একটি স্বপ্ন ছিল

জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের সুখ যেন বিসর্জন দিয়েছে রাতুল। ভাড়া গাডি, ভাড়া ধরতে পারলেই তো টাকা। রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আরও তিন তিনটা মুখ। একটা ছোট বোন এস.এস.সি পাস করে বসে আছে, বিয়ের অপেক্ষায়। তার জন্য চলছে পাত্র দেখাদেখি, ভালো কোনো পাত্রের কাছে তাকে পাত্রস্থ করতে পারলে একটা বোঝা কমবে। একটা ছোট ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে, সামনে তার অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যত। সে ছাত্র ভালো, একটু প্রাইভেট টিউশনি দিতে পারলে এস.এস.সি’তে ভালো রেজাল্ট করবে। তারপর এইচ.এস.সি তারপর আরও অনেকদূর। বাবা প্রায় বছরখানেক আগে মারা গেছে, তখন থেকে পুরো সংসারটাই চেপেছে রাতুলের ওপর। প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে মা, ভাই আর বোনের জন্য রাতুলকে অনেক টাকা পাঠাতে হয়, সবগুলোই প্রয়োজনীয় টাকা, কোনোটা খরচই যেন বাদ দেয়ার নেই।

গ্রামে থাকতে রাতুল প্রাইভেট কার চালাত। তখন তেঁতুলিয়ায় পাথর তোলা এবং পাথরের ব্যবসা জমজমাট ছিল, রাতুল  মঞ্জুরের প্রাইভেট কার চালাত, সে ছিল পাথর ব্যবসায়ি। প্রাইভেট কার চালতে গিয়ে রাতুলের সঙ্গে পরিচয় হয় কুসুমের। কুসুমও এস.এস.সি পাস করে এইচ.এইচ.সি ভর্তি হয়েছে। কুসুম মঞ্জুরের বোনের মেয়ে, পাড়ার সম্পর্কে মঞ্জুরও রাতুলের মামা। কুসুম রাতুলের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট।

মঞ্জুরের প্রতিদিন গাড়ি প্রয়োজন হয় না। তার মোটর সাইকেল আছে, বেশিরভাগ জায়গায় সে মোটর সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে, মাঝে মধ্যে গাড়ি প্রয়োজন হয় সেদিন রাতুলকে ডেকে পাঠায়, তাছাড়া মাঝে মধ্যে গাড়ি ভাড়া খাটে। আবার যেদিন মঞ্জুরের ডিউটি বা ভাড়া কিছুই থাকে না সেদিন রাতুলের ডিউটি থাকে না সেদিন সে মঞ্জুরের বাড়িতেও যায় না।

এল পেটার্নের একটা সেমিপাকা বাসা। যে রুমে কুসুম থাকে সে রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই খোলা আঙিনা, আঙিনার শেষ প্রান্তে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। যেদিন ডিউটি পড়ে সেদিন সকালবেলা রাতুল গাড়ি নিতে আঙিনার সামনে দিয়ে গ্যারেজে যায় তখন রাতুলকে দেখে কুসুম বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, দু’জনে দাঁড়িয়ে কথা বলে, কোনোদিন কুসুম বেরিয়ে আসতে দেরি হলে রাতুল ইচ্ছা করেই গাড়ি স্টার্ট না দিয়ে স্টার্ট দেয়ার ভান করার, কুসুম আসার জন্য সময়ক্ষেপণ করে, কুসুম দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলে রাতুল গাড়ি স্টার্ট দেয়।

কুসুম রাতুলের চোখের ভাষা বোঝে, কথার পেছনের কথাও বোঝে, কুসুম জিজ্ঞেস করে, রাতুল ভাইয়া তোমার গাড়ির কি ব্যারাম হইছে নাকি?

রাতুল একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলে, হ্যাঁ। সকালবেলা একটু ডিসটার্ব করে। ইঞ্জিন একটু হিট হইলে ঠিক হয়্যা যায়?

তাই নাকি?

হ্যাঁ। গাড়ির আর কী দোষ, সকাল সকাল মানুষেরও একটু হাঁটাহাঁটি না করলে শরীরও তো জ্যাম হয়্যা যায়, তাই না?

কুসুম রেগে যায়, রাতুল ভাইয়া তুমি কী বলতে চাও, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছ?

আরে না, তোমাকে কিছু বলব কেনো, দেখ সকালবেলা মানুষ কেমন হেঁটে বেড়ায়, সকালবেলা হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। তুমি তো কম দেখ, আমি যেদিন সকালবেলা গাড়ি নিয়ে শহরে যাই সেদিন কত বুইড়া বুইড়া মানুষকে যে শহরের রাস্তায় বেড়াতে দেখি।

কুসুম রেগে যায়, বুঝি, সব বুঝি, কী কারণে গাড়ি ডিসটার্ব হয় সেটাও বুঝি।

রাতুল একটা মুচকি হাসি হেসে বলে, ঐ যে কারণে সকাল সকাল বাইরে বের হইতে হয় সে কারণেই আর কী।

এই, এই রাতুল ভাইয়া ভালো হবে না কিন্তু।

রাতুল চলে যায়।

যেদিন মঞ্জুরের ডিউটি করে সেদিন রাতে যখন রাতুল গাড়ি রাখতে যায় তখন কুসুম জানালার সামনে বসে জোরে জোরে বই পড়ে আর যেদিন বাইরে ভাড়া খেটে রাতুল একা গাড়ি নিয়ে বাসায় আসে সেদিন কুসুম ঘরের ভেতর থেকে ডাক দেয়, রাতুল ভাইয়া। আজ গাড়ি ঠিক আছে তো?

রাতুল উত্তর দেয়, গাড়ি ঠিক আছে তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া কর, গাড়ির চিন্তা তোমার না করলেও চলবে।

এভাবে প্রতিদিন দুয়েকটা করে কথা আর মিষ্টি ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে কখন যে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেছে কেউ বুঝতে পারেনি। যেদিন রাতুলের ডিউটি থাকে না সেদিন কুসুমকে তার খুব দেখতে ইচ্ছা করে। পর পর কয়েকদিন ডিউটি না পড়লে বা গাড়ি ভাড়া না হলে যখন রাতুল ওবাড়িতে যায় না, কুসুমের সঙ্গেও দেখা হয় না তখন মনটা ছটফট করে, কুসুমের রাতুলের মতোই অস্থির অস্থির লাগে, সে লুকিয়ে লুকিয়ে রাতুলকে ফোন করে, রাতুল ভাই তোমার ডিউটি নেই?

রাতুল বলে, না।

গাড়ির ভাড়াও পাও না?

না।

ও সেজন্য আসো না বুঝি?

ঠিক বলেছ?

বসে থাকলে কি তোমার গাড়ির অসুখ-বিসুখও হয় না?

তা হতে পারে।

তাহলে তো এসে একবার গাড়িটা দেখে যেতে পার।

হ্যাঁ। তা অবশ্য পারি, দেখি কাল সকালে যদি ডিউটি না পড়ে, ভাড়াও না পাই তবে একবার দেখে আসব, গাড়িটার কোনো অসুখ-বিসুখ হলো নাকি? গাড়ির অসুখ না হলেও অন্য কারও তো কিছু হতে পারে।

কুসুম মুখ বিকৃত করে বলে, ইসস, অন্য কারও বয়েই গেল। থাক, থাক, তোমাকে আসতে হবে না।

আচ্ছা থাক তাহলে, আসব না।

কুসুম রেগে যায়, প্রচণ্ড রেগে বলে তুমি না এসে দেখ তো একবার। আমি তোমাকে একদিন না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি, আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আর উনি সেটা বুঝতেই পাচ্ছেন না। পাষাণ, নিষ্ঠুর কোথাকার।

পরদিন রাতুল যায়, রাতুলকে দেখে কুসুম আঙিনায় আসে, যতক্ষণ রাতুল গাড়ি ধোয়া মোছা করে ততক্ষণ কুসুম ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতুলের সঙ্গে কথা বলে, গাড়ি ধোয়া মোছা শেষ করে রাতুল স্টার্ট দেয়, কুসুমকে গাড়িতে বসিয়ে আঙিনায় কয়েকটা চক্কর দেয়, সুযোগ বুঝে কুসুমের বাম হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চাপ মারে, কুসুমের ফর্সা গাল টেনে ধরে। কুসুম একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, ভালো হবে না কিন্তু। তারপর কুসুমকে নামিয়ে দিয়ে রাতুল চলে যায়। কিন্তু কুসুম আর রাতুলের এই সুখ বেশিদিন টিকল না।

সেদিন রাতে গাড়ি জমা দিতে গিয়ে মঞ্জুর গম্ভীর স্বরে বলল, রাতুল গাড়িটা বোধ হয় আর রাখা যাচ্ছে না।

রাতুলের বুকটা শুকিয়ে গেল। কয়েকদিন থেকে রাতুল এমন আভাসই পাচ্ছে আর সেরকম আভাস পাওয়ার পর থেকে রাতুলের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গাড়ি রাখা যাচ্ছে না মানে কী, রাতুল বেকার হয়ে পড়বে, কীভাবে তার দিন চলবে, এতগুলো মুখ তার একার রোজগারের ওপরই ভরসা করছে। তারচেয়ে বড় কথা হল, গাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে তার আর এ বাড়িতে আসা হবে না, এবাড়িতে আসা হবে না মানে তার সাথে কুসুমের দেখা হবে না কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব, কুসুমকে একদিন না দেখে সে কীভাবে থাকবে। সকালবেলা সে যখন কুসুমকে দেখে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় তখন সারাদিন কুসুমের মুখটা তার হৃদয়ে ভেসে ওঠে, রাতে যখন কুসুমের সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে যায় তখন মনে হয় কুসুম তার সঙ্গেই আছে, কুসুম যে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। কুসুম, কুসুমের সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে রাতুলের দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। কিছু বলতে গিয়ে তার গলার স্বর বুজে এলো, কেনো মামা?

দেখছিস না সরকার তো পাথর তোলা বন্ধ করে দিল, লেবার, ব্যবসায়ি, জনগণ সবাই মিলে আন্দোলন করেও তো সরকারকে রাজি করতে পারল না, আর গাড়িটা চলতই তো পাথরের ব্যবসা ছিল বলে। পাথরই যদি না থাকে তবে ব্যবসা চলবে কী করে আর ব্যবসাই যদি না চলে তবে গাড়ি চালাব কেমন করে। আগে যা টুকটাক ভাড়া পাওয়া যেত তাও পাথরের ব্যবসা ছিল বলে, মানুষের পকেটে টাকা ছিল, বাইরে থেকে পাথরের ব্যবাসীয়রা আসত বলে এখন তো আর ভাড়াও পাওয়া যাবে না।

রাতুলের সঙ্গে যখন মঞ্জুর বারান্দায় বসে কথা বলছিল তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে কুসুম সব কথা শুনছিল। এবার কুসুম ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, এটা তুমি কী কথা বল মামা, তুমি না বলতে গাড়িটা তোমার  লক্ষ্মী, যেদিন গাড়িটা কিনেছ সেদিন থেকে তোমার ব্যবসা দিন দিন উন্নতি হয়েছে আর এখন বলছ তুমি গাড়িটা বেচে দিবে।

হ্যাঁ রে মা। গাড়িটা বেচে না দিলে যে বসে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়্যা যাবে।

তবু তুমি একবার ভেবে দেখ মামা। মামিসহ আমরা গাড়ি নিয়ে বাড়িতে যাই, তুমিও যখন-তখন গাড়ি নিয়ে ব্যবসার কাজে যাও।

ব্যবসাই তো আর থাকবে না রে মা। দেখ কয়েকদিনের মধ্যে তেঁতুলিয়া, ভোজনপুর বাজার, জগদল বাজারে কেমন হাহাকার পড়ে যায়।

আল্লাহ চাইলে কিছুই হবে না মামা।

আচ্ছা রে মা দেখি।

কিন্তু মঞ্জুর শেষ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্তেই অনড় রইল। গাড়ি বিক্রি করে দিল। আর গাড়ি বিক্রি করে দেয়ার দিন থেকে রাতুলের সঙ্গে কুসুমের দেখা করাও বন্ধ হয়ে গেল। কুসুমের কোথাও মন বসে না, সবসময় একটা অস্থিরতায় ভুগে, সকাল হলেই কুসুম জানালার সামনে গিয়ে বসে কিন্তু রাতুল আসে না, কুসুম জানে রাতুল আর আসবে না তবুও মনকে বোঝাতে পারে না। কোনো কাজ, লেখাপড়া, শুয়ে থাকা, বসে থাকা কোনোকিছুতেই কুসুমের মন বসে না। আর রাতুল! একটা নিষ্ঠুর, পাষাণ, ওর গাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, চাকরি চলে গেল আর উধাও হয়ে গেল! চাকরি ছাড়া এবাড়িতে আর বুঝি ওর কেউ নেই! একবার গেল তো গেলই। দেখি এবার কাছে পেয়ে।

সেদিন রাতের খাবারের পর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন কুসুম রাতুলকে ফোন করল।

রাতুল কুসুমের ফোন দেখেই চমকে উঠল, কুসুম তুমি এত রাতে? কোনো সমস্যা?

সমস্যা তো বটেই। তুমি সমস্যা তৈরি করেছ তো সমস্যা হবে না।

কেনো? কী করেছি আমি?

কী করেছ তাও জানো না, হায় আল্লাহ আমি কাকে ভালোবাসলাম।

এতক্ষণ রাতুলের বুক ধুক ধুক করছিল, সে ভেবেছিল কী না জানি হয়ে গেছে। এবার সে নিশ্চিন্ত হল কুসুমের তাকে ফোন করার কারণ। সে বলল, আমিও তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি কুসুম কিন্তু কী করব বল?

কী করব মানে? সাহস করে একবার সামনে এলেও তো পার, মামাকে বলবে, আমি কুসুমকে ভালোবাসি, আমি কুসুমকে বিয়ে করব।

রাতুল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, কুসুম, মামা যদি বলে তুমি বিয়ে করে কী করে খাওয়াবে।

তাই বলে আমাকে একবার দেখতেও আসবে না তাই কি হয়?

আসব কুসুম, আসব। তবে একটা কাজেরও ব্যবস্থা করতে হবে।

সেটাও কর।

হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। আগে তো তাও ড্রাইভারের চাকরিটা ছিল এখন তো সেটাও নেই। আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছে না কুসুম। আমার শুধু মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

কুসুম একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, বাহ বাহ বাহ। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ আর বলছ বলে কুসুম মুখ বিকৃত করে বলল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। প্লিজ রাতুল তুমি কিছু একটা কর।

সেকথা কি আর তোমাকে বলতে হবে কুসুম। আমিও কি কম কষ্ট পাচ্ছি। দেখি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি একটা কিছু করতে হবে।

পাথর তোলা বন্ধ হওয়ায় এলাকার হাজার হাজার পাথর শ্রমিক বেকার হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে বেকার হলো অনেক ট্রাক ড্রাইভার, ট্রাক্টর ড্রাইভার এবং কাঁচা টাকার গরমে যারা প্রাইভেট কার কিনেছিল তাদের ড্রাইভাররাও, রাতুলও তাদের মধ্যে একজন। শুধু তাই নয় এলাকার হাটবাজারগুলো পর্যন্ত জৌলুস হারাল। একসময়ের জমজমাট জগদল, ভজনপুর, শালবাহান বাজার যেন মিইয়ে গেল। রাতুল কিছুদিন অন্য কোনো কাজ করার চেষ্টা করল কিন্তু সে তো একটাই কাজ জানে শুধু ড্রাইভিং, গাড়ি না থাকলে আর সে ড্রাইভিং করবে কী? শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো কাজ জোগাড় হলো না। পুরো এলাকায় বেকারত্বের অভিশাপ নামল।

এলাকার অনেক মানুষ ঢাকায় গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন মিল-কারখানায় কাজ করে। রাতুল একবার ভাবল ঢাকায় গিয়ে কোনো গার্মেন্টসে চাকরিতে ঢুকবে কিন্তু তার তেমন লেখাপড়া নেই, এস.এস.সি পাস করেছে মাত্র। তাতে করে গার্মেন্টস শ্রমিকের চাকরি ছাড়া কিছু হবে না, বেতন হবে অনেক কম। যা দিয়ে হয়ত চারজন মানুষের সংসার চালান কঠিন হয়ে পড়বে। রাতুল ভোজনপুর বাজার যায়, পরিচিত জনদের কথা বলে, অনেকেই, যাদের সামান্য কিছু জমি আছে তারা পাথর তোলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কৃষিকাজে মনোযোগী হয়েছে, অনেকেই কৃষি শ্রমিক হয়েছে কিন্তু রাতুলের কৃষি জমিও নেই আর কৃষি জমিতে শ্রমিকের কাজ করার মতো অভ্যাসও নেই।

রাতুলের এক বন্ধু, ঢাকায় থাকে। কয়েকবছর আগে ঢাকা গেছে, রাতুল জানত সে গার্মেন্টসে চাকরি করে কিন্তু বাজারে সেদিন তার ভাই বলল সে নাকি গাড়ি চালায়। কথাটা শোনার পর রাতুলের মনের মধ্যে আশা জাগল। সে রাতে কামরুলকে ফোন করল।

কামরুল ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো।

রাতুল হ্যালো বলে সালাম দিল, হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম।

কামরুল প্রথমে চিনতে পারেনি, সে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন প্লিজ!

রাতুল নিজের পরিচয় দিল, এই কামরুল, আমি রাতুল।

ও রাতুল। কেমন আছিস?

ভালো না রে।

কেনো? কী হয়েছে? কামরুলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

রাতুল পাথর উত্তোলন বন্ধ এবং পাথর শ্রমিকসহ এলাকার বেকার সমস্যার কথা কামরুলকে বলার পর বিনয়ের সুরে বলল, কামরুল আমার একটা কাজ খুব দরকার।

তুই তো প্রাইভেট কার চালাতিস না?

হ্যাঁ।

ঢাকায় প্রাইভেট কার চালাতে পারবি?

অবশ্যই পারব।

আচ্ছা, তুই এক কাজ কর। তুই ঢাকা চলে আয়।

রাতুল আবেগ আল্পুত হয়ে গেল। সে এত সহজে কামরুলের কাছ থেকে কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারবে এটা ভাবেনি। সে কামরুলকে জিজ্ঞেস করল, কামরুল তোর ওখানে গেলে চাকরি হবে তো, এতগুলো টাকা-পয়সা খরচ করে ঢাকা যাব…

কামরুল রাতুলের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, তুই চলে আয়। আমি তোকে বলছি না। ঢাকায় আয় আমি একটা ব্যবস্থা করে দিব।

ধন্যবাদ দোস্ত।

সেদিন রাতে কুসুমের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে সবসময় দু’জনে ফোনে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রাতের বেলা অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলে, রাতুল ভাবে এতদিন কুসুমের এই প্রেম কোথায় ছিল? আবার কখনও মনে হয় কুসুমের তো কোনো দোষ নেই্‌, সে মেয়ে মানুষ সে তো গাড়ি নিয়ে গেলেই সুযোগ পেলে সামনে এগিয়ে আসত কিন্তু রাতুল তো তাকে কোনোদিন বলে নি কুসুম চল একদিন আনন্দধারা থেকে বেড়িয়ে আসি, চল একদিন বিকেলবেলা তেঁতুলিয়া গিয়ে মহানন্দার তীরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্গা দেখি, আমাদের প্রেম, আমাদের স্মৃতিকে অমর করার জন্য ছবি তুলি। আসলে হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনা ঘটল তাদের ভালোবাসা এলোমেলো করে দিবে এটা দু’জনের কেউ-ই ভাবতে পারেনি। রাতুল ভাবত মামা যদি জানে তবে চাকরি চলে যাবে, কুসুমকে শাস্তি দিবে এবং আর কোনোদিন দেখা হবে না। তাছাড়া মঞ্জুরের পরিবার অত্যন্ত রক্ষণশীল, চাইলেই বাড়ির কোনো মেয়ে কোথাও যেতে পারে না কিন্তু তাই বলে রাতুল কি কুসুমকে একবার না দেখে ঢাকা যাবে? এটাও কি সম্ভব?

রাতুলের ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে কুসুম কেঁদে ফেলল, তুমি, তুমি আমাকে ছেড়ে ঢাকা যাবে?

তোমাকে ছেড়ে কেনো বলছ কুসুম, আমি তো ঢাকায় যাচ্ছি তোমার জন্য বলতে পার। আমি ঢাকা গিয়ে একটা চাকরি জোগাড় করে, বাসা ভাড়া নিব, আর বাসা ভাড়া নিয়েই তোমাকে নিয়ে যাব।

তা কতদিন লাগতে পারে?

কতদিন আর লাগবে, বড়জোর একমাস।

কুসুম যেন কুঁকড়ে গেল, এক মাস!

রাতুল জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কামরুল তো বলেছে গেলেই একটা ব্যবস’া হবে, তারপর বাসা খুঁজতে হবে আর আমি তোমাকে একটু বাড়িয়ে বললাম, পরে তো তুমি অস্থির হয়ে যাবে।

আহা হা আর তুমি বুঝি অস্থির হবে না। গরজটা শুধু আমার একার।

না, না তা হবে কেনো, আমাদের দু’জনের। আমাদের যা হবে তা দু’জনের, কষ্ট হোক, আনন্দ হোক, পাতিলে যদি একপ্লেট ভাত থাকে তবে আমরা দু’জনে ভাগাভাগি করে খাব, কথাগুলো বলতে বলতে রাতুলের কণ্ঠস্বর বুজে এলো।

কুসুমও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, তুমি, তুমি আমাকে এত ভালোবাস। আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান রাতুল।

রাতুল ঢাকা যাওয়ার আগের দিন মামা-মামির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ছুঁতোয় কুসুমের সঙ্গে দেখা করতে গেল। কুসুম রাতুলের জন্য সেজেগুঁজে তার রুমের মধ্যে পায়চারি করছিল আর বার বার করে রাতুলকে ফোন করছিল, কখন আসবা? সন্ধ্যা হলে তো মামা বাড়ি আসবে।

এইতো আসছি।

কুসুম অভিমান করে বলল, আমার প্রতি তোমার একটুও টান নেই। টান থাকলে সেই দুপুরবেলা এসে তুমি আশেপাশে ঘুরঘুর করতে, এমনই হয় যখন আমি তোমার জন্য উতলা হই তখন তুমি…বলতে বলতে রাতুল বলে এই তো চলে এসেছি, বাড়ি থেকে বাইরে আসো।

কুসুম একরকম দৌড়ে আসে আঙিনায়, আরে রাতুল ভাইয়া তুমি?

হ্যাঁ। কেমন আছ?

এই তো ভালো, তুমি ভালো আছ?

এই তো আছি, বলে সে বাড়ির দরজায় ঢুকতে ঢুকতে জোরে ডেকে বলল, মামি দেখ কে এসেছে?

মামি তখন কাজ করছিল, সে রাতুলকে ডেকে বলল, ও রাতুল যে, কেমন আছ বাবা?

ভালো মামি, আপনারা সবাই ভালো আছেন?

এই তো বাবা আছি ভালো।

রাতুল জিজ্ঞেস করল, মামা বাড়ি নেই মামি?

তোর মামা কি আর এসময় বাড়ি থাকে, বাজারের দিকে গেছে। বস বাবা, বস, বলে ডাইনিং টেবিলের সামনের একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বস, মা কুসুম রাতুলকে নাস্তা দে, রাতুল তো এখন বাড়ির মেহমান।

হ্যাঁ মামি তাইতো। কী নাস্তা দিব?

আচ্ছা থাক, তুইও বস আমি নাস্তা তৈরি করে দিচ্ছি।

রাতুল একটা চেয়ারে বসল, মুখোমুখী একটা চেয়ারে বসল কুসুম। কারও মুখে কোনো কথা নেই, দু’জনের চোখ পানিতে ছলছল করছে। অশ্রু সজল দু’চোখ, অব্যক্ত কিছু কথা সহস্র কথার চেয়ে বেশি অনুভুতি প্রকাশ করে।

কুসুম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি ঢাকা গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?

রাতুল কোনো কথা বলতে পরল না, কথা বলতে গিয়ে তার ঠোঁট দু’টো শিথিল হয়ে আসছে। সে একবার ডানে একবার বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানাল সে তাকে ভুলে যাবে না।

মামি দু’জনের জন্য নাস্তা নিয়ে এলো, তো বাবা, কী করবে এখন?

দেখি মামি কিছু একটা তো করতে হবে, কালকে ঢাকা যাব।

চাকরির কোনো খবর হয়েছে?

জি মামি।

ঢাকা অনেক বড় শহর, সাবধানে থেক বাবা।

রাতুল আরও কিছুক্ষণ মামি আর কুসুমের সঙ্গে কথা বলল। তারপর চেয়ার থেকে উঠে বলল, আমার জন্য দোয়া করবেন মামি।

অবশ্যই বাবা। আল্লাহ যেন তোমার সহায় হোন।

রাতুল ভেবেছিল কুসুম তার রুমে গিয়ে ঠিক আগের মতো জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু না সে তা করল না, সে দৌড়ে তার রুমে গিয়ে জোরে ডাক দিল, রাতুল ভাইয়া এদিকে আসো দেখি।

রাতুল একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাল, দেখল মামি নাস্তার প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে। সে কুসুমের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আবার একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাল।

কুসুম উত্তেজিত হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি আসো।

রাতুল কুসুমের রুমে ঢুকতেই সে রাতুলের বুকে মাথা রাখল, আমি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি রাতুল, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।

রাতুল কুসুমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কুসুম। তুমি দেখ আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব।

তুমি বল, ঢাকায় গিয়ে তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?

কখনই না কুসুম। আমি তোমাকে কখনই ভুলে যাব না।

যদি অন্য কোনো মেয়ের…

ছিঃ এমন কথা কক্ষণও বলতে নেই কুসুম।

রাতুলের জন্য কামরুলের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। সে তার বিছানায় রাতুলকে শেয়ার করতে দিল, রাতুলকে উবার অ্যাপস শিখিয়ে দিল, কয়েকদিন তার গাড়িতে করে নিয়ে বেড়াল এবং দু’য়েকদিন রাতুলকে গাড়ি দিয়ে সে পাশের সিটে বসে রইল।

এই কয়েকদিনে কুসুমের অভিযোগের অন্ত নেই। কামরুলের সঙ্গে থাকার কারণে আর বেশিরভাগ সময় গাড়িতে থাকার কারণে রাতুল সবসময় কুসুমের ফোন রিসিভ করতে পারেনি। রাতুলের উবার চালান শেখা শেষ হয়েছে, কামরুলের চেষ্টায় একটা প্রাইভেট কারেরও ব্যবস্থা হয়েছে। কামরুলের পাশের রুমে একটা সিট ফাঁকা ছিল রাতুল সেই সিটে উঠেছে। সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে রাতুল একরকম হাঁপিয়ে উঠেছে।

সেদিন রাতে রাতুল কুসুমকে ফোন করল কিন্তু কুসুম বার বার রাতুলের ফোনের লাইন কেটে দিল। অবশেষে রাতুল কুসুমকে ম্যাসেজ দিল, কুসুম পিলিজ ফোনটা ধর।

কুসুম ম্যাসেজ দিল, বার বার ফোন দিচ্ছ কেনো? আমি ঘুমাচ্ছি।

রাতুল লিখল, আমি জানি তুমি ঘুমাওনি, আমার ওপর রাগ করে গাল ফুলিয়ে শুয়ে আছ, পিলিজ ফোনটা রিসিভ কর, অনেকগুলো ভালো খবর আছে, তোমার আমার খবর।

ওকে। কল দাও।

রাতুল আবার ফোন করল। কুসুম ফোন রিসিভ করে অভিমানের সুরে বলল, বল, ফোন দিচ্ছ কেনো?

কুসুম আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করেছ কিন্তু সমস্যা কি তুমি জানো?

কুসুম গম্ভীর স্বরে বলল, না, জানতে চাই না।

কিন্তু তোমাকে জানতে হবে কুসুম। আমি কেনো এতদিন তোমার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করতে পারিনি।

আমি জানি, তুমি অন্য কারও প্রেমে পড়েছ। তার কাছে যাও।

না। তোমার ধারণা ভুল।

এবার কুসুমের অভিমানের বরফ কিছুট গলল, তবে ঠিকটা কী?

এতদিন সবসময় কামরুলের সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম, ওর রুমেই থাকতাম, আজ আলাদা রুমে উঠলাম। তাই তোমাকে ফোন দিলাম। তুমি তো জানোই একই এলাকার মানুষ, যদি তোমাকে চিনে ফেলে।

আর দিনের বেলা?

দিনের বেলা তো ভাই’র কাছেই উবার চালাতে শিখলাম।

কুসুম রাতুলের কথা বুঝতে পারল না, কী চালাতে শিখলে?

উবার।

উবার আবার কী? তুমি না গাড়ি চালাতে পার।

গাড়ি তো চালাতে পারি কিন্তু ঢাকা শহরে গাড়ি চালাতে গেলে একটা অ্যাপস চালাতে শিখতে হয়।

কুসুম বিরক্তির সুরে বলল, থাক, থাক আমাকে আর বোঝাতে হবে না। যাকে পেয়েছ তাকে নিয়েই থাক, আর তাকেই বোঝাও, বলে কুসুম ফোন কেটে দিল।

রাতুল আবার ফোন দিল, কেটে দিলে কেনো?

ঘুম নষ্ট করে তোমার ওসব জোড়াতালি দেয়া গল্প শোনার আমার সময় নেই।

কুসুম পিলিজ! আগে তুমি শোন।

বল, শুনছি।

আমি যেমন মামার প্রাইভেট কার দিয়ে ভাড়া মারতাম তেমনি উবারও একটা প্রাইভেট কার কিন্তু মোবাইল ফোনের অ্যাপসের মাধ্যমে চলে। এই যেমন একজন প্যাসেঞ্জার গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে, যাবে গুলিস্তান। তার মোবাইলে অ্যাপস সেট করা আছে, সে অ্যাপসের মাধ্যমে খুঁজল প্রাইভেট কার, তখন আমার মোবাইলে নোটিফিকেশন এলো আমি যেতে রাজি আছি কী না, যদি রাজি থাকি, তবে আমি গুগল ম্যাপ দেখে দেখে তার কাছে গিয়ে হাজির হব এবং তাকে নিয়ে গুলিস্তান যাব। এই অ্যাপসটার  নাম উবার অ্যাপস।

আর যদি কোনো মহিলা প্যাসেঞ্জার ডাকে বা কোনো কম বয়সী মেয়ে?

প্যাসেঞ্জার তো প্যাসেঞ্জারই, প্যাসেঞ্জারের আবার ছেলে-মেয়ে কী?

হ্যাঁ। এইবার আরও ভালোমত বুঝছি, এতদিন থেকে তাহলে ঐসব মেয়ে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঘুরে বেড়ালে। যাও, যাও, তুমি আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিও না। তোমাকে ভালোবেসে আমি শুধু কষ্টই পেলাম, উফ, আল্লারে আল্লা, আমি যে কী ভুলটাই করলাম, বলে কুসুম রাতুলকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিল এবং মোবাইল অফ করে রাখল।

পরদিন রাতুল গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার আগে কুসুমকে বার বার ফোন করল কিন্তু কুসুম বার বার করে ফোন কেটে দিল। আবার রাতুল ম্যাসেজ দিল, কুসুম পিলিজ, ফোনটা ধর, আমি আজ প্রথম উবার নিয়ে বের হচ্ছি, তুমি আমার জন্য দোয়া করবে না।

আমার দোয়া তোমার লাগবে না, যাদের দোয়া কাজে লাগবে তাদের কাছে যাও।

রাতুল লিখল, কুসুম তুমি তো জানো না, ঢাকায় অনেক জ্যাম, খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়, তুমি এভাবে রাগ করে থাকলে আমিও যে ভালোভাবে গাড়ি চালাতে পারব না। যেকোনো সময় এক্সিডেন্ট হতে পারে।

এবার কুসুম নিজেই ফোন করল, রাতুলের ম্যাসেজ পড়ে সে খুব কষ্ট পেয়েছে। এক্সিডেন্ট শুনেই তার বুক কেঁপে উঠেছে, সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, এরকম কথা কখনও বলবে না, বুঝলে। আমি দোয়া করছি তোমার কিচ্ছু হবে না।

আল্লাহ যেন তোমার দোয় কবুল করে কুসুম।

রাতুল কুসুমকে ফোন করল, হ্যালো।

হ্যালো। হ্যাঁ বল, কখন ফিরেছ?

এই তো কেবল ফিরলাম।

এখন না রাত দশটা বাজে।

হ্যাঁ।

এত দেরি হল যে।

রাতুল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, যত ট্রিপ মারব, তত টাকা, তাই টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে দেরি হয়ে গেল।

কত হয়েছে।

দু হাজার।

দু হাজার মানে? কুসুম চমকে উঠল।

মানে সব খরচ বাদ দিয়ে দু হাজার টিকছে।

কুসুম যেন আকাশ থেকে পড়ল, একদিনে দু হাজার।

হ্যাঁ। এভাবে প্রতিদিন টাকা কামাই হলে মাসে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা রোজগার হবে। শোন কুসুম।

হ্যাঁ বল।

শোন কিছু টাকা হলেই আমি বাড়ি যাব, তারপর তোমাকে বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসব।

আমারও এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না রাতুল, যত তাড়াতাড়ি পার আমাকে নিয়ে চল।

অবশ্যই।

কুসুম মৃদু হেসে বলল, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে প্যাসেঞ্জারের মতো তোমার উবারে চড়ে বেড়াব।

সেটা কি আবার বলতে হয়।

কুসুমের সঙ্গে কথা বলা শেষ হতে না হতেই কামরুল রাতুলের রুমে ঢুকল।

রাতুল মোবাইল ফোনে ফিসফিস করে বলল, রাখ, রাখ, আমি পরে কথা বলব।

কামরুল মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, কী রে ডিস্টার্ব করলাম নাকি?

না, না আয়, বস।

প্রথম দিন কত হলো?

অনেক টাকা।

অনেক মানে কত?

দু’হাজার।

খুব ভালো, টাকা পয়সা যেন নষ্ট করিস না, কষ্টের টাকা।

না, খরচ করব না।

আর সাবধানে গাড়ি চালাবি, নিয়ম মেনে গাড়ি চালাবি, নিয়ম না মানলে কিন্তু সার্জেন্ট আটক করবে, কেস দিবে।

হ্যাঁ। ঠিকভাবে চালাব।

থাক, আমার রুমে যাই, বলে কামরুল চলে গেল।

রাতুলের আজ খুব আনন্দের দিন। তার স্বপ্নগুলো যেন পূরণ হতে চলেছে। কুসুম ঠিকই বলেছে, সে মাঝে মাঝে প্যাসেঞ্জারের মতো উবারে চড়ে বেড়াবে। ডিউটির ফাঁকে রাতুল ফোন করে বলবে, কুসুম তুমি রেডি হও আজ আমরা বেড়াতে যাব।

কোথায়?

আরে বাবা, রেডি হতে বলেছি তুমি রেডি হও। কোথায় যাব, যাব।

তবু বললে কী হয়? আমার একটা মেন্টাল প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে না।

কী, কী বললে যেন, মেন্টাল প্রিপারেশন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি মনে মনে একটু ভাবব, কোথায় যাচ্ছি।

রাতুল একটা দুষ্টুমীর হাসি হেসে বলল, তোমার আবার ভাববার কী আছে, তুমি তো ঢাকা শহরে যেখানে যাবে সেটাই নতুন।

আহা রে আর নিজের বুঝি মনে হচ্ছে জন্ম থেকে ঢাকায় থাক যে সব দেখেছ। আমার ক’দিন আগেই তো তুমি ঢাকা এলে আর বড় বড় কথা।

ক’দিন আগে এলেও আমি এই ক’দিনে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি।

বেড়াবেই তো, উবার ড্রাইভার বলে কথা, বলে রাতুলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মোবাইল ফোন রেখে দিল।

কিছুক্ষণ পর রাতুল গাড়ি নিয়ে বাসায় এলো তারপর দু’জনে বের হলো। বাসায় ঢুকে দেখল কুসুম রেডি। রাতুল কুসুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরে আমার বউ রে, আমার পরীর মতো বউ।

কুসুম নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলল, এই ছাড়, ছাড় আমার মেকাপ নষ্ট হবে তো।

রাতুল বলল, হোক।

দুজনে একসঙ্গে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। রাতুল আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, তোমাকে পেয়ে আমি খুব খুশি কুসুম।

আমিও।

বাসা থেকে দু’জনেই বের হয়ে গাড়িতে উঠবে এমনসময় রাতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, সে আপনমনে বলল, স্বপ্নগুলো কেনো এমন হয় ঠিক পূরণ হওয়ার সময় আসে আর ঘুম ভেঙ্গে যায়।

রাতুল পরদিন আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়, সারাদিন কুসুমকে নিয়ে ভাবে, সুযোগ পেলেই কুসুমকে ফোন দেয়, কুসুমও রাতুলকে ফোন দেয়, দুজনের হৃদয় যেন এক সুতোয় গেঁথে গেছে এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকুই বাকি। সেদিন রাতে আবার এক নতুন স্বপ্ন দেখল। রাতুল সকালবেলা গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার আগে কুসুমকে বলল, কুসুম আসি।

কুসুম একটা অভিমানী হাসি হেসে বলল, সব কি ভুলে গেলে নাকি?

রাতুল কুসুমকে জড়িয়ে ধরল, তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ভুলিনি।

সাবধানে গাড়ি চালাইও, ডানে-বাঁয়ে তাকাইও না কিন্তু…

রাতুল বলল, কুসুম গাড়ি চালালে সবদিকে তাকাতে হয় বুঝলে।

কুসুম রাতুলের নাকটা টেনে ধরল, আমি কী বলেছি তা তুমি ভালো করেই বুঝেছ।

ওকে কুসুম।

সাবধানে গাড়ি চালাইও কিন্তু।

বাসা থেকে বের হওয়ার একটু পরই কুসুম ফোন দিল, তুমি কোথায়?

এই তো শ্যামলী।

আবার কিছুক্ষণ পর ফোন করল, তুমি কোথায়?

এই তো ফার্মগেট।

ফ্রি থাকলে ফোন দিও।

আচ্ছা।

রাতুলের যে মোবাইল ফোনটাতে উবার অ্যাপস সেট করা আছে সেটা থাকে তার স্টিয়ারিংয়ের সামনে ছোট্ট একটা স্ট্যান্ড আছে যেখন থেকে গুগল ম্যাপ দেখা যায় সেখানে, কোনো কোনো প্যাসেঞ্জার পিছন থেকে ডান-বাম বলে রাতুল সেই নির্দেশনা অনুযায়ী গন্তেব্যে নিয়ে যায় আবার কোনো কোনো প্যাসেঞ্জার গুগল ম্যাপে লোকেশন দিয়েই চুপ করে থাকে গুগল ম্যাপ রাতুলকে নিয়ে যায় যাত্রীর গন্তব্যে।

রাতুল যখন গাড়ি চালায় তখন তার আরেকটা ফোন থাকে পাশের সিটে আর প্যাসেঞ্জার বেশি থাকলে সেটা রাখে তার পকেটে। ঢাকার রাস্তায় সবসময় যানজট লেগেই থাকে, সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়, গুগল ম্যাপে দেখে কোনো রাস্তায় যানজট কম সেই রাস্তা দিয়ে যেতে হয়, সামনের গাড়ির গতি অনুযায়ী নিজেকে গাড়ি চালাতে হয়। রাতুলের গাড়ি জ্যামে পড়েছে, গাড়ি এক হাত আগায় তো দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। তিনজন প্যাসেঞ্জার, পিছনের সিটে দু’জন আর সামনের সিটে একজন, পার্সোনাল ফোনটা পকেটে রাতুল বুঝতে পারছে তার ফোনের রিং বাজছে, ম্যাসেজ আসছে কিন্তু সে ফোন রিসিভ করতে পারছে না।

প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে রাতুল ফোন বের করে দেখল কুসুম অনেকবার ফোন দিয়েছে, তারপর ম্যাসেজ করেছে, কী করছ? ফোন রিসিভ করছ না কেনো? নিশ্চয়ই কোনো লেডি প্যাসেঞ্জার পেয়েছ? তুমি, তুমি একটা কী…, আমি শুধু সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এলাম আর তুমি একটা সুন্দরী প্যাসেঞ্জারকে ট্রিপ দিতে গিয়ে আমাকে ভুলে গেলে।

কুসুমের ম্যাসেজ দেখে রাতুল হাসল, ফোন ব্যাক করে, হাসতে হাসতে বলল, হ্যালো।

কুসুম প্রচণ্ড অভিমানে যেন ফেটে পড়ল, এই, এই তুমি হাসছ? আমি তোমার জন্য মরে যাচ্ছি আর তুমি হাসছ? তুমি একটা পাষাণ, নিষ্ঠুর।

রাতুল আবারও হাসল, হাসতে হাসতে বলল, আমি পাষাণ, নিষ্ঠুর হলে কি তোমার মতো একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারি।

হয়েছে, হয়েছে, কোথায় এখন?

ধানমন্ডি। এইমাত্র একটা ট্রিপ মারলাম।

প্যাসঞ্জার কি নারী না পুরুষ?

পুরুষ।

মিথ্যা বলছ, পুরুষ হলে তুমি আমার ফোন ধরতে।

আসলে রাস্তায় অনেক জ্যাম, স্টিয়ারিং ধরব, নাকি গুগল ম্যাপের দিকে তাকাব, নাকি রাস্তার দিকে তাকাব। বল। পিলিজ রাগ কর না, তুমি তো জানোই তুমি একজন উবার ড্রাইভারের বউ।

হয়েছে, হয়েছে আর বলতে হবে না।

আচ্ছা এখন রাখি, একটা কল এসেছে। দেখি আবার কোথায় যেতে হবে।

ওকে। আজ তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।

ওকে বাই বলে রাতুল ফোন পকেটে রাখতে গিয়ে তার হাতটা লাগল তার সিটের পাশে দেয়ালে। অমনি রাতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাতুল আপনমনে একবার হেসে উঠল।

কয়েক দিন পরই দেশে শুরু হলো করোনার সংক্রমণ। উবার বন্ধ হয়ে গেল, রাতুল প্রথমে ভেবেছিল কয়েকদিন পরেই বুঝি গাড়ি চালু হবে। তাই ঢাকায় রইল, তাছাড়া ঢাকা থেকে পঞ্চগড় ফেরা অনেক দুঃসাধ্য এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ল। রাতুল যখন প্রতিদিন টাকা রোজগার করেছে তখন খরচও করেছে সেভাবে, বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছে বেশি তাই তেমন টাকা জমাতে পারেনি। যেদিন লকডাউন শুরু হলো তার আগের দিন বাড়িতে টাকা পাঠাল। যেদিন লকডাউন শেষ হওয়ার কথা ছিল তার আগের দিনও বাড়িতে টাকা পাঠাল, রাতুলের ধারণা ছিল লকডাউন শেষ হবে আবার সে গাড়ি চালাবে কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল। রাতুলের তো মাথায় হাত।  কাছে যে টাকা সঞ্চিত ছিল তা শেষ হয়ে গেল, কামরুলের কাছে কিছু ধারদেনা করে করোনা কাল কাটিয়ে দিল। তারপর শর্ত সাপেক্ষে সবকিছু চালু হলো। রাতুল গাড়ি চালায় নাক-মুখে মাস্ক লাগিয়ে।

একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই কুসুমের ফোন, রাতুল ফোন রিসিভ করতেই কুসুম ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যালো।

রাতুল জিজ্ঞেস করল, কুসুম কী হয়েছে?

কুসুম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, খারাপ খবর, খুব খারাপ খবর।

রাতুলের বুক কেঁপে উঠল, কুসুম বলবে তো কী হয়েছে?

কুসুম বলল, আজ আমাকে দেখতে আসবে।

রাতুল আঁতকে উঠল, দেখতে আসবে মানে?

হ্যাঁ। মামি বলেছে আজ আমাকে দেখতে আসবে। আর দেখতে এসে যদি পছন্দ হয় তবে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে।

না, না কুসুম তুমি বিয়ে করবে না, আমি তোমাকে কারও সাথে বিয়ে হতে দিব না। তুমি আমার, তুমি শুধু আমার।

আমিও তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব না রাতুল, আমার জীবনে, তুমি, শুধু তুমি।

আমি আসছি, আমি আসছি কুসুম। আর ক’টা দিনই তো মাত্র। হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তা তো করোনায় বসে বসে খেয়ে শেষ করলাম। ক’টা টাকা না হলে তোমাকে ঢাকায় আনব কী করে?

আগে তুমি আসো পরে আমাকে ঢাকা নিয়ে যেও।

আচ্ছা। আমি কাল বাদ পরশু আসছি কুসুম।

আসো, তাড়াতাড়ি আসো রাতুল, আমার খুব ভয় করছে, আমাকে দেখতে এসে যদি ওরা পছন্দ করে আর… বলে কুসুম আর কথা বলতে পারল না, তার কণ্ঠস্বর বুজে এলো ।

রাতুল গাড়ি নিয়ে বের হলো কিন্তু তার মন ভালো নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। একবার রাতুল চিন্তা করল আজ আর গাড়ি চালাবে না, গাড়ি জমা দিয়ে পঞ্চগড় চলে যাবে কিন্তু তার কাছে টাকা নেই। বাড়ি গেলে অন্ততঃ যাওয়া-আসার টাকা তো লাগবে, তারপর আছে বিয়ের খরচ, কুসুমকে নিয়ে পালিয়ে গেলেও তো কাজি অফিসের টাকা লাগবে। রাতুল গাড়ি চালাতে চালাতে আপনমনে হেসে উঠল, কীভাবে বিয়ে করবে, মামা-মামিকে গিয়ে বলবে, তারা যদি রাজি না হয়, তবে কি পালিয়ে বিয়ে করবে, খুব মজা হবে, আজ রাতেই কুসুমের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করতে হবে।

কুসুম সেই যে বিকেলবেলা তার ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করেছে তো আর থামছেই না। দুপুরবেলা ভাতও খায়নি, মামি কয়েকবার এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু কুসুম এক ফোটা পানিও মুখে নেয়নি। কুসুমের জানালা খোলা ছিল সে দেখতে পেল আঙিনা দিয়ে কয়েকজন লোক বাড়িতে ঢুকল। তাদের দেখে কুসুমের হৃদয় ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে এলো। কুসুমের মনে হলো আজ বুঝি তার রক্ষা নেই। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো।

আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পর মামি কুসুমকে ডাকতে এলো। তখন কুসুমের ঘরের দরজা বন্ধ, মামি দরজায় কড়া নেড়ে ডাক দিল, কুসুম, মা কুসুম।

কুসুম সাড়া দিল না।

আবার ডাকতে শুরু করল, দরজাটা খুলে দে মা।

কুসুম তবুও দরজা খুলল না।

এবার মামি আরও দরদ দিয়ে ডাক দিল, খুলে দে মা। তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, আগে কথা বল মা, তারপর যা হয় তুই করবি।

কুসুম আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলে দিতেই মামি কুসুমকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

কুসুম মামির বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

মামি কুসুমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, সারাদিন না খেয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে চেহারাটা নষ্ট করে ফেলেছিস। আয় মা আগে ভাত খা।

কুসুম কোনো কথা বলল না। অবিরত কাঁদতেই থাকল।

মামি কুসুমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তোকে জন্ম দিতে গিয়ে তোর মা মারা গেল। আমরা তোকে নিয়ে এলাম। সেই ছোটবেলা থেকে তোকে লালন-পালন করলাম। তুই আমাদের মেয়ের মতো না, মেয়েই। এই গ্রামের সবাই জানে তুই আমাদের মেয়ে, আমরাও তোর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেলাম যে আমাদের কোনো সন্তান নেই, তুই বল আমরা তোকে পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ওপর একটু ভরসা রাখ মা।

মামি।

বিয়ের আগে আজকাল সব মেয়েরই কারও না কারও সঙ্গে রিলেশন থাকে মা, তাই বলে ভালো ঘর-বর পেলে কেউ ফিরিয়ে দেয় না। তুই আর জিদ ধরিস না মা। আল্লাহ চাহে তো তুই সুখি হবি। চল মা।

বিকেলবেলা অনেক ট্রিপ পেল রাতুল। একের পর এক, একটা ট্রিপ শেষ না করতেই আরেকটা ট্রিপ। কুসুমের সঙ্গে কথা হলো না। রাতুল কুসুমকে ফোন করল একেবারে রুমে ফিরে, তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে কিন্তু কুসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ। রাতুল পর পর কয়েকবার ফোন করল কিন্তু বার বার সেই বিরহী নারীকণ্ঠ, দুঃখিত কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতেএই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

রাতুলের বুক কেঁপে উঠল, কুসুমের বিয়ে হয়ে গেল না তো! না, না কুসুম আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারে না কিন্তু জোর করে বিয়ে দেয়, এরকম বিয়ে তো গ্রামে অহরহ হয়। কনের কাছে তো বিয়ের আগে কোনো মতামতই নেয়া হয় না। সারারাত রাতুলের চোখে ঘুম নেই, কিছুক্ষণ পর পর কুসুমের মোবাইল ফোনে ফোন করল কিন্তু কুসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ।

পরদিনও রাতুল গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কুসুমকে ফোন করল কিন্তু কুসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ। রাতুলের সন্দেহ হলো কোনো একটা অঘটন ঘটেছে নইলে কুসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকবে কেনো। রাতুল সিদ্ধান্ত নিল দুই দিন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যাবে। কুসুমের যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে রাতুল বাঁচবে না।

পরদিন সকালবেলা রাতুল আবার গাড়ি নিয়ে বের হলো। সে গাড়ি চালাতে চালাতে বার বার ফোন করল, একটা ট্রিপ শেষ করে আরেক ট্রিপের ফাঁকে রিং করল কিন্তু না, কুসুমের মোবাইল ফোন বন্ধ। সন্ধ্যা সাতটার দিকে একটা ভাড়া পেল, মাজার রোড থেকে মোহাম্মদপুর। প্যাসেঞ্জার এক দম্পতি, পুরুষ লোকটির মাথায় টুপি, দাড়ি আছে, সঙ্গে থাকা মহিলাটি নাক-মুখ ঢাকা বোরকা পরা, চোখে কালো সানগ্লাস, রাতুলের মনে হলো মহিলাটির বয়স কম। গাড়ি চালাতে চালাতে রাতুল লক্ষ্য করল, মহিলাটি বার বার কী যেন বলতে চাচ্ছে কিন্তু লোকটি তার হাত চেপে ধরে কথা বলতে নিষেধ করছে। একবার তো মহিলাটির মুখ চেপে ধরল। রাতুল একবার জিজ্ঞেস করতে চাইল কিন্তু তার মনে হলো এটা তাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার।

মাজার রোড থেকে মোহাম্মদপুরের দূরত্ব খুবই কম কয়েক মিনিটের পথ, পথে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলল না। গাড়িতে থাকতেই রাতুলকে ভাড়া মিটিয়ে দু’জনে নেমে গেল। যাওয়ার সময় রাতুল পিছন দিকে তাকাল, মহিলাটির হাঁটুনিটা কুসুমের মতোই। গাড়িতে থাকতেও রাতুলের সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে সে খুব একটা কথা বলে না।

রাতুল প্যাসেঞ্জার নামিয়ে তাদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখের মাস্কটা খুলে ফেলল। আড়াল হওয়ার আগে মহিলাটিও মুখের ওপর থেকে বোরকার পর্দা খুলে ফেলল। রাতুল অবাক হয়ে গেল, কুসুম, হ্যাঁ কুসুমই তো।

কুসুম একবার ফিরে আসতে উদ্যোত হলো কিন্তু তার স্বামী তাকে টেনে নিয়ে গেল।

রাতুল আবার কুসুমের মোবাইল ফোনে রিং করল, তার কানে ভেসে এলো, ’’দুঃখিত কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতেএই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’’।

রাতুলের হাত থেকে মোবাইল ফোন পড়ে গেল, দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ল।

সমাপ্ত।

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*