আমারও পরাণও যাহা চায়

ক’দিন থেকে জয় একটা গানই শুনছে, আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো… কিন্তু এই একটা গানের মধ্যে কী আছে যে যে দিনরাত জয় একটা গানই শুনছে। কোন কোন দিন গভীর রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, শিশুর মতো, কখনো কখনো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতেই থাকে, কেন চলে গেলে অভিমানী, কেন এভাবে চলে গেলে। তুমি জান না, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি, আমি বলতাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, খুব সহজভাবে, হাসতে হাসতে, আর তুমি ভাবতে আমি বুঝি কথার কথা, বলতে হয়, তাই বলছি।

তুমি বলতে এভাবে বলতে হয় না, তুমি ভালোবাসি কথাটা এমনভাবে বল যে মনে হয় হাল্কাভাবে, কৃত্রিমভাবে, আমাকে খুশি করার জন্য বলছ, যার মধ্য কোন আবেগ নেই, কোন গভীরতা নেই।

আমি তখন সত্যিই কৃত্রিমভাবে কণ্ঠস্বর গভীর করার চেষ্টা করতাম, বলতাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরা।

তুমি বলতে তবুও হয়নি।

তখন আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে বলতাম, একবার আমার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করো, বুঝতে পারবে আমি তোমাকে কত ভালোবাসি।

তুমি নিবীড়ভাবে আমার হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে মিশে যেতে, দু’জন অনেকক্ষণ পরস্পরের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করতাম, আমি বিশ্বাস করতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে না।

আমি আবারো জিজ্ঞেস করতাম, কী বুঝতে পেরেছ?

তুমি বলতে, পেরেছি, তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসো, তবে শুধু আমাকে না, আরো অনেককে।

ইরা মার খাবে কিন্তু…

তুমি হেসে বলতে, পারবে, তুমি আমাকে মারতে পারবে, মারো না গো, একটু মার দাও, বলে রান্নাঘরে একরকম দৌড়ে যেতে, তরকারি কাটার চাকু এনে হাতে দিতে, এই নাও, এই নাও চাকু, আমাকে মার, কাট, আমার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দাও, যেন সারাজীবন হৃদয়ে তোমার স্মৃতি, আমার সমস্ত শরীরে তোমার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে পারি, সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে সুখের জীবন, বলতে বলতে তুমি আবেগ প্রবণ হয়ে যেতে।

আমিও হেসে ফেলতাম আবার তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম, আমি তোমাকে মারতে পারবো না ইরা, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না।

মুহূর্তে তুমি গম্ভীর হয়ে যেতে, তুমি কষ্ট দিতে পারবে না কিন্তু আমি তো কষ্ট পাচ্ছিই জয়।

কেন? তুমি কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমি তো এমনকিছু করছি না যাতে তুমি কষ্ট পাও?

এই যে তুমি ফোনে হাজার জনের সাথে কথা বল, তোমার কত ফ্যান, ফ্রেন্ড। তোমার হৃদয়ে এতো মানুষের ভিড়ে জায়গা করে নেয়া আমার জন্য কঠিন। আমি পারব না।

পারবো না মানে? পেরেছ, আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে তো এখন তুমিই ইরা।

এটা তুমি বলতে পার কিন্তু আমি তো তোমার মাঝে আমাকে খুঁজে পাই না জয়। একসাথে সারাজীবন থাকার মানে এই না যে একজন আরেকজনকে পেয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকার পরও কেউ কাউকে নাও পেতে পারে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জান?

কী?

কোনদিন কোন স্বামী বা স্ত্রী বোঝার চেষ্টাও করেনা যার সঙ্গে সে সারাজীবন সংসার করছে, একঘরে থাকছে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন করছে সে আদৌ তাকে পেয়েছে কী না। কোনদিন জানার চেষ্টাও করে না। তুমি একবার চোখ বন্ধ করো আমাকে অনুভব করো, দেখবে আমাকে তুমি ষোল আনা পেয়েছ, আমার ভালোবাসায় কোন খাত নেই।

আমি চোখ বন্ধ করলাম, হ্যাঁ সত্যি সত্যি আমি তোমাকে পেয়েছি ইরা।

কিন্তু আমি তো তোমাকে পাইনি জয়। আমি দু’চোখ বন্ধ করে যখন তোমাকে খুঁজি…

আমি ইরার দু’বাহুতে ঝাঁকি মেরে বললাম, থামলে কেন ইরা?থামলে কেন বল?

মিথ্যা কথা বলব না, পেয়েছি, আমিও তোমকে পেয়েছি, খণ্ডিত, আমি তোমার কাছে পেয়েছি খণ্ডিত ভালোবাসা। আর দিয়েছি নিখুঁত প্রেম।

আমি ইরাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম, ইরা রান্নাঘরে চলে গেল। যেতে যেতে বলল, আমি নাস্তা তৈরি করি, তুমি রেডি হও। তোমার অফিসের সময় হয়নি?

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোরে বললাম, না, এখনো আমার অফিসের সময় হয়নি।

তাহলে শুয়ে শুয়ে এই গানটা শোন বলে তুমি গানটা চালু করে দিয়ে চলে গেলে, আমারও পরাণও যাহা চায়…

অফিসের রেস্ট হাউজে শুয়ে শুয়ে জয় চোখ বন্ধ করে সেই গান শুনছে আমারও পরাণও যাহা চায়… আর তার মন চলে গেছে জয়পুরহাটের তাদের সেই ছোট্ট বাসায়। যেখানে জয় আর ইরা ঘর বেঁধেছিল। তাদের সেই ঘরে দু’জনে সুখেই ছিল। প্রতিদিন কোন না কোন বিষয়ে দু’জনে ঝগড়া করতো, হাসতো, কাঁদতো। আবার এক হয়ে যেতো। ইরার অভিমানটা ছিল একটু বেশি। শুধু অভিমানই নয়, রাগ, ক্ষোভ, জিদ আর সন্দেহপ্রবণতা সবকিছু যেন একটু বেশিই ছিল। আর জয় ছিল বরাবরই শান্ত, তাতেও ইরার সন্দেহ ছিল, আচ্ছা তুমি আমার ওপর রাগ করো না কেন বলতো?

জয় বলতো, ইরা দু’জনে রেগে গেলে কি চলে? একজন রেগে গেলে আরেকজনকে তো শান্ত থাকতে হবে।

ইরার সেই রাগান্বিত কণ্ঠস্বরটাও যদি জয় একবার শুনতে পেতো। মোবাইল ফোনে কতদিন থেকে ইরার কোন ম্যাসেজ আসে না। অথচ আগে সবসময় জয়ের ফোনে ইরার ম্যাসেজ আসতো, কী করছ?

এই তো লিখছি।

নাস্তা খেয়েছ?

না, খাবো এখন।

কেন তোমাকে না বলেছি সকাল সকাল নাস্তা করবে। তুমি তো লিখতে বসলে আর সময়জ্ঞান থাকে না। তারপর হঠাৎ করে দেখো অফিসের সময় হয়ে গেছে। তখন তাড়াহুড়ো করে সব ফেলেটেলে অফিসের কাজে লেগে যাও। সেদিন আর নাস্তা করাই হয় না। কোনদিন নিজের দিকে খেয়াল রাখলে না। অন্যের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিলে।

আামি নিজেকে বিসর্জন দিলাম, একথা তুমি বললে, তুমি না আমাকে সবসময় স্বার্থপর বল, আজ আবার নতুন সুর শুনছি।

ওগুলো তো আমার রাগের কথা। আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি জীবনে কোনদিন নিজের কথা ভাবনি।

জয়ের মোবাইল ফোনে তখন বেজেই চলেছে,

আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো

আমারও পরাণও যাহা চায়।

তোমা ছাড়া আর এজগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো

আমারও পরাণও যাহা চায়

তুমি তাই, তুমি তাই গো

আমারও পরাণও যাহা চায়।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও,

যাও সুখেরও সন্ধানে যাও,

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে

আর কিছু নাহি চাই গো।

আমারও পরাণও যাহা চায়

তুমি তাই, তুমি তাই গো

আমারও পরাণও যাহা চায়।

জয় তন্ময় হয়ে গানটা শুনছিল আর গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সেদিন ইরা জয়কে গানটা শুনতে বলছিল আর জয় না শুনেই বলেছিল, আমি তোমাকে পেয়েছি, তুমি আমার ছন্দ, কবিতা, গান, তুমিই আমার সব। আমার আর নতুন করে আমারও পরাণও যাহা চায় শুনতে হবে না। ওসব তুমিই শোন।

অথচ আজ ইরা চলে যাবার পর জয় গানটা শুনছে আর দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, হায় অভিমানী, কেন, গানে গানে তোমার চলে যাবার কথা জানিয়েছিলে। আমি সেদিন যদি পুরো গানটা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর তোমার চলে যাওয়ার কথা জানতাম তবে সবকিছু অন্যরকম হতো ইরা। আমি তোমাকে কোনভাবে যেতে দিতাম না।

জয়ের মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ আসার রিংটোন বেজে উঠল, জয় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখল, না ইরার ম্যাসেজ না, হেল্প লাইনের কমার্সিয়াল ম্যাসেজ।

ফোনটা এভাবেই জয়কে যন্ত্রণা দিচ্ছে। জয় আপনমনে বিলোপ করে আবার বলতে শুরু করল, কেন দিয়েছিলে তুমি মোবাইল ফোনটা? প্রথমে একবার কিনে দিলে সখের বশে, জিদের বশে, ফোনটা হাতে দিয়ে বললে, আজ থেকে এই ফোন দিয়ে শুধু আমার সঙ্গে কথা বলবে, না, সরি, শুধু আমার সাথে না, আমার সাথে, ফ্যামিলির সবার সাথে আর অফিসের কাজে।

আমি জানতাম এর পরের কথাটা তুমি কী বলবে, তবু জিজ্ঞেস করছিলাম তাহলে কার সাথে কথা বলতে পারব না?

তুমি বললে, তোমার ভক্তদের সাথে।

আমি একটা দুষ্টুমীর হাসি হেসে বললাম, যদি কোন ছেলে ভক্ত হয়?

তুমি রেগে বললে, তুমি বোঝোনি কার সাথে কথা বলতে নিষেধ করছি, তোমার মেয়ে ভক্ত, মেয়ে বন্ধু, মেয়ে কলিগদের সাথে। বুঝেছো বৎস।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

আমি তো তোমার কথামতো কোন মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম না। সেদিন রাতে তোমার সাথে ঝগড়া হলো, তুমি রাগ করে পাশের ঘরে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লে, আমি তোমাকে তুলে আনার চেষ্টা করলাম, তুমি এলে না। তোমাকে ছাড়া কি আমার ঘুম আসে….

আমি বিছানায় ছটফট করছিলাম, তাই ফেসবুকে বসেছিলাম। তুমি দৌড়ে এলে পাশের ঘর থেকে, ছোঁ মেরে আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে মেঝেতে আছাড় মারলে, ফোনের স্ক্রিনটা ফেটে গেল কিন্তু তোমার রাগ কমল না, মাটি কাটার সময় লোকেরা যেমন কোদাল দিয়ে মাটিতে কোপ মারে সেভাবে মোবাইল ফোনটা সজোরে আঘাত করলে মেঝেতে। ফোনটা ভেঙ্গে গেল, আমি অসহায়ের মতো তোমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার মুখ থেকে অষ্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ফোনটা ভেঙ্গে দিলে!

তারপর তুমি আমার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে, তুমি আমার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিলে না কেন? আমাকে মারলে না কেন? অন্য কেউ হলে, মোশা হলে মেরে আমার হাড় ভেঙ্গে দিতো। আর তুমি কী না ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলে, তুমি ভালো, খুব ভালো জয়।

ফোনটা ভেঙ্গে দিয়ে ভালোই তো করেছিলে, কিন্তু না তাও তোমার সইবে না। আবার আরেকটা ফোন কিনে দিলে, ইসস আজ যদি আমার ফোন না থাকতো তবে ঘনঘন হেল্প লাইনের ম্যাসেজ আসতো না, আমিঘুমে, জাগরণে চমকেও উঠতাম না।

তোমার মনে আছে? যখন আমাদের ছোট্ট ডিঙি নৌকার মতো সংসারটা প্রতিদিন ঝড় আর ঢেউয়ের তাণ্ডবে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছিল তখন আমি একবার তোমাকে বলেছিলাম যদি শেষ পর্যন্ত হেরে যাই তবে দু’জনে একসঙ্গে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব।

তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কীভাবে?

আমি বলেছিলাম আমার কাছে একপাতা, মানে দশটা হাই পাওয়ার ঘুমের ঔষধ আছে, খেলে…শেষ।

তুমি বলেছিলে, তাহলে একপাতা কেন? তুমি চলে গেলে আমাকে কার কাছে রেখে যাবে। দু’পাতা আন, একসঙ্গে মরব, খুব ভালো হবে, ভালোবাসার একটা দৃষ্টান্ত হবে।

তারপর কেমন করে সব কী হলো? ঢেউয়ের তোড়ে আর ঝড়ের তাণ্ডবে আমাদের সংসার নামক বৈতরণী টাইটানিকের মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সমুদ্রের অতলে ডুবে গেল। কোথায় চলে গেলে তুমি আর কোথায় আমি। আমি কিন্তু সেই ঘুমের ঔষধগুলো নষ্ট করিনি। তুমি অনেকবার সেই ঔষধের নাম জানতে চেয়েছিলে, আমি বলিনি। এবার আমি একাই মরবো, তুমি তো চলে গেছো তোমার সুখের সন্ধানে, আর আমি তোমাকে পেয়েছে হৃদয়ের মাঝে, আর কিচ্ছু চাই না আমার, বলে জয় পাতা থেকে একে একে ঘুমের ঔষধগুলো খুলতে শুরু করল। তার মোবাইল ফোনে তখনো গান চলছেই…

আমি তোমারো বিরহে রহিবও বিলীন,

তোমাতে করিবও বাস,

দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী

দীর্ঘ বরসও মাস

যদি আরও কারও ভালোবাসো,

যদি আরও ফিরে নাহি আস

তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও

আমি যত দূ:খ পাই গো।

জয় পুরো ঘর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ক’দিন আগে দু’জনের কিছু ছবি প্রিন্ট করে এনেছিল। একটা ছবিতে দু’জন আধশোয়া হয়ে আছে, ইরা জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে আর জয়ও ইরার চোখের দিকে, দু’জনে একসাথে থেকে কী তৃপ্তি ফুটে উঠেছিল ওদের দু’জনের চোখে। সেই-ই বিছানার চাদর, যেটা ইরা জোর করে জয়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যখন ওদের দু’টো পথ দু’দিকে বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল, ইরা চলে যাচ্ছিল তার ম্যাসে আর জয় তার অফিসে। ইরা জয়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এটাতে ঘুমাবে, আমাকে পাবে, আমার ছোঁয়া পাবে।

দু’জনের গণ্ডদেশ বেয়ে তখন অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছিল।

আমি আজো সেই বিছানার চাদরেই শুয়ে আছি ইরা, পরণের সেই গেঞ্জি, সেই প্যান্ট-শার্ট, রুমের দেয়ালে দেয়ালে আমাদের পোস্টার সাইজের ছবি, হৃদয়ে তোমারই ছবি। এতো স্মৃতি নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকি বল তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলেই যাবো, তুমি নিশ্চয়ই জান রবী ঠাকুরের মতো দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী অপেক্ষা করার মতো মানুষ আমি নই কিন্তু আজ আমি এতো সি’র, শান্ত কেন? হাতে আমার মৃত্যু পরোয়ানা, কিছুক্ষণ পরেই হয়তো আমি চলে যাবো এই পৃথিবী ছেড়ে কিন্তু আমার মধ্যে কোন দুশ্চিন্তা নেই, অস্থিরতা নেই, যেন আমি হাসতে হাসতে মরতে যাচ্ছি সেই কবিতার মতো…

যখন তুমি এসেছিলে ভবে,

কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে,

এমন জীবন তুমি করিবে গঠন,

হাসিতে হাসিতে মরিবে তুমি সবাই কাঁদিবে তখন।

জয় একে একে কয়েকটা ঔষধ আমি খেয়ে নিল, আমি কি তোমার জন্য কয়েকটা রেখে যাবো? তুমি যদি আমাকে বেঈমান বল, যদি বল আমার জন্য কয়েকটা রেখে গেলে না কেন? এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয়ের দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে, আর কয়েকটা, আরো কয়েকটা কি আমি খেয়ে নিবো ইরা, যদি তাড়াতাড়ি, আরো তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম, নাকি তোমার জন্য….

পাশের ঘরে জরিফুল থাকে। অনেক রাত জেগে কাজ করে, ফেসবুকে আড্ডা দেয়, রাতে শোয়ার সময় সে কয়েকবার লক্ষ্য করেছে একই গান বাজছে, হতে পারে জয়ও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, বই পড়ে, লেখালেখি করে। এইতো প্রায় দু’মাস আগের কথা। জয় প্রথম জয়েন করল।

কয়েকদিন পর একদিন জরিফুল জয়ের রুমে ঢুকে একটা বই হাতে নিল, পাতা উল্টিয়ে লেখক পরিচিতি পড়ে কিছুটা আবেগ আল্পুত হয়ে পড়ল, আপনি বই লিখেন স্যার? আমি জানতাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন স্যার বই লিখেন, আপনি সেই স্যার! আমি খুব খুশি হয়েছি স্যার, আমি একজন স্যার পেলাম যিনি একজন লেখকও, বলে জরিফুল বইটা নিয়ে বলল, আমি এটা নিই স্যার, পড়ে আবার দিয়ে দিব।

পরের দিন এক ভদ্রমহিলা জরিফুলকে ফোন করল, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালাইকুম আস্‌সালাম, কে বলছেন প্লিজ!, অপরিচিত মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে জরিফুল কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ল।

জয় আপনাদের ওখানে জয়েন করেছে না?

স্যারের কথা বলছেন? হ্যাঁ, ও আপনি ম্যাডাম বলছেন? আস্‌সালামুয়ালায়কুম ম্যাডাম।

ওয়ালাইকুম আস্‌সালাম। আপনি কি রাতে রেস্ট হাউজেই থাকেন?

জি ম্যাডাম।

আপনার স্যারের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।

জি ম্যাডাম, অবশ্যই।

আর একটা কথা, বলে ভদ্রমহিলা যেন থমকে গেল।

জি ম্যাডাম বলুন।

আর আমি যে আপনার কাছ থেকে আপনার স্যারের খোঁজখবর নিই এটা যেন কেউ না জানে, এমনকি আপনার স্যারও না।

কথাটা শুনে জরিফুল কেমন একটা হোঁচট খেল, না ম্যাডাম কাউকে বলব না।

সেদিনের পর থেকে সেই ভদ্রমহিলা প্রতিদিন রাতে জয়ের খোঁজখবর নেয়, আপনার স্যার সকালে কোথায় নাস্তা খায়, দুপুরে কোথায়, রাতে কোথায়? কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়?

ক’দিন আগে জিজ্ঞেস করল, আপনার স্যার আরেকটা মোবাইল ফোন কিনেছে নাকি? রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলে নাকি? ফেসবুকে আরো এ্যাকাউন্ট খুলেছে নাকি?

জরিফুল অবশ্য সত্যি কথাই বলল, না, স্যার তো কাজ আর কাজ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকে। তবে ফেসবুকে বসে…

বসে মানে?

ঠিক রাত ন’টায়। অল্প কিছুক্ষণ, এই প্রায় আধ ঘণ্টা।

অ।

সেদিনের পর থেকে ভদ্রমহিলা আগের মতোই খোঁজখবর নিতো। গতকাল রাতেও খবর নিয়েছে, এটা যেন জরিফুলেরও রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। রাতে স্যারের খবর ম্যাডামকে না দেয়া পর্যন্ত জরিফুলের যেন দিনটা অসম্পুর্ণই থেকে যায়। কিন্তু আজ প্রায় তিন চার দিন হলো সেই ভদ্রমহিলার কোন খোঁজখবর নেই, স্যারের সঙ্গে ম্যাডামের ঝগড়া-বিবাদ হলো নাকি?

জয়ের রুমে সেই একই গান বেজেই চলেছে, আমারও পরাণও যাহা চায়।

জরিফুল একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, সকাল সাড়ে আটটা বাজে এখনো স্যার ঘুম থেকে উঠলেন না। স্যার তো প্রতিদিন সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেন, কিছুক্ষণ লেখালেখি করেন তারপর অফিসে এসে বসেন ঠিক সকাল ন’টায়। অথচ আজ সাড়ে আটটা বাজল স্যার এখনো ঘুম থেকে উঠলেন না।

জরিফুল একবার জয়ের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রুমে সেই গানটা বেজেই চলেছে, জরিফুল মৃদু কণ্ঠে কয়েকবার ডাক দিল, স্যার, স্যার

জয়ের কোন সাড়া নেই।

জরিফুল জয়ের মোবাইল ফোনে রিং করলকিন্তু জয় ফোন রিসিভ করল না।

জরিফুল পর পর কয়েকবার রিং করলকিন্তু জয়ের কোন সাড়া মিলল না।

ততক্ষণে সকাল ন’টা বেজে গেছে। অফিসের সবাই আসতে শুরু করেছে। জরিফুল প্রথমে খবরটা অফিসের বড় বাবুকে বলল। বড়বাবু বসকে জানাল।

বস আগে কয়েকবার ফোন করলেন, নিজে জয়ের নাম ধরে ডাকলেন কিন্তু কোনভাবেই জয়ের সাড়া মিলল না। অবেশেষে তিনি থানায় ফোন করলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে থানা থেকে পুলিশ এলো। পুলিশ অফিসার সবার উদ্দেশ্যে কিছুটা আদেশের সুরে বললেন, আপনারা কেউ অফিস ত্যাগ করবেন না। রুমের ভেতরেও আসবেন না। তারপর দরজা খোলার ব্যবস্থা করলেন।

পুলিশ অফিসার এবার জয়ের পালস পরীক্ষা করতে শুরু করলেন।

জরিফুলের হঠাৎ করে মনে হলো খবরটা একবার ম্যাডামকে দেয়া দরকার। সে তখনই ভদ্রমহিলাকে ফোন করল।

অনেক দিন আগে থেকেই গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙ্গে যায়, বিছানায় ছটফট করে। পাশে শুয়ে মোশা ঘুমায়, নাক ডেকে ঘুমায়। ইরা ভেবেছিল ফিরে আসার পর হয়তো মোশা তাকে ভালোবাসবে, তার কষ্ট বুঝবে, তার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করবে কিন্তু ইরার সে আশা অপূর্ণই রয়ে গেল অথচ নিয়ে আসার আগে মোশা তাকে কত স্বপ্নই না দেখিয়েছিল, আমাদের পঁচিশ বছরের সংসার, কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনা মিশে আছে। হতে পারে কখনো কখনো একটু মনোমালিন্য হয়েছে তাই বলে আমাদের কি সুখের কোন স্মৃতি নেই? এস ইরা, আমার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে মিলে মিশে চলব।

এই মোশার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে চলার নমুনা, আমার চোখে ঘুম নেই, দুশ্চিন্তায় ছটফট করছি আর মোশা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

জয় যেন ইরাকে ঘুমের মাঝেও লক্ষ্য রাখতো, হয়ত ইরার প্রতিটি নি:শ্বাসও খেয়াল করত, ইরার সুখ-দুঃখ অনুভব করতো। একদিন গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙ্গে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জয় চমকে উঠল, ইরা।

ইরাও চমকে উঠল, কী হলো তোমার?

না, আমার কিছু হয়নি। তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেল কেন? কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছো?

না, এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটু পানি খাও, বলে জয় নিজেই এক গ্লাস পানি এনে দিল।

সেদিন ইরার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আর জয় তাকে নিজে পানি এনে দেয়াকে ইরার খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিলকিন্তু আজ গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আর মোশার নাক ডেকে ঘুমান দেখে মনে হলো, জয় তার কত আপন ছিল।

ইরা কয়েকমুহূর্ত মোশার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, এই, এই, ওঠো না। আমার ঘুম আসছে না, চল তো একটু ছাদে যাই।

না, মোশার কোন সাড়া শব্দ নেই। এবার ইরা মোশাকে মৃদু ধাক্কা দিল, এই, ওঠো না…

মোশা এবার জোরে একটা ধমক দিল, ইরা, শোওতো, ঘুমানোর চেষ্টা করো। এতো রাতে কেউ ছাদে যায়। তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে। ঘুমাও, বলে মোশা আবার চোখ বন্ধ করল। কয়েকমুহূর্ত পর আবার সেই নাক ডাকা ঘুম।

ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, হায় আল্লাহ আমি, আমি কি হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নিলাম?

স্কুলে এসে চেয়ারে বসে ইরা ঝিমোচ্ছে। পাশের চেয়ারে বসেছে তার কলিগ সাহেদা, সে বার বার তাকে টোকা মারছে, এই আপা, এই।

ইরার মুখোমুখি বসেছে শরীফ সাহেব। ভদ্রলোক ইরাকে সবসময় খোঁচা মেরে কথা বলে। ইরার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সবার সামনে তুলে ইরাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে, ইরা মার্জিতভাবে অনেকবার ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা না বলার জন্য অনুরোধ করেছে কিন্তু তারপরও একটু সুযোগ পেলেই কেউ কথা না বললেও শরীফ সাহেব বলবেনই।

আজ ইরাকে ঝিমাতে দেখে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সাহেদাকে লক্ষ্য করে বললেন, ঘুমাতে দেন আপা, ঘুমাতে দেন। আপাকে আজ খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

শরীফ সাহেবের কথা শুনে ইরার মাথায় যেন রক্ত চেপে গেল। সে কিছু বলবার জন্য মুখ তুলে তাকাতেই ক্লাসের ঘণ্টা বেজে গেল।

ইরা হাজিরা খাতা নিয়ে ক্লাসে রোল কল করছে। ইরা ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুব প্রিয়। ইরা নিজে যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়ায়, ছাত্র-ছাত্রীরাও তেমনি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে কিন্তু আজ ইরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছে না। ছাত্র-ছাত্রীরাও ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। পরস্পরের সাথে কথা বলছে, হৈ চৈ করছে।

সাধারণত ইরার এমন হয় না, ইরা লক্ষ্য করেছে যেদিনই এমন হয়েছে, তার মন ছটফট করেছে, অমনোযোগী হয়ে পড়েছে, সেদিনই জয়ের কোন না কোন দু:সংবাদ এসেছে। ক’দিন থেকে জয়ের কোন খবর নেয়া হয়নি আর জরিফুলকে তো সে ফোন করতে নিষেধই করেছে, ইসস কেন যে জরিফুলকে ফোন করতে নিষেধ করলাম, জয়ের কোনকিছু হলে আমি কীভাবে জানবো? কীভাবে? ক্লাস শেষ হলে একবার জরিফুলকে ফোন দিতে হবে, আল্লাহ আমার জয়কে তুমি ভালো রেখ।

ইরার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে পাশের রুম থেকে সেই শরীফ সাহেব এলেন, আপা, স্টুডেন্টরা এতো কথা বলছে আপনি কিছু বলছেন না?

ইরা চমকে উঠল, ও হ্যাঁ।

শরীফ সাহেব নিজে টেবিলে জোরে শব্দ করে বললেন, এই যে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে এতো কথা বলছ কেন?

ছাত্র-ছাত্রীরা চুপ করল।

শরীফ সাহেব বললেন, ছেলেমেয়েদের শাসন করবেন আপা আর ক্লাসে মনোযোগী হবেন। টিচার এ্যাফসেন্ট মাইন্ড হলে স্টুডেন্টরা তো গোলমাল করবেই।

ইরা আবার ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলকিন্তু কিছুতেই মন ফেরাতে পারল না।

ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

জরিফুল ফোন করেছে, ইরা তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করল, হ্যালো।

হ্যালো ম্যাডাম।

ইরা কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে ফোন ধরে রাখল। চোখের সামনে পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গেল, দু’ঠোট মৃদু ফাঁক হয়ে বুক চিরে হয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, জয়।

তারপর মোবাইল ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*