এসো একসাথে

কণ্ঠস্বরটা পরিচিতই মনে হচ্ছে কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না আর ফোনের ওপাশ থেকে সেই কণ্ঠস্বর বার বার মনিরুলকে কটাক্ষ করছে, মনে পড়বে না তো, কেউ একবার উপরে উঠে গেলে আর নিচের দিকে ফিরেও তাকায় না।

মনিরুল কিছুটা বিরক্ত হলো, আমি মনিরুল ঠিক আছে কিন্তু কীসব বড় ছোট বলছেন আমি বুঝতে পারছি না, আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

আরে না, না, আমার ভুল হবে কেনো, আমি ঠিক নাম্বারে ফোন করেছি। তুই চিনতে পারছিস না সেটা তোর দোষ। আমি আনিস, উনিশশ চূরাশির ব্যাচ, বিরল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

মনিরুল এবার চিনতে পারলো, এই বেটা আগে বলবি তো। কেমন আছিস? কোথায় আছিস?

আমি আর কোথায় থাকবো সেই যে প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি শুরু করেছি তো সেই মাস্টারই আছি।

কেনো শিক্ষকতা তো ভালো পেশা, সম্মানের পেশা।

আনিস ক্ষোভের সুরে বলল, হ্যাঁ, ভালো তো, এসে একদিন ছোট ছোট বাচ্চা পড়াস, আরে দুষ্টু রে দুষ্টু এখনকার বাচ্চা। আর বেতন তো জানিস, নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

যা দিনকাল পড়েছে, নুন আনতে পান্তা সবারই ফুরায় দোস্ত বলে মনিরুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। আচ্ছা তারপর বল আর কী খবর?

তোকে একটা খবর দেয়ার জন্য ফোন করলাম।

কী খবর?

আমাদের স্কুলে তো অনুষ্ঠান হবে।

কীসের অনুষ্ঠান?

আরে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। আমি সেজন্য তোকে ফোন করেছি। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে চূরাশি ব্যাচের সবার সাথে যোগাযোগ করা, রেজিস্ট্রেশন করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাহ খুব ভালো তো।

তোকে কিন্তু আসতে হবে, না বলতে পারবি না। কতদিন কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না।

ঠিকই বলেছিস। আমি অবশ্যই আসবো।

আরো অনেকক্ষণ দুই বন্ধু কথা বলার পর আনিস ফোন রাখল।

সেদিন আনিসের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে মনিরুলের সেই শৈশব কৈশোরের কথা মনে পড়ছে। কত হই চই আনন্দময় ছিল দিনগুলো। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত পাঁচ বছরের একটা নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল সবার মধ্যে। এস.এস.সি পাসের পর কে কোথায় ছড়িয়ে পড়ল। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ছিল না, থাকলে হয়তো পরস্পরের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যম হতে পারতো।

মনিরুলের বাবা সরকারি চাকুরি করতো, তার পোস্টিং ছিল বিরল উপজেলায়। বাবার চাকরি সূত্রে মনিরুল বিরল পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। এস.এস.সি পাসের পর মনিরুল দিনাজপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হলো, তার বাবাও তখন দিনাজপুর সদর উপজেলায় বদলি হলো। তখন পর্যন্ত কারো কারো সাথে যোগাযোগ ছিল কিন্তু দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো তখন সব যোগসূত্র যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। কে কোথায় চলে গেল আর কারো সাথে কারো যোগাযোগ রইল না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে দুয়েকজনের সঙ্গে মনিরুলের যোগাযোগ হয়েছে, যারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু যারা জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, তাদের খবর কেউ রাখে না, যদিও তাদের সংখ্যাই বেশি। কথায় কথায় আনিস বলল মিনিমাম একটা রেজিস্ট্রেশন ফি ধরা হয়েছে তবে শুধু রেজিস্ট্রেশনের টাকায় সব খরচ মেটানো যাবে না। তাই আয়োজকরা কিছু স্পন্সার এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা বিত্তবান তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক বেশি বেশি করে টাকা দিবে। তুই চাইলেও বেশি দিতে পারিস।

 

কয়েক বছর আগে শফিকুলের সঙ্গে মনিরুলের দেখা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে। শফিকুল ডিসি অফিসে চাকরি করে, ঢাকা এসেছিল চিকিৎসা করতে, ইবনে সিনায় দেখা হলো। অনেকদিন পর দেখা, মনিরুল প্রথমে চিনতে পারেনি, শফিকুল মনিরুলকে জিজ্ঞেস করল, তুই মনিরুল না?

মনিরুল চমকে উঠল। শফিকুল দাড়ি রেখেছে, তাকে অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছে। মনিরুল আমতা আমতা করে বলল, তুই, শফিকুল না?

হ্যাঁ চিনতে পারছিস তাহলে? বলে শফিকুল মনিরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ কথা হলো, মনিরুল তার বাসায় নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু শফিকুল রাতের ট্রেনে দিনাজপুর ফিরবে বলে বাসায় নিয়ে আসা হয়নি। শফিকুল অবশ্য কয়েকজন বন্ধুর কথা বলতে পারলো যেমন : মুরাদ, বিপ্লব, সাজ্জাদ এদের কথা কিন্তু বেশিরভাগের কথা বলতে পারলো না। তানজিনা তানু নামে একটা মেয়ে পড়তো, মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মেধাবী, গান গাইতো, কবিতা আবৃত্তি করতো। পুরো স্কুলের সবাই তাকে এক নামে চিনতো, বেশিরভাগ ছেলে সখ্য গড়ে তোলার জন্য তানুর পিছনে ঘুরঘুর করতো, মনিরুল নিজেও কম চেষ্টা করেনি কিন্তু মেয়েটার মধ্যে একটা অহঙ্কার ছিল।

শফিকুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনিরুলের চোখের সামনে তানুর সুন্দর মুখশ্রী ভেসে উঠল, আচ্ছা আমাদের সঙ্গে একটা মেয়ে পড়তো না, তানু।

শফিকুল মনিরুলের পিঠ চাপড়ে বলল, তুই তো দেখি বুড়ো বয়সেও তানুকে ভুলতে পারিস নি বলেই শফিকুল হা হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসলো। তারপর বলল, না রে, তানুর খবর আমার কাছে নেই।

 

দেখতে দেখতে মিলনমেলার দিন ঘনিয়ে এলো। মনিরুলের শিডিউল হলো অনুষ্ঠানের দিন ফার্স্ট ফ্লাইটে সৈয়দপুর যাবে, সেখান থেকে একটা প্রাইভেট কার ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠানে যাবে, অনুষ্ঠান শেষে সেই গাড়িতে সৈয়দপুর এসে লাস্ট ফ্লাইটে ঢাকা ফিরবে। মনিরুলের শিডিউল শুনে বউ টিটকারি করল, কী ব্যাপার তুমি তো খুব সহজে ঢাকার বাইরে যেতে চাও না, অথচ সেই কবে স্কুলে পড়েছ তার পুনর্মিলনীতে যেতে চাচ্ছো। কিছু আছে নাকি সেই আমলের?

মনিরুল শম্পার কথার অর্থ বুঝতে পারল, তবুও না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল, মানে?

না, মানে আমি বলছিলাম আগের দিনের গ্রাম্য কিশোরীর সাথে কিছু থাকলে তো থাকতেও তো পারে। ছেলেমানুষ বলে কথা।

মনিরুল একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, কত বছর আগের কথা জানো। সেইসব কিশোরীরা সবাই বুড়ি হয়েছে। কাজেই নো টেনশন।

শম্পা আর কথা বাড়ালো না, একটা মুচকি হাসি হেসে রান্নার কাজে মনোযোগ দিলো।

 

মনিরুল স্কুলের গেটে পৌঁছালো সকাল এগারোটায়। সৈয়দপুর নেমে মনিরুল আনিস আর শফিকুলকে ফোন করেছে, তখন থেকে দুজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। স্কুলের গেটে পৌঁছাতেই দুজনে এগিয়ে এলো। মনিরুল গাড়ি থেকে নেমে দুজনের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করলো। তাদের সঙ্গে থাকা সুন্দরী রমণীকে চিনতে মনিরুলের ভুল হলো না। সে আর কেউ না, মনিরুল মনে মনে যাকে প্রত্যাশা করেছিল সেই তানু। তানু এখনো সুন্দরই আছে, বয়সের কারণে চামড়ায় কিছুটা ভাঁজ পড়েছে আর মুটিয়ে গেছে। তানু সালাম দিল, আসসালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরে মেঘ না চাইতেই জল। কেমন আছিস তোরা সবাই?

আনিস আর শফিকুল একসাথে বলল, ভালো। তোর আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

আরে না কী অসুবিধা হবে। তানু তুই কেমন আছিস?

ভালো আলহামদুলিল্লাহ।

অনেকদিন দেখা নেই। কারো সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগও নেই। শফিকুলের সঙ্গে দেখা হয়েছে ভাগ্যক্রমে, ভাগ্যক্রমেই বলতে হয় কারণ ঢাকা শহরে কোটি মানুষের ভিড়ে এভাবে কারো সঙ্গে দেখা হয় না। আর আনিস তো ফোন করল এই অনুষ্ঠানের জন্য তারপর আনিসের কথা জানলাম। তানু তোর খবর কী?

আমার আর কী খবর? লেখাপড়ার পাঠ তো চুকে গেল সেই ইন্টার পাসেই তারপর বিয়ে, বিয়ের পর থেকে সংসার…

তোর সাহেব কী করে? মনিরুল জিজ্ঞেস করল।

ব্যবসা করে, দিনাজপুরে।

আসে শুধু ব্যবসা না, ব্যবসা তো কটকটি বেচাকেও বলে, ওর হ্যাজবেন্ড অনেক বড় বিজনেসম্যান।

তাহলে তো খুব ভালো। শুনে ভালো লাগলো।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনজনে কয়েকমিনিট কথা বলল তারপর মনিরুল জিজ্ঞেস করল, তোরা আমাদের ব্যাচের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিস?

আনিস মিনমিন করে বলল, এখন কি আর সেদিন আছে যে কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসবে। আমার কাছে যাদের মোবাইল নাম্বার ছিল আর যারা ফেসবুক ব্যবহার করে শুধু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আর আমাদের বয়সের কজনই বা ফেসবুক ব্যবহার করে বল।

তা অবশ্য ঠিক।

আমিও কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কাউকে পেয়েছি, কাউকে পাইনি। কারো কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

কার কথা শুনে? শফিকুল জিজ্ঞেস করল।

আমাদের ক্লাসের যে মেয়েটা ফার্স্ট ছিল, রেনু। নিশ্চয়ই রেনুর নাম তোদের মনে আছে?

হ্যাঁ কী হয়েছে ওর? মনিরুল জিজ্ঞেস করল।

ও খুব অসুস্থ। কিডনির সমস্যা, বিছানায় পড়ে আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না, যেকোনো সময় মৃত্যৃর খবর আসতে পারে কথাটা বলতে বলতে তানুর গলার স্বর বুজে এলো।

আমাদের সবার উচিত রেনুর পাশে দাঁড়ানো। তুই এক কাজ কর। আমাকে রেনুর মোবাইল নাম্বারটা দে, আমি কথা বলবো। দেখি আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে যদি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।

তোর মোবাইল নাম্বার দে আমি ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।

মনিরুল তার মোবাইল নাম্বার বলল, তানু মনিরুলের মোবাইলে রেনুর মোবাইল নাম্বার ম্যাসেজ করে দিল।

সবাই হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের দিকে আসছিল কিন্তু এখনো তেমন জমজমাট হয়নি, শফিকুল বলল, এখনই সিটে বসে কী করবি তারচেয়ে বাদাম খাই বলে সে বাদাম, এই বাদাম বলে জোরে বাদামওয়ালাকে ডাক দিল।

বাদামওয়ালা একবার আড়চোখে দেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

আশ্চর্য, বাদামওয়ালা শুনতে পেয়েও চলে যাচ্ছে বলে শফিকুল জোরে হেঁটে গিয়ে বাদামওয়ালার সামনে গিয়ে একরকম পথরোধ করে দাঁড়ালো, আপনি আমার ডাক শুনে চলে যাচ্ছেন কেনো?

বাদামওয়ালা শফিকুলের সমবয়সীই হবে কিন্তু বয়স বেশি বলে মনে হচ্ছে। লম্বা, শুকনা, রোগা রোগা চেহারা, চুল-দাড়ি পেকে গেছে, মুখমণ্ডলের চামড়াগুলো জড়সড় হয়ে গেছে। কাঁধে ঝুলানো বাদামের ডালি। সে মাথা নিচু করে বলল, বাদাম নিবেন?

কেনো জানি বাদামওয়ালা তার কাছে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। শফিকুল বুঝতে পারল কোনো একটা ঝামেলা আছে। সেও নাছোড়বান্দা। বলল, একশ গ্রাম বাদাম দেন।

বাদামাওয়ালা মাপতে মাপতে শফিকুল তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করল কিন্তু তবুও চিনতে পারছে না। এবার টাকা দেয়ার সময় সে টাকাটা একটু উঁচু করে ধরলো যেন টাকা নেয়ার সময় বাদামওয়ালার মুখ দেখতে পায়। হলোও তাই। সে টাকা দেয়ার সময় বাদামওয়ালাকে চিনতে পেরে আঁতকে উঠল, বারি তুই?

ততক্ষণে পিছন থেকে আনিস, মনিরুল আর তানু এসে পড়েছে। সে শফিকুলকে জিজ্ঞেস করল, কী হলো?

এ আমাদের বারি। আব্দুল বারি, রোল নাম্বার সেভেন। ওর রোল প্রায় সেভেন হতো।

বারি প্রতিবাদ করল, কাকে আপনি বারি বলছেন, আমি বারি না।

এবার সবাই ওকে চিনে ফেলল, মিথ্যা কথা বলছিস কেনো, আমরা চিনে ফেলেছি তুই বারি।

বারির দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো স্কুলের মাঠ ভরে গেল, বিভিন্ন বয়সের সাবেক এবং বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণায় মুখরিত হলো পুরো ক্যাম্পাস। স্কুলের সাবেক ছাত্র এবং প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তা আজাদ সাহেবকে করা হয়েছে প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি হিসেবে মনিরুলেরও নাম লেখা হয়েছে কিন্তু তখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। দর্শক সারির প্রথমে আগত অতিথিদের জন্য সোফা দেয়া হয়েছে। আনিস মনিরুলকে পথ দেখিয়ে সোফায় বসানোর জন্য পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পিছনে পিছনে শফিকুল আর তানু। পথে মনিরুল কয়েকজনের সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক করল। তাদের মধ্যে বিপ্লব, বাতেন, হামিদও ছিল। কুশলাদি বিনিময় হলো তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সঙ্গে মনিরুলের পরিচয় নেই। মনিরুল, শফিকুল, আনিস আর তানু পাশাপাশি বসল।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। উপস্থাপক একে একে সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিদের আসন গ্রহণের জন্য আহবান করল। একে একে সবাই আসন গ্রহণ করল। মনিরুলও আসন গ্রহণ করল কিন্তু যে আনন্দ, উৎসাহ নিয়ে সে ঢাকা থেকে অনুষ্ঠানে এসেছে রেনুর কিডনি সমস্যা আর তারই বন্ধু বাদামওয়ালা বারিকে দেখে তার সেই আনন্দ হারিয়ে গেছে, হৃদয়টা অনেকটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। বিবেকের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত, গীতা পাঠ করার পর একে একে বক্তৃতা শুরু হলো। বেশিরভাগ বক্তার বক্তৃতায় নিজেদের সাফল্য, স্মৃতিচারণমূলক আর প্রতিষ্ঠানের জুনিয়রদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। মনিরুল লক্ষ্য করল এক বৃদ্ধ, পরনে মলিন পাঞ্জাবি, পুরাতন লুঙ্গি, চেহারায় অতিদারিদ্রের ছাপ, লাঠিতে ভর করে মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, শৃঙ্‌ক্ষলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছেলেরা তাকে মঞ্চে উঠতে নিষেধ করছে কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, মঞ্চে উঠবেই। অবশেষে মনিরুল নিজে চেয়ার থেকে উঠে হাত ধরে সেই বৃদ্ধকে মঞ্চে নিয়ে এলো। একটা ফাঁকা চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কত সালের ব্যাচ?

উনাশি সালের।

কী নাম আপনার?

মফিজ, আমি আজাদের ক্লাস ফ্রেন্ড।

প্রধান অতিথি আজাদ সাহেব একবার আড়চোখে তাকিয়ে এমন একটা ভাব দেখালো যেন সে চিনতে পারেনি।

দরিদ্র বন্ধুর প্রতি আজাদ সাহেবের আচরণ মনিরুলকে আরো আহত করল। আজাদ সাহেবের নামটা তার কানে যাওয়ার পর অন্তত: সে একবার কথা বলতে পারতো।

 

বক্তাদের বক্তৃতা পর্ব চলছে। উপস্থাপক বক্তাদের আহ্‌বানের সময় নামের সঙ্গে অনেকগুলো বিশেষণ ব্যবহার করছে। মনিরুলকে আহ্‌বানের সময়ও অনেকগুলো বিশেষণ ব্যবহার করল, এখন আপনাদের উদ্দেশ্য মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন, এই স্কুলেরই একসময়ের মেধাবী ছাত্র, সফল ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, মানবতাবাদী জনাব মোঃ মনিরুল ইসলাম।

মনিরুল মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করল, আজকের এই মিলনমেলার সম্মানিত সভাপতি মোবারক ভাই, প্রধান অতিথি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পদস্থ কর্মকর্তা জনাব আবুল কালাম আজাদ, মঞ্চে উপবিষ্ট বিশেষ অতিথিগণ এবং স্কুলের বর্তমান ও সাবেক ছাত্র-ছাত্রীগণ আসসালামুয়ালাইকুম। আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে এই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করেছি। আমি এই এলাকার মানুষ না, বাবার চাকরি সুত্রে এই স্কুলে লেখাপড়া করেছি। বাবার বদলির সঙ্গে আমিও চলে গেছি এই এলাকা থেকে আবার কোনোদিন আসবো এমন কথা চিন্তা করিনি কিন্তু এখানে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন আজকের এই মিলনমেলার আয়োজকরা। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এই অনুষ্ঠানের যারা আয়োজন করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

দীর্ঘদিন পর স্কুলের ক্যাম্পাসে এসে ছাত্রজীবনের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে, মনে পড়ছে সেইসব বন্ধুদের কথা যাদের সাথে এই স্কুলে একসাথে লেখাপড়া করেছি, এই মাঠে খেলা করেছি। স্কুল জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা থাকে নিঃস্বার্থ আর কর্মজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা হয় কিছুটা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। আমি আশা করেছিলাম আজ অনেকের সঙ্গে এখানে দেখা হবে, কথা হবে, আড্ডা হবে কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানে আসার পর আমি অনেকটা আশাহত হয়েছি, অনেক বন্ধুকে দেখতে না পেয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি।

আজকের অনুষ্ঠানে যাদের পেয়েছি তাদের বেশিরভাগই কর্মজীবনে সফল, ব্যক্তিজীবনে স্বচ্ছল ও সুখী, বিত্তবান, সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ। অনুষ্ঠানের প্রচারণা চালানো হয়েছে শুধু মোবাইল ফোন আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, ফলে বন্ধুদের মধ্যে যারা কর্মজীবনে সফল হতে পারেনি, যারা দরিদ্র ও হতদরিদ্র তারা জানতেই পারেনি, আবার কেউ কেউ দিন আনে দিন খায়, তাদের পক্ষে রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আজ মিলনমেলায় দেখা হলো আমার বন্ধু আব্দুল বারির সঙ্গে, আমাদের দেখে সে লজ্জায় পালিয়ে যাচ্ছিল কারণ সে এসেছে বাদাম বিক্রি করতে, আমাদের এক ফ্রেন্ড রেনু কিডনি রোগে ভুগছে, টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে, এমনিভাবে আমাদের অনেক সিনিয়র এবং জুনিয়র ছাত্র-ছাত্রী যারা জীবন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, আমরা তাদের দেখা পাচ্ছি না, আমরা তাদের খোঁজ নিচ্ছি না। আমাদের তাদের খুঁজে বের করতে হবে, সেইসব বন্ধু, অগ্রজ ও অণুজদের, কাছে ডেকে নিতে হবে মফিজ ভাইয়ের মতো অগ্রজদের। তবে আজকের মিলনমেলার উদ্দেশ্য সফল হবে। মিলনমেলা কিংবা পুনর্মিলনী শুধু আনন্দমেলা নয়, এই মিলনমেলা হোক ভ্রাতৃত্বের ও বন্ধুত্বের পরস্পর বন্ধন সৃষ্টির ও বন্ধন দৃঢ় করার মেলা। আমরা সবাই একসাথে হাসবো, একসাথে কাঁদবো, তবেই মিলনমেলার উদ্দেশ্য সফল হবে। কথা বলতে বলতে মনিরুলের কণ্ঠস্বর আবেগে বুজে এলো, সে তার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে চেয়ারে বসে পড়ল।

এতক্ষণ পুরো ক্যাম্পাসে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল তা যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। কেউ কেউ আশেপাশে তাদের সহপাঠী বন্ধুদের কৌতূহলী দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগল। প্রধান অতিথি আজাদ সাহেব চেয়ার থেকে উঠে মফিজকে বুকে টেনে নিল।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*