অনুশোচনা

প্রাপ্তির বয়স এখন বারো বছর, সবকিছু বুঝতে শিখেছে। আজকাল শিরিন কিছু বললেও হায়দার সাহেব এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্রাপ্তিকে কাছে দেখলে নিঃশব্দে এড়িয়ে যান। আর আশে-পাশে কাউকে না দেখলে গম্ভীর মুখে শিরিনের কথার জবাব দিয়ে ভিতরে চলে যান।
হায়দার সাহেব আজ সারাদিন ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন। তাই দুপুরবেলা বাসায় ফিরতে পারেননি। বিকেল বেলা শিরিনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই হায়দার সাহেব বাসায় ফিরে আসা মাত্র শিরিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেছে আর হায়দার সাহেব সবকিছু শুনেও মাথা নত করে নীরবে সবকিছু হজম করছেন। কিছুক্ষণ পর প্রাপ্তি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হায়দার সাহেবের পাশে বসে একরকম হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, আব্বা তুমি কি বিয়েতে যৌতুক নিয়েছিলে?
হায়দার সাহেব তার মেযে প্রাপ্তির কথার কোন জবাব দিতে পারলেন না। তিনি মাথা নত করে চুপ করে বসে রইলেন।
প্রাপ্তি আবার বলল, চুপ করে আছ কেন বাবা? বলো? বলে কী মনে করে যেন প্রাপ্তি তার ঘরে চলে গেল।
হায়দার সাহেব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
পনেরো বছর আগের একটি ঘটনা তাঁকে এমন বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করবে একথা তিনি কোনদিন ভাবতেই পারেন নি। আজ সেই ঘটনাই হায়দার সাহেবকে ভাবিয়ে তুললো। বি.এ পাসের পর হায়দার সাহেব চাকরির জন্য দরখাস- করতে করতে এক সময় নিরাশ হয়ে পড়লেন তবুও চাকরির বয়স থাকা পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়েননি। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ চাকরির বয়সও একদিন অতিক্রান্ত হলো।
বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ায়। সরকারী চাকরিতে তার দরখা্সত করার পথটিও রুদ্ধ হলো চিরতরে। যেদিন তাঁর চাকরির বয়স অতিক্রান্ত হলো সেদিন তাঁর ইচ্ছা হচ্ছিল সমস্ত সার্টিফিকেটগুলো জ্বালিয়ে ফেলতে কিন্তু সার্টিফিকেটের মায়া কাটিয়ে তিনি আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে পারেননি তাঁর সার্টিফিকেটগুলি। বরং বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। ব্যর্থতা তার জীবনে জেদ চাপিয়েছিল। তিনি তাঁর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষি কাজ চালু করলেন সেখানেও পুঁজির অভাবে সুবিধা করতে পারেননি, এমন সময় বিয়ের প্রস্তাব এলো।
হায়দার সাহেব একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলেছিলেন, আমি বেকার যুবক, নিজে খাবো সেই সংস্থানই নেই তারপর আর একজনের দায়িত্ব নিবো কীভাবে?
ঘটক তাঁরই দূর-সম্পর্কের এক মামাতো ভাই তিনি বলেছিলেন, ভেবে দেখ হায়দার বিয়েই তোর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে, বিয়ের যৌতুক তোর কৃষিকাজের পুঁজির হবে, তোর বাড়িও শহরের কাছে, শহরে একটা ব্যবসা চালু করতে পারবি, তুই বুদ্ধিমান ছেলে তোর প্রতিষ্ঠিত হতে বেশিদিন সময় লাগবে না।
নিজের দুরবস্থা আর যৌতুকের লোভনীয় প্রস্তাবের কথা ভেবে হায়দার সাহেবের প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্নটা মনের মধ্যে যেন মেঘলা আকাশে সুর্যের আভার মতো উঁকি দিলো। তাই তিনি সানন্দে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন। অভিশপ্ত যৌতুকের টাকা দিয়েই হায়দার সাহেব ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু বিধিবাম যৌতুকের অবৈধ টাকায় ব্যবসা করতে গিয়ে তাঁর সমস্ত টাকা গচ্ছা গেল। তিনি সেকথা নিজের স্ত্রীকেও জানাননি, নিজের সামান্য জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋৃণ নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করলেন। তারপর তিনি আর কখনো পিছু ফিরে তাকাননি। দ্রুতগতিতে ব্যবসায় সফলতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। শহরে তিনি এখন হাতে গোনা দু’চারজন ব্যবসায়ির মধ্যে একজন। কিন্তু তারপরও দাম্পত্য জীবনে তিনি সুখী নন। যৌতুক গ্রহণের অজুহাতে স্ত্রীর অবহেলা, গঞ্জনা আর সহস্র আবদার মেনে নিয়েছেন।
কয়েকমিনিট পর প্রাপ্তি ফিরে এলো।
হায়দার সাহেব ভেবেছিলেন প্রাপ্তি হয়ত বিষয়টি ভুলে গেছে। তাই তিনি শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, কী রে মা? কোথাও যাবি?
প্রাপ্তি হায়দার সাহেবের চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে আবার জিজ্ঞেস করল, বাবা বলো?
হায়দার সাহেব না বোঝার ভান করে বললেন, কী রে মা?
প্রাপ্তি শাসনের সুরে বলল, তুমি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছ বাবা, বিষয়টি আমার জানা খুব প্রয়োজন. তুমি বিয়েতে যৌতুক নিয়েছ কি না?
হায়দার সাহেব অসহায়ের মতো মুখ তুলে তাকালেন।
প্রাপ্তির চোখ থেকে কয়েক ফোটা পারি গড়িয়ে পড়ল। সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, বাবা আমি অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম মা’র কাছে তোমার নিশ্চয়ই কোন দুর্বলতা আছে নইলে মা’র এতো অত্যাচার তুমি সইবে কেন? কাল মা বলল তুমি নাকি নানা বাড়ি থেকে যৌতুক নিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু করেছিলে? তারপর বুঝলাম তুমি এত অসহায় কেন?
হায়দার সাহেব বললেন, মা রে তুই তাহলে বুঝিস আমি তোর মায়ের কাছে অসহায়।
প্রাপ্তি দু’চোখ মুছে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, বাবা তুমি যৌতুক নিয়ে মাকে বিয়ে করেছ দেখে মা তোমাকে অপমান করার সাহস পায়।
হ্যাঁ রে মা বড় ভুল হয়ে গেছে, ঐ একটা ভুলের জন্য আমাকে সারাজীবন মূল্য দিতে হচ্ছে। সারা জীবন তোর মায়ের উপর আমি কোন কথা বলিনি কারণ তোর মা আমাকে কথা দিয়েছিল যৌতুক নেওয়ার কথা বলে কোনদিন তোর কাছে আমাকে ছোট করবে না। কিন্তু তোর মা কথা রাখেনি। তোর কাছেও আমার মুখ রইল না। আমার সব শেষ হয়ে গেল রে মা, আমার ব্যাংকে গচ্ছিত অঢেল টাকা, মিল কারখানা, লোকসমাজে সুনাম সবকিছুই ম্লান করে দিয়েছে সামান্য কয়েকটা যৌতুকের টাকা- বলতে বলতে হায়দার সাহেবের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
সোরি বাবা আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
তুই আমাকে কষ্ট না দিতে চাইলেও আমি কষ্ট পেতেই থাকবো মা, কারণ আমি যে কষ্টের গাছ লাগিয়েছি, হায়দার সাহেব অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলে একটু থামলেন তারপর বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, যৌতুকের যে অভিশপ্ত টাকা দিয়ে আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম সে টাকা আমার কোন কাজে আসেনি শুধু দুর্নাম আর কলংটুকু অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে । এত বছর পর আজ মনে হচ্ছে যদি আমি কলংকমুক্ত হতে পারতাম, যে মেয়ে সারাজীবন আমার নীতি ও আদর্শকে হৃদয়ে লালন করেছে তা যদি ফিরে পেতাম তবে- বলে তিনি আবার কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় শিরিন বেরিয়ে এসে অগ্নিমুর্তি ধারণ করে বলল, কী হলো? বাপ-মেয়ে এভাবে চুপ করে বসে আছ কেন? তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
হায়দার সাহেব কাউকে কোন কিছু না বলে গম্ভীর মুখে ভিতরে চলে গেলেন। তারপর স্টীল আলমারি খুলে তাঁর জমির দলিল, ব্যাংকের চেক বইসহ তাঁর বিষয়-সম্পত্তির সমস- কাগজ-পত্র বের করে ড্রয়িং রুমে এনে সজোরে চিৎকার করে বললেন, শিরিন তোমার বাবার কাছ থেকে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা যৌতুক নিয়েছি, সেজন্য তুমি সারাজীবন আমাকে অবহেলা করেছ, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছ, আমি তোমার সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছি কিন’ আর না আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না তোমার বাবার দেয়া যৌতুকের টাকা পরিশোধ করে তোমার অত্যাচার থেকে মুক্তি চাই, বলো পঞ্চাশ হাজার টাকা পনেরো বছরে সুদে-আসলে কত হয়েছে?
শিরিন প্রচণ্ড বিষ্ফোরণে ফেটে পড়ল, তুমি আমার বাবার টাকা পরিশোধ করতে চাও? পঞ্চাশ হাজার টাকা পনেরো বছরে কত হয়েছে জানতে চাও? তবে জেনে রাখো যৌতুকের টাকা তোমার রক্ত অপবিত্র করেছে আর অপবিত্র রক্ত তোমার অসি-ত্বের সঙ্গে মিশে গেছে, তুমি কি তোমার অপবিত্র রক্ত থেকে তোমার অসি-ত্বকে আলাদা করতে পারবে? বলে শিরিন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভিতরে চলে গেল।
হায়দার সাহেব কয়েকমুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর ধপাস করে বসে পড়লেন, প্রাপ্তি মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*