হাসি কান্নার ঈদ

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশী। তাই রমযানের চাঁদ দেখার পর থেকেই আরম্ভ হয়ে যায় ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি, কেনাকাটার ধুম। রাজধানীর শপিং সেন্টাগুলোতে শুরু হয়ে যায় দামি কাপড়, অর্নামেন্টস, কসমেটিকস, ফ্যাশন সামগ্রী কেনার প্রতিযোগিতা। মফ:স্বল শহর এমনকি গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারগুলোও এদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করে কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, ক্ষুধা আর দারিদ্র যাদের নিত্য সঙ্গী, ভোগ আর উপভোগের না হয়ে জীবন যাদের কাছে সংগ্রামের তাদের জন্যও কি ঈদ আনন্দের?
এতো গেল ফুটপাথ আর বস্তিতে বসবাস করা একেবারে হতদরিদ্র মানুষের কথা। আর মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। সমাজে যাদের অবস্থান ফুটপাথ আর অট্টালিকার কোনো এক স্তরে কিংবা যারা সাদেক আলীর মতো সামান্য বেতনের চাকুরী করে তাদের জন্য ঈদ যেন একটা হাসি-কান্নার খেলা। তাইতো প্রতি বছর রমযানের চাঁদ দেখার পর থেকে সাদেক আলীর মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে এবার ঈদটা আনন্দের হবে তো?
চার সদস্যের সংসার। স্বামী-স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে। প্রতিবছর সাদেক আলী ঈদ বোনাস পেয়ে সেমাই চিনির টাকা আলাদা করে রেখে তারপর সবাইকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে যায়। সবার আগে ছেলেমেয়ে দু’টোর জামা-কাপড়, তারপর গিন্নির, তারপর মায়ের জন্য একটা শাড়ি। এসব কেনাকাটার পর পকেটে হাত দিয়ে টাকা হিসেব করে দেখে যদি তার কোনোকিছু কেনার মতো টাকা থাকে তো কেনে আর যদি না থাকে তবে একটা শুষ্ক হাসি হেসে গিন্নিকে বলে, আমি গতবছর একটা পাঞ্জাবি কিনেছিলাম, আছে না?
ঝুমা কিছুটা তিরস্কারের সুরে বলে, তারমানে তোমার টাকা শেষ?
সাদেক আমতা আমতা করে বলে, শেষ না, আমি তো আর লম্বা হই নি, আগে পাঞ্জাবিটাও ছিঁড়ে যায় নি কাজেই অতিরিক্ত টাকা খরচ করার দরকার কী?
ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠে, তোমার বাজেট শেষ তো তোমার মা’র জন্য শাড়িটা কিনলে কেন? আমি তো এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম একটা ট্রাঙ্ক ভরা শাড়ি। মাতো ওগুলো শাড়িই পরে শেষ করতে পারবে না।
সাদেকের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই ছোটবেলার কথা। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে গাদাগাদি করে মানুষ হয়েছে তারা। বাবা প্রান্তিক চাষী। প্রতি বছর ঈদের সময় বাবা তাদের সবাইকে একটা একটা করে কাপড় কিনে দিত। যে জামা নিত তার প্যান্ট বা পায়াজামা হতো না আর যার প্যান্ট বা পায়জামা হতো তার জামা হতো না। সবার একটা একটা করে কাপড় নেয়ার পর যখন তার বাবা-মা’র পালা আসতো তখন কম পড়তো সেমাই চিনি কেনার টাকায়। তাই বেশিরভাগ ঈদের সময় বাবা-মা’র কাপড়-চোপড় কেনা হতো না।
তারপরও তাদের কত আনন্দ ছিল। মা সেমাই রান্না করতো দুধ ছাড়া। সবার গায়ে একটা একটা করে নতুন কাপড়। মা’র পরণে সেই আগের শাড়ি, বাবার গায়ে পুরাতন পাঞ্জাবি। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে হলেও ঈদে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। সাদেক কোনোদিন শাড়ির জন্য মাকে বাবার সাথে ঝগড়া করতে দেখে নি। মা সবার প্লেটে সেমাই আর মুড়ি তুলে দিয়ে হাসি মুখে ঈদ পালন করতো। সেদিনের ভাগাভাগি করে সেমাই মুড়ি খেয়ে খুশীতে ঈদ পালন করার মতো আনন্দ আজ পর্যন্ত আর হলো না।
সাদেকের বাবা মারা গেছে। সেই এখন বাবা হয়েছে। তার আর্থিক অবস্থাও বাবার চেয়ে খুব ভালো না। সেও বাজার করতে গিয়ে সবার পছন্দমতো জামা-কাপড় কিনে দিতে পারে না। আর সেটা নিয়ে প্রতি বছর ঈদ এলে ঝুমার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়, কোনো কোনো বছর তুমুল কাণ্ড বেঁধে যায়।
সাদেকের মা গ্রামের বাড়িতে শয্যাশায়ী। যেকোনো সময় দু:সংবাদ আসতে পারে। তাই আজকাল প্রায়ই সে গ্রামের বাড়ি যায়। মা’র পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকে, তার ভালো-মন্দের খবর নেয়। আসার সময় মা’র হাতে ক’টা টাকা দিয়ে চলে আসে আর ভাবে তার মা’র সাথে বুঝি এটাই তার শেষ দেখা।
ঈদ বোনাস পাবার পর সাদেক বাড়ি গেল। কয়েক দিন আগে বাড়ি যাওয়ার সময় মা তার কাছে ফলমূল খেতে চেয়েছিল। স্বল্প শিক্ষিত মানুষ পথ্য বলতে, ফলমূল বলতে আপেল, কমলা, আঙ্গুরের মতো দামি ফলকে বোঝে।
সাদেক যাওয়ার সময় মা’র জন্য ফলমূল কিনল। মা শয্যা পাশে ফলমূলের ব্যাগ দেখে খুব খুশী হলো। আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল। মা’র খোঁজখবর নিয়ে আসার সময় মা’র হাতে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল। সবমিলিয়ে সাদেকের প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল।
আজ মা’র জন্য শাড়ি কিনতে গিয়ে ঝুমা যখন প্রশ্ন তুলল তখন সে প্রচণ্ড কষ্ট পেল, তার মনে হলো এটাই হয়ত তার মা’কে দেয়া শেষ শাড়ি।
তারপরও ঝুমাকে কিছু বলল না শেষে ঝুমা বড় আকারে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলে ঈদের আনন্দ নিরানন্দ হয়ে যায় সেই আশঙ্কায়।
মেয়েটি সাদেককে খুব ভালোবাসে। সে মেয়েকে সবসময় মা বলে ডাকে। সে পাশে এসে দাঁড়াল, বাবা তুমি কিছু নিবে না?
সাদেক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমার তো পাঞ্জাবি-পাজামা আছে রে মা। আমি তো সবসময় শার্ট-প্যান্ট পরি। পাঞ্জাবি-পাজামা পরি তো শুধু ঈদের দিন। একটা দিন কোনোমতে পার করতে পারলেই হয়।
তাই বলে ঈদে তুমি নতুন কিছু নিবে না। আগে জানলে আমি এত দামি থ্রি-পিস নিতাম না বাবা।
সাদেক মেয়েকে আদর করে বলে, ওরে আমার মা। নিজে কমদামি জামা কিনে আমাকে কিনে দিবে। ঠিক যেন আমার মায়ের মতো।
ঈদের কেনাকাটা করে সবাই বাসায় ফিরল। ঈদের শাড়ির দাম কম হওয়াতে ঝুমার মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। সাদেক বাজার থেকে ফিরে ঝুমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ঝুমা, মন খারাপ কর না। মা বয়স্ক মানুষ, যেকোনো দিন মারা যেতে পারে, একটা শাড়িই তো, এমনো তো হতে পারে আর কোনোদিন মা’কে কিছু দেয়ার সুযোগই হবে না।
কিন’ ঝুমা কিছুতেই বুঝতে চায় না। সে আরো বেশি দামি একটা শাড়ি দেখেছিল দাম এক হাজার টাকা বেশি কিন্তু টাকা না থাকায় তার পছন্দের সেই শাড়িটা কেনা হলো না। তার যুক্তি হলো সাদেক তার মা’র জন্য শাড়িটা না কিনলেই তার সেই পছন্দের শাড়িটা কিনতে টাকার কমতি হতো না।
সেদিনের পর থেকে ঝুমার মুখ ভার। যেকোনো কাজে সে সাদেককে খোঁটা দিয়ে কথা বলছে। সাদেক জানে না ঈদের দিন সে কী কাণ্ড করে বসবে।
আগামীকাল ঈদ। সাদেক সকালবেলা কাপড়-চোপড় পরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কাপড়-চোপড় পরে সাদেক জুতা পরছিল এমনসময় ঝুমা শাড়িটা সাদেকের হাতে দিয়ে একটু ঝাঁঝালো গলায় বলল, নাও, তোমার মা’র জন্য শাড়িটা নিয়ে যাও। তুমি তো তোমার মা’র যোগ্য ছেলে। সারাজীবন আমাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিতে পারলে না আর তোমার অসুস্থ, বার্ধক্য জনিত মা’র জন্য শাড়ি কিনলে।
সাদেক কষ্ট পেলেও রাগ করল না। সে কোনোভাবেই চায় না ঈদের আগে ঝুমার সাথে কোনো গণ্ডগোল বাঁধিয়ে তার আনন্দময় ঈদটা নষ্ট হয়ে যাক। সে মৃদু হেসে বলল, বুঝছই তো, অসুস্থ মানুষ এমনো হতে পারে এই ঈদই তার শেষ ঈদ।
একথা তো আরো দু’বছর আগে থেকে শুনছি। আর কতদিন যে বুড়ি আমাদের ভোগাবে।
সাদেক একবার রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে শাড়িটা নিয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছিল এমনসময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে স্ক্রিনে নাম দেখল তার ছোটভাই বাড়ি থেকে ফোন করেছে, হ্যালো কীরে?
সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ভাইজান মা নেই।
নেই মানে?
নেই মানে মারা গেছে।
সাদেক আলীর তার মুখ থেকে অষ্ফুটস্বরে বের হলো, মা চলে গেছে। তারপর শাড়িটা ঝুমার হাতে দিয়ে বলল, এটা আর লাগবে না।
ঝুমা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*