ছবি

যে মেয়েটি একসময় খুব ছবি তুলতো, সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা, সবসময়, সুযোগ পেলেই খেলার মাঠ, পার্কের বেঞ্চ, রান্নাঘর অথবা ক্লাসের ফাঁকে বান্ধবীদের সাথে কমনরুমে কিংবা কলেজের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে চিনাবাদাম খাওয়ার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিতো। দিন নেই রাত নেই সবসময় ফেসবুকে অ্যাক্টিভ থাকতো, দিনে বেশ কয়েকটা পোস্ট দিতো, ফেসবুক ফ্রেন্ডরা হাজার হাজার লাইক দিতো, শত শত কমেন্টস করতো, ইউ আর সো সুইট, ইউ আর লুকিং নাইস, সো কিউট, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে মেয়েটি এখন ক্যামেরা দেখলে মুখ লুকায়, ছবি তুলতে ভয় পায়। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ করে দেয়। মেয়েটির উচ্ছলতা প্রাণচাঞ্চল্যতা, তারুণ্য, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন সব যেন ভেঙ্গে গেছে। সারাদিন সে এখন শুধু চুপচাপ বসে থাকে আর ভাবে সেই নারকীয় পাশবিক নির্যাতনের কথা।

মেয়েটির নাম ফারিয়া। গায়ের রং ফর্সা, লম্বা আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারী। ক্লাসের মধ্যে এমনকি পুরো কলেজের মধ্যে সেই সবচেয়ে সুন্দরী, আধুনিক এবং অনেক গুণে গুণান্বিত একটি মেয়ে। কলেজের যেকোনো অনুষ্ঠান সে উপস্থাপনা করতো। অনুষ্ঠানের দিনে সে খুব সেজেগুঁজে আসতো। পরনে লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, ম্যাচিং করা লিপ স্টিক, নেইল পালিশ পরে যখন সে মঞ্চে উঠতো তখন সবার দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ হতো। বিশেষ বিশেষ দিন যেমন : বসন্ত বরণ, পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র মতো দিনগুলোতে সে যখন সাদা শাড়ি লাল পাড় অথবা হলুদ শাড়ি, চুলে মেহেদী, হাতে কাঁচের চুড়ি পরে বের হতো আর কাঁচে চুড়িগুলি বাজতো তখন মনে হতো যেন স্বর্গের অপ্সরী নেমে এসেছে পৃথিবীতে।

চেহারায় একটু উঁচু-লম্বা আর অপরূপ সুন্দর হওয়ার জন্য তার বিড়ম্বনারও শেষ ছিল না। প্রায়ই বিয়ের প্রস্তাব আসতো, সেই কিশোর বয়স থেকেই স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বখাটে ছেলেরা উত্যক্ত করতো, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করলে অনেকেই ইনবক্সে আজেবাজে প্রস্তাব দিতো। ফারিয়া অনেকটা অনড় ছিল, ইনবক্সে কারো প্রশ্নের উত্তর দিতো না অথবা খুব সাবলীলভাবে উত্তর দিতো। খুব সাবধানে চলছিল আর হৃদয়ের মধ্যে শুধু একটাই স্বপ্ন লালন করছিল, বড় হওয়া, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, মানুষের মতো মানুষ হওয়া কিন্তু এতো সচেতনতার মধ্যেও ফারিয়ার জীবনে এতবড় একটা কেলেঙ্কারি ঘটে গেল যে লোকসমাজের তার মুখ দেখানো তো দূরের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মুখ দেখাতে পারল না, সেই কিশোর বয়সে না যখন সে এইচ.এস.সি পাস করে বি.এ ভর্তি হয়েছে।

যে কারণে ফারিয়া ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কারো সাথে খুব একটা চ্যাট করতো না ঠিক একই কারণে সে আজ সবকিছু হারিয়ে ক্যামেরা দেখলে ভয় পায়, মুখ লুকায়। তুমি কেন আমার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিলে তপু, আমি ওদের না চিনি তুমি তো ওদের চেনো, তুমি তো জানো ওরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই, এমনকি খুন খারাপিও করতে পারে, তবুও শুধু আমার সম্মানের কথা ভেবে নিজের জীবনটাই দিয়ে দিলে।

খুব জানাশোনা ছাড়া ফারিয়া কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করতো না, তপুর রিকোয়েস্টও এক্সেপ্ট করতো না কিন্তু সেদিন তপু সামনে এসে দাঁড়ালো। সে এমন একটা ভাব দেখালো যে জানতো না ফারিয়া এখানে আছে, হঠাৎ করে এমনভাবে ফারিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো যেন ঘটনাটা হঠাৎই ঘটেছে অথচ তপু ঘটনাটা ঘটিয়েছ পরিকল্পিতভাবেই, তুমি ফারিয়া না?

জি আস্‌সালামুয়ালাইকুম।

ওয়ালাইকুম আস্‌সালাম। কেমন আছ ফারিয়া?

জি ভালো।

পড়ালেখা নিয়ে বুঝি খুব ব্যস্ত?

জি।

ও আচ্ছা। তাইতো আমি তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি এক্সেপ্ট করার সময় পাওনি বোধ হয়?

তপুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ফারিয়ার চোখে পড়েছে কিন্তু সে ইচ্ছা করেই এক্সেপ্ট করেনি। ফারিয়া লক্ষ্য করেছে কলেজে এবং কলেজের বাইরেও অনেকেই তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, ভদ্রতাবশতঃ কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করা, তারপর গায়ে পড়ে হেল্প করার প্রস্তাব, প্রথমে সিনিয়র ভাই, বন্ধু এবং শেষ পর্যন্ত প্রেম করার প্রস্তাব। ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে ফারিয়া এসব অনেক দেখেছে। তাই সে খুব সহজে কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় না এবং কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্টও করে না কিন্তু তপু এমনভাবে ধরলো যে আর বুঝি রক্ষা পাওয়া গেল না। ফারিয়া তপুকে খুব একটা যে চিনে তা না, তবে সে একটু নেতা গোছের বলে কখনো কখনো ফারিয়ার চোখে পড়েছে বলে মনে হলো। ফারিয়া আমতা আমতা করে বলল, আসলে আপনাকে তেমন চিনি না…

তুমি আমাকে চেনো না! অবাক তো। কথাটা তপু এমনভাবে বলল যে সে অনেক বড় মাপের কিছু একটা তাই তাকে এতদিনে ফারিয়ার চেনা উচিত ছিল।

ফারিয়া আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, আপনি এমন কে হয়েছেন যে আপনাকে আমার চিনতেই হবে।

তপু আবার গর্বভরে বলতে শুরু করল, আমার প্রোফাইল দেখ। আসলে তোমাদের এটাই দোষ, আগে চিনবা না, যখন কোন ঝামেলায় পড়বা তখন ঠিকই চিনবা।

ওকে আজ আমি তোমাকে নক দিব। তখন এক্সেপ্ট কর।

ফারিয়া একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, জি।

সেদিন ফেসবুকে লগ ইন করতেই তপু ম্যাসেঞ্জারে নক করল, হাই।

ফারিয়া তপুর ফেসবুক প্রোফাইল চেক করল। খুব সুন্দর চেহারার একটি ছেলে, কোন রাজনৈতিক ব্যানার নেই কিন্তু বড় বড় অনেক নেতাদের সঙ্গে ছবি আছে। প্রোফাইল পিকচারের ছবিতে তার চোখ দুটো বেশ সুন্দর। শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, কিছু পারিবারিক ছবিতেও তাদের পারিবারিক আভিজাত্যের ছবি ফুটে উঠেছে। তপুর সবকিছুই ফারিয়ার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হলো কিন্তু মনের মধ্যে একটা সংশয় রয়ে গেল শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তার ঘণিষ্ঠতা বলে। ফারিয়ার মনে রাজনীতি সম্পর্কে একটু ভীতি আছে কিন্তু তপুকে দেখে তার সেরকম মনে হয়নি।

ফারিয়া রিপ্লাই দিল, ভাইয়া। এটা আপনার আইডি?

হ্যাঁ।

ওকে ভাইয়া আমি এক্সেপ্ট করছি বলে ফারিয়া ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করতেই তপু লিখল, ধন্যবাদ ফারিয়া।

ওয়েলকাম ভাইয়া।

তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?

ফারিয়া বিরক্ত সহকারে আপনমনে বলল, উফ্‌ এই শুরু হয়েছে প্যারা কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে লিখল, জি ভাইয়া ভালো।

তুমি থাকো কোথায়?

মেসে।

কোন মহল্লায়?

জি ভাইয়া সুইহারী।

এলাকাটা তো ভালোই, তবু খারাপ ছেলেপেলের তো অভাব নেই, কোন প্রব্লেম হলে বলিও। কোন সংকোচ করিও না।

জি ভাইয়া, আপনি তো আছেন।

ফারিয়া লিখছিল আর বিরক্ত হচ্ছিল। এসব আজাইড়া প্যাঁচাল সে একেবারে পছন্দ করে না, মোবাইল ফোনে একের পর এক লেখা লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল কিন্তু তপুর কথার যেন শেষ নেই। এবার তপু লিখল, এখন কী করছ?

ফারিয়ার বিরক্তির সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। সে অন্য কেউ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্লাকলিস্ট করে দিতো কিন্তু তপু তার সিনিয়র এবং কলেজে খারাপ ছেলেপেলে আর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তপুর ঘণিষ্ঠতা আছে। যারা যেকোন সময় যেকোন কাজ করতে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না, তাই ফারিয়া তপুর ওপর প্রচণ্ড রেগে থাকলেও তার কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটাল না। সে লিখল, পড়ছি ভাইয়া।

ওকে রাখি তাহলে।

ফারিয়া তপুকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিল না, ওকে ভাইয়া ভালো থাকবেন। বাই।

তপুও লিখল, বাই।

সেদিনের পর থেকে ফারিয়া ফেসবুকে যেকোনো পোস্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তপু সবার আগে ফারিয়ার অনেক প্রশংসা করে কমেন্টস করতো। ফারিয়া খুব খুশি হতো, ফারিয়ার মনে হতো তপু বুঝি তার জন্যই ফেসবুকে লগ ইন করে বসে থাকে। সে তপুর কমেন্টসের রিপ্লাই দেয়, এভাবেই কমেন্টস আর রিপ্লাই রিপ্লাই খেলা চলে অনেকক্ষণ। তারপর শুরু হতো ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং, হাই ফারিয়া।

জি ভাইয়া।

কেমন আছ?

ভালো, আপনি?

হ্যাঁ ভালো। তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?

ভালো ভাইয়া।

তারপর তপু ফারিয়ার কোনো সুন্দর ছবি কপি পেস্ট করে ইনবঙে দিয়ে বলে, তোমার এই ছবিটা অদ্ভুত সুন্দর হয়েছে। দেখলে মনে হয়…

নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। ফারিয়ার কৌতূহল বেড়ে যায়, কী মনে হয় ভাইয়া?

না থাক।

থাক কেনো বলুন?

দেখা হলে বলবো। তুমি কি আমার সঙ্গে দেখা করবে?

দেখা তো প্রায়ই হচ্ছে ভাইয়া।

এভাবে ক্লাসের ফাঁকে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কিংবা করিডরে দেখা হলে কি কথা বলা যায়?

তো?

অন্য কোথাও।

আচ্ছা ভাইয়া, যদি কোনোদিন দেখা হয় তো বলবেন।

আচ্ছা।

এমনিভাবে কথা বলতে বলতে ইদানীং ফারিয়াও তপুর সঙ্গে চ্যাট না করলে একটা টান অনুভব করে, সবসময় তপুকে মনে পড়ে। প্রথম প্রথম তপুর নক করাকে তার বিরক্ত মনে হলেও আজকাল আর সেটা মনে হয় না বরং ফেসবুকে লগ ইন করে তপুকে না দেখলে তার খুব খারাপ লাগে, মনটা খুঁত খুঁত করে। একদিন হঠাৎ করে তপু ফেসবুকে এলো না, কলেজও বন্ধ ছিল তাই ফারিয়ার সঙ্গে দেখাও হয়নি। সেদিন ফারিয়ার মন একটা অজানা আশঙ্কায় ছটফট করছিল, তপুর কিছু হলো না তো।

ফারিয়া তপুর ফোন নাম্বারও জানে না। জানলে হয়তো ফোন দিতে পারতো, কয়েকদিন আগে তপু একবার তার ফোন নাম্বার ফারিয়াকে দিতে চেয়েছিল। ফারিয়া বলল, ফোন নাম্বার লাগবে না ভাইয়া, ফেসবুকে তো আছিই সবসময়। অথচ আজ ফারিয়ার মনে হলো সেদিন যদি সে ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখতো তবে আজ আর দুশ্চিন্তা করতে হতো না। ফারিয়া ফেসবুকে লগ ইন করে তপুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু সেদিন তপু ফেসবুকে এলোই না। অবশেষে ঘুমানোর আগে ফারিয়া তপুর ইনবঙে ম্যাসেজ করল, হাই। কেমন আছেন? হঠাৎ করে যে উধাও হয়ে গেলেন। কোন প্রব্লেম হলো না তো। নেটে এলে একবার নক দিয়েন। বাই।

সারারাত ফারিয়া ঘুমের মাঝে বার বার জেগে উঠেছে আর ফেসবুক লগ ইন করেছে কিন্তু তপু ফেসবুকে আসেনি। সকালবেলা তার চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। ফারিয়ার নাস্তায় রুচি নেই। ফারিয়ার মনোবল অত্যন্ত কঠোর, স্কুল জীবন থেকে কতজন যে তাকে প্রপোজ করতে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে মনের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা কথা ভুলে গেছে তার ঠিক নেই। কতজন যে প্রপোজ করতে এসে এক দৃষ্টি শাসনের ভয়ে পালিয়েছে তার ঠিক নেই অথচ তপু তাকে একবারও বলল না, একবারও তার হাত ছুঁয়ে দেখলো না, হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটল না অথচ ফারিয়ার হৃদয়ের সিংহদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। ফারিয়ার পুরো মন দখল করে নিল। যারা কারো হৃদয় জয় করার জন্য যুদ্ধ করে তারা বেশিরভাগই পরাজিত হয় আর যারা ভালোবাসা দিয়ে কারো হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার জন্য হৃদয় নিংড়ে ভালোবাসে তারা বিনা যুদ্ধে পুরো ভালোবাসার রাজত্ব পেয়ে যায়।

সত্যি তপু ফারিয়াকে জয় করেছে। ইদানীং প্রায় ফারিয়া তপু একসাথে ঘুরে বেড়ায়। তপু ফোন করে, হ্যালো ফারিয়া।

হ্যাঁ বলো।

ফারিয়া নিজের অজান্তে তপুকে আপনি থেকে তুমি বলে ফেলেছে, মুখ দিয়ে কথাটা বের হওয়ার পরেই জিহব্বা কামড়ে ধরেছে, সরি আপনাকে তুমি বললাম।

না, সরি কেনো আমরা তো এখন আর সিনিয়র জুনিয়র না, ফ্রেন্ড। তুমি বলো শুনতে বেশ ভালো লাগছে।

জি বলুন।

তপু কিছু শাসনের ভঙ্গিতে বলল, আবার আপনি?

ওকে বলো।

কী করছ?

মেসে বসে আছি।

এখন তো বিকেল, এখন কেউ ঘরে বসে থাকে না। বের হও, আমি আসছি তোমার মেসের সামনে।

না, থাক। আজ কোথাও বের হবো না।

না, না আমি আসছি তুমি বের হও।

ফারিয়া আর না করতে পারল না।

কিছুক্ষণের মধ্যে তপু মোটর সাইকেল নিয়ে মোড়ে এসে ফোন করল, ফারিয়া।

কোথায়?

মোড়ে।

ওকে, আমি আসছি।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ফারিয়া মোড়ে এসে তপুর মোটর সাইকেলে উঠল। মোড়ে কয়েকটা বখাটে ছেলে সবসময় আড্ডা দেয়। মেয়েরা কলেজে বা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় পাশ থেকে নানান কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে। কোনো কোনো মেয়ে মজা নেয়, মুখ ভেঙচিয়ে চলে যায় আবার কেউ কেউ নীরবে মাথা নত করে হেঁটে চলে যায়। ফারিয়াও নীরবে মাথা নত করে চলে যায়, বেশিরভাগ সময় সে মোড়টা এড়িয়ে চলে কিন্তু যখন মোড় দিয়েই কোথাও যেতে হয় তখন তো আর উপায় থাকে না। ফারিয়া যখন তপুর মোটর সাইকেলে উঠল তখন একটা ছেলে জোরে চিৎকার করে কী যেন বলল, ফারিয়া কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু কথাটা যে কুরুচিপূর্ণ আর তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে সেটা বুঝতে পারল। কিছুদূর যাওয়ার পর তপুও বিষয়টা বুঝতে পারল, সে ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করল, ফারিয়া ছেলেটা কি তোমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল।

ফারিয়া আমতা আমতা করে বলল, কিছু না বাদ দাও।

তপু মোটর সাইকেল ব্রেক কষল, প্রচণ্ড রেগে বলল, বাদ দাও মানে। ওরা তোমাকে নোংরা কমেন্টস করবে আর আমি ছেড়ে দিব।

ফারিয়া বিনয়ের সঙ্গে বলল, তপু প্লিজ বাদ দাও তো, ওরা সারাদিন মোড়ে আড্ডা দেয় আর যেকোনো মেয়ে দেখলেই আজেবাজে কথা বলে, ওরা স’ানীয়, আমি বাইরে থেকে লেখাপড়া করতে এসেছি আমার ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার দরকার কী সাধ করে একটা ঝামেলা ঘাড়ে নেয়া।

তপু আবার মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করল কিন্তু মনে মনে সে বিষয়টার একটা সুরাহা করার জন্য সি’র করল।

শরৎকাল, একটু একটু কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত, তপু জোরে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে, গন্তব্য উদ্দেশ্যবিহীন। মোটর সাইকেল আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ পার হয়ে দিনাজপুর ফুলবাড়ী রোড দিয়ে চলছে, শহর পার হয়ে অনেকদূর চলে এসেছে। ফারিয়া জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?

জানি না তবে ঘুরে বেড়াতেই বেশ ভালোই লাগছে বলে তপু পিছনে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভালো লাগছে না?

তপু যখন দ্রুতগতিতে মোটর সাইকেল চালাতে শুরু করেছে ফারিয়া তখন থেকে তপুর কাঁধে একটা হাত রেখে পিছনে শক্তভাবে বসে আছে কিন্তু ভাঙাচোরা রাস্তা আর অপরিকল্পিত স্পিড ব্রেকারের কারণে ফারিয়া বার বার তপুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এক অসাধারণ নতুন অনুভূতি ফারিয়াকে আচ্ছন্ন করেছে। সে কী করে এই অনুভূতি ব্যক্ত করবে তপুর কাছে। ফারিয়া তপুর গলা জড়িয়ে ধরে তার কানের কাছে মুখ রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, খুব ভালো লাগছে, খুব। মনে হচ্ছে আমি আজ স্বর্গ হাতে পেয়েছি।

আরো কয়েকমিনিট পর দুজনে মোহনপুর ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছালো। ব্রিজের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গেছে নদীর ধারে, নদীর নাম আত্রাই। নদীর ধারে ব্লক বসিয়ে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ করা হয়েছে, নদীর পাড়ে বসানো হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য কংক্রিটের ছাতা, কংক্রিটের বেঞ্চ, তৈরি করা হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধক অনেক কারুকার্য। তপু মোটর সাইকেল দাঁড় করল। ফারিয়া মোটর সাইকেল থেকে নেমে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ওয়াও। খুব সুন্দর জায়গা তো।

তপু গর্বভরে বলল, দেখতে হবে না পছন্দটা কার!

হ্যাঁ, তোমার পছন্দ আছে বলতে হয় নইলে কি আর আমার মতো স্মার্ট, ইয়াং লেডির মনজয় করতে পারো।

মোটর সাইকেল রেখে দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল এবার তপু থমকে দাঁড়ালো, ফারিয়ার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল, মনজয় করেছি তাহলে?

ফারিয়া লজ্জায় সংকুচিত হয়ে একটা লাজুক হাসি হাসল।

অনেকক্ষণ দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করল। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন শুরু হয়েছে, দর্শনার্থীরা যেতে শুরু করেছে। ফারিয়া তপুকে তাড়া দিল, চল যাই।

তপু ফারিয়ার কানের কাছে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, আরেকটু প্লিজ!

ফারিয়া উঠে দাঁড়ালো, চলো তাহলে নদীর তীরে।

তপুও উঠে দাঁড়ালো, ফারিয়া একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল তারপর দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ালো। গোধূলিও অতিক্রান্ত হয়েছে। দুয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ দর্শানার্থী চলে গেছে। আকাশে শরতের চাঁদ মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা করছে। ফারিয়া তপুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাক দিল, তপু।

তপু উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখছিল। ফারিয়ার ডাক শুনে তেমনিভাবে বলল, বলো।

তপু তুমি আমাকে কখনো ভুলে যাবে না তো।

তপু ফারিয়ার মুখ উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলল, আমিও তো সে চিন্তায় করছি ফারিয়া।

মানে? তুমি আমাকে নিয়ে ভাবছ?

কেন না, তুমি একটা স্মার্ট, অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। নিজেকে এত তুচ্ছ ভাবছ কেনো?

এসব তুমি কী ভাবছ তপু আমি তোমাকে ছাড়া কখনো চিন্তাই করি না।

সত্যিই? বলে তপু দুহাত বাড়িয়ে দিল।

ফারিয়া তপুর বুকে মাথা রাখল।

তপু ফারিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

কয়েকমাস পরের কথা আবার একদিন তপু আর ফারিয়া বেরিয়েছে কিন্তু মোড়ে সেই আড্ডাটা আর নেই। ফারিয়া লক্ষ্য করেনি কিছুদূর যাওয়ার পর তপুই কথাটা ফারিয়াকে বলল, ফারিয়া একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ?

কী?

মোড়ের আড্ডাটা আর নেই।

ফারিয়ার মনে পড়ল সত্যিই তো আজ তো কাউকে দেখলো না। সে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল, এমন কী করেছ যে আড্ডাটা উঠে গেল।

প্রথমে তপু বলতে চাইল না কিন্তু ফারিয়া যখন জোর করে ধরলো তখন বলল যার বিষয়বস্তু হলো তপু তার কলেজের এক স্টুডেন্ট লিডারকে বলেছে, সে একদিন মোড়ে এসে সব আড্ডাবাজ বখাটেদের আচ্ছা করে শাঁসিয়ে দিয়েছে। ফারিয়া জিজ্ঞেস করল, সেদিন তুমিও ছিলে?

হ্যাঁ। আমি থাকবো না!

ফারিয়ার বুক কেঁপে উঠল, তুমি কী করেছ তপু। তুমি ওদের সামনে এলে কেনো?ওরা ভয়ঙ্কর, কখন কী করে বসে ঠিক নেই।

আরে না। ওরা জীবনে কিছু বলার সাহস পাবে না। আমি তোমার জন্য এটুকু করব না।

কিন্তু আমার জন্য কিছু করতে গিয়ে তো তুমি তোমার আমার দুজনেরই বিপদ ডেকে এনেছ তপু।

তপু ফারিয়াকে আশ্বস্থ করল, এখন ওসব আলাপ বাদ দাও তো। একটা বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা করতে ভালো লাগে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমার জন্য সব করতে পারি আর সামান্য কয়েকটা বখাটেকে শাসানো তো সামান্য ব্যাপার।

ফারিয়া তপুকে জড়িয়ে ধরলো, আমি খুব লাকি তপু যে তোমার মতো একজন বন্ধু পেয়েছি। অথচ তোমার প্রতি প্রথমে আমার ধারণাটা ভুল ছিল।

এমনিভাবে কথা বলতে ফারিয়া একবার পিছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠল। সে আতঙ্কগ্রস্থ গলায় বলল, তপু!

কী হলো?

একটা মোটর সাইকেল আমাদের ফলো করছে।

তপু মোটর সাইকেলের লুকিং গ্লাসে একবার তাকালো। ফারিয়া সত্যি বলেছে পিছনে একটা মোটর সাইকেল আসছে কিন্তু তাদের অনুসরণ করছে কী না সে বুঝতে পারলো না। একদিনের দেখায় মোটর সাইকেলের চালককেও চিনতে পারলো না। তপু মোটর সাইকেল ব্রেক করে একবার পিছনে ফিরে তাকালো। হ্যাঁ সেদিনের একটা ছেলেকে তপুর চেনা চেনা মনে হলো।

পুনর্ভবা নদীর বেড়ি বাঁধ, বেড়িবাঁধের দুপাশে ঘন ঘন করে গাছ লাগানো হয়েছে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, শুধু নিরিবিলি নয়, গাছের ছায়ায় বিকেল বেলাতেও বেশ অন্ধকার, ফারিয়ার মতো তপুর বুক কেঁপে উঠলো। সে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে মোবাইল ফোনে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করল, খুব সম্ভবত তার স্টুডেন্ট লিডারদের কাউকে হবে কিন্তু তার আগে সামনে থেকে আরো একটা মোটর সাইকেল এসে দাঁড়ালো। ততক্ষণে পিছনের মোটর সাইকেলও তপুর মোটর সাইকেলের পিছনে এসে দাঁড়ালো। কোনোকিছু বলার আগেই সামনের মোটর সাইকেল থেকে নেমে মোটর সাইকেলের পিছনের সিটে বসানো বখাটে টাইপের ছেলেটি তপুর চোয়ালে একটা ঘুষি মারলো।

তপু মোটর সাইকেল থেকে পড়ে গেল। পিছনের মোটর সাইকেলের দু’জন মোটর সাইকেল থেকে নেমে ফারিয়া যেন চিৎকার করতে না পারে সেজন্য তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে তাকে জোর পূর্বক তাদের মোটর সাইকেলে তুললো। সামনে একজন মোটর সাইকেল চালাচ্ছে আর পিছনে একজন শক্ত করে ফারিয়াকে ধরে রেখেছে। চোখ বন্ধ ফারিয়া বুঝতে পারলো না কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর তপুকেই বা কী করছে তারা। কয়েকমিনিট মোটর সাইকেল চালানোর পর একটা জায়গায় মোটর সাইকেল থামলো। পিছনের ছেলেটি ফারিয়াকে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। ফারিয়া একবার চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়ার জন্য সে চিৎকার করতে পারলো না। তারপর ফারিয়ার ওপর নেমে এলো পাশবিক নির্যাতন, প্রথম একজনের নির্যাতনের সময় সে জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো তারপর শুরু হলো পালাক্রমে নির্যাতন। একসময় ফারিয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন ফারিয়া হাসপাতালের বেডে কিন্তু তপু, তপু কোথায়! ফারিয়া চোখ মেলে তাকিয়েছে দেখে একজন সিস্টার পাশে এসে দাঁড়ালো। ফারিয়ার সমস্ত শরীরে ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত ও পাশবিক নির্যাতনের দাগ। সে মনে করার চেষ্টা করল, ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়ল। সে মৃদু কণ্ঠে আবার ডাক দিল, তপু, তপু কোথায়?

সিস্টার ফারিয়াকে বলল, এটা হাসপাতাল।

ফারিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমাকে এখানে কে নিয়ে এলো?

আপনি এখনো অসুস্থ। সুস্থ হোন ধীরে ধীরে সব জানতে পারবেন।

ফারিয়া ধীরে ধীরে সব জানতে পারল, জানতে পারল ফারিয়ার সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে তপুকে দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাতে প্রাণ দিয়েছে। নিজের রূপ-লাবণ্যের ওপর ফারিয়ার ঘৃণা হলো, সে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, রূপ, আমার এই রূপ, আমার এই সৌর্ন্দেযর কারণে একটা ছেলে জীবন দিল।

পুলিশ এলো, চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিরা এলো। মিডিয়া কর্মীরা এলো। একজন সাংবাদিক ফারিয়ার দিকে ক্যামেরা তাক করতেই সে দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে বলল, না, আমি আর কোনোদিন ছবি তুলব না।

একজন পুলিশ অফিসার মিডিয়া কর্মীদের ধমকের সুরে বলল, আপনার জানেন না রেপ কেসে নারীদের নাম, পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করা নিষেধ।

মিডিয়ার কোথাও ফারিয়ার নাম, পরিচয় বা ছবি প্রকাশিত হলো না কিন্তু কারো জানতে বাকি রইল না। কেউ তাকে কিছু বলে না কিন্তু ফারিয়ার নিজের কাছেই মনে হয় এই বুঝি কেউ তাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলছে। যে ফারিয়া একদিন নিজের পরিচয় বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতো নিজের সুন্দর সুন্দর স্টাইলিশ ছবি আপলোড দিতো সেই ফারিয়া এখন ক্যামেরা দেখলে মুখ লুকায়।

সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*