হেদায়েত সাহেব উপরের চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছে সেই ছাব্বিশ বছর বয়স থেকে যখন সে নিম্নমানসহকারী হিসেবে এই চাকরিতে যোগদান করে। তখন সে টগবগে যুবক, বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে সেই বি.এ পাসের পর থেকে কিন্তু চাকরির আগে বিয়ে করবে না বলে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল, তাই চাকরির আগে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেনি। যদিও চাকরির বাইরেও হেদায়েত সাহেবের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় পাত্র হিসেবে বিয়ের বাজারে তার কদর এমনিতেই যথেষ্ট ছিল তারওপর সরকারি চাকরিতে যোগদানের কারণে কদর আরো বেড়ে গেছে বহুগুণ।
হেদায়েত সাহেবের কাছে পদ-পদবির চেয়ে একটা সরকারি চাকরিই বড় ছিল। সরকারি চাকরি মানে একটা সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর সে দেখলো শুধু সরকারি চাকরি হলেই হলো না, নিচু পদে চাকরি করা একটা আত্মসম্মানেরও বিষয় যখন নিজ এলাকার কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর অধীনে চাকরি করতে হয়। তবুও সান্ত্বনা যে একটা সরকারি চাকরি হয়েছে।
হেদায়েত সাহেবের উপরের পদে যিনি চাকরি করেন তিনি আর কেউ না, তারই এলাকার এক সিনিয়র ভাই, এস.এস.সি পাসের বছর হিসেবে এক বছরের সিনিয়র কিন্তু বয়সে হেদায়েত সাহেবের চেয়ে মাত্র ছয় মাসের বড়। সরকারি চাকরিতে জয়েন করার আগে হেদায়েত সাহেবের ধারণা ছিল চাকরি করলে প্রমোশন পেয়ে সে একদিন উঁচু পদে চাকরি করবে, বড় অফিসার হবে কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সে বুঝতে পারল, শুধু চাকরির বয়স বেশি হলেই প্রমোশন হয় না, উপরের পদ শূন্য থাকতে হয়, তবে সেই শূন্য পদে প্রমোশন হয়। হেদায়েত সাহেব হিসেব করে দেখলো তার উপরের পদে আছেন কুদ্দুস সাহেব, তার পদবি উচ্চমান সহকারী, তবে সবাই তাকে বড় বাবু বলে বেশ সম্মান করে। তার অবশ্য কারণও আছে, অফিসের বড় সাহেব বড় বাবু ছাড়া আর কাউকে বোঝেন না, অফিসে ঢুকেই কলিং বেল টিপে আগে বড় বাবুকে ডেকে পাঠান, বড় বাবুর কাছে সুপারিশ ছাড়া কারো ছুটি হয় না, কোনো ফাইল সই করতে বড় বাবুর কাছে নিশ্চিত হন, এমনকি অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার আগে বড় বাবুকে ডেকে আর কোনো কাজ আছে কী না জেনে অফিস থেকে বেরিয়ে যান, হেদায়েত সাহেবের কাছে বড় সাহেবের সান্নিধ্য আর অফিসে অন্যান্য কর্মচারীদের ওপর খবরদারিই যেন অনেক সম্মানের।
কুদ্দুস সাহেব হেদায়েত সাহেবের চেয়ে মাত্র ছয় মাস আগে রিটায়ার্ড করবেন আর তখনই তার স্থলে হেদায়েত সাহেব প্রমোশন পেয়ে নিম্নমানসহকারী থেকে উচ্চমান সহকারী হবে অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক হলে হেদায়েত সাহেব বড় বাবু হবে মাত্র ছয় মাসের জন্য।
চাকরির কয়েক মাস পর হেদায়েত সাহেব বিয়ে করল, মধ্যবিত্ত পরিবারের এক স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে। মেয়ে দেখতে, শুনতে ভালো, বংশ বুনিয়াদও ভালো। পদ-পদবি সম্পর্কে তার ধারণা নেই, সরকারি চাকুরে স্বামী পেয়ে সেও ধন্য এবং গর্বিত। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে গিয়ে এলাকায় স্বামী আর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে অনেক সুনাম ছড়িয়েছে।
স্ত্রী লাইলির ধারণা ছিল সরকারি চাকুরি মানে অনেক টাকা, মাস গেলে বড় অঙ্কের বেতন, উপরি-টুপরি তো আছেই কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে তার ভ্রম কাটলো যখন মাসের শেষ দিকে এসে স্বামীর হাতের অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারল।
লাইলির এক মামাতো ভাই আছে, কয়েক বছর আগে পুলিশে চাকরি পেয়েছে, লাইলি তার সম্পর্কে জানে, সে কনস্টেবল পদে জয়েন করার কয়েক বছরের মধ্যে প্রমোশন হয়েছে। লাইলি একদিন হেদায়েত সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?
হেদায়েত সাহেবের সঙ্গে লাইলির সম্পর্ক শুধু স্বামী-স্ত্রীই না অনেকটা বন্ধুসুলভ। লাইলির এমন কথায় হেদায়েত সাহেব একটু অবাক হলো, তুমি তো এমন করে কথা বলো না লাইলি, আজ আবার হঠাৎ করে কী হলো?
না, বলতে ভয় পাচ্ছি।
কোনো ভয় নেই বলে ফেল।
আচ্ছা তোমার প্রমোশন হবে না?
হেদায়েত সাহেব স্ত্রীর মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল তারপর বলল, হ্যাঁ হবে তো।
কবে।
দেরি আছে।
আমার এক মামাতো ভাই আছে, পুলিশে চাকরি করে, ওর প্রমোশন হয়েছে বলে তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। তুমি আবার কিছু মনে করো না।
হেদায়েত সাহেব হেসে উড়িয়ে দিল, আরে না, না মনে করবো কেনো? আসলে সরকারি চাকরিতে প্রমোশন শুধু বয়সের ওপর নির্ভর করে না, উপরের পদ ফাঁকা আছে কী না তারওপরও নির্ভর করে।
তোমার ওপরের পদ ফাঁকা হবে কবে?
হেদায়েত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল, সেটাই তো কথা। আমার ওপরের পদ ফাঁকা হবে আমার রিটায়ার্ড করার ছয় মাস আগে।
তারমানে তুমি বড় বাবু হয়ে মাত্র ছয় মাস থাকবে।
হেদায়তে সাহেব একটা কষ্টের হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ যদি উনি রিটায়ার্ড করার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রমোশন হয় তবে, আর যদি ফাইল প্রসেস করতে দেরি হয় তবে হয়তো প্রমোশনের আগেই আমি রিটায়ার্ড করবো আর তুমিও ছোটবাবুর স্ত্রী হিসেবেই থেকে যাবে।
হেদায়েত সাহেবের এক ছেলে, সে মাস্টার্স পাস করে চাকরির জন্য ছুটোছুটি করছে। আজ এক দরখাস্ত তো আরেকদিন আরেক দরখাস্ত। আজ এক ইন্টারভিউ তো আরেকদিন আরেক ইন্টারভিউ। তবে ছেলেটা মেধাবী, হিমেলের কোনো ভালো চাকরি হবে সে ব্যাপারে সবাই আশাবাদী। প্রথমবার বি.সি.এস দিয়েছিল কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি দ্বিতীয়বার সে আরো ভালোভাবে লেখাপড়া করেছে, প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সে আদা নুন খেয়ে লাগল।
কয়েক মাস আগে বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে, এবার সে আশাবাদী তার চাকরি হবে। সে সবসময় খোঁজখবর রাখে কবে রেজাল্ট হবে। একদিন সেই প্রত্যাশিত, বহুল আকাঙ্ক্ষিত বি.সি.এস পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। হিমেলের চাকরি হয়েছে। সেদিন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ছেলে বি.সি.এস অফিসার হয়েছে, শুধু বাড়িতে না পুরো এলাকায় যেন খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
অফিসের বন্ধু ও কলিগরা হেদায়েত সাহেবের ছেলের সফলতায় গর্ববোধ করল। অনেকেই বলতে শুরু করল, ছোটবাবুর আর চাকরির দরকার নেই। ছেলে এখন বি.সি.এস অফিসার।
হেদায়েত সাহেব অনুভব করে ছেলে অফিসার হওয়াতে তার প্রমোশনটা কত জরুরি হয়ে পড়েছে কিন্তু প্রমোশন তো আর তার হাতে নেই। দেখতে দেখতে ছেলের চাকরির তিন বছর হলো তার একটা প্রমোশন হলো। ছেলের প্রমোশনের খবরে বাড়িতে আরো একটা আনন্দের ঢেউ লেগে গেল।
সেদিন রাতে লাইলি হেদায়েত সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের হিমেলের মাথায় আল্লাহ বুদ্ধি দিয়েছে, চাকরি হতে না হতেই প্রমোশন। আচ্ছা তোমার প্রমোশনের কী হলো গো?
হেদায়েত সাহেবের চাকরি আর এক বছর আছে, বড় বাবুর চাকরি আছে তিন মাস। হেদায়েত সাহেব বুকে একটা কষ্ট চেপে বলল, এই তো আর তিন মাস পর বড় বাবু রিটায়ার্ড করবে তারপর আমার প্রমোশনের ফাইল যাবে।
তারপর আর কতদিন লাগবে?
প্রমোশনের ফাইলের সময় লাগে, দেখি কবে হয়। আল্লাহ ভালো জানেন।
লাইলি আর কথা বলে না।
বড় বাবু রিটায়ার্ড করল। বিধি মোতাবেক হেদায়েত সাহেবের প্রমোশনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। হেদায়েত সাহেব ছোট কর্মচারী হলেও তার প্রমোশনের ফাইল যাবে সেই ঢাকায়, ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে বড় কর্তার টেবিল পর্যন্ত, বড় কর্তার কত কাজ, সারাদেশের ফাইল তাকে দেখতে হয়, সচিবালয়ে যেতে হয়, চলে মিটিংয়ের পর মিটিং, ফাইলের ওপর ফাইল। হেদায়েত সাহেবের প্রমোশনের ফাইলেরই বা তার কাছে কতটুকু গুরুত্ব। তারওপর আছে বিধি, নীতিমালা, প্রজ্ঞাপন। সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে হবে, প্রমোশনের জন্য কমিটি আছে, কমিটির মিটিং হবে তারপর চূড়ান্ত হবে হেদায়েত সাহেবের প্রমোশন।
বড় বাবুর রিটায়ার্ডের পর সেই কাজগুলো ছোটবাবুই চালিয়ে নিচ্ছে। ছোট বাবু কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো যোগ্য কিন্তু প্রমোশন না হওয়া পর্যন্ত সেই চেয়ারে বসার মতো যোগ্য না। তাই হেদায়েত সাহেব চেয়ে থাকে সেই অফিস আদেশের দিকে। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস সময় অতিবাহিত হলো। হেদায়েত সাহেব আর প্রমোশনের জন্য মাস গুনে না, দিন গুনে। আর উনত্রিশ দিন, আঠাস দিন এভাবে গুনতে গুনতে সময়ও প্রায় শেষ হলো কিন্তু প্রমোশনের চিঠি এলো না।
আগামীকাল হেদায়েত সাহেবের শেষ অফিস। আজ পর্যন্ত প্রমোশনের চিঠি আসেনি। হেদায়েত সাহেব ভারাক্রান্ত মনে অফিস থেকে বের হলো। অফিসের দিকে সে একবার তাকালো, দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। এই অফিসে তার অনেক স্মৃতি। একদিন এই অফিসে ছোটবাবু হিসেবে জয়েন করেছিল। আগামীকাল তার শেষ অফিস, সারাজীবনের তার প্রত্যাশিত প্রমোশনটা হয়নি, আর একদিনের জন্য প্রমোশন হওয়াই কী আর না হওয়াই বা কী।
হেদায়েত সাহেব অনেকদিন থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, আজকাল খাওয়া-দাওয়ার সামান্য অনিয়ম কিংবা দুশ্চিন্তায় প্রেসার বেড়ে যায়, ঘাড় ব্যথা করে, কোনো কোনো সময় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অফিস থেকে ফেরার সময় একটু একটু করে ঘাড় ব্যথা শুরু হয়েছে। কোনোরকমে বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল, এরকম প্রায়ই হয়। হেদায়েত সাহেব রাতের প্রেসার ঔষধের পর একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আজ ঘাড় ব্যথা আরো বেড়েই চলছে, ঘুমের ঔষধ খেয়েও চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। ব্যথা আরো বেড়েই চলল, গভীর রাতে শুরু হলো বুক ব্যথা। লাইলি হিমেলকে ফোন করল, আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করল, দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স করে হেদায়েত সাহেবকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
হেদায়েত সাহেব সারাজীবন ঠিক সময়মতো অফিসে আসে, আজ শেষ কর্মদিবসে প্রায় দুপুর বারোটা বেজে গেল কিন্তু হেদায়েত সাহেব অফিসে এলো না। পোস্ট অফিসের পিয়ন চিঠি দিয়ে গেল, আগত চিঠি খুলে একজন অফিস সহকারী ডকেট করে ডাকফাইল বড় সাহেবের রুমে নিয়ে গেল। বড় সাহেব আফসোস করে বললেন, আরে হেদায়েত সাহেবের যে প্রমোশন হয়েছে, একেবারে শেষ দিনে।
বড় সাহেব কলিংবেল এ টিপ দিতেই পিয়ন চলে এলো, স্যার।
হেদায়েত সাহেব এসেছে?
না স্যার।
হেদায়েত সাহেব তো এমন করে না। চাকরির শেষ দিনে আজ আবার কী হলো, বলে বড় সাহেব হেদায়েত সাহেবের নাম্বারে মোবাইল করলেন কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। বড় সাহেব আপনমনে বললেন, হেদায়েত সাহেব তো ফোন রিসিভ করে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। তিনি কলিং বেল-এ টিপ দিবেন এমন সময় দরজা খুলে অফিস পিয়ন ভিতরে ঢুকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, স্যার আমাদের ছোটবাবু মারা গেছে।
বড় সাহেব একরকম আঁতকে উঠলেন, ছোটবাবু! মানে হেদায়েত সাহেব।
জি স্যার।
হেদায়েত সাহেবের প্রমোশনের অফিস আদেশটা টেবিলের ওপর আস্তে করে রাখলেন, তার বুক চিরে ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে বেরিয়ে এলো, এমনদিনে অফিসের বড় কর্তার আদেশে ছোটবাবু বড়বাবু হলো যেদিন পৃথিবীর একমাত্র কর্তার নির্দেশে ছোটবাবু ছোটবড়’র সীমানা অতিক্রম করে চলে গেছে। আমাদের সিস্টেমটাই এমন কারো ন্যায্য অধিকার পেতে পেতে জীবনের শেষ দিনটিও চলে যায়। এই সিস্টেমের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন যাতে করে প্রতিটি মানুষ যথাসময়ে নিজ নিজ অধিকার থেকে একমুহূর্ত বঞ্চিত না হয়।
সমাপ্ত।
Leave a Reply