ম্যাজিক চুলা

দৃশ্যত চুলা জ্বলছে একটি। আগুনের লেলিহান শিখা দৃশ্যমান নেই কিন্তু উত্তাপ আছে আর সে উত্তাপেই রান্না হচ্ছে মোলা মাছ। আরও একটা অদৃশ্য চুলা জ্বলছে, যে ভদ্র-শান্তশিষ্ট রমণী কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে রান্না করছে সেই চুলাওয়ালীর হৃদয়ে। আগুনের লেলিহান শিখা দৃশ্যমান নেই, উত্তাপও নেই। তবু ম্যাজিক চুলার মতোই নিজে সংসার নামক এই সোনার খাঁচায় আগুনে জ্বলে ডানা ঝাপটে মরছে এই রমণী সেই কিশোরী বয়স থেকেই। লোহার শিকল ছিন্ন করা যায়, লোহার শিকল থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিকামী মানুষ পাশে দাঁড়ায়, মিছিল-মিটিং করে, জ্বালাও-পোড়াও করে, মুক্তিকামী মানুষ লোহার শিকল ছিন্ন করে স্বাধীন হয়েছে এমন নজির ইতিহাসে অহরহ আছে।

ছনের ঘরে আগুন লাগলে প্রতিবেশীরা ছুটে আসে, পানি নিয়ে, বালির বস্তা নিয়ে কিন্তু সোনার খাঁচায় থেকে কারও হৃদয়ে আগুন জ্বলছে এ যে অবিশ্বাস্য। তাই চুলাওয়ালীর হৃদয় আগুনে জ্বলতে জ্বলতে কয়লা হলেও সেই অদৃশ্য আগুন দেখার কেউ নেই। আর খাঁচা ভেঙ্গে পালাবার…

সে চেষ্টাও করেছিল চুলাওয়ালী। অনেকটা সফলও হয়েছিল কিন্তু সবাই এলো সোনার খাঁচা ভেঙ্গে পালানোর মতো দু:সাহসী চুলাওয়ালীকে খাঁচায় পুরতে। তারপর… সমাজযন্ত্র, ধর্মযন্ত্র, প্রশাসনযন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র সব একাকার হয়ে শেষ পর্যন্ত চুলাওয়ালীকে সোনার খাঁচায় পুরে তবেই শান্ত হলো।

চুলাওয়ালী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই মোলা মাছের পিঠপোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার মন চলে গেছে মাস্টারপাড়ার সেই বাসায় যে বাসায় সে এই সোনার খাঁচা ভেঙ্গে আপন ভুবন রচনা করেছিল। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য শিকল ছিঁড়ে ভালোবাসার এক স্বর্গ রচনা করেছিল। কতক্ষণ চুলাওয়ালী সেই মাছের দিকে তাকিয়ে আছে মনে নেই। মাছ পুড়ে যে পোড়া গন্ধে পুরো বাসা ভরে গেছে সেটাও বুঝতে পারেনি চুলাওয়ালী।

সেই চুলাওয়ালীর নাম দীপা। সত্যি, সত্যি মাছ পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি। মোজাহার সন্ধ্যাবেলা বাজার থেকে পেট পচা অনেকগুলো মোলা মাছ এনে দিয়ে চলে গেল ছাদের ওপর। একের পর এক সিগারেট টানছে আর ফোনে কথা বলছে। মোজাহারকে দীপা সিগারেট ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে সেই বিয়ের পর থেকে। সিগারেটের গন্ধ দীপা একদম সহ্য করতে পারে না। অনেক অনুরোধ করেছে, অনেক ঝগড়া বিবাদও হয়েছে কিন্তু সিগারেট ছাড়াতে পারেনি। অথচ হৃদকে দীপা যা যা বলেছে ঠিক তাই মেনে নিয়েছে। হৃদদীপার কষ্ট বুঝত। দীপা কষ্ট পাবে এমন কোন কাজ সে কখনই করত না।

দীপার মাছ কুটতে কষ্ট হবে জেনে হৃদ কোনদিন ছোট মাছ আনেনি। মাছ আনলে ইলিশ বা রুই মাছ বাজার থেকে কেটে ধুয়ে নিয়ে আসত। মুরগী কিনলে জবাই করে পরিষ্কার করে নিয়ে আসত। তারপর বাজারের ব্যাগ দীপার হাতে দিয়ে, একটা অনুনয়ের হাসি হেসে বলত, তোমার খুব কষ্ট হবে জানি, তবু খেতে তো হবে নাকি বল!

খেতে যখন হবেই তখন আবার বলছ কেন?

আচ্ছা আমিও তোমার সঙ্গে শেয়ার করছি।

কী শেয়ার করবে তুমি?

দেখই না কী শেয়ার করছি, বলে হৃদদীপার সাথে সাথে রান্নাঘরে ঢুকতো, দীপা রান্না করত আর হৃদ পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, গান গাইত। জয়ের কণ্ঠস্বর ভালো না, মোটা, ভাঙ্গা বাঁশের মতো।

দীপা ঠাট্টা করে বলত, তোমার যা গলা জোরে বল না, তোমার কাক বন্ধুরা সব চলে আসবে।

কাক বন্ধু মানে?

মানে তোমার গলাটা তো কাকের মতো তাই তোমার গলার স্বর শুনে কাকরা যদি মনে করি তুমিও ওদের দলের তবে চলে আসবে না, তখন ও তো কাক তাড়াবে কে?

তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে। আমি জানি আমার কণ্ঠস্বর ভালো না। তাই বলে আমি তো সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি না যে গলার স্বর ভালো হতে হবে। এমন ক’জন মানুষ আছে যে বাথ রুমে গান গায়নি, স্ত্রীর মনজয় করার জন্য গান গায়নি বলে হৃদ আবার গান শুরু করত, ওগো তুমি যে আমার…

দীপা কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলত, থাক, থাক আর বলতে হবে না। তবে তোমার কণ্ঠস্বর ভালো না হলেও গানের কথাগুলো যে হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসছে তা বোঝা যায়। আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় তোমার গানের প্রতিটি লাইন।

কখনও কখনও হৃদ পেছন থেকে এসে কাঁধে হাত রাখত, দীপা চমকে উঠত। কী মধুর ছিল দীপার সেই দিনগুলি।

অথচ মোজাহার সন্ধ্যাবেলা এতোগুলো মোলা মাছ কিনে দিয়ে চলে গেলো ছাদে, একের পর এক সিগারেট টানছে মোবাইল ফোনে কথা বলছে, আর আমি যেন কাজের মেয়ে। হৃদ ভালোবেসে বউ হিসেবে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল আর মোজাহার কৌশল করে এনে দাসি বানিয়েছে।

মাছের পোড়া গন্ধ পেয়ে ছাদের ওপর থেকে নেমে এলো তার স্বামী মহাশয়। রাগান্বিত স্বরে বলল, দীপা, মাছ পুড়ে যাচ্ছে, আমি ছাদের ওপর থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে নিচে নেমে এলাম। আর তুমি কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখতে পাচ্ছ না? কী করছ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

মোজাহার চুলো অফ করে দিয়ে বলল, চুলোর কাছে দাঁড়িয়েই তো ছিলে তবুও মাছ পুড়ে গেলো কীভাবে? মনটা নিশ্চয়ই এখানে ছিল না।

দীপা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কতকিছুই তো পুড়ছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুমিও তো দেখছ…

দীপা বাজে কথা বল না।

আচ্ছা মাছ পুড়ে গেছে, মাছের কথা বলে তো আর লাভ নেই। তুমি একটা কথা বলতে পার?

মোজাহার কিছুটা শান্ত হলো, কী কথা?

এই যে মাছগুলো পুড়ে গেলো ওদের মন এখন কোথায় আছে? ওদের আত্মাগুলো কোথায় আছে?

মোজাহার কিছুটা রেগে গেল, তোমার মাথাটা বেশি খারাপ হয়েছে, তোমাকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছ না, নিয়ম মানছ না, সুস’ হবে কীভাবে।

ডাক্তার কি শুধু আমাকে নিয়ম মেনে চলতে বলেছে আর তোমাকে বুঝি কিছু বলেনি?

কী বলেছে আমাকে? তোমার অসুখ, ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিয়েছে তোমাকে। তুমি সেগুলো মেনে চলবে।

আর একথা বুঝি বলেনি প্যাসেন্টের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে, কোনোরকম ঝগড়া বিবাদ করা যাবে না। প্যাসেন্টের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না।

হ্যাঁ বলেছে।

তুমি কি সেগুলো মানছ? বলে দীপা উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলতে শুরু করল, এই মাছগুলোর আত্মাগুলো এখনো সেই নদীতে খেলা করছে। ইসস নদীর পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে মাছগুলো মা’র সাথে, বন্ধুদের সাথে কিলবিল করে খেলা করছে আর তাদের দেহটা আমরা মজা করে খাওয়ার জন্য পিঠ পোড়া করছি। মানুষ কত নিষ্ঠুর!

মোজাহার একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, সেজন্য দুনিয়ার মানুষ আর মাছ খাবে না, এক প্রাণী অন্য প্রাণীকে খাবে এভাবেই তো প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হবে।

তাই না, দীপা কিছুটা তিরস্কারের সুরে বলল। আচ্ছা বাদ দাও, তুমি তো সাইকোলজি নিয়ে পড়েছ?

এটা আবার নতুন কী, তুমি আগে থেকেই জানো।

তুমি কি জানো আমার মনটা সবসময় কী বলে?

এতো আজাইড়া চিন্তা করার আমার সময় আছে।

নেই, স্ত্রীর মন নিয়ে চিন্তা করাটা আজাইড়া, তাহলে কাজের চিন্তাটা কী শুনি?

চাকরি-বাকরি কত কী চিন্তা আমার আছে।

স্ত্রীর সুখের জন্য, স্ত্রীর মুখে এক চিলতে হাসি দেখার জন্য মানুষ কত কী করে আর তুমি শুধু আমার জন্য একটু ভাববে, আমার সুখের জন্য আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য একটু পাশে দাঁড়াবে, তাই পারবে না?

মোজাহার কোনো কথা বলল না।

দীপা আবার বলতে শুরু করল, থাক, পারবে না। আচ্ছা নজরুলের একটা কবিতা আছে, সিন্ধু, পড়েছ?

না। আমার ও তো সময় নেই।

কবিতাও পড় না, স্ত্রীর মন জয় করার জন্য সামান্য আজাইড়া চিন্তাও করো না তবে তুমি করো কী সারাদিন। আচ্ছা যে কথা বলছিলাম। সিন্ধু কবিতায় নজরুল সমুদ্রকে উদ্দেশ্য লিখেছেন, তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী! সুরা-নাই-পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী। এই কবিতায় নজরুল বুঝাতে চেয়েছেন সমুদ্র পৃথিবীকে তিন ভাগ গ্রাস করেছে আর এক ভাগ বাকী আছে তেমনি তুমিও আমার জীবন তিন ভাগ খেয়ে ফেলেছ বাকী এক ভাগ নিয়ে বাঁচার জন্য তোমার কাছ থেকে মুক্ত হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে নানান ষড়যন্ত্রে আবার খাঁচায় পুরেছ। এবার সমস্তটাই খেয়ে ফেলবে তো।

দীপা! মোজাহার গর্জে উঠল।

গর্জে উঠছ কেন আমাকে মারবে?মার? আর মার খাওয়ারও ভয় করি না আবার মরতেও ভয় করি না। আমি তো মরাই। মরার আবার ভয় কীসের।

মোজাহার গজগজ করতে করতে বলল, তোমাকে ফিরিয়ে আনাটাই আমার ভুল হয়েছে।

এবার সংশোধন করো, আমাকে মুক্তি দাও, আমাকে মুক্তি দিয়ে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করো জনাব।

তোমার মাথাটা আবার নষ্ট হয়ে গেছে, বলে মোজাহার শুভকে ফোন করল।

শুভ ফোন রিসিভ করেছে, হ্যালো বাবা।

শুভ আগে তোর মার সঙ্গে কথা বল। তোর মা’র মাথাটা আবার নষ্ট হয়ে গেছে বলে মোজাহার মোবাইল ফোনটা দীপার হাতে দিল।

মা, অপর পাশ থেকে শুভ’র কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

দীপা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল।

শুভ জিজ্ঞেস করল, মা, কী হয়েছে?

কী হয়েছে তুই জানিস না?

মা যা হয়েছে তুমি ভুলে যাও। বাবা তোমাকে ফিরিয়ে এনে নিশ্চয়ই কোন ভুল করেনি। প্লিজ তুমি মাথা ঠাণ্ডা করো। সমাজে আমাদের একটা মান-সম্মান আছে। তুমি একবার আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে বাবা বলেই তোমাকে মেনে নিয়েছে এখন আবার ছিঃ মাঃ, ছিঃ

তোমরা বাপ-বেটা মিলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ কখনও আইনের ভয় দেখিয়ে আর কখনও মায়ায় জড়িয়ে, বলে দীপা হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। মোজাহার চাপাস্বরে বলল, দীপা চুপ করো, আমি গিয়ে দেখি কে যেন এলো।

দীপা আঁচলে চোখ মুছল।

সমাপ্ত

Facebook Twitter Email

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০২০ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪ টি উপন্যাস, ০৪ টি কিশোর উপন্যাস, ০১ টি গল্পগ্রন্থ এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

Posted in ছোটগল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*