল রশিদ সাহেবকে নিয়ে বের হলো। মধুকুঞ্জের গেটে যেতেই সিকিউরিটি স্যালুট দিল। জামালের বুকটা যেন গর্বে ভরে গেল। সে বীর দর্পে ভবনের দিকে এগিয়ে গেল পিছনে পিছনে রশিদ সাহেব চললেন। জামাল প্রথমে নীচ তলার প্রত্যেকটা রুম ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল, তার মনে হলো সে যেন ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁয়ে দেখতে চলছে। জামাল দ্বিতীয় তলার একটা রুমে ঢুকলো। রুমের সঙ্গে এ্যাটাচ্‌ড বাথ, নদীর দিকে একটা বেলকনি। তখন পড়ন্ত বিকেল জামাল বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একবার নীচের দিকে তাকাল ছোট নদীর স্বচ্ছ পানি বয়ে যাচ্ছে। জামাল কিছুক্ষণ নীচের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আবার ঘরে ঢুকতেই রশিদ সাহেব পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে দেয়ালের এক কোণায় প্লাস্টারে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন সেখানে চাবি ঢোকানোর একটা পয়েন্ট বের হলো। রশিদ সাহেব চাবি দিয়ে খুলতেই দেয়ালের একাংশ খুলে গেল। জামাল অবাক হয়ে গেল।

রশিদ সাহেব বললেন, ভাইজান দ্বিতীয় তলার সমস্ত ওয়াল ক্যাভিটি ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।

জামাল জিজ্ঞেস করল, ক্যাভিটি ওয়াল জিনিসটা কি রশিদ সাহেব?

ক্যাভিটি ওয়াল মানে ফাঁকা দেয়াল। এই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় আপনি যে দেয়ালগুলো দেখছেন আসলে এখানে দু’টা করে দেয়াল আছে। ভিতরে এবং বাহিরে একটা দেয়াল মাঝ খানে পাঁচ ইঞ্চি ফাঁকা আপনি যেভাবে বলেছিলেন ঠিক সেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যেক রুমের সঙ্গে একটা করে বাথরুম একটা করে বারান্দা। উপরে ছাদের পরিবর্তে সবুজ রংয়ের ফাইবার গ্লাস লাগানো হয়েছে।

জামাল লক্ষ্য করল প্রত্যেক রুমে বক্স খাট ড্রেসিং টেবিলসহ প্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। জামাল মনে মনে হেসে বলল, রশিদ সাহেব আপনার বুদ্ধি আছে, আপনি আমাকে অবাক করেছেন।

রশিদ সাহেব কিছু বললেন না, তাঁর বুকটা গর্বে ভরে গেল।

রশিদ সাহেব আমি যেদিন আপনাকে প্রথম মধুকুঞ্জ তৈরির কথা বলি সেদিন আমি নিজেও কল্পনা করতে পারিনি আপনি এত সুন্দর অপূর্ব করে মধুকুঞ্জ তৈরি করতে পারবেন। বলতে বলতে দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলো। সিঁড়ির নিচে একটা কংক্রিটের ঢাকনা নীচে কংক্রিটের তৈরি সুড়ঙ্গ। দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলো। মাটির নীচে কংক্রিটের তৈরি সুড়ঙ্গ। বেশ কয়েক মিনিট দু’জনে সুড়ঙ্গ বেয়ে চলল। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ছো- রুম, জামাল ভিতরে ঢুকলো তার মনে পড়ল রশিদ সাহেবকে টর্চার সেল তৈরির কথা বলেছিল। জামাল কোন কিছু না বলে রশিদ সাহেবের পিছু অনুসরণ করল। আরো কিছুদূর যাবার পর সুড়ঙ্গ শেষ হলো।

রশিদ সাহেব বললেন, এই সুড়ঙ্গের উপর যে ঢাকনাটা আছে সেই ঢাকনার উপর মাটি দিয়ে ঘাস লাগানো হয়েছে। উপর থেকে কারো বুঝবার উপায় নেই যে, এটা একটা সুড়ঙ্গের উপরিভাগ, সুড়ঙ্গের ঢাকনা খোলার জন্য একটা লোহার হুক আছে যা ধরে টান দিলেই সুড়ঙ্গ থেকে বের হবার পথ পাওয়া যাবে।

জামাল গম্ভীরভাবে বলল, রশিদ সাহেব সবকিছু দেখে আমার মনে হচ্ছে আমরা একটা আশ্চর্যজনক কাজ করতে পেরেছি, কিন্তু-

জামালের মুখের দিকে তাকাতেই রশিদ সাহেব চমকে উঠলেন। জামালের দু’চোখ লাল হয়ে গেছে, বড় বড় চোখ করে ভয়ংকর দৃষ্টিতে রশিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, রশিদ সাহেব এই বিল্ডিং আর সুড়ঙ্গ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব লেবার মিস্ত্রী এই বিল্ডিংয়ের ভিতরে কি আছে তার সবকিছু জানে, তাই না?

রশিদ সাহেব মৃদু কণ্ঠে বললেন, জি ভাইজান।

জামাল রশিদ সাহেবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, কিন্তু আমি যে কোন সাক্ষী বাঁচিয়ে রাখতে চাই না।

রশিদ সাহেব ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমি কাউকে বলব না ভাইজান।

কিভাবে বিশ্বাস করব?

ভাইজান অনেকদিন ধরে আপনার ফার্মে কাজ করছি। কোনদিন তো আপনার বিশ্বাস হারাবার মতো কাজ করিনি। প্লিজ আমাকে জানে মারবেন না।

জামাল রশিদ সাহেবের চোখের দিকে তাকাল, তার মায়া হলো অনেক দিনের স্টাফ তাছাড়া রশিদ সাহেব এতদিনেও বিশ্বাস ভঙ্গ করার মতো কোন কাজ করেনি।

জামাল পিস্তল নামিয়ে বলল, আপনাকে না হয় বিশ্বাস করলাম কিন্তু লেবার মিস্ত্রীরা যদি বলে বেড়ায়?

ভাইজান আপনার কাছে হেড মিস্ত্রীকে হাজির করে দিব আপনি বলে দিলে আর কেউ বলার সাহস পাবে না।

জামাল কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

রশিদ সাহেবকে বললেন, চলুন রশিদ সাহেব বের হই।

দু’জনে সুড়ঙ্গ থেকে বের হলো ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

জামাল রশিদ সাহেবকে বলল, রশিদ সাহেব আপনি এখন আসুন।

রশিদ সাহেবকে বিদায় দিয়ে জামাল দোতলায় তার বেডরুমের সঙ্গে বেলকনিতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে রহমতকে মোবাইল করল।

ভাইজান।

হ্যাঁ  আমি মধুকুঞ্জে, তোমার আয়োজন শুরু কর, বলে জামাল মোবাইল অফ করল।

পূর্ণিমার রাত বেলকনিতে চাঁদের আলো ছড়াচ্ছে। জামাল কিছুক্ষণ বেলকনিতে বসে রইল তারপর বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে বসে রইল জামালের চোখের সামনে যেন ঐশীর ছবি ভেসে উঠল। ঐশী তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি তারপর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে বাবা-মার অনুরোধ এবং সামাজিকতা রক্ষার জন্য জামালকে তার বাবা-মা অনন্যার সঙ্গে বিয়ে দেয়। অনন্যা তার বিবাহিতা স্ত্রী যার সঙ্গে জামালের অন্তরের কোন সম্পর্ক নাই শুধুমাত্র আইন আর সামাজিকতার বন্ধন আছে।  অনন্যা সুন্দরী, ভদ্র, মার্জিত ব্যবহারের অধিকারিণী, তার কোন দোষ নাই কিন্তু ঐশী আর আরিফের বিয়ের পর থেকে জামাল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, সে ক্রমাগত নারী বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে, পণ্যের মতো ভোগ করতে থাকে একের পর এক নারীকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মদ।

মধুকুঞ্জের গেটের বাইরে দু’টা রিক্সা এসে দাঁড়াল। সিকিউরিটি রহমতকে আগে থেকেই চিনে কাজেই কিছু জিজ্ঞেস করল না।

জামাল দোতলার উপর থেকে বলল, রহমত চলে এসো।

রহমত এবং তার সঙ্গে দু’জন তরুণী উপরে এলো। জামাল একবার করে তরুণী দু’জনের আপাদমস্তক তাকাল। একটা মেয়ে ফর্সা লম্বা,  মাংসল। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো। মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই জামালের সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মেয়েটার বয়স বিশ কিংবা বাইশ বছর হবে। অপর মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা, স্লিম ফিগারের অধিকারিণী চোখ দু’টা আকর্ষণীয়, বয়স ষোল কিংবা সতেরর বেশি হবে না।

রহমত তার নিয়ে আসা মদ এবং কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলগুলো পাশের রুমে রেখে বলল, ভাইজান আমি এখন আসি।

          জামাল ইশারা করে বলল, আচ্ছা।

রহমত চলে যাবার পর জামাল মেয়ে দু’টাসহ তার বেড রুমে ঢুকলো।

সত্তর

মাদক ব্যবসায় একক আধিপত্য বিস্তার করলেও মাঝে মাঝে মহল্লা ভিত্তিক কিছু উঠতি বয়সের তরুণ ফেন্সি কুইনদের বাসায় বাসায় চাঁদাবাজি করত। আর ফেন্সি কুইনরা এসব অভিযোগ আমীর কিংবা হিটলারকে জানাতো তখনই হিটলার সিংহের মতো গর্জন করে উঠত, আমার উপর মাস্তানি করতে চায় কার এত বড় সাহস?

হিটলার তার বাবা-মা’র কথা জানে না, শৈশব থেকে বস্তিতে এক নিঃসন্তান দম্পতির আদর যত্নে বড় হয়েছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে প্রথমে টোকাইয়ের কাজ করত, তারপর ছিঁচকে চোর, পরে একসময় শহর নিয়ন্ত্রণকারী টপ টেররের দলে যোগ দেয়। শুরু হয় হিটলারের সন্ত্রাসী জীবন। কয়েক বছরের মধ্যে গ্রুপে সে সেকেন্ড ইন কমান্ডের স্থান দখল করে। তার ওস্তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর হিটলার গ্রুপের শীর্ষস্থান দখল করে। তার সন্ত্রাসী জীবনে সে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে কত সম্মানী লোককে অপমান করেছে, কত বড় ব্যবসায়ীকে অপহরণ করেছে, টাকা দিতে অস্বীকার করায় হত্যা করেছে, তার একক আধিপত্য বজায় রাখতে কতজনকে গুলি করে মেরেছে তার ইয়ত্তা নাই । হিটলারের কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকত তখন সে দলেরই কোন না কোন নেতার আশীর্বাদে সে অবাধে অপরাধ করত। শহরে সমস্ত অপরাধ জগত তার একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। অথচ একদিন হিটলারের লাশ রাস্তায় পড়ে রইল। হিটলারের মৃত্যুর খবর শুনে জামাল তাৎক্ষণিকভাবে  মন্ত্রীকে জানাল পুলিশ এবং জেলা প্রশাসনকে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করল। হিটলারের মৃত্যুতে জামাল যেমন তার একটা শক্তিশালী হাত হারালো তেমনি তার সমস্ত অপকর্মের একজন সাক্ষীও নিশ্চিহ্ন হলো। জামাল অভ্যাসবশত: চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল।

কিছুক্ষণ পর আমীর দরজা নক করে বলল, ভাইজান আসি।

এসো।

ভাইজান গালপোড়া সেলিম এসেছে।

আসতে বল।

আমীর বের হয়ে গেল এবং গালপোড়া সেলিম ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে দাঁড়াল, বস।

জামাল গম্ভীরস্বরে বলল, সেলিম কি মনে করে?

গালপোড়া সেলিম কাঁপা স্বরে বলল, বস আমাদের বাঁচান, পুলিশের অত্যাচারে আমরা বাসায় থাকতে পারছি না। এতদিন  ওস্তাদ আপনার জন্য কাজ করল, ওস্তাদের কথায় আমরাও সব কাজ করেছি। ওস্তাদ অন্য গ্রুপের গুলিতে মারা গেল, পুলিশ ওদের না ধরে আমাদের বাসায় দিন রাত হানা দিচ্ছে, পুলিশের অত্যাচারে আমরা কেউ বাসায় থাকতে পারছি না। আপনি পাওয়ার পার্টির সেক্রেটারি অথচ বিরোধী দলের সেক্রেটারির গ্রুপের সন্ত্রাসীদের হাতে ওস্তাদ মারা গেল আবার পুলিশ আমাদেরকেই ধরার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আপনি কিছু একটা করেন বস।

জামাল একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, হ্যাঁ হিটলার আমার ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করত। সে আমার খুব বিশ্বস্ত ছিল, তুমি নতুন কাজে দক্ষ হবে কি না জানি না। তার ওপর বিশ্বাসের ব্যাপার তো আছেই।

বিশ্বাস করুন বস আপনি আমাদের এ বিপদ থেকে বাঁচান আমরা সারাজীবন আপনার হয়ে কাজ করব।

জামাল একবার গালপোড়া সেলিমের চোখের দিকে তাকাল তার চোখে-মুখে ভীতির স্পষ্ট ভাব ফুটে উঠেছে।

জামাল জিজ্ঞেস করল, কথা ঠিক রাখবে তো?

বিশ্বাস করুন বস আমার বাপ যদি একটা হয় তবে আমি সারাজীবন আমার ওস্তাদের মতোই আপনার সব কাজ করব শুধু আমি কেন আমার গ্রুপের সবাই আপনার হয়ে কাজ করবে, আপনার জন্য জীবন দিবে।

          জামাল কলিং বেল এ টিপ দিতেই পিয়ন চলে এলো।

          জামাল বলল, আমীরকে ডাক দাও।

আমীর ভিতরে ঢুকলো।

জামাল আমীরকে বলল, এখন থেকে গালপোড়া সেলিম তোমার সঙ্গে কাজ করবে। সেলিম একটা কথা মনে রাখবে আমার কাছে বিশ্বাস ঘাতকের স্থান নাই। কোনদিন যদি তোমার আচরণে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা দেখি তবে বুঝতে পাচ্ছ কি অবস্থা হবে?

জি বস।

জামাল গম্ভীরস্বরে বলল, তুমি বাইরে বস আমীর তোমাকে সব বুঝিয়ে দিবে।

সেলিম বাইরে চলে গেল।

জামাল আমীরকে বলল, আমীর হিটলারের মতোই সেলিমকে পেমেন্ট দিবে। খেয়াল রাখবে তোমার কাছে বিশ্বস্ত কিংবা ব্যবসার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট মনে না হলে আমাকে জানাবে।

জি ভাই।

তুমি এখন সেলিমকে সবকিছু বুঝিয়ে দাও।

জি ভাই, বলে আমীর চলে গেল।

আমীর চলে যাবার পর জামাল ওসি সাহেবকে টেলিফোন করল, ওসি সাহেব।

জামাল ভাই বলুন।

আপনাকে আমি সদর থানায় এনেছি কি আমার লোকজনকে হয়রানী করার জন্য?

এমন কথা বলছেন কেন জামাল ভাই?

হ্যাঁ হিটলারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আপনি অযথা তার সহযোগীদের হয়রানী করছেন?

জামাল ভাই আসলে গুলিতে নিহত হিটলারের লাশ পাওয়া গেছে কাজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কে হিটলারকে খুন করেছে? তার কোন প্রতিপক্ষ নাকি তার সহযোগী কেউ?

দেখুন হিটলারের সহযোগীরা হিটলারের অত্যন্ত অনুগত ছিল তারা সবাই তাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। আর জন দরদী পার্টি ক্ষমতাসীন দলের সুস্থ রাজনীতিকে ব্যাহত করার জন্য সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেছে তারাই ছিল হিটলারের প্রতিপক্ষ। আপনি থানায় ওসি গিরি করেন, কি যে করেন তা আপনিই ভালো জানেন?

ওসি সাহেবের বিনয়ী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জামাল ভাই দেখুন আমি কি করি?

আপনি আর কি করবেন? আপনি তো জন দরদী পার্টিতে যোগ দিয়েছেন, তাই তো আপনাকে আর সদর থানায় রাখা যায় না।

জামাল ভাই বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, শুনুন হিটলারের কোন সহযোগীকে ডিস্টার্ব করবেন না। প্রতিপক্ষের সব সন্ত্রাসীকে যত শীঘ্রই সম্ভব এরেস্ট করুন। ওদের ধরে রিমান্ডে নিন দেখবেন হিটলার হত্যার রহস্য পেয়ে যাবেন।

জি ভাই, আমি দেখছি।

শুনুন দেখছি বললে হবে না, যা বললাম তাই করবেন। এর এক বিন্দু নড়চড় হলে সদর থানার মতো এক্ট্রাকটিভ পোস্টিং হারাবেন। আপনি জানেন এটা করার জন্য আমার ইচ্ছাই যথেষ্ট।

জি জামাল ভাই ঠিক আছে।

ওকে। আশা করি আমাকে আর কিছু বলতে হবে না, বলে জামাল টেলিফোন রেখে দিল।

একাত্তর

সকালবেলা পত্রিকার পাতা খুলতেই জামালের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে কখনো ভাবতেও পারেনি কোন সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় নিউজ করার সাহস পাবে। অথচ তার চোখের সামনে বড় বড় অক্ষরে ভাসছে তাকে নিয়ে লেখা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, মাদকের নেশায় ভাসছে শহর, নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে যুব সমাজ। সর্বনাশা মাদকের নেশায় শুধুমাত্র শহর নয় উপজেলা শহরসহ গ্রাম-গঞ্জের যুব সমাজও আসক্ত হয়ে পড়ছে। শুধু যুব সমাজ নয় ক্রমে ক্রমে কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীরাও আসক্ত হচ্ছে। স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীরাও নেশার ছোবল থেকে মুক্ত নয়। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় ফেন্সি কুইনরা খালা বা নানী সম্বোধনে মাদকাসক্তদের কাছে পরিচিত। শহরের প্রায় পঞ্চাশটি স্পটে এক ধরণের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের  সহযোগিতায় অবাধে মাদক দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। মাদক দ্রব্য বহনের কাজে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে মাদকদ্রব্য বহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এ্যাম্বুল্যান্স।

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে ক্ষমাতসীন দলের একজন রাজনৈতিক নেতা যার প্রথম অক্ষর জ্ঞজ’ তিনি তাঁর নিজস্ব যানবাহন ও কর্মচারীর দ্বারা মাদক ব্যবসা করছেন। পুলিশ প্রশাসনসহ আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থাকে মাসোয়ারা দিয়ে অথবা সৎ ও নীতিমান কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলি করে তিনি তার ব্যবসার পথকে নিষ্কণ্টক করেছেন। ফলে তার ব্যবসার পথে আর কোন কাঁটা নাই। উল্লেখ্য যে, মাত্র কয়েক বছর আগে তিনি সামান্য কয়েক লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও এখন তিনি কোটিপতি। টাকার জোরে তিনি শহরের সমস্ত সংগঠনের নেতা ও জনসেবার নাম করে লোক চক্ষুর আড়ালে অগণিত অর্থের মালিক হওয়ার জন্য কোমল মতি কিশোর-কিশোরীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইনের মতো বিষাক্ত মাদক, শুধু তাই নয় এমন কোন কাজ নাই যা তিনি পারেন না। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ব্যাংক জালিয়াতি, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ সবকিছুতেই তিনি যেন সিদ্ধ হস্ত। তার আছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা কুকর্মের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে তার প্রতিপক্ষ দলের লালিত বাহিনীর প্রধান অথচ তদন্ত কিংবা বিচার আজো হয়নি, বিচার হয়নি হিটলার হত্যাকাণ্ডের। সবকিছুর পিছনে সেই রাজনৈতিক নেতার শক্তিশালী অদৃশ্য হাত রয়েছে। তিনি শহরের এবং দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা দখলের পর শহরের একমাত্র গড ফাদারে পরিণত হয়েছেন। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে যুব সমাজ তথা সমাজের অবক্ষয় ঠেকানো সহজ হবে।

খবরটা পড়ে জামাল হিংস্র বাঘের মতো লাফিয়ে উঠল। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার চেম্বারের মধ্যে পায়চারী করতে থাকল। তারপর জামাল ড্রয়ার থেকে অন্য একটা মোবাইল সেট বের করে গাল পোড়া সেলিমকে মোবাইল করল।

বস।

সেলিম তুমি কোথায়?

জি বস শহরেই আছি।

জামাল জিজ্ঞেস করল, তুমি কি দৈনিক সাহসী কণ্ঠ পেপারের সাংবাদিককে চেনো?

জি বস।

তুমি কি জানো সে আমার বিরুদ্ধে একটা নিউজ করেছে?

জানি না বস।

যে হাত দিয়ে সে আমার বিরুদ্ধে নিউজ লিখেছে তার সে হাতটা আমি কেটে দিতে চাই। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তুমি ঐ হারামজাদাকে খুঁজে বের করে মধুকুঞ্জে নিয়ে এসো, ওর নিউজ লিখার হাতটা কেটে আমি মধুকুঞ্জের টর্চার সেল উদ্বোধন করব, বলে জামাল মোবাইল অফ করল।

রাত আটটার সময় জামাল অফিস থেকে বের হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে মধুকুঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। মধুকুঞ্জের চারিদিকে অন্ধকার আশে-পাশে দরিদ্র মানুষের বসবাস, দু’একটা বাড়িতে বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। গাঢ় অন্ধকার, আমাবস্যার রাত মধুকুঞ্জের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জামাল চারিদিকে একবার তাকাল, অন্ধকার নেমেছে। জামাল বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারী করল। এভাবে পায়চারী করতে করতে প্রায় দু’ঘণ্টা কেটে গেল। তবুও সেলিম না আসায় জামাল সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আরো কয়েক মিনিট পর দু’টা মোটর সাইকেল এসে দাঁড়াল।

জামাল দোতলা থেকে নীচে নেমে এলো।

মোটর সাইকেলের মাঝখানে বসা একজনের দু’চোখ বাঁধা, জামাল বুঝতে পারল এই সেই সাংবাদিক। জামাল সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, সেলিম সাংবাদিক সাহেবকে আমার পিছনে পিছনে নিয়ে এসো। সম্মানের সাথে নিয়ে এসো, বুদ্ধিজীবী মানুষ দেশের সম্পদ।

জি বস, বলে সেলিম সাংবাদিক সাহেবকে নিয়ে জামালের পিছনে পিছনে সুড়ঙ্গে চলে গেল। সুড়ঙ্গের ছোট রুমটাতে সেলিম সাংবাদিক সাহেবকে নিয়ে গেল। রুমে আগে থেকেই একটা হাতল চেয়ার রাখা ছিল। সেলিম সাংবাদিক সাহেবকে চোখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের হাতলের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধল।

জামাল গম্ভীরস্বরে  বলল, সেলিম সাংবাদিক সাহেবের চোখ খুলে দাও।

সেলিম সাংবাদিক সাহেবের চোখ খুলে দিল। সাংবাদিক সাহেবের থুতনি উঁচু করে ধরে জামাল বলল, আপনার নাম কি যেন সাংবাদিক সাহেব?

সাংবাদিক সাহেবের সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল, তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আব্দুস সালাম।

সালাম সাহেব বলুন তো আপনার নিউজে গড ফাদার নামে যাকে উল্লেখ করেছেন, আপনার সেই অদ্যাক্ষরের জ্ঞজঞ্চ লোকটা কে?

সালাম সাহেব কোন কথা বললেন না মাথা নত করে বসে রইলেন।

জামাল প্রচণ্ড গর্জন করে বলল, বল মাগীর বাচ্চা, কথা বল।

জামাল বলল, তোর বাপের সামনে নাম উচ্চারণ করতে ভয় করছে, তাই না? লিখার সময় তো ভয় পাসনি। তোর লিখাটা বেশ অনুসন্ধানী এবং গবেষণামূলক হয়েছে। তাই তোর হাতের লিখা কেমন সুন্দর দেখার আমার ইচ্ছা করছে, বলে জামাল বলল, লিখ, বেটা তোর নামটা লিখ।

সালাম সাহেব পকেট থেকে ছো- একটা প্যাডের পাতা বের করে তাঁর নামটা লিখলেন।

জামাল লেখাটা হাতে নিয়ে বলল, এটা তো ডান হাত দিয়ে লিখলি। এবার বাম হাত দিয়ে লিখ।

সালাম সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমি তো বাম হাত দিয়ে লিখতে পারিনা।

জামাল দাঁত কড়মড় করে বলল, সেলিম এই মাগীর বাচ্চার ডান হাতটা কেটে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখ।

সালাম সাহেব চমকে উঠলেন, তাঁর চোখে-মুখে আতংক এবং কথাবার্তায় জড়তা সৃষ্টি হলো, জামাল ভাই প্লিজ আমাকে এবারের মতো মাফ করে দিন।

জামাল সালাম সাহেবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, চুপ, মাফ করলাম বলেই তো এবারের মতো জানে মারলাম না, শুধু তোর লেখার হাতটা কেটে নিলাম, একথা কেউ জানলে জানে মেরে ফেলব?

সালাম সাহেবের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি অসহায়ের মতো ফ্যাল্‌ ফ্যাল্‌ করে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

জামাল গর্জন করে উঠল, সেলিম, অ্যাকশন কুইক।

সালাম সাহেব কান্নার সুরে বললেন, জামাল ভাই প্লিজ আমাকে এবারে মতো মাফ করে দিন।

ততক্ষণে গালপোড়া সেলিম একটা ধারালো দা বের করে সালাম সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, সেলিম।

সেলিমের একজন সঙ্গী সালাম সাহেবের হাত টেনে ধরল, সেলিম দায়ের কোপে সালাম সাহেবের কব্জি কেটে ফেলল।

সালাম সাহেব যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।

জামাল সালাম সাহেবের হাতের কব্জি নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারপর বলল, সাংবাদিক সাহেবের চোখ বেঁধে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসো।

জি বস, বলে সেলিম সালাম সাহেবের চোখ বেঁধে তাঁকে সুড়ঙ্গ থেকে বাইরে নিয়ে গেল।

বাহাত্তর

পৌরসভা নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকী অথচ কয়েক বছরেও জামাল পৌরসভা নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি বরং পৌরসভার জনগণের মনে জামালের নামে ভীতি জন্মেছে। সুশীল সমাজ জামালের নাম শুনলে নাক ছিটকায়, ঘৃণা করে। একথা জামাল মন্ত্রীর কাছ থেকে আড়াল করতে পারেনি। জামাল একবার ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন কাজ এবং জেলার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলাপ করছিল। কথা প্রসঙ্গে মাননীয় মন্ত্রী পৌরসভার নির্বাচনে জামালের অবস্থান জানতে চাইলেন, জামাল পৌরসভার নির্বাচন তো আর বেশি দেরি নাই তুমি জিততে পারবে?

জামাল বলল, জি ভাই আপনি দোয়া করবেন আমি অবশ্যই জিতবো।

মাননীয় মন্ত্রী গম্ভীর স্বরে বললেন, জামাল কিছু মনে কর না। আমি যতটুকু জানি তাতে তুমি রায়হান চেয়ারম্যানের সঙ্গে এবারো হেরে যাবে।

জামাল মাথা নত করে বসে রইল।

মাননীয় মন্ত্রী বললেন, তুমি পাওয়ার পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নিজের ইমেজে না হোক দলের ইমেজকে কাজে লাগিয়েও তুমি পজিশন ক্রিয়েট করতে পারতে। কিন্তু তা করতে পারনি বরং অল্প বয়সে বেশি ক্ষমতা পেয়ে তুমি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ। নিজে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছ জনগণের এবং দলের ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়ন না করার ফলে তোমার জনপ্রিয়তা কমেছে। এখনো কয়েক মাস সময় আছে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা কর। একটা কথা মনে রাখবে তুমি যদি হেরে যাও তবে দলের ভাবমূর্তি বলে আর কিছু থাকবে না। কেন্দ্রে আমাদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমি সেন্ট্রাল পলিটিক্স  করছি তুমি লোকাল পলিটিক্স করছ তোমার কারণে দলে আমার সম্মানের ক্ষতি হোক তা তুমি নিশ্চয় চাও না।

বড় ভাই আমাকে কিছুদিন সময় দিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

হ্যাঁ তাই যেন হয়।

ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকে মন্ত্রীর কথাগুলো বার বার জামালের কানের মধ্যে ধ্বনিত হলো। জামাল প্রায় দিনই সন্ধ্যার পর ব্যবসায়িক কাজ সেরে পার্টি অফিসে গিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বেলায়েত সাহেবের অভিমান কিছুটা কমেছে। ঢাকা থেকে ফিরে জামাল বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে আবার সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। একদিন পার্টি অফিসে জামাল অন্যান্য নেতা কর্মীদের সঙ্গে গল্প করছিল এমন সময় বেলায়েত সাহেব অফিসে ঢুকলেন। জামাল সালাম দিয়ে বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করল।

বেলায়েত সাহেব কিছুটা অবাক হলেন তিনি কোনকিছু না বুঝে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কি ব্যাপার জামাল?

জামাল মাথা নত করে বলল, কিছু না তো বেলায়েত ভাই, অনেক দিন পর দেখা হলো তো তাই।

জামাল বেলায়েত সাহেবের মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

বেলায়েত সাহেব বললেন, তোমার পৌরসভা নির্বাচনের খবর কি?

আমার পৌরসভা নির্বাচন বললেন কেন বেলায়েত ভাই? নির্বাচনে আমি পার্টির প্রতিনিধিত্ব করব কিন্তু নির্বাচন করবে পার্টি, পৌরসভার নির্বাচন শুধু আমার একার না, আমাদের সকলের, এই নির্বাচনে দলের সকল নেতা-কর্মীকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

বেলায়েত সাহেব একটা নিঃশ্বাস টেনে বললেন, নির্বাচন পার্টির একথা ঠিক কিন্তু নির্বাচন করবে তুমি আমরা তোমাকে সহযোগিতা করব।

জামাল বুঝতে পারল তার উপর বেলায়েত সাহেবের ক্ষোভ কমেনি। কিন্তু মুখে তার ভাব প্রকাশ না করে মৃদু হেসে বলল, বেলায়েত ভাই আপনি আমার সঙ্গে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমি নির্বাচনে জয়ী হব।

তোমার সঙ্গে থাকব না মানে? শুধু যে সঙ্গে থাকব তা না তোমাকে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তাই করব।

জামাল কয়েক মুহূর্ত বেলায়েত সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কৃতজ্ঞ চিত্তে বলল, আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন বেলায়েত ভাই।

জামাল বিভিন্ন ক্লাব, সভা-সমিতি দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেও রায়হান চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারল না। জামাল অনেক ভেবে চিন্তে দেখেছে রায়হান চেয়ারম্যানকে পরাজিত করে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। জামালের পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র পথ রায়হান চেয়ারম্যানকে হত্যা করা। হ্যাঁ প্রয়োজনে জামাল তাই করবে। চেয়ারম্যানকে হত্যা করে হলেও তাকে পৌরসভার চেয়ারম্যান হতে হবে। তাকে হতে হবে সমস্ত জেলার একমাত্র নেতা।

নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলো, পৌরসভার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ না থাকলেও প্রচ্ছন্নভাবে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের মৌন সমর্থন থাকে। নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল থেকে অলিখিতভাবে জামালকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জন দরদী পার্টি থেকে রায়হান সাহেবকে পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে সমর্থন দেয়া হয়েছে, আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। রায়হান চেয়ারম্যানের কাছে যে জামাল হেরে যাবে এটাও নিশ্চিত। মনোনয়ন পত্র দাখিলের পর জামাল গালপোড়া সেলিমকে মধুকুঞ্জে দেখা করতে বলল।

গালপোড়া সেলিম মধুকুঞ্জে ঢুকলো রাত আটটার সময়, জামালের চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে গালপোড়া সেলিম জিজ্ঞেস করল, বস কোন সমস্যা? জটিল কিছু?

হ্যাঁ জটিল তো বটেই, বেশ জটিল অপারেশন।

জি বস বলুন আপনার জন্য আমি জীবন দিতে রাজি আছি।

জামাল একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, তোমাকে জীবন দিতে হবে না একটা জীবন নিতে হবে।

তারমানে মার্ডার-

তুমি চমকে উঠলে মনে হয়?

না বস বলুন।

হ্যাঁ তুমি যা বলছ তাই, তবে তোমার জন্য একটা লোভনীয় প্রস্তাব আছে।

গালপোড়া সেলিম মৃদু হেসে বলল, জি বস বলুন।

অপারেশন সাকসেসফুল করতে পারলে তুমি পাঁচ লাখ টাকা পাবে, তুমি যদি চাও অ্যাডভান্স এক লাখ টাকা নিতে পার।

না বস আপনি বলছেন এটাই যথেষ্ট, এডভান্স লাগবে না।

জামাল গম্ভীর স্বরে বলল, টাকা লাগবে কারণ কাজটা তুমি নিজে করবে না, কোন প্রফেশনাল কিলারকে দিয়ে করাতে হবে একেবারে নিখুঁতভাবে। যেমন এই মনে কর তিনি হয়ত ঢাকা যাচ্ছেন রাস্তায় বাসে ডাকাতি হলো ডাকাতের ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হলেন অথবা তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন ট্রাক চাপা দিয়ে মারতে হবে যেন তাঁর মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসাবে সবাই মেনে নেয়।

জি বস বুঝতে পেরেছি এখন নাম ঠিকানাটা দিন।

জামাল গালপোড়া সেলিমের কানে কানে ফিস ফিস করে কি যেন বলল তারপর তার রুম থেকে টাকা এনে গালপোড়া সেলিমের হাতে দিল।

গালপোড়া সেলিম টাকা হাতে নিয়ে বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না বস অপারেশন সাকসেসফুল হলে আপনাকে মোবাইলে জানিয়ে দিব।

কিন্তু সময় সাতদিন মাত্র মনে থাকে যেন ।

জি বস।

তেহাত্তর

জামালের বেঁধে দেয়া সাতদিন সময়ের মধ্যে পাঁচ দিন অতিক্রান্ত হলো কিন্তু গাল পোড়া সেলিম রায়হান চেয়ারম্যানকে হত্যা করতে না পারায় জামাল কিছুটা নিরাশ হলো এবং মোবাইলে গালপোড়া সেলিমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল। গালপোড়া সেলিম মৃদু প্রতিবাদ করে বলল, বস আরো দু’দিন বাকী আছে আপনি দেখবেন আজকের মধ্যে ঐ বেটাকে আমি ট্রান্সফার করে দিব। আমি কথা দিচ্ছি রায়হান চেয়ারম্যানকে ট্রান্সফার করে তারপর আপনার সামনে আসব।

গালপোড়া সেলিমের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা শুনে জামাল বলল, হ্যাঁ আমিও তাই চাই, টাকা রেডি আছে অপারেশন সাস্‌কেসফুল হওয়া মাত্র পাবে।

জামালের বাসার অদূরে অতি সম্প্রতি একটা ক্লাব হয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের নিকট থেকে অবৈধ সুবিধা আদায়ের জন্য মহল্লায় মহল্লায় এমনি অসংখ্য ক্লাব হয়ে থাকে। নির্বাচনের পর আবার অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। জামাল তার মোটর সাইকেলে শাকিলকে নিয়ে প্রথমে সেই ক্লাবে গেল তখন ক্লাবে কয়েকজন উঠতি বয়সের তরুণ বসে তাস খেলছিল। জামালকে দেখে তারা তাড়াহুড়া করে তাস লুকিয়ে ফেলল। জামাল প্রথমে সকলের নাম শুনল, একে একে সবাই নাম বলল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ক্লাবের সভাপতি কে?

জি ভাই আমি সভাপতি।

আর সেক্রেটারি?

আরেকজন তরুণ দাঁড়িয়ে বলল, আমি।

তোমরা সবাই তো আমাকে চেনো তাই না?

সবাই মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল তারা চিনে।

আসলে গত পৌরসভার নির্বাচনে হেরে যাবার পর আমার পৌরসভায় চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা একেবারেই ছিল না। জনগণের দাবি বুঝলে তো, পলিটিক্স করলে আসলে জনগণের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। তাই দাঁড়ালাম আর কি। তোমরা আমাকে ভোট দিবে তো?

ক্লাবের সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

শাহেদ আমতা আমতা করে বলল, জি ভাই।

দেখ এভাবে বললে হবে না। আর শুধু ভোট দিলেও হবে না। কাজ করতে হবে, এই ধর আমি যদি চেয়ারম্যান হই তোমাদের যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন সমস্যায় সরাসরি আমার কাছে চলে আসতে পারবে। যেটা এখন হয়ত তোমরা পার না। দেখবে তোমরা যে কোন সমস্যায় আমাকে পাবে। তাছাড়া তোমরা তো জানো আমি পাওয়ার পার্টির জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি আমার সঙ্গে মন্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো। পৌরসভার উন্নয়নে পৌরসভার চেয়ারম্যান পাওয়ার পার্টির হওয়া উচিত।

ক্লাবের অনেক সদস্য জামালের কথায় সম্মতি দিল।

জামাল বলল, আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা যদি সম্মতি দাও তবে এই ক্লাব ঘরটা নির্বাচনী অফিস হিসাবে ব্যবহার করব অবশ্য সে জন্য তোমরা ভাড়া এবং অফিস খরচ হিসেবে দৈনিক টাকা পাবে।

শাহেদ ও হানিফের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জামাল ক্লাবের সদস্যদের দিকে খেয়াল করল। সকলের চোখে-মুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠল।

জামাল তার পকেট থেকে টাকা বের করে শাহেদের হাতে দিয়ে বলল, তাহলে এ কথাই থাকল কাল থেকে তোমরা কাজে লেগে যাও প্রতিদিন তোমাদের এখানে আমার কর্মীদের কেউ টাকা, পোষ্টার এসব দিয়ে যাবে। তোমরা তাহলে থাক। আমার অনেক কাজ তবুও তোমরা যে কোন প্রয়োজনে এলে খুশি হব বলে  জামাল ও শাকিল ক্লাব থেকে বের হলো।

নির্বাচনে জামালের মার্কা গরু গাড়ি, রায়হান সাহেবের মার্কা ছাতা। জামাল ক্লাব থেকে বেরিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে কিছুদূর যেতেই তার চোখে পড়ল রাস্তার পার্শ্বে, বাড়ির দেয়ালে, সব স্থানে শুধু ছাতা মার্কার পোস্টার মাঝে মাঝে দু’য়েকটা গরু গাড়ি। জামালের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর বিশাল বাউন্ডারি ওয়াল ঘেরা একটা বাড়ির গেটে কয়েকটা ছাতা মার্কার পোস্টার দেখে জামাল মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে কলিং বেল এ টিপ দিল।

কয়েক মিনিট পর বারো-তেরো বছর বয়সের একটা ছেলে দরজা খুলে দিল।

জামাল জিজ্ঞেস করল, কায়েস চাচা বাসায় আছেন?

জি আছেন, আপনারা ভিতরে আসেন।

জামাল ও শাকিল ভিতরে ঢুকলো।

কায়েস সাহেব বারান্দায় এসে বললেন, জামাল এসো বাবা।

জামাল ও শাকিল কায়েস সাহেবের ড্রয়িং রুমে বসল।

জামাল প্রথমে কথা বলতে শুরু করল, চাচা আপনি জানেন আমি পৌরসভার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছি, আমার মার্কা গরু গাড়ি।

কায়েস সাহেব কোন কথা না বলে নীরবে বসে রইলেন।

জামাল বুঝতে পারল কায়েস সাহেব ছাতা মার্কার সমর্থক তাকে ম্যানেজ করতে সময় লাগবে।

জামাল আবার বলতে শুরু করল, চাচা রায়হান চেয়ারম্যান কয়েকবার থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন ফলে তাঁর চেয়ে যে অন্য কেউ বেশি উন্নয়ন ও পৌরসভা বাসীর সেবা করতে পারে সেটা আপনারা বুঝতে পারেননি। আমি পাওয়ার পার্টির সেক্রেটারি এবং মন্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো। রায়হান চেয়ারম্যান সাহেবকে দিয়ে যে উন্নয়ন সম্ভব হয়নি আমাকে দিয়ে তা সম্ভব।

কায়েস সাহেব সবকিছু শুনেও কিছু বললেন না, তিনি ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি ফিরে এলেন সঙ্গে কাজের মেয়ে চা-নাস্তা নিয়ে এলো।

কায়েস সাহেব বললেন, নাও বাবা আগে চা খাও।

চাচা চা খাব ঠিক আছে কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা আছে।

খাও বাবা চা খেতে খেতেও কথা বলা যাবে।

জামাল চা খেতে খেতে বলতে শুরু করল, চাচা আপনি আমার বাবার বন্ধু, আমি আপনার ছেলের মতো আমি আপনার ছেলে হলে আমাকে ভোট দিতেন না? আমার ভোটের জন্য কাজ করতেন না?

কায়েস সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, জামাল বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়।

জামাল বিনয়ের সুরে বলল, জি চাচা বলুন।

তুমি নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে কি তোমার বাবার কাছে গিয়েছিলে?

জি গিয়েছিলাম।

তোমার বাবা কি তোমাকে ভোট দিবে?

জামাল আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ বাবা তো আমাকে অবশ্যই ভোট দিবে।

তোমার বাবা কি তোমার পক্ষে ভোটের ক্যানভাস করছে?

জামাল কোন উত্তর না দিয়ে নীরবে বসে রইল।

কায়েস সাহেব বললেন, দেখ বাবা আমি যতটুকু জানি তোমার বাবার সঙ্গে তোমার ভালো সম্পর্ক না বলে তোমার পক্ষে ভোটের জন্য ক্যানভাস করছে না।

জামাল যেমন নীরবে বসে ছিল তেমনি নীরবে বসে রইল।

কায়েস সাহেব বলতে শুরু করলেন, দেখ বাবা তুমি তোমার বাবা-মা’র সেবা কর না, তুমি কিভাবে আমাদের সেবা করার সুযোগ চাও?

জামালের মুখে কালো মেঘের ছায়া নেমে এলো। সে কায়েস সাহেবের কথার কোন উত্তর দিতে পারল না।

কায়েস সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমাকে আমি ভোট দিব না এমন কথা বলছি না, তোমার বাবা যদি তোমাকে ভোট দেয়ার জন্য বলে তবে আমি তোমাকে ভোট দিব, তা না হলে আমি ছাতা মার্কায় ভোট দিব। আমার মনে হয় এটা শুধু আমার কথা না অনেকে তোমাকে এ প্রশ্ন করতেই পারে। তাছাড়া তোমার বাবাকে সারা শহরের মানুষ একজন সৎ এবং ভালো মানুষ বলে জানে এ নির্বাচনে জিততে হলে তোমার বাবাকে তোমার পক্ষে মাঠে নামতে হবে।

জামাল আর কোন কথা বলল না, দাঁড়িয়ে কায়েস সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ড শ্যাক করে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন চাচা, বাবাকে আমি এ্যানি হাউ ম্যানেজ করব, বাবা আপনার কাছে আসবে, আপনি দোয়া করবেন চাচা, আমি যেন নির্বাচনে জিতে পৌরসভার চেয়ারম্যান হতে পারি, বলে জামাল এবং শাকিল কায়েস সাহেবের বাসা থেকে বের হলো।

চুয়াত্তর

জামালের চোখে ঘুম নাই। নির্বাচনে নমিনেশন পেপার দাখিল করে জামাল তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কিন্তু তিনি জামালকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমি একজন দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষ হয়ে কারো কাছ ক্যানভাস করতে যাব না, তুই নির্বাচনে জিতলে এই শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে, মাদকের ছোবলে যুব সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে, নিরীহ ব্যবসায়ীদের উপর চাঁদাবাজদের অত্যাচার বাড়বে, সন্ত্রাস বাড়বে।

জামাল আর কোন কথা বলতে পারেনি শুধু তার মা’র কাছে দোয়া চেয়ে চলে এসেছে। আজ কায়েস সাহেব যে কথা বললেন তাতে তার বাবার সহযোগিতা ছাড়া জামালের নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন হবে। কিন্তু জামাল তার বাবাকে চেনে তিনি একবার কোন বিষয়ে না বললে আর হ্যাঁ করেন না। জহির সাহেব অনন্যাকে খুব স্নেহ করেন, তাছাড়া জামালের একমাত্র ছেলে অয়নকে জহির সাহেব নিজের প্রাণের চেয়ে ভালোবাসেন। এখন জহির সাহেবকে ম্যানেজ করতে পারে অনন্যা আর অয়ন। হ্যাঁ হ্যাঁ জামাল তাই করবে শীঘ্রই অনন্যা আর অয়নকে নিয়ে তার বাবার কাছে যাবে। অয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে জহির সাহেব জামালকে ক্ষমা করতে পারেন।

জামাল একবার অনন্যার মুখের দিকে তাকাল।

অনন্যা ঘুমাচ্ছে, জামাল অনন্যাকে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে ডাক দিল, অনন্যা।

অনন্যা চোখ মেলে তাকাল, তুমি ঘুমাওনি।

জামাল বলল, অনন্যা তুমি একবার উঠবে?

অনন্যা বিছানায় উঠে বসল, তোমার কি কিছু হয়েছে?

না তেমন কিছু না।

তবে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

অনন্যা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

অনন্যা জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল জামালের কোন সমস্যা হয়েছে, যা অনন্যাকে দিয়ে সমাধান করতে চায় তাই জামাল মধুর সুরে এবং আদর্শ স্বামীর মতো কথা বলছে।

অনন্যা মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল, কি কথা?

অনন্যা তোমাকে একবার বাবার কাছে যেতে হবে। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

কেন?

অনন্যা ভোটের ক্যানভাস করতে গিয়ে বাবার জন্য আমি পদে পদে বাধা পাচ্ছি।

কেন বাবা আবার কি অপরাধ করলেন?

বাবা কোন অপরাধ করেনি বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপের কথা প্রায় সবাই জানে এনিয়ে নানান জনে নানান কথা বলছে, আসলে একজন জন প্রতিনিধির পরিবারে দ্বিমত থাকাটা ঠিক না।

এতদিন পর বুঝলে?

হ্যাঁ অনন্যা ভুল হয়ে গেছে, তোমাকেসহ একবার বাবার কাছে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস তুমি গেলে বাবা আমাকে ফেরাতে পারবেন না।

ঠিক আছে যাব তুমি এখন ঘুমাও তো।

অনন্যা তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে, বলে জামাল বিছানায় শুয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনন্যা আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো। কিন্তু জামালের চোখে ঘুম নাই। ক’দিন থেকে গোটা পৌরসভা ঘুরে জামাল যা দেখেছে তাতে নির্বাচনে তার জয়ী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। নিজের ঘরে, জনগণের কাছে, দলের কাছে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে মন্ত্রী আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবেন। তাছাড়া বেলায়েত ভাই’র ক্ষোভ আছে দলের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল। নির্বাচনে হেরে গেলে আমি অনেক পিছিয়ে পড়ব এমন কি আমার অস্তিত্ব বিলীনও হতে পারে। আর ভাবতে পারছে না জামাল। নির্বাচনে রায়হান সাহেবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামালের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ জেনে জামাল কয়েক দিন আগে গালপোড়া সেলিমকে রায়হান সাহেবকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে, এখনো তার কাছ থেকে কোন রেজাল্ট এলো না। রায়হান সাহেবকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে জামালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এক’শ পার্সেন্ট। জামাল বিছানায় ছটফট করে উঠল চোখের সম্মুখে গালপোড়া সেলিমের দৃঢ় প্রত্যয়ের দৃষ্টি ভেসে উঠল। গালপোড়া সেলিম এখনো কোন কাজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেনি। এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামালের মোবাইল সেট বেজে উঠল। মোবাইলের রিং টোন শুনেই জামাল বুঝতে পারল কারণ এই নাম্বারটা শুধুমাত্র আমীর, রহমত এবং সেলিমকে দেয়া আছে।

জামাল আশায় বুক বেঁধে মোবাইল রিসিভ  করল, হ্যালো।

বস অপারেশন সাকসেসফুল।

কোথায়? কিভাবে?

চেয়ারম্যান সাহেব ঢাকা যাচ্ছিলেন রাস্তায় বাসে ডাকাতি হয়, ডাকাতের ছুরির আঘাতে চেয়ারম্যানসহ দু’জন নিহত হয়েছে আরো কয়েকজন আহত হয়েছে।

অপারেশনে তুমি ছিলে নাকি?

না, আমার লোক ছিল।

পুলিশের ভিডিও ক্যামেরায়, তাদের ছবি আছে নাকি?

না তারা গাড়িতে উঠেনি, রাস্তায় গাছ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ডাকাতি, স্রেফ ডাকাতি করেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি কোন অস্বাভাবিক আচরণ করবে না, নরমাল থাকবে কাল সন্ধ্যায় একবার মধুকুঞ্জে এসো বলে জামাল মোবাইল অফ করল।

জামাল একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল, পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, তার পথের কাঁটা দূর হলো। জামালের ইচ্ছা হলো উচ্চস্বরে হেসে তার মনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে। কিন্তু জামাল তা করল না। অনেক কষ্টে মনের আনন্দ চেপে রেখে মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটা খুলল কারণ এই সিম কার্ডের মাধ্যমে গালপোড়া সেলিমের সাথে তার কথা হয়েছে। কোম্পানির কম্পিউটারে কল রেকর্ডে তার রেকর্ড রয়েছে। কোন কারণে পুলিশ সন্দেহ করলে এই সিম কার্ডটা তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও সিম কার্ডটি ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে কেনা হয়েছে।

জামাল মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটা খুলে ল্যাট্রিনের প্যানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ফ্লাশ ছেড়ে দিল। তারপরও একবার প্যানের দিকে তাকাল, না সিম কার্ডটা প্যানের ভিতরে আটকে নাই হয়ত পানির সঙ্গে সেপ্টিক ট্যাংকে চলে গেছে। জামাল তার অপরাধ জগতের সাক্ষী এই সিম কার্ড ফেলে দিয়ে যেন আরো নিশ্চিন্ত হলো। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল। ততক্ষণে অনন্যা বিছানায় হাত দিয়ে দেখেছে, জামালকে বিছানায় না পেয়ে দরজার আড়াল থেকে সবকিছু দেখেছে।

অনন্যা আবার জামাল বেডরুমে ঢুকবার আগেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

জামাল বেডরুমে ঢুকতেই অনন্যা বেড সুইচ অন করল।

জামাল এক রকম চমকে উঠল, তুমি ঘুমাওনি?

অনন্যা ইচ্ছা করেই ঘুম ভাঙ্গার ভান করে বলল, ঘুমিয়েছিলাম তুমি বিছানায় নাই দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মোবাইল এসেছিল?

জামাল একটা ঢোক গিলে বলল, জি।

অনন্যা বিছানায় উঠে বসল, এমন কার মোবাইল এসেছিল যে আমার সামনে কথা বলা গেল না?

জামাল ধমকের সুরে বলল, সব ব্যাপারে নাক গলাবে না। আমার ব্যবসা, রাজনীতি এসব ব্যাপারে তোমার সবকিছু জানার প্রয়োজন নাই।

আজকেই বাবার কাছে যাবার জন্য আমাকে রিকোয়েস্ট করলে আবার এখনই বলছ আমার কোন কিছু জানার প্রয়োজন নাই।

জামাল রাগান্বিত স্বরে বলল, এ বিষয়ে আমি এত রাতে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না। তোমাকে বাবার কাছে যেতে বলছি দেখে তুমি আমাকে জিম্মি করছ। ঠিক আছে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। চুপ কর প্লিজ আমি এখন ঘুমাবো।

অনন্যা আর কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পঁচাত্তর

রায়হান সাহেবের মৃত্যু সংবাদে সমস্ত শহরে শোকের ছায়া নামল। তাঁর লাশ শহরে পৌঁছামাত্র হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য তাঁর বাসায় ভিড় করল। জামাল চেয়ারম্যান সাহেবের লাশ বাসায় পৌঁছার খবর শুনে ছুটে গেল। সে প্রথমে একই বাসের যাত্রীর কাছে সবকিছু শুনল। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে রেবেকা ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলল।

সবকিছু শুনে জামাল বলল, ভাবী ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন, আল্লাহ তাঁর বেহেস্ত নসিব করবে। তাঁকে হারিয়ে পৌরসভা বাসী একজন নিবেদিত প্রাণ, দেশ সেবক হারালো, ভাই’র মনটা খুব উদার ছিল আমি নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন, বলতে গেলে তিনি আমার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমি অনেক কিছু শিখতে পারতাম, বলতে বলতে জামাল চোখ মুছলো। তারপর রেবেকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার জানা নাই মা, আমি ভাইকে খুব রেসপেক্ট করতাম তোমার মতো আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি, যা আমি তোমাকে বুঝাতে পারছি না। বাবা-মা সবার চিরদিন বেঁচে থাকে না। এটা কষ্ট করে সবাইকে মেনে নিতে হয়। তোমার বাবা একটা দুর্ঘটনায় আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি আছি মা তোমার বাবা নাই আমি আছি, তোমাদের যে কোন কাজে আমার কাছে এসো যে কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে সোজা আগে আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের মাথায় তুলে নিব। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে বলে জামাল লাশের কাছে গেল পাশে দাঁড়ান বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির কয়েকজন নেতা, কয়েকজন পুলিশ এবং একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে।

জামাল নেম প্লেটে নাম দেখে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ মামুন আপনি কি মামলার আই.ও।

মামুন সাহেব বললেন, জি।

আপনারা কোন ক্লু খুঁজে পেয়েছেন?

ঘটনাটা একটা ডাকাতি অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে তারা শুধু চেয়ারম্যান সাহেবকে খুন করত কিন্তু ডাকাতের ছুরির আঘাতে আরো একজন যাত্রী নিহত হয়েছে এবং কয়েকজন আহত হয়েছে।

জামাল মনে মনে বলল, যাক বাবা বাঁচা গেল পুলিশের দৃষ্টি অন্য দিকে আছে কাজেই আমার বিপদের আশংকা নেই।

জামাল ধমকের সুরে বলল, বাসে ডাকাতি হয়েছে ডাকাতের ছুরির আঘাতে দু’জন মারা গেছে এই বলে তো পার পাওয়া যাবে না। আপনারা কি ডাকাতদের ধরার চেষ্টা করছেন?

জি বিভিন্ন স্থানে ওয়ারলেস ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে।

আপনারা কবে ধরবেন। ভিডিওতে যেসব বাস যাত্রীর ছবি আছে তাদের মধ্যে কেউ সন্দেহজনক আছে কি?

ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে কিন্তু রাস্তায় ডাকাতি হওয়ায় ভিডিও ফুটেজে তাদের পাওয়া সম্ভব হবে না বলে আমার মনে হয়।

আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আপনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না, দেখুন আমার ভাই বিরোধী দলের একজন ডিসট্রিক্ট লিডার এবং পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান অথচ আপনি এটাকে একটা তুচ্ছ ডাকাতির ঘটনা বলে তাঁর হত্যাকাণ্ডকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন। রায়হান ভাই’র হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার না হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলে সমগ্র পুলিশ প্রশাসনের কি অবস্থা হবে আপনি বুঝেন? বলে জামাল ওসি সাহেবকে মোবাইল করল।

অপর পাশ থেকে ওসি সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, জি ভাই বলুন?

রায়হান ভাই হত্যাকাণ্ডের আসামী গ্রেফতার করতে পেরেছেন?

না চেষ্টা চলছে।

চেষ্টা চালান, আপনারা চেষ্টা চালাতে চালাতে ডাকাতরা নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাক।

অপর পাশ থেকে ওসি সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো না।

জামাল উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, আমি আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আসামী ধরতে ব্যর্থ হলে মনে রাখবেন আপনার ওসি গিরি এ পর্যন্তই শেষ। এত বড় একটা সেনসিটিভ ঘটনা আর আপনি সেই একই রকম কথা বলছেন, চেষ্টা চলছে। দেখি আমি এস.পি সাহেব এবং মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছি মনে রাখবেন সময় চব্বিশ ঘণ্টা, বলে জামাল মোবাইল অফ করল।

ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে জামাল উপস্থিত বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল লাশ দাফনের পর বিকেলে স্টেডিয়ামে এক শোক সভা অনুষ্ঠিত হবে তারপর শোক রেলি সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করবে বলে জামাল বের হলো। তার দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে সমস্ত শহর মাইকিং এর ব্যবস্থা করল। তারপর মোটর সাইকেল নিয়ে মধুকুঞ্জে রওয়ানা হলো।

জামাল মধুকুঞ্জে তার বেড রুমে ঢুকলো। প্রথমে মাননীয় মন্ত্রীকে মোবাইল করল।

জামাল বল।

বড় ভাই চেয়ারম্যান সাহেব ঢাকা যাচ্ছিলেন পথে বাসটা ডাকাতের কবলে পড়ে চেয়ারম্যান সাহেবসহ দু’জন ডাকাতের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে।

ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্নাইলাহি রাজেউন।

পুলিশ লাশ নিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ পর লাশ দাফন হবে। আমি বিকেলে শোক রেলির আয়োজন করেছি।

ভালো করেছ তুমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি যে উদারতা দেখাচ্ছ এটা তোমার রাজনৈতিক জীবনে সুফল বয়ে আনবে, কোন আসামী ধরা পড়েছে? আমি কি এস.পি সাহেবকে কিছু বলব?

জামাল নরম সুরে বলল, না বড় ভাই প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে বলব।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি দেখ, আমি এখন রাখছি।

তারপর জামাল এস.পি সাহেবকে মোবাইল করল, কি ব্যাপার বলুন তো?

জামাল বলল, এস.পি সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবকে হত্যাকারী ডাকাতদের ধরতে পেরেছেন?

না এখনো আসামী ধরা পড়েনি। সব জায়গায় ওয়ারল্যাস ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে শীঘ্রই ডাকাত ধরা পড়বে।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলে জামাল মোবাইল অফ করে ভয়ংকর একটা হাসি হেসে বলল, সবার দৃষ্টি ডাকাতের দিকে সাপও মরলো আর লাঠিও ভাঙ্গলো না।

মোবাইল অফ করে জামাল সেটটা খুলে পকেট থেকে একটা অন্য সিম কার্ড বের করে রহমতকে মোবাইল করল।

হ্যালো।

জামাল বলল, রহমত।

রহমত জামালের সুর বুঝতে পেরে বলল, বস, প্রথমে চিনতে পারিনি নতুন নাম্বার তো।

হ্যাঁ এই নাম্বারটা সেভ করে রাখ।

আচ্ছা ঠিক আছে, বস এর কি কিছু লাগবে?

হ্যাঁ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

রাত দশটায়, মধুকুঞ্জে।

জি বস ঠিক আছে।

ছিয়াত্তর

চেয়ারম্যান সাহেবের লাশ দাফনের পর স্টেডিয়ামে শোক সভা অনুষ্ঠিত হলো। শোক সভায় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল, বাংলাদেশ জন দরদী পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক সংগঠন এবং সকল শ্রেণীর মানুষের ঢল দেখে জামাল মনে মনে বলল, শালা চেয়ারম্যান তুই বেঁচে থাকলে তো শুধু এবার কেন জীবনে কোনদিন আমার পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়া হতো না।

বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির উপস্থাপনায় বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে শোকসভা শুরু হলো। বক্তৃতার এক পর্যায়ে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির সেক্রেটারি বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, আজকের এই শোক সভার সম্মানিত সভাপতি ও উপস্থিত সকল মুছল্লীগণ আস্‌সালামুআলায়কুম। আমি মরহুম চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। তিনি একজন সৎ, নীতিমান এবং নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি পৌরসভার যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। তিনি প্রথম যখন পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তখন পৌরসভার নিজস্ব ভবন ছিল না, শহরের রাস্তাঘাট কাঁচা ছিল, তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই শহরের অবকাঠামোগত যথেষ্ট উন্নয়ন করেছেন। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয় তিনি এই পৌরসভাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পৌরসভা থেকে প্রথম শ্রেণীর পৌরসভায় উন্নীত করেছেন। পৌরসভা থেকে বাল্য বিবাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, যৌতুকসহ নারী নির্যাতন মুক্ত হয়েছে। এই শহরের উন্নয়নে তাঁর অবদান পৌরবাসীর মনে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব ভদ্র, মার্জিত এবং সদালাপী ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ ছিল না তিনি ধনী-গরীব সব মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন। তিনি ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামি মুক্ত একজন উদারপন্থী মানুষ। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁর পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি দেন।

বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির সেক্রেটারির বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর উপস্থাপক জামালকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহবান জানালেন। জামাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল, আজকের সভার সম্মানিত সভাপতি, বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির  কর্মী ও নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত মুসল্লীগণ আস্‌সালামুআলায়কুম। আজকের এই শোকসভায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমার গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসছে। আমার আগে বাংলাদেশ জন দরদী পার্টির সেক্রেটারি রায়হান ভাই সম্পর্কে যে কথা বলেছেন সে বিষয়ে আমি তাঁর সাথে একমত। রায়হান ভাই’র সঙ্গে আমার বেশি দিন কাজ করার সুযোগ হয়নি তবু আমি যতটুকু মিশেছি তাতে আমি তাঁকে একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী হিসাবে জেনেছি। তাঁর মৃত্যু সংবাদে আমি দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছি। শুধু আমি কেন শহরের সমস্ত মানুষ তাঁর অকাল মৃত্যুতে মর্মাহত হয়েছে। আমি এই দুঃসংবাদ শোনামাত্র ছুটে এসেছি, পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়েছি মামলার আই. ও এবং ওসি সাহেবের ওপর আসামী ধরার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছি, মন্ত্রীকে মোবাইলে সমস্ত ঘটনা জানিয়েছি, এস.পি সাহেবকে দ্রুত আসামী ধরার জন্য রিকোয়েস্ট করেছি, শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে। আমি এস.পি সাহেবকে বলেছি অপরাধী যেই হোক না কেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনের কাঠগড়ায় সোপর্দ করতে। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন আসামী ধরার ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আমি রায়হান ভাই’র বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জামালের বক্তৃতার পর সভাপতি তাঁর বক্তব্য শেষ করে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। শোকসভা শেষে শোকরেলি শহর প্রদক্ষিণ করল, রেলি শেষ হওয়ার পর জামাল সোজা বাসায় চলে গেল। বাসায় ঢুকে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, অনন্যা তাড়াতাড়ি খেতে দাও।

অনন্যা কিছুটা অবাক হলো, তুমি এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলে, কেবল তো রাত দশটা বাজে।

তুমি বুঝতে পারছ না সামনে ইলেকশন আমার যে কত কাজ।

এখন তো আর বেশি কাজ থাকল না।

জামাল চমকে উঠল, কেন?

তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী মারা যাওয়ায় তুমি তো এখন খুব সহজে নির্বাচিত হবে বলতে গেলে তুমি পৌরসভার চেয়ারম্যান হচ্ছ তাতে কোন সন্দেহ নাই।

তা হয়ত সন্দেহ নাই তাই বলে হাতে পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না নির্বাচনের তফশিল আবার ঘোষণা হবে, জন দরদী পার্টি থেকে কাউকে মনোনয়ন দিবে তার সঙ্গে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে তাছাড়া একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তো আছে, রায়হান চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার ফলে বিরোধী দল স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সাপোর্ট দিবে ফলে তার সঙ্গে আমাকে কম্পিটিশন করতে হতে পারে।

অনন্যা আর কিছু বলল না জামালকে ডাইনিং টেবিলে ভাত দিয়ে বলল, তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি খাবার দিচিছ।

হাত মুখ ধোয়ার সময় নাই, বলে জামাল ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসল।

অনন্যা এখন ইলেকশনের কাজে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত তাই আমার ফিরতে দেরি হতে পারে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও না।

অনন্যা তিরস্কারের সুরে বলল, এটা আবার নতুন কি?

জামাল অনন্যার কথার কোন উত্তর দিল না নীরবে খাওয়া শেষ করে মোটর সাইকেল নিয়ে মধুকুঞ্জের দিকে রওনা হলো।

ততক্ষণে রহমত মধুকুঞ্জে প্রবেশ করেছে সঙ্গে বিশ/বাইশ বছর বয়সের অপূর্ব সুন্দর একটা মেয়ে।

জামাল মৃদু হাসল।

রহমত জামালের হাসি দেখে বলল, বস কিছু বলবেন?

না ভাবছি তোমার কালেকশন ভালো চল উপরে যাই, বলে জামাল সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠল।

রহমত চোখ টিপে মেয়েটাকে ইশারা করে জামালকে বলল, বস আমি আসি।

জামাল কোন কথা বলল না তার বেড রুমে ঢুকলো।

মেয়েটা জামালের পিছনে পিছনে তার বেড রুমে ঢুকলো।

জামাল রুমে ঢুকেই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটা বাধা দিয়ে বলল, একটু ধৈর্য ধরুন, আমি সারারাত আছি, একটু গল্প করি।

জামাল কিছুটা বিরক্ত বোধ করল।

মেয়েটা বলল, আমার নাম আলো।

আমি তো তোমার নাম শুনতে চাইনি।

কিন্তু যার সঙ্গে সারারাত কাটাবেন তার নামটা জানার ইচ্ছেটা কি আপনার নাই? এত কমার্শিয়াল হলে কি চলে?

জামাল আলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বাহ্‌ তোমার নামটা তো বেশ সুন্দর, তুমি দেখতেও বেশ সুন্দর, তোমার রূপের সঙ্গে নামের মিল আছে।

আলো জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব? উত্তর দিবেন?

জামাল বিরক্তির সুরে বলল, দেখ আমরা শুধুমাত্র আজকের রাতটা একসঙ্গে কাটাব তারপর আর কোনদিন হয়ত দেখা হবে না। আমরা জাস্ট এনজয় করব, বিয়ে তো করছি না কাজেই জিজ্ঞেস করার এত কি আছে?

দেখুন এনজয় করার জন্য দু’জনের মানসিকতার প্রয়োজন আছে আপনার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বললে যদি আমি খুশি হই তবে বলুন না প্লিজ?

বল কি জিজ্ঞেস করবে?

আপনার ঘরে বউ আছে না?

জামাল কিছু বলল না নীরবে বসে রইল।

আলো বলল, আমি যতটুকু জেনেছি আপনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। শুধুমাত্র ভোগবিলাসের জন্য যে মধুকুঞ্জের মতো এত বড় বিল্ডিং বানাতে পারে, যে কি না বড় একটা রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা, সমাজে যার স্থান সবার উপরে, সে যখন প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গ পাবার জন্য হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দেয় তখন বুঝতে হবে আপনার জীবনে এমন কিছু আছে যার কারণে আপনি ঘরে সুন্দরী বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সঙ্গে রাত কাটান?

আলোর কথায় জামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তার আগে বল, তুমি কতদূর লেখাপড়া করেছ?

আমি বি.এ পাস করেছি।

এখন বল আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিব।

বলুন।

আমি আমার জীবনকে একরকম খামখেয়ালি করে আজকের এ অবস্থায় পৌঁছেছি।

যেমন।

আমরা তিন বন্ধু এক সঙ্গে লেখাপড়া করতাম, শরীফ, আরিফ আর আমি। আমাদের সঙ্গে ঐশী নামে এক মেয়ে পড়ত। শরীফ আর আরিফ দু’জনে একদিন ইয়ার্কি করে ঐশীকে আমাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বাজি ধরে। আমিও বাজিতে রাজি হই। কিন্তু বাজিতে আমি হেরে যাই। ঐশী আমাকে অপমান করে উল্টো আরিফের প্রেমে পড়ে যায় এবং ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে এতে আমি নিজেকে অপমানিত বোধ করি।

শুধু কি এ কারণে আপনি ঘরে সুন্দরী বউ রেখে অন্য মেয়েকে নিয়ে এভাবে-

ঐ যে বলেছি খামখেয়ালি করে আমি আজকের এ অবস্থায় পৌঁছেছি।

তবে বিয়ে করলেন কেন?

অনেকদিন বিয়ে করিনি, বিয়ের বয়স প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছিল তখন মনের টানে নয় শুধুমাত্র সামাজিকতার কারণে এক জনের সঙ্গে একই ঘরে বসবাস করি।

কিন্তু আপনার স্ত্রীর তো কোন দোষ নাই।

না ওর কোন দোষ নাই, দোষ আমার কপালের। আলো আমার সব আছে টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, মধুকুঞ্জের মতো বিনোদন কেন্দ্র। ইচ্ছা করলেই আমি যা চাই তাই পাই, এই যেমন তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে, বিদেশি মদ আরো সব, সবকিছু দিয়ে আমি ঐশীর অপমান ভুলে যাবার চেষ্টা করছি, আমি আমার জীবনের একটা শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না আসলে ছোটবেলা থেকে আমার কোন অপ্রাপ্তি নাই তো, তাই ঐশীকে না পাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছি না, শুধু ওকে না পাওয়াটা না আমাকে অপমান করাটাও আমার জীবনের সব সফলতা ম্লান করে দেয় । একবার যদি ঐশীকে দেখতে পাই তবে মধুকুঞ্জে এনে ওর সব অহংকার ভেঙ্গে দিব।

আলো জামালের কাছে গেল তার দু’চোখ মুছে দিয়ে বলল, সরি বন্ধু আসলে আমি এসেছি আপনাকে আনন্দ দিতে কিন্তু দেখুন আপনাকে আনন্দ না দিয়ে আপনার কষ্ট বাড়িয়ে দিলাম।

না, না আলো আমার এই মধুকুঞ্জে অনেকে এসেছে, অনেকের সঙ্গে আমি এনজয় করেছি কিন্তু কেউ কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি। সবাই আমাকে সুখ দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে কিন্তু আমার মনের কথাটা জানতে চায়নি। আজ তুমি জানতে চেয়েছ আমার কষ্ট অনেকটা হালকা করে দিলে, বলে জামাল আলোর মুখ উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, খুব অল্প সময়ে আমি তোমার প্রেমে পড়লাম। আমার মনে হচ্ছে আমার বয়সটা যেন হঠাৎ করে কমে গেল।

সাতাত্তর

অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন বিরোধী দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামাল বিপুল ভোটে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলো। নির্বাচনের পরদিন সকালবেলা বিশালাকার এক মিছিল বের হলো। জামাল গলায় মালা পরে সবার সামনে হেঁটে চলছে, পিছনে পিছনে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উৎফুল্ল জনতা স্লোগান দিয়ে চলছে। মিছিল পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি আসতেই জামাল বাদ্যযন্ত্র বন্ধ করার ইঙ্গিত দিয়ে পাম্পে ঢুকলো।

জহির সাহেব তখন পাম্পে বসে ছিলেন।

জামাল পা ছুঁয়ে সালাম করতেই জহির সাহেব পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, নির্বাচনে জিতেছিস দেখে তোকে জনগণ রেসপেক্ট করে এটা কখনো মনে করিস না, তোর অপজিটে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে তুই নির্বাচনে জিতেছিস। তা না হলে তোর মতো একটা বাটপার, লুটেরা, মাদক ব্যবসায়ী কখনো পৌরসভার চেয়ারম্যান হতে পারতো না। তুই যা আমার পাম্প থেকে বেরিয়ে যা। জামালের দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, বাবা তুমি এমন আনন্দের দিনে আমাকে তাড়িয়ে দিলে? আমি যেন সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি দোয়া করবে না?

জহির সাহেব বললেন, তুই অবশ্যই পারবি, আমার দোয়া না হলেও তোর কোন অসুবিধা হবে না। তোর মতো জনপ্রতিনিধিকে আমি ঘৃণা করি।

জামাল আর কোন কথা না বলে পাম্প থেকে বেরিয়ে এলো। আনন্দ মিছিল সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করল, আজ জামালের মনে হলো সে দিনে দিনে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। মিছিল শেষে জামাল বাসায় গেল। অনন্যা ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে ভাত বাড়িয়ে দিয়েছে। জামাল হাসতে হাসতে বাসায় প্রবেশ করল। অয়ন হাঁটি হাঁটি পা পা করে জামালের কাছে এলো। জামাল অয়নকে কোলে তুলে নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল।

অনন্যা সামনে এসে দাঁড়াল তার চোখে-মুখে কোন আনন্দ নাই, স্বামীর বিজয়ে সে যেন খুশি হয়নি। জামালের ধারণা ছিল নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় অনন্যা খুশি হবে কিন্তু সে মোটেই খুশি হলো না।

জামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, অনন্যা তুমি খুশি হওনি।

অনন্যা নিষ্প্রাণ এবং শুষ্ক হাসি হেসে মৃদু কণ্ঠে বলল, তুমি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছ আর আমি খুশি হব না, তুমিই বল আমার চেয়ে কি অন্য কারো বেশি খুশি হওয়া উচিত?

অনন্যার কথার শেষদিকে জামালের প্রতি তার ঘৃণার সুর ফুটে উঠল।

জামাল অয়নকে কোল থেকে নামিয়ে অনন্যার দু’বাহুতে হাত রেখে বলল, অনন্যা সত্যি করে বলতো তুমি কি খুশি হওনি?

অনন্যা কোন কথা বলল না।

জামাল নিরাশ হয়ে বলল, অনন্যা আমি কিছুতেই বুঝতে পাচ্ছি না তুমি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছ কেন? পৃথিবীতে কে এমন স্ত্রী আছে যে স্বামীর উন্নতিতে খুশি না হয়ে থাকতে পারে?

না পারে না কিন্তু সেটা হতে হবে উন্নতি। তুমি যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছ এটাকে উন্নতি বলে না বরং উন্নতি না বলে অবনতি বলাই উচিত।

কেন?

তোমার কি উন্নতি হয়েছে? টাকা-পয়সা হয়েছে, গাড়ি-বাড়ি হয়েছে, মধুকুঞ্জের মতো প্রমোদখানা হয়েছে এটাকে কি তুমি উন্নতি বলছ?

হ্যাঁ অবশ্যই।

তুমি তো এটাই বলবে কারণ তুমি উন্নতির সংজ্ঞা জানো না, আমার বাবা স্কুল টিচার ছিলেন তিনি আমাকে উন্নতির সংজ্ঞা শিখিয়েছেন। আমার শ্বশুর অনেক উঁচু মানের মানুষ তিনিও নিশ্চয়ই উন্নতির সংজ্ঞা জানেন কিন্তু তিনি তোমাকে উন্নতির সংজ্ঞা শেখাতে পারেন নি। তাই তুমি শিখেছ উন্নতি মানে স্মাগলিং, ড্রাগ-বিজনেস, ব্যাংক-প্রতারণা, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক হয়রানী করে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, তাই তুমি এখন তথাকথিত উন্নতির নেশায় উন্মাদ হয়েছ। আসলে উন্নতির নেশায় তুমি মানসিক রোগী হয়েছ।

জামাল ধমকের সুরে বলল, অনন্যা আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে তুমি কিন্তু ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করছ।

আমি আবার কি করলাম? আমি শুধু চরম সত্যি কথাগুলো তোমাকে বললাম। কোনটা মিথ্যা বল? তুমি ব্যাংকের লোন নিয়ে গোডাউনে তুষ ঢুকিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করনি? এই শহরের কে না জানে তুমি মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায় তোমার প্রতিপক্ষের ক্যাডার কালা মাহবুবকে তুমি মারনি? বাস ডাকাতির নাম করে রায়হান চেয়ারম্যানকে তুমি হত্যা কর নি? তুমি মনে কর আমি কিছু জানি না?

এতদিন তো জানতাম তুমি কিছু জানো না এখন তো দেখছি তুমি সবকিছু জেনে ফেলেছ, বলে জামাল মনে মনে বলল, তবে তো আর তোমাকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না।

অনন্যা বলল, কি ভাবছ?

জামাল বলল, ভাবছি রাজনীতি করতে করতে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখছিলাম। একদিন এম.পি, মন্ত্রী হব কিন্তু পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েই দেখছি কুফা লেগে গেল।

কুফা বলে কোন কথা নাই, এটা কুসংস্কার মাত্র। তুমি যদি ভালো কাজ কর, জনগণের মন জয় করতে পার, জনগণ যদি তোমাকে ভোট দেয় তবে তুমি অবশ্যই এম.পি হবে, মন্ত্রী হবে। কিন্তু তা তো তুমি করবে না। তুমি টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে চাও, মধুকুঞ্জে মদ আর নিত্য নতুন কল গার্ল নিয়ে ফুর্তি করতে চাও, তুমি কি ভাবছ জনগণ এসবের কিছু জানে না? এবার না হয় রায়হান চেয়ারম্যানকে মেরে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী যোগ্য প্রার্থীর অভাবে তোমাকেই ভোট দিল সব সময় তো আর এমন হবে না রাজনীতিতে জনগণের মনজয় করার বিকল্প নাই।

বাঃ তুমি তো বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পার আমি জনগণের মনজয় করতে পারব না কে বলেছে? তোমার মতো জ্ঞানী স্ত্রী যার ঘরে আছে তাকে দিয়ে জনগণের মনজয় করা মোটেই কঠিন হবে না। তুমি আমাকে শিখিয়ে দিবে, তুমিও রাজনীতি করবে, আমার মনে হয় রাজনীতি করলে তুমি খুব অল্প দিনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক মহিলা দলের জেলা শাখার সভানেত্রী হতে পারবে।

অনন্যা ঘৃণার সুরে বলল, আমি করব রাজনীতি? তোমার কাছ থেকে রাজনীতির যে ঘৃণ্য রূপ দেখলাম তাতে রাজনীতি ওপর থেকে আমার শ্রদ্ধা উঠে গেছে।

জামাল দেখল অনন্যা আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে তাই সে অনন্যার রাগ কিছুটা প্রশমিত করার জন্য অনন্যাকে বুকে জড়িয়ে বলল, লক্ষ্মী বউ আমার, আমিও তোমাকে রাজনীতি করতে দিতে চাই না। তুমি ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাকবে। তারপর মনে মনে বলল, তুমি আমার সব অপকর্মের সাক্ষী কাজেই ক’টা দিন এভাবে থাক সুযোগ বুঝে তোমাকেও ট্রান্সফার করে দিতে হবে।

অনন্যা বলল, আমি ঘরের লক্ষ্মী আর মধুকুঞ্জের জন্য অন্য লক্ষ্মী আছে, না?

ছিঃ অনন্যা সবসময় আজে-বাজে কথা বল না তো।

অনন্যা জামালের বুকে মাথা রেখে বলল, তুমি একটু সংযত হও, আমাদের সুন্দর ফুট ফুটে একটা ছেলে আছে, ওর সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে, আমি আছি, আমার কি নাই বল? তোমার মধুকুঞ্জের প্রমোদ বালারা কি আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত? সুন্দরী?

জামাল কোন কথা না বলে অনন্যার পিঠে হাত বুলাতে লাগল।

আটাত্তর

আজ সারাদিন জামালের খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিন কেটে গেছে। সন্ধ্যায় অফিসে ঢুকে চেয়ারে হেলান দিয়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইল। জামালের কানে বার বার অনন্যার কথাগুলো বেজে উঠল। জামাল রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করেছে বিভিন্নভাবে কিন্তু তার ঘরের মধ্যে দিনে দিনে যে কালসাপ বেড়ে উঠেছে একথা জামাল কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। তার ধারণা ছিল অনন্যা শুধু সংসার নিয়েই ব্যস্ত আছে আসলে তার ধারণা ঠিক নয়, অনন্যা তার সমস্ত অপকর্ম জেনে ফেলেছে। অনন্যা তার স্ত্রী, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতো তাকে ঘায়েল করার কোন উপায় নাই। কিন্তু সবকিছু জানলেও স্ত্রী হয়ে অনন্যা কি কখনো তার বিরুদ্ধাচরণ করবে? তা হয়ত করবে না, কিন্তু জামালের আচরণে অনন্যা সন্তুষ্ট নয় কাজেই অনন্যার এই অসন্তোষের কারণে যদি কখনো ডিভোর্স হয়ে যায় তবে অনন্যা তার সমস্ত অপকর্মের সাক্ষী হতে পারে। কাজেই অনন্যাকে ডিভোর্স করলেই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না আবার অনন্যাকে মেরে ফেললে তার দায়-দায়িত্ব জামালের উপরই বর্তায়। এমনভাবে নানান কথা ভাবতে ভাবতে জামাল একরকম আনমনা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর পিয়ন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার শব্দে জামাল চোখ মেলে তাকাল।

পিয়ন একটা ভিজিটিং কার্ড জামালের হাতে দিয়ে বলল, ভাইজান এক ভদ্র মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

জামাল চমকে উঠল, মনে মনে বলল আমার এমন বেরসিক অফিসে ভদ্র মহিলা?

তারপর কার্ডটা পড়ে দেখল বিপ্লবী বেগম, ডেভলাপমেন্ট অফিসার, ফিউচার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লি:।

জামাল বলল, ঠিক আছে আসতে বল।

কয়েক মিনিট পর একজন ভদ্র মহিলা জামালের চেম্বারে ঢুকে তার পরিচয় দিল।

বসুন প্লিজ বলে জামাল তার পরিচয় দিতেই বিল্পবী বলল, আমি আপনাকে চিনি ভাইয়া আপনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলের জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি।

জামাল মৃদু হেসে বলল, হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।

বিপ্লবী জামালকে হাসতে দেখ কিছুটা আশ্বস্ত হলো। সে জামালের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ইনস্যুরেন্সটা বোধ হয় হবে, পার্টিও বড় ইনস্যুরেন্সটা হলে বেশ বড় এ্যামাউন্টের হবে।

জামাল বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিপ্লবী বলুন কি মনে করে আমার কাছে এসেছেন?

ভাইয়া আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট আমাকে তুমি বলবেন প্লিজ।

আচ্ছা বল।

বিপ্লবী বলল, ভাইয়া আসলে আমার জন্য কিছু করতে হবে না, আমি বলছিলাম আপনার নিজের জন্য কিছু করার কথা।

জামাল অবাক হয়ে বলল, আমার নিজের কথা?

হ্যাঁ আপনার কথা, এই ধরুন আপনি, আমি, আমরা সবাই তো কোন না কোন যানবাহনে চলাচল করি। আল্লাহ না করুন যদি কোন দুর্ঘটনায় আমরা মারা যাই বা পঙ্গু হয়ে যাই বা কাজ কর্ম করতে অক্ষম হই তবে আমাদের প্রত্যেকের পরিবারের প্রতি যে দায়িত্ব আছে তা পালন করব কিভাবে? তাই এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত সিচ্যুয়েশন ফেইস করার জন্য সকলের চাই আর্থিক নিরাপত্তা সে জন্যই সবার অন্তত: একটা করে লাইফ ইনস্যুরেন্স থাকা প্রয়োজন।

জামাল বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আমার সঙ্গে বিটলামী কর, তোমার নিজের কোন লাভ নাই, সবকিছু আমার জন্য। চাকরি কর বেতন পাও, আমি ইনস্যুরেন্স করলে তুমি কমিশন পাবে মনে কর আমি কিছু জানি না, বুঝি না, নিজেকে খুব চালাক ভাবো। আমি এত বোকা নই। আমার জন্য দরদ একেবারে উতলে পড়ছে। ইনস্যুরেন্স করব তবে তার সঙ্গে আমি বোনাস হিসেবে চাই তোমার এই সুন্দর দেহটা।

জামালকে আনমনা দেখে বিপ্লবী বলল, জামাল ভাই কিছু ভাবছেন?

হ্যাঁ ভাবছি তো বটেই।

আপনি কিছু ভাববেন না আপনি আপনার জন্য একটা আর ভাবীর জন্য একটা ইনস্যুরেন্স করুন আর ভাবনাটা ছেড়ে দিন আমাদের উপর। একটা প্রিমিয়াম জমা দেয়ার পরও যদি আল্লাহ না করুন আপনি কোন দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন এমনকি নরমাল ডেথও হয় কিংবা শরীরের কোন অংশ দুর্ঘটনায় অক্ষম হয়ে যায় তবুও আপনার নমিনি পাবে বোনাসসহ দাবীকৃত সমস্ত টাকা।

জামাল একটু নড়েচড়ে বসল।

বিপ্লবী বলল, আপনি ধনী মানুষ আপনার জন্যে বড় এ্যামাউন্টের মিনিমাম দু’টা ইনস্যুরেন্স থাকা প্রয়োজন।

জামাল একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ।

বিপ্লবী একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে মনে মনে বলল, যাক ইনস্যুরেন্সটা তাহলে হবে এখন এ্যামাউন্টটা বাড়াতে পারলেই হয়।

জামাল বিপ্লবীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আজ সারাদিন বেশ ঝামেলার মধ্যে ছিলাম একটার পর একটা কাজ করতে করতে হাফিয়ে উঠেছিলাম তোমাকে দেখে ক্লান্তি অনেকটা দূর হলো। মনে হলো আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।

লজ্জায় বিপ্লবী কিছুটা সংকুচিত হলো।

জামাল বলল, না তুমি বিষয়টাকে অন্যভাবে নিও না ইনস্যুরেন্সটা করলে কয়েক লাখ টাকার একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ হয়ে যায় এটা আমি জানি।

বিপ্লবী মৃদু হেসে বলল, জি ভাইয়া।

জামাল প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, বিপ্লবী তোমাকে কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি? অবশ্য তুমি যদি অনুমতি দাও?

জি বলুন।

তোমার হ্যাসবেন্ড কি করে?

বিপ্লবী লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল, ভাইয়া আমার এখনো বিয়েই হয়নি।

জামাল মনে মনে বলল, হ্যাঁ এমনই তো চেয়েছিলাম তারপর বলল, তাহলে তুমি মোটামুটি স্বাধীনভাবে চাকরিতে বেশ সময় দিতে পার। আমার কি মনে হয় জানো?

কি?

তোমার মতো সুন্দরী, ট্যালেন্ট, স্মার্ট মেয়েদের জন্য এ পেশায় সুনাম অর্জন করা সহজ।

বিপ্লবী খুব চালাক মেয়ে সে প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ভাইয়া কত টাকার ইনস্যুরেন্স করবেন?

জামাল মনে মনে বলল, এখনি সব মিটিয়ে ফেললে তোমাকে একবার মধুকুঞ্জে পাওয়া যাবে কিভাবে?

বিপ্লবী বলল, ভাইয়া আমি আশা করছি আপনি কমপক্ষে পঞ্চাশ লাখ টাকার করে দু’টা ইনস্যুরেন্স করবেন।

হ্যাঁ আমি অবশ্য বড় ইনস্যুরেন্সই করব। পঞ্চাশ লাখ টাকার করে দু’টা ইনস্যুরেন্স করলে বার্ষিক কত টাকা প্রিমিয়াম হবে? কি কি কাগজ-পত্র লাগবে?

কাগজ-পত্রের মধ্যে এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেট, দু’কপি ছবি আর প্রিমিয়াম হবে-বলে বিপ্লবী একটা বই বের করে প্রিমিয়ামের টাকার এ্যামাউন্ট জানিয়ে দিল।

জামাল সবকিছু শুনে একবার বিপ্লবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিপ্লবী আমি এখানে আসলে অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকি তুমি এক সময় মোবাইল করে মধুকুঞ্জে এসো।

মধুকুঞ্জে।

হ্যাঁ আমি একটু ভেবে দেখি, তুমি যোগাযোগ রেখো, আমি বললে তুমি মধুকুঞ্জে চলে এসো, কেমন। মধুকুঞ্জে যেতে তোমার কোন অসুবিধা নাই তো?

অনেকের কাছে শুনেছি আনন্দনগর নদীর ধারে আপনি নাকি মধুকুঞ্জ নামে একটা খুব ভালো খামারবাড়ি করেছেন, মধুকুঞ্জ নাকি দর্শনীয় স্থান হিসেবে অতুলনীয়, আমি মনে মনে ভাবছিলাম কিভাবে একবার ভিতরে ঢোকার সুযোগ পাব? ভালোই হলো।  আপনার কি আগামীকাল সময় হবে?

জামাল ড্রয়ার থেকে ডায়রি বের করে দেখে বলল, আগামীকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমি ব্যস্ত আছি তুমি না হয় তারপর এসো।

জি ভাইয়া থ্যাংক ইউ সো মাচ, বলে বিপ্লবী চলে গেল।

জামাল মনে মনে বলল, এক ঢিলে দু’পাখি একটা ইনস্যুরেন্স করব আমার নামে আর একটা অনন্যার নামে সুযোগ বুঝে ঘরের শত্রু অনন্যাকে বিদায় করে পাব ইনস্যুরেন্সের প্রচুর টাকা আর বোনাস হিসেবে বিপ্লবীকে-

চলবে…

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in উপন্যাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*